নাকের ফুটো দুটো কেন?
আজকের ল্যাম্প্রে এবং হ্যাগফিশের মত প্রাচীন অ্যাগনাথা মাছই প্রথম মেরুদণ্ডী প্রাণি যাদের প্রায় ৫৩ কোটি বছর আগে গন্ধের সাহায্যে খাদ্য ও প্রজনন সঙ্গী খুঁজে বের করা বা শিকারী সনাক্ত করা, এবং জলের গুণমান সনাক্ত করার জন্য একটি মাত্র নাকের ছিদ্রের উদ্ভব হয়েছিল। অর্থাৎ শুরুতে নাকের ফুটোর উদ্ভব হয়েছিল শুধু গন্ধ নেওয়ার জন্য, শ্বাস নেওয়ার জন্য নয়।
(অ্যাগনাথা (Agnatha) বা "চোয়ালবিহীন" হল মেরুদণ্ডী প্রাণিদের একটি শ্রেণি, এরা সম্ভবত প্রাচীনতম মেরুদণ্ডী প্রাণি এবং এদের চোয়াল এবং জোড়া পাখনা নেই)
জোড়া নাসাছিদ্রের বিকাশ (Paired nostril):
পরবর্তীকালে চোয়ালযুক্ত মাছের আবির্ভাব হয় (ন্যাথোস্টোম), এদের নাকের ছিদ্র জোড়া হয়ে ওঠে, সম্ভবত গন্ধ দিয়ে দিকনির্দেশনা করার প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাপে। এই মাছগুলির মধ্যে কয়েকটিতে অভ্যন্তরীণ নাসিকা গহ্বরও তৈরি হচ্ছিল যা মুখগহ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, সম্ভবত এই পরিবর্তন তাদের মুখ প্রসারিত করে নাসিকা গহ্বরে নেগেটিভ চাপ তৈরি করে নাকের ছিদ্র দিয়ে জল টেনে আনতে সক্ষম করে, ফলে সাঁতার না কাটলেও গন্ধ নেওয়া সম্ভব হয়। বিবর্তনের টাইমলাইনে প্রাথমিক চোয়ালযুক্ত মাছ (ন্যাথোস্টোম) সাধারণত জোড়া নাকের ছিদ্র যুক্ত প্রথম প্রাণি হিসাবে বিবেচিত হয়।
এরপর টাইমলাইনে আসে কিছু ফুসফুস যুক্ত মাছের মধ্যে নাসারন্ধ্র দিয়ে বাতাস থেকে শ্বাস নেওয়ার পদ্ধতির আবির্ভাব, জলজ থেকে স্থলজ প্রাণিতে বিবর্তনের সময় মধ্যবর্তী প্রাণিগুলিতে যেমন টিকটালিক (Tiktaalik) এবং ইকথিওস্টেগা (Ichthyostega) এর মতো প্রাথমিক প্রাণিগুলিতে নাকের ছিদ্র বা নাসারন্ধ্র শুধু গন্ধ শনাক্তকরণই নয়, বরং বাতাসে শ্বাস নেওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হতে শুরু করে, এই প্রাণিরা কম গভীর জলে বাস করত এবং মাঝে মাঝে জলের উপরে মাথা তুলে বাতাস থেকে শ্বাস গ্রহণ করত, এখনও এইরকম মাছ আছে, যাদের লাংফিশ বলে।
এই সময়ে অভ্যন্তরীণ নাসারন্ধ্র বা অণুনাসিক গহ্বর (choanae) আরও উন্নত হয়, যা বায়ুকে মুখগহ্বর থেকে ফুসফুসের দিকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়, এটাই ছিল শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য নাকের ফুটো বা নাসারন্ধ্রের প্রথম ব্যবহার।
তারপর স্থলচর মেরুদণ্ডী প্রাণিদের নাসারন্ধ্রের বিবর্তনের একটি জটিল প্রক্রিয়া শুরু হয়; উভচর, সরীসৃপ, পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মধ্যে নাসারন্ধ্র আরও বিশেষায়িত হয়, এইসব প্রাণিদের নাসারন্ধ্র ভালোভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে গন্ধ শনাক্তকরণের জন্যও আরও বিশেষায়িত হয়। যেমন মানুষের মত স্তন্যপায়ী প্রাণিদের ক্ষেত্রে নাকের গহ্বরে টারবিনেট হাড় (turbinate bones) এবং শ্লেষ্মা ঝিল্লি বিকশিত হয়, যা বাতাসকে ফিল্টার করা, উষ্ণ করা এবং আর্দ্র করার কাজে সহায়তা করে, এই বৈশিষ্ট্য প্রাণিগুলিকে স্থলে দীর্ঘ সময় বাঁচিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এখন প্রশ্ন হল নাকে দুটো ফুটো বা জোড়া নাসারন্ধ্র থাকার সুবিধা কি?
মাছ, উভচর ও সরীসৃপ প্রাণিদের দুটি নাসারন্ধ্র থাকার প্রধান কারণ হল, জোড়া নাকের ফুটো মস্তিষ্ককে গন্ধের উৎসের দিক নির্ধারণ করতে সহায়তা করে, যা প্রাণীদের শিকার, খাদ্য, যৌনসঙ্গী খুঁজে পেতে এবং শিকারি ও বিপদ সনাক্তে সাহায্য করে, যেমন আগুন, বিষাক্ত গ্যাসের উৎস কোনদিকে, সেটা সনাক্ত করতে সাহায্য করে।
পরে স্তন্যপায়ী ও পাখিদের ক্ষেত্রে জোড়া নাসারন্ধ্র থাকার সুবিধা হল ফুসফুসে বাতাসের প্রবাহ বৃদ্ধি:- দুটি নাসারন্ধ্র থাকার কারণে বাতাস গ্রহণ ও নির্গমনের ক্ষমতা বাড়ে। এটি স্তন্যপায়ীদের, বিশেষ করে যারা দৌড়ানো বা শারীরিক কার্যকলাপে বেশি সক্রিয়, তাদের পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে। এছাড়া জোড়া নাসারন্ধ্রের ফলে নাকের চক্র বা ন্যাসাল সাইকেল নামে একটি প্রক্রিয়া তৈরি হয়, এর কারণে মানুষ সহ অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের একটি নাসারন্ধ্র বেশি সক্রিয় থাকে এবং অন্যটি কম, এটি পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত হয়, যা নাকের আর্দ্রতা, পরিচ্ছন্নতা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের দক্ষতা ও গুণমান বজায় রাখে। যদি কোন কারণে একটি নাসারন্ধ্র বন্ধ হয়ে যায় (যেমন সর্দি বা অ্যালার্জির কারণে), তখন অন্য নাসারন্ধ্র শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে নিতে যেতে পারে, যা শ্বাসকষ্ট কমায়।
জোড়া নাসারন্ধ্র কিভাবে গন্ধের উৎস নির্ণয়ে সাহায্য করে?
জোড়া নাসারন্ধ্র গন্ধের উৎস নির্ধারণে সাহায্য করে মূলত স্টিরিওলফ্যাকশন (stereo-olfaction) নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, এখানে দুটি নাসারন্ধ্রের মধ্যে সামান্য দূরত্বের কারণেই গন্ধের তীব্রতার পার্থক্য তৈরি হয়, যার তথ্য ব্যবহার করে প্রাণীদের মস্তিষ্ক গন্ধের উৎসের দিক নির্ণয় করে নিতে পারে।
যেমন, দুটি নাসারন্ধ্র মাথার দুই পাশে অবস্থিত হওয়ায়, গন্ধের উৎস যদি একপাশে থাকে, তবে সেই নাসারন্ধ্রটি গন্ধের অণুগুলো বেশি পরিমাণে গ্রহণ করে, মস্তিষ্ক এই তীব্রতার পার্থক্য বিশ্লেষণ করে গন্ধের উৎসের দিক নির্ধারণ করে, আবার গন্ধের অণুগুলো দুটি নাসারন্ধ্রে সামান্য ভিন্ন সময়ে পৌঁছায়, মস্তিষ্ক এই সময়ের পার্থক্য ব্যবহার করে গন্ধের উৎসের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে, অনেকটা যেভাবে দুই কান শব্দের উৎস নির্ধারণ করে। কুকুর, বিড়াল বা অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা আরও উন্নত, তাদের দুটি নাসারন্ধ্রের মধ্যে দূরত্ব মানুষের থেকে একটু বেশি হওয়ায় গন্ধের উৎস নির্ধারণ আরও সুনির্দিষ্ট হয়।
জলবায়ু এবং মানু্ষের নানা আকৃতির নাক ও নাকের ছিদ্রের সম্পর্ক!
গবেষণার ফলে বোঝা গেছে যে, জলবায়ুর প্রভাবে মানুষের নাকের ছিদ্রের বিবর্তন হয়েছে, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং পরিবেশের সাথে অভিযোজনের সাথে সম্পর্কিত। দেখা গেছে যে, নাকের ছিদ্রের আকার ও আকৃতি জলবায়ুর ধরন, বিশেষ করে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার ওপর নির্ভর করে বিবর্তিত হয়েছে। নাকের ছিদ্রের আকার ও গঠন শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বাতাসকে ধুলোমুক্ত, উষ্ণ এবং আর্দ্র করার কাজের সাথে জড়িত। বিভিন্ন জলবায়ুতে এই কাজের চাহিদা ভিন্ন হয়, যা নাকের ছিদ্রের বিবর্তনকে প্রভাবিত করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঠান্ডা এবং শুষ্ক জলবায়ু: ঠান্ডা, শুষ্ক জলবায়ুতে (যেমন উত্তর ইউরোপ বা উচ্চ-উচ্চতার অঞ্চল) মানুষের নাকের ছিদ্র সাধারণত সরু এবং লম্বা হয়। এটি বাতাসকে বেশি সময় ধরে নাকের মধ্যে ধরে রাখে, যার ফলে ঠান্ডা বাতাস উষ্ণ ও আর্দ্র হয়ে ফুসফুসে পৌঁছায়। এই অভিযোজন ফুসফুসকে ঠান্ডা ও শুষ্ক বাতাসের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
আবার নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলের গরম, আর্দ্র জলবায়ুতে নাকের ছিদ্র সাধারণত চওড়া এবং ছোট হয়। এটি বাতাসকে দ্রুত প্রবাহিত হতে দেয়, কারণ এই পরিবেশে বাতাস ইতিমধ্যেই উষ্ণ ও আর্দ্র থাকে, ফলে বাতাসকে অতিরিক্ত উষ্ণ বা আর্দ্র করার প্রয়োজন কম থাকে।
২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা (PLOS জেনেটিক্স) দেখায় যে, নাকের ছিদ্রের আকৃতি জিনগতভাবে প্রভাবিত এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছে। এই গবেষণায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নাকের গঠন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে নাকের ছিদ্রের আকার ও গঠনের জন্য নির্দিষ্ট জিন, যেমন DCHS2 এবং RUNX2, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এই জিনগুলো জলবায়ুর সাথে অভিযোজনের সময় পরিবর্তিত হয়েছে।
তবে বর্তমানে জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ ও জিন প্রবাহের কারণে দক্ষিণ এশিয়া, ভারত, উত্তর আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়ার মত অঞ্চলগুলিতে নাকের ফুটোর গড়নে সমস্তরকম বৈচিত্র্য দেখা যায়।
তথ্যের উৎস:
Why do we have two noses? - The Physiological Society
Why Do Our Noses Have Two Nostrils? - Britannica
Why do we have two nostrils? - BBC Science Focus Magazine
Why You Need Nostrils - Science | AAAS
মহাপ্লাবন ও নৌকার বিবর্তন:
টাইগ্রিস–ইউফ্রেটিস উপত্যকা ছিলো প্রাচীন বিশ্বের সেই অতি উর্বর, আবার একই সঙ্গে অতি অস্থিতিশীল ভূখণ্ড, যেখানে বন্যা ছিলো একটি নিয়মিত দুর্যোগ। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২৯০০ অব্দে ঘটে যাওয়া এক বিশাল প্লাবন, যা প্রত্নতত্ত্ব উর, কিশ এবং শুরূপ্পাকের মাটিতে নিশ্চিত চিহ্নিত করে, সুমেরীয়দের মনে এক গভীর দুঃস্বপ্নের মতো রয়ে যায়। এই বন্যাই পরবর্তী চার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী ও প্রভাবশালী কাহিনিগুলোর একটি—মহাপ্লাবন কাহিনির জন্ম দিতে শুরু করে।
সুমেরে প্রথম যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা হলো জিউসাবরার কাহিনি। এখানে দেবতারা মানুষের কোলাহল ও অস্থিরতা সহ্য করতে না পেরে মানবজাতির ওপর বন্যা বর্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা এক ন্যায়বান মানুষকে সতর্ক করেন ভবিষ্যৎ বিপদ সম্পর্কে, এবং তাকে একটি “জাহাজ” বানাতে বলেন—এখানে “জাহাজ” কথাটি আধুনিক অর্থে জাহাজ নয়, বরং নলখাগড়া বাঁধা ভেলা, যা সুমেরীয়দের দৈনন্দিন জীবনে মাছ ধরা, কৃষিপণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হতো। এই “ভেলা-জাহাজই মানবসভ্যতার প্রথম নৌকা হিসেবে প্লাবনকাহিনিতে প্রবেশ করে। সে সময়ে লোহা আবিষ্কৃত হয়নি; কাঠের তক্তা জোড়া দেওয়ার উন্নত প্রযুক্তি তৈরি হয়নি; অতএব বাস্তবে বড়ো জাহাজ নির্মাণ করা ছিলো সম্পূর্ণ অসম্ভব। মানুষের বোধে নৌকা বলতে তখন ছিলো নলখাগড়ার মোটা গোছা, দড়ি এবং বিটুমেন দিয়ে বাঁধা একধরনের ভাসমান প্ল্যাটফর্ম।
এই সুমেরীয় স্মৃতিই পরে আক্কাদীয় ভাষায় অ্যাট্রাহসিস-এর কাহিনিতে আরও সুসংগঠিত আকার পায়। এখানে দেবতাদের সিদ্ধান্ত—মানুষ বেড়ে গেছে, পৃথিবী ভরে গেছে, দেবতাদের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটছে। তাই রোগ, খরা, অনাহারের পর আসে মহাপ্লাবন।
অ্যাট্রাহসিস-এর নৌকাটি আবারও সুমেরীয় ভেলার মতো—গোলাকার বৃহৎ কাঠামো, যা ভেসে থাকতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই সেই যুগের প্রযুক্তিতে তৈরি একটি প্রকৃত জাহাজ নয়। গল্পে দেবতা ইনকি গোপনে নৌকা তৈরির নির্দেশ দেয়। এই গোপন নির্দেশই পরবর্তী হিব্রু বাইবেলে নোয়ার প্রতি ঈশ্বরের সতর্কবাণীর সাহিত্যিক পূর্বসূরি।
এই ধারার তৃতীয় বৃহৎ রূপ গিলগামেশ মহাকাব্যের ৬ ট্যাবলেটে উত্নাপিশতম-এর বর্ণনা। এখানে প্লাবন আর স্থানীয় নয়—মহাজাগতিক হয়ে উঠেছে। দেবতারা সিদ্ধান্ত নেয় মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করবে। আর নৌকা? এবার সেটি হয়ে যায় এক বিশাল, সাততলা, প্রায় ঘনাকৃতির কাঠামো, যার বর্ণনা বাস্তব জাহাজবিদ্যার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অসম্ভব। এ রকম উচ্চতা, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ—সবই ব্রোঞ্জ যুগের প্রযুক্তির বাইরে, কারণ তখনো লোহার যন্ত্রপাতি ছিলো না, না ছিলো সেই পর্যায়ের কাঠের স্থাপত্য। বাস্তব সুমেরীয় নৌকা ভেলা হলেও তার আকার, স্মৃতি ও প্রতীকই হয়ে উঠলো এক পৌরাণিক নৌকার কল্পচিত্র। গিলগামেশে এই নৌকা আর প্রযুক্তিগত বস্তুর কথা নয়—এটি হয়ে ওঠে দেবতাদের ইচ্ছায় মানুষের রক্ষার মহাকাব্যিক ভাষণ।
এরপর আসে হিব্রুদের বই বুক অফ জেনেসিস। এখানে গল্পটি ধর্মীয় নৈতিকতার ভিত্তিতে পুনর্গঠিত হয়। মানুষ পাপ করেছে, তাই ঈশ্বর পৃথিবী শুদ্ধ করতে বন্যা পাঠান। নোয়া একমাত্র ন্যায়বান; তাকে বাঁচানোর জন্য ঈশ্বর নৌকা বানাতে বলেন। জেনেসিসে নৌকার মাপ—৩০০, ৫০, ৩০ কিউবিট—এক বিশাল বক্স-শিপ, যার আকার বাস্তব জাহাজবিদ্যায় কার্যত অচল। তবুও হিব্রু লেখকের কাছে নৌকার প্রযুক্তিগত বাস্তবতার চেয়ে ঈশ্বরের রক্ষা প্রতীকই ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। পাখি পাঠানো, পানি নামা, ইন্দ্রধনুর চুক্তি—সবই সুমেরীয়-আক্কাদীয় ধারার পুরনো অংশগুলোকে নতুন নৈতিক অর্থে পুনর্লিখন।
সবশেষে আসে ইসলামে। এখানে নৌকাকে বলা হয়েছে “ফুল্কা”। এখানে নৌকার কোনো মাপ কিংবা কাঠামো উল্লেখ করা হয় নাই। ফলাফলে নৌকা আর ভেলা–জাহাজ–পৌরাণিক বক্স—সবকিছুকে রূপান্তরিত করে এক অতিপ্রাকৃতিক রূপকে পরিণত করা হয়েছে।
এভাবেই মহাপ্লাবন কাহিনি বাস্তব বন্যা স্মৃতি থেকে জন্ম নিয়েছে, সুমেরীয় নলখাগড়া ভেলায় ভর করে শুরু হয়েছে, কিন্তু মানুষের ধর্মীয় ও কল্পনাশক্তির বিবর্তনে সেই ভেলাই পরিণত হয়েছে মহাজাগতিক জাহাজে।
১৮শ শতকে, বিশেষ করে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায়, এটি একটি প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল, যা “টোব্যাকো স্মোক এনিমা” (Tobacco Smoke Enema) বা তামাকের ধোঁয়ার এনিমা নামে পরিচিত ছিল।
এই পদ্ধতিটি প্রধানত ব্যবহার করা হতো পানিতে ডুবে যাওয়া বা প্রায়-মৃত ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য। তখনকার ডাক্তাররা বিশ্বাস করতেন, তামাকের ধোঁয়া গরম এবং এতে থাকা নিকোটিন একটি শক্তিশালী উদ্দীপক (stimulant) হিসেবে কাজ করে।তাদের ধারণা ছিল, এই ধোঁয়া রোগীর মলদ্বার দিয়ে অন্ত্রে প্রবেশ করালে তা শরীরকে ভেতর থেকে গরম করবে এবং রোগীর হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস পুনরায় চালু করতে সাহায্য করবে।প্রথমদিকে, ডাক্তাররা সাধারণ ধূমপানের পাইপ ব্যবহার করেই এই কাজটি করতেন। একজন পাইপের এক প্রান্ত রোগীর মলদ্বারে স্থাপন করতেন এবং অন্য প্রান্ত দিয়ে মুখে করে ধোঁয়া ফুঁ দিয়ে প্রবেশ করাতেন।কিন্তু এতে একটি বড় বিপদ ছিল। যিনি ধোঁয়া ফুঁ দিতেন, তার দুর্ঘটনাক্রমে রোগীর দেহ থেকে নিঃসৃত বর্জ্য বা জীবাণু শ্বাসের সাথে টেনে ফেলার গুরুতর আশঙ্কা থাকত। এই বিপদ এড়াতেই পরবর্তীতে ছবিতে দেখানো বিশেষ যন্ত্রের (bellows যন্ত্র) উদ্ভব হয়, যা দিয়ে রোগীর মুখে স্পর্শ না করেই নিরাপদে ধোঁয়া প্রবেশ করানো যেত।লন্ডনের রয়্যাল হিউম্যান সোসাইটি (Royal Humane Society) টেমস নদীর তীরে এমন “রেসাসিটেশন কিট” (Resuscitation Kit) স্থাপন করেছিল, যাতে ডুবে যাওয়া ব্যক্তিকে দ্রুত এই চিকিৎসা দেওয়া যায়।১৮১১ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার বেন ব্রোডি (Sir Ben Brodie) গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, নিকোটিন আসলে হৃৎপিণ্ডের জন্য একটি বিষাক্ত পদার্থ এবং এটি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারে। তার এই আবিষ্কারের পরই এই অদ্ভুত, বিপদজনক ও অকার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতিটি চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে বাতিল হয়ে যায়।
প্রতিদিনই শত টনের বেশি মহাকাশ থেকে ধুলো আর পাথরের খণ্ড পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। বছরে প্রায় ৬,১০০টি উল্কাপিণ্ড বায়ুমণ্ডল ভেদ করে, যার মধ্যে প্রায় ১,৮০০টি ভূমিতে পৌঁছায়। বেশিরভাগই নজরে আসে না, তবে মাঝে মাঝে এমন এক বিরল ঘটনা ঘটে যা ইতিহাস হয়ে যায়। তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৫৪ সালের নভেম্বরের এক বিকেলে, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামার সিলাকগা শহরে।
উল্কাপিণ্ড
সেদিন সিলাকগা শহরের আকাশে হঠাৎই এক উজ্জ্বল আলোর রেখা দেখা দেয়। স্থানীয়রা ভেবেছিলেন হয়তো কোনো বিমান বি’স্ফো’রিত হয়েছে কিংবা আকাশে পার’মাণ’বিক হাম’লার মতো কিছু ঘটছে। কিন্তু আসল ঘটনা ছিল আরও অদ্ভুত।
৩৪ বছর বয়সী অ্যান হজেস সেই সময় নিজের লিভিং রুমে সোফায় কম্বল গায়ে ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই আকাশ থেকে ছুটে আসা একটি উল্কাপিণ্ড তাদের বাড়ির ছাদ ভেদ করে ভেতরে ঢোকে। প্রথমে রেডিওতে আছড়ে পড়ে, তারপর লাফিয়ে উঠে সরাসরি হজেসের কোমরে আঘাত করে। এর ওজন ছিল প্রায় ৩.৮ কেজি। প্রচণ্ড ধাক্কায় তার কোমরে আঙুরফলের মতো বড় একটি কালশিটে পড়ে যায়। সৌভাগ্যবশত, তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
এই উল্কাটি ছিল এক ধরনের শিলাময় উল্কাপিণ্ড, যেটির বয়স প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর। ঘটনাটিকে আরও অদ্ভুত করে তুলেছিল তাদের বাড়ির সামনে থাকা একটি ড্রাইভ-ইন থিয়েটারের সাইনবোর্ড। যেখানে দেখা যাচ্ছিল পতিত ধূমকেতুর ছবি।
সংবাদমাধ্যম, পুলিশ আর কৌতূহলী প্রতিবেশীদের ভিড়ে মুহূর্তেই তাদের ঘর যেন জনসমাগমে ভরে ওঠে। হজেসকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও গুরুতর শারীরিক আঘাতের কারণে নয় বরং মানসিক ধাক্কার জন্য। তিনি লাজুক স্বভাবের মানুষ ছিলেন এবং এই হঠাৎ খ্যাতি তার জীবনে অস্বস্তি বয়ে আনে।
পরে শুরু হয় উল্কাপিণ্ডটির মালিকানা নিয়ে টানাপোড়েন। বাড়িওয়ালী দাবি করেন, যেহেতু বাড়িটি তার তাই উল্কাও তারই সম্পত্তি। এক বছরের মামলার পর সমঝোতার ভিত্তিতে উল্কাটি হজেসের দখলে আসে। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বিরক্ত হয়ে সেটি আলাবামা মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রিকে দান করেন।
অ্যান হজেস পৃথিবীর ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত একমাত্র নথিভুক্ত ব্যক্তি যাকে সরাসরি উল্কাপিণ্ড আ’ঘা’ত করেছে। ঘটনাটির বিরলতা এতটাই যে বিজ্ঞানীরা বলেন, একইসঙ্গে টর্নেডো, বজ্রপাত আর হারিকেনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও এর চেয়ে বেশি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই আলোড়ন তার ব্যক্তিগত জীবনে অশান্তি বয়ে আনে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে তিনি মা’রা যান। কিন্তু ইতিহাসে তার নাম থেকে যায় এক অনন্য কারণে। তিনি আকাশ থেকে পতিত মহাজাগতিক পাথরের আঘাত পাওয়া পৃথিবীর একমাত্র মানুষ। (বিজ্ঞান্বেষী)
ভার্জিনিয়া উলফ ও বেগম রোকেয়া
ভার্জিনিয়া উলফ জন্মেছিলেন দেখা যাচ্ছে আমাদের বেগম রোকেয়ার জন্মের মাত্র দু’বছর পরে- ১৮৮২ সালে। জীবনসঙ্গী লিওনার্ড উলফের আজীবন গভীর মমতা, প্রেম ও আনুগত্য সত্তে¡ও ডিপ্রেশন রোগে ভোগা ভার্জিনিয়া কোটের পকেটে নুড়ি পুরে, নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করেন ১৯৪১ সালে। পরাধীন ভারতের পূর্ব বাংলার রংপুরের মেয়ে রোকেয়া ১৮৮০ সালে জন্মে, ষোল বছর বয়সেই বিয়ে ও ত্রিশে বিধবা হয়ে মেরে-কেটে ৫২ বছর মাত্র বাঁচতে পেরেছিলেন। তবে, পশ্চিমের সাদা নারী ভার্জিনিয়া ১৯২৯ সালে যখন মেয়েদের জন্য একটি ’নিজস্ব কক্ষের দাবি’ তোলেন, তার বহু আগে- ১৯০৮ সালে আমাদের রোকেয়া তাঁর ’সুলতানাস ড্রিম’-এ নারীর জন্য চেয়েছেন একটি আস্ত প্রজাতন্ত্র। রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম নেওয়া যে কন্যা শিশুটি পাঁচ বছর বয়স থেকে ’অবরোধবাসীনী’র জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছে, সেই বিষাদগ্রস্থ কন্যা শিশুটি একরোখা এক জীবন কী ভয়ানক লড়াই করে হারিয়ে গেলেন ৫২ বছর বয়সেই।
কৃষক ও ঘোড়া
এক গ্রামে এক বৃদ্ধ কৃষক বাস করত। তার একটি তেজী ঘোড়া ছিল। কৃষিকাজে, ভারী জিনিস বহনে ও নিত্যদিনের চলাফেরায় সে ঘোড়াটিকে ব্যবহার করত।
একদিন হঠাৎ করেই ঘোড়াটি হারিয়ে গেল। অনেক খুঁজেও তাকে আর কোথাও পাওয়া গেল না।
কৃষকের স্ত্রীর খুব মন খারাপ। কিন্তু কৃষকের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। হারিয়ে যাওয়া ঘোড়ার জন্য তার কোনো আফসোস বা দুঃখবোধও নেই! তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কিছুই হয়নি।
আশেপাশের প্রতিবেশীরা এসে বলল, তোমার কি দুর্ভাগ্য! একটা মাত্র ঘোড়া তাও হারিয়ে গেল।
এ কথা শুনে কৃষক মৃদু হেসে বলল, হতে পারে!
