ইতিহাস-১০১ ▌আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান:
তিনি ৬৮৫ সালে উমাইয়া বংশের পঞ্চম খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। পি. কে. হিট্টি আবদুল মালিকের রাজত্বকাল স¤পর্কে বলেন, "আব্দুল মালিকের সময় দামেস্কের এই রাজবংশ শৌর্যবীর্য ও গৌরবের চরম শিখরে আরোহণ করে।"তিনি ৬৮৭ সালে আল মুখতারের বিদ্রোহ দমনের মাধ্যমে অনারব মুসলমান ও ইরাকবাসী আরব মুসলমানদের বিদ্রোহ দমন করেন। ৬৮৯ সালে আমর বিন সাঈদ নিজেকে খলিফা হিসেবে দাবী করলে তিনি তাকে কৌশলে রাজপ্রাসাদে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীতে তিনি মুসয়াব, আবদুল্লাহ বিন যোবায়ের ও খারেজীদের বিদ্রোহ দমন করেন। তারপর তিনি উমাইয়া বংশের হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। রোমান সাম্রাজ্যের আর্মেনিয়া,সাইপ্রাস ও এশিয়া মাইনরের বিস্তৃত অঞ্চল অধিকার করেন। তিনি প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবী ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেন এবং প্রথমবারের মত মুসলিম বিশ্বে আরবী মুদ্রা চালু করেন।
ইতিহাস-১০২ ▌আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান:
৬৮৫ সালে আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর মক্কা দখলের উদ্দেশ্যে এবং আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রা.-কে হত্যার জন্য চল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে পাঠালেন। হাজ্জাজ নির্মমভাবে তাঁকে শূলে ছড়িয়ে হত্যা করে। প্রায় ১২ বছর প্রসিদ্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের মক্কার খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পি. কে. হিট্টি আবদুল মালিকের রাজত্বকাল স¤পর্কে বলেন, "আব্দুল মালিকের সময় দামেস্কের এই রাজবংশ শৌর্যবীর্য ও গৌরবের চরম শিখরে আরোহণ করে।"তিনি ৬৮৭ সালে অনারব মুসলমান ও ইরাকবাসী আরব মুসলমানদের বিদ্রোহ দমন করেন। তারপর তিনি উমাইয়া বংশের হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। রোমান সাম্রাজ্যের আর্মেনিয়া,সাইপ্রাস ও এশিয়া মাইনরের বিস্তৃত অঞ্চল অধিকার করেন। তিনি প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে আরবী ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেন এবং প্রথমবারের মত মুসলিম বিশ্বে আরবী মুদ্রা চালু করেন।
ইতিহাস-১০৩ ▌ আল ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক:
(৬৬৮-২৩ ফেব্রুয়ারি ৭১৫) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি খলিফার পদে আসীন ছিলেন। তার শাসনামলে খিলাফত তার বৃহৎ বিস্তৃত প্রত্যক্ষ করে। এসময় মাওয়ারান নহর, সিন্ধু, হি¯পানিয়া ও বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালানো হয়। আল ওয়ালিদের খিলাফতকালে সেনাপতি কুতাইবা ইবনে মুসলিমের নেতৃত্বে মুসলিমরা সেন্ট্রাল এশিয়ার বিস্তৃত অংশ জয় করেছিলেন। আল ওয়ালিদ পিতা আব্দুল মালিকের মতো যোগ্যতাস¤পন্ন ছিলেন না। তার রাজত্বকালে মূলত মুসলিম বিশ্ব হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দ্বারাই শাসিত হয়েছে। হাজ্জাজ খুবই অত্যাচারী ও কঠোর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তার সময়ে ভারতবর্ষে মুসলিম বাহিনী পোঁছে যায়। আর এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তারই ভাতিজা ও মেয়ের জামাই মুহাম্মদ বিন কাসিম। হাজ্জাজের কঠোরতাকে পছন্দ করতেন না উমাইয়া শাসক আল ওয়ালিদের ভাই সুলাইমান। ৭১৪ সালে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইন্তেকাল করেন।
ইতিহাস-১০৪ ▌ মুসলিমদের আন্দালুস অভিযান:
৬৯৮ সালে মুসা বিন নুসায়েরকে ইফরিকিয়ার (লিবিয়া ও আলজেরিয়ার অংশবিশেষ) গভর্নর বানানো হলো। মুসা বিন নুসায়ের তার সেরা সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদকে পাঠালেন হি¯প্যানিয়া জয় করতে। তিনি ৭,০০০ সৈন্য নিয়ে মুখোমুখি হলেন প্রায় এক লক্ষ সৈন্য। এমন সময় তারিক আদেশ দিলেন পিছনে থাকা নিজেদের জাহাজ পুড়িয়ে দিতে। তারিক বিন জিয়াদ সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বিখ্যাত ভাষণ দিলেন। “হে আমার সৈন্যরা, তোমাদের পিছনে সাগর, সামনে শত্রু। আর জীবন বাঁচানোর জন্য তোমাদের কাছে রয়েছে শুধু তলোয়ার।... ”তারিকের ভাষণ শুনে উজ্জীবিত সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়লো বিশাল বাহিনীর উপর। সে বাহিনীতে ছিল সামন্ত রাজাদের লোক, নিজেদের সুরক্ষিত শহর ছেড়ে এই প্রান্তরে যুদ্ধ করতে এসে যারপরনাই বিরক্ত। এই সুযোগটাই কাজে লাগালো মুসলিমরা। অসাধারণ রণকৌশলে হি¯প্যানিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হলো মুসলিম শাসন।
ইতিহাস-১০৫ ▌আল-ওয়ালিদের রাজ্য বিস্তার:
আল-ওয়ালিদ ছিলেন খলীফা আব্দুল মালিকের জ্যেষ্ঠ্য পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে আল-ওয়ালিদ দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তার ধর্মপ্রাণ চাচাতো ভাই ওমর বিন আব্দুল আযীজকে হেজাযের গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ করেন। গৃহযুদ্ধের সময় মক্কা ও মদীনায় যে ক্ষতি সাধিতহয়েছিলো তিনি তা পূরণে অগ্রগামী হন। তিনি উভয় শহরে ব্যাপক সংস্কার সাধন ও বহু অট্টালিকা, প্রাসাদ নির্মাণ করেন। মসজিদে নববী সম্প্রসারণ করেন এবং পবিত্র কাবা ঘর পুণঃনির্মাণ করেন। তার সময়ে মধ্য এশিয়া, সিন্ধু, স্পেন মুসলিম পদানত হয়। স্পেন বিজয়ের ফলে সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহুদী ও খ্রিস্টানগণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বীকৃত হয়। মুুসলিম বিজয়ের পর যাজক শ্রেণির শোষণের হাত থেকে স্পেনীয়রা মুক্তি পায়। তিনি ভূ-মধ্যসাগরে বাইজানটাইনদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান এবং নৌবহরের সাহায্যে মেজর্কা, মাইনরকা, ইভিকা প্রভৃতি ভূ-মধ্যসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ দখল করেন। আল-ওয়ালিদ ছিলেন উমাইয়া বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ খলীফা যার রাজত্বকাল ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসেবে খ্যাত।
ইতিহাস-১০৬ ▌ সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক:
তিনি ৭১৫ থেকে ৭১৭ সাল পর্যন্ত খলিফার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের ছোট ভাই। সুলাইমান ক্ষমতায় এসে যারা হাজ্জাজের সহযোগী ছিলো তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। হাজ্জাজের শাস্তি তার আত্মীয় ও তার কাছের লোকদের দিয়েছেন। সেই হিসেবে সুলাইমান মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ভারত থেকে ডেকে পাঠান এবং নানান অত্যাচারের অভিযোগ এনে মৃত্যুদ-ের শাস্তি দেন। সুলাইমানের চাচাতো ভাই উমার বিন আব্দুল আজিজ (দ্বিতীয় উমার) এই মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং তা রহিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সফল হননি। ৭১৫ সালে মুহাম্মদ বিন কাসিম খুন হন। এই খুন সুলাইমানের বিরুদ্ধে সবাইকে উত্তেজিত করে। হাজ্জাজের পক্ষ থেকে সুবিধাভোগীরা সুলাইমানকে হত্যা করে এবং বিখ্যাত ইসলামী স্কলার ও মদিনার গভর্ণর উমার বিন আব্দুল আজিজকে ক্ষমতায় আসার জন্য আহ্বান করেন।
ইতিহাস-১০৭ ▌ দ্বিতীয় ওমর:
৭১৭ খৃষ্টাব্দে খলিফা সুলায়মানের মৃত্যুর পর তার চাচাত ভাই ওমর বিন আব্দুল আজীজ খিলাফত লাভ করেন। খুলাফায়ে রাশেদিন এর চার খলিফার সাথে তুলনা করতে গিয়ে অনেকে তাকে ইসলামের পঞ্চম খলিফা বলে থাকেন। হজরত ওমরের সাথে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মিল থাকায় ওমর বিন আব্দুল আজীজ ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় ওমর হিসেবে পরিচিত। তাকে ইসলামের প্রথম মুজাদ্দিদ বলে গণ্য করা হয়। অনাচার, অধর্ম, বর্বরতা, ষড়যন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, বিলাসিতা যখন উমাইয়া খিলাফতে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল সে সময় তিনি শাসনভার গ্রহণ করেন। প্রশাসক হিসেবে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন। কেননা খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বে তিনি হেজাজের শাসনকর্তা ছিলেন। এ সময় তিনি ন্যায়পরায়ণতা, সরলতা, চারিত্রিক মাধুর্য, ধর্মপরায়ণতা ও প্রজাবাৎসল্য দ্বারা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সার্বজনীন মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি নিরপেক্ষ শাসননীতি প্রবর্তন করেন।
ইতিহাস-১০৮ ▌ উমর ইবনে আব্দুল আযীয (র.) এর শাসননীতি:
উমর ইবনে আব্দুল আযীয (র.) ছিলেন মারওয়ানের দৌহিত্র। তিনি ছিলেন খলীফা আব্দুল মালিকের ভাই ও মিসরের শাসনকর্তা আব্দুল আযীযের পুত্র। তিনি আব্দুল মালিকের কন্যা ফাতিমাকে বিয়ে করেন। খলীফা আল-ওয়ালিদের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই সুলাইমান খলীফা হন। তিনি মাত্র ২ বছর ৮ মাস রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তিনি তাঁর চাচাতো ভাই উমর ইবনে আব্দুল আযীযকে পরবর্তী খলীফা হিসেবে নির্বাচিত করেন। ৭১৭ খি. উমর ইবনে আব্দুল আযীয দামেস্কের সিংহাসণ আরোহণ করেন। ইতিহাসে তিনি ২য় উমর হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। রাজ্য জয়ের পরিবর্তে তাঁর সা¤্রাজ্যে বসবাসকারী প্রজাদের কল্যাণসাধনকেই তিনি তার পরম দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি শাসনকার্যে ন্যায়পরায়ণ, সৎ ও বিশ্বস্ত লোককে নিয়োগ করেছিলেন। খিলাফত লাভের পর তার সকল সম্পত্তি রাজকোষে জমা করেন। তিনি খোলাফায়ে রাশিদীনের নীতি অনুসরণ করে দৈনন্দিন জীবন যাপন করতেন। তিনি বায়তুল মালকে জনগণের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। শাসন ক্ষেত্রে তিনি মজলিস-আল-শুরা অনুসরণ করতেন যা তার পূর্বসূরীরা স্থগিত করেছিল। অমুসলিমগণ তাঁর সময়ে রাজকার্যে নিয়োগ পেতেন। তিনি খ্রিস্টান ও ইহুদীদের গীর্জা ও উপাসনালয় তাদের নিকট হস্তান্তর করেন।
ইতিহাস-১০৯ ▌ইয়াজিদ বিন আবদুল মালিক বা দ্বিতীয় ইয়াজিদ:
ছিলেন একজন উমাইয়া খলিফা। দ্বিতীয় উমরের মৃত্যুর পর তিনি ৭২০ থেকে ৭২৪ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খলিফা হিসেবে আসীন ছিলেন। উমর খারেজিদের সাথে আলোচনা করলেও তিনি তাদের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। ইয়াজিদ বিজয় লাভ করে এবং খারেজিদের নেতা শাওদাব নিহত হয়। মদিনার গভর্নর আবদুর রহমান ইবনে দাহহাক একজন নারীকে জোরপূর্বক বিয়ে করতে বাধ্য করলে সে নারী ইয়াজিদের কাছে অভিযোগ করেন। ইয়াজিদ আবদুল রহমানকে সরিয়ে আবদুল ওয়ালিদ ইবনে আবদাল্লাহকে তার স্থলে বসান। দ্বিতীয় ইয়াজিদ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওয়ালিদ ইবনে ইয়াজিদ বা দ্বিতীয় ওয়ালিদ: তিনি ৭৪৩ থেকে ৭৪৪ সাল পর্যন্তশাসন করেন। তার চাচা হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের উত্তরসুরি হিসেবে তিনি খলিফার পদে আসীন হন। ইয়াজিদ ইবনে ওয়ালিদ বা তৃতীয় ইয়াজিদ: তিনি ৭৪৪ সালে মাত্র ৬ মাস শাসন করেন। এসময় তার মৃত্যু হয়।
ইতিহাস-১১০ ▌ইহিশামের শাসন ব্যবস্থা:
খলীফা আব্দুল মালিকের চতুর্থ পুত্র ছিলেন হিশাম। ৭২৪ খ্রি: দুর্বল শাসক দ্বিতীয় ইয়াযিদের মৃত্যুর পর হিশাম দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন উমাইয়া বংশের সর্বশেষ কর্মদক্ষ খলীফা। এই সময় উমাইয়া ও হাশিমী দ্বন্দ্ব, খারিজী বিদ্রোহ, বার্বার ও রোমানদের হুমকি এবং সর্বোপরি আব্বাসীয় আন্দোলন উমাইয়া খিলাফতকে সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। এসকল সংকট নিরসন করে উমাইয়া হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধার করতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। খলীফা হিশাম ২০ বছর রাজত্ব করেন। এই সময়ে আব্বাসীয়গণ উমাইয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। আবু মুসলিম খোরাসানী নামক এক ইস্পাহানবাসী হযরত আব্বাস (রা.) এর বংশধর-এর পক্ষে খোরাসান অঞ্চলে প্রচারণা শুরু করেন। অন্যদিকে খলীফা হিশাম প্রজাদের উপর বাড়তি কর আরোপ করেন। এর ফলে জনগণ অসন্তুষ্ট হয় এবং আব্বাসীয় আন্দোলন দ্রুত প্রসার লাভ করে।
ইতিহাস-১১১ ▌ইবরাহিম ইবনুল ওয়ালিদ:
একজন উমাইয়া খলিফা ও খলিফা প্রথম ওয়ালিদের পুত্র। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পূর্বে ৭৪৪ সালে তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য শাসন করেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভয়ে তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। শাসনকালের স্বল্পতা ও সর্বজন মান্যতার অভাবের কারণে মুহাম্মদ ইবনে জারির আল তাবারি তাকে খলিফা হিসেবে অসফল বলে উল্লেখ করেছেন। ইবরাহিম তার ভাই খলিফা তৃতীয় ইয়াজিদ কর্তৃক উত্তরাধিকারী মনোনীত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় মারওয়ান ইয়াজিদের বিরোধিতা করেন। ৭৫০ সালে উমাইয়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মত তিনিও আব্বাসীয়দের হাতে নিহত হন। মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মারওয়ান বা দ্বিতীয় মারওয়ান: (৬৮৮-৬ আগস্ট ৭৫০) ছিলেন একজন উমাইয়া খলিফা। তিনি ৭৪৪ থেকে ৭৫০ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি দামেস্কের উমাইয়া শেষ খলিফা ছিলেন।
ইতিহাস-১১২ ▌হাদিস সংকলনের ইতিহাস:
রাসুল (সঃ) এর নবুয়াতী জীবনের সকল কথা, কাজ এবং অনুমোদনকে হাদীস বলে। রাসূলুল্লাহ (সা.) যা বলতেন, করতেন এবং যে নির্দেশই দিতেন, সাহাবিরা সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যে পরিণত করতেন; তারা মসজিদ অথবা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে একত্র হয়ে তা নিয়ে আলোচনা করতেন। সাহাবিরা এভাবে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে হাদিসের জ্ঞান লাভ করেন এবং তেমনিভাবে হাজার হাজার তাবিঈদের হাদিসের শিক্ষা দিতেন। হিজরি দ্বিতীয় শতকে প্রবীণ তাবিঈনের বর্ণিত ও লিখিত হাদিসগুলো ব্যাপকভাবে একত্র করতে থাকেন এ সময় খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রাহ.) এবং সেগুলোর একাধিক পা-ুলিপি তৈরি করে দেশের সর্বত্র পাঠিয়ে দেন। হিজরি দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধ থেকে চতুর্থ শতকের শেষ পর্যন্ত সময়কালে বোখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজার মতো সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ছয়খানি হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়।
:: আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে::
ইতিহাস-১১৩ ▌আব্বাসীয় আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ:
