‘গণতন্ত্র আসলে কী? গণতন্ত্র কিভাবে এসেছে?
ব্রিটানিকায় দেওয়া তথ্যমতে, প্রাচীন গ্রিকের অ্যাথেন্স শহরে প্রথম গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত দেখা যায়—যেইখানে প্রায় হাজার নাগরিকের একটি অ্যাসেম্বলির মাধ্যমে সকল সিদ্ধান্ত নেওয়া হইত। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম দিককার অঙ্গরাজ্যগুলিও এই ধরনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা টমাস জেফারসনের 'অন ডেমোক্রেসি' বইটি হুইতে জানা যায় : ১৭৮৯ সালে জেফারসন লিথিয়াছিলেন, 'কতগুলি অধিকার রহিয়াছে, যাহা সরকারের নিকট সমর্পণ করা নিষ্প্রয়োজন, অথচ ঠিক সেইগুলিরই ওপর হস্তক্ষেপ করিতে সকল দেশে সকল ধরনের সরকারকে সর্বদা ব্যস্ত থাকিতে দেখা গিয়াছে। এই অধিকারগুলি হইতেছে—চিন্তার অধিকার, ভাবপ্রকাশের অধিকার, অবাধ বাণিজ্যের অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার।'
বিস্ময়কর ব্যাপার হইল, জেফারসন যখন ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন ফরাসিরা তাহাদের সম্রাটের মস্তকছেদ করিতেছে। জেফারসন যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট, তখন নেপোলিয়ন যুদ্ধের পর যুদ্ধ জয় করিয়া ইউরোপের একচ্ছত্র নায়ক হইবার পথ প্রস্তুত করিতেছেন। জেফারসন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, তখন নেপোলিয়নের স্থলবাহিনী দেশের পর দেশ পদদলিত করিতেছে এবং ইংরেজদের নৌবাহিনী সমুদ্রে ধ্বংসের কাজ চালাইতেছ। দীর্ঘ ২০ বৎসরেরও অধিক সরকারি পদে থাকাকালীন জেফারসন দেখিয়াছেন—পৃথিবীতে কোথাও শান্তি নাই। এজন্য তিনি চাহিয়াছিলেন— গণতন্ত্র কায়েম হউক সারা বিশ্বে। ইহার পূর্বে ১৬৮৯ সালে, ইংল্যান্ডের রাজা-রানি উভয়েই অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করিলেন, যাহা পরিচিত হইল—'বিল অব রাইটস' নামে। এই দলিল কয়েকটি সাংবিধানিক নীতিকে স্বীকৃতি দিল, যাহার মধ্যে ছিল নিয়মিত সংসদ বসানোর অধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচনের অধিকার, এবং সংসদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার। ক্রমশ প্রজাতন্ত্র তথা গণতন্ত্রের পথে হাঁটিল ইংল্যান্ড। ইহার পর সুইজারল্যান্ড এবং অনেক মার্কিন অঙ্গরাজ্য ১৯ শতকে তাহাদের সংবিধানে গণতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করিল।
এই ভারতীয় উপমহাদেশে 'ব্রিটিশ ভারতে' ১৯১৯ সালে ভারত শাসন আইন রচিত হয়— যেইখানে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার কথা প্রথম বলা হয়। অতঃপর ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইহার পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হইল। ১৯৫০ সালে ভারত নিজেকে প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে, যাহার মূল কথা হইল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। অন্যদিকে পাকিস্তানে গণতন্ত্র এবং ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র বারংবার হোঁচট খাইয়াছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩) গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জনমত গঠন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর জোর দেন। তাহার মতে, যদি কোনো একটি মতবাদকে কৃত্রিমভাবে দমন করা হয়, তাহা হইলে সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অভাবও একই ধরনের দমনমূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। মার্কিন ও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট এ ডাহল তাহার polyarchy (পলিআর্কি) নামক ধারণায় রাজনৈতিক অংশগ্রহণের স্বাধীনতা এবং প্রতিযোগিতার গুরুত্বের কথা বলিয়াছেন। তাহার মতে, একটি দেশে যত বেশি রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থী অবাধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে পারিবে, সেই দেশটি তত বেশি গণতান্ত্রিক হইবে; কিন্তু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকিলে গণতন্ত্রের কাঠামো দুর্বল হইয়া পড়ে এবং নানান সমস্যার সৃষ্টি হয়। ইহার ফলে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পায়। জনগণ ভোটদানের আগ্রহ হারায়, কারণ তাহারা মনে করে যে, তাহাদের ভোট কোনো পরিবর্তন আনিতে পারিবে না।
ভারতের বিবাহরীতি
‘ঋগ্বেদ’-এর আনুমানিক রচনাকাল খ্রীস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ১০০০-এর মধ্যে। ‘ঋগ্বেদ’-এ বেশ কয়েকজন নারী কবির নাম জানা যায় – ‘ঘোষা’, ‘শাশ্বতী’, ‘রোমশা’, ‘লোপামুদ্রা’, ‘অপালা’, ‘বিশ্ববারা’ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এ সময় কিছু মহিলা যথেষ্ট সরব ছিলেন এবং পুরুষরা কোনও কুণ্ঠা না করেই ‘নারী কবি’ হিসেবে তাঁদের নাম রক্ষা করেছেন। তবু সভা-সমিতিতে উপস্থিত হওয়ার দস্তুর মেয়েদের ছিল না।
‘যজ্ঞে’ নারীর ভূমিকা ছিল নিতান্ত নীরব। তাঁকে ‘অর্ধেক’ বলার কারণ হল এই যে, যতদিন পত্নী না থাকে ততদিন পুরুষের ভাগ্যে সন্তানলাভও ঘটে না। সুতরাং পত্নীর আসল ‘উপযোগ’ ছিল ‘সন্তান প্রসব করা’। ‘সোমযাগের অগ্নিপত্নীব্রত অনুষ্ঠানে’ একটা লাঠি দিয়ে ঘি-তে আঘাত করা হত। লাঠিটি যেন ‘বজ্ৰ’ আর এই ভাবে দেবতারা তাঁদের পত্নীদের দুর্বল করে দিতেন যাতে আপন শরীরের কিংবা উত্তরাধিকারের উপর পত্নীদের কোনও অধিকার না থাকে। সুতরাং মারধর করলেও পত্নী নিষ্ক্রিয়, নীরব, কেননা এহেন মারধর ছিল ‘যজ্ঞ-অনুমোদিত’।
সেই সময়ের কোনও নারী ‘শিক্ষাদান’ করছেন, এমন কোনও লিখিত প্ৰমাণ অবশ্য নেই। ‘সম্মানীয় ব্যতিক্রম’ নিশ্চয় ছিল।
‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’-এর মূল অংশে অবশ্য কিছু নারীচরিত্র আছেন যাঁরা সরব থেকেছেন। অরণ্যবাসে রামের সঙ্গী হওয়ার জন্য অনুমতি পেতে ‘সীতা’ তাঁর সঙ্গে ‘বিতর্ক’ করেছিলেন। সাবিত্রী’ প্ৰকাশ্য রাজসভায় পিতার সঙ্গে ‘বিতর্ক’ করেছিলেন – নিজের পছন্দ মতো স্বামী নির্বাচনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। সেই সময়ের ‘বারললনাদের’ বাদ দিলে, মেয়েদের কথা খুব কমই কনে তোলা হয়েছিল। তাই সেই সময়ে ‘বারাঙ্গনারা’ সরকারি খরচে শিক্ষালাভ করতেন এবং ‘সমাজে শিক্ষাপ্রাপ্ত নারী’ বলতে শুধু তাঁরাই ছিলেন। পরবর্তী সাহিত্যে মেয়েদের ‘বাল্যবিবাহ’ দেখা যায় ।
সমাজে নারীর প্রতি ‘উপেক্ষা’ ছিল অত্যন্ত তীব্র। এতটাই যে নারী আপন অন্তরে এই অন্যায় ‘সামাজিক বিধান’ মেনে সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে তাঁদের যেন কেউ না শুনে ফেলে। যেমন, ‘খনা’ আপাতদৃষ্টিতে সমাধানের অতীত ‘একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান’ করেছিলেন। ‘রাজা বিক্রমাদিত্য’ এতে এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, তিনি তাঁকে তাঁর রাজসভায় ‘দশম রত্ন’ রূপে গণ্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘খনার স্বামী বরাহমিহির’ তাঁর জিভ কেটে দিয়ে বা তাঁকে দিয়ে কাটিয়ে নিয়ে, সত্যি সত্যি তাঁকে ‘বাক্যহীনা’ করে দিয়েছিলেন, যাতে তিনি তাঁর গুণের জন্য আর প্রশংসা না পান। এই ঘটনাটি সর্বকালের জন্য একটি প্রতীকী তাৎপর্য পেয়েছে। মেয়েরা ‘দর্শনীয়’ হলেও তাঁদের ‘নির্বাক’ হওয়া চাই। পতিব্ৰতা’ ও ‘সতী’ হিসেবে নিজেকে বড় প্রমাণ করার জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতায় মাতেন – ‘চিন্তাশীল হিসেবে’ কিংবা ‘সামাজিক মূল্যাবোধের বিচারক’ হিসেবে নয়। জ
আদিবাসীসমাজ সংগঠিত হয় ‘উপজাতি’ বা ‘ট্রাইবের’ ভিত্তিতে। প্রত্যেক ট্রাইবেরই স্বকীয় ভাষা ও কৃষ্টি আছে। প্রায়ই ট্রাইবগুলি বহু শাখায় বিভক্ত হয়। ট্রাইব ও তার শাখাগুলি সাধারণত অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী। যদি কেউ ট্রাইব বা তাঁর শাখার বাইরে বিবাহ করেন তাহলে তাঁকে ট্রাইব থেকে বহিষ্কৃত করে দেওয়া হয়। ট্রাইব বা তার শাখাগুলি আবার কতকগুলি উপশাখা বা দলে বিভক্ত হয়। এই সকল উপশাখা বা দলগুলি হচ্ছে বহির্বিবাহের গোষ্ঠী। আদিবাসীর মধ্যে বহির্বিবাহের এই গোষ্ঠীগুলি সাধাবণত টোটেমভিত্তিক। তাব মানে প্রত্যেক গোষ্ঠীরই এক একটি নিজস্ব টটেম আছে। একই টোটেমবিশিষ্ট গোষ্ঠীর স্ত্রী-পুরুষ পরস্পরকে বিবাহ করতে পারেন না। তাঁদের বিয়ে করতে হয় অন্য টোটেম গোষ্ঠীতে। অনেক সময় এগুলি গ্রামভিত্তিক হয়। সেরূপ ক্ষেত্রে একই গ্রামের ছেলেমেয়েরা পরস্পরকে বিবাহ করতে পারেন না। কেননা,তাঁদের বিশ্বাস এই যে, একই গ্রামের সকল অধিবাসীর মধ্যে একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে এবং সেই কারণে তাঁদের মধ্যে রক্তের ঐক্যতা আছে।
অনেক জায়গায় আবার বিবাহ ব্যাপারে একটা গ্রাম-ক্রমও দেখতে পাওয়া যায়। যথা, ‘ক’ গ্রামের মেয়ের বিয়ে হয় ‘খ’ গ্রামের ছেলের সঙ্গে আবার ‘খ’ গ্রামের মেয়ের বিয়ে হয় ‘গ’ গ্রামের ছেলের সঙ্গে - এরূপভাবে যেখানে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলি গ্রামভিত্তিক সেখানে এরূপ গোষ্ঠীগুলিকে আদিবাসীদের ভাষায় ‘খেরা’, ‘গোচী’, ‘খেল’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। যেখানে আদিবাসী জীবনের উপর হিন্দু প্রভাব বিস্তারিত হয়েছে সেখানে এগুলিকে ‘গোত’ বা ‘গোত্র’ বলা হয়। হিন্দুদের মতন এই সকল সমাজে বিবাহের পর পুরুষদের গোত্র অপরিবর্তিত থাকে, কেবল বিবাহের পর মেয়েদের গোত্রেরই পরিবর্তন ঘটে। হিন্দুসমাজের সপিণ্ডবিধানের অনুসরণে আদিবাসীদের মধ্যেও অনেকস্থানে আবার পিতৃকুলে বা মাতৃকুলে নির্দিষ্ট পুরুষ পর্যন্ত বিবাহ নিষিদ্ধ আছে। যেমন - উত্তর প্রদেশের ‘ভানটু’দের মধ্যে বিবাহের জন্য মাতামহীর কুলে ছয় পুরুষ বর্জন করার বিধি আছে। মধ্যপ্রদেশের ‘ভীল’জাতির
মধ্যেও মাতৃকুলে দুইপুরুষ বর্জন করার রীতি আছে। এছাড়া তাঁরা পিতামহীর ও মাতামহীর কুলেও তিন পুরুষ বর্জন করেন। ভীলরা ৪১টি বহির্বিবাহের দলে বিভক্ত এবং সেগুলি সবই টোটেমভিত্তিক। মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট ও মাণ্ডালা অঞ্চলের ‘বাইগার’ অনেকগুলি অন্তর্বিবাহের শাখায় বিভক্ত। প্রতি শাখা আবার অনেকগুলি বহির্বিবাহের দলে বিভক্ত। এখানে প্রত্যেক লোককেই নিজ শাখার মধ্যে বিবাহ করতে হয়; কিন্তু তাঁরা নিজ দলে বিবাহ করতে পারেন না, অপর দলে বিবাহ করতে হয়। কেবল তাই নয়, তাঁদের এমন দলে বিবাহ করতে হয় যে-দল তাঁদের মত একই দেবদেবীর পূজা করেন। অনেক জায়গায় আবার কৌলীন্যপ্রথাও প্রচলিত আছে। যেমন মধ্যপ্রদেশের ‘গোণ্ড’জাতির মধ্যে দুটি বিভাগ আছে - ‘রাজগোণ্ড’ ও ‘ধরগোণ্ড’। ধরগোণ্ডের পিতার রাজগোণ্ডে কন্যা দান করেন। কিন্তু রাজগোণ্ডের পিতারা কখনও ধরগোণ্ডে মেয়ে দান করেন না। বস্তার জেলার ‘মারিয়া’দের মধ্যে দলের যে সমস্ত লোক পরস্পরের সহিত ‘দাদাভাই’ সূত্রে আবদ্ধ তাঁদের মধ্যে বিবাহ হয় না। কিন্তু অপর যে দল তাঁদের সঙ্গে ‘মামাভাই’ সূত্রে আবদ্ধ তাঁদের সঙ্গেই বিবাহ হয়।
‘সাঁওতাল’দের মধ্যে এক সময় ১২টি বহির্বিবাহের গোষ্ঠী ছিল। এর মধ্যে একটি এখন লুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে মাত্র ১১টি গোষ্ঠী আছে। এগুলি সবই বহির্বিবাহের গোষ্ঠী। তবে এদের মধ্যে ‘কিসকু’ বা ‘মুর্মূ’ গোষ্ঠীর মর্যাদা অন্য গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক উচ্চ। এছাড়া মানভূমে কোন কোন জায়গায় ধর্মের ভিত্তিতে সাঁওতালরা দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত। এ দুটির নাম ‘দেশওয়ালী’ ও ‘থেরা’। দেশওয়ালীরা নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেয়। আর থেরারা জড়োপাসনার উপর বিশ্বাস রাখেন। দেশওয়ালীদের সঙ্গে থেরাদের কখনও বিবাহ হয় না।
রাঁচী জেলার ‘ওরাঁও’দের মধ্যে বহির্বিবাহের জন্য যে গোত্রবিভাগ আছে সেগুলিকে ‘পরী’ বলা হয়। পরীগুলি টোটেম-ভিত্তিক। এক পরীর ছেলেকে অপর কোন পরীতে বিবাহ করতে হয়। ‘গডাব’ উপজাতির মধ্যেও গোত্রবিভাগকে পরী বলা হয়। একই পরীর মধ্যে তাঁরা কখনও বিবাহ করেন না। এমন কি পরীর ভেতরে ব্যভিচারও গুরুতরভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়।
কাছারের ‘পাহাড়ী কাছারী’রা ২০টি দলে বিভক্ত। এঁদের সাতটি দলকে ‘পুরুষ’ দল বলা হয় আর ১৩টিকে বলা হয় ‘মেয়ে’ দল। এঁদের মধ্যে ছেলেরা কখনও মায়ের দলে ও মেয়েরা কখনও বাপের দলে বিয়ে করতে পারেন না।
যে প্রাচীন ভারতে ‘রাক্ষস’, ‘আস্থর’ ইত্যাদি বিবাহপ্রথা আর্যগণ কর্তৃক আদিবাসী সমাজ থেকেই গৃহীত হয়েছিল। রাক্ষস বিবাহ বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের ভীলজাতির মধ্যে প্রচলিত আছে। এরূপ বিবাহকে ভীলেরা ‘ঘিসকরলেজানা’ বলেন। তার মানে যে বিবাহে মেয়েকে কেড়ে আনা হয়েছে। এরূপ বিবাহের প্রশস্ত সময় ‘ভাগোরিয়া’ উৎসবের দিন। ভাগোরিয়া উৎসব অনুষ্ঠিত হতো হোলিপর্ব উপলক্ষে, ‘মেড়’ পোড়ানোর আগের দিনে। সাধারণত বর বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে কোন গ্রামে প্রবেশ করতেন ও মেয়েটিকে জোর করে কেড়ে নিয়ে আসতেন। তারপর একটা সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহকে নিয়মানুগত করে নেওয়া হত। মধ্যপ্রদেশের চানডা ও বস্তার জেলার ‘গোণ্ড’দের মধ্যেও পূর্বে এরূপ বিবাহ প্রচলিত ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এরূপ বিবাহকে দণ্ডবিধি আইন অনুসারে অপরাধ বলে গণ্য করে শাস্তি দেওয়ার ফলে বর্তমানে আদিবাসীরা সন্ত্রস্ত হয়ে এ সম্পর্কে এক বিকল্প পন্থা অবলম্বন করেছেন। এঁরা প্রথমে বর-কনের মধ্যে বিবাহ স্থির করেন এবং পরে বিবাহ অনুষ্ঠিত হবার সময় পুৰ্বকালেব রীতি অনুযায়ী কনেকে কেড়ে নেওয়ার একটা কপট অভিনয় মাত্র করেন। দক্ষিণ ভারতের ত্রিবাঙ্কুরের ‘মুড় বন’দের মধ্যেও মেয়ে কেড়ে নিয়ে এরকম বিবাহেব প্রচলন আছে।
