বাংলা ইংরেজদের আমোদ’ বিনোদন
পলাশী-যুদ্ধের বেশ কিছুদিন পরেও মুর্শিদাবাদের নবাবই বাংলার শাসকের দিক থেকে বড় তরফ ছিলেন। কিন্তু ইংরেজদের মনের অজ্ঞাত আশঙ্কা তখনও পর্যন্ত দূর হয়নি। নবাব যিনিই হোন না কেন, সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর খাতির কিন্তু অব্যাহত থেকে গিয়েছিল। অন্যদিকে নবাবী-আমোদের আমীরী মেজাজের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ তথা বিপুলতর প্রতিপত্তির দরকার ছিল, সেটা ইংরেজদের কাছে তখনও পর্যন্ত ছিল না। পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী দশ বছর ইংরেজদের নবাব হওয়ার যুগ ছিল। তখন নানা কৌশলে অর্থ সংগ্রহ করে ধনবান হওয়াই কেবলমাত্র তাঁদের লক্ষ্য ছিল না। সেই অর্থ অজস্রধারায় ব্যয় করে সাধারণের কাছ থেকে নবাবী খাতির আদায়ের চেষ্টাও তাঁদের মধ্যে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ১৬৩৩ সালে পিটার মণ্ডির লেখা থেকে জানা যায় যে, সুরাটে কুঠি স্থাপনের সময় থেকেই ইংরেজদের খাবারের টেবিলে কাবাব পোলাও, দো-পেয়াজী, ভাত-খিচুড়ি ও আমের চাটনি জায়গা পেয়েছিল; পলাশীর যুদ্ধের পরে সেগুলো তো বটেই, আর বিভিন্ন ধরণের ভারতীয় খাবার অধিকতর মর্যাদার সঙ্গে সাহেবদের পাতে উঠেছিল। তখন ইংরেজদের মধ্যে বেনিয়ান পরে হুঁকা টানবার হুজুগও আগের চেয়েও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। নবাবদের অনুসরণে অপ্রয়োজনেও তাঁরা নিজেদের জন্য অসংখ্য দাস-দাসী নিয়োগ করেছিলেন। ওদিকে তখন নবাব ও জমিদারেরা প্রায়ই সাহেবদের তাঁদের বিভিন্ন আমোদ-প্রমোদে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করতেন, এবং তাঁরাও তাতে সাগ্রহে যোগ দিতেন। তখনকার দুটি দেশীয় আমোদের দিকে সাহেবদের আগ্রহ সর্বাধিক ছিল। সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি ছিল পশুর লড়াই, এবং দ্বিতীয়টি ছিল দেশীয় নাচের আসর। ওই সময়ে যেখানেই তামসিক উল্লাস করা যেত, সেখানেই ইংরেজরা গিয়ে উপস্থিত হতেন। যেসুইট পাদ্রীরা তাঁদের গ্রন্থে মধ্যযুগের ভারতের পশুর লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন। আকবরের আহ্বানে তাঁরা প্রায়ই সেই দৃশ্য দেখতেন। পরবর্তীকালে সেই দৃশ্য বিভিন্ন নবাবের রাজধানীতে দেখতে পাওয়া যেত।
একবার অযোধ্যায় নবাব কর্তৃক আয়োজিত এক পশুর লড়াই দেখবার জন্য জন্য ‘কর্নেল চ্যাম্পিয়ন’ (Alexander Champion) আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “সারা শহর ভেঙ্গে কত লোক জড়ো হয়েছে দুর্গ মধ্যে। বাঘের সঙ্গে আজ মহিষের লড়াই হবে, হাতির সঙ্গে গণ্ডারের, আর দুটি উটের মধ্যে। এক বিস্তীর্ণ বর্গক্ষেত্র বেড়া দিয়ে ঘেরা - এই হল রণক্ষেত্র। তার মধ্যে কাটা-দরজা দিয়ে ছ’টি মহিষ নিয়ে ছ’জন লোক হাজির। একটু পরে ছেড়ে দেওয়া হল একটি বাঘ। সম্মুখে এমন লোভনীয় খাদ্য থাকতেও বাঘ ছ’টি নধর মহিষের কোনটিকেই আক্রমণ করল না। অগত্যা একটি মহিষ তার উপরে চড়াও হল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও খেলা জমল না। আবার একটি বাঘ ছেড়ে দেওয়া হল। এ বেচারী আকারে বড় হলেও খোঁড়া। একটি মহিষ তাকে শিঙের উপর তুলে সজোরে আছাড় মারা সত্ত্বেও বাঘ প্রতিরোধের কোন চেষ্টা করল না। বরং ভদ্র মনোভাব (নোবল স্পিরিট) প্রকাশ করল। তারপর সে নিজে নিহত হল। … এরপর উটের লড়াই। দু’জনে পরস্পরের পা জড়িয়ে ধরে লড়াই। তেমন আকর্ষণীয় কিছু নয়। ইতিমধ্যে, লড়াইয়ের জন্য আনীত একটি হাতি হঠাৎ ক্ষেপে গেল। মত্ত অবস্থায় তার পায়ের চাপে পাঁচজন মারা গেল। হাতিটি ছুটে গিয়ে দৃঢ়সংবদ্ধ রণক্ষেত্রের বেড়া ভেঙ্গে ফেলবার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। তারপর ছুটে গিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি বাগানবাড়ির ছাদ ভেঙ্গে ফেলে। মাহুতবেচারী অনেক চেষ্টা করে তাকে শান্ত করে। একটি গণ্ডার আনা হয়েছিল লড়াইয়ের জন্য। কিন্তু তাকে মোটেই নড়ানো গেল না।” কর্নেল চ্যাম্পিয়ন দুর্ভাগা ছিলেন। কিন্তু ‘মুডি’ সাহেব ঐ অযোধ্যার নবাবের সৌজন্যেই মানুষের সঙ্গে বাঘের লড়াই দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সেই লড়াই দেখবার পরে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে, এই বীরের দেশে পরশাসন টিকবে তো?
মুর্শিদাবাদের নবাববাড়িতেও প্রায় নিয়মিত পশুর লড়াই হত বলে কথিত রয়েছে। কথিত এই কারণে যে, কোন বিদেশীর ডায়েরীতে সেই পশুর লড়াই দেখবার বর্ণনা পাওয়া যায় না। আঠারো- ঊনিশ শতকের বঙ্গদেশ ভাঁড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। ‘মস্করা’ শব্দটি এখন লঘু-পরিহাস অর্থে ব্যবহৃত হলেও, মূল পর্তুগীজ শব্দটি হল - ‘ম্যাসকারেড’, অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধারণ করা।
আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলায় মস্করার অনুষ্ঠান (ছদ্মবেশ ধারণপূর্বক কৌতুক সৃষ্টি) বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অবশ্য নাচ-গানই তখন প্রধান আকর্ষণ ছিল, তবে আনুষঙ্গিকহিসেবে মস্করার ব্যবস্থাও করা হত। আঠারো শতকের শেষের দিকে কলকাতা ও অন্যান্য বড় শহরে ইংরেজদের সোসাইটি গড়ে উঠেছিল। ফলে তখন থেকে সাহেবপাড়ায় দেশী নাচের কদর কমে গিয়েছিল। খাঁটি ইংরেজ রমণীর কোমর জড়িয়ে ধরে নাচবার সুযোগ পেলে কোন সাহেব আর শুধু দর্শকরূপে দেশীয় নাচ দেখতে চাইতেন? তবে ক্যান্টনমেন্টগুলিতে দেশীয় নাচের জনপ্রিয়তা কিন্তু বহুদিন ধরে অক্ষুণ্ণ ছিল। কারণ, ইংরেজ সেনা-ছাউনীতে ইউরোপীয় নারীরা থাকতেন না, কাজেই সেখানে কোন সোসাইটি ছিল না। ১৭৯৪ সালে ‘কার্ডিনার’ ভারতে এসেছিলেন। তাঁর সময়ে ইংরেজরা তেমনভাবে দেশীয় নাচ পছন্দ করতেন না, তবে তখন বিলেত থেকে “কোন নতুন বন্ধু এলে, সেই বন্ধু ও বন্ধু-স্ত্রীকে শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্যের সঙ্গে দেশীয় নাচ দেখানোর রেওয়াজ প্রচলিত ছিল।” দেশীয় লোকেরা যেদিন দেখেছিলেন যে, সাহেবরা আর নাচ দেখেন না, বরং তাঁরা নিজেরাই স্ত্রী-পুরুষ মিলিতভাবে নাচেন, তখন তাঁরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে ‘হান্টার’ তাঁর জার্নালে লিখেছিলেন, “গ্রামবাসীরা আমাদের নাচতে দেখে তো অবাক। তাঁরা বলাবলি করতে লাগল যে, আমরা (সাহেবরা) পয়সা খরচ করলেই তো নর্তকী পেতে পারি। নিজেদের নাচবার দরকার কি?”
ঊনিশ শতকের শুরু থেকেই সাহেবপাড়ায় দেশীয় নাচ আর নিত্যঘটনা ছিল না। তখন নিজেদের অর্থ ব্যয় করে ইংরেজরা বাড়িতে আর নাচের আসর বসাতেন না। তবে দেশীয় জমিদার বা নবাবেরা যখন কোন উৎসব উপলক্ষে তাঁদের আমন্ত্রণ করতেন, তখনই তাঁরা নাচ দেখতেন। দেশীয় নাচ তাঁদের কাছে কোনদিনই খুব একটা আকর্ষণীয় কিছু ছিল না। কিন্তু তবুও ভদ্রতার খাতিরে আমন্ত্রণ রক্ষা করবার জন্য তাঁদের যেতেই হত, এবং এর সাথে বহু অর্থব্যয়ে সংগৃহীত বিলিতী মদের আকর্ষণ তো ছিলই। এই যে ভদ্রতা রক্ষা করবার জন্য নাচ দেখতে যাওয়া, এবং পান-পর্ব শেষ করে নর্তকীদের প্রতি অবজ্ঞার হাসি হেসে চলে আসা - এটা তখনকার দেশীয় নর্তকীদের সম্ভ্রমে আঘাত করেছিল। সেই সময়ের নর্তকীদের কেউ কেউ ‘কমেডিয়ান’ও ছিলেন। তাঁরা হাস্য-কৌতুকে পারদর্শী ছিলেন। তাছাড়া পর্তুগীজদের মধ্যে অনেকেই কৌতুকাভিনয়ে পটু ছিলেন। তাঁরা উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলেই বিভিন্ন আসরে আনন্দ বিতরণ করবার জন্য যোগ দিতেন। সাহেবীপোশাক পরে সাহেবদের আচার-আচরণের প্রতি কটাক্ষ করবার ক্ষেত্রে তাঁদের কোন জুড়ি ছিল না। ‘মারিয়া গ্রাহাম’ কলকাতায় এক মহারাজার বাড়িতে নাচের আসরে একবার আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি প্রথম রাত্রে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেশীয় নাচ তাঁর ভাল লাগেনি, তাই দ্বিতীয় রাত্রে তিনি সেখানে আর যাননি। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “শুনলাম সে রাত্রে কয়েকজন পর্তুগীজ ও দেশী অভিনেতা ইউরোপীয়ান সেজে আমাদের নাচ-গান এমন কি আমাদের আচরণ পর্যন্ত নকল করে লোক হাসিয়েছে।” ‘শ্রীমতী ফ্লোরা এ্যানি স্টীল’ স্বয়ং একটি কৌতুকাভিনয়ের আসরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “... দু’জন সাদা মুখোশ-পরা মানুষ পরস্পরের কোমর ধরে ওয়ালজ নাচের ভঙ্গীতে পা টিপে টিপে আসরে হাজির হল। একজনের অঙ্গে ইংরেজ বিচারপতির পোশাক, মাথায় কোঁকড়ানো উইগ, পরিধানে স্বচ্ছ মসলিনের পোশাক। এত স্বচ্ছ যে বুকের ও পায়ের চুল পর্যন্ত দেখা যায়। আরেকজনের মাথায় কক-হ্যাট কিন্তু পরিধানে স্টাফ ইউনিফর্ম। সাহেবদের আচার-আচরণের প্রতি কটাক্ষ করে তাঁরা দু’জনে যে অভিনয় করল সেটা সহ্য করা যায় না।” আরেক ইউরোপীয়ান ‘রাজী’ ও ‘কল্যাণী’ নামের দু’জন নর্তকীর কথা লিখেছিলেন, যাঁরা সাহেবরা আসর ছেড়ে চলে গেলেই ইংরেজি পোশাক পরে অঙ্গভঙ্গী সহকারে ‘ক্যারিকেচার’ শুরু করে দিতেন। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, কোন আসরে রাজী ও কল্যাণী উপস্থিত থাকলেই সাহেবরা সেই আসরের ধারে-কাছেও ঘেঁষতেন না। আসলে ইউরোপীয়দের মেয়ে-পুরুষের সম্মিলিত নাচ ভারতীদের চোখে অশোভন বলে ঠেকেছিল, কাজেই সেটার প্রতি ব্যঙ্গ করেই সেই কৌতুকাভিনয় করা হত।
তখন দেশীয় নাচ দেখবার ব্যাপারে ইউরোপীয় পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের আগ্রহই বেশি ছিল। তাঁরা অকপটে দেশীয় নাচের সমালোচনা করলেও, পুরুষদের মত কিন্তু অবজ্ঞা প্রদর্শন বা ব্যঙ্গ করেন নি। ‘মিসেস কিণ্ডার্সলি’ (১৭৫৪), ‘মিসেস শেরউড’ (১৭৯৯), ‘মিসেস গ্রাহাম’ (১৮১০), ‘লেডী মুজেন্ট’ (১৮১২), ‘মিসেস পার্লবী’ (১৮২৩), ‘মিসেস ফেণ্টন’ (১৮২৬) - সকলেই তাঁদের লেখায় অল্পাধিক দেশীয় নাচের কথা লিখেছিলেন। ইউরোপীয় পুরুষ মহলে আঠারো শতকের শেষের দিকে দেশীয় নাচের কদর একেবারে কমে গিয়েছিল। তখন কেবলমাত্র ক্যান্টনমেন্টগুলিতে সৈন্যদের কাছে দেশীয় নাচের কদর ছিল। সাহেব মহলে একদা হাফিজের কিছু রুবাইৎ, কিছু উর্দু গজল ও নর্তকীদের অন্যান্য বহু গানও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ইউরোপীয়দের মধ্যে অনেকেই সেই গান অনুবাদ করেছিলেন। তখনকার ভারতীয় বাঈজীদের গান সংগ্রহ করবার ক্ষেত্রে পাদ্রী ‘কেরী’রও খুব খ্যাতি ছিল, তিনিও বহু গান অনুবাদ করেছিলেন। আবার দেশীয় নর্তকীদের প্রতি কটাক্ষ করে কেউ কেউ কবিতাও লিখেছিলেন।
