"নোব ইফেক্ট"  প্লাসিব এফেক্ট

মানুষ বারবার বলে যে, আমরা অস্থির সময়ের মধ্যে রয়েছি। এটা অবশ্য ভুল। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এই সময়ে আমরা সবচেয়ে ভালো আছি এবং আগামী দিনগুলোতে মানুষ আরো বেশি ভালো থাকবে। যেমন- এই মুহূর্তে এক লাখ মানুষের মধ্যে হয়তো একজন বন্ধু আরেকজন বন্ধুকে খুন করে ফেলেছে। তাই বলে বাকি ওই এক লাখ বন্ধুদের গল্প তো নিউজ হচ্ছে না, নিউজ তো হচ্ছে ওই এক্সেপশন এক বন্ধুকে নিয়ে। অতীতে এরকম এক্সেপশনাল ঘটনা আরও বেশি হতো, যেটা বর্তমানে মত হাতে হাতে মিডিয়া না থাকার কারণে ওইভাবে প্রকাশ হতো না। 


মানুষ অতীতের চেয়ে বা অমুকের শাসন আমলের চেয়ে, বর্তমানে খারাপ অবস্থায় আছে এমন বিশ্বাস করার কারণ হলো, "নোব ইফেক্ট" । "নোব ইফেক্ট" হলো, এক বা এ্কাধিক হতাশাগ্রস্ত, নেতিবাচক ব্যক্তির দ্বারা সৃষ্ট কোনো বিশেষ প্রভাব। এই মানুষগুলো যখন অসফল হয় বা কোনো হতাশায় ভোগে, তখন তার ভুলগুলোকে অন্যের উপর বা বিশেষ কোনো পরিস্থিতি কিংবা কোনো ঘটনার উপর চাপায়। এই দোষ চাপানোগুলো যখন অন্যকে প্রভাবিত করে, তখন তাকে "নোব ইফেক্ট"  বলে। চিকিতসা ক্ষেত্রে এই "নোব ইফেক্ট"কে নোসিবো ইফেক্ট বলে।  যেমন- মনে করুন, আপনি ডাক্তারের কাছে গেলেন, ডাক্তার সব দেখে বললঃ আপনার কিন্তু হার্টটা ঠিক নেই, একটু যত্ন নেবেন। ব্যাস, তার পরদিন থেকে বুকের সেই জায়গাটায় একটু চিনচিন করবে। যদিও আপনার হার্টে কোন সমস্যা নেই, তারপরও কিন্তু বুক চিনচিন করবে। এটাকে বলে নসিভো এফেক্ট। এর বিপরীতে আছে,  প্লাসিব এফেক্ট। কি এই প্লাসিব? । প্লাসিবো এফেক্ট হলো, যেখানে কোনো রোগী মনে করে যে,  কোনো লতাপাতা বা ঝাড় কুক, তাবিজ-কবজ, জাদু টোনা কিংবা কোনো ওষুধ তাকে সুস্থ কবেছে,; যদিও সেই ব্যবস্থা বা ওষুধটির আসলে কোনো ঔষধিগুণ নেই। কিন্তু রোগীর বিশ্বাস ও ইতিবাচক মানসিকতার কারণে, তার শরীর ও মস্তিষ্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যেমন-  আপনি অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার আপনার শরীরের পরীক্ষা-টরীক্ষা করে বললেন যে, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এমনটা হচ্ছে, আসলে আপনার কিছুই হয়নি, সব ঠিক আছে। তিনি একটা ট্যাবলেট দিয়ে দিলেন; ওর মধ্যে আদ্তে কিচ্ছু নেই; কিন্তু সেটা খেয়ে আপনার মনে হলো, হ্যাঁ এবার ঠিক আছি। এটাকে বলে প্লাসিবো এফেক্ট।


এইরকম পিগম্যালিয়ান ইফেক্ট-এর মাধ্যমে যদি কাউকে বিশ্বাস করানো হয় যে, তুমি ভালো আছো বা তুমি খুব ভালো মানুষ; বা তুমি খুব মেধাবী ছাত্র, তাহলে সে নিজেকে অনেক বেশি ভালো অনুভব করবে, তার ভিতরের ক্ষমতা বেড়ে যাবে এবং ধীরে ধীরে সে উন্নতি করবে। 



রকফেলার ফাউন্ডেশন


তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন — ২৫ বছর বয়সে, তিনি আমেরিকার বৃহত্তম তেল শোধনাগারগুলির মধ্যে একটি পরিচালনা করতেন। ৩১ বছর বয়সে, এটি বিশ্বের বৃহত্তম তেল শোধনাগারের মালিক হয়ে ওঠে এবং ৩৮ বছর বয়সে, তিনি মার্কিন তেল পরিশোধনের ৯০% নিয়ন্ত্রণ করতেন। ৫০ ​​বছর বয়সে, তিনি সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির মর্যালা পান।কিন্তু ৫৩ বছর বয়সে, তার শরীর খারাপ হতে শুরু করে। লিভারে সমস্যার কারণে  খুব একটা খেতে পারতেন না। সর্বদা  যন্ত্রণা এবং বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বাস করতেন। ডাক্তাররা সতর্ক করলেন যে, তিনি হয়তো বেশি দিন বাঁচবেন না। রকফেলার বুঝতে পেরেছিলেন: তার টাকা তাকে বাঁচাতে পারবে না। সুখ, শান্তি  ফিরিয়ে আনতে পারে না। তাই, তিনি তার সঞ্চিত সম্পত্তিকে মানবকল্যানে বিলিয়ে দিতে শুরু করেন। তিনি রকফেলার ফাউন্ডেশন তৈরি করেন এবং এর মাধ্যমে চিকিৎসা, শিক্ষা এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য অর্থায়ন করেন। শুধুমাত্র অতি সামান্য সবুজ শাকসবজি এবং ফলমূল খেয়ে এবং  মজুরের মত পরিশ্রম করেতিনি স্বাস্থ্যের উন্নতি করেন। তিনি ৯৮ বছর বেঁচে ছিলেন।

রকফেলার সেই রহস্য আবিষ্কার করেছিলেন যে, টাকা দিয়ে অনেককিছু কেনা যায় না; পরিশ্রম এবং সঠিক খাবারের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।



সুইস ব্যাংক ও টাইম ব্যাংক’


সুইজারল্যান্ড ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত একটি ছোট্ট রাষ্ট্র, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত নয়। সুইজারল্যান্ডের মুদ্রার নাম সুইস ফ্রাংক।

এটি পৃথিবীর সবচেয়ে স্থিতিশীল মুদ্রা। সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি পৃথিবীর অন্যতম স্থিতিশীল অর্থনীতি। দেশটির রাজনৈতিক অবস্থাও খুব ভারসাম্যমূলক ও সুস্থির। সুইস সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিবছর ১ জানুয়ারিতে এর রাষ্ট্রপতি পরিবর্তিত হয়। ছয় বছরের জন্য গঠিত মন্ত্রিপরিষদের একজন মন্ত্রী পালাক্রমে এক বছরের জন্য রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।


সুইজারল্যান্ড কখনো কোনো যুদ্ধে জড়ায় না। নিরপেক্ষ থাকার বিষয়েই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আর এ জন্যই রাষ্ট্রটিকে অত্যন্ত নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই ব্যাংক ব্যবস্থাও এখানে খুব নিরাপদ। গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা না থাকায় সারাবিশ্বের ধনীদের অর্থ জমানোর জনপ্রিয় উৎস হলো সুইস ব্যাংক। বিশ্বের নানা দেশের রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে বহু বিত্তশালী ব্যক্তি সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন।এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো, অনেকেই গোপনীয়ভাবে টাকা রাখতে গিয়ে তার পরিবারের কাছেও সুইস ব্যাংক বিষয়ক কোনো তথ্য দেন না। ফলে, এমন ব্যক্তির মৃত্যুর পর কেউ জানতেই পারে না যে, তার সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে। সেদেশের নিয়ম অনুসারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি কোনো উত্তরাধিকারী সম্পত্তি দাবি না করেন, তবে সুইস সরকার সে সম্পত্তি তাদের কোষাগারে জমা করেন।ফিলিপিন্সের একসময়ের প্রভাবশালী শাসক মার্কোস তীব্র গণআন্দোলনের মুখে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ক্ষমতা ছাড়ার আগে দেশ থেকে মোটা অঙ্কের ডলার সুইস ব্যাংকে পাচার করেন। তার মৃত্যুর পর এসব ডলার সুইজারল্যান্ডের সরকারি কোষাগারে চলে যায়। একইভাবে লিবিয়ার তৎকালীন শাসক কর্নেল গাদ্দাফি ও মিসরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে।


সরকারিভাবে সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীরা সুইস নামে পরিচিত। রাজধানী বার্ন। অন্যতম দুটি শহর হলো জেনেভা ও জুরিখ। আল্পস পর্বতমালা ও প্রশস্ত হ্রদ সুইজারল্যান্ডকে এক অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভূষিত করেছে। বিশ্বের পর্যটকদের জন্য এটি একটি অন্যতম আকর্ষণীয় দেশ।

ইজারল্যান্ডে সুইস ব্যাংক ছাড়াও আরেক ধরনের ব্যাংক রয়েছে, যার নাম ‘টাইম ব্যাংক’। বিশ্বের আর কোথাও এ ধরনের ব্যাংক আছে বলে আমার জানা নেই। সুইজারল্যান্ডের এ টাইম ব্যাংকিং সিস্টেম আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে। ব্লাড ব্যাংকের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। টাইম ব্যাংক অনেকটাই ব্লাড ব্যাংকের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে। ব্লাড ব্যাংকে যেমন ব্লাড সংরক্ষণ বা জমা রাখা হয়, একইভাবে টাইম ব্যাংকেও টাইম জমা রাখা হয়।