কন্যা-বিনিময় প্রথা ত্রিবাঙ্কুরের ‘পাহাড়িয়া পান্তারাম’ ও ‘উরালী’দের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে। বস্তুত উরালীদের মধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণভাবে বিনিময় প্রথার উপর স্থাপিত। এঁদের সমাজে কন্যাপণ দিয়ে স্ত্রী পাওয়া যায় না। যখন কোন যুবক বিবাহ করতে চান তখন তাকে নিজের কোন বা অপরের কোন আত্মীয়াকে অপর দলের হাতে সমর্পণ করে তবে স্ত্রী সংগ্ৰহ করতে হয়। এরূপ বোন বা আত্মীয়া যে যুবতী হতে হবে এমন কোন কথা নেই। যে-কোন বয়সের বোন বা আত্মীয়া হলেই চলে, কেবল তাঁকে স্ত্রীলোক হতে হবে। এই কারণে আগেকার দিনে ‘উরালীসমাজে’ কোন যুবকের যতগুলি বোন থাকতো তাঁর ততগুলি বিবাহ করবার সম্ভাবনা ছিল।
আর এক রকমের রাক্ষস বিবাহ আদিবাসীসমাজে প্রচলিত আছে। একে বলা হয় ‘সিন্দুর ঘষা’ বিবাহ। সিন্দুর ঘষা বিবাহ অনেক জায়গায় প্রচলিত আছে। এটা বিশেষ করে প্রচলিত আছে আমাদের ঘরের কাছে সাঁওতালসমাজে। এ বিবাহে পুরুষ হাটে বা বাজারে জোর কবে কোন মেয়ের সিথিতে সিন্দুর ঘষে দেন। সিন্দুর ঘষে দেবার পর উভয়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক হয়ে যায়। মেয়ে যদি বরকে পছন্দ না করে তাহলেও তাঁর সঙ্গে তাকে ঘর করতে হয়। তার কারণ, সিন্দুর-ঘষা মেয়েকে সমাজে আর কেউ বিবাহ করেন না।
‘অসুর বিবাহ’ রাক্ষস বিবাহেরই এক অনুকৌশল মাত্র। যে জায়গায় কোন কারণবশতঃ কন্যা বিনিময় করা সম্ভবপর হতো না সেই জায়গায় কন্যার পরিবর্তে তাঁর মূল্য ধরে দেওয়া হতো, যাতে অপর দল ঐ পণের বিনিময়ে অপর কোন দল থেকে কন্যা ক্রয় করে দলের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে পারত। এইভাবে কন্যাপণ প্রথার উদ্ভব হয়েছিল। কন্যাপণ যে মাত্র টাকা- পয়সাতেই দেওয়া হয়, তা নয়। অনেক সময় কন্যাপণ অন্যরকম ভাবেও দেওয়া হয়। যেমন - শ্রমদান করে। এ সম্পর্কে মনে রাখতে হবে যে পণ দিয়ে মেয়ে কেনা ঠিক ক্রীতদাসী কেনা বা অন্য পণ্যদ্রব্য কেনার মত নয়। কেননা ক্রীতদাসী বা ক্রীত অন্য পণ্যদ্রব্য ক্রেতা আবার বিক্রি করতে পারে। কিন্তু যেখানে কন্যাপণ দিয়ে বিবাহ করা হয় সেখানে মেয়েকে আবার বিক্রি করা যায় না। বস্তুত যা কেনা হয় সেটা হচ্ছে কন্যার সন্তানপ্ৰসবিনী ক্ষমতা। সেই কারণে দেখতে পাওয়া যায় যে, যেখানে স্ত্রী ‘অনুর্বরা’ হয় সেখানে তাঁকে সহজে বিচ্ছেদ করা যায়।
আদিবাসীসমাজে কন্যাপণ প্রথা বহুবিস্তৃত। অনেক উপজাতির মধ্যে বরকে কন্যাপণের পরিবর্তে শ্রমদান করতে হয়। এরূপ বিবাহে বরকে নির্দিষ্টকালের জন্য শ্বশুরবাড়ীতে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমিকের কাজ করতে হয়। এরূপ শ্রমদানের কাল সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বৎসর পর্যন্ত নির্দিষ্ট হয়। কোন কারণে যদি বিবাহ না হয় তা হলে কন্যার পিতাকে বর যে সময়ের জন্য শ্রমদান করেছে সে সময়ের নিমিত্ত প্রচলিত হারে পারিশ্রমিক অমনোনীত বরকে প্রদান করতে হয়। কন্যাপণের বিনিময়ে শ্রমদান যে সকল ক্ষেত্রে বলবৎ আছে সে সকল ক্ষেত্রে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে কন্যার কোন ভাই থাকে না। এসকল ক্ষেত্রে যুক্তি এই যে, যেহেতু মেয়েটি তাঁর বাবাকে কাজে সাহায্য করত সেহেতু তাঁর পিতাকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ বরকে শ্রমদান করতে হবে। মধ্যপ্রদেশের ভীলদের মধ্যে কন্যাপণের বিনিময়ে শ্রমদানের প্রথা প্রচলিত আছে। এঁদের মধ্যে আগেকার দিনে সাধারণত সাত বছর শ্রমদান করতে হত। কিন্তু বর্তমানে শ্রমদানের কাল বাড়িয়ে দিয়ে নয় বছর করা হয়েছে। প্রায়ই দেখা যায় যে দুই তিন বছর শ্রমদানের পর যুবক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। শ্রমদানের সময় যুবক-যুবতী সাধারণতঃ স্বামী-স্ত্রী রূপে বাস করেন। কিন্তু শ্রমদানের নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ না হলে যুবক সাধারণতঃ শ্বশুরালয় ত্যাগ করতে পারেন না। ঝাবুয়ার ‘পাতলিয়া’দের মধ্যে শ্রমদানের নির্দিষ্ট সময় সাত বৎসর। এই নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ হবার পর যুবকযুবতী স্বতন্ত্র গৃহ স্থাপন করে এবং তাঁরা যাতে স্বাধীনভাবে কৃষিকর্ম করতে পারেন তার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সাত বৎসর উত্তীর্ণ হবার আগেই যদি তাঁরা পালিয়ে যান তাহলে বরকে অমৃত্তীর্ণকালের জন্য আনুপাতিক হারে কন্যাপণ দিতে হয়। বিন্ধ্য ও সাতপুর পর্বতমালা অঞ্চলের অধিবাসী ‘ভাললা’ উপজাতিদের মধ্যেও কন্যাপণের বিনিময়ে শ্রমদান প্রথা প্রচলিত আছে। মাণ ডালা ও বালাঘাটের ‘বাইগা’দের মধ্যে ৫ থেকে ৯ টাকা কন্যাপণ দেবার প্রথা আছে, কিন্তু বর যদি অর্থাভাবের জন্য ওই কন্যাপণ দিতে না পারে তা হলে তাঁকে তিন বৎসরের জন্য শ্রমদান করতে হয়। অনুরূপ প্রথা দক্ষিণ ভারতে ‘উল্লাটান’দের মধ্যেও প্রচলিত আছে। এঁদের মধ্যে সাধারণত কন্যাপণ দিয়েই কন্যা সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু বরের যদি কন্যাপণ দেবার ক্ষমতা না থাকে তা হলে তাঁকে শ্রমদান করে স্ত্রী সংগ্রহ করতে হয়। এরূপ শ্রমদান এড়াবার জন্য যুবক অনেক সময় যুবতীকে লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কোন গোপন জায়গায় কিছুকাল বসবাস করেন। এরূপ বসবাসের পর বিবাহ বৈধ বলে গণ্য হয় এবং সমাজে তা স্বীকৃত হয়।
দক্ষিণ ভারতে কিন্তু এমন অনেক উপজাতি আছে যাঁদের মধ্যে মাতৃকুলে বিবাহই হচ্ছে বাঞ্ছনীয় বিবাহ। অন্ধ্রপ্রদেশের মহবুবনগরের ‘চেনচু’দের মধ্যে মামাতো বোন কিংবা পিসতুতো বোনকে বিবাহ করাই প্রচলিত রীতি। তবে তাঁরা খুড়তুতো কিংবা জাঠতুতো বোনকে কখনও বিবাহ করেন না। মাণ ডালা ও বালাঘাট অঞ্চলের ‘বাইগার’ মাত্র পিসতুতো বোনকেই বিবাহ করেন, মামাতো বোনকে নয়। ‘মুরিয়া’দের মধ্যে পিসতুতো ও মামাতো উভয় বোনকেই বিবাহ করার রীতি আছে। মাত্রার ‘পালিয়ান’দের মধ্যে বিবাহ হয় মামাতো বোন বা ভগ্নীর সহিত, পিসতুতো বোনের সঙ্গে কখনও নয়। কিন্তু কোচিনের ‘কাদার’দের মধ্যে পিসতুতো বোনের সঙ্গেও বিবাহের চলন আছে। ত্রিবাঙ্কুরের ‘মুড় বন’দের মধ্যে এরূপ বিবাহই একমাত্র রীতি। ত্রিচুরের ‘মলপুলায়ণ’ ও ‘মলবেদন’দের মধ্যেও এরূপ বিবাহের রীতি আছে। ত্রিবাঙ্কুরের ‘উলুড়ণ’রা মাত্র পিসতুতো বোনকে বিবাহ করেন কিন্তু ‘মলকুরুবন’রা পিসতুতো বোনকে বিবাহ করেন না। তাঁরা মামাতে বোনকেই বিবাহ করেন। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, মামাতোপিসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহের উৎপত্তি হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। এরূপ বিবাহের দ্বারা খরচপত্র এড়ানো যায় ও সম্পত্তি অক্ষত অবস্থায় রাখা যায়। এই কারণে পিতার দিক থেকে তাঁর বোনের মেয়ের সঙ্গে এবং মাতার দিক থেকে তাঁর ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে বিবাহে উৎসাহ দেওয়া হয়। আবার অনেকে অল্পমান করেন যে কন্যা বিনিময় দ্বারা ‘পালটি’ বিবাহের রীতি থেকেই এরূপ বিবাহের উৎপত্তি হয়েছে।
একাধিক স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার রীতি নীলগিরি পাহাড় অঞ্চলের ‘টোডা’দের মধ্যে প্রচলিত আছে। ত্রিবাঙ্কুরেব ‘মুড় বন’, ‘মল-পুলায়ণ’ ও ‘মল-আরয়ন’দের মধ্যেও বহুপতিক বিবাহ একসময় প্রচলিত ছিল, কিন্তু এখন তা বিরল। ‘উল্লাটান’দের মধ্যেও ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতি গ্রহণ কখন কখনও দেখা যায়, যদিও ওটা তাঁদের মধ্যে সাধারণ রীতি নয়। হিমালয়ের সীমান্ত প্রদেশের কয়েকটি উপজাতির মধ্যেও বহুপতিক বিবাহ প্রচলিত আছে। টোডাদের মধ্যে অন্তর্বিবাহমূলক দুটি বিভাগ আছে। এ-দুটি বিভাগের নাম হচ্ছে ‘টারথার’ ও ‘টিভালি’। ‘টারথার’গণ নিজেদের ‘টিভালি’ অপেক্ষা উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন বলে মনে করেন। দুটি বিভাগই হচ্ছে অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী। তার মানে টারথারদের সঙ্গে টিভালিদের কখনও বিবাহ হয় না। টারথারদের বিভাগে ১২টি ও টিভালিদের বিভাগে ৬টি গোত্র আছে। বিবাহ সব সময় নিজ গোত্রের বাইরে হয়। ‘টোডা’দের মধ্যে মামাতে ও পিসতুতো বোনের সঙ্গে বিবাহের রীতিও প্রচলিত আছে। কিন্তু টোডাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যমূলক বৈবাহিক আচরণ হচ্ছে বহুপতি গ্রহণ।
টোডাদের মধ্যে যে বহুপতিক বিবাহের চলন আছে তা হচ্ছে ভ্রাতৃত্বমূলক। তার মানে একাধিক ভ্রাতা একজন স্ত্রীলোককে বিবাহ করেন। অনেক সময় ভ্রাতৃগণ সহোদর না হয়ে দলভুক্ত ভ্রাতাও হন। টোডাদের মধ্যে সন্তানের পিতৃত্ব ‘পুরুসুৎ পুমি’ নামে এক অনুষ্ঠানের দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। স্ত্রীর ৭ মাস গর্ভকালে স্বামীদের মধ্যে একজন ধনুর্বান নিয়ে এই অনুষ্ঠান নিম্পন্ন করেন এবং সেই জাতসন্তানের পিতারূপে পরিচিত হন। যতদিন না অপর কোন স্বামী অনুরূপ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করছেন ততদিন অনুষ্ঠানকারী স্বামীই সমাজে সন্তানের পিতারূপে গণ্য হন। যেক্ষেত্রে স্বামীরা সকলে একত্রে বাস করে না বা ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে বাস করেন সে-ক্ষেত্রে স্ত্রী পালা করে প্রত্যেক স্বামীর সঙ্গে একমাস কাল করে বাস করেন।
কাশ্মীরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত লাদাখ উপত্যকার অধিবাসী ‘লাদাকি’দের মেয়েরাও বহুপতি গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সাধারণত জ্যেষ্ঠ ভাইই বিবাহ করেন কিন্তু সেই বিবাহিতা স্ত্রী তাঁর কনিষ্ঠ ভাইদেরও স্ত্রীরূপে পরিগণিত হন। তবে যেখানে অনেকগুলি ভাই থাকেন সেক্ষেত্রে ওই সম্পর্ক মাত্র তিন চার ভাইদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়। এরূপ ক্ষেত্রে পরবর্তী ভাইয়ের কোন মঠের অন্তর্ভুক্ত হয়ে লামার জীবনযাপন করেন। তবে যেক্ষেত্রে কনিষ্ঠ ভাই এরূপভাবে মঠে প্রবেশ করেন না সেক্ষেত্রে সে ‘মাগপা’ স্বামী হিসাবে কোন মেয়েকে বিবাহ করতে পারেন। ‘মাগপা’ স্বামীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়। তাঁকে সব সময় স্ত্রীর বশীভূত হয়ে থাকতে হয় এবং স্ত্রী যখন খুশী তখন তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে আবার নূতন ‘মাগপা’ গ্রহণ করতে পারেন। তবে দ্বিতীয় স্বামীর অবস্থাও প্রথম স্বামীরই অনুরূপ হয়। তাঁর সঙ্গেও স্ত্রী যে কোন সময় খুশীমত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে পারেন।
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলে ‘লেপচা’জাতির মধ্যেও বহুপতিক বিবাহ সীমিতভাবে প্রচলিত আছে। এ সম্পর্কে এদের মধ্যে প্রথার কিছু বৈচিত্র্য আছে। সাধারণত কোন ব্যক্তি যখন চাষবাসের কাজ একা করতে অসমর্থ হয় বা তাঁকে অন্য কাজে ব্যাপৃত থাকতে হয় তখন সে প্রতিবেশীদের মধ্য থেকে কোন অবিবাহিত যুবককে তাঁর মাঠের কাজ করবার জন্য এবং তাঁর দাম্পত্য শয্যার অংশীদার হতে আহ্বান করে নেয়। এক্ষেত্রে কোন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না। এই দ্বিতীয় স্বামী কখনও নিজের বাবদে স্বতন্ত্র বিবাহ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে প্রচলিত রীতি হচ্ছে এই যে, স্ত্রী পর্যায়ানুক্রমে একান্তর রাত্রিতে প্রত্যেক স্বামীর সঙ্গে শয্যা গ্রহণ করবেন। তবে যে-কোন স্বামীর দ্বারা সন্তান উৎপন্ন হউক না কেন সে সন্তান প্রথম স্বামীর ঔরসজাত বলে পরিচিত হবে। কেবল প্রথম স্বামী যদি দীর্ঘকালের জন্য বিদেশে যান এবং তাঁর দ্বারা সন্তান উৎপাদন অসম্ভাব্য হয় তা হলে সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্বামীকেই সন্তানের পিতা বলে গণ্য করা হয়।
হিমালয়ের পাদদেশের জৌনসর বেওয়া অঞ্চলের ‘খস’ জাতীয় অধিবাসীদের মধ্যেও বহুপতি গ্রহণ প্রথা প্রচলিত আছে। উত্তর ভারতের ‘জাট’জাতির দরিদ্রশ্রেণীর মধ্যে ও কেরালার 'নায়ার’দের মধ্যে বহুপতিক বিবাহ দেখা যায়। কেরালার স্বর্ণকার বৃত্তিধারী ‘আশরী’জাতির মধ্যেও ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতিক বিবাহের চলন আছে। ভারতের বাইরে তিব্বতেও বহুপতিক বিবাহ আছে। প্রাচীন আর্যদের মধ্যেও যে বহুপতিক বিবাহের প্রথা ছিল। এক সময় এরূপ বিবাহ ইউরোপেও প্রচলিত ছিল।
মধ্যপ্রদেশের ‘ভীল’দের মধ্যে ১৫ থেকে ৪০ বছর হচ্ছে মেয়েদের বিবাহের প্রচলিত বয়স। ত্রিবাঙ্কুরের উপজাতি সমূহের মধ্যে ১৫ বৎসরের পূর্বে কখনও মেয়েদের বিবাহ হয় না। প্রায় সমস্ত আদিবাসীসমাজেই মেয়েদের বিবাহের বয়স পনেরোর বেশী।
বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রথা আদিবাসীসমাজেও প্রচলিত আছে। মধ্যপ্রদেশের ‘ভীল’দের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রায়ই ঘটে থাকে। তাঁদের মধ্যে যে কোন কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। তবে যেক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ স্বরূপ স্ত্রীর চরিত্রের উপর দোষারোপ করা হয়, সে-ক্ষেত্রে স্বামী গ্রামের পঞ্চায়েতকে ডেকে তাঁর সামনে নিজের মাথার পাগড়ি থেকে একখণ্ড কাপড় ছিঁড়ে নিয়ে স্ত্রীকে দেয় এবং বলে যে, যেহেতু তাঁর চরিত্রে তাঁর আর আস্থা নেই সেইহেতু সে তাঁকে পরিহার করছে এবং ভবিষ্যতে সে তাঁকে ভগ্নীরূপে দেখবে। স্ত্রী ওই কাপড়ের টুকরাটি পিতৃগৃহে নিয়ে গিয়ে ঘরের চালের আড়ায় একমাস কাল ঝুলিয়ে রাখে। এর দ্বারা প্রচার করা হয় যে তাঁর পূর্বস্বামী তাঁকে পরিহার করেছে এবং সে এখন দ্বিতীয়বার পতিগ্রহণের অধিকারিণী। একথা এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বিবাহ-বিচ্ছেদের সময় স্বামী তাঁর দেওয়া কন্যাপণ ফেরত নিয়ে নেয়।
