ইতিহাস-৩০১  ▌গিয়াসউদ্দিন বলবন:  

তিনি প্রথমে নাসিরউদ্দিন মাহমুদের উজির ছিলেন। নাসিরউদ্দিন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যাওয়ার পর বলবন মসনদে বসেন। বলবন ১২৬৬ থেকে ১২৮৬ সাল শাসন করেছেন। ১২৪২ সালে আমিররা বাহরাম শাহেকে অপসারিত করে, ইলতুৎমিস-এর অপর পুত্র  আলাউদ্দিন মাসুদ শাহকে সিংহাসনে বসান। গিয়াসউদ্দিন বিষয়টি সহজভাবে নেননি। তিন ইলতুৎমিস-এর অপর পুত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদ-এর সাথে ষড়যন্ত্র করে, ১২৪৪ সালে মাসুদ শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং নাসিরুদ্দিন মাহমুদকে দিল্লির সিংহাসনে বসান। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন বাংলার ক্ষমতা করায়ত্ত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। সে উদ্দেশ্যেই তিনি তুগান খানকে বাংলায় প্রেরণ করেন। কিন্তু  তাঁর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে তুগরল তুগান খান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ফলে বলবন ১২৮০ সালে দুই লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলে তুগরল তুগান খান লখনৌতি থেকে পলায়ন করেন।


 ইতিহাস-৩০২  ▌আলাউদ্দিন খলজী: 

আলাউদ্দিন খলজী ১২৯৬ সালে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। আলাউদ্দিন খলজী জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য দ্রব্যের মূল্য নির্দিষ্ট হারে বেধে দেন। তিনি মূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রর্বতন করেন। আলাউদ্দিন খলজী শিল্পানুরাগী ছিলেন। বিখ্যাত আলাই দরওয়াজা তাঁরই কীর্তি। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারনী, কবি হোসেন দেহলবী, কবি আমির খসরু প্রমুখ গুণীজন তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তিনি প্রথম মুসলমান শাসক হিসাবে দক্ষিণ ভারত জয় করেন। তিনি ১৩০৬ সালে সর্বপ্রথম দক্ষিণাত্যের দেবগিরির রাজা রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেবগিরির রাজা দিল্লির আনুগত্য স্বীকার করেন। আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন খিলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন খিলজির ভাগ্নে এবং জামাতা। দিল্লির সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন । তিনি উলেমাদেরও অগ্রাহ্য করতেন। 


ইতিহাস-৩০৩  ▌মুহাম্মদ বিন তুঘলক: 

মুহাম্মদ বিন তুঘলক অত্যন্ত প্রতিভাবান শাসক ছিলেন। তিনি ১৩২৫ সালে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ  করেন। তিনি সোনা ও মুদ্রার পরিবর্তে প্রতীকী তামার মুদ্রা প্রচলন করে মুদ্রামান নির্ধারণ করেন। কিন্তু প্রতীক মুদ্রা জাল না হওয়ার জন্য যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার তা সে যুগে ছিল না। এর ফলে মুদ্রা জাল হতে থাকে। এ জন্য সুলতানকে এ পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হয়।

মাহমুদ শাহ: তুঘলক বংশের শেষ সুলতান ছিলেন মাহমুদ শাহ। বিখ্যাত তুর্কি বীর তৈমুর বেগ ছিলে মধ্য এশিয়ার সমরখন্দের অধিপতি। শৈশবে তার একটি পা খোড়া হয়ে যায় বলে তিনি তৈমুর লঙ নামে অভিহিত হন।  তিনি ১৩৯৮ সালে ভারত আক্রমণ করেন। তাকে বাধা দেওয়ার শক্তি মাহমুদ শাহের ছিল না। তিনি বিনা বাধায় দিল্লিতে প্রবেশ করেন। প্রায় তিন মাস ধরে অবাধে হত্যা ও লুন্ঠন করে বিপুল পরিমাণ স¤পদ নিয়ে স্বদেশে ফেরেন। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘তুজুক ই তৈমুরী’।


  ইতিহাস-৩০৪  ▌ইবরাহিম লোদি:  

লোদি রাজবংশের শেষ সুলতান। ১৫১৭ সালে তার পিতা সিকান্দার লোদির মৃত্যুর পর তিনি সুলতান হন। পানিপথের যুদ্ধে তার পরাজয় ও নিহত হওয়ার ফলে লোদি রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে। ইবরাহিম লোদি জাতিতে পশতুন ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতায় আসেন। তবে শাসনকাজে তিনি দক্ষ ছিলেন না। তার সময় বেশ কিছু বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। মেবারের শাসক রানা সংগ্রাম সিং উত্তর প্রদেশের পশ্চিম পর্যন্ত তার রাজ্য বিস্তার করেছিলেন এবং আগ্রায় হামলার হুমকি সৃষ্টি করেন। এছাড়াও পূর্বাঞ্চলেও বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। পুরনো ও জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের স্থলে তার প্রতি অণুগত অপেক্ষাকৃত তরুণদের নিয়োগ করায় ইবরাহিম লোদির প্রতি অভিজাত শ্রেণীও অসন্তুষ্ট ছিল। এসময় তার আফগান অভিজাতরা বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানায়। ১৫২৬ সালে বাবরের মুঘল সেনাবাহিনী ইবরাহিম লোদির বৃহৎ সনাবাহিনীকে পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত ও ইবরাহিম লোদিকে হত্যা করেন।


ইতিহাস-৩০৫  ▌বখতিয়ার খলজী: 

তিনি  উত্তর আফগানিস্তানের তুর্কি জাতির খলজী সম্প্রদায়র্ভুক্ত ছিলেন। গজনীতে তিনি তাঁকে সৈনিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য মুহম্মদ ঘুরীর নিকট আবেদন করেন। কিন্তু খর্বাকৃতি ও বাহুদ্বয় হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা হওয়ার কারণে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। অল্পকাল পরেই তিনি বাদাউনের শাসনকর্তা মালিক হুসামউদ্দীনের অধীনে তিনি মির্জাপুর জেলার ভাগওয়াত ও ভিউলী নামে দুটি পরগণার জায়গির প্রাপ্ত হন এবং মুসলমান রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে সীমান্তরক্ষীর কাজে নিয়োজিত হন। এখান থেকেই বখতিয়ার খলজী তাঁর ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টায় সফল হন। তিনি সীমন্তবর্তী ছোট ছোট হিন্দু রাজ্য আক্রমণ করে স¤পদ বৃদ্ধি করেন এবং খলজী সম্প্রদায়ের অন্যান্য লোক তাঁর দলভূক্ত হলে সৈন্যসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ১২০৩ সালে বখতিয়ার খলজী বিহার আক্রমণ করেন এবং ১২০৪ সালে বাংলার রাজধানী নদীয়া আক্রমন করেন।  ফলে নদীয়া মুসলমানদের  অধিকারে আসে।


 ইতিহাস-৩০৬  ▌ ফখরুদ্দিন মুবারক শাহী শাসন (১৩৩৮-১৩৪৯): 

ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের পূর্ণনাম ফকরা। ১৩৩৮ সালে তিনি সোনারগাঁয়ের শাসন ক্ষমতা দখল করেন ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীন সুলতান হিসেবে তিনি উপাধি গ্রহণ করেন ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। তবে তিনি পুরো বাংলা দখল করতে পারেননি। মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের শাসনামলে বাংলায় আসেন। তিনি নদী পথে সিলেট থেকে সোনারগাঁয়ে আসেন। ইবনে বতুতা প্রথম বিদেশী হিসেবে ‘বাঙ্গালা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক দ্রব্যাদির প্রচুর ও স্বল্পমূল্য আর মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী তাকে আকৃষ্ট করলেও এদেশের আবহাওয়া তাঁর পছন্দ হয়নি। এজন্য তিনি বাংলাদেশের নামকরণ করেন ‘দোযখপুর আয নিয়ামত’ বা আর্শীবাদপুষ্ট নরক বা ধনপূর্ণ নরক। তার ‘কিতাবুল রেহেলা’ নামক গ্রন্থে বাংলার অপরূপ বর্ণনা দেওয়া আছে।


 ইতিহাস-৩০৭  ▌সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৭): 

সুলতান ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ সালে সমগ্র বাংলা অধিকার করেন। এজন্য দিল্লির ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ আফীফ তাকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ বলে উল্লেখ করেন। তার সময় সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল ‘বাঙ্গালা’ নামে পরিচিত হয়ে উঠে। ইলিয়াস শাহ বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে পা-ুয়া নগরীতে স্থানান্তর করেন। তাঁর রাজত্বকালে বিখ্যাত সুফী সাধক শেখ শিরাজ উদ্দিন ও শেখ বিয়াবানী বাংলায় এসেছিলেন। শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের সময় বাংলার সবগুলো জনপদ একত্রে বাংলা নামে পরিচিতি লাভ করে। এ জন্য তাকে বাংলার প্রথম জনক বলা হয়। 

সুলতান সিকান্দার শাহ (১৩৫৭-১৩৯৩): পিতা সুলতান সিকান্দার শাহ ইলিয়াস শাহের পর ১৩৫৭ সালে বাংলার সুলতান হন।  পা-ুয়ার আদিনা মসজিদ সুলতান সিকান্দার শাহের অমর কীর্তি। তার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আজম শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন।


 ইতিহাস-৩০৮  ▌ সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ (১৩৯৩-১৪১১): 

এ যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ। তাঁর সহায়তায় বাঙালি প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা’ রচনা করেন। তিনি সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। পারস্যের কবি হাফিজের সাথে তাঁর পত্রালাপ হত। তাঁর রাজত্বকালে চীনা পরিব্রাজক ‘মাহুয়ান’ বাংলায় আসেন। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ তাঁর আদর্শ চরিত্র, শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা এবং সুশাসনের জন্য যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন।  তিনি পবিত্র মক্কা ও মদীনার তীর্থযাত্রীদের সব ধরনের সাহায্য দিতেন। তিনি একাধিকবার মক্কা ও মদীনা শহরের অধিবাসীদের জন্য প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। তিনি ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের জন্য মক্কার উম্মে হানির ফটকে একটি এবং মদীনার ‘বাব আল-সালামে’র  নিকটে অপর একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করান। এ প্রতিষ্ঠান দুটির জন্য তিনি প্রয়োজনীয় অর্থও প্রদান করেন। হিন্দুরা তাঁর দরবারে বেশ প্রাধান্য লাভ করে ছিল। 


 ইতিহাস-৩০৯  ▌ আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯): 

 হাবশি সুলতান শামসউদ্দিন মোজাফফর শাহ নিহত হওয়ার পর তিনি বাংলার সুলতান হন। ইতঃপূর্বে তিনি মোজাফফর শাহের উজির ছিলেন। তিনি সুলতানকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি নেতৃস্থানীয় আমীরদের দ্বারা সুলতান নির্বাচিত হন। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। হুসেন শাহের আমলে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। হুসেন শাহের রাজত্বকালে শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। তাঁর শাসন আমলে বাংলা সাহিত্যের চরম উন্নতি হয়। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী বাংলা ভাষায় মহাভারত রচনা করেন। তার আমলে বাংলা গজল ও সুফী সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। বিপ্রদাস, বিজয়গুপ্ত, যশোরাজ খান প্রমুখ সাহিত্যিকগণ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় লাভ করেছিলেন। তাঁর শাসনামলে গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ ও গুমতিদ্বার নির্মিত হয়। তার  শাসনাধীনে দেশে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজ করছিল।


 ইতিহাস-৩১০  ▌বারভূঁইয়াদের ইতিহাস: 

সম্রাট আকবর পুরো বাংলার উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। বাংলার বড় বড় জমিদাররা মুঘলদের অধীনতা মেনে নেয়নি।  স্বাধীনতা রক্ষার জন্য একজোট হয়ে মুঘল সেনাপতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বাংলার ইতিহাসে এ জমিদাররা বারভূঁইয়া নামে পরিচিত। অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদার বলতে বোঝাতেই বার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমদিকে বার ভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খাঁ। তিনি বাংলার রাজধানী হিসেবে সোনারগাঁওয়ের গোড়াপত্তন করেন। সম্রাট আকবরের সেনাপতিরা ঈসা খাঁকে পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। ঈসা খাঁ মৃত্যুর পর বারভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁর ছেলে মুসা খান। এদিকে আকবরের মৃত্যুর পর মুঘল সম্রাট হন জাহাঙ্গীর। তাঁর আমলে বারভূঁইয়াদের চূড়ান্তভাবে দমন করা হয়। এ সাফল্যের দাবিদার সুবেদার ইসলাম খান। তিনি বারভূঁইয়াদের নেতা মুসা খানকে পরাস্ত করেন ফলে অন্যান্য জমিদারগণ আত্মসমর্পণ করে।


  ইতিহাস-৩১১  ▌ ইসলাম খান(১৬০৮-১৬১৩): 

সুবেদার ইসলাম খানই বাংলার রাজধানী হিসাবে ঢাকার গোড়াপত্তন করেন। তিনি ১৬১০ সালে সুবা বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থান্তরিত করেন। তিনি সম্রাটের নাম অনুসারে নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। তিনি ‘ধোলাইখাল’ খনন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারের প্রথম দূত হিসেবে আসেন ক্যাপ্টেন হকিন্স। ক্যাপ্টেন হকিন্স ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের সুপারিশপত্র নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে ১৬০৮ সালে আগমণ করেন। ইসলাম খান ঢাকা এবং বাংলার গভর্নর ছিলেন ১৬০৮ থেকে ১৬১৩ সাল পর্যন্ত। ১৬১৩ সালে তিনি ঢাকা থেকে ২৫ মাইল উত্তরে ভাওয়ালে রহস্যজনক এবং অনাকাঙ্খিত ভাবে মৃতুবরণ করেন। তিনি প্রথমে সমাহিত হন বাদশাহী বাগ (ঢাকার পুরনো হাইকোর্ট এলাকা)।  তিনি ফতেহপুর সিক্রি নিবাসী দরবেশ শেখ সেলিম চিশতির দৌহিত্র ছিলেন। কথিত আছে ইসলাম খান শৈশবকালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের খেলার সাথী ছিলেন।


ইতিহাস-৩১২ ▌ মীর জুমলা(১৬৬০-১৬৬৩): 

তার জন্ম ইরানি ই¯পাহানের ১৫৯১ সালে। তিনি ছিলেন এক দরিদ্র তেল-ব্যবসায়ীর পুত্র। তনি হীরক এক হীরক ব্যবসায়ীর অধীনে কেরানির চাকরি লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি অন্য একজন ব্যবসায়ীর অধীনে চাকরি নিয়ে ভারতে এসেছিলেন। এরপর তিনি ঝুঁকিপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যে লিপ্ত হন। ক্রমে ক্রমে বহু জাহাজের মালিক হন। মীরজুমলা গোলকুন্ডার সুলতানের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন এবং রাজ্যের উজির বা প্রধানমন্ত্রীর পদে উন্নীত হন। তিনি কর্নাটক রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে জয়লাভ করেন। ঢাকা গেট নির্মাণ করনে মীর জুমলা। ২. তিনি আসাম যুদ্ধে যে কামান ব্যবহার করেন তা বর্তমানে ওসমানী উদ্যানে সংরক্ষিত আছে। ৩. মীরজুমলা ১৬৬১ সালে ১ নভেম্বরে ১২ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং ৩২৩ টি জাহাজ ও নৌকার বহর নিয়ে আসাম আক্রমণ করেন। তিনি ছিলেন উদ্যোগী এবং নম্র ও সৌহার্দ্যপূর্ণ।


ইতিহাস-৩১৩  ▌ সুবাদার শায়েস্তা খান: শায়েস্তা খান (১৬৬৪-১৬৭৮ এবং ১৬৭৯-১৬৮৮):

 শায়েস্তা খান ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের মামা। মীর জুমলার মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব শায়েস্তাখানকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন। শায়েস্তা খা আরাকান রাজাকে প্রচ- হুমকি হিসেবে গণ্য করেছিলেন কেননা তারা সেনা ও নৌ শক্তিতে সমৃদ্ধ ছিল। তিনি তৎক্ষণাত মুঘল নৌ-বাহিনীর উন্নয়ন শুরু করেন। এক বছরে নৌ-বহরের সংখ্যা প্রায় ৩০০ পৌছে। তিনি ডাচ ইস্ট ই-িয়া কো¤পানি এবং পর্তুগালের সমর্থন অর্জনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালান। ডা” সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শায়েস্তা খাঁ আরাকানদের দখলে থাকা সন্দ্বীপ দখল করেন। চট্টগ্রাম তখন ছিল আরাকানদের রাজধানী। সেখানে সাগরে এবং পরবর্তীতে কর্ণফুলীতে প্রচ- নৌ-যুদ্ধ হয়, যাতে পর্তুগিজদের সহায়তায় মুঘলরা জয় লাভ করে। একই সাথে কুচবিহার ও কামপূরায় মুঘল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।  তার কল্যাণে ঢাকা উন্নত শহরে পরিণত হয়।


ইতিহাস-৩১৪  ▌ মুর্শিদ কুলি খান: 

ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। এছাড়াও বিভিন্ন নথি-পত্র নির্দেশ করে তিনিই মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু পরবর্তী প্রথম স্বাধীন নবাব। তার উপর মুঘল সাম্রাজ্যের নামমাত্র আধিপত্য ছিল, সকল ব্যবহারিক উদ্দেশ্যেই তিনি বাংলার নবাব ছিলেন।  মুর্শিদ কুলি খানকে, হাজি শফি ইসফাহানি নামে ইরানের একজন উচ্চপদস্থ মুঘল কর্মকর্তা ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করেন। ইসফাহানিই তাকে শিক্ষিত করে তুলেন। ভারতে ফেরার পর তিনি মুঘল সাম্রাজ্যে যোগদান করেন। তিনি বেরার প্রদেশের দেওয়ান হাজী আব্দুল্লাহ কুরাইশির অধীনে চাকরি নেন। পরবর্তীতে বেরার প্রদেশের দেওয়ান সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনে চলে আসে। ১৭০০ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে কার্তালাব খান নামে ইসলাম ধর্মে স্থানান্তরিত করেন ও বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করেন।  নতুন নিয়োগ পেয়ে ঢাকায় পৌঁছেন। তিনি রাজস্ব ও প্রশাসনে যোগ্যতার পরিচয় দেন। তিনি ছিলেন সৎ এবং সম্রাটের অত্যন্ত বিশ্বস্ত।


