মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য
মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য
০৯৬ ▌চিতোরের রানা প্রতাপ
১৫২৭ সালের ২৩ শে জুলাই, বিখ্যাত যুদ্ধক্ষেত্র রাজস্থানের হলদিঘাটি প্রান্তর। একপাশে কামান আর বন্দুক সজ্জিত লক্ষাধিক মোগল সৈন্য। সবার মুখে কেমন জানি তাচ্ছিল্যের হাসি। কারণ অপর পারে রয়েছে মাত্র হাজার বিশেক রাজপুত। নেই কামান বা বন্দুক। এই যুদ্ধে জয় তাদের যে হাতের মুঠোয় সে ব্যাপারে তারা মোটামুটি নিশ্চিত। যেখানে প্রধান সেনাপতি রাজা মানসিংহ নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত, সেখানে তাদের জয় আর ঠেকায় কে?
সৈনিকদের মতো অতোটা নিশ্চিত নন রাজা মানসিংহ। যুদ্ধ তাঁর জীবনের আরেক নাম। শতাধিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাঁর ভাণ্ডারে। নিজে রাজপুত তিনি। ভালোমতোই জানেন রাজপুতরা একমাত্র ভগবান শিব ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নোয়ায় না। জীবন আর মৃত্যু তাদের কাছে সমার্থক। ইতিহাসে কখনোই হার মেনে নেয়নি তারা। আর এই বারে রাজপুতেরা আরো এককাঠি সরেস। সম্মান হারানোর চেয়ে মৃত্যুকেই তারা বড় বেশি আপন বলে মনে করে। অষ্টম শতকে তারা তাদের দেশে গ্রিক আক্রমণ প্রতিহত করে। তাদের রানী কর্ণাবতী যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো লড়াই করেন। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর লালসা হতে রক্ষা পেতে রানী পদ্মাবতী ও শত শত রাজপুত কন্যারা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে জীবনের বিনিময়ে সতীত্ব রক্ষা করেন। এমনই এক লড়াকু জাতি তারা। অনেক ঐতিহাসিকের মতে সতীদাহ প্রথাটি এখান থেকেই উৎপত্তি হয়। কারণ প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় টেক্সট বেদ বা পুরাণে এই প্রথাটির উল্লেখ নেই।
সম্রাট আকবর ছিলেন বাস্তবিকই বিচক্ষণ। তিনি বলের পরিবর্তে ছলের আশ্রয় নিলেন। রাজপুত রাজা টোডরমল আর বীরবলের ঠাঁই হলো নবরত্ন সভায়। মহারানী করলেন রাজা ভগবান দাসের কন্যা রাজকুমারী যোধাবাইকে। আর প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ দিলেন তৎকালীন ভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা রাজা মানসিংহকে। সর্বতোভাবে চেষ্টা করলেন ছলে, বলে, কৌশলে অধিকার করতে এই অজেয় যোদ্ধা জাতিটিকে। অধিকাংশ রাজপুত রাজারা আকবরের বশ্যতা মেনে নিলেও বেঁকে বসেন চিতোরের রানা প্রতাপ। মোঘলদের তিনি ভারতীয় বলে জ্ঞান করতেন না। পছন্দও করতেন না একেবারেই। তাঁর দৃষ্টিতে মোঘলরা ছিল স্রেফ বৈদেশিক হানাদার। রানা প্রতাপকে নানা ধরনের প্রলোভন দেখানো হয়, হুমকিও দেয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই তাকে বৈশ্যতা স্বীকারে রাজি করানো গেল না। সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে সম্রাট আকবর সেনাপতি মানসিংহকে পাঠান দূত হিসেবে। মানসিংহকে যথেষ্ট পরিমাণ আপ্যায়িত করার পরেও তাঁর সঙ্গে এক টেবিলে বসে আহার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান রানা। এতে বিস্মিত হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে রানা উত্তর দেন, বিদেশি শত্রুর নিকট আত্মমর্যাদা বিলিয়ে দেয়া মানুষের সঙ্গে আমি এক পাতে খেতে বসতে পারি না।
প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েই দিল্লি ফিরে যান মানসিংহ। গিয়ে সবিস্তারে সবকিছু খুলে বলেন সম্রাটকে। সব শুনে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন সম্রাট। রানাকে দমনের জন্য মানসিংহ আর শাহজাদা সেলিমের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। প্রতাপও বুঝতে পারেন যে লড়াই অত্যাসন্ন। আর পিছু হটা সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। তিনিও নির্দেশ দিলেন তাঁর বাহিনীকে প্রস্তুত হতে।অবশেষে এলো সেই চূড়ান্ত দিন। ১৫২৭ সালের ২৩শে জুলাই। বিখ্যাত যুদ্ধক্ষেত্র রাজস্থানের হলদিঘাটিতে সর্বসাকুল্যে হাজার বিশেক রাজপুত সেনা প্রতাপের নেতৃত্বে কামান বন্দুকে সজ্জিত বিশাল মোঘল বাহিনীর মুখোমুখি হয়। শুরু হয় ইতিহাস বিখ্যাত এক অসম লড়াই। বীরের মতো লড়াই করতে থাকে রাজপুতরা। কিন্তু কামান, বন্দুকের সামনে তলোয়ার আর বর্শা দিয়ে কতক্ষণ টেকা যায়? দলে দলে মারা পড়তে লাগল তারা। এমন অবস্থায় প্রতাপ দেখতে পেলেন মানসিংহকে। যুদ্ধক্ষেত্রে একটি বিশাল হাতির পিঠে বসে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন তিনি। প্রতাপ জানতেন যে মানসিংহ শুধু বড় যোদ্ধাই নন, একজন যোগ্য সেনাপতিও বটে। তাঁর যদি পতন হয়, তাহলে মোগল বাহিনীর মনোবল অনেকটাই ভেঙে যাবে। নিজের যুদ্ধ অশ্ব চেতকের পিঠে বসে হাতের বর্শা উঁচিয়ে মানসিংহের দিকে ছুটে যান তিনি। ছুড়ে মারেন বর্শা। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে হাতিটা সামান্য সরে যায়, বর্শার আঘাত মানসিংহের বুকে না লেগে তাঁর দেহরক্ষীর গায়ে লাগে।
অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। এদিকে মোগল সৈন্যদের হাতে রাজপুতদের অবস্থা তখন শোচনীয়। চারপাশ থেকে তাঁদের ঘিরে ফেলেছে তারা। হঠাৎ একটি গুলির আঘাতে রানা আহত হয়ে লুটিয়ে পড়েন। রানাকে বাঁচাতে তাঁর সেনাপতি ও বন্ধু মানা প্রতাপের শিরস্ত্রাণ নিজের মাথায় পরে নেন। তাকেই রানা প্রতাপ মনে করে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় মোগলরা। এই সুযোগে রানার দেহরক্ষীরা তাঁকে নিরাপদে সরিয়ে নেন। যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজয় হয়। পতন হয় চিতোরের। জঙ্গলে আশ্রয় নেন সপরিবারে রানা ও তাঁর অনুসারীরা। পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন তারা। কিন্তু পেছনে মোঘল বাহিনীও নাছোড়বান্দা। সম্রাটের আদেশ, যেভাবেই হোক জীবিত অবস্থায় আটক করতে হবে এই উদ্যত রাজপুত রাজাকে।
রানা প্রতাপ বুঝতে পারলেন, এভাবে পালিয়ে জীবন বাঁচানো তাঁর মতো বীরের পক্ষে অসম্ভব। প্রয়োজনে জীবন দেবেন, তবুও মাথা নত করবেন না। অবশিষ্ট শক্তি নিয়ে তিনি রুখে দাঁড়ালেন মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে। বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তারা। দেখতে দেখতে তাঁর অবশিষ্ট সৈন্যও নিঃশেষ হয়ে এলো। তিনি নিজেও প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ঘটলো একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ঝাঁকে ঝাঁকে তীর আর বর্শা এসে বিদ্ধ করতে লাগল মোগলদের। জঙ্গলে থাকার সময়ে প্রতাপের বাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল স্থানীয় ভীল আদিবাসীদের। বন্ধুদের বিপদে পড়তে দেখে তারাই ছুটে এসেছে অস্ত্র হাতে। ভীলরা আদিবাসী হলেও ভয়ঙ্কর যোদ্ধা। সংখ্যায়ও ছিল অনেক। মোগলদের রীতিমতো কচুকাটা করে তারা। উদ্ধার করে প্রতাপদের। আশ্রয় দেয় নিজেদের কাছে। ভীলদের আশ্রয়ে নিরাপদে থাকলেও স্বাধীনতার বাসনা তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে। কিন্তু কিছুই যে করতে পারছেন না। এমন সময় ঘটলো আরেকটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। চিতরের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী প্রতাপের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর হাতে তুলে দেন তাঁর আজীবন সঞ্চিত সব সম্পদ স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য।
নতুন উদ্যমে কাজে নেমে পড়েন রানা প্রতাপ। ভীলদের নিয়েই গঠন করেন তাঁর নতুন বাহিনী। শিবাজীর মতো একই কায়দায় গেরিলা কৌশলে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেন মোগল বাহিনীকে। তাঁর নামে কেঁপে উঠত মোগল শিবির। যেকোনো মূল্যে তাঁকে খতম করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। প্রতাপকে কোনোদিনই গ্রেফতার করতে পারেননি তারা।দীর্ঘ ২০ বছর মোগলদের বিরুদ্ধে এই অক্লান্ত সংগ্রামের পরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় চির বিদায় নেন রানা প্রতাপ। কিন্তু দেশপ্রেম আর সাহসিকতার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইলো ইতিহাসের পাতায়।
০৯৭ ▌পাকিস্তানে কেনো সভ্যতার চাকা পিছনের দিকে ঘুরছে ???
