হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য
তথ্য ও জ্ঞান (৫১-৭৫)
হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য
তথ্য ও জ্ঞান (৫১-৭৫)
০৫১ ▌ পানামা খাল মিশরের সুয়েজ খাল, হরমুজ প্রণালী ও মালাক্কা প্রণালী:
পানামা প্রজাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা কৃত্রিম খালটি একটি ক্যানেল যা আটলান্টিক ও প্রশান্তমহাসাগরকে যুক্ত করেছে। এর খনন কাজ ১৯০৪ সালে শুরু হয়ে ১৯১৪ সালে সমাপ্ত হয়। এর দৈর্ঘ্য ৬৫ কি.মি। ২০১৪ সাল থেকে পানামা খাল দিয়ে একসাথে দুটি জাহাজ চলাচল করতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮৫ ফুট উপর দিয়ে পানামা খাল প্রবাহিত হয়েছে। এত উঁচু দিয়ে পানি প্রবাহ চলমান রাখার জন্য এর রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতিও বেশ চ্যালেঞ্জিং। জাহাজ পারাপার করার সময় বিশেষ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। পানামা খাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা সমগ্র আমেরিকা মহাদেশের সাথে এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যের নতুন রূপ দান করেছে। পানামা খাল তৈরির ফলে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার জাহাজ চলাচলের দূরত্ব ৬৫০০ কি.মি. কমে গিয়েছে। তেমনি আমেরিকা যাওয়ার ক্ষেত্রে এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার জাহাজসমূহকেও ৩৫০০ কিলোমিটার পথ কম পাড়ি দিতে হয়।
১৮৫৪ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রকৌশলীরা মিলে সুয়েজ খাল খননের নিঁখুত পরিকল্পনা করেন। ১৮৫৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয় সুয়েজ খালের খনন কাজ। দীর্ঘ দশ বছর ধরে খনন করার পর ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে খালটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এ খাল খনন করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার শ্রমিককে। শুরুর দিকে সুয়েজ খালের দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ কিলোমিটার ও প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। তারপর আরো কিছু সংস্কারের পর ২০১০ সালের হিসাব মতে, সুয়েজ খালের দৈর্ঘ্য ১৯০.৩ কিলোমিটার, গভীরতা ২৪ মিটার ও সবচেয়ে সরু স্থানে এর প্রস্থ ২০৫ মিটার। এই সুয়েজ খাল দিয়ে দৈনিক ৯৭ টি জাহাজ চলাচল করতে পারবে। সুয়েজ খালে পানির সমতা বজায় রাখার জন্য পানামা খালের মতো কোন গেট নেই। তবে দুটি লেক রয়েছে।
হরমুজ প্রণালী মূলত একটি সরু জলপথ যা পশ্চিমের পারস্য উপসাগরকে পূর্বে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে এবং আরব উপদ্বীপ থেকে ইরানকে পৃথক করেছে। ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রণালীটি পারস্য উপসাগরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ওমান ও ইরানকে সংযুক্ত করেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় তেল রপ্তানি করা হয় হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমে। এই সমুদ্র পথে আরব দেশগুলো থেকে তেল যায় এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অন্যান্য জায়গায়। ২য় স্থানে রয়েছে মালাক্কা প্রণালী। মালয়েশিয়া উপদ্বীপ এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত সরু জলপথের নাম মালাক্কা প্রণালী। ভারত মহাসাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে মূল শিপিং চ্যানেল এ মালাক্কা প্রণালী। বিশ্বে সমুদ্র পথে যত পন্য পরিবহন করা হয় তার ৬০ ভাগেরও বেশি আনা নেয়া করা হয় এ প্রণালী দিয়ে। মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ফলে মালাক্কা প্রনালীর এ প্রবেশ মুখে রয়েছে ভারতের ন্যাচারাল আধিপত্য। আর চীনা সমুদ্র বানিজ্যের মূল রুট এ মালাক্কা প্রণালী।
০৫২ ▌আমেরিকান ইন্ডিয়ান এস্কিমো : :
আমেরিকায় উপজাতিরা সবাই আমেরিকান ইন্ডিয়ান নামে পরিচিত। তাদের পোশাক, ঘরবাড়ি প্রভৃতির বৈশিষ্ট্য আছে। ঘরগুলো বেশ উঁচু এবং গম্বুজের মতো। এক জায়গায় অনেকগুলো ঘর থাকে। ঘরের উপরিভাগ শুকনো তৃণ দিয়ে ঢাকা থাকে। পোশাক অনেকের জমকালো। পুরুষেরা সর্বাঙ্গ ঢাকা দিয়ে রাখেন পোশাকে। অনেকে মাথায় পাখির পালকের টুপি পরেন। কেউবা দু-একটা পালক মাথায় গুঁজে রাখেন। এক এক জায়গায় বাস করেন এক একটি দল। আলু একমাত্র আমেরিকার কৃষিজীবী উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ চাষ করতেন। তাঁদের অন্যতম প্রধান খাদ্য ছিল আলু। কোকো গাছের মাদকগুণও আমেরিকার আদিম বাসিন্দাদের আবিষ্কার। অপরদিকে কোকো ফলের বীচিকে ভেজে খোসা ছাড়ানোর পর পিষে কেকের মতো তৈরি করার বিদ্যাটা স্পেনীয়রা আমেরিকার আদিবাসীদের কাছ থেকেই রপ্ত করেছিলেন। ওই কেকের কিছু অংশ পানিতে গুলে এবং মশলাপাতি দিয়ে আদিম বাসিন্দারা এক ধরনের শরবত তৈরি করতেন।স্পেনীয়রা কোকো বীজ থেকে চকোলেট বানিয়ে ছিলেন।
তুন্দ্রা অঞ্চলের প্রবল শীত এলাকায় এস্কিমোরা বাস করেন। বছরের অধিকাংশ সময় সাগর ও নদী বরফে বরফে আচ্ছাদিত হয়ে থাকে। এস্কিমোরা শিকারি জাতি। জনসংখ্যা মাত্র আট লক্ষের মতো। জাতিতে সবাই মঙ্গোলীয়। সবাই একটি ভাষায় কথা বলেন না। সীল, তিমি, সিন্ধুঘোটক, স্যামন মাছ প্রভৃতি শিকার করেন। আর ডাঙার প্রাণী শ্বেতভল্লুক, মেরু শিয়াল, মেরু খরগোশ, ক্যারিবু নামের একজাতের হরিণ ও পাখি শিকার করেন। চর্বিকে রান্নার তেল হিসেবে, আলো জ্বালাতে এবং ঘরকে গরম রাখতে ব্যবহার করেন। সারা বছর আপাদমস্তক লোমশ পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি মোটা পোশাকে ঢেকে রাখতে হয়। সীল সিন্ধুঘোটকের চামড়া দিয়ে যেমন অস্থায়ী তাঁবু ও কায়াক নৌকা নির্মাণ করেন, তেমনই ক্যারিবু হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি করেন পোশাক এবং পানির ব্যাগ। ওই ব্যাগে গরম পানি রেখে ঘুমানোর সময় ব্যবহার করেন। পুরুষেরা একের অধিক স্ত্রী রাখতে পারে উপরুন্ত নীজের স্ত্রী শারিরিকভাবে অসুস্থ হলে বন্ধুর স্ত্রীকে পারিবারিকভাবে ধার করতে পারে। এই বউ বদল করে বেড়ায়।
০৫৩ ▌নিগ্রো -হ্যামিটিক, মাসাই ও পিগমি:
আফ্রিকার কেনিয়া অঞ্চলেই যেসব আদি মানবের আবির্ভাব হয়েছিল। তাদের নিগ্রো বলা হয়। এঁরা দীর্ঘকায়, শক্তিমান, কটিদেশ দেহের অনুপাতে সরু, মোটা ঠোঁট এবং ভোঁতা নাক এবং মাথার চুল অত্যন্ত কোঁকড়ানো হলেও কালো। হ্যামিটিকদের উন্নত হাতিয়ারের সামনে নিগ্রোরা দাঁড়াতে পারেননি। বহু নিগ্রো হ্যামিটিকদের দাসত্ব স্বীকার করেছিলেন। ওই নিগ্রো শ্রমিক ও ক্রীতদাসরাই পিরামিড প্রভৃতি নির্মাণ করেছিলেন। উন্নত কৃষি ব্যবস্থাও সম্ভব হয়েছিল নিগ্রো শ্রমিকদের দ্বারা। খ্রিষ্ট-পূর্ব ৩৩২ অব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের হাতে প্রথম পর্যুদস্ত হয়েছিল হ্যামিটিক সভ্যতা। অতএব সহস্র সহস্র বছর নিগ্রো ও হ্যামিটিক একত্রে বসবাসের ফলে উভয়ের মধ্যে রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। উদ্ভব হয়েছিল সঙ্কর জাতির। পশুপালক শিলুক ও ডিংকা উপজাতির সঙ্গে হ্যামিটিকদের মিশ্রণে বেশকিছু উপজাতির উদ্ভব হয়েছে। তাঁরা যথাক্রমে কেনিয়া রাজ্যের মাসাই, নান্দী, লমবাওয়া, সুফ, তুরকানা প্রভৃতি এবং দক্ষিণ সুদানের ডিডিংগা ও উগান্ডার ইতোসো বিশেষ প্রসিদ্ধ উপজাতি। এঁরা সবাই যাযাবার পশুপালক।
আফ্রিকার পশুপালক আদিম উপজাতির সংখ্যা প্রায় ৪০। মাসাইরা তাঁদের মধ্যে প্রধান এবং বৃহৎ গোষ্ঠী। যেহেতু স্বভাবে ওঁরা পশুপালক, তাই পশুখাদ্যের অভাব দেখা দিলে বাধ্য হয়ে অন্যত্র সরে যেতে হয়। মাসাইরা একজাতীয় গরুকেই পালন করেন। সেসব গরুর পিঠে উটের মতো কুঁজ আছে। ওঁরা গরুর মাংস, গরুর দুধ এবং গরুর রক্ত খেয়ে জীবন ধারণ করেন। গরুর রক্ত গ্রহণের জন্য গরুকে মেরে ফেলেন না। গলার কাছে রক্তবাহী নালীতে তীক্ষè শলাকা বিদ্ধ করিয়ে রক্ত বার করেন। সেই রক্তকে মোটা মোটা বাঁশের চোঙে পুরে রাখেন। রক্তকে শুকনোও করে রাখেন। এদের দেহের গড়ন লম্বাটে হলেও মোটাসোটা নয়, ছিপছিপে। মাসাই পুরুষ ও মহিলা একই ধরনের কাপড় পরেন। বগলের নিচে কাপড়কে ভালোভাবে বেঁধে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখেন। পুরুষ ও মহিলা সবাই কানে বড় বড় রিং পরেন, হাতে মাদুলি বাঁধেন এবং গলায় পুঁতির মালা ঝুলিয়ে রাখেন। প্রধান হাতিয়ার তীর-ধনুক ও বর্শা।পুরুষেরা হাতে একটি করে বর্শা থাকে। অনেকে কোমরে একটা ছোরাও গুঁজে রাখেন। কেনিয়া ও তানজেনিয়ায় বাস।
আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকার আদিম অধিবাসী পিগমি। পিগমিরা সেই দুর্গম অঞ্চলের বাসিন্দা এবং ওই কারণে তাঁরা সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে পারেননি। পিগমিরা অরণ্যের ফলমূলাদি সংগ্রহ করেন এবং বন্যপশুদের শিকার করেন। কৃষিকাজ জানেন না, পশুপালনও করেন না। তাঁরা অত্যস্ত বেঁটে মানুষ, তাই তাঁদের তৈরি ঘরও ছোট-খাটো। মাত্র দশ বারোটি পরিবার মিলে এক জায়গায় থাকেন। শিকার ও বনজ খাদ্যের উপর নির্ভর করে বাস করতে হয় বলে দশ বারোটি পরিবার একত্রে গোল করে বাস করেন। ওই গোল উঠানটাতেই তাঁদের দলের বাজনা, নাচ, গান ইত্যাদি চলে। কাছাকাছি নদী অবশ্যই থাকে। কেননা, নদী থেকে পানি ও মাছ উভয়ই পেয়ে থাকেন। ঘরের ছাউনি দেন বড় বড় পাতার। মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে হওয়ায় মেঝেতে শুকনো পাতা বিছিয়ে রাখেন। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে কেবলমাত্র কোমর থেকে হাঁটুর উপর পর্যন্ত গাছের চওড়া পাতা অথবা গাছের বাকল অথবা পত্রবহুল লতা কোমরে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখেন। কীট-পতঙ্গের দংশনকে প্রতিহত করতে গায়ে কাদার প্রলেপও দেন।
