নোয়াম চমস্কি এবং কিছু ভাষাবিদের তত্ত্ব অনুসারে- বাচ্চাদের মস্তিষ্কে, “ইউনিভার্সাল গ্রামার মেশিন” নামে একটি অংশ এ্যাকটিভ থাকার কারনে বাচ্চারা স্বাভাবিকভাবেই কোন নতুন ভাষা শিখে নেয়। কিন্তু একটা বয়সের পর মানুষের আর এই ক্ষমতা থাকে না। তখন নতুন ভাষা শিখতে হলে মানুষকে অনেক অনুশীলন করে তারপর সেই ভাষা আয়ত্ত্ব করতে হয়।
লেখকের তত্ত্ব অনুসারে- মানুষের ভাষার শুরুটা হয়েছিল হোমো ইরেক্টাসের আমলে। এই প্রাচীন মানুষেরা ছড়িয়ে পরেছিল প্রায় সারা পৃথিবীতে। নতুন নতুন পরিবেশে চলার জন্য এরা নতুন এক ধরণের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। আর এই কাজগুলো করার জন্য তাদের দরকার হয়েছিল সংকেত ভিত্তিক এক ধরনের শব্দ আবিস্কারের। এই প্রাচীন মানুষগুলোর মস্তিষ্ক যখন বড় হচ্ছিল, তখন এরা ধীরে ধীরে নতুন ধরণের অঙ্গভঙ্গী এবং গলার স্বর আয়ত্ত্ব করছিল। আর এই কাজটা হয়েছে বিশাল একটা সময় জুড়ে। প্রায় ৬০ হাজার প্রজন্ম ধরে চলেছে এই আয়ত্ত্ব করার কাজ। এই ৬০ হাজার জেনারেশন ধরে যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে সেগুলোর সংখ্যাও অনেক বিশাল। মানুষের স্বরযন্ত্র এবং ডায়াফ্রামের মধ্যে থাকা ১০০ এরও বেশি ছোট ছোট পেশিতে হয়েছে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন।
===========
সৌদি আরবের দিকে। ১৭৪০ সালে মধ্য আরবের নজদ অঞ্চলের বেশ কিছু অংশ স্থানীয় আমির মুহাম্মাদ বিন সৌদ নিয়ন্ত্রন করতেন। ১৯৩০ সালের মধ্যে তার এক বংশধর নিজেদের শাসন এলাকা আরও অনেকখানি বৃদ্ধি করেন এবং এলাকার নাম বদলে নাম রাখেন সৌদি আরব। এখন একটা দেশের নাম যদি একটা পরিবারের নামে রাখা হয়, তাহলে ওই দেশের অন্য পরিবারগুলোর কি হবে! শুনতে আজব শোনালেও সৌদি আরবের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই হয়েছে। এর ফলে দেশের মধ্যে তৈরি হয়েছে অনেক জটিলতা। দেশটির উপসাগর অঞ্চলে রয়েছে বেশকিছু সিয়া মতালম্বী। উগ্র সুন্নি মতবাদের বিকাশের ফলে সেখানে জন্ম নিয়েছে অসন্তোষ। কিন্তু ১৯৩৮ সালে অ্যামেরিকানরা সৌদি আরবে তেলের সন্ধান পায়, বদলে যায় সৌদি আরবের পরিবর্তী ইতিহাস। তেল এনে দেয় সম্পদ, সম্পদ এনে দেয় বিশ্বের বড় বড় শক্তির ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু তেল একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। এক সময় তেল শেষ হয়ে যাবে, আর অন্যদিকে বিশ্বেও তেলের চাহিদা কমবে। তাই সৌদি আরবকে এখন বিকল্প খুজতে হচ্ছে। এই বিকল্প অর্থনীতি কি ঘনিষ্ঠতা পরিবর্তন করবে? কোন পথে যাচ্ছে সৌদি আরব? সৌদির পরবর্তী অর্থনীতি কি কয়েকশত বছরের পুরনো ইসলামী সংস্কৃতিকে বালিত করে দেবে? কেমন হবে সৈদি আরবসহ বাকি আরব বিশ্বে?
অন্যদিকে ভূ-রাজনীতি ভূমি থেকে আকাশে উঠতে যাচ্ছে। কারন ভূমিতে যেমন সম্পদ আছে, তেমনি চাঁদেও আছে। ভূমিতে জায়গা দখল করলে বন্দুক রাখার ষ্টেশন বানানো যায়, তেমনি মহাকাশ বা চাঁদেও ষ্টেশন বানানো প্রয়োজন। ২০২০ সালের অক্টবর মাসে অ্যামেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালি, যুক্তরাজ্য এবং লুক্সেমবার্গ আর্টেমিস চুক্তি নামে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী তারা ২০২৮ সালে চাঁদে ১৩ তম মানুষ এবং প্রথম নারী পাঠবে। এই অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো চাঁদে একটি বেজ ক্যাম্প তৈরি করা এবং খনিজ সম্পদ আহরন করা। কিন্তু এই বেজ ক্যাম্পটিই পরবর্তীতে দূরমহাকাশে মানব বসতি স্থানান্তরের জন্য লাঞ্চ প্যাড হিসেবে ব্যবহার হবে। চুক্তি অনুযায়ী যেসব দেশ এতে অংশ এবং কার্যক্রম পরিচালনা করবে তাদের অবশ্যই ২০২৪ সালের মধ্যে স্বাক্ষর করতে হবে এবং কার্যক্রম সম্পর্কে জানাতে হবে। এতে পরবর্তীতে ২১ টি দেশ স্বাক্ষর করলেও বাকি দেশগুলো স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু সমস্যা সেটা না। সমস্যা হলো- এতে না স্বাক্ষর করেছে রাশিয়া, না স্বাক্ষর করেছে চীন। প্রথমত এরা স্বাক্ষর করবে না, আর স্বাক্ষর করতে চাইলেও সম্ভবত এদের স্বাক্ষর করতে দেওয়া হবে না।
অন্যদিকে স্পেস ষ্টেশন নিয়েও অ্যামেরিকার সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব হয়েছে। তাই স্পেস স্টেশনেও আর অ্যামেরিকা ও রাশিয়া একসাথে কাজ করছে না। চীন আর রাশিয়া আলাদা আলাদাভাবে চাঁদে তাদের বেজ ষ্টেশন তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে। এখন রাশিয়া, চীন বা অ্যামেরিকা কেউই চাইবে না চাঁদে বেজ ক্যাম্প করার জন্য প্রতিপক্ষ কোন নিয়ম তৈরি করুক। কে’ইবা অন্যের তৈরি করা নিয়ম মানতে চায়! রাশিয়ান স্পেস এজেন্সির প্রধান Dmitry Rogozin অলরেডি ঘোষণা দিয়েছেন যে– কোন রকম সম্মতিতে না এসে চাঁদে বা মহাকাশে আগ্রাসন চালালে আরেকটি আফগানিস্থান বা ইরাক তৈরি হতে পারে। তাহলে এতসব দ্বন্দ্বের মধ্যে কেমন হতে যাচ্ছে আগামী দিনের মহাকাশ রাজনীতি?
বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং লেখক টিম মার্শালের মতে দশটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল আগামী দিনের বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপথকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে । এই অঞ্চলগুলো হলো- ইরান, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, তুরস্ক, গ্রিস, সাহেল, ইথিওপিয়া, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া এবং মহাকাশ।
-----
আফ্রিকাতে এক ধরনের কুমির পাওয়া যায়, নাম নীল নদের কুমির। ইংরেজিতে বলে Nile Crocodile। এই কুমিরদের দাতের ফাকগুলো একটু বেখাপ্পা ধরনের। খানাপিনার পরে দাতের ফাকে অনেক মাংস লেগে থাকে। এই মাংস পচে গিয়ে ওদের দাতে ইনফেকশন হয়ে যায়। তবে এই কুমিরগুলো এই সমস্যার একটা আজব বের করেছে। প্লাভার নামে এক ধরনের পাখি আছে, দেখতে কিছুটা চড়ুই পাখির মত। দাতের মধ্যে মাংস আটকে গেলে কুমিরগুলো বিশাল একটা হা করে, আর এই প্লাভার গিয়ে কুমিরের মুখের মধ্যে ঢুঁকে পরে। তারপর দাতের ফাকে আটকে থাকা মাংস দিয়ে এক ধরনের ভুরিভোজ করে নেয়। আর এতে কুমিরগুলোও ইনফেকশনের হাত থেকে বেচে যায়।
কুমিরের দাতের মাংসের টুকরো পাখিটা খেয়ে নিলে দুই পক্ষেরই লাভ। এই ধরনের সম্পর্ককে জীব বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন- সিমবায়োসিস।
------------
সেই কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শুরু করে করে আজকে পর্যন্ত যতগুলো জীবাণুর কারনে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে তার প্রায় সবগুলোই এসেছে প্রাণীদের শরীর থেকে। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে- সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে গুটিবসন্ত আর ম্যালেরিয়ার কারনে। এরপরে রয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা, যক্ষা, প্লেগ ও কলেরা। আর এইসব জীবাণু যে শুধু মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে তা’ই নয়, এই জীবাণুর কারনে বদলে গেছে ইতিহাসের অনেক গতিপথ।
ইউরোপ এশিয়ার মানুষেরা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের পশুপালনের সাথে অভ্যস্ত। এই পশু তাদের জীবনযাপনকে একদিকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি তার পাশাপাশি পশুর শরীর থেকে যুগ যুগ ধরে অনেক রোগ এই অঞ্চলের মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। ফলে হাজার বছরের ইতিহাসে এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ মারাও গেছে। কোন জীবাণুর দ্বারা মানুষ সংক্রমিত হলে- হয় সে মানুষটি মারা যায়, আর যদি না মারা যায়, তবে তার শরীরে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নিতে পারে। সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নেয়। ফলে পশুপালনের অভ্যাসের মধ্য দিয়ে এই ইউরোপ ও এশিয়া অঞ্চলের মানুষের শরীরে এইসব রোগ জীবাণুর প্রতি এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইম্যুনিটি তৈরি হয়েছে।
