‘বাবু সংস্কৃতির যুগে বঙ্গনারীর রূপসজ্জা’

রানা

ভারতে ‘বহিরাগত’ কম আসেননি। শাসক হিসেবে এসেছেন প্রবল পরাক্রমী দুটি ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ - ‘মুসলমান’ ও ‘খ্রীস্টান’। আমাদের কাছে ‘পাঠান-মুঘল-নবাব-বাদশাহ’ সকলেই

‘মুসলমান’ আর ‘পর্তুগীজ’, ‘ফরাসী’, ‘ডাচ’ প্রভৃতি এখানে এসে যতই ‘কলোনী’ তৈরি করুন, তাঁদের মধ্যে ‘ইংরেজরা’ ছিলেন প্রধান এবং তাঁরা সকলেই আমাদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘সাহেব’

হিসেবে। পোশাকের ক্ষেত্রেও প্রধান প্রভাব পড়েছিল তাঁদেরই। বিশেষ করে পুরুষেরা রাজার পোশাককে নিজেদের পোশাকরূপে গ্রহণ করেছিলেন প্রাণের তাগিদে, রাজদরবারে, কর্মক্ষেত্রে

 

126

 

সর্বত্র তাঁদের ‘রাজপোশাক’ পরতে হত। তাই হিন্দুদের সাবেকী সাজ ছেড়ে ‘চোগা চাপকান-পাগড়ি’ পরতেও যেমন তাঁদের দেরি হয়নি, আবার ‘কোট-প্যান্ট-শার্ট-টাই-টুপি’ পরে ‘সাহেব’

সাজতেও তাঁরাই ছিলেন অগ্রণী। (রানা চক্রবর্তী) কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ভারতীয় নারীদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ‘চীন-জাপান-মিশর-তুরস্ক’ প্রভৃতি দেশের মেয়েরা যখন

ক্রমশই নিজেদের ‘সাবেকী সাজ’ ত্যাগ করে ‘পশ্চিমী সাজ পোশাককে’ একান্ত আপন করে নিয়েছিলেন, ভারতীয় নারীরা তখনও নিজেদের বৈশিষ্ট্য আঁকড়ে থেকেছেন। পরিবর্তন আসেনি কি?

তা নয়, এসেছে৷ প্রবলভাবেই এসেছে, কিন্তু সেটার রূপ আলাদা। ‘ইংরেজ’, ‘ফরাসী’, ‘ডাচ’ ও ‘পর্তুগীজ’ মেয়েরা সংখ্যায় কম হলেও এদেশে এসেছিলেন, সঙ্গে এনেছিলেন তাঁদের দেশের

সাজসজ্জা, তাঁদের নিজস্ব রুচি। তারপর ভারতীয় মেয়েদের দেখে কেউ মুগ্ধ হয়েছিলেন, কেউ আবার নাক সিঁটকেছিলেন ঘৃণায়৷ কিন্তু হারেমের নারীদের মতো ভারতীয় রুচিকে তাঁরা আত্মসাৎ

করতে পারেননি। কারণ ভারতীয় নারীদের সংস্পর্শে আসাও সম্ভব হয়নি তাঁদের পক্ষে। রাজপরিবার থেকে অনেক মেয়ে আসতেন ‘হারেমে’। ‘হারেম’ থেকে কখনও হয়ত ‘বেগমরা’ বেড়াতে

যেতেন অন্তঃপুরের অঙ্গনাদের কাছে। ‘ইউরোপীয় নারীদের’ সঙ্গে ভারতীয়দের সেভাবে মেলামেশা কখনও সম্ভব হয়নি, এমনকি দেশীয় মহারাজারা যখন ইউরোপে গিয়েই যে কোন দেশের এক

‘মেমসাহেব’কে রানী করে ফিরে আসতেন তাঁরাও ভারতের অন্তঃপুরে ভারতীয় রানীদের মতো জীবনযাপন করতেন না। স্বদেশের মতো করেই সাজাতেন শ্বশুরবাড়িটিকে, না হোক নিজের মহল বা

ঘরটিকে। মেলামেশা করতেন স্বজাতীয় পুরুষ ও নারীদের সঙ্গে। ভারতীয় নারীরাও সে সময়ে ছিলেন পুরোপুরি ‘পর্দানশিন’, বিদেশিনীদের ভাষাও ছিল তাঁদের কাছে অপরিচিত, পুরুষদের সঙ্গে

অবাধে মেলামেশা করেন বলেও বিদেশিনীদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলাই তাঁরা সঙ্গত বলে মনে করতেন। সেইজন্যে সাধারণতঃ সাহেব-মেমরা ভারতে এসে যাঁদের দেখতেন তাঁরা সবাই হয় ‘বাঈজী’

বা ‘নর্তকী’, ‘গায়িকা’ ও ‘গণিকা’, নয় তো ‘পরিচারিকা’ বা ‘শ্রমিক শ্রেণীর নারী’। খ্রীস্টিয় অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ভারতে এসেছিলেন ‘এলিজা ফে’। কিন্তু প্রথমদিকে ‘ভারতীয়

সম্ভ্রান্ত নারীদের’ সঙ্গে মেলামেশা তো দূরে থাকুক, তাঁদের তিনি চোখের দেখা দেখতেও পাননি। অবশেষে একদিন তাঁর সেই সৌভাগ্য ঘটেছিল। (রানা চক্রবর্তী) ১৭৮১ সালের ৫ই

সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘একবার আমি দৈবাৎ দুটি অতীব সুন্দরী মহিলাকে দেখে ফেলেছিলাম। কিন্তু নানারকমের বেশভূষায় ও গহনাগাটিতে তাঁরা এমন সুসজ্জিত যে

সত্যিই আসলে তাঁরা কতখানি সুন্দর তা বলা মুশকিল। যাবতীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাজগোজ করতে তাঁদের সমস্ত সময়টুকু কেটে যায়। মাথার চুল বাঁধতে, চোখের ভ্রূ-জোড়া ও পাতা কাজল-

কালো করতে, দাঁত-হাত-নখ সুদৃশ্য করতে প্রচুর সময় ও অবকাশের দরকার হয়। হিন্দু রমণীদের প্রসাধন-নৈপুণ্য দেখলে অবাক হতে হয়। সাজগোজের কলাকৌশল চর্চা করতে এত বেশি

সময় তাঁরা অতিবাহিত করেন যে মনে হয় যেন এছাড়া আর কোন কাজ নেই তাঁদের। কিন্তু তার জন্য তাঁদের বোধহয় দোষ দেওয়া যায় না, যেহেতু রূপচর্চা তাঁদের করতেই হয়, প্রথমতঃ,

স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য, দ্বিতীয়তঃ, সপত্নীদের চিত্তাকর্ষণের প্রতিযোগিতায় পরাজিত করার জন্য।’’ এর পঁয়তাল্লিশ বছর পরের কথা। ‘ফ্যানি পার্কস’ এসেছিলেন ভারতে। চার বছর

ধরে তিনি এদেশে ছিলেন কিন্তু ‘পরিচারিকা’ আর ‘বাঈজী’ ছাড়া কোন ভারতীয় নারীর মুখ তিনি দেখতে পাননি। অবশেষে তিনিও একটা সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৮২৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি

লিখেছিলেন একটি ‘ধনী সম্ভ্রান্ত পরিবারের অন্দরমহলে’ প্রবেশাধিকার লাভের তাঁর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা। সেখানে তিনি গিয়েছিলেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে, তারপর গৃহস্বামীর

নির্দেশে তিনি ‘অন্দরমহলে’ গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘গৃহ স্বামীর স্ত্রী ও অন্যান্য মহিলা আত্মীয়েরা এসে আমাকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। দু’জন

মহিলা রীতিমতো সুন্দরী দেখতে। তাঁদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে বুঝলাম কেন অন্দরমহলে এই মহিলাদের স্বামীরা ছাড়া অন্য সকলের প্রবেশ নিষেধ। তাঁদের পরনে অতি সূক্ষ্ম বেনারসী

শাড়ি, সোনার জরির পাড় বসানো, দুই পেঁচ দিয়ে গায়ে জড়ানো প্রান্তটি বা আঁচল পিঠে ফেলা। এই বস্ত্রের তলায় অন্য কোন অন্তর্বাস নেই। কাজেই গায়ে দুই পেঁচ জড়ানো থাকলেও তা এত

সূক্ষ্ম যে অঙ্গের শোভা পর্যন্ত বিচ্ছুরিত হয় তার ভেতর দিয়ে। মনে হয় যেন একটা রেশমী ওড়না গায়ের ওপর ফেলা রয়েছে। গলায় ও হাতে সোনা-হীরের অলঙ্কার।’’

আধুনিক যুগে আসার অব্যবহিত পূর্বের সময়টাকে ‘বাবু সংস্কৃতির সময় বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, তাঁদের ঘরের বধূদের কথা আগেই বলা হয়েছে ‘এলিজা ফে’ ও ‘ফ্যানি পার্কসের’ কলমে।

(রানা চক্রবর্তী) তাঁরা যদিও ‘পর্দানশিন’ ছিলেন, তবুও তাঁদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত গয়না ও দামী শাড়িতে মোড়া থাকত৷ ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন’ ‘বিহার অঞ্চলের’ ধনী

মুসলমান ঘরের বধূদের দেখেছিলেন গয়নার ভারে ক্লান্ত জড়পদার্থরূপে৷ একটি গৃহে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন এক ‘দুলহিন বেগম’কে - এই শব্দের অর্থ ‘বধূবেগম’, বা ‘বেগমের পুত্রবধূ’।

এরপর ‘রোকেয়া’র ভাষায়, ‘‘শরীরের কোন অংশে কয় ভরি সোনা বিরাজমান, তাহা সুস্পষ্টরূপে বলিয়া দেওয়া আবশ্যক মনে করি। ১) মাথায় (সিথির অলঙ্কার) অর্ধ সের (৪০ ভরি)। ২) কর্ণে

কিঞ্চিৎ অধিক এক পোয়া (২৫ ভরি)। ৩) কণ্ঠে দেড় সের (১২০ তোলা)। ৪) সুকোমল বাহুলতায় প্রায় দুই সের (১৫০ ভরি)। ৫) কটিদেশে প্রায় তিন পোয়া (৬৫ ভরি)। ৬) চরণযুগলে ঠিক তিন

সের (২৪০ ভরি স্বর্ণের বোঝা)! বেগমের নাকে যে নথ দুলিতেছে উহার ব্যাস সার্ধ চারি ইঞ্চি (কোন কোন নথের ব্যাস ছয় ইঞ্চি এবং পরিধি ন্যূনাধিক ১৯ ইঞ্চি হয়। ওজন এক ছটাক)।

পরিহিত পাজামা বেচারা সলমা চুমকির কারুকার্য ও বিবিধ প্রকারের জবির (গোটা পাট্টার) ভারে অবনত। আর পাজামা ও দোপাট্টার ভারে বেচারি বধূ ক্লান্ত। ঐরূপ আট সের স্বর্ণের বোঝা

লইয়া নড়াচড়া অসম্ভব, সুতরাং হতভাগী বধূবেগম জড় পদার্থ না হইয়া কী করিবেন?’’ তবে এখানেই শেষ নয়, আরো আছে। বধূর ‘কেশসজ্জা’ – ‘‘সুচিক্কণ পাটী বসাইয়া কষিয়া কেশবিন্যাস,

বেণী ও সিঁথির উপর অলঙ্কারের বোঝা’’, শুধু তাই নয়, ‘‘অর্ধেক মাথায় আটা সংযোগে আফ্শা (রৌপ্যচূর্ণ) ও চুমকি বসানো হইয়াছে।’’ উপরন্তু ‘‘ভ্রূ-যুগ চুমকি দ্বারা আচ্ছাদিত, কপালে

রাঙের বিচিত্র বর্ণের চাঁদ ও তারা আটা সংযোগে বসানো হইয়াছে।’’ এই সাজসজ্জা কি সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম? ‘সুফিয়া কামাল’ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন পূর্ববঙ্গের সম্ভ্রান্ত

মুসলমান পরিবারের কথা। সেখানে অলঙ্কারের প্রাচুর্য এত বীভৎস হয়ে ওঠেনি। (রানা চক্রবর্তী) তবে সেখানে সোনা পরার চল্ ছিল না। তখন মুসলমান সমাজে প্রচুর সোনার গয়না পরতেন

তাঁদের ‘আমলা-কর্মচারী ডাক্তার-কবিরাজদের স্ত্রী’রা। তাঁরা সবাই ছিলেন হিন্দু। ‘সুফিয়া’ লিখেছিলেন, ‘‘আমাদের খানদানে সোনা কেউ বড় একটা পরতেন না। সাচ্চা পাথরের জড়াও (এখন

একে বলা হয় জড়োয়া) গয়না এবং সাধারণতঃ মোতির ব্যবহার বেশি ছিল। মুরুব্বীরা বলতেন সোনা যদি আমরা পরব তবে বাদী-চাকরানী-দাই খেলাইরা কি পরবে?’’ এইভাবে দুটি ভিন্ন

সংস্কৃতির ছবি পাওয়া যায়, অবশ্য ‘রোকেয়া’ ছিলেন বহু ‘পূর্ববর্তিনী’, তাঁর রচনাটি যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল (১৩১১ বঙ্গাব্দ) তখনও ‘সুফিয়া’ জন্মগ্রহণ (১৩১৭ বঙ্গাব্দ)

করেননি। তাহলেও সব মিলিয়ে সময়টি বহু দূরের নয়, ঊনবিংশ শতকেরই গোড়ার দিকের কথা।

অষ্টাদশ শতকের কাগজপত্রে গয়নাপত্রের কথা খুব বেশি পাওয়া যায়। গবেষকরা অনুমান করেন যে, একদিকে ‘স্ত্রীধন’ হিসেবে গয়নার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি ও অপরদিকে ‘সম্পদ’

হিসেবে গয়নার মূল্য বৃদ্ধি - সেই সময় থেকে ‘ভারতীয় অর্থনীতিতে’ ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল৷ যেটা ছিল শুধুই ‘দেহসজ্জার উপকরণ’, ‘নারীর রূপরচনা’র প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য যেটার

ব্যবহার হত, তখন থেকে সেই অলঙ্কার হয়ে উঠেছিল ‘সম্পদ’ এবং ‘সৌন্দর্যবৃদ্ধি’ নয়; সম্পদ দেখানোর আগ্রহই সেই সময়কার সাজসজ্জায় প্রাধান্য লাভ করেছিল। ‘কিশোরীচাঁদ মিত্র’র

স্ত্রী ‘কৈলাসবাসিনী দেবী’র একটি হিসেবের খাতা পাওয়া গিয়েছিল। তাতে তাঁর ‘দিনপঞ্জী ও খরচের হিসেব’ ছাড়াও যা ছিল, তা হল ‘গহনার ফর্দ’। (রানা চক্রবর্তী) সেটা পড়লে বিস্মিত হতে

হয়, একজন নারীর এত গয়না! অথচ সেরকম নাকি সেকালে অনেকের ঘরেই ছিল। বিয়ের সময় মেয়েকে গয়না দিতেন পিতা, শ্বশুরবাড়ি থেকেও সে গয়না পেত কিছু। বিশেষ করে ‘সাধের সময়’ বা

অন্য উপলক্ষেও মেয়েদের গয়না দেবার চল্ সেকালে ছিল। সেকালের বাবুরা পুজোর সময় গিন্নিদের জন্যে গড়াতেন ভারী ভারী গয়না। ‘ফকির গরীবুল্লাহের’ ‘সোনাভান’ বলেছিল –

‘‘সেই মর্দ দিবে মোরে অষ্ট অলঙ্কার॥

তারবালা বাজুবন্ধ গলায় হাসুলি৷

সিতেপাটি চন্দ্রহার পায়েত পাসুলি॥

কানে কানবালা দিবে গলায় দিবে হার।

হাতে চুড়ি পৌঁছি আর সাজের সোনার॥’’

এটাই বোধহয় একজন ‘সালঙ্কারা বধূ’র সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সাজের অর্থাৎ ‘অলঙ্কারের ফর্দ’। ‘কৈলাসবাসিনীর ফর্দে’ দেখা যায় তিনি হিসেব করেছিলেন যে তাঁর কি কি গয়না আছে, কত

গয়না তিনি তাঁর মেয়েকে দিয়েছিলেন এবং নিজে কত গয়না পেয়েছিলেন। সেই ফর্দটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। তাতে বঙ্গনারীদের ‘সম্পদ’, ‘বাসনার চিত্র’, ‘অলঙ্কারের নকশা’ বা ‘ডিজাইন’

এবং ‘তৎকালীন রুচি ও প্রবণতার ছবি’ স্পষ্ট ভাবে পাওয়া যায়। জানা যায়, সেই সময় ‘অন্তঃপুরিকারা’ পরস্পরকে সোনার গয়না ‘পরতে দিতেন’, ‘ধার দিতেন’, ‘উপহার দিতেন’, আবার

‘বন্ধকও দিতেন’। বলা বাহুল্য সেসব খবর ‘বাবু মহলে’ পৌঁছাত না। ‘কৈলাসবাসিনী’ লিখেছিলেন, ‘‘সব সমেত আমার এই গহনা। পায়ে ঘুমুর দেয়া ছ’গাছা মল । কোমরে দুই ছড়া চন্দ্রহার আর

গোট চারি শিকলি। হাতে বালা দমদম মিচরি তিন জোড়া, পিনখাড়ু তিন জোড়া। যোড়য়া (জড়োয়া) পঁইচা, হাতা হার, জাল ও হাতের মুকুতা। হাতে চালদানা, মরদানা, নঙ্গ কলি (লবঙ্গ), নঙ্গ ফুল,

নারিকেল ফুল, মাদুলি, সোনালি, সোনার পঁইচা, বাউটি ও হাত মাদুলি। উপর হাতে তাবিজ, বাজু, তাগা, জসন ঝাঁপা ও নবোরত্ন। গলায় ডামন (ডায়মণ্ড) কাটা চিক, জড়োয়া চিক, গোপ হার, দড়ি

হার, হেসো হার। ন-নর গোলমালা সাত-ন নর দানা, পাঁচ নর পান হার, ন-নর মুকুতা, দো-নর মুকুতা, মুকুতার কন্ঠি, আরেক ছড়া কন্ঠি। কানে তিন জোড়া চৌদানি, দু’জোড়া কানবালা, মুকুতার

গোছা, কান, কর্ণফুল, ঝোমকা। মাথার সিঁতিও ফুলকাটা গোট, গলার চাপকলি ও ধুকধুক।’’ এটা পড়তে পড়তে মনে হয় যেন ‘বৌবাজারের’ কোন সম্পন্ন গয়নার দোকানের শো-কেসের সামনে

দাঁড়িয়ে গয়না দেখা চলছে। (রানা চক্রবর্তী) কত ডিজাইন, কত নকশা, এবং কতরকম নাম। সৌভাগ্যবশতঃ ‘কৈলাসবাসিনী’ এরপরে জানিয়েছিলেন যে তাঁকে অলঙ্কারগুলি কে কে দিয়েছিলেন।

তা থেকে তৎকালীন কতগুলি চিত্র বেশ স্পষ্ট হয়। যদিও তা ‘রূপরচনার’ কাজে লাগে না কিন্তু নেপথ্য চিত্রটি অস্পষ্ট থাকে না। যেমন, ‘কৈলাসবাসিনী’ লিখেছিলেন, ‘‘আমার গহনা

পিতাঠাকুর দেন – হাতে চালদানা, পলাকাটি, মাদুলি, পঁইচা, বাউটি, তাবিজ ও বাজুদানা, কণ্ঠমালা। পায়ে ছ’গাছা মল ও পাইজোর, গোকরি, পথম ও চুটকি। কানে বোঁদা ও মাছ। কোমরে রূপার

চন্দ্রহার, গোট ও চাবি শিকলি।’’ এগুলো সবই ‘কৈলাসবাসিনী’ পেয়েছিলেন তাঁর বিয়ের সময়। কারণ তারপরেই তিনি লিখেছিলেন, ‘‘এই সকল আমার শাশুড়ী ঠাকুরানী নেন, তাঁর ভিক্ষা পুত্রের

বৌকে দেন।’’ তখন ‘বালিকা বধূ’ তা নিয়ে মুখ ফুটে কোন আপত্তি জানাতে পারেননি, তবে তাঁকেও বঞ্চিত হতে হয়নি। শাশুড়ি তাঁকে গড়িয়ে দিয়েছিলেন নতুন গয়না এবং সেগুলো সবই ছিল খুব

ভারী - ‘‘আমাকে আশী ভরির ঝুমুর দেয়া ছ’গাছা মল দেন। আশী ভরির খোটায়ে পাজর (পায়জোর?) দেন। বালা, ডামনকাটা পাড়িখাড়ু, হাতহার, চালদানা, নবঙ্গকলি, বাউটি ৪০ ভরির, গোলমালা

১৪ ভরির, ১২ ভরির তাবিজ, ৫ ভরির দুইখান বিল্বপত্রে বাজু, গোপহার, মুকুতার কন্ঠি, পানহার, সিঁতি, দো-নর মুকুতা। ২৮ ভরির সোনার চন্দ্রহার, কানবালা, কর্ণফুল, ঝুমকা, চৌদানি,

মুকুতার গোছা, দুইটি ছোট ছোট ঝুমকা, দুইটি ছোট ফুল, দুইখানি পিপুলপাত৷’’ এই চিত্র থেকে মনে হয় যে, তখন একজন বধূকে উভয় পক্ষই প্রচুর গয়না দিতেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিয়ম

ছিল শ্বশুরবাড়ি থেকে অলঙ্কার পাঠানো। (রানা চক্রবর্তী) ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি’তেও সেই নিয়ম ছিল। ‘প্রফুল্লময়ী দেবী’ তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছিলেন যে তাঁর বিয়ের পরের দিন তাঁর

দেবর ‘বাড়ির সরকার’কে সঙ্গে নিয়ে গহনার বাক্স দিয়ে গিয়েছিলেন। উৎসবের সময় তাঁদের নানারকম অলঙ্কার পরতে হত। ‘প্রফুল্লময়ী’ লিখেছিলেন, ‘‘বাড়ির যে নতুন বৌ আসিত তাঁহাকে

আরো বেশি রকম গহনার উৎপাত সহ্য করিতে হইত। আমি তখন নতুন বৌ, কাজেই আমারও অবস্থা নিতান্ত মন্দ হয় নাই। গলায়-চিক, ঝিলদানা; হাতে চুড়ি, বালা, বাজু-বন্ধ; কানে –

মুক্তার গোচ্ছা, বিরবৌলি, কানবালা; মাথায় – জড়োয়া সিঁথি; পায়ে – গোড়ে, পায়জোড়, মল, ছানলা, চুটকী। এই ছয়-সাত সের ওজনের গহনা পরিয়া চলাফেরা করিতে হইত।’’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে,

একটা সময়ে ভারতের সব অঞ্চলেই, বিশেষ করে ‘উত্তর ভারতে’, মেয়েদের প্রচুর পরিমাণে গয়না পরার চল দেখা গিয়েছিল। ‘দক্ষিণ ভারতে’ও যে সেটা হয়নি তা নয়, সেই অংশে এখনও

প্রচুর গয়না পরা হয়। নাকে হীরের গয়না, হাতে-কানে-গলায় সোনার গয়না পরা ‘দক্ষিণী কন্যা’র সংখ্যা আজও কম নয়, এর সঙ্গে তাঁরা মাথায় পরেন ফুল। ‘উত্তর ভারতে’ সেটার প্রচলন

কম। ‘কৈলাসবাসিনী’র ‘গয়নার ফর্দ’ অবশ্য এখনও শেষ হয়নি। তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘‘তারপরে স্বামী দেন তাবিজের ঝাঁপা, তাগা, দুইখান ডামনকাটা বাজু, একছড়া চন্দ্রহার, একছড়া

গোট, একছড়া চাবি শিকলি, একটা নথ, ৩০০ টাকার মুকুতা, ন-নর মুকুতা। হাতের মুকুতা, হাতের জাল, দুই জোড়া পিন খাড়ু, বড় মুকুতার কন্ঠি, জড়োয়া চিক, ডামনকাটা চিক, সাত নর দানা,

এক জোড়া ভাল চৌদানি, দুইছড়া জড়োয়া পঁইচা, দুইখান ছোট ডামনকাটা বাজু, নবরত্ন, চাঁপ কলি, ভাল চাউদানি এয়ারিন, দড়ি হার, ১০ ভরির গোপ হার, দমদম গোখরি ডামনকাটা চুড়ি। আর

 

127

 

আর বাকি যত গহনা সকল স্বামী দেন।’’ আগেই বলা হয়েছে যে, নারীরা তাঁদের অলঙ্কারকে মনে করতেন ‘স্ত্রীধন’ এবং বাড়ির পুরুষদের অজ্ঞাতেই তাঁরা সেসব গয়না বদল করা কিংবা নতুন

করে গড়াতে দ্বিধা করতেন না। সেই সময় মেয়ে ‘বাপের বাড়ি’ এলেই পুরানো গয়না ভেঙে নতুন গড়ানোর চল ছিল। (রানা চক্রবর্তী) ‘শিবায়ন’-এ ‘উমা’ অভিমান করে পিতৃগৃহে ফিরে এলে জননী

প্রবোধ দিতেন ‘‘নথ ভেঙে ভবানী গড়াঅ নাকচনা’’ বলে৷ ‘কৈলাসবাসিনী’ কাকে কী কী গয়না দিয়েছিলেন সেটাও লিখে রেখেছিলেন। নিজের মেয়েকে তিনি দিয়েছিলেন - ‘পান হার’, ‘কানবালা’,

‘মল’, ‘পাঁয়জোর’ ও একটা ‘নথ’। সেগুলো ‘কুমুদিনী’ পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে বিয়ের সময়, সেগুলো পিতৃপ্রদত্ত গয়না ছিল না। মেয়ের ‘সাধের সময়’ ‘কৈলাসবাসিনী’ তাঁকে দিয়েছিলেন

‘জাল’ ও ‘তাগা’। এছাড়া ‘কৈলাসবাসিনী’র ‘হাতের মুক্তোর সেট’টি তাঁর মেয়ে দাম দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন আর ১৮ ভরির ‘গোখরি’ (হার?) এমনি নিয়েছিলেন, অর্থাৎ বিনিময় হয়নি। এছাড়াও

অনেককে অনেক কিছু দিয়েছিলেন ‘কৈলাসবাসিনী’; কাউকে পুরনো গয়না, তো আবার কাউকে নতুন করে গড়ানো গয়না। অবশ্য তাঁর ক্ষোভও ছিল দুটি-একটি - ‘‘প্রিয়নাথের স্ত্রী বালা ও

তাবিজ বাঁধা দে নেয় একশত টাকা। সে একদিন বাপের বাড়ি যায়, তার বালা ও তাবিজ, আমার ডামনকাটা চিক পরে, তাহা যদু রায় ফাঁকি দে দেয়। ... বাজু আমার মামাতো ভাজ পরতে নেন, তাহা