০৫৪ ▌বুশম্যান, সাহারার তুয়ারেগ ও আরবের বেদুইন :
বুশম্যান নামিবিয়ার কালাহারি মরুভূমির যাযাবর বাসিন্দা। প্রায় ৬২০০০ বুশম্যান আছেন। মাত্র চার পাঁচটি পরিবারের এক একটি দল। এক এক জায়গায় মাত্র সপ্তাহ খানেক অবস্থান করেন। বুশ অর্থ ঝোপ অর্থাৎ তারা ঝোপের মানুষ। বুশম্যানরা কিছুটা খর্বাকায়। শরীরের উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির মতো। কিন্তুু চোখ, নাক ও ঠোঁটের গড়ন নিগ্রোদের মতো নয়। মরুভূমির বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, দিনে প্রচন্ড গরম এবং রাতে বেজায় শীত। সারা বছরই ওই একই আবহাওয়া। লজ্জা নিবারণের জন্য কোমরে পশুচর্ম জড়িয়ে রাখেন। বুশম্যানরা যাযাবর। ঝোপের পাশে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে এবং কখনও বা দু-চারটে ঝোপ কেটে এনে চারপাশে বেড়া দিয়ে উপরটা চামড়া দিয়ে ঢেকে দেন। গর্ত পেলে গর্তে, গুহা পেলে গুহায়ও আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাতের শীত থেকে পরিত্রাণের জন্য সামনে আগুনও জ্বালিয়ে রাখেন। শিকার করা পশুর মাংস খেয়েই জীবন ধারণ করেন। পশুর গলার স্বর নকল করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছেএঁদের। শিকার করার কাজে ব্যবহার করেন শরকাঠি দিয়ে তৈরি তীর। ইঁদুর, সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি, পোকা-মাকড়ও খেতে থাকেন।
আলজেরিয়ার আহাগগার মালভূমি অঞ্চলে তুয়ারেগরা ঘোরাফেরা করেন। নীল নদের তীরে এককালে যাঁরা নগর সভ্যতার পত্তন করেছিলেন, সেই বহিরাগত হ্যামিটিকদের বংশধর তারা। লম্বাটে গড়ন, নাসার অগ্রভাগ তীক্ষè, মাথায় ঢেউ খেলানো কালো চুল, ছিপছিপে গড়ন এবং গায়ের রঙ হালকা বাদামি। এদের সদস্য সংখ্যা ১০ লাখ। পৌত্তলিক অবস্থাতেও তুয়ারেগরা যেমন স্বাধীন যৌনতার চর্চা করতো, ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পরেও তা অব্যাহত রেখেছে। বিয়ের আগে তুয়ারেগ নারী-পুরুষেরা অনেকের সঙ্গে স¤পর্কে জড়াতে পারে। তাদের মাঝে নর-নারীর মধ্যকার সম্পর্কটা এতোটাই স্বাভাবিক যে, কোনো নর-নারী যদি তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাঁবুর বাইরে কোনো উট অপেক্ষমান থাকে তাহলে সেই তাঁবুর আশেপাশে কেউই যায় না। যদি ওই দুই নর-নারীর ইচ্ছে হয় একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকার, তবেই তাদের বিয়ে হয়। তুয়ারেগরা সারা শরীর যেন কাপড় দিয়ে ঘেরা। তুয়ারেগরা, উট,ভেড়া ও ছাগল প্রতিপালন করেন।
বেদুইনরা সাহারা ও লিবিয়ার মরুভূমিতে থাকেন। তাছাড়া মিসরেও দেখা যায়। এঁরা যাযাবর পশুপালক। বেদুইন অর্থে মরুভূমির সন্তান। আরবের রূবাল আলখালি মরুভূমিতে প্রায় ১০ লক্ষের মতো বেদুইন জীবন-যাপন করেন। এঁদেরও নিত্যসঙ্গী উট। প্রতিপালন করেন ছাগল ও মেষকে। মরুভূমির শুষ্ক পরিবেশে কাল কাটানোর দরুন তাঁদের চেহারাও শুষ্ক ও রুক্ষ। নাকের ডগা তীক্ষè। মুখম-ল সরু ও লম্বাটে। প্রধান খাদ্য দুধ, বার্লি, মাংস ও খেজুর। পানি সঙ্কটে ভুগতে হয় এবং বহু দূর থেকে পানি বয়ে আনতে হয়। বেদুইনরা তাঁবুতে বাস করেন। উটের চুল দিয়ে দড়ি তৈরি করেন এবং উটের চামড়া দিয়েই তৈরি করেন পানি ও দুধ রাখার থলে। যাঁরা একটু অভিজাত তাঁরাই ঘোড়া প্রতিপালন করেন। বেদুইনরা সাহসী, যোদ্ধা। অধিকাংশ বেদুইন গরিব। ডাকাতি বা লুন্ঠনকে অন্যায় বলে মনে করেন না তাঁরা। বরং ডাকাতি করার সাহস যাঁদের নেই, তাঁরা বেদুইন সমাজে মর্যদাহীন। ভয়ানক অতিথি বৎসল ও বন্ধুবৎসল। অভাবের ফলে ডাকাতি করেন। মরুদ্যানগুলোতে এখন সেচের ব্যবস্থা হয়েছে এবং কৃষিজমির প্রসার ঘটেছে।
০৫৫ ▌মধ্য এশিয়ার কিরঘিজ , মঙ্গোল ও ফিলিপাইনের মালয়:
কিরঘিজ শব্দের স্থানীয় অর্থ ‘পশুচোর’। এঁরাও তাঁবুতে বাস করেন। শীতকালে পর্বতের থেকে নেমে আসতে বাধ্য হন কিরঘিজরা। সারা শীতকালটা কাটিয়ে দেন উপত্যকা ও নিম্নভূমিগুলোতে। অধিকাংশ কিরঘিজ রিপাবলিক অব কিরঘিজিয়ার বাসিন্দা। এঁদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখের মতো। দেহাকৃতি মঙ্গোলীয়দের অনুরূপ। একটু বেঁটে বটে কিন্তু শক্তিমান। গাত্র বর্ণ পীত এবং মাথার চুল কালো। অনেকে মনে করেন মঙ্গোলীয় ও তুর্কিদের মিশ্রণে কিরঘিজ উপজাতি। তাদের শিকারের উপযুক্ত সময় বসন্তকাল। মর্যাল নামক এক জাতের হরিণ তাঁদের প্রিয় শিকার। কিরঘিজরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তাঁদের ব্যবহৃত পোশাককে কাফটান বলা হয়। পুরুষ ও মেয়ে উভয়েই মাথায় ব্যবহার করেন ভেড়ার চামড়ার টুপি। পশুপালনই কিরঘিজদের একমাত্র বৃত্তি, প্রত্যেক পরিবারের থাকে পালে পালে পশু। কাজেই তৃণভূমির খোঁজে ঘুরে বেড়াতে হয়। কিরঘিজদের প্রধান খাদ্য পশুর মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী। দুধ থেকে মাখন ও পনির প্রস্তুত করেন। কিরঘিজদের বড় সম্পদ মেষ।
মঙ্গোলরা মঙ্গোলিয়ার আদি বাসিন্দা। মঙ্গোলরা সুতি ও পশম উভয় প্রকারের পোশাক ব্যবহার করেন। বাস করেন তাঁবুতে এবং তাঁবুর সরঞ্জাম কিরঘিজদের মতো হলেও তাঁবু ছোট। বেশি উঁচুও করেন না। ঘরের ভেতরে দাঁড়ালে তাঁবুর উপরিভাগ মাথায় ঠেকে যায়। মঙ্গোলদের এলাকায় প্রচুর নেকড়ে ও শেয়াল থাকে। ওঁরা প্রতি বছর প্রচুরসংখ্যক শেয়াল মেরে চামড়া সংগ্রহ করেন। নেকড়ের উপদ্রবের জন্য যেখানে পশুপাল নিয়ে অবস্থান করেন সেখানে খোঁয়াড় বানাতে হয়। পশুর বিষ্ঠা দিয়ে তৈরি ইটের বেড়া। এঁরা ভেড়া ছাড়াও ঘোড়া, উট ও চামরি গাই প্রতিপালন করেন। সুখের কথা, এঁরা আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসছেন। অনেকে যাযাবর জীবন পরিত্যাগ করলেও পশুপালন ছাড়েননি। তাই স্থায়ী বাসস্থানের মতো স্থায়ী পশুখামারও গড়ে তুলছেন। মঙ্গোলরা কৃষিকাজেও অংশগ্রহণ করছেন। বাড়ছে শিক্ষিতের সংখ্যা। ধীর ও মন্থরগতিতে হলেও তাঁরা উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
মালয়, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সের আদিম বাসিন্দা মালয় উপদ্বীপ (১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৩টি রাজ্য নিয়ে মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠা) ও ইন্দোনেশিয়া। সারা বছরই বৃষ্টিপাত ঘটে। তাই ঘন অরণ্য অধ্যুষিত দ্বীপবহুল এলাকায়। প্রায় সাড়ে তিন হাজার দ্বীপ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়া। সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও প্রভৃতি বড় বড় দ্বীপ। এদের মধ্যে বোর্নিও দ্বীপই সব থেকে বড় এবং পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ (গ্রিনল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার পরে)। সংস্কৃতিগত কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও দেখতে এবং জীবনযাত্রা প্রণালী অনেকটা কঙ্গো অববাহিকার আদিম বাসিন্দাদের মতো। গাত্রবর্ণ কালো, মাথার চুল পশমের মতো কুঁচকানো, উঁচু চোয়াল এবং ঠোঁট পুরু, দেহ দৈর্ঘ মাঝারি। এঁরা কৃষিকাজ জানতেন না। পশু শিকার, মংস্য শিকার ও বনের ফলমূল সংগ্রহ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কোমরে চওড়া পাতার মালা ঝুলিয়ে লজ্জা নিবরণ করতেন। পশু শিকার ও মৎস্য শিকার পুরুষের এবং ফলমূল, পোকামাকড়, পাখির ডিম ইত্যাদি সংগ্রহ মেয়েদেরই কাজ। তাঁরা সেই প্রস্তর যুগেই পড়েছিলেন। হরিণ, শুয়র, বানর প্রভৃতি শিকার করেন।
০৫৬ ▌ওশিয়ানিয়ার পাপুয়ান এবং অস্ট্রেলিয়া মানুষ ও প্রকৃতি:
এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের মাঝখানে প্রায় দশ লক্ষ ছোট-বড় দ্বীপ ও দ্বীপপুঞ্জ আছে। সবচেয়ে বড় দ্বীপ অস্ট্রেলিয়া। অন্যদের মধ্যে নিউজিল্যান্ড, তাসমানিয়া, পাপুয়া, নিউগিনি, ফিজি, সোলেমান, সামোয়া, টোঙ্গা প্রভৃতি দ্বীপ উল্লেখযোগ্য। এই আদিম বাসিন্দাদের পাপুয়ান বলা হয়। এদের প্রায় ৮০০ উপজাতি বিচ্ছিন্নভাবে এখানে ওখানে বসবাস করেন। এঁরাও নেগ্রিটো জাতি। ওদের নিজস্ব ভাষা আছে। বিগত হিমযুগেও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পানির ব্যবধান ছিল। তা না হলে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে বাঘরা ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ার আদিম বাসিন্দাদের অধিকাংশ এখনও সেই আদিম অবস্থায় পড়ে আছেন। আগুনও জ্বালাতে জানেন না। আগুনকে কাছে কাছে রাখেন। লজ্জা নিবারণের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে নেংটির মতো ব্যবহার করেন একফালি গাছের বাকল বা চামড়া। পশু-পাখি শিকারই প্রধান উপজীবিকা। বুমেরাং নামক পশু শিকারের এক ধরনের অস্ত্র এঁদের প্রধান হাতিয়ার।
অস্ট্রেলিয়ায় সমভূমির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে খুবই কম এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কম। মরুভূমি এবং মালভূমিতে ভরা। পৃথিবীর আদিম স্থলভাগ যখন খ--বিখ- হয়ে চলমান অবস্থায় এসেছিল তখন এটি আন্টার্কটিকা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়েছিল স্তন্যপায়ীদের বিবর্তনের দ্বিতীয় ধাপের সময়। এজন্য অস্ট্রেলিয়াতে কোনও উন্নতমানের স্তন্যপায়ী নেই। এখানে আছে ডিম্বপ্রসবী ও স্তন্যপায়ীর মাঝামাঝি প্রাণীগুলো। মা অপুষ্ট সস্তান প্রসব করে এবং সেই অপুষ্ট সন্তান বুকের বিকল্প গর্ভ বা থলিতে রাখে। থলির ভেতর থেকেই মায়ের দুধ পান করতে করতে পূর্ণাঙ্গ অবস্থা লাভ করে। ক্যাঙ্গারু, ে নানাজাতের বেড়ালÑ সবাই অঙ্কগর্ভ প্রাণী। হিংস্র প্রাণী বলতে একমাত্র ‘ডিঙ্গো’ নামক এক জাতীয় কুকুর। এখানে বানর জাতীয় কোনও প্রাণীও নেই। তখন ডাঙা থেকে অস্ট্রেলিয়ার পানির ব্যবধান সামান্যই ছিল। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো থেকে বরফের চাঁইর উপর বা ভেলায় করে হাজির হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ার আদিম বাসিন্দারা অন্তত ৫০০ দল ও উপদলে বিভক্ত ছিলেন। ত্াদের ভাষাও পৃথক।
