ক্যারিয়ারে সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাতটি সফট স্কিল

 এই দক্ষতাগুলো শুধু পেশাগত জীবনেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও মানুষকে উন্নত করে। 

এই দক্ষতাগুলো অর্জন করলে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে উন্নত করা যায় এবং সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়া যায়। 


প্রতিটি মানুষহ্যাবিটাসদিয়ে পরিচালিত হয় 

ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে; কিন্তু ক্ষমতার চরিত্র, প্রতাপ ও নৈতিক কাঠামো অপরিবর্তিত থেকেছে।  আধুনিক শিল্পসমাজে মানুষকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়, যাতে সে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।পুঁজিবাদ ও প্রযুক্তির যৌথ প্রভাবে ব্যক্তি হয়ে ওঠে একমাত্রিকসে যা দেখে, তা-ই বিশ্বাস করে; নতুন কিছু কল্পনা করতে পারে না।ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী পিয়েরে বুর্দোর ভাবনা দিয়ে আলোচনা শেষ করা যায়। বুর্দোর মতে, প্রতিটি মানুষহ্যাবিটাসদিয়ে পরিচালিত হয়। হ্যাবিটাস হলো, সমাজের ভেতরে বেড়ে ওঠার ফলে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা অবচেতন অভ্যাস ও মানসিকতা। অর্থাৎ ব্যক্তি যত বড়ই হোক না কেন, চিন্তাচেতনায় তাঁর কিশোরকাল প্রভাব রাখবেই। Aমাদের নয়া রাষ্ট্রীয় কর্তাদের হ্যাবিটাস কী, তার ওপর নির্ভর করবে আগামীর বাংলাদেশ। মানুষ জন্মঘর দিয়ে নয়, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিয়ে পরিচালিত হয় বেশি।



পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনা আর সার্টিফিকেট অর্জন শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রের উপযোগী করে তুলবে না। বিষয়ভিত্তিক নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন না করলে পরবর্তী শ্রেণিগুলোতেও ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীকে পিছিয়ে পড়তে হবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থায় নম্বরভিত্তিক পরীক্ষা বাদ দিয়ে যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা দরকার।

 

যতদিন শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু চাকুরি পাওয়া হবে, ততদিন সমাজে শুধু চাকরই জন্মাবে, মালিক নয়।


জমানো টাকা ভালো বিছানা দেয়; কিন্তু ভালো ঘুম তো দিতে পারে না। তেমনিভাবে স্বাস্থ্য বীমা চিকিৎসা সেবা দিতে পারে; কিন্তু সুস্বাস্থ্য দিতে পারে কি? ভালো দামী খাবার স্বাদ দেয়; কিন্তু হজমশক্তি তো আর দেয় না। এই হজম শক্তি বলুন বা সুস্বাস্থ্য কিংবা নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম ; এর সবগুলির জন্য দরকার শারীরিক পরিশ্রম, মোটা টাকা নয়। আপনার ব্যাংক ব্যালেন্স যতই বাড়ুক তা কিন্তু শারীরিক পরিশ্রমের বিকল্প হতে পারবে না। সুতরাং শুয়ে বসে নয়, খেটে খেতে হবে।


লেবার ও স্কিল

মানুষ যখন শারিরীক শ্রম দিয়ে কাজ করে সেটাকে বলা হর লেবার। কিন্তু শ্রমটা যদি হয় মাথার, সেটা হয়ে যায় বলে স্কিল। কিন্তু শ্রম বাদ দিয়ে যেমন স্কিল নয়, তেমনি স্কিল বাদ দিয়েও শ্রম নয়। দুটোতেই ব্যালেন্স রাখতে হয় 

আপনার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কী? টাকা-পয়সা, সম্মান, সুস্বাদু খাদ্য, নাকি নিরাপত্তা? 




বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব  ‘থিওরি অব মোটিভেশন’ 


মানুষের মনে কোনকিছু করার ইচ্ছা জাগে কীভাবে, কোথা থেকে বা কীভাবে আসে এই মোটিভেশন? একদম বেসিক একটা প্রশ্ন দিয়ে যদি শুরু করি- মানুষ বেঁচে থাকতে চায় কেন? এই বেঁচে থাকার প্রেরণা বা মোটিভেশন সে পায় কোথা থেকে? আপনি খেয়াল করলে দেখবেন আপনার আশেপাশে কোথাও কেউ পুরোপুরি সুখী না, এবং আপনি নিজেও না। যদি বৈজ্ঞানিকভাবে বলা হয় তাহলে বলতে হবে- একটা নির্দিষ্ট লেভেলের বেশি সুখী কারও পক্ষেই হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু রাজ্যের অশান্তি, সমস্যা, দারিদ্র্য, হতাশা ইত্যাদি নিয়েও আমরা বেচেই থাকতে চাই। কিন্তু এই বেঁচে থাকার প্রেরণা আমরা পাই কোথায়?


বিষয়টা মোটামুটি বোঝার জন্য জেনেটিক ইমপ্রিন্টিং সম্পর্কে আপনার একটা ধারণা থাকলেই চলবে।

খেয়াল করলে দেখবেন- হাসের বাচ্চা ডিম থেকে ফুটে বের হয়ে সামনে যাকে পায় তার পিছনেই চলতে থাকে। সামনে যদি আপনি থাকেন, তাহলে বাচ্চাটা আপনার পেছনেই চলতে শুরু করবে, সামনে ফুটবল থাকলে ফুটবলের পেছনেই ছুটবে। কিন্তু এর কারণ কী? এর কারণ হলো- জেনেটিক ইমপ্রিন্টিং। অর্থাৎ এই চলমান কিছুর পেছনে চলার ইন্সট্রাকশনটা হাসের বাচ্চার জিনোমের মধ্যে প্রিন্ট করা আছে। জন্ম নেওয়ার পরেই কিছু জিন একটিভ হয়ে যায়, আর সেই জিনের প্রভাবেই এই সহজাত প্রবৃত্তির উৎপত্তি ঘটে। ঠিক একই কারনে জন্মের পরেই অনেক প্রাণীর বাচ্চারা হাটতে শুরু করে। তাদের হাটতে শেখাতে হয় না।


বেঁচে থাকার ইচ্ছা আর খাদ্য গ্রহন করার ইচ্ছাটাও তেমনি একটা জেনেটিক ইম্প্রিন্টিং। শত দুঃখ মনে থাকলেও আমরা তাই মরতে চাই না। বেচেই থাকতে চাই।  মানুষের কিছু জিন কার্যকর হতে উপযুক্ত পরিবেশ লাগে। এই উপযুক্ত পরিবেশকে বলা হয় এপিজেনেটিক ফ্যাকটর। কিন্তু কিছু জিন একদম বাই ডিফল্ট একটিভ থাকে। এইসব জিনের কাজ জন্মের পরই শুরু হয়। যেসব প্রবনতা জন্মের পর থেকেই আমাদের মধ্যে থাকে সেগুলোকেই আমরা সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে জানি। আর এইসব সহজাত প্রবৃত্তিগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত আপনার জিন দ্বারা।

এই যে প্রবৃত্তি এর আবার একটা হায়ারার্কি আছে। অর্থাৎ কিছু কিছু প্রবৃত্তিকে আমাদের মস্তিষ্ক বেশি গুরুত্ব দেয়, আবার কিছু প্রবৃত্তিকে আমাদের মস্তিষ্ক বা জিন কম গুরুত্ব দেয়। যদি গুরুত্ব অনুসারে সাজানো হয় তাহলে কোন জিনিসগুলো প্রাধান্য পায় সেটা নিচে দেওয়া হলো।