অ্যামেরিকা মহাদেশে যে সাম্রাজ্যগুলো গড়ে উঠেছিল যেমন- অ্যাজটেক, মায়া বা ইনকা সভ্যতা, তারা পশুপালনে অভ্যস্ত ছিল না। অন্য কোন কারনেও তাদের সাথে পশুদের কোন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। এর ফলে প্রাণী শরীর থেকে খুব বেশি রোগ তাদের মধ্যে প্রবেশ করতেও পারেনি, আর এর ফলে তাদের শরীরেও তেমন কোন ইম্যুনিটি তৈরি হয়নি। ইউরোপীয়রা যখন অ্যাজটেক বা এই ধরনের প্রাচীন আমেরিকান সাম্রাজ্য দখল করতে গিয়েছিল তখন, ইউরোপীয়দের সংখ্যা স্থানীয়দের তুলনায় এতই কম ছিল যে- আধুনিক অস্ত্র দিয়েও ওদের দেশটা দখল করা সম্ভব হতো না। ইউরোপীয়দের আমেরিকা জয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে একটি হলো- তাদের রোগ। ইউরোপীয়দের শরীর থেকে যে রোগগুলো আমেরিকানদের শরীরে প্রবেশ করেছিল সেটা তাদের এতই কাবু করে ফেলেছিল যে, কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের জনসংখ্যার ৯০% মানুষ শেষ হয়ে যায়।
--------------
সুমেরীয় সভ্যতার মানুষদের মুখে মুখে একটি কাহিনী প্রচলিত ছিল। ওদের বৃদ্ধরা বলত যে- একুরের পবিত্র পাহাড় থেকে তাদের পূর্বপুরুষরা কৃষিকাজ, পশুপালন, কাপড় বুননের বিদ্যা নিয়ে এসেছিলেন। একুরের পাহাড়ে তখন থাকত আনুন্না নামের অনেকগুলো প্রাচীন দেবতা। এই দেবতারা এতই প্রাচীন দেবতা যে, এদের আলাদা আলাদা নাম ছিল না। সবাইকে একত্রে বলা হত আনুন্না (𒀭𒀀𒉣𒈾) ।
এই কাহিনীটা অনেক প্রাচীন। আসলে আমরা যে সুমেরীদের কথা বলছি সেই সুমেরীয়রাই হলো প্রাচীন এক সভ্যতার লোক। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যকার উর্বর জমিতে সুমেরীয়রা বসতি গড়েছিল। কিন্তু এই কাহিনী সুমেরীয়দের পূর্বপুরুষদের কাহিনী। তাই এই গল্প হয়ত আরও কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। হয়ত প্রায় সাড়ে এগারো হাজার বছর পুরনো। এই প্রাচীন মানুষেরা যখন দল বেঁধে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে এসে বসতি শুরু করে– তখন তারা ইতোমধ্যে কৃষিকাজ, পশুপালন, কাপড় বুনন ইত্যাদি জীবন ধারনের মূল বিদ্যাগুলো জানত। সুমেরীয়রা নিশ্চয় এগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেই পেয়েছিল। কিন্তু ওদের পূর্বপুরুষরা বিদ্যাগুলো পেল কিভাবে? আর এই মিথের সাথে কি কোনভাবে অন্য কোন প্রাগৈতিহাসিক ঘটনার যোগ থাকা সম্ভব? জার্মানির বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লাউস শ্মিট মনে করেন– এই কাহিনীর সাথে জড়িত আছে প্রায় সাড়ে এগারো হাজার বছর পুরনো এক প্রাচীন স্থপনা–যার নাম গোবেকলি তেপে।
গোবেকলি তেপে আসলে এক ধরণের প্রাচীন মন্দির। বেশিরভাগ প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা এই গোবেকলি তেপেই হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম উপাসনালয়। তুরস্কের উরফা শহর থেকে ৬ মাইল দূরে এক পাহাড়ঘেরা জায়গায় অবস্থিত এই গোবেকলি তেপে। গোলাকারে সাজানো বিশাল বিশাল পাথরের স্তম্ভ আর কারুকার্য খচিত পাথরের ভাস্কর্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই আশ্চর্য মন্দির। এর একেকটি স্তম্ভের ওজন সাত থেকে দশ টন পর্যন্ত, আর উচ্চতা পাঁচ থেকে সাত মিটার অর্থাৎ ২৩ ফুট পর্যন্ত। এই বিশাল বিশাল স্তম্ভগুলো আসলে বিশাল একেকটা আস্ত পাথরের টুকরো। এখানে একটি আধা খোদাই করা পাথর পাওয়া গেছে যার ওজন প্রায় ৫০ টন। পাওয়ায় গেছে বিশাল বিশাল পাথরে খোদাই করা দশটি ভাস্কর্য। এই পাথরগুলো বহন করে আনা, খোদাই করা এবং খাড়া করে বসানো একটি জটিল প্রক্রিয়া। আজ থেকে সাড়ে এগারো হাজার বছর আগে ওই প্রাচীন মানুষগুলো কিভাবে এটি সম্ভব করেছিল তা ভাবলে সত্যি আশ্চর্য হতে হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা থেকে জানা যায় যে- এই স্থপনাগুলো যারা তৈরি করেছিল তারা ছিল শিকারী ও সংগ্রহজীবী এক ধরণের যাযাবর মানুষ। তখনও মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করার শুরু করেনি। প্রাচীন এই উপাসনালয়টা ছিল খুবই পবিত্র একটি স্থান। কয়েক হাজার শিকারী ও সংগ্রহজীবী মানুষ অন্তত দশ বছর পরিশ্রম করে এই স্থপনাটা নির্মান করেছিল। এই প্রাচীন উপাসনালয়ে অনেক দূর দুরান্ত থেকে মানুষ আসত। শুনতে অবাক লাগলেও বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী এখানে অন্তত ১৫০ কিলোমিটার দূর থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ এসে উপাসনা করত।
যখন মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করতেই শুরু করেনি- তখন এমন একটি স্থপনা তৈরি করতে শিকারি সমাজের মানুষদের অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল। প্রায় যাযাবর শিকারি সমাজের মানুষদের পক্ষে দশ বছরব্যপী একটি স্থপনা চালিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন একটি উদ্যোগ। কিন্তু এই উদ্যোগ সফল হয়েছিল। বিশাল অঞ্চলে বিস্তৃত অনেকগুলো গোষ্ঠীর মানুষ সম্মিলিতভাবে এই উপাসনালয় তৈরি করেছিল। এখানে ছিল প্রায় ২০ টি আলাদা আলাদা মন্দির। ধারণা করা হয় এই আলাদা আলাদা মন্দিরগুলো আসলে আলাদা আলাদা গোষ্ঠীর দেবতাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
সারে এগারো হাজার বছর আগের প্রাচীন শিকারি মানুষদের অনেকগুলো গোষ্ঠী মিলে, কেন এই আশ্চর্য উপাসনালয় তৈরি করেছিল সে প্রশ্নের উত্তর আজ পুরোপুরি জানা সম্ভব নয়। কিন্তু পাথরের স্তম্ভগুলো এবং এর আশেপাশের অঞ্চল নিয়ে গবেষণা করে প্রত্নতাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানীরা এমন কিছু জিনিস জানতে পেরেছেন– যা একদম অপ্রত্যাশিত, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এর একটি হলো কৃষিকাজ। আজকে আমরা যেসব ফসল চাষ করি সেগুলো একসময় বন্য প্রজাতি ছিল। বন্য প্রজাতির মধ্য থেকে সবথেকে ভাল জাতগুলোকে বাছাই করে করে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। ফসলের জিন নিয়ে যে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেন, তারা দেখতে পেয়েছেন যে- আজকে আমরা সেসব গমের প্রজাতি চাষ করি তারমধ্যে থেকে একটি প্রজাতি এসেছে গোবেকলি তেপের আশপাশের অঞ্চল থেকে। তখনও মানুষ আসলে কৃষিকাজ শুরু করেনি। কিন্তু হাজারের উপর মানুষকে দশ বছর খাওয়াতে হলে খাদ্যের ব্যবস্থা তো করতে হবে। তখন মানুষ বাধ্য হয়েই ওই অঞ্চলে অল্প পরিসরে গমের চাষ শুরু করেছিল। গোবেকলি তেপের উপসনালয়ে বিশাল বিশাল পাথরের হামান দিস্তার মত জিনিস পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রমাণ পেয়েছেন যে এগুলোর মধ্যে শস্যদানা প্রক্রিয়জাত করা হত । অর্থাৎ এটাই ছিল সম্ভবত কৃষির প্রাথমিক অবস্থা। এই অঞ্চল থেকেই হয়ত মানুষ প্রথম কৃষিকাজের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিল। গোবেকলি তেপে যখন তৈরি করা হয়, তার কয়েক হাজার বছর আগেই শেষ বরফযুগ বিদায় নিয়েছে। তখন ওই অঞ্চলের আবহাওয়া ছিল আরও আদ্র। ওই অঞ্চলে তখন ছিল প্রচুর ঘাসি জমি। গমসহ আরও অনেক শস্য ছিল তখন ওই আশেপাশের অঞ্চলে। একদিকে খাদ্যের চাহিদা, অন্যদিকে শস্যের জমি– এই দুই মিলেই তৈরি হয়েছিল কৃষিকাজের শুরু।
এই অঞ্চলে তখন শুধু শস্যই ছিল না, ছিল অনেক প্রকার বন্য প্রাণী । এর মধ্যে সবচেয়ে উপযোগী ছিল এক ধরনের হরিণ (gazelle)। প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা থেকে জানা যায় যে– হেমন্ত আর গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি সময়ে শিকারীরা প্রচুর পরিমাণে শিকার করত। এটা অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায় যে– বছরের অন্তত নির্দিষ্ট কিছু ঋতুতে ওরা গ্রাম তৈরি করে বসবাস করা শুরু করেছিল। আর এটাই ছিল সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম গ্রাম। এই গোবেকলি তেপেকে কেন্দ্র করেই হয়ত মানুষ প্রথমবারের মত স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লাউস শ্মিট মনে করেন, মানুষের এই প্রথমদিকের কৃষিকাজ এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সাথে হয়ত সুমেরীয়দের মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনীটার একটা যোগ আছে। তিনি গোবেকলি তেপের পাথরের স্তম্ভের সাথে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের মন্দির ও ধর্মীয় স্থপনাগুলোর তুলনা করেছেন। তার মতে মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন মানুষদের মুখে মুখে যে কাহিনীটি প্রচলিত ছিল তা আসলে মানুষের আদিম বসতি সম্পর্কে একটা আংশিক গল্প।
জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে– এই ধারণা সত্য হওয়া সম্ভব। কারন গোবেকলি তেপে ছিল টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর একদম উপরের (পর্বতের উচ্চ) দিকের অঞ্চলে অবস্থিত। শেষ বরফযুগ বিদায় নেওয়ার পর কয়েক হাজার বছর যখন খুব শুষ্ক আবহাওয়া ছিল, তখন টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর একদম উপরের দিকের এই অংশটাতে মানুষ অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিতে আসত। এই অঞ্চলটাতে তখন অপেক্ষাকৃত আদ্র ও ঘাসি জমি ছিল।
প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লাউস শ্মিট হলেন গোবেকলি তেপের আবিষ্কারক দলের প্রধান, এবং তিনিই তেপে নিয়ে সবচেয়ে বেশি সময় গবেষণা করেছেন। তার ধারণা– তেপের যে ইংরেজি টি আকৃতির স্তম্ভগুলো আছে, সেগুলো দিয়ে মূলত মানুষকে বোঝানো হয়েছে বা পূর্বপুরুষদের সিম্বল হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। সভ্যতা শুরুর পর মানুষের মধ্যে দেবতার ধারণা অনেক পরিপক্ক হয়, যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই সুমেরীয় মন্দিরগুলোর মধ্যে। কিন্তু সুমেরীয়রা সভ্যতা তৈরি করেছিল গোবেকলি তেপি তৈরি করারও প্রায় ছয় হাজার বছর পরে। ক্লাউস শ্মিটের ধারণা– এই তেপে এবং তেপের স্তম্ভগুলো আসলে মানুষের মধ্যে দেবতার ধারণা পরিপূর্ণতা পাওয়ার আগের ধাপ। দেবতার ধারণা তৈরি হওয়ার আগে মূলত পূর্বপুরুষদের বা টোটেম পশুকেই মানুষ দেবতার মত মান্য করত। আর তেপের ওই টি আকৃতির স্তম্ভগুলো মূলত তেপের নির্মানকারীদের পূর্বপুরুষ দেবতাদের প্রতীক।
ক্লাউস শ্মিটের ধারণা সঠিক হলে সুমেরীয়দের মুখে মুখে যে কাহিনী প্রচলিত ছিল, তা ছিল মূলত গোবেকলি তেপের পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাচীন মানুষদের কৃষিকাজ, দেবতা উপাসনা আর স্থায়ী বসতি স্থাপনের আদি গল্প। কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে এই গল্পের অনেককিছুর পরিবর্তন হলেও টিকে আছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ।
ডলফিনরা কিন্তু মাছ নয়, বরং আমাদের মতই স্তন্যপায়ী প্রাণী। একটা মানুষ বা গরু যেমন পানির নিচে সারাদিন থাকতে পারবে না, বার বার শ্বাস নিতে উপরে উঠতে হবে- ঠিক তেমনি ডলফিনদেরও তাই করতে হয়। কিন্তু একবার চিন্তা করেন, এই অবস্থায় ওরা তাহলে ঘুমাবে কিভাবে? ওদের ঘুমটাও তাই একটু আজব। ডলফিনরা ঘুমের সময় তাদের মস্তিষ্কের অর্ধেক জাগ্রত করে রাখে, আর অর্ধেক ঘুমিয়ে রাখে। তাহলে চোখের পাতা?? হ্যাঁ অদ্ভুত হলেও সত্যি, ওরা এক চোখের পাতা খোলা রাখে আর অন্য চোখের পাতা বন্ধ রাখে !!!
আসলে মানুষের মত স্থলের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ঘুমের সাথে ডলফিন, তিমি ও অন্যান্য জলজ স্তন্যপায়ীদের ঘুমের বেশ কিছুটা তফাৎ রয়েছে। আমাদের মত ওরা ঘুমের সময় পুরো শরীরের ঐচ্ছিক পেশিগুলো অকেজো করে দেয় না। আমাদের মস্তিষ্কের যেমন দুইটা ভাগ আছে, তেমনি ওদের মস্তিষ্কও ডান হেমিস্ফিয়ার আর বাম হেমিস্ফিয়ার এই দুইভাগে আলাদা করা । ডানভাগ শরীরের বাম অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, আর বামভাগ শরীরের ডানদিন নিয়ন্ত্রণ করে। এই ডলফিনরা ঘুমের সময় তাদের মস্তিস্কের যেকোনো একভাগ কার্যকর রাখে। যেভাগ কার্যকর রাখে তার বিপরীত দিকের চোখের পাতা খোলা রাখে। এই ঘুমের সাথে মানুষের ঘুমের আরও কিছু মূলগত পার্থক্য রয়েছে। ওদের এই ধরণের ঘুমকে বলা হয় স্লো ওয়েব স্লিপ।
আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে ব্রিটেনের ইতিহাস হঠাৎ করেই একটা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। রোমান সাম্রাজ্য ব্রিটেন থেকে তাদের সেনাবাহিনী তুলে নেয়। এর ফলে শুরু হয় অর্থনীতিক মন্দা। পাশাপাশি সেনাবাহিনী না থাকায় বহিঃশত্রুর আক্রমনের থেকে কোন নিরাপত্তা নেই। শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী দেশটি হঠাৎ করেই মারাত্মকরকমের অনিরাপদ হয়ে ওঠে। ধনী গরীব সবাই গাদাগাদি করে প্রাচীন পাহাড়ি দুর্গগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। যে দুর্গগুলো সেই লৈহযুগের পর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে ছিল, সেগুলোই হয়ে উঠে মানুষের একমাত্র নিরপদ আশ্রয়। দেশে শিক্ষাদান পড়াশুনা সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। আক্ষরিক অর্থেই ব্রিটেনে নেমে আসে এক অন্ধকার যুগ।
এই পরিত্যক্ত রাজ্যে একদিন একদল নতুন মানুষ প্রবেশ করে। ওরা এসেছিল ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের যে উত্তর সীমান্ত, তারও বেশ খানিকটা বাইরে থেকে। সেই অর্থে ওরা ছিল একদমই ভিনদেশী। এই মানুষগুলোই এংলো স্যাক্সন নামে পরিচিত। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল যোদ্ধা। এরা ব্রিটেনের আদিবাসী রাজাদের সাথে মারাত্মক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করে দেয়। তবে এই দলটার বেশিরভাগ লোকই এসেছিল নতুন আবাদী জমির খোঁজে। আশা ছিল নতুন অঞ্চলে গিয়ে খামার করে, কৃষিকাজ করে- একটা সুখী জীবন পাবে। ওরা ব্রিটেনের দক্ষিণ এবং পূর্ব উপকূলে এসে নেমেছিল। এরপর ধীরে ধীরে দ্বীপের নিচু অঞ্চলগুলো দখল করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে। আর এভাবে এরা তৈরি করে সম্পূর্ণ এক নতুন সভ্যতা।
এই আংলো স্যাক্সনরাই মূলত ইংল্যান্ডের গোড়া পত্তন করেছিল। প্রাচীন ব্রিটেনের দাস ব্যবস্থা, পুরনো মন্দির, ছোট ছোট বাড়ি, কেল্টিকদের দ্রুইড যাদুকরের পরিবর্তে আজকের দিনে ব্রিটেনের যে পরিচিত চেহাড়া আমরা দেখি, তার ভিত্তি তৈরি করেছিল এই আংলো স্যাক্সনরাই। থর এবং ওডিনের পুজার বদলে নতুন যে বিশ্বাস আজকের দিনে আমরা দেখি- সেটার শুরুও হয়েছিল ওদের মাধ্যমেই। ওরা আসার আগে মানুষ কথা বলত ল্যাটিন এবং কেল্টিক ভাষায়। আজকের দিনে সেই ভাষার কোন অস্তিত্ব আধুনিক ইংরেজির মধ্যে পাওয়া যাবে না। ওরা যে ভাষাটার প্রচলন করেছিল সেটাকে এখন আমরা ওল্ড ইংলিশ বা প্রাচীন ইংরেজি বলি। আজকের দিনে আমরা যে আধুনিক ইংরেজি দেখি সেই ইংরেজির প্রায় ২৬ শতাংশ এসেছে এংলো স্যাক্সনদের ওল্ড ইংলিশ থেকে।
আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে, ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্রায় ৭০০০ হাজার কিলোমিটার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে– পালতোলা ক্যানুতে করে এসেছিল একদল লোক। তারা এসে পৌঁছায় অদ্ভুত এক দ্বীপে। এই দ্বীপের গাছপালা বা জীবজন্তু কোনকিছুই যেন তাদের চেনা নয়। জন্তু-জানোয়ারগুলো দেখতেও যেমন অচেনা, গাছগুলো’তো আরও বেশি অদ্ভুত রকমের। এই দ্বীপটাকে বলা হয় মাদাগাস্কার। আর এই মানুষগুলোকে বলা হয় মালাগাসি জনগোষ্ঠী।
আজ থেকে প্রায় প্রায় ১৮৫ মিলিয়ন বছর আগে ভারত উপমহাদেশ, এন্টার্কটিকা, অস্ট্রেলিয়া আর মাদাগাস্কার এক সাথে জোড়া লেগে ছিল। এরপর ১২৫ মিলিয়ন বছর আগে এই বিশাল ভূমি দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগে ছিল ভারত উপমহাদেশ আর মাদাগাস্কার, আর অন্য ভাগে ছিল এন্টার্কটিকা আর অস্ট্রেলিয়া। এরপর ৮৮ মিলিয়ন বছর আগে ভারত উপমহাদেশ আর মাদাগাস্কারও শেষ পর্যন্ত আলাদা হয়ে যায়। ভারত এসে ধাক্কা খায় এশিয়া মহাদেশের সাথে, আর এর ফলে তৈরি হয় হিমালয় পর্বত। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরের মধ্যে মাদাগাস্কার থেকে যায় একা। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে, সমুদ্রের মধ্যে হওয়াতে মাদাগাস্কারের জীবজগত বেড়ে উঠতে থাকে বাকি পৃথিবীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে। মাদাগাস্কারে তৈরি হয় এক আশ্চর্য জীবজগত।
পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় প্রাণীকূলের সন্ধান পাওয়া যায় এই মাদাগাস্কারে । এখানে যেসব প্রাণী বা উদ্ভিদের দেখা পাওয়া যায়, তাদের অধিকাংশই পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। ফলে আমরা যেসব চেহাড়া ও আকৃতির জীব দেখি তাদের সাথে এদের মিল কম। ফলে এই দ্বীপের প্রাণী ও উদ্ভিদগুলো আমাদের কাছে খুবই অদ্ভুত লাগে। মাদাগাস্কারের প্রায় ৯৬ শতাংশ সাধারণ উদ্ভিদ, পাম জাতীয় উদ্ভিদগুলোর ৯৭ শতাংশ, ৮৫ শতাংশ অর্কিড, ৯০ শতাংশ সরীসৃপ, ৩৭ শতাংশ পাখি আর ৭৩ শতাংশ বাদুরই এন্ডেমিক। অর্থাৎ এদের পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। মাদাগাস্কারে পাওয়া যায় এমন উভচরদের ১০০ শতাংশই এন্ডেমিক ।
