১% মানুষের কাছে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক সম্পত্তি

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, মাস্কের ৫০০ বিলিয়ন ডলার  পৃথিবীর সব মানুষের মাঝে সমানভাবে ভাগ করলে প্রতিজনের বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭ হাজার ৬০৯ টাকা পাবে। গত বছরের অক্টোবরের আয় হিসেবে ইলন মাস্কের একদিনের আয় বাংলাদেশের সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের মাঝে সমানভাবে ভাগ করলে প্রতিজন পাবে প্রায় ২৩ হাজার ৬৯৩ টাকা। সম্পদ বৃদ্ধির বর্তমান হার যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আগামী ৬ বচরের মধ্যেই দ্বিগুণ অর্থাৎ এক ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক হবেন বর্তমানে ৫৪ বছর বয়সী মাস্ক। মাস্কের আয়ের বড় অংশই ৫০% আসে টেসলা থেকে। স্পেসএক্স থেকে এসেছে ২০%, বাকীটা অন্যান্য আয় থেকে। ব্যক্তি হিসেবে মাস্ক খুব বেশি সুবিধার মানুষ নয়। বদমেজাজি, কর্মীদের হঠাৎ বরখাস্ত করেন, কৃতিত্ব ভাগাভাগি করেন না। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম বলছে, বর্তমান বিশ্বে মাক্সের মতো  ১% ধনী ব্যক্তি সারা বিশ্বের মোট প্রায় ৪৫% দখল করে আছে। তাদের ব্যবসার প্র্যোজনে বিশ্বে যুদ্ধ -সংঘাত বাড়ছে, যাতে মানুষ আরও দারিদ্র্য হচ্ছে  ও ধনী গরিব বৈষম্য বাড়ছে।


অপারেশনের আট ঘন্টা আগে খাবার নিষেধ কেন?

সার্জারির আগে প্রায় ৮ ঘণ্টা শক্ত খাবার এবং ২ ঘণ্টা পানি বা তরল খাওয়া নিষিদ্ধ থাকে। এটি একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া—যাকে বলে ‘এনপিও’ (নাথিং বাই মাউথ)।‘অস্ত্রোপচারের সময় যখন অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়, তখন শরীরের স্বাভাবিক রিফ্লেক্সগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখন যদি পেটে খাবার বা তরল কিছু থাকে, সেগুলো ওপরে উঠে গিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে। ‘ছোট সার্জারি হোক বা বড়, সব ধরনের অস্ত্রোপচারের আগেই মুখ দিয়ে কিছু না খাওয়ার নিয়ম।


আমরা ডিম ওয়ালা কেবল নারী ইলিশই দেখি কেন? 

অক্টোবর মাসে যখন ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম চলে, তখন প্রায় সমপরিমাণ নারী ও পুরুষ ইলিশই নদীর উজান পেরিয়ে আসে মিঠাপানিতে। একটি ইলিশের ঝাঁকে নারী পুরুষের অনুপাত থাকে প্রায় অর্ধেক অর্ধেক । আকারে ছোট এবং এরা দেখতেও ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল, ক্ষীণকায় ও অনাকর্ষণীয়।'নারী ইলিশের মাঝে যে দীপ্তি দেখা যায়, পুরুষ ইলিশের ভেতর তা অনুপস্থিত।বাজারে তাই আর এসব পুরুষ ইলিশের ঠাঁই হয় না। জেলেরা সেগুলোকে আলাদা করেন এবং পাঠিয়ে দেন লবণ মাখিয়ে শুকানোর জন্য। এসব ইলিশকে জেলেরা বলে পাইক মাছ আমরা বলি 'নোনা ইলিশ'।  

মিয়ানমারের ইরাবতী নদী এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী-হুগলী ছাড়া ইলিশ রয়েছে  ভিয়েত্নামের মেকং নদী থেকে শুরু করে পশ্চিমের পারস্য উপসাগরে। সাধারণ জেলের পক্ষে একটি ইলিশ নারী না পুরুষ, তা শনাক্ত করা কঠিন।  পুরুষ মাছ পানিতে তাদের ফোমের মতো শুক্রাণু ছেড়ে দেয় এবং নারী মাছ তার মধ্যে ডিম্বাণু ছেড়ে নিষিক্ত করে। 


অ্যাগনোডিস

প্রাচীন গ্রিসে নারীদের মেডিকেল পড়া নিষিদ্ধ ছিল। খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ৩০০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন একজন নারী, নাম তার অ্যাগনোডিস। ছোটবেলা থেকেই তার ডাক্তার হওয়ার শখ ছিল। তিনি চুল কেটে পুরুষ বেশে আলেকজান্দ্রিয়া মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন।

ডাক্তারি শিক্ষা শেষ করে অ্যাগনোডিস একদিন এথেন্সের রাস্তায় হাঁটছিলেন। সেসময় তিনি প্রসব যন্ত্রণায় কাতর এক নারীর কান্না শুনতে পান। নারীটি প্রচণ্ড ব্যথায় মরে গেলেও চাননি কোনো পুরুষ  তাকে স্পর্শ করুক!

অ্যাগনোডিস ভেতরে গিয়ে ডেলিভারি করাতে চাইলে মহিলাটি কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না, কারণ সে ভেবেছিল অ্যাগনোডিস একজন পুরুষ।  সেদিন অ্যাগনোডিসকে জামাকাপড় খুলে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে তিনি একজন নারী।  তারপর তিনি সফলভাবে ওই নারীর সন্তান প্রসব করান।

গল্পটি শীঘ্রই গ্রিসের নারী মহলে মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমস্ত অসুস্থ নারীরা অ্যাগনোডিসের কাছে ভিড় জমাতে শুরু করে। পুরুষ চিকিৎসকরা ঈর্ষান্বিত হয়ে অ্যাগনোডিসকে অভিযুক্ত করে বলেছিলেন, অ্যাগনোডিস একজন চরিত্রহীন পুরুষ, সে বিভিন্নভাবে নারীদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে।

বিচারে অ্যাগনোডিসকে আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার প্রমাণ করতে হয়েছিল যে তিনি একজন নারী। কিন্তু এবার তাকে মেডিসিন অধ্যয়ন করা এবং একজন নারী হিসেবে চিকিৎসা শাস্ত্র অনুশীলন করার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

সাথে সাথে গ্রিসের নারীরা এই দণ্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, বিশেষ করে সেই সব বিচারকদের স্ত্রীরা যারা মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছিলেন, যদি অ্যাগনোডিসকে হত্যা করা হয় তবে তার সাথে তাদেরকেও মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। অবশেষে নারীদের চাপ সহ্য করতে না পেরে বিচারকরা অ্যাগনোডিসের সাজা তুলে নেন। তারপর থেকে গ্রীসে নারীদের চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করার অনুমতি দেওয়া হয়, তারা শুধুমাত্র নারীদের চিকিৎসা করবে এই শর্তে।

অ্যাগনোডিস প্রথম গ্রীক নারী চিকিৎসক এবং স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইতিহাসে তার চিহ্ন রেখে গিয়েছিলেন। নারীদের জন্য ইতিহাস সৃষ্টি করা কোনদিনই সহজ কোনো কাজ ছিল না। হিমালয়সম প্রতিকূলতার পাহাড় একটু একটু করে কেটেই তৈরি হয়েছে আজকের নারী জাতি।


"কোবরা প্রভাব" (Cobra effect) 

ঔপনিবেশিক দিল্লিতে ব্রিটিশরা যখন অতিরিক্ত কোবরা সাপের সমস্যা মোকাবেলা করছিল, তখন তারা একটি পুরস্কার বা 'বাউন্টি' ব্যবস্থা চালু করে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিটি মৃত কোবরা সাপের জন্য একটি পুরস্কার প্রদান করা হতো। কিন্তু এর ফলস্বরূপ, ব্রিটিশদের একটি নতুন সমস্যা দেখা দেয়, যা "কোবরা প্রভাব" (Cobra effect) নামে পরিচিত, কারণ কিছু মানুষ কেবল পুরস্কার পাওয়ার লোভে কোবরা পোষা শুরু করে এবং সাপের সংখ্যা কমানোর পরিবর্তে আরও বাড়িয়ে তোলে, যা সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তোলে।

যখন কোনো সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তার ফলস্বরূপ সমস্যা আরও খারাপ হয়, তখন তাকে "কোবরা প্রভাব" বলা হয়।



আরাকান যেভাবে বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়েছিল :

রাখাইন  নামে যে ভূমি আজ মিয়ানমারের অন্তর্গত, একসময় তাকে ডাকা হতো “আরাকান” নামে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা ছিল সেই ভূমি। পাহাড়, নদী, আর নোনা বাতাসে মেশানো বন্দরনগরী—যেখানে একদিন বাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ী, কবি, সুলতান ও রাজারা পাশাপাশি হেঁটেছেন ইতিহাসের বালুকাবেলায়।

প্রাচীন আরাকান ছিল এক বিস্ময়ভূমি। মাটির নিচে ছিল তেল, কয়লা, ইউরেনিয়াম, সোনা আর রূপার বিপুল ভাণ্ডার। কিন্তু এই প্রাচুর্যই হয়ে উঠেছিল তার শত্রু। একে দখল করতে এসেছিল বারবার বিভিন্ন শক্তি—কখনো বর্মি রাজা, কখনো ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক, কখনো প্রতিবেশী রাজ্য।

চতুর্দশ শতাব্দীতে আরাকানের রাজপুত্র নরমিখলা, যিনি একসময় নির্বাসিত হয়েছিলেন, ফিরে এলেন নিজের রাজ্য দখল করতে—বাংলার গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহের সৈন্যবাহিনীর সহায়তায়। সেই সঙ্গে বদলে গেল আরাকানের ভাগ্যও।

তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন, নাম নিলেন সুলতান সোলায়মান শাহ। আরাকানের রাজদরবারে শুরু হলো নতুন ইতিহাস।

