:: অটোম্যান বা ওসমানীয় সাম্রাজ্য ::
ইতিহাস-২০১ ▌অটোম্যান বা ওসমানীয় সাম্রাজ্য:
তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহর থেকে সারা পৃথিবীর তিনটি মহাদেশ শাসন করা এই রাজবংশ টিকে ছিল ৬২৪ বছর। ওসমানীয় সুলতানগণ শাসন করেছেন ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়াসহ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহ এবং বর্তমান বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশ। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন শুরু হয় তুরস্কের আনাতোলিয়া থেকে। ঐতিহাসিকভাবে তুর্কি সাম্রাজ্য বা ওসমানীয় সাম্রাজ্য বলে পরিচিত। এই সম্রাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা উসমান গাজীর পিতা আরতুগ্রুল গাজী উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ার দ্বায়িত্ব পান সেলযুক সাম্রাজ্য কর্তৃক। রোমের সেলজুক সাম্রাজ্যের ক্রান্তিলগ্নে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ধীরে ধীরে একটি বৃহত সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেলজুক রাজবংশের জামাতাও ছিলেন এবং তার স্ত্রী অর্থাৎ ওসমানের মাতা হালিমে সুলতান ছিলেন সেলজুক সাম্রাজ্যের শাহজাদী। বলকান ও মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যের সাবেক অংশগুলো প্রায় ৪৯টি নতুন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে।
ইতিহাস-২০২ ▌ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়:
১২৯৯ সালে ওসমান গাজীর হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় ওসমানীয় সাম্রাজ্যের। তরুণ বয়স থেকেই সবার কাছে ধর্মভীরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন ওসমান। ১২৮৮ সালে বাবার স্থলাভিষিক্ত হন ওসমান গাজী। ওসমান দেখতে পেলেন যে, আশেপাশের অন্যান্য গোত্র প্রধানরা তাদের এলাকা বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে উঠেছেন। এসব দেখে তিনি নিজেও তার এলাকার পরিধি বাড়ানোর প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। ১৩০০ সাল থেকেই একে একে বিভিন্ন অঞ্চল জয় করতে শুরু করে ওসমান গাজীর নেতৃত্বাধীন বাহিনী। তিনি রাজ্যের রাজধানী হিসেবে বেছে নেয়া হয় ইয়েনিশেহিরকে। বার্সা ছিলো তৎকালীন এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। তার জয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মানচিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠলো অটোম্যানরা। বয়সজনিত নানা অসুস্থতার জন্য তখন বড় ছেলে ওরহান গাজীর হাতেই রাজ্যের দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন তিনি।
ইতিহাস-২০৩ ▌ দ্বিতীয় সুলতান ওরহান গাজী:
অত্যন্ত সহৃদয়, ক্ষমাশীল, ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন ওরহান গাজী। ধর্মশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞগণ ছিলেন তার বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। আশেপাশের লোকজনের নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন তিনি। ‘জেনিসারি’ নামে বেতনভুক্ত এক সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। ওরহান গাজীর বিজয়গুলো এসেছিলো মূলত উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ায় বাইজান্টাইনদের অধিকৃত এলাকাগুলো নিজের দখলে আনার মাধ্যমে। সর্বশেষ ১৩৪৫ সালে কারেসীর (বর্তমান বালিকেসির ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ) দখলও নিয়ে নেন ওরহান গাজী। এর ফলে প্রায় পুরো উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়া জুড়ে অটোম্যান সাম্রাজ্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বুর্সা, নিকোমিডিয়া, নাইসীয়া ও পার্গেমাম ছিলো এর চার শক্তিশালী স্তম্ভ। জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাম্রাজ্যের অধিকাংশ শাসনভার দ্বিতীয় পুত্র মুরাদের হাতে তুলে দিয়ে বুর্সাতেই নীরবে-নিভৃতে সময় পার করতে থাকেন তিনি।
ইতিহাস-২০৪ ▌প্রথম মুরাদ:
(১৩২৬-১৩৮৯) তিনি পূর্ববর্তী শাসক প্রথম ওরহানের পুত্র। বলকান অঞ্চলের অধিকাংশ জয় করে তিনি দক্ষিণপূর্ব ইউরোপে ওসমানীয় সীমানা বৃদ্ধি করেন। প্রশাসনিক কারণে মুরাদ সালতানাতকে দুইটি প্রদেশে ভাগ করেন। এদের একটি হল আনাতোলিয়া (এশিয়া মাইনর) এবং অন্যটি হল রুমেলিয়া (বলকান)। সার্বীয়দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় মুরাদের মৃত্যুর ফলে ওসমানীয়রা সামরিকভাবে তাদের রাজ্যবিস্তার স্থগিত করে এবং দুর্বল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের উপর মনোযোগ প্রদান করে। ইউরোপে সীমানা বৃদ্ধি করে মুরাদ সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলকানের অধিকাংশ অঞ্চল ওসমানীয়দের অধীনে আনেন এবং বাইজেন্টাইন সম্রাটকে কর প্রদানে বাধ্য করেন। ১৩৮৩ সালে তিনি সুলতান উপাধি ধারণ করেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নিজের তাবুতে তিনি খুন হন। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রথম বায়েজীদ এরপর দায়িত্বগ্রহণ করেন।
ইতিহাস-২০৫ ▌প্রথম বায়েজীদ:
(৯ জানুয়ারি ১৩৬০- ৮ মার্চ ১৪০৩) ছিলেন ওসমানীয় সুলতান। ইসলাম শিক্ষা কিংবা সামরিক প্রশিক্ষণ, সব ক্ষেত্রেই তৎকালীন বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয় তার। তিনি একটি সুবিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি কনস্টান্টিনোপলও আক্রমণ করেছিলেন তবে তাতে ব্যর্থ হন। এশিয়ায় তার সাম্রাজ্য তোরোস পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বায়েজীদের সেনাবাহিনী মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৩৮৯ সালে বায়েজীদ বুলগেরিয়া ও উত্তর গ্রিস জয় করেন। ১৩৯৪ সালে তিনি দানিউব নদী অতিক্রম করে ওয়ালাচিয়া আক্রমণ করেন। ১৩৮৯ থেকে ১৩৯৫ সাল পর্যন্ত বুলগেরিয়া ও গ্রীসের উত্তরাংশ চলে আসে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। ১৪০২ সালে আঙ্কারার যুদ্ধে তিনি তৈমুর লঙের কাছে পরাজিত ও বন্দী হন। বন্দী অবস্থায় ১৪০৩ সালের মার্চে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-২০৬ ▌ ঈসা চেলেবি:
(১৪০৩-১৪০৫) ১৪০২ সালের আঙ্কারা যুদ্ধের পরে, ঈসা চেলেবি মুসা চেলেবিকে পরাজিত করে এবং প্রায় দুই বছরের জন্য পশ্চিম আনাতলিয়ান রাজ্যাংশকে নিয়ন্ত্রাধীন করেন। ১৪০৫ সালে মেহমেদ চেলেবির কাছে পরাজিত ও খুন হন।
সুলেমান চেলেবি: ২০ জুলাই ১৪০২ রুমেলির সুলতান উপাধি অর্জন করেন কারণ সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় ভূখন্ডে, ২০ জুলাই ১৪০২ এর আঙ্কারার যুদ্ধে ওসমানীয় পরাজয়ের পর সল্প সময়ের জন্য সুলতান ছিলেন। ১৪১১ সালে খুন হন।
মুসা চেলেবি: সুলেমান চেলেবির মৃত্যুর পর, ১৮ই ফেব্রুয়ারী ১৪১১ সালে সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় ভূখন্ডের জন্য রুমেলির সুলতান উপাধি অর্জন করেন। ১৪১৩ সালের ৫ই জুলাই বুলগেরিয়ার সামোকোভের কাছে কামুরুল দারান্তের যুদ্ধে মেহমেদ চেলেবির বাহিনীর হাতে খুন হন।
ইতিহাস-২০৭ ▌মেহমেদ চেলেবি:
(১৪০৩-১৪০৬) ২০ জুলাই ১৪০২ সালের আঙ্কারার যুদ্ধে পরাজয়ের পর উপ-সুলতান থাকাকালিন পূর্ব আনাতলিয়ার রাজ্যাংশের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেন। ১৪০৬ সালে ঈসার মৃত্যুর পর ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আনাতলিয়া রাজ্যের একমাত্র শাসক হন। ৫ জুলাই ১৪১৩ সালে মুসার মৃত্যুর পর ওসমানীয় সুলতান প্রথম মুহাম্মদ খান উপাধি অর্জন করেন।
প্রথম মুহাম্মদ চেলেবি: (৩ আগস্ট ১৩৮১-২৬ মে ১৪২১) ছিলেন ওসমানীয় সুলতান। ১৪১৩ থেকে ১৪২১ সাল পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেছেন। তিনি সুলতান প্রথম বায়েজীদ-এর পুত্র। তার শাসনামল ওসমানীয় গৃহযুদ্ধের কারণে সমগ্র সালতানাত বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি সাম্রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন, তিনি ওসমানীয় সালতানাতের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত।
ইতিহাস-২০৮ ▌মুস্তাফা চেলেবি:
(জানুয়ারী ১৪১৯-মে ১৪২২) প্রথম বায়েজিদের সন্তান দ্বিতীয় মুরাদের হাতে খুন হন। দ্বিতীয় মুরাদ ২৫ জুন ১৪২১-১৪৪৪ প্রথম মুহাম্মদ এবং আমিনা হাতুনের সন্তান; তার সন্তান দ্বিতীয় মুহাম্মদের কাছে সেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করেন।
দ্বিতীয় মুহাম্মদ: (১৪৪৪-১৪৪৬) দ্বিতীয় মুহাম্মদ। জেনিসারিদের ক্রমবর্ধমান হুমকিসহ, তাঁর বাবাকে ক্ষমতায় সমর্পণ করেন।
দ্বিতীয় মুরাদ: (১৪৪৬-১৪৫১) দ্বিতীয়বার রাজত্ব। জেনিসারি বিদ্রোহের অনুকরণে সিংহাসনে পুনরায় অভিষেকে বাধ্য হন।
দ্বিতীয় মুহাম্মদ: (৩ ফেব্রুয়ারী ১৪৫১-৩ মে ১৪৮১) দ্বিতীয়বার রাজত্ব। ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল বিজয়; আমৃত্যু রাজত্ব।
দ্বিতীয় বায়েজিদ: (১৪৮১-১৫১২) দ্বিতীয় মুহাম্মদ এবং গুলবাহার সুলতানের সন্তান সিংহাসনচ্যুত হন।
জেম সুলতান: (১৪৮১-১৪৮১) দ্বিতীয় মুহাম্মদের পুত্র জেম বিন মুহাম্মদ উপনাম অর্জন করে পলাতক অবস্থায় মৃত্যু।
ইতিহাস-২০৯ ▌প্রথম সেলিম:
সুলতান সেলিম (৪৬৫-১৫২০) ছিলেন প্রথম ওসমানীয় খলিফা। সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতির জন্য তার শাসনামল পরিচিত। ১৫১৪ সালে মুসলিম সাম্রাজ্য শিয়া ফেতনা থেকে মুক্ত করার জন্য শিয়া সাফাভি ইসমাইল শাহকে পরাজিত করেন। তৎকালীন মিশরীয় মামুলোকেরা ইউরোপে খৃষ্টানদের সাথে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, সুলতান প্রথম সেলিম ১৫১৬ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত চলমান যুদ্ধে ওসমানীয়রা মিশরের মামলুক সালতানাত জয় করে নেয়। মামলুকদের শাসন শেষ হলে তাদের অঞ্চলসমূহ লেভান্ট সিরিয়া ফিলিস্তিনি, হেজাজ, তিহামাহ ও মিশর ওসমানীয়দের অধিকারে আসে। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল জয় এবং একীভূত করার মাধ্যমে সেলিম মক্কা ও মদিনার রক্ষক ও খাদেম হয়ে উঠেন। সুলতান প্রথম সেলিম মুসলিম বিশ্বের নতুন খলিফা মনোনীত হলে তৎকালীন শক্তিশালী এই ওসমানীয় সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে ওসমানীয় খিলাফত। ১৫২০ সালে তার মৃত্যু হয়।
ইতিহাস-২১০ ▌প্রথম সুলাইমান:
সুলতান সুলায়মান নামে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের দশম এবং সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী শাসনরত সুলতান, যিনি ১৫২০ সাল থেকে ১৫৬৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওসমানীয় সাম্রাজ্য শাসন করেন। যার শাসনামলে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির বিস্তার ঘটে। সুলতান সুলাইমানের সেনাবাহিনী রোমান সাম্রাজ্য এবং হাঙ্গেরির পতন ঘটায়। সুলতান সুলাইমান মধ্য প্রাচ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করে নেন। তিনি উত্তর আফ্রিকায় আলজেরিয়াসহ বড় বড় অঞ্চলগুলো রোমান সাম্রাজ্যের হাত থেকে দখল করে নেয়। তার ওসমানীয় নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগর পর্যন্ততাদের আধিপত্য বজায় রাখে। সুলতান সুলায়মান একজন কবিও ছিলেন। তিনি তুর্কি ও ফারসি ভাষায় বহু কালজয়ী কবিতা লিখেছেন। তার শাসনামলে ওসমানীয় সংস্কৃতির অনেক উন্নতি হয়। তিনি পাঁচটি ভাষায় কথা বলতেন।
ইতিহাস-২১১ ▌ দ্বিতীয় সেলিম:
( ১৫২৪-১৫৭৪)১৫৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সুলাইমানের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় সেলিম কনস্ট্যান্টিনোপলের সিংহাসনে বসেন।তীয় সেলিম সাধারণত মানুষের কাছে 'স্বর্ণকেশী সেলিম' নামে পরিচিত ছিলেন। দ্বিতীয় সেলিম দয়ালু ছিলেন। তবে তিনি মদ্যপানে আসক্ত হওয়ায় শাসন কাজে অনাগ্রহী ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন কবি এবং সাহিত্য প্রেমিক।দ্বিতীয় সেলিম এই প্রথম ওসমানীয়া খলিফা যে কখনো নিজে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তবে তার উজিরে আযম সোকল্লু মেহমেদ বহু অভিযান পরিচালনা করেছেন। তার পরিকল্পনা ও উদ্যোগে ওসমানীয় সৈন্যরা বহু সামরিক অভিযানে বের হয়। ক্রীটস দ্বীপ জয় দ্বিতীয় সেলিমের শাসনকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আট বছর শাসন করার পর তিনি ১৫ই ডিসেম্বর, ১৫৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ইস্তানবুলে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার প্রথম সন্তান শাহজাদা মুরাদ সুলতান তৃতীয় মুরাদ হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
ইতিহাস-২১২ ▌তৃতীয় মুরাদ:
তিনি ১৫৭৪ সাল থেকে ১৫৯৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওসমানীয় সাম্রাজ্য শাসন করেন। জানা যায় যে, ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথের সঙ্গে সুলতান তৃতীয় মুরাদ মিত্রতা বজায় রেখেছিলেন।
তৃতীয় মুহাম্মদ: তিনি (৫৬৬-১৬০৩) ছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ১৩ তম সুলতান। পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসে তিনি একসাথে নিজের ১৯ ভাইকে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদ- দেন। তিনি নিজের বড় ছেলে শাহজাদা মাহমুদকেও ফাঁসি দিয়েছিলেন। এসব নৃশংসতার কারণে তিনি ইতিহাসে চরম কুখ্যাত।
প্রথম আহমেদ: (১৫৯০ - ১৬১৭) তার শাসনামল থেকে ওসমানীয় শাসকরা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আর তাদের ভাইদের হত্যা না করার আইন চালু হয়। তূর্কিতে তার নির্মিত নীল মসজিদ পৃথিবী বিখ্যাত,মাত্র ২৭ বয়সে মারা যান।
ইতিহাস-২১৩ ▌প্রথম মুস্তাফা:
(১৫৯১ -১৬৩৯), ঐতিহাসিকদের দ্বারা পাগল মুস্তাফা (ডেলি মুস্তফা) বলা হত, জনগণ দেখেছিল এবং বুঝতে পেরেছিল যে, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। ১৬১৮ সালে, একটি সংক্ষিপ্ত নিয়মের পরে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তার তরুণ ভাগ্নে দ্বিতীয় ওসমানের (১৬১৮-১৬২২) পক্ষে ফিরিয়ে দেয় দ্বিতীয়বার জানিসারি এবং দ্বিতীয় ওসমানের দ্বন্দ্ব তাকে আবার সুযোগ করে দিয়েছিল। মুস্তাফা সিংহাসনে পুর্নআগমন করেন এবং আরও এক বছরের জন্য অধিষ্ঠিত হন।