টাইম ব্যাংক মূলত Swiss Federal Ministry of Social Security কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি অবসরকালীন ভাতা প্রকল্প (Old Age Support Programme)। এতে কমবয়সীরা কর্মক্ষম অবস্থায় নিজেদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অসুস্থ বয়স্ক মানুষদের যতটা সময় ধরে সেবা প্রদান করেন, সেই সময়টা টাইম ব্যাংকে জমা থাকে। যেমন- বয়স্ক মানুষের জন্য বাজার ঘাট করা, ঘর দোর পরিষ্কার করা, তার জন্য পুষ্টিকর খাবার তৈরি করা, তাকে রোদে নিয়ে যাওয়া, তার সঙ্গে গল্প করা ইত্যাদি ইত্যাদি যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘Old Age Support’।


টাকা-পয়সার মতো টাইম জমিয়ে রাখার লক্ষ্যে সুইজারল্যান্ডের বেশির ভাগ মানুষ সে দেশের টাইম ব্যাংকে সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাকাউন্ট বা টাইম ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন। এই অ্যাকাউন্টের বিপরীতে উক্ত ব্যাংক তাকে ‘টাইম ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড’ ইস্যু করেন, যা দ্বারা তিনি পরবর্তীতে বার্ধক্য সেবা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।


সুইজারল্যান্ড ধনী দেশ। অবসরকালীন সময় তাদের পেনশনও বেশ ভালো। শেষ বয়সে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের তেমন একটা অসুবিধা হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বার্ধক্যের সময়টা তারা আরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে টাইম ব্যাংকে টাইম জমান। সেবাপ্রদানকারী ব্যক্তি যখন নিজেও বয়োবৃদ্ধ হবেন, আগের মতো নড়াচড়া করতে পারবেন না, তখন তার ক্রেডিট কার্ডের রেফারেন্স দিয়ে টাইম ব্যাংককে দরখাস্ত করলেই তাকে দেখভাল করার জন্য তারা সেবাকর্মী পাঠাবেন।


পঙ্গু স্ত্রীকে শহর দেখানোর ইচ্ছা থেকেই রিকশার আবিষ্কার


রিকশা যদিও প্রথম উদ্ভাবিত হয় জাপানে, তবে এর নকশা করেছিলেন একজন মার্কিন খ্রিস্টান মিশনারি—জোনাথন স্কোবি (বা জোনাথন গোবলে)। পারকার এফ. ক্যালভিনের লেখা "জোনাথন গোবলে ইন জাপান" বইয়ে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

ধর্ম প্রচারের কাজে মি. স্কোবি থাকতেন জাপানের ইয়োকোহামা শহরে। তাঁর স্ত্রী এলিজা গোবলে চলাফেরা করতে পারতেন না। স্ত্রীকে ইয়োকোহামা শহর ঘুরে দেখানোর ইচ্ছা থেকেই ১৮৬৯ সালে তিনি একটি দুই চাকার, সামনের দিকে হাতলযুক্ত একটি বাহনের নকশা করেন এবং কাঠ দিয়ে সেটি তৈরি করেন। এই বাহনের নাম দেন "জিনরিকশা"।

সময়ের বিবর্তনে এই বাহনই "রিকশা" নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। হাতে টানা এই দুই চাকার যানটি যুক্তরাষ্ট্রে প্রাথমিক রিকশা হিসেবে পেটেন্টও পায়।

পরে এই নকশার ভিত্তিতে জাপানে রিকশা তৈরির কাজ শুরু হয়। যদিও প্রথমদিকে এটি মানুষের পরিবর্তে মালপত্র পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হতো।

তবে রিকশার আবিষ্কার নিয়ে আরও কিছু মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ১৮৮৮ সালে আরেকজন মার্কিন ব্যাপ্টিস্ট রিকশা আবিষ্কার করেন। উইলিয়াম ই. লুইসের "থ্রু দ্য হার্টল্যান্ড অব ইউএস" বইয়ে দাবি করা হয়, রিকশার আবিষ্কার হয় ১৮৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ওরচেস্টারে। সেখানে অ্যালবার্ট টোলম্যান নামের এক কামার দক্ষিণ আমেরিকান এক মিশনারির চলাফেরার সুবিধার জন্য এই বাহন তৈরি করেন।

এছাড়া বার্লিংটন কাউন্টি হিস্টোরিকাল সোসাইটির এক গবেষণায় জানা যায়, মার্কিন গাড়ি নির্মাতা জেমস বার্চের জাদুঘরে ১৮৬৭ সালের দিকে এই ধরনের এক রিকশার মডেল প্রথম প্রদর্শিত হয়। মি. বার্চ দাবি করেন, সেটি তাঁরই তৈরি করা নকশা।

তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা



কীভাবে আজকের বাঙালি জাতিসত্তা গড়ে উঠেছে।


প্রায় ৬ হাজার বছর আগে আমাদের এই ভূমিতে প্রথম পা রাখে আদি-অস্ট্রাল জাতিগোষ্ঠী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আসা এই নব্য প্রস্তর যুগের মানুষেরাই ছিল এই অঞ্চলের আদিম অধিবাসী। আমাদের পরিচিত সাঁওতাল, মুণ্ডা, শবর, কোলের মতো আদিবাসী গোষ্ঠীগুলো তাদেরই উত্তরসূরী।

তাদের আগমনের প্রায় এক থেকে দুই হাজার বছর পর, অর্থাৎ প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার বছর আগে দক্ষিণ ভারত থেকে আসেন দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মানুষ।

অনেকে মনে করেন, সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা ছিল এই দ্রাবিড়রা। তারা কৃষিকাজ ও নগর সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দুই আদিম গোষ্ঠীর সংমিশ্রণই আমাদের জাতিগত পরিচয়ের প্রথম ভিত্তি স্থাপন করে।

মধ্য এশিয়ার যাযাবর গোষ্ঠী  শকরা আসে প্রায় ২০০০ বছর আগে আর হুনরা আসে ১৫০০ বছর আগে। তারা স্থানীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে নিজেদের পরিচয়কে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিশিয়ে দেয়।

৩৫০০ বছর পূর্ব  থেকে আর্যদের আগমন শুরু হয়। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা এই গোষ্ঠী তাদের ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে আসে। সময়ের সাথে সাথে আর্য, আদি-অস্ট্রাল ও দ্রাবিড়দের মিশ্রণ ঘটে এবং বাঙালি জাতিসত্তায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব এবং পার্বত্য অঞ্চলে ত্রিপুরা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী  আসে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মঙ্গোলিয়া থেকে। এদের পর গারোরা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে তিব্বত থেকে।

আবার চাকমা ও মারমারা আসেন ৫০০ থেকে ৭০০ বছর আগে, আর ম্রো জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে প্রায় ৬০০ বছর আগে।

দশম শতাব্দী থেকে বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে আসে আরবরা। এদের মধ্যে অনেক পীর, দরবেশ, এবং শাসক ছিলেন।

এরপরে আসে ১৫১৬ খৃষ্টাব্দে পর্তুগিজ, ইংরেজ, আর্মেনীয়দের মতো ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠী। বাণিজ্যিক ও শাসনের প্রয়োজনে তারা এখানে আসে এবং তাদের রক্তের ধারাও বাঙালির সাথে মিশে যায়।

এই দীর্ঘ হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে আজকের বাঙালি জাতি একটি সমৃদ্ধ ও মিশ্র জাতিসত্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আমরা বিভিন্ন সংস্কৃতির এক বিশাল এবং প্রাণবন্ত মেলবন্ধন। 



 সমুদ্রপথে ভারত আবিষ্কার – ভাস্কো দা গামা থেকে কলম্বাস পর্যন্ত


১৫শ শতকের শেষ ভাগে ঘটে যাওয়া সমুদ্রপথ আবিষ্কার মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। তখনকার ইউরোপ ছিল বাণিজ্যে পিছিয়ে থাকা, ছোট ছোট রাজ্য আর অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে জর্জরিত এক মহাদেশ। অন্যদিকে পূর্ব দিক—ভারত, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া—ছিল সমৃদ্ধ বাণিজ্য, মসলা, রত্ন আর উন্নত প্রযুক্তির আধার। তাই ইউরোপীয়দের চোখে ভারত তখন স্বপ্নের দেশ। কিন্তু সমস্যা ছিল একটাই—ওখানে পৌঁছানো। ১৪৫৩ সালে অটোমান তুর্কিরা কনস্টান্টিনোপল দখল করার পর ইউরোপ থেকে পূর্বে যাবার রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তখনই ইউরোপীয় রাজ্যগুলো বুঝতে পারল, টিকে থাকতে হলে নতুন সমুদ্রপথ খুঁজে বের করতেই হবে। তাই ইউরোপীয় শক্তিগুলো এক অদম্য লোভে নেমে পড়ল নতুন সমুদ্রপথ খুঁজে বের করতে। এই অভিযাত্রার দুই বড় নাম—ভাস্কো দা গামা আর ক্রিস্টোফার কলম্বাস। একজন সত্যিই ভারতে পৌঁছালেন, আরেকজন রাস্তা ভুলে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন। ১৪৯৭ সালের জুলাই মাসে পর্তুগিজ অভিযাত্রী ভাস্কো দা গামা লিসবন থেকে চারটি জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।  ১৪৯৮ সালের মে মাসে এসে পৌঁছান ভারতের ক্যালিকটে (আজকের কেরালা)। দা গামার যাত্রার মাধ্যমে ইউরোপ আর ভারতের মাঝে সরাসরি বাণিজ্যের দরজা খুলে যায়। ব্যবসা থেকে বিশাল লাভ বের করে পর্তুগাল একসময় ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। গোয়া, কোচিন, মালাবারের মতো বন্দরগুলোতে পর্তুগিজরা তাদের দুর্গ আর বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলে। 

অন্যদিকে ইতালীয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস, চেয়েছিলেন ভারত পৌঁছাতে। ১৪৯২ সালে স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ আর রানি ইসাবেলা তাঁর যাত্রায় অর্থায়ন করেন। কিন্তু তিনি ভুল পথে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলেন আমেরিকায়। মজার ব্যাপার কলম্বাস ভেবেছিলেন তিনি ভারতেই পৌঁছেছেন। তাই জায়গাটার নাম দেন ইন্ডিজ, পরে ভুল জানার পর নাম দেন  ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের পর শুরু হয় ইউরোপীয় শক্তিগুলোর এক দৌড়।

এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়ে নতুন খাবার, প্রযুক্তি, ভাষা ও ধর্ম। নতুন কাঁচামালের উৎস খুঁজে তারা শিল্পবিপ্লবের পথে এগোয়।

, এই “আবিষ্কার” ছিল দুই ধারী তরবারি। একদিকে এটি বিশ্বকে একসাথে যুক্ত করেছে, নতুন জ্ঞান আর সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে এটি নিয়ে এসেছে ঔপনিবেশিকতা, শোষণ, দাসপ্রথা আর ধ্বংস। 


 সঙ্গীত চর্চার ভাল-মন্দ


আমাদের মস্তিষ্কের দুইপাশে ‘হিপ্পোক্যামপাস’ এবং ‘ফ্রন্টাল করটেকস’ নামের দুটো অংশ স্মৃতি সংরক্ষণের কাজ করে। সংগীতের ছন্দ মেলানো কথা, সুর, বাদ্যযন্ত্র, এবং নৃত্য ; মস্তিষ্কের ডান ও বাম অংশের এই স্মৃতি সংরক্ষণের কোষগুলিতে,  'আলফা ও থিটা তরঙ্গ' উৎপন্ন করে। ফলে মস্তিষ্কের এই  'স্মৃতি কোষগুলির' সক্রিয়তাকে বাড়িয়ে তোলে এবং মনঃসংযোগে সাহায্য করে। স্নায়ুবিজ্ঞানী রবার্ট জ্যাটোর বলেন, ‘ আপনার সংগীত উপভোগের অভিজ্ঞতা যত বেশি হবে, আপনার মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমের কার্যকলাপ তত বেশি সংঘটিত হবে। বর্তমানে নিউরোসায়েন্সে সংগীতকে ওষুদের বিকল্প হিসেবে দেয়া হয়। কোমা বা মৃতপ্রায় মস্তিষ্কের চিকিৎসায় রোগীদের কানে মিউজিক থেরাপি দেয়া হয়। আলঝেইমার্স রোগের একমাত্র চিকিৎসা এখন সংগীত।  এমনকি বর্তমানে অটিজম চিকিৎসা এবং পুরোনো স্মৃতি ফেরাতে ডাক্তাররা মিউজিক থেরাপি দেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ছোটবেলা থেকে সংগীত চর্চার সুযোগ পায়, তাদের স্মরণশক্তি, মনোযোগ এবং শেখার ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি হয়। অর্থাৎ শিশুর স্মরণশক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সংস্কৃতিচর্চা যেমন সংগীত, নাচ, খেলাধুলা, নাটক, বিতর্ক ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্ব রাখে।  সঙ্গীত চর্চা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে থাকলেও, সরকারি স্কুলে নাই। মেধাবী আমলারা বিষয়টি যথার্থ উপলব্দি করেছেন।  শিশুরা সঙ্গীত শিখলে তাদের গণিতের দক্ষতাও বাড়ে। আল রাজির মত আলেম এই কারণেই সঙ্গীত সম্পর্কেও অনেক বড় জ্ঞানী ছিলেন। বলতে কি, মধ্যযুগের বহু বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত সঙ্গীতের জ্ঞান আর গণিতের জ্ঞানের এই আন্তসম্পর্ক বিষয়ে জানতেন। তারের বাদ্যযন্ত্রের বিকাশে মধ্যযুগের, এবং বিশেষ করে স্পেনের গণিত জানা মুসলমানদের ভূমিকা ছিল। .... ভাষার ব্যবহার, স্মরণশক্তি বিকাশ এগুলোতেও ছড়া বা গান ভূমিকা রাখে। বিশেষকরে শিশুদের সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি করতেও এর গুরুত্ব আছে। সঙ্গীতের জ্ঞানকে অবশ্যই শিশুশিক্ষায় বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। সন্তানের সৃজনশীলতা বিকাশ নিয়ে আগ্রহী যে কোন অভিভাবকেরও উচিত এই বিষয়ে তৎপর হওয়া।.. 



প্রতিহিংসা  নতুন অশান্তির ভিত্তি গড়ে তোলে


প্রতিহিংসা শান্তি আনে না; বরং নূতন অশান্তির ভিত্তি গড়ে তোলে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিশোধ স্পৃহা  পোষণ করলে মানসিক স্বাস্থ্য দুর্বল হয়; উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং আত্মঅহংকার বাড়তে থাকে। দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিহিংসার চিন্তা লালন করে, সে নিজেই নিজের শুকানো ক্ষতকে খোচিয়ে গভীর ঘা করেতোলে। 


দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তার হাতে ছিল প্রতিশোধ নেবার পূর্ণ রাজনৈতিক সুযোগ ও সামর্থ্য। অথচ তিনি সেই পথ ত্যাগ করে গঠন করেন ' মানবিক কমিশন', যার উদ্দেশ্য ছিল মানবিক পুনর্মিলনের মধ্য দিয়া এক নূতন রাষ্ট্র নির্মাণ। চল্লিশ বছর দমনপীড়নের পরও তিনি প্রতিপক্ষের প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণ হন নাই। বরং বলেছিলেন-'যদি আমি হৃদয়ে ঘৃণা বহন করি, তা হলে আমি আজীবন বন্দীই থাকব।' তার সেই উদার নৈতিকতার ফলেই দক্ষিণ আফ্রিকা ভাতৃত্ব ও শান্তির নতুন দেশ হিসেবে পরিচিত পায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির উপর কঠোর প্রতিশোধ হিসেবে বিভিন্ন শর্ত চাপানো  ও তীব্র হেনস্তার কারণে পরবর্তীকালে নাৎসিবাদের পুনর্জাগরণ এবং আরেকটি মহাযুদ্ধের জন্ম হয়। অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের উপর মার্কিনদের বোমাবর্ষণের পর তাদের প্রতি প্রতিহিংসার পরিবর্তে জাপান দেশ পুনর্গঠনের জন্য মার্কিন 'মার্শাল প্ল্যান'-গ্রহন করে । আজ সেই জাপান অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও উন্নয়নের সব ক্ষেত্রেই এক উদাহরণ। 



পুরুষ জলহস্তী কেন নিজ ছেলেকে হত্যা করে? 


প্রায় ২৪৩ দিন গর্ভধারণ শেষে একটি জলহস্তী মা জন্ম দেয় তার সন্তানকে। কিন্তু যদি সন্তানটি ছেলে হয়, তখন বাবা জলহস্তী সন্তানকে মেরে ফেলার জন্য সর্বদা ওত পেতে থাকেন। পিতার আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষার জন্য পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সর্বক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখে। জলহস্তী পরিবারে ৬-১০টি সদস্য থাকে। এর মধ্যে মাত্র একজনই পুরুষ, বাকিরা নারী। পুরুষটি পুরো দলের একক 'রাজত্ব করার জন্য অন্য  কোনো পুরুষকে সহ্য করতে পারে না। যদি মা ও পরিবার সন্তানের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়, একদিন বড় হয়ে সে-ই হয়তো ক্ষমতা কেড়ে নেয়। 

জানলে অবাক হবেন~~

একবার ভাবুন প্রায় ২৪৩ দিন গর্ভধারণ শেষে একটি জলহস্তী মা জন্ম দেয় তার সন্তানকে। কিন্তু যদি সন্তানটি ছেলে হয়, তবে শুরু হয় এক নি*ষ্ঠু*র বাস্তবতা। বাবা জলহস্তীই হয়ে ওঠে তার প্রা*ণ*না*শে*র জন্য সবচেয়ে বড় হু*ম*কি!

মায়ের অশান্তি ও পরিবারের সতর্ক পাহারা:

ছেলে সন্তান জন্মের পর পরিবারজুড়ে তৈরি হয় এক অজানা আ*ত*ঙ্ক। পিতার আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষার জন্য পরিবার তাকে সর্বক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখে। কারণ, পিতা সারাক্ষণ খুঁজে ফেরে সুযোগ—নিজ সন্তানকে প্রা*ণে মে*রে ফেলার।

জলহস্তীর সমাজব্যবস্থা:

ডাঙায় বসবাসকারী প্রাণীদের মধ্যে জলহস্তী আকারে তৃতীয় বৃহত্তম। সাধারণত এক একটি দলে ৬-১০টি সদস্য থাকে, যার মধ্যে মাত্র একজনই পুরুষ, বাকিরা নারী। পুরুষটি পুরো দলের একক শাসক—তার 'রাজত্ব' অক্ষুণ্ণ রাখাই তার প্রধান লক্ষ্য। তাই দল বা হেরেমে আর কোনো পুরুষকে সে সহ্য করতে পারে না।

তাই যদি সন্তান ছেলে হয়...

পুরুষ জলহস্তী ভাবে—এই ছোট ছেলেটিই ভবিষ্যতে তার জন্য রাজনৈতিক হুমকি। একদিন বড় হয়ে সে-ই হয়তো ক্ষমতা কেড়ে নেবে। তাই জন্মের পরপরই সুযোগ পেলেই ছেলেকে হ**ত্যা করে ফেলে। বিশেষ করে, যদি সন্তান বাবার সামনে আত্মসমর্পণ না করে বা বশ্যতা না মানে।

যদি বেঁচে যায়...

যদি মা ও পরিবার সন্তানের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়, তবে অনেক ক*ষ্টে লুকিয়ে তাকে বড় করতে হয়। তবে এক সময় সেই সন্তান বড় হয়ে বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তখন শুরু হয় পিতা-পুত্রের র*ক্ত*ক্ষ*য়ী লড়াই, যার শেষ হয় হয় কারও মৃ*ত্যু*তে, নয়তো দল ত্যাগে।

এমন প্রবণতা শুধু জলহস্তীতেই নয়...

