কিছু প্রাণীর রক্ত নীল রঙের হয়  

আমরা সবাই জানি মানুষের রক্ত লাল। কারণ আমাদের রক্তে হিমোগ্লোবিন থাকে, যা আয়রন (লোহা) দ্বারা গঠিত। যখন হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন সেটি উজ্জ্বল লাল হয়ে ওঠে। কিন্তু পৃথিবীতে সব প্রাণীর রক্ত লাল নয়! প্রকৃতপক্ষে কিছু প্রাণীর রক্ত নীল রঙের হয়। এটি শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এর পেছনে আছে একদম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।

কেন কিছু প্রাণীর রক্ত নীল হয়?

যেসব প্রাণীর রক্ত নীল, তাদের রক্তে হিমোসায়ানিন (Hemocyanin) নামের এক বিশেষ প্রোটিন থাকে।

হিমোসায়ানিন হিমোগ্লোবিনের মতোই কাজ করে—অক্সিজেন পরিবহন করে।

তবে পার্থক্য হলো, হিমোসায়ানিনে লোহা (Fe) নয়, বরং তামা (Cu) থাকে।

যখন হিমোসায়ানিন অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন এটি নীল বা নীলচে-সবুজ রঙ ধারণ করে।

তাই এই প্রাণীদের রক্ত স্বাভাবিক অবস্থায় হালকা বর্ণহীন থাকে, আর অক্সিজেন পেলে নীলচে হয়ে যায়।

কোন কোন প্রাণীর রক্ত নীল?

নীল রক্তের প্রাণী সাধারণত আর্থ্রোপড এবং মলাস্ক গোত্রভুক্ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—

হর্সশু ক্র্যাব (Horseshoe Crab)

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন প্রাণী।

এর রক্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে থাকা উপাদান দিয়ে টিকা ও ওষুধের সুরক্ষা পরীক্ষা করা হয়।

অক্টোপাস (Octopus)

সাগরের অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী।

অক্টোপাসের রক্ত ঠান্ডা পানিতে ও অক্সিজেন-স্বল্প পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে।

স্কুইড (Squid)

দ্রুত সাঁতার কাটে এবং গভীর সাগরে বসবাস করতে পারে।

তাদের নীল রক্ত তাদেরকে উচ্চচাপ ও কম অক্সিজেনযুক্ত পানিতে বাঁচতে সাহায্য করে।

কাঁকড়া ও লবস্টার (Crabs & Lobsters)

সাধারণ সামুদ্রিক প্রাণী হলেও তাদের রক্তও হিমোসায়ানিন নির্ভর হওয়ায় নীল।


বিজ্ঞানীরা কেন নীল রক্ত নিয়ে আগ্রহী?

চিকিৎসা গবেষণায় ব্যবহার: হর্সশু ক্র্যাবের রক্ত দিয়ে জীবাণু শনাক্ত করা যায়। অনেক ভ্যাকসিন ও ইনজেকশন নিরাপদ কিনা তা পরীক্ষায় তাদের রক্তের উপাদান ব্যবহার হয়।

জীববৈজ্ঞানিক রহস্য: নীল রক্তধারী প্রাণীরা সাধারণত গভীর সমুদ্র বা অক্সিজেন-স্বল্প পরিবেশে থাকে। বিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা করছেন কীভাবে এই বিশেষ রক্ত তাদের দীর্ঘ সময় বাঁচিয়ে রাখে।

ভবিষ্যতের ওষুধ: তামা-ভিত্তিক অক্সিজেন পরিবহন ব্যবস্থা হয়তো একদিন নতুন ধরণের চিকিৎসা আবিষ্কারে সাহায্য করবে।

উপসংহার-

আমাদের চোখে অদ্ভুত লাগলেও প্রকৃতির বৈচিত্র্য সত্যিই বিস্ময়কর। মানুষের রক্ত লাল হলেও, অনেক প্রাণীর রক্ত নীল। এর পেছনে কাজ করছে বিজ্ঞানের এক অসাধারণ রহস্য—তামাভিত্তিক হিমোসায়ানিন। এই জ্ঞান শুধু প্রাণীজগৎকে বুঝতেই নয়, বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বিপ্লব ঘটাচ্ছে।



নেদারল্যান্ডস — সমুদ্র শাসনের আরেক নাম!”

ভাবো তো—যেখানে একসময় ছিল উত্তাল সমুদ্র, সেখানে আজ দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক শহর, রাস্তা আর সবুজ কৃষিজমি! অবিশ্বাস্য শোনালেও এটাই সত্যি। নেদারল্যান্ডস নামের এক ছোট্ট দেশ একদিন সিদ্ধান্ত নেয়, তারা সমুদ্রকে হার মানাবে। আর সেই থেকেই শুরু হয় মানব মেধার এক বিস্ময়কর অধ্যায়—Zuiderzee Works।

১৯২০ সালের দিকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে উত্তর সাগরের ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করা। তারা বিশাল এক বাঁধ নির্মাণ করে, নাম দেয় Afsluitdijk—৩২ কিলোমিটার লম্বা এই দেয়াল সমুদ্রের পানি আটকে দেয়, আর ধীরে ধীরে সেই পানিকে পাম্প করে বের করে সেখানে তৈরি করা হয় নতুন ভূমি।

যে জায়গায় একসময় ঢেউ গর্জাত, সেখানে এখন গড়ে উঠেছে নতুন প্রদেশ Flevoland—আছে শহর, রাস্তা, কৃষিজমি, এমনকি বিমানবন্দরও! এই প্রকল্পকেই বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় Land Reclamation—অর্থাৎ সমুদ্র থেকে জমি উদ্ধার করার কাজ।

আজ নেদারল্যান্ডসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা একসময় ছিল সমুদ্রের নিচে। মানুষ নিজের মেধা, পরিশ্রম আর সাহস দিয়ে প্রমাণ করেছে—চাইলে ঢেউকেও থামানো যায়।


মাইগ্রেন সম্পর্কে কিছু কথা

মাইগ্রেন আসলে কী?

এক ধরনের বিশেষ মাথাব্যথা, যা সাধারণ মাথাব্যথার মতো নয়। সাধারণত মাথার একপাশে তীব্র ব্যথা হয়, সাথে থাকে বমি বমি ভাব, আলো-শব্দে বিরক্তি।

কেন হয়?

মানসিক চাপ

ঘুমের অভাব বা অনিয়ম

হরমোনের পরিবর্তন

কিছু খাবার (যেমন চকলেট, ক্যাফেইন, প্রসেসড খাবার)

আবহাওয়ার পরিবর্তন

হলে প্রতিরোধ কীভাবে করবেন?

পর্যাপ্ত ও নিয়মিত ঘুম

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ

নিয়মিত পানি পান

সঠিক খাদ্যাভ্যাস

শরীরচর্চা

প্রতিকার কী?

ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন

অন্ধকার ও শান্ত পরিবেশে বিশ্রাম

মাথায় ঠান্ডা সেঁক

বেশি আলো, শব্দ ও স্ক্রিন এড়িয়ে চলা

মাইগ্রেন বারবার হলে অবহেলা না করে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।



পৃথিবীর কিছু নদী উল্টো দিকে বয়ে যায় – বিস্ময়কর তথ্য

আমরা ছোটবেলা থেকেই শিখেছি, নদীর পানি সবসময় উঁচু জায়গা থেকে নিচের দিকে নামে এবং সাগর কিংবা মহাসাগরে গিয়ে মিশে যায়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, পৃথিবীতে কিছু নদী আছে যেগুলো নির্দিষ্ট সময় বা পরিস্থিতিতে উল্টো দিকে বয়ে যায়। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটি পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক সত্য, যার পেছনে আছে প্রকৃতির নানা শক্তি।

কেন নদী উল্টো দিকে বয়ে যায়?

নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ উল্টো হওয়ার প্রধান কয়েকটি কারণ হলোঃ

জোয়ার-ভাটা (Tidal Effect)-

সমুদ্রের জোয়ার যখন খুব প্রবল হয়, তখন এটি নদীর মুখ দিয়ে ভেতরের দিকে চাপ সৃষ্টি করে। ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ উল্টো দিকে চলে যায়। এটি বিশ্বের অনেক মোহনায় দেখা যায়।

ভূমিকম্প বা ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন-

কোনো অঞ্চলে আকস্মিক ভূমিকম্প বা ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের কারণে নদীর তলদেশ উঁচু-নিচু হয়ে গেলে পানির প্রবাহ বদলে যায়। কখনো কখনো তখন নদী উল্টো দিকে গড়ায়।

বাতাসের চাপ (Wind Effect)-

প্রবল ঝড় বা বাতাস নদীর উপর চাপ সৃষ্টি করলে কিছু সময়ের জন্য পানি বিপরীতমুখী হয়ে যেতে পারে।

মানবসৃষ্ট বাঁধ বা ড্যাম-

কখনো ড্যাম খোলা বা বন্ধ করার কারণে নদীর স্রোত উল্টো দিকে যেতে পারে। বিশেষ করে কৃত্রিম জলাধার ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে এ ঘটনা ঘটে।

পৃথিবীর কয়েকটি বিখ্যাত উল্টোদিকের নদী-

১. শিকাগো নদী (Chicago River), যুক্তরাষ্ট্র

শিকাগো শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদী মূলত একসময় মিশিসিপি নদীর দিকে প্রবাহিত হতো। কিন্তু ১৮শ শতকে প্রকৌশলীরা নদীর প্রবাহ কৃত্রিমভাবে উল্টো করে দেন, যাতে শহরের দূষিত পানি সরাসরি মিশিগান লেকে গিয়ে না পড়ে। এটি পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত "উল্টোদিকের নদী"।

২. আমাজন নদী (Amazon River), দক্ষিণ আমেরিকা

বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী আমাজনের একটি বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হলো, জোয়ার-ভাটার কারণে এর কিছু অংশ উল্টো দিকে বয়ে যায়। বিশেষ করে “পোরোরোকা” (Pororoca) নামক জলোচ্ছ্বাসের সময় আমাজনের পানি সমুদ্র থেকে উল্টো স্রোতে প্রবাহিত হয়।

৩. তেমস নদী (River Thames), যুক্তরাজ্য

লন্ডনের তেমস নদীতেও জোয়ার-ভাটার প্রভাবে প্রায় প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য পানি উল্টো দিকে প্রবাহিত হয়। পর্যটকেরা এটি দেখতে বিশেষভাবে আগ্রহী।

৪. মিসিসিপি নদী (Mississippi River), যুক্তরাষ্ট্র

প্রবল ঝড় বা হারিকেনের সময়, যেমন ২০০৫ সালের হারিকেন ক্যাটরিনা, মিসিসিপি নদীর বিশাল অংশ কয়েক ঘণ্টার জন্য উল্টো দিকে প্রবাহিত হয়েছিল।

৫. গঙ্গা নদীর মোহনা, ভারত ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ও ভারতের গঙ্গা নদীর মোহনায়ও জোয়ার-ভাটার কারণে অনেক সময় স্রোত বিপরীত দিকে চলে যায়। বিশেষ করে চাঁদপুর অঞ্চলের মেঘনা মোহনায় এ দৃশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

কেন এ তথ্য গুরুত্বপূর্ণ?

এটি প্রমাণ করে, প্রকৃতি কখনোই একরকম থাকে না।

পৃথিবীর নদীগুলোর গঠন ও প্রবাহ কতটা বৈচিত্র্যময়, তা জানা যায়।

নদীর এই আচরণ বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও পরিবেশবিদদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়।

উপসংহার-

নদী মানেই একমুখী প্রবাহ—এই ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নদীর উল্টো স্রোত প্রমাণ করে, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম সবসময় আমাদের কল্পনার বাইরে। শিকাগো থেকে শুরু করে আমাজন, এমনকি গঙ্গার মোহনাতেও আমরা দেখতে পাই নদীর এই রহস্যময় উল্টো যাত্রা।



হাইপেশিয়া

পৃথিবীতে আরো একবার সেই বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল এবং সেটা ঘটেছিল আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিকে ঘিরে। প্রায় দুই হাজার বছর আগে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে এই লাইব্রেরিটি গড়ে উঠেছিল। আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি ছিল সত্যিকার অর্থে একটি কসমোপলিটান শহর। পৃথিবীর সব দেশের মানুষ এই শহরে থাকত। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর যে গ্রিক সম্রাটরা মিসর শাসন করত তারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞানের সাধনা করত। সেই দুই হাজার বছর আগে তারা গবেষণার গুরুত্বটি ধরতে পেরেছিল, তাই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিকে ঘিরে তারা গবেষণার একটা পরিবেশ তৈরি করেছিল, যেখানে গবেষকরা গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে শুরু করে ভূগোল বা সাহিত্যে গবেষণা করতেন।

গবেষণা করার জন্যে দরকার বই, তাই আলেকজান্দ্রিয়ায় একটা বিশাল লাইব্রেরি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। বলা যেতে পারে সেই যুগে আলেকজান্দ্রিয়া ছিল এই প্রকাশনার স্বর্গ। বই বলতে আমরা এখন যা বুঝি আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বই মোটেও সে রকম ছিল না। প্রিন্টিং প্রেস ছিল না বলে সেগুলো ছিল হাতে লেখা। আসল কপিটি লেখক নিজে লিখতেন এবং অন্যেরা সেটা দেখে দেখে তার অন্য কপিগুলো আরেক জায়গায় লিখে রাখতেন। সে কারণে বইগুলো ছিল অসম্ভব মূল্যবান এবং যাদের কাছ সেই বইগুলো থাকত তারা যক্ষের মতো সেগুলো আগলে রাখত। মিসরের গ্রিক সম্রাটরা অনেক কষ্ট করে সারা পৃথিবী থেকে অমূল্য বইগুলো সংগ্রহ করেছিল। কেউই তাদের আসল বইটি হাতছাড়া করতে চাইত না–অনেক টাকা জামানত রেখে তারা বইগুলো কপি করার জন্যে আনত! সেই সময়কার গ্রিক সম্রাটরা বইগুলোকে এতই মূল্যবান মনে করত যে তারা জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হতে দিয়ে সেই বইগুলো আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে রেখে দিত–ফেরৎ দিত কোনো একটা কপি! লাইব্রেরিতে ঠিক কতগুলো বই ছিল সঠিকভাবে কেউ জানে না, অনুমান করা হয় তার সংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশি ছিল। এই বিশাল লাইব্রেরিকে ঘিরে গবেষকরা যেসব কাজ করেছেন সেগুলো ছিল যুগান্তকারী। যেমন ইরাতেস্থিনিস প্রথম বারের মতো নিখুঁতভাবে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ বের করে তার একটা ম্যাপ তৈরি করেছিলেন, হিপার্কাস নক্ষত্রের প্রকৃতির সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তাদের নিখুঁত ক্যাটালগ তৈরি করেছিলেন। ইউক্লিড তার বিখ্যাত জ্যামিতির বই লিখেছিলেন, গেলেন লিখেছিলেন চিকিৎসা আর শারীরবিদ্যার বই। এরকম একটি-দুটি নয়, আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিভিত্তিক গবেষণার অজস্র উদাহরণ দেয়া যায়।

সেই লাইব্রেরির একজন গবেষক ছিলেন হাইপেশিয়া। তার জন্ম হয় 370 সালে। তার বাবাও ছিলেন বড় দার্শনিক, নাম থিওন। সেই যুগে মেয়েরা যখন পুরুষের সম্পত্তি হয়ে ঘরের ভেতর আটকা পড়ে থাকত তখন হাইপেশিয়া সদর্পে পুরুষদের জগতে ঘুরে বেড়াতেন। যে কোনো হিসেবে হাইপেশিয়া ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী, তাকে বিয়ে করার জন্যে পুরুষরা পাগল ছিল কিন্তু তিনি কখনো বিয়ে করতে রাজি হন নি। কথিত আছে তার এক ছাত্র একবার তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল, সেই ছাত্রকে তিনি মেয়েলী বিড়ম্বনার একটা নমুনা দেখিয়ে মোহমুক্ত করে ছেড়ে দিয়েছিলেন! এই সুন্দরী মহিলা নিয়মিতভাবে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে বক্তৃতা দিতেন–তার বক্তৃতা শোনার জন্যে অনেক দূর থেকে জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা আসত, রীতিমতো টিকেট কিনে তারা হাইপেশিয়ার বক্তৃতা শুনত! হাইপেশিয়া যে শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন তা নয়, আলেকজান্দ্রিয়া শহরের নগরপাল অরিস্টিসের সাথেও তার এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তখন খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার শুরু হয়েছে, খ্রিস্টান আর্চ বিশপের নাম সিরিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে ধর্মান্ধ খ্রিস্টানরা ধর্মবিরোধী মনে করত তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক হাইপেশিয়া ছিল তাদের চক্ষুশূল। বিশেষ করে নগরপাল অরিস্টিসের সাথে তার বন্ধুত্বকে সিরিল খুব খারাপ চোখে দেখতেন। হাইপেশিয়া খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন কিন্তু তার ধারণা ছিল ধর্ম হতে হবে যুক্তিনির্ভর আর জ্ঞানভিত্তিক। হাইপেশিয়া তার বক্তৃতায় সেটা প্রচারও করতেন, গোঁড়া আর ধর্মান্ধ খ্রিস্টানরা সেটা খুব অপছন্দ করত। একজন মেয়ে হয়ে তার এরকম সাহসী কথাবার্তায় মানুষগুলো খুব বিরক্ত হতো। তারা চেষ্টা করত যেন হাইপেশিয়ার বক্তৃতা শুনতে কেউ না আসে, তার বিজ্ঞানের উপর কথাবার্তা কেউ শুনতে না পারে। কিন্তু এই তেজস্বী আর সুন্দরী মহিলাকে তারা কোনোভাবে থামাতে পারল না, তাই তারা তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল।

417 খ্রিস্টাব্দে একদিন হাইপেশিয়া ঘোড়ার গাড়িতে ঘর থেকে বের হয়েছেন কাজে যাবার জন্যে, পথে তাকে ধর্মান্ধ । মানুষেরা ঘিরে ধরল। মুহূর্তের মাঝে সেই মানুষগুলো তাকে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে নেয়, তাকে বিবস্ত্র করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় একটা গির্জায়, সেখানে শরীর থেকে তার মাংস খুবলে নেয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে, তারপর শরীর টুকরো টুকরো করে আগুনে ছুঁড়ে দেয় উন্মত্ত দানবের মতো। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নজির খুব বেশি আছে বলে জানা নেই। এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই আর্চ বিশপ সিরিলকে সাধারণ মানুষ থেকে উপরের স্তরে নিয়ে সেইন্ট বানিয়ে দেয়া হয়–জগতে এর চাইতে উৎকট রসিকতা কী আর কিছু হতে পারে?

হাইপেশিয়াকে হত্যা করার সাথে সাথে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিরও দিন শেষ হয়ে যায়। এই লাইব্রেরিকে ঘিরে যে সভ্যতার জন্ম হয়েছিল সেই সভ্যতার বিকাশ থমকে দাঁড়ায়–একদিন দু’দিন নয়, প্রায় এক হাজার বছরের জন্যে। হাইপেশিয়া যেন ছিলেন একটা আলোর শিখা, ফুঁ দিয়ে সেই আলোর শিখা নিভিয়ে দেবার পর যেন পুরো জগৎটি এক হাজার বছরের জন্যে অন্ধকারে ডুবে

গেল। কোপার্নিকাস, গ্যালেলিও, নিউটনরা এসে সেই অন্ধকারকে দূর করার চেষ্টা শুরু না করা পর্যন্ত পুরো পৃথিবী এক হাজার বছরের জন্যে অন্ধকারে ঢাকা পড়েছিল!

আলেকজান্দ্রিয়ার সেই লাইব্রেরি একদিন পুড়ে ছাই করে দেয়া হলো–ঠিক কারা সেটি করেছিল সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কথিত আছে লাইব্রেরির বইগুলো পুড়িয়ে গোসলখানার পানি গরম করা হয়েছে–দশ লক্ষের উপর বই পুড়িয়ে শেষ করতে সময় লেগেছে ছয় মাস থেকেও বেশি! পৃথিবীর ইতিহাসে এর থেকে হৃদয়বিদারক কোনো ঘটনা আছে বলে জানা নেই। হাইপেশিয়ার সব বই, গবেষণার সব নমুনা সেই লাইব্রেরির সাথে সাথে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। তার কাজের নমুনার বিশেষ কিছু নূতন পৃথিবীর মানুষ খুঁজে পায় নি–ভাসা ভাসাভাবে নানা সূত্র থেকে কিছু তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যে কোনো হিসেবে সেগুলো অসাধারণ।

মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্যে ধর্মান্ধ মানুষেরা এই অসাধারণ বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদকে কেটে টুকরো টুকরো করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। ধর্মান্ধ মানুষেরা ইতিহাসের পাতা থেকে কিন্তু তাকে মুছে দিতে পারে নি। আধুনিক পৃথিবীর মানুষ চাঁদের একটি অঞ্চলের নাম রেখেছে হাইপেশিয়ার নামে।

যতদিন আকাশে চাঁদ উঠবে ততদিন হাইপেশিয়া পৃথিবীর মানুষের কাছে বেঁচে থাকবেন জ্ঞানের প্রতীক হয়ে।


মুখ দিয়ে হাঁটে যে মাছ

আমরা সাধারণত মাছকে কল্পনা করি পানিতে সাঁতার কাটতে, পাখনা ও লেজ নেড়ে নেড়ে চলতে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু অদ্ভুত মাছ আছে, যারা শুধু সাঁতারই কাটে না, বরং তাদের মুখ ও পাখনা ব্যবহার করে পানির নিচে “হাঁটে”। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটি পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক সত্য।

এই মাছগুলো কারা?

