হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য
তথ্য ও জ্ঞান (১-২০)
হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য
তথ্য ও জ্ঞান (১-২০)
০০১ ▌নক্ষত্র বা তারা কি?
নক্ষত্র হচ্ছে, এমন একটি উত্তপ্ত গ্যাস পিণ্ড যা আলো বিকিরণ করে যেমন- সূর্য। সূর্য হচ্ছে পৃথিবীর কাছাকাছি থাকা সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। কীভাবে সৃষ্টি হয় এই নক্ষত্র? নক্ষত্রসমূহ মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস নিয়ে গঠিত। মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা কাছাকাছি গ্যাসসমূহ (হাইড্রোজেন, হিলিয়াম) মহাকর্ষ বলের টানে এরা একসময় ঘনীভূত হতে থাকে। সেই গ্যাস কণাগুলো ঘনীভূত হতে হতে প্রচণ্ড অভিকর্ষের চাপে সংকুচিত হয়ে একটি অতি উত্তপ্ত ঘন কেন্দ্রের সৃষ্টি করে। সেই উত্তপ্ত কেন্দ্র হতেই একসময় নিউক্লিয় ফিউশন নামক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন প্রচুর পরিমাণ শক্তি ও আলো নির্গত হয়। তখন ওই উজ্জ্বল গ্যাসপিণ্ডকেই আমরা নক্ষত্র বা তারা বলি।
সূর্য : সূর্য মাঝারি আকারের একটি তারা বা নক্ষত্র। সূর্য পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়। অর্থাৎ, ১৩ লক্ষেরও বেশি পৃথিবী সূর্যের ভেতরে সহজেই এঁটে যেতে পারে। । সূর্য পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাই পৃথিবী থেকে আমরা সূর্যকে এত ছোট দেখি। এই সূর্য নামক নক্ষত্র বা তারা হতে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড। নক্ষত্রের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে এক সময় সেটি বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে জীবনের ইতি টানে। তবে বিস্ফোরণের পরে অবশিষ্ট থাকা কেন্দ্রভাগ মাঝে মাঝে আবার ছোট নক্ষত্রে পরিণত হয় এবং ছড়িয়ে পড়া অন্যান্য টুকরো গ্রহ, উপগ্রহে পরিণত হয়। আমাদের সূর্য নামক নক্ষত্রটিও এ রকম অন্য একটি নক্ষত্রের বিস্ফোরণের পর সৃষ্টি হয়েছিল এবং আমাদের পৃথিবীটাও নক্ষত্রেরই ছিটকে পড়া একটা অংশ থেকে তৈরি হয়েছিল।
০০২ ▌গ্রহ-উপগ্রহ কি? গ্রহাণু কাকে বলে?
তারা বা নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান গোলাকার বস্তুপিণ্ডকে বলা হয় গ্রহ। যেমন-পৃথিবী। আবার যে বস্তু গ্রহকে কেন্দ্র করে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরে তাকেই বলে উপগ্রহ। যেমন- চাঁদ। চাঁদ একটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ। কিন্তু মানুষ নিজেও কৃত্রিম যান্ত্রিক উপগ্রহ তৈরি করে মহাকাশে পৃথিবীর চারিদিকে ঘূর্ণায়মান করে রাখতে পারে।
সৌরজগতের গ্রহগুলো যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। তেমনি উপগ্রহগুলিও গ্রহগুলোকে কেন্দ্র করে ঘুরছে । পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। উপগ্রহগুলো আকারে গ্রহের চেয়ে অনেক ছোট হয়। সূর্যের আলো চাঁদের পৃষ্ঠে পড়ে প্রতিফলিত হয় বলে আমরা চাঁদকে আলোকিত দেখি। চাঁদ ২৭ দিন ৮ ঘণ্টায় একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
গ্রহাণু বলতে বুঝায় সূর্য বা কোনো নক্ষত্রের আশপাশে ভাসমান পাথরখণ্ড যেগুলো গ্রহও নয়, উপগ্রহও নয়। মূলত নক্ষত্রের বিস্ফোরণের পর যে সমস্ত টুকরো গ্রহ কিংবা উপগ্রহ হতে পারেনি এবং এদের নির্দিষ্ট কক্ষপথ নেই, এরাই শেষপর্যন্ত গ্রহাণুতে পরিণত হয়।
০০৩ ▌সৌরজগতের পরিচয়
সূর্য ও তার গ্রহ, উপগ্রহকে নিয়ে যে পরিবার (জোটবদ্ধ অবস্থান) তাকে সৌরজগৎ বলে। সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে আটটি গ্রহ। পৃথিবী এমন একটি গ্রহ। গ্রহসমূহ সাধারণত গোলাকার। গ্রহগুলোতে বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থ রয়েছে।
আটটি গ্রহের পরিচয়ঃ বুধ-বুধ সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ। এতে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। এটি ৮৮ দিনে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসে।
শুক্র - পৃথিবী থেকে সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারা এবং ভোরবেলায় শুকতারা রূপে যে তারাটি দেখা যায় সেটি কোনো নক্ষত্র নয়। এটি আসলে সূর্যের একটি গ্রহ যার নাম শুক্র। সূর্যের আলো এ গ্রহের উপরে পড়ে। তাই আমরা একে আলোকিত দেখি। এটি ৫৯ দিনে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
পৃথিবী -কেবল পৃথিবীতেই জীবনের জন্য উপযোগী উপকরণ ও পরিবেশ রয়েছে। পৃথিবী সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে তৃতীয় গ্রহ।
মঙ্গল-মঙ্গলকে লাল গ্রহ বলা হয় কারণ এর পৃষ্ঠ লাল রঙের। এর পৃষ্ঠ ধুলিময় এবং এর খুবই পাতলা বায়ুমণ্ডল রয়েছে। মঙ্গলের মাটির নিচে পানি থাকার সম্ভাবনা আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
বৃহস্পতি- বৃহস্পতি সূর্যের সবচেয়ে বড় গ্রহ। বৃহস্পতি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১১ গুণ চওড়া । এটিতে শুধু গ্যাসই রয়েছে, কোনো কঠিন পৃষ্ঠ নেই। শনির মতো বৃহস্পতির চারপাশেও বলয় রয়েছে, তবে সেগুলো খুব হালকা এবং সহজে দৃশ্যমান নয়। বৃহস্পতি সৌরজগতের দ্রুততম ঘূর্ণনশীল গ্রহ। এটি প্রায় ১০ ঘণ্টার মধ্যে নিজের অক্ষের উপর একবার ঘুরে আসে,
শনি -শনি গ্রহটিও কেবল গ্যাস দিয়ে তৈরি। এর কোনো কঠিন পৃষ্ঠতল নেই। এটি প্রধানত হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাস দিয়ে গঠিত। এটিকে ঘিরে কতগুলো রিং বা আংটা রয়েছে। এটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৯ গুণ চওড়া। শনির ১৩০টিরও বেশি প্রাকৃতিক উপগ্রহ বা চাঁদ রয়েছে। এর সবচেয়ে বড় এবং পরিচিত চাঁদ হলো টাইটান (Titan), যা সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম চাঁদ
ইউরেনাস- ইউরেনাস গ্যাস ও বরফ দিয়ে গঠিত। মিথেন গ্যাসের উপস্থিতির কারণে দূর থেকে এটিকে হালকা নীল বা নীলচে-সবুজ দেখায়। শনির মতো ইউরেনাসের চারপাশেও বলয় বা রিং ব্যবস্থা রয়েছে, যদিও সেগুলো শনির বলয়ের মতো উজ্জ্বল নয়। এটি প্রথম আবিষ্কৃত গ্রহ যা দূরবীনের সাহায্যে দেখা গিয়েছিল। ১৭৮১ সালে উইলিয়াম হার্শেল এটি আবিষ্কার করেন।
নেপচুন - নেপচুনও অনেকটা ইউরেনাসের মতো একটি বরফ গ্রহ। সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী প্রধান গ্রহ। এটি পৃথিবীর ভরের প্রায় ১৭ গুণ। সূর্য থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় এটি অত্যন্ত শীতল। এর গড় তাপমাত্রা প্রায় -২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস । নেপচুনের ১৪টি প্রাকৃতিক উপগ্রহ বা চাঁদ রয়েছে। এর সবচেয়ে বড় চাঁদ হলো ট্রাইটন (Triton),
আগে প্লুটো নামক একটি জ্যোতিস্ককে গ্রহ বলা হতো। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নেন যে, এটি একটি ক্ষুদ্র অসম্পূর্ণ গ্রহ।
০০৪ ▌ আলোকবর্ষ , গ্যালাক্সি , নীহারিকা , ধূমকেতু , সুপারনোভা ও ব্লাকহোল কি?
আলোকবর্ষ মানে হলো- আলো এক বছরে যতদূর যায়। আলো এক সেকেন্ডে অতিক্রম করে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। তাহলে এক বছরে যত সেকেন্ড হয়, সেই বিশাল সংখ্যাকে ১,৮৬০০০ মাইল দিয়ে গুণ করলে পাবেন আলো এক বছরে কতদূর যায়। এটাই আলোকবর্ষ। আমাদের এই মহাকাশটি ছোট বড় প্রায় ১০ হাজার কোটি গ্যালাক্সি নিয়ে গঠিত।
গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ হচ্ছে মহাকাশের কোনো এলাকায় অবস্থিত অনেকগুলি নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্যাস, এবং অনেক অদৃশ্য বস্তুসমূহের জোটবদ্ধ অবস্থান, যারা একটি সুশৃক্সখল নিয়মে আবদ্ধ থাকে। গ্যালাক্সির ব্যাস কয়েকশ’ আলোকবর্ষ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত হয়ে থাকে। আবার একটি গ্যালাক্সি থেকে আরেকটি গ্যালাক্সির দূরত্ব লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ পর্যন্ত হয়ে থাকে। আমরা যে গ্যালাক্সিতে থাকি তার নাম মিল্কিওয়ে। এর ব্যাস প্রায় এক লক্ষ আলোকবর্ষ। আমাদের সৌরজগতের ব্যাস হলো প্রায় ১০ ঘণ্টা আলোকবর্ষ।
নীহারিকা বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো- আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে দৃশ্যমান দূরবর্তী কুয়াশার মতো এক ধরনের আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘ। এই মেঘ বিভিন্ন ধরনের ধূলিকণা, হাইড্রোজেন গ্যাস এবং প্লাজমা দিয়ে গঠিত।
ধূমকেতু হচ্ছে সূর্যের খুব নিকট দিয়ে অতিক্রমকারী মহাজাগতিক বস্তু যা মূলত ধুলো, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর, বরফ ও গ্যাসের তৈরি। আকাশ কি? আসলে আকাশ বলতে কিছুই নেই। মহাশূন্যে যে অসীম স্থান আছে তাই হচ্ছে মহাবিশ্বের মহাকাশ। উপরে আমরা নীল যে আকাশ দেখি, সেটা হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল।
ব্ল্যাক হোল হলো মহাকাশের এমন একটি অঞ্চল যেখানে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এতটাই তীব্র যে, কোনো কিছু, এমনকি আলো পর্যন্ত, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। সাধারণত খুব বড় তারার জীবনচক্রের শেষে সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর ব্ল্যাক হোল তৈরি হয়, যখন তারার কেন্দ্রটি নিজের ওজনে চুপসে যায়। আর সুপারনোভা হলো- যখন একটি বৃহৎ নক্ষত্রের কেন্দ্রে পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়ে যায়, তখন একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়। আমাদের নক্ষত্র অর্থাৎ সূর্য বর্তমানে তার জীবনকালের মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে এবং এর পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়ে যেতে আরও প্রায় ৫০০ কোটি বছর সময় লাগবে । এখন পৃথিবীর আনুমানিক বয়স প্রায় ৪৫৪ কোটি বছর।
০০৫ ▌ কৃষি ও নগর সভ্যতার সূচনা কিভাবে হয়?
