তথ্য-১ ▌ সৌর জগত : পৃথিবী সূর্য থেকে প্রায় ৯৩০ লক্ষ মাইল দূরে থেকে এক গোলাকার কক্ষপথে আবর্তন করছে এবং প্রায় একই সমান্তরালে কম-বেশি দূরে থেকে আরো গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। গ্রহদের এই আবর্তন ক্ষেত্রকে বলা হয় সৌরজগত। নেপচুন গ্রহটি পৃথিবী থেকে আয়তনে ৬০ গুণ বড়, শনি গ্রহটি বড় ৭৩৪ গুণ। বৃহ¯পতি বড় ১৩১২ গুণ এবং আয়তনে সূর্য পৃথিবীর চেয়ে ১৩ লক্ষ গুণ বড়। সৌরজগতের বাইরে যে সকল জ্যোতিষ্ক দেখা যায়, তাদের দূরুত্ব হিসাব করতে হয় আলোক বছরে। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৮৬ হাজার মাইল বেগে চলে আলো এক বছরে যতোটা পথ অতিক্রম করতে পারে, তাকে বলা হয় এক আলোক বছর। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছুতে সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট। কিন্তু মহাকাশে কোটি কোটি নক্ষত্রের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে কাছে যে নক্ষত্রটি আছে, তার আলো পৃথিবীতে আসতো সময় লাগে প্রায় ৪ বছর। মহাকাশে ৪ আলোক বছরের কম দূরত্বে কোনো দিকে কোন নক্ষত্র নেই। এ পর্যন্ত মহাকাশে প্রায় ১০,০০০ কোটি নক্ষত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। মহাকাশে এমন নক্ষত্রও আছে, যা আমাদের সূর্য অপেক্ষা কোটি কোটি গুণ বড়।
তথ্য-২ ▌পৃথিবীর জন্মের প্রথম অবস্থা : প্রথম অবস্থায় পৃথিবী ছিল একটা জ্বলন্ত গ্যাসের পুঞ্জ। তার থেকে তেজ বেরিয়ে যেতে যেতে পৃথিবী ক্রমশই ঠা-া হয়েছে। গ্যাস ঠা-া হলে তরল অবস্থায় পরিণত হয়। এই রকম তরল অবস্থায় পরিণত হতে পৃথিবীর লাগে কয়েকশ কোটি’ বছরের। গরম দুধের উপরে হাওলা দিলে যে রকম সর পড়ে, অনেকটা সেইভাবে ঠা-া হতে হতে তরল পৃথিবীর বাইরের দিকটা ক্রমশ শক্ত হয়ে এলো। এভাবে আরো কোটি কোটি বছরের পর বছর ঠা-া হতে হতে পৃথিবীর উপরকার ওই খোলসটির নিজস্ব উত্তাপ বলতে প্রায় সবটুকু খোয়া গেল। যে বায়ুম-ল দিয়ে পৃথিবী মোড়া ছিল তা ঘন মেঘের মতো বাষ্পের পুঞ্জ। পৃথিবী আরও একটু ঠাণ্ডা হবার পর সেই মেঘ ফুটন্ত বৃষ্টিধারা হয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে এলো। ফলে, রুক্ষè পৃথিবীর বুকে দেখা দিল সমুদ্র, নদী, হ্রদ। কিন্তু পৃথিবীর একেবারে ভিতরকার অংশটা এখনো প্রচ-রকম গরম। ভেতরকার সেই প্রচণ্ড উত্তাপের চাপে পৃথিবীর উপরকার শক্ত খোলসকে ভেদ করে ভিতরকার তরল ফুটন্ত পদার্থ ঠিকরে বেরিয়ে আসে। তারই নাম আগ্নেয়গিরি।
তথ্য-৩ ▌প্রাণের উৎপত্তি : পৃথিবীর জ্বলন্ত সময়কালেই জৈব পদার্থের সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর আদিম সমুদ্রে তৈরি হয় হাজার হাজার কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সুবিন্যন্ত সংযোগে। এই প্রোটিন হতে জন্ম নিয়েছিল জীবদেহের মূল উপাদান প্রোটোপ্লাজম। ইহা সম্পূর্ণ পানিতে মিশে না, পানির উপর ভাসমান অবস্থায় থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ গুণ দেখা যায়। এটি পানিতে ভাসমান অন্য জৈব-অজৈব পদার্থকে আত্মসাৎ করে নিজ দেহ পুষ্ট করতে থাকে। এই জৈব পদার্থটি আয়তন ও ওজনে বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং একটা পর্যায়ে এসে ফেটে দুই টুকরা হয়ে যায়। এই টুকরাদ্বয় আগের মতো আলাদা আলাদাভাবে পুষ্ট হতে থাকে এবং কালের পরিক্রমায় এভাবে হয় অসংখ্য টুকরা। এই বিশেষ ধরনের পদার্থটির নাম প্রোটোপ্লাজম বা জীবকোষ। আদিম সমুদ্রের পানিতে এই প্রোটোপ্লাজম বিন্দুকে আশ্রয় করেই প্রায় ৩৮০০ মিলিয়ন বছর আগে প্রথম অভ্যুদয় হয়েছিল এককোষী জীব ‘প্রোক্যারিওটিস’। পৃথিবীর সেই প্রোটোপ্লাজম এর মতো জীব আজকের দিনের অ্যামিবা।
তথ্য-৪ ▌ এককোষি থেকে বহুকোষি প্রাণী : অ্যামিবার শরীরের আগাগোড়াই হলো একটি বিন্দুর মতো। হাত-পা, চোখ-মুখ বলে ওদের শরীরে আলাদা-আলাদা অঙ্গ নেই। এগুবার সময় ওরা নিজেদের শরীরের যে-কোনো অংশকে সামনের দিকে একটুখানি যেন ঠেলে দেয়; তার পুরো শরীরটাই যেন মুখ, পুরো শরীরটাই যেন পেট। শরীরের মধ্যে খাবার আত্মসাৎ করার ফলে শরীরটা ক্রমশ বড় হয় আর বড় হবার পর সেটা আস্তে আস্তে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তখন একটির বদলে দুটি জীব হয়ে যায়। একসময় ক্রমশ এসব ছোট ছোট জীবগুলো দলা পাকাতে শুরু করল, একটি জীবকোষের বদলে একদল জীবকোষ। এই নতুন ধরনের জীবদের বেলায় দেখা গেল শরীরের পাঁচ রকম চাহিদা মেটাবার জন্যে কাজের ভার যেন স্বতন্ত্র হয়ে যাচ্ছে, শরীরের কোনো একদল জীবকোষের উপর খাওয়া-দাওয়ার ভার, আর-এক দলের উপর চলাফেরার ভার। আর এভাবে ক্রমশ তৈরি হলো সেই ছোট ছোট আদিম জীব থেকে বড় বড় জীবের শরীর। প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে এই বহুকোষী ইউক্যারিওটের আবির্ভাব ঘটে।
তথ্য-৫ ▌উদ্ভিদের জন্ম : সমুদ্রের পানিতে জীবাণুদের বংশবিস্তার চলছিল ধীরে ধীরে। ভূ-পৃষ্ঠের সূর্যালোক থেকে সমুদ্র পানিতে থাকা কিছু জীবাণু ক্ষুধা নিবৃত্ত করে দেহ পুষ্ট করতে লাগল। এরূপ সুবিধাভোগী জীবাণুরা কালক্রমে উদ্ভিদে পরিণত হলো। উদ্ভিদের পাতায় সূর্যালোক পড়লে এক প্রকার সবুজ রঙের প্রলেপ (ক্লোরোফিল) পড়ে। এই ক্লোরোফিল বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে শোষণ করে। এভাবে শেওলা জাতীয় নানা প্রকার জলজ উদ্ভিদ-এর জন্ম হয়। যেসব জীবাণু পানির গভীরে থাকার দরুন সূর্যালোকের ¯পর্শ পেল না, তারা উদ্ভিদাণুর দেহে প্রচুর কার্বন মজুত পেয়ে এদের খাওয়া শুরু করল। উদ্ভিদাণুদের খেয়ে খেয়ে এসব জীবাণুর রাক্ষুসেপনা বেড়ে গেল। এতে সবল জীবাণুরা দুর্বল জীবাণুদের খেতে আরম্ভ করল। ফলে আত্মরক্ষার্থে দুর্বল জীবাণুরা পালাতে লাগল এবং সবল জীবাণুরা তাদের আক্রমণ করার জন্য তাড়া করতে লাগল। এতে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে দ্রুত চলাচলের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেল। তারা বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে ক্রমোন্নতির পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল।
তথ্য-৬ ▌ক্রাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ : মোটামুটিভাবে দু’শ কোটি বছর আগে যৌন-প্রজননের উদ্ভব ঘটেছিল বলে ধারণা হয়। যৌন প্রজননের ফলে দুটো জীব তাদের ডিএনএ সংকেত বিনিময় করে নতুন প্রকারণের উদ্ভব ঘটায়। আজকের আমরা মানুষেরাও ডিএনএ'র অংশ বিনিময়ের জন্য উদগ্রীব। প্রায় একশ কোটি বছর আগে, উদ্ভিদরা সমবেত কাজের মাধ্যমে পৃথিবীর আবহমন্ডলে এক চমকপ্রদ পরিবর্তন ঘটায়। সবুজ উদ্ভিদ উৎপন্ন করে অক্রিজেন অণূ। আর সেই সঙ্গে শেষ হতে থাকে অজৈব প্রক্রিয়ায় জীবের উপাদান সৃষ্টির অধ্যায়। কিন্তু বিপুল সংখ্যক প্রাণী অক্সিজেনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অসমার্থ্য হয়, ফলে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অল্পকিছু সংখ্যক আদিম জীব, যেমন বোটনিজম ও টিটেনাস বেসিলি টিকে থাকতে সামর্থ্য হয়েছে। প্রাণের জন্মের ৪০০ কোটি বছরের ইতিহাসে বেশিরভাগ সময় রাজত্ব করেছে নীলাভ-সবুজ শৈবালের মতো অণূজীবেরা, যেগুলো সাগর-মহাসাগর আবৃত্ত ও পরিপূর্ণ করে রেখেছিল। তারপর ৬০ কোটি বছর পূর্বে, শৈবালের একচেটিয়া রাজত্ব বা প্রভাব ভেঙ্গে পড়ে এবং সদ্য উদ্ভাবিত নতুন প্রাণের বিপুল বৃদ্ধি ঘটে, এই ঘটনাকে 'ক্রাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ বলে।
তথ্য-৭ ▌মস্তিষ্ক ও শিরদাঁড়া প্রাণী : পানির নিচে অস্ট্রাকোডার্ম নামে এক রকমের প্রাণী দেখা দিতে শুরু করছে। তাদের মুখগুলো ছুঁচালো কিন্তু চোয়াল নেই, তারা কাদার ভেতরে ছুঁচালো মুখ গুঁজে খাবার শুষে খেতো। আর এদের শরীরে দেখা দিয়েছিল দারুণ জরুরি একটি অঙ্গ। তার নাম মস্তিষ্ক। ওদের ওই মস্তিষ্কের দৌলতেই ওরা হয়ে দাঁড়ালো সেকালের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী। এই প্রাণীগুলোই প্রায় সাড়ে সাত কোটি বছর ধরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী হয়ে রইলো। তারপর, এদেরই বংশধররা বদলাতে-বদলাতে, শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ালো আদিম মাছ। তাদের শরীরেও মস্তিষ্ক ছাড়াও দেখা দিলো শিরদাঁড়া। এই শিরদাঁড়া ছাড়াও আদিম মাছদের মুখের মধ্যে দেখা দিলো চোয়াল। চোয়ালের দৌলতে ওরা চিবিয়ে খেতে শিখল। ফলে অন্যদের তুলনায় আদিম মাছরা অনেক ভালো করে বাঁচতে পারলো। দেখতে দেখতে পৃথিবীর সাগরে মাছে মাছে ভরে গেল। আর তারপর প্রায় পাঁচ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জীব বলতে ওই মাছেরাই ছিল। তখনকার পৃথিবীতে প্রাণী বলতে শুধুমাত্র জলচরই ছিল।
তথ্য-৮ ▌মেরুদন্ডী প্রাণীর উৎপত্তি : বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৫০ কোটি বছর আগে অমেরুদন্ডী প্রাণী ল্যান্সলেট- নামের এক ধরনের অমেরুদন্ডী জলজ প্রাণীর জেনেটিক মিউটেশনের কারণেই সৃষ্টি হয়েছিলো প্রথম মেরুদন্ডের। তা নাহলে হয়তো জন্মই হতো না আজকের মানব জাতির। যেসব প্রাণী শারীরিক মিলনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে, তাদের শরীরে পুরো জেনোমের দু’টি কপি থাকে, যা আসে দুই অভিভাবকের কাছ থেকে। কিন্তু ৫০ কোটি বছর আগে একটি মেরুদন্ড- হীন প্রাণীর বংশবৃদ্ধির সময় একটি ভুল হয়। ফলে ওই প্রাণীটির শরীরে চলে আসে দ্বিগুণ জিন। প্রাণীটির পরবর্তী প্রজন্মে একই ঘটনা আবার ঘটে। ফলে প্রাণীটির শরীরের রয়ে যায় প্রতিটি জিনের চারগুণ কপি। ওই জিন দ্বৈত করণের ফলে জন্ম নেয়া পৃথিবীর প্রথম প্রাণীটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন তারা। যা হচ্ছে এক ধরনের মেরুদন্ডহীন জলজ প্রাণী ল্যান্সলেট, এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুই ধাপে জিন কপি হবার ব্যাপারটি বাদ দিলে মানব শরীরের জিনের গঠনের সঙ্গে ল্যান্সলেটের জিনের গঠনের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
তথ্য-৯ ▌উভচরদের জন্ম: মাছ সাধারণত কানকোর সাহায্যে পানি হতে বাতাস সংগ্রহ করে শ্বাসকার্য চালায়। কিন্তু আদিম যুগে অনাবৃষ্টির সংকটের সঙ্গে লড়াই করে একদল জলচর প্রাণীর দেহে পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল। প্রথমত, তাদের দেহে ফুসফুস বলে একটি নতুন অঙ্গ গজাতে শুরু করল। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বছর ধরে বংশের পর বংশ উত্তীর্ণ হয়ে সেই আদিম মাছদের শরীরে কানকোও রইলো, আদিম ফুসফুসও দেখা দিলো। ফলে, এসব ফুসফুসওয়ালা মাছ পানিতে ও স্থলে উভয় স্থানে বেঁচে থাকতে পারে। উপকূলের কাছাকাছি বসবাসরত এসব মাছেরা অনেক সময় জোয়ার ও ঢেউয়ের আঘাতে ডাঙ্গায় উঠে পড়ত। তখন এই ফুসফুসওয়ালা মাছগুলো পরবর্তী ঢেউ বা জোয়ারের পানি না আসা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারত। এভাবে যেসব মাছ পানিতে ও স্থলে বেঁচে থাকার শক্তি অর্জন করল, তারা হলো উভচর প্রাণী। বর্তমানে কুমির, ব্যাঙ এদের বংশধর। এই উভচরদের আবার কতগুলো পানিতে ফিরে যায়। এদের বংশধর হলো তিমি, শুশুক ইত্যাদি।
তথ্য-১০ ▌সরীসৃপদের জন্মকথা: উভচরদের যে দলগুলো স্থায়ীভাবে ডাঙ্গায় বসবাস শুরু করেছিল, পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের শরীরে ফুসফুস ধরনের অঙ্গ গজাতে লাগল, আর পাখনার ঢিপির তলায় গজালো পা। ওদের ডিমগুলো তখনো তুলতুলে নরম, ডাঙ্গায় সে ডিম সহজেই নষ্ট হয়ে যেত। তাই ডিম পাড়বার সময় তাদের পানিতে ফিরে যাবার দরকার পড়তো। আজ প্রায় বিশ কোটি বছর আগে প্রাণীজগৎ জুড়ে রাজত্ব শুরু হলো উভচরদেরই এই বংশধর, সরীসৃপ। যারা বুকে ভর দিয়ে চলে। যেমনÑ আজকালকার সাপ, টিকটিকি, গিরগিটি। কালের বিবর্তনে তাদের ডিমের উপরের খোলস শক্ত হতে থাকলো। ফলে ডিম পাড়বার জন্যে তাই সরিসৃপদের আর পানিতে যেতে হয় না। কিন্তু সব সরীসৃপই একরকম নয়। কারুর বা পা রীতিমতো মজবুত; চলার সময় তারা আর শুধুমাত্র বুকের উপর ভর দেয় না। কারুর বা শরীর থেকে আবার পায়ের চিহ্ন একেবারে মুছে গেছে; যেমন সাপ। আবার কারুর শরীরে পায়ের বদলে গজালো চামড়ার ডানা বাঁদুড়দের মতো। ফলে এরা সরীসৃপ হয়েও আকাশে উড়তে শিখল ।
তথ্য-১১ ▌ডাইনোসরের যুগ : সে যুগে গাছপালা, জীবজন্তু বিরাট আকৃতির ছিল। সরীসৃপরাই ছিল বিশালকার। ডাইনোসরদের প্রাধান্য ছিল বেশি। নানা রকম ডাইনোসর; কারুর নাম ডিপলোডোকাস, লম্বায় ৫৮ হাত। কিন্তু নিরামিষাশী। তাদের মাথার মধ্যে মস্তিষ্কটা আজকালকার মুরগির ডিমের মতো এতটুকু। আর এক রকম ডাইনোসরের নাম দেওয়া হয় ব্রাসিওসরাস। তারা ওজনে এক একটি প্রায় ৪৫০ মণ করে। আর তাদের গলাগুলো এমনই লম্বা যে মাটিতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে আজকালকার বাড়ির তিনতলা জানালায় উঁকি দিতে পারতো। ডাইনোসরদের আর এক জাতের নাম টিরেনোসরাস। তারা লম্বায় ১৯ ফুট। পেছনের পা দুটো থামের মতো, সামনের পা দুটো ছোট-খাটো। দাঁতগুলো মুলোর মতো, প্রকা- বড় মুখের হাঁ। তাদেও লেজের ঝাপটায় কেঁপে উঠতো বন-জঙ্গল আর তারা ছিল মাংসাশী। তারা অন্য প্রাণীর মাংস খেয়ে জীবন নির্বাহ করত। সে আজ প্রায় ছ’কোটি বছর আগেকার কথা। পৃথিবীর আবহাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে ওরা কিছুতেই নিজেদেও খাপ খাওয়াতে পারলো না। শেষ হলো সরীসৃপদের যুগ।
তথ্য-১২ ▌ ডাইনোসর থেকে পাখি : এখনো ডাইনোসরের প্রায় ১০ হাজার প্রজাতি টিকে আছে পাখি হয়ে! অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা ৪২৬ প্রজাতির ডাইনোসরের দেহাবশেষের নানা পরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছেন, এখন থেকে প্রায় ২২ কোটি বছর আগে দ্রুতগতিতে পাল্টাতে থাকে ডাইনোসরের আকৃতি। আর এই পাখিকুলে বিবর্তিত ডাইনোসরই পৃথিবীজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট নতুন বাস্তসংস্থানের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়। ‘দেখা গেছে, আরজেনটিনোসোরাস নামের সবচেয়ে বড় আকৃতির ডাইনোসরের ওজন প্রায় ৯০ টন, যা কিনা সবচেয়ে ছোট প্রজাতির ডাইনোসরের ওজনের প্রায় ৬০ লাখ গুণ বেশি। চড়–ইপাখির মতো ছোট আকৃতির সবচেয়ে ছোট প্রজাতির ডাইনোসরের নাম কিলিয়ানা। এদের ওজন মাত্র ১৫ গ্রাম। এগুলোকে মেসোজায়িক ডাইনোসর বলা হয়। পৃথিবীতে ডাইনোসর যুগের প্রথম ১৬ কোটি বছর জুড়ে নানা প্রজাতির ডাইনোসরের স¤পূর্ণ বংশধারার নমুনা থেকে ওই প্রজাতিগুলোর দেহকাঠামো ও আকৃতির বিবর্তন বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছে গবেষক দলটি।
তথ্য-১৩ ▌প্যানগি আর টেথিয়ান-সি : অনেক কোটি বছর আগের কথা। তখন পৃথিবীতে একটা মহাদেশ ছিল। সেটির নাম ছিল প্যানগি। সেই মহামহাদেশের মাঝখানে একটা সাগর ছিল। সেটির নাম টেথিয়ান-সি। একসময় প্যানগি ভেঙ্গে ২ টা মহা মহাদেশ হলো। গন্ডোয়ানা আর লরেশিয়া। গন্ডোয়ানা দক্ষিণ গোলার্ধে, দক্ষিন মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত। আর লরেশিয়া উত্তর মেরু পর্যন্ত এবং তা উত্তর গোলার্ধে। ভারত উপমহাদেশ গন্ডোয়ানা ল্যান্ডের অংশ ছিল। গন্ডোয়ানা ভেঙে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, ভারত, এন্টারকটিকা মহাদেশ সৃষ্টি করে। আর লরেশিয়া ভেঙে এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা সৃষ্টি হয়। ভারত ক্রমাগত উত্তরে সরে আসতে আসতে এশিয়ায় এসে ধাক্কা দেয়। এশিয়া আর ভারেতের মধ্যবর্তী পাললিক শিলাগুলো দ’ুদিক থেকে ধাক্কা খেয়ে উচুতে উঠে যায় এবং হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি করে। গ্রেট হিমালয় পর্বতমালা ক্ষয় হয়ে বেঙ্গলবেসিনে জমা হতে হতে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। একমাত্র দিনাজপুর শিল্ড এরিয়া যা বরাবরই মহাদেশ বা স্থলভূমি ছিল বাকী পুরোটাই সমুদ্রের নীচে সমুদ্র ভূমি ছিল।
তথ্য-১৪ ▌স্তন্যপায়ী প্রাণী: আজ থেকে প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে ট্রিয়াসিক উপযুগে একদল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী গর্ভধারণ ও বাচ্চা প্রসব করতে শুরু করে। উষ্ণ রক্তের অধিকারী হওয়ায় স্তন্যপায়ী জীবেরা প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের অধিক খাপ খাওয়াতে পেরেছিল। সরীসৃপ পর্যন্ত সমস্ত প্রাণীই ডিম পাড়ত। স্তন্যপায়ীরা ডিমের পরিবর্তে বাচ্চা পাড়বার পর তাদের বাচ্চার জন্যে খাবার সংগ্রহ করার হাঙ্গামাটাও রইলো না। কেননা বাচ্চারা তাদের মা-র বুক থেকে দুধ খাবে। আজ থেকে প্রায় ৭ কোটি বছর আগের এয়োসেন উপযুগে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিভিন্ন শাখা ভূপৃষ্ঠের অধিকাংশ অঞ্চলজুড়ে বসবাস শুরু করেছে। এদের একদলের চেহারা ছিল কুকুরের মতো। এই দলের ক্রমবিবর্তনে নেকড়ে ভালুক, কুকুর ইত্যাদি প্রাণীর জন্ম হয়েছে। অন্যদলের চেহারা ছিল বিড়াল আকৃতির। এদের ক্রম- বিবর্তনে বাঘ, সিংহ, বিড়াল ইত্যাদি প্রাণীর আবির্ভাব হয়েছে। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে এক প্রকার প্রাণী ছিল। এরা গাছে চড়তে পারত ও ডালে ডালে বিচরণ করত।
তথ্য-১৫ ▌জীবদেহে পরিবর্তন কেন হয়?: কেন এক জাতের প্রাণী বদলাতে বদলাতে অন্য জাতের প্রাণী হয়ে যায়? এই প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করলেন একজন ফরাসি বৈজ্ঞানিক। তাঁর নাম লামার্ক। লামার্ক বললেন, এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে শরীরের অঙ্গের ব্যবহার আর অ-ব্যবহার। কোনো একদল প্রাণী যদি তাদের শরীরের কোনো একটি অঙ্গ বেশি ব্যবহার করে, তাহলে ওই অঙ্গের বৃদ্ধি পেয়ে চলবে এবং এইভাবে একটি অঙ্গ বৃদ্ধি পেতে পেতে শেষ পর্যন্ত তাদের শরীরের চেহারাটাই সম্পূর্ণ বদলে যাবে। অপর পক্ষে তারা যদি শরীরের কোনো একটি অঙ্গের ব্যবহার না করে, তাহলে তাদের বংশধরদের শরীর থেকে ওই অঙ্গটি একেবারে মুছে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সাপের পূর্বপুরুষরা তাদের পাগুলোকে ব্যবহার বন্ধ করল বলেই সাপদের শরীর থেকে মুছে গেল পায়ের চিহ্ন। জিরাফের পূর্বপুরুষরা ক্রমাগতই গাছের উঁচু ডালের কচি পাতা খাবার লোভে গলাটা এগিয়ে দেবার চেষ্টা করে চলেছিল বলে গলাটা লম্বা হয়ে গেল।
তথ্য-১৬ ▌মধ্যবর্তী বা ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল: জীবন্ত প্রাণিদের মধ্যেও মধ্যবর্তী পর্যায়ের বহু নির্দশন রয়েছে; যেমন একমাত্র অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায় প্লাটিপাস স্তন্যপায়ী প্রাণি হলেও ‘সরীসৃপের মতো’ ডিম পাড়ে। আবার মাছ এবং উভচর প্রাণীর ‘মধ্যবর্তী ফসিলের’ উদাহরণ তো আছেই সিলাকান্ত এবং লাং ফিশ। সিলাকাহ্নের একটি প্রজাতি জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেছে মাদগাস্কার উপকূল এলাকায় ১৯৩৮ সালে। এই মাছের মধ্যে মাছ এবং উভচর প্রাণির বিবর্তনের এতোগুলো মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যে একে ‘জীবন্ত ফসিল’ই বলা চলে। এছাড়া সম্প্রতি পাওয়া গেছে মাছ থেকে চতুষ্পদী প্রাণিতে বিবর্তনের মধ্যবর্তী বৈশিষ্টযুক্ত প্রাণি টিক্টালিকের ফসিল। পাওয়া গেছে স্তন্যপায়ী প্রাণি থেকে তিমির বিবর্তনের মাঝামাঝি ধাপগুলোর অসংখ্য ফসিল। নরবানর (এপ) এবং মানুষের মধ্যবর্তী হারানো সূত্রের জীবাশ্মও কয়েক দশক আগে খুব ভালোভাবেই পাওয়া গেছে। পুরানো ‘দ্বিপদী মানুষের’ ফসিল পাওয়া গেছে ২০০৫ সালে। এদের করোটির গঠন ছিলো অনেকটা শিম্পাঞ্জির মতো , কিন্তু‘ তাদের দাঁতের গঠন ছিলো আধুনিক মানুষের মতো।
তথ্য-১৭ ▌প্রাইমেটের কথা: স্তন্যপায়ীদের একটি জাত বাসা বাঁধলো গাছের ডালে। বনে-জঙ্গলে এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে যাওয়ার জন্য সামনের পা দুটিকে ব্যবহার করতো ধরার কাজে। এতে এই পা দুটি পরিণত হলো থাবায়। বৃক্ষের ডালে ডালে লাফালাফি করতে হলে প্রতি মুহূর্তে লক্ষ্য ও কর্তব্য নির্ধারণ করতে হয়। এভাবে দ্রুত মস্তিষ্ক চালনা করতে করতে ধীরে ধীরে তাদের মস্তিষ্ক বড় হচ্ছিল। অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে থাবা দুটি ব্যবহার করতে শুরু করল আক্রমণ ও আত্মরক্ষার কাজে। তাদের নাম প্রাইমেট। এরকম একটি প্রাইমেট হল অ্যানথ্রাপয়েড। ঐ অ্যানথ্রাপয়েডই গোরিলাÑশিম্পাঞ্জিÑমানুষ সবারই পূর্বপুরুষ। ওই বনমানুষদের মধ্যে কোনো কোনো দল নেমে এলো সমতলে। ক্রমশই তারা দু-পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে শিখল। তাদের সেই সামনের পা-জোড়া শেষ পর্যন্ত মানুষের হাত হয়ে গেল। বনমানুষেরা যে মানুষ হয়েছে তা এই হাতের গুণেই। গরিলা-শিম্পাঞ্জির থাবা আছে কিন্তু হাত নেই। থাবা দিয়ে কিছু ধরতে পারে। কিন্তু বানাতে পারে না।
তথ্য-১৮ ▌ মানুষ আর বনোবো: শিম্পাঞ্জি, বনোবো এবং মানুষ একই পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে যার যার আলাদা পথে বিবর্তিত হয়েছে গত ৭০-৮০ লক্ষ বছর ধরে। শিম্পাঞ্জির জিনোমের সংশ্লেষণ থেকে আমরা দেখতে পাই শিম্পাঞ্জি আর মানুষের জিনের মধ্যে সাদৃশ্য প্রায় ৯৮.৬%। ৮০ লক্ষ বছর আগে গোরিলারা ভাগ হয়ে গেছে আধুনিক মানুষ, শিম্পাঞ্জি এবং বানরের ‘সাধারণ পূর্বপুরুষ’ থেকে। তারপর ৬০-৭০ লক্ষ বছর আগে বিবর্তনের মানুষের পূর্বপুরুষেরা ভাগ হয়ে গেছে শিম্পাঞ্জি এবং বনোবোর পূর্বপুরুষ থেকে। প্রায় ৪৩ লক্ষ বছর আগেই মানুষের আদি-পুরুষদের মধ্যে দ্বিপদী বৈশিষ্ট্য ছিলো। আর্ডি নামক ফসিল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তারা যেমন দু’পায়ে ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো, মাটিতে ঘুরে বেড়াতে পারতো, তেমনি আবার দিব্যি গাছে গাছে বিচরণও করতে পারতো।
তথ্য-১৯ ▌ হোমিনিডিদের বিবর্তন: ৩০ লাখ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ হোমিনিডিরা আধুনিক শিম্পাঞ্জির মতোই গাছে ঘুমাতো। অনেক বনমানুষ এখনও গাছে বাসা বেঁধে ঘুমায়। কিন্তু ২০ লাখ বছর আগে বিভিন্ন মানব প্রজাতির হোমিনিডিরা স¤পূর্ণরূপে ঋজুকায় হয়ে উঠেলো। ‘লাখ লাখ বছর আগে যখন বহুসংখ্যক হোমিনিন প্রজাতি বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করতো, তারা প্রধানত উদ্ভিদ খেয়ে বাঁচতো’। পরিবর্তিত অবস্থা এবং বন ও গাছ থেকে কমে যাওয়া, পানির উৎসস্থল শুকিয়ে ও সরে যাওয়ায় তারা ক্রমবর্ধমান মাংসাশী হয়ে ওঠে। পরে আরো বেশি কাজ ও মাংস খেতে শুরু করায় চুল কমতে শুরু করে। বাড়তি তাপে গিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাদের ঘাম ঝরার হার বাড়ে এবং মস্তিষ্কের ঘিলু উত্তপ্ত হতে থাকে। ফলে চুলের হার কমতে থাকে। এই মানবদের একটি দল আফ্রিকা ছেড়ে নানান দিকে যাত্রা শুরু করে এবং ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ আর এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।
তথ্য-২০ ▌ আমাদের পূর্বপুরুষ: যেহেতু উত্তর ইউরোপের তুষারাচ্ছন্ন এলাকায় বেঁচে থাকার জন্য যে ধরনের বৈশিষ্ট্যাবলি জরুরি সেগুলো ইন্দোনেশিয়ার প্লাবিত বনভূমিতে প্রয়োজনীয় গুণাবলির তুলনায় ভিন্ন, সেহেতু বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত মানবগোষ্ঠীর বিবর্তন নানা বিচিত্র দিকে মোড় নেয়। যার ফলে পৃথক পৃথক কিছু মানব প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। নিয়ান্ডারথাল, হোমো ইরেক্টাস ও হোমো সেপিয়েন্স ইত্যাদি। আদি মানবদের যে দল ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের নানা অঞ্চলে স্থায়ী হয়েছিল তারা কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে ‘হোমো নিয়ান্ডারথাল (নিয়ান্ডার উপত্যকার মানব) প্রজাতিতে পরিণত হয়। তারা গুহায় বাস করতো, শিকার করা পশুর মাংস ছাড়া শামুক, কাঁকড়া, চিংড়ি, মাছ প্রভৃতিও খেত। অন্যদিকে, এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে জনবসতি গড়ে তুলেছিল মানুষের যে প্রজাতিÑ তারা হলো হোমো ইরেক্টাস (যার অর্থ ‘খাড়া মানব’)। হোমো ইরেক্টাস হলো পৃথিবীতে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকা মানব প্রজাতি; ওরা প্রায় ২০ লাখ বছর পৃথিবীতে বিচরণ করেছে। আমাদের পূর্বপুরুষ সেপিয়েন্সরা ১৫০,০০০ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় পরিপূর্ণ ছিল। প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে, কিছু সেপিয়েন্স পূর্ব আফ্রিকা ছেড়ে আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে তারা খুব দ্রুত পুরো ইউরোপ-এশিয়ার ভূখ-ে বিস্তার লাভ করে।
তথ্য-২১ ▌ খর্ব মানব: ইন্দোনেশিয়ার একটি ছোট দ্বীপ ফ্লোরেসে একদল আদি মানব ছিল যারা খুবই খর্বাকৃতির। আদি মানবদের প্রথম দল এই সম্বলহীন দ্বীপে আটকা পড়েছিল। খাদ্যের অপ্রতুলতার কারণে কম খাওয়াই তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তী প্রজন্মগুলোতেও একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এভাবে অনেকগুলো প্রজন্ম অতিবাহিত হবার পর ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ ‘খর্ব মানবে’ পরিণত হয়। এদের উচ্চতা ছিল সর্বোচ্চ এক মিটার এবং ওজন কোনোভাবেই ২৫ কেজির বেশি নয়। খর্বাকৃতির মানব হওয়া সত্ত্বেও এরা পাথরের নানা সরঞ্জাম তৈরি করতে পারত, এমনকি মাঝে মাঝে দ্বীপের হাতিও শিকার করতে পারত। ফ্লোরেস দ্বীপ থেকে বামন-সদৃশ মানবেরা উধাও হয় প্রায় ১২ হাজার বছর আগে।
তথ্য-২২ ▌ হোমো সেপিয়েন্স: সেপিয়েন্স যখন মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে পৌঁছে, তখন তারা নিয়ান্ডারথালদের মুখোমুখি হয়। এই প্রজাতির মানবেরা সেপিয়েন্সের তুলনায় ছিল পেশিবহুল, তাদের মস্তিষ্ক ছিল বড়, এবং ঠা-া জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। তারা পাথুরে হাতিয়ার ও আগুন ব্যবহার করত, ছিল খুব ভালো শিকারি। যখন সেপিয়েন্সরা নিয়ান্ডারথালদের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেপিয়েন্স ও নিয়ান্ডারথাল মিলিত হয়ে একটি প্রজাতিতে পরিণত হয়। অর্থাৎ ইউরোপ-এশিয়ার অধিবাসীরা খাঁটি সেপিয়েন্স নয়; তারা সেপিয়েন্স ও নিয়ান্ডারথালের সংমিশ্রণ। একইভাবে, সেপিয়েন্সরা যখন পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছুল তখন তারা মিলিত হলো স্থানীয় ইরেক্টাসদের সঙ্গে; সুতরাং চীনা আর কোরিয়ানরা হলো সেপিয়েন্স আর ইরেক্টাসের মিশাল। আধুনিক মানুষের ডিএনএ’র বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে বসবাসকারী আধুনিক জনগোষ্ঠীর ডিএনএ’তে থাকা ১-৪ শতাংশ মূলত নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ। নিয়ান্ডারথালরা ৩০ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে ইউরোপের দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়ে হারিয়ে গেছে চিরতরে।
তথ্য-২৩ ▌গুহামানব: সমতল জমিতে ক্রমশ সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখবার দরুন শরীরের পুরো ভারটাই পা-জোড়ার উপর পড়ল। ফলে হাত জোড়া নিপুণ থেকে নিপুণতর কাজে ব্যবহার হতে লাগল। যতদিন পর্যন্ত হাত জোড়া এভাবে মুক্তি পায়নি ততদিন পর্যন্ত অনেক বেশি দায়িত্ব ছিল দাঁত আর চেয়ালের উপর। অনেক কাজই দাঁত দিয়ে করতে হতো। কিন্তু হাত জোড়া মুক্ত হওয়ার দরুন দাঁত আর চোয়ালের উপর আর অতখানি দায়িত্ব রইলো না। আর তারই ফলে মাথার খুলির মধ্যে মস্তিষ্কের জন্যে জায়গা বাড়তে লাগল। মস্তিষ্ক বাড়তে লাগল। আবার অপরদিকে মস্তিষ্ক যতই বড় হতে লাগল, উন্নত হতে লাগল, ততই হাত জোড়াকে আরো দক্ষভাবে, আরো আরো নিপুণভাবে, কাজে লাগাবার সম্ভাবনা দেখা দিতে লাগল। জীবন সংগ্রামের জন্য তাদের প্রধানত দুটি সম্বল। এক. অন্যদের তুলনায় ভালো মস্তিষ্ক। দুই. চলাফেরার কাজ-থেকে-মুক্তি-পাওয়া দুটি হাত।
তথ্য-২৪ ▌আগুনের ব্যবহার: প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে থেকে, হোমো ইরেক্টাস, নিয়ান্ডারথাল এবং হোমো সেপিয়েন্সের পূর্বপুরুষেরা নিয়মিতভাবে আগুন ব্যবহার করা শুরু করে। ফলে আদিম মানুষ পেল আলো ও উষ্ণতার একটি নির্ভরযোগ্য উৎস এবং শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো সিংহ থেকে বাঁচার জন্য পেল মারাত্মক একটি অস্ত্র। দীর্ঘকাল পরেই, মানুষেরা ইচ্ছে করেই প্রতিবেশের বন-জঙ্গল জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করে। আগুন নিভে আসলে, উদ্যোগী মানুষেরা পোড়া বনভূমি ঘুরে দগ্ধ পশুপাখি তুলে আনতে পারত। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার ফলে সবচেয়ে অসাধারণ যে বিষয়টি ঘটেছিল সেটি হলো- রান্নার উদ্ভাবন। যেসব খাদ্য তাদের প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ খেতে পারত না- যেমন : গম, চাল, আলু সেগুলো একেবারে প্রধান খাদ্য পরিণত হলো, রান্নার বদৌলতে। ফলমূল, বাদাম, পোকামাকড় আর মাংস সেদ্ধ করে খেতে শুরু করায় মানুষকে খাবার চিবানো ও হজম করার পেছনে আগের তুলনায় অনেক কম সময় ব্যয় করলেই চলতো।
তথ্য-২৫ ▌ বন্য থেকে বর্বর-দশা : সবচেয়ে আদিম অবস্থা থেকে মাটির পাত্র তৈরি করতে শেখার আগে পর্যন্ত বন্য দশা ধরা হয়। বন্য দশার মধ্যস্তরে মাছ ধরতে শেখা এবং তীর-ধনুক আবিষ্কারেই শেষ। অস্ট্রেলিয়া আর পলিনেশিয়ার আদিবাসীদের এই বন্য দশার মধ্যস্তরে আটকে থাকতে দেখা যায়। বন্য দশার উচ্চস্তর হচ্ছে তীর-ধনুক আবিষ্কার থেকে এর শুরু করে মাটির পাত্র আবিষ্কার পর্যন্ত। আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে কলম্বিয়া উপত্যকার আর হাড়সন-বে এলাকার আদিবাসীরা এই স্তরে আটকে পড়েছিল। অন্যদিকে মাটির পাত্র তৈরি করতে শেখা থেকে শুরু করে পশুপালন বা চাষবাস করতে শেখা পর্যন্ত অবস্থাকে বর্বর-দশা বলে। বর্বর দশার মধ্যস্তরে চাষবাস কিংবা পশুপালন করতে শেখা এবং লোহা ব্যবহার করতে শেখাতেই এর শেষ। নিউ মেক্সিকো, আর পেরুর আদিবাসীদের দেখা গিয়েছিল বর্বর দশার এই মধ্যস্তরটি আটকে পড়ে থাকতে। বর্বর দশার উচ্চস্থরে লোহার ব্যবহার করা থেকে ধ্বনি-সাংকেতিক লিপি (ফোনেটিক অ্যালফাবেট) আবিষ্কার পর্যন্তকে বুঝায়।
তথ্য-২৬ ▌ চিত্রলিপি ও ভাবব্যঞ্জকলিপি: কোনো বিষয়ের চিত্রময় অর্থবোধক চিহ্ন হিসাবে ব্যবহৃত প্রতীককে চিত্রলিপি বলা হয়। এই লিখন পদ্ধতিতে প্রত্যক্ষভাবে বিষয়াবলির ছবির ছাপ দেওয়া হতো, কিন্তু কালক্রমে এই চিত্রলিপি প্রতীকধর্মী লিপিতে পরিণত হয়। যেমন- সরু রাস্তার পাশে পাহাড়ের গায়ে পানির ঢেউ এঁকে বুঝানো হতো, আশপাশে পানি আছে। এই লিপি ব্যবহৃত হয়েছে সুমেরীয় লিপিতে। এই চিত্রলিপিকে লেখায় পরিণত করতে মানুষের অনেক সময় লেগেছিল, মাত্র পাঁচ হাজার বছর হলো মানুষ লিখতে শিখেছে। সুমের-এর প্রাচীন অধিবাসীরা লেখার ব্যাপারে এক ধাপ এগিয়ে ছিল। হাঁড়িগুলোর গায়ে একটা-দুটো তিনটে দাগ মেরে বোঝবার চেষ্টা হলো যে, একটা-দাগওয়ালা হাঁড়িতে বার্লি আছে, দুটো-দাগওয়ালা হাঁড়িতে গম আছে, তিনটে দাগওয়ালা হাঁড়িতে যব আছে। দেখা এবং ভাবনা মেলানো এই যে নতুন লেখা, এটি চিত্রলিপিরই উন্নততর অবস্থা। এই লেখাকে ভাবব্যঞ্জক লিপি বলা হয়। কোনো জিনিসের পুরো ছবি না এঁকে, তার জায়গায় একটা সংকেত চিহ্ন এঁকেই সেটাকে বোঝানো হতে লাগল।
তথ্য-২৭ ▌ ধ্বনি যুক্ত লিপি: ভাবব্যঞ্জক লিপি প্রচলিত হবার পর লেখার মধ্যে কতকগুলো চিহ্ন ব্যবহারের করে ভাবব্যঞ্জক লিপিতে ক্রমশ ধ্বনি যুক্ত করার চেষ্টা দেখা যেতে লাগল। ধ্বনিলিপির বিশেষ দিক হলো, মানুষের গলা থেকে যতগুলো ধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেই প্রত্যেকটি ধ্বনির আলাদা আলাদা বিশুদ্ধ উচ্চারণকে লিপিতে প্রকাশ করা। এই থেকে প্রত্যেক ভাষার বর্ণমালার উৎপত্তি হয়েছে। সুমেরীয়দের লিখিত ভাষা ধ্বনিগত এই শব্দাংশ প্রকাশ করার ধাপ পর্যন্ত এসে আর এগোতে পারেনি। এর পরবর্তী যে ধাপ, অর্থাৎ বর্ণমালার ব্যবহার, এই ভাষার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। খ্রিষ্ট-পূর্ব তিন হাজার বছরের আগে যেখানে প্রায় ২০০০ চিহ্ন ব্যবহার করতে হতো, সেখানে একহাজার বছরে মাত্র ৬০০ চিহ্ন ব্যবহার করেই লেখার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এর ঠিক বিপরীত হয়েছিল চীন দেশে। সেখানে লেখা চিত্রলিপি থেকে ভাবব্যঞ্জক লিপি পর্যন্ত এগিয়ে আসবার পর, আর এগোয়নি। ফলে ক্রমশ বেশি চিহ্ন ব্যবহারের প্রচলন এখানে করতে হয়েছিল। সেজন্য আজও পর্যন্ত চীন দেশের লিখিত ভাষায় বিপুলসংখ্যক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।
তথ্য-২৮ ▌ বর্ণমালার আবিষ্কার: চিত্রলিপি আবিষ্কারের প্রায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার বছর পরে বর্ণমালার আবির্ভাব ঘটেছিল। এই সময়ের মধ্যে সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, সিনাই, ক্রিট প্রভৃতি অঞ্চলে বর্ণমালার প্রচলন দেখা যায়। পরের যুগে বিভিন্ন ভাষার সমস্ত বর্ণমালাই আদিম এই বর্ণমালা থেকে উদ্ভুত হয়েছিল। ওই বর্ণমালাই ক্রমশ বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় ছড়িয়ে আজকের সকল ভাষার বর্ণমালার জন্ম দিয়েছিল। আদিম এই বর্ণমালাকে ‘সেমিটিক বর্ণমালা’ বলে। পরিপূর্ণ বিকাশের পথে এই বর্ণমালা দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ‘উত্তর সেমিটিক’ (উত্তর অঞ্চলের সেমিটিক জাতিগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত বর্ণমালা) এবং ‘দক্ষিণ সেমিটিক’ (দক্ষিণ অঞ্চলের সেমিটিক জাতিগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত বর্ণমালা।) আধুনিক বর্ণমালার সৃষ্টির ক্ষেত্রে ‘উত্তর সেমিটিক বর্ণমালা’রই প্রধান অবদান। খ্রিস্ট-পূর্ব তিন হাজার বছরের কাছাকাছি সময়ে মিসরীয়রা ধ্বনিচিহ্ন ব্যবহার করতে পারলেও তারা কখনই ভাবব্যঞ্জক চিহ্নকে পরিত্যাগ করতে পারেনি; তাই বর্ণমালার পর্যায়ে উন্নত হওয়া এই ভাষার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তথ্য-২৯ ▌ বর্ণমালার জন্মভূমি : পশ্চিমে মিসর এবং পূর্বে মেসোপটেমিয়া এই দুটি প্রাচীন সভ্যতার সেতু ছিল সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইন। স্মরণাতীতকাল থেকে যুগের পর যুগ হাজার হাজার বছর ধরে সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনের বুকের উপর দিয়ে মানুষের অসংখ্য গোষ্ঠীর আসা-যাওয়া চলছিল। সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনে আবিষ্কৃত উত্তর সেমিটিক বর্ণমালার মোট বর্ণসংখ্যা ছিল ২২টি। সব কটিই ব্যঞ্জনবর্ণ। স্বরবর্ণ একটিও ছিল না। পরবর্তীকালে সেমিটিক ফিনিশীয় বণিকদের কাছ থেকে গ্রিকরা যখন এই বর্ণমালা গ্রহণ করেছিল, তখন তারাই প্রথম ২২টি বর্ণমালার সঙ্গে স্বরবর্ণগুলো যোগ করেছিল। ভারতে বৌদ্ধ যুগ শুরু হবার দু-তিনশ’ বছর আগে থাকতে বর্ণমালার লিপি প্রচলিত হয়েছিল। উত্তর সেমিটিক-এর আরামিকা উপশাখা থেকেই ব্রাহ্মীলিপি গড়ে উঠেছিল। বর্তমান ভারতবর্ষ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় প্রচলিত বহু বর্ণমালার উৎপত্তি ঘটেছে আদি এই ব্রাহ্মীলিপি থেকে। ব্রাহ্মণদের দ্বারা এই লিপির বিকাশ হয়েছিল বলেই এর নাম ব্রাহ্মীলিপি। ব্রাহ্মীলিপিতে মাত্র ৪৪টি বর্ণের মধ্যে স্বরবর্ণ পাওয়া গেছে ৯টি।
তথ্য-৩০ ▌মানুষের বিভিন্ন ভাষা : মানুষের ভাষা-গোষ্ঠী কয়েকটি মূল বিভাগে বিভক্ত (১) ইন্দোইউরোপীয় : এর অন্তর্ভুক্ত হলো কেলট্গ্রিক, ল্যাতিন, টিউটনিক, স্লাভ, আর্য, হিট্টাইট্ ইত্যাদি। (২) সেমিটিক : এর অন্তর্ভুক্ত হলো প্রাচীন ব্যাবিলন ও আসীরিয়ার ভাষা, ফিনিশীয়দের ভাষা, হিব্রু, সিরিয়ান, আরব আবিসিনিয়ান্ ইত্যাদি। (৩) হ্যামিটিক : প্রাচীন মিসরবাসীদের ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। (৪) উত্তর আফ্রিকার বার্বার এবং ফিনো-উগ্রীয়: ল্যাপল্যান্ড, সাইবেরিয়া, ফিনল্যান্ড, ম্যাজার, তুর্কি, মাঞ্চ, মোঙ্গল, ইত্যাদি ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। (৫) ভোট-চীন : চীন, বর্মী, শ্যাম এবং তিব্বতী ভাষাগুলো এর অন্তর্ভুক্ত। (৬) আমেরিন্ডিয়ান : অর্থাৎ উত্তর আমেরিকার আদিম অধিবাসী রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলো। (৭) অস্ট্রিক : মালয় এবং পলেনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের আদিম অধিবাসীদের ব্যবহৃত ভাষাসমূহ। নীল নদী থেকে সিন্ধু নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চলেই মানুষের ইতিহাসে প্রথম সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। কিন্তু এশিয়ার পূর্বস্থিত চীন দেশে হোয়াংহো নদীর উপত্যকায় মানুষের আরেকটি সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল।
তথ্য-৩১▌ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা : প্রায় ৭০০০ বছর আগে এই এশিয়া-ইউরোপ জুড়ে একটিমাত্র মূলভাষা ছিল। তার নাম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। এর কাছাকাছি সময়টাতেই মিশরের রাজবংশ গঠিত হয়, সুমেরীয় সভ্যতাসহ আরও কিছু মেসোপটেমিয় সভ্যতার সুচনা ঘটে, সিন্ধু সভ্যতার শুরু হবার কাজ চলতে থাকে। ঠিক এই সময়টায়ই মানে আজ থেকে প্রায় ৫৫০০ বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এদের একটির নাম শতম আরেকটির নাম কেস্তম। কেস্তম শাখা হতে পরে ইতালীয়, ফরাসি, ¯প্যানিশ, ইংলিশ, জার্মান ইত্যাদি ভাষার উৎপত্তি হয়। শতম ভাষাগোষ্ঠী সৃষ্টি হবার প্রায় ১০০০ বছর পরে এই ভাষাগোষ্ঠীটি ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এদের এক দল ইরান, আফগানিস্তান হয়ে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে। তাদের ভাষা ইন্দো-আর্য ভাষা। এই ভাষা আবার দুইটি ভাগ ছিল। ১. বৈদিক ২.প্রাচীন প্রাচ্য ভারতীয় আর্য। প্রথম দিকে বেদের শিষ্যরা শুনে শুনে বেদকে মনে রাখত। তাই বেদের আরেক নাম শ্রুতি। পরবর্তীতে বেদকে সংকলন করার জন্য সংস্কৃত ভাষা তৈরি হয়। এ ভাষায় কেউ কথা বলতো না।
তথ্য-৩২ ▌ ব্রাহ্মীলিপি থেকে অন্যান্য লিপি: ব্রাহ্মীলিপিটি উত্তরী ও দক্ষিণী এই দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তর ভারতীয় লিপিগুলি হচ্ছে কুষাণ লিপি, গুপ্তলিপি, পালি, বার্মিজ, সারদা, তাক্রী, কাশ্মিরী, নাগরী, ম-িনাগরী, দেবনাগরী, গুরুমুখী, কুটিল (প্রাগ-বাংলা), বাংলা, উড়িয়া, গুজরাটি, মণিপুরি, তিব্বতী, মোঙ্গোলিয়ান, দক্ষিণ ভারতীয় লিপি, কলিঙ্গ, মধ্য ভারতীয়, কাদম্ব, প্রাচীন কাদম্ব, আধুনিক কাদম্ব, তেলেগু, গ্রন্থ, তামিল, মালালায়ম। উত্তরী লিপিগুলোর মধ্যে পূর্বদেশীয় গুপ্তলিপি প্রধান, এটি ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল। গুপ্তলিপি থেকে আবির্ভাব হয় ‘কুটিল লিপির’, এটি ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কুটিল লিপি থেকে উদ্ভব হয় নাগরী লিপির। প্রাচীন নাগরী লিপির পূর্ব শাখা থেকে ১০ম শতকের শেষভাগে বাংলা লিপি ব্যবহার করা হয় বাংলা, মণিপুরি, ককবরক ও অসমীয়া ভাষায়। অসমীয়া লিপির উৎপত্তি বাংলা লিপি উৎপত্তির অন্তত আড়াইশ বছর পর। দুই ভাষায় ভিন্নতা (বাংলা র-এর বেলায় ) ১৮ শতকের পরে নিচে ফোঁটা দেওয়া ‘র’ বাংলায় ব্যবহৃত হয়।
তথ্য-৩৩ ▌বাংলা ভাষার উৎপত্তি : অস্ট্রিক ও দ্রাবীড় ভাষার লোকেরা ছাড়াও পূর্ব ও উত্তর বাংলায় বহু পূর্বকাল হতে নানা সময়ে এসেছিল মঙ্গোলীয় বা ভোট চীনা গোষ্ঠীর নানা জাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোক। এরা হলো গাড়ো, বড়ো, কোচ, মেছ, কাছাড়ি, টিপরাই, চাকমা প্রভৃতি জাতি। এরা ভোটচীনা গোষ্ঠীর নানা ভাষা- উপভাষায় কথা বলত। অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনা ভাষাগোষ্ঠীর পর যে নতুন একটি ভাষা গোষ্ঠীর মানুষবাংলায় প্রবেশ করে তারা হলো আর্য। আর্যদের ভাষার নাম প্রাচীন বৈদিক ভাষা। পরবর্তীকালে এ ভাষাকে সংস্কার করা হয়। পুরানো ভাষাকে সংস্কার করা হয় বলে এ ভাষার নাম হয় সংস্কৃত ভাষা। সংস্কৃত হতে প্রকৃত এবং প্রাকৃত হতে অপভ্রংশ ভাষার উৎপত্তি হয়। অপভ্রংশ ভাষা হতে অষ্টম বা নবম শতকে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়। নয় ও দশ শতকে বাংলায় সংস্কৃত ছাড়াও দুটো ভাষা প্রচলিত ছিল- এর একটি হলো শৌরসেনী অপভ্রংশ এবং অন্যটি মাগধী অপভ্রংশের প্রাচীনতম বাংলা ভাষা। চর্যাপদের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম হয়। পরবর্তীযুগে বাংলায় সহজিয়া গান, বাউল গান ও বৈষ্ণব পদাবলীর উৎপত্তি হয়।
তথ্য-৩৪ ▌ বাংলা ও বাঙালি : পাকিস্তানামলে মৌলবাদীরা বাংলা ভাষার তৎসম শব্দগুলিকে হিন্দুয়ানি ব্যাপার বলে পরিত্যাগ করে; তার বদলে রাষ্ট্রীয়ভাবে উর্দূ-ফারসি-আরবী শব্দ ব্যবহার শুরু করে। এমনকি উর্দূর মতো আরবী হরফে বাংলা লেখার চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু টিকিয়ে রাখতে পারেনি। পানি এবং জল দুটিই বাংলা ভাষারই অমূল্য শব্দ। একটার বদলে অন্যটি নয়। জলকে বাদ দিলে-জলাশয়, জলাতংক, জলবায়ু, জলাধার, জলযান, জলপ্রপাত, জলকেলি ইত্যাদি শুব্দ বদলাতে গেলে ভাষাগত অনর্থই তৈরি হবে। বাঙ্গালীদের একটি অংশ আর্যভাষাভাষী মানবগোষ্ঠির বংশধর। নৃতত্ত্বের ভাষায় এদের 'আলপীয়' বলে। এরা ছিল ইরান অঞ্চল থেকে বাংলায় আগুন্তুক জাতি। বঙ্গ দেশের আদি অধিবাসীরা ছিল দ্রাবিড় গোষ্ঠির লোক। নৃতত্ত্বের ভাষায় এদের বলা হয় 'আদি অস্ট্রাল'। এর অর্থ অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের দৈহিক গঠন ও রক্তের মিল আছে। তাদের রক্তের মধ্যে গ্রুপ 'এ'('অ' অমমষঁঃরহড়মবহ)-এর শতকরা হার খুব বেশি। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, আনুমানিক ৩০,০০০ বছর আগে খাদ্যের খোঁজে এই যাযাবর জাতি ভারত থেকে অষ্ট্রেলিয়া গিয়েছিল।
তথ্য-৩৫ ▌মানুষের মধ্যে কয়েকটি পার্থক্য: নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীরা মানুষকে মোটামুটি চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন: (১) ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়া জুড়ে শ্বেতকায় মানুষদের ককেশয়েড বলে। ককেশিয়ানদের মধ্যে একেবারে উত্তর অঞ্চলের শ্বেতকায় মানুষরা নর্ডিক; মাঝামাঝি দল আলপাইন; এবং দক্ষিণ অঞ্চলের ঈষৎ ঘন বর্ণের মানুষ মেডিটারেনিয়ান বা আইবেরিয়ান। (২) পূর্ব এশিয়া জুড়ে পীতকায় মানুষেরা হলো মঙ্গোলয়েড। (৩) আফ্রিকার কৃষ্ণকায় মানুষ হলো নিগ্রয়েড, এবং (৪) অষ্ট্রেলিয়া ও নিউগিনির প্রাচীনতম অধিবাসীরদের অষ্ট্রেলয়েড বলে। মানুষের ভাষা-গোষ্ঠী ৭ভাগে বিভক্ত। ১. ইন্দোইউরোপীয়: এর অন্তর্ভুক্ত হলো ল্যাতিন, স্লাভ, আর্য, হিট্টাইট ইত্যাদি। ২. সেমিটিক: এর অন্তভুর্ক্ত হলো প্রাচীন ব্যাবিলন ও আসীরিয়ার ভাষা, ফিনিশীয়দের ভাষা, হিব্রু, সিরিয়ান, আরব আবিসিনিয়ান ইত্যাদি। ৩. হ্যামিটিক: প্রাচীন মিশরবাসীদের ভাষা ৪. ফিনো-ঊগ্রীয়: সাইবেরিয়া, ফিনল্যান্ড ইত্যাদির ভাষা ৫. ভোট-চীন: চীন,বর্মী, ভুটান এর অন্তভর্ুৃক্ত। ৬. আমেরিন্ডিয়ান: আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ানদের ভাষা। ৭. অষ্ট্রিক: মালয় এবং পলেনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের ভাষাসমূহ।
তথ্য-৩৬ ▌বিভিন্ন যুগ: প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। ৪৬৭ খিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন যুগ; পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত মধ্য যুগ, যার মধ্যে রয়েছে ইসলামের স্বর্ণযুগ (৭৫০-১২৫৮ খিস্টাব্দ) ও ইউরোপীয় রেনেসাঁ (১৩০০ শতক হতে শুরু)। আধুনিক যুগের সূচনাকাল ধরা হয় পঞ্চদশ শতক হতে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত। Í যার মধ্যে রয়েছে ইউরোপের আলোকিত যুগ। শিল্প বিপ্লব হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত আধুনিক কাল বলে বিবেচিত। ১৫ শতকের মাঝামাঝি গুটেনবার্গ আধুনিক ছাপাখানা আবিষ্কার করেন, যা জ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। ফলে মধ্যযুগের সমাপ্তি ঘটে এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূত্রপাত হয়। ১৮ শতকের মধ্যে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার এমন একটি চরম অবস্থায় উপনীত হয়, যা শিল্প বিপ্লবকে অবধারিত করে তুলে। উনিশ শতক হচ্ছে বাঙালির নবজাগরণের যুগ। এ সময় বাঙালি-প্রতিভার সর্বতোমুখী বিকাশ ঘটে এবং জাতি হিসেবে বাঙালির অভ্যুদয়ের সর্ববিধ প্রচেষ্টারও সূত্রপাত ঘটে। এ যুগেই শক্তিশালী সাহিত্যেরও সৃষ্টি হয়।
তথ্য-৩৭ ▌আদিম ও মধ্যযুগীয় সভ্যতা : ১. আগুন আবিষ্কার - শীত নিবারণ করা, মাছ-মাংস সিদ্ধ করে খাওয়া ইত্যাদি অভিনব কাজ আদিমকালে মানুষের আয়ত্তে এলো আগুন আবিষ্কারের পরে। ২. কৃষি ও পশুপালন - পূর্বে মানুষের আহারের ব্যবস্থা ছিলো পশু-পাখিদের মতোই। লড়ে, ঝাঁপিয়ে ও কুড়িয়ে যা পাওয়া যেতো, তা দিয়েই খেয়ে-না-খেয়ে দিন কাটাতে হতো। মানুষ স্বাবলম্বী হতে পেরেছে কৃষি ও পশুপালন প্রথা প্রবর্তনের পরে। ৩. ধাতু ও গৃহ - আদিম মানবরা পর্বতের গুহায় বা বৃক্ষকোটরে বাস করতো এবং 'হাতিয়ার' বলতে তাদের ছিলো দাঁতের জোর এবং পাথর। মানুষ পশুত্বের সীমানা পার হয়েছে - ধাতু গৃহ আবিষ্কারের পরে। ৪. তাঁত- আদিম মানুষেরা উলঙ্গই থাকতো এবং গাছের ছাল ও পশুর চামড়া পরিধান করতো। বসনে - ভূষণে মানুষ সজ্জিত হয়েছে তাঁত আবিষ্কারের পরে। ৫. চাকা আবিষ্কার - যানবাহনের দ্রুতোন্নতি ঘটে চাকা ব্যবহারের পরে। ৬. নৌকা ও পাল- নৌকা ও পাল আবিষ্কার মানুষকে দান করেছে পানির উপর রাজত্ব। ৭. লিপি ও কাগজ - মানব সভ্যতার বিস্মৃতির মুলে রয়েছে লিপি ও কাগজ আবিষ্কার।
তথ্য-৩৮ ▌মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগ : আদিম মানুষেরা সময়কে নির্দিষ্ট করতো সূর্য,চাঁদ,এবং বিভিন্ন গ্রহ, তারাকে হিসেব করে। তাই শুক্রবারের নাম এসেছে শুক্র গ্রহ থেকে, শনিবারের নাম এসেছে শনিগ্রহ থেকে, রবিবারের নাম এসেছে রবি অর্থাৎ সূর্য থেকে, সোম বারের নাম এসেছে চাঁদ থেকে, মঙ্গল বারের নাম এসেছে মঙ্গল গ্রহ থেকে, বুধবারের নাম এসেছে বুধ গ্রহ থেকে, বৃহষ্পতি এসেছে বৃহঃপতি গ্রহ থেকে। বলা যায় আকাশই ছিল তাদের বর্ষ পুঞ্জিকা। কুষান সম্রাজের রাজা কনিষ্ক ৭৮খ্রিষ্টাব্দে শতাব্দের প্রচলন করেন। বুদ্ধাব্দ শুরু হয় গৌতম বুদ্ধের নির্বানের বছর থেকে। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে চালু হয় হিজরি সনের। যীশুখ্রিষ্টের জন্মের সময় থেকে খ্রিষ্টাব্দের প্রচলন হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৩৮ অব্দে রোমের সম্রাট রোমুলাসই ক্যালেন্ডার চালু করেন । প্রথম অবস্থায় ক্যালেন্ডার ছিল ১০ মাসের, মানে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারী ছিল না। রোম সম্রাট লুমা পন্টিলাস ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারী যোগ করেন। পরে রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার ক্যালেন্ডারটিকে সংস্কার করেন, তিনি চাঁদের হিসেব বাদ দিয়ে সূর্যকে দিয়ে হিসেব করে ৩৬৫ দিনে বছর করেন।
তথ্য-৩৯ ▌প্রাচীন যুগের ধারাবাহিকতা : প্রাচীনকালে পশু শিকার ছিল মানুষের পেশা। কৃষিতে নির্ভরশীল হওয়ার পরও মাছ-মাংসের প্রতি পুরাতন আকর্ষণ আজও বহাল আছে। বন্যপশু ও পাখির পরিবর্তে পালিত পশু-পাখির মাংসই তাদের খাদ্য হিসেবে প্রচলিত। মানুষ সেদিন চিকিৎসা কাকে বলে জানত না। ভাবতো রোগ মাত্রই প্রকৃতির অভিশাপ। তাই রোগ মুক্তির জন্য ওই তুকতাক ও জাদুবিদ্যার শরণাপন্ন হয়েছিল। আজও পানিপড়া, দোয়া ও মাদুলি গ্রহণ করেন। কবজ-তাবিজ-আংটি ইত্যাদি ধারণ করেন। ধর্মগুরুর পায়ের ধুলো এবং আশীর্বাদ গ্রহণ করে মনে শান্তি পায়। আদিম মানুষেরা ভূতপ্রেত এবং পরলোকগত ব্যক্তির আত্মায় বিশ্বাসী ছিল। এখন আমরা প্রচ- সভ্য হয়ে উঠলেও মৃতব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনা করি। আজ আমরা নদী পাহাড় প্রভৃতির পূজা না করলেও তার অধিষ্ঠাত্রী দেবীর পূজো করি। আর্যরা পানির, আগুনের, মৃত্যুর, বজ্রের ইত্যাদির দেবতাদেরও কল্পনা করেছিলেন। আমরা আর্যদের বংশধর বলে এখনো বিভিন্ন কাল্পনিক শক্তির পূজা করি।
তথ্য-৪০ ▌কাজের ভাগাভাগি: শিকার করতে শেখবার আগে পর্যন্ত মানুষের দলের মধ্যে কাজের ভাগাভাগি বলে কিছু ছিল না: সকলে মিলেই একসঙ্গে ফল আর ছোট ছোট পশু-পাখি যোগাড় করার জন্যে ঘুরতো। কিন্তু বল্লম তৈরি করতে শেখবার পর বনে-জঙ্গলে শিকার করে বেড়ানোটা হলো পুরুষদের কাজ। মেয়েরা এই কাজে পুরুষদের সঙ্গে সমানে-সমান হয়ে পারতো না। মাতৃত্ব ও সন্তান পালনের দায়িত্বও ছিল। তাহলে, বল্লম আবিষ্কারের পর থেকেই মানুষের দলের মধ্যে একরকম কজের ভাগাভাগি দেখা গেল। দলের পুরুষেরা বনে-জঙ্গলে বর্শা-বল্লম হাতে শিকার করে বেড়াবে আর দলের মেয়েরা আগের মতোই বস্তির আশপাশে ফলমূল আহরণের চেষ্টা করবে। এইভাবে ফলমূল আহরণের চেষ্টা থেকেই শেষ পর্যন্ত মেয়েরা কৃষিকাজ আবিষ্কার করেছিল। আর সেই শুরুর যুগে চাষবাস ছিলনেহাতই মেয়েলি ব্যাপার। প্রথমদিকে ধারালো পাথরের নিড়ানি দিয়ে বস্তির আশপাশের ছোট-খাটো জমি কুপিয়ে ক্ষেত রচনা করা হতো। হালে লাঙল জুড়ে বড় বড় ক্ষেতে চাষ করার অবস্থায় মানুষ যখন পৌঁছলো তখন সে-কাজ মেয়েদের হাত থেকে পুরুষদের হাতে এলো।
তথ্য-৪১ ▌খাদ্য-আহরণ ছেড়ে খাদ্য-উৎপাদন: পৃথিবীর বুকের ওপর টিকে থাকতে গেলে, মানুষের প্রথম দরকার খাবারের। কৃষি-আবিষ্কার হবার আগে পর্যন্ত আদিম মানুষ ছিল খাদ্য আহরণকারী। পরগাছার মতো, পৃথিবীতে যা রয়েছে, তাই-ই সংগ্রহ করে মানুষ বাঁচবার চেষ্টা করছে, হয়তো নদীর ধারে ধারে শামুক-কাঁকড়া আর মাছ খুঁজে খুঁজে বেড়িয়েছে, আরো কিছুকাল পরে শিখেছে বনের পশুপাখি শিকার করতে। কৃষিকাজ আবিষ্কার করতে পারবার পর থেকে মানুষ আর পরগাছার মতো প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বাঁচবার চেষ্টা করেনি; তার বদলে তৈরি করতে শুরু করেছে নিজের দরকার মতো খাবারটুকু। চাষবাস শিখতে পারার দরুন খড়-ভুষির যোগান পাওয়া যায়, আর এই খড়-ভুষি খাইয়েই গৃহপালিত পশুদের বাঁচিয়ে রাখা অনেক সহজ। তাই দেখা যায়, কৃষিজীবীরা ক্রমশই পশুপালনও করছে, ক্রমশই তারা গৃহপালিত পশুদেরও নিযুক্ত করছে চাষবাসের কাজে। এই কৃষিকাজ আবিষ্কারের দরুনই মানুষ বন্য দশা ছেড়ে ক্রমশ সভ্যতার দিকে এগুতেই পারতো না।
তথ্য-৪২ ▌নারী-প্রধান সমাজ : কৃষিকাজ আবিষ্কার হবার দরুন আদিম মানুষের বুনো আধা-জানোয়ারের মতো অবস্থা পিছনে ফেলে সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাবার যে-সব পরিচয় দিতে লাগল তার মধ্যে কয়েকটি হলো ঘর তৈরি, কাপড়-বোনা ইত্যাদি। সমস্ত শিল্পই শুরুতে ছিলে কুটির-শিল্প আর কুটিরের সমস্ত কাজই ছিল মেয়েদের কাজ। আজকের দিনেও পিছিয়ে-পড়া মানুষদের মধ্যে এ কাজের দায়িত্ব মেয়েদের উপর। ভারত-বাংলাদেশে বসবাসরত খাসিয়াদের কাছে জীবন ধারণের প্রধান অবলম্বন বলতে চাষের কাজ। কিন্তু তাদের অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গাতেই এখনো হাল-বলদের চল হয়নি। অর্থাৎ খাসিয়ারা এখনো মোটের ওপর চাষবাসের প্রথম দিককার অবস্থাতেই আটকে রয়েছে। কৃষি কাজের ওই রকম একটা শুরুর দিকের পর্যায়ে আটকে থেকেছে বলেই ওদের মধ্য থেকে নারীপ্রধান সমাজের রূপটি আজো লুপ্ত হয়নি। খাসিয়াদের বেলায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার চলে মায়ের সূত্রেই। তাদের কাছে বাবা অনেকটাই যেন বাইরের মানুষ, বাবার আত্মীয়-স্বজনেরা তাদের কাছে প্রায় অনাত্মীয় মতোই।
তথ্য-৪৩ ▌ ঘর-তৈরি, কাপড়-বোনা : সমস্ত শিল্পই শুরুতে ছিলে কুটিরশিল্প আর কুটিরের সমস্ত কাজই ছিলো মেয়েদের কাজ। পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের দিকে চেয়ে দেখলে আমরা জানতে পারি জামা-কাপড় তৈরি করা থেকে শুরু করে কুমোরের কাজটাও সর্বত্রই মেয়েদের কাজ। রোমানদের চেয়েও ঢের আগেই যারা পৃথিবীতে সভ্যতা গড়ে তুলতে শুরু করেছিলো তাদের আস্তানাগুলি খোঁজ করলে আমরা মাতৃপ্রধান সমাজের নানানরকম টুকরো-টাকরা চিহ্ন খুঁজে পাবো। প্রাচীন যুগে চীনদেশে পুরোপুরি মাতৃপ্রধান সমাজ ছিলো। কয়েক শো বছর আগে পর্যন্ত উত্তর-তিব্বতে ওই রকম মেয়েদের রাজত্ব, এহেন একটি জাতির নাম সু-মু সংখ্যায় তারা প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ মানুষ। তাদের মধ্যে শাসন ব্যাপারে সবচেয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা তাদের রানীর হাতে। আর একটি জাতির নাম নুয়ে-কুন্Ñতাদের বেলাতেও একই ব্যবস্থা। তাদের এ রাজ্যে ৮০টি নগর, ৪০,০০০ পরিবারের বাস, ১০০০০ সৈন্য ছিল।
তথ্য-৪৪ ▌পশু পালনের ফলে পুরুষের হাতে এলা অর্থনৈতিক ক্ষমতা: শিকারবৃত্তি থেকেই পশুপালনের উৎপত্তি এবং পশু পালনের ফলে পুরুষের হাতে প্রথম সুনিশ্চিত অর্থনৈতিক ক্ষমতা এলো। এই ক্ষমতার সাহায্যে প্রায়ই মেয়েদের কিনে নেওয়া শুরু হলো। গৃহপালিত পশুর বিনিময়ে মেয়েদের কেনা হতো। পশুপালনমূলক সমস্ত সমাজই অনিবার্যভাবে পিতৃপ্রধান। অপরপক্ষে, যাদের বেলায় পশুপালন বাদ দিয়ে ভালো রকমের কৃষিকাজ দেখা দিয়েছে, তাদের মধ্যে প্রায়ই মাতৃপ্রধান্য বর্তমান থেকেছে। উত্তর আমেরিকার ইরোকোয় এবং পিউলোদের মধ্যে এমনটা দেখা গেছে। তেমনি, ইন্দোনেশিয়া এবং মাইক্রোনেসিয়ায় যেসব মাতৃপ্রাধান্য টিকে থাকতে দেখা যায়; এসব জায়গায় পশুপালনের অবস্থা কখনোই ছিল না। আফ্রিকার জায়গায় জায়গায়, যেখানে মানুষেরা কৃষিপ্রধান হয়ে রয়েছে সেখানে দেখা যায় মাতৃপ্রাধান্য টিকে থেকেছে। আর্যরা কৃষি কাজে কখনোই আত্মনিয়োগ না করেও উত্তর ভারতের উর্বর উপত্যকায় পশুপালক যোদ্ধা হিসেবেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল; তারা কৃষি কাজের দায়িত্ব স্থানীয় আদিবাসীদের উপরই ছেড়ে দিয়েছিল।
তথ্য-৪৫ ▌আদিম মানুষের প্রজননের রহস্য: আদিম মানুষের পক্ষে প্রজননের প্রকৃত রহস্য অনুমান করা সম্ভব ছিল না। তারা মৈথুনের সঙ্গে যে প্রজননের সম্পর্ক আছে, তা বুঝতেন না। কারণ মাসিক হওয়া মেয়েরা বাপ-ভাই থেকে শুরু করে যে কোন পুরুষের সাথে যত্রতত্র হরহামেশাই যৌনতায় লিপ্ত হত। যে গুহা বা ছাওনিতে যুবতী থাকতো, সে গুহা বা ছাওনির পাশে যুবকের আড্ডা স্থল ছিল। কোন মেয়েরা একা থাকার সুযোগ কম পেতো। এতে মেয়েদের বিরতিহীন যৌনতা উপভোগ করার ক্ষমতা তৈরি হতে থাকে, যা পুরুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। পুরুষের বিরতির প্রয়োজন হয়। ফলে, তারা গর্ভসঞ্চার সংক্রান্ত নানারকম অবাস্তব ধারণা করতো। পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের মধ্যে এ-জাতীয় নানা ধারণা এখনো দেখতে পাওয়া যায় এবং রূপকথা ও লোককথায় তার স্মারক খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। এ জাতীয় ধারণার মধ্যে অত্যন্ত প্রাকৃত পর্যায়ের একটি ধারণা হলো, সন্তানের প্রথম আবির্ভাব হয় নারীর বক্ষদেশে; তারপর বক্ষস্থল থেকে সন্তান পেটের দিকে নেমে আসে। ব্রিটিশ নিউগিনির (সিনাউগোলোদের) মধ্যে আজো এই আদিম ধারণাটি টিকে থাকতে দেখা যায়।
তথ্য-৪৬ ▌মিশরীয় সভ্যতা: খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের পূর্বেই নগর বিপ্লব সংঘটিত হয়। প্রাচীন মিশর লম্বায় প্রায় ৫০০ মাইল এবং সবচেয়ে বেশি চওড়া যেখানে, সেখানে মাত্র ১০ মাইলেরও কিছু কম। নীলনদ তীরবর্তী প্রায় ১২৫০০ বর্গমাইল এলাকার পলি মাটিতে প্রাচীন মিশরীয়রা ফসল ফলাত এবং সমৃদ্ধ নগর গড়ে তুলেছিল। মিশরের সমাজ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, ১. এক ফারাও, রাজ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তি,পুরোহিত ও ভূমির মালিক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা উচ্চ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন.২.বণিক কারিগর ও অন্যান্য শ্রম শিল্পীরা মধ্যম শ্রেণিভুক্ত ছিল। ৩.ভূমিদাস, সেবা দাস এবং ক্রিতদাসরা নি¤œ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরাই ছিল জনগনের বৃহত্তম অংশ। দাসদেরকে সাধারণত রাস্তাঘাট নির্মাণ, খাল কাটা, বাধ নির্মাণ, চাষাবাদ, খনির কাজে নিয়োগ করা হতো। পিরামিড নির্মাণের শ্রমদানে দাসদের বাধ্য করা হতো। বেঁেচ থাকার সামান্য খাদ্য ও পানীয় পাবার নিশ্চয়তা ছিল তাদের কাছে অকল্পনীয়।
তথ্য-৪৭ ▌সুমেরীয় সভ্যতা: পশ্চিম মিশর থেকে শুরু করে পারস্য উপসাগরের তীর পর্যন্ত এ ঊর্বর এলাকা বিস্তৃত। এই মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে প্রথম যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা সুমেরীয় সভ্যতা। ৫০০০ থেকে ৪০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সুমেরীয়দের সভ্যতা গড়ে উঠে এবং এ সভ্যতার ধ্বংস হয় ২৪০০খ্রিস্ট পূর্বাব্দে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার মাধ্যমে। সুমেরীয়দের পশু প্রীতি ছিল। পরাজিত সৈনিক ও বেসামরিক নাগরিকদের দাসে পরিণত করা হতো। অনেককে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়াও হতো। সেনাবাহিনী কোনো নগর দখল করলে অত্যন্ত নৃশংসতার পরিচয় দিত। সুমেরীয় পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক। তারা উপপতœী রাখত। তাদের কৃষি পণ্য ছিল গম,যব, বার্লি, খেজুর, শাক-শবজি। চাকাওয়ালা ঠেলাগাড়ি ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার তাদের অন্যতম দিক। সুমেরীয় ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট ওজনের সোনা বা রুপার বাট মুদ্রা ব্যবহার করে। খ্রিস্ট পূর্ব ৩৫০০ অব্দে চিত্রলিপির মাধ্যমে সুমেরীয় লিখন পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটে। দিনপঞ্জি আবিষ্কার তাদের প্রধান অবদান। তারা চন্দ্রের মাস অনুযায়ী গণনা করতো। তারাই ৭ দিনে এক সপ্তাহ এবং ৬০ মিনিটে এক ঘন্টার নিয়ম প্রবর্তন করেন।
তথ্য-৪৮ ▌ব্যাবিলনীয় সভ্যতা: সুমেরীয়দের বিতাড়িত করে ব্যাবিলনীয়রা নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও হাম্বুরা¡ীর মৃত্যুর পর ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য নামেমাত্র টিকে ছিল। তার পাঁচ জন উত্তরাধিকারী দেশ শাসন করেন। হাম্বুরাবী দুধর্ষ যোদ্ধা, সংগঠক, প্রশাসক ও আইন প্রণেতা ছিলেন। তার এই আইন সংকলন পৃথিবীর আইন প্রণয়নের ইতিহাসে সর্বপ্রথম। হাম্মুরবীর প্রায় চারশ বছর আগে সুমেরীয় রাজা লিবিট ইশতার এবং রাজা ডঙ্গীও আইন প্রণয়ন করেন। হাম্মুরবীই প্রথম সব আইনের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ আইন সংকলন করেন। সুমেরীয়দের মত প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রাও বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। সুমেরীয়দের মত ব্যাবিলনীয়দের ধর্মও ছিল ইহলৌকিক ধর্ম। পরকাল সম্বন্ধে তাদের ধারণা ও উৎসাহ কোনটাই ছিল না। যাদুবিদ্যা, ভবিষ্যৎবাণীতে বিশ্বাস, জ্যোতিষী নির্ভরশীলতার কারণে তারা নানান কুসংস্কারেও বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ব্যাবিলনীয়রা ৩০ দিনে একমাস, ১২ মাস বা ৩৬০ দিনে এক বছর নির্ধারণ করে। ব্যাবিলনীয় দিনপঞ্জি সূর্য নয় বরং চন্দ্রের ভিত্তিতে সময় নিরূপণ করতো। ৩৬০ দিনের পর বছর মেলানোর জন্য ১ টি অতিরিক্ত মাস গণনা করতো যাকে তারা ‘মল মাস’ বলত।
তথ্য-৪৯ ▌এসেরীয় সভ্যতা: খ্রিস্টপূর্ব চৌদ্দ শতকে যখন ব্যাবিলনীয় শাসনের অন্তিমকাল, মিশর সিরিয়া ও আরব ভূখন্ডের অধিকাংশ হারিয়ে ক্ষুদ্র অঞ্চলে পরিণত হয়েছে, সেই সময় দুর্বল প্রতিবেশীর উপর আধিপত্য বিস্তার করে এসেরীয়রা একটি নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। খ্রিস্টপূর্ব আঠারো শতকে হাম্মুরাবীয় সময় পর্যন্ত ‘আসুর’ ছিল ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের একটি করদ রাজ্য। সুমেরীয়দের সময় আসুর অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। এসেরীয়রা বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্পকলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ব্যাবিলনীয়, সুমেরীয়, আক্কাদীয়দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তিগলাথ পিলসারের সময় এসেরীয় সাম্রাজ্যগৌরবের চরম পর্যায়ে পৌঁছে। বিশাল সেনাবাহিনী, উন্নত অস্ত্র সংগ্রহ করে তিনি আর্মেনিয়া ও ব্যাবিলন জয় করেন। সিরিয়া থেকে পূর্বে আনাতোলিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকাংশ রাজ্য থেকে কর আদায়ে সক্ষম হন। এরপরের সফল শাসক দ্বিতীয় সারগন ইসরাইলের রাজধানী দখল করেন এবং ইসরাইলকে এসেরীয় একটি প্রদেশে পরিণত করেন।
তথ্য-৫০ ▌পারস্য সভ্যতা: খ্রিস্ট পূর্ব ছয় শতকে পারস্য অঞ্চলে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। পারস্য সাম্রাজ্য ভারতের পাঞ্জাবের সিন্ধু নদের তীর থেকে ঈজিয়ান সাগর এবং ভারত মহাসাগর থেকে ক্যা¯িপয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পারস্য স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি ছিল স¤পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ‘পারসা’ নামে প্রদেশ থেকেই দেশের নাম হয়েছে ‘পারস্য। পারস্যের অপর নাম ইরান। আর্যদের বাসভূমি ‘আরিয়ানা” শব্দ থেকে দেশের নাম হয়েছে ইরান হয়েছে। পারস্যকে আদি আর্যভূমি বলা হয় যায়। সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্য সম্রাটের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। তার উপাধি ছিল শাহেন শাহ। ইরানে কৃষি কাজ ছিল জীবিকার প্রধান উৎস। জমির মালিক ছিল জমিদার শ্রেণি। জমি চাষ করতো দাসরা। ভূমির সঙ্গে তাদেরও কেনাবেচা হতো। গম, যব, আক্সগুর ও জলপাই ছিল প্রধান উৎপন্ন ফসল। গরু,মেষ, ছাগল, গাধা, ঘোড়া প্রভৃতি পশু প্রজননের ব্যবস্থা ছিল। তখন চিনি ছিল না, মধু ব্যবহার হতো আর মধু আহরণের জন্য মৌমাছি চাষ হতো। প্রাচীনকাল থেকে পারস্যবাসীরা বহু দেবতায় বিশ্বাসী ছিল। দেবতাদের তুষ্ট রাখার জন্য বন্দনা করতো এবং বলি অর্ঘ দিত।
তথ্য-৫১ ▌ হিব্রু সভ্যতা: হিব্রুরা ইহুদি জাতি নামেই পরিচিত। খ্রিস্ট পূর্ব ১৮০০ অব্দে হিব্রুদের আদি বাসস্থান উত্তর পশ্চিম মেসোপটেমিয়া হলেও এবং পরে তারা ১০২৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দেকেনানে (যা পরবর্তীকালে প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত হয়) বসতি গড়ে তোলে। ক্রমান্বয়ে পশ্চিম এশিয়ায় তারা একটি সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে তোলে। নবীর আবির্ভাবসহ আধুনিক সকল একেশ্বরবাদী ধর্মের ভিত্তি গড়ে তুলতে তারা অসামান্য অবদান রাখেন। ১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ডেভিড (দাউদ আঃ)হিব্রুদের রাজা হন। তিনি শুধু রাজাই ছিলেন না ধর্মেরও নেতৃত্ব প্রদান করেন। বাইবেলে প্রকাশ তার সময় জেরুজালেম ইহুদি ধর্মের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।ডেভিডের ছেলে সোলমান (সোলায়মান) হিব্রু সাম্রাজ্যের পরবর্তী রাজা হন। তার সময় হিব্রুদের শক্তি ও প্রতিপত্তির চরম সীমায় পৌঁছে। তিনি ইউফ্রেটিস নদী থেকে প্যালেস্টাইন ও মিশরের সীমান্ত পর্যন্ত রাজ্যের কর্তৃত্ব করেন। তিনিও পিতার ন্যায় রাজা ও ধর্মীয় নেতা ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ অব্দে এসেরীয়রা ইসরাইল দখল করে ইহুদিকে নির্বাসন দেয়।
তথ্য-৫২ ▌ফিনিশীয় সভ্যতা: খ্রিস্ট পূর্ব ৩০০০ অব্দে উত্তর মেসোপটেমিয়া থেকে সেমেটিক গোষ্ঠীভুক্ত একদল যাযাবর লেবাননের পর্বতমালা ও ভুমধ্যসাগরের উপকূলে বসতি গড়ে তোলে। ক্রমান্বয়ে তারা সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল ও মরুভূমির পশ্চিমাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এমন ভৌগোলিক অবস্থায় তাদের কৃষিযোগ্য জমি কম থাকায় তারা সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের দিকে ক্রমান্বয়ে ঝুঁকে পড়ে। ফিনিশীয়রা ছিল ব্যবসায়ী জাতি। কৃষি ও পশুপালন ফিনিশীয়দের প্রাথমিক জীবিকায় ভূমিকা রাখে। পাহাড় ও সমতল উপত্যকায় বিভিন্ন ধরনের শষ্যদানা, আক্সগুর,জলপাই, খেজুরের চাষ হতো। পশুর মধ্যে গাধা, ছাগল ও ভেড়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। হিব্রুদের সঙ্গে ফিনিশীয়দের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রমাণ বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট, ইলিয়াড ও ওডিসি মহাকাব্যে উল্লেখ আছে। ১২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ফিনিশীয় ধর্মে উৎসর্গ প্রথা প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন জিনিষপত্র, খাদ্য,পানীয়, পশু-পাখি এমনকি মানুষ বলি দেয়া হতো। কেনানাইট লিপি থেকে ফিনিশীয়রা ১২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ২২টি ব্যঞ্জনবর্ণের বর্ণমালা উদ্ভাবন করে। খ্রিস্ট পূর্ব ৮০০ অব্দে এই বর্ণমালার সঙ্গে গ্রীকরা স্বরবর্ণ যোগ করে বর্ণমালাকে পূর্ণতা দেয়।
তথ্য-৫৩ ▌চীনা সভ্যতা: চীনের প্রভাবশালী রাজবংশ চৌ বংশের শাসনামলে (খি:পূ: ১১২২-২২১) ‘চিন’ ছিল একটি করদ রাজ্য। কিন্তু ২২১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ চিন পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো জয় করে সমগ্র দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে। এ রাজ বংশের নামানুসারেই দেশের নাম হয়ে যায় ‘চীন’। চীনে পৃথিবীর প্রাচীন মানব গোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এরা “পিকিং মানুষ” নামে পরিচিত। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, মানব জাতির এ প্রজাতি কমপক্ষে ৫ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করতো। চীনের বিগত চার হাজার বছরের ইতিহাসে সেখানকার আদিম মঙ্গোলীয় জাতির সঙ্গে তিব্বতি, তাতার, জাপানি প্রভৃতি জাতির সংমিশ্রণ ঘটে। যার ফলে চৈনিকদের মুখাকৃতি বর্তমান আদল রূপ নেয়। প্রাচীন চীনে নির্দিষ্ট ধর্ম বিশ্বাস লক্ষ করা যায়নি। চীনারা বিশ্বাস করতো পূর্ব পুরুষরা পরিবারের সুখ সমৃদ্ধি দান করে। তাদের পূজা না করলে বহু বিপদ হতে পারে। ভারত সম্রাট অশোকের কাল (খ্রিঃপূঃ২৭৩-২৩২) থেকে বৌদ্ধ ধর্ম চীনের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের হুন তাতারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
তথ্য-৫৪ ▌রোমান সভ্যতা: গ্রীক সভ্যতা যখন বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন ইতালির তাইবার নদীর তীরে আরেকটি সভ্যতার উদয় হয় যা রোমান সভ্যতা নামে পরিচিত। খিস্ট-পূর্ব পঞ্চম শতকে রোম শহরের পত্তন হয়। কালক্রমে টাইবার নদীর মোহনায় সাতটি পার্বত্য টিলাকে কেন্দ্র করে এই নগরীর বিস্তৃতি ঘটে। রোম শহরকে কেন্দ্র করে ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে এই সভ্যতা বিকাশিত হতে থাকে, এবং কালক্রমে একটি প্রাচীন যুগের বৃহত্তম সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। এই সভ্যতার স্থায়িত্বকাল ছিল প্রায় বারো শতক এবং এ দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় রোমান সভ্যতা একটি রাজতন্ত্র থেকে একটি প্রজাতন্ত্র এবং পর্যায়ক্রমে একটি একনায়কতন্ত্রী সাম্রাজ্যে পরিবর্তিত হয়। আমরা যে আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারটির সঙ্গে পরিচিত সেটির প্রথম সূত্রপাত ঘটান রোমানরা। বর্তমান ইউরোপের প্রায় সব দেশের আইন রোমান আইনের মূলনীতি সম্পর্কিত ১২টি তালিকার ওপর ভিত্তি করে রচিত। রোম, গ্রিস, কার্থেক ও প্যালেস্টাইনসহ ভূমধ্যসাগর অঞ্চলজুড়ে বিদ্যমান সব রাষ্ট্রকে এটি যেমন অধিকার করে, তেমনি অধিকৃত রাষ্ট্রগুলোর শিল্প সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণা আত্মস্থ করে নিজস্ব অবদানে তা সমৃদ্ধও করে।
তথ্য-৫৫ ▌বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য : তবে ৭১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রোমে দাস বিদ্রোহের নেতা ¯পার্টাকাস নিহত হওয়ার পর রোমের সংকট বৃদ্ধি পায় এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করে। বাস্তবিক অর্থে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যকে আর রোমান সাম্রাজ্য না বলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য বলা হয়। কারণ বাইজেন্টাইন একদা রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হলেও এর ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি প্রায় সবকিছুই ছিল পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য হতে ভিন্নতর। রোমে বিকাশ লাভ করেছিল রোমান ক্যাথলিক মতবাদ অন্যদিকে কনস্টান্টিনোপলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গ্রীক অর্থডক্স চার্চের দর্শন। বাইজেন্টাইন ধারণ করেছিল মূলত গ্রীক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কিদের হাতে প্রায় এক হাজার বছর স্থায়ী এ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
তথ্য-৫৬ ▌মিসরের প্রাচীন সভ্যতা: প্রাচীনকালের এই মিসরেই মানুষের সভ্যতার প্রথম সূচনা হয়েছিল। মিসর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের বিভিন্ন গোষ্ঠীতে এই সভ্যতা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল। মিসরের চারদিকের ধু-ধু করা রুক্ষ মরুভূমির মধ্যে ছোট্ট এক ফালি এই সবুজ দেশের সন্ধান পেয়ে, যারা এখানে প্রথম বসবাস শুরু করেছিল, তারা যে বহুকাল আগেই এখানে এসেছিল, সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। ব-দ্বীপের মুখেই মাটি খুঁড়ে মাটির পাত্র, ইট, এমনকি মাথার খুলি পর্যন্ত যেসব জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে, তা থেকে প-িতরা অনুমান করেন যে, অন্তত ষোলো হাজার বছর আগেই এখানে মানুষের বসবাস ছিল। নীল নদীর দু’ধারে গোটা মিসর জুড়ে প্রতœতাত্ত্বিকরা আরো অসংখ্য যেসব বসতি এবং কবর আবিষ্কার করেছেন, সেগুলো থেকেও বোঝা যায় যে, চাষবাসই ক্রমশ জীবনযাত্রার প্রধান ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা যাকে মৃত বলে মনে করি, মিসরীদের বিশ্বাসে সেটি ছিল একটি সাময়িক বিরতি মাত্র। এই বিশ্বাস থেকে তারা যে শুধু মৃতদেহটিকে অবিকল অবস্থায় রক্ষা করার চেষ্টা করত।
তথ্য-৫৭ ▌পিরামিডের কথা: ৬৮ মণ ওজনের বিরাট বিরাট পাথরের চাঁই নীল নদীর অন্য পাড়ে দশ-বারো মাইল দূর থেকে মানুষকেই বয়ে আনতে হয়েছিল। একটা দুটো নয়, তেইশ লক্ষ পাথর! জোর-করে খাটানো এই মানুষগুলো রাজার সিপাই-শাস্ত্রীর চাবুক খেয়ে পাথরচাপা পড়ে কত হাজারে হাজারে মরেছে, তার হিসাব নেই; এসব কাজে ক্রীতদাসদেরই খাটানো হতো। আর সে যুগের মানুষের কাছে ক্রীতদাসরা তো মানুষ বলে গণ্যই হতো না। যুদ্ধবিগ্রহে যারা বন্দি হতো, শুরুতে এদের মেরে ফেলাই হতো; পরে যখন দেখা গেল যে, নানারকম অমানুষিক খাটুনির কাজে এদের লাগানো যায়, তখন আর মারতো না। অন্যদিকে রাজারাজড়া, তাঁদের আত্মীয়-স্বজন, পোষ্য এবং পুরোহিতদলের বিলাস আর ব্যাসনের কোনো সীমা ছিল না। কবরগুলোই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। প্রাচীন মিসরের এই সমাজ পরিষ্কারভাবে দুটোভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। দেশের যাবতীয় ধন-সম্পদ জমা হয়েছিল ওই রাজারাজড়াদের হাতে, অন্যদিকে -সাধারণ মানুষের জীবন ছিল নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের।
তথ্য-৫৮ ▌ নীল নদ থেকে সিন্ধু নদী: পশ্চিমে নীল নদী থেকে পূর্বে সিন্ধু নদী পর্যন্ত রুক্ষ বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলটিকে মানুষের সভ্যতার জন্মকেন্দ্র বলা যায়। যাযাবরি ছেড়ে থিতিয়ে বসা নতুন পাথরের যুগের মানুষরা নীল নদী থেকে শুরু করে সিরিয়া, ইরাক এবং ইরান পেরিয়ে ভারতবর্ষের সিন্ধু নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অসংখ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ বসতি গড়েছিল। শিকার এবং সংগ্রহই যখন মানুষের খাদ্য সংস্থানের প্রধান উপায় ছিল, তখন এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করার কোনো প্রয়োজন মানুষের ছিল না। বরঞ্চ তাতে অসুবিধাই ছিল বেশি। কারণ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একই জায়গায় শিকার বা ফলমূল যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় না। ঘুরে ঘুরে এ জায়গা থেকে ও জায়গা এদেশ থেকে ওদেশে গিয়ে শিকার বা ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন বাঁচাতো। কিন্তু চাষবাস মানুষের খাবারের অভাব মেটালো, তাই চাষের জমির পাশেই থাকার ঘর বেঁধে ফেললো। পাথরের যুগের অসংখ্য গ্রাম এই ভাবেই দেখা দিয়েছিল। সেগুলো কিছুকাল অন্তর অন্তর ভেঙে পড়ত; ফলে আবার নতুন করে বাড়ি-ঘর তুলতে হতো। এভাবেই এক-একটা ঢিবি হয়ে উঠত।
তথ্য-৫৯ ▌ ইরাকের প্রাচীন বসতি: খ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছরের কিছু আগে ইরাক-এর জীবন ধারার মধ্যে বেশ একটি বড় পরিবর্তন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। জরাজীর্ণ ভাঙা কুঁড়েঘরের বদলে এখানে চোখে পড়ে প্রকা- বড় বড় বাড়ি-ঘর, মন্দির। এই যুগের যে অসংখ্য লিখিত নথিপত্র পাওয়া গিয়াছে, তা থেকে জানা যায় যে সুমেরদের এই নগরগুলোর প্রায় সমস্ত ধনসম্পদ এবং জমিজমার মালিক ছিল এক-একজন নগর-দেবতা। আর এই নগরদেবতাদের পূজা অর্চনা করা বা মন্দিরের সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করার ভার যাদের উপর ছিল, সেই পুরোহিত শ্রেণিই ক্রমশ নগর দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে নগরগুলোর প্রধান হয়ে উঠেছিল। এই সভ্যতার প্রধান ভিত্তিই ছিল টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস্ নদী দুটির পানি। দরকারি অনেক জিনিসপত্রের জন্য দূর দেশ থেকে আমদানি বাণিজ্যের উপর নির্ভর করতে হতো। কাজেই জমিজমা এবং নদীর পানি নিয়ে এবং বাইরের ওই আমদানি বাণিজ্যের সম্পদ নিয়ে এই নগরগুলোর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি লাগত।
তথ্য-৬০ ▌মেহেরগড় সভ্যতা: আফ্রিকা থেকে যাযাবর শিকারি গোষ্ঠীর একটি দল সেন্ট্রাল এশিয়ায় গিয়ে সম্মুখীন হয় পর্বতসংকুল এলাকার। প্রায় ৩০ হাজার বছর পূর্বে এদের অনেকে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছায় ভারতের সিন্ধু নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এবং সেখানে স্থাপন করে বসতি। এই নরগোষ্ঠীর বিস্তৃতি ছিল লাইবেরীয়া থেকে উপমহাদেশ পর্যন্ত। এরা দেখতে মধ্যম থেকে লম্বাকৃতির ছিল, গায়ের ও চোখের রং ছিল কালো থেকে হালকা বাদামি, এদের মাথা ও মুখাবয়ব ছিল দীর্ঘ। ধারণা করা হয় (খ্রিষ্ট-পূর্ব ৮৫০০-৭০০০) এরা ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা মেহেরগড় সভ্যতা পত্তন করেন। মেহেরগড় সভ্যতা নতুন প্রস্তর যুগের সভ্যতা। বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত বালুচিস্তানের জোব নদী থেকে পশ্চিম ভারতের সিন্ধু নদ পর্যন্ত মেহেরগড় সভ্যতা বিস্তৃত ছিল। পশুপালনের ওপর ভিত্তি করে ভারতবর্ষের মেহেরগড় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। খ্রিষ্ট-পূর্ব ৫ম শতকের মধ্যেই সিন্ধু অববাহিকায় কৃষিকাজ শুরু হয়ে যায় এবং খ্রিষ্ট-পূর্ব ৩য় শতক নাগাদ নদীর উপকূল জুড়ে এখানে ছোট-বড় শহর স্থাপিত হয়।
তথ্য-৬১ ▌সিন্ধু সভ্যতা: ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ভারত উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতা। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ ছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণ বেলুচিস্তানে এ সভ্যতার অস্তিত্ব লক্ষণীয়। সিন্ধু সভ্যতার যে সমস্ত নগরীর সন্ধান পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে আছে রাজস্থানের কালিবাঙ্গান, পাকিস্তানের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো। এই তিনটি নগরী এবং আরো প্রায় দুশ ছোট বড় শহরের এক বিশাল নগর সভ্যতা পূর্বে ঊর্ধ্ব গঙ্গা এবং দক্ষিণে বর্তমান মুম্বাই শহর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সিন্ধু সভ্যতা আকারে ছিল সমসাময়িক প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ। সিন্ধু সভ্যতা ছিল একটি ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো-সিন্ধু-উপত্যকার প্রাচীন নগর-সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশের এই দুটি শহর যে খ্রিস্ট-পূর্ব ২৫০০ থেকে খ্রিস্ট-পূর্ব ১৫০০ পযর্ন্ত মহাআড়ম্বর এবং জাঁকজমকের সঙ্গেই টিকেছিল। হরপ্পা সভ্যতা মেসোপটেমিয়া এবং সুমেরীয় সভ্যতার সমসাময়িক।
তথ্য-৬২ ▌ হরপ্পা- মহেঞ্জোদারো: হরপ্পা ‘ঢিবি’ খুঁড়ে পরপর ছ’টি বসতির সন্ধান মেলে। আর মহেঞ্জোদারোয় মেলে ন’টি। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো এই দুটি শহরে আরেকটা ব্যাপার খুব বেশি নজরে পড়ে। শহর-পরিকল্পনা থেকে শুরু করে এই সভ্যতার সমস্ত কিছুর মধ্যে সওদাগরী ব্যবসার প্রাধান্য সুস্পষ্ট। রাস্তাঘাট দোকানপাটের ছড়াছড়ি। বাজারে বিক্রি করার জন্যই যেন সমস্ত জিনিসপত্র প্রচুর পরিমাণে তৈরি হতো। হরপ্পা- মহেঞ্জোদারোর পাথরের জিনিস, নকশা-কাটা মাটির পাত্র এবং সিলমোহর সুমের পাওয়া গেছে। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো সিন্ধু-উপত্যকার প্রাচীন নগর সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশ। এই দুটি শহর যে খ্রিষ্ট-পূর্ব ২৫০০ থেকে খ্রিষ্ট-পূর্ব ১৫০০ পযর্ন্ত মহাআড়ম্বর এবং জাঁকজমকের সঙ্গেই টিকেছিল। হরপ্পা সভ্যতা মেসোপটেমিয়া এবং সুমেরীয় সভ্যতার সমসাময়িক। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত নরমু- পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেখানে যেমন দীর্ঘমু-, সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ গড়নের মানুষের চিহ্ন পাওয়া গেছে, তেমনি খর্বাকৃতির দীর্ঘ নাসিকা, ধনুকের মতো বঙ্কিম ও উন্নত কপালের অপেক্ষাকৃত দুর্বল গড়নের মানুষও ছিল।
তথ্য-৬৩ ▌লাঙলের ব্যবহার: পাথর কিংবা হরিণের স্বাভাবিক শিং দিয়েই এই হাতিয়ারটি তৈরি হতো। কিন্তু একই জমিতে বছরের পর বছর বেশি পরিমাণ ফসল পাবার জন্যে শিগগিরই দরকার হলো এমন একটি হাতিয়ারের যা দিয়ে একটু বেশি গভীর করে মাটি খোঁড়া যায়। কাজেই মানুষকে মাথা খাটাতে হলো এমন একটি হাতিয়ার বের করার জন্য, যা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে কম সময়ে বেশি জমি বেশি গভীরভাবে চষে ফেলা যায়। মিসরবাসীদের মধ্যে আদিম লাঙলের যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তা এই রকমই। ষাঁড়, গাধা, খচ্চরÑ প্রভৃতি কয়েকটি পশুর শক্তিকে এখন সে নিজের খাটুনি লাঘব করার কাজে লাগাতে শুরু করল। লাঙল এই পশুগুলোকে যুতে দিয়ে, লাঙল চষার হাড়ভাঙা খাটুনিকে মানুষ এদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো। ফলে চাষের কাজ হয়ে উঠলো অনেক সহজ। মানুষের চেয়ে গাধা, খচ্চর বা ঘোড়ার দীর্ঘপথ চলবার ক্ষমতা যেমন বেশি, তেমন ভারী জিনিস বইবার ক্ষমতাও বেশি। মাল বইবার কাজ মানুষ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে করে এসেছে; কিন্তু এ কাজটাও সে শিগগিরই পশুর কাঁধে চাপিয়ে দিল।
তথ্য-৬৪ ▌ চাকার আবিষ্কার: মাল বইবার কাজটাকে সে আরো বেশি সহজ, আরো বেশি দ্রুত করে তোলার জন্যে চেষ্টা করতে লাগল। আর এই চেষ্টার ফলে সে এমন একটা জিনিস আবিষ্কার করল যায় ফলে দূর-দূরান্তে নিদারুণ ভারী ভারী জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়াও তার কাছে খুব সহজ হয়ে এলো। এই আবিষ্কারটি হলো চাকার আবিষ্কার। চাকার আবিষ্কার মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে একটা প্রকা- বড় ঘটনা। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের তিন হাজার পাঁচশ বছর আগেই চাকার ব্যবহার চালু হয়েছিল। সিন্ধু-উপত্যকার গ্রামবাসীরা এখনো যে ধরনের চাকা-গাড়ি ব্যবহার করে, পাঁচ হাজার বছর কেটে গেলেও সেগুলো ওই আদিম চাকা-গাড়িরই প্রায় হুবহু সংস্করণ। সে যুগের মানুষের রোজকার জীবনে খুব দরকারি জিনিস ছিল মাটির ঘটি, বাটি, থালা। কিন্তু চাকা আবিষ্কার হবার পর এর মধ্যেও একটা বিপ্লব এসে গেল। ফলে আগের তুলনায় অনেক কম সময়ে একশ’গুণ বেশি পাত্র অনেক ভালোভাবে তৈরি করা সম্ভব হলো। খ্রিষ্টের জন্মের সাড়ে তিন হাজার বছর আগেই প্রায় সর্বত্রই মাটির জিনিস তৈরি করার কাজে চাকার ব্যবহার হয়েছিল।
তথ্য-৬৫ ▌ নৌকার পালের ব্যবহার: স্থলপথে মাল বইবার কাজে মানুষ যেমন পশুশক্তিকে ব্যবহার করতে শিখেছিল, তেমনি জরপথেও সে আরেকটা প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগাল। এটা হলো বাতাসের বেগ। বাতাসের গতি-প্রকৃতি ভালোভাবে বুঝে নিয়ে, সেই অনুসারে নৌকাতে পাল লাগিয়ে নদী-বা-সমুদ্র পথে যাতায়াতের ব্যাপারটা মানুষ অনেক সহজ এবং দ্রুত করে তুলল। পুরনো পাথরের যুগের একেবারে শুরুর দিকেও মানুষ ডিঙি বা ভেলা তৈরি করে নদী পারাপার করত। কিন্তু নৌকায় পাল-লাগানোর রেওয়াজ শুরু হয় নতুন পাথরের যুগেই। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগেই পাল-তোলা নৌকা চালু হয়েছিল। প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা তো প্রায় একশ ফুট লম্বা প্রকা- নৌকাতে পাল লাগিয়ে মহাসমুদ্রে হাজার হাজার মাইল পর্যন্ত পাড়ি দিত। আগে লোকে হিসাব রাখত দড়িতে গিঁট দিয়ে লাঠিতে দাগ কেটে, লিখতে শেখার আগে আদিম মানুষ এইভাবে ঘটনা মনে রাখত।
তথ্য-৬৬ ▌ চাঁদ-তারার হিসাব-নিকাশ: বহু আগে থেকেই মানুষ চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব করে মাস-বছরের হিসাব করতো। এতে ৩০ দিনে মাস এবং ৩৬০ দিনে বছরের হিসাব করত। কিন্তু ক্রমশ এই ব্যবস্থার অসুবিধা বুঝতে মানুষের দেরি হলো না। নীল নদের উৎসে আবিসিনিয়ার পাহাড় চূড়ায় প্রবল বৃষ্টি আসত, সেই বর্ষার নীল নদ ফেঁপে-ফুলে উঠে, আসে বন্যা। বন্যার দিনটিতে ভোরবেলায় আকাশে শেষ তারা হিসাবে দেখা দেয় একটি তারা। মিসরীরা এর নাম দিয়েছিল ‘সোথিস্’। এখন ইউরোপ-আমেরিকার এটি ‘সিরিয়াস’ নামে পরিচিত আমরা বলি ‘লুব্ধক’, সে দিন থেকে দিন গুনে গুনে আবার শেষ তারা হিসাবে লুব্ধক। সুতরাং বছরে যে দিন ভোরের আকাশে শেষ তারা হিসাবে লুব্ধক দেখা দেবে, সেটাই হলো বছরের হিসাব; তা হলেই সঠিকভাবে বলে দেওয়া যায় যে, নীল নদের বন্যা কবে আসবে। হিসাব করে দেখা গেল ঠিক ৩৬৫ দিন পর পর লুব্ধক ভোরের আকাশে শেষ তারা হিসাবে একবার মাত্র দেখা দেয়। কাজেই ৩৬৫ দিনের বছর হিসাব হয়ে গেল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের এটি প্রধান আবিষ্কার।
তথ্য-৬৭ ▌ গ্রীক সভ্যতা: প্রাচীন গ্রীস কোনো অখন্ড রাষ্ট্র ছিল না। এটা ছিল মূলত অসংখ্য নগর রাষ্ট্রের সমষ্টি। নদীনালা গ্রীসে নেই বললেই চলে। নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সর্বপ্রধান দুটি হচ্ছে ¯পার্টা এবং এথেন্স । এথেন্স ছিল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল এবং উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী, আর ¯পার্টা ছিল অভিজাততান্ত্রিক, রক্ষণশীল, পশ্চাৎমুখী এবং অনুন্নত সংস্কৃতির অধিকারী। ¯পার্টানদের আগমন ঘটেছিল আক্রমণকারী হিসেবে। স্থানীয় একিয়ান (মাইসিনীয়) অধিবাসীদের চূড়ান্তভাবে পরাস্থ করতে তাদের কয়েকশত বছর যুদ্ধ করতে হয়েছিল, ততদিনে সামরিক অভ্যাস হয়েছিল তাদের মজ্জাগত। ¯পার্টানদের জীবনের সমস্ত দিক তাদের সামরিক প্রয়োজন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। অন্যদিকে ‘এথেন্স’ নগর রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল গ্রীসের এটিকা নামক স্থানে এক পার্বত্য এবং অনুর্বর ভূমিতে। এথেন্সের নাগরিক সমাজ ছিল চার ভাগে বিভক্ত । প্রথম শ্রেণিতে ছিল ধনী অভিজাত শ্রেণির লোক। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল কৃষক, বণিক, নাবিক, কারিগর ও ব্যবসায়ী প্রমুখ। তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল অন্য দেশ হতে আগত জনগণ। চতুর্থ শ্রেণিতে ছিল দাস। এথেন্সে বহুসংখ্যক দাস ছিল।
তথ্য-৬৮ ▌ গ্রিক দার্শনিক : প্রাচীন গ্রিস গোটা পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে। যেমন গণতন্ত্র। গ্রিসের চিকিৎসা দেবতা এস্কে¬পিওসের লাঠিতে সাপ পেঁচিয়ে আছে; চিকিৎসা বোঝাতে এই প্রতীকই ব্যবহার করছে সারা বিশ্ব। শুধু চিকিৎসা আর গণতন্ত্রই নয়, গ্রিস আমাদেরকে প্রথম ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসকে দিয়েছে, প্রথম গণিতজ্ঞ দিয়েছেÑ থালিস, পিথাগোরাস। প্রথম দার্শনিক দিয়েছেÑ সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল। প্রথম চিকিৎসাবিদ হিপোক্রেটকে দিয়েছে। বিচার ব্যবস্থায় জুরির শুনানি দিয়েছে। প্রথম থিয়েটার দিয়েছে। অলিম্পিক গেইম দিয়েছে। মেকানিক্যাল অডোমিটার দিয়েছে। স্থাপত্যশিল্প দিয়েছে। গ্রিক পুরাণের শিক্ষণীয় গল্প দিয়েছে। আরও কতশত কিছু দিয়েছে। উৎস যেহেতু গ্রিস, তাই গ্রিসের পুরাণ গ্রিসের ভাস্কর্য আসে। এটার অর্থ ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধারণ করে পথচলা। প্রাচীন গ্রিসের পুরাণে বিভিন্ন দেবদেবীর কল্পনা করা হয়েছিল। কেউ যুদ্ধের, কেউ শান্তির, কেউ সমৃদ্ধির, কেউবা সৌন্দর্যের ইত্যাদি। ন্যায়বিচারের জন্যও গ্রিকরা একজন দেবীর কল্পনা করেছিল। দেবীর নাম দিয়েছিল থেমিস।
তথ্য-৬৯ ▌প্রাচীন গ্রিস ও পৃথিবীর ধারণা : থেলিসকে বলা হয় বিজ্ঞানের জনক। অনেকে আবার তাকে গণিত ও জ্যামিতির জনকও বলেন। মোট কথা তিনিই প্রথম পৌরাণিক গল্পের স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে, বিশুদ্ধ চিন্তা ও গাণিতিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে স্বর্গের কাহিনী বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। ওদিকে গণিতকে প্রথমবারের মতো একটা বিপ্লবে রূপ দিতে পেরেছিলেন পিথাগোরাস। পথাগোরাসের এক শিষ্য ছিল ফিলোলাউস। এই ফিলোলাউস-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে বিদায় করেন। পিথাগোরাসের মৃত্যুর ৪২৪ অব্দ পর প্লেটোর জন্ম হয়, কিন্তু চিন্তা-চেতনায় তিনি পিথাগোরাসের খুব কাছাকাছি ছিলেন। প্লেটোর ছাত্র ছিলেন এরিস্টটল। এরিস্টটল কিন্তু গুরুর সব কথার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তবে এরিস্টটলই প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন এবং বুঝতে পারেন পৃথিবী একটা গোলক। তিনি সম্ভবত খেয়াল করেছিলেন জাহাজ যখন বন্দর ছেড়ে যেতে থাকে, তখন তার পালের আগা সবার পরে অদৃশ্য হয়। এই এরিস্টটলই ছাত্র ছিলেন গ্রিক বীর আলেকজান্ডার।
তথ্য-৭০ ▌থেলিস থেকে প্লেটো: দার্শনিক থেলিস সর্বপ্রথম(৫৮৫ খ্রীঃপূর্বঃ ) সূর্যগ্রহণ স¤পর্কে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, মানুষের পাপের কারণে সূর্য গ্রহণ হয় বলে ধারণা প্রচলিত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক কারণেই সূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়ে থাকে। থেলিস ছিলেন প্রাক সক্রেটিস যুগের প্রধান দার্শনিক। থেলিসের অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যান তারই শিষ্য অ্যানাক্সিমানদার। মানুষের উৎপত্তি ও বিকাশ স¤পর্কিত চিন্তার ক্ষেত্রে গ্রীসে একশ্রেণির যুক্তিবাদী দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে, যারা সফিস্ট নামে পরিচিত। সফিস্ট চিন্তাবিদগণ ছিলেন যে কোনো বক্তব্য প্রমাণ সাপেক্ষে গ্রহণের পক্ষে। এভাবে তারা চিন্তা চর্চার ক্ষেত্রে গ্রীসে এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন। সক্রেটিস ছিলেন সফিস্ট চিন্তার অনুসারী। ৪৬৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে তার জন্ম। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে ভাল মন্দ অথবা ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিষয়ে জানা ও বোঝার চেষ্টা করাই ছিল সক্রেটিসের শিক্ষার প্রকৃত পদ্ধতি। প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের ছাত্র। বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিসের মৃত্যুর প্রায় দুই বৎসর পর প্লেটো জন্মগ্রহণ করেন।
তথ্য-৭১ ▌ এথেন্স ও সক্রেটিস : মহাকবি হোমার, বিখ্যাত বীর আলেকজান্ডার, দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো, ইতিহাসবিদ হেরডেটাস, পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড হিপোক্রেটস, এপেলেসের মতো গ্রিসের আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান,সভ্যতা ও ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। প্রাচীন গ্রিসের সূচনা ধরা হয় ৭৭৬ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে অলি¤িপক গেমস-এর আয়োজনের মধ্য দিয়ে, আর পরিসমাপ্তি ধরা হয় ৩২৩ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে মহামতি আলেকজেন্ডরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। সক্রেটিস ছিলেন এক দরিদ্র নিরক্ষর ব্যক্তি, যিনি বাস করতেন গ্রিসের অ্যাথেন্সে। তিনি ছিলেন এক ভালো যোদ্ধা। তবে তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিল বিস্ময়কর। সক্রেটিস এথেন্সের বাজারে এলোমেলোভাবে ঘোরাফেরা করতেন, যেদিকে যেতেন যেন হেমিলনের বাঁশিওয়ালা, পেছনে যুবকদের সারি। অ্যাথেন্সের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি অসহ্য ঠেকল। তারা সক্রেটিসের বিরুদ্ধে দেবতাদের প্রশ্নবিদ্ধ করা দিয়ে তরুণদের নষ্ট করার অভিযোগে মৃত্যুদ- প্রদান করলেন।
তথ্য-৭২ ▌ সক্রেটিসের“ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট”: একদিন একজন লোক সক্রেটিসের কাছে এসে বলল, সক্রেটিস, তুমি কি জানো এইমাত্র আমি তোমার বন্ধুর ব্যাপারে কি শুনে আসলাম? সক্রেটিস বলল, ঘটনাটি বলার আগে আমি তোমাকে তিনটি প্রশ্ন করবো। আমি এর নাম দিয়েছি “ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট”। প্রথম প্রশ্নটি সত্য মিথ্যা নিয়ে, তুমি কি নিশ্চিত তুমি আমাকে যা বলতে যাচ্ছ তা নির্ভেজাল সত্য? লোকটি উত্তর দিল, না, আমি জানি না এটা সত্য কিনা, আসলে আমি একজনের কাছে শুনেছি। ঠিক আছে, সক্রেটিস আবার বলল, এখন আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি কি আমার বন্ধু সম্বন্ধে ভালো কিছু বলবে? -উম, নাহ, আসলে খারাপ কিছুই...! এবার তৃতীয় প্রশ্নটি হলো, তুমি আমাকে যা বলতে যাচ্ছ তা কি আমার জন্য উপকারী?' লোকটি উত্তর দিল, না, তোমার উপকার হবে না। এবার সক্রেটিস শেষ কথাটি বললো, তুমি আমাকে যা বলতে চাও তা সত্যও নয়, ভাল কিছুও নয় এবং আমার জন্য উপকারীও না, তাহলে তা আমাকে বলে কি লাভ! শিক্ষা: কোন মিথ্যা যা জেনে আপনার লাভ হবার কোনও সম্ভাবনা নেই, এমন তথ্য চারদিকে ছড়িয়েই কি লাভ?
তথ্য-৭৩ ▌ প্রচীন গ্রিসের অবদান: প্রাচীন গ্রিস গোটা পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে। যেমন গণতন্ত্র। আর এই গণতন্ত্রের ভিত্তিতেই আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। গ্রিসের চিকিৎসা দেবতা এস্কে¬পিওসের লাঠিতে সাপ পেঁচিয়ে আছে- চিকিৎসাবিজ্ঞান বোঝাতে এই প্রতীকই ব্যবহার করছে সারা বিশ্ব। গ্রিস আমাদেরকে প্রথম ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসকে দিয়েছে। এই গ্রিস আমাদের প্রথম গণিতজ্ঞ দিয়েছেÑ থালিস, পিথাগোরাস। প্রথম দার্শনিক দিয়েছেÑ সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল। প্রথম চিকিৎসাবিদ হিপোক্রেটকে দিয়েছে। বিচার ব্যবস্থায় জুরির শুনানি দিয়েছে। প্রথম থিয়েটার দিয়েছে। অলিম্পিক গেইম দিয়েছে। মেকানিক্যাল অডোমিটার দিয়েছে। গ্রিক পুরাণের শিক্ষণীয় গল্প দিয়েছে। এদেশে জন্ম নিয়েছেন মহাকবি হোমার, এখানেই ভূমিষ্ঠ হয়েছন স্থাপত্য-ভাস্কর্যের অবিস্মরনীয় দিকপাল ইকটিনাস ও ফিডিয়াস, রাজনীতি মঞ্চের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কৌশলী থেমিস, টকলস, এরিস্টাইডিস ও পেরিক্লিস, সাহিত্যের অনির্বাণ জ্যোতিষ্ক সফোক্লিস, এরিস্টোফেলেস, ইউর্পিাইডিস প্রমুখ। আরও কতশত কিছু দিয়েছে।
তথ্য-৭৪ ▌ প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞানচর্চা': প্রাচীন গ্রিসের সূচনা ধরা হয় ৭৭৬ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে অলিম্পিক গেমস-এর আয়োজনের মধ্য দিয়ে এবং পরিসমাপ্তি ধরা হয় ৩২৩ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এই প্রাচীন গ্রিসকেই আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তিভূমি বলা হয়। খ্রিস্ট-পূর্ব ১৪৬-তে করিন্থের যুদ্ধের পর রোমান শাসনের অধীনে আসে গ্রিস। তখন গ্রিক সংস্কৃতি প্রচ- রকম প্রভাব ফেলে রোমান সভ্যতার উপর, যা ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে আধুনিক পৃথিবীর ভাষা, রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, দর্শন, শিল্পকলা এবং স্থাপত্যের উপর প্রাচীন গ্রিকের প্রভাব বেড়ে যায়। গ্রিকদের সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে থেলিসের নাম, যাকে বলা হয় বিজ্ঞানের জনক। তিনিই প্রথম পৌরাণিক ধর্মের স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে, বিশুদ্ধ চিন্তা ও গাণিতিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে স্বর্গের কাহিনী বোঝার চেষ্টা করেছিলেন।
তথ্য-৭৫ ▌এরিস্টটল ও আলেকজান্ডার: দার্শনিক সক্রেটিসের ছাত্র প্লেটোর জীবনের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সক্রেটিসের আদর্শকে যথার্থ বলে প্রমাণ করা। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন রাজনীতিতে সক্রেটিসের মত জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রয়োজন সবচাইতে বেশি। প্লেটোর ছাত্র ছিলেন এরিস্টটল। এরিস্টটল কিন্তু গুরুর সব কথার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তবে এরিস্টটলই প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন এবং বুঝতে পারেন পৃথিবী একটা গোলক। তিনি সম্ভবত খেয়াল করেছিলেন জাহাজ যখন বন্দর ছেড়ে যেতে থাকে, তখন তার পালের আগা সবার পরে অদৃশ্য হয়। এই এরিস্টটলই ছাত্র ছিলেন আলেকজান্ডারের। ৩৩২ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার মিসর দখল করেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য তিন সৈন্যাধ্যক্ষের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। সাম্রাজ্যের আফ্রিকান অংশ মিশর,Ñতার অধিকর্তা হন সেনাধ্যক্ষ টলেমি। এই টলেমি বংশের রাজারা, যারা ইতিহাসে ফারাও (রাজা) নামে অভিহিত, তাদের অধীনেই থাকে জেরুজালেম। রোমানরা জেরুজালেম দখল করে খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে। ইহুদিরা রোমান শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। সম্রাট ডেসপাসিয়ানের সৈন্যরা জেরুজালেম প্রায় পুরোটাই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ দাঁড়িয়ে থাকে। যা এখন ডধরষষরহম ডধষষ বা বিলাপ প্রাচীর নামে পরিচিত। ইহুদি ধার্মীকরা এই দেয়ালে প্রার্থনা করে।
তথ্য-৭৬ ▌প্লেটোর গুহার রূপক: মানুষের ধর্মবিশ্বসকে একটি গুহায় বন্ধীদের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন প্লেটো। “কিছু বন্ধী তাদের সমগ্র জীবন শিকলে আটকা পড়ে আছে। কোন পাহাড়ের নির্জন গুহার অন্ধকার দিকে ওদেরকে বন্দি করে রাখা হয় অজস্র বছর ধরে। ঠিক যখন ওরা অনেক ছোট ছিল সেই সময়টা থেকে। ওদের হাত পেছন দিক থেকে শিকলে দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। আর তাই ওরা দেখতে পাচ্ছে না, ওদের পেছনের প্রজ্বলিত অগ্নিকু- (যা ওদের সামনের গুহার দেয়ালটিতে আলো ফেলেছে) গুহায় প্রবেশ ও বাহিরের আঁকাবাঁকা একটি রাস্তা। প্রতিদিন গুহার দেয়ালের আলোতে দুর্বোধ্য আওয়াজ তুলতে তুলতে ওরা কিছু ছায়াকে চলে যেতে দেখে। আসলে প্রতিদিন গ্রামের লোকেরা এই পথ দিয়েই কাজকর্মের শেষে নিজেদের কথাবর্তা বলতে বলতে ঘরে ফেরে। এখন যদি হঠাৎ একদিন কোনো আগন্তুক এসে ঐ বন্দিদের মধ্য থেকে একজনকে টেনে-হিঁচড়ে গুহার বাইরে এনে তাকে বাস্তব জগৎ দেখায়, তবে সে একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা লাভ করবে, সে যখন বুঝতে পারবে যে, ছায়া এবং প্রতিধ্বনিগুলো আসলে কি ছিল। এবার সে এ সত্যটি স¤পর্কে জানাতে তার পুরাতন বন্ধুদের কাছে ফিরে যাবে? কিন্তু গুহার অন্য বন্দিরা তাদের এই পুরাতন সাথীটির কথা বিশ্বাস করবে কি? কারণ, তাদের কাছে বিশাল বিশাল ছায়াগুলো হচ্ছে-দৈত্য আর ঈশ্বর। জন্ম থেকে যা দেখে আসছে, যা শুনে আসছে, যা কল্পনা করে আসছে, ওদের কাছে তা-ই সত্য।”
তথ্য-৭৭ ▌ জ্ঞানের জন্য অন্ধকার যুগ: খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীরা প্লেটো, এরিস্টটল এবং টলেমির মতবাদ পুরোপুরি গ্রহণ করে। এই তিনজন পরিণত হন খ্রিস্টান চার্চ শাসিত পশ্চিমা বিশ্বের তিন পথপ্রদর্শকে। 'এরিস্টটলের পরবর্তী সময়কে বলা হয় জ্ঞানের জন্য অন্ধকার যুগ। এরিস্টটল এতই বড় হয়ে উঠেছিলেন যে, তার সমালোচনা বা তার চাইতে অধিক জ্ঞান অর্জনকে ধর্মবিরোধী বা বিজ্ঞানবিরোধী বলা শুরু হয়ে গেল। যার ফলে পৃথিবী আর আগাল না, থমকে গেল জ্ঞান-বিজ্ঞান। যখনই নতুন কোনো চিন্তা আসল, সবাই এরিস্টটলের তত্ত্বের সঙ্গে তা মেলে কিনা হিসাব করতে বসে গেল। মিলে গেলে ভালো কথা, কিন্তু যখনই এরিস্টটলের তত্ত্বে¡র সঙ্গে কোনো তত্ত্ব¡ বিন্দুমাত্র দ্বিমত পোষণ করল, তার আর রক্ষা নাই, তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হলো বা পুড়িয়ে মারা হলো। যেমনÑ কোপানির্কাস, গ্যালিলিও, ব্রনো আরো অনেকে। এভাবে প্রায় দেড় হাজার বছর এরিস্টটলের ভূত মানুষের মাথায় ভর করেছিল। এরিস্টটল না জন্মালেই হয়তো জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষ আরও অনেক এগিয়ে যেত।
তথ্য-৭৮ ▌ আলেকজান্দ্রিয়া: ৩৩২ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার যখন মিসর দখল করেন। তখন মিসরের ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে আলেকজান্ডার ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ উপকূলে একটা শহর তৈরি করেন, শহরটার নাম হয় আলেকজান্দ্রিয়া। তার মৃত্যুর পর তার সেনাপতি টলেমি আলেকজান্দ্রিয়ায় থেকে মিসর শাসন করতে থাকে। টলেমি রাজবংশের শাসনামলে প্রায় ৩০০ বছর আলেকজান্দ্রিয়া গোটা পৃথিবীর বুদ্ধিবৃত্তিক রাজধানী ছিল। মজার ব্যাপার হলোÑ এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের প্রথম গ্রন্থাগার। তখন লেখা হতো প্যাপিরাস পাতায়, প্রায় ১০ লক্ষ প্যাপিরাস স্ক্রল ছিল এই গ্রন্থাগারে যার সবগুলোই আজ হারিয়ে গেছে। এক সময় আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ছিলেন ভূগোলের জনক এরাটোস্থেনিস। তিনিই প্রথম পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করেছিলেন ৪০,০০০ কিলোমিটার, যা আসল মানের খুবই কাছাকাছি।
তথ্য-৭৯ ▌প্রাচীন ভারত: খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দশ লক্ষ(?) বছর আগে ভারত ভূখ-ে প্রথম মানববসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়। তবে ভারতের জ্ঞাত ইতিহাস বলতে ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ ও প্রসারকে বুঝানো হয়। পরবর্তী হরপ্পা যুগের সময়কাল ২৬০০ - ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সূচনায় এই ব্রোঞ্জযুগীয় সভ্যতার পতন ঘটে। সূচনা হয় লৌহনির্ভর বৈদিক যুগের। এই যুগেই সমগ্র গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে মহাজনপদ নামে পরিচিত ১৬টি প্রধান প্রধান রাজ্য তথা জনবসতির উত্থান ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে মগধে জন্মগ্রহণ করেন মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ; পরবর্তীকালে যাঁরা ভারতের জনসাধারণের মধ্যে শ্রমণ ধর্মদর্শন প্রচার করেন। পরবর্তীতেই একাধিক বৈদেশিক শাসনে আওতায় চলে আসে উত্তর-পূর্বের এই অঞ্চল। এগুলির মধ্যে ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হখামনি পারসিক সাম্রাজ্য ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের রাজত্বকাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তথ্য-৮০ ▌ভারতীয় সভ্যতা : যদি আমরা লিখন পদ্ধতি, ধাতুর কাজ, ও অ-কৃষিভিত্তিক নাগরিক বসতি স্থাপনকে সভ্যতার ন্যূনতম সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করি, তবে সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হল মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দ), এবং প্রায় কাছাকাছি সময়ের মিশরীয় সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের মধ্যেই সিন্ধু নদের উপত্যকায় এরকম আদি সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। চীনে তা ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের সময়। কিন্তু মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতাগুলি রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে এই এলাকাগুলি ইসলামের অধীনে আসে। ফলে এলাকাগুলির বর্তমান সভ্যতার সাথে প্রাচীন সুমেরীয় বা মিশরীয় সভ্যতার কোন মিল নেই। অন্যদিকে ভারতীয় সভ্যতা প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত মোটামুটি অবিকৃত রয়ে গেছে। ভারতীয় উপমহাদেশ পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমানে এলাকাটি পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমার রাষ্ট্রগুলিতে বিভক্ত।
তথ্য-৭৮১ ▌ভারতের সুবর্ণ যুগ: খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে স্থানীয় গুপ্ত রাজবংশ ক্ষমতায় আসে এবং মৌর্যদের হারানো সাম্রাজ্যের প্রায় পুরোটাই পুনরুদ্ধার করে। গুপ্তরা ৩য় শতক থেকে ৫ম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত উত্তর ভারত শাসন করে। এই সময় দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের মধ্যে বিভক্তি ছিল। এই যুগটি ছিল হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের কাল। ভারতের ইতিহাসে এই যুগ "ভারতের সুবর্ণ যুগ" নামে অভিহিত। এই সময়ই ভারতীয় সভ্যতা, প্রশাসন, সংস্কৃতি তথা হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। গুপ্তদের পর হর্ষবর্ধন সামান্য সময়ের জন্য উত্তর ভারত শাসন করেন (৬ষ্ট শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত)। এরপর আবার গোটা ভারত বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যের এক জটিল সহাবস্থানমূলক ব্যবস্থায় ফেরত যায়। তবে এই সমস্ত রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মাঝেও ভারতীয় সভ্যতার মূল উপাদানগুলি অবিচ্ছিন্নভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত সঞ্চারিত হয়ে এসেছে।
তথ্য-৮২ ▌তক্ষশীলা: তক্ষশীলার সূচনা কম করে হলেও সম্ভবত খিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে। ৫ম শতাব্দীর দিকে শ্রীলংকায় লিখিত জাতক কাহিনীতেও তক্ষশীলার বর্ণনা আছে। তক্ষশীলার অবস্থান পাকিস্তানের ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির মাঝামাঝি। প্রাচীন তক্ষশীলা শহর ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, কালক্রমে তক্ষশীলা বৌদ্ধদের বিহার ও শিক্ষাকেন্দ্রে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। বৌদ্ধ রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে, হিন্দু রাজারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তশালী হয়ে উঠে। এসময় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্ব হারায়। প্রায় ১০ হাজার ছাত্রের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি হতো ১৬ বৎসর বয়সে। এই সময় এরা বেদ অধ্যয়ন করতো। ১৮ বৎসর বয়স থেকে ছাত্রদের শেখানো হতো শিল্পকলা, তীর নিক্ষেপ, শিকার, আইন, চিকিৎসা এবং সমরবিদ্যা। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রগুলো ছিল- বেদ, ভাষা, ব্যাকরণ, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র (আয়ুর্বেদ), ধনুর্বিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, জ্যোতিঃশাস্ত্র, হিসাব বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, সঙ্গীত ও হস্তশিল্প।
তথ্য-৮৩ ▌নালন্দা: নালন্দা ভারতের বিহারের রাজধানী পাটনার কাছে। ঐতিহাসিকদের মতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে। খ্রিষ্টীয় ৪২৭ অব্দ থেকে ১১৯৭ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে নালন্দা ছিল একটি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র। বিশেষজ্ঞরা এই মহাবিহারকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম বলে মনে করেন। ঐতিহাসিকদের মতে গুপ্ত সম্রাট শক্রাদিত্যের রাজত্বকালে নালন্দা মহাবিহারের বিকাশলাভ ঘটে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন এবং পাল সম্রাটগণও এই মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন। তৎকালীন জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই চর্চার সুযোগ থাকায় সুদূর কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য এবং তুরস্ক থেকে জ্ঞান পিপাসুরা এখানে আসতেন। নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে পূর্বভারতের বৌদ্ধধর্মে তান্ত্রিক রীতিনীতির আবির্ভাব ঘটলে এই মহাবিহারও ধীরে ধীরে পতনের পথে ধাবিত হয়।
তথ্য-৮৪ ▌ভারতীয় দর্শন : প্রাচীনতম ভারতীয় সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক কপিল মুনি। এ দর্শনের উদ্ভবকাল গৌতম বুদ্ধের পূর্বে খ্রি.পূ অষ্টম শততে বলে স্বীকৃত। ভারতীয় দর্শনের প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: আস্তিক্য এবং নাস্তিক্য দর্শন। আস্তিক শাখায় রয়েছে ৬টি দর্শন, যাদেরকে আস্তিক ষড়দর্শন বলা হয়, যথা- ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা এবং বেদান্ত দর্শন। আর নাস্তিক ধারার মধ্যে রয়েছে- বৌদ্ধ, জৈন এবং চার্বাক দর্শন। ভারতীয় দর্শনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত চার্বাক দর্শন। পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখ ভোগই মানুষের একমাত্র কাম্য বলে চার্বাকরা মনে করত। একমাত্র চার্বাক বাদে বাকি সব ভারতীয় দর্শন তিনটি মৌলিক দার্শনিক চিন্তা নিয়ে কথা বলে: আত্মা, কর্ম এবং মোক্ষ। এর মধ্যে কেবল আত্মার ধারণাটিই পুরোপুরি এবং অনন্যভাবে ভারতীয়। চার্বাকদের মত: যেহেতু ঈশ্বর প্রত্যক্ষযোগ্য নন, সেহেতু তাঁর কোনো অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে মানুষের দুঃখমোচনই বৌদ্ধদর্শনের একমাত্র লক্ষ্য। আর জৈনরা দ্বৈতবাদে বিশ্বাসী।
তথ্য-৮৫ ▌বলি প্রথা : অনেক অনেক আগের কথা, মানুষ তখন সবে বনে-জণ›গল-গুহা ছেড়ে বসতি গড়তে শিখেছে, ভাব প্রকাশের জন্য কিছু ইশারা-ইংগিতকে সংহত করে নিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি বড় নির্মম - কখনো আকাশ এফোঁড়-ওফোঁড় করে বিদ্যুত চমকায় ঝড় আসে। কখনো দাবানল পুড়িয়ে দেয় বনানী, আবার কখনো রোগ-বালাই মহামারীর আকারে এসে উজার করে দেয় গোত্রের পর গোত্র। এ সবে ভীত হয়ে মানুষ পুজা করে সমুদ্র, সূর্য-চন্দ্র-বৃক্ষ -পর্বত সাপ-বাঘ-কুমীর প্রভৃতি শত শত দেব-দেবীর। তারপরেও বিপদ কি যায় না। তখন মানুষ ভাবে প্রভূর মন ভরেনি - প্রভু বলি চান। শুরু হয় বলি দেয়া, ভোগ দেয়া। একসময় চালু হয় মানুষ বলির সংস্কৃতি। ধীরে ধীরে মানুষ সভ্য হতে থাকে, বদল হতে থাকে বলির ধরন - মানুষের বদলে পশু-পাখী। ইসলামী প্রেক্ষাপটে ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে পশু জবাইকে দাবিহা বলা হয়। দাবিহা হচ্ছে দরিদ্রদের সংগে সমৃদ্ধশালীদের সৌভাগ্য শেয়ার করা। কুরবান শব্দটির মূলত ইহুদি শব্দ। ইহুদি কুরবান কয়েকভাগে বিভক্ত। হোমবলিতে সমগ্র প্রাণীটিকে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
তথ্য-৮৬ ▌ পশু বলি ও নেপাল : নেপালের ছোট্ট গ্রাম বারিয়াপুর পশু বলিতে বিশ্বসেরা। দেবতার মন জয় করতে এখানে চার লাখ পশু বলি দিচ্ছেন পূজারিরা। গাধিমাই মেলায় দু'দিনব্যাপী এই পশু বলি হয়। নেপাল ও ভারতের প্রায় অর্ধ কোটি হিন্দুধর্মাবলম্বী এতে যোগ দেন। নেপালের বারা জেলার বারিয়ারপুরে গাধিমাই দেবীর মন্দিরসংলগ্ন বিশাল মাঠে এই মেলা বসে। ভারতের বিহার রাজ্যের সীমান্তবর্তী ওই নেপালি মন্দিরে নেপালিদের পাশাপাশি ভিড় জমায় ভারতীয়রাও। মন্দিরে শূকরছানা, ঘুঘু, হাঁস-মুরগি আর ইঁদুর এই পাঁচ প্রাণীর সমন্বয়ে হয় পঞ্চবলি। এরপর শুরু হয় মহিষ বলি। এর বেশির ভাগই বাছুর। মন্দিরের আশপাশের গ্রামের মানুষ সাধ্য অনুযায়ী নিজেদের বাড়িতেই ছাগল, মুরগি, হাঁস, ঘুঘু আর ইঁদুর বলি দেন। গাধিমাই মন্দিরের আশপাশের বিভিন্ন হাটে কয়েক লাখ মহিষ- ছাগল বিক্রি হয়। ধর্মের মোড়কে এভাবে হাজার হাজার পশু মারা হয়। হয়তো শত শত বছর আগে এই প্রথার প্রাসঙ্গিকতা ছিল, আজ মানবিক হবার সময় হয়েছে।
তথ্য-৮৭ ▌ বৈদিক সভ্যতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদ: আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম বেদ। খ্রিষ্ট-পূর্ব ১,৫০০-১০০০ অব্দের মধ্যে বেদ রচনা করা হয়। বেদকে ভিত্তি করে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে তাই এর নাম বৈদিক সভ্যতা। সাধারণভাবে খ্রিষ্ট-পূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্ট-পূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত প্রায় ১০০০ বছরকে আমরা বৈদিক যুগ বলে থাকি। বৈদিক সভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। প্রথমে তারা যাযাবর জীবন-যাপন করত। পশুপালন ছিল তাদের প্রধান উপজীবিকা। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ও যাযাবর বৃত্তি পরিত্যাগ করে কৃষিকার্যকে উপজীবিকা হিসেবে গ্রহণ করার পর তারা পূর্ব দিকে গঙ্গা-যমুনা বিধৌত অঞ্চলে বন কেটে বসতি স্থাপন করে। এইভাবে বৈদিক যুগের শেষে তারা বিহার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বৈদিক যুগে বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম ছিল গরু। আর্য সমাজ প্রথমে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল যোদ্ধা বা অভিজাত, পুরোহিত ও সাধারণ মানুষ। অনার্য দাসদের গায়ের রং ছিল কালো, আর আর্যদের ফর্সা। আর্যদের প্রধান ভাষা ছিল সংস্কৃত। আর্য যোদ্ধা বা অভিজাত (ক্ষত্রিয়), ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) ও বৈশ্য (বণিক) ছিল দ্বিজ। দাসদের বলা হতো শূদ্র।
তথ্য-৮৮ ▌ আর্য দ্রাবিড় মিশ্র সংস্কৃতি: নগর গড়ে তোলার জন্য পানির সরবরাহ অনিবার্য। সে কারণেই, আর্যরা গঙ্গার তীরে নগর নির্মাণ করে। এর ফলে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যেই পশ্চিমের কাশ্মীর থেকে পূর্বের বিহার (প্রাচীন মগধ) অবধি উত্তর ভারতে সব মিলিয়ে ষোলটি বৃহৎ নগর গড়ে ওঠে। ভারতবর্ষে আগমনের এক হাজার বছরের মধ্যেই আর্যরা তাদের উন্নত ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষার প্রভাবে স্থানীয় অনার্য দ্রাবিড় ভাষা অপসারিত করে। কিন্তু উত্তর ভারতের অধিকাংশ জনগণই ছিল অনার্য দ্রাবিড়। কাজেই দ্রাবিড়দের জীবনধারার মাধ্যমে আর্যরা প্রভাবিত হতে থাকে। এভাবে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। যে সংস্কৃতিকে বলা হয়: ‘আর্যদ্রাবিড় মিশ্র সংস্কৃতি’। আর্যদ্রাবিড় মিশ্র সংস্কৃতিতে ধর্মীয় ভাবনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। যেমনÑ ওই সময় ভারতবর্ষের অধিবাসীদের মন থেকে অধিকাংশ বৈদিক দেবতারা সমাজে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরকে নিয়ে ‘ত্রিমূর্তি’ ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। এই মহেশ্বরই হলেন অনার্য দেবতা শিব। যিনি পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতার আসন লাভ করেন। আর্যরা অনার্য দ্রাবিড় জাতির প্রধানতম দেবতা শিবকে গ্রহণ করেছিল।
তথ্য-৮৯ ▌ বাংলার প্রাচীনতম জাতি: সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের দেহে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর রক্তধারার সংমিশ্রণ ঘটেছিল বলেই কালক্রমে বাঙালি একটি বর্ণশঙ্কর জাতিতে পরিণত হয়েছে। সেজন্য বাঙালিদের মধ্যে আর্য-সুলভ গৌড়বর্ণ যেমন দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি নিগ্রোয়েড-সুলভ মোটা কোঁকড়া চুল ও পুরু ঠোঁটও দেখা যায়। প্রাচীন বাংলায় অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় ছাড়াও আরো একটি জাতি ছিল। এরা কিরাত নামে পরিচিত। কিরাতরা ছিল মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর মানুষ। আর্যরা তাদের বৈদিক সাহিত্যে অস্ট্রিক ও কিরাতদের অনেকটা ঘৃণাসূচক ‘নিষাদ’ বলে অবহিত করেছিল। কিরাতগণ অরণ্যক জীবন-যাপন করলেও (আজও তারা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ে এক রকম অরণ্যক জীবন-যাপনই করছে) অস্ট্রিক ও কিরাতদের পর, দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠী প্রাচীন বাংলায় এসেছিল। আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগেই ভারতীয় উপমহাদেশ দ্রাবিড়-অধ্যুষিত ছিল। দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর আদি বাসভূমি ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। ‘নব্যপ্রস্তরযুগের এই দ্রাবিড় ভাষাভাষী লোকেরাই ভারতবর্ষের নগর সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা।’
তথ্য-৯০ ▌আর্য ও দ্রাবিড়: ভোরতের মুল জনগোষ্ঠি হলো আজকের তামিলরা এবং মুন্ডারা, যাদের গায়ের রঙ কালো, প্রশস্ত কপাল ও গায়ে গতরে বেশ শক্ত সামর্থ্যবান। আর যারা আজ ভারতবর্ষের ফর্সা কিংবা উন্নত নাসিকাসমৃদ্ধ মানুষ, তারা মূলত আর্যদের বংশদর। এই আর্যরা দলে দলে ভারতবর্ষের পাঞ্জাবে প্রথম প্রবেশ করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সাল পর্যন্ত। মূলত যাযাবর আর্যরা পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরবর্তী সময়ে আর্যরা কৃষিকাজকেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে একস্থানেই বসবাস শুরু করেন। হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতে আসা এই আর্যদের অত্যাচার, দখল, নির্যাতনে ভারতের স্থায়ী বাসিন্দা দ্রাবিড়রা আস্তে আস্তে দক্ষিণে সরে যায়। মুন্ডারা আশ্রয় নেয় দুর্গম পাহাড়ে। আর্যরা মূলত পারস্য থেকেই এসেছিল। আর্যরা সঙ্গে নিয়ে আসে ভাষা (সংস্কৃত), উন্নত যুদ্ধাস্ত্র, বর্ণভেদ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র)। নারীমূল্যকে এরা বহুগুণে হ্রাস করে দেয় ধর্মের কথা বলে।
তথ্য-৯১ ▌মনুসংহিতা : আর্যরা নিজেদের গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের কারণেই ভারতবর্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রবেশ করতে পারেনি। আর্যদের একটি ধারা বিনা যুদ্ধে এক প্রকার ভিনদেশী আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। এ ধারাটিকে বলা হয় আলপীয়। যদিও আর্যদের সাথে দীর্ঘকাল সহাবস্থানের ফলে খুব দ্রুত এদেশীয় দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক তাদের সাথে মিশে যায়। আর যে ধারাটি সশস্ত্র রূপ নিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে’ তাদের বলা হয় নর্ডিক। আলপীয়দের সাথে তাদের ব্যাপক পার্থক্যের সৃষ্টি হয়; চলন, বলন, অর্থনীতি সবক্ষেত্রে। ফলে আলপীয়রা তাদের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের ভাষাও দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বর্তমান বাংলা, মারাঠী, গুজরাটী আলপীয় আর্যগোষ্ঠীর ভাষা থেকে এসেছে। অন্যদিকে হিন্দী, রাজস্থানী প্রভৃতিতে নর্ডিক আর্যগোষ্ঠীর ভাষার বিবর্তন। ভারতবর্ষে বর্ণপ্রথার বীজ আর্যরাই রোপন করে, নি¤œবর্ণের জাতি, তফসিলি জাতি, দলিত সম্প্রদায় আর্যদের ঐ নিয়মেরই বহিঃপ্রকাশ। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার সকল কুসংস্কারের অন্যতম ভিত্তি আর্যদের তৈরি করা মনুসংহিতা।
তথ্য-৯২ ▌বং থেকে বঙ্গ : এই উপমহাদেশে আর্য অভিযানের পূর্বে অস্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত নিষাদ জাতি বাস করত। কিছু কিছু গবেষক মনে করেন, বং শব্দ থেকেই বঙ্গের উৎপত্তি। এই বং একটি চৈনিক শব্দ, যার অর্থ জলাশয় বা নদীমাতৃক এলাকা। এই ভু-অঞ্চলের আশপাশ নদীবেষ্টিত বলেই বংগ শব্দের উৎপত্তি। বহু ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে ‘বংগ’ শব্দটি থেকে ‘বংগদেশ’, ‘গৌড়ীয় বাংলা’, ‘বঙ্গীয় এলাকা’, ‘সুবে বাঙ্গাল’, ‘বঙ্গীয় ফোর্ট বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী, ‘পূর্ব বংগ’, পূর্ব পাকিস্তান’ এবং অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম। দ্রাবিডীয় সভ্যতার পর কেবল বুদ্ধদের সময়কাল, গৌড়ের পাল বংশের শাসনকাল, পাঠান সুলতান, বারো ভুঁইয়াদের সময় ছাড়া ১৯৭১এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো সময় ছিল বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের শাসনকাল। এর গোড়াপত্তন হয়েছিল যীশুর জন্মের কয়েক শতাব্দী পূর্বে বহিরাগত আর্য সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে।
তথ্য-৯৩ ▌চর্যাপদ : চর্যাপদ শুধু প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেরই নিদর্শন নয়, প্রাচীন বাংলা গানেরও নিদর্শন। এর প্রতিটি পদের শুরুতে রাগ-তাল ও প্রতি জোড়-পদে ‘ধ্রুব’ শব্দের উল্লেখ থাকায় নিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে, এগুলি তখন গাওয়া হতো। এ ছাড়া এই পদগুলি থেকে তৎকালীন বাঙালি জীবনের আচার-আচরণ ও সমাজের বাস্তবঘন পরিচয়ও পাওয়া যায়। যেমন তখনকার মানুষ হরিণ শিকার, নৌকা চালনা, চেঙারি তৈরি, শুঁড়ির কাজ ইত্যাদি করত। কাড়া-নাকাড়া ও ঢাক- ঢোল বাজিয়ে বর-কনেকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়া হতো। সমাজে যৌতুক প্রথা প্রচলিত ছিল। গরু ছিল গৃহপালিত পশু; হাতিরও উল্লেখ আছে। মেয়েরা পরিধানে ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা এবং কর্ণে কুন্ডল পরত। টাঙ্গি, কুঠার, নখলি বা খন্তা ছিল উল্লেখযোগ্য অস্ত্র। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে এ দোহা পুথি আবিষ্কার করেন।
তথ্য-৯৪ ▌প্রাচীন বাংলা: খ্রিস্টীয় তেরো শতকের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় দু’ হাজার বছরের সময়কে বাংলার প্রাচীন যুগ বলে ধরা হয়ে থাকে। প্রাচীনযুগে বাংলা নামে কোনো অখ- রাষ্ট ছিল না। বাংলার বিভিন্ন অংশ তখন ১৬টি জনপদে বিভক্ত ছিল। পু-: বৃহত্তর বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর নিয়ে গঠিত। বরেন্দ্র : রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর এবং ভারতের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দার্জিলিং ও কোচবিহার। গৌঢ় : ভারতের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানের কিছু অংশ বঙ্গ : বৃহত্তম ঢাকা ও ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর সমতট : কুমিল্লা ও নোয়াখালী হরিকেল : শ্রীহট্ট (সিলেট) থেকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঢ়: পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলা। চন্দ্রদ্বীপ : বরিশাল, খুলনা এবং সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল। কামরূপ: রংপুর, জলপাইগুড়ি, আসামের কামরূপ জেলা, তা¤্রলিপি: মেদিনীপুর জেলা। আরাকান: কক্সবাজার, মায়ানমারের কিছু অংশ, কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণাঞ্চল।
তথ্য-৯৫ ▌উয়ারী-বটেশ্বর: নরসিংদীর বেলাব উপজেলায় অবস্থিত উয়ারী ও বটেশ্বর নামীয় দুটি গ্রামব্যাপী একটি প্রতœতাত্ত্বিক স্থান। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত কিছু প্রতœ নিদর্শনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস এবং নিউজিল্যান্ড তিনটি দেশের পরীক্ষাগারে কার্বন-১৪ পরীক্ষার প্রেক্ষিতে উয়ারীর বসতিকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। উয়ারী-বটেশ্বর ছিল একটি সমৃদ্ধ, সুপরিকল্পিত, প্রাচীন বাণিজ্য কেন্দ্র। সাম্প্রতিক প্রতœতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত হয়েছে পেরেক, লৌহমল, লৌহ গলানোর ফলে অতি ক্ষুদ্র বল, মরিচাপড়া লৌহবস্তু প্রভৃতি। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, এ স্থানে উচ্চ তাপমাত্রায় লোহা গলানোর প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল। উয়ারী-বটেশ্বরের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল। কারণ প্রাপ্ত মৃৎপাত্র, কাচের পুঁতি, স্বর্ণ আবৃত কাঁচের পুঁতি, টিন মিশ্রিত ব্রোঞ্জ ইত্যাদি সব উপকরণ এ তথ্যের সত্যতার প্রমাণ দেয়। গর্ডন চাইল্ডের মতে, উয়ারী- বটেশ্বর অঞ্চলটি টলেমি (দ্বিতীয় শতকের ভূগোলবিদ) উল্লেখিত ‘সোনাগড়া’। এখানে খননের ফলে ১৬০ মিটার দীর্ঘ রাস্তা আবিষ্কৃত হয়েছে।
তথ্য-৯৬ ▌বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়: নিষাদ বা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর অনার্য লোকেরাই এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। একটি শূণ্য ভূমিকে আবাদযোগ্য করেছে তারাই। আজকের কোল, ভিল, সাঁওতাল, শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি আদিম অধিবাসীরা তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। দ্রাবিড়ীয় জাতি দক্ষিণ ভারত থেকে বঙ্গে প্রবেশ করে, যখন তিব্বতী-বর্মী জাতি হিমালয় থেকে প্রবেশ করেছিল। ইন্দো-আর্য জাতি বঙ্গে প্রবেশ করেছিল উত্তর- পশ্চিম ভারত থেকে। এ অঞ্চলের আদি জনগোষ্ঠী দ্রাবিড়-নিষাদ তথা অনার্য কালোরা বৈদিক আর্যদের সংস্কৃতির প্রথম শিকার। আর্যরা জলাভূমি ও বনজঙ্গলের জন্যে এ ভূমিকে বলেছিল - জন্মান্তরের পাপের জন্যই কেবল এখানে জনপদ গড়ে উঠেছে। সংস্কৃত শাস্ত্রে বলা হয়েছে ‘বঙ্গে যেওনা, কারণ সেটা হল ব্রাত্য (নীচ অর্থে চন্ডাল) দের দেশ। ’নৃতাত্ত্বিকেদের গবেষণা মতে, আমাদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে সিংহলের ভেড্ডারা। এরা অনেক আগে সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিল। তাদের রক্তের ডিএনএ আমাদের শরীরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে। ভেড্ডা রক্তধারার সাথে পরে মিলিত হয়েছে মঙ্গোলীয় ইন্দো-আর্য। ফলে আমরা অজস্র রক্তধারার মিশ্রণ।
তথ্য-৯৭ ▌বাংলার বার ভূঁইয়া: মোঘল শাসন অস্বীকার করে, মোঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যারা যুদ্ধ করে স্বাধীনভাবে চলার চেষ্টা করত, তারা বাংলার বার ভূঁইয়া নামে পরিচিত। ভূঁইয়া শব্দের অর্থ ভূমির মালিক। এক বা একাধিক পরগনার জমিদার মালিকেরা ভূঁইয়া উপাধি গ্রহণ করত। ভূঁইয়াদের ব্যক্তিগত বীরত্ব ও নিজস্ব বাহিনী ছিল। তারা শুধু রাজস্ব আদায় ও জমিদারী ভোগ দখল নিয়ে ব্যস্ত থাকত না, তারা শাসন কার্য পরিচালনার জন্য সীমিত সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সহায়তায় যুদ্ধ পরিচালনা করত। সেজন্য পদাতিক ও নৌ-বাহিনীর পাশাপাশি রাজধানী সংলগ্ন দূর্গ, অস্ত্রাগার, কামান ও গুলাগুলির সংস্থান থাকত। যে বার ভূঁইয়াগণ বংগদেশ বিভক্ত করে মোঘল শক্তিকে বঙাধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করত; ঈশা খাঁ’ ছিল তাদের নেতা। তবে সমগ্র বাংলাকে বিবেচনায় নিলে ভূঁইয়াদের সংখ্যা বারোর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। বারটি রাজ্যের নাম যথা- ১। বাংলা ২। হিজলী ৩। উড়িষ্যা ৪। যশোর ৫। চ-ীকান ৬। মেদিনীপুর ৭। কতাভু ৮। বাকলা ৯। ছলিমানবাদ ১০। ভুলুয়া ১১। ঢাকা ১২। রাজমহল
তথ্য-৯৮ ▌সোনারগাঁও ও পানাম: ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। এটি বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র, যা বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। এটি পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত একটি বিস্তৃত জনপদ ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দু আমলের রাজধানী এখানেই অবস্থিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীকালে এটি মুসলিম শাসকদের পুর্ববঙ্গের প্রাদেশিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম থেকে সোনারগাঁও নামের উদ্ভব বলে কারো কারো ধারণা রয়েছে। আবার কারো মতে, ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামে সোনারগাঁও এর নামকরণ করা হয়েছিল। সোনারগাঁয়ের রাজকার্য পরিচালিত হতো পানাম নগরী থেকে। বর্তমানে যে পানাম দাঁড়িয়ে আছে তার অবকাঠামো ব্রিটিশ আমলের। প্রাচীন পানাম চাপা পড়ে আছে আধুনিক পানামের নিচে। এই এলাকাটি ১৯শ শতকে সোনারগাঁওয়ের উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ীদের বাসস্থান ছিলো। এখানে কাপড় ব্যবসায়ীরা বাস করতেন।
তথ্য-৯৯ ▌বাঙালি সংস্কৃতি : আমাদের বংশলতিকা অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। হিন্দু ধর্মের পার্বণগুলো আসলে গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজের বিভিন্ন উপলক্ষের উৎসব-পার্বনের পরিবর্তিত পরিবর্ধিত রূপ। এখানে বহু বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন সংস্কৃতির যোগসাজশে বাঙালিদের নিজস্ব কিছু লোকাচার তৈরি হওয়ার কারণে সকল ধর্ম মতের লোক সাম্প্রদ্রায়িক সম্প্রিতি নিয়ে সহজ-সরল জীবন-যাপন করে আসছিল। বৌদ্ধ সহজিয়া ও মুসলিম সুফি সাধকদের দ্বারা প্রচারিত ইসলাম তাই সহজেই প্রবেশ করেছে সাধারণের জীবনে, পরিণত হয়েছে লোকাচারের অংশ হিসেবে। কাজেই হাজার বছরের পালিত ঐতিহ্যের বিপরীতে ভিন্ন দেশের সংস্কৃতিকে নিজেদের জন্য অনুসরণীয় হিসেবে গ্রহণ করাটা বাঙালি জীবনসত্ত্বার বিনাস হওয়াই স্বাভাবিক। এদেশ থেকে বাঙ্গালিত্বের শিকড় উপড়ে ফেলার এই চেষ্টার ফলশ্রুতিতে উগ্রবাদের বিষ আজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এর থেকে রেহাই পেতে আমাদের সেই মূলের কাছে, শেকড়ের কাছে ফিরে যেতে হবে।
তথ্য-১০০ ▌বাঙালির পোশাক: বাঙালির পোশাকের ক্ষেত্রে নারীর পোশাক হিসেবে ইতিহাসে শাড়ির ধারাবাহিকতা দেখা যায় এবং শাড়ি আজো জৌলুস নিয়েই দুনিয়াতে টিকে আছে। শাড়িই বোধহয় বাঙালির একমাত্র পোশাক যা ভারত এবং দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা বেশ আগ্রহ নিয়ে পরে। শাড়ি শব্দটির উৎস শাট বা শাটক থেকে। শাটক শব্দের অর্থ সরু দৈর্ঘের জোড়া দেয়া কাপড়। বাংলায় তাঁতযন্ত্রের আবির্ভাবের আগে শটক বা জোড়া দেয়া কাপড় ব্যবহারের প্রচলন ছিল এবং এই শটক নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সবাই ব্যবহার করতেন। ধুতি ও শাড়ি পড়ার মধ্যে কোনো গুরুতর লিঙ্গভেদ সে-কালে মানা হত না। সেকালে শ্রমিক শ্রেণীর পুরুষরা ল্যাঙ্গোটি পরতেন। পনেরো-ষোল শতকে বাংলার নারীরা শুধু একখন্ড শাড়ি গায়ে জড়াতেন। লুঙ্গির মূল উৎস তামিলে। তামিলদের লুঙ্গি প্রচলন হয় রেঙ্গুনে। বর্মীদের অনুকরণে পূর্ববঙ্গে লুঙ্গির প্রচলন হয়। সে সময় লুঙ্গি ছিল সেলাইহীন। পাদুকা হিসেবে ব্যবহৃত হতো কাঠের খড়ম। নারীরা খালি পায়েই চলতেন।