মুখ দিয়ে হাঁটা মাছের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো Batfish। এর বৈজ্ঞানিক নাম Ogcocephalidae। এছাড়াও কিছু বিশেষ প্রজাতির মাছ যেমন Handfish (অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়), Frogfish ইত্যাদিও এভাবে হাঁটে।

কিভাবে মুখ দিয়ে হাঁটে?

Batfish এর দেহ এমনভাবে তৈরি যে তারা সাধারণ মাছের মতো ভালো সাঁতার কাটতে পারে না।

পানির তলদেশে চলাফেরা করার জন্য তারা তাদের পেক্টোরাল ফিন (হাতের মত পাখনা) এবং মুখ ব্যবহার করে একপ্রকার হামাগুড়ি দেয়ার মতো হাঁটে।

দেখতে অনেকটা এমন লাগে যেন মাছটা “চারপেয়ে প্রাণীর মতো হাঁটছে”, আর মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে ভর নিয়ে সামনের দিকে টেনে নিচ্ছে।

এরা কোথায় থাকে?

এই অদ্ভুত মাছগুলো সাধারণত গভীর সমুদ্র বা কোরাল রিফের কাছে পাওয়া যায়।

সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ক্যারিবিয়ান সাগর, গালফ অব মেক্সিকো এবং অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ উপকূলে।

এরা পানির নিচে সমুদ্রের তলদেশে বসবাস করে, কারণ দ্রুত সাঁতারের জন্য এদের শরীর তৈরি হয়নি।

কী খেয়ে বেঁচে থাকে?

Batfish এর মুখে একটি বিশেষ fishing lure (প্রলোভনকারী অংশ) থাকে, যেটি ছোট পোকামাকড় বা সামুদ্রিক কীটকে কাছে টানতে পারে।

এরপর হঠাৎ মুখ দিয়ে শিকার ধরে ফেলে।

তারা সাধারণত ছোট মাছ, কৃমি, কাঁকড়া জাতীয় প্রাণী খেয়ে থাকে।

কেন এরা এত অদ্ভুত?

Batfish এর শরীর চাপা ও ত্রিভুজাকৃতির।

এদের মুখ দিয়ে হাঁটার ভঙ্গি দেখতে অনেকটা ব্যাঙ বা কচ্ছপের মতো হামাগুড়ি দেয়ার মতো লাগে।

এ কারণে বিজ্ঞানীরা এদের নাম দিয়েছেন “Walking Batfish” বা “Handfish”।

বিজ্ঞানীরা কী বলেন?

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ধরনের অভিযোজন (Adaptation) হয়েছে কোটি কোটি বছর আগে।

পানির নিচে যেসব প্রাণী দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে না, তারা বেঁচে থাকার কৌশল হিসেবে অন্যরকমভাবে চলাফেরা শুরু করে।

Batfish এর ক্ষেত্রে মুখ দিয়ে ভর নিয়ে হাঁটা তাদের শিকার ধরা ও আশেপাশের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে।

কেন আমাদের জানা দরকার?

প্রকৃতির বৈচিত্র্য কতটা আশ্চর্যজনক হতে পারে তার দারুণ উদাহরণ হলো এই মাছগুলো।

আমরা যাকে “মাছ” বলি, সে শুধু সাঁতার কাটে না—বরং মুখ দিয়ে হাঁটতেও পারে!

পৃথিবীর অজানা প্রাণীদের সম্পর্কে জানলে আমাদের কৌতূহল বাড়ে, জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়।

শেষ কথা:

কিছু মাছের মুখ দিয়ে হাঁটা সত্যিই “Believe it or not” ধরনের তথ্য। হয়তো ভাবা যায় না যে একটি মাছ মুখকে হাতের মতো ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু সমুদ্রের তলদেশে এ দৃশ্য বাস্তবেই দেখা যায়। প্রকৃতি আমাদের কাছে যতটা পরিচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি রহস্যময়।



ফার্স্ট হওয়ার চাপ: ১০টি ক্ষতি ও বাস্তব উদাহরণ

1. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়ে

উদাহরণ: রাফি প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ভাবে কাল যদি পরীক্ষায় ভুল হয় তাহলে বাবা-মা রাগ করবে — ফলে ঠিকমতো ঘুম হয় না।

2. শেখার আনন্দ হারায়

উদাহরণ: সায়মা একসময় বিজ্ঞান নিয়ে গল্প পড়তে ভালোবাসত, কিন্তু এখন শুধু সিলেবাসের প্রশ্ন মুখস্থ করে, কারণ "অতিরিক্ত কিছু পড়ার সময় নেই"।

3. শারীরিক স্বাস্থ্য খারাপ হয়

উদাহরণ: নিয়মিত রাত জেগে পড়াশোনা করার কারণে আরিয়ান চোখের ব্যথা ও মাথাব্যথায় ভোগে, সকালে ক্লাসে মনোযোগ রাখতে পারে না।

4. সামাজিক দক্ষতা কমে যায়

উদাহরণ: মিথিলা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে চায়, কিন্তু মা বলেন “সময় নষ্ট করো না, পড়তে বসো” — ফলে সে ধীরে ধীরে একা হয়ে যায়।

5. আত্মমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়

উদাহরণ: ফয়সাল পরীক্ষায় দ্বিতীয় হলে ভাবে, “আমি ব্যর্থ, আর কেউ আমার ওপর গর্ব করবে না।”

6. ঝুঁকি নেওয়ার সাহস কমে যায়

উদাহরণ: নতুন কোনো প্রজেক্ট বা কুইজে অংশ নিতে বলে শিক্ষক, কিন্তু তানিয়া ভয় পায় “ভুল করলে লজ্জা হবে” বলে অংশ নেয় না।

7. সৃষ্টিশীলতা কমে যায়

উদাহরণ: আগে রুহান গল্প লিখতে ভালোবাসত, কিন্তু এখন বাবা বলেন “এগুলো সময় নষ্ট, শুধু ম্যাথ প্র্যাকটিস করো” — ফলে তার কল্পনাশক্তি চর্চা বন্ধ হয়ে গেছে।

8. দীর্ঘমেয়াদে পড়াশোনার প্রতি অনীহা তৈরি হয়

উদাহরণ: সবসময় চাপ দিয়ে পড়ানোর কারণে সোহা কলেজে গিয়ে বই দেখলেই বিরক্ত হয়ে যায়।

9. অতিরিক্ত তুলনা ও ঈর্ষা তৈরি হয়

উদাহরণ: মাহির প্রতিদিন ভাবে কাদের থেকে সে ভালো করছে আর কারা তাকে পেরিয়ে যাচ্ছে — ফলে সহপাঠীদের সঙ্গে স্বাভাবিক বন্ধুত্ব হয় না।

10. পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। উদাহরণ: সবসময় ফলাফল নিয়ে চাপ দেওয়ায় লিজা বাবা-মায়ের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা বন্ধ করে দেয়, শুধু রাগ বা চুপচাপ প্রতিক্রিয়া দেখায়।


ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া


ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া উভয়ই মানুষের শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে পারে, তবে ভাইরাস অপেক্ষাকৃত বেশি বিপজ্জনক। এর সংক্রমণ দ্রুত ছড়ায় এবং অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ওষুধ বা প্রতিকার থাকে না—যেমন কোভিড-১৯, এইচআইভি বা হেপাটাইটিস। ভাইরাস শরীরের কোষে প্রবেশ করে তা ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে রোগ আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে এবং প্রাণঘাতীও হতে পারে।

অন্যদিকে, ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যেমন টাইফয়েড বা যক্ষা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণযোগ্য, যদিও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স দিন দিন উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে।

ইতিহাস বলছে, ভাইরাসজনিত মহামারিই সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে—প্রাণহানি, অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সামাজিক অস্থিরতা ডেকে এনেছে।

সবকিছু বিবেচনায়, ভাইরাসকে বেশি মারাত্মক বলা যায়। তাই সচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা ও টিকা গ্রহণই আমাদের সুরক্ষার প্রধান উপায়।


জোঁকের রহস্যময় জগৎ!

জোঁক এমন এক অদ্ভুত প্রাণী, যেটা মানুষ কিংবা পশুর শরীরে লেগে ধীরে ধীরে রক্ত শোষণ করে নেয়। বিস্ময়ের বিষয় হলো, রক্ত খাওয়ার সময় আমরা বেশিরভাগ সময় বুঝতেই পারি না! কারণ, কামড় দেওয়ার মুহূর্তে জোঁক শরীরে এমন এক ধরনের পদার্থ ছেড়ে দেয়, যা ব্যথার অনুভূতি ব্লক করে দেয়। শুধু তাই নয়, এরা শরীরে অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট ছাড়ে, যার কারণে রক্ত জমাট বাঁধে না এবং অবিরতভাবে রক্ত খেতে পারে।আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো—জোঁক একবার শরীরে লেগে গেলে সহজে ছাড়ানো যায় না। এর মুখে থাকা শক্তিশালী চুষনী (sucker) ত্বকের সাথে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে, যে জোর করে ছাড়াতে গেলে আরও বেশি আঁকড়ে ধরে।তবে লোকজ অভিজ্ঞতা বলছে—লবণ, ছাই কিংবা সাবান ব্যবহার করলে জোঁক ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয়।প্রকৃতির এই ছোট্ট জীবটির জীবনধারা সত্যিই বিস্ময়কর!


মহাস্থানগড় 

এটি বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এবং আমাদের দেশের প্রাচীনতম নগরীর ধ্বংসাবশেষ হিসেবে পরিচিত। প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো এই শহরকে বলা হয় প্রাচীন পুণ্ড্রনগরীর রাজধানী।ইতিহাসবিদদের মতে, মহাস্থানগড় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক থেকেই একটি সমৃদ্ধ নগরী ছিল। এখানে পাওয়া নানা শিলালিপি, মুদ্রা, ভাঙা ইট, প্রাচীর আর প্রাচীন স্থাপত্য প্রমাণ করে যে এটি ছিল এক শক্তিশালী জনপদ। মজার বিষয় হলো, মহাস্থানগড়ে আমরা মौर্য, গুপ্ত, পাল থেকে শুরু করে মুসলিম শাসনামল—সব যুগেরই চিহ্ন দেখতে পাই।মহাস্থানগড়ের ভেতরে এখনও দেখা যায় উঁচু প্রাচীর, দুর্গ, প্রাচীন কূপ আর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এখানকার প্রতিটি ইট যেন আমাদের অতীতের গল্প বলে। অনেক গবেষক মনে করেন, সেই সময়ের প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি—সবকিছুর কেন্দ্র ছিল এই নগর।আজও মহাস্থানগড় দাঁড়িয়ে আছে নীরবে, যেন প্রমাণ দিচ্ছে আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এখানে ভ্রমণে আসে শুধু আমাদের ইতিহাসের গভীরতা কাছ থেকে অনুভব করার জন্য।আমাদের দেশ ছোট হলেও, এর ইতিহাস আর ঐতিহ্য সত্যিই অসীম। মহাস্থানগড় সেই ঐতিহ্যের অন্যতম সেরা সাক্ষী।

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, যা সোমপুর মহাবিহার 

বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায় অবস্থিত এই প্রাচীন বিহারটি গড়ে ওঠে ৮ম শতাব্দীতে পাল রাজবংশের মহান শাসক ধর্মপাল-এর শাসনামলে। এটি শুধু একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানই ছিল না বরং এক সময় এশিয়ার অন্যতম শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল।

এই বিশাল স্থাপনাটির আয়তন প্রায় ২৭ একর এবং এতে রয়েছে ১৭৭টি ছোট কক্ষ যেখানে সন্ন্যাসীরা বাস করতেন ও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতেন। কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিশাল স্তূপাকৃতি মূল মন্দির যা এখনো আমাদের গৌরবময় অতীতের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এই স্থাপনাটিকে ঘোষণা করে “বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ” (UNESCO World Heritage Site)  যা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মর্যাদাকে বিশ্বে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে।



ঘুমের সময় অন্ধকারে থাকা কেন জরুরি?

ঘুম হলো সেই সময় যখন মস্তিষ্ক তার মেরামত, রিসেট এবং রিচার্জের কাজ করে, কিন্তু এমনকি সামান্য আলোও এই প্রক্রিয়ায় বাধা দিতে পারে।

​গবেষণায় দেখা গেছে যে নাইটলাইট (dim glows), রাস্তার আলো বা ফোনের স্ক্রিন থেকে আসা মৃদু আলো মেলাটোনিন হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যা গভীর বিশ্রামের জন্য অপরিহার্য। মেলাটোনিনের সঠিক মাত্রা ছাড়া, মস্তিষ্ক তার বিষাক্ত পদার্থ (toxins) পরিষ্কার করতে, স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করতে এবং মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে সংগ্রাম করে।

​রাতে অল্প পরিমাণ আলোও হতাশা, উদ্বেগ , ক্লান্তি , দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং দীর্ঘমেয়াদী জ্ঞানীয় হ্রাসের (cognitive decline) উচ্চ ঝুঁকির সাথে যুক্ত।

​মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সত্যিকারের অন্ধকার অপরিহার্য।


অদ্ভুত এক রহস্যময় প্রাণী হলো জলহস্তী 

আমরা অনেকেই ধরে নিই যে জলহস্তী দারুণ সাঁতার জানে, কিন্তু সত্য হলো — তারা একেবারেই সাঁতার পারে না! বরং পানির ভেতরে চলাফেরার সময় তারা নদী বা হ্রদের তলার মাটি ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগোয়।তাদের বিশাল শরীরের ওজন (সাধারণত ১,৫০০ থেকে ৩,২০০ কেজি পর্যন্ত) এতটাই বেশি যে সহজে ভেসে থাকতে পারে না। তাই প্রায় ৫ মিনিট পর্যন্ত নিঃশ্বাস আটকে ডুবে থাকতে পারে, তারপর আবার মাথা তুলে অক্সিজেন নেয়।সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ডুব দেওয়ার সময় তাদের নাক ও কান নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়, যাতে পানি ভেতরে ঢুকতে না পারে। এজন্যই তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানির ভেতর থাকতে পারে শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য।এমন এক প্রাণী, যাকে আমরা ভাবি কেবল অলস আর ভারী — অথচ তার শরীরের গঠনই তাকে বানিয়ে তুলেছে পানির ভেতরের অদ্ভুত ভ্রমণকারী।


ভুলে যাবার সমস্যা  

হঠাৎ কোনো কথা মনে করতে পরছে না, মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে কিংবা মাথায় ঝাপসা ভাব কাজ করছে—এ অবস্থাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ফগ’। এটি আসলে কোনো রোগ নয়, বরং শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি, ঘুমের অভাব কিংবা জীবনযাত্রার বিশৃঙ্খলার কারণে তৈরি হওয়া একটি অবস্থা। তবে দীর্ঘস্থায়ী হলে এটি কাজের দক্ষতা ও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

কেন হয় ব্রেন ফগ?

• পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব

• অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা

• অপুষ্টিকর খাবার ও পানিশূন্যতা

• হরমোনের অসামঞ্জস্য

• কিছু ওষুধ বা স্বাস্থ্য সমস্যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

মুক্তির উপায়

• পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন: প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম মস্তিষ্ককে পুনরুজ্জীবিত করে।

• সুষম খাদ্যগ্রহণ করুন: মাছ, ডিম, বাদাম, শাকসবজি ও ফল মস্তিষ্কের জন্য উপকারী।

• নিয়মিত ব্যায়াম করুন: হাঁটা, যোগব্যায়াম বা হালকা ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং মন সতেজ রাখে।

• স্ট্রেস কমান: মেডিটেশন বা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

• ডিজিটাল ডিটক্স করুন: মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে দীর্ঘসময় কাটানো কমিয়ে দিন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, জীবনযাত্রায় ছোট ছোট পরিবর্তন এনে ব্রেন ফগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে সমস্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত করে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।


কিছু প্রাণী মৃত্যু পর্যন্ত নিজের বয়স গণনা করতে পারে 

কিছু প্রাণী কি সত্যিই নিজের বয়স বুঝতে পারে?

আমরা মানুষ জন্মদিন পালন করি, বয়স গুনি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—প্রাণীরা কি নিজেদের বয়স সম্পর্কে সচেতন?

বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, কিছু প্রাণী শুধু সময়ের ধারনা নয়, নিজের “বয়স” সম্পর্কেও প্রাথমিক ধারণা রাখতে পারে। যদিও তারা মানুষের মতো ক্যালেন্ডার দেখে বয়স গোনে না, তবে তাদের শরীর, মস্তিষ্ক এবং আচরণের মাধ্যমে বয়স সম্পর্কে অবচেতন উপলব্ধি কাজ করে।

বয়স বোঝার প্রমাণ কোথায়?

হাতি-

হাতিদের নিয়ে বহু গবেষণায় দেখা গেছে, তারা তাদের জীবনের বিভিন্ন ধাপ (শৈশব, কৈশোর, প্রাপ্তবয়স্ক, বার্ধক্য) আলাদা করতে পারে।

বয়স্ক হাতিরা জানে তারা তরুণ হাতিদের মতো দ্রুত চলতে বা লড়াই করতে পারবে না।

একে বলা হয় self-age awareness, অর্থাৎ নিজের বয়স অনুযায়ী আচরণ নিয়ন্ত্রণ।

শিম্পাঞ্জি-

শিম্পাঞ্জি, বনোবো, এমনকি ওরাংওটাং—এদের মধ্যে বয়স সম্পর্কে সচেতনতার অনেক প্রমাণ মিলেছে।

ছোট শিম্পাঞ্জিরা খেলায় বেশি অংশ নেয়, কিন্তু বড় বয়সী শিম্পাঞ্জিরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এড়িয়ে চলে।

২০২১ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, শিম্পাঞ্জিরা তাদের বয়স অনুযায়ী সামাজিক সম্পর্কের ধরণও বদলায়, যেটি মানুষের মতো।

পাখি-

কিছু গায়ক পাখি (যেমন—জেব্রা ফিঞ্চ) বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের গান পরিবর্তন করে।

গবেষকরা দেখেছেন, পুরুষ পাখিরা যখন বুড়ো হয় তখন তারা বুঝতে পারে আগের মতো সুন্দরভাবে গান গাইতে পারছে না, এবং প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলে।

ডলফিন-

ডলফিনদের বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাছাকাছি বলে ধরা হয়।

তাদের ওপর চালানো পরীক্ষায় দেখা গেছে, তারা বয়স অনুযায়ী নিজেদের শারীরিক সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন থাকে।

তারা অনেক সময় ছোট ডলফিনদের খেলার সুযোগ দিয়ে নিজেরা পাশে থাকে।

প্রাণীরা কীভাবে বয়স “গণনা” করে?

প্রাণীরা মানুষের মতো সংখ্যা দিয়ে বয়স গণনা করে না। বরং—

শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন → শরীরের শক্তি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, গতি ইত্যাদি থেকে তারা নিজের বয়স বুঝতে পারে।

অভিজ্ঞতা → বয়স বাড়লে প্রাণীরা ঝুঁকি এড়িয়ে চলে এবং আগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়।

সামাজিক আচরণ → অনেক প্রাণী সমাজে বয়স্ক প্রাণীকে আলাদা ভূমিকা দেয়। যেমন—হাতির পাল নেতৃত্ব সাধারণত সবচেয়ে বয়স্ক মাদী হাতি করে।

বিজ্ঞানীদের মতামত-

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলেন,

“Self-age awareness প্রাণী জগতে এক নতুন গবেষণার ক্ষেত্র। প্রাণীরা সংখ্যায় বয়স জানে না, কিন্তু তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বয়সের পরিবর্তন উপলব্ধি করতে পারে।”

প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক ফ্রান্স দে ওয়াল উল্লেখ করেন,

“এপ ও হাতির মতো প্রাণীরা জীবনের বিভিন্ন পর্যায় আলাদা করে বোঝে। এটি তাদের সামাজিক বুদ্ধিমত্তার অংশ।”

উপসংহার-

আমরা হয়তো ভেবেছি শুধু মানুষই বয়স গোনে, কিন্তু বাস্তবে কিছু প্রাণীও নিজের বয়সের সীমাবদ্ধতা বোঝে।

তারা জানে, শৈশব খেলাধুলার, যৌবন প্রতিযোগিতার আর বার্ধক্য হলো বিশ্রামের সময়।

বিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা করছেন, তবে প্রমাণ স্পষ্ট—প্রাণীদের মধ্যেও বয়স সম্পর্কে সচেতনতা আছে, যা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টিকে থাকে।


কিছু পাখি হাজার মাইল ভ্রমণ করে জন্মস্থানেই ফিরে আসে 

হাজার মাইল ভ্রমণ শেষে পাখিরা কেন জন্মভূমিতেই ফিরে আসে?

প্রকৃতির সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর একটি হলো পাখিদের অভিবাসন (Bird Migration)। পৃথিবীর অসংখ্য প্রজাতির পাখি প্রতি বছর হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো—ঐ দীর্ঘ ভ্রমণের পর তারা ফিরে আসে তাদের জন্মভূমিতে, ঠিক সেই জায়গাতেই যেখানে তারা প্রথম ডিম থেকে বের হয়েছিল।

পাখিদের এই বিস্ময়কর যাত্রার কারণ-

পাখিরা মূলত খাদ্য, আবহাওয়া ও প্রজনন—এই তিন কারণে অভিবাসন করে।

শীতকালে যখন খাবারের অভাব দেখা দেয়, তখন তারা উষ্ণ অঞ্চলে চলে যায়।

আবার ডিম পাড়ার মৌসুমে তারা ফিরে আসে সেই জায়গায়, যেখানে পরিবেশ ও খাদ্য উভয়ই বাচ্চা লালন-পালনের জন্য উপযোগী।

কীভাবে তারা পথ চিনে ফিরে আসে?

বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করে দেখেছেন, পাখিদের রয়েছে অসাধারণ নেভিগেশন ক্ষমতা।

সূর্যের অবস্থান: দিনের বেলায় সূর্যের অবস্থান দেখে তারা দিক নির্ধারণ করে।

তারার অবস্থান: রাতের আকাশের তারামণ্ডলীকে ব্যবহার করে পাখিরা দিক খুঁজে নেয়।

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র (Earth’s Magnetic Field): কিছু পাখির চোখে বিশেষ প্রোটিন থাকে, যেটা তাদের চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করতে সাহায্য করে।

ঘ্রাণশক্তি (Smell): বিশেষ করে সামুদ্রিক পাখিরা সমুদ্রের গন্ধ ও বাতাসের ধরণ চিনে পথ খুঁজে নেয়।

অবিশ্বাস্য কিছু উদাহরণ-

আর্কটিক টার্ন (Arctic Tern): পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভ্রমণকারী পাখি। তারা বছরে প্রায় ৭০,০০০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে, আর্কটিক অঞ্চল থেকে অ্যান্টার্কটিকা এবং আবার ফিরে আসে।

বার-টেইল্ড গডউইট (Bar-tailed Godwit): কোনো বিরতি ছাড়াই একটানা ১২,০০০ কিলোমিটার উড়ে যেতে পারে, যা এখন পর্যন্ত দীর্ঘতম নন-স্টপ ফ্লাইটের রেকর্ড।

সোয়ালো (Swallow): ইউরোপ থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত প্রায় ৬,০০০ মাইল ভ্রমণ করে প্রতি বছর।

কেন জন্মভূমিতেই ফিরে আসে?

প্রকৃতির এক রহস্যময় নিয়ম হলো, পাখিরা তাদের জন্মভূমিকে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা মনে করে প্রজননের জন্য। জন্মভূমির পরিবেশ, জলবায়ু ও খাদ্যশৃঙ্খল তাদের জেনেটিক স্মৃতিতে (Genetic Memory) প্রোথিত থাকে। তাই হাজার মাইল দূরে গেলেও, মৌসুম শেষে তারা ঠিক জন্মভূমিতেই ফিরে আসে।

পাখিদের অভিবাসন সম্পর্কিত চমকপ্রদ তথ্য

অবিশ্বাস্য উচ্চতায় ওড়ে-

কিছু পাখি প্রায় ৮,০০০ মিটার (২৬,০০০ ফুট) উচ্চতায় উড়তে পারে।

উদাহরণ: বার-হেডেড গুজ (Bar-headed Goose) হিমালয়ের উপরে মাউন্ট এভারেস্ট অঞ্চলের উচ্চতায়ও উড়ে যায়।

অসাধারণ গতি-

সোয়িফট (Swift) এক দিনে গড়ে ৫০০–৬০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে।

পেরেগ্রিন ফ্যালকন (Peregrine Falcon) ডাইভিং করার সময় ঘন্টায় প্রায় ৩২০ কিমি বেগে উড়তে পারে, যা পৃথিবীর দ্রুততম প্রাণী।

অন্ধকারে যাত্রা-

অনেক পাখি বিশেষ করে গানপাখি (Songbirds) রাতের বেলা উড়ে যায়। কারণ রাতের বাতাস ঠান্ডা থাকে এবং শিকারিদের সংখ্যা কম থাকে।

ছোট শরীর, বিশাল ভ্রমণ-

ছোট্ট হামিংবার্ড প্রতি বছর উত্তর আমেরিকা থেকে মধ্য আমেরিকা পর্যন্ত হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করে, অথচ তার ওজন মাত্র ২–৩ গ্রাম!

ভ্রমণে ক্লান্তি সামলানো-

অনেক পাখি উড়ার সময়ই ঘুমায়। একে বলে Unihemispheric Sleep—অর্থাৎ মস্তিষ্কের এক অংশ ঘুমায়, আরেক অংশ জেগে থেকে ডানা চালায়।

নেভিগেশনের গোপন রহস্য-

গবেষণায় জানা গেছে, পাখিদের রেটিনা (চোখের কোষ) বিশেষভাবে আলো ও চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করতে পারে। ফলে তারা পৃথিবীর অদৃশ্য “ম্যাগনেটিক মানচিত্র” ব্যবহার করে পথ খুঁজে নেয়।

পরিযায়ী পাখির মৃত্যু ঝুঁকি-

এই দীর্ঘ ভ্রমণে হাজার হাজার পাখি মারা যায় ঝড়, শিকারি প্রাণী, শিকারি মানুষ এবং খাদ্যের অভাবে। তবুও তাদের বেঁচে থাকার প্রবল তাগিদ তাদের আবারও ভ্রমণে নামায়।

বিজ্ঞানীরা যেভাবে খুঁজে পান পথচিহ্ন-

পাখিদের পায়ে বিশেষ ব্যান্ড (Bird Ringing/Tagging) লাগানো হয়। আবার স্যাটেলাইট ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে দেখা হয়, তারা কোন রুট ব্যবহার করছে। এতে তাদের রহস্যময় অভিবাসন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে।

মানুষের জন্য শিক্ষণীয় দিক-

এই অভিবাসন শুধু প্রকৃতির বিস্ময় নয়, আমাদের জন্যও বড় শিক্ষা—

পরিবার ও শিকড়ের প্রতি টান

প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলা

ধৈর্য ও অধ্যবসায়

সংক্ষেপে, পাখিদের অভিবাসন হলো এক অনন্য প্রাকৃতিক বিস্ময়। হাজার মাইল দূরে ভ্রমণ করার পরও তারা জন্মভূমিতে ফিরে আসে—যা প্রমাণ করে, প্রকৃতির তৈরি এই ছোট প্রাণীগুলোও কতটা সুসংগঠিত ও অসাধারণ।



হর্সশু কাঁকড়া : পৃথিবীর সবচেয়ে দামী রক্তের প্রাণী...

হর্সশু কাঁকড়া আমাদের থেকেও বহু পুরনো প্রাণী। এমনকি এরা ডাইনোসরেরও আগে পৃথিবীতে এসেছে! সময়ের পরীক্ষায় টিকে থেকে এরা আজও বেঁচে আছে ও বিবর্তিত হয়েছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, এদের রক্ত নীল, এরা উল্টো হয়ে সাঁতার কাটতে পারে এবং তাদের শরীরে আছে প্রায় নয়টি চোখ।

৪৫০ মিলিয়ন বছরের পুরনো প্রাণী:-

হর্সশু কাঁকড়ার উৎপত্তি প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন বছর আগে। অর্থাৎ, ডাইনোসরেরও প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর আগে তারা পৃথিবীতে এসেছে। এদের বলা হয় “লিভিং ফসিল” বা জীবন্ত জীবাশ্ম। গবেষকরা এদের পূর্বপুরুষের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন অর্ডোভিসিয়ান যুগের শেষ দিকে, যখন পৃথিবীতে প্রথম প্রাচীন মাছ দেখা দিয়েছিল।

হর্সশু কাঁকড়া আসলে কাঁকড়া নয়:-

হর্সশু কাঁকড়া হলো সামুদ্রিক আর্থ্রোপড। এদের খোলস ঘোড়ার খুরের মতো দেখতে, তাই এ নামকরণ। তবে নামের মধ্যে “কাঁকড়া” থাকলেও এরা আসল কাঁকড়া নয়। এরা বরং মাকড়সা ও বিচ্ছুর মতো আরাকনিড গোষ্ঠীর কাছাকাছি।

বিশ্বে হর্সশু কাঁকড়ার মাত্র চারটি প্রজাতি আছে। এদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মেক্সিকো উপসাগর এবং আমেরিকার উপকূলে পাওয়া যায়। ফিলিপাইনে কেবল পালাওয়ান দ্বীপেই এদের দেখা মেলে।

দেখতে ভিনগ্রহের মতো হলেও শান্ত স্বভাবের এদের লম্বা কাঁটা-ওয়ালা লেজ দেখে অনেকে ভয় পান। কিন্তু আসলে এরা খুবই শান্ত প্রাণী। লেজ তারা ব্যবহার করে শুধু সাঁতারের সময় দিক বদলাতে বা ঢেউয়ে উল্টে গেলে আবার সোজা হতে। তাই লেজ ধরে কখনোই এদের ধরা উচিত নয়, এতে প্রাণীটি আহত হয়।

নীল রক্তের রহস্য:-

আমাদের রক্ত লোহায় ভরপুর হিমোগ্লোবিনের জন্য লাল হয়। হর্সশু কাঁকড়ার রক্ত নীল, কারণ এতে থাকে তামাযুক্ত হিমোসায়ানিন। এ প্রোটিন শরীর জুড়ে অক্সিজেন বহন করে।

তাদের রক্তে থাকে আমিবোসাইট নামের বিশেষ কোষ, যা রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে। হর্সশু কাঁকড়ার কোনো পূর্ণাঙ্গ রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। যখনই শরীরে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস প্রবেশ করে, তখন এই কোষগুলো ফেটে গিয়ে আক্রমণকারী জীবাণুর চারপাশে জেলি জাতীয় আবরণ তৈরি করে এবং প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়।

এই কোষগুলি এতটাই সংবেদনশীল যে ই. কোলাই (E. Coli) ধরনের জীবাণুকেও সঙ্গে সঙ্গে শনাক্ত করতে পারে। তাই এদের রক্ত থেকে তৈরি করা হয় LAL (Limulus Amebocyte Lysate), যা চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করতে এবং ভ্যাকসিন ও ওষুধ পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়।

এক লিটার হর্সশু কাঁকড়ার রক্তের দাম প্রায় ১৫,০০০ ডলার বা তার বেশি। এজন্যই এ রক্ত পৃথিবীর অন্যতম দামী তরল পদার্থ।

নয়টি চোখ:-

হর্সশু কাঁকড়ার শরীরে মোট নয়টি চোখ থাকে। এদের খোলসের উপর দু’টি বড় যৌগিক চোখ আছে, যা সঙ্গী খুঁজতে সাহায্য করে। উপরিভাগে আরও পাঁচটি চোখ থাকে, যেগুলো সূর্যালোক ও অতিবেগুনি আলো শনাক্ত করতে পারে। নিচের দিকে দু’টি চোখ থাকে, যা সাঁতারের সময় তাদের দিক নির্ধারণে সাহায্য করে। এমনকি লেজের উপরও আলোক সংবেদী অঙ্গ আছে, যা তাদের মস্তিষ্ককে দিন-রাতের ছন্দের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।

উল্টো হয়ে সাঁতার কাটে কেন?

হর্সশু কাঁকড়া সাধারণত উল্টো হয়ে সাঁতার কাটে। এভাবে তারা অন্য প্রাণীদের থেকে দূরে থাকতে পারে এবং শিকারি প্রাণী এড়াতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে অল্পবয়সি হর্সশু কাঁকড়াদের এভাবে সাঁতার কাটতে দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত গভীর সমুদ্রতলে খাদ্য খুঁজে বেড়ায়।

প্রজনন ও জীবনচক্র:-

মেয়ে হর্সশু কাঁকড়া আকারে বড় হয়। চাঁদের পূর্ণিমা রাতে বা উষ্ণ মৌসুমে এরা কাদামাটি বা বালুকাবেলায় ডিম পাড়ে। একটি মেয়ে প্রায় ৬০,০০০ থেকে ১,২০,০০০ ডিম পাড়তে পারে। ডিমের বড় অংশই পাখি, মাছ ও সরীসৃপের খাদ্য হয়। কেবল কয়েকটি ডিম থেকেই বাচ্চা ফোটে, যারা প্রথমে জোয়ার-ভাটার তটে থাকে, পরে গভীর সমুদ্রে চলে যায় এবং ৮-১০ বছরে পূর্ণবয়স্ক হয়।

মানুষের কারণে বিপন্ন:-

প্রায় অর্ধেক বিলিয়ন বছর ধরে টিকে থাকলেও হর্সশু কাঁকড়া এখন বড় বিপদের মুখে। চিকিৎসা শিল্পে রক্ত সংগ্রহ, অতিরিক্ত শিকার, উপকূল ধ্বংস এবং খাবারের জন্য ব্যবহার তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলছে। একসময় এদের সার ও পশুখাদ্য বানাতো মানুষ। বর্তমানে চিকিৎসা শিল্পেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়।

তবে বিজ্ঞানীরা বিকল্প পথ খুঁজছেন—যাতে এই অসাধারণ প্রাণীগুলোকে রক্ষা করা যায়। বহু দশক ধরে মানুষ এদের কাছে ঋণী, কারণ এদের নীল রক্ত আমাদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করছে।



কোয়েলাক্যাথ

কোয়েলাক্যাথ (Coelacanth) পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় মাছ, যাকে বলা হয় “জীবন্ত জীবাশ্ম”। বিজ্ঞানীরা একে বহুদিন ধরেই কেবল ফসিল (জীবাশ্ম) হিসেবেই চিনতেন এবং মনে করতেন এটি প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরের সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, ১৯৩৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে প্রথমবারের মতো একটি জীবন্ত কোয়েলাক্যাথ ধরা পড়ে। এই আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক সমাজকে হতবাক করে দিয়েছিল, কারণ এতদিন যাকে বিলুপ্ত মনে করা হচ্ছিল, সেটি আসলে সমুদ্রের গভীরে টিকে ছিল!

 কোয়েলাক্যাথের দৈর্ঘ্য প্রায় ২ মিটার পর্যন্ত হতে পারে এবং ওজন ৯০ কেজি পর্যন্ত হয়।

 এরা সাধারণত সমুদ্রের গভীর অন্ধকারে, প্রায় ৭০০ মিটার নিচে বাস করে।

 এর বিশেষ ধরনের লোবযুক্ত পাখনা (lobe-finned fins) রয়েছে, যা বিবর্তনের ইতিহাসে মাছ থেকে স্থলচর প্রাণীর দিকে অগ্রগতির একটি জীবন্ত প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়। আজও এদের দেখা পাওয়া খুবই বিরল।



কোলাজেন

কোলাজেন হলো দেহের স্ট্রাকচারাল প্রোটিন। এটা ত্বক, হাড়, পেশি, চুল, নখ, চোখ, রক্তনালী, জয়েন্ট এ সবকিছুর জন্য কাঠামো তৈরি করে।

সোজা কথায়, এটা দেহের প্রাকৃতিক আঠা, যা সবকিছুকে শক্তভাবে একসাথে ধরে রাখে।

শরীরের মোট প্রোটিনের প্রায় ৩০ শতাংশই কোলাজেন দ্বারা গঠিত!

অনেকেই ভাবে, হাড় মানে শুধুই ক্যালসিয়াম। কিন্তু আসলে হাড়ের গঠন অনেকটা স্টিল ও কংক্রিটের মতো।

কোলাজেন হলো স্টিলের মতো, এটি হাড়ের ভেতরে ফাইবার নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা হাড়কে নমনীয়তা ও কিছুটা ইলাস্টিসিটি দেয়।

আর, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য মিনারেল হলো কংক্রিটের মতো, এগুলো কোলাজেন ফ্রেমওয়ার্কের ফাঁকা জায়গাগুলো ভরে দেয়, ফলে হাড় শক্ত ও টেকসই হয়।

যদি কোলাজেন না থাকে, তাহলে হাড় ভঙ্গুর হয়ে যাবে, একটু চাপেই ভেঙে যাবে।

আর যদি ক্যালসিয়াম না থাকে, তাহলে হাড় নরম ও বাঁকানো হয়ে যাবে।

হাড়ে কোলাজেন ও ক্যালসিয়াম দুটিই সমান জরুরি।

এ কারণেই হাড়ের জন্য শুধু ক্যালসিয়াম খেলেই হবে না; প্রোটিন, ভিটামিন C, ভিটামিন D এবং কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবারও লাগবে।

শরীরে ২৮ প্রকারেরও বেশি কোলাজেন রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০-৯০ শতাংশই হলো টাইপ-১, ২, ৩, ৫ এবং ১০ কোলাজেন।

শরীর নিজেই প্রাকৃতিকভাবে কোলাজেন তৈরি করে।

তবে ২০-৩০ বছর বয়সের পর থেকে দেহে কোলাজেন উৎপাদন কমতে শুরু করে।

বিশেষ করে, নারীদের ক্ষেত্রে মেনোপজ পরবর্তী সময় ও হরমোন পরিবর্তনের কারণে কোলাজেন পতন ত্বরান্বিত হয়।

এই প্রক্রিয়াকে আরো বেশি তরান্বিত করে ফ্রি র‍্যাডিক্যালের প্রভাব, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, ধূমপান, মদ্যপান, চিনি, রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট, রিফাইন্ড ফুড, জাংকফুড ইত্যাদি!

এর ফলাফল হিসাবে দেখা দেয়–

- ত্বকের বলিরেখা, শুষ্কতা, ঝুলে পড়া, ফাইন লাইন

- ঠোঁট, চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, পড়ে যাওয়া

- হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া (osteoporosis), জয়েন্টে ব্যথা ও শক্ত ভাব

কোলাজেন শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং যৌবন ও স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। ৩০ বছরের পর যখন শরীর স্বাভাবিকভাবে কম কোলাজেন তৈরি করতে শুরু করে, তখন খাদ্য থেকেই এটি পাওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে যায়।

কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার ও ভিটামিনসমূহ শরীরে নতুন কোলাজেন তৈরি করে, ফলে ত্বক টানটান, গ্লো করা এবং যৌবনদীপ্ত থাকে।

বয়সের সঙ্গে কোলাজেন কমে যাওয়া স্বাভাবিক, তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করলে এই প্রক্রিয়া ধীর করা সম্ভব।

যেমন- পর্যাপ্ত প্রোটিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টযুক্ত খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান, ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা, নিয়মিত ব্যায়াম।

ভিটামিন সি কোলাজেন সংশ্লেষণের একটি অপরিহার্য কো-ফ্যাক্টর।

কোলাজেন উৎপাদন অপ্টিমাইজ করতে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের সাথে কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত।

কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবারের তালিকা–

- হাড়ের ঝোল (Bone Broth)

পশুপাখির হাড়, হাটু-গোড়ালির হাড় (পায়া)

মাছের মাথা, মাছের চামড়া, ছোট মাছ, হাঁস-মুরগির চামড়া ও পা

- অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (Organ Meats)

পশুপাখির লিভার (কলিজা), কিডনি, গিলা (হৃদপিণ্ড), মগজ (Brain)

- হোল প্রোটিন

ডিম, মাছ, মাংস, ডাল।

- পশুপাখির চামড়া কোলাজেনের ভাল উৎসগুলোর একটি। গরু ছাগলের চামড়া রান্না করে খাওয়া যায়। হাঁস-মুরগির চামড়াসহ মাংস খাওয়া যায়।

- মাছের মধ্যে কোলাজেন সবচেয়ে বেশি থাকে স্কিন, কাঁটা, মাথায় ও ছোট মাছে।

শুধু কোলাজেন খেলেই হবে না, শরীরে যাতে এটি উত্তমরূপে এবজর্ব হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

এর জন্য প্রয়োজন–

- ভিটামিন-সি

লেবু, কাচা মরিচ, আমলকী, টমেটো, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলি

- তামা, জিংক সমৃদ্ধ খাবার

বাদাম, তিল, যকৃত (লিভার), বীজ, ডাল, ছোলা, ডিম

- সালফার সমৃদ্ধ খাবার

পেঁয়াজ, রসুন, ডিম, বাঁধাকপি, ব্রকলি, ফুলকপি

- অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ খাবার

কালো চাল, লাল চাল, সবুজ শাক, হলুদ, গ্রিন টি, হার্বাল টি

সবচেয়ে উত্তম হলো ব্যালান্সড ডায়েট ফলো করা, যেখানে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি, ফলমূল, বীজ এর সমন্বয় থাকে।

কোলাজেন বাড়ানোর জন্য এই খাবারগুলো খেলে যেমন ভালো, তেমনি চিনি, রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেটযুক্ত, রিফাইন্ড ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এতে কোলাজেন তৈরি হওয়ার হার কমে যায় এবং শরীরে ইনফ্লামেশন হয়।

ভেতর ঠিক না রেখে বাইরে থেকে ক্রিম-লোশন মেখে কোনো লাভ নাই।

- দিনে অন্তত ২–৩ লিটার পানি পান করুন। কোলাজেন হাইড্রেশনের জন্য পানি দরকার। পর্যাপ্ত পানি পান না করলে ত্বকের আর্দ্রতা কমে যায়, ফলে কোলাজেন ভাঙন দ্রুত ঘটে।

- ধূমপান, অতিরিক্ত চিনি, জাঙ্ক ফুড বাদ দিন। এগুলো কোলাজেন ভেঙে দেয়। অস্বাস্থ্যকর খাবার (প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনি, রিফাইন্ড খাবার) কোলাজেন উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করে।

- রোদে প্রতিদিন ১০–১৫ মিনিট থাকুন। ভিটামিন D ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করবে।

- মানসিক দুশ্চিন্তা ও ঘুমের অভাব কোলাজেন উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। চাপ বা দুশ্চিন্তা কর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে দেয়, যা কোলাজেন ভাঙনের গতি বাড়িয়ে দেয়। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবেও কোলাজেন ক্ষয় হয়। ঘুমের সময় শরীরের কোষ মেরামত হয়, যা কোলাজেন উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।