দ্বিতীয় উসমান: তিনি ইতিহাসে তরুণ ওসমান নামে খ্যাত, (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৬১৮ থেকে ২০ মে ১৬২২)। তিনি নিষ্ঠুরভাবে হত্যার শিকার হওয়া পর্যন্ত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান ছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে সিংহাসনে বসা এই সুলতান ছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে জেনিসারি বাহিনীর হাতে নিহত হওয়া প্রথম সুলতান।
ইতিহাস-২১৪ ▌চতুর্থ মুরাদ:
(২১৬১২-১৬৪০) ওসমানীয় সম্রাজ্যের সুলতান, তিনি সুলতান প্রথম আহমেদ এর পুত্র। ১৬২৩ সালে তাকে প্রাসাদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় আনা হয়েছিল এবং তিনি তার চাচা প্রথম মুস্তাফা পরে উত্তরাধিকারী হন। সিংহাসনে আরোহণের সময় তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সী ছিলেন। তাঁর রাজত্ব ওসমানীয়- সাফাভিদ যুদ্ধের (১৬২৩-১৬৩৯) পক্ষে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, যার ফলস্বরূপ প্রায় দুই শতাব্দী ধরে উভয় সাম্রাজ্যের শক্তির মধ্যে ককেসাস স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে উঠে।
ইব্রাহিম: ১৬১৫ - ১৬৪৮) ইতিহাসবিদরা তাঁর তথাকথিত মানসিক অবস্থার কারণে তাঁকে পাগল ইব্রাহিম বলে অভিহিত করেছিলেন। ইব্রাহিম ১৬৪০ সালে তার ভাই চতুর্থ মুরাদ এর উত্তরাধিকারী হয়। ইব্রাহিম প্রায়শই পুনরাবৃত্তি হওয়া মাথাব্যথা এবং শারীরিক দুর্বলতার আক্রমণে রাজকার্য পরিচালনায় অসমর্থ ছিলেন।
ইতিহাস-২১৫ ▌ চতুর্থ মুহাম্মদ:
১৬৪২ - ৬ জানুয়ারি ১৬৯৩) ছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্য সুলতান। একটি অভ্যুত্থানে তাঁর পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করার পর মাত্র ৬ বছর বয়সে তাঁকে সিংহাসনে বসানো হয়। চতুর্থ মুহাম্মদ ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শাসনকালকারী ওসমানীয় সুলতান (৩৯-৪০ বছর)। মুহাম্মদ খুব ধার্মিক শাসক ছিলেন এবং একইসাথে দীর্ঘ শাসনামলে অনেকগুলো সামরিক বিজয়ের কারণে তাঁকে গাজী বলা হয়ে থাকে। তাঁর অধীনেই ওসমানীয় সাম্রাজ্য ইউরোপে ভৌগোলিক বিস্তৃতির শীর্ষে পৌঁছায়। ১৬৮৭ সালে সৈন্যদের বিদ্রোহে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
দ্বিতীয় সুলাইমান: (১৬৪২-১৬৯১) তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি প্রাসাদের কাফসে কাটান। এটি একধরনের বিলাসবহুল বন্দীশালা। রক্তস¤পর্কীয় যুবরাজরা যাতে বিদ্রোহ করতে না পারে তার জন্য এতে তাদের আটকে রাখা হত।
ইতিহাস-২১৬ ▌দ্বিতীয় আহমেদ:
(১৬৪৩ - ১৬৯৫) তার বড় ভাইদের রাজত্বকালে আহমেদ কাফেসে বন্দী ছিলেন এবং তিনি সেখানে প্রায় ৪৩ বছর অবস্থান করেন। দ্বিতীয় মোস্তফা: ১৬৯৫-১৭০৩ এবং তৃতীয় আহমেদ:১৭০৩-১৭৩০ওসমানীয় সুলতান ছিলেন।
প্রথম মাহমুদ: কুঁজো হিসাবেও পরিচিত (কাম্বুর)(১৭৩০-১৭৫৪)। তার পিতার নাম দ্বিতীয় মুস্তাফা প্রথম মাহমুদ ছিল তৃতীয় ওসমান (১৭৫৪-৫৭) এর বড় ভাই। তৃতীয় উসমান:১৭৫৪-১৭৫৭ এবং তৃতীয় মুস্তাফা: (১৭৫৭-১৭৭৪) ।
প্রথম আব্দুল হামিদ: (১৭২৫-১৭৮৯) দীর্ঘ কারাবাস এর ফলে রাষ্ট্রীয় বিষয় স¤পর্কে উদাসীনতা সত্ত্বেও আবদুল হামিদকে সবচেয়ে দয়ালু ওসমানীয় সুলতান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৭৮৯ সালে ভারতের টিপু সুলতান তার কাছে ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানির বিরুদ্ধে সহায়তার আবেদন করেছিলেন। তৃতীয় সেলিম-১৭৮৯-১৮০৭ এবং চতুর্থ মুস্তাফা-১৮০৭-১৮০৮ শাসক ছিলেন।
ইতিহাস-২১৭ ▌দ্বিতীয় মাহমুদ:
১৭৮৫ - ১৮৩৯) ছিলেন ৩০তম ওসমানীয় সুলতান। তার পিতা সুলতান প্রথম আবদুল হামিদের মৃত্যুর পর তিনি জন্মলাভ করেন। তার শাসনামল প্রশাসনিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য প্রসিদ্ধ। এসব তানজিমাতের সময় চরমে পৌছায় এবং তার পুত্র প্রথম আবদুল মজিদ ও প্রথম আবদুল আজিজ তা চালিয়ে যান। ১৮২৬ আলে তিনি ১,৩৫,০০০ জনের জানিসারি দলকে বিলুপ্ত করেন এবং এভাবে তিনি সামরিক সংস্কারের বাধা দূর করার জন্য এর নেতাদের মৃত্যুদন্ড দেন। প্রথম আবদুল মজিদ: ১৮৩৯-১৮৬১ আবদুল আজিজ: ১৮৬১-১৮৭৬ ওসমানীয় সুলতান ছিলেন।
পঞ্চম মুরাদ:(-১৮৪০-১৯০৪) সুলতান প্রথম আবদুল মজিদ ছিলেন তার বাবা, চাচা আব্দুল আজিজ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মুরাদ সিংহাসনে বসেন। মাত্র ৯৩ দিন শাসন করার পর ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর তাঁর ভাই দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ সিংহাসনে বসেন।
ইতিহাস-২১৮ ▌ দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ:
(১৮৪২-১৯১৮) ছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ৩৪তম সুলতান। সম্ভবত তিনিও ভাবেননি যে তিনি কখনো খলিফা হবেন। কারণ পিতার জীবদ্দশায় প্রায় ১৮ বছর তিনি ছিলেন মসনদের তৃতীয় উত্তরাধিকারী। কিন্তু ১৮৬১ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে পিতা সুলতান আব্দুল মাজিদ ইন্তেকাল করলে খলিফা হন ৩১ বছর বয়সি চাচা আব্দুল আজিজ। কিন্তু ১৮৭৬ সালে ৪৬ বছর বয়সে তিনিও নিহত হন। এরপর মসনদে বসেন তারই বড় ভাই ৫ম মুরাদ। যিনি তার থেকে দুই বছরের বড় ছিলেন। চাচাকে হত্যাকারীদের সঙ্গে ৫ম মুরাদেরও যোগসাজস ছিল। মসনদে আরোহণের পরপরই তার মস্তিষক বিকৃতির লক্ষণ ফুটে উঠে। সবরকমের প্রচেষ্টা ও চিকিৎসা সত্ত্বেও যখন তিনি পুরোপুরিভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। ডাক আসে ৩৪ বছর বয়সী যুবরাজ আব্দুল হামিদের। তার আমলে খিলাফত ব্যবস্থা মূলত একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়।
ইতিহাস-২১৯ ▌ পঞ্চম মুহাম্মদ:
(২/৩ নভেম্বর ১৮৪৪-৩/৪ জুলাই ১৯১৮) ছিলেন ৩৫তম ওসমানীয় সুলতান। তিনি সুলতান প্রথম আবদুল মজিদের পুত্র ছিলেন। তার শাসনের পরবর্তীকালে তার সৎ ভাই ষষ্ঠ মুহাম্মদ তার উত্তরাধিকারী হন। ১৯০৮ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময় ওসমানীয় সুলতানরা নির্বাহী ক্ষমতাবিহীন সাংবিধানিক সম্রাট হিসেবে বিবেচিত হতেন। এসময় ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত পার্লামেন্ট ক্ষমতা ভোগ করত। তিনি প্রতীকীভাবে ক্ষমতায় ছিলেন। তার প্রকৃত কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। ১৯০৮ সালের তরুণ তুর্কি বিপ্লবের সময় থেকে ওসমানীয় রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো তিন পাশা বলে পরিচিত তিনজন ব্যক্তিত্ব দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল। এরপর ১৯২৪ সালে খিলাফত বিলুপ্ত হয়। ১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহের মাধ্যমে আরবরা ব্রিটিশদের পক্ষে যোগ দেয়।
ইতিহাস-২২০ ▌ষষ্ঠ মুহাম্মদ:
(১৮৬১-১৯২৬) ছিলেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ৩৬তম ও সর্বশেষ সুলতান। তিনি ১৯১৮ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্তসিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সুলতান প্রথম আবদুল মজিদ ছিলেন তার বাবা। ১৯২২ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হওয়ার পর তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
দ্বিতীয় আবদুল মজিদ: (২৯ মে ১৮৬৮, ইস্তানবুল - ২৩ আগস্ট ১৯৪৪, প্যারিস) ছিলেন ইসলামের শেষ খলিফা। তিনি ওসমানীয় রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২২ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ততিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। আঙ্কারায় তুরস্কের জাতীয় সংসদ তাকে খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করে। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ তিনি গদিচ্যুত হন এবং তাকে সপরিবারে তুরস্ক থকে বহিষ্কার করা হয়।
ইতিহাস-২২১ ▌ মুসলিমদের কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ:
৩৩০ সালে রোমান সম্রাট কনস্টান্টিন বসফরাস প্রণালীর উপকূলে প্রতিষ্ঠা করেন কনস্টান্টিনোপল শহর। ৩৯৫ সালে রোমান সাম্রাজ্য দু’ভাগ হলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের নাম হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, যার রাজধানী হয় কনস্টান্টিনোপল। মুসলিমরা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে এ শহর বিজয়ের। শুরুটা হয়েছিল ইয়াজিদের হাত ধরে। কিন্তু তার আক্রমণ থেমে গিয়েছিল শহরের প্রাচীরের কাছেই। ওসমানীয় সুলতান বায়োজিদও চেষ্টা করেছিলেন এ শহর দখলের, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনিও। এতো ব্যর্থতার পরেও ওসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ সিদ্ধান্ত নেন কনস্টান্টিনোপল দখলের। এক সময়ের প্রতাপশালী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যও তার জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছিল সে সময়ে। ল্যাটিন, সার্বিয়া, বুলগেরিয়ার কাছে রাজ্যের অনেক জায়গাই হাতছাড়া হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের। ফলে এ সময় তারা ভয়ের মধ্যে ছিল।
ইতিহাস-২২২ ▌ মুসলিমদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়:
সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ১৪৫৩ সালে শুরু করে কন্সটান্টিপোল দখলের যুদ্ধ। ওসমানীয় বাহিনী নগর থিওডেসিয়ান দেয়ালে কামানের গোলা বর্ষণ শুরু করে। কিন্তু বলার মতো কোনো সাফল্যের মুখ দেখেনি, সুলতান নতুন পদক্ষেপ নেন। সার্বিয়ান সৈন্যদের নেতৃত্বে সুড়ঙ্গ তৈরি করা শুরু হয়। ওসমানীয়দের নতুন কৌশল ধরতে পেরে বাইজেন্টাইন প্রকৌশলী সুড়ঙ্গ দখল করে। দীর্ঘদিন ধরে কোনো সফলতা না পাওয়ায় ওসমানীয় বাহিনী সেনাপতিরা আলোচনায় বসেন। পরদিন উত্তর দিকের একটি প্রবেশদ্বার ওসমানীয়রা খুলে ফেলায় তারা চাপে পড়ে পিছিয়ে যেতে থাকেন। বাইজেন্টাইনদের প্রায় চার হাজার সেনা মারা যায়, কন্সটান্টিনোপল শহর দখল করে নেয় ওসমানীয় সাম্রাজ্য। ওসমানীয়দের এই বিজয় ইউরোপের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এশিয়ার সাথে সরাসরি বাণিজ্যের পথ হারায় ইউরোপিয়ানরা।
ইতিহাস-২২৩ ▌ভ্রাতৃহত্যা আইন:
সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ ভ্রাতৃহত্যা আইন পাশ করেন। হত্যার আগে প্রধান মুফতি বা শায়খুল ইসলামের অনুমোদন গ্রহণ করা হতো। অনেক ক্ষেত্রেই মুফতি হত্যার জন্য ফতোয়া দিতে অস্বীকার করতেন। দ্বিতীয় উসমান যুদ্ধে যাবার আগে তার ভাই মুহম্মদকে মৃত্যুদ- দেবার ফতোয়া চাইলে মুফতি ইসাদ আফেন্দী অস্বীকার করেন। পরে রুমেলি কাজি আসকার (সামরিক কাজি) এবং কামাল উদ্দীন আফেন্দীর নিকট থেকে ফতোয়া পাওয়া যায়। ছোট ভাই প্রথম মুহম্মদ সিংহাসন নিশ্চিত করতেই বাকি ভাইদের হত্যা করেন। বংশধরদের যে শক্তিশালী আর ভাগ্যবান সিংহাসনে আসীন হতেন, তিনি পেতেন নিজের পথ পরিষ্কার করার বৈধ ক্ষমতা। এই হত্যার পেছনে দুটি কারণ বেশ স্বচ্ছ। প্রথমত, শাহজাদাদের বিদ্রোহ এবং সিংহাসন দখল করার সম্ভাবনা। ক্ষমতাসীন সুলতানরা শত্রুমুক্ত থাকার জন্য এই আইনের মাধ্যমে অন্তত ৮০ জন শাহজাদাকে হত্যা করেন।
ইতিহাস-২২৪ ▌ আর্মেনীয় হত্যাকা-:
আর্মেনীয়রা ছিল খ্রিস্টান, পঞ্চদশ শতকে ওসমানীয় সাম্রাজ্য দখল করে নেয় আর্মেনিয়াকে। এ সত্ত্বেও, আর্মেনীয় সম্প্রদায় ওসমানীয় শাসনে বেশ উন্নতিসাধন করে। তারা তাদের তুর্কি প্রতিবেশীদের চেয়ে এগিয়ে ছিল শিক্ষা-দীক্ষায়, ছিল বেশ স¤পদশালীও। তুর্কিরা জানতো, খ্রিস্টান আর্মেনীয়রা ওসমানীয় খেলাফতের প্রতি যতটা অনুগত, তার চেয়ে হয়তো অনেক বেশি অনুগত ছিল খ্রিস্টান রাশিয়ার। তুরস্কের সাথে তখন একটা অস্থিতিশীল সীমান্তছিল রাশিয়ার। ১৯১৪ সালে তুর্কিরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয় জার্মানির পক্ষে। যুদ্ধ যখন তীব্র হয়ে উঠল, আর্মেনীয়রা তখন ককেশাস অঞ্চলে তুর্কিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রুশ সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করল। এরই ফলাফল স্বরূপ, তুর্কি সরকার তখন পূর্ব রণাঙ্গন (ইস্টার্ন ফ্রন্ট) জুড়ে থাকা যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে আর্মেনীয়দেরকে দমন করার নীতি গ্রহণ করল। যাতে অনেক আর্মেনীয় মারা যায়।
ইতিহাস-২২৫ ▌ জেনেসারি:
ওসমানীয় বাহিনী মানেই ছিলো জেনেসারি বাহিনী। ইউরোপের প্রথম স্থায়ী পেশাদার সামরিক বাহিনী। এক সময় যোদ্ধা বলতে ছিলো তুর্কি যাযাবর। এই যাযাবরদের প্রধান জীবিকা যুদ্ধলব্ধ স¤পত্তি। ওসমানের পুত্র ওরহান (১২৮১-১৩৬২) যাযাবরদের জায়গায় ভাড়াটে সৈন্য আনেন। তাদের দেয়া হতো বেতন। এই ভাড়াটে সৈন্যদের বড় অংশ ছিলো বলকান অঞ্চলের খ্রিস্টান। জেনেসারিতে সৈন্য নিয়োগ দেয়া হতে থাকে ১৩৮০ সাল থেকে। ৮-১৮ বছরের ছেলেদের রাষ্ট্রের সেবার জন্য তাদের পরিবার থেকে নেয়া হতো। শিক্ষকদের দ্বারা ইসলাম স¤পর্কে একটি সাধারণ ধারণা দেয়া হতো। তারপর অশ্বারোহণ, বর্শা নিক্ষেপ, তীরচালনা, কুস্তি এবং ভারোত্তলন শিক্ষা দেয়া হতো।সবচেয়ে দক্ষরা চলে যেতো সুলতানের দরবারে। আর বাকিরা যোগ দিতো জেনেসারিতে। এভাবে ধীরে ধীরে মুসলমানরাও যুক্ত হতে থাকে। ১৮২৬ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৩৫,০০০।
ইতিহাস-২২৬ ▌ অটোমান-সাফাভি দ্বন্দ্ব:
অটোমান(ওসমানীয়) আর সাফাভিদের মধ্যে যুদ্ধের মূল কারণ ছিল নিজ নিজ সাম্রাজ্যের সীমানার বিস্তৃতি ঘটানো, যেখানে মূল রসদ হিসেবে কাজ করেছিল ধর্মীয় মতভেদ। একদিকে অটোমানরা ছিলেন সুন্নি মুসলিম। অন্যদিকে সাফাভিরা ছিলেন শিয়া। তাদের হাত ধরেই ইরানে শিয়া মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে ইরানের অধিকাংশ মানুষ সুন্নি মুসলিম ছিলেন। ১৫০৩ সালে অটোমানরা কয়ুনলুকে সাহায্য করার পরও যুদ্ধে ইসমাইল হামাদানে জয়লাভ করে নিজেকে ইরানের শাহ হিসেবে ঘোষণা করেন। রাজ্যের সুন্নিদের জোরপূর্বক শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেন। এরপর ধীরে ধীরে পুরো ইরানে তার শিয়া মতবাদ ছড়িয়ে দেন। ফলে ১৫১৪ সালে ওসমানীয় সুলতান সেলিম সাফাভিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। ইসমাইলকে পরাজিত করেন রাজধানী তাবরিজ দখল করেন। এরপর পুরো সাফাভি সাম্রাজ্য জয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও জেনেসারিরা সায় দেননি।