তার কিছুদিন পর ঘোড়াটি আবার কৃষকের বাড়ি ফিরে আসলো এবং তার সাথে আরোও তিনটি বন্য ঘোড়া।
কৃষকের বাড়িতে সেদিন আনন্দের বান ডেকেছে। শুধু হারানো ঘোড়াটিই ফিরে আসেনি, তার সাথে আরও তিনটি।
প্রতিবেশীরা আবার দেখতে আসলো। সবাই বৃদ্ধকে বলতে থাকল, তোমার কি সৌভাগ্য! হারানো ঘোড়া ফিরে পেয়েছ, সেই সাথে আবার তিনটা বাড়তি ঘোড়া!
কৃষক আগের মতই হাসিমুখে বলল, হতে পারে!
দুই দিন পর কৃষকের একমাত্র ছেলে বন্য ঘোড়াগুলোর একটিতে চড়তে গিয়ে ছিটকে পড়ে গেল। দুর্ঘটনায় তার পা গেল ভেঙে।
এই খবর শুনে প্রতিবেশীরা এসে খুব আফসোস করল। দুঃখ করে কৃষককে বলল, এমন করে ছেলের পা ভেঙে গেল, সত্যিই বড় দুর্ভাগ্য!
কথা শুনে কৃষক লোকটি মুচকি হেসে বলল, হতে পারে!
পরদিন গ্রামে রাজার সৈন্যরা এসে হাজির। যুদ্ধের জন্য তারা গ্রামের যুবক ছেলেদেরকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। সবাইকে নিয়ে গেলেও কৃষকের ছেলের ভাঙা পা দেখে সৈনরা তাকে নিল না।
এইবার প্রতিবেশীরা এসে বলল, তোমার তো দেখছি অনেক বড় সৌভাগ্য, ছেলেকে আর যুদ্ধে গিয়ে মরতে হবে না।
হালকা হেসে কৃষকের একই উত্তর, হতে পারে।
শিক্ষা :
১. জীবনের ভালো বা খারাপ ঘটনাগুলো সাময়িক এবং পরিবর্তনশীল।
২. এখন যা দুর্ভাগ্য মনে হয়, পরবর্তীতে তা সৌভাগ্যে পরিণত হতে পারে, এবং এর বিপরীতটাও সত্যি।
৩. জ্ঞানীর ধর্ম হচ্ছে কষ্টের দিনে ভেঙে না পড়া এবং আনন্দের মুহূর্তে উদ্বেলিত না হওয়া। যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত ও নির্মোহ থাকার গুরুত্ব অপরিসীম।
৪. সবকিছুই আপেক্ষিক এবং আমাদের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি হয়তোবা ভবিষ্যতের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করে না। তাই জীবনের অপ্রত্যাশিত ফলাফলগুলি আমাদের চমকে দেয়।
৫. এক জীবনে আমাদের ভালো-মন্দ সবকিছুই মেনে নিতে হয়। জীবনের সকল পরিবর্তনকে সহজভাবে নেওয়া আমাদের মানসিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা এনে দেয়।
ভিয়েতনামের চম্পা সাম্রাজ্যের বিস্ময়কর ইতিহাস!
আজ যে দেশটিকে আমরা ভিয়েতনাম নামে চিনি, প্রাচীন যুগে তার বিস্তীর্ণ অংশ পরিচিত ছিল চম্পা নামে। এই ‘চম্পা’ নামটির মূল শিকড় ভারতীয় উপমহাদেশেই—বর্তমান বিহারের প্রাচীন অঙ্গ জনপদের রাজধানীর নামও ছিল চম্পা। ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতীয় চম্পার নামেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই চাম-রাষ্ট্র চম্পা নামে পরিচিত হয়। প্রাচীন ভিয়েতনামের বহু শহর, জনপদ ও রাজধানীর সংস্কৃত নামকরণই এর সাক্ষ্য বহন করে।
চম্পা রাজ্যের রাজধানীগুলোর মধ্যে ইন্দ্রপুর, বিজয়, বীরপুর, অমরাবতী উল্লেখযোগ্য। ইন্দ্রপুর শহর বর্তমান কালে ডোং ডুয়োং নামে পরিচিত; এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা দ্বিতীয় ইন্দ্রবর্মা (৮৫৪–৯১৩ খ্রি.)। আবার বিজয় শহরের আধুনিক রূপ হলো বিন দিন। অমরাবতী অঞ্চল আজকের কুয়াংনাম প্রদেশ। এসব নামের মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত ভারতীয় সংস্কৃতির গভীর স্বাক্ষর।
রাজপরিবারে ভারতীয় নামের প্রাধান্য
চম্পা রাজ্যের রাজারা ভারতীয় নাম গ্রহণ করতেন—যেন ভারতীয় সংস্কৃতি তাঁদের রক্তে ও পরিচয়ে মিশে ছিল। রাজাদের নামের তালিকায় নজর দিলে দেখা যায়–
দেববর্মা, বিজয়বর্মা, রুদ্রবর্মা, ইন্দ্রবর্মা, জয়সিংহবর্মা, হরিবর্মা, ভদ্রবর্মা, পরমেশ্বরবর্মা, মহাবিজয়, জয়শক্তিবর্মা—সবই ভারতীয় নাম। অথচ তারা কেউই ভারতীয় ভূখণ্ডে শাসন করেননি; শাসন করেছেন সুদূর ভিয়েতনামের স্বাধীন রাজ্যগুলিতে।
রানিদেরও নামকরণে ভারতীয় প্রভাব ছিল। যেমন—বাদি গৌরোজলক্ষ্মী, ভাস্করদেবী, তাপসী প্রভৃতি।
শুধু নামই নয়, তাঁদের উপাধিতেও ভারতীয় ছাপ ছিল স্পষ্ট—রাজাধিরাজ, পরমেশ্বর, উৎকৃষ্টরাজ ইত্যাদি।
ভৃগুবংশ ও পুরাণ-সংযোগ
৮৬০ থেকে ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভিয়েতনাম শাসনকারী রাজবংশকে বলা হয় ভৃগুবংশ। অভিলেখে উল্লেখ আছে—মহাদেবের আদেশে ঋষি ভৃগু চম্পায় এসেছিলেন। অর্থাৎ, শাসকবংশের আত্মপরিচয়ের মধ্যেও ভারতীয় পুরাণের মর্যাদা গভীরভাবে প্রতিফলিত।
সমাজব্যবস্থায় ভারতীয় প্রভাব
চম্পা সমাজেও ভারতীয় বর্ণবিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। তবে ভারতের তুলনায় এখানে বর্ণভেদ অনেকটাই শিথিল ছিল। বৈশ্য, শূদ্র ও চাম সম্প্রদায়ের মধ্যে তেমন পার্থক্য ছিল না; আন্তঃবিবাহ ছিল স্বাভাবিক। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের সামাজিক মর্যাদা ছিল সমান।
সতীপ্রথারও উল্লেখ রয়েছে—চতুর্থ হরিবর্মার মৃত্যুর পর তাঁর চতুর্দশ পত্নী সতী হন।
সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রভূমি
চম্পা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রধান সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র।
সংস্কৃত ভাষায় রচিত শতাধিক শিলালিপি আজও পাওয়া যায়। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংস্কৃত ব্যবহৃত হত এবং রচিত শিলালিপিতে পাওয়া যায়—
• চতুর্বেদ
• রামায়ণ
• মহাভারত
• মনু, নারদ, ভৃগু-স্মৃতি
• পুরাণ
• ব্যাকরণ, অষ্টাধ্যায়ী, কাশিকা
• জ্যোতিষ
• শৈব, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ শাস্ত্র
রাজারা নিজেরাই ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ। তৃতীয় ইন্দ্রবর্মা মীমাংসা ও ষড়দর্শন, ব্যাকরণে পারদর্শী ছিলেন। জয় ইন্দ্রবর্মা ও হরিবর্মারা মনুস্মৃতি ও নারদীয় স্মৃতিতে দক্ষ ছিলেন।
ধর্মজীবনে ভারতীয় ধর্মের প্রভাব
প্রাচীন চম্পায় শৈবধর্মই ছিল প্রধান। ইষ্টদেবতা ছিলেন শিব। মানবমূর্তি ও লিঙ্গ—উভয় রূপেই শিব পূজিত হতেন। শিবের পত্নী উমা-গৌরীও বিভিন্ন নামে পূজিতা হতেন।
অনেক রাজা নিজেদের নামাঙ্কিত শিবলিঙ্গ স্থাপন করতেন, যেমন ভদ্রবর্মার প্রতিষ্ঠিত ‘ভদ্রেশ্বর’ লিঙ্গ।
বৈষ্ণবধর্ম-ও জনপ্রিয় ছিল, বিশেষত রাম ও কৃষ্ণের আরাধনা। কৃষ্ণের গিরিগোবর্ধন তুলা, কংস-বধ ইত্যাদির উল্লেখ বিভিন্ন লেখে আছে।
বৌদ্ধধর্মও প্রসার লাভ করেছিল। ডোং ডুয়োং অঞ্চলে বিশাল এক বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। চীনা ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে চীন সেনাধ্যক্ষ চম্পা রাজ্য থেকে ১৩৫ বৌদ্ধগ্রন্থ নিয়ে যান। রাজারা ব্যক্তিগতভাবে শৈব হলেও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছিল তাঁদের বৈশিষ্ট্য।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে ভারতীয় ছাপ
মাইসোন, পো, ডোং ডুয়োং এলাকার মন্দিরগুলিতে স্পষ্ট দেখা যায় দ্রাবিড় স্থাপত্যের প্রভাব—
• শিখরশ্রেণি
• বহুস্তর মন্দিরশিখর
• মহাবলিপুরম ও বাদামি শৈলীর অনুকরণ
• পৌরাণিক দেবমূর্তি
তবে ভারতীয় শৈলী অনুকরণ করলেও স্থানীয় স্থপতিরা নিজস্ব সৃজনশীলতাও ধরে রেখেছিলেন। ফলে চম্পার স্থাপত্য একটি স্বতন্ত্র শিল্পধারা সৃষ্টি করেছে।
সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়—প্রাচীন ভিয়েতনাম বা চম্পা রাষ্ট্র ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি, সাহিত্য, ধর্ম, শিল্প, সমাজসংস্কার ও রাজনৈতিক আদর্শের এক উজ্জ্বল প্রতিলিপি।
নাম, ভাষা, উপাধি, পুরাণ, ধর্মাচার, স্থাপত্য—সব ক্ষেত্রেই ভারতীয় প্রভাব উপদ্বীপের বহু গুণ অতিক্রম করে সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেমন ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি স্থানীয় সমাজও তা গ্রহণ করে নিজেদের সংস্কৃতির অংশ করে নিয়েছিল।
ইবনে বতুতার বর্ণনায় বাংলাদেশ
বহুকাল পূর্বে মরক্কোর এক পর্যটক বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি ইবনে বতুতা। তার প্রকৃত নাম ছিল শেখ আবু মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বতুতা। ইবনে বতুতা ছিল তার বংশগত পদবী যা আজও মরক্কোতে প্রচলিত দেখা যায়৷ ইবনে বতুতা 'আর রিহলা' নামক গ্রন্থে তার ভ্রমণকাহিনীগুলো লিপিবদ্ধ করেন। রিহলা একটি আরবি শব্দ, যার বাংলা অর্থ ভ্রমণকাহিনী। ১৩০৪ খৃস্টাব্দে মরক্কোর তাঞ্জিয়ারে জন্মগ্রহনকারী এই পর্যটক মাত্র ২১ বছর বয়সে হজ্ব পালনের জন্য গৃহত্যাগ করেন। হজ্ব পালনের পর তিনি বিভিন্ন দেশের সূফী-সাধকদের সঙ্গলাভের প্রত্যাশায় ভ্রমনে বেড়িয়ে পরেন।
বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৪৬ খৃস্টাব্দে তৎকালীন সুলতানী বাংলায় আসেন। এর আগে ৮ বছর দিল্লীতে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলগের অধীনে কাজী (বিচারক) পদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে সমুদ্র পথে ৪৩ দিন ভ্রমনের পর বাংলাদেশের 'সাদকাওয়ান' বন্দরে পদার্পন করেন। ধারণা করা হয়, সাদকাওয়ান বলতে তিনি চট্টগ্রামকে বুঝিয়েছেন।
ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আগমনের উদ্দেশ্য ছিল, শেখ জালাল উদ্দীন (হযরত শাহ জালাল রহঃ) নামের এক বিখ্যাত সূফী-সাধকের সাথে সাক্ষাৎ। সুতরাং তিনি শেখ জালাল উদ্দীনের আস্তানা 'কামরু' পর্বতের (খাসিয়া-জৈয়ন্তিয়া হিলস) দিকে যাত্রা করেন এবং একমাস পর সেখানে পৌছান। ইবনে বতুতা 'আর রিহলা' গ্রন্থে সূফী হযরত শাহ জালাল রহঃ এর আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করেছেন। হযরত শাহ জালাল ইবনে বতুতাকে একটি খেরকা (দরবেশী আলখাল্লা) উপহার দিয়েছিলেন।
এরপর তিনি সিলেট থেকে নৌকাযোগে 'নহর উল আজরাক' (মেঘনা নদী) পাড়ি দিয়ে ১৫ দিন পর সোনারকাওয়ানে (সোনারগাঁও) পৌঁছান। এই পনেরো দিনের নদী পথের যাত্রায় বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। তার এই যাত্রাপথে তিনি নদীর দুইধারে ফলের বাগান ও সমৃদ্ধ গ্রামগুলি দেখতে পেয়েছিলেন, যা তিনি বাজারের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার তুলনা করেছেন। অসংখ্য নৌকা এই নদীপথে যাত্রা করতো, কিন্তু যখন একটি নৌকা অপর নৌকার সঙ্গে দেখা হতো তখন উভয়ে নিজেদের ঢাক পিটিয়ে অভিবাদন জানাত। বাংলার স্বাধীন সুলতান সুলতান ফখরউদ্দীন মোবারক শাহ সুফি দরবেশদের চলাচলের জন্য এই নদীতে কোনো ধরণের কর নিতেন না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ফলজ উপাদান এবং অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে আন-নহর উল-আজরাক অর্থাৎ মেঘনা নদীকে তিনি মিশরের নীল নদের সাথে তুলনা করেছিলেন।
তৎকালীন বাংলার সমৃদ্ধির বর্ণনায় ইবনে বতুতা তার 'আর রিহলা' গ্রন্থে বলেছেন, "এ বিশাল দেশে প্রচুর চাল উৎপন্ন হয়। সারা পৃথিবীতে আমি এমন কোনো দেশ দেখিনি যেখানে জিনিসপত্রের মূল্য বাংলার চেয়ে কম।
এখানে এক দেরহামে (রৌপ্যমুদ্রায়) আটটি মোটাতাজা মুরগি, দুই দেরহামে একটি মোটাতাজা ভেড়া এখানে বিক্রি হতে আমি দেখেছি। তাছাড়া ত্রিশ হাত লম্বা উৎকৃষ্ট ধরনের সূতী কাপড় (মসলিন) মাত্র দুই দিনারে (স্বর্ণমুদ্রা) এখানে বিক্রি হতে দেখেছি। বাংলাদেশের নারিকেল ইবনে বতুতাকে মুগ্ধ করেছিল। তবে এটাও সত্য যে, ইবনে বতুতা তৎকালীন বাংলাকে 'ভাল ভাল জিনিসে পরিপূর্ণ একটি দোজখ বলেছেন'।
সক্রেটিস...
(খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৯-৪৬৯) দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল। দুজন মানুষ তার চেয়েও দ্রুত এগিয়ে চলছিলেন। ওই আঁধার নামার আগেই তাদের পৌঁছাতে হবে ডেলফিতে। একজনের নাম চেরেফোন (Chaerephon) মধ্যবয়সী গ্রিক। দুজনে এসে থামলেন ডেলফির বিরাট মন্দির প্রাঙ্গণে। সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই মন্দিরের পূজারি এগিয়ে এলো। চেরেফোন তার দিকে চেয়ে বললেন, আমরা দেবতার কাছে একটি বিষয় জানার জন্য এসেছি। পূজারি বলল, আপনারা প্রভু অ্যাপলের মূর্তির সামনে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিন আর বলুন আপনারা কী জানতে চান?