নাইজারসরাস 

প্রায় ১১ কোটি বছর আগে আফ্রিকার মরুভূমিতে বিচরণ করত এক অদ্ভুত শাকাশি ডাইনোসর—নাইজারসরাস। দৈর্ঘ্যে নয় মিটার হলেও ওজনে এটি ছিল প্রায় হাতির সমান, অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে হালকা। এর সবচেয়ে আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য ছিল মাথার খুলি আর দাঁত। মাথার হাড় এতটাই পাতলা ছিল যে আলোয় ধরলে প্রায় স্বচ্ছ মনে হতো। আর মুখের সামনের দিকে সারিবদ্ধভাবে বসানো ছিল প্রায় ৫০০ দাঁত, যেগুলো মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই ক্ষয়ে যেত এবং নতুন দাঁত জন্ম নিত। এই দাঁতের সাহায্যে এটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো মাথা নিচু করে একসাথে প্রচুর ঘাস ও নরম গাছপালা খেত। এই অদ্ভুত খাওয়ার ভঙ্গির জন্য বিজ্ঞানীরা একে মজা করে “মেসোজোয়িক গরু” বা “ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ডাইনোসর” বলে ডাকেন।

এদের এমন দাঁতের গঠন আর কোনো ডাইনোসরের মধ্যে পাওয়া যায়নি। দাঁতের সারি ও দ্রুত দাঁত বদলানোর ক্ষমতা তাকে শুধু টিকে থাকার সুবিধাই দেয়নি, বরং বিশাল এলাকায় নিচু গাছপালা একটানা খেয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ডাইনোসরের ঝাঁক একসাথে ঘাস খেতে নামলে তারা পুরো ভূমিকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় খালি করে ফেলতে পারত।


মোবাইল নম্বরের শুরুতে +৮৮০ বসাতে হয় কেন

আমরা যখন কাউকে কল করি, তখন ০১৭/০১৮/০১৯… এভাবে নম্বর লিখি। মজার ব্যাপার হলো, সামনের এই শূন্যটা (০) না দিলেও কল যায়। (বিশ্বাস না হলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যাহোক, এই শূন্য রহস্য নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।) আপনারা যদি কেউ বাল্ক এসএমএস (একসঙ্গে বহু মানুষকে মেসেজ পাঠানো) পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে জানেন, আমরা এক্সেল ফাইলে নাম্বারটা লিখি। সামনের শূন্যটা (০) সেখানে না দিলেও চলে। এসএমএস চলে যায়।

অর্থাৎ ১৭/১৮/১৯…—এরকম ১০ সংখ্যার মোবাইল নম্বরটাই আমাদের আসল নম্বর। কথাটা ভিন্নভাবে বললে বলতে হবে, আমরা যখন কাউকে ফোন করি, তখন ১০ সংখ্যার মোবাইল নম্বরটিই যথেষ্ট। সামনের ০-টা বিশেষ কোড। আন্তর্জাতিক কলের ক্ষেত্রে এই কোড আরেকটু বড়।

এই কোড কী কাজে লাগে? বিদেশ থেকে আপনার কোনো আত্মীয় বা বন্ধু যদি আপনাকে মোবাইলে কল দেয়, তখন সামনে +৮৮০ বসাতে হয়। না বসালে কল আসবে না ঠিকভাবে।

এবারে আসল প্রশ্ন, কেন? কেন দেশের বাইরে থেকে কল করতে গেলে আমাদের নম্বরের আগে জুড়ে দিতে হয় +৮৮০-এর মতো একটি কোড? এই কোড কতটা জরুরি? চলুন, বিষয়টার ভেতরের কাহিনি জেনে নেওয়া যাক।

সংখ্যায় লেখা ঠিকানা

পুরো ব্যাপারটা বোঝার জন্য মোবাইল নম্বরকে আমাদের বাসার ঠিকানার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ধরুন, আপনি বিদেশে থাকা কোনো বন্ধুকে চিঠি পাঠাবেন। খামের ওপরে কী লিখবেন? নিশ্চয়ই শুধু বাসার নম্বর আর রাস্তার নাম লিখবেন না। কারণ, শুধু ওটুকু লিখলে চিঠিটা সেই বাসা বা রাস্তায় পৌঁছাবে না। আপনাকে লিখতে হবে এলাকার নাম, শহরের নাম, পোস্টকোড এবং সবচেয়ে জরুরি—দেশের নাম।

মোবাইল নম্বরও ঠিক একইভাবে কাজ করে। এটি আপনার মোবাইলের জন্য বরাদ্দ করা ডিজিটাল ঠিকানা। এই ঠিকানার শেষের ৮টি সংখ্যা আপনার বাসার নম্বরের মতো। ইংরেজিতে এটাকে বলা হয় ‘সাবস্ক্রাইবার নম্বর’। এই সংখ্যাটা ইউনিক বা অনন্য, নির্দিষ্ট করে শুধু আপনাকে শনাক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর আগের ২টি সংখ্যাকে বলা হয় অপারেটর কোড। যেমন ১৭, ১৮ বা ১৯। আমরা জানি, ১৭ দিয়ে বাংলাদেশে গ্রামীণফোনকে চিহ্নিত করা হয়, ১৮ দিলে বোঝায় রবি, ১৯ দিলে বোঝায় বাংলালিংক। হয়তো খেয়াল করেছেন, গ্রামীণফোন এখন নতুন করে ১৪ অপারেটর কোডটি ব্যবহার করছে, বাংলালিংক ব্যবহার করছে ১৩। ফলে মোবাইল নম্বর শুরু হচ্ছে (সামনের ০ বাদ দিয়ে) ১৩……..—এভাবে।

সামনের শূন্যটা আসলে বাংলাদেশের কান্ট্রি কোড +৮৮০-এর অংশ। একইভাবে ভারতের কান্ট্রি কোড +৯১, যুক্তরাষ্ট্রের +১। ঠিক ধরেছেন, কান্ট্রি কোড দিয়ে বোঝায় দেশের নাম। +৮৮০ দিয়ে বোঝায় বাংলাদেশ।

কেউ যখন বিদেশ থেকে কোনো নম্বরে কল করেন, তখন এই পুরো ঠিকানাটি দরকার হয়। নাহলে বিশ্বজুড়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ফোনের ভিড়ে ওই কলটি পথ হারিয়ে ফেলবে। বুঝতেই পারবে না, কোন দেশে যেতে হবে।

কান্ট্রি কোড কোত্থেকে আসে

হয়তো প্রশ্নটা ইতিমধ্যেই মনে মনে ভেবে ফেলেছেন আপনি। কে ঠিক করল যে বাংলাদেশের কোড হবে ৮৮০, ভারতের ৯১, আর যুক্তরাষ্ট্রের ১? এই কাজটি করে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন বা আইটিইউ (ITU)। এটি জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা। মজা করে বলতে পারেন, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার অভিভাবক (কর্তৃপক্ষ)।

সারা বিশ্বে যাতে ফোনকল ব্যবস্থা নির্বিঘ্নে এবং সুশৃঙ্খলভাবে চলে, তা নিশ্চিত করাই আইটিইউর কাজ। এই সংস্থার আইটিইউ-টি (ITU-T) বিভাগটি টেলিকমিউনিকেশন স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন সেক্টর নামেও পরিচিত। এই বিভাগ ই.১৬৪ (E.164) নামে একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। এই নীতিমালা মেনেই গঠিত হয় সারা বিশ্বের সব মোবাইল নম্বর। এই নীতিমালার অংশ হিসেবেই প্রতিটি দেশকে এক বা একাধিক স্বতন্ত্র ‘কান্ট্রি কোড’ দেওয়া হয়।

+৮৮০-এর অ্যানাটমি

এবার আমাদের কান্ট্রি কোড +৮৮০-এর প্রতিটি অংশের অর্থ খতিয়ে দেখা যাক। প্রথমেই আছে একটা যোগ চিহ্ন। এই ছোট্ট চিহ্নটির কাজ অনেক বড়। এর নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল আক্সেস কোড’। আপনি যখন কোনো নম্বরের আগে এই + চিহ্ন ব্যবহার করেন, তখন মূলত ফোনের নেটওয়ার্ককে বোঝাতে চান, এই কল দেশের বাইরে যাবে। এটি একটি সর্বজনীন প্রতীক।

এরপর আসে ৮৮০ বা কান্ট্রি কোড। এই কোডের পেছনের ঘটনা হলো, আইটিইউ ভৌগোলিক অঞ্চল অনুযায়ী গোটা বিশ্বকে ৯টি জোন বা অঞ্চলে ভাগ করেছে। এর মধ্যে ৮ নম্বর জোনটি পূর্ব এশিয়ার জন্য সংরক্ষিত। এই জোনের মধ্যে ‘৮০’ সংখ্যাটি বিশেষভাবে বরাদ্দ করা হয়েছে বাংলাদেশকে বোঝাতে। অর্থাৎ ৮৮০ বোঝায়, পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ। (এখানে বলে রাখি, এমনিতে ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অংশ। তবে মোবাইল নম্বরের বিভাগ অনুসারে, উত্তর আমেরিকার জন্য ১, আফ্রিকার জন্য ২, দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপের জন্য ৩, উত্তর ইউরোপের জন্য ৪, লাতিন আমেরিকার জন্য ৫, ওশেনিয়ার জন্য ৬, রাশিয়া ও কাজাখস্তানের জন্য ৭—ইউএসএসআরের বাকি অংশটা ৩ ও ৯-এর আওতায় পড়বে, পূর্ব এশিয়া ৮ এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার জন্য বরাদ্দ ৯। এর মধ্যে বাংলাদেশ পড়েছে ৮-এর ভাগে।)

যেভাবে বিশ্বজুড়ে মোবাইল কল করা হয়

ধরুন, আপনি বিদেশে বসে আছেন। +৮৮০ দিয়ে শুরু একটি নম্বরে ডায়াল করলেন। এবারে কী ঘটবে?

প্রথমেই আপনি যে দেশে আছেন, সেই দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক + চিহ্ন দেখে বুঝে ফেলে, কলটি একটি আন্তর্জাতিক কল। এরপর সেটি এই কলকে পাঠিয়ে দেবে সে দেশের ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়েতে (IGW)। এই গেটওয়ে হলো আন্তর্জাতিক ফোনকল আদান-প্রদানের দরজা।

গেটওয়ে প্রথমেই পড়বে কান্ট্রি কোড। ৮৮০ পড়ে বুঝতে পারবে, এই কলের গন্তব্য বাংলাদেশ। তখন এটি সাবমেরিন কেবল বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশের কোনো একটি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে।

বাংলাদেশের গেটওয়ে কলটি গ্রহণ করার পর নম্বরের পরের দুটি সংখ্যা দেখবে। যেমন ১৭। এই কোডটি দিয়ে সে বুঝবে, এটি গ্রামীণফোনের নম্বর। তখন কলটিকে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এবারে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক নম্বরের শেষ অংশ বা সাবস্ক্রাইবার নম্বরটি খুঁজে বের করে আপনার ফোনটিকে সংযুক্ত করে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠবে আপনার মোবাইল।

এই পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, একটা কল করার আগে আপনি মোটেও এত কিছু ভাবেন না। আপনার যেন ভাবতে না হয়, নির্বিঘ্নে কথা বলতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করাই প্রযুক্তিবিদদের কাজ।

এবারে শূন্য রহস্য: নম্বরের প্রথম ০ আন্তর্জাতিক কলের সময় কোথায় হারিয়ে যায়?

এটা খুব সাধারণ প্রশ্ন। আমরা যখন দেশের ভেতরে ০১৭… নম্বরে কল করি, তখন তো শুরুতে ০ ব্যবহার করি। কিন্তু আন্তর্জাতিক কলের সময় +৮৮০ লেখার পর শূন্য (০) বাদ দিয়ে ১৭… এভাবে লিখি। কেন?

কারণ, নম্বরের সামনের এই শূন্যকে বলা হয় ‘ট্রাঙ্ক প্রিফিকস’। এর কাজ হলো, দেশের ভেতরের এক শহর থেকে অন্য শহরে বা এক নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্কে কল করতে সাহায্য করা। এটি লোকাল নেটওয়ার্ককে জানায়, এই কলটি জাতীয় পর্যায়ের।

কিন্তু আপনি যখন +৮৮০ ব্যবহার করেন, তখন সামনের + চিহ্নটিই সেই নির্দেশনা দিয়ে দেয়। ফলে জাতীয় পর্যায়ের কল বোঝাতে শূন্যটার (০) আর দরকার পড়ে না। এই হলো শূন্য রহস্য, আন্তর্জাতিক পরিসরে যে কারণে শূন্যটা হারিয়ে যায়।

এই লেখা পড়ে থাকলে এবারে আপনি ভাবতে পারেন, এতদিনে আপনি নিজের মোবাইল নম্বরের ব্যাখ্যাটুকু জানেন। মজার না ব্যাপারটা?



জন্মদিনের বিস্ময় – Birthday Paradox

ধরুন, একটা ঘরে বসে আছেন কয়েকজন বন্ধু। হঠাৎ কেউ প্রশ্ন করল—

"কতজন মানুষ থাকলে অন্তত দুজনের জন্মদিন একই দিনে হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% ছাড়াবে?"

প্রথমে হয়তো ভাববেন, ৫০-৬০ জন লাগবে, হয়তো একশো জন!

কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো—উত্তরটা মোটে ২৩ জন।

একে বলে Birthday Paradox।

এটা আসলে কোনো ম্যাজিক নয়, খাঁটি গণিত।

কারণ ২৩ জন মানে শুধু ২৩টা জন্মদিন নয়—বরং ২৫৩টা আলাদা জোড়া। এতগুলো সম্ভাবনা একসাথে যোগ হলে অন্তত একটা মিল পাওয়ার সুযোগ অর্ধেকের বেশি হয়ে যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে:

২৩ জন থাকলে সম্ভাবনা ≈ ৫০.৭%

৩০ জন থাকলে সম্ভাবনা ≈ ৭০%

৫০ জনে সম্ভাবনা ≈ ৯৭%

আর ৭০ জনে পৌঁছালে, জন্মদিন মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত—৯৯.৯%!



 বিদ্যাসাগরের কথা

১৮৫৩ সালের কোন একদিনের ঘটনা। হুগলী দশঘরার এক অভিজাত বাড়ি। বেলা ১১টা। ঘরের মধ্যে চলছে এক আলোচনা সভা। পাড়ার গন্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত। জলখাবারের জন্য আছে লুচি ছোলার, ডাল, নানা মিষ্টি। সুখাদ্যের সুঘ্রানে ঘর মাতোয়ারা। আহার শেষে হবে আলোচনা। বিষয়বস্তু একটি মেয়েদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। কিন্তু গ্রামের মানুষেরা মেয়েদের বাইরে আসতে দিতে নারাজ। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আমন্ত্রন জানানো হয়েছে। চলছে তারই প্রস্তুতি।

এমন সময় একটি সাদা থান পড়া ছোট্ট ৬/৭ বছরের মেয়ে দৌড়ে এলো ঘরে, "বাবা বাবা, মা কে বলোনা, আমার খুব খিদে পেয়েছে। দাদারা লুচি খাচ্ছে, আর আমি চাইলেই মা বলছে, ছিঃ আজ একাদশী না। খাবার কথা বলতে নেই মা। কিন্তু বাবা, আমি সকাল থেকে কিচ্ছু খাইনি। একটু জল পর্যন্ত না। তুমি, মা, দাদারা কেউ একাদশী করোনা। আমায় কেন করতে হবে! আমার বুঝি খিদে পায়না?"

সকলের সামনে লজ্জায়, আর মেয়ের প্রতি মায়ায় করুণ হয়ে ওঠে গৃহকর্তার মুখ। আস্তে করে বলেন, "এখানে সভা চলছে মা, তুমি ঘরে যাও।"

করুণ দৃষ্টিতে সকলের পাতের দিকে তাকিয়ে বিফল মুখে ভেতরের ঘরে ঢুকে যায় একরত্তি অভাগা মেয়েটি। তারপরেই রূপোর থালা বাটিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্য সুখাদ্য সাজিয়ে ঘরে আসে বামুন ঠাকুর। বিদ্যাসাগর বলেন, "শরীরটা ঠিক নেই,আমি খাবোনা কিছু। নিয়ে যাও।"

শুরু হয় সভা। গ্রামের মানুষদের কাছে প্রথমেই বিদ্যাসাগর তুলে ধরেন নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা। নারী শিক্ষা বিষয়ে শ্লোকগুলি বলতে থাকেন একের পর এক। তীক্ষ্ণ যুক্তি, উদাহরন আর বাগ্মীতার সামনে ভেঙে পড়ে সংস্কারের দেওয়াল।

সকলে চলে যাবার পর গৃহকর্তাকে বিদ্যাসাগর বলেন, "আমি নারীদের শিক্ষার জন্য ছুটছি, কিন্তু এই বিধবা নারীরা, তাদের দুঃখ,তাদের প্রতি এই ধর্মীয় অমানবিকতা এই দিকে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলাম আমি। ছিঃ ছিঃ, ভাবতেই আমার গ্লানি হচ্ছে। রামমোহন রায় মহাশয় তাদের বাঁচিয়ে ছিলেন জ্বলন্ত চিতা থেকে। কিন্তু ওরা মরছে, রোজ জ্বলছে খিদেয়, অবহেলায়,অমানবিকতায়। আপনার কন্যা আজ চোখ খুলে দিয়েছে।"

শুরু হোল লড়াই। কলকাতার রক্ষনশীল দল, পুরোহিত সমাজ বিধবা বিবাহের ঘোর বিপক্ষে। তারা কিছুতেই মেনে নেবেনা এই অনাচার। তারা পাল্টা আবেদন করেছে সরকারের কাছে, ধর্মবিরোধী এই আইন চালু হলে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে তারা। বিদ্যাসাগরের বাড়ির সামনে চলছে প্রতিবাদ ব্যঙ্গ বিদ্রুপের ঝড়। নারীদের প্রতি তাঁর সহানুভুতি নিয়ে অশ্লীল কটুক্তি। বাড়িতে যখন তখন পড়ছে ঢিল, ময়লা, আবর্জনা।

একদিন বিদ্যাসাগরকে হামলার মুখেও পড়তে হয়েছে রাস্তায়।

এইসব কটাক্ষেও কিন্তু বিদ্যাসাগর অনড়। বড়লাটের দপ্তর বলেছে বেদ পুরানে কি কোন উদাহরন আছে পুনর্বিবাহের? না হলে আইন পাশ করা মুশকিল। রক্ষনশীলদের চটিয়ে কিছু করার ইচ্ছা নেই ডালহৌসির।

তাই রাতের পর রাত জেগে পুঁথি পত্র পড়ছেন তিনি। অবশেষে পাওয়া গেলো সেই মুক্তো। পরাশর সংহিতার অমর সেই শ্লোক "নষ্টে মৃতে প্রবরজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ/ পচস্বাপতসু নারীনাং পতিরন্যো বিধয়তে।"(স্বামী মারা গেলে, সন্ন্যাস নিলে, নিখোঁজ হলে, সন্তানগ্রহনে অক্ষম হলে অধার্মিক ও অত্যাচারী হলে পত্নী আবার বিবাহ করতে পারে।)

তিনি ছুটলেন সরকারের দ্বারে। প্রমান করলেন বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। আর বাধা রইলো না কিছুই। এমনই নানা বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে শেষমেশ বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হল।

দাশরথি রায় আর শান্তিপুরের তাঁতিরা দাঁড়ালেন বিদ্যাসাগরের পক্ষে। ‘বিদ্যাসাগর পেড়ে’ শাড়ি বুনলেন তাঁতিরা। পাড়ে লেখা থাকল বিদ্যাসাগরের জয়গান, ‘সুখে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হ’য়ে।’

এর পাল্টা বাঙালি শুনল, ‘শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে।’

প্রবল বিরুদ্ধবাদীরা ভাবলেন, আইনে কী বা হয়। কিন্তু সেই ধারণাও গুঁড়িয়ে গেল ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর। আইনসম্মত বিধবা বিবাহ হল শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং কালীমতী দেবীর।

বিদ্যাসাগরের জয় হলেও এই বিয়ের সূত্রেই তাঁর বৌদ্ধিক ধারণায় নেমে এল আঘাত। এ বার রমাপ্রসাদ রায়ের কাছ থেকে। তিনি এ বিয়েতে আসবেন বলেছিলেন। কিন্তু বিয়ের কিছু দিন আগে তিনি জানালেন, এ বিয়েতে তাঁর মনে মনে মত রয়েছে। সাধ্য মতো সাহায্যও করবেন। কিন্তু বিবাহস্থলে না-ই বা গেলেন!

ঈশ্বর সব বুঝলেন। আর দেওয়ালে টাঙানো মনীষীর ছবিটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, "ওটা ফেলে দাও, ফেলে দাও।"

ছবিটি রাজা রামমোহন রায়ের। রমাপ্রসাদ তাঁরই পুত্র।

রমাপ্রসাদ যে আঘাত দিলেন, পথে নেমে কুৎসিত ভাবে তা-ই যেন প্রকট করল সে কালের বাঙালি জনতার বড় অংশ।

বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার ‘অপরাধে’ সমাজে একঘরে করা হল বিদ্যাসাগরকে।

পথে বেরোলেই জোটে গালমন্দ, ঠাট্টা, অশালীন ইঙ্গিত। কেউ বা মারধর, খুনের হুমকিও দেয়। ব্যাপারটা শুধু হুমকিতে থামল না। বিদ্যাসাগর শুনলেন, তাঁকে খুন করার জন্য ভাড়াটে গুন্ডাদের বরাত দিয়েছেন কলকাতার এক নামী ব্যক্তি। বিদ্যাসাগর নিজেই সেই তথাকথিত নামীর ঘরে গেলেন। বললেন, ‘শুনলাম, আমাকে মারবার জন্য আপনাদের ভাড়াটে লোকেরা আহার-নিদ্রা ছেড়ে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।’

এই সময়পর্বে ছেলেকে রক্ষার জন্য ঠাকুরদাস বীরসিংহ থেকে জেলে-সর্দার তথা লেঠেল শ্রীমন্তকে বিদ্যাসাগরের কাছে পাঠান। ঠনঠনের কাছে এক হামলার উপক্রম থেকে বিদ্যাসাগরকে রক্ষাও করলেন শ্রীমন্ত সর্দার।

শুধু সমাজ নয়, বাঙালির বড় আপনজন, বড় গর্বের ব্যক্তিরও বিদ্যাসাগরকে বুঝতে সমস্যা হল—

‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের সূর্যমুখীকে দিয়ে বঙ্কিম লেখালেন, ‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে না কি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?’

