গুপ্ত সাম্রাজ্যে

গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভারতীয় সভ্যতার এক নবজাগরণের সূচনা বলে বিবেচিত। এই সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল এক ক্ষুদ্র রাজ্য থেকে, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীগুপ্ত। তবে প্রকৃত অর্থে একটি সাম্রাজ্য গঠনের কৃতিত্ব অর্জন করেন তাঁর পৌত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। শ্রীগুপ্তকে সাধারণত গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন, তিনি খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের কোনো অংশে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নাম পাওয়া যায় চীনা ভিক্ষু ইয়ি-চিং (Yijing) ও তাং যুগের অন্যান্য লেখকদের বর্ণনায়, যেখানে তাঁকে “গুপ্ত রাজা” বা “শ্রীগুপ্ত” নামে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ধর্মপরায়ণ হিন্দু শাসক ছিলেন এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রতি অনুকূল ছিলেন বলেও কিছু সূত্রে উল্লেখ রয়েছে। তাঁর রাজত্বকাল ছিল তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ও স্থানীয় পর্যায়ের শাসনব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। সেই সময় গুপ্ত রাজবংশের প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল একটি ছোট ভূখণ্ডে। শ্রীগুপ্তের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র ঘটোৎকচ। তিনিও ক্ষুদ্র রাজ্যের সীমার মধ্যে শাসন পরিচালনা করতেন। তাঁর শাসনামলে রাজ্য কিছুটা সম্প্রসারিত হলেও তা এখনও সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত হয়নি। তবে তিনি রাজবংশকে স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা প্রদান করেন, যা ভবিষ্যতে বৃহৎ সাম্রাজ্য গঠনের ভিত্তি স্থাপন করে।

এরপর ঘটোৎকচের উত্তরসূরি হিসেবে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁর পুত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (৩২০–৩৩৫ খ্রিষ্টাব্দ)। ইতিহাসের বিচারে তিনিই ছিলেন প্রকৃত অর্থে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি “মহারাজাধিরাজ” উপাধি গ্রহণ করেন, যা একাধিপত্য ও সাম্রাজ্যিক মর্যাদার প্রতীক। তাঁর শাসনকালে গুপ্ত রাজ্য মগধ, প্রয়াগ, পাটলিপুত্র ও গঙ্গা–যমুনা দুয়াব অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

প্রথম চন্দ্রগুপ্ত রাজনীতিতে কৌশলী ও বাস্তববাদী শাসক ছিলেন। তিনি লিচ্ছবী রাজকন্যা কুমারদেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, যা রাজনৈতিক দিক থেকে ছিল এক সুবিবেচিত পদক্ষেপ। এই বিবাহের মাধ্যমে তিনি গঙ্গার উত্তর তীরবর্তী লিচ্ছবী রাজ্যের সঙ্গে এক মজবুত জোট গঠন করেন এবং উত্তর ভারতে তাঁর প্রভাব বৃদ্ধি করেন। সেই সময়ের লিচ্ছবী রাজ্য ছিল সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী, ফলে এই বিবাহের মাধ্যমে গুপ্ত রাজবংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক মর্যাদা লাভ করে। তাঁদের পুত্র সমুদ্রগুপ্ত পরবর্তীকালে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সুবর্ণযুগের সূচনা করেন।


গুপ্ত রাজারা সাধারণত ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব পোষণ করলেও, তাঁরা হিন্দুধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে মর্যাদা দিতেন। চন্দ্রগুপ্ত নিজে বিষ্ণুভক্ত ছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রশাসনে অন্যান্য ধর্মের প্রতিও সহিষ্ণুতা বজায় ছিল।

প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পর তাঁর পুত্র সমুদ্রগুপ্ত (৩৩৫–৩৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) সাম্রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করেন এবং ভারতবর্ষে গুপ্ত শাসনের প্রকৃত মহিমা প্রতিষ্ঠা করেন। 


৭ নভেম্বর (রাশিয়া)

১৯১৭ সালের এই দিনে  একনায়ক লেনিনের নেতৃত্বে রুশ দেশে এক মহাবিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। রুশ বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই শ্রমিক শ্রেণী 'জারকে' উচ্ছেদ করে রুশ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। এ বিপ্লব ইতিহাসে 'অক্টোবর বিপ্লব' নামেও খ্যাত।

মার্কসের 'তত্ত্ব' ব্যবহার করে রাশিয়া কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এসেছিল। তলস্তয় গোর্কী চেকভ পুশকিন ডস্টয়েভস্কিদের লেখা দুর্নীতিপরায়ণ জারের বিরুদ্ধে জনতার রোষ বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিপ্লবীরা সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে জারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। জারকে সপরিবারে গুপ্তহত্যা করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল। তাঁর ১৩ বছরের বাচ্চা ছেলেটার অপরাধ ছিল সে তো ভাবী রাজা। তাই তাকেও মরতে হয়েছে।

কমিউনিস্টরা সরকার বিরোধী কোন কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেই তৎক্ষণাৎ গলা টিপে স্তব্ধ করে দিত। কথা বলার স্বাধীনতা ছিল না। তাই প্রাক বিপ্লব রাশিয়ায় যে অসামান্য প্রতিভাবান লেখকগোষ্ঠীকে পেয়েছিলাম আমরা, বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় তা পাওয়া যায় নি।

বিপ্লবের মাত্র কয়েকমাস পর মার্চ ১৯১৮ রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। খাদ্যের অভাবে মানুষকে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হয়। লেনিন এই দুর্ভিক্ষের জন্য কিছু “ধনী” কৃষককে দায়ী করেন। তারাই না কি খাদ্যশস্য মজুত করে দেশে দুর্ভিক্ষ এনেছে। সশস্ত্র বাহিনী পাঠিয়ে তাদের তাদের ভান্ডার লুঠ করা হয়। উদ্দেশ্য “গরীব” কৃষকদের মধ্যে তা বিলি করা। এর ফলে কৃষক বিদ্রোহ শুরু হল। লেনিনের বাহিনী নিষ্ঠুরভাবে সেই বিদ্রোহ দমন করল। প্রায় ১০০ জন বিদ্রোহী কৃষককে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করল।

লেনিন রাষ্ট্রীয় হিংসার পক্ষপাতী ছিলেন। বুর্জোয়া দেশগুলির হিংসার সঙ্গে তাঁর সোভিয়েত এর হিংসার পার্থক্য আছে। কারণ তিনি “জনগণের স্বার্থে হিংসা করেন” -  এই জনগণের স্বার্থে হিংসার বলি হয়েছেন প্রায় দেড় মিলিয়ন মানুষ। ১৯১৮ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত। একেই বলে "লাল বিপ্লব"।

ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, পারলৌকিকে বিশ্বাস করা, মানুষের অধিকার। আমাদের ব্যক্তিগত মতামত যাইহোক, কেউ কারও নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারি না, আমরা কেউ কোন 'অভিভাবক' নই, মানুষকে তাঁর চিন্তা প্রকাশে বাধা দেয়ার।



৭ নভেম্বর (বাংলাদেশে)


১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা তিন দিন আগে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের 'ক্যু'-এর বিরুদ্ধে একটি পাল্টা 'ক্যু' সংঘটিত করে।

৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা সেনানিবাসে কিছু লিফলেট বিতরণ করা হয়। লিফলেটে লেখা ছিল, সৈনিক-সৈনিক ভাই-ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই।

রাত ১২টা বাজতেই গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠে ঢাকা সেনানিবাস। ব্যারাক ছেড়ে সৈন্যরা দলে-দলে ক্যান্টন্টমেন্টের ভেতরে রাস্তায় নেমে আসে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সেনানিবাসের ভেতরে তখন ভয়াবহ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল।

বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিপ্লবীরা ট্যাঙ্ক নিয়ে রাজপথে নেমেই স্লোগান দিয়েছিল, "নারায়ে তকবির-আল্লাহু আকবর", "রুশ-ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান!"

গণবাহিনীর' ক্যাডাররা অস্ত্র হাতে সিপিবি এবং মস্কোপন্থি ন্যাপ নেতাদের খোঁজাখুঁজি করেছিল সেই রাতে।গুলির তীব্রতা এতোটাই বেশি ছিল যে কেউ শুনতে পাচ্ছিল না একে অন্যের কথা। তিন দিন আগে ৩রা নভেম্বর তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়, খালেদ মোশারফ কে করা হয় সেনাপ্রধান। তারপর থেকেই পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা জোরদার হতে থাকে।

সে সময় কর্নেল তাহেরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তার ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অভিসন্ধি ছিল তাদের। পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে আনোয়ার হোসেন বর্ণনা করেছেন, " কর্নেল তাহের পরিকল্পনা করেছিলেন অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া সৈন্যরা অস্ত্র হাতে রাস্তায় বেরিয়ে আসবে। তিনি সৈন্যদের বলেছিলেন প্রত্যেকে কয়েকটি অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসবে। আর বাইরে অপেক্ষমাণ আমাদের শ্রমিক ও ছাত্ররা সশস্ত্র হবে। এভাবেই সৈনিক জনতার অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন কর্নেল তাহের। আমাদের লক্ষ্য ছিল অভ্যুত্থানের পর একটি বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল হবে, রাজবন্দীদের মুক্ত করা হবে এবং দেশে একটা সাধারণ নির্বাচন দেয়া হবে।"

জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পেছনে জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছিল। তারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাদের পাশে চেয়েছিলেন। কর্নেল তাহের ভেবেছিলেন জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হলে তিনি জাসদের পাশে থাকবেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান মুক্ত হবার পর পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

জিয়াকে বন্দী করেছিলেন মূলত মেজর হাফিজ, জেড ফোর্সের এক অফিসার ও জিয়ার কমান্ডে মুক্তিযুদ্ধ করা এক অফিসার, তাই জিয়া কখনো বন্দুকের নলের সামনে ছিলেন না। জিয়াকে মুক্ত করেছিলেন ৪ র্থ বেঙ্গলের সিও কর্নেল আমিনুল হক ও মুক্ত করে তাকে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারির অফিসে এনে কমান্ডে বসিয়েছিলেন, তিনিও জেড ফোর্সের অফিসার।

কর্নেল তাহেরের নির্দেশনা ছিল যে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে যেন ঢাকার এলিফেন্ট রোডে কর্নেল তাহেরের বাসায় নিয়ে আসা হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পর তাকে সঙ্গে না নিয়েই সিপাহী জনতা গুলি ছুঁড়তে-ছুঁড়তে এলিফেন্ট রোডে ফিরে আসে। জিয়াউর রহমানকে না দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন কর্নেল তাহের। তার মনে পাল্টা আশংকা তৈরি হয়। তখন তিনি বলেছিলেন, আওয়ার আপরাইজিং প্ল্যান ইজ লস্ট।

অভ্যুত্থানের রাতে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু অফিসারকে হত্যা করা হয়। ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলীর কিছু পরে জনপ্রিয় 'সাপ্তাহিক বিচিত্রা' প্রচ্ছদের শিরোনাম দেয়, 'সিরাজুল আলম খানঃ বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্য পুরুষ'। তাতে লম্বা দাঁড়ি এবং চুলওয়ালা সিরাজুল আলম খানের ছবি ছাপা হয়। অনেকটা যেন কার্ল মার্কস বা রাসপুটিনের মত দেখতে। এ ব্যক্তিটিকে বাংলাদেশের রাজনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং নেপথ্যের কারিগর, সি আই এজেন্ট হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনায় এবং জাসদের সম্পৃক্ততায় সে অভ্যুত্থান না হলে জেনারেল জিয়ার ভাগ্যে কী ঘটতো সেটি বলা মুশকিল। ১৫ আগস্টের অপারেশনে অংশগ্রহনকারী ল্যান্সার, ২য় ফিল্ডের ডেসপারেট সৈনিকেরা নিজেদের বাঁচার তাগিদেই জিয়াকে মুক্ত করেছিল।

জিয়া মুক্ত হওয়ার ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই তাহেরের ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, সেনা চেইন অব কম্যান্ডের বলে বলীয়ান জিয়া মুহুর্তেই উড়িয়ে দেয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও তাদের নেতাকে।

ট্রেড ইউনিয়ন ধাঁচের কিছু দাবি-দাওয়া দিয়ে সাধারণ সৈনিকদের সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার মধ্যে 'সমাজ বিপ্লবের' উপাদান খুঁজতে থাকা গণবাহিনীর ক্যাডাররা আসলে সেদিন যা ঘটিয়েছিল তার মূল ঘটনা ছিল শুধু 'ক্ষমতা দখলের' উদ্দেশ্যে 'ক্যু' এবং পাল্টা 'ক্যু'।


মা এবং সন্তান

গর্ভাবস্থায় মা এবং সন্তানের মধ্যে শুধু খাবার আর অক্সিজেনই আদান প্রদান হয় না। তাদের কোষও একে অপরের শরীরে প্রবেশ করে।

সন্তান জন্মের পর মায়ের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু কোষগুলো থেকে যায়। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, মায়ের মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস এমনকি ত্বকেও ছড়িয়ে থাকে সন্তানের কোষ। কখনো কখনো মৃত্যু পর্যন্ত।

এই ঘটনাকে বলা হয় মাইক্রোচিমেরিজম। গ্রিক পুরাণের কাইমেরা নামক প্রাণীর মতো, যার শরীরে ছিল বিভিন্ন প্রাণীর অংশ।

আরও অবাক করা বিষয় হলো, এই বিদেশি কোষগুলো নিষ্ক্রিয় নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের শরীরে কোনো ক্ষত হলে সন্তানের কোষগুলো সেখানে ছুটে যায় এবং সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। মায়ের হৃদরোগ হলে সন্তানের কোষ হৃদযন্ত্রের টিস্যু মেরামতে অংশ নেয়।

প্রকৃতি যেন নিশ্চিত করতে চায়, মা এবং সন্তানের বন্ধন শুধু আবেগের নয়, শারীরিকভাবেও তারা চিরকাল সংযুক্ত।

মাতৃত্ব আসলেই এক অলৌকিক বিজ্ঞান।


আলাউদ্দিন হোসেন শাহ

বাংলা ইতিহাসে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের নাম এক স্বর্ণাক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তিনি ছিলেন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান, যিনি শুধু মুসলমান শাসক হিসেবেই নন, বরং এক ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক রাজাধিরাজ হিসেবে সমগ্র বাঙালি জাতির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। হোসেন শাহের শাসনামল (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ) মধ্যযুগীয় বাংলার এক নবজাগরণের যুগ হিসেবে পরিচিত। তাঁর শাসনে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই শান্তি, সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতির বিকাশে এক অভূতপূর্ব যুগের সাক্ষী হয়েছিল।