প্রকৃতির আরো কিছু প্রাণীর মধ্যেও এমন আচরণ দেখা যায়। তবে জলহস্তীদের মধ্যে এই ছেলেশিশু হত্যার প্রবণতা সবচেয়ে প্রকট।



ইনকা সভ্যতা  


ইনকা সাম্রাজ্যের উত্থান হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার আন্দেস পর্বতমালায়। বর্তমান পেরু, বলিভিয়া, চিলি, ইকুয়েডর ও আর্জেন্টিনার কিছু অংশ জুড়ে ছিল এই বিশাল সাম্রাজ্য। রাজধানী ছিল কুসকো, যাকে তারা "বিশ্বের নাভি" বলত। ইনকাদের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাদের সংগঠিত প্রশাসন। এক বিশাল পর্বতশ্রেণীজুড়ে বিস্তৃত সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য তারা নির্মাণ করেছিল সড়কব্যবস্থা – প্রায় ২৫,০০০ মাইল লম্বা পথ, যা রোমানদের সড়কব্যবস্থাকেও টেক্কা দিত। এই রাস্তার মাধ্যমে বার্তা পৌঁছে যেত চাস্কি নামের দৌড়বিদদের মাধ্যমে।

ইনকাদের সবচেয়ে বিস্ময়কর সাফল্য ছিল কৃষি। খাড়া পাহাড়কে ধাপে ধাপে কেটে চাষযোগ্য জমি বানানো হয়েছিল। তারা আলু, ভুট্টা, কুইনোয়া চাষে দক্ষ ছিল। ইনকাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে ছিল সূর্যদেব ইন্তি। তাদের প্রধান মন্দির কোরিকানচা ছিল সোনার প্রলেপে মোড়ানো। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অনেক সময় মানব বলিও দেওয়া হতো, বিশেষ করে শিশুদের, যাদের পাহাড়ের চূড়ায় উৎসর্গ করা হতো দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য।

ইনকাদের সমাজ ছিল অত্যন্ত সংগঠিত। কর ব্যবস্থার বদলে তারা শ্রম দিত, যাকে বলা হতো মিত্তা সিস্টেম। জনগণকে কৃষিকাজ, সড়ক নির্মাণ বা সামরিক কাজে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নিতে হতো। ১৫৩২ সালে ফ্রান্সিসকো পিজারোর নেতৃত্বে স্প্যানিশরা ইনকা সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে। ইউরোপীয়দের সঙ্গে আনা গুটি বসন্ত রোগ, উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ইনকাদের শেষ করে দেয়। শেষ সম্রাট আতাহুয়ালপা বন্দি হয়ে নিহত হন।


অ্যাজটেক সভ্যতা  


অন্যদিকে, উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল অ্যাজটেক সভ্যতা। তাদের রাজধানী টেনোচটিটলান ছিল এমন এক শহর, যা আজকের মেক্সিকো সিটির ভেতরেই লুকিয়ে আছে। ১৪শ শতকে লেকের মাঝখানে দ্বীপের ওপর নির্মিত এই শহর ছিল প্রকৌশল কীর্তি।

অ্যাজটেকরা কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করেছিল, যাকে বলা হয় চিনাম্পাস। এগুলো ভাসমান কৃষিজমি, যা লেকের পানিতে মাটি ভরে বানানো হতো। এর ফলে তারা বছরে একাধিক ফসল তুলতে পারত। অ্যাজটেক সভ্যতার সবচেয়ে আলোচিত ও ভয়ঙ্কর দিক ছিল মানব বলিদান। তাদের বিশ্বাস ছিল, সূর্য দেবতাকে শক্তি জোগাতে হলে মানুষের রক্ত প্রয়োজন। এজন্য যুদ্ধে বন্দি শত্রুদের মন্দিরে এনে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হতো। ইতিহাসবিদদের মতে, একেকবার উৎসবে হাজার হাজার মানুষকে বলি দেওয়া হতো।

অ্যাজটেকদের সমাজ ব্যবস্থা ছিল সামরিক শক্তিনির্ভর। সম্রাট ছিলেন সর্বোচ্চ শাসক, তবে পুরোহিত শ্রেণি বিশাল প্রভাব রাখত। তাদের অর্থনীতি নির্ভর করত বাণিজ্য ও কৃষির ওপর।  ১৫১৯ সালে হার্নান কোর্তেজ নেতৃত্বাধীন স্প্যানিশরা মেক্সিকোয় প্রবেশ করে। ইউরোপীয় অস্ত্র, ঘোড়া, এবং গুটি বসন্তের মহামারির কারণে অ্যাজটেকরা দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৫২১ সালে শেষ সম্রাট মোন্টেজুমা নিহত হন এবং অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।




জমিদারি প্রথা 


জমিদারি প্রথা বিলোপ করা হয়েছিল ‘স্টেট অ্যাকুজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০-এর মাধ্যমে। কার্যকর করা হয়েছে ১৯৫১ সনের ১৬ মে থেকে। প্রখ্যাত লেখক বদরুদ্দীন উমর তার ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘জমির ওপর রাষ্ট্র অথবা জমিদার জাতীয় কোন শ্রেণির দখলী স্বত্ব মোগল আমলে ছিল না। জমির সত্যিকার মালিক তখন ছিল তারাই, যারা নিজেরা গ্রামে কৃষি কার্যের দ্বারা ফসল উৎপাদন করতো। সে সময় যাদেরকে জমিদার বলা হতো, তারা ছিল সরকারের রাজস্ব আদায়ের এজেন্ট মাত্র, তারা জমির মালিক নয়।’ সুতরাং দেখা যায় মোঘলদের সময় বা তার পূর্ববর্তী শাসনামলেও বাংলায় প্রচলিত অর্থে কোনো জমিদার ছিল না। জমির মালিক ছিল কৃষক। সে সময় জমির মালিকদের বলা হতো রায়ত বা চাষি। 


ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে একটি অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গাকে ভাগ করে করে বছরে খাজনা প্রদানকারী এক ধরনের ভূস্বামীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হতো। এসব ভূস্বামীরাই সমাজ ব্যবস্থায় ‘জমিদার’ নামে পরিচিত হয়ে উঠে। জমিদারেরা তাদের প্রজাদের কাছ থেকে ইচ্ছামত কর আদায় করতে পারতো। এই সুযোগ ব্যবহার করে তৎকালীন জমিদারেরা শোষণ নিপীড়নের প্রতীক হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। অনেক সাধারণ প্রজা জমিদার শ্রেণির রোষানলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছে এরকম উদাহরণ প্রচুর। তবে এটাও সত্য যে, এই জমিদার শ্রেণি দ্বারা এখানে শিক্ষার বিস্তার হয়েছে ব্যাপক।


 লর্ড কর্নওয়ালিশ  ইংল্যান্ডের জমিদার পরিবার থেকে এসেছিলেন। তিনি ১৭৯০ সালে জমিদার শ্রেণি তৈরির উদ্দেশ্যে দশশালা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, যা ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিবর্তিত হয়।  লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর মাধ্যমে জমিদারদের করে দেয়া হলো জমির মালিক , অথচ এই জমিদারেরাই একসময় ছিল খাজনা আদায়ের এজেন্ট মাত্র। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বর্তমানে বাংলাদেশে ১৯৫০ সনের পূর্বে জমিদারি প্রথা বিদ্যমান ছিল। ১৯৪৭ সনে ব্রিটিশ সরকার বিতাড়িত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে ১৯৫০ সনে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও প্রজাদের স্ব-স্ব ভূমিতে মালিকানা অর্জনের আইন পাস হয়। যা রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এখনো রয়ে গেছে জমিদারি প্রথা।



 ক্লিনিং স্প্রে বা বাড়ী ঘর ধোয়া-মোছা


নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব বার্গেনের গবেষকরা বিশ বছর ধরে ছয় হাজারেরও বেশি মানুষের উপর একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা চালান। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ক্লিনিং স্প্রে বা বাড়ী ঘর ধোয়া-মোছা বা পরিষ্কার করেন, বিশেষ করে নারীরা, তাদের ফুসফুসের কর্মক্ষমতা অন্যদের তুলনায় দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতি এতটাই হয় যে, যেটা প্রতিদিন এক প্যাকেট সিগারেট একটানা কুড়ি বছর ধরে খাওয়ার সমান। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে হাঁপানির ঝুঁকিও অনেক বেশি হয়। গবেষকরা মনে করছেন, ক্লিনিং কেমিক্যালের রাসায়নিক পদার্থ ঘরের ধুলো-বালি বা ময়লায় থাকা ব্যাকটেরিয়া শ্বাসনালিতে বারবার জ্বালা ও প্রদাহ সৃষ্টি করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রদাহ স্থায়ী ক্ষতিতে রূপ নেয়, যা ধীরে ধীরে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। 



মানবজাতির সেরা অর্জন 

ভ্যাকুয়াম টিউব থেকে আজকের সেমিকন্ডাক্টর চিপ


১৯৪৩ সালের মার্চ মাসের কথা। তখন একদিকে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আর অন্যদিকে উত্তর আটলান্টিক কাঁপছে ঝড়ো হাওয়া আর বরফ শীতল ঢেউয়ে। এই ভয়াবহ আবহাওয়ার মধ্যে কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে এক ঝাঁক জাহাজ রওনা দিয়েছে ইংল্যান্ডের লিভারপুলের উদ্দেশ্যে। এই বহরে ছিল ৪০ টিরও বেশি জাহাজ, আর জাহাজগুলো বোঝাই ছিল শস্য, তেল, কাঁচামাল, যুদ্ধের সরঞ্জাম দিয়ে। হিটলারের ভাষায় এই বহরটা ছিল ব্রিটেনের ‘লাইফলাইন’। কারণ ব্রিটেন সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর একটা দ্বীপরাষ্ট্র। এই জাহাজগুলো ইংল্যান্ডে না পৌঁছালে ব্রিটেনের খাদ্যভাণ্ডার দ্রুতই খালি হয়ে যাবে।