০৫৭ ▌খর্বাকৃতির মানব ও মিনাংকাবাউ :
ভারতের আদিম বাসিন্দাদের কথা উঠলে প্রথমেই মনের কোণে ভেসে উঠে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দাদের কথা। এরা পড়ে আছেন সভ্যতার একেবারে আদিম পর্যায়ে। মোট ২০৪টি দ্বীপের সমষ্টি আন্দামান দ্বীপপুুঞ্জ এবং মাত্র ১৯টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। সারা বছর প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে মোট চারটি উপজাতির মানুষ বাস করেন এবং নিকোবরে দুটি। আশ্চর্য, আন্দামানের চারটি উপজাতি নেগ্রিটো গোষ্ঠীর এবং নিকোবরের আদিম বাসিন্দারা মঙ্গোলীয়। সেই আদিম প্রস্তর যুগে শ্রীলঙ্কারও দক্ষিণ-পূর্ব ভারত থেকে মায়ানমার, মালয়, ইন্দোনেশিয়া এমনকি পাপুয়া নিউগিনি পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এলাকায় নেগ্রিটো গোষ্ঠীর মানুষ এক বিশেষ ধরনের সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। সময়টা পনেরো হাজার বছর আগে। সে সময় পৃথিবীর সব জাতের মানুষই প্রস্তর যুগে ছিলেন এবং তাঁদের সবার সংস্কৃতিও ছিল আদিম সংস্কৃতি। নেগ্রিটোদের কিছু দল হয় বর্তমানের মায়ানমার অথবা সুমাত্রা থেকে ভেলার মাধ্যমে আন্দামানে উপস্থিত হয়েছিলেন।
ইন্দোনেশিয়ার মুসলিম সমাজের মাঝে সারা পৃথিবীর আড়ালে থেকে যাওয়া একটা গোত্রের নাম মিনাংকাবাউ। পশ্চিম সুমাত্রায় আবাস গড়ে তোলা সুশৃঙ্খল সভ্য এই সমাজটি অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। এ সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও এখানে পুরুষদের চেয়ে নারীরা প্রাধান্য পেয়ে থাকে বেশি। মিনাংকাবাউ গোত্রে সকল সম্পদের অধিকার মা থেকে মেয়ের ওপর বর্তায়। পরিবারে মাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেয়া হয়। কুমারীত্ব থাকাও এখানে বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু হালের ‘ডেটিং’, অর্থাৎ প্রেমের সম্পর্ক কিংবা বিয়ের আগেই একসাথে সেক্স করা খুবই স্বাভাবিক একটি সংস্কৃতি- যা কি না সাধারণ একটি মুসলিম সমাজে কল্পনাতীত। মিনাংকাবাউ পরিবারের মায়েরা আশা করেন, তাদের মেয়েরা সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার ভিত্তিতে নিজেদের স্বামীকে পছন্দ করে নেবে। বিয়ের ক্ষেত্রে নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নারীরা আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী বিধায় এখানে বিবাহবিচ্ছেদ খুব অহরহ ঘটছে বলে জানা যায়।
০৫৮ ▌নাগাল্যান্ডের নাগা এবং খাসিয়া সমাজ :
মনিপুরের উত্তরের ও উত্তর-পূর্ব নাগাল্যান্ডের বাসিন্দা হল নাগা। ‘নাগা’ নামটির উৎপত্তি নাগা পর্বত থেকে। নাগা ভাষায় নাগা অর্থে মানুষ। নাগারা স্বাধীনচেতা। এঁরা দীর্ঘকাল ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। এঁদের দমন করতে হামেসাই সরকারকে সামরিক অভিযান প্রেরণ করতে হতো। নাগাদের গাত্রবর্ণ অনেকটা ধূসর। গায়ে লোম আছে। দাড়ির চুল পাতলা। মাথার চুল কালো ও ঢেউ খেলানো। মুখম-লের অবয়ব মঙ্গোলীয়দের মতো। নাগারা প্রায় সব ধরনের প্রাণী শিকার করেন। কুকুরের মাংস তাঁদের খুব প্রিয়। যুবকরা একত্রিত হয়ে বনের এক একটা অংশকে ঘিরে ফেলেন। বর্শা নিক্ষেপের দ্বারা নাগালের মধ্যে পাওয়া পশুকে ঘায়েল করে। শিকার করা পশু সমভাবে বন্টন করা হয় গ্রামের সমূহ পরিবারের মধ্যে। নাগাদের শিকারের প্রধান হাতিয়ার বর্শা ও তীরধনুক। নাগাদের প্রধান খাদ্য ভাত এবং ভাত থেকে চোলাই করা মদ। পাহাড়ের ঢালে ঘর। ঘরগুলোর দেওয়াল বাঁশ দিয়ে তৈরি। পাম গাছের পাতার ছাউনি। নাগাদের গ্রামে যুব আবাস থাকে। যার নাম মোরাঙ। মেয়েদের জন্য পৃথক মোরাং থাকে।
খাসিয়ারা প্রধানত খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের ঢালগুলোতে গ্রাম গড়ে তুলেছেন। তাঁদের মধ্যেও শিক্ষিতের হার বেশ ভালোই। এঁরা কৃষিজীবী ও স্বাধীনচেতা। গাত্রবর্ণ কালো, ঈষৎ পীতাভ কিংবা ধূসর। কারও কারও নাসারন্ধ্র বড়। চেহারা একটু বেঁটে হলেও সুঠাম ও শক্তপোক্ত। পায়ের জোর অসাধারণ। তাই তো তাঁরা অক্লেশে পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই পার হতে পারেন। খাসিয়াদের প্রধান খাদ্য ভাত। নিজেরাই ধানের চাষ করেন। হস্তশিল্পে খাসিয়াদের জুড়ি নেই। মৃৎশিল্প, রেশমশিল্প, বস্ত্রবয়ন শিল্প, বাঁশ ও বেত শিল্প প্রধান। নাচ-গান করতে ভালোবাসেন। পুরুষেরা সুতির কাপড় এবং হাতাবিহীন জামা পরেন। মেয়েরা কোমর বন্ধের উপর শাড়ি পরেন। খাসিয়া সমাজ পুরোপুরি মাতৃতান্ত্রিক। বিবাহের পর মেয়েরা স্বামীসহ পিত্রালয়েই থাকেন। মূল গৃহের কাছাকাছি একটা বাসস্থান তৈরি করে নেন। জামাইয়ের রোজগারকেও পরিবারের প্রধানের হাতে তুলে দিতে হয়। প্রধানের মৃত্যুর পর তাঁর মেয়েরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। কিন্তু মূল গৃহটি কনিষ্ঠা কন্যার প্রাপ্য।
০৫৯ ▌গারো, চাকমা ও সাঁওতাল :
গারোদের আদি বাসভূমি বর্তমান চীনের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সিন-কিয়াং প্রদেশ, যেখান থেকে তারা দেশত্যাগ করে পরবর্তীকালে তিববতে দীর্ঘদিন বসবাস করে। এরপর ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় এবং বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় এরা বসবাস শুরু করে। সর্বশেষ গারোরা ময়মনসিংহ জেলায় আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ক্ষুদ্র সামন্ত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে গারোদের শতকরা নিরানববইজনই খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। এরা ভারতের নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও বাস করেন। গারো গ্রামে সহজ ও চমৎকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা থাকে। গ্রামে প্রতি পরিবারের জন্য মাত্র একটি ঘর। ঘর বড়-সড় ও বাঁশের তৈরি। সামনে ও পেছনে দরজা থাকে। গারোরা কৃষিজীবী। -গারোরা মঙ্গোলীয়। দেহের উচ্চতা মাঝারি। গায়ের রঙ পীতাভ ও ধূসর। নাক চ্যাপ্টা, চোখ ছোট ছোট। গারোদের সমাজও মাতৃতান্ত্রিক। মায়ের গোত্রকে ওঁরা ‘মাচাং’ বলেন। ছেলেরা মামাতো, খুড়তুতো ও পিসতুতো বোনকে বিয়ে করে থাকেন। সস্তানরা মায়ের পদবি ধারণ করে।
চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিম বাসিন্দা। চাকমারা পূর্বে হরি ধর্মের অনুসারী হলেও পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। চাকমারা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করে। হিন্দুদের মতোই শবদাহ করেন। ঘর বাঁধেন মাচার উপরÑ বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। এঁদের দৈহিক গঠন মগ ও আরাকানীদের সঙ্গে মিল আছে। বিবাহে কন্যার পিতাকে পণ দিতে হয়। সমাজে বিধবা বিবাহেরও প্রচলন আছে। এঁরা এখন উন্নত। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের সংখ্যা তিন লাখের বেশি। ভারতের অরুণাচল, মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে চাকমাদের কিছু বসতি রয়েছে। চাকমাদের মধ্যে স্বগোত্রে বা স্বগোষ্ঠীতে বিবাহ হয় না। পিসী, মাসী, সিতুতো, মাসতুতো , চাচাত ফুপাত বোনের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ। ধর্মীয় উৎসব পূর্ণিমা কেন্দ্রিক। চাকমাদের অন্যতম সামাজিক, সাংস্কৃতিক উৎসব বিঝু। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন এবং বাংলা নববর্ষেরএকদিন মোট তিন দিন বিঝু উৎসব উদযাপন করা হয় । মাথা ধোয়া একটি সামাজিক রীতি। কোন অমঙ্গল, অশুভ, আপদ- বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য এ অনুষ্টানটি করেন ।
সাঁওতালরাই ভারতের প্রথম বৃহত্তম উপজাতি, আমাদের দেশেও অনেক সাঁওতাল বাস করেন। অত্যন্ত সরল তাঁদের জীবনযাত্রা প্রণালী। কোনও প্রকার কপটতা ও অসাধুতা তাদের অভিধানে ছিল না। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন যা ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ইংরেজরা ২৫ হাজার সাঁওতালকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। গায়ের রঙ বাদামি থেকে কালো, চুল ঢেউ খেলানো, ঠোঁট পুরু ও লম্বা। অনেকের মতে সাঁওতালরা দ্রাবিড় গোষ্ঠীর বংশধর। নিজস্ব ভাষা আছে, কিন্তু বর্ণমালা নেই। সাঁওতালরা মূলত কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ। সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য ভাত। সাঁওতালদের বাসগৃহ ছোট। মাটির দেওয়াল পাঁচ-ছয় হাত উঁচু। মেয়েরা গোবর মাটির প্রলেপ দিয়ে ঘরকে ঝকঝকে করে রাখেন। ঘরের জানালা থাকে না, দরজাও ছোট। বিবাহে জাঁকজমক না হলেও বরপক্ষকে কন্যাপণ দিতে হয়। কিছু অর্থ, ধান, একটা গাভী এবং একটা শূকর। মেয়ে বন্ধ্যা হলে পুরুষ দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। নিজেদের গোত্রে বিবাহ হয়। হিন্দুদের মতো ওরা মৃত দেহকে দাহ করেন।
০৬০ ▌ মসুও সমাজ ও জিপসি :