 ইতিহাস-৩১৫  ▌ নবাব আলীবর্দী খান: 

(১৬৭১-১৭৫৬) ছিলেন ১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর বাংলার নবাব ছিলেন এবং তার শাসনামলের অধিকাংশ সময়ই মারাঠা আক্রমণকারী ও আফগান বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যয়িত হয়। একজন অসমসাহসী ও রণনিপুণ সেনাপতি হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন এবং কর্মদক্ষ ও দূরদর্শী শাসক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। নবাব পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আলীবর্দী বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন এবং পরবর্তী এক যুগ তাকে দেশীয় ও আফগান বিদ্রোহী, মারাঠা আক্রমণকারীসহ বিভিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতে হয়।  আঠারো শতকের গোড়া থেকেই বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা মিলে ক্রমান্বয়ে একটি স্বাধীন প্রাদেশিক রাজ্যে পরিণত হয়। বিদেশী মুসলমানরা ভাগ্যের সন্ধানে ভারতবর্ষে এসে নিজ কৃতিত্বগুণে প্রশাসনের উচ্চতর স্থানগুলো দখল করতে থাকেন। আলিবর্দী খানের আরব বংশীয় পরিবারও এমনই এক সময় বাংলায় আসেন। 


ইতিহাস-৩১৬  ▌ নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা (১৭৫৬-১৭৫৭): 

আলীবর্দী খানের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। ছোট মেয়ে আমেনার বিবাহ হয় জয়েরউদ্দিনের সাথে। তাঁদের সন্তান সিরাজ-উ-দ্দৌলাকে তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। সিরাজউদ্দৌলার প্রকৃত নাম মীর্জা মুহম্মদ আলী। তিলি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিরাজ-উ-দ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে আরোহণ। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। তিনি সিংহাসন লাভ করায় তার বড় খালা ঘষেটি বেগম এবং দরবারের প্রভাবশালীগণ নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। ইংরেজগণ এ ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ অধিকার করেন। কলকাতা অধিকার করে সিরাজউদ্দৌলা নিজ মাতামোহের নামানুসারে এর নাম রাখেন আলীনগর। মীরজাফরের সিরাজবিরোধী প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল জগৎ শেঠের নীলনকশা মাফিক।


 ইতিহাস-৩১৭  ▌ পলাশীর যুদ্ধ:

 ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজউদ্দৌলার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নওয়াব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানির মধ্যে বিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। নবীন নওয়াব বাংলায় কো¤পানির অবৈধ কার্যক্রমের তীব্র প্রতিবাদ জানান। মুর্শিদাবাদ দরবারে কিছু প্রভাবশালী তার প্রতি যে অসন্তুষ্ট ছিল। নওয়াবকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে। ২৩ জুন, ১৭৫৭ পলাশীর প্রান্তরে নবাবের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়। মীরমদন, মোহনলাল প্রমুখ দেশপ্রেমিক সৈনিকগণ প্রাণপণ যুদ্ধ করলেও নবাবের সেনাপতি মীরজাফর, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, ইয়ারলতিফ, উমিচাঁদ এদের ন্যায় দেশদ্রোহীদের ষড়যন্ত্রে নবাব পরাজিত ও নিহত হন। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তিমিত হয়। সিরাজ-উ-দ্দৌলার হত্যাকারী মোহাম্মদী বেগ (মতান্তরে মীর জাফরের পুত্র মীরন)। পলাশীর প্রান্তর হল ভারতের পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরের উত্তরে ভাগীরথি নদীর তীরে ছোট একটি গ্রাম।


ইতিহাস-৩১৮  ▌মীর কাসিম ও বক্সারের যুদ্ধ: 

তিনি ১৭৬০ সাল থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত বাংলার নবাব ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধ পরবর্তী নবাব মীর জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি মীর কাসিমকে ক্ষমতায় বসায়। তিনি ছিলেন মীর জাফরের জামাতা। তবে তিনি দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাচেতা ছিলেন। ক্ষমতায় বসার অনতিকাল পরেই নবাব মীর কাসিম রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারের মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেছিলেন। সেখানে তিনি নিজের একটি স্বতন্ত্র সেনাবাহিনীও গড়ে তোলেন। তিনি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ১৭৬৪ সালে বিহারের বক্সার নামক স্থানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বক্সারের যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু তার সম্মিলিত বাহিনী মেজর মনরোর ইংরেজ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধের পর মীর কাশিম আত্মগোপন করেন এবং ১৭৭৭ সালে মারা যান। শাহ আলম ইংরেজদের পক্ষে যোগদেন এবং সুজাউদ্দোলা রোহিলাখ-ে পালিয়ে যান।


 ইতিহাস-৩১৯  ▌ ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষে মুসলমানদের পিছিয়ে যাওয়া: 

১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের শাসনক্ষমতা ধরে রাখাটাই ইংরেজদের মূল চিন্তা ছিল। আর সে কারণেই ইংরেজরা তৈরি করে 'উরারফব ধহফ জঁষব' নীতি। এই জঘন্য রাজনীতির প্রধান শিকার ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠী। পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা বাংলার হিন্দুদের জমিদারী, তালুকদারী, সরকারি চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিজেদের দলভুক্ত করে নেয়। মুসলিম শাসনামলে সম্রাট, নওয়াব, জমিদার, জায়গীরদার ও ধনী ব্যক্তিবর্গের অর্থানুকূল্যে মুসলিমদের জন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানী এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস নানাভাবে বন্ধ করে দেয়। শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত মুসলমানরা তাদের শিক্ষার আর্থিক উৎস হারিয়ে ধীরে ধীরে এক অশিক্ষিত সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। কয়েকশ বছরব্যাপী প্রতিষ্ঠিত একটি সুদৃঢ় শিক্ষা ব্যবস্থাকে কয়েক দশকের মধ্যে এভাবে ধ্বংস করা হয়। 


 ইতিহাস-৩২০  ▌ যেভাবে পাকিস্তান ধারণার জন্ম নিল: 

ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর জন্যও পৃথক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ দেখেন  মোহাম্মদ আলী নামে ৩৬ বছরের এক যুবক। ইংরেজিতে চধশংঃধহ শব্দটির মাধ্যমে তিনি তাঁর উল্লিখিত পাঁচটি অঞ্চলকে নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন। পাঞ্জাবের চ, আফগান প্রদেশের অ, কাশ্মীরের ক, সিন্ধুর ঝ, এবং বেলুচিস্তানের ঃধহ নিয়ে তৈরি হয়েছিল চধশংঃধহ । আলী জন্মেছিলেন ১৮৯৭ সালে ভারতের পাঞ্জাবের হোশিয়ারপুর জেলার অন্তর্গত বালাচৌর শহরে একটি মুসলিম গুরজার পরিবারে।  তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে  এক বেলুচি জমিদারের আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৩০ সালে চলে যান ইংল্যান্ডে, ১৯৪০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন এমএ ডিগ্রি। লন্ডনে বাসের দোতলায় যাত্রা করতে করতে তিনি প্রথম পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৩৪ সালে আলী ভারতে এসে জিন্নাহর সাথে দেখা করে তার ধারণাটি তুলে ধরেন।


 ইতিহাস-৩২১ ▌ গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’: 

১৯৪৬ সাল, সোহরাওয়ার্দী হয় অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রী। পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য  জিন্না ঘোষিত ‘ডাইরেক্ট এ্যকশন ডে’ বাংলায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে সোহরাওয়ার্দীর উপর। ই¯পাহানি মির্জাপুর চা কো¤পানির মালিক ই¯পাহানি নিজের সব লরি মুসলিম লীগের লোকজনদের ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলো। সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতেই তৈরি হওয়া আইনশৃংখলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছক, তা গোপনে হিন্দু মহাসভা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে সোহরাওয়ার্দীর মেয়ের শিক্ষক বৃদ্ধ হরেন ঘোষ। হিন্দু কসাই গোপাল পাঁঠা ১ দিনের মধ্যে ৮০০ হিন্দু ও শিখ যুবককে সাথে নিয়ে গড়ে তোলে এক বিশাল কিলিং বাহিনী এবং মুসলমানদের হত্যা করতে শুরু করে। মুসলমানেরাও রুখে দাঁড়ায়। তখন শেখ মুজিব কলকাতায় মুসলিম ছাত্রদের প্রধান নেতা। দাঙ্গায় হিন্দুদের হত্যার অভিযোগ উঠলো তার বিরোদ্ধে। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো বিহারে ও নোয়াখালীতেও। মারা গেল দুপক্ষের অগণিত হাজার হাজার লোক।


 ইতিহাস-৩২২  ▌কারা বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করলো: 

বিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও মুসলিম লীগ নেতৃত্ব প্রস্তুত ছিলো বাংলাকে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তানের বাইরে অবিভক্ত রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাকে স্বীকার করতে; কিন্তু‘ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলো না কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয়  নেতারা। ১৯৪৬ সার্লের বাংলায় মুসলমান ছিলো ৫৫%, হিন্দু ৪৫%। বাংলা হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান থেকে পৃথক রাষ্ট্র হবে; তাতে মুসলিম লীগ  নেতাদের সম্মতি ছিলো। ২৬শে এপ্রিল ১৯৪৭সালে মাউন্টব্যাটেন যখন জিন্নাকে সোহরাওয়ার্দীর স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ  বাংলার প্রস্তাবের কথা বললেন, তখন জিন্না  একটুও ইতস্তত না করে বলেছিলেন, “আমি আনন্দিত  হবো তারা ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন থাকে”; কিন্তু‘ কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বরাবর বাংলাকে দ্বিখ-িত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলো। বাংলাকে ভাগ করতে হবে- এই ছিলো তাঁদের অন্যতম দাবি। বিড়লা প্রমুখ  মাড়োয়ারী, বড় মুৎসুদ্দিদের ঘাঁটি কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গকে তাঁরা কখনো হাতছাড়া করতে প্রস্তুত  ছিলেন না।


ম আছে ৯৭%, জম্মুতে হিন্দু-মুসলিম ও বৌদ্ধ প্রায় সমান আর লাখাদে হিন্দু সংখ্যাগরিস্ট। ১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হন। মুসলিমরা ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। এই সময়ের মধ্যে বেশিভাগ কাশ্মীরী ইসলাম গ্রহন করে। পরে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের কাছে থেকে কিনে নেন। ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার সময় গোলাব সিং-এর নাতি হরি সিং ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের সাথে চুক্তিনামা তৈরি করল কাশ্মীর স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকার। পাকিস্তান চুক্তিনামায় সই করলেও ভারত সময়ক্ষেপন করছিল। ফলে কাশ্মীরে সৈন্য পাঠিয়ে দুজন দু অংশ দখল করলো। ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধে চীন কাশ্মীরের ২০% দখল করে। 

 ইতিহাস-৩২৪ ▌মুসলিম হায়দ্রাবাদ: 

হায়দ্রাবাদ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল, তার ছিল স্বাধীন প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। মীর লায়েক আলী ছিলেন স্বাধীন হায়দারাবাদের শেষ প্রধানমন্ত্রী। হায়দারাবাদে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ত্রয়োদশশতকের শেষ দিকে। তখন থেকেই হায়দারাবাদকে কেন্দ্র করে মুসলিম শিল্প-সংস্কৃতির যে বিকাশ ঘটে তা পুরো দাক্ষিণাত্যকে প্রভাবিত করেছিল।  বৃটিশ শাসননামলে বৃটিশ সরকারের সাথে চুক্তি সাপেক্ষে স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল। ৮২,৬৯৮ বর্গমাইল এলাকা বিস্তৃত এবং বাংলাদেশের তুলনায়ও আয়তনে বড় দেশ হায়দারাবাদ। দেশটিতে নিজস্ব আইন আদালত ছিল। বিচার ব্যবস্থা ছিল। নিজস্ব মুদ্রা ছিল, সেনাবাহিনী ছিল, হাইকোর্ট ছিল, ছিল শুল্ক বিভাগ।  ভাষা ছিল; নিজস্ব পতাকা ছিল, জাতীয় সংগীত ছিল।  ১৯৪৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর হায়দারাবাদে অভিযান শুরু করে ভারত। প্রায় ২ লাখ মুসলিম প্রতিরোধযোদ্ধাদের হত্যা করে দখল করে ভারত।


ইতিহাস-৩২৫  ▌ আরবদের চট্রগ্রাম আগমণ: 

যীশু খ্রীষ্ট্রের জন্মের পূর্ব থেকে আরবরা পালবাহী নৌকায় করে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষ ও বাংলায় জলপথে যাতায়াত করত। চট্টগ্রাম বন্দর আরব বণিকদের নিকট বহুকাল থেকে পরিচিত ছিল। তারা এ বন্দরে অবতরণ করে বাণিজ্যিক পণ্য সংগ্রহ করত। এ বন্দর হয়ে তারা ব্যবসায় উদ্দেশ্যে স্থলপথ ধরে তিব্বত ও চীনে গমন করত। এ ছাড়াও  তারা আরাকান ও বার্মায় সফর করত। এমনকি চাটগাঁ নামটি আসলে তাদের দেয়া নাম। গঙ্গার ব-দ্বীপ বা শেষ প্রান্তে এই স্থানটির অবস্থিতি বলে আরব বণিকরা এর নাম দেয় শাতিউল গাঙ্গ বা গঙ্গার উপকূল। তা থেকেই কালক্রমে চিটাগাং  বা চাটগাও  এ রূপান্তরিত হয়েছে।  সুলায়মান নামের জনৈক্য আরব বণিক-এর বর্ণনায়,  চট্টগ্রাম-এ ‘জাযিরাতুর রামি’ নামের একটি রাজ্যের কথা আছে। রামির রাজার নাকি অনেক হাজার হাতি এবং সৈন্য ছিল।  আজকের কক্সবাজারের সন্নিকটবর্তী রামু সেই রাজ্যরই একটি ক্ষুদ্রাংশ।


ইতিহাস-৩২৬ ▌পাহাড়পুরে আরব বণিকের আগমন: .

বাংলায় আগত আরব বণিকরা ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি ইসলাম প্রচারে ও ব্রতী থাকতেন।  উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে পাল বংশের রাজত্ব শুরু হয়। আর এ সময়কাল ছিল আব্বাসীয়দের খিলাফত। ধর্মপাল যখন বাংলাদেশের শাসক, তখন মুসলিম জাহানের খলিফা ছিলেন, হারুনুর রশীদ। তারই খিলাফত কালে নওগাঁ জেলার অন্তর্গত পাহাড়পুরে কয়েকজন আরব বণিক আগমন করেছিল। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার খনন কালে খলিফা হারুনুর রশীদের আমলের একটি স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। মুদ্রাটিতে ১৭২ হিজরি সন খোদিত ছিল। বণিকদের মধ্য থেকে অতি উৎসাহী কেউ কেউ ধর্মালোচনা ও ধর্ম প্রচারার্থে তৎকালীন বাংলার শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় কেন্দ্র পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার ও ময়নামতির শালবন বিহারে গিয়ে থাকতে পারেন বলে ঐতিহাসিকদের অভিমত।

.