১। প্রথমেই প্রাধান্য প্রায় আপনার জৈবিক চাহিদা। ক্ষুধা, শারীরিক অসুস্থতা, যৌনতা এগুলো জৈবিক চাহিদা। এগুলোর প্রাধান্য সবার আগে। এগুলোর যেকোনো একটার যদি তীব্রতা দেখা দেয়, তখন আপনার আর কোন চিন্তা মাথায় আসবে না। আপনি আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। যেমন আপনার যদি প্রচণ্ড শারীরিক কষ্ট হয়, ব্যাথা অনুভব হয় , তাহলে আপনি সবার আগে সেই ব্যাথাকে উপশম করতে চাইবেন। তারপর বাকি সবকিছু। ক্ষুধা বা যৌনতাও যেহেতু জৈবিক চাহিদা তাই এগুলোর ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। ফলে অনেক নীতিবাগিস লোকজনকে যৌন কেলেংকারিতে কলংকিত অবস্থায় দেখা যায়। কারণ তখন তার আবেগ কাজ করে বিবেক কাজ করে না।


২। জৈবিক চাহিদা যখন মিটে যায় তখন দ্বিতীয় প্রাধান্য প্রায় নিরাপত্তা। খিদে মিটে গেলেই আপনি নিরাপদে থাকার চিন্তা শুরু করবেন। বাকি সবকিছুর চাইতে বেশি মনোযোগ তখন থাকে তার নিরাপত্তার দিকে। যেমন, খাদ্য নিরাপত্তা, বাসস্থানের নিরাপত্তা , সম্পর্কের নিরাপত্তা, যাতায়াতের নিরাপত্তা এমনকি বেঁচে থাকার নিরাপত্তা ইত্যাদি। এইসব নিরাপত্তায় অনিশ্চয়তা থাকলে তখন মাথায়  এই সব সমাধানের চিন্তা বারবার মাথায় আসবে।


৩। এইবার নিরাপত্তার সমস্যাও যখন মিটে যায়, তখন মানুষের যে চাহিদাটা তৈরি হয় এটাই মানুষের সবচেয়ে জটিল চাহিদা। এটাকে ঠিক এক কথায় বলা যায় গুরুত্ব পাবার চিন্তা। যেমন- সবাই আমাকে পছন্দ করুক, আমাকে গুরুত্ব দিক, আমাকে সম্মান করুক, আমাকে ভালোবাসুক, আমার পক্ষে থাকুক। এরপরে মানুষ চায়, আমি যা পছন্দ করি অন্য সবাইও সেটাই পছন্দ করুক। এভাবে তৈরি হয় বন্ধুর বন্ধু আমার বন্ধু, শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু  যেমন, ধরুন আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম সাপোর্ট করি, তাই আমি চাই সবাই বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম সাপোর্ট করুক ইত্যাদি।

 আমি কুমিল্লার লোক, ফলে আপনি যদি বলেন কু মানে খারাপ, কু মানে ইতর। তাহলে আপনি আমার ইগুতে  আঘাত করলেন। আপনি ঠিক না ভুল তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আপনি ইতর বলে গালি দিয়েছেন?? তার মানে এখন আমি আমার কাজকর্ম সব বন্ধ করে আপনাকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য আমরন লড়ে যাব।


এই থিওরি অব মোটিভেশন কিন্তু শুধু থিওরি না। এটাকে বাংলাতে বলে ‘প্রেষণার তত্ত্ব’। তাহলে মার্কেটিং-এ এই প্রেষনার তত্ত্ব-এর মাধ্যমে ভালমতই বোঝা যায় যে- মানুষ কেন কেনাকাটা করে। কেন একজন মানুষ কষ্ট করে আয় করা টাকা দিয়ে আপনার পণ্যটি কিনবে।

মানুষের যখন চাহিদার প্রথম দুইটা ধাপ অর্থাৎ জৈবিক চাহিদা আর নিরাপত্তার সমস্যা মিটে যায়, তখন তার নিজের গুরুত্ব, নিজের সমাজ, নিজের কমিউনিটি ইত্যাদি নিয়ে অসংখ জটিল চাহিদা তৈরি হয়। আর সেটা হলো- আমাকে গুরুত্ব দাও, আমাকে পছন্দ কর, এবং আমার প্রশংসা কর। এ


 

রেনে জিরার্দের মিমেটিক তত্ত্ব 


 কারো হাতে দামী স্মার্টফোন বা দামী হাতঘড়ি, দামী পোশাক, বা দামী মোটরসাইকেল দেখে এইসব নিজের পেতে বা ক্রয় করতে ইচ্ছে করে। কারো কাছে এই সবগুলো দেখে অন্য ব্যক্তির মনে কেনার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। কোনো একটি রেস্তোরাঁতে বসে পাশের টেবিলে কাউকে কিছু খেতে দেখে নিজের জন্যও সেই একইরকম খাবার অর্ডার করা। মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেখে,কোনো পণ্য বা মডেলকে বারবার দেখে, সে পণ্য বা মডেলের মতো কিছু বা কাউকে দেখলে প্রেমে পড়ে যাওয়া ।

 

দুটি শিশু একসঙ্গে অনেক খেলনা নিয়ে খেলার সময় যেকোনো একটি খেলনার দখলকে কেন্দ্র করে নিজেদের মাঝে মারামারিতে জড়িয়ে যেতে পারে। কেননা প্রথম শিশুর হাতে সেই বিশেষ খেলনা দেখে অন্য শিশুটি বাকি খেলনাগুলোকে ভুলে গিয়ে প্রথম শিশুর হাত থেকে তা কেড়ে নিতে উদ্যত হতে পারে। এই সবই মিমেটিক ডেজায়ারের সহজ বহিঃপ্রকাশ।

 

ফরাসি দার্শনিক রেনে জিরার্দের বলেন যে, “মানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা আসলে স্বতন্ত্র নয়, বরং আমরা অন্যদের অনুকরণ করেই আমাদের ইচ্ছা গঠন করি।” মানুষ শুধুমাত্র অন্যের থেকে কথা, আচরণ বা পোশাক-আশাক বা বস্তু কেন্দ্রিক বিষয়গুলো অনুকরণ করে না বরং সে অন্যের থেকে তার ‘Desires (ইচ্ছা/বাসনা/আকাঙ্খা)’ -ও অনুকরণ করে থাকে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ‘সৃজনশীলতায়’। সব মানুষ যদি অন্যের অনুকরণ করতেই থাকে; তাহলে মানুষ নিজেকে এবং নিজের ক্ষমতাকে ছোট করে প্রতিনিয়ত। সবাই যদি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পিছনে ছুটে নদীতে ঝাঁপ দেয় তাহলে সমাজ সভ্যতার আলো নিভে যাবে; কাউকে না কাউকে তার নিজস্ব ও ভিন্নতার মশাল নিয়ে সামনে এগুতে হবে।  



ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা কিভাবে নেতৃত্ব দেয়?