এমন সমাজ ব্যবস্থা মসুও গোত্রে, যেখানে বিয়ের কোনো অস্তিত্বই নেই। চীন আর তিব্বতের সীমারেখার একেবারে কাছাকাছি বসবাসরত এই গোত্রটি পৃথিবীর একমাত্র শুদ্ধতম মাতৃতান্ত্রিক জাতি। পরিবারপ্রধান একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী। মসুওদের মাঝে আছে একটি অদ্ভুত রীতি, যাকে বলা হয় 'ওয়াকিং লাভ'। এর মানে হলো নারী-পুরুষ চাইলেই কিছু সময় পর পর নিজেদের সঙ্গী পরিবর্তন করতে পারে। দুজনের মাঝে এই মিলনের ফলে দুটো পরিবার কখনোই এক হয় না। মেয়েরা তার পরিবারের সাথেই থাকে, ছেলেরা থাকে তার নিজের মায়ের পরিবারের সাথে। কেবলমাত্র একটা নির্দিষ্ট সময়ে দুজন মিলিত হয়। মসুও কিশোরীর মাসিক চক্র শুরু হলেই পরিবার অনুষ্ঠান করে তার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করে দেয়। তখন থেকে সে পছন্দসই যে-কোন পুরুষের সাথে একলা সময় কাটাতে পারে। এখানে জীবিকা অর্জন থেকে শুরু করে বাজার সদাই, ঘরের কাজ, ছেলেমেয়েদের বড় করে তোলা- এই সবই নারীরা করে থাকে। সকল স¤পদের মালিক পরিবারের নারীরা হয়।
ইউরোপের জিপসিদের পূর্বপুরুষরা ভারতবর্ষ থেকে এসেছিল। দশম শতাব্দীর অনেক আগেই ছোট ছোট দলে দেশ ছাড়ে তারা। ছড়িয়ে পড়ে পারস্য, মধ্য এশিয়া, মিশর, আর্মেনিয়া ইত্যাদি দেশে,পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও যেতে শুরু করে তারা। রুমেনিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরিসহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আজও তারা এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের এড়িয়ে চলে। তাই তাদের বসবাস করতে হয় আলাদা বসতিতে। জিপসিরা ইউরোপে হাজির হয়েছিল ১৪ শতকের শেষ ও ১৫ শতকের প্রথম ভাগে, মানে আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে। এই মানুষদের ইউরোপে এনেছিল ভেনেসিয়ান ও অন্যান্য উদ্যোক্তারা। এদের আনা হয়েছিল বাজিকর, গায়ক, নাচিয়ে ও আরো বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কসরত দেখানোর জন্য। তারা এসেছিল মিসরীয় মাধ্যম থেকে। ইজিপশিয়ান-এর সংক্ষিপ্ত শব্দ জিপসি। কিন্তু তারা নিজেদের রোমা পরিচয়ে পরিচিত করল। তাদের ভাষা, যা আদতে ছিল ভারত, বাইজানাটিয়াম, আর্মেনিয়া ও পারস্যের ভাষার সমন্বয়ে তৈরি লিংগুয়া ফ্রাংকা।
০৬১ ▌কালাশ ও উড্যাব
হন্দুকুশ পর্বতমালার দক্ষিণ ঢালে অবস্থিত আফগানিস্তানের একটি এলাকা কাফিরিস্তান। মূর্তি পূজারিদের দেখে মুসলিমরা একদা কাফিরিস্তান নামকরণ করেছিলেন। ১৮৯৫ সালে শেষ কাফিরকেও বলপ্রয়োগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করেন আফগান নেতা আমির আবদুর রহমান খান। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনওয়া প্রদেশের একটি জেলা চিত্রাল। এ চিত্রাল ও সোয়াত উপত্যকা জুড়ে বিস্তৃত কালাশ সম্প্রদায়। পান্ডুর গাত্রবর্ণ আর নীল চোখ। এ শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উৎস খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা কালাশদের মিল খুঁজে পান গ্রিকদের সঙ্গে। কালাশরা নিজেদের আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সেনাবাহিনীর বংশধর বলে দাবি করেন। উল্লেখ্য, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। জার্মানি গবেষকরা দেখেছেন কালাশদের শরীরে আছে ইউরোপীয় ডিএনএ। মূর্তি উপাসক কালাশদের দেবতা, পূজা পদ্ধতি, পুরাণে প্রাচীন গ্রিসের ছায়া পাওয়া যায়। রাতের বেলা অগ্নিকু-কে ঘিরে নাচ, মদ ও অলি¤িপকের অনুকরণে বিভিন্ন খেলাধুলা, তাদের আন্তরিক আতিথেয়তা।
সেপ্টম্বরের বাৎসরিক উৎসবে পুরুষেরা নানা সজ্জায় নিজেকে সাজান নারীর চোখে আকর্ষণীয় হতে। কারণ এখানেই নারীরা সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন পছন্দের পুরুষকে। এমনকি নিজের স্বামীকে রেখেই অন্যপুরুষকে সঙ্গী হিসেবে বাছাই করার অধিকার রয়েছে বিবাহিত নারীদের। সঙ্গী, স্বামী কিংবা খন্ডকালিন সঙ্গী নির্বাচনে প্রায় স্বয়ংবর সভার মতই স্বাধীনতা উপভোগ করেন উড্যাব উপজাতির নারীরা। বিয়ের আগে খুশীমত সঙ্গী খুঁজে যৌনাচারের স্বাধীনতা রয়েছে তাদের। রয়েছে যতজন খুশী ততজন স্বামীকে বিয়ে করার। পুরুষদের রূপচর্চা এবং নিজেকে আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হয় নারীদের কাছে নিজের যথাযথ উপস্থাপনের জন্যই। নিজের সাজ সজ্জা পরিপাটি রাখার উদ্দেশ্যে সকল পুরুষই বয়ে বেড়ান আয়না। সাহেল মরুভূমিতে মূলত এই যাযাবর নিগ্রো উপজাতির বসবাস। এছাড়া ক্যামেরুন, মূল আফ্রিকা রিপাবলিক, চাঁদ, নাইজেরিয়ায় দেখা মেলে গর্বিত উড্যাবদের। মাসের পর মাস তারা হেঁটে বসত গড়ে কোন একটা জায়গায়। মেতে ওঠে গান, নাচ, মদ এবং উৎসবে।
০৬২ ▌ মাড়োয়ারি ও মণিপুরী সমাজ :
রাজস্থানের মরুভূমিতে বসবাসকারী একটি ছোট্ট গোষ্ঠী উনিশ শতকে বাংলা থেকে শুরু করে পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে; গড়ে তোলে অসংখ্য গ্রাম, নগর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে হতে এ গোষ্ঠী পুরো ভারতবর্ষের স্থলপথের বাণিজ্যের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। ঝুঁকি নেয়ার ক্ষুধা ছিল তাদের, তারা মাড়োয়ারি। পশ্চিম বাংলায় এদের ডাকা হয় মেরো বাংলাদেশে মাউরা। মাড়োয়ারি মানে গ্রাম বা শহরের কোণে ছোট এক শয়তান দোকানদার। এরা চড়া সুদে মানুষকে ঋণ দেয় এবং টাকা বা সুদ দিতে না পরলে মানুষকে হেনস্তা করে। এ ছিল সাধারণ মানুষের প্রচলিত ধারণা। ব্যবসা পরিচালনার প্রতিভার কারণে সারা ভারতবর্ষের লোকরা তাদের সম্মান করে। ব্যবসার ক্ষেত্রে কঠোরভাবে রীতি-রেওয়াজ মেনে চললেও মাড়োয়ারিরা বন্ধুবৎসল। গবেষকদের মতে ‘ভারতে দশজন ব্যবসাসংক্রান্ত ব্যক্তির নয়জনই মাড়োয়ারি এবং এরা মূলত জৈন ধর্মাবলম্বী’। বিড়লাদের নাম ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত স্কুল-কলেজ, মন্দিরে মিশে আছে। এই শতকেও টাটার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বিড়লা। এরা সবাই মাড়োয়ারি।
রস থেকেই রাস শব্দের উৎপত্তি। আর লীলা মানে খেলা। অর্থাৎ রাসলীলার মানে শ্রীকৃষ্ণ, ও রাধার লীলাখেলা। মণিপুরী সমাজে রাসনৃত্য আবার ছয়টি ভাগে ভাগ করা। রাসলীলা উৎসবের শুরুটা হয় সকালে। গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য দিয়ে। রাখাল নৃত্য একটানা চলে বিকেল পর্যন্ত। সন্ধ্যার পর শুরু হয় রাসপূর্ণিমার রাসলীলা বা রাসনৃত্য। রাসনৃত্য পরিবেশনা করে মণিপুরী কুমারী মেয়েরা। রাসনৃত্য কখনও একক, কখনও দ্বৈত এবং কখনও দলবেঁধে পরিবেশিত হয়। এ নৃত্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের শুরু, মান-অভিমান এবং শেষে মিলন দেখানো হয়। # অষ্টাদশ শতাব্দীতে(১৮৪৩ খ্রীঃ) মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র একদিন স্বপ্নে দেখতে পান রাধা ও কৃষ্ণের রাসলীলা। তারপর তিনি স্বপ্নের আলোকেই উপস্থাপন করেন রাসলীলার রাসনৃত্য। মণিপুরীদের তিনটি গোত্র। এর একটি মৈতেই, আরেকটি বিষ্ণুপ্রিয়া সর্বশেষ মৈতেই পাঙান। বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতেই গোত্রের লোকরা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। এরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত। এ ছাড়া মৈতেই পাঙানরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তবে সব মণিপুরীরই প্রধান বার্ষিক উৎসব রাসলীলা।
০৬৩ ▌ অ্যামিশ, টোডা ও মিও মুসলিম :
অ্যামিশরা হল উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত পেনসিলভানিয়াতে বসবাসরত একদল এ্যানা ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টান। তারা প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর নিজ ইচ্ছায় বুঝেশুনে পুনরায় খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেয়। আমরা মুসলমানের ঘরে জন্মালে মুসলমান হই, হিন্দুর ঘরে জন্মালে হিন্দু। জেনে-বুঝেশুনে ধর্ম বেছে নেই না ! অ্যামিশরা খুব সাধাসিধে জীবনযাপনে বিশ্বাসী। তারা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারে অনাগ্রহী। তারা মোটরচালিত যানবাহন, ফোন, টেলিভিশন ইত্যাদি ব্যবহার করে না। অ্যামিশ কমিউনিতে মুখোমুখি যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যামিশরা তাদের বাড়িতে রান্নার জন্য কাঠের চুলা ব্যবহার করে। তাদের যানবাহন বলতে শুধু ঘোড়ায় টানা গাড়ি আর বাইসাইকেল। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের অষ্টম শ্রেণীর পর আর স্কুলে পাঠায় না। অ্যামিশদের ঘরে আসবাবপত্র থাকে না। তাদের তিনটির বেশি পোশাক থাকে না। পোশাকে কোন সেলাই থাকে না, পিন দিয়ে আটকায়। বিবাহিত মহিলারা সাদা এবং অবিবাহিতরা কাল ক্যাপ পড়ে। ছেলেরা বিয়ে করার পর তারা শেভ করা বন্ধ করে দেয়।
টোডা জাতি হলো দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পাহাড়গুলোয় বসবাসরত উপজাতি। ২০ শতকে টোডাদের জনসংখ্যা ছিল মোটামুটি ৭০০ থেকে ৯০০ জন। জনসংখ্যার নগণ্য অংশ হলেও টোডারা "তাদের প্রতিবেশীদের থেকে ভিন্ন রূপ, প্রথা ও রীতিনীতির কারণে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। টোডারা ঐতিহ্যগতভাবে মান্ড নামক বসতিতে থাকে। তিন থেকে সাতটি খড়-ছাওয়া বাড়ি নিয়ে একটি মান্ড গঠিত হয়। তাদের অর্থনীতি মহিষ-নির্ভর, মহিষের দুগ্ধজাত খাদ্য তারা নীলগিরি পাহাড়ের অন্য লোকদের কাছে বিক্রি করে। টোডা সমাজে কয়েক ভাইকে একসাথে বিয়ে করা ছিল বেশ সাধারণ ব্যাপার। টোডাদের জমিগুলো এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত। টোডা পোশাক হলো একপ্রস্থ কাপড়, যা পুরুষেরা শালের মতো করে ধুতির ওপর গায়ে জড়িয়ে নেয় এবং নারীরা নেয় স্কার্টের মতো করে এবং শাল জড়িয়ে। টোডারা নারী কোনো পরিবারের সব ভাইকে বিয়ে করলেও সন্তানেরা সামাজিকভাবে বড়ভাইয়ের বলে গণ্য করা হতো। এই প্রথা এখন বাতিল হয়ে গেছে।
