যেখানে সবাই চুরির ভাগ পায়, তাই কেউ আইনের আওতায় আসে না।
ক্লেপটোপিয়া (তস্করতন্ত্র)
‘কাজির গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের উপদেষ্টা চাণক্য ( ৩৭৫ খ্রিষ্টপূর্বাদ্বে) তাঁর অর্থশাস্ত্রে লিখেছিলেন, ‘মাছ কতটুকু পানি খায় নদীতে, সেটা যেমন বলা দুষ্কর, তেমনি বলা দুষ্কর, একজন সরকারি কর্মকর্তা কতখানি চুরি করে। কয়েক যুগ আগে পর্যন্ত এই চোররা ধরা পড়লে তাদের দণ্ড হতো। আজ তা হয় না, তাই সরকারি চাকরিতে চৌর্যবৃত্তিও বন্ধ হয় না। মাননীয়া প্রধান মন্ত্রী তার বাসার পিয়নের ৪০০কোটি টাকা লোপাটের কথা জানাতে পারে কিন্তু দৃশ্যমান শাস্তি দিতে পারেন না। কারণ শক্তিশালী ক্লেপটোপিয়া। কি এই ক্লেপটোপিয়া চলুন দেখে নিই।
ক্লেপটোপিয়ার আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা হলো চোরদের একটি জায়গা বা আস্তানা, যেখানে দুর্বৃত্ত ও ডাকাতেরা অবৈধ আয়ের ব্যবস্থা করে। এটি ক্লেপটোক্রেসি সেখানে পরিচালিত হয়, যেখানে আইনের শাসন থাকে না। ক্লেপটোপিয়ায় বড় বড় চোরেরা একত্রিত হয়, তবে তারা নিজেরা সরকার চালায় না, তারা ক্ষমতার ছায়ায় বাস করে এবং বাণিজ্য, শিল্প, এমনকি রাজনৈতিক হেভিওয়েটদের যোগসাজশে কাজ করে। এটি উভয় গ্রুপের জন্য একটি সুবিধা। কারণ, নেতারা সর্বদা ছায়ায় থেকে দুষ্কৃতকারীদের নিন্দা করতে পারেন আর আসল চোর-ডাকাতেরা, সহজেই আইনকে ফাঁকি দিতে পারে। তারা জানে, নেতারা কখনোই তাদের ওপর আইন প্রয়োগ করবে না।
ক্লেপটোপিয়ায় অপারেটিং নীতি হলো ক্লেপটোক্রেসি। সবাই চুরির ভাগ পায়, তাই কেউ আইনের আওতায় আসে না। কারণ, এ সিস্টেমে যারা কাজ করে, তাদের জন্য আইন লোক দেখানো পাতানো খেলা চলে। এই খেলায় চোর, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেইট, সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক মাফীয়া এক সঙ্গে কাজ করেন। এ প্রক্রিয়ায় প্রচুর অর্থ ভাগ ভাটোরোয়া করে নিরাপদ গন্তব্যে পাচার করতেপারে। এর কারণ, তারা নিজেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অঙ্গ অথবা সংস্থার নিকট সহযোগী। তারা হঠাৎ ধরা পড়লে বা তাদের অপারেশনগুলো প্রকাশ্য হয়ে গেলে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলেও কিন্তু কদিন পর যে লাউ ওই কদু। কিন্তু ততক্ষণে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যায়। তাদের এই অপরাধের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি আবহাওয়া-মোরগের মতো হয়ে যায়, তারা রাজনৈতিক বাতাস দ্বারা চালিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি ক্লেপটোক্রেসিতে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদেরা গোপনে নিজেদের পকেট ভারি করে, ঘুষ, লবিস্ট ও করপোরেশনগুলোর কাছ থেকে বিশেষ প্রাপ্তীর মাধ্যমে। তারা তাদের সহযোগী দুর্নীতিবাজ আমলাদের সঙ্গে মিলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করে। এ ছাড়া, ক্লেপটোক্র্যাটরা প্রায়ই অর্থ হারানোর ভয়ে তাদের জমানো বেশির ভাগ টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। ক্লেপটোক্রেসির প্রতিষেধক হলো এই ষাঁড়ের বিরুদ্ধে অদম্য প্রতিরোধ।’ ক্লেপটোক্র্যাটদের খপ্পর থেকে দেশকে মুক্ত করতে একটি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হতে পারে, তবে আমাদের এখনই শুরু করতে হবে।
উচ্চমাত্রার দুর্নীতি কমাতে সরকারি চাকরিজীবীদের কাছ থেকে প্রতিবছর সম্পদের হিসাব নেওয়া এবং তা নিয়মিত হালনাগাদ করতে সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যে পরামর্শ দিয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করতে হবে।
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার বিষয়টি তো ১৯৭৯ সালে প্রণীত সরকারি কর্মচারী আইনেই আছে। আইনের বিধি ১২ ও ১৩ অনুসারে সরকারি কর্মচারীর স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রি ও সম্পদ বিবরণী জমার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি এতে জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটসহ যেকোনো সম্পদ কিনতে বা বিক্রি করতেও সরকারের অনুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে তাঁদের টাকার উৎস এবং সম্পদ বিক্রির ক্ষেত্রে দাম জানানোর কথা।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সম্পদের হিসাব দেওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি করায় অনেকেই হিসাব দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার একটানা সাড়ে ক্ষমতায় থাকলেও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নেয়নি। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশেরও প্রয়োজন তারা বোধ করেনি। এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধান যুক্ত করায় সরকারি কর্মকর্তারা আরও আশকারা পেয়েছেন। এ কারণেই আমরা বেসিক ব্যাংক-কাণ্ড, হল-মার্ক কাণ্ড, বালিশ ও পর্দা-কাণ্ডের পর জনপ্রশাসনে বেনজীর, মতিউরদের আবির্ভাব ঘটতে দেখি। বড় কোনো অঘটন ঘটলে দুদককে কিছুটা নড়েচড়ে বসতে দেখি। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আবার সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে।দেশে ন্যূনতম আইনের শাসন থাকলে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এভাবে দুর্নীতি প্রসারিত হতে পারত না।প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা সর্বত্রই যেন দুর্নীতি। দুর্নীতির টাকা উৎপাদন খাতে যোগ না হবার ফলে দিন দিন বেড়েই চলেছে বেকারত্বের হার। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্য মরে, বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। মা–বাবা ছেলে বা মেয়েটির পথ চেয়ে বসে থাকে, কখন তারা পড়াশোনা শেষ করে পরিবারে সচ্ছলতা আনবে, তাঁদের মুখে হাসি ফোটাবে। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত হয়েও তাঁদের সন্তানেরা পাচ্ছেন না কোনো কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করে বসে বসে চিন্তা করতে হয়, এখন কী হবে! কোথাও তাঁদের নেই কোনো কাজের সুযোগ। , তখন তাঁর মধ্যে বিষণ্নতা বহু গুণ বেড়ে যায়।
কাজের সুযোগ না পেয়ে অনেকেই মাদকসহ নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। হতাশায় জীবন কাটাচ্ছেন। অনেকেই বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ।
বড় সেতু, উড়ালসড়ক, শুধু রাজধানীতে ওভারহেড মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দূর থেকে দেখা যায়; ‘দেখানো’ও যায় বেশ গর্বের, দর্পের, এমনকি দম্ভের সঙ্গে। দেখিয়ে বহু মানুষের মনও জয় করা যেতে পারে; কিন্তু গণমানুষের ভেতর থেকে উন্নয়ন না ঘটলে, মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে না পারলে ইট-পাথর-লোহায় গড়া বাহ্যিক উন্নয়ন সবই যে বৃথা হয়ে যাবে!
০০০০০০০০০০০০০০০০০
দুঃখের বিষয় হল, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এত ত্যাগ-তিতিক্ষা, দুঃখ-বঞ্চনা, হয়রানি-ভোগান্তি, জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে যখন পরিবর্তন আনা হয়, তখন দেখা যায়—যারা অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে ক্ষমতায় আসেন, তারা সেই পূর্বের মতোই চুরি আর ভোগ-বিলাসিতায় মেতে উঠেন। এটা দেখে জনগণের হূদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে। ফলে কিছু দিনের মধ্যে হতাশায় মন ভেঙ্গে যায়।
অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যা সাড়ে ৯ শতাংশের আশপাশে রয়েছে। ফলে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ জর্জরিত, এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং ক্ষেত্র বিশেষে মধ্যবিত্তদের পারিবারিক অর্থনীতিতে অসহ চাপ পড়েছে।
ইসলাম ধর্ম এসেছে আরব থেকে এসেছে,কিন্তু আরবের কোথাও ওয়াজ মাহফিল নাই, তাবলীগ নাই, ইজতেমা নাই, মাজার, পীর নাই,এগুলা কোত্থেকে আসলো?
নবাব সিরাজউদ্দৌলা
প্রথম শতকের গ্রিক ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক প্লুতার্ক বিশ্বাস করতেন, বয়সের মধ্য দিয়ে বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানসিক দৃঢ়তা শুধুমাত্র প্রবীণ ব্যক্তিরাই অর্জন করতে পারেন। এই বৃদ্ধরা দুর্বল হতে পারে, কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার কারণে রাস্ট্র সঠিকভাবে পরিচালিত হবে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, যে রাষ্ট্র নবীণ রাজনীতিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়, সেখানকার রাষ্ট্র-সমাজ অনিবার্যভাবে ঝুকিতে পড়ে যায়। একজন যথার্থ রাষ্ট্রনায়কের যে প্রজ্ঞা ও ধীশক্তি থাকা দরকার, তরুণ নেতাদের মধ্যে তা থাকে না। ফলে রাস্ট্রের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমনটি হয়েছে নবাব সিরাজোদ্দোলাহ বেলায়। ২৫ বছরের এই তরুণ রাস্ট্র নায়ক হওয়ায় বাংলার সিংহাসন চিরদিনের জন্য হাতচাড়া হয়ে যায়। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে সম্রাট আকবর তো মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন এবং প্রায় ৫০ বছর শাসন করেন, ভারতবর্ষের শ্রেষ্ট শাসক হিসেবে তাকে বলা হয় আকবর দ্যা গ্রেট। এর কারণ হচ্ছে অভিজ্ঞ উজির বৈয়ম খা। মুলত একটা বড় সময় পর্যন্ত আকবরের হয়ে তিনিই রাস্ট্র পরিচালনা করতেন।
ছোটবেলায় আমরা সবাই পড়েছি, খোকা ঘুমাল, পাড়া জুড়াল, বর্গী এলো দেশে…। এ বর্গী আর কেউ নয়, সেই মারাঠাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে মীরজাফর খ্যাতি লাভ করে। বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ তাঁর বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানম সাহিবাকে মীরজাফরের সাথে বিবাহ দেন। সে ঘরে মীরন এবং ফাতিমা নামে দুই সন্তানের জন্ম হয়। আলীবর্দী খানের কোন ছেলে ছিল না। আলীবর্দী খাঁ তার তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই হাজী আহমেদের তিন ছেলের সাথে। তিনি ছোট মেয়ে আমিনার বড় ছেলে সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু তার বড় মেয়ে নিঃসন্তান ঘসেটি বেগম চেয়েছিলেন মেজবোনের ছেলে শওকত জংকে সিংহাসনে বসাতে।
১৭৫৬সালের ৯ই এপ্রিল নবাব আলিবর্দি খাঁ মারা গেলে সিরাজদৌলা বাংলার নবাব হন। জানা যায় ২৫ বছরের যুবক সিরাজের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহারের জন্য তাঁর বেশিরভাগ অধীনস্থ কর্মচারিরা তাঁর বিরুদ্ধে রাগ পোষণ করতেন। সিরাজউদ্দৌলা নবাব হিসেবে সাহসী হলেও ভালো শাসক বা বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ দুটোর কোনটাই ছিলেন না। ফলে ইংরেজ ও ফরাসি দুই দলের সঙ্গেই তার সংঘাত শুরু হয়। বর্গি আক্রমণকে কেন্দ্র করে চন্দননগরে ফরাসিরা এবং ইংরেজরা কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ মজবুত করে গড়ে তুলেছিল। সিরাজ এতে অখুশি হয়ে দুই পক্ষকেই চিঠি লিখে নতুন নির্মাণ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ফরাসিরা সে কথা মেনে নিলেও ইংরেজরা নবাবের নির্দেশ মানল না। সেসব কারণে সিরাজ রেগে কলকাতা দখল করে নাম রাখলেন আলিনগর। কিন্তু রবার্ট ক্লাইভ মাদ্রাস থেকে এসে কলকাতা আবার দখল করলেন এবং একই সঙ্গে বাংলার মসনদে নতুন শাসক বসানোর কথা ভাবলে্ন। এভাবেই নাম উঠে এসেছিল মিরজাফরের। মিরজাফর প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি নবাব হলে ইংরেজদের বিপুল ঐশ্বর্য উপহার দেবেন।
রবার্ট ক্লাইভ গোপনে সৈন্য ও অস্ত্র ফোর্ট উইলিয়ামে মজুত করতে থাকেন। অন্যদিকে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে একাধিক ইংরেজ কর্মচারীদের মুর্শিদাবাদের প্রেরণ করেছিলেন। যাদের মূলত কাজ ছিল সিরাজের সেনা ও অস্ত্র ভান্ডারের ব্যাপারে খবরাখবর নিয়ে আসা এবং, মুর্শিদাবাদে থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। কোম্পানির তরফে ওয়াটস, মহিলাদেরই যাতায়াত করা পালকির মধ্যে লুকিয়ে মিরজাফরের বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন। নিজ বাড়িতেই মিরজাফর একহাতে কোরান আর অন্যহাতে ছেলে মিরানের মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করে চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। তার সঙ্গে যোগ দেয় নবারের খালা ঘসেটি বেগম, ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ ও উমিচাঁদ। সবারই ছিল অভিন্ন উদ্দেশ্য, নবাবকে উৎখাত করা।
১৭৫৭ সাল ভারতের মুর্শিদাবাদ শহর থেকে ৫০ মাইল দূরে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হলেন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। হত্যা করা হলো সিরাজকে। এরপর “মীরন আলিবর্দি খানের পরিবারের প্রায় সত্তুরজন নিরাপরাধ সদস্যকে একটি নৌকায় চাপিয়ে মাঝ-গঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয়,আর সেখানেই নৌকাটি ডুবিয়ে দেয়া হয়। সবাইকে একসঙ্গে নদীর ধারে খুশবাগ নামের একটি বাগানে দাফন করা হয়। পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের কারন ছিল,,,, সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতা এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার অযোগ্যতা। নবাব সিরাজউদ্দৌলা মাত্র পনেরো মাস মসনদে ছিলেন।
পলাশীর যুদ্ধ শেষ হলে বাংলার ধনসম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল লুটেরারা। এদের মধ্যে অন্যতম কলকাতার নবকৃষ্ণ দেব। বাংলার তোষাখানা লুট করতে ব্রিটিশদের সাহায্য করে এই ন নবকৃষ্ণ। এই জন্য নবকৃষ্ণ পেলেন ‘রাজা বাহাদুর’ খেতাব এবং বিপুল অর্থ। গোটা সুতানুটি অঞ্চলের জমিদার হয়ে গেলেন তিনি। সামান্য মুনশী থেকে বিশাল জমিদার। নবকৃষ্ণ তখন বাংলার বাসন্তীপূজোকে এগিয়ে এনে শুরু করে দিলেন "দুর্গাপূজা"। ইংরেজ সাহেব মেমরা ত বটেই, ওয়ারেন হেস্টিংস পর্যন্ত হাতীতে চড়ে এলেন সেই পূজায়। ক্লাইভ দক্ষিণা দিলেন ১০১ টাকা। সাহেবরা মৌজ করে দেখলেন বাঈজী নাচ আর নানা আয়োজনে। এরপর থেকে ধুমধাম করে চালু হল দুর্গাপূজা।
