হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য
তথ্য ও জ্ঞান (২১-৫০)
হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য
তথ্য ও জ্ঞান (২১-৫০)
০২১ ▌ভারতীয় দর্শন, তক্ষশীলা ও নালন্দা :
প্রাচীনতম ভারতীয় সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক কপিল মুনি। এ দর্শনের উদ্ভবকাল গৌতম বুদ্ধের পূর্বে খ্রি.পূ অষ্টম শততে বলে স্বীকৃত। ভারতীয় দর্শনের প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: আস্তিক্য এবং নাস্তিক্য দর্শন। আস্তিক শাখায় রয়েছে ৬টি দর্শন, যাদেরকে আস্তিক ষড়দর্শন বলা হয়, যথা- ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা এবং বেদান্ত দর্শন। আর নাস্তিক ধারার মধ্যে রয়েছে- বৌদ্ধ, জৈন এবং চার্বাক দর্শন। ভারতীয় দর্শনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত চার্বাক দর্শন। পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখ ভোগই মানুষের একমাত্র কাম্য বলে চার্বাকরা মনে করত। একমাত্র চার্বাক বাদে বাকি সব ভারতীয় দর্শন তিনটি মৌলিক দার্শনিক চিন্তা নিয়ে কথা বলে: আত্মা, কর্ম এবং মোক্ষ। এর মধ্যে কেবল আত্মার ধারণাটিই পুরোপুরি এবং অনন্যভাবে ভারতীয়। চার্বাকদের মত: যেহেতু ঈশ্বর প্রত্যক্ষযোগ্য নন, সেহেতু তাঁর কোনো অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে মানুষের দুঃখমোচনই বৌদ্ধদর্শনের একমাত্র লক্ষ্য। আর জৈনরা দ্বৈতবাদে বিশ্বাসী।
তক্ষশীলার সূচনা কম করে হলেও সম্ভবত খিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে। ৫ম শতাব্দীর দিকে শ্রীলংকায় লিখিত জাতক কাহিনীতেও তক্ষশীলার বর্ণনা আছে। তক্ষশীলার অবস্থান পাকিস্তানের ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির মাঝামাঝি। প্রাচীন তক্ষশীলা শহর ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, কালক্রমে তক্ষশীলা বৌদ্ধদের বিহার ও শিক্ষাকেন্দ্রে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। বৌদ্ধ রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে, হিন্দু রাজারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তশালী হয়ে উঠে। এসময় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্ব হারায়। প্রায় ১০ হাজার ছাত্রের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি হতো ১৬ বৎসর বয়সে। এই সময় এরা বেদ অধ্যয়ন করতো। ১৮ বৎসর বয়স থেকে ছাত্রদের শেখানো হতো শিল্পকলা, তীর নিক্ষেপ, শিকার, আইন, চিকিৎসা এবং সমরবিদ্যা। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রগুলো ছিল- বেদ, ভাষা, ব্যাকরণ, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র (আয়ুর্বেদ), ধনুর্বিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, জ্যোতিঃশাস্ত্র, হিসাব বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, সঙ্গীত ও হস্তশিল্প।
নালন্দা ভারতের বিহারের রাজধানী পাটনার কাছে। ঐতিহাসিকদের মতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে। খ্রিষ্টীয় ৪২৭ অব্দ থেকে ১১৯৭ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে নালন্দা ছিল একটি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র। বিশেষজ্ঞরা এই মহাবিহারকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম বলে মনে করেন। ঐতিহাসিকদের মতে গুপ্ত সম্রাট শক্রাদিত্যের রাজত্বকালে নালন্দা মহাবিহারের বিকাশলাভ ঘটে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন এবং পাল সম্রাটগণও এই মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন। তৎকালীন জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই চর্চার সুযোগ থাকায় সুদূর কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য এবং তুরস্ক থেকে জ্ঞান পিপাসুরা এখানে আসতেন। নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে পূর্বভারতের বৌদ্ধধর্মে তান্ত্রিক রীতিনীতির আবির্ভাব ঘটলে এই মহাবিহারও ধীরে ধীরে পতনের পথে ধাবিত হয়।
০২২ ▌প্রাচীন বাংলা, উয়ারী-বটেশ্বর ও চর্যাপদ:
খ্রিস্টীয় তেরো শতকের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় দু’ হাজার বছরের সময়কে বাংলার প্রাচীন যুগ বলে ধরা হয়ে থাকে। প্রাচীনযুগে বাংলা নামে কোনো অখন্ড রাষ্ট ছিল না। বাংলার বিভিন্ন অংশ তখন ১৬টি জনপদে বিভক্ত ছিল। যেমন- পুন্ডু: বৃহত্তর বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর নিয়ে গঠিত। বরেন্দ্র : রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর এবং ভারতের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দার্জিলিং ও কোচবিহার। গৌঢ় : ভারতের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানের কিছু অংশ বঙ্গ : বৃহত্তম ঢাকা ও ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর সমতট : কুমিল্লা ও নোয়াখালী হরিকেল : শ্রীহট্ট (সিলেট) থেকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঢ়: পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলা। চন্দ্রদ্বীপ : বরিশাল, খুলনা এবং সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল। কামরূপ: রংপুর, জলপাইগুড়ি, আসামের কামরূপ জেলা, তাম্রলিপি: মেদিনীপুর জেলা। আরাকান: কক্সবাজার, মায়ানমারের কিছু অংশ, কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণাঞ্চল। বং শব্দ থেকেই বঙ্গের উৎপত্তি। এই বং একটি চৈনিক শব্দ, যার অর্থ জলাশয় বা নদীমাতৃক এলাকা। এই ভু-অঞ্চলের আশপাশ নদীবেষ্টিত বলেই বংগ শব্দের উৎপত্তি। ‘বংগ’ শব্দটি থেকে ‘বংগদেশ’, ‘গৌড়ীয় বাংলা’, ‘বঙ্গীয় এলাকা’, ‘সুবে বাঙ্গাল’, ‘বঙ্গীয় ফোর্ট বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী, ‘পূর্ব বংগ’, পূর্ব পাকিস্তান’ এবং অবশেষে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম।
উয়ারী ও বটেশ্বর নামীয় দুটি গ্রামব্যাপী একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নরসিংদীর বেলাব উপজেলায় অবস্থিত । ২০০০ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত কিছু প্রতœ নিদর্শনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস এবং নিউজিল্যান্ড তিনটি দেশের পরীক্ষাগারে কার্বন-১৪ পরীক্ষার প্রেক্ষিতে উয়ারীর বসতিকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। উয়ারী-বটেশ্বর ছিল একটি সমৃদ্ধ, সুপরিকল্পিত, প্রাচীন বাণিজ্য কেন্দ্র। সাম্প্রতিক প্রতœতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত হয়েছে পেরেক, লৌহমল, লৌহ গলানোর ফলে অতি ক্ষুদ্র বল, মরিচাপড়া লৌহবস্তু প্রভৃতি। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, এ স্থানে উচ্চ তাপমাত্রায় লোহা গলানোর প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল। উয়ারী-বটেশ্বরের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল। কারণ প্রাপ্ত মৃৎপাত্র, কাচের পুঁতি, স্বর্ণ আবৃত কাঁচের পুঁতি, টিন মিশ্রিত ব্রোঞ্জ ইত্যাদি সব উপকরণ এ তথ্যের সত্যতার প্রমাণ দেয়। গর্ডন চাইল্ডের মতে, উয়ারী- বটেশ্বর অঞ্চলটি টলেমি (দ্বিতীয় শতকের ভূগোলবিদ) উল্লেখিত ‘সোনাগড়া’। এখানে খননের ফলে ১৬০ মিটার দীর্ঘ রাস্তা আবিষ্কৃত হয়েছে।
চর্যাপদ শুধু প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেরই নিদর্শন নয়, প্রাচীন বাংলা গানেরও নিদর্শন। এর প্রতিটি পদের শুরুতে রাগ-তাল ও প্রতি জোড়-পদে ‘ধ্রুব’ শব্দের উল্লেখ থাকায় নিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে, এগুলি তখন গাওয়া হতো। এ ছাড়া এই পদগুলি থেকে তৎকালীন বাঙালি জীবনের আচার-আচরণ ও সমাজের বাস্তবঘন পরিচয়ও পাওয়া যায়। যেমন তখনকার মানুষ হরিণ শিকার, নৌকা চালনা, চেঙারি তৈরি, শুঁড়ির কাজ ইত্যাদি করত। কাড়া-নাকাড়া ও ঢাক- ঢোল বাজিয়ে বর-কনেকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়া হতো। সমাজে যৌতুক প্রথা প্রচলিত ছিল। গরু ছিল গৃহপালিত পশু; হাতিরও উল্লেখ আছে। মেয়েরা পরিধানে ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা এবং কর্ণে কুন্ডল পরত। টাঙ্গি, কুঠার, নখলি বা খন্তা ছিল উল্লেখযোগ্য অস্ত্র। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে এ দোহা পুথি আবিষ্কার করেন।
০২৩ ▌বহুবিবাহ বাঙালি কুলীন ব্রাহ্ম সমাজে !?
একাদশ শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গ-এ ব্রাহ্মণের অভাবের কারণে উত্তর ভারতের কনৌজ থেকে ৫টি গোত্রের ব্রাহ্মণকে আনা হয় বলে জানা যায়। এরা হল, ব্যানার্জি, চ্যাটার্জি, মুখার্জি, …। এরাই বাংলায় কুলীন ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত হয়। বাংলায় আসার পর, এদের বিবাহের যে প্রচলিত নিয়ম তৈরি হয় তা হল, একজন পুরুষ কুলীন ব্রাহ্মণ যেকোন ব্রাহ্মণ বংশেই বিয়ে করতে পারবেন, কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যার বিয়ে হবে কেবলমাত্র কুলীন বংশেই। যদি কুলীন কন্যা কুলীন বংশের বাইরের কাউকে বিয়ে করত, তবে ঐ কন্যার পিতা কৌলিন্য হারাতো। অন্যদিকে কুলীন পুরুষেরা যেকোনো বংশের সুন্দরী ব্রাহ্মণ মেয়েদের বিয়ে করে ঘরে তুলে নিতে পারত। এতে দেখা গেল, কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যাদের জন্য পাত্র পাওয়া যায় না। অর্থাৎ কুলীন কন্যারা ছিল অসহায়। আর এরই সুযোগে কুলীন পুরুষদের মধ্যে বেড়ে গেল বহুবিবাহ। কুলীন কন্যার পিতার ছিল কন্যাদায় মুক্ত হবার তাড়া, যে কোনো বয়সের কুলীন ব্রাহ্মণ পেলেই মেয়েকে তার সাথে বিয়ে দিয়ে কন্যাদায়মুক্ত হতে হতো তাকে। ফলে সমাজে যে নিয়ম তৈরি হল, তা অনেকটা এমন- কুলীন পুরুষেরা বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে কুলীন কন্যাকে বিয়ে করে কন্যার পিতাকে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করতো, আর নতুন বঊয়ের সাথে কয়েক রাত কাটিয়ে শ্বশুরের নাম ধাম একটা খাতায় লিখে নিয়ে চলে যেতো। কুলীন কন্যা নিজের বাপের বাড়িতেই থাকতো। এরপর মাঝেমাঝে বছরে দুই একবার কুলীন স্বামী তার স্ত্রীকে দেখতে আসতো, এরপর ভালমন্দ খেয়ে দেয়ে, রাত কাটিয়ে আবার চলে যেতো। অর্থ ও নতুন যুবতী মেয়ের লোভে কুলীন পুরুষেরা একে বাণিজ্যিক পেশায় পরিণত করেছিল। দেখা যেত অনেক সময় কুলীন ব্রাহ্মণেরা কুল রক্ষার জন্য মৃত্যুশহ্যায় থাকা কোন কুলীন পাত্রের সাথেও মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিত। অনেক সময় কুলীন পাত্রেরা রাতে শুতে গিয়ে স্ত্রীর সব গয়না নিয়ে চম্পট দিত। এর ফলে গ্রামে গ্রামে যুবতি বিবাহিত কুলিন মেয়ে্রা বেশিরভাগ সময় পরপুরুষের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হত। আর তার ফল হত অবাঞ্চিত সন্তান আর ভ্রূণ হত্যা।
কুলীন নারীদের এই জীবনের কথা রাম নারায়ণ তর্করত্ন তার কুলীনকলসর্বস্ব’ নাটকে দেখিয়েছেন এভাবে যে, "কুলীন স্বামী তিন বৎসর শ্বশুরবাড়ি যায়নি। হঠাৎ খবর এল তার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। কুলীন স্বামী আশ্চর্য হয়ে পিতাকে যখন এ কথা বলছে, তখন পিতা বলছেন–বাপু হে, তাতে ক্ষতি কি? আমি তো বিবাহ করবার পর একবারও শ্বশুর বাড়ি যাইনি। তোমার মায়ের সাথে শুভদৃষ্টির পর একেবারে তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়।"
এভাবে নাটকে ও অন্যান্য গণমাধ্যমে এই অনাচারের বিরোদ্ধে প্রচারণা মুরু হয়। বিদ্যাসাগরের 'বহুবিবাহ' প্রবন্ধে এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'বামুনের মেয়ে' উপন্যাসে এই সামাজিক ভয়াবহতার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই কৌলীন্য প্রথা নিরোধের জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়েছিলেন রাম নারায়ণ তর্করত্ন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যদিও ইংরেজ সরকার এ সম্বন্ধে কোন আইন প্রণয়ন করেনি। তার পরও বিদ্যাসাগরগংদের প্রচেস্টার ফলে যে জনমত গড়ে ওঠে, তারই প্রভাবে পরবর্তীতে কৌলীন্য প্রথার অবলুপ্তি ঘটে।
০২৪ ▌বাংলার বার ভূঁইয়া, সোনারগাঁও -পানাম ও বাঙালির পোশাক :
মোঘল শাসন অস্বীকার করে, মোঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যারা যুদ্ধ করে স্বাধীনভাবে চলার চেষ্টা করত, তারা বাংলার বার ভূঁইয়া নামে পরিচিত। ভূঁইয়া শব্দের অর্থ ভূমির মালিক। এক বা একাধিক পরগনার জমিদার মালিকেরা ভূঁইয়া উপাধি গ্রহণ করত। ভূঁইয়াদের ব্যক্তিগত বীরত্ব ও নিজস্ব বাহিনী ছিল। তারা শুধু রাজস্ব আদায় ও জমিদারী ভোগ দখল নিয়ে ব্যস্ত থাকত না, তারা শাসন কার্য পরিচালনার জন্য সীমিত সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সহায়তায় যুদ্ধ পরিচালনা করত। সেজন্য পদাতিক ও নৌ-বাহিনীর পাশাপাশি রাজধানী সংলগ্ন দূর্গ, অস্ত্রাগার, কামান ও গুলাগুলির সংস্থান থাকত। যে বার ভূঁইয়াগণ বংগদেশ বিভক্ত করে মোঘল শক্তিকে বঙাধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করত । তবে সমগ্র বাংলাকে বিবেচনায় নিলে ভূঁইয়াদের সংখ্যা বারোর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। বারটি রাজ্যের নাম যথা- ১। বাংলা ২। হিজলী ৩। উড়িষ্যা ৪। যশোর ৫। চন্ডীকান ৬। মেদিনীপুর ৭। কতাভু ৮। বাকলা ৯। ছলিমানবাদ ১০। ভুলুয়া ১১। ঢাকা ১২। রাজমহল । ঈশা খাঁ’ ছিল বার ভূঁইয়াদের নেতা।
ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। এটি বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র, যা বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। এটি পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত একটি বিস্তৃত জনপদ ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দু আমলের রাজধানী এখানেই অবস্থিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীকালে এটি মুসলিম শাসকদের পুর্ববঙ্গের প্রাদেশিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম থেকে সোনারগাঁও নামের উদ্ভব বলে কারো কারো ধারণা রয়েছে। আবার কারো মতে, ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামে সোনারগাঁও এর নামকরণ করা হয়েছিল। সোনারগাঁয়ের রাজকার্য পরিচালিত হতো পানাম নগরী থেকে। বর্তমানে যে পানাম দাঁড়িয়ে আছে তার অবকাঠামো ব্রিটিশ আমলের। প্রাচীন পানাম চাপা পড়ে আছে আধুনিক পানামের নিচে। এই এলাকাটি ১৯শ শতকে সোনারগাঁওয়ের উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ীদের বাসস্থান ছিলো। এখানে কাপড় ব্যবসায়ীরা বাস করতেন।