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ রাজনীতিতে যেমন ছিলেন বিচক্ষণ, তেমনি সংস্কৃতিচর্চা ও মানবিক মূল্যবোধেও ছিলেন অগ্রগামী। তিনি ধর্মকে কখনো রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেননি। বরং হিন্দু ও মুসলমান উভয় প্রজার কল্যাণকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর প্রশাসনে হিন্দু মন্ত্রী, কবি ও সেনাপতিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। যেমন বিখ্যাত সেনাপতি রায়ধনুজ, কবি বিজয় গুপ্ত ও শ্রীচৈতন্যদেবের সমসাময়িক বহু হিন্দু পণ্ডিত তাঁর রাজসভায় মর্যাদা পেয়েছিলেন।

এমন ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই হিন্দু সমাজের মধ্যেও হোসেন শাহ অসীম জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁকে হিন্দুরা “নৃপতি তিলক” উপাধিতে ভূষিত করেন, যার অর্থ “রাজাদের তিলকচিহ্ন” বা “রাজাদের শিরোমণি”। এই উপাধি শুধু তাঁর প্রশাসনিক কৃতিত্বের জন্যই নয়, বরং প্রজাদের প্রতি তাঁর মানবিক ব্যবহারের স্বীকৃতিস্বরূপ দেওয়া হয়েছিল। তিনি হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি যে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন, তা মধ্যযুগের অন্য কোনো মুসলমান শাসকের ক্ষেত্রে এত স্পষ্টভাবে দেখা যায় না।

তাঁর আরেকটি উপাধি ছিল “জগৎ-ভূষণ” বা “বিশ্বের সৌন্দর্য”, যা তাঁর অসাধারণ রাজনীতি, ন্যায়বোধ ও সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার প্রতীক। এই উপাধিগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তিনি শুধু একজন মুসলমান সুলতান নন, বরং সমগ্র বাংলার এক অভিন্ন শাসক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

তাঁর শাসনকালে বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলার এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। কবি বিজয় গুপ্ত তাঁর পদ্মাপুরাণ এই সময়েই রচনা করেন। চণ্ডীদাস, দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ পরবর্তী সাহিত্যিকরা হোসেন শাহের যুগকে “বাংলা সাহিত্যের সোনালি যুগ” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি কৃষি, বাণিজ্য ও প্রশাসনে উন্নতি ঘটান, নদীপথ সংস্কার করেন, এবং প্রজাদের করের বোঝা হ্রাস করেন। এই সকল মানবিক উদ্যোগের ফলে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, এমনকি বিদেশি ব্যবসায়ীরাও তাঁর রাজত্বে নিজেদের নিরাপদ ও সম্মানিত বোধ করতেন।

তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম দৃষ্টান্ত ছিল মহান ভক্তি আন্দোলনের যুগপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেবের প্রতি তাঁর সহনশীল ও উদার মনোভাব। যদিও চৈতন্যদেবের ভক্তদের জনসমাবেশ ও আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তবুও সুলতান হোসেন শাহ কখনো তাঁদের দমন করেননি। বরং তাঁর আদেশে চৈতন্যদেবের সঙ্গে শ্রদ্ধার আচরণ করা হয়।

এই সকল দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে যে, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ছিলেন এক সত্যিকার অর্থে “জনপ্রিয় রাজা”—যিনি জাতি, ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাকেই রাষ্ট্রনীতির ভিত্তি করেছিলেন। তাঁর সময়ে “বাংলা” শব্দটি একটি ভৌগোলিক পরিচয়ের পাশাপাশি একটি সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।


নাগার্জুন ও আর্যভট্ট 

নাগার্জুনকে প্রাচীন ভারতের "আইনস্টাইন" বলা হয়ে থাকে মূলত তাঁর শূন্যবাদ তত্ত্বের গভীর দার্শনিক ও যুক্তিবাদী বিশ্লেষণের জন্য। নাগার্জুন ছিলেন দ্বিতীয় শতকের এক অসাধারণ বৌদ্ধ দার্শনিক, যিনি মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের মধ্যমক শাখার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত। তাঁর রচিত "মূলমধ্যমককারিকা" গ্রন্থে তিনি ‘শূন্যতা’ বা ‘শূন্যবাদ’-এর তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। নাগার্জুনের মতে, বিশ্বের সমস্ত বস্তু ও ঘটনা আপেক্ষিক, অর্থাৎ কোনো কিছুর অস্তিত্ব অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। কোনো বস্তু বা ভাব একা, স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না।

এই চিন্তাধারা পরবর্তীকালে আধুনিক পদার্থবিদ্যার আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব যেমন বলছে, সময়, স্থান ও বস্তুর গতি একে অপরের সঙ্গে আপেক্ষিকভাবে সম্পর্কিত, নাগার্জুনও একইভাবে বলেছেন যে, কোনো কিছুর অস্তিত্ব একান্তভাবে নিরপেক্ষ নয়—এটি সর্বদা অন্য কিছুর সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। 

নাগার্জুনের দর্শনে বাস্তবতার চূড়ান্ত সত্যকে নির্ণয় করা যায় না কোনো স্থির সত্তায়; বরং তিনি বলেছেন, "শূন্যতা" হচ্ছে সেই অবস্থা যেখানে কোনো বস্তু বা চিন্তার স্থির, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, এবং সমস্ত অস্তিত্বই পরস্পর নির্ভরশীল। এই দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে যেমন বৌদ্ধ চিন্তাকে নতুন দার্শনিক উচ্চতায় নিয়ে যায়, অন্যদিকে আধুনিক বিজ্ঞানের আপেক্ষিক চিন্তাধারার সঙ্গে সাযুজ্য স্থাপন করে।

অন্যদিকে, কিছু সূত্রে আর্যভট্টকেও "ভারতের আইনস্টাইন" বলা হয়, কারণ তিনি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন। "যখন পুরো পৃথিবীর মানুষ ভাবত- সূর্য ঘোরে, তখন একজন ভারতীয় বললেন—না, পৃথিবীই ঘোরে নিজের অক্ষে। তাঁর নাম ছিল আর্যভট্ট।   তিনি ছিলেন ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া একজন প্রভাবশালী ভারতীয় গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ এবং দার্শনিক, যিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত।তাঁর অবদান এতটাই বিশাল যে, স্বাধীন ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহের নামও রাখা হয় তাঁর নাম অনুসারে — "আর্যভট্ট"। তার জন্ম দক্ষিণ গুজরাট ও উত্তর মহারাষ্ট্রে অবস্থিত বলে ধারণা করা হয়। তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও শিক্ষকতা করেন বলে প্রচলিত আছে। অনেকেই মনে করেন, তিনিই ছিলেন সে সময়ের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গণিত শিক্ষক।   আর্যভট্ট মাত্র ২৩ বছর বয়সে আর্যভট্টীয় রচনা করেন। বইটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত: দশগীতিকা, গণিতপাদ, কালক্রিয়াপাদ ও গোলপাদ। এতে পাই-এর মান, ত্রিকোণমিতি, ঘনমূল, বর্গমূল, দ্বিঘাত সমীকরণ, জ্যোতির্বিদ্যা ও ক্যালেন্ডার গণনার উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যা রয়েছে।



শশাঙ্ক বাংলার প্রথম স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন


বাংলার ইতিহাসে প্রথম সার্বজনীন সম্রাট বা নরপতি হিসেবে যাঁর নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়, তিনি হলেন গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক। তাঁর আবির্ভাব ছিল এমন এক সময়ে, যখন ভারতবর্ষে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজনীতি ছিল বিভাজিত, এবং বাংলার ভূমি ছিল অসংগঠিত বহু ক্ষুদ্র জনপদে বিভক্ত। উত্তর ভারতের রাজনীতিতে তখন উঠেছিল নতুন নতুন শক্তি, যেমন মউখারী, ভল্লভ ও পুষ্যভূতি রাজবংশ। বাংলার ভিতরে তখনও কোনও কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এই রাজনৈতিক অরাজকতার মধ্যেই কর্ণসুবর্ণের শশাঙ্ক বাংলার প্রথম স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

শশাঙ্কের জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবনের বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য সীমিত হলেও ইতিহাসবিদরা অনুমান করেন যে তিনি সম্ভবত ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে ক্ষমতায় আসেন। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ, যা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কাছে অবস্থিত। কর্ণসুবর্ণ তখন ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এক সমৃদ্ধ নগর। এখান থেকেই শশাঙ্ক তাঁর শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন এবং ধীরে ধীরে সমগ্র বঙ্গ, দক্ষিণবিহার, উড়িষ্যা, এমনকি গঙ্গার দক্ষিণ উপত্যকার কিছু অংশের উপরেও কর্তৃত্ব বিস্তার করেন।

শশাঙ্কের রাজনৈতিক কৌশল ও সামরিক দক্ষতা তাঁকে উত্তর ভারতের শক্তিশালী সম্রাট হর্ষবর্ধনের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। হর্ষবর্ধনের লক্ষ্য ছিল সমগ্র উত্তরভারতকে একত্রিত করা, কিন্তু বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্নে শশাঙ্ক কখনও তাঁর সামনে নতি স্বীকার করেননি। হর্ষচরিত নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, কীভাবে শশাঙ্ক হর্ষের ভাই রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেছিলেন, যা দুই রাজ্যের সম্পর্ককে চরম বিরোধিতায় রূপ দেয়।  

শশাঙ্ক নিজেকে “গৌড়েশ্বর”, “পরমেশ্বর” ও “মহাসামন্ত” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এসব উপাধি থেকে বোঝা যায় যে তিনি নিজেকে শুধুমাত্র আঞ্চলিক শাসক হিসেবে নয়, বরং সর্বময় সম্রাট বা সার্বজনীন নরপতি হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাঁর শাসনব্যবস্থা ছিল সুসংগঠিত। রাজস্ব, সেনা ও বিচারব্যবস্থা তিনি সুচারুভাবে গড়ে তোলেন। শিলালিপি ও তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে তিনি ভূমি অনুদান দিতেন এবং ব্রাহ্মণ ও মঠে ভূমি দান তাঁর রাজত্বে প্রচলিত প্রথা হয়ে ওঠে। এতে তাঁর প্রশাসনিক দূরদর্শিতা এবং রাজনীতিক প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে।

ধর্মের ক্ষেত্রে শশাঙ্ক ছিলেন একনিষ্ঠ শৈব হিন্দু। তিনি শিবপূজাকে রাজধর্মের মর্যাদা দেন। বাণভট্টের হর্ষচরিত এবং চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে শশাঙ্ক বৌদ্ধধর্মের প্রভাব হ্রাস করেছিলেন এবং হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা করেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এটি ছিল রাজনৈতিক কৌশলও, কারণ বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র ছিল মগধ, যা তৎকালীন হর্ষবর্ধনের প্রভাবাধীন ছিল। তাই শশাঙ্ক ধর্মীয়ভাবে শৈবপন্থা অবলম্বন করে হর্ষের রাজনৈতিক প্রভাবের বিরোধিতা করেন।

তবে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রশ্নে শশাঙ্কের অবস্থান একপাক্ষিক ছিল না। তিনি যেমন শিবমন্দির নির্মাণ ও শৈব ধর্মের প্রচার করেন, তেমনই বৌদ্ধমঠ ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেননি। বরং তাঁর শাসনকালে ধর্মীয় জীবনের বহুমাত্রিকতা বজায় ছিল। বাংলার প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কৃতিতে যে বহুত্ববাদী চেতনা আজও টিকে আছে, তার সূচনা বলা চলে শশাঙ্কের যুগেই।

শশাঙ্কের শাসনামলে বাংলা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়। কর্ণসুবর্ণ বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল। গঙ্গা নদী ও তার উপনদীগুলির মাধ্যমে বঙ্গদেশে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চলত। বঙ্গের লবণ, মসলিন, রেশম, ধান ও নৌযান তখন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানি হত। ফলে শশাঙ্কের রাজত্বে বাংলা শুধু রাজনৈতিক দিক থেকে নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

শশাঙ্কের শাসনকাল শেষ হওয়ার পর কিছুদিন বাংলায় পুনরায় অরাজকতা দেখা দেয়। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া প্রশাসনিক কাঠামো, রাজনৈতিক ঐক্যের ধারণা ও স্বাধীনতার চেতনা পরবর্তী পাল সাম্রাজ্যের উত্থানের পথ তৈরি করে দেয়। ই


 

দই-এর ইতিহাস : 

দই বা দধি— ভারতীয় উপমহাদেশের এক অতি প্রাচীন ও জনপ্রিয় দুগ্ধজাত খাদ্য। এর টক-মিষ্টি স্বাদ, পুষ্টিগুণ এবং হজমশক্তি বৃদ্ধির ক্ষমতার জন্য দই আজও প্রতিদিনের আহারের এক অপরিহার্য অংশ। অনেক গবেষক মনে করেন, দই বা ফারমেন্টেড দুধজাত খাদ্য প্রথম আবিষ্কৃত হয় মধ্য এশিয়া বা ইউরোপের তৃণভূমি অঞ্চলে, যেখানে পশুপালক জাতিগোষ্ঠী ছাগল ও গরুর দুধ চামড়ার থলেতে সংরক্ষণ করত। রোদ ও তাপমাত্রার প্রভাবে দুধ স্বাভাবিকভাবেই জমে গিয়ে দইয়ের মতো পদার্থে রূপ নিত। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে থেকেই ভারতীয়রা দুধ থেকে দই তৈরি করত। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নস্থল হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো থেকে প্রাপ্ত পাত্র ও নিদর্শনে দুধ জমানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বৈদিক সাহিত্যে দই-এর উল্লেখ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদে “দধি” (দই) শব্দটি বারবার এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, ঋগ্বেদে বলা হয়েছে: “দধি গব্যং সমনসে জুহোমি” — অর্থাৎ, “আমি দেবতাদের উদ্দেশ্যে দুধের দই অর্পণ করছি।” দই ছিল বৈদিক যুগের যজ্ঞ ও পূজার অন্যতম উপাদান। “

মহাকাব্য ও পুরাণেও দই-এর উল্লেখ বারবার এসেছে। কৃষ্ণকে “মাখন-চোর” বলা হলেও, তিনি দই ও মাখনের মিশ্রণ বা দধিমণ্ড খুবই পছন্দ করতেন বলে ভাগবত পুরাণে উল্লেখ আছে। দুধ, দই, ঘি, চিনি ও মধুর মিশ্রণ “পঞ্চামৃত” দেবতাদের পূজায় আজও অপরিহার্য। 

মধ্যযুগে দই শুধু ধর্মীয় বা গৃহস্থালির খাদ্য নয়, বরং রাজকীয় ভোজনের অংশ হয়ে ওঠে। দিল্লি সালতনাত ও মুঘল আমলে “দই-বড়া”, “দই-ফলুদা”, “মিষ্টি দই” ইত্যাদি নানা রকম খাদ্যের প্রচলন ঘটে। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি-তে “দধি” ও “দুধের মিষ্টান্ন”-এর তালিকায় দইকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলায় দই কেবল খাদ্য নয়, এক সাংস্কৃতিক পরিচয়। রাজশাহী, বগুড়া, নড়াইল, কৃষ্ণনগর ও কলকাতার বিখ্যাত “মিষ্টি দই” আজও সুপরিচিত। গ্রামীণ বাংলায় দই বিয়ে, পূজা, অন্নপ্রাশন ও নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে শুভ লক্ষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

উনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে দই জমে ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া-র কারণে। এই ব্যাকটেরিয়া দুধের ল্যাকটোজ ভেঙে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে, ফলে দুধ জমে যায়। রাশিয়ার জীববিজ্ঞানী ইলিয়া মেচনিকভ দইয়ের প্রোবায়োটিক গুণ আবিষ্কার করেন এবং এর জন্য ১৯০৮ সালে নোবেল পুরস্কার পান। এর পর থেকেই দই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রস্তুত ও প্যাকেজজাত খাদ্য হিসেবে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

বিশ্বের নানা দেশে দইয়ের নাম ও রূপ ভিন্ন হলেও মূল ধারণা এক। গ্রিসে একে বলা হয় “ইয়োগার্ট”, তুরস্কে “ইয়োগুর্ট”, মধ্যপ্রাচ্যে “লাবান”, ভারতে “দই” বা “কার্ড” নামে পরিচিত। প্রতিটি অঞ্চলে এর স্বাদ, ঘনত্ব ও প্রক্রিয়ায় সামান্য পার্থক্য থাকলেও দুধ ফারমেন্ট করে তৈরি করার মূল ধারণাটি অভিন্ন।



কালীপ্রসন্ন সিংহ

কালীপ্রসন্ন সিংহ, উনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশের নবজাগরণ যুগের এক উজ্জ্বল প্রতিভা। তিনি ছিলেন একাধারে ধনী জমিদার, সমাজসেবক, অনুদানদাতা, ব্যঙ্গরচয়িতা এবং অনুবাদক। কালীপ্রসন্ন সিংহ কলকাতার এক ধনী জমিদার পরিবারে ১৮৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়স থেকেই তিনি ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই পারদর্শী ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহের অমর সৃষ্টি হলো ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ (১৮৬১)। তিনি এই গ্রন্থটি “হুতোম প্যাঁচা” ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন। এটি ছিল এক প্রকার ব্যঙ্গ-রচনা, যেখানে কলকাতার তথাকথিত ভদ্রসমাজের ভণ্ডামি, পাশ্চাত্য অনুকরণ, সামাজিক অন্যায়, ধর্মীয় কুসংস্কার ও রাজনীতির অনৈতিক দিকগুলিকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ ও রসিকতার মাধ্যমে উন্মোচন করা হয়েছিল।

কালীপ্রসন্ন সিংহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পরিচয়গুলির একটি হল তাঁর এই উপাধি—‘টিকি কাটা জমিদার’। তৎকালীন সময়ে ব্রাহ্মণ্য সমাজে “টিকি” (শিখা) ছিল ব্রাহ্মণ পরিচয়ের প্রতীক। কালীপ্রসন্ন সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, একসময় তিনি মজা করে বা প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে ৫১ জন ব্রাহ্মণের টিকি কেটে সংগ্রহ করেছিলেন। এরপর থেকেই তাঁকে কলকাতার সমাজে ‘টিকি কাটা জমিদার’ নামে ডাকা হত। কালীপ্রসন্ন ছিলেন তৎকালীন বর্ণাশ্রমধর্ম ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের কঠোর সমালোচক। তাঁর এই কাজের মধ্য দিয়ে এক প্রকার “প্রতীকী বিপ্লব”-এর প্রকাশ ঘটে, যা রক্ষণশীল সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।


হরপ্পা সভ্যতা

হরপ্পা সভ্যতা ছিল প্রাচীন ভারতের অন্যতম সুসংগঠিত ও উন্নত নগরসভ্যতা, যা খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৫০০ থেকে ১৭৫০ অব্দ পর্যন্ত সিন্ধু নদীর তীরে বিকশিত হয়েছিল। এই সভ্যতার মানুষের জীবনযাত্রা, নগর পরিকল্পনা, সামাজিক কাঠামো এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত। তাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, যা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক — উভয় ক্ষেত্রেই সমৃদ্ধ ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা শুধু নিজেদের প্রয়োজন মেটাত না, বরং পার্শ্ববর্তী সভ্যতার সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করত।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হরপ্পা সভ্যতার মানুষদের মধ্যে একটি শক্তিশালী ও বিস্তৃত বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। যেহেতু তখন মুদ্রার প্রচলন ছিল না, তাই লেনদেনের মূল ভিত্তি ছিল পণ্য বিনিময়। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিভিন্ন ধরণের পণ্য, যেমন খাদ্যশস্য, ধাতু, গহনা, মৃৎপাত্র, কাপড়, পশুর চামড়া ইত্যাদি বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালিত হতো। প্রতিটি নগর বা অঞ্চল নিজস্বভাবে কোনো একটি পণ্যে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিল — যেমন লোথাল ও মহেঞ্জোদারো শহরগুলো ধাতু প্রক্রিয়াকরণ ও গহনা তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখানে ব্রোঞ্জ, তামা, সোনা, রূপা প্রভৃতি ধাতু দিয়ে নানা অলংকার ও সরঞ্জাম তৈরি করা হতো, যা পরবর্তীতে অন্যান্য শহরে বিনিময় বা বিক্রয়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ত।

হরপ্পাবাসীরা স্থলপথে যোগাযোগের জন্যও উন্নত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তারা শহরগুলোর মধ্যে সংযোগ রক্ষার জন্য পাকা রাস্তা তৈরি করেছিল, যা মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, কালিবঙ্গান, লোথাল ইত্যাদি শহরগুলিকে যুক্ত করত। এই অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলির মাধ্যমে শুধু পণ্য পরিবহনই নয়, কারিগর, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের চলাচলও সহজতর হয়ে ওঠে। স্থানীয় বাজারগুলিতে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য বিনিময় হতো, আবার বৃহত্তর আকারের বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন অঞ্চলের পণ্যসম্ভার জমা হয়ে আদান-প্রদান চলত। এইভাবে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখত।

বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও হরপ্পা সভ্যতার অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তারা বহির্বিশ্বের সঙ্গে, বিশেষ করে মেসোপটেমিয়া, পারস্য, আফগানিস্তান এবং মিশরের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। তাদের পণ্য পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে যেত। হরপ্পাবাসীরা সমুদ্রপথে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। লোথাল শহর ছিল একটি সুপরিকল্পিত বন্দরনগরী, যেখানে একটি জেটি বা নোঙরঘাটের মতো স্থাপনা আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, তারা সমুদ্রপথে বিদেশি বণিকদের সঙ্গে পণ্য বিনিময় করত। ইরান ও আফগানিস্তানের মতো দেশ থেকে খনিজ পদার্থ, দামি পাথর, সোনা, রূপা ও সিসা আমদানি করা হতো। অন্যদিকে, তারা রপ্তানি করত তুলা, সুতির কাপড়, পশমজাত দ্রব্য, হাতির দাঁত এবং তা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন অলংকার ও হস্তনির্মিত সামগ্রী।

তুলা ছিল হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী, হরপ্পাবাসীরাই বিশ্বের প্রথম দিকের তুলা উৎপাদক ও সুতার ব্যবহারকারী জাতি। তাদের তৈরি সূক্ষ্ম তুলার কাপড় মেসোপটেমিয়া ও মিশরের রাজদরবার পর্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তুলার পাশাপাশি, তারা পশমজাত দ্রব্য, কাঠ, হাতির দাঁতের শিল্পজাত পণ্য এবং মৃৎপাত্র রপ্তানি করত। প্রতিদানে তারা মূল্যবান ধাতু, যেমন সোনা, রূপা, সিসা ও দামি পাথর আমদানি করত, যা পরে গয়না বা ধর্মীয় উপকরণ তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।

হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্য ব্যবস্থা এতটাই সুসংগঠিত ছিল যে, তার প্রমাণ আজও তাদের ব্যবহৃত ওজন ও পরিমাপের নিখুঁত মানদণ্ডে পাওয়া যায়। বিভিন্ন শহরে একই ধরণের ওজন ব্যবস্থা ব্যবহারের ফলে বোঝা যায় যে, তাদের বাণিজ্যে নির্ভুলতা ও ন্যায্যতার উপর জোর দেওয়া হতো। এই নিয়মিত ও নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যব্যবস্থা একদিকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখত, অন্যদিকে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্যও সৃষ্টি করেছিল।



সেন্টিনেলিজ : রহস্যময় আদিবাসী জনগোষ্ঠী....


আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে অবস্থিত নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপ পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় এবং বিচ্ছিন্ন মানবগোষ্ঠীর আবাসভূমি। এই দ্বীপেই বসবাস করে সেন্টিনেলিজরা—যাদের পৃথিবীর “সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন উপজাতি” বলা হয়। আজও তারা বাইরের বিশ্বের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না, বরং বহিরাগতদের প্রতি সবসময় শত্রুভাবাপন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়।

সেন্টিনেলিজদের ইতিহাস বহু প্রাচীন। নৃতাত্ত্বিকদের ধারণা, তারা প্রায় ষাট হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে আগত প্রাগৈতিহাসিক মানবগোষ্ঠীর বংশধর, যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। জেনেটিক গবেষণায় দেখা গেছে, তারা আন্দামানের অন্য আদিবাসী গোষ্ঠী যেমন ওংগে, জারোয়া এবং গ্রেট আন্দামানিজদের সঙ্গে দূর সম্পর্কযুক্ত হলেও নিজেদের আলাদা সংস্কৃতি ও পরিচয় ধরে রেখেছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ১৮৮০ সালে মি. মরিস ভিডাল পোর্টম্যান নামের এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা প্রথমবারের মতো সেন্টিনেলিজদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের আক্রমণাত্মক আচরণের কারণে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ প্রশাসন এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ স্থাপন থেকে বিরত থাকে। স্বাধীনতার পর ভারত সরকারও কয়েকবার মানবিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণার উদ্দেশ্যে দ্বীপে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেন্টিনেলিজরা কখনোই তা মেনে নেয়নি।


সেন্টিনেলিজদের জীবন সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি নির্ভর। তারা কৃষি বা পশুপালন করে না; বনের ফলমূল, শিকড়, মাছ, কচ্ছপ ও বন্য প্রাণী শিকার করে জীবনধারণ করে। তাদের সমাজে আধুনিক কোনো প্রযুক্তি নেই, তবে তারা কাঠ ও বাঁশ দিয়ে অস্ত্র তৈরি করতে পারে—ধনুক, তীর, বর্শা ইত্যাদি। তাদের বসবাস ছোট ছোট কুঁড়েঘরে, যা গাছের ডাল ও পাতা দিয়ে তৈরি। পোশাক হিসেবে তারা গাছের আঁশ বা পাতা ব্যবহার করে, এবং শরীরে অলঙ্কার হিসেবে কাঠ বা শাঁসের টুকরো পরে। তাদের ভাষা আজও অজানা, কারণ বাইরের কেউই তা বুঝতে সক্ষম হয়নি।

বাইরের কোনো মানুষ তাদের দ্বীপের কাছাকাছি গেলেই তারা তীর ছুঁড়ে সতর্ক করে দেয়। তাদের আক্রমণাত্মক মনোভাবের পেছনে রয়েছে অতীতের ট্রমা ও আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি—বহু শতাব্দী ধরে তারা বাইরের আক্রমণ, রোগ ও শোষণ থেকে নিজেদের রক্ষা করে এসেছে। ১৯৯১ সালে ভারতের নৃবিজ্ঞানী ত্রিলোকী নাথ পণ্ডিতের নেতৃত্বে একদল গবেষক তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে সেই প্রচেষ্টাও বন্ধ হয়ে যায়।

ভারত সরকার বর্তমানে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপকে একটি “প্রটেক্টেড এরিয়া” ঘোষণা করেছে, যেখানে কোনো বহিরাগত প্রবেশ করতে পারে না। দ্বীপটির চারপাশে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্র অঞ্চলও নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যাতে এই জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা অব্যাহত থাকে এবং তারা বাইরের রোগজীবাণুর সংস্পর্শে না আসে। কারণ তাদের দেহে আধুনিক জীবাণুর বিরুদ্ধে কোনো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নেই।

২০১৮ সালে জন অ্যালেন চাউ নামে একজন আমেরিকান মিশনারি বেআইনিভাবে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে প্রবেশ করেন ধর্মপ্রচার করার উদ্দেশ্যে। সেন্টিনেলিজরা তাকে তীর মেরে হত্যা করে এবং তার দেহ আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনাটি বিশ্বজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি করে এবং আন্তর্জাতিক মহল ভারতের নীতি—“তাদের একা থাকতে দাও”—এই অবস্থানকে সমর্থন করে।

আজও সেন্টিনেলিজরা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও স্বাধীন জনগোষ্ঠীগুলোর একটি হিসেবে টিকে আছে। তাদের জনসংখ্যা অনুমান করা হয় ত্রিশ থেকে একশো পঞ্চাশ জনের মধ্যে, যদিও কোনো সঠিক হিসাব নেই। তারা কৃষি, শিক্ষা, প্রযুক্তি বা আধুনিকতার কোনো ধারণা ছাড়াই প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাপন করছে।


প্রাচীন তাম্রলিপ্ত 


প্রাচীন তাম্রলিপ্ত যা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুকের কাছে অবস্থিত, বঙ্গোপসাগরের তীরে রূপনারায়ণ নদীর উপকূলে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন নগরী এবং বন্দর ছিল। এর নাম সংস্কৃত শব্দ "তাম্র" (তামা) থেকে উদ্ভূত, যা ছোট নাগপুরের ঘাটশিলা অঞ্চলের তামার খনি এবং বাণিজ্যকে নির্দেশ করে। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুসারে, খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দী থেকে এখানে বসতি ছিল, যদিও খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে এর উন্নয়ন স্পষ্ট। এটি সুহ্ম এবং বঙ্গ রাজ্যের রাজধানী ছিল এবং ভারতীয় উপমহাদেশের একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব মূলত বাণিজ্য, ধর্মীয় প্রসার এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যা খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টাব্দ ১১ম-১২শ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত।