বাংলার নবাব হয়ে পঁয়ষট্রি বছরের বৃদ্ধ মীর জাফর পর পর দুইজন সুন্দরী নর্তকীকে বিয়ে করে। মীরজাফরের মৃত্যুর পর থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই দুই নটীর গর্ভজাত সন্তান এবং তাদের উত্তরাধিকাররা বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব ছিল।
মুতাজিলা
খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে মুতাজিলা এই মতবাদ জন্মলাভ করে। এতকাল মুসলমানদের জ্ঞানচর্চার পরিধি কুরান এবং হাদিসের ভেতরই সীমাবদ্ধ ছিলো। মুতাজিলারাই প্রথম কুরান ও হাদিসের জ্ঞানের বাইরে যুক্তিতর্ককেও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। যেমন- সূরা লাহাবে আল্লাহ তায়ালা আবু লাহাবকে অভিশাপ দিয়েছেন। মুতাজিলাদের মতে, আবু লাহাব যেহেতু তখনো জীবিত ছিলো তাই আল্লাহ তায়ালা জীবিত আবু লাহাবকে নয় বরং অভিশাপ দিয়েছে আবু লাহাব চরিত্রের মানুষদেরকে।
মুতাজিলাদের মতে, মানুষের সব কাজ যদি আল্লাহ আগে থেকেই নির্ধারণ করে থাকেন তাহলে সেই কাজের জন্য আল্লাহ মানুষকে পুরস্কার বা শাস্তি দিতে পারেন না, অর্থাৎ মানুষ তার কর্মের ফল ভোগ করবে কেন? এই মতবাদ খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক থেকে পরবর্তী ৩০০ বছর মুসলমানদেরকে এমনভাবে প্রভাবিত করে রাখে যে, এই সময়কালকে ইসলামের স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই সময়্র জ্ঞানবিজ্ঞান দর্শন চর্চায় মুসলমানরা খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান নেয়। যে সমস্ত মুসলিম স্কলারদের নিয়ে আমরা এখনও গৌরব ও অহংকার করে থাকি, তাদের প্রায় সবাই মুতাজিলা মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।।
জ্ঞানচর্চা
জ্ঞানচর্চায় ধারাবাহিকতা থাকতে হয়। অন্যথায় অজ্ঞতা দ্রতই দখল করে জ্ঞানের স্থান। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। মুসলিমরা যখন সমরখন্দ জয় করে (৭১২ সাল), তখন চাইনিজদের কাছ থেকে তারা কাগজ বানানোর কৌশল শিখেছিলো। এ কৌশল ব্যবহার করে বাগদাদে স্থাপন করা হয়েছিলো কাগজ কারখানা (৭৯৪ সাল)। কে করেছিলো? খলিফা হারুনের উজিরের ছেলে আল-ফজল । এই কাগজ বানানোর কৌশল মুসলিমরা ধীরে ধীরে স্পেন, সিসিলি, ইতালি, ও ফ্রান্সে ছড়ায়। তার আগে ইউরোপে কাগজ ছিলো না। বই বলতে এখন আমরা যা বুঝি, তা মুসলিমরা যাওয়ার আগে ইউরোপে ছিলোই না। অর্থাৎ কাগজ প্রচলন চীনে শুরু হয়েছিলো ১০৫ সালে, মক্কায় ৭০৭ সালে, মিশরে ৮০০ সালে, স্পেনে ৯৫০ সালে, সিসিলিতে ১১০২ সালে, ইতালিতে ১১৫৪ সালে, জার্মানিতে ১২২৮ সালে, এবং ইংল্যান্ডে মাত্র ১৩০৯ সালে।
৮৯০-৮৯৫ সালের দিকে, বাগদাদে একশোর বেশি বইয়ের দোকান ছিলো। তখন হাতে লিখে বই কপি করা হতো, এটা ছিলো খুব জনপ্রিয় পেশা। অধিকাংশ ছাত্ররা এ কাজ করতো। এতে হতো কী, বই কপি করার সময় বইটাও পড়া হয়ে যেতো। ধনী মুসলিমদের প্রধান শখই ছিলো বই সংগ্রহ করা। মোঙ্গলরা যখন বাগদাদ আক্রমণ করে, তখন সেখানে ৩৬টির মতো গণগ্রন্থাগার ছিলো। ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিলো অসংখ্য। এক ধনী আরেক ধনীর সাথে বই সংগ্রহের প্রতিযোগিতা করতো। মসজিদগুলো যতোটা না নামাজের স্থান ছিলো, তার চেয়ে বেশি ছিলো বিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। মসজিদে ঢুকলেই কোনো না কোনো এলাকার ভূগোলবিদ, চিকিৎসক, কবি, ইতিহাসবিদ -এর দেখা মিলতো। দার্শনিক বিতর্ক ছিলো খুবই জনপ্রিয়। কেউ ধনী, কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেনি, এমনটি মুসলিম সমাজে দেখা যেতো না।
=
সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব ও নিকোলাস কোপারনিকাস
সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের মডেলের কথা শুনলেই আমাদের প্রথমেই মনে আসে নিকোলাস কোপার্নিকাসের নাম । কিন্তু কোপার্নিকাসের অনেক আগেই গ্রিক দার্শনিক সামোসের অ্যারিস্টার্কাস সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের প্রস্তাব করেছিলেন ।খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২৭০ সালের দিকে তিনি প্রথমবার সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন। তার মতে পৃথিবী আর অন্যান্য গ্রহরা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। কিন্তু সেই সময় গ্রিসে অ্যারিস্টটল ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী এক দার্শনিক।তিনি এই তত্ত্ব নাকচ করেন বলে গ্রিসে তার তত্ত্বটি তেমন কারো সমর্থন পায়নি।এরপর প্রায় অনেক বছর সেই তত্ত্ব কেউ গ্রহণ করেননি।
এদিকে আবার কোপার্নিকাসের প্রায় এক হাজার বছর আগে ভারতীয় দার্শনিক আর্যভট্ট সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের একটি গাণিতিক মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন। তার মডেল অনুযায়ী, পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর ঘূর্ণনরত এবং গ্রহগুলো নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরছে।
এদিকে মধ্যযুগে টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের তত্ত্বের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা লিখেছিলেন আরবের বিজ্ঞানী আল হাজেন (আল হাইসাম)।প্রায় ১০০০ সালের দিকে আবু রায়হান বিরুনি (আল বিরুনি) সৌরকেন্দ্রিক সৌরজগতের কথা বেশ জোড়ালোভাবেই প্রচার করেছিলেন।তার প্রস্তাবনায় পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর ঘূর্ণনরত ।সে সময় অন্যদের চরম বিরোধিতায় তিনি আক্রান্ত হবার ভয়ে হঠাৎ করেই স্থির পৃথিবীর তত্ত্বে ফিরে আসেন। ১৩০০ সালের দিকে নাজিদ আল দিন আল খাজইনি আল কাতিবিও সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন। তবে তিনিও শিগগিরিই তার মত পরিবর্তন করেন।
তবে এ বিষয়ে অনেক দূর এগিয়ে ছিলেন নিকোলাস কোপার্নিকাস ।১৫৪৩ সালে তিনি On the Revolutions of the Celestial Spheres নামের একটি বই প্রকাশ করেছিলেন।প্রমাণ আছে যে কোপার্নিকাস আরবের বিজ্ঞানী আল কাতিবির কাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কারণ আল কাতিবির অনেক রেখাচিত্রের সাথে কোপার্নিকাসের রেখাচিত্রের মিল পাওয়া গেছে।এমনকি এসব রেখাচিত্র একই বর্ণ দিয়ে চিহ্নিত করেছিলেন কোপার্নিকাস। তবে অনেকেই মনে করেন কোপার্নিকাস আল কাতিবির চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন । তিনি সুস্পষ্টভাবে সৌরকেন্দ্রিক ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছিলেন। তার যুক্তি ছিল, টলেমির ভূকেন্দ্রিক ব্যবস্থার চেয়ে সৌরকেন্দ্রিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ আর যুক্তির সাথে একদম খাপ খায়। আবার এর পাশাপাশি তিনি দার্শনিকগত কিছু ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল,পৃথিবী বা মানবজাতিই যে সবকিছুর কেন্দ্রে নয়, এ অভিনব ভাবনার প্রকাশ। অবশ্য এই অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করার জন্য তাকে ভুগতে হয়েছিল।খ্রিষ্টীয় গির্জা এই ধারণাকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত হিসেবে দেখেছিল।সে কারণে এ ধারণাকে যতটা সম্ভব নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল তারা।কারণ তাদের দৃষ্টিতে সৌরকেন্দ্রিক ধারণা ছিল বিপথগামিতার নামান্তর।
কোপার্নিকাসের এই বইটি ১৫৪৩ সালে যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখন তিনি মৃত্যুশয্যায়।শোনা যায় যখন এই বইটি ছাপা অবস্থায় তার কাছে এসে পৌছালো তখন তিনি শুধুমাত্র বইটি দুইহাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলেন, তার কয়েক ঘণ্টা পরেই তার মৃত্যু হলো।
কোপার্নিকাস এই বইয়ের মাধ্যমে যে সত্যের প্রতিষ্ঠা করলেন তার উপর ভিত্তি করে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন, আইনস্টাইন জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।
কোপার্নিকাস যে শুধু একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছিলেন তাই নয়, তিনি ইউরোপের প্রথম বিজ্ঞানী যিনি মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের মূলে তীব্র আঘাত হেনেছিলেন। তাই বিংশ শতাব্দীতে আইন্সটাইন বলেছিলেন, "বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসই হচ্ছেন আধুনিক যুগের পথিকৃৎ"।
জিওর্দানো ব্রুনো
ব্রুনোর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি বলেছেন- "এই মহাবিশ্বের মতো আরো মহাবিশ্ব আছে, পৃথিবী গোল, সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় এবং এটি একটি নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নয়"
কিন্তু বাইবেল বলেছে : ‘সূর্য পৃথিবীর চার পাশে ঘোরে’-
অতঃপর শাস্তি : বিনা রক্তপাতে মৃত্যু। অর্থাৎ পুড়িয়ে মারা হল ব্রুনোকে।
১৭ ফেব্রুয়ারী তারিখে আজ থেকে প্রায় ৪০০বছর আগে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে রোমে জীবন্ত জ্বালিয়ে জিওর্দানো ব্রুনোকে হত্যা করা হয়েছিলো– সামনে উপস্থিত মানুষ সেই দৃশ্ব্য দেখেছিলো নীরবে।
জিওর্দানো ব্রুনো এক বেপরোয়া মানুষ ছিলেন, তিনি জ্যোতিবিজ্ঞানী কোপারনিকাসের সেই সময়ের নিষিদ্ধ বইগুলো পড়তেন। বিপদকে অগ্রাহ্য করে সাধারন মানুষের অন্ধবিশ্বাস ভাঙ্গতে শুরু করে তিনি প্রচার করতে থাকেন– নিকোলাস কোপারনিকাস ভ্রান্ত নন। পৃথিবী সূর্যকেই প্রদক্ষিণ করে ঘুরছে।
ব্রুনো গির্জার কুনজরে পরলেন, বাধ্য হলেন দেশান্তরী হতে। যাজকের ছদ্মবেশ নিয়ে তিনি চললেন সুইজারল্যাণ্ড, হাতে কোপারনিকাসের বই– ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, জার্মান গিয়ে তিনি মানুষকে সত্যের ধারনা দিতে থাকেন। রোমের যাজকরা চর পাঠিয়ে কৌশলে তাঁকে ধরে আনে। বিচারে তাঁকে বিনা রক্তপাতে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়, যার মানে জীবন্ত পুড়িয়ে খুন করার নির্দেশ। তখন ৫২বছর বয়স জিওর্দানো ব্রুনোর।
তাঁকে হাত-পা শিকলে বেঁধে নিয়ে এসে, ধর্মের বিপক্ষে যাতে আর কিছু বলতে না পারেন তাই পেরেক ফুটিয়ে তাঁর জিভ ঠোঁটে আটকানো হয়। সেই অবস্থায় যাজকরা তাঁকে আবারো তাকে বিজ্ঞানের বিপক্ষে যেতে বলে, রক্তাক্ত ব্রুনো আপোষ করে বেঁচে থাকতে চাননি। আগুন দেয়া হয় লোহার পিলারে বাঁধা ব্রুনোর শরীরে।
ব্রুনোকে খুন করার ৪০০ বছর পরে সেই গির্জাকেই ভুল স্বীকার করতে হয়। ইতিহাসের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সত্য হার মানেনা। অন্ধকার কখনোই শেষ কথা না। খুন হওয়ার দিনে শ্রদ্ধা জানাই জিওর্দানো ব্রুনো।
সিন্ডিকেট
ভুয়া কাগজপত্র দাখিল, লোক নিয়োগে অনিয়মসহ অন্যান্য কারণে মালদ্বীপের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ স্থগিত করেছে। মালয়েশিয়াও বাংলাদেশ থেকে আর নতুন কোনো শ্রমিক নিচ্ছে না এবং অনুমোদন পাওয়া ৮হাজার শ্রমিকেরাও মালয়েশিয়ায় ঢুকতে পারেননি। এ ছাড়া প্রায়ই মালয়েশিয়ার কিছু পাম তেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগে বিরত থাকছে।
আমাদের আইনপ্রণেতারা যেখানে প্রতিনিয়ত দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আলোচনা করছেন, সেখানে আমরা সত্যিই কি উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী তৈরিতে কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে পেরেছি? বিশ্বব্যাপী দক্ষ শ্রমিকদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছি। এই দেশগুলো বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর কারিগর হিসেবে খ্যাত।
এতে বিদেশি নিয়োগকর্তা বা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দক্ষতা নিয়ে ভুল ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংস্থার করা বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণাসূচকে ফিনল্যান্ড কিংবা নরওয়ে যেখানে দুর্নীতি প্রতিরোধের দিক থেকে প্রথম কাতারে, সেখানে বাংলাদেশ কিংবা প্রতিবেশী মিয়ানমারের অবস্থান পেছনের দিক থেকে শীর্ষ দশে।
মালয়েশিয়া যেতে যেখানে সরকারের নির্ধারিত ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা, সেখানে সংসদের ৪জন সদ্যের একটি চক্রের কারণে সে ব্যয় বেড়ে হয়েছিল ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
এই সিন্ডিকেট দেড় বছরে সাড়ে চার লাখ তরুণের কাছ থেকে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা এবং তাদের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্য অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। ১৭ হাজার বাংলাদেশি তরুণ ভিটেমাটি, সোনাদানা, জমিজিরাত বিক্রি করে, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সাড়ে ৫ লাখ টাকা করে দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য । কিন্তু তাঁরা শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। মালয়েশিয়া ১৫টি দেশ থেকে শ্রমশক্তি নেয়। এর মধ্যে ১৪টি দেশ সব এজেন্সি কর্মী পাঠাতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশ পারে না।
অব্যাহত মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক রিজার্ভের পতন, রাজস্ব সংগ্রহের স্বল্পতা, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের স্থবিরতা, পুঁজি পাচার, ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা, সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও সরকারি ব্যয়ের অনিয়ম-অপচয়, জবাবদিহিহীনতার সংস্কৃতি এবং বৈদেশিক অভ্যন্তরীণ খাতের ঋণের সুদ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান দায় পরিশোধ করতে যেখানে রাষ্ট্র হিমসিম খাচ্ছেম সেখানে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি ও ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার করে নতুন জমিদারি শ্রেণী গড়ে উঠেছে, সেখানে কোনোরকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষরা তাদের শেষ সম্বলটুকু নতুন জমিদারদের ব্লাক হোলে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এই অসংখ্য-অগুনতি নতুন জমিদারের সম্পদের অনন্ত ক্ষুধা মেটানোর মতো সম্পদ কি দেশে আছে?