পাকিস্তান সৃষ্টির দুবছরের মাথায় ১৯৪৯ সালে, লাহোরে কাদিয়ানি বিরোধী দাঙ্গা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নেপথ্যে ছিলেন আবুল আলা মওদুদী। এই মওদুদী ও তার দল পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধাচরণ করে জিন্নাহকে 'কাফির-এ-আজম' বলেছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কোণঠাসা মওদুদী তাই কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি তুলে দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসতে চাইছিল। এই দাঙ্গা প্রথমে পাঞ্জাবে, পরে সিন্ধুতে ছড়িয়ে পড়ে এবং চার বছর স্থায়ী হয়। এই দাঙ্গায় লাহোরের পরিস্থিতি এতটা জটিল হয়ে পড়ে যে, শেষ পর্যন্ত সেখানে ১৯৫৩ সালে সামরিক আইন জারি করতে হয়। সেই সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সে দেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করে, আজও তারা পরোক্ষভাবে রাজনীতির মঞ্চ দখল করে রেখেছে। একইভাবে ধর্মও পাকিস্তানের রাজনীতির মঞ্চ ছেড়ে যায়নি। এসবের ফল দাঁড়িয়েছে এই,, পাকিস্তান আজ একটা ব্যর্থ রাস্ট্রের নাম; যেটার অর্থনীতি মৃত্যুযাত্রীর মতো ধুকছে। ধর্মের নামে উগ্র সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও রক্তপাত সেখানে এখন দৈনন্দিন ঘটনা।
প্রথম ভুলটি করেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। তার পূর্বসূরি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো তিনিও ছিলেন উদার গণতন্ত্রী। ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন বটে, কিন্তু দেশটি ধর্মব্যবসায়ীদের কবলে চলে যাক, তা তিনিও চাননি। কিন্তু মওদুদী গংদের আন্দোলনের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়লে তিনি প্রথম আপোসটি করেন সংবিধান প্রশ্নে জামায়াতিদের ছাড় দিয়ে। ধর্মকে নবগঠিত রাষ্ট্রটির ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মওদুদীর দাবি ছিল, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র হবে ‘শুদ্ধ ইসলামিক, শরিয়তি আইননির্ভর। কিন্তু পাকিস্তানের প্রথম পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা ছিলেন রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমাঘেঁষা, ওয়েস্ট মিনস্টার ধাচের পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার সমর্থক। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মবাদীদের ঠেকানোর বদলে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। শরিয়তবিরোধী আইন নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয় পাঁচ সদস্যের একটি উলেমা বোর্ডকে।
পাকিস্তানের রাজনীতিকরা ক্ষমতায় টিকে থাকার সহজ পথ হিসেবে একজোট হয়ে ১৯৫৬ সালে গৃহীত শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে বসলেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে রাজনীতিকদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন তারা অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ, এই যুক্তিতে। সে সময় তিনি যে শাসনতন্ত্র ঘোষণা করেন, তাতে পাকিস্তানের নামের আগে ইসলামি নামটি বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু আইয়ুবের মোল্লাতন্ত্র বিরোধিতা খুব বেশিদিন টিকে থাকেনি। ফলে পাকিস্তানের নামের আগে ওই ইসলামি নামটি আবার ফিরে এল। কারণ, ১৯৬৫-র নির্বাচনে বিরোধী দলের সম্মিলিত প্রার্থী ছিলেন জিন্নাহর কনিষ্ঠ ভগিনী ফাতেমা জিন্নাহ । বিপদ টের পেয়ে আইয়ুব মোল্লাদের দিয়ে ফতোয়া ছাড়লেন যে, ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দেওয়া অনৈসলামিক হবে। কারণ ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান মহিলা হতে পারেন না। এবার আইয়ুবের বিজয়ের আসল, ফায়দা নিল মোল্লারা।
ভুট্টো সমাজতান্ত্রিক দাবি-দাওয়া গুলে খাওয়ালেন জনগণকে। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার ছয় বছরের মাথায় মোল্লাদের বিরোধিতার মুখে হাত বাড়ালেন সেই ধর্মের দিকে। প্রথমবারের মতো শরিয়াভিত্তিক কিছু কিছু আইন চালু করলেন তিনি। তিনিই ১৯৭৭ সালে কাদিয়ানিদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ঘোষণা করলেন। পরবর্তীতে জিয়াউল হক ক্ষ্মতায় এসে তাদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করলেন। তার ক্ষমতা দখলকে আইনসিদ্ধ করতে দেশে পুরো মাত্রায় শরিয়তি আইন চালু করেন। তার পক্ষে কথা বলার জন্য জিয়া এ সময় একটি 'ইসলামি পরিষদ' গঠন করেছিলেন। তার সংগে গাঁট বাঁধে জামায়াতে ইসলামী। তাদের কথায় সরকারি চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয় কাদিয়ানিদের, মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাদের ওপর বিশেষ কর চালু করা হয়। ইসলামিকরণের সেই যে গাড়ি জিয়া চালু করে দেন, তার পরবর্তী সরকারপ্রধান বেনজির ভুট্টো বা নওয়াজ শরিফ, কারো পক্ষেই তার গতি রুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদ বাম-ডান-মধ্যপন্থী রাজনীতির সম্মিলন ঘটিয়ে তাঁর স্বৈরশাসনকে একটা গণতান্ত্রিক মোড়ক পরানোর চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শুরু করে শিল্পকারখানাগুলোতে দলীয় মাস্তান ও ক্যাডার সৃষ্টি করেছেন। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দলে ভিড়িয়েছেন।ফ্রিডম পার্টিকে সংসদে এনেছেন। তাদের মুখপত্র দৈনিক মিল্লাতকে সহযোগিতা করেছেন।তাঁর সময়ে ইসলামি মৌলবাদের উত্থান ঘটে, নব্বইয়ের দশকে যা দানবে পরিণত হয়। কারও দাবি না থাকা সত্ত্বেও তিনি সরকারি ছুটি রোববার থেকে শুক্রবার করেন। তাতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
সবচেয়ে বড় যে সর্বনাশটি তিনি করে গেছেন তা হলো রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা। তাতে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের এক বিন্দু উপকার হয়নি, কিন্তু অমুসলিম নাগরিকদের মনে গভীরতম আঘাত লেগেছে। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের চরিত্রে কলঙ্ক লেগেছে। তাঁর বিরুদ্ধে যত অপরাধের অভিযোগ ছিল তার মধ্যে কবিতা চুরি অন্যতম। তিনি টাকা দিয়ে বাঙালি কবিদের কবিতা কিনে নিজের নামে ছাপাতেন। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে তিনি হাজির হতেন দেরিতে, আর কয়েক পঙ্ক্তি কবিতা লেখার অজুহাত দিতেন।
তাঁর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতাবিরোধী মাওলানা মান্নান মাদ্রাসাশিক্ষকদের সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনটি পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। আরও অন্তত অর্ধডজন পীর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতেও প্রভাবশালী হয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাও আন্দোলনেও তাঁর সমর্থনের কথা সবারই জানা। সবকিছু বিচার করে দেখুন তো পাকিস্তান থেকে আমারা কতো দূরে?
০৯৮ ▌ভারত -পাকিস্তানের বিবাদের মূলে কেনো কাশ্মীর?
জম্মুও কাশ্মীরের ৪৩% অংশ ভারতে,৩৭%অংশ পাকিস্থানে রয়েছে, যাকে স্বাধীন কাশ্মীর বা পাক অধিকৃত কাশ্মীর বলা হয়।আর ২০% অংশ চীনের কাছে রয়েছে, যাকে আক্সাই চীন বলা হয়। জম্মু ও কাশ্মীরের যে অংশটি ভারতের কাছে আছে, তাকে ৩টিভাগে ভাগ করা হয়েছে। জম্মু, কাশ্মীর আর লাদাখ। কাশ্মিরে মুসলিম আছে ৯৭%, জম্মুতে হিন্দু-মুসলিম অবৌদ্ধ প্রায় সমান আর লাখাদে হিন্দু সংখ্যাগরিস্ট। প্রাচীন কাশ্মীরে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিস্ট ছিল। ১০০ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরে চতুর্থ বৌদ্ধসংঘ হয়েছিল। এর পর এখানে হিন্দু সাম্রাজ্য শুরু হয়। ১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী কাশ্মীরে মুসলিম শাসন বজায় ছিল। এর মধ্যে মুঘল সম্রাটরা ১৫৮৬ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত এবং আফগান দুররানি সম্রাটরা ১৭৪৭ থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। এই সময়ের মধ্যে বেশিভাগ কাশ্মীরী ইসলাম গ্রহন করে। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। ১৮৪৬ সালে ইংরেজদের-শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে শিখরা পরাজিত হয়। এরপর অমৃতসর চুক্তি অনুসারে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের কাছে থেকে কিনে নেন এবং কাশ্মীরের নতুন শাসক হন। এই গোলাব সিং-এর নাতি ছিলেন মহারাজা হরি সিং, যিনি ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হবার সময় কাশ্মীরের রাজা ছিলেন।
কাশ্মীরের রাজার কাছে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশ থেকেই প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল যে ভারত বা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে। কিন্তু রাজা হরি সিং স্বতন্ত্র থাকার সিদ্ধান্তে অটল থাকল। এই রকম আর একটি প্রিন্সিপল স্টেট ছিল হায়দ্রাবাদ। হায়দ্রাবাদ কিভাবে ভারতের অন্তরভূক্ত হল সে ইতিহাস সবারি জানা। কাশ্মীরী পণ্ডিত নেহেরু চেয়েছিল কাশ্মীরকে ভারতের মধ্যে একিভূত করতে। কারণ তাতে জিন্নার দ্বিজাতিতত্ব অসার প্রমান হবে আর প্রমাণ হবে ভারত সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাস্ট্র। হরি সিং ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের সাথে চুক্তিনামা তৈরি করল স্বাধীন দেশ হিসেবে সার্বভৌম থাকার। পাকিস্তান চুক্তিনামায় সই করলেও নানা অজুহাতে নেহেরু সময়ক্ষেপন করছিল। এসব দেখে পাকিস্তান বুঝল যে, ভারতের মতলব ভাল নয়, তাই আগেই দখল করে বসি। ফলে তারা কাশ্মীর আক্রমণ করে বসল। রাজা হরি সিং পাক আক্রমনে দিশেহারা হয়ে গেল। এবার নেহেরু তার গেইম শুরু করে বলল, আমার জোয়ানরা কোন চুক্তির বলে তোমাকে সহায়তা করবে? আস, একটা ড্রিল করি।
হরি সিং বলল, কাশ্মীরের স্বাধীন অস্থিত্ব বজায় রেখে আমরা একটা চুক্তি করতে পারি। কিন্তু সবকিছু শান্ত হলে কাশ্মীরী জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে যে, তারা পাকিস্তানে, না ভারতে থাকবে, নাকী স্বাধীন থাকবে। চুক্তি অনুযায়ী ভারত পালটা আক্রমণ শুরু করল। এরি মধ্যে নেহেরু জাতিয়সঙ্গে চলে গেল।১লা জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘ রায় দিল, যে দেশের সেনা যেখানে আছে, সেই বরাবর বিরাম চিহ্ন হউক। ফলে নিয়ন্ত্রণ রেখা তৈরি হল। জাতিসংঘের রায়ে বলা হল-পাকিস্তান প্রথমে তাদের সৈন্য সরাবে, তারপর ভারত সরাবে। এরপর কাশ্মীরী জনগণ ভোট দিয়ে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধে চীন কাশ্মীরের ২০% ভুমি দখল করে নেয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯ সালে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে।
রাজা হরি সিং 'ইনষ্ট্রুমেণ্ট অফ এ্যাসেশন' স্বাক্ষর করলেও, তিনি তাঁর ফরওয়ার্ডিং লেটারে লিখেন যে, তিনি চান কাশ্মীর হানাদার মুক্ত হওয়ার পর যেনো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফল ঘটিয়ে তার রাষ্ট্রিক অবস্থান নির্ধারণ করা হয়।প্রতিরক্ষা, বিদেশ নীতি ও যোগাযোগ ব্যতীত বাকী সমস্ত বিষয়ে কাশ্মীরের স্বায়ত্ব শাসন মেনে নিয়ে সংবিধানে ৩৭০ ধারা যুক্ত করে ভারত। অনুচ্ছেদ ৩৭০ এ জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়। জম্মু-কাশ্মীরের কোনো মহিলা ভারতের বাকি রাজ্যর পুরুষের সঙ্গে বিবাহ করলে ওই মহিলার জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিত্ব সমাপ্ত হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে ভারতের অন্য কোনো রাজ্যের কোনো মহিলা জম্মু-কাশ্মীরের কোনো বাসিন্দাকে বিয়ে করলে তিনি জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিকত্ব পেয়ে যান। এমনকি পাকিস্তানি কোনো নারী জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিককে বিয়ে করলেও সে কশ্মীরের নাগরিকত্ব পায়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বা আদেশ জম্মু-কাশ্মীরে প্রয়োগ হয় না।জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দারা ভারতের কোথায়ও জমি কিনতে পারেন না।