তখন সাধারণতঃ সারা রাত্রিব্যাপী নাচের আসর বসত। কোন ‘নতুন প্রতিভা’ আবিষ্কৃত হলেই সেই সুন্দরী, সুকন্ঠী সকলের আলোচ্য বিষয় হতেন। নাচের ফাঁকে ফাঁকে কিছু মস্করা, কৌতুকাভিনয়ও চলত। ‘মিসেস শেরউড’ মুর্শিদাবাদের নবাব-বাড়িতে সেকালের কৌতুকাভিনয়ের কিছু বর্ণনা দিয়েছিলেন। একালের বিচারে সেদিনের হাস্য-পরিহাসকে বড় স্থূল, বড় রসজ্ঞানহীন বলে মনে হলেও, সেদিন কিন্তু ওগুলোই বাঙালী সমাজের একমাত্র ভরসা ছিল, ওগুলোই তখনকার নিস্তরঙ্গ জীবনে একমাত্র হিল্লোল ছিল। ওই দেশীয় কৌতুক মিসেস শেরউডেরও ভাল লাগে নি। কিন্তু বঙ্গ-সংস্কৃতির পুর্বপট সম্পর্কে যাঁরা আগ্রহী, তাঁদের কাছে সেই বর্ণনা আজও প্রত্যক্ষদর্শীর প্রামাণিক বর্ণনারূপে অত্যন্ত মূল্যবান। তিনি লিখেছিলেন, “অতঃপর এক ডজন ভাঁড় ও বিদূষকের আগমন-নির্গমন ঘটল। তাঁরা যেসব কায়দা প্রদর্শন করল তাতে রসের কিছু ছিল না। একটি প্রহসন হল - একটি ঘোড়ার মালিকানা সম্পর্কে ইংরেজ বিচারপতির বিচার। একজন মানুষ ঘোড়া সেজে হাঁটু মুড়ে বসে, পিছনে ঘোড়ার মতই ল্যাজ, পিঠে জিন। দু’জন দাবিদার। দু’জনেই তাঁর পিঠে চড়তে চায়। কিন্তু নকল দাবিদার ঘোড়ার পিঠে চড়লেই ঘোড়া দাঁড়িয়ে ওঠে, দাবিদার মাটিতে পড়ে যায়। এই পড়ে যাওয়াই হল রসিকতা। একজন অশ্ববেশী মানুষকে ল্যাজ নাড়তে ও মুখ দিয়ে চিঁহিচিঁহি আওয়াজ ছাড়তে দেখে যদি কারও হাসি পায়, তাহলে সে হাসতে পারে। দ্বিতীয় অনুষ্ঠানও প্রায় অনুরূপ। … প্রধান কৌতুকাভিনেতা নবাবের কাছে গিয়ে বলল - ‘শাহানশাহ, আপনার জন্য এক অভিনব রাস্তা বানিয়েছি।
আপনার প্রজাদের রাস্তার উপর শুইয়ে এই পথ তৈরী হয়েছে। হুকুম করুন, রাস্তাটি পরীক্ষা করি।’ নবাবের পক্ষ থেকে একজন অনুমতি দিল। লোকটি রাস্তার উপর দিয়ে বীরদর্পে কয়েকবার চলাফেরা করল। তারপর হঠাৎ দেখা গেল, শায়িতদের মধ্যে একজন উঠে দাঁড়িয়েছে। কৌতুকাভিনেতা তাঁরই পিঠে পা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। একেবারে পপাত ধরণীতলে। এই পতনটাই নাকি হাসির ব্যাপার। উপস্থিত সবাই হেসে লুটোপুটি। কিন্তু নবাব গম্ভীর। কারণ নবাব যদি অল্পেই তুষ্ট হন, তবে এদেশে সাধারণের কাছে তাঁর সমাদর কমে যায়। … এবার আরেকজন, তাঁর বুকে একটি বর্শা আমূলবিদ্ধ। রক্তে সর্বাঙ্গ লাল। তাঁর সেই অবস্থা দেখে আমি ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করলাম। মিঃ শেরউড পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সত্যিই কেউ বর্শা দিয়ে তাঁকে আঘাত করেছে, সে নবাবের কাছে অভিযোগ জানাতে এসেছে। এই সিরিয়স ফার্সের অনুষ্ঠান অন্যান্যদের চেয়ে ভাল। করুণ মুখে সে নবাবের সামনে এসে দাঁড়াল। তাঁর পিছনে এল একদল পুরুষ গায়ক। আগের গায়িকাদের মত তাঁদেরও গানের বিষয়বস্তু হল নবাবের প্রশস্তি-কীর্তন - ‘তুমি তোমার বাপের চেয়েও মহান। যদিও তোমার তেমন অর্থ নেই। বহু বিশিষ্ট শ্বেতাঙ্গ আজ তোমায় তাঁদের অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসেছে। কেউ ঘোড়ায় চেপে, কেউ ঘোড়ার গাড়িতে, কেউ নৌকোয়, কেউ পাল্কিতে।’ …” এরপরেই মিসেস শেরউড সেখান থেকে চলে এসেছিলেন।
সাহেব-নবাবদের দৈনন্দিন জীবন
পলাশী যুদ্ধের আগে বঙ্গদেশ থেকে কোন ইংরেজ যে ধনশালী হয়ে স্বদেশে ফিরে যাননি, তা নয়; অনেকেই ফিরেছিলেন। কিন্তু তাতে কোন বৈচিত্র্য ছিল না, সেসব কারো দৃষ্টি আকর্ষণও করেনি। সেইসব ইংরেজরা অন্য দশজন ইউরোপীয় গ্রাম্য ব্যবসায়ীর মত নিজেদের দেশে ফিরে জমিজমা কিনেছিলেন। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পরে তাঁরা বাংলা থেকে রীতিমত ‘নবাব’ হয়ে নিজেদের দেশে ফিরতে শুরু করেছিলেন। পলাশীর যুদ্ধ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীকে আমূল পরিবর্তিত করে দিয়েছিল। তখন তাঁদের শুধু ধনী হলেই চলছিল না, মান প্রতিপত্তি খেতাব - এসবেরও দরকার ছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল, আর ১৭৬৮ সালে দেখা গিয়েছিল যে, সেই ‘সাহেব-নবাবেরা’ নিজেদের দেশে ফিরে দলবদ্ধভাবে পার্লামেন্টে প্রবেশ করছেন, এবং তার মাত্র তিন বছর পরে, অর্থাৎ ১৭৭১ সালে দেখা গিয়েছিল যে, ‘হিউফুটের’ ব্যঙ্গ-নাটক ‘দি-নাবুব’ গ্রন্থে নবাব-চরিত্র নিন্দিত ও উপহসিত হচ্ছে। নাটকীয় ক্ষিপ্রতায় সেই পট-পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। পলাশী-যুদ্ধ ইংরেজদের বাংলা তথা ভারতবর্ষের একেবারে অন্তঃস্থলে ঠেলে দিয়েছিল। তখন তাঁরা বাংলার বিপুল ধনসম্পদের মুখোমুখি হয়েছিলেন, আর সামান্য একটু পরিশ্রম করলেই তো একেবারে ‘শ্যাংগ্রিলা’। ফলে তখন যাঁরা ‘ছোট ইংরেজ’ ছিলেন, যাঁরা সামান্য একটা চাকরিকে সম্বল করে কোনরকমে এদেশে এসে পৌঁছেছিলেন, তাঁরা কিছু কিছু ভারতীয় আদব- কায়দা গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন, তাঁরা ভারতীয় বিলাসিতাকে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে গ্রহণ করে কৃতার্থ হয়েছিলেন। আর তখন যাঁরা ‘বড় ইংরেজ’ ছিলেন, যাঁরা রুচিবান, উন্নত সংস্কৃতির ধারক ছিলেন, তাঁরা (শোর, হেষ্টিংস, ফোর্বস) তাঁরা ফার্সি সাহিত্য, হিন্দুপুরাণ, দর্শন পড়ে নিজেদের সময় কাটাতে শুরু করেছিলেন।
ঠিক সেই সময়ে ভারতের মাটিতে আরেক শ্রেণীর ইউরোপীয়ানদের আগমন শুরু হয়েছিল। তাঁরা ভাগ্যান্বেষীর দল ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের পরে লর্ড ক্লাইভ ও মীরজাফরের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল যে, কোম্পানির কোন কর্মচারীর কাছ থেকে নবাব নদীপথে যাতায়াতকারী মালের জন্য কোন ধরণের শুল্ক আদায় করতে পারবেন না। কিন্তু তখন যাঁরা কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন, এমন স্বাধীন ইংরেজ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করাও কোম্পানি বা নবাবের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে সেই শুল্ক-রেহাই ও সরকারী অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে দলে দলে ইংরেজ, ফরাসী, জার্মান ও আমেরিকানরা ইংরেজ সেজে বঙ্গদেশের গ্রামে গ্রামে ব্যবসা করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তাঁদের পরিধানে থাকত ইংরেজ সিপাহীর পোশাক, আর হাতে থাকত ইংরেজদের পতাকা। নবাবের কর্মচারীরা তাঁদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে, তাঁরা কোন বিশিষ্ট ইংরেজের গোমস্তা বা এজেন্টের পরিচয় দিতেন, আর চ্যালেঞ্জ করলে নকল পরিচয় পত্র পর্যন্ত দেখিয়ে দিতেন।
তখনকার সাধারণ গ্রামবাসী, বিশেষতঃ সেদিনের সরল গ্রামবাসীদের পক্ষে কে আসল আর কে নকল - সেটা বোঝা সহজ ছিল না। ফলে ওই সব ভাগ্যান্বেষীরা গঞ্জে বা নগরে হাজির হয়ে দেশী-ব্যবসায়ীদের বাজার দামের চেয়ে ঢের বেশি দাম দিয়ে তাঁদের মাল কিনতে বাধ্য করতেন। বস্তুতঃ ওই সব ছদ্মবেশী ‘ইংরেজ’ ব্যবসায়ীদের দুর্বৃত্তপনা দমন করতে গিয়েই মীরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের ১৭৬৪ সালে যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। যাই হোক, লর্ড হেষ্টিংস ১৭৭২ সালে নতুন আদেশ জারী করে ঐসব ব্যবসায়ীদের কলকাতার চৌহদ্দির বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য নীলকর সাহেবরা তাঁর সেই আদেশের এক্তিয়ারভুক্ত ছিলেন না। সেই আদেশের ফলে ওই ভাগ্যান্বেষী সাহেবদের বাংলার মফঃস্বলে যাওয়া পুরাপুরি বন্ধ হয়নি বটে, কিন্তু বাংলার গ্রামে গ্রামে ওই ‘গোরা-সাহেবরা’ যে ত্রাসের, যে বীভৎস অরাজকতার সৃষ্টি করেছিলেন, সেটা অনেকাংশে দূর হয়েছিল।
ওদিকে বাংলার শহরগুলিতেও তখন নতুন একটি শ্রেণীর দেখা পাওয়া গিয়েছিল। তাঁরা ভবঘুরে ও ভাগ্যান্বেষী ছিলেন না, কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে অধিক অর্থ সংগ্রহ করা তাঁদেরও লক্ষ্য ছিল। কোম্পানির বিভিন্ন পদে তাঁদের ঘনিষ্ঠ পরিচিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তখন অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাই দেশের সেই এলোমেলো অবস্থায় লুটেপুটে খাওয়ার জন্য তাঁরা ব্যগ্র ছিলেন। তাঁদের হাতে সময় বেশি ছিল না। তাঁরা জানতেন যে, কোম্পানির শাসনব্যবস্থা একটু বেশী কায়েমী হয়ে বসলে, নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, আর সহজে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হবে না। সেই অবস্থায় কোম্পানিতে কোনমতে বড় একটি পদ সংগ্রহ করতে পারলে তাঁদের পোয়া-বারো ছিল। তাঁদের নবাব হওয়া কে ঠেকাতেন? এই প্রসঙ্গে ‘টপহ্যাম’ ১৭৬৫ সালে ‘বারিংটন’কে লিখেছিলেন, “The Company's Civil Service is the only certain track to a fortune or preferment and much more on the Bengal Establishment than any other.” (Home miscellaneous series, Topham to Barrington, 1765. P- 153) অর্থাৎ, কোম্পানির সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করাই হল বড়লোক হওয়ার নিশ্চিত পথ। আর তখন সেইসব পদের মধ্যে সেরা পদ ছিল, কোন দেশী নবাব বা রাজার অভাবে কোন বড় জমিদারের দরবারে ‘বৃটিশ রেসিডেন্টের’ পদ। তাতে দু’-দফা লাভ ছিল। প্রথমতঃ, কোম্পানি নবাবকে যে বৃত্তি দিত, সেটা রেসিডেন্টের হাত দিয়ে নবাবের কাছে পৌঁছাত। ফলে নবাবের কাছ থেকে সেই টাকা বাবদ তাঁরা কমিশন বা দস্তুরী পেতেন। দ্বিতীয়তঃ, নবাব যখন তাঁর নিজের বিলাসের জন্য কোন বিলাতী জিনিস কিনতেন, সেটাও ঐ রেসিডেন্টই তাঁকে সরবরাহ করতেন। সেটার জন্যও তিনি কমিশন পেতেন। অর্থাৎ, শাঁখের করাতের মত দু’-দিক দিয়ে কেটে তাঁরা টাকা রোজগার করতেন।