বাঙালির পোশাকের ক্ষেত্রে নারীর পোশাক হিসেবে ইতিহাসে শাড়ির ধারাবাহিকতা দেখা যায় এবং শাড়ি আজো জৌলুস নিয়েই দুনিয়াতে টিকে আছে। শাড়িই বোধহয় বাঙালির একমাত্র পোশাক যা ভারত এবং দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা বেশ আগ্রহ নিয়ে পরে। শাড়ি শব্দটির উৎস শাট বা শাটক থেকে। শাটক শব্দের অর্থ সরু দৈর্ঘের জোড়া দেয়া কাপড়। বাংলায় তাঁতযন্ত্রের আবির্ভাবের আগে শটক বা জোড়া দেয়া কাপড় ব্যবহারের প্রচলন ছিল এবং এই শটক নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সবাই ব্যবহার করতেন। ধুতি ও শাড়ি পড়ার মধ্যে কোনো গুরুতর লিঙ্গভেদ সে-কালে মানা হত না। সেকালে শ্রমিক শ্রেণীর পুরুষরা ল্যাঙ্গোটি পরতেন। পনেরো-ষোল শতকে বাংলার নারীরা শুধু একখন্ড শাড়ি গায়ে জড়াতেন। লুঙ্গির মূল উৎস তামিলে। তামিলদের লুঙ্গি প্রচলন হয় রেঙ্গুনে। বর্মীদের অনুকরণে আরাকান ও পূর্ববঙ্গে লুঙ্গির প্রচলন হয়। সে সময় লুঙ্গি ছিল সেলাইহীন। পাদুকা হিসেবে ব্যবহৃত হতো কাঠের খড়ম। নারীরা খালি পায়েই চলতেন।
০২৫ ▌বাঙালিরা যেভাবে মুসলমান হল:
সেই সময় পূর্ববঙ্গের মানুষ তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ছিল। বাংলার এই পূর্বাঞ্চলকে বলা হয় (ভাটি বাংলা)। বছরের অধিকাংশ সময় কয়েকফুট পানির নিচে থাকত এই অঞ্চল। ঘনঘন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোনে আক্রান্ত হয়ে প্রায়শঃই ব্যাপকভাবে বিধ্বস্ত থাকত এই পূর্ব বাংলা। ফলস্বরূপ, এই অঞ্চলে বসতিস্থাপনকারী কৃষিজীবি, মৎস্যজীবী, নৌকাবাসী এবং অনুরূপ অন্যান্য জনগোষ্ঠিসমূহ নিরন্তর ব্যস্ত থাকত ধ্বংসাত্মক এইসব প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে। কিন্তু পূর্ববাংলার উর্বর ভূমিতে অগ্রবর্তী কৃষিজীবীরা নতুন চর দখল করে জনবসতি গড়ে তুলতে থাকলে পূর্ববাংলা সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামীণ সমাজের উদ্ভব ঘটে। বিশৃংখলা আর কলহ-বিবাদ হয়ে দাঁড়ায় এই সমাজের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা। একই কারণে পূর্ববাংলায় শক্তিশালী ও সুগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা দুরূহ ছিল যা’ ইংরেজরাও লিপিবদ্ধ করে গেছে। এই বৈরী প্রকৃতি আর প্রাতিষ্ঠানিক শূন্যতা একটা বিশৃংখল সামাজিক অবস্থার জন্ম দেয়। তারা প্রকৃতি বা দেব-দেবির পুজা করে মানসিক শান্তনা লাভ করলেও বাস্তবিক দিকনির্দেশনা, পরামর্শ এবং নের্তৃত্বের অভাব তাদের সমাজ জীবনে থেকেই যায়। এই বিশেষ অভাববোধের সুযোগ নেয় পীর হিসেবে আসা লোকেরা। পূর্ববাংলার জনগোষ্ঠি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় এই ‘পীর’দের মাধ্যমে।
ফলে বাঙালি মুসলমান সমাজ পীরের নির্দেশিত এক ধরনের লৌকিকধর্ম গড়ে তোলে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানান ঘাতপ্রতিঘাতে তারা পীরদের মুখাপেক্ষী হয়। এজন্যই পূর্ববাংলার আনাচে-কানাচে পীরদের অস্তিত্বের নিদর্শন দেখা যায় । পীরের কবর জিয়ারত বা সেখানে মাজার প্রতিষ্ঠা করা এবং ধর্মের বয়ান দিয়ে ওয়াজ-নচিহত করার প্রথা সারা পৃথিবীর মধ্যে পুর্ব বাংলায় সবচেয়ে বেশি। এমন কি ভারতের যেসব এলাকায় ব্রাহ্মণ্যবাদ কঠোরভাবে বর্ণপ্রথা চাপিয়ে দিতে পেরেছিল (যেমন উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, ইত্যাদি) সেসব এলাকা কয়েকশ’ বছর মুসলমান শাসনাধীনে থাকার পরেও এইসব তথাকথিত পীরেরা সেখানকার নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠিসমূহ ধর্মান্তরিত করে মুসলিম করতে পারেনি। কারণ পুর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশে) ভারতের অন্যান্য অংশের মত শক্তিশালী কোন 'পঞ্চায়েত' না থাকায় মুসলমান সুফিদের প্রবেশ সহজ ছিল এবং তাদের পক্ষে ব্রাহ্মণ্য অত্যাচারে জর্জরিত বৌদ্ধএবং বৈশ্য- শূদ্রদের কাছে পৌছা সহজ হয়েছিল।
১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী সেনদের হটিয়ে বাংলা দখল করার পর তার বিজিত রাজ্যের সীমানা দাড়ায় পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত নদিয়া থেকে রংপুর শহর, তিস্তা ও করতোয়া, পদ্মা এবং কুশীইয়ারা নদীর নিম্নাঞ্চল পর্যন্ত । এ সময় ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে দলে দলে মুসলিমরা এবং অনেক পীর দরবেশরা বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন এবং ইসলাম প্রচার কাজ শুরু করেন। ১৩০৩ সালে সিলেট অঞ্চলে হযরত শাহজালাল(রহঃ) এর প্রভাবে মুসলিম বাড়তে থাকে, ১৩৯৮ এর দিকে খানজাহান আ(রহঃ) এর প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলে মুসলিম বাড়তে থাকে৷ এ সবের মধ্যেই রাজা গণেশ পুনরায় বাংলায় হিন্দু শাসনের আবির্ভাব ঘ্টান। কিন্তু ১৪১৮ সালে রাজা গণেশের ছেলে জাদু নারায়ণ শাসনভার নিয়েই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম রাখেন জালালউদ্দিন মোহাম্মদ শাহ। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন এবং আরাকানকেও বাংলার অধীনে নিয়ে আসেন। এভাবেও মুসলিম সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
এরপর সাড়ে পাঁচ’শ বছর ধরে মুসলমানরা এখানকার শাসনকর্তা সুলতান বা সুবেদার বা নবাব ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদের প্রাধান্য থাকতো সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ , রাজস্ব বিভাগ ইত্যাদিতে। আবার দিল্লী ভারতের মধ্যে প্রধান মুসলমান কেন্দ্র হলেও সেখানে সব সময় ষড়যন্ত্র-শঠতা-হত্যা আর রাজনৈতিক গোলযোগ লেগেই থাকত। বাংলা ছিল তুলনায় নিরাপদ। ফলে বেশ কিছু সংখ্যক অবাঙালি (আরবী, ইরানী, তুর্কী, আফগানী, হাবশী, মোগল, পাঞ্জাবী, বিহারী প্রভৃতি) মুসলমান বাংলায় বসবাস করতে শুরু করে। এ দেশের মানুষ মুসলমান হয়ে যাওয়ার সব থেকে বড় কারণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুতি। পাল আমলে এদেশে বাংলার মেজরিটি মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। আজও বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে বৌদ্ধ শাসনামলের নানা নিদর্শন, পুরনো অনেক বিহারের অস্তিত্ব বিদ্যমান।
পাল বংশের বৌদ্ধদের শাসনামল ৭৫০ সাল থেকে শুরু হয়ে ৪শ’ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পরবর্তীতে দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন বংশের ব্রাহ্মণরা পালদের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক এই সেন-বর্মন-দেব আমলে বৌদ্ধদের উপর অকথ্য অত্যাচার হতো। স্বাভাবিকভাবেই বহুসংখ্যক বৌদ্ধ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। সুফী দরবেশরা বিভিন্ন জায়গায় খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করলেন। সূফীদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। ফলে খুব সহজেই মানুষ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হতো। সেন রাজাদের অত্যাচারে বৌদ্ধদের একটা অংশ নেপালে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বাঁচার তাগিদে বাধ্য হয়ে বৌদ্ধদের একটা অংশ হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে বর্ণপ্রথার সর্বনিম্নে স্থান পায়। বৌদ্ধদের আরেকটি অংশ দিল্লির মুসলিম শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের শরণাপন্ন হয় এবং বৌদ্ধদের রক্ষার অনুরোধ করেন। বৌদ্ধদের অনুরোধে বখতিয়ার খিলজি তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং লক্ষণ সেনকে আক্রমণ করে ১২০৪ সালে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন।
০২৬ ▌কাসিমের ভারত অভিযান ও বখতিয়ার খিলজী: :
হজরত মুহাম্মদ (স:)- এর জীবদ্দশাতেই সাহাবী মালিক ইবনে দিনার ২০ জন সঙ্গী নিয়ে ইসলাম প্রচারে ভারত আসেন। ৬২৯- সনে ভারতের কেরালাতে চেরামান জুম্মা মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রায় ১০০ বছর পর মাত্র ১৭ বছর বয়সে ৭১০ সালে ৬০০০ সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারত অভিযানে আসেন এবং সিন্ধু ও মুলতান জয় করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্পর্কের দিক থেকে ছিলেন ইরাকের তৎকালীন গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ-এর জামাতা। সিন্ধুর রাজা দাহিরকে পরাজয়ের মাধ্যমে সিন্ধু মুসলিমদের অধীনে চলে আসে। অন্যত্র অগ্রসর না হয়ে তারা সেখানেই বসতি স্থাপন করল এবং ভারতীয়দের জন্য নতুন কোনও উপদ্রব তৈরি করল না। পরিস্থিতি কিছুকাল শান্ত থাকলেও ১০০০ সাল থেকে গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারতের মূল ভূখন্ডে ১৭বার আক্রমণ করেন, উদ্দেশ্য ধনসম্পদ লাভ। প্রতিবারই তিনি বিজয়ী হয়ে সম্পদ নিয়ে স্বদেশ আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেন। পিতার মৃত্যুর পর ৯৯৭ খৃস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনীর সিংহাসনে বসেন। এরপর ভারতবর্ষে প্রায় 150 বছর আর কোন আক্রমণ হয়নি। তারপরে
১২০৬ সাল থেকে শুরু করে ১৫২৬ সাল পর্যন্ত মোট ৩২২ বছর একাধিক মুসলিম রাজবংশ ভারত শাসন করেছে। ১২০৬-১৫২৬ সাল পর্যন্ত তুর্কী আর আফগান মুসলিম রাজবংশের এই শাসনকে একত্রে ‘দিল্লি সালতানাত’ বলা হয়। গজনীর শাসনকর্তা মুহাম্মদ ঘুরি ভারত জয়ের পর তার বিশ্বস্ত সেনাপতি কুতুবুদ্দীন আইবেককে রেখে গজনী ফিরে যান। কুতুবুদ্দীন আইবেক ১২০৬ সালেই দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে বসার মাত্র ৪ বছর পর, পোলো খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মারা যান। তার নির্দেশে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১২০৩ সালে বিহার এবং ১২০৫-০৬ সালের মধ্যে তিনি বাংলা জয় করেন। কুতুবুদ্দীন আইবেকের জামাতা ইলতুতমিশ ১২১১-৩৬ সাল পর্যন্ত দিল্লীর সুলতান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১২৩৬ সালে ইলতুতমিশের মৃত্যুর পর তার কন্যা রাজিয়া দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ইলতুতমিশের অবর্তমানে রাজ্য পরিচালনা করতেন তার কন্যা রাজিয়াই।
ত্রিয়োদশ শতকের গোড়ার বাংলায় রাজত্ব করতেন সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন। রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। তিনি বৃদ্ধ বয়সে গঙ্গাপাড়ের পবিত্র তীর্থস্থান নদীয়ায় বাস করছিলেন। ততদিনে সমগ্র উত্তর ভারত তুর্কীরা অধিকার করেছে এবং বখতিয়ার খিলজী বিহার জয় করেছেন। পন্ডিতগণের পরামর্শে রাজা লক্ষণ সেন নিশ্চিত হন যে, বিহারজয়ী বখতিয়ার খিলজী তাকে আক্রমণ করবে। তার অনতিকাল পরেই বখতিয়ার খিলজী নদীয়া আক্রমণ করেন। বখতিয়ার খিলজী ১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে নদীয়া পৌঁছেন এবং তার মূল বাহিনী পেছনে আসছিল। খিলজী সোজা রাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং দ্বাররক্ষীদের হত্যা করেন। রাজা তখন মধ্যাহ্নভোজে লিপ্ত ছিলেন। খবর শুনে তিনি নগ্নপদে প্রাসাদের পশ্চাৎদ্বার দিয়ে পলায়ন করেন এবং বিক্রমপুরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বাংলা বিজয়ের অনতিকাল পরে তিনি তিব্বত আক্রমনে বের হন। এই অভিযানে তিনি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়ে বিপর্যস্ত বখতিয়ার ১২০৬ সালে মারা যান।
ভারতের প্রাচীন শিক্ষার ইতিহাসে ওদন্তপুরী (Odantapuri বা Odantapura) বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। এটি প্রাচীন বিহারের বিখ্যাত বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রগুলির অন্যতম, নালন্দা ও বিক্রমশীলার সমসাময়িক ও সমগৌরবময়। এটি স্থাপিত হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে পাল সম্রাট গোপালের আমলে। ওদন্তপুরী মহাবিহার নালন্দা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে, বর্তমান বিহারের নালন্দা জেলার বিহারশরীফ নামক স্থানে অবস্থিত ছিল। ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি উত্তর ভারতের দিকে অগ্রসর হন। তার লক্ষ্য ছিল গঙ্গা উপত্যকার সমৃদ্ধ নগর ও রাজ্যগুলো জয় করা। প্রথমে তিনি বিহারে প্রবেশ করে ওদন্তপুরী মহাবিহার আক্রমণ করেন। ইতিহাসবিদ মিনহাজ-উস-সিরাজ তাঁর গ্রন্থ তবকাত-ই-নাসিরী তে লিখেছেন, বখতিয়ার খিলজি ওদন্তপুরী আক্রমণ করে সেটিকে ধ্বংস করেন। সেখানে প্রচুর সংখ্যক সন্ন্যাসী ও পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়, কারণ তার সৈন্যরা মনে করেছিল যে এই বিহার আসলে কোনো দুর্গ, যেখানে সেনারা আশ্রয় নিয়েছে। তারা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অস্ত্রধারী সৈন্য ভেবে নির্বিচারে হত্যা করে। পরে পুরো প্রতিষ্ঠানটি আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অমূল্য পাণ্ডুলিপি, তাম্রলিপি, শাস্ত্রগ্রন্থ এবং বহু শতাব্দীর জ্ঞানভাণ্ডার মুহূর্তেই ছাই হয়ে যায়।
০২৭ ▌মুঘল শাসনামল (বাবর,হুমায়ুন, আকবর) :
বাবর ছিলেন তৈমুর লং-এর বংশধর। তিনি বর্তমান উজবেকিস্তানের ফারগানার শাসক ছিলেন। ১৫২৬ সালে তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। বাবর ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা, কবি, ও আত্মজীবনীকার। তাঁর আত্মজীবনী “বাবরনামা” ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। ১৫৩০ সালে আগ্রায় বাবর মারা যান। তাঁকে প্রথম আগ্রায় সমাহিত করা হলেও পরে তাঁর দেহাবশেষ কাবুলে স্থানান্তর করা হয়।
