এই পৃষ্ঠাটি শুধুমাত্র কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া
শিক্ষার্থীদের জন্য, হাই স্কুল গ্রেডের জন্য নয়
============================
আংলো স্যাক্সনদের ইংরেজি ভাষা ও বিজ্ঞান চর্চার আরবি ভাষা
আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে ব্রিটেনের ইতিহাস হঠাৎ করেই একটা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। রোমান সাম্রাজ্য ব্রিটেন থেকে তাদের সেনাবাহিনী তুলে নেয়। এর ফলে সেনাবাহিনী না থাকায় বহিঃশত্রুর আক্রমনের থেকে কোন নিরাপত্তা নেই। জীবন অনিরাপদ হয়ে উঠায় ধনী গরীব সবাই গাদাগাদি করে প্রাচীন পাহাড়ি দুর্গগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দেশে শিক্ষাদান পড়াশুনা সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। আক্ষরিক অর্থেই ব্রিটেনে নেমে আসে এক অন্ধকার যুগ। এই পরিত্যক্ত রাজ্যে একদিন একদল নতুন মানুষ প্রবেশ করে। ওরা এসেছিল ইউরোপের খানিকটা বাইরে থেকে। এই মানুষগুলোই এংলো স্যাক্সন নামে পরিচিত। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল যোদ্ধা। এরা এসেছিল নতুন আবাদী জমির খোঁজে। এরা ধীরে ধীরে দ্বীপের নিচু অঞ্চলগুলো দখল করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে। আর এভাবে এরা তৈরি করে সম্পূর্ণ এক নতুন সভ্যতা। এই আংলো স্যাক্সনরাই মূলত ইংল্যান্ডের গোড়া পত্তন করেছিল। ওরা আসার আগে ব্রিটেনের মানুষ কথা বলত ল্যাটিন এবং কেল্টিক ভাষায়। ওরা যে ভাষাটার প্রচলন করেছিল সেটাকে এখন আমরা ওল্ড ইংলিশ বা প্রাচীন ইংরেজি বলি। আধুনিক ইংরেজি এসেছে এংলো স্যাক্সনদের ওল্ড ইংলিশ থেকে।
এই সময় প্রায় ৭০০ বছরের বেশি সময় ধরে বিজ্ঞান চর্চার জন্য যে আন্তর্জাতিক ভাষা ছিল- সেটা হলো আরবি! এ্যলজেব্রা শব্দটির উৎপত্তিই হয়েছে আরবি আল-জবর থেকে। শুধু এ্যলজেব্রাই নয়, আল-খারেজমির লেখা পাটিগনিত নয়। ইতিহাসের বিশাল একটা সময় জুড়ে আরব ও পারস্যের এই বিজ্ঞানীরাই ছিলেন তখন ইউরোপের বিজ্ঞানের কাণ্ডারি।
ম্যাকিয়াভেলির সুত্র
প্রায় পাঁচশত বছরের পুরনো লেখক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির 'দ্যা প্রিন্স' বইটিকে আধুনিক কূটনীতির বাইবেলও বলা হয়। এত বছর পেরিয়ে গেলেও বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতায় আজও বইটি খুব প্রাসঙ্গিক। লিবিয়ার গাদ্দাফি কিংবা ইরাকের সাদ্দাম হোসেইনের পতন ঘটেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। কিন্তু এর আগে গাদ্দাফি ও সাদ্দাম হোসেইনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব ভালো সম্পর্কই ছিল। তাহলে পরিণতি এরকম হল কেন? ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব টিকে থাকে। এটা ব্যক্তি-পরিবার কিংবা রাস্ট্রের ক্ষেত্রে সমানভাবে সত্য। সব ক্ষেত্রে এইকটাই সূত্রঃ কার সাথে আপনার কি্ রকম স্বার্থ রয়েছে, তার সাথে সে রকম বন্ধুত্ব আপনার থাকবে। পৃথিবীতে আমরা সবাই দুধের মাছি। দুধ নাই তো মাছি নাই, এখানে স্বার্থকে বাদ দিয়ে চিরস্থায়ী সম্পর্ক বলে কিছু নেই। সবটাই নির্ভর করছে পারস্পরিক লাভের ওপর। লাভ বা স্বার্থ না থাকলে বন্ধুত্বও ঠিকবে না।
ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন- ক্ষমতায় আরোহন করার পর প্রথম কাজ হবে আগের রাজাকে বা প্রতিদ্ধন্দী দল বা গ্রুপকে সমূলে বিনাশ করা। যদি তা না করা যায়, তবে সে ব্যক্তি বা দল তুলনামূলক ছোট ছোট নেতাদের নিজের দলে টেনে নেবে এবং একসময় সে আপনাকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেবে।
ম্যাকিয়াভেলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদেশ হল- মানুষকে ইচ্ছামত দান দক্ষিণা করবেন না বা বিনামূল্যে কিছু দিবেন না। মানুষ উপকারের কথা বেশিদিন মনে রাখে না, আর বিনামূল্যে পেলে ডায়মন্ডকেও পাথুরে কয়লা মনে করে। এভাবে দান দক্ষিণা করার ফলে আপনার প্রয়োজনীয় বাজেটেরও ঘাটতি পড়বে। পরবর্তীতে আরো বেশি বা আরো দামী কিছু ফ্রি না দিলে বা দান না করলে আপনার প্রতি তাদের সন্তুষ্টি উড়ে যাবে। মনে রাখবেন, আপনার দেবার ক্ষমতা যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষ আপনার পাশে থাকবে। কাজেই মানুষের কল্যাণের জন্য নিরন্তর কাজ করুন, তবে কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়।
হাজী মোহাম্মদ মহসিনের দানকৃত অর্থে শিক্ষিত হন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ বিখ্যাত বাঙ্গালিরা
একসময় সকলেরই ধারণা ছিল বাংলা মূলত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা কিন্তু ১৮৭২ সালে বাংলায় যে প্রথম আদমশুমারি হয় তাতে দেখা যায় যে,বাংলার মোট জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ মুসলমান,ফলে এ তথ্য অনেককেই বিস্মিত করে । ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজীর বঙ্গ বিজয়ের পর থেকে ছয় শতাব্দীরও বেশি সময়কালে মুসলমানদের সংখ্যা কেমন করে বাংলার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকে পৌছেছিল সেটা গবেষণার বিষয় । বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পায় মূলত ব্রিটিশ শাসনামলে । ১৯০১ সাল থেকে মুসলমান জনগোষ্ঠীর অনুপাত নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯০১ সালে মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ (৬৬.১ শতাংশ) ছিল মুসলিম, ২০০১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯.৭ শতাংশে। কিন্তু মুসলমানদের প্রধান সমস্যা ছিল অশিক্ষা। এই চরম বাস্তবতাই হাজী মোহাম্মদ মহসিনের কাছে সত্য মনে হয়েছিল। তাই তিনি চেয়েছিলেন তার দানকৃত সম্পদ যেন শিক্ষার পেছনেই বেশি ব্যয় হয়।
দানবীর হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের বয়স তখন প্রায় ৭০ এর কাছাকাছি। তখন তার চিন্তা এসেছিল যে, তার মৃত্যুর পরে এই বিপুল সম্পত্তির কি হবে? তাই ১৮০৬ সালে তিনি পুরো সম্পত্তির ওয়াকফ বা দানপত্র করে দেন। সেখানে এই সম্পত্তির আয় কীভাবে বিলি বণ্টন করা হবে, তার বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় স্থাপনা, জনকল্যাণে ব্যয় করা হবে এসব অর্থ।
হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের দান করা সম্পত্তির পরিচালনা নিয়ে পরবর্তীতে কিছু মামলা-মোকদ্দমার তৈরি হয়। যাদের পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অবশেষ ১৮৩৪ সাল নাগাদ এই তহবিল ব্যবহারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা।
১৮৩৫ সালে এই তহবিল দিয়ে ;মহসিন এডুকেশনাল এনডাউমেন্ট ফান্ড; তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার। হাজী মোহাম্মদ মুহসীন যেভাবে দানপত্র লিখেছিলেন, তাতে কিছু পরিবর্তন এনে ব্রিটিশরা দুইটি আলাদা তহবিল গঠন করে। তার একটিতে হাজী মহসিনের ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যয় যেমন ইমামবাড়ীর খরচ, পেনশন প্রদান ও মোতোয়ালির বেতন ইত্যাদি খাতে ব্যয় হবে। সাধারণ ফান্ড নামের আরেকটি ফান্ড থেকে শিক্ষার পেছনে ব্যয় হবে।
১৮৩৪ সাল নাগাদ এই তহবিল ব্যবহারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা। তারা ১৮৩৫ সালে এই তহবিল দিয়ে 'মহসিন এডুকেশনাল এনডাউমেন্ট ফান্ড' তৈরি করে । এই তহবিল থেকে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসীন কলেজ। এরপরে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা, সিতাপুর মাদ্রাসা, ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।
নবাব আব্দুল লতিফ, খাজা আব্দুল গনি, তাদের চেষ্টায় ১৮৭৩ সালে এই ফান্ড থেকে স্কলারশিপ চালু করা হয়। শুধু এটাই না, তখনকার স্কুলগুলোয় একজন আরবি শিক্ষকসহ বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার খরচ এই ফান্ড থেকে সহযোগিতা আসতো। ''
হাজী মোহাম্মদ মহসিনের দানকৃত অর্থে তৈরি হুগলি মহসীন কলেজ থেকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গুরুদেব মুখোপাধ্যায়, দিজেন্দ্রনাল রায়, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, স্যার উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- এরকম বিখ্যাত বাঙ্গালিরা শিক্ষালাভ করেছেন।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে আমরা চিনি আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কারক হিসেবে।
কিন্তু আসলেই কি তিনি আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কারক?
তুরস্কের বর্ত্মান ইস্তাম্বুল্কে আগে কনস্টান্টিনোপল নামে ডাকা হত। তূর্কিরা খৃস্টান্দের কাছ থেকে কনস্টান্টিনোপল দখল করে নিলে প্রাচ্যের সাথে ইউরোপের স্থলপথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু ইউরোপীয়দের বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে প্রাচ্যের সাথে যোগাযোগ লাগবেই, তাই তারা জলপথে বাণিজ্যের প্রতি মনোযোগী হয়, কিন্তু ইউরোপ থেকে প্রাচ্যের জলপথের ঠিকানা তখন পর্যন্ত কারোর জানা ছিল না। এই জলপথ আবিষ্কার ও প্রাচ্যের সিল্ক, স্বর্ণ, মসলার কথা বলে কলম্বাস স্পেনের রাজা ও রানির আনুকুল্যে তিনটি জাহাজ নিয়ে প্রাচ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কলম্বাস জাতিতে একজন ইতালীয় নাগরিক, তিনি একজন দক্ষ নাবিক ছিলেন। যাত্রা শুরু করে কলম্বাস ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর বাহামায় অবতরণ করেন। কলম্বাস ভেবেছিলেন তিনি ইন্ডিয়াতে এসেছেন কিন্তু ইউরোপ থেকে সোজা পথে যে আমেরিকা নামে মহাদেশ রয়েছে তখন তা ছিল ইউরোপীয়দের কাছে অজানা। কলম্বাস ও তাঁর সঙ্গীরা তীরে নামলে স্থানীয় আরাওয়াক গোষ্ঠীর লোকজন তাদের অভ্যর্থনা জানায়। কলম্বাস লক্ষ করেন তারা স্বর্ণের কানের দুল পরা, তিনি বেশ খুশি হলেন এই ভেবে যে স্বর্ণের জায়গা তিনি পেয়ে গেছেন। আরাওয়াক লোকজনদের অনেককে বন্দী করে কলম্বাস স্বর্ণের উৎস সন্ধানে ব্রতী হন। তিনি তাঁর সঙ্গীদের একাংশ এখানে রেখে ইউরোপে ফিরে যান,সাথে নিয়ে যান আমেরিকা হতে বন্ধী করা কিছু দাস। সেখানে গিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করেন তার ইন্ডিয়া যাবার জলপথে বিশাল এক দেশ তিনি আবিষ্কার করেছেন, সে অঞ্চলে স্বর্ণের ভাণ্ডার আছে। তাই তাঁর আরো সহযোগিতা দরকার, ফলে এবার তিনি সতেরটি জাহাজ ও বারোশত লোকের একটি বহর নিয়ে রওনা দেন আমেরিকার উদ্দেশ্যে। এর পরের কাহিনী খুবই করুন।
কলম্বাস কলম্বাস ১৪ বছরের ঊর্ধ্বে সবার জন্য তিন মাসের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ সংগ্রহ করে দেবার নির্দেশ দেন৷ যারা দিতে পারতো না তাদের হাত কেটে ফেলে রাখা হতো, ফলে তারা রক্তক্ষরণে মারা যেত। ৯ বছরের ঊর্ধ্বে মেয়েদের যৌনদাস হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে কলম্বাস ও তাঁর সঙ্গীরা। আরাওয়াকরা এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, কিন্তু পরাজিত হয় । েই বিদ্রোহী বন্দীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় আরাওয়াকরা "গণ-আত্মহত্যা" শুরু করে কাসাভা বিষ খেয়ে। এমনকি পিতা-মাতা তাদের শিশুসন্তানদের মেরে ফেলেন কলম্বাসবাহিনীর হাত থেকে বাঁচাতে ! ১৫১৫ সালে আরাওয়াক জনসংখ্যা ৫০ ০০০,১৫৫০ সালে ৫০০, ১৬৫০ সালে আরাওয়াকরা বিলুপ্ত হয়ে যায়! কলম্বাস নিষ্ঠুর হলেও কলম্বাসের যে গুণের প্রশংসা প্রত্যেকেই করেছেন তা হলো সমুদ্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও নাবিক হিসেবে দক্ষতা।
এন্টি অ্যামেরিকানিজম
এন্টি অ্যামেরিকানিজম নামে একটা টার্ম আছে, যার অর্থ হচ্ছে অ্যামেরিকার সরকার, অ্যামেরিকার ফরেন পলিসি ইত্যাদি অপছন্দ করা, বিরোধীতা করা। বিভিন্ন দেশের মানুষ ছাড়াও খোদ অ্যামেরিকার অনেক মানুষ এই এন্টি অ্যামেরিকানিজম টার্ম-এ জডিত। একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশের মধ্যেও ধীরে ধীরে এন্ট্রি ইন্ডিয়া টার্ম তৈরি হচ্ছে। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের চারপাশের সকল রাস্ট্রের মানুষের মধ্যে এন্ট্রি ইন্ডিয়ানিজম তৈরি হচ্ছে, এমন কি হিন্দু রাস্ট্র নেপালে আরো বেশি। এর মূল কয়েকটি কারণ আমরা খুঁজে বের করেছি। প্রথমটি হল- একটি বড় রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের দাদাগিরি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটা বিশাল অংশের মঙ্গার একমাত্র কারণ তিস্তার বাধ। এই বাধের কারণে বিশাল বাংলাদেশি তরুণ সমাজ মনে করে ভারত বাংলাদেশের প্রতি অন্যায়, অবিচার ও দাদাগিরি করে চলেছে। দ্বিতীয়ত করোনা মহামারীর সময় টিকার চালান বন্ধ করা, প্রায় প্রতিদিন সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা, কোন সঙ্কট তৈরি হলে চাল, পেয়াজ ইত্যাদি রপ্তানী ভারত কতৃক বন্ধ করা। ভিসা নিয়ে কড়াকড়ি করা ইত্যাদি অন্যয্য বহিবিধ কারণে খোদ আওয়ামিলীগের অনেক কর্মীরাও ভারতের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে । এক জরিফে দেখা গেছে, দেশের শতকরা ৭৩% তরুন ভারতকে শত্রু মনে করে এবং জাপান-রাশিয়া-চিনকে বন্ধু রাস্ট্র মনে করে। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করা ভারতের বিজেপি যখন সেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নির্যাতন হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতাও তাতে প্রভাবিত হয়। ভারতের পণ্য বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পার হয়ে ভারতেরই আরেক অঞ্চলে নেওয়ার জন্য নানা ব্যবস্থা করা হচ্ছে জনগণকে না জানিয়ে। এর জন্য বাংলাদেশের কী লাভ, কী ক্ষতি—সে সম্পর্কে সরকার জনগণকে পরিষ্কারভাবে কিছু জানায়নি। বাংলাদেশের তিন দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে ভারত সন্ত্রাসীদের ঠেকানোর নামে। এরপরও প্রতিনিয়তই চলছে সীমান্ত হত্যা। তাছাড়া, ভারত থেকে বাংলাদেশে আইনি পথে যেসব পণ্য আসে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আসে বেআইনিভাবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে আইনিভাবে পণ্য নিতে গেলেও শত রকমের শুল্ক বাধা। প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও ভারতের পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে বাংলাদেশের কোন ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পারছে না নানা অজুহাতের শুল্ক বাধার কারণে । এত সব বৈষম্য, অসম্মান ও আধিপত্যের ঘটনা থাকলে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষমাত্রই তার প্রতিকার চাইবে। এ ক্ষোভকে ভারতবিরোধী বিদ্বেষ বা মৌলবাদীদের তৎপরতা হিসেবে চিত্রিত করা মানে মূল ইস্যুকে আড়াল করা।
আর একটি কারণ হল- ভারতীয় ‘র’। ভারতীয় ‘র’ নিয়ে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের মধ্যে একটা অস্বস্তি আছে। ১টা উদাহরণ দিই- বিগত কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশের ৬৫২টি থানার মধ্যের অধিকাংশ থানার ওসিই হচ্ছে হিন্দু ধর্মের। অথচ হিন্দু হচ্ছে মোট জনগুষ্ঠির ৮ % মাত্র। প্রশাসনের প্রায় সকল বড় বড় পদে হিন্দুরা বসে আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মেধা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে হিন্দুরা আসন দখল করে নিয়েছে, কিন্তু প্রায় ৯০% বাংলাদেশিরা মনে করে, ভারতীয় -'র' এই কর্মকান্ডের মূলে। এমনকি এই র-এর কারণে দেশের সেনাবাহিনীও অলিখিতভাবে বন্ধী হয়ে পড়েছে; যার কারণে আমেরিকান সি-আই পর্যন্ত কোন খবদারি বা গোপন মিশন চালাতে পারছে না।
তৃতীয় কারণ কি হলো বাংলাদেশের জনগন মনে করে- ভারত এখানে তদের নিজের স্বার্থে অন্য কোনো দলকে ক্ষমতার বসতে দিবে না; তাহলে ভারতের ৭টি পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আলাদা হবার বা জঙ্গী তৎপরতা বেড়ে যাবে। এই যে অন্যদলকে ক্ষমতায় বসতে না দেয়ার অভিযোগ, তা আক্রোশ তৈরি করছে নতুন প্রযন্মের মধ্যে।
অনেকে এন্ট্রি ইন্ডিয়ানিজম এর সাথে অনেক মুক্তমনারা মেয়েদের বোরকাপ্রীতি ও ব্যাগের ছাতার মত মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন।কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেয়েদের বোরকাপ্রীতির একমাত্র কারণ কিন্তু ধর্ম নয়; ৩টি কারনের মধ্যে প্রথম হচ্ছে ,সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্চে সিংহ ভাগ বাংলাদেশি চাকরি করে। তারা তাদের বৌ-ঝি কে ঐদেশের মেয়েদের স্টাইলে দেখতে পছন্দ করে। দ্বিতীয় কারণ হল, মেয়েরা ঘরের বের হতে পরিষ্কার জামা ও সাজগোজ করতে হয়। যা আনেকটা সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং অপ্রয়োজনীয়। একটা বোরখা পরলে সেসব থেকে রেখাই পাওয়া যায়। ৩য় কারণ হচ্ছে, বোরখা সভ্য মেয়েদে পোশাক হিসেবে আইকন তৈরি হয়েছে ধর্মীয় কারণে।
সমাধান কি?