সেই সময় রোসাং (আরাকানের রাজধানী) হয়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক রাজধানী। বাংলার কবিরা সেখানে পেতেন সম্মান ও আশ্রয়।

মহাকবি আলাওল, দৌলত কাজী, সৈয়দ মোহাম্মদ রফি—ইত্যাদি কবিদের পদচারণায় আরাকানের রাজদরবারে প্রতিধ্বনিত হতো বাংলা কবিতার সুর।

এভাবেই মুসলিম সংস্কৃতি ও আরাকানের স্থানীয় ঐতিহ্য মিশে গড়ে ওঠে এক নবজীবন—যার ফলাফল আজকের রোহিঙ্গা জাতির উৎপত্তি।   স্থানীয় আরাকানি জাতি ও মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমানদের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে এক নতুন জাতিসত্তা, যারা নিজেদের “রুহাঙ্গা” বা “রোহিঙ্গা” বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু শান্তি টেকেনি বেশি দিন। ১৭৮৪ সালে বর্মি রাজা ভোধাপোয়া আগুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন আরাকানের ওপর। তিনি হত্যা করলেন হাজার হাজার মানুষ, মন্দির লুট করলেন, মুসলমানদের মসজিদ ধ্বংস করলেন। আরাকানের রাস্তায় তখন রক্ত বইছিল নদীর মতো। হাজারো মানুষ পালিয়ে এল চট্টগ্রামে আশ্রয়ের খোঁজে—যেন নিজের ঘরে ফিরে আসা শরণার্থী। এরপর এলো ব্রিটিশরা। তারা আরকা করায়ত্ত করে নিল।

১৯৪৬ সালে যখন ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সুর বাজছে, তখন আরাকানের মুসলমান নেতারা একটি স্বপ্ন দেখলেন—বাংলার সঙ্গে এক হওয়ার স্বপ্ন। তারা গঠন করলেন আরাকান মুসলিম লীগ, আর প্রকাশ করলেন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

কিন্তু ইতিহাস তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা ভয় পেলেন—যদি আরাকান যুক্ত হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তান সমুদ্রপথে অতিশক্তিশালী হয়ে উঠবে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও সে সময় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেন না। আরাকান হারিয়ে গেল সীমান্তের ওপারে, রেখে গেল এক দীর্ঘশ্বাস। যদি সেই সময় বাংলার নেতারা দূরদৃষ্টি দেখাতেন, যদি জিন্নাহ বুঝতেন এই অঞ্চলের গুরুত্ব—তবে হয়তো আজ রাখাইন রাজ্যের এই গল্পটি অন্যরকম হতো।



========


===========

বিজ্ঞান বলছে, মানুষের মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় চাহিদা হলো 'social connection' বা সামাজিক সংযোগ। অক্সফোর্ডের মনোবিজ্ঞানী রবিন ডানবারের মতে, শারীরিক স্পর্শের মতোই 'কথোপকথন' আমাদের শরীরে এন্ডোরফিন (Endorphin) নিঃসরণ করে, যা আমাদের ভালো থাকার অনুভূতি দেয়। যখন আপনার সঙ্গী আপনার কথা মন দিয়ে শোনে, বা মন খুলে আপনাকে কিছু বলে তখন আপনাদের মস্তিষ্কে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, তা সবচেয়ে তীব্র অর্গ্যাজমের চেয়েও বেশি শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

=======

পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাণীগুলোর মধ্যে হায়েনা অন্যতম! মাদী হায়েনার ক্লিটোরিস এতটাই বড় হয় যে, সেটি অবিকল পুরুষ হায়েনার অঙ্গের মতো।   বাইরে থেকে দেখে কে পুরুষ আর কে মাদী হায়েনা—তা বোঝা প্রায় অসম্ভব! গবেষকরা আল্ট্রাসাউন্ড, হরমোন টেস্ট কিংবা জেনেটিক এনালাইসিসের মাধ্যমে লিঙ্গ নিশ্চিত করেন। তবে, মাদী হায়েনারা শারীরিকভাবে বড়, সামাজিকভাবে বেশি কর্তৃত্বশালী এবং পুরুষদের চেয়েও আক্রমণাত্মক স্বভাবের হয়। 

========

মেয়েদের শরীরে এমন বেশ কিছু জিন রয়েছে, যা তাদের ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি করে তোলে। গবেষকরা জানিয়েছেন, মেয়েদের দেহে ডিপ্রেশনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত জিনের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।মেয়েদের মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার জিন ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে, যেগুলো সরাসরি হতাশা বা ডিপ্রেশনের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে, পুরুষদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম—প্রায় ৭ হাজারের মতো।


===========


মুঘল যুগের অর্থনীতি: বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতির একটি....

মুঘল যুগ (প্রায় ১৫২৬-১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ) ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতিকে একটি অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির শীর্ষে নিয়ে যায়, যা তৎকালীন বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী অংশ হিসেবে স্বীকৃত। ঐতিহাসিক অর্থনীতিবিদ অ্যাঙ্গুস ম্যাডিসনের অনুমান অনুসারে, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের মোট জিডিপির (GDP) প্রায় ২২.৭% অবদান রাখত, যা চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে স্থান পায়। ১৭০০ সালের দিকে এই অংশীদারিত্ব বেড়ে ২৪% এবং আওরঙ্গজেবের শাসনকালে (১৬৫৮-১৭০৭) প্রায় ২৫% হয়ে ওঠে, যা চীনের কিং রাজবংশ এবং পুরো পশ্চিম ইউরোপকে ছাড়িয়ে যায়। এই সমৃদ্ধি কেবল আকারের দিক থেকে নয়, প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন (প্রাক-শিল্পায়ন), উন্নত অবকাঠামো এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে।

১.

মুঘল যুগের অর্থনীতি ১৬শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল। ১৬০০ সালে এর জিডিপি বিশ্বের ২৪.৩% ছিল, যা দ্বিতীয় স্থানীয় অর্থনীতি হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে যায়। ১৭শ শতাব্দীর প্রথম দিকে এটি কিং চীন এবং ইউরোপকে অতিক্রম করে বিশ্বের শীর্ষে উঠে আসে। উদাহরণস্বরূপ, আকবরের শাসনকালে (১৫৫৬-১৬০৫) এর মূল্য ছিল প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার (আধুনিক মূল্যায়নে), যা বিশ্ব জিডিপির প্রায় এক-চতুর্থাংশ। আওরঙ্গজেবের আমলে এই অংশ ২৫% ছিল, যা একটি শিক্ষিত অনুমান হলেও ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত।

তুলনামূলকভাবে, ১৭শ শতাব্দীতে ভারতের প্রতি মাথাপিছু জিডিপি ব্রিটেনের ৬০% ছিল, যা ১৮৭১ সালের মধ্যে ১৫%-এ নেমে আসে। শিল্প উৎপাদনে ভারত ১৮শ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের ২৮% অবদান রাখত এবং ১৭৫০ সাল পর্যন্ত ২৫%। বাংলা সুবাহ (প্রদেশ) একাই সাম্রাজ্যের জিডিপির ১২% অবদান রাখত এবং বিশ্ব বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র ছিল। সেক্টরভিত্তিক অবদান ছিল: প্রাইমারি (কৃষি) ৫২%, সেকেন্ডারি (শিল্প) ১৮%, টারশিয়ারি (সেবা) ২৯%। শহুরে শ্রমিক (জনশক্তির ১৮%) অর্থনীতির ৫২% অবদান রাখত, যখন গ্রামীণ শ্রমিক (৮২%) ৪৮%। খাদ্য গ্রেইনের দাম ব্রিটেনের তুলনায় অনেক কম ছিল (দক্ষিণ ভারতে অর্ধেক, বাংলায় এক-তৃতীয়াংশ), যা শিল্পের উন্নয়নে সাহায্য করে।

২.

কৃষি মুঘল অর্থনীতির মূল স্তম্ভ ছিল, যা সম্রাজ্যের সমৃদ্ধির প্রধান উৎস। শের শাহ সুরির সংস্কারের ভিত্তিতে আকবর জাবত (zabt) ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করেন, যা উপহারের পরিবর্তে মুদ্রায় কর আদায় করে এবং জমির জরিপের ভিত্তিতে কর নির্ধারণ করে। এতে কৃষকদের উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি কর দিতে হতো, যা তাদের বাজারে টানত। নগদ ফসল (কটন, ইন্ডিগো, চিনি, আফিম) উৎসাহিত হয় এবং নতুন জমিতে করমুক্তির ব্যবস্থা ছিল। সেচ ব্যবস্থা উন্নত করা হয়, যা ফলন বাড়ায়।

প্রধান ফসল ছিল- খাদ্য (গম, চাল, যব) এবং নগদ (কটন, ইন্ডিগো, আফিম)। নতুন বিশ্বের ফসল যেমন ভুট্টা এবং তামাক ১৭শ শতাব্দীর মাঝামাঝি চালু হয়। বাংলায় রেশম চাষ (সেরিকালচার) উন্নত হয়, যা বাংলাকে বিশ্বের প্রধান রেশম উৎপাদক করে। উন্নত কৌশল যেমন সীড ড্রিল (ইউরোপের আগে) এবং গিয়ারড চিনির মিল ১৭শ শতাব্দীতে ব্যবহৃত হয়। ফলে, ১৭শ-১৮শ শতাব্দীতে ভারত ব্রিটিশ আমদানির ৯৫% এবং ডাচ আমদানির ৪০% সরবরাহ করে।

৩.