আমাকে দিলেন না, ৫০ টাকা দে পাঠায়ে ছিলেন, তাহা আমি রাগ করে নিলেম না, তাহা আর পাইলাম না।’’ এইসব ছোটখাট ঘটনা থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, সেই সময় থেকে অলঙ্কার

নারীজীবনে শুধুমাত্র ‘দেহসজ্জার বস্তু’ হয়ে না থেকে ‘স্ত্রীধনে’ পরিণত হচ্ছিল এবং তার ফলে, যেটা ছিল সেটার মূল প্রয়োজন অর্থাৎ সৌন্দর্য সৃষ্টি করা, তার প্রতি ক্রমেই আগ্রহ

কমে যাচ্ছিল। ‘পুষ্প অলঙ্কারে’ নারীর অঙ্গে যে ‘লাবণ্যসঞ্চার’ হত; পরিমিত ও নির্বাচিত অলঙ্কার ‘দেবদাসী’র অঙ্গে ‘সৌষ্ঠব’ বৃদ্ধি করত, গত শতকের অলঙ্কার সেই প্রয়োজন সাধনে

ব্যর্থ হয়েছিল।

পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে বিয়ের সময় মেয়েকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অলঙ্কার দিতে হত মেয়ের অভিভাবকদের এবং এটি শেষে ‘অত্যাচারের পর্যায়ে’ গিয়ে ঠেকেছে। ‘জ্যোতির্ময়ী দেবী’ তাঁর

আত্মকথায় লিখেছিলেন তাঁর দিদির বিয়ের কথা। সেই বিয়েতে পাত্রপক্ষ চেয়েছিলেন – ‘‘মুকুট নয় ভরি, কান ছয় ভরি, সাত নরী চোদ্দ ভরি, চূড় চোদ্দ ভরি, বালা পাঁচ ভরি, জড়োয়া মুক্তার

মীনার সরস্বতী হার একটি, জড়োয়া নেকলেস একটি, খোপার ফুল চিরুণি চার ভরি, তাবিজ সাত ভরি, বাঁক পাঁচ ভরি, গোঠ দশ ভরি, রুপোর মল তিরিশ ভরি, পায়জোর কুড়ি-পঁচিশ ভরি।’’ এই

ফর্দ পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় ‘বেগম রোকেয়া’র দেখা মুসলমান বধূটিকে। (রানা চক্রবর্তী) অবশ্য দ্বিতীয় দফায় পাত্রপক্ষ আরো একটি ফর্দ পাঠিয়েছিলেন, কারণ মেয়ের গাত্রবর্ণ

ছিল ঈষৎ চাপা, ভালো করে বললে মাঝারি ধরনের ফর্সা। তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েদের গায়ের রঙের ওপর তাঁর ‘সৌন্দর্যবিচার’ করা হত। ভারতে ফর্সা রঙের বড় বেশি আদর,

‘‘সর্বদোষ হরে গোরা’’ – বাস্তবে কিন্তু সৌন্দর্য নির্ভর করে সব কিছু মিলিয়ে দেখার ওপর। ‘গৌরী’ কন্যা নিশ্চয় সুন্দরী কিন্তু ‘কৃষ্ণাঙ্গী’ও কিছু কম কী? প্রাচীন সাহিত্যে কিন্তু

দুইয়েরই সমাদর লক্ষ্য করা যায়। ‘পার্বতী’র গায়ের রঙ ছিল ‘সোনার মতো উজ্জ্বল’, অন্যদিকে ‘দ্রৌপদী’র গায়ের রঙ ছিল ‘নীল পদ্মের মতো’। যাইহোক, তখন গায়ের রঙ নিয়ে সবচেয়ে

বেশি চেঁচামেচি করতেন মেয়েরাই, তাই বিয়ের আগে মেয়ে নির্বাচন করা হত ‘বর্ণবিচার’ করে। ‘জ্যোতির্ময়ী’র দিদির গায়ের রঙ চাপা বলে পরে ফর্দ এসেছিল - ‘‘মুকুট, ঝাপটা, ফুল, চিরুণি,

কাঁটা, রতনচূড়, নেকলেস, চুড়ি, বালা, জশম, তাবিজ, বাজু, অনন্ত, কান, ইয়ারিং, চিকহার, বিছা বা সূর্যহার, চরণপদ্ম, মল, পাঁয়জোর এবং গহনাগুলি যেন ভাল হয়।’’ আসলে নতুন ফর্দে

সুকৌশলে অনেকগুলো নাম যোগ করে দেওয়া হয়েছিল। বলা বাহুল্য দ্বিতীয় ফর্দ অনুযায়ী গয়না দেওয়া হয়নি। আবার পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। নতুন যুগের সাজসজ্জার কথা জানতে

হলে গত শতকের সেই প্রেক্ষাপটটিকে মনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন। (রানা চক্রবর্তী) বস্তুতঃ, সেই সময়েই সৌন্দর্যচর্চায় সবচেয়ে বেশি অধঃপতন হয়েছিল বললে খুব ভুল বলা হয় না।

কারণ ভাল শাড়ি-গয়নাকে বিচার করা হত সৌন্দর্য দিয়ে নয়, মূল্য দিয়ে। সাজসজ্জায় সুকচির বালাই ছিল না, ছিল ‘অর্থের দম্ভ’। ‘মুঘলযুগে’ যেটা শুরু হয়েছিল, এখানেই তার চূড়ান্ত রূপ

চোখে পড়ে। ‘সোনা-রুপোর জরির পাড় বসানো বেনারসী’, ‘পঞ্চম পেড়ে’, ‘গুল বাহার’ প্রভৃতি শাড়ি, কলসীর কানার মতো চওড়া ‘বাউটি’; গলায় একগাদা ‘নুড়ি’, ‘ঢ্যালা’ প্রভৃতি নানা আকারের

সোনার গয়না - এই দাঁড়িয়েছিল সংস্কৃতি বা পরম্পরা, প্রতিটি গয়নাই হত ভারী, কাজেই সুক্ষ্মতার অবকাশ ছিল না। শাড়ির পাড়েও কত ‘ভরি রুপো’ আছে সেটার হিসেব করা হত। এক-একটি

শাড়িতে ‘কুড়ি-পঁচিশ তোলা খাঁটি রুপোর জরির কাজ’ থাকত। কিন্তু কোন কিছুই যেমন চির স্থায়ী নয় তেমনি ভারতীয় নারীও তাঁর রূপরচনায় সেই ধারাও দ্রুত বদলে ফেলেছিলেন। এর সুখস্মৃতি

রয়ে গিয়েছিল ‘প্রাচীনাদের’ স্মৃতিতে। কিন্তু ‘নবীনারা’ পরিবর্তনপ্রিয়া, তাই পালাবদল শুরু হয়েছিল এবং সেটাও এক বিচিত্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে।

রক্ষণশীল হিন্দুদের অধর্ম কথা’

(১৮২৬-৫৬)

রানা

ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাকালে সনাতন হিন্দুধর্মের ঘোরতর দুর্দিন দেখা দিয়েছিল। ওই সময়ে দীর্ঘকালের পুঞ্জীভূত অনাচার, গ্লানি, হাজারো বিধিনিষেধে প্রচলিত হিন্দুধর্মের রূপ

অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। ধর্ম মানে তখন ছিল লোকাচার ও কুসংস্কার, যেগুলোর সুযোগে অধিকারভোগীরা তখন যথেচ্ছ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছিলেন। এরপরে নানাদিক থেকে যখন হিন্দু-ধর্মের

ওপরে আক্রমণ শুরু হয়েছিল, তখন সেই সনাতনীরা যুগধর্মের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে প্রাচীন সংস্কারগুলিকেই আরো নিষ্ঠার সঙ্গে আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করেছিলেন। উক্ত সময়ে সমাজের

বিত্তবান ব্যক্তিরা নিজে থেকেই প্রচলিত হিন্দুধর্মের মর্যাদারক্ষার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তৎকালীন কলকাতার হঠাৎ-ধনী সম্প্রদায় তখন হিন্দুধর্মের সতর্ক

প্রহরী হয়ে উঠেছিলেন। মজার ব্যাপার হল যে, তাঁরা অনেক সময়েই মুখে যেটা বলতেন, সেটা কাজে করতেন না। মুখে তাঁরা হিন্দু আচারের গুণগান করলেও, সামনে না হলেও আড়ালে সেটাকে

ভাঙতে কোন দ্বিধাবোধ করতেন না। ওই সময়ে লেখা ‘দি পার্সিকিউটেড’ নাটকে ‘কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়’ তাঁর সৃষ্ট চরিত্র, সংবাদপত্র-সম্পাদক ‘লালচাঁদের’ মুখ দিয়ে বিষয়টিকে

পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেছিলেন। ওই নাটকে লালচাঁদ সেই সময়ের উগ্র হিন্দুদের সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “Why do they not eat and drink in private? Why do

the fools excite a noise about it? Who does not eat and drink in this age? Those who are looked upon as examples of virtues indulge in excesses.” (The

persecuted, K. M. Banerji, Act 3, Scene 1) এছাড়া ‘প্যারীচাঁদ মিত্র’ তাঁর ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’ প্রহসনে ‘হেমচন্দ্রের’ মুখ দিয়ে একই কথা বলাতে গিয়ে

লিখেছিলেন, “এক্ষণে হিন্দুয়ানীর মাহাত্ম্য বুঝিলাম লুকাইয়া খাইলে পাপ নাই, প্রকাশ্যরূপে খাইলে পাপ। কপটতা পূজ্য - সরলতা নিন্দনীয়। জুয়াচুরি ফ্রেবি জুলুম জাল মিথ্যা শপথ এবং

পরস্ত্রীহরণ এ সকল কুকর্ম বলিয়া ধর্তব্য নয় - এসব কর্মে হিন্দুয়ানির হানি হয় না ... দ্বার বন্ধ করিয়া যবনীয় আহার ও মদ্যপানে উন্মত্ত হইবে - তাহাতে দোষ নাই - তাহাতে অধর্ম

নাই, কিন্তু অন্য কেহ দ্বার খুলিয়া ঐ আহার ও পান পরিমিতরূপে করিলে জাতিচ্যুত হইবে।” (প্যারীচাঁদ রচনাবলী, ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, পৃ- ১৭৩) বলাবাহুল্য যে, উক্ত

সময় সম্পর্কে প্যারীচাঁদের উপরোক্ত উক্তিটি কিছুমাত্র অতিশয়োক্তি ছিল না। (রানা চক্রবর্তী) একই সময়ে ‘কালীপ্রসন্ন সিংহ’ ওরফে ‘হুতোম’ কলকাতার অনেক প্রকৃত হিন্দু

দলপতির আসল রূপটি মানুষের সামনে তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছিলেন, “সহরের অনেক প্রকৃত হিন্দু বুড়ো দলপতির এক একটি রাড় আছে একথা আমরা পূর্বেই বলেচি, এদের মধ্যে কেউ কেউ

রাত্তির দশটার পর শ্রীমন্দিরে যান, একেবারে প্রাতঃস্নান করে টিপ তেলক ও ছাপা কেটে, গীতগোবিন্দ ও তসর পরে, হরিনাম কত্তে কত্তে বাড়ি ফেরেন - হঠাৎ লোকে মনে করতে পারে

শ্রীযুত গঙ্গাস্নান করে এলেন, কেউ কেউ বাড়িতে প্রিয়তমাকে আনান, সমস্ত রাত্তির অতিবাহিত হলে ভোরের সময় বিদায় দিয়ে স্নান করে পূজো কত্তে বসেন।” (হুতোম প্যাঁচার নকশা,

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সংস্করণ, পৃ- ৯৪) হুতোমের বলা অনাবৃত বিবরণ যে অপ্রকৃত কিছু ছিল না, সেটার সমর্থন সমসাময়িক সাময়িকপত্রগুলি থেকেও পাওয়া যায়। ‘জ্ঞানান্বেষণ’

পত্রিকা সেই সময়ের ওই সব ‘বিড়াল ব্রহ্মচারির’ আসল রূপটি তুলে ধরেছিল। (সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ- ২৬৯) তখন নিকি, নিক্কণ ইত্যাদি

বিখ্যাত বিদেশী নর্তকীদের নাচের তালে তালে ওই সব হিন্দু সমাজপতিদের মনও দুলে উঠেছিল। “কোন ভাগ্যবান লোক”-এর সেই যুগের প্রধান নর্তকী নিকীকে নিজের রক্ষিতা রাখবার

সংবাদ ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) সেকালের কলকাতার নামকরা ধনী ‘রূপলাল মল্লিকের’ বাড়িতে রাসলীলার সময়ে ‘তায়ফা নর্তকী’দের নাচ দেখে,

সুখাদ্য খেয়ে, এবং মদিরা পান করে নিমন্ত্রিতরা আমোদিত হয়েছিলেন। ওই সময়ে বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে রক্ষণশীল হিন্দুরা তো সর্বপ্রকারের উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয়

দিতেন। হিন্দুয়ানি তখন বিত্তশালী মানুষের অবাধ ভোগ প্রবৃত্তি চরিতার্থ করবার অন্যতম উপায় হয়ে উঠেছিল। এই প্রসঙ্গে ১৮৩১ সালের ৫ই নভেম্বর তারিখে ‘সমাচার দর্পণ’

পত্রিকার সম্পাদকের কাছে লেখা একটি চিঠিতে জনৈক পত্ৰলেখক ‘সমাচার চন্দ্ৰিকাকা’র সম্পাদকের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, “চন্দ্রিকা সম্পাদক লিবারালেরদের প্রতি নিত্য বকাবকি

করিয়া থাকেন তিনি ধর্মসভারও সম্পাদক এবং হিন্দুরদিগকে অন্ধকারাবৃত করিয়া রাখিতে এবং হিন্দুশাস্ত্রের বিধি প্রবল করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন তবে যে হিন্দু বাবুরা হিন্দুশাস্ত্রের

বিদ্যুলঙ্ঘন করিতেছেন তাহারদিগকে তিনি কেন অব্যবহার্য না করেন, হইতে পারে যে তাঁহারা সতীধর্ম সংস্থাপনার্থ কিছু ধন দিয়া থাকিবেন ঐ ধনের দ্বারা তাঁহার চক্ষু একেবারে আবৃত

হইয়াছে অতএব ধর্মসভা সম্পাদক মহাশয়কে আমি এইক্ষণে জিজ্ঞাসা করি যে বাবু মহাশয়েরা দুর্গোৎসবাদিতে মাংসাদ্যাহরণ করিয়া ইষ্টসিদ্ধ করেন তাহা হিন্দুর বিধ্যনুসারে কিনা।

গো-মাংসের নামশ্রবণে শ্রবণ পিধান করেন এমত অনেক দক্ষিণাচারি বাবুরদিগকে দেখিয়াছি তবে কি নিমিত্ত তাঁহারা দুর্গার্চন বাটিতে বিফষ্টেক মটন চাপ ও বৎস মাংস ও ব্রাণ্ডি

সাস্পেনসেরি ইত্যাদি নানাপ্রকার মদিরা আনয়ন করেন। অতএব হে প্রিয়ে চন্দ্রিকে আপনি অনুসন্ধান করিয়া দেখুন যে এমত কোন ব্যক্তি কি ধর্মসভান্তঃপাতি প্রাপ্ত হওয়া যায় না।

আপনি কহুন গত দুর্গোৎসব সময়ে কাহার বাটিতে ইউরোপীয় লোকেরদের নিমন্ত্রণ ও নাচ হইয়াছিল তেরেটি বাজারের অতিসুস্বাদু মাংসসকল কে ক্রয় করিয়াছিল। নিমন্ত্রিত

ব্যক্তিরদের নিমিত্ত গন্টরহুপর সাহেবেরদের স্থানে ভূরি ২ খাদ্যসামগ্রী কে আনয়ন করিয়াছিল এবং ইউরোপীয় লোকেরদের রুচিজনক ভোজ প্রস্তুত করিতে অত্যন্ত মনোযোগী কে হইল।

হরিবোল ২ অতিধার্মিক শিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিরদের মধ্যে কি এমত ব্যবহার হইতে পারে। … প্রভাকরের অধ্যক্ষ অথচ সম্পাদক ঐ সভান্তঃপাতী এমত ব্যক্তিরদিগকে যে কিছু কহেন না

ইহাতে তাঁহার অপরাধ নাই। যেহেতুক তৎসম্পক্তেরা পাথুরিয়াঘাটাতে স্ব ২ বাটিতে তদ্রূপ ভোজ নাচ করাইতেন, তাহা অদ্যাপিও প্রতিবাসি লোকেরদের বিলক্ষণরূপ স্মরণ আছে অনুমান

হয় যে তৎপ্রযুক্ত তাঁহারা মৌনাবলম্বী আছেন।” (সমাচার দর্পণ, ৭০৩ সংখ্যা, ৫ই নভেম্বর, ১৮৩১ সাল) স্পষ্ট কারণেই উপরোক্ত পত্রলেখক তখন যাঁরা ঐসব কাণ্ড করেছিলেন তাঁদের

কারো নাম নিজের লেখায় উল্লেখ করেন নি। বিত্তবানরা চিরকালই সমাজে প্রভাবশালীর ভূমিকা নিয়ে থাকেন। ১৮৩১ সালের ৫ই অক্টোবর তারিখে ‘A Guest at Each House’ স্বাক্ষরে

জনৈক ব্যক্তি ‘জন বুল’ নামক ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদকের কাছে প্রেরিত একটি পত্রে, আগের বছরের (১৮৩০ সালের) দুর্গোৎসবের সময়ে কলকাতার বিভিন্ন ধনী-গৃহে নাচ, গান ও

আমোদ-প্রমোদের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) পরবর্তী সময়ে ‘ইণ্ডিয়া গেজেট’ সেই চিঠিটি পুনর্মুদ্রিত করেছিল। ওই চিঠিটি থেকে জানা যায় যে - মহারাজা শ্রীকৃষ্ণ,

নবকৃষ্ণের নাতি কালীকৃষ্ণ ও তাঁর ভাইরা, গোপীমোহন দেব, রাধাকান্ত দেব, আশুতোষ দেব, প্রমথনাথ দেব - এঁরা সবাই দুর্গাপূজার সময়ে নিজেদের বাড়িতে নাচগানের জমজমাট আসর

বসিয়েছিলেন। সেখানে সাহেবদের আপ্যায়নের সবরকম ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। “They all observed the Doorgah festival and given their guests an excellent meal (?), for they

feasted upon wines and liquors of all kinds, and had enough of eatables.” (The India Gazette, 22nd October, 1881) বলাবাহুল্য যে, পত্রোল্লিখিত ব্যক্তিরা সবাই

‘ধর্মসভা’র উৎসাহী সদস্য, এবং সনাতন হিন্দুধর্মের সদাজাগ্রত প্রহরী ছিলেন। তবে এখানেই শেষ নয়, ওই সময়ের হিন্দু সমাজপতিরা সমাজে নিজের নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করতে

গিয়ে ধর্মের নামে দলাদলি ও বিত্তের প্রতিযোগিতাও চালিয়ে গিয়েছিলেন।

১৮২৯ সালে আইনের সাহায্যে দেশ জুড়ে সতীপ্রথা নিবারিত হওয়ার পরে, ১৮৩০ সালের ১৭ই জানুয়ারি তারিখে সেই আইনের বিরুদ্ধে “আপীল করণার্থ ও ধর্মবজায়” রাখবার জন্য

‘ধর্মসভা’ স্থাপিত হয়েছিল। উক্ত “ধর্মসভার তাৎপর্য হিন্দুশাস্ত্র বিহিত ধর্মকর্ম অনাদি ব্যবহার শিষ্টাচার সংরক্ষণ তদ্বিষয়ক নিবেদনপত্রাদি রাজসন্নিধানে সমর্পণ এবং দেশের

মঙ্গল চিন্তন ইত্যাদি।” (সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ- ৫৮১) সেটারই অনুষঙ্গ হিসেবে ধর্মসভার সদস্যরা তখন স্বধর্মত্যাগীদের সংস্রব

 

128

 

ত্যাগ করেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) ওই সময়ে প্ৰতি মাসের প্রথম রবিবারটি ধর্মসভার বৈঠকের দিন বলে ঠিক করা হয়েছিল। সেই বৈঠকে কলকাতা ও আশেপাশের রক্ষণশীল প্রভাবশালী

ধনীরা মিলিত হতেন। তাঁদের প্রথম কাজ ছিল সতী আইনের বিরুদ্ধে আপীল করা। ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ সোৎসাহে ধর্মসভার মুখপত্র হয়ে উঠেছিল। একই সঙ্গে

প্রথমদিকে ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘সংবাদ তিমিরনাশক’ ও ‘সংবাদ রত্নাকর’ও ধর্মসভার সমর্থকরূপে দেখা দিয়েছিল। উক্ত সভার কাজ চালানোর জন্য প্রচুর টাকাও উঠেছিল। ধর্মসভার

সাথে যুক্ত সমাজপতিরা তখন ফরমান জারি করেছিলেন যে, ‘সতীদ্বেষী’দের সঙ্গে কোনোরকম সংস্রব রাখা চলবে না। অবশ্য কার্যকালে, সভার সাধারণ সভ্যরা শুধু নন; বিধানদাতা, জাত

মারতে ওস্তাদ ধর্মসভার পণ্ডিতেরাও কিন্তু সেই নিয়ম মেনে চলতে পারেন নি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ধর্মসভার একটি বৈঠকে জনৈক ‘উদয়চাঁদ দত্ত’ ধর্মসভার তিনজন পণ্ডিতের

বিরুদ্ধে সতীদ্বেষীদের সঙ্গে সংস্রব রাখবার অভিযোগ তুলেছিলেন। (Annual Meeting of the Dhormo Shobha, The Calcutta Christian Observer, June, 1883, P- 282) এমনকি

ধর্মসভার প্রধান দুই দলপতি ‘গোকুলনাথ মল্লিক’ ও ‘রাধাকান্ত দেবের’ বিরুদ্ধেও তখন একই ধরনের অভিযোগ উঠেছিল। এই প্রসঙ্গে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা রাধাকান্ত দেবের নামে

সরাসরি অভিযোগ তুলে জানিয়েছিল, “তিনি ধর্মসভার এক অধ্যক্ষ ও সতীদাহের দরখাস্ত আপনি প্রস্তুত করিয়াছেন তিনি কি প্রকারে সতীদ্বেষীদিগের সংসর্গীয় শ্রীযুতবাবু হরলাল

মিত্রজ মহাশয়ের সহিত সর্বদা নিমন্ত্ৰণামন্ত্রণ ব্যবহার করিতেছেন।” (সমাচার দর্পণ, জ্ঞানান্বেষণ থেকে পুনর্মুদ্রিত, ৭৬৪ সংখ্যা, ৭ই জুলাই,. ১৮৩২ সাল) ধর্মসভা একদিকে তখন

যেমন সতীদ্বেষীদের মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়েছিল, অন্যদিকে ডিরোজিও ও ইয়ংবেঙ্গলের কার্যকলাপ তাঁদের ভাবিয়ে তুলেছিল। ফলে ধর্মসভার কর্তাব্যক্তিরা জোর করেই সাধারণ

মানুষকে ‘হিন্দুয়ানি’ মান্য করাতে চেয়েছিলেন, ডিরোজিওকে পদচ্যুত করেছিলেন, এবং তাঁর ছাত্র-শিষ্যদের একঘরে করেছিলেন। এর ফলে তাঁরা সাময়িকভাবে জয়ী হলেও, তাঁদের সেই জয়

কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। (রানা চক্রবর্তী) এরপরেই লণ্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে সতীপক্ষীয়দের চূড়ান্ত পরাজয়ে এবং আভ্যন্তরীণ দলাদলিতে ধর্মসভা খুব শীঘ্রই শ্রীহীন হয়ে পড়েছিল,

এবং শুধু নামমাত্রই সেটার অস্তিত্ব টিকে ছিল। তখন ধর্মসভা শুধুমাত্র যে, বাহ্যিক আচার-আচরণ রক্ষা করতে গিয়েই নিজের সব উদ্যম নিঃশেষ করে দিয়েছিল, সেটার প্রমাণ

সমসাময়িক পত্রিকাগুলির পৃষ্ঠাতেই পাওয়া যায়। ওই সময়ে কে বা কারা সতীদ্বেষীদের সঙ্গে সংস্রব রেখেছিলেন, কে বা কারা নিজেদের দোষ স্খলনার্থে ‘শ্রীশ্রীবিষ্ণু’ স্মরণ করেছিলেন -

এসবই ধর্মসভার আলোচ্য বিষয় ছিল। ধর্মসভার কার্যবিবরণীতে কোনো গঠনমূলক প্রস্তাবও থাকত না, আর কোনো বৃহত্তর সমস্যাও আলোচিত হত না। প্রসঙ্গতঃ দু’-একটি উদাহরণ

তুলে ধরা যেতে পারে। একবার সভার একটি বৈঠকে সতীদ্বেষী কালীনাথ মুন্সীর কাছে যাওয়ার জন্য জনৈক ব্যক্তি ধর্মসভার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন, এবং তাঁর সেই ক্ষমা মঞ্জুর

করা হয়েছিল। আরেকবার অন্য একজন ধর্মসভার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, যেখানে আগে কোনো ম্লেচ্ছ থেকেছে, সেখানে কোনো হিন্দুর থাকা উচিত কিনা? সে যুগের কলকাতার অন্যতম

প্রভাবশালী ব্যক্তি ‘মতিলাল শীল’ (ইনি ধর্মসভাকে ‘অধর্মসভা’ আখ্যা দিয়েছিলেন) ধর্মসভার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, বিষ্ণু-উপাসক শূদ্রেরা ব্রাহ্মণের কাছে শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য

কিনা? অন্য একজন প্রশ্ন করেছিলেন, “If a Shudra has the privilege of offering libations?” (Annual Meeting of the Dhormo Shobha, The Calcutta Christian Observer,

June, 1893, P: 280-'Annual Meeting of the Dhormo Shobha', 'The Calcutta Christian Observer', June, 1893, P. 280-83) প্রায় একই সময়ে গঠিত ‘আত্মীয় সভ৷’ বা

‘একাডেমিক এসোসিয়েশনের’ তুলনায় ধর্মসভার দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা সহজেই চোখে পড়ে। প্রাচ্য ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী ধর্মসভার কাজকর্ম কিন্তু ‘ইঙ্গরেজী নকশা’তেই পরিচালিত

হত। (সমাচার দর্পণ, ৮২৬ সংখ্যা, ৯ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৩ সাল, পৃ- ৭২) অন্যদের আচার-আচরণের নিষ্ঠাবান বিচারক ধর্মসভা কিন্তু নিজের দলপতিদের আচারাদি সম্পর্কে আশ্চর্য

নীরবতা পালন করত। (রানা চক্রবর্তী) ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ পত্রিকা সেই বিষয়টির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছিল, “ধর্মসভার অধ্যক্ষ মহাশয়েরা নিজ ব্যবহার দ্বারা

আপনারদিগের নিয়মভঙ্গ করিতেছেন ... আমরা প্রার্থনা করি এক্ষণে যেন দলপতি মহাশয়েরা স্বীয় পরিবারগণের চরিত্র অবলোকন করিয়া অন্য ব্যক্তিকে শ্ৰেণীচ্যুত করেন।” (দি

