হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য
তথ্য ও জ্ঞান (৭৬-১০০)
হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য
তথ্য ও জ্ঞান (৭৬-১০০)
০৭৬ ▌সুফীবাদ :
সুষ্টিকর্তা ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে পারস্পরিক গভীর প্রেম সুফিবাদের মূল কথা। অষ্টম শতাব্দীতে মধ্যপ্রচ্যে সুফিবাদের জন্ম। সুফিবাদের প্রভাব ইসলাম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মের উপরেও ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধধর্ম, ইহুদিধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম ও হিন্দুধর্মের অনেক আধ্যাত্মিক গুরু সুফিবাদ গ্রহণ ও প্রচার করেন। এহসব কারণে সংকীর্ণতা পরিহার করার জন্য উদারপন্থিদের কাছে সুফিবাদ প্রশংসিত হয়েছে। কবি হাফিজ ও ওমর খৈয়াম সুফিবাদের বড় মাপের কবি। ইরানী সাহিত্য ছাড়াও আরবি, কুর্দী, উর্দুসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় সুফি সাহিত্য গড়ে উঠেছে। জিকর (আল্লার নাম স্মরণ করা), হাদকা (জিকর করার সময় নৃত্য), কাওয়ালি (আরাধনার সংগিত), সামা (আল্লার প্রর্থনার সময় আরবীয় নাচ-গান), খালওয়া (ধর্মচিন্তার জন্য নির্জনে বাস) ইত্যাদি সুফিবাদের ঐতিহ্য।
সুফীবাদের উৎপত্তি প্যাগানিজম থেকে। যুগে যুগে এই Paganism বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে মিশে সেই ধর্মের রূপ ধারণ করেছে। সে জন্য আমরা বিভিন্ন ধর্মে যেমন সনাতন, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মে এর প্রভাব দেখতে পাই। ইসলাম ধর্মে এই ংঃরপরংস সুফীবাদ বা সুফীইজম নামে পরিচিত। একটা খুব লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই Paganism যেভাবে ইহুদিদের মধ্যে প্রবেশ করেছে, ঠিক একইভাবে এটা ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করেছে। আমরা অনেকেই অনেক সুফী ধারণা ইসলামি বিশ্বাস বলে মনে করি, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইসলামের সঙ্গে সূফীবাদের কোনো মৌলিক মিল নেই। সুফিরা বিশ্বাস করে তারা সরাসরি ঈশ্বর থেকে জ্ঞানপ্রাপ্ত।
বিখ্যাত সুফী ‘মহিউদ্দিন বিন আরাবী’ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফাহসুল হুকম’ এ বলেন : ‘সুফীরা নবীদের মতো একই উৎস থেকে জ্ঞান লাভ করে থাকে’ সুফীবাদে আল্লাহকে বলা হয় নূর ;. ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ১শত বছরের মধ্যে এই তাসাউফ বলে কোনো ধারণা ইসলামে ছিল না। ধারণা করা হয়, মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ‘খানকা’ স্থাপন করেন ‘আবুল হাসেম উসমান বিন সারেক’ নামক এক ব্যক্তি যিনি কুফাতে (ইরাক) বসবাস করতেন এবং ১৬০ হিজরি সনে মৃত্যুবরণ করেন। এই ব্যক্তি আগে অগ্নি উপাসক ছিলেন, পরে অনেকের মতো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু উনার এই ‘খানকা’ তখনকার সময়ে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি, কিন্তু ধীরে ধীরে পরে এই ধরণা জনপ্রিয়তা লাভ করে। তারা নিজেদেরকে মুমিনের বদলে সুফী বলে পরিচয় দিত। এটা সত্য যে সুফীরা এই উপমহাদেশে সুফীবাদের নামে ইসলামের প্রচলন করেছে। তারা এই সুফীইজমকে ইসলামের ছদ্দবেশে এই উপমহাদেশে এনেছে এবং উপমহাদেশের মানুষ এটাকে গ্রহণ করেছে এই জন্য যে, এই সুফীজমের বেশিরভাগ মতবাদই তাদের মতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সুফীজমের প্রভাবের কারণেই এই উপমহাদেশে কবর পূজা এত বেশি এবং এর প্রভাবেই এই উপমহাদেশের মাটিতে এত বেশি মাজার। আমাদের ধর্মের উপর সুফীবাদের প্রভাব ব্যাপক। আমরা ধর্মের নামে অনেক কিছুই করি যা মূলত এই সুফীবাদ থেকে এসেছে, যেমন কবর পূজা, মাজার পূজা, কুলখানী, চল্লিশা ইত্যাদি, পীর, মুর্শিদ, মুরীদ, মিলাদ, শবেবরাত, বিভিন্ন অলৌকিক কাহিনি ইত্যাদি। উদাহরণ এত বেশি যে দিয়ে শেষ করা যাবে না। শুধুমাত্র নিজের ধর্মের সঠিক জ্ঞান থাকলেই বুঝতে পারবেন কোনটা ধর্মীয় আর কোনটার সঙ্গে ধর্মের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
একজন বিখ্যাত সুফী সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করব. ‘আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)’ উনাকে বলা হয় পীরানে পীর দস্তগীর, গাউসুল আযম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)। ইউটিউবে ওনার সম্পর্কিত ওয়াজের ভিডিও দেখেছি। যেমন : মানুষকে কবর থেকে জীবিত করা, অনেক বছর আগে নদীতে ডুবে যাওয়া কয়েকশ’ বরযাত্রীকে পুনর্জীবিত করা, উড়ে বেড়ানো, বাঘকে বশ করা, আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে তর্ক করা, ইসলামকে পুনর্জীবন দান করা এসব। উনার জীবনকাল ১০৭৭-১১৬৬ সাল। জন্ম জিলান প্রদেশ, তাবারিস্তান, পার্সিয়া। সুফীবাদ অনুযায়ী উনি সবচেয়ে বড় পীর। বায়েজিদ বোস্তামি: একজন বিশিষ্ট সুফী। উনার মাজার বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত। যদিও উনি চট্টগ্রামে এসেছিলেন কিনা এবং চট্টগ্রামে মারা গিয়েছিলেন কিনা এ সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী মতবাদ আছে।
সুষ্টিকর্তা ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে পারস্পরিক গভীর প্রেম সুফিবাদের মূল কথা। অষ্টম শতাব্দীতে মধ্যপ্রচ্যে সুফিবাদের জন্ম। সুফিবাদের প্রভাব ইসলাম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মের উপরেও ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধধর্ম, ইহুদিধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম ও হিন্দুধর্মের অনেক আধ্যাত্মিক গুরু সুফিবাদ গ্রহণ ও প্রচার করেন। এহসব কারণে সংকীর্ণতা পরিহার করার জন্য উদারপন্থিদের কাছে সুফিবাদ প্রশংসিত হয়েছে। কবি হাফিজ ও ওমর খৈয়াম সুফিবাদের বড় মাপের কবি। ইরানী সাহিত্য ছাড়াও আরবি, কুর্দী, উর্দুসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় সুফি সাহিত্য গড়ে উঠেছে। জিকর (আল্লার নাম স্মরণ করা), হাদকা (জিকর করার সময় নৃত্য), কাওয়ালি (আরাধনার সংগিত), সামা (আল্লার প্রর্থনার সময় আরবীয় নাচ-গান), খালওয়া (ধর্মচিন্তার জন্য নির্জনে বাস) ইত্যাদি সুফিবাদের ঐতিহ্য।
সুফীবাদের উৎপত্তি প্যাগানিজম থেকে। যুগে যুগে এই ংঃরপরংস বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে মিশে সেই ধর্মের রূপ ধারণ করেছে। সে জন্য আমরা বিভিন্ন ধর্মে যেমন সনাতন, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মে এর প্রভাব দেখতে পাই। ইসলাম ধর্মে এই ংঃরপরংস সুফীবাদ বা সুফীইজম নামে পরিচিত। একটা খুব লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই ংঃরপরংস যেভাবে ইহুদিদের মধ্যে প্রবেশ করেছে, ঠিক একইভাবে এটা ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করেছে। আমরা অনেকেই অনেক সুফী ধারণা ইসলামি বিশ্বাস বলে মনে করি, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইসলামের সঙ্গে সূফীবাদের কোনো মৌলিক মিল নেই। সুফিরা বিশ্বাস করে তারা সরাসরি ঈশ্বর থেকে জ্ঞানপ্রাপ্ত।
বিখ্যাত সুফী ‘মহিউদ্দিন বিন আরাবী’ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফাহসুল হুকম’ এ বলেন : ‘সুফীরা নবীদের মতো একই উৎস থেকে জ্ঞান লাভ করে থাকে’ সুফীবাদে আল্লাহকে বলা হয় নূর (খরমযঃ). ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ১শত বছরের মধ্যে এই তাসাউফ বা ংঃরপরংস বলে কোনো ধারণা ইসলামে ছিল না। ধারণা করা হয়, মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ‘খানকা’ স্থাপন করেন ‘আবুল হাসেম উসমান বিন সারেক’ নামক এক ব্যক্তি যিনি কুফাতে (ইরাক) বসবাস করতেন এবং ১৬০ হিজরি সনে মৃত্যুবরণ করেন। এই ব্যক্তি আগে অগ্নি উপাসক ছিলেন, পরে অনেকের মতো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু উনার এই ‘খানকা’ তখনকার সময়ে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি, কিন্তু ধীরে ধীরে পরে এই ধরণা জনপ্রিয়তা লাভ করে। তারা নিজেদেরকে মুমিনের বদলে সুফী বলে পরিচয় দিত। এটা সত্য যে সুফীরা এই উপমহাদেশে সুফীবাদের নামে ইসলামের প্রচলন করেছে। তারা এই সুফীইজমকে ইসলামের ছদ্দবেশে এই উপমহাদেশে এনেছে এবং উপমহাদেশের মানুষ এটাকে গ্রহণ করেছে এই জন্য যে, এই সুফীজমের বেশিরভাগ মতবাদই তাদের মতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সুফীজমের প্রভাবের কারণেই এই উপমহাদেশে কবর পূজা এত বেশি এবং এর প্রভাবেই এই উপমহাদেশের মাটিতে এত বেশি মাজার। আমাদের ধর্মের উপর সুফীবাদের প্রভাব ব্যাপক। আমরা ধর্মের নামে অনেক কিছুই করি যা মূলত এই সুফীবাদ থেকে এসেছে, যেমন কবর পূজা, মাজার পূজা, কুলখানী, চল্লিশা ইত্যাদি, পীর, মুর্শিদ, মুরীদ, মিলাদ, শবেবরাত, বিভিন্ন অলৌকিক কাহিনি ইত্যাদি। উদাহরণ এত বেশি যে দিয়ে শেষ করা যাবে না। শুধুমাত্র নিজের ধর্মের সঠিক জ্ঞান থাকলেই বুঝতে পারবেন কোনটা ধর্মীয় আর কোনটার সঙ্গে ধর্মের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
একজন বিখ্যাত সুফী সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করব. ‘আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)’ উনাকে বলা হয় পীরানে পীর দস্তগীর, গাউসুল আযম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)। ইউটিউবে ওনার সম্পর্কিত ওয়াজের ভিডিও দেখেছি। যেমন : মানুষকে কবর থেকে জীবিত করা, অনেক বছর আগে নদীতে ডুবে যাওয়া কয়েকশ’ বরযাত্রীকে পুনর্জীবিত করা, উড়ে বেড়ানো, বাঘকে বশ করা, আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে তর্ক করা, ইসলামকে পুনর্জীবন দান করা এসব। উনার জীবনকাল ১০৭৭-১১৬৬ সাল। জন্ম জিলান প্রদেশ, তাবারিস্তান, পার্সিয়া। সুফীবাদ অনুযায়ী উনি সবচেয়ে বড় পীর। বায়েজিদ বোস্তামি: একজন বিশিষ্ট সুফী। উনার মাজার বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত। যদিও উনি চট্টগ্রামে এসেছিলেন কিনা এবং চট্টগ্রামে মারা গিয়েছিলেন কিনা এ সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী মতবাদ আছে।
৭৭ ▌বাহাই ধর্ম :
শিয়া মতবাদের প্রাথমিক যুগে ইমামের প্রধান শিষ্যকে বাব বলা হতো। বাবী মতবাদের শুরু হয় সাইয়েদ আলী মুহাম্মদ শিরাজী’র হাত ধরে, যিনি ইরানের শিরাজ নগরে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। এক সময় তিনি নিজেকে মাহদী হিসেবে দাবি করেন এবং প্রচার করতে থাকেন যে, আল্লাহ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন, তার নিকট ওহী আসে এবং তিনি আল্লাহর মনোনীত বাব। ধীরে ধীরে তার সমর্থক সংখ্যা বাড়তে থাকে। শিয়াতন্ত্রের সঙ্গে বিরোধের কারণে ইরানের শাহ তাকে গ্রেফতার করে। ১৮৫০ সালের জুলাই মাসে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
বাব-এর হত্যাকাণ্ডের পর বাবের দেখানো পথ থেকে বাহাই আন্দোলনের সূত্রপাত হলো। তাঁর একজন একনিষ্ঠ অনুসারী মন্ত্রীপুত্র ছিল হুসাইন আলী নূরী। তিনি দেখতে পান বাব কোরআনের আদলে ‘বেয়ান’ নামের যে ধর্মগ্রন্থ রচনা করেছিলেন, সেখানে একজন ইমাম মাহদী আগমনের কথা বলে গেছেন। তিনি সুযোগটিকে কাজে লাগান। তিনি নিজেকে মাহদী দাবি করে বাহাউল্লাহ নাম ধারণ করেন। কিন্তু বাহাউল্লাহর আপন ভাই, যে কিনা বাবীদের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী ছিল, তিনি বাহাউল্লাহকে ভণ্ড বলে আখ্যা দেন। দুই ভাই একে অন্যকে হত্যার কয়েকটি নিস্ফল চেষ্টা চালায়। তবে বাহাউল্লাহ তাঁর সৌম্যদর্শন চেহারা ও মোহগ্রস্ত করা কথার জালে বেঁধে ফেলে বাবীদের বৃহত্তম অংশকে। আর সেই থেকে তার বাহাউল্লাহ নাম থেকে তাদের নামকরণ করা হয় বাহাই। শেষ জীবনে বাহাউল্লাহ লিখলেন ‘কিতাব ই আকদাস’, যা বাহাইদের ‘ধর্মগ্রন্থ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯ই মে, ১৮৯২ সালে উসমানীয়দের হাতে বন্দি অবস্থায় বর্তমান ইসরাইলের বাহজী ম্যাসনে মৃত্যুবরণ করেন বাহাউল্লাহ। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে বিভেদে জড়িয়ে পড়েন ও দুই ভাগে বিভক্ত হয় বাহাই ধর্মমত। আবদুল বাহা নামের ছেলে বাহাই ধর্মের প্রধান অংশের হাল ধরেন।
পুথিবীর ২০০টি দেশে প্রায় ৬০ লক্ষ বাহাই আছে। বিস্তৃতির দিক দিয়ে এরা পৃথিবীতে দ্বিতীয়। বাহাউল্লার মতে তিনি হচ্ছেন আল্লার প্রেরিত পুরুষদের একজন যদিও তিনি মনে করেন না যে, তিনিই শেষ। বাহাউল্লাহ ঘোষণা করেন যে, তার দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, যার ফলে পৃথিবীতে শান্তি ও সুবিচার ফিরে আসবে। বাহাবাদের মতে এক একটি ধর্ম এক একটি যুগে আসে সে যুগের প্রয়োজন অনুসারে। বাহাবাদের ধর্ম পালনের উৎস হচ্ছে বাহাউল্লাহর লেখা কিতাব-ই-আকদাস। বাহাদের ৩টি প্রার্থনা রয়েছে। এর যে কোন একটি বেছে নিয়ে প্রত্যেকদিন একবার প্রার্থনা করতে হয়।
বাহাইদের কিছু ধর্মবিশ্বাস-