প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের উদাহরণ

মুঘল অর্থনীতি প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের চিহ্ন দেখায়, যা ইউরোপের ১৮শ শতাব্দীর পট-আউট সিস্টেমকে অনুপ্রাণিত করে। টেক্সটাইল ছিল সবচেয়ে বড় সেক্টর, যা ১৮শ শতাব্দীর প্রথমে বিশ্বের ২৫% অবদান রাখত। অন্যান্য শিল্প: জাহাজ নির্মাণ, ইস্পাত, চিনি, তেল, মাখন। উদ্ভাবন যেমন কটন জিন (১৩-১৪শ শতাব্দী থেকে) এবং ক্র্যাঙ্ক হ্যান্ডেল। বাংলার জাহাজ নির্মাণ ১৬-১৭শ শতাব্দীতে বছরে ২২৩,২৫০ টন ছিল, যা উত্তর আমেরিকার কলোনির চেয়ে অনেক বেশি। গোলকুন্ডায় হীরা খনি বিশ্বের একমাত্র উৎস ছিল (যেমন কোহিনুর, হোপ ডায়মন্ড)।

৪.

বাণিজ্য ছিল রপ্তানি-কেন্দ্রিক, যেখানে টেক্সটাইল, জাহাজ, ইস্পাত, মশলা, ইন্ডিগো, রেশম এবং সল্ফেটারের বিশ্বব্যাপী চাহিদা ছিল। ভারতীয় কটন টেক্সটাইল ১৮শ শতাব্দীর বিশ্ব বাণিজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ছিল, যা আমেরিকা থেকে জাপান পর্যন্ত পৌঁছাত। ইন্ডিয়ান ওশান ট্রেডে প্রভাবশালী, পশ্চিম আফ্রিকায় ৩৮% এবং ইংল্যান্ডের দক্ষিণ ইউরোপ বাণিজ্যে ২০%। বাংলা ডাচ আমদানির ৫০% টেক্সটাইল এবং ৮০% রেশম সরবরাহ করত। ইউরোপীয়রা কম পণ্য দিত, ফলে ৮০% আমদানি ছিল বুলিয়ন (নতুন বিশ্ব এবং জাপান থেকে রুপা)। বাণিজ্য নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে ছিল ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া (চীন, মালয়) এবং জাপানে।

৫.

কৃষি কর ছিল প্রধান রাজস্ব, যা কৃষক উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি। জাবত সিস্টেম জমি জরিপ, অভিন্ন মুদ্রা এবং নগদ ফসলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের ভিত্তিতে কাজ করত। আকবরের সংস্কার এবং আওরঙ্গজেবের ১৬৬৫ ফিরমান জনসংখ্যা, চাষ এবং কৃষক কল্যাণ বাড়ানোর উপর জোর দেয়। মুঘল আমলে জমি কর জিডিপির ১৫% ছিল, যা ব্রিটিশ রাজে ১%-এ নেমে আসে। মুদ্রা সিস্টেম উচ্চ বিশুদ্ধতার ছিল (রুপি রুপায়, মোহর সোনায়, ডাম তামায়), যা ১৭২০-এর পর্যন্ত অবমূল্যায়নমুক্ত ছিল।

৬.

এই আধিপত্যের পিছনে ছিল উচ্চ কৃষি উৎপাদনশীলতা (বৈচিত্র্যময় ফসল এবং নতুন ফসলের দ্রুত গ্রহণ), উন্নত উৎপাদন (টেক্সটাইল উদ্ভাবন), বিস্তৃত অবকাঠামো (সড়ক, সেচ), স্থিতিশীল মুদ্রা (বুলিয়ন আকর্ষণ) এবং রপ্তানি অতিরিক্ত (বাণিজ্য ভারসাম্য ভারতের পক্ষে)। বাংলার ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে, ১৮শ শতাব্দীতে ঔপনিবেশিকতা, যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা (যেমন আওরঙ্গজেবের পরবর্তীকাল) এর অবনতি ঘটায়, যা ১৮শ শতাব্দীর শেষে ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের কারণে আরও তীব্র হয়।

শেষে বলতেই হবে যে, মুঘল অর্থনীতি কেবল "শ্রেষ্ঠ" ছিল না, বরং এটি বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করত, যা পরবর্তীকালের ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এর উত্তরাধিকার আজও ভারতীয় অর্থনীতির কৃষি এবং টেক্সটাইল সেক্টরে দেখা যায়।



==============

মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব আলমগীর 

মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব আলমগীর (শাসনকাল: ১৬৫৮–১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ) । তিনি কঠোর ধর্মানুরাগী ও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে পরিচিত, অন্যদিকে নিজের সিংহাসন রক্ষার জন্য নিকট আত্মীয়দের প্রতিও নির্মম ছিলেন। তাঁর ক্ষমতা লাভের পথ রক্তাক্ত হয়েছিল— নিজের ভাইদের হত্যা ও পিতাকে বন্দি করার মধ্য দিয়েই তিনি মুঘল সিংহাসন দখল করেন।

যাদের হত্যা বা মৃত্যুর জন্য তিনি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে দায়ী ছিলেন, তাদের কাহিনী তুলে ধরলাম—

১. দারা শিকোহ-প্রিয় জ্যেষ্ঠ ভাই : দারা শিকোহ ছিলেন শাহজাহান ও মুমতাজ মহলের জ্যেষ্ঠ পুত্র, এবং শাহজাহানের উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত ছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্তমনা, সুফিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার মানুষ। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মিলনের দর্শনে তিনি বিশ্বাস করতেন, উপনিষদ অনুবাদ করিয়েছিলেন ফারসিতে।

ঔরঙ্গজেবের চোখে এই চিন্তাধারা ছিল ধর্মবিরোধী। তাই ১৬৫৮ সালে ক্ষমতার লড়াই শুরু হলে দারা শিকোহকে তিনি শত্রু হিসেবে দেখেন। একাধিক যুদ্ধে দারাকে পরাজিত করে বন্দি করা হয়। ১৬৫৯ সালে দিল্লির রাস্তায় তাঁকে এক অপমানজনকভাবে হাতি চড়ার শোভাযাত্রায় দেখানো হয়— যেন রাজ্যের সামনে তাকে ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করা হয়। পরে ঔরঙ্গজেবের আদেশে দারাকে হত্যা করা হয় এবং তাঁর মাথা পাঠানো হয় বন্দি শাহজাহানের কাছে— উপহার হিসেবে!

এ ছিল ইতিহাসের এক ভয়ংকর অধ্যায়, যেখানে ভাই ভাইয়ের রক্তে নিজের রাজমুকুট রাঙায়।


২. মুরাদ বখ্‌শ-ছোট ভাই  : ঔরঙ্গজেবের আরেক ভাই মুরাদ বখ্‌শ ছিলেন গুজরাটের সুবেদার। দারা শিকোহের বিরুদ্ধে প্রথমে তিনিও বিদ্রোহে অংশ নেন, পরে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে জোট বাঁধেন। কিন্তু সিংহাসন দখলের পর ঔরঙ্গজেব তাকে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার করেন। ১৬৫৯ সালে মুরাদকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যার মিথ্যা মামলা সাজিয়ে ১৬৬১ সালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের প্রাণ— রাজনীতির নির্মমতা এখানে চরমে পৌঁছায়।


৩. শাহ শুজা — দ্বিতীয় ভাই : শাহ শুজা ছিলেন বাংলার সুবেদার। শাহজাহানের অসুস্থতার পর তিনিও সিংহাসনের দাবিদার হন। দারা, ঔরঙ্গজেব, মুরাদ— চার ভাইয়ের মধ্যে সিংহাসনযুদ্ধ শুরু হয়। শুজা বাংলার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করেন কিন্তু পরাজিত হন । তিনি পালিয়ে অরাকান (বর্তমান মায়ানমার)-এ আশ্রয় নেন। সেখানে গিয়ে তাঁর ও পরিবারের রহস্যময় মৃত্যু হয়। যদিও সরাসরি প্রমাণ নেই, ইতিহাসবিদরা মনে করেন, শুজার পরাজয় ও মৃত্যুর পেছনে ঔরঙ্গজেবের গুপ্তচর ও ষড়যন্ত্র জড়িত ছিল। এভাবেই শাহজাহানের চার রাজপুত্রের মধ্যে কেবল ঔরঙ্গজেবই বেঁচে থাকেন— বাকিরা মৃত্যু বা কারাগারের শিকার।


৪. শাহজাহান-পিতা : ঔরঙ্গজেবের নির্মমতার সবচেয়ে করুণ শিকার তাঁর নিজের পিতা সম্রাট শাহজাহান। শাহজাহান যখন অসুস্থ হন, তখন চার পুত্রই সিংহাসনের জন্য যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু ঔরঙ্গজেব বিজয়ী হয়ে শাহজাহানকে আগ্রায় তাজমহলের বিপরীতে আগ্রা দুর্গে বন্দি করে রাখেন। সেখানে শাহজাহান জীবনের শেষ সাত বছর বন্দি অবস্থায় কাটান— নিজের ভালোবাসার স্মৃতিস্তম্ভ তাজমহল-এর দিকে চেয়ে। মৃত্যুর পর তাঁর দেহ সেই তাজমহলের পাশেই মুমতাজ মহলের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। 


৫. অন্যান্য ব্যক্তিত্ব : ঔরঙ্গজেব কেবল রাজবংশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদেরই নয়, অসংখ্য হিন্দু ও শিখ নেতাকেও নির্মমভাবে দমন করেছিলেন। বিশেষত গুরু তেগ বাহাদুর— নবম শিখ গুরু—কে ধর্মান্তরিত না হওয়ার অপরাধে ১৬৭৫ সালে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করানো হয়। এছাড়া তিনি অসংখ্য রাজপুত নেতা, মারাঠা যোদ্ধা, এমনকি ধর্মীয় ভিন্নমতের মুসলিম সুফিদেরও হত্যা করান বা বন্দি করেন।