আব্বাসীয় খিলাফতের নামকরণ হয়েছে মহানবী (সাঃ) এর চাচা আল-আব্বাসের নাম হতে। তিনি আল-আব্বাস আব্দুল্লাহ, ফজল, উবায়দুল্লাহ ও কায়সার নামে ৪ পুত্র রেখে মৃত্যুবরণ করেন। তারা প্রত্যেকেই হযরত আলী (রা.) এর পক্ষ অবলম্বন করেন। আব্দুল্লাহ ইতিহাসে ‘ইবনে আব্বাস’ নামে পরিচিত। ৭৩৫ খ্রি: আলীর(রা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অতিশয় উচ্চাভিলাষী ‘মুহাম্মদ’ পরিবারের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনিই ছিলেন আব্বাসীয় আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি নিজেকে খিলাফতের ন্যায্য দাবিদার ভাবতেন। হযরত ফাতিমা (রা.) এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (রা.) হানাফিয়া গোত্রের জনৈকা রমণীকে বিবাহ করেন এবং মুহাম্মদ আল-হানাফীয়া তাঁর গর্ভজাত পুত্র ছিলেন। কারবালার ঘটনায় ইমাম হুসাইন (রা.) এর মৃত্যুর পর ইসলামের ধর্মীয় নেতৃত্ব ইবনুল হানাফিয়ার হাতে অর্পিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হাশিম নেতৃত্ব লাভ করেন। হাশিম তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ইবনে আব্বাসের প্রপৌত্র মুহাম্মদকে ধর্মীয় নেতৃত্ব অর্পন করেন। মুহাম্মদ তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়নের পূর্বেই ৭৪৪ খ্রি: মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তদ্বীয় ৩ পুত্র ইব্রাহিম, আবুল আব্বাস ও আবু জাফরকে পরপর তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যান। আবুল আব্বাসের বংশধরগণ ছিলেন হাশিমী গোত্রভুক্ত ও মহানবী (সাঃ) এর নিকটাত্মীয়। তাই তাদের এই আন্দোলনকে জনগণ স্বাগত জানায়। বিশেষ করে শিয়া মুসলিম ব্যাপকভাবে তাদের সমর্থন জানায়। মূলত উমাইয়া খলীফা দ্বিতীয় ইয়াজিদের সময় হতেই এই আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। এই সময় আবু মুসলিম খোরাসানী নামক আরব বংশোদ্ভূত ইস্পাহানবাসীর আবির্ভাব ঘটে, যিনি নিজেকে আব্বাসীয় প্রচার কাজে সম্পৃক্ত করেন। তিনি একজন দক্ষ সামরিক সংগঠক ও কৌশলী সেনানায়ক ছিলেন। তিনি খোরাসান অঞ্চলে আব্বাসীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন। তার তৎপরতায় খোরাসান আব্বাসী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়। খলীফা মারওয়ান তখন সিরিয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। খোরাসানের সর্বশেষ উমাইয়া গভর্ণর নসর বিন সাইয়্যার কিরমানের খারিজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগে আবু মুসলিম খোরাসানের রাজধানী মার্ভ দখল করেন (৪৭৭ খ্রি:)। খলীফা মারওয়ান আব্বাসীয় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হিসেবে ইব্রাহিমকে বন্দী ও হত্যার করে। ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর আবুল আব্বাস আস-সাফফা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। আবুল আব্বাস কুফার মসজিতে খলীফা হিসেবে ঘোষিত হন। ইরাকবাসী এতে পূর্ণ সমর্থন জানায় ও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। খলীফা দ্বিতীয় মারওয়ান তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেন আব্বাসীয়দের প্রতিহত করতে। ১,২০,০০০ সৈন্য সমেত ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী জাব নদীর তীরে কুসাফ নামক গ্রামে যুদ্ধ শুরু করেন। যুদ্ধে মারওয়ান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং নিহত হন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উমাইয়া বংশ বিলুপ্ত হয় এবং আব্বাসীয়গণ খিলাফতে অধিষ্ঠিত হন।
ইতিহাস-১১৪ ▌আব্বাসীয় খিলাফত:
আব্বাসীয়রা ৭৫০ থেকে ১২৫৮ পর্যন্ত সুদীর্ঘ কাল শাসন ক্ষমতায় ছিল। এই সময়টি ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। মুসলিম সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশে এই বংশ এক মাইলফলক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এই বংশে সর্বমোট ৩৭ জন খলীফার আবির্ভাব ঘটেছে। উমাইয়া খিলাফতকাল ছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে একক আধিপত্যের যুগ, কিন্তু আব্বাসীয় শাসনকালের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মুসলিম খিলাফত ৩টি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসীয় খিলাফত, মিসরের কায়রো কেন্দ্রিক ফাতিমীয় খিলাফত ও স্পেনের কর্ডোভা কেন্দ্রিক উমাইয়া খিলাফত। এছাড়া এই বংশের শেষ দিকে দুর্বল সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তির কারণে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের উদ্ভব ঘটে। আরবীয়দের স্থলে পারসিকদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। কেন্দ্রীয় শাসনে খলীফার পর উযির পদ্ধতির প্রথম সূচনা। বাগদাদ পরিণত হয় মুসলিম রাজনীতি, শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে। সা¤্রাজ্য বিস্তারের যুগকে পেছনে ফেলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে মুসলিমগণ এই খিলাফতের মাধ্যমে প্রবেশ করে। ৫০৮ বছর শাসন করে আব্বাসীয় খিলাফত পৃথিবী দীর্ঘস্থায়ী শাসনকালের ইতিহাস গড়ে। ১২৫৮ খ্রি: হালাকু খান কর্তৃক বর্বরোচিত আক্রমণে সর্বশেষ খলীফা আল মুসতাসিম বিল্লাহর হত্যার মধ্য দিয়ে এই খিলাফতের অবসান ঘটে।
ইতিহাস-১১৫ ▌ প্রথম আব্বাসী খলিফা আবুল আব্বাস :
উমাইয়াদের পরাজিত করে ৭৫০ সালে মুসলিম বিশ্বের নেতা বনে যায় আব্বাসীয়রা। আবুল আব্বাস প্রথম আব্বাসী খলিফা যিনি নিজেই তার নামে জুড়ে দিয়েছিলেন সাফফাহ, যার অর্থ রক্ত পিপাসু। ৭৫০ সালের ২৫ জুন আব্বাসের সেনাপতি আব্দুল্লাহ ফিলিস্তিনের আবু ফুট্রুস নামক জায়গায় উমাইয়া বংশের ৮০ জন নেতাকে এক নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান এবং সব উমাইয়া নেতাদের হত্যা করা হয়। এর কিছুদিন পর বসরায়ও একইভাবে আরো কিছু উমাইয়াদের হত্যা করা হয়। আবুল আব্বাসের পুরোটা জীবনই কেটে যায় হত্যা, গুপ্তহত্যা, বিদ্রোহ দমন করে। ৭৫৪ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন আব্বাসী খিলাফতের প্রথম এই খলিফা।
ইতিহাস-১১৬ ▌ দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর:
আবুল আব্বাসের মৃত্যুর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তার ভাই আল মনসুর। ৭৫৪-৭৭৫ তার শাসনামলে সাহিত্য ও পা-িত্যপূর্ণ কর্ম ইসলামী জগতে পূর্ণ উদ্যমে যাত্রা শুরু করে। আল মনসুরের আমলে এ অঞ্চলে ইসলামের প্রসার বৃদ্ধি পায়। তিনি নিজেও একজন বৈজ্ঞানিক। রাজকীয় কাজ থেকে সামান্য অবসর পেলেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান সাধনায় হতেন মগ্ন। তাকে বলা হয় আরবের প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী। খলিফা আল মনসুর খুবই বিদ্যোৎসাহী ও জ্ঞানী-বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপে আরব বৈজ্ঞানিকেরা গ্রিক, রোমান, আর্য প্রভৃতি মৃত সভ্যতার দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি ব্যাপকভাবে অনুবাদ শুরু করেন। অনেক বৈজ্ঞানিক তার দরবারের সভাসদ ছিলেন। এদের মধ্যে ইসহাক আল ফাজারি, ইয়াকুব ইবনে তারিক, আবু ইরাহিয়া আল বাতারিক, নও-বখত ও মাশাল্লাহ উলেখযোগ্য। তিনি ২২ বছর রাজত্ব করার পর ৬৫ বছর বয়সে ৭৭৫ খ্রি: হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় যাত্রাপথে মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-১১৭ ▌আল মনসুর এর শাসনব্যবস্থা:
আল মনসুর ছিলেন আব্বাসীয় বংশের প্রথম খলীফা আবুল আব্বাসের জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা। আবুল আব্বাস মৃত্যুর পূর্বে তাঁর ভ্রাতা তাকে সিংহাসনের জন্য মনোনীত করে যান। আবুল আব্বাস যদি আব্বাসীয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা হন তাহলে আবু জাফর আল মনসুর ছিলেন এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। । তিনি শাসন ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করেছিলেন, বিদ্রোহ দমন করেন এবং সুন্নী ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও আলী বংশীয়গণ ভবিষ্যতে খিলাফত দাবি করবে এই আশংকায় আল-মনসুর তাদেরকে নির্মূল করার নীতি গ্রহণ করেন। উমাইয়া খিলাফত পতনেরকালে মদীনায় সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হয় যে, উমাইয়াদের পতনের পর ইমাম হাসানের প্রপৌত্র মুহাম্মদ খিলাফত গ্রহণ করবেন। তখন মদিনায় ইমাম হাসান ও হুসাইনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিক কারারুদ্ধ হন। এভাবে আল মনসুর তাঁর রাজত্বকালের কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত করেন।
ইতিহাস-১১৮ ▌ মুহাম্মদ ইবনে মনসুর আল মাহদির শাসনামল:
আব্বাসীয় তৃতীয় খলিফা ছিলেন মাহদী ইবনে মনসুর। তিনি ৭৭৫-৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যস্ত শাসন করেন। তিনি তার পিতা আল মনসুরের উত্তরাধিকারী হন। শাসনপ্রণালীর ক্ষেত্রে আল-মাহদী ছিলেন তাঁর পিতার বিপরীত। তিনি শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। অযথা রক্তপাত ও কঠোরতা পরিহার করে তিনি উদার ও সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি প্রজাবৎসল ও দয়ালু ছিলেন। অনেক শিল্পী ও কবি তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তিনি সঙ্গীত ও কাব্যের বিস্তারে ভূমিকা রাখেন। ৭৭৭ সালে তিনি খোরাসানের ইউসুফ ইবনে ইবরাহিমের বিদ্রোহ দমন করেন। ৭৭৮ সালে সিরিয়ায় উমাইয়া শক্তির নেতৃত্ব দানকারী আবদুল্লাহ ইবনে মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদের বিদ্রোহ দমন করেন। আল মাহদির শাসনামলে বহুজাতিক বাগদাদ নগরী প্রাচুর্যপূর্ণ হয়ে উঠে। আরব উপদ্বীপ, ইরাক, সিরিয়া, পারস্য এবং আফগানিস্তান ও ¯েপনের মত দূরবর্তী স্থান থেকেও অভিবাসীরা আসতে থাকে। বাগদাদ মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম শহর হয়ে উঠে।
ইতিহাস-১১৯ ▌ খলিফা আল-হাদি:
পিতা আল-মাহদীর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ্য পুত্র মুসা ‘আল-হাদী’ (পথ প্রদর্শক) উপাধি নিয়ে ৭৮৫খ্রি: বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি তাঁর পিতার মনোনয়নকে অস্বীকার করেন এবংপরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর ভ্রাতা হারুনের পরিবর্তে নিজ পুত্র জাফরকে মনোনীত করেন। ৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শাসন করেন। পিতার মত তিনি উদার ছিলেন এবং নাগরিকদের বাগদাদের প্রাসাদে তার সাথে দেখা করার অনুমতি দেন। আব্বাসীয় আমলের অগ্রগতি তিনি বজায় রাখেন। তার স্বল্পকালীন শাসনে বেশ কিছু সামরিক সংঘাত ঘটে। হুসাইন ইবনে আলি ইবনে হাসান মদিনায় নিজেকে খলিফা ঘোষণা করলে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়। আল হাদি বিদ্রোহ দমন করেন। আল হাদি একটি খারিজি বিদ্রোহও দমন করেন। তাছাড়া তাকে বাইজেন্টাইন আক্রমণও প্রতিহত করতে হয়। আল হাদি ৭৮৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি তাঁর মাতার কাছে তাঁর অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং পিতার ইচ্ছানুসারে তাঁর ভ্রাতা হারুনকে পরবর্তী খলীফা হিসেবে মনোনীত করেন।
ইতিহাস-১২০ ▌ হারুন অর রশীদ:
বিশ্বের ইতিহাসে যে সকল নরপতি গৌরবের ইতিহাস রচনা করেছেন, খলীফা হারুন-অর-রশিদ তাদের মধ্যে একজন। তিনি ছিলেন রূপকথার বাগদাদ নগরীর ¯্রষ্টা। তাঁর খিলাফত আব্বাসীয় বংশকে এমনই এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল যা আর কোন শাসকের পক্ষে তেমনটি সম্ভব হয়নি। ৩৭ জন আব্বাসীয় খলীফার মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা সফল রাজনীতিবিদ, সমরনায়ক, শ্রেষ্ঠ শাসক, প্রজারঞ্জক, বিদ্যানুরাগী ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক। তিনি ছিলেন খলীফা আল-মাহদীর কনিষ্ঠ পুত্র এবং আল-হাদীর ভ্রাতা। ভ্রাতা আল-হাদীর মৃত্যুর পর ৭৮৬ খ্রি: ২৫ বছর বয়সে হারুন-অর-রশীদ বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার খিলাফতের শুরুতেই খারিজীরা বিদ্রোহ শুরু করে। খলীফা হারুন-অর-রশিদের সময় ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে কাবুল ও কান্দাহার আব্বাসীদের অধীনস্ত হয় এবং সা¤্রাজ্যের সীমানা হিন্দুকুস পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।
ইতিহাস-১২১ ▌হারুন অর রশীদ-এর শাসনামল :
আব্বাসীয় বংশের ৫ম শাসক হিসেবে ২০ বছর বয়সে খিলাফতের মসনদে আরোহণ করেন তিনি। দক্ষতার সঙ্গে ২৩ বছর শাসন করার পর ৮০৯ সালে তুস নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। হারুন অর রশীদের শাসনকালে বিজ্ঞান, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির জন্য তার শাসনকালকে আব্বাসীয় খিলাফতের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। এ সময় ইসলামী শিল্প ও সংগীতের যথেষ্ট প্রসার হয়। তিনি বাগদাদের বিখ্যাত গ্রন্থাগার বাইতুল হিকমাহ প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে বাগদাদ জ্ঞান, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। রাতে ঘুরে ঘুরে প্রজাদের অবস্থা দেখতেন। ছদ্মবেশে শহরে ঘুরতেন। নিজের শাসন অধিভুক্ত রাজ্যে কেউ অপরাধ করলে তিনি খতিয়ে দেখতেন নিজের কর্তব্যপরায়নতার জায়গা থেকে। প্রতিষ্ঠা করেছেন ইসলামের আইনে ন্যায়বিচার। তার নৈশভ্রমণ ও মানবকল্যাণের স্তুতি নিয়ে বহু আরব্য উপন্যাস রচিত হয়েছে।
ইতিহাস-১২২ ▌হারুন অর রশীদ-এর চারিত্রক বৈশিষ্ট্য:
খলীফা হারুন-অর-রশীদের চরিত্র ছিল কঠোরতা ও কোমলতার সংমিশ্রণে তৈরি। অন্যায় ও বিদ্রোহীদের প্রতি তিনি ছিলেন কঠোর, অপরদিকে অসহায় ও সম্বলহীনদের জন্য তাঁর হৃদয় ছিল কোমল। তিনি ছিলেন তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ, উদার, মহানুভব, দানবীর ও বিচক্ষণ নরপতি। তিনি প্রজাদের অবস্থা দেখার জন্য প্রত্যেক রাত্রিতে ছদ্মবেশে নগর ভ্রমণ করতেন। তিনি সীমান্ত অঞ্চল ও দুর্গ পরিদর্শন করতেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি প্রজাদের মঙ্গল সাধন করতেন। তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য বহু স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র ও সরাইখানা নির্মাণ করেন। খলীফা গরীব ও অসহায় ব্যক্তির জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন যে, “নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে দুটি বিশাল ব্যক্তিত্বশালী নৃপতির নাম দেখা যায়- পাশ্চাত্যে শার্লিমেন, আর প্রাচ্যে হারুন-অর-রশীদ, এর দুজনের মধ্যে নিঃসন্দেহে হারুন অধিকতর শক্তিশালী এবং উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী ছিলেন।”
ইতিহাস-১২৩ ▌আল আমিনের শাসনামল:
আলিফ লায়লা বা এক হাজার এক আরব্য রজনী উপাখ্যানের স্রষ্টা খলিফা হারুন অর রশিদের একাধিক পুত্র ছিল। তারা সকলেই ছিলেন সিংহাসনের দাবিদার। কিন্তু খলীফা তাঁর প্রিয়তমা পতœী জুবাইদা ও তাঁর ভ্রাতার চাপে পড়ে তাঁর জৈষ্ঠ্য পুত্র আল-আমিনকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু খলীফা হিসেবে আল-আমিন ছিলেন অযোগ্য। ৮০৯ সালে তিনি তার পিতা হারুনুর রশিদের উত্তরসুরি হন। ৮১৩ সাল পর্যন্ত তিনি শাসন করেন। ব্যক্তিগত চরিত্র, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার জন্য আল-মামুন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের ও প্রজাদের নিকট জনপ্রিয় ছিলেন। মামুন প্রাচ্যের প্রদেশসমূহে রাজ কর মওকুফ করে দেন। এতে জনগণের ওপর তিনি প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। এর ফলে মামুনের প্রতি আল-আমিনের ঈর্ষার উদ্রেক হয়। তিনিমামুনের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার উপর ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। এসময় তার ভাই আল মামুনের সাথে গৃহযুদ্ধ চলার সময় তিনি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন।
ইতিহাস-১২৪ ▌খলীফা আল-আমীন ও খলীফা আল-মামুনের মধ্যকার গৃহযুদ্ধ:
আল-আমিন ছিলেন খাঁটি আরব বংশদ্ভূত মাতা যুবাইদার পুত্র। অপরদিকে আল-মামুন ছিলেন একজন পারসিক ক্রীতদাসীর সন্তান। আল-আমিন তাঁর মাতা যুবাইদার ও মাতুল ঈসার তত্ত্বাবধানে ছিলেন এবং অপরদিকে আল-মামুন ছিলেন মাতৃহীন। আল-আমিন ছিলেন অস্থিরমতি, চঞ্চল-বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ও আমোদপ্রিয়। কিন্তু আল মামুন ছিলেন প্রজ্ঞাবান-বিচক্ষণ, দার্শনিক ও আইনজ্ঞ। পিতার ইচ্ছানুযায়ী আল-আমিন বাগদাদের সিংহাসনে বসেন এবং আল-মামুন তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু খলীফা হিসেবে আল-আমিন ছিলেন অযোগ্য যা এই গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ। আল-আমিন তাঁর আমোদ-প্রমোদ ও বিলাসবহুল জীবনে ব্যাপক অর্থ অপচয় করতে লাগলেন। প্রজাসাধারণ এই কুশাসনকে ঘৃণা করতে শুরু করলো। আল-আমিন তাঁর পিতা কর্তৃক লিখিত চুক্তিপত্রের শর্ত লংঘন করে পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর ভ্রাতা মামুনের পরিবর্তে নিজ পুত্র মুসাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
ইতিহাস-১২৫ ▌আল মামুনের শাসনামল:
আল মামুন ইবনে হারুন ৭ম আব্বাসীয় খলিফা ছিলেন ৮১৩ সাল থেকে ৮৩৩ সাল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। খলিফা আল মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় বাইতুল হিকমাহর অর্থনৈতিক সুবিধা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আল মামুনের শাসনামলে মানমন্দির স্থাপিত হয়। এসময় এই প্রতিষ্ঠানটি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আলকেমি, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ও মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানচর্চার অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্থান হয়ে উঠে। তিনি মিশর বিষয়ক গবেষণায় পিরামিডের খননে অংশ নেন। যেগেতু পারস্যরমণী মারজিলের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, সেহেতু শিয়া সম্প্রদায়ের আকুন্ঠ সমর্থন সে লাভ করেন। যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোকদের তিনি প্রশাসনে নিযুক্ত করেন। তিনি আলী পন্থীদের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করেন। আলীর বংশধরদের তিনি খিলাফতের অংশীদার করার উদ্দেশ্যে আব্বাসী বিরোধিতা সত্ত্বেও শিয়া অষ্টম ইমাম আলী আল-রিজাকে তাঁর পরবর্তী সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু ৮১৮ খ্রি: আলী আল রিযা মৃত্যুবরণ করলে তা বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়নি।
ইতিহাস-১২৬ ▌আল মুতাসিমের শাসনামল:
৮ম আব্বাসীয় খলিফা ছিলেন আল মুতাসিম। ৮৩৩ সাল থেকে ৮৪২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শাসন করেন। তিনি তার সৎভাই আল মামুনের উত্তরসুরি হন। আল মামুনের অধীনে তিনি সামরিক কমান্ডার ও গভর্নর ছিলেন। তার আমলে তুর্কি দাস সৈনিকদের সূচনা হয়। তাদের জন্য সামারায় নতুন রাজধানী স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে তুর্কিরা দ্রুত আব্বাসীয় সরকারে প্রভাবশালী হয়ে উঠে। তিনি তার পূর্বসূরি আল মামুনের মত মুতাজিলাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখেন। নিজের মতবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বা সহ আহলুস সুন্নাহর অন্যান্য আলেমদের উপর তিনি প্রচন্ড নির্যাতন চালান বলে কথিত আছে। তার সময় প্রশাসনের কেন্দ্রীকরণ, গভর্নরদের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। আল মুতাসিমের শাসনে বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তিনি ৮৪২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-১২৭ ▌ আল-ওয়াসিকের শাসনামল:
আল-ওয়াসিক ছিলেন ৯ম আব্বাসীয় খলিফা। তিনি ৮৪২ থেকে ৮৪৭ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি তার পিতা ও পূর্ববর্তী খলিফা আল মুতাসিমের স্থলাভিষিক্ত হন। আল-ওয়াসিক শাসক এবং ব্যক্তি উভয় হিসাবেই তুলনামূলকভাবে অ¯পষ্ট, এবং তার রাজত্ব মূলত তার বাবার ধারাবাহিকতা হিসাবে বিবেচিত হয়। তার শাসনামলের প্রধান ঘটনাগুলো ছিল ৮৪৫ সালে হেজাজে বেদুইন বিদ্রোহ দমন এবং ৮৪৬ সালে বাগদাদে একটি বিদ্রোহ। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল, এবং আব্বাসীয়রা এমনকি মাউরোপোটামোসে একটি উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করেছিল, কিন্তু ৮৪৫ সালে একটি যুদ্ধবিরতির পরে, বেশ কয়েক বছর ধরে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। ইতিহাসবিদ জন টার্নার-এর মতে,আল-ওয়াসিক মাঝারি উচ্চতার, সুদর্শন এবং সুগঠিত ছিল। তার রাজত্ব সংক্ষিপ্ত এবং অলক্ষণীয় ছিল, আল-ওয়াসিককে "তার বাবার বিশ্বস্ত এজেন্টের ভূমিকায়" দেখা যায়।
ইতিহাস-১২৮ ▌ আল-মুতাওয়াক্কিল:
তিনি ছিলেন ১০ম আব্বাসীয় খলিফা। তিনি ৮৪৭ সাল থেকে ৮৬১ সাল পর্যন্তশাসন করেন। তিনি তার ভাই আল ওয়াসিকের উত্তরসুরি হয়েছিলেন। তিনি মিহনার সমাপ্তি ঘটান। খলীফা আল-মুতাওয়াক্কিলের পুত্রদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নীতি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আল-মুনতাসিরকে অসন্তুষ্ট করে তোলে। এরফলাফল হিসেবে ৮৬১ খ্রি: তিনি কয়েকজন তুর্কি সেনাপতির সাহায্যে এক রাত্রিতে তাঁর পিতাকে হত্যা করেন এবং সিংহাসনে বসেন। এরপর থেকে পরবর্তী খলীফাগণ হয়ে যান তুর্কি সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল।
আল-মুনতাসির: তিনি ৮৬১ থেকে ৮৬২ সাল পর্যন্তশাসন করেন। তার পক্ষে তুর্কি গোষ্ঠীর সমর্থন ছিল।
আল-মুসতাইন: তিনি ৮৬২ থেকে ৮৬৬ সাল পর্যন্তশাসন করেন। পূর্ববর্তী খলিফা আল মুনতাসিরের মৃত্যুর পর তার তুর্কি সামরিক নেতৃবৃন্দরা উত্তরাধিকারী বিষয়ে বৈঠকে বসে। তারা আল মুতাজ বা তার ভাইদের ব্যাপারে উৎসুক ছিল না তাই আল মুতাসিমের নাতি আল মুসতাইনকে খলিফা নির্বাচন করা হয়।
ইতিহাস-১২৯ ▌ আল-মুতাজ:
তিনি ছিলেন ১৩শ আব্বাসীয় খলিফা। তিনি ৮৬৬ থেকে ৮৬৯ সাল পর্যন্তশাসন করেন। ক্ষমতালাভের সময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর। ক্ষমতালাভকালে বয়সের হিসাবে আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ।
আল-মুহতাদি: তার পিতা খলিফা আল-ওয়াসিকের (রাজত্ব. ৮৪২-৮৪৭) ১৪তম আব্বাসীয় খলিফা যিনি তার রাজকীয় নাম আল মুহতাদি বি-ল্লাহ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। ৮৬৯ থেকে ৮৭০ সাল পর্যন্ততিনি খলিফার পদে আসীন ছিলেন। আল-মুহতাদি প্রদেশগুলোতে আলীয়দের (আলীর বংশধরা) উত্থানের মুখোমুখি হন।
আল-মুতামিদ: ছিলেন ১৫শ আব্বাসীয় খলিফা। তিনি ৮৭০ থেকে ৮৯২ সাল পর্যন্ত খলিফার পদে আসীন ছিলেন। আল মুতাওয়াক্কিলের বেঁচে থাকা সন্তানদের মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ। ২৩ বছর যাবত খলিফার দায়িত্ব পালন করেন।
ইতিহাস-১৩০ ▌ আল-মুতাদিদ:
৮৯২ সালে আল মুতামিদ মারা গেলে আল মুতাদিদ খলিফা হন। পিতার মত আল মুতাদিদের ক্ষমতাও সেনাবাহিনীর সাথে তার ঘনিষ্ঠ স¤পর্কের উপর নির্ভরশীল ছিল। আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে আল মুতাদিদ সামরিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন। পূর্ববর্তী দশকে নিয়ন্ত্রণ হারানো কিছু অঞ্চলে তিনি নিয়ন্ত্রণ পুনপ্রতিষ্ঠা করেন।
আল-মুকতাফি: পিতা আল মুতাদিদের পর তিনি খলিফা হন। পিতার মৃত্যুর সময় তিনি রাকাহতে দায়িত্বরত ছিলেন। তিনি তার উদারতার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেন এবং তার পিতার গোপন কারাগার বিলুপ্ত করেন। তার শাসনামলে সাম্রাজ্যে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তিনি সাহসিকতার সাথে সেগুলোর মোকাবেলা করেন।
ইতিহাস-১৩১ ▌আল-মুকতাদির:
তিনি ৯০৮ থেকে ৯৩২ সাল পর্যন্তখলিফার পদে ছিলেন। তিনি তার পূর্বসূরি আল মুকতাফির উত্তরসূরি হন।
আল-কাহির: তিনি ছিলেন ১৯তম আব্বাসীয় খলিফা। ৯৩২ থেকে ৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি ২৮৬ হিজরিতে (৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩৩৯ হিজরিতে (৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ) মারা যান।
আর-রাদি: ৯৩৪ থেকে ৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি খলিফার পদে আসীন ছিলেন। ৯৪০ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৩১ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তার রাজত্বকাল খলিফার রাজনৈতিক শক্তির সমাপ্তি এবং সামরিক শক্তিধর দের উত্থান চিহ্নিত করে, যারা আমির আল-উমারা খেতাবের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।
ইতিহাস-১৩২ ▌আব্বাসীয় খিলফতের অন্যান্য শাসক:
আল-মুত্তাকি-৯৪০-৯৪৪, আল-মুসতাকফি-৯৪৪-৯৪৬, আল-মুতি-৯৪৬-৯৭৪, আল-তাই-৯৭৪-৯৯১, আল-কাদির-৯৯১-১০৩১, আল-কাইম-১০৩১-১০৭৫, আল-মুকতাদি-১০৭৫-১০৯৪, আল-মুসতাজির-১০৯৪-১১১৮, আল-মুসতারশিদ-১১১৮-১১৩৫, আল-রশিদ -১১৩৫-১১৩৬, আল-মুক'তাফি-১১৩৬-১১৬০, আল-মুসতানজিদ-১১৬০-১১৭০, আল-মুসতাদি-১১৭০-১১৮০, আন-নাসির-১১৮০-১২২৫, আজ-জাহির -১২২৫-১২২৬, আল-মুসতানসির-১২২৬-১২৪২, আল-মুসতাসিম- ১২৪২-১২৫৮। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গোল নেতা হালাকু খানের বাগদাদ দখলের পর খিলাফত বিলুপ্ত হয়। আব্বাসীয় শাসনের শেষের দিকে মুসলিম শাসকরা সুলতান উপাধি ব্যবহার শুরু করেন।
:: বুয়াইয়া রাজবংশ ::
ইতিহাস-১৩৩ ▌বুয়াইয়া বংশের উত্থান ও পতন:
আব্বাসী শাসনামলে যে সকল আঞ্চলিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের শাসন সূচনা হয়, সে গুলোর মধ্যে বুয়াইয়া বংশ অন্যতম। এই বংশটি ছিল শিয়া মতাবলম্বী। আবু সুযা বুয়াইয়া ছিলেন এই বংশের একজন শক্তিশালী নেতা, যার নেতৃত্বে বুয়াইয়ারা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। তারা কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলে তাবারিস্তান ও গীলানের মধ্যবর্তী ভূ-ভাগ দাইলাম নামক স্থানে বসবাস করতেন। এই অঞ্চলে তখন সামানী বংশের শাসন কার্যকরী ছিল, এবং আবু সুযা বুখারার সামানীয় বংশের অধীনে চাকরি করতেন। আলী, হাসান ও আহমদ নামক আবু সুযার ৩ পুত্র ছিল। এই বংশটি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। । বাগদাদের খলীফা তুর্কি বাহিনীর হাতের পুতুলে পরিণত হন। এই সময় বুয়াইয়ারা আহমদ এর নেতৃত্বে বাগদাদ উপকণ্ঠে হাজির হন। আহমদ খলীফার আহবানে সাড়া দিয়ে বাগদাদে প্রবেশ করেন। তুর্কি আল-আমির-উল-উমারা ও তুর্কি বাহিনী রাজধানী হতে পলায়ন করেন। আহমদ বাগদাদে খলীফাকে তাঁর সিংহাসনে পুন:প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি মুইয-উদ-দৌলাহ উপাধিতে ভূষিত হন।
ইতিহাস-১৩৪ ▌মুইয-উদ-দৌলা :
(৯৪৫-৯৬৭) খ্রি: মুইয-উদ-দৌলা ছিলেন বাগদাদে বুয়াইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ধীরে ধীরে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হন এবং দুর্বল খলীফার উপর তিনি তাঁর প্রভাব ও কর্তৃত্ব খাটান। তিনি সা¤্রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। তিনি সকল ক্ষমতা হস্তগত করেন, মুদ্রায় নিজের নাম অঙ্কিত করেন। খুতবায় খলীফার নামের সাথে তাঁর নামও উচ্চারিত হতো। খলীফা তাঁর অধীনে আশ্রিত ব্যক্তির ন্যায় ছিলেন। খলীফা রাজকোষ হতে দৈনিক ৫০০০ দিনার ভাতা হিসেবে পেতেন। খলীফার উপর তাঁর প্রভাব এবং প্রতিপত্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে মুইয-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। এই সংবাদে অবগত হয়ে মুইয-উদ-দৌলা খলীফাকে অন্ধ করে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং আলমুস্তাকফীর পুত্র আল-মুতীকে সিংহাসনে (৯৪৬ খ্রি:) বসান। খলীফা আল-মুতীর সাথে বুয়াইয়াদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। তিনি ১০ই মুহাররমকে শোক দিবস হিসেবে পালন করার নিয়ম প্রচলন করেন। ৯৬৭ খ্রি: মুইয-উদ-দৌলা মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-১৩৫ ▌ইজজুদ্দৌলাহ (৯৬৭খ্রি:) :
মুইজ-উদ-দৌলার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বখতিয়ার ইজজুদ্দৌলাহ উপাধি নিয়ে আল-আমিরউল-উমারাহ পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু তিনি ছিলেন দুর্বলচিত্তের অধিকারী। তিনি তুর্কি বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলে তাঁর পিতৃব্য পুত্র আজদুদ্দৌলাহ তাকে উদ্ধার করেন এবং তাকে বন্দী করেন। পিতা রুকনুদ্দীনের অনুরোধকে উপেক্ষা করে আজদুদ্দৌলাহ ইজজুদ্দৌলাহকে হত্যা করেন। আজদুদ্দৌলাহ (৯৬৭-৯৮৩) খ্রি: আজদুদ্দৌলাহ ছিলেন শ্রেষ্ঠ বুয়াইয়া শাসক। তিনি বুয়াইয়াদের ক্ষমতার চরম শিখরে আরোহণ করেছিলেন। তিনি বুয়াইয়া শাসকদের অধীনে এবং প্রতিষ্ঠিত ইরাক ও পারস্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোকে একত্রে করে একটি সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জুমুআর খুতবায় তাঁর নাম উচ্চারিত হয়। মুদ্রায় তাঁর নাম অংকন করা হয়। তাঁর প্রাসাদের দরজায় খলীফা দৈনিক তিনবার ঢোল পিটাবার জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। আজদুদ্দৌলাহর সময়ে বুয়াইয়া সা¤্রাজ্য কাস্পিয়ান সাগর হতে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তিনি প্রজাদরদী শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। আজ্দুদ্দৌলাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শামসুদ্দৌল্লাহ ‘শামস-উল-মিল্লাত’ উপাধি নিয়ে আমীর-উলউমারার পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁর ভাই শরাফউদ্দৌল্লাহ কর্তৃক পদচ্যুত হন। শরাফউদ্দৌল্লাহ ৯৮৩-৯৮৯ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ৯৮৯ খ্রি: তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র নসর বাহাউদ্দৌল্লাহ উপাধি নিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। ৯৯১ খ্রি: আব্বাসীয় খলীফা আল-কাদিরকে বাহাউদ্দৌল্লাহ আত্তায়ীর স্থলে সিংহাসনে বসান। খলীফা আল-কাদিরের সময়কাল হতে বুয়াইয়াদের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। সুলতানুদ্দৌল্লাহ (১০১২-১০২৪ খ্রি:) এবং ইমাদুদ্দীন (১০২৪-১০৪৮ খ্রি:) খ্রিস্টাব্দে আমীর-উল-উমারার পদে আসীন হন। বুয়াইয়া বংশের শেষ সুলতান ছিলেন আমীর-উল-উমারাহ মালিক আর রহিম (১০৪৮-১০৫৫) সেলজুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা তুগ্রিল বেগ কর্তৃক বুয়াইয়াদের বিতাড়িত হওয়ায় এই বংশের শাসনের অবসান ঘটে।
:: সেলজুক সাম্রাজ্যে ::
ইতিহাস-১৩৬ ▌সেলজুক শাসন:
তুর্কিদের অন্যতম উপজাতিকে বলা হয়েছিল ওগুজি। ৭-৯ শতকে তারা মধ্য ও মধ্য এশিয়ার বিশাল অঞ্চল দখল করতে শুরু করে। যাযাবর হওয়ায় তারা ভাল ভাল জমি নিয়েছিল। দশম শতাব্দীর শেষে, এই উপজাতির একটি শাখা পৃথক হয়ে যায় এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন শাসক সেলজুক। তুরস্কের প্রথম ধরণের রাজ্যত্ব সেলজুক উপজাতিদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল। সেলজুক শাসকদের একজন তুগ্রিলবেক ১০৩৮ সালে সুলতানের উপাধি নিয়েছিলেন এবং খুব শীঘ্রই তুর্কি বিজয় শুরু হয়েছিল। ১০৪০-এর দশকে, তুর্কিরা মধ্য এশিয়া, ইরান, ট্রান্সকোসেশিয়া এবং কুর্দিস্তান জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। সুলতান মালিক শাহের অধীনে তুর্কিরা রাজনৈতিক পর্যায়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১০৪৩ সালে, সেলজুক তুর্কিরা খোরেজম এবং তারপরে পুরো ইরানকে নিয়ে যায়। ১০৫০ সালে আর্মেনিয়ান-জর্জিয়ান সেনাদের সেনাবাহিনী ওয়ানাদের কাছে ধ্বংস হয়ে যায়। তুগ্রীলের নেতৃত্বে সেলজুকগণ বলখ, জুরজান, তাবারিস্তান, হামাদান,রাই, ইস্পাহান ও পারস্য দখল করে নেয়।
