ইসলামের ইতিহাস
:: ইসলামপূর্ব আরব ::
ইতিহাস-১ ▌আরব উপদ্বীপের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা:
এই উপদ্বীপটি ইসলাম আগমনের আগেই তৎকালীন আরবদের মাঝে “জাজিরাত আল-আরব” কিংবা “আরবদের দ্বীপ” হিসেবে পরিচিত ছিল। একমাত্র বলিষ্ঠ, কষ্টসহিষ্ণু,আরবের পক্ষেই এই বিজন অঞ্চলে টিকে থাকা সম্ভব ছিল। রোমানরাই ছিল প্রাচীনকালে বিশ্বের পরাশক্তি। ইসলাম-পূর্ব যুগে অন্য আরেক পরাশক্তি ছিল পারসিক (পারস্য/ ফারসি) সাম্রাজ্য, রোমানদের সাথে ফারসিদের উপর্যুপরি সংঘাত ও যুদ্ধ লেগেই থাকতো। কিন্তু এই সম্মুখ যুদ্ধের সীমারেখা সিরিয়া এবং ইরাকের মধ্যেই ঘুরপাক খেতো। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে বিচ্ছিন্ন আরবে ভ্রমণ করা বেশ কঠিন একটি কাজ। তাই বহিঃশক্তির কোনো ধরনের আধিপত্য ছাড়াই এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিরাজমান ছিল। গোত্রের প্রতি আনুগত্য ছিল সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি। গোটা মরুভূমিজুড়ে ডজনখানেক গোত্র ছিল, যারা যাযাবরবৃত্তি, পশুচারণ, ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে জীবন যাপন করতো।
ইতিহাস-২ ▌আরব জাতির প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস:
ইসলামের আগমনের পূর্বে, মক্কার কাবা শরিফে অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি ছিল। ইবনে হিশামের মতে, মেসোপটেমিয়া হতে সর্বপ্রথম আরবে দেবমূর্তির আগমন ঘটান আমর ইবনে লুহাই নামের এক ব্যক্তি। মক্কার উপাসনালয়ের সর্বপ্রথম মূর্তির নাম ছিল হোবল। ভবিষ্যত গণনার জন্য এ মূর্তির চারপাশে তীর রাখা হত। কিন্তু আল্লাহ্ হলেন স্রষ্টা। তিনি সবার উপরে। আল উজ্জাহ, আল লাত ও আল মানাহ ছিল আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেবী। এই তিন দেবীকে তারা আল্লার কন্যা মনে করত। তাদের মতে, ছোটোখাটো কাজগুলো দেখভাল করতেন এই দেবদেবীরাই। যেমন-মানাহ ছিল ভাগ্যের দেবী। তখন আরবের একেক অঞ্চল একেক দেবতার প্রাধান্য ছিল। মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী কুবেদ নামক স্থানে মানাহ দেবীর আলাদা মন্দির ছিল। তায়েফের নিকটবর্তী স্থানে ছিল লাত দেবীর মন্দির। আর উজ্জাহ দেবীর মন্দির ছিল মক্কার পূর্বদিকে নাকলা নামক জায়গায়। এর বাইরে ওয়াদ, ইয়াগুস, ইয়ায়ুক ও নসর দেবদেবীর কথা পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে। কাবার কাছে আনুমানিক ৩৬০ মূর্তি ছিল।
ইতিহাস-৩ ▌ ইসলামপূর্ব কারা:
ইব্রাহিম (আ) এবং তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ) আরবদেরকে একেশ্বরবাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সনে মক্কার পবিত্র কা’বা শরীফ নির্মাণ করেছিলেন। কালের পরিক্রমায় আরবরা ইব্রাহিম (আ) এর একেশ্বরবাদের বাণী বিকৃত করে ফেলে এবং মূর্তির মতো অসংখ্য “ঈশ্বর” এর প্রবর্তন করে। মোহাম্মদ(সা.)-এর নবুয়তের আগে মক্কার কাফের সর্দারেরা পুরনো কাবা ঘরকে নতুনভাবে তৈরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। এ লক্ষে আবু জাহেল, আবু লাহাব,ও তবা, শায়েবা এবং ওয়ালিদ ইবনে মগিরাসহ কাবা তদারককারী নেতারা যে পরিমাণ হালাল অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন, তাতে শুধু চারপাশে দেয়াল দেয়া সম্ভব কিন্তু ছাদ দেয়ার মত অর্থ আর থাকে না। তাই তারা দেয়ালের একাংশ ছেড়ে দিয়ে সে খরচের অর্থে ছাদের কাজ স¤পন্ন করলেন। যা এখনো খালি পড়ে আছে, এটি বর্তমানে ‘হাতিম’ নামে পরিচিত।
ইতিহাস-৪ ▌ইসলামপূর্ব মক্কা:
তখন কাবা ছিল মক্কা গ্রামের কেন্দ্রে। যাদের বসবাস ছিল কাবার কাছে তাদের নাম ছিল ‘কুরাইশ আল বিতাহ’। এখানে বসবাসরত ১৪টি গোত্রের কথা জানা যায়। ইবনে ইসহাকের বই থেকে জানা যায় পঞ্চম শতকের শেষার্ধে কাবাতে তীর্থভ্রমণ করতে আসা লোকদের কারণে মক্কা একটি গ্রাম ধীরে ধীরে নগরী হয়ে উঠলো। এ সময়ে তীর্থ ভ্রমণকারীদের সংগে ভাল সম্পর্কের ফলে কুরাইশ বংশ শুরু করল বাণিজ্য। নব্য বণিক কুরাইশগণ শীতকালে যায় ইয়েমেনে, আর গ্রীষ্মে যায় গাজা, বসরা, দামেস্কে। সিরিয়ার এসব শহরে কুরাইশদের ঘাটি হয়ে গেল। ব্যবসা করে উমাইয়া গোত্র হয়ে উঠল ধনী শ্রেণির। এ গোত্রেই ছিলেন হযরত উসমান (রা.)। কিন্তু এসময় হজের দায়িত্ব দেখভাল করত হাশিম গোত্র। এ গোত্রেই ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব। আরবেরা তাদের ১০ পুরুষের নাম মনে রাখতেন, তাদেরকে সম্মান করতেন। এমন কি তারা তাদের নামের শেষে বাবা, দাদা এবং পূর্বপুরুষদের নাম নামের অংশ যোগ করতেন এবং এখনো করেন। যেমন মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ।
ইতিহাস-৫ ▌ইসলামপূর্ব আরবে ধর্মপ্রচার:
মুর্তি পূজাই প্রাচীন আরবের প্রচলিত ধর্ম হলেও সে সময় খ্রিস্টান ভিক্ষুরা মিশর, তুরস্ক, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও আরবের সড়ক পথের ধারে আশ্রম গড়ে তুলেছিল। তারা দরিদ্র, রোগী ও এতিম নারী শিশুদের পরিচর্যায় জীবন উৎসর্গ করেছিল। রাত্রিকালে ক্লান্ত বাণিজ্য-কাফেলা ও পর্যটকরা এসব সৈন্ন্যাসী মঠগুলোতে যাত্রা বিরতি করত। খ্রিস্টান ছাড়াও মক্কা এবং মদিনায় বসবাসরত অনেক ইহুদি গোত্র ছিল, কিন্তু তারা ধর্ম প্রচার করতো না। ইতিহাসবিদ বেঞ্জামিন ওয়াকার লিখেছেন, ঐ সময় মক্কায় কাবার আঙিনায় বাণিজ্য ডিপো স্থাপনকারী দুটি খ্রিস্টান গোত্র ‘ইজল’ ও ‘জুহরা’ চুক্তিবদ্ধ ছিল ‘সাহম’ কোরাইশ গোত্রের সঙ্গে। তারা শিল্পী, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, রাজমিস্ত্রি ও খোদাইয়ের কাজ করত। এছাড়া মক্কার তলোয়ার প্রস্তুতকারক ‘জাবরা’ নামক আর এক খ্রিস্টান ছিলেন, যিনি যিশুর শিক্ষা ও তাওরাত প্রচার করতেন। কাইস গোত্রের কাইস ছিলেন আর একজন খ্রিস্টান, যার বাড়িতে রাতে ধর্মীয় আসর বসত। এই আসরে জনৈক তামিম দারী নামে এক খ্রিস্টান যাজক মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন ব্যাখ্যা করত।
ইতিহাস-৬ ▌আরবদের গোত্র নিরাপত্তা ও উচ্চ নৈতিকতা:
তৎকালীন আরব গোত্রগুলো রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল না, অর্থাৎ তাদের কোনো রাষ্ট্র বা কেন্দ্রীয় প্রশাসন ছিল না। তখন গোত্রপ্রধানরাই সমাজের নিরাপত্তা দিত। তাই ইসলাম গ্রহণ না করা সত্ত্বেও চাচা আবু তালিব কখনোই তাঁর ভাতিজাকে নিরাপত্তা দেয়া থেকে বিরত থাকেননি। পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এই ঐতিহ্য যদি আরবে না থাকতো, তাহলে হয়তো কুরাইশের মুশরিকরা নবুওয়াতের প্রাথমিক বছরগুলোতেই রাসূল(স.)-এর কণ্ঠরোধ করে ফেলতো। ওয়াদা ও আমানত রক্ষায় ‘জাহেলিয়াহ’ যুগের আরবরা ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। কবি ইমরুল কয়েসের গচ্ছিত ৫টি লৌহবর্ম প্রদানে চাপ সৃষ্টির জন্যে শত্রুরা ‘সমভাল বিন আদিয়া’র নিজ পুত্রকে প্রথমে অপহরণ ও পরবর্তীতে হত্যা করলেও, তিনি একজনের গচ্ছিত বর্মকে অন্যকে দিতে রাজি হননি, যা আরবদের উচ্চ নৈতিকতার প্রমাণ সু®পষ্ট করে বিশ্বময়।
ইতিহাস-৭ ▌ওকাজ মেলা ও হারবুল ফেজার:
প্রাক-ইসলাম যুগে হেজাযের বিশেষ বিশেষ স্থানে একেকটি মেলা অনুষ্ঠিত হত। এ সকল মেলায় বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় বিক্রয় পুরোদমে চলত। এতদ্ব্যতীত কবিদের কবিতার লড়াই এবং গোত্র বিশারদ পন্ডিতদের মেধা প্রতিভার পরীক্ষা হত। ওকাজ মেলা থেকেই ফেজার যুদ্ধের সূত্রপাত হয় এবং ক্রমশ তা হেজায প্রদেশের প্রায় সব কটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এ যুদ্ধ দাবানলের ন্যায় হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ প্রথম কুরাইশ এবং কায়স বংশের মধ্যে শুরু হলেও তৎকালীন আরবে প্রচলিত প্রথানুসারে এ দু'সম্প্রদায়ের আত্মœীয় ও বন্ধু গোত্রসমূহ উভয় পক্ষে যোগ দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সময় বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছিলেন বলেই চাচারা তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়েছিলেন। তাঁর কাজ ছিল চাচাদেরকে তীর কুড়িয়ে দেওয়া। বহু হত্যা লীলার পর পঞ্চম বছর সন্ধিসূত্রে এ যুদ্ধের অবসান ঘটে। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য কাফেলার পথের অধিকার দখল করা।
ইতিহাস-৮ ▌জমজম কূপের আবিস্কার:
কাবা চত্বরে জমজম কূপের অবস্থানের সন্ধান পান আব্দুল মুত্তালিব। অন্যান্য গোত্রের লোকেরা তখন বলতে শুরু করল, এ তো আমাদের পূর্বপুরুষ ইসমাইলের কুয়া। আমাদেরও এতে নিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। ফলে বিচার মিমাংসার জন্য সবাই একমত হয় যে, তারা সিরিয়ার কাছে সাদ হুযাইম গোত্রের প্রখ্যাত জ্বিন উপাসিকার কাছে যাবেন; উনি নাকি জ্বিনদের সাহায্যে ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। আরবে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এরকম অনেক জ্বিন উপাসিকা। (রসুল (সা,)-এর মা আমিনা ছিলেন এ রকম এক জিন উপাসিকা সোদা বিনতে জেহরার ভাতিজি)। সব গোত্র থেকে কিছু মানুষ একত্রে রওনা দিলেন সেই মহিলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তারা যখন হেজাজ আর সিরিয়ার মাঝের এক জনশূন্য এলাকায় পৌঁছালেন তখন আব্দুল মুত্তালিবের গোত্রের পানি শেষ হয়ে গেল। অন্য গোত্রের কাছে পানি চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করল। এসময় আব্দুল মুত্তালিবের উট হঠাৎ এক জায়গায় পা দিতেই খুড়ের আঘাতে সেখান থেকে পানি বেরুতে লাগলো! তখন বাকি গোত্রের সকলে মেনে নিলেন যে আব্দুল মুত্তালিবই জমজম কূপের আবিস্কারক।
ইতিহাস-৯ ▌প্রাক-ইসলামী আরবের সামাজিক জীবন:
তৎকালীন আরবে মদিনা ছিল কৃষিকাজের উপযোগী বৃহৎ নগরী, অন্যদিকে মক্কা ছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসতিস¤পন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এই দুই অংশের সাথেই মুহাম্মাদ(স.)র জীবনের স¤পৃক্ততা ছিল। তৎকালীন আরব অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল ব্যবসায় ও পশুপালন। স্থানীয় আরবরা যাযাবর ও গৃহী দুই শ্রেণিরই ছিল। যাযাবররা মরুপথে যাত্রীবাহী গাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে তাদের থেকে মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের ভরণপোষণ করত। তারা এই কাজকে অপরাধ বলে মনে করত না। মক্কাবাসীরা মদ্যপান, জুয়া ও সঙ্গীতের প্রতি গভীরভাবে আসক্ত ছিল। যে সকল দাসী-রমনী নৃত্যগীত করত তাদেরকে ‘কীয়ান’ বলা হত। বড় বড় দলপতিরা তাদের প্রতি প্রণয় নিবেদন করত। বহুবিবাহ ও দাসীদের সাথে যৌনতার প্রথা অবাধে অনুশীলন হত। ছোট অবস্থায় মেয়েদের বিয়ে (বাল্য বিবাহ) দেয়া ছিল তৎকালীন আরবের রেওয়াজ।
ইতিহাস-১০ ▌আরবের হাতিবর্ষ:
খ্রিস্টান বাইজান্টাইনরা ইয়েমেনের ইহুদী হিমিয়ার রাজাকে শায়েস্তা করতে পাঠান আবিসিনিয়ার (ইথিওপিয়া) কমান্ডার আব্রাহাকে। পরে তিনি ইয়েমেনের রাজা হন। রাজা হয়েই খ্রিস্টান আব্রাহা শুরু করেন ইহুদী আর পৌত্তলিক দমন। এসময় দূর দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ মক্কার উপাসনালয় ভ্রমণ করতে যেতো। এটা শুনে আব্রাহা একটি ক্যাথেড্রাল (উপসনালয়) বানালেন। মক্কায় এই উপসনার প্রচারকাজ চালানোর সময় এক লোককে কেউ তীর চালিয়ে মেরে ফেলে। এ খবর পেয়ে আব্রাহা ক্রোধে অন্ধ হয়ে যান। ৫৭০ সালে আব্রাহা ৪০,০০০ সৈন্যসহ মক্কা আক্রমণ করেন। তার বাহিনীতে ছিল ৮টি হাতি। হাতি ছিল তখন আরবদের কাছে পাহাড় সমান অদেখা দুর্লভ প্রাণী, ভয়ে মক্কাবাসীবা আবাস ত্যাগ করে পাহাড়ে চলে যান। পরবর্তী সময়ে আরবে, কেউ যদি কোন আগের ঘটনা বর্ণনা করত, তাহলে এভাবে শুর করত যে, ঘটনাটা ঘটেছিল সেই হাতিবর্ষের এত বছর আগে/পরে। এ হাতিবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ (সা.)।
:: নবী জীবনী ::
ইতিহাস-১১ ▌ মুহাম্মাদ (সা.) এর জন্ম:
বিয়ের সময় রসুল(সা.)-এর মা আমিনার বয়স তখন ১৪ আর বাবা আব্দুল্লাহর বয়স যখন ২৪ বছর। একইসাথে আব্দুল মুত্তালিব নিজেও আমিনার এক চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন, যার নাম ছিল হালাহ। হালাহ এর গর্ভে জন্ম নেন হামজা (রা)। এজন্যই চাচা হামজার বয়স মুহাম্মাদ (সা.) এর কাছাকাছি। কিন্তু, শীঘ্রই সিরিয়া আর ফিলিস্তিনে ব্যবসার ডাক পড়ল মুহাম্মাদ (সা.)-এর বাবা আব্দুল্লাহর। আব্দল্লাহ যখন চলে গেলেন, তখন আমিনা গর্ভবতী। হযরত মুহাম্মদ (সা.) সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বনু হাশিম গোত্রে ৫৭০ খিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আবরাহা কাবাঘর ধ্বংসের জন্য অভিযান পরিচালনা করেছিল। এর ৫০ দিন পরই নবী (সা.) কাবাঘরের সন্নিকটে তাঁর পিতৃভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের প্রায় ছয় মাস পূর্বে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-১২ ▌ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাল্যকাল:
তৎকালীন আরবের রীতি ছিল যে ‘মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠার জন্য’ শিশুদেরকে দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। সাদ বংশের হালিমা নামে এক বেদুইন স্ত্রীলোক মক্কায় সেই সময় এসেছিল। প্রতিপালনের জন্য হালিমা শিশু মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে তার ডেরায় চলে যায়। এভাবে শিশু মুহাম্মদ (সা.) চার বছর বয়সকাল পর্যন্ত বেদুইনগৃহে পালিত হন। তারপর আবার তিনি তার ¯েœহময়ী জননীর কোলে ফিরে আসেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সঙ্গে কাটান। তাঁর মা আমিনা আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মদিনায় পিতৃগৃহে যাত্রা করেন, সঙ্গে শিশুপুত্র মুহাম্মদ (সা.)ও ছিলেন। মদিনা থেকে ফেরার সময় ‘আরওয়া’ নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মারা যান।
ইতিহাস-১৩ ▌আরবে ধাত্রী মা অথবা দুধ মা রাখার প্রথা কেন প্রচললন হয়?:
তৎকালীন আরবের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে শহরের মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে বা খোলা মাঠে বা বালিতে লাঠি দিয়ে গর্ত করে সেখানে প্রাকৃতিক কাজ সারতো। মক্কায় প্রায় দু’এক বছর পর পর গরম আসার সময় প্রচুর বৃষ্টি হতো। অনেক সময় পবিত্র কাবা ডুবে যাবার মত বন্যাও হত। যখন বৃষ্টি বা বন্যা হতো, তখন উদারাময় বা পেটের পীড়ায় মারা যেতো শিশুরা? সামর্থ্যবান মক্কাবাসীরা এমন বছরে জন্ম নেওয়া শিশুদেরকে মক্কার বাইরে পাঠিয়ে দিতেন। সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। যে বছর আবহাওয়া ভালো থাকতো, সে বছর দুধ মার কাছে পাঠানো শিশুর পরিমাণ ছিল কম। যে বছর নবী মুহাম্মদ(স:)কে মা হালিমা নিয়ে যান, সেই বছর প্রবল খরার পর বৃষ্টির বছর ছিল। মুহাম্মাদ (স) এর পালক বাবা ছিলেন হারিস ইবনে আব্দুল উজ্জা। তাঁরা উজ্জাহ দেবতার উপাসনা করতেন। মহানবী (সা) এর দুধভাই ছিল আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহ পরে সাহাবী হন। হযরত মুহাম্মাদ (স) এর দুধবোন ছিল দুজন, আনিসা এবং সাইমা।
ইতিহাস-১৪ ▌রসুল(স.)-এর প্রথম বাণিজ্য সফর:
মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) নিয়ে মক্কায় পৌঁছেন। এর পর থেকে দাদা'ই হয়রত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর দেখাশোনা করতেন। হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দায়িত্ব দিয়ে যান। বালক বয়সে তিনি কখনো বকরি চরাতে নিয়ে যেতেন, কখনোবা সমবয়স্ক সঙ্গীদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চরাতেন, সেগুলো ছিল বনি সা’দ গোত্রের। কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চরাতেন। চাচা আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন। তখনকার আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) এর বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি চাচা আবু তালিবের সাথে বাণিজ্য সফরে সিরিয়া গমন করেন।
ইতিহাস-১৫ ▌হিলফুল ফুজুল:
ফিজারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন মহা নবীর বয়স ১৫ বছর। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছুই করার ছিল না। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। মুহাম্মাদ (সা.) অল্প সময়ের মধ্যেই এত বিশ্বস্থতা ও খ্যাতি তিনি লাভ করেন যে তাঁর উপাধি হয়ে যায় ‘আল-আমিন’ (অর্থ : বিশ্বাসযোগ্য) আর ‘আল-সিদ্দিক’(অর্থ : ‘সত্যবাদী’)। এসময় আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধ¯পৃহা দমনের জন্যই ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাম্মদ (সা.) এই সংঘকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখেন। ‘হিলফুল ফুজুলে’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-১. মজলুম ও অসহায়দের সাহায্য করা। ২. সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। ৩. বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রী ও প্রীতির স¤পর্ক স্থাপন করা। ৪. পথিক ও মুসাফিরের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ইতিহাস-১৬ ▌হাজরে আসওয়াদ স্থাপন:
মুহাম্মাদ(সা.)-এর বয়স যখন ৩৫ বছর তখন কা'বা গৃহের পূনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পুনঃনির্মানের সময় যখন হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। মূলত কোন্ গোত্রের লোক এই কাজটি করবে তা নিয়েই ছিল কোন্দল। চার-পাঁচ দিন যাবৎ এ বিবাদ অব্যাহত থাকা অবস্থায় আবু উমাইয়া মাখজুমি একটি সমাধান নির্ধারণ করে যে, পরদিন প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরজা দিয়ে যে প্রথম প্রবেশ করবে তার সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেবে। পরদিন মুহাম্মাদ সবার প্রথমে কাবায় প্রবেশ করেন। ফলে দায়িত্ব পেয়ে মুহাম্মাদ(স.) একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ রাখেন এবং বিবদমান প্রত্যেক গোত্রের নেতাদের ডেকে তাদেরকে চাদরের বিভিন্ন কোণা ধরে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেন এবং তারা তা ই করে। এরপর তিনি পাথর উঠিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করেন।
ইতিহাস-১৭ ▌ হযরত খদিজা(র.) বাণিজ্যে পরিচালনা:
মুহাম্মদ (সা.) অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর সুখ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন খাদিজা বিনতে খোওয়াইলিদ তা অবহিত হয়েই তাকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার অনুরোধ জানান। মুহাম্মদ (সা.) এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদিজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান। খাদিজা(র.) ছিলেন নবী মুহাম্মদ(সা.) -এর দুর স¤পর্কের ফুফু, তার দু’বার বিবাহ হয়েছিল, কয়েকটি সন্তানও ছিল। দ্বিতীয় স্বামী মৃত্যুকালে অগাধ ধন-স¤পত্তি রেখে গিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর খদিজা(র.) স্বামীর বিস্তৃৃত বাণিজ্যের হাল ধরেন। কর্মচারীর মাধ্যমে তিনি নানা দেশে বাণিজ্য পরিচালনা করতেন এবং নিজেই সমস্ত বিষয়ের তত্ত্বাবধান করতেন। মুহম্মদ(সা.) ২০ বৎসর বয়সে খাদিজার(র.) সিরিয়াগামী বাণিজ্য কাফেলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ইতিহাস-১৮ ▌বিয়ে ও সংসার:
মুহাম্মদ (সা.)-এর সততা ও ন্যায়পরায়ণতায় মুগ্ধ হন খাদিজা(র.)। এছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা দেখে তিনি তাঁর যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন। একপর্যায়ে তিনি মুহাম্মদকে(সা.) বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে বিয়ের প্রস্তাব শুনে মুহাম্মদ (সা.) তাঁর চাচাদের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিবি খাদিজার(র.) পিতা খোওয়াইলিদ ফিজার যুদ্ধের পূর্বেই মারা গিয়েছিলেন। খাদিজার(র.) জীবদ্দশায় মুহাম্মদ (সা.) আর কোনো বিয়ে করেননি। খাদিজার(র.) গর্ভে মুহাম্মদ(সা.)-এর ছয়জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে, যার মধ্যে চারজন মেয়ে এবং দুই জন ছেলে। তাদের নাম যথাক্রমে কাসিম, জয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতিমা এবং আবদুল্লাহ। ছেলে সন্তান দুজনই শৈশবে মারা যায়। মেয়েদের মধ্যে একমাত্র ফাতিমা ব্যতীত সবাই নবীর জীবদ্দশাতেই মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-১৯ ▌নবুওয়ত লাভ:
হযরত মুহাম্মদ (সা.) বাণিজ্যের প্রয়োজনে দেশ-বিদেশে যাত্রা করতেন এবং তখন অনেক খ্রিস্টান সাধু মহাত্মার দর্শন পেয়েছিলেন, যারা ছিলেন একেশ্বরবাদী, মূর্তি পূজার বিরোধী। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন। চল্লিশ বছর বয়সে মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ) নবুওয়ত লাভ করেন, অর্থাৎ এই সময়েই আল্লাহ তাঁর কাছে ওহি প্রেরণ করেন। হাদীসের বর্ননা অনুযায়ী এমনি একদিন ধ্যানের সময় ফেরেশতা জিব্রাইল তাঁর কাছে আল্লাহ প্রেরিত বাণী নিয়ে আসেন এবং তাকে বলেন:“পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। উত্তরে মুহাম্মাদ (সা.) জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিব্রাইল তাঁকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেয়ার পর মুহাম্মাদ (সা.) পংক্তিটি পড়তে সমর্থ হন।
ইতিহাস-২০ ▌ গোপনে ইসলাম প্রচার:
প্রথম বাণী লাভের পর মুহাম্মাদ (সা.) এতই ভীত হয়ে পড়েন যে, কাঁপতে কাঁপতে নিজ গৃহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাকেন, "আমাকে আবৃত কর"। খাদিজা নবীর সকল কথা স¤পূর্ণ বিশ্বাস করেন এবং তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নেন। ভীতি দূর করার জন্য মুহাম্মাদ(সা.)কে নিয়ে খাদিজা নিজ চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে যান। নওফেল তাঁকে নবী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ধীরে ধীরে আত্মস্থ হন মুহাম্মাদ(সা.)। তারপর একটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মত আল্লাহর বাণী আসে। এবার অবতীর্ণ হয় সূরা মুদ্দাস্সির-এর কয়েকটি আয়াত। এরপর থেকে গোপনে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। মুহাম্মদ (সা.) বুঝতে পারেন যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাকে পুরো আরব সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে।
ইতিহাস-২১ ▌প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার:
মুহাম্মদ (সা.)-এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন তার সহধর্মিণী খাদিজা(রা.), এরপর মুসলিম হন মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচাতো ভাই এবং তাঁর ঘরেই প্রতিপালিত কিশোর আলি, ইসলাম গ্রহণের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য নবী ‘নিজ বংশীয়’ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা করেন; এই সভায় কেউই তাঁর আদর্শ মেনে নেয়নি। ইসলাম গ্রহণকারী তৃতীয় ব্যক্তি ছিল নবীর অন্তরঙ্গ বন্ধু আবু বকর। এভাবেই প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন এবং এই প্রচার কাজ চলতে থাকে সম্পূর্ণ গোপনে। তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেওয়ার পর মুহাম্মদ (সা.) প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেন। এ ধরনের প্রচারের সূচনাটা বেশ নাটকীয় ছিল। মুহাম্মদ (সা.) সাফা পর্বতের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সবাইকে সমবেত করেন। এরপর প্রকাশ্যে বলেন যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল’।
ইতিহাস-২২ ▌ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ:
ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তা হল উমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ। মুহাম্মাদ (সা.) সবসময় চাইতেন যেন আবু জেহেল ও উমরের মধ্যে যেকোন একজন অন্তত ইসলাম গ্রহণ করে। তাঁর এই ইচ্ছা এতে পূর্ণতা লাভ করে। এরপর একসময় নবীর চাচা হামযা ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে ইসলাম যখন শ্লথ গতিতে এগিয়ে চলছে, তখন মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মাদ(স.) ও তাঁর অনুসারীকে একঘরে ও অবরোধ করে। তিন বছর অবরোধ থাকার পর তাঁরা মুক্তি পায়। পরের বছর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁর স্ত্রী খাদিজা(রা.) ও চাচা আবু তালিব মারা যায়। ফলে হতাশ হয়ে তিনি মক্কা বাদ দিয়ে এবার ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ যান কিন্তু সেখানে তিনি চূড়ান্ত অপমান ও উপহাসের শিকার হন। তায়েফের লোকজন তাদের কিশোর-তরুণদেরকে মুহাম্মাদ(স.)এর পিছনে লেলিয়ে দেয়। তারা ইট-প্রস্তরের আঘাতে নবীকে রক্তাক্ত করে দেয়। কিন্তু তবুও তিনি হাল ছাড়েননি।
ইতিহাস-২৩ ▌ হিজরি সন গণনা:
মক্কাবাসীদের কাছে ইসলাম ধর্ম প্রচার করার সময় কাবার পুরোহিত সম্প্রদায়ের অন্যতম কুরাইশীয়রা হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে নানা ধরনের কষ্ট দিয়েছিল। এমনকি তারা মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল, তখন বাধ্য হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ত্যাগ করে মদিনাকে তাঁর নিবাস স্থল হিসেবে বেছে নেন। এই প্রবাসের তিথি থেকেই মুসলমানদের হিজরি সনের আরম্ভ হয়। সেই সময় মদিনা নগরে প্রচুর সংখ্যায় ইহুদিদের বাস ছিল এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের চাতুর্যের কারণে তারা বেশ বিত্তবান এবং প্রভাবশালী ছিল। মদিনার কোনো কোনো অঞ্চলে খ্রিস্টানদের বসতিও ছিল। এই দুই ধর্মের বেশ কিছু লোক ইসলাম গ্রহন করেছিলেন, যারা ব্যক্তিগতভাবে মূর্তি পূজার প্রতি কোনো শ্রদ্ধা রাখত না। এদের মধ্যে সায়দা-পুত্র কায়েস, হজশ-পুত্র আবদুল্লাহ, হবরিস-পুত্র ওসমান এবং অমরু-পুত্র জৈদ প্রসিদ্ধ ছিল।
ইতিহাস-২৪ ▌নবীজির চাচাগণ:
আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানগণ হলেন নবীজির চাচা। সর্বসম্মত মতে, সংখ্যায় তারা নয় জন-১. হামযা রা., ২. আব্বাস রা., ৩. আবু তালিব; যার প্রকৃত নাম আবদে মানাফ, ৪. আবু লাহাব; যার প্রকৃত নাম আব্দুল উযযা, ৫. যুবায়ের, ৬. যিরার, ৭. মুকাওয়িম, ৮. মুগিরা ৯. গিদাক; যার প্রকৃত নাম মুসআব। নবীজির পিতা আব্দুল্লাহ হলেন আব্দুল মুত্তালিবের দশম সন্তান। অনেকে বলেন, হারেস নামেও তাঁর এক চাচা ছিলেন। আব্দুল কাবা নামে আরেকজন ছিল; কারও মতে, এটা মুকাওয়িম-এর অপর নাম। কেউ বলেছেন, জাহল নামক আরেকজন ছিল; অন্যরা বলেছেন, এটা মুগিরার অপর নাম। কেউ বলেছেন, কসাম নামেও একজন ছিল। এদের মধ্যে হামযা (রা.) ও আব্বাস (রা.) ছাড়া কেউ ইসলাম গ্রহণ করেননি।
ইতিহাস-২৫ ▌আবু লাহাব:
জন্মের সময় তার রক্তবর্ণ গাল ও সুন্দর মুখয়বয়ব দেখে তার বাবা তার নাম দিয়েছিলেন আবু লাহাব। তিনি মুহাম্মদ(সা.)-এর আপন চাচা। মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্মের পর থেকেই চাচা আবু লাহাবের প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু নবুয়াত প্রকাশ করার পর থেকেই তিনি মুহাম্মদের বিরূদ্ধে চলে যান। সাফা পাহাড়ের উপর থেকে নবী মুহাম্মদ (সঃ) যখন সমবেত লোকজনকে এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানিয়েছিলেন, তখন সেখানে আবু লাহাব তাঁকে সবার আগে তিরস্কার ও ভৎসনা করেছিলেন। ইসলাম ধমের্র বিরোধিতার কারণে তিনি ইসলামের শত্রু পরিগণিত হয়েছিলেন। তার স্ত্রী উম্মে জামিল মুহাম্মদ (সা.) চলার পথে কাটা বিছিয়ে রাখতেন। আবু লাহাব বদর যুদ্ধের প্রাককালে শরীরে পঁচন রোগে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ সময় ধরে অসহনীয় কষ্ট ভোগ করার পর তিনি মারা যান। তার পরিবার তাকে ফেলে চলে যায়। লাশ পচন ধরলে একজন হাবশী মজদুরকে ডেকে আনা হয়।