আমাদের দেশে কিছু দল কর্তৃক ঘৃণার রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে পরিচর্যা হচ্ছে। ভারত সাম্রাজ্যবাদী, শোষক, ‘হিন্দুরাষ্ট্র’, এই দেশটি নানাভাবে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে, অন্যায়ভাবে অধিক সুবিধা আদায় করছে-এমনি নানা অভিযোগ করে চলেছে দেশটির বিরুদ্ধে। অবশ্য ধর্মও এ ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা বড় ফ্যাক্টর। আমরা বড় বেশি ধর্মমুখী হয়ে একই সঙ্গে অন্যধর্মের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠছি। যার যার দেশের স্বার্থের কারণে সে দেশ ভিন্ন আচরণ করে। কেউ নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যকে বেশি কিছু দিতে পারে না। কাজেই অভিমান, অভিযোগ আর আক্রোশের ঘৃণা মনে পোষে না রেখে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক তৈরিতে এগিয়ে যাই।
লেখাপড়ায় ড্রপ করা ছাত্র-দেশে বিদেশে যত ক্রিয়েটিভ এবং সফল
পরজীবিরা নতুনত্বকে মানতে চায় না, তারাসন্তানকে শিক্ষিত করতে চায়, কিন্তু আদতে যেটা চায় সেটা হল একটা চাকরি করার সার্টিফিকেট।
কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একটা পরিবর্তন এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে.। কয়েক বছর আগে যেখানে জেএসসি পিএসসি পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে পরীক্ষা ব্যতীত বর্তমান মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষা কারিকুলাম;একেবারেই উল্টো পথে যাবে যাত্রা, যা অনেকে ভালো চোখে দেখছে না। আসলে পরিবর্তন, পরিমার্জন আলোচনা-সমালোচনা এসবের মধ্যে দিয়ে একটি সুন্দর শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়। প্রত্যেকের তার দৃষ্টিকোণ থেকে অভিজ্ঞতা থেকে মতামত দিবে এটাই স্বাভাবিক। কথায় বলে তিনজন ইহুদী যেখানে থাকে, সেখানে নাকি চারটি মত তৈরি হয়; ইহুদিদের উন্নতির পেছনে নাকি এটাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। সরকারপক্ষ বলছেন, পূর্বেকার মুখস্ত বিদ্যার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি হলো বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা। পূর্বেকার পদ্ধতিতে ডজন ডজন প্রশ্ন মুখস্ত করে সার্টিফিকেট অর্জনের পিছনেই আমরা সমম ব্যয় করেছি, সেইসব মুখস্ত করার বিষয়গুলি আমাদের কোন কাজে আসেনি; যে কারণে বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষা থাকার পরেও বছর বছর তা পড়ে, এমনকি বিএ-এমএ পাস করার পরেও কেউ ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতে পারে না। অথচ কোন কোচিং সেন্টার, কিংবা ক্লাবে যে-কেউ মাত্র কয়েক মাসের মৌখিক চর্চার ফলে সাবলীলভাবে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতে পারে। এজন্য বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে গ্রুপ ডিসকাশন বিষয়টা এসেছে। আশেপাশে একটু খেয়াল করলে দেখবেন যে, দেশে বিদেশে যত ক্রিয়েটিভ এবং সফল কাজ বা ব্যবসা-বাণিজ্য করা মানুষ আছে, তাদের সিংহভাগই হচ্ছে লেখাপড়ায় ড্রপ করা ছাত্র; যারা মুখস্ত বিদ্যার পরিবর্তে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে বেড়ে উঠেছে। কাজেই গরুর রচনা মুখস্থ করে গরু হওয়ার পরিবর্তে গুগল ইউটিউব সার্চ করে কোন তথ্য জানা বা ব্যবহার শিখে জীবন জীবিকা পরিচালনা করা শ্রেয় নয় কি? তবে হা একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ হওয়া যেন নিশ্চিত হয়। অনেকেই শিক্ষা ব্যবস্থায় রান্নাবান্না কিংবা ব্যাঙের নাচ ইত্যাদি নিয়ে উপহাস করে চলেছে, তারা মনে করে, রান্না হল মায়ের কাজ বা ঝি-চাকরের কাজ। আসলে বর্তমান এই ঈদুর দৌড়ের যুগে কোনো কাজ মেয়েদের বা বিশেষ কোনো শ্রেণির কাজ বলে নির্দিষ্ট করা’ পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। রান্নাবান্না জানা থাকলে মাকে যেমন সহযোগিতা করা যায়, তেমনি এই খাদ্য শিল্পের মাধ্যমে বিশাল আয় করাও সম্ভব। মানুষের প্রথম মৌলিক চাহিদািই হল খাবার। এই খাবার সংগ্রহের জন্য আফ্রিকা থেকে একদল আদিম মানুষ অজানা গন্তব্যের পথে বের হয়েছিল বলেই আজকের সভ্যতার জন্ম হয়েছে। আর ব্যাঙের নাচ কেন দরকার বলবো? প্রথমত একটা পাঠ সেকশন থেকে অন্য সেকশনে যাওয়ার বিরতি সময় মস্তিষ্ক এবং শরীর রিলাক্সের জন্য এটা করা হলেও শিক্ষার্থী যদি ব্যাঙের জীবন চক্র যদি নিয়ে যদি কেউ একটু ভাবে, তাহলে দেখবে্ ব্যাঙ্গাচির পিছনে দুইপা জন্ম হবার পর লম্বা লেজ কিভাবে ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে এবং সামনের দুই পা জন্ম নেওয়ার পর লেজ কিভাবে নিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং চার পা থাকার পরও হাটার পরিবর্তে ব্যাঙে লাফিয়ে চলে। এসব পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, মানুষসহ পৃথিবীর সকল প্রজাতির জীবজন্তুদের মধ্যে ভ্রুণ অবস্থায় লেজ থাকে, জন্মের পর কোন প্রজাতির সেই লেজ অটুট থাকে আবার মানুষের মত অনেক প্রজাতির লেজ মাতৃ গড়বেই ব্যাঙ্গাচির মতো বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর লাফিয়ে চলাটা মানুষ দু’পা দিয়ে চলার আগের অবস্থাকে ইঙ্গিত করে। যাই হোক’
বিগত কয়েক বছর ধরে সরকার প্রাইমারি স্কুল এবং কলেজগুলিতে ভালো মানের মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে সক্ষম হলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে এর বিপরীত ঘটে। মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে অভিভাবক ও পরিচালনা কমিটির আত্মীয়-স্বজন শিক্ষক হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার হলে মাধ্যমিক শিক্ষা খারাপ অবস্থায় আছে। এর ফলে কোচিং বাণিজ্য, গাইড বাণিজ্য বেড়ে গিয়েছিল। ভালো মানের শিক্ষকেরা স্কুলে না পড়িয়ে কোচিংয়ে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠ। এখান থেকে ভালো মানের শিক্ষকদের খুজে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং তাদের ভালো আউটপুটের জন্য আলাদা টাকা পুরষ্কৃত করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অনেকেই বলছেন মাধ্যমিক শিক্ষায় দশটি সাবজেক্ট বাধ্যতামূলক না করে, ভারতের মত সব সাব্জেক্ট ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য, যার যেদিকে আগ্রহ, সে সেদিকে যাবে। বিষয়টা পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে নেওয়া যেতে পারে।
মূলত এতদিন ডজন ডজন প্রশ্ন মুখস্ত করে অফিসের কর্মকর্তা হওয়া মানুষগুলো নিজেদের স্যার ভাবা শিখেছে কিন্তু নিজের কাজটা নিজে করতে শিখেনি। এরা পোশাক পড়ে ভদ্রলোক সেজেছে কিন্তু ভদ্র মানুষের আচরণ শিখেনি । এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে দেশের যেকোনো অফিস-দপ্তরে সেবা নিতে গেলে এর সত্যতা টের পাবেন। এই পরজীবিরা নতুনত্বকে মানতে চায় না । এর মুখে বলবে সন্তানকে শিক্ষিত করতে চায়, কিন্তু আদতে যেটা চায় সেটা হল একটা চাকরি করার সার্টিফিকেট। বেশিরভাগ বাঙালি এখনো টয়লেট ব্যবহার করতে জানেন না। টয়লেটটা ব্যবহার করার পর যে তা পরবর্তী ব্যক্তির জন্য পরিস্কার করে রাখতে হয়- এটা এরা শেখেন নাই। এরা মুখ বন্ধ করে নিঃশব্দে খেতে জানেন না। খেতে খেতে মোবাইলে কথা বলে। খাওয়ার পর নিজের খাবারের প্লেট বা উচ্ছিষ্ট খাবার টেবিলে ছড়িয়ে রাখে, ওয়েটার বা বাডীর চাকর-বাকর পরিষ্কার করবে বলে। এরা রান্না করে খেতে জানেন না। নিজের কাপড়-চোপড় নিজে ধুতে পারেন না। যেখানে সেখানে ধুমপান করেন। রাস্তায় কারো সামনে বা বাড়ির ভেতরে কিংবা বাচ্চাদের সামনে যে ধুমপান করাটা অশোভন- এটা এরা বোঝেন না। জীবনের এরকম আরো অসংখ্য প্রাথমিক জ্ঞান বা আচরণ আছে- যা এই উচ্চ শিক্ষিত প্রগতিশীল বাঙ্গালিরাও শিখতে পারেননি। কারণ, বাঙালির এই কাজগুলো করে দেন আমাদের 'মায়েরা'। আর ধনীদের বেলায় করে দেন তাদের 'বুয়া'।
স্কুলে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের পাঠ্যক্রমে জীবনের এসব বেসিক ট্রেনিং, জ্ঞান, বা শিক্ষার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করছেন কিছু মানুষ। দেশের সিংহভাগ বাবা-মায়েরা সেই বক্তার সঙ্গে বিনাপ্রশ্নে একমত হচ্ছেন। আদতে আমাদের বাবা-মায়েদের বড়ো অংশই শিক্ষা বঞ্চিত এবং সেকেলে। একটা দেশের পাঠ্যক্রম তৈরি করা বিশেষজ্ঞদের কাজ, তারা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কারিকুলাম, গবেষণা ও বাস্তব ফলাফল বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যক্রম তৈরি করে। সুতরাং নিজেকে মহা পন্ডিত ভেবে নিয়ে কিছু একটা গলা ফাটিয়ে বলাটা নেহায়েত বাচালতা। বর্তমান শিক্ষানীতির সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে আমার মনে হয় আগামী দিনের সুন্দর একটি বাংলাদেশ পাবো আমরা।
ফরেনসিক গবেষণাগারে মানুষের DNA নিয়ে তা বিশ্লেষণ করে আদিপিতা ও আদিমাতা
আদিপিতা আফ্রিকাতে, আজ থেকে প্রায় ২ লক্ষ বছর প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার বছর আগে আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলে এক মহিলা বাস করতেন, তিনি হলেন আজকের পৃথিবীর জীবিত সব মানুষের আদিমাতা।
দুই জার্মান অভিযাত্রী বরফাবৃত আল্পস পর্বতের সাড়ে ১০,০০০ ফুটের অজানা খাঁজে ক্লান্তি পিঠে নিয়ে ধীর লয়ে এগনোর সময় হঠাৎই দেখেন উপুড় হয়ে থাকা বরফচাপা মানব শরীর। প্রথমে ভেবেছিলেন, অচেনা কোনও অভিযাত্রীর দেহ। পরে জানা যায়, সেটির বয়স ৫,৩০০ বছর, পৃথিবীর ইতিহাসে অবিকৃত ও সর্বাধিক সুরক্ষিত প্রকৃতির ফ্রিজে লুকনো এক মমি! তারই নাম দেওয়া হল ‘ওটজি’। মৃত্যুর কারণ জানতে গিয়ে বোঝা গেল, বাম কাঁধে বেঁধে রয়েছে তীক্ষ্ণ শলাকার খণ্ড, যা হৃৎপিণ্ডের সাবক্লেভিয়ান ধমনীতে তৈরি করেছিল গভীর ক্ষত। অজ্ঞাতসারে পিছন থেকে অতর্কিত আঘাতে ডানহাতের উপর ভর করে মুখ থুবড়ে পড়ে ওটজি। বছর ৪৬-এর এই মানুষটির সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল অসমাপ্ত তির আর ধারালো ছুরি। ছুরিটি ধরা ছিল তার ডান হাতে, সেই সঙ্গে ডান কবজিতে এলোমেলো গভীর ক্ষত। পাকস্থলী পরীক্ষা করে বোঝা গেল, মৃত্যুর আগে শেষ খাবারই বা কী ছিল।
ওটজির পোশাক তৈরিতে ব্যবহার হয়েছিল পঁাচ ধরনের প্রাণীর চামড়া। ভেড়ার চামড়া কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ক’টি বস্ত্র, ছাগলের চামড়া কাজে লাগিয়ে প্যান্ট, হরিণের চামড়া ব্যবহার করে তির রাখার ডালি, ভল্লুকের চামড়া দিয়ে টুপি, গরুর চামড়া দিয়ে জুতোর ফিতে, ছাগলের চামড়া দিয়ে প্রস্তুত ঝোলা কোট যা এলোমেলোভাবে ভেড়ার সরু চামড়া দিয়ে তাড়াতাড়িতে বোনা।
প্রথম দেখায় ওটজির শরীরে ৪৯টি ট্যাটু লক্ষ করা গিয়েছিল, পরে আরও ১০টি, সবশেষে সংখ্যাটি দঁাড়ায় ৬১। কিছু ট্যাটু লম্বা কিছু আড়ে, ‘ট্যাটু’ বলতে বেশ কয়েকটি দাগ। বাম কবজি, পায়ের নিম্নভাগে, কোমর-সহ ওটজির বুকেও রয়েছে ট্যাটু। চামড়ার উপরের অংশ চিরে তার মধ্যে চারকোল ঘষে তৈরি করা হয়েছিল আদিম ট্যাটুগুলো। রহস্যময় ট্যাটুগুলো নিয়ে চাপা বিতর্কের স্রোত এখনও। ভাবা হয়, ট্যাটুগুলোয় দক্ষিণ আমেরিকার চিনচোরো সংস্কৃতির প্রভাব। চিনচোরো মূলত মৎস্যজীবী। তারা চিলি, পেরুর প্রান্তে বসবাস করত।
তাদের ছয় হাজার বছর পুরনো মমি থেকে পৃথিবীর আদিমতম ট্যাটুর খোঁজ মিলেছিল। তবে মমির এই বয়স বিতর্কিত, সেক্ষেত্রে বরফ মানব ওটজির ট্যাটুগুলোই প্রাচীনতম। ওটজির শেষ খাবার কী ছিল? মৃত্যুর আগে বিজ্ঞান দেখল, ওটজি ৩০০ গ্রাম খাবার নিয়েছিল। কী ছিল তাতে। লম্বা সিং হরিণের মাংস, গম আর অল্প পরিমাণে বিষাক্ত ফার্ন। এই বিষাক্ত ফার্ন বেশি পরিমাণে খেলে গরুদের অ্যানিমিয়া হয় এবং ছাগলগুলো অন্ধ হয়ে পড়ে। হরিণের চর্বির স্বাদ নাকি ভয়ংকর, তবুও পাহাড়ে যাবতীয় শক্তির উৎস চর্বি থেকে পাওয়া শক্তি।
DNA অনুসারে আমাদের আদি মাতা / আদিপিতা
নব্বইয়ের দশকে ইতালির আল্পস পর্বতে বরফের মধ্যে একটা মৃত দেহ খুজে পাওয়া গেল। কার্বন পরীক্ষার শেষে জানা গেলো, দেহটি এই মানুষটি আসলে ৫০০০ থেকে ৫৩৫০ বছর আগের। ঘটনাটা তখন আন্তর্জাতিক খবর হয়ে দাঁড়ালো। এরপর ফরেনসিক গবেষণাগারে দেহটির DNA নিয়ে তা বিশ্লেষণ করে অবিশ্বাস্য একটা তথ্য পাওয়া গেল! তা হল- মৃতদেহটির DNA বর্তমানে ইউরোপে বাস করা মানুষদের DNAএর সাথে একদম হুবহু মিলে যায়। সার্চ করে দেখা ওই ল্যাবেরই ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টেন্ট হিসেবে কর্মরত মেরির DNA এর সাথে এই বরফ মানবের DNA একদম হুবহু ম্যাচ করে। অর্থাৎ বরফ মানব আক্ষরিক অর্থেই মেরির পূর্বপুরুষ। নিউজটি প্রথমে সানডে টাইমসে প্রকাশিত হয়। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মেরি রীতিমত আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটিতে পরিণত হন। আমাদের DNA থাকে কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে। তবে নিউক্লিয়াস ছাড়াও মাইট্রোকন্ড্রিয়ার মধ্যে থাকা DNA বিশ্লেষণের সাহায্যে মায়ের দিকের বংশধারা বের করা হয়।
এরপর প্রফেসর এর মাথায় আরও একটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। যদি পাঁচ হাজার বছর আগের একজন মানুষকে মেরির পূর্বপুরুষ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে আমাদের প্রত্যেকরই হাজার হাজার বছর আগের পূর্বপুরুষদের খুজে বের করা যাবে ! এরপর তিনি প্রায় দশ বছর ধরে এই বিষয়টা নিয়েই গবেষণা করে গেছেন। তার গবেষণায় যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য! প্রাচীনকালের বিভিন্ন নমুনা এবং আজকের দিনের হাজার হাজার মানুষের DNA নিয়ে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখতে পেলেন যে- আজকের দিনে যে ৬৫০ মিলিয়ন ইউরপিয়ান বেঁচে আছে, তারা প্রত্যেকেই সাতজন মহিলার বংশধর। অর্থাৎ এরাই হলেন ইউরোপের সকল মানুষদের আদিমাতা। প্রফেসর সাইকস এদের নাম দিয়েছেন “The Seven Daughters of Eve”।
এই আদিমাতারা কিন্তু একই সময়ে জীবিত ছিলেন না। কেউ হয়ত ১৭ হাজার বছর আগের মানুষ, আবার কেউ হয়ত জীবিত ছিলেন আজ থেকে ২৫ হাজার বছর আগে। পরবর্তীতে জেনেটিসিস্টরা হিসাব করে দেখেছেন যে, আজ থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার বছর আগে আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলে এক মহিলা বাস করতেন, তিনি হলেন আজকের পৃথিবীর জীবিত সব মানুষের আদিমাতা। এই আদিমাতা এখন মাইট্রোকন্ড্রিয়াল ইভ (Mitochondrial Eve) নামেই পরিচিত। মাইট্রোকন্ড্রিয়া যেমন আমরা শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকে পাই, তেমনি Y ক্রোমোজোমের DNA টা আমরা শুধু বাবার কাছ থেকেই পাই। Y ক্রোমোজোম শুধুমাত্র বাবা থেকে ছেলেরা পায়। Y ক্রোমোজোমের জেনেটিক লিঙ্ক থেকে যে আদিপিতা পাওয়া যায় তাকে বলা হয় “Y ক্রোমোজমাল এডাম”। এই লোকটিও বাস করতেন আফ্রিকাতে, আজ থেকে প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে। এই লোকটি হলেন আজকের পৃথিবীতে বাস করা প্রতিটি লোকের আদিপিতা।
মানুষের DNA বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে যে- আজ থেকে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে ১ হাজার জনেরও কম মানুষের একটা দল আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পরে। পরবর্তীতে তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে। আজকের দিনে আফ্রিকার বাইরে যত লোক বাস করে, তারা সবাই ঐ ছোট্ট দলটিরই বংশধর। ১২০০০ বছরের আগে মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করত না। ফলে এই সময়ের আগের তেমন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ খুজে পাওয়া খুব কঠিন।
৫০০০ বছরে লিখিত ইতিহাস আমাদের কাছে আছে। আগের যেকোনো কিছুকেই বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা। এই প্রাগৈতিহাসিক সবকিছু আমরা DNA বিশ্লেষণ করে এখন জানতে পারছি
লিও তলস্তয় The Imp and the Crust
রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক লিও তলস্তয় ১৯০২ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার-এর জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন
এবং তাঁর পুরস্কার না পাওয়ার ঘটনাটি নোবেল পুরস্কার বিতর্কের একটি অন্যতম বিষয় আজও হয়ে আছে।
তলস্তয়কে নিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন, ‘তলস্তোয় নিজেই একটি পৃথিবী’। দস্তয়ভস্কি মনে করতেন, “জীবিত সকল সাহিত্যিকদের মধ্যে তলস্তয়
সর্বশ্রেষ্ঠ”। আন্তন চেখভ বলেছেন, “কত প্রতিভাবান একজন শিল্পী এবং মনস্তাত্বিক!!” তাঁর সমগ্র লেখা দিয়ে মানুষের মধ্যে জীবনবোধ,
মনুষ্যত্ববোধ, নীতিবোধ জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন তলস্তয়।
তলস্তয়য়ের;The Imp and the Crust গল্পটি আমার প্রিয় গল্পগুলির অন্যতম। চমৎকার এই গল্পটির সারকথা লেখার তাগিদ অনুভব করছি আজ।
এক গরিব চাষী ভোরবেলা লাঙল নিয়ে মাঠে এসেছে জমি চাষ করতে। খাবারের জন্য সঙ্গে আছে এক টুকরো রুটি। সে তার গায়ের জামা খুলে তা দিয়ে
রুটিখানা পেঁচিয়ে রেখে দিল এক ঝোপের আড়ালে। দুপুর অবধি লাঙল টেনে ঘোড়াটা ক্লান্ত হয়ে উঠল, চাষীরও বেশ খিদে পেল। তখন চাষী খাবার খাবে বলে ঝোপের কাছে এল। কিন্তু জামাটা খুলেই সে অবাক! দেখে রুটির টুকরোটি সেখানে নেই। সে জামা তুলে ঝাড়ল, আশেপাশে অনেক খুঁজল কিন্তু রুটিখানা সত্যিই নেই। চাষী খুব অবাক হল। সে মনে মনে ভাবল, তাজ্জব ব্যাপার কাউকে কোথাও দেখতে পেলাম না অথচ রুটিটা নেই! নিশ্চয়ই কেউ চুপিচুপি এসে রুটি নিয়ে পালিয়েছে।
আসলে এক শয়তান তখন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। চাষী যখন কাজে ব্যস্ত ছিল তখন সে রুটি সরিয়েছে। রুটি হারিয়ে চাষী কীভাবে গালাগালি করে তাই সে শুনবে। শুনে আমোদ পাবে।
রুটির টুকরো হারিয়ে চাষীর মনে দুঃখ হলেও সে মনে মনে বলল; আমি তো খিদেয় মরে যাব না। নিশ্চয়ই কোনো ক্ষুধার্ত লোক ওটা নিয়েছে।
লোকটি কুয়োর কাছে গেল। সেখান থেকে পেট পুরে জল পান করল। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আবার লাঙল জুড়ে জমি চাষ করতে লাগল।
এদিকে শয়তান ভেবেছিল, রুটির টুকরোটি না-পেয়ে চাষী ভয়ানক রেগে যাবে। রেগে গিয়ে গালাগালি শুরু করবে। কিন্তু চাষীকে তেমন কিছু করতে না দেখে খুব হতাশ হল। শয়তান অবশেষে তাদের সরদারের কাছে গিয়ে সব খুলে বলল।
শয়তান সরদার তার কথা শুনে ভয়ানক চোটে গেল, সবাই যদি এমন ভালোমানুষ হয়ে ওঠে তাহলে শয়তানদের ঠাই হবে কোথায় ? তিনি আদেশ দিলেন শিগগির আবার ফিরে যাও। গিয়ে ঠিকমতো কাজ করে এসো। যদি তিন বছর সময়ের মধ্যে সে ওই চাষীকে বিপথে না-আনতে পারে তবে তাকে আর দলে রাখা হবে না বলে হুঁশিয়ার করে দিল।
সরদারের কথায় শয়তান ভয় পেয়ে গেল। সময় নষ্ট না করে সে আবার পৃথিবীতে নেমে এল। এসে ভাবতে লাগল, কী উপায় সে করবে। কী করে লোকটাকে দিয়ে খারাপ কাজ করাবে। ভাবতে ভাবতে একটা মতলব শয়তানের মাথায় এল। চমৎকার মতলব!