হুমায়ুন ছিলেন বাবরের পুত্র এবং মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট। তাঁর শাসনকাল ছিল অস্থিরতায় পূর্ণ। তার তিন ভাই — কামরান, আসকারী ও হিন্দাল তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যা সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে। তিনি প্রথমে ১০ বছর শাসন করেন, কিন্তু শেরশাহ সুরির হাতে পরাজিত হয়ে ১৫৪০ সালে সিংহাসন হারান এবং ১৫ বছর নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। নির্বাসনের সময়ই তাঁর পুত্র আকবরের জন্ম হয়। এরপর তিনি ইরানের (পারস্যের) সাফাভিদ রাজবংশের সহায়তায় আবার দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। তিনি একজন পণ্ডিত ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। সিংহাসন পুনরুদ্ধারের এক বছরের মধ্যেই ১৫৫৬ সালে তাঁর লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে পড়ে আকস্মিক মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর সময় তার পুত্র আকবর মাত্র ১৩ বছর বয়সী ছিলেন।
আকবর ছিলেন হুমায়ুনের পুত্র এবং মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক । তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন, যখন সাম্রাজ্য আবারও হুমায়ুনের মৃত্যুর পর অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল। ১৫৫৬ সালে তাঁর অভিভাবক বৈরাম খাঁর নেতৃত্বে তিনি পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হেমুকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। তিনি সামরিক অভিযান এবং রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যকে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত এবং দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশে প্রসারিত করেন। তিনি 'দীন-ই-ইলাহি' নামে একটি সমন্বয়বাদী ধর্মমত প্রবর্তন করেন এবং ১৫৬৪ সালে অমুসলিমদের উপর ধার্য জিজিয়া কর প্রত্যাহার করেন। তিনি 'মনসবদারি প্রথা' নামে একটি দক্ষ সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেন। তাঁর দরবারে নবরত্ন বা নয়জন গুণী ব্যক্তি ছিলেন (যেমন: তানসেন, বীরবল, আবুল ফজল)। তিনি ফতেহপুর সিক্রি শহর নির্মাণ করেন।
আকবরের ছেলে সম্রাট জাহাঙ্গীর সমৃদ্ধির সাথে শাসন করেন । তবে জাহাঙ্গীর আফিমে আসক্ত ছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় কাজে অনীহা দেখায় এবং দরবারের বিদ্রোহীদের প্রভাবে পড়ে । তার ছেলে শাহজাহানের শাসনকাল মুঘল দরবারের জাকজমকের জন্য প্রসিদ্ধ । এসময় অনেক বিলাসবহুল ইমারত নির্মিত হয় যার মধ্যে তাজমহল ছিল অন্যতম । এসময় দরবারের রাজস্ব আয়ের চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেশি ছিল । শাহজাহানের অসুস্থতার পর তার বড় ছেলে দারা শিকোহ অভিভাবক হন । সিংহাসন নিয়ে শাহজাহানের ছেলেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অন্যান্যদের পরাজিত করে শেষপর্যন্ত আওরঙ্গজেব জয়ী হন । আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছায়। ১৭৩৯ সালে কারনালের যুদ্ধে নাদির শাহের বাহিনীর কাছে মুঘলরা পরাজিত হয়ে মুঘল শক্তি ক্রমান্বয়ে সীমিত হয়ে পড়ে এবং শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ই্ংরেজরা কারাবন্দী করে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে এবং সেখানেই তিনি মারা যান।
০২৮ ▌অশোক না আকবর, কে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ট শাসক?
ভারতের ইতিহাসে দুজন রাজাকে গ্রেট উপাধি দেয়া হয়েছে, তাদের একজন হলেন ‘অহিংসার পূজারী অশোক দ্যা গ্রেট আরেকজন‘ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ আকবর দ্যা গ্রেট। মজার ব্যাপার হল হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে একজন হিন্দু রাজাও এই উপাধি লাভ করেননি।
ভারতবর্ষের প্রত্যেক শাসকদের নিয়ে যদি আপনি নিখুঁতভাবে গবেষণা করেন, তাহলে দেখবেন মোগল সম্রাট হুমায়ুন ছিলেন সবচেয়ে প্রতিভাবান, সেরা কৌশলি, দক্ষ পরিকল্পনাবিদ, সবচেয়ে মানবিক, অতুলনীয় সৃজনশীল এবং আজীবন লডাকু একজন মানুষ। তার পুরো শাসনকালই ছিল অশান্তির। সাম্রাজ্যহারা হয়ে তিনি দিল্লি থেকে পালিয়ে ঘুরেছেন পথে পথে। পালিয়ে বেড়ানো এমনি এক রাতে তার স্ত্রী হামিদা বানু সন্তান ধারণের খবর দেন। সে সন্তান আকবর একদিন হয়ে ওঠেন দিল্লির সবচেয়ে দাপুটে শাসক। মাত্র ১৩ বছর বয়সে দিল্লির শাসনভার গ্রহণ করে ৬৩ বছরের জীবনে টানা প্রায় ৫০ বছর ক্ষমতায় । এই কারিসমার মূলে ছিল বাবা হুমায়ুন। হুমায়ুনের প্রধান একটা বৈশিষ্ট ছিল, তিনি দীর্ঘ স্ট্যাডি করে যুদ্ধসহ প্রতিটি পদক্ষেপের একটা পরিকল্পনা সিট তৈরি করতেন হাতে-কলমে। অল্প বয়সে মারা গেলেও তিনি এমন একটি সুপরিকল্পিত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে তার শিশুপুত্রও নিশ্চিন্তে সফল্ভাবে শাসন করতে পেরেছিলেন। বাবার অনুসরনে আকবরও তার একক কর্তৃত্বের পরিবর্তে দক্ষ, মেধাবী, বিচক্ষণ মানুষদের নিয়ে দরবার গঠন করে সম্মিলিতভাবে সমস্যার সমাধান খুঁজতেন। দেশের সেরা রত্নদের তিনি রাজসভায় ঠাঁই দিতেন। এ কারণে তার মন্ত্রিসভাকে বলা হতো নবরত্ন। আকবর সবার কথা শুনতেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত দিতেন নিজে। শাসনকাজে নিজের সন্তানকেও ছাড় দিতেন না। শাহজাদা সেলিমকেও ছাড় না দেবার কথা সবার জানা। তার শাসনাধীন প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে প্রত্যেক অঞ্চলে একজন করে শাসক নিয়োগ দিতেন আকবর। আর শাসকদের নিয়োগ দেওয়ার সময় বলা হতো, ক্ষমতার অপব্যবহারের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সরকার চালানোর সময় কেউ ন্যায়পরায়ণতা ভঙ্গ করলেই ব্যবস্থা নেওয়া হতো। নবরত্নের কাজ ছিল সম্রাটকে সব বিষয়ে সতর্ক রাখা ও উন্নত পরামর্শ দিয়ে যাওয়া। তার রাষ্ট্র পরিচালনায় সততা ও দক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। আমলাদের প্রমাণ দিতে হতো সততা ও দক্ষতার। রাজ্যের সুখ-দুঃখ আলোচনা-সমালোচনা হত রাজসভায়। গোপনে বাদশাহ খবর নিতেন প্রজাদের।
শাসন কার্য পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মারাঠা অর্থাৎ রাজপুতদের শক্তি ও সাহসিকতার সঙ্গে তাঁর পেরে ওঠা প্রায় অসম্ভব। তার পূর্বসূরি মুসলমান শাসকরা যেমন রাজপুতদের খুঁচিয়েছিলেন, আকবর কিন্তু সেই পথে হাঁটলেন না। তিনি অভিজাত রাজপুতদের আপন করে নিলেন। বহু রাজপুতকে রাজদরবারে চাকরি দিলেন। আকবর নিজে কাচ্ছোরা রাজার কন্যাকে বিয়ে করলেন। শুধু তাই নয়, রাজার নাতিনির সঙ্গে তাঁর বড় ছেলে জাহাঙ্গিরকেও বিয়ে দেন। এই বন্ধুত্বের নীতি খুব ভালোভাবে কাজে লাগলো। এর ফলে যোধপুর, জয়পুর, ইত্যাদি রাজপুত অঞ্চল তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নিল। তিনি রাজপুতদের শক্তি নিয়ে প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে একের পর এক জয় করে নিলেন। এইভাবে আকবর উত্তর ,মধ্য ও দক্ষিণ ভারত তাঁর অধীনে আনেন।
আকবর তাঁর রাজত্বকালের দ্বিতীয় ভাগে মানবতাবাদকে জাতীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করে বহু সংস্কার প্রবর্তন করেন। জয় করা অঞ্চলে তাঁর উন্নত শাসন, ও ন্যায় বিচারব্যবস্থার কারণে কোন বিদ্রোহ দেখা যায় নাই। আকবর তাঁর ধর্মসহিষ্ণু নীতিদ্বারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্য ও সম্প্রীতি স্থাপন করেন। তিনি প্রশাসন পরিচালনা করার জন্য প্রশাসকদের নিজস্ব একটা ধর্ম ও নীতি তৈরি করেন যার নাম দীন-ই-ইলাহি । এটি ছিল বিভিন্ন ধর্মমতের (প্রধানত ইসলাম ও হিন্দুধর্ম, পাশাপাশি জৈনধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম ও পারসিধর্ম) মূল দর্শনগুলির ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি সমন্বিত জীবনদর্শন বা নৈতিক আচরণবিধি, যা তিনি মূলত তার ঘনিষ্ঠ সভাসদ এবং প্রশাসকদের জন্য করেন। তিনি মনে করতেন সুশাসন চালাতে গেলে এই নীতি লাগবেই, কিন্তু কট্টরপন্থী মুসলিমরা প্রচার করে বেড়ালো তিনি ইসলামের সংস্কার করে নতুন ধর্ম করেছেন।
তিনি অ-মুসলিমদের উপর থেকে জিজিয়া কর বন্ধ করে সকল ধর্মের প্রজাদের সমান মর্যাদা দেন। তার সময় বহু হিন্দু ফারসি শিখে মোগল সরকারের চাকরি করতেন। যোগ্যতার প্রশ্নে হিন্দু-মুসমান হিসেবে কোনো আপোস করতেন না তিনি। তিনি ভারতীয় চিত্রকলা, স্থাপত্য, সংগীত ও সাহিত্যের বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি কোতোয়ালদের ক্রীতদাস কেনাবেচা বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়ে ভারতের ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত করেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ভারতবর্ষের জনসাধারণের কাছে মানবিক শাসক হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
আকবরের জন্মের পৌনে দুই হাজার বছর আগে ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির অন্যতম ছিল অশোকের সাম্রাজ্য। সেই বিশাল সাম্রাজ্যকে শাসন করতে সকল ধর্ম গোষ্ঠীগুলিকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়েছে তাকে। বিহারের পার্টনার কাছাকাছি পাটলীপুত্র থেকে এই বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করতেন সম্রাট অশোক। (২৬৯-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) 37 বছর অশোকের শাসনামল ( বাংলাদেশের বগুড়া ছিল পুণ্ড্রবর্ধন নামে একটি প্রদেশ ।)
নিজের শাসনের প্রথম পর্বে অশোক উপমহাদেশের প্রায় বেশির ভাগ অংশে তাঁর রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান; তখন শক্তিশালী প্রতিবেশী রাজ্য ছিল কলিঙ্গ যা বর্তমানে উড়িষ্যা রাজ্য। সম্রাট অশোক মনে শান্তি ছিল না। কলিঙ্গ নামের প্রতিবেশী শক্তিশালী এই শত্রুকে রেখে কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়! দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনীই শক্তিশালী। ফলে শুরু হয়ে গেল কলিঙ্গ যুদ্ধ। কলিঙ্গের সৈন্যরা বীর বীক্রমে লড়াই করেও পরাজিত হলো। লক্ষ লক্ষ আহত আর নিহত সৈন্যে ভরে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র। বিজয়ী অশোক হাতির পিঠে চেপে যেতে যেতে দেখলেন তার দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কত অসংখ্য মৃতদেহ। কত আহত সৈনিক। কেউ আর্তনাদ করছে, কেউ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে চিৎকার করছে। কেউ সামান্য একটু পানির জন্য ছটফট করছে। যুদ্ধক্ষেত্রের এই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে তার সমস্ত অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে নিজের তাঁবুতে ফিরে দেখলেন তাবুর সামনে দিয়ে চলেছে একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীরা বললেন, তারা যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের বাচাতে যাচ্ছেন। মুহূর্তে অনুতাপের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল অশোকের হৃদয়। তিনি শপথ করলেন আর যুদ্ধ নয়, আর হিংসা নয়, অহিংসা মন্ত্রে ভরিয়ে দিবেন সমগ্র পৃথিবী।
এরপর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় আমূল পরিবর্তন আনেন। তার নির্মিত অশোকস্তম্ভ বর্তমানে ভারতের রাস্ট্রীয় প্রতীক। তিনি মোট ১৯ টি অশোকস্তম্ভ নির্মান করেছিলেন। আশোকস্তম্ভের উপরে চারটি সিংহমূর্তি চারদিকে মুখ করে বসে আছে। এরদ্বারা বোঝানো হয় যে, অশোক ভারতের চতুরদিকে রাজত্ব করেছিলেন। বাস্তবিকভাবে সম্রাট অশোকের আগে বা পরে এমন কোন রাজা বা সম্রাট ছিলেন না, যিনি আজকের নেপাল, বাংলাদেশসহ, সমগ্র ভারত, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান এর মতো বিশাল ভূখণ্ডের উপর এক ছত্রে শাসন করেছেন।
সম্রাট অশোক রাজা হয়েও ছিলেন ঋষি। " তার রাজত্বকালকে ইতিহাসবিদরা ভারতীয় ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলে মনে করেন’ সম্রাট অশোকের সময়ে 23টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যার মধ্যে তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, কান্দাহার প্রভৃতি ছিল তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় ।
০২৯ ▌মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব আলমগীর
মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব আলমগীর (শাসনকাল: ১৬৫৮–১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ) । তিনি কঠোর ধর্মানুরাগী ও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে পরিচিত, অন্যদিকে নিজের সিংহাসন রক্ষার জন্য নিকট আত্মীয়দের প্রতিও নির্মম ছিলেন। তিনি নিজের ভাইদের হত্যা ও পিতাকে বন্দি করার মধ্য দিয়েই তিনি মুঘল সিংহাসন দখল করেন। ঔরঙ্গজেবের শাসন তাই ইতিহাসে এক ভয়াবহ দ্বন্দ্বের প্রতীক—একদিকে ধর্মপ্রাণ, কুরআনের বিধান অনুসারে জীবনযাপনকারী সম্রাট; অন্যদিকে নিজের ভাই, পিতা ও অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের হত্যাকারী এক নির্মম শাসক। তবে তাঁর শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছিল। তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা আফগানিস্তান থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তিনি 'ফতোয়া-ই-আলমগীরি' নামে ইসলামিক আইনের একটি সংকলন চালু করেন, যা ছিল তাঁর শাসনামলের আইন ব্যবস্থা। যাদের হত্যা বা মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী ছিলেন, তারা হলেন-
১. দারা শিকোহ-প্রিয় জ্যেষ্ঠ ভাই : দারা শিকোহ ছিলেন শাহজাহান ও মুমতাজ মহলের জ্যেষ্ঠ পুত্র, এবং শাহজাহানের উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত ছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্তমনা, সুফিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার মানুষ। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মিলনের দর্শনে তিনি বিশ্বাস করতেন, উপনিষদ অনুবাদ করিয়েছিলেন ফারসিতে। ঔরঙ্গজেবের আদেশে দারাকে হত্যা করা হয় এবং তাঁর মাথা পাঠানো হয় বন্দি শাহজাহানের কাছে— উপহার হিসেবে!