ইতিহাস-২৬ ▌হযরত হামযা(র.) ও আব্বাস(র.):
হযরত হামযা নবুয়তের ষষ্ঠ বছরে মুসলমান হন, ওমর রা.-এর ইসলাম গ্রহণের ঠিক তিনদিন আগে। তিনি মদিনায় হিজরত করেছেন, অংশগ্রহণ করেছেন বদর যুদ্ধে। এরপর উহুদ যুদ্ধেও অংশ নেন এবং শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাতের পর তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকৃত করা হয়েছিল। তাকে এবং তার বোনের ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ রা.-কে একই কবরে দাফন করা হয়। হযরত আব্বাস(র.) বদর যুদ্ধের সময় মুসলিমদের হাতে বন্দি হতে হয়। পরে মুক্তিপণ দিয়ে মক্কায় ফিরে যান। মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের পূর্বে তিনি ইসলামের ঘোষণা দেন এবং হিজরতের উদ্দেশ্যে মদিনায় রওয়ানা হন। পথিমধ্যে ‘জুহফা’ নামক স্থানে নবীজি(স.)-র সাথে সাক্ষাৎ হয়। ফলে তিনি মক্কা বিজয়ে শরিক হওয়ার জন্য নবীজির সাথে আসেন। ওসমান রা.-এর শাহাদাতের দুই বছর পূর্বে তিনি মদিনায় ইন্তেকাল করেন।
ইতিহাস-২৭ ▌নবীজির (সা.) ফুপুগণ:
আব্দুল মুত্তালিবের কন্যারা হলেন নবীজির স. এর ফুপু। তারা মোট ছয়জন- ১. সাফিয়া; তিনি যুবায়ের ইবনে আওয়াম রা.-এর মাতা, ২. আতিকা, ৩. বাররাহ, ৪. আরওয়া, ৫. উমাইমাহ, ৬. বাইযা; যাকে উম্মে হাকিম বলা হয়। সাফিয়া রা. মুসলমান হন। ২০ হিজরিতে ওমর রা.-এর আমলে তিনি মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তাকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।
নবীজির দাসীগণ:
নবীজির দু’জন দাসী ছিলেন- মারিয়া কিবতিয়া ও রাইহানা কুরাজিয়া রা.। মারিয়া কিবতিয়া বিনতে শামউনকে মিশর অধিপতি মুকাওকিস উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তিনিই নবীজির পুত্র ইবরাহিম রা.-এর মাতা। রাইহানা কুরাজিয়া এসেছেন বনি কুরাইজা থেকে। তিনি ইন্তেকাল করেন নবীজির বিদায় হজের ফিরতি পথে। তাকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। অনেকে আরও দু’জন দাসীর কথা বলেছেন- যয়নব বিনতে জাহাশ রা.-এর দেওয়া দাসী এবং কোনো এক যুদ্ধবন্দি দাসী।
ইতিহাস-২৮ ▌নবীজি(স.)র বড় মেয়ে যাইনাব :
তিনি নবীজির ত্রিশ বছর বয়সকালে জন্মগ্রহণ করেছেন। পরিণত বয়সে খাদিজার রা. তার ভাগ্নে আবুল আস ইবনে রবী’র সঙ্গে যাইনাবের বিয়ে দিয়েছিলেন। নবীজীর সকল কন্যা ইসলাম গ্রহণ করলেও আবুল আস মুশরিক থেকে যান। তবে কুরাইশরা যাইনাবকে ছেড়ে দিতে বললেও আবুল আস স্ত্রী ত্যাগ করেননি। বদরের যুদ্ধে আবুল আস বন্দি হন। সাহাবিগণ তাকে মুক্তি দিয়ে দেন। শর্ত দেন যে, ফিরে গিয়ে যাইনাবকে রা. মদিনায় পাঠিয়ে দিতে। আবুল আস যাইনাবকে রা. ফিরিয়ে দেন। অষ্টম হিজরিতে যাইনাব রা. ইন্তেকাল করেন। তার গর্ভে দুটি সন্তান- আলী ও উমামা (রা.)। উমামা মায়ের মৃত্যুর সময় ছিলেন ছোট্ট শিশু। তাঁকে কাঁধে রেখে নবীজি নামাজ আদায় করতেন। নবীজির জামাতা খলিফা আলী (রা.) তাঁকে তাঁর খালা ফাতিমার (রা.) ইন্তেকালের পর বিয়ে করেন। আলীর (রা.) শাহাদাতের পর তার বিয়ে হয় মুগিরা ইবনে নওফল হাশেমির সঙ্গে। তাঁর কোনো সন্তান হয়নি।
ইতিহাস-২৯ ▌নবীজি(স.)র কন্যা রুকাইয়া :
তাঁর জন্ম হয় নবীজির বয়স যখন ৩৩ বছর। উজ্জ্বল সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। প্রথমে তার বিয়ে হয় আবু লাহাবের ছেলে উতবার সাথে। কিন্তু নবুয়তের কারণে উতবা তাকে ছেড়ে দিলে হযরত ওসমান (রা.) তাকে বিয়ে করেন। তিনি তার স্বামীর সাথে দুইবার হিজরত করেছেন-হাবশায় ও মদিনায়। নবীজি বদর যুদ্ধে যাত্রা করার প্রাক্কালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ঘরে এক ছেলে জন্ম নেয় আব্দুল্লাহ। ছয় বছর বয়সে তিনি মারা যান।
নবীজি(স.)র কন্যা উম্মে কুলসুম :
তার প্রথম বিয়ে হয় আবু লাহাবের আরেক ছেলে উতাইবার সঙ্গে। একই কারণে উতাইবা কুলসুম(রা.)কে ফিরিয়ে দেয়। রুকাইয়া মারা যাওয়ার পরে তৃতীয় হিজরিতে ওসমান (রা.)-এর সাথে বিয়ে হয় তার। নবম হিজরিতে উম্মে কুলসুমের রা. মৃত্যু হয়। নবীজি নিজে তার জানাযা পড়ান। উম্মে কুলসুমের কোনো সন্তান হয়নি।
ইতিহাস-৩০ ▌নবীজি(স.)র কন্যা ফাতিমা :
দ্বিতীয় হিজরিতে নবীজি তাঁকে আলী (রা.)-এর কাছে বিয়ে দেন। ফাতিমা রা. ইন্তেকাল করেন নবীজির মৃত্যুর ছয় মাস পরেই। তাঁর তিনটি ছেলে হয়- হাসান, হুসাইন ও মুহসিন। মুহসিন ছোট থাকতেই মারা যান। বাকি দুই হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা.)এর মাধ্যমে নবীজির বংশধারার বিস্তার হয়েছে। ফাতিমার (রা.) মেয়ে ছিল তিনজন- উম্মে রুকাইয়া, কুলসুম ও যয়নব। রুকাইয়া ছোটকালে মারা যান। উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেছিলেন আফ্রান বিনতে ওমর (রা.)। তাঁর ঘরে যায়েদ ও রুকাইয়া নামে দুটি সন্তান হয়। তবে তাদের কোনো উত্তরসূরি হয়নি। তারপর তাঁর বিবাহ হয় আউন ইবনে জাফরের সাথে। তাঁর মৃত্যুর পরে বিবাহ হয় আউনের ভাই মুহাম্মদ ইবনে জাফরের সাথে। তিনিও মারা গেলে তাদের আরেক ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে জাফরের সাথে বিবাহ হয় এবং তার ঔরসে একটি মেয়ে হয়। তাঁর মৃত্যুর পর আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর পরে তার বোন, ফাতিমার (রা.)আরেক মেয়ে যাইনাবকে বিয়ে করেন। তার কয়েকটি সন্তান হয়।
টিকা: একদিন মসজিদে নববীতে সিজদা থাকা অবস্থায় কুরাইশ নেতাদের আদেশে উকবা ইবনে আবু মুয়াত মুহাম্মাদ(সা.)এর পিঠে উটের পচা-গলা নাড়ী-ভুঁড়ি উঠিয়ে দিয়েছিলো, ফাতিমা এই ঘটনা শুনতে পেয়ে দ্রুত এসে তার পিতার পিঠ থেকে এসব পচা নাড়িভুরি পরিষ্কার করে দেন এবং কুরাইশ নেতাদের সাথে ঝগড়া করেন। কিশোর বয়সে ফাতিমা পিতার হাত ধরে কাবার প্রাঙ্গণে গিয়েছিলো, মুহাম্মাদ(সা.)কে একা পেয়ে হাজারে আসওয়াদের নিকটে তাকে ঘিরে ফেলে এবং এক পর্যায়ে আক্রমণ করে মুহাম্মাদ(সা.)এর দাড়ি ধরে টানাটানি ও চাদর গলায় পেচিয়ে ফাঁস লাগাতে শুরু করে, এমনকি মাথায়ও আঘাত করে। এই ঘটনা দেখে ফাতিমা প্রচ- ভয় পেয়ে যায়। সেইদিন হযরত আবু বকর(রা.)র সাহায্যে বাবা-মেয়ে শত্রুদের হাত থেকে মুক্তি পায়।
ইতিহাস-৩১ ▌নবীজির পুত্রসন্তানগণ:
সুতরাং নবীজির তিনজন পুত্রসন্তান ছিলেন। কাসিম : তিনি নবীজির প্রথম সন্তান। নবুয়তের পূর্বে তার জন্ম হয়েছে। তার কারণে নবীজিকে আবুল কাসিম (কাসিমের পিতা) বলা হতো। তিনি বয়স নিয়ে মতপার্থক্য আছে; অনেকে বলেন ১৭ মাস। নবীজি সা.-এর সন্তানদের মধ্যে তিনিই প্রথম মারা যান। আব্দুল্লাহ : বলা হয় তিনি মক্কায় বাল্যকালেই মারা গেছেন। তবে তার জন্ম কি নবুয়তের পরে না পূর্বে-এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কয়েকজন নবুয়তের পরে হওয়ার মতকে সহীহ বলেছেন।
ইতিহাস-৩২ ▌ নবীজির পুত্র ইবরাহিম :
ইবরাহিম রা. জন্ম গ্রহণ করেন অষ্টম হিজরির যিলহজ মাসে। তার মাতা হলেন মারিয়া কিবতিয়া রা.। নবীজি তাকে উম্মে সাইফের কাছে পালতে দিয়েছিলেন; যিনি আবু সাইফ নামক এক কামারের স্ত্রী। নবীজি প্রায়ই মদিনার উঁচু ভূমিতে যেতেন ইবরাহিমকে দেখতে, যেখানে ইবরাহিমের দুধ মায়ের বাড়ি। তাকে চুমু দিতেন এবং তার ঘ্রাণ নিতেন। দুধপানের বয়সেই তিনি মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুর সময় নবীজি কেঁদেছেন।
ইতিহাস-৩৩ ▌ নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রীগণ:
নবীজির মোট এগারোজন স্ত্রী ছিলেন। জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেছেন দু’জন- খাদিজা ও উম্মুল মাসাকিন যয়নব(র.)। বাকি নয়জন স্ত্রী হলেন- আয়েশা, হাফসা, উম্মে হাবীবা, যয়নব বিনতে জাহাশ, উম্মে সালামা, মাইমুনা, সাওদা, জুওয়াইরিয়া, সাফিয়া। খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ছিলেন কুরাইশ নারীদের মধ্যে বংশধারায় মধ্যম, মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ এবং ও স¤পদে ধনাঢ্য। নবীজির(স.) সাথে বিয়ের পূর্বে তার আরও দু’বার বিয়ে হয়েছিল। প্রথমে আতিক ইবনে আবিদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মাখযুম-এর সাথে। এই ঘরে একটি ছেলে ‘আব্দুল্লাহ’ ও একটি মেয়ে ‘হিন্দ’ জন্মগ্রহণ করে। হিন্দ মুসলমান হয়েছেন। আতিক মারা যাওয়ার পরে খাদিজা(র.) বিবাহ করেন আবু হালা ইবনে নাবাশ ইবনে যারারা তামীমিকে। তিনিও মারা গেছেন। এই ঘরেও হিন্দ ও হালা নামে দুটি ছেলে হয় এবং উভয়েই মুসলমান হয়েছেন। ইবরাহিম ছাড়া নবীজির সকল সন্তান হয় খাদিজা(র.) এর গর্ভে।
ইতিহাস-৩৪ ▌বিয়ের রয়স:
বলা হয়ে তাকে বিয়ের সময় রসুল(স.)-এর বয়স ছিল ২৫ আর হযরত হদিজার ৪০। কিন্ত এ ৪০ ইতিহাসটি পবিত্র কোরআনে নেই, হাদীসে নেই। এমনকি নবী মৃত্যুর ২১০ বছরের কোনো রচনায় এটি নেই, এটি আছে নবীর মৃত্যুর ২৮০ বছর পরের রচনা তাবারিতে। জরির আল-তাবারি তার সময়ে কেবল প্রচলিত কাহিনীর সংকলিত করে রেখেছেন। ইবনে কাসীর খাদিজার(র.) ৪০ বছর বয়স নিয়ে বহু গবেষণা করেছেন। তিনি দেখেছেন খাদিজা(র.) মারা গেছেন ৬৫ বছরে বলা হলেও সঠিক ছিল ৫২ বছর। বিয়ের বয়স ৪০ ধরে নিলে খাদিজা(র.) ছাড়া এমন কোনো মেয়ে পাওয়া যাবে না, যিনি ৪০ বছর বয়সের পর ধারাবাহিকভাবে ৬ সন্তান জন্ম দিয়েছেন। ইবনে সাদ বলেছেন, বিয়ের সময় হাদিজার বয়স ছিল ২৭ বছর। সংকলনের সময় ইতিহাসটি বিকৃতি হয়েছে। এর বড় কারণ হতে পারে শিয়ারা। কারণ, তারা ফাতেমা(র.) ব্যতিত আর কোনো সন্তানকে মহনবীর ঔরসজাত সন্তান বলে মনে করে না।
ইতিহাস-৩৫ ▌নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা :
আয়েশা বিনতে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) জন্মগ্রহণ করেন ইসলামের আবির্ভাবের পরে। নবুয়তের দশম বছরে নবীজির(স.) সাথে বিবাহ হয়। তিনি তখন ছয় বছর বয়সী। নয় বছর বয়সে মদিনায় আগমনের সাত মাস পরে শাওয়াল মাসে বাসর হয়। আয়েশা(র.) হলেন নবীজি(স.)র বিবাহিত একমাত্র কুমারী নারী। অল্প বয়স হওয়ায় নবীজিকে তাকে খেলার সাথিদের সাথে খেলার স্বাধীনতা দিতেন। তিনি ছিলেন নবীজির সবচে’ প্রিয় মানুষ। তিনি ছাড়া অন্য কারও সাথে একবিছানায় থাকাকালে নবীজি(স.)র ওপর অহী নাযিল হয়নি। তিনি ছিলেন উম্মতের মধ্যে সবচে’ বড় ফকীহ নারী এবং নারী-সাধারণের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী। বড় বড় সাহাবী তাঁর বক্তব্যের দিকে ‘রুজু’ হতেন এবং তার ফতোয়া গ্রহণ করতেন। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা দুই হাজার দুইশ’ দশটি। তিনি ইন্তিকাল করেন ৫৮ হিজরির রমজান মাসে। আবু হোরায়রা(র.) তাঁর জানাযার পড়ান।
ইতিহাস-৩৬ ▌নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রী সাওদা বিনতে যাময়া :
সাওদা বিনতে যাময়া ইবনে আব্দুশ শামস(র.)কে নবীজি বিবাহ করেন খাদিজা (রা.)-এর ইন্তিকালের পরে মক্কায়। এর আগে সাওদা তার চাচার ছেলে সাকবান ইবনে আমর-এর বিবাহধীন ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হাবশায় দ্বিতীয় হিজরত করেন। হাবশার মুহাজিরদের সাথে মক্কায় ফেরার পর সাওদার স্বামী মারা যান। মদিনায় হিজরতের পর তাঁর বার্ধক্য এসে পড়লে তার আশংকা হয়, নবীজি তাকে তালাক দিয়ে দেন কি-না, যদিও নবীজির পক্ষ থেকে এমন কোনো আচরণ পাননি। তাই তাঁর জন্যে বরাদ্ধ নবীজিকে পাওয়ার নির্ধারিত দিনটি তিনি হযরত আয়েশা(র.)কে দিয়ে দেন। তিনি ইন্তেকাল করেছেন ওমর(র.)-এর খেলাফতের শেষ দিকে।
ইতিহাস-৩৭ ▌নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রী হাফসা বিনতে ওমর :
হাফসা বিনতে ওমর ইবনুল খাত্তাব(র.) জন্মগ্রহণ করেন নবুয়তের পাঁচ বছর পূর্বে। তার মা হলেন যয়নব বিনতে মাযঊন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হিজরত করেন তার স্বামী খুনাঈস ইবনে হুযাফা সাহমি(র.)-এর সাথে; যিনি বদরে অংশ নিয়ে আহত হয়েছেন এবং সেই জখমে শহিদ হয়েছেন। তৃতীয় হিজরিতে নবীজি তাকে বিবাহ করেন। তার থেকে ৬০টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তাঁর ইন্তেকাল হয় মদিনায় ৪৫ হিজরিতে।
উম্মুল মাসাকিন যাইনাব : তাঁর নাম যয়নব বিনতে খুযায়মা ইবনে হারেস হিলালিয়া। মিসকিনদের খওয়ানোর কারণে তাকে জাহেলি যুগে ‘উম্মুল মাসাকিন’(মিসকিনদের জননী) ডাকা হতো। তার পূর্বের স্বামী ছিল নবীজির ফুপাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ; যিনি উহুদ যুদ্ধে শহিদ হন। ইদ্দত শেষ হওয়ার পরে নবীজি তাকে বিবাহ করেন। কিন্তু দুই-তিন মাসের মধ্যে তাঁর ইন্তেকাল হয়।
ইতিহাস-৩৮ ▌নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রী উম্মে সালামা :
তিনি হলেন হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া ইবনে মুগিরা মাখযুমি। পূর্বে তার বিয়ে হয় নবীজি (স.)র ফুপাতো ভাই আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদের সাথে। স্বামীর সাথে প্রথমবারে হাবশায় হিজরত করলে সেখানে একটি মেয়ে ‘যাইনাব’-এর জন্ম হয়। এরপর সালামা(র.), ওমর ও দুররা নামে আরও তিন সন্তানের জননী হন তিনি। স্বামীর সাথে মদিনায়ও হিজরত করেন তিনি। আবু সালামা(র.) বদর ও উহুদের যুদ্ধে শরিক হন। পরে একটি অভিযানে উহুদে পাওয়া আঘাত তাজা হয়ে গেলে চতুর্থ হিজরির জুমাদাল উখরা মাসে ইন্তেকাল করেন। ইদ্দত শেষ হলে নবীজি তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী নারী এবং একজন ফকীহও বটে। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা তিনশত আটাত্তর। উম্মাহাতুল মুমিনীনের মধ্যে তিনি সবার শেষে ইন্তেকাল করেন, কারো মতে তেষট্টি হিজরি। সে-সময় তার বয়স হয়েছিলো ৮৪ বছর।
ইতিহাস-৩৯ ▌নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রী যাইনাব বিনতে জাহাশ :