বেঙ্গল স্পেক্টেটর, ১লা নভেম্বর, ১৮৪২ সাল, পৃ- ১২৯) ধর্মসভার ওই অদ্ভুত আচরণ দেখে শ্যামবাজারের জনৈক ব্রাহ্মণ ১৮৩৪ সালের ৫ই এপ্রিল তারিখে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায়

একটি চিঠি লিখে ধর্মসভার তৎকালীন অধ্যক্ষদের কাছে ৪টি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলেন। তাঁর চতুর্থ প্রশ্নটি ছিল, “এতন্নগরস্য কোন ব্যক্তি নান্নিজান ও সুপনজান ও নিক্কি

প্রভৃতি জবনী নর্তকীদিগের সহিত তাবৎকাল নানারূপ আহার ও ব্যবহার করিয়া এবং মির্জা জান তপসের সহিত দ্বাদশ বৎসরেরও অধিককাল একন্নভুক্ত থাকিয়া নগরকীর্তনোপলক্ষে

পুনরায় হিন্দুদিগের মধ্যে গৃহীত হন। এইক্ষণে ঐ ব্যক্তির সন্তান ও পরিবারেরা এই দলাদলির উদ্যোগে বিশেষ অনুরাগ প্রাপ্ত হইতে পারেন কিনা।” ওই পত্রের একেবারে শেষে সেই

পত্রলেখক আরো মারাত্মক একটি প্রশ্ন করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “‘যদি উপরিউক্ত মহাশয়েরা হিন্দুসমাজে মান্য ও অগ্রগণ্য হইতে পারেন এবং ধর্মসভার বিধিব্যবস্থা মন্ত্রাদি

শাস্ত্রের বিপরীত অন্য কোন শাস্ত্রানুসারে থাকে তবে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যো প্রভৃতি কি নিমিত্ত ধর্মসভায় অগ্রাহ্য হয়।” (সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ

বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ: ৫৯৩-৯৪)

সতী আইন রদে ব্যর্থ হওয়ার পরেও “দেশের মঙ্গল ও ধর্মস্থাপনার্থ” ধর্মসভাকে বজায় রাখবার সিদ্ধান্ত করা হলেও, শেষপর্যন্ত ওই সভার কার্যকলাপ কিন্তু নিছক দলাদলিতে

পর্যবসিত হয়েছিল। ধর্মসভার সেই দলাদলির কারণে পিতাপুত্র ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটেছিল। তখন নিজের দল বজায় রাখতে গিয়ে ও বিত্তবান দলপতির অনুগ্রহ লাভের

আশায় ওই ধরনের অমানবিক ঘটনাও বঙ্গদেশে ঘটত। কিন্তু ধর্মসভা তাতে কোন অধর্ম খুঁজে পায়নি! সেই পরিস্থিতিতে ধর্মসভাপন্থীদের ওই ধরনের কার্যকলাপকে ধিক্কার জানিয়ে

১৮৪২ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তারিখে ইয়ংবেঙ্গলের মুখপত্র ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ লিখেছিল, “ধর্মসভা স্থাপিত হইয়া এতাবৎকাল পর্যন্ত কি ফল জন্মিল? সভ্যগণেরা যাবজ্জীবন

অন্যায়াচরণ করিয়া বরং কেবল অধর্মেরি বৃদ্ধি করিলেন এবং এক্ষণে ও হিন্দু ধর্মাভিমানী হইয়া কেবল দলপতিত্ব রূপ স্ব ২ সম্ভ্রম মাত্র রক্ষা করিতেছেন।” (ধর্মসভার গত বৈঠক',

দি বেঙ্গল স্পেক্টেটর, ১লা সেপ্টেম্বর, ১৮৪২ সাল, পৃ- ৮৩) ধর্মসভার মাথারা, অর্থাৎ - রাধাকান্ত দেব, কালীকৃষ্ণ বাহাদুর, আশুতোষ দেব, প্রমথনাথ দেব - এঁরা সকলেই তখন

পরস্পরের বিরুদ্ধে দলাদলিতে লিপ্ত হয়েছিলেন। সেই কারণে “কস্যচিৎ পক্ষপাত রহিতস্য” এক ব্যক্তি ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকায় লেখা একটি চিঠিতে “ধর্মসভাতে শিশ্নোদরপরায়ণ

মনুষ্যই অধিক” বলতেও দ্বিধা করেন নি। (সমাচার দর্পণ', ৮৪৪ সংখ্যা, ১৮ই এপ্রিল, ১৮৩৩ সাল, পৃ- ১৮০) উক্ত সময়ে ‘সুকৃতিভঙ্গ’, ‘মিথ্যাশপথ’, ‘টাকা আত্মসাৎ’ প্রভৃতি ধর্মসভার

ভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই সময়ে প্রেত-শ্রাদ্ধে অনুমতি দান করে, কিংবা কেউ খ্রীষ্টান হলে তাঁর পরিবার থেকে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ (পড়ুন সামাজিক জরিমানাস্বরূপ) মোটা টাকা আদায়

করে ধর্মসভা হিন্দুধর্মকে রক্ষা করবার মহৎ কাজটি সম্পন্ন করত। (রানা চক্রবর্তী) ধর্মসভার সেই ধরনের সংকীর্ণতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ১৮৪২ সালের ১লা নভেম্বর তারিখের

‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ পত্রিকা লিখেছিল, “ধর্মসভা হয় স্বীয় লীলা সম্বরণ করুন অথবা সত্য ও ধর্মপরায়ণ হইয়া এতদ্দেশীয় জনগণের সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধিকরণের উপায়ানুসন্ধানে প্রবৃত্ত

হউন।” (দি বেঙ্গল স্পেক্টেটর, ১লা নভেম্বর, ১৮৪২ সাল, পৃ- ১৩০) একই কারণে সমকালীন আরেকটি পত্রিকা ধর্মসভা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিল, “The causes of the decay and

dissolution were within itself.” (Dharma Sabha, The Calcutta Christian Observer, May, 1838, P- 295)

ইতিহাস থেকে ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে রক্ষণশীল বাঙালী হিন্দুসমাজে গঠনমূলক এবং যুগোপযোগী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন কোনো একক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। ‘রামকমল

সেন’ (১৭৮৩-১৮৩৮), ‘রাধাকান্ত দেব’ (১৭৮৪-১৮৬৭), বা ‘ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ (১৭৮৭-১৮৪৮) ব্যক্তিত্বের সবটাই নেতিবাচক (negative) না হলেও, সেটা অবশ্যই স্ববিরোধে

ভরা ছিল। (রানা চক্রবর্তী) যে কারণে নিজের পরিবারে সতী প্রথার কোন চল না থাকা সত্ত্বেও রাধাকান্ত সতী প্রথা নিবারণের বিরোধী হয়েছিলেন। এমনকি বিধবাবিবাহকে শাস্ত্রবিরুদ্ধ,

এবং বহুবিবাহকে শাস্ত্রানুমোদিত বলতেও তিনি কোন দ্বিধা করেন নি। পাশ্চাত্য শিক্ষায় আগ্রহী হলেও রাধাকান্ত পাশ্চাত্য সংস্কৃতির স্পর্শকে সযত্নে বর্জন করতে চেয়েছিলেন, যদিও

একটির সঙ্গে অপরটির অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে। স্ত্রীশিক্ষার সমর্থক হয়েও রাধাকান্ত কিছুতেই প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে মেয়েদের পাঠানোকে সমর্থন করতে পারেন নি। নিজের বাড়িতে

দুর্গোৎসবের সময়ে ‘বীফস্টিক বৎসমাংস ও মদিরা’র স্রোত প্রবাহিত করলেও, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে গো-হাড় সংক্রান্ত ঘটনার পরিণতিতে কৃষ্ণমোহন ও রসিককৃষ্ণ

মল্লিককে তিনিই স্কুল সোসাইটি পরিচালিত পটলডাঙ্গা স্কুল থেকে কর্মচ্যুত করবার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং পরমবৈষ্ণব রাধাকান্ত দেবের সমস্ত আচরণ যে

মোটেও বৈষ্ণবোচিত ছিল না, সেটা বলাই বাহুল্য। তাঁর মৃত্যুর পরে আয়োজিত শোকসভায় কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্ছ্বসিত ভাষায় তাঁর প্রশংসা করে, তাঁকে তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায়

অগ্রবর্তী বলবার পরেও বলা যেতে পারে যে, ওই সময়ের রক্ষণশীল হিন্দুদের মধ্যে তিনি অগ্রবর্তী হলেও, তাঁর পদক্ষেপ কিন্তু প্রায় কখনোই একটি সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে ঘটে নি।

‘কিশোরীচাঁদ মিত্র’ তাঁকে ‘Patron of errors’ বলে অভিহিত করে, তাঁর প্রতি কোনো অবিচার করেন নি। সেই সময়ের আরেক রক্ষণশীল হিন্দু নেতা ছিলেন - হিন্দুধর্মের একনিষ্ঠ উকিল,

ধর্মনিষ্ঠ ‘চন্দ্রিকা’ পত্রিকার সম্পাদক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঊনিশ শতকে পর্দাপন করেও তিনি হিন্দুসমাজে সতীপ্রথা পুনঃপ্রবর্তনের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন; স্ত্রীশিক্ষার

নামেই তিনি শঙ্কিত হতেন, এবং তিনি কৌলীন্য প্রথারও ঘোরতর সমর্থক ছিলেন। চরম ধর্মনিষ্ঠ হয়েও নিজের ব্যক্তিগত জীবনে অবশ্য তিনি ধর্মসভার আয়-ব্যয়ের হিসেবে পর্যন্ত

দিতে অস্বীকার করেছিলেন! ধর্মসভার কয়েকজন অধ্যক্ষ সেই কারণে তাঁর ওপরে ক্ষুব্ধও হয়েছিলেন। তখন ওই ব্যাপারে সমস্ত সংশয়ের অবদান ঘটিয়ে তাঁকে হিসাব প্রকাশ করতে

পরামর্শ দেওয়ার জন্য তিনি ‘সমাচার দর্পন’ ও ‘রিফর্মার’ পত্রিকার ওপরে খড়্গহস্ত হয়ে উঠেছিলেন। (সমাচার দর্পণ, ১০৩৯ সংখ্যা, ১৩ই জুন, ১৮৩৫ সাল) বলাই বাহুল্য যে, ওই সব

নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তখন প্রচলিত হিন্দুধর্মকে সঠিক কোনো পথনির্দেশ দিতে পারেন নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার ধর্মীয় আন্দোলন সম্পর্কে ইতিহাস থেকে যে তথ্য

পাওয়া যায়, সেগুলো হল - (ক) রামমোহন ও তাঁর অনুবর্তীরা তখন হিন্দুধর্মের সংস্কার করতে চাইলেও স্ববিরোধিতায় বহুলাংশে তাঁদের সেই প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়েছিল; (খ) খ্রীষ্টান

মিশনরিরা তখন প্রবল উৎসাহ নিয়ে ধর্ম প্রচার ও ধর্মান্তরিত করবার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন; সেই কাজে তাঁরা কিছুটা সাফল্য পেলেও পরধর্মের যুক্তিহীন কুৎসা করাকেই নিজেদের

পরম ধর্ম বলে বিবেচনাও করেছিলেন; এবং (গ) প্রচলিত হিন্দুধর্মের সমর্থক রক্ষণশীলেরা তখন ইয়ংবেঙ্গল, রামমোহন ও রামমোহনপন্থী সংস্কারক এবং খ্রীষ্টান মিশনরিদের দ্বারা

আক্রান্ত হয়ে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় আত্মসংস্কারের চেষ্টা না করে প্রাণপণে অচলায়তনের ঘণ্টাধ্বনি করে গিয়েছিলেন।

‘বঙ্গদেশে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক’

(প্রথম পর্ব)

রানা

কথায় বলে যে, রাজনীতিই সময়ের নিয়ন্ত্রক। সাধারণভাবে দেশ, জাতি, সমাজের ইতিহাস এভাবেই যুগে-যুগে রাজা, রাজনীতি আর যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস বলে পরিগণিত হয়েছে। কিন্তু

অতীতের রাজা, রাজ-পরিবার, শাসন-নীতির বাইরেও যে বিপুল সাধারণ জনসমষ্টি ছিল, ইতিহাসকারেরা সেদিকে তেমনভাবে নজর দেন নি। ইতিহাসের প্রধান অসুবিধা সম্ভবতঃ এটাই যে,

অতীতের রাজা বা রাজনৈতিকরা নিজের ক্ষমতার সুবাদে যেভাবে কালে কালে নিজেদের মাহাত্ম্যগাথা রচনায় সমকালীন রাজ-ঐতিহাসিকদের নিযুক্ত করেছিলেন, সমকালীন সাধারণ মানুষের

ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁরা সেভাবে প্রণোদিত হননি। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে জনজীবনের পরিচয় ইতিহাসের রক্তাক্ত পৃষ্ঠায় কখনও বিচ্ছুরিত হলেও, সার্বিক ও ধারাবাহিক কোনও

জনচিত্র কিন্তু ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দুর্লক্ষই থেকে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে সমকালীন সাহিত্য, সরকারি আদেশনামা, বিভিন্ন পর্যটকের বিবরণ, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং নানা লোকগাথা

ইত্যাদি উপকরণই ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মানুষকে বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করে। আর সেই অসুবিধার বাধা পেরিয়েই ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসকে অনুধাবন করতে হয়। মধ্যযুগের

সময়সীমায় ভারতে তথা বঙ্গদেশে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে ঐতিহাসিক মতভেদও দুস্তর ও পরস্পরবিরোধী। যেমন, হিন্দু-ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে,

মুসলমান-শাসনের ইতিহাস আসলে সম্পূর্ণতই অসহিষ্ণুতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সন্ত্রাস ও রক্তপাতের ইতিহাস। বিপরীতে, মুসলমান ঐতিহাসিকেরা ইসলামি শাসকদের তথা তাঁদের শাসনকাজের

 

129

 

নানা সদর্থকতা আবিষ্কার করেছেন, এবং সেইসব রাজা ও রাজনীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখও হয়েছেন। তাঁরা স্পষ্টই জানিয়েছেন যে, হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠী কখনওসখনও পারস্পরিক

নৈকট্যে এলেও, স্থাযীভাবে সেই মিলন বস্তুতঃই এক অসম্ভব ও অলীক আকাঙ্ক্ষা; সেই আকাঙ্ক্ষার যেমন কোন তীব্রতা নেই, তেমনই বিন্দুমাত্র বাস্তব ভিত্তিও নেই। অন্যদিকে

তাঁদের বিপরীতে গিয়ে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, অতীতে এই দ্বিবিধ সম্প্রদায়ের মিলন এক সাধারণ-কৃষ্টি-তথা-জাতিসত্তার উদ্ভবও সম্ভব করেছিল। এইসব মতামতগুলি

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ভারতে মুসলমান বিজয়ের সঙ্গে নৃশংসতার একটি ইতিহাসগত সম্পর্ক অবশ্যই ছিল। আসলে যুদ্ধের সঙ্গে ওই ধরণের হিংস্রতা খুবই মানানসই। যুদ্ধের

ইতিহাস মানেই খুন, লুন্ঠন, রক্তপাত আর অসহিষ্ণুতার ইতিহাস। শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীর ইতিহাসই এটা বলে যে, জয়ী-পক্ষ সব সময়েই বিজিত-পক্ষেব উপরে সেই অত্যাচার

চালিয়েছিল। সমস্ত ইতিহাস এটাই বলে যে, পৃথিবীতে সব যুদ্ধের ইতিহাসই একইরকম। মধ্যযুগের ভারতের ক্ষেত্রে জয়ী-পক্ষ যেহেতু মুসলমান, এবং বিজিত পক্ষ যেহেতু হিন্দু ছিল, সেহেতু

ওই সময়ের মঠ-মন্দিরের উপরে আক্রমণগুলোও খুবই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। সেক্ষেত্রে জয়ী পক্ষ যে সব সময়েই নিজের ধর্মের প্রেরণায় অন্যের ধর্মের উপরে আঘাত হেনেছিলেন, তা

কিন্তু নয়। আসলে মধ্যযুগের ভারতের দেবালয়গুলি সম্পদের ভাণ্ডার ছিল। ফলে, লুঠেরা সুলতানেরা (বিশেষতঃ মধ্যযুগে যাঁরা স্থায়ীভাবে শাসন করবার উদ্দেশ্যে নয়, স্রেফ লুন্ঠন করবার

বাসনায় ভারত আক্রমণ করেছিলেন) সেই সম্পদ লুণ্ঠনের বাসনাতেই দেবালয়গুলি চূর্ণ করেছিলেন। অন্যদিকে, বিজিত-পক্ষকে অধীনস্ত ও সন্ত্রস্ত করবার অভিপ্রায়েও তাঁরা যে

হিন্দুদের মন্দির, ও বৌদ্ধদের মঠ ধ্বংস করেছিলেন, ঐতিহাসিকদের এমন অনুমানও অবাস্তব নয়। তাই মুসলমান ঐতিহাসিকদের ইসলামী শাসনের প্রশংসা যেমন সবক্ষেত্রে যথার্থ নয়,

তেমনি ওই পরিব্যাপ্ত সময়সীমায় কোনও শাসনকর্তাই যে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন না, এমন মনে করলে তাতেও যথেষ্ট অতিশয়োক্তি থেকে যায়। এইসব ঐতিহাসিকেরা তখনকার

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যেসব ঘটনার বিবরণ উপস্থাপিত করেছেন, সেটাকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ এবং ‘অতিবঞ্জিত’ বলে মনে করবার মধ্যেও একধরনের প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা থেকে

যায়। বস্তুতঃ, বিপরীত-মতবাদী ঐতিহাসিকেরা যে অনেকক্ষেত্রেই দুই সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বিভেদকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক দূরত্বকেই আরও বাড়িয়ে তুলেছেন, এমন

অনুমান করাও অসঙ্গত কিছু নয়। এখানে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রণিধানযোগ্য, সেটা হল, তখন ভারত ও বাংলার দুই বিবাদমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবধান তথা

স্বাতন্ত্র্য্যবোধ এতটাই প্রবল, এবং দুই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উন্নাসিকতা ও পরধর্ম-অসহিষ্ণুতা এতটাই তীব্র ছিল যে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন স্থায়ী ঐক্যের সম্ভাবনা

সম্পূর্ণই সুদূরপরাহত ছিল। কিন্তু, এরপরে দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বসবাস করে দুই সম্প্রদাযের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছিল। ইতিহাস

অন্ততঃ সেকথাই বলে। পরবর্তীকালে সম্মিলিত কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বিনিময়ে অনেকক্ষেত্রেই অতীতের বিবাদমান দুই সম্প্রদায়ের মিলন সাধিত হযেছিল। কিন্তু, তা সত্ত্বেও গোটা

বিষয়টিই রাজনীতি সাপেক্ষ ছিল। উক্ত সময়ে রাজনীতির ইচ্ছাতেই সামাজিক জীবন কখনও সহজ-স্বাভাবিক ছন্দে প্রবাহিত হত, তো কখনও আবার সেটা সংকীর্ণ খাতে অবরুদ্ধ হযে

পড়ত। ইতিহাস কিন্তু কখনওই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই মিলনের ছবি আঁকেনি। অতীতের ঐতিহাসিকেরা যেহেতু সততই রাজনৈতিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতেই সমধিক আগ্রহী ছিলেন,

সেহেতু সামাজিক মিলনের সেই স্বাভাবিক পরিচয় তাঁদের রচনায় প্রায়শঃই অলিখিত থেকে গিয়েছিল। রাজানুকূল্য এবং পৃষ্ঠপোষকতাই যেখানে অতীতের ঐতিহাসিকদের পাথেয় ছিল, সেখানে

রাজ্ আধিপত্যই যে ইতিহাসের অবলম্বন হবে, তাতে বিস্ময়ের কোনও কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু সেই সময়ের শাসকের ও রাজনীতির তথাকথিত গৌরবের অন্তবালে সাধারণ মানুষের

মধ্যে যে মিলনাকাঙ্ক্ষা ও মিলন চেষ্টার বাস্তবতা প্রবাহিত ছিল, ইতিহাসকারেরা সেটাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিলেও, সাধারণ মানুষের কাছে সেটার গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম ছিল। সেই

আকাঙ্ক্ষা ও মিলনের চিত্র ওই সময়ের সাহিত্য লিখে রেখেছিল। আর সাহিত্যকে যেহেতু সমাজের দর্পণ বলা হয়, সেহেতু সাহিত্যই সেক্ষেত্রে ইতিহাস অনুরাগী মানুষের কাছে প্রামাণ্য

এবং দিশাবী বলে মনে হয। কিন্তু ইতিহাসকারেরা যুগেব ইতিহাস লিপিবদ্ধ করবার ক্ষেত্রে প্রায়শঃই যেহেতু তখনকার শাসক ও রাজনীতির প্রভাবকে কাটিয়ে উঠে কখনোই নিজেদের

নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে পাবেননি, সেহেতু ওই সময়ের সাহিত্যের অভিজ্ঞানকে গ্রহণ করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হয়েছিলেন। সাহিত্যের আশ্রয়ে ইতিহাস যেখানে সত্য, সবিশেষ

ও গভীরতর হতে পাবত, এই ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই করা হযনি। ফলে, দুর্ভাগ্যবশতঃ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইতিহাসের বিবরণ একপেশে, সংকীর্ণ এবং পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে গিয়েছে।

বঙ্গদেশে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের টানাপোড়েনের ইতিহাসে রাজনীতির প্রভাব একটি মুখ্য বিষয়। ইতিহাস বলে যে, তখন ব্যক্তি-বিশেষে সেই সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হত - শাসকের আগ্রহ

বা অনীহাই সেই নিয়ন্ত্রণের একমাত্র চালিকাশক্তি ছিল। এক্ষেত্রে তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবর বা শেষ শক্তিশালী মোঘল সম্রাট ঔরংজেবের দৃষ্টান্ত মনে করা যেতে পারে। আকবর

যেভাবে সাহিত্য-শিল্প বা জীবনচর্যার ক্ষেত্রে অনুকূলপন্থী ছিলেন, ঔরঙ্গজেবের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু ঠিক তার বিপরীত ছিল। শত সংঘর্ষ সত্ত্বেও আকবরের শাসনকালে ভারতীয় সমাজে

যে, ধর্মে, সাহিত্যে, শিল্পে - দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট সমন্বয় সাধিত হয়েছিল, সেটা অনস্বীকার্য। তাঁর সময়ে সম্মিলিত জাতির উদ্ভবের চেষ্টাগুলি নানা প্রতিকূলতায় অভিপ্রেত

পরিণতিতে পৌঁছাতে না পারলেও, তাতে সেই চেষ্টাগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিন্তু বিন্দুমাত্র খর্ব হয় না। আকবরের সময়ের মিলনের আকুতি ও আবেগের বিচ্ছিন্ন চিত্র তৎকালীন

সাহিত্যে বারবার পাওয়া গেলেও, ইতিহাস কিন্তু সেভাবে সেটাকে গুরুত্ব দেয়নি। সেই কারণেই, ভারতের প্রথমদিকের ইতিহাস, কেবলমাত্র রাজনৈতিক ইতিহাস। এই দেশে সামাজিক ইতিহাস

চিন্তার উন্মেষ অনেক পরে ঘটেছে। সমকালীন মুসলমান-ঐতিহাসিকেরা সম্রাট, সুলতান, উজির, আমির, ওমরাহদের জয়গাথা লিখতে যতটা উৎসাহী হয়েছিলেন; সামাজিক ইতিহাসের

তাৎপর্য অনুধাবন করতে তাঁরা ঠিক ততটাই ব্যর্থ হযেছিলেন। ফলে তাঁরা কখনওই নিজের ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে, তাঁদের আগের ও

তাঁদের পরের হিন্দু বা ইংরেজ-ইতিহাসকারেরাও কিন্তু সেই একই পথের পথিক ছিলেন।

‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ই বাঙালির এই ইতিহাস-অভাবের দিকে সর্বপ্রথম দৃষ্টি-আকর্ষণ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ শিরোনামের একটি

প্রবন্ধে (বঙ্গদর্শন, অগ্রহায়ণ, ১২৮৭ বঙ্গাব্দ) তিনি লিখেছিলেন, “... আমাদিগের বিবেচনায় একখানি ইংরেজি গ্রন্থেও বাঙ্গালার প্রকৃত ইতিহাস নাই। সে সকলে যদি কিছু থাকে, তবে

যে সকল মুসলমান বাঙ্গালার বাদসাহ, বাঙ্গালার সুবাদার ইত্যাদি নিরর্থক উপাধিধারণ করিয়া নিরুদ্বেগে শয্যায় শয়ন করিয়া থাকিত, তাঁহাদিগেব জন্ম মৃত্যু গৃহবিবাদ এবং খিচুড়ীভোজন

মাত্র। ইহা বাঙ্গালার ইতিহাস নয়, ইহা বাঙ্গালার ইতিহাসের এক অংশও নয়। বাঙ্গালার ইতিহাসের সঙ্গে ইহার কোন সম্বন্ধও নাই। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস ইহাতে কিছুই নাই। যে

বাঙ্গালী এ সকলকে বাঙ্গালার ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করে, সে বাঙ্গালী নয়। আত্মজাতি-গৌরবান্ধ, মিথ্যাবাদী, হিন্দুদ্বেষী মুসলমানের কথা যে বিচার না করিয়া ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করে,

সে বাঙ্গালী নয়। … বাঙ্গালার ইতিহাস নাই, যাহা আছে, তাহা ইতিহাস নয়, তাহা কতক উপন্যাস, কতক বাঙ্গালার বিদেশী বিধর্মী অসার পরপীড়কদিগের জীবনচরিতমাত্র। বাঙ্গালার

ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙ্গালী, তাঁহাকেই লিখিতে হইবে।” কটু হলেও একথা সত্যি যে, একজন সতিত্যিক

হয়েও বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির ইতিহাস-অভাবের বিষয়টি সঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। যেমন, তিনি বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের ঘটনার ঐতিহাসিকতাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব

দেননি। উক্ত প্রসঙ্গে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা প্রবন্ধে’ (বঙ্গদর্শন, অগ্রহায়ণ, ১২৮৭ বঙ্গাব্দ) তিনি লিখেছিলেন, “সতের জন অশ্বারোহীতে বাঙ্গালা জয় করিয়াছিল,

এ উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রমাণ কি? মিন্হাজ উদ্দীন বাঙ্গালা জয়ের ষাট বৎসর পরে এই এক উপকথা লিখিয়া গিয়াছেন। ... তুমি তাঁহার কথায় বিশ্বাস কর। ... এ বিশ্বাসের আর কোন

কারণ নাই, কেবল এইমাত্র কারণ যে, সাহেবরা সেই মিনহাজ উদ্দীনের কথা অবলম্বন করিয়া ইংরেজিতে ইতিহাস লিখিয়াছেন।” কিন্তু, তিনিও যে সেখানে, বিপরীত অর্থে, কিঞ্চিৎ