‘উইলিয়াম হিকি’র বন্ধু ‘বব পট’ যেদিন মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে বৃটিশ রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন, সেদিন তিনি যেন আনন্দের আতিশয্যে ফেটে পড়েছিলেন! “He rejoiced for not only did the whole stipend allowed by Government to the Nabob pass through the Resident’s hands he had likewise the further advantage of purchasing and paying for every European article the Nabab wished to have.” মুর্শিদাবাদ থেকে চার মাইল দূরে ‘আফজল বাগে’ তখন বৃটিশ রেসিডেন্টের বাসভবন ছিল। পট ভবিষ্যৎ লাভের কথা ভেবে আগে থেকেই বিশ হাজার টাকা ব্যয় করে সেই বাড়িটি সাজাবার ব্যবস্থা করে, সেখানে হিকি ও অন্যান্য বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হিকি সেই বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেটা বাড়ি নয়, রীতিমত প্রাসাদ ছিল,
‘ম্যাকিনটসের’ (১৭৭৭-১৭৮১) ভ্রমণ কাহিনীতে আঠারো শতকের কলকাতার সাহেব-নবাবদের দৈনন্দিন জীবনের একটি নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন - “সকাল প্রায় সাতটায় দারোয়ান গেটের দরজা খুলতেই সাহেবের সরকার, পিওন, হরকরা, চোপদার, হুঁকাবরদার, খানসামা, রাইটার ও সলিসিটরের দল বারান্দায় এসে জড়ো হয়। হেড-বেয়ারাসহ জমাদার সর্বপ্রথম হলঘরের মধ্যে দিয়ে সাহেবের শয়নকক্ষে সকাল আটটায় প্রবেশ করে। সাহেবের পাশ থেকে এক মহিলা উঠলেন, তাঁকে পাশের গোপন-সিঁড়ি দিয়ে পাশের কোন ঘরে বা একেবারে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। সাহেব শয্যা থেকে একটু নড়ে একটি পা বাড়াতেই বাইরের অপেক্ষমান সকলেই সাহেবের ঘরে প্রবেশের জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে। তারপরে শুরু হয় সালামের পালা। শরীরটাকে বাঁকিয়ে, মাথা নিচু করে, হাতের তালু কপালে ও উন্টা দিকে পিঠ স্পর্শ করে তিনবার তাঁরা সেলাম করল। তিনি চোখ মেলে তাঁদের দিকে তাকিয়ে বা ঈষৎ মাথা নেড়ে অনুগ্রহপ্রার্থীদের সালাম গ্রহণ করলেন। আধ-ঘণ্টার মধ্যে তাঁর ঢিলা পায়জামা চলে গেল, অঙ্গে উঠল নতুন পোশাক-শার্ট, ব্রিচেস, স্টকিং সিপার - সব কিছু। তিনি স্ট্যাচুর মত বসে রইলেন, কিছুই তাঁকে করতে হল না। নাপিত এল, ক্ষৌরকর্ম সমাধা করল, নখ কেটে, কানের ময়লা সাফ করে সে বিদায় নিল। এরপর এল আরেক নফর, হাতে চিলমজী ও বড় বালতি বোঝাই জল নিয়ে। সাহেবের হাতে ও মুখে জল ঢালা ও তোয়ালে দিয়ে সেই তাঁর গাত্র-মার্জনা করাই তাঁর কাজ। অতঃপর মহাশয় হেলতে দুলতে গেলেন ব্রেকফাস্টের ঘরে। গায়ে কেবল ওয়েস্টকোট। খানসামা চা ও টোস্ট এগিয়ে দিল।
এবার আগমন হেয়ার-ড্রেসারের। অপর দিক দিয়ে হুঁকাবরদার। প্রায় নিঃশব্দে নলের একটি প্রান্ত সে বাবুর হাতে ধরিয়ে দেয়। হেয়ার ড্রেসার সাহেবের মাথায় যখন টেরি বানাতে ব্যস্ত, সাহেব তখন হুঁকো টানেন, কিছু খান বা পান করেন। … কখন এক সময়ে বেনিয়ানের আবির্ভাব হয়। সাহেবকে সালাম করে সে (অন্যান্য নফরদের তুলনায়) একটু বেশি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। উপস্থিত অনুগ্রহপ্রার্থীদের মধ্যে যাঁদের গুরুত্ব বেশি, তাঁদের জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা থাকে। বেলা দশটা পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান চলে। তারপর সেই নফরের দল সারি দিয়ে সাহেবকে পাল্কি পর্যন্ত নিয়ে যায়। পাল্কির আগে আগে ছুটে চলে আট থেকে বারো জনের চোপদার, হরকরা ও পিওন-বাহিনী। প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ড্রেস, মাথায় পাগড়ির রং ও কোমরবন্ধ দেখে তাঁদের পদমর্যাদা বোঝা যায়।” মোটামুটিভাবে এটাই ছিল তখনকার সাহেব-নবাবের রোজনামচা। পলাশী-যুদ্ধ বৃটেনের হাতে বাংলার রাজশক্তিকে তুলে দিয়েছিল, পলাশী-যুদ্ধই সেই নতুন নবাবদের সৃষ্টি করেছিল। পলাশী-যুদ্ধ বৃটিশ সেনাবাহিনী তথা সিভিলিয়ানদের মধ্যে এক নতুন শ্রেণীচেতনা এনে দিয়েছিল। সর্বোপরি পলাশী-যুদ্ধ সাধারণ শহর কলকাতাকে তার ‘কসমোপলিটান’ রূপটি দিয়েছিল।
অর্থ হাতে আসবার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজদের আগেকার অনাড়ম্বর জীবনে বিলাসিতা দেখা দিয়েছিল। ফলে অনেক সাহেবই তখন দেশী নবাবদের অনুকরণ করতে শুরু করেছিলেন। নিয়মিত নাচের আসরে যাওয়া ও বাড়িতে নাচের আসর বসানো সেই নব্য-নবাবদের ফ্যাশান হয়ে উঠেছিল। হিন্দুস্থানী নাচ যে তাঁরা তেমন কিছু বুঝতেন তা নয়, হিন্দুস্তানী গানও তাঁদের কাছে বোধগম্য হওয়া তো দূরের কথা, উল্টে বিরক্তিকর বলেই মনে হত। কিন্তু তবুও তাঁদের ফ্যাশানের দরকার ছিল। আগে দেশী মদ ‘আরক’ পান করেই তাঁদের দিন কাটত। তখন সেই আরক তাঁদের কাছে ‘পুওর ম্যানস ড্রিঙ্ক’ হয়ে পড়েছিল। বস্তুতঃ আরক ও হুইস্কি প্রায় একই রকমের বলে হুইস্কি দীর্ঘদিন পর্যন্ত ‘জেন্টলম্যানস ড্রিঙ্ক’ বলে ইংরেজ সমাজে স্বীকৃত হয়নি। সেই সময়ে হুঁকা-সেবন অনেক ইংরেজেরই স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। সম্ভবতঃ তামাকের সুগন্ধই সেটার মূল কারণ ছিল। পকেটে অর্থ আসবার ফলে সেই সাহেব-নবাবরা দেশীয় নবাবদের অনুসরণে নিজের নিজের বাড়িতে হারেম গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন। আগে ইংরেজদের মধ্যে কেউ কেউ পর্তুগীজ বা অন্যান্য খৃষ্টান নারীদের এদেশে বিয়ে করতেন। কিন্তু তারপরে নতুন যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা ইংরেজ ছাড়া অন্য কোন নারীকে বিবাহ করা নিজেদের জন্য সম্মানহানিকর বলে মনে করেছিলেন। তখন যেহেতু তাঁদের হাতে যথেষ্ট অর্থ ছিল, সেহেতু তাঁরা বিবাহের পরিবর্তে উপপত্নী গ্রহণ করাই নিজেদের জন্য নিরাপদ বলে মনে করেছিলেন। তদানীন্তন ভারতীয় রীতি অনুসারে সেই সময়ে একাধিক উপপত্নী গ্রহণ নিন্দনীয় ছিল না। আগে কলকাতার মধ্যেই একতলা বাড়িতে কোন রকমে তাঁদের মাথাগুঁজে বাস করতে হত। পরে হাতে অর্থ আসবার পরে তাঁরা খাস শহর ছেড়ে বাইরে বাগানবাড়ি ও বসতবাড়ি বানাতে শুরু করেছিলেন। দেখতে দেখতে গার্ডেনরীচ, বারাসত, ব্যারাকপুর প্রভৃতি জায়গায় ইংরেজদের নতুন নতুন বাগানবাড়ি গড়ে উঠেছিল। কেউ কেউ আবার নিজের বিলাস-ব্যসন চরিতার্থ করবার জন্য ফরাসি চন্দননগরে, ডেনিশ শ্রীরামপুর বা ডাচ চুঁচুড়াতেও বাড়ি বানিয়েছিলেন। কলকাতার ঐশ্বর্যের ও বিলাস-ব্যসনের খবর বিলেতে পৌঁছবার পরে সেখান থেকে অনূঢ়া কন্যারা দলে দলে স্বামী শিকার করবার জন্য ভারতে আসতে শুরু করেছিলেন। তাছাড়া, তখন নতুন যেসব অফিসারেরা ভারতে আসতে শুরু করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের স্ত্রী ও অন্যান্য পরিজনবর্গসহ এদেশে এসেছিলেন।
ফলে ইংরেজ সমাজে মহিলাদের সংখ্যা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ভারতে তাঁদের একটা সোসাইটি গড়ে উঠেছিল। সেই সোসাইটির সঙ্গে সঙ্গে এদেশে বিলাতী-নাচের আগমন ঘটেছিল। আগে গভর্নমেন্ট হাউসে বছরে মাত্র এক-দু’বার ‘বল নাচ’ অনুষ্ঠিত হলেও, পরে বারোমাস সেই নাচের আসর বসতে শুরু করেছিল। বাইরে ক্লাব ঘরে বা বিশিষ্ট সাহেবদের প্রশস্ত হলঘরে নাচের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে রোদ ছিল না, বৃষ্টি ছিল না, শীত-গ্রীষ্ম ভেদাভেদ ছিল না, কুল-গোত্রের বালাই ছিল না - শুধু নাচ হলেই চলত। এমনকি নাচেরও - “চরম গরম বা বর্ষার সময়েও এমন একটি সপ্তাহ ছিল না যখন নাচ বাদ পড়েছে। যে ঘরে নাচের আয়োজন সেখানে পাখা নেই, মৃদু মোমবাতির আলো। ‘কোটিলো’ নাচতে হলে যে পরিশ্রম করতে হয়, তার ফলে নাচিয়েদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে।” কিন্তু সেই পরিশ্রম কেউ গায়ে মাখতেন না। কারণ, হাজার হোক দয়িতার সঙ্গে সাক্ষাতের সেটাই তো সবচেয়ে নিরাপদ সুযোগ ছিল।
ইংরেজ সেনাবাহিনীতে, যেখানে শ্বেতাঙ্গিনী ললনারা দুর্লভ ছিলেন, সেখানে কিন্তু দেশী নাচের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ থেকে গিয়েছিল। তখন নিজেদের অভিজাত প্রমাণ করবার জন্যই সদ্য-জাতে-ওঠা ইংরেজরা প্রায়শঃই নিজের নিজের বাড়িতে দেশী নাচের ব্যবস্থা করতেন, আর সেখানে অন্যান্য ইউরোপীয়দের আমন্ত্রণ জানাতেন।
১৭৬৯ সালে বঙ্গদেশে ইংরেজদের বিলাসী জীবনে পরিবর্তনের দ্বিতীয় জোয়ার এসেছিল। সেই বছরই বঙ্গদেশের জেলায় জেলায় ইংরেজ ‘সুপারভাইজার’ নিয়োগ করা হয়েছিল। ১৭৭২ সালে হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতে এসেছিলেন। সেই বছরই কোম্পানি নবাবের কাছ থেকে দেওয়ানি স্বহস্তে গ্রহণ করেছিল। এরপরে সুপারভাইজারদের নাম হয়েছিল ‘কালেক্টর’। সেই কালেক্টরদের সরকারী কাজ ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করবার অধিকারও ছিল। হেস্টিংস জেলাপর্যায়ে অধিকাংশ কাজের দায়িত্ব ভারতীয় দেওয়ানদের উপরেই ন্যস্ত করেছিলেন। তাই কালেক্টররা তখন শুধু জেলার সদরে বসে টাকা গুনতেন আর বিচার করতেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির রাজস্ব ও কোম্পানির বাণিজ্যে অর্জিত টাকা গোনা অপেক্ষা তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে অর্জিত টাকা গুনতেই বেশি ভালবাসতেন। সেই বাণিজ্যে তখন বিপুল লাভও হত। ফলে তাঁরাও দেখতে দেখতে সিভিলিয়ন থেকে ‘নবাবে’ পরিণত হয়েছিলেন।