আমাদের তৎকালীন আধুনিক অনেক এলিট বুদ্ধিজীবীও তাদের মননের বাটখারায় শুদ্ধ মাপে অপারগ হয়েছিলেন বিদ্যাসাগরকে মাপতে। যার কারণে জীবনের শেষ বত্রিশ বছর বন্ধুহীন, সমাজহীন হয়ে সরল সাঁওতালদের অগরল সান্নিধ্য গ্রহন করতে হয়েছিল তাঁকে।

বিদ্যাসাগরের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, "আশ্চর্যের বিষয়, কি করে ভগবান ৪ কৌটি বাঙালির মধ্যে একটি মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন।"

২৬শে জুলাই, ১৮৫৬ সালে পাশ হয়েছিল বিধবা বিবাহ আইন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজ সংস্কারের জন্য যে কয়টি আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আন্দোলন তার অন্যতম। এই নবজাগরনের অন্যতম পথিকৃত ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

বিদ্যাসাগর নবজাগরণের অগ্রদূত, ঘোর অন্ধকারের আলোক বর্তিকা! মানবিকতা, বাগ্নীতা আর মেধার এক অসাধারণ সমন্বয়! 


খৃষ্টধর্মের কট্টর অনুসারী এবং  বিবর্তনের তত্ত্ব 

জন নামে ২৫ বছর বয়সী এক বিজ্ঞান শিক্ষক, যিনি ছেলেদের ফুটবল কোচ -ও বটে; তিনি পড়ান বায়োলজি। একদিন তাঁর তলব হলো কর্তাদের কাছে।

"আপনি বায়োলজি পড়ান ?" ,

" হ্যাঁ "

"কোন বই থেকে পড়ান ?"

" কেন জর্জ হান্টারের - আ সিভিক বায়োলজি। এটা-ই তো সবচেয়ে ভালো বই।"

" ওই বইতে কি ডারউইনের বিবর্তন তত্ব আছে ?"

"তা তো আছেই , ও বাদে বায়োলজি পড়ান যায় নাকি ?"

" তো সেই তত্বে কি কোথাও বলা আছে যে মানুষ আগে বানর ছিল?"

" না, ঠিক ওই ভাবে বলা নেই। বলা আছে, প্রাকৃতিক নির্বাচন নামক এক প্রক্রিয়া তে এক প্রজাতি আরেক প্রজাতি তে রুপান্তরিত হচ্ছে। সেইভাবেই একদিন বনমানুষ জাতীয় স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব হয় , আর সেইভাবেই তার বিবর্তনের মধ্যে দিয়েই একদিন হোমো সাপিয়েন্স বা আজকের মানুষের উদ্ভব হয়।"

" কিন্তু বাইবেলে যে বলা আছে অন্য কথা - ' And God said, Let us make man in our own image, after our likeness' .

"বাইবেল তো ধর্মপুস্তক। আমি তো পড়াই বিজ্ঞান।"

"যে বিজ্ঞান ছেলেদের বাইবেল বিরোধী কথা শেখায় , সে বিজ্ঞান পড়ানো এই টেনেসি স্টেটে আইনতঃ নিষিদ্ধ। আপনি বড়জোর বলতে পারেন ইতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে বিবর্তন দেখা গেছে , কিন্তু মানুষ কে ঈশ্বর তাঁর প্রতিরূপে নির্মাণ করেছেন।"

উইলিয়াম জেনিংস একজন গভীর ধার্মিক, বাস করতেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি প্রদেশ -এ। বিশের দশকে ৩ বার আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদের জন্য লড়েছিলেন, কিন্তু সফল হননি একবারও। যদিও তিনি নিজ স্টেট টেনেসি -তে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি স্কুলের কোমলমতি ছাত্রদের কিছুতেই চার্লস ডারউইনের বিবর্তন পর্ব যেন না পড়ান হয় তার জন্য লড়েছিলেন। পবিত্র বাইবেল অনুযায়ী, ঈশ্বর বলছেন, "আমার প্রিয় মানুষ জাতিকে আমি আমার আকারেই সৃষ্টি করেছি। আর ডারউইন সাহেব নাকি বলেছেন , মানুষ বানরের বংশধর। ক্লাসে এই সব আজগুবি পড়লে তো খ্রিস্টধর্ম এক্কেবারে রসাতলে যাবে। ১৯২৫ সালে আমেরিকার অন্তত ১৫ টি স্টেটে বিবর্তন -তত্ব পড়ানো বন্ধ হয়ে যায়।

পরবর্তীতে আমেরিকার বিজ্ঞানীরা সব এক হয়ে কোর্টে মামলা করেন। তাঁদের ডারউইন তত্বে উইলিয়াম জেনিংস মামলা করলেন আর বললেন চুড়ান্ত বিদ্রুপের সঙ্গে -" ছ্যা ,বলে কিনা মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল বানর এবং আমেরিকান নয়, ওল্ড ওয়ার্ল্ডের বানর "।

১৯২৬ সালে, এক বছর পরে সুপ্রিম কোর্ট, নিম্ন আদালতের রায় খারিজ করে বলে - ' এই বিদকুটে ( Bizarre ) মামলাটিকে আর টেনে নিয়ে যাওয়ার মানে নেই কোনো' ।

এই রায় খ্রিস্টীয় মৌলবাদী শক্তিকে বেশ জোর ধাক্কা দেয়। ১৫ টি রাজ্যের মধ্যে ২ টি ছাড়া বাকিগুলো কিন্তু মামলা তুলে নেয়। তারপরও খৃষ্টধর্মের কট্টর অনুসারী এবং প্রচারকরা বিবর্তনের তত্ত্বকে একদমই মানতে চায় না। কারণ বিবর্তন তত্ত্ব আদম হওয়ার আদিপাপের তত্ত্বটিকে এক ফুৎকারে অলীক কাহিনী হিসেবে উড়িয়ে দেয়।

আমেরিকান এপিস্কোপাল চার্চ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিবর্তন বাদের উপর কোর্টের , ‘ এই অনুসিদ্ধান্ত (বিবর্তন তত্ত্ব) যদি সঠিক প্রমাণিত হয়, তাহলে বাইবেল একেবারেই একটা রদ্দি গল্প হিসাবে পরিণত হবে। আর সেই সাথে তা এমনই একখানা গল্প হবে, যা প্রায় দু'হাজার বছর ধরে খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীদের একটা দানবীয় মিথ্যের দ্বারা প্রতারিত করে আসছে।"

যদিও শুধু খ্রিস্ট ধর্ম নয়, সেমেটিক ধর্মগুলোরও প্রায় এক রা। যাক সে কথা। অনেকে ভুল ভেবে থাকেন যে, জঙ্গলে গাছের ডালে কিংবা চিড়িয়াখানায় খাঁচার রডে ঝুলে থাকা আধুনিক বাদঁর (মাঙ্কি) বা শিম্পাঞ্জিগুলো থেকেই বুঝি মানুষের উদ্ভব হয়েছে। আসলে ব্যাপারটা তা নয়।

বিবর্তন তত্ত্ব বলছে যে, আমরা আসলে এসেছি বহুদিন আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক ধরনের সাধারণ পূর্বপুরুষ হিসেবে কথিত প্রাইমেট থেকে।

মাঙ্কি বা বানর থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নি, বরং সঠিকভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ প্রজাতিরও উদ্ভব ঘটেছে বহুদিন আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক ধরনের বানর জাতীয় কোন সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে।

এখানে 'বানর জাতীয়' বলতে প্রাইমেট বঝানো হচ্ছে, মাঙ্কি বা বানর নয়। শুধু মানুষই নয়, শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং ওরাংওটাং-এর মতো প্রাণীকূলেরও উদ্ভব ঘটেছে সেই একই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে।

মানুষ সহ সব বনমানুষই স্তন্যপায়ী প্রানীর অন্তর্গত প্রাইমেট বর্গে পড়েছে। এখন পর্যন্ত প্রাইমেটদের দু'শরও বেশি প্রজাতির সন্ধান বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। মানুষকে এই প্রাইমেট বর্গের মধ্যে হোমিনিডি অধিগোত্রের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়।

খোদ চার্লস ডারউইনকেও এ সব কথা বলার জন্য বিপদে পড়তে হয়েছিল, তাঁকে নিয়ে বানরের আদলে ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকা হয়েছিল।

একবার অক্সফোর্ডে ব্রিটিশ এসোসিয়েশনের সম্মেলনে বিবর্তনের তীব্র বিরোধিতাকারী খ্রিষ্টান ধর্ম বিশপ স্যামুয়েল উইলবারফোর্স ডারউইনের তত্ত্বকে ঈশ্বরবিরোধী ব্যক্তিগত মতামত বলে আক্রমণ করেন। তিনি হঠাৎ করে সভায় উপস্থিত বিজ্ঞানী হাক্সলিকে উদ্দেশ্য করে জানতে চান তার দাদা এবং দাদীর মধ্যে কে আসলে বানর ছিলেন। তারই উত্তরে হাক্সলি বিবর্তনবাদের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বিশপকে তুলাধুণা তো করে ছাড়েনই বক্তৃতার শেষে এসে তিনি এও বলেন যে,

"যে ব্যক্তি তার মেধা, বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন ও বাগ্মিতাকে কুসংস্কার ও মিথ্যার পদতলে বলি দিয়ে বৌদ্ধিক বেশ্যাবৃত্তি করে, তার উত্তরসুরী না হয়ে আমি বরং সেইসব নিরীহ প্রাণীদের উত্তরসুরী হতে চাইবো যারা গাছে গাছে বাস করে, যারা কিচিরমিচির করে ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়।"

২০১২ সালের মে মাসে লন্ডনের প্রায় সকল পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়; ব্রিটিশ পাবলিক স্কুলে বাইবেলের "স্বর্গীয় উদ্যান কাহিনী" পড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের মতে ছাত্ররা বাইবেল ও বিজ্ঞান একসাথে পড়লে দ্বিধায় পড়ে যাবে। তারা না হবে ধার্মিক না হবে বিজ্ঞানী; ছাত্রের মনোজগৎ বিকাশ ব্যাহত হবে। তাই ব্রিটিশরা আইন করে বাইবেলের এই অধ্যায়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

সম্প্রতি ব্রিটিশ ইন্ডিপেন্ডেন্স নিউজ পেপার স্পষ্টভাবে লিখেছে; পোপ ফ্রান্সিসের মতে বিবর্তনের বাইরে "মানুষ" সৃষ্টির অন্য কোন তত্ত্বই প্রমাণিত না, তাই পোপ ফ্রান্সিস সৃষ্টিতত্ব ও বিবর্তনবাদ মেনে নিয়েছেন বাস্তব সত্য হিসেবে।


 মুসলমানদের মাদ্রাসা 

কলকাতা শহরের পত্তনের পর ইংরেজরা নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য এদেশীয়দের ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে চেষ্টা শুরু করল। তখন কম্পানির কাজের জন্য ইংরেজি ভাষা জানাটা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছিল। কলকাতায় তখন এখানে সেখানে ইংরেজি স্কুল গড়ে উঠতে শুরু করল। ১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার কিছু মুসলমান তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে দেখা করেন। ওয়ারেন হেস্টিংকে তারা জানাল, তারা ‘মজিদউদ্দীন’ নামের একজন পণ্ডিতের সন্ধান পেয়েছেন। সেই পণ্ডিতকে নিয়ে কলকাতায় একটা মাদ্রাসা গড়ে তুলতে পারলে কলকাতার মুসলমান ছাত্রেরা আইন শিখে সরকারকে কাজে সাহায্য করতে পারবেন। হেস্টিংস তাদের সেই প্রস্তাবে রাজি হলেন। তিনি মজিদউদ্দীনকে মুসলমানদের মাদ্রাসা চালাবার দায়িত্ব দিলেন। সেই মাদ্রাসা চালাবার জন্যে হেস্টিংস তখন মাসে ৬২৫ টাকা করে খরচ দিতেন। এর কিছুদিন পরে হেস্টিংস মাদ্রাসার নিজস্ব দালান তৈরির জন্য ৫,৬৪১ টাকা দিয়ে পদ্মপুকুরে একটা জমি ক্রয় করেন।

একবছর ধরে নিজের টাকায় মাদ্রাসা চালালেন হেস্টিংস। পরে কোম্পানির বোর্ডের কাছে ব্রিটিশ সরকারকে সেই মাদ্রাসা চালাবার দায় দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। এরপরে ইংল্যান্ডে হেস্টিংসের সেই প্রস্তাব জানিয়ে চিঠি পাঠানো হল। সরকারী খরচে সেই মাদ্রাসা চালাবার ব্যবস্থা এরও বছর খানেক পরে পাকাপাকি হল। কোম্পানির পুরানো নথি থেকে জানা যায় যে, হেস্টিংস একবছর ধরে সেই মাদ্রাসা চালাবার খরচা বাবদ ১৫,২৫১ টাকা আর পদ্মপুকুরের জমির দাম বাবদ ৫,৬৪১ টাকা তাকে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য বোর্ডের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

কলকাতায় যেখানে সেই মাদ্রাসার বাড়িটা ছিল সেই জায়গাটা অস্বাস্থ্যকর তো ছিলই, সাথে সেখানকার পরিবেশও ছাত্রদের জন্য উপযুক্ত ছিল না। তাই তখনকার দিনের কলকাতার মুসলমান প্রধান অঞ্চল ‘কলিঙ্গা’তে নতুন মাদ্রাসার বাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। পরবর্তী সময়ে এই কলিঙ্গা নাম পাল্টে হল ওয়েলেসলি স্কোয়ার।

১৮২৪ সালের ২৪শে জুলাই তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় সেই মাদ্রাসা স্থাপন প্রসঙ্গে লেখা হল , ১৫ জুলাই বৃহস্পতিবার শহর কলিকাতাতে এক মহম্মদী মদরসার মূল প্রস্তর সংস্থাপন হইয়াছে।” সেই মাদ্রাসাই বর্তমানে কলকাতার বুকে ‘আলিয়া মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়’ নাম নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।


ফ্রান্ৎস কাফকার মেটামরফোসিস’ ও আমাদের জীবন 

 যে গল্পটি সারা পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞানী মানুষকে বার বার ভাবিয়েছে ফ্রান্ৎস কাফকার সে প্রখ্যাত উপন্যাস ‘মেটামরফোসিস’ ও আমাদের জীবন নিয়ে আজ মজাদার খাবারের একটা রেসিপি তৈরি করব। মনোযোগ দিয়ে শুনলে আপনি অনেক কিছু পাবেন।

গল্পের মুল চরিত্র গ্রেগর নামে একজন ভ্রাম‍্যমাণ সেলস্ম‍্যান, চাকরি তার ভাল লাগত না, পরিবারকে টাকা যোগাতে সে বিরক্ত আর অনিহা নিয়েই প্রতিদিন কাজে যেত। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে আবিষ্কার করে, সে একটি বিশালকায় পোকায় পরিণত হয়েছে, প্রথমে সে মনে করেছিল এটা সে স্বপ্ন দেখেছে; কিন্তু পরে সে বুঝতে পারে সে সত্যি সত্যি সে পোকায় পরিণত হয়েছে অর্থাৎ তার রূপান্তর ঘটেছে। গ্রেগরের বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা,মা আর তার ছোট একটা বোন আছে। সেলসম‍্যানের চাকরি করে সে একাই পুরো সংসারের খরচ চালাত,তার আয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেচে থাকতো বাকি ৩জন মা-বাবা আর বোন। 

পোকায় রূপান্তর হবার পর ঘরেই সারাদিন বন্দী হয়ে থাকতে হতো গ্রেগরকে। কোথাও যাওয়ার জো ছিল না। এমনকি জানালাও খোলা রাখার অনুমতি ছিল না, পাছে কেউ দেখে ফেলে এই ভয়ে। আমাদের সমাজেও মানসিক রোগীদের এভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তাদেরকে একটি অসহ্যকর রসকষহীন জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়। ফলে এসব রোগীর শেষ জীবনীশক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে যায়। গল্পের নায়ক গ্রেগরকে এভাবেই বাবা-মা বাড়িতে তার ঘরেই বন্দি করে রাখে। বাড়ির একমাত্র  আয়ের উৎস পুরুষটি অক্ষম হয়ে গেলে কিভাবে বাড়ির সকল সদ‍স‍্যকে অর্থ উপার্জনের রাস্তায় পা বাড়াতে হয়, গল্পের পরের অংশে সেটাই ফুটে উঠেছে। গ্রেগরের  অলস‍্ বৃদ্ধ বাবা যোগ দেন ব‍্যাঙ্কের দারোয়ানরূপে,মা শুরু করেন সেলাই কাজ, আর কিশোরী বোন কিছু একটা। আয়ের অংশীদার না হওয়ায় গ্রেগর ধীরে ধীরে সকলের কাছে চরম বোঝা হয়ে গ্রেগর শেষ পর্যন্ত করুনভাবে মৃত‍্যুবরণ করে। তার মৃত‍্যুতে যেন একরকম হাঁপ ছেড়ে বাঁচে তার পরিবার। 

এই গল্পের মাধ্যমে আমরা ৩টি বিষয়ে শিক্ষা পাই। ১) বাধ্য হলে মানুষ সবকিছু করতে পারে। বাধ্য হওয়ায় সংসারের বাকি তিনজন মানুষ আত্মনির্ভরশীল হবার প্রচন্ড চেষ্টা করে সফল হয়েছে, যেটা এতদিন আরামে থাকাকালীন সম্ভব হয়নি।  গোটা পরিবার এক সময় গ্রেগরের উপর নির্ভর করত। একান্ত বাধ্য হয়েই তারা  আস্তে আস্তে গ্রেগরকে ছাড়াই নিজেরা টিকে থাকার পথ খুঁজে নেয়। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়- সমগ্র ইউরোপ প্রায় সারা বছর বরফে ঢাকা থাকে। খাবার সংগ্রহ করার জন্য ইউরোপীয়দেরকে বছরের পর বছর  দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে হত। আমেরিকা আবিস্কার না হলে ইউরোপীয়দেকে ভাগ্য অন্বেষণে এখনো ভারতে আসতে হতো। অন্যদিকে তখন আমাদের পরিবারে গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছ থাকায় আমরা গল্পের তিন জন (বাবা-মা আর বোনের মত) নিজের মধ্যকার শক্তিকে বিলুপ্ত করে অকরমণ্য হয়ে জীবন কাটিয়েছিলাম। আর এখন খাবারের অভাবে পড়ে বাঙালিরা সারা বিশ্বে মরনপণ শ্রম দিয়ে সাবলম্বী হচ্ছে। এখানে মূল শিক্ষা হল, পরিবারের কারো উপর হেলান দিয়ে জীবন কাটিও না, নিজের হাত-পা মস্তিষ্ক ব্যবহার করে কিছু কর।

দ্বিতীয় শিক্ষা হল- মা ভা্‌ল, না বাপ ভাল, সবচেয়ে ভাল টাকা। যতদিন আপনি কিছু দিতে পারবেন, সব জায়গায় আপনার দাম থাকবে। আর যখন পারবেন না, আপন রক্তও আপনাকে চিনবে না, এটাই জীবন। অর্থাৎ জন্ম নেয়া মানেই পানিতে পড়া, যতক্ষণ নিঃশ্বাস আছে, ততক্ষণ সাতার কাটতে হবে, হাত-পা গোটিয়েছেন তো পানিতে তলিয়ে যাবেন। তেলেপোকার মত ঘৃণিত জীবনও যদি আপনার হয়, তবুও কখনো হার মেনে নিবেন না, পরনির্ভরশীল হবেন না। নিজের প্রতিবন্ধী জীবনকে ঘৃণা করতে শিখুন। কেউ দিবে, কারো দয়া হবে, এমন দরবেশী আশা ছাড়ুন। এক লোকের পেশাই ছিল সৈনাস, না খেয়ে থাকা, উপোস করা তার অভ্যাস। এর ফলে রক্ত শূন্যতা, আর কিড়নি অকেজো হয়ে একদিন সে মারা যায়। মরার পর ইশ্বরকে সে বলল, পর্যাপ্ত খাবার পায়নি বলেই সে অনাহারী হয়ে মরেছে। ইশ্বর বলল, যেখানে মানুষ অতিরিক্ত খাবারের কারণে মোটা হয়ে দলে দলে মরছে, সেখানে তুমি কেন খাবার পাওনি? পৃথিবীতে সব ভাল ভাল খাবার তোমার জন্য ছিল, ্কিন্তু খাবার সংগ্রহের জন্য যা করা দরকার ছিল, তা তুমি করনি। তুমি নিজেই নিজেকে প্রতিবন্ধী বানিয়ে  অক্ষম ব্যক্তি হিসেবে পৃথিবী থেকে বিধায় নিয়েছ। কাজেই হতাশা-ব্যর্থতা, রাগ অভিমান সব আমদেরকে ঘিরে ফেলুক কিন্তু অক্ষম্তা যেন কাছে ঘেষতে না পারে সে চেষ্টাই করে যেতে হবে।