(অনেকের মতে পুরোপুরি) সাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সেটার প্রমাণও বঙ্কিমচন্দ্রের ওই প্রবন্ধেই পাওয়া যায়। তিনি ওই সময়ের প্রকৃত ইতিহাস বলতে যা বুঝেছিলেন,

সেটা সাধারণভাবে মুসলমান-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতা বলে অনায়াসেই বিবেচিত হতে পারে। বঙ্কিম লিখেছিলেন, “... দেশীয় লোকেরা যে স্বধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া

মুসলমান হইয়াছে, ইহাই সিদ্ধ। দেশীয় লোকের অর্দ্ধেক অংশ কবে মুসলমান হইল? কেন স্বধৰ্ম্ম ত্যাগ করিল? কেন মুসলমান হইল? কোন জাতীয়েরা মুসলমান হইয়াছে? বাঙ্গালার

ইতিহাসে ইহার অপেক্ষা গুরুতর তত্ত্ব আর নাই।” বঙ্কিমচন্দ্র পরবর্তীকালে তাঁর সেই ইতিহাস-চেতনার আলোয় তাঁর উপন্যাসগুলিকে উদ্ভাসিত করতে চাইলেও, সেখানেও তিনি সতত খুব

উদার মানসিকতার পরিচয় দিতে পারেননি বলেই গবেষকরা মনে করে থাকেন। ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে সফল তুর্কী-অভিযান কেবল যে ওই সময়ের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসেই এক

যুগান্তর এনেছিল, তা নয়; সেটা তৎকালীন বাংলার সামাজিক জীবনেও এক গভীর আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। ওই তুর্কী-বিজয়ের আগে বঙ্গভূমিতে সমান্তরালভাবে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য

ধর্ম-সংস্কৃতি প্রবাহিত ছিল। গুপ্তযুগ থেকেই বাংলায় সেই দুই ধর্ম এক অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের সৃষ্টি করেছিল। সপ্তম শতাব্দীতে উক্ত দুই ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সংঘর্ষ ঘটেছিল,

পাল যুগে গিয়ে সেটার প্রশমন ঘটেছিল। বস্তুতঃ, বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বী পাল রাজত্বের চারশো বছরের ইতিহাস বাংলার এক পরম সৌহার্দ্যের ইতিহাস, সেটা মহিমময় সম্প্রীতির ইতিহাসও

বটে। পাল-রাজারা বৈদিক ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণেতর ও মহাযান-বজ্রযান-তন্ত্রযান ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর মেলবন্ধন ঘটাবার চেষ্টা করেছিলেন। ইতিহাস বলে যে, সমস্ত

ধর্ম ও সংস্কৃতি রাজ-আনুকূল্য পেয়ে, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেই, পরধর্ম-সংস্কৃতি-সহিষ্ণু হয়। ফলে সমস্ত ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে। কিন্তু এরপরে দক্ষিণ

ভারত থেকে সেন ও বর্মন বংশের রাজারা বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করবার পরে বাংলার সামাজিক চিত্রটি একেবারেই পাল্টে গিয়েছিল। ওইসব ব্রাহ্মণ্য রাজগোষ্ঠী একাধারে রক্ষণশীল

ও পরধর্ম-অসহিষ্ণু ছিলেন। তাঁরা প্রথমাবধিই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতাকেই নিজেদের একমাত্র অবলম্বন বলে মনে করেছিলেন। তাঁদের নিজ-ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন

বাংলার অন্যান্য ধর্ম-সংস্কৃতিগুলি স্বাভাবিক নিয়মেই অবহেলিত হতে শুরু করেছিল। এর ফলে ওই সময়ের দেশীয় জনসাধারণের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর একটি ভেদ-সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল,

এবং সেই স্বেচ্ছাচারিতার মূল্য ‘লক্ষ্মণ সেন’কে দিতে হয়েছিল; এর ফলেই বাংলায় (পূর্ব-বঙ্গে নয়) তুর্কী-বিজয় সম্ভব হয়েছিল। তুর্কী শাসকেরা বঙ্গভূমি জয় করে অবশ্য একই

গোঁড়ামির পরিচয় দিয়েছিলেন। বরং তাঁরা সেনদের তুলনায় আরো বেশি নৃশংস হয়ে উঠেছিলেন। প্রথমেই তাঁরা বাংলার বৌদ্ধ-বিহার এবং হিন্দু-মন্দিরগুলির উপরে আঘাত হেনেছিলেন। তাঁদের

সেই অনর্থক আক্রমণের পিছনে যত না ধর্মীয় উন্মাদনা ছিল, সেটার চেয়ে অনেক বেশি লুণ্ঠন ও সন্ত্রাসের প্রণোদনা ছিল। ধর্মপ্রাণ জাতির আরাধনাস্থল ধ্বংস করলেই মানুষের মনের

রংও যে পরিবর্তিত হয়ে যাবে, এমন সরল বিশ্বাস নিশ্চই সেই সাম্রাজ্যবাদী সুলতানদের ছিল না। আসলে ওই সময়ে ধনসম্পদ-লুণ্ঠনের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁরা মানুষের মনে ত্রাসও সৃষ্টি করতে

চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে তাঁরা মানুষকে শাসনবন্দি করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের সেই আকস্মিক আক্রমণে বিহ্বল ও বিভ্রান্ত হয়ে বাংলার বৌদ্ধ-শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ-

পণ্ডিতেরা নেপাল, মিথিলা, উড়িষ্যা, কামরূপ ও ঝাড়খণ্ডে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত ‘শূন্যপুরাণ’ গ্রন্থের ‘নিরঞ্জনের রুম্মা’ শীর্ষক অধ্যায়ে ওই নির্বাসনী পর্বের

পরিচয় পাওয়া যায় -

“ব্রাহ্মণের জাতি ধ্বস হেতু নিরঞ্জন,

সাম্বাইল জাজপুরে হইয়া যবন।

দেউল দেহারা ভাঙ্গে গোহাড়ের ঘায়,

হাতে পুঁথি করা কত দেয়াসি পালায়।

ভালের তিলক যত পুঁছিয়া ফেলিল,

ধর্মের গাজনে ভাই যবন আইল।

দেউল-দেহারা যত ছিল ঠাঁই ঠাঁই,

ভগ্ন করি পাড়ে তারে না মানে দোহাই।”

 

130

 

তবে বহিরাগত মুসলমানরাই যে এই দেশে প্রথম আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তা নয়। প্রাচীন যুগে ভারতভূমি পারসিক, গ্রিক, শক-পহ্লব, হুন ইত্যাদি নানা বৈদেশিক

আক্রমণের মুখে পড়েছিল। সেইসব বিদেশিরা ভারতের জনজীবনে তেমন কোনও সদর্থক বা নঞর্থক ভূমিকা বিস্তার করতে পারেন নি। কিন্তু, মুসলমান শাসকদের সঙ্গে সেই সমস্যা দেখা

দিয়েছিল কেন? কেন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দুস্তর সামাজিক, ধর্মীয়, মানসিক ব্যবধান তৈরি হয়েছিল? ঐতিহাসিকদের মতে, পূর্বোক্ত বিদেশিরা এই দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ওতপ্রোত

হতে পারলেও, উন্নত আরব-সংস্কৃতি ও সুদৃঢ় ইসলাম ধর্মের ধারক মুসলমানেরা কিন্তু এই দেশের সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ত হতে পারেন নি। অন্যদিকে, তৎকালীন হিন্দু জনগোষ্ঠীও তাঁদের

গ্রহণ করতে অনীহা দেখিয়েছিলেন। এই ভাবেই তখন বিবাদমান দুই পক্ষের মাঝখানে এক দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর গড়ে উঠেছিল। দুই সম্প্রদায়ই অবশ্য পারস্পরিক দোষারোপের ক্ষেত্রে প্রথম

থেকেই একই মানসিকতা অবলম্বন করেছিলেন; বস্তুতঃ, সেই মধ্যযুগ থেকে বর্তমান সময়েও ওই মিল অটুট রয়েছে। একাদশ শতাব্দীর বিশিষ্ট মুসলমান পণ্ডিত তথা ভারতবিদ ‘আলবেরুনি’

দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেকার ব্যবধানের সেই কারণ বিশ্লেষণ করবার একটা চেষ্টা করেছিলেন। তিনি স্পষ্টই লিখেছিলেন, “হিন্দুরা সমস্ত বিষয়েই আমাদের থেকে আলাদা।” তিনি উভয়

সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেকার ধর্ম, ভাষা, আচার-আচরণগত অমিলের কথা যেমন বলেছিলেন, তেমনই ওই সময়ের ভারতের মুসলমান-সম্প্রদায়ের প্রতি হিন্দু জনসাধারণের সাধারণ

উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তৎকালীন হিন্দু জনগোষ্ঠী মুসলমানদের যেভাবে ‘ম্লেচ্ছ’ প্রতিপন্ন করে তাঁদের সঙ্গে বিবাহ বা অন্য কোন রকমের সামাজিক

বা পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল, আলবেরুনি সেটার সমালোচনা করে লিখেছিলেন, “তাঁরা আমাদের থেকে ধর্মে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁরা যা বিশ্বাস করে, আমরা তা করি

না, এবং আমবা যা বিশ্বাস কবি, তাঁরা তা করে না। ... তৃতীয়তঃ সমস্ত আচার আচরণেও তাঁরা আমাদের সঙ্গে তফাত করে। তাঁদের বিদ্বেষ এতটাই যে তাঁদের শিশুদের পর্যন্ত আমাদের থেকে

তফাতে রাখে। পোশাকাশাক, এবং রীতি-নীতিতেও তাঁরা আমাদের থেকে আলাদা। হিন্দুরা আমাদের ‘শয়তানের সন্তান’ বলে অভিহিত করে। ... তাঁদের ধর্মীয় গোঁড়ামি এতটাই তীব্র যে অন্য

সকলকেই, সমস্ত বিদেশিকেই তাঁরা অপছন্দ করে, এবং ‘ম্লেচ্ছ’ বলে চিহ্নিত করে। তাঁদের সঙ্গে দুস্তর বজায় রেখে চলে। আমাদের সঙ্গে বিবাহ বা অন্য-কোনও সম্পর্ক গড়বার

ক্ষেত্রেও তাঁদের প্রবল অনীহা রয়েছে। একসঙ্গে বসা শোয়া পানভোজনের - কোনও বিধান হিন্দুদের নেই। তাঁরা মনে করে এতে তাঁদের জাত যাবে, তাঁরা কলুষিত হবে। কোনও বিদেশির স্পর্শে

জল ও আগুনও তাদের কাছে অপবিত্ৰ বলে মনে হয়। ... এর ফলে তাঁদের সঙ্গে কোন ন্যুনতম সম্পর্ক গড়ে তোলা খুবই দুরূহ। ফলে তাঁদের আর আমাদের মধ্যেকার বাধা বেড়েই যাবে, কমবে

না।” (Sachan, Alberuni’s India, Vol. I, অনুবাদ - বদরুদ্দিন উমর) এখানে মনে হতে পারে যে, আলবেরুনিও এই ক্ষেত্রে নিজের সম্প্রদায়গত ভাবনার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে

পারেননি। কিন্তু বিষয়টি আদতে তেমন ছিল না। কারণ, আলবেরুনির গ্রন্থটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা ভালোভাবেই অবগত রয়েছেন যে, তাতে তিনি নিজের ধর্ম সম্প্রদায়েরও কম কিছু সমালোচনা

করেননি। নিজের লেখায় তিনি খোলাখুলিভাবে ওই সময়ের মুসলমানদের নিষ্ঠুরতা এবং তাঁদের মঠ-মন্দির চূর্ণ করবার তীব্র সমালোচনাও করেছিলেন। বস্তুতঃ, হিন্দুদের সমালোচনা করলেও

তিনি তাঁদের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন বলেই ঐতিহাসিকেরা মনে করেন।

আশ্চর্যের বিষয় হল যে, ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের বাংলা সাহিত্যে কিন্তু সেই সময়ের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের তেমন কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। খৃষ্টীয় পনেরো শতকে এই

প্রসঙ্গে ‘বিদ্যাপতি’র রচনায় বিচ্ছিন্নভাবে নিম্নলিখিত বর্ণনা পাওয়া যায় -

“হিন্দু তুরকে মিলল বাস,

একক ধৰ্ম্মে অওকো উপহাস।

কতহুঁ বাঙ্গ কতহুঁ বেদ,

কতহুঁ মিলিমিস, কতহুঁ ছেদ।

কতহুঁ ওঝা কতহুঁ খোজা,

কতহুঁ নকত কতহুঁ রোজা।

কতহুঁ তম্বারু কতহুঁ কুজা,

কতহুঁ নামাজ কতহুঁ পূজা।

কতহুঁ তুরক বর কর,

বাট জাইতেঁ বেগার ধর।

ধরি আনএ বাভন বড়ুআ,

মথা চড়ার এ গাইক চূড়ুয়া।

ফোট চাট জনউ তোড়,

উপর চড়ার এ চাহ ফোড়।

ধোআ উরিধানে মদিরা সাঁধ,

দেউল ভাঁগি মসীদ সাঁধ।

গোরি-গোমঠ পুরিল মহী,

পত্ররহুঁ দেবাক চাম নহী।

হিন্দু বোলি দূর হি নিকার,

ছোটেও তুরুকা ভভকী মার।”

বলাই বাহুল্য যে, একজন ইতিহাসবিদ ও একজন কবির দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক তফাত থাকবেই। কিন্তু তবুও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যবর্তী ব্যবধানকে - অলবেরুনি ও বিদ্যাপতি - দু’জনেই যে

যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ থাকে না। কেননা, ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পাওয়া যায় যে, মধ্যযুগ ছাড়িয়ে আধুনিকতর যুগে পৌঁছেও উভয়

সম্প্রদায়ের মধ্যেকার সেই দুস্তর ব্যবধান কিন্তু এখনও কমার বদলে বেড়েই চলছে।

রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব যে কেবলমাত্র মধ্যযুগ বা আধুনিক যুগেরই লক্ষণ ছিল, তা নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, একেবারে প্রাচীন যুগ থেকেই এই বৈশিষ্ট্যটি সুপ্রোথিত হয়েছিল।

অতীতের গ্রিক মনীষী প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় রাখবার জন্য ধর্মের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। তিনি তৎকালীন শাসকশ্রেণীকে ওই সময়ের

সাধারণ মানুষকে আয়ত্তে রাখবার জন্য এক অলীক সৃষ্টিতত্ত্ব-প্রচারের উপদেশ দিয়েছিলেন। এমনকি সেই সৃষ্টিতত্ত্বে ঠিক কী বলতে হবে, সেটাও তিনি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি

বলেছিলেন যে, মানুষকে বোঝাতে হবে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাস ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই পূর্ব-নির্দিষ্ট। কেননা, তিনিই বিভিন্ন ধরণের মানুষ সৃষ্টি করবার

সময়, ওই বিন্যাস বজায় রাখবার জন্য, কারও মধ্যে সোনা, তো কারও মধ্যে মধ্যে রুপো, আর বাকিদের মধ্যে তামা ও লোহা মিশিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই অনুযায়ীই মানুষের গাত্রবর্ণ তথা

শ্রেণী-পরিচয় নির্দিষ্ট হয়েছে। ভারতে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থেও ঈশ্বরের অলীক অনুশাসনের প্রচার করে প্রজাদের শাসন করবার উপদেশ পাওয়া যায়। ‘শ্রীমদ্ভাগবৎগীতা’য়

শ্রীকৃষ্ণ নিজেই জানিয়েছিলেন যে, তিনি বর্ণাশ্রম প্রথা তৈরি করেছিলেন। ‘কোরান শরিফ’ ও ‘হাদিস শরিফে’ও ধর্মকে রাজনীতির অঙ্গ হিসাবেই দেখা হয়েছে। সেখানে ধর্মযুদ্ধের (জেহাদ)

কথা বলা হয়েছে। আধুনিক যুগেও সারা পৃথিবীতেই এই একই প্রবণতা সুবিস্তৃত রয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। এখনও রাজনীতি নিজের সুবিধামতো ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে। মধ্যযুগের

বাংলার সমাজ-জীবনে মুসলমান-শাসনের প্রভাব খুবই তীব্রতর হয়েছিল। ঐতিহাসিকেরা জানিয়েছেন যে, তখনকার মুসলমান শাসকেরা প্রায়শঃই কেবলমাত্র শাসনক্ষমতা অধিকার করেই

সন্তুষ্ট হতেন না। তাঁরা তাঁদের ক্ষমতার প্রতাপকে আরো বিস্তৃত করবার জন্য সার্বিক চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। আর সেক্ষেত্রে প্রথমেই তাঁরা ধর্মের দিকে নিজেদের দৃষ্টি দিয়েছিলেন।

সাধারণভাবে সেই সময়ের মুসলমান শাসকদের উপরে ধর্মের প্রভাব ছিলই। মধ্যযুগের ক্ষমতাপিপাসু সুলতানেরাও ইসলামি অনুশাসনে বাঁধা ছিলেন। ফলে সে সময় থেকেই ধর্ম, সুলতানের

সুবাদে সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে গিয়েছিল। অনেকেই বলেন যে, মুসলমান শাসকেরা নাকি এক হাতে তরবারি, অন্য হাতে কোরান নিয়ে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এই

ধারণা সর্বাংশে সত্যি না-হলেও, এর আংশিক সত্যতা অবশ্যই থাকতেই পারে। কেননা, ভারতের ইতিহাস থেকে লক্ষ্য করা যায় যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে যাওয়ার ফলে

ইসলাম অনেক বেশি প্রচারিত ও প্রসারিত হতে শুরু করেছিল। তাই ওই সময়ে, প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় পোষকতাই যে সেটার পিছনে মূল কারণ ছিল, তা সহজেই

অনুমেয়। যদিও কোরানে স্পষ্ট করেই বলপূর্বক ধর্মপ্রচারকে অধর্ম বলা হয়েছে (“লা ইকরাহা ফিদ্দিন”), কিন্তু মধ্যযুগের ভারতে যে সেটা সবক্ষেত্রে অনুসৃত হয়েছিল, তা নয়। বাস্তব

ক্ষেত্রে তখন বলপ্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করবার ঘটনাও অনেক ঘটেছিল। বস্তুতঃ, মধ্যযুগের বাংলায় ইসলাম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ - দুই উপায়েই প্রবর্তিত হয়েছিল। প্রত্যক্ষ পথের

মধ্যে ছিল বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, স্বেচ্ছা ধর্মান্তর, ধর্মে আগ্রহীকরণ এবং বহিরাগত মুসলিম-অভিবাসন। অন্যদিকে মসজিদ, মাদ্রাসা ও পীর-ফকিরদের জনহিতকর ও দিব্য

কার্যকলাপেও হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করবার চেষ্টা তখন সক্রিয় ছিল। মুসলমান-ঐতিহাসিকেরা যেমন ওই সময়ের বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণের সত্যতাকে মেনে নিতে

চাননি; তাঁদের বিপরীতে গিয়ে হিন্দু-ইতিহাসকারেরা এই বিষয়টির উপরেই সমধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। মুসলমান-ঐতিহাসিকরা আজও মনে করেন যে, দেশে সংখ্যাগুরু হিন্দু-বৌদ্ধ-জনগোষ্ঠীকে

সংখ্যালঘু মুসলিম-সম্প্রদায়ের পক্ষে কখনোই বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু, ওই সময়ের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যেখানে শাসকগোষ্ঠীর মদত-প্রাপ্ত ছিল, বস্তুতঃ

তাঁরাই যেখানে শাসক ছিলেন, সেখানে এই তত্ত্বটির যৌক্তিকতা যথেষ্ট অসাড় বলেই মনে হয়। দেশে যখন মঠ-মন্দির ভাঙার ও লুঠ, ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তখন ভীত সন্ত্রস্ত সাধারণ

মানুষ যে নিজের প্রাণের চেয়ে ধর্মকে তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না, তাতে কি কোন সন্দেহ থাকে?

তত্ত্বগতভাবে ইসলাম ধর্মান্তরকরণে বিশ্বাসী। পৃথিবীর অন্যান্য সকল ধর্মমতের মতো ইসলামও চিরকাল নিজের ধর্মকে ‘শ্রেষ্ঠতম’ বলেই প্রচার করেছে। আর সেই প্রচারের অন্যতম

অবলম্বন হিসাবে ইসলাম অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিজের দিকে টানতে চেয়েছে। ইসলামের এই মনোভাব সাধারণভাবে উদার মানসিকতার পরিচায়ক বলে গণ্য হলেও, অতীতে

অনেকক্ষেত্রেই কিন্তু তা বিপরীত অভিঘাতও তৈরী করেছিল (এখনও করে)। মধ্যযুগের হিন্দুত্ববাদ যেখানে স্বীয় ধর্মাবলম্বীকে অনাচারের দায়ে পতিত জ্ঞান করত; গো-মাংস ভক্ষণ শুধু

নয়, গো-মাংস রান্নার ঘ্রান নাকে গেলেও যেখানে একজন হিন্দুর হিন্দুত্ব অবসিত হয়ে যেত; সেখানে ওই সময়ে ইসলাম কিন্তু সকলের জন্যই নিজের দরজা খুলে রেখে উদারতার পরিচয়

দিয়েছিল। তখন হিন্দুত্ববাদ যেখানে পরধর্মীকে স্রেফ ‘ম্লেচ্ছ’ ছাড়া অন্য কিছু মনে করত না - মুসলমানত্ব কিন্তু তেমন গোঁড়া ছিল না; সেটা যে কেউ গ্রহণ করতে পারতেন। এই

পরিস্থিতির আজও খুব একটা বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। বস্তুতঃ, বিশ্বজুড়ে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ানোই ইসলামের নির্দেশ। মধ্যযুগের সুলতানেরা বঙ্গবিজয়ের পরে সেই

ব্রতই নিয়েছিলেন। অবশ্য ওই সময়ের সাম্রাজ্যবাদী, রক্তপিপাসু সুলতানেরা যে নিছক ধর্মীয় ভাবাবেগের জন্যই ইসলাম-প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, যে কোন ইতিহাস সচেতন

মানুষের পক্ষে একথা বিশ্বাস করা শক্ত। বাস্তবে শাসনক্ষমতা ভোগ করবার জন্য বিরুদ্ধবাদীকে স্বধর্মে বশীভূত করবার রাজনৈতিক তাগিদই সেখানে মুখ্য হওয়ার অধিক সম্ভাবনা

 

131

 

দেখতে পাওয়া যায়। কেননা, বিরুদ্ধবাদীর চেয়ে অধীনস্থ প্রজাকে শাসন করা অনেক বেশি সহজসাধ্য হয় বলেই ইতিহাস থেকে দেখা যায়। তখনকার সুলতানেরা মূলতঃ সন্ত্রাসের মাধ্যমে

নিজেদের শাসনক্ষমতা ভোগ করতে এবং টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। অবশ্য, তখন কেবলমাত্র বাহুবলের জোরেই নয়, ওই সময় থেকেই বঙ্গদেশে স্বেচ্ছা-ধর্মান্তরের একটি সুবিস্তৃত

অধ্যায়েরও সূচনা ঘটেছিল। ইতিহাসের সঙ্গে মধ্যযুগীয় সাহিত্যেও সেই বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এই প্রসঙ্গে এটাও লক্ষ্যণীয় যে, তৎকালীন সমাজের তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর

জনসমষ্টিই সেই স্বেচ্ছা-ধর্মান্তরে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিকেরা এর সম্যক কারণও নির্দেশ করেছেন। তাঁদের মতে ওই ধর্মান্তরের কারণ যত

না ধর্মীয় ছিল, তার থেকে ঢের বেশি আর্থ-সামাজিক ছিল। হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব পূর্ব-ভারতে কখনওই সেভাবে নিজের সর্বজনীন প্রভাববিস্তার করতে পারেনি। অতীতে উত্তর,

পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের তুলনায় পূর্ব-ভারতে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুত্ববাদীরা তেমন সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ ছিলেন না। তুলনায় বৌদ্ধধর্ম এখানে অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছিল। সেই সময়ের

ব্রাহ্মণেরা তথাকথিত অন্ত্যজশ্রেণিকে কখনও বিশেষ সুনজরে দেখেন নি। ফলে, ব্রাহ্মণ্য আচার-বিচার, জাতপাত অন্ত্যজশ্রেণিকে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। জমির মালিকানা

উচ্চবর্ণের করগত থাকবার ফলে তখন শ্রেণী-শোষণও তীব্র আকার ধারণ করেছিল। অতীতের ওই সব অবমাননা ও শোষণ থেকে আত্মরক্ষার তাগিদেই বাংলায় মুসলমান বিজয়ের আগেই

একটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বৌদ্ধধর্মের অনুগামী হয়েছিলেন। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণদের মধ্যেও তখন চরম বিবাদ-বিসম্বাদ লেগেই থাকত। পাল-যুগের বৌদ্ধরা সেন-যুগে নিগৃহীত হয়েছিলেন।

আর সেই নিগৃহীত জনগোষ্ঠীকে নবাগত মুসলমানেরা নিজেদের দল ভারী করবার তাগিদেই সাদরে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেন-যুগের বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। ওই

সময়ে ব্রাহ্মণেরাও তন্ত্রমতের আকর্ষণে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পাল-যুগে সমাজের সমস্ত শ্রেণীই রাজানুকূল্য পেলেও, সেন-যুগে কিন্তু কৃষকশ্রেণী ও তথাকথিত নিম্নবর্গীয় জনসাধারণ

অবহেলা ও শোষণের শিকার হয়েছিলেন। সমসাময়িক ‘তারানাথের’ বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ওই সময়ের ব্রাহ্মণ-শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ও ক্রোধই বৌদ্ধদের লক্ষ্মণ সেনের

বিরোধী করে তুলেছিল। তখন বৌদ্ধ-ভিক্ষুরা মহম্মদ ইক্তিয়ারউদ্দিন ইবন বক্তিয়ার খিলজির চরবৃত্তিও করেছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিক অভিযোগ করেছেন। এই প্রসঙ্গে, ঐতিহাসিক

‘ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার’ তাঁর ‘ডিকলাইন অফ বুদ্ধইজম’ গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, সেই সময়ের অত্যাচারিত বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু-রাজাদের প্রতি স্বাভাবিক বিদ্বেষে মুসলমান

শাসকদের প্রতি নিজেদের সমর্থন করেছিলেন। এমনকি সমকালীন ‘ধর্মপূজাবিধান’ গ্রন্থের মধ্যেও এইরকম তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমানে ধর্মঠাকুরের পূজাবিধির মধ্যে যে তান্ত্রিক ও

ব্রাহ্মণ্যধর্মের রীতিনীতির সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়, সেটা ওই সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। বস্তুতঃ, তখনকার ব্রাহ্মণ্য অত্যাচারের ফলে অন্ত্যজ হিন্দুদের নিয়েই সেই ধর্মীয় শাখাটি

গড়ে উঠেছিল। বলাই বাহুল্য যে, বৌদ্ধরা পরবর্তীকালে ইসলামকে নিজেদের ‘মুক্তির দূত’ হিসাবে গণ্য করেছিলেন। কেননা, ওই সময়ের বর্ণ হিন্দুদের অত্যাচারে তাঁরা ক্রমশঃই সমাজে

কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। এই বিশেষ ধর্ম-শাখাটির সঙ্গে সেই কারণেই মুসলমান-ধর্মের একটি মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এমনকি হিন্দু দেবদেবীরা পর্যন্ত ওই সময়ে বিভিন্ন মুসলমান

নামে রূপান্তরিতও হয়েছিলেন। বাংলার মধ্যযুগীয় ইতিহাসের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, সেই সংমিশ্রণে ধর্ম হয়েছিলেন ‘যবন’, বিষ্ণু হয়েছিলেন

‘পয়গম্বর’, ব্রহ্মা হয়েছিলেন ‘পাকাম্বর’, শিব হয়েছিলেন ‘আদম’, গণেশ হয়েছিলেন ‘গাজী’, কার্তিক হয়েছিলেন ‘কাজী’, চণ্ডী হয়েছিলেন ‘হায়াবিবি’, পদ্মাবতী হয়েছিলেন ‘বিবি নূর’ ইত্যাদি।

এ ভাবেই বর্ণ ব্রাহ্মণের নিপীড়ন এড়ানোর জন্য ওই সময়ের বাংলার অন্ত্যজশ্রেণীর মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তাঁরা ইসলামকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেই শ্রেণীর

মানুষেরা স্বেচ্ছায় ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। উক্ত সময়ে পূর্ববঙ্গের ধীরব, কৃষক, নিষাদ, জলদস্যু-শ্রেণীর কাছে ইসলাম-ধর্ম প্রচারকেরা ইসলামের একেশ্বরবাদ ও সাম্যের

বাণী প্রচার করে সেই শ্রেণীকে নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন। একদিকে সেই মৌলবীদের কাছে ওই অন্ত্যজশ্রেণী যেমন উন্নততর জীবনবোধের সন্ধান পেয়েছিলেন; অন্যদিকে

ইসলাম যেহেতু সেই সব মানুষকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখেছিল, সেহেতু তাঁরাও নির্দ্বিধায় নিজেদের ধর্ম বিসর্জন দিয়ে ঘোর হিন্দুবিদ্বেষী তথা কট্টর-মুসলমান হয়ে উঠেছিলেন। গায়ের জোরে

ধর্মান্তরকরণের চেয়ে সেই ধর্মান্তর সামাজিকভাবে তৎকালীন বঙ্গদেশে অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছিল। ওই সময়ে বলপূর্বক ও স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরের পাশাপাশি ঐহিক লাভালাভের

আশাতেও বঙ্গদেশে ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেছিল। তখন মর্যাদা লাভের আশাতেও অনেকেই স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। এমনকি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধালাভের লোভেও তখন

ধর্মান্তরের ঘটনা কম কিছু ঘটেনি। তৎকালীন হিন্দু-সমাজে ঐসব মানুষেরা যেহেতু আর্থ-সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে বঞ্চিত ছিলেন, সেহেতু তাঁরা খুব স্বাভাবিক প্রবণতাতেই

বিকল্প পথও খুঁজেছিলেন। তখন কেউ মুসলমান হলে তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য থেকে অনেকাংশে মুক্তি পেতেন। অন্যদিকে, ‘ড. সুকুমার সেন’ তৎকালীন বাংলা সাহিত্য থেকে

উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, তখন কেবলমাত্র নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই নন, অনেক উচ্চবর্ণজাত হিন্দুও সেই সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লাভালাভের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায়

ধর্মান্তবিত হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে ‘বৃন্দাবন দাসের’ পদ উদ্ধৃত করে সুকুমার সেন তাঁর মন্তব্যের যাথার্থ্যতা নিরূপণ করেছিলেন -

“হিন্দুকুলে কেহ যেন হইয়া ব্ৰাহ্মণ,

আপনে আসিয়া হয় ইচ্ছায় যবন।

হিন্দুরা কি করে তারে তার যেই কর্ম,

আপনি যে মৈল তারে মারিয়া কি ধর্ম।”

বৃন্দাবন দাস ধর্মের নিরিখে সেই সময়ের ওই জাতীয় ধর্মান্তরের প্রতি নিজের বিদ্রূপ পোষণ করলেও, তখনকার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে কিন্তু ওই জাতীয় ধর্মান্তরের যৌক্তিকতাকে

কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। অবশ্য, ওই জাতীয় ধর্মান্তরের কার্যকারণ নিয়ে বর্তমানে প্রশ্ন ওঠা নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। কেননা, ওই সময়ের নিম্নবর্ণের জনসাধারণের

ইসলামধর্ম গ্রহণের কারণাকারণ যতটা সহজবোধ্য, উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা নয়। কারণ, তখনকার বর্ণ-হিন্দুদের ক্ষেত্রে স্ব-সমাজের শোষণ, এবং অবমাননা-অবহেলার কোন

প্রশ্ন এক্ষেত্রে উঠতে পারে না। তাই ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন যে, সেক্ষেত্রে সামাজিকভাবে ‘পতিত’ হওয়াই তখন উচ্চবর্ণের ওই ধর্মান্তরের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল।

তৎকালীন হিন্দু-অনুশাসন উপেক্ষা করবার ফলেই ওই জাতীয় বর্ণ-হিন্দুরা প্রায়শঃই স্ব-সমাজে পতিত হয়ে পড়তেন। তখন সাধারণতঃ অপেয় পানীয় (মদ), অমেধ্য খাদ্য (গোমাংস), অবৈধ

প্রণয় বা বিবাহ, ম্লেচ্ছদের (মুসলমানদের) সঙ্গে মেলামেশা ইত্যাদি নানা কারণে হিন্দুসমাজে ‘একঘরে’ করবার রীতি বহুল প্রচলিত ছিল। যাঁরা সেসব করতেন, তাঁরা ‘জাতিনাশের’ কারণে

তখনকার হিন্দুসমাজে অপরাধী বলে গণ্য হতেন। আর সেই অপরাধের শাস্তিস্বরূপ তাঁর যাবতীয় সামাজিক প্রয়োজন মেটাবার উপায়গুলিকে কেড়ে নেওয়া হত। এর ফলে অনেকেই তখন যেমন

আত্মঘাতী হতেন, তেমনি আবার দেশান্তরীও হয়ে যেতেন। আর যাঁরা সেই দুটোর একটাও করতেন না, তাঁরা ধর্মান্তরকেই শ্রেয় বলে মনে করে ইসলামে দীক্ষা নিয়ে নিতেন। তাতে তাঁরা

আশ্রয় ও ইনাম - দুই-ই পেতেন। তখন অনেকক্ষেত্রে অবশ্য বর্ণহিন্দুরা তাঁদের নিজের অজ্ঞাতে ফাঁদে পা দিয়েও ফেলতেন। সেই সময়ের এমন অনেক ঘটনার কথাও জানা যায় যেখানে,

প্রতিবেশী বা শত্রু-মনোভাবাপন্ন মুসলমান প্রতিবেশী রীতিমতো ষড়যন্ত্র করে বর্ণ-হিন্দুকে নিষিদ্ধ খাদ্য-পানীয় খাইয়ে দিয়েছিলেন, বা অবৈধ প্রণয়ের প্রতি প্ররোচিত করেছিলেন। পরে

সেটা নিয়ে সামাজিক বিচারের মুখে পড়লে সেই অভিযুক্ত হিন্দুরা বিড়ম্বিত হতেন; তখন হয় তাঁকে গৃহত্যাগী বা দেশত্যাগী হতে হত, আর নয়তো ‘যবনাচার’ মেনে নিয়ে ইসলামের বশবর্তী হতে

হত। এই প্রসঙ্গে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায় যে, সুলতান ‘হুসেন শাহ’ তাঁর কোতোয়াল ‘সুবুদ্ধি রায়’কে নিষিদ্ধ ‘কারোয়ার পানি’ দিয়েছিলেন। নিজের অজ্ঞাতে সেটা পান

করে প্রথমে তিনি মনোবেদনায় সংসার ত্যাগ করেছিলেন, এবং পরে শ্রীচৈতন্যদেবের কৃপায় বৃন্দাবনবাসী হয়েছিলেন। বিপরীতে, সেই সময়ের হিন্দুদের কঠোর আচার-বিচার মুসলমানদের

কাছে রীতিমত চক্ষুশূল ছিল। কেননা, হিন্দুদের ওই ধরণের উন্নাসিকতায় একদিকে যেমন ইসলাম অপমানিত হয়েছিল, অন্যদিকে তেমনই বাংলার শাসককুলও তাতে অপদস্ত বোধ করেছিলেন।

ফলে ওই জাতীয় কঠোর অনুশাসনকে চূর্ণ করবার তাগিদও তখনকার মুসলিম শাসকশ্রেণীর মধ্যে কম ছিল না। বৃন্দাবন দাস লিখিত ‘চৈতন্যভাগবত’ (আদি) গ্রন্থের যবন হরিদাস-আখ্যানে

ওই ধরণের ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। যবন হরিদাসের বিরুদ্ধে কাজীর অভিযোগের ভিত্তিতে সুলতান হুসেন শাহ হরিদাসকে অবর্ণনীয় অত্যাচারে পীড়িত করেছিলেন। তিনি হরিদাসকে

গ্রেফতার করবার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন -

“যবন হইয়া করে হিন্দুর আচার

ভালমতে তারি আনি করহ বিচার।”

তখন ব্রাহ্মণেরা মুসলমানদের ঘৃণা করে তাঁদের যেমন ‘যবন’ আখ্যা দিয়েছিলেন, অন্যদিকে মুসলমানেরাও তেমনি হিন্দুদের প্রতি একইরকমের মনোভাবাপন্ন ছিলেন। ওই সময়ে ব্রাহ্মণেরা

নিজেদেরকে যেমন ‘শ্রেষ্ঠধর্মজাত’ বলে মনে করতেন, মুসলমানেরাও একইভাবে নিজেদের ‘মহাবংশজাত’ বলে বিবেচনা করতেন। সেই অহঙ্কারেই সুলতান হুসেন শাহ হরিদাসকে বলেছিলেন -

“আমরা হিন্দুরে দেখি নাই খাই ভাত,

তাহা তুমি ছাড় হই মহাবংশজাত।”

অবশ্য, এক্ষেত্রে এটাও মনে রাখবার দরকার রয়েছে যে, বৈষ্ণব-কবির উপরোক্ত রচনাংশে কিঞ্চিৎ স্বীয় ধর্ম-প্রবণতাও কাজ করে থাকতে পারে। যদিও, একথা বিশ্বাস করতেই মন

চায় যে, সত্যি কথা বলা ছাড়া কবিতার আর কোন দায় নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাশাপাশি এই কথা মনে করবার যথেষ্ট কারণও রয়েছে যে, মধ্যযুগের বাংলা-কাব্যগুলি যেহেতু ‘ধর্মকাব্য’

ছিল, হিন্দুধর্মের নবজাগরণ ঘটাবার কারণেই যেহেতু সেগুলি লিখিত হয়েছিল, সেহেতু ওইসব কাব্যপ্রণেতারা স্বীয় ধর্মের ঔজ্জ্বল্য বাড়ানোর তাগিদেই হয়ত অন্য ধর্মকে কিছুটা

অনুজ্জ্বল করে দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন।

ত্রয়োদশ শতকে তুর্কী অভিযানের আগেই বাংলায় মুসলমান-ধর্মের প্রবর্তন ঘটেছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করে থাকেন। এই প্রসঙ্গে ‘আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন’ বলেছিলেন যে, ভারতে

ইসলামের প্রচার প্রাথমিকভাবে বলপূর্বক ও রক্তপাত ঘটিয়ে শুরু হয়নি। মুসলমান সাধুসন্তরাই ভারতে ইসলাম প্রচারের সূত্রপাত করেছিলেন। ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন যে, তুর্কী

বিজয়ের অনেক আগেই বঙ্গদেশে ‘বাবা আদম শহিদ’, ‘শাহ সুলতান রুমি’ প্রমুখ সুফিসন্ত ও ধর্মীয় প্রবক্তারা পদার্পন করেছিলেন। তাঁরা মনে করেন যে, পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম অঞ্চলের

সঙ্গে মুসলিম-যোগাযোগ ইসলামের সূচনার কয়েকশো বছরের মধ্যেই হয়েছিল। পণ্ডিতেরা বলেন যে, কোথাও সৈন্যবাহিনী আসবার আগেই সেখানে ধর্মবাহিনীর পদার্পণ ঘটে। এই বিষয়ে

‘আবদুল করিম’, ‘ক্ষিতিমোহন সেন’, ‘জাফর শরিফ’, ‘রিসলে’ প্রমুখ প্রখ্যাত ঐতিহাসিকদের রচনা কিন্তু এই মতকেই সমর্থন করে। এহেন শান্তিপূর্ণ উপায়েও ইসলাম এই দেশে প্রচারিত

হয়েছিল। মধ্যযুগে বিদেশী অনুপ্রবেশের ফলে বঙ্গদেশের গ্রামাঞ্চলে, বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ইসলাম ক্রমশঃ প্রসারিত হয়ে পড়েছিল। অতীতে ইংরেজ ঐতিহাসিক

রিসলে দেখিয়েছিলেন যে, তখন প্রধানতঃ নিম্নবর্ণের হিন্দু ও উপজাতিদেরই ধর্মান্তর হয়েছিল। লক্ষ্যণীয় যে, হিন্দুধর্মে কিন্তু প্রচারের বিষয়টি গৌণ। কেননা, হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরের

কোনও উদ্দেশ্য নেই। অন্য ধর্মাবলম্বীকে নিজের ধর্মে দীক্ষিত করবার বিধি হিন্দুধর্মে অনুসৃত হয় না। কেননা, হিন্দুত্ব জন্মসূত্রে অর্জিত হয়, অন্য ধর্ম ছেড়ে হিন্দুত্ব গ্রহণ করা

যায় না। যদিও হিন্দুত্ব ছেড়ে অন্য ধর্মে দীক্ষা নিয়েও পরে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করে হিন্দুত্বে ফিরে আসবার বিধান শাস্ত্রে রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মতো

(খ্রিস্টান, বৌদ্ধ) ইসলামধর্মেও প্রচারের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রচারে স্বভাবতঃই হিন্দুধর্ম-সহ সকল ধর্মই, নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করে। ইসলাম যেহেতু

ধর্মান্তরকে সবিশেষ মূল্যবান বলে বিবেচনা করে, সেহেতু সেই ধর্মে প্রচারের গুরুত্বও অপরিসীম। এই প্রসঙ্গে আরো লক্ষ্যণীয় যে, ইসলামে কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোন যাজক বা

পুরোহিত বলে কিছু নেই। কোন ধর্মপ্রাণ মুসলমান নিজেই পরম শক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রণিপাত করতে পারেন। একেশ্বরবাদী ইসলাম যেমন মূর্তিহীন আরাধনায় বিশ্বাসী, সেহেতু তার

ধর্মচারণা পুরোহিত-নিরপেক্ষভাবেই সাধিত হতে পারে। যেকোন ধর্মপ্রাণ মুসলমান নিজেই তাঁর নিজের ধর্মের প্রচারক। অবশ্য পীর, ফকির, দরবেশ, গাজী, কাজি বা মৌলবীদের বিশেষ

 

132

 

ভূমিকাও ইসলামে দেখতে পাওয়া যায়। অতীতে ওই সব ধর্মজ্ঞানী পীর-ফকিরদের সাধারণ জীবনযাত্রা, বাণী এবং ক্ষেত্রবিশেষে নানা অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে সাধারণ মানুষ বিশেষভাবে

প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই মধ্যযুগের বাংলায় ইসলাম ধর্মপ্রচারে সেইসব প্রচারকেরা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের উদ্যোগে সেই সময়ের বাংলায় অনেকগুলি শিক্ষা-ধর্মকেন্দ্র

গড়ে উঠেছিল। পরে সেইসব কেন্দ্রগুলিকে ঘিরে পূর্ব-ভারতে বিহার শরিফ, সাতগাঁও, পাণ্ডুয়া, সোনারগাঁও, শ্রীহট্ট ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ শহর তৈরী হয়েছিল। মধ্যযুগের বাংলায় ইসলামধর্ম-

প্রচারে সুফি-সাধকেরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁরা সকলেই অবশ্য বহিরাগত ছিলেন না, তখনকার অনেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুফি-সন্তরাও সেই প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন। সেই

সময়ে কেবলমাত্র সাধারণ মানুষের উপরেই নয়, শাসকগোষ্ঠী তথা বৃহত্তর ধর্ম সমাজেও তাঁদের প্রভাব অপরিসীম ছিল। মধ্যযুগে যেসব সুফি-সাধক বাংলায় ইসলাম-ধর্মপ্রচারে সদর্থক

ভূমিকা নিযেছিলেন, তাঁরা ছিলেন - ‘আলাওল হক’, তাঁর পুত্র ‘নূর কুতুব আলম’, ‘শেখ জালালুদ্দিন তব্রেজী’, ‘শাহজালাল’ প্রমুখরা। তখনকার রক্ষণশীল, অনুশাসনগ্রস্ত, জাতপাত বিশ্বাসী

হিন্দুসমাজে সুফি, পীর, ফকির, দরবেশরা বিশেষ আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ধর্ম নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ ইসলামের বাণীকে তখন পরম-গ্রহণীয় বলে মনে করেছিলেন; আর,

ইসলামি প্রচারকরাও তৎকালীন হিন্দুসমাজ ব্যবস্থার সেই সুযোগটি পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করেছিলেন। উক্ত সময়ে কোরানের নির্দেশানুসারে আল্লাহর বাণী প্রচার করে সেই ইসলামি

প্রচারকেরা যেখানে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে বিপুল সংখ্যায় ধর্মান্তরিত করে দেশে মুসলমানের সংখ্যাবৃদ্ধি করেছিলেন, অনুরূপভাবে নানা কারণে তখন বঙ্গদেশে বিদেশী মুসলিম-জনগোষ্ঠীরও

অভিবাসন ঘটেছিল। এর ফলেও বঙ্গদেশে মুসলিম-জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেই সময়ে মূলতঃ তুর্ক, ফারসি, আরবি, মোঘল-জনগোষ্ঠী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও

ব্যক্তিগত কাজের সূত্রে এই দেশে এসেছিল। তাঁরা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। এর ফলে বাংলার সামাজিক জীবনেও এক নতুন অভিঘাত তৈরি হয়েছিল। সেই বিদেশী আগমনে

বাংলার তৎকালীন জনজীবন বিশেষভাবে আলোড়িত হয়েছিল। তাঁরা অনেকেই হিন্দু-নারীকে বিবাহ করবার ফলে বাংলার মুসলিম-জনসংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেই সময়ের ওই সব

বিদেশী পুরুষদের মধ্যে স্পষ্টতই কয়েকটি স্তবভেদ ছিল। ভারত-আক্রমণের প্রথম যুগে মুসলমান-যোদ্ধারা নিজেদের সঙ্গে নিজস্ব নারীদের এদেশে নিয়ে আসেন নি। যুদ্ধজয়ের পরে, দেশে

ইসলাম-আধিপত্য সুদৃঢ় এবং এদেশে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরী হওয়ার পরে তাঁরা অনেকেই নিজের দেশ থেকে স্ত্রীলোকদের এখানে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্য

অনেকেই আবার এদেশের হিন্দু-নারীরই দ্বার-পরিগ্রহ করেছিলেন। ইসলাম যেহেতু বহু-বিবাহে অনুমোদন দেয়, সেহেতু ওই সময়ের অনেক বিবাহিত মুসলমানও ফের একাধিক হিন্দু-নারীকে

বিবাহ করেছিলেন। তখন হিন্দু-নারীরা একদিকে তাঁদের কাছে যেহেতু নতুন অভিজ্ঞতা ছিলেন, সেহেতু মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বশেই তাঁরা সেই সংসর্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

অন্যদিকে, এই ধরণের বিবাহে যেহেতু মুসলমানের সংখ্যা বাড়ে, সেহেতু ইসলামও এই বিবাহকে কেবল অনুমোদনই করে না, এইরকম বিবাহকে অনুপ্রাণিতও করে। তখন অবশ্য এইসব বিবাহে

বাহুবল এবং দারিদ্র্যের সুস্পষ্ট একটা ভূমিকা ছিল। একই সাথে এই ধরণের বিবাহের পিছনে একটি নৃশংস প্রণোদনাও নিহিত ছিল। যুদ্ধের জয়-পরাজয়ে নারীর ভাগ্য-নির্ধারণ মধ্যযুগের

ভারতের এক মান্য রাজনৈতিক বিষয় ছিল। সেই সময়ে জয়ী-পক্ষ বিজিত-পক্ষের সমস্ত নারীর ভোগ-অধিকারী হতেন। বিশেষতঃ, হিন্দু-নারীকে করায়ত্ত করে তখনকার মুসলমান-বিজেতারা

নিজেদের জযোল্লাস, এবং হিন্দুদের চূড়ান্ত অবমাননাকে উপভোগ করতেন। সেই বিজিত নারীদের কেউ তাঁদের স্ত্রী, আবার কেউ বা দাসী হতেন। তবে স্ত্রী বা দাসী যেটাই হোন না কেন,

তাঁদের সকলকে তখন সর্বাগ্রে মুসলমান হতে হত। ইতিহাস বলে যে, মধ্যযুগের হিন্দু-রাজারাও কিন্তু একইভাবে অনেক মুসলমান-কন্যাদের বিবাহ করেছিলেন। ঐতিহাসিকেরা তুর্ক-আফগান

যুগে এই ধরণের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হিন্দু-মুসলিম বিবাহের তালিকা দিয়েছেন। যেমন - ইলিয়াস শাহের (১৩৪২-৫৭) সঙ্গে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামের ব্রাহ্মণ-কন্যা ফুলমতির

বিবাহ, রাজা গণেশের সঙ্গে সুলতান আজম শাহের বিধবা স্ত্রী ফুলজানির বিবাহ, হুসেন শাহের কন্যার সঙ্গে ভাতুরিয়ার ব্রাহ্মণ মদন ভাদুড়ির পুত্র কন্দর্পদেবেব বিবাহ, হুসেন শাহের

একাদশ কন্যার সঙ্গে মদন ভাদুড়ির একাদশ পুত্রের বিবাহ, হুসেন শাহের উজির চতুরঙ্গ খানের (তিনি ধর্মান্তরিত মুসলমান ছিলেন, নিজের মুসলমানত্ব দৃঢ়প্রতিষ্ঠ কবতে তিনি এক

মুসলমান-রমণীকে বিবাহ করেছিলেন) সঙ্গে জনৈক মুসলিম কন্যার বিবাহ, পীর খান জাহান আলির সঙ্গে সোনামণির বিবাহ (স্বামীর মৃত্যুর পরে সোনাবিবি ঘোড়াদীঘিতে আত্মহত্যা

করেছিলেন, জাহান আলির মুসলমান স্ত্রী বাঘিবিবি ওই দীঘির পশ্চিমপ্রান্তে সমাধিস্থ), এক ফকিরের সঙ্গে সাতক্ষীরার রাজা মুকুট রায়ের কন্যা চম্পাবতীর বিবাহ (ওই ফকির রাজাকে

হত্যা করে রাজকন্যাকে বিবাহ করেছিলেন, সাতক্ষীরার অদূরে চম্পাবতীর কবর হিন্দু-মুসলমানের যৌথ তীর্থক্ষেত্রের মহিমা পেয়েছে), ইউসুফ শাহর সঙ্গে হিন্দু-নর্তকী মীরার বিবাহ

(পরে মীরার নামকরণ হয়েছিল লোটনবিবি; গৌড়ের এক মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তরিত করে ইউসুফ শাহ তাঁর বিবির নামে সেই মসজিদের নামকরণ করেছিলেন, এবং সংলগ্ন দীঘিটিরও

অনুরূপ নামকরণ করা হয়েছিল), এবং মুর্শিদাবাদের মুর্তজা খানের সঙ্গে বৈষ্ণব-রমণী আনন্দময়ীর বিবাহের বিবরণ নানা লোকগাথায় ছড়িয়ে রয়েছে। (যদু বা জয়মল্লের বা সুলতান

জালালুদ্দিনের সঙ্গে আজম শাহের কন্যা আশমানতারার বিবাহকে এই তালিকায় স্থান দেওয়ার প্রয়োজন নেই; কারণ, আধুনিক সময়ের ঐতিহাসিকদের মতে, সেটি নিছকই এমন একটি

কিংবদন্তী, যার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নেই।) এই প্রসঙ্গে আরো উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে, কিন্তু তালিকা দীর্ঘ করলে প্রসঙ্গান্তর ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সময়ে

নিছক বাহুবলে মুসলমান বা হিন্দু-পুরুষেরা যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলমান রমণীদেরকে বিবাহ করে ঠিক কতখানি হাহাকার আর কতখানি প্রণয় অর্জন করেছিলেন, ইতিহাস সেটা লিখে রাখেনি।

কিন্তু এই বিবাহ-প্রথা যদি প্রণয়বাহিত হত, এবং তৎকালীন সমাজের সার্বিক অনুমোদন পেত, তাহলে যুদ্ধবিগ্রহ আর কূপমণ্ডুকতার মধ্যযুগ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক দিশা

তৈরি করত, তাতে কোন সন্দেহ থাকে না। কিন্তু তার পরিবর্তে ওই সব যুগপৎ নৃশংস ও করুণ বিবাহ কেবলমাত্র দুই সম্প্রদায়ের ধর্ম-জিঘাংসার উপকরণ হয়েই ইতিহাসে থেকে গিয়েছে।

তখন ওই সব প্রত্যক্ষ পথ ছাড়া পরোক্ষ পথেও ইসলাম বাংলায় প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। মধ্যযুগে কোন রাজনৈতিক বিজয়ের পরেই জয়ী সুলতানেরা বিজয়সৌধ হিসেবে মসজিদ ও

মাদ্রাসা স্থাপন করতেন। সেই মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার শিক্ষক আলিম ও মৌলবীরা সমাজে বিশেষ শ্রদ্ধার আসন পেতেন। এরপরে ক্রমশঃ তাঁরা অঞ্চল-বিশেষে নিজেদের প্রবল

ব্যক্তিগত প্রভাব তৈরি করে ফেলতেন। মসজিদ বা কবরস্থান-সংলগ্ন উৎসবে, অনাথালয় (ইয়াতিমখানা) এবং অতিথিশালায় (মেহমানখানা) সেইসব ইমাম এবং মৌলবীরা নানা জনহিতকর

কাজকর্ম করতেন। তখনকার সাধারণ মানুষ সে সবে বিশেষ আকর্ষণবোধ করতেন। অন্যদিকে ওই সময়ের পীর-ফকিরদের নিয়েও নানা অলৌকিক কাহিনী পল্লবিত হয়েছিল।

ধর্মান্তরকরণই সেই সবকিছুর নিহিত উদ্দেশ্য ছিল বলে পণ্ডিতেরা মনে করে থাকেন। সবকিছু মিলেই ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকের মধ্যে ইসলাম বিপুলভাবে বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল।