কিন্তু ভাগ্য সেদিন ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল না, গভীর সমুদ্রের অন্ধকারে ওঁত পেতে ছিল জার্মানির সাবমেরিন। তবে একটা সাবমেরিন নয়, প্রায় ৩০টিরও বেশি সাবমেরিন মিলে তৈরি হয়েছিল এক বিশাল “উলফপ্যাক”। রাত নামতেই তারা নেকরের মতো একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়বে ব্রিটিশ নৌবহরের ওপর। ব্রিটিশ এসকর্ট জাহাজগুলো সেদিন মরিয়া হয়ে প্রতিরোধ করছিল; ডেপথ চার্জ ছুড়ে সাবমেরিন ধ্বংসের চেষ্টা করছিল। কিন্তু জার্মান সাবমেরিনগুলো সংখ্যায় এত বেশি ছিল যে সবগুলো আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ফলে মাত্র দুই রাতের মধ্যেই বহরের ২১টি জাহাজ ডুবে যায়। হাজার হাজার টন খাবার, তেল, কাঁচামাল হারিয়ে যায় সমুদ্রগর্ভে। শত শত নাবিক প্রাণ হারায় ঠান্ডা পানিতে।

জার্মানির এই সাবমেরিন আক্রমণ শুরু হয়েছিল এই ঘটনার আরও অনেক আগে। একটা পর্যায়ে একের পর এক ব্রিটিশ জাহাজ ডুবিয়ে দিতে থাকে জার্মান সাবমেরিনগুলো। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়টা এসেছিল ১৯৪২ সালে। জার্মানি তখন এমন গতিতে জাহাজ ডুবাচ্ছিল যে, নতুন জাহাজ তৈরি করার আগেই আগের জাহাজগুলোকে আর সমুদ্রের বুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।


ঘন ঘন সাবমেরিন আক্রমণের ফলে ১৯৪২ সালের শেষের দিকে এসে ব্রিটেনের গমের মজুত প্রায় শেষ হয়ে আসে। একটা পর্যায়ে মাত্র ছয় সপ্তাহের গম অবশিষ্ট ছিল ব্রিটেনেরা হাতে। যদি এই অবস্থা কয়েক মাস চলে তাহলে বাজারে আর কোনো খাবারই পাওয়া যাবে না। না খেয়ে মারা যাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ। যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের আগেই খাবারের অভাবে ব্রিটেন হয়তো আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। আসলে ব্রিটেনের বেঁচে থাকার জন্য খাবার, তেল, অস্ত্র, কাঁচামাল সবকিছুই আসতো অ্যামেরিকা, কানাডা এবং অন্যান্য উপনিবেশ থেকে—সমুদ্রপথে। জার্মানির পরিকল্পনা ছিল এই জাহাজগুলো ডুবিয়ে ব্রিটেনকে শ্বাসরোধ করে দেওয়া—যেন খাবার ফুরিয়ে যায়, শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, যুদ্ধ চালানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে ব্রিটেন। হিটলারের ভাষায় এটাকে বলা হতো ব্রিটেনের ‘লাইফ লাইন কেটে ফেলা’। ব্রিটেন যদি খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না করতে পারে, তাহলে যুদ্ধে হেরে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। 


কিন্তু জার্মানির এই সাবমেরিন আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো সহজ উপায় ছিল না। জার্মানি যে সাবমেরিনগুলো  দিয়ে ব্রিটিশ জাহাজ আক্রমণ করত সেগুলোর নাম ছিল ইউ-বোট। এই ইউ-বোটগুলো চলত একটা গোপন নির্দেশনা অনুযায়ী। জার্মানরা এমন একটা মেশিন তৈরি করেছিল যে মেশিনের সাহায্যে এক ধরনের গুপ্ত সংকেত বা কোড তৈরি করা যেত। এই মেশিনটি ছিল অ্যাটলান্টিক যুদ্ধে জার্মানির সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এটার নাম ছিল এনিগমা মেশিন। জার্মান নৌ-অফিসাররা প্রতিদিন এনিগমা মেশিন ব্যবহার করে দুইটা গোপন বার্তা পাঠাত। একটা বার্তা যেত অ্যাটলান্টিকে থাকা ইউ-বোটগুলোর কাছে এবং আরেকটা বার্তা যেত স্থলভাগ থাকা সদর দপ্তরে। এই গোপন বার্তার সাহায্যে জানানো হতো—ব্রিটেন এবং তাদের মিত্রবাহিনীর কোন কোন কনভয় কোথায় যাচ্ছে, কতগুলো জাহাজ আছে, আর কোন “উলফপ্যাক” সাবমেরিন আক্রমণের জন্য একত্র হবে। এনিগমা মেশিনের সাহায্যে প্রতিদিন নতুন সংকেত তৈরি করা হতো বলে মিত্রবাহিনী এই বার্তাগুলো পড়তে পারত না। ফলে ইউ-বোটগুলো কোথায় আছে সে সম্পর্কে মিত্র বাহিনী ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ইউ-বোটগুলো যেন হঠাৎ করেই আটলান্টিকের বিশাল সমুদ্র থেকে ভুতের মতো উঠে এসে আক্রমণ করত।

সহজভাবে বললে: এনিগমা মেশিনের কারনে জার্মানির ইউ-বোটগুলো জানত যে ব্রিটিশ কনভয় কোথায় আছে, কিন্তু ব্রিটিশরা জানত না যে ইউ-বোটগুলো কোথায় আছে।


ব্রিটেন এবং মিত্রবাহিনী বুঝতে পারল—এই কোড না ভাঙ্গতে পারলে জার্মানির সাথে পেরে উঠা অসম্ভব। কিন্তু সমস্যাটা ছিল খুব জটিল। জার্মানরা মেশিনের সাহায্যে এমন জটিল কোড তৈরি করেছিল যে অনেকেই তখন বলেছিল—এই কোড ভাঙ্গা অসম্ভব। আর একটা কোড ভাঙতে পারলেও কোনো লাভ নেই। কারন, জার্মানরা এনিগমা মেশিন ব্যবহার করে প্রতিদিনই তাদের কোডের ধরণ বদলে ফেলত। পরের কোডটা হতো সম্পূর্ণ আলাদা। মাঝে মাঝে একই দিনে তারা দুই বা তিন ধরনের কোডও ব্যবহার করত। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছিল। 

এখন জার্মান আক্রমণ থেকে বাঁচার একটা মাত্র উপায়ই আছে। সেটা হলো—জার্মানরা যে মেশিন ব্যবহার করে দ্রুত কোড তৈরি করছে, তার চেয়েও আরও শক্তিশালী একটা মেশিন তৈরি করে কোড পাওয়ার সাথে সাথেই নতুন কোড ভেঙ্গে ফেলা।  

দেশের এই সংকটের মুহূর্তে কাজে নেমে পরে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা Government Code and Cypher School (GC&CS)। তখন GC&CS-এর প্রধান ছিলেন অ্যালেস্টার ডেনিস্টন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাদের পুরো গোয়েন্দা বিভাগ একসাথে কাজ করলেও এই জটিল কোড ভাঙ্গা সম্ভব নয়। এজন্য তিনি অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের কাছে চিঠি পাঠালেন—যাতে তারা দেশের সেরা মেধাবী গণিতবিদ আর যুক্তিবিদদের একটা তালিকা তাদের অফিসে পাঠায়।


সেই তালিকায় উঠে আসে এক তরুণ প্রতিভাবান গণিতবিদ। নাম তার অ্যালান টিউরিং। তখন তার বয়স মাত্র ২৭ বছর। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ “Universal Machine” তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এই Universal Machine-কেই আজ আমরা টিউরিং মেশিন বলি। যুদ্ধ শুরুর পর ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টিউরিংকে ব্লেচলি পার্কের একটি গোপন দলে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পাঠানো হয়।

অ্যালান টিউরিং যখন প্রথম দিন ব্লেচলি পার্কে হাজির হলেন, তখন গোটা জায়গাটাকে মনে হচ্ছিল যেন রহস্যে মোড়া একটা সামরিক ঘাঁটির মতো। সেখানে প্রবেশের আগে তাঁকে কঠোর গোপনীয়তার অঙ্গীকারে সই করতে হয়। টিউরিং দেখলেন, সবাই স্যুট-টাই পরে সামরিক বাহিনীর মতো গম্ভীর ভঙ্গিতে হাজির হয়েছে।


কিন্তু টিউরিং ঢুকলেন একখানা পুরোনো সাইকেল চালিয়ে। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলছে একটা গ্যাসমাস্ক। তখন জার্মানদের বোমাবর্ষণের ভয়ে লন্ডন থেকে বেরোনো লোকদের মধ্যে গ্যাসমাস্ক বহন করা ছিল সাধারণ ব্যাপার। তবে টিউরিংয়ের স্টাইল ছিল একেবারেই ভিন্ন। তাঁর পোশাক ছিল বেশ অগোছালো, চুল ছিল এলোমেলো, মুখে গম্ভীর অথচ একটু অন্যমনস্ক ভাব। কিন্তু প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দলের সবাই বুঝে ফেলল যে, জার্মানদের বিরুদ্ধে কোড ভাঙ্গার যুদ্ধে এই মানুষটিই তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে উঠবে।


প্রথম দিন কাজ করার পরই টিউরিং আর তাঁর সহকর্মীরা বুঝতে পারলেন যে, শুধু মানুষের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে হাতে কলমে হিসাব কষে এনিগমা মেশিনকে হারানো সম্ভব নয়। কারণ এনিগমার সেটিংস প্রতিদিন বদলাত, আর এর ফলে তৈরি হতো বিলিয়ন বিলিয়ন সম্ভাব্য আউটপুট। এত বিশাল জটিলতার সামনে মানুষের গতি খুবই ধীর। তাদের দরকার ছিল কোড ভাঙ্গার যুক্তিকে যান্ত্রিক করে তোলা।