প্রায় ১ লক্ষ বছর পৃথিবী ছিল ভয়াবহরকম শীতল। যাকে বরফযুগ বলা হয়। তখন গোটা স্থলভাগের ২৫ ভাগ তো ছিল রীতিমতো বরফের নিচে! আজ থেকে ১১,৬০০ বছর আগে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে বেশ আরামদায়ক উষ্ণ পরিবেশ তৈরি হয়। এই উষ্ণ আবহাওয়াতে জন্মাতে থাকে প্রচুর গাছপালা, বাড়তে থাকে পশু-পাখির সংখ্যা। একই সাথে দ্রুত বাড়তে থাকে মানুষের সংখ্যাও। এই সময়টাতে মানুষ মূলত পশু-পাখি বা মাছ শিকার এবং বন্য ফলমূল সংগ্রহ করে জীবনযাপন করত। এই ধরনের মানব সমাজ ‘হান্টার গ্যাদারার’ বা শিকারি-সংগ্রহজীবী বলে। এরা ছিল মূলত যাযাবর। পৃথিবীর প্রাচীন স্থপনা ও উপাসনালয় হচ্ছে গোবেকলি তেপে। তুরস্কের উরফা শহর থেকে ৬ মাইল দূরে এক পাহাড়ঘেরা জায়গায় অবস্থিত এটি। গোলাকারে সাজানো বিশাল বিশাল পাথরের স্তম্ভ আর কারুকার্য খচিত পাথরের ভাস্কর্য দিয়ে তৈরি করা এর একেকটি স্তম্ভের ওজন সাত থেকে দশ টন পর্যন্ত, আর উচ্চতা পাঁচ থেকে সাত মিটার অর্থাৎ ২৩ ফুট পর্যন্ত। এই বিশাল বিশাল স্তম্ভগুলো আসলে বিশাল একেকটা আস্ত পাথরের টুকরো। এখানে একটি আধা খোদাই করা পাথর পাওয়া গেছে যার ওজন প্রায় ৫০ টন। পাওয়ায় গেছে বিশাল বিশাল পাথরে খোদাই করা দশটি ভাস্কর্য। এই পাথরগুলো বহন করে আনা, খোদাই করা এবং খাড়া করে বসানো একটি জটিল প্রক্রিয়া। আজ থেকে সাড়ে এগারো হাজার বছর আগে ওই প্রাচীন স্থপনা যারা তৈরি করেছিল তারা ছিল ‘হান্টার গ্যাদারার’ যাযাবর মানুষ। কয়েক হাজার মানুষ অন্তত দশ বছর পরিশ্রম করে এই স্থপনাটা নির্মান করেছিল।
ফসলের জিন নিয়ে যে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেন, তারা দেখতে পেয়েছেন যে- আজকে আমরা সেসব গমের প্রজাতি চাষ করি তারমধ্যে প্রাচীন প্রজাতি এসেছে গোবেকলি তেপের আশপাশের অঞ্চল থেকে। তখন হাজারের উপর মানুষকে দশ বছর খাওয়াতে এখানে গমের চাষ শুরু করেছিল। গোবেকলি তেপের উপসনালয়ে বিশাল বিশাল পাথরের হামানের মত জিনিস পাওয়া গেছে, যেগুলোর মধ্যে শস্যদানা প্রক্রিয়জাত করা হত। আর এটাই ছিল সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম গ্রাম। এই গোবেকলি তেপেকে কেন্দ্র করেই হয়ত মানুষ প্রথমবারের মত স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল। গোবেকলি তেপে ছিল টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর একদম উপরের (পর্বতের উচ্চ) দিকের অঞ্চলে অবস্থিত। তখন এই অঞ্চলটাতে তখন অপেক্ষাকৃত আদ্র ও ঘাসি জমি ছিল।এরপর এরা ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হয় ফিলিস্থিনের জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে এবং সিরিয়ার তেল আসওয়াদ অঞ্চলে। এই লোকগুলোকে বলা হয় নাটুফিয়ান সংস্কৃতির লোক। ইউফ্রেটিস নদীর তীরে আবু হুরায়রা নামক এক গ্রামে নাটুফিয়ানদের ছোট্ট একটি বসতি পাওয়া গেছে। এই গ্রামের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ এর মত। এরপর পৃথিবীর অন্তত ১১ টা অঞ্চলের মানুষ কৃষিকাজ শুরু করেছিল অর্থাৎ ধীরে ধীরে কৃষি-ভিত্তিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়।
১১ হাজার বছর আগে কৃষি সভ্যতা শুরু হলেও তারপরে পাঁচ-ছয় হাজার বছর তারা কোনো উন্নত সভ্যতা তৈরি করতে পারেনি তার প্রথম কারনটা, রোগ-জীবাণু। মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর, তারা পশু পালনেও অভ্যস্ত হয়। পশু সংক্রামক রোগের সবচেয়ে বড় বাহন ছিল। গুটি বসন্ত থেকে শুরু করে যত ভয়াবহ সংক্রামক রোগ, প্রায় সব রোগ এসেছে পশুর শরীর থেকে। এইসব সংক্রামক রোগ থেকে মাঝে মাঝেই ভয়াবহ মহামারি শুরু হতো। অনেক মহামারিতে গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যেত। এছাড়া নিজেদের এবং পশুর বর্জ্যকে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে জানত না মানুষ। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের খাবা্রের পানি দূষিত হত। ফলে কৃষি ভিত্তিক জীবনে রোগবালাইয়ের আক্রমণ ছিল অনেক অনেক বেশি।
মহামারি এবং রোগের কারণে কয়েক হাজার বছর পৃথিবীর জনসংখ্যা কখনোই ৪০ থেকে ৫০ লাখের উপরে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয় সমস্যা ছিল চুরি। প্রথম দিকের কৃষকেরা অনেক কষ্ট করে ফসল ফলাতো, কিন্তু সেই ফসল রক্ষা ও সংরক্ষণ করতে জানত না। আশেপাশের অনেক যাযাবর গোষ্ঠী কৃষকদের ফসল চুরি করে নিয়ে খেত’। এই ফসল চুরির সমস্যাটা সমাধান করতে মানবজাতি সমাজ গঠন করে প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করে। এই প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের কারণে আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মানব জাতির প্রকৃত অগ্রগতি শুরু হয় । এই সময় মানুষ প্রথম জটিল সভ্যতা নির্মাণ করতে শিখেছিল। পৃথিবীর প্রথম শহর হল মেসোপটেমিয়ার এরিদু। তবে দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া শ্রেষ্ঠ শহর হল উরুক। এই উরুক হল মানব সভ্যতার সৃষ্টি ও উন্নতির মূল কারিগর। এটি হল বর্তমান দক্ষিণ ইরাকের আল-মুঠান্না প্রদেশে। এই ‘নগর রাষ্ট্র’ থেকে শুরু হয় পৃথিবীর প্রথম প্রশাসন, প্রথম কর ব্যবস্থা , লিখন পদ্ধতি, সঠিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ফসল চুরি বন্ধ করার মতো বাহিনী ইত্যাদি। মূলত এই সময় থেকেই মানব সভ্যতার ইতিহাসের শুরু। এই মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়দের কিউনিফর্ম লিখিত দলিলের মাধ্যমে আমরা সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, যুদ্ধ ও চিন্তাধারার বিস্তারিত রেকর্ড পেতে শুরু করি।
০০৬ ▌ চিত্রলিপি, ভাবব্যঞ্জকলিপি ও ধ্বনি যুক্ত লিপি:
কোনো বিষয়ের চিত্রময় অর্থবোধক চিহ্ন হিসাবে ব্যবহৃত প্রতীককে চিত্রলিপি বলা হয়। এই লিখন পদ্ধতিতে প্রত্যক্ষভাবে বিষয়াবলির ছবির ছাপ দেওয়া হতো, কিন্তু কালক্রমে এই চিত্রলিপি প্রতীকধর্মী লিপিতে পরিণত হয়। যেমন- সরু রাস্তার পাশে পাহাড়ের গায়ে পানির ঢেউ এঁকে বুঝানো হতো, আশপাশে পানি আছে। এই লিপি ব্যবহৃত হয়েছে সুমেরীয় লিপিতে। এই চিত্রলিপিকে লেখায় পরিণত করতে মানুষের অনেক সময় লেগেছিল, মাত্র পাঁচ হাজার বছর হলো মানুষ লিখতে শিখেছে। সুমের-এর প্রাচীন অধিবাসীরা লেখার ব্যাপারে এক ধাপ এগিয়ে ছিল। হাঁড়িগুলোর গায়ে একটা-দুটো তিনটে দাগ মেরে বোঝবার চেষ্টা হলো যে, একটা-দাগওয়ালা হাঁড়িতে বার্লি আছে, দুটো-দাগওয়ালা হাঁড়িতে গম আছে, তিনটে দাগওয়ালা হাঁড়িতে যব আছে। দেখা এবং ভাবনা মেলানো এই যে নতুন লেখা, এটি চিত্রলিপিরই উন্নততর অবস্থা। এই লেখাকে ভাবব্যঞ্জক লিপি বলা হয়। কোনো জিনিসের পুরো ছবি না এঁকে, তার জায়গায় একটা সংকেত চিহ্ন এঁকেই সেটাকে বোঝানো হতে লাগল। এই লিপিতে প্রতিটি চিহ্ন একটি সম্পূর্ণ ধারণা বা শব্দকে প্রকাশ করে, ধ্বনিকে নয়। পরে আরো অগ্রসর হয়ে তৈরি হয় কিউনিফর্ম লিপি। এটি মূলত একটি ধ্বনিভিত্তিক লিপি।
ভাবব্যঞ্জক লিপি প্রচলিত হবার পর লেখার মধ্যে কতকগুলো চিহ্ন ব্যবহারের করে ভাবব্যঞ্জক লিপিতে ক্রমশ ধ্বনি যুক্ত করার চেষ্টা দেখা যেতে লাগল। ধ্বনিলিপির বিশেষ দিক হলো, মানুষের গলা থেকে যতগুলো ধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেই প্রত্যেকটি ধ্বনির আলাদা আলাদা বিশুদ্ধ উচ্চারণকে লিপিতে প্রকাশ করা। এই থেকে প্রত্যেক ভাষার বর্ণমালার উৎপত্তি হয়েছে। সুমেরীয়দের লিখিত ভাষা ধ্বনিগত এই শব্দাংশ প্রকাশ করার ধাপ পর্যন্ত এসে আর এগোতে পারেনি। এর পরবর্তী যে ধাপ, অর্থাৎ বর্ণমালার ব্যবহার, এই ভাষার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। খ্রিষ্ট-পূর্ব তিন হাজার বছরের আগে যেখানে প্রায় ২০০০ চিহ্ন ব্যবহার করতে হতো, সেখানে একহাজার বছরে মাত্র ৬০০ চিহ্ন ব্যবহার করেই লেখার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এর ঠিক বিপরীত হয়েছিল চীন দেশে। সেখানে লেখা চিত্রলিপি থেকে ভাবব্যঞ্জক লিপি পর্যন্ত এগিয়ে আসবার পর, আর এগোয়নি। ফলে ক্রমশ বেশি চিহ্ন ব্যবহারের প্রচলন এখানে করতে হয়েছিল। সেজন্য আজও পর্যন্ত চীন দেশের লিখিত ভাষায় বিপুলসংখ্যক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।
০০৮ ▌ বর্ণমালার আবিষ্কার:
চিত্রলিপি আবিষ্কারের প্রায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার বছর পরে বর্ণমালার আবির্ভাব ঘটেছিল। এই সময়ের মধ্যে সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, সিনাই, ক্রিট প্রভৃতি অঞ্চলে বর্ণমালার প্রচলন দেখা যায়। পরের যুগে বিভিন্ন ভাষার সমস্ত বর্ণমালাই আদিম এই বর্ণমালা থেকে উদ্ভুত হয়েছিল। ওই বর্ণমালাই ক্রমশ বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় ছড়িয়ে আজকের সকল ভাষার বর্ণমালার জন্ম দিয়েছিল। আদিম এই বর্ণমালাকে ‘সেমিটিক বর্ণমালা’ বলে। পরিপূর্ণ বিকাশের পথে এই বর্ণমালা দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ‘উত্তর সেমিটিক’ (উত্তর অঞ্চলের সেমিটিক জাতিগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত বর্ণমালা) এবং ‘দক্ষিণ সেমিটিক’ (দক্ষিণ অঞ্চলের সেমিটিক জাতিগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত বর্ণমালা।) আধুনিক বর্ণমালার সৃষ্টির ক্ষেত্রে ‘উত্তর সেমিটিক বর্ণমালা’রই প্রধান অবদান। খ্রিস্ট-পূর্ব তিন হাজার বছরের কাছাকাছি সময়ে মিসরীয়রা ধ্বনিচিহ্ন ব্যবহার করতে পারলেও তারা কখনই ভাবব্যঞ্জক চিহ্নকে পরিত্যাগ করতে পারেনি; তাই বর্ণমালার পর্যায়ে উন্নত হওয়া এই ভাষার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