নিজেদের মুসলিম বলেই পরিচয় দেয় হরিয়ানার মিওরা, তবে হিন্দু ধর্মের প্রায় সব আচরণবিধিও মেনে চলে। তাদের ধারণা, তারা রাম, কৃষ্ণ এবং অর্জুনের মতো হিন্দু দেবতাদের বংশধর। এমনকি দিওয়ালি, দুশেরা এবং হোলির মতো উৎসবগুলোও পালন করে। ভারতের উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা এবং রাজস্থানজুড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মিও মুসলিমের বাস। মূলধারার হিন্দু এবং মুসলিম সমাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা পরিচয় বহন করে মিওরা। বিয়ের ক্ষেত্রেও ইসলাম এবং হিন্দু উভয় ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে পারেন। বিয়ের পর ধর্ম বদলানো প্রয়োজন মনে করে না তারা। মসজিদের পাশাপাশি মন্দিরেও পুজা দেন। ধারণা করা হয়, বারো থেকে ষোল শতকের মধ্যে ধীরে ধীরে ইসলামে প্রবেশ করে মিওরা। তাদের নামগুলোতে এখানো হিন্দু যুগের উপাধি ব্যবহার করা হয়। তাদের নামগুলো হয়, রাম সিং, তিল সিং এই ধরনের। তারা বিভিন্ন সুফি পীরদের সংস্পর্শে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। গ্রামের ভেতরে মিওরা সবাই হিন্দুদের মতোই জীবন যাপন করে। আপনি হিন্দু এবং মিওদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারবেন না।
০৬৪ ▌ হিন্দু ধর্ম ও দেব-দেবি
হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ। হিন্দু ধর্মের যাবতীয় একান্ত করণীয় বিষয়ই বেদে বর্ণিত আছে। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, বেদ ঐশ্বরিক পুঁথি নহে। ইহা কেবল প্রাচীন মুনি-ঋষিদের ও আর্যদের সভ্যতার ইতিহাস মাত্র। ইহার লিখিত শ্লোকগুলো তৎকালীন আর্য ঋষিদের ধ্যান--ধারণা এবং অভিজ্ঞতার সৃষ্টি । হিন্দু ধর্মের তিনটি শাখা। শাক্ত ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম, শৈব ধর্ম। ‘হিন্দু মাতৃকা শক্তি বা দেবীই সর্বোচ্চ ঈশ্বর’ এই মতবাদের উপর ভিত্তি করেই শাক্ত ধর্মের উদ্ভব। তান্ত্রিক ও অতান্ত্রিক পদ্ধতিসহ একাধিক পন্থায় শাক্ত ধর্মানুশীলন চলে। যারা দূর্গা/কালির পূজা করে তারা শাক্ত, যারা শিবের পূজা করে তারা শৈব, আর যারা বিষ্ণুর পূজা করে তারা বৈষ্ণব। বৈষ্ণববাদে ভগবান বিষ্ণু বা কৃষ্ণকে ভক্তির মাধ্যমে ভজন করা হয়। বিষ্ণুর পূজারীদের দার্শনিক ভিত্তি প্রধানত ভাগবত গীতা এবং ভগবত পুরাণসহ উপনিষদ। দ্রাবিড়দের প্রধান দেবতা ছিলেন শিব। যে কারণে সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে শিব-এর সম্পর্ক রয়েছে। শৈব ধর্মটি একেশ্বরবাদী এবং ভক্তিবাদী। ধর্মটির ব্যবহারিক দিক হল চর্যা, ক্রিয়া, যোগ ও জ্ঞান।
শাক্ত ধর্ম
শাক্ত ধর্মমতে, দেবী হলেন ব্রহ্ম। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। সকল দেব ও দেবী তাঁর রূপভেদমাত্র। দর্শন ও ধর্মানুশীলনের ক্ষেত্রে শাক্তধর্মের সঙ্গে শৈবধর্মের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। যদিও শাক্তরা কেবলমাত্র নারীমূর্তিরই পূজা করে থাকেন। এই ধর্মে ব্রহ্মের পুরুষ রূপটি হল শিব। তবে তাঁর পূজা সাধারণত সহায়ক অনুষ্ঠান রূপে পালিত হয়ে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশ ও তার বাইরে বহু অঞ্চলে তান্ত্রিক ও অতান্ত্রিক পদ্ধতিসহ একাধিক পন্থায় শাক্ত ধর্মানুশীলন চলে। যদিও এই ধর্মের বৃহত্তম ও সর্বাধিক প্রচলিত উপসম্প্রদায় হল দক্ষিণ ভারতের শ্রীকুল (শ্রী আরাধক সম্প্রদায়) এবং উত্তর ও পূর্ব ভারতের’ বিশেষত বঙ্গদেশের কালীকুল (কালী আরাধক সম্প্রদায়)।
বৈষ্ণব ধর্ম
বৈষ্ণববাদ ভগবান বিষ্ণু বা কৃষ্ণকে ভক্তির মাধ্যমে ভজনা করা। বিষ্ণুর পূজারীদের দার্শনিক ভিত্তি প্রধানত ভাগবত গীতা এবং ভগবত পুরাণসহ উপনিষদ। খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে বৈষ্ণব ধর্মের যাত্রা শুরু হয়। তবে প্রচার ও প্রসার লাভ করে বহু পরে। প্রথমে রামানুজ (১০১৭-১১৩৭ খৃ.) ভারতের দাক্ষিণাত্যে, এরপর মাধবাচার্য (১২৩৮-১৩১৭ খৃ.) কর্ণাটকে এবং রামানন্দ (১৪০০-১৪৭৬ খৃ.) বারাণসীতে, শ্রীমন্ত শংকর দেব (১৪৪৯-১৫৬৮ খৃ.) আসামে এবং শ্রীচৈতন্য বাংলায় এই ধর্মমত প্রচার শুরু করেন। শ্রী চৈতন্যর আবির্ভাব ঘটে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে। বাবা-মার দ্বিতীয় পুত্রসন্তান। ডাক নাম ছিল গৌরাঙ্গ। সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করার পর নাম হয় শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভক্তরা বলেন মহাপ্রভূ। জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপে। তাদের আদি পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলার ঢাকা-দক্ষিণ গ্রাম। ১৫০৮ খৃস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য গয়ায় তীর্থ ভ্রমণে গিয়ে গুরু কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাসব্রতের দীক্ষা ও শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম পেয়ে তিনি ১৫১০ খিস্টাব্দে তীর্থস্থান পরিভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন এবং শান্তিপুর, পুরী, দাক্ষিণাত্য, কাশী, প্রয়াগ, মথুরা, ঝাড়খণ্ড, রামেশ্বর, কেরল, মহারাষ্ট্র ও বৃন্দাবনসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থস্থানে বহুবছর কৃষ্ণ নাম জপ প্রচার করেন। জীবনের শেষ আঠরো বছর, মতান্তরে চব্বিশ বছর, কাটান উড়িষ্যার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। উড়িষ্যার হিন্দু রাজা প্রতাপরুদ্র তাঁর ধর্ম প্রচার ও প্রসারে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ১৫৩৩ খৃস্টাব্দের ২৯শে জুন ৪৮ বছর বয়সে পুরীতেই তিনি লোকান্তরিত হন।
বৈষ্ণবদের বাস্তব জীবনচর্চা প্রক্রিয়ার নাম ভক্তিযোগ। ঝাড়ু দিয়ে যেমন ময়লা পরিষ্কার করা হয়, তেমনি শ্রী চৈতন্য ভক্তিযোগ প্রার্থনার মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধতার জন্য প্রতিদিন সুর করে বহুবার হরে কৃষ্ণ মন্ত্র বা কীর্তন গাইতে বলেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, শ্রীচৈতন্যের একান্ত সঙ্গী ও ভক্ত হরিদাস ঠাকুর প্রতিদিন তিন লক্ষ বার ঈশ্বরের নাম জপ করতেন।
শৈবধর্ম
শৈবরা বেশ কটি উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত। শৈব ধর্মটি একেশ্বরবাদী এবং ভক্তিবাদী। শৈবধর্মের মূলভিত্তি হল কপিল প্রবর্তিত সাংখ্য দর্শন। এটি অনার্য দর্শন। এই ধর্মের অনুগামীরা ভগবান শিবকেই স্রষ্টা, পালনকর্তা, ধ্বংসকর্তা, সকল বস্তুর প্রকাশ ও ব্রহ্মস্বরূপ হিসেবে পুজার্চ্চনা করেন। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় শৈবধর্ম সুপ্রচলিত। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়াতেও শৈবধর্মের প্রসার লক্ষিত হয়। বাংলার রাজা শশাংক ছিলেন শৈবধর্মের উপাসক। এছাড়া বাংলার সেন বংশীয় রাজারা ছিলেন শৈবধর্মের উপাসক। কিন্তু সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষন সেন পিতামহ ও পিতৃদেবের শৈবধর্মের প্রতি অনুরাগ ত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহন করেন। পৌরাণিক যুগ থেকে শিব তাঁর পরিবারসহ হিন্দু মনে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেন। শিব পরিনত হন পরিপূর্ণ দেবতায়। পার্বতী, উমা, গঙ্গা, দূর্গা ও কালী- এঁরা শিব-এর স্ত্রীরূপে কল্পিত হন। সেই সঙ্গে শিব-এর দুই পুত্র-গনেশ এবং কার্তিক। কন্যাদের মধ্যে মনসা ও লক্ষ্মী। পরবর্তীকালে বাংলার লোকায়ত দেবদেবী শিব এর পরিবারের অর্ন্তভূক্ত হন।
পার্বতী
পার্বতী হিন্দুদের প্রেম, উর্বরতা ও ভক্তির দেবী। তিনি শিষ্টতা ও নম্রতার প্রতিরূপ। "পার্বতী" শব্দের অর্থ "পর্বতের কন্যা"। পর্বতের রাজা হিমালয়ের কন্যা বলে তাঁকে পার্বতী বলা হয়। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সাথে পার্বতীকে একত্রে ত্রয়ীদেবী বলা হয়। পার্বতী হলেন হিন্দু দেবী দুর্গার একটি রূপ। পার্বতী শিবের দ্বিতীয়া স্ত্রী। কোনো কোনো সম্প্রদায়ে তাঁকে বিষ্ণুর ভগিনী মনে করা হয়। তিনি হিন্দুধর্মে মাতৃদেবী এবং গণেশ ও কার্তিকের মা। ভারতীয় শিল্পকলায়, আদর্শ দম্পতির ধারণা শিব ও পার্বতী থেকে প্রাপ্ত। পার্বতীকে ব্যাপকভাবে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে পাওয়া যায়। তাঁর ভয়ংকরী রূপগুলি হল দুর্গা, কালী, তারা, চণ্ডী, দশমহাবিদ্যা ইত্যাদি। অন্যদিকে পার্বতী একসঙ্গে "গৌরী" নামে অভিহিত হন। ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে গৌরীপূজা হয়। মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে গৌরীপূজা খুব জনপ্রিয়। রাজস্থানে গঙ্গৌর উৎসবের সময় গৌরীপূজা হয়। চৈত্র মাসের প্রথম দিন পূজা শুরু হয় এবং ১৮দিন চলে। পার্বতী পূজার একটি বিশেষ উৎসব হল নবরাত্রি ও দুর্গাপূজা।
লক্ষ্মী
লক্ষ্মী, হিন্দুদের সম্পদ, ভাগ্য, এবং সমৃদ্ধির দেবী। লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা। তাঁর চার হাত মানব জীবনের চারটি লক্ষ্য প্রতিনিধিত্ব করে- ধর্ম, কর্ম, অর্থ ও মোক্ষ। বাঙালি হিন্দুরা প্রতি বৃহ¯পতিবার লক্ষ্মীপূজা করে থাকেন। নববর্ষে দোকানে ব্যবসায়ীগণ গণেশের সহিত মা লক্ষ্মীর পূজো করেন। এছাড়া লক্ষ্মী পূজোতে কলা গাছের কান্ড দিয়ে নৌকা বানিয়ে পূজোতে দেওয়া হয়, তা বাণিজ্য ও লক্ষ্মী ঘরে আনারই প্রতীক।