এই দ্বীপটি আফ্রিকার তীর থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার সমুদ্রের গভীরে। তবে আফ্রিকার লোকজন এই দ্বীপে আসার অনেক আগেই কয়েক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে একদল মানুষ এসে এখানে স্থায়ীভাবে বসতি শুরু করে দেয়। পরবর্তীতে কিছু আফ্রিকান এবং আরবীয় লোকজনও এই দ্বীপে এসে ওই জনগোষ্ঠীর রক্তের ধারায় মিশে যায়। ওরা তৈরি করে এক ভিন্নরকম সভ্যতা। ওদের রয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব মিথ, এমনকি একটি প্রাচীন পৌরাণিক মহাকাব্য- ইবোনিয়া। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো- ওদের এই পৌরাণিক কাহিনী আর রামায়ণের মধ্য অসাধারণ মিল। রামায়ণ হলো রাক্ষস রাজা রাবনের হাত থেকে রামের স্ত্রীকে উদ্ধার করার অভিযান, আর ইবোনিয়া হলো পাথর মানব রাভাতোর হাত থেকে রামপেলাকে উদ্ধার করার অভিযান।
ইবোনিয়ার জন্ম হয়েছিল দেবতাদের ইশারায়। তিনি যখন তার মায়ের গর্ভে ছিলেন, তখন থেকেই তার কিছু আশ্চর্য ক্ষমতা দেখা দিতে থাকে। মায়ের গর্ভ থেকেই তিনি কথা বলতে শুরু করেন, আর সেখানেই তিনি একদিন ঘোষণা দেন যে- রামপেলা নামে এক অসাধারণ গুণবতী মেয়েকে তিনি বিয়ে করবেন। আর এই ঘটনা অবশ্য-অবশ্যই ঘটবে।
ইবোনিয়া আর রামপেলা বড় হতে থাকে। প্রকাশ পেতে থাকে তাদের অসাধারণ সব গুণ। যখন তাদের বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক, একদিন রাভাতো নামে এক পাথর মানব রামপেলাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ইবোনিয়া রামপেলাকে ফিরিয়ে আনার জন্য যেকোনো কিছু করতে রাজি । কিন্তু কাজটি অতটা সহজ নয় । রামপেলার কাছে পৌছাতে হলে তাকে অনেকগুলো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এজন্য শুধু ক্ষমতা প্রয়োগ করলেই হবে না, প্রয়োজন হবে বিশেষ ধরণের জ্ঞানের । এই জ্ঞান আছে কেবল একজনের কাছে। তিনি হলেন মহান প্রতিধ্বনি দেবতা। কিন্তু মহান প্রতিধ্বনিকে তর্ক যুদ্ধে পরাজিত না করলে তিনি এই জ্ঞান ইবোনিয়ার কাছে প্রকাশ করবেন না। ইবোনিয়া তার সমস্ত জ্ঞান প্রয়োগ করে মহান প্রতিধ্বনিকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেন। এরপর রামপেলাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সেসব কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে তার সব উপায় তিনি জেনে নেন মহান প্রতিধ্বনির কাছে।
কিন্তু ইবোনিয়ার বাবা মা এই ভয়ঙ্কর অভিযানে যেতে তাকে বাধা দেয়। এই বিষয় থেকে দূরে রাখার জন্য তার বাবা-মা অনেক সুন্দরী ও গুণবতী মেয়েদের সাথে তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ইবোনিয়া কিছুতেই রাজি হয় না। এই কঠিন যাত্রায় অদ্ভুত ও শক্তিশালী সব প্রাণীদের কিভাবে পরাজিত করতে হবে সেই বিষয়ে শক্তির প্রমাণ চাওয়া হয় ইবোনিয়ার কাছে। যদি সে তার শক্তির প্রমাণ দিতে পারে তবেই তাকে যেতে দেওয়া হবে এই কঠিন অভিযানে। তেব শেষ পর্যন্ত ইবোনিয়া এই কঠিন অভিযানে বেড়িয়েই পরেন।
যাত্রাপথের প্রতিটি বাধাতেই ইবোনিয়া তার শক্তি আর বুদ্ধির পরিচয় দেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই শক্তিশালী পাথর মানবের শক্তিশালী সুরক্ষাবলয় থেকে রামপেলাকে ছিনিয়ে নেওয়া। ইবোনিয়া বুঝতে পারেন যে– রামপেলাকে ছিনিয়ে নিতে হলে রাভাতোর ঘনিষ্ঠ হতে হবে। তিনি খুনখুনে-বৃদ্ধের এক ছদ্মবেশ ধারণ করে রাভাতোর বিশ্বাস ও ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেন। তিনি ভালিহা নামে এক ধরণের বাশের তৈরি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। পাশাপাশি তিনি ফানোরনা নামে এক ধরনের গুটি খেলায় রাভাতোসহ সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। পুরোপুরি বিশ্বাস অর্জন করার পর একদিন তিনি সুযোগ বুঝে রামপেলাকে নিয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু রাভাতো আর তার সৈন্য তাকে আক্রমন করে। মারাত্মক যুদ্ধ হয় তাদের সাথে। ইবোনিয়া সবাইকে পরাজিত করে রামপেলাকে নিয়ে তার নিজের রাজ্যে ফিরে আসে। বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
এই দুইটি মহাকাব্যের অনেক কিছুতেই মিল পাওয়া যায়। কিন্তু রামায়নের সাথে কি সত্যিই ইবোনিয়া মহাকাব্যের কোন যোগ আছে? ভারতীয় কবি ও কূটনৈতিক অভয় কুমার মনে করেন– রামায়ণ ও ইবোনিয়ার সাথে কোন ঐতিহাসিক যোগাযোগ আছে। তিনি এই বিষয় নিয়ে গবেষণার সময় জানতে পারেন যে, মালাগাছি ভাষার প্রায় ৩০০ শব্দ এসেছে সংস্কৃত থেকে। কিন্তু এটি কি কোনভাবে সম্ভব? এই বিষয়ে নিশ্চিত কোন তথ্য দিতে হলে আমাদের নিশ্চয় আরও অনেক তথ্য এবং গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে কিছু জিনিস বিবেচনা করলে মনে হতে পারে যে বিষয়টি সম্ভব ।
আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে, প্রথম শতাব্দীর দিকে ভারতীয় সংস্কৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ব্যপক মাত্রায় ছড়িয়ে পরে। এর ফলে কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও মালয় অঞ্চলে ভারতীয় সংস্কৃতির একটা স্থায়ী ছাপ রয়ে যায়। এই প্রভাব এতটাই তীব্র যে- বর্তমান সময়ে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় প্রতীক হচ্ছে গরুরা (Garuda)। উত্তর ভারতীয়রা গরুরা উচ্চারন করলেও বাংলাতে হিন্দুদের এই দেবতা গরুড় পাখি হিসেবেই পরিচিত। গরুড় ছিলেন হিন্দুদের দেবতা বিষ্ণুর বাহন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী তিনি এক পাখি মানব। এই পাখি মানব ইন্দোনেশিয়ার মত একটি দেশের জাতীয় প্রতীক হওয়াটা একটা ইঙ্গিত বহন করে। এতেই বোঝা যায় যে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব ওই সময় কতটা জোরালো ছিল। ইন্দোনেশিয়াসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে এখনও রামায়ণ মঞ্চ নাটক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। ওই বিশেষ সময়টাতে আর্য সংস্কৃতি এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে তা একদম স্থায়ী প্রভাব রেখে যায়।
এই প্রভাবের জন্যই কম্বোডিয়া, জাভা, ফিলিপিনো, থাই, লাও, বার্মিজ ও মালয় ভাষাতে রামায়নের একটা করে ভার্সন রয়েছে। তবে এই রামায়নগুলো কিন্তু হবহু ভারতীয় সংস্কৃত রামায়নের মত নয়। বিভিন্ন দেশে গিয়ে সেই দেশের নিজেদের সংস্কৃতির ছাপ পড়েছে সেই রামায়নগুলোর উপর। যেমন, ইন্দোনেশিয়ার রামায়নের কথাই ধরা যাক। এটি লেখা হয়েছিল প্রাচীন জাভা ভাষাতে। এই রামায়নের প্রথম অর্ধেক মূল সংস্কৃত রামায়নের মত হলেও বাকি অর্ধেক কিন্তু অনেকখানি আলাদা। এই অংশে ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী স্থানীয় দেবতা Dhayana এবং তার সন্তান গারেং, পেত্রুক, বাগোংসহ আরও অনেক স্থানীয় চরিত্রদের কাহিনী যোগ করা হয়েছে। এর ফলে ইন্দোনেশিয়ান রামায়ন এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। ঠিক একইভাবে অন্যান্য অঞ্চলের রামায়নেও যোগ হয়েছে নতুন নতুন মাত্রা।
আরেকটি বিষয় হলো- যে রামায়ন এই বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পরেছিল সেটা কিন্তু মূল সংস্কৃত রামায়নটি নয়। কম্বোডিয়াতে যে রামায়ন এসেছিল সেটাতে ছিল মূলত বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রভাব। বৌদ্ধ ধর্মও ওই কাছাকাছি সময়েই ছড়িয়ে পরেছিল। আর বৌদ্ধ ধর্মও নিজেদের সাথে করে ভারতীয় সংস্কৃতি ও মিথ পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াসহ চীন জাপান পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়। আর ইন্দোনেশিয়াতে যে রামায়ন এসেছিল সেটাও মূল সংস্কৃত রামায়ন নয়। এটি ছিল ভত্তিকাব্য । ভত্তিকাব্য শব্দের অর্থ হলো ভত্তির লেখা কাব্য। এই সংস্কৃত কবি বিশেষ একটি উদ্দেশ্য নিয়ে এই কাব্যটি রচনা করেছিলেন। রামায়নের কাহিনী আর পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন তিনি তার কাব্যে। আর এর ফলে সম্ভবত মূল সংস্কৃত রামায়নের থেকে ভত্তির এই রামায়ণ সাধারণ মানুষের কাছে বেশি সহজ সরল মনে হয়েছিল। তিনি ব্যকরনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের ভাষায় রামায়ণকে নতুন করে লিখেছিলেন। আর এই রামায়ণই ভত্তির বর্ননার গুণে চলে এসেছিল ইন্দোনেশিয়ায় ।