পশ্চিমে মিসর এবং পূর্বে মেসোপটেমিয়া এই দুটি প্রাচীন সভ্যতার সেতু ছিল সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইন। স্মরণাতীতকাল থেকে যুগের পর যুগ হাজার হাজার বছর ধরে সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনের বুকের উপর দিয়ে মানুষের অসংখ্য গোষ্ঠীর আসা-যাওয়া চলছিল। সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনে আবিষ্কৃত উত্তর সেমিটিক বর্ণমালার মোট বর্ণসংখ্যা ছিল ২২টি। সব কটিই ব্যঞ্জনবর্ণ। স্বরবর্ণ একটিও ছিল না। পরবর্তীকালে সেমিটিক ফিনিশীয় বণিকদের কাছ থেকে গ্রিকরা যখন এই বর্ণমালা গ্রহণ করেছিল, তখন তারাই প্রথম ২২টি বর্ণমালার সঙ্গে স্বরবর্ণগুলো যোগ করেছিল। ভারতে বৌদ্ধ যুগ শুরু হবার দু-তিনশ’ বছর আগে থাকতে বর্ণমালার লিপি প্রচলিত হয়েছিল। উত্তর সেমিটিক-এর আরামিকা উপশাখা থেকেই ব্রাহ্মীলিপি গড়ে উঠেছিল। বর্তমান ভারতবর্ষ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় প্রচলিত বহু বর্ণমালার উৎপত্তি ঘটেছে আদি এই ব্রাহ্মীলিপি থেকে। ব্রাহ্মণদের দ্বারা এই লিপির বিকাশ হয়েছিল বলেই এর নাম ব্রাহ্মীলিপি। ব্রাহ্মীলিপিতে মাত্র ৪৪টি বর্ণের মধ্যে স্বরবর্ণ পাওয়া গেছে ৯টি।
মানুষের ভাষা-গোষ্ঠী কয়েকটি মূল বিভাগে বিভক্ত (১) ইন্দো-ইউরোপীয় : এর অন্তর্ভুক্ত হলো কেলট্গ্রিক, ল্যাতিন, টিউটনিক, স্লাভ, আর্য, হিট্টাইট্ ইত্যাদি। (২) সেমিটিক : এর অন্তর্ভুক্ত হলো প্রাচীন ব্যাবিলন ও আসীরিয়ার ভাষা, ফিনিশীয়দের ভাষা, হিব্রু, সিরিয়ান, আরব আবিসিনিয়ান্ ইত্যাদি। (৩) হ্যামিটিক : প্রাচীন মিসরবাসীদের ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। (৪) উত্তর আফ্রিকার বার্বার এবং ফিনো-উগ্রীয়: ল্যাপল্যান্ড, সাইবেরিয়া, ফিনল্যান্ড, ম্যাজার, তুর্কি, মাঞ্চ, মোঙ্গল, ইত্যাদি ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। (৫) ভোট-চীন : চীন, বর্মী, শ্যাম এবং তিব্বতী ভাষাগুলো এর অন্তর্ভুক্ত। (৬) আমেরিন্ডিয়ান : অর্থাৎ উত্তর আমেরিকার আদিম অধিবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলো। (৭) অস্ট্রিক : মালয় এবং পলেনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের আদিম অধিবাসীদের ব্যবহৃত ভাষাসমূহ। নীল নদী থেকে সিন্ধু নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চলেই মানুষের ইতিহাসে প্রথম সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। কিন্তু এশিয়ার পূর্বস্থিত চীন দেশে হোয়াংহো নদীর উপত্যকায় মানুষের আরেকটি সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল।
০০৮ ▌ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা ও ব্রাহ্মীলিপি :
প্রায় ৭০০০ বছর আগে এই এশিয়া-ইউরোপ জুড়ে একটিমাত্র মূলভাষা ছিল। তার নাম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। এর কাছাকাছি সময়টাতেই মিশরের রাজবংশ গঠিত হয়, সুমেরীয় সভ্যতাসহ আরও কিছু মেসোপটেমিয় সভ্যতার সুচনা ঘটে, সিন্ধু সভ্যতার শুরু হবার কাজ চলতে থাকে। ঠিক এই সময়টায়ই মানে আজ থেকে প্রায় ৫৫০০ বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এদের একটির নাম শতম আরেকটির নাম কেস্তম। কেস্তম শাখা হতে পরে ইতালীয়, ফরাসি, ¯প্যানিশ, ইংলিশ, জার্মান ইত্যাদি ভাষার উৎপত্তি হয়। শতম ভাষাগোষ্ঠী সৃষ্টি হবার প্রায় ১০০০ বছর পরে এই ভাষাগোষ্ঠীটি ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এদের এক দল ইরান, আফগানিস্তান হয়ে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে। যা হচ্ছে ভাষা ইন্দো-আর্য ভাষা। এই ভাষার আবার দুইটি পর্যায় ছিল। ১. বৈদিক (ঋগ্বেদের যুগের সংস্কৃত ভাষা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-৫০০ অব্দ। পরবর্তীকালে এ ভাষাকে সংস্কার করা হয় বলে এর নাম হয় সংস্কৃত ভাষা। ) ২.প্রাচীন প্রাচ্য ভারতীয় বা প্রাকৃত ভাষাসমূহ (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের পর)।
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে পারস্য সাম্রাজ্য (যার রাষ্ট্রভাষা ছিল আরামাইক) ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশ শাসন করত। এই প্রশাসনিক যোগাযোগের মাধ্যমে আরামাইক লিপি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। ভারতীয়রা আরামাইক লিপি গ্রহণ করে, কিন্তু তাদের নিজস্ব ভাষা (প্রাকৃত) ও ধ্বনিগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য তারা লিপিটিকে আমূল পরিবর্তন করে। তারা যুক্তাক্ষর এবং অমাত্রা/মাত্রাব্যবস্থা দিয়ে এই লিপিকে আরামাইক বা সেমিটিক লিপিগুলো থেকে আলাদা করে। একে বলা হলো ব্রাহ্মী লিপি। সম্রাট অশোক (রাজত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮-২৩২ অব্দ) তার বিশাল সাম্রাজ্য জুড়ে ধর্মলিপি (শিলালিপি) খোদাই করার জন্য ব্রাহ্মী লিপিকে প্রমিত ও পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। ব্রাহ্মীলিপিটি উত্তরী ও দক্ষিণী এই দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তর ভারতীয় লিপিগুলি হচ্ছে- কুষাণ লিপি, গুপ্তলিপি, পালি, বার্মিজ, সারদা, তাক্রী, কাশ্মিরী, নাগরী, মন্ডিনাগরী, দেবনাগরী, গুরুমুখী, কুটিল (প্রাগ-বাংলা), বাংলা, উড়িয়া, গুজরাটি, মণিপুরি, তিব্বতী, মোঙ্গোলিয়ান, দক্ষিণ ভারতীয় লিপি, কলিঙ্গ, মধ্য ভারতীয়, কাদম্ব, প্রাচীন কাদম্ব, আধুনিক কাদম্ব, তেলেগু, গ্রন্থ, তামিল, মালালায়ম। গুপ্তলিপি থেকে আবির্ভাব হয় ‘কুটিল লিপির’, এটি ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কুটিল লিপি থেকে উদ্ভব হয় নাগরী লিপির। প্রাচীন নাগরী লিপির পূর্ব শাখা থেকে ৯ম শতকের শেষভাগে বাংলা লিপি ব্যবহার করা হয়- বাংলা, মণিপুরি, ককবরক ও অসমীয়া ভাষায়। অসমীয়া লিপির উৎপত্তি বাংলা লিপি উৎপত্তির অন্তত আড়াইশ বছর পর। দুই ভাষায় ভিন্নতা (বাংলা র-এর বেলায় ) ১৮ শতকের পরে নিচে ফোঁটা দেওয়া ‘র’ বাংলায় ব্যবহৃত হয়। চর্যাপদের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম হয়। পরবর্তীযুগে বাংলায় সহজিয়া গান, বাউল গান ও বৈষ্ণব পদাবলীর উৎপত্তি হয়।
০০৯ ▌ বিভিন্ন যুগ, বছর ও দিন:
ইরান বা পারস্য থেকে আর্যরা দলে দলে ভারতবর্ষের পাঞ্জাবে প্রথম প্রবেশ করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সাল পর্যন্ত। খ্রিষ্ট-পূর্ব ১,৫০০-১০০০ অব্দের মধ্যে আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ রচনা করা হয়। বেদকে ভিত্তি করে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে তাই এর নাম বৈদিক সভ্যতা। সাধারণভাবে খ্রিষ্ট-পূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্ট-পূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত প্রায় ১০০০ বছরকে আমরা বৈদিক যুগ বলে থাকি। বৈদিক সভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। প্রথমে তারা যাযাবর জীবন-যাপন করত। পশুপালন ছিল তাদের প্রধান উপজীবিকা। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ও যাযাবর বৃত্তি পরিত্যাগ করে কৃষিকার্যকে উপজীবিকা হিসেবে গ্রহণ করার পর তারা পূর্ব দিকে গঙ্গা-যমুনা বিধৌত অঞ্চলে বন কেটে বসতি স্থাপন করে। এইভাবে বৈদিক যুগের শেষে তারা বিহার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এই আর্যদের অত্যাচার, দখল, নির্যাতনে ভারতের স্থায়ী বাসিন্দা দ্রাবিড়রা আস্তে আস্তে দক্ষিণে সরে যায়। মুন্ডারা আশ্রয় নেয় দুর্গম পাহাড়ে। অনার্যদের গায়ের রং ছিল কালো, আর আর্যদের রঙ ফর্সা। আর্যদের প্রধান ভাষা ছিল সংস্কৃত। বৈদিক যুগে আর্যদের বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম ছিল গরু। আর্য সমাজ প্রথমে ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। আর্য যোদ্ধা বা অভিজাত (ক্ষত্রিয়), ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) ও বৈশ্য (বণিক) আর দাসদের বলা হতো শূদ্র। নারীর মূল্যকে এরা বহুগুণে হ্রাস করে দেয় ধর্মের কথা বলে।
বৈদিক মানুষেরা সময়কে নির্দিষ্ট করতো সূর্য,চাঁদ,এবং বিভিন্ন গ্রহ, তারাকে হিসেব করে। তাই শুক্রবারের নাম এসেছে শুক্র গ্রহ থেকে, শনিবারের নাম এসেছে শনিগ্রহ থেকে, রবিবারের নাম এসেছে রবি অর্থাৎ সূর্য থেকে, সোম বারের নাম এসেছে সোম অর্থাৎ চাঁদ থেকে, মঙ্গল বারের নাম এসেছে মঙ্গল গ্রহ থেকে, বুধবারের নাম এসেছে বুধ গ্রহ থেকে, বৃহষ্পতি এসেছে বৃহঃপতি গ্রহ থেকে। বলা যায় আকাশই ছিল তাদের বর্ষ পুঞ্জিকা। কুষান সম্রাজের রাজা কনিষ্ক ৭৮খ্রিষ্টাব্দে শতাব্দের প্রচলন করেন। বুদ্ধাব্দ শুরু হয় গৌতম বুদ্ধের নির্বানের বছর থেকে। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে চালু হয় হিজরি সনের। যীশুখ্রিষ্টের জন্মের সময় থেকে খ্রিষ্টাব্দের প্রচলন হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৩৮ অব্দে রোমের সম্রাট রোমুলাসই ক্যালেন্ডার চালু করেন । প্রথম অবস্থায় ক্যালেন্ডার ছিল ১০ মাসের, মানে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারী ছিল না। রোম সম্রাট লুমা পন্টিলাস ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারী যোগ করেন। পরে রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার ক্যালেন্ডারটিকে সংস্কার করেন, তিনি চাঁদের হিসেব বাদ দিয়ে সূর্যকে দিয়ে হিসেব করে ৩৬৫ দিনে বছর করেন। প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। ৪৬৭ খিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন যুগ; পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত মধ্য যুগ, যার মধ্যে রয়েছে ইসলামের স্বর্ণযুগ (৭৫০-১২৫৮ খিস্টাব্দ) ও ইউরোপীয় রেনেসাঁ (১৩০০ শতক হতে শুরু)। আধুনিক যুগ-এর সূচনাকাল ধরা হয় পঞ্চদশ শতক হতে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত। যার মধ্যে রয়েছে ইউরোপের আলোকিত যুগ। শিল্প বিপ্লব হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত আধুনিক কাল বলে বিবেচিত। ১৫ শতকের মাঝামাঝি গুটেনবার্গ আধুনিক ছাপাখানা আবিষ্কার করেন, যা জ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। ফলে মধ্যযুগের সমাপ্তি ঘটে এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূত্রপাত হয়। ১৮ শতকের মধ্যে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার এমন একটি চরম অবস্থায় উপনীত হয়, যা শিল্প বিপ্লবকে অবধারিত করে তুলে। উনিশ শতক হচ্ছে বাঙালির নবজাগরণের যুগ। এ সময় বাঙালি-প্রতিভার সর্বতোমুখী বিকাশ ঘটে এবং জাতি হিসেবে বাঙালির অভ্যুদয়ের সর্ববিধ প্রচেষ্টারও সূত্রপাত ঘটে। এ যুগেই শক্তিশালী সাহিত্যেরও সৃষ্টি হয়।