২. মুরাদ বখ্শ-ছোট ভাই : ঔরঙ্গজেবের আরেক ভাই মুরাদ বখ্শ ছিলেন গুজরাটের সুবেদার। ১৬৫৯ সালে মুরাদকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যার মিথ্যা মামলা সাজিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
৩. শাহ শুজা — দ্বিতীয় ভাই : শাহ শুজা ছিলেন বাংলার সুবেদার। শাহজাহানের অসুস্থতার পর তিনিও সিংহাসনের দাবিদার হন। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে অরাকান (বর্তমান মায়ানমার)-এ আশ্রয় নেন। সেখানে গিয়ে তাঁর ও পরিবারের রহস্যময় মৃত্যু হয়। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, শুজার পরাজয় ও মৃত্যুর পেছনে ঔরঙ্গজেবের গুপ্তচর ও ষড়যন্ত্র জড়িত ছিল।
৪. শাহজাহান-পিতা : ঔরঙ্গজেবের নির্মমতার সবচেয়ে করুণ শিকার তাঁর নিজের পিতা সম্রাট শাহজাহান। ঔরঙ্গজেব শাহজাহানকে আগ্রায় তাজমহলের বিপরীতে আগ্রা দুর্গে সাত বছর বন্দি করে রাখেন।
০৩০ ▌বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ
বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এর আসল নাম ছিল সূর্যনারায়ণ মিশ্র বা হিরা মিশ্র। তিনি দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীসময়ে ভারতে আগত পারস্য নিবাসী এক মুসলমান তাঁকে অল্প বয়সে দাসবাজার থেকে ক্রয় করে ইসলামধর্মে দীক্ষিত করে তাঁর নাম রাখেন মোহাম্মদ হাদি । এরপরে তিনি হাদিকে তৎকালীন পারস্যের অন্তর্গত ইস্পাহানে নিয়ে গিয়েছিলেন, এবং সেখানে তাঁকে ফারসি ভাষায় সুশিক্ষিত করে তুলেছিলেন। পরবর্তীসময়ে হাদি তাঁর পালক প্রভুর সঙ্গে পুনরায় ভারতে ফিরে এসেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, হাদির এই পালক প্রভু ঔরঙ্গজেবের আমলের বাংলায়, দক্ষিণ ভারতে এবং দিল্লিতে মোঘল রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন এবং তাঁর অধীনে কাজ করেই হাদি তখন রাজস্ব সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন।
মুঘল দরবারে তাঁর মেধা, বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতার কারণে তিনি ধীরে ধীরে রাজস্ব প্রশাসনে উচ্চ পদে উন্নীত হন। তাঁর পরিশ্রম ও আর্থিক দক্ষতার জন্যই সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে ‘কারতুলহু মুর্শিদকুলি’ উপাধিতে ভূষিত করেন, যার অর্থ—যিনি রাজস্ব সংগ্রহ ও হিসাবরক্ষায় বিশেষ পারদর্শী। পরবর্তীকালে তিনি ‘মুর্শিদকুলি খাঁ’ নামেই খ্যাতি লাভ করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি বাংলার দেওয়ান বা রাজস্ব প্রশাসক ছিলেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দক্ষতা, কঠোর শাসননীতি ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি কার্যত স্বাধীন নবাব হিসেবে বাংলার শাসনভার নিজের হাতে নেন। এভাবেই বাংলায় নবাবি যুগের সূচনা হয়।
মুর্শিদকুলি খাঁ দুর্নীতি দমন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কর্মকর্তাদের উপর কঠোর নজরদারি চালাতেন। যেকোনো প্রকার ঘুষ বা অনৈতিক কাজের জন্য তিনি কঠোর শাস্তি প্রদান করতেন। ধর্মীয় দিক থেকেও তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। যদিও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তবুও তিনি অনেক হিন্দু কর্মচারীকে প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত করেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তবে রাজস্ব আদায়ে তিনি ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বিশেষ ছাড় দেননি; হিন্দু বা মুসলমান উভয়কেই সমানভাবে কর প্রদান করতে হতো। ঔরঙ্গজেবের আমলে তিনি সম্রাটকে প্রতিবছর এককোটি টাকা পাঠিয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেব একারণেই মুর্শিদকুলিকে নিজের ‘জীবনরক্ষক দেবদূত’ বলতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দত্তক পুত্র শরফউদ্দিন খান (শুজাউদ্দিন মোহাম্মদ খাঁ) ক্ষমতা গ্রহণ করেন, এবং এই ধারাই পরবর্তী আলিবর্দী খাঁ পর্যন্ত গড়ায়। নবাব মুর্শিদ কুলি খান বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় ১৭১৭ সালে স্বাধীন নবাবী আমল প্রতিষ্ঠা করেন। মুর্শিদ কুলি খান ঢাকা থেকে রাজধানী বদলি করে মুকসুবাদ নিয়ে যান। পরে এই শহরকেই মুর্শিদাবাদ নাম করণ করেন।
০৩১ ▌ নবাব সিরাজ উদদৌল্লাহ :
প্রথম শতকের গ্রিক ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক প্লুতার্ক বিশ্বাস করতেন, বয়সের মধ্য দিয়ে বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানসিক দৃঢ়তা শুধুমাত্র প্রবীণ ব্যক্তিরাই অর্জন করতে পারেন। এই বৃদ্ধরা দুর্বল হতে পারে, কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার কারণে রাস্ট্র সঠিকভাবে পরিচালিত হবে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, যে রাষ্ট্র নবীণ রাজনীতিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়, সেখানকার রাষ্ট্র-সমাজ অনিবার্যভাবে ঝুকিতে পড়ে যায়। কারণ একজন যথার্থ রাষ্ট্রনায়কের যে প্রজ্ঞা ও ধীশক্তি থাকা দরকার, তরুণ নেতাদের মধ্যে তা থাকে না। ফলে রাস্ট্রের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমনটি হয়েছে নবাব সিরাজোদ্দোলাহ বেলায়। ২৫ বছরের এই তরুণ রাস্ট্র নায়ক হওয়ায় বাংলার সিংহাসন চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে যায়। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে সম্রাট আকবর তো মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন এবং প্রায় ৫০ বছর শাসন করেন, ভারতবর্ষের শ্রেষ্ট শাসক হিসেবে তাকে বলা হয় আকবর দ্যা গ্রেট। এর কারণ হচ্ছে অভিজ্ঞ উজির বৈয়ম খা। মুলত একটা বড় সময় পর্যন্ত আকবরের হয়ে তিনিই রাস্ট্র পরিচালনা করতেন।
ছোটবেলায় আমরা সবাই পড়েছি, খোকা ঘুমাল, পাড়া জুড়াল, বর্গী এলো দেশে…। এ বর্গী আর কেউ নয়, সেই মারাঠাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে মীরজাফর খ্যাতি লাভ করে। বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ তাঁর বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানম সাহিবাকে মীরজাফরের সাথে বিবাহ দেন। সে ঘরে মীরন এবং ফাতিমা নামে দুই সন্তানের জন্ম হয়। আলীবর্দী খানের কোন ছেলে ছিল না। আলীবর্দী খাঁ তার তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই হাজী আহমেদের তিন ছেলের সাথে। তিনি ছোট মেয়ে আমিনার বড় ছেলে সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু তার বড় মেয়ে নিঃসন্তান ঘসেটি বেগম চেয়েছিলেন মেজবোনের ছেলে শওকত জংকে সিংহাসনে বসাতে।
১৭৫৬সালের ৯ই এপ্রিল নবাব আলিবর্দি খাঁ মারা গেলে সিরাজদৌলা বাংলার নবাব হন। জানা যায় ২৫ বছরের যুবক সিরাজের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহারের জন্য তাঁর বেশিরভাগ অধীনস্থ কর্মচারিরা তাঁর বিরুদ্ধে রাগ পোষণ করতেন। সিরাজউদ্দৌলা নবাব হিসেবে সাহসী হলেও ভালো শাসক বা বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ দুটোর কোনটাই ছিলেন না। ফলে ইংরেজ ও ফরাসি দুই দলের সঙ্গেই তার সংঘাত শুরু হয়। বর্গি আক্রমণকে কেন্দ্র করে চন্দননগরে ফরাসিরা এবং ইংরেজরা কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ মজবুত করে গড়ে তুলেছিল। সিরাজ এতে অখুশি হয়ে দুই পক্ষকেই চিঠি লিখে নতুন নির্মাণ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ফরাসিরা সে কথা মেনে নিলেও ইংরেজরা নবাবের নির্দেশ মানল না। সেসব কারণে সিরাজ রেগে কলকাতা দখল করে নাম রাখলেন আলিনগর। কিন্তু রবার্ট ক্লাইভ মাদ্রাস থেকে এসে কলকাতা আবার দখল করলেন এবং একই সঙ্গে বাংলার মসনদে নতুন শাসক বসানোর কথা ভাবলে্ন। এভাবেই নাম উঠে এসেছিল মিরজাফরের নাম। মিরজাফর প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি নবাব হলে ইংরেজদের বিপুল ঐশ্বর্য উপহার দেবেন।
রবার্ট ক্লাইভ গোপনে সৈন্য ও অস্ত্র ফোর্ট উইলিয়ামে মজুত করতে থাকেন। অন্যদিকে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে একাধিক ইংরেজ কর্মচারীদের মুর্শিদাবাদের প্রেরণ করেছিলেন। যাদের মূলত কাজ ছিল সিরাজের সেনা ও অস্ত্র ভান্ডারের ব্যাপারে খবরাখবর নিয়ে আসা এবং, মুর্শিদাবাদে থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। কোম্পানির তরফে ওয়াটস, মহিলাদেরই যাতায়াত করা পালকির মধ্যে লুকিয়ে মিরজাফরের বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন। নিজ বাড়িতেই মিরজাফর একহাতে কোরান আর অন্যহাতে ছেলে মিরানের মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করে চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। তার সঙ্গে যোগ দেয় নবারের খালা ঘসেটি বেগম, ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ ও উমিচাঁদ। সবারই ছিল অভিন্ন উদ্দেশ্য, নবাবকে উৎখাত করা।
১৭৫৭ সাল ভারতের মুর্শিদাবাদ শহর থেকে ৫০ মাইল দূরে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হলেন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। হত্যা করা হলো সিরাজকে। এরপর মীরজাফর পুত্র “মীরন" আলিবর্দি খানের পরিবারের প্রায় সত্তুরজন নিরাপরাধ সদস্যকে একটি নৌকায় চাপিয়ে মাঝ-গঙ্গায় নিয়ে যায়, আর সেখানেই নৌকাটি ডুবিয়ে দেয়া হয়। সবাইকে একসঙ্গে নদীর ধারে খুশবাগ নামের একটি বাগানে দাফন করা হয়। পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের কারন ছিল, সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতা এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার অযোগ্যতা। নবাব সিরাজউদ্দৌলা মাত্র পনেরো মাস মসনদে ছিলেন।
পলাশীর যুদ্ধ শেষ হলে বাংলার ধনসম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল লুটেরারা। এদের মধ্যে অন্যতম কলকাতার নবকৃষ্ণ দেব। বাংলার তোষাখানা লুট করতে ব্রিটিশদের সাহায্য করে এই নবকৃষ্ণ। এই জন্য নবকৃষ্ণ পেলেন ‘রাজা বাহাদুর’ খেতাব এবং বিপুল অর্থ। গোটা সুতানুটি অঞ্চলের জমিদার হয়ে গেলেন তিনি। সামান্য মুনশী থেকে বিশাল জমিদার। নবকৃষ্ণ তখন বাংলার বাসন্তীপূজোকে এগিয়ে এনে শুরু করে দিলেন "দুর্গাপূজা"। ইংরেজ সাহেব মেমরা ত বটেই, ওয়ারেন হেস্টিংস পর্যন্ত হাতীতে চড়ে এলেন সেই পূজায়। ক্লাইভ দক্ষিণা দিলেন ১০১ টাকা। সাহেবরা মৌজ করে দেখলেন বাঈজী নাচ আর নানা আয়োজনে। এরপর থেকে ধুমধাম করে চালু হল দুর্গাপূজা।
বাংলার নবাব হয়ে পঁয়ষট্রি বছরের বৃদ্ধ মীর জাফর পর পর দুইজন সুন্দরী নর্তকীকে বিয়ে করে। মীরজাফরের মৃত্যুর পর থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই দুই নটীর গর্ভজাত সন্তান এবং তাদের উত্তরাধিকাররা বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব ছিল।
০৩২ ▌ভারতে ইংরেজ শাসন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লব :
১৭৬৫ সালের ১লা অগাষ্ট লর্ড ক্লাইভ দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা- বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন। বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে, নবাবের নামে মাত্র অস্তিত্ব থাকে। ফলে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিতি পায়। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কো¤পানি। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে কো¤পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। মূলতঃ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল এই প্রায় ১০০ বছর ইষ্টইন্ডিয়া কো¤পানির হাতে ভারতবর্ষের শাসনভার থাকে। ১৮৫৮ সালে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হন। রানি ভিক্টোরিয়া নিজ হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রথম ‘দশ বছরের জন্য’ জমিদারদের জমির মালিকানা দিয়েছিলেন। তিনি এর নাম দেন দশশালা বন্দোবস্ত। এই ব্যবস্থাই পরবর্তীকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপান্তরিত হয়। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ২২ মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও বেনারসে এই ব্যবস্থা চালু হয়। নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তকালের মধ্যে খাজনা জমা দিতে না পারলে জমিদার জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। বছরের নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে রাজস্ব পরিশোধ করতে হত বলে একে সূর্যাস্ত আইন ও বলা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নতুন অভিজাত শ্রেণি গড়ে ওঠে যারা সরকারের প্রধান সমর্থক ছিলেন। এদের সহযোগিতায় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব ও বিস্তার ঘটতে থাকে। অপরদিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে জমিদার ও প্রজা উভয়কেই টাকার জন্য বিত্তবানদের কাছে হাত পাততে হত। এইভাবে সমাজে মহাজন তথা সুদখোর সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্য সেন-এর নেতৃত্বে কয়েকজন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ব্রিটিশবাহিনীর চট্টগ্রামে অবস্থিত অস্ত্রাগার লুন্ঠনের প্রয়াস চালায়। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, শশাঙ্ক দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, অনন্ত সিং, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। এদের সাথে সুবোধ রায় নামক ১৪ বছরের এক বালকও ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা গোলাবারুদের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। বিপ্লবীরা সফলভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন এবং রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা - এই নামের অধীনে সর্বমোট ৬৫ জন বিপ্লবী এই বিপ্লবে অংশ নেন। মাস্টারদার নেতৃত্বে প্রীতিলতা ইউরোপীয় ক্লাবে আক্রমণ করেন। যেখানে ¯পষ্টভাবে লেখা থাকতো ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশের অধিকার নেই’। ধরা পড়ে প্রীতিলতা সায়ানাইড খেয়ে নিজের প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন।
০৩৩ ▌চিতোরের রানা প্রতাপ , টিপু সুলতান ও নীল বিদ্রোহ :
অধিকাংশ রাজপুত রাজারা আকবরের বশ্যতা মেনে নিলেও বেঁকে বসেন চিতোরের রানা প্রতাপ। তাঁর দৃষ্টিতে মোঘলরা স্রেফ বৈদেশিক হানাদার। সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে সম্রাট আকবর সেনাপতি মানসিংহকে পাঠান দূত হিসেবে। কিন্তু মানসিংহর সাথে এক টেবিলে বসে আহার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান রানা। এতে বিস্মিত হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে রানা উত্তর দেন, বিদেশি শত্রুর নিকট আত্মমর্যাদা বিলিয়ে দেয়া মানুষের সঙ্গে আমি এক পাতে খেতে বসতে পারি না। প্রচ- ক্ষুব্ধ হয়েই দিল্লি ফিরে যান মানসিংহ। সব শুনে ক্ষিপ্ত হন সম্রাট। মানসিংহ আর শাহজাদা সেলিমের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। কামান, বন্দুকের সামনে তলোয়ার আর বর্শা দিয়ে কতক্ষণ টেকা যায়? জঙ্গলে আশ্রয় নেন সপরিবারে রানা ও তাঁর অনুসারীরা। জঙ্গলে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল স্থানীয় ভীল আদিবাসীদের সঙ্গে। ভীলদের নিয়েই গঠন করেন তাঁর নতুন বাহিনী। গরিলা কৌশলে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেন মোগল বাহিনীকে। দীর্ঘ ২০ বছর মোগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান রানা প্রতাপ।
