প্রথমে দর্শনধারী তারপর গুণ বিচারী

আমাদের মাথায় দুটো সিস্টেম কাজ করে। প্রথমটা হলো রেড়িমেট,  আর দ্বিতীয়টি হল চিন্তাভাবনা করা।  রেডিমেড সিস্টেমটা কাজ করে চারিদিক থেকে পাওয়া ডাটার উপর। যেমন আপনাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে যে, আপনার ফোনে কোন কোন অ্যাপ আছে? তাহলে আপনি অনায়াসে দু’তিনটা নাম বলে দেবেন, কিন্তু মোবাইল খুলে দেখুন, তার থেকে বেশি অ্যাপ আছে্‌ কিন্তু যে অ্যাপগুলো আপনি সবসময় ইউজ করেন,  আপনার মাথার রেড়িমেট সেকশন, ওই অ্যাপগুলোকেই আপনার কাছে তুলে ধরেছে। আমাদের মাথায় এত,অলস যে, সে প্রথম সিস্টেম অর্থাৎ রেডিমেড সেকশনেই সব কাজ সেরে ফেলতে চায়; দ্বিতীয় সেকশন অর্থাৎ চিন্তাভাবনায় যেতে চায় না। 

 ধরুন, একটা মানুষকে আপনি প্রথম দেখলেন, লোকটা ভালো জামাকাপড় পরে নেই, পায়ে ময়লা জুতো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুল এলোমেলো। এসব দেখে আপনার মধ্যে লোকটা সম্পর্কে একটা মামুলি ধারণা হয়ে গেল, কিন্তু তিনি কত জ্ঞানী বা কত মহৎ, সেটা তার সাথে কথা না বললে বা তার সম্পর্কে না জেনে অর্থাৎ দ্বিতীয়টি সিস্টেম চিন্তাভাবনা দিয়ে বিচার না করে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা ভুল হতে বাধ্য।

আমরা সারাদিন বা সারাজীবনে যত সিদ্ধান্ত নিই বা যত কাজ করি তার ৯০% থেকে ৯৫% রেড়িমেট সিস্টেম দিয়ে হয় অথচ আমরা বিশ্বাস করি যে, আমরা দ্বিতীয়টি সিস্টেম অর্থাৎ চিন্তাভাবনা করে করছি। 

পরীক্ষার খাতায় কোনো শিক্ষার্থী যদি প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা খুব ভালো লিখেন, তাতে পরীক্ষক খুব সন্তুষ্ট হয়ে তাকে পুরো নাম্বার দিলেন; এরপর পরীক্ষকের মনের মধ্যে শিক্ষার্থীটি সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা তৈরি হয়। পরের উত্তরটাও যদি মোটামুটি ভালোই হয়, তাহলে পরীক্ষক তাকে একটু বেশি নাম্বার দেওয়া শুরু করেন। এমনকি  এর পরের উত্তরগুলি মোটামুটি রকমের হলেও তাকে কিন্তু পরীক্ষক ভালো নাম্বার দেন। এর জন্য দায়ী হলো পরীক্ষকের মাথার রেড়িমেট সিস্টেম। যেহেতু চিন্তাভাবনা করতে ,মাথার প্রচুর ব্যান্ডউইড লাগে নিউরণ এক্টিভ করতে, তাই সে সহজে দ্বিতীয় সিস্টেম চিন্তাভাবনায় যেতে চায় না। ধরুন আপনাকে হোটেলে খাওয়ার জন্য কেউ দাওয়াত দিয়েছে, হোটেলে আপনি দামি দামি খাবারগুলি খাবেন; তখন আপনার মাথায় আসবে না , কোন খাবারগুলো স্বাস্থ্যসম্মত বা কোনগুলি খেলে শরীরের স্থূলতাবাড়বে। 

আরেকটা উদাহরণ দিই , আপনাকে যদি একসাথে বা পর পর গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ করতে বলা হয়; তাহলে এই মাল্টিটাস্কিং কাজ করতে গেলে আপনার ভুলের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। কারণ  মস্তিষ্কের নিউরন একটা কাজের জন্য এতটা ব্যান্ডউইড নিয়ে নেয় যে, অন্য কাজের জন্য রেডিমেড সিস্টেমে যাওয়া ছাড়া তার আর অপসন থাকে না।  মস্তিষ্কের এই রেডিমেড সিস্টেম নিজের জমাকৃত তথ্য ছাড়াও কিছুটা অনুমান নির্ভর হয়ে চলে। যেমন-রাস্তায় কোন রক্ত দেখলে সে অনুমান করে নেয় যে, এখানে হয়তো কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে।