মানুষের ৬টি প্রজাতি
একসময় মানুষের ৬টি প্রজাতি ছিল, যার পাঁচটি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। থেকে গেছে মাত্র একটি প্রজাতি - *হোমো স্যাপিয়ান্স*। কেন হোমো স্যাপিয়ান্স প্রজাতিটি টিকে গেলো আর অনেক বড়ো আকৃতির এবং অনেক বেশি শক্তিশালী *"নিয়ান্ডারথাল"* নামক মানুষের প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গেলো তার কারণ খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন - তার প্রধান একটি কারণ হচ্ছে নিয়ান্ডারথাল মানুষ ছিল মূলত *"সলিটারি"* - মানে তারা একা একা বাঁচতে পছন্দ করতো। অন্যদিকে হোমো স্যাপিয়ান্স প্রজাতিটি সব সময় দল বেঁধে থাকতো। কিন্তু ঘোর নগরকেন্দ্রিক জীবনে এসে আমরা *ক্রমশ ভুলে যাচ্ছি* যে হোমো স্যাপিয়ান্স প্রজাতিটি সংঘবন্ধ জীব। নেচারে আমরা যে এখনো বিলুপ্ত হইনি তার কারণ আমরা দল বেঁধে ছিলাম। *একা বাঁচার জন্য আমাদের তৈরী করা হয়নি*।
একাকিত্ব মানে কিন্তু একা থাকা নয়। *একাকিত্ব একটি "স্টেট অফ মাইন্ড" যেখানে মানুষটির মনে হচ্ছে সে একা, নির্বান্ধব*, মন খুলে দুটি কথা বলার যার কেউ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
বিশিষ্ট গবেষক ও দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম একবার প্রশ্ন করেছিলেন জ্ঞানতাপস প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে, স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নাকি নবাব সলিমুল্লাহ অর্থ ও জমিদান করেছিলেন। সে কারণেই তার নামে একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ নাকি করা হয়েছিলো। প্রফেসর রাজ্জাক এই দাবী পুরোটাই নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন আপনারা ঢাকা কালেক্টরেটে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেন জমি দান করার মত জমি আহসান মঞ্জিলের ছিল না। প্রফেসর রাজ্জাক স্যার বলেছেন, আহসান মঞ্জিলের বৃত্তিতে কিছু মুসলমান ছেলে লেখাপড়া করত। তাদের একজন আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী। কৃতজ্ঞ আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী সাহেব সলিমুল্লার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করত। সলিমুল্লাহর মৃত্যুর দশ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের জন্য একটি ছাত্রাবাস তৈরি করা হলে তার নামকরণ সলিমুল্লাহ মুসলিম হল প্রস্তাব করেন আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী। (সূত্র: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ: সরদার ফজলুল করিম, পৃষ্ঠা ২০-২১)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে সরকারের খাস জমিতে ও কিছু হিন্দু জমিদারের দান করা জমিতে। ঢাকায় শিক্ষা বিস্তারে ঢাকার হিন্দু জমিদারদের ভূমিকা আমাদের ইতিহাস হাইড করে ফেলে । তখনকার সময়ে সারা দেশের সমস্ত স্কুল-কলেজগুলোর প্রতিষ্ঠাতা হিন্দু জমিদার, উকিল, সরকারী চাকুরে ব্যক্তিবর্গ। বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর দানে তার পিতার নামে ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জগন্নাথ কলেজ’ যা বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের নিয়ে। এর স্বীকৃতি স্বরূপ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশে কলেজ দুটির নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ছাত্রাবাসের নাম করা হয়। যথাক্রমে ‘জগন্নাখ হল’ এবং ‘ঢাকা হল’।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতার কোন ইতিহাস নেই। একটি প্রমাণ, দলিলও আজ পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেনি। কোলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে যে সভা হয়েছিলো সেখানে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন না, তখন তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। তাছাড়া ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হোক এটা মুসলমান নেতারাই চাচ্ছিলেন না। কারণ এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হলে তার সুফল মুসলমানরা পাবেন না। কারণ ছাত্র তো সব হিন্দু। মুসলমানরা তখন কলেজ পর্যন্ত যেতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সরকারের শিক্ষা বাজেটের সেখানে চলে যাবে। ফলে স্কুলের ফান্ডে টান পড়বে। এমন কি আলীগড় পর্যন্ত ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হোক চায়নি। প্রফেসর রাজ্জাক সাহেব জানিয়েছেন, দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল শিক্ষকদের অভাবে। শিক্ষকদের ৯৯ জন ছিলেন হিন্দু। তারা চলে যাওয়ায় শিক্ষকের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঠেকাতে বিলেত থেকে শিক্ষক আমদানি করে আনতে হয়েছিল। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষক হওয়ার মত তেমন শিক্ষিত শ্রেণীই গড়ে উঠেনি তখন পর্যন্ত!
ঢাকার নবাব
ঢাকার নবাবরা মুর্শিদাবাদের মত নবাব ছিল না। মূলত এরা কাশ্মিরের লোক। সেখানে মামলায় পড়ে সিলেটে এসে লবনের ব্যবসা করতেন। সিলেট থেকে ঢাকায় এসে ব্যবসায় প্রচুর লাভ করেন। ভাষা ছিল উর্দু। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহে ইংরেজদের দালালী করতেন এবং ইংরেজ সরকারের বিদ্রোহীদেরকে ভিক্টোরিয়া পার্কের গাছে গাছে ফাঁসি দিতে সহায়তা করেন। পুরস্কার স্বরূপ ইংরেজরা নবাব উপাধি দেন। তারা সুন্দর বনের পার্শবর্তী জমি নামমাত্র মুল্যে কিনে বন কেটে বেশি দামে বেঁচেন। কোন কোন এলাকার জমিদারী নিলাম হলে তা কিনে লাভবান হন। পরে ঢাকা মিউনিসিপালিটির কর্মকর্তা হন। তখন ইংরেজরা মেডিকেলসহ কিছু প্রতিষ্ঠান করতে সহায়তা দেন। মেডিকেল প্রতিষ্ঠার সময় সলিমুল্লাহ দান করেছিলেন পাঁচ হাজার টাকা, রাণী দিনমণি দিয়েছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা আর মিটফোর্ট সাহেব দিয়েছিলেন তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয়, জমি সব। তবু নামকরণ হলো নবাবের নামে, আর দিনমনির নাম তো প্রায় বিলুপ্ত।
ঢাকার নবাবদের যে জমি ছিল, তা ছিল মুসলমানদের জমি, ঢাকার নবাবদের ওয়াকফ করে দিতো মুসলমানরা। এমনকি নবাব বাড়ীটাও তাদের করা না। এটি জামালপুরের এক জমিদারের করা প্রমোদ ভবন। সে জমিদারকে মোগল ফৌজদার বিষ খাইয়ে হত্যা করে, নাচনেওয়ালী এক সুন্দরীকে পাওয়ার জন্য। সে নাচনেওয়ালী আত্মহত্যা করেছিল । সে এক করুন কাহিনী। এরপর বাড়ীটা ফরাসি ও ইংরেজদের হাতে আসে। পরে নবাবরা নিলামে কিনে নেয়। এই নবাবেরাই ভারতে মুসলিম লীগ করে।
দুর্ঘটনা মৃত্যু ও ডিনামাইট
আলফ্রেড নোবেলের বাবার ছিল মানুষ মারার কারবার; যুদ্ধে অস্ত্র সাপ্লাই দিতেন। কিন্তু যুদ্ধ থেমে গেলে ব্যবসায় মন্দা আসে। অচীরেই দরিদ্র হয়ে পড়ে নোবেল পরিবার। তবে আলফ্রেড নোবেল ছিলেন নাছোড়বান্দা।
মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন পৈত্রিক ব্যবসায়। বুঝতে পারেন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন অস্ত্র যদি তৈরি না করা যায়, তাহলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তিনি তাই নতুন বিস্ফোরকের খোঁজ করেন—এমন বিস্ফোরক, যা মুহূর্তেই ধ্বংস করে দিতে পারবে বড় বড় বিল্ডিং কিংবা পাথুরে পাহাড়। তিনি জানতেন, তরল নাইট্রোগ্লিসিরিনের আছে এহেন বিস্ফোরণের ক্ষমতা।
কিন্তু সমস্যা হলো নাইটোগ্লিসিরিন স্পর্শকাতর। একটুখানি ঝাুঁকনিতেই ঘটে যেতে পারে বড়সড় দুর্ঘটনা। তাই অত্যন্ত সাবধানে কাজ করতে হয়।
আলফ্রেড সুইডেনে একটা বিস্ফোরক কারখানা গড়লেন।
সেখানেই চলছিল নাইটোগ্লিসারিনকে বশে আনার চেষ্টা। কারণ, যত শক্তিশালী বিস্ফোরকই হোক, তাকে যদি নিরাপদে বহন বা নিক্ষেপ না করা যায়, সেটা কোনো কাজেই আসবে না। নানা পরীক্ষা-নিরীেক্ষা চলছিল, এর মধ্যে একদিন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। নাইট্রোগ্লিসারিনের বিস্ফোরণে কারখানার একাংশ উড়ে যায়, নোবেল ছোট ভাই এমিল মারা যান, এমনকী আলফ্রেডও মারাত্মক আহত হন।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ফ্রান্স সরকার নোবেলের কারখানা বন্ধ করে দেয়।
ফলে নোবেল সুইডেন থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যান জার্মানিতে। সেখানে আরেকটি কারখানা খোলেন। নতুন উদ্যমে শুরু হয় নাইট্রোগ্লিসারিন গবেষণা। কিন্তু সেখানেও দুর্ঘটনা ঘটনার উপক্রম হয়েছিল। তাঁর হাত ফসকে নাইটোগ্লিসারিনের একটা বোতল পড়ে যায় মেঝেতে। নোবেল আতংকিত হয়ে উঠেছিলেন, ভেবেছিলেন এবার বিস্ফোরণে হয়তো তিনিও মারা পড়বেন। কিন্তু সেটা আর ঘটেনি।
নাইট্রোগ্লিসারিন তরল মাটিতে পড়ে দিব্যি শান্ত হয়ে ওঠে। এমনটা কেন হলো? নোবেল দেখলেন, মেঝেতে নাইট্রোগ্লিসারিণ যেখানে পড়েছে, সেখানে বিশেষ এক ধরনের বালু আছে। সেই বালু নাইট্রোগ্লিসারিনকে শুষে নিয়েছে বিস্ফোরণ ঘটার আগেই।
নোবেল বোঝার চেষ্টা করেন এই বালুর উৎস কী? খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যান উত্তর—নাইট্রোগ্লিসারিনের বাক্সেই ছিল সেই বালু। ঝাঁকুনি লেগে যাতে নাইট্রোগ্লিসারিনের বোতল পড়ে না যায়, সেজন্য বাক্সে বোতলের চারপাশে বালু ঠেসে দেওয়া ছিল। পরে তারই কিছু অংশ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল।
নোবেল বুঝে ফেলেন, এই বালুই হতে যাচ্ছে তার তুরুপের তাস। সেই বিশেষ বালু আর নাইট্রোগ্লিসারিণের পেস্ট তৈরি করে দেখলেন বিস্ফোরণ ঝাঁকুনি বা নড়াচড়ায় বিস্ফোরণ ঘটায় না। কিন্তু জোরে ছুড়ে মারলে কিংবা আগুনে পোড়ালে ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটায়। তবে স্বাভাবিক তাপ-চাপে এর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এটাই ছিল মহাবিস্ফোরক ডিনামাইট আবিষ্কারের মূলমন্ত্র। আলফ্রেড নতুন উদ্যমে কাজে লেগে যান। ১৯৬৭ সাল নাগাদ উদ্ভাবন করে ফেললেন ডিনামাইট। ইউরোপে এর পেটেন্ট রাইট নিলেন, আমেরিকাতেও নিলেন।