তাঁর মা হলেন উমাইমা বিনতে আব্দুল মুত্তালিব। নবীজির আদেশে তিনি আজাদ দাস যায়েদ ইবনে হারেসার(র.) স্ত্রী হন। কিন্তু বংশ-গৌরবের কারণে তিনি নিজেকে যায়েদের চেয়ে উর্ধ্বের মনে করতেন। যায়েদ (র.) অবশেষে তালাক দিয়ে দেন। ইদ্দত শেষ হওয়ার পর নবীজি তার উদ্দেশে বিবাহের পায়গাম পাঠান। আয়াত নাযিল হয়- “এরপর যখন যায়েদ আপন স্ত্রী থেকে প্রয়োজন পূরণ করে নিলো, তখন আমি তাকে আপনার বিবাহে দিয়ে দিলাম, যাতে মুসলমানদের জন্য নিজেদের পালক-পুত্রের স্ত্রীদের বিয়ে করতে কোনো সমস্যা না থাকে।” এর ফলে পঞ্চম হিজরিতে নবীজি আকদ ও মোহর ছাড়াই তাকে গ্রহণ করেন। যাইনাব(র.) অন্য স্ত্রীদের উপর গর্ববোধ করতেন যে, আল্লাহ এ-বিবাহ আসমানে পড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি নয়টি হাদিস বর্ণনা করেন। নবীজির ইন্তেকালের পর বিশ হিজরিতে মদিনায় তাঁর ইন্তেকাল হয়।
ইতিহাস-৪০ ▌ নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রী জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেস মুসতালিকিয়া :
ষষ্ঠ হিজরিতে বনি মুসতালিকের যুদ্ধে যুদ্ধবন্দি হিসেবে জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেস মদিনায় আসেন। তিনি নবীজির কাছে মুক্তির সাহায্য চাইতে আসেন। তাঁর বাবা ছিলেন গোত্রের সর্দার। নবীজি তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। তিনি সম্মত হলে সাহাবিগণ তাদের হাতে থাকা বন্দিদের ছেড়ে দেন, যেহেতু তারা এখন নবীজির স. শ^শুর-সম্বন্ধীয় আত্মীয়। ফলে বনি মুসতালিকের শতাধিক সদস্য মুক্তি পায়। তিনি ছিলেন মিষ্টি লাবণ্যময়ী চেহারার নারী। মোট পাঁচটি হাদিস তিনি বর্ণনা করেন। পঞ্চাশ হিজরিতে তাঁর ইন্তেকাল হয়।
ইতিহাস-৪১ ▌নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রী উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান :
তিনি প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। আবিসিনিয়ার দ্বিতীয় হিজরতে তিনি ও তাঁর স্বামী আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ উভয়ে শরিক ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বামী সেখানে গিয়ে খ্রিস্টান হয় এবং আবিসিনিয়ায় থাকতেই মারা যায়। ষষ্ঠ হিজরিতে নবীজি (স.) নাজ্জাশির মাধ্যমে তাকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। নাজ্জাশি তাঁকে বিবাহ দিয়ে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে চারশত দিনার মোহর পরিশোধ করেন। বিবাহে তাঁর অভিভাবক ছিলেন খালেদ ইবনে সায়িদ ইবনুল আস (রা.)। তার থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে পয়ষট্টিটি। ৪৪ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
ইতিহাস-৪২ ▌নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রী সাফিয়া বিনতে হুয়াই :
মুসলমানরা সপ্তম হিজরিতে খাইবার বিজয় করেন। যুদ্ধবন্দি হয়ে মদিনায় আসেন সাফিয়া বিনতে হুয়াই আখতাল। তিনি দাহিয়া কালবি(রা.)র দাসী হন। অথচ তিনি ছিলেন কুরাইযা ও নাযির উভয় গোত্রের সর্দারের মেয়ে। এটা জানতে পেরে নবীজি তাঁকে মুক্ত করে দেন এবং বিবাহ করে নেন। এ-সময় নবীজি মদিনা ও খাইবারের মধ্যবর্তী একস্থানে অবস্থান করেছিলেন। খেজুর, পনির ও মাখন দিয়ে অলিমা আয়োজন করা হয়। এর আগে সাফিয়া (রা.) স্ত্রী ছিলেন কেনানা ইবনে আবু হাকিক-এর; যিনি খাইবার যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তিনি মোট দশটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। ৫০ হিজরিতে রমজান মাসে তাঁর ইন্তেকাল হয়।
ইতিহাস-৪৩ ▌ নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রী মাইমুনা বিনতে হারিস হিলালিয়া :
নবীজি তাঁকে বিবাহ করেন ওমরায়ে কাযা আদায় করতে গিয়ে খাইবার যুদ্ধের পরে সপ্তম বর্ষে। তিনিই নবীজির সর্বশেষ স্ত্রী। তাঁর বোন উম্মে ফযল লুবাবাতুল কুবরা ছিলেন নবীজির চাচা আব্বাস (রা.)-এর স্ত্রী এবং বৈপিত্রেয় বোন সালামা বিনতে উমাইস ছিলেন আরেক চাচা হামযা( রা.)-এর স্ত্রী। আব্বাস (রা.)-ই তাকে নবীজি (স.)র সাথে বিবাহ করিয়ে দেন। ওমরার সময় যেহেতু কুরাইশরা তাকে মক্কায় থাকতে অনুমতি দেয়নি, তাই সারাফ নামক স্থানে তাঁর সাথে বাসর করেন। ৫১ হিজরিতে সেই সারাফেই ইন্তেকাল করেন। এর আগে তিনি আবু রহম ইবনে আব্দুল ওযযার স্ত্রী ছিলেন, যিনি মারা গেছেন। তিনি মোট বর্ণনা করেছেন ছিয়াত্তরটি হাদিস।
ইতিহাস-৪৪ ▌ আকাবার শপথ:
মুহাম্মাদ(স.)-এর আহ্বানে মক্কায় বেশকিছু লোক ইসলামের প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা মূলত হজ্জ করতে এসে ইসলামে দাওয়াত পেয়েছিল। এরা আকাবা নামক স্থানে মুহাম্মাদ(স.)-এর কাছে শপথ করে যে, তারা যে কোনো অবস্থায় তাদের নবী মুহাম্মাদ(স.) কে রক্ষা করবে এবং ইসলামে প্রসারে কাজ করবে। এই আকাবার শপথ-এর মাধ্যমেই মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং একসময় মদিনার ১২টি গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের মাধ্যমে মুহাম্মাদ(স.)কে মদিনায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। মদিনায় অনেক আগে থেকে গোত্র গোত্র এবং ইহুদিদের সাথে অন্যদের যুদ্ধ লেগে থাকতো। এজন্য তাদের একজন নেতা দরকার, যে সবাইকে একতাবদ্ধ করতে পারবে। এই আমন্ত্রণে মুসলিমরা মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় চলে যায়। যারা মুহাম্মাদ(স.)-এর সাথে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিল তারা "মুহাজিরুন" নামে পরিচিত হয়ে উঠল।
ইতিহাস-৪৫ ▌ কুবায় নবীজির মসজিদ নির্মাণ:
মদিনাবাসী যেদিন থেকে শুনতে পেয়েছিলো,নবীজি আসছেন, সেদিন থেকেই তাঁরা রোজ ভোর থেকে দুপুর চড়া পর্যন্ত মদিনার বাইরে এসে নবীজির অপেক্ষা করতেন। মদিনায় পৌঁছানোর আগে রাসূলুল্লাহ(স.) এবং তার সহচরগণ কুবায় কতদিন অবস্থান করেন, এ নিয়ে মতভেদ আছে। মতান্তরভেদে তিনি ৩, ৪, ৫ বা ১৪ দিন কুবায় অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি কুবায় একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। এটাই ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ; মসজিদে তাকওয়া এর নাম। এ সময় মক্কায় রয়ে যাওয়া হযরত আলি (রা.) নবীজির সাথে কুবায় মিলিত হন। তিনি নবীজির কাছে গচ্ছিত নানা লোকজনের আমানত বুঝিয়ে দেওয়ার দরকারে এবং নবীজির বিছানায় শুয়ে থাকার নির্দেশ পালনে সেখানে থেকে গিয়েছিলেন। এখানে অবস্থানের পালা শেষ হলে নবীজির মামাগোষ্ঠী বনু নাজ্জারের লোকদের অভ্যর্থনাযোগে তিনি মদিনার দিকে যাত্রা করেন।
ইতিহাস-৪৬ ▌মসজিদে নববি প্রতিষ্ঠা:
মদিনায় হিজরত করার পর রাসূলুল্লাহ (স.) প্রথম কাজ হলো মসজিদে নববির নির্মাণ। আর এজন্য সে স্থানটি নির্ধারিত হলো,মদিনায় প্রবেশের যেখানে সর্বপ্রথম তাঁর উটটি বসেছিলো। এ স্থানটির মালিক দুই এতিম বালক নবীজিকে মসজিদ নির্মাণের জন্য সে জমি দিতে চাইলেও তিনি জমিটি ন্যায্যমূল্যে ক্রয় করলেন এবং নিজে নির্মাণ-কাজে অংশগ্রহণ করলেন। সে সময় কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস। দরজার দুই বাহুর স্তম্ভগুলো পাথর এবং দেওয়াল নির্মিত হলো কাঁচা ইট দিয়ে। ছাদের উপর খেজুরের ডাল পালা চাপিয়ে আবরণ তৈরি করা হলো আর খেজুর গাছের গুঁড়ি দিয়ে থাম তৈরি করা হলো। মেঝেতে বিছানো হলো বালি ও ছোট ছোট কাঁকর। মসজিদ-ঘরে তিনটি দরজা লাগানো হয়েছিলো। নবীজি মসজিদের পাশে কয়েকটি ঘর তৈরি করিয়ে নিলেন; এগুলোর দেয়াল ছিলো কাঁচা ইটের আর ছাউনি দেয়া হয়েছিলো খেজুরের শাখা ও পাতা দিয়ে। এগুলো ছিল নবী পতœীগণের আবাসকক্ষ।
ইতিহাস-৪৭ ▌মুহাম্মাদ(স.) এর মাদানী জীবন:
মুহাম্মাদ(সা.) মদিনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী এবং শাসক হিসেবে। তখন বিবদমান দুটি মূল পক্ষ ছিল বনু আওস ও বনু খাজরাজ। তিনি মদিনার সকল গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদিনা সনদ স্বাক্ষর করেন, যা ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই সনদের মাধ্যমে সকল রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির গোড়াপত্তন করা হয় এবং সকল গোত্রের জবাবদিহিতার নিশ্চিত করা হয়। আওস, খাযরাজ উভয় গোত্রই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও প্রধানত তিনটি ইহুদি গোত্র (বনু কাইনুকা, বনু কুরাইজা এবং বনু নাদির)সহ মোট আটটি গোত্র এই সনদে স্বাক্ষর করেছিল। এই সনদের মাধ্যমে মদিনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুহাম্মাদ (সা.)হন তার প্রধান। যে সকল মদিনাবাসী ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মুসলিম মুহাজিরদের আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেন তারা আনসার নামে পরিচিত হন।
ইতিহাস-৪৮ ▌ মক্কার সাথে বিরোধ ও যুদ্ধ:
মক্কার কুরাইশরা মদিনা রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করতে থাকে। মক্কার কুরাইশরা গৃহত্যাগী সকল মুসলিমদের স¤পত্তি ছিনিয়ে নেয়। এই অবস্থায় ৬২৪ সালে মুহাম্মাদ ৩০০ সৈন্যের একটি সেনাদলকে মক্কার একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাঠায়। কারণ উক্ত কাফেলা বাণিজ্যের নাম করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। কুরাইশরা তাদের কাফেলা রক্ষায় সফল হয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যুদ্ধের ডাক দেয়। এ সময় মদিনার বসবাসকারী ইহুদিরা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য হুমকী হয়ে দেখা দেয়। মূলত ইহুদিরা কখনই ইসলামের আদর্শ মেনে নেয়নি এবং যখন ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি বুঝতে পারে তখন তারা এর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ শুরু করে। বদর ও উহুদের যুদ্ধের পর বনু কাইনুকা ও বনু নাদির গোত্র সপরিবারে মদিনা থেকে বিতাড়িত হয়; আর খন্দকের পর সকল ইহুদিকে মদিনা থেকে বিতাড়ন করা হয়।
ইতিহাস-৪৯ ▌বদর-এর যুদ্ধ:
মদিনায় আসার পর মুহাম্মাদ (সা.) তিনটি প্রধান সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। প্রথমত, মদিনার গোত্রগুলির সাথে শান্তিচুক্তি স্থাপন; দ্বিতীয়ত, কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের ইতিহাস সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করা; তৃতীয়ত, মদিনার পাশ দিয়ে সিরিয়াগামী মক্কার বাণিজ্য কাফেলায় অভিযান চালানো। ২ হিজরির ১৭ রমজান (১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ) মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এটি প্রথম প্রধান যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পূর্বে ৬২৩ থেকে ৬২৪ সালের মধ্যে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে বেশ কিছু খন্ডযুদ্ধ হয়। বদর ছিল প্রথম বড় আকারের যুদ্ধ। যুদ্ধে সুসংগঠিত মুসলিমরা মক্কার সৈনিকদের সারি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে মুসলিমদের প্রধান প্রতিপক্ষ আবু জাহল নিহত হয়। মুসলিমদের বিজয়ের অন্যদের কাছে বার্তা পৌছায় যে মুসলিমরা আরবে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং এর ফলে নেতা হিসেবে মুহাম্মাদ(স.)-এর অবস্থান দৃঢ় হয়।
ইতিহাস-৫০ ▌ ওহুদ-এর যুদ্ধ:
হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় অবস্থানের ছয় মাসের মধ্যে নিজ সম্প্রদায়ের জন্য একটা বাসস্থান গড়ে তুলেন এবং সেখানকার গোত্রগুলোর সঙ্গে একটি চুক্তি করেন, যা ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। মক্কাবাসীদের সঙ্গে বদর যুদ্ধের অবিশ্বাস্য বিজয়ের পর মুহাম্মদ (সা.)-এর যোদ্ধাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। এরপর মুসলিম বাহিনী পরপর আরও তিনটি মক্কার কাফেলার উপর হামলা চালায়। ফলে মক্কার কুরাইশরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ৬২৫ সালের ২৩শে মার্চ আবু সুফিয়ান ৩০০০ লোকের এক যোদ্ধা বাহিনী নিয়ে মক্কা থেকে রওয়ানা দেন। তারা মদিনার কাছে ওহুদ নামক স্থানে মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বাধীন ৭০০ যোদ্ধার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয় হলেও ৬২৬ সালের এপ্রিল মাসে আবার মক্কার কাফেলার উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় আশপাশের কিছু অমুসলিম গোত্রও মুহাম্মদ (সা.)-এর বাহিনীতে যোগ দেন।
ইতিহাস-৫১ ▌ খন্দকের যুদ্ধ:
মুহাম্মদ (সা.)-এর হুমকি চিরতরে শেষ করার জন্য ৬২৭ সালের এপ্রিল মাসে মক্কার আবু সফিয়ান প্রায় ১০,০০০ যোদ্ধার একটা বিশাল বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমণের জন্য রওয়ানা হন। সে সময় সালমান নামে মুহাম্মদ (সা.)-এর পারস্যের এক শিষ্য মদিনায় মুসলিম বাসস্থানের চারদিকে খন্দক বা পরিখা খননের পরামর্শ দেন। মুহাম্মদ (সা.) এই ধারণাটা লুফে নিয়ে বাসস্থানের চারদিকে পরিখা খনন করে মুসলিম যুদ্ধাদের খন্দকের ভেতর একত্রিত করেন। এই রণকৌশল কোরাইশদের কাছে অপরিচিত হওয়ায় তারা খন্দকটি পার হতে ব্যর্থ হয়। আক্রমণকারী কোরাইশরা ২০ দিন (মতান্তরে ৩০ দিন) অবরোধ করে হতাশ হয়ে ফিরে যান। কুরাইশরা অবরোধ তুলে নেবার পরপরই মুহাম্মদ (সা.) মদিনার ইহুদী গোত্র বানু কুরাইজা’র বিরোদ্ধে অভিযোগ তুলেন কুরাইশদেরকে সহযোগিতা করার এবং তাদের বিরোদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।
ইতিহাস-৫২ ▌ হুদায়বিয়ার সন্ধি:
খন্দকের যুদ্ধের এক বছর পর ৬২৮ সালের মার্চ মাসে মুহাম্মদ(সা.) ১,৫২৫ জনের একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হন। কোরাইশরা মুহাম্মদ(সা.)-এর আগমনের খবর পেয়ে তাঁর মক্কা প্রবেশ রুখতে শপথ নেন। কোরাইশদের এই প্রতিজ্ঞার খবর পেয়ে নবী সামনে অগ্রসর না হয়ে হুদায়বিয়া নামক স্থানে তাঁবু গাড়েন। তিনি মক্কায় বার্তা পাঠান এই বলে যে, তিনি কেবল শান্তিপূর্ণ ওমরা করতে এসেছেন, তা করার পর মদিনায় ফিরে যাবেন। সংঘর্ষের ফলাফল বিবেচনা করে কোরাইশরা সংঘর্ষ এড়াতে আপোষের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে দু’পক্ষের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়, যা ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। এতে উল্লেখ থাকে যে, উভয় পক্ষের মধ্যে ১০ বছরের জন্য হানাহানি বন্ধ থাকবে। সন্ধির শর্ত মতে, মুহাম্মদ(সা.) ও তার দল এবারের জন্য কাবা দর্শন না করেই মদিনায় ফিরে যাবে কিন্তু পরবর্তী বছর থেকে তিনদিন কাবায় ওমরা করতে পারবে।