সরস্বতী
সরস্বতী হিন্দুদের জ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলা, প্রজ্ঞা এবং শিক্ষার দেবী। তিনি ব্রহ্মার পত্নী। কিছু হিন্দু তার সম্মানে বসন্ত পঞ্চমী (বসন্ত পঞ্চম দিনে) উৎসব উদযাপন করে এবং দিবসটি উপলক্ষে শিশু-কিশোরদের সেদিন বর্ণমালা লিখতে শিখতে সাহায্য করে। তাঁর সাধারণত চার বাহু, আবার কখনও কখনও শুধু দুই বাহু দেখানো হয়। চার হাত প্রতীকী অর্থে চারটি জিনিশ ধারণ করে, একটি পুস্তক (বই অথবা স্ক্রিপ্ট), একটি মালা (জপ, মালা), একটি পানির পাত্র এবং একটি বাদ্যযন্ত্র (বাঁশি বা বীণা)। তাঁর হাতের বইটি পরম জ্ঞান ধারণ করে। স্ফটিকের মালাটি ধ্যান শক্তির প্রতিনিধিত্বমূলক, পানির পাত্র ভুল থেকে সঠিককে শুদ্ধ করার ক্ষমতা প্রতিনিধিত্ব করে। বাদ্যযন্ত্রটি, যা একটি বীণা, সব সৃজনশীল শিল্পকলা ও বিজ্ঞান প্রতিনিধিত্ব করে। সরস্বতীকে ভারতের বাইরে যেমন, জাপান, ভিয়েতনাম, বালি (ইন্দোনেশিয়া) এবং মিয়ানমারের মধ্যে পাওয়া যায়।
দুর্গা ও কালী
বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার ধারণা হিসেবে কোনো বিশেষ দেবী নেই। তাঁঁর কিংবদন্তী মধ্যযুগ পাওয়া যায়, আট বা দশ বাহুবিশিষ্ট দেবী হিসাবে অস্ত্র ও অসুরের খুলিহাতে তিনি প্রকাশিত হন। তাঁর বাহন বাঘ বা সিংহ। মধ্যযুগে রচিত পুরাণ গ্রন্থে সঙ্কটের মুহুর্তে যখন অশুভ অসুরদের আগমন ঘটে, তখন তিনি একজন বিশিষ্ট দেবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পুরুষ দেবতাগণ মহিষাসুরের অশুভ শক্তি শায়েস্তা করতে যখন ব্যর্থ হয়। তখন যোদ্ধা দেবী দুর্গা সকল দেবতার সম্মিলিত রূপ হিসাবে মহিষাসুর বধ করেন এবং দুষ্টের দমনের মধ্য দিয়ে ধর্মরক্ষা করেন। শ্লোকে বর্ণিত আছে, দুর্গা যখন খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন, তখন কালীরূপ ধারণ করেন। হঠাৎ দুর্গার কপাল থেকে কালী বেরিয়ে আসে। কালী দুর্গার মত শিবের স্ত্রী এবং একজন স্বাধীন দেবী হিসাবে প্রদর্শিত হন।
ত্রিদেবী
সর্বোচ্চ দেবী মহাদেবী সৃষ্টির জন্য দেবী মহাসরস্বতী, স্থিতির জন্য মহালক্ষ্মী এবং ধ্বংসের জন্য মহাকালী হিসাবে প্রকাশিত হন। মহাদেবীর এই তিনটি রূপকে সম্মিলিতভাবে ত্রিদেবী বলা হয়।ন
সীতা
সীতা মহাবিষ্ণুর অবতার রামকে বিয়ে করেন। তার জীবন কাহিনী এবং তার স্বামী রাম ও দেবর লক্ষ্মণের সাথে বনবাসের কাহিনী হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের অংশ। বাল্মীকির রামায়ণে সীতাকে বারংবার লক্ষ্মী অবতার হিসেবে প্রকাশ করে, যিনি কৃষি, খাদ্য, এবং ধনসম্পদের আশীর্বাদ নিয়ে আসেন। তাঁকে সুবর্ণ দেবী হিসেবে উল্লেখ করা হয় কেননা সীতাবিচ্ছেদের পর রাম পুনরায় বিবাহে অস্বীকৃতি জানান।
রাধা
রাধা মানে সমৃদ্ধি, সাফল্য এবং বজ্র। তিনি কৃষ্ণের সহচরী। কিংবদন্তি অনুসারে, রাধা বিবাহিত হলেও তাঁর কৃষ্ণের সঙ্গে রহস্যময় অন্তরঙ্গতা ছিল। শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধার প্রেম বিষয়ক বহু গাথা কবিতা বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি গোয়ালিনী হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন।
০৬৫ ▌ব্রাহ্ম সমাজ ও জরাথুস্ট্রবাদ :
বাংলা গদ্য প্রথম লেখেন রাজা রামমোহন রায়, তাঁর যখন ১৬ বছর বয়স (১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দ), তখন হিন্দু ধর্মের অসারতা নিয়ে লেখা বইটি হিন্দুদের বিশ্বাসে আঘাত করার কারণে বাজেয়াপ্ত করা হয়। রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মণ হলেও, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণরাই জাতিপ্রথা বা জাতিবিভেদ তৈরি করেছিল। ধর্মের সকল সুবিধা তারাই ভোগ করত। রাজা রামমোহন রায় এর প্রতিবাদে ব্রাহ্মণ সভা ভেঙে ব্রাহ্ম সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। তাঁর এই আন্দোলন গতি লাভ করে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারণায় যুক্ত হন। তাঁর ধর্মবিশ্বাস ছিল সকল ধর্মের সমন্বয়ের পক্ষে। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর বা যেকোনো লোকের নিজের ধর্ম পরিবর্তন করার কোনো প্রয়োজন নেই। সব ধরনের অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি ও কুসংস্কার বর্জন করে প্রতিটি ধর্মের নৈতিক উপদেশগুলো গ্রহণ করা উচিত।
ব্রাহ্মসমাজের মধ্য থেকে একটি শ্রেণি দাবি করে বেদ পুরোপুরি নির্ভুল নয়। তাই উপনিষদের নির্বাচিত অংশসমূহ নিয়ে ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাসের পুনঃনির্মাণের প্রচেষ্টা করা হয়। ১৮৫৭ সালে কেশবচন্দ্র হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্মের সারাংশ আহরণ করে সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। ১৮৭৮ সালে নতুন ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। রামমোহনের ব্যতিক্রমধর্মী ধর্ম তাঁর সময়কালে খুব বেশি লোককে আকৃষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু‘ তা সত্ত্বেও আধুনিক হিন্দু সমাজচিন্তায় এর গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়।
জরাথুস্ট্রবাদ একটি অতিপ্রাচীন ইরানীয় একেশ্বরবাদী ধর্ম। এটি পারসিক বা পার্সি ধর্ম নামেও পরিচিত। জরাথুস্ট্রীয় এই ধর্মের প্রবর্তক জরাথুস্ত্র। ধর্মগ্রন্থের নাম জেন্দ আবেস্তা। বর্তমানে পৃথিবীতে জরাথুস্ট্রীয়দের প্রায় ২৬ লক্ষ। ভারত, আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ইরানসহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশে এদের বাস। তবে ধর্মটির অনুসারীদের অর্ধেকই বর্তমানে ভারতে বসবাস করছে। ভারতে এসব পার্সিদের ৯০ শতাংশ থাকেন মুম্বাইয়ে। বাকি ১০ শতাংশ সারা ভারতে। কলকাতায় পার্সি জনসংখ্যা প্রায় চারশ’। তবে ২০১৫ সালে ইরাকের কুর্দ উপজাতির ১ লক্ষ মানুষ নতুন করে জরাথুস্ট্রীয় ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। জরাথুস্ট্রীয় ধর্মে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষিত করার জন্য নভজোত নামে একটি আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। সাত বছর বয়স হওয়ার আগে কারও নভজোত হয় না। জরথুস্ট্রীয়বাদী অগ্নি উপাসক। অগ্নিকে জরাথুস্ট্র ধর্মে শুদ্ধতার প্রতিনিধি এবং ন্যায় ও সত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এমনকি তাদের ফায়ার টেম্পল বা অগ্নি মন্দিরও এই ধারণার উপর তৈরি। এই ধর্মে সর্বোচ্চ দেবতা হিসেবে অহুর মজদা ( "প্রজ্ঞা-প্রভু")-কে পূজা করা হয়। এই ধর্ম পরবর্তীকালে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলামসহ অন্যান্য একেশ্বরবাদী ধর্মকে প্রভাবিত করেছে বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন।
০৬৬ ▌বৌদ্ধধর্ম :
বৌদ্ধধর্ম গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত একটি ধর্ম বিশ্বাস এবং জীবন দর্শন। আনুমানিক খ্রিষ্ট-পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম। বর্তমানে বৌদ্ধধর্ম দুটি প্রধান মতবাদে বিভক্ত। প্রধান অংশটি হচ্ছে হীনযান বা থেরবাদ। দ্বিতীয়টি মহাযান নামে পরিচিত। হীনযান (যার অর্থ "ক্ষুদ্রতর যান") ব্যক্তিগত মুক্তির উপর জোর দেয় এবং এতে সাধারণত স্ব-শৃঙ্খলা ও ধ্যানের মাধ্যমে ব্যক্তিগত পরিত্রাণ লাভ করা হয়। অন্যদিকে, মহাযান (যার অর্থ "মহান যান") সকল জীবের কল্যাণের জন্য বোধিসত্ত্বের পথে চলে এবং মুক্তি অর্জনের জন্য সকলের প্রতি সমবেদনা ও বুদ্ধের দেবত্বে বিশ্বাস রাখে। বজ্রযান বা তান্ত্রিক মতবাদটি মহাযানের একটি অংশ। জনসংখ্যার দিক দিয়ে (৩৮ কোটি) এটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম। শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভুটান, নেপাল, লাওস, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, চীন, জাপান, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কোরিয়াসহ অনেক দেশে এ ধর্মের অনুসারী রয়েছে। এই ধর্মমতে, ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ধরে নিলে মানুষের সব কাজ ও উদ্যম অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই সৃষ্টিকর্তার অস্তিতে বিশ্বাস না করে সম্পূর্ণ নিজের বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে নির্বাণ লাভের চেষ্টা করতে হবে। নির্বাণ মানে- যে অবস্থায় সুখও নাই, দুঃখও নাই, যাহার কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটে না। বুদ্ধ তার মতবাদে অভিজাতদের ভাষা সংস্কৃতকে অপসারিত করে সাধারণ মানুষের ভাষা পালিকে করলেন ধর্ম ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যম। বুদ্ধ যেমন দেব-দেবীর অস্তিত্বকে স্বীকার করেননি , তেমনি কখনোই নিজেকে দেবতা বা অবতার হিসেবে জাহির করেননি। তিনি ঘোষণা করেছিলেন :
# শুধু জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে কোনো কিছু বিশ্বাস কোরো না।
# কোনো একটি ঐতিহ্যকে শুধু প্রাচীন হওয়ার কারণে এবং বংশপর¤পরায় প্রচলিত হয়ে আসছে বলে বিশ্বাস কোরো না।
# লোকে কোনো বিষয়ে খুব বেশি বলাবলি করে বলেই ঐ বিষয়ে বিশ্বাস কোরো না।
# শুধু প্রাচীন কোনো বিজ্ঞ লোকের লিখিত প্রমাণ হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে বলেই কোনো কিছুকে বিশ্বাস কোরো না।
# তুমি কেবল সেটিকেই সত্য বলে এবং জীবনের পথ প্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করবে যা নিখুঁতভাবে অনুসন্ধানের পর তোমার যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলবে এবং যা তোমার নিজের এবং সব প্রাণীর মঙ্গলের জন্য সহায়ক হবে।
গৌতমের এই ভাষ্য এসেছে পালি ভাষায় লিখিত নিকায়ে গ্রন্থে। আসলে এটি হচ্ছে অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে বুদ্ধের বিদ্রোহ; বেদের বর্ণভেদ ও সাধারণ মানুষের শ্রম-ডাকাতির বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ।