অবশেষে কর্ণওয়ালিশ ১৭৮৭ সালে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এমনকি কোম্পানির রাজস্ব আদায় ও কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনাকে তিনি দুটি স্বতন্ত্র ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিলেন। ওয়েলেসলির আমলে (১৭৯৮) দেখা গিয়েছিল যে, প্রত্যেক অফিসারের ক্ষমতাই আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়েছে। তখন ‘সেক্রেটারী বোর্ড অব রেভেন্যু’ বা ‘কালেক্টর অব বার্ডোয়ান’ ইত্যাদি নামগুলি বেশ গালভরা হলেও তাঁরা আদতে বাঁধা মাইনের সরকারী কর্মচারী ছাড়া অন্য কিছুই ছিলেন না। ওদিকে তখন কোম্পানির ‘কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টে’ যাঁরা কাজ করছিলেন, তাঁদের কোন জৌলুস ছিল না। তাঁরা শুধু চিনির বলদের মত চিনি বয়ে বেড়াতেন, কিন্তু সেই চিনি ভোগ করবার কোন অধিকার তাঁদের ছিল না। ইংরেজ শাসন ব্যবস্থায় তাঁরা নাক গলাতে পারতেন না। সেই সময়ে গ্রামের ব্যাপারী বেনিয়ানরাও তাঁদের রক্তচক্ষুকে ভয় পেতেন না। ১৮১৩ সালে ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার লুপ্ত হয়েছিল। এর কুড়ি বছর পরে, ১৮৩৩ সালে কোম্পানির বাণিজ্যিক পরিচয়ই একেবারে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কোম্পানি তখন কেবলমাত্র শাসকে পরিণত হয়েছিল, সেই সময়ে বণিকের মানদণ্ড আর তাঁদের হাতে ছিল না, শুধু রাজদণ্ড ছিল। এর থেকে দেখা যায় যে, আঠারো-ঊনিশ শতকের সাহেব-নবাবদের আয়ুষ্কাল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল, জোয়ারের মতই তাঁদের যেমন আবির্ভাব ঘটেছিল, তেমনি আবার ভাঁটার টানে তাঁদের তিরোভাব হয়েছিল।
বাংলায় ইউরোপীয়ান বিবাহ’
আঠারো-ঊনিশ শতকের ইংল্যাণ্ডে বিবাহযোগ্যা কোন পাত্রীর জন্য উপযুক্ত পাত্র না পাওয়া গেলেই, তাঁর পাড়া-প্রতিবেশীরা সেই পাত্রীর অভিভাবককে উপদেশ দিতেন - ‘ভাবনা কি, ইণ্ডিয়ায় পাঠিয়ে দাও। গাড়ি জুটবে, বাড়ি জুটবে, সিন্দুক বোঝাই মোহর জুটবে, খেঁদি-বুচি কেউ পড়ে থাকে না সে দেশে। ’ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম যুগে ভারতে ইংরেজ মহিলাদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তখন যাও দু’-একজন বিবাহিত ইংরেজ মহিলা এদেশে ছিলেন, তাঁদের নিয়ে স্বামীরা সদাশঙ্কিত ছিলেন। কোম্পানির ব্যারাকে ব্যারাকে তখন ব্যাচেলরের দল বাস করতেন। তাঁরা দেশী মদ খেতেন, আর দেশী মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতেন। তখন ভারতে তেমনভাবে ইউরোপীয় মহিলারা না থাকবার ফলে কোন ইউরোপীয় সোসাইটি ছিল না, আর সোসাইটি নেই বলে ‘এটিকেটের’ও কোন বালাই ছিল না। কিন্তু ঊনিশ শতকের শুরু থেকেই ‘হোম’ থেকে অবিবাহিতা ইউরোপীয় কন্যারা একে একে ভারতে আসতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল মাত্র একটি - স্বামী চাই, এবং সেই সূত্রে দু’-হাতে ওড়াবার মত অঢেল পয়সাও চাই। ‘গ্র্যাণ্ডপ্রি’ জাতিতে ফরাসী ছিলেন। সেকালের ভারতবাসী ইংরেজদের সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, “The Englishmen who are inclined to every sort of speculation, send year after year annual large cargoes of females who are tolerably handsome and are seldom six months in this country without getting husbands.” ১৭৬৮ সাল থেকে ১৭৮১ সাল পর্যন্ত পোলিশ পর্যটক ‘ম্যাক্সমিলিয়ান উইকলিনস্কি’ এদেশে ছিলেন। তিনিও লিখেছিলেন, “The most beautiful girls of England and of all the parts of India continually arrived there in order to tempt fortune.” তখন কলকাতার জাহাজঘাটায় ইউরোপ থেকে কোন জাহাজ এসে দাঁড়ালেই সেখানে ইংরেজ যুবকদের ভিড় লেগে যেত। ওই জাহাজে করে হোম থেকে কি কি জিনিস এসেছে সেটা দেখতে যাওয়াটা তাঁদের উপলক্ষ্য মাত্র ছিল, জাহাজে করে কোন সজীব পণ্য কিছু এসেছে কিনা সেটা দেখাই তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল। আর যদি কেউ বা এসেও থাকতেন, তাহলে তাঁকে দূর থেকে আলতো এক নজর দেখেই তাঁদের তৃষ্ণা মেটাতে হত। হুট্ করে কাছে গিয়ে আলাপ করতে তাঁরা সাহস করতেন না। অনেক-কাল বিদেশে থাকবার ফলে তাঁদের কেউই ‘এটিকেট দুরস্ত’ ছিলেন না। কোন বংশের মেয়ে, কার বাড়ির গেস্ট হবেন, সেই খবরও তাঁদের জানা থাকত না। অতএব দূর থেকে এক নজর বাঁকাচোখে চেয়েই তখনকার মত তাঁদের তৃষ্ণা মেটাতে হত। তারপরে যথাসময়ে কাকমুখে সব খবর ছড়িয়ে পড়ত। সদ্য আগত মহিলা কার মেয়ে, কোথায় উঠেছেন, কেমন দেখতে, নাক-সিঁটকে চলেন কিনা, নজর কেমন - সব খবরই ফিসফিস করে আদান-প্রদান হতে শুরু হত। যাঁর বাড়িতে গিয়ে মেয়েটি উঠতেন, তাঁর খানসামা-বেয়ারাদের কিছু বকশিশ কবুল করালেই তাঁকে নিয়ে সব খবর জোগাড় হয়ে যেত। তারপরে ওই কন্যার সম্ভাব্য পাত্ররা সেই বাড়ির আশেপাশে ছুঁক ছুঁক করে ঘুরে বেড়াতে শুরু করতেন। এমনকি অকারণে অপ্রয়োজনেও সেই বাড়ির গৃহস্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তাঁকে ‘হাউ-ডু-ডু’ বলে তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টাও করতেন। ‘Memoirs of a Cadet’ (১৮৩৮) গ্রন্থের লেখক লিখেছিলেন, “On the summit of the ghaut we perceived several groups of young gentlemen both in civil and military guise. They were conversing and anxiously watching, as it seemed to me, the movements on board our lately arrived vessel. The mystery was soon explained, for a Sirkar told me-'when Missy Beebee (young ladies) come new from Europe, then always plenty young gentlemen come to ghaut to see.”
সেকালের কলকাতার ইংরেজ সমাজে কনে দেখবার একটি বিশিষ্ট রীতি প্রচলিত ছিল। কলকাতার উল্লেখ এই কারণেই করা হল যে, তখন কিন্তু বোম্বাই বা মাদ্রাজে ইউরোপীয় জাহাজ খুব একটা ভিড়ত না। তাই বিয়ে করতে হলে ‘আপ-কান্ট্রির’ সাহেবদের কলকাতায় এসে হা-পিত্যেশ করে মাসের পর মাস বসে থাকতে হত। তখনকার সাহেবদের ওই কনে দেখবার রেওয়াজ হিন্দু- সমাজের কনে দেখবার চেয়েও লজ্জাকর ব্যাপার ছিল। সমসাময়িক লেখক ও পত্রিকা-সম্পাদকরা সেই রীতির তীব্র নিন্দা করেছিলেন। ইংরেজদের শালীনতাবোধ ইণ্ডিয়ায় এতদূর কিভাবে অধঃপতিত হল - সেটা ভেবে তাঁদের সবাই দিশেহারা হয়েছিলেন। কোম্পানির ডিরেক্টররাও সেই বিষয়ে বহু আলাপ আলোচনা করেছিলেন। শেষপর্যন্ত তাঁদের সমালোচনা ও নিন্দাবাদের ফলে ঊনিশ শতকের মধ্যপাদ থেকে ওই রীতি লোপ পেয়েছিল। তারপর থেকে পাত্রী কলকাতায় এসে পৌঁছানোর পরে গৃহস্বামী (হোস্ট) পরপর তিন সন্ধ্যায় সম্ভাব্য পাত্রদের কনে দেখবার সুযোগ করে দিতেন। সেই কারণে, কন্যাকে যথারীতি সেজেগুজে বাড়ির বৈঠকখানায় বসে থাকতে হত। হয়ত কাউকে সময় দেওয়া থাকত সন্ধ্যা ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টা, পরবর্তী জনের জন্য সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে সাতটা, তারপরের জনের জন্য সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা। সেই সময়ে নির্ধারিত ঘরে তৃতীয় কোন ব্যক্তি থাকতে পারতেন না, পাত্র নিভৃতে পাত্রীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতেন। এমন হত যে, হয়ত প্রথম নজরেই পাত্রের পাত্রীকে পছন্দ হয়ে গেল, কিন্তু পাত্রীর মন গলল না। আবার এমনও হত যে, হয়ত পাত্র দ্বিতীয় দিনেও নিজের মনস্থির করতে পারলেন না, কিন্তু তৃতীয় সন্ধ্যায় প্রথম দর্শনেই তাঁর হৃদয় গলে একেবারে জল হয়ে গেল। আগেই বলা হয়েছে যে, কনে দেখবার সেই রীতি কিন্তু ইউরোপীয় শালীনতাবিরোধী ছিল। সমসাময়িক সমালোচকরা সেটার সঙ্গে দোকানের জিনিস কেনাবেচার তুলনা করেছিলেন। ভারতে নবাগত ইংরেজ কন্যাদের সম্পর্কে ১৮৩৮ সালের ‘এশিয়াটিক জার্নালে’ জনৈক লেখক মন্তব্য করেছিলেন, “A batch of new arrivals are like the hams and cheeses imported by the same vessels, they will not keep to another season.” এই সমালোচকদের মতে - “An Anglo-Indian marriage is quite a veni vidi vici sort of thing. A few glances rapidly interchanged commence and complete the conquest.” অথচ এদেশের কনভেন্টেই তখন বহু ইউরোপীয় ‘অরফ্যান গার্ল’ লালিত-পালিত হতেন। কিন্তু কেউ তাঁদের দিকে ফিরেও চাইতেন না। কারণটা সহজবোধ্য। টাকা পেলে কে আর বাসি জিনিস নিতে চায়! ‘বিশপ হেবার’ তাঁর জার্নালে সেই অরফ্যান গার্লদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, “... অথচ ইউরোপীয় অরফ্যান গার্লের অভাব নেই। তাঁদের বিয়ের জন্য মাঝে মাঝে জাহাজে চাপিয়ে বৃটেনে পাঠানো হয়। সেখানে অধিকাংশেরই পাত্র জোটে না। ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে তাঁরা আবার ভারতেই ফিরে আসে।” আঠারো শতকের শেষের দিকের কলকাতায় ইউরোপীয় সোসাইটি একটু একট করে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। সেই সোসাইটি গড়ে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে এদেশের ইউরোপীয় ঘরনীরা তাঁদের হোম থেকে বিবাহোপযোগী ভাইঝি বা বোনঝিদের ভারতে আনাতে শুরু করেছিলেন। তখন কোন প্রতিশ্রুতিবান পাত্র দেখলেই তাঁরা সেই পাত্রের ঘাড়ে নিজের ভাইঝি বা বোনঝিকে ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করতেন। ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া স্কেচ বুকে’ সেই সোসাইটির আলাপ-আলোচনার একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। “একবার জনৈক মিসেস মার্লের বাড়িতে মজলিস বসেছিল। সেখানে নবাগতা এই ইংরেজ পাত্রী যাঁকে এখনও পর্যন্ত কেউ চোখেও দেখেনি, তাঁর সম্পর্কে আলোচনায় আসর সরগরম। মিসেস ক্লিনবি বললেন, ‘দেখুন মিসেস মার্লে, আপনার সঙ্গে আমি একমত নই। আপনি যতটা শুনেছেন আসলে ততটা নয়। মেয়েটির গায়ের রঙের কথা যদি বলেন, তবে জেনে রাখুন, ইণ্ডিয়ার জলবায়ুতে পিঙ্ক-হোয়াইট রঙ টেকে না, ব্লু-হোয়াইট হলে কিছুদিন টিকতে পারে।’ … ‘ঠিক বলেছেন’, মিসেস ওয়াটানবী সায় দিলেন - ‘আর এইরকম একখানি শ্রীচরণ’ - মিসেস হ্যারিস মুখ খুললেন - ‘সেদিন মেয়েটিকে আমি খালি পায়ে দেখেছি। যেন গোদ হয়েছে।’ ক্যাপ্টেন প্রোবি বললেন, ‘না না ঠিক তা নয়, আমি তাঁকে হোমে যখন দেখেছি, তখন তাঁর হাত-পা দুটোই বেশ সুন্দর। ঠিক মিসেস ও’নীলের মত দেখতে।’ … ‘কি বললেন? ও’নীল!