# বাহাই ধর্মমত হচ্ছে; পরকাল নেই। এমনকি কবরের আজাব, কিয়ামত, পুনরুত্থান, হাশর, নশর, হিসাব, প্রতিদান পূর্ণ-পরিণাম, জান্নাত-জাহান্নাম বলতে কিছু নেই ।
# বাহাইরা মকামিতার বৈধতার প্রবক্তা।
# শুধুমাত্র পিতার স্ত্রী ব্যতীত অন্য সকল মহিলাকে বিবাহের অনুমতি আছে বাহাই ধর্মে। বোন, খালা, ফুফু, দুধমাতা, মায়ের মা (ওপরের দিকে), মেয়ে, নাতনী থেকে নিচের দিকে, ভাইয়ের মেয়ে, ছেলের মেয়ে, বোনের মেয়ে, সকলকেই বিয়ে করা বৈধ। একসঙ্গে দুই বিয়ে বৈধ। উভয়ের সম্মতিতে জিনা করাও বৈধ।
# বাগদাদে অবস্থিত হুসাইন আলী বাহা’র ঘরকে কেন্দ্র করে কাবার আদলে হজ্ব করে তারা। আর তা শুধুমাত্র পুরুষদের ওপর ফরজ নারীদের ওপর নয়।
# ভারতে প্রায় ২২ লাখ এর পরে ইরানে প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার, আফ্রিকায় ১৮ লাখ, ল্যাটিন আমেরিকায় নয় লাখ, আমেরিকায় দেড় লাখ বাহাই অনুসারী আছে। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের একদল লোক বাহাই ধর্মমত গ্রহণ করে। বাংলাদেশে বাহাই জনসংখ্যা বাহ্যিক প্রকাশিত হিসেব অনুযায়ী ১০ হাজার, ঢাকার শান্তিনগরে বাহাইদের ধর্মীয় কেন্দ্র রয়েছে। তারা তাদের ধর্মীয় পরিচয় গোপন রেখেই সবার সঙ্গে মিশে, সেক্ষেত্রে আর দশটা সাধারণ মুসলিমের মতো আবদুল্লাহ, জামাল, নজরুল ইত্যাদি নাম নিয়ে নিজেদের মতবাদ কৌশলে প্রচার করে।
# পৃথিবীতে বর্তমানে সাতটি চিহ্নিত প্রার্থনাগার আছে ওদের। অষ্টমটি চিলিতে নির্মাণাধীন। ভারতের নয়াদিল্লিতে এদের পদ্মফুলের আকারে লোটাস মন্দির একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। বাহাইদের এই প্রার্থনা কেন্দ্রগুলোকে ‘মাস্রিকুল আধকার’ বলে, এগুলোতে হাসপাতাল, ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি সন্নিবেশিত থাকে।
# ১৫ বছরের অধিক বয়স্ক প্রত্যেক বাহাই প্রতিদিন একবার বাধ্যতমূলক প্রার্থনা করে। সব বাহাই মার্চের ২ থেকে মার্চের ২০ তারিখ পর্যন্ত সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস রাখে ।
# এদের বর্ষপঞ্জিতে ১৯ মাস, প্রতি মাসের ১৯ দিন এর মধ্যে ৪/৫ দিন ‘ইন্টার কেলারী’ দিবস রয়েছে যা মিলে সৌরবর্ষ নির্ধারণ করে। এদের সপ্তাহে সাতদিন, সারা বছরে সর্বমোট ১১ দিন ছুটির দিন পালন করে। এর মধ্যে ৯ দিন কোনো কাজ করে না, এদিনগুলোকে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়।
০৭৮ ▌সাবমিশন ইসলাম , আলাওয়িবাদ ও জায়েদিবাদ :
আল-কোরআনই একমাত্র গ্রহণীয় ধর্মগ্রন্থ। তবে এটি বিকৃতি থেকে রক্ষা পায়নি বলে মত সাবমিশনবাদীদের। তাই পবিত্র কোরআনের এই বিকৃত অংশ বাদ দেওয়ার জন্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে রাশেদ খলিফা নিজেকে ইসলামের একজন রাসূল দাবি করে বসলেন। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সুন্নাহ পুরোপুরি বাতিল করে এবং নবী ইব্রাহিমের রীতি অনুসরণ করে ‘সাবমিশন ইসলাম’ নামে নতুন একটি ধর্মের প্রচার করেন। এই মিসরীয় পণ্ডিত একদা কায়রোর এইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ১৯৬৪ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন জৈব-রসায়ন বিদ্যায়। ১৯৭৫-৭৬ সালে তিনি লিবিয়া সরকারের বিজ্ঞান উপদেষ্টাও ছিলেন। পরবর্তীতে রসায়নবিদ হিসেবে জাতিসংঘের অধীনে ভিয়েনাতে শিল্প উন্নয়ন সংস্থায় যোগ দেন। তিনি নিজে ইংরেজিতে কোরআন অনুবাদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে রাশেদ খলিফার নিজেকে রাসূল দাবি-বক্তব্য মুসলিম কট্টরপন্থীদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা ১৯৯০ সালের ৩১ জানুয়ারি আমেরিকার এরিজোনা রাজ্যের টুকসন মসজিদের ভেতর ৫৪ বছর বয়সী রাশেদ খলিফাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
আলাওয়ি শব্দের অর্থ হচ্ছে আলীর অনুসারি। আলাওয়িরা মূলত সিরিয়াতে বসবাস করেন। তাদের সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ। সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম আলাওয়ি। আলাওয়িরা আগে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের অংশ ছিল। ৯ম শতাব্দীতে শিয়াদের ইমাম আল হাসান আল আসকারী এবং তার শিষ্য ইবনে নুসায়রী এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। আলাওয়িদেরকে নুসায়রিসও বলা হয়। আলাওয়িরা আল্লাহর নবরূপে বিশ্বাস করেন। তাদের মতে, হযরত আলী হচ্ছে আল্লাহর নবরূপ। হযরত মোহাম্মদ (স:) আলাওয়ি ধর্মের ইমাম ‘সালমান’কে সৃষ্টি করেছেন। কোরান শরীফকে তারা বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। তারা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। কিন্তু তাদের মতে, যেহেতু ‘নারীদের আত্মা নেই’ তাই তাদের পুনর্জন্ম হবে না। আলাওয়িরা বিশ্বাস করে যে, প্রত্যেককে ৭বার পুনর্জন্ম লাভ করে বিশুদ্ধ হতে হবে মহাকাশে আলীর দেশে বাস করতে। যারা বিধর্মী তারা পশু হিসাবে পুনর্জন্ম লাভ করে। সিরিয়ার শাসক হাফিজ আল আসাদ আলাওয়ি সম্প্রদায়ের। তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে কিতাব আল মাযম। আলাওয়িদের ধর্মচর্চা অত্যন্ত গোপনীয়।
বইমাম জায়েদ ইবনে আলীর প্রবর্তিত ধর্মই জায়েদিবাদ। জায়েদিরা পাঁচজন ইমামে বিশ্বাস করে কিন্তু পঞ্চম ইমাম হিসাবে তারা মোহাম্মদ আল বাকিরের পরিবর্তে জায়েদ ইবনে আলীকে স্বীকার করে। ধর্মীয় দর্শনের দিক দিয়ে তারা উদারপন্থী মোতাজ্জিলা সম্প্রদায়ের অনুসারী। ইয়েমেনের শতকরা ৪৫ জন জায়েদি। সৌদি আরবে ১০ লক্ষ জায়েদি আছে। জায়েদিদের একটা বড় অংশ ইরাকের ওয়াসিটে বসবাস করে। জায়েদিরা তিনটি উপদলে বিভক্ত। প্রথম দলটির নাম জুরুদিয়া। এরা মনে করে, রসুল (স:) হযরত আলীকে উত্তরাধিকারী মনোনিত করেছিলেন। তাঁর নির্দেশ না মানবার জন্য হযরত আবু বকর(র:), হযরত ওসমান(র:) ও হযরত ওমর(র:)কে তারা পাপী মনে করে। দ্বিতীয় দলটিকে সুলায়মানী বলা হয়। হযরত আবু বকর(র:), হযরত ওসমান(র:) ও হযরত ওমরকে(র:) তারা পাপী মনে করে না, কিন্তু দোষী মনে করে। তৃতীয় দলটিকে তারাবিয়া বলা হয়। হযরত আবু বকর(র:), হযরত ওসমান(র:) ও হযরত ওমরকে(র:) তারা পাপী ও দোষী মনে করে না। এরা সর্বাপেক্ষা উদারপন্থী।
০৭৯ ▌কাদারবাদ ও মায়াবাদ
মুসলমানরা বিশ্বাস করে মানুষ যা কিছুু করে, তা আল্লাহ আগে থেকেই ঠিক করে রাখে। কিন্তু কাদারবাদীরা ঠিক এর উল্টো ভাবেন। তারা বলেন, মানুষের নিয়তি মানুষই স্থির করেন। কাদারবাদের জন্ম সপ্তম শতাব্দীতে। কাদারিরা বিশ্বাস করেন, মানুষের ভাল কাজগুলি আল্লার ইচ্ছাতেই ঘটে, মন্দ কাজগুলির জন্য দায়ী মানুষ। কাদারিপন্থীদের প্রবক্তা জুহানিক প্রথম নিয়তি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, যদি আল্লাহ আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে, কার নিয়তি কেমন হবে; তাহলে তাদের ভুলের জন্য মানুষ দায়ী হবে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ যদি মানুষের ভবিষ্যত আগে থেকেই না জানেন, তবে অনেকেই তাঁকে সর্বশক্তিমান বলে মনে করবে না। এই নিয়তি বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘেলান আদ্্ দিমাস্কি। তিনি মনে করেন যে, ‘আল্লাহ সবকিছু আগে থেকেই জানেন’ এই মতবাদটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করলে মানুষের কর্মতৎপরতা কমে যেতে পারে। কারণ সবাই মনে করবে যে, সে কি করবে তা আল্লাহ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। কাজেই তার চেষ্ঠা করে লাভ নেই।
অশরীরী আত্মায় বিশ্বাসকে মায়াবাদ বলে। তাবিজ, পানি পড়া, ফুঁ দেয়া এসব পীর-ফকিরের চিকিৎসা মায়াবাদেরই অংশ। জ্বীন তাড়ানোর নাম করে অসহায় কিশোরী ও নারীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয় আমাদের দেশে। এই সব বর্বর নির্যাতনে উৎসাহদাতারা মনে করেন, অত্যাচারটার হচ্ছে জ্বীনের উপর। ইউরোপ-আমেরিকায় মায়াবাদে বিশ্বাস ছিল কয়েক শ’ বছর আগে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্বার্থান্ধ ক্ষমতাবানরা সাধারণ মানুষের মনে মায়াবাদ বজায় রাখতে ধর্মীয় নেতাদের সাহায্য নিয়েছেন। পাশ্চাত্যে অশরীরী আত্মা যেটাকে উইচ, আরবে যাকে জ্বীন আর ভারতবর্ষে সেটা ভুত হয়ে বিরাজ করেছে ধর্মের সহায়তায়।
খ্রিস্টানদের কাছে অশরীরী শয়তান স্যাটান বা ডেভিল হিসাবে পরিচিত। এরা ইশ্বরের শত্রু। এরা মানুষকে সৎপথ থেকে দূরে নিয়ে যায়। স্যাটান ইহুদীদের হিব্রু ভাষার একটি শব্দ। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় থেকে ২য় শতাব্দীতে ইহুদী সংস্কৃতিতে স্যাটান সবচেয়ে বেশি জেকে বসে। যীশু খ্রিস্টের সময় থেকে মন্দ কাজের দোষ স্যাটানের উপর পড়ে। বলা হয় যীশু এসেছে স্যাটানের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের কয়েকশ বছর পর্যন্ত খ্রিস্টান সাধু-পাদ্রীরা তাবিজ-কবজ, ঝাড়-ফু ব্যবহার করেছিলেন স্যাটান ধমন করতে। অশরীরী আত্মা ভর করেছে এমন সন্দেহে হাজার হাজার নারীকে ডাইনী বা উইচ অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে সমগ্র ইউরোপে। উইচদের পোড়ানোর খরচ উইচদের আত্মীদেরকে বহন করতে হতো। জল্লাদরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করতো এ থেকে। ইউরোপের উইচদের মতো জ্বীনেরাও মুসলমানদের কাছে রহস্যময়। তাই কেউ আবোলতাবোল কথা বললে অনেকে মনে করে মানুষটির উপর জ্বীনের আছর হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখেছেন জ্বীনের আছর বলে যেসব উৎসর্গ দেখা যায়, তার ৯৯.২১ শতাংশই মস্তিষ্কের রোগ। বিজ্ঞান এখনো মস্তিষ্কের অসংখ্য রোগের ঔষধ আবিষ্কার করতে পারেনি।
০৮০ ▌দ্রুজ ধর্ম ও ইয়াজিদি ধর্ম :
একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম এবং সামাজিক সম্প্রদায়। দ্রুজদের আবাসভূমি সিরিয়া, লেবানন, ইসরাইল, এবং জর্ডানে। দ্রুজ ধর্মের ভিত্তিমূল ইসলাম। দ্রুজ ধর্ম মূলত শিয়া ইসলামের একটি শাখা। দ্রুজগণ নিজেদেরকে ‘আহলে তাওহীদ’ (একতাবদ্ধ মানুষ) অথবা ‘আল মুয়াহিদুন’ বলে পরিচয় দেয়। লেবাননের ইতিহাস গঠনে দ্রুজদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুজদের সামাজিক রীতিনীতি মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের থেকে ভিন্ন। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় দ্রুজ অনুসারীগণ বাস করে। দ্রুজগণ আরবিতে কথা বলে এবং প্রাচ্যীয় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণ করেন। পৃথিবীতে দ্রুজ অনুসারীগণের সংখ্যা দশ লাখেরও বেশি।
লেবানন ছাড়াও দ্রুজরা সিরিয়া, জর্দান ও ইসরাইলে বাস করে। দ্রুজ ধর্মের উৎপত্তি ১০ শতাব্দিতে। ইসমাইলিয় খলিফা আল হাকিমের রাজত্বকালে ধর্মনেতা মোহাম্মদ আদ দারাজি খলিাফা আল হাকিমকে স্বর্গীয় দূত হিসাবে ঘোষণা করেন। এই ধর্মনেতা আদ দারাজির নামানুসারেই এই ধর্মের নাম দ্রুজ। ১০১৮ সালে আদ-দারাজী আততায়ীর হাতে নিহত হন। দ্রুজরা দাবি করে যে তিনি আল্লাহ’র হাতে নিহত হন। দ্রুজ ধর্মবিশ্বাসে গ্রীক দর্শন, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মের প্রভার আছে। দ্রুজরা প্রধানত পর্বতবাসী। লেবানন ছাড়াও তারা সিরিয়া ও মিশরে তারা বিশেষ মর্যদায় বাস করে। লেবাননের গৃহযুদ্ধে (১৯৭৫-১৯৯০) দ্রুজবাহিনী বিশেষ ভূমিকা পালন করে। দ্রুজরা তাদের আদর্শ ও ধর্মকর্ম সম্পর্কে গোপনীয়তা বজায় রাখে। নতুন কাউকে তাদের ধর্ম গ্রহণ করতে দেয় না, অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করাও নিষেধ। ইহুদিদের মত নিজেদের রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করতেই এই ব্যবস্থা। সততা, অন্যকে সাহায্য করা, বৃদ্ধদের সন্মান করা, নিজের স্বধর্মীকে রক্ষা করা ইত্যাদি মানবিক গুণণাবলীকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় দ্রুজ ধর্মে। ধুমপান, মদ্যপান ইত্যাদি শুয়রের মাংসের মতোই নিষেধ তাদের ধর্মে। পিথাগোরাস, প্লেটো ও অন্যান্য জ্ঞানী ব্যাক্তিদেরকে দ্রুজরা পয়গম্বরের মতোই শ্রদ্ধা করে।
দ্রুজদের দুইভাগে ভাগ করা হয়। শতকরা ৯০ জনকে বলা হয় অজ্ঞান। এরা রাজনীতি করতে পারে এবং সেনাবাহিনীতেও যোগ দিতে পারে। অন্য ১০ জনকে বলা হয় জ্ঞানী। শুধু জ্ঞানীরাই ধর্মীয় নেতা হতে পারেন। মহিলাদেরকে দ্রুজরা জ্ঞানীদের মতোই সন্মান করেন।
ইয়াজিদি বা এজিদিরা হচ্ছে একটি কুর্দি নৃ-ধর্মীয় গোষ্ঠী, ইয়াজিদিগণ প্রধানত উত্তর ইরাকের নিনেভেহ প্রদেশে বসবাস করে। আমেরিকা, জর্জিয়া এবং সিরিয়ায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইয়াজিদিদের সাক্ষাৎ মেলে। ১৯৯০ সালের দিকে ইয়াজিদিদের একটা অংশ ইউরোপে বিশেষ করে জার্মানিতে অভিবাসিত হয়। ইয়াজিদিগণ বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি সাতটি পবিত্র জিনিস বা ফেরেশতার মাঝে এটাকে স্থাপন করেছেন। এই সাতজনের প্রধান হচ্ছেন মেলেক তাউস, ময়ূর ফেরেশতা। ইয়াজিদিদের বর্ণিত তাউসের সঙ্গে ইসলাম ধর্মে বর্ণিত শয়তানের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এমনকি স্বর্গ থেকে শয়তান ও মেলেক তাউসের বিতাড়নের কাহিনি একই, আদমকে সিজদা না করা। ইয়াজিদিরা দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করে। দিনের সকল প্রার্থনা সূর্যের দিকে মুখ করে পড়া হয়। বুধবার হচ্ছে তাদের পবিত্র দিন এবং শনিবার বিশ্রাম দিবস। ডিসেম্বর মাসে তারা তিন দিনের রোজা পালন করে। ইয়াজিদিদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি হচ্ছে ইরাকের উত্তর মসুলের লালিস-এ অবস্থিত শেখ সাদি ইবনে মুসাফির (সেখ সাদি)-এর মাজারে সাতদিনের হজ্বব্রত বা তীর্থভ্রমণ পালন। যদি সম্ভব হয় প্রত্যেক ইয়াজিদিকে তাদের জীবদ্দশায় একবার শেখ সাদির মাজারে তীর্থভ্রমণের চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। তীর্থভ্রমণের সময় তারা নদীতে গোছল করে। তাউস মেলেকের মূর্তি ধৌত করে এবং শেখ সাদির মাজারে শত প্রদীপ জ্বালায়। এই সময়ে তারা একটি ষাঁড় কুরবানি করে।