ভারতের কর্ণাটক রাজ্য মহীশূরের শাসনকর্তা ছিলেন টিপু সুলতান। বীরত্বের জন্য তিনি মহীশূরের বাঘ নামে পরিচিত ছিলেন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আগ্রাসনের শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তিনি। যুদ্ধের ময়দানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। টিপুর ছিল চার স্ত্রী। পুত্র সন্তানের সংখ্যা ১৫ জন। আর কন্যা আটজন। টিপু সুলতানের রাজ্যের প্রতীক ছিল বাঘ। তিনি সিংহাসনে বসে প্রায়ই বলতেন ভেড়া বা শিয়ালের মতো ২০০ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দুদিন বেঁচে থাকাও ভালো। টিপু সুলতানের শাসনামলে ধাতব মুদ্রায় বাঘের ছবি খোদাই করা ছিল। বাঘময় ছিল টিপুর জীবন। ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর কাছে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধে টিপু এবং তার বাবা মারাত্মক নাজেহাল হন। ১৭৯৯ সালের ৪ মে ইংরেজ ও হায়দ্রাবাদের নিজামের যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ হারান তিনি। টিপু সুলতানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ, পূর্ণিয়া। আর তার সেনাপতি কৃষ্ণ রাও-ও ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ। তাছাড়া মন্দিরে মুক্তহস্তে দান করতেন তিনি। কারও ধর্ম পালনে বাধা দিতেন না।
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে সেখানকার বস্ত্র-শিল্পে নীলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এই সময় নীলের ব্যবসা হয়ে উঠেছিল লাভজনক। ইংরেজরা নীল উৎপাদনে তৎকালীন বাংলায় সামন্ততান্ত্রিক শোষণ প্রক্রিয়া চালু করে এর জবরদস্তিমূলক চুক্তির প্রচলন করেছিল। এই চুক্তির পরিণতিতে কৃষকরা নীল চাষ করে যে টাকা পেতেন তাতে দাদনের টাকা পরিশোধ হতো না। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে কৃষকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে নীল চাষ অবনতির দিকে গিয়েছিল। কৃষকদের নেতৃত্বে বহু নীলকুঠি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। কুঠিরের পর কুঠি লুটতরাজ করে সব রকমের হিসাবের খাতা আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। বিলাতের পার্লামেন্টে বাংলার তৎকালীন কৃষকরা দুরবস্থার বিষয় নিয়ে এ দেশের ইংরেজ শাসকদের কাছে কৈফিয়ত তলব করে। বাংলার ছোট লাট এ বিষয়ে ফয়সালার জন্য ডাকেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে নীলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় নীলকরদের এ ব্যবসা তুলে নিতে হয়েছিল।
০৩৪ ▌ তেভাগা আন্দোলন ও জমিদারি প্রথার বিলোপ :
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের ফলে চাষিদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। ফসল উৎপাদনের স¤পূর্ণ খরচ কৃষকেরা বহন করলেও যেহেতু তারা জমির মালিক নন সে অপরাধে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো। জমিদারদের এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত করে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় ‘সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি’। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় ‘ফ্লাউড কমিশন’। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষিদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করা। তেভাগা মানে তিন ভাগ। তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর-এ শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে। তেভাগা আন্দোলনের অগ্রদূতি ছিলেন নাচোলের রানী ইলা মিত্র। তবে ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রদ করা সম্ভব হয়নি, পাকিস্তান আমলে গিয়ে ১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রদ হয়।
মুগল আমলে জমিদাররা শুধু খাজনা আদায়ের স্বত্বাধিকারী, জমির স্বত্বাধিকারী নয়। পক্ষান্তরে, জমির মালিকদের বলা হতো রায়ত। বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে কোম্পানির অভ্যুদয়ের পর জমিদারদের ওপর নবাবের নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যায়। উদীয়মান অর্থলগ্নিকার তথা ব্যাংকিং শ্রেণী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশক্রমে বড় জমিদারগণ রাজনীতির মূলধারায় প্রবেশ করেন। পুর্বপাকিস্তনে ১৯৫০ সালে “ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট”-এর অধীনে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে আজ অবধি সেই জমিদারী প্রথা চালু আছে। যার ফলে মাত্র ৫% পরিবার পাকিস্তানের ৭৫% জমি নিয়ন্ত্রন করে এবং পাকিস্তান সরকার এ প্রথা বিলোপ করার সামর্থ রাখে না। উল্লেখ্য পুর্ববাংলায় জমিদারেরা ছিল প্রধানত হিন্দু, যার ফলে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত করতে সরকারের কোন সমস্যা হয়নি। পূর্বপাকিস্তানের মুসলমানরা তাই নিমেষেই চাষী থেকে জমির মালিক হয়ে যেতে সক্ষম হন।
০৩৫ ▌বাংলার নবজাগরণ ও বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলন :
রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭৫-১৮৩৩) সময় এই নবজাগরণের শুরু এবং এর শেষ ধরা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) সময়কাল পর্যন্ত। ঊনবিংশ শতকের বাংলা ছিল সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় দর্শনচিন্তা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম, ও বিজ্ঞানের পথিকৃৎদের এক অন্যন্য সমাহার; যা মধ্যযুগের অন্ত ঘটিয়ে এদেশে আধুনিক যুগের সূচনা করে। রাজা রামমোহন রায় শিক্ষা সংস্কারের যে সূচনা করে দিয়েছিলেন সেটা আরও বহুদূর নিয়ে গিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলায় আধুনিক সমাজ তৈরির পথিকৃৎ যদি রাজা রামমোহন রায় হয়ে থাকেন, তাহলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পেছনে অবদান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে কাজ করবার সময়ে তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে বিশটি মডেল স্কুল এবং পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি শুধু বিধবা বিবাহপ্রথা চালুরই অগ্রদূত নন স্বয়ং নিজ ছেলেকে দুঃখিনী এক বিধবার সাথে বিয়ে দেন। তৎকালীন সমাজপতিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাল্যিবিবাহ রোধে এগিয়ে আসেন তিনি।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৬ সালে। এই প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আর এর মুখপত্র ছিল ‘শিখা পত্রিকা’। ‘শিখা’ ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজের আধুনিকত্ব ও অগ্রগতির অবিস্মরণীয় স্মারক। এই পত্রিকার শ্লোগান ছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ উদ্দেশ্য এবং আদর্শ ছিল নবজাগরণ, এটি ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারবিরোধী একটি প্রগতিশীল আন্দোলন। এই শিখা গোষ্ঠী ছিল বাংলাদেশের প্রথম বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলনের দল, এর কর্ণধার ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুল কাদির এবং আবুল হুসাইন। ছয়টি বিষয়কে কেন্দ্র করেই তাদের চিন্তা-ভাবনা আবর্তিত হতো। বিষয় ছয়টি হলো: মাতৃভাষা, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক সমস্যা, ললিতকলার চর্চা, ধর্মীয় রীতিনীতির ব্যাখ্যা। বাংলার মুসলমান সমাজের যে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও কুপ্রথা ছিল, তা দূর করা ছিল এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য।
০৩৬ ▌রাজা রামমোহন রায়, রাজ্য না থাকলেও কেন তিনি রাজা?
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তিনি এক জ্বলন্ত মশাল। আঠারশো শতকে যে লড়াই তিনি করেছিলেন,ভাবলে শিহরণ হয়। অদম্য মনের জোর আর সাহস না থাকলে সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে ওভাবে বুক চিতিয়ে লড়াই করা যায় না । অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই কীভাবে করতে হয় আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি চরিত্রে রাজা, চেহারায়ও রাজা। রাজ্যপাট না থাকলেও তিনি রাজা। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সজ্জন। প্রায় ৬ ফুটের মত লম্বা, হাত-পায়ের গড়ন শক্তিশালী। অত বড় শরীর মজবুত রাখতে প্রতিদিন প্রচুর ডিম দুধ খেতেন। পাঁঠার মাংস থেকে আম-জাম, কোনটাই বাদ যেতো না তার খাদ্য তালিকা থেকে। যখন খেতে বসতেন তখন কেউ একজন পড়ে শোনাতেন খবরের কাগজ, খবর শেষ হয়ে যেত, তার খাবার নয়। যদি কেউ এসে বলতেন, অমুক লোক আপনার সঙ্গে তর্ক যুদ্ধ করবে, রামমোহন হেসে বলতেন, আরে ও কি খায় যে, আমার সাথে তর্ক করবে। আমার খাদ্য তালিকাটা তাকে দিয়ে এসো, তাহলে আর আসবে না।
ছোটবেলা মায়ের সাথে খুব তর্ক ও প্রশ্ন করতো। তখন রাজকাজ জোটাতে গেলে আরবি আর ফারসি শেখা অত্যন্ত প্রয়োজন। রামকান্ত ছেলে রামমোহনকে পাটনা পাঠিয়ে দিলেন ওই দুই ভাষা যেন ভালভাবে শিখতে পারে। তিনি পাটনায় গিয়ে একই সঙ্গে পড়েছেন অ্যারিস্টটল থেকে দিকপাল সব পণ্ডিতদের লেখা। ফলে অল্প বয়সেই ইচঁড়ে পাকা। এরপ্র তাকে কাশীতে পাঠানো হল ভাল করে সংস্কৃত শিখতে। সংস্কৃত শিখে পড়ে ফেলেন হিন্দু ও বোদ্ধ ধর্মের প্রায় সব বই, এর আগে ফার্সিতে সে ইসলাম পড়েছে। কাশী থেকে ফিরে বাবা- ছেলের তর্কযুদ্ধ। কি ধর্ম পালন করো তুমি? কি আছে তোমার ধর্মে, জানো তুমি? ধর্ম নিয়ে মতবিরোধ। রামাকান্ত এত বাড়াবাড়ি সহ্য করতে রাজি নন, দিলেন ছেলেকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে। রামমোহন এসবে ভ্রুক্ষেপহীন। ঘর হারালেন কিন্তু নিজের বিশ্বাস হারালেন না। চলে গেলেন তিব্বত। সেখানেও তর্ক করেছেন। তবে তিব্বতী কন্যাদের মমতায় বিপদে পড়তে হয়নি। সেই থেকে রামমোহনের বুকে নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায় । তিব্বতী নারীদের মতো মুক্ত স্বাধীন জীবন কেনো বাঙালি নারীদের নেই? কলকাতায় এসে জড়িয়ে পড়েছিলেন সমাজ বদলের কাজে। প্রথমে ' আত্মীয় সভা'। যারা আত্মীয় সভা নিয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ একদিন মহাসভা ডেকে শুরু হল তর্কযুদ্ধ। কলকাতার বাঘা বাঘা পণ্ডিতরা হাজির । সভা যখন শেষ হল দেখা গেল বিপক্ষদলের সেরা পণ্ডিতের ঘাড় মাটির দিকে নামানো। এবার তৈরি করলেন 'ব্রাহ্মসমাজ'। সতীদাহ থেকে বাঙালি সমাজে যত অন্যায় রামমোহন সবকিছুর বিরুদ্ধে। মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য আগ্ৰহ,উদ্যমের অন্ত নেই। নিজের বৌদিকে পুড়ে মরতে দেখেছিলেন চোখের সামনে। সেইদিন থেকে প্রতিজ্ঞা একদিন চিরতরে বন্ধ করবেন সতীদাহ প্রথা। তিনি পেরেছিলেন, প্রাণপণ চেষ্টা আর দীর্ঘদিনের সংগ্ৰামে ১৮২৯ এর ৪ ডিসেম্বর লর্ড বেন্টিকের আমলে আইন করে চিরতরে বন্ধ করলেন সতীদাহ।
অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে বিলেত যাবার ইচ্ছা। বিলেতগামী জাহাজে চাপার আগে দিল্লির বাদশা পরিয়ে দিলেন 'রাজা ' উপাধির মুকুট। কারণ বিলেতে রাজার দরবারে দিল্লীর বাদশার পক্ষে কথা বলে তার পদবি দরকার। থামলেন লিভারপুল। সেখানে পেলেন প্রশংসা আর নিমন্ত্রণ। ইংল্যান্ডের রাজা প্রকাশ্য ভোজসভায় তাঁকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন। লন্ডন থেকে ফ্রান্সে গিয়ে সম্রাট লুইয়ের সঙ্গে ভোজ। ততদিনে শরীর ভেঙে পড়েছে। ফিরে এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। জ্বর হল তারপর ধনুষ্টংকার। হাজার চিকিৎসায় তাঁকে বাঁচানো গেল না। না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন বাংলার নবজাগরণের প্রথম পুরুষ রাজা রামমোহন রায়।
০৩৭ ▌ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
ছেলেবেলায় গ্রামের পাঠশালাতে পড়তেন ঈশ্বরচন্দ্র। পাঠশালার পাঠ শেষ করে আরও শিক্ষালাভের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতায় পৌঁছান পায়ে হেঁটে, যখন তাঁর বয়স মাত্র আট পেরিয়েছে। কথিত আছে ঈশ্বরচন্দ্রের লেখাপড়ায় এতটাই আগ্রহ ছিল যে বাসায় আলো জ্বালার যথেষ্ট সামর্থ্য পরিবারের না থাকায় তিনি রাস্তার আলোর নিচে পড়াশোনা করতেন। "কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ থেকে খুবই কৃতিত্বের সঙ্গে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি নিয়ে পাশ করেন তিনি ১৮৪১ সালে এবং তখন থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এরপর তাঁকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড পণ্ডিত পদে নিয়োগ করা হয়," "শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান অবদান হচ্ছে দেশের সর্বসাধারণের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা এবং একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম তৈরি করা, "ছয় মাসের মধ্যে তিনি বাংলার মেয়েদের জন্য প্রায় ৪০টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।" নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিদ্যাসাগর সারা জীবন লড়াই চালিয়েছিলেন। "বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন বাল্যবিবাহের অবসান ঘটাতে। বিধবা বিবাহ প্রচলন করে নারীর অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে, বহুবিবাহ রহিত করে নারীকে অবিচার ও যন্ত্র্রণার হাত থেকে মুক্তি দিতে।"
সেই সময়ে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজে মেয়েদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। "সমাজে মেয়েদের খুবই ছোট চোখে দেখা হতো। কিন্তু যে দরদ নিয়ে এবং যেভাবে সাহসের সঙ্গে বিদ্যাসাগর তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য লড়াই করেছেন, তার আর তুলনা নেই।" তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ। তিনি মনে করতেন, নারী জাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় যে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটিই ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। "গ্রামের যেসব মানুষ শিক্ষার আলো থেকে ছিল বঞ্চিত- বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ তাদের জন্য বিদ্যাসাগর প্রথম এই বীরসিংহ গ্রামে নৈশ স্কুল তৈরি করেছিলেন।" কলকাতায় উচ্চশিক্ষার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত। অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন প্রাণপুরুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি বলেছিলেন শিক্ষার ক্ষেত্র থেকে, পাঠ্যপুস্তক থেকে ধর্মের কথা, ধর্মশিক্ষা বাদ দিয়ে দাও, সে প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে উঠুক, ধর্মের মধ্যে নয়। এটাই ছিল বিদ্যাসাগরের সেক্যুলারিজমের মূল তত্ত্ব। তিনি প্রমাণ করতে পেরেছিলেন তাঁর ধর্ম হল মানবতাবাদ - রিলিজিয়ন অফ হিউম্যানিটি।" ঈশ্বরচন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল তাঁর স্বাধীন চিন্তায়- শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে। ঈশ্বরচন্দ্র শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে বারবার বলেছেন- শিক্ষা হতে হবে যুক্তি-ভিত্তিক।