এখন ইন্দোনেশিয়া অঞ্চল থেকে কয়েকশত বছরে যদি মাদাগাস্কারে বেশ কয়েকটি মাইগ্রেশন হয়, তবে রামায়নের কাহিনী ওই মানুষগুলো সাথে করে মাদাগাস্কারে নিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। আর ইবোনিয়া মহাকাব্যটি কত বছর পুরনো সেটা সম্পর্কেও তেমন স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। গবেষকদের মতে এই মহাকাব্য মাদাগাস্কারের ছাপাখানা তৈরি হওয়ারও কয়েকশত বছর আগে থেকে প্রচলিত। কিন্তু কত বছর আগে থেকে এটি প্রচলিত, তা নিয়ে সঠিক কোন গবেষণা নেই। সে যাই হোক, রামায়নের সাথে ইবোনিয়ার কাহিনীর যোগ থাকুক বা না থাকুক, এটি বিশ্বসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
উত্তরে সাহারা মরুভূমি আর দক্ষিণে সুদানের সাভানা তৃণভূমি– এর মাঝখানে যে অঞ্চলটা আছে সেটা হলো আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল। সাহেলের দশটি দেশই হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে অশান্তির জায়গা। কারন অনেকগুলো। বেশিরভাগ দেশেই হয় সামরিক শাসন চলছে, অথবা সরকার খুবই দুর্বল। সন্ত্রান্স, জঙ্গিবাদ, গোলাগুলি থামানোর মত শক্তি প্রশাসনের নেই। তার উপর প্রতিনিয়ত লিবিয়া থেকে অবাধে অস্ত্র ঢুকছে। জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে, কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থা খুব দ্রুত খারাপ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলটি মহাখড়ার কবলে আছে প্রায় চারশ বছর ধরে। পাশাপাশি আছে বিদেশী শক্তির বাম হাত প্রবেশ। এছাড়াও এই অঞ্চলের যাযাবর পশুপালক ও কৃষকদের মধ্যে একটা ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব আছে । এই দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ লেগেই থাকে । সাথে আছে স্থানীয় ক্রিমিনাল গ্যাং। এই অঞ্চলটা নরক হওয়ার জন্য এগুলোই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বোনাস হিসেবে আছে কয়েকটি ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী এবং তাদের মধ্যে বিবাদ। আইসিস, বোকো হারাম, আল কায়েদা সবাই আছে এই অঞ্চলে। এতসব সহিংসতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকলে সেই অঞ্চলের সাধারণ মানুষও মারাত্মক অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু এই অঞ্চলের সমস্যা আর অশান্তি শুধুমাত্র এই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। রপ্তানি হচ্ছে। শুধুমাত্র বিগত কয়েক বছরেই এই অঞ্চলের ৩.৮ মিলিয়ন মানুষ এই অঞ্চলে থেকে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইউরোপে গিয়ে ঢুকেছে। তুলনামূলক কম জনসংখ্যার অঞ্চল হলেও ইউরোপে ২৬ মিলিয়নের বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। এই হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইউরোপ অলরেডি প্রচুর চাপের মধ্যে আছে। তার উপর সাহেল অঞ্চল থেকে আসা শরণার্থীরা এমন একটি সামাজিক পরিস্থিতি থেকে এসেছে যে তারা ইউরোপীয় সমাজের সাথে মোটেই খাপ খাওয়াতে পারছে না । অন্যদিকে বেশিরভাগ ইউরোপীয় নাগরিক এই অঞ্চলের মানুষ এবং তাদের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। এর ফলে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে একটা নতুন ভয়ংকর পরিস্থিতি। ইতোমধ্যে সুইডেনসহ বেশকিছু দেশ এই খারাপ প্রভাব বুঝতে পেরেছে এবং সেই সমস্যা সামাল দিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। সুইডেনে ঘন ঘন আতংক ছড়াচ্ছে, নরওয়েতে বন্দুক হামলা হচ্ছে। তাহলে ইউরোপ কি শরণার্থী বিষয়ে তাদের অবস্থান বদলাতে যাচ্ছে? আর ইতোমধ্যে যে সমস্যার বীজ তৈরি হয়েছে– ইউরোপ কি এই সমস্যা সামাল দিতে পারবে? অন্যদিকে সাহেল হলো একটা সমস্যার ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরিতে যে বোমা তৈরি হচ্ছে সেই বোমা কখন বিস্ফোরিত হবে? কারাই বা বিস্ফোরন ঘটাবে? এখানে ফ্রান্স এবং অ্যামেরিকার সেনাবাহিনী যে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান চালাচ্ছে তার ভবিষ্যৎ কী? সাহেল অঞ্চল আগামী দিনে কিভাবে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করবে?
এবার আসি সৌদি আরবের দিকে। ১৭৪০ সালে মধ্য আরবের নজদ অঞ্চলের বেশ কিছু অংশ স্থানীয় আমির মুহাম্মাদ বিন সৌদ নিয়ন্ত্রন করতেন। ১৯৩০ সালের মধ্যে তার এক বংশধর নিজেদের শাসন এলাকা আরও অনেকখানি বৃদ্ধি করেন এবং এলাকার নাম বদলে নাম রাখেন সৌদি আরব। এখন একটা দেশের নাম যদি একটা পরিবারের নামে রাখা হয়, তাহলে ওই দেশের অন্য পরিবারগুলোর কি হবে! শুনতে আজব শোনালেও সৌদি আরবের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই হয়েছে। এর ফলে দেশের মধ্যে তৈরি হয়েছে অনেক জটিলতা। দেশটির উপসাগর অঞ্চলে রয়েছে বেশকিছু সিয়া মতালম্বী। উগ্র সুন্নি মতবাদের বিকাশের ফলে সেখানে জন্ম নিয়েছে অসন্তোষ। কিন্তু ১৯৩৮ সালে অ্যামেরিকানরা সৌদি আরবে তেলের সন্ধান পায়, বদলে যায় সৌদি আরবের পরিবর্তী ইতিহাস। তেল এনে দেয় সম্পদ, সম্পদ এনে দেয় বিশ্বের বড় বড় শক্তির ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু তেল একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। এক সময় তেল শেষ হয়ে যাবে, আর অন্যদিকে বিশ্বেও তেলের চাহিদা কমবে। তাই সৌদি আরবকে এখন বিকল্প খুজতে হচ্ছে। এই বিকল্প অর্থনীতি কি ঘনিষ্ঠতা পরিবর্তন করবে? কোন পথে যাচ্ছে সৌদি আরব? সৌদির পরবর্তী অর্থনীতি কি কয়েকশত বছরের পুরনো ইসলামী সংস্কৃতিকে বালিত করে দেবে? কেমন হবে সৈদি আরবসহ বাকি আরব বিশ্বে?
অন্যদিকে ভূ-রাজনীতি ভূমি থেকে আকাশে উঠতে যাচ্ছে। কারন ভূমিতে যেমন সম্পদ আছে, তেমনি চাঁদেও আছে। ভূমিতে জায়গা দখল করলে বন্দুক রাখার ষ্টেশন বানানো যায়, তেমনি মহাকাশ বা চাঁদেও ষ্টেশন বানানো প্রয়োজন। ২০২০ সালের অক্টবর মাসে অ্যামেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালি, যুক্তরাজ্য এবং লুক্সেমবার্গ আর্টেমিস চুক্তি নামে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী তারা ২০২৮ সালে চাঁদে ১৩ তম মানুষ এবং প্রথম নারী পাঠবে। এই অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো চাঁদে একটি বেজ ক্যাম্প তৈরি করা এবং খনিজ সম্পদ আহরন করা। কিন্তু এই বেজ ক্যাম্পটিই পরবর্তীতে দূরমহাকাশে মানব বসতি স্থানান্তরের জন্য লাঞ্চ প্যাড হিসেবে ব্যবহার হবে। চুক্তি অনুযায়ী যেসব দেশ এতে অংশ এবং কার্যক্রম পরিচালনা করবে তাদের অবশ্যই ২০২৪ সালের মধ্যে স্বাক্ষর করতে হবে এবং কার্যক্রম সম্পর্কে জানাতে হবে। এতে পরবর্তীতে ২১ টি দেশ স্বাক্ষর করলেও বাকি দেশগুলো স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু সমস্যা সেটা না। সমস্যা হলো- এতে না স্বাক্ষর করেছে রাশিয়া, না স্বাক্ষর করেছে চীন। প্রথমত এরা স্বাক্ষর করবে না, আর স্বাক্ষর করতে চাইলেও সম্ভবত এদের স্বাক্ষর করতে দেওয়া হবে না।
অন্যদিকে স্পেস ষ্টেশন নিয়েও অ্যামেরিকার সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব হয়েছে। তাই স্পেস স্টেশনেও আর অ্যামেরিকা ও রাশিয়া একসাথে কাজ করছে না। চীন আর রাশিয়া আলাদা আলাদাভাবে চাঁদে তাদের বেজ ষ্টেশন তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে। এখন রাশিয়া, চীন বা অ্যামেরিকা কেউই চাইবে না চাঁদে বেজ ক্যাম্প করার জন্য প্রতিপক্ষ কোন নিয়ম তৈরি করুক। কে’ইবা অন্যের তৈরি করা নিয়ম মানতে চায়! রাশিয়ান স্পেস এজেন্সির প্রধান Dmitry Rogozin অলরেডি ঘোষণা দিয়েছেন যে– কোন রকম সম্মতিতে না এসে চাঁদে বা মহাকাশে আগ্রাসন চালালে আরেকটি আফগানিস্থান বা ইরাক তৈরি হতে পারে। তাহলে এতসব দ্বন্দ্বের মধ্যে কেমন হতে যাচ্ছে আগামী দিনের মহাকাশ রাজনীতি?
বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং লেখক টিম মার্শালের মতে দশটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল আগামী দিনের বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপথকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে । এই অঞ্চলগুলো হলো- ইরান, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, তুরস্ক, গ্রিস, সাহেল, ইথিওপিয়া, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া এবং মহাকাশ। তিনি তার পাওয়ার অফ জিওগ্রাফি বইতে এই অঞ্চলগুলোর ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
· ·
জ্যারেড ডায়মন্ডের এক ডাক্তার বন্ধুর গল্প বলি। ডাক্তার ভদ্রলোক তখন নতুন ডাক্তার হয়েছেন। একদিন কল পেয়ে নতুন এক হসপিটালে গেছেন এক দম্পতির জটিল কোন এক রোগের চিকিৎসা করতে। গিয়ে দেখা গেল- জামাই বউ একটি কেবিনের মধ্যে রয়েছে। জামাই দেখতে একদম ছোটখাট একজন মানুষ, খুবই রোগা, একদম অজানা একটি জীবাণুর সংক্রমনের কারনে নিউমোনিয়াতে ভুগছেন। বেশ কিছুক্ষন দেখার পর ডাক্তার সাহেব রোগীকে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি কি সম্প্রতি এমন কোন যৌনকর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন, যার ফলে আপনার এই ইনফেকশন হতে পারে? এই প্রশ্নটি শোনার পর জামাই বেচারা তো সাইজে আরও ছোট হয়ে গেল। কিন্তু তার ছিল উচ্চারনে সমস্যা, তাই সে কি বলছিল তা ডাক্তার সাহেব তেমন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন বউ এর মধ্যেই স্টিলের একটি বড় বোতল দিয়ে জামাইকে মারার জন্য উঠে পড়েছে। তিনি বহু কষ্টে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পর বুঝতে পারলেন- জামাই বেচারা কিছুদিন আগে তাদের পারিবারিক ভেড়ার খামারে গিয়েছিলেন। সেকথা বলতেই বউ বোতল-হস্ত হয়েছে।
এই ধরনের ঘটনা খুব কম ঘটলেও, একদম বিরল নয়। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে এই ঘটনার তেমন কোন ঐতিহাসিক গুরুত্ব অন্তত খুজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই ঘটনাটা মানুষের সংক্রমিত রোগ বা ইনফেকসিয়াস ডিজিজের মূল কারণটা আমাদের চোখের সামনে এনে তুলে দেয়। সেই কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শুরু করে করে আজকে পর্যন্ত যতগুলো জীবাণুর কারনে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে তার প্রায় সবগুলোই এসেছে প্রাণীদের শরীর থেকে। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে- সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে গুটিবসন্ত আর ম্যালেরিয়ার কারনে। এরপরে রয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা, যক্ষা, প্লেগ ও কলেরা। আর এইসব জীবাণু যে শুধু মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে তা’ই নয়, এই জীবাণুর কারনে বদলে গেছে ইতিহাসের অনেক গতিপথ।
ইউরোপ এশিয়ার মানুষেরা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের পশুপালনের সাথে অভ্যস্ত। এই পশু তাদের জীবনযাপনকে একদিকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি তার পাশাপাশি পশুর শরীর থেকে যুগ যুগ ধরে অনেক রোগ এই অঞ্চলের মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। ফলে হাজার বছরের ইতিহাসে এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ মারাও গেছে। কোন জীবাণুর দ্বারা মানুষ সংক্রমিত হলে- হয় সে মানুষটি মারা যায়, আর যদি না মারা যায়, তবে তার শরীরে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নিতে পারে। সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নেয়। ফলে পশুপালনের অভ্যাসের মধ্য দিয়ে এই ইউরোপ ও এশিয়া অঞ্চলের মানুষের শরীরে এইসব রোগ জীবাণুর প্রতি এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইম্যুনিটি তৈরি হয়েছে।
অ্যামেরিকা মহাদেশে যে সাম্রাজ্যগুলো গড়ে উঠেছিল যেমন- অ্যাজটেক, মায়া বা ইনকা সভ্যতা, তারা পশুপালনে অভ্যস্ত ছিল না। অন্য কোন কারনেও তাদের সাথে পশুদের কোন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। এর ফলে প্রাণী শরীর থেকে খুব বেশি রোগ তাদের মধ্যে প্রবেশ করতেও পারেনি, আর এর ফলে তাদের শরীরেও তেমন কোন ইম্যুনিটি তৈরি হয়নি। ইউরোপীয়রা যখন অ্যাজটেক বা এই ধরনের প্রাচীন আমেরিকান সাম্রাজ্য দখল করতে গিয়েছিল তখন, ইউরোপীয়দের সংখ্যা স্থানীয়দের তুলনায় এতই কম ছিল যে- আধুনিক অস্ত্র দিয়েও ওদের দেশটা দখল করা সম্ভব হতো না। ইউরোপীয়দের আমেরিকা জয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে একটি হলো- তাদের রোগ। ইউরোপীয়দের শরীর থেকে যে রোগগুলো আমেরিকানদের শরীরে প্রবেশ করেছিল সেটা তাদের এতই কাবু করে ফেলেছিল যে, কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের জনসংখ্যার ৯০% মানুষ শেষ হয়ে যায়।
মানুষের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী যে কারও কাছেই এটা একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা। এই Germs বা জীবাণু যেমন ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছে, তেমনি Gun (বন্দুক) এবং Steel (লোহা-ইস্পাত) ও তেমনি ইতিহাসের অনেক গতিপথ ওলট-পালট করেছে। ইয়্যলির মত আমার মনেও অনেক আগে থেকেই প্রশ্ন ছিল যে- আমরা উপমহাদেশের মানুষরা কি ইউরোপীয়দের থেকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অনেক পিছিয়ে? তাহলে কেন প্রযুক্তি, এমনকি চিন্তা চেতনায়ও আমরা ওদের থেকে এত পিছিয়ে!
জ্যারেড ডায়মন্ড নামে এক আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী আশির দশকে পাখির বিবর্তন নিয়ে গবেষনা করতে পাড়ি জমান জীব বৈচিত্রে ভরা পাপুয়া নিউগিনির দ্বীপে। সেখানে এক বীচে হাঁটতে হাঁটতে তার আলাপচারিতা হয় স্থানীয় যুবক ইয়্যালির সাথে। একথায় সেকথায় ইয়্যালি জ্যারেডকে এমন একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেন যা তাকে রীতিমত ভাবনায় ফেলে দেয়। তো প্রশ্নটা কি ছিল? প্রশ্নটা ছিল এই যে, আপাতদৃষ্টিতে নিউগিনি ও সাদা চামড়ার ইউরোপ আমেরিকানদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিতে কোনো পার্থক্য দেখা না গেলেও কেন সাদা চামড়ার লোকগুলো প্রযুক্তিতে নিউগিনির লোকদের থেকে এত বেশি এগিয়ে? সাদা লোকরা কিনা আকাশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উড়োজাহাজে অথচ নিউগিনির প্রযুক্তি পড়ে আছে সেই প্রস্তর যুগে।
প্রশ্নটা শুনতে সহজ হলেও এর উত্তর লুকিয়ে আছে অনেক গভীরে। জ্যারেড ডায়ামন্ড সেদিন কৌতুহুলী ইয়্যালিকে হতাশ করলেও এর ২৫ বছর পর আমদের সবাইকে এই প্রশ্নের উত্তর উপহার দেন তার গানস, জারমস অ্যান্ড স্টিল ( Guns, Germs, and Steel)। বইটি প্রকাশ পাওয়া মাত্রই পাঠক ও বোদ্ধা সমাজে ব্যাপক সারা ফেলে এবং বছর ঘুরতেই পায় পুলিৎজার পুরস্কার।
ইয়্যালির এই প্রশ্নের উত্তর দিতে লেখক আমাদের যেন চড়িয়ে বসান আলাদীনের যাদুর পাটিতে, আর ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন সেই শিকারী যুগ থেকে কৃষিবপ্লবের যুগে আবার,
কৃষিযুগ থেকে বর্তমান শিল্প বিপ্লবের যুগে। সভ্যতা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তের এই ধারাবাহিক বিবরন কোনো সহজ কাজ নয়। অথচ জ্যারেড ডায়মন্ড এই কাজটি করেছেন কত সহজ ভাষায়, কত সাবলিল ভঙ্গিতে। কেন ইউরোপিয়ানরা এশিয়া , আমেরিকা বা আফ্রিকায় উপনিবেশ গড়ে তুললো? কেন এর উল্টোটা ঘটতে পারেনি? মানে এশিয়ানরা বা আমেরিকানরা ইউরোপ দখল করতে পারেনি, কেন কোনো সভ্যতা এগিয়ে গেছে তর তর করে আর কোনো সভ্যতা থেমে আছে সেই দড়ি, কাচি, লাঠিতে? কেন একেক এলাকায় বিশাল সময় ধরে রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থা একটা বিশেষ প্যাটার্ন ফলো করে? যেমন বিশাল চীন ভুখন্ড হাজার বছর ধরে একক চীন শাষনের অধীনে অথচ ইউরোপ প্রায় সময়ই ছিল অনেকগুলো দেশে বিভক্ত।
মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হোমো স্যাপিয়েন্স। অস্ট্রালোপিথিকাস নামক গণের গ্রেট এপ থেকে বিবর্তিত হয়ে ২৫ লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় মানুষের প্রথম উদ্ভব ঘটে। পৃথিবীর বর্তমান মানুষ প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভব ঘটে প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে। প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে স্যাপিয়েন্সের এক বিবর্তনীয় পরিবর্তন ঘটলো যাকে আমরা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব বলতে পারি। হঠাৎ করে মানুষের তার চিন্তা করার ক্ষমতা জন্মালো এবং সে যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন করলো। অধিকতর কৌশলসম্পন্ন অস্ত্র, এমনকি আগের থেকে আরো বড় বানিজ্য নেটওয়ার্ক গঠন করতে শুরু করলো।
কীভাবে খাবারের খবর অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। যদি শুধু মুখের ভাষা বিবেচনা করি, সেই হিসেবেও সেপিয়েন্সদের এই ভাষা প্রথম ভাষা নয়। অনেক প্রাণীর, যেমন গরিলা, শিম্পাঞ্জি এবং বানরের অনেক প্রজাতির নিজস্ব মুখের ভাষা আছে। উদাহরণ হিসেবে সোনালি-সবুজ পশমওয়ালা এক জাতীয় বানরের নাম করা যায় (Green monkey), যারা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিভিন্ন মৌখিক ধ্বনি ব্যবহার করে।তিমি ও হাতিরও এরকম অনেক ধরনের ধ্বনি তৈরির ক্ষমতা আছে। আমাদের পূর্ব পুরুষগণ তাদের জীবন অতিবাহিত করতো শিকার করে ও অন্যান্য খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে। কোন এক জায়গায় স্থিত হয়ে বসবাস না করে তারা ক্রমাগত জায়গা পরিবর্তন করেছে। তাদের স্থানান্তরের প্রধান কারণই ছিল খাদ্য। বর্তমান থেকে প্রায় ১০০০০ বছর আগে পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলের মানুষই শিকার ও সংগ্রহ পরিত্যাগ করে কৃষিতে স্থিত হয়ে গেলো। সত্যিকারার্থেই এটা ছিল একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আমরা তাই এটাকে মানুষের কৃষি বিপ্লব বলে অবহিত করে থাকি। এ সময়ে যে বড় পরিবর্তনটা ঘটলো তা হলো, সংখ্যায় মানুষ অনেক বেড়ে গেলো।