আপনি তাহলে মিসেস ও’নীলের চেহারাটাই ভুলে গেছেন’ - মন্তব্য করলেন হোম থেকে সদ্য আগত মিসেস প্লেটার। ‘আমি তো তাঁকে দেখেছি। অস্বাভাবিক লম্বা গড়ন। খুব কম হলেও পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। মেয়ে মহলের দৈত্য আর কি।’ … ‘তাহলে তাঁর উচিত কোন রিটায়ার্ড আর্মি ক্যাপ্টেনের পাণিগ্রহণ করে হোমে ফিরে যাওয়া।’ ক্যাপ্টেন প্রোবি পাত্রীটির অনুকূলে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মিসেস ক্লিনবি বাধা দিয়ে বললেন, ‘তোমরা পুরুষরাই তো মেয়েগুলোর মাথা খেয়ে দাও। দু’দিন যেতে না যেতে এমন করে তাঁদের ফ্লাটার কর যাতে হীরে-মুক্তোর গহনা ছাড়া আর কোন দিকেই তাঁরা চেয়ে দেখে না। অথচ হোমে থাকলে …’ …” তবে পাত্রীর রূপ-গুণ নিয়ে তখন মতভেদ যতই প্রবল হোক না কেন, সবাই কিন্তু সেকালের কলকাতার সাহেব পাড়ার বিয়ের প্রশংসাই করেছিলেন। কারণ, সেই বিয়েতে বিলেতের মত হাঙ্গামা ছিল না। পাত্রীর বাপ-মায়ের মত নেওয়ার দরকার হত না। পাত্রীর বাড়ি কোথায়, কুল-পরিচয় কি - ইত্যাদি দুর্বিনীত প্রশ্নগুলিও করতে হত না। কেবল চোখে ভাল লাগলেই হল। সবচেয়ে মূল্যবান কথা হল যে, সেই ধরণের বিয়েতে ‘স্ক্যাণ্ডাল’ কম হত, আর ‘ডিভোর্স’ প্রায় হত না বললেই চলে। পুরানো নথি থেকে জানা যায় যে, ভারতে কোম্পানির আদি থেকে শুরু করে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত মাত্র তেত্রিশটি ক্ষেত্রে ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছিল। সেটাও আবার শুধু কলকাতায় নয়, সারা ভারতে। কিন্তু কেন? ওই সময়ে ভারতে থাকা ইংরেজদের নৈতিক চরিত্র খুব উন্নত ছিল বলে কি? মোটেই তা নয়। বরং, সেই সময়ে ভারতের বাসিন্দা ইংরেজদের নীতিবোধ খুবই ক্ষীণ ছিল। এই প্রসঙ্গে ‘হার্টলি হাউস’ গ্রন্থের গ্রন্থকার জানিয়েছিলেন যে, তখনকার কলকাতার ইংরেজদের নিজেদের মধ্যে একটা অলিখিত সন্ধি ছিল। তাঁদের নিজেদের সমাজের সর্বজনমান্য নীতি ছিল, “I
trust you with my wife, you trust me with yours.” তবে গ্র্যাণ্ডপ্রি অন্য কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, যে মেয়েটি তখন ভারতে এসে ধনী স্বামী পেয়েছিল, গাড়ি পেয়েছিল, বাড়ি পেয়েছিল, সম্মান-প্রতিপত্তি লাভ করেছিল, নিজের দেশে সে কে ছিল? অবহেলিত নিম্নশ্রেণীর অতি সাধারণ কন্যা ছাড়া তো কিছুই না। কাজেই তাঁকে স্বামী-সোহাগিনী হতেই হত। তখন কৃতজ্ঞতাবোধই ছিল আসল কথা। ওই সময়ে ডিভোর্স না হওয়ার কারণই ছিল স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কৃতজ্ঞতা। কিন্তু সেসব কিন্তু প্রকৃত কারণ ছিল না। এই প্রসঙ্গে ‘ডগলাস ডিউয়ারের’ অভিমতকেই ঠিক বলে মনে হয়। তিনি জানিয়েছিলেন যে, এদেশের সাহেব বাড়িতে তখনকার কালে ‘প্রাইভেসি’ বলে কিছুই ছিল না। ভারত এমনিতেই গরম দেশ। বাড়ির দরজা জানলা সবই খুলে রাখতে হত। একপাল দাস-দাসী সারাক্ষণ শত কর্মে রত থাকতেন। তাই নিভৃতে প্রেমালাপের সুযোগ কোথায় ছিল? দ্বিতীয়তঃ, তখন ‘ইলোপ’ করে পালাবার কোন উপায়ও ছিল না। ভারতে তখনও রেলগাড়ি চালু হয়নি। ঘোড়ার গাড়ি সামান্য যা কিছু ছিল, তাতে চেপে শহরের চৌহদ্দির মধ্যেই চলাফেরা করা গেলেও, শহরের বাইরে যাওয়া যেত না। এছাড়া পাল্কি ছিল বটে, কিন্তু সেকালে এখনকার মত পথের দু’ধারে ডাক-বাংলো ছিল না। ফলে রাস্তায় রাত্রিবাসের কোন ব্যবস্থাও ছিল না। তখনকার দিনে দূরে কোথাও যেতে হলে অন্ততঃ পনের দিন আগেই পোস্টমাস্টারকে চিঠি লিখে জানাতে হত। তিনি সেই চিঠি পেয়ে তবেই রান্নার সরঞ্জাম, বাবুর্চি, খানসামা, পাল্কিবাহক ইত্যাদি যোগাড় করতেন। ফলে দূরে কোথাও যেতে হলে অনেক টাকা লাগত। তাই এতকাণ্ড করে তখন পরের ঘরের পরের মেয়েকে নিয়ে পালানো রীতিমত অসম্ভব ছিল।
‘কিনকেয়াড’ অনেক চেষ্টায় সেদিনের বহু কাহিনী সংগ্রহ করে পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর ‘বৃটিশ সোস্যাল লাইফ ইন ইণ্ডিয়া’ গ্রন্থে কিনকেয়াড আঠারো ও ঊনিশ-শতকীয় ভারতের বিভিন্ন জায়গার ইংরেজদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাণ্ডকারখানার বহু কাহিনী উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর নিজের পরিবার বৃটেন থেকে দু’পুরুষ আগে ভারতে এসেছিল, ফলে পারিবারিক সূত্রেও তিনি বহু তথ্য জানতে পেরেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন যে, তখন ইঙ্গ-ভারতীয় বিবাহের ব্যাপারে মাদ্রাজ কলকাতার চেয়েও বহুদূর এগিয়ে ছিল। বিলেতের কাউন্সিলও সেই বিবাহের জন্য সর্বদাই উদ্বিগ্ন বোধ করত। তবে ওই উদ্বেগের কারণ কেবলমাত্র ইঙ্গ-ভারতীয় বিবাহই ছিল না। তাঁরা কোন ইংরেজের ভারতীয় কন্যার পাণিগ্রহণ সহ্য করতে পারলেও, প্রোটেস্ট্যান্ট ইংরেজদের ক্যাথলিক বিবাহে অসহ্য বোধ করতেন। সেই কারণেই ইঙ্গ-ফরাসী বিবাহেও তাঁদের আপত্তি ছিল। তাই বাধ্য হয়ে বিলেতের কাউন্সিল একবার নির্দেশ দিয়েছিল যে, ভবিষ্যতে ভারতের খৃস্টান নাগরিকদের বিবাহের ব্যাপারে আগে থেকেই সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। তখন কেবল ছেলে-ছোকরার দলই যে ইউরোপীয় মহিলাদের সঙ্গে ভাব জমাবার জন্য চেষ্টা করতেন - এমন নয়। বয়স্করাও সেই ব্যাপারে বেশ পারদর্শী ছিলেন। কলকাতায় চার্চ স্থাপিত হওয়ার আগে প্রতি রবিবার সকালে কাস্টমস অফিসে ধর্মানুষ্ঠান হত। তাই রবিবার সকালে সবাইকে সেখানে উপস্থিত থাকতে দেখা যেত। হয়ত আগের দিন, অর্থাৎ শনিবার রাত্রে অত্যধিক খানাপিনার ফলে কারো পেটের যন্ত্রণা, অথবা অধিক রাত্রি পর্যন্ত উদ্দাম নৃত্যের ফলে শরীর ক্লান্ত - কিন্তু তবুও রবিবার ভোরে শরীরের সব প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে পুরুষের দল সেখানে হাজির হতেন। তাঁরা খুব ভোরেই উপস্থিত হতেন, অন্যথায় ভালো জায়গা পাওয়া যেত না। ইংরেজ মহিলারা সেখানে পাল্কি চেপে, ধীরগমনে আসতেন। তারপরে কাস্টমস-অফিসের সামনে তাঁদের পাল্কি থামা মাত্র - আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান - প্রতিযোগিতা পড়ে যেত। তখন কোন পাল্কি এসে দাঁড়ালেই, সেখানে ঈষৎ নতজানু হয়ে ভদ্রমহিলাকে সম্মান দেখিয়ে হাত ধরে তাঁকে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনা ও সযতনে হাত ধরে তাঁকে প্রার্থনা সভার কোন এক জায়গায় বসিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। আর মাত্র এইটুকুতেই সবাই কৃতার্থ বোধ করতেন। খাঁটি ইংরেজ ললনার নরম হাতের একটু পরশ পাওয়ার লোভে সবাই ভোর থেকে সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। নবাগতা কোন মহিলা এলে তাঁরা অনেক দুঃসাহস সাহস করে তাঁর দিকে এগিয়ে যেতেন, এবং নিয়ম-মাফিক আত্মপরিচয় দিয়েই তাঁর হস্তধারণ করতেন। কিন্তু তখনকার ইংরেজ রমণীরা যদিও স্বামী ধরতেই এদেশে আসতেন, তবুও যে কেউ এগিয়ে গিয়ে তাঁকে হাত ধরে নামলে, সেটাকে বেয়াদপি বলে গণ্য করা হত। ফলে অনেকেই নবাগতা মহিলাদের হাত ধরতে গিয়ে দু’-একটা চড়-চাপড়ও খেতেন, এছাড়া কটু মন্তব্যও শুনতে হত। কিন্তু সেসব কেউই গায়ে মাখতেন না। তখন কলকাতা কাস্টমস অফিসে সবচেয়ে নিয়মিতভাবে বুড়োরা হাজিরা দিতেন; তাঁদের কেউ মার্চেন্ট, তো কেউ পদস্থ কর্মচারী ছিলেন। নিজেদের প্রায় সারাটা জীবন তাঁরা দেশী মেয়ে দেখেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে হয়ত তাঁদের ভরসা ছিল যে, একদিন ব্যবসাতে প্রচুর পয়সা হবে, চাকরিতে পদোন্নতি হবে। তখন জুড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে তাঁরা ইউরোপীয় মেয়েদের তাক লাগিয়ে দেবন। কিন্তু শেষপর্যন্ত যেদিন তাঁদের ব্যবসায়ে অর্থের পরিমাণ বিপুল হয়েছিল, চাকরিতে উন্নতি ঘটেছিল, ততদিনে তাঁদের যৌবন বিদায় নিয়েছিল। হোমের সঙ্গে তাঁদের সম্বন্ধ বহুকাল আগেই চুকে গিয়েছিল। ফলে সেখানে ফিরে গিয়ে নতুন করে সমাজের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে তাঁদের পক্ষে সংসার পাতানো আর সম্ভব ছিল না। কাজেই তাঁরা হা-পিত্যেশ করে তখনকার কাস্টমস হাউসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। শ্রীমতী ‘গোল্ডবর্ন’ তাঁদের, - “দে আর চিফলী ওল্ড ফেলোজ” - বলেছিলেন (Hartley House, Sophia Goldburne)। কিন্তু সেই পদস্থ ধনবান ব্যক্তিদের শিকার করতেই তখন বছর বছর বিলেতের বাপ-মায়ের দল ইণ্ডিয়ায় তাঁদের বিবাহযোগ্যা মেয়েদের পাঠাতেন। তাদের পরিষ্কার বক্তব্য ছিল যে, পাত্রের টাকা পয়সা আর মান-সম্মান থাকলেই হোল, চুলে পাক ধরলেই কি বাইবেল অশুদ্ধ হয়ে যাবে!
যেমন তখনকার ইউরোপীয় চার্চের নৈতিক পরিবেশ ছিল, তেমনি সেদিনের পাদ্রী ছিলেন। যেটাকে বলে সোনায় সোহাগা। ‘হিকি’ তাঁর স্মৃতিগ্রন্থে ‘মিঃ ব্লান্ট’ নামধেয় একজন পাদ্রীর কথা লিখেছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর পাদ্রী ছিলেন, এবং তিনি নামে ও কাজে সত্যিই ‘ব্লান্ট’ ছিলেন। হিকি লিখেছিলেন, “এই অসভ্য ছোকরা পাড় মাতাল হয়ে থাকত। আর সেই ঘৃণ্য অবস্থাতেই সৈনিক ও নাবিকদের সম্মুখে হাজির হত, তাঁদের মধ্যে একেবারে দিগম্বর হয়ে ছোটাছুটি করত। আর সেসবের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর মুখ দিয়ে সব রকমের অশ্লীল অশালীন বাক্য, বা নোংরা রুচি- বিগর্হিত গান বের হত। ফলে সবাই তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত।” যিনি উপাসনাকালে পুরোহিতের পবিত্র কার্যসম্পাদনের দায়িত্ব নিতেন, তাঁর নৈতিক চরিত্র যদি এই হয়, তবে তাঁর অনুগামী সমাজের নীতিবোধ তখন যে কতটা দুর্বল ছিল, সেটা সহজেই অনুমেয়। এমনিতেও সেদিনের সমাজব্যবস্থাই শিথিল-নিবদ্ধ ছিল। বিলেতের আইন-কানুন তো দূরের কথা, সেদেশের নৈতিক মূল্যবোধের কোন গুরুত্বও এদেশে ছিল না। কোম্পানির লণ্ডনস্থ কোর্ট সবই টের পেত, মাঝে মাঝেই তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কড়া নোট পাঠাত। কিন্তু সেই কাগজের লেখা কাগজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যেত। যে সরিষার সাহায্যে ভূত ছাড়ানো হবে, সেই সরিষার মধ্যেই তখন ভূতের বাসা ছিল। কলকাতার যখন পত্তন ঘটেছিল সেই তখন থেকেই ঐসব ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল। কলকাতার প্রথম ইংরেজ গভর্নর ‘জোব চার্নক’ স্বয়ং একজন হিন্দু বিধবাকে বিবাহ করেছিলেন বলে জানা যায়। অবশ্য তাঁর প্রেমে কোন খাদ ছিল না। আর আঠারো শতকে সর্বাধিককাল ধরে যিনি গভর্নর-জেনারেলরূপে বৃটিশ-ভারত শাসন করে গিয়েছিলেন, যাঁর হাতে চরিত্র-নীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সব কিছুর ভার দিয়ে কোম্পানির ডিরেক্টররা লণ্ডনে বসে থাকতেন, সেই ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রী ছিলেন ‘মিসেস ইমহফ’। জার্মান চিত্রকর ইমহফ, সস্ত্রীক জাহাজে করে ভারতে এসেছিলেন, হেস্টিংসও সেই জাহাজের যাত্রী ছিলেন।