কোনো প্রতিষ্ঠান বা সমাজে যদি উচ্চ–নিচ বিভাজনটি থাকে, ইংরেজিতে তাকে হায়ারার্কি বলা হয়। এই উচু নিচু বিভাজনটা ইহুদী সংস্কৃতিতে একদম নাই। তাদের সমাজে বা প্রতিষ্ঠানে ‘চুটজপাহ’ সংস্কৃতি চালু আছে। চুটজপাহ সংস্কৃতি হচছে: মনে করুন একটি প্রতিষ্ঠানে ১০জন মানুষ আছে। এই দশজনের কেউ দারোয়ান আবার কেউ কর্মী বা কর্মকর্তা। সেখানে কেউ কাউকে স্যার বা ম্যম বলবে না। সবাই সবাইকে নাম ধরে কিংবা ভাইজান বলে ডাকবে। সার্টিফিকেট বা টাকার জোরে কেউ নেতা হবে না, কাজে যোগ্যতার ভিত্তিতে পদ মর্যদা হবে। সবাই মিলে আনন্দ আর সুবিধা-অসুবিধা ভাগাভাগি করে কমিউনাল বা কৌম সমাজ গড়ে তুলে।

অপরদিকে হিন্দু সমাজ হচ্ছে জাত-পাত ভেদাভেদ-এর সমাজ। এ সমাজের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা নিজেদেরকে উঁচু জাত বলে মনে করে। এভাবে বংশ পরস্পরায় নিজেদেরকে সেরা বলে মনে করার কারণে তাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের অহংকার এবং আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। যার ফলাফলে তারা সর্ব ক্ষেত্রে উন্নতি করে। তারাই হয়ে উঠে নেতা বা কর্তা। আপনি হিসাব করলে দেখবেন, ভারতে যত সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী কিংবা প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তি দেখা যায়, তারা প্রায় সবাই এই দুই বর্ণের লোক।  কাজেই আপনার প্রজন্ম বা আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবকে  অন্য অনেক মানুষ থেকে সেরা হিসেবে আখ্যা দিন এবং তাকে এগিয়ে যেতে সর্বদা উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করুন।


 

প্রখ্যাত তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড সাইদের ওরিয়েন্টালিজম

 

প্রখ্যাত গবেষক এডওয়ার্ড সাইদের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১ নভেম্বর জেরুজালেমে। তাঁর বাবা ও মা উভয়েই ছিলেন খৃস্টান মতাবলম্বী। আরব ইসরাঈল যুদ্ধ শুরু হলে সাইদের পরিবার মিসরের কায়রো চলে যান। সেখানে তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচ্যুসেটস অঙ্গরাজ্যের নর্থফিল্ড মাউন্ট হারমন স্কুলে ভর্তি হন। এখানে শিক্ষালাভের সময় ধীরে ধীরে সাইদের চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৬৩ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে সাইদের কর্মজীবন শুরু হয়। ২০০৩ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত ছিলেন।

 

১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ওরিয়েন্টালিজম সাইদকে একজন জগৎবিখ্যাত তাত্ত্বিকের স্থানে আসীন করে। সাইদের আবির্ভাব পশ্চিমা শিক্ষা-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের আধিপত্যবাদী ধারাকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সাইদের দর্শন বোঝার পর সহজেই মানুষের কাছে স্পষ্ট হয় বিভিন্ন মিশনারী প্রকল্পের উদ্দেশ্য কিংবা গ্যালিভার ট্রাভেলস এর মতো বিদঘুঁটে কল্পকাহিনীর মূল শেকড়টা কোথায়।

 

পশ্চিমরা প্রাচ্যতত্ত্বের নামে এক বিশেষ ডিসকোর্স বা আখ্যান তৈরি করেছে, তার আলোকে ‘পশ্চিমের মানুষ প্রাচ্যের উপর আধিপত্য করবে, আর প্রাচ্য আধিপত্যের শিকার হবে। পশ্চিমরা প্রাচ্যের মানুষদেরজকে অযোগ্য ও অক্ষম বলে প্রমাণ করার পাশাপাশি নিজেদেরকে প্রায় প্রভু বানিয়ে রেখেছে তাদের সংস্কৃতিতে। পশ্চিমের উপস্থাপনায় একজন এশিয়া-আফ্রিকার মানুষের রূপ কখনও সর্বহারা শরণার্থী, কখনও খুনী-সন্ত্রাসী কিংবা একজন অপহরণকারী জংলি মানুষের আলাদা একটা জগৎ আর পাশ্চাত্য মনে করে তারা সভ্য, অতি উন্নত । পশ্চিমাদের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রাচ্য কখনই যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, তারা কাউন্টার ডিসকোর্সকে বেশ জোরালোভাবে উপস্থাপন করে 


“শীপল” (Sheeple) কি? কারা “শীপল” ? আপনি কি ধর্মীয় শীপল? না রাজনৈতিক শীপল?

 

ভেড়ার পালে একটা নেতা থাকে । ভেড়ারা নেতাকে এমন অন্ধভাবে অনুসরণ করে, নেতা যদি নদীতে ঝাঁপ দেয়, তাহলে অন্যান্য ভেড়ারা কোন বিকল্প চিন্তা না করেই তাকে অনুসরণ করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে “শীপল” (Sheeple)। শীপ এবং পিপল-এর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এই শব্দটি। যে মানুষ ভেড়ার মতো আচরণ করে,তাকেই শীপল বলা হয়। বিশেষ করে একজন মানুষ যখন কোন ব্যক্তি বা মতবাদকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে, কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই, সন্দেহাতীত বা প্রশ্নাতীতভাবে উক্ত ব্যক্তি বা মতবাদের নির্দেশনা মান্য করে বা অনুসরণ করে, তাদেরকেই শীপল বলা হয়।

বাংলাদেশে দুই ধরণের শীপল-এর সংখ্যাধীক্য লক্ষ্য করা যায়। নাম্বার ওয়ান- ধর্মীয় শীপল এবং নাম্বার টু- রাজনৈতিক শীপল! ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক শীপল-এর মিশ্রণও আর এক ধরনের শীপল আছে। তবে কেউ যদি নিজে শীপল হয়ে থাকেন, তাহলে অন্যান্য শীপলদের উপস্থিতি সে টের পায় না। পড়াশুনার কারণে বিশ্বের অনেক দেশে শীপলদের সংখ্যা দিন দিন কমছে, আর বাংলাদেশে বাড়ছে বেশ দ্রুতগতীতে।

 

নিজের ব্রেনকে কাজে লাগিয়ে মানুষ অন্যের মতামত, চিন্তা বা সিদ্ধান্তকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে, চ্যালেঞ্জ করতে পারে্‌ ভিন্নমত পোষণ করতে পারে। কিন্ত,মানুষ তা না করে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করে?? আপনার ব্রেনটিকে কাজে লাগান। চিন্তা করুন, গবেষণা করুন, প্রশ্ন করুন, প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করুন! তখন দেখতেই পাবেন আপনার চারপাশে শীপলদের উপস্থিতি কত ভয়াবহ!!