প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকরা সংক্রামক রোগে অনেক কম আক্রান্ত হতো। কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজে যে সমস্ত রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল (যেমন গুটিবসন্ত, হাম, যক্ষা) সেগুলোর বেশিরভাগেরই উৎপত্তি আসলে গৃহপালিত পশুপাখি থেকে। এইসব রোগজীবাণু পরবর্তী সময়ে মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হয় মূলত কৃষিবিপ্লবের পরে, আগে নয়।কৃষি বিপ্লবের ফলে গোত্রভিত্তিক সমাজ ভেঙে ক্রমে পরিবারভিত্তিক সমাজ তথা গ্রাম গঠিত হতে থাকে। প্রায় তিন হাজার খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ঠিক এ ধরণের সমস্যা থেকেই লিখন পদ্ধতি ও মুদ্রার উদ্ভব ঘটায় মানুষ।মানুষের প্রথম মুদ্রা কিন্তু কোন ধাতব মুদ্রা ছিল না। একেক সভ্যতায় একেক রকম মুদ্রার প্রচলন দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় কড়ির ব্যবহার, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে, মেসোপটেমিয়াতে। রূপাকে মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করে সেখানকার মানুষ। ১৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যবিলনীয় রাজা হাম্মুরাবি যে আইনমালা লিপিবব্ধ ও প্রয়োগ করেন, সেটি হাম্মুরাবি কোড নামে পরিচিত। এই আইনের প্রয়োগ ছিল পুরো ব্যবিলনীয় রাজ্যে, যার মাধ্যমে শুল্ক নির্ধারণ করা হতো; চুরি/ডাকাতি/হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধের বিচার করা হতো। ফলে পুরো সাম্রাজ্যের মানুষ জানতো কোনটা করা যাবে আর কোনটা করা যাবে না।
, নতুন নতুন আইডিয়া ও নতুন সম্পদের খোঁজে রাজা ও সম্রাটগণ দু’হাত ভরে বিনিয়োগ করতে শুরু করেব। স্পেনের রাজা কলম্বাসের আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার অর্থ যোগালেন। বিনিময়ে তিনি পেলেন সোনা রূপায় সমৃদ্ধ বিরাট আমেরিকান সাম্রাজ্য।একইভাবে ব্রিটিশ সরকার জেমস কুককে আর্থিক সহায়তা দিয়ে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল অনুসন্ধানে পাঠায়, যার ফলস্বরূপ আবিস্কৃত হলো অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। উভয় ক্ষেত্রেই লাভবান হলো ইউরোপিয়ান অর্থনীতি।স্পেন ও ব্রিটেনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের আনাচে কানাচে এবং এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় তাদের উপনিবেশ গড়ে তোলে। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে কেবল বিট্রিশ সাম্রাজ্যই পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক ভূমিতে তাদের বিস্তার কায়েম করে। ইউরোপের দিকে তাকালে দেখা যায়, সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে তাদের সমষ্টিগত ক্ষমতা অনেক বেড়েছে, তাদের আদর্শ, চিন্তাধারা, প্রযুক্তি আর বৈচিত্র্যময় খাবার ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে,
বিবর্তন মানুষকে দেহে-মনে একটা শিকারি-সংগ্রাহক প্রাণী হিসেবেই তৈরি করেছিল। সেখান থেকে প্রথমে কৃষিনির্ভর ও তার পরে শিল্পনির্ভর জীবনে প্রবেশ করে মানুষ তার প্রাকৃতিক জীবন হারিয়েছে। এই কৃত্রিম জীবন তার চাওয়াগুলো পূরণ করতে পারছে না, তার সহজাত প্রবৃত্তিকে বিকশিত হতে দিচ্ছে না। তাই তার সন্তুষ্টিও হচ্ছে না। আদিম মানুষের ম্যামথ শিকারের যে সুতীব্র উত্তেজনা আর বুনো উল্লাস, তা আজকের একটা শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবার কল্পনাও করতে পারবে না। অতএব এটা বলা যুক্তিসংগত যে, আমাদের প্রত্যেকটা নতুন আবিস্কার আমাদেরকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বর্গ থেকে একটু একটু করে দূরে নিয়ে যাচ্ছে।
বয়স প্রতিরোধেও বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি আশানুরূপ। জিন কাঠামোতে পরিবর্তন এনে তারা কৃমি জাতীয় একটি প্রাণীর আয়ু দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ইঁদুরের ক্ষেত্রে প্রয়োগের প্রক্রিয়া চলছে এখন। একদিন যে মানুষের ক্ষেত্রেও এটা সক্ষম হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন বিজ্ঞালব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগে মানুষ প্রজাতিটি তার শরীরের এমন পরিবর্তন করবে যে টেকনিক্যালি তাকে আর হোমো স্যাপিয়েন্স বলা যাবে না। আমরা একটি নতুন প্রজাতিতে পরিণত হব – অর্ধেক জৈবিক আর অর্ধেক যান্ত্রিক।
=============
পশ্চিমা বিশ্বে যৌনতাকে দেখা হয় ক্ষুধা বা নিদ্রার মতোই মানুষের একটা স্বাভাবিক শারীরিক এবং মানসিক চাহিদা বা প্রবৃত্তি হিসাবে। সে কারনেই এখানকার মানুষ যৌনতাকে উপভোগ করে, মানুষের যৌন-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। তারমানে এই নয় যে, এরা রাস্তা-ঘাটে বা যেখানে সেখানে বা যারতার সঙ্গে যৌনতা করে বেড়ায়। এদের যৌনতায় সুন্দর একটা সম্পর্ক থাকে, প্রতিজ্ঞা থাকে, থাকে শিল্প। আর এ-কারণেই পশ্চিমারা তাদের সন্তানদের এই প্রয়োজন বা চাহিদার বিষয়টাও ভাবে। সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে যৌনতা নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা করেন, সন্তানের প্রেমের সম্পর্ককে সম্মান করেন, আর তাদের প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরির জন্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে দেন।
এবার বলি পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসরত বাঙালিদের কথা। বাঙালিরা পশ্চিমা বিশ্বে বসবাস করেও, তাদের সন্তান পশ্চিমা বিশ্বে জন্মগ্রহণ করার পরও, তারা যৌনতাকে দেখেন পাপ, অশ্লীলতা আর অপরাধ হিসেবে। তারা সন্তানের যৌন স্বাধীনতা হরণ করার উদ্দেশ্যে কন্যা সন্তানের জন্য বাংলাদেশ থেকে পাত্র ধরে নিয়ে আসেন, কন্যা সন্তানকে পাহারা দিয়ে রাখেন, অনেকে কন্যা সন্তানকে জোর করে বোরখা হিজাব পরতে বাধ্য করেন।
======================
আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষের কাছে একটি ঘৃণিত প্রাণী হচ্ছে শুকর। ওমিপ্রাজল, ওয়ারফারিন, লিভোথাইরক্সিন, অ্যাসপিরিন, সিটালোপ্রাম , কোডেন, ইভুপ্রোফেন, হাইড্রোকর্টিসন, সিমভাস্টাটিন এমন আরো অসংখ্য ওষুধ যে আপনি খাচ্ছেন তা তৈরি হচ্ছে শুকরের দেহ থেকে।আপনার অগ্নাশয়ে এনজাইমের ঘাটতি হলে তা পূরণ করা হয় শুকরের অগ্নাশয় নিঃসৃত এনজাইম ব্যাবহার করে। মানুষের থাইরয়েড গ্লান্ডে সমস্যা হলে শুকরের শুকনো থাইরয়েড গ্লান্ড ব্যাবহার করে মানুষকে সুস্থ করা হয়।রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করতে আপনারা যে হেপারিন ব্যাবহার করেছেন তা এসেছে শুকরের নাড়িভুঁড়ি থেকে।
গরুর মুত্রের কথা শুনে যারা হাসাহাসি করেন তারা কি জানেন প্রিমারিন নামক ঔষুধ তৈরির জন্য প্রতিবছর সাত লাখ পঞ্চাশ হাজার ঘোড়ার প্রস্রাব ব্যাবহার করা হয় ? গরুর মুত থেকেও এই ধরণের ওষুধ তৈরি হয় কারণ গরুর মুতে প্রচুর পরিমাণে ইস্ট্রোজেন হরমোন থাকে।
ক্যাপসুলের উপরে যে একটি আবরণ থাকে একে জেলাটিন বলে এবং যা তৈরি হয় শুকর থেকে। কিন্তু এতোকিছু জেনে আপনি কি করবেন ? শুকরের হৃদপিন্ড লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা মানুষকে সুস্থ করে ফেলেছে এসব বা কয়জনে জানেন? আমরা শুধু ঘৃণা করার শিক্ষা পেয়েছি , ভালোবাসার শিক্ষা নয়।
আপনারা দিনের পর দিন যে ইনসুলিন গ্রহণ করেছেন তাও তৈরি হতো শুকর থেকে। আমেরিকার ৭৪ শতাংশ ওষুধ তৈরি হয় গরু, শুকর , কুকুর, উট , সাপ ও বিভিন্ন প্রাণী থেকে।একটা অনাহারী কুকুরকে কেউ একটু খাবার দিলে আপনারা যেভাবে উপহাস করেন বোবা বলেই কুকুর হয়তো তার প্রতিবাদ করতে পারেনা। আপনি কুকুরকে খাবার না দিলেও অন্য বাড়ি থেকে মারামারি করে খাবার খেয়ে এসে ঠিক আপনার বাড়িটাই পাহারা দিবে এবং এটাই হচ্ছে কুকুর। মানুষের শুরু থেকেই কিছু প্রাণী মানুষের সাথেই চলছে।গরু , ছাগল , কুকুর , বিড়াল , উট , শুকর এদের অন্যতম।
আমরা পৃথিবীর অনেক প্রাণীকেই অহেতুক/ অকারণে ঘৃণা করি ও হত্যা করি। অথচ ওদের শরীর থেকেই আসছে আমাদের জীবনরক্ষাকারী নানা ওষুধ। আমাদের জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন টিকা বানর , শুয়োর ও ইদুরের শরীরে পরীক্ষা করে তারপর তাদের দেহে সফল হলে তা মানুষের দেহে পরীক্ষা করা হয়।মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে ওদের জীবন নিয়ে জুয়া খেলা হয়। তারপরও মানুষের কাছে কিছু প্রাণী অহেতুক ঘৃণার পাত্র। মানুষের ঘৃণায় ওই বোবা প্রাণীদের কিছুই যায় আসেনা। কারণ ওরা মানুষের চরিত্র কেমন তা খুব ভালো করেই জানে।।
===========
আব্রাহামীয় ধর্ম বা সেমেটিক ধর্ম
গাজা আর ফিলিস্তিন হচছে ইস্রাইলের ২পাশে ছোট্ট দুটি অঞ্চল, অনেকটা পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মত, প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল বর্ডার জর্জ হাবাস লাইন.