ঔরঙ্গজেবের শাসন তাই ইতিহাসে এক ভয়াবহ দ্বন্দ্বের প্রতীক—একদিকে ধর্মপ্রাণ, কুরআনের বিধান অনুসারে জীবনযাপনকারী সম্রাট; অন্যদিকে রাজ্য রক্ষায়, ক্ষমতা দখলে এবং মতবিরোধে, নিজের ভাই, পিতা ও অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের হত্যাকারী এক নির্মম শাসক। ১৭০৭ সালে বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুকাল পর্যন্ত এসব নবাবেরা মোঘল বাদশাহের কর্তৃত্বাধীনে কাজ করতেন; এবং তাঁদের নিয়োগ, পদচ্যুতি, বদলি প্রভৃতি তখন বাদশাহের ইচ্ছার উপরেই নির্ভর করত।





বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ 

বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এর আসল নাম ছিল সূর্যনারায়ণ মিশ্র বা হিরা মিশ্র।তিনি দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীসময়ে ভারতে আগত পারস্য নিবাসী এক মুসলমান তাঁকে অল্প বয়সে দাসবাজার থেকে ক্রয় করে ইসলামধর্মে দীক্ষিত করে তাঁর নাম রাখেন মোহাম্মদ হাদি । এরপরে তিনি হাদিকে তৎকালীন পারস্যের অন্তর্গত ইস্পাহানে নিয়ে গিয়েছিলেন, এবং সেখানে তাঁকে ফারসি ভাষায় সুশিক্ষিত করে তুলেছিলেন। পরবর্তীসময়ে হাদি তাঁর পালক প্রভুর সঙ্গে পুনরায় ভারতে ফিরে এসেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, হাদির এই পালক প্রভু ঔরঙ্গজেবের আমলের বাংলায়, দক্ষিণ ভারতে এবং দিল্লিতে মোঘল রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন এবং তাঁর অধীনে কাজ করেই হাদি তখন রাজস্ব সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন।


মুঘল দরবারে তাঁর মেধা, বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতার কারণে তিনি ধীরে ধীরে রাজস্ব প্রশাসনে উচ্চ পদে উন্নীত হন। তাঁর পরিশ্রম ও আর্থিক দক্ষতার জন্যই সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে ‘কারতুলহু মুর্শিদকুলি’ উপাধিতে ভূষিত করেন, যার অর্থ—যিনি রাজস্ব সংগ্রহ ও হিসাবরক্ষায় বিশেষ পারদর্শী। পরবর্তীকালে তিনি ‘মুর্শিদকুলি খাঁ’ নামেই খ্যাতি লাভ করেন। মুর্শিদকুলি খাঁ প্রথমে বিহারের রাজস্ব সংগ্রাহক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর যখন মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দুর্বল হতে থাকে, তখন তিনি বাংলার সুবাদার হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রাথমিকভাবে তিনি বাংলার দেওয়ান বা রাজস্ব প্রশাসক ছিলেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দক্ষতা, কঠোর শাসননীতি ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি কার্যত স্বাধীন নবাব হিসেবে বাংলার শাসনভার নিজের হাতে নেন। এভাবেই বাংলায় নবাবি যুগের সূচনা হয়, যার প্রথম শাসক ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ।


মুর্শিদকুলি খাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তাঁর রাজস্ব সংস্কার। বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থা মুঘল আমলেও ছিল দুর্নীতিপ্রবণ ও অগোছালো। জমিদাররা প্রজাদের উপর অত্যাচার চালাত, আবার রাজকোষে নির্ধারিত পরিমাণ রাজস্ব জমা দিত না। মুর্শিদকুলি খাঁ এই দুর্নীতি দূর করতে প্রশাসনিক কঠোরতা আরোপ করেন। তিনি রাজস্ব ব্যবস্থা পুনর্গঠন করেন এমনভাবে, যাতে প্রতিটি অঞ্চলের জমির উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী কর নির্ধারিত হয়। তিনি পূর্ববর্তী মুঘল প্রথা অনুযায়ী ‘জমিনদারী’ পদ্ধতিকে সীমিত করে ‘ইজারাদারী’ প্রথার প্রচলন করেন। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাজস্ব আদায়ের ঠিকাদার নিয়োগ করা হতো, যারা সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করত। এর ফলে রাজস্ব ব্যবস্থায় স্থায়িত্ব আসে এবং কেন্দ্রীয় কোষাগারে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল রাজধানী পরিবর্তন। তিনি বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। তাঁর নামানুসারে শহরটির নামকরণ হয় ‘মুর্শিদাবাদ’। এ পরিবর্তন শুধু প্রশাসনিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। গঙ্গার তীরবর্তী এই শহর দ্রুত বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে নবাবি দরবার, রাজকোষাগার, রাজস্ব অফিস ও বাণিজ্যিক ঘাঁটি স্থাপিত হয়। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি—বিশেষত ইংরেজ, ডাচ, ফরাসি ও ডেনিশ বণিকরা—মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত করে, ফলে শহরটি এক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে।


মুর্শিদকুলি খাঁ দুর্নীতি দমন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কর্মকর্তাদের উপর কঠোর নজরদারি চালাতেন। যেকোনো প্রকার ঘুষ বা অনৈতিক কাজের জন্য তিনি কঠোর শাস্তি প্রদান করতেন। রাজস্ব আদায়ে নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতা আনতে পেরেছিলেন। তাঁর আর্থিক নীতির ফলে বাংলার রাজকোষ মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ প্রদেশে পরিণত হয়েছিল। সমসাময়িক পর্যবেক্ষকদের মতে, মুর্শিদকুলি খাঁর সময় বাংলার রাজস্ব থেকে মুঘল দরবারের এক-তৃতীয়াংশ আয় হতো, যা প্রদেশটির সমৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে।


ধর্মীয় দিক থেকেও তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। যদিও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তবুও তাঁর প্রশাসনে হিন্দু অফিসার ও জমিদারদের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক হিন্দু কর্মচারীকে প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত করেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তবে রাজস্ব আদায়ে তিনি ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বিশেষ ছাড় দেননি; হিন্দু বা মুসলমান উভয়কেই সমানভাবে কর প্রদান করতে হতো।

মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার কৃষি, বাণিজ্য ও রাজস্বব্যবস্থাকে যে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিলেন, তার প্রভাব পরবর্তী নবাবদের আমলেও বজায় ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দত্তক পুত্র শরফউদ্দিন খান (শুজাউদ্দিন মোহাম্মদ খাঁ) ক্ষমতা গ্রহণ করেন, এবং এই ধারাই পরবর্তী আলিবর্দী খাঁ পর্যন্ত গড়ায়।  

সব মিলিয়ে বলা যায়, মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন বাংলার নবাবি শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা, একজন দক্ষ আর্থিক সংস্কারক, কঠোর প্রশাসক এবং বাস্তববাদী শাসক। তাঁর রাজস্ব সংস্কার, রাজধানী স্থানান্তর, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক নীতির ফলে বাংলায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল—যা পরবর্তী শতাব্দীর রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।


ইতিহাস বলে যে, সেযুগের মোঘল প্রশাসনে অজ্ঞাতকুলশীল মুর্শিদকুলিই সম্ভবতঃ একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন—যিনি নীল রক্তের অধিকারী ছিলেন না, এবং তৎকালীন প্রশাসনিক পদে তাঁর উন্নতির মূলে নিজস্ব কর্মদক্ষতাই ছিল। ঔরঙ্গজেবের আমলে তিনিই বাংলার রাজস্ব বিভাগে শৃঙ্খলা প্রবর্তন করে দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করবার জন্য সম্রাটকে প্রতিবছর এককোটি টাকা পাঠিয়েছিলেন। এসময়ে অর্থাভাবে জর্জর ঔরঙ্গজেবের পক্ষে এটা এমন এক সুযোগ ছিল, যা এর আগের কোন সুবেদারই তাঁকে দিতে পারেন নি। আর একারণেই মুর্শিদকুলিকে তিনি সবসময় নিজের ‘জীবনরক্ষক দেবদূত’ (life-saving angel) বলে গণ্য করেছিলেন, এবং তাঁর এই দেবদূতের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তৎকালীন মোঘল দরবারে গ্রাহ্য করা হত না।


মুর্শিদকুলি বাংলার সুবেদার হয়ে প্রথমেই এখানে চালু থাকা মোঘল শাসনবিধির একটি মৌলিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। এর আগে আকবরের সময় থেকে মোঘল সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত প্রাদেশিক দেওয়ানেরা প্রায় স্বাধীনভাবে প্রাদেশিক রাজস্ব বিভাগ পরিচালনা করতেন, এবং দিল্লিতে থাকা বাদশাহী দেওয়ানই তখন তাঁদের উপরওয়ালা ছিলেন। কিন্তু বাংলার সুবেদারীর দায়িত্ব পাওয়া পরে মুর্শিদকুলি এই নিয়মটি বদলে দিয়েছিলেন। তাঁর সময় থেকে তিনিই বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করবার ফলে, দেওয়ান তখন বাদশাহের অধীনস্থ কর্মচারী না হয়ে সুবাদারের অধীনস্থ কর্মচারীতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। এরফলে মুর্শিদকুলির সময় থেকেই রাজস্ব বিভাগের পরিচালনা সংক্রান্ত ব্যাপারে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে বাংলার যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন তো হয়ে গিয়েছিলই; একইসাথে শাসন সংক্রান্ত সব ব্যাপারেও বাংলায় সুবেদারের পূর্ণ কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর মুর্শিদকুলির পরবর্তী নবাবরাও এই একই রীতি অনুসরণ করবার ফলে তাঁদের সময়েও বাংলা দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের বাইরেই থেকে গিয়েছিল।