গল্পের তৃতীয় শিক্ষা হল-শিকল ভাঙ্গার ্স্বপ্ন দেখো। অবাস্তব কল্পনা, অযথা ভয়, হীনমন্যতা এসবের শিখল ্ভেঙ্গে বেরিয়ে আস। শরীর থেকে ক্যান্সারের জিবানু বের করার চেয়ে জরুরী হলো পরাজিত মানসিকতা পরিহার করা। মনে রাখবেন, সাহিসীর সবই হয়, আর ভীরু ব্যক্তিকে সব হারাতে হয়। আপনার মনে যদি ভয় বা নেতিবাচক কল্পনা থাকে, আপনি মানুষ থেকে তেলোপোকা হয়ে যাবেন। সবা্র ঘৃণা আর লাথিই হবে সম্বল। অপরদিকে আপনার বাস্তবসম্মত সাহসী চিন্তাই আপনাকে এগিয়ে রাখবে। মানুষ যা কিছু করে, প্রথমে তা তার মাথায় আসে, তারপর সেভাবে হাত-পা চলে। মাথায় যদি সারাক্ষণ যৌন চিন্তা খেলা করে, তাহলে আপনি যৌন অপরাধ করতে বাধ্য, যদি হতাশা,ভয় মাথা দখল করে, তাহলে মানুষ থেকে তেলেপোকায় রূপান্তর হবেন আপনি। আর যদি ইতিবাচক ও সাহসী চিন্তায় মন উজ্জিবিত করতে পারেন, নেতৃত্ব আপনাকে ছাড়বে না। 



'The Imp and the Crust' 'দ্য ইম্প অ্যান্ড দ্য ক্রাস্ট'


প্রয়োজনের অতিবিক্ত অর্থ কারো জীবনে মঙ্গল আনে না, বরং বংশ পরম্পরায় ধংস ডেকে আনে।

তলস্তয়য়ের "'The Imp and the Crust' 'দ্য ইম্প অ্যান্ড দ্য ক্রাস্ট' নামের গল্পটির সারমর্ম সবার জানার সুবিধার্থে অতি সংক্ষেপে বলছি


  এক গরিব চাষী লাঙল নিয়ে মাঠে এসেছে জমি চাষ করতো।দুপুরের খাবারের জন্য সঙ্গে থাকত এক টুকরো রুটি । সে তার গায়ের জামা খুলে তা দিয়ে রুটিখানা পেঁচিয়ে রেখে দিত এক ঝোপের দিল। দুপু্রে চাষীর খিদে পেলে সে ঝোপের কাছে এল। কিন্তু জামাটা খুলেই সে অবাক! দেখে রুটির টুকরোটি সেখানে নেই। সে আশেপাশে অনেক খুঁজল কিন্তু রুটি্র টুকরাটি কোথাও খুজে পেল না। চাষী খুব অবাক হল এবং মনে মনে ভাবল, তাজ্জব ব্যাপার তো, আশে-পাশে কেই নেই অথচ রুটিটা গায়েব! নিশ্চয়ই ক্ষুধার্থ কেউ রুটি নিয়ে পালিয়েছে। রুটির টুকরো হারিয়ে চাষীর মনে দুঃখ হলেও সে মনে মনে বলল; আমি তো খিদেয় মরে যাব না। নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত লোক ওটা নিয়ে পালিয়েছে, চোর হলে তো জামাটাই নিয়ে যেত। চাষী কুয়োর কাছে গেল। সেখান থেকে পেট ভরে পানি পান করল। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আবার জমি চাষ করতে লাগল।

  রুটির টুকরা হারিয়ে যাবার আসল কারণ হল- এক শয়তান বা ভুত রুটিটি সরিয়েছে। সে মনে ্করেছিল রুটি হারিয়ে চাষী ক্ষিধেয় অতিষ্ট চাষি চিৎকার করে গালাগালি করবে।  এটা দেখে সে মজা পাবে। কিন্তু চাষীকে তেমন কিছু করতে না দেখে খুবই হতাশ হল। শয়তান অবশেষে তাদের সরদারের কাছে গিয়ে সব খুলে বলল। শয়তান সরদার তার কথা শুনে ভয়ানক চোটে গেল, বলল- যদি তিন বছর সময়ের মধ্যে সে ওই চাষীকে বিপথে না-আনতে পারে তবে তাকে আর দলে রাখা হবে না । সরদারের কথায় শয়তান ভয় পেয়ে গেল। ভাবতে লাগল, কী করা যায়। ভাবতে ভাবতে একটা মতলব শয়তানের মাথায় এল। সে এক দিন মজুর সেজে সেই গরিব চাষীর বাড়িতে গিয়ে এক টুকরা রুটির বিনিময়ে কাজ করতে চাইল। চাষী তার কথায় রাজি হল। প্রথম বছর চাষী তার চাকর শয়তানের পরামর্শে নিচু জমিতে ফসল বুনল। সে বছর বৃষ্টি খুব কম হল। খড়ায় সবার ফসল নষ্ট হয়ে গেল আর গরিব চাষীর দ্বিগুণ ফসল ফলল, দামও ্কয়েকগুণ বেশি পেল।

  শয়তান পরের বছর অপেক্ষাকৃত উঁচুভূমিতে ফসল ফলাতে চাষীকে পরামর্শ দিল। চাষী তাই করল। সেবার গ্রীষ্মের সময় অতি বৃষ্টির কারণে সমতল ও নিচু জমির সব ফসল নষ্ট হয়ে গেল। আর চাষী উঁচুজমির ফসল আগের বছরের চেয়েও ভালো হল। শয়তান তখন চাষীকে এক নতুন পথ বাতলে দিল, বলল,শস্য বিক্রি করলে যে ্লাভ হবে, তার চেয়ে ৫০গুণ লাভ হবে যদি শস্য পচিঁয়ে মদ তৈরি করে বেচা যায় । শয়তান চাষীকে মদ তৈরি করা শিখিয়ে দিল।  চাষীর তখন মহানন্দ। ঘরে মদের কারখানা; এলাকার সব বড় লোকেরা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তার বাডীতে এসে ফুর্তি করছে, টাকা উড়াচ্ছে। চাষী যত ধনী হয়ে লাগল, তত বেপরোয়া লাগামহীন হতে থাকল।

 এবার শয়তান মনের আনন্দে তার সরদারকে ডেকে নিয়ে আসল। শয়তান সরদার এসে দেখল, সব ধনীরা বঊ আর বান্দবী নিয়ে চাষীর বাড়িতে । চাষীর বউ মেহমানদের মদ পরিবেশন করছে। ধনীরা মদের সঙ্গে চাষীর বউকেও কাছে টানল। এতে বউয়ের অসস্তি দেখে চাষী রেগে বলল, ও সব কিছু না, কাস্টমার  লক্ষী, মেনে নাও। আফটার অল, আমরা আর কৃষক হয়ে কষ্ট করে বাচতে চাই না, হাওয়া থেকে টাকা আসছে, অনেক টাকা। যত ইচ্ছা খরচ কর।

এমন সময় চাষীর বাড়িতে এসে ঢুকল সে-গাঁয়েরই এক গরিব লোক। ঘরে ঢুকেই একপাশে দাড়িয়ে এ সব দেখতে লাগল। চাষী তাকে দেখে চিতকার করে উঠল, বলল-সব স্থানে সবার ঢুকার অনুমতি থাকে না। বেরিয়ে যাও।

 চাষীর মুখের কথা শুনে শয়তান তার সরদারকে বলল-এবার দেখ, এ  চাষী একদিন একমাত্র সম্বল তার রুটির টুকরোটি হারিয়ে একটুও অস্থির হয়নি। কিন্তু আজ কিছু না হারিয়েও উম্মাদ।

শয়তান সরদার বলল-বলো তো, কী করে এই আজব জিনিসটা তুমি করেছ? শয়তান মাথা নেড়ে বলল,মানুষ মুলত জন্তু-জানোয়ারের মতো একটা প্রাণী। যতক্ষণ সে প্রয়োজনীয় ফসল পেয়েছে ততক্ষণ শান্ত, স্বাভাবিক ছিল তার জীবন। কিন্তু যখনি সে প্রয়োজনের অতিবিক্ত পেতে লাগল, তখন থেকে তার ভিতরের পুরাতন পশুত্বগুলি জেগে উঠতে থাকে। তখন তার সমাজের মানুষগুলোকে সে সহ্য করতে পারে না। নিয়ম-নীতি মানে না। প্রাকৃতিক খাবারের পরিবর্তে প্রসেস ফুডে আসক্ত হয়ে লাইফস্ট্যাইল রোগে ভোগে। অতিরিক্ত অর্থ থাকার কারণে তাদের বংশধররা কোনো কিছু করতে চেষ্টা করে না, তাদের শৃজনশীলতা, মেধা, যোগ্যতা সব হারিয়ে প্রতিবন্ধীভ মতো জীবন কাটায়, পূর্বপুরুষদের লাইফস্ট্যাইল রোগ-ব্যাধী সঙ্গে নিয়ে। এজন্য পশ্চিমা দেশে বাবা-মা সন্তানদের জন্য কিছু করে দেয় না। নিজেকে নিজের দায়িত্ব তুলে নিতে বলে। 

 

  শিয়া ইরান কেন সুন্নি হামাসের সমর্থনে যুদ্ধ করতে চায়।

৬৭৪ খ্রিষ্টাব্দে, আরবের মুসলমানরা বৃহত্তর খোরাসান জয় করেন (এই  বৃহত্তর খোরাসান অঞ্চল হলো আধুনিক ইরানের খোরাসান প্রদেশ এবং বর্তমান আফগানিস্তান, মাওয়ারাননহর)। ইসলামী শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে অভিজাত ও শহরের অধিবাসীরা সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে, তবে গ্রামের কৃষক মধ্যবিত্তরা ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু হলেও একাদশ শতাব্দির শেষের দিকে, পারস্যদের অধিকাংশ লোকই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং ইরান মুসলিম সুন্নি প্রধান দেশে পরিণত হয়। তারপর ১৫০১ সাল থেকে সাফাবিদ শিয়া রাজবংশ  ওসমানিয়া খেলাফত ও মুঘল সালতানাতের সাথে একাধিক যুদ্ধে জয়ী হয়ে শিয়া ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণা করে। এরপর তারা সুন্নি মসজিদ সমূহ ধ্বংস করে লক্ষ্ লক্ষ্ মুসলিম হত্যা করে সমস্ত ইরানে সাফাবিদরা ১২ ইমামের শিয়া ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে।  এমনকি, সতের শতকের মাঝামাঝি সময়েও ইরানের প্রতিবেশী আজারবাইজান অঞ্চলের মানুষও শিয়া হয়ে উঠেছিল, এই অব্যাহত ভয়ের প্রভাবে।

বিষয়টি বুঝতে হলে মধ্যপ্রাচ্যের ২টি তেলের ফাইপ লাইনকে জানতে হবে।  প্রথম পাইপলাইনটি হল যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকৃত পাইপলাইন- (যাকে বলা হয় কাতার-তুরস্ক পাইপলাইন)ঃ এই লাইনটি কাতার-সৌদি আরব-জর্দান-সিরিয়া এবং তুরস্ক হয়ে ইউরোপের বুলগেরিয়ায় যাবে। দ্বিতীয় পলাইনটি হল রাশিয়া প্রস্তাবকৃত  লাইনটি ইরান, ইরাক হয়ে সিরিয়া যাবে। এখানে সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, ২টি পাইপলাইনেই সিরিয়া সংযুক্ত রয়েছে। সিরিয়া সংকটের পেছনে এটিই সবচেয়ে বড় কারণএই দুই পাইপলাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয়া । সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার  আমেরিকার প্রস্তাবকৃত পাইপলাইন প্রজেক্ট বাতিল করে দিয়েছেন  রাশিয়ার অনুরোধ। কেননা এই পাইপলাইন বাস্তবায়িত হলে ইউরোপে রাশিয়ার যে বিশালগ্যাসের বাজার’, তা বন্ধ করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা সিরিয়ায় এই পাইপলাইনের জন্য আসাদবিরোধী একটি সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার কারণে তাদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। আবার ইরাক ও সিরিয়ার সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের উত্থান ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্য। কিন্তু শিয়া নেতারা ইরানের সহযোগিতায় আইএস দমনে সফল হয়। এরপর আমেরিকা শিয়া-সুন্নি বিরোধের চেষ্টা করলেও চিনের মধ্যস্থতায় এ বিরোদের অবসান ঘটে। ইরাকে ৬৩ ভাগ শিয়া হলেও সংখ্যালঘু সুন্নি মুসলমানরা দীর্ঘদিন দেশটি শাসন করে আসছিল, এখন তারা সেখানে মিলেমিশে চলে। 


ইরান কিংবা লেবাননের হেজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুথি এরা সবাই শিয়া গোষ্ঠী হলেও সুন্নীগোষ্ঠী হামাসকে কয়েক দশক ধরে সহযোগিতা করে আসছেকারণ একটাই, ইস্রাইলকে কোনটাসা করে রাখা, যাতে যুক্তরাস্ট্র এ অঞ্চলে খবরদারী করতে না পারে। ইসরাইলকে কাবু করতে পারলেই যুক্তরাস্ট্র এ অঞ্চলে আর টিকে থাকতে পারবে না। ইরান তখন এত বছরের অবিকৃত তেল, ব্যবসা-বানিজ্য ও পরমানু শক্তিতে ফুলে ফেপে বড় হয়ে উঠবে। এবার চলুন শিয়া-সুন্নী প্রসঙ্গে।

আমরা সবাই জানি যে, রসুলের সুন্নাহ অনুসারণকারীরা সুন্নি  আর হজরত আলী (রা.)-এর অনুসারীরাই শিয়াত-ই-আলী কিংবা আলীর দল বা শিয়া নামে পরিচিত। এই শিয়া-সুন্নির বিরোধ শুরু হয় রসুলের মৃতুর পর। শিয়াপন্থীরা বিশ্বাস করেন যে হজরত আলী (রা.) হচ্ছে ্রসুলের-এর প্রকৃত উত্তরসূরি এবং অন্যদিকে সুন্নিপন্থীরা মনে করেন যে রাসুল  তাঁর বংশ পরম্পরার মাধ্যমে খেলাফত প্রথা প্রবর্তন করেননি। 

কিন্তু প্রশ্ন হলো ইরান-ইরাকে এত শিয়া কিভাবে হল?

৬৭৪ খ্রিষ্টাব্দে, আরবের মুসলমানরা বৃহত্তর খোরাসান জয় করেন (এই  বৃহত্তর খোরাসান অঞ্চল হলো আধুনিক ইরানের খোরাসান প্রদেশ এবং বর্তমান আফগানিস্তান, মাওয়ারাননহর)।  ইসলামী শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে অভিজাত ও শহরের অধিবাসীরা সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে, তবে গ্রামের কৃষক মধ্যবিত্তরা ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু হলেও একাদশ শতাব্দির শেষের দিকে, পারস্যদের অধিকাংশ লোকই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং ইরান মুসলিম সুন্নি প্রধান দেশে পরিণত হয়। তারপর ১৫০১ সাল থেকে সাফাবিদ শিয়া রাজবংশ  ওসমানিয়া খেলাফত ও মুঘল সালতানাতের সাথে একাধিক যুদ্ধে জয়ী হয়ে শিয়া ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণা করে। এরপর তারা সুন্নি মসজিদ সমূহ ধ্বংস করে লক্ষ্ লক্ষ্ মুসলিম হত্যা করে সমস্ত ইরানে সাফাবিদরা ১২ ইমামের শিয়া ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে।  এমনকি, সতের শতকের মাঝামাঝি সময়েও ইরানের প্রতিবেশী আজারবাইজান অঞ্চলের মানুষও শিয়া হয়ে উঠেছিল, এই অব্যাহত ভয়ের প্রভাবে।

তারপর কালক্রমে ১৯২৫ সালে পাহলবিরা ক্ষমতায় আসে। তারা ছিল সেকুলার আমেরিকা পন্থি। ১৯৭৯ সালে খোমেনির নেতৃত্বে পাহলবিদের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটানো হয় এবং ইরানে পুনরায় সাফাবিদদের ১২ ইমামের শিয়া ধর্ম পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা হয়।


সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত খ্রিস্টানদের উপদল সংখ্যা মুসলমানদের তুলনায় মোটেও কম ছিল না, এই খ্রিস্টান উপদলগুলো নিজেদের মাঝে বহু লড়াই করেছে। ইউরোপে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যোন্ট প্রধান রাজ্যগুলোর মাঝে সংঘটিত হয়েছে। তারা যতটা নির্মম নিষ্ঠুর পন্থায়স্বধর্মী ভিন্নমতবিলম্বীকেহত্যা করেছে, সেটি  মুসলমানদের মাঝে হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আনাব্যাপ্টিস্ট নামে একটি ক্ষুদ্র ও নিরীহ খ্র্রিস্টান উপদলের সদস্যদেরকে বিরোধী খ্র্রিস্টানরা হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করত। ইউরোপ  সেই দল-উপদলের এই লড়াই-এর মানসিকতা পার হয়ে এসেছে। আমরাও  পরস্পরকে আমলে নিয়ে, মেনে নিয়ে মিলেমিশে সুন্দর একটি সমাজ তৈরি করতে পারি। কে খাটি মুসলমান আর কে নকল  সেটা নির্ধারণের ভার সৃষ্টকর্তার, আপনার আমার নয়। আসুন আমরা পরস্পরের হাত ধরে  চলতে শিখি।


সুন্নি মুসলমানদের দেশ ইরান কখন কিভাবে শিয়া মুসলিম দেশ  হয়ে যায়?   

৬৭৪ খ্রিষ্টাব্দে, আরবের মুসলমানরা বৃহত্তর খোরাসান জয় করেন (এই  বৃহত্তর খোরাসান অঞ্চল হলো আধুনিক ইরানের  খোরাসান প্রদেশ এবং বর্তমান আফগানিস্তান, মাওয়ারাননহর)।  একাদশ শতাব্দির শেষের দিকে, পারস্যদের অধিকাংশ লোকই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং ইরান মুসলিম সুন্নি প্রধান দেশে পরিণত হয়। তারপর ১৫০১ সাল থেকে সাফাবিদ শিয়া রাজবংশ  ওসমানিয়া খেলাফত ও মুঘল সালতানাতের সাথে একাধিক যুদ্ধে জয়ী হয়ে শিয়া ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণা করে। এরপর তারা সুন্নি মসজিদ সমূহ ধ্বংস করে লক্ষ্ লক্ষ্ মুসলিম হত্যা করে সমস্ত ইরানে সাফাবিদরা ১২ ইমামের শিয়া ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে।  


 

ইসলামী রাস্ট্র আল-আন্দালুস যেভাবে স্পেন হয়ে গেলো?