০১০ ▌সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা ও এসেরীয় সভ্যতা :
পশ্চিম মিশর থেকে শুরু করে পারস্য উপসাগরের তীর পর্যন্ত এ ঊর্বর এলাকা বিস্তৃত। এই মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে প্রথম যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা সুমেরীয় সভ্যতা। ৫০০০ থেকে ৪০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সুমেরীয়দের সভ্যতা গড়ে উঠে এবং এ সভ্যতার ধ্বংস হয় ২৪০০খ্রিস্ট পূর্বাব্দে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার মাধ্যমে। সুমেরীয়দের পশু প্রীতি ছিল। পরাজিত সৈনিক ও বেসামরিক নাগরিকদের দাসে পরিণত করা হতো। অনেককে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়াও হতো। সেনাবাহিনী কোনো নগর দখল করলে অত্যন্ত নৃশংসতার পরিচয় দিত। সুমেরীয় পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক। তারা উপপত্নী রাখত। তাদের কৃষি পণ্য ছিল গম,যব, বার্লি, খেজুর, শাক-শবজি। চাকাওয়ালা ঠেলাগাড়ি ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার তাদের অন্যতম দিক। সুমেরীয় ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট ওজনের সোনা বা রুপার বাট মুদ্রা ব্যবহার করে। খ্রিস্ট পূর্ব ৩৫০০ অব্দে চিত্রলিপির মাধ্যমে সুমেরীয় লিখন পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটে। দিনপঞ্জি আবিষ্কার তাদের প্রধান অবদান। তারা চন্দ্রের মাস অনুযায়ী গণনা করতো। তারাই ৭ দিনে এক সপ্তাহ এবং ৬০ মিনিটে এক ঘন্টার নিয়ম প্রবর্তন করেন। এই যুগের যে অসংখ্য লিখিত নথিপত্র পাওয়া গিয়াছে, তা থেকে জানা যায় যে সুমেরদের এই নগরগুলোর প্রায় সমস্ত ধনসম্পদ এবং জমিজমার মালিক ছিল এক-একজন নগর-দেবতা। আর এই নগরদেবতাদের পূজা অর্চনা করা বা মন্দিরের সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করার ভার যাদের উপর ছিল, সেই পুরোহিত শ্রেণিই ক্রমশ নগর দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে নগরগুলোর প্রধান হয়ে উঠেছিল। এই সভ্যতার প্রধান ভিত্তিই ছিল টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস্ নদী দুটির পানি। দরকারি অনেক জিনিসপত্রের জন্য দূর দেশ থেকে আমদানি বাণিজ্যের উপর নির্ভর করতে হতো। কাজেই জমিজমা এবং নদীর পানি নিয়ে এবং বাইরের ওই আমদানি বাণিজ্যের সম্পদ নিয়ে এই নগরগুলোর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি লাগত।
সুমেরীয়দের বিতাড়িত করে ব্যাবিলনীয়রা নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও হাম্বুরীর মৃত্যুর পর ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য নামেমাত্র টিকে ছিল। তার পাঁচ জন উত্তরাধিকারী দেশ শাসন করেন। হাম্বুরাবী দুধর্ষ যোদ্ধা, সংগঠক, প্রশাসক ও আইন প্রণেতা ছিলেন। হাম্মুরবীর প্রায় চারশ বছর আগে সুমেরীয় রাজা লিবিট ইশতার এবং রাজা ডঙ্গীও আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু হাম্মুরবীই প্রথম সব আইনের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ আইন সংকলন করেন। সুমেরীয়দের মত প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রাও বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। সুমেরীয়দের মত ব্যাবিলনীয়দের ধর্মও ছিল ইহলৌকিক ধর্ম। পরকাল সম্বন্ধে তাদের ধারণা ও উৎসাহ কোনটাই ছিল না। যাদুবিদ্যা, ভবিষ্যৎবাণীতে বিশ্বাস, জ্যোতিষী নির্ভরশীলতার কারণে তারা নানান কুসংস্কারেও বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ব্যাবিলনীয়রা ৩০ দিনে একমাস, ১২ মাস বা ৩৬০ দিনে এক বছর নির্ধারণ করে। ব্যাবিলনীয় দিনপঞ্জি সূর্য নয় বরং চন্দ্রের ভিত্তিতে সময় নিরূপণ করতো। ৩৬০ দিনের পর বছর মেলানোর জন্য ১ টি অতিরিক্ত মাস গণনা করতো যাকে তারা ‘মল মাস’ বলত।
খ্রিস্টপূর্ব চৌদ্দ শতকে যখন ব্যাবিলনীয় শাসনের অন্তিমকাল, মিশর সিরিয়া ও আরব ভূখন্ডের অধিকাংশ হারিয়ে ক্ষুদ্র অঞ্চলে পরিণত হয়েছে, সেই সময় দুর্বল প্রতিবেশীর উপর আধিপত্য বিস্তার করে এসেরীয়রা একটি নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। খ্রিস্টপূর্ব আঠারো শতকে হাম্মুরাবীয় সময় পর্যন্ত ‘আসুর’ ছিল ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের একটি করদ রাজ্য। সুমেরীয়দের সময় আসুর অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। এসেরীয়রা বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্পকলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ব্যাবিলনীয়, সুমেরীয়, আক্কাদীয়দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তিগলাথ পিলসারের সময় এসেরীয় সাম্রাজ্যগৌরবের চরম পর্যায়ে পৌঁছে। বিশাল সেনাবাহিনী, উন্নত অস্ত্র সংগ্রহ করে তিনি আর্মেনিয়া ও ব্যাবিলন জয় করেন। সিরিয়া থেকে পূর্বে আনাতোলিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকাংশ রাজ্য থেকে কর আদায়ে সক্ষম হন। তারা ইসরাইলকে একটি এসেরীয় প্রদেশে পরিণত করেন।
০১১ ▌ফিনিশীয় সভ্যতা ও হিব্রু সভ্যতা:
খ্রিস্ট পূর্ব ৩০০০ অব্দে উত্তর মেসোপটেমিয়া থেকে সেমেটিক গোষ্ঠীভুক্ত একদল যাযাবর লেবাননের পর্বতমালা ও ভুমধ্যসাগরের উপকূলে বসতি গড়ে তোলে। ক্রমান্বয়ে তারা সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল ও মরুভূমির পশ্চিমাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এমন ভৌগোলিক অবস্থায় তাদের কৃষিযোগ্য জমি কম থাকায় তারা সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের দিকে ক্রমান্বয়ে ঝুঁকে পড়ে। ফিনিশীয়রা ছিল ব্যবসায়ী জাতি। কৃষি ও পশুপালন ফিনিশীয়দের প্রাথমিক জীবিকায় ভূমিকা রাখে। পাহাড় ও সমতল উপত্যকায় বিভিন্ন ধরনের শষ্যদানা, আক্সগুর,জলপাই, খেজুরের চাষ হতো। পশুর মধ্যে গাধা, ছাগল ও ভেড়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। হিব্রুদের সঙ্গে ফিনিশীয়দের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রমাণ বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট, ইলিয়াড ও ওডিসি মহাকাব্যে উল্লেখ আছে। ১২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ফিনিশীয় ধর্মে উৎসর্গ প্রথা প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন জিনিষপত্র, খাদ্য,পানীয়, পশু-পাখি এমনকি মানুষ বলি দেয়া হতো। কেনানাইট লিপি থেকে ফিনিশীয়রা ১২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ২২টি ব্যঞ্জনবর্ণের বর্ণমালা উদ্ভাবন করে। খ্রিস্ট পূর্ব ৮০০ অব্দে এই বর্ণমালার সঙ্গে গ্রীকরা স্বরবর্ণ যোগ করে বর্ণমালাকে পূর্ণতা দেয়।
হিব্রুরা ইহুদি জাতি নামেই পরিচিত। খ্রিস্ট পূর্ব ১৮০০ অব্দে হিব্রুদের আদি বাসস্থান উত্তর পশ্চিম মেসোপটেমিয়া হলেও এবং পরে তারা ১০২৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দেকেনানে (যা পরবর্তীকালে প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত হয়) বসতি গড়ে তোলে। ক্রমান্বয়ে পশ্চিম এশিয়ায় তারা একটি সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে তোলে। নবীর আবির্ভাবসহ আধুনিক সকল একেশ্বরবাদী ধর্মের ভিত্তি গড়ে তুলতে তারা অসামান্য অবদান রাখেন। ১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ডেভিড (দাউদ আঃ) হিব্রুদের রাজা হন। তিনি শুধু রাজাই ছিলেন না ধর্মেরও নেতৃত্ব প্রদান করেন। বাইবেলে প্রকাশ তার সময় জেরুজালেম ইহুদি ধর্মের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। ডেভিডের ছেলে সোলমান (সোলায়মান) হিব্রু সাম্রাজ্যের পরবর্তী রাজা হন। তার সময় হিব্রুদের শক্তি ও প্রতিপত্তির চরম সীমায় পৌঁছে। তিনি ইউফ্রেটিস নদী থেকে প্যালেস্টাইন ও মিশরের সীমান্ত পর্যন্ত রাজ্যের কর্তৃত্ব করেন। তিনিও পিতার ন্যায় রাজা ও ধর্মীয় নেতা ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ অব্দে এসেরীয়রা ইসরাইল দখল করে ইহুদিকে নির্বাসন দেয়।
০১২ ▌মিশরীয় সভ্যতা ও পারস্য সভ্যতা:
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের পূর্বেই নগর বিপ্লব সংঘটিত হয়। প্রাচীন মিশর লম্বায় প্রায় ৫০০ মাইল এবং সবচেয়ে বেশি চওড়া যেখানে, সেখানে মাত্র ১০ মাইলেরও কিছু কম। নীলনদ তীরবর্তী প্রায় ১২৫০০ বর্গমাইল এলাকার পলি মাটিতে প্রাচীন মিশরীয়রা ফসল ফলাত এবং সমৃদ্ধ নগর গড়ে তুলেছিল। মিশরের সমাজ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, ১. ফারাও, রাজ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তি,পুরোহিত ও ভূমির মালিক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা উচ্চ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলে। ২.বণিক কারিগর ও অন্যান্য শ্রম শিল্পীরা মধ্যম শ্রেণিভুক্ত ছিল। ৩.ভূমিদাস, সেবা দাস এবং ক্রিতদাসরা নিম্ন শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরাই ছিল জনগনের বৃহত্তম অংশ। দাসদেরকে সাধারণত রাস্তাঘাট নির্মাণ, খাল কাটা, বাধ নির্মাণ, চাষাবাদ, খনির কাজে নিয়োগ করা হতো। পিরামিড নির্মাণের শ্রমদানে দাসদের বাধ্য করা হতো। বেঁচে থাকার সামান্য খাদ্য ও পানীয় পাবার নিশ্চয়তা ছিল তাদের কাছে অকল্পনীয়।