একটা কলম না লিখলেও সক্রেটিসকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বলা হয়। কারণ প্রশ্ন ছাড়া কোন সিদ্ধান্তকে মেনে নিত না। সবকিছুতে সে প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুড়ে দিত। 


সাফল্য আর সার্থকতার  পার্থক্য

ক্লাসে ভালো ফল একধরনের সাফল্য, কিন্তু একজন ভালো মানুষ হওয়াটাই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা। সাফল্য আর সার্থকতার এই পার্থক্য নিরূপণে বেশির ভাগ অভিভাবক আগ্রহী নন। আর এই অবহেলা থেকেই জন্ম হয় বুয়েটের আবরার ফাহাদের খুনিদের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকরের খুনির। এই খুনিদের সবাই মেধাবী ছিল, কিন্তু হয়তো আশপাশের সবাই ওদের যেভাবে পরীক্ষায় ভালো করতে বলেছে, জীবনে ভালো মানুষ হতে সেভাবে বলেনি।মেধাবী জাতির আগে নীতিমান জাতি গড়ার দিকে আমাদের বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। নীতিহীন মেধাবীরা দেশ আর সমাজের ক্ষতিই ডেকে আনে, মঙ্গল বয়ে আনে না। ভুলে গেলে চলবে না, দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। 


গোল্ডেন এ প্লাসের ভবিষ্যৎ


.আন্তর্জাতিক স্কেলের মানদণ্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান হতাশাজনক। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে (Global Knowledge Index) ১৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। আন্তর্জাতিক স্কেলের মানদণ্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান-২.৮, ভারত-২০.৮ এবং শ্রীলঙ্কার শিক্ষার মান-১১.৩ শতাংশ। ইউনেসকোর ভাষ্যমতে, যে দেশে শিক্ষকের মান যত ভালো, সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা তত উন্নত। আমেরিকায় এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসম্মত শিক্ষার ২০ শতাংশ নির্ভর করে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপর। কিন্তু ৮০ শতাংশ নির্ভর করে যোগ্য শিক্ষকের ওপর।  একজন যোগ্য শিক্ষক গাছতলায় বসেও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন।  নীতিহীন, আদর্শহীন, অকর্মণ্য, অপদার্থ মানুষটিকে হাজারো প্রশিক্ষণ দিলেও ভালো শিক্ষক বানানো যায় না, দক্ষ প্রশাসক হতে পারে না। তাই তো বলা হয়, ভালো শিক্ষক জন্মায়, তৈরি করা যায় না। পক্ষান্তরে এ কথাও সত্য, মেঘাচ্ছন্ন আকাশে প্রজ্বলিত সূর্যটাও আলো ছড়াতে পারে না, কাচের পাত্রে কোনো গোলাপের বীজ অঙ্কুরিত হয় না। গোলাপ ফোটানোর জন্য প্রয়োজন প্রথমে গোলাপের বীজ, তারপর মাটি, পানি, আলো ও বাতাস। পরিচর্যাকে যদি প্রশিক্ষণ বলি, তবে বীজ হিসেবে প্রশিক্ষণের আগে যোগ্য ও মেধাবী মানুষটিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।


 

গোল্ডেন এ প্লাসের শিক্ষার্থী অধিকাংশই উচ্চশিক্ষার পথ বেছে নেবেন। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসন সংখ্যা প্রায় ৫২ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী কম জিপিএ পেয়েও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভর্তি নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী তাদের কাঙ্ক্ষিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেননি বা এবারেও পারবেন না বলেই ধারণা করা যায়।

বাংলাদেশে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছেন তার বিপরীতে চাকরির বাজার বেশ অপ্রতুল। এক জরিপের তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৮৪.৯ শতাংশ যুবক-যুবতীর প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতার অভাব রয়েছে। দেশের জনগণকে গুণগত, যথাযথ জ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা না গেলে বিশ্ববাজার-নির্ভর টেকসই দক্ষতা প্রদান সম্ভব হবে না। শুধু পরিমাণ বৃদ্ধি নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের মাধ্যমেই প্রযুক্তি নিভর এই বিশ্বে তাল মিলিয়ে চলার মতো জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারকে যেমন শিক্ষা বাজেট বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে, আবার অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে এই স্তরকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। 



সারাক্ষণ অন্যকে হারানোর অনিবার্য যুদ্ধ করছি আমরা সবাই।


আমরা যদি আমাদের চারদিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো প্রতারণার ফাঁদ আমাদের প্রত্যেকের জীবনের নিত্য দিনের। চিন্তা করুন, আপনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ঠকেন।বাচ্চার স্কুলে গিয়ে ঠকে। বাসা ভাড়া নিয়ে ঠকেন। নিত্যপণ্যের গিয়ে ঠকেন। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে ঠকতে ঠকতে কাজে যান; আবার ঠকতে ঠকতে ঘরে ফিরেন। সারাদিন যেখানে কাজ করলেন সেখানে কত রকমভাবে ঠকলেন সে চিন্তা করার সময়ও হয়তো পায় না মানুষ। কেন এই প্রতারণা? ঘুরে ফিরে সেই একটাই কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য, বঞ্চনা।  



মানুষের শরীরে বানরের মন ( ডোয়ার্ফিজম ও জাইগান্টিজম)

 

বড় প্রাণীরা, যেমন হাতি, বাঘ, সিংহ, এরা যখন কোনো ছোট ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস শুরু করে, তখন বংশপরম্পরায় এদের আকার ছোট হতে থাকে। তাদের শরীর, মগজ, সবই ধীরে ধীরে খর্বাকায় হয়। কারণ বড় শরীর ধারণের জন্য যে-পরিমাণ খাদ্য দরকার, তা ছোট দ্বীপ বা এলাকায় পাওয়া যায় না। ফলে টিকে থাকার তাগিদে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, প্রাণীগুলোর আকার খর্ব হয়ে আসে, যেন কম খাবারে বেশিদিন বাঁচা যায়। বড় অতিকায় প্রাণী তখন পরিণত হয় বেঁটে জন্তুতে।

অন্যদিকে ছোট প্রাণীরা, যেমন ইঁদুর, ছুঁচো, টিকটিকি, এগুলো ওই পরিবেশে বংশ পরম্পরায় বড় হতে থাকে। কারণ ছোট দ্বীপে বড় প্রাণীর খাবার কম থাকলেও, ছোট প্রাণীর খাবার থাকে অঢেল। শিকারী প্রাণীর ভয়ও সেখানে কম থাকে। ফলে ছোট প্রাণীগুলো নির্ভয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। এতে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, ছোট প্রাণী পরিণত হয় বড় প্রাণীতে।

উদাহরণ হিশেবে মাদাগাস্কার, সার্ডিনিয়া, ও মৌরিশাসের কথা বলা যায়। ওখানে ইঁদুর, টিকটিকি, কোমোডো, এসব প্রাণী দানবাকৃতির, কিন্তু হাতি, ছাগল, জলহস্তী, এগুলো খর্বাকৃতির।

এই যে ছোট দ্বীপ বা এলাকায়, রসদের অভাবে বড় প্রাণীর ছোট হয়ে যাওয়া, এটি হলো ডোয়ার্ফিজম; আর রসদের প্রাচুর্যে, ছোট প্রাণীর বড় হয়ে যাওয়া, এটি হলো জাইগান্টিজম।

জাইগান্টিজম ও ডোয়ার্ফিজম, প্রাণিজগতের মতো সমাজেও প্রতিদিন ঘটে চলছে।

কোনো এলাকায় মহৎ সাহিত্য, মহৎ দর্শন, মহৎ শিল্পকলা, মহৎ বৈজ্ঞানিক চিন্তা, উঁচু রাজনীতিক ভাবনা, এগুলোর গ্রাহক যদি কমে যায়, তাহলে ওই এলাকায় প্রতিভাবান মহৎ মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, কমতে থাকে। জাতি টবের গাছের মতো বেচে থাকে,কিন্তু বড় গাছে পরিণত হয় না। উঁচু সভ্যতা ক্ষয় হয়ে হয়ে রূপ ধারণ করে বামন-সভ্যতার।