কুৎসিত চেহারার মানুষটি প্রথমে এগিয়ে এসে বললেন, আমি সক্রেটিস, প্রভু, আমি কিছুই জানি না। এবার চেরেফোন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, হে সর্বশক্তিমান দেবতা, আপনি বলুন গ্রিসের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী কে? চেরেফোনের কথা শেষ হতেই চারদিক কাঁপিয়ে আকাশ থেকে এক দৈববাণী ভেসে এলো। যে নিজেকে জানেন সেই সক্রেটিসের জন্ম (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬৯/৪৬৩) পিতা সফরেনিকাশ (Sopphroniscus) ছিলেন স্থপতি। পাথরের নানা মূর্তি গড়তেন মা ফেনআরেট (Sopphroniscus)।
ছিলেন ধাত্রী। পিতা-মাতা দুজনে দুই পেশায় নিযুক্ত থাকলেও সংসারে অভাব লেগেই থাকত। তাই ছেলেবেলায় পড়াশোনার পরিবর্তে পাথর কাটার কাজ নিতে হলো। কিন্তু অদম্য জ্ঞানসপৃহা সক্রেটিসের। যখন যেখানে যেটুকু জানার সুযোগ পান সেটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করেন। এমনি করেই বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। একদিন ঘটনাচক্রে পরিচয় হলো এক ধনী ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি সক্রেটিসের ভদ্র ও মধুর আচরণে, বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন। পাথরের কাজ ছেড়ে সক্রেটিস ভর্তি হলেন এনাক্সগোরাস (Anaxagoras) নামের এক গুরুর কাছে।
কিছুদিন পর কোনো কারণে এনাক্সগোরাস আদালতে অভিযুক্ত হলে সক্রেটিস আরখ এখলাসের শিষ্য হলেন। এই সময় গ্রিস দেশ ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ফলে নিজেদের মধ্যে মারামারি, যুদ্ধবিগ্রহ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। দেশের প্রতিটি তরুণ, যুবক, সক্ষম পুরুষদের যুদ্ধে যেতে হতো। সক্রেটিসকেও এথেন্সের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে অ্যামপিপোলিস অভিযানে যেতে হলো। এই যুদ্ধের পর তার মন ক্রমশই যুদ্ধের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠল। চিরদিনের মতো সৈনিকবৃত্তি পরিত্যাগ করে ফিরে এলেন এথেন্সে। এথেন্স তখন জ্ঞান-গরিমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শৌর্য, বীর্যে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ।
শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির এক স্বর্ণযুগ। এই পরিবেশে নিজেকে জ্ঞানের জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না সক্রেটিস। তিনি ঠিক করলেন জ্ঞানের চর্চায়, বিশ্ব প্রকৃতি জানার সাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করবেন। প্রতিদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে সামান্য প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়তেন। খালি পা, গায়ে একটা মোটা কাপড় জড়ানো থাকত। কোনোদিন গিয়ে বসতেন নগরের কোনো দোকানে, মন্দিরের চাতালে কিংবা বন্ধুর বাড়িতে। নগরের যেখানেই লোকজনের ভিড় সেখানেই খুঁজে পাওয়া যেত সক্রেটিসকে। প্রাণ খুলে লোকজনের সঙ্গে গল্প করছেন।
আড্ডা দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছেন, নিজে এমন ভাব দেখাতেন যেন কিছুই জানেন না, বোঝেন না। লোকের কাছ থেকে জানার জন্য প্রশ্ন করছেন। আসলে প্রশ্ন করা, তর্ক করা ছিল সে যুগের এক শ্রেণীর লোকদের ব্যবসা। এদের বলা হতো সোফিস্ট। এরা পয়সা নিয়ে বড় বড় কথা বলত। যারা নিজেদের পাণ্ডিত্যের অহংকার করত, বীরত্বের বড়াই করত, তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করতেন, বীরত্ব বলতে তারা কী বোঝে? পাণ্ডিত্যের স্বরূপ কী? তারা যখন কোনো কিছু উত্তর দিত, তিনি আবার প্রশ্ন করতেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন সাজিয়ে বুঝিয়ে দিতেন তাদের ধারণা কত ভ্রান্ত। মিথ্যা অহমিকায় কতখানি ভরপুর হয়ে আছে তারা।
নিজেদের স্বরূপ এভাবে উদঘাটিত হয়ে পড়ায় সক্রেটিসের ওপর তারা সকলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। কিন্তু সক্রেটিস তাতে সামান্যতম বিচলিত হতেন না। নিজের আদর্শ, সত্যের প্রতি তার ছিল অবিচল আস্থা। সেই সাথে ছিল অর্থ সম্পদের প্রতি চরম উদাসীনতা। একবার তার বন্ধু অ্যালসিবিয়াদেশ তাকে বাসস্থান তৈরি করার জন্য বিরাট একখণ্ড জমি দিতে চাইলেন। সক্রেটিস বন্ধুর দান ফিরিয়ে দিয়ে সকৌতুকে বললেন, আমার প্রয়োজন একটি জুতার আর তুমি দিচ্ছ একটি বিরাট চামড়া এ নিয়ে আমি কী করব জানি না।
পার্থিব সম্পদের প্রতি নিসপৃহতা তার দার্শনিক জীবনে যতখানি শান্তি নিয়ে এসেছিল, তার সাংসারিক জীবনে ততখানি অশান্তি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার প্রতিও তিনি ছিলেন সমান নিসপৃহ। তার স্ত্রী জ্ঞ্যানথিপি (Xanthiphe) ছিলেন ভয়ংকর রাগী মহিলা। সাংসারিক ব্যাপারে সক্রেটিসের উদাসীনতা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। একদিন সক্রেটস গভীর একাগ্রতার সাথে একখানি বই পড়ছিলেন। প্রচণ্ড বিরক্তিতে জ্ঞ্যানথিপি গালিগালাজ শুরু করে দিলেন। কিছুক্ষণ সক্রেটিস স্ত্রীর বাক্যবাণে কর্ণপাত করলেন না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রক্ষা করতে না পেরে বাইরে গিয়ে আবার বইটি পড়তে আরম্ভ করলেন। জ্ঞ্যানথিপি আর সহ্য করতে না পেরে এক বালতি পানি এনে তার মাথায় ঢেলে দিলেন। সক্রেটিস মৃদু হেসে বললেন, আমি আগেই জানতাম যখন এত মেঘগর্জন হচ্ছে তখন শেষ পর্যন্ত একপশলা বৃষ্টি হবেই। জ্ঞ্যানথিপি ছাড়াও সক্রেটিসের আরো একজন স্ত্রী ছিলেন, তার নাম মায়ার্ত (Myrto)। দুই স্ত্রীর গর্ভে তার তিনটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। দারিদ্র্যের মধ্যে হলেও তিনি তাদের ভরণ পোষণ শিক্ষার ব্যাপারে কোনো উদাসীনতা দেখাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
শিক্ষার মধ্যেই মানুষের অন্তরের জ্ঞানের পূর্ণ জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। জ্ঞানের মধ্যে দিয়েই মানুষ একমাত্র সত্যকে চিনতে পারে। যখন তার কাছে সত্যের স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সে আর কোনো পাপ করে না। অজ্ঞানতা থেকেই সমস্ত পাপের জন্ম। তিনি চাইতেন মানুষের মনের সেই অজ্ঞানতাকে দূর করে তার মধ্য বিচার বৃদ্ধি বোধকে জাগ্রত করতে। যাতে তারা সঠিকভাবে নিজেদের কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। তার লক্ষ্য ছিল আলোচনা জিজ্ঞাসা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সেই সত্যকে উপলব্ধি করতে মানুষকে সাহায্য করা। কথার মধ্য দিয়ে তর্ক বিচারের পদ্ধতিকে দার্শনিকরা আস্তি নাস্তিমূলক পদ্ধতি (Dialectic Methood)
নাম দিয়েছেন, সক্রেটিস এই পদ্ধতির সূত্রপাত করেছিলেন। পরবর্তীকালের তার শিষ্য প্লেটো, প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল সেই ধারাকে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত করেছিলেন ন্যায় শাস্ত্রে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শেষ ভাগ থেকে পঞ্চম শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত গ্রিক সভ্যতার স্বর্ণযুগ। এই যুগেই সক্রেটিসের জন্ম। কিন্তু তার যৌবনকাল থেকে এই সভ্যতার অবক্ষয় শুরু হলো। পরসপরের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহের ফলে প্রত্যেকেরই প্রভাব-প্রতিপত্তি কমতে আরম্ভ করল। গ্রিসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র এথেন্সও তার প্রভাব থেকে বাদ পড়ল না। শুধু অর্থনীতি নয়, সমাজ রাজনীতিতেও নেমে এলো বিপর্যয়।
তর্কের মধ্যে দিয়ে আলোচনার পথ ধরে মানুষের মধ্যে চিন্তার উন্মেষ ঘটানো, সত্যের পথে মানুষকে চালিত করা। সক্রেটিসের আদর্শকে দেশের বেশ কিছু মানুষ সুনজরে দেখেনি। তারা সক্রেটিসের সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা করল। তাছাড়া যারা ঐশ্বর্য, বীরত্ব শিক্ষার অহংকারে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত , সক্রেটিসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাদের এই অহংকারের খোলসটা খসে পড়ত। এভাবে নিজেদের স্বরূপ উদঘাটিত হয়ে পড়ায় অভিজাত শ্রেণীর মানুষরা সক্রেটিসের ঘোর বিরোধী হয়ে উঠল। তাদের চক্রান্তে দেশের নাগরিক আদালতে সক্রেটিসের ঘোর বিরোধী অভিযোগ আনা হলো (৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্ব)।
তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল তিনি এথেন্সের প্রচলিত দেবতাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে নতুন দেবতার প্রবর্তন করতে চাইছেন। দ্বিতীয়ত তিনি দেশের যুবসমাজকে ভ্রান্ত পথে চালিত করেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের আরো দুটি কারণ ছিল সপার্টার সঙ্গে ২৭ বছরের যুদ্ধে এথেন্সের পরাজয়ের ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাট আঘাত এলো। অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিল। সেকালের ধর্মবিশ্বাসী মানুষরা মনে করল নিশ্চয়ই দেবতাদের অভিশাপেই এই পরাজয় আর এর জন্য দায়ী সক্রেটিসের ঈশ্বরবিদ্বেষী শিক্ষা। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে এলো মেলেতুল, লাইকন, আনাতুস নামে এথেন্সের তিনজন সমভ্রান্ত নাগরিক। এই অভিযোগের বিচার করার জন্য আলোচোনের সভাপতিত্বে ৫০১ জনের বিচারকমণ্ডলী গঠিত হলো।
এই বিচারকমণ্ডলীর সামনে সক্রেটিস এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার বিরোধীপক্ষ কী বলেছিল তা জানা যায়নি। তবে সক্রেটিসের জবানবন্দি লিখে রেখে গিয়েছিলেন প্লেটো। এক আশ্চর্য সুন্দর বর্ণনায়, বক্তব্যের গভীরতায় এই রচনা বিশ্ব সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ। …হে এথেন্সের অধিবাসীগণ, আমার অভিযোগকারীদের বক্তৃতা শুনে আপনাদের কেমন লেগেছে জানি না, তবে আমি তাদের বক্তৃতার চমকে আত্মবিস্মৃত হয়েছিলাম, যদিও তাদের বক্তৃতায় সত্য ভাষণের চিহ্নমাত্র নেই। এর উত্তরে আমার বক্তব্য পেশ করছি। আমি অভিযোগকারীদের মতো মার্জিত ভাষার ব্যবহার জানি না। আমাকে শুধু ন্যায়বিচারের স্বার্থে সত্য প্রকাশ করতে দেয়া হোক। কেন আমি আমার দেশবাসীর বিরাগভাজন হলাম? অনেক দিন আগে ডেলফির মন্দিরে
দৈববাণী শুনলাম তখনই আমার মনে হলো এর অর্থ কী? আমি তো জ্ঞানী নই তবে দেবী কেন আমাকে দেবীর কাছে নিয়ে গিয়ে বলল এই দেখ আমার চেয়ে জ্ঞানী মানুষ। আমি জ্ঞানী মানুষ খুঁজতে আরম্ভ করলাম। ঠিক একই জিনিস লক্ষ করলাম। সেখান থেকে গেলাম কবিদের কাছে। তাদের সাথে কথা বলে বুঝলাম তারা প্রকৃতই অজ্ঞ। তারা ঈশ্বরদত্ত শক্তি ও প্রেরণা থেকেই সবকিছু সৃষ্টি করেন, জ্ঞান থেকে নয়। শেষ পর্যন্ত গেলাম শিল্পী, কারিগরদের কাছে। তারা এমন অনেক বিষয় জানেন যা আমি জানি না। কিন্তু তারাও কবিদের মতো সব ব্যাপারেই নিজেদের চরম জ্ঞানী বলে মনে করত আর এই ভ্রান্তিই তাদের প্রকৃত জ্ঞানকে ঢেকে রেখেছিল।
এই অনুসন্ধানের জন্য আমার অনেক শত্রু সৃষ্টি হলো। লোকে আমার নামে অপবাদ দিল, আমিই নাকি একমাত্র জ্ঞানী কিন্তু ততদিনে আমি দৈববাণীর অর্থ উপলব্ধি করতে পেরেছি। মানুষের জ্ঞান কত অকিঞ্চিৎকর। দেবতা আমার নামটা দৃষ্টান্তস্বরূপ ব্যবহার করে বলতে চেয়েছিলেন তোমাদের মধ্যে সেই সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী যে সক্রেটিসের মতো জানে, যে সত্য সত্যই জানে আর জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই। আমি নিশ্চিত যে আমি অনেকের অপ্রিয়তা এবং শত্রুতা অর্জন করেছি এবং আমার চরম দণ্ড হলে এই শত্রুতার জন্যই হবে, মেলেতুস বা আনিতুসের জন্য নয়। দণ্ড হলে তা হবে জনতার ঈর্ষা ও সন্দেহের জন্য যা আমার আগে অনেক সৎকারের নিধনের কারণ হয়েছে এবং সম্ভবত আরো অনেকের নিধনের কারণ হবে।
আমিই যে তাদের শেষ বলি তা মনে করার কোনো কারণ নেই…অতএব হে এথেন্সের নাগরিকগণ, আমি বলি তোমরা হয় আনিতুসের কথা শোন অথবা অগ্রাহ্য কর। হয় আমাকে মুক্তি দাও নয়তো দিও না, কিন্তু নিশ্চিত থাকতে পার আমি আমার জীবনের ধারা বদলাব না। …আমাকে ঈশ্বর এই রাষ্ট্র আক্রমণ করতে পাঠিয়েছেন। রাষ্ট্র হলো একটি মহৎ সুন্দর ঘোড়া। তার বৃহৎ আয়তনের জন্য সে শ্লথগতি এবং তার গতি দ্রুততর করতে, তাকে জাগিয়ে তোলার জন্য মৌমাছির প্রয়োজন ছিল।
আমি মনে করি যে আমি ঈশ্বর প্রেরিত সেই মৌমাছি। আমি সর্বক্ষণ তোমাদের দেহে হুল ফুটিয়ে তোমাদের মধ্যে সুস্থ ভাবনা জাগিয়ে তুলি, যুক্তির দ্বারা উদ্বুদ্ধ করি এবং প্রত্যেককে তিরস্কারের দ্বারা তৎপর করে রাখি। …বন্ধুগণ সম্ভব অসম্ভবের কথা বাদ দিয়ে বলছি মুক্তিলাভের জন্য বা দণ্ড এড়ানোর জন্য বিচারকদের অনুনয় করা অসঙ্গত। যুক্তি পেশ করে তাদের মনে প্রত্যয় জন্মানোই আমাদের কর্তব্য, বিচারকের কর্তব্য হচ্ছে ন্যায়বিচার করা। বিচারের নামে বন্ধু তোষণ করা নয়। …
আমি দেবতাকে বিশ্বাস করি, আমার অভিযোগকারীরা যতখানি বিশ্বাস করে তার চেয়েও অনেক বেশি বিশ্বাস করি। এতক্ষণ আমি ঈশ্বর এবং তোমাদের সামনে আমার বক্তব্য রাখলাম। এবার তোমাদের এবং আমার পক্ষে যা সর্বোত্তম সেই বিচার হোক। কিন্তু বিচারে ২৮১-২২০ ভোটে সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। সেই যুগে এথেন্সে কোনো অভিযুক্তকে দোষী ঘোষণা করা হলে তাকে দুটি শাস্তির মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হতো। কিন্তু সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন তিনি নির্দোষ, তাই রায় ঘোষিত হওয়ার পর তিনি উত্তর দিলেন, হে এথেন্সের অধিবাসীগণ, আমার পক্ষ থেকে কি পাল্টা দণ্ড প্রস্তাব করব? আমার যা ন্যায়ত প্রাপ্য তাই নয় কি?