০৬৭ ▌ ইহুদি ধর্ম :
অত্যন্ত প্রাচীন একেশ্বরবাদী ধর্ম। ইহুদি ধর্মের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে খিস্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম, বাহাই ধর্ম, ইয়াজিদি ধর্ম ও দ্রুজ ধর্ম। ইহুদি ধর্মানুসারীরা নিজেদেরকে ইব্রাহিমের পৌত্র জ্যাকব (বা ইয়াকুব)-এর উত্তরপুরুষ বলে মনে করেন। তাদের মূল ধর্মগ্রন্থ (তানাখ), যা তাওরাত, বা হিব্রু বাইবেল।ইহুদিদের মতে, ঈশ্বর এবং ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে একটি বিশেষ চুক্তি রয়েছে, যা এই ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। আব্রাহাম এবং মূসা এই ধর্মের দুজন গুরুত্বপূর্ণ নবী। মূসাকে মিশরীয় দাসত্ব থেকে মুক্তির পথ দেখানো নবী হিসেবে গণ্য করা হয়। ইহুদিরা ঐতিহ্যগতভাবে ঈশ্বরের নাম সরাসরি উচ্চারণ করে না। প্রার্থনায় তারা "অ্যাদোনাই" (আমার প্রভু) শব্দ ব্যবহার করে এবং ঈশ্বরের নামকে "হাশেম" হিসেবে উল্লেখ করে।
ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের কিছু সাদৃশ্য
ইসলাম ও ইহুদি ধর্মে পার্থক্য যেমন আছে, তেমনি বেশকিছু ক্ষেত্রে সাদৃশ্য আছে। যেমন-
১. মুসলমান ও ইহুদিরা এক ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী।
২. মুসলমান ও ইহুদিদের মতে তাদের জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম ((আ.) / আব্রাহাম। সমগ্র মানব জাতির পিতা হযরত আদম ((আ.) ) / অ্যাডাম।
৩. মুসলমানরা প্রতিদিন পাঁচ বার নামাজ আদায় করে। ইহুদিরা প্রতিদিন তিনবার (ভোরে, দুপুরে ও রাতে) প্রার্থনা করে।
৪. এই দুই ধর্মেই প্রার্থনার জন্য কিবলা (দিক) আছে। মুসলমানদের কিবলা মক্কার কাবা ও ইহুদিদের কিবলা (দিক) জেরুজালেমের প্রার্থনা স্থান। আগে মুসলিমদের কিবলা জেরুজালেমে ছিল।
৫. মুসলমানদের জীবনে একবার হজ্ব করতে হয় মক্কায়। ইহুদিদের বছরে তিনবার তীর্থ যাত্রা করতে হয় জেরুজালেমে।
৬. মুসলমান ও ইহুদি পুরুষদের খাতনা করতে হয়।
৭. দাড়ি রাখতে দুই ধর্মেই বলা আছে। দাড়ি কাটা দুই ধর্মের দৃষ্টিতে গুনাহ/পাপ।
৮. সম্পদ দান করা দুই ধর্মেই অবশ্য পালনীয় বিষয়। মুসলমানরা নিজের সম্পদের একটি অংশ যাকাত হিসেবে দেয়। ইহুদিরা তাদের সম্পদের একটি অংশ প্রতি বছর চ্যারিটি হিসেবে দেয়।
৯. মুসলমানরা কোনো ব্যক্তিকে দেখলে সালাম দেয়। ইহুদিরা কোনো ব্যক্তিকে দেখলে সালোম/শালোম বলে। দুই শব্দের অর্থই শান্তি।
১০. দুই ধর্মেই বিশেষ আইন রয়েছে। মুসলমানদের জন্য শরীয়াহ আইন। ইহুদিদের জন্য হালাখা আইন। এই দুই আইনেরই শাস্তির বিধান কঠোর। জেনা (বিয়ে বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক) করা এই আইন অনুসারে মারাত্মক অপরাধ। জেনা করলে মুসলমানদের শরীয়াহ আইন মোতাবেক ১০০ বেত্রাঘাত। ইহুদিদের হালাখা আইন মোতাবেক পাথর ছুড়ে মারা।
১১. ইসলাম ধর্ম মতে শুক্রবার সপ্তাহের পবিত্র দিন ও বিশেষ ইবাদতের দিন (জুম্মা)। ইহুদি ধর্মমতে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সপ্তাহের পবিত্র সময় ও বিশেষ প্রার্থনার সময়।
১২. দুই ধর্ম মতেই পশুর রক্ত ও শূকরের মাংস কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
১৩. পশু জবাইয়ের নিয়ম দুই ধর্মেই প্রায় এক ধরনের। মুসলমানরা প্রতিটি পশু জবাইয়ের আগে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। ইহুদিরা শুধু একবার প্রভুর নাম স্মরণ করে একসঙ্গে সব পশু জবাই করে।
১৪. মেয়েদের ক্ষেত্রে দুই ধর্মেই মাথায় কাপড় দেয়ার বিধান আছ তবে ইসলাম ধর্মে মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলেই মাথায় কাপড় দেয়ার বিধান আছে। আর ইহুদি ধর্মে মেয়ে বিয়ে করলে মাথায় কাপড় বাঁধার বিধান আছে। নারী ও পুরুষের জন্য শালীন কাপড় পরার বিধান দুই ধর্মে আছে।
১৫. পুরুষের টুপি পরার বিধান দুই ধর্মে আছে। ইহুদি পুরুষরা প্রার্থনা করার সময় মাথায় টুপি পরে।
১৬. ইবাদত/প্রার্থনার অংশ হিসেবে সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থাকা দুই ধর্মেই আছে। মুসলমানদের রমজান মাসের প্রতিদিন রোজা রাখা ফরজ আর ইহুদিদের বছরে পাঁচটি বিশেষ দিনে পানাহার থেকে বিরত থাকা অবশ্য পালনীয়।
১৭. সন্তান জন্ম নিলে মুসলমানদের অনেকে বাচ্চার কানের কাছে আজান দেয়। ইহুদিরা অনেকে বাচ্চার কানের কাছে শিমা দেয়।
১৮. দুই ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ।
১৯. দুই ধর্মেই ধর্মীয় দিন পঞ্জিকায় মাস নতুন চাঁদ দেখে ঠিক করা হয়।
২০. দুই ধর্মেই সন্তানের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে রাখার সময় ছাগল জবাই দেয়া ধর্মের বিধান।
২১. দুই ধর্মেই জেরুজালেম হচ্ছে পবিত্র নগরী । মুসলিমদের জন্য মক্কা হচ্ছে সবচেয়ে পবিত্র নগরী তারপর মদিনা তারপর জেরুজালেম। ইহুদিদের জন্য জেরুজালেম সবচেয়ে পবিত্র নগরী।
২২. পবিত্র কোরআন অনুসারে অমুসলিমদের মধ্যে একমাত্র ইহুদি জাতির নারীর সঙ্গে মুসলিম পুরুষের বিয়ের অনুমতি আছে। আলেম ওলামাদের মতে এই বিয়ে জায়েজ হবে, তবে তা মাকরুহ/পছন্দনীয় কাজ না। এই ধরনের বিয়ে করলে শর্ত হলো সন্তান মুসলিম হতে হবে।
০৬৮ ▌খ্রিস্টান ধর্ম :
খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে যিশু খ্রিস্ট হচ্ছেন ঈশ্বরের পুত্র। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ হিব্রু বাইবেলকে খ্রিষ্টানরা পুরাতন বাইবেল বলে থাকে। নতুন বাইবেল বা নিউ টেস্টামেন্ট খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের শেষভাগ। গবেষকদের মতে-খ্রিস্টীয় পূর্ব ৪ থেকে ৮ অব্দে যিশু জন্মগ্রহণ করেন। কাঠমিস্ত্রী যোসেফের সঙ্গে ম্যারির বাগদানের পরে যোসেফ স্বপ্নের মাধ্যমে দেখতে পান যে, ম্যারি অলৌকিকভাবে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন এবং তার গর্ভে যেই পুত্র সন্তানটি জন্মগ্রহণ করবে, সে পবিত্র আত্মা নিয়ে জন্ম নিবে। তারা ‘জুড়িয়া দেশের নাজরাথ’ নামক গ্রামে বসবাস করতেন। যোসেফ ম্যারিকে নিয়ে জেরুজালেমের দিকে আসছিলেন। তখন তারা পথিমধ্যে বেথেলহ্যামের এক ঘরে এসে আশ্রয় নিলেন। অতঃপর বেথেলহাম শহরে এক গোয়ালঘরে অলৌকিকভাবে যিশু্র জন্ম হয়। ৩০ বছর বয়সের আগ পর্যন্ত তার জীবনীর ব্যাপারে তেমন কিছু জানা যায় না। ৩০ বছর বয়সে একদিন জর্ডান নদীর তীরে ডুব দিয়ে তিনি ব্যাপ্টাইজ তথা পবিত্র হন। এরপর থেকে তার দাওয়াতি কার্যক্রম গালীল, দিকাপলী, জেরুজালেম এবং জর্দান নদীর তীর পর্যন্ত ছড়াতে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় প্রচার হতে থাকে, তার হাতের ছোঁয়ায় অন্ধ তার দৃষ্টিশক্তি, বধির তার শ্রবণশক্তি, খোড়া তার সুস্থ পা, মৃত ব্যক্তি ফিরে পায় তার জীবন, কুষ্ঠরোগী রোগমুক্তি প্রভৃতি। তার ইচ্ছায় ঝড়-বৃষ্টি থেমে যায় এবং তার ইচ্ছায় খাদ্য উৎপাদন বেড়ে যায়।
যিশু বিয়ে করেছিলেন কি? ড্যান ব্রাউনের থ্রিলারধর্মী উপন্যাস ‘দ্য ডা ভিঞ্চি কোড’ মূলত এ কাহিনির ওপর ভিত্তি করে। ইউরোপে এখনও খ্রিস্টানদের মধ্যে একটি মিস্টিক ও গুপ্ত সম্প্রদায় রয়েছে- যাদেরকে ‘সেক্রেড সোসাইটি’ বলে; মনে করা হয় এরা যিশুর উত্তরাধিকার। গ্রিক দার্শনিক ও লেখক কাজান জাকিসকে বলা হয় সে দেশের মেগনাম ওপাস বা জ্ঞানের বিশ্বকোষ। তার লাস্ট টেম্পটেশন অব ক্রাইস্ট গ্রন্থে যিশু যে মেরি মেগদালিয়ানকে বিয়ে করেছেন, সে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। নিউ টেস্টামেন্টের চারটি গসপেল বা সুসমাচারে মেরি মেগদালিনয়ানকে যিশুর একজন শিষ্য হিসেবেই দেখানো হয়েছে; স্ত্রী হিসেবে নয়। টরন্টোর ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক বেরি ইউলসন ও তার দল নতুন আবিষ্কৃত দ্য লস্ট গসপেল ছয় বছর ধরে গবেষণা করছেন। তারা দেখেছেন, যিশু ও মেরি মেগদালিনয়ান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এ গসপেলটি প্রাচীন সিরীয় ভাষায় লিখিত; দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত ছিল। যিশু যখন তার দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন, তখন তার পথে অনেক বাধা-কষ্ট ও নির্যাতন নেমে আসে। ইহুদি রাব্বীগণ মনে করতে থাকেন যে, তার দাওয়াতি কার্যক্রমের ফলে তাদের কর্তৃত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। তাই তারা তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকে। তারা তাকে পাগল, যাদুকর, অবৈধ সন্তান, মুরতাদ বলে হেয় প্রতিপন্ন করতে থাকে। পাথর নিক্ষেপ করে, দেশ হতে বের করার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। অতঃপর একদিন তাকে ব্লাসফেমী আইনে আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করা হয় যে, তার দ্বারা খোদা অবমাননামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। ইহুদি স্বার্থান্বেষী ধর্মযাজকদের প্ররোচনায় পড়ে প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ডের ঘুষ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিচারক তার মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। যিশুকে হত্যা করার তিনদিন পর তিনি নাকি পুনরায় এই দুনিয়াতে আগমন করেন এবং তার ১১ জন অনুসারীদের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে তার ধর্ম প্রচার করার নির্দেশ জ্ঞাপন করেন। এরপর তাকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এভাবে যিশু খ্রিষ্টের জীবনাসন হয়।