০৮১ ▌ জৈন ধর্ম :
জৈনধর্ম প্রাচীন ভারতে প্রবর্তিত একটি ঈশ্বরহীন দর্শন। জৈনধর্মে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই। তারা আত্মাতত্ত্বে বিশ্বাসী। মানুষের আত্মা দেহের উপর ভর করে মুক্তির পথে পরিভ্রমণরত। সংখ্যায় কম হলেও বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ধর্ম মতাবলম্বীদের দেখা যায়। জৈনধর্মের মূল বক্তব্য হলো সকল জীবের প্রতি শান্তি ও অহিংসার পথ গ্রহণ। এই ধর্ম মতে, নির্বাণ বা মোক্ষলাভ মানব জীবনের পরম লক্ষ্য। এর সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের কিছুটা মিল রয়েছে।
"জৈন" শব্দটি এসেছে সংস্কৃত "জিন" (অর্থাৎ, জয়ী) শব্দটি থেকে। যে মানুষ আসক্তি, আকাক্সক্ষা, ক্রোধ, অহংকার, লোভ ইত্যাদি আন্তরিক আবেগগুলিকে জয় করেছেন এবং সেই জয়ের মাধ্যমে অনন্ত জ্ঞান লাভ করেছেন, তাঁকেই "জিন" বলা হয়। "জিন"দের আচরিত ও প্রচারিত পথের অনুগামীদের বলে "জৈন"।
জৈনরা তাঁদের ইতিহাসে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের কথা উল্লেখ করেন। এঁদের শিক্ষাই জৈনধর্মের মূল ভিত্তি। প্রথম তীর্থঙ্করের নাম ঋষভ এবং সর্বশেষ তীর্থঙ্করের নাম মহাবীর। ভারতে জৈন ধর্মবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় ১০,২০০,০০০। এছাড়া উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বের অন্যত্রও অভিবাসী জৈনদের দেখা মেলে। ভারতের অপরাপর ধর্মমত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জৈনদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তিদানের একটি প্রাচীন প্রথা জৈনদের মধ্যে আজও বিদ্যমান; এবং ভারতে এই সম্প্রদায়ের শিক্ষার হার অত্যন্ত উচ্চ। শুধু তাই নয়, জৈন গ্রন্থাগারগুলি দেশের প্রাচীনতম গ্রন্থাগারও বটে। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনই তো জৈন ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত।
অহিংসা জৈনধর্মের প্রধান ও সর্বাধিক পরিচিত বৈশিষ্ট্য। কোনোরকম আবেগের তাড়নায় কোনো জীবিত প্রাণীকে হত্যা করাকেই জৈনধর্মে ‘হিংসা’ বলা হয়। এই ধরনের কাজ থেকে দূরে থাকাই জৈনধর্মে ‘অহিংসা’ নামে পরিচিত। প্রতিদিনের কাজকর্মে অহিংসার আদর্শটিকে প্রাধান্য দেওয়া জৈনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক মানুষ নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ ও কোনোরকম আদানপ্রদানের সময় অহিংসার চর্চা করবে এবং কাজ, বাক্য বা চিন্তার মাধ্যমে অন্যকে আঘাত করা থেকে বিরত থাকবে, এই হল জৈনদের অহিংসা আদর্শের মূল কথা। মানুষ ছাড়াও সমস্ত জীবিত প্রাণীর প্রতিই জৈনরা অহিংসা ব্রত পালন করেন। এই আদর্শ যেহেতু বাস্তবক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে প্রয়োগ করা অসম্ভব, সেহেতু জৈনরা একটি ক্রমোচ্চ শ্রেণীশৃঙ্খলা মেনে চলেন। এই শ্রেণীশৃঙ্খলায় মানুষের পরে পশুপক্ষী, তারপর কীটপতঙ্গ ও তারপর গাছপালার স্থান রয়েছে। এই কারণেই জৈন ধর্মানুশীলনে নিরামিষ আহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ জৈন দুগ্ধজাত নিরামিষ খাবার খেয়ে থাকেন। দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের সময় যদি পশুদের প্রতি হিংসাÍক আচরণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে সাধারণ নিরামিষ আহারই গ্রহণ করার নিয়ম।
ইচ্ছাকৃতভাবে কীটপতঙ্গদের ক্ষতি করা জৈন ধর্মানুশীলনে নিষিদ্ধ। উদাহরণ স্বরূপ, কীটপতঙ্গ মারার বদলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। জৈনধর্মে ঐচ্ছিকভাবে ক্ষতি করা ও নির্দয় হওয়াকে হিংসার চেয়েও গুরুতর অপরাধ মনে করা হয়। জৈন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা মূল-জাতীয় সবজি (যেমন আলু, পিঁয়াজ, রসুন) খান না। কারণ, কোনো গাছকে উপড়ে আনতে গেলে গাছের ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
জৈনধর্মের দ্বিতীয় প্রধান আদর্শ হল ‘অনেকান্তবাদ’। জৈনদের কাছে, ‘অনেকান্তবাদ’ হল মুক্তমনস্ক হওয়া। এর মধ্যে সকল মতাদর্শ গ্রহণ ও বিভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা এর অঙ্গ। জৈনধর্ম এই ধর্মের অনুরাগীদের বিপরীত ও বিরুদ্ধ মতবাদগুলিকে বিবেচনা করার শিক্ষা দেয়। অনেকান্তবাদ একাধিক মতবাদের সহাবস্থানকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সেই সঙ্গে মনে করে সত্য ও বাস্তবতাকে বিভিন্ন ও বৈচিত্রপূর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা উচিত। কারণ একটি মাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তা সম্পূর্ণ বিচার করা যায় না। এই তত্ত্বটিকে জৈনরা অন্ধের হস্তীদর্শন উপাখ্যানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। এই গল্পে এক এক জন অন্ধ এক হাতির এক একটি অঙ্গ ¯পর্শ করেছিল। কেউ শুঁড়, কেউ পা, কেউ কান বা কেউ অন্য কিছু ধরেছিল। প্রত্যকে হাতির যে অঙ্গটি ধরেছিল, হাতি সেই রকম পশু বলে দাবি করে। হাতিটিকে সম্পূর্ণ ভাবে ¯পর্শ না করতে পেরে তাদের জ্ঞানও সম্পূর্ণ হয় না।
অপরিগ্রহ হল জৈনধর্মের তৃতীয় প্রধান আদর্শ। ‘অপরিগ্রহ’ বলতে নির্লোভ হওয়া, অপরের দ্রব্য না নেওয়া ও জাগতিক কামনাবাসনা থেকে দূরে থাকাকে বোঝায়। জৈনরা যতটুকু প্রয়োজনীয়, তার চেয়ে বেশি নেওয়ার পক্ষপাতী নন। দ্রব্যের মালিকানা স্বীকৃত। তবে দ্রব্যের প্রতি আসক্তিশূন্যতা শিক্ষা দেওয়া হয়। অপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ না করা ও যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা’ এই হল জৈন ধর্মের শিক্ষা।
মহাবীর খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৯ অব্দে অধুনা ভারতের বিহার রাজ্যের অন্তর্গত একটি প্রাচীন রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ৩০ বছর বয়সে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেন এবং বস্ত্র সহ যাবতীয় জাগতিক সম্পত্তি পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। পরবর্তী সাড়ে বারো বছর মহাবীর গভীর ধ্যান অনুশীলন করেন এবং কঠোর তপস্যা করেন। এরপর তিনি ‘কেবলী’ (সর্বজ্ঞ) হন। পরবর্তী ৩০ বছর তিনি জৈন দর্শন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া পরিভ্রমণ করেন। বর্ধমান মহাবীরের মৃত্যুর বেশ কিছুকাল পর জৈনদের মধ্যে বিভাজন হয় এবং দুটি মতের সৃষ্টি হয়।
০৮২ ▌ শিখ ধর্ম :
একেশ্বরবাদী ধর্মটির মূল ভিত্তি গুরু নানক দেব ও তার উত্তরসূরি দশজন গুরুর ধর্মোপদেশ। এর মধ্যে ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহেব’ দশম গুরু হিসেবে বিবেচিত। প্রথম পাঁচ জন শিখ গুরু তা সংকলন করেছিলেন। শিখধর্ম বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী। এই ধর্মের অনুগামীর সংখ্যা প্রায় প্রায় ৩ কোটি।
শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক ১৪৬৯ সালে পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর শহর থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে 'রায় ভর দি তালবন্দী' (বর্তমান নাম, নানকানা সাহেব) গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক ক্ষৈত্রেয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মেহতা কল্যাণ বেদী ও মা তৃপ্তা দেবী এবং স্ত্রী সুলক্ষিণী। তার দুইজন ছেলে ছিল। বলা হয়ে থাকে, একদিন নানক তার মুসলমান বন্ধু মারকানার সঙ্গে বাইন নদীতে স্নান করতে গিয়ে ডুব দিয়ে হারিয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনদিন পর নানক উপস্থিত হয়ে বলেন, 'আমি ঈশ্বরের দেখা পেয়েছি, তিনি আমাকে তার প্রেরিত পুরুষ হিসাবে উল্লেখ করেছেন'। নানকের এই জাগরণ হয় ১৫০৭ সালের ২০ আগস্ট।
শিখদেরকে পাঁচটি 'ক' দ্বারা চিহ্নিত করা হয়-
১. চুল-দাড়ি না কেটে লম্বা করা।
২. কাঙ্গা বা চিরুনি ব্যবহার করা।
৩. আত্মশক্তি ও আত্মসংযমের জন্য কড়া বা লোহার চুড়ি ব্যবহার করা।
৪. আত্মরক্ষার জন্য কৃপাণ বা ছুরি রাখা।
৫. হাঁটু পর্যন্ত লম্বা অন্তর্বাস ও মাথায় পাগড়ি পরিধান করা।
যারা 'খালসা' হিসাবে দীক্ষা গ্রহণ করেন তাদেরকে বলা হয় 'অমৃতধারী'। যারা গুরুদের বাণী, রীতি-নীতি ও গ্রন্থসাহেব মানেন কিন্তু 'খালসা' হিসেবে দীক্ষিত নন এবং পঞ্চ 'ক' ধারণ করেন না তাদেরকে বলা হয় 'সহজধারী'
কয়েকজন সাধু-সন্তের জীবনাদর্শ এই ধর্মের দর্শনে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন রবিদাস ও কবির। তাদের ঈশ্বরভক্তি অনেকটা বৈষ্ণববাদের ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে শিখ ধর্মে মূর্তিপুজা নিষিদ্ধ। শিখ ধর্ম কঠিন আত্ম সাধনায় বিশ্বাসী। একেশ্বরবাদ এই ধর্মের প্রধান বিশ্বাস। গুরু নানক স্বর্গ, নরক ও কর্মফলে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলেন, ধর্মাচরণ করলেই সমস্ত পাপ ক্ষয় হয় ও ঈশ্বরের নাম জপ করে স্বর্গের অধিকারী হওয়া যায়। পশুবলীর চেয়ে সত্যভাষণ ভালো। গুরুর প্রতি অনুরাগ তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মানুষ্ঠানের চেয়ে শ্রেয়। সকল মানুষই ঈশ্বরের সন্তান- কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দিয়ে মানুষ সমাজে ভেদ-বুদ্ধি সৃষ্টি করেছে।
ধর্মপ্রাণ শিখরা সাধারণত সূর্য ওঠার তিন ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে ওঠেন। স্নান শেষে গুরুর আরাধনায় মনোনিবেশ করবেন। তাদের মধ্যে সকাল, সন্ধ্যা ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রার্থনা করার রীতি প্রচলিত আছে। শিখ ধর্মালম্বীরা গুরুদুয়ারায় উপস্থিত হয়েও সমবেত প্রার্থনায় যোগ দেন।
শিখ ধর্ম তিনটি বিশেষ স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হলো-
১. নামজপ: প্রতিদিন সকালে স্নানের পর ছন্দে ছন্দে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে গুরুকে স্মরণ করা।
২. কিরাত: সৎভাবে জীবিকা অর্জন ও সক্ষমতা অনুযায়ী পরিশ্রম করা।
৩. ভান্দ চাখো : নিজের যা সম্পদ তা সবার সঙ্গে সহভোগ করো।
ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সবার সমান অধিকার আছে বলেই শিখ ধর্মাবলম্বীগণ বিশ্বাস করেন। শিখ ধর্মাবলম্বীগণ ধর্মযাত্রা, উপবাস, কুসংস্কার এবং অন্যান্য রীতি-নীতিতে বিশ্বাস করে না। শিখ ধর্মানুযায়ী, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান, কোনো নির্দিষ্ট স্থানে ঈশ্বর থাকেন না। এই ধর্ম সম্প্রদায়ের সেবায় বিশ্বাসী। শিখ ধর্মালম্বীরা গুরুদুয়ারায় উপস্থিত হয়েও সমবেত প্রার্থনায় যোগ দেন। শিখদের লঙ্গর হলো- যেখানে সব ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষেরা পাশাপাশি বসে আহার করে। গুরু নানক তার সময়ে লঙ্গরের প্রচলন করেছিলেন। বর্তমানে প্রতিটি গুরদুয়ারায় লঙ্গরের ব্যবস্থা আছে। আহমেদিয়া জামাত সম্প্রদায় মনে করে গুরু নানক আসলে মুসলমান ছিলেন। আহমেদিয়ারা নানকের নাম নেয়ার সময় হযরত বাবা নানক (রাঃ) বলে।
শিখরা মনে করেন, “সকল ধর্মমত সমভাবে সঠিক এবং নিজ নিজ মতাবলম্বীদের আলোকিত করতে সক্ষম। শিখধর্মে ‘অহংকার, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও কাম’ এই পাঁচটি ‘পাঞ্জ চোর’ (পাঁচ চোর) হিসেবে পরিচিত। শিখরা মনে করেন, এগুলি মানুষকে বিচ্যুত করে এবং এগুলি ক্ষতিকারক। শিখদের মতে, জগতে একখন কলিযুগ অর্থাৎ অন্ধকারের যুগ চলছে। কারণ, জগত মায়াকে ভালবেসে মায়ার প্রতি আসক্ত হয়ে সত্যভ্রষ্ট হয়েছে। মানুষের ভাগ্য ‘পাঞ্জ চোরে’র কাছে পরাহত হতে পারে। অন্যদিকে মানুষের পাঁচটি সদগুণ হলো- সততা, সন্তোষ, দয়া, নম্রতা ও প্রেম। গুরুবাণী গাওয়াকে বলা হয় শবদ কীর্তন। গুরু গ্রন্থ সাহিবের সমগ্র অংশই কাব্যের আকারে ছন্দে রচিত। শাস্ত্রীয় সংগীতের নির্দিষ্ট ৩১টি গুরু গ্রন্থ সাহিব গাওয়ার নিয়ম। তবে উক্ত গ্রন্থে উল্লেখিত সব কটি রাগের সঙ্গে পরিচিত এমন সংগীতজ্ঞ শিখদের মধ্যে কমই দেখা যায়। শবদ কীর্তন প্রথা চালু করেছিলেন গুরু নানক। ধ্যানের সময় কীর্তন শোনা এবং ভক্তিপূর্ণ চিত্তে সর্বোচ্চ সময়াতীত ঈশ্বরের মাহাত্ম্য কীর্তন করাকে তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায় মনে করতেন। শিখেরা খুব ভোরে উঠে ধ্যান করেন। সেবা ও কার্য ছাড়া ধ্যান নিষ্ফল। শিখরা নিঃস্বার্থ সেবার উপদেশ দিয়ে থাকেন। সেবা ও দাতব্য কার্যের ফলে অহংকারের বিনাশ ঘটে। শিখধর্মে সেবা তিন প্রকার। যথা: "তন" বা দৈহিক সেবা, "মন" বা মানসিক সেবা (যেমন অন্যের সাহায্যার্থে অধ্যয়ন) ও "ধন" বা আর্থিক সেবা। শিখধর্মে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান। শিখধর্মে ধর্মস্থানে মহিলারা প্রার্থনায় অগ্রণী ভূমিকা নেন।
০৮৩ ▌ তাও ধর্ম :
সুপ্রাচীনকালে লোকেরা প্রকৃতিকে পুঁজা করতেন এবং দেবতা ও ভূতে অন্ধ বিশ্বাস করতেন। বদমাশদের তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে লোকেরা জাদুবিদ্যা আবিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে আড়াই হাজার বছর আগে চীনের পূর্ব চৌ আমলে বসবাসকারী দার্শনিক লাওচি " নৈতিকতা শাস্ত্র" রচনা করেন । এ শাস্ত্রে তিনি ধীরস্থির চিন্তাধারা ও জীবনযাত্রার পদ্ধতির পক্ষপাতী ছিলেন। তাও ধর্ম ছুয়ান চেন ও চেং ই - দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত। ছুয়ান চেন সম্প্রদায়ের লোক মানে সন্যাসী। তারা বিয়ে করেন না এবং মাংস জাতীয় খাবার খান না। তারা সাধারণত তাও ধর্মের মন্দিরে বাস করেন। চেং ই সম্প্রদায়ের লোকেরা সাধারণত নিজেদের বাড়িতে থাকেন । তারা বিয়ে করতে পারেন এবং মাংস জাতীয় খাবার খেতে পারেন।