সভ্যতা কী? লর্ড রাগলান বলতেন— মানুষ যা করে, আর বানর যা করে না, তাই সভ্যতা। বামন-সভ্যতার লোকজন শরীর ধারণ করে মানুষের, আর মন ধারণ করে বানরের। (সংকলিত) 



আমরা যত পাই, তত চাই। নিজের ঘর ভরে গেলে শ্বশুরবাড়ি পাঠাই। শ্বশুরবাড়ি উপচে পড়লে ভায়রার বাড়ি পাঠাই।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত জাপানিরা যেসব কারণে দ্রুত উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তাদের সততা।

পুরাণে ইঁদুরকে লুটেরা, মজুতদার, মধ্যস্বত্বভোগী, স্বার্থপর, সর্বভুক ও আত্মসাত্কারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। ইঁদুর রাতের আঁধারে সম্পদ হরণ করে নিজের ডেরায় তা মজুত করে। দিনের বেলায় আলোতে ইঁদুর খাদ্য-সম্পদ আহরণ করে না। কেবল অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে সম্পদ লুট করে। নিজের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সম্পদ মজুত করে সর্বগ্রাসী ইঁদুর। বিপুল সম্পদের মাঝে নিজে ভোগে আনন্দ পায়।মজুতদার, লুটেরা ও সর্বগ্রাসী ইঁদুরকে তাড়াতে খ্রিষ্টীয় বারো শতকে জার্মানির হ্যামিলন শহরে এসেছিলেন এক বাঁশিওয়ালা। কিন্তু ইঁদুররূপী মানুষ লুটেরাদের কে তাড়াবে?


সিডনি জে. হ্যারিস-এর বিখ্যাত লেখা

সিডনি জে. হ্যারিস-এর বিখ্যাত একটি লেখা আছে। যেখানে তিনি ও তার বন্ধু এক রাতে হেঁটে হেঁটে একটি পত্রিকার স্ট্যান্ডে যান । একটি পত্রিকা কেনেন এবং দোকানদারকে ধন্যবাদ জানান বিনয়ের সঙ্গে। কিন্তু দোকানদার কোন প্রতুত্তর দিল না।

বন্ধুটি মন্তব্য করলো, “বিক্রেতা একজন গোমড়ামুখো লোক, তাই না?”

কাঁধ ঝাকিয়ে লেখক বললেন, “সে প্রতি রাতেই এমন আচরণই করে।

বন্ধু জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে তুমি কেন এমন বিনয়ী আচরণ অব্যাহত রেখেছ?”

লেখক জানতে চাইলেন, “কেন নয়? যদি আমি তার ‘অভদ্রতার প্রতিদানে তাকে অভদ্র ব্যবহার করি, তা হলে সদাচরণের উপর আর আমার কর্তৃত্ব থাকবে না । আমার শিক্ষা, আমার রুচি, আমার আদর্শ , আমার ব্যবহারের ছন্দপতনের মাধ্যমে ধুলোয় মিশে যাবে। মন্দের বিনিময়ে ভালোকে ফেরত আনার শিক্ষা, নৈতিকতার পতনের মাধ্যমে আমার মনুষ্যত্ব, মানুষ হিসাবে জন্ম নেওয়ার সার্থকতা বিলীন হয়ে যাবে। 



‘আমি’ ও ‘আমার’ 


পৃথিবীতে ‘আমি’ ও ‘আমার’ শব্দ দু’টির ব্যবহার যতো বেশি হয়, হয়তো আর কোন শব্দের ব্যবহার এতো বেশি হয় না। ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়া এবং ইউনিভার্সিটি অফ সিনসিনাটির গবেষণা অনুযায়ী হাসপাতালের একজন মানসিক রোগী ‘আমি' শব্দটি অন্য যে কোন শব্দের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবহার করে—প্রতি ১২টি শব্দের মধ্যে একবার । সুস্থ মানুষের চেয়ে তিন গুণ বেশি। কিন্তু রোগী যেই সুস্থ হয়ে উঠে, তার ‘আমি’ শব্দটির ব্যবহার অনেক কমে যায় এবং ‘আমরা' শব্দটির ব্যবহার বৃদ্ধি পায় । অর্থাৎ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, উৎকণ্ঠা-হতাশা , উদ্বিগ্নতা যত বৃদ্ধি পায়; মানুষ ততই আমিত্বের দাস হয়ে পড়ে। এইজন্য আমিত্বকে বলা হয় ‘নিম্ন শ্রেণীর মানুষের আহাজারি’।

 

শৈশব থেকেই আমরা শুধু ক্রমাগত চেয়েছি, আর নিতেই শিখেছি। আজ এটা, কাল সেটা। শুধু চাই আর চাই, আর পাই নাই; পাই নাই গল্প। ফলে অবচেতনভাবে এই ‘আমিত্ব’টা আমাদের মন ও চিন্তার মধ্যে সেট হয়ে গেছে। সবকিছু আমার চাহিদামতো হবে! এর ব্যত্যয় ঘটলেই যত বিবাদ, বিতর্ক ! সাবালক এমনকি শক্তিশালী যুবক হয়েও আমরা স্রষ্টার কাছে দু’হাত তুলে বারবার বলতে থাকি, ‘হে সৃষ্টিকর্তা, আমাকে এটা দাও, ওটা দাও। একবারও বলি না, পথশিশু, অসহায় মানুষদের পাশে বসার মানবিক গুণ আমাকে দাও।

 

জন এফ কেনেডি যখন প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভাষণ দিতে মঞ্চে ওঠেন, তখন তিনি প্রথমেই বলেন, ‘দেশ আপনাকে কি দেবে’ সেটা জানতে চাইবেন না; বরং আপনি দেশের জন্য কী দিতে পারবেন, সেটা ভাবেন প্রথমে!’ তার মত করে বলা যায়, কে আপনাকে কি দিলো, সেটা ভেবে কাতর না হয়ে; বরং আপনি আপনার সীমিত সক্ষমতায় কাকে কি দিতে পেরেছেন, সেটা ভাবুন।

 

মনে রাখবেন, যত বেশি জীবনটা ‘আমি’ শব্দটা দিয়ে পরিচালিত করবেন, তত বেশি এই ‘আমি’ হতাশায় নিমজ্জিত হবেন। কারণ পৃথিবীর মানুষ আপনার-আমার প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য বাঁচে না।

‘আমিত্ব’ আর ‘পশুত্ব’ একে অন্যের দোসর। মানুষের মধ্যে আমিত্ব গ্যাঁট হয়ে বসলে পশুত্ব দ্রুত বাড়ে। এতে মানবতা পালায়, পাশবিকতা ডালপালা ছড়ায়।

 