ইতিহাস-৩২৭  ▌ আরব বণিকদের সন্দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন: 

চট্রগ্রামের ‘সন্দ্বীপ’ একটি প্রাচীন দ্বীপ। সপ্তম শতাব্দী থেকে তিন হাজার বছরের প্রাচীন এই দ্বীপের সাথে আরব বণিকদের বাণিজ্যিক স¤পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। সে সময় থেকে আরব বণিকরা সন্দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন ও স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা চীন যাওয়ার পথে এই দ্বীপ সফর করেন। তিনি এ সময় চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ ও উপকূলীয় দ্বীপসমূহে অসংখ্য আরবকে বসবাস করতে দেখেন। ১৪১২ খ্রিস্টাব্দে সুদূর বাগদাদ থেকে হযরত শাহ আলী আল-বাগদাদী নামে জনৈক মুসলিম সাধক সন্দ্বীপে আগমন করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপীয় পরিব্রাজক পাচাচ  সন্দ্বীপ সফর করে এখানকার অধিবাসীদেরকে মুসলমান বলে উল্লেখ করেন। তিনি এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীকে ধর্মভীরু হিসেবে দেখতে পেয়েছেন এবং তাদের মসজিদগুলো ২০০ বছরেরও অধিক প্রাচীন বলে উল্লেখ করেন।


ইতিহাস-৩২৮  ▌ বার আউলিয়ার দেশ: 

হযরত মুআবিয়ায় খিলাফতকাল থেকে নৌ অভিযানের সূচনা হওয়ায় আরবদের এক নবযুগের সৃষ্টি হয়। আরবীয় মুসলমানরা একদিকে যেমন বিভিন্ন দেশে নৌ পরিচালনা করেছিল অপরদিকে তারা শান্তিপূর্ণ নৌ ভ্রমণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আরব পর্যটক সুলায়মান সায়রাফী আরবদের নৌযান পরিচালনা সম্বন্ধে তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে যে বিন্তারিত আলোচনা করেছেন তাতে দেখা যায় যে, আরবরা পারস্য সাগর থেকে বের হয়ে ভারত মহাসাগরে অবতরণ করার পর বঙ্গোপসাগর অতিক্রমকালে বাংলার বিখ্যাত বন্দর চট্টগ্রাম ও সিলেট পর্যটন করে। এছাড়া তারা মেঘনার মোহনাস্থ সন্দ্বীপ ও অন্যান্য নিকটস্থ এলাকাসমূহে তাদের উপনিবেশ ও প্রভুত্ব বিস্তার করেছিল। তখন সন্দ্বীপ বন্দর দিয়ে ধর্মপ্রচারক ও সূফী সাধকদের আগমনের ফলে চট্রগ্রাম গৌরবময় স্থানে পরিণত হয়। এজন্য চট্টগ্রামকে বার আউলিয়ার দেশ অথবা দ্বিতীয় আরব বলেছেন অনেক ঐতিহাসিক।


ইতিহাস-৩২৯  ▌প্রথম ভারতীয় মুসলমান ও মসজিদ: 

ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আরব জাতি বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এরপর আরব বণিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিশ্বের সর্বত্র তাদের নতুন ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। ৬২৯ সালে মুহাম্মাদ (৫৭১-৬৩২ খ্রি.) এর জীবদ্দশাতেই ভারতে প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়। চেরামন পেরুমল নামে জনৈক ধর্মান্তরিত মুসলমানের নির্দেশে কেরলের ত্রিসূর জেলায় মালিক বিন দিনার এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, রাজা পেরুমলকেই প্রথম ভারতীয় মুসলমান মনে করা হয়। মালাবারের মাপ্পিলা সম্প্রদায়ই আরব বণিকদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করত। এই সময় সমগ্র উপকূল জুড়ে ব্যাপক প্রচারকার্য চালানো হয় এবং বেশ কিছু স্থানীয় অধিবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই সকল নব্য ধর্মান্তরিতেরা মাপ্পিলা সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছিলেন। আরব বণিকদের সঙ্গে এই সম্প্রদায়ের বৈবাহিক স¤পর্কও স্থাপিত হয়েছিল।


ইতিহাস-৩৩০  ▌ বাংলাদেশে ইসলামের আগমন: 

‘জাতীয় অধ্যাপক’ দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের মতে, হজরত ওমর (রা.) এর শাসনামলে মামুন ও মুহাইমেন (রা.) নামক সাহাবিদ্বয় বাংলাদেশে আগমন করেন। বিশিষ্ট সাহাবি আবু ওয়াক্কাস (রা.) ৩য় হি. (৬২৬ খ্রি.) ইসলাম প্রচারের জন্য চীন যাওয়ার পথে কিছুকাল রংপুর এলাকায় অবস্থান করে ইসলাম প্রচার করেন। এর সপক্ষে প্রমাণ হচ্ছে-রংপুরের ৪৮ কিমি দূরে লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের বড়বাড়িতে রামদাস মৌজার ‘মসতার পাড়’ নামক স্থানে এক অভূতপূর্ব নদর্শন পাওয়া গেছে, যা ৬৯ হিজরিতে (আনুমানিক ৬৯২ খ্রি.)  নির্মিত একটি মসজিদ। এর মধ্যে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়, যার মধ্যে ¯পষ্টাক্ষারে আরবিতে লেখা আছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি ৬৯ সাল। আরও খননের পর মসজিদের মেহরাব এবং মসজিদ সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠ ও ইমাম সাহেব যে স্থানে খুৎবা পাঠ করতেন, তাও আবিষ্কৃত হয়। 


ইতিহাস-৩৩১  ▌  বাঙালিরা যেভাবে মুসলমান হলো: 

সুফীর সাধকদের প্রচারের ফলে ইসলামি ধর্মীয় দর্শন বেশ প্রসার লাভ করে। এতে বহু লোককে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। তবে তাদের সংখ্যা নিশ্চয় তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। ভারতে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই ধর্মাস্তরের গতি বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে যে সব মুসলমান ধর্মপ্রচারক এদেশে ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন তারা মুসলমান প্রশাসক (১২০৪-১৭৫৭ পর্যস্ত)দের সহায়তা পেয়েছিলেন। সাড়ে পাঁচ’শ বছর ধরে মুসলমানরা এখানকার শাসনকর্তা, সুলতান বা সুবেদারদের আস্তানা দিল্লিতে সব সময় ষড়যন্ত্র-শঠতা-হত্যা আর রাজনৈতিক গোলযোগ লেগেই থাকত। বাংলা ছিল তুলনায় নিরাপদ। ফলে বেশ কিছু সংখ্যক অবাঙালি (আরবী, ইরানী, তুর্কী, আফগানী, হাবশী, মোগল, পাঞ্জাবী, বিহারী প্রভৃতি) মুসলমান বাংলায় বসবাস করতে শুরু করে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক সেন-বর্মন-দেব আমলে নিুবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হত। ব্রাহ্মণ্য সমাজ যাদের পতিত,বা ছোয়ারও অযোগ্য করে দুরে সরিয়ে রেখেছিল, ইসলাম তাদের সব রকম শৃঙ্খলমুক্ত করে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছিল।  


ইতিহাস-৩৩২  ▌খান জাহান আলী: .

হযরত উলুঘ খান জাহান আলী ছিলেন বিশিষ্ট ধর্ম প্রচারক ও বাংলাদেশের বাগেরহাটের একজন স্থানীয় শাসক। তিনি ১৩৬৯ সালে দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। খান জাহান আলী ১৩৮৯ সালে সেনাবাহিনীতে সেনাপতি পদে যোগদান করেন। তিনি রাজা গণেশকে পরাজিত করে বাংলার দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে ইসলামের পতাকা ওড়ান। তিনি বাগেরহাট জেলার বিখ্যাত ষাটগম্ভুজ মসজিদ (১৪৩৫-১৪৫৯ খিঃ) নির্মাণ করেন। এটি বাংলাদেশে মধ্য যুগের সবচেয়ে বড় মসজিদ। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো ষাটগম্ভুজ মসজিদকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করেন। খানজাহানের প্রথম স্ত্রীর নাম সোনা বিবি। কথিত আছে সোনা বিবি ছিলেন খানজাহানের পির  নুর-কুতুবুল আলমের একমাত্র কন্যা। খানজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী রূপা বিবি ওরফে বিবি বেগনি ধর্মান্তরিত মুসলমান ছিলেন। খানজাহান আলি তাঁর দুই স্ত্রীর নাম অনুসারে সোনা মসজিদ এবং বিবি বেগনি মসজিদ নামে মসজিদ নির্মাণ করেন। 


 ইতিহাস-৩৩৩  ▌ তালেবানদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: 

১৯৭৩ সালের আগ পর্যন্ত রাজা জহির শাহ দেশটি পরিচালনা করছিলেন গণতন্ত্রের আদলে। ১৯৭৯ সালের দিকে তখনকার পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাবতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আফগানিস্তান রাষ্ট্রকে ব্যবহার করবে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল ভূখ-ে আঘাত হানার জন্য। ফলে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত সেনাবাহিনী আফগানিস্তান আবস্থান শুরু করে। ১৯৭৯ সালে তালেবান গঠিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্থান থেকে সোভিয়ত ইউনিয়নের সৈন্যদের দূর করে দেশকে স¤পূর্ন স্বাধীন করা। প্রথমে তাদেরকে সাহায্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান। এ সময়ে প্রায় পনের হাজার সোভিয়ত সৈন্য নিহত হয়। ১৯৮৯ সালে সোভিয়ত সৈন্যরা আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হল। দেশে চালু করল ইসলামী শরীয়া আইন। পরবর্তীতে ২০০১ এ আমেরিকা ওয়ান ইলেভেন হামলাকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। ২০২১ সালে তারাও বিদায় নেয়।


ইতিহাস-৩৩৪  ▌রোহিঙ্গাদের ইতিহাস: 

"বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মিয়ানমার(বার্মা) ছিল এশিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ। ফলে বার্মায় আসা ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়তেই থাকে এবং ১৯২৭ সালে অভিবাসীদের সংখ্যা হয় ৪৮০,০০০ জন,  রেক্সগুন নিউ ইয়র্ককেও অতিক্রম করে বিশ্বের বড় অভিবাসন বন্দর হিসেবে। মোট অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১.৩ কোটি (১৩ মিলিয়ন)। " তখন বার্মার রেক্সগুন, আকিয়াব, বেসিন, প্যাথিন এবং মৌমেইনের মত অধিকাংশ বড় শহরগুলোতে ভারতীয় অভিবাসীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯ শতকে হাজার হাজার বাঙালি কাজের সন্ধানে  চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে টেকনাফের নাফ নদী পেরিয়ে ওপাড়ে মংডোতে গিয়ে বসতি গড়েছিল। এই মংডো অঞ্চলেই মুলত রোহিঙ্গাদের বাস।  ১৯৬২ সালে বর্মি সামরিক জান্তারা সারা বিশ্ব থেকে নিজেদের দরজা বন্ধ করে দেয় এবং ফলে তারা হয়ে যায় এশিয়ার দরিদ্রতম একটি দেশ। রোহিঙ্গা, কাকাং,পানথাইদের(চীনা মুসলিম) মত ক্ষুদ্র জাতিকে ব্যপকভাবে নির্যাতন করে থাকে।


ইতিহাস-৩৩৫  ▌ ফিলিপাইনে ইসলাম: 

১৩৮০ সালে করিম উল 'মখদুম নামক আরব বণিক সর্বপ্রথম ফিলিপাইনের সুলু এবং জুলু দ্বীপপুঞ্জে আগমন করেন এবং সেখানে বাণিজ্যের সাথে সাথে সমস্ত দ্বীপে ইসলামকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ফিলিপাইনে প্রথম ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩৯০ সালে মিনাঙ্গ‹াবাউ রাজবংশের প্রিন্স রাজা ব্যাগুইনদা এবং তার অনুসারীরা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং দ্বীপপুজ্ঞে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। "শেখ করিম আল-মাখদুম" মসজিদটি ফিলিপাইনের প্রথম মসজিদ যা মিন্দানাওয়ের সিমুনুল প্রদেশে ১৪'শ শতকে প্রতিষ্টিত হয়। পরবর্তীতে মালেশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় ভ্রমণকারী আরব ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে ফিলিপাইনে ইসলাম আরও শক্তিশালী হয়। আর তখনকার ফিলিপাইনের রাজ্যগুলো দাতু, রাজা এবং সুলতানদের দ্বারা শাসিত হত। চীন, ভারত এবং পারস্য থেকে আগত মুসলিম মিশনারিদের দ্বারাও এখানে ইসলাম প্রচারিত হয়। 


ইতিহাস-৩৩৬  ▌ ব্রুনাইয়ে ইসলামের আগমন ও বিকাশ: 

আরব, পারস্য, ভারত ও চীন থেকে আগত ব্যবসায়ী ছাড়াও সুলতান মাহমুদ শাহের ইসলাম গ্রহণের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্রুনাইয়ে ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রসার হয়। তাছাড়া এ সময়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বংশধর শরিফ আলী নামের একজন ইসলাম প্রচারকের আগমন ঘটে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সুলতান আহমদের কন্যাকে বিয়ে করেন। স্থানীয় বহু ইসলাম প্রচারকের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। ফলে আশপাশের বহু অঞ্চলে দ্রুততর সময়ে ইসলাম বিস্তার লাভ করে। বোর্নিও দ্বীপ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। দ্বীপের একটি অংশ ব্রুনাই। আর বাকি অংশে আছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া।  ব্রুনাইয়ের আয়তন ৫ হাজার ৭৬৫ কি.মি.। জনসংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৬২০ জন। উন্নয়ন ও উন্নত জীবনমানের দিক থেকে সিঙ্গাপুরের পরেই এর অবস্থান। ১৩৭৬ সালে সুলতান মুহাম্মাদ শাহ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ১৪০২ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রুনাই রাজ্য শাসন করেন। 


ইতিহাস-৩৩৭  ▌ চীনে ইসলাম: 

সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (৫৯৪-৬৭৪), জাফর ইবনে আবি তালিব, এবং জাহস সহ চারজন সাহাবী ৬১৬/১৭ সাল থেকে চীনে এসে ধর্মপ্রচার শুরু করে। তারা ৬১৫/১৬ সালে আবিসিনিয়া থেকে জাহাজে যাত্রা করে চট্টগ্রাম-কামরূপ-মনিপুর রাস্তা ধরে চীনে পৌঁছান। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস পুনরায় তৃতীয়বারের মত ৬৫০-৫১ সালে খলিফা উমরের কথায় চীনে দূতের দলের নেতা হয়ে যান। সেই দূতের দলকে চীনের সম্রাট উষ্ণতার সাথে গ্রহণ করেন। ইসলাম-পূর্ব আরব এবং চীনের দক্ষিণ তীরের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক স¤পর্ক ছিল, এবং আরব উপকূলের ব্যাবসায়ীগণের ইসলামে ধর্মান্তরিত হবার পর এই বাণিজ্য সমৃদ্ধ হয়। মঙ্গোল ইউয়ান রাজবংশের সময়ে এই সমৃদ্ধি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। হুয়াইশেং মসজিদ হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতম মসজিদগুলোর মধ্যে একটি। ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বাস করা হয় যে এটি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস দ্বারা নির্মিত। 


ইতিহাস-৩৩৮  ▌চীনের উইঘুর জাতি: 

মূলত, এরা স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী।  ১৯১১ সালে মাঙ্কু সাম্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ব তুর্কিস্তানে চীনা শাসন চালু হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনচেতা বীর উইঘুররা এই বৈদেশিক শাসনের সামনে মাথা নোয়ায়নি। এ কারণে ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে তারা দুবার চীনাদের সঙ্গে সাহসিকতার চরম রূপ দেখিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ভাগ্য তাদের অনুকূলে ছিল না। এ কারণে ১৯৪৯ সালে আবারও তারা চীনা কমিউনিস্টদের হাতে পরাজিত হয় আর জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গড়ে ওঠে। জিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখের মতো। এর মধ্যে মুসলমান প্রায় ১ কোটি ২৬ লাখ। চীন হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম ধর্মীয় নিপীড়ক দেশ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এসব নিপীড়নের গোঙানির শব্দ বিশ্ববাসী খুব একটা জানতে পারে না। গত কয়েক দশকে সংখ্যাগুরু চীনা হান জাতির বহু মানুষ শিনজিয়াং অঞ্চলে গেছেন সেখানে বসবাস করতে। উইঘুর সম্প্রদায়ের লোকজন মনে করছেন এর ফলে তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপন হুমকির মুখে পড়েছে।


ইতিহাস-৩৩৯  ▌ চীনের হুই মুসলমান: 

চীনের সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী হল হান জাতি। এদের একাংশ ইসলাম গ্রহণ করায় তাদের বলা হয় হুই। পুরো চীনে প্রায় নয় লাখের মতো হুই গোষ্ঠীর বাস। তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চীনজুড়েই। তবে উত্তর-পশ্চিম চীনেই হুই জাতির বসবাস বেশি। হুই গোষ্ঠীর প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্ম ইসলাম। ধারণা করা হয়, সিল্ক রুটের কল্যাণে যখন আরবদের সঙ্গে চীনাদের ব্যবসায়িক স¤পর্ক গড়ে ওঠে, সে সময় হুই গোষ্ঠীর লোকজন ইসলামের সাম্য আর শান্তির বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। মঙ্গোলীয় সেনাপতি কুবলাই খান যখন চীন জয় করতে আসেন, তখন তাঁর অনেক সৈনিক এ দালি অঞ্চলের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধ জয় করে কুবলাই খান চলে যান বেইজিং, তাঁর অনেক মুসলিম সৈনিক থেকে যায়। তাঁদেরই বংশধরেরা এখন দালির বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করছে। লিনসিয়াত হল মুসলিম পুরাকীর্তির শহর। হুইরা চীন সরকারের প্রিয় গোষ্ঠী।


ইতিহাস-৩৪০  ▌ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম: 

 ইন্দোনেশিয়ায় ১৭ থেকে ১৮ হাজার দ্বীপ রয়েছে । এটি হল বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যাবিশিষ্ট দেশ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি।  ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জটি জায়ফল, লবঙ্গ এবং আদাজাতীয় এক ধরনের মশলা গলঙ্গলের প্রাচুর্যের কারণে মুসলিম নাবিকদের কাছে বিখ্যাত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে বহু আরব ব্যবসায়ীরা সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং ১২৯৭ সালে সুলতান মালিক আল-সালেহের কবরের উপরে নির্মীত স্মৃতিসৌধটি হল ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া প্রাচীনতম ইসলামী শিলালিপিগুলির মধ্যে একটি। এর থেকে জানা যায় যে, সুমাত্রার একটি রাজ্য ‘সমুদ্রের’ প্রথম শাসক মুসলমান ছিলেন। মুসলিম সুফি ও ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে স্থানীয় লোকেরা ইসলামের সং¯পর্শে আসেন এবং ধর্মান্তরিত হন। বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো ১২৯২ সালে সুমাত্রায় এসেছিলেন। তখন তিনি পার্লাক নামের একটি ইসলামিক শহর পরিদর্শন করেছিলেন।  


ইতিহাস-৩৪১ ▌ মালয়েশিয়ার ইসলাম: 

মুসলিমদের সংখ্যা হল মালয়েশিয়ার ৬১.৩%। মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রসার ঘটেছিল শান্তিপূর্ণভাবে। বিশ্বের এই অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ করেছিল বাণিজ্যের পথ অনুসরণ করে। যুগে যুগে জাহাজগুলি এই উপদ্বীপের উপকূলকে ডক হিসেবে ব্যবহার করে ব্যবসা চালিয়েছে। মালাক্কা উপদ্বীপের সাথে বাণিজ্যিক স¤পর্কের জেরে চীন, ভারত এবং মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল এবং এভাবে কোনও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়াই ইসলাম এই অঞ্চলটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, যখন এই এলাকায় ¯প্যানিশ এবং পর্তুগিজদের আগমন ঘটে, তত দিনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  স্থানীয় বাসিন্দারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, বা ব্যবসায়ীরা এই স্থানে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিল। টিন, কর্পূর এবং প্রাকৃতিক স¤পদে সমৃদ্ধ ছিল মালয়েশিয়া। 