ইতিহাস-৫৩ ▌মক্কা আক্রমণ:
ইতিহাসবিদ ড্যানিয়েল পাইপস বলেন, হুদায়বিয়ার সন্ধিটি মূলত কোরাইশরাই ভঙ্গ করেছিল। ফলে ৬৩০ সালের জানুয়ারি মাসে ১০০০০ যোদ্ধার একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে মুহাম্মদ(সা.) মক্কা আক্রমণ করেন। আবু সুফিয়ান নিশ্চিত পরাজয় জেনে জনগণকে যুদ্ধ না করার উপদেশ দেন। মুসলিম বাহিনী মক্কায় প্রবেশ করে কাবাঘরে রক্ষিত সমস্ত মূর্তি ধ্বংস করেন। মক্কা বিজয়ের দিন অনেক পৌত্তলিক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ(সা.)-এর মক্কা দখলের পর ওমান, বাহরাইন, মিসরসহ অনেক রাজাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে দূত মারফত চিঠি পাঠান। কেউ ইসলাম গ্রহণ না করলেও মিসরের রোমান গভর্নর মোহাম্মদ(সা.)-এর কাছে তাঁর পত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ উত্তর পাঠান। পরবর্তীতে যেসব খ্রিস্টান শাসক ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করেননি, তাদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধাভিযান চালান। কিন্তু মিসর আক্রমণ করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর মুসলিম শাসকরা মিসর আক্রমণ করে।
ইতিহাস-৫৪ ▌ বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের কাছে পত্র প্রেরণ:
মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী মুহাম্মাদ(সা.) সারা বিশ্বের রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন এবং পৃথিবীর সব জায়গায় ইসলামের আহ্বান পৌঁছে দেওয়া তার দায়িত্ব ছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রগুলো থেকে আশ্বস্ত হয়ে তিনি এ কাজে মনোনিবেশ করেন। সে সময়ে পৃথিবীর প্রধান রাজশক্তিগুলো ছিল ইউরোপের রোম সাম্রাজ্য, এশিয়ার পারস্য সাম্রাজ্য এবং আফ্রিকার হাবশা সাম্রাজ্য। এছাড়াও মিশরের 'আজিজ মুকাউকিস', ইয়ামামার সর্দার এবং সিরিয়ার গাসসানী শাসনকর্তাও বেশ প্রতাপশালী ছিল। তাই ষষ্ঠ হিজরির জিলহজ মাসের শেষদিকে একইদিনে এদেঁর কাছে ইসলামের আহ্বানপত্রসহ ছয়জন দূত প্রেরণ করেন। শাসকদের মধ্য হতে বাদশাহ নাজ্জাসি ও মুনজির ছাড়া আর কেউ তখন ইসলাম গ্রহণ করেননি।
ইতিহাস-৫৫ ▌ বিরে মাউনার যুদ্ধ:
আবু বারা আমির বিন মালিক মদিনায় নবী করিম (স.) খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে বললো,‘হে রাসূল, যদি আপনি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য কিছু সাহাবিকে নাজদবাসীর নিকট প্রেরণ করেন, তাহলে তারা আপনার দাওয়াত গ্রহণ করবে। ওখানে সাহাবিরা আমার আশ্রয়ে থাকবেন। রাসূল তারপর এই কথায় আশ্বস্ত হয়ে ৭০ জন সাহাবাকে তার সঙ্গে প্রেরণ করেন। তাঁরা মাউনার কূপের নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। এই স্থানে শিবির স্থাপনের পর সাহাবিগণ হযরত হারাম বিন মিলহানকে রাসূলুল্লাহর পত্রসহ আমির বিন তোফাইলের নিকট প্রেরণ করেন। সে তাকে বর্শাবিদ্ধ করে অবশিষ্ট সাহাবাদের উপর আক্রমণ করলে হযরত কাব ইবনে যায়েদ বাদে সকলেই শাহাদত বরণ করলেন। চরম এক বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে স¤পূর্ণ অসহায় অবস্থায় ৭০ জন বিজ্ঞ মুসলিমের এ হৃদয়বিদারক শাহাদাত বরণ করেন। এক মাস যাবৎ নবী করিম(স.) তাদের বিরুদ্ধে বদদুয়া করেছেন।
ইতিহাস-৫৬ ▌মদিনায় অবাঞ্ছিত বনু নাযির:
আমর বিন উমাইয়া(র.) বিরে মাউনার ঘটনার সংবাদ নিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে বনু কিলাবের দুই ব্যক্তিকে এই ভেবে হত্যা করে যে, এরা বিরে মাউনার বিশ্বাসঘাতকদের দলছুট সদস্য; কিন্তু আসলে তারা তা ছিলো না। ফলে এই দুই নিহত ব্যক্তির পণ দেওয়া অপরিহার্য ভেবে ইহুদিদের এলাকায় গিয়ে যখন বনু কিলাবের দুই নিহতের ব্যাপারে সুরাহা করতে চান, তখন ইহুদিরা নবীজিকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। নবীজি সেই সংবাদ জেনে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করেন এবং মদিনয় ফিরে বনু নাযিরকে এই বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে অবিলম্বে মদিনা ছাড়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু হুয়াই মোনাফেক-নেতা ইবনে উবাইয়ের কথায় মজে নবীজির নির্দেশ-পালনে অস্বীকৃতি জানালো। ফলে বনু নাযিরের দুর্গ অবরোধ করলেন। পনেরো দিন অবরুদ্ধ থাকার পর তা আত্মসমর্পণ করে। শুধু উট বোঝাই করে যে মালপত্র নেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে মদিনা ছাড়ে। বিপুল সম্পত্তি মুসলিমদের কর্তৃত্বাধীন হয়।
ইতিহাস-৫৭ ▌হুনাইনের যুদ্ধ:
হাওয়াযিন ও সাকিব গোত্র দুটি জাত্যাভিমান ও আত্মসম্মানবোধের খাতিরে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য মক্কার দিকে অগ্রসর হলো। রাসূলুল্লাহ(স.) এ ব্যাপারে অবগত হয়ে ১২ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনীকে তাদের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করলেন। এঁদের মধ্যে ১০ হাজার ছিলেন আনসার ও মুহাজিরগণ,যাঁরা মক্কা বিজয়ের সময় মদিনা হতে নবীজির সাথে এসেছিলেন;আর ২ হাজার ছিলেন নও মুসলিম। তারা রওনা হয়ে যখন হুনাইন প্রান্তরে উপনীত হলেন, তখন পাহাড়ের ঘাঁটিতে আত্মগোপনকারী শত্রুরা অতর্কিতভাবে মুসলমানদের উপর হামলা করে বসলো। নবী করিম(স.)তখন দুটি বর্ম পরিধান করে দুলদুল নামক একটি সাদা খচ্চরের উপর উপবিষ্ট হয়ে বীরত্বব্যঞ্জক আওয়াজ দ্বারা দৃঢ় থাকার আহ্বান জানালেন। এতে শত্রুবাহিনী পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হলো। মুসলিম-বাহিনীর চারজন এবং কাফেরদের সত্তরজনের অধিক লোক নিহত হলো।
ইতিহাস-৫৮ ▌রাযির যুদ্ধ:
চতুর্থ হিজরির সফর মাসে আযাল এবং কারাহ গোত্রের কয়েক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (স.) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করে, তাদের মধ্যে কিছু কিছু ইসলামের চর্চা রয়েছে। কাজেই, কুরআন ও দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য তাদের সঙ্গে কয়েকজন সাহাবিকে পাঠালে ভালো হয়। সে মোতাবেক রাসূল (স.) দশজন সাহাবিকে তাদের সঙ্গে প্রেরণ করে আসিম বিন সাবেতকে এ দলের নেতৃত্বে প্রদান করেন। এরা যখন রাযি নামক ঝরনার নিকটে পৌঁছান, তখন উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ হুযাইল গোত্রের শাখাগোত্র বানু লাহয়ানকে তাদের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য লেলিয়ে দেয়। এ গোত্রের একশত তিরন্দাজ তাঁদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে অবিরাম তির তাদের উপর বর্ষণ করা হয়। বেঁচে থাকেন শুধু খুবাইব এবং যায়দ ইবনে দাসিন্না (র.)। তাঁদেরকে মক্কায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাঁরা বদর যুদ্ধে শীর্ষ পর্যায়ের কুরাইশদের হত্যা করেছিলেন। তাঁদেরও মর্মান্তিকভাবে শহিদ করা হয়।
ইতিহাস-৫৯ ▌গাজওয়ায়ে খায়বর:
মদিনার ইহুদিদের মধ্য থেকে বনু নাযির যখন খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে, তখন থেকেই খায়বর যাবতীয় ইহুদি-তৎপরতার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। তারা আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণকে ইসলামের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতো। তাদের এই অপতৎপরতা বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নবী করিম (স.) ৭ম হিজরির মুহাররম কিংবা জুমাদাল উলায় চারশত পদাতিক এবং দুইশত অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে খায়বর অভিমুখে যাত্রা করেন। তুমুল সংঘর্ষ ও হতাহতের পর মুসলমানদের বিজয় আসে। খাইবার বিজয়ের পর রাসূল(স.) কয়েক দিন সেখানে অবস্থানকরেন। যায়নাব নামে এক ইহুদি রাসূলের কাছে বিষ মেশানো ভুনা বকরি পাঠায়।সামান্য একটু চেখে দেখে রাসূল তা বর্জন করেন।এতে নবীজির কিছু না হলেও হযরত বিশর (রা.) ইন্তেকাল করেন; তবে নবীজির অন্তিম পীড়ায় এই বিষের প্রতিক্রিয়া ছিলো বলে সিরাতের বইগুলোতে এই বিবরণ রয়েছে।
ইতিহাস-৬০ ▌মুতারযুদ্ধ:
মুতাসিরিয়ার বালকাশহরের সন্নিকটে বাইতুল মুকাদ্দাস হতে প্রায় দুই মনযিল দূরত্বে অবস্থিত একটি স্থানের নাম। এখানেই মুসলমান এবংরোমানদের মাঝে প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়;রোম-সম্রাটের পক্ষে বসরার শাসনকর্তাআমর ইবনে শুরাহবিল নবী করিম (স.)এর দূত হযরত হারেস ইবনে উমায়ের (রা) আনহুকে হত্যার বদলায় এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। ৮ম হিজরির মাঝামঝিতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন হাজার সাহাবার একটি বাহিনীকে সেদিকে প্রেরণকরেন।যখন মুসলিম-বাহিনী মুতার নিকট পৌঁছুলো, রোমানরা তখন দেড় লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে তাঁদের মোকাবেলায় প্রস্তুত হয়ে আছে। কয়েকদিন যুদ্ধের পর হযরত খালেদ বিন ওলিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর রণকৌশলে রোম-বাহিনী বিভ্রান্তহয়।যুদ্ধে মুসলিমদের মারমুখি দাপট ও বুদ্ধির কৌশলেপিছুহটা ব্যতীত প্রাণ বাঁচানোর জন্য রোমকদের আর কোনো পথ ছিলো না।
ইতিহাস-৬১ ▌ তায়েফ যুদ্ধ:
নবী করিম(স.)বনি সাকিফ ও হাওয়াযিন গোত্রেরপ্রাণকেন্দ্র তায়েফের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। প্রায় ১৮ দিন পর্যন্তগোত্রের লোকদের অবরোধকরে রাখলেন,কিন্তু বিজয়অর্জিত হলো না। সুতরাং অবরোধ তুলে দিয়ে তিনি সেখান থেকে ফিরে আসতে লাগলেন। পথিমধ্যে জিরান নামক স্থানে তায়েফ হতে হাওয়াযিন গোত্রের প্রতিনিধিদল নবীজির খেদমতে এসে উপস্থিত হলো এবং হুনাইন যুদ্ধে তাদের যেসব লোক বন্দি হয়েছিলো, তাদেরকে প্রত্যার্পণ করার আবেদন জানালো। নবীজিতাদের আবেদন মঞ্জুর করে তাদের বন্দীদেরকে প্রত্যার্পণ করলেন। নবী করিম (স.) মদিনায় এসে পৌঁছালে, তায়েফ বাসীদের একটি প্রতিনিধিদল নবীজির খেদমতে উপস্থিত হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করলো। জিরানার ওমরা: হুনাইন যুদ্ধের পর জিরানা নামক স্থানে অবস্থানকালে নবী করিম(স.) ওমরা আদায়ের পর পবিত্র মদিনায় ফিরে যান।
ইতিহাস-৬২ ▌‘নেকলেসের ঘটনা ও হযরত আয়েশার সংগে হযরত আলীর বিরোধ’:
ঘটনাটি বুখারি শরীফে লিপিবদ্ধ রয়েছে। মুস্তালিক অভিযানে শেষে ফিরার সময় আইশা (রা.)-কে যে উটে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তার পিঠে ছিল একটি হাওদা (পর্দা ঘেরা জায়গা)। মদিনার কাছাকাছি এক জায়গায় কাফেলা থামার পর প্রাকৃতিক ডাকে আইশা(রা.) কাছের ঝোঁপে গেলেন। হাওদায় ফিরে এসে দেখলেন তাঁর গলায় নবীজীর দেওয়া ইয়েমেনি নেকলেসটি নেই! তিনি আবার খুঁজতে গেলেন এবং পেয়ে গেলেন। কিন্তু কাফেলা ততক্ষণে নেই! পেছনে পেছনে সাফওয়ান নামের এক সাহাবী আসছিলেন কাফেলা কিছু ফেলে গেল কিনা দেখার জন্য। তিনি আবিষ্কার করলেন স্বয়ং আইশা (রা.)-কে! তিনি তাঁকে তার উটে বসিয়ে বাকি পথ চলেন হেঁটে। কিন্তু গুজব রটিয়ে দেওয়া হলো যে, দীর্ঘ পথ নবীপতœী আইশা (রা.) এক অনাত্মীয়ের সাথে! তখন নবীজীকে এসব অপবাদ-এর ব্যাপারে নেতিবাচক পরামর্শ দেন আলী(রা.)। এটাই আইশা (রা.) এবং আলী(রা.)-এর বিরোধের প্রধান কারন। ৮০দেখুন।
ইতিহাস-৬৩ ▌বিদায় হজ্ব:
দশম হিজরির যিলকদের ২৫তারিখ সোমবার নবী করিম(স.) হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা মুয়াযযমা অভিমুখে যাত্রা করেন। সাহাবাদের এক বিরাট দল তাঁর সঙ্গী,যাঁদের সংখ্যা একলাখের চেয়েও বেশি। মদিনা হতে ছয় মাইল দূরে যুলহুলায়ফা নামক স্থানে গিয়ে ইহরাম বাঁধেন। অতঃপর ৪ঠা যিলহজ শনিবার মক্কায় প্রবেশ করেন এবং শরীয়তের বিধান অনুযায়ী হজ্ব আদায় করেন। জিলহজ মাসের নবম তারিখে নবী করিম (স.)আরাফাতের ময়দানে একটি ভাষণ প্রদান করেন, যা হিতোপদেশ ও বিধি-বিধান সম্বলিত মহান আল্লাহর সর্বশেষ নবীর সর্বশেষ পয়গাম। একে বিদায় হজ্বের ভাষণ বলে। হজ্ব স¤পন্ন করে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশদিন মক্কা মুয়াযযমায় অবস্থান করেন। তারপর পবিত্র মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
ইতিহাস-৬৪ ▌ মোহাম্মদ(সা.)-এর শেষ দিনগুলি:
৬৩০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মোহাম্মদ(সা.) আমর বিন আ’স-এর নেতৃত্বে ওমানের রোমান শাসকদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বাহিনী পাঠান। তারা ইসলাম গ্রহণ করেন। ৬৩০ সালের অক্টোবর মাসে মোহাম্মদ(সা.) সিরিয়ার বাইজেন্টাইন সীমান্তের তাঁবুকে ৩০,০০০ জিহাদিদের সমবেত করেন। সেখানে তাঁবু গেড়ে ২০ দিন অবস্থান করে আশপাশের কয়েকটি সম্প্রদায়কে বশীভূত করেন। ৬৩২ সালে নবী প্যালেস্টাইন সীমান্তে একটা অভিযানের প্রস্তুতিকালে হঠাৎ অন্তিম রোগে আক্রান্ত হন। বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর হিজরি ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মাদ (সা.) জ্বরে আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন। বলা হয়, এই অসুস্থতা ছিল খাইবারের এক ইহুদি নারীর তৈরি বিষ মেশানো খাবার গ্রহণের কারণে। মোহাম্মদ(সা.)-এর জীবনের শেষ দশ বছরে অনেক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৩ বছর।
:: খোলাফায়ে রাশেদিন ::
ইতিহাস-৬৫ ▌ হযরত আবু বকর(রা:):