ইউরোপে প্রথম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র যেভাবে মুসলিমশুন্য হয়ে গেল!? সাতশো বছরের বেশি শাসন করার ফলে ৭০-৮০% স্পেনবাসি মুসলিম হয়। তখন স্পেনের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি। স্পেনের সরকারী ভাষাও আরবী করা হয়। ৭০০ মসজিদ, ৮০০ শিক্ষাকেন্দ্র, ৭০টি সুবিশাল লাইব্রেরি ও কর্ডোভাতে গড়ে উঠলো বিশ্ববিদ্যালয়। নির্মিত হলো ৯০০ পাবলিক গোসলখানা ও ৬০০০০ প্রাসাদ। এখানেই জন্ম নেন ইবনে রুশদ, ইবনে ফিরনাস, ইবনে তোফায়েলসহ অসংখ্য মুসলিম বিজ্ঞানী। এইসময়  সমগ্র ইউরোপ ঐক্যবদ্ধ হলো মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ করার জন্য। তখন মুসলিমরা ছিল বিভিন্ন তরিকায় বিভক্ত। নিজের মধ্যে  কন্দোল আর মতপার্থ্যকের কারনে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারল না। ফলেভখ্রীষ্টান রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানী ইসাবেলা ১৪৯২তে স্পেন জয় কর্ল এবং  ১৫০২তে সব মুসলমানকে ইসলাম ত্যাগ করে খ্রীষ্টান হতে নির্দেশ দেয়া হয়। ১৬১০ পর্যন্ত ৩০ লাখ মুসলিম যারা ইসলাম ত্যাগ করতে সম্মত হয়নি তাদেরকে স্পেন ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হল।  ৭/৮শ বছর মুসলিমরা  যে স্পেন শাসন করেছে, সেখানে বর্তমানে  মুসলমান আছে শতকরা ৪জন মাত্র। 

 

 বর্তমান স্পেনকে আগে  হিস্পানিয়া বলে ডাকা হত। ৭১১ সালে মুসলিম উমাইয়া সেনাপতি তারিক ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে  সেখানে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর ধীরে ধীরে এই হিস্পানিয়া  অর্থাৎ বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল-এর অধিকাংশ ভূখণ্ডই ইসলামী শাসনের অধীনে চলে আসে। নাম হয় আন্দালুস সাম্রাজ্য। নবম ও দশম শতাব্দীর মধ্যেই এই আল-আন্দালুস পরিণত হলো ইউরোপ, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সফল রাষ্ট্র হিসেবে। এখানকার সরকারী ভাষাও আরবী করা হয়। অলিতে-গলিতে মসজিদ, শিক্ষাকেন্দ্র, লাইব্রেরী, পাবলিক গোসলখানা ইত্যাদির মাধ্যমে শুরু হয় স্বর্ণযুগ। এখানেই জন্ম নেন ইবনে রুশদ, ইবনে ফিরনাস, ইবনে তোফায়েলসহ অসংখ্য মুসলিম বিজ্ঞানী। এরপর  ১০০৯ থেকে ১০১৩ সালে এখানে মুসলমান শাসকদের মধ্যে ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধ হয় এবং অবশেষে  ১০৩১ সালে ছয় লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের এই আন্দালুস সাম্রাজ্য কয়েকটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে।  সাতশো বছরের বেশি সময় মুসলমানরা এই ভূখণ্ড শাসন করার ফলে এখানে স্থানভেদে ৭০-৮০% অধিবাসি মুসলিম হয়ে যায়। তখন এ সাম্রাজ্যে লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি।

এইসময়  সমগ্র ইউরোপ ঐক্যবদ্ধ হলো মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ করার জন্য। তখন এখানকার  মুসলিমরা ছিল বিভিন্ন তরিকায় বিভক্ত। নিজের মধ্যে  কন্দোল আর মতপার্থ্যকের কারনে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারল না। ফলে –তারা  ১৪৯২সালে এই আন্দালুস সাম্রাজ্য জয় করে নিল এবং এর নাম পরিবর্তন করে স্পেন রাখা হল। ১৫০২তে সব মুসলমানকে ইসলাম ত্যাগ করে খ্রীষ্টান হতে নির্দেশ দেয়া হয়। ১৬১০ পর্যন্ত ৩০ লাখ মুসলিম, যারা ইসলাম ত্যাগ করতে সম্মত হয়নি, তাদেরকে স্পেন ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হল।

 তখনও মুসলিমদের অধীনে ছিল আন্দালুসের গ্রানাডা রাজ্য। দক্ষি্ণ স্পেনের এই পাহাড়ী অঞ্চলটি দুর্গম হবার কারণে এখানে সেনা অভিযান কঠিন  ছিলো। ট্রাজিটি হলো- ১৪৮৫ সালে গ্রানাডার শাসক বাদশা হাসান তার ভাইয়ের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে বাদশার পুত্র আবু আব্দুল্লাহ ক্ষিপ্ত হয়ে চাচার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। চাচা-ভাতিজার এই দ্বন্দ্বের সুযোগে স্পেনের শাসক গ্রানাডাও দখল করে নেন। অতি আশ্চর্য এবং দুঃখের বিষয় হলো ৭/৮শ বছর ধরে মুসলিমরা যে স্পেন শাসন করেছে, সেখানে বর্তমানে  মুসলমান আছে শতকরা ৪জন মাত্র।



বিজ্ঞানীদের পক্ষে কি প্রাণ সৃষ্টি করা সম্ভব ?


প্রাণের উৎস হচ্ছে কোষ। প্রাণ সৃষ্টি করতে হলে কৃত্রিম কোষ সৃষ্টি করতে হবে। কৃত্রিম কোষ সৃষ্টি করার জন্য আমেরিকা ২ কোটি ১৩ লক্ষ মার্কিন ডলার খরচ করে প্রায় ২০ বছরের অধিক সময় গবেষণা করে গবেষণাগারে কৃত্রিম প্রাণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। পৃথিবীতে এই অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছেন বিজ্ঞানী ক্রেইগ ভেন্টর। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ব্যাকটেরিয়া Mycoplasma mycoides এর কাছাকাছি প্রজাতির আরেকটি ব্যাকটেরিয়া Mycoplasma capricolum থেকে ৪৭৩ টা জিন বের করে তার মধ্যে DNA সুত্রক ঢুকিয়ে দিয়ে একটি কৃত্রিম ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ সৃষ্টি করে ২০১৭ সালে পুরো বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন।এই জেনোমকে নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন কৃত্রিম জীব তৈরি করার গবেষণা করে চলেছেন।

১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের ' অরিজিন অফ স্পিসিস ' পড়ার আগে যারা মারা গিয়েছে তারা প্রাণের উৎস সম্পর্কে না পড়েই মারা গেছে এবং বিবর্তনের বিন্দু ও বিসর্গ সম্পর্কে তারা কিছুই জানতে পারেনি।১৯৬১ সালে যারা ইউরি গ্যাগরিনের মহাকাশ যাত্রা সম্পর্কে জেনেছে তারা এখন মহাশূন্যে বসবাস করছে।এইভাবেই প্রশ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ তার উত্তর আবিষ্কার করেছে।

আজ থেকে ১৪০০ কোটি বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিলো আমাদের মহাবিশ্ব।এর ৯৫০ কোটি বছর পর সৃষ্টি হয়েছে আমাদের পৃথিবী।আজ থেকে ৩৫০-৪০০ কোটি বছর আগে সর্বপ্রথম পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থের অনুসারীরা মনে করে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ হচ্ছে মানুষ সৃষ্টি। এদের অনেকেই জানতো না ব্যাকটেরিয়াও একটা প্রাণ।৩.৭০ বিলিয়ন বছর পূর্বের অনুজীবের মধ্যে প্রাণ ও জিন এই দুটোর উপস্থিতি পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক।

এত কঠিন বিষয়গুলো বুঝতে যাদের কষ্ট হচ্ছে তারা ডায়নোসরের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। আজ থেকে ২৫ কোটি বছর আগে এই ডায়নোসর পুরো পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে। কিন্তু পৃথিবীতে আজ মানুষের অস্তিত্ব আছে অথচ ডায়নোসরের অস্তিত্ব নেই।কখনো নিজেকে প্রশ্ন করেছেন কোথায় হারিয়ে গেছে এই ডায়নোসর? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বিজ্ঞানীরা চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন।একের পর এক বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর প্রশ্নের উত্তর মিলতে থাকে।

এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের অন্য কোন গ্রহে যেহেতু প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি তাই পৃথিবীতেই প্রাণের অস্তিত্ব বিকাশ হয়েছে এই সুত্র ধরেই বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা অস্ট্রেলিয়ায় আজ থেকে ৩৭০ কোটি বছরের পুরোনো জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছেন। বিজ্ঞানীদের অনেকেই ধারণা করেন মহাবিশ্বের অন্য কোন গ্রহ থেকে কোন উল্কাপিন্ড পৃথিবীতে প্রাণ নিয়ে এসেছে। কিন্তু ধারণা ও প্রমাণ এক বিষয় নয়। প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে সতের শতকে আধুনিক মাইক্রোস্কোপ আবিস্কারের পর থেকে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখতে পেলেন আকার ও আকৃতি ভিন্ন হলেও এই পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণীর শরীর কোষ দিয়ে গঠিত।এই কোষ থেকেই প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে। তিনি প্রমাণ করলেন প্রাণের সাথে অলৌকিকতার কোন সম্পর্ক নেই । নিরীহ রাসায়নিক উপাদান থেকেও প্রাণ সৃষ্টি করা সম্ভব।

১৮০০ শতকের আগেও অধিকাংশ বিজ্ঞানী প্রাণবাদে( Vitalism) বিশ্বাস করতেন। এদের একাংশ মনে করতেন প্রাণ হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং এটা অলৌকিক।১৭৯৯ সালে একদল বিজ্ঞানী মানুষের মুতের মধ্যে ইউরিয়া রাসায়নিকের উপস্থিতি পেয়ে মানুষের প্রাণকে অলৌকিক ভাবা শুরু করে দিয়েছিলেন। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর হাগা ও মুতা নিয়ে সমান গবেষণা করলে তখনি হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর মিলে যেত। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে মানুষ তার ২৯ বছর পর। জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বোহলার অ্যামোনিয়াম সায়ানেট থেকে ইউরিয়া উৎপাদন করে পুরো পৃথিবীর মানুষকে চমকে দিলেন যে জড় বস্তু থেকেও প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে।১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন নামে এক বিজ্ঞানী পুরো পৃথিবীর মানুষেরচিন্তা ধারণা পাল্টে দেন। দীর্ঘ কয়েক যুগ গবেষণা করে তিনি প্রমাণ করে দেন 'সব জীবের আদিপিতা হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া।' বর্তমান বিজ্ঞানীরা এই সুত্র ধরেই তাদের গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং নতুন নতুন আরো অনেক রহস্যর সমাধান করেন। কিন্তু সারাবিশ্বে তখন চার্লস ডারউইনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মিছিল বের হতে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাকে অনবরত হত্যার হুমকি দেয়া হতে থাকে।

১৮৭১ সালে চার্লস ডারউইন তাই এক আবেগমাখা চিঠিতে লিখেন ' প্রাণের উৎপত্তি কিভাবে এই প্রশ্নের উত্তর তিনি জানেন।প্রাণের উৎপত্তি একটা ছোট উষ্ণ পুকুরে।যেখানে ছিল পর্যাপ্ত অ্যামোনিয়া , ফসফরাস লবন , আলো , উত্তাপ এবং তড়িৎ প্রবাহ। রাসায়নিকভাবে প্রোটিন আমিষের জটিলযোগ।যা আরো জটিল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়ে প্রাণে রূপান্তরিত হয়েছে।" পরবর্তীতে জীব বিজ্ঞানী ওপারিন ও হালডেন উভয়েই চার্লস ডারউইনের তত্ত্বকে জিনতত্ত্বের আলোকে আরো সহজভাবে ব্যাখা করেন।ওপারিন ও হালড্রেন বলেন , সমুদ্রের জলেই প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে।প্রাণের বিকাশ অলৌকিক নয় বরং এটা ঘটেছে রাসায়নিক বিক্রিয়ায়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বেশীরভাগ মানুষ তখন ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না ফলে সেখানে এই ধারণা জনপ্রিয় হতে থাকে।১৯৩৪ সালে পরমাণু বোমার সাথে জড়িত থাকা নোবেলজয়ী আমেরিকান বিজ্ঞানী হ্যারল্ড উরে ইউরেনিয়াম -২৩৫ খোঁজ করতে গিয়ে এর স্বপক্ষে আরো প্রমাণ হাজির করেন। তিনি বলেন , আদিম অবস্থায় পৃথিবী অ্যামোনিয়া , মিথেন ও হাইড্রোজেন মিশেল পিন্ডাকৃতির ছিল।এই মিশ্রনে যদি বৈদ্যুতিক তড়িৎ প্রবাহ যোগ করা যায় তবে অ্যামাইনো এসিড উৎপাদন করা সম্ভব।" বর্তমান যুগের সব বিজ্ঞানী এখন একবাক্যে স্বীকার করেন পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির প্রথম উপাদান হলো অ্যামাইনো এসিড।

২০১৭ সালে কৃত্রিম প্রাণ সৃষ্টি করে দেখানোর পর একদল বিজ্ঞানী এখন বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণীদের আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন।

একটা আবিস্কারের পর বিজ্ঞান কখনোই থেমে থাকেনা বরং তারা ছুটে চলে নতুন নতুন আবিস্কারের নেশায়। বর্তমান বিজ্ঞানীরা প্রাণকোষের আরো গভীরে চলে গিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা এখন কাজ করছেন স্টেম সেল নিয়ে। ইতিমধ্যে জাপানের একদল বিজ্ঞানী একশো জোড়া গান গাওয়া ইঁদুর তৈরি করেছেন।

বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রা যতদিন চলমান থাকবে ততদিন অসম্ভব কিছুই নয়।ল্যাবটরীতে বিজ্ঞানীদের কৃত্রিম জীব গবেষণা সফল হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা এখন খুব আশাবাদী।খুব শীঘ্রই মানুষ তৈরি করা সম্ভব হবে বলে এখন প্রায় সব বিজ্ঞানী আশাবাদী। অতি সম্প্রতি স্টেম সেল গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাজ্যর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ৪ দিনে ইঁদুরের ভ্রুণ তৈরি করে পুরো পৃথিবীকে চমকে দিয়েছেন। বিজ্ঞানীদের এই যাবৎকালে এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ছাড়াই এই প্রথম বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের ভ্রুণ তৈরি করে দেখালেন যা এক কথায় অবিশ্বাস্য। যেভাবে গবেষণাগারে প্রযুক্তির সাহায্যে ইঁদুরের কৃত্রিম ভ্রুণ তৈরি করা হয়েছে একই পদ্ধতিতে মানুষেরও ভ্রুণ তৈরি করে মানুষ সৃষ্টি করা সম্ভব । এক্ষেত্রে নৈতিকতার একটি বিষয় বিজ্ঞানীদের খুব ভাবাচ্ছে। কৃত্রিমভাবে মানুষ তৈরি হলে হয়তো এর ভূল প্রয়োগ ঘটাতে পারে মানুষ এমনি মনে করছেন অধ্যাপক মেনডালিনা জেনরিকা গয়েস।তাই এই বিষয়ে মানব জাতিকে বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিজ্ঞানের পক্ষে এখন মানব ভ্রুণ থেকে মানুষ সৃষ্টি করা সম্ভব হলেও এটার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা চিন্তা করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে।। মানুষ হিসেবে সবসময় আমাদের নৈতিকতার বিষয়টি সর্বোচ্চ জোর দিয়ে দেখতে হবে। 


দ্যা সিল্ক রোড/How the Silk Road Made the World

প্রাচীনকালে বর্তমান ইরাক ও তার আশেপাশের অঞ্চলটি ছিল খুবই উর্বর জায়গা। দজলা এবং ফোরাত নদীর পলিমাটি জমে এখানে যে উর্বর অঞ্চল গড়ে উঠেছিল, তাকে লোকে বলত মেসোপটেমিয়া।  প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ায় জন্ম নেওয়া একটি বাণিজ্যপথ পৃথিবীকে চিরতরে বদলে দিয়েছিলো। তবে এই পথকে কিন্তু একটি রাস্তা ভাবলে ভুল হবে। বরং এটি ছিল- বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকগুলো পথের সমষ্টি বা নেটয়ার্ক। এই পথের নাম- দ্য সিল্ক রোড। এই পথেই মার্কো পোলো ইতালি থেকে চীন পর্যন্ত তার বিখ্যাত যাত্রা করেন। পূর্ব এবং পশ্চিমের মানুষেরা এই পথে নানানভাবে ব্যবসা করেছে।  এপথের চারিদিকে ছিল স্তেপ অঞ্চল। স্তেপ হলো ঘাসি জমি, যা ইউক্রেন থেকে মঙ্গলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।   এই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বাস করা যাযারর গোত্রগুলো  গম, চাল, মদ ইত্যাদির বিনিময় করে সংগ্রহ করত চীনের সিল্ক বা রেশম,হা রেশমি কাপড় । আর এই গুরুত্বপূর্ণ পণ্যটির কারনেই এই পথের নাম হয়েছিল দ্য সিল্ক রোড। এই সিল্ক রোডের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের দর্শন উত্তর ভারত থেকে গিয়ে প্রবেশ করলো চীনে। আর সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়লো পুরো এশিয়া জুড়ে। 

 সিল্ক রোড মূলত পাথুরে ও রুক্ষ একটি পথ। এ পথের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই উত্তপ্ত ধু ধু প্রান্তরে পানী খুঁজে বের করা। পানির এ সমস্যা দূর করার জন্য এই যাত্রাপথের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হয়েছিল বিভিন্ন সরাইখানা। এখান থেকে প্রয়োজনীয় খাবার ও পানীয় সংগ্রহ করা হত। এসব সরাইখানায় নানা পণ্যের বিনিময়ও হতো ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এর ফলে যাত্রীদেরকে অচেনা স্থানে রাত কাটানো লাগতো না।

এই  প্রাচীন বাণিজ্যিক পথটি প্রায় ৬৫০০ কি.মি. দীর্ঘ ছিল। পারস্য অর্থাৎ বর্তমান ইরানের রয়্যাল রোড-ই মূলত সিল্ক রোডের প্রধান শিরা। এই রয়্যাল রোড ইরান থেকে শুরু হয়ে তুরস্ক-এর  ভিতর দিয়ে ইউরোপে গেছে।

১৪৫৩ সালে তুরস্কর বিখ্যাত অটোমান সাম্রাজ্য চীনের সাথে বানিজ্য বয়কটের পূর্ব পর্যন্ত সিল্ক রোড ব্যবহৃত হতো। এরপর সমুদ্রপথে অধিক মাল পরিবহণ সহজ হবার কারণে ১৫ শতাব্দীর শেষের দিকে সিল্ক রোড ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় । ১৯৩০ সালে যুক্তরাজ্য প্রাচীন সিল্ক রোড চালুর উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৪ সালে চীন সরকার নিউ সিল্ক রোড চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে । রাস্তা, রেলপথ ও নদীপথে এশিয়া, আফিকা ও ইউরোপের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মতো উচ্চাভিলাষী নতুন সিল্ক রোড প্রকল্প গ্রহণ করে চীন। এ স্বপ্নের প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিশ্বের প্রায় ৬৫টি দেশের রাস্তাঘাট, বন্দর ও রেলপথ উন্নয়ন করবে চীন। চীন ও ইউরোপকে সংযুক্ত করতে উচ্চ গতি সম্পন্ন বুলেট ট্রেন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা  এতে আছে। 



আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি স্তেপ অঞ্চল`!! 


ইউরোপ আর এশিয়ার মাঝামাঝি থাকা বিশাল ঘাসি জমিকে বলা হয় স্তেপ অঞ্চল। এখানে বসবাসকারীরা যে ভাষায় কথা বলত তাকে বলা হয় পাই ল্যাংগুয়েজ। আমাদের বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, থেকে শুরু করে ইংরেজি, স্প্যানিশ, জার্মান বা রাশিয়ান; পার্সিয়ান প্রায় সব ভাষা এসেছে এই পাই থেকে। অর্থাৎ এরাই আমাদের পূর্বপুরুষ। কিন্তু তারা কেন কিভাবে ইউরোপ এবং এশিয়ার অধিকাংশ এলাকায় ছড়িয়ে পডেছিল? বিস্তারিত–

 

ইউরোপ ও এশিয়াকে একত্রে বলা হয় ইউরেশিয়া, এই ইউরেশিয়ার মধ্যভাগে অর্থাৎ ইউরোপ আর এশিয়ার মাঝামাঝি থাকা বিশাল ঘাসি জমিকে বলা হয় স্তেপ অঞ্চল। এটি হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, মলদোভা থেকে ইউক্রেন হয়ে রাশিয়া, কাজাখস্তান, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ  এবং মঙ্গোলিয়া হয়ে মঞ্চুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। 

এই বিশাল অঞ্চলে বড় কোন গাছ নেই। এই ঘাসি জমিতে আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে ঘুরে বেরাত একদল লোক। ওরা যে ভাষাটায় কথা বলত তাকে বলা হয় পাই ল্যাংগুয়েজ (PIE), বা প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ। এটা হলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার আদিরূপ। অর্থাৎ আমাদের ভারত উপমহাদেশের বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, থেকে শুরু করে ইংরেজি, স্প্যানিশ, জার্মান বা রাশিয়ান; পার্সিয়ান কিংবা ইউরোপ এবং এশিয়ার অধিকাংশ ভাষার জন্ম হয়েছে এই প্রাচীন ভাষা থেকে। 

 এই অঞ্চলের যাযাবরদের সাথে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্যের সৈন্যদের প্রায়ই সংঘাতের সৃষ্টি হতো। পুরো স্তেপজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যাযাবরদের একত্রিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা ছিল। তাদের নিজেদের মধ্যেই কৃষিজমি দখল ও পশুপাল চুরি করে নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। মঙ্গোলিয়া এবং চীনাদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকত। আর যুদ্ধের যতগুলো ক্ষেত্র আছে, সবগুলোই এই বিস্তৃত স্তেপের মধ্যেই ছিল। 

ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে হঠাৎ করে এই অঞ্চলের আবহাওয়া শুষ্ক এবং ঠাণ্ডা হয়ে পরে। ফলে ভাল ফসলের আশায় এই মানুষগুলো তাদের ঘোড়া এবং পশুপাল নিয়ে স্তেপের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। এভাবেই ওরা ছড়িয়ে গিয়েছিল ইউরোপ আর এশিয়ার হাজার হাজার কিলোমিটারের বিশাল অঞ্চল জুড়ে। তৈরি করেছিল আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি। 

এই  স্তেপ অঞ্চলের মানুষগুলো প্রথম চাকা তৈরি করেছিল, পোষ মানিয়েছিল ঘোড়াকে, আর কারিগরি জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপ আর এশিয়া জুড়ে।  এই স্তেপ শুধুমাত্র আদিমযুগ এবং মধ্যযুগের সময়ই সভ্যতা বিকশিত করেনি, বরং বর্তমানে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে উঠেছে এই স্তেপ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে।

স্তেপ অঞ্চল

নৃবিজ্ঞানী ডেভিড এন্থনি-র  " দ্য হর্স, হুইল এ্যান্ড লাংগুয়েজ"

ইউরোপ আর এশিয়ার মাঝামাঝি রয়েছে বিশাল অঞ্চলে বড় কোন গাছ নেই। এই ঘাসি জমিতে আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে ঘুরে বেরাত একদল লোক। ওরা যে ভাষাটায় কথা বলত তাকে বলা হয় পাই ল্যাংগুয়েজ (PIE), বা প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ। বাংলা করলে দাঁড়াবে- প্রাক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। অর্থাৎ এটা হলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার আদিরূপ। আমাদের ভারত উপমহাদেশের বাংলা, হিন্দি থেকে শুরু করে ইংরেজি, স্প্যানিশ, জার্মান বা রাশিয়ান; পার্সিয়ান বা গুজরাটি, ইউরোপ এবং এশিয়ার অধিকাংশ ভাষার জন্ম হয়েছে এই প্রাচীন ভাষা থেকে। আজকের পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ কথা বলে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায়।