"সমাজের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর মধ্যেই ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়। শুধু তাই নয় বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। বাংলা গদ্যের যে সৃষ্টি , তাতে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম।" সর্বস্তরের জন্য শিক্ষা বিষয়ক বই বর্ণপরিচয়। বইটি এত সংগঠিত ছিল যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বই থেকে অক্ষর পরিচয় হয়ে চলেছে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একদিকে ছিল যেমন অসাধারণ বুদ্ধি ও মেধা, অন্যদিকে ছিল চরিত্রের কঠোরতা এবং সংগ্রামী মনোভাব। "সমাজ সংস্কারের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিরলস আন্দোলন সমগ্র বাঙালি জাতিকে নতুন পথে চলার রাস্তা দেখিয়েছিল।
০৩৮ ▌ ব্যাকরণ ও বাংলা অক্ষর, কাপড়ের দাঙ্গা’, ও ফরাজি আন্দোলন:
প্রথম দিকের মুদ্রিত বাংলা পুস্তক হিসেবে পর্তুগিজ পাদ্রি মানোএল রচিত কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ ছাপা হয়েছিল রোমান হরফে আর পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে ১৭৪৩ সালে । কিন্তু এ বই ছাড়াও মানোএল একটি বাংলা ব্যাকরণও রচনা করেছিলেন। এর প্রায় ৩৫ বছর পর হ্যালহেডের পূর্ণাঙ্গ ব্যায়াকরণ প্রকাশিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানির ইংরেজদেরকে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর প্রয়োজন থেকেই হ্যালহেড ব্যাকরণটি লিখেছিলেন ১৭৭৮ সালে। এটি ছাপার জণ্র ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি হুগলিতে একটি প্রেস স্থাপন করেন । এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার। হরফ নির্মাণের পাশাপাশি পঞ্চানন কর্মকার খোদাই চিত্র শিল্পী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। হ্যালহেডের জন্ম ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে।। ১৭৭৪ সালে হ্যালহেডের বাংলা শিখতে গিয়েই একটি বাংলা ব্যাকরণ পুস্তকের প্রয়োজন অনুভব করেন। ১৭৭৫-এর শেষে হ্যালহেড সুপ্রিম কোর্টে দোভাষীর কাজ করতেন।
কয়েকশ’ বছর আগে ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যে হিন্দুদের মধ্যে এক প্রকার ট্যাক্স বা কর প্রচলিত ছিলো। যার নাম স্তনকর। ঐ সময় নিয়ম ছিলো শুধু ব্রাহ্মণ ব্যতিত অন্য কোন হিন্দু নারী তার স্তনকে ঢেকে রাখতে পারবে না। যদি কোন নারী তার স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করতে চাইতো, তবে তাকে কর দিতে হতো। ১৮০৩ সালে নাঙ্গেলী নামক এক নারী তার স্তনকে আবৃত করে রাখে। যথন গ্রামের ট্যাক্স কালেকটর তার থেকে স্তনকর চাইতে আসে, তখন নালেঙ্গী তা দিতে অস্বীকার করে এবং নিজের দুটি স্তনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটে, এতে ট্যাক্স কালেকটর অবাক হয়ে পালায়। কিছুক্ষণ পরেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য নাঙ্গেলীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর স্তনকর রোহিত হলেও তখন হিন্দু পুরোহিতরা ¯পষ্ট করে বলে দেয়, নিচু বর্ণের নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্ম বিরোধী। বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে একটি দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এটা ‘কাপড়ের দাঙ্গা’ হিসেবে পরিচিত।
বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের আদর্শে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ফরাজি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরাজি আন্দোলন চলে। ফরাজি আন্দোলনের মূল প্রবর্তক ছিলেন হাজি শরিয়তুল্লাহ। ফরিদপুর ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল প্রভৃতি স্থানের গরিব হিন্দু-মুসলিম কৃষক, তাঁতি, কারিগর, শ্রমিক প্রমুখ এই ফরাজি আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। বাংলার নিপীড়িত ও অত্যাচারিত মানুষের কাছে হাজি শরিয়তুল্লাহ ছিলেন এক আদর্শ পুরুষ। হাজি শরিয়তুল্লাহ এই সম্প্রদায়ের লোকজনদের নিয়ে তিনি সংস্কার ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে হাজি শরিয়তুল্লাহ মারা গেলে তাঁর পুত্র দুধু মিঁয়া এই আন্দোলনের হাল ধরেন। দুধু মিঁয়া ফরাজি আন্দোলনকে একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করেন। ক্রমে ফরাজি আন্দোলন তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারায়। কো¤পানি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে দুধু মিঞাকে কারারুদ্ধ করেন। কারারুদ্ধ অবস্থায় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।
০৩৯ ▌ সিপাহী বিপ্লব ও মঙ্গল পান্ডে, ও অসহযোগ আন্দোলন
১৮৪৯ সালে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিতে সিপাহী পদে চাকরি নেন মঙ্গল পান্ডে। চাকরি করতে এসে তিনি অনেক রকম বৈষম্য আর অন্যায় দেখতে পান, যা মঙ্গল পান্ডেকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ১৮৫৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল ৫৫৭ ক্যালিবার রাইফেল। রাইফেলগুলোর কার্তুজ গরু ও শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরি হতো। সৈন্যরা তাদের রাইফেলের কার্তুজ লোড করার সময় তা দাঁত দিয়ে খুলে লাগাতে হতো। গরু ও শুকরের চর্বি মুখে দেওয়া হিন্দু- মুসলিম সৈন্যদের জন্য অধার্মিক ও গর্হিত কাজ। সিপাহীরা নতুন কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করে। ধীরে ধীরে বিদ্রোহের সূচনা করে। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ কলকাতার ব্যারাকপুরে মঙ্গল পা-ে সমস্ত সৈনিকদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ডাকেন ও দেশ স্বাধীন করার আহ্বান জানালেন। কিন্তু পা-েকে শায়েস্তা করার জন্য ছুটে এলেন ইংরেজ সেনাপতিরা। মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। অনেক ইংরেজ সেনাপতি মারা যান। ফাঁসির দন্ডাদেশ দেয়া হয় তাকে। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এ বিদ্রোহ ছিল এক নতুন সূর্য।
১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে “গান্ধী যুগ”-এর সূত্রপাত ঘটায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রাওলাট আইন পাস হলে, ভারতের ভাইসরয় ও ই¤িপরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল সেই আইন বলবৎ করে। এই আইনবলে ভারতবাসীর উপর দমনমূলক নানা বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হয়, ন্যূনতম প্রমাণ দাখিল ব্যতিরেকেই সেনা ও পুলিশকে সাধারণ ভারতীয়দের গ্রেফতার, কয়েদ ও স¤পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়। অধিকন্তু, ভারতীয় জনসাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের একতরফা ভারতীয় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত অনেক ভারতবাসীকেই ক্ষুব্ধ করেছিল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এটিই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বৃহত্তম আন্দোলন।
০৪০ ▌জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড ও লবন আন্দোলন:
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা- (অমৃতসর হত্যাকা-) ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল তারিখে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে এই হত্যাকা- সংঘটিত হয়। এই শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি বদ্ধ উদ্যানে সমবেত নিরস্ত্র জনগণের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজ সরকারের দেওয়া "নাইটহুড" উপাধি ত্যাগ করেন। ১০০ জন গুর্খা সৈন্য আর ২টি সাজোয়া গাড়ি নিয়ে ডায়ারের নির্দেশে জালিয়ানওয়ালাবাগে ২০০০-এর মত "বিদ্রোহী"কে হতাহত করা হয়েছিল। দেশে-বিদেশে সর্বত্র সরকারের নগ্ন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের ঘটনার প্রতিবাদে দেশের সর্বত্র ঘৃণা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৩০ সালের ১২ মার্চ ডান্ডি পদযাত্রা ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশদের একচেটিয়া লবণ নীতির বিরুদ্ধে একটি অহিংস করপ্রদান-বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা হয়। মহাত্মা গান্ধী আমেদাবাদের কাছে তার সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি পদযাত্রা শুরু করে ২৪ দিনে ২৪০ মাইল (৩৯০ কিলোমিটার) পথ পায়ে হেঁটে ডান্ডি গ্রামে এসে বিনা-করে সমুদ্রের জল থেকে লবণ প্রস্তুত করেন। বিরাট সংখ্যক ভারতীয় তার সঙ্গে ডান্ডিতে আসেন। ১৯৩০ সালের ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৬টার সময় গান্ধীজি লবণ আইন ভেঙে প্রথম লবণ প্রস্তুত করেছিলেন। সেই সঙ্গে তার লক্ষাধিক অনুগামীও লবণ আইন ভেঙে ভারতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করলেন। এই আন্দোলনের ফলে ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ব্রিটিশদের মনোভাব অনেকটাই বদলে যায়। আইন অমান্য আন্দোলন ভারত জাতিকে সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকার করতে প্রস্তুত করে তোলে।
০৪১ ▌বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত ও বঙ্গভঙ্গ রদ ও ঢাবি প্রতিষ্ঠা ও কলকাতা দাঙ্গা :
১৭৬৫ সালের পর থেকেই বিহার ও উড়িষ্যা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সরকারি প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বাংলা অতিরিক্ত বড় হয়ে যায় এবং বৃটিশ সরকারের পক্ষে এটির সুষ্ঠু শাসনক্রিয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত এখান থেকেই। বড়লাট কার্জনের বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলার হিন্দু নেতাদের মধ্যে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন চন্দ্র পাল, বাল গঙ্গাধর তিলক এবং লালা লাজপত রায়ের যুদ্ধংদেহী রাজনীতির সুত্রপাত হয়। স্বদেশী আন্দোলন এবং ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের কার্যক্রমের ফলে কংগ্রেসের মধ্যেও একটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। ১৯১১ সালে, প্রচ- গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বাংলার পুনরেকত্রীকরণের দিন ধার্য হয় ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল। বাংলার পুনরেকত্রীকরণ বাঙালিদের ক্রোধকে কিছুটা প্রশমিত করে বটে, কিন্তু কলকাতাকে ভারতের রাজধানী থেকে কেবল প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় নামিয়ে আনায় পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা আহত হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের নতুন গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার মুসলমানদের শিক্ষার উন্নতির জন্য বিশেষ নজর দেন। ব্রিটিশ সরকার এপর্বে নানাভাবে মুসলমানদের সুবিধা দিতে থাকে, নতুন প্রশাসনে মুসলমান ও হিন্দুর অনুপাত ২:১ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গ জেগে উঠে এবং ব্যস্ত হয়ে পরে মাধ্যমিক শিক্ষার সম্প্রসারনে। পরবর্তী পাঁচ বছরে এই এলাকায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় বৃদ্ধির শতকরা হার দাঁড়িয়েছিলো ৮২.৯ ভাগ। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। ফলশ্রুতিতে, পূর্ববঙ্গে চরম হতাশা দেখা দেয়। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় এলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। লর্ড হার্ডিঞ্জ এ দাবির যৌক্তিকতা অনুভব করে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।
মূলত পাকিস্তান কায়েম হয়েছে রক্তক্ষয়ী এক দাঙ্গার মাধ্যমে। একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে মুসলিম লিগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট একটি সাধারণ ধর্মঘটের (হরতাল) ডাক দেয়। উপমহাদেশের সর্বত্র মুসলমানগণ ওই দিন সকল কাজ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে, হিন্দু জনমত পাকিস্তান বিরোধী হিসেবে সংগঠিত হতে থাকে। ১৬ আগষ্ট ভোরে উত্তেজনা শুরু হয় যখন মুসলিম লীগের স্বেচ্ছাসেবকেরা উত্তর কলকাতায় হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানপাট বন্ধ রাখতে বাধ্য করে এবং হিন্দুরা এর সমুচিত প্রতিশোধ হিসেবে লীগের শোভাযাত্রাসমূহের পথে বাধার সৃষ্টি করে। সমবেত জনতা প্রতিপক্ষ সম্প্রদায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সরকারি হিসাব মতে এ দাঙ্গায় ৪,০০০ লোক নিহত ও ১,০০,০০০ আহত হয়। দাঙ্গা আরম্ভের বহু পূর্বে হিন্দুদের মালিকানাধীন ফ্যাক্টরিসমূহে বোমা মজুদ রাখা হয়। মুসলিমরাও বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাকে করে অনেক যোদ্ধা কলকাতায় জড়ো করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সোহরাওয়ার্দী ১,২০০ প্রশিক্ষিত মুসলিম পাঞ্জাবি সিপাহি নিয়োগ করে কলকাতা দাঙ্গা দমন করে।
০৪২ ▌ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হিরোসিমা ও নাগাসাকি ও আজাদ হিন্দ ফৌজ:
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলে জার্মানির প্রতি তোষণ নীতি ত্যাগ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় । ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত জার্মানি ইতালির সঙ্গে একটি মিত্রজোট গঠন করে এবং ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চল নিজের দখলে আনতে সমর্থ হয়। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান অক্ষশক্তিতে যোগ দেয়। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে। কিন্তু হিটলার বাহিনী রাশিয়ার শীতের জন্য প্রস্তুত ছিল না। গরমের পোশাকে রাশিয়ার প্রবল শীতে যুদ্ধ করতে গিয়ে মস্কো দখলে ব্যর্থ হয় জার্মানরা। যুদ্ধে আমেরিকা নিরপেক্ষ থাকলেও গোপনে যুক্তরাজ্যকে সহায়তা করে থাকে এমন অজুহাতে জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নৌ-ঘাঁটি এই পার্ল হার্বার আক্রমণ করে প্রায় সব যুদ্ধজাহাজ ও ২৭২টি মার্কিন বিমান ধ্বংস করে দেয়। এতে প্রায় আড়াই হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হয়।
১৯৪৪ সালে ১৫ই জুন আমেরিকা জাপানের চাইপান দ্বীপে আক্রমণ চালিয়ে দ্বীপটি দখল করে নেয়। জাপানীরা যখন দেখল তারা জিততে পারছে না, তখন তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সবথেকে বেদনাদায়ক হল এই দ্বীপের প্রায় ২৫ হাজার সাধারণ জনগণ জাপানী সৈন্যদের সাথে আত্মহত্যা করে। এ আত্মহত্যা সময়ের সাথে সাথে বাড়তে খাকে। প্রতিটি পরাজয়ের পর জাপনীরা আত্মহত্যা করতে থাকে। আত্মহত্যা করে প্রায় ২০ হাজার জাপানী সেনা আর জনগণ অগণিত। মাঞ্চুরিয়ায় সোভিয়েত সৈন্যবাহিনীর হাতে কুয়ান্টুং বাহিনীর পরাজয়ের ফলে জাপান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেও জাপনী সৈন্যরা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোদ্ধে বিদ্রোহ করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা কিছুতেই আত্মসমর্পণ করছিল না। ফলে আমেরিকা বাদ্য হয়ে জাপানের মূল ভূখ-ে আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। তারা জাপানীদের পরাজিত করার জন্য সবচেয়ে জঘন্য পথ বেচে নেয়। জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পরমানু হামলা চালায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় "ইংরেজ ভারত ছাড়" আন্দোলন তীব্রতর হয়। কিন্তু মহাত্তা গান্ধীর "অহিংসা মনোভাব"-এর কারণে আন্দোলন বেগবান হচ্ছিল না। নেতাজী সুভাষ বসুর বক্তব্য ছিল, "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব"। এই সময় নেতাজী সুবাস বসু ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হিটলারের কাছে গেলেন। কিন্তু সেই মুহুর্তে হিটলার প্রচ- ব্যস্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। তাই নেতাজী জাপানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। জাপান নেতাজীকে প্রয়োজনীয় অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। নেতাজী তখন রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নিয়ে ইংরেজদের আক্রমণ করেন। তার নেতৃত্বের ফলে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যের একটি সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ভিতরে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারতের আরাকান, ইম্ফল, ময়রাং, বিষেণপুর প্রভৃতি স্থান সুভাষ চন্দ্র দখল করে নেন। কিন্তু ঠিক সেই মূহুর্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় পরাজিত হয় অক্ষ বাহিনী। যুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পনের পর নেতাজী নিখোঁজ হন।