আমি তোমাদের প্রত্যেকের কাছে ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছি, সে শুধু তোমাদের কল্যাণের জন্য। এভাবে আমি তোমাদের উপকার করতে চেয়েছি। উপকারীকে সরকারি ব্যয় ভরণ-পোষণের ভার গ্রহণ করা হোক এই আমার শেষ ইচ্ছা। সক্রেটিসের এই বক্তব্যে জুরিরা আরো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। তাদের ধারণা হলো সক্রেটিস তাদের ব্যঙ্গ করছেন। আরো অনেকে তার বিরুদ্ধে চলে গেল এবং বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। সেই ভয়ঙ্কর রায় শুনে এতটুকু বিচলিত হলেন না সক্রেটিস। স্থির শান্তভাবে বললেন, এখন সময় হয়েছে আমাদের সকলকে চলে যাওয়ার, তবে আমি যাব মৃত্যুর দিকে, তোমরা যাবে জীবনের দিকে। জীবন কিংবা মৃত্যু-একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন এর মাঝে শ্রেষ্ঠ কে? সক্রেটিসের বন্ধুদের মধ্যে ক্রিটো ছিলেন সবচেয়ে ধনী।
তিনি কারারক্ষীদের ঘুষ দিয়ে সক্রেটিসকে অন্য দেশে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই দেশের আইনশৃঙ্খলা মেনে চলা কর্তব্য। বিচারালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার অর্থ আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। তাছাড়া এতে সকলের মনে এই ধারণা হবে যে সক্রেটিস সত্যি সত্যিই অপরাধী। তাকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচারকরা ঠিক কাজই করেছেন। মৃত্যুর দিন সকল শিষ্য একে একে উপস্থিত হলেন কারাগারে। তিনি গোসল করে ফিরে এলেন। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। মুহূর্তে মৃত্যুদূতের মতো দ্বারে এসে দাঁড়াল জেলের কর্মচারী।
গভীর বেদনায় কাঁদতে কাঁদতে ঘোষণা করল সক্রেটিসের বিষপানের সময় হয়েছে। ক্রিটো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রাজকর্মচারীর দিকে ইঙ্গিত করতেই জল্লাদ কক্ষে প্রবেশ করল, হাতে তার বিষের পাত্র। সক্রেটিস হাসিমুখে সেই পাত্র নিজের হাতে তুলে নিলেন। অকল্পিতভাবে শেষবারের মতো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন তারপরই সমস্ত বিষ পান করলেন। তারপর জল্লাদের নির্দেশে ঘরের মধ্যে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। ধীরে ধীরে বিষ তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পা দুটো ভারী হয়ে এলো। চলৎশক্তিহীন হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। কাপড়ে মুখ ঢেকে দিলেন। কয়েক মুহূর্ত সব শান্ত। মৃত্যুর সব শান্ত। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সক্রেটিস যাত্রা করলেন অমৃতলোকে।
তার মৃত্যুর পরেই এথেন্সের মানুষ ক্ষোভে দুঃখে ফেটে পড়ল। চারদিকে ধিক্কার ধ্বনি উঠল। বিচারকদের দল সর্বত্র একঘরে হয়ে পড়ল। অনেকে অনুশোচনায় আত্মহত্যা করলেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে মেনেতুসকে পিটিয়ে মারা হলো, অন্যদেশ থেকে বিতাড়িত করা হলো। দেশের লোকেরা তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিরাট মূর্তি প্রতিষ্ঠা করল। প্রকৃতপক্ষে সক্রেটিসই পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক, চিন্তাবিদ যাকে তার চিন্তা দর্শনের জন্য মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার নশ্বর দেহের শেষ হলেও চিন্তার শেষ হয়নি। তার শিষ্য প্লেটো, প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলের মধ্য দিয়ে সেই চিন্তার এক নতুন জগৎ সৃষ্টি হলো, যা মানুষকে উত্তেজিত করেছে আজকের পৃথিবীতে।"
নারী স্বভাবের 10টি কালো সত্য ।
প্রথম সত্য।
নারীর প্রথম অস্ত্র আকর্ষণ। নারীর কাছে অস্ত্র থাকে না। তার কাছে শক্তি নেই। কিন্তু তার আছে সবচেয়ে বিষাক্ত শক্তি তার আকর্ষণ। ফ্রিডেরিক নিট সে বলেছেন, নারীর শক্তি লুকিয়ে থাকে তার আকর্ষণ ও সূক্ষ আচরণের মধ্যে। একজন নারীর হাসি, চোখের নরম দৃষ্টি বা তার কোমল স্পর্শ এই ছোট ছোট ইঙ্গিতি মুহূর্তে একজন পুরুষের কঠোর মানসিকতা নরম করে দিতে পারে। তুমি যতই ভাবো তুমি যুক্তিবাদী, স্থির এবং বুদ্ধিমান। নারীর আকর্ষণ সবসময় সেই যুক্তি ও লজিকের উপর নিঃশব্দে জয় পায়। কারণ এটাই তার প্রথম প্রাকৃতিক এবং সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার মোহ।
দ্বিতীয় সত্য।
নারী নিরাপত্তা চায় ভালোবাসা নয়। বেশিরভাগ পুরুষ মনে করেন নারীরা ভালোবাসা চায় কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নারীরা নিরাপত্তা চায়। ফ্রেডেরিক নিচ লিখেছিলেন মানুষ যুদ্ধের জন্য তৈরি। নারী পুনর্নির্মাণের জন্য। এখানে নিজেকে নিরাপদ রাখাই নারীর প্রকৃত স্বভাব। সে দেখে কে তাকে স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং শক্তি দিতে পারে। ভালোবাসা তার কাছে কেবল একটি পথ। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে নিরাপত্তা। এইজন্য নারী প্রায়শই সেই পুরুষটিকেই বেছে নেয় যিনি সবচেয়ে নিরাপদ ও শক্তিশালী মনে হয়। তাকে না , যে পুরুষ তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
তৃতীয় সত্য।
নারীর জন্য পুরুষ একটি মাধ্যম। এই কথা শুনে তোমাকে কষ্ট লাগতে পারে। কিন্তু এটি করা বাস্তবতা। কখনো নিরাপত্তার জন্য, কখনো সামাজিক মর্যাদার জন্য, কখনো নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য। ফ্রেডরিক নিচে বলেছেন, নারীর সবকিছুই একটি ধাঁধা এবং নারীর সবকিছুরই এক সমাধান আছে। তা হলো পুরুষ। অর্থাৎ নারীর খেলা পুরুষকে ঘিরেই ঘরে। কিন্তু এখানে কৌশল হলো পুরুষ ভেবে বসে যে সে কেন্দ্র। বাস্তবে সে শুধু একটি মাধ্যম। ভাবো অনেক নারী এমন পুরুষের সঙ্গে বিয়ে করে যাকে তারা সত্যি ভালোবাসে না, কেন করে। কারণ সেই পুরুষের থেকে তাদের কিছু পাওয়ার কারণ থাকে। কখনো সামাজিক সম্মান, কখনো আর্থিক নিরাপত্তা, কখনো পরিবার গঠনের সুযোগ, আর যখন সেটা পূরণ হয়। প্রায়শই নারীর প্রবণতা বদলে যায়। তখন পুরুষ হতবাগ হয়ে যায়। আমি সব করেছি তারপরও সে সুখী নয়। কেন আসলে সে কখনোই তোমাকে উদ্দেশ্য ধরে চলেনি। সে তোমাকে শুধু একটি মাধ্যম ধরেই চলেছে। এই কারণে পুরুষ বারবার হৃদয় ভাঙ্গার অভিযোগ করে। কারণ তারা নারীকে উদ্দেশ্য ধরে নিয়েছিল। অথচ নারী তাকে কেবল মাধ্যম মনে করেছে।
চতুর্থ সত্য
নারীর নিষ্ঠা সবসময় শর্ত সাপেক্ষ। পুরুষরা প্রায়ই মনে করে যদি তারা কোন নারীর প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা দেখায়। তাহলে সেই নারী সারাজীবন তাদের পাশে থাকবে। কিন্তু এটাই সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা। কারণ নারীর নিষ্ঠা কখনোই একতরফা বা নিঃশর্ত নয়। তা নির্ভর করে মূল্যবোধ, নিরাপত্তা, সম্মান, আবেগীয় সংযোগ এবং ভবিষ্যতের স্থিতির উপর। সে ততক্ষণ বিশ্বস্ত থাকে। যতক্ষণ
সে তোমার থেকে কিছু পাচ্ছে। সেটা হতে পারে টাকা, সেটা হতে পারে নিরাপত্তা বা সামাজিক সম্মান এবং মর্যাদা। ঠিক যেই মুহূর্তে তার মনে হয় যে এসব এখন তার থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তখন তার বিশ্বস্ততাও হালকা হতে থাকে।
তুমি দেখেছো কতজন নারী সম্পর্কের ভিতরে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত। যতক্ষণ পুরুষ শক্তিশালী উপার্জনশীল, এবং তাদের সহায়তা করে, কিন্তু যখনই পুরুষ পড়ে যায় প্রায়শই সেই নারীরা প্রথমেই চলে যায় এটা তিক্ত সত্য। নারীর বিশ্বস্ততা স্থায়ী নয়, বরং শর্ত সাপেক্ষ। এবং এই শর্তগুলোর নাম ফায়দা নিরাপত্তা এবং স্থিরতা। তাই যদি তুমি মনে করো যে নারী কেবল তোমার ভালোবাসার জন্য চিরকাল থাকবে। তাহলে সেটা একটা বিপদজনক ভুল। নারী বিশ্বস্ত কিন্তু শুধুমাত্র যতক্ষণ তার চাহিদাগুলো পূরণ হচ্ছে।
সত্য পাঁচ
নারী শক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। নারী নিজে থেকে শক্তি হতে পারে না। সে যুদ্ধ লড়তে পারে না। সাম্রাজ্য গড়তে পারে না। কিন্তু তার সবচেয়ে গভীর প্রবণতা হলো শক্তির
সঙ্গে জুড়ে যাওয়া। ইতিহাসে প্রতিটি রাজপ্রাসাদে রানী এবং স্ত্রীরা সেই রাজা, বা শাসকের চারপাশেই ছিল। যার হাতে তরবারি ও মুকুট ছিল। সাধারণ বা দুর্বল পুরুষ তাদের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেত। এটা শুধু ইতিহাস নয় আজও সত্য। আধুনিক জগতে
শক্তি মানে টাকা, প্রভাব, এবং আত্মবিশ্বাস। নারী তার দিকে আকৃষ্ট হয় যার কর্তৃত্ব আছে। যার কাছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। দুর্বল পুরুষ নারীর চোখে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। সে বলবে যে তাকে ভালো হৃদয় ও ভালোবাসা দরকার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার মন সেই পুরুষের প্রতি টিকে থাকে যে বিশ্বে নিজের আধিপত্য গড়ে তুলতে পারে। তাই মনে রেখো যদি তুমি জীবনে শক্তিশালী না হও। যদি তোমার কাছে নিয়ন্ত্রণ না থাকে। তাহলে নারী তোমাকে কখনোই সত্যিকারের অর্থে ভালোবাসবে না। সে কেবল শক্তির পাশে দাঁড়ায় এটাই তার স্বভাব।
সত্য ছয়
নারী নির্দোষতার মুখোষ পরিধান করে নারী কখনোই সরাসরি তার আসল উদ্দেশ্য বলে না। সে সবসময় নির্দোষতার একটি মুখোষ পড়ে। যাতে পুরুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। নিট বলেছেন নারী
শেখে ভালোবাসার ভেতরেই বিদ্বেষ করতে। ধীরে ধীরে সে ভুলতে থাকে কিভাবে নিখাতভাবে ভালোবাসতে হয়। অর্থাৎ যতক্ষণ নারী নির্দোষতা ও আকর্ষণের মুখোষ ধরে রাখে সে সহজে পুরুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এবং যখন সেই মুখোষ পড়ে যায়। তখন তার আসল চেহারা প্রকাশ পায়।
সত্য সাত।
নারী কখনো তৃপ্ত হয় না। এটা সম্ভবত সবচেয়ে করা কথা। নারী পুরোপুরি কখনোই সন্তুষ্ট হয় না। সে সবসময় চায় বেশি আরো চায়। নিট সে বলেছিলেন, প্রেম ও প্রতিশোধে নারী পুরুষের তুলনায় বেশি পরাক্রমশালী। অর্থাৎ নারীর স্বভাব সবসময় বিক্ষিপ্ত।
সবসময় লালায়িত এবং সবসময় অতিরিক্ত। সে কখনোই থামে না। না সম্পর্কে, না ইচ্ছায়, না প্রত্যাশায়।
সত্য আট।
নারীরা আবেগ নিয়ে খেলায় নিপুণ। পুরুষ প্রায়শই যুক্তি নিয়ে কাজ করে। কিন্তু নারী সবসময় আবেগের খেলা খেলতে জানে। সে জানে সরাসরি যুক্তি দিয়ে পুরুষকে পরাজিত করা যায় না। তাই সে আবেগকে অস্ত্র বানায়। অপরাধবোধ, কাঁদা, নীরবতা, অভিযোগ এসব তার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। নিট সে বলেছিলেন, যখন একজন নারীর
মনোবৃত্তি বিশ্লেষণ হয়, প্রায়শই তার আবেগে কিছু ত্রুতি ধরা পড়ে। অর্থাৎ তার আসল শক্তি আবেগকে মোড়ানোর ক্ষমতাতেই লুকিয়ে আছে। এবং এই কারণেই পুরুষ প্রায়ই জালে পড়ে যায়।
ট্রুথ নাইন।
নারী প্রতিযোগিতায় নির্মম। তুমি ভাবো নারী দয়ালু। কিন্তু সত্য হলো একজন নারী অন্য নারীদের সঙ্গেই সবচেয়ে কঠোর হয়। তার কাছে প্রেমের চেয়ে বড় যুদ্ধ হলো অন্য নারীদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া।
এজন্যই সে সুন্দর দেখাতে, নজর কাটতে, প্রতিযোগিতায় জিততে সকল সম্ভব কৌশল ব্যবহার করে। সে কখনো প্রকাশ্যে লড়াই করবে না। বরং আড়াল থেকে আঘাত করবে। এটাই তার কৌশল। আর এটাই তার প্রকৃত খেলা। সত্যের শীর্ষে দাঁড়ানো এই বাস্তবতা হলো নারী কখনো তোমাকে পুরোপুরি নিজের করে নিতে দেবে না। নিট সে বলেছিলেন, তুমি কি কোন নারীর কাছে যাচ্ছ? তোমার সঙ্গে চাবুক নিতে ভুলে যেও না। কথাটি শুনতে কঠোর লাগলেও এর অর্থ নারীকে অত্যাচার করা নয়। এর আসল সতর্ক বার্তা হলো যদি তুমি তাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে দাও। সে একসময় তোমাকে নিজের দাসে পরিণত করবে। নারী সবসময় চাইবে পুরুষ তার চারপাশে ঘুরে বেড়াক। কিন্তু যদি পুরুষ নিজেকে তার কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে ফেলে তবে সে তাকে কখনোই সম্পূর্ণভাবে নিজের করে নেবে না।
শেষ সত্য।
নারী তোমাকে সবসময় কিছুটা অসম্পূর্ণ অবস্থায় চাইবে। যাতে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এখন তুমি ভাবছো তাহলে কি নারীরা খারাপ? না। এটি তাদের স্বভাবের সত্য। সমস্যা হলো পুরুষ এই সত্যগুলো দেখতে চায় না। সে মিষ্টি মিথ্যার ভেতরেই বাঁচতে চায়। কিন্তু যদি তুমি সত্যকে দেখতে পারো তুমি মুক্ত হয়ে যাবে।
কারণ শক্তি শুরু হয় সেই স্থান থেকে। যেখানে ভ্রম ভেঙে যায়। আর আজ তোমার সেই ভ্রম ভেঙে গেছে। মনে রেখো নারীকে বোঝা তোমার উদ্দেশ্য নয়। তোমার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিজেকে এতটাই শক্তিশালী করে তোলা যেন কোন খেলা, কোন প্রতারণা, কোন বিভ্রম তোমাকে নিচে নামাতে না পারে। নিট সে বলেছিলেন, বিকাম হু ইউ আর। আর এটাই তোমার সবচেয়ে বড় কাজ। নিজেকে চিনো, নিজেকে শক্ত করো এবং নিজেকে এত উঁচুতে তুলো যে কেউ তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। জীবন সম্পর্কে এইরকম শক্তিশালী
শরীরের ভঙ্গি
শরীরের ভঙ্গি বদলে দেয় শুধু আপনার চেহারা নয়—বদলে দেয় আপনার আত্মবিশ্বাসের প্রকাশও।
ঝুঁকে বা কুঁজো হয়ে হাঁটলে মানুষ আপনাকে দুর্বল ভাববে; কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ালে, মাথা উঁচু রাখলে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চললে আপনার ভিতরের শক্তি ও আত্মবিশ্বাস চারপাশের মানুষ তৎক্ষণাৎ অনুভব করবে।
গবেষণা বলছে—সঠিক ভঙ্গি শরীরে অক্সিজেন সঞ্চালন বাড়ায়, স্ট্রেস কমায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ায়।
অন্যদিকে দীর্ঘসময় ভুল ভঙ্গিতে বসে থাকা আত্মবিশ্বাস কমায় এবং ঘাড়–পিঠ–কোমরের ব্যথা সৃষ্টি করে।
তাই আত্মবিশ্বাস শুধু কথায় নয়, ভঙ্গিতেও প্রকাশ পায়।
প্রতিদিন কয়েক মিনিট অনুশীলন করুন—
– সোজা হয়ে দাঁড়ান
– মাথা–কাঁধ সমান রাখুন
– গভীর শ্বাস নিন
এই ছোট অভ্যাসগুলোই আপনার উপস্থিতি, ভরসা এবং ব্যক্তিত্বকে বদলে দেবে।
ভঙ্গিই বলে দেয়—আপনি নিজেকে কতটা সম্মান করেন।
নিজের তৈরি করা মানসিক চাপ
জীবনে যা কিছুই করো না কেন, নিজের সুখের চাবিকাঠি অন্য কারো হাতে তুলে দিও না। কখনোই কারো ওপর এত বেশি নির্ভরশীল হয়ো না যে, তার সামান্য অবহেলাতেই তোমার মন খারাপ হয়ে যায়।
তোমার মন খারাপ? সুন্দর একটা গান শোনো, নিজের জন্য এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা বানাও, বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়ায় আপনমনে হাঁটো, জানলার পাশে বসে বৃষ্টি দেখো কিংবা প্রিয় লেখকের বইয়ে ডুব দাও। যদি তোমার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা থাকে, সেটাকে কাজে লাগাও।
অন্যকে ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া, নিজের দুঃখ দুর্বলতা সবার সামনে প্রকাশ করা — এগুলো কোনো পরিণত মানসিকতার পরিচয় নয়। খুব বেশি একা লাগলে বা মন খারাপ হলে সমুদ্র বা পাহাড় দেখতে চলে যাও।
পুরোনো স্মৃতি মনে করো, হাসো, কাঁদো — কিন্তু নিজের সাথে এমন একটা সম্পর্ক গড়ে তোলো, যেন দুঃখের দিনগুলোতে কাউকে না পেলেও নিজেই নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠতে পারো।
যদি কোনো কাজে সফল হও, নিজেকে পুরস্কৃত করো। যদি ব্যর্থ হও, নিজের সাথে একটু অভিমান করো, কিন্তু হাল ছেড়ো না। আর কখনোই অন্যের চোখে নিজের পারফেকশন খোঁজার ভুল করো না। কারণ মানুষ সবসময় তোমার গুণের চেয়ে তোমার ত্রুটিগুলোকে বড় করে দেখতেই বেশি পছন্দ করে।
একা রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়াটা স্বাভাবিক মনে করো, একা পার্কে সময় কাটানোটা যেন হাস্যকর না লাগে। নিজেকে ভালোবাসো। যে মানুষ নিজেকে ভালবাসতে পারে না, সে কখনো সুখী হতে পারে না।
নিজেকে আর্থিকভাবে স্বাধীন করো, যাতে মুড অফ থাকলে নিজের জন্য একটা চকলেট কিনতে পারো, নিজের জন্মদিনে নিজেকে একটা সুন্দর উপহার দিতে পারো, নিজের পছন্দের পোশাক নিজের জন্য নিজেই কিনতে পারো, পছন্দের কোনো জায়গায় ঘুরতে যেতে পারো।
মাঝেমধ্যে নিজেকে কিছু ফুল উপহার দাও, ঘরের কোণায় ফুলদানিতে একটা ফুল রাখো, সুন্দর সুবাস মন ভালো করে দেবে। সবার মন জয় করা তোমার দায়িত্ব নয়, কারণ পৃথিবীর কেউই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। তাই যেখানে মন টানে না, সেখানে "না" বলতে শেখো।
"আমার বাবা-মা আমাকে বোঝে না, বন্ধুরা আমাকে সময় দেয় না, কাছের মানুষ আমাকে অবহেলা করে" — এসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দিও না। কারণ এগুলো আসলে তোমার নিজের তৈরি করা মানসিক চাপ।
কেন নিজেকে অন্যের বিরক্তির কারণ বানাবে? যেখানে তোমার মূল্য নেই, সেখান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নাও। নিজেকে এমনভাবে গড়ে তোলো, যাতে তোমার ভালো থাকা বা না থাকাটা কারো ওপর নির্ভর না করে।
কাউকে ঘৃণা বা অপছন্দ করতে আসলে কোনো উদ্দেশ্য লাগে না
সার্বিয়ার এক সুন্দরী যুবতী, নাম মারিয়া আব্রামোভিচ, ১৯৭৪ সালে এক ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল পৃথিবীকে, একটি এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে। ওই এক্সপেরিমেন্টের নাম ছিল রিদম জিরো। লোকজনে ভর্তি একটি রুমের ভিতর মারিয়া স্ট্যাচুর মতোন দাঁড়িয়ে ছিল। সামনে টেবিলে রাখা অপ্রাসঙ্গিক, অগুরুত্বপূর্ণ, একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কহীন বাহাত্তরটি জিনিস — লিপস্টিক, কেক, ছুরি, কাঁচি, গোলাপ, পিস্তল সহ আরো অনেক কিছু। বলা হয়েছিল, রাত আটটা থেকে দুইটা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টা মানুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে মারিয়ার সঙ্গে। অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর ছিল মারিয়ার। প্রথম আড়াই ঘণ্টা মারিয়াকে ফুল দিয়েছিল মানুষ। চুল আঁচড়ে দিয়েছিল, ভালোবেসেছিল।
সময় যতই গড়াল, লোকজন ততই হিংস্র হয়ে উঠল। শেষ দুই ঘণ্টায় মারিয়াকে থাপ্পড় মারা হয়, পরনের জামাকাপড় ছিঁড়ে নগ্ন করে ফেলা হয়, ছুরি দিয়ে শরীরে আঘাত করা হয়, এমনকি শেষদিকে একজন পিস্তল নিয়ে মারিয়ার গলা চেপে ধরে ট্রিগার টানতে যাচ্ছিল প্রায়!
মারিয়া কি ওদের কোনো ক্ষতি করেছিল? ওদের কারোর জায়গা জমি নিজের বলে দাবি করেছিল? ওদের কাউকে মারধর করেছিল? কারো সাথে প্রতারণা করেছিল? সে তো কাউকে চিনতও না। কিন্তু ওরা মারিয়াকে থাপ্পড় মেরেছিল, গায়ে থুথু ছিটিয়েছিল, পরনের পোশাক ছিঁড়ে ফেলেছিল, একের পর এক আঘাতে করেছিল ক্ষতবিক্ষত! এক্সপেরিমেন্ট শেষে মারিয়া যখন হেঁটে চলে যাচ্ছিল, তখন তাকে অপমান করা একটি লোকও চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না তার, লজ্জায়।
১৯৯৮ সালে জার্মানিতেও প্রায় একই রকম একটি ঘটনা ঘটে। চৌদ্দজন লোককে স্বেচ্ছায় টাকার বিনিময়ে একটি সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করা হয় যার নাম ছিল দাস এক্সপেরিমেন্ট। এরপর ওই লোকগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ওদের কাছে সময় পনের দিন। এই পনের দিন ওদের একভাগ কারাগারের কয়েদি হিসেবে অভিনয় করবে, বাকিরা থাকবে কারাগারের গার্ড। সবার অজান্তে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে পরিস্থিতি মনিটর করা হবে। শর্ত ছিল, কোনো গার্ড কোনো কয়েদিকে শারীরিকভাবে আঘাত করতে পারবে না। অর্থাৎ কোনরকম ভায়োলেন্স অ্যালাউড না।
প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও ২ দিন পার হওয়ার আগেই গার্ডরা কয়েদিদের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করা শুরু করে। শেষদিকে তো পুরো এক্সপেরিমেন্টেরই বারোটা বেজে যায়।
লক্ষ্য করুন, ওরা জানে ওরা কেউই আসল গার্ড নয়। যারা কারাগারে বন্দি, তারাও সত্যিকারের কয়েদি নয়। ওদের শুধু অভিনয় করতে বলা হয়েছে কয়েকটা দিনের জন্য। অথচ বাহাত্তর ঘন্টা পার হওয়ার আগেই শুধুমাত্র বন্দিদের ওপর নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার জন্য ওরা কারাগারের লাইট অফ করে, গ্যাস ছেড়ে, কয়েদিদের জামাকাপড় খুলে উলঙ্গ করে শোয়ার একমাত্র বিছানাটাও বের করে নেয় যাতে কেউ ঘুমাতে না পারে। শুধু তাই নয়, সময় গড়ানোর সাথে সাথে গার্ডের দল কয়েদিদের হাত পা বেঁধে নির্যাতন করে, তাদের মুখের ওপর প্রস্রাব করে, এক নারী কয়েদিকে ধর্ষণের চেষ্টা করে এবং এমনকি একজনকে মেরে ফেলেছিল প্রায়!
মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করলে আপনি জানতে পারবেন, মানুষ অন্যকে ঘৃণা করে, অপছন্দ করে, হত্যা করে নানা কারণে। ওর বুদ্ধি বেশি, আমার কম কেন? ওর টাকা বেশি, আমার কম কেন? ওর সম্মান বেশি, আমার কম কেন?
রিদম জিরো এবং দাস এক্সপেরিমেন্ট আপনাকে শেখাবে কাউকে ঘৃণা বা অপছন্দ করতে আসলে কোনো উদ্দেশ্য লাগে না। মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই আরেকজনকে হিংসা করে, তার ক্ষতি করে, তার নামে বদনাম রটায় — কেননা মানুষের স্বভাবই অমন। মানুষ কোনোদিনই শান্তিকামী ছিল না, নয় এবং থাকবেও না। মানুষ সবসময়ই হিংস্র, লোভী, ভণ্ড, বর্বর এবং স্বার্থপর। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই পৃথিবীতে কি সত্যিকারের ভালো মানুষ বলে কিছু নেই? হ্যাঁ আছে — হাতেগোনা অল্পকিছু। বাকিরা, যাদেরকে আপনি ভালো বলে মনে করেন, তারা মূলত সুযোগের অভাবে ভালো।
প্রকৃত মূল্য
এটি একটি ১,০০০ গ্রাম লোহার বার, কাঁচামাল হিসেবে যার মূল্য মাত্র ১০০ ডলার।
যদি আপনি এটাকে ঘোড়ার খুর বানাতে ব্যবহার করেন, এর মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০ ডলার।
সেলাইয়ের সূঁচ তৈরি করলে এর মূল্য হয় প্রায় ৭০,০০০ ডলার।
ঘড়ির স্প্রিং ও গিয়ার তৈরি করলে এর মূল্য পৌঁছে যায় ৬ মিলিয়ন ডলারে।
আর এটাকে যদি উন্নত প্রযুক্তির লেজার উপাদানে রূপান্তর করা হয়, যা কম্পিউটার চিপ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, তখন এই একই লোহার বারের মূল্য দাঁড়ায় ১৫ মিলিয়ন ডলার।
আপনার প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হয় আপনি কি দিয়ে তৈরি তার মাধ্যমে নয়, বরং আপনি কীভাবে আপনার দক্ষতাকে বিকশিত করেন এবং তা প্রয়োগ করেন, তার উপর।
দাম বাড়াতে হলে তোমাকে সঠিক জায়গা খুঁজে বের করতে হবে
এক ব্যক্তি তার ছেলেকে ডেকে বললেন, যাও, আমাদের পুরাতন গাড়িটা বিক্রি করে এসো!