‘ভানটু’দের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয় বটে কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদ খুব আনুকুল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয় না। উড়িষ্যার ‘পরোজা’জাতির মধ্যে স্ত্রী যদি স্বামীকে পছন্দ না করে বা তাঁর সঙ্গে তাঁর বনিবনা না হয় তবে তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয় স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হবার জন্য। এঁদের মধ্যে স্ত্রী যদি স্বামীকে পরিহার করে তবে তাঁকে বাধ্য করা হয় ৫ টাকা অর্থদণ্ড দিতে আর স্বামী যদি স্ত্রীকে বর্জন করে তবে তাঁকে মাত্র এক টাকা অর্থদণ্ড দিতে হয়। ত্রিবাঙ্কুরের জাতিসমূহের মধ্যেও বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রচলিত আছে। কাশ্মীরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত লাদাখ উপত্যকার অধিবাসীদের মেয়েরাও খুশীমত বিবাহ বিচ্ছিন্ন করতে পারেন।
বিধবা বিবাহ আদিবাসীসমাজে খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। মধ্যপ্রদেশের ‘ভীল’জাতির মধ্যে এরূপ কোন বিশেষ ব্যক্তি বা আত্মীয়ের সঙ্গে বিবাহ বাধ্যতামূলক নয়। তাঁদের মধ্যে বিধবার সম্মতি পেলে বিবাহপ্রার্থী ব্যক্তি ৪৫ জন বন্ধু-বান্ধবসহ কিছু উপহার সামগ্রী ও বস্ত্র নিয়ে বিধবার বাড়ী যায় ও বিধবার ভাইয়ের স্ত্রীকে বা তাঁর পিসিকে সাত পয়সা দক্ষিণা দেয়। এরূপক্ষেত্রে ভাইয়ের স্ত্রী বা পিসি সধবা হওয়া চাই। তারপর ভোজ ও মদ্য পান করে বিবাহ নিম্পন্ন করা হয়। এরূপ বিবাহ সাধারণতঃ রাত্রিকালে হয় এবং নবপরিণীত বিধবা- কখনও দিবালোকে তাঁর স্বামীর গৃহে যায় না। কেননা, তাঁদের বিশ্বাস যে দিবালোকে স্বামীগৃহে গেলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়। এরূপ বিবাহের পর বিধবার বা তাঁর ছেলেদের প্রথম স্বামীর সম্পত্তিতে কোন উত্তরাধিকার থাকে না। যেক্ষেত্রে এরূপ বিবাহ দেবরের সঙ্গে হয় সেক্ষেত্রে যদি প্রথম স্বামীর ছেলে থাকে তা হলে দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসজাত সন্তান কখনও প্রথম স্বামীর সম্পত্তি পায় না। কিন্তু যদি প্রথম স্বামীর কোন ছেলে না থাকে তাহলে দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসজাত সন্তানরাই প্রথম স্বামীর সম্পত্তির অধিকারী হয়৷ ‘ভীল’দের মধ্যে বিধবা বিবাহও প্রচলিত আছে; কিন্তু এঁদের মধ্যে হিন্দুসমাজ দ্বারা প্রভাবান্বিত উচ্চশ্রেণীর লোকেরা এর অনুমোদন করে না। বারওয়ানির ‘পাতলি’, ‘রথিয়া’ ও ‘তারভি’জাতি সমূহের মধ্যেও বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। নীলগিরির ‘কুরুস্ব’রাও বিধবা বিবাহ অনুমোদন করে। উড়িষ্যার ‘পরোজা’দের মধ্যে বিধবাকে বাধ্যতামূলকভাবে দেবরকে বিবাহ করতে হয়। বিধবা যেক্ষেত্রে দেবরকে বিবাহ করতে অস্বীকৃত হন সেক্ষেত্রে বিধবা যাঁকে বিবাহ করবেন তাঁকে পঞ্চায়েত কর্তৃক নির্দিষ্ট অর্থদণ্ড দেবরকে দিতে হয়। ত্রিবাস্কুরের ‘মুড় বন’দের মধ্যেও বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে তবে এঁদের মধ্যে দেবর বা অন্য কোন স্বজনকে বিবাহ করা সম্বন্ধে কোন বাধ্যতামূলক নিয়ম নেই। কিন্তু ত্রিবাঙ্কুরের ‘মান্নান’দের মধ্যে এই নিয়ম প্রচলিত আছে। তাবার ত্রিবাঙ্কুরের ‘কুরুস্ব পুলায়ান’দের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতারও অধিকার আছে কনিষ্ঠ ভ্রাতার বিধবাকে বিবাহ করবার। কিন্তু ‘উল্লটন’রা মাত্র দেবরকেই বিবাহ করার অনুমতি দেন। আসামের ‘গারো’দের মধ্যে জামাতা কর্তৃক বিধবা শ্বাশুড়ীকে বিবাহ করার রীতি আছে। আসামের ‘বাগনি’, ‘দাফল’ ও ‘লাখের’দের মধ্যে পিতার মৃত্যুর পর বিধবা-বিমাতাকেই সন্তান স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে। এ সমাজে পুরুষ সাধারণতঃ অল্পবয়স্ক মেয়েকে বিবাহ করেন, যাতে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে কন্যাপণ এড়িয়ে বিমাতাকে স্ত্রীরূপে ব্যবহার করতে পারে। মধ্যপ্রদেশের ‘ভানটু’দের মধ্যে বিধবার যদি অনেকগুলি ছেলেমেয়ে থাকে তাহলে সে বিবাহ না করে অপর পুরুষের সঙ্গে যথেচ্ছা যৌনসঙ্গমে প্রবৃত্ত হতে পারে।
সংসার ধর্ম
লালন দর্শন হচ্ছে বস্তুবাদ ও ভাববাদের সমন্বয়। এখানে সন্ন্যাসব্রতের স্থান নেই। সন্ন্যাসব্রত হচ্ছে বস্তুগত ও ইন্দ্রিয় ভোগ- বিলাস, কামনা-বাসনা ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক সাধনায় জীবন অতিবাহিত করা। যিনি সন্ন্যাসব্রত পালন করেন তিনিই সন্ন্যাসী। এরা জগৎ জীবনের প্রতি, সংসারের প্রতি, সম্পত্তির প্রতি, জাগতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি উদাসীন। এরা সংসার, পিতামাতা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ত্যাগ করে সর্বক্ষণ ঈশ্বরের চিন্তায় বিভোর থাকেন। বাউল, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং ইসলাম ধর্মেও সন্ন্যাসব্রতের প্রচলন রয়েছে। যেমন – বৈষ্ণব ধর্মে বৈরাগী, বৌদ্ধধর্মে ভিক্ষু, খ্রিষ্টধর্মে মংক- নান, ইসলাম ধর্মে পির, ফকির, দরবেশ। এরা নিজেদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে কৃচ্ছসাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। ভিক্ষাবৃত্তি বা পরের দানকৃত বৃত্তি অবলম্বন করেই তারা নিজেদের আহার জোগাড় করেন, জীবন ধারণ করেন। এরা সমাজের মূল স্রোতের বাইরে জীবনযাপন করেন।
ভিক্ষু, বৈরাগী, মংক ও নানরা বিয়ে করত না এবং করতে পারত না। তারা মঠ, মন্দির, গির্জায় সেবাদাস ও সেবাদাসী হিসেবে জীবন অতিবাহিত করত। খ্রিষ্টান প্রোটেস্টান্ট ধর্মের প্রবর্তক মার্টিন লুথার যাজকদের বিয়ে করার অনুমতি দেন এবং নিজেও বিয়ে করেন। অনেক বাউলও আছেন তারা বিয়ে করেন না, করলেও সন্তান উৎপাদন করেন না। তারা ইহজগৎকে তুচ্ছ মনে করেন। এমনকি গৌতম বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য স্ত্রী-পুত্র, পিতামাতা, সংসার ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতী হয়েছেন। লালন এ ধরনের সন্ন্যাসব্রতের বিরোধী।
স্বামী-স্ত্রী একমত না হলে মুরিদ হওয়া যায় না, সাধক হওয়া যায় না।’ সাধু হতে হলে, সাধনা করতে হলে সাধন সঙ্গিনী লাগে। নারী হচ্ছে পুরুষের অর্ধাঙ্গ। অর্ধাঙ্গ বাদ দিলে থাকে অর্ধাঙ্গ। পূর্ণাঙ্গ না হলে সাধন হয় না, সাধুও হওয়া যায় না। সঙ্গিনী ব্যতীত জীবন যেখানে অপূর্ণাঙ্গ, সেখানে সাধন-ভজন হয় কেমনে? বিশাখা নামে লালনের একজন স্ত্রী বা সাধনসঙ্গিনী ছিল। পিয়ারী নামে এক কন্যাকে লালন দত্তক নিয়েছিলেন। তাকে তার প্রিয় শিষ্য ভোলাই শাহের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। সবকিছু ত্যাগ করে সাধনা করতে হবে, তাতে মুক্তি মিলবে—এ ধরনের সাধনা ও মুক্তির কথা লালন দর্শনে নেই।
মার্কসীয় বস্তুবাদী দর্শনের মূল কথা হচ্ছে, জীবনের মূল উদ্দেশ্য আনন্দ বা শান্তি প্রাপ্তি। এর জন্য দরকার পণ্য বা বস্তুর। বস্তুর জন্য দরকার উৎপাদন। উৎপাদনের জন্য দরকার শ্রম। তাহলে মানুষ শ্রম দিয়ে বস্তু উৎপাদন করবে, তারপরে তা ভোগ করবে। আনন্দের জন্য দরকার ভোগ, ভোগের জন্য দরকার বস্তু, বস্তুর জন্য দরকার উৎপাদন এবং উৎপাদনের জন্য দরকার শ্রম।
এলোমেলো ভাবনা-১
জাপানে প্রবীণদের বলা হয় 'living treasure' তথা জীবন্ত সম্পদ। চীনের কনফুসীয় দর্শনে প্রবীণদের পরিবার ও সমাজের ভিত্তি বলা হয়েছে।
আধুনিক জীবন যেন একটি প্রেশার কুকারের মতো-যেখানে অল্প সময়ে কাজ সম্পন্ন হয়; কিন্তু সেফটি ভালভ নষ্ট হইলে বিস্ফোরণ ঘটে। ইতিহাসে বহু মনীষী প্রবল মানসিক চাপে পিষ্ট হইয়াও আত্মনিয়ন্ত্রণে বিজয়ী হইয়াছেন। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল যুদ্ধকালীন দুশ্চিন্তা সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন- 'আমার জীবনের দুশ্চিন্তাগুলির অধিকাংশই কখনো ঘটেই নাই।' লেবাননের কবি খলিল জিবরান লিখিয়াছেন-'আমাদের উদ্বেগ ভবিষ্যতের কারণে আসে না: আসে ইহাকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা হইতে।' আবার জে কে রাউলিং বলিয়াছেন- 'কোনো কিছুতে ব্যর্থ না হইয়া বাঁচিয়া থাকা অসম্ভব।' এই উক্তিগুলির সারমর্ম-ব্যর্থতা ও চাপ জীবনেরই অংশ এবং ইহাদের মূল্যও অপরিসীম।
খাবারের অভাবের চেয়ে ভালোবাসা ও যত্নের অভাবেই মানুষ বেশি কষ্ট পায়। ধনীরাও আন্তরিক মমতার জন্য হাহাকার করে। অর্থনীতির চাকা ঘুরছে বটে, কিন্তু সেই চাকায় অনেকেই পিষ্ট হচ্ছে।
নেলসন ম্যান্ডেলার এই কথাটি জগদ্বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ: 'এডুকেশন ইজ দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল উইপন হুইচ ইউ ক্যান ইউজ টু চেইঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড। অর্থাৎ পৃথিবীর পরিবর্তন আনয়নে শিক্ষা হইল শক্তিশালী হাতিয়ার। এই জন্য প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসকে আমরা বলিতে দেখি 'দেয়ার ইজ নাথিং পারমানেন্ট এক্সেপ্ট চেইঞ্জ'। আসলে এই পৃথিবীতে পরিবর্তন ছাড়া কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নহে। নিডো কিউবিন নামে একজন মার্কিন উদ্যোক্তা বলিয়াছেন, 'চেইঞ্জ ব্রিংস অপোরচুনিটি'। সত্যিই পরিবর্তনের ফলে সুযোগ তৈরি হয়। যাহারা সুযোগসন্ধানী তাহারাই ইহার প্রকৃত সদ্ব্যবহার করিতে পারেন। এই জন্য চেইঞ্জ বা পরিবর্তন এত দামি স্লোগান ।
ভেঙে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির কাঠামো
আগেকার সময়ে বই পড়ার জন্য গ্রামগঞ্জে ক্লাব ছিল এবং জ্ঞান বিতরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার আসর বসত। ওই সময়ে স্কুলপড়ুয়া একটি ছেলে গ্রামের সবার ছেলে হিসেবে থাকত। কোনোদিন যদি সে ছেলে গোপনে ধূমপান করত এবং তা কারও চোখে পড়ত, তিনি তো বকা দিতেনই এবং খবরটা তাঁর বাবা-মা পর্যন্ত চলে আসত। এটিই হলো সমাজের অনুশাসন, আমাদের সংস্কৃতি। আজ আমাদের সেই সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। কে শোনে কার কথা! আমাদের হাতে আজ প্রযুক্তি। অফুরন্ত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত। ফলে তাদের সামাজিক যোগাযোগ কমে যায়; পড়ালেখায় মনোযোগ ব্যাহত হয়। দীর্ঘ সময় মোবাইল স্ক্রিনে থাকলে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, ঘুমের ব্যাঘাত ও একাকিত্ব বাড়ে। ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রামের লাইক বা কমেন্ট আসক্তি তৈরি করে, যা অবচেতনভাবে আত্মমর্যাদা কমিয়ে দেয়। চোখের সমস্যা, ঘাড়, মেরুদণ্ড ও আঙুলে ব্যথা, ঘুমের ব্যাঘাত ও স্থূলতা বাড়ে।
ডিজিটাল যুগ ধীরে ধীরে ভেঙে দিচ্ছে আমাদের সামষ্টিক সংস্কৃতির কাঠামো। চায়ের দোকান, উঠোনের আড্ডা, পাড়ার বা শহরের লাইব্রেরিতে বসে বই পড়া, ঈদ বা দুর্গাপূজা উৎসব– এসব জায়গায়ই তো জন্ম নেয় আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু এখন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে মানুষ ক্রমে একাকী হয়ে পড়ছে। সম্পর্কগুলো স্ক্রিনে সীমাবদ্ধ। এতে সমাজের বন্ধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য জরুরি একটি সংস্কৃতি-সচেতন ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সচেতন মিডিয়া ব্যবহারের অভ্যাস তৈরি করা এবং সেই শিল্পী ও রূপকারদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া,
আমাদের জনসংখ্যা ও জনসম্পদ
‘গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ আর ঘরভরা সন্তান’—এই ছিল একসময় বাঙালির আদর্শ সুখী পরিবারের প্রত্যাশা। এখন গোয়ালভরা গরুও নেই, পুকুরভরা মাছও নেই, গোলাভরা ধানও নেই। তবে সুখের কথা, ঘরভরা সন্তানের কোনো অভাব নেই। এ দেশ ‘ফেরেশতা’ এলেও চালাতে পারবেন না, কারণ এ দেশে শুধু মেট্রোরেলের নিচে যত মানুষ রাত যাপন করে, পৃথিবীর বহু দেশেও এত মানুষ নেই। ভারতের বিখ্যাত লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী খুশবন্ত সিংয়ের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘...আমি মোটামুটি নিশ্চিত, আজকের দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, বস্তি, দুর্নীতি ও অপরাধ—এসবের বেশির ভাগই অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং আমরা যে আত্মঘাতী হারে সন্তান জন্ম দিচ্ছি, তার ফল।’ কথাগুলো আমাদের ক্ষেত্রেও শতভাগ প্রযোজ্য। বেঁচে থাকার অধিকার সবার আছে। স্বাভাবিক পন্থায় সুযোগ না পেলে যেকোনো পন্থায় সে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবেই। চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস ইত্যাদির জন্মও এভাবেই। তবে ‘কচু কাটতে কাটতে ডাকাত’—একপর্যায়ে বেঁচে থাকার এ যুদ্ধ ওপরে ওঠার সংক্ষিপ্ত পন্থা হয়ে ওঠে। বহু বিত্তশালীর উত্থানের পেছনেও এই শর্টকাট পন্থা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। উইনস্টন চার্চিলের একটি মন্তব্য মনে পড়ছে, ‘ইন্ডিয়ান্স ব্রিড লাইক রেবিট’ (ভারতীয়দের প্রজনন ইঁদুরের মতো) । মন্তব্যটি আমাদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক এবং ক্ষুব্ধ হওয়াও স্বাভাবিক, কিন্তু কথাটি কি একেবারেই মিথ্যা? আমরা জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করব, লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করব—এসব জনতুষ্টিমূলক মেঠো বয়ান অনেক শুনেছি। যাঁরা এসব আশ্বাসবাণী শোনান, তাঁরা নিজেরাও জানেন যে, বৈদেশিক ঋণ আর সরকারি ব্যয় মেটাতে মিঠাতেই পরের বাজেট এসে পড়ে, এইসব করবে কোথা থেকে?