মাযহাব / মতবাদ /ি ফর্কা:

ইতিহাস-৩৪২  ▌মাজহাব: 

সুন্নিদের মধ্যে প্রধান ৫ টা মাজহাব। হানাফি, মালেকি, শাফেয়ী, হাম্বলী এবং জহিরি। শিয়াদের মধ্যেও এইরকম ভাগবিভাগ আছে। এদের কেউ ১২ ইমামপন্থী। ১২ ইমামপন্থীদের মূলত ২ টি প্রধান ভাগ। জাফরি ও বাতিনিয়্যাহ। জাফরিদের আবার প্রধান ৩ টি ভাগ। এক) উসুলপন্থী জাফরি- এরা ইরান ও ইরাক অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া। দুই) আখবারপন্থী জাফরি- এরা বাহরাইনে সংখ্যায় বেশি। তিন) শায়েখপন্থী জাফরি- ১৯ শতকের শুরুতে এদের একটা বৃহৎ অংশ বাহাউল্লাহকে নবী দাবী করে বাহা’ই ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে। বাতিনিয়্যাহদেরও ৩ টি প্রধান ভাগ। এক) আলভী, এরা সিরিয়া ও লেবাননে সংখ্যাগরিষ্ঠ। দুই) আলেভী, এরা তুরস্ক, আলবেনিয়ার শিয়াদের মধ্যে সংখ্যায় বেশি। তিন) বেকতেশি- এরা সংখ্যায় খুব সামান্য, সিরিয়া এবং লেবাননে সামান্য পরিমাণে আছে। ১২ ইমামপন্থী ছাড়া আছে ইসমাইলি শিয়া। ইসমাইলি শিয়াদের প্রধান ২ টি ভাগ। নিজারি ও মুসতালি। মুসতালিদের বেশ কিছু শাখা থেকে এখন বোহরা নামে কেবল একটি শাখা টিকে আছে। বোহরাদের প্রধান তিনটি ভাগ দাউদি বোহরা, সুলাইমানি বোহরা এবং আলাভি বোহরা। ইসমাইলি ছাড়া শিয়াদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা যাইদি। সুখারেজিদের ৪ টি প্রধান শাখা। আজারিকা, নাজদাত, সুফরি এবং ইবাদি। উপমহাদেশের হানাফি সুন্নিদের মধ্যে দুইটি প্রধান ভাগ- দেওবন্দী ও বেরেলভি। সূফীবাদ ইসলামের  আধ্যাত্ববাদী ধারা। সারা পৃথিবীতে বহুল প্রচলিত সূফীধারাগুলো হলো- চিশতিয়া, বেকতাশি, কুব্রাবিয়া, নকশাবন্দী, মুরিদিয়া, মৌলভিয়া, নিয়ামাতুল্লাহি, নুরবকশিয়া, উয়াইসি, সুহরাওয়ার্দিয়া, তিজানিয়াহ, সেনুসি, কাদিরিয়া প্রভৃত। এরমধ্যে উপমহাদেশে চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশাবন্দী ধারা বেশ জনপ্রিয়। 


ইতিহাস-৩৪৩  ▌ বিখ্যাত চার ইমাম ও মাযহাব: 

সম্মানিত চার ইমাম নিজ নিজ সময়ে স্ব স্ব এলাকায় বড় আলিম হিসেবে খ্যাত ছিলেন। ফলে লোকজন তাঁদেরকে জরুরী মাসআলা-মাসাইল জিজ্ঞাসা করতো, তাঁরা ফয়সালা দিতেন। ইমামগণের ইন্তেকালের পর তাঁদের ভক্তরা তাঁদের মতামত ও নীতি প্রচার প্রসার করেন। এমনকি গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করতে থাকেন। এভাবে বিভিন্ন দলে এবং এলাকা কেন্দ্রীক ইমাম ও মুহাদ্দিসদের অনুসরণ শুরু হয়। যেমন: কুফা শহর কে কেন্দ্র করে ইমাম আবু হানিফার অনুসরণ চলতে থাকে। মদিনা শহরকে কে কেন্দ্র করে ইমাম মালিক এর অনুসরণ চলতে থাকে। বাগদাদকে কেন্দ্র করে ইমাম আহম্মদ ইবনে হাম্বল এর অনুসরণ চলতে থাকে। মিশর কে কেন্দ্র করে ইমাম শাফেঈ এর অনুসরণ চলতে থাকে। এভাবে ইমাম সুফিয়ান ছাওরীর, ইমাম লাইছ ইবন সা’দ, ইমাম মুবারক, ইমাম আওযাই সহ প্রায় ১১/১২ জন মুজতাহিদ আলেমের নামে ১১/১২ টি মাযহাবের সৃষ্টি হয়।


ইতিহাস-৩৪৪  ▌মাযহাব এর মধ্যে সংঘর্ষ: 

আবু হানীফার ইন্তেকালের ২৫০ বছর পর হানাফী মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম মালেকের ইন্তেকালের ২২১ বছর পর মালেকী মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম শাফেরীর ইন্তেকালের ১৯৬ বছর পরে শাফেয়ী মাযহাব এবং ইমাম আহমাদের ইন্তেকালের  ১৫৯ বছর পর হাম্বলী মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে।  ১৭ হিজরীতে বাগদাদে হাম্বলী ও অপর তিন মাযহাবের অনুসারীগণের মধ্যে সংগ্রাম শুরু হয়, এতে শত সহস্র লোক হতাহত হয়। ৩২৩ হিজরীতে হাম্বলী ও শাফেয়ীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুহয়ে ৭ বৎসর পর্যন্ত চলে। ৫৫৪ হিজরীতে নেশাপুর শহরে হানাফী ও শাফেয়ীগণের মধ্যে,৫৬০ হিজরীতে হানাফী শাফেয়ীদের মধ্যে, ৫৮৭ হিজরীতে মিসরে হাম্বলী ও শাফেয়ীগণের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মুসলমানদের মধ্যে মাযহাব নিয়ে আত্মকলহ মারাত্মক আকার ধারণ করলে মিশরে চারটি মাযহাব সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে এবং চার মাযহাবের জন্য চারজন সরকারী কাজীও নিযুক্ত করা হয়।


 ইতিহাস-৩৪৫ ▌ কাবা ঘরে মাযহাব এর বিরোধ: 

৮০৯ হিজরীতে কাবার ইব্রাহিমী মুসাল্লাতে ইমামতি নিয়ে ১০/১১টি মাযহাবী দলের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ বাঁধে। তাহাতে বহু মুসলমান হতাহত হয়। জাহল বাদশা ফারহা ইবনে বয়কুফ সংঘর্ষ মিটাবার উদ্দেশ্যে বিবাদরত দলগুলির মধ্যে হতে চারটি দলকে কাবার চার পার্শ্বে খাড়া করে দিলেন। অন্যান্য দল এই চার মাযহাবের মধ্যে মিশিয়া গেল। ফলে কাবাঘরের চার কোণে চার মাযহাবের চারখানা ভিন্ন ভিন্ন মুসাল্লাহ তৈরি হল। প্রতি ওয়াক্তে চার মাজহাবের চার ইমাম চার মুসাল্লায় দাঁড়িয়ে পর্যায়ক্রমে নামাজ আদায় করতে থাকেন। এই নিয়ম প্রায় ৫০০ বৎসর পর্যন্ত চালু থাকে। সৌদী আরবের বাদশাহ আব্দুল আযীয আল সউদের রাজত্বকালে ১৩৪৩ হিজরীতে বাদশা সাউদ ইবনে আবদুল আযীয তাঁর সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে উমরার উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ প্রবেশ করেন। তখন তিনি হারাম শরীফে সকল মুসল্লিকে একই ইমামের পেছনে জামাআতে নামায আদায়ের নির্দেশ জারী করেন।


ইতিহাস-৩৪৬  ▌হানাফি মাযহাব: 

এটি সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি মাযহাব। এই মাযহাব অবলম্বী মানুষেরা ইমাম আবু হানিফার অনুসারী। ইমাম আবু হানিফা ছিলেন ফিকহশাস্ত্রের একজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ এবং হিজরী প্রথম শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব। ফিকহ ও ইসলামী আইন সংকলন ও স¤পাদনার জন্য তিনি ৪০ জন ফকিহ নিয়ে এক আইনজ্ঞ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। ওই যুগে যেসব মাসয়ালা-মাসায়িল সংকলন হয়েছিল, তার সংখ্যা ১২ লাখ ৭০ হাজারের ঊর্ধ্বে। ইমাম আবু হানিফার দুই ছাত্র আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ ইবনে হাসান শাইবানীর অধীনে এই মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ইমাম আবু হানিফার বাস ছিল কুফা শহরে। হানাফি মতবাদের অনুসারী রয়েছেন: সুদান, মিশর, জর্দান, সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, উজবেকিস্তান , আলবেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, কাজাখস্তন, তাজিকিস্তান, কিরগিজিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানে। 


ইতিহাস-৩৪৭  ▌হাম্বলী মাযহাব: 

এটা ইরানি আলেম ইমাম আহমদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বলের নামানুসারে এই মাযহাব পরিচিত। ইমাম আহমাদ ছিলেন হাদীসের এক বিশাল পন্ডিত ব্যক্তি। মুসনাদ আহ্মাদ নামে এক বিশাল গ্রন্থের তিনি ছিলেন প্রণেতা। ফিকাহের ব্যাপারে তিনি তাঁর শিক্ষক ইমাম আল-শাফি’ঈ কর্তৃক গভীরভাবে প্রভাবিত হন। চারটি মাযহাবের মধ্যে, হাম্বলি মাযহাবের অনুসারী সংখ্যাই সবচেয়ে কম।  আজকের দিনের সৌদী আরবে হাম্বলী মাযহাবই হচ্ছে প্রধান। এ ছাড়াও কাতার, মিশর, সিরিয়াতেও এ মাযহাবের অনেক অনুসারী রয়েছে। অধুনা পশ্চিমাদেশ, কাশ্মির, এমনকি বাংলাদেশেও এ মাযহাবের অনুসারী পাওয়া যায়। ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল থেকে ইমাম বুখারী, মুসলিম সহ পরবর্তী জমানার প্রায় সকল মুহাদ্দিসগন হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাই সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম সহ প্রায় সকল হাদীসের কিতাবে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলের বর্ণীত হাদীস রয়েছে। হাম্বলি মাযহাবকে ক্ষেত্রবিশেষ আহলে সুন্নাহ বা আসারি বলেও পরিচয় দেওয়া হয়। 


ইতিহাস-৩৪৮  ▌ মালিকী মাযহাব: 

এই মাযহাবের বিকাশ ঘটে নবীর (সা.) শহর মদীনায়, যেখানে তাঁর অনেক সাহাবী বসবাস করতেন।  এই মাযহাব মালিক বিন আনাসের  নামানুসারে পরিচিত, যিনি হাদীসের একজন স্কলার ও ফিকাহশাস্ত্রবিদ ছিলেন। তদানীন্তন কালে মিশরে ইমাম মালেক (রহঃ)-এর শাগরেদ তুলনামূলক অধিক ছিল। তাই তাদের মাধ্যমে সেখানে উক্ত মাযহাব যথেষ্ট প্রসার লাভ করে। চতুর্থ শতাব্দীতে ইরাক, আহওয়ায, আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে মালেকী মাযহাবের বেশ প্রভাব ছিল । এই মাযহাব দ্রুত উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে যেখানে আজও এর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়, উপরন্তু মুসলিম ¯েপনেও এটাই ছিল প্রধান মাযহাব। মুলত উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকায় এই মাযহাবের মানুষদের দেখা যায়। এই মাযহাবের মধ্যে বিভিন্ন উপজাতীয় মানুষ (যেমন নোমাড) দেখা যায়। লিবিয়া, নাইজার, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, পশ্চিম সাহারা, চাদ ইত্যাদি দেশের অধিকাংশ মানুষ এই মতালম্বী।


ইতিহাস-৩৪৯  ▌শফিঈ মাযহাব: 

এই মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুহাম্মাদ ইবন ইদ্রিস আল শাফি’ঈ- যাঁর নাম অনুসারে এই মাযহাবের নামকরণ হয়েছে। মক্কার একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করা আল শাফি’ঈ মদীনায় গমন করেন। তিনি ইরাকেও যান এবং আবু হানিফার ছাত্র মুহাম্মাদ আল হাসানের সাথেও কথাবার্তা বলেন। তিনি ছিলেন ইমাম মালিক ইবনে আনাসের অন্যতম সেরা শিক্ষার্থী এবং তিনি নাজারাহ-এর গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। উসূল আল ফিক্হ বা ইসলামী আইনতত্ত্বের উপরে প্রথম পুস্তকের সংকলন ইমাম শাফি’ঈই করেছিলেন। এটা একটা বিশাল কাজ ছিল এবং এতে ইসলামে সুন্নাহর কর্তৃত্ব ও মর্যাদা ¯পষ্ট করে নির্দেশিত হয়েছে। এটি সুন্নি ইসলামের অন্যতম মাজহাব। শাফিঈ মাজহাব সৌদি আরবের হেজাজ অঞ্চল, ইয়েমেন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডান, মিশর, জিবুতি, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, উত্তর ককেসাস, কুর্দিস্তান ও মালদ্বীপে প্রধান মাজহাব।


ইতিহাস-৩৫০  ▌জাহিরি মাযহাব: 

ইসলামি আইনের অন্যতম মাযহাব। আইনবিদ দাউদ ইবনে আলি এ মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। তারা কোরআন হাদীসের জাহেরী বা বাহ্যিক দিকের অনুসরণ করতেন। তাই এ মাযহাবের প্রবক্তা এবং অনুসারীদের জাহেরী বলা হয়। ইবনে হাজম আজ জাহেরী এ মাযহাবকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। মধ্যযুগ থেকে এই মতের অনুসারীদের সংখ্যা কমতে থাকে। মরক্কো ও পাকিস্তানে এ মাযহাবের কিছু অনুসারি আছে। অতীতে দক্ষিণ ইরান, ইবেরিয়ান উপদ্বীপ, বেলেরিক দ্বীপ ও উত্তর আফ্রিকায় এর অনেক অনুসারী ছিল। আধুনিককালের আহলে হাদিস আন্দোলনের অনেকেই জাহিরি চিন্তাধারার অনুসরণ করেন। জাহেরি মাযহাব মতে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখার সময় মেয়ের আপাদমস্তক সবই দেখা জায়েয, ইমাম ইবনে হাজমের এই মতের ভিত্তি ছিল রাসূল সাঃ এর একটি হাদীস, "যখন কোন মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে, তখন তাকে দেখে নাও।" ইবনে হাজম রহঃ এই হাদীস থেকে যে মত দিয়েছেন, তা পৃথিবীর কোন আলেম সঠিক বলেন নি, কিন্তু কেউ তার সমালোচনায়ও লিপ্ত হননি। 


ইতিহাস-৩৫১  ▌ইবাদি মাযহাব:  

ইবাদি ইসলামের একটি মাযহাব যা ওমানে সবচেয়ে প্রভাবশালী। এছাড়া আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে এর অস্থিত্ব রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে এই আন্দোলন ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে বা মহানবী হজরত মুহম্মদের (স.) মৃত্যুর ২০ বছর পর শুরু হয় যা সুন্নি ও শিয়া মতবাদের চেয়েও প্রাচীন। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এর উৎপত্তি সন্ধান করতে গিয়ে একে খারিজি আন্দোলনের একটি মধ্যপন্থী ধারা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সমসাময়িক ইবাদিরা তাদের খারিজি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করার তীব্র বিরোধিতা করেন, যদিও তারা স্বীকার করেন যে তাদের আন্দোলন ৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দের খারিজি বিদ্রোহ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।  ইবাদি ইসলামের একটি ক্ষুদ্র মাযহাব। এই মাযহাব সুন্নি বা শিয়া পন্থার অন্তর্ভুক্ত নয়। এর আবির্ভাব ইবাদি আন্দোলন থেকে। এই আন্দোলন মহানবীর প্রয়াণের ২০ বছর পর শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। আব্দুল্লাহ ইবন ইবাদ আল-তামিমিকে এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। 


ইতিহাস-৩৫২  ▌জাফরি মাযহাব: 

মাযহাব হল শিয়া ইসলামের একটি মাযহাব বা ফিকহশাস্ত্রীয় ঘরানা যা ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল-সাদিকের নামানুসারে পরিচিতি লাভ করে।  এটি ইরানের রাষ্ট্রীয় মাযহাব। জাফরি মাযহাব ইজতিহাদের ওপর নির্ভরতা, উত্তরাধিকার, ধর্মীয় শুল্ক, বাণিজ্য, ব্যক্তিগত মর্যাদা, অস্থায়ী বিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে প্রভাবশালী সুন্নি মাযহাবগুলোর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে। ১৯৫৯ সাল থেকে জাফরি ফিকহ চারটি সুন্নি মাযহাবের পাশাপাশি পঞ্চম মাযহাব হিসেবে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা স্বীকৃত। এছাড়া, এটি জর্ডানের রাজার আম্মান বার্তার তালিকাভুক্ত আটটি স্বীকৃত মাযহাবের একটি। "জাফরি মাজহাব" হচ্ছে শিয়া ইসনা আসয়ারী (১২ ইমামী) মাজহাব। ইমাম জাফর সাদিক (আ.)এর সময় অধিকাংশ ফেকহ ব্যক্ত হওয়ার কারণে শিয়া মাজহাবকে জাফরি মাজহাবও বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও শিয়া ফিকাহকে জাফরি ফিকাহও বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, বর্তমানে কুয়েতে ৩৫ শতাংশ জনগণ শিয়া মাযহাবের অনুসারী।


ইতিহাস-৩৫৩  ▌আসারি: 