সে এক মজুর সেজে সেই গরিব চাষীর বাড়িতে কাজ করতে গেল। চাষী তার কথায় মুগ্ধ হল। প্রথম বছরে সে চাষীকে পরামর্শ দিল শুধু নিচু জমিতে ফসল বুনতে। চাষী তার কথা শুনে নিচু জমিতে ফসল বুনল। সে বছর বৃষ্টি খুব কম হল। খড়ায় জ্বলেপুড়ে সব ফসল নষ্ট হয়ে গেল। এদিকে সেই গরিব চাষীর দ্বিগুণ ফসল ফলল। ফলে সারাবছর খেয়েও তার অনেক শস্য বেঁচে গেল। বাড়তি শস্য বিক্রি করে সে অনেক টাকা পেল।
শয়তান পরের বছর অপেক্ষাকৃত উঁচুভূমিতে ফসল ফলাতে চাষীকে পরামর্শ দিল। চাষীও সেবার তাই করল। সেবার গ্রীষ্মের সময় বৃষ্টি হল খুব বেশি। সবার ক্ষেতের ফসল অতিবৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেল। আর চাষী উঁচুজমির ফসল আগের বছরের চেয়েও ভালো হল। এবার খেয়ে বেঁচে গেল আরও বেশি ফসল। শয়তান তখন চাষীকে এক নতুন পথ বাতলে দিল। শস্য থেকে কী করে মদ তৈরি করতে হয় তাই চাষীকে শিখিয়ে দিল। চাষীর তখন মহানন্দ। মদ তৈরি করে সে নিজেও পান করল, বন্ধুদেরও ডেকে পান করাতে লাগল।
শয়তান তখন মনের আনন্দে তার সরদারকে গিয়ে বলল, এতদিনে আমার মনের বাসনা পূরণ করে এসেছি। সরদার শুনে বলল, দাঁড়াও, একবার আমার নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখে আসতে দাও। এই বলে সরদার নেমে এল চাষীর বাড়ি। এসে দেখল, চাষী তার সব ধনী–বন্ধুদের দাওয়াত করে এনেছে। বাড়িতে এনে মদ পান করতে দিয়েছে। চাষীর বউ মেহমানদের মদ পরিবেশন করছে। মদের পাত্র নিয়ে একটি টেবিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ধাক্কা লেগে তার খানিকটা মেঝেয় পড়ে গেল। তাই দেখে চাষী রেগে বলল, ও কী করেছ, যতসব বে-আক্কেলে মেয়েমানুষ।
শয়তান তখন সরদারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, এবার দেখ, এ লোকই একদিন একমাত্র সম্বল তার রুটির টুকরোটি হারিয়ে একটুও অস্থির হয়নি। কিন্তু আজ ?
এমন সময় চাষীর বাড়িতে এসে ঢুকল সে-গাঁয়েরই এক গরিব লোক। তাকে দাওয়াত করা হয় নি। মাঠে কাজ করে লোকটা বাড়ি ফিরছিল। ঘরে ঢুকেই সবাইকে অভিবাদন করে সে একপাশে বসে মদ খাওয়া দেখতে লাগল। সারাদিন কাজ করে লোকটা খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তৃষ্ণাও পেয়েছে বেশ। সে ভাবছিল, এ-সময় একফোটা মদ পেলে বেশ হত। চেয়ে চেয়ে দেখে তৃষ্ণাটা তার বেড়েই চলেছে। কিন্তু চাষী তার দিকে একফোটা মদও দিতে রাজি নয়। সে বরং বলে উঠল, যাকে-তাকে মদ বিলানো তার কাজ নয়।
চাষীর মুখে একথা শুনে শয়তানের সরদার খুব খুশি। কিন্তু শয়তান নিজে খুশি হয়েছে আরও বেশি। তাই হাসতে হাসতে সে সরদারকে বলল, চুপ করো একটু, আরও মজা দেখতে পাবে এক্ষুনি।
মেহমানরা সবাই মদ খেয়েছে। বাড়িঅলা চাষীও খেয়েছে মনের সুখে। ভদকা খেয়ে যত রাজ্যের সত্যিমিথ্যে আবোল-তাবোল গল্প শুরু করেছে সবাই মিলে। শয়তানের সরদার সব শুনছে আর মনে মনে শয়তানের বুদ্ধির প্রশংসা করছে। শয়তান বলল, আরেকটু থামো। দেখে নাও এরপর কী মজা শুরু হয়। আরেক গ্লাস করে সবাইকে খেতে দাও। তখন দেখবে মজা। এখন ওরা শিয়ালের মতো লেজ নাড়ছে আর একে অপরকে খুশি করতে চাইছে। এরপর দেখবে, এরাই হয়েছে সব এক একটা ভয়ানক নেকড়ে বাঘ! আরও এক গ্লাস করে সবাই যখন খেল তখন তাদের মুখে তুবড়ি ছুটছে। গল্প-গুজবের পরিবর্তে এবার আরম্ভ হয়েছে চিৎকার। রাগের মাথায় একজন আরেকজনকে যা-খুশি বলছে। একটু পরেই শুরু হল হাতাহাতি আর মারামারি। একজনের নাকের উপর আরেক জনের ঘুষি। চাষীও এসে যোগ দিল মেহমানদের সঙ্গে। সে মারও খেল আচ্ছারকম।
শয়তানের সরদার অতি-আনন্দে তামাশা দেখতে লাগল। আর মনে মনে বলে উঠল, চমৎকার তো! কিন্তু তখনও শয়তান বলছে, আরেকটু সবুর করো। আরেক গ্লাস পেটে পড়তে দাও, তারপর দেখবে মজা। এখন ওরা লড়াই করছে নেকড়ের মতো। এরপর করবে শূকরের মতো।
তৃতীয় গ্লাস খেয়ে সত্যিই লোকগুলো জানোয়ারের মতো ব্যবহার করতে লাগল। অদ্ভুত ধরনের চিৎকার শুরু করল তারা। অকারণে শুধুই চিৎকার করছে, কেউ কারোর কথায় কান দিচ্ছে না।
এরকমভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়ে তারা বাড়ি ফিরতে লাগল। কেউ একাই টলতে টলতে হেলেদুলে চলতে লাগল, অনেকে দুজন বা তিনজনের দল বেঁধে বাড়িওলা চাষী দরজা অবধি এসেছিল তাদের বিদায় দিতে। সেখানে সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কাদায়। মাথা থেকে পা অবধি সারা গা তার লেপটে গেল কাদার ভেতর। মুখ গুঁজে পড়ে সে ঠিক শূকরের মতো ঘোঁত ঘোত করত লাগল।
তাই দেখে শয়তানের সরদার আরও খুশি। সে শয়তানকে বলল, ভারি মজার জিনিস তৈরি করেছ তুমি। রুটির ব্যাপারে যে ভুলটুকু করেছিলে, মদ তৈরি করে সে-ভুল শুধরে গেল তোমার। কিন্তু এখন বলো তো, কী করে এই আজব জিনিসটা তুমি তৈরি করেছ? প্রথমে বুঝি দিয়েছ শিয়ালের রক্ত, তাই শিয়ালের মতো করছিল লোকগুলো। তারপর বুঝি দিয়েছ নেকড়ের খানিকটা রক্ত, তাতেই নেকড়ের স্বভাব পেয়েছিল ওরা। আর সবশেষে দিয়েছ শূকরের রক্ত, তাই ঘোঁত ঘোঁত করছিল ওরা ঠিক শূকরের মতোই।
শয়তান মাথা নেড়ে বলল, না, সেসব কিছুই না। প্রথমে আমি শুধু বুঝতে পেরেছিলাম, চাষী তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফসল পেয়েছে। জানোয়ারের রক্ত মানুষের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। যতক্ষণ অবধি সে শুধু প্রয়োজনীয় ফসল পেয়েছে ততক্ষণ সেই জানোয়ারের স্বভাব চাপা পড়েছিল। সে সময় চাষী তার শেষ সম্বল একটুকরো রুটি হারিয়েও কোনও অনাসৃষ্টি কাণ্ড বাধায়নি। কিন্তু যখন থেকে তার ফসল খেয়েদেয়ে বাড়তি হতে লাগল তখনই সেই বাড়তি ফসল দিয়ে সে আমোদ করার উপায় খুঁজল। আমি তখনই তাকে সেই আমাদের পথ দেখিয়ে দিলাম, মদ পানের আনন্দ। তারপর যখন থেকে সে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ দান এই ফসলকে মদে পরিণত করে তাই পান করতে লাগল তখন থেকেই তার ভেতরকার শিয়াল, নেকড়ে ও শূকর মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
অসুন্দরকে সুন্দর দিয়ে জয়
প্রতিপক্ষ যত অপরাধ করুক বা যত অশালীন আর খারাপ আচরণই করুক না কেন, আমাদের সংযত হয়ে আন্তরিকতা মেশানো ভাষাতেই জবাব দিতেহবে।অসুন্দর ব্যবহারের বিপরীতে সুন্দরভাবে জবাব দিয়ে আপনার মেধা-রুচি আর ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করুন। সব ব্যপারেই অন্যের সাথে একমত হতে হবেন, এমন কোন কথা নেই। তবে ভিন্ন মতকে শ্রোদ্ধার চোখেই দেখুন। নিজের কথায় যুক্তিওশালীনতা যেন বজায় থাকে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। রক্তের সম্পর্ক ও আত্মার সম্পর্ক বিলুপ্ত হয় যদি সেখানে স্বার্থের সম্পর্ক না থাকে বৃষ্টি থেমে গেলে ছাতাটাকেও বােঝা মনে হয়। কালি ফুরিয়ে গেলে কলমটাও আবর্জনার ঝুড়িতে জমা হয়। বাসি হয়ে গেলে প্রিয়জনের দেয়া ফুলটাও পরদিন ডাস্টবিনে পাওয়া যায়।
পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সত্য হলাে আপনার উপকারের কথা মানুষ বেশিদিন মনে রাখবে না। জীবনের সবচেয়ে নিদারুণ বাস্তবতা হলাে, কার কাছে আপনি কতদিন গুরুত্ব পাবেন, সেটা নির্ভর করবে কার জন্য কতদিন কিছু একটা করার সামর্থ্য আছে তার উপর। আপনি কারাে জন্য কিছু করে থাকলে সেটা চিরতরে ভুলে যান। কারণ সেটা যতদিন আপনি মনে রাখবেন ততদিন সেটা আপনাকে অহংকারী করে তুলবে।
আবার কেউ যদি আপনার জন্য খুব ছােট কিছুও করে থাকে, তবে সেটা আজীবন মনে রাখবেন। কারণ এটা আপনাকে বিনয়ী ও কৃতজ্ঞতাসম্পন্ন একজন ভালাে মানুষ হিসেবে বাঁচিয়ে রাখবে।
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল চীনের নেতা মাও সে তুং।
১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সব ধরনের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড ও সংগঠন চীনে নিষিদ্ধ ছিল। এখনো কোনো ধর্মবিশ্বাসী ব্যক্তি চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে পারে না।মাও সে-তুংয়ের শাসনামল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চীনে কুকুর পালাও নিষিদ্ধ ছিল। মাও সরকার মনে করত, কুকুর পালা বুর্জোয়া বিলাসিতা; ফ্রিতে মাংস খাওয়ার লোভে চীনের অনেক প্রদেশে কুকুর জবাই করে খাওয়া শুরু হলো, এখনো চলমান। শুধু কুকুরই নয়, মাও সরকার ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত চীনে ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ নামে এক আন্দোলন শুরু করেন।
মাও বলেন, ইঁদুর, মশা, মাছি আর চড়ুই পাখি হলো মানুষের মূল শত্রু। এসব মেরে ফেলতে হবে। কারণ একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে, উ ল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফসল খেয়ে ফেলে আমাদের চারপাশে বসবাসরত চড়ুই পাখির দল। হকুম দেয়া হল, প্রত্যেক নাগরিক নিকটবর্তী চড়ুই পাখির আবাসস্থল খুঁজে দিনভর পাখিগুলোকে তাড়া করে বেড়াবে। সকলে একসাথে বিকট শব্দের সৃষ্টি করবে যেন ভয়ে পাখিগুলো কোথাও নামতে না পারে। এভাবে উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে যখন পাখিগুলো নিচে পড়ে যাবে, তখনই ধরে মেরে ফেলতে হবে।মূলত, কম বয়সী মানুষের ঘাড়ে পড়েছে চড়ুই পাখি ধরা, তাড়া করা, বিষ দিয়ে মারার মতো কাজগুলো। আর বৃদ্ধ ও শিশুদের দেয়া হয়েছে প্রহরীর দায়িত্ব। হাজার হাজার ফ্রি ফায়ার জোন স্থাপন করা হয়েছিল। পাখি শিকার করার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। করল।ছাত্র/ছাত্রী থেকে শুরু করে সেনাসদস্যসহ সাধারণ মানুষ, সবাই অংশ নিল এতে। চড়ুই পাখি দিয়ে মহা ভোজ শুরু হলো। তা শুনে বাঙালি কবিরা চড়ুইবাতি নামে বাংলা শব্দ তৈরি করে কবিতা লেখা শুরু করলো। যাই হোক, ধারণা করা হয় প্রায় ৬৫ কোটি চড়ুই পাখি খুন হয়েছিল চীনে। এর পোশাকি নাম ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’। তবে হিতে বিপরীত হলো। ফল পাওয়া গেল পরের বছরই। চড়ুই কমে যাওয়ায় বেড়ে গেল শস্য ধ্বংসকারী কীটের উপদ্রব। দেখা গেল, চড়ুই যতটা শস্য খেত, তার চেয়ে কীটের কারণে কয়েক গুণ বেশি ক্ষতি হয়েছে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শস্যভাণ্ডার খালি হয়ে গেল। খাদ্য সংকটের মুখে পড়লো কোটি কোটি মানুষ। দেখা দিলো মহাদুর্ভিক্ষ। এ দুর্ভিক্ষ ‘দ্য গ্রেট ফেমিন’ নামে পরিচিত। চীনা সরকারের অফিসিয়াল নথি অনুযায়ী, খাদ্য সংকটে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা ছিল ১৫ মিলিয়ন। যদিও দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মতে, সংখ্যাটা ৪৫ মিলিয়ন কিংবা ৭৮ মিলিয়নেরও বেশি। সেই মহাদুর্ভিক্ষে 'Cannibalism'- নরমাংস ভক্ষণ বহু জায়গায় ঘটেছিল। শেষমেশ চিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েক লাখ চড়ুই আমদানি করতে বাধ্য হয়। এই চড়ুই সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে চীন আস্তে আস্তে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামাল দিতে সক্ষম হয়।
চীনাদের করা এই ভুলের খেসারত তাদেরকে দিতে হয়েছিল কয়েক দশক ধরে। কিন্তু তবুও কি প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণের পরিণাম থেকে শিক্ষা নিতে পায়নি তারা? গত বছর এক চীনা গবেষক দলের প্রকাশিত রিসার্চ পেপারে উঠে এসেছিল চীনাদের অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসের ফলে জন্ম করোনা ভাইরাস। তবুও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন বা গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে কর্তৃপক্ষ কোনো রকম পদক্ষেপ নেয়নি। মাওসেতুং ৬৫ কোটি চড়ুই পাখি হত্যা করেছিলেন পরিণতিতে দুর্ভিক্ষে প্রায় দেড়কোটি মানুষ মারা যায়।
যেভাবে ঈদ উৎসব উদযাপন শুরু হয়েছিল
রাসুলুল্লাহ (সা.) ৬২২ সালে মদিনায় পৌঁছে দেখতে পান যে মদিনাবাসী ইহুদিরা শরতের পূর্ণিমায় নওরোজ উৎসব ও বসন্তের পূর্ণিমায় মেহেরজান উৎসব উদযাপন করছে। মহানবী (সা.) মুসলমানদের এ দুটি উৎসব পালন করতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ তোমাদের ওই উৎসবের বিনিময়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মতো পবিত্র দুটি দিন দান করেছেন। ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ঈদ উদযাপন করা হয়েছিল। ইসলামের শুরু যুগে নারী ও শিশুদেরও ঈদগাহে নিয়ে যাওয়া হতো; এমনকি ঋতুমতী নারীও ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে এক পাশে অবস্থান করত।
মুঘলরা ঢাকায় এসেছিল ১৬১০ সালে। তখন তাদের পাঠানো নায়েব-নাজিমরা ঈদ উদযাপন করতেন। ঈদের চাঁদ উঠলে কামান দাগা হত। ঈদের দিন তারা একসঙ্গে নামাজ পড়তেন, নামাজ পড়ে ফেরার পথে হাতি বা ঘোড়ার পিঠ থেকে তারা সাধারণ মানুষের দিকে পয়সা ছুঁড়ে দিতেন। নিম্নবিত্ত মানুষও তখন রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে থাকত, মোগল-আমিরদের ঈদযাত্রা দেখার জন্য বা উপহার পাওয়ার আশায়।
১৭২৯ সালের পবিত্র রমজান মাসের শেষ দিন। রাত পোহালেই ঈদ। দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খান খবর পেলেন ত্রিপুরা রাজ্য জয় হয়েছে, এটি এখন তাঁদের দখলে। এই সংবাদ মুর্শিদ কুলি খানের ঈদের আনন্দ দ্বিগুণ করে দিল। তিনি আদেশ দিলেন, ঢাকা কেল্লা থেকে (ধানমন্ডির) ঈদগাহ পর্যন্ত দুই মাইল রাস্তায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এক হাজার টাকা বিলিয়ে দিতে। ঈদযাত্রা করে তাই-ই করা হলো।
মোগলরা ঈদ উদযাপন করতো ২ থেকে ৩ দিন ধরে। খাবারের আয়োজনে থাকতো নানান বৈচিত্র্য। মুঘলদের তৈরি ঈদের একটা প্রতীক এখনো ঢাকায় আছে, সেটি হচ্ছে ধানমন্ডি ঈদগাহ।১৬৪০ সালে প্রথম দিকে গড়ে ওঠা ধানমন্ডির ওই ঈদগাহে সবার যাওয়ার সুযোগ ছিল না, কেবল নবাব, উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারী, কাজি-হাকিম এবং তাঁদের বন্ধুবান্ধবই ঈদগাহে যেতেন।
পরে সতের শতকের দিকে সিলেটের প্রথম ঈদগাহ শাহি ঈদগাহ এবং আঠারো শতকে কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদীর তীরে শোলাকিয়াহ ঈদগাহসহ পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঈদগাহ বা ঈদের মাঠের গোড়াপত্তনের মধ্য দিয়ে মূলত ঈদ উৎসব পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ঢাকায় আসা খোরাসানি শিয়া সম্প্রদায়ের ঈদ-মিছিল বের হতো, মিছিলে জমকালো হাওদায় সজ্জিত ঘোড়া, হাতি, উট, পালকি,বাদ্যকর..আরও কত কী থাকতো! এই ঈদ আনন্দমিছিল ঢাকার নিমতলি প্রাসাদ থেকে চকবাজার, হোসেনি দালান ঘুরে আবার ফিরে আসত প্রাসাদে। বিশ শতক পর্যন্ত চাঁদরাতে ঈদের কেনাকাটায় ছেলেরা কাগজের টুপি কিনত, মেয়েরা কিনত চুড়ি। সেসময়কার সাধারণ মানুষ ধুতি পরতেন। নামাজের সময় ধুতির পেছনের গিঁঠ খুলে দিতেন। দেড়শ বছর আগেও আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে ঈদ তেমন বড় কোন উৎসব ছিল না।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র হবার পর - এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঈদ উৎসব আস্তে আস্তে বিস্তৃত হতে থাকে।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ঘটনাটি জনপ্রিয় একটি জার্মান গল্প। জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি প্রদেশের ওয়েসার নদীর তীরে অবস্থিত হ্যামিলন শহর। বর্তমানের হ্যামেলিন শহরে যদি আপনি কখনো বেড়াতে যান. তবে দেখবেন সেখানে রাস্তার মোড়ে বাঁশিওয়ালার একটি মূর্তি আছে, সাথে ইঁদুর। মূলত বাঁশিওয়ালার গল্পটি নিছক ছেলেধরার কাহিনী, এর সাথে শুধু হ্যামিলন জায়গাটা যোগ হয়েছে।অনেকটা আমাদের বনলতা সেনের সাথে যেভাবে নাটোর যুক্ত হয়েছে। প্রতি বছর ২৬ জুন পালন করা হয় র্যাট ক্যাচার দিবস। যে রাস্তায় সর্বশেষ বাঁশিওয়ালাকে দেখা গিয়েছিল বলে দাবী করা হয়, সে রাস্তার নাম হচ্ছে Bungelosenstrasseবা ‘নো ড্রাম স্ট্রিট’। এ রাস্তায় কোন মিউজিক বাজানো নিষিদ্ধ। প্রায় ৭০০ বছর ধরেই এমনটি চলে আসছে বলে জানা যায়।১২৮৪ এর দিকে জার্মানে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। ইঁদুর ছিল এ রোগের বাহক। সে সময় শহরে ইঁদুর ধরার বিশেষ লোক ছিল, যারা বাঁশি বাজিয় ইঁদুর ধরতো। সেসময় প্লেগে অনেক শিশু মারা যায়। তাই পুথির পাতায় বর্নিত বাঁশিওয়ালার আসলে রূপক অর্থে তুলে ধরা হয়েছে।
ফ্রেঞ্চ আমেরিকান দার্শনিক রেনে জিরার্দের মিমেটিক তত্ত্ব দ্বারা ঘটনাটা বিশ্লেষণ করলে, হ্যামিলনের বাশিওয়ালাকে ধরতে হবে একজন মডেল হিসেবে। মডেল হচ্ছে সে, যাকে অন্য মানুষেরা অনুকরণ করে। গল্পে বর্ণিত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে বাচ্চারা যখন অনুসরণ করলো, তখন তাদের কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ছিল না। মডেল যেদিকে গেছে, শিশুরা সেদিকে গেছে। কাউকে অন্ধভাবে অনুসরণকারীর নিজস্ব শক্তি শক্তি হারিয়ে যায়, তারা জিরো হয়ে যায়। জিরোর নিজস্ব কোন মান নেই, ক্ষমতা নেই। সে সবসময় অন্যের পাশে বসে ব্যক্তিটির ক্ষমতা বাড়ায়। কোন ব্যক্তি যখন বক ধার্মিকের অন্ধভাবে কোন পাওয়ার বা বাঁশিওয়ালার আনুগত্য প্রকাশ করে, তখন ধরে নিতে হবে ব্যক্তিটি জিরো অর্থাৎ সে শিশুর মতই নির্বোধ।
যাকে সে অনুসরণ করছেন, তিনি বা তার নির্দেশিত পথ তাকে বিনাশও করতে পারেন । কাজেই কোনো মানুষের সম্পদ,, সাফল্য, লাইফস্টাইল ইত্যাদি দেখে তাকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী কিংবা সুপারহিরো বলে নির্বোধের মতো অন্ধ অনুসরণ করতে যাবেন না। তাহলে ধীরে ধীরে তাকে হিরো বানিয়ে আপনি জিরোতে পরিণত হবেন। তার জীবন থেকে কিছু শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের জীবনে প্রয়োগ করুন। ব্যাস এতোটুকুই। সুতরাং বাঁশিওয়ালাদের থেকে নিজস্বতা ও সৃজনশীলতা রক্ষা করুন । নিজেকে পাওয়ার ভাবতে শুরু করুন, ধীরে ধীরে আপনি পাওয়ার হয়ে উঠবেন।
চীনের আফিম যুদ্ধ!