ধর্মীয় বিস্তার প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অটুট ও প্রসারিত করবার একটি উপায়-মাত্র। মধ্যযুগের ইতিহাসকে যতই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হোক না কেন, তুর্ক-

আফগান-মোঘল যুগকে যতই ধর্মীয় প্রবর্তনার যুগ বলে চিহ্নিত করা হোক না কেন, সেটা আসলে রাজনীতিরই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। ওই সময়ের মুসলমান শাসকেরা বিষয়টিকে যেভাবে

রূপায়িত করেছিলেন, তাতে এখন মনে করা যেতে পারে যে, তখন ধর্মই ছিল মুখ্য আর রাজনীতি ছিল গৌণ। কিন্তু, বিষয়টি কিন্তু মোটেই অত সরল ছিল না। আসলে, ধর্মকে সামনে রেখেই সেই

ধুরন্ধর সুলতানেরা নিজেদের রাজনীতির আখের গুছিয়েছিলেন। বাংলায় তথা ভূ-ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক বিন্যাসটি লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারা যায় যে, এখানেও মুসলমান শাসকেরা

একধরনের উপনিবেশ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ের বাংলা ইসলামি রাষ্ট্রের এক অঙ্গরাজ্য ছিল। এখানেও দিল্লীর প্রশাসনিক নীতি অনুযায়ী তখন হিন্দু-প্রজাদের কোনও

ধরণের রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। কোনও অ-মুসলমান নাগরিক এখানে তখন পূর্ণ নাগরিক-মর্যাদা পেতেন না। কেবলমাত্র ‘জিম্মি’দের (যাঁরা রাষ্ট্রের সঙ্গে আশ্রয়ের পরিবর্তে শ্রম-

প্রদান ও জিজিয়া কর দেওয়ার চুক্তি করতেন) তখন কিছুটা সহ্য করা হত। সেই সময়ের হিন্দুরা আক্ষরিক অর্থে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ছিলেন; তাঁরা নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দি

ছিলেন। যেমন ওই সময়ে তাঁদের ঘোড়ায় চড়া বা অস্ত্র-ব্যবহারের কোনও অনুমতি ছিল না, তাঁদের পছন্দমতো পোশাকের বদলে বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে হত, তাঁরা কাজীর কাঠগড়ায়

সাক্ষী হতে পারতেন না, এমনকি প্রকাশ্যে কোনও রকমের ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানও তখন তাঁরা করতে পারতেন না। ‘শেখ হামদানি’ তাঁর ‘জাখিরত-উল-মুলুক’ গ্রন্থে সেই সময়ের

জিম্মিদের উপরে আরোপিত কুড়িটি বিধিনিষেধের উল্লেখ করেছিলেন। তখন ওই সব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের ফরমান জারি করা হত। সেই সব ফরমানের পিছনেও

স্পষ্ট রাজনৈতিক কারণ ছিল। সেই সময়ের বিজিত-শ্রেণীর বিদ্রোহ-সম্ভাবনার কথা ভেবেই সুলতানেরা তাঁদের সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপের মধ্যে রাখতেন। মধ্যযুগের ভারতে ধর্মকে

সামনে রেখে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী যে সামাজিক বিন্যাস তৈরি করেছিলেন, সেটার মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল শোষণ এবং ক্ষমতা বলবৎ ও নিরঙ্কুশ রাখা। তখন তাঁরা মিশ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে

‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উক্ত সময়ে রাজ-দরবারে দীর্ঘ দু’শো বছর ধরে কোনও হিন্দু কিন্তু উচ্চপদে আসীন হতে পারেননি। সেই সময়ের কোনও নীতি-নির্ধারক পদেও

তাঁদের নিয়োগ যে স্পষ্টতই রাজনৈতিক কারণে বন্ধ করা হয়েছিল, সেই সহজেই অনুমেয়। এর ফল যা হওয়ার, সেটাই হয়েছিল। হিন্দুরা দাঁতে দাঁত চেপে মুসলমান শাসনের নিষ্পেষণ সহ্য

করেছিলেন, আর সময়মত প্রতিশোধ নেওয়ার অপেক্ষা করেছিলেন। তখন বাংলায় এক মেরুকরণ-সর্বস্ব সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।

ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। তবে সেটির একটি সামাজিক প্রকাশও থাকতে পারে। ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষেরই মৌলিক অধিকার।

কোনও ব্যক্তি মানুষ যেমন তাঁর স্বীয় ধর্মকে স্বীকার বা অস্বীকার করতে পারেন, তেমনি তিনি ধর্মের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করতে পারেন; এমনকি তিনি ইচ্ছা করলে কোন

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে জীবনধর্ম, মানবধর্মে ব্রতীও হতে পারেন - এসবই তাঁর ধর্মীয় অধিকারের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু, পৃথিবীর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই

মানুষের ব্যক্তিগত ধর্ম-ভাবনাকে বিন্দুমাত্র আমল দেয় না। ধর্মের সঙ্গে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই রাজনীতির সংমিশ্রণ ঘটেছে, আর তখন থেকেই ধর্মভিত্তিক মেরুকরণও স্থিরীকৃত

হয়ে গিয়েছে। ফলে ব্যক্তি-মানুষের ধর্মভাবনা ও ধর্মবিশ্বাস নিজের গুরুত্ব হারিয়েছে।

ধর্ম যখনই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তখনই বিপরীতবাদী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মই তাত্ত্বিকভাবে মানবপ্রেম ও সৌভ্রাতৃত্বের কথা

বললেও বারবার একে অন্যের সঙ্গে বিরোধে, যুদ্ধে, রক্তপাতে, শক্তিক্ষয়ে নিয়োজিত হয়েছে। রাজনীতির ধর্ম, এবং ধর্মের রাজনীতি ব্যক্তি-মানুষের উপরে চিরকালই প্রবলতর চাপ

সৃষ্টি করেছে। মানুষের উপরে তাঁর নিজস্ব ধর্মের চাপ ছাড়াও ক্রমশঃ অন্য ধর্মের চাপও তৈরী হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মই বারবার সোচ্চারে ঘোষণা করে যে, আমিই শ্রেষ্ঠ; বারবার

তারা মানুষের কাছে আহবান জানায় যে, এসো, আমি তোমাকে মুক্তির দিশা দেখাব। সুদূর অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত কখনও লোভে, তো কখনও ভয়ে, আবার কখনও প্রেরণায় মানুষ

ধর্মান্তরিত হয়েছে। শেষপর্যন্ত তাতে ব্যক্তি-মানুষের আত্মার কোনও মুক্তি কিন্তু হয়নি। বরং সে নানা ব্যবহারিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। তাতে লাভ যা হয়েছে, সেটা প্রতিষ্ঠানের -

ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতার। বাংলায় মুসলমান-আধিপত্যের আগে হিন্দু-যুগে বর্ণ-হিন্দুরা যেভাবে অন্ত্যজ ও বৌদ্ধদের সামাজিক নিগ্রহ এবং অবমাননার মধ্যে রেখেছিলেন,

পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা সেসবেরই প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। এই দুই ধর্ম-সম্প্রদায়ের প্রাতিষ্ঠানিকতার চাপে তখন সাধারণ মানুষের অবস্থা যে দুর্বিষহ হয়ে

উঠেছিল, সাধারণ মানুষের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান তৈরী হয়েছিল, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। আসলে, তত্ত্বগতভাবে, পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের মধ্যেই কিন্তু বিভেদের বীজ নিহিত রয়েছে।

একটু লক্ষ করলেই একটি ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের মৌলিক বিরোধটা চোখে ধরা পড়ে। এই বিরোধ যে কেবলমাত্র ব্যবহারিক, তা কিন্তু নয়। তত্ত্বগতভাবেও ধর্মগুলির মধ্যে বিরোধ

রয়েছে, এছাড়া পরস্পরবিরোধী মতবাদ তো রয়েছেই। বস্তুতঃ, ধর্মের এতরকম পরস্পর-বিরোধী সংজ্ঞা রয়েছে যে, তাতে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে। কেননা, এক ধর্মের সংজ্ঞার

সঙ্গে অন্য ধর্মের সংজ্ঞার সাথে বিন্দুমাত্র মেলে না। এক ধর্মের ঈশ্বর অন্য ধর্মের কাছে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন। হিন্দুধর্মে যেমন মূর্তিপুজোর বিধান রয়েছে, ইসলামে তেমনই

মূর্তিপুজো নিষিদ্ধ। আবার হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে জন্মান্তর একটি প্রধান বিষয় হলেও, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মে জন্মান্তরবাদ বলে কিছু নেই। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে যে, মানুষ

এই পৃথিবীতে কেবলমাত্র একবারই জন্মায়। মহম্মদ যেমন একবারই পৃথিবীতে জন্মেছিলেন, তেমনি যিশুও তাই। কিন্তু বুদ্ধ আগে নানা জাতক হয়ে জন্মে শেষে বুদ্ধ হয়ে জন্মাবার পরে তিনি

বোধিলাভ করেছিলেন, কাঙ্খিত নির্বাণ পেয়েছিলেন। হিন্দুধর্মে জন্মান্তরবাদে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাউল-তত্ত্বে তো একলক্ষ চুরাশি হাজার যোনি-ভ্রমণের কথা রয়েছে। খ্রিস্টধর্মেও

পৌত্তলিকতার কিছুটা স্থান রয়েছে। তত্ত্বগতভাবে হিন্দুত্ব আর ইসলাম এতটাই পরস্পরবিরোধী যে, অতীতে কোনওভাবেই এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কখনো মিলন বা মিশ্রণ সম্ভব

 

133

 

বলেও কেউ চিন্তা করতেন না। হিন্দুত্ব অন্তর্নিহিত পরমার্থে বিশ্বাসী, আর ইসলাম জ্ঞানাতীত আল্লাহর আদেশে বিশ্বাস করে। হিন্দুর ঈশ্বর যেখানে মূলতঃ সাকার (উপনিষদে

একেশ্বরবাদের কথা থাকলেও সেটাকে ব্রাহ্ম ছাড়া অন্যান্যরা মেনে নেন নি), ইসলামে সেখানে নিরাকার। হিন্দুরা বহু প্রতিমায় ঈশ্বরকে কল্পনা করেন, তাঁকে পূজা করেন; অন্য দিকে

ইসলামে মূর্তিপূজা, বহু-ঈশ্বরবাদের কোনও স্থানই নেই। এমনকি ইসলাম এক-পয়গম্বরের (রসুল) অস্তিত্ব ছাড়া অন্য পয়গম্বরের কথা কল্পনাও করে না। মুসলিম শাসনের ভারতে

হিন্দুদের ক্ষেত্রে এর ফল বিষময় হয়েছিল। সেই সময়ে শাসক মুসলমানদের কাছে হিন্দুদের মন্দির ও মূর্তিগুলি চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। এইসব মৌল অমিলগুলিই প্রতিটি ধর্মের মধ্যে

বিভেদরেখা তৈরী করেছে। বিশেষতঃ, ইসলামের একেশ্বরবাদ এবং হিন্দুত্বের বহুত্ববাদ; ইসলামের নিরাকার ধর্ম ও হিন্দুত্বের সাকার ধর্ম; ইসলামের সর্বজনীনতা ও হিন্দুত্বের

সঙ্কীর্ণতা, ইসলামের ধর্মান্তর ও হিন্দুত্বের অবিকল্প হিন্দুত্ব - এইসব তত্ত্বগত বিভেদও যে দুই ধর্ম-সম্প্রদায়ের মিলনের পক্ষে বাধাস্বরূপ, সেটা মনে রাখবার প্রয়োজন রয়েছে।

কেননা, উক্ত দুই ধর্মই জানায় যে, তার ধর্মই শ্রেষ্ঠ, অন্যটি অকিঞ্চিৎকর। এই শাস্ত্রীয় অহমিকাই দু’য়ের মধ্যে মিলন ও গ্রহণকে সুদূরপরাহত করে তোলে। সেক্ষেত্রে কেবলমাত্র

ধর্ম পরিত্যাগ করলেই এই মিলন সম্ভব। শুধুমাত্র দুটি ধর্মহীন মানুষই তাঁদের নিজেদের ধর্ম ছেড়ে পারস্পরিক প্রেমে মিলতে পারেন; সেখানে একটি তৃতীয় ধর্ম গড়ে ওঠে, সেটা হল

মিলনের ধর্ম। বাংলার ফকির ও বাউল-সম্প্রদায় অতীত থেকে সেই চেষ্টাই করেছেন। কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্র কখনওই সেই ধর্মহীন-ধর্মকে মেনে নেয় না। ফলে ফকির-বাউলদের তখনও

যেমন সমাজের প্রত্যন্ত প্রদেশে বসবাস করতে হয়েছিল, এখনও তাই করতে হয়। তবে ভারতের ইতিহাসে যে এই রকমের মিলন-প্রয়াস কখনো দেখা যায়নি, তা কিন্তু নয়। তৃতীয় মোঘল

সম্রাট আকবর ‘দীন-ই-ইলাহি’ নামের একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করে হিন্দু ও মুসলমান-মনকে মেলাতে চেয়েছিলেন। ‘দারা শুকো’ কোরান আর উপনিষদের সংমিশ্রণ করবার চেষ্টা

করেছিলেন। আধুনিককালে ‘বিনোবা ভাবে’ বিভিন্ন ধর্মের সারাৎসার সংকলন করে একধরনের ধর্ম-সমন্বয়ের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেইসব প্রয়াস শেষপর্যন্ত ব্যর্থতাতেই

পর্যবসিত হয়েছিল। ধর্ম যেহেতু ভাবাবেগ, সেহেতু বিজ্ঞানের রসায়ন এখানে কার্যকরী হয় না। হাইড্রোজেনও অক্সিজেন মিলে জল তৈরি হলেও, দুটি ধর্ম মিশিয়ে তৃতীয়, নতুন ও অপূর্ব

একটি ধর্ম তৈরী করবার চেষ্টা বস্তুতঃ ব্যর্থতারই নামান্তর। তাই বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কও কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। দুটি সমান্তরাল ধর্ম, দুটি পরস্পরবিমুখ রাজনৈতিক

শক্তি, দুটি ধর্ম ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক সমাজ-ব্যবস্থার বিপরীতমুখিতার মধ্যেই দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্ক, সম্পর্কের টানাপোড়েন নিহিত রয়েছে। এখানে মনে রাখা দরকার যে,

মধ্যযুগের ভারত তথা বঙ্গদেশে (বিশেষতঃ মধ্যযুগের প্রথমভাগে) হিন্দুদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও মর্যাদার অবনমনেও উক্ত দুই সম্প্রদায়ের সামাজিক ও ধর্মীয় সম্পর্কে আরো বেশি

ব্যবধান গড়ে উঠেছিল। লক্ষ্য করবার বিষয় হল যে, এর আগে যেসব আক্রমণকারী বাংলা অধিকার করেছিলেন, তাঁরা সংস্কৃতিগতভাবে সেই সময়ের হিন্দু-বাঙালির তুলনায় দুর্বলতর

ছিলেন। ফলে তাঁরা রাজ্যজয় করলেও ওই সময়ের বাংলার সংস্কৃতি ও ধর্মে কিন্তু কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। তাঁরা হিন্দুত্বের মূল স্রোতেই মিশে গিয়েছিলেন। কিন্তু

মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেই একই ঘটনা-প্রবাহ সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে গড়িয়েছিল। কেননা, ইসলাম তখন এক নবীন বিশ্বজনীন ধর্ম-হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। মধ্য-

প্রাচ্যের বিকশিত সভ্যতার পটভূমিকায় ইহুদিধর্ম, খ্রিস্টধর্ম, জরোথুস্ট্রীয়বাদ, নয়া প্লেটোবাদ, বৌদ্ধধর্ম ও বেদুইন-সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত ইসলাম ধর্ম ততদিনে পৃথিবীর নানা

দেশে নিজের প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এক আল্লাহ, এক রসুল, এক ধর্মগ্রন্থ ও এক সাম্রাজ্যের বাণী নিয়েই ইসলাম তখন এক সহজ, সুদৃঢ় ও মৌলিক ধর্ম হিসাবে বিশ্বের নানা

প্রান্তে ক্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই তুলনায় উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নিজেদের হীনবল ধর্ম ও সংস্কৃতি দিয়ে প্রতিহত করবার ক্ষমতা কিন্তু ওই সময়ের হিন্দুদের মধ্যে ছিল না।

যথাসময়ে সেই নবগঠিত ধর্ম তথা ধর্মাবলম্বীরা সাম্রাজ্যবাদের হাত ধরে ভারতেও প্রবেশ করেছিলেন। মধ্যযুগের বাংলায় তুর্কী আধিপত্য বিস্তার একদিকে যেমন সেই সময়কার হিন্দু-

শাসকদের রাজনৈতিক আধিপত্যকে খর্ব করেছিল, তেমনই তা হিন্দুধর্মের উপরেও প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিল। দুই ধর্মের তত্ত্বগত ও আচরণগত পার্থক্যই তখন অনিবার্য

সংঘাতের সৃষ্টি করে দিয়েছিল। বাঙালি-হিন্দুরা যেমন প্রথমাবধি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে উন্নাসিকতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষের চোখে দেখেছিলেন, মুসলমানরাও তেমনি তীব্রতর প্রতিহিংসার

মাধ্যমে সেটার জবাব দিয়েছিলেন। অনেক সামাজিক গবেষকই সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করে মুসলমান সমাজ-বিন্যাস অনেক বেশি আধুনিক ও প্রগতিশীল রায় দিয়েছেন। ইসলাম

শ্রেণীগত, জাতিগত ও বর্ণগত ভেদগুলিকে সামাজিক ক্ষেত্রেও বর্জন করে। ইসলাম প্রথম থেকেই সাম্যের কথা বলেছে। অন্যদিকে হিন্দুধর্ম কেবল বর্ণাশ্রম প্রথাকে তৈরীই করেনি,

সেটাকে সামাজিক জীবনে কঠোরভাবে বলবৎও করেছে। একেবারে প্রথমাবধি অস্পৃশ্যতা হিন্দুধর্মে এক পরম-গ্রহণীয় বিষয় বলে গণ্য হয়েছে। সামাজিক প্রথাগুলিতেও হিন্দু-মুসলমানের

মধ্যে দুস্তর পার্থক্য রয়েছে বলে দেখা যায়। হিন্দুর বিবাহ সম্পর্ক যেখানে চিরস্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য (অন্ততঃ শাস্ত্রীয় বচন অনুসারে), মুসলমানেরা সেখানে অনায়াসেই বিবাহবিচ্ছেদে

(তালাক) ধর্মীয় সমর্থন পেয়ে থাকেন। শাস্ত্রীয় বিধানে নারীর বৈধব্য পালনের কঠোর হিন্দু-বিধানের পাশে ইসলামে বিধবা মুসলমান-রমণীর পুনর্বিবাহের ধর্মীয় সমর্থন পাওয়া যায়।

এমনকি প্রাত্যহিক জীবনচর্যার ক্ষেত্রেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। খাদ্যাভ্যাস ও আহার গ্রহণেও দুই ধর্ম ভিন্নমুখী। হিন্দুরা যেহেতু গো-দুগ্ধ পান

করেন, সেহেতু গো-নিধনকে তাঁরা মাতৃহত্যা বলেই মনে করেন। অন্যদিকে, মুসলমানেরা গো-দুগ্ধ পান করেও গো-মাংসকেই তাঁদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় খাদ্য বলে বিবেচনা করেন। পাশাপাশি

শূকর ও কচ্ছপের মাংস মুসলমানের কাছে ত্যজ্য (হারাম) হলেও, হিন্দু-সমাজে কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ-বর্জনীয় নয়। অতীতে হিন্দুধর্ম জাতপাত নির্বিশেষে একত্রে খাদ্য-গ্রহণকে অনুমোদন

করত না। তখন ব্রাহ্মণেরা যেমন কায়স্থের পাক খেতেন না, কায়স্থরাও তেমনি নমঃশূদ্রদের খাদ্য গ্রহণ করতেন না। সর্বোপরি, সমস্ত সম্প্রদায়কে একসঙ্গে বসে খাদ্য-গ্রহণের

কোনও সুযোগই তখন হিন্দুধর্ম দিত না। এছাড়া পোশাক, সৎকার, অভিবাদন পদ্ধতি, উত্তরাধিকার আইন, কালগণনার পদ্ধতি ইত্যাদি নানা বিষয়েও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দুস্তর

পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে মধ্যযুগের মুসলমান-সুলতানেরা যে সবক্ষেত্রেই হিন্দুদের উপরে বিধিনিষেধ জারি করেছিলেন, তা নয়। তৎকালীন হিন্দুসমাজের অনেক রীতিনীতিকে তাঁরা

আবার মেনেও নিয়েছিলেন। তখন অনেকক্ষেত্রেই তাঁরা ইসলাম-অননুমোদিত বহু আচার-আচরণও হিন্দু জনগোষ্ঠীকে পালন করতে দিয়েছিলেন। হিন্দুদের বহু সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানও

তাঁরা বন্ধ করেন নি। প্রকাশ্যে পূজা-পার্বণ, বলি, প্রতিমা-শোভাযাত্রা, কীর্তন, সৎকার, মদ বিক্রি, কচ্ছপ ও শূকরের মাংস বিক্রি এবং খাওয়ায় তখন তাঁরা কোন ধরণের বিধিনিষেধ

কিন্তু আরোপ করেননি। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘দিল্লি সুলতানেট’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে নানা তথ্য লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। কিন্তু তবুও ক্রমশঃ দুই সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবন

এক গভীর সঙ্কটের মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত হয়েছিল। মধ্যযুগের ভারতের হিন্দু-জনগোষ্ঠী সততই অবিশ্বাস ও উৎকণ্ঠার মধ্যে নিজেদের দিন কাটিয়েছিলেন। তখন পাশাপাশি বাস করেও

দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কখনোই অভিপ্রেত সম্মিলন গড়ে ওঠেনি। ফলে তৎকালীন শাসক-মুসলমান ও শাসিত-হিন্দুর মধ্যে এক অদ্ভুত স্বাভাবিক টানাপোড়েন ও দূরত্ব তৈরী হয়েছিল।

তখন কেবলমাত্র সামাজিক ক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক অবস্থানেও দুই সম্প্রদায় বিভেদের বশবর্তী হয়ে পড়েছিল। আর সেক্ষেত্রেও ওই বিভেদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সেই ধর্ম। মধ্যযুগের

মুসলমান শাসকেরা যেখানে মূর্তি-ভাঙা আর মন্দির-বিনাশকে ‘ধর্মসম্মত’ বলে মনে করে গৌরববোধ করতেন, হিন্দুরা তেমনই সেই ধর্মনাশের ঘটনায় বিচলিত, বিষণ্ণ ও রাগান্বিত হতেন।

তখন মুসলমানেরা নিজেদের ধর্ম-প্রবণতায়, ইসলামের অনুপ্রেরণায় যে জেহাদকে গৌরবজনক বলে মনে করে উল্লসিত হতেন, হিন্দুরা সেই ঘটনায় হীনম্মন্যতা বোধ করতেন। এর ফলে,

তখন সুযোগ পেলেই ভারতীয় হিন্দু-রাজারাও নানাসময়ে প্রতিশোধকামী হয়ে উঠে মসজিদ চূর্ণ করেছিলেন ও মুসলমান নারীদের অবমাননা করেছিলেন। রাজপুতানার ‘মহারাণা কুম্ভ’ মুসলমান

নারীদের বন্দি করেছিলেন, একটি মসজিদও তিনি ধ্বংস করেছিলেন। মালবদেশের ‘মেদিনী রায়’ মুসলমান নারীদের ক্রীতদাসী করেছিলেন। বিজয়নগরের রাজারা মুসলমানদের হত্যা করেছিলেন

এবং মুসলমান নারী ও সম্পদ লুণ্ঠন করেছিলেন। সবক্ষেত্রেই (বলা ভালো, উভয় ক্ষেত্রেই) সেই একই দোহাই ছিল - ধর্মের দোহাই। অবশ্য, এই রকমের লিপিবদ্ধ তথ্য ইতিহাসের পাতায়

তুলনায় অনেক কম পাওয়া যায়। তাই অনুমান করা যেতে পারে যে, মুসলমান-ঐতিহাসিকেরা যেভাবে সুলতানদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিজয়গুলিকে উৎসাহদীপ্ত হয়ে বর্ণনা করেছিলেন,

যেহেতু সেগুলি তাঁদেরও মুসলমান হিসাবে গর্বিত ও উদ্দীপিত করেছিল, তেমনি মুসলমান-নিগ্রহ ও পরাজয়গুলিকে তাঁরা বিপরীত কারণেই উহ্য রাখতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, মুসলমান

আমলে কোনও হিন্দু সেভাবে রাজ-ঐতিহাসিক হওয়ার সুযোগ পাননি। ফলে সেইসব তথাকথিত হিন্দু-বিজয়ের ঘটনা হিন্দু-কলমে লিপিবদ্ধ হওয়ার সুযোগও পায়নি। সর্বোপরি, হিন্দুরা ওই সব

ভাঙনের খেলার বিশেষ সমর্থক ছিলেন বলেও মনে হয় না। ফলে উক্ত ঘটনাগুলিকে তাঁরা হিন্দুত্বের সহনশীলতা, এবং রক্ষণশীলতার পরিপন্থী, কলঙ্কজনক অধ্যায় বলে বিবেচনা করেই

সম্ভবতঃ গোপন রেখেছিলেন। কিংবা, তখন যাঁরা রাজসভার দাক্ষিণ্য পেয়েছিলেন, তাঁরা বিপরীতে আখ্যান রচনার কোন দায় নিতে চান নি।

চতুর্দশ শতকে মুসলমান পরিব্রাজক ‘ইবন বতুতা’ তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার সম্পর্কের নানা চিত্র লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সমকালীন ভারতীয় সাহিত্যেও এর নানা

বিবরণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও সমকালীন মুসলমান শাসনের নানা বৃত্তান্ত রয়েছে। মুসলমান-শাসনের প্রথম যুগে সুলতানেরা শত্রুপক্ষীয় হিন্দুদের কোনও রকমের উচ্চ

রাজপদে বসাননি। কেননা, তখন তাঁদের পক্ষে হিন্দু-প্রশাসকদের বিশ্বাস ও নির্ভর করা স্বাভাবিকভাবেই দুরূহ ছিল। কিন্তু, ঘটনাচক্রে পরবর্তীকালে সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তনও

ঘটেছিল। ক্রমশঃ হিন্দু-আমলারা যেমন সুলতানের আস্থা অর্জন করেছিলেন, তেমনই অনেকক্ষেত্রে মুসলমান উজির-ওমরাহরাও বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন। ফলে সুলতানি প্রশাসনে ধীরে

ধীরে হিন্দু-আধিপত্য বাড়তে শুরু করেছিল। উক্ত সময়ে মুসলমান আমির ও জায়গিরদাররা প্রায়শঃই সুলতানের প্রাপ্য কর প্রদানে অসম্মত হতেন। সেই অবস্থায় মুসলমান শাসকেরা হিন্দু