তারপরে যা ঘটেছিল, সেই করুণ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বহুবার হয়েছে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত শিল্পী ইমহফ, নিজের চোখের জলকে সম্বল করে তাঁর স্ত্রীকে গভর্নর জেনারেলের হাতে সমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে হেষ্টিংস পরবর্তীকালে কোনদিনই তাঁর স্ত্রীর প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করেননি, বরং স্ত্রীকে সুখী করবার জন্য তিনি সর্বপ্রকারের চেষ্টা করেছিলেন। তখন সপারিষদ গভর্নর জেনারেল ছাড়া বাইরে যেসব টম-ডিক-হ্যারির দল পড়ে ছিলেন, তাঁদের কাছে খুব উন্নত মানের নীতিবোধ নিশ্চই আশা করা যায় না। ভারতের অপরিমেয় ধনৈশ্বর্যের কথা যখন সাগর পারে গিয়ে পৌঁছাতে শুরু করেছিল, তখন সেখানকার বাপ-মায়ের দল তাঁদের বিবাহযোগ্যা কন্যাদের ভাবী-সৌভাগ্যের কথা বিবেচনা করে ভারতে পাঠাতে শুরু করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। আঠারো শতকের শেষদিকে যেসব ইংরেজ ললনা এদেশে এসে ইউরোপীয় সোসাইটিতে বেশ একটু আলোড়ন তুলেছিলেন, তাদের মধ্যে ‘মিস ক্রুটেনডেন’, ‘মিস এমা র্যাংহাম’ ইত্যাদির নাম অনেকেই উল্লেখ করেছেন। ‘মিস ক্রুটেনডেন’ হিকির আমলের কলকাতার ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন। হিকিরই এক বন্ধু ‘বব পট’কে তিনি শেষপর্যন্ত বিবাহ করেছিলেন। তবে তার আগে তিনি অন্ততঃ চারজন কভেন্যান্টেড অফিসারের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছিলেন; এবং একের পর এক ডিভোর্স করে তাঁদের চারজনকেই বিবাহ করেছিলেন। বব পট তাঁর পঞ্চম স্বামী ছিলেন।
মিস এমা র্যাংহাম, একালে রোম্যান্টিক নায়িকা বলতে যা বোঝায়, সেটা ছিলেন। তাঁর কথা প্রসঙ্গে হিকি লিখেছিলেন, “চমৎকার ধারালো মেয়ে। যাঁকে সুন্দরী বলে ঠিক তা নয়, কিন্তু দেহের গড়নে ও চাল-চলনে একেবারে অসাধারণ। অত্যধিক চতুর, অতিশয় বুদ্ধিমান তাঁর স্বভাবই তাঁকে উচ্ছৃঙ্খলতা ও ভুলের দিকে বার বার ঠেলে দিয়েছে। মেয়েরা সাধারণতঃ যেভাবে ঘোড়ায় চাপে, সেভাবে না বসে পুরুষের মত সদর্পে সে ঘোড়ায় চড়ত। নির্দ্বিধায় ঘোড়ার পিঠ থেকে এমন ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত ঝোপের বা খালের মধ্যে যা অতি পাকা খেলোয়াড়ের পক্ষেও সাহস করা সম্ভব নয়। ঘোড়ায় চেপে সে প্রতিযোগিতায় নামত, এবং বহু ক্ষেত্রে সেরা জকিকেও হারিয়ে দিয়েছে। বন্দুক চালাতেও মেয়েটির হাত ছিল পাকা। পাখি শিকারে খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁর গুলি ব্যর্থ হয়েছে। মুষ্টিযুদ্ধের আধুনিক প্যাঁচের কথাও তাঁর অজানা ছিল না। কেউ যদি কখনো সামান্যতম অসম্মানকর ব্যবহার করেছে তো তাঁকে বিনা দ্বিধায় ঘুষি মেরে ভূমিসাৎ করতেও সে বিলম্ব করত না। এক কথায় সে নিজ খুশিমত চলত।” এহেন গুণ্ডা মেয়ে এমা র্যাংহামের সঙ্গে আলাপ জমাবার জন্য সারা ভারতের উচ্চ-নীচ সর্বশ্রেণীর ইংরেজরা তখন পাগল হয়ে উঠেছিলেন। ওই সময়ে তাঁর কথা শোনেনি বা আলোচনা করেনি, এমন কেউ ভারতে ছিলেন না। কেউ তাঁকে পেশোয়ারে দেখেছিলেন, তো কেউ লক্ষ্ণৌতে, তো কেউ আবার দিল্লীতে। এমা অন্ততঃ চারজনের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে শেষপর্যন্ত ‘জন ব্রিস্টো’কে বিবাহ করেছিলেন। ১৭৮১ সালে এমার জন্মদিনে ‘রাজা নবকৃষ্ণ দেব’ তাঁর বাড়িতে নাচের আয়োজন করেছিলেন, এবং সেই উৎসবের শেষে তিনি এমাকে তাঁর মুখচন্দ্রিমার আলোকে তাঁর গৃহ আলোকিত করবার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
উইলিয়ম হিকি যেমন তাঁর স্মৃতিগ্রন্থে, ‘অগাস্টাস হিকি’ তেমনি তাঁর গেজেটে উৎসাহসহকারে তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজের ওই সব কেচ্ছা-কাহিনী ছেপেছিলেন। তখনকার অনেক সংবাদপত্রের রেওয়াজ ছিল যে, একের সঙ্গে অপরের কোন অবৈধ প্রণয় ঘটলেই পরোক্ষে তাঁর প্রতি কখনো কবিতায়, তো কখনও বাঁকা গদ্যে কটাক্ষ করা হত। তবে কারো নাম সরাসরিভাবে কাগজে উল্লেখ করা হত না। ওই সময়ে প্রত্যেক বিখ্যাত ব্যক্তির জন্যই একটি করে ছদ্মনাম ব্যবহৃত হত। কিন্তু সংবাদপত্রের পাঠক-পাঠিকা ও উদ্দিষ্ট ব্যক্তি উভয়েই বেশ বুঝতে পারতেন যে, কার প্রতি অন্তরাল থেকে এই শরক্ষেপণ করা হচ্ছে। উদাহরণ: “Public Notice:- Lost on the course, last Monday evening, Buxey Clumsy’s heart, whilst he stood simpering at the footstep of Hookah Turban’s carriage …” মিস এমা র্যাংহামকে ‘বেঙ্গল গেজেটের’ বিভিন্ন সংখ্যায় “চুঁচরা-কন্যা’, ‘পাগড়ি বিজয়ী’, বা ‘হুঁকা-পাগড়ি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। কলকাতার কাউন্সিলে হেস্টিংসের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ফ্রান্সিস’ ভারত থেকে চলে যাওয়ার পরে তাঁর এক বন্ধু ‘লিভিউস’কে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। তাঁর একটি চিঠি থেকে জানা যাইব যে, ওই সময়ে এমা র্যাংহামের পাণিগ্রহণের জন্য ফ্রান্সিসের অন্ততঃ চারজন পুরুষ ব্যস্ত ছিলেন। “If you have literally married the Wrangham, or if Mackenzie should have married her, or Collings or Archdekin.” সেই সময়ের আরেক বহুবল্লভা হতভাগিনী ছিলেন ‘বেগম জনসন’। উক্ত ভদ্রমহিলা খাঁটি ইংরেজ ছিলেন না, তাঁর গায়ের রঙ কালো ছিল; তাঁর মা হয় পর্তুগীজ অথবা পর্তুগীজ বংশোদ্ভবা ছিলেন। তাঁর বাপ ঠাকুরদা উভয়েই ভারতে বিবাহ করেছিলেন। সেসবের জন্যই তাঁকে মিসেস না বলে সবাই আড়ালে ঠাট্টা করে ‘বেগম’ বলে সম্বোধন করতেন। এহেন ‘বেগম’ কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে মেলামেশা করতেন না। তিনি কেবল ইউরোপীয়ানদেরই সঙ্গদান করতেন। আর তাঁর বাড়িতে সন্ধ্যায় আড্ডা না জমালে ইউরোপীয়রা তাঁদের সারা দিনকেই ব্যর্থ বলে মনে করতেন। কারণ সেই সময়ের কলকাতায়, পরনিন্দা-পরচর্চার অমন উপভোগ্য কেন্দ্র আর দ্বিতীয়টি ছিল না। যেদিন আলোচনার জন্য কিছুই থাকত না, সেদিনও গৃহস্বামিনীর গাত্রবর্ণ ও বংশ-পরিচয় নিয়ে লঘু পরিহাস করেও কিছুটা সময় কাটানো যেত। তবে বেগম জনসন সত্যিই হতভাগিনী ছিলেন। মাত্র চার বছরের মধ্যে তিনি দু’বার বিধবা হয়েছিলেন, তারপরে তিনি ‘ওয়াটস’কে (ক্লাইভের ডান হাত) বিবাহ করেছিলেন, তাঁর চতুর্থ স্বামী ছিলেন ‘রেভারেণ্ড উইলিয়ম জনসন’। শেষোক্ত জনের নাম কেউ বেগমের ঘরে বসে তাঁর সামনে উচ্চারণ করতেন না, কারণ রেভারেণ্ড হলেও তিনি বিনা নোটিশে বেগমকে ছেড়ে ১৭৮৮ সালে বিপুল ধনসম্পদ সহ ইংল্যাণ্ডে পাড়ি দিয়েছিলেন। বেগম কিন্তু তারপরেও দীর্ঘ চব্বিশ বছর বেঁচেছিলেন। তখন নিজের আগের স্বামীদের (জনসন ছাড়া) গৌরবময় কাহিনী রোমন্থন করেই তাঁর সময় কাটত। তাঁরই নাতি ‘লর্ড লিভারপুল’ একটা সময়ে ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, এবং সেই সংবাদ শোনার পরে আনন্দের সঙ্গেই তিনি মারা গিয়েছিলেন।
এবারে আরেকজনের কথা বলে এই প্রসঙ্গ শেষ করা যাক। তাঁর নাম ছিল ‘মিস স্যাণ্ডার্সন’। এমা র্যাংহামের ঠিক আগে তিনিই সর্বজনের মানসী, হৃদয়সুন্দরী ছিলেন। ইউরোপীয় পুরুষদের নিয়ে তিনি পুতুল খেলতেন বললেও কম কিছু বলা হয়। একবার গভর্নমেন্ট হাউসে বল-নাচের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে মিস স্যাণ্ডার্সন ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি নিজে এক বিশেষ ধরনের পোশাকের পরিকল্পনা করেছেন। সেই বিশেষ পোশাক পরে যাঁরা তাঁর সঙ্গে নাচতে রাজি হবেন, তাঁদেরই একজনকে তিনি বিয়ে করবেন। তৎক্ষণাৎ ষোল জন প্ৰণয়ী তাঁদের আস্তিন গুটিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের সবাই তাঁর প্রস্তাবে রাজি ছিলেন। সেটি ছিল সবুজ রঙের একটি পোশাক, তার মধ্যে গোলাপি রঙের সিল্কের পট্টি দেওয়া, আর স্থানে অস্থানে চুমকি বসানো ছিল। মিস স্যাণ্ডার্সন সবাইকে তাঁর সঙ্গে নাচবার সুযোগ দিয়েছিলেন। কেউ তাঁর সঙ্গে ফরাসি কায়দায় কোটিলো, তো কেউ রীল, তো কেউ আবার গ্রাম্য-নাচ নেচেছিলেন। তারপরে সেই ষোলজন প্রণয়ী দরজার বাইরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শ্রীমতী ধীরপায়ে এসে পাল্কিতে চড়েছিলেন। আর ওই ষোল জন প্ৰণয়ী মার্চ করে পাল্কির দু’পাশে গার্ড-অব-অনার দিয়ে তাঁকে তাঁর বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। “We gravely attended her home, marching by the side of her palankeen, regularly marshalled in procession of two and two.” কিন্তু একসাথে ষোলজনকেই তো আর বিবাহ করা চলে না। তাই মিস স্যাণ্ডার্সন তাঁদের মধ্যে থেকে একজনকে বিবাহ করেছিলেন। সেই ভাগ্যবানের নাম ছিল ‘রিচার্ড বারওয়েল’; যিনি সর্বদাই হেস্টিংসকে কাউন্সিলের সভায় সমর্থন করতেন এবং ফ্রান্সিসের আক্রমণ থেকে বাঁচাতেন।
আসল কথা যে, তখনকার জগৎটাই ছোট ছিল। দূরত্বের জন্য তখন হোমের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষা করা যেমন শক্ত ছিল, তেমনি আবার নেটিভদের সঙ্গেও বেশি মেলামেশা করা সম্ভব ছিল না। আর এই গরম দেশে, ইউরোপীয়দের জীবনটাই তখন ‘নলিনীদলগতজলম’ ছিল। কখন যে কার মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে, সেটার কোন ঠিক ছিল না। চার্বাকপন্থাই তখন জীবনের নীতি ছিল - ‘যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’। আমোদ-প্রমোদ বলতে ছিল কেবলমাত্র পরচর্চা আর পরের কেচ্ছা রোমন্থন। তখন একটু ভালো পোশাক পরে রাস্তায় বের হলে আর রেহাই ছিল না, অমনি আড়ালে আলোচনা শুরু হয়ে যেত। আর কারো মেয়েকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে সান্ধ্য বায়ু সেবন করলেই লোকে ধরে নিতেন যে, সেই ছেলেটির সঙ্গে ওই মেয়েটির বুঝি ‘ইয়ে’ রয়েছে। বেকন তাঁর কলকাতার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাতেই ব্যাপারটা টের পেয়েছিলেন। তাঁর গৃহস্বামীর মেয়ে ‘ম্যাটিল্ডা’কে নিয়ে সন্ধ্যায় গাড়ি চেপে তিনি বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। নিছক বেড়ানো ছাড়া তাঁর আর কোন মতলব ছিল না। কিন্তু পরদিনই এক ইংরেজ ভদ্রলোক অকারণে তাঁকে পথের ধারে ধরে বিবাহের জন্য ‘কনগ্রাচুলেশন’ জানিয়েছিলেন! বেকন অবাক হয়েছিলেন। তার পরদিন পিওন এসে গৃহস্বামীর হাতে একটি চিঠি দিয়ে গিয়েছিল, তাতে লেখা ছিল - “নবাগত যুবকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন ভাল, কিন্তু তার আগে একটু ভেবে দেখবেন।” গৃহস্বামী সেই চিঠি পড়ে চটে আগুন হয়ে বেকনকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ব্যাপার কি? তোমাদের দু’জনের মধ্যে সত্যিই কি বিয়ের কোন কথা হয়েছে? তোমরা একদিনে এতদূর এগিয়েছ, অথচ ...” গৃহস্বামী বেকনকে চিঠিটি দেখিয়েছিলেন। বেকনও তাঁর পকেট থেকে একটি চিঠি বের করেছিলেন, যাতে তাঁকে বিবাহের জন্য কনগ্রাচুলেশন জানানো হয়েছিল। এরপরে গৃহস্বামী সেই দুটি চিঠিকে পাশাপাশি রেখে ব্যাপারটি বুঝেছিলেন, এবং বলেছিলেন, “বৎস, ভবিষ্যতে আর কোনদিন আমার মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে চেপে বের হবে না। ভারতে এটা রুচিবিগর্হিত ব্যাপার। ভবিষ্যতে যদি এমনটি করো তো ম্যাটিল্ডার আর কোনদিন বরই জুটবে না।” (“Why don’t you know, my dear fellow that carting a girl or riding out with her is considered in India as a regular publication of the banns, just as good as having them asked in an English Church, faith you must not do so in future or Matilda will never get a husband.”)