আসারিয়া বা আল-আথারিয়া হল একটি ইসলামী পা-িত্যনির্ভর আন্দোলন, যা ৮ম শতাব্দীর শেষের দিকে উদ্ভূত হয়। যারা পরবর্তীতে আহমদ ইবনে হাম্বলের (খ্রীঃ ৭৮০-৮১৫) অনুসরণে "আহলুল হাদিস" নামে একটি আন্দোলনের মাধ্যমে সংগঠিত হন। ঐতিহ্যবাদী এই ধর্মতত্ত্বের অনুসারীগণ  কুরআন ও হাদিসের লেখনীকে তারা কোন রকম প্রশ্ন করা ব্যতিরেকে গ্রহণ করে থাকে। তারা কুরআনকে আক্ষরিক অর্থে পড়ে থাকে, এবং তারা কুরআনকে ব্যাখ্যা করার বিরোধিতা করে। তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের বাস্তবতা শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা উচিত, যাকে তাফউইদ বলা হয়। আসারিয়া অনুসারীরা একে সনাতন সুন্নি ধর্মবিশ্বাস বলে দাবি করে আসছে। আধুনিক যুগে, ইসলামী ধর্মতত্ত্বের উপর আসারী মতবাদের একটি ধারণাতীত প্রভাব রয়েছে, যা ওয়াহাবি ও অন্যান্য সমসাময়িক ঐতিহ্যবাদী (আসারী) সালাফি অনুসারীদের দ্বারা অনুসৃত হচ্ছে এবং তা হাম্বলি মতাদর্শের সীমা অতিক্রম করে আরও বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।


ইতিহাস-৩৫৪  ▌সুফিবাদ: 

অষ্টম শতাব্দীতে  মধ্যপ্রচ্যে সুফিবাদের জন্ম। কবি হাফিজ ও ওমর খৈয়াম সুফিবাদের বড় মাপের কবি। মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ‘খানকা’ স্থাপন করেন ‘আবুল হাসেম উসমান বিন সারেক’ নামক এক ব্যক্তি যিনি কুফাতে (ইরাক) বসবাস করতেন এবং ১৬০ হিজরি সনে মৃত্যুবরণ করেন। এই ব্যক্তি আগে অগ্নি উপাসক ছিলেন, পরে অনেকের মতো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু উনার এই ‘খানকা’ তখনকার সময়ে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি, কিন্তু ধীরে ধীরে পরে এই ধরণা জনপ্রিয়তা লাভ করে। তারা নিজেদেরকে মুমিনের বদলে সুফী বলে পরিচয় দিত। এটা সত্য যে সুফীরা এই উপমহাদেশে ইসলামের প্রচলন করেছে। তবে তারা এই সুফীইজমকে ইসলামের ছদ্দবেশে এই উপমহাদেশে এনেছে এবং উপমহাদেশের মানুষ এটাকে গ্রহণ করেছে এই জন্য যে, এই সুফীজমের বেশিরভাগ মতবাদই তাদের মতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সুফীবাদ থেকে এসেছে, মাজার পূজা, কুলখানী, চল্লিশা ইত্যাদি।


ইতিহাস-৩৫৫  ▌ মাতুরিদি মাযহাব: 

মাতুরিদি হল সুন্নি ইসলামের অন্তর্গত অন্যতম প্রধান ধর্মতাত্ত্বিক মাজহাব। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন আবু মনসুর আল-মাতুরিদি যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের মধ্যে ইতোমধ্যে বিদ্যমান আকীদাগুলোকে একটি সুসংবদ্ধ কালামশাস্ত্রীয় চিন্তাধারায় উপনীত করেন এবং যৌক্তিকতা ও যুক্তিবাদের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মাতুরিদি মতবাদকে আশআরি মতবাদের পাশাপাশি সর্বজনগৃহীত বা অর্থডক্স সুন্নি আকীদা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মাতুরিদিবাদ পারস্যের সুন্নি মুসলমান, হানাফি ও আহল আর-রায়ের মাঝে বরাবরই প্রভাবশালী ছিল এবং অটোমান সাম্রাজ্য ও মোগল সাম্রাজ্যে অগ্রগণ্য মাজহাবের মর্যাদা লাভ করেছিল। এর বাইরে অধিকাংশ তুর্ক, মধ্য এশীয় ও দক্ষিণ এশীয় সুন্নি মুসলমানরা মাতুরিদি আকীদায় বিশ্বাসী। আরব মুসলিমদের মধ্যেও মাতুরিদিবাদী প-িত বিদ্যমান। পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, তুর্কিস্তান,  উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, বুখারা, সমরকন্দ, তাশখন্দ, তিরমিজ ইত্যাদি অঞ্চলের অধিকাংশ মুসলমান মাতুরিদি মতাবলম্বী।


ইতিহাস-৩৫৬  ▌ আহলে হাদিস: 

আহলে হাদিস কথাটির অর্থ হাদিসের অনুসারী। যারা যেকোনো বিষয়ের সিদ্ধান্তের জন্য ফিকহ শাস্ত্র আর প্রচলিত মতবাদের বদলে সরাসরি সহীহ হাদিসের উপর নির্ভর করে থাকে, তাদের আহলে হাদিস বলা হয়। তারা প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ইমাম, ইমাম আবু হানিফা (রহঃ), ইমাম মালিক (রহঃ), ইমাম শাফী (রহঃ), ইমাম হাম্বল (রহঃ) সহ সকল মুজতাহিদগণের ফতোয়াকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে, তবে কোনো একটি নির্দিষ্ট মাযহাব বা ইমামের মতকে একক ভাবে অনুসরণ করেন না, আনুমানিক ইসলাম আগমনের তৃতীয়তম শতাব্দীর দিকে সমসাময়িক আইনশাস্ত্রের আলেমদের মতামতের থেকে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মতাদর্শ বা হাদিসের উপর অধিক জোর দেয়ার মাধ্যমে এই মতবাদের সূচনা হয়। এই মতবাদের অনুসারীগণ নিজেদের রাশিদুন খলিফার মতবাদের অনুসারী বলে মনে করেন।


ইতিহাস-৩৫৭  ▌দেওবন্দ: 

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ইংরেজ বণিকরা এ অঞ্চলে এক জোরজবরদস্তি মূলক আধিপত্যবাদী শাসন কায়েম করে। একদিকে এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অন্যদিকে স্বয়ং মুসলিম সমাজের ইসলামী জীবনাচরণে ইলম-আমল, ঈমান-আকিদা ও ইসলামী তাহযীব তামদ্দুন সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের সুমহান বাস্তব কর্মসূচী হাতে নেওয়া হয়। ভারতের উত্তর প্রদেশের শাহারানপুর জেলার ‘দেওবন্দ’ স্থানে ১৮৬৬ সালে হাজী ইমদাদুল্লাহ মোহাজিরে মক্কীর ইংগিতে, কাশেম নানুতভীর বলিষ্ঠ নেতৃতে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ‘দারুল উলুম দেওবন্দ; নামের একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। দেওবন্দ দারুল উলূম প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই আরও প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠান কায়েম হয়। এমনিভাবে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসরনে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অসংখ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়। ধারনা করা হয় শুধু বাংলাদেশেই প্রায় পনের হাজার মাদ্রাসা আছে। 


ইতিহাস-৩৫৮  ▌তাবলিগ জামাত: 

১৯২৬ সালে মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভি কর্তৃক ভারতের মেওয়াতে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনটি তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার মাধ্যমে ইসলামের আধ্যাত্মিক পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। তাবলিগ জামাত-এর মুল ভিত্তি হিসেবে ৬টি উসুল বা মূলনীতিকে ধারণ করা হয়। এগুলো হলো: কালিমা, নামায, ইলম ও যিকির, একরামুল মুসলিমিন (মুসলমানদের সহায়তা করা), সহিহ নিয়ত বা এখলাসে নিয়ত (বিশুদ্ধ মনোবাঞ্ছা), এবং দাওয়াত-ও-তাবলিগ (ধর্মপ্রচারের আহ্বান)। তাবলিগ জামাত রাজনীতি ও ফিকহে (আইনশাস্ত্র) সকলপ্রকার স¤পৃক্ততাকে অস্বীকার করে ১৯৪৬ সালে হেজাজে (পশ্চিম সৌদি আরব) এবং ব্রিটেনে সংগঠনটির প্রথম বিদেশী প্রচারণা সফর পাঠানো হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে এবং ১৯৭০ ও ১৯৮০র মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপ মহাদেশেও তাবলীগ জামাত প্রতিষ্ঠিত করে।


ইতিহাস-৩৫৯  ▌ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দলন: 

উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন দিল্লির খ্যাতনামা মুসলিম নেতা সন্তওয়ালিউল্লাহ এবং তাঁর পুত্র আজিজ। ওয়াহাবি আন্দোলন মূলত ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও অচিরেই তা রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণত হয়। এই আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বিধর্মী ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা । ওয়াহাবিগণ দ্রুত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তেশক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন । ১৮২৭ সালে পাঞ্জাবে শিখ শাসনের অবসান ঘটাবার জন্য তাঁরা ধর্মযুদ্ধ শুরু করেন । ১৮৩০ সালে ওয়াহাবিগণ পশ্চিম পাঞ্জাবের রাজধানী পেশোয়ার জয় করেন। কিন্তু তাদের এই সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। ১৮৩১ সালে বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহম্মদ প্রাণ হারান এবং ওয়াহাবিরা পরাস্ত হন। পাঞ্জাবে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর আবার ওয়াহাবিগণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। ক্রমশ বাংলা, বিহার, মীরাট ও অন্ধ্রের হায়দরাবাদে ওয়াহাবি আন্দোলন বিস্তারলাভ করে ।


ইতিহাস-৩৬০  ▌বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন: 

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মীর নিশার আলি বা তিতুমির। তিনি কিছুদিন মক্কায় অবস্থান করেন। মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিনি ওয়াহাবি আদর্শ অনুসারে ইসলাম ধর্মের সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। তিতুমির প্রথমে নিজ গ্রামে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। এতে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ওয়াহাবিদের দাড়ি রাখার ওপর আড়াই টাকার কর ধার্য করেন। তা ছাড়াও ওয়াহাবি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করলে পাকা ইটের তৈরি বাড়ির ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা ও কাঁচা মাটির বাড়ির ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা কর আদায় করা হবে। এতে তিতুমির ও তাঁর অনুগামীরা ক্ষিপ্ত হন। কর আদায়কে কেন্দ্র করে দুপক্ষের লোকজনদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। তিতুমির নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করে ২৪ পরগনা জেলার নারকেলবেরিয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। শেষ পর্যন্ত কো¤পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তিতুমিরকে দমনের জন্য গভর্নর  উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক দশম পদাতিক বাহিনী পাঠান । উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এই সংঘর্ষে তিতুমীর তাঁর বহু অনুগামীসহ যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন।


ইতিহাস-৩৬১  ▌ইখওয়ান-আস সাফা: 

৯৮০-৮২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় ইখওয়ান-আস সাফা বা ভ্রাতৃসংঘ। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তারা ঝুকে পড়ে। গোটা সংগঠন বিন্যস্ত ছিলো চারটি ক্রমিক পদে। প্রথম স্তরে শিক্ষানবীশ। ১৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত বছরের যুবক। তাদেরকে শিক্ষকের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও বাধ্যতার শিক্ষা দেয়া হতো। এদের বলা হতো আল আবরার ওয়াল রুহামা বা গুণী ও দয়ালু। দ্বিতীয় স্তরে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের এই ব্যক্তিদের পার্থিব শিক্ষা ও  রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে প্রায়োগিক জ্ঞান দেয়া হত। আখ্যা দেয়া হতো আল আখিয়ার ওয়াল ফুদাল বা উত্তম ও মঙ্গলজনক হিসেবে। তৃতীয় ধাপে অন্তর্ভুক্ত ছিলো ৪০-৫০ বছরের ব্যক্তিরা। বস্তু জগতে চর্চা করতেন তারা। তাদের বলা হতো আল ফুদালা ওয়াল কিরাম বা মঙ্গলময় ও সম্মানিত। সর্বশেষ স্তরে ৫০ উর্ধ্ব হওয়া শর্ত ছিল। এটা  প্রজ্ঞা ও তত্ত্বজ্ঞানের স্তর। একে বলা হতো আল মারতাবাতুল মালাকিয়া বা ফেরেশতার স্তর।


 ইতিহাস-৩৬২  ▌সালাফিবাদ:

 ‘সালাফিরা’ ইসলামের নবী ও তার সাহাবীদের অনুসৃত ইসলাম অনুসরণ করতে চান!  বিশুদ্ব ইসলাম চর্চার দাবীদার ওহাবীদের মতে, রসুলের মদীনায় হিজরতের ৩০০ বছর পর পর্যন্ত মুসলমানরা খাঁটি ইসলাম ধর্ম পালন করেছে। এই সময়টা হচ্ছে সালাফ। তারা মনে করে এই সালাফের পর মুসলমানরা খাঁটি ইসলাম ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছে। মুসলমানদেরকে সালাফের সময়ের মতো ইসলাম চর্চায় ফিরিয়ে আনাই সালাফিবাদের লক্ষ্য। সালাফি মুসলমানেরা মনে করেন, বিধর্মীদের এমন কোনো কিছু টিকিয়ে রাখা যাবে না’ যা মুসলমানের মনে শিরক-এর জন্ম দেয়! এমনকি কিছু কিছু সুন্নাতের অনুসরণকে শিরকের সাথে তুলনা করেন তারা। সালাফিবাদের মূল ভাবনাগুলো গৃহীত হয়েছে 'ইবনে তাইমিয়া'র চিন্তাধারা থেকে। তাইমিয়ার বক্তব্য সাংঘর্ষিক হবার ফলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। যার পরিণতিতে ৭০৫ হিজরিতে সিরিয়ার আদালত তাঁর বিরুদ্ধে মিশরে নির্বাসনের রায় দেয়। 


ইতিহাস-৩৬৩  ▌মুতাজিলা মতবাদ:  

সালাফির বিপরীত মুতাজিলা। মুসলমানদের পাপ ও শাস্তি নিয়ে ইমাম হাসান আল বসরির সাথে তার ছাত্র ওয়াসিল ইবনে আতারের মতবিরোধ হয়। ওয়াসিল ও তার অনুসারীরা আল হাসানের শিক্ষায়তন পরিত্যাগ করে বলেই তাঁরা মোতাজিলি নামে অভিহিত হন। ৮ম থেকে ১০ শতাব্দীতে বসরা ও বাগদাদে মুতাজিলা মতবাদের প্রাধান্য ছিল। মুতাজিলারা আরব দার্শনিক বলে পরিচিত আল কিন্দির ইতিহাস ‘শূন্য থেকে সৃষ্টি’ তত্ত্বটি সত্য বলে বিশ্বাস করেন। আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন মোতাজিলা মতবাদকে সরকারী নীতি হিসাবে জনসাধারণকে গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। অনেকে এই মতবাদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। এর ফলে অসংখ্য মানুষ  কারারুদ্ধ হন। অনেকে প্রাণ হারান। এই ঘটনা মুসলিম ইনকুইজিশন মিনহা বলে পরিচিত। জনসাধারণের বিরোধিতার মুখে খলিফা আল মুতাওয়াকিলের রাজত্বকালে মিনহা বন্ধ করে দেয়া হয়।  


ইতিহাস-৩৬৪  ▌ওহাবী সম্প্রদায়:  

মুহাম্মাদ ইবন  আবদুল ওহাব (১৭০৩-১৭৮৭) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি মুসলিম সম্প্রদায়। তাঁদের বিরুদ্ধবাদীরা  তাঁর জীবদ্দশায় তাঁদেরকে এ নামে অভিহিত করেন। তাঁরা নিজেদেরকে মুওয়াহিদী (একত্ববাদী) অথবা সালাফী (আদিপন্থি) রূপে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। এটি হচ্ছে ইসলামের একটি শাখাগোষ্ঠী, যা অর্থোডক্স, ধর্মের দিক থেকে অতিচরমপন্থী, বিশুদ্ধবাদী  উপাসনার জন্য ইসলামী পূনর্জাগরণ আন্দোলন।  ইবনে তাইমিয়া এবং আহমাদ ইবনে হানবাল এর শিক্ষায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে এই মতবাদে বিশ্বাসীরা ইসলামের মূলধারা থেকে বিচ্যুতদেরকে কোরআন ও হাদিসের বর্ণিত পথে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।ওহাবীরা কোনো প্রকার রহস্যময়তা ও ওলীদের বিশেষ ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন না। তাঁরা মাজার বা সমাধিসৌধ বৈধ মনে করেন না।  সৌদি আরবের ২২.৯%, কাতারের ৪৬.৮৭%, আমিরাতের ৪৪.৮%, বাহরাইনের ৫.৭%, কুয়েতের ২.১৭% জনগণ ওয়াহাবী পন্থী।


ইতিহাস-৩৬৫  ▌খারিজি সম্প্রদায়: 

খারিজি শব্দ দ্বারা ইসলামের প্রথম যুগে উদ্ভব হওয়া একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে বুঝায়। ৭ম শতাব্দীতে এই গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। ইরাকের দক্ষিণ অংশে তারা কেন্দ্রীভূত হয়। সুন্নি ও শিয়াদের থেকে খারিজিরা ভিন্ন মত পোষণ করত। পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে খারিজিরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়। খলিফা আলি ইবনে আবি তালিবের শাসন শুরু হওয়ার পর তারা প্রথমে তা মেনে নেয়, তবে পরে তার শাসন প্রত্যাখ্যান করে। তাদের মতে, কেউ যদি কোন পাপ করে থাকে তাহলে পাপের প্রভাবে সে অবিশ্বাসী হয়ে যায়। এ ধরনের ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করা যাবে, তাকে হত্যাও করা যাবে এমনকি ব্যক্তিটি যদি রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীও হন। অন্যদিকে, কেউ যদি তাদের এই বিশ্বাসের সাথে একমত না হয় তাহলে তো সে ব্যক্তি এমনিতেই একজন কাফির (অবিশ্বাসী) হিসেবে গণ্য হবে, এবং তার সাথেও যুদ্ধ করা যাবে, তাকে হত্যাও করা যাবে।


ইতিহাস-৩৬৬  ▌ইসমাইলিয়া সম্প্রদায় : 

শিয়াদের মধ্য থেকে একটি দলছুট সম্প্রদায় নজারী শিয়া। তাদের দাবি ও তালিকা মোতাবেক তাদের প্রথম ইমাম হলো আলী (রা.)। তাঁর পুত্র হুসাইন(রা.) দ্বিতীয় ইমাম, যথাক্রমে তাঁর পুত্র জয়নুল আবেদিন তৃতীয়, তাঁর পুত্র মোহাম্মদ আল বাকের চতুর্থ, তাঁর পুত্র ঈমাম জাফর সাদেক(রহ.) পঞ্চম। ঈমাম জাফর সাদেকের দুই সন্তান, যথাক্রমে মুসা কাজেম ও  ইসমাইল। এই ইসমাইল-এর ১৪তম অধঃস্থন পুরুষ নিজার এবং নিজারের ২৭তম অধঃস্থন পুরুষ  প্রথম আগা খান। খলিফা আলী(রা.)-এর সূত্র ধরে তাদের হিসেবে বর্তমানের প্রিন্স করিম আগা খান  ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের ৪৯তম ইমাম। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে বহু দেশে বিভক্ত হয়ে যাবার ফলে, আগা খান তাজিকিস্তানে ঢুকে পড়েন এবং ব্যাপক শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেন। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীর সঙ্গে সঙ্গে পরকালীন মুক্তির জন্য ইসমাইলিয়া ধর্মকে উপস্থাপন করে তাজিকিস্তান থেকেই ১ কোটি অনুসারীকে দলে ভিড়াতে সক্ষম হয়!