৬৮ মণ ওজনের বিরাট বিরাট পাথরের চাঁই নীল নদীর অন্য পাড়ে দশ-বারো মাইল দূর থেকে মানুষকেই বয়ে আনতে হয়েছিল। একটা দুটো নয়, তেইশ লক্ষ পাথর! জোর-করে খাটানো এই মানুষগুলো রাজার সিপাই-শাস্ত্রীর চাবুক খেয়ে পাথরচাপা পড়ে কত হাজারে হাজারে মরেছে, তার হিসাব নেই; এসব কাজে ক্রীতদাসদেরই খাটানো হতো। আর সে যুগের মানুষের কাছে ক্রীতদাসরা তো মানুষ বলে গণ্যই হতো না। যুদ্ধবিগ্রহে যারা বন্দি হতো, শুরুতে এদের মেরে ফেলাই হতো; পরে যখন দেখা গেল যে, নানারকম অমানুষিক খাটুনির কাজে এদের লাগানো যায়, তখন আর মারতো না। অন্যদিকে রাজারাজড়া, তাঁদের আত্মীয়-স্বজন, পোষ্য এবং পুরোহিতদলের বিলাস আর ব্যাসনের কোনো সীমা ছিল না। কবরগুলোই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
খ্রিস্ট পূর্ব ছয় শতকে পারস্য অঞ্চলে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। পারস্য সাম্রাজ্য ভারতের পাঞ্জাবের সিন্ধু নদের তীর থেকে ঈজিয়ান সাগর এবং ভারত মহাসাগর থেকে ক্যাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পারস্য স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি ছিল সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ‘পারসা’ নামে প্রদেশ থেকেই দেশের নাম হয়েছে ‘পারস্য। আর আর্যদের বাসভূমি ‘অ্যারিয়ানা” শব্দ থেকে দেশের নাম হয়েছে ইরান হয়েছে। পারস্যকে আদি আর্যভূমি বলা হয় যায়। সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্য সম্রাটের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। তার উপাধি ছিল শাহেন শাহ। ইরানে কৃষি কাজ ছিল জীবিকার প্রধান উৎস। জমির মালিক ছিল জমিদার শ্রেণি। জমি চাষ করতো দাসরা। ভূমির সঙ্গে তাদেরও কেনাবেচা হতো। গম, যব, আক্সগুর ও জলপাই ছিল প্রধান উৎপন্ন ফসল। গরু,মেষ, ছাগল, গাধা, ঘোড়া প্রভৃতি পশু প্রজননের ব্যবস্থা ছিল। তখন চিনি ছিল না, মধু ব্যবহার হতো আর মধু আহরণের জন্য মৌমাছি চাষ হতো। প্রাচীনকাল থেকে পারস্যবাসীরা বহু দেবতায় বিশ্বাসী ছিল। দেবতাদের তুষ্ট রাখার জন্য বন্দনা করতো এবং বলি অর্ঘ দিত।
০১৩ ▌পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা গ্রীক সভ্যতা:
প্রাচীন গ্রিকরা নিজেদের মনে করত দেবতা ডিয়োকেলিয়নের পুত্র হেলেনের বংশধর। তাই তারা নিজেদের হেলেনীয় বলত। এ কারণে তাদের সভ্যতা হেলেনীয় সভ্যতা নামেও পরিচিত হয়। প্রাচীন গ্রীস কোনো অখন্ড রাষ্ট্র ছিল না। এটা ছিল মূলত অসংখ্য নগর রাষ্ট্রের সমষ্টি। নদীনালা গ্রীসে নেই বললেই চলে। নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সর্বপ্রধান দুটি হচ্ছে ¯পার্টা এবং এথেন্স । এথেন্স ছিল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল এবং উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী, আর স্পার্টা ছিল অভিজাততান্ত্রিক, রক্ষণশীল, পশ্চাৎমুখী এবং অনুন্নত সংস্কৃতির অধিকারী। স্পার্টানদের আগমন ঘটেছিল আক্রমণকারী হিসেবে। স্থানীয় একিয়ান (মাইসিনীয়) অধিবাসীদের চূড়ান্তভাবে পরাস্থ করতে তাদের কয়েকশত বছর যুদ্ধ করতে হয়েছিল, ততদিনে সামরিক অভ্যাস হয়েছিল তাদের মজ্জাগত। স্পার্টানদের জীবনের সমস্ত দিক তাদের সামরিক প্রয়োজন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। অন্যদিকে ‘এথেন্স’ নগর রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল গ্রীসের এটিকা নামক স্থানে এক পার্বত্য এবং অনুর্বর ভূমিতে। এথেন্সের নাগরিক সমাজ ছিল চার ভাগে বিভক্ত। প্রথম শ্রেণিতে ছিল ধনী অভিজাত শ্রেণির লোক। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল কৃষক, বণিক, নাবিক, কারিগর ও ব্যবসায়ী প্রমুখ। তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল অন্য দেশ হতে আগত জনগণ। চতুর্থ শ্রেণিতে ছিল দাস। এথেন্সে বহুসংখ্যক দাস ছিল। এথেনীয় সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী শাসক ছিলেন পেরিক্লিস। এথেন্সের স্বর্ণযুগের সূচনা তারই শাসনামলে। তার শাসনামলে তথা খ্রিস্ট পূর্ব পাঁচ শতকে শিক্ষা, দীক্ষা, রাজনীতি, শিল্পকলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দর্শন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে এথেনীয়রা চরম উন্নতি সাধন করে।
প্রাচীন গ্রিসের সূচনা ধরা হয় ৭৭৬ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে অলিম্পিক গেমস-এর আয়োজনের মধ্য দিয়ে, আর পরিসমাপ্তি ধরা হয় ৩২৩ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে মহামতি আলেকজেন্ডরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। মহাকবি হোমার, বিখ্যাত বীর আলেকজান্ডার, দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো, ইতিহাসবিদ হেরডেটাস, পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড হিপোক্রেটস, এপেলেসের মতো গ্রিসের আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান,সভ্যতা ও ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। প্রাচীন গ্রিস গোটা পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে। যেমন গণতন্ত্র। গ্রিসের চিকিৎসা দেবতা অ্যাসক্লেপিয়াস লাঠিতে সাপ পেঁচিয়ে আছে; চিকিৎসা বোঝাতে এই প্রতীকই ব্যবহার করছে সারা বিশ্ব। শুধু চিকিৎসা আর গণতন্ত্রই নয়, গ্রিস আমাদেরকে প্রথম ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসকে দিয়েছে, প্রথম গণিতজ্ঞ দিয়েছে- থালিস, পিথাগোরাস। প্রথম দার্শনিক দিয়েছে- সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল। প্রথম চিকিৎসাবিদ হিপোক্রেটকে দিয়েছে। বিচার ব্যবস্থায় জুরির শুনানি দিয়েছে। প্রথম থিয়েটার দিয়েছে। অলিম্পিক গেইম দিয়েছে। ভাস্কর্য শিল্প দিয়েছে। মেকানিক্যাল অডোমিটার দিয়েছে। স্থাপত্যশিল্প দিয়েছে। গ্রিক পুরাণের শিক্ষণীয় গল্প দিয়েছে। আরও কতশত কিছু দিয়েছে। ন্যায়বিচারের জন্যও গ্রিকরা একজন দেবীর কল্পনা করেছিল নাম থেমিস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিচারালয়ের এখনো থেমিস ভাস্কর্য দাড়িপাল্লা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে গণিতবিদ থেলিসকে বলা হয় বিজ্ঞানের জনক। তিনি গণিতকে প্রথমবারের মতো একটা বিপ্লবে রূপ দিতে পেরেছিলেন। থেলিস ছিলেন প্রাক সক্রেটিস যুগের প্রধান দার্শনিক। থেলিসের অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যান তারই শিষ্য অ্যানাক্সিমানদার। পিথাগোরাস উপপাদ্য এখনো পৃথিবীর প্রায় সব শিক্ষালয়ে পাঠ্য। পিথাগোরাসের শিষ্য ফিলোলাউস-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে বিদায় করেন।
০১৪ ▌সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল :
মানুষের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কিত চিন্তার ক্ষেত্রে গ্রীসে একশ্রেণির যুক্তিবাদী দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে, যারা সফিস্ট নামে পরিচিত। সফিস্ট চিন্তাবিদগণ ছিলেন যে কোনো বক্তব্য প্রমাণ সাপেক্ষে গ্রহণের পক্ষে। এভাবে তারা চিন্তা চর্চার ক্ষেত্রে গ্রীসে এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন। সক্রেটিস ছিলেন সফিস্ট চিন্তার অনুসারী। ৪৬৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে তার জন্ম। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে ভাল মন্দ অথবা ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিষয়ে জানা ও বোঝার চেষ্টা করাই ছিল সক্রেটিসের শিক্ষার প্রকৃত পদ্ধতি। সক্রেটিস ছিলেন এক দরিদ্র ব্যক্তি, যিনি বাস করতেন গ্রিসের অ্যাথেন্সে। তিনি ছিলেন একজন ভালো যোদ্ধা। তবে তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিল বিস্ময়কর। সক্রেটিস এথেন্সের আঘোরায় (বাজারে) এলোমেলোভাবে ঘোরাফেরা করতেন, যেদিকে যেতেন যেন হেমিলনের বাঁশিওয়ালা, পেছনে যুবকদের সারি। অ্যাথেন্সের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি অসহ্য ঠেকল। তারা সক্রেটিসের বিরুদ্ধে দেবতাদের প্রশ্নবিদ্ধ করা নিয়ে তরুণদের নষ্ট করার অভিযোগে মৃত্যুদন্ড প্রদান করলেন। সক্রেটিসের“ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট” ছিল এরকম: একদিন একজন লোক সক্রেটিসের কাছে এসে বলল, সক্রেটিস, তুমি কি জানো এইমাত্র আমি তোমার বন্ধুর ব্যাপারে কি শুনে আসলাম? সক্রেটিস বলল, ঘটনাটি বলার আগে আমি তোমাকে তিনটি প্রশ্ন করবো। আমি এর নাম দিয়েছি “ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট”। প্রথম প্রশ্নটি সত্য মিথ্যা নিয়ে; তুমি কি নিশ্চিত তুমি আমাকে যা বলতে যাচ্ছ তা নির্ভেজাল সত্য? লোকটি উত্তর দিল, না, আমি জানি না এটা সত্য কিনা, আসলে আমি একজনের কাছে শুনেছি। ঠিক আছে, সক্রেটিস আবার বলল, এখন আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি কি আমার বন্ধু সম্বন্ধে ভালো কিছু বলবে? -উম, নাহ, আসলে খারাপ কিছুই...! এবার তৃতীয় প্রশ্নটি হলো, তুমি আমাকে যা বলতে যাচ্ছ, তা কি আমার জন্য উপকারী?' লোকটি উত্তর দিল, না, তোমার উপকার হবে না। এবার সক্রেটিস শেষ কথাটি বললো, তুমি আমাকে যা বলতে চাও, তা সত্যও নয়, ভাল কিছুও নয় এবং আমার জন্য উপকারীও না, তাহলে তা আমাকে বলে কি লাভ! শিক্ষা: কোন মিথ্যা যা জেনে আপনার লাভ হবার কোনও সম্ভাবনা নেই, এমন তথ্য চারদিকে ছড়িয়েই কি লাভ?
বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিসের মৃত্যুর প্রায় দুই বৎসর পর প্লেটো জন্মগ্রহণ করেন। প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের ছাত্র। তার শিক্ষক সক্রেটিস এর মৃত্যুদন্ড প্লেটোর দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্লেটোর মতে, একট সভ্য রাষ্ট্রগঠনের জন্য প্রথম শর্ত হলো সুশিক্ষিত নাগরিক। তার দৃষ্টিতে শিক্ষা কেবল জ্ঞানার্জনের উপায় নয়, বরং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের ভিত্তি। তিনি আনুমানিক ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সে 'একাডেমি' প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে দর্শন, গণিত, রাজনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হতো। এটি ছিল পশ্চিমা বিশ্বের উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি এবং এটি প্রায় ৯০০ বছর ধরে টিকে ছিল। প্লেটোর প্রায় সমস্ত লেখাই তাঁর গুরু সক্রেটিসের সঙ্গে অন্যান্য দার্শনিকদের কথোপকথন বা ডায়ালগ আকারে লেখা। প্লেটোর জীবনের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সক্রেটিসের আদর্শকে যথার্থ বলে প্রমাণ করা। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন রাজনীতিতে সক্রেটিসের মত জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রয়োজন সবচাইতে বেশি। প্লেটোর ছাত্র ছিলেন এরিস্টটল। এরিস্টটল কিন্তু গুরুর সব কথার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তবে এরিস্টটলই প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন এবং বুঝতে পারেন পৃথিবী একটা গোলক। তিনি সম্ভবত খেয়াল করেছিলেন জাহাজ যখন বন্দর ছেড়ে যেতে থাকে, তখন তার পালের আগা সবার পরে অদৃশ্য হয়। এরিস্টটল নিজে প্লেটোর অ্যাকাডেমিতে প্রায় বিশ বছর অধ্যয়ন করার পর নিজের একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। এর নাম হলো লাইসিয়াম। এরিস্টটল সেখানে হেঁটে হেঁটে ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন, যে কারণে এই প্রতিষ্ঠানের অনুসারীদের "পেরিপ্যাটেটিকস" বা "যারা হেঁটে শেখে" বলা হতো। লাইসিয়ামে একটি বিশাল পাঠাগার এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য সংগ্রহশালা ছিল। এটি ছিল পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম দিকের প্রধান গবেষণা কেন্দ্রগুলির একটি। এই এরিস্টটলই ছাত্র ছিলেন আলেকজান্ডার। ৩৩২ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার মিসর দখল করেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য তিন সৈন্যাধ্যক্ষের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। সাম্রাজ্যের আফ্রিকান অংশ মিশর, তার অধিকর্তা হন সেনাধ্যক্ষ টলেমি। এই টলেমি বংশের রাজারা, যারা ইতিহাসে ফারাও (রাজা) নামে অভিহিত, তাদের অধীনেই থাকে জেরুজালেম। রোমানরা জেরুজালেম দখল করে খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে। ইহুদিরা রোমান শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। সম্রাট ডেসপাসিয়ানের সৈন্যরা জেরুজালেম প্রায় পুরোটাই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ দাঁড়িয়ে থাকে। যা এখন বিলাপ প্রাচীর নামে পরিচিত। ইহুদি ধার্মীকরা এই দেয়ালে প্রার্থনা করে।
০১৫ ▌ আলেকজান্দ্রিয়া ও এরাতোসথেনেস:
৩৩২ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার যখন মিসর দখল করেন। তখন মিসরের ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে আলেকজান্ডার ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ উপকূলে একটা শহর তৈরি করেন, শহরটার নাম হয় আলেকজান্দ্রিয়া। তার মৃত্যুর পর তার সেনাপতি টলেমি আলেকজান্দ্রিয়ায় থেকে মিসর শাসন করতে থাকে। টলেমি রাজবংশের শাসনামলে প্রায় ৩০০ বছর আলেকজান্দ্রিয়া গোটা পৃথিবীর বুদ্ধিবৃত্তিক রাজধানী ছিল। মজার ব্যাপার হলো- এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের প্রথম গ্রন্থাগার। তখন লেখা হতো প্যাপিরাস পাতায়, প্রায় ১০ লক্ষ প্যাপিরাস স্ক্রল ছিল এই গ্রন্থাগারে যার সবগুলোই আজ হারিয়ে গেছে। এক সময় আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ছিলেন ভূগোলের জনক এরাটোস্থেনিস।
এরাতোসথেনেস একদিন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীতে কিছু প্রাচীন পুঁথি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলেন। একটি প্যাপিরাসের পুঁথিতে এমন অদ্ভুত একটা কথা লেখা ছিল- যেখানে তার চোখ আটকে যায়। সেখানে লেখা আছে, “সায়ানের দক্ষিণ সিমান্তের কাছে একটি এলাকায়, অর্থাৎ নীলনদের প্রথম খাড়া জলপ্রপাতের কাছে একটি এলাকাতে- ২১ শে জুন দুপুর বেলা খাড়া করা লাঠির কোন ছায়া পরে না”। এরাতোসথেনিস খুবই আবাক হলেন। এটি কিভাবে সম্ভব? পৃথিবীর পৃষ্ঠটা যদি সমতল হয় তবে এটি কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাহলে পৃথিবী নিশ্চই কোন গোলোক, আর এর পৃষ্ঠটা নিশ্চয় বাকা। তিনি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন যে আসলেই ২১ জুন দুপুরবেলা সায়েনে থাকা কোন লম্বা লাঠিতে ছায়া পরে না। এরপর তিনি একজন লোক নিয়োগ করে সায়েন থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার দূরত্ব মেপে বের করলেন। এরপর তিনি মেপে দেখলেন আলেকজান্দ্রিয়ার ছায়ার সাথে লাঠিটি ৭ ডিগ্রি কোন তৈরি করে। পৃথিবী যদি একটি গোলোক হয়, তাহলে তার পরিধিও এবার বের করা সম্ভব। কারন বৃত্তের ৩৬০ ডিগ্রিকে সাত দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় ৫০। তাহলে পৃথিবীর পরিধি হবে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সায়েনের দূরত্বের ৫০ গুণের মত। তার নিয়োগ করা লোক মেপে দেখেছিলেন যে দুই জায়গার দূরত্ব ৮০০ কিলোমিটারের মত। ফলে তিনি ঘোষণা করলেন যে- পৃথিবীর পরিধি হলো ৮০০ গুণ ৫০ = ৪০০০০ কিলোমিটার। ভাবলে অবাক হতে হয় আজ থেকে প্রায় ২৩০০ বছর আগে একটা লাঠির সাহায্যে তিনি হিসেব করে পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করেছিলেন ৪০,০০০ কিলোমিটার, যা আসল মানের খুবই কাছাকাছি।
এর পরের সময়টা ছিল জ্ঞানের জন্য অন্ধকার যুগ: খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীরা প্লেটো, এরিস্টটল এবং টলেমির মতবাদ পুরোপুরি গ্রহণ করে। এই তিনজন পরিণত হন খ্রিস্টান চার্চ শাসিত পশ্চিমা বিশ্বের তিন পথপ্রদর্শকে। 'এরিস্টটলের পরবর্তী সময়কে বলা হয় জ্ঞানের জন্য অন্ধকার যুগ। এরিস্টটল এতই বড় হয়ে উঠেছিলেন যে, তার সমালোচনা বা তার চাইতে অধিক জ্ঞান অর্জনকে ধর্মবিরোধী বা বিজ্ঞানবিরোধী বলা শুরু হয়ে গেল। যার ফলে পৃথিবী আর আগাল না, থমকে গেল জ্ঞান-বিজ্ঞান। যখনই নতুন কোনো চিন্তা আসল, সবাই এরিস্টটলের তত্ত্বের সঙ্গে তা মেলে কিনা হিসাব করতে বসে গেল। মিলে গেলে ভালো কথা, কিন্তু যখনই এরিস্টটলের তত্ত্বে¡র সঙ্গে কোনো তত্ত্ব¡ বিন্দুমাত্র দ্বিমত পোষণ করল, তার আর রক্ষা নাই, তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হলো বা পুড়িয়ে মারা হলো। যেমন- কোপানির্কাস, গ্যালিলিও, ব্রনো আরো অনেকে। এভাবে প্রায় দেড় হাজার বছর এরিস্টটলের ভূত মানুষের মাথায় ভর করেছিল। এরিস্টটল না জন্মালেই হয়তো জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষ আরও অনেক এগিয়ে যেত।
০১৬ ▌রোমান সভ্যতা জুলিয়াস সিজার ও ক্লিওপেট্রা:
গ্রীক সভ্যতা যখন বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন ইতালির তাইবার নদীর তীরে আরেকটি সভ্যতার উদয় হয় , যা রোমান সভ্যতা নামে পরিচিত। খিস্ট-পূর্ব পঞ্চম শতকে রোম শহরের পত্তন হয়। কালক্রমে টাইবার নদীর মোহনায় সাতটি পার্বত্য টিলাকে কেন্দ্র করে এই নগরীর বিস্তৃতি ঘটে। রোম শহরকে কেন্দ্র করে ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে এই সভ্যতা বিকাশিত হতে থাকে, এবং কালক্রমে একটি প্রাচীন যুগের বৃহত্তম সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। এই সভ্যতার স্থায়িত্বকাল ছিল প্রায় বারো শতক এবং এ দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় রোমান সভ্যতা একটি রাজতন্ত্র থেকে একটি প্রজাতন্ত্র এবং পর্যায়ক্রমে একটি একনায়কতন্ত্রী সাম্রাজ্যে পরিবর্তিত হয়। আমরা যে আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারটির সঙ্গে পরিচিত সেটির প্রথম সূত্রপাত ঘটান রোমানরা। বর্তমান ইউরোপের প্রায় সব দেশের আইন রোমান আইনের মূলনীতি সম্পর্কিত ১২টি তালিকার ওপর ভিত্তি করে রচিত।
এইসময় ধন-দৌলত, ঐতিহ্য বা ইতিহাস- সবদিক থেকেই মিশর ছিল অতুলনীয়। সেখানে টলেমি রাজবংশ প্রায় ৩০০ বছর ধরে শাসন করে আসছিল। টলেমিদের পূর্বপুরুষ ছিলেন গ্রিকের মেসোডোনিয়ার, যারা আলেকজান্ডারের সৈন্য। আদি অধিবাসী না হয়েও বছরের পর বছর মিশরের নাগরিকদের শাসন করে আসছিল তারা, এই নিয়ে ধীরে ধীরে ক্ষুব্ধ হতে থাকে মিশরীয় রক্ত ধারণ করা মানুষগুলো। আবার পাশে এক পরাশক্তি ছিল রোমানরা। যেকোনো সময়েই রোমানরা আক্রমণ চালাতে পারে, এই ভয়ে টলেমি বংশ রোমানদের সাথে শান্তিচুক্তি করে। দামি দামি উপঢৌকন আর প্রজাদের কর রোমানদের পাঠিয়ে তুষ্ট রাখতে চায় টলেমিরা, বিনিময়ে তাদের চাওয়া ছিল মিশরের শাসক হিসেবে বহাল থাকা। এমনই এক নড়বড়ে অবস্থায় জন্ম ক্লিওপেট্রার। ৫১ খ্রিস্টপূর্বে অলেটিস যখন মারা যান, তার উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যান তার মেয়ে ক্লিওপেট্রা আর ছেলে ত্রয়োদশ টলেমিকে। প্রাচীন মিশরের নিয়ম অনুসারে, একজন নারী শাসক সবসময়ই পুরুষ শাসকের অধীনে থাকবে। তবে ক্লিওপেট্রার ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। সিংহাসনে আরোহণের কিছুদিনের মাথায় সরকারি সকল নথি থেকে, এমনকি মুদ্রা থেকেও ভাইয়ের ছবি বর্জন করেন তিনি।
উল্লেখ্য যে, ক্লিওপেট্রার বয়স ছিল তখন ১৮ আর ত্রয়োদশ টলেমির বয়স ১০ এবং তাদের বিয়েও হয়েছিল! প্রাচীন মিশরীয় বংশে ভাই-বোন বিয়ে ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এ রীতির ফলে সিংহাসনের দাবিদার যেমন কমে যেত, তেমনি রাজবংশের মেয়েরাও রানী হিসেবে যথোপযুক্ত মর্যাদায় জীবন অতিবাহিত করতেন! কিন্তু ক্লিওপেট্রা এতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার চোখে ছিল সারা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নারী আর ধনকুবের শাসক হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু অচিরেই তার এই কর্মকান্ড রাজকার্যের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের খেপিয়ে তোলে। কিছুদিনের মধ্যের আলেকজান্দ্রিয়া (তৎকালীন মিশরের রাজধানী) থেকে তাকে বিতাড়িত করেন ভাই ত্রয়োদশ টলেমি। ক্লিওপেট্রা পালিয়ে যান সিরিয়ায়। এইসময় জুলিয়াস সিজার হলেন রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের এক ঐতিহাসিক চরিত্র। সিজার খুব সহজেই টলেমিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন। আর তখনই চাল চাললেন বুদ্ধিমতী ক্লিওপেট্রা। অ্যাপোলোডোরাস নামের বিশ্বস্ত সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে হাজির হলেন তিনি। অ্যাপোলোডোরাস খুব দামি একটি কম্বল কিনে ক্লিওপেট্রাকে ওই কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে সিজারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন । যুদ্ধের উপহার হিসেবে ক্লিওপেট্রাকে পেয়ে আকাশ থেকে পড়লেন তিনি। সিজারকে বশ করতে খুব বেশি সময় লাগল না ক্লিওপেট্রার। বিনা যুদ্ধে সিংহাসনে বসলেন ক্লিওপেট্রা! একটি সৈন্যও মারা গেল না, একটি তীরও ছুঁড়তে হল না তাকে !