এত কিছুর মধ্যে কাশ্মীরের মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল চাইছে পাকিস্তানে থাকত্এ, অন্যদল ভারতে আর বড় অংশ স্বাধীন কাশ্মীর করে করে কাদছে। এই তিন দল নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে দিল। তারমধ্যে পাক আর্মি কাশ্মীরে বার বার আক্রমন করে দখল করতে তৎপর। তারা আবার মুসলিম স্বধীনতাকামীদের সহযোগিতা করে চোরাগুপ্তা হামলা শুরু করে দিল। আর এদিকে ভারতও জঙ্গী দমনের নামে জগণকেই লক্ষ্যবস্তু করলো। সবদিকের ফল ভুগতে থকল কাশ্মীরী জনগণ। এইদিকে কাশ্মীর অঞ্চলটি পাকিস্তানের জন্য খুই দরকার। কারণ পাকিস্তানের চাষের পানির বড় উৎস কাশ্মীরের নদী।
০৯৯ ▌মারে বুকসিন ও কৌম সমাজ
প্রখ্যাত পরিবেশবাদী দার্শনিক মারে বুকসিন বলেছিলেন, সারা পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ যে বিপন্ন হচ্ছে এবং মানুষ হাহাকার করছে, এ দুটি মূলত আধিপত্যবাদের কারণেই হচ্ছে। যেমন এই পরিবেশ বিপন্নতার মধ্য দিয়ে আমরা শিকার হচ্ছি খাদ্য সংকটসহ নানামূখী সংকটে। তিনি বলছেন, সাম্রাজ্যবাদ যেমনভাবে মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, তা যেমন সুখকর নয়; তেমনি মানুষ প্রকৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, তাও বিপর্যয়ের কারণ। বিষয়টি সমাধান করতে তিনি ফিরে গেলেন আদিম কৌমভিত্তিক সমাজের কাছে।
অনেকে বলেন আদিম এ সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ছিল। বুকসিন বলতে চাচ্ছেন, সে সমাজ মাতৃতান্ত্রিক নয়, বরং মাতৃকেন্দ্রিক ছিল। নারী কর্তৃক শাসন হল মাতৃতান্ত্রিক, আর মাকে কেন্দ্র করে জীবন-যাপন হল মাতৃকেন্দ্রিক। সে সমাজ ব্যবস্থার দুটো ভাল দিক হল- সুসম বন্টন আর সৌহাদ্য। অর্থাৎ কর্ম করতে অক্ষম অসহায় মানুষদের দায়িত্ব কৌম সমাজ বহন করে। তাদের এই আচরণের পিছনে মূল কারণটি হল-তাদের সোসাইটি ছিল অর্গানিক।
অর্গানিক সোসাইটি মানে হল ইন্টার ডিফেন্সি, ইন্ ডিফেনসি নয়। আজকের মানুষের মতো স্বাধীন বা স্ব-অধীন নয়, পরষ্পরের অধীন। যেমন আমাদের শরীর হল একটা অর্গানিক সিস্টেম। দুই, হাত, দুই চোখ, দুই কান, দুই পা কিংবা দুই কিডনি যেমন পরষ্পরের সাথে ব্যালেন্স করে (কোন কারণে একটি আক্রান্ত হলে অন্যটিতে প্রভাব পড়ে), তেমনি শরীরের প্রতিটি অঙ্গ অন্য অঙ্গের সাথে ব্যালেন্স করে চলে। একই কারণে ডায়বেটিস হলে, কিডনি, দন্ত, রক্তচাপ কিংবা হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। পরষ্পরের উপর এই নির্ভরতাকে বুকসিন নাম দিয়েছেন ইন্টার ডিফেন্সি।
তাহলে সমাজ কিভাবে অর্গানিক হয়? বুকসিন বলেন- মানুষ প্রকৃতিরই একটি অংশ। যেমন, বায়ুশূণ্য যে-কোন একটি কক্ষে যদি কাউকে বন্দী করে রাখা হয়, তাহলে সে কতক্ষণ আর বাছবে? কয়েক মিনিট মাত্র। এতে দেখা যায়, মানষের বেচে থাকা শুধু তার নিজের উপর নির্ভর করছে না; প্রকৃতির অক্সিজেনের উপরও সমানভাবে নির্ভর করছে। তাহলে কি মানুষ প্রকুতির উপর নির্ভরশীল নয়? মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা সবকিছু কোন না কোনভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল।
বুকসিন বলছেন, কৌম সমাজের মানুষরা কখনো প্রকৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবে না। ফলে তারা কখনো প্রকৃতি ধ্বংস করে না। এই বিষয়টি তিনি বুঝানোর জন্য তার ইকোলজিক্যাল ফ্রিডম বইয়ে দুইটি কমিউনিটির কথা বলেছেন- এক হলো ল্যাটিন আমেরিকার হিপ্পো কমিউনিটি আর একটি হলো অন্তু ইন্ডিয়ান কমিউনিটি। বুকসিন সে সমাজকে স্ট্যাডি করে দেখেছেন, তাদের জীবনাচরণে এমন কোন শব্দ নেই, যে শব্দ দিয়ে আধিপত্যবাদ, শোষণ, নিপিড়ন, বৈষম্য, ধর্ষণ এসব বুঝায়। যেমন, আমি, আমার, এই ধারণা তাদের নেই। যেমনটি নেই আমাদের মান্দি সমাজে ধর্ষণের ধারণা।
হিপ্পো বা অন্তু সমাজে কোনো সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে শিশুটি সমাজের সকল স্তন্যদায়ী মাতার দুগ্ধ পান করে বড় হয়। যাদের দুগ্ধ নেই, তারা মুখের লালা মিশ্রিত ছিবানো খাবার খাইয়ে সন্তানটি বড় করে। এর মধ্য দিয়ে তারা মনে করে সমস্ত মাকে এ সন্তান ধারণ করেছে। এ প্রকৃয়ার মধ্য দিয়ে সন্তানটি সকল মায়ের সন্তানে পরিণত হয়। এই কারণে তাদের মধ্যে আমি-আমার ধারণা নেই। আমার স্বামী/স্ত্রী এসবের পরিবর্তে সেখানে বলা হয়, তার সাথে আছি, তাদের সাথে থাকছি।
পৃথিবীব্যাপী কোটি কোটি শিশু অনাহারে অপুষ্টিতে রাস্তায় প্রভুহীন কুকুরের মতো মানবেতর জীবন-যাপন করছে, শুধু আমি এবং আমার সন্তান কনসেপ্টের কারণে। ছা-পোষা বাঙালি বুঝতে চায় না, নিজের সন্তানটা তার ‘হাজার হাজার কোটি’ শুক্রাণুর মধ্যে মাত্র একটির অর্ধেকাংশ। তার বাকীসব বিলিয়ন বিলিয়ন শুক্রাণু প্রতিদিন মরে যাচ্ছে বেচে থাকার আশ্রয় না পেয়ে। অন্য মানুষ বা প্রাণির যে শুক্রাণু অংশটি বেচে থাকার সুয়োগ পেয়েছে, তাকে বাচিয়ে রাখা তার দায়িত্ব ও নৈতিকতার মধ্যেই পড়ে।
দার্শনিক ’মারে বুকসিন’ আফ্রিকার আদিবাসী মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কিছু ছেলে মেয়ের মধ্যে মজার এক খেলা উপস্থান করেন। তিনি এক ঝুড়ি মিষ্টি একটা গাছের কাছে রেখে ছেলেমেয়েদের সেখান থেকে ১০০ মিটার দূরে রাখেন। এরপর তিনি ছেলেমেয়েদের জানায়, যে সবার আগে মিষ্টির ঝুড়ি স্পর্শ করবে, ঝুড়ির সব মিষ্টি সে পাবে। এরপর যখন সে বলল, প্রস্তুত হও এবং যাও। এরপর ছেলেমেয়েরা সবাই হাত ধরাধরি করে দাড়াঁল এবং গাছের দিকে একসঙ্গে দৌড় দিল। ঝুড়ির মিষ্টি তারা সবাই ভাগাভাগি করল আর মজা করে খেল। যখন ‘বুকসিন’ তাদের জিজ্ঞেস করল, কেন তারা সবাই হাত ধরাধরি করে দৌড় দিল?
উত্তরে সবাই বলল, উবুন্টু। যার মানে "কিভাবে একজন সুখী হতে পারে যখন অন্যরা দুঃখী?" তাদের ভাষাতে, উবুন্টু অর্থ "আমি অন্যদের সাথে আছি"।
১০০ ▌গ্রামসির একমূখী শিক্ষানীতি ও একটি জাতীয় ভাষা
আন্তোনিও গ্রামসির জীবনকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত; কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত জীবনেই তিনি এত বেশি কাজ করে গেছেন যে, একক কোনো অভিধায় তাকে চিহ্নিত করাটা বেশ কঠিন। একাধারে রাজনীতি, সাংবাদিকতা, ইতিহাস, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি কাজে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ইতালির খুব অনগ্রসর, পশ্চাদপদ সারদিনিয়ার দ্বীপরাজ্য অ্যালেসে গ্রামসির জন্ম হয়েছিল ১৮৯১ সালে। ইতালির বেশিরভাগ অংশই তখনো ছিল বৃহৎ জমিদারের অধীন, শিল্প অবকাঠামোও তখনো গড়ে ওঠা শুরু করেনি; কৃষকরাই ছিল সংখ্যাগুরু, যারা ছিল বিক্ষিপ্ত ও দরিদ্র।
মার্কসবাদকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে গ্রামসি সর্বাগ্রে ছিলেন। ১৯২৪ সালে গ্রামসি ইতালিয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন গ্রামসির প্রেমে পড়েছিলেন ইউজেনিয়া। সে ছিল তিন বোনের মধ্য বোন। কিন্তু গ্রামসিকে বিয়ে করেছেন তার ছোট বোন। তার ঘরে গ্রামসির দুই ছেলে। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, আজীবন অবিবাহিতা থেকে গ্রামসির সেবায় জীবন উৎস্বর্গ করে গেছেন তাদের বড় বোন ‘তাতিয়ানা’।
ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর কোপানলে পরে গ্রামসি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। মুসোলিনির জেলেই তাঁর জীবনের পরবর্তী এগারো বছর কেটেছিল অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, রক্তবমির মধ্যে। জেলেই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে, জেল থেকে বেরিয়েই তিনি মারা যান। এই সকল প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই তিনি লিখে গেছেন তাঁর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে এসে ‘তাতিয়ানা’ তাঁর ঘর থেকে নিমিষে সরিয়ে ফেলেন যে পান্ডুলিপি, তা-ই বিখ্যাত ‘প্রিজন’স নোটবুক’।
এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, গ্রামসি ২০ শতকের সবচেয়ে শিক্ষাতাত্ত্বীকদের একজন। ইউরোপে তখন শিক্ষা নিয়ে যেসব চিন্তা চালু ছিল, তার মধ্যে প্রধান চিন্তা ছিল রুসোর প্রকৃতিবাদী শিক্ষা। রুসো ১৭৬২ সনে প্রকাশিত ‘অন এ্যডুকেশন’ বইতে দেখিয়েছেন একজন বাচ্চাকে কিভাবে শিক্ষিত করতে হবে। ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চার হাতে বই দিতে নাই, সে যা কিছু শিখার সবকিছু প্রকৃতি থেকে দেখে শিখবে।
গ্রামসি এই শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এই শিক্ষানীতিকে বলেছিলেন ‘রোমান্টিক ফিলোসফি অব এ্যাডুকেশন’। তবে গ্রামসি মুসলিনি সরকারের শিক্ষানীতির বিপরীতে পুরানো শিক্ষা পদ্ধতির প্রশংসা করেছেন। তিনি বলছেন, পুরানো পদ্ধতিতে শিক্ষার দুটো উদ্দেশ্য ছিল। একটা হল- প্রকুতির সাথে শিক্ষার্থীর পরিচয় করিয়ে দেয়া। আর একটি হলো একজন মানুষ হিসাবে অধিকার এবং দায়িত্ব বিষয়ে শিক্ষার্থীকে সচেতন করা। গ্রামসির মতে পুরানো এই পদ্ধতি মোটেও খারাপ ছিল না। তবে তিনি একমূখী জেনারেল এ্যাডুকেশনের কথা বলেছেন।
তাঁর মতে, আমরা ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে (যেমন, ইংলিশ স্কুল, ধর্মীয় মক্তব, জেনারেল স্কুল, ক্যাডেট স্কুল ইত্যাদি) আলাদা ভাগে শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে, সমাজে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্ঠিভঙ্গির আর বিপরীত জ্ঞানের হযবরল শ্রেণীর প্রাণী তৈরি করছি, মানুষ নয়। এর ফলে পরিবারে-সমাজে তথা রাষ্ট্রে শ্রেণী বিভেদ শুধু অক্ষুন্ন থাকবে না, দিন দিন তা ভয়াবহ রূপ নেবে। একটা শ্রেণী জ্ঞান বুদ্ধিতে এগিয়ে থাকবে, আর অন্যশ্রেণী আদিম অবস্থায় পড়ে থাকবে। তিনি বলতেন- সমাজের সচ্ছল, শিক্ষিত পরিবারের ছেলেমেয়েরা তাদের অবস্থানগত কিংবা অর্থগত সুবিধার কারণে কোনো কোনো শিক্ষায় এগিয়ে থাকবে, কিন্তু যারা সুবিধাবঞ্ছিত তাদের কি হবে? মানুষের শরীরটাকে একটা হার্ডওয়্যার হিসাবে গ্রামসি অনুভব করতেন। উন্নত শিক্ষা মানে দামী সফ্টওয়্যার, যার মাধ্যমেই সভ্যতা এগিয়ে যাবে, তা প্রত্যেক হার্ডওয়্যারেই থাকতে হবে।
প্রিজন’স নোটবুক-এর এক জায়গায় গ্রামসি লিখেছেন, সব মানুষই দার্শনিক একটা লেভেল পর্যন্ত। মানুষের এই দার্শনিক হবার অন্যতম উপায় হল ভাষা। ভাষা কি? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন-ভাষা হল চিন্তার বাহক। ভাষার কারণেই কেউ নতুন কিছু বললে অন্যরা তা বুঝতে পারে, আবার পূর্বে কখনো শুনেনি এমন কিছুও বলতে পারে। সকল সৃজনশীল চিন্তা ভাষার মাধ্যমেই হয়। গ্রামসি একটা জাতীয় ভাষার গুরুত্বের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, উন্নত চিন্তা তখনি আমরা পাব, যদি সব ভাষার সমন্বয়ে একটি জাতীয় ভাষা থাকে। এক অঞ্চলে যদি একাধিক ভাষার প্রাধান্য থাকে, সেখানে ঐক্য ও চিন্তার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। কারণ, ভাষা হচ্ছে মানুষের মধ্যে কানেক্টিভিটি।
১০১ ▌ বিটগেনস্টাইন-এর সূত্র
টাইম ম্যাগাজিনের বিংশ শতকের ১০০ সেরা ব্যক্তির তালিকায় একজন দার্শনিক আছেন, তিনি হচ্ছেন বিটগেনস্টাইন। তার রচিত পিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেসন্স বইটির কারণে তাকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হিসাবে ভাবা হয়। দুটি বড় দার্শনিক আন্দোলন তার দর্শন চিন্তার প্রভাবে তৈরি হয়েছে। একটা হচ্ছে লজিকাল পজেটিভিজম (যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ) আর অন্যটি অডিনারি ল্যাংগুয়িজ ফিলোসফি। আল কেমি থেকে কেমিস্টি (রসায়ন) -তে উত্তরণের মতো বিশাল একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন তিনি ঘটিয়েছেন দর্শনের ক্ষেত্রে। আল কেমি যেমন পরদ বা সিসার মতো ধাতু থেকে কিভাবে বিশেষ প্রকৃয়ায় ক্যামিকাল তৈরি করা যায়, যা দিয়ে বিভিন্ন রোগের ঔষধ তৈরি করা যায়, তার চর্চা শুরু করেছিল, তেমনি বিটগেনস্টাইন-এর দর্শনটা দার্শনিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরণ বলা যায়। তিনি আসলে শুধু চিন্তা দিয়ে দর্শন চর্চা করেননি বরং যাপিত জীবন দিয়ে দর্শনের চর্চা করেছিন।
.