মুর্শিদকুলি থেকে শুরু করে সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত পাঁচজন নবাব স্বাধীনভাবেই বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন, কিন্তু তবুও এঁদের মধ্যে কেউই দিল্লির বাদশাহের সার্বভৌম অধিকার অস্বীকার করেননি। এঁদের পরে মীরজাফর এবং মীর কাসিম ইংরেজদের কর্তৃত্ব মানতে বাধ্য হয়েছিলেন; কারণ, ইংরেজদের সাহায্যেই তাঁরা বাংলার মসনদ অধিকার করেছিলেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে মীর কাসিম আবার নবাব হওয়ার কিছুকাল পরেই এই কর্তৃত্ব অস্বীকার করে নিজের রাজ্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। অন্যদিকে মীরজাফর বংশীয় নবাবেরা ইংরেজের হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত ১৭৯০ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস মুর্শিদাবাদ থেকে নিজামত আদালত কলকাতায় স্থানান্তরিত করেছিলেন, এবং ফৌজদারী বিচার-ব্যবস্থায় নবাবের কর্তৃত্ব বিলোপ করে বাংলায় নবাবী শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন। তবে এর আগে ১৭১৭ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত—এই চল্লিশ বছর ধরে বাংলার নবাবেরা কার্যতঃ স্বাধীন ছিলেন বলে, মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসে এই যুগকে নবাবী আমল বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এরপরে যেহেতু আবার ১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত ইংরেজেরা রাজনৈতিক কারণে বাংলার নবাবী কাঠামো বজায় রেখে দিয়েছিলেন, সেহেতু এই যুগকেও ঐতিহাসিকেরা নবাবী আমলেরই অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন।





 নালন্দা নয়, বখতিয়ার খিলজি  আক্রমণ করেছিল ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয়


ভারতের প্রাচীন শিক্ষার ইতিহাসে ওদন্তপুরী (Odantapuri বা Odantapura) বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। এটি প্রাচীন বিহারের বিখ্যাত বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রগুলির অন্যতম, নালন্দা ও বিক্রমশীলার সমসাময়িক ও সমগৌরবময়। ধারণা করা হয়, এটি স্থাপিত হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে পাল সম্রাট গোপালের আমলে। গোপালই ছিলেন প্রথম পাল সম্রাট, যিনি ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে বাংলার ও বিহারের এক বৃহৎ অঞ্চল একত্র করে একটি সুসংগঠিত সাম্রাজ্য গঠন করেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রবল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বৌদ্ধ শিক্ষার প্রচার ও সম্প্রসারের জন্য একাধিক বিহার ও মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন।


ওদন্তপুরী মহাবিহার নালন্দা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে, বর্তমান বিহারের নালন্দা জেলার বিহারশরীফ নামক স্থানে অবস্থিত ছিল। এটি ছিল একটি সুবৃহৎ বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র, যেখানে হাজার হাজার ভিক্ষু ও পণ্ডিত বসবাস করতেন। এখানে প্রধানত মহাযান বৌদ্ধধর্মের দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ব্যাকরণ, গণিত ও দর্শনচর্চা হতো। ওদন্তপুরী ছিল একদিকে ধর্মীয় কেন্দ্র, অপরদিকে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা এখানে এসে অধ্যয়ন করতেন — যেমন তিব্বত, চীন, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে বহু ভিক্ষু এই বিহারে আসতেন।

তিব্বতের ঐতিহাসিক গ্রন্থ “তারা নাথের ইতিহাস” (Taranatha’s History of Buddhism in India) অনুযায়ী, ওদন্তপুরী ছিল পাল আমলের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক তিব্বতীয় ভিক্ষু এই বিহারে শিক্ষা গ্রহণ করে পরে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন।


তবে এই গৌরবময় শিক্ষা কেন্দ্রের পতন ঘটে দ্বাদশ শতাব্দীতে। ভারতের ইতিহাসে এক ভয়াবহ সময় — মুসলিম আক্রমণের যুগ — এই সময়েই শুরু হয়। ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি উত্তর ভারতের দিকে অগ্রসর হন। তার লক্ষ্য ছিল গঙ্গা উপত্যকার সমৃদ্ধ নগর ও রাজ্যগুলো জয় করা। প্রথমে তিনি বিহারে প্রবেশ করে ওদন্তপুরী মহাবিহার আক্রমণ করেন। ইতিহাসবিদ মিনহাজ-উস-সিরাজ তাঁর গ্রন্থ তবকাত-ই-নাসিরী তে লিখেছেন, বখতিয়ার খিলজি প্রথমে ওদন্তপুরী আক্রমণ করে সেটিকে ধ্বংস করেন। সেখানে প্রচুর সংখ্যক সন্ন্যাসী ও পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়, কারণ সৈন্যরা মনে করেছিল যে এই বিহার আসলে কোনো দুর্গ, যেখানে সেনারা আশ্রয় নিয়েছে। তারা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অস্ত্রধারী সৈন্য ভেবে নির্বিচারে হত্যা করে। পরে পুরো প্রতিষ্ঠানটি আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অমূল্য পাণ্ডুলিপি, তাম্রলিপি, শাস্ত্রগ্রন্থ এবং বহু শতাব্দীর জ্ঞানভাণ্ডার মুহূর্তেই ছাই হয়ে যায়।



রোম যখন পুড়ছিল, নিরো কি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন?


রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জুলিও-ক্লদিয়ান বংশের শেষ শাসক ছিলেন নিরো। ৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পঞ্চম সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন নিরো। ১০ বছর পর জুলাই মাসে অ্যান্টিমে (ইতালির সমুদ্রতীরবর্তী শহর আনজিও) তিনি ছুটি কাটাতে যান। ঠিক তখনই ভয়াবহ আগুন রোমে, টানা ছয় দিন জ্বলে–পুড়ে রোমের ৭০ শতাংশ ধ্বংস হয়। গৃহহারা হয় অর্ধেক মানুষ। 

দাবি করা হয়, রোমান সম্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে ‘নিষ্ঠুর’ ও ‘পাগলাটে’ শাসক নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। বিশ্বজুড়েই মানুষ এটা বিশ্বাস করে। 

তবে এই প্রবাদ সত্য নয়।  যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিরো–বিষয়ক এক প্রতিবেদনে জানা যায়,

অগ্নিকাণ্ডের খবর জেনে নিরো অ্যান্টিম থেকে তাৎক্ষণিক রোমে ফিরে আসেন এবং ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁর প্রতি আস্থাহীনতার কারণে অনেকেই বিশ্বাস করত, রোমের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিরোর নির্দেশেই হয়েছে। তবে এর কিছু কারণও আছে—আগুনে পুড়ে খালি হওয়া জায়গায় নিজের জন্য রাজপ্রাসাদ ও বিলাসী বাগান গড়ে তোলেন নিরো। আবার ঘটনার জন্য খ্রিষ্টানদের দায়ী করেন এবং এই কারণে অনেককে গ্রেপ্তার ও প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। তবে নিরোর কুখ্যাতি থাকলেও রোমের আগুনের ঘটনায় তাঁর বাঁশি বাজানোর দাবিকে ‘বহুল প্রচলিত রূপকথা।  সম্রাট নিরো সম্পর্কে আধুনিক বিশ্বে যত তথ্য পাওয়া যায়, তার প্রায় সবগুলোই রোমান সিনেটর এবং খ্রিষ্টানদের দ্বারা রচিত এবং উভয়ই ছিল নিরোর ঘোর শত্রু


সুলতানার স্বপ্ন, সাহসী মেয়েদের এক অমীমাংসিত লেডিল্যান্ড

সম্প্রতি ইউনেসকো রোকেয়া সাখাওয়া হোসেনের উপন্যাস সুলতানাস ড্রিমকেবিশ্বস্মৃতিবাওয়ার্ল্ড মেমোরির তালিকায় স্থান দিয়েছে।  অনেকের মতে,  সুলতানাস ড্রিম একটিফেমিনিস্ট ইউটোপিয়া ২৫ বছর বয়সে রোকেয়ার ইংরেজিতে লেখা সুলতানা’স ড্রিম প্রথম প্রকাশিত হয় ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিনে। সেই ১৯০৫ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা বাংলার প্রেক্ষাপটে মুসলিম পারিবারিক রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপে বসে এই যে কল্পনাটি করেছিলেন তা এক বিরাট বিস্ময়। ১৯০৮ সালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালে তিনি নিজেই এটি বাংলায় অনুবাদ করেন। 

আমাদের প্রচলিত ব্যাখ্যায় বেগম রোকেয়া কেবলমাত্র একজন নারীবাদী সমাজ সংস্কারক ও লেখক। সুলতানার স্বপ্ন উপন্যাসে তিনি এমন একটি ছবি একেছেন; যেখানে দেখা যায়, সুলতানার আধো পরিচিত ভগিনী সারার লেডিল্যান্ডে বা নারীস্থানে নারীরাই রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা করে, আর পুরুষেরা ঘরের কাজ করে। আজ থেকে প্রায় সোয়াশো বছর আগে অনগ্রসর বাংলায় বসে এমন একটি মাতৃকেন্দ্রীক (মাতৃতান্ত্রীক নয়) সমাজ কল্পনা করতে পারাটা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক। 

 'সুলতানার স্বপ্ন'-এ বেগম রোকেয়া পরুষজাতকে অকর্মণ্য, মোটাবুদ্ধি, যুদ্ধবাজ, এবং নারী-নিগৃহক আখ্যা দিতে কোনো পিছপা হননি। গল্পের সিস্টার সারা সুলতানাকে বলেন, নিরীহ নারীদের জেনানায় আটকে রেখে পুরুষদের ছেড়ে রাখাটা কত বড় অন্যায়? রোকেয়া আসলে নারীর সামনে একটা উল্টো চিত্র হাজির করে তাঁদের জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। অভ্যস্ত গৃহকোন থেকে তিনি তাঁদের বের হতে বলছেন আর স্বপ্ন দেখিয়েছেন নারীর নিজের শক্তির প্রতি আস্থা রাখতে।  রোকেয়া নিজের সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছ থেকে আঘাত পেয়েও অটল থেকেছেন কর্তব্যেনারী জাতিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার লড়াইয়ে দিয়ে গেছেন জীবনটাই



হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট (এশিয়ার প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র)

হাল ছেড়ে দেওয়া এক ক্ষ্যাপাটে সাংবাদিকের জীবন থেকে শিক্ষা

 