ইতিহাস-২২৭ ▌ ওসমানীয় সময়ে শিক্ষা:
১৫৬৬ সালে দেখা যায় সামরিক প্রযুক্তির দিক থেকে ওসমানীয়রা ইউরোপের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছিল। কিন্তু এসব সমস্যা সত্ত্বেও ওসমানীয় সাম্রাজ্য সম্প্রসারণশীল শক্তি হিসেবে টিকে ছিল। ১৬৮৩ সালে ভারনার যুদ্ধের পর ইউরোপে ওসমানীয় সম্প্রসারণ সমাপ্ত হয়। পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো কর্তৃক নতুন নৌপথ আবিষ্কার হওয়ার তারা ওসমানীয়দের কর্তৃত্বের বাইরে যেতে সক্ষম হয়। সুলতান চতুর্থ মুরাদ তার শাসনামলে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব জোরদার করেন এবং সাফাভিদের কাছ থেকে ইরাক পুনরুদ্ধার করেন। পরবর্তীতে তরুণ সুলতানদের মায়েরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার করেছিলেন। এই সময়কালকে মহিলা সালতানাত বলা হয়ে থাকে। সাম্রাজ্যের খ্রিস্টান নাগরিকরা উচ্চশিক্ষায় মুসলিমদের চেয়ে অগ্রসর হয়ে যায়। মুসলিম শিক্ষার্থীরা মূলত আরবি ও ইসলাম বিষয়ে পড়াতো। ১৯১১ সালে ইস্তানবুলের ৬৫৪টি বড় কো¤পানির মধ্যে ৫২৮টির মালিক ছিল জাতিগত গ্রীকরা।
ইতিহাস-২২৮ ▌ওসমানীয় খেলাফতের পতন:
ওসমানীয় খেলাফতের পতন ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি এবং তাদের মিত্র আরব জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহীদের কাছে পরাজয়ের মাধ্যমে। যুদ্ধের শেষ ওসমানীয়রা তাদের সমগ্র সাম্রাজ্য হারায়। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সাবেক অংশগুলো প্রায় ৪৯ টি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। তুর্কি জাতীয় আন্দোলনের ফলে তুরস্কে গঠিত হয় গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি। ১৯২২ সালে কামাল পাশা তুর্কি সালতানাত বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও খেলাফত বহাল রাখা হয়। তৎকালীন সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ দেশ ছেড়ে চলে গেলে তার ভাই দ্বিতীয় আব্দুল মজিদকে খেলাফতের আসনে বসানো হয়। নামেমাত্র খলিফা বানানো হলেও তার হাতে দেওয়া হয়নি কোনো ক্ষমতা। ক্ষমতায় বসেই আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক তুরস্কে সংস্কার শুরু করেন। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি খেলাফতের বিলুপ্তি ঘোষণা করে। এভাবে খেলাফত ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিলুপ্তি ঘটে।
ইতিহাস-২২৯ ▌তুরস্কে ইসলাম ও সেক্যুলারিজম:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিটি ফ্রন্টে পর্যুদস্ত তুর্কিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অপমানজনক সেভ্রে চুক্তি। রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মিত্রশক্তির হাতে, প্রশাসনেও প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের কর্তৃত্ব। তুরস্কের স্মার্না, ব্রুসা, আফিয়ুনের মতো বেশকিছু অঞ্চল দখল করে নেয় গ্রিকরা। এরপর মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় জাতীয়তাবাদী তুর্কিরা, গ্রিকদের হাত থেকে মুক্ত করে আফিয়ুন, ব্রুসা ও স্মার্নার মতো শহরগুলো। ১৯২২ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাসীন হন মোস্তফা কামাল। তুর্কি জাতিকে ইউরোপীয়করণের জন্য নেন অনেকগুলো সংস্কারপন্থী পদক্ষেপ। শাসনকাঠামোর অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে সেক্যুলারিজমকে। খিলাফতের বিলুপ্তির মাধ্যমে আধুনিক তুরস্কের দিকে যাত্রা শুরু করে। বিলুপ্ত করা হয় ধর্মীয় আইনের ব্যাখ্যা দানকারী শায়খ-উল-ইসলামের পদ। যা তৈরি করেছে সীমাহীন বিতর্ক।
:: ফাতেমি সম্রাজ্য ::
ইতিহাস-২৩০ ▌ ফাতেমীয় খিলাফত:
ইসলামের এই খিলাফত ইসমাইলি শিয়া মতবাদকে ধারণ করত। এই রাজবংশ আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল শাসন করত এবং মিশরকে খিলাফতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছার পর ফাতেমীয় খিলাফতের অধীনে মাগরেব, সুদান, সিসিলি, লেভান্ট ও হেজাজ শাসিত হয়। ফাতেমীয়দের দাবি অনুযায়ী তারা মুহাম্মদ(স.)এর কন্যা হযরত ফাতিমা (রাঃ) ও হয়রত আলী (রাঃ)-র বংশধর। তাদের মতে ৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় ফাতেমি খলাফত প্রতিষ্ঠাতা ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত ফাতেমা (রাঃ) বংশের ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদিকের পুত্র ইসমাঈলের বংশধর ছিলেন। তিনি ছিলেন ফাতেমীয় খিলাফতের একজন যোগ্য শাসক। তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। যা পরবর্তীতে ১১৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ খিলাফত ১৪ জন খলিফা কর্তৃক আড়াই’শ বছরেরও বেশি শাসন করে।
ইতিহাস-২৩১ ▌খলিফা আল মুইজ:
আল-মনসুরের মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র তামিম মা'দ আল-মুইজ উপাধি ধারণ করে মিসরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ফাতেমীয় খিলাফতের ইতিহাসে খলিফা আল-মুইজের রাজত্বকাল এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ৯৫২ খৃস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করে রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য আল মুইজ কঠোর নীতি অবলম্বন করেন। তাঁর সুদক্ষ শাসন ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে রাজ্যের সর্বত্র শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ফাতেমীয় বংশ একটি সামান্য অবস্থা থেকে একটি বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। তিনি একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করেছিলেন। খলিফা আল মুইজের সুযোগ্য সেনাপতি জওহর অতি সহজেই মৌতিানিয়া, সিসিলি প্রভৃতি জয় করে উত্তর আফ্রিকায় আল মুইজের অপ্রতিহত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে ¯েপনের খলিফা তৃতীয় আব্দুর রহমানের সাথে যুদ্ধ করে আল মুইজ বহুল পরিমাণে শক্তি ক্ষয় করেন।
ইতিহাস-২৩২ ▌খলিফা আল আজিজ:
খলিফা আল মুইজের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র নিসার আল মনসুর “আল আজিজ বিল্লাহ” উপাধি গ্রহণ করে ৯৭৫ সালে ফাতেমীয় খিলাফতের পঞ্চম খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হন। তার সুদীর্ঘ ২২ বৎসরের রাজত্বকালে ফাতেমীয় প্রতিপত্তি ও গৌরব চরম শিখরে উঠেছিল। খলিফা আল আজিজ উদার, সুদক্ষ ও প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। তিনি হেজাজ, মসুল, ইয়েমেন, আলেপ্পো প্রভৃতি অঞ্চলে ফাতেমীয় অধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি সংকীর্ণতার উর্ধ্বে থেকে সকল সম্প্রদায়ের লোকজনকে রাজকাজে নিয়োগ করতেন। তিনি পরধর্মে সহিষ্ণু ছিলেন। তার আমলে কপটিক, ইহুদী ও খ্রিস্টানরা স্বাধীনতা ভোগ করত। আল-আজিজের সময় সম্রাজ্যের সর্বত্র অর্থনৈতিক অবস্থা অতি উন্নত ছিল। মিশর, প্যালেষ্টাইন, জর্ডান, সিরিয়া, মরক্কো, ইত্যাদি উর্বর ভূমি খলিফার অধীনের থাকায় সম্রাজ্যে প্রচুর অর্থে সমাগত হতো। তিনি সর্বদা জ্ঞানী ও প-িতদের সমাদর করতেন।
ইতিহাস-২৩৩ ▌মুসলিম সিসিলি:
ইতালির দক্ষিণ উপকূলে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জটিতে ছিল এক বৃহদাকার মুসলিম জনসংখ্যার আবাস এবং এখানে মুসলিমরা ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসনকার্য পরিচালনা করে। রাজধানী বাগদাদ থেকে বহুদূরবর্তী অঞ্চল উত্তর আফ্রিকায় শাসনকার্য পরিচালনার জটিলতার কথা চিন্তা করে আব্বাসীয় সরকার ৭৯৯ সালে কায়রাওয়ান নগরীতে (বর্তমান তিউনিশিয়ার একটি শহর) ইব্রাহিম ইবন আল-আগলাব নামক একজন স্থানীয় গভর্নরকে শাসনকার্য পরিচালনার ভার দেয়। আগলাবিরা সিসিলিতে অভিযান পরিচালনা করে। ১০,০০০ এরও বেশি সৈন্য নিয়ে ৮২৭ সালের জুন মাসে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছায়। মুসলিমদের মাঝে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ায় মুসলিম বাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়ে। কিন্তু তখনই আল-আন্দালুস থেকে একদল মুসলিম বাহিনী যোগ দেয় ও জয়লাভ করে। ফাতেমীয়রা ক্ষমতায় এসে সিসিলির গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়।
ইতিহাস-২৩৪ ▌ ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী:
উত্তর আফ্রিকার ফাতিমীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা। লিবিয়ার মরু অঞ্চল থেকে মিশরের সীমা পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ৯১৪ খিষ্টাব্দে তিনি আলেকজান্দ্রিয়া অবরোধ করেন এবং দুই বছর পর তা দখল করেন। রাজ্যের নিরাপওা নিশ্চিত করার জন্য ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী নতুন রাজধানীর কাজ শুরু করেন। এই নতুন নগরীর নাম দেওয়া হয় মাহদীয়া। পাঁচ বছরে এর নির্মাণ কাজ স¤পন্ন হয়। এর সুরক্ষার জন্য একটি লৌহফটক তৈরি করা হয়। ওবায়দুল্লাহ আল মাহদীর প্রশাসনে কাতামা গোত্রের লোকজন বেশি ছিল। তিনি রাজ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অত্যন্তযোগ্যতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তিনি ফাতেমীয় খিলাফতের ভিত্তি ¯হাপন করেন, যা পরবর্তীতে ১১৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ¯হায়ী হয়। তিনি ইদ্রসীয়দের দমন করেন। কিন্তু তিনি মিশর বিজয়ে ব্যর্থ হন। ¯েপনের ওমর বিন হাফসুনের সাথে তিনি স¤পর্ক ¯হাপন করছিলেন।
ইতিহাস-২৩৫ ▌খলিফা আল হাকিম:
পিতা আল আজিজ এর মৃত্যুর পরে ৯৯৬ সালে ১১ বছর বয়সে আল-হাকিম ফাতেমীয় সিংহাসনে আরোহন করেন। ৩৯০ হিজরীতে আল-হাকিম কিছু খামখেয়ালিপূর্ণ পদক্ষেপ চালু করেন। তিনি দিনের বদলে রাতের বেলায় অফিস-আদালত হাট বাজার খোলা রাখার ব্যবস্থা করেন। তবে আল-হাকিম ছিলেন জনহিতকর একজন শাসক। প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য তিনি অকাতরে দান করেছেন এবং মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তার সবচেয়ে বড় কাজ হলো- ১০০৫ সালে ‘বায়তুল হিকমাহ” এর অনুকরণে “দারুল হিকমাহ” প্রতিষ্ঠা। বিশ্বের ইতিহাসে দারুল হিকমা ছিল এক প্রদীপ্ত আলোকবর্তিকা। দারুল হিকমাহ শিয়া মতবাদের বিকাশের ক্ষেত্র হলেও সাম্রাজ্যে জ্ঞানী, গুণী, প-িত ব্যক্তি ও সংস্কৃতিমনাদের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়। বায়তুল হিকমা প্রধানত বিজ্ঞান গবেষনা, সাহিত্যচর্চা ও গ্রস্থাগার এই তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল।
ইতিহাস-২৩৬ ▌ আল-আজহারের ইতিহাস:
৯৬৯ সালে আব্বাসীয় খিলাফতের কাছ থেকে ফাতেমি খিলাফতের শাসক আল-মুইজ-লি-দ্বীন মিশর জয় করে নেন। গড়ে ওঠে ফাতেমি প্রশাসনের কেন্দ্রীয় মসজিদ জামিউল-কাইরো। পরবর্তীকালে জামিউল কাইরোর নতুন নামকরণ হয় আল-আজহার। আল-আজহার নামকরণ করা হয়েছে হযরত মুহাম্মদ (সা) এর মেয়ে ফাতিমা আল-জাহার (রা) এর নামানুসারে, তাঁর সম্মানার্থে। তখন সেখানকার অধিকাংশই ছিল সুন্নি মুসলিম। এদিকে ফাতেমিরা ছিল শিয়া মুসলিম। সেসময়ে শিয়া মতবাদ স¤পর্কে মিশরের সুন্নি মুসলিমদের তেমন ধারণা ছিল না। মসজিদের পাশে মাদ্রসা নির্মাণের আদেশ দেন, যেন সেখানে শিয়া মতবাদ চর্চা করা যায়। ৯৭৫ সাল, আল-আজহারের প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফাতেমি খিলাফতের ২৯ বছর পেরিয়ে গেলেও তখন পর্যন্ত আল আজহারে কেবল ইসমাইল-ই শিয়া মতবাদই শিক্ষা দেওয়া হত।
ইতিহাস-২৩৭ ▌ আল-আজহারের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠা:
৯৯৮ সালের পর আল-আজহারকে নতুন করে সাজানো হয়। ইসমাইল-ই শিয়া মতবাদের পাশাপাশি যোগ হয় আরবি সাহিত্য, আরবি ব্যাকরণ, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি বিষয়সমূহ। ১১৭১ সালে। সালাউদ্দিন আইয়ুবি ফাতেমিদের ক্ষমতাচ্যুত করে মিশরে পুনরায় সুন্নি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় তিনি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করেন। কিছুদিন পরেই শিয়া মতবাদের বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে নতুন করে আল-আজাহার বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয়। ১৯২২ সালে মিশরও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬২ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। সেই সাথে ধর্মীয় বিষয়ের সাথে ইতিহাস, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, মেডিসিন, চিকিৎসা, প্রকৌশল ইত্যাদি বিষয় সংযোজন করেন।
ইতিহাস-২৩৮ ▌ক্রুসেডের যুদ্ধ (১০৯৫-১২৯২)ঃ
প্রথমে ক্রুসেড বলতে মুসলমানদের কাছ থেকে জেরুসালেম শহর ফিরিয়ে নেওয়ার ইউরোপীয় প্রচেষ্টাকে বোঝানো হত। হযরত ওমরের (রা.) খেলাফতকালে (৬৩৭ খৃ:) জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে আসে। এগারো শতাব্দীতে ইউরোপিয়ান শাসকেরা ধর্মীয় এবং বাণিজ্যিক অভিপ্রায়ে জেরুজালেমকে মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিতে পরিকল্পনা শুরু করেন। এই কাজ করতে গিয়ে তারা যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করেন। তা ছোট বড় আকারে ১৩ শো শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে। ১০৯৫ সালে একজন ফরাসী সৈন্যের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হন। ১০৯৯ সালে মুসলমানদেরকে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম তাদের দখলে আনেন। এই যুদ্ধে গোটা ক্যাথোলিক চার্চ ও পোপ ২য় আর্বানের (১০৩৫-১০৯৯) সমর্থন ছিল। বিজয়ের পর ক্রুসেড যোদ্ধারা জেরুজালেমে রক্তের বন্যা বয়ে দেন।
ইতিহাস-২৩৯ ▌দ্বিতীয় ক্রুসেড:
জেরুজালেম ক্রুসেডদের দখলে থাকা অবস্থায় তারা সেখান থেকে অপরাপর স্থান দখল করার জন্যও যুদ্ধ করে। তারা ইউরোপ থেকে এই উদ্দেশ্যে আরও যুদ্ধাদি নিয়ে আসে। একটি ক্রুসেড ১১৪৭ থেকে ১১৪৯ পর্যন্ত চালানো হয়। কিন্তু তারা এই অভিযানে তেমন কোন ফায়দা হাসিল করতে পারেননি। ক্রুসেড যুদ্ধবাজ খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে হজ্জে যাতায়াতে বাধা দেয় এবং ব্যবসায় কাফেলাদেরকে বাধা সৃষ্টি করে। এভাবে প্রায় চার যুগ ধরে চলছিল। কিন্তু ১১৮৭ সালে পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুসলমানদের ঐক্য ও শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ১১৮৭ সালে সালাউদ্দীন আইয়ূবী ক্রুসেডদেরকে দারুণভাবে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর জেরুজালেমে প্রবেশ ও বিজয় ছিল রক্তহীন। ক্রুসেডের প্রথম যুদ্ধেই জেরুজালেম মুসলমাদের হাত ছাড়া হয়। এর প্রায় ২০০ বছর পর জেরুজালেম আবার পুনরুদ্ধার করেন এই মুসলিম সেনাপতি সুলতান গাজী সালাহউদ্দীন আল আইয়ুবী।
ইতিহাস-২৪০ ▌তৃতীয় ক্রুসেড:
সালাউদ্দীনের বিজয় ইউরোপে তুমুল ক্ষোভ সৃষ্টি করে। পোপ ৭ম গ্রিগোরি পাল্টা ক্রুসেড নিয়ে যাওয়ার জন্য আহবান করেন। জার্মানের ১ম ফ্রেড্রিক বারোসা, ফ্রান্সের ২য় ফিলিপস অগাস্টাস এক বিরাট বাহিনী নিয়ে জেরুজালেমের দিকে যাত্রা করেন। পথে কোনো এক নদীতে ফ্রেড্রিক ডুবে মারা যান, ফলে নিরাশ হয়ে তারা যাত্রা ভঙ্গ করেন। ১১৮৯ সালে ইংল্যান্ডের বাদশাহ তৃতীয় রিচার্ড সেকালের সবচেয়ে ভারী অস্ত্র ও কামানসহ ১৭,০০০ সৈন্য নিয়ে বিপুল শক্তিতে যুদ্ধ করে একর, জাফা, কেসারিয়া এবং টায়ারÑএই শহরগুলো মুসলমানদেরকে পরাজিত করে নিজ দখলে নেন। কিন্তু জেরুজালেম আক্রমণ না করেই রিচার্ড ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। পরবর্তী বৎসর সালাদ্দিনের মৃত্যুর পরের একশো বছর পর্যন্ত চলতে থাকে যুদ্ধ। কিন্তু ক্রুসেডরা জেরুজালেম দখল করতে সমর্থ হননি। যুদ্ধ হয় ১২০২-৪ সালে, ১২১২-২১ সালে, ১২২৮-২৯ সালে, ১২৪৯-৫৪ সালে, ১২৭০-৭২ সালে, ও ১২৯১ সালে।
ইতিহাস-২৪১ ▌ সালাহউদ্দীন আয়ুবী (১১৩৭-১১৯৩):
তিনি ছিলেন মিশর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর লোক ছিলেন। তার সালতানাতে মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১১৬৯ সালে তাঁর চাচা শেরেকোহ মৃত্যুবরণ করলে ফাতেমীয় খলিফা আল আদিদ সালাহউদ্দীনকে তাঁর উজির নিয়োগ দেন। শিয়া নেতৃত্বাধীন খিলাফতে সুন্নী মুসলিমের এমন পদ দেয়া বিরল ঘটনা ছিল। আল আদিদের মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের আনুগত্য ঘোষণা করেন। পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি ফিলিস্তিনে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান এবং মিশরে ফাতেমীয়পন্থি বিদ্রোহ উৎখাত করেন। ১১৯৩ সালে তিনি দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেন। তার অধিকাংশ স¤পদ তিনি তার প্রজাদের দান করে যান। উমাইয়া মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
ইতিহাস-২৪২ ▌ফাতিমা আল-ফিহরি:
আল-আজহারেরও প্রায় একশ বছরের অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মরক্কোর কারাউইন ইউনিভার্সিটি। ইউনেস্কো এবং গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ডের রেকর্ড অনুযায়ী এটিই হচ্ছে বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিগ্রী প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, যা এখন পর্যন্ত একটানা চালু আছে। আর এই ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন মুসলিম নারী, ফাতিমা আল-ফিহরি! ফাতিমা আল-ফিহরির জন্ম বর্তমান তিউনিসিয়ার কাইরাওয়ান শহরে। বাবার রেখে যাওয়া বিপুল স¤পত্তি কোনো বিলাসিতার পেছনে ব্যয় না করে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এই অর্থ তারা ব্যয় করবেন মানবতার কল্যাণের জন্য। ফলে তিনি নির্মাণ করেন কারাউইন মসজিদ। ফাতিমা মসজিদের বর্ধিতাংশে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন, যা নির্মাণ স¤পন্ন হতে সময় লেগেছিল ১৮ বছর। ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি ব্যাকরণ, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, রসায়ন, ভূগোলসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান শুরু হয়।
:: মক্কা অবরোধ ::
ইতিহাস-২৪৩ ▌ প্রথম মক্কা অবরোধ:
৬৮৩ সালে উমাইয়া শাসক ইয়াজিদ সম্ভাব্য বিদ্রোহ/গৃহযুদ্ধ দমন করতে আরবে সৈন্য পাঠান। মদিনা দখল করে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সেই বাহিনী। কিন্তু মক্কাবাসীরা আত্মসমর্পণ করেনি। এক মাস অবরোধ করে রাখা হয় মক্কা। এ সময়টিতেই আগুনে কাবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘোড়া দুর্ঘটনায় ইয়াজিদের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর অবরোধ শেষ হয়ে যায়। মক্কাতে ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.), যিনি ছিলেন পরবর্তী সম্ভাব্য খলিফা। ইবনে জুবাইর (রা). ক্ষতিগ্রস্ত কাবা পুরোটা ভেঙে নতুন করে বানানো শুরু করলেন। তবে এবার আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর কাছ থেকে শোনা একটি হাদিসের ভিত্তিতে কাবার পরিধি বাড়িয়ে হাতিম জায়গাটিকে অন্তর্ভুক্ত করলেন। ফলে জায়গা অনেক বেড়ে গেল, হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর টুকরো টুকরো হয়ে যায় এই আক্রমণে। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) একটা রুপার ‘লিগামেন্ট’ ব্যবহার করে সেগুলো জোড়া লাগান।
ইতিহাস-২৪৪ ▌ দ্বিতীয় মক্কা অবরোধ (৬৯২ সাল):
উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান তখন জেনারেল হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে পাঠান মক্কার আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা)-কে পরাজিত করে খিলাফতের প্রতিদ্বন্দ্বী নিশ্চিহ্ন করতে। খুব নৃশংস এই মক্কার অবরোধ স্থায়ী হয় ছয় মাস! আব্দুল্লাহ (রা) মারা যাবার পর অবরোধ শেষ হয়। আব্দুল্লাহর (রা) দুই পুত্র কাবার পাশেই লড়াইরত অবস্থায় মারা যান। এই আক্রমণের সময় পাথর নিক্ষেপ করে কাবা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। এরপর আব্দুল মালিক আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের বানানো অতিরিক্ত অংশ ধ্বংস করে কাবার কুরাইশি ঘনক আকৃতি ফিরিয়ে আনেন। প্রচ- বৃষ্টিতে ১৬২৯ সালে বন্যা হয়ে যায় মক্কায়, তখন কাবার দেয়াল ধসে যায়। বন্যা শেষে গ্রানাইট পাথরে নতুন করে কাবা বানানো হয়। ওসমানী সম্রাট চতুর্থ মুরাদের আমলে তখন মসজিদ পুরোটা সুন্দর করে আবার বানানো হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সেই একই মূল গঠন আছে।
ইতিহাস-২৪৫ ▌ কার্মাতিয় আক্রমণ (৯৩০):
কার্মাতিয় সম্প্রদায়ের ধর্ম ছিল শিয়াদের থেকে অপভ্রংশ ইসমাইলি গ্রুপ আর পারস্যের কিছু আধ্যাত্মিকতার যোগসাজশে গড়ে ওঠা ধর্ম। তারা ৮৯৯ সালে পূর্ব আরবে একটি ধর্মীয় স্বাধীন সরকার ঘোষণা করে। এরা আব্বাসীয় খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ৯৩০ সালের হজ্বের সময় কার্মাতিয়রা মক্কায় সন্ত্রাসী আক্রমণ করে। হাজীদের খুন করে লাশ জমজম কূপে ফেলে দেয়। এরপর তারা পবিত্র ‘কালো পাথর’ চুরি করে নিয়ে যায়। তারা একটা উপাসনালয় বানায় (মসজিদ আল দিরার) যেখানে কালো পাথর স্থাপন করা হয়। এর মূল হোতা ছিল তাদের নেতা আবু তাহির। তার উদ্দেশ্য ছিল মক্কা থেকে হজ্ব বাতিল করা, কিন্তু সেটি সফল হয়নি। ২৩ বছর পর, ৯৫২ সালে আব্বাসীয় খলিফা বিশাল টাকা দিয়ে সেই পাথর ফিরিয়ে আনেন। এতে সাত টুকরা হয়ে যায় পাথরটি। উল্লেখ্য, ফাতিমীয় খলিফা আল হাকিমের পাঠানো এক লোকপবিত্র পাথরটি ভেঙে ফেলতে চেষ্টা করে।
ইতিহাস-২৪৬ ▌ মসজিদুল হারাম দখল (১৯৭৯):
১৯৭৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের ঘটনা। ঘটনার হোতা ছিল জুহাইমান আল-ওতাইবি, সৌদি আরবের নাজদের প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। সে হঠাৎ করেই তার শ্যালক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল-কাহতানিকে ঘোষণা করে বসে ‘ইমাম মাহদি’ হিসেবে! মূল হোতা জুহাইমান যোগদান করে মদিনার একটি স্থানীয় সালাফি গ্রুপে। ২০ নভেম্বর ফজরের সময় মসজিদুল হারামে ৫০ হাজার মানুষ। ঠিক তখন আলখাল্লার নিচ থেকে অস্ত্র বের করে ৪০০-৫০০ জন সন্ত্রাসীরা। ইমাম থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে জুহাইমান বর্তমান সৌদি সরকারের দুর্নীতি নিয়ে বলা শুরু করল। এরপর কিছু হাদিস আর ভবিষ্যৎবাণী শুনিয়ে ‘ইমাম মাহদি’কে পরিচয় করিয়ে দিল। গেট আটকে দেয় সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের দলে নারী সদস্যও ছিল! মসজিদ পুনরুদ্ধার চেষ্টায় প্রচুর পুলিশ প্রাণ হারায়। পরে সৌদি আর্মি আর ন্যাশনাল গার্ড যোগদান করে তাদের সাথে কাবা পুর্ণদখল করে।
ইতিহাস-২৪৭ ▌১৯৮৭ সালের মক্কার ঘটনা:
৩১ জুলাই, ১৯৮৭; ইরানি হাজিরা সেখানে ইজরায়েল-আমেরিকা বিরোধী একটা বার্ষিক বিক্ষোভ করছিল। কিন্তু সৌদি পুলিশ আর ন্যাশনাল গার্ড বাধা দেয়। এটি রূপ নেয় সংঘর্ষে। এরপর জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। চাপা পড়ে মারা যায়, নাকি পুলিশের হাতে মারা যায় সেটা নিয়ে ইরান আর সৌদির মধ্যে তর্ক রয়েছে; কিন্তু প্রাণহানি হয়েছিল ২৭৫ ইরানি হাজীর, ৮৫ পুলিশ আর অন্য দেশের ৪২ হাজীর। এটি শিয়া হাজী বনাম সৌদি পুলিশের সংঘর্ষ নামে পরিচিত। ইরানের বিক্ষোভকারীরা তেহরানে সৌদি ও কুয়েতী দূতাবাসগুলিতে হামলা করে প্রতিক্রিয়া জানান । ১৯৮৭ সালের সংঘর্ষের জবাবে সৌদি আরব হজযাত্রীদের ভিসা সংখ্যা হ্রাস করার পরে ইরান হজ বর্জন করেছে । ১৯৮৮ সৌদি আরব ইরানের সাথে কুটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ১৯৯১ সালে রিয়াদ এবং তেহরান কূটনৈতিক স¤পর্ক পুনরুদ্ধার করে।
ইতিহাস-২৪৮ ▌ কাবা শরীফের দরজার ইতিহাস:
হযরত ইব্রাহিম (আ) যে কাবাগৃহ নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে আলাদা করে কোনো দরজা ছিল না। তবে দুটো প্রবেশপথ ছিল। কুরাইশরা যখন এর সংস্কার করে, তখন পূর্বদিকে কাঠের তৈরি দরজা মাটির লেভেল থেকে বেশ খানিকটা উপরে স্থাপন করে এবং পশ্চিমের দরজাটি একেবারে বন্ধই করে দেয়। ১৬২৯ সালের বন্যায় বেশ ক্ষতি হয় কাবার। ওসমানীয় সুলতান ৪র্থ মুরাদ ১৬২৯ সালের অক্টোবরে রুপা ও স্বর্ণের দিয়ে কাবার দরজা তৈরি করে দেন। বাদশা আব্দুল আজিজ ১৯৪৭ সালে কাবার দরজাটি অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি করে, এর উপর রূপার পাত এবং স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া হয়। সর্বশেষ ১৯৭৮ সালে বাদশা খালিদ বিন আব্দুল আজিজ নতুন দরজা তৈরিতে সর্বমোট ২৮০ কেজি সোনা ব্যবহৃত করে। এখানে আল্লাহ্র গুণবাচক নাম, কোরআন শরীফের আয়াত এবং আরবি প্রবাদের পাশাপাশি ঐতিহাসিক বিভিন্ন টীকাও উঠে এসেছে।
:: মামলুক সাম্রাজ্য ::
ইতিহাস-২৪৯ ▌মামলুক সাম্রাজ্য:
‘আইয়ুবী বংশের’ ধ্বংসস্তূপের উপরে মিশরে প্রতিষ্ঠিত হয় আরব দুনিয়ার শেষ রাজবংশ “মামলুক সাম্রাজ্য”। মিশর ছাড়াও লেভান্ট, মেসোপটেমিয়া ও ভারতে মামলুকরা সালতানাত প্রতিষ্ঠা (১২৫০-১৫১৭) করেছিল। মুসলিম বিশ্বকে বিভিন্নভাবে রক্ষা করে মামলুক শাসন মিশরের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে।“মামলুক” শব্দের অর্থ ক্রীতদাস। মিশরে যুদ্ধবন্দীদেরকে বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করা হত। “আইয়ুবী” সুলতান মালিক আল সালিহর সময়ে এই সমস্ত ক্রীতদাসদেরকে দেহরক্ষী বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়। বিভিন্ন দেশ ও জাতির এ ক্রীতদাসরা মুসলিম খলিফা ও সুলতানদের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে তারা আইয়ুবী বংশের দুর্বলতার সুযোগে একটি স্বাধীন সালতানাতের সূচনা করে। ১২৫০ সালে শাজার আদ-দুর নামে একজন বিধবা নারী মিশরে এ মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
ইতিহাস-২৫০ ▌ বাহরি মামলুক:
মামলুক শাসকগণ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত- বাহরি মামলুক ও বুরজি মামলুক। “বাহরি” মামলুকরা নীলনদের রওডা দ্বীপ অঞ্চলের সেনানিবাসে বসবাস করত। বাহরিগণ রাজত্ব করেন ১২৫০ থেকে ১৩৯০ সাল পর্যন্ত। বিদেশি ক্রীতদাসদের দেহরক্ষী নিযুক্ত করার প্রথা চালু করেন বাগদাদের খলিফারা। বাহরি মামলুক শাসকদের সংখ্যা মোট ২৪। আইবাক (১২৫০-১২৫৭): ইজ্জ আদ-দ্বীন আইবাকই ছিলেন প্রথম মামলুক সুলতান। তিনি ১২৫০ থেকে ১২৫৭ পর্যন্ত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শাসন করেন। কুতুজ (১২৫৯-৬০): তার শাসনের ব্যাপ্তিকাল খুবই সংক্ষিপ্ত হলেও ইতিহাসে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে আছেন আইন জালুতের যুদ্ধে তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য।
ইতিহাস-২৫১ ▌ আইন জালুতের যুদ্ধ (১২৬০):
১২৬০ সালে সংঘটিত আইন জালুতের যুদ্ধ মিশরের মামলুক ইতিহাস তথা মুসলিম ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কুতুজ ক্ষমতায় থাকাকালে মঙ্গোল বীর হালাকু খান বাগদাদ নগরী ধ্বংসের পর মিশর দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলে কুতুজ তাঁর সেনাপতি বাইবার্সকে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তবে শেষ পর্বে কুতুজ স্বয়ং নেতৃত্ব দেন। আইনজালুত নামক স্থানে দুপক্ষের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ায় এই যুদ্ধ আইন জালুতের যুদ্ধ হিসেবেই পরিচিতি পায়। যে কয়টি যুদ্ধ ইতিহাসের গতিপথকে পরিবর্তন করেছিল “আইন জালুতের যুদ্ধ” এদের মধ্যে অন্যতম। মামলুকদের জয়ের মাধ্যমেই মিশর মঙ্গোলদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং ফলশ্রুতিতে মিশরে মামলুকদের গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধের পরপরই সুলতান কুতুজের সাথে সেনাপতি বাইবার্সের মনোমালিন্য শুরু হলে একপর্যায়ে তাঁকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন বাইবার্স।
ইতিহাস-২৫২ ▌সুলতান বাইবার্স:
মোঙ্গল ও ক্রুসেডাররা মাথা নত করেছিল তার তলোয়ারের সামনে। বাইবার্স ছিলেন চতুর্থ মামলুক সুলতান এবং মামলুক শাসকদের ভেতর সবচেয়ে জনপ্রিয়। তিনি মিসর এবং সিরিয়া শাসন করেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। তার আনুকূল্যে কায়রোতে শিল্প-সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি ঘটে, বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তিনি উৎসাহিত করতে থাকেন সবাইকে। যদিও তিনি আধুনিকতাকে প্রশ্রয় দিতেন, কিন্তু আদতে তিনি ইসলামি অনুশাসন কঠোরভাবে পালন করতেন। একজন ক্রীতদাস থেকে তার সিংহাসনের অধিপতি হওয়ার পেছনে ছিল একটু একটু করে নিজেকে প্রস্তুত করার কঠিন অধ্যবসায়। ক্রীতদাসদের সামরিক প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময় থেকেই বাইবার্স মিশর ও সিরিয়ার সুলতান নাজম আল-দীন-আইয়ুব নজর কেড়ে নিতে সমর্থ হন। ১২৫০ সালে সংগঠিত আল মানসুরার যুদ্ধে রাজা লুইসকে বন্দি করার অন্যতম কমান্ডার ছিলেন বাইবার্স।