‘আমিত্ব’ মানে আমাকে কেন্দ্র করেই সব।এই আমি’র চারপাশে আছে শুধু আমার মতামত, আমার সিদ্ধান্ত, আমার ইচ্ছা,আমার পছন্দ, আমি এটা ভালোবাসি, আমি সেটা চাই, আমি এটা চাই না- আমার কথার বাইরে ভিন্নমত সহ্য করব না, আমিই সেরা, ভিন্নমতের কারও অস্তিত্বই রাখব না-এ ধরনের ভাবনাগুলোই আমিত্ববাদ! । এই আমিত্ববাদ মানুষকে স্বৈরাচারী করে তোলে। কিন্তু প্রকৃতির একটা সূত্র মনে রাখা দরকারঃ মানুষ কোনো কিছু ‘যত শক্ত করেই ‘ আঁকড়ে ধরুক না কেন, সময়ের পরিক্রমায় এই শক্ত মুঠো এক সময় আলগা হবেই। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় “ একসময় সব কিছুই ভেঙ্গে পড়ে”। তখন এই আমিত্ব তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। ‘আমিত্বের’ কঠিন পূজারি ছিলেন জার্মান একনায়ক হিটলার । সবাইকে তাঁর পদতলে রাখতে গিয়ে নির্মম কঠিন পরিণতি হয়েছে।

 

উগান্ডায় স্বৈরশাসক ইদি আমিন নিজেকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না। প্রায় এক দশকের শাসনামলে গোটা উগান্ডাকে তিনি জীবন্ত নরক বানিয়ে ছাড়েন। নির্বিচারে মানুষ হত্যা এমনকি কেউ তাঁর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করলেই মাথা কেটে নিতেন। তাঁর টর্চার সেলে যে কত মানুষের প্রাণ গেছে, এর ইয়ত্তা নেই। তার কুখ্যাতি জুটেছিল ‘বুচার অব উগান্ডা’ বলে। ১৯৭৮ সালে তাঁরও পতন হয়েছিল নির্মমভাবে। তিনিও দেশ ছেড়েছিলেন হাসিনার মতো, মরণেও দেশের মাটিতে তার ঠাঁই হয়নি।

 

গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে : ‘নো দাইসেলফ’। যার মানে ‘নিজেকে জানো’। এই কথাটির মূল নির্যাস হচ্ছে সবকিছ্রু আগে নিজের ‘আমিত্ব’-কে জানো, ‘আমিত্বকে জয় করো। যদি নিজেকে কেউ না জানে, আমিত্বকে জয় করতে না পারে, তাহলে সে কখনো ‘আমরা’-তে উত্তীর্ণ হতে পারবে না। মানুষ যতই ‘আমি’, ‘আমি’ করবে; ততই হতাশ হবে। তার বদলে যত আমরা বলে, অন্যকে দিতে চাইবে, আনন্দ ততই বাড়বে। কারণ দিন শেষে, ‘উই আর নট ইনডিপেনডেন্ট, উই আর ইন্টারডিপেনডেন্ট।’ 



আরো বেশি টাকা কখনোই আপনার সব সমস্যার সমাধান করবে না

 

আপনার যদি খাবার এবং থাকার জন্যে পর্যাপ্ত টাকা থাকে, তাহলে এরচেয়ে বেশি টাকা ছাড়াও আপনি জীবন চালিয়ে নিতে পারবেন। এটা আরো ভালো করে বুঝতে পারবেন যদি আপনি অসচ্ছল অথচ মোটামুটি সুখী এমন মানুষদের সাথে মিশেন।

 

যখন আপনি জীবনে দামী জিনিসপত্র ছাড়া চলতে পারবেন না, তখন এই জিনিসপত্রগুলিই আপনার জীবনকে পরিচালিত করবে। আপনার দামী বাড়ি বা ফ্ল্যাট এবং ঘরের দামী ফার্নিচার থাকার কারণে আপনি অন্য জায়গায় সহজে চলে যেতে পারবেন না এবং এ রকম আরো দামী জিনিস পাওয়ার জন্যে আপনাকে সবসময় অনেক বেশি উপার্জন করা নিয়ে চিন্তা করতে হবে, নয়তো অনৈতিকতার আশ্রয় নিতে হনে। অথচ এইসব দামী সম্পদ আপনার জীবনকে খুব বেশি সমৃদ্ধ করে না। জীবনে যতো কম সম্পদ থাকবে আসলে ততোই ভালো থাকবেন, সুখি থাকবে্ন, ভোগবেন কম।  



‘ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স’ জানুন এবং অন্যকে জানান।

 

আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করছি, যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ হীনম্মন্যতায় ভুগছে, যার একটি বড় অংশ তরুণ প্রজন্ম। হীনম্মন্যতা এমন এক ধরনের মানসিক সমস্যা, যা নিজের ভালো দিকগুলোকে অস্বীকার করে অহেতুক অন্যের তুলনায় নিজেকে দুর্বল ভাবতে বাধ্য করে।


প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে পড়বে। পিছিয়ে পড়া মানুষটি ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি দিয়ে আবার সামনের দিকে ধাবিত হবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত হয় তখন, যখন অন্য কারো সাফল্য আমরা সহজভাবে মেনে নিতে পারি না। অথবা অন্য কারো তুলনায় নিজেদের কম যোগ্যতাসম্পন্ন কিংবা কম আকর্ষণীয় মনে করতে শুরু করি। মনস্তত্ত্বের ভাষায় এটিই ‘ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স’।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সাধারণত ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স শৈশবের কোনো জটিল অভিজ্ঞতার কারণে তৈরি হয় বা এমন কোনো পরিবারে শিশুর বেড়ে ওঠে, যেখানে শিশুকে ক্রমাগত হেয় করা হয় কিংবা শিশুকে উত্সাহিত না করে বরং সাফল্য অর্জন করতে না পারায় কটাক্ষ বা বিদ্রুপ করা হয়।

আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করছি, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বা সাফল্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, শারীরিক সৌন্দর্য, উচ্চতা এমনকি গায়ের রং দিয়ে সমাজে মানুষকে বিচার করা হয়। ফলে আমাদের আশপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা খুব অল্পতেই ভেঙে পড়েন। এইসব মানুষদের দুর্বলতায় প্রতিনিয়ত আঘাত করছি আমরা। 


লার্নিং ইজ আ নেভার এন্ডিং প্রসেস।

শেখার যেমন কোনো বয়স নেই, তেমনি নেই শেষও। যে কোনো বয়সে, যে কোনো অবস্থাতেই শেখার সুযোগ রয়েছে। আমরা প্রতিনিয়তই শিখছি—হোক তা প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক। আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যে আমাদের শিক্ষিত করে তোলে, সবক্ষেত্রে এমনটাও নয়! একইভাবে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করলেই যে শিক্ষিত হওয়া যায়, এ কথাও ঠিক নয়! মূলত এ কারণেই ‘সুশিক্ষিত’ ও ‘স্বশিক্ষিত’ শব্দ দুটির সঙ্গে প্রতিনিয়ত পরিচিত হতে হয় আমাদের।


 

বাচ্চার মেধা কম হওয়ার জন্য দায়ী মা !!!