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর ব্যক্তিগত নাম ছিল আব্দুল্লাহ, কিন্তু তাঁর ছেলের নাম বকর থেকে আবু বকর (বকরের পিতা) নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি মহানবী (সাঃ) এর একজন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তিনি মহানবী (সাঃ) এর মক্কা থেকে মদীনা হিজরতের সময় তাঁর সহযাত্রী ছিলেন। তিনিই হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর একমাত্র সাহাবী, যিনি তাঁর সাথে সেই সফরে ‘সাওর’ গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। হযরত মুহাম্মদ(স.)এর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। মুহাজির ও আনসাররা নিজেদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচনের পক্ষে ছিল। আনসাররা সাকিফা নামক স্থানে একত্রিত হয়ে হযরত মোহাম্মদ(সা.)-এর শ্বশুর হযরত আবু বকর(রা:) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রথম খলিফা নির্বাচিত করেন। আবু বকরের খিলাফত ২৭ মাস স্থায়ী ছিল। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বেশ কিছু অস্থিতিশীলতা এবং নতুন নবী দাবিকারী বিদ্রোহীদেরকে তিনি রিদ্ধার যুদ্ধে দমন করেছেন।
ইতিহাস-৬৬ ▌ হযরত আবু বকর(রা:)
খেলাফত: হযরত আবু বকর (রা.) এর সময়ে বহু লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করে, হযরত আবু বকর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে প্রতিটি সক্ষম ব্যক্তি থেকে যাকাত আদায়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তাঁর খিলাফতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের একটি হলো পবিত্র কুরআনকে একস্থানে সংগৃহিত করা। বিবিধ চামড়ার টুকরা, বৃক্ষ পত্ররাজি এবং পাথরের ফালিতে বিছিন্নভাবে লিখিত অংশকে একত্রিত করেন এবং কুরআন সংরক্ষণের নিমিত্তে হিফযকারীদের ব্যবস্থাপনাকে পদ্ধতিগত ভাবে পূনর্বিন্যস্ত করেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) নেতৃত্বে ইসলামের আওতা সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকে। ৬৩৩ সালে ওমান, হাদ্রামাউত, কাজিমা, ওয়ালাজা, উলেইস ও আনবারের যুদ্ধ এবং ৬৩৪ সালে বসরা, দামেস্ক ও আজনাইনের যুদ্ধ পরিচালনার পর হযরত আবু বকর(রা.) মারা যান। তিনি বাইজেন্টাইন ও সাসনীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
ইতিহাস-৬৭ ▌ রিদ্দা যুদ্ধ:
হযরত আবু বকর (রা.)-এর শাসনকালের (৬৩২-৩৪ খ্রিষ্টাব্দ) অধিকাংশ সময় রিদ্দা যুদ্ধে অতিবাহিত হয়। রিদ্দা আরবী শব্দ। এর অর্থ হল প্রত্যাবর্তনকরণ। নও-মুসলমানরা যাতে তাদের পূর্ব-ধর্মে প্রত্যাবর্তন না করে, তার জন্য এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পর ইয়ামেনের কিন্দানেতা আল-আসাদ বিন কায়েস ইসলাম ধর্মত্যাগ করে। দীর্ঘকাল স্থায়ী যুদ্ধে আল-আসাদ মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়ে মদীনায় প্রেরিত হয়। খলিফা তখন তাকে ক্ষমা করে দিলে, সে ইসলাম কবুল করে। তাছাড়া বাহরাইনের মুসলিম শাসনকর্তা মুনজিরের মৃত্যুর পর বানু আবুল কায়েস নামে একটি গোত্র ইসলামের প্রতি অনুগত ছিল, কিন্তু বানু বকর গোত্র ইসলাম ত্যাগ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ফলে এই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বানু বকর পারস্যের ও সম্মিলিত বাহিনী মুসলমানদের নিকট পরাজিত হয়। খলিফা পূর্ব-প্রদেশের উমান ও মাহরার স্বধর্ম ত্যাগ আন্দোলন দমন করে।
ইতিহাস-৬৮ ▌ হযরত ওমর(রা.):
হযরত আবু বকর(রা.) মৃত্যুর পর নবীর আরেক শ্বশুর হযরত ওমর(রা.) (হযরত হাফসার পিতা) দ্বিতীয় খলিফা হন। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে আল-ফারুক উপাধি দেওয়া হয়। আমীরুল মুমিনীন উপাধিটি সর্বপ্রথম তাঁর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসে তাঁকে '''''প্রথম উমর''''' হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। ইসলাম পূর্ব আরবে লেখাপড়ার রীতি বেশি প্রচলিত ছিল না। এরপরও তরুণ বয়সে উমর(রা.) লিখতে ও পড়তে শেখেন। তিনি দীর্ঘদেহী ও শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন। কুস্তিগির এবং সুবক্তা হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। সুন্নিরা তাকে একজন শ্রেষ্ঠ ফকিহ হিসেবে শ্রদ্ধা করে থাকে। হযরত উমর(রা.) নিজে খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি প্রতি সন্ধ্যায় জনগণের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য রাস্তায় বের হতেন।
ইতিহাস-৬৯ ▌ হযরত ওমর(রা.)-এর শাসনকাল:
শাসক হিসেবে উমর দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। তাই বিশাল সাম্রাজ্যকে ধরে রাখার জন্য তিনি বেশ কিছু প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করেন। তিনি ইহুদিদেরকে জেরুজালেমে পুনরায় বসতি করার সুযোগ দেন। তিনি আদেশ জারি করেন যাতে বলা হয় যে এই খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে। উমর সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় বিভাগ হিসেবে গঠন করেন। হযরত ওমর(রা.) ইসলামের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ৬৩৪ সালে নামারক ও সাকাতিয়ার যুদ্ধ, ৬৩৫ সালে বুয়াইব, দামাস্কাস ও ফাহলের যুদ্ধ, ৬৩৬ সালে ইয়ারমুক, কাদিসিয়া ও মাদাইনের যুদ্ধ, ৬৩৭ সালে জালুলার যুদ্ধ, ৬৩৮ সালে জেরুজালেম ও জাজিরা বিজয়, ৬৩৯ সালে খুজইজিস্থান ও মিসর আক্রমণ, ৬৪১ সালে নিহাওদ্দার যুদ্ধ, ৬৪২ সালে পারস্যের রেই যুদ্ধ, ৬৪৩ সালে আজারবাইজান এবং ৬৪৪ সালে ফারস ও খারান বিজয় লাভ করেন। মুসলিমরা তাকে একজন শ্রেষ্ঠ ফকিহ হিসেবে শ্রদ্ধা করে থাকে। তার শাসনামলে হিজরি বর্ষপঞ্জি প্রণীত হয়।
ইতিহাস-৭০ ▌ হযরত ওমর(রা.)-এর শাসনামলে দুর্ভিক্ষ ও প্লেগ:
৬৩৮ সালে আরবে খরার ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ক্ষুধা ও মহামারীর কারণে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। মদিনায় সঞ্চিত খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর উমর সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইরাকের প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে সাহায্যের জন্য চিঠি লেখেন। গভর্নরদের সময়মত পাঠানো সাহায্য হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সিরিয়ার গভর্নর আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ সর্বপ্রথম আবেদনে সাড়া দেন। মদিনায় সাহায্য পৌঁছানোর ফলে লক্ষাধিক লোক প্রাণে বেঁচে যায়। ৬৩৯ সাল নাগাদ আরবে বৃষ্টিপাত হওয়ায় দুর্ভিক্ষ শেষ হয়। আরবে দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার পর সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের অনেক জেলায় প্লেগ দেখা দেয়। ৬৩৯ সালে আবু উবাইদাসহ সিরিয়ায় প্রায় ২৫,০০০ মুসলিম প্লেগে মৃত্যুবরণ করে। উমর(রা.) বাইতুল মাল নামক রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্থাপন করেন। বাইতুল মাল থেকে মুসলিম ও অমুসলিম অসহায়, বৃদ্ধ, এতিম, বিধবা ও অক্ষমদেরকে সহায়তা প্রদান করা হত।
ইতিহাস-৭১ ▌ হযরত ওমর হত্যাকা-:
৬৪৪ সালে একজন পাসির্য়ান দাস পিরুজ নাহাওয়ান্দি (আবু লুলু বলেও পরিচিত) হযরত ওমরের কাছে তার মনিব মুগিরার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে। তার অভিযোগ ছিল যে তার মনিব মুগিরা তার উপর বেশি কর ধার্য করেছে। ওমর এরপর মুগিরার কাছে এ বিষয়ে জানতে চান। মুগিরার উত্তর সন্তোষজনক হওয়ায় ওমর রায় দেন যে পিরুজের উপর ধার্য করা কর ন্যায্য। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পিরুজ হযরত ওমরকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সে ফজরের নামাজের পূর্বে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে। এখানে নামাজের ইমামতি করার সময় ওমরকে সে আক্রমণ করে। তাকে ছয়বার ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়। হামলার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় আশেপাশের লোকেরা তাকে ঘিরে ফেলে। এসময় সে আরো কয়েকজনকে আঘাত করে যাদের কয়েকজন পরে মারা যায়। এরপর পিরুজ নিজ অস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করে। তিনদিন পর ওমর আঘাতের কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাস-৭২ ▌ হযরত ওসমান(রা.):
৬৪৪ সালে হযরত ওমর(রা.) খুন হলে নবীর জামাতা হযরত ওসমান(রা.)পরবর্তী খলিফা হন। তিনি ৬৪৪ থেকে ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত খিলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর মুহাম্মদ (সা:) তাঁর কন্যা রুকাইয়্যার সাথে তাঁর বিয়ে দেন। হিজরী দ্বিতীয় সনে তাবুক যুদ্ধের পরপর মদিনায় রুকাইয়্যা মারা যায়। এরপর নবী তাঁর দ্বিতীয় কন্যা উম্মু কুলসুমের সাথে তাঁর বিয়ে দেন। এ কারণেই তিনি মুসলিমদের কাছে যুন-নূরাইন বা দুই জ্যোতির অধিকারী হিসেবে খ্যাত। মক্কার সমাজে একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন বলেই তাঁর উপাধি হয়েছিল গনী যার অর্ধ ধনী। উসমানের নেতৃত্বে ৬৪০ এর দশকে আর্মেনিয়া বিজয়, ৬৪৭ সালে সাইপ্রাস বিজয়, ৬৪৮ সালে বাইজেস্টাইন ৬৫০ সালে ফার্স (বর্তমান ইরান) এবং ৬৫১ সালে খোরাসান (বর্তমান আফগানিস্তান) এর কয়েকটি অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছিল। এবং ৬৫৪ সালে উত্তর আফ্রিকা ইসলামের পতাকাতলে আসে।
ইতিহাস-৭৩ ▌হযরত ওসমান(রা.) শাসনামল:
এর আগ পর্যন্ত খিলাফতের অর্থনীতি কেন্দ্রীয়ভাবে তেমন সুসংহত ছিল না। যেমন ট্যাক্স বা খরচের নিখুঁত হিসাব রাখা হত না। ওসমান (রা) এসব রিফর্ম করেন। তার সময় অর্থনীতি শক্তিশালী হয়। প্রাপ্ত খাজনা কয়েকগুণ বাড়ে। অর্থনীতির ব্যাপারে কোন ব্যর্থতা প্রশ্রয় দিতেন না। কিন্তু ২য় খলিফ উমরের সাথে তার এক জায়গায় পার্থক্য ছিল। হযরত ওমর (রা) স্বজনপ্রীতি সহ্য করতেন না। উসমান (রা) এদিক দিয়ে অতটা কঠিন ছিলেন না। অল্প সময়েই তার নিজ বংশ উমাইয়ারা প্রভাবশালী হয়ে উঠে। এতে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। ইসলামি প্রদেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে আত্মীয়দের বসানোর মাধ্যমে অনেককে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা ছিল মূল কারণ। এর মাঝে মিশে যায় আলী (রা)কে খলিফ হিসেবে দেখতে চাওয়া উপদলটি। এরা সবথেকে সক্রিয় হয় মিশরে। ওসমান (রা)-র বসানো মিসরের গভর্নরের কর অত্যচারে মিসর থেকে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ এসেছিল বিদ্রোহী হয়ে।
ইতিহাস-৭৪ ▌হযরত ওসমান(রা.) বিরোদ্ধে বিদ্রোহ:
বিদ্রোহের আশঙকা করে ওসমান(রা.)কে ত্রাঁ চাচাতো ভাই সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া(রা.) পাহারা দেবার জন্য সিরিয়া থেকে শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনী প্রেরনের প্রস্তাব দেন। উসমান(রা.) না করলেন, বললেন সিরিয়ান সেনা দেখলে মানুষ ক্ষেপে যেতে পারে; পরে গৃহযুদ্ধ হয়ে যাবে। দেখা গেলো মিশরের পাশাপাশি ইরাকের কুফা ও বসরা থেকেও বিদ্রোহী এলো মদিনাতে। আলী(রা.) তাদের বুঝিয়ে সুজিয়ে নিজেদের প্রদেশে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। তারা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন মদিনা থেকে পাঠানো এক পত্রবাহককে বিদ্রোহীরা আটক করে। পত্রে গভর্নরকে লেখা ছিল, পৌঁছা মাত্রই বিদ্রোহীদের নেতাদেরকে শাস্তি দিতে। তারা এ চিঠি দেখে ক্ষেপে আবার মদিনা ফেরত আসলো। উসমান(রা.) চিঠির ব্যাপারে কিছু জানতেন না বলে জানালেও এবার আর বিদ্রোহীদের শান্ত করার কোনো উপায় থাকলো না। ফলে ওসমান(রা.) গৃহবন্দী হয়ে পড়লেন।
ইতিহাস-৭৫ ▌কোরআন সংকলনের ইতিহাস:
যখন কোনো আয়াত রসুল (সা.)-এর প্রতি নাজিল হতো তিনি অনতিবিলম্বে তা মুখস্থ করে নিতেন এবং সাহাবাদের শোনাতেন এবং তাঁদের মুখস্থ করতে ও লিখে রাখতে নির্দেশ দিতেন এবং তিনি সাহাবাদের পড়িয়ে শোনাতে বলতেন শুদ্ধতা যাচাই করতেন অর্থাৎ সাহাবিদের স্মরণ শক্তি পরীক্ষা করে দেখতেন। কোরআন সংরক্ষিত হয়েছিল বিভিন্ন আঙ্গিকে-গাছের বাকলে, চমড়ায়, উটের হাড়ে, সমতল পাথরে, গাছের পাতায়। প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে ইয়ামামার যুদ্ধে বহু কোরআনে হাফেজ শহীদ হন। তিনি সাহাবিগণের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে যয়িদ-বিন-সাবিদ (রা.)-কে কোরআন সংকলনের দায়িত্ব প্রদান করেন। সব সাহাবিকে একসঙ্গে করে যয়িদ-বিন-সাবিদ (রা.) কোরআনের সব আয়াতকে একসঙ্গে করেন। আবু বকর (রা.)-এর মৃত্যুর পর তা ওমর (রা.) তাঁর মেয়ে হাফসা (রা.) এর কাছে সংরক্ষণ করেন।
ইতিহাস-৭৬ ▌ মাসহাফে সিদ্দিকী:
ঐতিহাসিকেরা হাফসা (রাঃ)র কাছে সংরক্ষিত পবিত্র কোরআনের সঙ্কলনকে “মাসহাফে সিদ্দিকী” বলে অভিহিত করেন। তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.)-এর সময় ইসলাম যখন প্রসার লাভ করছিল, তখন আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক ভাষায় কুরআন পাঠ অব্যাহত থাকলে তার মুল অর্থ বিকৃত হতে পারে ভেবে ওসমান (রা.) বিভিন্ন দেশের কোরআন হাফেজ এবং সংকলকদের ডেকে পাঠান ও হজরত হাফসা (রা.)-এর কাছ থেকে সংরক্ষিত কোরআন কপি রাখতে বলেন ও তা সম্প্রচার করতে বলেন। তিনি সংরক্ষিত বিভিন্ন কপি খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দেন। মূল কুরআন আরবের কুরাইশদের ভাষায় নাযিল করা হয়েছিল, ওসমান(রা.) বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত কুরআনের বিভিন্ন সংস্করণগুলো সংগ্রহ করে জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। কোরআনের আদি সংকলন হুবহু তুরস্কের ফাত্তাকি জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে ।
ইতিহাস-৭৭ ▌হযরত ওসমান হত্যাকা-:
মদিনা থেকে অনেক স্থানীয় মানুষ মক্কায় হজ্ব করতে গিয়েছে আগেই। ওসমান(রা.) ঘরের চারপাশে অবস্থানরত বিদ্রোহীরা বুঝতে পারলো, হজ্ব শেষ হয়ে গেলেই পুরো সাম্রাজ্য থেকে আসা হাজীরা ওসমান(রা.) এর পক্ষে মদিনায় ছুটে আসবে, এর আগেই যা করবার তা করতে হবে। বিদ্রোহীদের আক্রমণের আশংকা বেড়ে গেলে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর(রা.) এবং আলী(রা.)-এর দুই পুত্র হাসান(রা.) ও হুসাইন(রা.) গেট বন্ধ করে পাহারা দিতে লাগলেন। ৬৫৬ সালের ১৭ জুন। মিসরীয় বিদ্রোহীরা প্রতিবেশীর বাড়ির দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে ভেতরে নেমে পড়ল। গেটের পাহারা দেয়া সাহাবীরা জানলেনও না কী হলো। তখন ওসমান(রা.) কুরআন শরীফ পড়ছিলেন। বিদ্রোহীরা সজোরে তাঁর মাথায় আঘাত করল। স্ত্রী নাইলা ওসমান(রা.)-কে রক্ষা করতে গিয়ে আঙুলগুলো কেটে মাটিতে পড়ে গেল। টানা তিনদিন ওসমান(রা.) এর লাশ পড়েছিল বাসায়।
ইতিহাস-৭৮ ▌ মুয়াবিয়া(রা.) প্রতিশোধের শপথ:
আলী(রা.), হাসান(রা.), হুসাইন(রা.) ও অন্যরা উসমান(রা.)-এর লাশ রাতের আঁধারে মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে নিয়ে যায়। দেখা গেলো বিদ্রোহীরা টের পেয়ে সেখানে হাজির। নিরুপায় হয়ে তাঁকে দাফন করা হলো পেছনের ইহুদী কবরস্থানে। [পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফারা এই দুই কবরস্থানের প্রাচীর ভেঙে দুই কবরস্থান এক করে ফেলেন, যেন উসমান (রা.) মুসলিম কবরস্থানে শায়িত হতে পারেন।] এদিকে নিহত উসমান(রা.)-এর রক্তমাখা জামা আর স্ত্রী নাইলার কাটা আঙুলগুলো নিয়ে নুমান বিন বশির মদিনা ত্যাগ করেন। তিনি সিরিয়ার গভর্নর হযরত মুয়াবিয়া(রা.)-এর নিকট উপস্থিত করেন ওগুলো। মুয়াবিয়া(রা.) তখন সেগুলো সবাইকে দেখাতে মিম্বরে স্থাপন করলেন। সে জামা আর আঙুলগুলো দেখে কান্নাকাটি আর প্রতিশোধের আগুন জেগে ওঠে। পুরো এক বছর ধরে ‘স্ত্রীশয্যায় যাবেন না প্রতিশোধ না নিয়ে’- এরকম শপথ করে সেনারা।
ইতিহাস-৭৯ ▌ হযরত আলী ও হয়রত মোয়ারিয়ার দ্বন্ধ:
খলিফা ওসমান খুন হন ৬৫৬ সালে। নবীর কন্যা ফাতিমা(রা.)-র স্বামী হযরত আলী(রা.) পরবর্তী খলিফা হন। খলিফা হবার পর হযরত আলী(রা.)-কে সাহাবীরা এসে অনুরোধ করলেন খুনিদের মৃত্যুদ- দেবার। কিন্তু আলী(রা.) সেটা করতে অস্বীকৃতি জানালেন, বললেন সন্ত্রাসীদের সাঙ্গপাঙ্গ আছে। আপাতত তিনি এটা করতে পারবেন না। অন্যদিকে বিদ্রোহী খারেজি নেতারা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কেই সিরিয়ার গভর্নর করার কথা বললেন মুয়াবিয়াকে সরিয়ে। মুয়াবিয়া(রা.)-এর দূত যখন আলি(রা.)-এর দরবারে এসে সিরিয়ার মানুষের প্রতিশোধ ইচ্চার কথা জানালেন,তখন বিদ্রোহীরা মুয়াবিয়ার দূতকে খুন করে ফেলতে চাইলো। অনেক কষ্ট করে সেই দূত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আলী(রা.) তখন সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার চিন্তা করলেন, না করলে মুসলিম বিশ্ব দু’ভাগে ভাগ হয়ে থাকবে। তিনি সেজন্য মিসর আর কুফা থেকে সেনা চাইলেন। হযরত আলীর(রা.) অধীনে মাত্র দুটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৬৫৮ সালে নাহ্রাওনের যুদ্ধ, ৬৫৯ সালে মিসর বিজয়। এ সময় অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ ও দ্বন্দ্বে নিজেদের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়।
ইতিহাস-৮০ ▌বসরা যুদ্ধ, উটের যুদ্ধ বা জঙ্গে জামাল:
আলী(রা.) ২০ হাজার সেনা নিয়ে বসরা আসলেন। ওদিকে আয়েশা(রা.), তালহা(রা.), জুবাইর(রা.) প্রমুখ সকলেই আলী (রা.)-কে বোঝাতে রওনা দিয়ে দেন। তবে যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা তখনো ছিল না, কিন্তু তাদের অবস্থান যে আলী(রা.)-এর বিরুদ্ধে সেটা পরিষ্কার ছিল। আইশা(রা.) রাজি হলেন আলোচনা করে পরিস্থিতি মেটাতে। কিন্তু এতে আলীর পক্ষের বিদ্রোহীরা রেগে যায়, কারণ সালিশ হলে কিংবা শান্তিপূর্ণ উপায়ে ঘটনা মিটে গেলে তাদের ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে। শান্তি প্রস্তাবের রাতে এই খারেজি বিদ্রোহীরা লুকিয়ে আলী(রা.)-এর শিবির থেকে এসে আইশা(রা.)-এর শিবিরের তাঁবুগুলো পুড়িয়ে দেন। সবাই বুঝে নিলো যে, আলী(রা.) বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। তারাও পাল্টা আক্রমণ চালালেন। আলী(রা.) চেষ্টা করেও তাঁর নিজের মানুষদের থামাতে পারলেন না প্রতিপক্ষের রক্ত ঝরাতে। এভাবে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো।
ইতিহাস-৮১ ▌'উটের যুদ্ধ বা বসরা যুদ্ধের পরিণতি:
তালহা(রা.) ও জুবাইর(রা.) দুজনেই বসরা যুদ্ধে মারা গেলে হযরত আয়েশা(রা.) উটের পিঠের ভেতর হাওদা থেকে যুদ্ধ চালাতে থাকেন। তাঁর উটের হাল ধরে ছিলেন অনেক সাহাবী। একে একে সবার হাত কেটে ফেলতে থাকে প্রতিপক্ষ আলীর(রা.)-র সেনারা; প্রায় ৭০ জনের এ অবস্থা হয় আইশা(রা.)-এর উটের হাল ধরতে গিয়ে। এরপর সকল তীরন্দাজ’ উটের উপরের হাওদা লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারতে থাকেন, কারণ হাওদার পতন হলেই যুদ্ধ শেষ হবে। এত তীর সেখানে গিয়ে লাগলো যে মনে হচ্ছিল উটের পিঠে সজারু। শেষ নাগাদ আলী(রা.)-এর সেনারা উটের কাছে এগুতে লাগলেন, কিন্তু লাশের স্তূপের কারণে পারছিলেন না। উট উপুড় হয়ে পড়ে গেলে আয়েশা(রা.)-এর ভাই মুহাম্মাদ বিন আবু বকর (আলীর প্রধান সৈনিক) আলী(রা.)-এর পক্ষ থেকে গিয়ে তাঁকে হাওদা থেকে বের করে আনলেন। এই মর্মান্তিক যুদ্ধটা হয়েছিল ৬৫৬ সালের ৭ নভেম্বর।
ইতিহাস-৮২ ▌খারেজী যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো:
‘সিফফীন’ যুদ্ধকালে সমস্যার সমাধানের লক্ষে দু’পক্ষ থেকে দু’জন বিচারক নির্ধারণ করা হয় এই মর্মে যে, তারা দু’জনে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য যে সিদ্ধান্ত দিবেন তা উভয় পক্ষ মেনে নিবে। পলে এরপর আলী (রা.)-কুফায় ফিরে যায়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তকে অমান্য করে তখনই আলী (রা.)-এর দল থেকে কিছু লোক বের হয়ে ‘হারুরা’ নামক প্রান্তরে এসে অবস্থান করে। তাদের সংখ্যা মতান্তরে ৬, ৮, ১২ হাজার হবে। আলী (রা.) তাঁর সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.)-কে তাদের নিকট পাঠান। তিনি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ২ অথবা ৪ হাজার লোক ফিরে আনেন। যারা ফিরে আসেনি তারা সালিশ সমর্থনকারীদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়াতে থাকেন। এরপর কয়েক দফা আলোচনা করে ব্যর্থ হয়ে ৬৫৮ সালে আলী(রা.)র সেনাবাহিনী ও খারিজিদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এই নাহরাওয়ানের যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া খারেজীরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে আলী (রা.)-কে হত্যা করতে।
ইতিহাস-৮৩ ▌সিফফিনের যুদ্ধ:
আলী(রা.) মুয়াবিয়া(রা.)-কে বাইয়াত (আনুগত্য) নেবার আহ্বান জানালেন। কিন্তু মুয়াবিয়া(রা.) দূত মারফত জানালেন, তিনি বাইয়াত নেবেন না। তিনি আত্মীয় ওসমান(রা.) এর হত্যার বিচার চান। আলী তখন তাঁর বাহিনীকে উত্তর দিকে নিয়ে গেলেন এবং আলী ও মুয়াবিয়া(রা.)-এর বাহিনী মিলিত হলো সিফফিন নামক জায়গায়। মাসের পর মাস ধরে চিঠি চালাচালি চলল দু’পক্ষের মাঝে। শুরু হলো আসল যুদ্ধ ৬৫৭ সালে। যুদ্ধের সপ্তম দিন ফজরের পর আলী(রা.) স্বয়ং যুদ্ধে নামলেন এবং তাঁর হাতে মারা গেলো পাঁচশ জন। সিরিয়া বাহিনী হেরে যাচ্ছে দেখে মুয়াবিয়া(রা.) এর পক্ষের সাহাবী আমর ইবনুল আস(রা.)-এর বুদ্ধিতে সিরিয়ার বাহিনী তাদের অস্ত্রের সাথে কুরআনের কপি তুলে ধরে কুরআনের দিকে আহবান করল। আলীর সেনারা কুরআনের আহ্বান দেখে থেমে গেলেন। ফলে দু’পক্ষের একজন করে বিচারক নিযুক্ত করেন। কিন্তু প্রকৃত কোনো সমাধানে মেলেনি।
ইতিহাস-৮৪ ▌হযরত আলীকে যেভাবে হত্যা করা হয়:
খারেজীরা ইসলামি সাম্রাজ্য জুড়ে তা-ব শুরু করে দেয়। এদের দমন করতে ৬৫৯ সালে নাহরাওয়ানে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আলী(রা.) খারেজীদের পরাজিত করেন। কিন্তু বেঁচে যাওয়া খারেজীরা প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকে। তারা যথাক্রমে আলী(রা.), মুয়াবিয়া (রা.) ও আমর(রা.)-কে হত্যার অঙ্গিকার করে। আলী(রা.) থাকতেন কুফাতে। সেখানে পৌঁছাল ইবনে মুলজিম। কুফাতে কিছু খারেজীও বসবাস করত। তাদের সাথে বৈঠক হয়। ১৭ রমজান শুক্রবার। লোকদের জাগাতে আলী (রা.) “নামাজ নামাজ” বলে আহ্বান করতে করতে মসজিদে যেতেন। মসজিদে ঢুকবার সময় ইবনে আবু মুলজিম আলী(রা.)-এর মাথার উপর আঘাত করে। আলী(রা.) চিৎকার করার পর লোকজন তাদের ধরে ফেলে। একজন সহযোগী পালিয়ে যায়, একজনকে হত্যা করা হয়। আলী (রা.)-কে তাঁর ঘরে নিয়ে দুই ছেলে তাঁকে গোসল দেন, হাসান(রা.) জানাজাতে ইমামতি করেন।
:: উমাইয়া সম্রাজ্য ::
ইতিহাস-৮৫ ▌উমাইয়া কথন:
কুরাইশদের দুইটা ভিন্ন গোত্র ছিল উমাইয়া আর হাশিম। উমাইয়া ও হাশিমিদের মধ্যে মুহাম্মদ (সা) এর আসার পূর্ব থেকেই দ্বন্দ্ব চলছিল। বদরের যুদ্ধের পর তা আরো বিরূপ অবস্থায় পড়ে। এ যুদ্ধে উমাইয়া গোত্রের তিনজন শীর্ষ নেতা হাশিমি গোত্রের হাতে নিহত হয়। এ ঘটনার ফলে উমাইয়ার নাতি আবু সুফিয়ানের ইসলামের প্রতি বিরোধিতা বৃদ্ধি পায়। রসল(স.)-এর মক্কা বিজয়ের পর আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী হিন্দ ইসলাম গ্রহণ করেন। এসময় তাদের পুত্র ও পরবর্তী খলিফা মুয়াবিয়াও ইসলাম গ্রহণ করেন। ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে প্রথম মুয়াবিয়া সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। ইতিমধ্যে মুয়াবিয়া (রা.) বিশাল এক নৌবাহিনী গড়ে তোলেন এবং সেই বাহিনীতে মুসলিম ছাড়াও মিসরীয় ও সিরীয় খ্রিস্টানরা যোগদান করেন। এই নৌবাহিনী ৬৫৫ সালে দুর্দান্ত রোমান বাইজান্টিন নৌবাহিনীকে ভূমধ্যসাগরে পরাস্ত করে।
ইতিহাস-৮৬ ▌উমাইয়া খিলাফত (৬৬১-৭৫০ খ্রি.):
খেলাফায়ে রাশেদিনের পতনের পর হযরত মুয়াবিয়া (রা.) ৬৬১ খ্রিস্টব্দে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে যে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন তা ‘উমাইয়া খিলাফত’ নামে পরিচিত। এই বংশটি ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করে। এই বংশে মোট ১৪ জন খলীফা ছিলেন। উমাইয়া বংশ কুরাইশ গোত্রের একটি শাখা। তাঁর পিতা ছিলেন পবিত্র কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণকারীদের একজন আবু সুফিয়ান। তাঁর মাতা ছিলেন আবু জেহেলের কন্যা হিন্দা। ৬৩০ খ্রি:) রাসূল (সা.) কর্তৃক মক্কা বিজয়ের পর মুয়াবিয়া (রা.) ও তাঁর পিতা-মাতা ইসলাম কবুল করেন। এই সময়ে তার বয়স ছিল ২৪ বছর। ইসলাম কবুলের পর তিনি রাসূল (সা.) এর একজন বিশিষ্ট সাহাবায় পরিণত হন। রাসূল (সা.) মুয়াবিয়া (রা.)কে তাঁর ব্যক্তিগত ওয়াহী লেখক হিসেবে নিযুক্ত করেন। হযরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে হযরত মুয়াবিয়া (রা.) সিরিয়া অভিযানে তার যোগ্যতার পরিচয় দেন। খলীফা উমর (রা.) তাকে ৬৩৮ খ্রি: সিরিয়ার শাসনকর্তারূপে নিযুক্ত করেন।
ইতিহাস-৮৭ ▌মুসলিম নৌবাহিনী গঠন :
খলীফা হযরত উসমান (রা.) এর শাসনামলে সিরিয়ার গভর্ণর হযরত মুয়াবিয়া (রা.) এর নেতৃত্বে প্রথম মুসলিম নৌবাহিনী গঠিত হয়। এই নৌবাহিনীর সাহায্যে ভূ-মধ্যসাগরীয় কতিপয় দ্বীপ-সাইপ্রাস, ক্রীট, মেজর্কা, মাইনর্কা ইত্যাদি মুসলিমদের অধীনস্ত হয়েছিল। তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে ভূ-মধ্যসাগরে টিকে থাকার জন্য মুয়াবিয়া ৫০০ রণতরী নিয়ে এক বিশালনৌ-বহর গঠন করেন। এর ফলেই ভূ-মধ্যসাগরে মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬৬৯ খ্রি: এই পোতাশ্রয় হতে মুয়াবিয়া বাইজানটাইন শক্তির রাজধানী কনস্টানিটনোপলে নৌ-অভিযান প্রেরণ করেন। এই অভিযানের নেতৃত্বে দিয়েছিলেন মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ কিন্তু বেশ কিছুদিন ‘কনস্টান্টিনোপল’ অবরোধ রাখার পর মহামারী, খাদ্যাভাব, বিশৃঙ্খলা ও সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে অভিযানটি ব্যর্থ হয়ে যায়।
ইতিহাস-৮৮ ▌ সংস্কার:
খিলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে মুয়াবিয়া আমর ইবনে আল আসকে মিসরের শাসনকর্তারুপে নিয়োগ করেন এবং আল মুগিরাকে মুয়াবিয়া (রা.) কুফার শাসনকর্তা রুপে নিয়োজিত করেন। এই আল মুগিরার পরামর্শেই মুয়াবিয়া (রা.) তদ্বীয় পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। যিয়াদ সম্পর্কে ছিল মুয়াবিয়ার সৎ ভাই। মুয়াবিয়া (রা.) তাকে বস্রার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেন। এভাবে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠার পর মুয়াবিয়া (রা.) সা¤্রাজ্য বিস্তারে মনযোগ দেন। মুয়াবিয়া তার শাসন প্রণালীতে বাইজানটাইনও পারস্য সা¤্রাজ্যের রীতি প্রবর্তন করেন। মুসলিমদের মধ্যে মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম ডাক বিভাগ চালু করেন। সমগ্র রাজ্যে ১২ মাইল অন্তর একটি ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া হযরত উমর (রা.) এর সময়ে প্রবর্তিত প্রশাসনের অন্যান্য শাখা যেমন- দিওয়ানআল-জুনদ (সামরিক বিভাগ), দিওয়ান আল-কাজা (বিচার বিভাগ), দিওয়ান আল-রাসায়িল ইত্যাদি বিভাগ তিনি পুন:প্রবর্তন ও বহাল রাখেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যে তিনি অমুসলিমদের নিয়োগ করতেন। একজন খ্রিস্টান ছিলেন তার প্রধান উপদেষ্টা।
ইতিহাস-৮৯ ▌মুয়াবিয়া (রাঃ) শাসনামল:
হজরত ওমর (রা.) খেলাফতকালে মুয়াবিয়াকে দামেস্কের আমির নিযুক্ত করেছিলেন। হজরত ওসমান (রা.) তাঁকে পুরো শামের (সিরিয়ার) আমির নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর শাসনামলে সারা পৃথিবীতে কোনো মুসলমান ভিক্ষুক ছিল না। রাজ্যের অমুসলিম নাগরিকদেরও শান্তিও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম যোগাযোগের জন্য ডাক বিভাগ চালু করেন এবং সরকারি দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের জন্য পৃথক বিভাগ চালু করেন। তিনি মুসলিম বাহিনীকে সুশৃঙ্খল রূপ দেন ও ইসলামের দাওয়াত বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে আফগানিস্তান ও পারস্যের অধিকত অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে সীমান্ত উপজাতিদেরকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। তার দীর্ঘ ২৫ বছর খেলাফতে পর্তুগাল থেকে চীন পর্যন্ত এবং আফ্রিকা থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ৬৫ লাখ বর্গমাইল বিস্তৃত অঞ্চল ইসলামের পতাকাতলে চলে আসে।