ইতিহাস-২৫৩ ▌ কালাউন (১২৭৯-৯০):
বাইবার্সের পর আল-মালিক উল-মনসুর কালাউন ছিলেন মামলুকদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ সুলতান। বাইবার্সের পুত্রের সাথে তাঁর কন্যার বিয়ে হয়। আল-আশরাফ (১২৯০-১২৯৩) কালাউনের পুত্র আল-আশরাফ ১২৯০ সালে পিতার মৃত্যুর পর বাহরি রাজবংশের সুলতান নিযুক্ত হন। মাত্র ৩ বছর রাজত্ব করার পর ১২৯৩ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন তিনি। আল-নাসির মোহাম্মদ: সুলতান কালাউনের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র সুলতান আল-নাসির মোহাম্মদের রাজত্বকাল মিশরের মামলুক ইতিহাসে ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ। মাত্র নয় বছর বয়সে ক্ষমতায় আসার পর দু বার পদচ্যুত হয়ে তিনদফায় (১২৯৩-৯৪, ১২৯৮-১৩০৮, ১৩০৯-৪১) সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর এই দীর্ঘ শাসনকালে রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখেন তিনি। “মারজ-আস-সাফার” যুদ্ধে মঙ্গোলদের পরাজিত করে চিরতরে বিদায় করেন।
:: বুরজি মামলুক ::
ইতিহাস-২৫৪ ▌বুরজি মামলুক:
যেসব মামলুক(ক্রীতদাস) বুরুজ অর্থাৎ দুর্গে অবস্থান করত। সুলতান কালাউন এদের বুরুজে অবস্থান করতে দেয় বলে এদেরকে “বুরজি মামলুক” বলা হয়। বুরজি মামলুকদের শাসনকাল ১৩৮২ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। বুরজি শাসকের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। ১৩৫ বছর রাজত্ব করেন ঠিকই কিন্তু বাহরি মামলুকদের মতো এত গৌরবময় যুগ সৃষ্টি করতে পারেননি। এ বংশের উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন কানসু আল ঘুরী। তাঁর সময়েই “মারজ দাবিকের” যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। ষড়যন্ত্র, লুঠতরাজ এবং হত্যার ক্ষেত্রে বাহরিদের প্রবণতাই অব্যাহত রেখেছিল বুরজিরা। বুরজি যুগকে সিরিয়া ও মিশরের ইতিহাসের অন্ধকার যুগ বলা হয়। ৯ জন সুলতান মিলেই ১২৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তারা যথাক্রমে বারকুক, ফারাজ, আল-মুয়াইয়াদ শাইখ, বারস বে, জাকমাক, ইনাল, খুশ কদম, কাইত বে এবং কানসু আল ঘুরী। অবশিষ্ট ১৪ জনের বিশেষ কোন ক্ষমতা ছিল না।
ইতিহাস-২৫৫ ▌মারজ দাবিকের যুদ্ধ:
মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গল শক্তির অভ্যুদয়ের কালে রাজনৈতিক কারণে মিশরের মামলুক ও তুরস্কের ওসমানীয়দের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স¤পর্ক গড়ে উঠলেও এই স¤পর্ক বেশি দিন স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি। মামলুক সুলতান কায়েতবাই-এর সঙ্গে ওসমানীয় সুলতান ২য় বায়েজীদের দু’বার যুদ্ধের ফলে এই স¤পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে এবং অবশেষে সুলতান সেলিমের সময়ে ইহা চরম আকার ধারণ করে যুদ্ধের রূপ নেয়। অবশেষে মামলুক ও ওসমানীয়দের মধ্যে ১৫১৬ সালের ২৪ অগাস্ট সিরিয়ার আলেপ্পোর নিকটবর্তী মারজ-দাবিক প্রান্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মামলুকগণ বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে। কিন্তু সেনাপতি কায়েদ-এর ষড়যন্ত্রের ফলে পরাজিত হয়। মামলুক সুলতান গুরী পলায়নের সময় ঘোড়ার পৃষ্ঠ হতে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই যুদ্ধের ফলে মিশরে মামলুক সুলতানাতের চির অবসান ঘটে এবং মিশর তুর্কী সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।
ইতিহাস-২৫৬ ▌ মামলুক শাসকদের অবদান:
দীর্ঘ ২৫০ বছরে মামলুকরা মিশরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু অবদান রেখে গেছেন। ১. জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা: মামলুক আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অনেক উন্নতি সাধিত হয়। জ্যোতিষশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতিক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করে। ২. ইতিহাস ও সাহিত্য: ইতিহাস রচনায় মামলুকরা খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। এসময় ইসলামের কতিপয় খ্যাতনামা ঐতিহাসিক যেমন- আবুল ফিদা, ইবন তাগরিবিরদি, আল-সুয়তি এবং আল মাকরিযির আবির্ভাব ঘটে। আবু ফিদা “মুক্তাতাসার তারিখ উল বাশার” অর্থাৎ “মানব জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” রচনা করেন। মামলুক রাজত্বকালে মিশরে স্থাপত্য শিল্প ও চারুকলার এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ সময়ে অনিন্দ্য সুন্দর মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, স্কুল, সমাধি ইত্যাদি নির্মিত হয়। কুফি লিখন পদ্ধতি, জ্যামিতিক নকশা, লতা-পাতা প্রভৃতি উপাদানের ব্যবহারে মামলুক স্থাপত্য শিল্প বেশ সমৃদ্ধ ছিল।
:: সৌদি আরবের ইতিহাস ::
ইতিহাস-২৫৭ ▌ মক্কা- মদিনার শাসক:
৭৪৯ খি: দামেস্ক কেন্দ্রীক উমাইয়া রাজবংশের পতনের মধ্যদিয়ে উত্থান হয় ইরাকের বাগদাদ কেন্দ্রীক আব্বাসীয় সাম্রাজ্য। তখন স্বাভাবিকভাবে মক্ক-মদীনা আব্বাসীয়দের অধীনে চলে যায়। ফলে, হাশেমী গোত্রের লোকেরা হেজাজ অঞ্চলে আধিপত্ব বিস্তার করতে শুরু করে। কেননা আব্বাসীয় রাজবংশের ধারা মক্কার বনু হাশেমী গোত্রে থেকে প্রবাহিত। ৮৩৩ খ্রিঃ আব্বাসীয় শাসক আল মামূনের মৃত্যুর পর খিলাফতের শক্তি কমতে থাকে। এ সুযোগে ৯৬৭ খ্রিঃ হাশেমীয়রা হেজাজে মক্কা এবং মদীনাকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। স্বায়িত্ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে তারা আব্বাসীয়,ফাতেমীয়,আয়ুবী, ওসমানীয় খিলাফতের প্রতিনিধি হিসেবে মক্কা-মদীনা তথা হেজাজ শাসন করতো। ১২০১ খ্রিঃ মক্কার কাতাদাহ ইবনে আলী হেজাজের বাকি অঞ্চল গুলোও অর্থাৎ- জেদ্দা,তায়িপ,তাবুক,বদর ইত্যাদি হেজাজ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করেন।
ইতিহাস-২৫৮ ▌রাজ বংশ ও আরব:
বর্তমান সৌদি রাজবংশের পূর্বপুরুষ মুহাম্মদ বিন সউদ ছিলেন রিয়াদের অদম্য মরুযোদ্ধা। ১৭৪৪ সালে তিনি আরবের বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাবের সহায়তায় ’দিরিয়া আমিরাত’ নামে স্বতন্ত্র একটি ছোট্ট রাজ্য গঠন করেন। ১৭৬৫ সালে মুহাম্মদ বিন সউদের মৃত্যু হলে তাঁর ছেলে আবদুল আজিজ দিরিয়ায় ক্ষমতাসীন হয়ে ওয়াহাবী মতবাদকে কাজে লাগিয়ে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং ১৮০১-১৮০২ সালে বৃটিশদের সাথে হাত মিলিয়ে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ইরাক দখল করেন। ক্ষিপ্ত ওসমানীয়রা ১৮০৩ সালে মক্কা ও ১৮০৪ সালে মদিনা দখল করে নেন। ফলে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের পতন ঘটে। দ্বিতীয়বার সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন মুহাম্মদ বিন সৌদের নাতী আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন সউদ। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি পুনরায় আরব ভূখ-ে কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনেন। মুলায়দার যুদ্ধে দ্বিতীয় সৌদি রাস্ট্রেরও পতন ঘটে।
ইতিহাস-২৫৯ ▌ সৌদি আরব:
ইবনে সৌদ ছিল আরব বিশ্বে ওসমানি খেলাফতকে বিপর্যন্ত করার কাজে নিয়োজিত ব্রিটেনের বেতনভোগী অনুচর। ব্রিটিশ ভারতের বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকে তাকে অর্থ দিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। বিংশ শতকের তথা গত শতকের বিশের দশকে ব্রিটেনের আরেক অনুচর হেজাজের শাসক শরিফ হুসাইনকে ব্রিটিশরাই সরিয়ে দেয় ইবনে সৌদকে ব্যবহার করে। ফলে ইবনে সৌদ দখল করে হিজাজ এবং ইয়েমেনেরও এক বিশাল অংশ। ১৯১৪ সালে স্বাক্ষরিত আল-আকির চুক্তি অনুযায়ী ইবনে সৌদ তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য দেয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন এবং সহায়তা করেন। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি হিজাজের নাম পরিবর্তন করে নিজ বংশের নাম অনুযায়ী এই বিশাল আরব ভূখ-ের নাম রাখে সৌদি আরব। আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ছিল ‘নজদ্’ নামক মরুঅঞ্চলের অধিবাসী। রাজনৈতিক স্বার্থে তিনি ওয়াহাবি সম্প্রদায়ের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়।
ইতিহাস-২৬০ ▌আরব বিদ্রোহীরা মক্কা ও জেদ্দা :
বৃটেন ১৮৮৮ সাল থেকে মিশর এবং ১৮৫৭ সাল থেকেই ভারত দখল করে নিয়েছিল। ওসমানী খিলাফতের অবস্থান ছিল বৃটেনের এই দুই উপনিবেশ-এর ঠিক মাঝখানে। ফলে ১ম বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে ওসমানী খিলাফতকে উচ্ছেদ করতে বৃটেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। বৃটেনের অন্যতম বড় পরিকল্পনা ছিল ওসমানী খিলাফতের বিরুদ্ধে আরব জনগণকে উস্কে দেয়া। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেয়েও যায় মক্কার গভর্নর শরীফ হুসেইন বিন আলী-কে। ১৯১৬ এর জুনে, শরীফ হুসেইন তার সশস্ত্র আরব বেদুঈনদের নিয়ে ওসমানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বেড়িয়ে পড়েন। কয়েক মাসের মধ্যেই বৃটিশ সেনা ও নৌবাহিনীর সহায়তায় আরব বিদ্রোহীরা মক্কা ও জেদ্দা সহ হেজাজের বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নিতে সক্ষম হয়। ১৯১৭ এবং ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আরব বিদ্রোহীরা ওসমানীদের থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নিতে সক্ষম হয়।
ইতিহাস-২৬১ ▌ সাইকস-পিকোট চুক্তি:
শরীফ হুসেইন তার আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে বৃটেন ও ফ্রান্সের অন্য পরিকল্পনা করা ছিল। ১৯১৫-১৬ এর শীতে, বৃটেনের স্যার মার্ক সাইকস ও ফ্রান্সের ফ্রান্সিস জর্জেস পিকোট গোপনে মিলিত হন। তাদের করা সাইকস-পিকো চুক্তি অনুযায়ী বৃটেন ও ফ্রান্স পুরো আরব বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার ব্যাপারে চুক্তি করে, যা পরবর্তীতে সাইকস-পিকোট চুক্তি নামে পরিচিতি লাভ করে। বৃটেন বর্তমানের জর্ডান, ইরাক, কুয়েত “নামে পরিচিত” দেশগুলোর দখল নেবে আর ফ্রান্স পাবে বর্তমান সিরিয়া, লেবানন ও দক্ষিণ তুরস্ক। আর ইহুদীরা নেবে ফিলিস্তিনের অংশ। কিন্তু ১৯১৭ সালে রাশিয়ান বলশেভিক সরকার এই গোপন চুক্তি সবার সামনে উন্মোচন করে দেয়। ফলে দেখা যায় সাইকস-পিকোট চুক্তির সাথে শরীফ হুসেইনকে দেয়া বৃটেনের প্রতিশ্রুতির মধ্যে ¯পষ্টতই অনেক ঝামেলা হয়। পরবর্তীতে তা সমঝোতা হয়।
ইতিহাস-২৬২ ▌ বেলফোর ঘোষণা:
জায়োনিজম হল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন যা ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিলো। এ আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯ শতকে এবং এর লক্ষ্য ছিল ইউরোপের ইহুদিদের জন্য (যারা মূলত পোল্যান্ড, জার্মানি, রাশিয়ার বাসিন্দা) ইউরোপের বাইরে একটি আবাসভূমি খুঁজে বের করা। বৃটিশ সরকারের ভিতরেও এমন অনেক কর্মকর্তা ছিলেন যারা এই রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার বেলফোর। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আর্থার বেলফোর কাছে জায়োনিস্টরা বৃটেন সরকারের কাছে যুদ্ধ পরবর্তীতে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের ব্যাপারে সাহায্য চায়। ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বরে, বেলফোর ইহুদি নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। এই চিঠিতে তিনি ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের সরকারী সমর্থন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
ইতিহাস-২৬৩ ▌১ম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্য:
ম্যান্ডেট সিস্টেমের মাধ্যমে বৃটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যের উপর তার কাঙ্খিত দখল বুঝে পায়। অন্যদিকে শরীফ হুসেইনের ক্ষেত্রে, তার ছেলেরা বৃটিশদের ছায়াতলে থেকে শাসনকাজ পরিচালনার সুযোগ পায়। প্রিন্স ফয়সালকে সিরিয়া ও ইরাকের রাজা করা হয় এবং প্রিন্স আব্দুল্লাহকে করা হয় জর্ডানের রাজা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৃটেন এবং ফ্রান্স-ই এইসব এলাকার প্রকৃত কর্তৃত্বে ছিল। অন্যদিকে, বৃটেন সরকার ইহুদীদেরকে কিছু শর্তসাপেক্ষে ফিলিস্তিনে বসতি গড়ার অনুমতি দেয়। তারা ফিলিস্তিনে আসা ইহুদিদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা বেঁধে দেয়। এতে জায়োনবাদীরা ক্ষেপে ওঠে, ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ইহুদিরা বৃটেনের শর্ত না মেনেই ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা বাড়াতে থাকে। এসব ঘটনা আরবদের ক্ষোভও বাড়িয়ে দেয়, ফিলিস্তিন ভূমিতে বসতি স্থাপনের ফলে জোরপূর্বক ইহুদিদের দখলে চলে যাচ্ছিল।
:: ফিলিস্তানের ইতিহাস ::
ইতিহাস-২৬৪ ▌ ফিলিস্তিনের ইতিহাস:
ইব্রাহিম (আ) এর দুই পুত্র ইসমাইল (আ) আর ইসহাক (আ)। ভাগ্যক্রমে, ইসমাইল (আ) আর তার মা হাজেরা-কে আরবের মক্কায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। আর ওদিকে কেনান দেশে রয়ে যান ইসহাক (আ) [আইজ্যাক]। তাঁর পুত্র ছিলেন ইয়াকুব (আ) [জ্যাকব]। ইয়াকুব (আ) এর আরেক নাম ছিল ইসরাইল, তাঁর বারো সন্তানের নামে ইজরায়েলের বারো গোত্রের নাম হয়। ঘটনাক্রমে ১২ পুত্রের একজন ইউসুফ (আ) ভাইদের চক্রান্তে মিসরে উপনীত হয় দাস হিসেবে। সাত বছর পর তিনি মিসরকর্তার প্রিয়জন এবং নবী। দুর্ভিক্ষপীড়িত অন্য ভাইরা তারই কাছে সাহায্য চাইতে মিসরে আসে। কালের পরিক্রমায় শত শত বছর বাদে এই ইজরায়লিরা মিসরের ফারাও এর দাসে পরিণত হয়। তখন এক মিসরীয় যুবরাজ (পালিত পুত্র নবী হযরত মুসা (আ) এসব নির্যাতিতদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। অবশেষে নবী ইউশা (আ) এর নেতৃত্বে তারা কেনান দেশে উপনীত হয়।