জেমস অগাস্টাস হিকির জন্ম আয়ারল্যান্ডে। হিকি কোনো বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন না। হিকি বাল্যকালেই বাবাকে হারান। তরুণ বয়সে সংসার চালাতে ডাবলিনে একজন আইনজীবীর অফিসে কেরানির চাকরি নিয়েছিলেন। ওই কাজে সুবিধা করতে না পেরে চলে যান লন্ডনে। সেখানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ জোটে একটি ছাপাখানায়। কিছুদিন পর ওই কাজও ছেড়ে দেন। নতুন কাজ নেন ব্রিটিশ নৌ-বাহিনীতে। এ সময় তিনি দু-একটা যুদ্ধেও অংশ নেন। এরপর লন্ডনে ফিরে যোগ দেন এক বিখ্যাত উকিলের অফিসে। তবে বেশিদিন এ কাজও তার ভালো লাগেনি। এরপর শল্য চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর দাস ব্যবসায়ীদের একটি জাহাযে যোগ দেন একজন সার্জনের সাহায্যকারী হিসেবে।  মালিক তাকে কোনো পারিশ্রমিক না দেয়ায় রাগ করে এই কাজও ছেড়ে দেন। এরপর রকিংহাম নামের একটি জাহাজে চড়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় হিকি পেশাগত জীবন শুরু করেন একজন শল্য চিকিৎসক হিসেবে। ছোট-খাটো রোগের নানা ধরনের ওষুধ দিতেন।

 

তবে কিছুদিন পর ধারদেনা করে ছোট একটা জাহাজ কিনে কলকাতা-মাদ্রাজ মালপত্র পরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন। যদিও সমুদ্র ঝড়ে তার আমদানি করা মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। ব্যবসায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার হন হিকি। পাওনাদারদের মামলায় তাকে জেলে যেতে হয়। জেল থেকে মুক্তির পর কিছু টাকা জমিয়ে একটি ছাপাখানা খুলে বসেন। যাতে ছাপা হতো হ্যান্ডবিল, বিজ্ঞাপন, পঞ্জিকা, এমনকি কোর্টের দলিল ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ফর্ম ইত্যাদি। ১৭৭৯ সালের অগাস্টে হিকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর নিয়ম-নীতি (রেগুলেশন) ছাপার দায়িত্ব পান। কিন্তু লিখিত অর্ডার না নিয়ে কাজ শুরু করার অপরাধে জটিলতা তৈরি হয়। এতে কোম্পানির কাছে হিকির পাওনা টাকা আটকে যায়। ফলে  হিকির সাথে ওয়ারেন হেস্টিংসের দ্বান্দ্ব শুরু হয়। এইসময় হিকি সহযোগিতা পান কোম্পানির কর্মকর্তা ফ্রান্সিস ফিলিপের। একসময় ফ্রান্সিস ফিলিপ ইংল্যান্ডে সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন। ফিলিপের সহযোগিয়ায় কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট। দিনটি ছিল ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি। এই সংবাদপত্রের পাঠক ছিলেন ইংরেজসহ অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকেরা। কলকাতা বন্দরে কোন জাহাজ কবে ভিড়বে, কী কী পণ্যের নিলাম হবে— এ সব খবর থাকত। হিকি ওই সময় তার সংবাদপত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জ করে বসেন। কলকাতাবাসীদের কাছ থেকে হেস্টিংসের অন্যায্য কর আদায়ের বিরোদ্ধে হিকি অবস্থান নিয়েছিলেন। পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। দ্বিতীয়বার জেলে যাওয়ার পর হিকি প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। জীবনে কিছু করার শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি রওনা হয়েছিলেন চীনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু চীনে পৌঁছানোর আগেই শ্রীলঙ্কার কাছে জাহাজেই তার মৃত্যু হয়। 

 

হিলির জীবন থেকে আমরা কয়েকটি শিক্ষা পাই। এক) কখনো হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। যতক্ষণ শ্বাস আছে, ততক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

দুই) প্রয়োজনীয় শক্তি মজুদ না থাকলে, বড় কিছুকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। তিন) শেষ বয়সের জন্য কিছু শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে হয়। চার) ক্ষ্যাপাটে একরোখা মানসিকতার পরিবর্তে , বন্ধুসুলভ সুন্দর মানসিকতার চর্চা একান্ত জরুরী। অর্থাৎ মেধার চেয়েও বিনয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।



 

ইনফ্লুয়েন্সাররা শেখ হাসিনাকে কেন সাইকো বলে অভিহিত করে? সাইকো আসলে কি?

 

সাইকোপ্যাথদের বৈশিষ্ট্য হল, আবেগ-অনুভূতি অভাব এবং প্রায়শই অসামাজিক বা অপরাধমূলক আচরণ করে। তাদের কোনো অনুশোচনা নেই এবং কখনোই অপরাধবোধ কাজ করে না।  সাইকোপ্যাথরা সাধারণত মিথ্যা বলা, প্রতারণা বা নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে অন্যদের ক্ষতি করতে পারে এবং নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যদের অনুভূতি ও অধিকার উপেক্ষা করতে পারে।  তারা খুব মিষ্টভাষী ও মোহময়ী হতে পারে, যা অন্যদের সহজেই আকৃষ্ট করে। তারা সত্য লুকিয়ে বা বিকৃত করে নিজের সুবিধা আদায় করে। অন্যের কষ্ট বা দুঃখ তাদের স্পর্শ করে না। অপ্রত্যাশিত ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়, মানুষকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে এবং ঠান্ডা মাথায় প্রতারণা চালিয়ে যায়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, কাজ অসম্পূর্ণ রাখা, এবং একের দোষ অন্যের ওপর চাপানো। আইন ভঙ্গ করা বা অন্যদের ক্ষতি করার প্রবণতা। নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বা অহংকার প্রদর্শন।

সাইকোপ্যাথি কেন হয়?

মস্তিষ্কের গঠন বা রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা এবং  শৈশবে নির্যাতন, অবহেলা, বা অস্থিতিশীল পারিবারিক পরিবেশ-এর কারণে হয়।

সাইকোপ্যাথ vs সোসিওপ্যাথ:

  সাইকোপ্যাথ: এরা সাধারণত ঠান্ডা মাথার এবং পরিকল্পিত আচরণ করে। তাদের অপরাধমূলক আচরণ প্রায়শই সুপরিকল্পিত হয়।

 সোসিওপ্যাথ: এরা বেশি আবেগপ্রবণ এবং তাদের আচরণ কম পরিকল্পিত এবং বেশি আবেগনির্ভর।

প্রতিকারঃ

সাইকোপ্যাথি সাধারণত অসুস্থতা হিসাবে বিবেচিত হয় না, বরং এটি একটি ব্যক্তিত্বের ব্যাধি। এর জন্য কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে থেরাপি বা কাউন্সেলিং মাধ্যমে কিছু আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাইকোপ্যাথরা তাদের আচরণ পরিবর্তনে অনিচ্ছুক হয়।



"এজেন্ট অফ ইনফ্লুয়েন্স" এবং তার ক্ষমতা**

গোয়েন্দা দুনিয়ায় তথ্য সংগ্রহ এবং প্রভাব বিস্তারের কৌশলগত দিক গুলো বহুবিধ এবং অনেক সূক্ষ্ম। এর মধ্যে একটি বিশেষ ধরনের গোয়েন্দা  বা এজেন্ট রয়েছে যাদের কার্যক্রম অত্যন্ত জটিল এবং শক্তিশালী। এদের বলা হয় "এজেন্ট অফ ইনফ্লুয়েন্স" বা প্রভাব বিস্তারকারী এজেন্ট।

এজেন্ট অফ ইনফ্লুয়েন্স হল এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাকে শত্রু রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তার উপস্থিতি এবং প্রভাব ধীরে ধীরে এতটাই ব্যাপক হয় যে, সেই দেশ বা জনগণ তার প্রতি অন্ধবিশ্বাস করতে শুরু করে। তার সব বয়ান অন্ধভাবে মেনে নেয়।এই ইনফ্লুয়েন্সার এতটা প্রভাব বিস্তার করে যে ধর্মিয় পরিচয় ও অকার্যকর।এমনকি  হিন্দু ইনফ্লুয়েন্সার মুসলিম নেতাদের দিয়ে কার্য হাসিল করতে পারে। এই ধরনের এজেন্ট সাধারণত সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন জনপ্রিয় লেখক, সাংবাদিক বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে "এজেন্ট অফ ইনফ্লুয়েন্স" হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। প্রথমে সে ওই দেশের জনগণের মধ্যে বিশ্বাস অর্জন করে, এবং পরবর্তীতে তার মাধ্যমে সেই জনগণ বা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য ব্যবহার হয়।

এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং দীর্ঘমেয়াদী। "এজেন্ট অফ ইনফ্লুয়েন্স" প্রথমে তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করে এবং ধীরে ধীরে তাদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। ফলে, শত্রু রাষ্ট্র তার পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য এই এজেন্টকে ব্যবহার করে। তারা এমন সব তথ্য প্রচার করে যা শত্রু রাষ্ট্রের পক্ষে যায়, কিন্তু জনগন ভাবে তার নিজের দেশের হয়েই কাজ করছে এবং যা লক্ষণীয়ভাবে ওই দেশের রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় কিউবায় এবং অন্য অনেক দেশে সোভিয়েতপন্থী লেখক, সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের ব্যবহার করা হতো। তারা সোভিয়েত আদর্শকে প্রচার করতেন এবং ধীরে ধীরে ওই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে নিয়ে যেতেন।

এই ধরনের "এজেন্ট অফ ইনফ্লুয়েন্স" শুধু তথ্য সংগ্রহে নয়, বরং একটি গোটা জাতির মনোজগতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তাদের কার্যক্রম প্রমাণ করে, যুদ্ধ এবং সংঘাত শুধুমাত্র অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, বরং মনোজগতের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও জয় করা যায়"।