পপি গাছের কাঁচা ফলের খোসা কাটলে যে সাদা রস পাওয়া যায় তা ২৪ ঘণ্টা রোদে শুকালে পাওয়া যায় আফিম।প্রায় ছয় হাজার বছর আগে থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আফিমের ব্যবহার শুরু হয়। ব্যথা-নিবারক হিসেবে আফিম ব্যবহারের চিকিৎসাপত্র গ্রিক এবং রোমান চিকিৎসকেরা দিতে শুরু করেন যিশুখ্রিষ্টের জন্মের অনেক আগে থেকে। সপ্তম শতাব্দীতে আরব বণিকেরা ওষুধ হিসেবে আফিম পৌঁছান চীনে এবং ভারতে।
ব্রিটিশরা ভারতের ক্ষমতায় বসার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে চীনের চা, সিল্ক এবং চিনামাটির বাসন অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা ছিল। কিন্তু চীনারা কেবল রৌপ্যের বিনিময়ে তা বিক্রি করত। এর ফলে ব্রিটেনের প্রচুর রুপা চীনের কাছে চলে যায়। তখন চা ব্রিটেনে তখন খুব জনপ্রিয়।
কিন্তু সে চা কিনতে ব্রিটেনকে রূপা আনতে হতো মেক্সিকো থেকে। মেক্সিকোতে চাহিদা ছিল সোনার। তো সোনার বিনিময়ে রূপা এনে সেই রূপার বিনিময়ে কিনতে হতো চা। এভাবে চা কিনে আনায় দুর্বল হয়ে পড়ছিল ব্রিটিশ অর্থনীতি। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহযােগিতায়
চোরাচালানের মাধ্যমে চীনে আফিম প্রেরণ করা শুরু করে। ১ কেজি আফিমের বদলে মিলতো ২ কেজি চা। এভাবেই আফিম রপ্তানির মাধ্যমে ব্রিটিশরা চীনাদের সামজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেলে দেয়।এভাবে চীনের কয়কটি প্রদেশের প্রায় নব্বই শতাংশ লোক মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এতে করে
টনক নড়ে সম্রাটের।এদিকে অতি লাভজনক এই আফিমের ব্যবসা গুটাতে ব্রিটিশরা কিছুতেই আগ্রহী ছিল না।
ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের আফিম ব্যবসা চীনে আনা বন্ধ করার লক্ষ্যে চীন সরকার ১৮৩৯ সালে চীনের ক্যান্টন বন্দরে ব্রিটিশ গুদামের সব আফিম বাজেয়াপ্ত করে। তাদের ২০ হাজার আফিমের বাক্স বিনষ্ট করে দেন। ওই সময় কতিপয় মাতাল ব্রিটিশ নাবিক চীনের এক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ঘাতকদের চীনের আদালতের কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়।ফলে ১৮৩৯ সালে শুরু হয় তিন বছরব্যাপী চীন বনাম ব্রিটিশ প্রথম আফিম যুদ্ধ! এতে ব্রিটিশরা জয়ী হয়। ১৮৪২ সালের ২৯ আগস্টে স্বাক্ষরিত নানকিং চুক্তিমূলে ব্রিটিশদের ব্যবসা ও বসবাসের জন্য পাঁচটি বন্দর সমর্পণ করতে চীন বাধ্য হয়। যে চুক্তির অধীনে হংকংকে ব্রিটিশ কলোনি হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের পক্ষে ২য় আফিম যুদ্ধে ফরাসিরাও যোগ দেয়। এভাবে ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা চীনের মানুষদের আফিমে আসক্ত করে চীনের সহায় সম্পত্তি লুণ্ঠন করে বছরের পর বছর।
‘ক্যাসিনো’ :
ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা-কে ৩ রকম। টেবিল গেম, মেশিন গেম এবং টিকেট গেম। ইতালিয়ান শব্দ ‘ক্যাসিনো’ অর্থ ঘর। সাধারনত সামাজিক ক্লাব ঘর বোঝাতে ক্যাসিনো শব্দটি ব্যবহার করা হয়। উনিশ শতকের দিকে ক্যাসিনো নামে এমন সব ভবন গড়ে উঠতে থাকে, যেখানে বিনোদন মূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। তখন শহরের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন এবং নাচ, গান ও জুয়া খেলা হতো ক্যাসিনোতে। আধুনিককালে ইতালির বিভিন্ন পতিতালয়কেও ক্যাসিনো বলা হয়। জার্মান এবং স্প্যানিশ ভাষায় ক্যাসিনো অর্থ অফিসার মেস। তবে বিশ্বব্যাপী ক্যাসিনো বলতে প্রধানত জুয়া খেলার ক্লাবকেই বোঝানো হয়। ১৬৩৮ সালে ইতালির ভেনিস শহরে প্রথম ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠিত হয়। অভিজাত ক্যাসিনো গুলোর সাথে সংযুক্ত থাকে হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও শপিং মলের মতো বিভিন্ন স্থাপনা। আমেরিকার লাস ভেগাস, মোনাকোর মন্টে কার্লো, চীনের ম্যাকাও ও পর্তুগালের ক্যাস্কেইস শহর ক্যাসিনোর জন্য বিখ্যাত।পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ১০ টি ক্যাসিনোর মধ্যে পাঁচটিই চীনের ম্যাকাও-এ অবস্থিত। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ক্যাসিনো রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে প্রায় এক হাজারেরও বেশি ক্যাসিনো আছে।
ক্যাসিনোতে সকল ধরনের খেলা -কে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- টেবিল গেম, মেশিন গেম এবং টিকেট গেম। টেবিল গেমের মধ্যে আছে ডাইস, রুলেট ও বিভিন্ন ধরনের তাস খেলা। তাসের মধ্যে জুয়ার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি ধরন হলো পোকার, ব্ল্যাক জ্যাক, ব্র্যাকেট ইত্যাদি। ইলেক্ট্রিক গেমিং মেশিনেও বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলা হয়। কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে গড়ে তোলা এই যন্ত্রগুলোকে বলা হয় ‘স্লট মেশিন’। স্লট মেশিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো জ্যাকপট, বিঙ্গো, ভিডিও পোকার ইত্যাদি। ক্যাসিনোগুলো সবচেয়ে বেশি টাকা আয় করে থাকে তাদের স্লট মেশিন থেকে। টিকেট গেমের মধ্যে আছে লটারি, কেনো, হাউজি, পাকাপুস্, স্ক্র্যাচ কার্ড ইত্যাদি।
তামাগো আম
জাপানের কিউসু দ্বীপের মিয়াজাকি অঞ্চলে উৎপাদিত হয় টাইয়ো নো তামাগো আম। এর টকটকে লাল রঙের কারণে বিশেষ জাতের এই আমের নাম রাখা হয়েছে সূর্যের ডিম। এক একটি আমের ওজন গড়ে ৭০০ গ্রাম এর মত হয়, এবং একটি আমের দাম প্রায় ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর মিয়াজাকি আমের নিলামে সবচেয়ে সেরা আমটি লাখ টাকারও বেশি দামে বিক্রি হয়।গ্রীন হাউজ এর ভেতর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় বেড়ে ওঠে সূর্যের ডিম। রেড ম্যাঙ্গো গাছ আকৃতিতে বেশ ছোট। ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী গাছও সর্বোচ্চ ছয় ফুটের বেশি লম্বা হয় না। প্রাপ্তবয়স্ক একটি গাছ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টি আম উৎপাদন করা হয়। প্রাকৃতিক ভাবে বড় ও সেরা আকৃতির আম পাওয়ার জন্য চাষিরা প্রায় ৮০ শতাংশ আমের মুকুল ছাটাই করে ফেলেন। এরপর প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত আমগুলোকে ক্লিপ এর সাহায্যে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। তিন মাসের ব্যবধানে আমগুলো বেশ বড় হয়ে ওঠে।তি বছর এপ্রিলে মিয়াজাকির পাইকারি বাজারে সূর্যের ডিম আমের নিলাম হয়।মাত্র ৩০ থেকে ৫০ টি আম সর্বোৎকৃষ্ট আমের খেতাব পাওয়ার লড়াই করে। সবচেয়ে সেরা একজোড়া আমের দাম ৫ লক্ষ ইয়েন পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য প্রায় ৪ লক্ষ টাকা।উপহার আদান-প্রদান জাপানের সংস্কৃতির একটি বহুল চর্চিত বিষয়। কিছু ক্ষেত্রে উপহার না দেওয়াটা অসৌজন্যমূলক আচরণ হিসেবে বিবেচিত।রেড ম্যাংগো মানুষ যতটা না নিজে খাওয়ার জন্য কিনে, তার চেয়ে অনেক বেশি উপহার হিসেবে বিক্রি হয়।স্বাদের দিক থেকে অনন্য ভারতের ‘আলফানসো’ আম। তাই আলফানসো -কে বলা হয় আমের রাজা।
‘পৌষ সংক্রান্তি বা ‘সাকরাইন’
পুরান ঢাকার এক ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে ‘পৌষ সংক্রান্তি’ বা ঘুড়ি উৎসব বলেও বর্ণনা করা হয়। পঞ্জিকামতে বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন উদযাপন করা হয় পৌষসংক্রান্তি। পুরান ঢাকার মানুষ একে বলে ‘সাকরাইন’।দুদিনব্যাপী এই উৎসবটি পালন করেন পুরান ঢাকা বাসিন্দারা।মাঘ মাসের শুরুর দিনটিতে আগুন নিয়ে খেলা ও আতশবাজির মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম প্রহর।সাকরাইন শব্দটিএর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে : বিশেষ মুহূর্ত। ঢাকার শেষ নবাব গাজিউদ্দিন, যিনি পাগলা নবাব নামে পরিচিত ছিলেন, তার ঘুড়ি উড়ানোর নেশা আর আহসান মঞ্জিলের নবাববাড়ীর ঘুড়িপ্রীতি শহরের সবার জানা।শীত মৌসুমের তিন মাস ঢাকার লোকদের বার্ষিক ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতা ও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল। পৌষের শেষ দিনটাকেই তারা বেছে নিতেন ঘুড়ি উড়ানোর শেষ মওসুমি উপলক্ষ হিসেবে।ঢাকার নবাবেরা ছিলেন এর মূল পৃষ্ঠপোষক। ঢাকার – চকবাজার, শাহবাগ, পল্টন ময়দান (দিলকুশা), আরমানিটোলা মাঠসহ সব উন্মুক্ত স্থানেই চলত এই আয়োজন।একসময় পৌষের শেষে পুরান ঢাকার জামাইরা শ্বশুরবাড়ি এলে তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হতো ঘুড়ি ও নাটাই। সব বাড়ির জামাই ঘুড়ি উড়ালে ঘটা করে সেসব দেখতেন মহল্লাবাসী ।শত বছরের নানা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত উত্তেজনার মাঝেও পৌষসংক্রান্তি এই শহরে হিন্দু মুসলিম সবার সর্বজনীন এক সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে আজো টিকে আছে।
গার্মেন্টস ব্যবসা
রিয়াজউদ্দিন তার পারিবারিক গার্মেন্টস ব্যবসায়ে যোগ দেন ১৯৫৮ সালে। করাচি থেকে কাপড় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র এনে তারা বিক্রি করতেন। দুই বছর পরে তিনি ও তার ভাতিজা মাইজুদ্দিন মিলে চকবাজারে 'রিয়াজ স্টোর' চালু করেন। তারা দেশীয় বাজারে পুরুষের শার্ট,
নারীদের লেগিংস, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে পুরোনো ঢাকার উর্দূ রোডে রিয়াজ ষ্টোর নামে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের প্রথম গার্মেন্টস। ১৯৬৫ সালে রিয়াজ ষ্টোর এর মালিক জনাব রিয়াজ উদ্দিন করাচি ভ্রমণকালে একটি গার্মেন্টসকে মাসে ১লক্ষ পিস পোশাক রপ্তানী করতে দেখেন। ভখন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার বিদেশে পোষাক রপ্তানীর স্বপ্ন দেখতে থাকেন। শুরুতে তাঁরা শুধু দেশের চাহিদাই পুরণ করত। এরপর ১৯৭৩ সালে রিয়াজ ষ্টোর এর নাম পরিবর্তন করে রিয়াজ গার্মেন্টস রাখেন এবং বিদেশে পোষাক রপ্তানীর জন্য কাজ শুরু করেন। অবশেষে আসে সেই স্বপ্ন পূরণের দিন। ১৯৭৮ সালের ২৫শে জুলাই টিসিবির সহায়তায় বাংলাদেশ থেকে সর্বপ্রথম ৪ লক্ষ টাকা মূল্যের পুরুষদের শার্ট রপ্তানী করা হয় ফ্রান্সে। এই পোষাক রপ্তানী নিয়ে বিখ্যাত কার্টুনিষ্ট রণবী কার্টুন পর্যন্ত একে ছিলেন। “৪ লক্ষ টাকার পোষাক রপ্তানী করা হয়েছে ফ্রান্সে” এই শিরোনামে যে কার্টুনটি এঁকে ছিলেন, সেখানে একজন টোকাই আরেকজনকে বলছে, “আরে চিন্তা করিস না, ওই পোশাকগুলো পুরোনো হয়ে আবার আমার দেশেই ফেরৎ আসবে”।
যাই হোক, সেই সময় কিন্তু নারী শ্রমিকের কথা ভাবাই যেতনা। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানে নারী শ্রমিক নিয়োগের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হোন। এরপর রিয়াজ গার্মেন্টস এর মালিক জনাব রিয়াজ উদ্দিন সর্বপ্রথম নিজের মেয়েকেই রিয়াজ গার্মেন্টেসে পোশাক তৈরির কাজে লাগিয়ে দেন। তাঁর মেয়েকে দেখে আরও কিছু নারী এই পেশায় আসতে আগ্রহী হন এবং আস্তে আস্তে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর বর্তমানে পোশাকে শিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যাতো একটি ইতিহাস।বাংলাদেশের তৈরী পোষাক শিল্পে ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৮৫% নারী শ্রমিক যুক্ত আছে। যা সম্ভব হয়েছে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে।১৯৭৪ সালের প্রাক কালে তৈরী পোষাক শিল্পে প্রায় ৯৮% পুরুষ শ্রমিক কাজ করতো। জনাব রিয়াজউদ্দিন সাহেব প্রতিটি পরিবারের দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছেন শুধু মাত্র নারী শ্রম শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, তাদের পরিবারকে আর্থিক ভাবে সহযোগীতা করার উদ্দেশ্যে। যেহুতু এটা ছিলো কঠিন প্রত্যয় যেখানে পরিবারের মেয়ে/বোন/বউদেরকে পরিবারের বাহিরে গিয়ে কাজ করতে হবে যা নারীদেরকে তাদের ভবিষ্যত জীবনে বাধার সম্মুখীন করতে পারে তাই বেশির ভাগ পরিবার তার উদ্যোগকে সম্মতি দেয়নি। ১৯৭৭ সাল, জনাব রিয়াজউদ্দিন সাহেব অতন্ত যুকিপূর্ণ এবং সাহসী একটি উদ্দোগ নেন যে, তার কন্যা জনাবা ফাতেমা বেগম মুক্তা কে তিনি তার নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে কাজে নিযুক্ত করেন শুধু মাত্র নারীদের কে এই শিল্পে এগিয়ে নিয়ে আসার সাহস জোগানোর জন্য। জনাবা ফাতেমা বেগম বাংলাদেশের পোষাক শিল্পের সর্ব প্রথম নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি পান। ফাতেমা তখন মাত্র ম্যাট্রিক পাশ করেছে, বাবার কথায় রাজি হয়ে গেলেন তিনি। মাসে ১০০ টাকা বেতন দেখে আশেপাশের মেয়েরাও আগ্রহী হয়ে উঠল। প্রথমে ৫ জন নারী রিয়াজ গার্মেন্টসে কর্মচারী হিসেবে যোগ দিলেন।
যে ষাটের দশকে একটি রিয়াজ শার্টের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১০০ টাকা এবং সমাজের সবচেয়ে ধনী শ্রেণির লোকেরাই এই শার্ট পরতেন। সে সময়ে কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ছিল তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯৮১-৮২ সালে মোট রপ্তানি আয়ে এই খাতের অবদান ছিল মাত্র ১.১%। ২০১০ সালের মার্চ মাসে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান দাঁড়িয়েছে মোট রপ্তানি আয়ের ৭৬%। শুরুতে এই শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প সম্পূর্ণভাবেই আমদানিকৃত কাঁচামাল নির্ভর ছিল। এই নির্ভরশীলতার কারণে পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশি মালিকেরা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয় এবং পরিস্থিতির উন্নতি হয়। স্থানীয় উদ্যোক্তারা পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্পের বিকাশ ঘটায় এবং স্থানীয়ভাবেই দক্ষতা বৃদ্ধি করে মানসম্পন্ন রপ্তানিযোগ্য সুতা ও কাপড় উৎপাদন শুরু করে। তাছাড়া পোশাক শিল্প রং ও প্রক্রিয়াজাত করার পর কাপড় কেটে এবং সেলাই করে রপ্তানিযোগ্য পণ্যে রূপান্তরিত করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। গত ১৫ বছরে এই কার্যক্রম আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। দ্রুত পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প গড়ে ওঠার কারণে এই শিল্প আর আগের মতো কাঁচামাল আমদানির উপর নির্ভরশীল নয়।
তিন নভোচারীর প্রশংসা পাওয়ার পর রিয়াজউদ্দিন বেশ কয়েকবার করাচিতে যান রিয়াজ শার্ট রপ্তানি করা যায় কিনা সে সুযোগ খুঁজে বের করতে। তিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অলড্রিন কিন্তু তাদের ওয়ার্ল্ড গুডউইল ট্যুরের অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এসেছিলেন। তারা নেমেছিলেন তেজগাঁও বিমানবন্দরে। সেদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এই তিন নভোচারীর জন্য আয়োজন করা হয়েছিল এক নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। শত শত মানুষের উল্লাস ও চিৎকারের ভিড়ের মধ্যে সেদিন রিয়াজউদ্দিন নামের একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীও ছিলেন, যিনি নিজের দোকান 'রিয়াজ স্টোর' এ বানানো তিনটি শার্ট নিয়ে গিয়েছিলেন তিন নভোচারীকে শুভেচ্ছা জানাতে। সেদিন রিয়াজউদ্দিনের উপহার তারা গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনজনের কাছ থেকে ধন্যবাদ ও প্রশংসামিশ্রিত একটি চিঠিও পান রিয়াজউদ্দিন। তিন নভোচারীর প্রশংসা পাওয়ার পর রিয়াজউদ্দিন বেশ কয়েকবার করাচিতে যান রিয়াজ শার্ট রপ্তানি করা যায় কিনা সে সুযোগ খুঁজে বের করতে।
পরের বছর রিয়াজউদ্দিন ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ(টিসিবি) এর কাছে রিয়াজ শার্ট রপ্তানি করার ব্যাপারে রাজি করাতে চেষ্টা করেন। বেশিরভাগ কর্মকর্তাদের কাছ থেকেই নিরাশ হয়ে ফিরলেও টেএক্সটাইল মন্ত্রণালয়ের সচিব ইদ্রিস তাকে আশার আলো দেখান। এরপর রিয়াজ শার্টের নমুনা ফ্রান্সে পাঠানো হয়। রিয়াজ পণ্যের উন্নত মান দেখে তারা কিনতে আগ্রহী হন।
রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা দেখে শিল্পপতি নুরুল কাদের খান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানির সঙ্গে মিলে চট্টগামের কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত করলেন দেশ গার্মেন্টস, যা ছিল দেশের প্রথম শ্ভাতগ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা। রিয়াজ গার্মেন্টস অনেক বেশি পরিমাণে স্কুলের ইউনিফর্ম বানিয়েছে, তাই আমরা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে তেমন যুক্ত হতে পারিনি। বিখ্যাত ব্র্যান্ড জর্জের (যা পরে ওয়ালমার্ট কিনে নেয়) সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছিল। প্রতি মাসে আমরা দুই থেকে তিন লাখ পিস স্কুলের ইউনিফর্ম রপ্তানি করেছি।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী তীরবর্তী কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকা। যেথানে গ্রথিত রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের সূতিকাগার। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা বাংলাদেশের ১৩০জন কর্মী দিয়ে ৪২ বছর আগে দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পোশাক তৈরির সূচনা হয়েছিল এখান থেকেই। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল সেই প্রতিষ্ঠানটি। দেশের প্রথম শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা ‘দেশ গার্মেন্টস’ ব্যাক টু ব্যাক এলসি পদ্ধতি ও কারখানা পর্যায়ে বন্ডেড ওয়্যার হাউস সিস্টেম নুরুল কাদের খানের অবদান বলে উল্লেখ করে ভিদিয়া অমৃত খান বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্নে দেশ গার্মেন্টসে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ফাইনান্সিং করার কথা ছিল, তখন ব্যাংক ওই পরিমাণ টাকা দিতে পারেনি।
তখন আব্বা বললেন, শতভাগ কাঁচামাল মালিক নিজেরা কিনে তো কারখানা চালানো সম্ভব হবে না। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন আব্বার বন্ধু নুরুল ইসলাম সাহেব। তখন উনার সঙ্গে কথা বলে আব্বা ব্যাক টু ব্যাক এলসি সিস্টেম চালু করাতে সক্ষম হন। এটা আব্বার সৃষ্টি এবং অবদান। এ ফাইন্যান্সিং সিস্টেম যদি তখন না হতো তাহলে গার্মেন্টস শিল্প আজ এতদূর এগিয়ে আসতে পারত না। উনার আরেকটা অবদান ছিল বন্ডেড ডিউটি ফ্রি ওয়্যার হাউস সিস্টেম। এ সিস্টেম চালু না হলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কোনোভাবেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারত না। তখন এ শিল্পের এতটা বিকাশ হতো না। যখন কোটা সিস্টেম শুরু হলো তখন তিনি দুই বার আমেরিকা এবং কানাডায় কোটার বিষয়ে নেগোশিয়েশন করতে গিয়েছিলেন। দুইবারই সফলভাবে দেশের জন্য কোটা নিয়ে এসেছিলেন।
এই সময় ব্যাক-টু-ব্যাক এল.সি (লেটার অব ক্রেডিট বা আস্থাপত্র) লেনদেনের জন্য উদ্ভাবিত নতুন পন্থার অবদানে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে।ব্যাক-টু-ব্যাক এল.সি চলতি মূলধনের সমস্যা লাঘব করে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য মানসম্পন্ন কাপড় আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ১৯৮২ সালে কারখানার সংখ্যা ছিল ৪৭ এবং ১৯৮৫ সালে ৫৮৭, আর ১৯৯৯ সালে ২,৯০০টিতে উন্নীত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই শিল্পের সাফল্য
স্পষ্ট হয়ে উঠে।
সস্তা শ্রমিক ও বড় আকারের রপ্তানি কোটার সুবাদে বাংলাদেশ একটি আদর্শ বিকল্প হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে অব্যাহতভাবে কোটামুক্ত মর্যাদা এবং জিএসপি সুযোগ-সুবিধা দিতে থাকে। তাছাড়া, ইউএসএ এবং কানাডা বাংলাদেশের জন্য বেশ বড় আকারের কোটা বহাল রাখে। এসব সুযোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে ইউএসএ, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার নিশ্চিত করে।
কোটা পদ্ধতি। এই কোটা পদ্ধতিতে তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক আউট সোর্সিং পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বেশি দামে প্রস্ত্ততকারী দেশ থেকে কম দামে প্রস্ত্ততকারী দেশে স্থানান্তর করা হতো। এমএফএ’র প্রয়োগ বাংলাদেশের জন্য অনেকটা আশির্বাদ বয়ে আনে। নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাকের একটি উল্লেখযোগ্য ‘কোটা’ রপ্তানির সুযোগ পায়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোটামুক্ত বাজারের পাশাপাশি বাংলাদেশকে জিএসপি সুযোগ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ সীমিত কয়েক শ্রেণীর তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশের কারখানাগুলি প্রধানত শার্ট, জ্যাকেট ও পায়জামা তৈরি করে এবং মোট তৈরি পোশাকের প্রায় ৬০% শার্ট, যা রপ্তানি করা হয় কম দামে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বয়স্ক পুরুষ ও শিশু-কিশোরদের সুতি শার্টের প্রধান রপ্তানিকারক। এই বাজারে নিম্নমূল্যে পণ্য বিক্রয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা করে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো এবং সেন্ট্রাল আমেরিকার অন্যান্য দেশের সাথে। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে ডজন প্রতি ৬২.৭৪ ডলারে শার্ট বিক্রয় করত। এই মূল্য ছিল দ্বিতীয় নিম্নতম। ডোমিনিকান রিপাবলিক একই ধরনের শার্ট বিক্রয় করতো সর্বনিম্ন মূল্য প্রতি ডজন ৫৪.৭৯ ডলারে। ভারতীয়, মেক্সিকান এবং শ্রীলঙ্কার শার্টের মূল্য ছিল ডজন প্রতি ৮১.০৪ ডলার, ৭৬.২৬ ডলার এবং ৭৪.৭৭ ডলার। অপরদিকে হংকং এবং মালয়েশিয়ার শার্টের মূল্য ছিল ডজন প্রতি ১০৭.৩৪ ডলার এবং ১৩৪.০৮ ডলার।
ডাচ ডিজিজ
১৯৫৯ সালে নেদারল্যান্ডসে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুদের সন্ধান পায় দেশটি। বিপুল পরিমাণ গ্যাসের উত্তোলন ও রপ্তানির ফলে নেদারল্যান্ডসের অর্থনীতি প্রাথমিক দিকে সমৃদ্ধ হলেও পরবর্তী সময়ে এ গ্যাসেই তাদের বিপর্যয় ডেকে আনে অর্থনীতিতে। ফলে এক ধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হয় তাদের জাতীয় জীবনে। দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনটি নেদারল্যান্ডসের এ অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে বুঝানোর জন্য ডাচ ডিজিজ কথাটির প্রয়োগ করেন। অর্থাৎ ডাচ ডিজিজ বলতে বোঝায় কোনো দেশ একটি মাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ কিংবা একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিনির্র্ভরতা (৮০ ভাগ বা বেশি) এবং ভবিষ্যতে এ সম্পদের কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি হলে যে আর্থিক মন্দার সৃষ্টি হয়, সেটাকে ডাচ ডিজিজ বলা হয়ে থাকে।
বর্তমান বিশ্বে ডাচ ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ভেনিজুয়েলা। কারণ তারা বিশ্বে বৃহত্তম তেল রপ্তানি ও মজুদকারী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। দেশটিরও আর্থিক সমস্যার শুরু বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য হ্রাস দিয়েই। ২০১৪ সাল থেকে বিশ্ববাজারে তেলের দরপতন শুরু হয়।
অথচ ২০০৪ থেকে ২০১৩, এ সময়ের মধ্যে ভেনিজুয়েলা ছিল বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ করা দেশগুলোর একটি, যখন তেলের মূল্য বিশ্ব বাজারে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু তেলের মূল্য কমতে শুরু করলে ভেনিজুয়েলা অর্থনীতি ধসে পড়ে। কারণ ক্রমহ্রাসমান অর্থনীতিকে সামাল দেওয়ার মতো অন্য কোনো রিসোর্স তাদের হাতে ছিল না। আর তেল রপ্তানি যখন তাদের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস, আর এটির যখন নাজুক অবস্থা তখন ভেনিজুয়েলায় দেখা দেয় মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বাজেট ঘাটতি সমস্যার শুরু হলে দেশটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ LDC (Least developed country) থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যাবে এবং মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে। এখন এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। যেমন GSP, TRIPS, ODA, DFQF মতো সুবিধা। আর GSP সুবিধা হচ্ছে (Generalised System of Preference) বা অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা, যা স্বল্পোন্নত দেশের পণ্য ধনী দেশে আমদানির ক্ষেত্রে তাদের শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়, যা রপ্তানি আয়ের দিক থেকে অনেক সুবিধাজনক।
কিন্তু ২০২৬ সালে আমাদের এ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে, ফলে অন্য পোশাক রপ্তানিকারী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়বে। ২০২৬ সালে যখন বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে, তখন শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। অপরদিকে GSP সুবিধা না থাকার কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে, ফলে অন্যদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমরা মার্কেটে টিকতে পারব না। আবার চীনের মতো দেশ আফ্রিকা মহাদেশের দরিদ্র দেশগুলোতে পোশাক কারখানা তৈরি করার মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেসব দেশের কারখানায় পোশাক উৎপাদন শুরু হলে তারা কম শ্রমমজুরিতে পোশাক উৎপাদন করবে এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে LDC সুবিধা পাবে, ফলে আমাদের চেয়ে অনেক কম মূল্যে পোশাক রপ্তানি করবে আবার ইউরোপ এর দেশগুলো তাদের নিকটবর্তী হওয়ায় পরিবহন খরচ কমবে ও দ্রুত সময়ে মার্কেট
পৌঁছাবে।
আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর পোশাক শিল্পের প্রসার ঘটলে আমাদের পোশাকশিল্প বৈশ্বিক বাজারে আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে না। ফলে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পে মন্দাভাব শুরু হবে। আর বৈশ্বিক বাজারে ধস নামলে আমাদের গার্মেন্ট থেকে যে বৈদেশিক আয়, তা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে লাখ লাখ শ্রমিকের ভবিষ্যৎ শঙ্কার দারপ্রান্তে। পাশাপাশি আমাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করে রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করা এবং যুবকদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি করতে সরকারিভাবে সহযোগিতার হাত প্রসার করা, তবেই আমরা আশু বিপর্যয় মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো। *
মীরজাফর সবে মাত্র নবাব হয়েছেন। ইংরেজদের সাথে চুক্তির তিন কোটি টাকা মেটাতে গিয়ে তার তহবিল শূন্য হয়ে গেল। নবাবের সৈন্যবাহিনীর ঘোড়সওয়াররা মাইনে না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল। ফলে নবাবী সৈন্যবাহিনী ভেঙে পড়ল। নবাবের সেই দুরবস্থায় সুযোগ বুঝে বহু জমিদার ও ফৌজদারেরা নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। নবাব তখন বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে ইংরেজ ফৌজ ব্যবহার করতে বাধ্য হলেন। গোরা ও তেলেঙ্গা সৈন্যদের সমস্ত খরচ নবাবকেই বহন করতে হবে, এই শর্তে ক্লাইভ নবাবকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসলেন। বিদ্রোহীরা তখনকার মত শায়েস্তা হল বটে, কিন্তু যুদ্ধের খরচ মেটাবার জন্য পর্যাপ্ত টাকা ছিল কোথায়? মীরজাফর ‘বর্ধমান’ ও ‘নদীয়া’ জেলার গোটা খাজনা ইংরেজদের নামে লিখে দিতে বাধ্য হলেন।
নবাবের খাজনা আদায়ের শাসনযন্ত্রে সেই যে ইংরাজদের প্রবেশ শুরু হল, এরপরে ধীরে ধীরে সারা ‘দেওয়ানী’ ও ‘নিজামত’ ইংরেজদের হাতে সম্পূর্ণভাবে চলে গেল। তখন থেকেই নবাবী শাসনযন্ত্র ক্রমশঃ অচল হয়ে পড়তে শুরু করল। নবাবের দরবারের সব ওমরাওরা তখন থেকেই উপলব্ধি করতে পারছিলেন যে তাঁদের দিন ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে।
পলাশীর ষড়যন্ত্রে যেসব মনসবদারা মীরজাফরকে সাহায্য করেছিলেন, তারা বুঝে গেল যে মীরজাফর ইংরেজদের ‘ঠুটো জগন্নাথ’ মাত্র। তার হাত থেকে তাদের কোন কিছুই প্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা নেই। মীরজাফরের এক বন্ধু আশা করেছিলেন যে নতুন নবাব তাকে যথোচিত পুরস্কার দেবেন। কিন্তু তিনি কিছুই পেলেন না। আশাহত সেই আমীর, নতুন নবাবের নবাবিয়ানা ভেতর থেকে যে কতটা ফাঁপা, সেটা প্রকাশ্য দরবারে বাজিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ওই ঘটনার আগের দিনই ক্লাইভের লোকজনদের সঙ্গে সেই আমীরের লোকজনদের প্রকাশ্যে হাতাহাতি হয়ে গিয়েছিল। পরের দিন সকালে নবাব মীরজাফর তার পুরনো বন্ধুর দিকে রক্ত চক্ষে তাকিয়ে বলেছিলেন, “জনাব, কর্নেল সাহেবের লোকেদের সঙ্গে কাল আপনার লোকেরা ঝগড়া বাঁধিয়েছিল। জনাবের কি জানা আছে, এই কর্নেল ক্লাইভ কে? জান্নাতের হুকুমে জাহানে তাঁর কি জায়গা?” নবাবের পুরানো বন্ধু ‘মির্জা শামসুদ্দিন’ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সবার সামনেই উত্তর দিয়েছিলেন, “হুজুর নবাব বাহাদুর, কর্নেলের সঙ্গে ঝগড়া করব আমি? এই আমি? যে রোজ সকালে উঠে তার গাধাটাকে পর্যন্ত তিন বার সলাম না করে কোনো কাজ করে না? তবে কোন সাহসে আমি গাধাটার সওয়ারের সঙ্গে লাগতে যাবো?” মীরজাফর ‘আলিবর্দি খানের’ মতো ‘মহাবৎ জঙ্গ’ নামে খ্যাত হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ‘ক্লাইভের গাধা’ নামে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রসিদ্ধি হয়েছিল। রাজকার্যে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মীরজাফর‘ভাঙ’ খেয়ে চুর হয়ে থাকতেন। লোকে তাঁর ছেলে ‘মীরন’কে বলত ‘ছোট নবাব’।
যত দিন সেই নিষ্ঠুর নবাবজাদা বেঁচেছিলেন তত দিন প্রকৃতপক্ষে তিনিই মীরজাফরের হয়ে রাজকার্য চালিয়ে গেলেন। তার হুকুমে ‘ঘসেটি বেগম’ ও ‘আমিনা বেগম’ - দুই নবাবনন্দিনীকে জলে ডুবিয়ে মারা হল। ‘ঘসেটি বেগম’ তাঁর সমস্ত লুকানো ধনরত্ন দিয়ে মীরজাফরকে পলাশীর ষড়যন্ত্রে সাহায্য করেছিলেন। শোনা যায় যে, জলে ডুবে মরবার আগে ওই দুই বোন মীরনের মাথায় ‘বজ্রাঘাতের’ অভিসম্পাত করে গিযেছিলেন।
মীরনের সব দুষ্কার্যের সাথী ছিলেন ‘খাদেম হোসেন খান। নয়া জমানায় সেই ‘খাদেম হোসেন খান’ ‘পূর্ণিয়ার ফৌজদার’ হয়ে বসলেন। তারপর মীরন ও খাদেম হোসেন খানের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে গেল। বিদ্রোহী খাদেম হোসেন খানের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে খোলা মাঠে তাঁবুর মধ্যে ‘বজ্রাহত’ হয়ে মীরন মৃত্যুর মুখে পতিত হলেন। আর খাদেম হোসেন খান তরাইয়ের নিশ্ছিদ্র অরণ্যের মধ্যে পালিয়ে গিয়ে চিরকালের জন্য লোকচক্ষুর অন্তরালে অন্তরীণ হয়েছিলেন।
ইংরেজদের টাকা মেটাতে না পারায় মীরজাফর প্রথমে মসনদচ্যুত হলেন। তারপরে আবার ইংরেজদের কৃপায় তিনি মসনদে বসেছিলেন, শেষে মীরজাফর ‘কুষ্ঠ রোগে’ মরেছিলেন। শেষের দিকে তিনি একপ্রকার মরিয়া হয়ে ইংরেজদের একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনারা কি ভাবেন টাকার বৃষ্টি হয়?” পলাশীর অপর নায়ক ছিলেন ‘রায় দুর্লভ’। নতুন নবাব ও তাঁর নতুন দেওয়ানের মধ্যে দু’ দিন যেতে না যেতেই মারাত্মক রেষারেষি শুরু হয়ে গেল। মীরজাফর সন্দেহ করলেন যে, রায় দুর্লভ সিরাজের ছোট ভাই ‘মীর্জা মেহদী’কে মসনদে বসিয়ে নিজে রাজত্ব করবার মতলব আঁটছেন। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মীরন সেই নিরাপরাধ তরুণকে হত্যা করেন।
এরপর রায় দুর্লভের উপরে চোরা গোপ্তা আঘাত হানবার ফিকির খুঁজতে থাকেন। ক্লাইভের কৃপায় রায় দুর্লভের প্রাণ রক্ষা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই মীরন ঢাকার রাজবল্লভ’কে ডেকে এনে রায় দুর্লভকে তার হাতে রাজকার্য তুলে দেবার হুকুম দিলেন।