আমরা যাকে ইব্রাহীম আঃ বলে জানি,ইহুদীদের কাছে তিনিই হচ্ছেন ১ম ইহুদি আব্রাহাম । তার নাতি হচ্ছে জ্যাকব বা এয়াকুব নবী । ইহুদীরা নিজেদেরকে এই যাকোব বা ( HYPERLINK "https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%87%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%AC"ইয়াকুব)-এর উত্তরপুরুষ বলে মনে করেন। এই জ্যাকব বা ইয়াকুব (আ.)-এর এক পুত্রের নাম ছিল ইয়াহুদা। সেই নামানুসারে তাদের অনুসারীদের ‘ইহুদি’ বলে ডাকা হয়। এই জেকব বা ইয়াকুব-এর বারো পুত্র ফিলিস্তিনের ছোট্ট এওটা অংশ কেনান এলাকাকে বার ভাগে ভাগ করে শাসন করতো। এই বারো পুত্রের একজন হচ্ছেন বেনিয়ামিন-। তার উপাধি নাম ছিল ইসরাঈল। তার শাসনাধীন গোত্ গুলোকে একত্রে বলা হত বনী ইসরাঈল । বনী ইসরাঈল নামে কোরআনে একটি HYPERLINK "https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B8%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A6%BE"সূরাও আছে। এই বনী ইসরাঈলের ইসরাঈল নাম অনুসারে ইহুদীদের বসবাসরত জায়গাটির নাম হয় ইসরাইল।
ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ীই ইসরায়েলিরা তাদের বসবাসের এই কেনান এলাকাকে পবিত্র ভূমি বা প্রমিসড ল্যান্ড বলত; ঐ সময় প্যালেস্টাইনে ছোট একটা অংশে ইজরাইলিরা বাস করত। অর্থাৎ ফিলিস্তিনি এবং ইজরাইলি এই দুটি জাতিই এই বিতর্কিত অঞ্চলের আদি অধিবাসী। পরবর্তীকালে প্রথম খৃষ্টাব্দে অর্থাত ৭০ সালে রোমান সম্রাট ক্লদিয়াস দ্বারা ইজরাইলিরা ঐ জায়গা থেকে উচ্ছেদ হয়। এরপর তারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেও তাদের ইহুদি জাত্যাভিমান ছিল প্রবল। তারা যখন নির্বাসিত জীবনযাপন করছিল তখন তারা সেখানে বসে তাদের প্রিয় মাতৃভূমি জেরুসালেমের দিকে মুখ করে মাথা ঝাকিয়ে কাঁদতে থাকতো আর বিরহ গীত গাইতো।
জেরুজালেম-এ ইহুদিরা কিছু ভূমি প্রাপ্য ছিল। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে তারা তাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী প্রমিসড ল্যান্ড নামে বিশাল ভূমি দাবী করা। ইসলামের আভির্বাবের পর মুহাম্মদ (দ.) যখন এই বিবাদিত ধর্মীয় স্থানের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করত, তখন ইহুদিরা বলত, মুহাম্মদ আমাদের নবী ও ধর্ম অনুসরণ করে। হঠাৎ একদিন মুহাম্মদ(দ.) নামাজরত অবস্থায় কাবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এর দুটো কারণ ছিল, এক মক্কা ও কাবা দখল করা, দুই ইহুদিদের গর্ব খর্ব করা।
পরবর্তীতে মুহাম্মদের (দ.) শশুর ওমর (র।) যখন খলিফা হয়, সেই সময় এই ইহুদিদের ইবাদত গৃহ আক্রমণ করে একটা মসজিদ নির্মাণ করেছিল। ঐ মসজিদ পরবর্তীতে খৃষ্টানদের দখলে চলে যায়, এবং তারা তা গির্জা হিসাবে ব্যবহার করে। তারপর জায়গাটি ফের মুসলিমদের অধীনে আসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির পক্ষে থাকায় ইহুদিদের সেটলমেন্টের ব্যবস্থা করল ব্রিটিশ সরকার। ঠিক এই জায়গাতেই লাগল সংঘর্ষ। কারণ ফিলিস্তিনিরা নিজেদের দখল ছাড়তে নারাজ ছিল। ইউনাইটেড নেশনস-এর স্থির করে দেওয়া প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল বর্ডার জর্জ হাবাস লাইন যদি ফিলিস্তিনিরা মেনে নিতো; তাহলে ফিলিস্তিনরা এভাবে স্বাধীনতা হারাতো না । ইজরাইলিরা যেভাবে প্যালেস্টাইনে আধিপত্য বিস্তার করেছে, একই কায়দায় মুসলমান হিজবুল্লাহ গোষ্টি খৃস্টান অধ্যুষিত দেশ লেবানন দখল করে আজ প্রচন্ড শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
গাজা ফিলিস্তিনের অংশ হলেও গাজার সঙ্গে বর্তমান ফিলিস্তিনের কোন সীমান্ত নেই। গাজার একদিকে ভূমধ্যসাগর। দুদিকে ইসরাইল (সীমান্ত ৫১ কিলোমিটার) ও একদিকে মিশর (সীমান্ত ১১ কিলোমিটার)। গাজা থেকে ফিলিস্তিনের মূল ভূখণ্ডে যেতে হলে ইসরাইলের ওপর দিয়ে যেতে হয়। গাজার আয়তন ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার। লম্বায় প্রায় ১০০কলো আর প্রস্ত ৩০কিলো। জনসংখ্যা ২৩ লাখ। পৃথিবীর মধ্যে সম্ভবত তৃতীয় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। ১৯৪৮-এর যুদ্ধে গাজা এলাকা মিশরের দখলে চলে যায়। এভাবেই ছিল ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৭ আরব-ইসরাইল যুদ্ধে গাজাসহ মিশরের সিনাই এলাকা দখল করে নেয়। ১৯৭৯ সালে মিশর-ইসরাইল চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল সিনাই থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় কিন্তু গাজা ইসরাইলের দখলে থেকে যায় ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৪ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল ফিলিস্তিনকে বিভিন্ন এলাকা ছেড়ে দিতে সম্মত হয়। এরই অংশ হিসেবে গাজা ফিলিস্তিনের অংশভুক্ত হয়।
ফিলিস্তিনে বর্তমানে যে সরকার আছে তা ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাতের দলের সরকার। ফিলিস্তিনে ইয়াসির আরাফাতের দলের বিরুদ্ধে ১৯৮৭ সালে গাজা ভূখন্ডে হামাসের জন্ম হয়। ইয়াসির আরাফাতের দলের বিরুদ্ধে হামাসকে তখন গোপনে সহযোগিতা করছিলো ইসরায়েল। ২০০৫ সাল পর্যন্ত হামাস কোন স্বশস্ত্র সংগঠন ছিলো না। ২০০৫ সালে ইসরায়েলের স্বশস্ত্র বাহিনী গাজা ভূখন্ড ছেড়ে চলে আসে, তখন ছোট এই দেশে দুই প্রান্তে দুই সরকার গড়ে উঠে। এভাবে চলে ২০০০ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে গাজার গেরিলারা ইসরাইলে আত্মঘাতী হামলাসহ রকেট হামলার সূচনা করলে ইসরাইল সীমান্তে দেয়াল ও কাঁটাতারের প্রতিবন্ধক তৈরি করে। এভাবে চলতে থাকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। এসময়ে গাজায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হামাস জয়লাভ করে। এভাবে ২০০৭ সালের জুনে গাজার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়।
হামাসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সব ধরণের সংযোগ বন্ধ করে দেয়। অপরদিকে ইসরাইল ও মিশর গাজাকে সবদিক থেকে বন্ধি করে ফেলে, এর ফলে গাজা একটা ওপেন-এয়ার জেলখানায় পরিণত হয়।
তবে প্রতিদিন গাজা উপত্যকা থেকে ১৯ হাজার মুসলমান গিয়ে ইসরায়েলের বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে যার মাধ্যমে গাজা উপত্যকার ১৯ হাজার মুসলমানদের পরিবার চলে। এছাড়া ইসরায়েল নামক ইহুদী রাষ্ট্রে প্রায় ২৪ লক্ষ মুসলমান বাস করে। কাজেই এই অঞ্চলের লড়াইটা ধর্মের লড়াই নয় , এখানে চলছে ভূমি দখলের লড়াই। করেছে।
আমি মনে করি এস সমধান দুইটি। ১- গাজা ফিলিস্তিন ও ইসরাইল একটি রাস্ট্র হিসেবে থাকা নতুবা ৩টি আলাদা রাস্ট্র গড়ে তোলা। কারণ দুই রাস্ট্রভিত্তিক সমধান করা হলে ফিলিস্তিনিরা জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ সবকিছুতে পিছিয়ে পডবে এবং গাজার লোকেরা ফিলিস্তিনের অধীনতা মানবে না বর্তমানের মত। ফলে পূর্বপাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান তৈরি হবে; যার ভবিষ্যত যুদ্ধ আর দ্বন্ধ।