পাঁচ ধাপে বয়স অতিক্রম করে মস্তিষ্ক
মানব মস্তিষ্কের বয়স বিভিন্ন ধাপে বৃদ্ধি পায়, যার মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো আসে ৯, ৩২, ৬৬ ও ৮৩ বছর বয়সে। সম্প্রতি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ৪ হাজার মানুষের মস্তিষ্ক স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে এই চমকপ্রদ তথ্য উদঘাটন করেছেন। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ‘নেচার কমিউনিকেশনস’-এ ।
শৈশবকাল (জন্ম থেকে ৯ বছর): এ সময়ে মস্তিষ্ক দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তবে মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত সংযোগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এই সময়ের মস্তিষ্ক কাজ করে এক শিশু হিসেবে, যা অগোছালোভাবে কাজ করার মতো।
কৈশোর (৯ থেকে ৩২ বছর): এই পর্যায়ে মস্তিষ্কের কোষগুলোর সংযোগ আরও দক্ষ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে, এই সময়ের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বেশি থাকে। নতুন গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, মস্তিষ্কের কৈশোর শেষ হয়ে যায় ১৮-১৯ বছর বয়সে, তবে তা প্রকৃতপক্ষে ৩০ বছর বয়স পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে।
প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থা (৩২ থেকে ৬৬ বছর): এই সময়কালে মস্তিষ্কের পরিবর্তন কম হয়ে যায় এবং এটি বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্বের এক স্থিতিশীল অবস্থানে পৌঁছে যায়। এই ধাপটি দীর্ঘস্থায়ী- ৩২ থেকে ৬৬ বছর বয়স পর্যন্ত।
বার্ধক্যের শুরু (৬৬ থেকে ৮৩ বছর): এই পর্যায়ে মস্তিষ্কের সক্ষমতা কমতে শুরু না করলেও, মস্তিষ্কের কোষের সংযোগের ধরনে পরিবর্তন আসে। মস্তিষ্কের অংশগুলো একত্রে কাজ না করে, আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করতে থাকে। ডিমেনশিয়া ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে।
বার্ধক্যের শেষ (৮৩ বছরের পর): এই সময় মস্তিষ্কে আরও স্পষ্ট পরিবর্তন ঘটে, যা আগের পরিবর্তনের মতোই তবে অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়, এবং বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক সমস্যা বৃদ্ধি পায়।
আমাদের সংস্কৃতিতে বক্তার মূল্য বেশি; কর্মীর মূল্য কম
প্রকৃত ‘ডুয়ার’ শুধু ভাবনা বা কথায় সীমাবদ্ধ থাকেন না; বরং দ্রুততা, দক্ষতা ও কার্যকারিতার সঙ্গে কাজ সম্পন্ন করেন। তারা হাতে-কলমে বাস্তবায়নে মনোযোগী এবং পরিকল্পনা থেকে ফল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যেতে সক্ষম। ডুয়াররা উদ্যোগী ও লক্ষ্যনিষ্ঠ। তারা স্পষ্ট, পরিমাপযোগ্য লক্ষ্য নিষ্ঠার সঙ্গে অর্জনে মনোনিবেশ করেন। তারা বাধাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে দ্রুত কার্যকর সমাধান বের করেন। তারা ফলমুখী, নির্ভরযোগ্য এবং দায়িত্ব গ্রহণে দ্বিধাহীন। সমাজ বা পেশাগত যে কোনো প্রেক্ষাপটে তারা পরিবর্তনের চালিকাশক্তি।
বাংলাদেশের উন্নয়নের বড় বাধা সম্পদের ঘাটতি নয়; বরং প্রকৃত কাজের মানুষ বা ডুয়ারদের অভাব। আমরা চিন্তা করি, আলোচনা করি, পরিকল্পনা করি; কিন্তু বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ি। আমাদের সমাজে পরিকল্পনা, সভা, পরামর্শ ও প্রতিশ্রুতির ঘাটতি নেই। কিন্তু কাজ শুরু করতে গেলেই অজুহাতের বন্যা– সময় নেই, সুযোগ নেই, পরিবেশ নেই। তারাই ডু-নাথিং শ্রেণি। ডুয়ার শ্রেণি অজুহাত খোঁজেন না; বরং সুযোগ তৈরি করেন।
কথার ফুলঝুরি নয়; সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে দরকার কর্মমুখী মানুষ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, সামাজিক সুরক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংখ্য নীতি ও কৌশল প্রণীত হয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের দৃশ্য প্রায়ই হতাশাজনক। সমস্যা নীতিতে নয়; কাজের মানুষের ঘাটতিতে। আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো এখনও ‘ফাইল সংস্কৃতি’ দ্বারা প্রভাবিত। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি, দায় এড়ানোর প্রবণতা, ব্যর্থতার ভয় মিলিয়ে কাজের গতি কমে যায়। একজন প্রশাসক তখনই প্রকৃত ডুয়ার হন যখন তিনি ঝুঁকি নেন, মাঠে নামেন এবং ফলের দায় স্বীকার করেন। অনেক তরুণ ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ– লাইক, শেয়ার, কমেন্টে। বাস্তব সমস্যার সমাধানে তাদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। এই প্রবণতা বদলাতে হবে।
‘জাহাঙ্গীর নগর থেকে ঢাকা (বাংলার সামাজিক অবস্থা)
সপ্তদশ শতাব্দীকে বাঙালীর অবক্ষয়ের কাল বলা যেতে পারে। গৌতম বুদ্ধ যেমন তাঁর মতবাদ সম্পর্কে নিজে কিছুই লিখে যাননি, শুধু তাঁর ভক্তের দলকে মৌখিক উপদেশই দিয়েছিলেন; চৈতন্য দেবও তেমনি ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব পন্থা’ সম্পর্কে নিজে কিছুই লিখে যাননি। এর ফলে বৌদ্ধমতের দুটি শব্দের, অর্থাৎ ‘নির্বাণ’ ও ‘করুণা’র তাৎপর্য নিয়ে পরবর্তীকালে বৌদ্ধ মতালম্বীদের মধ্যে প্রবল মতদ্বৈধ সৃষ্টি হয়েছিল; যার ফলে মহাযান পন্থার জন্ম হয়েছিল, যা কালক্রমে সহজযানের আবিলতায় পর্যবসিত হয়েছিল; এবং সেই আবিলতার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে বৌদ্ধধর্ম ক্রমে রসাতলে গিয়েছিল। ঠিক তেমনি বৈষ্ণবীশক্তির প্রভাবও পরবর্তীকালের চৈতন্য চরিতকারদের মনঃপুত হয়নি। এর ফলে তাঁদের হাতে বৈষ্ণবী-শক্তিতত্ত্ব পরিবর্তিত ও বিকৃত হতে হতে শেষে শুধু মাধুর্য আস্বাদনে গিয়ে ঠেকেছিল। সেই মাধুর্যের আধার হয়েছিলেন নারী; তাও আবার স্বকীয়া নয়, পরকীয়া। সেই পরিবর্তন চৈতন্য দেবের অন্তর্ধানের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অতিদ্রুত গতিতে ঘটেছিল। অর্থাৎ, পূর্ববর্তী ‘সহজযানের ভূত’ তখন মাধুর্য-লোলুপ বৈষ্ণব সমাজের ঘাড়ে চেপে বসেছিল। ফলে তৎকালীন বাঙালী বৈষ্ণব সমাজে দূরগন্ধময় বদ্ধ জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু তাই নয়; বৈষ্ণবপন্থায় হিন্দুসমাজের বহুল প্রচলিত জাতিভেদও ফিরে এসেছিল। চৈতন্য দেবের প্রবর্তিত নিয়মে বৈষ্ণব ভক্তদের নারীর সঙ্গে কথাবার্তাও নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতকে নারীরা শুধু বৈষ্ণবদের লীলাসঙ্গিনীই হননি, বৈষ্ণব-ধর্ম প্রচারে গুরুও হয়েছিলেন। এর ফল যা হওয়ার সেটাই হয়েছিল; গৌড়ীর বৈষ্ণব সমাজও রসাতলে গিয়েছিল। তবে সহজিয়া বৈষ্ণবদের মধ্যে যে কোন মতদ্বৈধ ছিল না, তা কিন্তু নয়। মতদ্বৈধের ফলেই তাঁদের মধ্যে - আউল, বাউল, শাই, দরবেশ, নেড়া, কর্তাভজা, স্পষ্টদায়ক, কিশোরীভজা প্রভৃতি নানা দলের সৃষ্টি হয়েছিল। এই দলগুলি বিভিন্ন হলেও মূলতঃ যে তিনটি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মিল ছিল, সেগুলো হল - গুরুবাদ, স্ত্রী-পুরুষের অবাধ মিলন, এবং পরকীয়া প্রেম। উক্ত সময়ে বাঙলার নদীয়া জেলার ঘোষপাড়া, শান্তিপুর, চব্বিশ পরগণার খড়দহ, বীরভূমের কেন্দুলী এবং বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলার কোনো কোনো অঞ্চলে তাঁদের ঘাঁটি তৈরী হয়েছিল। তবে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে(বাংলাদেশে) বৈষ্ণবদের এই ধরণের খানাডোবার সন্ধান বেশি পাওয়া যায় না।
১৫৯৪ খৃষ্টাব্দে ‘রাজা মানসিংহ’ প্রথমবারের জন্য, সম্রাট আকবরের প্রতিভূরূপে, বাঙলার শাসনকর্তা হিসাবে বঙ্গদেশে এসেছিলেন। এরপরে ১৬০১ খৃষ্টাব্দে আবার তিনি বারোভূঁইঞা ও মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের সঙ্গে মোকাবিলা করবার জন্য বাঙলায় উপস্থিত হয়েছিলেন। সেবারে বাঙলায় এসেই মানসিংহ সোজা ময়মনসিংহে পৌঁছে, সেখানকার পাঠান ভূঁইঞা ‘মুসা খাঁ’র এলাকা ঘেঁষে নিজের শিবির তৈরী করেছিলেন। এর দু’বছর আগেই মুসা খাঁর পিতা ঈশা খাঁর মৃত্যু হয়েছিল। বাঙলার মোঘল-পাঠান সীমান্তে তখন মোঘলদের মাত্র পাঁচটি ঘাঁটি বা থানা ছিল; সেগুলি হল - করতোয়ার পাড়ের ঘোড়াঘাট, ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব-পাড়ের ‘শেরশাহী’ শেরপুর, আধুনিক ঢাকার কাছে টোক ও ভাওয়াল, এবং আধুনিক নারায়ণগঞ্জের কাছে ত্রিমোহানি। এগুলি সবই তখন বঙ্গদেশে মোঘলদের সেনানিবাস ছিল। এরপরেই শুধু মুসা খাঁর বিরুদ্ধে নয়, প্রতাপাদিত্য সহ আরো কয়েকজন ভূঁইঞা ও জলদস্যুদের বিপক্ষেও মানসিংহের লড়াই শুরু হয়েছিল। ১৬০৫ খৃষ্টাব্দে আকবরের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর দিল্লীর মসনদে বসেছিলেন। জাহাঙ্গীর এমনিতেই মানসিংহকে বিশেষ পছন্দ করতেন না। কারণ, একে তো তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী খসরুর মামা ছিলেন; তার উপরে তিনি এটাও ভালো করেই জানতেন যে, মানসিংহ বাঙলার শাসনকর্তা থাকলে তাঁর একটি বিশেষ কামনা কোনভাবেই পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাঁর সেই সুপ্ত কামনাটি ছিল, একজন পরস্ত্রী আত্মসাৎ। বর্ধমানের তুর্কী জায়গীরদার ‘শের আফগানের’ স্ত্রী ‘নূরজাহান’ তাঁর প্রথম যৌবনের বল্লভা ছিলেন; জাহাঙ্গীর তাঁকে ছলে, বলে, কৌশলে যেভাবেই হোক দখল করতে মনস্থ করে ফেলেছিলেন। ফলে, বাদশাহী ফরমান মান্য করে মানসিংহকে জাহাঙ্গীরের বন্ধু ‘কুৎবুদ্দীন খাঁ’কে বাঙলার শাসনভার ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তাতে জাহাঙ্গীরের ইচ্ছা পূরণ হলেও, শের আফগান ও কুৎবুদ্দীনের লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত তাঁদের দু’জনেরই প্রাণহানি ঘটেছিল। জাহাঙ্গীর ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থের লেখক ‘আবুল ফজল’কেও বিষ-দৃষ্টিতে দেখতেন। সেটার পিছনে প্রধান কারণ ছিল যে, তাঁর উপরে আকবরের প্রভাব অপরিমিত ছিল। তাছাড়া তিনি সূফী ছিলেন, আর ওই সময়ের সূফীরা সর্বতোভাবে রসুলের বাণী মান্য করে চলতেন না।
সেকালে মোঘলদের তরফে ‘ইসলাম খাঁ’ ভাওয়ালের শাসক ছিলেন; মানসিংহ যে কাজ শুরু করে অসমাপ্ত রেখে ফিরে গিয়েছিলেন, তিনি সেটাকে সমাপ্ত করেছিলেন। তাঁর কর্মদক্ষতাতেই পূর্ব-বঙ্গ মোঘলদের করায়ত্ত হয়েছিল। তারপরে সেই অঞ্চলে মোঘলদের দখলীস্বত্ব কায়েম করবার জন্যই, সেখান থেকে বারোভূঁইঞা বিশেষ করে ঈশা খাঁ এবং পর্তুগীজ ও মগ দস্যুদের দমন করা সহজ হবে বলে, ‘জাহাঙ্গীর নগর’ নাম দিয়ে ঢাকা শহরের পত্তন করা হয়েছিল। এর মধ্যে দিল্লীর রাজনৈতিক রঙ্গভূমিতে নানা ঘটনা ঘটে গিয়েছিল; জাহাঙ্গীরের পুত্র ‘শাহজাহান’ বাঙলার জাহাঙ্গীর নগর (ঢাকা) ও রাজমহল দুই-ই দখল করে নিলেও, ১৬২৮ খৃষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পরেই দিল্লীর তখতে পোক্ত হয়ে বসতে পেরেছিলেন শাহজাহান পুত্র ‘ঔরঙ্গজেব’। ঔরঙ্গজেব ১৬৫৯ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর তখত দখল করে পূর্ববঙ্গকে পুরোপুরিভাবে মোঘলদের আয়ত্তে আনবার জন্য প্রথমে মানসিংহের, এবং তারপরে ‘ইসলাম খাঁ’র, একটা পোক্ত নৌবাহিনী গড়ে তুললেন। ফলে ঢাকায় মোঘলদের ‘মীর বহরের’ ঘাঁটি তৈরী করা হয়েছিল। সেখানে তখন বহুরকমের নৌকা তৈরী করা হত; যথা - কোশ, জলবাস, গ্রা, পরিন্দা, বজরা, ভড়, বালাম প্রভৃতি। সেকাজের জন্য তখন শ্রীহট্ট থেকে নানা রকমের কাঠ নিয়ে আসা হত, আর বেতনভুক সূত্রধর অর্থাৎ ছুতোরেরা সেসব দিয়ে নৌকা তৈরী করতেন। ঢাকার ‘সূত্রাপুর’ পল্লী আজও তাঁদের সেই স্মৃতি বহন করে রয়েছে। তখন যে লোহার পেরেক দিয়ে নৌকার কাঠ জোড়া দেওয়া হত, সেটাও ঢাকায় তৈরী করা হত। ‘জাহাঙ্গীর-নামা’ অনুসারে ওই সময়ের মোঘল নৌবহরে সর্বসমেত চারশো থেকে পাঁচশো নৌকা ছিল। এই প্রসঙ্গে ‘দীনেশচন্দ্র সেন’ তাঁর ‘বৃহৎবঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, অতীতে চট্টগ্রামের ‘বালামী’ নামক এক শ্রেণীর ছুতোর সম্প্রদায় সমুদ্রগামী নৌকা তৈরি করতেন; ‘বালামী’ নৌকা তাঁদের নাম থেকেই এসেছে। নৌচালন বিদ্যায় তাঁদের দক্ষতা অসাধারণ ছিল। সমকালীন ইটালীয়ান (ভেনিসের) পর্যটক ‘ফেডারীচি’ বলেছিলেন যে, সেই সময়ে ঢাকার তৈরী জাহাজ পোক্ত ও সস্তা ছিল; ফলে ইস্তাম্বুলের সুলতান আলেকজান্দ্রিয়ায় তার জাহাজ তৈরী না করিয়ে পূর্ববঙ্গ থেকেই করাতেন।
তখন বাঙলার অধিকাংশ বাড়ী ঘর বাঁশ, বেত ও শণ দিয়ে তৈরী করা হত। তৎকালীন বাঙলার বাঁশ ও বেতের কাজ অপূর্ব ছিল; সেসব দিয়ে তখন এমন ঘরও তৈরী করা হয়েছিল, যেগুলো তৈরী করতে গিয়ে সেকালেই হাজার পাঁচেক টাকা বা তার থেকেও বেশি টাকা খরচ হয়েছিল। তখন বঙ্গদেশে যে কোন ইঁট কাঠের তৈরী বাড়ী ছিল না, তা কিন্তু নয়; তবে তখন সাধারণতঃ প্রাসাদ বা প্রাসাদোপম বাসগৃহ, মন্দির, মসজিদ ও দরবার ইঁট কাঠ দিয়ে তৈরী করা হত; একই সময়ে বাঙলার কুটির দেউল দোচালা বা চৌচালা ঘরের ধাঁচে তৈরী করা হত। সেই ধাঁচের খ্যাতি তখন বাঙলার বাইরেও বিস্তৃত হয়েছিল। যাকে আজো দেশে বিদেশে বাংলো বাড়ী নামে ডাকা হয়।‘সোনারগাঁ’-এ তখন প্রচুর মসলিন তৈরী করা হত,
সপ্তদশের শুরুতে ভারতে তামাকের প্রচলনের পরে, অল্পকালের মধ্যেই সারা দেশের উচ্চ-নীচ সকল সমাজকেই, অন্য সব নেশাকে ছাপিয়ে সেই নেশা পেয়ে বসেছিল। বিশেষ করে দিল্লীর অভিজাত মুসলমান সমাজে তখন ধূমপানের জমে উঠেছিল। তখন খাওয়ার পরে আরামের ধূমপান - আলবলা ও হুঁকো - দুই-ই চলত। সমকালীন ইতালীয় পর্যটক ‘মানুচি’ লিখেছিলেন যে, ওই সময়ে শেষে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে, একমাত্র দিল্লীতেই তামাকের ওপরে খাজনা হিসেবে প্রতিদিন রাজকোষে পাঁচ হাজার টাকা জমা পড়তে শুরু করেছিল। সেই নেশাকে প্রতিরোধ করবার জন্য জাহাঙ্গীর ১৬১৭ খৃষ্টাব্দে একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও, সেটা কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি। উক্ত সময়ে সমগ্র বাঙালী সমাজেও ধূমপানের নেশা ক্রমে ব্যাপক হয়ে উঠেছিল।
আহার্যের ব্যাপারে সতেরো শতকের হিন্দু ও মুসলমানরা বিপরীতধর্মী ছিলেন। তখনকার হিন্দুরা সাধারণতঃ নিরামিষ-ঘেঁষা, মুসলমানেরা আমিষ-ঘেঁষা ছিলেন। সারা ভারতের মধ্যে তখন শুধুমাত্র পাঞ্জাব ও বাঙলার ব্রাহ্মণেরা মাছমাংস খেতেন। উক্ত সময়ে খিচুড়ি সাধারণ মানুষের জনপ্রিয় খাদ্য ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসী পর্যটক ‘লে ব্লাঙ্ক’ বলেছিলেন যে, বাঙালীদের মধ্যে তখন সংরক্ষিত মিষ্টি ও ফল, টাটকা মিষ্টি ও মসলার প্রচলন খুবই বেশি ছিল। পর্তুগীজদের বাঙলায় পদার্পণের কিছু পরেই সেটা বেড়ে উঠেছিল,পর্তুগীজদের নানারকম মিষ্টি তৈরীর কৌশল, তখন রসাল মিষ্টির ছড়াছড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল। আলোচ্য সময়েরই আরেক পর্যটক ‘স্টেভরিনাস’ লিখেছিলেন যে, মুসলমানেরা ও বাঙালীরা তখন খেমটাওয়ালী ও বাঈনাচের দারুণ পক্ষপাতী ছিলেন। ইতালীয় পর্যটক মানুচি জানিয়েছিলেন যে, সেই সময়ে সাধারণতঃ মুসলমান ঘরের মেয়েরাই সেই পেশা গ্রহণ করলেও, কিছু কিছু হিন্দু ঘরের মেয়েদেরও ওই সব নাচ-গানের আসরে দেখা যেত।
ঔরঙ্গজেবের আমলে প্রথমে ‘মীরজুমলা’, তারপরে ‘শায়েস্তা খাঁ’, এবং তারপরে ঔরঙ্গজেবের পৌত্র আজিম-উস-সান বাঙলার শাসক হয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মাঝখানে চূড়ান্ত অপদার্থ খান-ই-জাহান’ কিছুদিনের জন্য বাঙলার শাসক হয়েছিলেন, তিনি এক বছরের মধ্যে রাজকোষ থেকে দু’ কোটি টাকা চুরি করে তখনকার বহুল প্রচলিত বাঙলা প্রবাদে ‘নবাব খাঞ্জা খাঁ’ নামে কুখ্যাত হয়েছিলেন। শায়েস্তা খাঁরও চুরির অপবাদ ছিল, তার ওপরে তিনি আবার প্রজাপীড়নে ও বেনামী একচেটিয়া ব্যবসায়ে দক্ষ ছিলেন। বঙ্গদেশে থাকবার সময়ে তাঁর দৈনিক আয় দু’ লাখ টাকা আর ব্যয় সেটার অর্ধেক ছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথম তেরো বছর সুবেদারীতে তিনি আটত্রিশ কোটি টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। বাঙলার সুবেদার থাকবার সময়ে তিনি নিম্নবঙ্গে জলদস্যুদের ভয় অনেকটাই দূর করতে পেরেছিলেন; কিন্তু সেই কাজ তিনি সম্ভবতঃ পর্তুগীজদের ঘুষ দিয়ে করেছিলেন। ‘মীরজুমলা’ থেকে ‘মুর্শীদকুলী খাঁ’ পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৬৬০ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৭২৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সাতষট্টি বছর ধরে বাঙলার সুবেদারদের সবার ‘পেশা সুবেদারী হলেও, নেশা কিন্তু ছিল গোপন ব্যবসা। পেশার চেয়ে নেশার শক্তি চিরকালই বেশি হয়, তাই সেই সময়ে বাঙলার শোষণ অবাধে চলেছিল।