ফলে রায় দুর্লভের দু’ দিনের দেওয়ানী ঘুচে গেল। রায় দুর্লভ কলকাতায় পালিয়ে গিয়ে নিজের ধন প্রাণ বাঁচাতে সমর্থ হলেন। যদিও তার সঞ্চিত ধন তাঁর উত্তরপুরুষদের ভোগে লাগে নি। ছেলে ‘রাজবল্লভ’ ইংরেজ আমলে ‘রায় রায়ান’ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর একমাত্র সন্তান ‘মুকুন্দবল্লভ’ তাঁর জীবদ্দশাতেই মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ায় রায় দুর্লভের বংশ চিরতরে লোপ পেল।
সিরাজের বিশ্বস্ত প্রধানমন্ত্রী ‘মোহনলাল কাশ্মীরী’কে রায় দুর্লভ বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। পলাশীর যুদ্ধের ঠিক আগে নিযুক্ত সিরাজের আরেক বিশ্বস্ত কাবুলী সেনাপতি ‘খাজা আবদুল হাদি খান’কে মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করেন।
ঢাকার ভূতপূর্ব নায়েব ‘রাজবল্লভ সেন’ পরে ‘পাটনার নায়েব’ হলেন। যদিও তিনি শেষ পর্যন্ত মীরকাশিমের হুকুমে গঙ্গাবক্ষে সলিল সমাধি প্রাপ্ত হলেন। হুগলীর অস্থায়ী ফৌজদার ‘নন্দকুমার’ পরে মীরজাফরের ‘দেওয়ান’ হয়েছিলেন। তিনিও শেষ পর্যন্ত ‘ওয়ারেন হেস্টিংসের’ ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছিলেন। সিরাজের অতি বিশ্বস্ত গুপ্তচর ও ‘পাটনার নায়েব’ ‘রামনারায়ণ’ নবাব মীরকাশিমের হুকুমে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলেন। অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের কুড়ি বছরের মধ্যে প্রায় সমস্ত ‘মহাবৎজঙ্গী’ ওমরাওরা সমূলে বিনষ্ট ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন।
‘জগৎশেঠ মহাতাব রায়’ ও ‘মহারাজা স্বরূপচন্দের’ পরিণামও ভয়াবহ হল। নবাব মীরকাশিম আরো অনেকের সঙ্গে সেই দুই প্রধান শেঠকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে হত্যা করেন। ওই ঘটনায় জগৎশেঠ পরিবারের ব্যবসা যে ঘা খেল, সেটা থেকে তারা আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। দেওয়ানী হাতে পেয়েই ক্লাইভ রুক্ষভাবে তাঁদের উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে রাজকোষের চাবি ছিনিয়ে নিল। রাজকোষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগের ভিত্তিতেই জগৎশেঠের বিশাল ব্যবসা গড়ে উঠেছিল। সেই সংযোগ ঘুচে যাবার পরে তাদের ব্যবসাও আর টিকে থাকে নি। ইংরেজরা অসংখ্য প্রকারে ওই পরিবারের কাছে ঋণী ছিল। সেই ঋণ তারা চরম বেইমানি দিয়েই শোধ করল।
নদীয়ার রাজা ‘কৃষ্ণচন্দ্র’ তলে তলে পলাশীর ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন। ইংরেজরা সে সবও মনে রাখেনি। তিন কোটি টাকার দাবি মেটাতে মীরজাফর লিখে দিয়েছিলেন যে নদীয়া জমিদারীর খাজনা মুর্শিদাবাদে না গিয়ে ইংরেজদের ‘তনখা’ হয়ে কলকাতায় যাবে। ওই টাকা আদায় করবার জন্য ইংরেজরা কৃষ্ণচন্দ্রকে অশেষ উৎপীড়ন করল। এমন কি সনাতন হিন্দু সমাজের প্রধান ধারক ও বাহক সেই রাজার ‘জাতিনাশ’ করবার ভয় পর্যন্ত দেখানো হল। শেষে বুড়ো বয়সে তাঁর জমিদারী অপরিমেয় ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ল। রাজা মারা যাবার পরে তার বংশধরেরাও সেই জমিদারীকে আর রক্ষা করতে পারল না। ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূর্যাস্ত আইনে’ নদীয়া জমিদারীর প্রায় সব নিলাম হয়ে গেল।
সক্রেটিস গণতন্ত্র পছন্দ করতেন না
মহান দার্শনিক সক্রেটিস গণতন্ত্র পছন্দ করতেন না। কারণ, সক্রেটিস তার নিজের চোখেই দেখেছিলেন, একটা দেশ বা সমাজের জনগোষ্ঠীকে একটা
জাহাজের নাবিক নির্বাচন করতে বলা হলে জনগণ সবসময়ই জনপ্রিয় ব্যক্তিটিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। তারা জাহাজ চালানোর জন্য উপযুক্ত
ব্যক্তিটিকে নির্বাচিত করে না। কারণ, অশিক্ষিত জনগণ জানেই না- একটা জাহাজ চালাতে আসলে কি ধরণের শিক্ষা আর যোগ্যতার প্রয়োজন হয়।
মূল কথাটা হচ্ছে, গণতন্ত্র আসলে অশিক্ষিত জনগণের জন্য নয়। কারণ, গণতন্ত্র কি জিনিস, সেটা বুঝতে হলে একটা জনগোষ্ঠীকে নূন্যতম শিক্ষিত
হতে হয়।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন মানেই তীতুমীর
তিতুমীর যুদ্ধ করেছিলেন সে যুগের প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে, কোলকাতা স্টাইলের চারুকলা ও বড় টিপওয়ালা জমিদারদের বীরুদ্ধে।
১ বছর তিনি রাস্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। নীলকর ও জমিদারদের উলটো কর দিতে বাধ্য করেছিলেন।
শহীদ তিতুমীরের সমকালীন জমিদার এবং তালুকদার শ্রেণীর লোকদের অত্যাচার এবং জুলুমের বিবরণ আমরা মোটামুটি সবাই জানি। কিন্ত এরপরে হিন্দু জমিদার এবং বৃটিশ গভমেন্টকে তিতুমীর যে পালটা জবাব দিয়েছিলেন ।
(১) তিতুমীর গরীব কৃষক শ্রেনীর লোকদের নিয়ে যে দল গঠন করে জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন সেই দল গঠন করার জন্য বা যুদ্ধ করার
জন্য আশ্চর্য হলেও সত্য তিনি কারো কাছ থেকে পরামর্শ বা উৎসাহ এবং তৎকালীন মুসলিম জমিদারদের থেকে কোন অর্থ সাহায্য নেননি।
(২) তিনি তাঁর দল গঠনের পরে দলের লোকদের নিয়ে হায়দ্রাপুর থেকে নারিকেলবাড়িয়াতে চলে যান এবং দলের লোকদের নিয়ে মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ে হাতের তৈরি যে বর্শা, তরবাড়ি, লাঠি যে অস্ত্র সহজল্ভ্য ছিল তা দিয়েই তিতুমীর তার অনুসারীদের প্রশিক্ষন দেওয়া আরম্ভ করেন।
(৩) ১৮৩০ সালের অক্টোবর মাসে তিতুমীর ঘোষণা দেন। জনগণ ! বৃটিশদের সময় সমাপ্ত। এবং রাষ্ট্রের আসল মালিক এখন মুসলিমরাই কেননা মুসলিমদের থেকেই তারা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। এরপর তিনি ঘোষণা দেন যে আশপাশে যত জমিদার আছে তাদের সকলে এখন থেকে আর বৃটিশের ট্রেজারিতে লভ্যাংশ জমা দিতে পারবে না এবং লভ্যাংশেরপুরোটাই তাঁর নিকট জমা দিতে হবে। এর অন্যথা হলে চরম পর্যায়ের শাস্তিভোগ করতে হবে।
(৪) ১৪ অক্টোবর, ১৮৩০ সালে তিতুমীরের বাহিনী খাসপুরের একজন মুসলিম জমিদারের সম্পদ লুট করে। কেননা তিনি তিতুমীরের উপরোক্ত ঘোষণাকে অমান্য করেছিল।
(৫) এমনকি তিতুমীর তাঁর অধীনে থাকা দলের লোকদের মধ্যে কড়াভাবে ঘোষণা করে দেন , যে সব জমিদারেরা তাঁর আন্দোলনের বিরুদ্ধে যাবে তাদেরকে কোন প্রকার ভাড়া পরিশোধ করা যাবে না আর অবৈধ ট্যাক্স দেওয়ার প্রশ্নই তো আসে না।
(৬) স্থানীয় পুলিশ বাহিনী অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাই কিছু জমিদার এবং তালুকদার বাধ্য হয়ে কলকাতা পালিয়ে যায়।
(৭) এরপর তিতুমীর তাঁর পুরাতন শত্রু জমিদার কৃষ্ণদেবের দিকে নজর দেন। ১৮৩০ সালের ৩১ অক্টোবর তিতুমীর তিনশ জনের এক বাহিনী নিয়ে
শরফারাজপুরে কৃষ্ণদেবের বাড়ি ঘেরাও করে। এবং আশপাশের মার্কেট দোকানে লুট করে। পাশাপাশি যারা টাকা পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে অসুদাপয় অবলম্বন করত এদের ব্যবসা প্রতিষ্টানে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন হলঃ লক্ষন দেব, মোহন সাহা, গোলক সাহা এবং অন্যান্যরা।
(৮) চার মাস পূর্বে জমিদার কৃষ্ণদেব একটি মসজিদ ধ্বংস করেছিল এর জবাবে তিতুমীরের বাহিনী স্থানীয় একটি মন্দিরের সামনে একটি গরুকে জবাই
করে।
(৯) তিতুমীরের বাহিনীর এরকম অপারেশনের ভয়ে চব্বিশ পরগনা এবং নদিয়ার জমিদারেরা একত্রিত হয় এবং কিভাবে তিতুমীরকে পরাস্ত করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা আরম্ভ শুরু করে। এছাড়া নীল রোপনের জন্য যেসব লোক স্থানীয়দেরকে বাধ্য করত তারাও বুঝতে পারে যে তারা তিতুমীরের পরবর্তী টার্গেট হতে যাচ্ছে। এজন্য তারাও জমিদারদের সাথে একত্রিত হয়।
(১০) হাবড়া-গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখার্জী এই জমিদারদের নেতৃত্ব দেন। তিনি তিতুমীরকে কোন লভ্যাংশ পাঠাতে অস্বীকার করেন।
পাশাপাশি প্রজাদের উপর যে অবৈধ করারোপ করা হয়েছিল তাও তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানান।
(১১) তিতুমীর কালীপ্রসন্নের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। সে তাঁর বাহিনী নিয়ে গোবরডাঙ্গার দিকে রওয়ানা করে। ডেভিস যে মোল্লাহটিতে নীল চাষ নিয়ন্ত্রন করত সে তৎক্ষণাৎ এই খবর শুনতে পেয়ে ২০০ জন অস্ত্রসহ বাহিনী দিয়ে কালীপ্রসন্নের নিকটে সাহায্যের জন্য পাঠান। কিন্ত ডেভিসের নিজেকেই তিতুমীর বাহিনীর হাত থেকে খুব কষ্ট করে জীবন নিয়ে পালাতে হয়। সে কোনক্রমে বেঁচে গোবড়া গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রয়ের নিকট গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়।
(১২) কালীপ্রসন্ন আর ডেভিসের বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করার পর তিতুমীর গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ কে শাস্তি দেওয়ার জন্য রওয়ানা করে। লৌঘাটিতে গিয়ে তিতুমীরের বাহিনীর সাথে দেবনাথের বাহিনীর যুদ্ধ বাধে। তুমুল সংঘর্ষে দেবনাথের বাহিনী পরাজিত হয় এবং দেবনাথ কে হত্যা করা হয়।
(১৩) এবার তিতুমীর নীলকরদের দিকে নজর দেয়। সে চব্বিশ পরগনার বারাশাত এবং বারিশাতের নীলকরদের যত নীল চাষের জমি আছে তা ধংস করে । এ সংক্রান্ত যত দলিলাদি আছে তা সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ কাজগুলো কৃষকেরাই মূলত করে যাতে করে তাদের চরামূল্যে সুদের লেনদেনের কোন রেকর্ডের অস্তিত্ব যেন আর না পাওয়া যায়।
(১৪) ১৮৩০ সালের নভেম্বরের শুরুতে জমিদার এবং নীলকররা সামগ্রিকভাবে মানুষের উপর থেকে তাদের প্রভাব হারায়। আট নভেম্বর থেকে ১৫ ই নভেম্বর পর্যন্ত তিতুমীরের দলে লোক আরো বাড়তে থাকে।
(১৫) নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় হতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্সি ডিভিসনের নিকট তিতুমীরের ব্যাপারে খবর পৌছানো শুরু হয়। এবং তিতুমীরের আওতাধীন এলাকাগুলোতে সরকারি কর্মকর্তারা যে আক্রান্ত হয়েছে সেটাও তাদের নজরে আসে। এছাড়া ডেভিস এবং স্টর্মের মত ইউরোপিয়ান নীল করেরাও ইস্ট ইন্ডিয়ার নিকট খবর পৌছায়।
(১৬) কমিশনার চব্বিশ পরগনা এবং নদিয়ার মেজিস্ট্রেট কে অতিদ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার হুকুম করে। ১৮৩০ সালের পনেরই নভেম্বর বারাসাতের জয়েন্ট মেজিস্ট্রেট আলেক্সান্ডার এবং বাদুড়িয়া থানার কর্মকর্তা ১২০ জনের এক পুলিশ বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ার মৌজাতে প্রবেশ করে।
(১৭) এই বাহিনীর আগমনের ব্যাপারে তিতুমীর আগেই জেনে ফেলেছিল। সে পাঁচশ জন কৃষক এবং লাঠিয়ালের এক বাহিনী তাদের মোকাবেলার জন্য পাঠান। এদের নেতৃত্ব দেন তিতুমীরের ভাতিজা গোলাম মাসুম। যিনি পুলিশ বাহিনীকে তৎক্ষণাৎভাবে পরাজিত করেন। জয়েন্ট মেজিস্ট্রেট কোনক্রমে নদিয়ার পাশের গ্রামে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন। এ সংঘর্ষের কারণে বাদুড়িয়া থানার ঘৃণিত পুলিশ কর্মকর্তা রামরাম চক্রবর্তী মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া একজন জমিদার , দশজন কনস্টেবল , এবং তিনজন বরকন্দাজ মৃত্যুবরণ করে।
(১৮) এই সফলতার পর তিতুমীর নিজেকে মোঘল শাসকদের ন্যায় 'বাদশাহ' ঘোষণা করে। রুদ্রপুরের মাইনুদ্দীন কে উযীর নিয়োগ করেন। মাইনুদ্দীন বংশীয়ভাবে জোলা বংশের লোক ছিলেন। তিতুমীর তাঁর ভাতিজা গোলাম মাসুম কে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। আট হাজারের মত অনুসারী নারিকেলবাড়িয়া এবং এর আশপাশ থেকে এসে যাদের মধ্যে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় ধর্মের লোকই ছিল তারা তিতুমীরের দলে যোগদান করে। বারাসাতের নির্দিষ্ট এলাকাতে তিতুমীর এদের নিয়ে নিজস্ব রাজ্য প্রতিষ্টা করেন। এই 'স্বাধীন' এলাকাতে তিতুমীর প্রায় এক বছরের মত রাষ্ট্রের মত পরিচালনা করেন। স্থানীয় জমিদারেরা হয় তিতুমীরের কাছে নত স্বীকার করতে হত আর নয়তো তাদের সম্পত্তি রেখে চলে যেতে হত। তিতুমীরের অনুসারিরাই ট্যাক্স নেওয়া আরম্ভ করল, এবং তারা বিচারকার্য সহ অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করল।
(১৯) এরকমভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য কিরকম মূল্য দেওয়া লাগতে পারে এটা তিতুমীর পূর্বেই আঁচ করতে পারে। তিনি বুঝতে পারেন অতি শীঘ্রই ইস্ট ইন্ডিয়ার বাহিনীর সাথে তাদের মোকাবেলা হতে যাচ্ছে। এজন্য নারিকেলবাড়িয়াকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তিনি বাঁশের কেল্লা বানানো শুরু করেন। এবং তিনি তাঁর বাহিনীকে নিয়ে অসম্ভব দ্রুততার সাথে বাঁশের কেল্লা তৈরি করে ফেলেন।
(২০) কিন্ত জমিদার এবং নীলকরেরাও বসে ছিল না। চব্বিশ পরগনা, নদিয়া এবং যশোরের জমিদারগণ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সাথে দেখা করেন এবং তাকে তারা সরাসরি অস্ত্র নিয়ে হামলা করার জন্য আহ্বান করেন। বেন্টিঙ্ক তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে নদিয়ার ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট স্মিথকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ বাহিনী এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করার জন্য আদেশ দেন।
(২১) ১৮৩১ সালের ১৭ ই নভেম্বর সকালে স্মিথ নীলকর ডেভিড অ্যান্ড্রু এবং আরো চারজন ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট মিলে নারিকেলবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা করে এবং তাদের সামনে থাকে তিনশ জনের অস্ত্রসহ এক পুলিশ বাহিনী। জমিদারেরা অনেক লোক এবং হাতি দিয়ে স্মিথের বাহিনীকে সহায়তা করে।
(২২) গোলাম মাসুম, যিনি তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি তিনি পূর্বেই স্মিথের বাহিনীর আগমন জানতে পারেন। স্মিথের বাহিনী নারিকেলবাড়িয়া আসার পূর্বেই সে পনেরশ জনের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বারঘরের দিকে রওয়ানা শুরু করে। বারঘরের অবস্থান নারিকেলবাড়িয়া থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে । দুই বাহিনী মুখোমুখি হলে স্মিথের বাহিনী তুমুল গুলি বর্ষন আরম্ভ করে। কিন্ত এগুলো তিতুমীরের বাহিনীর উপর কোন রকম প্রভাব ফেলতে পারে না। তিতুমীরের বাহিনীর লোকবলের নিকট স্মিথের বাহিনী অতি দ্রুত পরাজিত বরন করে। তিতুমীর বাহিনীর স্থানীয় অস্ত্রসস্ত্রের নিকট আধুনিক অস্ত্র বেকার হয়ে বসে। ইংলিশ অফিসারেরা ইছামতি নদী পার হয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।
(২৩) ১৭ই নভেম্বর ১৮৩১ সালে পরাজিত হওয়ার পর স্মিথ গভর্নর জেনারেলের কাছে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে তিনি বলেন, আমি এই বিস্ময়কর মানুষদের মধ্যে যে পরিমাণ উৎসাহ, সংকল্প এবং উগ্রতা দেখতে পেলাম যাদের সংখ্যা সব মিলিয়ে পনেরশোর বেশি হবে না। আমি এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা করছি না বলতে যে, এদেরকে পরাজিত করতে হলে গভমেন্টের অবশ্য এবং অতিশীঘ্র সাহায্য পাঠাতে হবে।
(২৪) এই চিঠির পর লর্ড বেন্টিংক আসল অবস্থার ব্যাপারে আঁচ পায়। নভেম্বরের আঠারো তারিখে মেজর স্কটের অধীনে পুরোদস্তুর একটি মিলিটারি বাহিনী পাঠানো হয়। এবং এ বাহিনীতে আরো ছিলেন লেফট্যানান্ট শেক্সপিয়র, ক্যাপ্টেন সাদারল্যান্ড । তারা একটি অশ্বারোহী বাহিনী এবং একটি পদাতিক বাহিনীর সমন্বয়ে তিনশজনের একটি বাহিনী পরিচালনা করেন। এবং এই বাহিনীতে দুটো কামানও ছিল। একমাত্র সিভিলিয়ান অফিসার হিসেবে ছিল আলেক্সান্ডার যিনি বারাসাতের মেজিস্ট্রেট ছিলেন। নভেম্বরের আঠারো তারিখের মধ্যাহ্ন নাগাদ তারা নারিকেলবাড়িয়াতে পৌছাল। এবং তারা বাঁশের কেল্লা চারিদিক থেকে ঘিরে রাখল। ইতোমধ্যেই অবশ্যই তিতুমীরের দলের বেশিরভাগ লোকই ফেরত চলে এসে তারা নিজ নিজ স্থানে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তত থাকল। সেদিন আর বেশি কিছু হয়নি।
(২৫) ঐতিহাসিক যুদ্ধ শুরু হয় নভেম্বরের উনিশ তারিখ সকালে। বৃটিশ বাহিনীর তিন ঘন্টা টানা কামান এবং গুলি বর্ষণের মধ্যেও তিতুমীরের বাহিনী তাদের লাঠি, বল্লম , তীর ধনুক এবং মাসকেট বন্দুকের সাহায্যে সাহসীকতার সাথে প্রতিরোধ করে । তিতুমীর আহত হয় কিন্ত তারপরেও তাঁর অনুসারীদের কে শেষ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করতে থাকে। কিন্ত অবশেষে কামানের একের পর এক গোলার আঘাত সহ্য করতে না পেরে বাঁশের কেল্লা ভেঙ্গে পড়তে আরম্ভ করে।