লাওৎস-এর হাত ধরে এ দর্শনের বিকাশ লাভ করে। মনে করা হয় তিনি ছিলেন অপর চীনা দার্শনিক কনফুসীয়াসের সমসাময়িক। লাওৎস স¤পর্কে খুব বেশী জানা যায় না। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন লাওৎস একজন নয়, অনেক। প্রায় দু হাজার বছর আগে চীনের পূর্ব হান আমলে লোকেরা "নৈতিকতা শাস্ত্রের" চিন্তাধারার সংগে প্রকৃতি ও স্বর্গকে পুঁজা করার অনুষ্ঠানের সমন্বয় করে তাও ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন । তাও অনুসারীদের দেব-দেবীর পূজার জন্য দেড় হাজার মন্দির রয়েছে। কিন্তু তারা কাউকে শক্তিমান বা শ্বাশত বলে স্বীকার করে না। তারা বলে, লাওৎস-সহ সকল দেবতা মহাজাগতিক শক্তির ঐশ্বরিক প্রকাশ।
বেইজিংয়ের হোয়াইট ক্লাউড মন্দিরকে ধরা হয় তাওবাদের মূলকেন্দ্র ভূমি। এখানে যাজক ও প্রশাসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ছড়িয়ে থাকা এ সব মন্দিরে ধর্মপ্রচারকের সংখ্যা ২৫ হাজার। প্রচারকদের মধ্যে নারীও রয়েছেন। এ পথের অনুসরণকারী ২০ লাখের মতো। তাওবাদের মূলগ্রন্থতা ওটেচিং।
০৮৪ ▌কনফুসীয় ধর্ম :
চীনের একটি নৈতিক ও দার্শনিক বিশ্বাস ও ব্যবস্থা যা বিখ্যাত চৈনিক সাধু কনফুসিয়াসের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ কনফুসিয়াস হলেন কনফুসীয় ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। এটি মূলত নৈতিকতা, সমাজ, রাজনীতি, দর্শন এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও চিন্তাধারাসমূহের সম্মিলনে সৃষ্ট একটি জটিল ব্যবস্থা যা একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি ও ইতিহাসে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। কনফুসিয় ধর্মের মূলকথা হচ্ছে মানবতাবাদ।
কনফুসিয়াস হলেন চীনের কনফুসিয়ান তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা। দু হাজার বছর ধরে চীনে কনফুসিয়ান তত্বের প্রভাব শুধু রাজনীতি ও সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নয় , চীনাদের চিন্তাধারা ও আচার-আচরণেও আছে । খৃষ্টপূর্ব ৫৫১ সালে কনফুসিয়াসের জন্ম । খৃষ্টপূর্ব ৪৭৯ সালে তার মৃত্যু হয়। তার জন্ম গ্রীসের বিখ্যাত পন্ডিত আরিষ্টোটলের চেয়ে শতাধিক বছর আগে। কনফুসিয়াসের বয়স যখন তিন বছর, তার বাবা মারা যান । তিনি মার সঙ্গে এখানকার পূর্ব চীনের সাংতুং প্রদেশে থাকতেন । কনফুসিয়াসের আসল নাম খুন ছিউ, কনফুসিয়াস হলো তার প্রতি সবার সম্মানসূচক ডাক ।
প্রাচীন চীনে পড়াশুনার সুযোগ পাওয়া শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানের অধিকার ছিল । কিন্তু কনফুসিয়াস এই ধরণের অধিকার ভেঙ্গে দেন। তিনি ছাত্রদের সংগ্রহ করে তাদের শিক্ষা দেন। যে কোনো লোক শিক্ষার ফি হিসেবে অল্প কিছু খাবার বা অন্য জিনিস জমা দিলেই কনফুসিয়াসের ছাত্র হতে পারতেন। জানা গেছে , কনফুসিয়াসের প্রায় তিন হাজার ছাত্রের মধ্যে বেশ কয়েকজন পরে বড় পন্ডিত হয়েছিলেন।
‘লুন ইয়ু ’ নামক একটি বইয়ে কনফুসিয়াসের চিন্তাধারা ও আচার- আচরণ বর্ণনা করা হয়েছে । এই বইয়ে কনফুসিয়াসের বক্তব্য আর তিনি ও তার শিষ্যদের কথাবার্তাও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রাচীন চীনে এই বই পাশ্চাত্য দেশের বাইবেলের মতো পবিত্র ছিল। এই বই সবার পক্ষে প্রয়োজন। একজন সাধারণ অধিবাসীকে এই বইয়ে লেখা আচার আচরণ অনুসারে জীবনযাপন করতে হয়। একজন সরকারী অফিসারের পক্ষে এই বই পড়া আরো প্রয়োজনীয়। এই বই ভালো করে পড়েই শুধু যোগ্য সরকারী কর্মকর্তা হতে পারেন। চীনের ইতিহাসে একটি কথা আছে , কনফুসিয়াসের মতবাদ সম্বলিত ‘লুন ইয়ু’ নামক বইয়ের অর্ধেক তত্বই দেশশাসনে যথেষ্ঠ । কনফুসিয়াস বলেছিলেন, তিনজনের মধ্যে অবশ্যই আমার শিক্ষক আছেন। কনফুসিয়াসের এ কথার অর্থ হলো প্রত্যেকজনের গুণ আছে, কাজেই পর¯পরকে শিখতে হবে।
কনফুসিয়াসের বিখ্যাত কিছু উক্তি :
১. প্রতিশোধ নিতে যাওয়ার আগে দুটি কবর খুঁড়ো।
২. সব কিছুরই রয়েছে সৌন্দর্য- কিন্তু, খুব কম লোকই তা দেখতে পায়।
৩. যারা মিতব্যায়ী নয়- তারা আজ হোক, কাল হোক ভুগবেই।
৪. ভবিষ্যৎকে মুঠোয় নেওয়ার জন্য অতীতকে বিশ্লেষণ কর।
০৮৫ ▌শিন্তো ধর্ম :
জাপানি জাতির প্রচলিত আচারনির্ভর ধর্ম। খ্রিস্টের জন্মের ৬৬০ বছর পূর্বে শিন্তো ধর্ম উৎপত্তি লাভ করে। জাপানের প্রধান ৮০% মানুষ বিভিন্নভাবে শিন্তো রীতিনীতি পালন করে কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক লোক নিজেদেরকে শিন্তো ধর্মানুসারী বলে পরিচয় দেয়। জাপানের প্রধান দুইটি ধর্ম হলো শিন্তো ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম। শিন্তো ধর্মে মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে কিছু বলা নেই বলে বৌদ্ধ ধর্ম ও শিন্তো ধর্ম বহু যুগ ধরে জাপানে সহাবস্থান করেছে। বর্তমানেও বহু জাপানি দুই ধর্মই সমানভাবে অনুসরণ করে। শিন্তো ধর্ম ১৬শ থেকে ১৯শ শতকে বিস্তার লাভ করে। জাপানের অনেক বাসাতে শিন্তো দেবদেবীদের পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি তাক বা স্থান থাকে। “জাপানি লোকেরা জন্মগ্রহনের অনুষ্ঠান পালন করে শিন্তো ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী, বিয়ে করে খৃস্টীয় ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী এবং শেষকৃত্য অনুষ্ঠান পালন করে বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী”। এই যে একই ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন ইভেন্টে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের রীতিগুলো পালন করে, একে তারা কখনো সাংঘর্ষিক বিষয় মনে করে না; বরং সানন্দেই তা গ্রহন করে।
শিন্তো মূলত বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। শিন্তো ধর্মের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা বা নির্দিষ্ট মতবাদ নেই। শিন্তো একটি আচার-নির্ভর ধর্ম, যা বিভিন্ন প্রথা ও আচারের মাধ্যমে পালিত হয়। শিন্তো ধর্মে তাদের ঈশ্বরের আদলে তৈরি কোনো মূর্তি বা ভাস্কর্য নেই। ধর্মটির উৎপত্তি কে করেছিল বা কীভাবে হয়েছিল সেই সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানা যায় না। এটি এমন এক ধর্ম যা প্রতিষ্ঠাতা ছাড়া বহু যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে। প্রকৃতি ও বিশুদ্ধতার প্রতি শ্রদ্ধা ও নমনীয়তা শিন্তো ধর্মের মূল কথা। জাপানি শিন্তোতে নেই কোনো কঠোর নিয়ম এবং আচার-অনুষ্ঠান, বরং এটি একটি জীবনপদ্ধতি। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সাথে সততা ও বিশ্বস্ততার মতো গুণাবলীর উপর জোর দিতে শেখায় শিন্তো। শিন্তোর অনুসারীদের উদ্দেশ্য হলো “মাকোতো নো কোকোরা” অর্থাৎ কলুষতা ও অরাজকতা থেকে মুক্তি লাভ করে স্বাধীন ও সুন্দর মনের অধিকারী হয়ে ওঠা।
শিন্তোর চারটি মৌলিক ভিত নিয়ে।
১) পরিবার: ঐতিহ্য ও আচার-অনুষ্ঠানের মূল হচ্ছে পরিবার। তাই পরিবার গঠন ও এর নিয়মকানুন অবশ্যই গুরুত্বের সহিত দেখতে হবে।
২) প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা: শিন্তো ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রকৃতি বেশ স্বর্গীয়। কামিরা বসবাস করে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানে। তাই প্রকৃতিকে যত্নের সহিত লালন করা বাঞ্ছনীয়।
৩) আচারের জন্য নিজেকে পরিশুদ্ধ করা: শিন্তো ধর্মাবলম্বীদের সকলেই নিজেদের মানসিক ও আত্মিক শান্তি ও শুচির জন্য বছরে দুবার উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এ থেকেই বোঝা যায় শিন্তো ধর্মে বিশুদ্ধতার গুরুত্ব কতখানি।
৪) মাতসুরি ও পৈতৃক আত্মাদের যথাযথ মর্যাদা দেয়া।
জাপানের অনেকেই শিন্তো ও বৌদ্ধধর্মের সংমিশ্রণে জীবনচর্চা শুরু করে। তবে দুটো ধর্ম কিন্তু মোটেই একরকম নয়, বরং এদের নিয়মকানুনে ব্যাপক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন- অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কোনো প্রচলনই ছিল না শিন্তো ধর্মে। বৌদ্ধধর্ম আসার পর জাপানিরা মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে শেখে। মিনজোকু শিন্তো সম্প্রদায় হচ্ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠী যারা মন্দিরে পূজা করে থাকে, এবং এই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ধর্ম, তাওবাদ এবং কনফুসিয়ানিজমের প্রভাব রয়েছে। প্রায় ১৫,০০০ শিন্তো মন্দিরের অস্তিত্ব আছে জাপানে। শিন্টো ধর্মে উপাসনা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুশীলন। প্রধানত পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের লক্ষ্যে শিন্টো ধর্মাবলম্বীরা প্রার্থনা, উৎসর্গ ও বিভিন্ন রীতিনীতির মাধ্যমে উপাসনা করেন।
০৮৬ ▌পুঁজিবাদ ও মৌলবাদ :
পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র (ইংরেজি ভাষায়: ঈধঢ়রঃধষরংস) বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বোঝানো হয় যেখানে বাজার অর্থনীতিতে মুনাফা তৈরির লক্ষ্যে বাণিজ্য, কারখানা এবং উৎপাদনের উপকরণসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার নিয়ন্ত্রণ থাকে। এটি হলো সেই সমাজ সংগঠন যাতে পণ্য স¤পর্ক, মানে কেনাবেচার স¤পর্ক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান যান্ত্রিক বিশ্বের চালিকা শক্তি হচ্ছে -পুঁজিবাদ। এখানে সবকিছুর উপরে অর্থের পূজা করা হয়। মানুষের শ্রম থেকে শুরু করে ভালোবাসা, মানবতা সবই অর্থের মানদ-ে মূল্যায়ন করা হয়। পুঁজিবাদের অভ্যুদয় ঘটেছিল সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে, তখন শিল্প বিপ্লবের ঝান্ডা বহন করে ব্যাপক শিল্পায়ন, বিজ্ঞানের অগ্রগতি, সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রগতি, মানবতাবাদ-গণতন্ত্রের শ্লোগান, এইসব ঘোষণা নিয়ে পুঁজিসামনে উপস্থিত হয়েছিল। তখন কেউই দুঃস্বপ্নে ভাবেন নাই এই পুঁজিবাদ আজকে মানবসভ্যতাকে কী ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন করবে। আজ ৩৫০ কোটি মানুষের সমান স¤পদ, মাত্র ৮৫ জন ব্যক্তি ভোগ করছে।-
মৗলবাদ মানে গোঁড়া সম্প্রদায়। ইংরেজি ফান্ডামেন্টালিজম শব্দের বাংলা অর্থ ‘মৌলবাদ’। ধর্মের আদি/মূল নীতি বা নিয়মগুলোর কঠোর অনুসরণই হলো মৌলবাদ। বর্তমানে মৌলবাদ শুধু গোঁড়া ধর্মীয় মতবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। এই মৌলবাদ এখন সার্বজনীন সকল মতবাদের মধ্যে লক্ষণীয়। যেমন- আস্তিক, নাস্তিক, আঞ্চলিক, রাজনৈতিক, জাতিগত, বর্ণবাদী, জেন্ডারবাদী ইত্যাদি এবং সর্বত্র। ঈহুদি মৌলবাদীরা মনে করে তারা ঠিক, অন্যরা বেঠিক। খ্রিস্টান মৌলবাদীরা মনে করে তাদের ধর্মের মত বা বাণী ব্যতীত অন্য সব অগ্রহণযোগ্য। হিন্দু মৌলবাদীরা মনে করে তাদের ধর্মের বাণী সনাতন বা আদি তাই অন্য সব অগ্রহণযোগ্য। মুসলিম মৌলবাদীরা মনে করে তাদের ধর্মের বাণী আধুনিক অন্য সব বাতিলযোগ্য। ঠিক এমনি করে প্রত্যেক ধর্মের মৌলবাদীরা মনে করে তাদের নিজেদের ধর্মের মত বা বাণী ব্যতীত অন্য সব তাদের জন্য অগ্রহণযোগ্য। যদি বিষয়টা এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলেও কোনো কথা ছিলো না। কিন্তু‘ এক ধর্মের মৌলবাদীরা অন্য ধর্মের প্রতি কোনোকালেই সহনশীল নয়, তার উপরে আবার সহিংস। শুধু অন্য ধর্ম কেনো, নিজ ধর্মের উদার ধর্মতত্ত্ববাদীদের প্রতিও তারা সহনশীল নয়! বর্তমানে ইসলামী মৌলবাদীরা বিশ্বময় বিষফোঁড়া। তারপরে আছে বিষফোঁড়া ঈহুদী এবং হিন্দু মৌলবাদীরা। আবার নাস্তিক মৌলবাদও আছে। একজন নাস্তিক মনে করে সে মহাজ্ঞানী আর বাকিরা মহামূর্খ্য। তবে নাস্তিক মৌলবাদীরা সহিংস নয়; ধর্ম বিদ্বেষী। আমাদের বিভিন্ন মৌলবাদী চেতনার পরিবর্তন ঘটিয়ে এবং মানবতাবাদী চেতনার সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তবেই উন্নত নৈতিকতাবোধ স¤পূর্ণ মানবিক গুণের অধিকারী হতে পারবো।
০৮৭ ▌প্রগতিবাদ :
ফরাসি বিপ্লবের সময় ঘোষণা করা হয় মানবাধিকারের দাবি। এই অধিকারের পক্ষে যারা থাকেন তারা হলেন প্রগতিশীল। কিন্তু‘ প্রগতিবাজ বলতে বোঝায় সেসব বাম রাজনীতিককে, যারা নিজেদের দাবি করেন মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের অনুসারী হিসেবে। ১৯১৭ সালে নভেম্বর মাসে ঘটে রুশ বিপ্লব। এরপর থেকে সৃষ্টি হয় প্রগতিবাজের ধারণা। প্রগতিবাজরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে আস্থাবান নন। তারা বিশ্বাস করেন, কেবল তাদের নেতৃত্বেই সমাজে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই একদলীয় শাসনের ধারণার ভিত্তিতেই প্রগতিবাজ ও প্রগতিবাদীদের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য তৈরি হয়।
বাংলাদেশেও প্রগতিশীল অসংখ্য সংগঠনের জয়জয়কার। কিন্তু‘ তারা মনে করেন এদেশে ফ্রি-থিংকিং ও বিজ্ঞানবাদিতা বাধাগ্রস্ত। তাদের মতে, গোঁয়ার মাথা মোটা বাঙালি জাতি বিজ্ঞানবাদিতার মাহাত্ম বুঝলো না। তবে এ কথাও সত্য পশ্চিমারা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তা রাতারাতি ঘটেনি, সেটা একটি দীর্ঘ সংগ্রাম, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের ফল। তারা মানুষের কল্যাণে, জাতির কল্যাণে, তাদের পশ্চাদপদ দেশকে ধর্মীয় অন্ধত্ব ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে প্রগতিশীল ও উন্নত সমাজ-দেশ গঠনের লক্ষ্যেই আদর্শিক আন্দোলন করেছিলেন, লেখালেখি করছিলেন, মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব কাঁধে তুলেছিলেন।