০৪৩ ▌পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবি, ভারত ভাগ করার প্রস্তাব ও সিলেটের গণভোট:
১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন ভারতীয় নেতৃবর্গের হাতে ব্রিটিশ ভারতের শাসনভার তুলে দেওয়ার প্রস্তাব রাখে। এই প্রস্তাবে একটি নতুন ভারত অধিরাজ্য ও তার সরকার গঠনেরও প্রস্তাব জানানো হয়। এর অব্যবহিত পরে, একটি বিকল্প প্রস্তাবে হিন্দুপ্রধান ভারত ও মুসলমানপ্রধান পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তব দেওয়া হয়। কংগ্রেস বিকল্প প্রস্তাবটি স¤পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে। এই প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে এবং একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট একটি সাধারণ ধর্মঘটের (হরতাল) ডাক দেয়। এই প্রতিবাদ আন্দোলন থেকেই কলকাতায় এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম হয়। মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শহরে চার হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান ও এক লক্ষ বাসিন্দা গৃহহারা হন। কলকাতার দেখাদেখি দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী, বিহার, যুক্তপ্রদেশ উত্তরপ্রদেশ) পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও। এই ঘটনাই ভারত বিভাগের বীজ বপন করে।
অন্তর্বর্তী সরকারে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দ্বন্ধের প্রেক্ষাপটে ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিস্থিতির পুরোপুরি সুযোগ নিয়ে ধীরে ধীরে পূর্ণ ক্ষমতা নিজের কাছে নিয়ে নেন। তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, একমাত্র ভারত বিভক্ত হলে এর সমাধান হতে পারে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয়পক্ষকে খুশি রাখতে চেয়েছিলেন এবং উভয়পক্ষকে বুঝিয়েছিলেন যে পাকিস্তানের সৃষ্টি না হয়ে উপায় নেই। ভারতীয় নেতাদের মধ্যে সরদার প্যাটেল মাউন্টব্যাটেনের এ ধারণা সবার আগে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে ভারত ভাগ করার বিষয়ে সরদার প্যাটেল এতোটাই অনড় ছিলেন যে, তিনি অন্য কারো মতামত শুনতে মোটেই রাজি ছিলেন না। এ ধরনের ভাগ করার ফর্মুলার কথা শুনে প্রথমে নেহেরু খুবই রাগান্বিত হন। শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। কংগ্রেসের এ অবস্থানের কারণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর পাকিস্তান সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে আরো জোরালো অবস্থান নিলেন।
ঐতিহাসিকভাবে পূর্ববঙ্গের সাথে সিলেটের যোগ থাকলেও ১৮৭৪ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ অহমিয়া ভাষীদের নিয়ে গঠিত আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয় সিলেটকে। ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই প্রদেশে অহমিয়া, বোড়ো আদিবাসী ছাড়াও বাঙালি, নাগা, মণিপুরীসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সম্মিলন ঘটেছে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭র ৩রা জুন এক ঘোষণায় সিলেটের ভবিষ্যৎ নির্ধারনের দায়িত্ব দেন স্থানীয় জনসাধারণের কাঁধে। সিদ্ধান্ত হলো গণভোট অনুষ্ঠানের। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ই জুলাই সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সিলেটের জনগণকে পাকিস্তানের পক্ষে ভোটদিতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল মুসলীম লীগ। মোট ভোটার ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৫ জন। ভোট দিয়েছিল ৭৭ শতাংশ মানুষ। ভোটে করিমগঞ্জের মানুষও আসাম ছাড়ার রায় দিলেও গণভোটের রায় না মেনে মানচিত্রে দাগ কেটে করিমগঞ্জের কিছু অংশ ভারতকে দিয়ে দেয়ায় সিলেটের মানুষের কাছেও চির বিতর্কিত হয়ে যায় র্যাডক্লিফ লাইন।
০৪৪ ▌ আরাকান যেভাবে বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়েছিল :
রাখাইন নামে যে ভূমি আজ মিয়ানমারের অন্তর্গত, একসময় তাকে ডাকা হতো “আরাকান” নামে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা ছিল সেই ভূমি। চতুর্দশ শতাব্দীতে আরাকানের রাজপুত্র নরমিখলা, যিনি একসময় নির্বাসিত হয়েছিলেন, ফিরে এলেন নিজের রাজ্য দখল করতে—বাংলার গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহের সৈন্যবাহিনীর সহায়তায়। সেই সঙ্গে বদলে গেল আরাকানের ভাগ্যও। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন, নাম নিলেন সুলতান সোলায়মান শাহ। আরাকানের রাজদরবারে শুরু হলো নতুন ইতিহাস। সেই সময় রোসাং (আরাকানের রাজধানী) হয়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক রাজধানী। বাংলার কবিরা সেখানে পেতেন সম্মান ও আশ্রয়। মহাকবি আলাওল, দৌলত কাজী, সৈয়দ মোহাম্মদ রফি—ইত্যাদি কবিদের পদচারণায় আরাকানের রাজদরবারে প্রতিধ্বনিত হতো বাংলা কবিতার সুর। এভাবেই মুসলিম সংস্কৃতি ও আরাকানের স্থানীয় ঐতিহ্য মিশে গড়ে ওঠে এক নবজীবন—যার ফলাফল আজকের রোহিঙ্গা জাতির উৎপত্তি। কিন্তু শান্তি টেকেনি বেশি দিন। ১৭৮৪ সালে বর্মি রাজা ভোধাপোয়া আগুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন আরাকানের ওপর। তিনি হত্যা করলেন হাজার হাজার মানুষ, মন্দির লুট করলেন, মুসলমানদের মসজিদ ধ্বংস করলেন। হাজারো মানুষ পালিয়ে এল চট্টগ্রামে আশ্রয়ের খোঁজে। এরপর এলো ব্রিটিশরা। তারা আরকান পুনরায় করায়ত্ত করে নিল। ১৯৪৬ সালে ভারতবর্ষে ভাগ হবার সময় আরাকানের মুসলমান বাংলার সঙ্গে এক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তারা গঠন করলেন আরাকান মুসলিম লীগ। কিন্তু ইতিহাস তাদের পক্ষে ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা ভয় পেলেন—যদি আরাকান যুক্ত হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তান সমুদ্রপথে অতিশক্তিশালী হয়ে উঠবে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও সে সময় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেন না। আরাকান হারিয়ে গেল সীমান্তের ওপারে।
০৪৫ ▌ র্যাডক্লিফ লাইন, কাশ্মীর নিয়ে দ্বন্দ্ব ও ভারত-পাকিস্তানের অভিবাসন
একজন ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল র্যাডক্লিফকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো ব্রিটিশ শাসিত ভারতকে ভাগ করে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা ঠিক করার জন্য। মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছিলো তাকে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ছিলো দুটি বড় প্রদেশ, (বাংলা ও পাঞ্জাব) যেখানে মুসলিম ও অমুসলিমরা ছিলো প্রায় সমান সংখ্যক। র্যাডক্লিফের দায়িত্ব ছিলো এই দুটি প্রদেশের মধ্যে বিভক্তি লাইন টেনে দেয়া। শত বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসা কোন সম্প্রদায়কে সোজা লাইন টেনে বিভক্ত করা জটিল কাজ। তার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছিলো ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার কয়েকদিন পর। যখন লাখ লাখ মানুষ স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপন করছে, কিন্তু তারা নিজেরাই জানতোনা যে তারা ঠিক কোন দেশের অধিবাসী। ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে র্যাডক্লিফের আঁকা বিভক্তি লাইন (র্যাডক্লিফ লাইন) লাইন অতিক্রম করতে হয় নিজের বসবাসের জন্য। ধর্মীয় সহিংসতায় প্রাণ হারায় ৫থেকে ১০লাখ মানুষ।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের অধীনে থাকা ভারত দুই দেশে বিভক্ত হয়। জন্ম নেয় নতুন দুই রাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং তাঁর দল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ মুসলিমদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি জানান। ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে, ঐ দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। জন্মভূমি ছেড়ে ভারত থেকে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে ভারতে আসে লাখ লাখ মানুষ। স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যেই ‘কাশ্মীর কার?’ এ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ায় দুই দেশ। হিন্দু মহারাজার অধীন থেকে মুসলমানদের ‘মুক্ত' করতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সহযোগীরা স্থানীয় যোদ্ধাদের পাঠান কাশ্মীরে, অন্যদিকে সৈন্য পাঠিয়ে কাশ্মীরের বেশিরভাগ দখলে নেয় ভারত, বাকিটা দখলে থাকে পাকিস্তানের। দুই দেশের স¤পর্কোন্নয়নের প্রধান বাধা এই কাশ্মীর বিরোধ।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত তৈরি হয়। এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল ১০০০ মাইল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ভারত বিভক্তির পর কয়েক মিলিয়ন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পূর্ব বাঙলা থেকে ভারতে অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু করে। তাদের অধিকাংশই পশ্চিম বাংলায় এবং অল্প কিছু জনগোষ্ঠী আসাম, ত্রিপুরা এবং অন্যান্য প্রদেশে থাকতে শুরু করে। কিন্তু শরণার্থী সমস্যা সবেচেয়ে বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করে পাঞ্জাবে, যেখানে চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এর ফলাফল স্বরূপ পুর্ব এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে খুব দ্রুতই ১ বছরের মাঝে উভয় পক্ষের লোকজনই অভিবাসন প্রক্রিয়া শেষ করেন। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে কোলকাতা এবং নোয়াখালিতে দাঙ্গা এবং সন্ত্রাস সীমাবদ্ধ ছিলো। ফলে অভিবাসন প্রক্রিয়া ছিলো ধীর গতির এবং বিভক্তির পরে তিন দশক ধরে এই প্রক্রিয়া চলমান ছিল।
০৪৬ ▌১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন , পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও ৬ দফার পরিবর্তে ১ দফা:
পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসের এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ এবং পাঁচটি দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দলগুলো ছিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, এ. কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি, মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলাম, হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দল এবং খিলাফতে রব্বানী পার্টি। এ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পান। এর মধ্যে ১৩০ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জের আসনে নির্বাচিত হয়ে প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টের এহেন বিজয়ের রূপকার ছিলেন এ.কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই দ্বন্দ্ব, সমঝোতাহীনতা, মতানৈক্য এবং বহুমুখি দলীয় কর্মসূচির কারণে যুক্তফ্রন্টের ঐক্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এই বছররে ২৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা বাতিল করে দেয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় বাঙালি প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল খুবই কম। পাকিস্তানের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি ছিলেন সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তারা। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের মন্ত্রণালয়গুলোতে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ৯৫৪ জনের মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ১১৯ জন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তনের কেন্দ্রীয় সরকারের ৪২০০০ কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল মাত্র ২৯০০। ১৯৪৭ সালে করাচিতে রাজধানী হওয়ায় সব সরকারি অফিস-আদালতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ব্যাপকহারে চাকরি লাভ করে। সিভিল সার্ভিসে পশ্চিম পাকিস্তানি ছিল ৮৪% আর আমাদের ১৬%। ফরেন সার্ভিসে তাদের ৮৫% আর আমাদের মাত্র ১৫%, আর্মিতে ৯৬% ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের আর আমাদের ৪%। জেনারেল পদে ছিল মাত্র ১ জন আর তাদের ১৬ জন। ৫ লাখ আর্মির মাত্র ২০ হাজার ছিল বাঙালি। ওদের ট্রাক্টর ছিল ২০০০০ আর আমাদের ১৮০০। ১ মন চাল পশ্চিম পাকিস্তানে দাম ছিল ১৮ রুপি আর আমাদের জন্য দাম ৫০ রুপি।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ওপর ভিত্তি করে আপাতত স্বায়ত্তশাসন অর্জনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ১ মার্চ থেকে সমগ্র দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যেতে থাকে। বাঙালিদের দাবি ৬ দফার পরিবর্তে ১ দফা তথা স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয়। ৬ মার্চ পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এই বার্তা দেন যে, এ অঞ্চলের স্বাধীনতার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করবে না। কিন্তু সারাবিশ্ব বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো- বিপক্ষে ছিল সবাই। তাই আমাদের স্বাধীনতা-অর্জন এক অসম্ভব পাহাড় ডিঙানোরও গল্প।
০৪৭ ▌সিরাজুল আলম খান ও তাজউদ্দীন আহমদ
বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামের অক্লান্ত যোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি নির্মাণের অন্যতম প্রধান কারিগর সিরাজুল আলম খান। বাঙালিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ’৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস গড়ে তোলে। তারপর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র¨ মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করেন। এছাড়াও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠন এবং ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যুত্থান’ এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। ছাত্রদের মধ্যে সিরাজুল আলম খানকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও মেধাবী হিসেবে গণ্য করতেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই ‘গুরু-শিষ্যের’ বিচ্ছেদ হলো। কাররণ, সিরাজুল আলম খান চেয়েছিলেন একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের বাইরে আরেকটি শক্তিশালী নতুন দল গঠন বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হতে পারত। সংসদের ভেতর ও বাইরে শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্র অচল। আওয়ামী লীগ যদি জাসদকে নিয়মতান্ত্রিক ধারায় রাজনীতি করার সুযোগ দিত, বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম হতো। তাহলে মুজিব হত্যা, রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রবেশ এবং মৌলবাদী শক্তি উত্থান ঘটত না। একসময় বঙ্গবন্ধুর আশঙ্কা হয়, তাঁর দলের লোকেরা সিরাজুল আলম খানকে হত্যা করার চেষ্টা করছে। তাই তাঁকে উপদেশ দিলেন দেশের বাইরে চলে যেতে। উপদেশ মেনে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আশ্রয় নিলেন চিত্ত সুতারের বাড়িতে। একদিন তিনি রেডিওতে শুনতে পেলেন বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর।
তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আদর্শবাদী নেতা। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। আদর্শিক দিক থেকে তিনি মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছেন। এমন মুক্তি, যেখানে মানুষ শোষণ, বঞ্চনার শিকার হবে না। আর বাস্তববাদী ছিলেন বলেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন এই যুদ্ধ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হবে না, এটি হবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। তবে ইন্দিরা গান্ধীর আশঙ্কা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে পশ্চিমবঙ্গ যেন পূর্ব বাংলার মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে না পড়ে। তাঁর এই সন্দেহ দূর করতে তখন স্বাধীন বাংলাদেশের যে পতাকা তৈরি করা হয়েছিল, তাতে লাল বৃত্তের মধ্যে হলুদ রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র যুক্ত করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই সংগ্রাম শুধুই পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের। তাজউদ্দীন আহমদ নেতা হতে চাননি। তিনি নেপথ্যে থেকে কাজ করতেই পছন্দ করতেন। তাঁর মতো প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী নেতা আওয়ামী লীগে ছিল না। সামগ্রিক রাজনীতিতেও দুর্লভ।
১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই সরকারের মধ্যে নানা রকম অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিল মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী। আর এর মধ্যেই মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ মেতে ওঠেন ভিন্ন এক ষড়যন্ত্রে। তাজউদ্দীন আহমদ খন্দকার মোশতাকের একান্ত সচিব হিসেবে কামাল সিদ্দিকীকে নিয়োগ করেন। নিয়োগের আগে তিনি খন্দকার মোশতাকের সন্দেহজনক আচরণ সম্পর্কে কামাল সিদ্দিকীকে জানান এবং খন্দকার মোশতাকের সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁকে সরাসরি অবহিত রাখার জন্য কামাল সিদ্দিকীকে নির্দেশ দেন। কামাল সিদ্দিকী খোন্দকার মোশতাকের টেলিফোনের নিচে কয়েকটি অচেনা কাগজে টেলিফোন নম্বর দেখতে পান। টেলিফোন নম্বরগুলোকে কপি করে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে দেন। তাজউদ্দীন আহমদ খোঁজ নিয়ে দেখেন, টেলিফোন নম্বরগুলো আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসের। আগস্ট ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে সভা অনুষ্ঠিত হবে, সে সভার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। তারপর হঠাৎ যাবের আগে খন্দকার মোশতাকের নিউইয়র্ক সফর বাতিল করা হয়। জানা যায়, ভারত সরকারের তথ্য এসেছে খোন্দকার মোশতাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার প্ল্যান করছেন। সে প্ল্যানে শর্ত ছিল পাকিস্তান যদি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়, তাহলে শেখ মুজিব এসে যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন এবং এক পাকিস্তানের কাঠামোতে সাংবিধানিক সমস্যার সমাধান করবেন। ফলে খন্দকার মোশতাকের জাতিসংঘে যোগদান করে পাকিস্তানের পক্ষে কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটিও তাঁকে ছাড়তে হয়।
তাজউদ্দীন আহমদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে- মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালিত হলেও দল-মতের ঊর্ধ্বে স্বাধীনতাকামী ভিন্ন ভিন্ন দলকে নিয়ে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন এই সরকারের সাফল্যকে বেগবান করে। তাজউদ্দীন অধস্তন ও সাধারণ ব্যক্তিদের সঙ্গে যেমন বিনম্র আচরণ করতেন, তেমনি বজ্রকঠোর ও আপসহীন থাকতেন। তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রকাশ্য বিতর্কে অংশ নেননি। তিনি বলেছিলেন, মুজিবের সঙ্গে হাতে ব্যাগ নিয়ে চলা লোকটি থাকলে আলোচনা-বিতর্কে যাবেন না তিনি।
০৪৮ ▌বঙ্গবন্ধুর শাসন আমল :
শেখ মুজিবুর রহমান নিঃসন্দেহে অনেক ভালো রাজনীতিবিদ ছিলেন, কিন্তু তিনি শাসক হিসেবে ফিট ছিলেন না। রাজনীতি করে যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, শাসনক্ষমতায় এসে সেটার নষ্ট করেছেন। পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘ সাড়ে নয়মাস কাটানোর পর অবশেষে ঢাকার বিমানবন্দরে পা রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। গত নয়মাসের কষ্ট, সংগ্রাম আর বিপ্লবের গল্প মুজিব ভাইকে শোনানোর জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ক্লান্ত বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রাণঢালা অভ্যর্থনা শেষে,বিশ্রাম নেন। ঐদিন রাতেই শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ মনি দেখা করতে আসেন মুজিবের সাথে। তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে কান ভারী করে উসকে দেন বঙ্গবন্ধুকে। বলেন- "তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের সহায়তায় সরকার প্রধান হতে চাইছেন। উনি একজন ক্ষমতালোভী এবং...।" পরদিন তাজউদ্দীন আহমদের সাথে দেখা হলে মুজিব নির্লিপ্ত আচরণ শুরু করেন। যেই তাজউদ্দীন কাছে নয়মাস মুক্তিযুদ্ধের গল্প আর শোনা হল না মুজিবের। দুজনের মধ্যে বাড়তে লাগল দূরত্ব। মুজিব তাজউদ্দীনকে দূরে সরিয়ে দিয়ে একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশাসনের গঠনের পরিবর্তে একনায়ক তন্ত্রের দিকে ঝুকে পড়লেন। যদি তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রীশাসিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতেন এবং শেখ মুজিব রাষ্ট্রপ্রধান হতেন, তাহলে হয়তো- বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুর হতে পারত। এমন হলে গণতন্ত্র থেকে দেশ একচুলও নড়ত না, উগ্র জঙ্গিবাদী রাজনীতির কবর হয়ে যেত ৭২ সালেই।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশের জন্য সৃষ্টি করে এক মারাত্মক পরিস্থিতির। এর উপর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে আশানুরূপ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় দেখা দেয় খরা। খরাজনিত দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সরকারকে মুখোমুখি হতে হয় প্রচণ্ড সমস্যার। কিন্তু প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও নেতা কর্মীদের সীমাহীন দুর্নীতি -লুটপাট এর কারণে ব্যর্থতা আসে। এই ব্যর্থতা দূর করতে প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার। কিন্তু চরম বাম ও ডানপন্থী দলগুলো বিনষ্ট করেছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আওয়ামী লীগের কর্মীদের লুটপাট সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। নিরাপত্তা ব্যবস্থার অবনতি এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছিয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু "জরুরি অবস্থা" ঘোষণা করতে বাধ্য হন। ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর ছেলে কামালকে নিয়ে নানা ধরনের গুজব রটে যায়। এ সব রটনার অধিকাংশই পরবর্তীকালে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থ দুর্নীতিসংক্রান্ত রটনাসমূহও পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়নি।
১৯ জানুয়ারি ৭৫ সালে গণভবনে সংসদীয় দলের বৈঠক বঙ্গবন্ধু দলের নেতা–কর্মীদের ‘নির্দয়’ সমালোচনা করেন এবং দেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে মৌলিক সমাধানের কথা বলেন। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন জাতীয় দল হিসেবে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’–এর কাঠামো ঘোষণা করা। অর্থাৎপরিস্থিতি সামলাতে না পেরে শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করেছিলেন। বাকশাল গঠনের পরে দেশের ওপর ফ্যাসিস্ট জুলুম আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। সব দলকে বন্ধ করে দিয়ে, সব খবরের কাগজ নিষিদ্ধ করে দিয়ে লোকজনকে ধরপাকড় করে ব্যাপকভাবে জুলুম করেছিলেন। মূলত একটা সরকার চালাতে যে জ্ঞান দরকার,শেখ মুজিবের মধ্যে সেটার যথেষ্ট অভাব ছিল। তার অভিজ্ঞ কোনো উপদেষ্টাও ছিল না।.তিনি দেশ চালিয়েছেন মধ্যযুগীয় শাসকের মত! অধ্যাপক -আহমদ শরীফের মতে, "...মুজিবকে যারা হত্যা করল, তারা গোড়ায় সবাই মুজিবের অনুগতই ছিল। .... শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের দুঃশাসন ও হত্যা লুন্ঠনের বিভীষিকা মুজিবকে গণশত্রুতে পরিণত করেছিল। ..১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট অবধি মুজিবশাসন হচ্ছে ত্রাসের, হত্যার, জোর জুলুমের, স্বৈরাচারের, দুর্ভিক্ষের, পীড়নের, শোষণের, জবরদখলের ও জবরদস্তির হৃদকাপানো বীভৎস রূপ। তাই তার সপরিবার হত্যায় কেউ দুঃখশোক পায়নি।"
০৪৯ ▌তাহের - জিয়ার দ্বন্ধ ও জিয়ার শাসনামল :
গৃহবন্দী জিয়া কর্নেল তাহেরের সাথে কথা বলেন ৭৫-এর নভেম্বরের পাঁচ তারিখে। ছয় তারিখে কর্নেল তাহের তাকে ঘরবন্দী দশা থেকে বাইরে বের করে আনেন। রাত আড়াইটায় দুজনার মধ্যে একান্ত উত্তপ্ত আলোচনার পরও দুজনার বনিবনা না হওয়াতে কর্নেল তাহের হিংসাত্মক পথে অগ্রসর হয়। ক্ষমতার সিংহাসনে বসার সন্ধিক্ষণে দুই বাদশাহ; এক সিংহাসন। তাহের জেনারেল জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জিয়া তার চেয়ে অধিক উচ্চাকাক্সক্ষী। লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে তাহের যখন দেখলেন, তার হাত থেকে ক্ষমতার মসনদ হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তখনই শুরু হয় অফিসার নিধন অভিযান। ৭/৮ নভেম্বরের রাত ছিল বিভীষিকার রাত। কিন্তু জিয়াকে ক্ষমতার আসন থেকে উৎখাত করতে ব্যর্থ হয় তাহের।” গ্রেফতার হন কর্নেল তাহের। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই তাকে ফাঁসি দেয় জিয়া। তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে করা হয়।
জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চরমে ছিল। জিয়াউর রহমানের সময়েই বাংলাদেশ প্রথম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে জিয়াউর রহমানই দেশে প্রথম সুন্দর শাসনব্যবস্থা তৈরি করেন। তিনি অসাধারণ দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। একই সাথে ভারত এবং পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। আমেরিকার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ভারতের সহায়তায় সীমান্তে বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের দমন করেন। তিনি পাহাড়ে বাঙালি বসতি বৃদ্ধি করার মতো বিতর্কিত কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। আবার পাহাড়ি অবাঙ্গালীদের কথা চিন্তা করে জাতীয়তাবাদ বঙ্গালী থেকে বাংলাদেশী করেন।
জিয়াউর রহমান ব্যক্তিগতভাবে সৎ ছিলেন। বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে খালকাটাসহ অনেক উন্নয়ন কর্মসূচি তিনি করেন। জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর তার ব্যক্তিগত কোনো সম্পদ পাওয়া যায়নি। জিয়াউর রহমান আরব বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ইরাক-ইরানের সুদীর্ঘ সময় ধরে চলা ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বন্ধ করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখেন। তিনি তার রাজনৈতিক দলে অনেক শিক্ষিত ও জ্ঞানীগুণীদের যুক্ত করেন। তবে শিক্ষিত সচেতন নাগরিকরা মনে করেন, যত ভালই তিনি হোন, একজন সৈনিক হয়ে অবৈধভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে তিনি গণতান্ত্রকে হত্যা করেছেন। তার উত্তরসুরি এরশাদ অযোগতার কারণে দেশকে ৫০ বছর পিছনে নিয়ে গেছেন।
০৫০ ▌এশাদের ক্ষমতা দখল ও ৯ বছরের শাসন:
লে. জে. এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা গ্রহণ এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি দেশের সংবিধানকে রহিত করেন, জাতীয় সংসদ বাতিল করেন, নিজেকে সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন এবং এবং সাত্তারের মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন।। তিনি ঘোষণা করেন যে ভবিষ্যতে সামরিক আইনের অধীনে জারিকৃত বিধিবিধান ও আদেশই হবে দেশের সর্বোচ্চ আইন। এরপর এরশাদ বিচারপতি আবুল ফজল চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু তার কোন কর্তৃত্ব ছিল না, কারণ সিএমএল-এর অনুমোদন ব্যতীত প্রেসিডেন্ট কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন না। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর নিজেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেনাপ্রধান থেকে ক্ষমতা দখল করে তিনি ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয় বছর শাসন করেন। এরশাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদ গ্রেপ্তার হন। বিএনপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য জেনারেল এরশাদ সামরিক গোয়েন্দাদের ব্যবহার করেন। এছাড়া সামরিক বাহিনীর সহায়তা নিয়ে তিনি ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে দুটি বিতর্কিত নির্বাচন করেন। অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের তুষ্ট রাখার জন্য সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ ব্যাপকতা লাভ করে তার শাসনামলে । ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জেনারেল এরশাদের দুর্নীতি নিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। ১৯৮৬ সালে ব্রিটেনের দ্য অবজারভার পত্রিকা এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মরিয়ম মমতাজ নামে এক নারী নিজেকে এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে দ্য অবজারভার পত্রিকাকে বলেন, জেনারেল এরশাদ আমেরিকা এবং সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় এসোসিয়েটেড প্রেস এবং ওয়াশিংটন পোস্ট সহ নানা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের শিরোনাম হয়েছিল। ক্ষমতাচ্যুত হবার পর দুর্নীতির মামলায় কারাগারেও থাকতে হয়েছে তাকে।
পরবর্তী >>