(২৬) ইংলিশ আর্মি ভিতরে প্রবেশ করে এবং তিতুমীর কে তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁর পঞ্চাশজন কমরেড কে হত্যা করা হয়। তিতুমীরের লাশ শহীদ হিসেবে তাঁর অনুসারীরা গ্রহণ করতে পারে এই ভয়ে আলেক্সান্ডার তিতুমীরের লাশ কে পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
(২৭) প্রায় আটশ জন বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে আলীপুর কোর্টে পাঠানো হয়। ১৪০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি প্রদান করা হয়। কিন্ত গোলাম মাসুম যিনি তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন তাকে ধ্বংস্প্রাপ্ত বাঁশের কেল্লার সামনে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় এবং সেখানে অন্যান্য বিদ্রোহীদের ভবিষ্যত শিক্ষার জন্য লাশটিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তিতুমীর এবং হাজী শরীয়তউল্লাহ এবং তাঁর ছেলে দুধু মিয়া এদেরকে বাদ দিলে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সত্যিকারার্থেই বাঙ্গালী সমাজের কোন অবস্থান নেই। এবং এ আন্দোলনগুলো স্পষ্ট করে বললে যে আঙ্গিকেই দেখা হোক না কেন, এগুলো চরমভাবে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। যেহেতু তৎকালীন সময়ে এলিট সমাজের প্রতিনিধিত্ব করত সরাসরি হিন্দু জমিদার এবং তাদের অনুগত সভাসদের বুদ্ধিজীবিরা তারা কখনোই মুসলিমদেরকে আপন মনে করে কাছে টানতে পারে নি। কিন্ত তিতুমীরের আন্দোলন এবং যুদ্ধ এগুলো যতই ধর্মকেন্দ্রিক হোক না কেন তা সমস্ত মজলুমদেরকে একত্রিত করার জন্য অন্যতম সহায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিতুমীর কে নিয়ে প্রথম বাংলা বই লেখা হয় ১৮৯৭ সালে। বইয়ের লেখক ছিলেন বিহারীলাল সরকার। তিতুমীরকে নিয়ে লেখা বই কিন্ত এই বইতে তিনি স্পষ্ট করে হিন্দু জমিদার এবং ইংরেজদের পক্ষে খোলাখুলিভাবে সাফাই গায়। তাই তিতুমীরকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে লেখা বইগুলো তিতুমীরকে বাস্তবভাবে তুলে ধরতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়। তারপরেও প্রবন্ধের লেখক অনেক যাচাই বাছাই করে নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রবন্ধটি নিবন্ধিত করেন।
মেয়েদের বহুবিবাহ ও ব্রেক আপ পার্টি
ইসলামি রাষ্ট্র পশ্চিম আফ্রিকা মৌরিতানিয়া। জনসংখ্যা : 50 লক্ষ। সরকারি ভাষা আরবি। জনসংখ্যার প্রায় ১০০% মুসলিম। মজার বিষয় হচ্ছে, এই মৌরিতানিয়ার মেয়েরা বহু বিবাহ করে থাকেন। যে নারীর যত বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, সেই নারী মৌরিতানিয়ায় তত সম্মানিত হয়। সেই দেশের লোকেরা মনে করেন, অনেক ডিভোর্সের মধ্য দিয়ে একজন নারী তার জীবন অভিজ্ঞতা ও পুর্ণতা পায়। কোনো নারীর ডিভোর্স হয়ে গেলে তার মাতাপিতারা উৎসব আয়োজন করে থাকেন। আবার অনেক মেয়েরা উৎসব করার সময়টুকুই পান না, তার আগেই নতুন সংসার পাতেন।
মৌরিতানিয়াতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই রীতি চলে এসেছে।। দেশটিতে প্রেমহীন ও অশান্তির সংসার নেই বললেই চলে। মৌরিতানিয়াতে বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে কেউ ছিঃছিঃ করে না, বা থাকে না দুঃখের আবহ। বরং সেখানে ডিভোর্স মানেই আনন্দ-উৎসব। ‘ডিভোর্স পার্টি’ উদযাপন করে জানানো হয়, এই নারী এখন নতুন বিবাহের পাত্র খুজছেন। এই ডিভোর্স পার্টিতে বন্ধু-বান্ধব কলিগসহ সবাই এসে একসঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করেন, গান করেন, নাচেন।
এখানে প্রায়ই ডিভোর্সের ঘটনা ঘটে বলে ওরা আমার স্বামী আমার স্ত্রী বলেন না, বলেন আমি অমুকের সাথে আছি। বিচ্ছেদ হলে বলেন অমুকের সাথে আমার সমস্যা হয়েছে। ্তাদের অনেকের জীবনে বিয়ে আসে ৫ থেকে ১০ বার। আবার কারও কারও জীবনে ২০ থেকে ২৫ বারও বিয়ের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। ওখানে পরকিয়া নেই বললেই চলে। আর ঘটা করে বিয়ের বদলে হুটহাট করে কলেমা পড়ে সাদামাটা বিয়েই বেশি হয়। সেখানে সঙ্গী বেছে নেবার ক্ষেত্রে খুব একটা বাছ-বিচার করতে দেখা যায় না। তবে ভাল পছন্দসই সঙ্গী পেলে এক বা একাধিক সন্তানের জন্ম দেয় মেয়েরা।
উল্লেখ্য, মৌরিতানিয়াবাসীরা পূর্বসূরিদের কাছ থেকে পেয়েছেন শক্তিশালী ‘মাতৃতান্ত্রিক প্রবণতা’। মৌরিতানিয়ায় ডিভোর্স এতটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে ওঠার এটি একটি কারণ বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তাদের মধ্যে এই বহু বিবাহের অন্য কারণ হিসাবে দেখা যায় যে, স্বামী তার স্ত্রী বা স্ত্রীদের সাথে যৌনতা করতে একঘেয়ে বোধ করে। অন্যদিকে নারীরা তাদের স্বামীদের অবহেলা, অনাদর, যৌনতায় অমনযোগী হবার অভিযোগ করে থাকেন। প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই মেয়েরা প্রাক্তন স্বামীর তুলনায় অধিক যোগ্য সঙ্গী পেতে চান। যেমন বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক অবস্হান, অর্থ, গোত্্ দৈহিক সৌন্দর্য্য ইত্যাদী। এক গবেষণায় দেখা যায়, সেখানে ১৪-২৮ বছর বয়সী মেয়েদের তুলনায় ৩০-৫০ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে নতুন সম্পকে জড়িয়ে পরার পরিমাণ প্রায় অনেক বেশী। অর্থাৎ সেখানে মেয়েদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই প্রবণতা বাড়তে থাকে।
আফ্রিকার মৌরিতানিয়ার পাশেই আছে আর এক মুস্লিম যাযাবর জাতি তুয়ারেগ। সাহারা মরুভূমির মুসলিম যাযাবর তুয়ারেগ জাতি মানুষ্রা নিজেদের বলে ‘আমাজ়িগ’ বলেন।— যার অর্থ মুক্ত মানুষ। তুয়ারেগরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হলেও পশুপালক এই জনগোষ্ঠীর সামাজিক রীতিনীতি পশ্চিমাদের চেয়ে বেশি উদার। মুসলিম সমাজে পুরুষের সামনে নারীরা মুখ ঢেকে রাখে। কিন্তু তুয়ারেগ সমাজে ঘটে এর উল্টোটাই। নারীর সামনে পুরুষেরা মাথায় এক ধরনের নীল রঙের কাপড় দিয়ে মুখম-ল ঢেকে রাখে। সেজন্য তাদেরকে ‘সাহারার নীল মানুষ’ বলা হয়। তাদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সম্পত্তি থাকে স্ত্রীর মালিকানায়। ফলে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন থাকেন। । তুয়ারেগ নারীদের এতটাই স্বাধীনতা রয়েছে যে, তারা বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরেও পুরুষ সঙ্গী রাখতে পারে। এর ফলে এই সমাজে তালাক ও বিচ্ছেদের ঘটনা প্রায়শ ঘটে। তুয়ারেগ নারীরা বিয়ে ছারাই অনেক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারে। তাদের নর-নারীর মধ্যকার সম্পর্ক এতোটাই স্বাভাবিকভাবে দেখা হয় যে, কোনো নর-নারী যদি তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাঁবুর বাইরে কোনো উট অপেক্ষমান থাকে, তাহলে সেই তাঁবুর আশেপাশে কেউই যায় না। এমনকি তাঁবুতে থাকা নর-নারীর পিতা-মাতাও এর ধারে কাছে যায় না। যদি ওই দুই নর-নারীর ইচ্ছে হয় একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকার, তবেই বিয়ে করানো হয়। তবে বিয়েতে রাজি হওয়া বা না হওড়া বা বিচ্ছেদ-এর সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকে শুধু নারীদের কাছে।
ব্রেক আপের আফ্রিকান ধরণের পর এবার চলুন পশ্চিমা দুনিয়ায়।
1লা আগস্ট, গার্লফ্রেন্ড ডে পালিত হয় ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে। এই দিনে ছেলে-মেয়েরা একত্রিত হতে তাদের বিশেষ বন্ধুত্বের বন্ধন উদযাপন করে। এরপর 27 সেপ্টেম্বর ক্রাশ দিবস আসে। এ দিনে কে কার ক্রাশ, তা জানিয়ে দেয়া হয়। ফেব্রুয়ারি মাসকে প্রেমের মাস বলা হয়। ৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স উইক পালন করা হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি রোজ ডে এবং ৮ ফেব্রুয়ারি -প্রপোস ডে.দিয়ে শুরু হয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি কিস ডে এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে দিয়ে শেষ হয়। ঠিক এর পরদিনই শুরু হয় অ্যান্টি ভ্যালেন্টাইন পিরিয়ড। এটা অনেকটা দিন শেষে রাত আসার মতো ঘটনা। ১৫ ফেব্রুয়ারি 'স্ল্যাপ ডে' যার সাথে ভ্যালেন্টাইন করা যায়নি, তাকে চড় মেরে হৃদয়ভাঙার প্রতিশোধ নেওয়ার দিন এটি। অ্যান্টি ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র দ্বিতীয় দিন কিক ডে। প্রাক্তনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা যাবতীয় বিষাদ, অপমানকে জীবন থেকে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দেয়া।
১৭ ফেব্রুয়ারি পারফিউম ডে। সুগন্ধীতে অবগাহন করে পুরনো স্মৃতিকে ভুলে নতুন করে নিজেকে ভালবাসতে শেখার দিন এটি । ১৮ ফেব্রুয়ারি - ফ্লার্টিং ডে, অর্থাৎ নতুন কারো সাথে ফ্লার্টিং করে বেকাপ লাভার তৈরি করার দিন এটি। ১৯ ফেব্রুয়ারি কনফেশন ডে: ফ্লার্ট ডে-তে ভাল লাগার মানুষটির সঙ্গে ডেট করার পর, এদিন তাকে মনের কথা বলার দিন।
২০ ফেব্রুয়ারি - মিসিং ডে, ফ্লার্টিং লাভারকে বলে দিন, তাঁর অভাব কতটা অনুভূব করছেন আপনি আর প্রাক্তন লাভার-এর সঙ্গে আনন্দদায়ক সময়গুলি স্মরণ করে তাকে চমৎকার উপহার দিন 'মিসিং ডে'-এর দিন । এরপর আসল দিন। ২১ ফেব্রুয়ারি-ব্রেক আপ ডে। প্রাক্তনের সঙ্গে বিচ্ছেদের দিন এটি । যে সম্পর্ক কোনও ভাল লাগা তৈরি করে না। বরং কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ধীরে ধীরে। সে সম্পর্কের ভার আর বয়ে চলার মানে হয় না। তাই সকল খারাপ লাগা থেকে মুক্তি পেতে ্ব্রেক আপ করুন। যাতে পরের বছর জোর করে অপছন্দের কারও সঙ্গে প্রেম দিবস পালন না করতে হয়।
পৃথীবীর সবচেয়ে বহুবিবাহ বাঙালি কুলীন ব্রাহ্ম সমাজে !?
একাদশ শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গ-এ ব্রাহ্মণের অভাবের কারণে উত্তর ভারতের কনৌজ থেকে ৫টি গোত্রের ব্রাহ্মণকে আনা হয় বলে জানা যায়। এরা হল, ব্যানার্জি, চ্যাটার্জি, মুখার্জি, …। এরাই বাংলায় কুলীন ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত হয়। বাংলায় আসার পর, এদের বিবাহের যে প্রচলিত নিয়ম তৈরি হয় তা হল, একজন পুরুষ কুলীন ব্রাহ্মণ যেকোন ব্রাহ্মণ বংশেই বিয়ে করতে পারবেন, কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যার বিয়ে হবে কেবলমাত্র কুলীন বংশেই। যদি কুলীন কন্যা কুলীন বংশের বাইরের কাউকে বিয়ে করত, তবে ঐ কন্যার পিতা কৌলিন্য হারাতো। অন্যদিকে কুলীন পুরুষেরা যেকোনো বংশের সুন্দরী ব্রাহ্মণ মেয়েদের বিয়ে করে ঘরে তুলে নিতে পারত। এতে দেখা গেল, কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যাদের জন্য পাত্র পাওয়া যায় না। অর্থাৎ কুলীন কন্যারা ছিল অসহায়। আর এরই সুযোগে কুলীন পুরুষদের মধ্যে বেড়ে গেল বহুবিবাহ। কুলীন কন্যার পিতার ছিল কন্যাদায় মুক্ত হবার তাড়া, যে কোনো বয়সের কুলীন ব্রাহ্মণ পেলেই মেয়েকে তার সাথে বিয়ে দিয়ে কন্যাদায়মুক্ত হতে হতো তাকে। ফলে সমাজে যে নিয়ম তৈরি হল, তা অনেকটা এমন- কুলীন পুরুষেরা বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে কুলীন কন্যাকে বিয়ে করে কন্যার পিতাকে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করতো, আর নতুন বঊয়ের সাথে কয়েক রাত কাটিয়ে শ্বশুরের নাম ধাম একটা খাতায় লিখে নিয়ে চলে যেতো।
কুলীন কন্যা নিজের বাপের বাড়িতেই থাকতো। এরপর মাঝেমাঝে বছরে দুই একবার কুলীন স্বামী তার স্ত্রীকে দেখতে আসতো, এরপর ভালমন্দ খেয়ে দেয়ে, রাত কাটিয়ে আবার চলে যেতো। অর্থ ও নতুন যুবতী মেয়ের লোভে কুলীন পুরুষেরা একে বাণিজ্যিক পেশায় পরিণত করেছিল। দেখা যেত অনেক সময় কুলীন ব্রাহ্মণেরা কুল রক্ষার জন্য মৃত্যুশহ্যায় থাকা কোন কুলীন পাত্রের সাথেও মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিত। অনেক সময় কুলীন পাত্রেরা রাতে শুতে গিয়ে স্ত্রীর সব গয়না নিয়ে চম্পট দিত। এর ফলে গ্রামে গ্রামে যুবতি বিবাহিত কুলিন মেয়ে্রা যৌনতৃষ্ণা মেটাতে বেশিরভাগ সময় পরপুরুষের সাথে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হত। আর তার ফল হত অবাঞ্চিত সন্তান আর ভ্রূণ হত্যা। কুলীন নারীদের এই অবৈধ সহবাসের কথা রাম নারায়ণ তর্করত্ন তার কুলীনকলসর্বস্ব’ নাটকে দেখিয়েছেন এভাবে যে, "কুলীন স্বামী তিন বৎসর শ্বশুরবাড়ি যায়নি। হঠাৎ খবর এল তার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। কুলীন স্বামী আশ্চর্য হয়ে পিতাকে যখন এ কথা বলছে, তখন পিতা বলছেন–বাপু হে, তাতে ক্ষতি কি? আমি তো বিবাহ করবার পর একবারও শ্বশুর বাড়ি যাইনি। তোমার মায়ের সাথে শুভদৃষ্টির পর একেবারে তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়।" এভাবে নাটকে ও অন্যান্য গণমাধ্যমে এই অনাচারের বিরোদ্ধে প্রচারণা মুরু হয়। বিদ্যাসাগরের 'বহুবিবাহ' প্রবন্ধে এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'বামুনের মেয়ে' উপন্যাসে এই সামাজিক ভয়াবহতার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই কৌলীন্য প্রথা নিরোধের জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়েছিলেন রাম নারায়ণ তর্করত্ন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যদিও ইংরেজ সরকার এ সম্বন্ধে কোন আইন প্রণয়ন করেনি। তার পরও বিদ্যাসাগরগংদের প্রচেস্টার ফলে যে জনমত গড়ে ওঠে, তারই প্রভাবে পরবর্তীতে কৌলীন্য প্রথার অবলুপ্তি ঘটে।
ভারতে এই নারী ভোগ প্রথা চালু হয় মুলত মুগলদের হেরেমের মাধ্যমে। যে সম্রাটের যত ক্ষমতা ও অর্থবিত্তের অধিকারী, তার হারেমে নারীর সংখ্যাও তত বেশি থাকত। আবুল ফজলের লেখায় পাওয়া যায়, আকবর নাকি পাঁচ হাজারেরও বেশি মহিলাকে তাঁর হারেমে রেখেছিলেন। তার আমলে বন্ধী চুক্তির প্রথম শর্ত ছিল যে, আকবর সেনা বন্দী শত্রু রাজপুত সৈনিকদের মুক্ত করে দেবে, বিনিময়ে রাজপুতরা তাদের সুন্দরী বঊ ঝিদেরকে মুঘল হারেমে প্রেরণ করবে। আকবরের আমলে তৈরি হওয়া হারেমের ঐতিহ্য পরবর্তী সময়ে রক্ষা করেছিলেন জাহাঙ্গির, শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবও। তবে জাহাঙ্গিরকে ঘিরেই মুঘল হারেমের সবথেকে বেশি গুঞ্জন শোনা যায়। কথিত আছে, বাংলার সুলতান সিকান্দার শাহের হারেমে ১০ হাজার নারী ছিল। বিখ্যাত অটোম্যান সুলতান সুলেমান প্রধানত ভার্জিন নারী পছন্দ করতেন। যদি দাসীটি তার মনোরঞ্জন, সন্তুষ্ঠ করতে পারত, তবেই ২য় বার সে সুলতানের দেখা পেত এবং যদি দাসীটি তার পুত্র সন্তান জন্ম দিতে পারত এবং দাসীটির আচার ব্যবহার, গুণ, শিক্ষা, রূপ যদি সব পচ্ছন্দ হত, তবেই সুলতান তাকে উপপত্নীর মর্যাদা দিতেন। তখন একজন সুন্দরী কুমারি মেয়ে প্রধান স্বপ্ন দেখতেন, যে কোন উপায়ে সুলতানের উপপত্নী হওয়া। প্রতিদিন এই প্রতিযোগিতায় অসংখ্য মেয়ে আসতো। এটা অনেকটা বর্তমানে মডেল বা নায়িকা হবার জন্য যাত্রা বলা যায়।
ভারতের বিচিত্র বিবাহ রীতি
ভারতের ত্রিবাঙ্কুরের ‘পাহাড়িয়া পান্তারাম’ ও ‘উরালী’দের মধ্যে যখন কোন যুবক বিবাহ করতে চান, তখন তাকে নিজের পরিবারের বা সমাজের কোন মেয়ে বা আত্মীয়াকে অপর দলের হাতে সমর্পণ করে তবে স্ত্রী সংগ্ৰহ করতে হয়। নীলগিরি পাহাড়ের ‘টোডা’দের একাধিক ভাই একজন স্ত্রীলোককে বিবাহ করেন। অনেক সময় ভাইগণ সহোদর না হয়ে দলভুক্ত বন্ধুও হন। অর্থাৎ যুবক বন্ধুরা একত্রে একজনকে বিয়ে করেন। ‘গারো’দের মধ্যে জামাতা কর্তৃক বিধবা শ্বাশুড়ীকে বিবাহ করার রীতি আছে। আসামের ‘বাগনি’, ‘দাফল’ ও ‘লাখের’দের মধ্যে পিতার মৃত্যুর পর বিধবা-বিমাতাকেই সন্তান স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে।
কেন? ভারতের আদিবাসী একাধিক ভাই/বন্ধু মিলে একজন স্ত্রীলোককে বিয়ে করে আর বয়স্করা অতি অল্পবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করে?