শুধু যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকে না ডিনামাইট ব্যবহার। মাটির নিচে খনি তৈরিতে, বড় বড় পরিত্যাক্ত দালান ভাঙতে, এমনকী প্রয়োজনে পাহাড় গুড়িয়ে দিতেও ডিনামাইট ব্যবহার করা হয়।
অন্ধকারের কালো বিড়াল, না জানলে মিস
অক্সফামের রিপোর্টে বলা হয়েছে এই পৃথিবীতে মাত্র ৮৫ জন ধনী ব্যক্তির সম্পদ, সারা পৃথিবী ৩৫০ কোটি দরিদ্র লোকের সম্পদের সমান। অক্সফামের জ্যেষ্ঠ গবেষক “জ্যাকবের মতে, বিশ্বে শত কোটি ডলারে উপরে যাদের সম্পত্তি, তাদের আয়ের উৎস বিশ্লেষণ করে তিনি দেখতে পেয়েছেন যে, তাদের মোট সম্পদের অর্ধেকের চেয়ে অনেক কম সম্পদ তারা পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারী সূত্রে অথবা রাস্ট্রয় আমলা বা ক্ষমতাবানদের সঙ্গে বিশেষ গোপন লেনদেনের ভিত্তিতে । অতএব নিজের উপার্জিত সম্পত্তি সেটা নয়। আরো ১৫থেকে৩০ শতাংশ সম্পদ জমা হয়েছে তাদের প্রতিযোগিতাহীন বাজারে একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের সুযোগ দ্বারা। যেমন- আমাদের গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসা। এলপিজি বা সিলিন্ডার ব্যবসার প্রধান অংশ বসুন্ধরা, বেক্সিমকো ও যমুনা গ্রুপের হাতে। এখানে সরকারের কোন বেধে দেয়া রেট চলবে না, পাবলিকের গলা কেটে সব রক্ত বের করে তাদের খাওয়া চাই, তেমনিভাবে বিটুমিন বলুন স্বর্ণ বলুন, সবকিছু আমদানিতে তারা থাকবেই। তারাই হবে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা। এইসব সম্পদও নিজের উপার্জিত সম্পদ নয়। আর রাষ্ট্রের নতুন নতুন প্রকল্প তৈরি এবং বাস্তবায়নের সুযোগকেও যদি সম্পদ ধরি, তাহলে ধনীদের আশি থেকে একশ’ ভাগ সম্পত্তিই হচ্ছে অনোপার্জিত ফাও সম্পত্তি। তবে জ্যাকবের অতি-ধনীদের তালিকায় আরো দু’ধরনের ‘বিলিওনিয়ারের’ কথা আছে। এদের মধ্যে একটি ছোট দল সম্পত্তি বানিয়েছেন অপরাধের মাধ্যমে। যেমন অবৈধ ব্যবসা চোরাচালান ট্যাক্স ফাঁকি, ঘুষ, কালো টাকা, ঋণ খেলাপি, ব্যাংক জালিয়াতি, চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি, ইত্যাদির মাধ্যমে । এই ধনীদের তালিকায় শেষে এমন সামান্য কয়েকজন আছেন যারা প্রকৃতই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে ভাগ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। যেমন-আইফোন আবিষ্কারক স্টীভ জব এবং হ্যারি পটার লেখক জে.কে. রলিং, microsoft এর বিল গেটস ফেসবুকের জোকার বাগ, টেসলার ইলেন মার্কস ইত্যাদি। এই নগণ্য সংখ্যক বাদ দিলে বেশিরভাগ ধনী হচ্ছেন ‘কালো বিড়াল’। আর এই কালো বিড়ালের আন্ডা বাচ্চারা ফুলে ফেঁপে উঠে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। ফলে আমরা অন্ধকারে কালো বিড়াল ধরার চেষ্টা করে করে ব্যর্থ হচ্ছি।@ আকাশ
আপনি কেন ইঁদুর দৌড়ে? টলস্টয়ের ‘থ্রি কোয়েশ্চেন!
জীবনের সবচেয়ে বড় স্ট্রেস হচ্ছে বিরামহীন কাজের শিডিউল নিয়ে দৌড়ের উপর থাকা। মনে রাখবেন,প্রকৃতির কোনোকিছুই অবিরাম দৌড়ের উপর থাকে না। আমরা কি এই পৃথিবীতে এসেছি শুধু পেট ভরে খাবারের জন্য কলুর বলদের মত খাটবো তারপর মরে যাব, এই জন্য?। একবার ভাবুন তো , আপনি আমি কি আর দ্বিতীয়বার এই সুন্দর পৃথিবীতে আসার সুযোগ পাবো জীবনকে উপভোগ করার জন্য?
আমাদের কি মনে আছে টলস্টয়ের সেই ‘থ্রি কোয়েশ্চেন’ গল্পের সারমর্ম?
“একদিন এক রাজা ভাবলেন, ‘আচ্ছা, যদি আমি জানতাম কোনো কাজ শুরু করার সঠিক সময়টা কখন? যদি জানতাম আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা কে? আর সর্বোপরি, কোন কাজটা করা সবেচেয়ে বেশি প্রয়োজন? তাহলে আমার রাজ্যচালনার কাজে, সেই সাথে ব্যক্তিগত জীবনে কোনো ভুল হতো না!’
অনেক ঘটনা শেষে রাজা এক সন্যাসির কাছে উত্তর পেলেন,
তিনি তাঁর রাজ্যজুড়ে ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে, যে তাঁর এই প্রশ্ন তিনটির উত্তর খুঁজে দিতে পারবে তাকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। রাজ্যের সব জ্ঞানী-পণ্ডিত এসে উপস্থিত হলো কিন্তু তাদের সবার কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পাওয়া গেলো। রাজা কারও সাথেই একমত হতে পারলেন না এবং কাউকে পুরস্কৃতও করলেন না। এক সন্ন্যাসীর নিকট গেলেন, যার জ্ঞান ও বুদ্ধির সুনাম রয়েছে রাজ্যজুড়ে।
রাজা কাছে গিয়ে দেখলেন সন্ন্যাসী তার কুঁড়েঘরের সামনে মাটি খনন করছে।রাজা বললেন, ‘হে জ্ঞানী সন্ন্যাসী! আমি তোমার কাছে এসেছি আমার তিনটি প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে। বলতে পারো, আমি কোনো কাজের সঠিক সময়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কী তা কীভাবে জানবো?
সন্ন্যাসী তাঁর কথা শুনলো কিন্তু কিছুই বললো না। সে মাটি কাটা চালিয়ে গেলো।’রাজা বললেন, ‘তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। তোমার কোদাল দাও, আমি কিছুক্ষণ কাজ করি’। সন্ন্যাসী তাঁকে ধন্যবাদ জানালো এবং কোদালটি তাঁর হাতে দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। অনেক্ষণ অতিবাহিত হয়ে গেলো। সন্ন্যাসী বললো, ‘কে যেন আসছে! দেখা যাক সে কে!’
রাজা ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন একজন দাড়িওয়ালা লোক তার রক্তাক্ত পেটে দু’হাত চেপে দৌঁড়ে আসছে। লোকটি তাদের কাছে এসেই মাটিতে আছড়ে পড়লো। রাজা ও সন্ন্যাসী তার গায়ের পোশাক খুলে দেখলেন লোকটার পেটে এক প্রকাণ্ড আঘাতের ক্ষত। রাজা যতটা সম্ভব ভালো করে জায়গাটা পরিষ্কার করে তাঁর নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে দিলেন এবং তাকে পানি পান করালেন। সন্ধ্যা হয়ে এলে লোকটিকে ঘরে নিয়ে গেলেন। রাজা ক্লান্তি বোধ করলেন এবং অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে উঠে রাজাকে লোকটি ক্ষীণকণ্ঠে বললো, ‘আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন।’ রাজা অবাক হয়ে জবাব দিলেন, ‘আমি আপনাকে চিনি না। লোকটি বললেন ‘আপনি আমাকে না চিনলেও আমি আপনাকে চিনি। আমি হচ্ছি আপনার শত্রু, আমি আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম। কারণ আপনি তার ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। আমি জানতাম আপনি সন্ন্যাসীর সাথে একা দেখা করতে এসেছেন, তাই আমি আপনাকে ফেরার পথে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলাম। আপনার দেহরক্ষীদের কবলে পড়লাম। তারা আমাকে চিনতে পেরে আক্রমণ করলো। আপনি আমার ক্ষত বেঁধে আমাকে বাঁচালেন।আমি আবারও ক্ষমাপ্রার্থী।’
শত্রুর সাথে এতো সহজেই মিটমাট হওয়াতে রাজা খুব আনন্দিত হলেন। তিনি কেবল তাকে ক্ষমাই করলেন না বরং তাকে একটা চাকরীও আশ্বাস দিলেন। এবার রাজা আরেকবার তার প্রশ্নগুলোর উত্তর চাইলেন সন্ন্যাসীর কাছে। সন্ন্যাসী বললো, ‘উত্তরগুলো তো আপনি ইতোমধ্যে পেয়েই গেছেন।’
আপনার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো বর্তমান মুহূর্তগুলি, কারণ শুধুমাত্র এর উপরই আপনার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে। বর্তমানে যা করবেন একটু পর তার সুন্দর অতীত হয়ে থাকবে। কাজটা কালকে নয়তো পরশু শুরু করবেন এসব অজুহাত ছাড়তে হবে, এক্ষুনি শুরু করে দিন, যতটুকু সম্ভব এগিয়ে রাখুন। ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করে বাঁচলে বর্তমান জীবন হবে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাময়। আপনার আজকের কাজের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হবে। প্রতিদিনই সচেতনভাবে নিজের ‘ভবিষ্যৎ’ তৈরি করুন ।
লক্ষ্য করুন আপনি গতকাল বিরক্ত হয়ে যদি ফেরত যেতেন, তাহলে এই শত্রুর কাছেই আপনার মরণ হতে পারতো। ওই সময়টায় লক্ষ্য অর্জনে আপনি অটুট ছিলেন, এবং কাজে লাগিয়েছেন। সুতরাং সঠিক সময় হল বর্তমান সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। দ্বিতীয় হল আপনি গতকাল যদি তার সঙ্গে ভালো আচরণ ও সহযোগিতা না করতেন, তাহলে সে আপনার বন্ধু হতো না। সুতরাং আর উপযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছে আপনার সামনে বা আশেপাশে বর্ত্মান সময়ে যারা উপস্থিত আছেন তারা, তাদের তাদের প্রতি মনোযোগী হওয়া সহযোগিতা করা, বিরক্ত বা অবহেলা করা যাবে না। আর ৩য় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো পারস্পরিক শেয়ারিং করা। এই যে আমরা তিনজন নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পরস্পরের সাথে শেয়ারিং ও সহযোগিতা করলাম এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
‘এট্রিবিউশন থিওরি
পরস্পরের সাথে শেয়ারিং করে বর্তমানকে উৎসবে রূপান্তর করুন। এভাবে আপনি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয়টি উপভোগ করতে পারবেন।
অন্যরা আপনাকে নিয়ে কি ভাবছে সে নিয়ে চিন্তিত হবেন না? কোনো কারণ ছাড়াই কিছু লোক কখনোই আপনাকে পছন্দ করবে না, আপনি ফেরেশতা-পয়গম্বর হলেও না’। তারা আপনার উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হবে। এটাই সাইকোলজিকাল ‘এট্রিবিউশন থিওরি’। তাই নিজের সবকিছু দিয়ে তাদেরকে ইম্প্রেস করার হীনমন্য চেষ্টা আপনাকে হতাশ করবে। পাওয়ার অব পজিটিভিটির কথা মনে রাখুন ‘যারা আপনাকে সম্মান করে না, তারা আপনার জীবন থেকে হারিয়ে গেলে আপনার ক্ষতি নয়, বরং লাভ।’ এই ‘বিষাক্ত ব্যক্তিরা জীবন থেকে বাদ পড়লে ভালোবাসার ব্যক্তিদের জন্য জায়গা তৈরি হবে’। তাই বর্ত্মানে আপনার সামনে উপস্থিত মানুষদের মধ্যে ভালোবাসার ব্যক্তিদের খোঁজে থাকুন। সর্বদা মনে রাখুন আপনি কে সেটা নির্ভর করবে আপনি কাদের সাথে চলাফেরা করেন অর্থাৎ আপনার বন্ধু কারা, তাদের মন-মানসিকতা জ্ঞান ও কোয়ালিটির উপর।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কি সনদ বিক্রির দোকান?