পর্তুগীজরা বাঙলায় প্রথম অভ্যাগত ছিলেন; চাটগাঁয়ে তাঁরা প্রথম পদার্পণ করলেও, পরবর্তী সময়ে দেশের অভ্যন্তরে গঙ্গাতীরের হুগলীতে নিজেদের ঘাঁটি তৈরী করেছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে হুগলীতে বসেও পর্তুগীজরা তাঁদের চিরাচরিত স্বভাব ভুলতে না পেরে যথারীতি দেশীয় বণিকদের ওপরে দৌরাত্ম্য শুরু করেছিলেন। তাঁদের সেই দৌরাত্ম্য যখন চরমে পৌঁছেছিল, আর সেকথা দিল্লীর বাদশাহ শাহজাহানের কানে উঠেছিল, তখন তিনি বাঙলার তৎকালীন শাসক ‘কাশিম আলী খাঁ’কে পর্তুগীজ বিতাড়নের আদেশ দিয়েছিলেন। কাশিম আলীর তিন মাসের চেষ্টার ফলে হুগলী মোঘলদের দখলে এসেছিল, এবং পরে ১৬৩২খৃষ্টাব্দ থেকে হুগলীই বাঙলার গঙ্গাতীরের বাদশাহী সদর বন্দর হয়েছিল। তবে শায়েস্তা খাঁর আমলের আগে চাটগাঁ মোঘলদের দখলে আসেনি। বাঙলায় দ্বিতীয় অভ্যাগতের দল ছিলেন ওলন্দাজরা। তাঁরা সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চুঁচুড়া ও কাশিমবাজারে নিজেদের আস্তানা তৈরী করেছিলেন। তৃতীয় ছিলেন ইংরেজরা, তাঁরাও ওই একই কালে প্রথমে হুগলীতে ও পরে কাশিমবাজারে গিয়ে বসেছিলেন। চতুর্থ ছিলেন ফরাসীরা, সপ্তদশ শতকের প্রায় শেষ পাদে তাঁরা ক্রমে ক্রমে ঢাকা, চন্দননগর ও কাশিমবাজারে নিজেদের ঘাঁটি বেঁধেছিলেন। ধূর্ত ইংরেজরা পরবর্তী সময়ে বাঙলার নবাবদের গোপন ব্যবসায়ে পরম সহযোগিতা করেছিলেন; অন্য কারোর সাথে তাঁদের তেমন বনিবনাও হয়নি।
বাঙলা কখনোই একান্তভাবে জমিনির্ভর ছিল না; প্রতিটি শতকেই কমবেশি আংশিক শিল্পজাত মাল সরবরাহ করে বঙ্গদেশের নিজস্ব ধনভাণ্ডার পূর্ণ হয়েছিল। সপ্তদশ শতকে বাঙলায় জাত প্রধান শস্য ছিল ধান, এবং শিল্পজাত দ্রব্য ছিল সুতী ও রেশমের কাপড় এবং চিনি। তখন বাঙলার সম্পূর্ণ চাহিদা মিটিয়েও সেসব জিনিস ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে ও বিদেশে চালান করা হত। তখন বাঙলার সর্বত্রই ধান ও তুলো জন্মাত, এবং প্রধানতঃ উত্তরবঙ্গে রেশম ও চিনি উৎপাদন করা হত। বলা বাহুল্য যে, ঐসব মাল দিয়েই তখন দেশে ও বিদেশে সুবেদার ও ইংরেজ কোম্পানির কারবার চলত।
আকবর ত্রিশ ‘ড্যামের’ ওজন এক সের বলে ধার্য করে দিয়েছিলেন, তাঁর আমলে ‘ড্যাম’ প্রধান তামার মুদ্রা ছিল। এক টাকায় তখন চল্লিশ ড্যাম ধরা হত, আটটি ‘ডামরি’তে একটি ড্যাম হত। কিন্তু সেই সময়ে গৃহস্থের দৈনন্দিন কেনাবেচায় এর চেয়ে অনেক কম মানের মুদ্রার দরকার পড়লেও ড্যামের চেয়ে কম মানের কোন ধাতব মুদ্রা তখন ছিল না; শুধু হিসাবের পাতায় এক ড্যামকে পঁচিশ ভাগে ভাগ করে, প্রতি ভাগকে ‘জিতেল’ বলা হত। কিন্তু বাস্তব বিনিময়ে তখন ‘কড়ি’র ব্যবহার চালু ছিল। উক্ত সময়ে সাধারণতঃ পাঁচ হাজার একশ কুড়ি কড়ির মূল্য এক টাকা ধরা হত। কিন্তু সর্বকালে ও সকল বাজারে যে কড়ির মূল্য একই ছিল না। সেই কড়ির বেশির ভাগই তখন মালদ্বীপ থেকে আসত। তখনো ভারতবর্ষে কয়লার আবিষ্কার হয়নি। তাই জ্বালানি হিসাবে ধনীদের ঘরে কাঠ ব্যবহার করা হত। আর দরিদ্রেরা শুকনো গাছের পাতা, খড় ইত্যাদি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতেন। মশাল জ্বালিয়ে পথ চলতে হত।
বাংলার মসলিনের সেই আগের সোনালী দিন, ইউরোপীয়দের চোখে মধ্যযুগের বাংলা’
( লর্ড রবার্ট ক্লাইভের বন্ধু ‘ক্রেকটন’,লিখেছেন, তাঁদের সময়ে বাংলার ব্যবসাবাণিজ্য মূলতঃ উদ্ভিজ্জ সম্পদ; অর্থাৎ - রেশম, কার্পাস সুতো, চাল, চিনি, আফিং ও নীল নিয়েই ছিল। সেই সঙ্গে তখনকার বাংলার, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে কিছু কিছু পাটের চাষও করা হত। ওই উদ্ভিজ্জ বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে কিছু শিল্পও অবশ্য তখনকার বাংলায় গড়ে উঠেছিল। তখন সাধারণ গৃহস্থালীর নিত্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র, চাষ আবাদের উপযোগী সাজ সরঞ্জাম, ছুতোর মিস্ত্রী প্রভৃতির যন্ত্রপাতি সবই প্রায় বাংলার প্রতিটি গ্রামেই তৈরী করা হত। সেই সময়ের গ্রামগুলি মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বয়ম্ভর ছিল। ওই সময়ের বাংলায় শিল্প ক্রমশঃ রেশম ও কার্পাসের অবলম্বনে বেড়ে উঠেছিল - প্রথমটি পশ্চিমবঙ্গে, এবং দ্বিতীয়টি পূর্ববঙ্গে। এর আগে তো বটেই, এমনকি অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগেও বাংলা ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অনেক মালের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরেও নানা দ্রব্যসম্ভার পাঠাত। যেমন বাংলা থেকে মাদ্রাজে তখন চাল, পাট, পাটের দড়ি, খাদ্যতেল ও সল্টপিটার যেত। উক্ত সময়ে পাটনায় সল্টপিটার পাওয়া যেত; পাটনা তখন বাংলারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। নুন ও চিনি দিল্লি ও আগ্রায় যেত। চিনি, আফিং, নানা প্রকারের শস্য ও সুতীর কাপড় আরবে ও পারস্যে যেত। তবে বাংলায় নীলের চাষ তখন হ্রাস পেয়েছিল।
মোটের উপরে সেকালে বাংলা সর্বদেশীয় বণিকদের কাছে তীর্থক্ষেত্র ছিল। পাশ্চাত্যের নানা দেশীয় বণিকের দল ছাড়াও বঙ্গদেশে তখন পারস্য, আরব, এবিসিনিয়া (আফ্রিকা) ও তুর্কীস্থান থেকে সওদাগরেরা আসতেন। আর আসতেন ইহুদী ও আর্মেনিয়ানরা। সমগ্র প্রাচ্যে বাংলাই সেকালে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। বলাবাহুল্য যে, রেশম ও কার্পাস-জাত দ্রব্যই তখন সেই কেন্দ্রের প্রধান পণ্য ছিল। বস্ত্রবয়নই তখনকার বাংলার জাতীয় শিল্প ছিল। সেই সময়ে মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের কাজ ও পিতলের বাসনপত্র, কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প, ঢাকার সূচী-কর্ম ও শঙ্খ শিল্প, ঢাকা ও কটকের বিবিধ স্বর্ণ ও রৌপ্যালঙ্কার, দেশে ও বিদেশে পরম আদরণীয় হয়েছিল বটে, তবে বাংলার বস্ত্রের মর্যাদার তুলনায় সেই সবের গৌরব হীনপ্রভ ছিল। তখন ঢাকার অপূর্ব শঙ্খশিল্পের জন্য কাঁচা মাল, অর্থাৎ শঙ্খ কারা যোগান দিতেন? সেটা যোগান দিতেন ডাচেরা; সেই কারবার তাঁদের একচেটিয়া ছিল। মান্নার উপসাগরে তখন সমুদ্র থেকে শঙ্খ তোলা হত। মাদ্রাজের দক্ষিণ উপকূলের বন্দর তুতিকোরিণ ও শ্রীলঙ্কার উপকূলের বন্দর মান্নারের মধ্যে সেই উপসাগর অবস্থিত।
সেখান থেকে ডাচেরা সব শঙ্খই তখন বাংলায় চালান দিতেন। এছাড়া কখনো কখনো তাঁরা পারস্য উপসাগর থেকেও শঙ্খ নিয়ে আসতেন। বাংলাতে সেই মালের কদরই তখন বেশী ছিল, আর সেখানে সারা বছর ধরেই শঙ্খ সংগ্রহ করা যেত। ডাচেরা মান্নার উপসাগরের একচ্ছত্র সম্রাট ছিলেন। উক্ত সময়ে সেখান থেকে তাঁরা শুধু শঙ্খ নয়, প্রতি বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত ঝিনুক তুলে মুক্তাও সংগ্রহ করতেন। হাজার হাজার ডুবুরী সেই কাজে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁরা সবাই মৎসজীবি ছিলেন। সেখানকার সাগরাধিপতি ডাচরা অর্থের বিনিময়ে তাঁদের সেই কাজ করবার অনুমতি দিতেন। সেজন্য তাঁরা খৃষ্টানদের কাছ থেকে জনপ্রতি বারো টাকা, হিন্দুদের কাছে আঠারো টাকা, এবং মুসলমানদের কাছে চব্বিশ টাকা খাজনা নিতেন। ডাচরা পাকা ব্যবসায়ী জাত ছিলেন। ওই ব্যবসায় তাঁরা গাছেরটা যেমন খেতেন, তেমনি গাছের তলারটাও কুড়োতেন। সেই সময়ে তাঁরা ওই ডুবুরীদের কাছেই চাল, ডাল, নুন, মাছ ইত্যাদি বিক্রি করে আবার আরো দু’ পয়সা নিজেদের ঘরে তুলতেন।
আগেই বলা হয়েছে যে, তখনকার বাংলার বস্ত্র শিল্পের রূপ দ্বিবিধ ছিল - কার্পাস ও রেশম। কার্পাস-শিল্প বাংলার আগের রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল; আর রেশম, পরবর্তী রাজধানী মুর্শিদাবাদের সম্পদ ছিল। মুর্শিদাবাদের প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, এখন আগে সেই সময়ের বাংলার কার্পাস-শিল্পের কথাই বলা যাক। বাংলার রেশম-শিল্পের অস্তিত্ব এখনও বা যা কিছু বজায় থাকলেও, কার্পাস-শিল্প কিন্তু পুরোপুরিভাবে ইতিহাসের পাতায় উঠে গিয়েছে। মধ্যযুগের বাংলার কার্পাস-শিল্পের পরম গৌরব ছিল মসলিন বা ‘আব-ই-রওয়ান’; বিদেশী বাণিজ্যের দপ্তরে সেটির পুরানো নাম ছিল - ‘বিয়েটিলহা’। এই শব্দটি সম্ভবতঃ পর্তুগীজ শব্দ ‘বিয়েটা’ (Beata) বা সন্ন্যাসিনী থেকে হয়েছিল; কারণ, মধ্যযুগের ইউরোপের ‘nun’ বা সন্ন্যাসিনীরা ওড়না পরতেন, আর মসলিন ওড়না পক্ষে পরম উপযোগী ছিল। সেই কাপড়ের সূক্ষ্মতার পরিমাপ এখন শুধুই কল্পনাগত। তবে তখন মসলিন ছাড়াও বাংলায় অবশ্য অনেক রকমের সাদা ও রঙিন মোটা কাপড়ও তৈরী করা হত। বাংলাতেই সেই সব কোরা কাপড়ের কিছুটা অংশ সাদা করা হত, আর কিছুটা ভারতেরই অন্যান্য বন্দরে, বিশেষ করে পশ্চিম উপকূলের বন্দর ব্রোচে সাদা করা হত। সেই মোটা সুতী কাপড়েরই কিছুটা অংশ তখন কালিকট বন্দর থেকে ‘ক্যালিকো’ নাম নিয়ে চলে যেত দেশ-বিদেশের স্তরে চলে যেত। ১৬৭৬ খৃষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডে প্রথমবারের জন্য সেই ক্যালিকো আমদানি করা হয়েছিল। সেই রঙিন ক্যালিকোর পরিচ্ছদ পরিধান করে ইংল্যাণ্ডের রাণী ‘দ্বিতীয় মেরি’ সেদেশে এক নতুন ফ্যাশনের প্রবর্তন করেছিলেন। সেই সূত্রেই তখন থেকে ইংরেজদের ঘরে ঘরে ক্যালিকোর মর্যাদা রাতারাতি বেড়ে গিয়েছিল। বাংলার রঙিন ক্যালিকোর পরিচ্ছদ, পরদা শয্যা-আরবণী, কুশন ইত্যাদিতে দেখতে দেখতে ইংরেজদের দেশ ছেয়ে গিয়েছিল। তার ফলে ইংল্যাণ্ডের নিজস্ব বস্ত্রশিল্পের অসামান্য ক্ষতি হয়েছিল। তাই ক্রমে আইন করে ইংল্যাণ্ডে ক্যালিকোর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে শুধুমাত্র অন্যদেশে রপ্তানি করবার জন্য, বিশেষ করে হল্যাণ্ডের বন্দর আমষ্টারডামে রপ্তানি করবার জন্য বাংলা থেকে ক্যালিকো আমদানি করা হত।
এবারে মসলিনের কথা বলা যাক। মধ্যযুগের শেষের দিকে বাংলায় ঢাকা, সোনারগাঁও ও ধামরাই-এ মসলিন তৈরী করা হত। সোনারগাঁ ও ধামরাই ঢাকা থেকে বিশ-ত্রিশ মাইল দূরে অবস্থিত; সোনারগাঁ পূর্বদিকে, আর ধামরাই উত্তরদিকে। তখন সাধারণতঃ অল্পবয়সী হিন্দুঘরের মেয়েরা মসলিনের সুতো হাতে কাটতেন; তাঁদের বয়স আঠারো থেকে ত্রিশ বছরের মধ্যে হত। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি কমে যেত বলে আরো বেশি বয়সের মেয়েরা তখন অত সূক্ষ্ম সুতো হাতে কাটতে পারতেন না। পুরুষেরা বস্ত্র বয়নের কাজ করতেন। বয়নের সাজ সরঞ্জাম অতি সাধারণ ছিল। সেই সময়ের বাংলার হিন্দুরা সর্বত্রই সেকাজ করলেও, শুধুমাত্র সোনারগাঁয়ের মুসলমানেরাও সেই কাজ করতেন। মসলিনের সুতা কিন্তু কখনই চরকায় কাটা যেত না; সেগুলো সবই হাতে তৈরী করা হত। চরকায় তখন মসলিনের চেয়ে মোটা সুতো তৈরী করা হত; সেযুগের হিন্দু যুগীরা আর মুসলমান জোলারা সেই মোটা কাপড় বেশী তৈরী করতেন। তাঁরাও তখন ঢাকারই আশপাশে বাস করতেন। উক্ত সময়ে মসলিনের জন্য কার্পাস কোথায় পাওয়া যেত? ঐ ঢাকারই কাছে। এখন যেটাকে ভাওয়াল পরগণা বলা হয়, আগে সেখানে বহুবিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে কার্পাসের চাষ করা হত। ঢাকার অদূরে গাজীপুরে অবস্থিত ‘কাপাসিয়া’ গ্রাম এখনও সেই কার্পাস তুলার ঐতিহাসিক স্মৃতি বহন করে টিকে রয়েছে। চুতুর্থ মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহানের কালে, সপ্তদশ শতকের প্রথম পাদে, মসলিন দিল্লিতে বাদশাহের অন্তঃপুরে স্থান পেয়েছিল। নূরজাহান খুব সম্ভবতঃ তাঁর প্রথম স্বামী শের আফগানের সঙ্গে বাংলায় ঘর করতে এসে প্রথমবারের জন্য মসলিনের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁর সময়ে একটি সরেস মসলিন শাড়ির দাম ছিল চারশো’ টাকার মত। মধ্যযুগের বাংলার মসলিনের মত শিল্পকে এখন অলৌকিক বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার; কিন্তু প্রশ্ন হল যে, বাংলার এমন মূল্যবান শিল্প লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল কেন? ঐতিহাসিকেরা বাংলার মসলিনের বিলুপ্তির পিছনে বহুবিধ কারণ দেখিয়েছেন। তাঁদের মতে সেটার কিছুটা হয়ত ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী তুলে নিয়ে যাওয়ার ফলে, কিছুটা পূর্ব-বঙ্গে পর্তুগীজ ও মগ দস্যুদের অত্যাচারের ফলে, কিছুটা নবাবদের সস্নেহ দৃষ্টির অভাবে, কিছুটা বিদেশী বণিকের ষড়যন্ত্রের পরিণামে হয়েছিল। কিন্তু যে পুরুষানুক্রমে অর্জিত অভিজ্ঞতা, ধৈর্য, অধ্যবসায় ও শিল্পানুরক্তির মধ্যে বাংলার মসলিনের জন্ম হয়েছিল, আধুনিক জগতের মানব- সমাজের পক্ষে কি সেটা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়? ফিরে পেলেও, বাংলার মসলিনের সেই আগের সোনালী দিন ফিরে আসা কিন্তু খুবই কঠিন।
মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের কথা
সেকালের বাংলার ঐশ্বর্যের প্রতীক মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার ছিল সমকালীনসময়ের লণ্ডন। সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগ থেকেই পূর্বতন মকসুদাবাদ বা পরবর্তীকালের মুর্শিদাবাদের বাজার জমজমাট হতে শুরু করেছিল। খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে মুর্শিদাবাদের নাম ছিল ‘কর্ণসুবর্ণ’। সেকালের চীনের প্রসিদ্ধ পরিব্রাজক ‘হিউয়েনসাং’-এর বিবরণেও কর্ণসুবর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন ওই শহরের পরিধি ছিল সাত মাইল। কর্ণসুবর্ণ নগরটি তখন গৌড়ের অর্থাৎ বাংলার রাজা ‘শশাঙ্কের’ রাজধানী ছিল। মধ্যযুগের মুর্শিদাবাদের গা ঘেঁষেই ছিল কাশিমবাজার, সৈদাবাদ ও কালিকাপুর। এগুলি প্রকৃতপক্ষে একই শহরের বিভিন্ন অংশ মাত্র ছিল। কলকাতা শহরের পত্তনের প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে, অর্থাৎ ১৬৫৮ থেকে ১৬৫৯ খৃষ্টাব্দের মধ্যে ইংরেজরা কাশিমবাজারে, ফরাসীরা সৈদাবাদে, আর ডাচরা কালিকাপুরে নিজেদের কুঠি তৈরী করেছিলেন। তৎকালীন মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের প্রধান পণ্য ছিল রেশম। সেখানে বিদেশিদের কুঠিগুলি ছিল ফ্যাক্টরি; ওই কুঠিগুলিতে তখন রেশমের সুতো ও কাপড় তৈরি করা হত। সেগুলিকে আধুনিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের পূর্বপুরুষ বলা যেতে পারে। ডাচদের কুঠিতে তখন প্রায় আটশো’ লোক কাজ করতেন, ইংরেজদের কুঠিতেও কর্মরত লোকের সংখ্যা অনুরূপ ছিল; শুধুমাত্র ফরাসীদের কুঠিতে কাজ করবার লোকের সংখ্যা কিছুটা কম ছিল। কর্মীর সংখ্যা বিবেচনা করেই তখনকার ওই সব কুঠির কাজের পরিমাণ অনুমান করা যেতে পারে। প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ ঐতিহাসিক আর্মি জানিয়েছিলেন যে, তখনকার মোঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাই সর্বশীর্ষে অবস্থান করত।
সেই সময়ে পাশ্চাত্যের সব বণিক-সঙ্ঘেরই সর্বাপেক্ষা বেশি মূলধন বঙ্গদেশে খাটত, আর সেই মূলধনের বেশিরভাগটাই রেশমের কাজে নিয়োজিত করা হত। তাই, ইংরেজ, ডাচ ও ফরাসী - সকলেই দাদন, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির সূত্রে বাংলার সাথে এমনভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁদের কারোরই বাংলা থেকে বাণিজ্য-পাট গুটাতে হলে সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সমস্ত কারবারই নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই, এই প্রবন্ধে যে যুগের কথা বলা হচ্ছে, সেকালে বাংলাই পাশ্চাত্য বণিকদের একমাত্র ভরসাস্থল ছিল, আর সেই বাংলার প্রথম প্রধান বাণিজ্য-কেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার, আর তারপরে কলকাতা। সেই ভরসার ফলেই, ১৬৮১ খৃষ্টাব্দে জোব চার্নকের আমলে, যখন ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বাংলার বাণিজ্যে ছ’ লক্ষ ত্রিশ হাজার পাউণ্ড বিনিয়োগ করেছিল, সেটার এক লক্ষ চল্লিশ হাজার পাউণ্ডই মুর্শিদাবাদের ভাগে পড়েছিল। বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁর আমলে, অর্থাৎ ১৭৪০ খৃষ্টাব্দ থেকে পরবর্তী পনেরো ষোলো বছর ধরে, মুর্শিদাবাদের ‘দোগানা’য় বা শুল্ক বিভাগের দপ্তরে গড়পড়তা সাড়ে সাতাশি লাখ টাকার রেশম উৎপাদনের কথা জানতে পারা যায়। যদিও তখনকার সেই হিসাব থেকে বিদেশী বণিকদের উৎপাদনকে বাদ দেওয়া হয়েছিল; কারণ, হয় তখন তাঁদের কোনো ধরণের শুল্ক দিতে হত না, আর নয়ত তাঁরা হুগলিতে শুল্ক দিতেন। তাই ওই সময়ে তাঁদের উৎপাদনকে অন্ততঃ সাধারণ উৎপাদনের অনুরূপ ধরে নিলেও, তখনও বাংলায় বছরে প্রায় পৌনে ছ’ কোটি টাকার রেশম তৈরী করা হত। সে কালেই ইংরেজদের হিসাবের খাতায় বাংলার কাঁচা রেশমের দর সাড়ে চার টাকা সের ছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই উক্ত সময়ে বাংলায় বছরে সত্তর থেকে আশি হাজার মন রেশম তৈরি হত বলে অনুমান করাটা খুব একটা অসঙ্গত হবে না। এখন ভাবতেও অবাক লাগে যে, বর্তমান সময় থেকে মাত্র দু’-তিনশো’ বছর আগে, বাংলার ধান ও বাংলার রেশম বাঙালীকে সমগ্র ভারতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঐশ্বর্যশালী করে রেখেছিল।