তাম্রলিপ্ত প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরগুলির একটি ছিল, যা গঙ্গা ব্যবস্থার প্রধান প্রবেশদ্বার নিয়ন্ত্রণ করে বাণিজ্যের উত্থান ঘটিয়েছিল। গুপ্ত যুগে (খ্রিস্টাব্দ ৪র্থ-৬ষ্ঠ শতাব্দী) এটি ভারতের প্রধান আমদানি-রপ্তানি কেন্দ্র হয়ে ওঠে, যেখান থেকে সিলন (শ্রীলঙ্কা), জাভা, চীন, বার্মা, মালয় উপদ্বীপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ ভারত এবং কলিঙ্গার সাথে সমুদ্রপথে বাণিজ্য হতো। এছাড়া, পশ্চিমের সাথে (মধ্যপ্রাচ্য এবং রোমান সাম্রাজ্য) যোগাযোগ ছিল, যা রোমান সোনার মুদ্রা, সাতবাহন যুগের নৌকা-চিহ্নযুক্ত মুদ্রা এবং খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী লিপিতে নৌকা-চিত্রযুক্ত টেরাকোটা সীলমোহর দিয়ে প্রমাণিত। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল নীল, রেশম, তামা, তুলা, ইন্ডিগো এবং মাটির পাত্র, যখন আমদানিতে গ্রিক/রোমান পণ্য অন্তর্ভুক্ত। নদীপথে গঙ্গা, যমুনা এবং ঘাঘরা দিয়ে এবং সড়কপথে রাজগৃহ, শ্রাবস্তী, পাটলীপুত্র, বারাণসী, চম্পা, কৌশাম্বী এবং তক্ষশিলার সাথে যুক্ত ছিল। চীনা পর্যটক ফাহিয়ান (খ্রিস্টাব্দ ৫ম শতাব্দী), হিউয়েন সাং এবং ই-জিং-এর বিবরণে এটি সমুদ্রবন্দর হিসেবে বর্ণিত, যা খ্রিস্টীয় যুগের শুরু থেকে ১১ম শতাব্দী পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। মৌর্য যুগে (আশোকের সময়, খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী) এটি গঙ্গা অববাহিকার প্রধান বন্দর হয়ে ওঠে এবং এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দর নগরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।


তাম্রলিপ্ত ধর্মীয় প্রসারের একটি কেন্দ্রবিন্দু ছিল, বিশেষ করে বৌদ্ধধর্ম এবং জৈনধর্মের। বৌদ্ধ সাহিত্যে এর প্রথম বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে খ্রিস্টাব্দ ৫ম শতাব্দীতে ফাহিয়ান ২০-২৪টি বিহার এবং ১,০০০-এর বেশি সন্ন্যাসীর উল্লেখ করেন। এটি বৌদ্ধ মিশনের প্রসারণের জন্য ব্যবহৃত হতো; উদাহরণস্বরূপ, মৌর্য সম্রাট আশোকের শ্রীলঙ্কা মিশন এখান থেকে যাত্রা করে। মহাবংশ এবং দীপবংশ অনুসারে, রাজকুমার বিজয় এখান থেকে শ্রীলঙ্কা বিজয়ের জন্য যাত্রা করেন। জাতক কথায় সুবর্ণভূমি (বার্মা/দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) যাত্রার উল্লেখ আছে, এবং বোধিবৃক্ষ এখান থেকে সিলনে পাঠানো হয়। ই-জিং খ্রিস্টাব্দ ৬৭৫ সালে এখানে ৫ মাস কাটিয়ে সংস্কৃত শিখে নালন্দায় যান। জৈন গ্রন্থ যেমন প্রজ্ঞাপনা এবং কল্পসূত্রে এটি বঙ্গের রাজধানী হিসেবে উল্লিখিত এবং জৈন তপস্যার কেন্দ্র ছিল। পরবর্তীকালে হিন্দু ধর্মের প্রভাব বাড়ে; বর্গভীমা মন্দির (৫১ শক্ত পীঠের একটি, রাজা কালু ভূইয়ান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, প্রায় ১১৫০ বছর পুরনো) এবং জিষ্ণু হরি মন্দির (মহাভারতের সাথে যুক্ত) এর প্রমাণ। এভাবে, তাম্রলিপ্ত দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


সাংস্কৃতিকভাবে, তাম্রলিপ্ত একটি কসমোপলিটান কেন্দ্র ছিল, যেখানে ভূমধ্যসাগরীয় হায়ারোগ্লিফিক্সযুক্ত স্টিয়াটাইট সীলমোহর, টেরাকোটা মূর্তি (যক্ষী, প্রাণী এবং দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্য), স্পিন্ডল-হোয়ার্ল এবং মিসর-ক্রিটের মাটির পাত্র পাওয়া গেছে, যা প্রথমদিকের বিশ্ব যোগাযোগ নির্দেশ করে। জাভা শিলালিপিতে বণিক বুধগুপ্তের উল্লেখ (রক্তমৃত্তিকা থেকে যাত্রা) এবং ৮ম শতাব্দীর দুধপানি শিলালিপি এর সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রমাণ করে। মহাভারতের উল্লেখ অনুসারে, এটি পান্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞের সাথে যুক্ত, যেখানে ভীমের স্তম্ভিত অশ্বকে তাম্রলিপ্তের রাজা আটকান।

খ্রিস্টাব্দ ৭০০ সালের দিকে নদীর গতিপথ পরিবর্তন (সরস্বতী নদী রূপনারায়ণ ছেড়ে পূর্বমুখী হয়), পলি, ক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, কর এবং বিদেশী আক্রমণের কারণে এর হ্রাস ঘটে, যার ফলে সপ্তগ্রাম (সাতগাঁও) নতুন বন্দর হয়ে ওঠে।, 



চাণক্যের “অর্থশাস্ত্র


প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় কৌটিল্য বা চাণক্যের “অর্থশাস্ত্র” একটি অমর গ্রন্থ। এটি শুধু প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক গ্রন্থ নয়, বরং রাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক গভীর দার্শনিক বিশ্লেষণ। এর মধ্যেই নিহিত আছে বিখ্যাত “মণ্ডল তত্ত্ব”, যার মূল ভাবনা — “শত্রুর শত্রু আমার মিত্র”। এই তত্ত্ব কৌটিল্যের কূটনীতি ও রাজনীতির বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

‘মণ্ডল’ শব্দের অর্থ হলো ‘চক্র’ বা ‘পরিধি’। কৌটিল্য রাষ্ট্রকে একটি কেন্দ্রবিন্দু (রাজা বা বিজিগীষু রাজা) ধরে তার চারপাশে একাধিক রাষ্ট্রকে পরিধি বা স্তরে বিন্যস্ত করেছেন। এইভাবে এক রাষ্ট্রের চারপাশে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি একটি “রাজনৈতিক মণ্ডল” গঠন করে।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রত্যেক রাজা নিজের ভূখণ্ড সম্প্রসারণ করতে চায়, ফলে তার প্রতিবেশী রাজ্য স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু। কিন্তু সেই শত্রুর প্রতিবেশী রাষ্ট্র তার মিত্র। এভাবেই “শত্রুর শত্রু আমার মিত্র” — এই নীতিই আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভিত্তি হয়ে ওঠে।

কৌটিল্য মোট বারোটি (১২) মণ্ডল রাষ্ট্র বা শক্তি চিহ্নিত করেছেন। এদের মধ্যে প্রধান হল —

১. বিজিগীষু রাজা (নিজ রাষ্ট্র) — যিনি জয় করতে ইচ্ছুক।

২. আরিরাজা (শত্রু রাষ্ট্র) — যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বিজিগীষুর বিরুদ্ধে।

৩. মিত্ররাজা — আরিরাজার শত্রু, অর্থাৎ বিজিগীষুর মিত্র।

৪. মিত্রের মিত্র — দ্বিতীয় স্তরের মিত্র।

৫. আরিরাজ্যের মিত্র — দ্বিতীয় স্তরের শত্রু।

৬. মধ্যম রাষ্ট্র — যে দুই শক্তির মধ্যে অবস্থিত এবং যার অবস্থান নিরপেক্ষ বা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

৭. উদাসীন রাজা — যে রাষ্ট্র দূরে, এবং সংঘর্ষে সরাসরি অংশ নেয় না।

এইভাবে, কৌটিল্য রাষ্ট্রসমূহের একটি বাস্তব রাজনৈতিক চক্র কল্পনা করেন, যেখানে সম্পর্ক নির্ভর করে কৌশলগত স্বার্থের উপর, নৈতিকতার উপর নয়।

মণ্ডল তত্ত্বের মূলনীতি,“শত্রুর শত্রু আমার মিত্র”-

এই নীতি অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্রই স্থায়ী শত্রু বা মিত্র নয় — বরং স্বার্থই একমাত্র চিরস্থায়ী ভিত্তি।

উদাহরণস্বরূপ — যদি রাষ্ট্র ‘A’-র সঙ্গে ‘B’-এর শত্রুতা থাকে, তবে ‘C’ যদি ‘B’-এর শত্রু হয়, তবে ‘C’ রাষ্ট্রকে ‘A’-এর মিত্র হিসেবে দেখা হবে।

এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রকে কূটনৈতিক জোট, যুদ্ধ, শান্তি, বা গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তা ও প্রভাব বাড়ানোর কৌশল শেখানো।

কৌটিল্যের চিন্তাভাবনা আধুনিক রাষ্ট্রনীতির রিয়ালিস্ট (Realist) তত্ত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে যায়। যেমন —

১. রাষ্ট্র সবসময় ক্ষমতা ও স্বার্থ অনুসারে সিদ্ধান্ত নেবে।

২. নৈতিকতা বা ধর্মনীতি রাষ্ট্রনীতির মুখ্য উপাদান নয়।

৩. যুদ্ধ, মৈত্রী, কূটনীতি, গুপ্তচরবৃত্তি — সবই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার হাতিয়ার।

৪. এই দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালে ম্যাকিয়াভেলির “The Prince”-এর সাথে তুলনাযোগ্য।

মৌর্য যুগেই এই নীতির প্রয়োগ দেখা যায়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যখন মগধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তিনি কৌটিল্যের নির্দেশে বিভিন্ন পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে কৌশলগত জোট গড়ে তোলেন — শত্রুর শত্রুকে মিত্রে পরিণত করেন।

আধুনিক যুগেও দেখা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের স্বার্থে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির বিরুদ্ধে মিত্রতা গড়ে তোলে। যেমন — দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জোটবদ্ধ হয়েছিল নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে — যা কৌটিল্যের মণ্ডল তত্ত্বেরই বাস্তব প্রয়োগ।

যদিও এটি প্রাচীন ভারতীয় রাজনীতির তত্ত্ব, তবুও আজকের আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, ন্যাটো বা ব্রিকসের মতো জোট, আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা নীতি — সব ক্ষেত্রেই কৌটিল্যের এই চিন্তাধারা প্রতিফলিত। অর্থাৎ, রাজনৈতিক স্বার্থই কূটনীতির মূল চালিকাশক্তি — এই ধারণা আজও অমলিন।

কৌটিল্যের মণ্ডল তত্ত্ব শুধু প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রচিন্তার নিদর্শন নয়, বরং আধুনিক বিশ্বরাজনীতিরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। “শত্রুর শত্রু আমার মিত্র” — এই নীতিটি রাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, এমনকি যুদ্ধনীতিতেও প্রযোজ্য। কৌটিল্যের এই বাস্তববাদী দর্শন প্রমাণ করে যে, ভারতের রাজনৈতিক চিন্তা পাশ্চাত্য চিন্তার থেকে কোনো অংশে কম ছিল না, বরং বহু শতাব্দী আগে থেকেই এখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ বিদ্যমান ছিল। যা আজও দেখা যাচ্ছে, ভারত ও আফগানিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে, যেখানে প্রতিবেশী পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের শত্রু এবং আফগানিস্তানের শত্রু, সুতরাং "শত্রুর শত্রু আমার মিত্র" স্বার্থক রাজনীতি ।

যাইহোক, এই অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ণ লেখাটি ভালো লাগলে অবশ্যই অবশ্যই একটা লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো । এগুলো সকলেরই জানা খুবই জরুরী ।


“দেওয়ানি” লাভ 

ভারতের ইতিহাসে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ একটি যুগান্তকারী বছর। এই বছরই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমবারের মতো ভারতের এক বিশাল ভূখণ্ডের শাসনক্ষমতা বা “দেওয়ানি” লাভ করে। এই দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে তারা বাংলার রাজস্ব ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপর প্রভুত্ব স্থাপন করে এবং কার্যত ভারতের উপনিবেশিক শাসনের সূচনা ঘটায়। পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) ছিল এই পরিবর্তনের প্রথম ধাপ, যেখানে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ইংরেজরা বাংলার রাজনীতির দখল নেয়। এরপর মীরজাফর ও মীরকাসিমের সময়ে ইংরেজদের সঙ্গে নবাবদের সংঘাত চলতে থাকে। এই সংঘাতের পরিণতি ঘটে ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধের মধ্যে, যেখানে ইংরেজ বাহিনী মীর কাসিম, মোগল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয় এবং আওধের (অযোধ্যা) নবাব সুজাউদ্দৌলাকে পরাজিত করে। বক্সারের এই জয়ই ইংরেজদের হাতে ভারত শাসনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।

বক্সারের যুদ্ধের পর মোগল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয় রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি নিজের সাম্রাজ্য রক্ষার স্বার্থে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হন। ১২ আগস্ট ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদে শাহ আলম দ্বিতীয় ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা “আল্লাহাবাদ চুক্তি” নামে পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমে শাহ আলম দ্বিতীয় কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশের দেওয়ানি অধিকার প্রদান করেন। দেওয়ানি অধিকার বলতে বোঝানো হয় রাজস্ব আদায়ের অধিকার এবং দেওয়ানি বিচারব্যবস্থার তত্ত্বাবধান। অর্থাৎ, এই তিন প্রদেশে সমস্ত আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ইংরেজ কোম্পানির হাতে চলে আসে। নবাবের হাতে কেবল “নিজামত” বা অপরাধ সংক্রান্ত দায়িত্ব ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব থাকে, যা ছিল কেবলমাত্র প্রতীকী। প্রকৃত ক্ষমতা তখন থেকে সম্পূর্ণরূপে ইংরেজদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।


এই দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোয় এক আমূল পরিবর্তন ঘটে। নবাবের আর কোনো বাস্তব ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকেনি। ইংরেজরা রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয়। রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল কৃষিজমি, তাই তারা কৃষকদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে এবং রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে চরম শোষণ শুরু হয়। এর ফলস্বরূপ বাংলার কৃষিজ অর্থনীতি ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় যে মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তা ইংরেজদের এই শোষণমূলক রাজস্বনীতির সরাসরি ফল ছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায়, অথচ ইংরেজ কোম্পানি রাজস্ব আদায়ে কোনো রকম ছাড় দেয়নি।

দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজরা প্রথমে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যার মাধ্যমে প্রশাসনের দুই দিক আলাদা করা হয়েছিল—রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ইংরেজদের, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নবাবের নামে। কিন্তু এই দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা খুব দ্রুত অকার্যকর ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমাণিত হয়, কারণ নবাবের হাতে কোনো বাস্তব ক্ষমতা ছিল না এবং ইংরেজরা পরোক্ষভাবে সমস্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করত। অবশেষে ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস এই দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন এবং রাজস্ব প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে কোম্পানির হাতে নেন। সেই সময় থেকে ইংরেজ শাসনভার সরাসরি প্রশাসনিক রূপ লাভ করে।

দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলার সমাজ-অর্থনীতি এক গভীর বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যায়। কৃষকরা ভূমিহারা হতে থাকে, কারণ তারা অতিরিক্ত করের চাপে জমি হারায়। বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প, বিশেষ করে মসলিন ও বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়, কারণ ইংরেজ কোম্পানি নিজস্ব ইংরেজ বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য ভারতীয় উৎপাদনকে প্রতিযোগিতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ফলে বাংলার শিল্পোন্নয়ন সম্পূর্ণভাবে থেমে যায় এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন হয়ে পড়ে। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ ছিল ভারতের উপনিবেশিক যুগের সূচনাবিন্দু, যার মাধ্যমে একদিকে ইংরেজদের রাজনৈতিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, অন্যদিকে ভারতীয় সমাজ-অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। এই ঘটনাকে তাই ইতিহাসবিদেরা যথার্থই ভারতের ভাগ্যনির্ধারক মোড় বলে অভিহিত করেছেন।


মতুয়া আন্দোলন

মতুয়া আন্দোলনকে অবশ্যই একটি ধর্মীয় বিপ্লব হিসেবে বিবেচনা করা যায় । এই আন্দোলন মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলায় উদ্ভূত হয়ে ঐতিহ্যবাহী হিন্দু ধর্মের জাতিভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসকে চ্যালেঞ্জ করে, নিচুজাত (উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চোখে) নিম্নবর্গীয় নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় পরিচয় গড়ে তোলে ।

এই বিপ্লব কেবলমাত্র ধর্মীয় সংস্কার নয়, বরং অস্পৃশ্যতা ও অবহেলার বিরুদ্ধে একটি আধ্যাত্মিক বিদ্রোহ, যা ভক্তির কাঠামোকে পুনর্গঠন করে সকলের জন্য মুক্তির পথ খুলে দেয় ।

মতুয়া আন্দোলনের উৎপত্তি হয় প্রায় ১৮৬০ সালের দিকে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা অঞ্চলে, বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়, যারা (নমঃশূদ্র) হিন্দু সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে (অস্পৃশ্য) বিবেচিত ছিল এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত ছিল । উক্ত শতাব্দীর শেষভাগে এটি একটি সুসংগঠিত সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলনের রূপ নেয়, যা মতুয়া মহাসংঘের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিস্তার লাভ করে ।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর এই আন্দোলন কিছুটা স্তিমত হয় কারণ, নমঃশূদ্র বা মতুয়াদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় । অধিনকাংশই এরা উদ্বাস্তু হয়ে পড়েন । পরবর্তীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের নেতৃত্বে ঠাকুরনগরকে কেন্দ্র করে এটি একটি শক্তিশালী ধর্মীয় কেন্দ্রে পরিণত হয় । আর একটি কেন্দ্র বর্তমান বাংলাদেশের ওড়াকান্দি ।

এই উৎপত্তি ধর্মীয় বিপ্লবের কারণে বিপ্লবী, কারণ এটি ঔপনিবেশিক যুগের জাতিভিত্তিক অবিচারের প্রতিক্রিয়া । নমঃশূদ্রদের বর্ণবাদী হিন্দু ধর্মের বাইরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল, কিন্তু মতুয়ারা বা "মতুয়া" তাদের মধ্যে থেকে একটি নতুন ধর্মীয় আত্মপরিচয় তৈরি করে, যা ব্রাহ্মণ্যবাদী নিয়মকে প্রত্যাখ্যান করে ।

মতুয়াদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল

"স্বয়ং-দীক্ষা বা স্বয়ং-দীক্ষিতি", আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমে মুক্তি, যা গুরু বা উচ্চবর্ণের মধ্যস্থতা ছাড়াই সম্ভব । আর একটি বিষয় হল শিক্ষা ও সমতা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার প্রাধান্য, এবং জাতি-বর্ণের অতীত সম্মিলিত ভক্তি । এটি প্রেম, ভালোবাসা, লিঙ্গ সমতা এবং অত্যাচারিতদের ঐক্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ।

এই বিশ্বাসগুলো ধর্মীয় বিপ্লবের প্রমাণ, কারণ এটি হিন্দু ধর্মের জাতিভিত্তিক বাধা অপসারণ করে । ঐতিহ্যবাহী বৈষ্ণবতায় মুক্তির পথ উচ্চবর্ণীয়দের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু মতুয়া এটিকে গণতান্ত্রিক করে তোলে, যা ধর্মের সামাজিক ক্ষমতাকে পুনরায় বিতরণ করে ।

কেন মতুয়া একটি ধর্মীয় বিপ্লব ?

মতুয়া বিপ্লবের মূলে রয়েছে হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কার, যা অস্পৃশ্যদের জন্য মন্দিরপ্রবেশ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং আধ্যাত্মিক সমতার পথ অর্জন করে । এটি দলিত উন্নয়নের একটি ধাপ হিসেবে কাজ করে, যেখানে ধর্মকে সামাজিক মুক্তির হাতিয়ারে পরিণত করে । উদাহরণস্বরূপ, হরিচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে এটি নমঃশূদ্র বা নিম্ন বর্ণের ধর্মীয় পরিচয়কে 'পবিত্র' করে তোলে, এবং অবহেলার চক্রকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয় ।

ধর্মীয় বিপ্লবের সংজ্ঞা অনুসারে, এটি একটি 'রিফর্ম মুভমেন্ট' যা ধর্মীয় স্থিতাবস্থাকেও উল্টে দেয় । এখানে বিপ্লবী উপাদান হল অবতার ধারণার পুনর্ব্যাখ্যা—যা উচ্চবর্ণের একচেটিয়া অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে এবং নিম্নবর্গকে আধ্যাত্মিক কেন্দ্র করে গড়ে তোলে । এটি প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশনের মতো, যেখানে ধর্মীয় ক্ষমতা গণতান্ত্রিক হয় ।

আন্দোলনের মাধ্যমে মতুয়ারা ধর্মীয় বিপ্লব হিসেবে বাংলার ধর্ম-সমাজের কাঠামোকে পরিবর্তন করে যাচ্ছে । এটি দলিত আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে রাজনৈতিক সচেতনতাও জাগাচ্ছে, তবে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন আধুনিক হিন্দুদের বর্ণবাদের সাথে সংঘাত এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন ।

সুতরাং সামগ্রিকভাবে, এটি দেখায় যে ধর্মীয় বিপ্লব কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার । তাই এর প্রভাব আজও বাংলাদেশ ও ভারতে দেখা যায়, যেখানে জাতিভেদের বিরুদ্ধে মতুয়ারা কঠিন হলেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ।


বক্সারের যুদ্ধ

ভারতের উপনিবেশিক ইতিহাসে বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪) এক ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনকারী অধ্যায়। এটি এমন একটি যুদ্ধ, যার ফলাফল ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয় এবং ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বকে অবিচল ও স্থায়ী করে তোলে। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর সিরাজউদ্দৌলার পতনে বাংলার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ইংরেজদের হাতে চলে যায়। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধ ছিল মূলত ষড়যন্ত্রের ফল, যেখানে প্রকৃত সামরিক সংঘর্ষের তুলনায় বিশ্বাসঘাতকতার ভূমিকা ছিল প্রধান। অন্যদিকে বক্সারের যুদ্ধ ছিল একটি প্রকৃত সামরিক সংঘর্ষ, যেখানে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সম্মিলিত ভারতীয় শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে হয়েছিল।

পলাশীর পর ইংরেজরা মীর জাফরকে নবাবের আসনে বসিয়ে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধি চালাতে থাকে। মীর জাফরের অক্ষমতা ও নির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে কোম্পানি বাংলার রাজস্ব থেকে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে। পরে যখন মীর কাসিম নবাব হন, তখন তিনি ইংরেজদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে শাসন করতে চান। তিনি রাজস্ব ও বাণিজ্য সংস্কারের মাধ্যমে নবাবি ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। ইংরেজদের করমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা বাতিল করে তিনি বাণিজ্যে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতে ইংরেজদের বিরোধিতা শুরু হয়। সংঘাত ক্রমে তীব্র হয়ে ওঠে, এবং অবশেষে মীর কাসিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

১৭৬৩ সালে তাঁর পরাজয়ের পর তিনি আশ্রয় নেন আওধের নবাব শুজাউদ্দৌলা এবং মোগল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয়ের কাছে। এই তিনজন মিলিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব সম্মিলিত অভিযান গড়ে তোলেন। সেই সম্মিলিত বাহিনী ও ইংরেজ সেনাদের মধ্যে ১৭৬৪ সালের ২২ অক্টোবর বিহারের বক্সার নামক স্থানে এক ভয়ংকর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন মেজর হেক্টর মনরো। ইংরেজদের সৈন্য সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে কম — প্রায় সাত হাজার — কিন্তু তারা ছিল প্রশিক্ষিত ও সুসংগঠিত। অপরদিকে মীর কাসিম, শুজাউদ্দৌলা ও শাহ আলম দ্বিতীয়ের বাহিনী ছিল প্রায় চল্লিশ হাজারেরও বেশি, কিন্তু তাদের নেতৃত্ব ও কৌশল দুর্বল ছিল।

যুদ্ধের সময় ইংরেজ বাহিনী আধুনিক অস্ত্র, শৃঙ্খলা এবং কৌশলের মাধ্যমে সম্মিলিত ভারতীয় বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করে। মীর কাসিম পালিয়ে যান, শুজাউদ্দৌলা ও শাহ আলম দ্বিতীয় পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হন। এই যুদ্ধের পর ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল ছিল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিরঙ্কুশ বিজয় এবং ভারতীয় শাসকদের সম্পূর্ণ পরাজয়।

যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সালে আলাহাবাদে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ইতিহাসে “আলাহাবাদ চুক্তি” নামে পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমে মোগল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিওয়ানি অধিকার প্রদান করেন। এর অর্থ, এই তিন প্রদেশের রাজস্ব আদায়ের পূর্ণ অধিকার কোম্পানির হাতে ন্যস্ত হয়। সম্রাট নামমাত্রভাবে দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকলেও প্রকৃত শাসনক্ষমতা চলে যায় ইংরেজদের হাতে। আওধের নবাব শুজাউদ্দৌলাকে যুদ্ধক্ষতিপূরণ বাবদ বিশাল অঙ্কের অর্থ দিতে হয় এবং মীর কাসিম রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান।

এই যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের প্রকৃত শাসক হয়ে ওঠে। বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানি এভাবে ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দখল করে নেয়। বক্সারের যুদ্ধের পর থেকে ভারতবর্ষে “কোম্পানি রাজ” নামে যে নতুন যুগের সূচনা হয়, তা ভারতের ইতিহাসে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। রাজস্ব আদায়ের দিওয়ানি অধিকার লাভের ফলে কোম্পানি ভারতের বিপুল অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এই রাজস্ব থেকেই পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠে এবং ভারতের সম্পদ ক্রমে পশ্চিমে প্রবাহিত হতে থাকে।

বক্সারের যুদ্ধ শুধু একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়; এটি ছিল ভারতের রাজনীতির দিক নির্ণয়ের যুদ্ধ। এর মাধ্যমে মোগল সাম্রাজ্যের পতন কার্যত সম্পূর্ণ হয়, বাংলার স্বাধীন নবাবি শাসন বিলুপ্ত হয়, এবং ইংরেজ শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। ভারতের ইতিহাসে ইংরেজ আধিপত্যের বাস্তব সূচনা এই যুদ্ধ থেকেই শুরু। পলাশীর যুদ্ধ ইংরেজদের ক্ষমতার দ্বার খুলেছিল, কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ সেই দ্বারকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল ভারতীয়দের জন্য।

এই যুদ্ধের পর ভারতবর্ষে যে শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তা বিদেশি প্রভুত্বের প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়। প্রশাসন, রাজস্ব, বিচার ও সেনাব্যবস্থা—সব ক্ষেত্রেই ইংরেজ প্রভাব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বক্সারের যুদ্ধের পর থেকে ভারতীয় সমাজে যে অর্থনৈতিক শোষণ, কৃষক নিপীড়ন ও রাজনৈতিক দাসত্বের যুগ শুরু হয়, তা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলতে থাকে।

সুতরাং বলা যায়, বক্সারের যুদ্ধ ভারতীয় ইতিহাসে এক অনিবার্য দিকনির্ণায়ক ঘটনা। এটি ছিল সেই মুহূর্ত, যখন ভারতের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দেশীয় শাসকদের হাত থেকে চিরতরে বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যায়। পরবর্তী কালে ইতিহাসবিদদের মতে—“পলাশী ছিল প্রস্তাবনা, আর বক্সার ছিল ভারতের উপনিবেশিক যুগের সূচনা।” তাই যথার্থই বলা হয়, “বক্সারের যুদ্ধই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রকৃত ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল।”

 

রামমোহন রায়ের দুটি গাই-গরু নিয়ে ইংল্যান্ড যাওয়ার গল্প-কাহিনী...

১৮৩০ সালের শেষ দিকে, ভারতের সামাজিক সংস্কারের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায় একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ইংল্যান্ড যাবেন—যা তখনকার হিন্দু সমাজে একটি নিষিদ্ধ কাজ ছিল। এছাড়া, তিনি ব্রিটিশ জনগণ এবং সরকারের কাছে ভারতের ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছিলেন, যাতে দেশের অগ্রগতির পথ সুগম হয়।

এই যাত্রা ছিল শুধু একটি ভ্রমণ নয়, বরং একটি সাহসী লড়াইয়ের শুরু। কিন্তু এই যাত্রায় তাঁর সাথে যে অদ্ভুত সঙ্গী ছিল, তা হল দুটি গাই-গরু। এই কাহিনীটি শুধু একটি ঘটনা নয়, বরং রামমোহনের জীবনের দ্বন্দ্বের প্রতীক—প্রগতিশীলতা এবং ঐতিহ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার লড়াই।

তিনি ইতিমধ্যে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করে হিন্দু সমাজের অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সতীদাহ নিষিদ্ধকরণের আইন (১৮২৯) পাস হয়েছে, কিন্তু এটি পুরোপুরি কার্যকর করতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সমর্থন দরকার। তাই, ১৮৩০ সালের ১৫ নভেম্বর, কলকাতা থেকে তিনি 'আলবিয়ন' নামক জাহাজে যাত্রা শুরু করেন। জাহাজে ছিলেন দু'জন হিন্দু চাকর, দুই জন/একজন ব্রাহ্মণ রাঁধুনি এবং—সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য—দুটি গাই-গরু। এই গরুগুলো ছিল না কোনো উপহার বা প্রতীক, বরং তাঁর দৈনন্দিন জীবনের অংশ।

বাংলায় তাঁকে ইতিমধ্যে কাস্ট-ভঙ্গের জন্য সমালোচনা করা হয়েছে। রামমোহন ছিলেন ব্রাহ্মণ, কিন্তু তিনি মাংসাহার সমর্থন করতেন এবং ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে গলা ফাটাতেন। ইংল্যান্ড যাওয়া মানেই 'কালসার্পের মুখে ঢোকা'—কারণ সমুদ্র পার হওয়া হিন্দু ধর্মে নিষিদ্ধ। তাই, তাঁকে প্রমাণ করতে হয় যে তিনি এখনও 'পবিত্র'। এখানেই আসে গরুগুলোর ভূমিকা।