কিন্তু ক্লিওপেট্রার ভাই ত্রয়োদশ টলেমি ২০,০০০ সৈন্য নিয়ে ৪৭ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণ করেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধে পরাজিত হন এবং পালাতে গিয়ে নীল নদে ডুবে মারা যান । তার কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন সিজার এবং ক্লিওপেট্রা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই আততায়ীর হাতে খুন হন সিজার। এরপর ক্লিওপেট্রাকে কঠোর বার্তা পাঠান পরবর্তী রোমান নেতা মার্ক অ্যান্টনি। আলোচনার উদ্দেশ্যে তারা সিলিসিয়ায় দেখা করেন। কিন্তু ক্লিওপেট্রাকে দেখে অ্যান্টনি এতটাই বিমোহিত হয়ে পড়েছিলেন যে, সবকিছু ভুলে রানীর সাথে আলেকজান্দ্রিয়ায় চলে আসলেন। তাকে বিয়ে করে এক বছরের মধ্যে জমজ সন্তানের জন্ম দিলেন ক্লিওপেট্রা। এবার অ্যান্টনি সাথে সকল রোমান মুদ্রায় মুদ্রিত হলো ক্লিওপেট্রার ছবি। অ্যান্টনি যখন রোমে। তখন ক্ষিপ্ত অ্যান্টনির আগের স্ত্রী অক্টাভিয়ার ভাই গোপনে নৌপথে আক্রমণ চালান আলেকজান্দ্রিয়ায়। বিধি বাম, ক্লিওপেট্রা শক্তির কাছে হেরে তিনি পালালেন। কিন্তু রোমে খবর রটে গেল ক্লিওপেট্রা মারা গেছে। অবশ্য এর জন্য ক্লিওপেট্রাও দায়ী ছিলেন। সে তখন কিছুদিন সিংহাসন থেকে আড়ালে ছিল কারণ তার ভয় ছিল, হয়তো আরো আক্রমণ আসতে চলেছে। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ অ্যান্টনিকে উদ্যত করে আত্মহত্যা করতে, নিজের তরবারি দিয়ে নিজেরই প্রাণ নেন এই মহান যোদ্ধা। অ্যান্টনির মৃত্যুর সংবাদে বিচলিত হয়ে ওঠেন ক্লিওপেট্রা । তিনি বুঝতে পারেন, কী বিশাল ভুল হয়েছে তার। এরপর ৩০ খ্রিস্টপূর্বে চরম হতাশায় সাপের কামড়ে আত্মাহুতি দেন ক্লিওপেট্রা। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর সাথে সাথে ভিত্তি স্থাপন হয় মিশরের বুকে রোমান সাম্রাজ্যের।
তবে ৭১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রোমে দাস বিদ্রোহের নেতা স্পার্টাকাস নিহত হওয়ার পর রোমের সংকট বৃদ্ধি পায় এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করে। বাস্তবিক অর্থে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যকে আর রোমান সাম্রাজ্য না বলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য বলা হয়। কারণ বাইজেন্টাইন একদা রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হলেও এর ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি প্রায় সবকিছুই ছিল পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য হতে ভিন্নতর। রোমে বিকাশ লাভ করেছিল রোমান ক্যাথলিক মতবাদ অন্যদিকে কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুল (Istanbul) শহর) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গ্রীক অর্থডক্স চার্চের দর্শন। বাইজেন্টাইন ধারণ করেছিল মূলত গ্রীক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কিদের হাতে প্রায় এক হাজার বছর স্থায়ী এ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
০১৭ ▌চীনা সভ্যতা, অ্যাজটেক, মায়া ও ইনকা সভ্যতা :
চীনা সভ্যতার জন্ম হুয়াং হো নদীর উপত্যকায়। নদীটি পানির সাথে প্রচুর পরিমাণে উর্বর পলি বয়ে আনে, যা কৃষির জন্য দরকারী হালকা হলুদ রংয়ের এই পলির কারণে তাই বলা হয় “হলুদ নদীর সভ্যতা” । ধ্বংসাত্মক বন্যার জন্যও এই নদীকে "চীনেরদুঃখ" বলা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১ সালে জন্ম নেয়া কনফুসিয়াসবাদ আজো রাষ্ট্রীয় দর্শন হিসেবে চীনের সামাজিক কাঠামো ও প্রশাসনের মূল ভিত্তি। এটি পারিবারিক আনুগত্য, বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নৈতিক আচরণবিধির ওপর জোর দেয়। মঙ্গোলীয় জাতির সঙ্গে তিব্বতি, তাতার, জাপানি প্রভৃতি জাতির সংমিশ্রণ ঘটে। যার ফলে চৈনিকদের মুখাকৃতি বর্তমান আদল রূপ নেয়। প্রাচীন চীনারা বিশ্বাস করতো পূর্ব পুরুষরা পরিবারের সুখ সমৃদ্ধি দান করে। তাদের পূজা না করলে বহু বিপদ হতে পারে। ভারত সম্রাট অশোকের কাল (খ্রিঃপূঃ২৭৩-২৩২) থেকে বৌদ্ধ ধর্ম চীনের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের হুন তাতারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
অ্যাজটেক সভ্যতা ছিল মধ্য আমেরিকার একটি শক্তিশালী মেসোআমেরিকান সভ্যতা, যা ১৪শ থেকে ১৬শ শতাব্দীতে বর্তমান মেক্সিকো অঞ্চলে বিকাশ লাভ করেছিল। অ্যাজটেকদের রাজধানী ছিল তেনোচতিৎলান, যা বর্তমান মেক্সিকো সিটির একটি হ্রদের দ্বীপে নির্মিত হয়েছিল। এটি ছিল সেই সময়ের বিশ্বের বৃহত্তম শহরগুলির মধ্যে একটি। তারা উন্নত কৃষি ব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যার মধ্যে 'চিনাম্পা' বা ভাসমান বাগান উল্লেখযোগ্য, অ্যাজটেক ধর্ম ছিল বহু-ঈশ্বরবাদী। তারা জটিল ধর্মীয় আচার, পিরামিড নির্মাণ এবং সূর্য দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য নরবলি প্রথা পালন করত। ১৫২১ সালে স্পেনীয়রা অ্যাজটেক সাম্রাজ্য দখল করে এবং এর পতন ঘটায়। স্প্যানিশরা সাথে নিয়ে আসে গুটিবসন্ত ও হামের মতো রোগ, যা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা স্থানীয় জনগণের ছিল না। এই রোগে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়, যা অ্যাজটেক সমাজ ও সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়।
মায়া সভ্যতা মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপ, গুয়াতেমালা, বেলিজ, হন্ডুরাস, এল সালভাদর -এ খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে ১৬শ শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ৯ম শতকের দিকে হঠাৎ অনেক শহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ধারণা করা হয়—অতিজনসংখ্যা, যুদ্ধ, খরা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সভ্যতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৬শ শতকে স্পেনীয়রা এসে বাকি অঞ্চল দখল করে নেয়। মায়ারা গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় অত্যন্ত উন্নত ছিল। তাদের ক্যালেন্ডার অত্যন্ত নিখুঁত (৩৬৫ দিনের সৌর বছর)। মায়ারা কোনো সাম্রাজ্য গঠন করেনি, বরং বিভিন্ন স্বাধীন নগর-রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল (যেমন: চিকেন ইতজা, তিকাল, কোপন)।
ইনকা সভ্যতা দক্ষিণ আমেরিকার বর্তমান পেরু, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, চিলি ও কলম্বিয়ার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ছিল। : ইনকারা একটি বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেছিল, যার রাজধানী ছিল কুসকো । তারা দক্ষ প্রকৌশলী ছিল; পাহাড় কেটে সিঁড়িযুক্ত চাষের জমি, চমৎকার রাস্তা ব্যবস্থা এবং সেতু নির্মাণ করেছিল। তাদের কোনো লিখন পদ্ধতি ছিল না, তবে 'গিঁটযুক্ত দড়ির সাহায্যে তথ্য সংরক্ষণ ও হিসাব করত। বিখ্যাত মাচু পিচু পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত ইনকা নগরী আজ অন্যতম । ১৫৩৩ সালে স্পেনীয় দখলদার ফ্রান্সিসকো পিজারোর নেতৃত্বে ইনকা সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। যুদ্ধ এবং ইউরোপ থেকে আসা গুটিবসন্ত রোগে লক্ষ লক্ষ ইনকা মারা যায়।
অ্যামেরিকা মহাদেশে যে সাম্রাজ্যগুলো গড়ে উঠেছিল যেমন- অ্যাজটেক, মায়া বা ইনকা সভ্যতা, তারা পশুপালনে অভ্যস্ত ছিল না। অন্য কোন কারনেও তাদের সাথে পশুদের কোন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। এর ফলে প্রাণী শরীর থেকে খুব বেশি রোগ তাদের মধ্যে প্রবেশ করতেও পারেনি, আর এর ফলে তাদের শরীরেও তেমন কোন ইম্যুনিটি তৈরি হয়নি। ইউরোপীয়রা যখন এইসব প্রাচীন আমেরিকান সাম্রাজ্য দখল করতে গিয়েছিল তখন, ইউরোপীয়দের শরীর থেকে যে রোগগুলো আমেরিকানদের শরীরে প্রবেশ করেছিল সেটা তাদের এতই কাবু করে ফেলেছিল যে, কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের জনসংখ্যার ৯০% মানুষ শেষ হয়ে যায়।
০১৭ ▌দ্য সিল্ক রোড ও স্তেপ অঞ্চল
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে চলে গেলে— লিখিত জিনিসের কোন অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যাবে না। তাই এই সময়ের আগে যা ঘটেছে তাকে বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক সময় বা প্রিহিস্টোরিন। প্রাচীনকালে বর্তমান ইরাক ও তার আশেপাশের অঞ্চলটি ছিল খুবই উর্বর জায়গা। দজলা এবং ফোরাত নদীর পলিমাটি জমে এখানে যে উর্বর অঞ্চল গড়ে উঠেছিল, তাকে লোকে বলত মেসোপটেমিয়া। এই অঞ্চলেই গড়ে উঠেছিলো ইতিহাসের প্রথমদিকের গ্রামগুলো, প্রথম শহর-বন্দরগুলো, এবং প্রথম সভ্যতা। প্রাচীনকালে যেসব সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল পারস্য সাম্রাজ্য। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে এটি ছড়িয়ে পড়ে মিসর, গ্রিস এবং হিমালয়ের পশ্চিম অঞ্চল পর্যন্ত।