 

গর্ভবর্তী মায়েদের হরমোনের মাত্রার সঙ্গে তার ৫ বছর বয়সী সন্তানের জ্ঞান ও দক্ষতার যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। মায়ের গর্ভাবস্থায় যেসব সন্তানের (ছেলেমেয়ে উভয়ই) মধ্যে হরমোন থাইরক্সিনের মাত্রা খুব কম থাকে, তাদের মেধা অন্যদের চেয়ে অর্ধেক কম হওয়ার আশংকা থাকে। মায়ের শরীর থেকে হরমোন থাইরক্সিন গর্ভাশয়ে থাকা শিশুর শরীরে যায়। মস্তিষ্কের উন্নয়নের জন্য এ হরমোনের ভূমিকা অপরিমেয়। কম আইকিউ–সম্পন্ন মানুষ, বন্ধ্যত্ব ও স্থূলদেহি হওয়ার পেছনে হাইপোথাইরয়েডিজমের অন্যতম কারণ হরমোন থাইরক্সিনের ঘাটতি।

লক্ষণঃ অবসাদ, সারাক্ষণ ঘুম ঘুমভাব, ওজন বৃদ্ধি, শীতকাতরতা, কণ্ঠস্বর ভারী বা কর্কশ হওয়া, গলগণ্ড বা থাইরয়েড ফোলা, ত্বক শুষ্ক-খসখসে হয়ে যাওয়া, মাসিকের সময় বেশি রক্তপাত, বারবার গর্ভপাত, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটে পানি জমা ইত্যাদি। প্রতকারঃ কম পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন থাইরক্সিন নিঃসৃত হওয়ার জন্য মেয়েরা থাইরক্সিন বড়ি খেতে হতে পারে। কিন্তু যাদের একেবারেই থাইরক্সিন নিঃসৃত হয় না বা কোনো কারণে থাইরয়েড গ্রন্থি কেটে বাদ দিতে হয়েছে তাদের সারা জীবন ওষুধ খেতে হয়। 


মধ্যযুগের দাসপ্রথা – ইউরোপের অন্ধকার ইতিহাস

মানব সভ্যতার ইতিহাসে দাসপ্রথা এক অন্ধকার অধ্যায়। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত ইউরোপে দাসপ্রথা শুধু প্রচলিতই ছিল না, বরং এটি সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে রাজারা, অভিজাতরা ও চার্চ দাসশ্রম থেকে উপকৃত হচ্ছিল, অন্যদিকে লাখো সাধারণ মানুষ নিজেদের স্বাধীনতা হারিয়ে “অন্যের সম্পত্তি”তে পরিণত হচ্ছিল। মধ্যযুগের ইউরোপীয় দাসপ্রথা তাই কেবল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই নয়, বরং ক্ষমতার এক ভয়ংকর প্রতীক ছিল।

দাসপ্রথার শিকড়

রোমান সাম্রাজ্য যখন শক্তিশালী ছিল, তখন দাসপ্রথা তার সামাজিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। যুদ্ধবন্দি, ঋণগ্রস্ত কৃষক কিংবা জোরপূর্বক বন্দি করা মানুষ – এরা সবাই দাসে পরিণত হতো। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর, বিশেষ করে পঞ্চম শতাব্দীর পর ইউরোপে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। তখন প্রথাগত দাসপ্রথার জায়গা নেয় “সার্ফডম” বা কৃষিভিত্তিক দাসত্ব।

যদিও সার্ফদের কিছু অধিকার ছিল, যেমন জমিতে কাজ করার অনুমতি বা পরিবার নিয়ে বসবাসের সুযোগ, তবুও তারা ভূমির সাথে বাঁধা ছিল। জমিদার বা লর্ডের অনুমতি ছাড়া তারা কোথাও যেতে পারতো না। অর্থাৎ স্বাধীন মানুষ হয়েও সার্ফরা বাস্তবে ছিল এক প্রকারের দাস।

চার্চ ও দাসপ্রথা

অনেক সময় আমরা ভাবি চার্চ হয়তো দাসপ্রথার বিরুদ্ধে ছিল। বাস্তবে পরিস্থিতি ছিল একেবারেই ভিন্ন। মধ্যযুগীয় ক্যাথলিক চার্চ দাসপ্রথাকে সরাসরি ন্যায্যতা দিয়েছিল বাইবেলের নানা ব্যাখ্যার মাধ্যমে। “মানুষ ঈশ্বরের দাস” – এই ধারণাকে ব্যবহার করে বলা হতো, তাই সমাজে প্রভু ও দাসের সম্পর্কও স্বাভাবিক।

অবশ্য খ্রিস্টধর্মের মধ্যে এমন কণ্ঠও ছিল যারা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, কিন্তু তারা খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং চার্চ নিজেই প্রচুর দাস রাখত – তারা চার্চের জমিতে কাজ করতো এবং আয়ের বড় অংশ চার্চে যেত।

ভাইকিং ও দাস ব্যবসা

মধ্যযুগীয় ইউরোপে দাস ব্যবসার অন্যতম বড় উৎস ছিল ভাইকিংরা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ভাইকিং যোদ্ধারা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স ও পূর্ব ইউরোপে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে বন্দি করতো। এদেরকে তারা “থ্রাল” বা দাস বানাত।

ভাইকিং দাসরা কৃষিকাজ, নির্মাণকাজ, এমনকি গৃহস্থালি কাজেও ব্যবহৃত হতো। তারা দাসদের আরব ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে বিক্রি করতো, যার মাধ্যমে ভাইকিংরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। এভাবে ইউরোপীয় দাস বাজার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অংশ হয়ে ওঠে।

মুসলিম দুনিয়া ও ইউরোপীয় দাস

মধ্যযুগে ইউরোপের দাসপ্রথা শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মুসলিম দুনিয়া ও ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের মধ্যে দাস ব্যবসা চলতো নিয়মিত। আরব বণিকরা স্লাভ, জার্মান ও অন্যান্য ইউরোপীয় দাস কিনে নিয়ে যেত এবং তাদেরকে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এমনকি এশিয়ার বাজারে বিক্রি করত।

এ থেকেই “Slav” শব্দ থেকে “Slave” শব্দের উৎপত্তি বলে অনেক ইতিহাসবিদ বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপের স্লাভিক জনগোষ্ঠী মধ্যযুগে দাসপ্রথার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগীদের মধ্যে ছিল।

ক্রুসেড ও দাসশ্রম

একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত চলা ক্রুসেড ছিল ধর্মীয় যুদ্ধ, কিন্তু বাস্তবে এগুলো দাস ব্যবসার অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে। মুসলিমদের পরাজিত করলে বন্দিদের দাস বানানো হতো, আবার ইউরোপীয় খ্রিস্টানদেরও বন্দি করে বিক্রি করা হতো।

ইতালির ভেনিস ও জেনোয়ার মতো শহরগুলো দাস ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তারা কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে দাস কিনে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে দিত। এই দাসদের অনেককে কৃষিকাজে, অনেককে গ্যালি জাহাজে দাঁড় টানার কাজে ব্যবহার করা হতো।

কৃষি, অর্থনীতি ও দাসশ্রম

মধ্যযুগীয় ইউরোপের অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক। বিশাল জমিদারি ব্যবস্থা, যাকে বলা হতো ম্যানোর সিস্টেম, তা সার্ফ ও দাস ছাড়া চালানো সম্ভব ছিল না। দাসরা শুধু কৃষিকাজই নয়, দুর্গ নির্মাণ, খাল খনন, রাস্তা বানানোসহ সব ধরনের শ্রম দিত।

রাজা, জমিদার ও চার্চ দাসদের শ্রম থেকে সম্পদ সঞ্চয় করতো। বলা যায়, মধ্যযুগের ইউরোপীয় সমাজের অর্থনৈতিক ভিতটাই দাঁড়িয়ে ছিল এই দাসশ্রমের উপর।