ইতিহাস-১৩৭ ▌তুগ্রীল বেগ (১০৩৭-১০৬৩) খ্রি:
১০৫৫ খ্রিঃ আব্বাসীয় খলীফা কায়িম-বিল্লাহ বুয়াইয়া শাসকদের প্রতাপে অতিষ্ঠ হয়ে তুগ্রিল বেগের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তুগ্রিল বেগ খলীফার আহবানে সাড়া দিয়ে বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং ১০৫৫ খ্রিঃ শেষ বুয়াইয়া শাসক মালিক রহিমকে পরাজিত করে বাগদাদ দখল করেন। তুগ্রিল বেগ বাসাসিরি নামক তুর্কি নেতাকে পরাজিত ও নিহত করেন যিনি খলীফা আল-কায়িম বিল্লাহ কে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন। ১০৬০ খ্রি: খলীফা পুনরায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। খলীফা তুগ্রিল বেগকে ‘সুলতান’ উপাধি দেন। তুগ্রিল বেগ বাগদাদে স্বয়ং উপস্থিত না থেকে তাঁর রাজধানী মার্ভ হতে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। তুগ্রিল বেগ অত্যন্ত উদার, সরল, সাহসী ও যোগ্য সামরিক সংগঠক ছিলেন। মার্ভে ছিল তাঁর রাজধানী। তিনি যে নগর বিজয় করতেন সেখানে তাঁর বিজয়ের স্মৃতিস্বরূপ একটি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা স্থাপন করতেন। দীর্ঘ ২৫ বছর গৌরবে সাথে রাজত্ব করে ১০৬৩ খ্রি: তুগ্রিলবেগ মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-১৩৮ ▌আলপ্ আরসলান (১০৬৩-১০৭২) খ্রি:
তুগ্রিল বেগের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আলপ্ আরসলান সেলজুক সা¤্রাজ্যের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। সুলতান তুগ্রিলের সময় বাইজানটাইন স¤্রাটের সঙ্গে যে সংঘর্ষের সূচনা হয়েছিল তা আলপ্ আরসলানের সময় চরমরূপ ধারণ করে। ১০৬০ খ্রি: আলপ্ আরসলান বাইজানটাইনদের কাপাডোসিয়া ও ফ্রিজিয়া হতে বিতাড়িত করেন। এরপর তিনি বাইজানটাইন অধিকার করে জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া দখল করেন। এতে ১০৭১ খ্রি: বাইজানটাইন স¤্রাট ডায়োজিনিসিম রোমানাস ২,০০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। আলপ্ আরসলান মাত্র ৪০,০০০ সৈন্যের সাহায্যে মালাজকার্দ নামক যুদ্ধক্ষেত্রে রোমানদের পরাজিত করেন। রোমান স¤্রাট তাঁর কন্যার সাথে আলপ্ আরসলানের পুত্রের বিবাহ, সকল মুসলিমকে বন্দীদশা হতে মুক্তি প্রদান ও নিজের মুক্তিপণ হিসেবে ১০ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে সুলতানের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। আলপ্ আরসলান ১০৭৩ খ্রি: ইন্তিকাল করেন। তিনি মার্ভ হতে ইস্পাহানে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। আব্বাসীয় খলীফার সাথে তাঁর সুসম্পর্ক বজায় ছিল।
ইতিহাস-১৩৯ ▌মালিক শাহ (১০৭২-১০৯২) খ্রি:
আলপ্ আরসলানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মালিক শাহ ‘জালালউদ্দিন’ উপাধি নিয়ে ১০৭৩ খ্রি: সিংহাসনে আরোহণ করেন। মালিক শাহের রাজত্বকাল ছিল সেলজুক ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। তাঁর রাজত্বের শুরুর দিকে তাকে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ দমন করতে হয়। নিজের ভ্রাতার তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই সময়ে আব্বাসীয় খলীফা ছিলেন মুকতাদির। তিনি একজন ব্যক্তি ছিলেন। মালিক শাহ তাঁর রাজধানী ইস্পাহান হতে বাগদাদে স্থানান্তর করে। একজন জ্ঞানী ও সুশাসক হিসেবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মালিক শাহ্ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর সময়ে সেলজুক সা¤্রাজ্য চীনের সীমান্ত হতে ভূ-মধ্যসাগরীয় তীর পর্যন্ত এবং উত্তরে জর্জিয়া হতে দক্ষিণে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি শাসন সংস্কারে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। তাঁর সময়ে সা¤্রাজ্যে সুখ-শান্তি বিরাজমান ছিল।
ইতিহাস-১৪০ ▌খাজা হাসান নিযামুল মুলক:
মালিক শাহ খাজা হাসান নিযামুল মুলককে পদে নিযুক্ত করে ‘আতাবেগ’ উপাধি দেন। নিযামুল মুলক ছিলেন একজন প-িত ও মেধাবী এবং তাঁর কর্মদক্ষতা বিচক্ষণতার ফলেই সেলজুক শাসকদের মধ্যে মালিক শাহের রাজত্বকাল স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণস্বরূপ রাজ্যশাসন কাঠামোর উপর ‘সিয়াসাত নামা’ নামক ফার্সি ভাষায় একটি মহামূল্যবান পুস্তক রচনা করেন। সুপ-িত নিযামুল মুলক ১০৬৫-৬৭ খ্রি: বাগদাদে নিযামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) এর মত দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন এই মাদ্রাসার একজন অধ্যাপক। শেখ সাদী এই মাদ্রাসার অন্যতম কৃতী ছাত্র ছিলেন এবং উমর আল-খৈয়াম নিযামুল মুলকের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। নিযামুল মুলকের পরামর্শে ১০৭৪ খ্রি: নিশাপুরে ৭০ জন জ্যোতির্বিদদের একটি সম্মেলন আহবান করেন এবং তাদের মাধ্যমে একটি পারসিক পঞ্জিকা সংস্কার করেন। এটি ‘জালালী পঞ্জিকা’নামে পরিচিত।
ইতিহাস-১৪১ ▌গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়:
মালিক শাহের রাজত্বের শেষ দিকে গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নিযামুল মুলকের সহপাঠি হাসান সাবাহ, যিনি পর্বতের বৃদ্ধ লোক (ঞযব ঙষফ গধহ ড়ভ ঃযব গড়ঁহঃধরহ) নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায় ফাতেমীয় খলীফার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং সা¤্রাজ্যের সর্বত্র নৈরাজ্য ও ত্রাসের সৃষ্টি করে। তারা তরবারি ও বিষের সাহায্যে বহু রাজবংশীয় লোককে হত্যা করে। নিযামুল মুলকের উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ১০৯১ খ্রি: গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় নিযামুল মুলককে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন এই গুপ্তঘাাতক সম্প্রদায়ের প্রথম হত্যার শিকার। মালিক শাহ তাদের বিরুদ্ধে ২টি অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হন। অবশেষে ১২৫৬ খ্রি: মোঙ্গল নেতা হালাকু খান কর্তৃক গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিনাশ ঘটে ও তাদের প্রধান ঘাটি আলামুত দুর্গ বিধ্বস্ত হয়। মালিক শাহ প্রায় একুশ বছর রাজত্ব করে ১০৯২ খ্রি: মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-১৪২ ▌পরবর্তী সেলজুকগণ:
মালিক শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পত্নী তুরখানের অনুরোধে খলীফা তাঁর শিশুপুত্র মাহমুদকে (১০৯২-৯৪) নাসিরুদুনইয়া ওয়াদ্দীন উপাধি দিয়ে সুলতানের পদে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু অচিরেই তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বরকিয়ারুক তাকে পদচ্যুত করেন ও রুকুনুদ্দীন উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। কিছুদিন পর তাঁর ভ্রাতা মুহাম্মদের সাথে তাঁর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বরকিয়ারুক পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন ও মুহাম্মদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সময় হতেই সেলজুক সুলতানদের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। সেলজুক সা¤্রাজ্য পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ১২৫৬ সালে মোঙ্গল সেনাপতি হালাগু খান গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযানে সাহায্য চাইলে খলিফা মুস্তাসিম (১২৪২-৫৮) তাতে কোন সাড়া দেননি। ১২৫৬ সালে হালাগু খান এককভাবে আক্রমণ চালিয়ে গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে সমূলে ধ্বংস করেন। গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযানে সাহায্য না করার অযুহাতে হালাগু খান বাগদাদ আক্রমণ করেন।
ইতিহাস-১৪৩ ▌বাগদাদ ধ্বংসের ঘটনা ও ফলাফল :
হালাগু খানের বাহিনী ১২৫৮ বাগদাদ অবরোধ করা হয়। তিনি নির্বিচারে বাগদাদের ২০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে ১৬ লক্ষকে হত্যা করেন। বাগদাদ নগরীকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস্তুপে পরিণত করা হয়। এখানে এতটাই হত্যাকা- চালানো হয় যে ইউফ্রেতিস ও তাইগ্রিস নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে যায়। এর ফলে মুসলিম বিশ্ব কয়েক বছরের জন্য খিলাফত শূণ্য হয়ে যায়। বাগদাদের পতনের ফলে শুধু একটি সা¤্রাজ্যেরই পতন হয়নি; বরং একটি সভ্যতারও পতন ঘটে। কারণ সমসাময়িক বিশ্বে বাগদাদ শুধু মুসলিম সভ্যতারই নয়, বিশ্ব সভ্যতারও প্রাণকেন্দ্র ছিল। আব্বাসীয় বংশের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আরবদের প্রাধান্য চিরতরে নি:শেষ হয়ে যায় এবং মূল খিলাফত ইতিহাসের অবসান ঘটে।
:: মুসলিমদের স্পেন শাসন ::
ইতিহাস-১৪৪ ▌স্পেনে মুসলিম শাসন (৭১১-১৪৯২):
মধ্যযুগে যেসকল স্থানে আরব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এর মধ্যে স্পেন অন্যতম। ৭১১ সালে এ অঞ্চলটি মুসলিম শাসনাধীনে আসে। মুসলিমরা এর নাম দিয়েছিল আন্দালুসিয়া বা আল-আন্দালুস। শুরুতে স্পেন দামেস্কের উমাইয়া খিলাফতের অধীনে একটি প্রদেশ হিসেবে পরিণত হয়। ৭৫৬ সালে আব্দুর রহমান আদ্-দাখিল এখানে একটি স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করেন। ৯২৯ সালে তৃতীয় আব্দুর রহমান এই আমীরাতকে খিলাফতে উন্নীত করেন। ১০৩১ সালে উমাইয়া খিলাফতের অবসানের পর স্পেনে আরব, বার্বার ও স্লাভরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের সৃষ্টি করে শাসন করতে থাকে। উত্তরের খ্রিস্টানরা ক্রমাগত আক্রমণ করে যখন ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি একে একে গ্রাস করছিল, সেসময় উত্তর আফ্রিকার মরক্কো হতে মুরাবিতুন (১০৯১-১১৪৬) রাজবংশ স্পেন শাসন করতে থাকে। এরপর মুরাবিতুনদের হটিয়ে মুয়াহিদুন (১১৪৬-১২৪৮) রাজবংশ মরক্কো হতে স্পেন শাসন করে। স্পেনে মুসলিমদের শেষ রাজবংশ ছিল গ্রানাডার নসর বংশ (১২৩২-১৪৯২)। ১৪৯২ সালে এই বংশের পতনের মধ্য দিয়ে স্পেনে মুসলিম শাসনের চির অবসান হয়।
ইতিহাস-১৪৫ ▌আরবদের লেভান্ত শহর দখল:
৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঈয়ারমুক নদীর ধারে রশিদুন সাম্রাজ্যের মুসলমান সৈন্যদের হাতে হেরে গেল শক্তিশালী বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যের এক বাহিনী। কনস্ট্যান্টিনোপলের শাসক সম্রাট হারকিউলিস আরবদের শহর দখল অবসম্ভাবি জেনে তিনি তড়িঘড়ি করে লেভান্ত শহর খালি করার নির্দেশ দেন। শহরের বেশিরভাগ মানুষ এশিয়া মাইনরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। আর ইতিমধ্যে, রশিদুন সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে প্রবেশ করে শহরে। এর ফলে, আরবদের পক্ষে সিরিয়া ও মিশর দখল সম্ভব হয়। মুসলিম সৈন্যরা ছিল যুদ্ধে কুশলী। তাদের আক্রমণের পন্থা ছিল ভিন্ন। তারা প্রথমে আক্রমণ করে মরুভূমিতে গা ঢাকা দিত। শত্রুসৈন্য দ্বন্দে পড়ে মরুভূমিতে পা রাখলে সেখানেই মরুযুদ্ধে অভিজ্ঞ মুসলিম বাহিনীর কৌশলী আক্রমণে তারা পরাজিত হতো। তাছাড়া, আরব সৈন্যরা খুব সহজেই স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারত।
ইতিহাস-১৪৬ ▌আরবদের তারসুস ও রোডস দ্বীপ দখল:
৬৬১ অব্দে, ইসলামে গৃহযুদ্ধ শেষ হলে মুয়াবিয়া আবার বাইজান্টিয়াম দখলের জন্য বাহিনী পাঠান। ততদিনে রশিদুন খিলাফতের স্থান নিয়েছে উম্মাইয়া খিলাফত। স্বয়ং মুয়াবিয়া তার প্রতিষ্ঠাতা। ৬৭০ অব্দে, আরব সেনা কনস্ট্যান্টিনোপলের বিপরীতে এশিয়ান তীর দখল করে। ঠিক তার পরের বছর প্রায় ৫০০ জাহাজের এক বহর দারদানেলিস দিয়ে যাত্রা শুরু করে। এই বহর সাইজিকাস উপদ্বীপে একটি নৌবাহিনীর ঘাঁটি তৈরি করে। এরপরেই মুয়াবিয়া তাঁর সর্বেশেষ আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরি করতে থাকেন। ৬৭২ সালে মুয়াবিয়া তিনটি বিশাল নৌ বাহিনী পাঠান। তৎকালীন কনস্ট্যান্টিনোপলের শাসক সম্রাট চতুর্থ কনস্ট্যান্টাইন নব্য আবিষ্কৃত অস্ত্র ‘গ্রিক আগুন’-এর মাধ্যমে মুসলমান নৌ বহরকে আটকাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হয়। ৬৭৩ অব্দে, সিলিসিয়া প্রদেশের তারসুস ও রোডস দ্বীপ আরবদের দখলে আসে।
ইতিহাস-১৪৭ ▌ আরবদের কনস্ট্যান্টিনোপল শহর বিজয়:
ঐতিহাসিকরা বলেন, বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল-এর বহু রাজনৈতিক শক্তির নজর থাকলেও সর্বপ্রথম আরবরাই এই শহর দখল করতে সক্ষম হয়। ৬৭৪ অব্দে পূর্ব ঈজিয়ন সাগর থেকে আরব বাহিনী মর্মর সাগরে প্রবেশ করে। তাদের প্রথম ঘাঁটি হয় হেবডোমন প্রদেশের থ্রাশিয়ান উপকূল। তারপরেই শুরু হয় বাইজান্টিয়াম বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমর। বাইজান্টিয়াম বাহিনী একসময় ধীরে ধীরে পিছু হটতে থাকলে কনস্ট্যান্টিনোপল শহরে পা রাখে আরব সেনাবাহিনী। যদিও ৬৭৭ অব্দে সম্রাট চতুর্থ কনস্টান্টাইন আবার আরবদের থেকে শহর দখল করে নেন, তাও বলা যায় যেটুকু সময় এই প্রাচীন শহর ইসলামের ছায়ায় ছিল সেটুকু সময় এখানে পবিত্র ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়েছিল মানুষের মধ্যে। আরবদের কনস্ট্যান্টিনোপল দখল ইসলামী ইতিহাসে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে গিয়েছে
ইতিহাস-১৪৮ ▌ স্পেন অভিযানে মূসা ইবনে নূসাইর:
তিনি (৬৪০-৭১৬) ছিলেন উমাইয়া খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের অধীনস্থ একজন গভর্নর ও সেনাপতি। তিনি উত্তর আফ্রিকার (ইফ্রিকিয়া) মুসলিম প্রদেশ শাসন করেন। মুসার পিতা দাস হিসেবে তৎকালীন সিরিয়ার গভর্নর ও খলিফা প্রথম মারওয়ানের পুত্র আবদুল আজিজ ইবনে মারওয়ানের অধীনে কাজ করতেন। মারওয়ান তাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তিনি সিরিয়ায় ফিরে আসেন। ৭৭ হিজরিতে খলীফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের শাসনামলে তিনি ইফ্রীকিয়া (বর্তমান তিউনিশিয়া) ও মাগরেবের (বর্তমান মরক্কো, আলজেরিয়া ও লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চল) প্রশাসকের দায়িত্ব পান। প্রশাসকের দায়িত্ব লাভ করেই মূসা তার শাসনাধীন অঞ্চলের স্থিতিশীলতার দিকে জোর দেন। তার মাধ্যমে সিউটা ব্যতীত পুরো মাগরেব অঞ্চলে উমাইয়া শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মূসা বিন নূসাইর শাসনামলেই উত্তর আফ্রিকায় উমাইয়াদের ভিত মজবুত হয়। তিনি খলিফার কাছে স্পেন জয়ের অনুমতি প্রার্থনা করেন।
ইতিহাস-১৪৯ ▌স্পেনে মুসলিমদের অগ্রাভিযান:
মূসা বিন নুসাইর খলিফার অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথেই যেন অভিযান শুরু করতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী গঠন করতে থাকেন। অবশেষে ৭১০ সালে তারা তরীফ বিন মালিকের নেতৃত্বে আন্দালুস-ভূমিতে পা রাখে। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্যই ছিল আন্দালুস সংক্রান্তযাবতীয় গোয়েন্দা ইতিহাস সংগ্রহ। তাদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই মূসা ইবনে নূসাইর তার পরবর্তী রণকৌশল ঠিক করেন। তরীফের অভিযানের প্রায় এক বছর পর ৭১১ সালে মাত্র সাত হাজার সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত মুসলিম বাহিনী তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে আন্দালুসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। এই বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্যই ছিল বার্বার বংশোদ্ভূত, আর প্রায় ৩০০ জনের মতো আরব সৈন্যও এতে ছিল। তারিক তার বাহিনী নিয়ে আন্দালুসের যে স্থানে অবতরণ করে তার নাম ছিল লাইনজরাক। পরবর্তীতে এর নাম হয় জাবালুত তারিখ বা জিব্রাল্টার।