ইতিহাস-৯০ ▌ ইমাম হাসান(রা.) ও মুআবিয়া(র)র সন্ধি:
মুয়াবিয়া(রা.) হযরত আলীকে অস্বীকার করার মত ইমাম হাসানকেও খলিফা বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। ইমাম হাসান মুআবিয়ার(রা.) বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে বের হন। কিন্তু মুআবিয়া(রা.) অর্থ-স¤পদ ও পদমর্যাদার প্রলোভন দেখিয়ে ইমাম হাসান(রা.)-এর সৈন্যদের কিনে নেন। এমনকি ইমাম হাসান(রা.)-এর প্রধান সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ ইবনে আব্বাসও রাতের অন্ধকারে নিজের দ্বীন বিক্রি করে মুআবিয়ার(রা.) দলে যোগ দেন। ফলে ইমাম হাসান(রা.) মুআবিয়ার সাথে সন্ধি করেন। সন্ধির অন্যতম শর্ত ছিল মুআবিয়ার মৃত্যুর পর খেলাফত ইমাম হাসান (রা.)-এর কাছে আসবে। আর তিনি জীবিত না থাকলে তা ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কাছে আসবে। উমাইয়াদের প্ররোচনায় স্বীয় স্ত্রী কর্তৃক বিষবিদ্ধ হয়ে ৪৫ বছরে হাসান (রা.) মৃত্যুবরণ করেন। হাসান (রা.)-এর মৃত্যুর পর মুআবিয়া(রা.) সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে তাঁর পুত্র ইয়াযীদকে খলিফা মনোনীত করেন। মৃত্যুকালে ইমাম হাসান(রা.) ১৫পুত্র ও ৮ কন্য রেখে যান।
ইতিহাস-৯১ ▌ ইমাম হোসাইন(রা.):
ইয়াযীদ ক্ষমতায় বসার পর ইমাম হুসাইন(রা.) ইয়াযীদের বিরোদ্ধে দ্বীনি আন্দোলন শুরু করেন। তাঁকে কুফায় গিয়ে নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে কুফা থেকে জনগণ চিঠি প্রেরণ করেন। অন্যদিকে হজ্বের সময় তাঁকে গুপ্তঘাতক দ্বারা হত্যা করা হবে জানতে পেরে তিনি হজ্ব অসমাপ্ত রেখেই কুফার দিকে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে তিনি সংবাদ পেলেন যে, ইয়াযীদ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ তাঁর পক্ষের লোকদের হত্যা করে চলেছে। এতে তিনি বিব্রত হলেন। এই দুর্দশার মুখে বেদুইনরাও ভয়ে হুসাইন(রা.)র দল ত্যাগ করল। অগত্যা তিনি ক্ষুদ্র দলসহ ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরে তাবু পেলেন। কিন্তু কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ হুসাইন(রা.)-এর নির্দেশে কয়েক হাজার অশ্বারোহীসহ ওমর-বিন-সা’দ ফোরাত নদীর তীর অবরোধ করেন। পানির অভাবে নারী ও শিশুদের হাহাকার এবং ভীতির মধ্যে ভোরে দুই অসম সেনাদলের যুদ্ধ শুরু হলো। শত্রুসৈন্যের তাঁর মস্তক ছেদন করে। মৃত্যুকালে ইমাম হোসাইন(রা.)৬পুত্র ও ৩ কন্য রেখে যান।
ইতিহাস-৯২ ▌ কারবালা যুদ্ধের ফলাফল:
কারবালার নির্মম হত্যাকা- হযরত আলী (রা.) ও ইমাম হুসাইনের সমর্থকরা ইসলামের মূল ধারা হতে পৃথক মতবাদ শিয়া সম্প্রদায় সৃষ্টি করে। কারবালার ঘটনা মক্কা ও মদীনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মক্কা ও মদীনাবাসী এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিশোধ দাবি করে। এই পেক্ষাপটে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ির (রা.) খিলাফত দাবি করে বসেন। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ির (রা.) কে বন্দী করার জন্য ও মদীনাবাসীকে প্রতিরোধ করার জন্য ইয়াযিদ মুসলিম-বিন উকবার নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। মদীনার নিকট হাররা নামক স্থানে ব্যাপক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মদীনার বহু সাহাবী এতে শাহাদাৎ বরণ করেন। দামেস্কের বাহিনী মদীনায় ৩ দিন যাবৎ লু›ঠন করে অতঃপর মক্কা অবরোধ করে। অবরোধকালে তারা পবিত্র কাবাঘরে অগ্নি সংযোগ করে। ইতোমধ্যে ৬৮৩ খ্রি: ২৭ নভেম্বর ইয়াযীদের মৃত্যু হলে সিরীয় বাহিনী দামেস্কে প্রত্যাবর্তন করে।
ইতিহাস-৯৩ ▌ শিয়া যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো:
রসুল(স.)এর ওফাতের পর কিছু লোক খেলাফতের উত্তরাধিকার নির্ধারণে হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর বংশধারাকে অনুসরণ করে। নবীর জামাতা হযরত আলীকে (রা.) তারা প্রথম খলিফার দাবিদার মনে করে। হযরত আলী (রা.) ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে শাহাদত বরণ করলে তাঁর পুত্র হযরত হাসান (রা.) খলিফা হন, কিন্তু তিনি মুয়াবিয়ার (রা.) নিকট খেলাফত ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মুয়াবিয়ার (রা.) মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াজিদ খলিফা হন। হযরত হোসেন (রা.) ইয়াজিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে কারবালা প্রান্তরে শহীদ হন। হযরত আলী (রা.) ও তাঁর পুত্রদের করুণ পরিণতি শিয়া সম্প্রদায়ের উত্থানে অনুপ্রেরণা জোগায়। শিয়া মতবাদ প্রথমে ছিল মূলত একটি রাজনৈতিক ব্যাপার। পরে ধীরে ধীরে তা একটি ধর্মমতের রূপ নেয়। সাফাভি শাসকরা শিয়া মতবাদকে পারস্যের রাষ্ট্রধর্ম করেন।
ইতিহাস-৯৪ ▌ইয়াযীদের উত্তান:
মুয়াবিয়া (রা.) উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করে তার পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে ইসলামের ইতিহাসে রাজতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটান। তার এই দৃষ্টান্ত পরবর্তী উমাইয়া খলীফা ও আব্বাসীয় খলীফাগণ অনুসরণ করেন। বাল্যকালে মুয়াবিয়া (রা.) ইয়াযীদের শিক্ষার জন্য তাকে গ্রামাঞ্চলে (আল-বাদীয়া) পাঠিয়ে দেন। কারণ গ্রামীণ আরবী ভাষা ছিল সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও পরিশীলিত। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.)ও ইয়াযীদের বিরোধিতা করেন। তিনিও বায়াৎ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি ইমাম হুসাইনকে ইয়াযীদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে প্ররোচিত করেন। কুফার পরিস্থিতি যাচাইয়ের জন্য ইমাম হুসাইন (রা.) তাঁর চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম কুফাবাসীর সমর্থন দেখে ইমাম হুসাইন (রা.) কে মদীনা ত্যাগ করার পত্র দেন। তার পত্র পেয়ে ইমাম হুসাইন (রা.) সপরিবারে ও অতি অল্প কয়েকজন অনুসারীসহ কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ইতোমধ্যে উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ কর্তৃক মুসলিম নিহত হন এবং কুফাবাসী ইমাম হুসাইন (রা.) এর পক্ষ ত্যাগ করে ইয়াযীদ কে সমর্থন জানায়।
ইতিহাস-৯৫ ▌ইয়াযীদ-এর শাসন:
ব্যক্তিগত জীবন ইয়াযিদ বিলাস-ব্যাসনে নিমগ্ন থাকত। তার চরিত্রে দাম্ভিকতা বিদ্যমান ছিল। তখন মদিনার পর ইসলামের আরেক পবিত্র শহর মক্কা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। উমাইয়া সেনারা মদিনার লোকদের পরাজিত করে শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। কিন্তু মক্কা মাসব্যাপী অবরোধের মুখে পড়ে। এসময় কাবা আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ইয়াযীদের আকস্মিক মৃত্যুর খবর পৌছার পর অবরোধ সমাপ্ত হয়। ৬৯২ সালে উমাইয়ারা আরেকটি সেনাদল প্রেরণ করে এবং এসময় মক্কা অবরোধ ও জয় করা হয়। তার শাসনকাল ৬৮০ থেকে ৬৮৩ সাল। জার্মান ঐতিহাসিক ভনক্রোমার বলেন যে,ইয়াযীদ তিনটি দুষ্কর্ম করে কুখ্যাত ছিল। তার তিন বছরের শাসনকালে তিনটি ঘটনা হয়। ১.প্রথম বছরে কারবালার যুদ্ধে ঈমান হোসেনকে হত্যা করে। ২.দ্বিতীয় বছরে পবিত্র মদিনা শহর লুন্ঠন ও অপবিত্র করে। ৩.তৃতীয় বছরে মক্কা নগরীর হেরেম শরীফে অগ্নি সংযোগ করে।
ইতিহাস-৯৬ ▌ দ্বিতীয় মুয়াবিয়া:
ইয়াজিদ মধ্যপান করতো। মাতাল অবস্থায় গোসলখান পড়ে গিয়ে তার মুত্যু হয়। কারো কারো মতে ঘোড়া থেকে পড়ে মৃত্যু হয় ইয়াজিদের। ইয়াজিদের মৃত্যুর পর ছেলে দ্বিতীয় মুয়াবিয়া ক্ষমতায় আসে ২১ বছর বয়সে। তিনি ছিলেন তৃতীয় উমাইয়া খলিফা। চার মাসের মধ্যেই মারা যান তিনি। শেষ হয় উমাইয়াদের শাসনামল। তার ক্ষমতারোহণের সময় আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের খিলাফত দাবি ও হেজাজসহ অন্যান্য এলাকার নিয়ন্ত্রণের কারণে সাম্রাজ্যে বিশৃংখলা বিরাজ করছিল। কারবালা হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী অন্য দুই ঘৃণ্য ব্যক্তি হচ্ছেন শিমার বিন জুল জওশান ও ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ। ইয়াজিদ মারা যাবার দুই বছর পর ৬৮৫ এর অক্টোবরে কুফার ক্ষমতায় আসে মুখতার আল তাকাফি। ক্ষমতায় এসে কারবালা হত্যাকান্ডে জড়িত সকলের শাস্তি প্রদান শুরু করেন। মুখতারের নির্দেশে শিরচ্ছেদ করা হয় শিমার ইবনে জুলজাওশানের।
ইতিহাস-৯৭ ▌মারওয়ান ইবনুল হাকাম:
৬৮৪ সালে খলিফা দ্বিতীয় মুয়াবিয়া ক্ষমতা হারানোর পর মারওয়ান খলিফা হন। তার ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে আবু সুফিয়ানের বংশধরদের কাছ থেকে হাকামের বংশধরদের কাছে ক্ষমতা চলে আসে। তারা উভয়েই উমাইয়ার নাতি ছিলেন। হাকাম ছিলেন হযরত ওসমান ইবনে আফফানের চাচা। তার সংক্ষিপ্তকালের শাসনের সময় সিরিয়ান আরব ও একই সাথে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের সাথে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের হেজাজ, ইরাক, মিশর ও সিরিয়ার অংশবিশেষে শাসন করছিলেন। মারজ রাহিতের যুদ্ধে মারওয়ান সিরিয়ার দখল ধরে রাখতে সক্ষম হন। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের কাছ থেকে মিশর ও সিরিয়া পুনরায় দখল করে নেন। সংক্ষিপ্তকাল শাসনের পর মারওয়ান ৬৮৫ সালে মৃত্যুবরণ করলে তার পুত্র আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান তার উত্তরসুরি হন। ৬৮৪ সালে মধ্য আরব, ইরাক ও ইরানে তারপর অন্যান্য খারিজিদের উত্থান হয়।
ইতিহাস-৯৮ ▌আব্দুল মালিকের সিংহাসন লাভ:
ইয়াযিদের মৃত্যুর পর তার পুত্র ২য় মুয়াবিয়া দামেস্কের খিলাফত গ্রহণ করেন কিন্তু ৩ মাস শাসনের পরই মৃত্যুবরণ করেন। তখন খিলাফতের দায়িত্ব বর্তায় তার ভাই খালিদ এর উপর। কিন্ত খালিদ বয়সে নাবালক ছিলেন। তাই তার স্থলে অভিজ্ঞ ও বয়োজৈষ্ঠ্য মারওয়ান ইবনে হাকাম খিলাফত গ্রহণ করেন। তিনি এই শর্তে সিংহাসন অধিকার করেন যে, খালিদ প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় পৌঁছলে খালিদের পক্ষে সিংহাসন ছেড়ে দিতে হবে। সুচতুর মারওয়ান সিংহাসনে বসেই খালিদের বিধবা মাতাকে বিবাহ করেন এবং তিনি তাঁর চুক্তি ভঙ্গ করে তাঁর নিজ পুত্র আব্দুল মালিককে পরবর্তী খলীফা হিসেবে মনোনীত করেন। এতে খালিদের মাতা ক্রোধান্বিত হয়ে মারওয়ানকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেন। অতঃপর ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল মালিক দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ করেন। আব্দুল মালিক ছিলেন মুয়াবিয়ার চাচাতো ভাই।
ইতিহাস-৯৯ ▌আব্দুল মালিকের খিলাফতকাল (৬৮৫-৭০৫):
মুখতার ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী যিনি ইমাম হুসাইনের হত্যার প্রতিশোধকল্পে অনুশোচনাকারীদের দলে যোগ দেন। তিনি ইমাম হুসাইনের হত্যাকারী শীমারসহ ২৮৪ জনকে হত্যা করেন। এই অবস্থায় আব্দুল মালিক উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে মুখতারের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। টাইগ্রীস নদীর তীরে জাবের যুদ্ধে উবায়দুল্লাহ নিহত হন। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের প্রেরিত সেনাপতি মুহাল্লাব কর্তৃক মুখতার নিহত হন। অন্যদিকে আমর ইবনে সাঈদ ছিলেন মারওয়ানের চাচাতো ভাই যিনি ২য় মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর দামেস্কের খিলাফত-এর দাবিদার ছিলেন। আব্দুল মালিক ভবিষ্যতে সিংহাসন নিষ্কন্টক রাখার জন্য আমরকে রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানান ও হত্যা করেন। মুসাব ছিলেন ইরাকের শাসনকর্তা যিনি আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের অধীনস্থ ছিলেন। আব্দুল মালিক মুসাবের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করলে দুই পুত্রসহ মুসহাব নিহত হন। এরপর হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে মক্কা-মদিনার (হেজায) খলীফা আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের-এর বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠান। আরাফাতের যুদ্ধে খলীফা আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের পরাজিত ও নিহত হন। তাঁর এর মৃত্যুর পর খুলাফায়ে রাশিদীনের যুগের পুরোপুরি পরিসমাপ্তি ঘটে এবং আব্দুল মালিকের একচ্ছত্র মুসলিম সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইতিহাস-১০০ ▌আব্দুল মালিকের সংস্কারসমূহ:
তার শাসনামলে ইসলাম তার নিজ ভূখ-ে ছাড়িযে আরো বিস্তৃতি লাভ করে। পারস্য, আর্মেনীয়া, খুরাসান,সিরিয়া ও মিসরে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়। তিনি রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় টাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। রোমান, পারস্য, হিমারীয় ও বিভিন্ন প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রার পরিবর্তে তিনি আরবী অক্ষর যুক্ত দিনার (স্বর্ণমুদ্রা), দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা), ও ফাল্স্(তা¤্রমুদ্রা) প্রচলন করেন। এতে করে ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য একক মাধ্যমের সৃষ্টি হয়। তিনি জেরুজালেমে উড়সব ড়ভ ঃযব জড়পশ এর পাশে ‘মসজিদ-উল-আকসা’ নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি দজলা নদীর তীরে ওয়াসিত নামক একটি শহর নির্মাণ করেন।