তিনি ১৮৮৯ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার সবচেয়ে প্রভাবশালী ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অস্ট্রিয়ার লোহা এবং ইস্পাত শিল্পের একচেটিয়া মালিকানা ছিল তার বাবার। তিনি ১৯১১ সালে ক্যামব্রিজের বিখ্যাত দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেলের কাছে পড়াশুনা শুরু করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৪ সালে তিনি দেশের হয়ে যুদ্ধে যান। যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি তার বিশাল পৈত্রিক সম্পত্তি নিজ ভাই বোন ও গরীব মানুষের মাঝে দান করে অতি সরল জীবন-যাপনের জন্য একটি সন্যাসিদের মঠে মালির কাজ করেন অনেকটা গৌতম বৌদ্ধের স্টাইলে।
এরপর তিনি অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন গ্রামের স্কুলে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। গ্রামের লোকজন বুঝতে পারতো যে, তিনি আসলে শুধুু একজন শিক্ষকই নন, মানব জাতীর একজন মহান শিক্ষকও। তাই চারপাশে ভিড় লেগে থাকতো তার একটা বাক্য শোনার জন্য। রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকটা তিনি অনুবাদ করে শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছেন। তার ট্রাক্টাটাস গ্রন্থটা বের হবার পর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে পিএইডি ডিগ্রি দেয়া হয়। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ সালে তিনি ক্যামব্রিজে লেকজারার ফেলো হিসাবে শিক্ষকতা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি পরিচয় গোপন করে লন্ডনের গাইস হাসপাতালে কুলির (গায়ে খাটার পুটার) কাজ নেন। উদ্দেশ্য যুদ্ধাহতদের সেবায় আত্মনিয়োগ। যুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি আবার ক্যামব্রিজে অধ্যাপকের পদে ফিরে আসেন। জীবনে তিনি বাড়ী করেননি, বিয়ে করেননি। শিক্ষকতায় পেশায় তিনি যে বেতন পেতেন, তাও তার কাছে বেশি মনে হতো বিধায় সঞ্চিত অপ্রয়োজনীয় টাকা গরীবদের মাঝে বিলি করে দিতেন।
.
প্রথম সূত্রঃ বিটগেনস্টাইন-এর বেশিরভাগ তত্ত্বই বেশ জটিল। বিটগেনস্টাইন-এর প্রথম সূত্র মতে, ইঞ্চি হিসেব করে আমার টেবিলটার মাপ হয় ৪ফুট, কিন্তু কত মিলিমিটারে ইঞ্চি হয় বা কতটুকু ফাঁকে এই ইঞ্চি, তা তৈরি করল কে? ইঞ্চির ফাঁক যদি আরো বেশি হতো, তাহলে কি আমার টেবিলটা ৪ফুট হতো? সুতরাং গজ, ফুট, ইঞ্জির মতো পৃথিবীর সকল নিয়ম’ যা আজ আমাদের কাছে চরম সত্য, তা কিন্তু এক বা একাধিক জনের বেধে দেয়া একটা সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয় সূত্রঃ তার বিখ্যাত দ্বিতীয় তাত্ত্বিক সূত্র হল-যা অমিমাংসিত তা পরিত্যাজ্য। অর্থাৎ যা কিছু মমাংসা করা যায় না, ভগ্নাংশ থেকে যায়, তা মিথ্যা। যেমন- জন্মিলেই মরতে হয়। যার জন্ম আছে, তার মৃত্যু হবেই; এটা মিমাংসিত। এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ বা দ্বিমত নেই; সুতরাং এটা সত্য। কিন্তু মৃত্যুর পরে জীবন আছে এমন ধারণা কেউ বিশ্বাস করে আবার কেউ মনে করে এটা গাজাখুরি কল্পনা। অর্থাৎ একটা অমিমাংসিত তর্ক আছে, আগামীতেও থাকবে। সুতরাং এটা মিথ্যা। তেমনিভাবে ইশ্বর আছে কি নেই, এ বিষয়ে হাজার বছর ধরে বিতর্ক ছিল, এখনো আছে, আগামীতেও থাকবে। সুতরাং এটাও মিথ্যা। তার মতে, 'ইশ্বর মানে একটা অন্ধকার ঘর। একদল বলেন, এই ঘরে কেউ একজন আছেন, যিনি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। আবার অন্য আরেকদল বলেন, ওই ঘরে একজন নয়, বরং একাধিক সুপার পাওয়ার আছেন; কিন্তু জ্ঞানীরা বলেন, আমরা টর্চ জালিয়ে তন্ন তন্ন করে দেখেছি, ওটা আসলে ফাঁকা খালি ঘর।' ধর্ম সম্পর্কে তার অভিমত-ধর্ম হল এক ধরনের পোষাক। কে কোন পোষাক গায়ে জড়াবে তা তুমি নির্ধারণ করতে পার না।কিন্তু পোষাকটাকে মানুষ ভেবে ভুল করো না যেন।
১০২ ▌মিশেল ফুকোর জীবন ও দর্শন
মিশেল ফুকো (১৯২৬ – ১৯৮৪) ফরাসি দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ। ১৯৬৯ সালে ফ্রান্সের সবচে সম্মানিত কলেজ ডি ফ্রান্সে ‘হিস্ট্রি অব সিস্টেম অব থট’ এর প্রফেসর নির্বাচিত হওয়ার পূর্বেই ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে বিদ্যাজগতে নিজের আসন পাকা করে নিয়েছিলেন। ফুকো বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন শারিরিক ও মানসিক চিকিত্সা শাস্ত্র, কারাগার পদ্বতির পর্যালোচনার জন্য বিখ্যাত। যৌনতার ইতিহাসের উপরও তিনি বেশ কিছু প্রভাবশালি লেখা প্রকাশ করেন। ফরাসী কাগজ এবং রিভিয়্যু জার্নালে নিয়মিত লিখতেন। তার জ্ঞান ও ক্ষমতার লেখার উপর ভিত্তি করে অনেক গবেষক ও চিন্তাবিদ বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছেন।
১৯৫০ সালে ফুকো ফরাসি সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দেন।কিন্তু বেশিদিন রাজনীতি করার কোন আগ্রহ পাননি ফুকো। ১৯৫৩ সালেই দল থেকে সরে আসেন। এই সরে আসার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল স্টালিনের অধীনে রাশিয়ায় সংঘটিত কিছু অপকর্ম যা ফুকোর মনে বিশেষ রেখাপাত করে।এরপর ১৯৬৮ সাল থেকে ফুকোর রাজনৈতিক সক্রিয়তা বেড়ে যায়। তিনি কয়েদীদের অধিকার আদায়ের জন্য একটা সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সমকামী ও অন্যান্য প্রান্তীক গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ হয়ে নিয়মিত প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। এই সময়েই তিনি এইডস আক্রান্ত হন এবং ১৯৮৪ সালের জুন মাসে অকালমৃত্যু বরণ করেন। তিনিই প্রথম বিখ্যাত ফরাসী যার এইডস রোগ শণাক্ত করা গেছে। সেই সময়ে এই রোগ সম্পর্কে খুব অল্পই জানা যেত।মৃত্যুর আগে, ফুকো তাঁর অধিকাংশ পাণ্ডুলিপি ধ্বংস করে যান।
সমকালীন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তাবিদদের মধ্যে মিশেল ফুকো অন্যতম। ১৯২৬ সালের ১৫ অক্টোবর ফ্রান্সের পইতিয়েহতে জন্ম ফুকোর।বার নাম পল ফুকো যিনি ফ্রান্সের বিশিষ্ট সার্জন ছিলেন। তার বাবার ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষে ফুকো বাবার পেশাকেই বেছে নেবেন।কিন্তু ফুকো হয়ে উঠলেন দর্শন-জগতের বাসিন্দা। খ্যাতিমান ইকোল নর্মাল সুপিরিয়র-এ ১৯৪৬ সালে ভর্তি হবার আগ পর্যন্ত ফুকোর শিক্ষাজীবন বিশেষ উজ্জ্বল ছিল না। ইকোল নর্মালে পড়ার সময় তিনি এতোটাই বিষন্নতায় ভুগতেন যে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেছিলেন। তখন তাকে একজন মনঃচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্ভবত এসময় থেকেই তিনি মনস্তত্ত্বে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অংশগ্রহণ করতে থাকেন জাক লাকাঁর বিশ্লেষণী মনোবিজ্ঞানের সেমিনারে এবং সেইঁ আঁ হাসপাতালেও আসা যাওয়া করতেন। পড়াশোনা আরম্ভ করেন হাইদেগার, মার্কস, ফ্রয়েড, বিশেষভাবে নীৎসের রচনাবলীর।
এখানে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত দর্শনের প্রভাষকের পদে চাকরি করেন। ১৯৫৪ সালে তার প্রথম বই প্রকাশিত হয়।
ফুকো তখন বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, শিক্ষকতা তার দ্বারা হবেনা। এই চিন্তা থেকেই ফ্রান্স থেকে দীর্ঘকালের জন্য স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। ১৯৫৪ সালে তিনি সুইডেনের উপশালা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রান্সের একজন সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার জন্য এই কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তার অন্যতম বন্ধু ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষক Georges Dumézil। ১৯৫৮ সালে উপশালা ছেড়ে কিছু সময়ের জন্য তিনি পোল্যান্ডের ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয় ও জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন।
১৯৬০ সালে তিনি আবার ফ্রান্সে ফিরে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল ডক্টরেট সম্পন্ন করা। এখানকার Clermont-Ferrand-এর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের একটি পদে চাকরি নেন। এই শিক্ষায়তনেই তার সাথে Daniel Defert-এর পরিচয় হয় যার সাথে তিনি জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়েছেন।
ফুকোর সহধর্মিনী কাজের সুবাদে তিউনিসিয়ায় বদলি হয়ে যাওয়ায় ফুকোও সেখানে চলে যান। ১৯৬৫ সালে তিউনিস বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
দার্শনিক ধারার সাথে ফুকোর সম্পৃক্ততা বিচার করলে বলা চলে তিনি কান্টের ক্রিটিক্যাল ধারার অনুসারী। তার প্রকল্পকে বলা যায় ‘ক্রিটিক্যাল হিস্ট্রি অব থট’। মিশেল ফুকোকে অনেকেই বলে থাকেন ‘ধোঁয়াটে তাত্ত্বিক’, কেউবা তাঁকে মনে করেন ‘জটিল ও দুর্বোধ্য’, কারো কাছে তিনি ‘তত্ত্বজ্ঞানী’ কিংবা ‘ফুকোশীয় চিন্তার জনক’।
সাম্প্রতিককালের জ্ঞানচর্চায় মিশেল ফুকো এক অনন্য প্রভাবক ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমের জ্ঞান ও জ্ঞানচর্চার পরম্পরার বাইরে গিয়ে তিনি বুঝতে চেয়েছেন এর অতীত ও বর্তমান, অন্তঃসার ও মেকির পরিমাণ। পাগলামি সম্পর্কিত ধারণা, বিজ্ঞান , ভাষা বিষয়ক উপলব্ধি , যৌনতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, আইন ও শাস্তি এসব কিছুর প্রতি আমাদের মনোভাবের গোড়া নড়বড়ে করে দিয়ে গেছে তাঁর রচনাবলী। মুখ্যত ক্ষমতাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তার চিন্তাভাবনা। ক্ষমতা কী? তার প্রকাশ কোথায়, কীভাবে? এই সব প্রশ্নের ভিত্তিতে প্রাপ্ত বোধবুদ্ধি দিয়ে তিনি মানবসভ্যতার পুনর্বিচার করেছেন। তিনি দেখেছেন প্রচলিত চিন্তাভাবনার প্রায় বিপরীতে দাঁড়িয়ে এবং এভাবেই চিহ্নিত করেছেন আমাদের জ্ঞানচর্চার ফাঁক-ফোকর।
মিশেল ফুকো’র পাগলবন্দনা