‘
যে কারণে তিব্বত কে নিষিদ্ধ দেশ বলা হয়
হিমালয়ের উত্তরে অবস্থিত ছোট একটি দেশ তিব্বত। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ দালাইলামা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গণচীনের একটি সশাসিত অঞ্চল তিব্বত। এই অঞ্চলটি চীনের অংশ হলেও এখানকার অনেক তিব্বতি এই অঞ্চলকে চীনের অংশ মানতে নারাজ।
১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিরা স্বাধিকার আন্দোলন করলে সেটি ব্যর্থ হয়। তখন দালাইলামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গোবি মরুভূমি। মরুভূমির নিষ্ঠুর ও কষ্টদায়ক পরিবেশ এসব এলাকার মানুষকে কাছে আনতে নিরুৎসাহিত করে। তিব্বতের বেশিরভাগ ভূ-ভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০০০ ফুটেরও ওপরে অবস্থিত হওয়ায় সেখানে বসবাস করা পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের চেয়ে একটু বেশি কষ্টকর। এই অঞ্চলগুলো এতই উঁচু যে, একে পৃথিবীর ছাদ বলা হয়ে থাকে। তিব্বতের স্থলভাগ বছরের প্রায় আট মাস তুষারে ঢেকে থাকে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই তিব্বতকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে অনেক রহস্য। তিব্বতের রাজধানী লাসা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল অনেক আগে থেকেই। লাসায় বহির্বিশ্বের কোনো লোকের প্রবেশাধিকার ছিল না। দেশটি পৃথিবীর অন্য সব অঞ্চল থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিল।
তিব্বত বা লাসায় বাইরের বিশ্ব থেকে কারও প্রবেশ করার আইন না থাকায় এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে সবার কাছে একটি রহস্যময় জগৎ হিসেবে পরিচিত ছিল। কী আছে লাসায়, সেটা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত সমগ্র বিশ্ব। লাসার জনগোষ্ঠী, শহর, বন্দর, অট্টালিকা সব কিছুই ছিল সবার কাছে একটি রহস্যঘেরা বিষয়। লাসা নগরীতে ছিল বিখ্যাত পোতালা নামক একটি প্রাসাদ। এই প্রাসাদটি প্রথমবারের মতো বহির্বিশ্বের মানুষেরা দেখতে পায় ১৯০৪ সালে। আমেরিকার বিখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় এই বিখ্যাত অট্টালিকার ছবি ছাপা হয়। তিব্বতের চতুর্দিকে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পাহাড় ও গুহা। সেই পাহাড়ি গুহাগুলোতে বাস করে বৌদ্ধ পুরোহিত লামারা।
তিব্বতিরা অত্যান্ত ধর্মভীরু । তাদের প্রধান ধর্মগুরুর নাম দালাইলামা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তিব্বতে লামা নামে পরিচিত। লামা শব্দের অর্থ সর্বপ্রধান, আর দালাই শব্দের অর্থ জ্ঞান সমুদ্র। অর্থাৎ দালাইলামা শব্দের অর্থ হচ্ছে জ্ঞান সমুদ্রের সর্বপ্রধান। ধর্মগুরু বা দালাইলামা বাস করে সোনার চূড়া দেওয়া পোতালা প্রাসাদে। ১৩৯১ সালে প্রথম দালাইলামার আবির্ভাব ঘটে। দালাইলামাকে তিব্বতিরা বুদ্ধের অবতার মনে করে থাকে। তিব্বতিদের বিশ্বাস, যখনই কেউ দালাইলামার পদে অভিষিক্ত হয় তখনই ভগবান বুদ্ধের আত্মা তার মধ্যে আবির্ভূত হয়।
তিব্বতের লামারাসহ সাধারণ মানুষেরাও প্রেতাত্মাকে খুবই ভয় পায়।, মানুষের মৃত্যুর পর দেহের ভেতর থেকে প্রেতাত্মারা মুক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। ওই প্রেতাত্মার লাশ সৎকার হওয়ার আগ পর্যন্ত সে মানুষের ক্ষতি করার জন্য ঘুরে বেড়ায়। প্রেতাত্মাদের হাত থেকে বাঁচতে ও প্রেতাত্মাদের খুশি রাখতে তিব্বতিরা পূজা করে থাকে।
তিব্বতিদের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আচার হলো মৃতদেহের সৎকার। এদের মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতি খুবই অদ্ভুত। কোনো তিব্বতি যদি মারা যায়, তবে ওই মৃতদেহ কাউকে ছুঁতে দেওয়া হয় না। ঘরের এক কোণে মৃতদেহটি বসিয়ে চাদর অথবা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। মৃতদেহের ঠিক পাশেই জ্বালিয়ে রাখা হয় পাঁচটি প্রদীপ। তারপর পুরোহিত পোবো লামাকে ডাকা হয়।
পোবো লামা একাই ঘরে ঢোকে এবং ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দেয়। এরপর পোবো মন্ত্র পড়ে শরীর থেকে আত্মাকে বের করার চেষ্টা করে। প্রথমে মৃতদেহের মাথা থেকে তিন-চার গোছা চুল টেনে ওপরে আনে। তারপর পাথরের ছুরি দিয়ে মৃতদেহের কপালের খানিকটা কেটে প্রেতাত্মা বের করার রাস্তা করে দেওয়া হয়। শবদেহকে নিয়ে রাখে একটা বড় পাথরের টুকরোর ওপর। ঘাতক একটি মন্ত্র পড়তে পড়তে মৃতদেহের শরীরে বেশ কয়েকটি দাগ কাটে। দাগ কাটার পর একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে সেই দাগ ধরে ধরে মৃতদেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। তারপর পশুপাখি দিয়ে খাওয়ানো হয়।
খাবার- দাবারের ও রয়েছে যথেষ্ট ভিন্নতা । শুনলে অবাক হবেন উকুন তিব্বতিদের অতি প্রিয় খাবার। ভেড়া, ছাগল ও ঘোড়া পালন তাদের প্রধান জীবিকা। চীনা ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে তিব্বতিরাও ভীষণ চা প্রিয়। তাদের বিশেষ চায়ে মেশানো হয় মাখন এবং লবণ। তবে তিব্বতিদের প্রধান খাবার হলো চমবা। গম এবং যবকে ভেজে পিষে চমবা তৈরি করা হয়।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিকের স্বপ্ন!
প্রাথমিক শিক্ষার স্তর কত দূর পর্যন্ত হবে, সে তর্ক শেষ হয়নি। পাকিস্তান আমলে এটা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ছিল। পঞ্চাশের দশকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করা হয়। তখন থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে তোলার সুপারিশ এসেছে। কত বছরের প্রাথমিক শিক্ষা যথাযথ, তা নিয়ে পৃথিবীতে মতভেদ আছে। ভারতে তা অনেক আগে থেকেই আট বছর মেয়াদি। অস্ট্রেলিয়ায়ও আট বছর। কিন্তু চীনে ছয় বছর। শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিসর, জাপানেও তা–ই। ওদিকে পাকিস্তানে এখনো আমাদের মতোই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। আলজেরিয়া, ব্রাজিল, ফিনল্যান্ড, রাশিয়া, সুইডেনে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর নবম শ্রেণি পর্যন্ত।
কিছু বিখ্যাত ব্যাক্তিদের বাণী
* উদীয়মান সুর্যের দিকে যার চোখ নেই, সে-ই ডুবন্ত তারার কথা বলে থাকে-
* নতুন দিনই নতুন চাহিদা ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়- জন লিভেগেট
* যেখানে পরিশ্রম নেই সেখানে সাফল্য ও নেই-উইলিয়াম ল্যাংলয়েড
* গুণমন হইলেই মানে সব ঠাঁই, গুণহীনে সমাদর কোনখানে নাই-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
* আমি তোমাকে সোনা কিম্বা রূপা দেইনি কিন্তু তার চেয়েও মুল্যবান জিনিস বই দিয়েছি-জর্জ ম্যাকডোনাল্ড
* অতি নির্বোধও অত্যাচারের প্রতিবাদ করে-সুইনবান
* যে প্রেমিক কান্ড জ্ঞানের পরিচয় দেয়, সে মোটেই প্রেমিক নয় - নর্মান ডগলাস
* দৃঢ় বিশ্বাস, অনবরত প্রচেষ্টা এবং বিশ্বজয়ী প্রেম-জীবনযুদ্ধ এই হলো মানুষের হাতিয়ার-আল্লামা ইকবাল
* দুঃখের ব্যথা-বেদনা থেকে বাঁচতে হলে কাজের ভিতর দিয়ে বাঁচতে হবে-জি, এইচ, লিউএস
* কর্মব্যস্ত লোকের জীবনে স্বপ্ন বলে কিছু থাকে না-ডব্লিউ জি বেনহাম
* প্রতিভাবানদের জন্য স্মৃতিশক্তি হচ্ছে এক অমূল্য সম্পদ -জে, এফ, নিসবেট
* নীরব থাকলে ভালো না হোক ক্ষতির সম্ভাবনা খুব কম-রিচার্ড বার্থওয়েট
* অতিরিক্ত চাহিদাই মানুষের পতনকে ডেকে আনে-রবার্ট বার্টন
* অলংকারের সাহায্যে সৌন্দর্য বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে প্রকৃত সৌন্দর্যকে লুকিয়ে রাখা-এডিলা মূরগ্যান
* পৃথিবী আমার দেশ, সমগ্র মানব জাতি আমার ভাই এবং মানুষের মঙ্গল কামনা করাই আমার ধর্ম-টমাস পাইন
* দুষ্টু লোকেরা তাদের গড়া নরকেই বাস করে-টমাস কুলার
* মায়ের শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের বুনিয়াদ-নেপোলিয়ন
* যে আশা করে সেই ভুগে আর যে ভুল করে সে সাহসী হয়-হুইটিয়ার
* দেহকে শক্তিশালী করে তোল, তবে সে মনের নির্দেশ মেনে চলবে-জন লক
* যে পরিশ্রমী সে অন্যের সহানুভূতির প্রত্যাশী নয়-এডমণ্ড বার্ক
* জ্ঞানী পুত্র পিতার আনন্দ বর্ধন করে কিন্তু নির্বোধ পুত্র মাতার কষ্টের কারণ-হযরত সোলায়মান (রাঃ)
* সত্যকে ভালবাস, কিন্তু ভুলকে ক্ষমা কর-ভলতেয়ার
* ব্যায়ামের দ্বারা যেমন শরীরের উন্নতি হয়, পড়াশুনার দ্বারা মনেরও তেমনি উন্নতি হয়ে থাকে-এডিসন
* নদীতে স্রোত আছে তাই নদী বেগমান, জীবনে দ্বন্দ্ব আছে তাই জীবন বৈচিত্রময়-টমাস মুর
* দারিদ্রকে যে মাথা পেতে গ্রহণ করে, সে ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ-লংফেলো
* অবাধ্য বউ যার, জীবন তার দূর্বিসহ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
* তোমার জীবনের প্রতিটি আনন্দঘন মহূর্তের দাম লক্ষ টাকা-জন বেল
* একজন অল্প বয়স্কা তরুণী, বউ হিসাবে অথবা মা হিসাবে কোনটাতেই ভাল নয়-জন এডামস
* যার অল্প আছে সে দরিদ্র নয়, যে বেশি আশা করে সে-ই দরিদ্র-ডানিয়েল
* গর্ব না করাই গর্বের বিষয় বড় হয়েও নিজেকে ছোট মনে করা গৌরবজনক-প্লেটো
* কিছু কিছু গোপনীয়তা রক্ষা না করে চললে কোন বন্ধুত্ব অটুট থাকে না -ডব্লিউ এস ল্যান্ডার
* প্রতিটি মানুষ চাঁদের মতো, যার একটা অন্ধকার দিক আছে যে দিবসে কাউকে দেখতে চায়না-মার্ক টোয়াইন
* একটি কাজের জন্য পুরষ্কার পাওয়ার মানেই আরেকটি কাজে হাত দেওয়ার উৎসাহ লাভ করা-হেনরী ক্লে
ঠগী: উপমহাদেশের এক ভয়ঙ্কর খুনী সম্প্রদায়
ঠগ একটি সংস্কৃত শব্দ যা থেকে ঠগী শব্দটি উদ্ভূত। শাব্দিকভাবে এর অর্থ ধোঁকাবাজ, প্রতারক। বাংলা অভিধানে ঠগী বলতে বিশেষ শ্রেণীর এক দস্যু দলকে বোঝায় যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে হত্যা করে। ঠগীরা ছিল ভারতবর্ষের একটি বিশেষ শ্রেণীর খুনী সম্প্রদায়। এদের মতন নিষ্ঠুর আর নিপুণ খুনীর দল পৃথিবীতে শুধু নয়, ইতিহাসেই বিরল।
ঠগীরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলাসহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা যত মানুষ হত্যা করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। কেবল ১৮৩০ সালেই ঠগীরা প্রায় ৩০,০০০ মানুষ হত্যা করেছে।
১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে ঠগীদের কথা প্রথম জানা যায়। এই ঠগী শ্রেণীর মানুষেরা উত্তর ভারতে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এরপর বহু শতাব্দী ধরে বংশ পরম্পরায় তাদের এই কর্মকান্ড চালাতে থাকে। এরা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতো, পথে যাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতো। তারপর সময় সুযোগ বুঝে যাত্রীদের মেরে ফেলে সবকিছু লুট করতো। ১৭ আর ১৮ শতকের প্রথম দিকে ভারতের পথিকদের জন্য মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম এই ঠগী।
কিন্তু বাংলায় তাদের আগমন ঘটে ১২৯০ সালের দিকে। ফিরোজ শাহর ইতিহাস গ্রন্থ হতে জানা যায়, ১২৯০ এর সুলতানী শাসনের সময় প্রায় হাজার খানেক ঠগী ধরা পরে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সুলতান তাদের কোনো রকম সাজা না দিয়ে দিল্লীতে ফিরে না আসার শর্তে, অনেকটা আপ্যায়নের সাথে নৌকায় তুলে দিয়ে ভাটির দেশে- তথা এই বাংলায় পাঠিয়ে দেয়। আর তারপর থেকেই বাংলার জলে-স্থলে, মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে পরে এই খুনির দল। বাংলায় ঠগীদের ইতিহাসের সূত্রপাত সম্ভবত এখান থেকেই।
শত শত বছর ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় হারিয়ে যেত অগণিত পথিক। কোথায়, কীভাবে হারাত, জানত না কেউ। কোনো এক জাদুবলে যেন তারা মুছে যেত পৃথিবীর বুক থেকে। কত মানুষ হারিয়েছিল এভাবে? গিনেস বুকের হিসাবে এই সংখ্যা ২০ লক্ষ! নিরীহ পথিকদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যেয়ে হত্যা করে তাদের মালামাল লুট করত যারা- ভারতীয় কিংবদন্তীতে আমরা তাদের ঠগী বলে চিনি।ঠগী ছিল ১৭ আর ১৮ শতকের প্রথম দিকে ভারতের পথিকদের জন্য মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম।
বিভিন্ন ছদ্মবেশে দলবদ্ধ হয়ে শিকারের উদ্দেশ্যে ওত পেতে থাকতো ঠগীর দল