ছেলে ফিরে এসে বলল, বাবা, গাড়ির দাম বলছে ৩০ হাজার টাকা!
বাবা বললেন, অন্য দোকানির কাছে যাও।
ছেলে ফিরে এসে বলল, বাবা উনি তো আরো কম বলছেন, ২০ হাজার।
বাবা বললেন, অন্য কোনো দোকান দেখো না!
ছেলে এবার গেল একটা এন্টিকের দোকানে। দোকানি গাড়ি দেখে হতবাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার গাড়ি! তিনি গাড়ির দাম দিতে চাইলেন ৩০ লাখ টাকা!
বাবা সব শুনে বললেন, শোনো বাবা, জীবনে তোমাকে সবাই সমান দাম দেবে না! নিজের দাম বাড়াতে হলে তোমাকে সঠিক জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো এমন কাউকে পাবে যে তোমার আসল মূল্য বুঝবে! যে বুঝবে সেই তোমার প্রকৃত বন্ধু। আর বাকিরা হলো দরকারের সঙ্গী! দরকারের সঙ্গীসহ সবাইকেই সঙ্গ দিও, বিশ্বাস করো কেবল তাকে যে তোমার মূল্য বোঝে।
আলেকজেন্ডারের তিনটি ইচ্ছা
মৃত্যুশয্যায় মহাবীর আলেকজেন্ডার তার সেনাপতিদের ডেকে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার তিনটি ইচ্ছা পূরণ করবে।
আমার ১ম ইচ্ছা হচ্ছে:
শুধুমাত্র আমার চিকিৎসকরাই আমার কফিন বহন করবেন।
আমার ২য় ইচ্ছা হচ্ছে:
আমার কফিন যে পথ দিয়ে যাবে সেই পথে আমার অর্জিত সকল সোনা, দামি রত্ন, ধন সম্পদ ছড়িয়ে দিবে।
আমার ৩য় এবং শেষ ইচ্ছা হচ্ছে:
কফিন বহনের সময় আমার দুই হাত কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখবে।
তার সেনাপতি তখন এই বিচিত্র অভিপ্রায়ের কারণ জানতে চাইলেন।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলেকজান্ডার বললেন, আমি দুনিয়ার সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই।
১. আমার চিকিৎসকদের কফিন বহন করতে বলেছি এই কারণে, যাতে লোকে বুঝতে পারে যে চিকিৎসক মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে না। তারা ক্ষমতাহীন আর মৃত্যুর থাবা থেকে রক্ষা করতে অক্ষম।
২. যাবার পথে সোনা-দানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি এই কারণে, সোনা-দানার একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি, কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। মানুষ বুঝুক এসবের পেছনে ছোটা মানে সময়ের অপচয়।
৩. কফিনের বাইরে আমার দুই হাত ঝুলিয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে বুঝানোর জন্য যে, পৃথিবীতে আমি খালি হাতে এসেছিলাম আর আজ পৃথিবী থেকে খালি হাতেই বিদায় নিচ্ছি।
ছোট ছোট ভুল বোঝাবুঝি
মানুষ কখনও পাহাড়ে হোঁচট খায় না, হোঁচট খায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইট পাথরের টুকরাতে। পাহাড়ের মতো বিশাল কিছুর সামনে আমরা সতর্ক থাকি, প্রস্তুত থাকি। কিন্তু ইট পাথরগুলো আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, যে কারণে প্রায়ই আমরা ইট পাথরে পা হড়কে পড়ে যাই।
জীবনের মতোই, সম্পর্কের পথও এরকমই। একটি সম্পর্ক – সেটা প্রেম, বন্ধুত্ব, দাম্পত্য কিংবা পারিবারিক যাই হোক না কেন – কখনোই বড় কোনো ইস্যুতে ভেঙে পড়ে না। সম্পর্ক ভাঙে ছোট ছোট ভুল বোঝাবুঝি, অবহেলা, না বলা কথার ভেতরে জমে থাকা কষ্ট, কিংবা সময়মতো একটুখানি মনোযোগ না দেওয়ার কারণে। এই ছোট ছোট অপ্রাপ্তিগুলো প্রথমে হয়ত তেমন একটা গুরুত্ব পায় না, কিন্তু দিনে দিনে সেগুলো জমতে জমতে পাহাড়ের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। একটা সময়ে গিয়ে যখন আর বোঝাপড়ার কোনো রাস্তা খোলা থাকে না, বিচ্ছেদ হয়ে ওঠে একমাত্র সমাধান।
আমরা অনেক সময় ভাবি, “এতো ছোট একটা বিষয়, ও এতটা রাগ করল কেন?” কিন্তু ওই ছোট্ট বিষয়টাই হয়ত তার কাছে বড় ছিল। হয়ত সে প্রতিদিন একটু কথা বলে হালকা হতে চেয়েছিল, হয়ত ও একটুখানি বেশি সময় চেয়েছিল, হয়ত আপনার কোনো একটা বাক্য বা অভিব্যক্তি তার মনে অনেক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। একটি ক্ষতের জন্য সবসময় বড় অস্ত্র লাগে না, ক্ষত গভীর হয় তখনই যখন অনুভূতির জায়গায় আঘাত লাগে।
তাই একটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে বড় কিছু করার প্রয়োজন পড়ে না। প্রয়োজন পড়ে ছোট ছোট যত্নের, সামান্য খেয়ালের, একটুখানি বোঝাপড়ার।
সময়মতো একটি মেসেজ, ক্লান্ত দিনে এক কাপ চা, কষ্টে থাকা মানুষটার পাশে নীরব উপস্থিতি, কিংবা কেবল মন দিয়ে তার মনের কথাগুলো শোনা — এই ছোট্ট ছোট্ট কাজগুলোই আজীবনের বন্ধন গড়ে তোলে।
সম্পর্ক মানে একে অপরের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে পারা। তার অনুভূতিকে তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। একটুখানি কেয়ার, একটুখানি সম্মান, একটুখানি গুরুত্ব দেওয়া, একটুখানি সহানুভূতি — এগুলোই একটি সম্পর্কের মেরুদণ্ড।
মনে রাখবেন, সম্পর্ক একটি সুন্দর বাগানের মতো। প্রতিদিন সেখানে একটু করে পানি দিতে হয়, আগাছা পরিষ্কার করতে হয়, খেয়াল রাখতে হয় সূর্যের আলো পড়ছে কিনা। অবহেলা করলেই তা শুকিয়ে যায়। তাই সম্পর্কের ছোট ছোট বিষয়গুলোকে অবহেলা নয়, বরং যত্নে আলিঙ্গন করা উচিত। কেননা, জীবনের সবথেকে বড় সুখ লুকিয়ে থাকে ওই ছোট ছোট খুঁটিনাটিতেই!
অনেক টাকার মালিক হওয়ার চেয়ে সুস্থ শরীর এবং দীর্ঘজীবন লাভ করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ
মৃত্যুর পরও ব্যাংকে আমাদের কত টাকা রয়ে যায়, অথচ বেঁচে থাকতে আমরা টাকা খরচ করি না। সেদিন এক ধনকুবের মারা গেলেন। বিধবা স্ত্রী মৃত স্বামীর ২০০ কোটি টাকার ওয়ারিশ হয়েই (স্বামীর) ড্রাইভারকে বিয়ে করে ফেলল। ড্রাইভার মনে মনে ভাবল, এতদিন জানতাম আমি আমার মালিকের জন্য কাজ করছি, এখন দেখি আমার মালিকই আমার জন্য শ্রম দিয়ে গেছেন!
নিরেট সত্যটি হচ্ছে, অনেক টাকার মালিক হওয়ার চেয়ে সুস্থ শরীর এবং দীর্ঘজীবন লাভ করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই অন্ধের মতো টাকার পিছনে না ছুটে সুস্থ জীবন যাপন করার চেষ্টা করা উচিত।
জীবনের নানা ঘটনা প্রবাহে আমার এই কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। যেমন:
১. দামি এবং অনেক ফাংশন ওয়ালা মোবাইল ফোনের ৭০%-ই অব্যবহৃত থেকে যায়।
২. একটি বিলাসবহুল ও দ্রুতগতি সম্পন্ন গাড়ির ৭০% গতি কখনোই দরকার হয় না।
৩. প্রাসাদতুল্য মহামূল্যবান অট্টালিকার ৭০% অংশে কেউ বসবাস করে না।
৪. আলমারি ভর্তি পোশাক পরিচ্ছদের বেশিরভাগই কোনোদিন পরা হয়ে ওঠে না।
৫. মানুষের সারা জীবনের পরিশ্রমলব্ধ অর্থ সম্পদের ৭০%-ই আসলে অন্যের জন্য। জমানো অর্থ যাদের জন্য আপনি রেখে যাবেন, আপনার জন্য বছরে একবার প্রার্থনা করার সময়ও তাদের হবে না।
তাহলে করণীয় কী?
১. অসুস্থ না হলেও নিয়ম করে মেডিকেল চেকআপ করান।
২. পিপাসার্ত না হলেও পানি পান করুন।
৩. কারো ওপর রাগ পুষে রাখবেন না। মানুষকে ক্ষমা করতে শিখুন।
৪. আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক জেনেও কখনো কখনো ছাড় দিন।
৫. যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন, মাঝে মাঝে সঙ্গীর সাথে নিরিবিলি কোথাও বসে গল্প করুন, বাইরে খেতে নিয়ে যান।
৬. ক্ষমতাবান হলেও বিনয়ী হোন।
৭. সুযোগ পেলেই পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ুন।
৮. ভালো ভালো বই পড়ুন, মজার মজার সিনেমা দেখুন, পছন্দের গান শুনুন।
৯. মাঝে মাঝে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, চাঁদের আলো, কুয়াশা, খোলা আকাশ দেখুন। বছরে একবার হলেও বৃষ্টিতে ভিজুন। আর দিনে অন্তত কিছুটা সময় গায়ে রোদ লাগান।
১০. টাকা-পয়সা কম থাকলেও তৃপ্ত থাকুন। মনে রাখবেন, পৃথিবীর অধিকাংশ ধনী লোক মানসিক অশান্তিতে থাকে।
সবশেষে বলি, জীবন তো একটাই, তাই মন খুলে বাঁচুন।
“ম্যাথম্যাটিক্স স্ট্যাক এক্সচেঞ্জার”
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। গণিত ক্লাস চলছে। প্রফেসর তার ছাত্রদের সামনে জটিল একটি গাণিতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন। ছাত্ররা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে, কিন্তু একজন ছাত্র, জর্জ ডান্টজিগ, ক্লান্তির কারণে ঘুমিয়ে পড়ে। সে হয়তো আগের দিন রাত জেগে পড়াশোনা করেছিল বা অন্য কোনো কারণে ক্লান্ত ছিল। যাই হোক, ক্লাসের বেশিরভাগ সময় সে ঘুমিয়ে কাটান। ক্লাস শেষ হওয়ার পর ছাত্রদের চেঁচামেচি আর হট্টগোলের শব্দে তার ঘুম ভাঙে। সে তাকিয়ে দেখে, ব্লাকবোর্ডে দুটো গাণিতিক সমস্যা লেখা রয়েছে। সে ধরে নেয়, এই সমস্যাগুলো পরের ক্লাসের জন্য হোমওয়ার্ক হিসেবে দেওয়া হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে সে সমস্যা দুটো খাতায় টুকে নেয় এবং ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়।
বাড়ি ফিরে জর্জ সমস্যা দুটির সমাধান করতে বসে। কিন্তু কিছুক্ষণ চেষ্টার পর সে বুঝতে পারে, এই সমস্যাগুলো অত্যন্ত জটিল এবং সমাধান করা মোটেই সহজ নয়। সাধারণ হোমওয়ার্কের মতো এগুলো সরল গাণিতিক সমীকরণ নয়। এগুলোর গভীরতা তাকে বিস্মিত করে। তবুও সে হাল ছাড়ে না। তার মধ্যে এক ধরনের জেদ কাজ করে। সে ভাবে, যেহেতু এগুলো হোমওয়ার্ক, তাই অবশ্যই সমাধানযোগ্য। এই বিশ্বাস তাকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।
জর্জ লাইব্রেরিতে ছুটে যায়। সে একের পর এক রেফারেন্স বই ঘাঁটতে থাকেন। গণিতের বিভিন্ন শাখা, তত্ত্ব এবং সমীকরণ নিয়ে পড়াশোনা করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয় লাইব্রেরির টেবিলে। তার মনের মধ্যে একটিই লক্ষ্য — এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতেই হবে। অবশেষে, অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সে একটি সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হন। দ্বিতীয় সমস্যাটি তার কাছে তখনও অমীমাংসিত থেকে যায়, কিন্তু প্রথম সমস্যার সমাধান তাকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়।
পরবর্তী ক্লাসে জর্জ তার সমাধান নিয়ে প্রফেসরের কাছে যায়। কিন্তু প্রফেসরের কাছে গিয়ে সে যা শোনে, তা তাকে হতবাক করে দেয়। প্রফেসর তাকে জানান, হোয়াইটবোর্ডে লেখা সমস্যা দুটি কোনো হোমওয়ার্ক ছিল না। বরং, ওগুলো ছিল গণিতের জগতে দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত দুটি জটিল সমস্যা। প্রফেসর সেদিন ক্লাসে আলোচনা করছিলেন গণিতের এমন কিছু সমস্যা নিয়ে, যেগুলো এখনো কেউ সমাধান করতে পারেনি। ওই সমস্যাদুটো ছিল উদাহরণ হিসেবে, যাতে ছাত্ররা বুঝতে পারে গণিতের জগত কতটা চ্যালেঞ্জিং।
জর্জের মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। সে ভেবেছিলে, এটি একটি সাধারণ হোমওয়ার্ক, কিন্তু বাস্তবে সে একটি অমীমাংসিত গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। সে প্রফেসরকে বলে, “কিন্তু আমি তো একটি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি।” প্রফেসর প্রথমে হয়তো বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু জর্জ যখন তার সমাধান দেখায়, তখন প্রফেসর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এই তরুণ ছাত্রটি এমন একটি কাজ করেছে, যা গণিতের জগতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে উঠতে পারে।
জর্জের ওই ঘটনা শুধুমাত্র একটি ক্লাসরুমের গল্পে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার সমাধানটি পরবর্তীতে প্যাটেন্ট করা হয় এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডকুমেন্টেড করা হয়। তার লেখা পেপারগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শিত হয়, যা আজও গণিতের ছাত্রদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। জর্জ ডান্টজিগের এই কৃতিত্ব গণিতের জগতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। সে সমাধান করেছিল এমন একটি সমস্যা, যা গণিতবিদদের মধ্যে বহুল প্রয়োজনীয় “ম্যাথম্যাটিক্স স্ট্যাক এক্সচেঞ্জার” হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
জর্জের এই সাফল্যের পিছনে আসল কারণটা হচ্ছে সে ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এই ঘুমের কারণে সে প্রফেসরের সেই কথাগুলো শুনতে পায়নি যে, “এই সমস্যাগুলো এখনও কেউ সমাধান করতে পারেনি।” সে জানত না যে ওগুলো অমীমাংসিত সমস্যা। তার মনে ছিল একটি সরল বিশ্বাস: এটি একটি হোমওয়ার্ক এবং এটি সমাধান করা সম্ভব। এই বিশ্বাস তাকে ভয়, উদ্বেগ বা নেতিবাচক চিন্তা থেকে মুক্ত রেখেছিল। সে নিজের যোগ্যতার উপর ভরসা রেখে এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছিল।
এই গল্প থেকে আমরা শিখতে পারি যে, আমাদের মধ্যে অনেক সময় সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু আমরা নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ করে ফেলি। “এটা অসম্ভব,” “আমি পারব না,” “এটি খুব কঠিন” — এই ধরনের নেতিবাচক চিন্তা আমাদেরকে পিছিয়ে দেয়। জর্জের গল্প আমাদের শেখায়, আমরা যদি নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখি এবং লক্ষ্যে অটল থাকি, তাহলে অসম্ভব বলে কিছু নেই।
জর্জ ডান্টজিগের এই গল্পটি কেবল গণিতের জগতের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য একটি শিক্ষা। আমরা প্রায়ই জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, যখন মনে হয় আমাদের সামনে আর কোনো আশা নেই। কিন্তু জর্জের মতো যদি আমরা এই ধারণা পোষণ করি যে সমস্যাটি সমাধানযোগ্য, তাহলে আমরা সফল হতে পারি। এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাগুলো তখনই প্রকাশ পায়, যখন আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে যাই।
নিজকে পুনরুত্থান করুন
বাজ পাখি প্রায় ৭০ বছর বাঁচে। কিন্তু মাত্র ৪০ বছর পার করার পরই বাজ পাখিকে বাঁচার জন্য কয়েকটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
ওই সময় তার শরীরের তিনটি প্রধান অঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়ে।
১. তার পায়ের নখ নরম হয়ে যায়। ফলে শিকার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
২. ঠোঁট সামনের দিকে মুড়ে যায়। যে কারণে খাবার খুঁটে বা ছিঁড়ে খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
৩. ডানা ভারী হয়ে বুকের কাছে আটকে যাওয়ার দরুন ওড়াড় ক্ষমতাও সীমিত হয়ে যায়। ফলস্বরূপ শিকার খোঁজা, ধরা এবং খাওয়া তিনটেই ধীরে ধীরে মুশকিল হয়ে পড়ে।
তখন ওর কাছে তিনটে পথ খোলা থাকে।
১. আত্নহত্যা
২. শকুনের মতো মৃতদেহ খাওয়া
৩. নিজকে পুনরুত্থান করা।
বাজ পাখি তখন একটা উঁচু পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে বাসা বাঁধে আর শুরু করে নতুন প্রচেষ্টা।
সে প্রথমে তার ঠোঁট বারবার পাথরে আঘাত করে ভেঙে ফেলে। এর থেকে কঠিন যন্ত্রণার কিছু আর হয় না।
একইরকমভাবে নখগুলো উপড়ে ফেলে আর অপেক্ষা করে নতুন নখ ও ঠোঁট গজানোর।
নখ আর ঠোঁট গজালে সে অসহনীয় ব্যথা সহ্য করে ডানার সমস্ত পালক ছিঁড়ে ফেলে আর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে নতুন পালকের জন্য।
দীর্ঘ ১৫০ দিনের যন্ত্রণা আর প্রতীক্ষার পর সে সবকিছু নতুন করে পায়। ফিরে পায় আবার সেই লম্বা উড়ান দেওয়ার ক্ষমতা এবং ক্ষিপ্রতা। এরপর সে আরো ৩০ বছর জীবিত থাকে আগের মতোই শক্তি ও সামর্থ নিয়ে।
মেয়েরা কেবল মানিয়ে নেওয়ার জন্যই জন্মায়?
ছোটবেলায় মেয়েটি তার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “মা, আমার স্বাধীনতা কোথায়?”
মা তখন হাসিমুখে বলেছিলেন, “এখন তো তুই বাবা মায়ের ঘরে থাকিস। বিয়ে হয়ে গেলে নিজের ঘর হবে, তখন যা ইচ্ছে তাই করবি, তখন বুঝবি স্বাধীনতার মানে কি!”
দিন কেটে গেল, বিয়েও হয়ে গেল। এক ভোরবেলা জানলার ধারে বসে মেয়েটি তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “মেয়েদের কি সত্যিই স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না? একটু নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার নেই?”
জবাবে স্বামী শান্ত গলায় বললেন, “বিয়ের আগে যা ইচ্ছে তাই করেছ, এখন আর সেসব হবে না। এখন সংসার আছে, লোকলজ্জার ভয় আছে। আগে ছেলেমেয়ে মানুষ করো, তারপর যা ভালো লাগে করো।”
সময় গড়াতে গড়াতে মেয়েটির ছেলের বয়স আজ বত্রিশ। সংসার হয়েছে, ছেলেমেয়েও আছে।
মেয়েটি একদিন কথাচ্ছলে তার ছেলেকে বলল, “বাবা, বলতে পারিস, মায়েদের স্বাধীনতা কোথায় গেল?”
ছেলে গম্ভীর মুখে বলল, "তোমার কি সেই বয়স আছে মা, যা মন চায় করবে? এখন তোমাকে একটু আমাদের মতো করে চলতে হবে।”
মেয়েটি নির্বাক হয়ে গেল। বুকের ভেতরটা ভারি হয়ে এল। সে বুঝল, এই পৃথিবীতে মেয়েরা কেবল মানিয়ে নেওয়ার জন্যই জন্মায়। তারা নিজের সুখ আহ্লাদ গুটিয়ে রেখে ঘর বাঁচাতে, সম্পর্ক বাঁচাতে, সমাজের মুখ রক্ষা করতে করতে, আস্তে আস্তে মরে যায়, বেঁচে থেকেও। স্বাধীনতা তাদের হাতে কখনোই আসে না, এক জীবনের বিনিময়ে কেবল অন্যের চাওয়াগুলোই পূরণ করে যেতে হয়।
৭টি গোপন সত্য
এই খেলাটা শুধুই তাদের জন্য, যারা ভাঙতে চায় শিকল, পাল্টাতে চায় নিজের জীবন। ৭টি গোপন সত্য আপনি যদি মনপ্রাণ দিয়ে কাজে লাগান, তাহলে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন একজন কোটিপতি:
১. ধনীরা কখনো টাকা নিয়ে নিজের সময় বিক্রি করে না, তারা বরং টাকা দিয়ে লোকের সময় কিনে নেয়।
আপনি যখন সকাল সন্ধ্যা চাকরি করে বেতন নেন, তখন তারা এমন একটা সিস্টেম বানায় যা ২৪/৭ ফর্মুলায় কাজ করে। তাদের ঘুমের মধ্যেও স্রোতের মতো টাকা আসতে থাকে। সময় সীমিত, কিন্তু সিস্টেম সীমাহীন — পার্থক্যটা বোঝার চেষ্টা করুন!