ইতিহাস-৩৬৭  ▌ মুরজিয়া মতবাদ: 

এটি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা পরিপন্থী একটি মতবাদ। মুরজিয়া আন্দোলন শুরু হয় খারিজী ও শিয়াদের প্রাদুর্ভাবের সাথে। খারেজীরা ঘোষণা করেছিল সকল সাহাবী কাফের, এমতাবস্থায় কিছু শিয়া উসমান, মোয়াবিয়া, আয়শা এবং আরো অনেককে কাফির ঘোষণা করে আলীকে মানুষের লেভেলের অনেক উপরের মর্যাদা দিয়ে দিল। আর এই দুই অবস্থার মাঝখানে তৃতীয় আরেকটি দলের উদ্ভব হল যারা দাবি করল এ দুদলের কোন একটির ব্যাপারে রায় দেওয়ার মাধ্যমে তারা অন্যটিকে মান্য করবে না। সর্বপ্রথম যে ইরজা করে তার নাম হল বাসর বিন আবদুল্লাহ আল হামদানি। এরপর ইরজা’র এই বিদআত ইরাকের কুফায় ব্যাপক আকারে দেখা দিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে ইসলাম ধর্মে চারটি ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তক সম্প্রদায়, গড়ে ওঠে, যা মুসলিম দর্শনে মুর্জিয়া, কাদারিয়া, জাবারিয়া এবং সিফাতিয়া হিসেবে পরিচিত। উদারনীতিই হচ্ছে মুর্জিয়াবাদের নির্যাস।


ইতিহাস-৩৬৮  ▌ মুরজিয়ার ৩ সিলসিলা: 

১.চরমপন্থী মুরজিয়া: জাহম বিন সফওয়ান এবং তার অনুসারীরা মনে করেন, একজন মানুষ শুধুমাত্র অন্তর দ্বারাই কামেল ঈমানদার হয়ে যায়; যদিও সে এর পাশাপাশি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে সমালোচনা করে, মসজিদ ধ্বংস করে, কুরআনের মাসহাফ করে। এর অনুসারীরা বলেন: এ কাজই গুনাহ, তবে তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মুমিন। কারণ ঈমান থাকে অন্তরে। 

২.হকপন্থী মুরজিয়া: যে সকল মুরজিয়াগন মনে করে  কবিরা গুনাহকারি ফাসিক তাওবা না করে মৃত্যু বরন করলে পাপের শাস্তি ভোগ করবে অথবা ক্ষমা করবেন এবং পরে জান্নাতে যাবে। অনন্তকাল জহান্নামে থাকবে না। তাদের এই বিশ্বাস সরাসরি অধিকাংশ সালাফদের মানহাজের সাথে সামজস্যপূর্ণ বলেই তারা হকপন্থী।

৩.বিদাতি মুরজিয়া: বিদাতি মুরজিয়া বলতে ঐ সকল মুরজিয়া বুঝান হয়েছে যারা মুরজিয়া নামে পরিচিত এবং যাদের ঈমান আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সাথে সাংঘর্সিক।


ইতিহাস-৩৬৯  ▌জাবরিয়া ফির্কা: 

'জাবর' বা নিয়তিবাদ বা পূর্বনির্ধারণবাদ চিন্তাধারার প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন জাহম ইবনে সাফওয়ান (মৃত্যু ৭৪৫ খ্রি)। তাঁর মতে, বিধাতা সর্বশক্তিমান। সুতরাং মানুষের কোনো শক্তি থাকতে পারে না। মানুষ যদি তাঁর কর্মের কর্তা হয়, তবে যত মানুষ ততসংখ্যক কর্মকর্তা আছেন। এর অর্থ হচ্ছে, বিধাতার ক্ষমতা সীমিত বা খর্ব করা। সুতরাং তিনি ঘোষণা করেন, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা বা সংকল্পের স্বাধীনতা বা কর্মের স্বাধীনতা নেই। সাধারণ জাবারিয়াদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়। খাঁটি জাবারিয়া এবং উদারপন্থী জাবারিয়া। খাঁটি জাবারিয়ারা মনে করেন, মানুষ কোনো কাজ করে না বা মানুষের কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই। উদারপন্থী জাবারিয়ারা মনে করেন, মানুষের শক্তি আছে যার কোনো রকম প্রভাব নেই। 'জাবর' মতবাদটি 'কাদর' মতবাদের স¤পূর্ণ বিপরীতধর্মী। মানুষের যদি ইচ্ছার বা কর্মের স্বাধীনতা না থাকে, তবে তাকে তার কর্মের জন্য দায়ী করা ঐশী ন্যায়পরায়ণতার পরিপন্থী। ইসলাম ধর্মে 'কাদর' বনাম 'জাবর' একটা হতবুদ্ধিকর এবং মীমাংসার অযোগ্য একটা বিষয়।


ইতিহাস-৩৭০  ▌ জায়েদিবাদ:

 ইমাম জায়েদ ইবনে আলীর প্রবর্তিত ধর্মই জায়েদিবাদ। জায়েদিরা পাঁচজন ইমামে বিশ্বাস করে কিন্তু পঞ্চম ইমাম হিসাবে তারা মোহাম্মদ আল বাকিরের পরিবর্তে জায়েদ ইবনে আলীকে স্বীকার করে। ধর্মীয় দর্শনের দিক দিয়ে তারা মোতাজ্জিলা সম্প্রদায়ের অনুসারী। জায়েদিরা অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী। ইয়েমেনের শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ জন জায়েদি। সৌদি আরবে ১০ লক্ষ জায়েদি আছে। জায়েদিদের একটা বড় অংশ ইরাকের ওয়াসিটে বসবাস করে। জায়েদিরা তিনটি উপদলে বিভক্ত। প্রথম দলটি জুরুদিয়া নামে পরিচিত। এরা মনে করে, রসুল (স:) হযরত আলীকে উত্তরাধিকারী মনোনিত করেছিলেন। তাঁর নির্দেশ না মানবার জন্য হযরত আবু বকর(র:), হযরত ওসমান(র:) ও হযরত ওমরকে(র:) তারা পাপী মনে করে। দ্বিতীয় দলটিকে সুলায়মানী বলা হয়। হযরত আবু বকর(র:), হযরত ওসমান(র:) ও হযরত ওমরকে(র:) তারা পাপী মনে করে না, কিন্তু দোষী মনে করে। তাদের মতে মুসলমানদের নেতা নির্বাচিত হওয়া উচিত আলোচনার মাধ্যমে। তৃতীয় দলটিকে তারাবিয়া বলা হয়। হযরত আবু বকর(র:), হযরত ওসমান(র:) ও হযরত ওমরকে(র:) তারা পাপী ও দোষী মনে করে না। এরা সর্বাপেক্ষা উদারপন্থী। 


ইতিহাস-৩৭১  ▌ কাদারিয়া: 

মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার (ভৎববফড়স ড়ভ রিষষ) পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণকারী হিসেবে ইসলামে কাদারিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। তাঁরা এই মত পোষণ করেন যে, মানুষের কাজ করার 'কাদর' বা শক্তি আছে। এই সম্প্রদায়ের যাত্রা শুরু মা'বদ আল-জুহানি (মৃত্যু ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ)-কে দিয়ে। এই মতবাদের প্রবক্তারা মানুষের ইচ্ছা বা কর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কাদারিয়া ইসলামের প্রথমদিকে দার্শনিক ধর্মতত্ত্বের একটি। এই আন্দোলন নিয়ে পাওয়া প্রাচীনতম দলিল হচ্ছে হাসান আল-বসরির রিসালা, যা ৬৭৫ থেকে ৬৯৯ এর মধ্যে লেখা হয়। অবশ্য ইসলামে মুক্ত ইচ্ছা নিয়ে বিতর্ক এই লেখার পূর্বে পাওয়া যায়। সুন্নি সূত্র মতে, জরাথুস্ট্রবাদের সাথে তুলনা দিয়ে মুহাম্মদ সা. নিজেই এর নিন্দা জানিয়েছেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে মানুষ যা কিছুু করে, তা আল্লাহ আগে থেকেই ঠিক করে রাখে। কিন্তু কাদারবাদীরা ঠিক এর উল্টো ভাবেন। তারা বলেন, মানুষের নিয়তি মানুষই স্থির করেন। কাদারিরা বিশ্বাস করেন, মানুষের ভাল কাজগুলি আল্লার ইচ্ছাতেই ঘটে, মন্দ কাজগুলির জন্য দায়ী মানুষ। কাদারিপন্থীদের প্রবক্তা হিসাবে মাবাদ আল জুহানিকেই গণ্য করা হয়। তিনিই প্রথম নিয়তি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, যদি আল্লাহ আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে, কার নিয়তি কেমন হবে; তাহলে তাদের ভুলের জন্য মানুষ দায়ী হবে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ যদি মানুষের ভবিষ্যত আগে থেকেই না জানেন, তবে অনেকেই তাঁকে সর্বশক্তিমান বলে মনে করবে না। এই নিয়তি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য আর একজন ব্যাক্তিও বিখ্যাত। তিনি ঘেলান আদ্্ দিমাস্কি।  তিনি মনে করেন যে, ‘আল্লাহ সবকিছু আগে থেকেই জানেন’ এই মতবাদটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করলে মানুষের কর্মতৎপরতা কমে যেতে পারে। কারণ সবাই মনে করবে যে, সে কি করবে তা আল্লাহ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। কাজেই তার চেষ্ঠা করে লাভ নেই। 


ইতিহাস-৩৭২  ▌আলাওয়িবাদ: 

আলাওয়ি শব্দের অর্থ হচ্ছে আলীর অনুসারি। আলাওয়িরা মূলত সিরিয়াতে বসবাস করেন। তাদের সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ। সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম আলাওয়ি। আলাওয়িরা আগে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের অংশ ছিল। ৯ম শতাব্দীতে শিয়াদের ইমাম আল হাসান আল আসকারী এবং তার শিষ্য ইবনে নুসায়রী এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। আলাওয়িদেরকে নুসায়রিসও বলা হয়। আলাওয়িরা আল্লাহর নবরূপে বিশ্বাস করেন। তাদের মতে, হযরত আলী হচ্ছে আল্লাহর নবরূপ।  মুসলমানদের প্রথাগত উপাসনাগুলি তারা পালন করে না। কোরান শরীফকে তারা বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। তারা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। কিন্তু তাদের মতে, যেহেতু ‘নারীদের আত্মা নেই’ তাই তাদের পুনর্জন্ম হবে না। আলাওয়িরা বিশ্বাস করে যে, প্রত্যেককে ৭বার পুনর্জন্ম লাভ করে বিশুদ্ধ হতে হবে মহাকাশে আলীর দেশে বাস করতে। যারা বিধর্মী তারা পশু হিসাবে পুনর্জন্ম লাভ করে। সিরিয়ার শাসক হাফিজ আল আসাদ আলাওয়ি সম্প্রদায়ের। তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে কিতাব আল মাযম। 


ইতিহাস-৩৭৩ ▌দ্রুজ মতাদর্শ: 

দ্রুজদের আবাসভূমি সিরিয়া, লেবানন, ইসরাইল, এবং জর্ডানে। দ্রুজ ধর্মের ভিত্তিমূল ইসলাম। দ্রুজ মতাদর্শ মূলত শিয়া ইসলামের একটি শাখা। দ্রুজগণ নিজেদেরকে ‘আহলে তাওহীদ’ (একতাবদ্ধ মানুষ) অথবা ‘আল মুয়াহিদুন’ বলে পরিচয় দেয়। লেবাননের ইতিহাস গঠনে দ্রুজদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় দ্রুজ অনুসারীগণ বাস করে। পৃথিবীতে দ্রুজ অনুসারীগণের সংখ্যা দশ লাখেরও বেশি।   দ্রুজ মতাদর্শের উৎপত্তি ১০ শতাব্দিতে। ইসমাইলিয় খলিফা আল হাকিমের রাজত্বকালে ধর্মনেতা মোহাম্মদ আদ দারাজি খলিাফা আল হাকিমকে স্বর্গীয় দূত হিসাবে ঘোষণা করেন। এই ধর্মনেতা আদ দারাজির নামানুসারেই এই ধর্মের নাম দ্রুজ। ১০১৮ সালে আদ-দারাজী আততায়ীর হাতে নিহত হন। 


ইতিহাস-৩৭৪  ▌ ব্রেলভী বা রেজভী ফির্কা: 

এটি প্রতিষ্ঠা করেন শাহ আহমদ রেজা খাঁন নামের এক ভারতীয়। তার রেজা নাম থেকে রেজভী হয়েছে। আবার তিনি ‘ব্রেলভী’ শহরে জন্ম গ্রহণ করেছেন বলে ফির্কাটি ‘ব্রলভী’ নামেও পরিচিত। শাহ আহমদ রেজা খাঁন ১৮৫৬ সাল ভারতের উত্তর প্রদেশের ব্রেলভী শহরে একটি মুসলিম হানাফি আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ও দাদা হানাফিদের মধ্যে খ্যাতনামা আলেম ছিলেন।  আরবী, উর্দূ, এবং ফারসী ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার পর মির্জা কাদীয়ানির ছোট ভাই মির্জা কাদের বেগ থেকে দীর্ঘ সাত বৎসর দীনি ইলিম শিক্ষা নেন। ১৮৮০ সালের দিকে তিনি তার মতবাদ প্রচার করা শুরু করেন।  ১৯১২ সালে তার প্রথম অনূদিত কুরআনের উর্দূ তরজমা ‘কুনূযূল ঈমান ফি তরজমাতিল কুরআন’ প্রকাশিত হয়।  এটি ইংরেজী, হিন্দি, বাংলা, ডাচ, তুর্কী, সিন্ধি, গুজরাটী এবং পশতু ভাষায়ও অনুবাদ হয়। তবে এই অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে আরব বিশ্ব তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ২৭ টা আরব দেশে তা ব্যান্ড করে দেওয়া হয়। তার প্রধান ও সর্ববৃহৎ রচনা হল ‘ফৎওয়া রিযভিয়াহ’ লাহোরে ৩০ খন্ডে প্রকাশিত হয়। 


ইতিহাস-৩৭৫  ▌  আহমদীয়া মতবাদ:

 মির্জা গোলাম আহমেদের নামানুসারেই আহমেদিয়া সম্প্রদায়। তিনি ভারতীয় পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান শহরে ১৮৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এই কাদিয়ান শহরের নামানুসারে সম্প্রদায়টির আরেক নাম কাদিয়ানি। পৃথিবীর ১১২টি দেশে কাদিয়ানিরা বাস করে। আহমেদিয়াদের মতে, রসুল(স:) বলেছিলেন যে, যখন মুসলমানদের ইমাম দূর্বল হয়ে আসবে, তখন ইসলামকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ ইমাম মেহেদি প্রেরণ করবেন। আহমেদিয়রা মনে করেন যে, ইমাম মেহেদি আর্বিভুত হয়েছেন, যার নাম মির্জা গোলাম মোহাম্মদ।  ইসলামে জিহাদকে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি মনে করতেন যে, বর্তমান যুগে মুসলমানরা যুদ্ধ করবে কলমের সাহায্যে, তরবারি নয়। আহমদিয়া মনে করে যে, ১৫০০ বছরের আগের তৈরি করা মুসলিম আইন যুগের কারণে সংস্কার কিংবা পরিবর্তন হওয়া উচিত। তাদের মতে, মির্যা গোলাম আহ্মেদ হচ্ছেন যিশুর পাশাপাশি মুহাম্মদ(সা.)-এর প্রদর্শিত পথে পাঠানো একজন নবী।


ইতিহাস-৩৭৬ ▌ বাহাই মিতবাদ: 