কে পাগল? কারা পাগল? কেন এবং কোন স্বার্থে সভ্যসমাজ কাদের পাগল বলে? এর সঙ্গে মানসিক ব্যাধির সম্পর্কই-বা কতটুকু? এই বিষয়গুলির উত্তর খুঁজেছেন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো।বিষয়টিকে একটু সহজ করার জন্য কয়েকটি দৃশ্যের অবতারণার মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি:
১। বঙ্গপুরে বাস করে ফটিক। সে সবকিছুতেই প্রশ্ন খোঁজে। সভ্যমানুষ থেকে একটু আলাদাভাবে সবকিছু চিন্তা করে। একদিন বঙ্গরাজা সিদ্ধান্ত নিলেন, রঙ্গরাজকে এক নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করবেন। তাই ঢোল পিটিয়ে প্রজাদের জানানো হল। কিন্তু ফটিকের মনে প্রশ্ন জাগল, ‘কেন বঙ্গরাজা রঙ্গরাজাকে ভোজের নিমন্ত্রণ জানাবে?’ যেখানে প্রজারা অনাহারে মরে, সেখানে রাজ্যের এতোগুলো অর্থ কেন খরচ করবে? তাই ফটিক প্রজাদের সচেতন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে বঙ্গরাজা মুশকিলে পরে। তাই সমাধানের জন্য ফটিককে বিচারে ডাকা হল। বিচারে রায় হল, ‘ফটিক একটা উন্মাদ মানুষ’। সে পাগল হয়ে গেছে। তার নাম রাখা হল- ফটিক পাগলা। তার স্থান হল পাগলাগারদে।
২। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে এক কন্যা-শিশুর জন্ম হল। শিশুটি বেড়ে ওঠার সাথে সাথে সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা, ধর্মান্ধতা, অধিকার, নিয়মতান্ত্রিকতা, যৌনতা প্রভৃতি বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হল। কেন এমন হল নারীদের জীবন? পুরুষের মত নারীরা কেন এত সুযোগ সুবিধা পেল না? প্রাপ্তবয়সে তার মনের মধ্যে এক ‘অন্যরকম অবস্থার’ সৃষ্টি হল। একটা সময়ে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলো সে। বাবা-মা ও আত্মীয়রা মেয়েটির এই পরিস্থিতি সমাধানের উপায় হিসেবে তাকে বিয়ে দিল। বিয়ের পর স্বামী বিষয়গুলো মেনে নিতে পারল না। স্বামীর অভিযোগ তার স্ত্রী একজন মানসিক রোগী। স্বামীর অভিযোগে অভিযুক্ত মেয়েটিকে অবশেষে যেতে হল মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। অবশেষে সেই মেয়েটিকে হারাতে হল সামাজিক মর্যাদা, বঞ্চিত হতে হল পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে, এমনকি পরিত্যক্ত হলেন ঘর সংসার থেকে।
৩। বিদ্যালয়ের একজন বাংলা শিক্ষক। তিনি জ্ঞানচর্চায় অনেক বেশি আবেগী। তার এই আবেগটা এমন এক পর্যায়ে ঠেকেছে যা তাঁর মনের মধ্যে ‘অন্যরকম এক অবস্থা’ সৃষ্টি করেছে। ফলে তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। শ্রেণিকক্ষে সুযোগ পেলে কিংবা অতিরিক্ত সময় পেলে শিক্ষার্থীদের সাথে ভূগোল ও বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। বিষয়টি প্রধান শিক্ষক জ্ঞাত হয়ে ওই শিক্ষককে পাঠদানে মনোযোগী হতে বললে তাঁকেও (প্রধান শিক্ষক) ভূগোল ও বিজ্ঞান বিষয়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন। একটা পর্যায়ে ওই শিক্ষক সবার মাথাব্যথার কারণ হলেন। আখ্যায়িত হলেন উন্মাদ শিক্ষক হিসেবে। সুতরাং তার চিকিৎসা প্রয়োজন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠালেন।
পাগলামি সম্পর্কে সক্রেটিস যে ধারণা দিয়েছেন তা থেকে আমরা তৎকালীন গ্রীকদের পাগলামি সম্পর্কে মনোভাব জানতে পারি। সক্রেটিস পাগলদের ২টি ভাগে ভাগ করেছিলেন।প্রথমটি সম্পূর্ণভাবে জৈবগত সমস্যা আর দ্বিতীয়টি মূলত সামাজিক রীতিনীতি বিবর্জিত আচরণের পর্যায়ভুক্ত। সক্রেটিস দ্বিতীয় ভাগটিতে শিল্পী, প্রেমিক, ধর্মান্ধ, ভাববাদী অথবা নবীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে প্লেটো বললেন,দ্বিতীয় ভাগটির উন্মাদনা যতক্ষণ পর্যন্ত না ধ্বংসাত্মক হিসেবে বিবেচিত হয়, তার আগপর্যন্ত এটি বরং সামাজিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতেই সাহায্য করে। অর্থাৎ মানব সভ্যতা বিকাশে এই পাগলদের ভূমিকাই মূখ্য…।
গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটস পাগলদের নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, হিস্টিরিয়ার ক্ষেত্রে তিনি মনে করতেন বিয়ে হচ্ছে এই রোগ আরোগ্য লাভের সবচাইতে ভালো পদ্ধতি। অর্থাৎ আশ্রম নয় বরং বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধন স্থাপনের মাধ্যমে এদের পাগলামি দূর করা সম্ভব। মধ্যযুগেও পশ্চিমের অনেক দেশে পাগলামিকে পবিত্র বলে গণ্য করা হতো। এখনো কোন পাগল জিকির করলে আমরা তাকে পাগলা পীর হিসেবে মান্য করি।অর্থাৎ মধ্য যুগে পাগলকে সমাজ থেকে বিতাড়িত ঘোষণা করা হয়নি। কিন্ত ফুকো দেখান যে, ইউরোপে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর পাগলা-গারদগুলোতে নির্যাতনমূলক চিকিৎসা পদ্ধতির অস্তিত্ব ছিলো আর ঐযুগে কোন কোন অঞ্চলে মানসিক ব্যাধিকে পাপের সাথে সম্পর্কিত বলেও মনে করা হতো”। এই অন্ধকার যুগে ডাইনী/ যাদুকরদের যখন হত্যা শুরু হয়েছিলো, তখন এদের একপ্রকার পাগল হিসেবেই ভাবা হতো।
১৬০৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন প্রথম কিং জেমস। তিনি অশুভ শক্তির ভয় করতেন এবং একারণে তিনি বাইবেলের কিছু লাইনও নিজের মনমতো মত বদলে ফেলেন। তিনি *“Witch craft act”* প্রণয়ন করে, এই আইনে ডাইনী আর ম্যাজিশিয়ানদের ফাঁসি দেয়ার কথা বলা হলেও তাদের অনেককে অগুনে পুড়িয়ে মারার নজির পাওয়া যায়। অনেক মানুষকে নিতান্ত তাদের অস্বাভাবিক আচরণের জন্য জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। এসময় ফ্রান্সকে ইংল্যান্ডের হাত থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন জোয়ান অব আর্ক নামক এক বীরকন্যা। তাকেও পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। আসলে এই সময় থেকেই পাগলদের পুরোদমে সমাজ থেকে আলাদা করার একটা প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো। এসময় থেকে একসাথে অনেকগুলো উন্মদনাগার প্রতিষ্ঠিত হওয়া শুরু হয় ।
সতেরো শতকে এসে অনেকেই বলতে শুরু করেন উন্মাদনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শারীরিক চিকিৎসাই পাগলামির ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। ফলে পাগলদের ঠিক করার জন্য যথারীতি ডাক্তারও নিয়োগ হল।ফুকো ডাক্তারদের এসকল চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বরং আরো বেশি নির্মম হিসেবে উল্লেখ করলেন। যেমন বরফ ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করানো, স্ট্রেইট জ্যাকেট ব্যাবহার। ফুকোর ভাষ্যমতে, এ সকল নিশ্রংস বিচার ও শাস্তি অনবরত চলত যতক্ষণ পর্যন্ত না রোগী কাবু হতো। এই ছিলো মোটামুটি মিশেল ফুকোর পাগলামি আর সভ্যতার সার সংক্ষেপ।
১০৩ ▌ডায়োজেনিসের জীবন ও দর্শন
একজন অন্ধ মানুষের কাছে “২৪ ঘন্টাই” রাত্রি ।
দিনের আলো নিয়ে তার সাথে ঝগড়া করা বৃথা...
ডায়োজেনিস ছিলেন গ্রিক দার্শনিক। কাউকে পরোয়া এবং তোষামোদ না করার ব্যাপারে দার্শনিক ডায়োজেনিসের খুব সুনাম ছিল। সেটা ছিল দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের শাসনামল। ডায়োজেনিস নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘সিনিক বা কুকুরের মতো’ মানুষ হিসাবে; যিনি তার স্বজাতীদের কামড়ায় ‘তাদের ভাল করার জন্য’। তিনি জীবনযাপনের আশ্রয়স্থল খুঁজতেন না।কারন তিনি দেখেছেন ইঁদুরের কোন আশ্রয়স্থল লাগে না। ‘নিজেকে প্রকৃতির ক্ষুদ্র একটি জীব হিসাবে মেনে নিতে পারলেই’ এমনতরো ভাবনা সম্ভব।
এক সকালে দার্শনিক ডায়োজেনিস তার বাসার সামনে রোদ পোহাচ্ছিলেন। হঠাৎ আলেকজান্ডার এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?' ডায়োজেনিস বললেন, 'আমি রোদ পোহাচ্ছি; আপনি সূর্যটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেন। আপাতত একটু সরে দাঁড়ালেই হয়।' তিনি দরিদ্র এবং তার কিছু ছিল না, কিন্তু তারপরও তিনি পুরোপুরিভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রাচীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজারও তাকে দেবার মত কিছু নেই, কারণ সূর্যের আলো ছাড়া আর কিছুর দরকার নেই তার। তার প্রজ্ঞা মূলত সেটাই, এমন কিছু কামনা না করা, যা দরকার নেই।
দার্শনিক ডায়োজেনিসের আমলে যিনি রাজা ছিলেন, তাঁর নাম ডেনিস। রাজাকে তোষামোদ করতেন না বলে ডায়োজেনিসের জীবন ছিল অত্যন্ত ভোগবিলাসহীন। জীবনযাপন করতেন একেবারে সাধারণ মানুষের মতো। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক অ্যারিস্টিপাস নামের আরেক দার্শনিক রাজাকে তোষামোদ করতেন বলে মালিক হয়েছিলেন প্রচুর বিত্তবৈভবের। একদিন খাওয়ার সময় ডায়োজেনিসকে শুধু শাক দিয়ে রুটি খেতে দেখে অ্যারিস্টিপাস ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘আপনি যদি রাজাকে তোষামোদ করে চলতেন, তাহলে আজ আর আপনাকে শুধু শাক দিয়ে রুটি খেতে হতো না।’ জবাবে ডায়োজেনিস হেসে বললেন, ‘আর আপনি যদি শাক দিয়ে রুটি খাওয়া শিখতেন, তাহলে আজ আর আপনার রাজাকে তোষামোদ করে চলতে হতো না।’
ডায়োজেনিসের বাবা শহরের মুদ্রা তৈরীর কারখানায় কাজ করতেন। মুদ্রা জালিয়াতির অভিযোগে তাকে ও তার বাবাকে তার জন্ম শহর থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল, তিনি অবশ্য তার জন্য কোনো অনুশোচনা করেননি। বলেছেন, ‘নির্বাসনই আমাকে দার্শনিক বানিয়েছে’। দেশ ছেড়ে পালাবার সময় তাকে দাস হিসাবে নিলামে তোলা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, ‘তাকে এমন কারো কাছে বিক্রি করতে, যার মনিব দরকার’। তিনি বলেছেলিনে,‘বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের সবচেয়ে সেরা সম্পদ’, এবং তিনি এই স্বাধীনতা ব্যবহার করেছিলেন গ্রীকদের বিরুদ্ধে, তাদের ভণ্ডামীগুলোকে তিরষ্কার করতে। একটি বিখ্যাত গল্পে আমরা তাকে বাজারে লন্ঠন হাতে হাজির হতে দেখি, তাকে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, তিনি আসলে মানুষ খুজছেন। গ্রীসের কোথায় তিনি সৎ আর ভালো মানুষ খুঁজে পাবেন কেউ কি বলতে পারবে?