ঠগীরা সবসময় চলত দল বেঁধে। তারা ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রী কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমন করত। এদেরই লোকজন গোপনে বাজার কিংবা সরাইখানা থেকে পথযাত্রীদের সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য যোগাড় করত। তারপর যাত্রীদের সংগে মিশে যেত। যাত্রা বিরতিতে যাত্রীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করত। সহযাত্রীদের সৌহার্দ্য, নিরাপত্তা আর বিশ্বাসের উষ্ণ আমেজে, গরম খাবার খেয়ে পথ চলতি ক্লান্ত যাত্রীরা নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে থাকেন। আর তখনেই আসতো সর্দারের হুকুম। সর্দারের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই যাত্রীদের ওপর ঘটতো নির্মম হত্যাকাণ্ড। একজন যাত্রীকে খুন করত তিনজনের একটি দল। একজন মাথা ধরে রাখত,অন্যজন ফাঁস পরাত, আরেকজন পা চেপে ফেলে দিত। কেউ পালিয়ে গেলেও রক্ষা নেই, ঠগীদের অন্য দলটি কাছেপিঠেই ওত পেতে থাকত।
পথযাত্রীদের বিশ্বাস অর্জন করে বিশ্রামের কথা বলে যাত্রীদেরকে নিজেদের ডেরায় নিয়ে আসতো ঠগীরা
এই ঠগীরা নানা সাঙ্কেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা আদান প্রদান করতো। যেমন- ‘বাসন মেজে আনার কথা’ বলার মধ্য দিয়ে সর্দার তার এক সাঙেতকে কবর তৈরি করার নির্দেশ দিত। ‘ঝিরনী’ শব্দে হত্যার প্রস্তুতি আর ‘তামাকু লাও’ শব্দের মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেয়া হতো। এই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে ফাঁস জড়ানো হতো শিকারের গলায়। যেকোনো সংগঠিত অপরাধী সমাজের মতোই এরূপ নিজস্ব নানা সাঙ্কেতিক ভাষায় ঠগীরা নিজেদের মধ্যে কথা আদান প্রদান করত। গোষ্ঠীভুক্ত না হলে এই সংকেতের পাঠোদ্ধার ছিল অসম্ভব।
বিভিন্ন ভূমিকা আর দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাদারি শ্রম বিভাজনের কাঠামো তৈরি করেছিল ঠগীরা। দলের সদস্যদের খুবই নির্দিষ্ট সব দায়িত্ব ছিল। সর্বাগ্রে থাকতো ‘সোথা’রা। সম্ভাব্য শিকার চিহ্নিত করা, তার সাথে ভাব জমানোর ও শিকার সম্পর্কে নানা তথ্য যোগাড়ের দায়িত্ব থাকতো তাদের ওপর। পুলিশের গতিবিধি নজরে রাখতো যারা তাদেরকে বলা হতো ‘তিলহাই’, তারা দল থেকে খানিকটা পিছনে থাকত। নিরাপদ জায়গা দেখে তাঁবু গড়ার দায়িত্ব থাকত ‘নিসার’দের উপর।
কবর তৈরি করারে দায়িত্ব যার তাকে বলা হতো ‘বিয়াল’। শিকারকে যে ধরে রাখবে তাকে বলা হতো ‘চামোচি’। শিকার যাতে বাধা দিতে না পারে তার জন্য হাত আটকে রাখার দায়িত্ব ‘চুমোসিয়া’র। ‘চুমিয়া’ শিকারের পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে। ‘ভোজারা’ মৃতদেহগুলো কবরে নিয়ে যাবে । ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হলো দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেওয়া। মৃতদেহ পাহারা দেয়া ও বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলা হতো ‘ফুরকদেনা’। আর হত্যাকাণ্ডের জায়গাটা সাফসুতরো করে ফেলার দায়িত্ব ছিল ‘ফুরজানা’দের।
‘ভোজারা’দের দায়িত্ব মৃতদেহগুলো কবরে নিয়ে যাওয়া ও তাদের কবর দেয়া
সদ্য মৃত মানুষদের কবরের ওপর বসত ঠগীদের অমৃতের ভোজ। সে ভোজ আর কিছু নয়, গুড়-মুডি ভোজ। ঠগীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সব ধর্মের লোকই ছিল।
ঠগিদের ফাঁস দেয়ার কৌশল
ঠগীদের খুনের অস্ত্রটা ছিল বেশ অবাক করার মতো। অতি সাধারণ, কিন্তু সাংঘাতিক কার্যকর। এক ফালি হলদে কাপড়ের টুকরো। দুই ভাঁজে ভাঁজ করলে মাত্র ৩০ ইঞ্চি। ১৮ ইঞ্চির মাথায় একটা গিট। তাতে একটা রুপোর কয়েন বা তামার ডবল পয়সা বাঁধা। ঘাতকের হাতে সেটাই হয়ে উঠে অব্যর্থ মরণ ফাঁস।
ঠগীদের সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকার প্রথম জানতে পারে ১৮১২ সালে । সেসময় গঙ্গার ধারে একটি গণকবর পাওয়া যায়। তাতে ৫০টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। তারপরও বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যাচ্ছিল গণকবর। এসময় ব্রিটিশদের বদন্যতায় যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা পায়। ফলে ঠগীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমতে থাকে। কিন্তু পুরোপুরি তাদের মূলোৎপাটন করা যাচ্ছিল না। ব্রিটিশ সরকার ঠগীদের নিমূর্ল করার জন্য উইলিয়াম শ্লিমানকে দায়িত্ব দেয়।
বেঙ্গল আর্মির অফিসার উইলিয়াম হেনরি শ্লিমান ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি দেখলেন, কিছুতেই অন্যান্য দুস্কৃতিকারীদের থেকে ঠগীদের পৃথক করা যাচ্ছে না। ঠগীরা নিপুণ কৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিল। শ্লিমান গুপ্তচর নিয়োগ করলেন, গঠন করলেন বিশেষ পুলিশ বাহিনী ও আলাদা বিচার আদালত। পাশাপাশি ঠগীদের অপরাধস্থল বিশ্লেষণ করে তৈরি করলেন মানচিত্র এবং অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকা তৈরি করলেন যাতে পরবর্তী হত্যার সময়কাল আঁচ করা যায়। নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ সেসব স্থানে পাঠাতে থাকেন।
তারপর ১৮৩০ সালে শ্লিমানের গুপ্তচরদের দক্ষতায় ঠগীরা দলে দলে ধরা পড়তে থাকে। এদের কারো কারো মৃত্যুদণ্ড, কারো যাবজ্জীবন জেল, কারো বা দ্বীপান্তর দিয়ে এদের দমন করতে সক্ষম হন। বাকী যারা ছিল তারা ভয়ে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ফলে ভারতবর্ষ ঠগী মুক্ত হয়।
ঠগীদের জবানবন্দি থেকে খুনের যে হিসাব পাওয়া যায় তা ছিল খুবই মর্মস্পর্শী। ১৯৩৩ সালে উইলিয়াম শ্লিমানের নাতি জেমস শ্লিমানের লেখায় জানা যায়, একজন ঠগী মাসে গড়ে ৮-১০ জনকে খুন করত। সে হিসেবে প্রায় ২০ লক্ষেরও অধিক মানুষ এই ঠগীদের শিকার হয়েছিল বলে অনেক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই। কারণ বাহরাম বলে এক নিষ্ঠুর ঠগীর নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৯৩১ জন মানুষকে সে খুন করেছিল এবং পরবর্তীতে ঐ নাম গিনেস বুক অব রেকর্ডে ওঠে। সে আরেক গল্প।
জেনে নিন সুস্থ থাকতে কতটা ঘুমের প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন সার্বিক সুস্থতার জন্য দিনে ৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু ঘুমের প্রয়োজনও সব বয়সে সমান থাকে না। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ৮ ঘণ্টা ঘুমোলে চললেও, শৈশব ও বয়ঃসন্ধিতে আরও বেশি ঘুমের প্রয়োজন। জেনে নিন কোন বয়সে কতটা ঘুম পর্যাপ্ত।
সদ্যোজাত (০-৩ মাস): দিনে ১৪-১৭ ঘণ্টা
ইনফ্যান্ট (৪-১১ মাস): দিনে ১৪-১৫ ঘণ্টা
টডলার (১২-৩৫ মাস): দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা
প্রি-স্কুলের বাচ্চা (৩-৬ বছর): দিনে ১১-১৩ ঘণ্টা
প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চা (৬-১০ বছর): দিনে ১০-১১ ঘণ্টা
বয়ঃসন্ধি (১১-১৮ বছর): দিনে ৯.২৫ ঘণ্টা
প্রাপ্তবয়স্ক: ৮ ঘণ্টা
৬৫ বছর বয়সের পর ৮ দিনে ৮ ঘণ্টার কম ঘুমোলেও চলে। ক্রমাগত পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ঝুঁকি বাড়ায় ওবেসিটি, হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিসের মতো শারীরিক সমস্যার। কমিয়ে দেয় আয়ুও।
গোপাল ভাঁড়ের রসের হাঁড়ি
বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ স্থান জুড়ে অবস্থান করেন তিনি, রসের হাঁড়ি যেন সত্যিই উপচে পড়ে তার গল্পে। যার নাম নিলে সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোলগাল মুখ, হেলতে দুলতে চলছেন একজন ভুঁড়িওয়ালা লোক। আশেপাশের সবাই যার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় কখনো না কখনো পরাজিত হয়েছিলেন, এমনকি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ও! তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বস্তুতই গুণীর কদর করতেন, গোপাল ভাঁড়ের সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাই তিনিও ভাস্বর হয়ে আছেন গল্পগুলোতে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মহারাজ গোপালের মুখ দেখলেন আর সেদিনই নাপিতের কাছে নখ কাটতে গিয়ে মহারাজের কড়ে আঙুলের কিছুটা মাংসও কেটে গেলো। নাপিত নিজের পিঠ বাঁচাবার জন্য বললো, “হুজুর, এতদিন ধরে আপনার নখ, দাড়ি ও চুল কাটছি- কই একদিনও তো একটু আঁচড় লাগেনি! আজ নিশ্চয়ই আপনি কোনো অনামুখোর মুখ দেখেছেন”।
তারপর রাজা বলে কথা! ভাবতে লাগলেন, “আজ সকালে কার মুখ দেখেছি যে আজ এই অনাসৃষ্টি হলো? আরে হ্যাঁ, আজ তো গোপালকেই দেখলাম সবার আগে! সে কি তবে অনামুখো?” ভাবতে দেরি হলো, মৃত্যুদণ্ড জারি করতে দেরি হলো না! কিন্তু গোপাল এই দণ্ডাদেশ শুনে একটুও বিচলিত হলো না। অবিচলিতভাবে রাজাকে বললো, “মহারাজ, ঘুম থেকে উঠে সবার আগে আপনি আমার মুখ দেখেছেন বলে আপনার কড়ে আঙুলের সামান্য মাংস কেটে গেছে। আর ঘুম থেকে উঠে সবার আগে আমি আপনার মুখ দেখেছি বলে আজ আমার মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে। তাহলে দেখুন মহারাজ, কে বেশি অনামুখো- আপনি না আমি?”
প্রভু নয়, রাজা নয়, গোপালের একজন সত্যিকারের বন্ধু হিসেবেই আমরা দেখতে পাই কৃষ্ণচন্দ্রকে। হাজারবার জব্দ হয়েও যিনি বলতেন, “একবার গোপালকে ডেকে পাঠাও দিকি!” গোপাল ভাঁড়ের উপস্থিতি ছাড়া জমে উঠতো না নদীয়ার সে রাজসভা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার মানুষের মুখে মুখে ছিলো গোপাল ভাঁড়ের নাম, প্রতিদিনই কিছু না কিছু কান্ড ঘটিয়ে লোককে জব্দ করতেন তিনি আর সে গল্প বিভিন্ন লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তো আশেপাশের সমগ্র অঞ্চলেও।
গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য
১৯২৯ সালে নগেন্দ্রনাথ রচিত ‘নবদ্বীপ কাহিনী’ গ্রন্থানুসারে, গোপাল ভাঁড় জাতিতে নাপিত ছিলেন, নগেন্দ্রনাথ নিজেকে গোপাল ভাঁড়ের বংশের সদস্য বলে দাবি করেন এবং একটি বংশলতিকাও তৈরি করেন। তিনি বিবাহিত ছিলেন। গোপালের এক ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। মেয়ের নাম রাধারানী। তার দুই পুত্র রমেশ ও উমেশ। কিন্তু খুব অল্প বয়সেই তার এক পুত্রের মৃত্যু হয়।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাকে রাজভাণ্ডারি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ওই ভাণ্ডারি শব্দটিরই অপভ্রংশ থেকে ভাঁড় হয়ে গেছে।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পঞ্চরত্নসভার একজন কি গোপাল ভাঁড় ছিলেন? ইতিহাস বলছে না, কারণ মঙ্গলকাব্যের অন্যতম কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের নাম সে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও গোপাল নামের কেউই এই তালিকায় ছিলেন না। তবে কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে একজন প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির কথা পাওয়া যায়; তিনি কোনো সভাসদ নন, একজন দেহরক্ষী। এই দেহরক্ষীর নাম ছিলো শঙ্কর তরঙ্গ, হয়তো তারই রূপান্তরিত চরিত্র গোপাল ভাঁড়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুকুমার সেনের মতে, গোপাল বলে হয়তো কেউ ছিলেন না, লোকমুখে সৃষ্ট হয়েছেন এই ‘গোপাল ভাঁড়’।
শুধু কি গোপালই সব রসের উৎস ছিলেন তার গল্পে? তার স্ত্রীর চরিত্রটিও পার্শ্বরস যুগিয়েছে সবসময়ই। তিল থেকে তালের গল্পটি তো বেশ পরিচিতই।
একবার হয়েছে কী, গোপাল তিলের নাড়ু বানাবার জন্য এক হাঁড়ি তিল কিনে এনেছিলো। কোনো এক কারণে নাড়ু আর বানানো হয় নি, আর হাঁড়িটিও গেছে খোয়া। বকুনি থেকে বাঁচতে গোপালের স্ত্রী করলো কী, তিলের নাড়ুর বদলে তালের বড়া হাজির করলো গোপালের পাতে! গোপাল তো অবাক, “তিলের নাড়ু কই? এ তো দেখছি তালের বড়া!” প্রত্যুৎপন্নমতি তার স্ত্রী জবাব দিলো, “তিল থেকেই তো তাল হয় গো!”
‘গোপাল ভাঁড়’ শুধু একটি নাম নয়, একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে মানুষের জীবনযাপনকেও প্রতিফলিত করে তার গল্পগুলো। বাংলা সাহিত্যই বলি আর লোককাহিনীই বলি, গোপাল ভাঁড় এর একটি চিরায়ত ও অবিচ্ছেদ্য চরিত্র।