শিয়া মতবাদের প্রাথমিক যুগে ইমামের প্রধান শিষ্যকে বাব বলা হতো। বাবী মতবাদের শুরু হয়  সাইয়েদ আলী মুহাম্মদ শিরাজী’র হাত ধরে, যিনি ইরানের শিরাজ নগরে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ  করেন। এক সময় তিনি নিজেকে মাহদী হিসেবে দাবি করেন। শিয়া মতবাদের সঙ্গে বিরোধের কারণে ইরানের শাহ তাকে গ্রেফতার করে। ১৮৫০ সালে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদ- হয়। বাব-এর হত্যাকা-ের সময় তাঁর একজন একনিষ্ঠ অনুসারী মন্ত্রীপুত্র ছিল হুসাইন আলী নূরী। তিনি দেখতে পান বাব কোরআনের  আদলে ‘বেয়ান’ নামের যে ধর্মগ্রন্থ রচনা করেছিলেন, সেখানে একজন ইমাম মাহদী আগমনের কথা বলে গেছেন। তিনি সুযোগটিকে কাজে লাগান। তিনি নিজেকে মাহদী দাবি করে বাহাউল্লাহ নাম ধারণ  করেন। তার বাহাউল্লাহ নাম থেকে নামকরণ করা হয় বাহাই। বাহাউল্লাহ লিখলেন ‘কিতাব ই আকদাস’, যা বাহাইদের ‘ধর্মগ্রন্থ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।  ১৮৯২ সালে উসমানীয়দের হাতে মৃত্যুবরণ করেন  বাহাউল্লাহ।  ২০০টি দেশে প্রায় ৬০ লক্ষ বাহায়ি আছে। 


ইতিহাস-৩৭৭  ▌ সাবমিশন ইসলাম মিতবাদ: 

আল-কোরআনই একমাত্র গ্রহণীয় ধর্মগ্রন্থ। তবে এটি বিকৃতি থেকে রক্ষা পায়নি বলে মত সাবমিশনবাদীদের। তাই পবিত্র কোরআনের এই  বিকৃত অংশ বাদ দেওয়ার জন্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে ‘রাশেদ খলিফা’ নিজেকে ইসলামের একজন রাসূল দাবি করে বসলেন এবং নবী ইব্রাহিমের রীতি  অনুসরণ করে ‘সাবমিশন ইসলাম’ নামে নতুন একটি ধর্মের প্রচার করেন। এই মিসরীয় প-িত একদা কায়রোর এইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করে ১৯৬৪ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন জৈব-রসায়ন বিদ্যায়।  ১৯৭৫-৭৬  সালে তিনি লিবিয়া সরকারের বিজ্ঞান উপদেষ্টাও ছিলেন।  তিনি ইংরেজিতে কোরআন অনুবাদসহ বিভিন্ন  ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে রাশেদ খলিফার নিজেকে রাসূল দাবির কারণে কট্টরপন্থী মুসলিমরা ১৯৯০ সালের ৩১ জানুয়ারি আমেরিকার এরিজোনা রাজ্যের টুকসন মসজিদের ভেতর ৫৪ বছর বয়সী রাশেদ খলিফাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।


:: কিছু ইসলামি পন্ডিত ::


ইতিহাস-৩৭৮  ▌ইমাম গাজ্জালী

দর্শনশাস্ত্রের এক কিংবদন্তি: ইরানের অধীনস্থ খোরাসানের তুস নগরীতে ১০৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁত ব্যবসায়ী পিতা মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদের ঔরসে জন্ম হয় ইমাম গাজ্জালীর। বিশ বছর বয়সে গাজ্জালী খোরাসানী আলেমদের পীঠস্থান নিশাপুরের নিযামিয়া একাডেমিতে ইমামুল হারমাইন নামের বিখ্যাত প-িতের শিষ্য বনে যান। তাঁর কাছে পাঠ নিতে থাকেন দর্শন,  ধর্মতত্ত্ব, আইন বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের। সেলজুক সুলতান মালিক শাহের উজির নিজামুল মুলক ইমাম গাজ্জালীকে বাগদাদে নিজামুল মুলকের প্রতিষ্ঠিত নিজামিয়া মাদ্রাসাতে অধ্যাপকের পদ নিয়োগ দেন। তিনি দীর্ঘ ১১ বছর মক্কা মদিনায় ঘুরে ঘুরে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেন পিতৃভূমিতে ফিরে এসে তিনি ইসলামি আইন ও সূফিতত্ত্বে উপর প্রায় ৪০০ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার রচিত বড় দুইটি গ্রন্থ হচ্ছে ইয়াহিউল উলুম এবং কিমিয়ায়ে সায়াদাত। ১১১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর তার নিজ শহর তুসে মৃত্যুবরণ করেন।


ইতিহাস-৩৭৯  ▌ইমাম আবু হানিফা (রহ.): 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  ৭০০ খ্রিস্টাব্দে কুফায় জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি তীক্ষè ধী-শক্তির অধিকারী ছিলেন। প্রাথমিক জীবনে তিনি বাবার ব্যবসার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে একজন বিশিষ্ট আলেমের পরামর্শে জ্ঞানার্জনে উৎসাহ লাভ করেন। একসময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একান্ত খাদেম ও প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আনাস (রা.) কুফায় আগমন করলে তিনি অল্প বয়সে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ইলমে কালামে পূর্ণ পা-িত্য অর্জন করেন।  তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আলেম,এবং ফিকহশাস্ত্রের উদ্ভাবক। তাঁর ৪০ জন সুদক্ষ ছাত্রের সমন্বয়ে একটি ফিকহ স¤পাদনা বোর্ড গঠন করেন। এ বোর্ডের মাধ্যমে দীর্ঘ ২২ বছর কঠোর পরিশ্রম করে ফিকহশাস্ত্রকে একটি পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্র হিসেবে রূপদান করেন। এভাবে ৯৩ হাজার মাসয়ালা কুতুবে হানাফিয়াতে লিপিবদ্ধ করা হয়। তিনি ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মনসুর কর্তৃক প্রয়োগকৃত বিষক্রিয়ার ফলে কারাগারে ইন্তেকাল করেন।


ইতিহাস-৩৮০  ▌ইমাম মালেক (রহ.): 

ইমাম মালেক (রহ.) ৯৩ হিজরিতে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এখানেই জ্ঞানার্জন করেন। আবদুর রহমান ইবনে হরমুজ (রহ.)-এর কাছে তিনি হাদিসশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। হিজাজের ফকিহ রাবিয়াতুর রায় (রহ.)-এর কাছে তিনি ফিকহশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ৭০ বছর বয়সে তিনি অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। মসজিদ-ই-নববী ছিল তাঁর পাঠদানের জায়গা। বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য জ্ঞানপিপাসু তাঁর দরবারে এসে  জড়ো হতো। ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রহ.) একজন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফিকহবিদ ও মুজতাহিদ ছিলেন। হাদিসের পাঠদানে ইমাম মালেক খুবই আগ্রহবোধ করতেন এবং এটাকে তিনি ইসলাম প্রচারের অংশ হিসেবে মনে করতেন।  পাঠদানের প্রারম্ভে গোসল করা, পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিধান করা ও খুশবু ব্যবহার ইত্যাদি ছিল তাঁর নৈমিত্তিক অভ্যাস। তিনি সুদীর্ঘ ৫০ বছরকাল শিক্ষা ও ফতোয়া দানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। 

.

ইতিহাস-৩৮১ ▌ইমাম শাফেয়ি (রহ.): 

 তিনি ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিনের আসকালান প্রদেশের গাজাহ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। দুই বছর বয়সের সময় তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। ফলে তাঁর মাতাই তাঁকে লালন-পালন করেন। বাল্যকালে তাঁর মাতা তাঁকে নিয়ে পবিত্র মক্কা শরিফে গমন করেন। মক্কা শরিফের বিশিষ্ট জ্ঞানপ-িত মুসলিম ইবনে খালিদ জানজি (রহ.) ও সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না (রহ.)-এর কাছে ফিকহ ও হাদিসশাস্ত্র শিক্ষা করেন। ১৫ বছর বয়সে  তিনি ইমাম মালেক (রহ.)-এর দরবারে উপস্থিত হন। তাঁর কাছে ফিকহশাস্ত্র শিক্ষা করেন।  ইরাকে গিয়ে তিনি ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর নিকট ফিকহ হানাফি শিক্ষা করেন। এভাবে তিনি মালেকি ও হানাফি মাজহাবের নিয়ম-কানুন আয়ত্ত করে মধ্যমপন্থী এক মাজহাব, তথা শাফেয়ি মাজহাব প্রবর্তন করেন। সে মতে গ্রন্থ রচনা করেন এবং এ মাজহাব অনুযায়ী ফতোয়া প্রদান করেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ছিলেন সর্ববিষয়ে যুগশ্রেষ্ঠ প-িত। তিনি ৫৪ বছর বয়সে ৯২০ খ্রি.  মিসরের ইন্তেকাল করেন। 


ইতিহাস-৩৮২  ▌ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.): 

তাঁর নাম আহমদ, পিতার নাম মুহাম্মদ, দাদার নাম হাম্বল। তিনি ৭৮০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিন বছর বয়সের সময় তাঁর পিতা মারা যান। তাঁর মাতাই তাঁর শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।  সাত বছর বয়স থেকে তিনি হাদিস অধ্যয়ন শুরু করেন।  স্থানীয় বড় বড় আলেমের কাছে নানা বিষয়ে জ্ঞানলাভের পর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি ইয়েমেন, কুফা, বসরা, মক্কা, মদিনা, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে ভ্রমণ করেন। তিনি একাধারে ফিকহ ও হাদিসশাস্ত্রের ইমাম ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দাতা ও অতিশয় বুদ্ধিমান। দ্বিনের হিফাজতের জন্য তিনি খলিফা মামুনের উত্তরসূরি কর্তৃক অনেক যাতনা সহ্য করেছেন।  তাঁর হাদিস সংকলনের প্রচেষ্টা ছিল শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।  তিনি প্রথমে বিভিন্ন সূত্রে সাড়ে সাত লক্ষাধিক হাদিসের এক বিশাল ভা-ার সংগ্রহ করেন। অতঃপর দীর্ঘ সময় ব্যয় করে যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে একটি হাদিস গ্রন্থ রচনা করেন, যা মুসনাদে আহমদ নামে সুপরিচিত। 


ইতিহাস-৩৮৩  ▌হুসাইন আহমদ মাদানি: 

সাইন আহমদ মাদানি (৬ অক্টোবর ১৮৭৯ - ৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামি প-িত ও ওলি, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা।  মুহাদ্দিস হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন।  তিনি একাধারে একজন রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি আওলাদে রাসূল তথা মুহাম্মদ(স.) ৩৬ তম বংশধর ছিলেন। তিনি মাহমুদ হাসান দেওবন্দির শিষ্য এবং দেওবন্দ আন্দোলনের একজন আকাবির হিসেবে সমাদৃত। তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের ৫ম প্রধান অধ্যাপক এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ৩য় সভাপতি ছিলেন। তিনি অখ- ভারতের পক্ষে ছিলেন। ইসলাম শাস্ত্রে তার অগাধ পা-িত্য ও অবদানের জন্য তাকে শায়খুল ইসলাম উপাধি দ্বারা সম্বোধন করা হয়। ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করে। মদিনায় ১৮ বছর অবস্থানকালের মধ্যে মাদানি তিনবার ভারতে এসেছিলেন। মদিনায় তার শিক্ষকতাকাল ১৩ বছর ৯ মাস।


ইতিহাস-৩৮৪  ▌সৈয়দ বাহা-উদ-দীন নকশবন্দি: .

(১৩১৮-১৩৮৯ (উজবেক একজন ইসলামি সুফি ব্যক্তিত্ব, লেখক ও অতীন্দ্রবাদী। তিনি নকশবন্দি তরিকার, ইসলামি বিশ্বের সর্ববৃহৎ তরিকার একটি, প্রতিষ্ঠাতা। শৈশব থেকেই বাহা-উদ-দিন অসংখ্য সুফি সাধকদের সাহচর্যে ও সংশ্রবে ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি বাবা মোহাম্মদ সাম্মাসির নিকট বায়াত গ্রহণ করেন এবং তিনিই ছিলেন তার আধ্যাত্মিক জীবনের প্রথম দীক্ষাগুরু। তবে বাবা তার আধ্যাত্মিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মূলত তার থেকেই বাহা-উদ-দিন আধ্যাÍিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। বাহা-উদ-দিন ১৩৮৯ সালে ৭৩ বছর বয়সে কাসরে আরেফানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। ১৫৪৪ সালে খান আবদুল আজিজ তার কবরের উপরে একটি সমাধি এবং আশেপাশের ইমারত নির্মাণ করেছিলেন। বুখারা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে একটি মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স রয়েছে এবং বর্তমানে এটি তীর্থযাত্রার স্থানে পরিণত হয়েছে।


ইতিহাস-৩৮৫  ▌কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী: 

খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী  (জন্ম ১১৭৩-মৃত্যু ১২৩৫) ছিলেন একজন মুসলিম সুফি সাধক। তিনি চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। তিনি খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর শিষ্য এবং খলিফা ছিলেন। তার নামেই দিল্লির বিখ্যাত কুতুব মিনার উৎসর্গ করা হয়। দিল্লিতে স্থায়ীভাবে চিশতিয়াতরিকাকে প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। তার দরগাহ দিল্লিতে অবস্থিত, যেখানে তার ওরশ পালিত হয়। ভারতের অনেক বিখ্যাত শাসক তার ওরশ মহাসমারোহে উদযাপন করতেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কুতুবউদ্দিন আইবাক, ইলতুতমিশ যিনি কাকীর জন্য “ঘান্দাক কি বাউলি” নামে এক গভীর নলকূপ স্থাপন করেন, শের শাহ সুরি যিনি একটি বড় গেইট তৈরি করেন, বাহাদুর শাহ-১ যিনি দরগাহের পাশে মতি মসজিদ নির্মাণ করেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত শিষ্য এবং খলিফা হলেন ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার যিনি আবার দিল্লির বিখ্যাত সাধক নিজামউদ্দিন আউলিয়ার পীর (সূফি গুরু)।


ইতিহাস-৩৮৬  ▌শাহ কারামত আলী জৌনপুরী: 

শাহ কারামত আলী জৌনপুরী ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দির একজন সমাজ সংস্কারক, হানাফি মাযহাবের অনুসারী ফকিহ ও সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তরিকায়ে মুহাম্মদিয়ার অন্যতম প্রচারক। তিনি মূলত বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ধর্মপ্রচার করেন। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ৪০-এরও বেশি। কারামত আলী ভারতের উত্তর প্রদেশের জৌনপুরে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিকের বংশধর। তাঁর কর্মজীবনের সিংহভাগ সময় ধর্মীয় প্রচারণামূলক কাজের স্বার্থে বাংলা ও আসাম অঞ্চলে নৌভ্রমণ করতে হতো। এ জন্য তিনি বড় একটি নৌকার মধ্যে একটি ভ্রাম্যমাণ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।  শিক্ষার্থীরা নৌকাতেই থাকতেন। ওয়াজ নসীহত ও ধর্মপ্রচারের সুবাদে কারামত আলী নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, আসাম, রংপুর এবং আরও অনেক প্রত্যন্তঅঞ্চল সফর করেন। সফরকালীন অবস্থায় ১৮৭৩ সালে রংপুরে তার ইন্তেকাল হয়। রংপুরে মুনশিপাড়া জামে মসজিদের পাশে দাফন করা হয়।


ইতিহাস-৩৮৭  ▌আবুল হাসান আল-আশআরি: 

আবুল হাসান আলি ইবনে ইসমাইল ইবনে ইসহাক আল-আশআরি (৮৭৪-৯৩৬ খ্রি:),তাকে শ্রদ্ধার সাথে ইমাম আল-আশআরি নামে ডাকা হয় । তিনি ছিলেন একজন আরবি,সুন্নি মুসলিম, বিজ্ঞ সুপ-িত, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং আশআরি মতবাদ বিষয়ক ধর্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা, যা তার সময়সহ পরবর্তীতে "সুন্নি ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদ" হয়ে উঠে। আল-আশআরি ইরাকের বসরায় জন্ম গ্রহণ করেন ।  ইসলামের নবী মুহাম্মদ (দঃ) এর বিশিষ্ট সাহাবি আবু মুসা আশয়ারী ছিলেন তার পূর্বপুরুষ । তারুণ্যে তিনি মুতাজিলি ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক গুরু আল-জুব্বাই এর তত্ত্বাবধানে থেকে শিক্ষা অর্জন করেন । আশআরী মতবাদকে মাতুরিদি মতবাদের পাশাপাশি সর্বজনগৃহীত বা অর্থডক্স সুন্নি আকীদা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শাফিঈ ও মালিকি মাজহাবের অনুসারীদের মধ্যে এই মতবাদ অধিক প্রচলিত। তার রচনা-কর্মের সংখ্যা ৩০০ বলে জানা যায়। 


ইতিহাস-৩৮৮  ▌আবদুল ওহাব নজদী: 

শায়খ মোহাম্মদ আবদুল ওহাব নজদী ১৭০৩ খৃস্টাব্দ, নজদের (বর্তমান রিয়াদ) ওয়াইনা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর অনুসারীকে ওয়াহাবী বলে। তাঁর সময় আল-আরবের অধিকাংশ এলাকাই তুরস্কের সুলতানের অধীনে ছিল। তুর্কী সরকার তাকে  বিরোধী অবস্থানের অভিযোগে সিরিয়ার দামেস্ক শহর থেকে বহিস্কার করেন। অবশেষে তিনি দেরইয়ার সরদার মোহাম্মদ বিন সৌদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারই সাহায্যে তিনি বেদুঈনদের সমন্বয়ে একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে প্রথম সুযোগে তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এইরূপে অতি অল্প কালের মধ্যে মরু অঞ্চলে বিশেষ করে নজদ প্রদেশে আবদুল ওহাব নজদীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৯১ সালে ওহাবীরা পবিত্র মক্কা নগরী আক্রমণ করে। কিন্তু স¤পূর্ণ সফল হতে পারেনি। ১৮০১ সালে আবার প্রায় লক্ষাধিক ওহাবী মুজাহিদ পবিত্র মক্কা নগরী আক্রমণ করে কয়েক মাস ব্যাপী  যুদ্ধ করে মক্কা নগরী তুর্কী শাসনের বিলুপ্তি করেন। ১৮০৩ সাল নাগাদ ওহাবীরা পবিত্র মদীনা নগরীর উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করে । 