ক্রিপ্টোগ্রাফিকে শুধু মানসিক দক্ষতা হিসেবে না দেখে তাদের এখন এমন একটা যন্ত্র তৈরি করতে হবে, যা নির্দিষ্ট কিছু লজিক বা যৌক্তিক নির্দেশনা বারবার চালাতে পারবে। আর এই কাজটা করার জন্য তাদের দরকার ছিল একটা প্রোগ্রামেবল কম্পিউটার। এই কম্পিউটারটা নির্দিস্ট কিছু যৌক্তিক নির্দেশনা মেনে বার বার একই কাজ করতে যেতে থাকবে ঘন্টার পর ঘন্টা। এটাই ছিল আধুনিক প্রোগ্রামিংয়ের সূচনালগ্ন। 


জার্মানির এনিগমা কোড ভাংগার জন্য ট্যুরিংয়ের নকশা অনুযায়ী তৈরি করা হয় বোম্বে মেশিন । এটা ছিল এক ধরনের বিশালাকার ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল মেশিন। এই যন্ত্রে শত শত ঘূর্ণমান ড্রাম আর ‘রিলে’ বা যান্ত্রিক সুইচ বসানো ছিল। এনিগমার সম্ভাব্য সেটিংসগুলোকে এটি দ্রুত পরীক্ষা করতে পারত। জার্মানির কোড ভাঙ্গার জন্য ট্যুরিং “ক্রিব” নামের একটি কৌশল ব্যবহার করতেন। এক্ষেত্রে টুরিং ধরে নিতেন যে, জার্মানির পাঠানো বার্তার ভেতরে কিছু শব্দ বা বাক্যাংশ প্রায় নিশ্চিতভাবেই আছে, যেমন: “Heil Hitler”। এবার এই অনুমান থেকে শুরু করে বোম্বে মেশিন সম্ভাব্য কম্বিনেশনগুলো একে একে বাতিল করত, যতক্ষণ না সঠিক কী পাওয়া যায়। একবার সঠিক কী পেয়ে গেলে সেই কোড ভাঙ্গা তুলনামূলক সহজ হয়ে যেত।


কিন্তু যুদ্ধ চলতে চলতে জার্মানরা আরও উন্নত কোড চালু করে। এই কোডের নাম ছিল Lorenz cipher। এই কোড এনিগমার থেকেও ভয়ংকর। ফলে এই কোড ভাঙ্গার জন্য বোম্বে মেশিন যথেষ্ট ছিল না। তখনই আসে ইতিহাস বদলে দেওয়া এক আবিষ্কার: কলোসাস।

কলোসাস তৈরি করেছিলেন প্রকৌশলী টমি ফ্লাওয়ার্স। এটা ছিল বিশ্বের প্রথম electronic programmable computer। এখানে রিলে বা ঘূর্ণমান ড্রামের বদলে ব্যবহৃত হতো হাজার হাজার ভ্যাকুয়াম টিউব। নতুন এই যন্ত্রটি অসাধারণ দ্রুতগতিতে গণনা করতে পারত। কলোসাসকে প্রোগ্রাম করা যেত সুইচ আর পাঞ্চড টেপ দিয়ে। এই মেশিনের গতি এতটাই বেশি ছিল যে, আগে যেখানে মাস লেগে যেত কোড ভাঙতে, সেখানে এখন কয়েক ঘন্টার ভেতরে কোড ভাঙা সম্ভব হলো।


এই আবিষ্কারের ফলাফল ছিল নাটকীয়। মিত্রবাহিনী হঠাৎ করেই জার্মান বাহিনীর সকল মেসেজ পড়তে শুরু করে। জার্মানির ইউ-বোটগুলো কোথায় ওঁত পেতে আছে, জার্মান জেনারেলরা কী নির্দেশ দিচ্ছে—সব ধরা পড়ছিল রেডিওতে। ইতিহাসবিদদের অনুমান, এই কোড ভাঙার সাফল্য যুদ্ধকে অন্তত দুই বছর কমিয়ে দিয়েছিল। প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল অন্তত কয়েক লাখ মানুষ।

তবে ইংল্যান্ডের ব্লেচলি পার্কের এই গোপন দলটি ছাড়াও পৃথিবীর আরেকটা জায়াগায় কম্পিউটার জিনিসটার খুব দরকার ছিল। ওই সময় ব্রিটিশদের মতো মার্কিন সেনাবাহিনীর সামনেও ছিল একটা ভয়াবহ সমস্যা। গোলন্দাজ কামানের ফায়ারিং টেবিল আর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ কীভাবে নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যায় তা নিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর তখন ঘুম হারাম। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আটলান্টিকের ওপারেও কম্পিউটারের জন্ম হচ্ছিল এই যুদ্ধক্ষেত্রের চাহিদা থেকেই।  


যুদ্ধের আগে পর্যন্ত এইসব কাজ করতেন “হিউম্যান কম্পিউটার” নামে পরিচিত একদল মানুষ। এদের বেশিরভাগই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত নারী। এরা হাতে-কলমে অঙ্ক কষে ফলাফল বের করতেন। কিন্তু সমস্যাটা ছিল গতি নিয়ে।  কামান, রকেট বা দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। এজন্য হিসাবের মধ্যে ধরতে হয় বাতাসের গতি, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, এমনকি পৃথিবীর বক্রতাঁকেও। ফলে প্রতিবার নতুন পরিস্থিতির জন্য তৈরি করতে হতো আলাদা আলাদা হিসাব। আর সেই হিসেব শেষ করতে অনেক ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টাও লেগে যেত। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে এত ধীরগতি মানেই পরাজয়।


এই বাস্তব সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে জন্ম নিল ENIAC নামের এক কম্পিউটার। ১৯৪৫ সালে এই কম্পিউটার তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। এই কম্পিউটারটিকেই আমরা এখন সাধারণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার উপযোগী প্রথম ইলেকট্রনিক কম্পিউটার বলি। তবে নামটা যাই হোক না কেন, এই কম্পিউটারের জন্ম মূলত সামরিক প্রয়োজনে।  মার্কিন সেনাদের কামান চালনা আর পরবর্তীতে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির গণনা আরও দ্রুত ও সঠিক করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল এই কম্পিউটার।


ENIAC কম্পিউটারের আকার ছিল বিশাল, ওজন প্রায় ৩০ টন। এর মধ্যে ছিল ১৮,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব। আর পুরো একটি হলঘর জুড়ে ছিল এই কম্পিউটারের তার ও যন্ত্রাংশ। এই মেশিনটি চালু করার সময় এত বিদ্যুৎ লাগত যে আশেপাশের শহরের আলো এক মুহূর্তের জন্য কমে যেত। কিন্তু এর ক্ষমতা ছিল অভাবনীয়। সেই সময়ের মানুষের হাতে করা হিসাবের চেয়ে অন্তত কয়েক হাজারগুণ বেশি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয়ের পেছনে বেশ বড় অবদান ছিল কম্পিউটারের। প্রথমত, এনিগমা আর লরেঞ্জ কোড না ভাঙ্গা গেলে গোটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই হয়ত আরও দুই বছর দীর্ঘ হতো। যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগেই চালু হয় ENIAC। এটি পরমাণু বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রোগ্রামে কাজে লাগে। পারমাণবিক বোমার কারনেও যুদ্ধে মিত্রশক্তি অনেকখানি এগিয়ে ছিল। পাশাপাশি ব্রিটিশ রাডার সিস্টেম পরিচালনায় প্রচুর গণনা করতে হতো। সেখানে ব্যবহার করা হতো অ্যানালগ কম্পিউটার। বিটিশরা বোমার ট্রিজেকটরি বের করতেও প্রাথমিক যুগের কম্পিউটারগুলো ব্যবহার করেছিল। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের সাপ্লাই চেইন ও পরিবহন পরিকল্পনায়ও গণনা দ্রুত করার জন্য ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল যন্ত্র কাজে লাগত। 


সবচেয়ে বড় কথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কম্পিউটার শব্দটার অর্থই বদলে যায়। এর আগে “computer” মানে ছিল একদল নারী, যাদের কাজই ছিল বসে বসে গণনা করা। কিন্তু যুদ্ধের পরে সেই অর্থ বদলে যায়, আর মেশিনকেই বলা হতে থাকে কম্পিউটার। 

যুদ্ধক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন কিছু নয়। সেই প্রাচীনকাল থেকেই আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন গোপন প্রযুক্তির ব্যবহার দেখতে পাই। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য একবার অদ্ভুত একটা দাহ্য তরল তৈরি করেছিল। এই তরলে আগুন ধরিয়ে দিলে পানির ওপরও জ্বলত। একবার একটা আরব নৌবহর কনস্টান্টিনোপলের কাছে আসা মাত্রই বাইজেন্টাইন জাহাজ থেকে সেই তরল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় নৌবহরে। শত্রুদের জাহাজ পানির ওপরেই পুড়ে যায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের গোপন অস্ত্র।


বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনও হয়েছিল এই প্রযুক্তির কারনেই। ১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেন। ইউরোপীয় প্রকৌশলী দ্বারা নির্মিত বিশাল কামান এক মাস ধরে গোলা নিক্ষেপ করে শহরের দেয়ালে। দেয়াল ভেঙে পড়লে হাজার বছরের পুরনো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য শেষ হয়ে যায়। গানপাউডার প্রযুক্তি বদলে দেয় ইতিহাস। 

তবে প্রযুক্তি সবসময় আধুনিক হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। চেঙ্গিস খান আর তার সৈন্যরা এক ধরনের ছোট আকারের তীর-ধনুক ব্যবহার করত। দেখতে ছোট হলেও ভীষণ শক্তিশালী ছিল এই তীর। সবচেয়ে বড় কথা আকারে ছোট হওয়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তীর চালিয়ে দিতে পারত মঙ্গোল যোদ্ধারা। দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে চারপাশ ঘিরে শত্রুর ওপর তীরের বৃষ্টি নামাত তারা। ইউরেশিয়ার অর্ধেক দখল হয়ে যায় মঙ্গোলদের এই ধনুক-প্রযুক্তির জোরে। 