ইতিহাস-১৫০ ▌তারিক বিন জিয়াদ:
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের কথা আসলেই যার কথা আর বীরত্ব আমাদের সামনে আসে তিনি তারিক বিন জিয়াদ। তিনি আরব বংশোদ্ভূত ছিলেন না। তিনি ছিলেন উত্তর আফ্রিকার আমাজিগ (বার্বার) বংশোদ্ভূত। আফ্রিকা অঞ্চলের অধিবাসীদের দৈহিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে আমাজিগরা ছিল শ্বেতাঙ্গ। এ কারণে বংশমূলের বিচারে কেউ কেউ তাদের ইউরোপীয় মনে করেন। দীর্ঘদেহী তারিক বিন জিয়াদ ছিলেন অসাধারণ নেতৃত্বগুণের অধিকারী। তিনি অনারব হলেও আরবিতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন। ফলে তিনিই ছিলেন আমাজিগ ও আরবদের মিশ্র সেনাবাহিনীর যোগ্য সেনাপতি। তাকে সেনাপতি নিয়োগ দিয়ে মূসা ইবনে নূসাইর দূরদর্শীতার পরিচয় দেন। জিব্রাল্টার নামটি আরবি জাবালে তারিক থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এর অর্থ "তারিকের পাহাড়"। তারিক বিন জিয়াদের নামে এটির নামকরণ হয়।
ইতিহাস-১৫১ ▌তারিক বিন জিয়াদ-এর স্পেন বিজয়:
মুসলিম বাহিনী আগমণে আন্দালুস শাসক রডারিক ¯েপনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি বেনশিয়োর নেতৃত্বে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী প্রেরণ করলেন। এ বাহিনী তারিকের হাতে পরাজিত হলো। ফলে মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলায় প্রায় এক লক্ষ সেনার আরও একটি বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করলেন। এই বিশাল বাহিনীর সংবাদে বিচলিত তারিককে সহযোগিতার জন্য মূসা বিন নূসাইর আরও পাঁচ হাজার সৈন্যের বাহিনী প্রেরণ করেন। ৭১১ সালের ১৯ জুন উভয় বাহিনী মুখোমুখি হলো। আট দিন যুদ্ধ শেষে মুসলিমদের জয় হলো। ফলে আন্দালুসিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নগরী কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা ও মুরসিয়া মুসলিমদের হাতে আসে। মূসা ইবনে নুসাইর-এর আরও আঠারো হাজার সৈন্যে যোগ দিলে উভয়ের সম্মিলিত বাহিনীর হাতে বার্সেলোনা ও জারাগোযার পতন হয়। আবদুল আযিয ইবনে মূসার পর থেকে একে একে অনেকেই ¯েপন শাসন করেন।
ইতিহাস-১৫২ ▌খাইরুদ্দীন বারবারুসা:
দক্ষিণ স্পেনের উপকূলীয় উপত্যকা আল বাশারাত। সেসময় ওসমানীয় শাসক ছিলেন সুলতান সুলায়মান। ওসমানীয় সুলতান দুর্ধর্ষ এই নৌ-সেনাপতিকে অর্থ, সৈন্য এবং নৌবহর দিয়ে সমুদ্রের বুকে ইউরোপের জন্য ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। সমুদ্রে সমগ্র ইউরোপীয় শক্তি তাকে যমদূতের মতো ভয় পেত। ইউরোপের কোনো বাণিজ্যিক জাহাজ, এমনকি সাধারণ মাঝিরাও সমুদ্রের নৌকা নামাতে ভয় পেত। তিনি যুদ্ধলব্ধ সমস্ত মালামাল পৌঁছে দিতেন ওসমানীয় সুলতানের পদতলে। ব্রিটিশ, ¯প্যানিশ কিংবা ফ্রান্সের কোনো রসদবাহী জাহাজই রক্ষা পেত না বারবারুসার বিধ্বংসী আক্রমণ থেকে। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া এবং মরক্কোর বিশাল এক অঞ্চল ¯প্যানিশদের কাছ থেকে তিনি দখল করে নেন। ইতালি, ফ্রান্স ও ¯েপন অধ্যুষিত দ্বীপসমূহ নিয়ে আসেন ওসমানীয় পতাকা তলে। সাগরে একক অধিপতি ছিলেন খাইরুদ্দিন বারবারুসা।
ইতিহাস-১৫৩ ▌কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণ:
সেনাধ্যক্ষ প্রথম মুয়াবিয়ার কাছে কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করা ছিল দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাকাক্সক্ষা। তিনি নিখুঁত পরিকল্পনা করে যুদ্ধজয় করেছিলেন। আরবের মুসলিমবাহিনী তার নির্দেশে খুব ধীরে এই অভিযান চালায়। কনস্ট্যান্টিনোপল বৃহৎ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। প্রতি বসন্ত ও শরতে আরব সৈন্যরা এই পাঁচিল ঘেরাও করত। এছাড়া মুসলমান নৌ বাহিনী বাইজান্টিয়াম নৌ বাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিত। মূলত নৌ যুদ্ধের মাধ্যমেই মুয়াবিয়া জয়লাভ করে। ৬৫৫ সালে বিখ্যাত ফিনিক্সের যুদ্ধে বাইজান্টিয়াম নৌ বহরকে ধ্বংস করে আরবীয় মুসলিম বাহিনী। কিন্তু তৎকালীন রশিদুন খিলাফতের খলিফা উসমানের গুপ্তহত্যার পর খিলাফতের অবস্থা খানিক টালমাটাল হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে মুয়াবিয়াকে বাহিনী সমেত ফেরত যেতে হয়। শুধু তাই নয়, ৬৫৯ সালে বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যের সঙ্গে শান্তিচুক্তিও স্বাক্ষর করেন তিনি।
ইতিহাস-১৫৪ ▌স্পেনে উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা:
স্পেনে মুসলিমদের আগমনের আগে সেখানকার সামাজিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। প্রাক-মুসলিম স্পেনীয় সমাজ প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। শাসক ও প্রজা শ্রেণী। রাজা, ধর্মযাজক এবং অভিজাতদের নিয়ে শাসক শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। স্পেনের শাসক শ্রেণী প্রজা-সাধারণের উপর নানারকম অত্যাচার ও নির্যাতন চালাত। তাদের উপর সীমাহীন কর আরোপ করা হত। ফলে স্পেনে কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিলনা। সে সময় স্পেনের সামরিক অবস্থাও সুসংগঠিত ছিল না। ক্রীতদাসদেরকে জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হত। ফলে সেনাবাহিনীর সামরিক মান সন্তোষজনক ছিল না। তাই সংখ্যায় বেশি হলেও রডারিকের লক্ষাধিক সৈন্য মাত্র ১২ হাজার মুসলিম সৈন্যের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদের সময়ে আফ্রিকার শাসনকর্তা মূসা বিন নুসাইর তাঁর সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের মাধ্যমে ৭১১ সালে স্পেন জয় করেন।
ইতিহাস-১৫৫ ▌র্টুসের যুদ্ধ:
আব্দুর রহমান আল-গাফিকি ৭৩২ সালে স্পেনের শাসনভার লাভ করেন। ৭৩২ সালে তিনি ১ লক্ষ সৈন্য নিয়ে পিরেনীজ অতিক্রম করে ফ্রান্সে প্রবেশ করেন। তিনি আর্লেস নগর দখল করেন। এরপর তিনি একুইটেনের শাসক ডিউক ইউডেসকে পরাজিত করে একে একে বার্তিমাস্ক, বুরন্ডি, লিওন, বেসাসকোন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সের আরও কয়েকটি শহর দখল করেন। ৭৩২ সালের অক্টোবর মাসে উত্তর ফ্রান্সের র্টুস ও পইটিয়ার্সের মধ্যবর্তী সমতল ভূমিতে আব্দুর রহমান আল-গাফিকির বাহিনী এবং খ্রিস্টান সম্মিলিত বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে মুসলিমদের জয়লাভ যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় তখন যুদ্ধের দশম দিবসে আব্দুর রহমান আল-গাফিকি তীরবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এরপর মুসলিমরা একজন নতুন সেনাপতি নির্বাচনে ব্যর্থ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে।
ইতিহাস-১৫৬ ▌স্পেনে প্রথম আব্দুর রহমানের শাসন :
প্রথম আব্দুর রহমান ছিলেন একজন উমাইয়া রাজপুত্র। তিনি উমাইয়া বংশের দশম খলিফা হিশামের দৌহিত্র ছিলেন। স্পেনে সে সময় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছিল যা আব্দুর রহমানের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। তিনি ৭৫৫ সালে আলমুনেকার বন্দরে অবতরণ করেন। ইয়ামেনীরা তাঁর পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। আব্দুর রহমান প্রথমে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই দক্ষিণ দিকের শহরগুলো দখল করলেন। এরপর তিনি কর্ডোভা অভিমূখে যাত্রা করেন। ৭৫৬ সালে কর্ডোভার মাসারা নামক স্থানে উত্তর আরবীয়দের সাথে আব্দুর রহমানের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। মাসারার যুদ্ধে আব্দুর রহমান জয়ী হন এবং কর্ডোভা দখল করেন। ফলে দামেস্কের উমাইয়া সা¤্রাজ্যের পতনের ৬ বছর পর স্পেনে উমাইয়া রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। আব্দুর রহমান আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের নামে খুত্বা পাঠ করলেও পরে তা বন্ধ করে দেন। আল-মনসুর স্পেনকে আব্বাসীয় খিলাফতের বলয়ে নিয়ে আসার জন্য কায়রোওয়ানের আব্বাসীয় গভর্নর আলা বিন মুগীসকে ৭৬৩ সালে স্পেনে পাঠান। আলা বিন মুগীস ৭০০০ বার্বার সৈন্যসহ নিহত হন। আব্দুর রহমান ৭৮৮ সালে ৫৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৩২ বছর স্পেন শাসন করেন।
ইতিহাস-১৫৭ ▌প্রথম হিশাম:
আব্দুর রহমান মৃত্যুর আগে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র হিশামকে (৮৮৮-৯৬) উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। হিশাম ছিলেন হুলাল নামক একজন স্পেনীয় দাসীর গর্ভজাত সন্তান। আব্দুর রহমানের অন্য দুই পুত্র ছিলেন সুলাইমান ও আবদুল্লাহ্ যারা তাঁর সিরীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান ছিলেন। হিশামের বুদ্ধিমত্তা ও ধার্মিকতার কারণে দাসীর সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে পরবর্তী আমীর হিসেবে মনোনীত করা হয়। পিতার আমলে তিনি মেরিদার গভর্নর ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর ৭৮৮ সালে ৩২ বছর বয়সে হিশাম নিজেকে স্পেনের আমীর হিসেবে ঘোষণা করেন। সিংহাসন লাভ করেই তাকে প্রথমেই ভাইদের বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে হয়। তাঁর শাসনামলে নানা ধরনের বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং তিনি সবগুলো বিদ্রোহ সফলভাবে মোকাবিলা করেন। তিনি ছিলেন ইমাম মালিক বিন আনাসের ভক্ত ও শিষ্য। হিশাম তাঁকে স্পেনে আগমন ও বসতি স্থাপন করার অনুরোধ করেন। ইমাম মালিক আব্বাসীয় অত্যাচার সত্ত্বেও এই প্রস্তাবে রাজি হননি। তিনি স্পেনে মালিকী মাযহাবের প্রবর্তন করেন।
ইতিহাস-১৫৮ ▌দ্বিতীয় আব্দুর রহমান:
পিতা হাকামের (৭৯৬-৮২২) মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় আব্দুর রহমান (৮২২-৮৫২) পিতৃ-সিংহাসন লাভ করেন। ৮৪৪ সালে জার্মান নরম্যানরা ৮টি জাহাজ নিয়ে লুসিতানিয়া, লিসবন ও কেডিজ লুট করে। এরপর সেভিলে আসে এবং লুন্ঠন ও অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। কর্ডোভা থেকে প্রেরিত আমীরের নৌবহর ও সেনাদলের তাড়া খেয়ে তারা আল্জেসিরাস ও উপকূলীয় অঞ্চলে হানা দেয়। সর্বশেষে তাদের সেখান থেকেও পলায়ন করতে বাধ্য করা হয়। এরপর আমীর একটি শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের সময় স্পেনের ধর্মান্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায় ‘ধর্মান্ধ আন্দোলন’ শুরু করে। এই আন্দোলনের কারণ হল: ইসলামের অধিকতর গ্রহণযোগ্যতার ফলে বহু খ্রিস্টান ইসলামে দীক্ষিত হয়। এতে ধর্মান্ধ খ্রিস্টানদের ঈর্ষা জন্মে।
ইতিহাস-১৫৯ ▌উমর বিন বিন হাফ্সুন:
আমীর মুহম্মদের শাসনামলে (৮৫২-৮৬) স্পেনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বোবাস্ট্র পর্বতের পাদদেশে উমর বিন হাফ্সুন নামে এক বিদ্রোহী নেতার নাটকীয় উত্থান ঘটে। মুসলিমদের নিকট তিনি একজন ধর্মদ্রোহী বিদ্রোহী নেতা হলেও স্বজাতির অনেকের নিকট তিনি জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে বিবেচিত। মুহম্মদ, মুন্যির, আবদুল্লাহ্ ও তৃতীয় আব্দুর রহমান- এ চারজন আমীরের বিরুদ্ধে তিনি ক্রমাগতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যান। প্রথম মুহম্মদ (৮৫২-৮৮৬) উমরের বিরুদ্ধে দুটি অভিযান প্রেরণ করেন এবং পরাজিত হয়। আমীর মুন্যির (৮৮৬-৮৮) সময়কালে উমর সারাগোসা, ইিউয়েসকা ও টলেডোতে তাঁর রাজ্য বিস্তৃত করেন। ২য় আবদুল্লাহ্র শাসনামলে (৮৮৮-৯১২) উমর বিন হাফ্সুন ইসলাম-ধর্ম ত্যাগ করে স্যামুয়েল নাম নিয়ে খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টান নরপতিদের সাহায্য ও সমর্থন লাভ করা। কিন্তু খ্রিস্টানগণ তাঁকে বিশ্বাস করতে পারেনি। মুসলিমরাও তাঁর পক্ষ ত্যাগ করে। তৃতীয় আব্দুর রহমানের সাথে সংঘর্ষে ৯১৭ সালে উমর মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-১৬০ ▌ তৃতীয় আব্দুর রহমান:
পিতামহ আবদুল্লাহ্র মৃত্যুর পর আব্দুর রহমান আল-নাসির ৯১২ সালে ২২ বছর বয়সে স্পেনের সিংহাসন লাভ করেন। স্পেনের ইতিহাসে তিনি তৃতীয় আব্দুর রহমান নামে পরিচিত। তিনি প্রায় ৪৯ বছর শাসনকালে (৯১২-৬১)স্বীয় প্রতিভাবলে সর্বপ্রকার বিশৃংখলা দূর করে স্পেনকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যান। এজন্য তাঁকে স্পেনের মুসলিম সা¤্রাজ্যের ত্রাণকর্তা বলা হয়। তিনি একজন অমায়িক, ন্যায়পরায়ন, প্রজাহিতৈষী, ন¤্র ও উদার শাসক ছিলেন বলে তাঁর খ্যাতি দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। কনস্টানটিনোপোল, জার্মান, ইতালি ও ফ্রান্সের নরপতিগণ তাঁর দরবারে দূত প্রেরণ করে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিলেন। তিনি বার্বার, স্লাভ, আরব ও খ্রিস্টানদের সমন্বয়ে সেনাবাহিনী গঠন করেন। সেনাবাহিনীতে প্রায় দেড় লক্ষ নিয়মিত ও অসংখ্য অনিয়মিত সৈন্য ছিল। আঁর আমলে স্পেনের ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশিরভাগ পরিচালিত হত ১ হাজারেরও বেশি জাহাজের মাধ্যমে। বাণিজ্য পণ্য বিক্রয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় এজেন্সি গড়ে তোলা হত। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির ফলে বার্ষিক রাজস্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
ইতিহাস-১৬১ ▌দ্বিতীয় হিশাম ও হাজিব আল-মনসুর:
তৃতীয় আব্দুর রহমানের পর স্পেনের শাসন ক্ষমতায় বসেন খলিফা দ্বিতীয় হাকাম (৯৬১-৭৬)। দ্বিতীয় হাকামের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হিশাম (৯৭৬-১০০৯) ১২ বছর বয়সে সিংহাসন লাভ করেন। রাজমাতা সুলতানা সুবাহ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী আল-মুশাফি ও রাষ্ট্রাধ্যক্ষ আবু আমির মুহম্মদের উপর। আবু আমির মুহম্মদ পরবর্তীতে হাজিব বা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ‘আল-মনসুর’ উপাধি ধারণ করেন এবং স্পেনের ইতিহাসে তিনি ‘হাজীব আল-মনসুর’ নামেই অধিক পরিচিত। সুলতানা সুবাহ্র সাথে কথিত সম্পর্ক নিয়ে তিনি সমালোচনার শিকার হন। ফকীহ্গণ তাঁকে ধর্মদ্রোহী বলে আখ্যা দেয় এবং তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করে। ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে গেলে ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁসি ও নির্বাসন দেয়া হয়। পরে তিনি বিচারক ও আলিমদের খুশী রাখার জন্য আল-হাকামের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক দর্শনের গ্রন্থসমূহ জ্বালিয়ে দেন। এছাড়া তিনি তাঁদের সমর্থন লাভের জন্য স্বহস্তে কুরআনের অনুলিপি করেন।
ইতিহাস-১৬২ ▌স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান:
দুর্বল শাসকদের সময় স্পেনের প্রশাসন যন্ত্রের অবনতি ঘটে। সেনাবাহিনীতে বহুজাতির সংমিশ্রণের ফলে বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। সুষ্ঠু উত্তরাধিকারী নীতির অভাবে গড়ে ওঠা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং সিংহাসনের দাবীদারদের মধ্যে শক্তি পরীক্ষা স্পেনীয় মুসলিম শাসনকে দুর্বল করে। ফলে বিদ্রোহী ও খ্রিস্টান অনুপ্রবেশকারীরা এই সুযোগ গ্রহণ করে। মুসলিমদের অদূরদর্শী নীতির ফলে খ্রিস্টানরা শহরের কেন্দ্রস্থলে বসবাসের সুযোগ লাভ করে। ফলে তারা মুসলিম সা¤্রাজ্য ধ্বংসের লক্ষ্যে সুবিধাজনক সময়ে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানসহ উত্তরাঞ্চলের স্বজাতীয়দের সাথে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। গ্রানাডার শাসক আবুল হাসান আলীর সময় (১৪৬৫-৮২) খ্রিস্টান জগতে নতুন শক্তিজোটের উত্থান ঘটে। ফলে ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারী কতিপয় শর্তসাপেক্ষে গ্রানাডা খ্রিস্টানদের নিকট হস্তান্তর করা হয়।