ইতিহাস-৩৬৫ ▌বৃটেন ও ফ্রান্সের পরিকল্পনা:
শরীফ হুসেইন তার আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে বৃটেন ও ফ্রান্সের অন্য পরিকল্পনা করা ছিল। ১৯১৫-১৬ এর শীতে, বৃটেনের স্যার মার্ক সাইকস ও ফ্রান্সের ফ্রান্সিস জর্জেস পিকোট গোপনে মিলিত হন। তাদের করা সাইকস-পিকো চুক্তি অনুযায়ী বৃটেন ও ফ্রান্স পুরো আরব বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার ব্যাপারে চুক্তি করে, যা পরবর্তীতে সাইকস-পিকোট চুক্তি নামে পরিচিতি লাভ করে। বৃটেন বর্তমানের জর্ডান, ইরাক, কুয়েত “নামে পরিচিত” দেশগুলোর দখল নেবে আর ফ্রান্স পাবে বর্তমান সিরিয়া, লেবানন ও দক্ষিণ তুরস্ক। আর ইহুদীরা নেবে ফিলিস্তিনের অংশ। কিন্তু ১৯১৭ সালে রাশিয়ান বলশেভিক সরকার এই গোপন চুক্তি সবার সামনে উন্মোচন করে দেয়। ফলে দেখা যায় সাইকস-পিকোট চুক্তির সাথে শরীফ হুসেইনকে দেয়া বৃটেনের প্রতিশ্রুতির মধ্যে ¯পষ্টতই অনেক ঝামেলা হয়। পরবর্তীতে তা সমঝোতা হয়।
ইতিহাস-২৬৬ ▌ ইসরাইলের ফিলিস্তিন দখল:
প্রায় ২০০০ বছর আগে জেরুজালেম দখল করে রোমানরা। ইহুদীরা বিতাড়িত হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। পরে এটি দখলে আসে ওসমানীয় সাম্রাজ্য আর ব্রিটিশদের। গত শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এবং চলাকালীন, জার্মানীতে হিটলারের হাতে নিহত হয় প্রায় "৬০ লক্ষ ইহুদী" ইতিহাসে যা "হলোকাস্ট" নামে পরিচিত। যুদ্ধে জার্মানীর পরাজয়ের পর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইহুদীরা তৈরি করে আজকের ‘স্টেট অফ ইসরায়েল’। ১৯৪৮ সালে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ যখন যুদ্ধ শেষ হলো, তখন জর্ডান দখল করে পশ্চিম তীর। আর মিশর দখল করে গাযা। জেরুজালেম নগরীর পশ্চিম অংশ ইসরায়েলি বাহিনী আর জর্ডানের বাহিনী পূর্ব অংশ। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীর, সিরিয়ার গোলান মালভূমি, গাযা, এবং মিশরের সিনাই অঞ্চল দখল করে নেয়।
ইতিহাস-২৬৭ ▌ফিলিস্তিনি শরণার্থী:
ফিলিস্তিন ছিল তুরস্কের মুসলিম ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ফিলিস্তিনের মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, আর ইহুদী ছিল সংখ্যালঘু। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৩ সালে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হয় আরব-ইসরায়েল-এর মধ্যে। এসব যুদ্ধে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি ফেলে চলে যেতে বাধ্য হয়। বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি যায় গাযা এবং পশ্চিম তীরে। প্রতিবেশী জর্ডান, সিরিয়া এবং লেবাননেও যায় অনেক। এসব ফিলিস্তিনি বা তাদের সন্তানদেন আর ফিরতে দেয়নি নিজ ভূমিতে। ইসরায়েল এখন পুরো জেরুজালেমকেই তাদের রাজধানী বলে দাবি করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে চায়। বর্তমানে গাযা শাসন করে ফিলিস্তিনি দল হামাস। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে। গাযার সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল।
ইতিহাস-২৬৮ ▌ বায়তুল মুকাদ্দস:
১৪০বর্গ কিলোমিটার দেয়াল ঘেরা পুরো এলাকা ‘আলকুদস’ যা ‘মসজিদুল আকসা’ ও ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ (ইহুদিদের কাছে ‘টে¤পল মাউন্ট’) নামে পরিচিত। হযরত দাউদ (আ) [ডেভিড] জেরুজালেম নগরী জয় করার পর তাঁর পুত্র হযরত সুলায়মান (আ) [সলুমন] খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে পুণর্নির্মাণ করেছিলেন বায়তুল মুকাদ্দাস। এটি ইহুদীদের প্রার্থনার কেবলা এবং মুসলিমদেরও প্রথম কেবলা ছিল বহু বছর। এরপর বহু যুদ্ধে বার বার ধ্বংসপ্রাপ্ত বায়তুল মুকাদ্দাস পুননির্মাণ করা হয়। সম্রাট হেরোদ দ্য গ্রেট বায়তুল মুকাদ্দাসকে ঘিরে এর চতুর্দিকের দেয়ালটি নির্মাণ করেন। এই এরিয়ার মধ্যখানে আছে ‘সাকারা’ নামে একটি বড় পবিত্র পাথর, যাকে কেন্দ্র করে ৬৯১ সালে উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক একটি গম্বুজ নির্মাণ করেন। ১৯৯৩ সালে জর্ডানের বাদশাহ হুসাইন ৮০ কেজি স্বর্ণের প্রলেপ দেয় গম্বুজটিতে। এর চতুর্দিকের দেয়ালের একটি অংশ হল ডবংঃবৎহ ধিষষ/বোরাক দেয়াল। ইহুদীরা এই দেয়ালে প্রার্থণা করে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো এটি মুসলমানদের সম্পত্তি বলে ঘোষণা দেয়।
ইতিহাস-২৬৯ ▌ইয়াসির আরাফাত:
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলওর চেয়ারম্যান হিসাবে আরাফাত ইসরায়েলী দখলদারির বিরুদ্ধে সারাজীবন সংগ্রাম করেন। তিনি প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় আরাফাত ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলন, ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি এবং ২০০০ সালের ক্যা¤প ডেভিড সম্মেলন এর মাধ্যমে আরাফাত ইসরাইলীদের সাথে কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটানোর প্রয়াস নেন। ২০০২ হতে ২০০৪ সালের শেষভাগ পর্যন্ত আরাফাত ইসরাইলী সেনাবাহিনীর হাতে তার রামাল্লার দপ্তরে কার্যত গৃহবন্দী হয়ে থাকেন। ২০০৪ এর শেষদিকে আরাফাত অসুস্থ হয়ে পড়েন,এবং কোমায় চলে যান। ২০০৪ সালের নভেম্বর ১১ তারিখে প্যারিসে চিকিৎসারত অবস্থায় ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রয়োগে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যু হয়েছে, বলছে সুইস গবেষকরা।
:: ইরানের ইতিহাস ::
ইতিহাস-২৭০ ▌ ইরানের রাজত্ব:
আরব উপদ্বীপের মুসলমানরা ইরান জয় করেছিল। ইরানিরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। একাদশ শতাব্দীর সময় সেলজুক তুর্কিরা ইরানকে জয় করে একটি সুন্নি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১২১৯ সালে চেঙ্গিস খান এবং মঙ্গোলরা পারস্য আক্রমণ করে। মঙ্গোল শাসনের অবসান ঘটে ১৩৩৫ সালে, এরপরে বিশৃঙ্খলা। ১৫০১ সালে সাফাভিদ রাজবংশ শিয়া ইসলামকে পার্সিতে নিয়ে আসে। নাদির শাহের বিদ্রোহ এবং জন্ড রাজবংশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাফাভিদরা আঠারো শতক জুড়ে ক্ষমতায় ছিল। কিজর রাজবংশ (তুর্কি বংশোদ্ভুত একটি ইরানী পরিবার) ১৭৮৫ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত পারস্য (ইরান) শাসন করেছিল। ১৯২১ সালে ইরানি সেনা কর্মকর্তা রেজা খান সরকারের নিয়ন্ত্রণ দখল করেন। চার বছর পরে তিনি শেষ কাজার শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজের নাম রাখেন শাহ। এ পাহলভী রাজবংশ (১৯২৫-১৯৭৯), ইরানের শেষ রাজতন্ত্র।
ইতিহাস-১৭১ ▌যেভাবে শিল্পকলায় শীর্ষে ইরান:
প্রথম আব্বাস (১৫৭১-১৬২৯) যিনি মহান আব্বাস নামেও পরিচিত। তিনি ১৫৮৭ থেকে ১৬২৯ সাল পর্যন্ত পারস্যের শাহ ছিলেন। আব্বাসকে সবচেয়ে শক্তিশালী সাফাভি রাজা হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি পারস্য থেকে ওসমানীয় ও উজবেক সৈন্যদের বিতাড়িত করেন এবং একটি সদাপ্রস্তুত সেনাবাহিনী গঠন করে পারস্যে সাফাভি রাজবংশের কর্তৃত্ব সুসংহত করেন। আব্বাস ইস্পাহান শহরকে রাজধানী ঘোষণা করেন। আব্বাসের আমলে শিল্পকলায় পারস্যের কীর্তি শীর্ষে আরোহণ করে। ১৬০২ সালে বাহরাইন পুনদ্ধার করেন তিনি। ভারতের মুঘল সম্রাটের নিকট হতে কান্দাহার পুনরুদ্ধার করেন। এক জাতি এক রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি শিয়া মতবাদকে জনপ্রিয় করে তোলেন। পিতাকে বধ ও তাকে অন্ধ করে তিনি সিংহাসন দখল করেন। পুত্রগণ কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত হতে পারেন আশংকায় তিনি পুত্রদের কাউকে হত্যা এবং কাউকেও অন্ধ করে দেন।
ইতিহাস-২৭২ ▌নাদের শাহ:
তিনি ছিলেন আফছারিদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রখর সামরিক দক্ষতার কারণে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ তাকে পারস্যের নেপোলিয়ন বা দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হুতাকি আফগানদের দ্বারা বিদ্রোহ শুরু হলে ইরানে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তারা পারস্যের শাহ সুলতান হুসাইনকে সহজেই ক্ষমতাচ্যুত করে। ওসমানীয় ও রাশিয়া উভয়েই পারস্যের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নেয়। এমন পরিস্থিতিতে নাদের শাহ ক্ষমতায় আসেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর পারস্যের অঞ্চলগুলোকে পুনরায় একত্রিত করেন ও সেখান থেকে দখলদারীদের উচ্ছেদ করেন। তিনি সাফাভিদ রাজবংশের শাসককে ১৭৩৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেকে ইরানের শাহ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বহু দেশে সামরিক অভিযান চালিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে। নাদের শাহ ১৬২২ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকেও রাজ্য উদ্ধার করেন।
ইতিহাস-২৭৩ ▌জন্ড রাজবংশ:
করিম খান জন্ড (১৭৫১-১৭৭৯) ১৮ শতাব্দীতে দক্ষিণ এবং মধ্য ইরান শাসন করেছিল। পরে এটি দ্রুত সমকালীন ইরান, আজারবাইজান, বাহরাইন এবং আর্মেনিয়া ও ইরাকের বেশিরভাগ অংশকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রসারিত হয়। শাসক করিম খানের রাজত্ব সমৃদ্ধি ও শান্তির দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল। শিরাজ শহরে তার রাজধানী হওয়ার সাথে সাথে শিল্প ও স্থাপত্যের বিকাশ ঘটেছিল। ইসলামী যুগের সবচেয়ে মানবিক ইরানী শাসক হিসাবে করিম খান জন্ড স্থায়ী খ্যাতি অর্জন করেছেন "। ১৭৯৯ সালে করিম খানের মৃত্যুর পরে জন্ড রাজবংশের সদস্যদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে জন্ড ইরান পতিত হয়। তাঁর পুত্র এবং উত্তরসূরি আবু আল-ফাত ছিলেন এক অযোগ্য শাসক। আলী মুরাদ ও জাফর খানের মতো অন্যান্য শাসকরাও করিম খানের নীতি অনুসরণ করতে ব্যর্থ হন এবং শীঘ্রই দেশটি চারদিক থেকে আক্রমণে পড়েছিল।
ইতিহাস-২৭৪ ▌ইরানে পাহলভীদের শাসন :
পাহলভীদের শাসনকাল মূলত দুজন রাজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রেজা শাহ এবং তার পুত্র মোহাম্মদ রেজা শাহ। পাহলভীদের আগের ইরান শাসন করেছে কাজার রাজবংশ, তার আগে সাফাভিদ রাজবংশ। সাফাভিদ বংশের প্রথম রাজা প্রথম ইসমাইল ইরানের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে শিয়া ইসলামের নাম ঘোষণা করেন। আর কিছুকাল পর কাজার রাজবংশ ক্ষমতায় এসে উলামাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে তেল আবিষ্কৃত হলে ব্রিটিশরা গোয়েন্দাবাহিনীর মাধ্যমে ইরানে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। তারা সামরিক শাসক রেজা খানকে ক্ষমতায় বসতে সহায়তা করে এই শর্তে যে, ইরানের খনিগুলো থেকে ব্রিটিশদের তেল উত্তোলন করতে দিতে হবে! রেজা শাহ একে ইরান নামে নামকরণ করেন এবং পশ্চিমাদের অনুকরণে ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক এক রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগ দেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে।
ইতিহাস-২৭৫ ▌ইরানে ইসলামি বিপ্লব:
একসময় ইরানের কমিউনিস্ট ভাবধারার রাজনৈতিক দল ‘টুডে পার্টি’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই দলের মোহাম্মদ মোসাদ্দেগ ১৯৫১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রীত্ব পান। তিনি ইরানের শাসন কাঠামো কমিউনিস্ট করার প্রয়াস চালান। কিন্তু মোসাদ্দেগ বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। শিয়া উলামাদের গণঅভ্যুত্থানে ১৯৫৩ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পলায়নে বাধ্য হন তিনি। মোসাদ্দেগের অপসারণ মোহাম্মদ রেজা শাহের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। শাহ হয়ে ওঠেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। রাজনৈতিক নির্যাতন, বিরুদ্ধমতকে গলা চেপে ধরা, রাজনৈতিক হত্যা ও গুম ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ইরানি সাধারণ মানুষের মাঝে ত্রাসের রাজত্য কায়েম করেন। ফলে ব্যাপক পরিমাণ বেকার তরুণের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে। এ ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে শিয়া নেতা উলামা আয়াতুল্লাহ খোমেনি ’ইরানিয়ান বিপ্লব’ সফল করেন।
:: ওমান শাসন ::
ইতিহাস-২৭৬ ▌ওমানে বনী নাবহান শাসন:
ইসলামের প্রাথমিক দিনগুলোতে ওমান শাসিত হতো ইমামদের দ্বারা। আজ্দ গোত্রে ইয়াহমাদ শাখা নবম শতকে ওমানের ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ক্ষমতার অর্ন্তদ্বন্দ্বে ইমামদের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এ সুযোগে ওমান হস্তগত হয় সেলজুক সাম্রাজ্যের। খ্রিষ্টীয় ১১শ ও ১২শ শতকে সেলজুকরা ওমান শাসন করেছে। ১১৫৪ সালে ‘নাবহানরা’ তাদের বিতাড়িত করে। তারা ১১৫৪ থেকে ১৬২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বছর ওমানের শাসক ছিল। নাবহানিরা তাদের রাজধানী ছিল বাহলা, যা মাসকাট বন্দরের খুব কাছেই। ১৫ শতক হতে ১৭ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ওমানে একজন নির্বাচিত ইমাম এবং একজন নাবহান বংশীয় সুলতান যৌথভাবে ক্ষমতায় থাকেন। কিন্তু ইমামগণের শাসনকার্যে অযোগ্যতার কারণে ওমান খুব দ্রুত পর্তুগিজদের দখলে চলে যায়। ১৬২৪ সালে ইয়ারুবা শাসক নাসির বিন মুরশিদ পর্তুগিজদের কাছ থেকে ওমান দখল করে নেন।
:: ভারত অভিযান ::
ইতিহাস-২৭৭ ▌ভারত অভিযান প্রস্তুতি:
ব্যবসায়িক কাজে শ্রীলংকা দ্বীপে পূর্ব থেকেই অনেক আরব বসবাস করত। সেখানে নির্মিত হয় বেশ কিছু মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষালয়। ৭০৭ সালে শ্রীলঙ্কা থেকে একটি জাহাজে করে ঐ অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমান পুরুষগণ হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব অভিমুখে যাত্রা করে। সিন্ধু বন্দরের কাছাকাছি আসলে জাহাজগুলো জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। সিন্ধুর উপজাতি মেড এবং রাজা দাহিরের সৈন্যরা মিলিত হয়ে এই কাজটি করেছিল বলে ধারণা করা হয়। ৭১১ সালের জুন মাসে হাজী জাহাজ এইসসব জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে অসহায় নারীরা তাদের রুমালের উপরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেন। বিষয়টা তিনি আপন ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিম মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের হতে ছেড়ে দেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর মুহাম্মদ বিন কাসিম যুদ্ধের নাকারা বাজিয়ে দিলেন।