পাকিস্তানের পাঞ্জাবে অবস্থিত প্রাচীন ভারতের তক্ষশিলা হচ্ছে সবচাইতে প্রাচীন শিক্ষালয়, যা খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে তৈরি হয়। শুরু হয় অংক, জোতির্বিজ্ঞান, বস্তুগত শিক্ষা দিয়ে। পরে সম্রাট অশোকের সময় শিক্ষালয়টিতে বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা শুরু হয়। এত প্রাচীনে অন্য শিক্ষালয় কেবল গ্রীসে হয়।
প্লাটোর একাডেমি স্কুল হয় ৩৮৭ বিসি(খ্রীষ্টপুর্ব) তে। এখানে এরিষ্টোটল পড়েন ২০ বছর। এরপর তিনি তৈরী করেন লাইসিয়াম স্কুল ৩৩৪ বিসি। ইউরোপের প্রাচীন ইউনিভার্সিটি সে শিক্ষা ধারায় তৈরি হয় ইটালীতে বলগনা ইউনিভার্সিটি-১০৮৮ সালে, লন্ডনে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি-১০৯৬ সালে, স্পেনে সালামানকা ইউনিভার্সিটি-১১৩৪ সালে, পেরিস ইউনিভার্সিটি, ফ্রান্সে-১১৬০ সালে, কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি লন্ডনে-১২০৯ সালে। নেপলস ফেডারিকো ইউনিভার্সিটি-১২২৪ সালে, সিয়েনা ইউনিভার্সিটি-১২৪০ সালে।
যে দুইটি ইউনিভার্সিটি নিয়ে মুসলমানেরা গর্ব করে তার ১টি মিশরের আল আযহার ইউনিভার্সিটি ১৯৬১ তবে এটি ৯৭০ সালে ছিল একটি মসজিদ এবং ২য়টি মরক্কোর আল কারাউইন ইউনিভার্সিটি ১৯৬৩তে ইউনিভার্সিটি হয়। এটাও ৮৯৫ সালে একটি মসজিদ হিসেবে তৈরি হয়েছিল। মুসলমানরা মসজিদকে মক্তব করতো সকালে ধর্ম পড়ানোর জন্য। কথিত আছে ইউনিভার্সিটি নাম হলেও মূলত এখনো এই দুটি প্রতিষ্ঠানে ধর্ম তত্ত্বই পড়ানো হয় বেশি, ফলে এখানে স্কলার তৈরি হয় না বললেই চলে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থারও একই অবস্থা। আমাদের শিশুপাঠ্য থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী পর্যন্ত কোথাও বিজ্ঞানবাদিতার প্রতিফলন নেই; যা আছে তা হচ্ছে- অন্ধবিশ্বাস, কল্পনা আর সমসাময়িক বিষয়ের মিশেল এক ককটেল; যা সর্বক্ষণ বিস্ফোরনের ঝুঁকিতে আমরা। ফলে আমারা হয়ে গেছি টবের গাছে মতো, বেঁছে আছি তবে বাড়ছি না। কিন্তু একটা কলি তখনি ফুল হয়ে ফুটে, যখন সে উপযুক্ত আলো, বাতাস, মাটি, সার, পানি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপদান পায়। একবার ভাবুন তো, বিজ্ঞানী আইনেস্টাইন যদি আমাদের বান্দরবনে বেড়ে উঠতো, তাহলে কি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হতে পারতো? কাজেই সেরা মেধা গড়ার জন্য যে প্লাটফরম দরকার, তার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে আমাদের গরজ নেই।
আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক চান পদ , আর শিক্ষারথীরা চায় সনদ । এগুলো পাবার জন্য শিক্ষকরা দিনরাত নেতানেত্রীদের তোষামোদি, চামচামি ও তেল মালিশ করায় ব্যস্ত থাকেন,অধ্যাপক , বিভাগীয় প্রধান , ডিন ইত্যাদি পদের জন্য। আর বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা সৎ , সংস্কৃতিমনা , রুচিবান ও মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে চায় না। তারা গবেষণার চর্চা করেন না । ফলে , এখান থেকে আর আলোকিত মানুষ বের হতে পারছে না , যা বের হচ্ছে- তা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশিলতা , কুসংস্কার , অন্ধবিশ্বাস , মূর্খতা , গোড়ামি , নোংরামি তে ভরা অর্থ ও ক্ষমতালোভী অমানুষ। এশিয়ার সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম নেই। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের শিক্ষার পার্থক্য তৈরি হচ্ছে ।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি করার মতো গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভভ হয়নি। ফলে বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয় সনদ বিক্রির দোকান। সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষা বা পুঁথিগত বিদ্যা নয়, দরকার আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য সৃজনশীল শিক্ষা।
-
গ্রীক সভ্যতা: স্পার্টানরা কেন দুর্বল শিশুকে পাহাড়ের গুহায় ফেলে দিয়ে আসতো?
মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঈর্ষণীয় গৌরবের অধিকারী হল গ্রীকরা। এদেশে জন্ম নিয়েছেন মহাকবি হোমার থেকে শুরু করে দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল, যাদের চিন্তাধারা পাশ্চাত্য দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে। কি পদার্থ বিদ্যা, কি ভূগোল জ্ঞানের সর্ব ক্ষেত্রে গ্রীসের উর্বর মননের ছাপ সুস্পষ্ট।
প্রাচীন গ্রীস কোনো অখন্ড রাষ্ট্র ছিল না। এটা ছিল মূলত অসংখ্য ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রের সমষ্টি। নদীনালা গ্রীসে নেই বললেই চলে। এই শত শত নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সর্বপ্রধান দুটি হচ্ছে স্পর্টা এবং এথেন্স । এথেন্স ছিল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল এবং উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী, আর স্পর্টা ছিল অভিজাততান্ত্রিক, রক্ষণশীল, পশ্চাৎমুখী এবং অনুন্নত সংস্কৃতির অধিকারী। ফলে এ দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে পরস্পরের প্রতি মনোভাব ছিল খুবই বিদ্বেষমূলক। স্পর্টানদের আগমন ঘটেছিল আক্রমণকারী হিসেবে। স্থানীয় অধিবাসীদের চুড়ান্তভাবে পরাস্থ করতে তাদের কয়েকশত বছর যুদ্ধ করতে হয়েছিল, ততদিনে সামরিক অভ্যাস তাদের এমন মজ্জাগত হয়েছিল যে, পরবর্তী সময়ে তা আর তাদের পক্ষে পরিত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। স্পার্টারা যেন ছিল যুদ্ধের বিরাট এক ক্যাম্প। এজন্য প্রতিটি স্পার্টানকে প্রথমে সৈনিক জীবনযাপনে বাধ্য বাধকতা ছিল। সেখানে প্রত্যেক নবজাতক ছেলে শিশুকে একটি সংস্থার নিকট হাজির করা হতো। শিশুটি স্বাস্থ্যবান এবং রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি বলে বিবেচিত হলেই কেবল তাকে লালনপালন করার অনুমতি দেওয়া হতো। দুর্বল শিশুকে পাহাড়ের গুহায় ফেলে আসা হতো। সে ওখানেই মারা যেত। সাত বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা পরিবারের সাথে থাকার সুযোগ পেত। তারপর তাকে রাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করা হতো। সে তখন অন্যান্যের সাথে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যারাকে জীবনযাপন করতো। রাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য ছিল অপরাজেয় যোদ্ধা তৈরি করা। স্পার্টার মেয়েরাও কঠোর দৈহিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য ছিল। বিশ বছর বয়সের পর তারা বিয়ের অনুমতি পেত। যখন কোন স্পার্টান মা তার ছেলেকে যুদ্ধের ঢাল দিতেন, তখন তিনি বলতেন, “এই ঢালসহ তুমি ফিরে এসো”। এই ঢাল এত বড় হতো যে, কোন সন্তানই তা ফেলে রেখে পালাতে পারত না।
অন্যদিকে ‘এথেন্স’ নগর রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল গ্রীসের এক পার্বত্য এবং অনুর্বর ভুমিতে। ফলে এখানে কোনো যুদ্ধবাজ শাসক গোষ্ঠীর উদয় ঘটেনি। এথেন্সের নাগরিক সমাজ ছিল চার ভাগে বিভক্ত । প্রথম শ্রেণিতে ছিল ধনী অভিজাত শ্রেণির লোক। এরা পূর্ণ রাজনৈতিক ও নাগরিক সুবিধা ভোগ করতো। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল কৃষক, বণিক, নাবিক, কারিগর ও ব্যবসায়ী প্রমুখ। এদের নাগরিক অধিকার ছিল কিন্তু রাজনৈতিক অধিকার ছিল না । তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল অন্য দেশ হতে আগত জনগণ। এদের কোন রাজনৈতিক বা নাগরিক অধিকার ছিল না। এরা সাধারণত শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসায়ে নিয়োজিত থাকত। চতুর্থ শ্রেণিতে ছিল দাস। এথেন্সে বহুসংখ্যক দাস ছিল। এরা মনিবের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হতো। কৃষিজ সম্পদের মধ্যে ছিল জলপাই ও আক্সগুরের বাগান।তাই এথেন্সে বাণিজ্য এবং নাগরিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
পেরিক্লিসের সময় (৪৬১-৪২৯ খ্রিঃপূঃ) এথেন্স ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে আরোহন করে এবং গণতন্ত্রের চুড়ান্ত বিকাশ ঘটে। তার শাসনামলে শিক্ষা, দীক্ষা, রাজনীতি, শিল্পকলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দর্শন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে এথেনীয়রা চরম উন্নতি সাধন করে। পেরিক্লিসের নেতৃত্বেই আইন ব্যবস্থার পূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র ।
প্রাচীন গ্রিস গোটা পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে। যেমন গণতন্ত্র। আজকে এই গণতন্ত্রের ভিত্তিতেই আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। গ্রিসের চিকিৎসা দেবতা আস্ক্লেপিউসের লাঠিতে সাপ পেঁচিয়ে আছে- চিকিৎসাবিজ্ঞান বোঝাতে এই প্রতীকই ব্যবহার করছে সারা বিশ্ব। শুধু চিকিৎসা, বিচার ব্যবস্থা আর গণতন্ত্রই নয়, গ্রিস আমাদেরকে প্রথম ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসকে দিয়েছে। এই হেরোডোটাসই পৃথিবীর মানুষকে ইতিহাস লিখতে শিখিয়েছে। এই গ্রিস আমাদের প্রথম গণিতজ্ঞ দিয়েছে থালিস, পিথাগোরাস। প্রথম দার্শনিক দিয়েছে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল। প্রথম চিকিৎসাবিদ হিপোক্রেটকে দিয়েছে। বিচার ব্যবস্থায় জুরির শুনানি দিয়েছে। প্রথম থিয়েটার দিয়েছে। অলিম্পিক গেইম দিয়েছে। মেকানিক্যাল অডোমিটার দিয়েছে। স্থাপত্যশিল্প দিয়েছে। গ্রিক পুরাণের শিক্ষণীয় গল্প দিয়েছে। আরও কতশত কিছু দিয়েছে। ন্যায়বিচারের জন্যও গ্রিকরা থেমিস নামেএকজন দেবীর কল্পনা করেছিল। যা বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার বিভিন্ন শহরে আদালত প্রাঙ্গণে লেডি জাস্টিস নামে ভাস্কর্য পেয়েছে।
সক্রেটিস
গ্রিকদের সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে থেলিসের নাম, যাকে বলা হয় বিজ্ঞানের জনক। অনেকে আবার তাকে গণিত ও জ্যামিতির জনকও বলেন। মোট কথা তিনিই প্রথম পৌরাণিক গল্পের স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে, বিশুদ্ধ চিন্তা ও গাণিতিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে স্বর্গের কাহিনী বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। যেমন- তারা (নক্ষত্র) পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি সমুদ্রে জাহাজের দূরত্ব নির্ণয় করার পদ্ধতি বের করেছিলেন। এরপর গণিতকে প্রথমবারের মতো একটা বিপ্লবে রূপ দিতে পেরেছিলেন পিথাগোরাস। পিথাগোরাসের মৃত্যুর ৪০০ বছর পর সক্রেটিসের জন্ম।
সক্রেটিস ছিলেন এক দরিদ্র ব্যক্তি, যিনি বাস করতেন গ্রিসের অ্যাথেন্সে। তিনি ছিলেন এক ভালো যোদ্ধা, যিনি জিমনেশিয়ামে লড়তেন; কিন্তু তিনি জানতেন যে, তিনি কোনো বুদ্ধিজীবী নন। তাই গ্রিসের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করতে চেয়েছিলেন বলেই তিনি গ্রিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী কে? তা খুঁজতে তিনি গিয়েছিলেন ডেলফির বিখ্যাত পুরোহিতের কাছে। পুরোহিত ডেলফির গুহায় তাঁর আসনে বসে সক্রেটিসের প্রশ্ন শুনলেন। অতঃপর তাঁর উত্তর ছিল, ‘গ্রিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হচ্ছে সক্রেটিস তুমি নিজে।’
‘কিন্তু, এটা অসম্ভব!’ তোতলিয়ে সক্রেটিস বললেন, ‘আমি এক মূর্খ’। পুরোহিত বললেন, যে ব্যক্তি নিজেকে মূর্খ বলে জানে এবং জ্ঞানের সন্ধান করে, সে হচ্ছে জ্ঞানী। কিন্তু সক্রেটিস এই কথায় সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি তাঁর নিজ নগরী অ্যাথেন্সে ঘুরে, যেখানে যত লোক জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের সবাইকে একই প্রশ্ন করতে লাগলেন। গ্রিকরা তখন বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাস করত এবং বলিদান দিত। সক্রেটিসও ধার্মিক হতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি আর একজন বিখ্যাত পুরোহিতের কাছে গেলেন।পুরোহিত দেবতাদের পুজো দিতে বলেন। সক্রেটিস বললেন ‘কিন্তু গ্রিসে দেবতারা সংখ্যায় অনেক। দৈব-কাহিনিতে দেখা যায় প্রায়ই দেবতারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করেন। আমি কীভাবে জানবো কখন কোন দেবতাকে সমর্থন করতে হবে এবং কখন অন্য জনকে অনুসরণ করতে হবে?’