মানবিক বিপর্যয়

দাসপ্রথার কারণে লাখো মানুষ স্বাধীনতা হারিয়েছিল। পরিবার ভেঙে যেত, শিশুদের আলাদা করে বিক্রি করা হতো। দাসদের কোনো আইনি সুরক্ষা ছিল না। তারা প্রভুর সম্পত্তি হিসেবেই গণ্য হতো – চাইলে তাকে বিক্রি করা যেত, হত্যা করলেও তেমন কোনো শাস্তি হতো না। নারী দাসদের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। তাদেরকে প্রায়শই যৌন দাসত্বে বাধ্য করা হতো। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ইউরোপীয় রাজদরবার থেকে সাধারণ গ্রাম পর্যন্ত নারী দাসরা ছিল ক্ষমতা ও লালসার শিকার।

মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কালে

মধ্যযুগের দাসপ্রথা ধীরে ধীরে বদলে যায় যখন ইউরোপে নতুন ধরনের অর্থনীতি ও রাজনীতি গড়ে ওঠে। পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু হয় আটলান্টিক দাস ব্যবসা – আফ্রিকা থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ধরে আমেরিকায় পাঠানো হয়। কিন্তু তার আগেই মধ্যযুগীয় ইউরোপ দাসপ্রথার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা লাভ করে ফেলেছিল। মধ্যযুগের দাস ব্যবসাই আধুনিক দাস ব্যবসার ভিত্তি তৈরি করেছিল।

মধ্যযুগের ইউরোপ প্রায়ই “ডার্ক এজ” নামে পরিচিত। এর অন্যতম কারণ হলো দাসপ্রথা। যুদ্ধ, লুটপাট, ধর্মীয় বিভাজন আর অর্থনৈতিক শোষণ – সবকিছুই দাসপ্রথাকে আরও শক্তিশালী করেছিল। যদিও আজ ইউরোপকে আমরা মানবাধিকারের জন্য পরিচিত মহাদেশ হিসেবে দেখি, বাস্তবতা হলো তাদের দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে অগণিত মানুষ স্বাধীনতা হারিয়ে অমানবিক দাসত্বের শিকার হয়েছিল।

লেখক- M Shawon Hossain


বাংলায় দাসপ্রথা ইতিহাসের। কেমন ছিল তখনকার সমাজ?

ইতিহাসের পাতায় আমরা যখন দাসপ্রথার কথা শুনি, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমেরিকার তুলার খেতে শৃঙ্খলিত নিগ্রো দাসদের ছবি, কিংবা আফ্রিকার দাসজাহাজে অমানবিক যাত্রার কাহিনী। কিন্তু আমাদের বাংলাতেও দাসপ্রথা ছিল, এবং তা শুধু সমাজের প্রান্তিক মানুষদের নয়—কখনো কখনো পরিবার, সন্তান, স্ত্রী পর্যন্ত গৃহস্থের জীবিকার যুদ্ধে বিক্রির বস্তু হয়ে উঠেছিল।

দাসপ্রথার সামাজিক বাস্তবতা

বাংলায় দাস ব্যবসা ছিল প্রাচীন প্রথা। একে অমানবিক বলা ছাড়া উপায় নেই, তবে পাশ্চাত্যের তুলনায় এর রূপ কিছুটা ভিন্ন ছিল। এখানে দাস কেনার লক্ষ্য ছিল মূলত কায়িক শ্রম পাওয়া। দাস-দাসীরা গৃহস্থের কাজে নিয়োজিত হতো, জমি-খেতেও পরিশ্রম করত। অনেক সময়ে তারা প্রায় পরিবারের সদস্যের মতোই মর্যাদা পেত। এমনকি ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো কোনো মনিব দাসী কন্যাকে নিজের পুত্রের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দিতেন—ফলে সে মুক্তিও পেত। তবে এই মানবিকতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল নির্মম বাস্তবতা। অনেক দলিলে স্পষ্ট লেখা আছে যে, দাস বা দাসীর গর্ভজাত সন্তানও মালিকের সম্পত্তি। অর্থাৎ দাসপ্রথা শুধু ব্যক্তির নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এক নিষ্ঠুর দাসত্বের শৃঙ্খল তৈরি করেছিল।

দারিদ্র্য ও আত্মবিক্রয়ের কাহিনী

অভাবই ছিল দাসপ্রথার সবচেয়ে বড়ো চালিকাশক্তি। দুর্ভিক্ষ, ঋণ, কিংবা অনাহারে জর্জরিত পরিবার অনেক সময়ে নিজেদের সন্তান, এমনকি স্ত্রীকে বিক্রি করত। কেউ কেউ আত্মবিক্রয়ের দলিলে স্বাক্ষরও করত। শুধু সন্তান নয়—সপরিবারে আত্মবিক্রয়-এর নজিরও আছে। জনৈক শুকদেব দে স্ত্রী হরিপ্রিয়া ও পুত্র যুগীরামকে নিয়ে রামকৃষ্ণ শর্মার কাছে আত্মবিক্রয় করেছিলেন। আবার কুঞ্জমালা নামের এক নারী নিজের ও সাত বছরের কন্যাকে মাত্র তিন টাকায় সত্তর বছরের জন্য বিক্রি করেছিলেন। দলিলে মুক্তির শর্ত রাখা ছিল—এক সোয়ামন হলুদ দিলে সে মুক্ত হবে। কিন্তু বিনে পয়সায় খেটে সেই মুক্তিপণ জোগাড় করা কার্যত অসম্ভব ছিল। এই দলিল ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দলিলগুলির একটি।

ইংরেজদের ভূমিকা

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই প্রথাকে কায়েমি করার চেষ্টা করেছিল। কোর্ট হাউসে জনপ্রতি চার টাকা চার আনা শুল্ক দিয়ে দাস রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ইংরেজ মনিবদের কাছে দাস হওয়া মানেই ছিল শৃঙ্খল, মারধর, অমানুষিক পরিশ্রম আর অনাহার।

অবসান

অবশেষে বাংলায় দাসপ্রথার অবসান হয়েছিল ১৮৪৩ সালের ভারতীয় দাসপ্রথা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, যা ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট-এর ভিত্তিতে সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে দাসপ্রথাকে অবৈধ ঘোষণা করে। যদিও ভারতে এই প্রথা বিলোপে ব্রিটিশদের ভূমিকা ছিল, এই আইন প্রণয়নের সময় গভর্নর-জেনারেল ছিলেন লর্ড এলেনবরো। তবে তার আগে পর্যন্ত অগণিত মানুষ এই প্রথার শিকার হয়েছিল। কত অশ্রু, কত স্বপ্ন, কত ভগ্ন সংসারের গল্প লুকিয়ে আছে সেই দাস ব্যবসার দলিলের পৃষ্ঠায়, তার হিসেব আজও করা সম্ভব নয়।

বাংলার দাসপ্রথার ইতিহাস কেবল আইনি দলিল বা অর্থনৈতিক বাস্তবতার ইতিহাস নয়—এ ইতিহাস আসলে মানুষের অদম্য টিকে থাকার সংগ্রামের ইতিহাস। অনাহারে জর্জরিত মা নিজের সন্তানকে তিন টাকায় বিক্রি করছে, বা এক নারী সত্তর বছরের জন্য দাসী হয়ে যাচ্ছে—এসব শুধু অতীতের কাহিনী নয়, এ আমাদের সমাজের বিবেককে আজও নাড়া দেয়।

দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু ইতিহাসের দলিল আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকারকে কখনোই অবহেলা করা যায় না।