রামমোহনের জীবন ছিল কঠোর ব্রাহ্মণীয় নিয়মের বন্দী। তিনি দুধ ছাড়া থাকতে পারতেন না—এটি ছিল তাঁর দৈনন্দিন খাদ্যের অংশ। ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংরেজি দুধ ব্যবহার করলে কাস্টের নিয়ম ভঙ্গ হবে, এবং তাঁর সমালোচকরা বলবে, "দেখো, এই সংস্কারক তো নিজের ধর্মই ভুলে গেছে!" তাই, তিনি দুটি 'মিল্ক কাউ' (দুধ দেওয়া গরু) নিয়ে যান। এই গরুগুলো ছিল ভারতীয় জাতের, যাতে তাঁর দুধ 'পবিত্র' থাকে। জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং চাকররা এই ব্যবস্থা করেন, যাতে যাত্রার সময় (প্রায় ৬ মাস) এবং ইংল্যান্ডে পৌঁছে দুধের অভাব না হয়।

জাহাজে গরুগুলোকে রাখা হয়েছিল বিশেষ জায়গায়, কিন্তু সমুদ্রের ঝড়ে গরুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ে। রামমোহন নিজে তাদের দেখাশোনা করেন, যেন তারা তাঁর পরিবারের সদস্য। এই যত্ন ছিল না শুধু ব্যবহারিক, বরং প্রতীকী—তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে সংস্কার মানেই ঐতিহ্যের অস্বীকার নয়। ব্রিটিশদের কাছে এটি একটি কৌতূহলের বিষয় হয়ে ওঠে। লিভারপুলে পৌঁছে (১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে) গরুগুলোকে নিয়ে তিনি লন্ডনে যান, এবং সেখানকার লোকেরা অবাক হয়ে দেখত যে এই ভারতীয় রাজা কীভাবে তার 'পোষা গরু' নিয়ে ঘুরে বেড়ান।

ইংল্যান্ডে গরুগুলোর ভূমিকা এবং ফলাফল

লন্ডনে পৌঁছে রামমোহনের জীবন হয়ে ওঠে একটি সেনসেশন। কিন্তু গরুগুলো ছাড়া তাঁর থাকা অসম্ভব। তিনি একটি ছোট ফ্ল্যাটে থাকেন, যেখানে গরুগুলোকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এই গরুর দুধ দিয়ে তিনি তার ব্রাহ্মণীয় খাদ্য রক্ষা করেন, যাতে বাংলার সমাজ তাঁকে 'ধর্মত্যাগী' বলে অভিযোগ না করে। একইসাথে, তিনি ব্রিটিশদের সাথে আলোচনায় যান—পার্লামেন্টে সতীদাহের আইনের পক্ষে বক্তৃতা দেন, এবং ভারতের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবি তোলেন।

দুর্ভাগ্যবশত, ১৮৩৩ সালে তিনি ব্রিস্টলে মারা যান। গরুগুলোর কী হল, তা ঠিক জানা যায় না, কিন্তু এই যাত্রা রামমোহনের জীবনের একটি অমর অধ্যায় হয়ে থাকে। রামমোহনের এই 'গাই-গরুর যাত্রা' ছিল তাঁর সাহসের প্রমাণ—যেখানে দুটি সাধারণ গরু হয়ে উঠেছিল বিশ্বাসের সেতু। দুঃখের বিষয় হল এই যে, এবিষয়ে (গাই গরু নিয়ে যাওয়ার) কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না, এটি সম্ভবত একটি গল্প বা কাহিনী হিসেবে প্রচলিত ।



ভারতে আধুনিক শিক্ষার প্রসার 

ব্রিটিশ শাসনকালে (১৭৫৭-১৯৪৭) ভারতে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার একটি ধীরগতির প্রক্রিয়া ছিল, যা প্রধানত প্রশাসনিক সুবিধা, অর্থনৈতিক লাভ এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছিল। ব্রিটিশরা শিক্ষাকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন যাতে ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি সংস্কৃতি এবং পশ্চিমা চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেওয়া যায়, যা পরোক্ষভাবে জাতীয়তাবাদের বীজও বপন করেছিল। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন আইন, কমিশন এবং নীতিমালা গৃহীত হয়, যা ধাপে ধাপে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

নীচে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হল :

১. প্রারম্ভিক উদ্যোগ (১৭৮০-এর দশক):

ঐতিহ্যবাহী শিক্ষার প্রসার :

কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা (১৭৮১): ওয়ারেন হেস্টিংস মুসলিম আইনের অধ্যয়নের জন্য কলকাতায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ব্রিটিশ প্রশাসনের স্থানীয় আইন-কানুন বোঝার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছিল। উদ্দেশ্য, প্রশাসনিক সহায়তা। ঐতিহ্যবাহী মুসলিম শিক্ষা ফোকাস। ভারতীয় ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিলেও, আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেনি।

সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা (১৭৯১): জোনাথন ডানকান বারাণসীতে হিন্দু দর্শন এবং আইন অধ্যয়নের জন্য সংস্কৃত কলেজ শুরু করেন।, উদ্দেশ্য, প্রশাসনিক জ্ঞান অর্জন।

২. চার্টার অ্যাক্ট (১৮১৩): শিক্ষার জন্য প্রথম সরকারি অর্থায়ন :

এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয় এবং মিশনারিদের শিক্ষা কার্যক্রমের অনুমতি দেওয়া হয়। এটি শিক্ষাকে সরকারি দায়িত্বের অংশ করে তোলে।

উদ্দেশ্য, শিক্ষাকে প্রশাসনিক লক্ষ্যের সাথে যুক্ত করা।

প্রভাব, ১৮২৩ সাল পর্যন্ত অর্থ ব্যবহার না হলেও, এটি পরবর্তী সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করে। রাজা রামমোহন রায়ের মতো ভারতীয় সংস্কারকরা ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে দাঁড়ান।

৩. ম্যাকলে মিনিটস এবং ইংরেজি শিক্ষা অ্যাক্ট (১৮৩৫) :

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে থমাস ব্যাবিঙ্গটন ম্যাকলে-এর মিনিটস প্রভাবে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা হয়। সংস্কৃত এবং আরবি গ্রন্থের প্রকাশ বন্ধ করা হয় এবং ইংরেজি কোর্ট ভাষা হয়।

উদ্দেশ্য, "ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিয়রি" – অভিজাতদের শিক্ষা দিয়ে জ্ঞান নীচের স্তরে ছড়ানো। পশ্চিমা বিজ্ঞান এবং সাহিত্য প্রচার; "ইংরেজি স্বাদের ভারতীয়" তৈরি।

প্রভাব, এলফিনস্টোন কলেজ (বম্বে) এবং কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি।

৪. উডস ডিসপ্যাচ (১৮৫৪):

ইংরেজি শিক্ষার 'ম্যাগনা কার্টা', স্যার চার্লস উড (বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট) লর্ড ডালহৌসির কাছে এই ডিসপ্যাচ পাঠান, যা প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলে।

উদ্দেশ্য:, সমন্বিত শিক্ষা কাঠামো তৈরি।

বৈশিষ্ট্য, স্থানীয় ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা, ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষা; মহিলা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা উৎসাহ; গ্রান্ট-ইন-এইড সিস্টেম; কলকাতা, মাদ্রাস এবং বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা (১৮৫৭)।

প্রভাব, শিক্ষা প্রসার ঘটে, কিন্তু ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতি অবহেলিত হয়; শিক্ষা চাকরির মাধ্যম হয়ে ওঠে।

৫. হান্টার কমিশন (১৮৮২-৮৩) :

উডস ডিসপ্যাচের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য গঠিত, প্রাইমারি শিক্ষার উন্নয়নের উপর জোর দেয়।

উদ্দেশ্য, প্রাথমিক শিক্ষা শক্তিশালী করা।

বৈশিষ্ট্য, স্থানীয় বোর্ডগুলোকে শিক্ষা করের অধিকার; সেকেন্ডারি কারিকুলামকে দুই ভাগে বিভক্ত (উচ্চশিক্ষা প্রস্তুতি এবং বৃত্তিমূলক); ঐতিহ্যবাহী স্কুলগুলোকে স্বাধীনতা।

প্রভাব, প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তার এবং পশ্চাদপদ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তি বাড়ায়।

৬. র‍্যালে কমিশন এবং ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিজ অ্যাক্ট (১৯০২-০৪) :

১৯০২ সালে গঠিত কমিশনের সুপারিশে ১৯০৪ সালের আইন পাস হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়।

উদ্দেশ্য, ছাত্রদের জাতীয়তাবাদী প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চশিক্ষা উন্নয়ন।

বৈশিষ্ট্য, কলেজ অ্যাফিলিয়েশনের কঠোর নিয়ম; পোস্টগ্র্যাজুয়েট কোর্স চালু; সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি।

প্রভাব, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কমে, কিন্তু গ্রান্ট সিস্টেম শুরু হয়।

৭. শিক্ষা নীতির সরকারি রেজোলিউশন (১৯১৩) :

গোপাল কৃষ্ণ গোখলে-এর প্রস্তাব এবং কিং জর্জ পঞ্চমের সফরের প্রভাবে গৃহীত, যা প্রাইমারি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দিকে অগ্রসর হয়।

উদ্দেশ্য, শিক্ষা সংস্কার এবং স্থানীয় শাসন বৃদ্ধি।

বৈশিষ্ট্য, নিম্ন ও উচ্চ প্রাইমারি স্কুল বিস্তার; শারীরিক শিক্ষা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ; মহিলা শিক্ষার জন্য বিশেষ কারিকুলাম; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা-কেন্দ্রিক করা।

প্রভাব, শিক্ষা বোর্ডগুলোকে শক্তিশালী করে, কিন্তু বিল পাস না হওয়ায় সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।

ব্রিটিশদের এই পদক্ষেপগুলো ভারতে আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করলেও, এর উদ্দেশ্য ছিল অভিজাত শ্রেণীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। ফলে সাক্ষরতার হার কম ছিল (১৯১১ সালে ৯৪% অসাক্ষর), মহিলা এবং নিম্নবর্ণের মধ্যে শিক্ষা অবহেলিত হয় এবং এতে ভারতীয় সংস্কৃতি দুর্বল হয়। তবে এটি জাতীয়তাবাদ এবং সংস্কার আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত করে।



ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ছিলেন বাংলা নবজাগরণের এক অপরিহার্য স্তম্ভ, যিনি শিক্ষা, সামাজিক সংস্কার এবং সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের অন্ধত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। নবজাগরণকালীন বাংলা সমাজে কুসংস্কার যেমন জাতিভেদ, বিধবাদের অধিকারহরণ, শিশুবিবাহ এবং নারীশিক্ষার অভাব ছিল প্রধান বাধা। বিদ্যাসাগরের কাজ ছিল এগুলিকে যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভেঙে ফেলা, যা ব্রিটিশ শাসনকালীন পশ্চিমা প্রভাবের ফলে উদ্ভূত হয়েছিল। তাঁর অবদানকে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, এটি শুধু সংস্কারমূলক ছিল না, বরং সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের ভিত্তি স্থাপনকারী। বিশ্লেষণাত্মকভাবে, তাঁর কাজগুলি সমাজের প্রতিরোধের মুখে অক্লান্ত লড়াইয়ের উদাহরণ, যা দীর্ঘমেয়াদীভাবে নারী অধিকার এবং যুক্তিবাদের পথ প্রশস্ত করেছে।

বিদ্যাসাগরের কাজগুলি তিনটি মূল ক্ষেত্রে বিভক্ত করা যায়: শিক্ষা সংস্কার, সামাজিক আইনি পরিবর্তন এবং সাহিত্যিক-ধর্মীয় প্রচার। এগুলি নবজাগরণের চেতনাকে জাগ্রত করতে সাহায্য করেছে, যা রাজা রামমোহন রায়ের মতো পূর্বসূরিদের কাজকে আরও গভীরতর করেছে।

বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষাকে সমাজের মুক্তির চাবিকাঠি মনে করতেন। ১৮৪৯ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নারীদের শিক্ষা প্রদানের পক্ষে লড়াই করেন, যা তৎকালীন সমাজে অভূতপূর্ব ছিল। তাঁর উদ্যোগে বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বাংলায় নারীশিক্ষার প্রথম আধুনিক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া, তিনি ৩৫টিরও বেশি মেয়েদের স্কুল স্থাপনে সহায়তা করেন এবং বাংলা গ্রন্থ যেমন 'বর্ণপরিচয়' লিখে শিক্ষাকে সহজলভ্য করেন। এই কাজের মাধ্যমে তিনি নারীদের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের শিকল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্য রাখেন, যা ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগে নারীশিক্ষার হার বাড়াতে সাহায্য করে।

১৮৫৬ সালে 'হিন্দু ওয়িডো রিম্যারেজ অ্যাক্ট' পাসের পিছনে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ছিল মূল। তিনি ধর্মশাস্ত্রের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ করেন যে বিধবা বিবাহ হিন্দু ধর্মের বিরোধী নয়, এবং লর্ড ডালহৌসির কাছে হাজারো স্বাক্ষরসহ পিটিশন জমা দেন। এছাড়া, তিনি শিশুবিবাহ, বহুবিবাহ এবং জাতিভেদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চালান। উদাহরণস্বরূপ, কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রচলিত বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁর প্রচেষ্টা সমাজের অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধ করে। এই সংস্কারগুলি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি ব্যবহারিক যুদ্ধ ছিল, যা ধর্মীয় গ্রন্থের অপব্যবহারকে চ্যালেঞ্জ করে।

সাহিত্যিক ও ধর্মীয় প্রচার: বিদ্যাসাগরের গ্রন্থ যেমন 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' এবং 'শকুন্তলা' বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তা ছড়িয়েছে। তিনি ধর্মগ্রন্থের সরল ব্যাখ্যা প্রচার করে অন্ধবিশ্বাস যেমন সতীদাহ এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করেন।

পশ্চিমা জ্ঞানের প্রভাবে তাঁর এই কাজগুলি বাংলা সমাজকে আধুনিকতার দিকে নিয়ে যায়।

বিদ্যাসাগরের অবদান নবজাগরণকে একটি সামাজিক বিপ্লবের রূপ দিয়েছে, কারণ তাঁর কাজ শুধু আইনি পরিবর্তন নয়, বরং মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নারীশিক্ষার প্রসারের ফলে ১৯শ শতাব্দীর শেষে বাংলায় নারী সাক্ষরতা হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা পরবর্তীকালে স্বদেশী আন্দোলন এবং নারী অধিকার আন্দোলনে ভিত্তি তৈরি করে। তাঁর কুসংস্কারবিরোধী লড়াই অজ্ঞতা ও কুসংস্কারকে ভেঙে যুক্তিবাদের পথ দেখিয়েছে, যা বাংলা রেনেসাঁর মূল চেতনা। তবে, চ্যালেঞ্জও ছিল প্রচুর। তাঁর সংস্কারের বিরুদ্ধে অর্থোডক্স হিন্দু সমাজের তীব্র প্রতিরোধ দেখা যায়; উদাহরণস্বরূপ, বিধবা বিবাহ আইনের পর তাঁকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া, তাঁর নিজস্ব অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও (যেমন, দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা) তিনি লড়াই চালিয়ে যান, যা তাঁর ব্যক্তিগত সাহসের প্রমাণ। সমালোচকরা বলেন, তাঁর কাজ কখনও কখনও অত্যধিক ধর্মীয় গ্রন্থ-কেন্দ্রিক ছিল, যা পশ্চিমা যুক্তিবাদের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়নি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, তাঁর উত্তরাধিকার অমূল্য—আজকের ভারতীয় সমাজে নারী অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনে তাঁর প্রভাব স্পষ্ট। বিদ্যাসাগরের জীবন ছিল ঐতিহ্যের সাথে সংস্কারের সংঘাতের প্রতীক, যা বাংলা নবজাগরণকে অমর করে রেখেছে।