আমাদের দেশে প্রগতিশীলদের একটি অংশ নিজেদের মুক্তমনা বলে দাবি করেন। মুক্তমনা মূলত মুক্তচিন্তক, যুক্তিবাদী এবং মানবতাবাদীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্র। এই মুক্তমনারা বর্তমান সমাজে বিদ্যমান অদৃষ্টবাদ, ভাববাদ আর বিশ্বাসনির্ভরতার বিপরীতে একটি বিজ্ঞানমনস্ক এবং যুক্তিবাদী ধারা প্রবর্তনে বদ্ধপরিকর। মুক্তমনাদের আস্থা মুক্তবুদ্ধিতে, অন্ধবিশ্বাসে নয়। কোন বিশ্বাস বংশ-পরম্পরায় প্রচলিত হয়ে এসেছে বলেই সেটাকে অবলীলায় বিশ্বাস করতে হবে এমন যুক্তি মুক্তমনারা মানেন না। তাঁরা মুক্তমনে প্রতিটি ধারণাকে যাচাই-বাছাই করতে চান। তারা বিজ্ঞানমনস্ক সংশয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি মিথ এবং অতিকথাকে বিশ্লেষণ করার পরে সিদ্ধান্তে পৌঁছান। অনেক মুক্তমনাই ধর্মের কঠোর সমালোচক। কারণ তাঁরা মনে করেন ধর্ম জিনিসটা পুরোটাই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত।
আবার অনেক মুক্তমনা ব্যক্তিগতভাবে নাস্তিক হলেও তার অবিশ্বাসকে সমগ্র সমাজের উপর চাপিয়ে দেবার নীতি পছন্দ করেন না। তাদের মতে, ওই প্রচেষ্টা কম হয়নি, কিন্তু‘ শেষাবধি ফলাফল জঙ্গিবাদের উত্থান। আপনাদের মেধা আছে, মননশীলতা আছে, জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগ করার সদিচ্ছাও আপনাদের আছে, কিন্তু‘ সেই সদিচ্ছার অপব্যবহার হচ্ছে বলে তা জাতির কোনো কল্যাণ বয়ে আনছে না। তারা মনে করেন, ধর্ম বা ধর্মবিশ্বাস তাদের প্রতিদ্বন্দ্বি নয়। যুগে যুগে ধর্ম বড় বড় সভ্যতার জন্ম দিয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের সাধনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে ধর্ম, ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাধনায় বাধা এসেছে মূলত ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে। তাই, তারা লড়াই করেন, ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। তাদের মতে, ধর্ম ভীরুতা ও ধর্মন্ধতা এক নয়। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে প্রবাহিত করে তাদের পেছন থেকে ধর্মব্যবসায়ীদের সরাতে পারলেই বিজ্ঞানের জয় হবে, সমাজ আলোকিত হবে।
০৮৮ ▌“মানবতাবাদ”:
পানির ধর্ম যেমন নিবারণ করা, আগুনের ধর্ম দহন করা তেমনি মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব বা মানবতা। আমরা যেটাকে বলি খ্রিস্টানধর্ম, ইসলামধর্ম বা আরও পৃথিবীর ১০০০+ধর্ম; এগুলো ধর্ম নয়। এসব এক একটা বিশ্বাস।
মানবতাবাদ হচ্ছে অন্যকে নিজের মত করে দেখতে জানা, তাকে যথোপযুক্ত আসনে সমাসীন করা। মানবতার কল্যাণে যা কিছু প্রয়োজন তার চিন্তা ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাই মানবতাবাদ। মানবিকতাবোধের যতো বেশি উন্মেষ ঘটবে ততোই মানবতাবাদ ধারণাটি পূর্ণতা পাবে।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, মৌলবাদী রক্ষণশীল মৌলভি-মোল্লাদের প্রচারণার চেয়ে সুফি-সাধক, পীর-দরবেশ, আউল-বাউলদের অবদান এ দেশে ইসলাম প্রচারে অধিক কার্যকর হয়েছে। ধর্মের ক্ষেত্রে তাঁরা যে ঐতিহ্যের সূত্রপাত করেছিলেন, তা ছিল আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের ঐতিহ্য, পরমতসহিষ্ণুতার ঐতিহ্য, যা বাংলার মন ও মানসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলার গ্রাম অঞ্চলে কিছুসংখ্যক আউল-বাউল ও চারণকবির আবির্ভাব দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মরমি কবি ফকির লালন শাহ। লালনের গান আজও বাঙালির মনকে গভীরভাবে ¯পর্শ করে। লালনের ধর্মবিশ্বাস স¤পর্কে একটা বিতর্ক রয়ে গেছে। হিন্দুরা লালনকে হিন্দু সাধক বলে মনে করতেন; অন্যদিকে মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন সুফি ফকির। লালন নিজেই জানতেন না তাঁর ধর্মপরিচয় কী?
মানবতাবাদ একটি গণতান্ত্রিক ও নৈতিক জীবন দর্শন, যা দাবী করে যে মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে নিজ জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার ও তার গতিবিধি নির্ণয় করার। মানবতাবাদ বিশ্বাস করে যে, মানুষ যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তা প্রয়োগ করে একটা অধিকতর মানবীয় সমাজ প্রতিষ্টা করার সামর্থ্য রাখে, যার ভিত্তি হবে মানবীয় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক গুণাবলী। তা ধর্মীয় নয় এবং বাস্তবতার অলৌকিক ধারণা গ্রহণ করে না।
০৮৯ ▌“আধ্যাত্মবাদ
আত্মা কি? পরমাত্মা (ঈশ্বর) কি? এই দুইয়ের মাঝে সম্বন্ধ কি? এই বিষয়ের নাম আধ্যাত্মবাদ। আমাদের মত প্রাচীন মানুষও ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখত। স্বপ্ন দেখত হয়ত এমন সব লোকজনকে, যারা তাদের থেকে দূরে কোথাও রয়েছে। অথবা এমন কাউকে দেখত, যে মারা গেছে। ঘুম এবং স্বপ্নের কারণ না জানা থাকায়, তারা যুক্তি খাঁড়া করে কল্পনা করেছিল যে, দেহের ভিতরে থাকে আত্মা। ঘুমের সময় সেই আত্মা বেড়িয়ে গিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেই আত্মাগুলো অন্যদের আত্মার সাথে যোগাযোগ করে, দেখা সাক্ষাৎ হয় ইত্যাদি। আর ভাবত, কেউ মারা গেলে, তার আত্মা তার দেহ ছেড়ে বেড়িয়ে যায় এবং ঘুরে বেড়ায়। তবে তারা এটাও ভাবত যে, আত্মা দুই ধরণের। একটা ভাল, আরেকটা মন্দ। তখনকার মানুষেরা মনে করতে শুরু করেছিল যে, শিকারের সময়, ভাল বা মন্দ আত্মাই শিকারের ভাল মন্দ স্থির করে। আবার মানুষকে রোগাক্রান্তও করে, সেই মন্দ আত্মারাই। এই ধরনের কাল্পনিক ধারণা থেকেই মানব সমাজে চালু হয়েছিল রোগীকে ঘিরে নানা রকমের অদ্ভুত কাজকর্ম। কোথাও রোগীকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে চিৎকার করত। কোথাও লাঠিসোটা নিয়ে রোগীকে ভয় দেখাতো। কোথাও বা ধোঁয়া দিয়ে একাকার করে ফেলত। অনেক সময় চেঁচামেচি করত। এই ভাবেই ঝাড়ফুঁকের সৃষ্টি হয়েছে, যা এখনো সমাজে বিদ্যমান। সৃষ্টি হয়েছে নানা রকমের আচার আচরণ অনুষ্ঠান ইত্যাদির।
আত্মা কি.......তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হলো- একটা গরুকে জবাই করার পর যখন এর মাংসগুলোকে টুকরো করা হয়, তখন খণ্ডিত টুকরোগুলোকে আমরা লাফাতে দেখি। অথবা সাপ, কেঁচো, টিকটিকি ইত্যাদির লেজ কেটে বা ছিঁড়ে ফেললে, ঐ ছিঁড়া অংশকেও আমরা কিছুক্ষণ লাফাতে দেখি, তার মানে সেখানে প্রাণ আছে। তাহলে শরীর টুকরো করার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণও কি টুকরো হতে থাকে? প্রতিটা জীবকোষেই কি তাহলে প্রাণ থাকে? কিংবা কোনো গাছের একটা থেকে দশটি শাখা কেটে রোপণ করলে তা থেকে পৃথক পৃথক দশটি জীবিত গাছ উৎপত্তি হয়। এই দশটি গাছের যে দশটি জীবন, এটা কোথা থেকে আসে? স্বর্গ থেকে, না আগের গাছ থেকে? মানুষ কল্পনা করে তার শরীর সক্রিয় রাখে যে শক্তি সেটাই প্রাণ। শরীর যখন মরে যায় বা দেহ পচে যায়, তখন এই শক্তি বা প্রাণ মরে না, আত্মা হয়ে অনন্তকাল টিকে থাকে। এটাই মানুষের কল্পিত আত্মা। ‘আত্মা অবিনশ্বর’ এই কথাটা সব ধর্মেই বলা আছে। আসলে আত্মার ধারণা অনেক পুরনো।
যখন থেকে মানুষ নিজের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে, তখন থেকে আত্মার ধারণা এসেছে। আদিকাল থেকেই মানুষ ইট, পাথর বা অন্যান্য জড় পদার্থের যে জীবনীশক্তি নেই, তা বুঝতে পারার পর অবাক বিস্ময়ে সে ভেবেছেÑ জীব-জগতের যে চলেফিরে বেড়াবার ক্ষমতাটি রয়েছে, তা কোথা থেকে আসে কোথায় বা যায়। আত্মা নামক কল্পনাটি তার চিন্তার সে শূন্যস্থানটি পূরণ করেছে, তারা রাতারাতি পেয়ে গেছে জীবন-মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার খুব সহজ একটা সমাধান। আত্মা নিয়ে জীবন মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা প্রথম শুরু হয়েছিল নিয়ান্ডার্থাল আমলে, নিয়ান্ডার্থালরা প্রিয়জন মারা গেলে তার আত্মার উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করত। এমনকি তারা মৃতদেহ কবর দেয়ার সময় এর সঙ্গে খাদ্যদ্রব্য, অস্ত্র সামগ্রী এমনকি মাদুলীসহ সবকিছুই রেখে দিত, যাতে তাদের আত্মা শান্তিতে থাকতে পারে আর সঙ্গে থাকা জিনিসগুলো ব্যবহার করতে পারে। অনেক গবেষক (যেমন নিলসন গেসছিটি, রবার্ট হার্টস প্রমুখ) মনে করেন, মৃতদেহ নিয়ে আদি মানুষের পারলৌকিক কল্পনার ফলশ্রুতিতেই মানব সমাজে ধীরে ধীরে আত্মার উদ্ভব ঘটেছে। নিয়ানডার্থাল মানুষের আগে এ ধরনের ধর্মাচরণের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
অনেক সময় ঘুমন্ত মানুষের অস্বাভাবিক স্বপ্ন দেখাকেও আত্মার অস্তিত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন প্রাচীন মানুষেরা। এখনো জাপানিরা বিশ্বাস করে যে, একজন মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন তার ভেতরের আত্মা খুব ছোট পিণ্ডের আকার ধারণ করে তার মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়। তারপর যখন ওই আত্মা আবার দেহের ভেতরে প্রবেশ করে তখনই ওই মানুষটি ঘুম থেকে জেগে ওঠে।
আফ্রিকার কালো মানুষদের মতে সব মানুষের আত্মার রং কালো রঙের। আবার মালয়ের বহু মানুষের ধারণা, আত্মার রং রক্তের মতোই লাল। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অনেকের ধারণা আত্মা আসলে তরল। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা আবার মনে করে আত্মা থাকে বুকের ভেতরে।
খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতক পর্যন্ত হিব্রু, ব্যাবলনীয়, গ্রিক এবং রোমানদের মধ্যে মৃত্যু-পরবর্তী আত্মার কোনো স্বচ্ছ ধারণা গড়ে ওঠেনি। জরথ্রুস্ট ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যার আত্মা সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনা ছিল আধুনিক মানুষের অনেকটা কাছাকাছি। জরথ্রুস্ট ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ বছর আগেকার একজন পারশিয়ান। তার মতানুযায়ী, প্রতিটি মানুষ তৈরি হয় দেহ এবং আত্মার সমন্বয়ে। জরথ্রুস্টবাদীদের মতে, প্রতিটি মানুষই নিজের ইচ্ছানুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করার অধিকারী এবং সে অনুযায়ী তার ভালো কাজ কিংবা মন্দ কাজের উপর ভিত্তি করে তার আত্মাকে পুরস্কৃত করা হবে কিংবা শাস্তি প্রদান করা হবে।
জরথ্রুস্টের দেওয়া আত্মার ধারণাই পরবর্তীকালে গ্রিক এথেনীয় দার্শনিকরা তাদের দর্শনের অঙ্গীভূত করে নেয়। এই দর্শনের তিন পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল। প্লেটোর বক্তব্য ছিল যে, প্রাণী বা উদ্ভিদ কেউ জীবিত নয়, কেবলমাত্র যখন আত্মা প্রাণী বা উদ্ভিদদেহে প্রবেশ করে তখনই তাতে জীবনের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়। প্লেটোর এই ভাববাদী তত্ত্ব অ্যারিস্টটলের দর্শনের রূপ নিয়ে পরবর্তীতে হাজার খানেক বছর রাজত্ব করে।
পিরামিড-মমি আর আমাদের রাখাইন জমিদারদের সমাধি স্তম্ভ সবই হচ্ছে আত্মা বিশ্বাসের স্বাক্ষর। আত্মা সংক্রান্ত কুসংস্কার শেষ পর্যন্ত এভাবেই মানব সমাজে ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসে।
জরথ্রুস্টের মৃত্যুর প্রায় এক হাজার বছর পর অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মবেত্তা সেন্ট অগাস্টিন (খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত নয় বছর অগাস্টিন ম্যানিকিন (Manchean গোত্রভুক্ত ছিলেন, যারা জরন্তুস্ট্রবাদ চর্চা করত।) খ্রিস্টধর্মের ভিত্তি হিসেবে একই ধরনের (মানুষ = দেহ + আত্মা) যুক্তির অবতারণা করেন। এর সঙ্গে যোগ হয় পাপ-পুণ্য এবং পরকালে আত্মার স্বর্গবাস বা নরকবাসের হরেক রকমের গালগল্প। এগুলোই পরে ডালপালায় পল্লবিত হয়ে ইসলাম ধর্মেও স্থান করে নেয়।
আত্মা নিয়ে বর্তমান বৈজ্ঞানিক সমাজের কৌতূহলও পিছিয়ে থাকেনি। তাই বিভিন্ন সময় ইউরোপ-আমেরিকায় বিভিন্ন দেশে গঠিত হয়েছিল ‘আত্মা অনুসন্ধান কমিটি’। ১৮৮২ সালে লন্ডনে যে আত্মা নিয়ে সমিতি গঠিত হয়েছিল, তার সভাপতি ছিলেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত প্রফেসর হেনরি সি জুইক, তার সহকারীদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আর্থার ব্যালফুর। যতদূর জানা যায় বাংলাদেশে ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ‘আত্মা অনুসন্ধান সমিতি’ গঠিত হয়, এর প্রসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. এ্যান্ড্রু অলক দেওয়ারী।
সে যাই হোক, ভারতীয় আর্যরা আত্মা সম্বন্ধে ব্যাপক আলোচনা করেছে কিন্তু তা পাশ্চাত্যের মতো বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নয়, আধ্যাত্মিক চিন্তার মধ্যেই ভারতীয়রা তাদের চিন্তা সীমাবদ্ধ রেখেছিল। বিবর্তনের আধুনিক তত্ত্ব না জানা সত্ত্বেও প্রাচীন ভারতের যুক্তিবাদী চার্বাকেরা সেই খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে তাদের সময়কার অর্জিত জ্ঞানের সাহায্যে আত্মার অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছিলেন। আত্মা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে করতে শেষ পর্যন্ত ঠোঁট কাটা চার্বাকেরা ঈশ্বর-আত্মা-পরলোক- জাতিভেদ-জন্মান্তর সবকিছুকেই নাকচ করে দিয়েছিলে। তারাই প্রথম বলেছিলেন বেদ ‘অপৌরুষেয়’ নয়, এটা একদল স্বার্থান্বেষী মানুষেরই রচিত। জনমানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া সেই সব স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণদেরকে ভণ্ড, ধূর্ত, চোর, নিশাচর বলে অভিহিত করেছিলেন চার্বাকেরা, তারা বাতিল করে দিয়েছিলেন আত্মার অস্তিত্ব। চার্বাকেরা একটি চমৎকার উপমা দিয়ে ব্যাপারটি বুঝিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন, আঙুর এবং মদ তৈরির অন্যান্য উপাদানগুলোতে আলাদা করে কোনো মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলোই এক ধরনের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো পাত্রে মিলিত করার পরে এর একটি নতুন গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে আমরা বলছি মদ। আত্মার চৈতন্যও তেমনি।
নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক পরিষ্কার করেই বলেছেন : আমার ‘আমিত্ব’, আমার উচ্ছ্বাস, বেদনা, স্মৃতি, আকাক্সক্ষা, সংবেদনশীলতা এবং আমার মুক্তবুদ্ধি এগুলো আসলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ থেকে উদ্ভুত অণুগুলোর বিবিধ ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়। স্নায়ুকোষ অণুগুলোর এই ব্যবহারই হচ্ছে ‘মন’। আসলে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের মৃত্যু মানেই কিন্তু ‘মন’-এর মৃত্যু, সেই সঙ্গে মৃত্যু তথাকথিত আত্মার।
অনেক সময় দেখা যায় দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমত কর্মক্ষম আছে, কিন্তু মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হারিয়ে গেছে। এ ধরনের অবস্থাকে বলে কোমা। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হারানোর ফলে জীবিত দেহ তখন অনেকটা জড়পদার্থের মতো থাকে। তাহলে জীবন ও মৃত্যুর যোগসূত্রটি রক্ষা করছে কে? আত্মা, নাকি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সঠিক কর্মক্ষমতা? একবার কেউ কোমায় চলে গেলে তাকে পুনরায় জীবনে ফেরৎ আনা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু যারা চেতনা ফিরে পান, তারা সাধারণতঃ ২/১ দিনের মধ্যেই তা ফিরে পান, আবার একমাস পরও কোমা থেকে ফিরে আসার নজির রয়েছে।
ব্রাইন শ্রিম্প (brine shrimp), গোলকৃমি বা নেমাটোড, কিংবা টার্ডিগ্রেডের মতো কিছু প্রাণী আছে যারা মৃত্যুকে লুকিয়ে রাখতে পারে। যেমন, ব্রাইন শ্রিম্পগুলো লবণাক্ত পানিতে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে, কিন্তু পানি যখন শুকিয়ে যায়, তখন তারা ডিম্বাণু উৎপাদন, এমনকি নিজেদের দেহের বৃদ্ধি কিংবা মেটাবলিজম পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। শ্রি¤পগুলোকে দেখতে তখন মৃত মনে হলেও এরা আসলে মৃত নয়, বরং এদের এই মরণাপন্ন অবস্থাটিকেই বলে ‘ক্রিপ্টোবায়টিক স্টেট’। আবার কখনো তারা পানি খুঁজে পেলে তখন নতুন করে ‘নবজীবনপ্রাপ্ত’ হয়। এর আর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ আফ্রিকার লাং ফিস। এদের অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার অনেকটা ভাইরাসের মতো। ভাইরাস জীবাণু ও জড়ের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে। ভাইরাসকে কেউ জড় বলতে পারেন, আবার কেউ জীবিত। এমনিতে ভাইরাস ‘মৃত’, (‘ক্রিপ্টোবায়টিক স্টেট’-এ থাকে) তবে তারা ‘বেঁচে’ ওঠে অন্য জীবিত কোষকে আশ্রয় করে। ভাইরাসে থাকে প্রোটিনবাহী নিউক্লিয়িক এসিড। এই এসিডই ভাইরাসের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের আধার। তারা উপযুক্ত দেহ কোষ বিভাজনের মাধ্যমে জীবিত হয়ে ওঠে।
আসলে মানব দেহের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রয়েছে। মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, আর ফুসফুস। যে কোনো একটির বা সবগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হলে মৃত্যু হতে পারে। যেমন- মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বন্ধ হলে কোমা হয়, হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা বন্ধ হওয়াকে বলে সিনকোপ, আর ফুসফুসের কার্যকারিতা বন্ধ হওয়াকে বলে আসফিক্সিয়া। আগেকার যুগের (বর্তমানেও) মানুষেরা মৃত্যুর এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানত না বা জানে না বলেই কল্পনার ফানুস উড়িয়ে ভাবতো বা ভাবে, ঈশ্বরের নির্দেশে যমদূত এসে প্রাণ হরণ করলেই কেবল একটি মানুষ মারা যায়। আর তখন তার দেহস্থিত আত্মা পাড়ি জমায় পরলোকে। তারা আত্মা বলতে বাতাসের মতো কোনো নির্দিষ্ট অদৃশ্য শক্তি কল্পনা করে, যা শরীরের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। এই শক্তি শরীর থেকে বেরিয়ে গেলেই কেউ মারা যায় বলে ধারণা করে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো- মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, আর ফুসফুস এর যে কোনো একটির বা সবগুলোর কার্যকারিতা বন্ধ হলে মৃত্যু হয়। শরীরের কোষ বেঁচে থাকে তৎক্ষণই, যতক্ষণ এর মধ্যে শক্তির যোগান থাকে। শক্তি উৎপন্ন বন্ধ হলে কোষেরও মৃত্যু হয়।
০৯০ ▌অজ্ঞেয়বাদ :
অজ্ঞেয়বাদ হচ্ছে একটি মতবাদ অথবা কতিপয় যুক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি ধারণা, এটি কোনো ধর্ম নয় যদিও এটি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে না আবার স্বীকারও করে না। ইংরেজ জীববিজ্ঞানী টমাস হেনরি হাক্সলি 'অজ্ঞেয়বাদ' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ১৮৬৯ সালে।
মার্কিন দার্শনিক উইলিয়াম এল. রোয়ে বলেন, "অজ্ঞেয়বাদ হচ্ছে মানবজাতি কখনো ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা যে আছেন এটি শক্তভাবে প্রমাণ করতে সমর্থ হবে না আবার ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা যে নেই এটিও শক্তভাবে প্রমাণ করতে অসমর্থ থেকে যাবে"। আস্তিকতা এবং নাস্তিকতার মধ্যে মিল হচ্ছে দুই পক্ষই নিশ্চিত যে তাদের বিশ্বাসটাই সঠিক। কিন্তু অজ্ঞেয়বাদীরা পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত নয় কোন ব্যাপারেই।
অজ্ঞেয় এর ইংরেজী প্রতিশব্দ 'অ্যাগনস্টিক' (agnostic) শব্দটি প্রাচীন গ্রীক ভাষার দুটি শব্দ 'এ', (a) এবং 'নসিস'(gnōsis)থেকে এসেছে যাদের অর্থ যথাক্রমে নেই এবং জ্ঞান। প্রাচীন যুগের খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা গ্রীক শব্দ 'নসিস' (জ্ঞান) কে "আধ্যাত্মিক জ্ঞান" বোঝাতে ব্যবহার করতেন।
অজ্ঞেয়বাদীরা কয়েকভাবে বিভক্ত-
গোঁড়া অজ্ঞেয়বাদী (Strict Agnostic): যাঁরা মনে করেন কোন ঐশ্বরিক শক্তি আছে কি নেই সে বিষয়ে কখনোই জানা সম্ভব নয়, তাঁদের বলা হয় গোঁড়া অজ্ঞেয়বাদী।
আস্তিক অজ্ঞেয়বাদী (Agnostic Theist): যাঁরা মনে করেন কোন ঐশ্বরিক শক্তি আছে কি নেই সে বিষয়ে কখনোই জানা সম্ভব নয় কিন্তু ধর্মপালন করেন এঁদেরকে আস্তিক অজ্ঞেয়বাদী বলা হয় ।
অ্যাপাথিস্ট (Apatheist): ঈশ্বর থাকুক কিংবা না থাকুক এতে কিছুই এসে যায় না এঁদের বলা হয় অ্যাপাথিস্ট।
ধর্মবিহীন আধ্যাত্মবাদী (Spiritual But Not Religious): যাঁরা প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসে এবং প্রচলিত ধর্মগ্রন্থবর্ণিত ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন, কিন্তু আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী, এঁদেরকে ধর্মবিহীন আধ্যাত্মবাদী বলা হয়।
বস্তুবাদী (Materialist): যাঁরা কোন অলৌকিকতা ও আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী নন এবং যে কোন প্রশ্নে বিজ্ঞানপন্থী ও যুক্তিবাদী তাঁরা হচ্ছেন বস্তুবাদী। মূলত বস্তুবাদী চিন্তা-ভাবনাই আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের উৎস্য ।
০৯১ ▌ বিবর্তনবাদ
ধরুন, আপনার বয়স ৫০ বছর। আপনার ১ বছর বয়সের একটি ছবি তোলা হয়েছিল। এরপর ১ মাস, ২ মাস, ৩ মাস... এভাবে ৫০ বছর বয়সের প্রত্যেক মাসের ছবি তোলা হয়েছিল। এবার যে-কোনো ২ মাসের ২টি ছবি পাশাপাশি রেখে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ছবি ২টির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু আপনি যদি ৫ বছর বয়সের ছবির সঙ্গে ৫০ বছর বয়সের ছবি পাশাপাশি রাখেন, তাহলে এই ছবি ২টি একই ব্যক্তির বলে মনে হবে না। সময়ের ব্যবধানে শরীরে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে একই ব্যক্তির ভিন্ন চেহারা বা ভিন্ন কাঠামো দেখা যায়, এটাই বিবর্তন।
কোটি কোটি কিংবা লক্ষ লক্ষ বছর ব্যবধানে পৃথিবীতে বা জীবদেহে যে পরিবর্তন এসেছে, এটা যারা জানেন এবং মানেন তারা বিবর্তনবাদী। বিবর্তনবাদিতা মানে পৃথিবী কীভাবে উৎপত্তি হয়েছে এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী কীভাবে পৃথিবীতে এসেছে, তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা জানা। এ বইটি মূলত বিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়েই লেখা।
প্রকৃতিতে নানা রকম পরিবর্তন আমরা হরহামেশাই দেখি। ভূত্বকের পরির্বতন হয়, নদী-নালা-খাল-বিল শুকিয়ে যায়, দাবানল বা অগ্ন্যুৎপাতে শহর ধ্বংস হয়, আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে এন্টার্কটিকার বরফ গলে যাচ্ছে। এগুলো সবই জড়-জগতে পরিবর্তনের উদাহরণ।
জীবজগতও আসলে স্থির নয়, জীবেরও পরিবর্তন হয়, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তনের হার খুবই ধীর। বিজ্ঞানীদের মতে আমরা আমাদের চারপাশের যত রকমের জীবজগতের সঙ্গে পরিচিত, তাদের সবার পূর্বপূরুষ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া সাদৃশ সরল এককোষী জীব, যাদের উদ্ভব পৃথিবীতে হয়েছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি বছর আগে। প্রায় ষাট কোটি বছর আগে বাস করত এমন এক প্রকার কৃমি জাতীয় জীব যা থেকে ক্রমান্বয়ে বিবর্তিত হয়েছে মাছ, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীসমূহ। প্রায় এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগেকার ছুঁচো-সদৃশ এক ধরনের প্রাণী থেকে এসেছে স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং মানুষের পূর্বপুরুষেরা।
১৯৫৯ সালে চার্লস ডারউইন ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ নামে যে গ্রন্থ রচনা করেন, তাতে তিনি প্রথমবারের মতো ব্যাখ্যা করেন বিবর্তনের পিছনে চালিকাশক্তি হলো ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’। ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ বিষয়টি ভারি মজার। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃতি যোগ্যতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেছে নেয় আর অযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাতিল করে দেয়, ফলে একটি বিশেষ পথে ধীরগতিতে জীবজন্তুর পরিবর্তন ঘটতে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
১৯৫০ সালের পর থেকে বিবর্তনের স্বপক্ষে সবচেয়ে জোরালো এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া গেছে ‘আণবিক জীববিদ্যা’ এবং কোষ বংশগতিবিদ্যা থেকে। ১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ডিএনএ’র আণবিক গঠন উদঘাটন করেন। ১৯৮৮ সালে দুই বিলিয়ন ডলার বাজেট নিয়ে ২০ বছরব্যাপী মানব-জিনোম প্রকল্প শুরু হয়, যা ২০০৪ সালে শেষ হয়েছে। এই জিনোম প্রকল্প থেকে জানা গেছে আমাদের ডিএনএ শিম্পাঞ্জির ডিএনএ’র সঙ্গে প্রায় ৯৮.৬%, ওরাং ওটাং-এর সঙ্গে ৯৭% মিলে যায়। এর উত্তর কি? উত্তর খুব সোজা। বিবর্তন তত্ত্ব বলছে শি¤পাঞ্জিকূলের সঙ্গে আমাদের জেনেটিক গঠনে এতো মিলের কারণ, আমরা ৫০-৮০ লক্ষ বছর আগে এক ধরনের প্রাইমেট থেকে বিবর্তিত হয়েছি।
সময়ের দিক থেকে পৃথিবীর বুকে প্রাণের ইতিহাসটুকু বোঝবার আমরা এমন একটা ঘড়ির কথা কল্পনা করবো’ যার কাঁটাটা ১৬ লক্ষ ৬০ হাজার বছরে একটি করে মিনিটের ঘর পার হয় আর যার ছোট কাঁটাটা ১০ কোটি বছরে একটি করে ঘণ্টার ঘর পার হয়। পৃথিবীর বুকে প্রাণের ইতিহাসের দিক থেকে এই ঘড়িতে এখন বারোটা বেজেছেÑ তার মানে, প্রায় ১২০ কোটি বছর আগে শুরু হয়েছে এই ইতিহাস! ওই ঘড়িতে যখন ৮টা বেজে ১২ মিনিট তখনই প্রথম শিরদাঁড়াবিশিষ্ট প্রাণীর আবির্ভাব হয়েছিল। উভচরের আবির্ভাব ৯টার সময়; ৯টা বেজে ২৪ মিনিটে সরীসৃপের। এই ঘড়িতে যখন ১০টা বেজে ১০ মিনিট, পৃথিবীতে তখন অতিকায় ডাইনোসরদের যুগ চলেছে! ১০টা বেজে ২৫ মিনিটের সময় স্তন্যপায়ীদের আবির্ভাব, পাখিদের আবির্ভাব ১০টা ৪০ মিনিটে।
আর মানুষ? ওই ঘড়ির হিসাব অনুসারে প্রায় আধুনিক মানুষের আবির্ভাব মাত্র সেকেন্ড নয়েক আগেকার ঘটনা, অর্থাৎ আড়াই লক্ষ বছর আগে। যদিও প্রায় মিনিট দেড়েক আগে পৃথিবীতে মানুষ ধরনের জীবের আবির্ভাব হয়েছে আনুমানিক পঁচিশ লক্ষ বছর আগে। মানুষ যন্ত্রচালিত এ্যারোপ্লেন আকাশে উড়িয়েছে মাত্র এক সেকেন্ড আগে। অথচ আজ কিনা আমাদের এই কাল্পনিক ঘড়ির হিসাব অনুসারে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বলবার মতো কথা শুধু এইটুকুই যে পৃথিবীর এখানে-ওখানে বুনো মানুষের দল ভোঁতা পাথরের হাতিয়ার সম্বল করে হন্যে হয়ে খাবারের আশায় ঘুরে বেড়িয়েছে, তারপর ক্রমশ আগুনের ব্যবহার সভ্যতার প্রকৃত ভিত্তি সৃষ্টি করল, মানুষের সম্পদ বাড়লো আর সে সম্পদের সাহায্যেই মানুষ প্রথম নগর সভ্যতা গড়ে তোলবার দিকে অগ্রসর হলো। ওই নগরসভ্যতাগুলোর চূড়ান্ত বিকাশ যিশুখ্রিষ্টের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে।
পরিবর্তন কেন ঘটে?