ইতিহাস ঘাটলে এমন শত শত উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। সভ্যতা যত এগিয়ে গেছে, মানুষের প্রযুক্তিও তত বেশি শক্তিশালী হয়েছে। ভ্যাকুয়াম টিউবের পর মানুষ এমন একটা প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিল, যা ছিল রীতিমত জাদুর মতো। এটা ছিল এমন এক প্রযুক্তি, যে প্রযুক্তি গড়ে দুই বছর পর পর দ্বিগুণ শক্তিশালী হতো। এই অগ্রগতি ষাটের দশক থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত অব্যাহত আছে। এই প্রযুক্তিকে এখন আমরা সিলিকন চিপ, সেমিকন্ডাক্টর, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা মাইক্রোপ্রসেসর নামে ডাকি। যে দেশ এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তারাই শাসন করবে পৃথিবী। আর সেটাই হয়েছে।


আবিষ্কৃত হওয়ার পরপরই যুদ্ধ ক্ষেত্রে এই সেমিকন্ডাক্টর চিপের ব্যবহার শুরু হয়। আসলে প্রথমদিকে যত সেমিকন্ডাক্টর চিপ উৎপাদিত হতো তার ৯০ শতাংশই কিনে নিত অ্যামেরিকার প্রতিরক্ষা দপ্তর। মূলত মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেম, বিমান চালনা, আর নাসার স্পেস প্রোগ্রামের জন্য এই চিপগুলো কিনত তারা।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অ্যামেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া আর বড় কোনো পরাশক্তি টিকে ছিল না। একটা পর্যায়ে এই দুই পরাশক্তির মধ্যে শুরু হয় পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা একটা পর্যায়ে যুদ্ধের রূপ নেয়। এজন্যই এই প্রতিযোগিতাকে অনেকেই স্নায়ুযুদ্ধ বলে উল্লেখ করেন।


স্নায়ু যুদ্ধের আমলে অ্যামেরিকাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য রাশিয়া বিপুল পরিমাণ ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য অস্ত্র তৈরি করে। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা এই ঘটনাকে বলেছেন সোভিয়েতদের সংখ্যার খেলা। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে তারা তৈরি করে লক্ষাধিক ট্যাঙ্ক: T-54/55 সিরিজ: প্রায় ৮৬,০০০, T-62: প্রায় ২২,৭০০, T-72: ২৫,০০০-এর বেশি, T-80: প্রায় ৫,৫০০। অন্যদিকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাঙ্ক সংখ্যা ছিল মোটামুটি ১০ হাজারের মতো। বিমানের ক্ষেত্রেও সোভিয়েতরা সংখ্যায় এগিয়ে ছিল। এমনকি আশির দশকে এসে পারমাণবিক ওয়ারহেডের ক্ষেত্রেও সোভিয়েত ইউনিয়ন অ্যামেরিকার থেকে এগিয়ে ছিল অনেকখানি।


সেই ষাটের দশকেই অ্যামেরিকা বুঝতে পেরেছিল যে, সংখ্যা দিয়ে আধুনিক যুগে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না। ফলে তারা সংখ্যার থেকে গুণগত মানের দিকে বেশি নজর দেয়। শক্তির চেয়ে বেশি নজর দেয় প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। আর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার এই কাজটিই করে দেয় সিলিকন চিপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ট্যাঙ্ক আর পারমাণবিক বোমা তৈরিতে তাদের সকল শক্তি ব্যয় করছিল, অ্যামেরিকা তখন সিলিকন ভিত্তিক মাইক্রোচিপ তৈরিতে বিপুল পরিমাণ ডলার ব্যয় করছিল। এটাই ছিল দুই পরাশক্তির কৌশলগত পার্থক্য।


স্নায়ু যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধে অ্যামেরিকা জড়িয়ে পরে। ১৯৬৯ সালে ভিয়েতনামে ছিল প্রায় ৫ লক্ষ মার্কিন সেনা।  ভিয়েতনাম যুদ্ধে অ্যামেরিকার প্রয়োজন ছিল ভিন্ন ধরনের অস্ত্র। এই যুদ্ধে প্রথম দিকের বোমা হামলা অভিযানের মধ্যে একটি ছিল ‘অপারেশন রোলিং থান্ডার’। এই অপারেশন চলে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। এই অভিযানে আট লাখ টনেরও বেশি বোমা ফেলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় থিয়েটারেও এই পরিমাণে বোমা ফেলা হয়নি। তবে এত বোমা ফেলা হলেও উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীর ওপর এর প্রভাব ছিল খুবই সীমিত। কারণ বেশিরভাগ বোমাই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়। 


বিমানবাহিনী তখন ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির পরীক্ষা চালাচ্ছিল। ১৯৭০-এর দশকের গাইডেড মিউনিশনগুলোর প্রধান সমস্যাটা ছিল ভ্যাকুয়াম টিউব। ভিয়েতনামের আকাশে যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানগুলো ব্যবহার করত স্প্যারো থ্রি এন্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইল। এই মিসাইলগুলো ছিল ভ্যাকুয়াম টিউবের ওপর নির্ভরশীল। টিউবগুলো হাতে ঝালাই করে লাগানো হতো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আর্দ্র আবহাওয়া এবং টেকঅফ-ল্যান্ডিংয়ের সময় তৈরি হওয়া চাপের কারণে টিউবগুলো বারবার নষ্ট হয়ে যেত।


যুদ্ধবিমানের অস্থির লড়াইয়ের কারণেও সৃষ্টি হতো সমস্যা। এই সবকিছু মিলিয়ে গড়ে প্রতি পাঁচ থেকে দশ ঘণ্টা ব্যবহারের পর ভেঙে পড়তো স্প্যারো মিসাইলের রাডার সিস্টেম। যুদ্ধের পর একটা গবেষণায় দেখা গেছে, ভিয়েতনামে নিক্ষিপ্ত স্প্যারো মিসাইলের মাত্র ৯.২ শতাংশই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। ৬৬ শতাংশ মিসাইল কাজ করেনি, আর বাকি মিসাইলগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল।


এই যুদ্ধের সময় অ্যামেরিকান বাহিনীর কর্নেল জো ডেভিস একবার ভিয়েতনামের থানহ হোয়া সেতুর ছবি পরীক্ষা করে দেখছিলেন। এই সেতুটি ছিল ৫৪০ ফুট লম্বা একটি ধাতব কাঠামো। ডেভিস ছবির মধ্যে আটশত ক্ষতচিহ্ন গুনে বের করেছিলেন। প্রতিটি ক্ষত ছিল অ্যামেরিকান বোমা বা রকেটের আঘাতের ফল। কিন্তু সেগুলো সেতুতে সঠিকভাবে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আরো অনেক বোমা পড়েছিল নদীতে এবং সেগুলোর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেতুটি তখনও দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ হাজারের উপর বোমা ফেলেও সেতুটি ধ্বংস করতে পারেনি অ্যামেরিকান বাহিনী।


এবার লেজার-নির্দেশিত একটা বোমা তৈরি করার জন্য টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টস নামে একটি সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিকে নয় মাস সময় দেন কর্নেল ডেভিস। বোমাটি দ্রুতই বিমানবাহিনীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। ১৯৭২ সালের ১৩ মে অ্যামেরিকান বিমানবাহিনী থানহ হোয়া সেতুর ওপর চব্বিশটি বোমা ফেলে। সেতুটি তখনও ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে। তবে এবার অ্যামেরিকান বোমাগুলো আঘাত করল সরাসরি সেতুর ওপর। ভেঙ্গে পড়ল সেতু। এই নতুন নির্ভুল বোমাগুলোর মাধ্যমে আঘাত হানা হয়েছিল অন্য অনেক সেতু, রেল জংশন এবং অন্যান্য কৌশলগত পয়েন্টেও। সেমিকন্ডাক্টর কীভাবে ভবিষ্যতের যুদ্ধ-কৌশল বদলে দিতে পারে সেটা ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে একদম হাতে কলমে বুঝতে পারে অ্যামেরিকা। এরপর থেকে প্রযুক্তিকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে তারা।


ভিয়েতনাম যুদ্ধের এই অভিজ্ঞতা পুঁজি করে প্রযুক্তি নির্ভর যুদ্ধের প্রথম সত্যিকারের প্রদর্শন শুরু হয় ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি। ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগ মুহূর্তে সৌদি আরবের মার্কিন ঘাঁটি থেকে আকাশে উড়ে গেল লকহিড এফ-১১৭ নাইটহকের প্রথম স্কোয়াড্রন। কালো রঙের স্টেলথ জেটগুলো মরুভূমির অন্ধকার আকাশে এমনভাবে মিলিয়ে গেল, যেন তারা রাতেরই অংশ। একের পর এক উড়ে গেল মোট ৩৬টি বিমান। সবগুলো বিমানের লক্ষ্য একই: বাগদাদ। সিএনএন লাইভ সম্প্রচারে দেখাচ্ছিল—শত শত বোমা আর ক্রুজ মিসাইল কীভাবে ইরাকি ট্যাংক, সাঁজোয়া যান আর সামরিক ঘাঁটিতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানছে। দর্শকদের কাছে এই যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল অনেকটা ভিডিও গেমের মতো। এভাবে গাইডেড মিসাইল সিস্টেমের মাধ্যমে এত দুর থেকে শত্রুকে প্রস্তুত হওয়ার আগেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া পৃথিবীর মানুষ আগে কখনো দেখেনি। সেই ভয়টা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যই হয়ত যুদ্ধটা লাইভ টেলিকাস্ট করা হয়।


কিন্তু এই যে সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি এটা কিন্তু রাতারাতি তৈরি হয়নি। প্রথম দিকে মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি যে এই প্রযুক্তি পুরো দুনিয়াকে পরিবর্তন করে দেবে। আজকের দিনে মোবাইল ফোন, মাইক্রোওয়েব ওভেন, ইলেকট্রিক গাড়ি থেকে শুরু করে যেকোনো অত্যাধুনিক যন্ত্রের মূল শক্তিই হলো সেমিকন্ডাক্টর চিপ। আজকের দিনে আমরা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রয়জন হয় জিপিইউ নামে এক ধরনের চিপ। তেমনি যেকোনো আধুনিক যন্ত্রের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে এই সেমিকন্ডাক্টর জিনিসটি।