২. ঋণ খারাপ নয়, মূর্খতা খারাপ।
ধনীরা “ভালো ঋণ” দিয়ে সাম্রাজ্য বানায়: প্রপার্টি, যন্ত্রপাতি, বিজনেস ক্যাপিটাল ইত্যাদি। আর আপনি “খারাপ ঋণ” নিয়ে দেখান: আইফোন, নাইটক্লাব, গাড়ি এইসব হাবিজাবি। মনে রাখবেন, ঋণ যদি টাকা না আনে, সেটা একধরনের দাসত্ব।
৩. ৯:০০–৫:০০ খেতে পড়তে দেবে, কিন্তু মালিকানা আপনাকে মুক্তি দেবে।
তারা চাকরির আয় দিয়ে বিজনেস শুরু করে। আর আপনি সেই আয় দিয়ে শো-অফ করেন। একদিকে গড়ে উঠে সাম্রাজ্য, আরেকদিকে জমে ঋণ। টাকা ইনভেস্ট করতে শিখুন — যেটুকু আছে, সেটুকু দিয়েই শুরু করুন, আজই শুরু করুন।
৪. তাদের নেটওয়ার্কই তাদের সম্পদ।
তারা কখনো হতাশ, নেগেটিভ মানুষের সঙ্গে সময় কাটায় না। প্রত্যেক বন্ধু আপনাকে কিছু না কিছু দেয়: জ্ঞান, যোগাযোগ, মূলধন ইত্যাদি। যদি আপনার আশেপাশের লোকেরা আপনাকে পজিটিভ কিছু না দিয়ে উল্টো আপনার শক্তি খেয়ে ফেলে, এখনই তাদেরকে মাইনাস করুন।
৫. নীরবতাই ধনীদের কৌশল।
তারা ঢাকঢোল বাজায় না। তারা ছায়ার মতো চলে, বজ্রের মতো আঘাত হানে। আপনি যখন সোশাল মিডিয়ায় ফেক লাইফ দেখান, তারা তখন জমি, শেয়ার আর ব্যবসা কিনে নেয়। তাই নীরবে কাজ করুন, আপনার গোপনীয়তা একদিন ঝড় তুলবে।
৬. ধনীরা আর্থিক শিক্ষায় সময় ব্যয় করে।
তারা বই পড়ে, কোর্স করে, মোটিভেশনাল ভিডিও দেখে, মাস্টারমাইন্ড সেট করে। আর আপনি? রিলস্ আর পর্ণ দেখেন। আজকের দিনে তথ্যই নতুন টাকা। হয় শিখুন, নইলে আজীবন গরীব থাকুন!
৭. তারা বিক্রি করে।
প্রতিটা মিলিয়নিয়ারই বিক্রেতা। কেউ পণ্য বিক্রি করে, কেউ ব্র্যান্ড, কেউ সার্ভিস, কেউ স্কিল। তারা প্রত্যেক মুহূর্তে নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ায়। এর মাধ্যমে তারা মানুষের আগ্রহ ধরে রাখে। আপনি যদি নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াতে না পারেন, তাহলে কে আপনাকে গুরুত্ব দেবে?
সবশেষে বলি, ধনী হওয়া ব্যাপারটা কোনো কাকতালীয় বা ভাগ্যনির্ভর ঘটনা নয়। এটা একটা মাইন্ডসেট আর কিছু ভালো অভ্যাসের ফলাফল। ধনীরা টাকার গাছ লাগিয়ে ধনী হয় না, তবে তারা এমন একটা সিস্টেম গড়ে তোলে যা টাকার গাছের মতোই ফল দেয়। আপনি যদি ৭টি ট্রিকস্ যেগুলোর কথা আমি বললাম, আজ থেকেই অনুসরণ করেন, তাহলে ধনী হওয়াটা আপনার জন্য শুধুই সময়ের অপেক্ষা।
শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন
বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন পড়ালেখায় খুব দুর্বল ছিলেন। একবার স্কুলের পরীক্ষায় তিনি একেবারেই ভালো করতে পারেননি।
রেজাল্টের দিন তার হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে হেডমাস্টার বললেন, "চিঠিটা খুলো না। সোজাসুজি বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে দেবে।"
এডিসন তাই করলেন আর কৌতূহলবশত মায়ের কাছে জানতে চাইলেন, "মা, চিঠিতে কি লেখা আছে?"
মা মৃদু হেসে ছেলেকে শুনিয়ে জোরে জোরে চিঠিটি পড়লেন, "আপনার পুত্র খুব মেধাবী। এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। অনুগ্রহ করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।"
তারপর থেকে এডিসন মায়ের কাছেই শিক্ষা গ্রহণ করা শুরু করলেন। কালক্রমে তিনি হয়ে উঠলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। আবিষ্কার করলেন পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়া ইলেকট্রিক বাল্ব। কিন্তু ছেলের এই সাফল্য নিজের চোখে দেখার জন্য তখন তার মা আর বেঁচে নেই।
হঠাৎ একদিন পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে ভাঁজ করা একটা কাগজের দিকে এডিসনের চোখ আটকে গেল। তিনি কাগজটি হাতে নিয়ে খুলে দেখলেন সেটা সেই ছোটবেলার স্কুলের চিঠি। চিঠিতে লেখা ছিল, "আপনার সন্তান স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন এবং মেধাহীন। সে এই স্কুলের উপযুক্ত নয়। আমরা কোনোভাবেই তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না।"
পড়তে পড়তে এডিসনের চোখ ভিজে গেল। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়তে লাগল তার। তখনই তিনি ডায়েরিতে লিখলেন:
টমাস আলভা এডিসন ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ এবং জড়বুদ্ধিসম্পন্ন শিশু, কিন্তু তার মা তাকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
পাশের ঘরে আগুন লাগলে কখনো নিরাপদ নয়
তিনটি ষাঁড় ছিল: সাদা, লাল এবং কালো। তারা সারাদিন একসাথে চড়ে বেড়াত। একদিন একটি সিংহ লাল ও সাদা ষাঁড়কে ডেকে বলল, "তোমরা যদি আমাকে কালো ষাঁড়টি খেতে বাধা না দাও, তাহলে আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না!"
ষাঁড় দুটি স্বার্থপরের মতো সিংহের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। সিংহটি তখন নির্বিঘ্নে কালো ষাঁড়টি খেয়ে নিল।
কিছুদিন পর সিংহ ফিরে এলো এবং সাদা ষাঁড়কে বলল, "তুমি যদি আমাকে লাল ষাঁড়টি খেতে বাধা না দাও, তাহলে তোমার কোনো ক্ষতি করব না।" সাদা ষাঁড়টি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল, যখন তার দ্বিতীয় সঙ্গীকে খাওয়া হচ্ছিল।
এর কিছুদিন পর সিংহ যখন আবার ফিরে এলো, সাদা ষাঁড়টি তখন সঙ্গীবিহীন, একা৷ সিংহ তাই বিনা প্রতিরোধে তাকে খেয়ে ফেলল। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সাদা ষাঁড়টি তখন আপন মনে বলল, "আমাকে তো সেদিনই মেরে ফেলা হয়েছে, যেদিন কালো ষাঁড়টিকে খাওয়া হয়।"
শিক্ষা: বন্ধুর বিপদে পাশে না দাঁড়ালে আপনিও বাঁচতে পারবেন না।
অ্যান্টিভেনম তৈরি
বিষধর সাপ কামড়ালে যেখানে হাতি পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, সেখানে এমন একটা প্রাণী আছে যার কিছুই হয় না। প্রাণীটির নাম ঘোড়া। সাপের ছোবল খেলে ঘোড়া ৩ দিন পর্যন্ত ঝিম মেরে পড়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। আর ওই সাপে কাটা ঘোড়ার রক্ত থেকে প্রস্তুত করা হয় সাপের বিষের প্রতিষেধক "অ্যান্টিভেনম"।
কোনো বিশেষ প্রজাতির সাপ যেমন রাসেল ভাইপারের অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে চাইলে ওই সাপের বিষ ঢুকিয়ে দিতে হয় ঘোড়ার শরীরে । বিষের পরিমাণ বেশি হলেও সমস্যা নেই, ঘোড়ার কিছু হবে না! কিছু হবে না বলতে ঘোড়া মারা যাবে না। কামড় খাওয়ার ৩ দিন পর ঘোড়া পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে। এই ৩ দিনে ঘোড়ার রক্তে ওই সাপের বিষের অ্যান্টিভেনম তৈরি হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা ঘোড়ার শরীর থেকে খানিকটা রক্ত নিয়ে রক্তের লাল অংশ আলাদা করেন। পড়ে থাকা সাদা অংশ অর্থাৎ ম্যাট্রিক্স থেকে তৈরি হয় অ্যান্টিভেনম যা সাপে কামড়ানো মানুষের শরীরে সরাসরি ইনজেকশন দিয়ে পুশ করা হয়।
এই মুহূর্তে পৃথিবীতে গাদা গাদা অ্যান্টিভেনম প্রস্তুতকারক কোম্পানি আছে। পালের পর পাল ঘোড়া তাদের মূল সম্বল। ঘোড়া না থাকলে সাপের কামড় খেয়ে মানুষের আর বাঁচা লাগত না। এক ছোবলে ডাইরেক্ট পরপারের টিকিট!
কন্যাসন্তান আসলে মায়েরই আরেক রূপ
অনেক দিন আগের কথা। ইতালির রোম নগরীতে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছিল। শহরের প্রহরীরা সিমন নামে এক বৃদ্ধকে রুটি চুরির অভিযোগে আটক করে। বিচারে সিমনকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। মৃত্যুবরণ না করা পর্যন্ত অনাহারে কারারুদ্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয় তাকে।
বৃদ্ধের যুবতী মেয়ে পেরো বাবার এই নিষ্ঠুর পরিণতি মেনে নিতে পারেনি। সে পোশাকের ভেতর খাবার লুকিয়ে দেখা করতে যায় তার বাবার সাথে। কিন্তু কারারক্ষীরা তার দেহ তল্লাশি করে খাবারগুলো কেড়ে নেয়। আর তাকে এই বলে সতর্ক করে যে, এরপর যদি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে তাকে আর তার বাবার সাথে দেখা করতে দেওয়া হবে না!
পিতা অন্তঃপ্রাণ পেরো ভিতরে গিয়ে দেখে তার বাবার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। ক্ষুধা তৃষ্ণায় ছটফট করছেন তিনি। এমন করুণ দৃশ্য দেখার পর সদ্য মা হওয়া পেরো আর সহ্য করতে পারে না। বাবাকে বাঁচাতে তখনই নিজের বুকের দুধ পান করায় পেরো। এতে কিছুটা বল ফিরে পায় বৃদ্ধ।
বাবার জীবন রক্ষা করার তীব্র আকুলতা থেকে দিনের পর দিন এই কাজ করে যেতে থাকে পেরো। এদিকে দীর্ঘদিন অভুক্ত থাকার পরও সিমন কেন মারা যাচ্ছে না তা সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। অবশেষে একদিন হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় পেরো।
কালবিলম্ব না করে উভয়কে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। বিচারসভায় রোমের বিচারকগণ পুরো ঘটনা জেনে চরম বেদনা অনুভব করেন। ব্যাপারটিকে তারা মানবতার এক অনন্য এক দৃষ্টান্ত বলে রায় দেন। রায়ের পর শাসকগোষ্ঠীর মনে মানবতাবোধ জাগ্রত হয়। এরপর পেরো এবং তার বাবাকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। হৃদয় নাড়া দেওয়া এই ঘটনা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এত বছর পর আজও একটি মেয়ের তার বাবার প্রতি ভালোবাসা কতটা গভীর তার আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয় পেরোকে। এবং সেই থেকে এই কথাটিও সর্বজন স্বীকৃত হয়ে যায় যে, কন্যাসন্তান আসলে মায়েরই আরেক রূপ!
যদি জীবনে সফল হতে চাও, তবে বন্ধনগুলো ছিঁড়ে ফেলো না।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর ছেলে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, "বাবা, সফল জীবন কাকে বলে?"
জবাবে বাবা বললেন, "চলো, আজ আমরা ঘুড়ি ওড়াব। তখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবো।"
ছেলে অবাক হয়ে বলল, "কি বলছেন বাবা, এই বয়সে আপনি ঘুড়ি ওড়াবেন?"
মাঠে কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। বাবা তাদের একজনের কাছ থেকে ঘুড়িটা চেয়ে নিলেন। বাবা নাটাই থেকে সুতা ছাড়ছেন আর ছেলে সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ঘুড়ি বেশ খানিকটা উপরে উঠে যাবার পর বাবা বললেন, "ওই দেখো, ঘুড়িটা অতো উঁচুতেও কেমন বাতাসে ভেসে আছে। তোমার কি মনে হচ্ছে না এই সুতার কারণে ঘুড়িটা আরো উপরে যেতে বাধা পাচ্ছে?"
ছেলে বলল, "তা ঠিক, সুতা না থাকলে ওটা আরও উপরে উঠতে পারত!"
বাবা আলগোছে সুতাটা কেটে দিলেন। ঘুড়িটা সুতার টান থেকে মুক্ত হয়েই প্রথমে কিছুটা উপরে উঠে গেল, কিন্তু একটু পরেই নিচের দিকে নামা শুরু করল এবং নামতে নামতে দূরে গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এবার বাবা ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে বোঝালেন, "শোনো খোকা, জীবনে আমরা যে পর্যায়ে বা উচ্চতায় আছি বা থাকি, সেখানে প্রায়ই আমাদের মনে হয় ঘুড়ির সুতার মতো কিছু কিছু বন্ধন আমাদের উপরে ওঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে। যেমন ঘর, মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, অনুশাসন ইত্যাদি। আর আমরাও মাঝে মাঝে সেইসব বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চাই। বাস্তবে ওই বন্ধনগুলোই আমাদেরকে উঁচুতে টিকিয়ে রাখে, স্থিরতা দেয়, নিচে পড়তে বাধা দেয়। ওই বন্ধনগুলো না থাকলে আমরা হয়তো ক্ষণিকের জন্য কিছুটা উপরে উঠতে পারি, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের পতন হবে ওই বিনা সুতার ঘুড়ির মতোই।"
বাবা বলে চললেন, "তুমি যদি জীবনে সফল হতে চাও, তবে কখনোই ওই পিছুটান বা বন্ধনগুলো ছিঁড়ে ফেলো না। সুতা আর ঘুড়ির মিলিত বন্ধন যেমন আকাশে ঘুড়িকে ভারসাম্য দেয়, তেমনি সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনগুলো আমাদের সাফল্যের শিখরে টিকে থাকার শক্তি দেয়। আর এটাই প্রকৃত সফল জীবন।"
রূপচর্চায় কম, যোগ্যতা অর্জনে বেশি সময় দিন
ফ্লার্ট করা ছেলেদের থেকে ১০০ হাত দূরে থাকুন। আপনি যতটুকু প্রশংসার যোগ্য তার চেয়ে বেশি প্রশংসা যখন কেউ আপনাকে করে, তার সম্পর্কে সাবধান হয়ে যান। ভালো ছেলেগুলো সাধারণত খুব একটা স্মার্ট হয় না। তারা হয়তো একটু বোরিং হয়, তবে তারা কখনও চিট করে না। অন্যদিকে, ফ্লার্ট করা পুরুষ এ্যাট্রাকটিভ হলেও কথার ফাঁদে ফেলে মেয়েদের সর্বনাশ করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। এজন্য চেহারা নয়, চরিত্রের প্রেমে পড়ুন।
সবসময় নিজের গাট ফিলিংসকে প্রাধান্য দিন। দেখে খারাপ মনে হয় না, কিন্তু মন থেকে কেন জানি লোকটাকে পছন্দ হয় না - এমন হলে সেই ব্যক্তি থেকে দূরে থাকুন।
আপনি কালো, শর্ট, মুখে ব্রণ - এগুলা কিচ্ছু না। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে যেভাবে বানিয়েছেন আপনি সেভাবেই সুন্দর। আপনার মেধা আর যোগ্যতা দেখে যেন একটা ছেলে আকৃষ্ট হয়, নিজেকে সেভাবে তৈরি করুন। নিজেকে সুন্দর দেখানোর বাসনা মেয়েদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। রূপচর্চায় কম, যোগ্যতা অর্জনে বেশি সময় দিন।
চোখ বন্ধ করে কাউকে বিশ্বাস করবেন না। (গণহারে ট্রাস্ট এর কথা বলছি, ট্রাস্টওয়ার্দি ম্যান অবশ্যই আছে) বাবার অফিসের কলিগ, মামার পরিচিত, বড় ভাইয়ের বন্ধু, একদম ফ্যামিলি পারসন, মহাপুরুষ টাইপের লোক - এরকম কারো সাথে একা কোথাও থাকবেন না। মনে রাখবেন, মেয়েরা কাছের মানুষদের দ্বারা সে*ক্সুয়ালি অ্যা*বিউজ হয় সবচেয়ে বেশি।
কারো বাসায় যেতে হলে পরিবারকে জানিয়ে যাবেন। যেখানে যাচ্ছেন সেখানকার ঠিকানা, ফোন নাম্বার মা, বাবা, বড় ভাই বা বোনকে দিয়ে যান। এবং অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরে আসুন। পরিবারের সদস্যদের ছাড়া কোথাও রাত কাটাবেন না।
বাবা-মাকে বন্ধু বানান। তাদের কাছে কোনোকিছু গোপন করবেন না বা তাদের অজান্তে কোনো কাজ করবেন না। নিজের সিক্রেট কথাগুলো পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কারো সাথে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন। মনের কথা কাউকে বলে হালকা হতে চাইলে শ্রোতা হিসেবে ফ্যামিলি মেম্বারদের বেছে নিন।
কারো সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে বা কাউকে বিশ্বাস করার আগে ১০০ বার ভাবুন। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, ১০০ বার।
নিজের আবেগ সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখুন। মেয়েরা আবেগের কারণে ভিকটিম হয়।
সব সময় সৎ পথে থাকবেন। খারাপ পথগুলো সহজ, অনেক বেশি আনন্দ দেয়, কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। সঠিক পথ আপনাকে দেবে নিরাপত্তা, তা যত কষ্টেরই হোক না কেন।
উন্নয়ন হলো চেষ্টা এবং ভুলের একটি সমন্বিত পক্রিয়া
কথায় আছে, মাঝে মাঝে ভুল বলো, না হলে তুমি বুঝতে পারবে না লোকে তোমার কথা শুনছে কিনা! মাঝে মাঝে ভুল লিখো, তাহলে যে তোমার ফেসবুকে জীবনেও কমেন্ট করবে না বলে পণ করেছে, সেও কমেন্ট করবে।
স্ট্যাসি বালিসের "How to change a life" বইটি দ্বিতীয় সংস্করণে নামের ভুলে "How to change a wife" হয়ে বের হয়েছিল। পরেরটা ইতিহাস। নামের ভুলের কারণে বইটি বেস্ট সেলার হয়ে যায়!
দুধ খারাপ হলে দই হয়ে যায়। দই কিন্তু দুধের চেয়ে দামি। যদি এটা আরো খারাপ হয়, এটা পনির হয়ে যায়। দই এবং দুধের চেয়ে পনিরের মূল্য অনেক বেশি।
আঙুরের রস টক হলে তা ওয়াইনে রূপান্তরিত হয়, যা আঙ্গুর রসের চেয়েও দামি। আপনি ভুল করেছন মানেই আপনি ব্যর্থ ব্যাপারটা এমন নয়। ভুল হলো সেই অভিজ্ঞতা যা আপনাকে একজন ব্যক্তি হিসেবে আরো মূল্যবান করে তোলে। আপনি ভুল থেকে শেখেন যা আপনাকে আরো বেশি নিখুঁত করে তোলে!
ক্রিস্টোফার কলম্বাস একটি নেভিগেশন ভুল করেছিলেন, যা তাকে আজকের আমেরিকা আবিষ্কার করতে বাধ্য করেছিল। আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের ভুল তাকে পেনিসিলিন আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছিল। টমাস আলভা এডিসনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, "আপনি জীবনে কতবার ভুল করেছেন?" তিনি মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, "অসংখ্যবার!" এটা শুনে প্রশ্নকর্তা বলেছিলেন, "তাহলে তো আপনার মাথায় বুদ্ধি কম?" উত্তরে এডিসন যা বলেছিলেন তা এরকম, "মাথায় বুদ্ধি কম ছিল কিন্তু অসংখ্যবার ভুল করার কারণে তা বেড়ে বহুগুণ বড় হয়ে গিয়েছে!" ব্যাপারটা এমন, প্রতিবার ভুলের পর এডিসন নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতেন।
কানাডিয়ান বিখ্যাত লেখক রবিন শর্মা বলেছিলেন, "ভুল বলে কিছু নেই সবই নতুন শিক্ষা।" বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, "কেউ যদি বলে সে কখনো ভুল করেনি, তার মানে সে কখনো চেষ্টাই করেনি!"
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, "উন্নয়ন হলো চেষ্টা এবং ভুলের একটি সমন্বিত পক্রিয়া।"
বিজনেস গুরু রিচার্ড ব্রানসনের মতে, "নিয়ম মেনে কেউ হাঁটা শিখতে পারে না, বরং চেষ্টা এবং বার বার ভুল পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে হাঁটা শিখতে হয়।"
কলিন পাওয়েলের মতে, "যোগ্য নেতা জন্ম নেয় না, তৈরি হয় চেষ্টা, ভুল এবং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।"
অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ মাইকেল জর্ডান বলেছিলেন, "আমি অসংখ্যবার ভুল করেছি এবং ব্যর্থ হয়েছি বলেই আজ আমি সফল।"
হেনরি ফোর্ড বলেছিলেন, "ভুল হলো একমাত্র সুযোগ যার মাধ্যমে নতুন করে শুরু করার আরো সুযোগ পাবেন।'
এক প্রেমিকের ভাষ্য, "ভুল মানুষের প্রেমে পড়া মানে আরেকটি শুদ্ধ মানুষের প্রেমে পড়ার অন্যতম সুযোগ।"
কথায় আছে, সত্যিকার মানুষ কখনো নির্ভুল হতে পারে না। যদি সবকিছু নির্ভুল থাকে তাহলে তুমি কখনো কিছু শিখতে পারবে না।
পেন্সিল মানসিকতা হওয়ার চেষ্টা করো, তাহলে ভুল হলে পিছন দিয়ে ঘষে মুছে নতুন করে চেষ্টা করার সুযোগ থাকবে! মুছতে না পারলে চিত্র হয় না! কলম মানসিকতার মানুষগুলো নিজেকে নির্ভুল ভাবে! তাই কলম দিয়ে সুন্দর চিত্র হয় না!