ফ্যামিলিয়ার এফেক্ট   


  মনে করুন,সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, বাংলাদেশের জাহাজগুলি পরিচালনা করার জন্য একজনকে দায়িত্ব দেয়া হবে , তিনজনের নাম দেয়া হলো। একজন ক্রিকেট সেলিব্রেটি সাকিব আল হাসান। তাহলে তিন জনের মধ্যে পাবলিক কিন্তু ওই সেলিব্রেটিকে ভোট দিবে, সে জাহাজ শিল্প পরিচালনার জন্য উপযুক্ত কিনা সেটা দেখবে না। এর কারণ হচ্ছে, একজন ব্যক্তি বা   একটা প্রোডাক্ট যতবার রিপিট করা হবে, মানুষের মনে ওই মানুষ বা প্রোডাক্টটার প্রতি তত বেশি ফ্যামিলিয়ারিটি তৈরি হবে। এজন্যই তিন টাকা বা পাঁচ টাকা দামের শ্যাম্পু , চনাচুর, বিস্কুট ইত্যাদির প্যাকেট রাস্তাঘাটে সব জায়গায় পাওয়া যায়। এর উদ্দেশ্য, লাভের চেয়েও বেশি হলো প্রোডাক্টটা মানুষ যাতে বারবার দেখে, এতে ঐ প্রোডাক্টটার উপর ফ্যামিলিয়ারিটি তৈরি হবে।   না দেখা নতুন কোনো প্রোডাক্ট বা বিষয়ের প্রতি মানুষ স্বাভাবিকভাবে রিয়াকশন করে; কারণ, যেকোনো নতুন কিছু বা আইডিয়া প্রথমে মস্তিষ্কের জন্য হার্মফুল হয়, কারণ মস্তিষ্ক তার ফ্যামিলিয়ারিটির মধ্যেই থাকতে চায়। তাই কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বা পলিটিশিয়ানরা একটা কনসেপ্ট বা আইডিয়াকে বারবার বলতে থাকে , ওটা ফ্যামিলিয়ার করার জন্য। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন আসার পর আমাদের মস্তিষ্ক ক্রমশ আরো বেশি রেডিমেড সিস্টেমে চলে যাচ্ছে । দিনে কয়েকবার ইউটিউব, টিকটক, ফেসবুক স্ক্রল করছি আর দেখছি ঘন্টার পর ঘন্টা। কনটেন্ট ক্রিয়েটররা আপনার সময় কেড়ে নিয়ে, তাদের টাইম ওয়াচ বাড়ানোর জন্য, কনটেন্টে সত্য-মিথ্যা, রংচং আর আজেবাজে প্যাচাল যোগ করে আপনার দ্বিতীয় সিস্টেম চিন্তাভাবনার  স্তরকে ক্রমশ আরো দুর্বল করে চলছে। ফলে আপনি আমি, দিন দিন একটু একটু করে নিজের রেডিমেড সিস্টেমের পরিধি বাড়িয়ে মাথামোটা প্রাণীতে পরিণত হচ্ছি। 

   




ফ্রেমিং এফেক্ট   

  দুধের প্যাকেটে 5% ফ্যাট আছে , এটা শুনে আপনার মনে হবে এটা আনহেলদি খাবার কিন্তু  যদি বলি এই প্যাকেটের দুধ 95% ফ্যাট ফ্রি। তখন মনে হবে এটা খুব হেলদি খাবার।  কিন্তু দেখুন, দুটো কথার মধ্যে আলাদা কিছু বলা হয়নি।  একজন ডাক্তার যদি বলেন আপনার এই অপারেশন ১০%  মৃত্যু ঝুঁকি আছে,তাহলে আপনার মধ্যে একটা মৃত্যু ভয় ঢুকে যাবে, আপনি আতঙ্কিত এবং হতাশায় ভুগবেন আর ডাক্তার যদি বলেন অপারেশনটা সাকসেসফুল হবার সম্ভাবনা ৯০% , তাহলে আপনার সাহস বেড়ে যাবে টেনশন কমবে। কিন্তু দুটোর মানে এক হলেও দুটোর ইম্প্যাক্ট পড়ে আলাদা । এটাকে বলে ফ্রেমিং এফেক্ট। অর্থাৎ একই কথা আপনি অন্যকে কিভাবে বলছেন তার উপর এফেক্ট তৈরি হয়।

 

হাইলাইট এফেক্ট   

মিডিয়া  ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা মেয়েদের বিয়ে নাকি টিকে না। মিডিয়া মানে বিয়ে না টেকার চান্স হাই। এবার মিডিয়ায় কাজ করা সব লোকজনের একটা ডেটাবেস তৈরি করলে দেখা যাবে, তাদের দিয়ে ভাঙ্গার হার অন্যান্য সেক্টরের প্রায় সমান। আসল কথা হল, মেয়েরা চাকরি/ ব্যবসা বা কোনোভাবে নিজে ইনকাম করতে সক্ষম হলে; সেখানে যদি তার স্বাধীনতার উপর কেউ হস্তক্ষেপ করে , তখন সমস্যাটা হয়। এটার সাথে তার পেশার আলাদা কোন সংযোগ নাই। বিয়ে সাধারণত আট বছরের বেশি টিকে থাকলে তাকে, টিকে থাকা বিয়ে বলা হয়।  প্রতিটি সংসারেই কমবেশি টুকিটাকি অশান্তি-ঝগড়াঝাঁটি হয় কিন্তু মিডিয়া লোকদের পিছে ক্যামেরা এবং মানুষের ইন্টারেস্ট বেশি থাকে বলেই তাদের বিষয়টা হাইলাইট হয়। আর হাইলাইট হওয়া মানেই আমাদের মস্তিষ্কের রেডিমেট সিস্টেমে চলে আসা। যেমন-