জমিদারদের ক্ষমতা-প্রদান করতে শুরু করেছিলেন। বাংলার ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, ‘শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’ (১৩৪২-৫৭) বহু হিন্দুকে রাজকার্যে নিযুক্ত করেছিলেন। ‘আমির খসরু’র

বিবরণ থেকে জানা যায় যে, গৌড়ের সুলতানের পক্ষে হিন্দু-সেনারা উড়িষ্যা-অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। অন্যদিকে তখন প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও হিন্দুদের হাতে কিছু কিছু ক্ষমতা দেওয়া

হয়েছিল। কর আদায়ের দায়িত্ব হিন্দু জমিদারদের উপরেই বর্তেছিল। ওই সময়ে বাংলার গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত হিন্দুদের নিজস্ব প্রাচীন শাসন-ব্যবস্থাও মুসলমান শাসকগোষ্ঠী বহাল রেখে

দিয়েছিলেন। সেই সময়ে সমাজে ‘ভূঁইয়া’ নামের একটি শ্রেণীর জন্ম হয়েছিল, তাঁরা আসলে হিন্দু ‘ভৌমিক’ বংশীয়। ওই সময়ে তাঁরা জমিদার হিসাবে প্রশাসনিক খ্যাতির অধিকারী ছিলেন।

শামসুদ্দিন ইলিয়াস সেই শ্রেণীর উপরে বিশেষ নির্ভর করতেন। সেই উচ্চ-শ্রেণীর আর্থিক স্বার্থ সুলতানের সঙ্গে জড়িত থাকবার ফলে, দুই পক্ষের মধ্যেই একধরনের প্রয়োজনভিত্তিক

বোঝাপড়া হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের ভূঁইয়ারা তো নিজস্ব সৈন্যবাহিনীও গঠন করেছিলেন। ক্রমশঃ সেই শ্রেণী সুলতানদের কাছে খুবই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। ভাদুড়িয়া (ভাতুরিয়া) পরগনার

হিন্দু-জায়গীরদার জগদানন্দ ভাদুড়ি শামসুদ্দিনের প্রধান উজির ছিলেন। তবে একই সাথে একথাও স্বীকার করতেই হবে যে, ব্যবহারিক কারণে হলেও, ওই সময়ের সুলতানদের সঙ্গে হিন্দু-

জনগোষ্ঠীর একাংশের একটি সুস্পষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তখন থেকেই ক্রমশঃ একধরনের সম্প্রীতির আবহও তৈরি হচ্ছিল। বস্তুতঃ, সুলতান হুসেন শাহই সেই ধারার পথিকৃৎ ছিলেন।

এর আগে গণেশ (১৪১০-১৮) ও জালালুদ্দিনের (১৪১৮-৩৩) শাসনকালেও গৌড়-দরবারে হিন্দু-পণ্ডিত ও প্রশাসকদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি হয়েছিল। পরে সেই ধারা অন্যান্য সুলতানদের

আমলেও অনুসৃত হয়েছিল। ক্রমে হিন্দুরা মুসলিম শাসকদের রাজস্ব ও সেনাপতিত্বের দায়িত্বেও বহাল হয়েছিলেন। মধ্যযুগের সামাজিক ইতিহাসে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ও অন্যান্য

হিন্দু-শ্রেণীর আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। সুলতানেরা নিজেদের প্রশাসনের অনেক গুরু দায়িত্বই তাঁদের উপরে ন্যস্ত করেছিলেন। গণেশ ও জালালুদ্দিনের সময়ে পণ্ডিত ও প্রশাসকরূপে

‘বৃহস্পতি মিশ্র’ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি কয়েকজন গৌড়াধিপতির মন্ত্রী হয়ে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এছাড়া ওই সময়ের বিভিন্ন মুসলিম শাসককে প্রীত করে

তিনি কবিচক্রবর্তী, কবিপণ্ডিতচূড়ামণি, পণ্ডিতসার্বভৌম, রাজপণ্ডিত, মহাচার্য, রায়মুকুট ইত্যাদি খেতাব এবং তাঁদের কাছ থেকে হার, কুণ্ডল, রতনচূড়, ছত্র ও তুরগ উপহার

পেয়েছিলেন। সুলতান হুসেন শাহর আমলেও ব্রাহ্মণরা রাজসভায় বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিলেন। সেই সময়ে ‘সনাতন’ এবং ‘রূপ গোস্বামী’ নামের দুই পণ্ডিত ও কবি-ভ্রাতার বিবরণ ড.

সুকুমার সেনের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ (প্রথমপর্ব) গ্রন্থের ‘মধ্যযুগে বাঙলা ও বাঙালী শীর্ষক’ অধ্যায়ে পাওয়া যায়। সেই দুই ভাই একাধারে প্রশাসক ও কবি ছিলেন। সনাতন ছিলেন

সুলতানের ‘দাবীর-খাস’ (ব্যক্তিগত সচিব), এবং রূপ ছিলেন ‘সাকর মল্লিক’ (রাজস্ব সচিব)। তাঁদের পূর্বপুরুষরা কর্নাটের রাজা বা ভূস্বামী ছিলেন। ‘রূপেশ্বর’ সম্পত্তি-বঞ্চিত হয়ে

শিখরভূমে বাস করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর পুত্র ‘পদ্মনাভ’ রাজা দনুজমর্দনের অনুরোধে ‘নরহট্টক’ (অধুনা নৈহাটি) গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মুকুন্দের পুত্র

 

134

 

কুমারের তিন পুত্র ছিলেন - সনাতন, রূপ ও বল্লভ। বল্লভের পুত্র ছিলেন ‘জীব’। বল্লভ সুলতানের মুদ্রাশালার অধ্যক্ষর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তাঁদের অন্যান্য আত্মীয়রাও তখন উচ্চ-

রাজপদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। মধ্যযুগের বাংলার মুসলমান শাসনে কায়স্থ শ্রেণীর প্রভাবও যথেষ্ট ছিল। তৎকালীন প্রশাসন পরিচালনা ও সেনাবাহিনীর সংগঠনে এই শ্রেণীর বিশেষ

অধিকার ও প্রতিপত্তি তৈরী হয়েছিল। সুলতান ‘রাকনুদ্দিন বারবক শাহ’ (১৪৫৯-৭৪) ‘মালাধর বসু’ নামের একজন হিন্দু-কায়স্থকে নিজের প্রধান রাজকর্মচারী পদে নিয়োগ করেছিলেন।

তাঁর বংশধরেরাও রাজ-দরবারে বহু দায়িত্বশীল পদে আসীন ছিলেন। অন্যদিকে ‘গৌর মল্লিক’ নামের একজন হিন্দু সেনাপতি ও ‘রামচন্দ্র খান’ নামের একজন হিন্দু প্রশাসকের উল্লেখও

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য থেকে পাওয়া যায়। কথিত আছে যে, সেই রামচন্দ্রের সাহায্যেই শ্রীচৈতন্যদেব, গৌড়ের সুলতান ও উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্রের সংঘর্ষের সময়ে, বাংলা-সীমান্ত

পেরিয়ে নীলাচলে (উড়িষ্যা) গিয়েছিলেন। হুসেন শাহর এক উজির ছিলেন বর্ধমানবাসী ‘গোপীনাথ বসু’, ওরফে ‘পুরন্দর খান’। বৃন্দাবন দাসের লেখা ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’ ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের

লেখা ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে ওই সব হিন্দু-রাজপুরুষদের বিবরণ পাওয়া যায়। সুলতানি আমলের বাংলায় ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ ছাড়া বৈদ্য-সম্প্রদায়ও বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।

তখন রাজ-পরিবারের অন্তঃপুরে বিশ্বস্ত বৈদ্যরা ছাড়া অন্য কেউ সঙ্গত কারণেই চিকিৎসা করবার সুযোগ পেতেন না। হুসেন শাহের প্রধান চিকিৎসক ছিলেন ‘মুকুন্দ দাশ’ (গুপ্ত)। এই

বৈদ্য-শ্রেণীরা পাল ও সেন বংশোদ্ভূত। এছাড়া সুকুমার সেনের গ্রন্থে ওই সময়ের ছত্রী ও বণিকদের মধ্যে ‘কেশব ছত্রী’ ও ‘কুলধরের’ নামোল্লেখ পাওয়া যায়। মধ্যযুগের মুসলমান-

রাজসভায় হিন্দু-রাজকর্মচারীরা যে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গেই বিরাজিত ছিলেন, সেটা তাঁদের বিভিন্ন পদবি ও খেতাবের ব্যবহার থেকেও বোঝা যায়। বাংলায় মুসলমান-বিজয়ের প্রথম দু’শো

বছর নৈরাজ্য ও অশান্তিতে অতিবাহিত হলেও চতুর্দশ শতকের শেষে এখানে স্বাধীন ইলিয়াস শাহী বংশের আধিপত্য স্থাপিত হলে দেশে সুস্থিতি ফিরে এসেছিল। তখন সাম্প্রদায়িক

বিদ্বেষও অনেক কমে যাওয়ার ফলে সুলতানেরা তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই প্রশাসনে হিন্দু-কর্মচারীদের নিয়োগ করেছিলেন, এবং তাঁদের যথাবিহিত সম্মান প্রদানও করেছিলেন। তখন সেই

উদ্দেশ্যে দ্বিস্তর পদবি-প্রদান পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন। সেটার প্রথম (প্রাচীন) স্তরে ছিলেন নিয়োগী ও চৌধুরী (মুকুন্দরাম লিখেছিলেন - “নিয়োগী চৌধুরী নহি না করি তালুক।”);

এবং দ্বিতীয় (নবীন) স্তরে ছিলেন শিকদার, ডিহিদার, মজুমদার, বকসি ইত্যাদি। ওই সময়ে হিন্দু-বাঙালির পরিচ্ছদেও মুসলমানি প্রভাব দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। রাজ-দরবারের হিন্দু-রাজা

ও সেনাপতিরা মুসলমানি পোশাক পরা শুরু করেছিলেন। আচার্য সুকুমার সেন সম্পাদিত রূপরাম চক্রবর্তীর ‘ধর্মমঙ্গল’ ও ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে (সম্ভবতঃ সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে

রচিত হয়েছিল) এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় -

“পরিল ইজার খাসা নাম মেঘমালা

কাবাই পরিল দশ দিগ করে আলা

পামরি পটুকা দিয়া বান্ধে কোমর বন্ধ …”

রূপরাম সুলতানের (শাহসুজা) হিন্দু-সেনাপতি লাউসেনের কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন। সমসাময়িক গ্রন্থগুলি থেকে তৎকালীন বাংলার শহরে ও গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার পারস্পরিক

সম্পর্কের তারতম্যও লক্ষ্য করা যায়। তখন সাধারণতঃ গ্রামীণ জীবনে সেই সম্পর্ক অনেক প্রীতিপূর্ণ ছিল। বস্তুতঃ, গ্রাম-জীবনে স্বার্থের প্রশ্নটি যেখানে তখন অনেকটাই সীমায়িত

ছিল, সেখানে সম্পর্কের জটিলতাও তখন হ্রস্ব ছিল। ঐ সময়ে ব্রাহ্মণেরা তথাকথিত ম্লেচ্ছ-আচার বর্জন করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে কিন্তু মুসলমানদের সঙ্গে সুসম্পর্কই বজায় রেখে

চলতেন। অন্যদিকে মুসলমানরাও তখন হিন্দু-পণ্ডিতদের প্রতি যথোচিত সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। প্রসঙ্গতঃ কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে শ্রীচৈতন্যদেব ও

কাজীর বাদানুবাদ-অংশে কাজীর সংলাপে সেই গ্রাম-সম্পর্কের বিবরণ লক্ষ্য করা যেতে পারে। চৈতন্যদেবের প্রকাশ্যে কীর্তনের উপরে কাজী নিষেধাজ্ঞা জাবি করবার ফলে চৈতন্যদেব

সদলবলে

কাজীর বাড়িতে চড়াও হয়েছিলেন। কাজী চৈতন্যর রুদ্রমূর্তি দেখে তখন তাঁর সঙ্গে চৈতন্যর গ্রাম-সম্পর্কের উল্লেখ করে বলেছিলেন -

“গ্রাম-সম্পর্কে চক্রবর্ত্তী হয় মোর চাচা,

দেহ-সম্বন্ধে হইতে হয় গ্রাম-সম্বন্ধ সাঁচা।

নীলাম্বর চক্রবর্ত্তী হয় তোমার নানা,

সে সম্বন্ধে হও তুমি আমার ভাগিনা।”

আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার কাজীর এই উক্তিকে বিদ্রূপ বলে গণ্য করলেও, অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতে ওই সময়ের এহেন গ্রাম-সম্পর্ককে একেবারে তুচ্ছ মনে করবারও কোন কারণ

নেই। বাংলার ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, ধর্মান্তরের পরেও তখনকার বহু নবীন মুসলমানই তাঁদের আগেকার হিন্দু-নামই রক্ষা করে চলেছিলেন। ‘বিবি মালতী’ বা ‘শুভোধন’ ইত্যাদি নামগুলি

এই সত্যিকেই প্রতিষ্ঠা করে। ওই সময়ে হিন্দুদের নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে মুসলমানদের অংশগ্রহণও ক্রমশঃ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কাজীরা প্রাতিষ্ঠানিক কারণে নাম-

সঙ্কীর্তনে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ওই সময়ের সাধারণ মুসলমান সমাজ কিন্তু সেটাকে যথেষ্ট উপভোগ করতেন। বিজয়গুপ্তর ‘মনসামঙ্গল’ এবং বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ (আদি)

গ্রন্থেও অনুরূপ বিবরণ পাওয়া যায়।

মধ্যযুগে সারা পৃথিবীর ধর্ম ও সমাজ অবিচ্ছিন্ন সূত্রে গ্রথিত ছিল। তৎকালীন এশিয়া ও ইউরোপের চিত্রটিও একই রকমের ছিল। ভারতের ক্ষেত্রেও সেটার কোনও অন্যথা ঘটেনি।

তৎকালীন বাংলায় ধর্ম-কেন্দ্রিক শাসন-পদ্ধতি দুই সম্প্রদায়কে পরস্পর-বিদ্বেষী করে তুলেছিল। ওই সময়ের সুলতানরা রাজ্যজয়ের পরে ইসলামের প্রসারের প্রতীক হিসাবে একদিকে

যেমন মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, অন্যদিকে তেমনি মন্দির চূর্ণ করেছিলেন। তখন অনেক সময়ে যেমন মন্দিরই মসজিদে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল, তেমনি অনেক বৌদ্ধস্তূপের উপরেও

মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। অবশ্য এর একটি অন্য দিকও রয়েছে। ওই সব রূপান্তরিত মসজিদ, দরগা, কবর, মাজারগুলিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠী এক

অন্যতর ঐক্যে পরস্পর-সম্পৃক্ত হয়েছিল। বহু দরগা বা মাজারে দুই ধর্ম-সম্প্রদায়ই যুক্তভাবে উপাসনায় ব্রতী হয়েছিল। বাংলায় এখনও সেরকম দৃষ্টান্ত কম কিছু নেই। মালদহে সুলতান

সিকন্দর শাহ নির্মিত আদিনা মসজিদ বা নুর কুতুব আলমের মসজিদ ও দরগা, গৌড়ে ভাগীরথীর তীরে জালালুদ্দিন ফতে শাহের গুণবন্ত মসজিদ, রাজশাহীর নিমাই শাহের দরগা, চব্বিশ

পরগনার হাড়োয়া গ্রামে বৈষ্ণব গোরাচাঁদের মসজিদ বা ঘুটিয়ারি শরিফে পীরগাজী মুবারক আলির দরগা ও মসজিদ, মল্লিকপুরের কাছে মহিনগরে হুসেন শাহের উজির পুরন্দর খানের (হিন্দু-

নাম গোপীনাথ বসু) মসজিদ, সুন্দরবন অঞ্চলে ধবধবি গ্রামে বরখান গাজীর দরগা (সেখানে স্থাপিত গাজীর মূর্তির সামনে এখনও প্রতি শুক্রবার মুসলমানেরা নামাজ পড়েন),

লক্ষ্মীকান্তপুরে মণিবিবির কবর ও মসজিদ, গোবরডাঙ্গায় পীর ঠাকুরের থান বা ওলাবিবির থান, বীরভূমের পাথরচাপুড়িতে দাতা মাহবুব শাহর মাজার, কালনায় বদর সাহেব ও মজলিম

সাহেবের কবর ইত্যাদি অজস্র হিন্দু-মুসলমান যৌথ ধর্মাচরণের ক্ষেত্র এখনও রয়েছে। এছাড়া মুসলমানদের মহরম তাজিয়ার সঙ্গেও মুসলমান-সংস্কারকরা হিন্দু-পৌত্তলিকতার মিল

খুঁজে পেয়েছিলেন। অতীতের গোঁড়া মুসলমানরা হিন্দুদের দুর্গাপ্রতিমার বিসর্জন বা রথযাত্রার সঙ্গে মহরমের সমুহ সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছিলেন, এবং সেই কারণে তাঁরা মহরম উপলক্ষ্যে ওই

ধরণের কোন অনুষ্ঠানকে ধর্মবিরুদ্ধ অনুষ্ঠান বলে ঘোষণাও করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ‘জেমস ওয়াইস’ জানিয়েছিলেন যে, অতীতের পাটনা ও বিহার শরিফ অঞ্চলের ১,৪০০ তাজিয়া

শোভাযাত্রার মধ্যে ৬০০টির পরিচালনার সঙ্গেই কোন না কোন ভাবে হিন্দুরা যুক্ত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপরীতে গিয়ে নিতান্ত সাধারণ মানুষের ভাবাবেগ তখন ওভাবেই প্রবাহিত

হয়েছিল। ওই সময়ের স্থানীয় লোকাচারগুলির সঙ্গেও হিন্দু-মুসলমানের যৌথ ভাবাবেগ জড়িয়ে গিয়েছিল। জ্যোতিষশাস্ত্র, ওঝা, মন্ত্রতন্ত্র, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি বিষয়ে তখন সম্প্রদায়-

নির্বিশেষে যথেষ্ট সাদৃশ্য তৈরি হয়েছিল (আজও রয়েছে)। তখন বাংলা-বিহারের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ওলাওঠা রোগের কবল থেকে বাঁচবার জন্য দুই সম্প্রদায়ই ‘ওলাদেবী’ তথা ‘ওলাবিবি’র

পূজা সেই মধ্যযুগ থেকে আজও করে চলেছেন। একইভাবে হুরি-পরিকে দুই সম্প্রদায়ই বিশ্বাস করেছিল। এমনকি হিন্দুদের সহমরণ প্রথানুসরণে জীবিত মুসলমান স্ত্রীও ক্ষেত্রবিশেষে মৃত

স্বামীর সঙ্গে কবরস্থ হয়েছিলেন। ক্রমশঃ হিন্দুদের বিবাহ-পণপ্রথা বা আড়ম্বর মুসলমান সমাজেও নিজের স্থান করে নিয়েছিল। অর্থাৎ লক্ষ্য করবার বিষয় হল যে, তৎকালীন

সমাজের বা রাজনীতির উপর-স্তরে স্বার্থবাহিত যে-ভেদবুদ্ধি প্রবহমান ছিল, নীচের মহলে কিন্তু সেটার বিপরীত মিলনাভিলাষী ঢেউই প্রবাহিত হয়েছিল। হয়তো শিক্ষার অভাবেই ওই

সমাজের নিম্নবর্গীয় দরিদ্র মানুষেরা নানা কুসংস্কারের ক্ষেত্রেই একীভূত হয়েছিলেন; কিন্তু, উচ্চবর্ণের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ যে উন্নাসিকতা ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিতে

পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হতেন বা এখনও হন, সেটাকেও খুব সু-সংস্কার বলা যায় না। রাজনীতি, বিধান বা শরিয়তের বাইরে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী জীবনের প্রয়োজনে, আবেগের বশে

সম্মিলনের যে গুরুত্ব তখন অনুধাবন করেছিলেন, সেটা নিশ্চয়ই ছোট করে দেখবার নয়। স্থানীয়ভিত্তিক নানা লোকাচার-তথ্যের গভীর অনুধাবনই বুঝিয়ে দেয় যে, ধর্ম বা রাজনীতি নয় -

মানুষই শেষ কথা। অন্ততঃ লোকসংস্কৃতির গবেষকরা সেই কথাই বলে থাকেন। বাংলার সূফী-সাধক ও পরবর্তীকালের বাউল-সম্প্রদায় কিন্তু সেই সমন্বয়ের বাণীই প্রচার করেছিলেন।

অন্যদিকে মুসলমান শাসনে নাভিশ্বাসগ্রস্ত হিন্দুধর্মের নবজাগরণের জন্য শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) তখন একক প্রচেষ্টা করেছিলেন। নাম-সঙ্কীর্তনের মায়ায় তিনি মুসলমান

শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। মধ্যযুগের বঙ্গদেশে চৈতন্যকে কেন্দ্র করেই বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হিন্দুধর্ম এক নবজাগরণের মুখোমুখি হয়েছিল। তাঁর প্রচারিত বৈষ্ণবধর্মে ‘যবন

হরিদাসের’ও স্থান হয়েছিল। তিনি মুসলমান শাসনের বিরোধিতা করলেও মুসলমানকে কখনোই অপাংক্তেয় বলে মনে করেননি। তিনিও গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতাই করেছিলেন।

মোঘল-পাঠান-যুগের অবসান ঘটবার পরে ভারতে যখন ইংরেজ শাসনের যুগ শুরু হয়েছিল, তখন তথাকথিত সুসংস্কৃত জাতি ইংরেজও ফের ইতিহাসের চাকাকে পিছন দিকে গড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা

করেছিল। ভারতে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের পুরনো টানাপোড়েনকে তাঁরা প্রথমাবধি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে বারবার নানা উপায়ে উভয় সম্প্রদায়ের পুরনো ক্ষত খুঁচিয়ে

জাগিয়ে তুলেছিলেন। পরাধীন ভারতের ইতিহাসের সরণি লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, এদেশে ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কংগ্রেসের নেতৃত্বে শুরু হলেও, ক্রমশঃ সেটা

একপেশে হয়ে পড়েছিল। দেশকে মাতৃরূপে বন্দনা করা, তার সঙ্গে পৌত্তলিকতাকে ওতপ্রোত করে ফেলা, অনগ্রসর মুসলমান সমাজকে আন্দোলনের মূল স্রোতে না নিয়ে আসা - এইসব

কার্যকারণে ভারতের তথাকথিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কখনোই একটা সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করতে পারেনি। মুসলমান জনগোষ্ঠী ক্রমশঃ সেই আন্দোলন থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন

হয়ে পড়েছিল। আর ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা সেই সুযোগটি বেশ ভালভাবেই নিজেদের কাজে লাগিয়েছিলেন। তাঁরা হিন্দু ও মুসলমানকে বিচ্ছিন্ন করবার পরিকল্পনায় দুই সম্প্রদায়কেই নিজস্ব

রাজনৈতিক দল গড়ার ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। কেবল উৎসাহ যোগানোই নয়, বঙ্গদেশে তাঁরা সেটার অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টিরও নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দুই সম্প্রদায়কে পরস্পরের প্রতি

বিদ্বেষী করে তোলবার নানা চক্রান্তকে তাঁরা ফলপ্রসূও করেছিলেন। শেষপর্যন্ত, ১৯০৫ সালে তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বৃহত্তর বাংলাকে বিভক্ত করবার প্রথম উদ্যোগটি

নিয়েছিলেন। যদিও সেক্ষেত্রে সেই সময়ের বাংলার আয়তনের বিস্তৃতির অজুহাত দেখানোর মাধ্যমে প্রশাসনিক অসুবিধার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু সেটার মধ্যে আসলে ইংরেজদের

সুকৌশলী মনোভাবই নিহিত ছিল। হিন্দু-মুসলমান-সমৃদ্ধ বৃহত্তর বাঙালি-জনগোষ্ঠীকে বিভাজিত করলে যে সম্মিলিত শক্তি অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হবে, তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী সেটা বুঝতে

পেরেছিল। সেই কারণে, ইতিহাস বিখ্যাত ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির প্রযোগ করে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা সারা ভারতের মতো বাংলাতেও একাধিপত্য স্থাপনের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন।

সেই উদ্দেশ্যেই ইংরেজ-সরকার একদিকে পশ্চিমবাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা; এবং অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ ও অসমকে রেখে বৃহত্তর বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছিল। এর ফলে ওই সময়ের

সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সামাজিকভাবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এর আগে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা একটি প্রাদেশিক শাসনের অধীনে ছিল। ১৮৭৪ সালে অসমকে অবশ্য

একজন পৃথক মুখ্য প্রশাসকের অধীনে একটি পৃথক প্রদেশের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। এর আগে ভৌগোলিক কারণে সংযুক্ত বঙ্গকে শাসন করবার কিছু প্রশাসনিক অসুবিধা হওয়ার ফলে

 

135

 

সেই বিরাট প্রদেশকে প্রশাসনিক কারণে বিভক্ত করবারও কিছু যৌক্তিকতা ছিল। ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকার আপাতভাবে বঙ্গভঙ্গের জন্য সেই যুক্তি দেখালেও, সেটার পিছনে যে

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই মুখ্য ছিল, তা পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ও ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকারের বিভিন্ন নীতি, সরকারি ভাষ্য ও নানা নথিপত্র ঘেঁটে ঐতিহাসিকেরা প্রমাণ করে

দিয়েছিলেন। বস্তুতঃপক্ষে, ওই সময়ে বঙ্গ-বিভাগের আসল কারণটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ছিল। ইতিহাস বলে যে, ভারতে মুসলমান-শাসনকাল থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসনের প্রথম পর্ব

পর্যন্ত মুসলমান-জনগোষ্ঠী কেবলমাত্র নিজেদের ধর্মকে কেন্দ্র করেই জীবন কাটিয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে সাধারণের মধ্যে শিক্ষা-বিস্তারের জন্য তেমনভাবে যেমন কোন উদ্যোগ

নেওয়া হয়নি, তেমনি মুসলমানেরাও সেরকমভাবে শিক্ষাগ্রহণের ব্যাপারে কোনও আগ্রহও দেখান নি। এর ফলে, ক্রমশঃই হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানেরা অনেক পিছিয়ে পড়েছিলেন। ভারতে

ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে সিপাহী-যুদ্ধের আগে পর্যন্ত হিন্দুরা ব্রিটিশদের সঙ্গে যেরকম সহযোগিতা করেছিলেন, মুসলমানেরা সেটা করেন নি। ওই সময়ে নবগঠিত হিন্দু-ধনিকশ্রেণী

নিজেদের স্বার্থের জন্য ইংরেজদের সঙ্গে সেই সহযোগিতার পথে চললেও উচ্চবিত্ত মুসলমানেরা কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তেমন কিছু করেন নি। ইংরেজিশিক্ষা-গ্রহণে হিন্দুরা আগ্রহ