প্রশ্ন শুনে পুরোহিত বিব্রত হলেন । এরপর সক্রেটিসের ধারালো প্রশ্নমালার উত্তর খুঁজতে অনেক জনসমাবেশ হতে থাকল। জিমনিশিয়ামে অনেক তরুণ সক্রেটিসের অনুসারী হয়ে প্রকাশ্য দেব-দেবীর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। সক্রেটিস তখন আগোরায় অর্থাৎ এথেন্সের বাজারে এলোমেলোভাবে ঘোরাফেরা করতেন, যেদিকে যেতেন যেন হেমিলনের বাঁশিওয়ালা, পেছনে যুবকদের সারি। শেষ পর্যন্ত অ্যাথেন্সের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি অসহ্য ঠেকল। তারা সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অধর্ম, দেবনিন্দা, দেবতাদের প্রশ্নবিদ্ধ করা দিয়ে তরুণদের নষ্ট করার অভিযোগ এনে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করলেন।
সক্রেটিস অভিযোগসমূহ অস্বীকার করলেন এই বলে যে, তাঁর প্রশ্নগুলো ছিল দেবতাদের সম্মান করার জন্য। তখন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাঁকে অভিযুক্ত করল তরুণদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভ্রষ্ট করার এবং তাঁর প্রশ্ন দিয়ে সমাজে আরও গোল বাঁধাবার পূর্বেই তাঁর মৃত্যুদন্ড দেয়া হল। সক্রেটিসকে তাঁর বন্ধুরা মিনতি করলেন প্রশ্ন করা বন্ধ করতে, কিন্তু তিনি বললেন এর অর্থ হবে দেব-দেবীকে স্বীকার করা। ফলে মৃতুদন্ডকে গ্রহন করলো সক্রেটিস।
প্লেটো
দার্শনিক প্লেটো সক্রেটিসের ছাত্র ছিলেন এবং দার্শনিক এরিস্টটল তার ছাত্র ছিলেন। এ হিসেবে প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনজন দার্শনিক মূলত পশ্চিমা দর্শনের ভিত রচনা করেছেন বলা যায়। প্লেটো একাধারে গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক ভাষ্যের রচয়িতা হিসেবে খ্যাত। ধারণা করা হয় প্লেটো ৪২৮ থেকে ৪২৭ খ্রীস্টপূর্বাব্দের কোন এক সময়ে গ্রিসের এথেন্স বা এজিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনে সক্রেটিসের প্রভাব অতি সুস্পষ্ট কারণ সক্রেটিসের সব কথোপকথন প্লেটোই লিখে গেছেন। শৈশবকাল থেকেই প্লেটোর সাথে সক্রেটিসের পরিচয় ছিল।আধুনিক সাম্যবাদ হলো প্লেটোর কাছ থেকে ধার করা সাম্যবাদ।
সক্রেটিসের মৃত্যুর পর প্লেটো ভ্রমণে বের হন। তিনি সাইরেন, ইতালি, সিসিলি, মিশরে ভ্রমণ করেন।তিনি প্রায় ১২ বছর দেশে দেশে ভ্রমণ করে বেড়ান। এ সময় তিনি সিরাকিউজ গমন করেন এবং বিখ্যাত গণিতবিদ পিথাগোরাসের অনেক শিষ্যের সাথে পরিচিত হন। সিরাকিউজের শাসকগোষ্ঠীর সাথেও তার খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো নিজ শহর এথেন্সে ফিরে আসেন। এর দু’বছর পর আনুমানিক ৩৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি গ্রীক বীর ‘আকাডেমাস’ এর উদ্যানে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং নাম দেন ‘দ্য একাডেমি’। প্লেটো আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন। তার মৃত্যুর পরও দীর্ঘকাল একাডেমির শিক্ষা কার্যক্রম চলেছিল (৫২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত)। গণিত, জোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, দর্শন এবং রাজনীতি ছিল প্লেটোর একাডেমির শিক্ষাক্রমের প্রধান বিষয়। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের জন্য কোনোরকম অর্থ গ্রহণ করতেন না তিনি। তবে ভর্তি হবার জন্য কঠিন ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন!
৩৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো সিরাকিউজে যান তার এক শিষ্যের বন্ধু ডায়নের আমন্ত্রণে। ডায়নের আমন্ত্রণটি ছিল তার বন্ধু তথা সিরাকিউজের শাসক দ্বিতীয় ডায়োনাইসিয়াসের গৃহশিক্ষক হবার। প্লেটো ভাবলেন ডায়োনাইসিয়াসকে শিক্ষা দিয়ে ‘ফিলোসফার কিং’ বানাতে পারলে মন্দ হয় না। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে ডায়োনাইসিয়াসকে নিয়ে প্লেটোর স্বপ্নভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। ডায়োনাইসিয়াস প্লেটোর দর্শন বুঝতে না পেরে ভাবলেন তার বন্ধু ডায়ন এবং প্লেটো মিলে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই ধারণা থেকে তিনি ডায়নকে নির্বাসনে পাঠান এবং প্লেটোকে গৃহবন্দী করেন। তবে সৌভাগ্যক্রমে প্লেটো সিরাকিউজ থেকে পালিয়ে নিজ শহরে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
এই মহান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্লেটো খ্রাষ্টপূর্ব ৩৪৭অব্দে ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। একটি বিকৃত গল্পের পাণ্ডুলিপির সূত্র থেকে জানা যায়, একটি ছোট মেয়ে তার কাছে বাঁশি বাজানো অবস্থায় প্লেটো তার বিছানায় স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। আরেক বর্ণনা অনুযায়ী, প্লেটো একটি বিয়ের ভোজ খেতে গেলে সেখানেই মারা যান।
দর্শন ও মানুষের প্রকৃতির উপর প্লেটোর চিন্তা ভাবনা নিজের দেশ গ্রীস ও নিজের কাল ছাড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। তার সমতা ভিত্তিক সমাজ গড়ার দর্শন থেকেই আজকের পৃথিবীর আধুনিক গণতন্ত্রের উদ্ভব।
এরিস্টটল
প্লেটোর ছাত্র ছিলেন এরিস্টটল। আনুমানিক ৩৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রীসের উত্তরাঞ্চলে সমুদ্র উপকূলবর্তী স্টাগিরা শহরে জন্মগ্রহণ করেন অ্যারিস্টটল। বাবা নিকোম্যাকাস ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজা ২য় অ্যামিন্টাস-এর গৃহ-চিকিৎসক। তার মা ফায়েস্তিসও ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। রাজদরবারে কাজের সুবাদে অ্যারিস্টটলের বাবার আয় ছিল খুব ভাল। ফলে অ্যারিস্টটলের শৈশব কাটে বেশ স্বাচ্ছন্দে। তবে কৈশোরে পা রাখতেই বাবাকে হারান তিনি। কয়েক বছর পর মাকেও হারিয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যান কিশোর অ্যারিস্টটল। তবে রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় কখনো অর্থাভাবের মুখ দেখেননি তিনি। তাছাড়া তার দুলাভাই তথা বড় বোনের স্বামী প্রোক্সেনাস তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি তাকে। ৬২ বছরের জীবনকালে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখে গেছেন অজস্র গ্রন্থ ।
৩৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, অ্যারিস্টটলকে ম্যাকেডনের দ্বিতীয় ফিলিপ তার পুত্র আলেকজান্ডারের শিক্ষক হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অ্যারিস্টটলকে ম্যাসিডনের রাজকীয় একাডেমির প্রধান হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। ৩৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, অ্যারিস্টটল এথেন্সে ফিরে আসেন এবং সেখানে লাইসিয়াম নামে পরিচিত তার নিজস্ব স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এথেন্সে থাকাকালীন, তার স্ত্রী পিথিয়াস মারা যান। অ্যারিস্টটল এবং পিথিয়াসের একটি কন্যা ছিল। হার্পিলিস ছিলেন স্ত্রী পিথিয়াস মারা যাওয়ার পর অ্যারিস্টটলের দ্বিতীয় পত্নী। অ্যারিস্টটল এবং হার্পিলিসের একটি পুত্র সন্তান ছিল।
এরিস্টটল কিন্তু গুরু প্লেটোর সব কথার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তবে এরিস্টটলই প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন এবং বুঝতে পারেন পৃথিবী একটা গোলক। পৃথিবী যে গোল—অ্যারিস্টটল কিভাবে নিশ্চিত হয়েছিলেন?
সেকালের গ্রিসের লোকেরা মনে করত পৃথিবী চ্যাপ্টা থালার মতো। শুধু গ্রিসে নয়, গোটা দুনিয়াজুড়ে এ ধারণা চালু ছিল। অ্যারিস্টটলই এই ভুল ভাঙলেন। ‘অন দ্য হ্যাভেনস’ বইয়ে লিখলেন, পৃথিবী চ্যাপ্টা থালার মতো নয়।
এটা একটা গোলক। কিন্তু লোকে সেটা মানবে কেন? অ্যারিস্টটল তাঁর বইয়ে শক্ত যুক্তি দেখিয়েছিলেন।
অ্যারিস্টটল ব্যাখ্যা দিলেন, চন্দ্রগ্রহণ কেন হয়? অ্যারিস্টল বলেছিলেন সূর্য আর চাঁদের মাঝখানে পৃথিবী এসে পড়ে বলেই চন্দ্রগ্রহণ হয়। চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর যে ছায়া পড়ে চাঁদের ওপর, সেই ছায়া সব সময় গোলাকার।
কখনো লম্বাটে হয় না, কিংবা উপবৃত্তাকারও হয় না। পৃথিবী যদি থালার মতো হতো তাহলে ছায়াটা উপবৃত্তাকার হতো, গোলাকার নয়। অ্যারিস্টটল বললেন, পৃথিবীর আকার গোলকের মতো বলে বলেই চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের ওপর গোলাকার ছায়া পড়ে।
আলেকজান্ডার
এই এরিস্টটলই ছাত্র ছিলেন আলেকজান্ডারের। ৩৩২ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার মিসর দখল করেন। মেসিডোনিয়ার শাসনকর্তা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সফল সামরিক প্রধান। টলেমির মানচিত্র অনুযায়ী আলেকজান্ডার পৃথিবীর বেশির ভাগ এলাকা জয় করেন। এতে তাঁর আমলে বিভিন্ন সভ্যতার মিলন ঘটে। যেমন মিসর, গ্রিক, পারস্য ও ভারতীয় সভ্যতার সংশ্লেষণে শুরু হয়েছিল এক নতুন সভ্যতা। এই সভ্যতাই হেলেনেস্টিক সভ্যতা নামে পরিচিত। ফরাসি ভাষায় তাঁকে ইস্কান্দর বলা হয়। মধ্য-পশ্চিম স্থানে জুলকারনাইন, আরবে আল ইস্কান্দর আল কাবের, উর্দুতে 'সিকান্দরে আজম' বলা হয়। তার সাম্রাজ্য মেসিডোনিয়া থেকে ভারতের পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আলেকজান্ডার তার সামরিক কৌশল ও পদ্ধতির জন্য বিশ্ব বিখ্যাত। আলেকজান্ডার ৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব জুন মাসের ১১ মতান্তরে ১২ তারিখে ব্যাবিলনে দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের প্রাসাদে মৃত্যুবরণ করেন।
মাত্র ৩৩ বছর বেঁচে ছিলেন আলেকজাণ্ডার দ্য গ্রেট। তিনি চেয়েছিলেন বিশ্বব্যাপী শুধু মাত্র একটি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর এই অদম্য বাসনাকে পূর্ণ করার অতিমানবীয় লক্ষ্যে ক্ষণজীবী এই মানুষটি সারাজীবনের অর্ধেকই কাটিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে।
আলেকজাণ্ডার গ্রিস দেশের মেসিডোনিয়া থেকে বের হয়ে পূর্ব দিকে বিজয় অভিজান পরিচালনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল এশেরিয়া আর ব্যবিলোনিয়া জয় করবেন। কেননা এশেরিয়ার রাজা দারায়ূস ১ম গ্রিস আক্রনণ করেছিল তার প্রতিশোধ হিসেবে। দারায়ুস জিততে পারে নি।
এরপর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সেতু বন্ধন রচনা করেছিলেন প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের। সেই সুদূর গ্রীস থেকে একের পর এক সাম্রাজ্য জয় করে তাঁর বাহিনী চলে এসেছিল ভারত পর্যন্ত। তাঁকে নিয়ে কতো কিংবদন্তী, কতো লোকগাথা! পারস্যের কাছে পরিচিত তিনি ইস্কান্দার বাদশাহ হিসেবে, ভারতবর্ষেও খ্যাত ইস্কান্দারের অপভ্রংশ “সেকান্দার বাদশাহ” নামে।
এবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি। এসেরিয়ার লোকরা ছিলো 'অসুর' (Asur)। এদের এক দিগ্বিজয়ী রাজার নাম ছিল অসুর বানি পাল।
তিনি প্রায় সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জয় করেছিলেন। পরবর্তীতে আলেক্সজান্ডার এশেরিয়া জয় করে। সেখানকার রাজধানী পার্সিপোলিসে তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখান থেকে যুদ্ধ করতে করতে আলেক্সজান্ডার পুরুষপুর অর্থাৎ পাকিস্তানের পেশওয়ার পর্যন্ত জয় করে নিয়েছিলেন।
এশারিয়া থেকে এসেছিলেন তাই আলেক্সজান্ডার 'অসুর' সেই সাথে তাঁর মোষের মুখোসের জন্য তিনি মহিষ+অসুর= মহিষাসুর হয়ে যান।