আজ আমার এই ছোট প্রয়াস এর কারন হলো  এমন কিছু এজেন্ট আছে যারা ইউটিউবিং এর মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক মনোজগত কে নিয়ন্ত্রণ করছে।  এজেন্ট অফ ইনফ্লুয়েন্স" কিভাবে শত্রু রাষ্ট্রের হয়ে জনগনের মধ্য থেকে কাজ করে তার বিস্তারিত বর্ননা করা।



কথা বলার ৫টি বিস্ময়কর টেকনিক

 

কথা বলাটা একটা শিল্প। এই শিল্পকলা চর্চার-বিষয়। ভালোভাবে  কথা না বলতে পেরে আমরা জীবনে অনেক ক্ষেত্রে অসফল হয়েছি এবং যারা ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না, তারা ভবিষ্যতেও অনেক ক্ষেত্রে অসফল হবেন। আপনারা দেখে থাকবেন, যারা ভালোভাবে কথা বলতে পারে, তাদের সবাই পছন্দ করে। আপনার অফিসে, কিংবা সমাজে অনেকের মাঝে এমন একজন আছেন, যিনি খুব ভালো কথা বলতে পারেন এবং খুব সহজেই অন্যকে ইম্প্রেস করতে পারেন। তাকে দেখে আপনার মধ্যে ইর্ষাও আছে, আবার মনে মনে আত্ম অভিমানও জন্মে; না না, আমার অত ভালো কথা বলার দরকার নেই। আসলে আপনি আপনার চেনা পরিচিত মানুষ ছাড়া কথাই বলতে পারেন না। যেটা আপনার জন্য খুবই ক্ষতিকারক। কারণ, মানুষের সাথে কথা বলা এবং কমিউনিকেট করা আমাদের সাফল্যের একটি বড় অংশ। এটা এমন একটা স্কিল, যা আমাদের প্রত্যেকেরই বাড়ানো উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এই স্কিল বাড়াতে তেমন কোন সাহায্যই করে না।

 

# কথা বলার টেকনিক-১: উইলিয়াম টেনজার একজন স্টক ব্রোকার ছিলেন। তিনি তার বিয়ের এক বছর পরেও তার স্ত্রীর সাথেও ভালোভাবে কথা বলতেন না এবং হাসি মজাও করতেন না। তিনি নিজের জীবনে বেশি খুশি ও সুখী ছিলেন না। অন্য লোকের সাথে তার রিলেশনশীপও খুব একটা ভালো ছিল না। একান্ত প্রয়োজন না হলে তিনি কখনো কারো সাথে কথা বলতেন না। তার স্ত্রী এই পরিস্থিতি নিয়ে খুবই দু:চিন্তায় পড়লেন। এটা কাটাবার জন্য তাকে একটি কথা বলার ক্লাবে ভর্তি করে দেয়া হলো। ক্লাবে ওনাকে একটা সিম্পল টিপস্ দেয়া হয়। টিপসটি হলো ওনাকে প্রতি ঘন্টায় অন্তত একবার কোনো মানুষের সাখে স্মাইল করতে হবে বা মৃদু হাসতে হবে। এটা উনি খুব সিরিয়াসলি নিলেন এবং এপ্লাই করা শুরু করে দিলেন। রাস্তাঘাটে পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে সৌজন্যমূলক স্মাইল দেয়া শুরু করলেন। তিনি উপলব্দি করলেন, যাদের তিনি স্মাইল  দেন, তারাও তাকে দেখে স্মাইল দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে সবাই তার সাখে কথা বলা শুরু করে দিলেন এবং তিনি একজন ইতিবাচক নেতা হয়ে উঠলেন।

 

#কথা বলার  টেকনিক-২: আপনি যদি কথা বলার সময় সামনের মানুষটির দিকে না থাকিয়ে এদিক-ওদিক তাকান, তা সামনের মানুষটিকে এই সিগন্যাল দেয় যেআপনি তার প্রতি ইন্টারেস্টেট বা আগ্রহী নন। এটা কোন মানুষই পছন্দ করেন না, মনে মনে বিরক্তবোধ করেন। কথা বলার সময় আপনি সামনের মানুষটির চোখের দিকে সরাসরি তাকান বা আই কনট্রাক্ট করুন।শ

 

# কথা বলার টেকনিক-৩: আপনার জীবনে এমন ঘটনা অনেক আছে যে, যখন আপনি খুব খারাপ মুড়ে আছেন। আপনি খুব খোলামেলা আলাপি মানুষ হলেও এই সময় ওই লোকটির প্রতি বিরক্তিও আসতে পারে। অথবা উল্টোটাও হতে পারে। আপনি খুব আনন্দে উত্তেজিত আর আপনার সামনের মানুষটি খারাপ মুড়ে আছেন। ফলে আপনার প্রতি তার বিরক্তি বা রাগ আসতে পারে। এই কারণে যখন আপনি কারো সাথে কথা বলা শুরু করবেন, তখন আপনাকে দেখতে হবে যে, সামনের মানুষটির মুড় কেমন আছে। প্রথমে আপনি শান্তভাবে তার সাথে কথা বলা শুরু করুন। তারপর ধীরে ধীরে আপনার মুড় এবং এক্সসাইট লেবেল বাড়ান। এই টেকনিকটা আপনার সামনে থাকা মানুষটির মুড়ও ঠিক করে দিতে পারে।

 

# কথা বলার টেকনিক-৪:  : আমরা নতুন কারো সাথে পরিচিত হলে তার সাথে কথা আগে বাড়াতে পারি না। নাম পরিচয় হয়তো জানা হলো কিন্তু কথা আর এগুতে না পারার কারণে চুপচাপ, তখন একটাই চিন্তা মনে আসে কিভাবে এই দমবন্ধ করা পরিস্থিাতি থেকে বের হওয়া যায়। এই ঘটনার পর যতদূর সম্ভব দুজন দুজনকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা হবে। কারণ তারা সে আগের পরিস্থিতিতে আবার পড়তে চান না। যদি আপনি এই পরিস্থিতিতে পড়তে না চান এবং নতুন কারো সাথে সুন্দর সম্পর্ক চান, তাহলে কখনোই তার প্রশ্নের জবাব একলাইনে দেবেন না। যেমন আপনি কোথায় থাকেন? কি করেন? এই প্রশ্নগুলোর জন্য বড় কোনো উত্তর খুঁজুন। মানে আপনি যেখানে থাকেন বা আপনার কর্মস্থল সম্পর্কে আরো কিছু ইন্টাররেস্টিং তথ্য বা ঘটনা যোগ করুন; যা আপনার সামনের মানুষটিকে আরো কিছুটা আকর্ষণ করতে এবং প্রভাব বাড়তে সহায়তা করবে। এটা কথোপকথন এগিয়ে নিয়ে যেতেও সাহায্য করবে। 

 

# কথা বলার টেকনিক-৫:  :  তোতা পাখির মত রিপিট করা। যদি আপনি সামেনের মানুষটির সাখে কথা আরো বাড়াতে চান, তাহলে সামনের মানুষটির কথার অংশ রিপিট করতে হবে। যেমন- এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, পথে এক মুখ চেনা মানুষের সাথে দেখা। যার সাথে সম্পর্ক আগে বাড়েনি; সে সম্পর্ক বাড়াতে চায়। চেনা মানুষটি বলল-  সে একটা বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরছে। লোকটি রিপ্লাই দিলো: বিয়ে? -হ্যা, আমার মামাত বোনের বিয়ে। -মামাত বোন? -হ্যা, আমার বড় মামার একমাত্র মেয়ে। ডাক্তারী পড়ছে। - ও ডাক্তার? -হ্যা, স্বামীও ডাক্তার; ছেলেটার বাড়ি কুস্টিয়া। - কুস্টিয়া? -হ্যা কুস্টিয়া শহরে তাদের পৈত্রিক ব্যবসা। এভাবে রিপিট করে কথা বাড়ান।

 

 সাড়ে তিন হাত জমি

বিশ্বখ্যাত লেভ তলস্তয় তাহারসাড়ে তিন হাত জমিগল্পে দেখাইয়াছেন -বিপুল ভূমি ক্রয় করিতে গিয়া পাখোম কীভাবে মারা গিয়াছিলেন জমি দখলের একদম শেষ মুহূর্তে। জমি ক্রয়ের শর্ত ছিল, পাখোম ভোর হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতখানি হাঁটিবেন ততখানি জমির মালিক হইবেন তিনি।লোভনামের শয়তান পাখোমকে অস্বাভাবিক পর্যায়ে হাঁটাইয়া লইয়া যায়। শেষ পর্যন্ত মূল জায়গায় ফিরিয়া আসিবার অন্তিম ক্ষণে তাহার মৃত্যু হয়। আর মৃত্যুর পর তাহার কবরের জন্য প্রয়োজন হয় মাত্রসাড়ে তিন হাত জমি। তলস্তয়ের গল্পটির ভাবার্থ আমাদের বুঝাইয়া দেয়, কেহ যদি তাহার সীমা লঙ্ঘন করে তাহা হইলে তাহার পরিণতি হয় ভয়াবহ। আমরা এখন চারিদিকে দেখিতেছি এই সীমা লঙ্ঘনের খেলা।

 

পৃথিবীতে এমন কোনো বড় অপরাধী নাই, যিনি মেধাবী নহেন।

আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের নাম অনেকেই শুনেছি। তিনি ৯ বছর বয়সে তার মাকে হারান। খুব অল্প বয়সেই দরিদ্র পরিবারের হাল ধরেন। কখনো নৌকা চালিয়ে, আবার কখনো কাঠ কেটেও সংসার চালিয়েছেন তিনি। পূর্বজীবনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের শরবত বিক্রি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চা বিক্রি, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর ফার্নিচারের দোকানদারি, ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বাস চালনো, ব্রিটেনের নির্বাচিত তিন বারের প্রধানমন্ত্রী ম্যাক ডোনাল্ডের খেতমজুরের কাজ করা এবং ইতালির প্রেসিডেন্ট মুসোলিনির দোকানের কাজের কথা সবারই জানা

 

ছাত্র রাজনীতিr সংস্কার কে করবে?