দেখালেও, মুসলমানেরা প্রথমদিকে তাতে তেমন কোন আগ্রহবোধ করেন নি। এসবের ফলে মুসলমানেরা তখন ক্রমশঃই প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়ছিলেন। বিপরীতে, একদিকে

ইংরেজ-সহযোগিতা, অন্যদিকে ইংরেজি-শিক্ষা হিন্দুদের অর্থনৈতিকভাবেও ক্রমশঃ সম্পন্ন করে তুলেছিল। আর সেই অর্থনৈতিক বিভেদের ফলেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার ধর্মীয়

সাম্প্রদায়িকতাও তখন ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেই সময়ের হিন্দু-ভূস্বামীরাও শ্রেণীস্বার্থে মুসলমান প্রজা ও কৃষি শ্রমিকের উপরে নানা ধরণের অত্যাচার ও শোষণ চালিয়েছিলেন।

১৮৫৭ সালের সিপাহী-বিদ্রোহ ইংরেজদেরকে খুব বড় একটি ধাক্কা দিয়েছিল। তখন থেকেই মুসলমান উচ্চবিত্ত সমাজও ক্রমশঃ নিজেদের স্বার্থেই ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতার

অবস্থান গ্রহণ করেছিল, আর সুচতুর ইংরেজরাও সেই সুযোগটি পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করেছিলেন। কেননা, ইতিমধ্যেই হিন্দু-উচ্চবিত্তশ্রেণী কংগ্রেসের মাধ্যমে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে

জড়িয়ে পড়বার ফলে ব্রিটিশ সরকার সঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, ওই আন্দোলন ক্রমশঃ সুদূরপ্রসারী হবে। ফলে তাঁরা সেই আন্দোলনের সূচনাতেই সেটাকে প্রতিরোধ করবার জন্য সক্রিয়

হয়েছিলেন। নিজেরা আড়ালে থেকে সেই প্রতিরোধের কাজটি তাঁরা অন্য কোনও অভ্যন্তরীণ শক্তির সাহায্যেই করতে চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে ভারতের মুসলমান-সমাজকেই তাঁরা নিজেদের

স্বার্থপূরণের অবলম্বন হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। অন্যদিকে কংগ্রেস দেশের মুসলমান-সম্প্রদায়কে তাঁদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সেভাবে শামিল করতে পারেনি। ব্রিটিশ

সরকার সেই সুযোগটিও তখন গ্রহণ করেছিল। তাঁদের পক্ষে মুসলমানদের একথা বোঝানো খুবই সহজ হয়েছিল যে, ওই আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক স্বার্থের

ন্যূনতম কোন যোগ নেই। তবে কেবলমাত্র বোঝানোই নয়, মুসলমান-সম্প্রদায়কে তাঁরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে সংঘর্ষের পরিবেশও সৃষ্টি করেছিলেন। তৎকালীন হিন্দু-

মধ্যবিত্তশ্রেণীর অপেক্ষাকৃত দ্রুত বিকাশ, এবং তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান সঙ্কুচিত করবার জন্যই সেই তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী পথটিকে তাঁরা খুব ভেবেচিন্তেই খুঁজে নিয়েছিলেন।

‘লর্ড কার্জনের’ তৎকালীন কয়েকটি ভাষণ, এবং চিঠিপত্রকে উদ্ধৃত করে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ‘সুমিত সরকার’ তাঁর ‘দি স্বদেশি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল: ১৯০৩-১৯০৮’ গ্রন্থে এই তত্ত্বই

প্রতিপাদ্য করেছিলেন যে, ওই সময়ের হিন্দু-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের ব্রিটিশ-বিরোধিতাকে লর্ড কার্জন মুসলমান-বিরোধিতার দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন; এবং সেই তাগিদে

বঙ্গবিভাগ তাঁদের সার্বিক পরিকল্পনারই অঙ্গ ছিল। অবশেষে, ১৯০৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তারিখে ইংরেজরা সেই পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সেদিনই বঙ্গবিভাগের

ঘোষণা প্রথম সরকারিভাবে প্রচারিত হয়েছিল। প্রকাশ্যে প্রশাসনিক অসুবিধার কথা বলে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ইংরেজ যুক্তি-বিস্তার করলেও কার্জনের পরবর্তী ভাইসরয় ‘লর্ড মিন্টো’,

১৯০৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ভাবতসচিব ‘মর্লি’র কাছে লেখা একটি চিঠিতে বঙ্গভঙ্গের নিহিত উদ্দেশ্যটি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, “বাঙালী রাজনৈতিক আন্দোলনের হ্রাসপ্রাপ্তি

উদ্বেগের একটি গুরুতর কারণ দূরীভূত করতে সাহায্য করবে। ... অতীব বুদ্ধিগত উৎকর্ষতা ও নিজেদের বক্তব্য প্রচারের ক্ষেত্রে যোগ্যতাসম্পন্ন একটি জনগোষ্ঠী, যে জনগোষ্ঠী

ভারতের অন্যান্য অনেক জাতির মধ্য থেকে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে শক্তিশালী না হলেও আমাদের জনমতকে ক্ষতিকরভাবে প্রভাবিত করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব নয়। পুরাতন

প্রদেশের প্রশাসনিক অসুবিধার কথা বাদ দিলেও তাই আমি বিশ্বাস করি বিভাগের প্রয়োজন খুব বেশি ছিল।” (দি স্বদেশি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল: ১৯০৩-১৯০৮, সুমিত সরকার, অনুবাদ:

বদরুদ্দিন উমর) দেশে খুব স্বাভাবিক কারণেই সেটার অপরিসীম প্রভাব পড়েছিল। এর ফলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক আবার এক দ্বন্দ্বমূলকতার মধ্যে

পড়ে গিয়েছিল। তৎকালীন মুসলমান-সম্প্রদায় এর ফলে সাময়িকভাবে উপকৃত হলেও, বঙ্গভঙ্গ আদতে তাঁদের যে কোনও সার্বিক উন্নয়নের দিশা দেখাতে পারবে না, সেটা তখনও তাঁরা

অনুধাবন করতে পারেন নি। অন্যদিকে, সম্পত্তিগত ও চাকুরিগত ক্ষেত্রে হিন্দু-মধ্যবিত্ত সমাজ তখন অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও, জমিদারি ব্যবস্থা কিন্তু ক্রমশঃই

অবনতির মুখোমুখি হচ্ছিল। একই সাথে ওই সময় থেকে মুসলমানেরা হিন্দু-কুক্ষিগত আর্থিক সুবিধাগুলিতে ভাগ বসানোর ফলে বাঙালি-হিন্দুদের আর্থিক অবস্থা অনেকটাই খারাপ হতে শুরু

করেছিল। তাঁদের মধ্যে সামাজিক অস্থিরতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়েছিল। স্বভাবতঃই তাঁরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। যার ফলে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠতে

শুরু করেছিল। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা সেই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। তবে কেবলমাত্র হিন্দুরাই নন, দুই বাংলার মুসলমানদের একটি অংশও সেই রাজনৈতিক-

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বঙ্গভঙ্গকে নীতিগতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁরা এক-ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে ধর্মের নামে বিচ্ছিন্ন করবার সুদূরপ্রসারী ফল যে কোন সম্প্রদায়ের পক্ষেই

ভাল হবে না, সেটা সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তখনকার ওই সব সচেতন মুসলমানেরাও হিন্দুদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। আবুল কাসেম,

লিয়াকত হোসেন, আবদুল গফুর, রসুল, গজনভি, আবুল হোসেন, দীন মোহম্মদ, দেদার বক্স এবং ইসমাইল হোসেন সিরাজি প্রমুখ বেশ কয়েকজন মুসলমান-নেতা তখন সেই আন্দোলনের

পুরোভাগে ছিলেন। তবে তাঁদের প্রগতিশীল চিন্তাধারা যে সমগ্র মুসলমান-সমাজকে যুক্ত আন্দোলনে প্রাণিত করতে পেরেছিল, তা নয়। তখন থেকে ক্রমশঃই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের

পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই সামগ্রিক মুসলমান-সমাজকে বেশি অধিকার করে নিচ্ছিল। সেই ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গ ও অসমের লেফটেন্যান্ট-গভর্নর ‘ব্যামফিল্ড ফুলার’ তখন প্রবল

প্ররোচনা যুগিয়েছিলেন। অন্যদিকে, হিন্দু-স্বাদেশিকতার সঙ্গে মুসলমান জাতীয়তাবাদীদের মানসিক সংযোগেরও তখন অভাব ঘটছিল। সেই সময়ের ওই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে

প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ‘বদরুদ্দিন উমর’ তাঁর ‘বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকারী হিন্দুরা ছিলেন প্রধানতঃ মধ্যশ্রেণীর লোক এবং

বঙ্কিমচন্দ্রের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চিন্তার দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত। এ কারণে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁরা বঙ্কিমরচিত ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতকে জাতীয়

সঙ্গীতের মর্যাদা প্রদান করেন, এবং তাঁদের বিভিন্ন সভা সমিতিতে সেই সঙ্গীত গীত হতে থাকে। ... মুসলমানরা বিপ্লবী আন্দোলনকে সে সময় খুব সন্দেহের চোখেই দেখতেন এবং তার

থেকে দূরে থাকতেন।” বলাই বাহুল্য যে, ইংরেজরা সম্পূর্ণভাবেই সেই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা মুসলিম লিগের মাধ্যমে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ তৈরী করতে

সমর্থ হয়েছিলেন। এমনকী, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে দুই বাংলায় তীব্র গণ-আন্দোলনের চাপে ইংরেজরা ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর তারিখে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

এরপরে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলাকে পুনরায় একীভূত করে একটি সংযুক্ত প্রদেশ গঠন করা হলেও, ইতিমধ্যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা

প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করবার কোন সদিচ্ছাও ইংরেজ-সরকারের ছিল না। আন্দোলনের চাপে ইংরেজরা তখন বঙ্গভঙ্গকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেও,

ওই দীর্ঘ পাঁচবছরে তাঁদের মূল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে সিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল - হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যেকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা সম্পূর্ণ হয়েছিল।

ইংরেজদের রাজনীতির সঙ্গে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে মিশিয়ে দেওয়ার মৌলিক ষড়যন্ত্রটিও একই সাথে সফল হয়েছিল।

১৯২০ সালে ভারতের সামগ্রিক রাজনীতিতে ‘খেলাফত’ ও ‘অসহযোগ’ আন্দোলন বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। দুই সম্প্রদায় আলাদাভাবে সেই আন্দোলন দুটি শুরু করলেও একটা সময়ে

দুটির মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল। এর ফলে ওই সময়ের বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার বিদ্বেষ ও বিচ্ছিন্নতা কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছিল। অবশ্য সেই আন্দোলন দুটি

ওই সময়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবিদাওয়াকে বিশেষ প্রাধান্য না দিয়ে ধর্মকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। ফলে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেই আন্দোলন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল, এবং

সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আবার সামনে এসে গিয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহৃত হলেও ১৯৪০ সাল থেকেই মুসলিম লিগ আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেশভাগের দাবি তুলেছিল। সেবারে ‘মহম্মদ

আলি জিন্নাহ’ বাংলার মুসলমান সমাজকেও নিজস্ব ভূখণ্ডের স্বপ্নে শামিল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওই সময়ে মুসলিম লিগ প্রাথমিকভাবে দেশের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের

মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলবার দাবি তুলেছিল। কিন্তু লিগের লাহোর প্রস্তাবে (১৯৪০) আপাতভাবে তখন খণ্ডিত রাষ্ট্র গড়বার কথা বলা হলেও,

আসলে মুসলিম লিগ শুরু থেকেই অখণ্ড পাকিস্তান গঠনের কথাই ভেবেছিল। এর দীর্ঘ ছয় বছর পরে মুসলিম লিগের বঙ্গীয় প্রাদেশিক নেতারা সেই লাহোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন।

১৯৪৬ সালে দিল্লিতে নব-নির্বাচিত লিগ-বিধায়কদের সম্মেলনে জিন্নাহ সরকারিভাবে অখণ্ড পাকিস্তানের দাবি তুলেছিলেন। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, “That zones comprising

Bengal and Assam in the North-East and Punjab, North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan in the North-West of India, namely Pakistan zone where the

Muslims are in a dominant majority be constituted into a sovereign independent state and that an unequivocal undertaking be given to implement the

establishment of Pakistan without delay.” তখন মুসলিম লিগের বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখার সাধারণ সম্পাদক ‘আবুল হাসিম’ জিন্নাহর সেই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেও কিন্তু

শেষপর্যন্ত পাকিস্তান-গঠনের দাবি থেকে জিন্নাহপন্থীদের সরাতে পারেন নি। বলা বাহুল্য যে, ইংরেজরাও নীতিগতভাবে জিন্নাহর সেই দাবিকে মেনে নিয়েছিলেন। ওই পরিস্থিতিতে ভারতীয়

হিন্দু মহাসভার সভাপতি ‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়’ ১৯৪৭ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংলার গভর্নর ‘স্যর ফেভারিখ বারোজের’ সঙ্গে দেখা করে বাংলাকেও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে

ভাগ করবার জোরালো দাবি পেশ করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল যে, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভারত-ভাগ হলে, সেই একই যুক্তিতে বাংলাকেও দ্বিখণ্ডিত করা উচিত। তৎকালীন কংগ্রেস-সভাপতি

‘আচার্য কৃপালনী’ও শ্যামাপ্রসাদের সেই বক্তব্যকে সমর্থন করেছিলেন। তখন কংগ্রেস থেকে শুধু কৃপালনী একা নন, ভারতের ইতিহাসে অসাম্প্রদায়িক তথা সমাজবাদী হিসাবে বহুল

পরিচিত ‘পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু’ পর্যন্ত শ্যামাপ্রসাদের ওই বক্তব্যকে সমর্থন করেছিলেন। বস্তুতঃ, শ্যামাপ্রসাদের আগেই তিনি একই যুক্তির আশ্রয় নিয়েছিলেন। উক্ত প্রসঙ্গে

১৯৪৭ সালের ২৭শে জানুয়ারি তিনি ‘স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস’কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “The British Government has to decide once for all its policy in regard to this

matter. It can no longer sit on the hedge. It can not force Pakistan on India, in the form demanded by Jinnah, for that certainly will lead to civil war ... Even if the

Muslims as a whole support the League and Pakistan, that can only mean a division of both Punjab and Bengal-Jinnah has indignantly rejected this. What then?

Compulsions of other areas to join Pakistan, that is inconceivable and impossible. Thus the crux of the Pakistan issue is this: A Pakistan consisting of only part of

Punjab and part of Bengal, or no separation at all.” (Partition of Bengal - 1947, Journal of Indian History, A. K. Majumdar) অর্থাৎ, হিন্দু মহাসভাকে যাঁরা ‘সাম্প্রদায়িক’

হিসাবে চিহ্নিত করেন, তাঁদের তার আগে তৎকালীন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের মৌলিক সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকেও ইতিহাসের সূত্রে মেনে নেওয়া উচিত। বিশেষতঃ, জিন্নাহর আগেই

নেহরু যখন সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বাংলা ও পাঞ্জাবকে খণ্ডিত করবার দাবি তুলেছিলেন, এবং সেটার রূপায়ণে ব্রিটিশ সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন; তখন স্বাধীন,

ধর্মনিরপেক্ষ ভাবতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রচারিত মহিমা মানুষের কাছে অনেকটাই ম্লান হয়ে যেতে বাধ্য। ইতিমধ্যে দেশজুড়ে দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠেছিল। ১৯৪৬ সালে

নোয়াখালিতে বীভৎস দাঙ্গা হয়েছিল, ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে উত্তর ভারতের সর্বত্রই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে দুই সম্প্রদায়ের রক্তে ভারতের মাটি ভিজে উঠেছিল। সেই

দুঃস্বপ্নের দিনগুলোর ওই সব দাঙ্গার পিছনে যে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল, সেটা এখন আর কারোরই অজানা নয়। ইংরেজরা ততদিনে তাঁদের ক্ষমতা যে

ছেড়ে দিতে হবে, সেটা ভালভাবেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। এর ফলে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে একটি শেষ ষড়যন্ত্রকে তাঁরা খুব সফলভাবেই রচনা করতে পেরেছিলেন। ‘লর্ড মাউন্টব্যাটেন’

সেই পরিকল্পনাকে ঠাণ্ডা মাথায় সার্থকভাবে রূপায়ণ করেছিলেন। ওই সময়ের ইতিহাস থেকে লক্ষ্য করবার বিষয় হল যে, মুসলিম লিগ, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা কিন্তু একযোগেই ধর্মীয়

 

136

 

জনসংখ্যার নিরিখেই বাংলাকে ভাগ করবার উদ্যোগ নিয়েছিল। তাঁদের কেউই বাংলার অখণ্ড ভাষা-সংস্কৃতির সূত্রটিকে যেমন আমল দেয়নি, তেমনি মানুষের নিজস্ব ভূমির ভাবাবেগকেও

গ্রাহ্য করেনি। সেই সময়ে ‘শরৎচন্দ্র বসু’র মতো কয়েকজন নেতা ওই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তখন কেউ কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য

সার্বভৌম বাংলার দাবিও তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতো উপনিষদবাদী মনীষীরা বাংলার ‘সাধারণ ভাষা, সাধারণ সংস্কৃতি এবং সাধারণ ইতিহাসের’ কথা বারবার মনে করিয়ে দিলেও, তখন

কেউই তাতে কর্ণপাত করেন নি। শরৎচন্দ্র বসু সেই বিষয়ে গান্ধীজিকে প্রভাবিত করবার একটা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। অন্যদিকে, শ্যামাপ্রসাদ মুসলমান-নেতা ‘সুহরাওয়ার্দি’র

সার্বভৌম বাংলা-গঠনের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ভারত যদি শেষপর্যন্ত অবিভক্তও থাকে, তাহলেও বাংলাকে ভাগ করতেই হবে। (মহাত্মা গান্ধী:

দ্য লাস্ট ফেজ, ২য় খণ্ড, পেয়ারেলাল) সেই সময়ের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বদরুদ্দিন উমর লিখেছিলেন, “সার্বভৌম বাঙলার বিরুদ্ধে হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেসের মধ্যে অবস্থিত

সাম্প্রদায়িক ও হিন্দু মহাসভাপন্থী নেতারা যেমন নিজেদের তৎপরতা শুরু করেছিলেন ঠিক তেমনিভাবে বাঙলার মুসলীম লীগের মধ্যে চরম সাম্প্রদায়িক, এবং ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে

মুসলীম লীগ নেতৃত্ব থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়া অংশটিও সার্বভৌম বাঙলার বিরুদ্ধে নিজেদের তৎপরতা শুরু করে। খাজা নাজিমুদ্দীন সার্বভৌম বাঙলা রাষ্ট্রগঠনের ব্যাপারে অন্যদের

সঙ্গে মুসলীম লীগের পক্ষে, শরৎ বসু প্রভৃতি কংগ্রেসী নেতাদের সঙ্গে যৌথ আলোচনায় একদিন উপস্থিত থাকেন, এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলার পক্ষে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দু’-

একটি বিবৃতি প্রদান করলেও তাঁরা সুহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশীমের নেতৃত্বাধীন সার্বভৌম বাঙলা রাষ্ট্রগঠনের বিরোধী ছিলেন, এবং সেই বিরোধিতা করতে গিয়ে নানা কৌশল অবলম্বন

করেছিলেন। নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমেও এ-সময় সাম্প্রদায়িক বক্তব্যকেই সামনে নিয়ে এসে তাঁরা অখণ্ড বাঙলায় মুসলমানদের আধিপত্য, এবং ইসলামের মূল নীতি

প্রতিষ্ঠার কথাই জোরে জোরে প্রচার করতে থাকেন।” (বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বদরুদ্দিন উমর) তখন কংগ্রেসের অবস্থানও আলাদা কিছু ছিল না। অবিভক্ত ভারতে কংগ্রেস

মূলতঃ সম্পদশালী ও মধ্যবিত্ত হিন্দুদের প্রতিনিধিস্থানীয় দল হিসাবেই গড়ে উঠেছিল। মুসলমানদের স্বার্থকে তাঁরা প্রথমাবধি উপেক্ষা করে আসলেও, কার্যতঃ, অসাম্প্রদায়িক দল

হিসাবেই নিজেদের প্রচার করত। বস্তুতঃ, মুসলমানদের শুধু নয়, ওই সময়ের সমাজের নিম্ন শ্রেণীর স্বার্থকে উপেক্ষা করবার জন্যই তারা যে নিজেদের ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলে পরিচিত

করেছিল, সেটাও বিভিন্ন ঐতিহাসিকেরা সুস্পষ্টভাবে বলে গিয়েছেন। তৎকালীন কংগ্রেসের তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক চারিত্র্য বিশ্লেষণ করে বদরুদ্দিন উমর তাঁর ‘বঙ্গভঙ্গ ও

সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “... বিভিন্ন ধরনের সংখ্যালঘু স্বার্থ, বিশেষতঃ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক স্বার্থ অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে উপেক্ষা করাই কার্যক্ষেত্রে

কংগ্রেসের সুস্পষ্ট নীতি ছিল। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আড়ালে হিন্দু সম্পত্তিশালী এবং অগ্রসর শ্রেণীর স্বার্থ এগিয়ে নেওয়ার উপযোগী বাস্তব পরিস্থিতির কারণে কংগ্রেসের

মধ্যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্রভাব প্রথম থেকেই ক্রমশঃ বৃদ্ধিলাভ করতে থাকে। ... সে কারণেই বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রাই, গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই

প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, আচার্য কৃপালনী প্রভৃতির মতো হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী ব্যক্তিরা উচ্চতম পদে অধিষ্ঠিত হতে

পেরেছিলেন।” ১৯৪৭ সালের জুন মাসে শরৎচন্দ্র বসু গান্ধীজীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমার ভাবতে কষ্ট হয় যে, যে কংগ্রেস একদা এক মহান জাতীয় প্রতিষ্ঠান তা দ্রুত

কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চলেছে।” (আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি, আবুল হালিম) নিষ্ঠুর হলেও ওই সময়ের ইতিহাস এই তথ্যই দেয়

যে, তৎকালীন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হয়ে জওহরলাল নেহরু বল্লভভাই প্যাটেলের সহযোগিতা ও সমর্থনে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে জিন্নাহর চেয়েও চরমপন্থী

হয়ে উঠেছিলেন। এমনকী, মাউন্টব্যাটন এবং তাঁর স্ত্রীর প্রীতিভাজন হিসেবে তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব-ভাগের ইংরেজ সিদ্ধান্তে সম্মতও হয়েছিলেন। তবে কেবল সম্মত হওয়াই নয়, নানা

ঐতিহাসিক নথিপত্র ঘেঁটে ঐতিহাসিকেরা একথাও জানিয়েছেন যে, নেহরু সেক্ষেত্রে “মাউন্টব্যাটেনের এক অতি প্রীতিভাজন এজেন্ট হিসেবেই কাজ করেছিলেন।” (বঙ্গভঙ্গ ও

সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বদরুদ্দিন উমর)

তখন হিন্দু ও মুসলমান দুই জনগোষ্ঠীকেই তাঁদের রাজনৈতিক নেতারা বুঝিয়েছিলেন যে, বাংলা ভাগ হলে, ভারত ভাগ হলে, স্ব-স্ব জনগোষ্ঠীর ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক

সুদিন সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে উভয় সম্প্রদায়ের নেতারাই তখন কেবলমাত্র ধর্মে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই সেক্ষেত্রে ক্ষমতালোভী কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের

নিছক দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছিল। মুসলমানেরা যেমন বুঝতে চাননি যে, ধর্ম ছাড়া সংস্কৃতি ও জীবনচর্চায় হিন্দুদের সঙ্গে তাঁদের কোনও অমিল নেই; তাঁরা যেমন বুঝতে চাননি যে, সুদূর

আরবের আরোপিত সংস্কৃতি তাঁদের নিজস্ব কৃষ্টি নয় - এই বাংলার জল-মাটি-আলো-বাতাসেই তাঁদের প্রাণ, গান, সংস্কৃতি নিহিত হয়েছে। আরবীয় কোর্মা-কাবাব-পোলাওয়ে নয়, হিন্দুদের

মতো মাছ-ভাতেই তাঁদের ক্ষুন্নিবৃত্তি তৃপ্ত হয়, হিন্দুদের মতোই তাঁরাও ওলাবিবি বা সত্যনারায়ণের সিন্নিতে আগ্রহী। কেননা, সুদূর আরবে নয়, তাঁদের শিকড় এই বাংলাতেই প্রোথিত

রয়েছে। তেমনি অন্যদিকে, হিন্দুরাও নিজেদের প্রতিবেশী মুসলমানকে অন্ধ উন্নাসিকতায় মেনে নিতে পারেন নি। ফলে সীমান্তে কাঁটাতার পড়েছে। গৃহহীন, ভূমিহীন মানুষ দাবার ঘুঁটির মতোই

রাজনীতির খেলার শেষে ভূলুণ্ঠিত হয়েছেন। ভাঙা ঘর, পরিত্যক্ত ভূমি, আর প্রতিবেশীর শবের উপর নিরর্থক স্বাধীনতা-ধ্বজা - অশোকচক্র আর চাঁদতারা-উজ্জ্বল ক্ষমতার প্রতীক হয়ে

উড্ডীয়মান হয়েছে। ওই পরিস্থিতিতে যা অনিবার্য ছিল, শেষপর্যন্ত সেটাই ঘটেছিল। নোয়াখালির ভয়ঙ্কর দাঙ্গা, বাংলা ও পাঞ্জাবের বিভক্তির বিনিময়ে, ভারত-ভাগের বিনিময়ে,

সাম্প্রদায়িক স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে ইংরেজরা মুসলিম লিগ ও কংগ্রেসকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে, ক্ষমতা পাওয়ার লোভে, নেহরুর অসাম্প্রদায়িক

মুখোশ যেমন খসে পড়েছিল, তেমনই স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেই তিনি প্রথমে নিজের সমাজতান্ত্রিকতার মুখোশটিও খুলে ফেলেছিলেন। পাঞ্জাব ও বাংলার লক্ষ-লক্ষ

নিরপরাধ মানুষের জীবনে দেশভাগের করাল ছায়া নেমে এসেছিল। কংগ্রেস ক্রমশঃ বানিয়া-শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বে আত্মনিয়োগ করেছিল। তথাকথিত স্বাধীনতার সঙ্গে সুচতুর ইংরেজরা

সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ বপন করে দিয়েছিলেন, ওই সময়ের ও পরবর্তীকালের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বারেবারে সেই বীজে জলসিঞ্চন করেছে। সেই বীজ থেকে চারা গাছ হয়ে বৃক্ষ হয়েছে,

আর সেই বৃক্ষ ক্রমে মহীরূহ হয়ে দেশের নানা প্রান্তে নিজের ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করে রাজনৈতিক নেতারা বারবার ক্ষমতার অলিন্দে সদর্প পদচারণা

করলেও, যাঁদেরকে তাঁরা ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছেন, তাঁরা কিন্তু সেই একই অবস্থানে থেকে গিয়েছেন।