:: ইসলামের স্বর্ণযুগ ::
ইতিহাস-১৬৩ ▌জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ:
উমাইয়া শাসকরা যে বিপুল বিক্রমে রাজ্য জয় করেন, আব্বাসীয় আমলে তা ব্যয় হয় জ্ঞানচর্চায়, সভ্যতার উন্নয়নে। বলা যায়, মুসলিমদের হাতে আধুনিক সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় এ সময়। খলিফা মামুন প্রতিষ্ঠিত বায়তুল হিকমা (৮৩০ খ্রি.)র সূত্র ধরে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, গণিত, চিকিৎসা, রসায়ন, পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিমরা অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। জাবের ইবনে হাইয়ান, আল খাওয়ারিজমি, ইবনে সিনা, আর রাজি, আততাবারি, আলী ইবনে আব্বাস, আল আব্বাস, ওমর খাইয়াম, আল-বিরুনী, ফারাবি, গাজালি, আল কিন্দি, আল ইদরিস, ইয়াকুবি, আল মাকদিসি, ইবনে হাইকাল, ইবনে ইসহাক ও ইবনে আসিরের মতো প-িতের জন্ম হয় আব্বাসীয় শাসনামলে। এ সময় হাদিসশাস্ত্রের বিশুদ্ধ ছয় কিতাব সংকলিত হয়। ফিকহশাস্ত্রের মহান চার ইমাম ও তাফসিরশাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থগুলো এই যুগেই রচিত।
ইতিহাস-১৬৪ ▌ ইসলামের স্বর্ণযুগ. ছয় শতাব্দী জুড়ে:
ইসলামের স্বর্ণযুগের ব্যাপ্তিকাল অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী। বাগদাদে তখন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো ঐড়ঁংব ড়ভ ডরংফড়স, যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলিম-অমুসলিম পন্ডিতেরা এসে জড়ো হতেন। শুধুমাত্র সেসব পন্ডিতদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের জন্যই মানবজাতি অতীতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক কিছুই জানতে পেরেছে। প্রথমে সেগুলোকে মূলত আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হলেও কালক্রমে তুর্কী, সিন্ধী, ল্যাটিন, ফার্সি, হিব্রু ইত্যাদি নানা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ফলে জ্ঞানের যে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিলো তা তো না বললেও চলে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, রোম, চীন, ভারত, গ্রীস, মিশর, পারস্য, উত্তর আফ্রিকা, বাইজান্টাইন প্রভৃতি সভ্যতার জ্ঞান নিয়ে চর্চা হতো সেখানে। ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ তথা বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সব প্রান্ত থেকেই জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটতো ‘হাউজ অফ উইজডমে’ জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্যে।’
ইতিহাস-১৬৫ ▌ইসলামের স্বর্ণযুগের সেরা রসায়নবিদ, ভূতত্ত্ববিদ ও গণিতবিদ:
রসায়নবিদ: জাবির ইবন হাইয়্যান, আব্বাস ইবন ফিরনাস, আল-কিন্দী, আল-মাজ্রিতী, আল-খাজিনী, ইবন সিনা, নাসির আল-দীন তুসি, ইবন খালদুন, জাফর আল-সাদিক, খালিদ ইবন ইয়াজিদ প্রমুখ।
ভূতত্ত্ববিদ: আল-মাসুদী, আল-কিন্দী, ইবন আল-জাজ্জার, আল-মাসিহী, আলী ইবন রিদওয়ান, ইবন সিনা, ইবন রুশদ, আহমেদ মুহিউদ্দীন পিরি, ইবন বতুতা, ইবন আল-নাফিস, ইবন জুবায়ের, ইবন খালদুন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
গণিতবিদ: মুহাম্মদ ইবন মুসা আল-খারিজি¥, ওমর খৈয়াম, শরাফ আল-দীন আল-তুসি, আল-কারাজি, আল-সামাও’আল, আবু মাহমুদ খোজান্দি, তাহিত ইবন কুর্রাসহ আরো অনেকে।
ইতিহাস-১৬৬ ▌ইসলামের স্বর্ণযুগের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী:
পদার্থবিজ্ঞান: জাফর ইবন সাদিক, আব্বাস ইবন ফিরনাস, আল-সাঘানি, ইবন ইউনুস, আল-কারাজি, আল-হাইথাম, আল-বিরুনি, ইবন বাজ্জাহ, ইবন রুশদ প্রমুখ।
অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী: ইবন তাইমিয়া, ইবন খালদুন, ইবন আল-নাফিস, আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ আল-গাজালি, ইবন সিনা, আল-বিরুনি, ইমাম আবু হানিফা প্রমুখ।
জীববিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী: ইবন সিরিন, আল-কিন্দী, আল-তাবারী, আল-বালখি, আল-ফারাবী, আল-মাজুসি, ইবন সিনা, আল রাজি, আল-বিরুনী, ইবন রুশদ, আল হাইথাম প্রমুখ।
ইতিহাস-১৬৭ ▌ ইসলামের স্বর্ণযুগের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যসেবা:
জ্যোতির্বিজ্ঞানী: সিন্দ ইবন আলী, আলী কুশজি, ইবরাহিম আল-ফাজারি, আল-খারিজি¥, আল-বালখি, আল-বাত্তানী, আল-ফারাবী, আবু নাস্র মনসুর, আল-হাইথাম, ইবন রুশদ, ইবন বাজ্জাহ, নাসির আল-দীন আল-তুসি প্রমুখ। স্বাস্থ্যসেবা: তখনকার হাসপাতালগুলো পরিচালিত হতো তিন সদস্য বোর্ড দ্বারা। নবম শতকে অনেক মুসলিম শহরেই ওষুধের দোকান চালু হয়ে গিয়েছিলো। হাসপাতালগুলো রাত-দিন ২৪ ঘন্টাই সেগুলো খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। দরিদ্র কাউকে যাতে অর্থের অভাবে ফিরে যেতে না হয় সেই ব্যাপারটাও নিশ্চিত করতে গড়ে উঠেছিলো বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা। উদাহরণস্বরুপ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মিশরে গড়ে ওঠা কালাউন হাসপাতালের কথা উল্লেখ করা যায়। ধনী-গরীব, সবল-দুর্বল, স্থানীয় কিংবা দূর থেকে আগত, চাকুরে-বেকার নির্বিশেষে সবাই সেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পেত। দৈনিক প্রায় ৪,০০০ রোগী আসতো।
ইতিহাস-১৬৮ ▌ ইসলামের স্বর্ণযুগের শিক্ষাব্যবস্থা:
মরক্কোর ফেজ শহরে স্থাপন করা হয়েছিলো আল-কারাওউইন বিশ্ববিদ্যালয়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়। এরপরই আসে মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যা কিনা ফাতিমীয় খেলাফতের আমলে ৯৭০ (মতান্তরে ৯৭২) খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করা হয়। ক্রুসেডের সময় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো ত্রিপলির লাইব্রেরীর প্রায় ৩০,০০,০০০ বই। স্বর্ণযুগের মুসলিম পলিম্যাথদের(পলিম্যাথ বলতে বোঝায় এমন এক ব্যক্তিকে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যার সুদক্ষ বিচরণ হয়েছে।) মাঝে রয়েছেন আল-বিরুনী, আল-জাহিজ, আল-কিন্দী, আল রাজি, ইবন সিনা, আল-ইদ্রিসী, ইবন বাজ্জাহ, ইবন জুহ্র, ইবন তুফাইল, ইবন রুশদ আল-সুয়ূতী, জাবির ইবন হাইয়ান, আব্বাস ইবন ফিরনাস, ইবন আল-হাইথাম, ইবন আল-নাফিস, ইবন খালদুন, আল-খারিজ¥ী, আল-মাসুদী, আল-মুকাদ্দাসী এবং নাসির আল-দীন আল-তুসী।
ইতিহাস-১৬৯ ▌ইসলামের স্বর্ণযুগের অর্থণীতি ও কৃষিব্যবস্থা:
অর্থনীতি: অর্থনীতিতেও সেই যুগের উন্নতি ছিলো চোখে পড়ার মতো। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমে এবং ভারতীয় মহাসাগর থেকে চীনা সাগরের পূর্ব পর্যন্ত ছিলো তাদের বাণিজ্যিক দাপট। বিশাল বড় এ বাণিজ্যিক অবকাঠামো ছিলো দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে ইসলামী সভ্যতার উন্নতির শিখরে আরোহনের অন্যতম চালিকাশক্তি।
কৃষিব্যবস্থা: ইসলামের স্বর্ণযুগে কৃষিব্যবস্থায় এতটাই উন্নতি ঘটেছিলো যে, অনেকেই একে ‘আরবের কৃষি বিপ্লব’ বলে থাকেন। ভারত, আফ্রিকা, চীন ইত্যাদি নানা দেশ থেকে খাদ্যশস্য এনে তা ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশে উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করতেন গবেষকেরা।
ইতিহাস-১৭০ ▌ইসলামের স্বর্ণযুগের শিল্পোন্নয়ন:
সপ্তম শতাব্দী থেকেই মুসলিম বিশ্বে ওয়াটার মিলের ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিলো। সেই সময়ে মুসলিম বিশ্বে যেসব মিল ছিলো তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ফুলিং মিল, গ্রিস্ট মিল, রাইস হালার, স’ মিল, শিপ মিল, স্ট্যা¤প মিল, স্টিল মিল, সুগার মিল ইত্যাদি। এছাড়া মুসলিম প্রকৌশলীরা র্ক্যাঙ্ক শ্যাফট, ওয়াটার টার্বাইন উদ্ভাবন করেছিলেন; মিলে গিয়ার লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তারা, করেছিলেন পানি উত্তোলনের যান্ত্রিক ব্যবস্থাও। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবে এসব উদ্ভাবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো।তখনকার বিভিন্ন শিল্প-কারখানার মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলো জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত জিনিসপত্র, সিরামিক দ্রব্যাদি, রাসায়নিক পদার্থ, পাতন প্রযুক্তি, ঘড়ি, গ্লাস, জলশক্তি ও বায়ুশক্তি চালিত যন্ত্র, কাগজ, মোজাইক, পারফিউম, পেট্রোলিয়াম, ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ, সিল্ক, চিনি, বস্ত্র, অস্ত্র নির্মাণ ইত্যাদি।
ইতিহাস-১৭১ ▌ ইসলামের স্বর্ণযুগের স্থাপত্যবিদ্যা:
স্থাপত্যবিদ্যাতেও অসাধারণ নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছিলেন তৎকালীন মুসলিম স্থপতিরা। গ্রেট মস্ক অফ কাইরোওয়ান (তিউনিশিয়া), গ্রেট মস্ক অফ সামারা (ইরাক), আলহাম্বরা প্যালেস, আল হাকিম মসজিদ, গ্রেট মস্ক অফ জিয়ান (চীন) প্রভৃতি স্থাপনাগুলো যেন সেই গৌরবোজ্জ্বল সময়ের স্মৃতি বুকে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। এসব ছাড়াও শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, সঙ্গীত, নাগরিক জীবনের বহুবিধ উন্নতি, শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতি বিভিন্ন শাখায় মুসলিম সমাজ অসাধারণ উন্নতির স্বাক্ষর রাখতে সময় হয়েছিলো সেই স্বর্ণযুগে। কিন্তু এগারো শতকে শুরু হওয়া ক্রুসেড ক্রমেই অস্থিতিশীল করে তোলে গোটা মুসলিম বিশ্বকে। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে গড়ে উঠে। ১২৫৮ সালের ২৯ জানুয়ারি হালাকু খানের নেতৃত্বে মঙ্গোল বাহিনী তছনছ করে দেয় আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী, তখনকার দিনের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী বাগদাদ।
ইতিহাস-১৭২ ▌স্বর্ণযুগের আরবী ভাষা:
মধ্যযুগের কয়েক শতাব্দী জুড়ে আরবী ভাষা ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল চিন্তার বাহক। কিন্তু আজ তা ব্যাপ্ত হয়েছে কয়েক কোটি মানুষের কথ্য ভাষায়। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে অন্যান্য ভাষার তুলনায় আরবীতেই বেশি চর্চিত হয়েছে দর্শন, ইতিহাস, ধর্ম, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূবিদ্যা। পশ্চিম ইউরোপের ভাষায় আরবীর প্রভাব আজও ¯পষ্ট। বহু আরবী শব্দই এই সব ভাষার শব্দ-তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের বহু ভাষা আরবি থেকে শব্দ ধার করেছে। লাতিনের পরেই আরবী বর্ণমালার ব্যবহার হত বিশ্বে সব থেকে বেশি। পারসি, আফগান, উর্দু এবং তুর্ক, বারবার ও মালয়ের অধিকাংশ ভাষাই লেখা হত আরবী বর্ণমালায়। আরবী ভাষা একটি কেন্দ্রীয় সেমেটীয় ভাষা এবং হিব্রু ও আরামীয় ভাষার সাথে এ ভাষার ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক আছে। আধুনিক আরবিকে একটি "ম্যাক্রোভাষা" আখ্যা দেয়া হয়; এর ২৭ রকমের উপভাষা স্বীকৃত।
ইতিহাস-১৭৩ ▌ স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক আল কিন্দি (৮০১-৮৭৩ খ্রি.):
কিন্দিকে আরব ইতিহাসের অন্যতম সেরা দার্শনিকের মর্যাদা দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন একাধারে কোরআন, হাদিস, ইতিহাস, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, রাজনীতি, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, মিউজিক, মনোবিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি নানা বিষয়ে বিশারদ। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় দক্ষতা দেখালেও দর্শনের মুনশিয়ানার কারণেই তিনি বেশি খ্যাতি পেয়েছেন। কিন্দির সেরা দার্শনিক সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে ‘অন ফার্স্ট ফিলসফি’ যাকে অনেকে বলেন ‘স্টাডি অব গড’ বা সৃষ্টিকর্তার অধ্যয়ন। এই বইয়ের মূল কপি, কিন্দির নিজ হাতে লেখা। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এর পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। এছাড়া এ পর্যন্ত আল কিন্দির লেখা ২৭০টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। তার জন্ম কুফা নগরীতে এবং এখানেই শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করেছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদ যান। আব্বাসীয় খলিফারা তাকে গ্রিক বিজ্ঞান ও দর্শন গ্রন্থসমূহ আরবিতে অনুবাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
ইতিহাস-১৭৪ ▌স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক আল ফারাবি (৮৭২-৯৫১ খ্রি.):
ইসলামি সেরা দার্শনিকরূপে খ্যাতি নয়; ধর্মতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্র, সংগীতে আল ফারাবির ছিল অসামান্য জ্ঞান। আল ফারাবি বাগদাদে প্রায় ৪০ বছর অবস্থান করেন এবং এই সময়ের মধ্যে বাগদাদে মোট ছয়জন আব্বাসীয় খলিফার আবির্ভাব ঘটে। আল ফারাবি তার জীবনে অনেক ভ্রমণ করেছেন। এসব ভ্রমণ তাকে করেছিল আরও বেশি অভিজ্ঞতাস¤পন্ন। ৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মারা যান তিনি। আল মদিনা আল ফাদিলা বা আদর্শ নগর তার সব থেকে বিখ্যাত গ্রন্থ। প্লেটোর রিপাবলিকের মতো তিনিও একটি আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেছেন তার আদর্শ নগর বইতে। যে শহরের পরম লক্ষ্য হবে নাগরিকের খুশি। তিনিই প্রথম ধর্ম ও দর্শনের মাঝে তফাৎ করেন। তিনি কোনো চরম মত পোষণ করতেন না এবং চিন্তার ক্ষেত্রে পর¯পরবিরোধী মতকে প্রায়শই একসঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করেছেন। পদার্থ বিজ্ঞানে তিনিই 'শূন্যতা'-র অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন।
ইতিহাস-১৭৫ ▌ স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮ খ্রি.):
ইবনে রুশদ ছিলেন উদারবাদী দার্শনিক। রেনেসাঁর যুগে ইউরোপে তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি পরিচিত ‘অ্যাভেরোস’ নামে। দর্শনের প্রতি আকর্ষণ জন্মেছিল মূলত তার গৃহশিক্ষক এবং বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে বাজ্জাহের হাত ধরে। দর্শন ছাড়াও তিনি ইসলামি শরিয়াহ, গণিত, আইন, ওষুুধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। দর্শনশাস্ত্রে তিনি বেশি জনপ্রিয় হয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের দর্শনের সঙ্গে ইসলামি মতবাদের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করে। ইবন রুশদ আলমোহাদ খেলাফতের রাজসভার চিকিৎসক এবং প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে বহুদিন কাজ করেছেন। তাঁর পরিবারের প্রধান পেশা ছিলো বিচারকায। তিনিই প্রথম যিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রেটিনা হচ্ছে আলোক্সংবেদনশীলতার প্রকৃত স্থান। তাঁর চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই আল-কুল্লিয়াত ফি আল-তিব্ব, কয়েক শতক ধরে ইউরোপে শিক্ষায় পাঠ্য ছিল।
ইতিহাস-১৭৬ ▌ বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে খালদুন(১৩৩২-১৪০৬ খ্রি.)