মুক্তিযুদ্ধের পর ফ্রান্সের দার্শনিক আন্ড্রে মলরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে এসেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আজকে পৃথিবীর এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবিত ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে মৃত ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা কম নয়। মৃত ছাত্রছাত্রীরা মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোত্সর্গ করে গেছেন।আপনারা আপনাদের মৃত সহপাঠীদের কবরে শুধু একটি কথা লিখে রাখবেন, ‘হে পথিক, তোমরা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য জীবন উত্সর্গ করেছো।তার এই কথাটি যে কত তাৎপর্যপূর্ণ, তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। স্বাধীনতাযুদ্ধে যে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে গেছেন, তার মধ্যে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী রয়েছেন। আমরা এই দেশটির সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পরস্পরের হাতে হাত ধরে একত্রে কাজ করে যাব । তখন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জাতীয় রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পর্ক ছিল না। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যখন রাজনৈতিক দল পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেনতখন সামরিক ফরমান বলে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একটি ছাত্র সংগঠন, একটি যুব সংগঠন, একটি শ্রমিক সংগঠন, একটি মহিলা সংগঠন থাকতে হবে। তখন থেকে সব ছাত্র সংগঠন রাজনৈতিক দলের ছায়ায় চলে যায়   এবং  নেতা-নেতৃদের আশ্রয়ে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে।   

ইউরোপ-আমেরিকায় ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই নিজস্ব আয় দিয়ে লেখাপড়া করে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে ছাত্র প্রতিনিধিরা নিজেরা আয় করতে পারে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সম্মানি দিয়ে থাকে। সেই সম্মানি দিয়ে সে তার লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ করে। 

আমাদের এইযে ছাত্ররাজনীতি চলছে, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ছাত্ররাজনীতি পরিশোধন ও সংস্কার করা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। 

 

 

অভদ্রতার  প্রতিদানে  ভদ্রতা কেন নয়?

সিডনি জে. হ্যারিস-এর বিখ্যাত একটি লেখা আছে। যেখানে তিনি ও তার বন্ধু এক রাতে হেঁটে হেঁটে একটি পত্রিকার স্ট্যান্ডে যান । একটি পত্রিকা কেনেন এবং দোকানদারকে ধন্যবাদ জানান বিনয়ের সঙ্গে। কিন্তু দোকানদার কোন প্রতুত্তর দিল না।

বন্ধুটি মন্তব্য করলো, “বিক্রেতা একজন গোমড়ামুখো লোক, তাই না?”

কাঁধ ঝাকিয়ে লেখক বললেন, “সে প্রতি রাতেই এমন আচরণই করে।

বন্ধু জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে তুমি কেন এমন বিনয়ী আচরণ অব্যাহত রেখেছ?”

লেখক জানতে চাইলেন, “কেন নয়যদি আমি  তারঅভদ্রতার  প্রতিদানে তাকে অভদ্র ব্যবহার করিতা  হলে সদাচরণের উপর  আর আমার কর্তৃত্ব থাকবে না । আমার শিক্ষা, আমার রুচি, আমার আদর্শ , আমার ব্যবহারের ছন্দপতনের মাধ্যমে ধুলোয় মিশে যাবে। মন্দের বিনিময়ে ভালোকে ফেরত আনার শিক্ষা, নৈতিকতার পতনের মাধ্যমে আমার মনুষ্যত্ব, মানুষ হিসাবে জন্ম নেওয়ার সার্থকতা বিলীন হয়ে যাবে।

 

আমরা স্বঅধীন (স্বাধীন) নই, আমরা পরষ্পরের অধীন 

পৃথিবীতে ‘আমি’ ও ‘আমার’ শব্দ দু’টির ব্যবহার যতো বেশি হয়, হয়তো আর কোন শব্দের ব্যবহার এতো বেশি হয় না। ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়া এবং ইউনিভার্সিটি অফ সিনসিনাটির গবেষণা অনুযায়ী হাসপাতালের একজন মানসিক রোগী ‘আমি' শব্দটি অন্য যে কোন শব্দের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবহার করে—প্রতি ১২টি শব্দের মধ্যে একবার । সুস্থ মানুষের চেয়ে তিন গুণ বেশি। কিন্তু রোগী যেই সুস্থ হয়ে উঠে, তার ‘আমি’ শব্দটির ব্যবহার অনেক কমে যায় এবং ‘আমরা' শব্দটির ব্যবহার বৃদ্ধি পায় । অর্থাৎ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, উৎকণ্ঠা-হতাশা , উদ্বিগ্নতা যত বৃদ্ধি পায়; মানুষ ততই আমিত্বের  দাস হয়ে পড়ে।  এইজন্য আমিত্বকে বলা হয় ‘নিম্ন শ্রেণীর মানুষের আহাজারি’/


শৈশব থেকেই আমরা শুধু ক্রমাগত চেয়েছি, আর নিতেই শিখেছি। আজ এটা, কাল সেটা। শুধু চাই আর চাই, আর পাই নাই; পাই নাই গল্প। ফলে অবচেতনভাবে এই ‘আমিত্ব’টা  আমাদের মন ও চিন্তার মধ্যে সেট হয়ে গেছে। সবকিছু আমার চাহিদামতো হবে! এর ব্যত্যয় ঘটলেই যত বিবাদ, বিতর্ক !  সাবালক এমনকি শক্তিশালী যুবক হয়েও আমরা স্রষ্টার কাছে দু’হাত তুলে বারবার বলতে থাকি, ‘হে সৃষ্টিকর্তা, আমাকে এটা দাও, ওটা দাও। একবারও বলি না, পথশিশু, অসহায় মানুষদের পাশে বসার মানবিক গুণ আমাকে দাও।


জন এফ কেনেডি যখন প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভাষণ দিতে মঞ্চে ওঠেন, তখন তিনি প্রথমেই বলেন, ‘দেশ আপনাকে কি দেবে’ সেটা জানতে চাইবেন না; বরং আপনি দেশের জন্য কী দিতে পারবেন, সেটা ভাবেন প্রথমে!’  তার মত করে বলা যায়, কে আপনাকে কি দিলো, সেটা ভেবে কাতর না হয়ে; বরং আপনি আপনার সীমিত সক্ষমতায় কাকে কি দিতে পেরেছেন, সেটা ভাবুন।

 

মনে রাখবেন, যত বেশি জীবনটা ‘আমি’ শব্দটা দিয়ে পরিচালিত করবেন, তত বেশি এই ‘আমি’ হতাশায় নিমজ্জিত হবেন। কারণ পৃথিবীর মানুষ  আপনার-আমার প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য বাঁচে না। 

‘আমিত্ব’ আর ‘পশুত্ব’ একে অন্যের দোসর। মানুষের মধ্যে আমিত্ব গ্যাঁট হয়ে বসলে পশুত্ব দ্রুত বাড়ে।  এতে মানবতা পালায়, পাশবিকতা ডালপালা ছড়ায়। 

‘আমিত্ব’ মানে আমাকে কেন্দ্র করেই সব। আমি’র চারপাশে আছে শুধু আমার মতামত, আমার সিদ্ধান্ত, আমার ইচ্ছা,আমার পছন্দ, আমি এটা ভালোবাসি, আমি সেটা চাই, আমি এটা চাই না- আমার কথার বাইরে ভিন্নমত সহ্য করব না, আমিই সেরা, ভিন্নমতের ভিন্ন কারও অস্তিত্বই রাখব না-এ ধরনের  ভাবনাগুলোই আমিত্ববাদ! । এই আমিত্ববাদ মানুষকে স্বৈরাচারী করে তোলে। কিন্তু প্রকৃতির একটা সূত্র মনে রাখা দরকারঃ মানুষ কোনো কিছু  ‘যত শক্ত করেই ‘ আঁকড়ে ধরুক না কেন, সময়ের পরিক্রমায় এই শক্ত মুঠো এক সময় আলগা হবেই। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় “ একসময় সব কিছুই ভেঙ্গে পড়ে”। তখন আমিত্ব তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। ‘আমিত্বের’ কঠিন পূজারি ছিলেন জার্মান একনায়ক হিটলার । সবাইকে তাঁর পদতলে রাখতে গিয়ে নির্মম কঠিন পরিণতি হয়েছে।


উগান্ডায় স্বৈরশাসক ইদি আমিন নিজেকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না। প্রায় এক দশকের শাসনামলে গোটা উগান্ডাকে তিনি জীবন্ত নরক বানিয়ে ছাড়েন। নির্বিচারে মানুষ হত্যা এমনকি কেউ তাঁর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করলেই মাথা কেটে নিতেন। তাঁর টর্চার সেলে যে কত মানুষের প্রাণ গেছে, এর ইয়ত্তা নেই। তার কুখ্যাতি জুটেছিল ‘বুচার অব উগান্ডা’ বলে। ১৯৭৮ সালে তাঁরও পতন হয়েছিল নির্মমভাবে। তিনি ও দেশ ছেড়েছিলেন হাসিনার মতো, মরণেও দেশের মাটিতে তার ঠাঁই হয়নি। 


গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে : ‘নো দাইসেলফ’।  যার মানে ‘নিজেকে জানো’। এই কথাটির মূল নির্যাস হচ্ছে সবকিছ্রু আগে নিজের ‘আমিত্ব’-কে জানো। যদি নিজেকেই কেউ না জানে, তাহলে সে কখনো ‘আমরা’-কেই জানতে পারবে না। মানুষ যতই ‘আমি’, ‘আমি’ করবে, ততই হতাশ হবে। আর বদলে যত আমরা বলে, অন্যকে দিতে চাইবে, আনন্দ ততই বাড়বে। কারণ দিন শেষে,  ‘উই আর নট ইনডিপেনডেন্ট, উই আর ইন্টারডিপেনডেন্ট।’