ডারউইন যখন গ্যালাপাগোস দ্বীপে গিয়ে নানা রকম ঠোটের আকার সম্পন্ন ফিঙ্গে, বিরাট গলাবিশিষ্ট কচ্ছপ পেয়েছিলেন, দেখেছিলেন সাঁতার কাটা ইগুয়ানা, যেগুলো আর কোথাও দেখা যায় না। তেমনি কোকাস দ্বীপে এমন এক ধরনের কাঁকড়া দেখেন যারা গাছের নীচে পড়া নারকেল ভেঙে খায়। এক ধরনের কুকুর দেখেন যারা ডুব দিয়ে সমুদ্রের পানি থেকে মাছ শিকার করে আনে, কিছু মাছ আছে যারা আবার কোরাল খেয়ে জীবন ধারণ করে। ঐ দ্বীপে বিরাট আকারের ঝিনুক আছে যা মানুষের পা কামড়ে ধরে আর ডুবিয়ে মেরে ফেলে। ওখানকার ইঁদুরেরা তাল গাছের আগায় গিয়ে বাসা বাঁধে। এর মানে টিকে থাকার প্রয়োজনে জীব-জগতে নানা ধরনের অভিযোজিত বৈশিষ্ট্যের আগমন ঘটে এবং তা থেকে নতুন নতুন প্রজাতির উৎপত্তি ঘটে। ফলে পূর্ববিকশিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকেই নতুন অঙ্গের কাঠামো তৈরির ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিভিন্ন মেরুদণ্ডী প্রাণীর সামনের হাত বা অগ্রপদের মধ্যে তাই লক্ষণীয় মিল দেখা যায়। আবার অব্যবহারের ফলে কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিলুপ্ত হয়।
০৯২ ▌ নাস্তিক্যবাদ :
এ দর্শনে ঈশ্বর বা স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না এবং সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়। আস্তিক্যবাদ-এর বর্জনকেই নাস্তিক্যবাদ বলা হয়। ইংরেজি ‘এইথিজম’ (Atheism) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক ‘এথোস’ শব্দটি থেকে। শব্দটি সেই সকল মানুষকে নির্দেশ করে, যারা এথেন্সবাসী সক্রেটিস, প্লেটো গং দার্শনিকদের মতো ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি অন্ধবিশ্বাসকে যুক্তি দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে। দিন দিন মুক্তচিন্তা, সংশয়বাদী চিন্তাধারা এবং ধর্মসমূহের সমালোচনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নাস্তিক্যবাদেরও প্রসার ঘটছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম কিছু মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দেয়। বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ১৪.৯% মানুষ কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না। জাপানের ৬৪% থেকে ৭৫% নাস্তিক, রাশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায় ৬৮% এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ৪০% (ইতালি) থেকে শুরু করে ৮৫% (সুইডেন) পর্যন্ত। চীনের ৯০ % লোক নাস্তিক। এ দর্শন বুঝতে গ্রিক সভ্যতা অধ্যায়টি বুঝে পড়ুন।
‘নব-নাস্তিক্যবাদ’ : ২০০৪ সালে স্যাম হ্যারিসের দি ইন্ড অব ফেইথ : বইয়ের মাধ্যমে নব-নাস্তিক্যবাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। স্যাম হ্যারিসের বই প্রকাশের পর এই ধারায় আরও ছয়টি বই প্রকাশিত হয় যার প্রায় সবগুলোই নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলারে স্থান করে নিতে সমর্থ হয়। কিন্তু দ্য নিউ এইথিজম প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। এ বইয়ের লেখক ভিক্টর স্টেংগাকে নব-নাস্তিক্যবাদের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
নাস্তিকতা ধর্ম নয়। একজন নাস্তিক কারো প্রার্থনা করেন না। কোনো সৃষ্টিকর্তা মানেন না। কোনো উপাসনালয়ে যান না। তাহলে সেটা ধর্ম হয় কীভাবে? একজন মুসলিম, হিন্দু, বা খ্রিস্টান জন্মগতভাবে সে সেই ধর্মের অনুসারী কিন্তু একজন নাস্তিক সে তার নিজের বিবেক, বুদ্ধি, বিচার-বিশ্লেষণ করেই কিন্তু নিজের ধর্ম নির্ধারণ করেন। নাস্তিকতা জন্মগতভাবে অর্জিত হয় না।
০৯৩ ▌চার্বাক দর্শন :
বৈদিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে অন্ধভাবে গা ভাসায়নি এই দর্শন। কঠোর যুক্তিবাদী সমালোচনাই এই দর্শনের মূল বিষয়। এই দর্শনে মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা বলতে বলা হয়েছে, এই চেতনা বিশিষ্ট দেহ ধ্বংস হলে তাহার আর পুনর্গমন হয় না। আত্মার যখন অস্তিত্বই নেই, তখন স্বর্গ, মোক্ষ, পরলোক, পুনর্জন্ম, কর্মফল কিছুই নেই। আত্মা দেহ হতে কোনো আলাদা সত্তা নয়। তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চার্বাক বলেনÑ গুড়, চাল ইত্যাদিতে পৃথক পৃথকভাবে মাদকতা নেই, কিন্তু সেইগুলোর সংযোগে যখন মদ প্রস্তুত হয়, তখন মাদকতা গুণ দেখা দেয়। তেমনি মাটি, জল, আগুন ও বাতাস হতে যখন দেহ গঠিত হয় তখন চৈতন্য গুণের উদ্ভব হয়। উক্ত চারিভূতের কোনোটিতেই চেতনারূপ না থাকলেও ‘চারিভূতের নির্দিষ্ট পরিমাণ সংমিশ্রণের ফলে’ এই গুণটি তৈরি হতে পারে। যেমনÑ পান, সুপারি ও চুন এই তিনটি বস্তুর ভেতর কোনোটিরই লাল রং নেই। কিন্তু এই তিনটি বস্তুকে একসঙ্গে চর্বন করলে লাল রং দেখা যায়। চার্বাকগন চতুষ্টয়বাদী। তাঁরা মাটি, জল, আগুন ও বায়ু এ চার প্রকার মৌলিক পদার্থ স্বীকার করেন। এ কটি মৌলিক পদার্থ থেকেই যাবতীয় সবকিছু উৎপন্ন হয় বলে বিশ্বাস করতেন তারা। তাঁরা বলেন, এই চারটি মৌলিক পদার্থের সংমিশ্রণে দেহে চৈতন্য জন্মায়; সুতরাং চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা। শরীরটাই জীবের সর্বস্ব; তার তুষ্টি ও পুষ্টি বিধান করেই সে কৃতার্থ হয়।
চার্বাক মতে ইন্দ্রিয়জ সুখই মানুষের জীবনে একমাত্র কাম্য। তাই এই ইন্দ্রিয়-সুখই মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত। পার্থিব দুঃখই নরক। মৃত্যুতেই সবকিছুর সমাপ্তি ঘটে। মৃত্যুর পর শরীর ও চৈতন্য কোনোটিই থাকে না। পরম আনন্দে জীবন উপভোগ করার জন্য তাঁরা সবাইকে উপদেশ দিতেন।
পশুবলির মতো অমানবিক কাজের তীব্র সমালোচনা করতে গিয়ে চার্বাকরা বলেন, মূর্খরা মনে করে যে, যজ্ঞে পশুবলি দিলে, সেই পশু স্বর্গে যায়। যদি মূর্খরা সত্যই ইহা বিশ্বাস করে তবে যজ্ঞে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বলি দেয় না কেন? আর শ্রাদ্ধ করলে যদি মৃতের পরিতৃপ্তি হয়; তাহলে বিদেশে যেতে মানুষ আহার সঙ্গে নিয়ে যায় কেন? বাড়িতে তার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিকে খাওয়ালে তো প্রবাসীর তৃপ্তি হওয়ার কথা। মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ করার কোনো মানে নেই, ইহা শুধু ব্রাহ্মণদের রোজগারের পথ। চার্বাকরা আরও বলেছেন, যারা ভণ্ড, ধূর্ত, নিশাচর তারাই বেদের কর্তা। ভগবানের কাহিনি পৌরানিক গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। পরজন্মে সুখভোগের জন্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য পূজা অর্চনা করা বোকামি মাত্র। তাঁরা বলেন, ধূর্ত পুরোহিতদের বিশ্বাস করা মানুষের উচিত নয়; কারণ পুরোহিতগণ নিজেদের জীবিকা অর্জনের জন্য মানুষকে ঈশ্বরের পূজা করতে প্ররোচিত করে। বেদও এই প্রতারক পুরোহিতদের সৃষ্টি। সুতরাং বেদকে বিশ্বাস করা মানুষের উচিত নয়।
চার্বাকগণ বলেন, অতীত চলে গেছে, ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত, কেবল বর্তমান মানুষের আয়ত্তে আছে। সুতরাং বর্তমান জীবনে মানুষ যে উপায়েই হোক, যত বেশি সুখ করতে পারে তা করা উচিত। দুঃখমিশ্রিত বলে বা অন্য কোনো কারণে বর্তমান সুখকে বিসর্জন দেয়া মানুষের পক্ষে মূর্খতা। চার্বাক দর্শন কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও অর্থহীন প্রচলিত রীতি-নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।
চার্বাক সেই বেদিক যুগেই বেদের অলীক কল্পনার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিলেন, তবে বিশাল আকার ধারণ করা সম্ভব হয়নি, আবার নির্মূল হয়েও যায়নি। বস্তুত চার্বকীয় মতবাদ ছিল অভিজ্ঞতাভিত্তিক, যা পরবর্তীকালে আধুনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদের ভিত্তিরূপে স্বীকৃত। বর্তমান বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিরা কার্যত চার্বাকীয় মতবাদের অনুসারী। তাই দেখা যায় পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য সমাজে চার্বাকপন্থী আন্দোলন।
ধর্ম নামক ভণ্ডামির ফাঁস প্রাচীন যুগেই হয়ে গিয়েছিল চার্বাক দর্শনের মাধ্যমে। কিন্তু এই দর্শন পরবর্তীকালে ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছেÑ তখনকার শিক্ষা-দীক্ষা ব্রাহ্মণদের হাতেই ছিল। সমাজের বেশিরভাগ মানুষই শিক্ষার বাইরে ছিল। ব্রাহ্মণরা যা বুঝিয়েছে, তাই বুঝেছে সাধারণ মানুষ। চার্বাক মতের সারমর্ম তারা বুঝতে পারেনি।
বৌদ্ধ ধর্ম চার্বাক দর্শনের সাহায্যে অগ্রসর হয়। বৌদ্ধরা বলেন যে, এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা কেহ নাই; জগত অনন্তকাল বিদ্যমান আছে এবং থাকিবে। চিরকালই বিশ্বের আকৃতি একরূপ আছে এবং থাকিবে। ক্রমানুসারে প্রাণীসমূহ সংসারে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে মাত্র। বৌদ্ধরা পরকাল বা স্বর্গ-নরকের অস্তিত্বও স্বীকার করেন না। বৌদ্ধ ধর্ম মতে, জীব কামনাবশে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে এবং জন্মে জন্মে রোগ, শোক ও নানাবিধ দুঃখ ভোগ করে থাকে। সংসারের নানান দুঃখ ভোগের চিরসমাপ্তির উপায় হইল জন্ম না লওয়া। যতদিন মানুষের মনে কোনোরূপ কামনা-বাসনার লেশমাত্র থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষ পুনঃ পুনঃ জন্মলাভ ও সুখ-দুঃখ ভোগ করিতে থাকবে। বিত্ত-সম্পদ ও আত্মজনাদি যাবতীয় বিষয়ের তাবৎ কামনা হতে মুক্ত হতে পারলে তার আর পনর্জন্ম হয় না। এমতাবস্থাকে বলা হয় মোক্ষ এবং জন্মহিতাবস্থাকে বলা হয় নির্বাণ। অর্থাৎ বুদ্ধ ধর্মের মূল বিশ্বাসে চার্বাক ধর্ম বিশ্বাস-এর ধারাবাহিকতা দেখা যায়।
০৯৪ ▌কমিউনিজম :
যেমনি প্রাচিন গ্রীসে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শত থেকে ৬০০ শত শতাব্দীর মধ্যে ঘটে যায় এক নতুন সভ্যতার বিপ্লব। জন্ম নেন দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টোটল, ঈশপ, ডেমোক্রেটাস ক্লাইদিনেসসহ অসংখ্য দার্শনিক। তাঁদের সবারই লেখনে-বলনে ফুটে উঠেছে গণতন্ত্রের কথা। কিন্তু‘ প্লেটো তাঁর রিপাবলিক নমে বই লিখে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বা রূপরেখা প্রণয়ন করেন। ঠিক তেমনি ১৪০০ সালের পর থেকে একে একে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে জন্ম নিতে থাকেন অসংখ্য বুদ্ধিজিবী তথা কবি সাহিত্যিক দার্শনিক,বিজ্ঞানী, শিল্পী এবং স্থপতি। যেমন: জার্মানী দার্শনিক হেগেল, ফয়েরবাখ, কান্তা, গোটে, শেলি, কার্লমার্কস, এঙ্গেলস, বিজ্ঞানী কেপলার, ফরাসি দার্শনিক, রুশো, কোঁতসহ অনেকে। সেই যুগ বা সময়টাকে ইতিহাস রেনেসাঁর যুগ বা নবজাগরণের যুগ বলে।
৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় পার্লামেন্টের ডানদিকে বসতেন শাসকদল এবং সভাপতির বাঁ পাশের আসনগুলোয় বসতেন বিরোধীদল। বাঁ দিকে বসার জন্য তাদের বলা হতো বামপন্থী। পরবর্তীকালে সমাজতন্ত্রীদেরই সাধারণভাবে বামপন্থী বলা শুরু হয়। কিন্তু‘ প্রশ্ন হচ্ছে মার্কসপন্থী বা কমিউনিস্টদের কেনো বামপন্থী বলা হয়?