মঙ্গল পান্ডে 


মঙ্গল পান্ডে ছিলেন ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ, যাঁর নাম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। তিনি ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তর প্রদেশের বলিয়া জেলায় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ইংরেজ শাসনের অবিচার ও দমননীতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর তিনি আরও কাছ থেকে উপনিবেশিক শাসনের শোষণ ও বৈষম্যের অভিজ্ঞতা পান।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল নতুন এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ। সৈন্যদের কার্তুজ কামড়ে খোলার নিয়ম ছিল, অথচ সেই কার্তুজে গরু ও শূকরের চর্বি মাখানো হয়েছিল বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এটি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের সিপাহীদের কাছে গভীরভাবে অপমানজনক ছিল। হিন্দু সিপাহীরা গরুর চর্বি ব্যবহারকে ধর্মবিরোধী মনে করত, আবার মুসলমানদের কাছে শূকরের চর্বি ছিল অশুচি। ফলে এই কার্তুজ বিদ্রোহের আগুন জ্বালানোর মতো কাজ করে।

এই প্রেক্ষাপটে ১৮৫৭ সালের ২৯শে মার্চ ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে মঙ্গল পান্ডে সাহসিকতার সঙ্গে ব্রিটিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেন। তিনি চিৎকার করে সহযোদ্ধাদের বিদ্রোহে আহ্বান করেন। যদিও তাঁর সহযোদ্ধারা তখন সরাসরি যোগ দেননি, তবুও তিনি একাই ইংরেজ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। অবশেষে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ৮ই এপ্রিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গল পান্ডেকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

মঙ্গল পান্ডের আত্মবলিদান শুধু এক ব্যক্তির বিদ্রোহ ছিল না, বরং তা গোটা ভারতবর্ষে এক বিরাট আন্দোলনের জন্ম দেয়। তাঁর সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের ফলে সিপাহীরা সংগঠিত হয়ে ১৮৫৭ সালের মে মাসে দিল্লিতে সমবেত হয়ে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে, যা ইতিহাসে "সিপাহী বিদ্রোহ" বা "প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ" নামে পরিচিত।

অতএব, মঙ্গল পান্ডেকে যথার্থভাবেই সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ বলা হয়। তাঁর আত্মত্যাগ স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় জনগণের অদম্য আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে আছে।

—--------

সিল্ক রুট ....

প্রাচীন বিশ্বের ইতিহাসে সিল্ক রুট বা সিল্ক রোড এক বিস্ময়কর সংযোগব্যবস্থা, যা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে পণ্যবিনিময়, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং সভ্যতার বিস্তার ঘটিয়েছিল। এই আন্তর্জাতিক রুটের নামকরণ হয়েছে মূলত রেশম বা সিল্কের নামে, কারণ প্রাচীন চীনা রেশম এই বাণিজ্যপথের সবচেয়ে মূল্যবান দ্রব্য হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। তবে শুধু রেশম নয়, মশলা, রত্ন, ধাতু, চিনির গুড়, নীল, তুলো, হাতির দাঁত, ঔষধি দ্রব্য, সাহিত্য, দর্শন ও ধর্মীয় মতবাদ—সবই এই পথ ধরে ভেসে বেড়িয়েছে।  

সিল্ক রুটের সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে, যখন চীনের হান রাজবংশ পশ্চিম এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্বের সাথে বাণিজ্যিক সংযোগ গড়ে তুলতে শুরু করে। এটি মূলত উত্তর চীনের শি’আন নগরী থেকে শুরু হয়ে মধ্য এশিয়ার মরুভূমি ও পর্বতমালা পেরিয়ে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে শেষ হয়েছিল। 

সিল্ক রুটের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ভারতের পণ্য। ভারতের তুলো ও সুতির কাপড়, বেনারসের মসলিন, দক্ষিণ ভারতের মশলা, মালাবারের গোলমরিচ, কাশ্মীরের উলের কাপড়, গঙ্গা-যমুনা অববাহিকার চিনির গুড়, কর্ণাটকের লোহা ও ইস্পাত, বিহার ও দক্ষিণ ভারতের মূল্যবান রত্ন ও হীরা পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বাজারে বিপুল চাহিদা অর্জন করেছিল। ভারতীয় মশলা ও বস্ত্র রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত পৌঁছে যেত, এবং রোমান সোনার মুদ্রা ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ব্যাপকভাবে পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে ভারতীয় বণিকরা এই মহাসড়ক থেকে বিশাল অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করেছিল।

ভারতের অবদান কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রেও সিল্ক রুট ভারতকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। বিশেষত বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার এই মহাসড়কের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অশোকের পরবর্তী সময়ে ভারত থেকে অসংখ্য ভিক্ষু মধ্য এশিয়া, চীন, কোরিয়া এবং জাপান পর্যন্ত যাত্রা করেছিলেন। 

ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, ই-চিং প্রভৃতি চীনা ভিক্ষুরা ভারতের তীর্থস্থানে এসে শিক্ষা নিয়ে তাঁদের মাতৃভূমিতে ফিরে গিয়েছিলেন এবং বৌদ্ধ দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। এভাবে ভারত কেবল পণ্য নয়, জ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ও ধর্মীয় মতবাদও এই মহাসড়কের মাধ্যমে বিশ্বে বিতরণ করেছিল।

তক্ষশিলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা প্রভৃতি প্রাচীন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল আন্তর্জাতিক শিক্ষা কেন্দ্র, যেখানে চীন, কোরিয়া, জাপান ও মধ্য এশিয়ার শিক্ষার্থীরা আসতেন। বৌদ্ধ সূত্র, ভারতীয় দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত ও চিকিৎসাশাস্ত্র এই পথ ধরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় অঙ্কশাস্ত্র, বিশেষত ‘শূন্য’ ধারণা, আরবি ভাষার মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করেছিল এবং তা বিশ্ববিজ্ঞানকে বিপ্লবী পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়।

সিল্ক রুটে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাব সুস্পষ্ট ছিল। মধ্য এশিয়ার বামিয়ান বুদ্ধ মূর্তি, তুর্কিস্তানের বৌদ্ধ গুহাচিত্র, চীনের দুনহুয়াং গুহা ভারতের বৌদ্ধ শিল্প ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণার জীবন্ত নিদর্শন। ভারতীয় শিল্পশৈলী ধীরে ধীরে স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে নতুন নতুন শিল্পধারার জন্ম দিয়েছিল।


সিল্ক রুট কেবল একটি বাণিজ্যপথ ছিল না, বরং ছিল সভ্যতার মেলবন্ধনের এক মহান সেতু। ইতিহাসবিদরা সিল্ক রুটকে শুধু চীনের রেশমের পথ নয়, বরং এক “মানব সভ্যতার মহাসড়ক” বলে অভিহিত করেন, যার কেন্দ্রস্থলে ভারত এক অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে।



সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ স্তূপ


সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ স্তূপ নির্মাণের প্রসঙ্গটি ভারতীয় ইতিহাসে যেমন বিস্ময়ের, তেমনি বেদনারও। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে কলিঙ্গযুদ্ধের ভয়াবহ হত্যালীলা দেখে অশোক যখন অহিংস বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন, তখন তিনি উপলব্ধি করেন যে কেবল যুদ্ধ আর রক্তপাত দ্বারা কোনো সম্রাজ্যের স্থায়িত্ব সম্ভব নয়। তাই তিনি বৌদ্ধ ধর্মের নীতি—মৈত্রী, করুণা ও অহিংসা—সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি যে অসংখ্য স্তূপ, বিহার ও স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন, তার সংখ্যা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে ৮৪,০০০ বলে উল্লেখ রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা প্রতীকী, অর্থাৎ “অগণিত” বোঝাতে ব্যবহৃত। কারণ অশোক সত্যিই ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, নেপাল এমনকি মধ্য এশিয়ার কিছু অংশ পর্যন্ত তাঁর বৌদ্ধ প্রচারের স্মারক নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু আজ সেই ৮৪,০০০ স্তূপ কোথায়? কেন আজ কেবল হাতে গোনা কয়েকটি অশোকীয় স্তূপই আমাদের চোখে পড়ে? 

অশোক-পরবর্তী সময়ে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই বৌদ্ধধর্মের রাজারাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কমতে থাকে। শুঙ্গ, কান্ব প্রভৃতি রাজারা পুনরায় ব্রাহ্মণ্যধর্মকে শক্তিশালী করেন এবং সেই সঙ্গে বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর আক্রমণ শুরু হয়। অনেক স্তূপ ধ্বংস হয় বা অবহেলায় পড়ে থাকতে থাকতে ভেঙে যায়। প্রাকৃতিক ক্ষয়ও এখানে বড় ভূমিকা নেয়। অশোকের সময়ে অনেক স্তূপই ইট ও মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছিল, যা শত শত বছর ধরে বজ্রপাত, ভূমিকম্প, বৃষ্টিপাত ও ঝড়ের আঘাতে ভেঙে পড়ে। এক্ষেত্রে মানুষের অমনোযোগও দায়ী—রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা কমে গেলে সেই স্তূপগুলির দেখভাল করার মতো কেউ থাকেনি।

তবে কেবল প্রাকৃতিক ক্ষয়ই যথেষ্ট ব্যাখ্যা নয়। গুপ্ত যুগ থেকে শুরু করে ভারতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটে। এই সময় শৈব-শাক্ত বৈষ্ণব উপাসনা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এবং ধীরে ধীরে বৌদ্ধ ধর্ম দুর্বল হতে থাকে। অনেক জায়গায় বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহার ভেঙে ফেলে সেখানে হিন্দু মন্দির গড়ে তোলা হয়। কিছু ক্ষেত্রে বৌদ্ধ দেবতাদের হিন্দু দেবতারূপে রূপান্তরিত করে মন্দিরে স্থান দেওয়া হয়। যেমন, প্রমাণ পাওয়া যায় যে বৌদ্ধ দেবী তারা বা মনীষীরা পরবর্তীকালে হিন্দু দেবীরূপে পূজিত হন। কিন্তু বৌদ্ধ স্তূপগুলোকে মন্দিরে রূপান্তর করার অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল সেই স্তূপের মূল কাঠামো ধ্বংস করে দেওয়া।

এছাড়া সাধারণ মানুষও বৌদ্ধ স্তূপ ধ্বংসে ভূমিকা রেখেছে। বহু অঞ্চলে প্রাচীন ইটের স্তূপকে ধ্বংস করে সেখানকার গ্রামবাসীরা নিজেদের বাড়িঘর বা অন্য স্থাপনা তৈরি করেছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এগুলিকে আর ধর্মীয় দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়নি। বিশেষত যখন বৌদ্ধধর্ম সমাজ থেকে প্রায় হারিয়ে গেল, তখন এই স্তূপগুলো স্রেফ পুরনো ভাঙাচোরা স্থাপত্যে পরিণত হয়। মানুষের চোখে এরা হয়ে ওঠে নির্মাণসামগ্রী মজুত রাখার স্থান।

তবুও সব স্তূপ ধ্বংস হয়নি। আজও অশোকনির্মিত বা অশোক-পরবর্তী যুগে গড়ে ওঠা কয়েকটি স্তূপ আমাদের চোখে পড়ে। যেমন—মধ্যপ্রদেশের সাঁচি স্তূপ, বারাণসীর সারণাথের ধামেক স্তূপ, বিহারের বৌদ্ধগয়া, অন্ধ্রপ্রদেশের অমরাবতী স্তূপ, নাগার্জুনকোন্ডার স্তূপ। এগুলি প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধন্যবাদেই রক্ষা পেয়েছে, নইলে হয়তো এদেরও আর টিকত না।

অশোকের ৮৪,০০০ স্তূপ আসলে তাঁর এক মহতী স্বপ্নের প্রতীক। তিনি চেয়েছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা সেই স্বপ্নকে অক্ষুণ্ণ থাকতে দেয়নি। রাজনৈতিক পরিবর্তন, ধর্মীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বহিরাগত আক্রমণ, মানুষের অবহেলা এবং প্রাকৃতিক ধ্বংস—সব মিলিয়ে সেই স্তূপগুলির অধিকাংশই আজ বিলীন হয়ে গেছে। হাতে গোনা কয়েকটি স্তূপই বেঁচে আছে, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় একদা ভারতবর্ষে বৌদ্ধ সভ্যতা কতখানি মহিমান্বিত ছিল।


. রামস্বামী নাইকার

ই. ভি. রামস্বামী নাইকার, সাধারণভাবে পেরিয়ার নামে পরিচিত, ১৯২০ শতকের প্রথমার্ধ থেকে মধ্য শতাব্দী পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এমন এক চরিত্র ছিলেন যাঁর চিন্তা ও কর্মজীবন কাস্ট-ভিত্তিক বঞ্চনা, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও ধর্মীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রশ্ন তোলে। তিনি ১৮৭৯ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন; রাজনৈতিকভাবে নিজেকে প্রথমদিকে কংগ্রেসের মত আধুনিক রাজনৈতিক ধাঁচের মধ্যে অবস্থান করলেও, ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারলেন যে কংগ্রেসের রীতিনীতিতে বর্ণ-ভিত্তিক সামাজিক অসমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রিভিলেজ কাটানোর যথেষ্ট মনোযোগ নেই। ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে পেরিয়ার তাঁর তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক শক্তি কাজে লাগিয়ে একটি স্বতন্ত্র সামাজিক আন্দোলন রচনা করলেন — আত্মসম্মান আন্দোলন — যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল যুক্তিবাদ, ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মুক্তি, এবং নিম্নজাতি/অপশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা।