তিনি চৌদ্দ শতকের একজন মুসলিম ইতিহাসবেত্তা, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং সর্বোপরি একজন দার্শনিক। তাকে আধুনিক ইতিহাস রচনা, সমাজবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির অন্যতম একজন জনক বলা হয়। তিউনিসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সে তিনি কুরআন, হাদিস, আইন, বক্তৃতা, ব্যাকরণ, দর্শন, সাহিত্যে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হচ্ছে ‘আল-মুকাদ্দিমা’, মুকাদ্দিমা’র একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য ছিল আস্যাবিয়া-এর ধারণা। সমাজের মানুষের মধ্যে পার¯পরিক বন্ধন কী করে কাজ করে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইবনে খালদুন আস্যাবিয়ার ধারণার উদ্ভব ঘটান। তিনাও প্রথম ব্যক্তি যিনি সামাজিক বিজ্ঞানের একেবারে নতুন একটি ধারা, ‘সাংস্কৃতিক বিজ্ঞান’ এর সূচনা করেন। বর্তমানে ইস্তানবুলে ইবনে খালদুন সোসাইটি নামে একটি সংগঠন রয়েছে। তারা সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় খালদুনীয় দর্শনের গুরুত্ব নিয়ে কাজ করছে।
ইতিহাস-১৭৭ ▌ স্বর্ণযুগের মুসলিম দার্শনিক ইবনে সিনা:
পশ্চিমা বিশ্বে আভিসেনা নামে পরিচিত (জীবনকাল: ৯৮০-১০৩৭), ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সেরা চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক ছিলেন। মধ্যযুগীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত রচনায় তিনি অবদান রেখেছেন। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশ্বকোষ কানুন ফিততিব্ব রচনা করেন যা ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠ্য ছিল। আরবিতে ইবন সিনাকে শায়খুল রাইস তথা জ্ঞানীকুল শিরোমণি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বহু দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে ইরানের হামাদানে তিনি চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে স্বাধীন জীবিকা উপার্জন করতেন। এর সাথে তিনি ধ্যান করতেন অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের মৌলিক বিষয়ে। এখানেই তিনি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ কিতাবুশ শিফা রচনা করেন। বিখ্যাত দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও গম্ভীর মূর্তিতে বসে থাকা তার স্বভাবে ছিল না, গল্প আর আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হতেন।
ইতিহাস-১৭৮ ▌স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী আল-খারেজমি:
(৭৮০-৮৫০) আরব সাগরে দ্বীপ খোয়ারিজম-এ জন্ম। খলিফা আল মামুনের মৃত্যুর ১৪ বছর পর আল খারিজমির মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতজ্ঞ, ভূগোলবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত, ভূগোল এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রভূত অবদান রাখেন। সর্বপ্রথম তিনিই বীজগণিতের সমীকরণ সমাধানের পদ্ধতি তিুলে ধরেন, তাই তাকে বীজগণিতের জনক বলা হয়। আলজেবরা (বীজগণিত) শব্দটিই এসেছে তার আল জিবর ওয়াল মুকাবিলা বই-এর শিরোনাম থেকে। এই বইটি ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণিতের প্রধান বই হিসেবে পড়ানো হত। এছাড়াও তিনি টলেমির এবড়মৎধঢ়যু এর বইটি সংশোধন করা। তিনি তার বইয়ে বিভিন্ন শহর এবং এলাকার অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ তালিকাভুক্ত করেন। তিনি আরও কিছু জ্যোতির্বিদ্যা লেআউট প্রস্তুত করেন এবং বর্ষপঞ্জি, সূর্যঘড়ি, অ্যাস্ট্রোল্যাব নিয়ে কাজ করেন।
ইতিহাস-১৭৯ ▌স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী আল-বেরুনি:
আবু রায়হান আল-বেরুনি (৯৭৩- ১০৪৮) ছিলেন মধ্যযুগের বিশ্বখ্যাত আরবীয় শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তিনি অত্যন্ত মৌলিক ও গভীর চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। শহরের বাইরে বসবাস করতেন বলে সাধারণভাবে তিনি আল-বেরুনি নামে পরিচিত। রুশীয় তুর্কিস্তানের খিওয়ায় এটি অবস্থিত ছিল। বর্তমানে শহরটি নদীতে বিলীন হয়ে গিয়েছে। তিনি ছিলেন গণিত, জ্যোতিঃপদার্থবিদ, রসায়ন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পারদর্শী। অধিকন্তু ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক, পঞ্জিকাবিদ, দার্শনিক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ববিদ ও ধর্মতত্ত্বের নিরপেক্ষ বিশ্লেষক। স্বাধীন চিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, সাহসিকতা, নির্ভীক সমালোচক ও সঠিক মতামতের জন্য যুগশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত। তিনি সর্বপ্রথম প্রাচ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি সর্বমোট ১১৪টি গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার বিধৃত ধারণ করা হয়েছে।
ইতিহাস-১৮০ ▌স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ও চিকিৎসক আল রাযী:
আল-রাযি (৮৬৫ - ৯২৫) একজন দক্ষ পারসিক চিকিৎসক এবং দার্শনিক। তিনি ইরানের তেহরানে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি সালফিউরিক এসিড আবিষ্কার করেন। তিনি ইথানল উৎপাদন, বিশোধন, ও চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ নিতে তখন তিনি বাগদাদে আসেন। ভীষণ মেধাবী এই মানুষটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক অবদান রেখেছেন, যা ছড়িয়ে আছে তার রচিত দু’শরও বেশি বইয়ের পাতায়। তার লেকচারের আকর্ষণে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক শিক্ষার্থী এসে তার ক্লাসে ভিড় জমাত। মানুষ হিসেবে আল রাযি মহৎ এবং উদারমনা ছিলেন। তিনি দরিদ্র রোগীদের থেকে টাকা নিতেন না। বাগদাদ নগরীতে তার একটি পরীক্ষাগার ছিল। তার রচিত অনেক বই পাশ্চাত্যের চিকিৎসাশিক্ষায় পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো। ইরানে প্রতিবছর ২৭শে আগস্ট রাযি দিবস পালন করা হয়।
’ইতিহাস-১৮১ ▌স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ সংস্কারক ইমাম আল-গাজ্জালি:
ইমাম গাজ্জালী (১০৫৮ - ১১১১) ইরানের খোরাসানের তুশ নগরীতে জন্মগ্রহণ এবং মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ তখনকার সময়ে একজন স্বনামধন্য সূতা ব্যাবসায়ী ছিলেন। গাজল অর্থ সূতা, তার বংশকে গাজ্জালী নামে পরিচিত করেছে। তিনি পরিণত বয়সে বাগদাদ গমন করেন। বাগদাদে তৎকালীন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ নিযামিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যাপনায় যোগ দেন। মুসলিম দর্শন, ফিকাহ, ইলমুল কালাম (ধর্মতত্ত্ব) বিষয়ে তিনি সর্বকালের প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদের একজন। ইমাম গাজ্জালীর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতি ছিল অগাধ তৃষ্ণা। তিনি সমকালীন রাজনীতিতে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেন যে, সালজুকী শাসক ও আব্বাসীয় খলিফার মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ দুর করার জন্যে তার খেদমত হাসিল করা হতো। তিনি ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও মুলনীতিসমূহের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা পেশ করেন, যা তাকে ইসলামি শ্রেষ্ঠ প-িতরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে।
ইতিহাস-১৮২ ▌স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক আল-জাহরাবি:
আবুল কাসিম আল জাহরাউয়ি ছিলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ শল্যচিকিৎসক এবং আধুনিক সার্জারির জনক। এই মুসলিম চিকিৎসক আন্দালুসিয়ানে খলিফা দ্বিতীয় আল হাকামের রাজচিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে তার লেখা বইয়ের নাম কিতাবুল তাসরিফ। এটি চিকিৎসা সংক্রান্ত ৩০ খন্ডের বিশ্বকোষ। শল্যচিকিৎসার প্রক্রিয়া ও যন্ত্র নিয়ে তার অবদান প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে আধুনিক কালেও প্রভাব ফেলেছে। কিছু কিছু বিষয়ে এখনও ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসকদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম এক্টোপিক গর্ভধারণ নিয়ে বর্ণনা করেছেন। হায়মোফিলিয়াকে তিনি সর্বপ্রথম বংশগত বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেন। মধ্যযুগে তার রচিত বিশ্বকোষটি ছিল অক্সিজেনস্বরূপ। সার্জারি থেকে শুরু করে মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, অপথ্যালমোলজি, অর্থোপেডিকস, প্যাথলজি, দন্তবিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান, শিশু চিকিৎসা- সবই অন্তর্ভুক্ত ছিল আল তাশরিফের ত্রিশ খণ্ডে।
ইতিহাস-১৮৩ ▌স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম গনিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাসান ইবনুল হায়সাম:
পশ্চিমা বিশ্বে তিনি তার ল্যাটিনকৃত নাম আল-হাজেন হিসেবেও পরিচিত) ইসলামি স্বর্ণযুগের একজন আরব গনিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানী। তাকে "আলোকবিজ্ঞানের জনক" বলা হয়। তার সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী কাজ হচ্ছে তার কিতাবুল মানাজির ("আলোকবিদ্যার গ্রন্থ")। তিনি একজন বহুবিদ্যাবিশারদ যিনি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব স¤পর্কেও লিখেছেন। তিনি বসরায় জন্মগ্রহণ করলেও তার কর্মজীবনের বেশিরভাগ কাটিয়েছেন ফাতেমীয় খিলাফতের রাজধানী কায়রোতে। সেখানে তিনি শিক্ষকতা ও গবেষণা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি টলেমির আলমাজেস্ত এ গ্রহসমূহের গতি-প্রকৃতির গাণিতিক প্রকাশ নিয়ে আলোচনা করে। তিনি দুইশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার মধ্যে ৯৬ টি বৈজ্ঞানিক কর্ম ২৩ টি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর, ১৪ টি আলোকবিজ্ঞানের উপর এবং অন্যান্যগুলির অধিকাংশ গনিতের উপর।
ইতিহাস-১৮৪ ▌ স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম গনিতবিদ, জ্যোতির্বিদ নাসিরুদ্দীন তুসী:
নাসির আল দীন তুসী জন্মগ্রহণ করেন ইরানের তুস নামক এলাকাতে ১২০১ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তুসীকে ত্রিকোণমিতির উদ্ভাবক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনিই প্রথম ত্রিকোণমিতিকে একটি স্বতন্ত্র গাণিতিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। নাসির উদ্দিন তুসি প্রায় ৫৬টি বই লিখেন। এরমধ্যে শুধু জ্যামিতি, গোলাকার ত্রিকোণমিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞান স¤পর্কে মোট ষোলটি গ্রন্থ রচনা করেন। জার্মান প্রাচ্যবিদ কার্ল ব্রোকেলম্যান মনে করেন নাসির উদ্দিন তুসি বড় ধরনের অবদান রেখেছেন গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায়। নাসির উদ্দিন তুসি বিজ্ঞান স¤পর্কিত অনেক বই অনুবাদ করেছিলেন জ্যোতির্বিদ্যার ওপরও কয়েকটি মূল্যবান রচনা রেখে গেছেন ইরানের এই মনীষী। গণিত বিষয়ে নাসির উদ্দিন তুসির বইগুলো মুসলিম প-িত বা আলেমদের শিক্ষা-কারিকুলামে স্থান পেয়েছিল। নাসির উদ্দিন তুসির অনেক বই অনুদিত হয়েছিল কয়েকটি বিদেশী ভাষায়।
ইতিহাস-১৮৫ ▌ স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনুন নাফিস:
১২১৩ খ্রিস্টাব্দে ইবনুন নাফিস সিরিয়ার দামেস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম জীবন অতিবাহিত করেন দামেস্কে, ইবনুন নাফিস কেবল মাত্র একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানীই ছিলেন না; বরং তিনি সাহিত্য, আইন, ধর্ম ও লজিক শাস্ত্রেও অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বহু বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন । রক্ত চলাচল সম্বন্ধে তৎকালীন প্রচলিত গ্যালেনের মতবাদকে ভুল প্রমাণ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১৩০০ শতাব্দীতে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন তিনি। মানবদেহে বায়ু ও রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন ইবনুন নাফিস। তিনি মানবদেহে রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি, ফুসফুসের সঠিক গঠন পদ্ধতি, শ্বাসনালি, হৃৎপিন্ড, শরীরে শিরা উপশিরায় বায়ু ও রক্তের প্রবাহ ইত্যাদি স¤পর্কে ইতিহাস দিয়ে বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেন। তিনি হাদীসশাস্ত্রের উপরও কয়েকখানা ভাষ্য লেখেন।
ইতিহাস-১৮৬ ▌স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম ভূগোলবিদ আল-ইদ্রিসি:
আল-ইদ্রিসি (১১০০ - ১১৬৫) ছিলেন একজন আরব মুসলিম ভূগোলবিদ, মানচিত্রাঙ্কনবিদ । মরোক্কান আরব মুসলিম আল-ইদ্রিসি উত্তর আফ্রিকা এবং আল-আন্দালিয়াসের বৃহত হাম্মুদিদ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর প্রাথমিক জীবনের বেশিরভাগ সময় উত্তর আফ্রিকা এবং আল-আন্দালুস (তৎকালীন মুসলিম ¯েপন) দিয়ে কাটিয়েছিলেন। তিনি সেই কার্টোগ্রাফার এবং মিশরবিজ্ঞানী যিনি পিসারমোতে সিসিলির রাজা দ্বিতীয় রাজার দরবারে বসবাস করতেন। তিনি ‘তাবুল রোজারিয়ানা’ তৈরি করেছিলেন, যা ছিল মধ্যযুগীয় এক অন্যতম উন্নত মানচিত্র। যা ক্রিস্টোফার কলম্বাস এবং ভাস্কো দা গামার মতো গবেষকরা তাদের আবিষ্কার এবং ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করেছিলেন। এই ভূগোল গ্রন্থের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ ১৫৯২ সালে রোমে এবং ১৬১৯ সালে প্যারিসে প্রকাশিত হয়েছিল, যা পশ্চিম ইউরোপের পরবর্তী গবেষণায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
ইতিহাস-১৮৭ ▌ স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম রসায়নবিদ জাবির ইবনে হাইয়ান:
জাবির ইবনে হাইয়ান(৭২২-১৮১৫) ছিলেন একাধারে রসায়নবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী দার্শনিক, পদার্থবিজ্ঞানী এবং ঔষধ বিশারদ ও চিকিৎসক। দক্ষিণ আরবেই জাবির ইবনে হাইয়ানের শিক্ষালাভের কার্যক্রম শুরু হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এখানে গণিতের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ পারদর্শী বলে খ্যাত হয়ে উঠেন। শিক্ষা সমাপ্তির পর জাবির ইবনে হাইয়ান পিতার কর্মস্থল কূফা নগরীতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি প্রথমে চিকিৎসা ব্যবসা আরম্ভ করেন এবং এ সূত্রেই তৎকালীন বিখ্যাত প-িত ইমাম জাফর সাদিকের অনুপ্রেরণায় তিনি রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেন। তিনি রসায়নের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছিলেন যার অনেকগুলো এখনও ব্যবহৃত হয়। যেমন: হাইড্রোক্লোরিক ও নাইট্রিক এসিড সংশ্লেষণ, পাতন এবং কেলাসীকরণ। তিনি দুই হাজারেরও বেশি ছোট ছোট গ্রন্থ রচনা করেন।
ইতিহাস-১৮৮ ▌ স্বর্ণযুগের বিখ্যাত মুসলিম হাদীস বিশারদ ইবনে মাজাহ:
ইবনে মাজাহ মধ্যযুগের ইরানী হাদীস বিশারদ। তিনি হাদিস বিষয়ক ছয়টি প্রধান গ্রন্থের সর্বশেষটি, সুনান-এ-ইবনে মাজাহ-এর সংকলক। তিনি ৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের প্রসিদ্ধ শহর কাযভীনে জন্মগ্রহণ করেন। মুসলিম জাহানের তৃতীয় খলীফা ওছমান বিন আফফান-এর খেলাফতকালে এ শহরটি বিজিত হয়। শিক্ষাজীবন : ইমাম ইবনু মাজাহ নিজ দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন। এরপর তিনি কুরআনুল কারীম হিফয স¤পন্ন করেন। অতঃপর উচ্চশিক্ষা অর্জন এবং হাদীছ সংগ্রহের জন্য তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ ও জনপদের যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছদের দ্বারস্থ হয়েছেন। ইমাম ইবনু মাজাহ ৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে ২২ বছর বয়সে হাদীছ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শহরের মুহাদ্দিছগণের নিকটে গমন করেন। হাদীছ সংগ্রহের জন্য কষ্টকর দেশ ভ্রমণের পরে তিনি ১৫ বছরের অধিক সময় ইলম চর্চায় নিমগ্ন থাকেন। বয়স ছিল ৬৪ বছর।
ইতিহাস-১৮৯ ▌বিখ্যাত মুসলিম সংস্কারক ইইবনে তাইমিয়া:
হিজরি অষ্টম শতকে মুসলিম ইতিহাসে সংস্কার,বিপ্লব ও পুনর্জাগরণের নেতৃত্ব দিয়েছেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র.)। তিনি এমন এক নাযুক ও দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বেড়ে উঠেছেন, যখন হালাকু খানের নেতৃত্বে তাতারি হামলায় মুসলিম বিশ্বের গৌরবময় রাজধানী বাগদাদ স¤পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। শায়খুল ইসলামের পিতা আব্দুল হালিম ইবন তায়মিয়াও (র.) ছিলেন হাম্বলি মাজহাবের উঁচু মাপের একজন ফকিহ। তিনি দামেস্কের প্রসিদ্ধ ‘জামি উমাইয়্যা’ মসজিদে দরস প্রদান করতেন। জ্ঞানের সব শাখায় পান্ডিত্য অর্জন করে মাত্র ২২ বছর বয়সে ‘দারুল হাদিস আসসুকরিয়া’য় দরস প্রদান শুরু করেন। তার ফতোয়া সংকলন ‘ফতোয়ায়ে ইবন তায়মিয়া’ এবং সৌদি সরকার কর্তৃক ত্রিশ খন্ডে প্রকাশিত ফকাহ শাস্ত্রের একটি পূর্ণঙ্গ বিশ্বকোষ। তার মেজাজে এক ধরনের ক্ষিপ্রতা ও উগ্রতা ছিল ফলে তাকে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়, এমনকি তিনি বিবাহও করতে পারেননি।
ইতিহাস-১৯০ ▌বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ ও কুরাআনের অন্যতম বিশুদ্ধ তাফসীরকারক ইমাম ইবনে কাসির:
তাঁর উপাধি ‘ইমাদ আদ্ব-দ্বীন, দ্বীনের স্তম্ভ’। ৭০৬ হিজরীতে ইবনে কাসীর দামেস্কে যান তাঁর বড় ভাই আবদুল ওয়াহাব এর সাথে, যিনি তাঁকে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর লালন-পালন করেন, শিক্ষা দান করেন। ইমাম ইবনে কাসীর ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁকে তাঁর উস্তাদ ইমাম ইবনে তাইমিয়ার পাশেই সমাধিস্ত করা হয়। তিনি হচ্ছেন কুরাআনের অন্যতম বিশুদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ তাফসীর আল-কুর’আন আল-আজীম ও সর্বাধিক বিশুদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া এর লিখক। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইবনে কাসীর গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার মধ্যে এমনকি কাব্যও আছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার হল। ০১। তাফসীর আল-কোরআন আল-আজীম : ০২। আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া : সৃষ্টির শুরু থেকে বিশ্বের শেষ, এমনকি এসকেটলজি পর্যন্ত আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটি ১৪ খন্ডে মুদ্রিত হয়েছে।
ইতিহাস-১৯১ ▌ বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে হিশাম:
ইবনে হিশাম সিরিয়ার বসরাতে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর তিনি মিসরে গমন করেন। সেখানে দ্বিতীয় হিজরির শেষাংশ এবং তৃতীয় হিজরির প্রথার্ধ অতিবাহিত করেন। মিসরে অবস্থানকালে তিনি ইমাম শাফেয়ি রহমাতুল্লাহি আলাইহির সান্নিধ্য লাভ করেন। যা ছিলো আব্বাসীয় খেলাফতের বিকাশকাল। ইবন ইসহাক এর রচিত সীরাতুর রাসুলুল্লাহ সংশোধনকারী হিসাবে ইবন হিশাম জগতে প্রসিদ্ধ লাভ করেন। তিনি একাধারে হাদিসবেত্তা, বংশ লতিকা বিশারদ,ঐতিহাসিক ও ভাষা বিজ্ঞানী হিসেবে জগতের সর্বাধিক খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছেন। তিনি আলোচিত বিষয়গুলোকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। তা হলো-ক. জাহিলি যুগের ইতিহাস। যেখানে তিনি মোহাম্মদ(স.)-এর বংশসহ অন্যান্য আরব গোত্রগুলোর ইতিহাস আলোচনা করেছেন। খ. মক্কা ও মদিনায় হজরত মোহাম্মদ(স.)-এর জীবন ও ইতিহাস। গ. হজরত মোহাম্মদ(স.)-এর যুদ্ধ অভিযানসমূহ।
ইতিহাস-১৯২ ▌ বিখ্যাত সিরাত গ্রন্থকার ইবনে ইসহাক:
মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (রহ.) ৮৫ হিজরি সনে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। মদিনাতেই তিনি যৌবন কাটান। এরপর তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে বের হন। মিসর থেকে তিনি আল জাজিরা, কুফা, বুহায়রা এবং সর্বশেষে বাগদাদ সফর করেন। এখানেই তার সঙ্গে আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি তাকে ছেলে মাহদির জন্য একটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করতে বলেন। খলিফা নির্দেশ দেন, তিনি যেনো এমন একটি গ্রন্থ রচনা করেন যেখানে হজরত আদম (আ.) থেকে ওই সময় সময় পর্যন্ত ঘটে যাওয়া যাবতীয় বিষয়ের উল্লেখ থাকে। খলিফার নির্দেশ মতেই ইবনে ইসহাক (রহ.) তার অমর গ্রন্থখানি রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে সব নবী ও রাসূলদের জীবন ও ইতিহাস একত্রিত করেছেন। ইমাম ইবনে ইসহাক (রহ.) বাকি সময়টুকু বাগদাদেই অতিবাহিত করেন এবং এখানেই ১৫২ হিজরি সনে তার ইন্তেকাল হয়।
ইতিহাস-১৯৩ ▌ বিখ্যাত ঐতিহাসিক আত তাবারি:
আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারির আল তাবারি (৮৩৯-৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন বর্তমান ইরানের অন্তর্গত মাজানদারানের তাবারিস্তানের একজন খ্যাতনামা ও প্রভাবশালী পারসিয়ান প-িত, ইতিহাসবিদ ও মুফাসসির। ইসলামি বিষয়াদি ও ইতিহাসের উপর তার পান্ডিত্যের কারণে বর্তমানকালেও তিনি সমাদৃত। তিনি কাব্য, অভিধান, ব্যাকরণ, নীতিশাস্ত্র, গণিত ও চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়েও লিখেছেন। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও পরিচিত কর্ম হল তাফসির আল তাবারি এবং তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ তারিখ আল রসুল ওয়াল মুলুক (ইংরেজিতে “হিস্ট্রি অব দ্য প্রফেটস এন্ড কিংস” বলে পরিচিত) যা তারিক আল তাবারি বলেও ডাকা হয়। তিনি তার নিজস্ব মাজহাব স্থাপন করেন যা সাধারণত তার নাম অনুসারে জারিরি বলা হয়। কিন্তু এ মাজহাব তেমন প্রসিদ্ধি পায়নি। তাঁর জন্মস্থান ইরানের কা¯িপয়ান সাগরের তীরবর্তী পাহাড়ঘেরা তাবারিস্তানের আমুল শহরে। মাত্র সাত বছর বয়সে পবিত্র কুরআন হিফজ এবং ১২ বছর বয়সে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, ইরানের ইতহাস ঐতিহ্যের ওপর গভীর জ্ঞান অর্জন করেন তিনি।
ইতিহাস-১৯৪ ▌ বিখ্যাত ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী (রহ.):
ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী হাদীস সংকলনের অগ্রপথিক,খলিফা উমর বিন আব্দুল আযীযের শাসনামলে হাদীস সংকলনের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গৃহীত হয়। হাদীস বিশেষজ্ঞ বড় তাবেয়ীদের এই মহান প্রয়াসে আহবান জানানো হয়। খলীফার আদেশে এগিয়ে আসেন ইমাম যুহরী। তিনি হয়ে উঠেন এই উদ্যোগের কেন্দ্রীয় ব্যাক্তিত্ব। এভাবে হিজরী প্রথম শতাব্দীর গোড়াতেই সর্ব প্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হাদীস সংকলন করেন ইমাম যুহরী। ৫১ হিজরীর মদীনায় জন্ম ইমাম যুহরীর। এ মহান মনীষী অত্যন্ত বিনয়ী, দানশীল ও মহানুভব ছিলেন। পথঘাটে মানুষের জন্য পানি পানের ব্যবস্থা করা, মানুষের প্রয়োজন পুরা করা ও অভাব-অনাথ মানুষের পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি সেবামূলক কাজের জন্য তাঁর খ্যাতি ছিল। মহান ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী রহ. ১২৪ হিজরিতে শাম ও ফিলিস্তিনের মাঝামাঝি সীমাস্তবর্তি এক গ্রামে ইন্তেকাল করেন।
ইতিহাস-১৯৫ ▌স্বর্ণযুগের বিখ্যাত কবি ফেরদৌসী (৯৪০-১০২০ সাল):
পারস্যের (বর্তমান ইরান) একজন বিখ্যাত কবি। তিনি বিখ্যাত মহাকাব্য শাহনামার রচয়িতা। সপ্তম শতাব্দীতে ফেরদৌসী মূলত সামানীয়ান সাম্রাজ্যের রানির জন্য লিখেছিলেন। কিন্তু পারস্যে মুসলিম বিপ্লবের পর যখন সামানীয়ান সাম্রাজ্যের পতন হয় তখন ফেরদৌসী নতুন শাসক মাহমুদ গজনবিকে তার লেখা উৎসর্গ করেন। মাহমুদ ছিলেন পারস্যের শিল্প ও সাহিত্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। ফেরদৌসী ৩০ বছরের (৯৭৭-১০১০) অধিক সময় নিয়ে তিনি এই মহাকাব্য রচনা করেন যা ইরানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ব্যাপক সমৃদ্ধ করেছে। শাহনামা হচ্ছে প্রাচীন ইরানের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন কাব্যগাথা। এতে আছে ৯৯০টি অধ্যায়, ৬২টি কাহিনি। পুরো মহাকাব্যে ৬০ হাজার বার আছে অন্ত্যমিল। এটি হোমারের ইলিয়ড-এর চেয়ে সাত গুণ ও জার্মান মহাকাব্য নিবেলুঙগেনলিয়েড-এর (ঘরনবষঁহমবহষরবফ) চেয়ে ১২ গুণ বড়।
ইতিহাস-১৯৬ ▌বিখ্যাত কবি শেখ সাদি:
শেখ সাদি ছিলেন মধ্যযুগের গুরুত্বপূর্ণ ফার্সি কবিদের অন্যতম। ফারসিভাষী দেশের বাইরেও তিনি সমাদৃত। তার লেখার মান এবং সামাজিক ও নৈতিক চিন্তার গভীরতার জন্য তার কদর করা হয়। ধ্রুপদি সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাদিকে একজন উচু মানের কবি ধরা হয়। তিনি তার লেখার মানের জন্য এবং তার সামাজিক এবং নৈতিক চিন্তার গভীরতার জন্য স্বীকৃত। তিনি পার্সিয়ান প-িতদের মধ্যে "মাস্টার অফ ¯িপচ" শিক্ষক বা "দ্য মাস্টার" (শিক্ষক) ডাকনাম অর্জন করেন। পশ্চিমা ঐতিহ্যগুলিতেও তাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান অনুসারে বুস্তান সর্বকালের সেরা ১০০ টি বইয়ের একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। তার লেখায় তিনি আল-আজহারের কাদিস, মুফতি, র্গ্যান্ড বাজার, সংগীত ও শিল্পের উল্লেখ করেছেন। সাদি সুফীদের সাথে যোগ দেয় যারা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে কঠোর লড়াই করেছিল। সাদিকে একবার ক্রুসেডাররা বন্দী করেছিল যেখানে সে তার দুর্গের বাইরে খননকাজ করার জন্য দাস হিসাবে সাত বছর অতিবাহিত করেছিল। পরে ক্রুসেডার অন্ধকূপে বন্দি মুসলিম বন্দীদের মামলুকরা মুক্তিপণ দেওয়ার পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইতিহাস-১৯৭ ▌ আল-জাজারি:
তার জন্ম ১১৩৬ সালে তৎকালীন মেসোপটেমিয়ার জাজিরাত এলাকায়। পারিবারিকভাবেই তিনি প্রকৌশলবিদ্যা রপ্ত করেন এবং ১১৮১ সাল থেকে তিনি তুরস্কের আনাতোলিয়ার দিয়ারবাকির রাজ্যের সুলতান নাসিরুদ্দিনের দরবারের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। আল-জাজারি ছিলেন একাধারে একজন যন্ত্র প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, গণিতবিদ, শিল্পী ও দক্ষ কারিগর। তার আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ঘড়ি, দৃষ্টিনন্দন ঝর্ণা, হাত ধোয়ার যন্ত্র, পানি উত্তোলন যন্ত্র, সুরযন্ত্র, স্বয়ংক্রিয় ফটক ইত্যাদি। তার লেখা একটি বইয়ে, মোট ১০টি অধ্যায় আছে। এ অধ্যায়গুলোতে তিনি বিভিন্ন ধরনের ঘড়ি নির্মাণের বিবরণ দিয়েছেন। যেমন দুর্গঘড়ি, নৌকাঘড়ি, ময়ূরঘড়ি, মোমঘড়ি ইত্যাদি। তবে সেরা আবিষ্কার হচ্ছে তার হস্তিঘড়ি বা এলিফ্যান্ট ক্লক।
ইতিহাস-১৯৮ ▌ কুতুব আল দীন আল সিরাজি:
জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, সঙ্গীতশাস্ত্র আর চিকিৎসাশাস্ত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি তিনি সুফিবাদ আর দর্শন চর্চায়ও পিছিয়ে ছিলেন না। ১২৩৬ সালের অক্টোবর মাসে ইরানের একটি সুফি পর¤পরার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আল সিরাজি। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই সিরাজি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন! ২৪ বছর বয়সে তিনি ডাক্তারি পেশা ছেড়ে হঠাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানের মনোযোগী হন। তিনি সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী নাসির আল দীন আল তুসি এবং মাওলানা জালালুদ্দীন রুমীর মতো বিখ্যাত প-িতের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১২৮০ কিংবা ১২৮২ সালে সিরিয়ায় ইবনে সিনার দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষা দিতে শুরু করেন। সিরাজির শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘নেহায়াত আল এদরাক’। ফাতহ আল মান্নান ফি তাফসির আল কুরআন- ৪০ খ- রচিত এই মহাগ্রন্থটি হচ্ছে পবিত্র কুরআনের ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সমৃদ্ধ চমৎকার একটি গ্রন্থ।
ইতিহাস-১৯৯ ▌ইমাম বুখারী (রহ.):
তিনি ১৩ই শাওয়াল শুক্রবার, ১৯৪ হিজরীতে (৮১০ খ্রিস্টাব্দ) খোরাসানের বুখারাতে (বর্তমানে উজবেকিস্তানের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত হাদীসবেত্তা। ‘বুখারী শরীফ’ নামে একটি হাদীসগ্রন্থটি তিনিই সংকলন করেন। যা মুসলমানদের নিকট হাদীসের সবোর্ত্তম গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। এই গ্রন্থে তিনি সকল সহিহ হাদীস সংকলন করেননি। বরং সহিহ হাদীসের মাঝে যেগুলো তার নির্ধারিত শর্তে উন্নীত হয়েছে,সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি স্বীয় শিক্ষক ইসহাক বিন রাহওয়াইহ থেকে এই গ্রন্থ রচনার প্রেরণা লাভ করেন। শিশুকালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর মাতার তত্বাবধানে তিনি প্রতিপালিত হন। দশ বছর বয়সে উপনীত হয়ে তিনি জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। ষোল বছর বয়সে তিনি মা এবং বড় ভাইয়ের সাথে হজ্জে গমন করেন। হজ্জের পর তিনি মক্কাতে রয়ে গেলেন এবং হিজাযের হাদীসবিশারদদের কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করতে থাকলেন। এ সময় তিনি "কাজায়াস সাহাবা ওয়াত তাবীয়ীন" নামক গ্রণ’ রচনা করেন। এরপর হাদীস অন্বেষণের জন্য তিনি ইরাক, সিরিয়া ও মিশরসহ বহু অঞ্চলে সফর করেন। ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-২০০ ▌হাসান বসরি:
তাঁর জীবনকাল ৬৪২-৭২৮ খ্রীস্টাব্দ। তিনি পারস্য বংশোদ্ভুত পিতামাতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন; সুফি সাধনার দিক দিয়ে তিনি হযরত আলীর অনুসারী ছিলেন। তিনি ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সমগ্র বসরার প্রায় সকল মানুষ তাঁর জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন। ব তাঁর ব্যক্তিত্ব সমসাময়িক সুফি সাধকদের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি যে সকল সাহাবীদেরসহচার্যে লাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে ৭০ জন সাহাবী ছিলেন যারা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের জন্য হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি মনি-মুক্তার ব্যবসা করতেন। এজন্য তাকে বিভিন্ন দেশ দেশান্তরে সফর করতে হতো। এই উপলক্ষে একবার তিনি রোমে সফর করেন এবং সেখানে এক বিষাদময় ভয়ংকর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। এরপর থেকে তিনি পার্থিব জীবনের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় লিপ্ত হয়ে পড়েন। কোরআন সুন্নাহর আলোকে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে তার চেষ্টায় তাসাউফ শাস্ত্র সুবিন্যাস্ত রূপ লাভ করে।