হিন্দুসমাজের সপিণ্ড বিধানের অনুসরণে অনেক আদিবাসীদের মধ্যেও পিতৃকুলে বা মাতৃকুলে বিবাহ নিষিদ্ধ আছে। যেমন - উত্তর প্রদেশের ‘ভানটু’দের মধ্যে বিবাহের জন্য মাতামহীর কুলে ছয় পুরুষ বর্জন করার বিধি আছে। মধ্যপ্রদেশের ‘ভীল’জাতি পিতার ও মাতা কুলেও তিন পুরুষ বর্জন করেন।
উড়িষ্যার কোরাপুট জেলার ‘পরোজা’দের সমাজে একই গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কখনও বিবাহ হয় না। তামিলনাড়ুতেও একই গ্রামের মধ্যে কখনও ছেলেমেয়ের বিবাহ দেন না। আসামের কাছাড় জেলার ‘পাহাড়ী কাছারী’ ছেলেরা কখনও মায়ের বংশে ও মেয়েরা কখনও বাপের বংশে বিয়ে করতে পারেন না।
বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের ভীলজাতির মধ্যে রাক্ষস বিবাহ প্রচলিত আছে। সাধারণত বর বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে কোন গ্রামে প্রবেশ করে ও মেয়েটিকে জোর করে কেড়ে নিয়ে আসে। তারপর একটা সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। দক্ষিণ ভারতের ত্রিবাঙ্কুরের ‘মুড় বন’ জাতিদের মধ্যেও মেয়ে কেড়ে নিয়ে এরকম রাক্ষস বিবাহ প্রচলিত আছে। একে বলা হয় ‘সিন্দুর ঘষা’ বিবাহ। সিন্দুর ঘষা বিবাহ প্রচলিত আছে আমাদের ঘরের কাছে সাঁওতাল সমাজেও। এ বিবাহে পুরুষ হাটে বা বাজারে জোর করে কোন মেয়ের সিথিতে সিন্দুর ঘষে দেন। সিন্দুর ঘষে দেবার পর উভয়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক হয়ে যায়। মেয়ে যদি বরকে পছন্দ না করে, তাহলেও তাঁর সঙ্গে তাকে ঘর করতে হয়। তার কারণ, সিন্দুর-ঘষা মেয়েকে সমাজে আর কেউ বিবাহ করেন না।
দক্ষিণ ভারতের ত্রিবাঙ্কুরে এখনো কন্যা-বিনিময় প্রথা প্রচলিত আছে। ত্রিবাঙ্কুরের ‘পাহাড়িয়া পান্তারাম’ ও ‘উরালী’দের মধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণভাবে বিনিময় প্রথার মাধযমেই হয়। এঁদের সমাজে যখন কোন যুবক বিবাহ করতে চান, তখন তাকে নিজের পরিবারের বা সমাজের কোন মেয়ে বা আত্মীয়াকে অপর দলের হাতে সমর্পণ করে তবে স্ত্রী সংগ্ৰহ করতে হয়। যে-কোন বয়সের বোন বা আত্মীয়া হলেই চলে, কেবল তাঁকে স্ত্রীলোক হতে হবে। এই কারণে পান্তারাম’ ও ‘উরালী সমাজে’ কোন যুবকের যতগুলি বোন থাকে, তাঁর ততগুলি বিবাহ করবার সম্ভাবনা থাকে, তাই সমাজে এই ভাইকে সবাই নেতা হিসেবে দেখে।
আদিবাসী সমাজে কন্যাপণ প্রথা বহুবিস্তৃত। তবে অনেক উপজাতির মধ্যে বরকে কন্যাপণের পরিবর্তে শ্রমদান করতে হয়। এরূপ বিবাহে বরকে নির্দিষ্টকালের জন্য শ্বশুরবাড়ীতে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমিকের কাজ করতে হয়। এরূপ শ্রমদানের কাল সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বৎসর পর্যন্ত নির্দিষ্ট হয়। কোন কারণে যদি বিবাহ না হয়, তা হলে কন্যার পিতাকে শ্রমের পারিশ্রমিক প্রদান করতে হয়। মধ্যপ্রদেশের ভীলদের মধ্যে কন্যাপণের বিনিময়ে শ্রমদানের প্রথা প্রচলিত আছে। এঁদের মধ্যে সাত বছর থেকে নয় পর্যন্ত শ্রম দিতে হয়। প্রায়ই দেখা যায় যে, দুই তিন বছর শ্রমদানের পর যুবক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায়।
উদয়পুরের ‘পাণ্ডো’দের মধ্যে এবং মাছরার ‘পালিয়ান’দের মধ্যে যুবক-যুবতী যদি গোপনে পালিয়ে যায়, বা সম্পর্ক থাকা অবস্থায় যুবতী গর্ভবতী হয় তাহলে সামাজিক রীতি অনুসারে যুবক ওই মেয়েটির স্বামী হিসেবে পরিচিত হন ।
হিমালয়ের সীমান্ত প্রদেশের কয়েকটি উপজাতির মধ্যেও একাধিক স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। তবে নীলগিরি পাহাড়ের ‘টোডা’দের মধ্যে বেশি প্রচলিত আছে। টোডাদের বহুপতিক বিবাহ হচ্ছে ভ্রাতৃত্বমূলক। একাধিক ভাই একজন স্ত্রীলোককে বিবাহ করেন। অনেক সময় ভাইগণ সহোদর না হয়ে দলভুক্ত বন্ধুও হন। অর্থাৎ যুবক বন্ধুরা একত্রে একজনকে বিয়ে করেন। টোডাদের মধ্যে সন্তানের পিতৃত্ব ‘পুরুসুৎ পুমি’ নামে এক অনুষ্ঠানের দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। স্ত্রীর ৭ মাস গর্ভকালে স্বামীদের মধ্যে একজন এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন এবং সেই সন্তানের পিতারূপে পরিচিত হন। অপর কোন স্বামী অন্য সন্তানের অনুরূপ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে অন্য সন্তানের পিতারূপে গণ্য হন। যেক্ষেত্রে স্বামীরা যদি সকলে ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে বাস করেন সে-ক্ষেত্রে স্ত্রী পালা করে প্রত্যেক স্বামীর সঙ্গে একমাস কাল করে বাস করেন।
কাশ্মীরের লাদাখ উপত্যকার অধিবাসী ‘লাদাকি’দের মেয়েরাও বহুপতি গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সাধারণত বড় ভাইই বিবাহ করেন কিন্তু সেই বিবাহিতা স্ত্রী তাঁর ছোট ভাইদেরও স্ত্রীরূপে পরিগণিত হন। তবে যেখানে অনেকগুলি ভাই থাকেন সেক্ষেত্রে ওই সম্পর্ক মাত্র চার ভাইদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়। এরূপ ক্ষেত্রে পরবর্তী ভাইকে কোন মঠের গিয়ে লামা বা সন্যাসির জীবনযাপন করেন। কেউ যদি এরূপভাবে মঠে প্রবেশ করেন না সেক্ষেত্রে সে ‘মাগপা’ স্বামী হিসাবে কোন মেয়েকে বিবাহ করতে পারেন। ‘মাগপা’ স্বামীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়। তাঁকে সব সময় স্ত্রীর বশীভূত হয়ে থাকতে হয় এবং স্ত্রী যখন খুশী তখন তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে আবার নূতন ‘মাগপা’ গ্রহণ করতে পারেন।
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলে ‘লেপচা’ জাতির মধ্যে বিবাহে নিয়াগ প্রথা প্রচলিত আছে। সাধারণত কোন ব্যক্তি যখন চাষবাস বা ব্যবসার কাজ একা করতে অসমর্থ হয় বা তাঁকে অন্য কাজেও সময় দিতে হয়, তখন সে প্রতিবেশীদের মধ্য থেকে কোন অবিবাহিত যুবককে তাঁর মাঠের কাজ করবার শর্তে তাঁর দাম্পত্য শয্যার অংশীদার হতে আহ্বান করে নেয়। এক্ষেত্রে কোন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না। এই দ্বিতীয় স্বামী কখনও স্বতন্ত্র বিবাহ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে স্ত্রী পর্যায়ানুক্রমে রাত্রিকালে প্রত্যেক স্বামীর সঙ্গে শয্যা গ্রহণ করবেন। তবে যে-কোন স্বামীর দ্বারা সন্তান উৎপন্ন হউক না কেন সে সন্তান প্রথম স্বামীর ঔরসজাত বলে পরিচিত হবে। হিমালয়ের পাদদেশের জৌনসর বেওয়া অঞ্চলের ‘খস’ জাতীয় অধিবাসীদের মধ্যে, উত্তর ভারতের ‘জাট’জাতির দরিদ্রশ্রেণীর মধ্যে ও কেরালার ‘নায়ার’ ও ‘আশরী’জাতির মধ্যেও বহুপতি বিবাহের চলন আছে। ভারতের বাইরে তিব্বতেও বহুপতি বিবাহ আছে।
বিধবা বিবাহ আদিবাসী সমাজে খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। তাবার ত্রিবাঙ্কুরের ‘কুরুস্ব পুলায়ান’দের মধ্যে বড় ভাইয়ের অধিকার থাকে ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করবার। কিন্তু ‘উল্লটন’রা শুধুমাত্র দেবরকেই বিবাহ করার অনুমতি দেন। আসামের ‘গারো’দের মধ্যে জামাতা কর্তৃক বিধবা শ্বাশুড়ীকে বিবাহ করার রীতি আছে। আসামের ‘বাগনি’, ‘দাফল’ ও ‘লাখের’দের মধ্যে পিতার মৃত্যুর পর বিধবা-বিমাতাকেই সন্তান স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে। এ সমাজে বয়স্ক পুরুষ সাধারণতঃ অল্পবয়স্ক মেয়েকে বিবাহ করেন, যাতে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে কন্যাপণ না দিয়ে বিমাতাকে স্ত্রীরূপে ব্যবহার করতে পারে। মধ্যপ্রদেশের ‘ভানটু’দের মধ্যে কোন বিধবা নারির যদি অনেকগুলি ছেলেমেয়ে থাকে, তাহলে সে বিবাহ না করে অপর পুরুষের সঙ্গে যথেচ্ছা যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাত্রীকালে যুবক ছেলেরা এই বিধবার ঘরের আশেপাশে অবস্থান নেয় এবং বিধবার খরচ মিলেমিশে বহন করেন।
নিয়োগ প্রথা
বিধবা নারী বা বিবাহিত নারী স্বামী ছাড়াও নিয়োগের মাধ্যমে যার সাথে রাত কাটাত, তাকেই দ্বিতীয় বর বা দেবর বলা হত!
মনে করুন, আজকে বিয়ে হল কোনো মেয়ের। বাসররাত কাটিয়ে পরেরদিন মেয়েটির স্বামী মারা গেলো। এখন যেহেতু মেয়েটি এক রাত কাটিয়ে ভারজিনিটি হারিয়েছে, তাই সে আর বিবাহ করতে পারবে না। তবে সে নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে মা হতে পারবে। আবারস্বামী বেঁচে থাকলেও স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে নিয়োগ পদ্ধতিতে রাত কাটিয়ে সন্তান জেনারেট করতে পারবে। স্বামী ধর্মের কাজে কিংবা বিদ্যার্জন বা খ্যাতি লাভের জন্য বা কাজের জন্য প্রবাসে গেলে কিংবা অপর স্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘদিন কাটালে স্ত্রী বয়ফ্রেন্ড নিয়োগের মাধ্যমে সন্তান জেনারেট করতে পারবে।
নিয়োগ প্রথা কী?
আর্যরা যখন ভারতে অনুপ্রবেশ করে তখন তাদের মেয়ে কম ছিলো, বংশের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য তারা একটি মেয়েকে কোন ব্যাক্তির সাথে নয়, এক পরিবারের কাছে বিয়ে দিতো, এবং পরিবারের সকল ভাই সেই মেয়ের স্বামীরূপে গণ্য হত। দ্রোপদির পাঁচ স্বামীর সাথে বিয়ের ব্যাপারটা সেই সমাজেরই প্রধিনিত্ব করে । এখনো ভারতের ডজন খানের আদিবাসী এই নিয়ম পালন করে। একাধিক স্বামীর সঙ্গে বা একটি পরিবারের সাথে বিবাহ হবার এই প্রথা পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে নিয়োগ প্রথায় রূপ নেয়। এই নিয়োগপথা, মহাভারতের যুগে চালু হয় এবং স্মৃতিযুগের শেষের দিকে এই নিয়োগপ্রথা পরিত্যক্ত হয়। চলুন এই নিয়োগ প্রথার বিস্তারিত জেনে আসি।
‘নিয়োগ’ বলতে বোঝায় কোনো বিবাহিত নারী কিংবা বিধবাকে কোনো বিশেষ পুরুষের কাছে যৌন মিলনের জন্য পাঠানো, যাতে সে পুত্রসন্তানের মা হতে পারে।
বাঙালি সমাজে দেবর নামটা এসেছে এই নিয়োগ প্রথা থেকেই। আগের যুগে বিধবা নারী বা বিবাহিত নারী স্বামী ছাড়াও নিয়োগের মাধ্যমে যার সাথে রাত কাটাত, তাকেই দ্বিতীয় বর বা, দেবর বলা হত। স্বামীর ছোট বা বড় ভাইরা হউক অথবা নিজ জাত বংশের ভাইয়েরা হউক, যার সহিত নিয়োগ হবে তারই নাম দেবর।
মনে করুন, আজকে বিয়ে হল কোনো মেয়ের। বাসররাত কাটিয়ে পরেরদিন মেয়েটির স্বামী মারা গেলো। এখন যেহেতু মেয়েটি এক রাত কাটিয়ে ভারজিনিটি হারিয়েছে, তাই সে আর বিবাহ করতে পারবে না। তবে সে নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে মা হতে পারবে। আবার
স্বামী বেঁচে থাকলেও স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে নিয়োগ পদ্ধতিতে রাত কাটিয়ে সন্তান জেনারেট করতে পারবে। তাতে স্বামী-স্ত্রীর আমরণ সম্পর্ক থাকবে। কিন্তু নিয়োগের স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক যৌন মিলন শেষে ছিন্ন হয়ে যায়। আবার নিয়োগের মাধযমে উৎপন্ন সন্তান সেই বীর্যদাতার উত্তরাধিকার পায় না। এটা অনেকটা বর্তমান স্পার্ম ব্যাংক থেকে স্পার্ম নিয়ে সন্তান উৎপাদন করার মত।
নিয়োগ পদ্ধতিতে একজন মহিলা এগারোজন পর্যন্ত পুরুষের সাথে যৌন মিলন করতে পারেন, এবং পুরুষরাও সন্তান উৎপাদনের জন্য এগারোজন পর্যন্ত মহিলাদের (একের পর এক) সাথে যৌন মিলন করতে পারেন। কোনো বিবাহিত দম্পতির মধ্যে স্বামী যদি সুস্থ হয়, আর স্ত্রী কোনো রোগে ভুগে থাকে, তাহলেও ঐ স্বামী অপর মহিলার সাথে যৌন মিলন করে সন্তান উৎপাদন করতে পারবে। আবার স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকে এবং এই দীর্ঘসময়টা যদি স্বামী তার উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তাহলে সে নিয়োগের মাধ্যমে অপর কোনো মহিলাকে গর্ভবতী করতে পারবে।
স্বামী ধর্মের কাজে প্রবাসে গেলে কিংবা বিদ্যার্জন বা খ্যাতি লাভের জন্য গেলে এবং অপর স্ত্রীর দীর্ঘদিন কাটালে স্ত্রী নিয়োগের মাধ্যমে সন্তান জেনারেট করতে হবে।
মহাভারতে এই প্রথার অনেক উদাহরণ আছে| প্রাচীন ভারতের হস্তিনাপুরের রাজা বিচিত্রবীর্য্যের দুই স্ত্রী ছিলেন - অম্বিকা ও অম্বালিকা| সন্তানের জন্মের আগেই বিচিত্রবীর্য্য মারা যান| সত্যাবতী প্রথমে ভীষ্মকে প্রস্তাব দেয় তার পুত্রবধূদের সন্তান উৎপাদন করার জন্য। পরে ভীষ্ম রাজি হয় না, এবং ব্যাসদেবের মাধ্যমে ব্যবস্থা করে দেয়। বেদব্যাস অম্বিকা, অম্বালিকা ও অম্বিকার দাসী পরিশ্রমীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করেন| তার ফলে তিন ছেলের জন্ম হয় - ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর| মজার ব্যাপার হল- পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র পাণ্ডবদের জন্মও ঐ ভাবেই হয়েছিল, কারণ পাণ্ডুও অক্ষম ছিলেন| আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল-মা সত্যবতী বিচিত্রবীর্য্যের বাবা শান্তনুকে বিয়ে করার আগে বেদব্যাসকে জন্ম দিয়েছিলেন এই নিয়োগের মাধ্যমেই|
রাজা পাণ্ডু এক ঋষির অভিশাপের কারণে সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা হারান। তাই বিভিন্নভাবে তার স্ত্রী কুন্তীকে বোঝান পরপুরুষের সাথে সেক্স করে সন্তান উৎপাদন করে দিতে। কুন্তী প্রথমে রাজি হয় না, কিন্তু পাণ্ডু বলে ঋতুকাল ব্যতীত মেয়েরা ইচ্ছামতো যার সাথে খুশি শুতে পারে, পাপ হয় না। স্বামী যদি স্ত্রীকে বাচ্চা উৎপাদনের জন্য নিয়োগ করে, তাহলে তা না মানলে স্ত্রীর পাপ হয়। এরপর কুন্তী রাজি হয়, এবং ছোটবেলায় পাওয়া মন্ত্রের সাহায্যে দেবতাদের সাথে সহবাস করে। অনেক বছর সন্তান না হওয়ায় ভণ্ড বাবার কাছে স্বামী তার স্ত্রীকে তুলে দেন। সেই ভণ্ড সাধুবাবা রাতভর ধর্ষণলীলা চালায়। পরদিন স্ত্রী স্বামীর সাহায্য চাইলে স্বামী কিছু বলে না।
পুরানো আরিয়া সমাজে নিয়োগ প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলনের অগনিত প্রমাণাদি মহাভারত গ্রন্থে আছে। দিয়াস সোওয়ামীজী তার ঐতিহাসিক ভাষণে ্বলেন- বর্তমান যুগে নিয়োগ প্রথা শেষ হয়ে যাওয়া্টাই, হিন্দুদের চারিত্রিক অধপতনের মূল করণ’। যদি ভিন্ন পুরুষের স্ত্রীদের সাথে সমাজের যে কোন পুরুষ নিয়োগ প্রথা অনুসারে যৌন মিলনের সুযোগ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হতো, তাহলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মারাত্মক অধপতন হতো না, শয়ারিরিক, মানসিক উন্নতির পাশাপাশি মেধারগত উন্নতিও লাস্ক হত।
সোওয়ামিজী বলেন, নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে যৌন মিলন অথবা স্থায়ী বিবাহের ব্যবস্থাপনার অভাবে মানুষের মধ্যে যে অবর্ণনীয় চরিত্রহীনতা এবং ধ্বংসত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা আজ বিশ্ববাসী স্বচক্ষে অবলোকন করেছে।
সোওয়ামিজী এতটুকু বলেই ক্ষ্যান্ত হন নাই বরং পরিস্কার ভাষায় ঘোষণা করেন, হে আরিয়া সমাজের লোকজন! ভাল করে শুনে রাখ!
স্থায়ী বিবাহের তুলনায় নিয়োগ পদ্ধতির যৌন মিলন প্রথা বহুগুনেই উত্তম। মনে রাখতে হবে যে, যদি সমাজে স্থায়ী বিবাহ প্রথা ব্যাপক আকার ধারণ করে, তাহলে নারী সমাজ স্বামীদেরকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে।