লিবারেল আর্টস শিক্ষা ব্যবস্থা ও সুনাগরিক সংঘ

 একটি ভাইরাল ভিডিওতে মিশরের আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে বলতে শোনা যায়, যা-কিছু পবিত্র কোরআনে নেয়, তা আমরা পড়বো কেন? দেশে বহু নতুন পন্ডিতকেও বলতে শোনা যায় যে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সবাইকে জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, পাটিগণিত, বীজগণিত সূত্র, বিজ্ঞানের সূত্র এগুলো পড়ানোর দরকার কি?  সবার তো এগুলি কাজে লাগে না, যারা বিজ্ঞান পড়বে তারা শুধু পড়লেই হয়। কিন্তু এইসব পন্ডিতদের জানা  উচিত, শুধু কাজে লাগার জন্য যে পড়া, তাকে শিক্ষা বলে না; বলে প্রশিক্ষণ। তাহলে শিক্ষা কি? শিক্ষা হলো- বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যত রকমের জ্ঞান আর আবিষ্কারের সমন্বয়ে সভ্যতা অগ্রসর হয়েছে, সেই সবের সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করানো। অর্থাৎ শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য দুইটি এক) পড়তে শিখানো আর দুই) যাবতীয় জ্ঞানের সাথে পরিচিত করে মনুষ্যত্বের বিকাশ করা। আমাদের মূল সমস্যা দ্বিতীয় উদ্দেশ্য নিয়ে। এখানে ইংরেজি মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম, মাদ্রাসা মিডিয়াম ইত্যাদি বহু পদ্ধতি চালু থাকার কারণে লিবারেল আর্টস পদ্ধতির শিক্ষা খন্ডিতভাবেও চালু করা যায়নি।

পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমেরিকার আধিপত্যের মূল কারণ তার "লিবারেল আর্টস" শিক্ষা ব্যবস্থা। আমেরিকার স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত পড়ানো হয় "লিবারেল আর্টস" পদ্ধতিতে। লিবারেল আর্টস পদ্ধতি ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে তিনটি ভাগে নাম্বার পেতে হয়। ১, সাধারণ শিক্ষা, যেখানে মোট নাম্বারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত; ২,নাম্বারে আছে মূল বিষয়গুলো এবং শেষাংশে ঐচ্ছিক বিষয়গুলো। লিবারেল আর্টস পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী শুধু ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে না, পাশাপাশি ইতিহাস,বিজ্ঞান, ভূগোল, পরিবেশ ইত্যাদি পড়েফলে একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষে সে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কিংবা রাজনীতিবিদ যেই হোক, রাষ্ট্র, ইতিহাস, পরিবেশ, বিজ্ঞান,গাণিতসহ সব বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা  রাখে 

আমাদের  দেশে মাত্র একটি নির্দিষ্ট সাবজেক্টে-এ পাশ করা একজনকে কেবল সে সাবজেক্টের (বাংলা-গণিত ইত্যাদি) শিক্ষক বানানো হয়। কিন্তু আমেরিকা বা  অস্ট্রেলিয়ায় সেটা করা হয় না। সে সব দেশে একজন শিক্ষকই পুরো বছর একটা সেকশনের সব সাবজেক্ট পড়ান। এতে তিনি জেনে যান যে, কোন শিক্ষার্থী কোন সাবজেক্টে ভালো বা কার কোথায় সমস্যা, কীভাবে কাকে পড়াতে হবে। আমাদের এখানে একটি শ্রেণীর জন্য একজন নির্দিষ্ট শিক্ষককে আমরা রাখতে পারছি না। এছাড়া আমাদের দেশে নৈতিক শিক্ষার আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই, মনে করা হয়, ধর্মীয় শিক্ষাই নৈতিক শিক্ষা। ফলাফল বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ জাতির তকমা আমাদের। উন্নত দেশে মানুষ কল্পনাও করতে পারে না যে, কেউ ‘‌স্বাভাবিক’ভাবেই মিথ্যা বলবে! আর বাংলাদেশে এ ব্যাপারটা কতই না সাধারণ ! আমাদের নৈতিক শিক্ষাগুলো যেভাবেই স্কুল-কলেজগুলো থেকে উধাও হয়ে গেছে! এর বলি হচ্ছে আমাদের জাতিগত চরিত্র ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। দেশি কোনো কলম কিনতেও মানুষ কয়েকবার ভাবে, এটা দিয়ে লেখা যাবে কিনা? আর বিদেশি হলে করেকগুণ দাম বেশি দিয়ে কিনি। 

দেশে স্থায়ী সরকারি সনদ পাওয়া প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আহসানউল্লাহ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটি সংগঠন আছে, যার নাম ‘‌এথিকস সেন্টার’। যা মূলত নর্থ আমেরিকান বাংলাদেশী কমিউনিটির অর্থায়নে চলে । তারা স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ এবং আচরণ উন্নয়ন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছে। কিন্তু তা অতি সংক্ষিপ্ত এবং খন্ডিত হওয়ায় সামগ্রিকভাবে প্রভাব পড়ছে না তাই ছাত্র-ছাত্রী এবং যুব সমাজকে লিবারেল আর্টস তথা নৈতিকতাসহ সকল রকমের তথ্য ও জ্ঞানের সাথে যুক্ত করে বিশ্বমানের আধুনিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সুনাগরিক সংঘ। এই সংগঠনটি মানুষের নৈতিকতা উন্নয়নে যেমন কাজ করে, তেমনি মানুষের আত্মউন্নয়ন ও দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে। এই সংগঠন বিশ্বের গ্রহণযোগ্য সকল তথ্য শিক্ষার্থীদের সাথে শেয়ার করে শুধুমাত্র জানার স্বার্থে কিন্তু মানা না মানা শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ব্যাপার; সংগঠনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

আমাদের পড়াশুনায় শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে সংযোগ না থাকার ফলে দুইটি সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এক. শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করার পর যোগ্যতা ও চাহিদা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। দুই. নিয়োগদাতারা দক্ষতা অনুযায়ী কর্মী খুঁজে পাচ্ছেন না। অর্থাৎ দেশে সার্টিফিকেটসর্বস্ব ডিগ্রিধারী বাড়ছে হুহু করে জোয়ারের পানির মত, কিন্তু যোগ্যতাসম্পন্ন মা্নুষ তৈরি হচ্ছে না। ওথচ আমাদের চারপাশে শিক্ষা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে অতি ছোট্ট দেশও উন্নতির শিখরে পৌছে গেছে। সিঙ্গাপুর শিক্ষা, গবেষণা ও উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মশক্তি নিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। চীন কৃষি অর্থনীতি থেকে প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার দিকে রূপান্তর করেছে। জাপান  উচ্চ মূল্যের উৎপাদন এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভারত আইটিতে শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন করে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছেন। তাই অনিবার্যভাবে এই সংগঠনটি শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সাথে সংযোগ করার চেষ্টা করে।