প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ায় জন্ম নেওয়া একটি বাণিজ্যপথ পৃথিবীকে চিরতরে বদলে দিয়েছিলো। তবে এই পথকে কিন্তু একটি রাস্তা ভাবলে ভুল হবে। বরং এটি ছিল- বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকগুলো পথের সমষ্টি বা নেটয়ার্ক। এই পথের নাম- দ্য সিল্ক রোড। এই পথেই মার্কো পোলো ইতালি থেকে চীন পর্যন্ত তার বিখ্যাত যাত্রা করেন। পূর্ব এবং পশ্চিমের মানুষেরা এই পথে নানানভাবে ব্যবসা করেছে। এই পথ চীনকে যুক্ত করেছিলো পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে। স্তেপ হলো এক ধরনের বিস্তীর্ণ ঘাসি জমি। এই ঘাসি জমি ছড়িয়ে রয়েছে বর্তমান রাশিয়ান দক্ষিণ এলাকা ও ইউক্রেন জুড়ে। এই ঘাসি জমির মধ্য দিয়ে পারস্যের বাণিজ্য পথ, চীনের নিজস্ব সড়ক অর্থাৎ সিল্ক রোড জুড়ে যায় । প্রাচীনকালে এই স্তেপ অঞ্চল ছিলো একেবারেই বুনো এলাকা। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বাস করা যাযারর গোত্রগুলো। তারা, গম, চাল, মদ ইত্যাদির বিনিময়ে সংগ্রহ করত চীনের সিল্ক বা রেশম। আর এই গুরুত্বপূর্ণ পণ্যটির কারনেই এই পথের নাম হয়েছিল দ্য সিল্ক রোড। এই সিল্ক রোডের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের দর্শন উত্তর ভারত থেকে গিয়ে প্রবেশ করলো চীনে। আর সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়লো পুরো এশিয়া জুড়ে।
০১৯ ▌মেহেরগড় সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা ও হরপ্পা- মহেঞ্জোদারো :
আফ্রিকা থেকে যাযাবর শিকারি গোষ্ঠীর একটি দল প্রায় ৩০ হাজার বছর পূর্বে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছায় সিন্ধু নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এবং সেখানে স্থাপন করে বসতি। এরা দেখতে মধ্যম থেকে লম্বাকৃতির ছিল, গায়ের ও চোখের রং ছিল কালো থেকে হালকা বাদামি। এরা (খ্রিষ্ট-পূর্ব ৮৫০০-৭০০০) এরা সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা মেহেরগড় সভ্যতা পত্তন করেন। বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত বালুচিস্তানের জোব নদী থেকে পশ্চিম ভারতের সিন্ধু নদ পর্যন্ত মেহেরগড় সভ্যতা বিস্তৃত ছিল। পশুপালনের ওপর ভিত্তি করে ভারতবর্ষের মেহেরগড় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
সিন্ধু সভ্যতা: ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ ছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণ বেলুচিস্তানে এ সভ্যতার অস্তিত্ব লক্ষণীয়। সিন্ধু সভ্যতার যে সমস্ত নগরীর সন্ধান পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে আছে রাজস্থানের কালিবাঙ্গান, পাকিস্তানের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো। এই তিনটি নগরী এবং আরো প্রায় দুশ ছোট বড় শহরের এক বিশাল নগর সভ্যতা পূর্বে ঊর্ধ্ব গঙ্গা এবং দক্ষিণে বর্তমান মুম্বাই শহর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সিন্ধু সভ্যতা আকারে ছিল সমসাময়িক প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো হচ্ছে সিন্ধু-উপত্যকার প্রাচীন নগর-সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশের এই দুটি শহর, যা খ্রিস্ট-পূর্ব ২৫০০ থেকে খ্রিস্ট-পূর্ব ১৫০০ পযর্ন্ত মহাআড়ম্বর এবং জাঁকজমকের সঙ্গেই টিকেছিল। হরপ্পা সভ্যতা মেসোপটেমিয়া এবং সুমেরীয় সভ্যতার সমসাময়িক।
হরপ্পা- মহেঞ্জোদারো: হরপ্পা ‘ঢিবি’ খুঁড়ে পরপর ছ’টি বসতির সন্ধান মেলে। আর মহেঞ্জোদারোয় মেলে ন’টি। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো এই দুটি শহরে শহর-পরিকল্পনা থেকে শুরু করে এই সভ্যতার সমস্ত কিছুর মধ্যে সওদাগরী ব্যবসার প্রাধান্য সুস্পষ্ট। রাস্তাঘাট দোকানপাটের ছড়াছড়ি। বাজারে বিক্রি করার জন্যই যেন সমস্ত জিনিসপত্র প্রচুর পরিমাণে তৈরি হতো। হরপ্পা- মহেঞ্জোদারোর পাথরের জিনিস, নকশা-কাটা মাটির পাত্র এবং সিলমোহর সুমের পাওয়া গেছে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত নরমুন্ড পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেখানে যেমন দীর্ঘদেহ, সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ গড়নের মানুষের চিহ্ন পাওয়া গেছে, তেমনি খর্বাকৃতির দীর্ঘ নাসিকা, ধনুকের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল গড়নের মানুষও ছিল।
০২০ ▌সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধ এবং বাংলায় মাৎস্যন্যায় :
সম্রাট অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য , পিতা বিন্দুসার, রাজধানীঃ ছিল পাটলিপুত্র (বর্তমান বিহারের পাটনাতে) কলিঙ্গ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ অব্দে। এটি ছিল সম্রাট অশোকের রাজ্যাভিষেকের আট বছর পর। কলিঙ্গ ছিল ভারতের পূর্ব উপকূলের একটি স্বাধীন রাজ্য, যা বর্তমান উড়িষ্যা রাজ্যের অংশ। এটি সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। কলিঙ্গ জয় করা মৌর্য সাম্রাজ্যের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কলিঙ্গ জয়ের মাধ্যমে অশোক সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে তার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই যুদ্ধ ছিল ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী সংঘাত। অশোকের শিলালিপি (১৩তম শিলালিপি) অনুসারে, যুদ্ধে ১ লক্ষ লোক নিহত হয়, দেড় লক্ষ লোক বন্দী হয় এবং এর চেয়ে বহু গুণ বেশি লোক আহত ও বাস্তুচ্যুত হয়। শেষ পর্যন্ত, সম্রাট অশোকের মৌর্য বাহিনী কলিঙ্গকে পরাজিত করে এবং সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। এটি ছিল সম্রাট অশোকের শেষ সামরিক অভিযান। যুদ্ধের পরে রক্তপাত, মৃত্যু ও ধ্বংসলীলা দেখে অশোক অনুতপ্ত হন। এই বিশাল হত্যাযজ্ঞ কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। এই মানসিক পরিবর্তনের ফলস্বরূপ তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি আর যুদ্ধ বা সহিংসতার মাধ্যমে রাজ্য বিস্তার না করার সিদ্ধান্ত নেন।
সকল জীবের প্রতি দয়া ও সহিংসতা পরিহার। বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা। বয়স্কদের প্রতি সম্মান ও সত্যবাদিতা। এইসব নীতি প্রচারের জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্তম্ভ ও শিলালিপি স্থাপন করেন। তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ ও প্রজাহিতৈষী শাসকের আদর্শ স্থাপন করেন, যার প্রভাব আজও বর্তমান। অশোকের প্রচেষ্টার ফলে বৌদ্ধ ধর্ম ভারতের সীমানা পেরিয়ে একটি বিশ্ব ধর্মে পরিণত হয়। ফলে ভারতীয় সংস্কৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ব্যপক মাত্রায় ছড়িয়ে পরে। কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও মালয় অঞ্চলে ভারতীয় সংস্কৃতির একটা স্থায়ী ছাপ রয়ে যায়। এই প্রভাব এতটাই তীব্র যে- বর্তমান সময়ে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় প্রতীক হচ্ছে গরুরা (Garuda)। উত্তর ভারতীয়রা গরুরা উচ্চারন করলেও বাংলাতে হিন্দুদের এই দেবতা গরুড় পাখি হিসেবেই পরিচিত। গরুড় ছিলেন হিন্দুদের দেবতা বিষ্ণুর বাহন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী তিনি এক পাখি মানব। এই পাখি মানব ইন্দোনেশিয়ার মত একটি দেশের জাতীয় প্রতীক হওয়াটাতেই বোঝা যায় যে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব ওই সময় কতটা জোরালো ছিল। ইন্দোনেশিয়াতে এখনও রামায়ণ মঞ্চ নাটক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এই প্রভাবের জন্যই কম্বোডিয়া, জাভা, ফিলিপিনো, থাই, লাও, বার্মিজ ও মালয় ভাষাতে রামায়নের একটা করে ভার্সন রয়েছে, যেগুলি হবহু ভারতীয় সংস্কৃত রামায়নের মত নয়। সেগুলোতে ছিল মূলত বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রভাব। বৌদ্ধ ধর্ম নিজেদের সাথে করে ভারতীয় সংস্কৃতি ও মিথ পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াসহ চীন জাপান পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়।
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে স্থানীয় গুপ্ত রাজবংশ ক্ষমতায় আসে এবং মৌর্যদের হারানো সাম্রাজ্যের প্রায় পুরোটাই পুনরুদ্ধার করে। গুপ্তরা ৩য় শতক থেকে ৫ম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত উত্তর ভারত শাসন করে। এই যুগটি ছিল হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের কাল। গুপ্তদের পর হর্ষবর্ধন সামান্য সময়ের জন্য উত্তর ভারত শাসন করেন (৬ষ্ট শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত)। এরপর আবার গোটা ভারত বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যের এক জটিল সহাবস্থানমূলক ব্যবস্থায় ফেরত যায়। তখন বাংলায় প্রথম একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন রাজা শশাঙ্ক । তাকেই আখ্যা দেওয়া হয় বাংলা অঞ্চলের প্রথম স্বাধীন নরপতি হিসেবে। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগে শশাঙ্ক রাজ্য শাসন করেছিলেন প্রায় সতেরো বছর। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী নৃপতি। কিন্তু তার মৃত্যুর যোগ্য উত্তরসুরীর অভাবসহ নানা কারণে বাংলার আকাশে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। শুরু হয় এক অভাবনীয় বিশৃঙ্খলার যুগ ‘মাৎস্যন্যায়’। সম্পূর্ণ অরাজক এক অবস্থা | যে যেমন পারে লুঠতরাজ করছে , কেউ কাউকে মানছে না , সবল দুর্বলের ওপর অত্যাচার করছে | সময়টি ছিল ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যকার প্রায় একশো বছর।পাল রাজারা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, বিক্রমশীলা মহাবিহার ইত্যাদি পৃষ্ঠপোষকতা করেন । এরপর বৌদ্ধ পাল বংশ শাসন করে প্রায় ৭৫০ থেকে ১১৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এরপর সেন বংশের শাসকরা দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক অঞ্চল থেকে বাংলায় আসে। বখতিয়ার খলজির নদীয়া দখলের পর সেন বংশের পতন ঘটে।