পেরিয়ারের আন্দোলনে নাট্য ও সাহিত্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। তিনি জানতেন যে বুদ্ধিদীপ্ত বক্তৃতা ও প্রবন্ধই যথেষ্ট নয়; জনমানসে পরিবর্তন আনতে হলে সংস্কৃতি এবং বিনোদনমাধ্যম ব্যবহার করতে হবে। তাই আত্মসম্মান কর্মীরা নাটক রচনা ও মঞ্চস্থ করতেন, যেখানে ধর্মীয় কাহিনি ও পুরাণসমূহকে যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে পরীক্ষা করা হতো। এসব নাটকে পুরোহিত-পাত্র, অন্ধ-ধর্মবিশ্বাস ও সমাজের দ্বৈতচরিত্র উন্মোচিত হতো; দর্শককে হাস্যরসের মাধ্যমে এক দরকারি প্রশ্নবোধে উদ্বুদ্ধ করা হতো। স্কুলে ও কিশোর সমাজে যুক্তিবাদী শিক্ষাক্রম ছড়িয়ে দেওয়া, সাধারণ মানুষের জন্য পাঠাগার খোলা, ছাপাখানায় সস্তা পুস্তক ছাপানো—এসব কৌশলও আন্দোলনের অংশ ছিল। তাঁর এই সাংস্কৃতিক কৌশলগুলো পরে দ্রাবিড় রাজনীতিকে এক ধরণের সামগ্রিক জনভিত্তিক নৈতিকতা প্রদান করেছিল, যা রাজনৈতিক সংগ্রামে অত্যন্ত ফলপ্রসূ ছিল।


নারী-অধিকার ছিল পেরিয়ারের তত্ত্ব ও কার্যক্রমের একটি মৌলিক অংশ। তিনি সামাজিকভাবে নারীকে পুরুষের অধস্তন রাখার ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাখ্যাগুলো তীক্ষ্ণভাবে সমালোচনা করতেন। পেরিয়ার বলেন, পরিবার ও বিবাহব্যবস্থাও একটি এমনই সংস্থাপিত ভারপ্রাপ্ত পরিবেশ যেখানে নারীর প্রতি বৈষম্য নিবিড় হয়, আর ধর্মীয় আচার এই বৈষম্যকে আইনি ও সামাজিক প্যাখণ্ডে যুক্ত করে শক্তিশালী করে। তাই আত্মসম্মান আন্দোলন নারীর শিক্ষার প্রসার, সন্তানদের পিতৃত্ববিহীন-স্বীকৃতি, সন্তানের লিঙ্গ-স্বীকৃতি ও মহিলাদের স্বাধীন অর্থনৈতিক পাটা দাবি করে। পেরিয়ারের এই নারীবান্ধব প্রভাব দক্ষিণ ভারতের সমাজে দৃশ্যমান পরিবর্তন সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিল, যদিও বাস্তবে পুরুষ-মার্জিত সমাজে সুচিকিৎসার চাহিদা মেটাতে অনেক বাধাই রয়ে গিয়েছিল।


পেরিয়ারের নীতিগুলি কেবল তামিলনাড়ুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তাঁর চিন্তা-প্রক্রিয়া পুরো দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি ও বৌদ্ধিক পরিবেশে অসীম প্রভাব ফেলেছে। দ্রাবিড় রাজনীতি, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলীয় রূপে (যেমন ডিএমকে) সংগঠিত হলো, বহু দিক থেকেই পেরিয়ারের চিন্তার ধারাকে গ্রহণ করেছে: আঞ্চলিক স্বকীয়তা, ভাষা-পণ, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিরোধিতা এবং শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক উৎকর্ষ। 



মীর মদন

মীর মদন ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং দক্ষ সেনাপতি, যিনি ১৭৫৭ সালের ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পক্ষে অসাধারণ সাহসিকতা ও নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি ‘বখশী মীর মদন’ নামে পরিচিত ছিলেন এবং নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তার জীবন ও কর্মজীবন বাংলার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়, যা স্বাধীনতার শেষ প্রচেষ্টা এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনার সঙ্গে জড়িত।

মীর মদনের ঢাকায় হোসেন কুলি খানের ভ্রাতুষ্পুত্র হাসানউদ্দিন খানের অধীনে সামরিক দায়িত্ব পালন করতেন। তার দক্ষতা, সাহস এবং আনুগত্যের কারণে তিনি নবাব আলিবর্দি খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আলিবর্দি খান তাকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন, যেখানে তিনি নবাবের সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন।

পরবর্তীতে, সিরাজউদ্দৌলা নবাব হলে তিনি মীর মদনকে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন। এই বাহিনী ছিল নবাবের সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কারণ তৎকালীন যুদ্ধে কামানের ব্যবহার যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।

পলাশীর যুদ্ধে মীর মদনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন মুর্শিদাবাদের কাছে পলাশীতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর বিরুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনী মুখোমুখি হয়।

মীর মদন তার গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে যুদ্ধের শুরুতেই ইংরেজ বাহিনীর ওপর প্রবল আক্রমণ চালান। তার কৌশলগত নেতৃত্বে নবাবের বাহিনী প্রাথমিকভাবে ইংরেজদের চাপে ফেলে দেয়। ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ এতটাই বিপর্যস্ত হন যে তিনি আমবাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। মীর মদনের কামানের আক্রমণ ইংরেজদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং যুদ্ধে নবাবের পক্ষে জয়ের সম্ভাবনা তৈরি করে।

কিন্তু যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় দুটি কারণে। প্রথমত, দুপুরে হঠাৎ বৃষ্টি নামে, যার ফলে নবাব বাহিনীর গোলাবারুদ ভিজে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এটি মীর মদনের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের ধার কমিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, নবাবের আরেক সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মীর জাফর ইংরেজদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে তার বাহিনীকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নেন।

এমনকি সিরাজউদ্দৌলার নির্দেশে যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হলেও মীর মদন এবং মোহনলালের মতো বিশ্বস্ত সেনাপতিরা লড়াই চালিয়ে যান। কিন্তু এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মীর মদন একটি ব্রিটিশ কামানের গোলার আঘাতে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। তার মৃত্যু নবাব বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভ বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের পথ প্রশস্ত করে।

মীর মদনের মৃতদেহ গোপনে মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের নিকট ফরিদপুর গ্রামে ভাগীরথী নদীর তীরে সমাহিত করা হয়। তার স্মৃতিতে পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে একটি স্মারক নির্মিত হয়েছে, যা আজও তার আনুগত্য, সাহস এবং দেশপ্রেমের সাক্ষ্য বহন করে। মীর মদনের মৃত্যু শুধু একজন সেনাপতির পতন নয়, বরং বাংলার স্বাধীনতার শেষ প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।



জগৎ শেঠ


জগৎ শেঠ যিনি ছিলেন ১৮শ শতাব্দীর ভারতের একজন প্রখ্যাত মারওয়ারি ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকার, তিনি এবং তার পরিবারের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান তৎকালীন ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মুর্শিদাবাদে অবস্থিত তাদের ব্যাংকিং ঘরানা ছিল ভারতের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা বাংলার নবাবদের পাশাপাশি বিভিন্ন ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠী, বিশেষ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে গভীর আর্থিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। জগৎ শেঠের ঋণদানের কার্যক্রম শুধুমাত্র স্থানীয় শাসকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি ইংরেজদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গেও জড়িত ছিল।

জগৎ শেঠের প্রকৃত নাম ছিল ফতেচাঁদ, এবং তিনি তার পূর্বসূরি মানিকচাঁদের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকিং ব্যবসাকে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাদের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান, যা ‘জগৎ শেঠ হাউস’ নামে পরিচিত ছিল, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের আর্থিক নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা বাণিজ্যিক ঋণ, হুন্ডি (অর্থাৎ প্রাচীন ভারতীয় বিনিময় পত্র) এবং অন্যান্য আর্থিক লেনদেন পরিচালনা করত। তাদের সম্পদ এতটাই বিপুল ছিল যে, সমকালীন ইউরোপীয় বণিকরা তাদেরকে ‘ভারতের রথচাইল্ড’ হিসেবে অভিহিত করত। এই আর্থিক শক্তির কারণে জগৎ শেঠ বাংলার নবাবদের পাশাপাশি ইংরেজ, ফরাসি এবং ডাচ বণিকদের সঙ্গেও ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে জগৎ শেঠের সম্পর্ক ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৮শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, ইংরেজরা ভারতে তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন অনুভব করছিল। তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম, বিশেষ করে কলকাতা ও অন্যান্য বাণিজ্য কেন্দ্রে কারখানা স্থাপন, জাহাজ পরিচালনা এবং পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন ছিল। জগৎ শেঠের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান তাদের এই আর্থিক চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

ইংরেজরা জগৎ শেঠের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করত, যা তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছিল। এই ঋণ প্রায়শই হুন্ডির মাধ্যমে প্রদান করা হত, যা ছিল একটি নিরাপদ এবং দ্রুত অর্থ স্থানান্তরের পদ্ধতি।

শুধু বাণিজ্যিক কার্যক্রমই নয়, ইংরেজদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাও জগৎ শেঠের আর্থিক সমর্থনের উপর নির্ভরশীল ছিল। বিশেষ করে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জগৎ শেঠের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালীন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল, এবং জগৎ শেঠ, যিনি নবাবের আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করতেন, ইংরেজদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে, জগৎ শেঠ এবং তার পরিবার সিরাজউদ্দৌলার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ নবাব তাদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করেছিলেন এবং তাদের ব্যবসায়িক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন। এই অসন্তোষের কারণে জগৎ শেঠ ইংরেজদের সঙ্গে গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং পলাশীর যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজদের সমর্থন করেন। এই সমর্থন শুধু রাজনৈতিকই ছিল না, বরং আর্থিক সহায়তার মাধ্যমেও প্রকাশ পেয়েছিল। ইংরেজরা তাদের সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য জগৎ শেঠের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ ধার করেছিল, যা তাদের যুদ্ধে বিজয় অর্জনে সহায়তা করেছিল।

পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয়ের পর জগৎ শেঠের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়। ইংরেজরা তাদের নতুন শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জগৎ শেঠের আর্থিক সহায়তার উপর নির্ভর করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, নতুন নবাব মীর জাফরের শাসনকালে জগৎ শেঠ তাদের ঋণদাতা এবং আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন। ইংরেজরা তাদের প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যয় মেটানোর জন্য জগৎ শেঠের কাছ থেকে নিয়মিত ঋণ গ্রহণ করত। এই সময়ে তাদের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বাংলার অর্থনীতির একটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হত।

তবে, জগৎ শেঠের এই প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইংরেজদের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এবং তাদের নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টার কারণে জগৎ শেঠের ব্যাংকিং ঘরানার প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। ১৭৬০-এর দশকে মীর কাশিমের শাসনামলে জগৎ শেঠের পরিবারের উপর নবাবের চাপ বৃদ্ধি পায়, এবং পরবর্তীতে তাদের সম্পদের একটি বড় অংশ হারিয়ে যায়। তা সত্ত্বেও, জগৎ শেঠের ইংরেজদের প্রতি ঋণদান এবং তাদের রাজনৈতিক সমর্থন ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

সুতরাং, জগৎ শেঠ কেবল স্থানীয় শাসকদেরই নয়, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক ও সামরিক কার্যক্রমের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন। তাদের এই ঋণদান এবং রাজনৈতিক জোট ইংরেজদের বাংলায় এবং পরবর্তীতে ভারতের অন্যান্য অংশে আধিপত্য বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।


নিয়োগ প্রথা


প্রাচীন ভারতের সমাজে নিয়োগ প্রথা একটি সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থা ছিল, যা প্রধানত বংশ রক্ষা এবং সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্যে প্রচলিত ছিল। এই প্রথা বিশেষত ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশি প্রচলিত ছিল এবং এর মূল উৎস হিসেবে ধর্মশাস্ত্র, বিশেষ করে মনুসংহিতা এবং অন্যান্য স্মৃতিশাস্ত্রে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। নিয়োগ প্রথার মূল উদ্দেশ্য ছিল সন্তানহীন পরিবারে বংশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, যেখানে স্বামী সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলে বা মৃত্যুবরণ করলে তার স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে সন্তান জন্মদানের অনুমতি দেওয়া হতো।

এই প্রথার পেছনে ধর্মীয় ও সামাজিক যুক্তি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে পুত্র সন্তানের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল, কারণ পুত্র কেবল বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবেই নয়, বরং পিতৃপুরুষদের জন্য শ্রাদ্ধ ও পিণ্ডদানের মতো ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম সম্পাদনের জন্যও অপরিহার্য বলে বিবেচিত হতো। সন্তানহীনতা বা পুত্রসন্তানের অভাবকে একটি সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যা হিসেবে দেখা হতো, এবং নিয়োগ প্রথা এই সমস্যার সমাধান হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।

নিয়োগ প্রথায় একজন নারী, সাধারণত বিধবা বা সন্তানহীন স্ত্রী, তার স্বামীর পরিবারের অনুমতিক্রমে এবং নির্দিষ্ট ধর্মীয় নিয়ম মেনে অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে সন্তান উৎপাদনের জন্য সম্পর্ক স্থাপন করতেন। এই পুরুষ সাধারণত স্বামীর নিকটাত্মীয়, যেমন ভাই, দেবর, বা কোনো সম্মানিত ব্রাহ্মণ হতে পারতেন। এই সম্পর্ক কোনো ব্যক্তিগত বা প্রেমমূলক সম্পর্ক ছিল না; বরং এটি সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় ও সামাজিক উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সন্তান জন্মের পর সেই সন্তানকে আইনত মৃত বা অক্ষম স্বামীর সন্তান হিসেবে বিবেচনা করা হতো, এবং তিনি বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃত হতেন।

মহাভারতের মতো প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্যে নিয়োগ প্রথার উদাহরণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, অম্বিকা ও অম্বালিকার ক্ষেত্রে ব্যাসদেবের মাধ্যমে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু জন্মগ্রহণ করেন। এই ঘটনা নিয়োগ প্রথার একটি বিশিষ্ট উদাহরণ। তবে, এই প্রথা সবসময় সর্বজনগ্রাহ্য ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে পরবর্তীকালে, নিয়োগ প্রথা নিয়ে সমাজে নানা বিতর্ক ও সমালোচনা দেখা দেয়। কেউ কেউ এটিকে নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করতেন, এবং ধর্মশাস্ত্রেও এর ব্যবহার কঠোর নিয়মের অধীনে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল।

নিয়োগ প্রথার সামাজিক প্রভাবও উল্লেখযোগ্য ছিল। এটি নারীর প্রজনন স্বাধীনতার উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও, একই সঙ্গে নারীকে সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে বংশ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ দিয়েছিল। তবে, এই প্রথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এবং নারীর ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা সম্মতির উপর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না।

পরবর্তীকালে, সমাজের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগ প্রথা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। মধ্যযুগে এসে এটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে অপ্রচলিত হয়ে পড়ে, এবং আধুনিক ভারতীয় সমাজে এর কোনো প্রভাব বা প্রচলন নেই। তবে, প্রাচীন ভারতের সামাজিক কাঠামো, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং বংশগত ধারণার উপর নিয়োগ প্রথার প্রভাব অধ্যয়ন করলে তৎকালীন সমাজের জটিলতা ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে গভীর ধারণা পাওয়া যায়।