আমরা তাকে দেখি তার কাছে একটি লাঠি, থলে আর খাবার জন্য একটি পেয়ালা ছাড়া কিছুই নেই, আর যখন তিনি একটি শিশুকে দুই হাত দিয়ে পানি খেতে দেখেন, তিনি তার পেয়ালাটাও ফেলে দিয়েছিলেন। ডায়োজিনিস জিজ্ঞেস করা হয়েছিল-‘মানুষের তো অনেক কিছু দরকার হয়, অথচ তার কিছু চাই চাই না কেন।? জবাবে ডায়োজিনিস বললেন-‘স্রষ্টার কোন কিছুর প্রয়োজন নেই, আর স্রষ্টার মতো মানুষদের প্রয়োজন খুব সীমিত’।
একবার তিনি এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন, তিনি সেই বিলাসবহুল বাসার নানা জায়গা ঘুরে মালিকের মুখের উপর থুতু ছুড়ে মারেন। তিনি হতভম্ব হয়ে যাওয়া সেই মালিককে ব্যাখ্যা করেন যে, তার বাসার সব কিছু এত সুন্দর যে, তিনি কোথাও থুতু ফেলতে পারছিলেন না। তিনি অর্থলালসাকে সব অশুভ কাজের জননী হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।
ডায়োজিনিস একবার এক চোরকে মারধোর করতে দেখেছিলেন মন্দিরের প্রহরীদের, বলেছিলেন, ‘বড় চোররা ছোট চোরদের ধরছে’। ‘বড় চোররা তাদের নিজের জুতো দিয়ে সারাক্ষণ নিজেকে পিঠা্নো দরকার; অথচ পিঠায় আন্য কাউকে। ডায়োজিনিসকে যখন প্রশ্ন করা হল-‘আপনার কাছে যে ছাত্ররা আসে, তারা প্রায়ই আপনাকে ছেড়ে অন্য শিক্ষকের কাছে চলে যায়; কিন্তু অন্য শিক্ষকের ছাত্ররা আপনার কাছে আসে না কেন?
জবাব দিলেন-‘স্বাভাবিক মানুষকে খোজা বানানো যায়। কিন্তু কাউকে একবার খোজা বানানো হয়ে গেলে তাকে আর স্বাভাবিক মানুষ বানানো সম্ভব নয়।
১০৪ ▌যে বিষয়গুলো নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে
সিগারেটের ধোঁয়া
সিগারেটের ধোঁয়া যে পলিউশন্টা ক্রিয়েট করে, সেটা আমাদের আয়ত্বের বাইরে নিয়ে যেতে ঘন্টায় ৮ কিমোমিটার বাতাসের গতির দরকার হয়।যা একমাত্র আমরা পাই মে-মাসের জড়ো হাওয়ায়।অন্যান্য সময় যেমনঃ অগাস্টে আমরা পাই ৫.৫৭ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়; আবার নভেম্বরে আমরা পাই ৩.০৩ কিলোমিটার, যেটা জানুয়ারীতে পাই ৩.৩৭ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। এতে বুঝা যায়, ধুমপায়ীরা সিগারেটের যে ধোঁয়া বের করে, ইচ্ছা না থাকলেও অধুমপায়ীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তা ফুসফুসে ঢুকে।এক গবেষণায় দেখা গেছে রাস্তার পাশে থাকা লোকজনের নিকোটিনজনিত রোগের হার অন্যান্য আবাসিক বাসিন্দাদের তুলনায় কয়েকগুন বেশি। আবার সিগারেট দিনে ১টা হুক কিংবা ৫০টা, ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সমান।
মেশিন থেকে নির্গত রেডিয়েশন
এক্স-রে, এমআরআই, সিটিস্ক্যানসহ নানা পরীক্ষার সময় নির্গত হওয়া রেডিয়েশন। রোগ নির্ণয়ে এক্স-রে, এমআরআই, সিটিস্ক্যানসহ নানা পরীক্ষার সময় নির্গত হওয়া রেডিয়েশন থেকে ক্যান্সার, হৃদরোগ, চোখে ছানি, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়াসহ নানা অসংক্রামক রোগে এখন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। রেডিয়েশন নির্গমনে কক্ষের দেওয়াল ১০ ইঞ্চি ও দরজায় লোহা বা তামার পাতের ব্যবস্থা রাখারও নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু মানা হয় না। এক্স-রে বা সিটিস্ক্যান কক্ষের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এই রেডিয়েশন শরীরে প্রবেশ করলে চোখে ছানিপড়া, ক্যান্সার, গর্ভপাত, বন্ধ্যাত্ব, মাথার চুল পড়ে যাওয়াসহ নানান জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। এমনকি গর্ভাবস্থায় এটি হলে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ কিংবা প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও জন্মগ্রহণ করার ঝুঁকিতে থাকে।
বায়ু দূষণে বুদ্ধির জড়তায় আক্রন্ত হওয়ার ঝুঁকি
বায়ু দূষণ মানুষের রক্তপ্রবাহে মিশে যায়, যার ফলে হৃদরোগের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়৷ এছাড়া ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাও বহুগুণে বেড়ে যায়৷ দূষিত পদার্থগুলো রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়বিক সমস্যা সৃষ্টি করে৷'' মস্তিষ্কের রোগ থেকে ডিমেনশিয়া হয়, বিশেষত আলৎসহাইমার রোগ হয়, এর ফলে মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্মৃতি বিঘ্নিত হয়৷ যারা প্রধান সড়কের ৫০ থেকে ১শ’ মিটার দূরে বাস করেন তাদের এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে চার শতাংশ বেশি। আর যারা প্রধান সড়কের ১শ’ থেকে ২শ’ মিটার দূরে বাস করেন তাদের বুদ্ধির জড়তায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের তুলনায় দুই শতাংশ বেশি। অন্যদিকে প্রধান সড়ক থেকে ২শ’ মিটারের বেশি দূরে বসবাসকারীদের বুদ্ধির জড়তায় আক্রন্ত হওয়ার ঝুঁকি খুবই কম।
শব্দদূষণ
মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণ ধারন ক্ষমতা ২৫-৫৫ ডেসিবল। কিন্তু আমরা আমাদের কানের স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতার চেয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ২ থেকে ৫ গুণ বেশি শব্দ শুনি।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতানুসারে যদি টানা ৮ ঘন্টা ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ প্রতিদিন শোনা হয়, তাহলে ২৫ বছরের মধ্যে শতকরা ৫০ জনের বধির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারের শব্দের তীব্রতা, গাড়ির হর্ণ বাজানো বা মাইকিং করা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। দেখা গেছে যে, ঢাকা শহরের যেকোন ব্যস্ত সড়কে সৃষ্ট শব্দের মাত্রা ৬০ থেকে ৮০ ডিবি, যানবাহনের শব্দ মিলে তা ৯৫ ডিবিতে দাঁড়ায়; লাউড স্পিকারের সৃষ্ট শব্দ ৯০ থেকে ১০০ ডিবি, কল কারখানায় ৮০ থেকে ৯০ ডিবি, মেলা-উৎসবে ৮৫ থেকে ৯০ ডিবি, যানবাহনের সৃষ্ট শব্দ ৭২ থেকে ৯৪ ডিবি। এই শব্দ দূষণ শ্রবণ ক্ষমতা ধ্বংস করে, যা কারো মানসিক ভারসাম্যকেও বিনষ্ট করতে পারে। শব্দ দূষণ খিটখিটে মেজাজ সৃষ্টিরও কারণ, এছাড়া এর দ্বারা ফুসফুস আক্রান্ত হয়, শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বাধাগ্রস্ত হয় এবং তাদের লেখাপড়ায় উদাসীন করে তোলে।
৫৪ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল
আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার গ্রহণ করি তার অর্ধেকেরও বেশি ৫৪ শতাংশ খাবারে পাওয়া যায় ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান। এসব খাবার খেয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। আগামী প্রজন্মকেও বুদ্ধিহীন, পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। তা ছাড়া, বাজারের মিনারেল ওয়াটারের নামে যা পাওয়া যায়, তার ৯৬ ভাগই পানের অযোগ্য।
১০৫ ▌তিব্বতঃ যা জানতে হবে
৩ হাজার ৬শ’ বছর আগে মানুষ তিব্বত মালভূমিতে বসবাস শুরু করে। প্রায় ৩ হাজার ৪শ’ মিটার উচ্চতায় মানব জাতির এটি প্রথম বসবাস। ব্রিটেনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানান, পশু শিকার করতেই মানুষ প্রথমে তিব্বত মালভূমিতে যায়। গবেষকরা তিব্বত মালভূমির উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৮শ’ মাইল এলাকা জুড়ে ৫৩টি স্থানে বিভিন্ন প্রাণী ও গাছপালা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এমন ধারণা পোষণ করেন।
হিমালয়ের উত্তরে ছোট একটি দেশ হলো তিব্বত। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ দালাইলামা কর্তৃক প্রবর্তিত গণচীনের একটি স্বশাসিত অঞ্চল এটি। এখানকার মালভূমির গড় উচ্চতা ১৬,০০০ ফুট; যার কারণে এই অঞ্চলকে পৃথিবীর ছাদও বলা হয়। তিব্বতীয় এই অঞ্চলকে গণচীনের অংশ মানতে রাজি নয়। ১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিদের স্বাধিকার আন্দোলনে ব্যর্থ হয়। তখন দালাইলামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তিব্বতের অধিকাংশ মানুষই বৌদ্ধ"ধর্মাবলম্বী। সম্রাট সগেন পো তিব্বতের রাজধানী লাসা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট একটি বিরাট জলাশয় ভরাট করে প্রাসাদ এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিব্বতের বিভিন্ন মন্দিরের ভেতর সোনার তৈরি বড় বড় প্রদীপ মাখন দিয়ে জ্বালানো থাকে। ৪ হাজার ভরি ওজনের একটি প্রদীপও সেখানে রয়েছে।
তিব্বতিরা অত্যান্ত ধর্মভীরু। তাদের প্রধান ধর্মগুরুর নাম দালাইলামা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তিব্বতে লামা নামে পরিচিত। ১৩৯১ সালে প্রথম দালাইলামার আবির্ভাব ঘটে। দালাইলামাকে তিব্বতিরা বুদ্ধের অবতার মনে করে থাকে। তিব্বতিদের বিশ্বাস, যখনই কেউ দালাইলামার পদে অভিষিক্ত হয় তখনই ভগবান বুদ্ধের আত্মা তার মধ্যে আবির্ভূত হয়। তিব্বতে সরকারি ভাষা হিসেবে চীনা ভাষার প্রচলন থাকলেও তিব্বতিদের ভাষার রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। তাই চীনের বেশ কিছু প্রদেশ এবং ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানে তিব্বতি ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে।
তিব্বতিদের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আচার হলো মৃতদেহের সৎকার। এদের মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতি খুবই অদ্ভুত। কোনো তিব্বতি যদি মারা যায়, তবে ওই মৃতদেহ কাউকে ছুঁতে দেয়া হয় না। ঘরের কোণায় মৃতদেহটি বসিয়ে চাদর অথবা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। মৃতদেহের ঠিক পাশেই জ্বালিয়ে রাখা হয় পাঁচটি প্রদীপ।
তারপর পুরোহিত পোবো লামাকে ডাকা হয়। পোবো লামা একাই ঘরে ঢোকে এবং ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দেয়। এরপর পোবো মন্ত্র পড়ে শরীর থেকে আত্মাকে বের করার চেষ্টা করে। প্রথমে মৃতদেহের মাথা থেকে তিন-চার গোছা চুল টেনে ওপরে আনে। তারপর পাথরের ছুরি দিয়ে মৃতদেহের কপালের খানিকটা কেটে প্রেতাত্মা বের করার রাস্তা করে দেয়া হয়। মৃতদেহকে নিয়ে রাখে একটা বড় পাথরের টুকরোর ওপর। ঘাতক একটি মন্ত্র পড়তে পড়তে মৃতদেহের শরীরে বেশ কয়েকটি দাগ কাটে। দাগ কাটার পর একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে সেই দাগ ধরে ধরে মৃতদেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। তারপর পশুপাখি দিয়ে খাওয়ানো হয়।
"তিব্বতীরা সহজে গোসল করতে চায় না। শুনলে অবাক হবেন উকুন তিব্বতিদের অতি প্রিয় খাবার। তিব্বতিরাও ভীষণ চা প্রিয়। তাদের বিশেষ চায়ে মেশানো হয় মাখন এবং লবণ। তবে তিব্বতিদের প্রধান খাবার হলো চমবা। গম এবং যবকে ভেজে পিষে চমবা তৈরি করা হয়। খাবারপাত্র হিসেবে ব্যবহার করে কাঠের পেয়ালা। ভেড়া, ছাগল ও ঘোড়া পালন তাদের প্রধান জীবিকা। মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ এই যাযাবর রাখাল সম্প্রদায়। এরা কখনও চাষাবাদের কাজ করে না। মোট ভূমির ৬৯ শতাংশ এলাকা চারণ বা তৃণভূমি।বছরের প্রায় ৮ মাস জায়গাটি তুষারে ঢেকে থাকে। সাগরের মৌসুমী বায়ু হিমালয় পাহাড়ের বিশাল প্রাচীর ডিঙিয়ে সে দেশে যেতে পারে না বলে বৃষ্টিপাত খুব কম হয়। তিব্বতীরা বেশিরভাগ পশুর চামড়ার পোশাক পরে। রোমশ চমরি গরু তিব্বতীদের কাছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জন্তু। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে এদের দিয়ে মাল বহন করা হয়। তিব্বতে বেশ বড় বড় কুকুর রয়েছে। শীতকালে সেখানকার কুকুরের গায়ে বড় বড় লোম জন্মায়, যার জন্য ওদের ঠাণ্ডা লাগে না। গ্রীষ্মে সেগুলো আবার ঝরে পড়ে।
তিব্বতিদের দালাইলামা বা নেতা নির্বাচনের পদ্ধতিটি খুবই বিচিত্র। কোনো লামার মৃত্যু হলে লাসার পূর্বে লহামপূর্ণ সরোবরের তীরে লামারা ধ্যান করতে বসে। ধ্যানযোগে প্রধান লামা তার সেই অলৌকিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এঁকে দেবে নতুন দালাইলামার তারপর কয়েকজন লামা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে যায় শিশু অবতারের খোঁজে। তারা তিব্বতের ঘরে ঘরে গিয়ে সেই ছবির হুবহু শিশুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। আর এভাবেই তারা খুঁজে বের করে তাদের নতুন দালাইলামাকে।
১৯৫৯ সালে তিব্বতী মানুষের গড়পড়তা আয়ু ৩৬ বছরেরও কম ছিল। বর্তমানে তিব্বতী মানুষের গড় আয়ু ৬৭ বছর হয়েছে। এখন তিব্বতে ১৩০০টি চিকিৎসা সংস্থা আছে এবং ৯১০০ চিকিৎসক স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিব্বতের মোট জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ লাখ ৪০ হাজার।বর্তমানে তিব্বতের ৭৩টি জেলায় ৯০ শতাংশ অঞ্চলে বাধ্যতামূলক শিক্ষা জনপ্রিয় হয়েছে। ১৯৫০ সালের আগে তিব্বতের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষেরই নিজেদের কোন বসতবাড়ি ছিল না। তারা যাযাবরের মত বাস করতো। এখন অল্প সংখ্যক চারণভুমি ছাড়া তিব্বতের সকল পরিবারের স্থায়ী বসতবাড়ি হয়েছে।প্রতি ২০ জন তিব্বতীর নিজের একটি ব্যক্তিগত গাড়ি আছে।
১০৬ ▌নজরুলের জীবন থেকে জানা যায়:-
পশ্চিম বঙ্গের আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। তারা ছিলেন তিন ভাই -বোন। সবার বড় ভাই কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম দুখু মিয়া।
তিনি স্থানীয় মক্তবে ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে যখন তার বাবা মারা যান তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর।
বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল) দলে যোগ দেন।
১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন প্রায় আড়াই বছর। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়।
নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনে নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সালে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৫৩ সালের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। অবশেষে ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কিছু অজানা তথ্যা----
১। নজরুল বাংলা ভাষায় সর্বাধিক “হামদ-নাত” এর রচয়িতা।
২। গ্রামোফোন কোম্পানী থেকে নজরুলের হামদ-নাত যখন বের হোতো, তখন মাঝে মাঝে রেকর্ডের ওপর “পীর-কবি নজরুল” লেখা থাকত।
৩। বাংলা ভাষায় যারা হামদ-নাত রচনা করে গেছেন, তাদের মধ্যে একই সাথে হিন্দু এবং ইসলাম ধর্ম উভয় বিষয়ে পারদর্শী কেউ ছিলনা, একমাত্র ব্যতিক্রম নজরুল।
৪। ইরানের কবি হাফিজ আর ওমর খৈয়ামের যতজন ‘কবি’ অনুবাদক আছেন তার মধ্যে নজরুল একমাত্র মূল ফারসী থেকে অনুবাদ করেছেন, বাকী সবাই ইংরেজীর থেকে।ঃ“ফারসী” এবং “আরবী”তে নজরুল এর জ্ঞান ছিল পাণ্ডিত্যের পর্যায়ে।
১০৭ ▌বাঙ্গালীর ঘাড়ে মাথা আছে, মস্তিষ্ক নেই
কোথায় যেন পড়েছিলাম- এক বাঙ্গালী দেশ প্রেমিকের গল্প। এক দেশ প্রেমিক বাঙ্গালী প্রতিদিন নামায পড়ে প্রার্থনা করতেন, যাতে তাঁর দেশে সৎ ও জ্ঞানীরাই যেন রাজনৈতিক নেতা হয়। তো একদিন তাঁর স্বপ্নে দেখা দিলেন এক দরবেশ। দরবেশ তাঁকে বললেন, হে দেশ-প্রেমিক, বল তুমি দেশের জন্য কী চাও? যা চাইবে তা-ই পাবে।’ দেশ প্রেমিক বললেন, ‘হে দয়াল দরবেশ, আমি শুধু চাই যে, আমার দেশের সব মানুষ সৎ হবে, জ্ঞানী হবে আর রাজনীতি করবে।’ কথা শুনে দরবেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘বড় কঠিন দাবি রে! যাক, আমি আশির্বাদ দিলাম, তো্মার দেশের মানুষের মধ্যে ওই তিনটি গুণই থাকবে, তবে কেউই একসঙ্গে দুটির বেশি বৈশিষ্ট্য পাবে না।’
তখন থেকে দেশে সৎ, জ্ঞানী আর রাজনীতিবিদের অভাব নেই। কিন্তু মুশকিল হলো, সৎ রাজনীতিবিদ কখনো জ্ঞানী হন না, যিনি একই সঙ্গে সৎ ও জ্ঞানী, তাঁকে মূর্খরা রাজনীতি থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে। ফলে আমাদের রাজনীতিতে ওশান্তি আর গেল না। আদিকাল থেকে বাঙালিরা নাকী সবসময় দুই ধরনের অশান্তির জন্ম দিয়ে আসছে: পরাধীন হলে জোট বেঁধে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে। আবার স্বাধীন হওয়া মাত্রই তারা দুই দলে ভাগ হয়ে নিজেদের ধ্বংস করে। জীবজগতে এই স্বভাবটি নাকি অ্যামিবা থেকে পেয়েছে বাঙ্গালীরা। অ্যামিবা পরিণত হওয়া মাত্রই নিজেকে দ্বিখণ্ডিত করে দইটি আলাদা অ্যামিবায় পরিণত হয়। অ্যামিবার দেহে যেমন মস্তিষ্ক নেই, আমাদের নেই, অবশ্য ঘাড়ে একটি মাথা আছে। এজন্যি নাকি সম্রাট আকবরের নবরত্নের এক রত্ন আবুল ফজল বাংলাকে নিয়ে মহাচিন্তিত হয়ে নাম দিয়েছিলেন, ‘বুলঘা খানা’। এর অর্থ চির অশান্তির দেশ। যতদিন বাঙ্গালীর ঘাড়ে মস্তিষ্কহীন মস্তকটি থকবে, ততদিন চেষ্টা করলেও ওশান্তি সে এড়াতে পারবে না। অল্প বিদ্যান বাঙ্গালীরা মনে করে পৃথিবীর সবকিছুই সে জানে, আর সে যা জানে একমাত্র সেটাই ঠিক। মস্তিষ্ক অর্জনের চেষ্টা মানে নাস্তিকতা। আসলে বাঙ্গালী মুসলমানরা খুবই আত্মকেন্দ্রিক জাতি। শামুকের মত নিজেকে সবসময় গুটিয়ে চলে। ইংরেজরা যখন প্রথম ইংরেজি অক্ষর শেখানোর জন্য বিস্কুটের গায়ে এ,বি,সি,ডি-লেখা বসাল, তখন বাঙ্গালী মোল্লারা ফতোয়া জারি করল-ইংরেজি লেখা বিস্কুট খাওয়া হারাম। ফলে ইংরেজি আর মুসলমানরা খেল না। প্রথম যখন মাইক আর কলের গান আসল, মোল্লারা ঘোষনা করল- যে বাড়ীতে মাইক বাজে, সে বাড়ীতে ফেরেস্তারা প্রবেশ করে না, তাই ঐবাড়ীর সাথে সমস্ত সম্পর্ক নিষেধ। কিন্তু যখন মাইকটিতে নিজের গলা বাজিয়ে আযান-বয়ান আর ওয়াজ শুনিয়ে নিজেকে প্রচার করা গেল..তো.সব জায়েজ। টেলিভিশনকে তো জাহান্নামের বাক্সই বলা হল, এখন অনেক মোল্লার ঘরে টিভি আছে, বলে-পিস তিভিতে জাকির নায়েকের বয়ান শুনি। আর হাল আমলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেই নাকী সব নাস্তিক ব্লগার হয়ে যাচ্ছে। ইহুদী-নসরারা মুসলমানদের নাস্তিক বানানোর জন্য এই গজব নেট লাগিয়েছে। আসলে বাংগালী চরিত্রই এটা, নিজের সুবিধা না দেখলেই আমরা নতুন নতুন ফতোয়া লাগাই।
১০৮ ▌চেঙ্গিস খান
চেঙ্গিসের শুরু করা মোঙ্গল হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারান, তৎকালীন বিশ্বের ৩ থেকে ৬ কোটি নিরপরাধ প্রাণ।
১১৬২ সালে মঙ্গোলিয়ার ওনান নদীর তীরে ছোট্ট একটি ট্রাইবে চেঙ্গিস খানের জন্ম। উনার আসল নাম তেমুজিন । চেঙ্গিস খানের যখন ৯ বছর বয়স তখন তার বাবা তার বিয়ে ঠিক করেন । কনে ছিলো তেমুজিনের চেয়ে বয়সে ১ বছরের বড় । মঙ্গোল রীতি অনুযায়ী বিয়েটা ছেলে-মেয়ে সাবালক হওয়ার পরেই হত । বিয়ে ঠিক হওয়ার কিছুদিন পর পুরোনো এক শত্রু বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে তার বাবাকে । এ অবস্থায় গোত্রের প্রধান হিসেবে বাবার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বাসনা পোষণ করেন তিনি। কিন্তু অপরিণত বয়সের দোহাই দিয়ে তার গোত্র তাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং মা, ভাই বোন সহ তেমুজিনকে গোত্র থেকে বের কর দেয় । চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি এই পরিবারটি জীবনের সঙ্গে যুঝতে থাকে। এ সময় তিনি সৎ ভাইকে হত্যা করেন এবং জেলেও যান। মুক্ত হয়ে চেঙ্গিস দেখতে পান রাজনৈতিক অনৈক্যে মোঙ্গল গোত্রগুলো দিশাহারা। চৌর্যবৃত্তি ও হানাহানি এ সময় ছড়িয়ে পড়েছিল।
তেমুজিনের সুন্দরী স্ত্রী অন্য একটি গোত্র দ্বারা অপহরণ হয়। তেমুজিন তার বাবার বন্ধুর সহায়তায় যুদ্ধ করে স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। এইটা ছিলো ইতিহাসে তার প্রথম বিজয়। এরপর তেমুজিন অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১২০৬ সালে সমস্ত মঙ্গল গোত্গুলাকে নিয়ন্ত্রণ ও একত্রিত করেন এবং নিজেকে চেঙ্গিস খান (অর্থাৎ সর্বময় প্রভু) উপাধি দেন । চেঙ্গিজ পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার অনেকগুলো যাযাবর জাতিগোষ্ঠীকে একটি সাধারণ সামাজিক পরিচয়ের অধীনে একত্রিত করেন । এই সামাজিক পরিচয়টি ছিল মঙ্গোল । তাকে মঙ্গোল জাতির পিতা বলা হয়ে থাকে । এক সাধারণ গোত্রপতি থেকে নিজ নেতৃত্বগুণে বিশাল সুশৃঙ্খল অশ্বারোহী বাহিনী তৈরি করেছিলেন। মঙ্গোলরা তাদের অভি্যান পরিচালিত করত উষ্ণ মৌসুমে, এ সময় তাদের চলার পথে পশুদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য থাকত।
দৈহিক আকৃতির দিক দিয়ে মঙ্গোলরা ছিল খর্বাকৃতি, পাতলা কোমর, ছোট পা এবং বড় মাথা বিশিষ্ট। মাথার পেছনে আর ওপরে চুল ছেটে রাখত কিন্তু কানের পাশ দিয়ে লম্বা চুল থাকত। মঙ্গোলরা ঘোড়ায় চড়া শুরু করত তাদের শৈশব থেকে, আর জীবনের একটি দীর্ঘ সময় কেটে যেত ঘোড়ার পিঠে। শিশুকাল থেকে ঘোড়ায় চড়ার কারনে তাদের পা ধনুকের মত বেকে যেত। এমনও হত কোন মঙ্গোলকে ১০০ পা এর বেশী যেতে হবে তারা লাফ দিয়ে ঘোড়ায় উঠে পড়ত। ভূপ্রকৃতির কারনে এ অঞ্চলে উন্নত ঘোড়া পাওয়া যেত, আর বিরূপ পরিবেশ তাদের করেছে দূর্ধর্ষ। সব মিলিয়ে চৌকষ যোদ্বা আর নৃশংষ খুনী।