জার্মান দার্শনিক হেগেলের মৃত্যুর পর হেগেলের সমর্থকগণ ডানপন্থী ও বামপন্থী এই দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। হেগেলের দর্শন আলোচনায় ঈশ্বর, অমরত্ব এসব ব্যাপারে কোনো ¯পষ্ট মত না থাকার কারণে এসব নিয়ে বিতর্ক জোরালো হতে থাকে। একদিকে ডানপন্থী হেগেলীয়রা হেগেলের ভাববাদের আলোকে ঈশ্বর অমরত্ব এসবের আরো গ্রহযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন। আবার অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত তরুণ হেগেলীয় সমর্থকগণ হেগেলের-দর্শনের রক্ষণশীল দিকটি প্রত্যাখ্যান করেন এবং দ্বান্দ্বিক দিকটি তাদের কর্ম ও প্রেরণার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন।
ফলে দু’দলের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে। আর এই বিরোধের জের ধরে হেগেলীয়দের একটি অংশ রক্ষণশীল বুর্জোয়া শ্রেণি ত্যাগ করে অপেক্ষাকৃত তরুণ বামপন্থী হেগেলীয়দের পক্ষাবলম্বন করে। এই দল ছিলো মনেপ্রাণে বাস্তুবাদী। আর এই দলের একজন অগ্রনায়ক ছিলেন ফয়েরবাখ। যিনি হেগেলীয় ভাববাদের স্থলে যান্ত্রিক বস্তুবাদ মতের অবতারণা করেন।
অন্যান্য দার্শনিকের মতো কার্ল মার্কসও ছিলেন স¤পূর্ণ হেগেল দ্বারা প্রভাবিত। কার্ল মার্কস ফয়েরবাখের যান্ত্রিক বস্তুবাদকে প্রায়োগিক দিকে গতিশীল করতে সচেষ্ট হোন। তিনি ভাববাদের মতানুসারে মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতিকে পরিত্যাগ করে মানুষের কর্মের উপর জোরারোপ করেন।
মার্কস ধর্মের ঈশ্বর এবং পরকাল তত্ত্বকে অস্বীকার করেন। গতানুগতিক ধর্ম ব্যবস্থার প্রতিও মার্কসের ধারণা ছিলো বিরূপ। সে সময়ে মার্কসের ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন এঙ্গেলস। মার্কস ও এঙ্গেলস -এর তত্ত্বই লেনিন-এর হাত ধরে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে যোগ হয়। আর এভাবেই হেগেলের দর্শনের বাম হাত বলে খ্যাত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের হাত করে বামপন্থী মতাদর্শের ভিত্তিমূল স্থাপন করেন।
তখন ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এই শ্লোগানের মাধ্যমে দেশে দেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে স্বশস্ত্র বিপ্লব শুরু হতে লাগলো। সেই সময় জন্ম নিলেন বেশ কয়জন কালজয়ী বিপ্লবী নেতা। লেনিন, স্টালিন স্ট্রুটস্কোভ, মাও, চেগুয়েভারা, কাস্ত্রো, কিম জন ইল, হোচিমিনসহ অনেকে। এই বিপ্লবীরা গণতন্ত্রের বিকল্প রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং সামাজিক একটা জীবন ব্যবস্থার জন্য লড়াই শুরু করেন। তাদের দর্শন হলোÑ মিল কারখানা প্রাকৃতিক স¤পদ সবকিছু থাকবে রাষ্ট্র মালিকানায়।
পাবলিকের যার যা কিছু লাগবে, অন্ন বস্ত্র বাসস্থান কর্মস্থান, শিক্ষা শান্তি, প্রগতি সবকিছু সমবায় ভিত্তিতে প্রয়োজনানুসারে সুসমবণ্টন হবে সবার মাঝে। থাকবে না সমাজে কেনো শ্রেণিবৈষম্য। এমনকি শিক্ষায়-দীক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে শোসিত জনগণই রাষ্টক্ষমতা পরিচালনা করবে। সাম্যমৈত্রির ভিত্তিতে সুন্দর শোষণহীন ঝগড়া বিবাদহীন এক সমাজ ব্যবস্থা।
এই সমাজতন্ত্র হলো দু ধরনের : একটা হলো কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র, আরেকটা হলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র।
কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র হলোÑ পূর্ণ সমাজতন্ত্র কায়েম করা যাক আর না যাক, যতোটুকু সম্ভব শ্রমজীবী মানুষের মঙ্গল করা হবে। কার্লমাক্সের জন্মের আগেও রাজনীতিবীদরা কল্পলৌকিক ব্যবস্থার কথা শুধু মুখে মুখে বলে বেড়াতো। হলে হলো, না হলে কি যায় আসেÑ এমন আর কি।
মার্ক্স -এর দর্শনের প্রধানত দু’টি দিক- একটি বস্তুবাদ এবং অন্যটি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। এই দু’য়ের সংমিশ্রণে তাঁর দর্শন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। হেগেল যেটি দেখিয়েছেন যে, প্রকৃতির মাঝে সবসময় একপ্রকার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের কারণে প্রতিটি বস্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালেও মানব জাতির মাঝে একই রকমের দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়।
মার্ক্স হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিকে বস্তুবাদের উপর দাঁড় করিয়ে দেখলেন যে আজ পর্যন্ত যতো সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। ডারউইন তার বিবর্তনবাদে যেমন দেখালেন যে প্রকৃতিতে সব সময় বিবর্তন হচ্ছে এবং যোগ্যতমরাই টিকে থাকছে, সে রকম মার্ক্সও দেখলেন যে মানব সমাজে সর্বত্র অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম চলছে এবং একটি সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে তার উপর আরেকটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। প্রাচীন রোমান যুগে ছিলো দাসভিত্তিক সমাজ। পরে মধ্যযুগে সেটা ভেঙ্গে হয় সামন্তপ্রথা সমাজ। সামন্তপ্রথা হচ্ছে আমাদের জমিদারী প্রথার মতো একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে মধ্যযুগে এই সামন্তপ্রথার সমাজই ছিলো। আধুনিক যুগে সেই সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে হল বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা।
আধুনিক এই বুর্জোয়া সমাজের বৈশিষ্ট্য কি? ব্যক্তিস্বাধীনতা, অবাধ বাণিজ্য, ব্যক্তিমালিকানা, পুঁজিবাদ। এই পুঁজিবাদী সমাজের মুল দ্বন্দ্ব হলো পুঁজি এবং শ্রমের দ্বন্দ্ব। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির নিয়ম অনুসারে এই পুঁজি এবং শ্রম একত্রে অবস্থান করতে পারে না। তারা একে অপরকে উচ্ছেদ করতে চায়। পুঁজির কাজ হলো শ্রমকে শোষণ করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। শ্রমিকশ্রেণি যখনি এই পুঁজিকে উচ্ছেদের মতো শক্তি অর্জন করবে তখন পুঁজির পতন অনিবার্য। এই হলো স্বল্প কথায় মার্ক্স-এর মূল তত্ত্ব।
আজ সমাজতান্ত্রিক সমাজ কোথাও নেই। কিউবা সমাজতন্ত্রী নয়, ভেনিজুয়েলা সমাজতন্ত্রী নয়, ভিয়েতনাম সমাজতন্ত্রী নয়, চীন সমাজতন্ত্রী নয়, লিবিয়া সমাজতন্ত্রী নয়, উত্তর কোরিয়া সমাজতন্ত্রী নয় । তারা সমাজতন্ত্রের কিছু কিছু বিষয় অনুসরণ করে। প্রকৃত সত্য হলো পৃথিবীতে বর্তমানে কোনো সমাজতন্ত্রী সমাজ নেই। তারা হলো সংশোধনবাদী। সমাজতান্ত্রিক সমাজ হলো শ্রমিকশ্রেণি কর্তৃক দখল ও নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থা। যেখানে শ্রমিকশ্রেণি শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, যা শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে পুনর্গঠিত হবে। সকল প্রকার নিপীড়ন ও শোষণের অবসান হবে। কেহ ধনী আর কেহ গরীব থাকবে না। জাতিগত, গোষ্ঠীগত ও লিঙ্গগত বৈষম্য থাকবে না। থাকবে না তরুণ ও যুব সমাজের অপব্যবহার। এক দলের উপর আর এক দলের কোনো প্রকার প্রভুত্ব করার সুযোগ থাকবে না। সাম্যবাদী সমাজে মানুষ নিজেকে একা বা এককভাবে বিবেচনা করবে না। সাম্যবাদ হলো সামগ্রীকতা, সকলের অংশগ্রহণে সকলের জন্য কল্যাণ। সাম্যবাদে কোনো প্রকার ব্যক্তিগত স¤পত্তি থাকবে না। মার্ক্সের ভাষ্য হলো, “ সামর্থানুসারে কাজ করবে এবং চাহিদানুসারে পাবে”। মানুষের কাজকর্ম মানব সেবার চেতনায় পরিচালিত হবে।
০৯৫ ▌প্রকৃতিবাদ :
(Naturism) হচ্ছে এক ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। এই আন্দোলন সর্বসমক্ষে ও প্রকাশ্যে নগ্নতাকে সমর্থন জানায় এবং তার সপক্ষে মতপ্রকাশ করে। তাঁরা এমন এক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চান যেখানে মানুষে নগ্ন মানুষের সাহচর্যে অথবা অন্যান্য নগ্নতাবাদী বা সাধারণ মানুষের সামনে নগ্ন হয়ে থাকতে অস্বস্তিবোধ করবে না।
নগ্নতাবাদীদের দর্শন বিভিন্ন সূত্র থেকে আগত। এই দর্শনের অনেকগুলো এসেছে স্বাস্থ্য ও শারীরিক সামর্থ্য সংক্রান্ত, যা এসেছে বিশ শতকের জার্মানি থেকে। এর পেছনে আছে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার ধারণা। এছাড়া সাম্যতার সৃষ্টিও এর পেছনে একটি স্পৃহা হিসেবে কাজ করেছে। জার্মানি থেকে পরবর্তীতে এই ধারণা ইংল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে বিস্তার লাভ করে এবং বিভিন্ন নেটওয়ার্ক ক্লাব তৈরি হয়। জার্মান নগ্নতাবাদীদের সংগঠনগুলো জার্মানিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে ও বিনোদনমূলক খেলাধুলায় নগ্নতার প্রসারে কাজ করছে। এ কাজের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে তারা জার্মান অলিম্পিক স্পোর্টস ফেডারেশনের সদস্যপদ লাভ করেছে। ফরাসিরা নগ্নতাবাদের প্রসারে দীর্ঘমেয়াদি ছুটিতে নগ্নতা উপভোগের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট স্থানে বড় কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছে। এই ধারণা পরবর্তীতে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রেও প্রসারিত হয়েছে। এছাড়া নগ্নতাবাদী পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন দেশে পর্যটনকেন্দ্র ও ন্যুড ভিলেজ তৈরি হয়েছে। এই ধারণাটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ক্যারিবীয় অঞ্চলে।
বিশ্বে বহু দেশ আছে যেখানে নগ্ন সৈকতগুলোতে, বা অন্য কিছু স্থানে প্রকাশ্য নগ্নতাকে বৈধ ধরা হয়। নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন, আদিম মানুষ ৭২,০০০ বছর আগেই মানব সমাজে নগ্নতা নিবারণের জন্য পশুর চামড়া, গাছের আশ-বাকলের ব্যবহার শুরু করে।
‘প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় খেলাধুলা ও সংস্কৃতির জগতে পূর্ণবয়স্ক বালক, নারী ও বালিকাদের নগ্নতাও প্রশংসা পেত। গ্রিকদের সৌন্দর্য চেতনায় প্রকৃতি, দর্শন ও শিল্পের পাশাপাশি মানবদেহেরও বিশেষ স্থান ছিল। গ্রিক শব্দ জিমন্যাসিয়াম কথাটির অর্থ ছিল ‘যেখানে নগ্ন অবস্থায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়’। পুরুষ খেলোয়াড়রা নগ্ন অবস্থায় সে যুগে অধিকাংশ নগররাষ্ট্রে নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, এমনকি দর্শকাসনে উপস্থিত থাকত। রোমানরা গ্রিক সংস্কৃতির অনেক রীতিনীতি গ্রহণ করলেও, নগ্নতা সম্পর্কে তাদের মানসিকতা পৃথক ছিল। সাধারণ স্নানাগার বা সাধারণ শৌচাগার ছাড়া অন্যত্র নগ্নতাকে অনুচিত আখ্যা দেওয়া হতো রোমান সাম্রাজ্যে।
খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্ম রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষিত হলে গ্লাডিয়েটর ক্রীড়া ধীরে ধীরে উঠে যায় এবং প্রাপ্তবয়স্কদের নগ্নতা পাপের পর্যায়ে পর্যবসিত হয়। খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি প্রথায় পরিণত হয়। যদিও অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপে খ্রিস্টানরা নগ্ন অবস্থায় ব্যাপ্টাইজড হতেন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে সেন্ট বেনেডিক্ট অফ নার্সিয়া তাঁর নিয়মাবলিতে সন্ন্যাসীদের তাঁদের ডরমিটরিতে সম্পূর্ণ পোশাক পরিহিত অবস্থায় ঘুমানোর পরামর্শ দেন।
নগ্ন ফটোগ্রাফি হলো নগ্ন দেহের শৈল্পিক প্রদর্শন। এখানে মানবদেহের রেখা ও রূপই প্রধান উদ্দেশ্য। অনেক ফটোগ্রাফারই একটি আর্ট ন্যুড ফটোগ্রাফকে ব্যক্তির বদলে মানবদেহের পাঠ মনে করেন। ব্যক্তির ফটোগ্রাফ, যেখানে তাঁকে চেনার উপায় থাকে, তাকে পোর্ট্রেট বলা চলে।
এক জরিপে দেখা যায়, ৩৯% কানাডীয় ঘরে নগ্ন অবস্থায় হাঁটাচলা করেন, এবং ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় এই হার ৫১%। সামাজিক নগ্নতাবাদ হচ্ছে সামাজিক প্রেক্ষাপটে নগ্নতার প্রসার। এটি হতে পারে বাসায় বন্ধুদের নিয়ে একটি নগ্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে।
নগ্ন চিত্র ও নগ্ন ভাস্কর্যকর্মের শুরু প্রাচীন গ্রিসে। প্রাচীন নন্দনতত্ত্বের একটি নিদর্শন হচ্ছে ভেনাস অফ উইলেনডর্ফ। এটি একটি ছোট নারী ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটির স্তন, পেট থেকে শুরু করে সারা শরীর স্থূলকায়। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রিহিস্টোরি ডিপার্টমেন্ট-এর জিল কুক বলেন, ভেনাস আসলে একটি মধ্যবয়স্কা মোটা নারীর অবয়ব। এর মাধ্যমে আসলে প্রাচীন মানুষের যৌন আকাঙ্খার ধরণ নিয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
পরবর্তী >>