তখন বাংলার অর্থনৈতিক ব্যাপারে ব্যাঙ্কার ‘জগৎশেঠ’ নবাবের কর্ণধার ছিলেন; সেই সময়ের মুর্শিদাবাদে নবাবের পরেই তাঁর আভিজাত্য ছিল। জগৎশেঠ কিন্তু কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম ছিল না, সেটি ওই ধনাগারপতি শ্রেষ্ঠীদের উপাধি বা সাধারণ নাম ছিল। মধ্যযুগে মোঘল দরবার থেকেই সেই উপাধি দেওয়া হয়েছিল। সেটির অর্থ ছিল জগৎ, অর্থাৎ সারা জগতের শ্রেষ্ঠী। বাংলার নবাবের সমস্ত আর্থিক কারবার তখন জগৎশেঠের গদিতে চলত, ঠিক এখন যেমন ভারত সরকারের সব ধরণের আর্থিক কারবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কে চলে। যোধপুরের নগর পরগণার এক রাজস্থানী পরিবার সেই সংস্থার অধিপতি ছিলেন। তখন শুধু মুর্শিদাবাদেই নয়, পাটনায় ও দিল্লীতেও তাঁদের কারবার ছিল। সেখানেও তাঁরা পাটনার নবাব ও দিল্লীর বাদশাহের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। জগৎশেঠ শুধুমাত্র একজন ব্যাঙ্কারই ছিলেন না, মুর্শিদাবাদে নবাবের টাঁকশালের সমস্ত ভারও তাঁর উপরেই ছিল। আগে রাজমহল, ঢাকা ও পাটনায় টাঁকশাল থাকলেও,ক্রমে সেসব বন্ধ করে দিয়ে মুর্শিদাবাদেই বাংলার একমাত্র টাঁকশালটি তৈরী করা হয়েছিল। বঙ্গদেশে তখন রৌপ্যমান চালু ছিল, অর্থাৎ সেই সময়ে রূপার টাকাকে প্রমাণ বলে ধরে নিয়ে সব জিনিসের মূল্য নির্ধারণ করা হত। জগৎশেঠ রূপা কিনে নিয়ে টাঁকশাল চালাতেন। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের টাঁকশালে তৈরি টাকা, বিদেশীদের আমদানি করা সোনা রূপা সবই তখন তাঁর কাছেই নিয়ে যেতে হত। তিনিই সেই সবের মূল্য নির্ধারণ করতেন। সেসবের বিনিময় হার ঠিক করে দিয়ে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে তিনি বছরে আট-নয় লক্ষ টাকা স্রেফ দালালি হিসেবেই উপার্জন করতেন। বাংলায় বর্গির হাঙ্গামার কালে, ১৭৪২ খৃষ্টাব্দে, তাঁর বাড়িতে একবার হানা দিয়ে বর্গিরা দু’ কোটি টাকা লুঠ করেছিল। কিন্তু সমুদ্রে বারি বিন্দুর অভাবের মতই, তাঁর সেই আর্থিক ক্ষতির কথা তিনি বিন্দুমাত্রও অনুভব করতে পারেন নি। এছাড়া, নবাব, জমিদার, দেশী ও বিদেশী বণিকদেরও তিনি চড়া সুদে টাকা ধার দিতেন। ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউ কেউ জগৎশেঠকে ‘ব্যাঙ্ক অব ইংল্যাণ্ডের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন, তো কেউ কেউ আবার সেকালের পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ‘রথচাইল্ডের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। তখন অর্থের বলে তাঁর যে সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল, সেটার কোন তুলনা হয় না। তিনি পলাশীর রণরঙ্গে পরোক্ষ নায়কদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ছিলেন। তখনকার রাজশক্তি তো বটেই, এমনকি দেশী ও বিদেশী সকল বণিক সম্প্রদায়ই তাঁর সঙ্গে সর্বদা মিতালি করে চলত। মুর্শিদাবাদের মহিমাগঞ্জে জগৎশেঠদের অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এই কুলের শেষ দুই শেঠকে, তাঁদের ইংরেজ প্রীতির জন্য, ইংরেজ-বিদ্বেষী নবাব মীরকাশিম মুঙ্গেরে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে (মতান্তরে মুঙ্গের দুর্গ থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেলে) হত্যা করেছিলেন।
মধ্যযুগে ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের বিস্তৃতি প্রায় দুই মাইল মত ছিল। সেকালে সেখানে লক্ষাধিক মানুষ বাস করতেন। শহরের রাস্তাগুলি অপ্রশস্ত হলেও, সেখানকার বেশিরভাগ বাড়িই পাকা ছিল। তখন মুর্শিদাবাদ শহরের বসতি এতটাই ঘন ছিল যে, পাশাপাশি সব পাকা বাড়িগুলির ছাদ ডিঙিয়ে ডিঙিয়েই সারা শহর পরিক্রমা করে আসা যেত। পলাশীর যুদ্ধের পরে রবার্ট ক্লাইভ তখনকার মুর্শিদাবাদ শহর সম্পর্কে অনেক কথা লিখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, আয়তন, লোকসংখ্যা ও ঐশ্বর্যের দিক থেকে সেই মুর্শিদাবাদের সঙ্গে লণ্ডনের তুলনা করা চলত। কিন্তু তাঁর মতে, “এ তুলনায় একটু বৈষম্য থেকে যায়। মুর্শিদাবাদের মত লণ্ডনে এত অধিক সংখ্যক ঐশ্বর্যশালী লোক নেই, অর্থাৎ মুর্শিদাবাদের বিশিষ্ট বিত্তশালীর সংখ্যা লণ্ডনের ধনীদের চেয়ে অনেক বেশি।” ক্লাইভ যখন মুর্শিদাবাদকে নিয়ে একথা লিখেছিলেন, তখনও পর্যন্ত অবশ্য ধনকুবের ইহুদী রথচাইল্ড লণ্ডনে গিয়ে তাঁর ব্যবসা শুরু করেন নি; তিনি ১৮০৫ খৃষ্টাব্দে লণ্ডনে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ব্যাঙ্ক অব ইংল্যাণ্ডের তখন সৃষ্টি ও পুষ্টি হয়ে গিয়েছিল; আর, ওই একই সময়ে লণ্ডনের যে স্বর্ণকারের দল এর আগে পর্যন্ত দেশের সর্বকার্যের, এমনকি রাজকার্যের জন্যও মূলধন জোগাত, তাঁরাও তখন লণ্ডনে ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন। কাজেই মধ্যমণি জগৎশেঠের কথা বাদ দিলেও, মুর্শিদাবাদে সেকালে যে আরো মহাবিত্তশালী লোকের কোন অভাব ছিল না, সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়। ওদিকে ইংরেজদের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মূল কেন্দ্র ছিল লণ্ডনে। তাদের জাহাজ তৈরী ও মেরামতের কারখানাও সেখানে ছিল। ক্রমে কোম্পানির ব্যবসা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ তৈরী ও মেরামতের কাজও অভাবিতরূপে বেড়ে যেতে শুরু করেছিল। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়ের লাভের মাত্রাও ক্রমাগতই বৃদ্ধি পেয়েছিল। শুধু তাই নয়, লণ্ডনে কাঁচা রেশম এনে, সেটা দিয়ে লণ্ডনের ‘স্পিটলফিল্ডস’ পাড়ায় কাপড় তৈরী করে বণিকদের দিয়ে নানা দেশে রপ্তানি করতে শুরু করেছিল। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ক্রমবর্ধমান লাভের ফলে সপ্তদশ শতকের শেষভাগ থেকে লণ্ডনের মূর্তিও পরিবর্তিত হয়েছিল। সেখানকার লোক সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছিল, ব্যবসায়ীদের হাতে প্রচুর অর্থ জমেছিল। ইংল্যাণ্ডের অন্য সব বন্দরের প্রভা ম্লান করে দিয়ে লণ্ডনই তখন সমগ্র ইংল্যাণ্ডের বাণিজ্য-জগতের কেন্দ্রস্থল ও মধ্যমণি হয়ে উঠেছিল। আর সে সবই সম্ভব হয়েছিল ভারতের জন্য, বিশেষ করে বাংলার সঙ্গে সম্পর্কের ফলে। আধুনিক লণ্ডনের রূপ দেখে তার সপ্তদশ শতকের মূর্তির কথা কল্পনা করা এখন সম্ভব নয়। সেকালের লণ্ডন অর্ধেক শহর ও অর্ধেক গ্রাম ছিল। তখন সেখানকার সাধারণ লোকের বাসস্থানের ব্যবস্থা নিতান্তই অস্বাস্থ্যকর ছিল। সেই সময়ে, এমনকি শহরের মধ্যেও বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের অফিস ও বাসস্থান সরু কাঠের উপরে সামান্য চুন ও সুরকির পলস্তারা দিয়ে তৈরী করা হত। ওই একই সময়ের মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের ঘরবাড়ি যে লণ্ডনের থেকে অনেক ভালো ও স্বাস্থ্যকর ছিল, তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। ওই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্যই সেকালে লণ্ডনে বহুবার প্লেগের আক্রমণ ঘটেছিল।
সেই আক্রমণের প্রকোপ এতটাই তীব্র ছিল যে, সপ্তদশ শতকের শুরুতেই প্লেগের আক্রমণে লণ্ডনের হাজার ত্রিশেক লোক মারা গিয়েছিলেন। লণ্ডনে দ্বিতীয়বার প্লেগ দেখা দিয়েছিল বিশ-বাইশ বছর পরে, এবং সেবারেও আগের চেয়ে কিছু কম লোক মারা যাননি। এরপরেই দেশের আর্থিক সচ্ছলতার সঙ্গে সঙ্গেই লণ্ডনেরও রূপ বদলাতে শুরু করেছিল, এবং সেখানে প্লেগের প্রকোপও কমে গিয়েছিল। ১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে লণ্ডনে এক বীভৎস অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। সেই সময়ের লণ্ডন শহরের বাড়ি ঘরের অবস্থার কথা তো আগেই বলা হয়েছে; ফলে তখন সেখানে আগুন একবার লাগলে সেটা নিভানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। দমকলের সৃষ্টি অবশ্য তখনো পর্যন্ত হয় নি। ১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে শহরের মধ্যস্থলে ব্যবসায়ীদের পাড়ায় সেই আগুন প্রথম লেগেছিল, আর সেটা পাঁচ দিন ধরে জ্বলেছিল। ওই অগ্নিকাণ্ডে, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের ঘরবাড়িই ভস্মীভূত হয়েছিল; এছাড়া নব্বইটি গির্জাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ‘সেন্টপলস ক্যাথিড্রাল’ সেগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল। সেই অগ্নিদাহের পরে যে নবরূপে ওই গির্জাটি দেখা দিয়েছিল, তা আজও ইংল্যাণ্ডের সেকালের বর্ধমান ঐশ্বর্যেরই প্রতীক। লণ্ডনের মতই, ইংরেজদের কলকাতা শহরও ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দের প্রবল ঝড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এর আগে কলকাতার বেশিরভাগ বাড়ি ঘরই কাঁচা অর্থাৎ বাঁশ, শণ ও বেতের তৈরী ছিল। সেই বিপর্যয়ের ফলেই কলকাতায় পাকাপোক্ত অট্টালিকার সৃষ্টি হয়েছিল, এবং তখন থেকেই কলকাতারও রূপ বদলের শুরু হয়েছিল। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আশাতিরিক্ত লাভের ফলে লণ্ডনের ব্যবসায়ীর দল তখন এতই বিত্তশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, সেই অগ্নিদাহের বিপুল ক্ষতিকেও তাঁরা ক্ষতি বলেই মনে করতে পারেন নি। সেই ভস্মীভূত, অশোভন ও সহজদাহ্য গৃহের বদলে তাঁরা পাকা ইমারত গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন। ফলে লণ্ডনের রূপ সেবারে আরো বদলে গিয়েছিল।
বাংলার প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্যের কথা স্মরণ করে, মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের কথা মনে রেখে, পলাশীর যুদ্ধের পরে ক্লাইভ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক সভার সভাপতিকে বলেছিলেন, “পলাশীর যুদ্ধ জয় করে আমার নিজের আর বিশেষ কি লাভ হয়েছে? সত্যি কথা বলতে কি, অর্থের দিক থেকে আমি নিজের আত্ম-সংযমের কথা ভেবে অবাক হয়ে যাই। আমি যে কি অবস্থায় পড়েছিলাম তা একবার চিন্তা করে দেখুন। একটা মহা ঐশ্বর্যশালী দেশের নবাব সহসা আমার তাঁবেদার হয়ে গেলেন। লণ্ডনের চেয়ে ধনে ও জনে অধিকতর সমৃদ্ধ একটি নগরী আমার পদতলে এসে পড়ল, আর সেখানকার বড় বড় ধনপতির দল আমার একটু কৃপাভিক্ষার জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে শুরু করল।” ক্লাইভের এই কথাটা কিন্তু বিন্দুমাত্রও অতিশয়োক্তি দোষে দুষ্ট ছিল না। তিনি ইচ্ছা করলেই তখন মুর্শিদাবাদের সমস্ত ঐশ্বর্যকে লুঠ করে নিতে পারতেন, যেমন ‘নাদির শাহ’ বা ‘আবদালী’র দল ভারতের অন্যত্র করেছিলেন।
সেই তুলনায়, তিনি নাকি অত বড় একটা কাজের জন্য মাত্র দু’ লক্ষ পাউণ্ড পারিতোষিকেই মোটামুটি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তবে ইতিহাসের অন্যত্র দেখা যায় যে, পলাশীর প্রহসনে ইংরেজ অভিনেতাদের, অর্থাৎ ক্লাইভ, ড্রেক, ওয়াটস প্রভৃতির ভাগে বারো লক্ষ ষাট হাজার পাউণ্ডের কিছু বেশি পড়েছিল, আর আঠারো লক্ষ পাউণ্ড দিয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ক্ষতিপূরণ করা হয়েছিল। ওই টাকার অঙ্ক যাই হোক না কেন, সেটা যে অপরিমিত ছিল তাতে কোন সন্দেহ থাকে না। ক্লাইভের বন্ধু স্ক্রেফটন সেসবের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “এই প্রাপ্তির ফলে দেশ থেকে এক আউন্সও সোনা, রূপা না এনে শুধু বাংলা দেশে নয়, সারা হিন্দুস্থানেই ইংরেজ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি পরবর্তী তিন বছর ফলাও করে বাণিজ্য করেছে। এর আগে বছরে অন্ততঃ দশ লক্ষ টাকার সোনা, রূপা তাদের দেশ থেকে এদেশে নিয়ে আসতে হত, কারণ এদেশে তাদের কোনো মালই বিশেষ বিক্রি হত না।” ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে ইংরেজদের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা শেষ হয়েছিল, এর আরো পঁচিশ বছর পরে ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে কোম্পানির পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। তখন কোম্পানিকে তাদের অংশীদারদের মূলধন ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। সেই টাকাটা কারা দিয়েছিলেন? অবশ্যই ভারতীয়রা। কত টাকা? মোটামুটি, প্রতি পাউণ্ড দশ টাকা হারে, একান্ন কোটি টাকা! সেই টাকাটাই আরো পাঁচ বছর পরে সুদশুদ্ধ সাতানব্বই কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল! এই ন্যায়নীতিই এক নির্বোধ, অসহায় নাবালক ও তার নিরঙ্কুশ অছির মধ্যে চিরদিন বজায় থেকে গিয়েছিল। সেই অছির অছিলার কিন্তু কোন অন্তঃ ছিল না। কিন্তু ক্লাইভ আরো সুদূরপ্রসারী শোষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ভারতের ও লণ্ডনের মধ্যে যে রাজস্ব-ঠিকাদারি ও বাণিজ্য-ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, সেটার ফলে অচিরেই ইংল্যাণ্ড ভরতের সর্বৈশ্বর্যে ভূষিত হয়েছিল। দৈন্য ও সমৃদ্ধির সেই পরস্পর স্থান পরিবর্তন সহসা কারো চোখ বেঁধে দেওয়ার মত নয়। তবে চোখে পড়লেও, এখন সেটার কদর্যতা এত তীব্র ও মর্মস্পশী হয় না, যেমনটা নাদির শাহের কথায় হয়। বাঙালী আত্মবিস্মৃত জাতি; নইলে এখন ইংল্যাণ্ডের তথা লণ্ডনের পরম ঐশ্বর্য দেখে তাঁর মুর্শিদাবাদের কথা মনে পড়ে না কেন? মুর্শিদাবাদের কাহিনী তো কোন প্রাচীন ইতিহাস নয়, সেট মাত্র দুশো’ বছর আগেকার কথা। আর একই সাথে বাঙালীর ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মর্মান্তিক ঘটনার কথাও মনে পড়ে না, যেটা পলাশীর অভিনয়ের মাত্র তেরো বছর পরে ঘটেছিল। তখন বাংলার মত অমন একটা মহা ঐশ্বর্যশালিনী দেশ যেন জাদু মন্ত্রে নিমিষে ভিক্ষুকের রাজ্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বাংলার চাষ গিয়েছিল, ব্যবসা গিয়েছিল, গোলা ভরা ধান আর গোয়ালভরা গরুও নিমেষের মধ্যে অন্তর্হিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে তখনকার বাংলার লোক সংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশও, অর্থাৎ প্রায় দু’ কোটি মানুষ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। আর তখনই বাংলার লক্ষ্মীও ইংরেজদের বাণিজ্য জাহাজে চড়ে চিরকালের জন্য শ্বেতদ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।
ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ
‘নবজাগরণ’ বলতে যদি পুনর্জন্ম, নতুন মূল্যবোধের উদ্ভব ও সৃজনীশক্তির নব নব প্রকাশকে বোঝায়, তাহলে নিঃসংশয়ে ঊনিশ শতকে বাংলার পুনরুত্থানকে নবজাগরণের আখ্যা দেওয়া চলে। তখন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনের ফলে যে জিজ্ঞাসা ও সমালোচনার, বিচার ও বিতর্কের মনোভাব বাঙালী সমাজে জাগ্রত হয়েছিল, সেটা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যবস্থাকেই অন্ধভাবে গ্রহণ করেনি, বরং বিগত কয়েক শতাব্দীর গতিহীন জীবন ও উৎকট রক্ষণশীলতাকে বর্জন করে বাঙালী প্রতিভার উন্মেষের এমন একটি সুচারু পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল, যেটার তুলনা এর আগে মাত্র দু’বার বাংলার ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে বাংলায় পাল রাজাদের শাসনকাল এবং সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ও বাংলার স্বাধীন সুলতানদের আমল অমন এক সৃজনী-সম্ভাবনায় দৃপ্ত অধ্যায় ছিল। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সেই দুটি যুগের আলোড়নের তুলনায় ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ব্যাপকতা এবং সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গীর বিচারে আরো সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠতে পেরেছিল। ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের বিষয়ে বলতে গিয়ে আচার্য ‘যদুনাথ সরকার’ মন্তব্য করেছিলেন, “এটিই ছিল প্রকৃতই এক নবজাগরণ, যা ব্যাপকতায়, গভীরতায় এবং বৈপ্লবিকতায় কনষ্টানটিনোপলের পতনের পরবর্তী ইউরোপীয় নবজাগরণকেও অতিক্রম করেছে। বৈদিক যুগে পাখীর দেশ আখ্যা দিয়ে, মহাকাব্যের যুগে পাণ্ডব বর্জিত স্থান বলে বর্ণনা করে, এবং মুঘল আমলে ‘রুটি-পূর্ণ নরক’ বলে অভিহিত করে বাংলাকে অবজ্ঞার সঙ্গে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে সেই বাংলা এখন ভারতের অন্যান্য অংশের কাছে পথ-প্রদর্শক ও আলোক-দাতার ভূমিকা গ্রহণ করল। যদি পেরিক্লিসের এথেন্সকে হেলেনীয় জাতির শিক্ষায়তন, ‘গ্রীসের নয়ন এবং শিল্প ও বাগ্মিতার জননী’ বলে মনে করা চলে, তাহলে বিদেশ হতে আহৃত নতুন জ্ঞানালোককে অতুলনীয় কৃতিত্বে স্বাঙ্গীকরণের দ্বারা বাংলা দেশও বৃটিশ শাসনাধীন ভারতের অবশিষ্ট অংশের কাছে সেই একই রূপে আবির্ভূত হয়েছিল। এই নতুন বাংলায় উদ্ভূত আধুনিক কালের প্রতিটি শুভ ও মহৎ প্রচেষ্টা ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ধীরে ধীরে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল। বাংলা দেশ থেকে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষক, এবং ইউরোপ-অনুপ্রাণিত ভাবধারা সর্বত্র প্রসারিত হয়ে বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর ভারত এবং দাক্ষিণাত্যের আধুনিকীকরণের পথ প্রশস্ত করেছিল। নতুন সাহিত্য রচনা, ভাষার সংস্কার, সমাজের পুনর্গঠন, রাজনৈতিক আন্দোলন, ধর্মসংস্কার, এমন কি জীবনযাত্রা ও আচার-ব্যবহারের পরিবর্তন বাংলার প্রাদেশিক গণ্ডী পেরিয়ে ঘূর্ণি থেকে বার হয়ে আসা ছোট ঢেউ-এর মত ভারতের সুদূরতম প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। (History of Bengal, Vol. II, Dacca University, 1948, p- 498)
আচার্য যদুনাথের এই মন্তব্যের মধ্যে অবশ্যই কিছু সত্যি নিহিত রয়েছে। সন্দেহাতীত ভাবে একথা বলা চলে যে, ঊনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথম কয়েকটি দশকে বাংলা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের কাছে আলোকবর্তিকাবাহীর ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু ইউরোপের নবজাগরণের তুলনায় বাংলার সেই নবজাগরণ আরো ব্যাপক, গভীর এবং বৈপ্লবিক ছিল কিনা - সে বিষয়ে কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ইতিহাস থেকে বাংলার নবজাগরণের সেই সীমিত রূপ সহজেই চোখে পড়ে, যদিও কোনো কোনো আধুনিক ঐতিহাসিকের অনুসরণে সেটাকে নবজাগরণ বলে একেবারে স্বীকার না করলে এই প্রবন্ধ অতিরঞ্জনের দোষে দুষ্ট হতে বাধ্য। তাই সেই জাগরণের প্রকৃত স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
প্রথমতঃ, ঊনিশ শতকের বাংলায় ক্রমশঃ গড়ে ওঠা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা সেই নবজাগরণ আন্দোলনের প্রাণশক্তি যুগিয়েছিল। সেই শিক্ষার প্রসারের ফলেই চিরাচরিত সমাজ ব্যবস্থা, এবং সনাতন ঐতিহ্য সম্বন্ধে বাঙালীর মনে সংশয় ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছিল, এবং নতুন মূল্যবোধ জেগে উঠেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে, শুধুমাত্র হিন্দু মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, যা সেই যুগে একটি বিশিষ্ট শ্রেণীচরিত্র নিয়ে গড়ে উঠছিল, তার মধ্যেই ওই পাশ্চাত্যশিক্ষার সুফল প্রধানতঃ সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছিল। তৎকালীন বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের বৃহৎ অংশ সেই নতুন শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দূরে সরে ছিল, এবং মেকলের অনুপ্রবেশ তত্ত্বের (Filtration Theory) ব্যর্থতা ও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাবিস্তারের ব্যাপারে সরকারের অনিচ্ছার ফলে দেশের বৃহত্তর জনসমাজ অজ্ঞতার তিমিরেই থেকে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, এর ফলে জনসাধারণ এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি নতুন ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছিল, যার জন্য সেই সময়ের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মনে বিশেষ কোন সহানুভূতির উদ্রেক করতে পারে নি।
দ্বিতীয়তঃ, ঊনিশ শতকের ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনগুলির গণ্ডীও অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ ছিল, কারণ সেগুলির আবেদন দেশের মানুষের হৃদয়ের চেয়ে বুদ্ধির কাছেই বেশি প্রবল ছিল। ওই সময়ের ব্রাহ্ম আন্দোলন তার নিজস্ব প্রকৃতির জন্যই জনমানসে অতি সামান্য প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। একটি মৌলিক বিভ্রান্তি নিয়ে সেই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল। হিন্দুধর্ম আসলে কোনো সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক মতবাদ নয়, বরং বহু সম্প্রদায়ের মতবাদ অতীতে এই ধর্মের বৃহৎ ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় পেয়েছিল। অভ্রভেদী দার্শনিকতা, এবং উৎকট পৌত্তলিকতা, এই দুই সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গী একটা সময়ে হিন্দুসমাজে সহাবস্থান করত। ধর্মাচরণের ব্যাপারে অধিকারভেদ বা অন্তর্নিহিত প্রবণতা ও শক্তিকে হিন্দুসমাজ চিরকালই স্বীকার করে এসেছে। আধ্যাত্মিক বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে অবস্থিত ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন সাধনমার্গকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতেও হিন্দুধর্মের কোনোদিনই কুণ্ঠাবোধ হয়নি। সুতরাং, ব্রাহ্মসমাজ যখন সমাজের সকলের জন্য একটি বিশেষ ধর্মীয় আদর্শ ও নীরস সাধন পদ্ধতি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, তখন সেটার আবেদন প্রধানতঃ বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ অংশের কাছেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছিল, এবং বৃহত্তর জনসমাজ সেটার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেনি। বহু দেবদেবীর পূজার্চনা এবং মূর্তিপূজায় আস্থা দূর করবার প্রাথমিক ও মৌলিক যে ব্রত নিয়ে ব্রাহ্মসমাজ অগ্রসর হয়েছিল, সে ব্রত এখনো পর্যন্ত উদ্যাপিত হতে পারেনি। বাংলা ও বাঙালীর ঐতিহাসিকতার দিক থেকে এই সত্যি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। এই প্রসঙ্গে গান্ধীজী একবার একটি রূঢ় মন্তব্য করে বলেছিলেন যে, চৈতন্য বা কবীরের তুলনায় রামমোহনকে ‘বামন’ (pigmy) বলা চলে। প্রথমোক্ত ধর্মগুরুরা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে উচ্চ-নীচ নির্বিচারে যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, এবং সবদিকেই এমন এক আত্মশুদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, সেটা ঊনিশ শতকের বাংলার ব্রাহ্ম নেতাদের স্বপ্নেরও অতীত ছিল। (Young India, 13th April, 1921)
ব্রাহ্মধর্মের বিরোধী নব্য হিন্দু প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও জনসংযোগের সেই একই অভাব ইতিহাস থেকে লক্ষ্য করা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যসৃষ্টি তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মনোজগতে হিন্দু আদর্শের পুনর্বাসনের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে গৃহীত হলেও, সেটার বুদ্ধিদীপ্ত পরিবেশন শৈলীর জন্য তা জনসাধারণের মনে বিশেষ রেখাপাত করতে পারেনি। শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষা সন্দেহাতীত ভাবে ওই সময়ের সাধারণ মানুষকে নব্য হিন্দু মতবাদের দিকে আকৃষ্ট করলেও, স্বামী বিবেকানন্দের ভাবপূর্ণ পরিশীলিত বাণী কিন্তু সেই সময়ের অশিক্ষিত জনসাধারণের মর্মকে পুরোপুরি স্পর্শ করতে পারে নি। রামকৃষ্ণ মিশনের সমাজসেবামূলক কার্যকলাপের দ্বারা সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সময়ে উপকৃত হলেও, মিশনের আধ্যাত্মিক প্রভাব তাঁদের জীবনে বিশেষ পড়েছিল বলে মনে হয় না।
সেই যুগের সমাজ-সংস্কার প্রচেষ্টাও অনেকক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে নি। ঊনিশ শতকের সব সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে একমাত্র সতীদাহ-নিরোধ আন্দোলনই ওই সময়ের সাধারণ মানুষের জীবনে, অন্ততঃ বঙ্গদেশের কোনো কোনো অংশে হয়ত কিছুটা পরিবর্তন এনেছিল। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করলেও একই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, হিন্দুসমাজের নিম্ন বর্ণগুলির মধ্যে একটি বৃহৎ অংশে কিন্তু বিধবাবিবাহ সেই আন্দোলনের আগেও প্রচলিত ছিল, এবং বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের আপাতদৃষ্ট সাফল্য সত্ত্বেও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে বিধবা-বিবাহ আজও তেমনভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। একই সময়ে কুলীনদের বহুবিবাহ-নিরোধ আন্দোলনও হিন্দুসমাজের বৃহত্তর অংশের কাছে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না; কারণ, কৌলীন্য প্রথা হিন্দুসমাজের উচ্চ বর্ণাশ্রয়ীদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। মানব- প্রেমিক ও খৃষ্টধর্ম প্রচারকদের সযত্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নারী-শিক্ষা ঊনিশ শতকের হিন্দু সমাজের উচ্চশ্রেণীর মধ্যেও বিশেষ অগ্রগতির স্বাক্ষর রাখতে পারে নি, নিম্নশ্রেণীর ক্ষেত্রে তো সেই ওঠেই না। ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টের সুযোগ হিন্দু সমাজের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ, বিশেষতঃ ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ই, গ্রহণ করতে পেরেছিল।
সমাজের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে জাতিভেদ প্রথার জটিলতা কিছুটা শিথিল হলেও, দেশের বৃহত্তর জনসমাজের মধ্যে ঐ প্রথার প্রকোপ সে যুগে যথেষ্টই দেখা গিয়েছিল। মোটের উপর এই কথা বলা চলে যে, ঊনিশ শতকের সমাজ-সংস্কার আন্দোলন শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত ছিল। বাংলার নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা এর মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ইতিহাস থেকে প্রতিফলিত হয়। রাজনীতির ক্ষেত্রেও ঊনিশ শতকের বেশির ভাগটা জুড়েই বাঙালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তাঁদের রাজনৈতিক এবং আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক উপায়ে আন্দোলন চালিয়েছিলেন, কিন্তু সাঁওতাল-বিদ্রোহ এবং ওয়াহাবী আন্দোলনের মতো ইংরেজ-বিরোধী ও প্রত্যক্ষ সহিংস আন্দোলনে তাঁদের কোন সহানুভূতি ও সমর্থন ছিল না।
বাংলার নবজাগরণের হোতারা (ঊনিশ শতকের শেষ দুই দশক বাদ দিলে) বৃটিশ শাসনকে বিধাতার এক মহৎ আশীৰ্বাদ বলেই মনে করেছিলেন। কেবলমাত্র বিংশ শতকের প্রথম দিকেই বাংলার মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক আন্দোলন এবং বিক্ষোভ কিছুটা গণ-আন্দোলনের রূপ ধারণ করেছিল।
ঊনিশ শতকের বাংলা সম্পদে, প্রাচুর্যে, এবং প্রাখর্যে দীপ্ত এক নবীন জীবনের সন্ধান পেলেও, সেটার স্বাদ গ্রহণ করাটা দেশের জনসাধারণের এক অতি সীমিত অংশের পক্ষেই সম্ভবপর হয়েছিল, এবং ইংরেজী-শিক্ষিত বাঙালী (মূলতঃ হিন্দু) মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রধানতঃ সেই নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছিল। বিদেশী শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বাংলার রাজনীতি ও বৈদেশিক আর্থিক শোষণ ঊনিশ শতকের বাঙালী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সম্প্রসারণকে নিদারুণভাবে ব্যাহত করেছিল, এবং সেই ঘটনার মধ্যেই বাংলার নবজাগৃতির সীমিত চরিত্রের মূল কারণ সুস্পষ্টভাবে নিহিত ছিল।
বাংলার বারো ভূঁইয়া ও তামাক পাতা
ষোড়শ শতকের বাঙলার সেই মাৎস্যন্যায়ের কালে, পূর্ববঙ্গে প্রধানতঃ পাঠান সর্দারেরা, এবং নিম্নবঙ্গে হিন্দু ভূস্বামীরা প্রবল প্রতাপশালী হয়ে উঠেছিলেন। ভারতের ইতিহাসে ওই সময়টাই বাঙলার ‘বারো ভুঞা’র আমল নামে পরিচিত। উক্ত ‘বারো ভূঞা’ বা বারোজন ভূস্বামী কিন্তু সংখ্যায় ঠিক বারোজনই ছিলেন না; ওই শব্দটি বাঙলার প্রচিলত প্রবাদ ‘বারো ভূতের’ মতই; কারো বেওয়ারিস সম্পত্তি যেমন বারো ভূতে খায়, ষোড়শ শতকের বেওয়ারিস বাঙলা রাজ্যও তেমনি বারো জনের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে তখনকার সবচেয়ে বড় ভূস্বামী ছিলেন পাঠান সর্দার ‘ঈশা খাঁ’। ময়মনসিংহ জেলার পুরোটা, ঢাকা, ত্রিপুরা, রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার অনেকটা নিয়ে তাঁর বিশাল জমিদারী ছিল। তখনকার বিখ্যাত বন্দর সোনারগাঁ সেই জমিদারীর কেন্দ্র ছিল। তবে তিনি অবশ্য ষোড়শ শতকের শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই লোকান্তরিত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ছেলে মুসা তাঁরই যোগ্য উত্তরাধিকারী হতে পেরেছিলেন। ‘প্রতাপাদিত্য’ তখন সুন্দরবনের ধুমঘাটে এসে জুড়ে বসেছিলেন। অধুনাতন যশোহর ও খুলনা জেলার সবটা, আর বাখরগঞ্জের বেশ খানিকটা জুড়ে তাঁর জমিদারি ছিল। তাঁরা দু’জন ছাড়া তখনকার শক্তিশালী ভূস্বামীদের তালিকায় যাঁরা উল্লেখযোগ্য ছিলেন তাঁদের মধ্যে - বাখরগঞ্জ বা বাকলার, নোয়াখালির ভুলুয়ার, ময়মনসিংহের পাহাড়-ঘেঁষা সুস্থঙ্গের ভূস্বামিরা প্রধান। তাঁরা সবাই স্ব স্ব প্রধান ছিলেন; যাঁর যাঁর জমিদারীর পরিধি রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য তৎপর তাঁদের মধ্যে যে কোনো আদর্শগত ঐক্য ছিল - তা নয়; সমগ্র বাঙলার পটভূমিকাও তাঁদের মানসচক্ষে ছিল না; এমনকি বর্তমানে স্বদেশভক্তি বলতে যেটাকে বোঝানো হয়, সেটা তো একেবারেই ছিল না। তাই তাঁদের কারোর সম্বন্ধে স্বদেশপ্রীতি বা বীরত্বের প্রশংসাপত্র দান করাটা, নিছক কবিকল্পনা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। বারো ভূঞাদের রাজ্যে শাসন-যন্ত্রও রাজার ইচ্ছামত চলত।
সেই সময়ে সামাজিক আদর-আপ্যায়নের ক্ষেত্রে পানের পরেই তামাকের স্থান ছিল। আকবরের রাজত্বের শেষের দিকে ভারতে তামাকের আগমন ঘটলেও, সপ্তদশ শতকের আগে কিন্তু বঙ্গদেশে তামাকের প্রচলন ঘটেনি। কারণ, সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগের আগে মোঘলরা পাকাপাকিভাবে বঙ্গদেশে তাঁদের দখলীস্বত্ব কায়েম করতে পারেন নি। ঐতিহাসিকদের মতে ‘ক্রিস্টোফার কলম্বাস’ ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকা থেকে ইউরোপে তামাকপাতা নিয়ে গিয়েছিলেন। পর্তুগীজরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেটাকে আরবে ও ভারতবর্ষের দক্ষিণাপথে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমানে যে যে প্রথায় তামাকপাতার ব্যবহার চালু রয়েছে, আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা প্রায় ঠিক একই ভাবেই তামাকপাতা ব্যবহার করতেন। তাঁদের ধারণা ছিল যে, তামাকের ভৈষজ গুণ রয়েছে। ষোড়শ শতকে তামাকপাতা পেয়ে সমগ্র ইউরোপ ধূমপানে মত্ত হয়ে উঠেছিল; এমনকি সেখানকার ভিষকেরাও তখন তামাকের গুণগান করেছিলেন। কিন্তু তবুও গোড়া থেকেই তামাকের প্রতি সবার একটা গভীর সন্দেহ জড়িয়ে ছিল যে, জিনিসটা হয়ত বিষাক্ত। পর্তুগাল তামাকপাতা প্রথমে গোয়ায় পদার্পন করবার পরে, ক্রমে দক্ষিণাপথে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে দিল্লীর বাদশাহী দরবারের স্বীকৃতিই ভারতে তামাকের ব্যাপক প্রচলন ঘটিয়েছিল। মোঘলদের মধ্যে বাদশাহ আকবর প্রথম ধূমপান করেছিলেন, এবং তাঁরই সভাসদ ‘আসাদ বেগ’ তাঁকে সেই তামাকের যোগান দিয়েছিলেন। আকবরের সঙ্গে তামাকের প্রথম পরিচয়ের বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে আসাদ বেগ লিখেছিলেন, “দক্ষিণাপথের বিজাপুরে আমি তামাকপাতা দেখতে পেলাম। ভারতবর্ষে এই প্রথম এর সন্ধান পেলাম। কিছুটা সঙ্গে কিনে নিলাম। তারপরে তিন হাতের মত একটি কারুকার্যময় নল তৈরি করিয়ে, সেটার দু’দিকমাণিক্যখচিত করে নিলাম। গোড়ার দিকে একটি রঙিন পাথরের নল বসিয়ে তার ওপরে সোনার কলকে দিলাম। সবটা দেখতে খুবই মনোরম হল। … কলকেতে তামাক সেজে বাদশাহকে বলা হল এই সেই তামাক - যা মক্কা ও মদিনায় বহুপরিচিত। বাদশাহ ধূমপান করতে শুরু করতেই তাঁর ভিষক এসে তাঁকে বাধা দিলেন। তবে বাধা দেওয়ার আগেই বাদশাহ দু’ তিনটে টান দিয়েছিলেন, তারপরে আর দিলেন না। ভিষক তৎক্ষণাৎ ভেষজ তৈরীকারককে ডেকে পাঠালেন। তিনি পুঁথি ঘেটে বললেন যে, তাতে তামাকের কথা নেই। অনেকে বলল যে, ইউরোপের ভিষকেরা এর গুণগান করেছেন, কিন্তু বাদশাহের ভিষক নিজে পরীক্ষা না করে সেটা মেনে নিতে রাজী হলেন না। …
দিন কয়েকের মধ্যে সবাই আরো তামাকপাতা চেয়ে বসলেন! দিল্লীতে তামাক চালু হল। বণিকেরা দক্ষিণাপথ থেকে তামাক এনে দিল্লীতে বিক্রি করতে শুরু করল, কিন্তু বাদশাহ নিজে আর সেটা স্পর্শ করলেন না।” এরপরে কিন্তু ক্রমশঃ এই নেশার বস্তুটি মোঘল ওমরার প্রাসাদ থেকে শুরু করে দরিদ্রের কুটিরে, দক্ষিণাপথের মাঠ থেকে শুরু করে উত্তরাপথের মাঠে; এবং বাঙলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে জলে পরিশুদ্ধ করে ধূমপানের রীতি চালু হয়েছিল। তখন ধূমপানের জন্য যেমন নানা ধরণের ধাতুর জলাধার ও কলকের প্রচলন ঘটেছিল, তেমনি নারকেলের খোল, মাটির কলকে ইত্যাদির ব্যবহারও শুরু হয়েছিল। দেখতে দেখতে তামাক সর্বসমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্রমে তামাক থেকে নস্যি ও দোক্তা তৈরী হয়েছিল। সপ্তদশ শতকে ইংল্যাণ্ডে সে দুটির বহুল প্রচলন ঘটেছিল। অষ্টাদশ শতকে সেই দুটিই বাঙলায় এসে সাদর অভ্যর্থনা পেয়েছিল।
হাজী মুহাম্মদ মুহসীন
দানবীর হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের বয়স তখন প্রায় ৭০ এর কাছাকাছি। তখন তার চিন্তা এসেছিল যে, তার মৃত্যুর পরে এই বিপুল সম্পত্তির কি হবে? তাই ১৮০৬ সালে তিনি পুরো সম্পত্তির ওয়াকফ বা দানপত্র করে দেন। সেখানে এই সম্পত্তির আয় কীভাবে বিলি বণ্টন করা হবে, তার বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় স্থাপনা, জনকল্যাণে ব্যয় করা হবে এসব অর্থ।
হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের দান করা সম্পত্তির পরিচালনা নিয়ে পরবর্তীতে কিছু মামলা-মোকদ্দমার তৈরি হয়। যাদের পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অবশেষ ১৮৩৪ সাল নাগাদ এই তহবিল ব্যবহারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা।
১৮৩৫ সালে এই তহবিল দিয়ে 'মহসিন এডুকেশনাল এনডাউমেন্ট ফান্ড #39; তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার। হাজী মোহাম্মদ মুহসীন যেভাবে দানপত্র লিখেছিলেন, তাতে কিছু পরিবর্তন এনে ব্রিটিশরা দুইটি আলাদা তহবিল গঠন করে। তার একটিতে হাজী মহসিনের ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যয় যেমন - ইমামবাড়ীর খরচ, পেনশন প্রদান ও মোতোয়ালির বেতন ইত্যাদি খাতে ব্যয় হবে। সাধারণ ফান্ড নামের আরেকটি ফান্ড থেকে শিক্ষার পেছনে ব্যয় হবে।
পরবর্তীতে এই তহবিল থেকে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসীন কলেজ। এরপরে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা, সিতাপুর মাদ্রাসা, ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।
নবাব আব্দুল লতিফ, খাজা আব্দুল গনি, তাদের চেষ্টায় ১৮৭৩ সালে এই ফান্ড থেকে স্কলারশিপ চালু করা হয়। শুধু এটাই না, তখনকার স্কুলগুলোয় একজন আরবি শিক্ষকসহ বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার ব্যাপারে এই ফান্ড থেকে সহযোগিতা আসতো।
হাজী মোহাম্মদ মহসিনের দানকৃত অর্থে প্রথম কলেজ শুরু হয়, হুগলি মহসীন কলেজ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ হুগলি কলেজেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গুরুদেব মুখোপাধ্যায়, দিজেন্দ্রনাল রায়, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, স্যার উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- এরকম বিখ্যাত বাঙ্গালিরা পড়াশোনা করেছেন।
১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের কাছে স্বাধীনতা চলে যাওয়ার পর একটি স্বাধীন জাতি যেভাবে ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে নিগৃহীত হয়েছে, তার পেছনে জাতীয়তাবোধ না থাকা, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর স্পৃহা তৈরি না হওয়ার পেছনে অশিক্ষাই প্রধান বিষয় বলে হাজী মোহাম্মদ মহসিনের কাছে মনে হয়েছিল। তাই তিনি চেয়েছিলেন তার দানকৃত সম্পদ যেন শিক্ষার পেছনেই বেশি ব্যয় হয়।
প্রাচীন মিশরের যত অজানা কথা
যাতায়াতের মাধ্যম
রাজবংশীয় শাসনামল শেষের দিকে আসার আগ পর্যন্ত মিশরীয়রা যাতায়াতের জন্য উট তেমন একটা নিয়মিতভাবে ব্যবহার করতো না। বরং এ কাজে তখন গাধাই ছিলো তাদের কাছে অধিক পছন্দনীয়। আর নৌপথে যাতায়াতের জন্য নৌকা তো ছিলোই।
মিশরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নীল নদ একদিকে যেমন তাদের যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিলো, অন্যদিকে বাড়িঘর সহ অন্যান্য নানা স্থাপনা খালের মাধ্যমে নীল নদের সাথে যুক্ত ছিলো। বড় বড় কাঠের বজরায় করে খাদ্যশস্য ও পাথরখন্ড পারাপার করা হতো।
সবাইকে মমি করা হতো না
তবে মমি বানানোর কাজটি একইসাথে বেশ সময়সাপেক্ষ ও পরিশ্রমের ছিলো বলে সমাজের উচ্চবিত্তরাই মূলত মৃতদেহ সৎকারের এ পথ বেছে নিতো।
তারা বিশ্বাস করতো যে, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবন লাভ করা সম্ভব কেবলমাত্র যদি মৃতদেহটি শনাক্ত করার মতো অবস্থায় থাকে। অন্য্যদিকে মমিটি সুরক্ষিত স্থানে রাখা হতো যেন কেউ সেটির কোনো ক্ষতি সাধন করতে না পারে।
‘উপত্যকার খাদ্যোৎসব’ নামে তারা বাৎসরিক একটি ভোজ-অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো যেখানে মৃতদের সাথে জীবিতদের পুনরায় সাক্ষাত হয় বলেই বিশ্বাস করতো মিশরীয়রা। সেই সময়টায় রাতের আধার নেমে আসলে তারা সমাধিস্তম্ভেই রাতটা কাটিয়ে দিতো। মশাল জ্বেলে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের মাধ্যমেই মৃতের সাথে পুনর্মিলনকে স্মরণীয় করে রাখতো তারা।
নারী-পুরুষের সমঅধিকার
নারীরাও সেখানে আয়-উপার্জন করা, কেনাবেচা করা কিংবা সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে পারতো। ইচ্ছে হলে তারা কোনো পুরুষের অভিভাবকত্ব ছাড়াই স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারতো। বিধবা হলে কিংবা স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে একজন মা একাই তার সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারতেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রী-ই তার ব্যবসাবাণিজ্য দেখাশোনা করতে পারতেন।
সকল ফারাও পিরামিড বানাতেন না
পুরাতন সাম্রাজ্য (২৬৮৬-২১২৫ খ্রি.পূ.) ও মধ্যবর্তী সাম্রাজ্য (২০৫৫-২৬৫০ খ্রি.পূ.)-এর প্রায় সকল ফারাওই পিরামিড বানিয়েছিলেন। এগুলো বানানো হতো দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় মরুভূমিতে। কিন্তু নতুন সাম্রাজ্যকালীন সময়ে (১৫৫০ খ্রি.পূ.) পিরামিড বানানোর এ প্রচলন বিলুপ্তির পথে যাত্রা শুরু করে।
তখন রাজারা তাদের মৃত্যু উপলক্ষ্যে দুটো সম্পূর্ণ পৃথক স্মৃতিস্তম্ভ বানানোর চল শুরু করেন। মিশরের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর থেবসে নীল নদের দক্ষিণ তীরে ‘রাজাদের উপত্যকা’য় পাথর কেটে বানানো হতো রাজাদের জন্য গোপন সমাধিস্তম্ভ। অন্যদিকে জনবসতি ও মরুভূমির মাঝামাঝি এলাকায় স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বানানো হতো আরেকটি মন্দির যা থাকতো জনতার মূল আকর্ষণ।
গ্রেট পিরামিড ক্রীতদাসরা বানায় নি
গবেষণা করে ইতিহাসবিদেরা জানিয়েছেন যে, আনুমানিক ৫,০০০ নিয়মিত বেতনভুক্ত শ্রমিক কাজ করেছিলো গ্রেট পিরামিড বানানোর জন্য। এদের পাশাপাশি কাজ করতো আরো প্রায় ২০,০০০ অনিয়মিত শ্রমিক। এই শ্রমিকেরা সবাই ছিলো মুক্ত মানুষ অর্থাৎ ক্রীতদাস না। ৩-৪ মাসের শিফটে তারা পিরামিডের ওখানে কাজ করতো। মজুরি হিসেবে তারা পেত খাদ্য, পানীয় ও চিকিৎসা সেবা।
মিশরীয়দের পশুপ্রেম
বিভিন্ন পশুপাখিকে প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা দেবতার প্রতিমূর্তি বলে মনে করতো। তারা বিড়াল খুব পছন্দ করতো যা ছিলো তাদের দেবী বাস্টেটের সাথে সম্পর্কিত। এর পাশাপাশি বাজপাখি, আইবিস পাখি, বেবুন, সিংহ, কুকুরও তারা পালতো। এমনকি অনেক সময় মালিকের মৃত্যুর পর তার পোষা প্রাণীটিকেও মমি করে মালিকের সাথে দিয়ে দেয়া হতো।
নারী ও পুরুষের রুপচর্চা
মিশরীয় নারী ও পুরুষ উভয়েই রুপচর্চা করতো। মহিলারা তাদের গালে লাল রঙ দিয়ে মাখাতো এবং হাত ও হাতের আঙুল সাজাতে ব্যবহার করতো মেহেদি। বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ তেল ও দারুচিনি থেকে প্রস্তুত সুগন্ধিদ্রব্য ব্যবহার করতো মিশরীয়রা।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সন্তান
নবাব সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতিদের মধ্যে ছিলেন মীরমদন, মোহনলাল, খাজা হাদি প্রমুখ। পলাশীর যুদ্ধের আগে সিরাজ-উদ-দৌলা যখন মীর জাফরকে বক্সী পদে ফিরিয়ে আনেন, তখন এই তিনজন সেনাপতি প্রবল আপত্তি করেন। কিন্তু সিরাজ তাদের কথায় গুরুত্ব দেননি। বিশ্বাসঘাতকতার ফলশ্রুতিতে নবাব পরাজিত ও বন্দী হন। সেনাপতি মোহনলাল আহতাবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন (যদিও অনেকের ধারণ তিনি নিহত হয়েছিলেন, তবে তার জীবিত থাকার পক্ষেই প্রমাণ বেশি)।
মোহনলাল আঠারো শতকের গোড়ায় কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন বাংলায়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সর্বপ্রকার ছুতমার্গ ও সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামির ঊর্ধে ছিলেন। নবাবের একান্ত অনুগত হিসেবে তিনি পলাশীর যুদ্ধে লড়াই করেন। কিন্তু এই মানুষটিকে নিয়ে ইতিহাসে তেমন আলোচনাই নেই।
মোহনলালের এক অতি সুন্দরী বোনের নাম ছিল মাধবী। তাকে হীরা বলেও ডাকা হতো। মোহনলালের সঙ্গে সিরাজের সখ্যের জের ধরে হীরার সাথেও নবাব সিরাজ অন্তরঙ্গ হয়ে পড়েন। তাদের অন্তরঙ্গতার ফলে হীরার গর্ভে সিরাজের এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। বৃদ্ধ আলিবর্দী খান তখনও এই সংবাদ পাননি। এই কথা জানলে তিনি ভয়ানক ক্রুদ্ধ হবেন ভেবে সিরাজ যথেষ্ট গোপনীয়তা অবলম্বন করে হীরা ও তার পুত্রকে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু শেষমেষ পিতামহের ভয়ে সিরাজ এক অস্বাভাবিক কান্ড করে বসেন। তিনি শিশুপুত্রকে একটি ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে বেঁধে দেন, তারপরে ঘোড়াকে ছুটিয়ে দেন। দায়িত্ব নেবার ভয়ে সিরাজ পুরোপুরি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেন নিজ শিশু সন্তানকে।
এই সংবাদ পেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হীরা ছুটে গিয়ে মোহনলালকে সব বলেন। মোহনলাল সাথে সাথে ঘোড়ায় চেপে দ্রুত ছুটে গিয়ে ছুটন্ত ঘোড়া থামিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেন। এই ঘটনায় মোহনলাল এতো ক্ষিপ্ত হন যে তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মোহনলালের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে আলিবর্দী খান কারণ অনুসন্ধান করে সমস্ত ঘটনা জেনে যান। মোহনলাল চলে গেলে সিরাজের ভয়ানক ক্ষতি হবে ভেবে দূরদর্শী আলিবর্দী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাই ইমামের সাথে আলোচনা করে মীমাংসার একটি সূত্র বের করেন। হীরা ইসলাম গ্রহণ করলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। হীরা ইসলাম গ্রহণ করলেন। তার নতুন নাম হলো আলেয়া। তারপরে ইসলামিক রীতি অনুযায়ী সিরাজের সাথে আলিয়ার বিবাহ সম্পন্ন হয়। আলিবর্দীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিরাজের পুত্রের দায়িত্ব মোহনলালকেই গ্রহণ করতে হয়।
“মুর্শিদাবাদ কাহিনী” গ্রন্থের লেখক নিখিলনাথ রায়ের মতে সিরাজের কতজন স্ত্রী ছিল তা স্থির করা যায় না, তবে তিন-চারজনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে যে আলেয়া একজন, তা বিভিন্ন সূত্রমতে স্বীকৃত।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাবের বিপর্যয়ের পরপরই মোহনলাল বুঝতে পারেন যে সিরাজের পুত্রের জীবনও বিপন্ন হবার মুখে। তাই যুদ্ধপরবর্তী বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সবার অলক্ষ্যে তিনি ছয় বছরের সিরাজপুত্রকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যান। তার সঙ্গে বাসুদেব ও হরনন্দ নামে দু’জন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন। তারা পদ্মা নদী পার হয়ে ময়মনসিংহের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত বোকাইনগর দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন।বাংলাদেশের প্রাচীন মানচিত্রে ময়মনসিংহ জেলায় বোকাইনগর গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ক্লাইভ ও মীর জাফর চারদিকে গুপ্তচর পাঠিয়ে তাদের ধরার চেষ্টা করছে, এই খবর পেয়ে মোহনলাল বোকাইনগর দুর্গ নিরাপদ মনে করেননি। তার বিশ্বস্ত সঙ্গী বাসুদেবের কাকা বিনোদ রায় আমহাটি গ্রামে বাস করতেন। মোহনলাল সিরাজপুত্রকে কিছুদিন সেই বাড়িতে রাখেন। এরপর তিনি এই পুত্রকে দত্তক নেওয়ার জন্যে ময়মনসিংহের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সাথে কথা বলেন এবং জমিদার সম্মতিও দান করেন।
নিরাপত্তাজনিত কারণে মোহনলালের এক জায়গায় থাকা সম্ভব হয়নি। তিনি ও তার দুই সঙ্গী সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে রংপুর যান। সিরাজের পুত্রর নাম রাখা হয় যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। এইভাবে নবাব সিরাজের পুত্র হিন্দু পরিচয়ে বড় হয়ে ওঠেন।
যুগলকিশোর জমিদার জমিদারী পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারী পান যুগলকিশোর। তিনি নিজেও হয়তো তার চেহারা ও দেহের গঠন হতে আভাস পেয়েছিলেন যে তার পূর্বপুরুষ ভিনদেশী মুসলিম কেউ ছিল। ইংরেজ সরকার তার পরিচয় ঝামেলা শুরু করতে পারে ভেবে তিনি গৌরীপুরের জমিদারী ত্যাগ করে শ্রীহট্টে (বর্তমান সিলেট) চলে যান।
যুগলকিশোর বিয়ে করেছিলেন ফরিদপুর জেলার ভট্টাচার্য বংশের রুদ্রাণী দেবীকে। তার গর্ভে হরকিশোর ও শিবকিশোর নামে তার দুই পুত্র এবং অন্নদা, বরদা, মোক্ষদা ও মুক্তিদা নামে চার কন্যার জন্ম হয়। রুদ্রাণী দেবীর দুই পুত্র অল্প বয়সেই মারা যায়। যুগলকিশোর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন পাবনার যমুনা দেবীকে। দ্বিতীয় পক্ষে তার প্রাণকৃষ্ণনাথ নামে এক পুত্র ছিল। যমুনা দেবী ও প্রাণকৃষ্ণনাথ তার সাথে সিলেটের কাজলশা নামক স্থানে বাস করতেন। এখানে যুগলকিশোর নতুন জমিদারী ক্রয় করেছিলেন।
সিলেটে এক প্রকার নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করতেন। তার পুত্র প্রাণকৃষ্ণনাথ পরবর্তীতে জমিদারী গ্রহণ করেন। সিলেটের উন্নতির জন্যে অনেক কাজ করেছিলেন প্রাণকৃষ্ণনাথ। সিলেটের বিখ্যাত যুগলটিলা আখড়া তিনি তৈরি করেন। যুগলকিশোর তার বংশ পরিচয় জানতে পেরেছিলেন এবং মৃত্যুর আগে নিজ পুত্রকে তা বলে গিয়েছিলেন। তিনি এই পরামর্শও দিয়েছিলেন যে, তার বংশধরদের সবাই যেনো সিলেটে না থেকে একটি অংশ পদবী পরিবর্তন করে শিলং-এ চলে যায়। ১৮১১ বা ১৮১২ সালের কোনো এক সময়ে যুগলকিশোরের মৃত্যু হয়। এই ছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পুত্রের আখ্যান। ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন না হলে হয়তো তিনিই হতেন বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার পরবর্তী নবাব।