চেঙ্গিস খান ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে চীনে হামলা চালান । তাঁর এই ভয়াবহ আক্রমণের জন্য চীনারা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না! চেঙ্গিস খান চীনের মহা প্রাচীরের অন্তত তিন জায়গায় ফাটল তৈরি করেন, যা দিয়ে তার বাহিনী ভেতরে ঢুকে পড়ে। ১২১৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পুরো উত্তর চীন তাঁর হাতে চলে আসে। জানা যায় চীন দখলের সময় মঙ্গোলরা ভীষন খাদ্যাভাবে পরে তখন পর্যপ্ত বন্দী সাথে না থাকায় প্রতি দশ জনে একজন সৈন্য তারা হত্যা করে খাদ্য হিসাবে। চীন থেকেই তিনি যুদ্ধবিদ্যা কূটনীতির মৌলিক কিছু শিক্ষা লাভ করেন । ফলে ১২২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চেঙ্গিস খানের রাজ্য বিস্তৃত ছিল পারস্য থেকে পিকিং, সাইবেরিয়া থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত।
চেঙ্গিস খান ১২২২ সালে আফগানিস্তানে ১৬ লাখ মানুষ হত্যা করে। আর ইরানের জনসংখ্যা পঁচিশ লক্ষ থেকে আড়াই লক্ষতে নেমে আসে। চীনের রাজকীয় হিসেব মতে দেখা যায় মোঙ্গল আক্রমণের আগে জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি আর ১২৭৯ সালে মোঙ্গল আক্রমণ শেষ হবার পরে ১৩০০ সালের আদমশুমারীতে দেখা যায় চীনের জনসংখ্যা ৬ কোটি। এভাবে নির্বিচারে পাইকারী গণহত্যা করা হয়েছে। অনেকদিনে তিলে তিলে গড়ে ওঠা স্থানীয় কৃষি ও সেচ-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলাতে' পরবর্তীতে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষে মারা যায় যুদ্ধের চেয়েও বেশী লোকজন। উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায় চেঙ্গিসের শুরু করা মোঙ্গল হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারান তৎকালীন বিশ্বের ৩ থেকে ৬ কোটি নিরপরাধ প্রাণ। পৃথিবীর জনসংখ্যার ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মতো। সাম্রাজ্য বিস্তারে চেঙ্গিস খান যে হত্যাযজ্ঞ চালান, এতে অনেক এলাকা মানবশূন্য হয়ে পড়ে । ওই এলাকাগুলোতে কৃষিজমি ও বসতবাড়িতে গাছপালা জন্মে ক্রমে তা বনজঙ্গলে পরিণত হয় ।
চেঙ্গিস খাঁন তার জীবদ্দশায় ওসিয়ত করে গিয়েছিল- কাক-পক্ষীও যেন তার দাফনের যায়গা জানতে না পারে । এজন্য যারা তার দাফনে নিয়োজিত ২৯১৬ জন মানুষের, সবাইকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছিল । চেঙ্গিস খানের সমাধিক্ষেত্র আজও রয়েছে অধরা,অনাবিষ্কৃত। যুগে যুগে মানুষ এই মঙ্গোলীয় সম্রাটের সমাধিক্ষেত্র খুজে গেছে। বলা হয় ,চেঙ্গিস খানের সমাধিটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনাবিষ্কৃত এবং অক্ষত,অর্ধেক পৃথিবীর ধনসম্পদে ঠাসা একটি রত্নভাণ্ডার ! কিন্তু আজো কেউ খুজে পায়নি তা।
পরবর্তিতে চেঙ্গিস খান এর ছেলেরা এমন এক সাম্রাজ্য শাসন করে গেছেন- যে সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল রাশিয়ার ইউক্রেইন থেকে কোরিয়া অবধি । তাঁর দৌহিত্ররা চিন, পারস্য ও রাশিয়ায় শক্তিশালী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিল । তাঁর বংশধরেরা ছিল মধ্য এশিয়ায় পরাক্রমশালী সম্রাট।
চেঙ্গীস খান অন্য সব মঙ্গোলিয়ানের মতই ছিলেন অশিক্ষিত। মঙ্গোলরা ছিল যাযাবর জাতী। ওদের ধর্ম ছিল তেনগ্রিবাদ। তেনগ্রি ছিলেন আকাশদেবতা। মঙ্গোলরা পূর্বপুরুষ পূজা করত। চেঙ্গিস খান অবশ্য ধর্মের বিষয়ে ছিলেন উদার। তিনি শিক্ষা ও শিক্ষিতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । তার দরবারে শিল্পী, সাহিত্যিক, গণিতজ্ঞ প্রমুখ গুণীদের সমাবেশ হতো । । যেকোন বিষয়ে দক্ষ, পারদর্শী, জ্ঞানী, গুণী ব্যক্তি, চিত্রকর, ভাস্কর, প্রকৌশলী, এবং ধর্মীয় গুরুদেরকে তিনি সন্মানের চোখে দেখতেন তার কড়া নির্দেশ ছিলো এধরণের মানুষদের যেন কোন ভাবেই হত্যা করা না হয় ।
তথ্য আদান প্রদান ছিলো চেঙ্গীস খানের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর একারণে তিনি চালু করেছিলেন ইয়াম (Yam) পদ্ধতির। ইয়াম পদ্ধতির কারণে তার তথ্য বাহকেরা দিনে প্রায় ২০০ মাইলেরও বেশী পথ পাড়ি দিয়ে এক যায়গা থেকে অন্য যায়গায় তথ্য নিয়ে যেতে পারত। এজন্য তিনি বিভিন্ন চেকপোস্ট তৈরী করেছিলেন যেখানে সবসময়ই তথ্য বাহকদের জন্য ঘোড়া, খাদ্য, এবং পানির সুব্যবস্হা থাকত। ফলে দূরবর্তী অঞ্চলের মধ্যে সবসময়ই খুব সহজেই যোগাযোগ রক্ষা করতে সমর্থ ছিলেন।
১০৯ ▌ব্রেইন-ড্রেইন’ : আমাদের অগ্রগতির পথে বড় অন্তরায়
উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা কম সন্তান নেন। একারণে ক্রমেই বিশ্বে বুদ্ধিমান মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।এর পাশাপাশি ব্রেইন ড্রেইনের কারণেও আমরা মাথামোটা জাতিতে পরিণত হচ্ছি। দেশে সুযোগ সুবিধার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা জীবন যাপনের ঝুঁকির এড়াতে “ব্রেইন ড্রেইন” মেধা পাচার হয়ে থাকে। তৃতীয় বিশ্বের মেধাবী ছাত্র, দক্ষ এবং উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা তাদের দেশ হতে তুলনামূলক উন্নত দেশে অভিবাসন করতে চান, যাতে তার দক্ষতা ও মেধা আরও ভালোমতো কাজে লাগাতে পারেন। অদক্ষ শ্রমিকদের কোনো উন্নত দেশ সাধারণত নাগরিকত্ব দিতে চা্য় না। বেশির ভাগ উন্নত দেশের অভিবাসন নীতি সেইভাবেই তৈরি। কিন্তু দক্ষ, মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিতদের প্রয়োজন সব উন্নত দেশেই আছে। এটা যেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণিকার কবিতার মতো—‘কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,/ভাই ব’লে ডাক যদি দেব গলা টিপে।/হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা—/কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!’ এইখানে উন্নত বিশ্ব হল কেরোসিনের শিখা, আর মাটির প্রদীপ হল অদক্ষ অশিক্ষিত শ্রমিক। অন্যদিকে আকাশের চাঁদ হল দক্ষ মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। সুতরাং গগনেতে চাঁদ উঠিলে অর্থাৎ এই দক্ষ মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিকে তো তারা চাইবেই। এভাবেই আমাদের আকাশের চাঁদগুলি বিদেশেই স্থায়ী হয়ে যান আর আমরা চাঁদহারা অন্ধকারের ডুবে আছি।
বেশ নীরবেই দেশ থেকে ‘মেধা পাচারের বিপ্লব’ ঘটে যাচ্ছে। অথচ সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই! সবাই শুধু ক্ষমতা দখলের চিন্তা আর দেশকে লোপাট করার চিন্তায় মশগুল নেতা-আমলারা।
মেধাবী প্রজন্মের সঠিক পরিচর্যা ও তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও মূল্যায়নের ওপরই নির্ভর করে একটা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কেমন হবে। এদেশে মেধাবীরা তাঁদের মেধার মূল্যায়ন পায় না। অথচ তাঁর চেয়ে কম যোগ্যতার কেউ একজন রাজনৈতিক চেষ্টা-তদবির বা ঘুষ–বাণিজ্যের মাধ্যমে তাঁর কাঙ্ক্ষিত যোগ্য আসনটি দখল করে নিচ্ছেন। ফলে সিস্টেমের প্রতি, সার্বিকভাবে দেশের প্রতি তার একটা অনীহা জন্মে যায়। তখন তিনি দেশত্যাগে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ ক্ষেত্রে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটার কালজয়ী কথা মনে পড়ছে, ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।’ এভাবে চলতে থাকলে দেশ অচিরেই মেধাশূন্য মাথা মোটা জাতিতে হব আমরা।
১১০ ▌বাঙালির বিলাত যাত্রা
আধুনিককালে, বহির্বিশ্বে বাঙালির যাত্রা শুরু হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাল তোলা জাহাজে করে লস্কর নামক নাবিকদের কর্মসূত্রে, তাও বঙ্গদেশে কোম্পানিটির দেওয়ানি লাভের শতাধিক বছর আগে থেকে। বাঙালি হিন্দুর কালাপানি (ভারত সাগর) পাড়ি দেয়াতে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা থাকায় লস্করদের প্রায় সকলেই ছিলেন বাঙালি মুসলমান। আবার, ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব থেকে বাঙালি শিক্ষিত ও ধনী (হিন্দু) ভদ্রলোকেরাও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেউ কেউ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তবে বেশির ভাগই বিদ্যার সন্ধানে—বিলাতে আসতে শুরু করেন। কিন্তু দেশে ফেরার পরে সমাজপতিদের বিচারে তাঁদের কঠোর দণ্ড ভোগ করতে হতো। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও রেহাই পাননি।
ঊনিশ শতকের শেষ দিকে এসে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা অনেকটা শিথিল হলে পরে উচ্চশিক্ষিতদের মাধ্যমেই বিলাতে বাঙালি বসতি স্থাপনের সূচনা হয়। কারণ, লস্করেরা বিলাতে আগে এলেও, এদেশে বসবাস করা নয় বরং স্বদেশে ফেরাটাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। তাদের বসতিস্থাপন বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয়ে, বিশ শতকের ৬ষ্ঠ দশক থেকে একটা ধারায় পরিণত হতে থাকে এবং ব্যাপকতা লাভ করে ১৯৭৫ সালের পরে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই বাঙালির উত্তরসূরিরা আজ ব্রিটিশ-বাঙালি হয়েছে। তারা বিলাতে মূলধারার শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি ও প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজ উন্নয়ন ইত্যাদির পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা, সংবাদপত্র প্রকাশনা ও সাংবাদিকতা মাধ্যমে নিজেদের নিয়ে গেছেন এক নতুন উচ্চতায়। এই ব্রিটিশ-বাঙালির সাফল্যগাথা বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে কমবেশি সবার জানা থাকলেও, এঁদের পূর্বসূরিদের প্রায় সাড়ে চারশ বছরের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় এখনো অনেকটা অনালোচিত ও বিস্মৃতপ্রায়। ফারুক আহমদ বিগত প্রায় তিন দশক থেকে বিলাতের বাঙালিদের ওপর গবেষণা করে আসছেন। এই সমাজ-সচেতন লেখক-গবেষক এই গ্রন্থটি রচনা করেছেন বিলাতের বাঙালির অভিবাসনের অনালোচিত ও বিস্মৃত প্রায় চারশ বছরের ইতিহাস নিয়ে। তিনি আঁকর সূত্রে গিয়েছেন, সেখান থেকে এ-যাবৎ-অজানা রোমাঞ্চকর সমস্ত কাহিনি বের করে এ গ্রন্থে মলাটবন্দি করেছেন। বইটি শুধু ইতিহাসের বিদগ্ধ পাঠককেই নয়, সাধারণ পাঠককে যেমন রোমাঞ্চিত করবে, তেমনি বিলাতে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকেও দেবে শিকড়ের সন্ধান।