দেশে হরতাল বা অবরোধ হয়ে বিগত ১২ বছরে কত মানুষ মারা গেছে? তার চেয়েও হাজার হাজার গুণ বেশি মানুষ মারা গেছে রোড এক্সিডেন্ট-এ। কিন্তু রোড এক্সিডেন্ট আমাদের কাছে গুরত্ব পায় না, , আমরা আতঙ্কে থাকি হরতাল অবরোধ নিয়ে। কারণ ওটাই হাইলাইট হয়। আরেকটা উদাহরণ দিই-

আপনি অনেক রিসার্চ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মার্কেটে গিয়ে একটা নির্দিষ্ট ব্রান্ডের টেবিল ফ্যান কিনবেন কিন্তু যখন কিনতে গেলেন, তখন হয়তো অন্য কোনোটার ডিজাইন ভালো লেগে গেছে বা হয়তো কোনো বন্ধু কিংবা সেলসম্যান বলেছে নতুন আসা  টেবিল ফ্যানটাই সেরা, অথবা বড় বড় বিলবোর্ড কিংবা চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে আপনার সিদ্ধান্ত পাল্টে গেল। ব্যাস, কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই আপনি ওটা কিনলেন। এবার আপনাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে  আপনি বলবেন, হ্যাঁ আমি খুব ভেবে চিন্তা এই ফ্যানটা কিনেছি।  অথচ আমাদের বেশিরভাগ জিনিস কেনা হয় এভাবে, ভাবনা চিন্তা ছাড়া; শুধু মাত্র মিডিয়া হাইলাইটের কারণে।



হাইপার বোলিক ডিসকাউন্টিং

কেউ যদি বলে যে, আপনি আমার কাছ থেকে এখন ১০০ টাকা বকশিশ পেতে পারেন কিন্তু  বকশিসটা যদি এক মাস পরে নেন , তাহলে ১১০ টাকা পাবেন। তাহলে আপনি সাধারণত এখন পাওয়া ১০০ টাকাকে চুজ করবেন, কিন্তু যদি আপনাকে বলা হয় কয়েক মাস পর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে যদি বকশিসটা নেন,  তাহলে 100 টাকা পাবেন, আর যদি ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নেন তাহলে একশ দশ টাকা পাবেন। তাহলে আপনি সাধারণত দ্বিতীয়টাই চুজ করবেন। আবার আপনি যদি কিস্তিতে মোবাইল কিনতে গিয়ে জানেন যে, প্রথম কিস্তি এই মাসে জমা দিলে ২০ টাকা ছাড় পাবেন, এই মাসে না দ্দিয়ে আগামী মাসে জমা দিলে ২০ টাকা বেশি দিতে হবে, তাহলে আপনি সাধারণত আগামী মাসে ২০ টাকা বেশি দিতে রাজি হবেন। আবার অনলাইনে যদি কোন সাডস্ক্রিপসন কিনতে যান, তাহলে দেখবেন  তিন বা তার বেশি অপশন থাকে;

  তিনটা সাবস্ক্রিপশন প্ল্যান যদি ভালভাবে দেখেন, তাহলে দেখবেন প্রথমটা ৫০০ টাকা, দ্বিতীয়টা টা ৮৫০ আর তৃতীয়টা ১০০০ টাকা।  কিন্তু মাঝখানের অপশনটা হল লোক দেখানো । এর সাথে আর সামান্য টাকা দিলেই আপনি ডবল বেনিফিট  পাবেন। ১০০০ টাকার প্যাকেজ কেনার জন্য আপনাকে ৮৫০ টাকা অফারের এংকারিং করা হলো; যাতে আপনার অনুভব হয় যে, সামান্য বেশি টাকা দিয়ে আমি বড় কিছু অর্জন করতে পেরেছি।

আপনি কোন রেস্টুরেন্টে বসে দামি কিছু অর্ডার দিলেন; খেতে গিয়ে দেখলেন এটা খাবার অযোগ্য, ফ্রিতে হলে আপনি এই খাবার কখনোই খেতেন না কিন্তু অনেক টাকা দিয়ে কিনেছেন বলে খাবারটা ফেলে দিতে মন চাইবে না অতঃপর চোখ মুখ বন্ধ করে খেতে হবে।