বিশ্বের অধিকাংশ ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষক চীনের ‘মালাক্কা সমস্যা’ নিয়ে বেশ গুরুত্ব দিয়েই কথা বলেন। মালাক্কা প্রণালি অবশ্যই চীনের জন্য একটি কৌশলগত সমস্যা। তবে আজকের দিনে তেলের ব্যারেল নয়, বরং চীনের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে সেমিকন্ডাক্টর চিপ। এই উপলব্ধি থেকেই চীন এখন সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের লড়াইয়ে নেমেছে। এই কাজে বিনিয়োগ করা হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।

অ্যামেরিকা চীনের গলা চেপে ধরেছিল ২০১৯ সালে। হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে নতুন একটি বিল পাশ করা হয়। নতুন বিলের মূল টার্গেট ছিল চীনের অন্যতম বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে। সাশ্রয়ী মূল্যে টেকসই পণ্য সরবরাহ করার কারণে হুয়াওয়ের পণ্য অল্প সময়েই বিশ্বজুড়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে এই কম দামের পেছনে মূল ভূমিকায় ছিল চীন সরকারের সরাসরি ভর্তুকি ও সহায়তা। হুয়াওয়ের মাধ্যমে বেইজিং তার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। আর এজন্য যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কা করছিল, হুয়াওয়ে যদি অচিরেই পরবর্তী প্রজন্মের টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করে, তাহলে বৈশ্বিক প্রযুক্তি ব্যবস্থার ওপর ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। এমনকি এতে চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাবও ব্যাপকভাবে বাড়বে—বিশেষ করে যদি এই অবকাঠামো হয় নজরদারি, প্রতিরক্ষা বা সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত। এই আশংকা থেকে প্রথম ধাপেই হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। চিপ তৈরি করার জন্য হুয়াওয়ে কিছু উন্নত মার্কিন প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল। সেগুলো হুয়াওয়ের কাছে বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।


এই পদক্ষেপের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। হুয়াওয়ের বৈশ্বিক সম্প্রসারণ হঠাৎ করেই থমকে যায়। নিষেধাজ্ঞার ফলে প্রয়োজনীয় চিপ ও বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্যের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়াই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের বিক্রয় এবং আয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। প্রযুক্তিগতভাবে একপ্রকার শ্বাসরোধ করে ফেলা হয়েছিল এই বিশাল প্রতিষ্ঠানটিকে। এই পরিস্থিতিতে হুয়াওয়ের জন্য একটি কঠিন সত্য উন্মোচিত হয়—তাদের মতো আধুনিক ইলেকট্রনিক্স-নির্ভর চীনা কোম্পানিগুলো চিপের জন্য বিদেশের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। আর এই নির্ভরশীলতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।


সব বুঝে শুনে চিপ তৈরিতে চীন এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢেলে দিচ্ছে। বেইজিং যদি তাদের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনায় সফল হয়, তাহলে শুধু চীন নয়, সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যই আমূল বদলে যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ক্ষমতায়। আর পরবর্তী সময়ের কোল্ড ওয়ারের ভাষা ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের আতঙ্ক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ পর্যন্ত হয়তো নির্ধারিত হবে কম্পিউটিং শক্তির মাপকাঠিতে। একটি সত্য দুই পক্ষই গভীরভাবে বুঝে গেছে: মেশিন লার্নিং হোক বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা, স্ব-চালিত যানবাহন হোক বা সশস্ত্র ড্রোন—আজকের দিনের প্রতিটি কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ভিত্তি উন্নত চিপ। আর এই চিপগুলো, অর্থাৎ যাকে আমরা সাধারণত ‘সেমিকন্ডাক্টর’ বা ‘ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট’ নামে চিনি, সেগুলো তৈরি করতে পারে বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র কোম্পানি।


কারণ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করা এখন ভয়াবহ জটিল। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির চিপ তৈরি করতে EUV লিথোগ্রাফি নামে একটি জটিল যন্ত্র প্রয়োজন হয়। এই যন্ত্রটি এতই জটিল যে এর লেজার সিস্টেমের মধ্যেই রয়েছে ৪৫৭,৩২৯টি আলাদা যন্ত্রাংশ। এটি তৈরির জন্য অনেকগুলো দেশের বিজ্ঞানীদের প্রায় ৩০ বছর শুধু গবেষণাই করতে হয়েছে। এই যন্ত্রের লেজার থেকে EUV আলো তৈরি করতে প্রয়োজন হয় এক ধরনের প্লাজমার। এই প্লাজমার তাপমাত্রা সূর্যের পৃষ্ঠের চেয়েও অনেক গুণ বেশি! তাপমাত্রা পৌছে যায় প্রায় পাঁচ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াসে! এই ভয়ঙ্কর তাপ থেকে জন্ম নেয় ক্ষণস্থায়ী EUV আলো। বুঝতেই পারছেন এই ধরনের একটা যন্ত্র চাইলেই তৈরি করা যায় না। সারা পৃথিবীতে এই যন্ত্রটি তৈরি করতে পারে মাত্র একটি কোম্পানি। 


প্রযুক্তি চুরির ঘটনা খুবই সাধারণ একটি বিষয়। এই চিপ ইন্ডাস্ট্রিতেও সে ঘটনা কম ঘটেনি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীন, কেউই আসলে সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি চুরি করে সুবিধা করতে পারেনি। কারণ চিপ তৈরির প্রযুক্তি প্রতি এক দুই বছর পরপর এতটাই জটিল হয়ে উঠে যে সেগুলো নকল করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।


অন্যদিকে আজকের দিনে সবচেয়ে সূক্ষ্ম প্রযুক্তির কিছু চিপের প্রায় ৯০ শতাংশই উৎপাদন করে তাইওয়ানের এই একটি কোম্পানিই। ফলে একটা পর্যায়ে এসে এই চিপ জিনিসটা জ্বালানী তেলের মতো ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

১৯৭৩ সালের তেল সংকটের সময় আরবের তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ‘ওপেক’ তেলকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তারা পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে তেল রপ্তানি হঠাৎ কমিয়ে দেয় এবং উৎপাদনও সীমিত করে ফেলে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সরবরাহ কমে যায়। কয়েক মাসের মধ্যে তেলের দাম বেড়ে যায় চারগুণ। আর এই ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতিকে পুরো অচল করে দিয়েছিল। অবস্থা এতই খারাপ হয়েছিল যে তেলের অভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর হাইওয়েতে স্পিড লিমিট পর্যন্ত কমিয়ে দেওয়া হয়। বেড়ে যায় বেকারত্ব। অনেক দেশে পেট্রোল স্টেশনে গাড়ির লাইন কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ হয়ে যেত।


২১ শতকে এসে তেলের সেই জায়গা দখল করেছে সেমিকন্ডাক্টর। সিলিকন চিপের সরবরাহ বন্ধ হলে পৃথিবীর অর্থনীতি শুধু ধীর হবে না, বরং পুরো পৃথিবী আক্ষরিক অর্থেই থেমে যাবে। মানবজাতির  ইতিহাসে এই মাইক্রোচিপের চেয়ে জটিল কোনো কিছু আমরা কখনো তৈরি করিনি। একটা চুলের চেয়েও হাজার ভাগের এক ভাগ পাতলা সার্কিটের মধ্যে থাকে কোটি কোটি ট্রানজিস্টর। এত সূক্ষ্ম প্রযুক্তি চাইলেই তৈরি করা যায় না। ফলে সেমিকন্ডাক্টরের একটা বড় কারখানা বন্ধ হলেই কেঁপে ওঠে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি। 


তেল যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল, তখন তেল নিয়েই হতো সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক লড়াইগুলো। এখন এই লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে সিলিকন চিপ। এই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে শুরু হয়েছে রীতিমত এক ভয়ংকর ভূ-রাজনৈতিক লড়াই। কিন্তু এই যুদ্ধে নেই যুদ্ধবিমান, নেই ট্যাংক। কিন্তু আছে গুপ্তচর, প্রযুক্তি চুরি, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা, আর ট্রিলিয়ন ডলারের সাপ্লাই চেইন। এই যুদ্ধ নীরব, কিন্তু এর পরিণতি হবে পরমাণু যুদ্ধের মতোই মারাত্মক। এই চিপ ওয়ারে যারা এগিয়ে যাবে তারাই গোটা বিশ্বের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে।


সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরি করা অসম্ভব জটিল একটি কাজ। কাজটি যেমন জটিল তেমনি ব্যয়বহুল। ভ্যাকুয়াম টিউব থেকে শুরু করে কিভাবে আমরা ট্রাঞ্জিস্টর আবিষ্কার করলাম, তারপর কীভাবে সেই ট্রাঞ্জিস্টর থেকে আইসি তৈরি হলো, আর সেই আইসি থেকে কীভাবে আমরা আজকের এই জিপিইউ-এর যুগে চলে এলাম তা এক মহাকাব্যের মতো গল্প। হয়ত মানবজাতির সেরা অর্জনের মধ্যেও একটি এই সেমিকন্ডাক্টর চিপ। ভ্যাকুয়াম টিউব থেকে আজকের দিনের জিপিইউতে আসার রাস্তাটা সরল ছিল না। এখানে ছিল প্রযুক্তির লড়াই, ময়দানের লড়াই, প্রযুক্তি চুরি, গুপ্তচরবৃত্তি এবং আরও অনেক কিছু। এই গল্পটি যেন আমাদের আধুনিক মানুষ হয়ে উঠার গল্প। সেই গল্পটি ক্রিস মিলার তার চিপ ওয়ার বইতে ছবির মতো করে তুলে ধরেছেন। ক্রিস মিলারের চিপ ওয়ার বইটি এই বিষয়ের সবথেকে বিখ্যাত বই। ভূ-রাজনীতি, বৈশ্বিক অর্থনীতি, আগামী দিনের প্রযুক্তি নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তাদের জন্য এই বইটি অবশ্যপাঠ্য। লেখকঃ হিমাংসু কর