প্রকৃতপক্ষে আলেকজাণ্ডারের এই উপমহেদেশ আক্রমণ ছিলো এক বিশাল আলোড়ন সৃষ্টিকারী সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা। অনেকটা ইতালীয় রেনেসাঁর মতো। কাবুল, যৌধেয়, জাবুল (হিন্দুকুশ), নেপাল, পুরুষপুর ইত্যাদি অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্যগুলিতে আশঙ্কা আর ভয় এক সামাজিক সঙ্কটের জন্ম দিয়েছিল। তারা অনুভব করেছিল সঙ্ঘবদ্ধতা ছাড়া আলেকজাণ্ডারের বিশাল বাহিনী আর তার রণকৌশলের মোকাবেলা করা সম্ভব না। আবার কেউ কেউ গোপনে আলেকজাণ্ডারের বাহিনীতে যোগ দেয়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এটা করেছিলেন বলে জানা যায়। এখান থেকে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করে তিনি হৃতরাজ্য উদ্ধার করেছিলেন।
আলেকজাণ্ডারের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধতার সূত্রে গণঅন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু এদেশে, শুধু এদেশেই নয়, দেখা গেছে পৃথিবীর সর্বত্র যে-কোন গণআন্দোলনই ধর্মাশ্রিত হতে বাধ্য ছিল। তাই মহিষাসুরমর্দ্দিনী দুর্গাদেবীর কল্পনা। দুর্গা দেবীর কছে এই আসুরকে বধ করার প্রার্থনার প্রচলন হয়। এর জন্য কাহিনি, মন্ত্র সবই রচিত হয়। সেই কাহিনি কালের গতিতে পরিবর্তিত হয়ছে অনেকখানি।
তথ্যসূত্র : 'বৃহৎবঙ্গ' দীনেশচন্দ্র সেন।
টলেমি রাজবংশ
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য তিন সৈন্যাধ্যক্ষের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। সাম্রাজ্যের আফ্রিকান অংশ মিশর,তার অধিকর্তা হন সেনাধ্যক্ষ টলেমি। এই টলেমি বংশের রাজারা, ইতিহাস ফারাও (রাজা) নামে অভিহিত। টলেমি রাজবংশের শাসনামলে প্রায় ৩০০ বছর আলেকজান্দ্রিয়া গোটা পৃথিবীর বুদ্ধিবৃত্তিক রাজধানী ছিল। মজার ব্যাপার হলো এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের প্রথম গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারে আজকের মতো বই ছিল না। তখন লেখা হতো প্যাপিরাস পাতায়, প্যাপিরাসের স্ক্রলগুলো গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত থাকত। অনেকে বলেন, প্রায় ১০ লক্ষ প্যাপিরাস স্ক্রল ছিল এই গ্রন্থাগারে যার সবগুলোই আজ হারিয়ে গেছে। এই গ্রন্থাগারেরই একটা অবিস্মরণীয় বই ছিল, যার লেখক আয়োনিয়ার সামোস দ্বীপের এরিস্টার্কাস। ফিলোলাউসের চেয়ে একধাপ এগিয়ে তিনি বলেছিলেন, সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আর পৃথিবীসহ সব জ্যোতিষ্ক তাকে কেন্দ্র করে আবর্তন করছে। সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সূর্য পৃথিবী থেকে অনেক বড়। আর একটা বড় বস্তু কেন একটা ছোট বস্তুর চারদিকে আবর্তন করবে তা তার মাথায় ঢুকছিল না। তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে অন্যান্য তারাগুলো আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরে।
এক সময় আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ছিলেন এরাটোস্থেনিস। তিনি গ্রন্থাগারের একটা বইয়ে হঠাৎ পড়েন, মিসরের সায়িন নামক স্থানে বছরের দীর্ঘতম দিনের ঠিক ভরদুপুরে কোনো বস্তুর ছায়া পড়ে না। তিনি আরও অবাক হলেন এই দেখে যে, সেই দিনের ঠিক একই সময়ে আলেকজান্দ্রিয়াতে ছায়া পড়ে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে এবং আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সায়িনের দূরত্ব পরিমাপের মাধ্যমে তিনি পুরো পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করে ফেলেন। তিনি পরিধি পেয়েছিলেন ৪০,০০০ কিলোমিটার যা আসল মানের খুবই কাছাকাছি। এছাড়া এরাটোস্থেনিসকে ভুগোলের জনক বলা হয়।
পৃথিবী যে অক্ষের চারদিকে ঘুরে তার গতির পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। আলেকজান্দ্রিয়ার এই গ্রন্থাগার কেবল গ্রন্থাগারই ছিল না, এখানে স্থাপিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক গবেষণাগার। এখানে কাজ করতেন ‘হিপ্পার্কাস’ যাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষক বলা হয়। তিনিই ত্রিকোণমিতির উন্নতি সাধন করেন, জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব-নিকাশে ত্রিকোণমিতিক ছক ব্যবহার করেন। সূর্য গ্রহণের প্রথম নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেন তিনি। ইউরোপে প্রথম পরিপূর্ণ তারা তালিকা প্রণয়নও করেন তিনি। দুঃখের কথা হলো- রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়া দখল নেয়ার জন্য শহর জ্বালিয়ে দেন যে আগুনে গ্রন্থাগারটিও পুড়ে যায়।
রেনেসা
খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীরা এরিস্টটল এবং টলেমির মতবাদ পুরোপুরি গ্রহণ করে। এই তিনজন পরিণত হন খ্রিস্টান চার্চ শাসিত পশ্চিমা বিশ্বের তিন পথপ্রদর্শকে। কিন্তু এতে করে বিজ্ঞান পিছিয়ে যায় হাজার বছর। যখনই নতুন কোনো চিন্তা আসত, সবাই এরিস্টটলের তত্তের সঙ্গে তা মেলে কিনা হিসাব করতো। মিলে গেলে ভালো কথা, কিন্তু যখনই দ্বিমত পোষণ করলে তার আর রক্ষা নাই, তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হতো বা পুড়িয়ে মারা হলো। যেমন কোপানির্কাস, গ্যালিলিও, ব্রনো আরো অনেকে।
ষোড়শ শতকে সুইজারল্যান্ডের বেলেস বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ফিলিপ্রাস প্যারাসেলসাস ঘোষণা করলেন- মানুষের অসুস্থতার কারণ কোনো পাপ বা অশুভশক্তি নয়, রোগের কারণ হলো জীবাণু। এই জীবাণু মারতে পারলেই মানুষটি সুস্থ হয়ে যাবে। এই কথা শুনে খ্রিস্টানরা ক্ষেপে উঠল। প্যারাসেলসাসকে বিচারের মুখোমুখি করে মৃতুদন্ড দিল। প্রাণ বাঁচাতে প্যারাসেলসাসকে মাতৃভূমি ছেড়ে পালাতে হলো। মুসলিমরাও কম নয়। ইবনে খালিদ, জিরহাম, আল দিমিস্কি, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে বাজা, আল কিন্দি, আল রাজি, কিংবা ইবনে রুশদের মতো দার্শনিকদের সবাই মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে নির্যাতিত বা নিহত হয়েছিলেন। যার কারণে সভ্যতা স্থবির হয়ে গেল, জ্ঞান-বিজ্ঞান মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
রোমান সভ্যতা:
খ্রিস্ট পূর্ব আট শতকে গ্রীক সভ্যতা যখন বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে তার পূর্বেই ইতালির তাইবার নদীর তীরে আরেকটি সভ্যতার উদয় হয়, যা রোমান সভ্যতা নামে পরিচিত। এসময় ইতালির বিভিন্ন অংশের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও প্রথাগত ব্যবধানের কারণে ইতালিতে অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এসব আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। তবে যুদ্ধ বিগ্রহের এক পর্যায়ে তারা রোমানদের আধিপত্য মেনে নেয়। এভাবে রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। এরপর হতে রোমানরা প্রতিবেশী প্রায় সব রাজ্যের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে।
খ্রিস্ট পূর্ব ২৫৪ অব্দের মধ্যে রোমানরা সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠে। ফলে রোমান বাহিনী নতুন নতুন ভূখন্ড অধিকার করতে অগ্রসর হয়। একসময় স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে রোমে সংঘটিত হয় এক ভয়াবহ দাস বিদ্রোহ । স্পার্টাকাস ছিলেন একজন অবিসংবাদী নেতা, দক্ষ সংগঠক ও সামরিক অধিনায়ক। বাল্যকালে ক্রীতদাস হিসেবে তাকে রোমে আনা হয়েছিল। স্পার্টাকাসের উদ্দেশ্য ছিল দাসদেরকে মুক্ত করে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো এবং তাদের অধিকার আদায় করা। কিন্তু ৭১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রোমানদের সাথে যুদ্ধে স্পার্টাকাস বাহিনী পরাজিত হয়। স্পার্টাকাস যুদ্ধ ক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর জুলিয়াস সিজার ক্ষমতায় আসার রোমান রাষ্ট্রকে শাসন করেন মাত্র ২ বছর। কিন্তু এ সল্পকালীন সময়ে তিনি তার সংস্কার ও প্রস্তাবিত কর্মসূচির মাধ্যমে নিজের অসাধারণ যোগ্যতা ও মেধার পরিচয় দিতে সক্ষম হন। গ্রিক জ্যোতির্বিদদের সহযোগিতায় তিনি প্রচলিত কেলেন্ডারের সংস্কার করে নতুন কেলেন্ডার প্রবর্তন করেন। উল্লেখ্য তিনি ৩৬৫ দিনে ১ বছর এবং প্রতি ৪ বছরের সাথে একদিন যোগ করে তিনি যে নতুন কেলেন্ডার প্রবর্তন করেছিলেন। তা ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী সামান্য পরিবর্তন সাধন করে বর্তমান কেলেন্ডার তৈরি করে।
জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় রোমানরা গ্রীকদের অনুকরণ করেছিল।
একসময় টলেমি বংশের অধীনেই ছিল জেরুজালেম। রোমানরা জেরুজালেম দখল করে খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে। ইহুদিরা রোমান শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। বছরব্যাপি যুদ্ধে রোমানরা ইহুদি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়। তাদের সৈন্যরা জেরুজালেম নগর-মন্দির প্রায় সবটাই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ দাঁড়িয়ে থাকে। এটি বিলাপ প্রাচীর নামে অভিহিত। এই প্রাচীর এখনো বিদ্যমান। গোঁড়া ইহুদিরা একটি বিশেষ দিনে এই প্রাচীরের সামনে এসে মাথা ঝাঁকিয়ে বিলাপ করে আর প্রার্থনা করে।
প্রথমদিকে রোমে বসবাসরত খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মীয় সভা করতো অত্যন্ত গোপনে। খ্রিস্ট ধর্ম দরিদ্র রোমান বিশেষ করে দাসদের মধ্যে ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করে এবং দলে দলে তারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিতে থাকে। এই ব্যাপক সাড়ায় সম্রাট ডায়োক্লিটিয়ান (২৮৪-৩০৫ খ্রিস্টাব্দে) শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এর প্রসার রোধে তিনি যে হত্যা কান্ড চালান, খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ এটি। কিন্তু‘ এই নিধন খ্রিস্টমতবাদকে নির্জীব করতে পারে না। ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন।
এরপর খ্রিস্টধর্মে রাজধর্মে পরিণত হওয়ায় যাজকরা হয়ে ওঠে পরাক্রান্ত। পরধর্ম বা মতবাদের প্রতি চরম অসিহিষ্ণুতা যেনো খ্রিস্টধর্মের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। তারা ইহুদিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চালায় নিষ্ঠুর নির্যাতন, নিপীড়ন আর হত্যাযজ্ঞ। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকে আরব থেকে ইসলামের আগমন পর্যন্ত।
মুসলিম বাহিনীর জেরুজালেম দখল
মুসলমানদের আগমন জেরুজালেমের ইহুদিদের জীবনে আনে স্বস্তি। প্রাণে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা মেলে। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী জেরুজালেম দখল করে। এ সময় খলিফা উমর সাম্রাজ্যের সীমানা আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু‘ তার পরবর্তী খলিফারা বিশেষ করে উমাইয়া ও আব্বাসীয়রা আরব সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটালেন। উমাইয়াদের রাজধানী ছিলো সিরিয়ার দামেশক। আব্বাসীয়রা রাজধানী সরিয়ে আনেন বাগদাদে। আব্বাসীয়দের শেষদিককার খলিফাদের মধ্যে এই বিশাল সাম্রাজ্য-সিরিয়া, মিশর, ইরাক, পারস্য, স্পেন, তুরস্ক ও খোরাসানসহ মধ্য এশিয়ার বিশাল অঞ্চল শাসনের যোগ্যতা ছিলো না। ফলে দশম শতকে আরো দুটো খেলাফতের সৃষ্টি হয়-একটি স্পেনের কর্ডোভা এবং অপরটি মিশরের কায়রোয়।
মিশরের ফাতেমী শাসকরা বাগদাদের খলিফার প্রতি নামকাওয়াস্তে আনুগত্য দেখালেও কার্যত তারা স্বাধীন ছিলো। ফাতেমী শাসকরা নিজেদের হযরত মুহাম্মদের কন্যা বিবি ফাতিমার বংশধর বলে দাবি করতো। ফাতেমী শাসকদের সময় শান্তি, সম্প্রীতি ও সোহার্দ্যমূলক পরিবেশ ছিলো বিরাজমান।
জাতীয় সংগীতের সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন!