Tripod শব্দটিকে যদি একটু ভালমতো খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন বাংলা আর ইংরেজির মধ্য কি অস্বাভাবিক মিল। এই Tri কে চাইলেই “ত্রি” আর “ট্রাই” দুইভাবেই উচ্চারন করা যায়। ত্রি মানে তিন,যেমন ত্রিভুজের তিন। আর ইংরেজিতে ট্রাইপড মানে তিন পা বিশিষ্ট। এই “পদ” আর “পড” দুইটার অর্থই পা। এমন শত শত শব্দ বের করা যাবে যেগুলো ইংরেজি এবং বাংলাতে খুবই কাছাকাছি। এই যে দুই প্রান্তের দুই ভাষার মিল, এর কারণ- এই দুইটি ভাষাই মূলত একটি আদি ভাষা থেকে উৎপত্তি হয়েছে। আর সেই ভাষা হলো প্রাক ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা বা পাই (PIE) ল্যাংগুয়েজ।

প্রাক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলা লোকগুলো থাকত কাস্পিয়ান সাগর আর কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী স্তেপ অঞ্চলে। আজকে আমরা যে আধুনিক পৃথিবী দেখি, এক অর্থে সেই পৃথিবীর কারিগর হলো এই মানুষগুলো। ভাবলে অবাক হতে হয়, আজকের দিনের জার্মানি বা নরওয়ের ভাষা-সংস্কৃতির মূল বিষয়গুলো যেমন এসেছে ইন্দো-ইউরোপীয় কালচার থেকে, তেমনি এই দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতের ভাষা-সংস্কৃতির কোর বিষয়গুলোও এসেছে সেই সাত হাজার বছর আগে স্তেপে বাস করা একই মানুষগুলোর কালচার থেকে।

এই মানুষগুলো চাকা তৈরি করেছিল, পোষ মানিয়েছিল ঘোড়াকে, আর ব্রোঞ্জ যুগের কারিগরি জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপ আর এশিয়া জুড়ে। এই মানুষগুলো যখন সমগ্র ইউরোপ, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার ছড়িয়ে পরে, তখন তারা সাথে করে নিয়ে যায় তাদের ভাষা আর সংস্কৃতি। ওদের ভাষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এতটাই শক্তিশালী ছিল যে- ওরা যেসব অঞ্চলে গিয়েছিল সেসব অঞ্চলের মানুষকে ওরা তাদের নিজেরদের সংস্কৃতি দিয়ে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। আর তৈরি করেছিল আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি। তাই আধুনিক সভ্যতার শেকড় জানতে হলে প্রাক ইন্দো-ইউরোপীয়দের ইতিহাস না জেনে উপায় নেই।

ইন্দো-ইউরোপীয়দের পূর্বপুরুষদের উৎপত্তি ঘটেছিল মূলত বর্তমান ইউক্রেন এবং রাশিয়ার কিছু অংশে। এই জায়গাটা কৃষ্ণ সাগর এবং কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত। এই প্রাচীন মানুষগুলো প্রথমে শিকারও খাবার সংগ্রহ করে জীবনযাপন করলেও পরে তারা বলকান সংস্কৃতির প্রভাবে পশুপালনে অভ্যস্ত হয়।

এরা ধীরে ধীরে গবাদি পশু পালন শুরু করে এবং ঘোড়াকে পোষ মানায়। পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে ব্রোঞ্জ যুগের হাতিয়ার এবং ব্রোঞ্জ যুগের প্রযুক্তি আয়ত্ত করে। তৈরি করে চাকা। এরপর ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে হঠাৎ করে এই অঞ্চলের আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পুরো স্তেপ অঞ্চল আরও শুষ্ক এবং ঠাণ্ডা হয়ে পরে। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের কারণে এই মানুষগুলো তখন তাদের ঘোড়া এবং পশুপাল নিয়ে স্তেপের মধ্যে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। আর এর ফলে এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের সংস্কৃতির জন্ম দেয়।

এই ধরনের সংস্কৃতিকে ইংরেজিতে বলা হয় পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক। পেট্রন হলো সামাজিকভাবে, ধনসম্পদের দিক থেকে বা শক্তির দিক থেকে উপরের শ্রেণীর লোক, আর ক্লায়েন্ট হলো দুর্বল বা গরীব শ্রেণীর কেউ। এই দুই শ্রেনি সামাজিকভাবে সমান না হলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এরা বিভিন্ন জিনিস লেনদেনের মাধ্যমে দুই শ্রেনীই লাভবান হতে পারে। এই পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ইন্দো-ইউরোপীয়রা সম্পূর্ণ নতুন এক সামাজিক সংগঠন তৈরি করতে পেরেছিল। এই নতুন সামাজিক সংগঠন, শক্তিশালী ভাষা, ঘোড়াকে পোষ মানানো, চাকার ব্যবহার ইত্যাদির ফলে ওরা চূড়ান্ত সফল হয়েছিল। ওরা ছড়িয়ে গিয়েছিল ইউরোপ আর এশিয়ার হাজার হাজার কিলোমিটারের বিশাল অঞ্চল জুড়ে। তৈরি করেছিল আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি।

নৃবিজ্ঞানী ডেভিড এন্থনি তার হর্স, হুইল এ্যান্ড লাংগুয়েজ (The Horse, the Wheel, and Language: How Bronze-Age Riders from the Eurasian Steppes Shaped the Modern World) বইতে দেখিয়েছেন যে- কারা এই ইন্দো-ইউরোপীয়, কীভাবেই বা তাদের উৎপত্তি; আর কীভাবেই বা এই একদল

লোক আজকের আধুনিক পৃথিবীতে এত প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। ইন্দো-ইউরোপীয়দের পূর্বপুরুষ কারা বা কোথায় ওদের উৎপত্তি এই বিষয়ে বেশকিছু তত্ত্ব থাকলেও, সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হলো কুরগান থিওরি বা কুরগান হাইপোথিসিস। 

 

(বুক রিভিও) জ্যারেড ডায়মন্ডের “Guns, Germs, and Steel

: Short History of Everybody for the Last 13,000 Years”   

জ্যারেড ডায়মন্ড একজন জিওগ্রাফার, ইতিহাসবিদ এবং পক্ষিবিদ। তিনি বিজ্ঞানী হলেও লেখক হিসেবে বিখ্যাত। তার কিছু বিশ্লেষণ খুবই আকর্ষণীয়। বিশেষ করে তার এই বইটি খুবই বিখ্যাত। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এই বইয়ের জনপ্রিয়তা এখনো কমেনি। পেয়েছে পুলিৎজার পুরষ্কার এবং এভেন্তিস পুরষ্কার। বলা হয় হারারির সেপিয়েন্স বইটি রচনার পেছনে এই বইটির অনুপ্রেরণা রয়েছে। আসলে এই বইটি বিগ হিস্টরি জনরার একটি পথপ্রদর্শক বই।

এই গান, জার্মস এ্যন্ড স্টিল বইটির পেছনে একটি ছোট্ট গল্প আছে। ডায়মন্ড তার গবেষণার কাজে একবার পাপুয়া নিউগিনিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তার সাথে আলাপ হয় স্থানীয় পলিটিশিয়ান ইয়ালির সাথে। কথায় কথায় ইয়ালি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল- তোমরা ইউরোপিয়ানরা এত এত প্রযুক্তি তৈরি করেছ, আর আমরা সেগুলো ব্যবহার করি। কিন্তু আমরা কেন নিজেরা তেমন কোন প্রযুক্তি তৈরি করতে পারিনি?

তাহলে ইউরোপিয়ানরা কি আমাদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান? জ্যারেড ডায়মন্ড একজন জিওগ্রাফার, পাশাপাশি তিনি একজন ইতিহাসবিদ। তাই এই সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই তিনি দেখলেন- এখানে চলে আসছে ইউরেশিয়ান মানুষদের উৎপত্তি, তাদের আধিপত্য, ইতিহাসের বিভিন্ন মোর ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা।

ডায়মন্ড হয়ত ইয়ালির এই প্রশ্নের উত্তর সেদিন বিস্তারিত দিতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এই প্রশ্নের জুতসই জবাব দিতে গিয়ে আস্ত একটা বই লিখে বসেন। এই প্রশ্নটা শুনতে সহজ হলেও এর সঠিক উত্তর খুজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মানবজাতির সুদূর অতীতে। বিগত ১৩ হাজার বছরে মানবজাতি কিভাবে আজকের অবস্থায় আসল সেই ইতিহাসটাই দেখানো হয়েছে এই বইতে।

ইউরোপ-এশিয়ার মানুষেরা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের পশুপালনের সাথে অভ্যস্ত। এই পশু তাদের জীবনযাপনকে একদিকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি তার পাশাপাশি পশুর শরীর থেকে যুগ যুগ ধরে অনেক রোগের জীবাণু এই অঞ্চলের মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। ফলে হাজার বছরের ইতিহাসে এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ মারাও গেছে। কোন জীবাণুর দ্বারা মানুষ সংক্রমিত হলে- হয় সে মানুষটি মারা যায়, আর যদি না মারা যায়, তবে তার শরীরে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নিতে পারে।

সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নেয়। ফলে পশুপালনের অভ্যাসের মধ্য দিয়ে এই ইউরোপ ও এশিয়া অঞ্চলের মানুষের শরীরে এইসব রোগ জীবাণুর প্রতি এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইম্যুনিটি তৈরি হয়েছে।

অ্যামেরিকা মহাদেশে যে সাম্রাজ্যগুলো গড়ে উঠেছিল যেমন- অ্যাজটেক, মায়া বা ইনকা সভ্যতা, তারা পশুপালনে অভ্যস্ত ছিল না। অন্য কোন কারনেও তাদের সাথে পশুদের কোন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। এর ফলে প্রাণী শরীর থেকে খুব বেশি রোগ তাদের মধ্যে প্রবেশ করতেও পারেনি, আর এর ফলে তাদের শরীরেও তেমন কোন ইম্যুনিটি তৈরি হয়নি। ইউরোপীয়রা যখন অ্যাজটেক বা এই ধরনের প্রাচীন আমেরিকান সাম্রাজ্য দখল করতে গিয়েছিল- তখন ইউরোপীয়দের সংখ্যা স্থানীয়দের তুলনায় এতই কম ছিল যে- আধুনিক অস্ত্র দিয়েও ওদের দেশটা দখল করা সম্ভব হতো না। ইউরোপীয়দের আমেরিকা জয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে একটি হলো- তাদের রোগ। ইউরোপীয়দের শরীর থেকে যে রোগগুলো আমেরিকানদের শরীরে প্রবেশ করেছিল সেটা তাদের এতই কাবু করে ফেলেছিল যে, কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের জনসংখ্যার ৯০% মানুষ শেষ হয়ে যায়। মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাথে বিজ্ঞান এভাবেই অতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে। শুধু ইউরোপিয়ানরাই নয়, আফ্রিকার বান্তু জাতিগোষ্ঠীর লোকদেরও এমন দেশদখলের ইতিহাস আছে। এর একটি বড় কারন হলো-এরাও ইউরেশিয়ানদের মত কৃষিকাজ এবং পশুপালন করা মানুষ। ফলে বান্তুদেরও রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা ভাল।

কিভাবে স্থানীয় সম্পদ আর ভৌগোলিক অবস্থান এক অঞ্চলের মানুষকে অন্য অঞ্চলের মানুষদের উপর প্রভুত্ব করতে সাহায্যে করে, ইস্পাত আর বন্দুকের ব্যবহার কিভাবে ইউরোপীয়দের আজকের অবস্থানে নিয়ে আসলো কিংবা পশুপালনের ফলে ইউরেশিয়ান মানুষরা কিভাবে ভাইরাসজনিত রোগের বিরুদ্ধে ইম্যুনিটি অর্জন করেছিল, আর কিভাবে সেই ইম্যুনিটি ইউরোপিয়ানদের অ্যামেরিকা জয় করতে সাহায্য করেছিল সেইসব প্রশ্নের উত্তর শুধু নয়- এই বই মানবজাতির বিগত ১৩ হাজার বছরের যাত্রাটাকেই তুলে ধরছে। মানবজাতির ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে চাইলে এই বইটি একটি মাস্ট রিড। এরপর আলোচনা করব Why Nations Fail: The Origins of Power, Prosperity, and Poverty – এই বইটি নিয়ে। এটা আসলে ইকোনমিক্স নিয়ে লেখা পৃথিবীর সেরা বইগুলোর মধ্যে একটি। তবে এটি কোন কাঠখোট্টা একাডেমিক ইকোনোমিক্সের বই না। আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব- কিছু রাষ্ট্র উন্নত এবং সম্পদের ভরপুর, অন্যদিকে কিছু রাষ্ট্র চরম দারিদ্রতার শিকার! কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন? এই বইতে দেখানো হয়েছে- কেন কিছু জাতি বা কিছু রাষ্ট্র কোনভাবেই উন্নতি করতে পারে না, আর কেনই বা কিছু রাষ্ট্র অন্যসব রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

বইটি লিখেছেন এমাইটির প্রফেসর ড্যারন অ্যাসেমগলু এবং আরেক বিখ্যাত অর্থনীতিবীদ প্রফেসর জেমস এ. রবিনসন। এই বইটি ২০১২ সালে প্রকাশের পর থেকেই তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু মজার বিষয় হলো- এই বইতে এই দুই অর্থনীতিবিদ- পৃথিবীর বিখ্যাত সব গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবার তত্ত্বকেই বাতিল করতে চেয়েছেন।

এই দলে আছে জ্যারেন্ড ডায়মন্ড, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেভিড ফিশার, ম্যাক্স ওয়েবারের মত বাঘা বাঘা সব গবেষক। তাহলে কি আছে এই দুই অর্থনীতিবিদের তত্ত্বে- যা কিনা এইসব বড় বড় দিকপাল গবেষকদের সবার থেকে আলাদা? লেখা বেশি বড় হয়ে যাবে বলে এই আলোচনায় আর গেলাম না। বইটি পড়ে ফেললেই উত্তর পাওয়া যাবে।



 (বুক রিভিও) 100 Million Years of Food: What Our Ancestors Ate and Why It Matters Today, লেখক স্টিফেন লি।

১০০ মিলিয়ন বছরের ইতিহাস! তবে ইতিহাস শুরু হয়েছিল মাত্র ৫০০০ বছর আগে। এর আগে চলে গেলে লিখিত জিনিসের কোন অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই বইয়ের লেখক স্টিফেন লি একজন নৃতত্ত্ববিদ। তিনি দেখিয়েছেন যে- লক্ষ লক্ষ বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষরা যেসব পোকামাকর খেত সেগুলো একদিকে যেমন ছিল প্রোটিনে ভর্তি, অন্যদিকে ছিল মিনারেলের ভান্ডার। আজকের দিনেও বিভিন্ন আদিবাসী এবং শিকারি জাতি-গোষ্ঠী সাধারণ খাদ্য হিসেবেই এগুলো খেয়ে থাকে। লেখক ভদ্রলোক একাডেমিক গবেষণার পাশাপাশি ভিয়েতনাম, কেনিয়া, ভারত, লাতিন অ্যামেরিকার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেরিয়েছেন মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে নতুন সব তথ্য খুঁজে পেতে। এই বইতে আপনি দেখতে পাবেন আমাদের পূর্বপুরুষরা কী কী খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকত, আর এটাও দেখতে পাবেন যে সেই লক্ষ বছরের পুরনো খাদ্যাভ্যাসটাই আসলে আমাদের শরীরের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। মানবজাতির ইতিহাসকে এটা একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা।


 

(বুক রিভিও)   Pathfinders: The Golden Age Of Arabic Science। লেখক ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জিম আল খলিলি।

শুনতে আজব লাগলেও- ইতিহাসের প্রায় ৭০০ বছরের বেশি সময় ধরে বিজ্ঞান চর্চার জন্য যে আন্তর্জাতিক ভাষা ছিল- সেটা হলো আরবি! জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী আল হিথাম ফ্রান্সিস বেকনেরও প্রায় ৫০০ বছর আগে সায়েন্টিফিক মেথড জিনিসটা ডেভেলপ করেছিলেন। এ্যলজেব্রা শব্দটির উৎপত্তিই হয়েছে আরবি আল-জবর থেকে। শুধু এ্যলজেব্রাই নয়, আল-খারেজমির লেখা পাটিগনিতের একটি বই ল্যটিন ভাষায় অনুবাদ হয়। আর সেই বইয়ের মাধ্যমেই পশ্চিমা বিশ্বের কাছে দশমিক সংখ্যা ব্যবস্থা জিনিসটা পরিচিতি পায়। এরপর আছে আবু রায়হান আল বিরুনী। যাকে তুলনা করা যায় একমাত্র লিওনার্দো দ্য ভিঞ্জির সাথে। শুধু এই গুটিকয়েক বিজ্ঞানীই নয়। ইতিহাসের বিশাল একটা সময় জুড়ে আরব ও পারস্যের এই বিজ্ঞানীরাই ছিলেন তখন বিজ্ঞানের কাণ্ডারি। ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জিম আল খলিলি আরবের বিজ্ঞানচর্চার সেই স্বর্ণযুগকে নতুন করে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই পাথফাইন্ডার বইতে।

এবার The Anglo-Saxons: A History of the Beginnings of England এই বইটি। আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে ব্রিটেনের ইতিহাস হঠাৎ করেই একটা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। রোমান সাম্রাজ্য ব্রিটেন থেকে তাদের সেনাবাহিনী তুলে নেয়। এর ফলে শুরু হয় অর্থনীতিক মন্দা। পাশাপাশি সেনাবাহিনী না থাকায় বহিঃশত্রুর আক্রমনের থেকে কোন নিরাপত্তা নেই। শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী দেশটি হঠাৎ করেই মারাত্মকরকমের অনিরাপদ হয়ে ওঠে। ধনী গরীব সবাই গাদাগাদি করে প্রাচীন পাহাড়ি দুর্গগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। যে দুর্গগুলো সেই লৈহযুগের পর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে ছিল, সেগুলোই হয়ে উঠে মানুষের একমাত্র নিরপদ আশ্রয়। দেশে শিক্ষাদান পড়াশুনা সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়।

আক্ষরিক অর্থেই ব্রিটেনে নেমে আসে এক অন্ধকার যুগ। এই পরিত্যক্ত রাজ্যে একদিন একদল নতুন মানুষ প্রবেশ করে। ওরা এসেছিল ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের যে উত্তর সীমান্ত, তারও বেশ খানিকটা বাইরে থেকে। সেই অর্থে ওরা ছিল একদমই ভিনদেশী। এই মানুষগুলোই এংলো স্যাক্সন নামে পরিচিত। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল যোদ্ধা। এরা ব্রিটেনের আদিবাসী রাজাদের সাথে মারাত্মক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করে দেয়। তবে এই দলটার বেশিরভাগ লোকই এসেছিল নতুন আবাদী জমির খোঁজে। আশা ছিল নতুন অঞ্চলে গিয়ে খামার করে, কৃষিকাজ করে- একটা সুখী জীবন পাবে। ওরা ব্রিটেনের দক্ষিণ এবং পূর্ব উপকূলে এসে নেমেছিল। এরপর ধীরে ধীরে দ্বীপের নিচু অঞ্চলগুলো দখল করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে। আর এভাবে এরা তৈরি করে সম্পূর্ণ এক নতুন সভ্যতা।

এই আংলো স্যাক্সনরাই মূলত ইংল্যান্ডের গোড়া পত্তন করেছিল। প্রাচীন ব্রিটেনের দাস ব্যবস্থা, পুরনো মন্দির, ছোট ছোট বাড়ি, কেল্টিকদের দ্রুইড যাদুকরের পরিবর্তে আজকের দিনে ব্রিটেনের যে পরিচিত চেহাড়া আমরা দেখি, তার ভিত্তি তৈরি করেছিল এই আংলো স্যাক্সনরাই। ভাইকিংদের থর এবং ওডিনের পুজার বদলে নতুন যে বিশ্বাস আজকের দিনে আমরা দেখি- সেটার শুরুও হয়েছিল ওদের আমলের শেষের দিকেই। ওরা আসার আগে মানুষ কথা বলত ল্যাটিন এবং কেল্টিক ভাষায়। আজকের দিনে সেই ভাষার কোন অস্তিত্ব আধুনিক ইংরেজির মধ্যে পাওয়া যাবে না। ওরা যে ভাষাটার প্রচলন করেছিল সেটাকে এখন আমরা ওল্ড ইংলিশ বা প্রাচীন ইংরেজি বলি। আজকের দিনে আমরা যে আধুনিক ইংরেজি দেখি সেই ইংরেজির প্রায় ২৬ শতাংশ এসেছে এংলো স্যাক্সনদের ওল্ড ইংলিশ থেকে।

মার্ক মরিস তার এই বইতে অ্যাংলো স্যাক্সোনদের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করেছেন একদম নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। ইংল্যান্ডের প্রাচীন কালের ইতিহাস নিয়ে যত বিরোধ আছে সেগুলো তিনি সমাধান করতে চেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং দলিলের উপর ভিত্তি করে। ইতিহাস বিশ্লেষণের পাশাপাশি তিনি আরও আকর্ষণীয় একটি কাজ করেছেন, সেটি হলো- এই বিষয়ক লিজেন্ডগুলোকেও তিনি তার আলোচনায় এনেছেন। এইসব লিজেন্ডের কতটুক সঠিক আর কতটুক লিজেন্ড সেটাও এক কৌতূহলোদ্দীপক টপিক।