একজন আদর্শ সন্তান আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ
প্রিয়জনের কাছে মূল্যহীন হয়ে গেলে নিজে থেকেই সরে আসুন, ভিতরে সাময়িক যন্ত্রণা হলেও এটা অনেক বেশি সম্মানের।
যদি বুঝতে পারেন কেউ হতাশায় ভুগছে, তাকে জ্ঞান বা উপদেশ দিতে যাবেন না। সে কি বলতে চায় সেটা আগে শুনুন। এই সময় মানুষ উপদেশ শুনতে চায় না, সে চায় কেউ তার ভেতরের কথাগুলো ধৈর্য ধরে শুনুক।
কাউকে অকারণে কষ্ট দেবেন না। এই মুহূর্তে আপনি যার সাথে ইচ্ছাকৃত অন্যায় করে নিজেকে জয়ী ভেবে ফুরফুরে মেজাজে আছেন, মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন — সে হয়তো প্রতিবাদ করবে না, কিন্তু তার নীরবতা, কষ্ট থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস আপনার সাথে বোঝাপড়াটা সঠিক সময়ে করে নেবে।
অন্যের চোখে ভালো সাজার জন্য নিজের ভালোলাগাগুলো বিসর্জন দেবেন না। যে আপনাকে আপনার মতো করে গ্রহণ করতে পারে না, তার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার চেয়ে একা থাকাই ভালো।
যা হাতছাড়া হয়ে গেছে তা নিয়ে কখনো আফসোস করবেন না।
বয়স, শিক্ষা, পদ বা পদবীর দিক দিয়ে কেউ ছোট হলেও কাউকে ছোট করে দেখবেন না, তাহলে আপনি ছোট হয়ে যাবেন।
নিজের অবস্থান নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের আত্মবিশ্বাসী বা অহংকারী হবেন না। সময় যখন বদলায় উত্তাল সাগরও শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায়।
সমালোচনাকারীদের যুদ্ধে করে নিজের সময় ও শক্তির অপচয় করবেন না। নিজেকে উন্নত করুন, তারা এমনিতেই চুপ হয়ে যাবে।
গাধার সাথে তর্ক করতে বা গাধাকে কিছু শেখাতে যাবেন না। গাধার পিঠে ঐশী কিতাব চাপালেও গাধা গাধাই থাকে।
ভুল জায়গায় স্যাক্রিফাইস আর ভুল মানুষের সাথে কম্প্রোমাইজ আপনাকে না দিবে সুখ, না দিবে সফলতা।
আপনাকে ডুবানোর ইচ্ছা নিয়ে কিছু লোক বসে আছে যাদেরকে সাঁতারটা আপনিই শিখিয়েছিলেন।
মানুষ সিংহের প্রশংসা করে কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।
পরের ক্ষতি করার নেশা যদি কাউকে একবার পেয়ে বসে, নিজের অস্তিত্ব ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত তার হুঁশ ফেরে না।
জীবন মানেই GPA 5 কিংবা ভালো বেতনের চাকরি নয়। আপনার জানাশুনা অনেককেই পাবেন যাদের জীবন সম্পর্কে জ্ঞান অসম্পূর্ন কিন্তু ঠিকই ভালো বেতনের চাকরি পেয়ে গেছে।
সন্তানের জন্য বেশি বেশি সম্পদ জমা না করে সন্তানকেই সম্পদ বানিয়ে ফেলুন। একজন আদর্শ সন্তান আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সত্য হলো আপনার উপকারের কথা মানুষ বেশিদিন মনে রাখবে না। কার কাছে আপনি কতদিন গুরুত্ব পাবেন, সেটা নির্ভর করবে কার জন্য কতদিন কিছু একটা করার সামর্থ্য আপনার আছে তার ওপর।
কিছু মানুষ আপনাকে এমনিতেই পছন্দ করবেন না। করবে না মানে করবেই না! না আপনি তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করছেন, না তাদের কষ্ট দিয়েছেন, না তাদের ক্ষতি করেছেন। তবুও তারা আপনাকে পছন্দ করবে না। এখন এই পছন্দ করা ব্যাপারটা তৈরি করার জন্য আপনার ঠ্যাকা পড়েনি।
খারাপ কাজের ফল একসময় আমাদের কাছেই ফিরে আসে
একদিন এক রাজা তার তিন মন্ত্রীকে ডেকে তিনটি খালি বস্তা দিয়ে বললেন, "তোমরা এই বস্তাগুলো নিয়ে জঙ্গলে যাও এবং আমার জন্য ফল কুড়িয়ে নিয়ে এসো। দেখি কে কত তাড়াতাড়ি বস্তাভর্তি ফল নিয়ে রাজ দরবারে ফিরে আসতে পারো!"
১ম মন্ত্রী চিন্তা করল, রাজার আদেশ, তাই ভালো ভালো ফল কুড়ানো উচিত। সেই মতো সে জঙ্গলের সবচেয়ে সুস্বাদু সব ফল কুড়িয়ে বস্তায় ভরল।
২য় মন্ত্রী চিন্তা করল, রাজা তো আর সব ফল দেখবেন না। তাই সে একগাদা পচা ফল নিচের দিকে রেখে, উপরে অল্প কিছু ভালো ফল বিছিয়ে বস্তা পূর্ণ করল।
৩য় মন্ত্রী চিন্তা করল, রাজার এত সময় কোথায় বস্তা খুলে খুলে দেখবেন, তিনি শুধু দেখবেন বস্তা পূর্ণ হয়েছে কিনা! তাই সে জঙ্গলের মরা পাতা, ঘাস, কাঠ এসব দিয়ে বস্তা পূর্ণ করল।
তিন মন্ত্রী যথাসময়ে রাজার দরবারে হাজির। রাজা সবার বস্তা পূর্ণ দেখে খুশি হলেন, কিন্তু বস্তাগুলো খুলেও দেখলেন না। ২য় এবং ৩য় মন্ত্রী নিজেদের বুদ্ধির কথা চিন্তা করে মনে মনে হাসতে লাগল।
রাজা তখন সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, "এই তিন মন্ত্রীকে তাদের বস্তা সহ ৭ দিনের জন্য কারাগারের তিনটি আলাদা আলাদা কক্ষে বন্দী করে রাখা হোক। এই সময়ে তাদেরকে যেন কোনো প্রকার খাবার দেওয়া না হয়।"
রাজার নির্দেশ মতো তিনজনকে কারাগারে পাঠানো হলো।
১ম মন্ত্রী এই ৭ দিন তার বস্তার ফলগুলো খেয়ে কাটিয়ে দিল।
২য় মন্ত্রী তার বস্তায় যে অল্পকিছু ভালো ফল ছিল তা ২ দিনের বেশি খেতে পারল না। বাকি দিনগুলো সে পচা ফল খেয়ে কাটানোর চেষ্টা করল, কিন্তু অচিরেই মারাত্মক পেটের পীড়ায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল।
৩য় মন্ত্রীর বস্তায় কোনো ফল ছিল না, তাই সে অনাহারে কারাগারেই মারা গেল।
শিক্ষা: আমাদের ভালো কাজের ফল ভালো রূপে এবং খারাপ কাজের ফল খারাপ রূপে একসময় আমাদের কাছেই ফিরে আসে।
দরিদ্রদের প্রতি আমাদের আচরণ কেন পাল্টে যায়?
এক মহিলা একজন বৃদ্ধা ফল বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপেলের দাম কত?"
বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, "৩০০ টাকা কেজি।"
মহিলা বললেন, “আমি ২৫০ টাকা দেব, না দিলে আমি চলে যাব, কিছুই নেব না।”
বৃদ্ধা করুণ চোখে উত্তর দিলেন, "আপনি যে দামে চান, তাতেই কিনতে পারেন। এটা আমার জন্য বউনি, কারণ আজ আমি একটাও আপেল বিক্রি করতে পারিনি। বাড়িতে অসুস্থ স্বামী বিছানায় পড়ে আছে, আমার কোনো কর্মক্ষম ছেলেও নাই। পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করতে আমাকে তাই আপেল বিক্রি করতেই হবে।"
মহিলা তার পছন্দের দামে ৫ কজি আপেল কিনলেন এবং মনে মনে ভাবলেন তিনি জিতে গেছেন।
তিনি আপেল নিয়ে হাজবেন্ডের সাথে তাদের বিলাসবহুল গাড়িতে উঠলেন এবং এরপর একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকলেন।
তারা রেস্টুরেন্টের সবচেয়ে দামি মেনু অর্ডার করলেন। যদিও তারা খেলেন সামান্যই, বেশিরভাগ খাবারই টেবিলে পড়ে থাকল।
তাদেরকে ৩৮০০ টাকা বিল দেওয়া হলো। মহিলা ৪০০০ টাকা দিয়ে এলেন এবং মুচকি হেসে মার্জিত রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে বললেন, "বাকিটা টিপস।"
এই গল্পটি একটি বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টের মালিকের জন্য স্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু একজন হতদরিদ্র ফল বিক্রেতার জন্য বড়ই নির্মম।
প্রশ্ন হলো, আমরা যখন একজন দরিদ্র বিক্রেতার কাছ থেকে কোনো জিনিস কিনি, তখন কেন সবসময় তার উপর ক্ষমতা জাহির করি?
আর যারা আমাদের উদারতার যোগ্য নয় তাদের প্রতি কেন আমরা উদার হই?
কোনও এক মহৎ মানুষের আত্মজীবনীতে পড়েছিলাম :
আমার বাবা গরিবদের কাছ থেকে বেশি দামে জিনিস কিনতেন, যদিও তার ওইসব জিনিসের কোনো প্রয়োজন ছিল না।
তিনি কখনো কখনো তাদেরকে বেশি দাম দিতেন। আমি তখন অবাক হয়ে যেতাম। একদিন আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, "বাবা, তুমি কেন এটা করো?"
আমার বাবা উত্তর দিলেন, "ওরা ভিক্ষা না করে পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আমার তরফ এটা শুধুই দান নয়, সম্মান দিয়ে দান।"
আমি জানি আপনাদের অনেকেই আমার এই বার্তাটি শেয়ার করবেন না, অনেকে হয়তো আমার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমতও হবেন না, কিন্তু যদি আপনি তাদের মধ্যে একজন হন যারা এই গল্পটি পড়ার জন্য সময় দিয়েছেন তাহলে দয়া করে এই গল্পটি শেয়ার করুন। সম্ভবত আপনি একটি ভালো বীজ বপন করছেন।
আত্মসম্মানবোধ বিক্রি হলে মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়
প্রায় দেড়শ বছর আগের কথা। এদেশে তখন ব্রিটিশ শাসন। একদিন এক ব্রিটিশ অফিসার একটি স্থানীয় যুবকের গালে থাপ্পড় দেন। সাথে সাথে যুবকটিও তার সমস্ত শক্তি দিয়ে অফিসারটিকে এত জোরে থাপ্পড় মারে যে তিনি তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। রাগে এবং অপমানে হতবাক হয়ে তিনি ভাবেন, সামান্য একজন সামান্য নেটিভ যুবক কীভাবে এমন এক সাম্রাজ্যের সেনা অফিসারকে থাপ্পড় মারল যে সাম্রাজ্যের সূর্য কখনও অস্ত যায় না।
তিনি দ্রুত তার পোস্টে গিয়ে ওই যুবককে কঠোর শাস্তি দেওয়ার দাবী জানালেন। কিন্তু উচ্চপদস্থ কমান্ডার অফিসারটিকে শান্ত করে বললেন, "লোকটিকে শাস্তি না দিয়ে বরং তাকে পুরষ্কৃত করা হোক।" আর পুরষ্কার হিসেবে দশ হাজার টাকা উপহার দিতে নির্দেশ দিলেন।
অফিসার ঘৃণায় চিৎকার করে উঠলেন, "এটা শুধু আমার, আপনার অপমান না, বরং এটা ব্রিটিশ মহারাণীরও অপমান। আর আপনি বলছেন তাকে শাস্তি না দিয়ে পুরষ্কৃত করতে!"
কমাণ্ডার এবার বললেন, "এটা একটি সামরিক আদেশ আর তুমি দেরি না করে এখনি এই আদেশ পালন করবে।" জুনিয়র অফিসার তার কমান্ডারের আদেশ মেনে দশ হাজার টাকা সাথে নিয়ে ওই যুবকের কাছে গিয়ে বললেন, "অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করে দিন। আর এই দশ হাজার টাকা উপহার হিসাবে গ্রহণ করুন।"
যুবক উপহার গ্রহণ করল এবং ভুলে গেল যে তাকে তার দেশের মাটিতে এক ঔপনিবেশিক সেনা অফিসার দ্বারা থাপ্পড় মারা হয়েছে।
সেই সময়ে দশ হাজার টাকা অনেক বড় অর্থ। সে এই অর্থ কাজে লাগিয়ে কয়েক বছরের মধ্যে জীবনযাত্রার মান উন্নত করে বেশ বিত্তশালী হয়ে উঠল। আগে সে ছিল একজন সাধারণ যুবক, এখন সমাজে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত।
অনেক বছর পর সেই ইংরেজ কমান্ডার তার জুনিয়র অফিসারকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, "তুমি কি সেই যুবককে মনে রেখেছ যে তোমাকে থাপ্পড় মেরেছিল?"
অফিসার বললেন, "সেই অপমান আমি ভুলি কেমন করে?"
কমান্ডার বললেন, "এখন সময় এসেছে। তুমি তাকে খুঁজে বের করো এবং জনসম্মুখে জোরে থাপ্পড় মেরে এসো।"
অফিসার বলল, "সেটা কিভাবে সম্ভব? সে গরীব থাকা অবস্থায় আঘাতের পাল্টা জবাব দিয়েছিল! আর এখন সে যথেষ্ট বিত্তবান। সে তো আমাকে মেরেই ফেলবে।"
কমান্ডার বললেন, "আমি যা বলছি তাই করো। এটাও তোমার উপর আমার আদেশ।"
একজন জুনিয়র অফিসারকে সিনিয়রের আদেশ মানতে হয়। তিনি সেই যুবকের কাছে গেলেন এবং তাকে খুর জোরে একটা থাপ্পড় মারলেন। কিন্তু এবার ঘটলো সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা।
যুবকটি এবার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। এমনকি সাহস করে অফিসারের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারল না।
অফিসার বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে ফিরে এসে তার কমান্ডারের কাছে গেলেন।
কমান্ডার বললেন, "আমি তোমার মুখে বিস্ময়ের ছাপ দেখছি। তুমি এত বিস্মিত কেন?"
অফিসার বললেন, "যখন সে দরিদ্র ছিল, তখন সে পাল্টা আঘাত করেছিল। কিন্তু আজ যখন তার অর্থসম্পদ হয়েছে, তখন সে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারল না। এটা কেমন করে সম্ভব?"
ইংরেজ কমান্ডার মৃদু হেসে বললেন, "প্রথমবার তার কাছে তার সম্মান ছাড়া আর কিছু ছিল না। সে সেটাকেই সবচেয়ে মূল্যবান মনে করেছিল এবং তা রক্ষার করার জন্য মৃত্যুর ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেনি। আর এবার সে তার সম্মান রক্ষার চেষ্টা করেনি। কারণ, এখন তার কাছে তার সম্মানের চাইতেও টাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেদিন সে দশ হাজার টাকা উপহার হিসাবে গ্রহণ করেছে সেদিনই সে তার মর্যাদা, আত্মসম্মানবোধ টাকার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। আর মানুষ যখন টাকার কাছে নিজের আত্মসম্মানবোধ বিক্রি করে দেয়, তখন তার মেরুদণ্ডও বাঁকা হয়ে যায়।"
বয়স্করা কখনো নতুন জ্ঞানকে মেনে নিতে চায় না
গ্যালিলিও যেদিন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, "আমি আবারো বলছি, সূর্য স্থির, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। আমাকে শাস্তি দিয়েও সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ করাকে আপনারা বন্ধ করতে পারবেন না, পৃথিবী আগের মতোই ঘুরতে থাকবে", সেদিন ওনার কথায় সবাই হেসেছিল। বিচার সভায় গ্যালিলিওর চরম শাস্তি হয়েছিল। বাকিটা ইতিহাস।
সতীদাহর মতো জঘন্য এক সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে যেদিন রাজা রামমোহন রায় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ওনাকে হাস্যস্পদ করেছিল। বাকিটা ইতিহাস।
সিগনেট থেকে প্রকাশিত বিভূতিভূষণের "পথের পাঁচালী"-র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ "আম আঁটির ভেঁপু"-র জন্য ছবি আঁকতে আঁকতেই সত্যজিতের মনে হয়েছিল, তিনি যদি কোনোদিন সিনেমা তৈরি করেন, তবে এটাই হবে তার প্রথম সিনেমা। সিনেমার শুটিং যখন শুরু হয়, তখন শুধু প্রযোজকরাই নন, তৎকালীন বিখ্যাত পরিচালকরাও তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছিল। অনেকে তো ওনাকে পাগল পর্যন্ত বলেছিল। বাকিটা ইতিহাস।
একটা কথাই মনে রাখবেন, লাখ লাখ লোকও যদি একটা পুকুরকে সমুদ্র বলে, রাতারাতি পুকুরটা সমুদ্র হয়ে যায় না। ৯৯.৯৯ পারসেন্ট লোক প্রচলিত বিশ্বাস এবং বাধা ধরা নিয়মের বাইরে যেতে চায় না ,এই সত্যকে মেনে নিয়ে আপনার নতুন আবিষ্কার নতুন জ্ঞান প্রতিস্থাপন করুন।
আজকের ছোট পদক্ষেপটাই আগামীকালের সাফল্যের ভিত্তি
মানুষের সাফল্য অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা কোনটা জানেন? কোনো কাজ পরে করব ভেবে ফেলে রাখা। এই যেমন:
আগামীকাল থেকে সকালে উঠে দৌড়াব।
পরের মাস থেকে নতুন কিছু শিখব।
আগামী বছর একটা বিজনেস শুরু করব বা চাকরি পাব।
পরের বার অবশ্যই ভালো পরীক্ষা দেব।
কিন্তু ওই "একদিন" কখনোই আসে না আপনার জীবনে। আর এই "অপেক্ষা", এই "আগামীকাল" আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতারক।
আপনার সমস্যাটা আসলে কোথায়?
১. কাজ না করে পরিকল্পনা:
পরিকল্পনা করা সহজ, কিন্তু সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করা কঠিন। আমাদের মস্তিষ্ক পরিকল্পনার সময় সাময়িক আনন্দ পায় এবং মনে করে কাজ শেষ। কিন্তু বাস্তবে কাজ শুরু না করলে সেটি শুধু একটা কল্পনা।
২. সঠিক মুহূর্তের অপেক্ষায় সময় নষ্ট:
“সবকিছু ঠিকঠাক হলে শুরু করব” — এই ভাবনাটা আত্মঘাতী। কারণ জীবন কখনোই নিখুঁত হবে না। এই অপেক্ষার মানে হলো, আপনি ভয় পাচ্ছেন।
৩. ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা:
বড় কিছু করার জন্য ছোট কিছু শুরু করাটা জরুরি। আপনি যদি দিনে মাত্র আধা ঘন্টা কিছু একটা করেন, সেটাও আপনার অগ্রগতির প্রথম ধাপ।
৪. ব্যর্থতার ভয়:
ব্যর্থতা জীবনের অংশ। আপনাকে ভুল থেকেই শিখতে হবে। ব্যর্থ না হলে সফলতাও আসবে না।
আপনার জন্য আজকের বার্তা:
জীবন কখনোই "পরে" বা "কাল" বলে আপনার জন্য অপেক্ষা করবে না। সময় তার মতো এগিয়ে যাবে। আপনি হয় আজ শুরু করবেন, নয়তো পিছিয়ে পড়বেন।
আজ থেকেই ছোট ছোট কিছু করুন।
যদি পড়াশোনা করতে চান, একটা পৃষ্ঠা পড়ুন।
যদি ফিটনেস বাড়াতে চান, ৫ মিনিট ব্যায়াম করুন।
যদি নতুন দক্ষতা শিখতে চান, ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখুন।
কাউকে প্রপোজ করতে চাইলে আজকেই করুন, কারণ কাল সে অন্য কারো হয়ে যেতে পারে।
যতদিন না আপনি শুরু করছেন, ততদিন সবকিছুই অসম্ভব। আর একবার শুরু করলে সবকিছুই সম্ভব। আজকের ছোট পদক্ষেপটাই হতে পারে আপনার আগামীকালের সাফল্যের ভিত্তি। তাই, “আগামীকাল” নয়, “আজ” থেকেই শুরু করুন। কারণ, জীবন বড়ই নিষ্ঠুর। সে আপনার জন্য একদিনও অপেক্ষা করতে রাজি নয়!
মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া
এক ভদ্রমহিলা একটি মাংস সরবরাহ কারখানায় চাকরি করতেন। একদিন তিনি ডিউটি শেষ করে মাংস সংরক্ষণ হিমাগারে কোনো একটি বিষয় পরীক্ষা করার জন্য ঢুকলেন। তখন আকস্মিকভাবে হিমাগারের দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তালাবদ্ধ হয়ে গেল এবং ভদ্রমহিলা ভিতরে আটকে পড়ে গেলেন।
মহিলা সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে সাহায্যের জন্য চিৎকার শুরু করলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার চিৎকারের শব্দ হিমাগারের বাইরে কারো কানে পৌঁছাল না।
এদিকে সন্ধ্যা নামার পর একে একে অফিসের সবাই বেরিয়ে গেল। মহিলা একাকী অন্ধকার হিমাগারে আটকা পড়ে থাকলেন।
এভাবে প্রায় পাঁচ ঘন্টা পার হয়ে গেল এবং মহিলা যখন ঠান্ডায় একেবারে মৃতপ্রায়, ঠিক তখন ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা প্রহরী হিমাগারের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। বলা যায়, সে রাতে ভদ্রমহিলা প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন।
বাইরে বের হয়ে উষ্ণ পরিবেশে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ভদ্রমহিলা নিরাপত্তা প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করলেন, "ওই সময়ে আপনি হিমাগারের দরজা খুলতে গেলেন কেন? ওটা তো আপনার রুটিন ওয়ার্কের অংশ ছিল না।"
তখন নিরাপত্তা প্রহরী বললেন, "আমি বিগত ৩৫ বছর যাবৎ কারখানার প্রবেশ দ্বারে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কর্মরত আছি। প্রতিদিন শত শত লোক এই কারখানায় কাজে আসে, কাজ শেষে ফিরেও যায়। এত বছরে এত লোকের মধ্যে একমাত্র আপনিই প্রতিদিন সকালে কারখানায় প্রবেশকালে আমাকে হাত তুলে 'হ্যালো' বলেন এবং সন্ধ্যার পর কাজ শেষে ফিরে যাবার সময় হাসিমুখে আমাকে 'গুড বাই, আবার কাল দেখা হবে' বলে বেরিয়ে যান। অন্য সবাইকে দেখে মনে হয়, আমি বোধহয় কোন অদৃশ্য বস্তু। কেউ আমাকে কোনদিন গুরুত্ব দেয় না! কিন্ত আপনি ভিন্ন...
আজও রোজকার মতো সকালে আপনি আমাকে 'হ্যালো' বলে কারখানায় ঢুকলেন। সন্ধ্যার পর একে একে সবাই কাজ শেষে বেরিয়ে গেল। আমি ভাবলাম গেট বন্ধ করে তালা লাগিয়ে বিশ্রাম নেব। হঠাৎ মনে হলো, কি ব্যাপার, যে ভদ্রমহিলা আমাকে 'গুড বাই , আবার কাল দেখা হবে' বলে বেরিয়ে যায়, তাকে তো আজ বের হতে দেখলাম না। প্রথমে ভাবলাম হয়তো কোনো কাজে আপনার বিলম্ব হচ্ছে, তাই গেট বন্ধ না করে প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করলাম। তারপরেও যখন আপনাকে বের হতে দেখলাম না, তখন কৌতূহলবশত সারা কারখানার আনাচে কানাচে প্রতিটি জায়গায় খুঁজে কোথাও না পেয়ে কেমন একট ভয় মিশ্রিত সন্দেহ হলো। তখনই আমি হিমাগারের দরজা খুলে আপনাকে মেঝের উপর পড়ে থাকতে দেখলাম।
সত্যি বলতে কি, আমি প্রতিদিন মনে মনে সকালে "হ্যালো" এবং সন্ধ্যায় "গুড বাই" এই শব্দ দুটো শোনার অপেক্ষায় থাকি। কেননা ওই শব্দ দুটিই আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে, আমিও একজন মানুষ!" সুইপার থেকে পাহারাদার তার পেশা যাই হোক না কেন সবাইকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিন। এরাই আপনার বিপদে সহযোগিতার হাত আগে বাড়াবে।
নিরাপত্তাহীনতা প্রতিটি প্রাণীর শরীর ও মনে বিপর্যয় দেখে আনে
একটি চিতাবাঘ একটি কুকুরকে তাড়া করেছিল। কুকুরটি একটি ঘরের দরজা খোলা পেয়ে, বাথরুমে ঢুকে পড়ে। পিছু পিছু চিতাবাঘটিও সেখানে যায়। বাড়ীর মালিক ঘটনাটি দেখতে পেয়ে, সাথে সাথে বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়।
ফলে প্রাণী দুইটি বাথরুমের ভিতরে আটকা পড়ে যায়। কুকুরটি চিতাবাঘকে দেখে ভয় পেয়ে এক কোণে চুপচাপ বসে পড়ে। প্রবল আতঙ্কে সে একবার জন্য ঘেউ ঘেউ করার সাহস পর্যন্ত করেনি।
অন্যদিকে, যদিও চিতাবাঘটি ক্ষুধার্ত ছিল এবং কুকুরটিকেই তাড়া করছিল, তবুও সে কুকুরটির উপর আক্রমণ করেনি।
চাইলেই চিতাবাঘটি কুকুরটিকে মেরে ফেলতে পারত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা দুজন দুই কোণে চুপচাপ বসে থাকল। দীর্ঘ ২৮ ঘন্টা একসঙ্গে কাটানোর পরও চিতাবাঘটি কুকুরটিকে আক্রমণ করেনি। পুরোটা সময় সে ভীষণ শান্ত ছিল।
অবশেষে বন বিভাগ চিতাবাঘটিকে নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ট্র্যাঙ্কুলাইজার ডার্ট ব্যবহার করে তাকে বন্দি করে।
এখন প্রশ্ন হলো, যখন চিতাবাঘের জন্য কুকুরটিকে আক্রমণ করা এত সহজ ছিল, তখন সে তা করল না কেন?
বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, বন্য প্রাণীরা স্বাধীনতার ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল। যখনই তারা বুঝতে পারে যে, তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তখন তারা এতটাই মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করে যে, ক্ষুধা তৃষ্ণার কথাও ভুলে যায়। তাদের স্বাভাবিক খাদ্যগ্রহণের প্রবৃত্তি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে।
শিক্ষা: স্বাধীনতা ও সুখ একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত। কারো চিন্তার স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা আর নিজের ইচ্ছামতো বাঁচার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে আপনি তাকে যা কিছুই দেন তা কেন, সবকিছু তার কাছে মূল্যহীন এবং অর্থহীন।
একসঙ্গে পথচলা খুব সংক্ষিপ্ত, তাই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করা নিষ্প্রয়োজন
একটি বাসে পাশাপাশি সিটে বসেছেন এক বৃদ্ধা এবং এক তরুণী। স্টপেজ এসে পড়ায় বাস থেকে নামতে গিয়ে তরুণীটি দৃষ্টিকটুভাবে বৃদ্ধাকে ধাক্কা মারল। কিন্তু সে সরি বলল না, নির্বিকারভাবে হেঁটে চলে গেল। বৃদ্ধা কোনো অভিযোগ করলেন না, তিনি আগের মতোই চুপচাপ বসে রইলেন।
পাশ থেকে এক যুবক ঘটনাটি লক্ষ্য করে বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করল, “মেয়েটি আপনাকে এভাবে ধাক্কা দিল, তারপরও আপনি কিছু বললেন না কেন?"
বৃদ্ধা মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, "এটি নিয়ে রাগারাগি বা কথা কাটাকাটি করার কোনো মানে হয় না। কারণ, আমার এই যাত্রা খুবই সংক্ষিপ্ত! আমিও পরের স্টপেজই নেমে যাব।"
বৃদ্ধার কথাগুলো যুবককে ভীষণভাবে আন্দোলিত করল। আসলেই তো! আমাদের একসঙ্গে পথচলা খুব সংক্ষিপ্ত, তাই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করা নিষ্প্রয়োজন। রাগ, ক্ষোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, অপমান এগুলো নিয়ে সময় নষ্ট করা বৃথা, নিরর্থক।
কেউ আপনার হৃদয় ভেঙেছে? শান্ত থাকুন। কেউ আপনাকে অপমান করেছে? উপেক্ষা করুন। কোনো বন্ধু আপনার সাথে প্রতারণা করেছে? ধৈর্য ধরুন। কোনো প্রতিবেশী আপনার নামে কুৎসা রটাচ্ছে? সহ্য করুন। কিছু বিচার সময় হাতে ছেড়ে দিন। সেই বিচার আপনার ধারনার চেয়ে কঠিন হবে। আমরা কেউ জানি না, আমাদের এই যাত্রা কতক্ষণ চলবে, কখনইবা থেমে যাবে। তাই আসুন একে অপরকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, দয়া দেখাই এবং ক্ষমাশীল হই। কারণ, শেষ পর্যন্ত আমাদের যাত্রা সত্যিই খুব সংক্ষিপ্ত।
নারীকে বিপদে ফেলার সবচেয়ে বড় ফাঁদ হলো প্রশংসা।
"আপনাকে দেখে মনে হয় এখনও কলেজে পড়েন!"
"আপনার হাসিতে জাদু আছে!"
"এমন সুন্দরীকে পেয়েও কেউ ঝগড়া করে কীভাবে!"
খেয়াল করলে দেখবেন কিছু মানুষ এই কথাগুলোই বিবাহিত মেয়েদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে৷ এগুলো শুনতে ভালো লাগলেও এর পিছনে থাকে অন্য উদ্দেশ্য। আপনাকে বোঝানো হয়, আপনি অনেক বেশি স্পেশাল — যেটা আপনার স্বামী বোঝে না, কিন্তু তৃতীয় ব্যাক্তিটি বোঝে!
এভাবেই তৈরি হয় প্রতারণার ফাঁদ। সামান্য অভিমান বা দাম্পত্যের টানাপোড়েনে বাইরের এই মিষ্টি কথা আপনার মনে বিষ ঢেলে দেয়। স্বামীর প্রতি ক্ষোভ বাড়ায়, সংসারে অশান্তি আনে, আর শেষমেশ একটি সাজানো সংসারকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
সত্যি কথা হলো, যারা এভাবে প্রশংসা করে, তারা আপনাকে বিয়ে করতে চায় না, তারা দায়িত্ব নিতে চায় না — তারা চায় শুধু ক্ষণিকের আনন্দ। যতদিন স্বার্থ, ততদিন আপনি স্পেশাল। উদ্দেশ্য হাসিলের পর তারা আর ফিরেও তাকাবে না।
এরকম মানুষদের লাইফে বিন্দুমাত্র জায়গা দেবেন না, প্রশংসা শুনে গলে যাবেন না। যে মানুষ আপনার সংসার ভাঙতে চায়, তাকে যত দূরে রাখা যায় ততই ভালো। কারণ দিনের শেষে, আপনার পাশে থাকে সেই মানুষটাই যে হয়তো কবির মতো প্রশংসা করে না, কিন্তু অসুস্থ হলে রাত জেগে আপনার যত্ন নেয়, আপনার সন্তানের দায়িত্ব নেয়, সংসারের বোঝা টানে। মনে রাখবেন, ক্ষণিকের প্রশংসার নেশা অনেক মিষ্টি হতে পারে, কিন্তু তার ফল অত্যন্ত তেতো আর ভয়ংকর।
সুখের সহজ সমীকরণ
একদিন এক শিক্ষিকা ক্লাসে অনেকগুলো বেলুন নিয়ে এলেন। তিনি তার ছাত্রছাত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "তোমরা এই বেলুনগুলোর গায়ে নিজেদের নাম লেখো, এরপর ওগুলো উপরের দিকে ছুঁড়ে মারো এবং সবগুলো একসাথে মিশিয়ে দাও।"
মেশানো শেষ হলে শিক্ষিকা সবাইকে তাদের নামের বেলুনটি দুই মিনিটের মধ্যে খুঁজে বের করতে বললেন। বলা বাহুল্য, অনেক চেষ্টা করেও কেউ তার নিজের নামের বেলুন খুঁজে পেল না।
শিক্ষিকা তখন বললেন, "এবার তোমরা বেলুনগুলোর মধ্যে যেটা তোমাদের সবচেয়ে কাছাকাছি সেটা হাতে নাও আর সেখানে যার নাম লেখা আছে তার কাছে পৌঁছে দাও।"
এবার দুই মিনিট পূর্ণ হবার আগেই প্রত্যেকেই তার নিজের নামের বেলুনটি পেয়ে গেল।
শিক্ষিকা তখন ছাত্রছাত্রীদেরকে বোঝালেন, "এই বেলুনগুলো অনেকটা সুখের মতো! যখন আমরা কেবল নিজেদের সুখ খুঁজি, আমরা সেটা পাই না। কিন্তু আমরা যখন আমাদের চারপাশের মানুষগুলোকে সুখী করার চেষ্টা করি, এটা শেষ পর্যন্ত আমাদের নিজস্ব সুখটাকেই খুঁজে এনে দেয়।"
সর্বোত্তম খাবার, সর্বোত্তম বিছানা এবং সর্বোত্তম ঘর
একদিন এক জ্ঞানী ব্যক্তি তার ছেলেকে বললেন, শোনো, জীবনে তিনটি বিষয়ে কখনোই আপোষ করবে না। সর্বোত্তম খাবার খাওয়া, সর্বোত্তম বিছানায় ঘুমানো এবং সর্বোত্তম ঘরে বসবাস করা।
একথা শুনে ছেলে বলল, কিন্তু বাবা, আমরা তো গরিব! এসব তো কেবল ধনীদের পক্ষেই সম্ভব। আমি চাইলেও তো এগুলো করতে পারব না।
বাবা তখন ছেলেকে বুঝালেন, যদি তুমি কেবল তখনই খাও যখন তুমি সত্যিকারের ক্ষুধার্ত এবং সে খাবার যদি আসে সৎ উপায়ে — অন্য কাউকে না ঠকিয়ে, তাহলে যা খাবে সেটাই হবে পৃথিবীর সর্বোত্তম খাবার।
যদি তুমি অনেক পরিশ্রম করো এবং ক্লান্ত হয়ে ঘুমাও তাহলে তোমার শোবার বিছানাই হবে সর্বোত্তম বিছানা।
আর যদি তুমি মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করো, মানুষের প্রতি সদয় হও, তাহলে তুমি তাদের হৃদয়ে বাস করবে। ফলে সেটাই হবে তোমার জন্য সর্বোত্তম ঘর।
শিকারিদের হারপুন গায়ে নিয়ে তিমিরা বহু দশক বেঁচে থাকে কিভাবে?
যখন কোনো বাহ্যিক বস্তু (foreign object) শরীরে প্রবেশ করে এবং দ্রুত কোনো মারাত্মক ইনফেকশন বা অঙ্গহানি না ঘটায়, তখন শরীর এক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
১. শরীর বুঝতে পারে যে বস্তুটি সরানো সম্ভব নয়। তখন সেটিকে শত্রু হিসেবে না দেখে, বরং তাকে "বন্দী" করার পরিকল্পনা করে।
২. আমাদের হাড়ের মধ্যে থাকা “অস্টিওব্লাস্ট” (Osteoblast) নামক কোষগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই কোষগুলোর কাজ হলো নতুন হাড় তৈরি করা। তারা ধীরে ধীরে ঐ ধারালো বস্তুর চারপাশে নতুন হাড়ের স্তর তৈরি করতে শুরু করে।
৩. বছরের পর বছর ধরে, হাড়ের এই বৃদ্ধি চলতে থাকে এবং একসময় বস্তুটি পুরোপুরি নতুন হাড়ের আবরণে ঢেকে যায়। এটি তখন শরীরেরই একটি অংশ হয়ে ওঠে, ঠিক যেন এটি সবসময় সেখানেই ছিল!
এই ঘটনাটি তিমি শিকারের ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে। শিকারিদের হারপুন গায়ে নিয়ে তিমিরা বহু দশক বেঁচে থেকেছে এবং পরে তাদের কঙ্কালে দেখা গেছে হারপুনটি হাড়ের সাথে একেবারে মিশে গেছে।
এটি প্রমাণ করে যে, শরীর এবং মনের বেঁচে থাকার ইচ্ছা কতটা অদম্য হতে পারে। নিরাময় মানে সবসময় কষ্ট বা ক্ষতকে উপড়ে ফেলা নয়; কখনো কখনো সেই কষ্টের সাথেই নিজেকে মানিয়ে নিয়ে, তাকে ঘিরে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠাটাই আসল বেঁচে থাকা।
প্রকৃতির নিজেরও নিরাময়ের পদ্ধতি আছে, যা অনেক সময় আমাদের জ্ঞান এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের সীমানাকেও ছাড়িয়ে যায়।
চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলন
ভূমি দখল, ধর্মীয় স্বাধীনতার সংকীর্ণতা এবং বিশেষত জোরপূর্বক ধর্মান্তর ঘটনার উল্লেখ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে পাওয়া যায় । সেই সঙ্গে হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরেও তৎকালীন ব্রাহ্মণ্য আচার, বর্ণবৈষম্য এবং কুসংস্কারের এমন অবস্থান তৈরি হয়েছিল, যেখানে সাধারণ মানুষ হিন্দু ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করেছিল এবং সমাজ ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ার দিকে এগোচ্ছিল ।
এই অস্থির সময়ে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা । তাঁর প্রচারিত ভক্তি আন্দোলন হিন্দু ধর্মকে অলঙ্কার-নির্ভর জটিল আচার থেকে মুক্ত করে সহজ, উন্মুক্ত ও সর্বজনীন করে তোলে, যেখানে জাতিভেদ, আচারগত উচ্চাভিলাষ বা ব্রাহ্মণ্য তেমন স্থান পায়নি । কৃষ্ণভক্তির নামে যে প্রেম, সমতা, ভক্তি ও মানবিকতার কীর্তন আন্দোলন নিম্নবর্ণ, অবহেলিত জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে শিক্ষিত ও উচ্চবর্ণীয় শ্রেণি সবাইকে একই ভক্তিধারায় যুক্ত করল। য়, সামাজিক ন্যায়বোধ ও মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধের জন্ম দিল, যা তৎকালীন বাংলার সমাজে অত্যন্ত বিরল ছিল ।
চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলন দ্রুত বাংলার গ্রাম-শহরে ছড়িয়ে পড়ে । তাঁর চারপাশে গড়ে ওঠে এক বিশাল সাহিত্যধারা, বৈষ্ণব পদাবলি, কীর্তন, জীবনী সাহিত্য এবং কৃষ্ণভক্তিকে কেন্দ্র করে নতুন এক কাব্যগত অনুভূতি । বাংলার মধ্যযুগীয় সাহিত্য যদি একটি উজ্জ্বল ধারার জন্ম পেয়ে থাকে, তবে তার একটি বড় অংশই এই বৈষ্ণব ভাবধারার কারণে সম্ভব হয়েছে । চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যভাগবত, রূপ-সনাতন গোস্বামীর তত্ত্বসহ গোড়াপত্তন হয় এক দার্শনিক ও ধর্মীয় শাস্ত্রভিত্তিক আন্দোলনের, যা বাংলার সংস্কৃতিকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয় । চৈতন্যদেবের আবির্ভাব কেবল একটি ধর্মীয় ঘটনা নয়, এটি ছিল বাংলার সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনার ইতিহাসে এক মৌলিক মোড় পরিবর্তন । তাঁর অনুপস্থিতিতে বাংলার হিন্দু সমাজের অস্তিত্ব, আত্মপরিচয়, সাংস্কৃতিক শক্তি ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য আজকের তুলনায় অনেক দুর্বল, অসংগঠিত এবং ইতিহাসের ধাক্কায় আরও ক্ষয়প্রাপ্ত হতো । তবুও চৈতন্য দেব ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাত থেকে রেহাই পাননি, চৈতন্য গবেষকরা অনেকেই বলছেন যে, তাঁকে "পুরীতে হ*/-ত্যা করে লা-/শ গোপন করা হয়েছে" । আজও তাঁর মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করা যায়নি ।
সব ধর্মের একই আলো
ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রাজা রামমোহন রায় বলেছেন যে, "গরুর রং বিভিন্ন হলেও তাদের দুধের রং একই । একইভাবে বিভিন্ন ধর্মের প্রচারকরা ভিন্ন শোনালেও সকল ধর্মের মূল এক ।" (Cows are different colours but the colour of their milk is the same. Similarly, different religious preachers may sound different, but the core of all religions is the same.) অর্থাৎ...গরুর রং বিভিন্ন হতে পারে—কোনোটা সাদা, কোনোটা কৃষ্ণবর্ণ, কোনোটা দুধে-আলতা, আবার কারও গায়ে দাগ থাকে । কিন্তু এই বাহ্যিক পার্থক্য দুধের রং বা গুণমানকে বদলে দেয় না; সকল গরুর দুধই সাদা, পুষ্টিকর ও সমান মূল্যবোধ বহন করে । ঠিক এই উপমার মতোই মানবসমাজে ধর্মের বহুরূপ দেখা যায় । কারও উপাসনা মসজিদে, কারও মন্দিরে, কেউ গির্জায় প্রার্থনা করে, কেউ ধ্যানমগ্ন হয় বৌদ্ধ প্রথায়। তাঁদের প্রার্থনার ভাষা আলাদা, আচার-অনুষ্ঠানের ধরণ ভিন্ন, বাহ্যিক পরিচয়ও কখনও কখনও একে অপরের বিপরীত বলে মনে হয় । তবুও ধর্মগুলির আসল ভিত্তি একই—সৎ পথে চলা, মিথ্যা ত্যাগ, অহিংসা, পরোপকার, ন্যায়বোধ এবং সর্বোপরি এক সর্বশক্তিমানের প্রতি আস্থা।
এই মূল সত্যকে ভুলে গিয়ে মানুষ যখন ধর্মের নামে ভেদাভেদ, ঘৃণা, হিংসা বা কুসংস্কার তৈরি করে, তখন তা প্রকৃত ধর্মবোধকে কলুষিত করে । কারণ কোনো ধর্মই ঘৃণা বা দাঙ্গার শিক্ষা দেয় না, মানুষই তার সংকীর্ণতা, অজ্ঞতা বা রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে বিবাদ সৃষ্টি করে । অথচ সকল ধর্মপ্রচারক—ঋষি, নবী, গুরু বা মুনি—নিজেদের সময় ও সমাজের প্রয়োজন অনুযায়ী উপদেশ দিয়েছেন, আর তাঁদের উপদেশ আলাদা শোনালেও উদ্দেশ্য ছিল একটাই, মানুষকে সত্য, সদাচার ও মানবতার পথে আনানো ।
এই উপমা তাই দেখায় যে বাহ্যিক ভিন্নতার আড়ালে সব ধর্মের অন্তরে একই আলো জ্বলে । ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য মানুষের উন্নতি, মনুষ্যত্বের বিকাশ এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা। তাই ধর্মকে বিভেদের অস্ত্র নয়, ঐক্য ও মানবিকতার সেতুতে পরিণত করাই প্রকৃত ধর্মাচরণের পরিচয় ।