ইতিহাস-৩৮৯  ▌আব্দুল কাদির আল-জিলানী: 

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ‘বড়পীর’ হিসাবে মুসলিম বিশ্বে সমধিক পরিচিত। তিনি ০১ রমজান ৪৭১ হিজরিতে ইরাকের বাগদাদ নগরের অন্তর্গত জিলান শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার মাতা ছিলেন হাসান ইবনে আলীর বংশধর। তিনি জিলান নগরের ¯হানীয় মক্তবেও বিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ৪৮৮ হিজরীতে যখন প্রথম তিনি বাগদাদ গমন করেন তখন তার বয়স হয়েছিল আঠার বৎসর। শিক্ষা-দীক্ষায় পূর্ণতা অর্জনের পর তিনি নিজেকে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত করেন। বিভিন্ন মাহফিলে তিনি ইসলামের সুমহান আদর্শ যুক্তিপূর্ণ ভাষায় বর্ণনা করতেন। তার মহফিলে শুধু মুসলমান নয়, অনেক অমুসলিমও অংশগ্রহণ করতো। তিনি কাব্য, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের প-িত ছিলেন। তার রচিত বহু গ্রন্থ রয়েছে। এসব গ্রন্থের মধ্যে ফতহুল গায়ের গুনিয়াতুত তালেবীন, ফতহুর রবযানী, কালীদায়ে গাওসিয়া উল্লেখযোগ্য। সুফিরাদিদের নিকট তিনি বড় পীর। 


ইতিহাস-৩৯০ ▌  ইবনে আরাবী: 

এক সুফি দার্শনিক। ধর্মকে বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করা, কুরআনের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, হাদীসের দার্শনিক ব্যাখ্যা, আইনশাস্ত্র, অতীন্দ্রিয়বাদ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করে গেছেন তিনি। তবে সুফিবাদ নিয়েই তিনি বেশি কাজ করেছেন। যে কারণে তাকে ‘আল শেইখ আল আকবার’ বা সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইসলামিক ¯েপনের মুরসিয়া শহরে,১১৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা আলি ইবনে আল আরাবী ছিলেন কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি। সিভিল শহরেই তিনি শিক্ষা দীক্ষায় পূর্ণতা লাভ করেন। সিভিল শহর ছিল মধ্যযুগের সুফিবাদ চর্চার কেন্দ্রস্বরূপ। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ ছিলেন আরাবীর বাবার বন্ধু। সে সুবাদের রুশদের সং¯পর্শেও আসেন তিনি। ৪০ বছরের মধ্যেই অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। মক্কায় থাকাকালীনই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ’ রচনা করেন। 


ইতিহাস-৩৯১  ▌আব্বাস ইবনে ফিরনাস: 

১৭০০ সাল থেকে ১৯০৩ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক ব্যক্তি বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছেন আকাশে উড়তে। তাদের মধ্যে  প্রথম সফলভাবে আকাশে ডানা মেলেছিলেন যিনি তিনি হচ্ছেন আব্বাস ইবনে ফিরনাস। তিনি ৯ম শতাব্দীতে উমাইয়া খিলাফতের সময় ¯েপনের আন্দালুসিয়ার একজন পলিম্যাথ বা বহুশাস্ত্র বিশারদ ছিলেন। তার জম্ম ৮১০ সালে তৎকালীন মুসলিম জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র ¯েপনে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, উড্ডয়ন বিশারদ, চিকিৎসক, কবি, সুরকার, পদার্থবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তার উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাথর থেকে প্লাস তৈরি। তিনি একটি সৌরমডেলও তৈরি করেছিলেন, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘূর্ণায়মান ছিল। প্রথম আকাশে ওড়ার কৃতিত্বের জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন। শরীরে কয়েকটি পাখা যোগ করে তিনি শূন্যে ভেসে পড়েন। কিন্তু সফলভাবে অবতরণ করতে ব্যর্থ হয়ে গুরুতর আহত হন।  


ইতিহাস-৩৯২ ▌আল-খাত্তাবি: 

আল-খাত্তাবিকে আধুনিক গেরিলাযুদ্ধের জনক বলা হয়। খাত্তাবির জন্ম ১৮৮২ সালে মরক্কোতে। খাত্তাবি ফেজের বিখ্যাত কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামি আইনশাস্ত্রের উপর পড়াশোনা স¤পন্ন করেন। সে সময় মরক্কো  ঔপনিবেশিক ¯প্যানিয়ার্ডদের নিয়ন্ত্রণে। ১৯১৫ সালে তিনি মেলিলার কাজি হিসেবে নিয়োগ পান।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় খাত্তাবি ¯প্যানিশ শাসনকে ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করলে তাকে আটক করা হয়। দীর্ঘ ১১ মাস আটক করে ১৯২০ সালে খাত্তাবির এলাকার নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ঔপনিবেশিক ফরাসি এবং ¯প্যানিয়ার্ডদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণে নিয়ে একটি সশস্ত্র গেরিলাদল তৈরি করে ফেলেন। খাত্তাবিকে ৩/৪ হাজার গেরিলাকে পরাজিত করার জন্য ৬০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী জড়ো করা হয়। তাতেও ব্যর্থ হন। ফলে ১৯২৬ সালে আড়াই লাখ ঔপনিবেশিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাকে লা রিইউনিয়ন দ্বীপে নির্বাসন দেয়। 


ইতিহাস-৩৯৩  ▌হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী: 

১৩৮ খ্রিস্টাব্দে (আফগানিস্তান) খোরাসানের অন্তর্গত সিস্তান রাজ্যের সানজার নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ বছর বয়সে পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্থ করেন। অতঃপর ১৩ বছর পর্যন্ত পিতার সার্বিক তত্ত্বাবধানে দ্বীনি ইলমে গভীর ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। সমরকন্দের প্রখ্যাত আলেম হযরত শরফুদ্দীন ও বোখারার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত হুসামুদ্দীন (রহঃ) এর নিকট দীর্ঘ পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। তিনি স্বীয় পীর উসমান হারুনীর নির্দেশে ভারতে আগমন করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তারই মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ইরাকের বাগদাদে আব্দুল কাদির জিলানীর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। এ সময় আব্দুল কাদির জিলানী তাকে হিন্দুস্থানের দায়িত্ব দেন। অধিক বয়সে তিনি বিয়ে করেন। তাঁর দুই স্ত্রীর গর্ভে দুই ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম হয়। তাঁর অনুসারীরা যেমন, বখতিয়ার কাকী, ফরিদ, নাজিমদ্দিন আউলিয়াসহ আরো অনেকে ভারতের ইতিহাসে সুফি ধারাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। ইন্তেকাল করেন ৯৭ বছর বয়সে। 


ইতিহাস-৩৯৪  ▌ হযরত শাহ  জালাল:  

হযরত শাহ  জালাল ১২৭১ সালে তার্কির কৌনাতে জন্মগ্রহণ করেন, পরে তিনি ইয়ামেন গমন করেন। তিনি ভারতে আসেন ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে। আজমীরে সাক্ষাৎ পান পীর খাজা মঈন উদ্দীন হাসান চিস্তিকে এবং পরে  দিল্লিতে হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার। তখন সিলেট শাসন করতেন হিন্দু রাজা গোবিন্দ। গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ তার ভাগ্নে সিকান্দার খান গাজীর নেতৃতে একদল সৈন্য বাহিনী পাঠালেন সিলেটে মুসলমানের বিজয় পতাকা ওড়ানোর জন্য। ১ম বার যুদ্ধে সিকান্দার খান গোবিন্দের কাছে হেরে যায়। এই পরাজয়ের পর সুলতান ফিরোজ শাহ হযরত নিজাম উদ্দীনকে আদেশ দিলেন সিলেট যুদ্ধে তাকে সাহায্য করতে। নিজাম উদ্দীন অনুরোধ করলেন শাহ জালালকে। শাহ জালাল তার সঙ্গে ইয়েমেন, তুর্কিস্তানসহ আরবের বিভিন্ন আঞ্চল থেকে আসা আরো ৩৬০ জন ভাগ্যান্বেষী যুবককে সঙ্গে নিয়ে ফিরোজ শাহ-র মুসলমান সৈন্য দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে সিলেট দখল করেন। এই ৩৬০ জনের মধ্য তার ভাগ্নে শাহ্ পরানও ছিলেন।


ইতিহাস-৩৯৫  ▌মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি: 

তিনি ত্রয়োদশ শতকের একজন ফার্সি কবি, ধর্মতাত্ত্বিক এবং সুফি দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। সুফি সাধক ও কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী রুমি খোরাসানের (বর্তমান আফগানিস্তান) বলখ শহরে  ১২০৭সালে জন্মগ্রহন করেন । তিনি ১২৭৩ সালের তুরস্কের কুনিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তার রচিত ফার্সি ভাষার গ্রন্থ ‘মসনবী’ সুফি মুসলমানদের কাছে খুবই সন্মানিত ও আদরণীয়। তিনি ইসলামের মৌল ধারণা তাওহীদকে বাতেনীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আজও বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় আলোচনা সভায় তার রচিত কবিতা আবৃত্তি করা হয়। রুমীর পরিচালিত দরবেশ সুফি তরিকার লক্ষ্য ছিল আত্বাকে উন্মোচন, মিলনের রহস্য আবিস্কার। তার এসব অনুশিলন করতেন গান, কবিতা, নৃত্য, ধ্যান, নিরবতা, কাহিনী, সংলাপের মাধ্যমে। রুমী তার জীবনের শেষ ১২ বছর ধরে তার বিখ্যাত কবিতার বই ‘মসনবী’ রচনা করেন।  তার দ্বারা ঘূর্ণনমান নৃত্যের একটি ধারার ব্যাপক প্রসার লাভ করে।

 

ইতিহাস-৩৯৬  ▌মুহাম্মদ ইকবাল: 

৯ নভেম্বর ১৮৭৭Ñ২১ এপ্রিল ১৯৩৮), আল্লামা ইকবাল নামে ব্যাপক পরিচিত। তিনি ছিলেন বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষের মুসলিম কবি, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ, শিক্ষবিদ ও ব্যারিস্টার। তার ফার্সি ও উর্দু কবিতা আধুনিক যুগের ফার্সি ও উর্দু  সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাকে পাকিস্তানের আধ্যাতিক জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তার একটি বিখ্যাত চিন্তা দর্শন হচ্ছে ভারতের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। এই চিন্তাই বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। ফার্সি সৃজনশীলতার জন্য ইরানেও তিনি ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ; তিনি ইরানে ইকবাল-ই-লাহোরী নামে পরিচিত। পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে "পাকিস্তানের জাতীয় কবি" হিসাবে স্বীকৃতি  দিয়েছে। ইকবালের বাড়ি শিয়ালকোটে অবস্থিত। লাহোরে তাঁর বেশিরভাগ জীবন কাটিয়েছেন এবং মারা গেছেন। 


ইতিহাস-৩৯৭  ▌আমর ইবনুল আস: 

আমর ইবনে আল আস ছিলেন আরব সেনাবাহিনীর একজন সেনাপ্রধান, যিনি ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে মিশরে  মুসলিম বিজয়ের জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি নবী মুহাম্মাদ(স.)-এর সাহাবী। তিনি মিশরীয় রাজধানী "ফুসতাতের" গোড়াপত্তন করেন এবং এর কেন্দ্রে বিখ্যাত আমর  ইবনে আস মসজিদ নির্মাণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮০ বছর, তিনি ৫৯১  সালের জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরবের মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং মিশরে মৃত্যুবরণ  করেন। মুহম্মদ(স.) মদিনায় হিজরতের পর  আমর ইবনুল আস মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের হয়ে সকল যুদ্ধে অংশ নেন এবং উহুদের যুদ্ধে  কুরাইশদের নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি ‘উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা’-কে বিয়ে করেছিলেন; কিন্তু  তিনি তাকে তালাক প্রদান করেন, যখন তিনি জানতে পারেন যে তার স্ত্রী তার অজান্তেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এর কয়েক সপ্তাহ পরেই আবু বকর ও উমর-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি  ইসলাম গ্রহণ করেন ও পরবর্তীকালে  ‘গভর্নর’ এর দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত হন। 


ইতিহাস-৩৯৮  ▌আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: 

(৫৬৮-৬৫৩) ছিলেন নবী মুহাম্মদ(স.) এর সবচেয়ে ছোট চাচা এবং বিশিষ্ট সাহাবা। বয়সে তিনি তার ভাতিজা মুহাম্মদ(স.) থেকে মাত্র চার বছরের বড় ছিলেন। মুহাম্মদ এর ১১ জন চাচাদের মাঝে হামজা এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে মদীনায়  সমাহিত করা হয়। তার বংশধরেরা আব্বাসীয় খিলাফতের সূচনা করে। হযরত রাসূলে কারীম সা. চাচা আব্বাসকে খুব সম্মান করতেন। তাঁর সামান্য কষ্টতেও তিনি দারুণ দুঃখ পেতেন। হযরত রাসূলে করীমের সা. পর পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদীন হযরত আব্বাসের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। হযরত উমার ও হযরত উসমান রা. ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে তাঁর পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাঁর সম্মানার্থে ঘোড়া থেকে নেমে পড়তেন এবং বলতেন: ‘ইনি হচ্ছেন রাসূলুল্লাহর সা. চাচা।’ হযরত আবু বকর রা. একমাত্র আব্বাসকেই নিজে আসন থেকে সরে গিয়ে  স্থান করে দিতেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ৩২ বছর এবং জাহিলী যুগে ৫৬ বছর জীবন লাভ করেন। হযরত আব্বাস রা. অত্যন্ত স¤পদশালী ছিলেন।


ইতিহাস-৩৯৯  ▌ হুসাইন ইবনে মানছুর হাল্লাজ: 

মনসুর হাল্লাজ। ইতিহাসের আলোচিত একজন সুফিসাধক। তাঁর কথা-বার্তা ও ধ্যান-সাধনা নিয়ে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে বিতর্ক আছে। কেউ বলেন দরবেশ, কেউ কাফের। নিজেকে ‘আনাল হক’ বলার কারণে  ওলামায়ে কেরামের ফতোয়া মুতাবেক তাঁকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইরানের পারস্য প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সুতা-প্রস্তুতকারক। শৈশব থেকেই সুফিদের মজলিশে মনসুর হাল্লাজ আসা-যাওয়া করতেন।  মানছুর হাল্লাজ প্রথমে বাগদাদে আসেন। আর মক্কায় বার বার আসা যাওয়া করতেন। সারা বৎসর ব্যাপী সে নাস্তার সময় কিছু রুটি খেতেন ও পানি পান করতেন। সে জাবালে আবি-ক্বুবাইসে প্রচন্ড গরম পাথরের উপর বসে থাকতেন। মানসুর হাল্লাজ গদ্য এবং পদ্য আকারে প্রচুর লেখালেখি করেন। উনার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হলো কিতাব আল-তাওয়াসিন। যে অভিযোগের বিচারে উনার প্রানদন্ড হয়, সেটা ছিলো যে, উনি হজ্ব করার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।  উনার মৃত্যুদন্ড হয় বাগদাদে প্রকাস্য দিবালোকে। তারা তাকে হত্যার পরে টুকরো টুকরো করে  কাটার সময়ও তিনি উচ্চারণ করতে ছিলেন "আনাল হাক্ক (আমিই সত্য)।


ইতিহাস-৪০০  ▌স্যার সৈয়দ আহমেদ খান: 

মুসলিম সমাজের রাজা রাম মোহন রায় নামে খ্যাত স্যার সৈয়দ আহমেদ খান-এর জন্ম হয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই অক্টোবর দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ডাক্তারি পড়া অসমাপ্ত রেখেই তিনি ১৮৪০ সালে ইংরেজ অধীনে ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করেন কিন্তু মেধাগত কারণে পদোন্নতি হতে থাকে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিনি প্রচুর বড় ইংরেজ অফিসার-এর জীবন তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে রক্ষা করেছিলেন। ফলে শুরু হয় ইংরেজদের সঙ্গে  ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তখন ইংলিশরা কিন্তু মুসলিমদেরকে একদম বিশ্বাস করতো না আর হিন্দু চাটুকার ব্রাহ্মণরা বড় বড় ভারতীয় প্রশাসনিক পদে। এই সময়ে তিনি উপলব্ধি করতে থাকেন যে, মুসলিম সমাজকে যদি বিজ্ঞানের আলো এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার আলো এক্ষণি না দেওয়া যায়, তাহলে এই জাতির আসলেই কোনো ভবিষ্যত নেই। ফলে সমাজ সংস্কারক হিসেবে প্রথম একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের মুরাবাদে। সেই মাদ্রাসায় কোরআন শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য গণিত, বিজ্ঞান এবং পাশ্চাত্য যুক্তিশাস্ত্রকে অবশ্যপাঠ্য করতে করলেন। পরের ৩-৪ বছরের মধ্যেই ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে গাজীপুরে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বানিয়ে ফেললেন। তার পরের বছরই ১৮৬৪ সালে আলীগড় সাইন্টিফিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি একদিকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ফান্ডিং পান, অন্যদিকে সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের কাছ থেকে। এসময় ধনী ও মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়তে শুরু করেছিল প্রচুর পরিমাণে। ১৮৭৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি। ১৮৭৮ সালে তিনি তৈরি করেন মোহামেডান এসোসিয়েশন। ১৮৮৫ সালে কংগেস দল গঠন হলে তিনি ১৮৮৬ সালে অল ইন্ডিয়া মহামেডান কনফারেন্সের আয়োজন করেন, যা মুসলিম লীগ গঠনে ভিত্তি তৈরি করে।  ১৮৯৮ সালের ২৭ শে মার্চ  মৃত্যুবরণ করেন।