রবী ঠাকুর হিন্দু নয়, ব্রাহ্ম ছিলেন। তিনি তিনি মুসলমানদের মত নিরাকার ইশ্বরের পুজা করতেন। মুর্তি পুজা বা মন্দির নিয়ে মাথা ঘামাতেননা। তাঁর দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের বন্ধু। সেই সুত্রে রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজের একজন অনুরাগী হিসাবে তিনি অসংখ্য গান রচনা করেন। রবীন্দ্র পিতা দেবেন ঠাকুরও ছিলেন একজন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু। ব্রাহ্মধর্ম অনেকটা সম্রাট আকবরের দ্বীন ই ইলাহি টাইপের ছিলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন শান্তি নিকেতন। যে প্রতিষ্ঠানে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই পড়াশোনা করার সুযোগ পান এবং আজকেও পাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবাররা কোনো মন্দির বানাইছেন তার প্রমান কোথাও নেই।
উল্লেখ্য আজকে আমরা যে লালন সাঁইয়ের একমাত্র স্কেচের দেখা পাই তাও রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই জোতিরিন্দ্র নাথ ঠাকুরের আঁকা৷ সুতরাং রবীন্দ্রনাথ পরিবারকে হিন্দু মনে করে বোকারা।
১৮৯০ থেকে ১৯০০ সাল। এই দশবছর টানা রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কাটিয়েছেন। রবিঠাকুর তখন শিলাইদহের জমিদার।স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন কুঠি বাড়িতে। একদিন গভীর রাত। রবীন্দ্রনাথ জেগে আছেন। হঠাৎ কে যে গান গেয়ে যায়। রবিন্দ্রনাথ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলেন সামনে চওড়া গেঁয়ো পথে কে যেন গান গাইতে গাইতে যাচ্ছেন। লোকটার হাতে লন্ঠন। রবীন্দ্রনাথের মনে ধরে গানটা। ''আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যারে…”
পরেরদিন রবীন্দ্রনাথ জানতে পারেন, রাতে যিঁনি গান গাইতে গাইতে এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি শিলাইদহ পোস্ট অফিসের পোস্টম্যান অর্থাৎ রানার। রাতে ডাক নিয়ে ফেরার পথে উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে চলতেন তিনি। লোকটার নাম গগন হরকরা।
রবিঠাকুর একদিন ডেকে পাঠান গগনকে। দারিদ্র মানুষ গগন। বয়সেও রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি। তিনি নিজের লেখা নিজেরই সুরে গানটি তৈরি করেন। রবীন্দ্রনাথ আবার শোনেন সেই গান। বড় ভালো লাগে। এর বেশ কয়েক বছর পর বৃটিশ সরকার শাসন করার সুবিদার্থে বাংলাকে ভেঙ্গে দুভাগ করেন। কিন্তু রবিন্দ্রনাথসহ বহু মানুষ তখন এই বাংলা ভাগের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, আন্দোলন করে। সেই আন্দলনের সময় রবীন্দ্রনাথ একটা গান লিখেন। সেটাই এখন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত । কিন্তু গানটা রবীন্দ্রনাথ লিখলেও, সুরটা তাঁর নিজের নয়, শিলাইদহের সেই ডাক হরকরা সেই গগনের।
অনেক ধর্মান্ধরা বলেন জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে কারণ রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ; কিন্তু প্রথম কথা হলো রবীন্দ্রনাথ যে হিন্দু নন, সেটা তারা জানেই না, যেমন, ইন্দিরা গান্ধীর স্বামীর নাম ছিল ফিরোজ। তাই বলে কি সে মুসলমান ছিল? দ্বিতীয় কথা হল জাতীয় কোন বিষয় চাইলেই পরিবর্তন করা যায় না। এমনকি আপনার এলাকার কোন মৌজার নামও সরকার ইচ্ছা করলে পরিবর্তন করতে পারবে না। কারণ এই নামটা রেকর্ড হয়ে আছে বিভিন্ন দলিল, জার্নাল ও রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক ডকুমেন্টেশনে। আর যারা কাজী নজরুল ইসলাম-এর কবিতাকে জাতীয় সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছেন, তারা কি জানেন, তাঁর স্ত্রী'র নাম আশালতা সেন গুপ্ত ডাকনাম প্রমিলা বা দুলি। তাঁর চার পুত্রের নাম কৃষ্ণ মোহাম্মদ, কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ, অরিন্দম খালেদ বুলবুল। অর্থাৎ সে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতেন। কাজেই কাজী নজরুলকে মুসলিম জাগরনের কবি বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জয় শ্রীরামের পুত্র ভাবা বন্ধ করে, যার যার যোগ্যতার তাকে মর্যাদা দিবার ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ধর্মের জয় গান নয় , মানবতার জয় গান হোক আমাদের জীবনে।
মানব সমাজের অগ্রগতি
বর্বর অবস্থা থেকে সভ্যতার পথে এগিয়ে চলা মানুষদের এককালে এক একটি বংশই ছিল এক একটি সমাজ। তাকে বলা হয় বংশগত সমাজ বা ক্লান। আবার কয়েকটি বংশগত সমাজ বা ক্লান একত্র হয়ে এক একটি মাঝারি ধরনের সমাজ গড়ে উঠত, যাকে বলা হয় আঞ্চলিক সমাজ বা ট্রাইব। ক্লান বা ট্রাইবের সব সদস্য মিলেমিশে খাদ্য আহরণ ও ভোগ করত। ‘ব্যক্তিগত’ সম্পদ বলতে কারো কিছু তখন ছিল না। এরূপ সমাজকে বলা হয় আদিম সাম্যবাদী সমাজ। কোনো কোনো সময় এই সমাজ বা ট্রাইবের সদস্যদের আহার্যের অভাব হলে তখন তারা পার্শ্ববর্তী ট্রাইবের উপর চড়াও হতো এবং জোরপূর্বক তাদের অঞ্চল দখল করত। এভাবেও একাধিক ট্রাইব যুক্ত হয়ে জন্ম নিত রাষ্ট্র। এরূপ রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দেবার মতো যোগ্যতা ও দক্ষতা যে ব্যক্তির থাকত, সেই হতো নতুন রাষ্ট্রের রাজা। সেসব ক্ষেত্রে নবীন রাষ্ট্রে পরাজিতরা রাজার দাসে পরিণত হত । এভাবে আদিম সাম্যবাদী সমাজ দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। যথা-দাস ও প্রভু, বর্তমানে রাজা ও প্রজা। প্রভুদের দরকার হলো শাসন ব্যবস্থার। এর সম্পত্তিতেও হাত দিতে পারবে না, বিদ্রোহ করা যাবে না। এইসব কতকগুলো নিয়ম-কানুন তৈরি হল। নিয়ম-কানুনগুলো কে মানলো আর কে মানলো না, তা বিচার করবার ও উপযুক্ত শাস্তি দেবার জন্য তৈরি হল সিপাহী, কোতয়াল, জেল ইত্যাদি। তাদের খরচ চালাবার জন্য সকলকেই খাজনা বা কর দিতে হবে।
লেখার ইতিহাস
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মন্থরগতিতে মানুষ অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু আট হাজার এবং পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার মানুষ করেছিল। তার মধ্যে চাকার আবিষ্কার মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে একটা প্রকান্ড বড় ঘটনা। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের তিন হাজার পাঁচশ বছর আগেই চাকার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এই সময় পাল-তোলা নৌকাও চালু হয়েছিল।
আগেকার লোকেরা হিসাব রাখত দড়িতে গিঁট দিয়ে বা লাঠিতে দাগ কেটে। কিন্তু নগর-সভ্যতার বিকাশের পরে লেখার আবিষ্কার হয়।
চিত্রলিপি
কোনো বিষয়ের অর্থবোধক চিহ্ন একে রাখাকে চিত্রলিপি বলা হয়। যেমন- সরু রাস্তার পাশে পাহাড়ের গায়ে পানির ঢেউ এঁকে বুঝানো হতো, আশপাশে পানি আছে। এই লিপি ব্যবহৃত হয়েছে সুমেরীয় লিপিতে। সুমেরু অঞ্চলের কাদার উপর নলখাগড়ার কাঠি দিয়ে এই চিত্রলিপিগুলো আঁকা হতো, তারপর আগুনে পুড়িয়ে এগুলোকে স্থায়ী করা হতো।। একে কিউনিফর্ম লিপি বলা হয়।
ভাবব্যঞ্জকলিপি
এই চিত্রলিপিকে লেখায় পরিণত করতে মানুষের অনেক সময় লেগেছিল, সুমের-এর প্রাচীন অধিবাসীরা তাদের হাঁড়িগুলোর গায়ে একটা-দুটো তিনটে দাগ মেরে বোঝাবার চেষ্টাকরা হতো যে, একটা-দাগওয়ালা হাঁড়িতে বার্লি আছে, দুটো-দাগওয়ালা হাঁড়িতে গম আছে, তিনটে দাগওয়ালা হাঁড়িতে যব আছে। এরপর থেকে একটা-দাগ দেখলেই বুঝে নিতে হতো যে, ওটাতে বার্লি আছে, সমাজে এটাও প্রচলিত হয়ে গেল। এটি চিত্রলিপিরই উন্নততর অবস্থা। এই লেখাকে ভাবব্যঞ্জক লিপি বলা হয়। এই ভাবব্যঞ্জক লিপি প্রচলিত হবার পর ক্রমশ লিপিগুলোর মধ্যে ছবি আঁকার ভাবটা কমে এলো। কোনো জিনিসের পুরো ছবি না এঁকে, তার জায়গায় একটা সংকেত চিহ্ন এঁকেই সেটাকে বোঝানো হতে লাগল। ফলে লেখার মধ্যে কতকগুলো রেখা বা চিহ্ন ব্যবহারের রীতি বাড়তে লাগল। এই ভাবব্যঞ্জক লিপি দিয়ে অনেক বিষয় বোঝানো গেলেও, তখনো পর্যন্ত লেখার সঙ্গে কথা যুক্তি হয়নি।
ধ্বনিলিপি
ভাবব্যঞ্জক লিপিতে ক্রমশ এই ধ্বনি যুক্ত করার চেষ্টা দেখা যেতে লাগল। এইভাবে লেখার ইতিহাসে আরেকটি বিপ্লব ঘটে গেল। মানুষের সমাজে ধ্বনিলিপির উদ্ভব হলো। খ্রিস্ট-পূর্ব তিন হাজার বছরের আগে যেখানে প্রায় ২০০০ চিহ্ন ব্যবহার করতে হতো, সেখানে খ্রি. পূ. ২৫০০ অব্দে দেখা যায় যে মাত্র ৬০০ চিহ্ন ব্যবহার করেই লেখার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে ইংরেজিতে ২৬ টি চিহ্ন দিয়ে এই লেখার কাজটি চালানো হচ্ছে। এর ঠিক বিপরীত হয়েছে চীন দেশে। সেখানে লেখা চিত্রলিপি থেকে ভাব-ব্যঞ্জক লিপি পর্যন্ত এগিয়ে আসবার পর, আর এগোয়নি। ফলে ক্রমশ বেশি চিহ্ন ব্যবহারের প্রচলন আজও পর্যন্ত চীন দেশের আজো রয়ে গেছে।
বর্ণমালার আবিষ্কার
লেখা আবিষ্কারের প্রায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার বছর পরে বর্ণমালার আবির্ভাব ঘটেছিল সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, সিনাই, ক্রিট প্রভৃতি অঞ্চলে, বিভিন্ন ভাষার সমস্ত বর্ণমালাই আদিম এই বর্ণমালা থেকে উদ্ভুত হয়েছিল। তাই পন্ডিতরা আদিম এই বর্ণমালাকে ‘সেমিটিক বর্ণমালা’ বলে অভিহিত করেন। বিকাশের পথে এই বর্ণমালা দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল ‘উত্তর সেমিটিক’ অর্থাৎ উত্তর দিকের সেমিটিক জাতিগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত বর্ণমালা এবং ‘দক্ষিণ সেমিটিক’ বা দক্ষিণ দিকের সেমিটিক জাতিগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত বর্ণমালা।
মিসর এবং মেসোপটেমিয়া এই দুটি প্রাচীন সভ্যতার সেতু ছিল সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইন। যুগের পর যুগ হাজার হাজার বছর ধরে সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনের বুকের উপর দিয়ে মানুষের আসা-যাওয়া চলছিল; ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারিগরি, সভ্যতা-সংস্কৃতির অসংখ্য আদান-প্রদানও এই দুই দেশের বুকের উপর দিয়েই ঘটেছিল। তখন সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনে উত্তর সেমিটিক বর্ণমালা ব্যবহার করা হতো সেই। তাতে মোট বর্ণসংখ্যা ছিল ২২টি। কিন্তু সব কটিই ব্যঞ্জনবর্ণ। পরবর্তীকালে গ্রিকরা এই বর্ণমালা ব্যবহার করতে গিয়ে এর অসম্পূর্ণতা বুঝতে পেরে তাতে স্বরবর্ণ যোগ করেছিল। ভারতে খ্রিস্ট-পূর্ব ৯ম শতাব্দী থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে বর্ণমালার লিপি প্রচলিত হয়েছিল। উত্তর সেমিটিক-এর আরামিকা উপশাখা থেকেই ব্রাহ্মীলিপি গড়ে উঠেছিল।ভারতের বহু বর্ণমালার উৎপত্তি ঘটেছে এই ব্রাহ্মীলিপি থেকে।
ব্রাহ্মীলিপিতে মাত্র ৪৪টি বর্ণের সন্ধান পাওয়া যায়। এর ভেতরে স্বরবর্ণ পাওয়া গেছে ৯টি। এ ব্রাহ্মীলিপি থেকে উদ্ভব হয় নাগরী লিপি। প্রাচীন এই দেব নাগরী লিপির পূর্ব শাখা থেকে ১০ম শতকের শেষভাগে এসে উৎপত্তি হয়েছে বাঙলা লিপির।
বাংলা অক্ষর
অন্যান্য ইংরেজের মতো হ্যালহেড প্রথমদিকে মুনশিদের কাছেই তিনি বাংলা শিখেছেন। এভাবে বাংলা শিখতে গিয়েই একটি বাংলা ব্যাকরণ পুস্তকের প্রয়োজন অনুভব করেন হ্যালহেড। ১৭৭৫-এর শেষে হ্যালহেড সুপ্রিম কোর্টে দোভাষীর কাজ পান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজদেরকে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর প্রয়োজন থেকেই হ্যালহেড একটি ব্যাকরণটি লিখেছিলেন। এটি প্রকাশিত হয় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে, হুগলি থেকে। ছেপেছিলেন চার্লস উইলকিনস। জানা যায়, উইলকিনসের নানা ছিলেন লন্ডনের নামকরা টাইপ নির্মাতা। খুব কাছ থেকে টাইপ তৈরির কাজ দেখার তাঁর পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল। পরে সেই অভিজ্ঞতা বাংলা টাইপের নকশা করার সময় ব্যবহার করেছিলেন। হ্যালহেডের ব্যাকরণের জন্যই প্রথম মুভেবল টাইপ তৈরি করেন চার্লস উইলকিনস। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার। পঞ্চানন কর্মকার খোদাই শিল্পী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। বাংলা ব্যাকরণ রচনায় তাঁর ভূমিকা্র হ্যালহেড এবং বাংলা মুদ্রাক্ষর তৈরির জন্য চার্লস উইলকিনস ও পঞ্চানন কর্মকার-এর নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।