ইতিহাস-২৭৮ ▌ মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযান:
দামেস্ক থেকে ৫ হাজার সৈন্য নিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন বসরা অভিমুখে। বসরায় সৈন্য সংগ্রহ করে ১২ হাজার সৈন্যের একটি কাফেলা নিয়ে সিন্ধু অভিমুখে যাত্রা করলেন। প্রথমেই তিনি দেবল দুর্গ অবরোধ করলেন। কয়েক মাস অবরোধ করে রাখার পর দেবল দুর্গ মুসলমানদের অধিকারে চলে আসে। রাজা দাহির তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন রাওয়ার দুর্গে। এরপর বিন কাসিম মাত্র ৪ হাজার সৈন্য দেবলে রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। উল্লেখ্য, রাজা দাহিরের উপরে স্থানীয় বৌদ্ধ, জেঠ, মেঠদের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিমের এই অভিযানে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। জেঠ, মেঠ ও বৌদ্ধ সৈন্যরাও যোগ দেয় মুহাম্মদ কাসিমের দলে। আবার অনেক হিন্দু সৈন্যও রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এই সৈন্যদের সাথে যোগদান করে। কাজেই মুহাম্মদ বিন কাসিম-এর সৈন্যসংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে প্রায় বিনাযুদ্ধে বহু এলাকা জয় করতে থাকেন তিনি। ৭১৫ সালে ২০ বছর বয়সে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-২৭৯ ▌ধর্মপ্রচার:
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আদেশ অনুযায়ী মুহাম্মদ বিন কাসিম সমস্ত অমুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেন। সিন্ধুবাসীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে মন্দির মেরামতের অনুমতি প্রদান করা হয় এবং যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদ, অরোর, রাওয়ার, মুলতান, এবং অন্যান্য স্থানেও একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। হিন্দুদেরকে বিভিন্ন উচ্চপদে বহাল করা হয়। তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার করতে আদেশ দেওয়া হয়। ফলে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যুর পর সিন্ধুবাসীরা তাঁর জন্য অশ্রু বিসর্জন দেয়। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পর হতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেবল, সোমনাথ, কাথিওয়ান, করুন, ব্রোচ, ক্যাথে, সিন্দন, ঢেউল, গুজরাট, প্রভৃতি স্থানে ক্ষুদ্র মুসলিম বসতি গড়ে উঠে, সেখানে ধর্মপ্রচারে ব্রতী হন। অধিকাংশ হিন্দু শাসক তাদের রাজ্যে মুসলমানদের স্বাগত জানান।
ইতিহাস-২৮০ ▌সুলতান মাহমুদ গজনবী:
সুলতান মাহমুদের একটি গুণ তাকে মহান করে রেখেছে সেটি হল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দান। তার দরবার জ্ঞানী-গুনিদের মিলনস্থলে পরিণত হয়। সুলতান মাহমুদ নিজে বিভিন্ন আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকতেন। তার দরবারে শাহনামার রচয়িতা ফেরদৌসি, দার্শনিক ফারাবী, ঐতিহাসিক উৎবী, আখ্যান রচয়িতা বাইহাকী, কবি আলগারী, উজারী প্রভৃতি জ্ঞানী-গুনিদের দ্বারা অলংকৃত ছিল। তাছাড়া বিখ্যাত আল বিরুনিও তার দরবারে কিছুদিন পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। ভারত থেকে বহু মূল্যবান বই-পুস্তক ও পা-ুলিপি তার দরবারের জ্ঞান বিজ্ঞানের পথকে অনেকটা সুপ্রসিদ্ধ করে। তিনি যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়া অন্য ধর্মের কোন জনসাধারণের উপর অত্যাচার করেননি ইতিহাসে সুলতান মাহমুদ বহুমাত্রিক প্রতিভাধর হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তিনি একাধারে ছিলেন ধর্মভীরু, বীর যোদ্ধা,দক্ষ প্রশাসক, শিল্পসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক, ন্যায় বিচারক।
ইতিহাস-২৮১ ▌ গজনবীর ভারত অভিযান:
সুলতান মাহমুদ ৯৭১ সালে বর্তমান আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। ৯৯৭ সালে তার পিতার মৃত্যু হলে মাহমুদ তার ভাইকে পরাজিত করে গজনির শাসন ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। আফগান সিংহাসনে আরোহণ করার পর থেকে যে পরিমাণ অভিযান পরিচালনা করছেন, এই পরিমাণ যুদ্ধ বিজেতা ইতিহাসে খুব কমই রয়েছে। শুধু ভারতেই তিনি ১৭ বার অভিযান প্রেরণ করেন এবং কাকতালীয় হলেও সত্য প্রতিবারই তিনি জয় লাভ করেন। তিনি আব্বাসী খলিফার আস্থা অর্জন করে নিজেকে আব্বাসী খিলাফতের অধীনস্থ শাসক হিসেবে ঘোষণা করে সুলতান উপাধি গ্রহণ করেন। তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভারত অভিযান হল ১০২৬ সালে সোমনাথ মন্দিরে অভিযান পরিচালনা। তার অভিযান সফলতা লাভের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, ভারতে কোন স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ফলে ভারতে তিনি কোন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
ইতিহাস-২৮২ ▌ মহম্মদ ঘুরি :
ভারতে তুর্কী অভিযানের নায়ক ছিলেন মহম্মদ ঘোরী। আফগানিস্তানের গজনী ও হিরাটের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল ঘোর রাজ্য। তখন আজমীর ও দিল্লির অধিপতি পৃথ্বীরাজ চৌহান ও কনৌজ-রাজ জয়চাঁদ ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী। ১১৯০-৯১ সালে মহম্মদ ঘুরি ভারত আক্রমণ করলে পৃথ্বীরাজ অন্যান্য রাজপুত রাজাদের সাহায্য নিয়ে মহম্মদ ঘুরিকে পরাস্ত করেন। এই যুদ্ধটি তরাইনের প্রথম যুদ্ধে নামে পরিচিত। পরের বছর ১১৯২ সালে মহম্মদ ঘুরি বিশাল বাহিনী নিয়ে এসে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে দিল্লি ও আজমীর দখল করেন। পরে মিরাট, বুলান্দগড়, এবং আলিগড় এবং কনৌজ রাজ্যও জয় করে নেয় । তিনি ১২০৬ সালে তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর কুতুবউদ্দিন আইবকের হাতে অর্পণ করেন ও মহম্মদ ঘুরি দেশে ফিরে যান। কুতুবউদ্দিন আইবক ১২০৬ সাল থেকে ১২১০ সাল পর্যন্তভারতে সুলতানি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন ।
ইতিহাস-২৮৩ ▌জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর:
জহির উদ্দিন মোহাম্মদ জন্মেছিলেন ১৪৮৩ সালে উজবেকিস্তানে। তিনি ওকানকার শাসনকর্তা ওমর ¤িজার বড় পুত্র ছিলেন। তিনি ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট। তিনি তৈমুর লঙ্গ-এর সরাসরি বংশধর এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লির লোদি রাজবংশের সুলতান ইবরাহিম লোদিকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পানি পথের যুদ্ধে তিনিই প্রথম কামানের ব্যবহার করেন। তার প্রখর রণকৌশলের কাছে হার মানে ইবরাহিম লোদি। বাবর একজন মুঘল হয়েও মধ্য এশিয়ার তুর্কি এবং ইরানীদের কাছ থেকে ব্যাপক সহযোগিতা লাভ করেছিলেন এবং তার সৈন্যবাহিনীতে পার্সি তুর্কি,পাঠান,আরবীয় মানুষ ছিলেন। তার শাসনামলে পার্সিয়া থেকে শিয়া ও সুফির মত একটি উগ্রপন্থী ধর্মীয় ধারা বর্তমান ছিল, যা পরবর্তীকালে মোঘল কোর্টে সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী হয়েছিল।
ইতিহাস-২৮৪ ▌বাবরের ভারত অভিযান:
জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর ১৫২৬ সালে সংঘটিত ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম যুদ্ধের পূর্বে ভারতে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, যা সাধারণত পর্যবেক্ষণমূলক অভিযান নামে সমধিক পরিচিত। বাবর ১৫২০ সালে আপগানিস্থানের বাদাখসান এবং ১৫২২ সালে কান্দাহার হস্তগত করেন। স্বীয় পুত্র হুমায়ুন ও কামরানকে যথাক্রমে বাদাখসান ও কান্দাহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সুলতান ইব্রাহীম লোদীর অত্যাচার ও নির্মম আচরণে অসন্তুষ্ট পাঞ্জাবের তৎকালীন শাসনকর্তা দৌলত খান লোদী, ইব্রাহিম লোদীর পিতৃব্য আলম খান জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবরকে ভারতবর্ষ আক্রমণে আহ্বান জানালে বাবর ১৫২৪ সালে লাহোর দখল করেন। এ সময় বাবর শিয়ালকোট, দিপালপুর এবং পাঞ্জাবের অন্যান্য স্থানও অধিকার করেন। এমতাবস্থায় আমন্ত্রণকারীদের বিশেষ অনুরোধে বাবর পূর্ণোদ্যমে ভারতের অন্যত্র অভিযান আরম্ভ না করে সসৈন্যে কাবুল প্রত্যাবর্তন করেন।
ইতিহাস-২৮৫ ▌পানিপথের প্রথম যুদ্ধ:
পানিপথ বর্তমান ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার উত্তরে হরিয়ানা রাজ্যে অবস্থিত। ১৫২৫ সালে বাবর কাবুল থেকে আগমন করে পাঞ্জাবের শাসক দৌলত খান লোদীকে পরাজিত করে লাহোর তথা সমগ্র পাঞ্জাব অধিকার করেন। ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিল লোদী বংশের সর্বশেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদী ও জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবরের মধ্যে ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ‘তুযুক-ই-বাবুরী’ বা ‘বাবরনামা’র বিবরণ অনুযায়ী পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের সেনাবাহিনীতে ছিল ১২,০০০ পদাতিক, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ। এই যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীর সৈন্যবাহিনীতে ছিল ১,০০,০০০ সৈন্য ও ১০০ হস্তী। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাবর ইব্রাহিম লোদীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত করেন। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয় লাভ করার মাধ্যমে লোদী বংশের পতন ঘটে এবং মুঘল বংশের রাজত্ব শুরু হয়।
ইতিহাস-২৮৬ ▌খানুয়ার যুদ্ধের ফলাফল:
১৫২৬ সালের ঐতিহাসিক পানিপথের যুদ্ধের পর ১৫২৭ সালের খানুয়ার যুদ্ধ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লির লোদী বংশের সর্বশেষ নামমাত্র সুলতান ইব্রাহিম লোদী পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু খানুয়ার যুদ্ধের ফলে ভারতে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ রাজপুত শক্তির শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে রানা সংগ্রাম সিংহের হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চিরতরে বিনষ্ট হয়ে যায় এবং রাজপুত শক্তির প্রাধান্য ক্ষুণœ হয়। খানুয়ার যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বাবরের প্রাধান্য ও ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়েছিল। বাবর এই যুদ্ধে জয়লাভের পর তাঁর ক্ষমতার মূলকেন্দ্রবিন্দু কাবুল থেকে হিন্দুস্থানে স্থানান্তর করেন। খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুত শক্তির পুনরুজ্জীবনের আশা স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত করে বিজয়ের নিদর্শনস্বরূপ জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর ‘গাজী’ উপাধি ধারণ করেন।
ইতিহাস-২৮৭ ▌শাসক হিসেবে বাবরের কৃতিত্ব:
জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর ১৫৩০ সাল পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্য শাসন করেন। তাঁর সময় মুঘল সাম্রাজ্য পশ্চিমে কাবুল থেকে পূর্বে বিহার এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে চান্দেরি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। মাত্র চার বছরের সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালে বাবর বিশাল সাম্রাজ্যে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের বাবর সমগ্র সাম্রাজ্যব্যাপী ১৫ মাইল অন্তর অন্তর ডাকচৌকির ব্যবস্থা করেন। বাবর খলিফার ক্ষমতাকে অস্বীকার করে স্বয়ং ‘বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি পূর্ববর্তী আমলে প্রচলিত সামন্ত প্রথা ও জায়গীরদারী প্রথা চালু রাখলেও তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব সীমিত করেন। বাবরের শাসনামলে বিভাগীয় প্রধান এবং বাদশাহের সাথে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতেন প্রধানমন্ত্রী নিজামউদ্দিন খলিফা। প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হত ওয়ালী (প্রাদেশিক গভর্ণর) দিওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা), সিকদার (সমর কর্মকর্তা) ও কোতয়াল (নগর কর্মকর্তা) প্রমুখ কর্মকর্তাদের দ্বারা।
ইতিহাস-২৮৮ ▌নাসির উদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন:
সম্রাট হুমায়ুনও ছিলেন তার বাবর মতন নরম মনের ও দয়ালু পকৃতির। ১৯৩৯ সালে তিনি শেরশাহ এর সাঙ্গে চৌশা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এরপর তিনি শেরশাহ এর সাথে কোনজের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দিল্লি ত্যাগ করেন। শেরশাহের নিকট পরাজিত হয়ে হুমায়ুন বহু দুঃখ দুর্দশার মধ্যদিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। যোধপুরে আশ্রয় লাভে ব্যর্থ হয়ে তিনি অমরকোটে রানা প্রসাদের আশ্রয় প্রার্থী হন। রানা প্রসাদ তাকে আশ্রয় দেন এবং সিন্ধু ও খাট্টা পুনরুদ্ধারে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। অমরকোটে থাকা অবস্থায় হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা বানুর গর্ভে পুত্র আকবরের জন্ম হয়। ১৫৪০ থেকে ১৫৫৫ সাল পর্যন্ত সাময়িকভাবে ভারত বর্ষে মুঘল স্বাশন ছিল না। এ সময় শেরশাহ এর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে শুর স্বাসন শুরু হয়। ১৫ বছর পর ১৫২২ সালে হুমায়ুন মুঘল সম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। ১৫৫৬ সালে হুমায়ুন গ্রন্থাগারের সিড়িঁ দিয়ে নামতে গিয়ে মৃত্যুবরন করেন।
ইতিহাস-২৮৯ ▌ শেরশাহের রাজ্য বিজয়:
শূর বংশের রাজত্বকাল (১৫৪০-১৫৫৫)। কালিঞ্জর দুর্গ অধিকার কালে বারুদ্দের গুদামে আকস্মিক বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১৫৪৫ সালে শেরশাহ মৃত্যুবরণ করলে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র জালাল খান ‘ইসলাম শাহ’ উপাধি ধারণ পূর্বক দিল্লির সিংহাসনে বসেন। দীর্ঘ নয় বছর শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে ইসলাম শাহ ১৫৫৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র ফিরোজ শাহ মাত্র বার বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু ফিরোজ শাহের মামা মুবারিজ খান তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিজে ‘মুহম্মদ আদিল শাহ’ উপাধি ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। অচিরেই শূর পরিবারের ইব্রাহিম খাঁ শূর আদিল শাহকে পরাস্ত করে আগ্রা ও দিল্লি দখল করেন। এ অবস্থায় পাঞ্জাবের শাসক সিকান্দার শাহ ইব্রাহিম খাঁ শূরকে বিতাড়িত করে দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করেন। ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন সিকান্দার শাহকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।
ইতিহাস-২৯০ ▌জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর:
হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মুঘল সম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট হিসাবে জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর মাত্র ১৩ বছর বয়সে শাসনভার গ্রহন করেন। তখন বৈরাম খার ততœাবধানে সম্রাট আকবর সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। ১৫৬০ সালে বৈরাম খাকে সরিয়ে নিজে সব ক্ষমতা দখল করে নেন। সম্রাট আকবর শাসন ব্যাবস্থাকে শক্তিশালি করার জন্য দুইটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ১.কেন্দ্রিয় শাসন ব্যবস্থা। ২.প্রদেশিক শাসন ব্যাবস্থা। কেন্দ্রিয় শাসন ব্যাবস্থার প্রধান ছিলেন স্বয়ং আকবর। সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করার জন্য তিনি বিশাল সম্রাজ্যকে ১৫টি প্রদেশে ভাগ করে ছিলেন। সম্রাট আকবরকে ভারত বর্ষের সবথেকে শ্রেষ্ঠ শাসক হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। আকবর ১৫৭৬ সালে বাংলায় মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দ্বীন-এ-ইলাহি নামের একটি ধর্মের ও প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর ১৫৫৬ সালে বাংলা সন এবং নববর্ষের প্রচলন করেন।
ইতিহাস-১৯১ ▌পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ:
হুমায়ুনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আফগান নেতা আদিল শাহের সেনাপতি হিমু ৫০ হাজার অশ্বারোহী ও ৫০০ হস্তীসহ ইবরাহিম শূরকে আক্রমণ ও পরাজিত করে আগ্রা অধিকার করেন। দিল্লির শাসনভার তখন তারদি বেগ নামক এক সেনাপতির হাতে ন্যস্ত ছিল। তারদি বীরত্বের সঙ্গে লড়েও হিমুর সঙ্গে পারলেন না। দিল্লি জয় করে তিনি নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা করে ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি গ্রহণ করলেন। তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধ সার্বিক বিজয় লাভের জন্য আরও অগ্রসর হতে থাকেন। আকবরের সেনাবাহিনী ঐতিহাসিক পানিপথ প্রান্তরে হিমুর মোকাবিলা করল (১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর)। যুদ্ধে মুঘল বাহিনী যখন পরাজয়ের মুখে তখন দুর্ভাগ্যবশত একটি তীর হিমুর চোখে বিদ্ধ হয়। হিমু ধৃত ও নিহত হলেন এবং তার সেনাবাহিনী পরাজিত হলো। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলেই মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল এবং মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তর শুরু হয়েছিল।
ইতিহাস-২৯২ ▌শাহাজাদা সেলিম/ সম্রাট জাহাঙ্গীর :
তুরষ্কের সুলতান আনারকলি নামে এক অনিন্দ সুন্দরীকে সম্রাট আকবরের কাছে রক্ষিতা করে পাঠান। যার প্রেমে ইতিহাস হয় পুত্র শাহাজাদা সেলিমের। আকবরের পর জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন তার জেষ্ঠ পুত্র শাহাজাদা সেলিম। জাহাঙ্গীরের অধীনে সাম্রাজ্য উত্তর-পূর্ব দিকে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। কুচবিহার, ত্রিপুরা এবং কামরূপ মুগলদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলায় মুঘল সম্রাজ্য পাকাপোক্ত করেন। তিনি সরকারি কাজে ফার্সি ভাষা চালু করেন। তিনি বাংলার সুবেদা হিসাবে ইসলাম খা-কে নিয়োগ করেন। পাশাপাশি বাংলার বারো ভুইয়াদেরকেও দমন করেছিলেন তিনি। তার আমলেই ১৬১০ সালে ইসলাম খা কতৃক বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। এবং ঢাকার নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীর নগর। জাহাঙ্গীরের আমলেই ইাস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি বাংলায় আগমণ করে। ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীর থেকে ফেরার পথে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয় এবং লাহোরে তাকে সমাহিত করা হয়।
ইতিহাস-২৯৩ ▌সম্রাট শাহজাহান:
জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তার তৃতীয় পুত্র খুররাম, শাহজাহান নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন। শাহজাহানের রাজত্বের সময়কালের মুঘল স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ ছিল। এ সময় মুঘল বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দশ লক্ষে উন্নীত হয় এবং তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হয়। তাজমহল, লাল কেল্লা, দিল্লির শাহজাহানাবাদ শহর (পুরান দিল্লি) প্রভৃতি নির্মাণ করেন। শাহজাহানের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেও মমতাজের বিয়ে হয়েছিল। মমতাজ ১৬৩১ সালে ৩৯ বছর বয়সে ১৪তম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। মমতাজের আগেও সম্রাট শাহজাহানের আরও ৩ জন স্ত্রী ছিলেন। মমতাজকে বিয়ে করার পরও আরও তিনটি বিয়ে করেন। এমনকি মমতাজের আপন ছোট বোনকেও বিয়ে করেন। তাজমহল নির্মাণের ৫ বছরের মাথায় ১৬৫৮ সালে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে বন্দি করেন এবং এ অবস্থায় ১৬৬৬ সালে আগ্রা ফোর্টে তার মৃত্যু হয়। তার জীবদ্দশায় আওরঙ্গজেব তার অবশিষ্ট পুত্র ও তাদের ঘরের নাতিদের হত্যা করেন।
ইতিহাস-২৯৪ ▌আরংগুজেব:
আরংগুজেব জোর করে শাহাজানকে বন্দি করে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। তিনি প্রায় ৫০ বছর শাসন করেন। আরংগুজেব ছিলেন খুবই ধার্মিক। তিনি তার দরবারে নৃত্য,গানবাজনা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মদ্য পান ও জুয়া খেলাও নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন তিনি। আওরঙ্গজেব একজন হাফিজ ছিলেন এবং সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাধারণ জীবন যাপন কাটিয়েছেন। তিনি টুপি এবং নিজের হাতের লিখা কুরআন বিক্রি করতেন আর রাজ্যের স¤পদ ¯পর্শ করতেন না। তার আমলে দক্ষিণাঞ্চলে ৪ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি ১৫৮ মিলিয়ন প্রজাকে শাসন করতেন। তার সময় মুঘল সাম্রাজ্যের বাৎসরিক করের পরিমাণ ছিল ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। যা তার সমসাময়িকআমলে ফ্রান্সের বাৎসরিক কর এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি ছিল। তার শাসনামলে ভারত পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। যা ছিল সমগ্র পৃথিবীর জিডিপি-র এক চতুর্থাংশ।
ইতিহাস-২৯৫ ▌শাহ আলম:
আরংগুজিবের মৃত্যুর পর তার পুত্র শাহ আলম ক্ষমতায় বসেন। পিতার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করে শাহ আলম প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। ১৭১৯ সালে তার মৃত্যুর পর সমগ্র মুঘল সম্রাজ্য এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এরপর বেশ কয়েকজন সম্রাট সিংহাসনে অধিষ্টিত হয়। কিন্তুু কেউ আর আগের শাসকদের মতো দক্ষ ছিল না। শাহ আলম দ্বিতীয় (১৭৬১-১৮০৫) দিল্লির মুগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের পুত্র। তিনি অনেক আক্রমণের সম্মুখীন হন, প্রধানত আফগানিস্তানের শাহ আব্দালি দ্বারা, যার ফলে মারাঠা সাম্রাজ্যের সাথে পানিপাতের তৃতীয় যুদ্ধ হয়। ১৭৭২ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লি ফিরতে পারেননি। বক্সারের যুদ্ধে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অসহায় অবস্থায় নিপতিত। এলাহাবাদ চুক্তি অনুসারে (১৭৬৫) শাহ আলম বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করেন।
ইতিহাস-২৯৬ ▌দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর:
সর্বশেষ মুঘল সম্রাটের নাম দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর (১৭৭৭- ১৮৬২)। তিনি পূর্বসূরি ও তার বাবা মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের ২য় সন্তান। প্রকৃতপক্ষে পিতামহ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং পিতা সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ(১৮০৬-১৮৩৭) উভয়ের মতো দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানির পেনশনভোগী ছিলেন। তিনি বার্ষিক ১ লাখ টাকা ভাতা পেতেন। তিনি নিজের ভরণপোষণে ভাতা বৃদ্ধির জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু "বাদশাহ" উপাধি ত্যাগ এবং লালকেল্লার বাইরে সাধারণ নাগরিকের মতো জীবনযাপনের শর্তে তিনি রাজি হননি। এ ছাড়া সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন নিয়েও ইংরেজদের সঙ্গে সম্রাটের মনোমালিন্য হয়। ছলেবলে কৌশলে ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নিয়েছে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে ব্যার্থ হলে ইংরেজ সরকার তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেয়। তিনি সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন।
ইতিহাস-২৯৭ ▌কুতুবুদ্দিন আইবেক:
কুতুবুদ্দিন আইবেক ছিলেন মুহাম্মদ ঘুরীর একজন ক্রীতদাস হিসেবে জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি মুহাম্মদ ঘুরীর সেনাপতি হন। তিনি মুহাম্মদ ঘুরীর অনুমতিক্রমে ভারত বিজয়ের পর দিল্লীতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। উপমহাদেশে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন কুতুবুদ্দিন। তিনি ছিলেন তুর্কিস্থানের অধিবাসী। কুতুবুদ্দিন ও তার উত্তরাধিকারীদের শাসনামলকে প্রাথমিক যুগের তুর্কী শাসনও বলে চিহিৃত করা হয়ে থাকে। দিল্লির কুতুবমিনার নামক সুউচ্চ মিনারটি তাঁর আমলেই নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তিনি মিনারটির কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। দিল্লির বিখ্যাত সাধক কুতুবউদ্দিন বখতিয়ারের কাকির নামানুসারে এর নাম রাখা হয় কুতুবমিনার। কুতুব উদ্দিনের মূল কৃতিত্ব আসলে রাজ্য বিস্তরের থেকেও ইসলামের প্রচার, প্রসার এবং ইসলামী স্থাপত্য নির্মাণের সূচনা করা। ইরান, আফগানিস্তান থেকে দলে আসতে লাগল সুফি দরবেশ, ইসলামী পন্ডিত।
ইতিহাস-২৯৮ ▌সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুতমিশ:
কুতুবুদ্দিন আইবেকের জামাতা ছিলেন ইলতুতমিশ। তাকে দিল্লী সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ভারতে মুসলমান শাসকদের মধ্যে তিনি প্রথম মুদ্রা প্রচলন করেন। তিনি কুতুবমিনার নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। তার ভাইয়েরা তার রুপ ও যোগ্যতায় ইর্ষান্বিত হয়ে তাকে এক দাস ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়। বিক্রির পর তাকে বুখারার কাজী সদর জং কিনে নেন। বুখারায় তিনি ভাল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পান। এরপরে তাকে দিল্লি নিয়ে আসা হয়, সেখানে তাকে কুতুবউদ্দিন আইবেক কিনে নেন। কুতুবউদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর পর তার পুত্র শাসনভার গ্রহণের অযোগ্য প্রমাণিত হলে তুর্কিরা তাকে সুলতান হিসেবে মনোনিত করে। ইলতুতমিশ একজন যোগ্য শাসক ছিলেন। তিনি জ্ঞানী, প্রশাসক ও উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তাদের দেশে নিয়ে আসেন যারা মঙ্গল আক্রমণের সময় চলে গিয়েছিল। এদের নিয়ে ইলতুতমিশ এক শক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
ইতিহাস-২৯৯ ▌সুলতানা রাজিয়া:
ইলতুতমিশের কন্যা সুলতানা রাজিয়া ১২৩৬ সালে দিল্লির সিংহাসনের আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণকারী প্রথম মুসলমান নারী । তিনি একাধারে একজন ভাল প্রসাশক ও সেনাপতি ছিলেন; তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে একজন দক্ষ সৈন্য হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। সুলতান ইলতুতমিশের মৃত্যুর পর তার আরেক পুত্র রোকনুদ্দিন ফিরোজ দিল্লির শাসন কেড়ে নেন এবং প্রায় সাত মাসের মত শাসন করেন। ১২৩৬ সালে দিল্লির জনগনের সাহায্য নিয়ে রাজিয়া সুলতানা তার ভাইকে অপসারণ করে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। নারী হওয়ার কারণে ও প্রকাশ্যে পর্দাপ্রথার বিরোধী হয়ে শাসনকাজ পরিচালনা করার জন্যে উলেমা ও প্রভাবশালী শ্রেনীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ছিলো চল্লিশ জন ক্রীতদাসদের সমন্বয়ে গঠিত “চল্লিশ চক্র”। ১২৪০ পলায়নকালে তার একজন ভৃত্য ছিল, তাকে খাদ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করে।
ইতিহাস-৩০০ ▌ সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ:
(১২৪৬-১২৬৬) তিনি নাসিরউদ্দিন মাহমুদের পুত্র ও সুলতান ইলতুতমিশের পৌত্র ছিলেন। ইলতুতমিশ তাকে তার বাবার নাম প্রদান করেছিলেন। আলাউদ্দিন মাসুদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি মসনদে বসেন। সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ অত্যন্ত ধর্মভীরু লোক ছিলেন। সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপনের জন্য তিনি ফকির বাদশাহ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি কুরআন নকল ও টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নামাজ এবং কুরআন লিপিবদ্ধকরণে তিনি অনেক সময় ব্যয় করতেন। তার শ্বশুর গিয়াসউদ্দিন বলবন মূলত শাসনকাজ তদারক করতেন। নাসিরউদ্দিন মাহমুদ সহজসরল জীবন যাপন করতেন। নিজের হাতে কুরআন বিক্রি করে তিনি ব্যক্তিগত খরচের ব্যস্থা করতেন। তার কোনো চাকর ছিল না এবং তার স্ত্রী পরিবারের জন্য খাবার রান্না করতেন। ১২৬৬ সালে মাহমুদ নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার পর বলবন মসনদে বসেন।