এই খ্রিস্ট মতবাদ দরিদ্র রোমান সাম্রাজ্যে বিশেষ করে দাসদের মধ্যে ব্যাপক আবেদন সষ্টি করে এবং দলে দলে তারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিতে থাকে। এই ব্যাপক সাড়ায় সম্রাট ডায়োকিটিয়ান (২৮৪-৩০৫ খ্রিস্টাব্দে) শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এর প্রসার রোধে তিনি যে হত্যাকাণ্ড চালান, খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ। কিন্তু এই নিধন খ্রিস্টমতবাদকে নির্জীব করতে পারে না। ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এতে খ্রিস্টমতবাদ এক প্রবল জোয়ার সষ্টি করে সারা রোমান সাম্রাজ্যে। জোয়ারের তোড়ে খ্রিস্টধর্মীদের প্রতি সহনশীল হওয়ার নীতি গ্রহণ করেন পুরো ইউরোপ।
০৬৯ ▌‘ইসলাম’ ধর্ম :
জনসংখ্যার দিক দিয়ে (১৪২ কোটি) এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। ধর্মীয় মতানৈক্যের ভিত্তিতে ইসলামের অনুসারীরা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত: সুন্নি ইসলাম (১২৫ কোটি) ও শিয়া ইসলাম (১৭ কোটি)। মুসলমানরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানের উপর। তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেওয়ার পর মুহাম্মদ (সা.) প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেন। এ ধরনের প্রচারের সূচনাটা বেশ নাটকীয় ছিল। মুহাম্মদ (সা.) সাফা পর্বতের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সবাইকে সমবেত করেন। এরপর প্রকাশ্যে বলেন যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল’। কিন্তু এতে সবাই তাঁর বিরুদ্ধে প্রচন্ড খেপে যায়। ধর্ম প্রচার করার সময় কাবার পুরোহিত সম্প্রদায়ের অন্যতম কুরেশীয়রা হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে নানা ধরনের কষ্ট দিয়েছিল। এমনকি তারা হযরতের প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল, তখন বাধ্য হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ত্যাগ করে মদিনাকে তাঁর নিবাস স্থল হিসেবে বেছে নেন। এই প্রবাসের তিথি থেকেই হিজরি সনের আরম্ভ হয়। ইসলামের সম্পূর্ণ ইতিহাস ১ থেকে ৫০০ পর্বে এখানে পডুন।
যেভাবে ইসলামের স্বর্ণযুগ শুরু হয়
আব্বাসীয় যুগকে বলা হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগ। বিশেষত হারুন অর রশিদ (৭৮৬-৮০৯) এবং আল মামুন (৮১৩-৮৩৩) এর যুগে ভারত থেকে গ্রিস পর্যন্ত প্রাচীন গ্রন্থিত চিন্তাকে একত্রিত করা হয়। বায়তুল হিকমাকে কেন্দ্র করে বাগদাদে শুরু হয় নতুন স্রোতের। তার প্রতিক্রিয়ায় ৯০৯ সালে ঘটে মিশরে শিয়া ফাতেমীয়দের উত্থান। প্রায় একই সময়ে সিরিয়া থেকে বিচ্যুত উমাইয়া রাজত্ব। মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তার এমন দ্বিধাগ্রস্থ সময়ে ৯৮০-৮২ সালের দিকে মঞ্চে আসে ইখওয়ান-আস সাফা। গোড়ায় ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসাবে তাদের আবির্ভাব ঘটলেও আস্তে আস্তে তারা দর্শনের দিকে ঝুকে পড়ে। ইখওয়ান আস সাফার পুরো কার্যক্রম চলতো গোপন রহস্যময়তার চাদরের আড়ালে। দীর্ঘদিন অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে যেতে হতো প্রতি সদস্যকে। এজন্য প্রায়ই বয়সকে মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করা হতো। গোটা সংগঠন বিন্যন্ত ছিলো চারটি ক্রমিক পদে। প্রথম স্তরে শিক্ষানবীশ। ১৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত বয়সের যুবক। তাদেরকে শিক্ষকের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও বাধ্যতার শিক্ষা দেয়া হতো। এদের বলা হতো আল আবরার ওয়াল রুহামা বা গুণী ও দয়ালু। দ্বিতীয় স্তরে থাকতো পরিণতরা। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের এই ব্যক্তিদের পার্থিব শিক্ষা ও আনুমানিক জ্ঞান দেয়া হতো। এছাড়া দেয়া হতো রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে প্রায়োগিক জ্ঞান। আখ্যা দেয়া হতো আল আখিয়ার ওয়াল ফুদাল বা উত্তম ও মঙ্গলজনক হিসেবে। তৃতীয় ধাপে অন্তর্ভুক্ত ছিলো ৪০-৫০ বছরের ব্যক্তিরা। বস্তুজগতে ঐশী বিধানাবলি অনুধাবনের চর্চা করতেন তারা। তাদের বলা হতো আল ফুদালা ওয়াল কিরাম বা মঙ্গলময় ও সম্মানিত। সর্বশেষ স্তরে যেতে কমপক্ষে ৫০ বছর হওয়ার শর্ত ছিল। এই স্তর ইতিহাসের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ এবং দার্শনিকদের স্তর। তিনি হতেন প্রজ্ঞা ও তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী। একে বলা হতো আল মারতাবাতুল মালাকিয়া বা ফেরেশতার স্তর। দলের সদস্যরা গোপনে তাদের অধিনায়ক যায়েদ বিন রিফার গৃহে মিলিত হতো মাসে তিনবার। ইখওয়ান আস সাফার সদস্যদের বিশ্বাস ছিলো তৎকালীন ধর্মীয় বিধান ও কার্যাবলি ক্রুটিপূর্ণ। তাই বিশুদ্ধ গবেষণা ও সামঞ্জস্য আনা প্রয়োজন। তাদের সবথেকে বড় অবদান রাসায়েলে ইখওয়ানুস সাফা গ্রন্থ, একে দর্শন ও বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ বলা হয়।
ইসলামের স্বর্ণযুগ. ছয় শতাব্দী জুড়ে : ইসলামের স্বর্ণযুগের ব্যাপ্তিকাল অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে অবশ্য এ সময়কাল পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘায়িত। তখনকার সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এক কেন্দ্রেই পরিণত হয়েছিলো আজকের ধুঁকতে থাকা মুসলিম সমাজ। বাগদাদে তখন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো House of Wisdom, যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলিম-অমুসলিম পন্ডিতেরা এসে জড়ো হতেন। একদিকে তারা যেমন জ্ঞানের বিনিময়ের মাধ্যমে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে সমৃদ্ধ করতেন, তেমনি প্রাচীন বিভিন্ন শাখার জ্ঞানকে অনুবাদের মাধ্যমে চিরস্থায়ী সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করতেন। তাদের এ অনুবাদ করার কাজটি যে আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কারণ শুধুমাত্র সেসব পন্ডিতদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের জন্যই মানবজাতি অতীতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক কিছুই জানতে পেরেছে। প্রথমে সেগুলোকে মূলত আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হলেও কালক্রমে তুর্কী, সিন্ধী, ল্যাটিন, ফার্সি, হিব্রু ইত্যাদি নানা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ফলে জ্ঞানের যে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিলো তা তো না বললেও চলে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, রোম, চীন, ভারত, গ্রীস, মিশর, পারস্য, উত্তর আফ্রিকা, বাইজান্টাইন প্রভৃতি সভ্যতার জ্ঞান নিয়ে চর্চা হতো সেখানে। ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ তথা বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সব প্রান্ত থেকেই জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটতো হাউজ অফ উইজডমে জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্যে।
স্বর্ণযুগের পরিসমাপ্তি: এগারো শতকে শুরু হওয়া ক্রুসেড ক্রমেই অস্থিতিশীল করে তোলে গোটা মুসলিম বিশ্বকে। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ায় গড়ে উঠেছিলো শক্তিশালী মঙ্গোল সাম্রাজ্য। ১২৫৮ সালের ২৯ জানুয়ারি হালাকু খানের নেতৃত্বে মঙ্গোল বাহিনী ও তার মিত্র শক্তিদের সামনে তছনছ হয়ে যায় আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী, তখনকার দিনের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী বাগদাদ। ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তেরদিন চলা সেই অভিযানে মঙ্গোল বাহিনীতে ছিলো ১,২০,০০০-১,৫০,০০০ সেনা। অপরপক্ষে আব্বাসীয় খেলাফতের সেনাসংখ্যা ছিলো মাত্র ৫০,০০০ প্রায়। যুদ্ধে মুসলিমরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আব্বাসীয়দের পক্ষে থাকা সকল সেনাই সেই অভিযানে নিহত হয়েছিলেন। পাশ্চাত্য সূত্রানুযায়ী সেই যুদ্ধে প্রায় ২,০০,০০০ থেকে ৮,০০,০০০ সাধারণ নাগরিক মারা গিয়েছিলেন। অপরদিকে আরব বিশ্বের মতে এ সংখ্যাটি ২০,০০,০০০ প্রায়। কালক্রমে একসময় অটোম্যান সাম্রাজ্য উঠে দাঁড়ালেও ইসলামের সোনালী সেই যুগ আর কখনোই ফিরে আসেনি, বরং সোনালী সেই সূর্য কালে কালে অস্তমিতই হয়েছে।
০৭০ ▌সালাফি মতবাদ
‘সালাফি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘পূর্বপুরুষকে নিঃশর্তভাবে অনুসরণ! বিশুদ্ব ইসলাম চর্চার দাবীদার ওহাবীবাদকে সালাফিবাদও বলা হয়ে থাকে। তাদের মতে রসুলের মদীনায় হিজরতের ৩০০ বছর পর পর্যন্ত মুসলমানরা খাঁটি ইসলাম ধর্ম পালন করেছে। এই সময়টাকে ওহাবীরা সালাফ বলে। তারা মনে করে সালাফের পর মুসলমানরা খাঁটি ইসলাম ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছে। মুসলমানদেরকে সালাফের সময়ের মতো ইসলাম চর্চায় ফিরিয়ে আনাই ওহাবীবাদের লক্ষ্য। ওহাবি মতবাদের মূল ভাবনাগুলো গৃহীত হয়েছে 'ইবনে তাইমিয়া'র চিন্তাধারা থেকে। ৬৬১ হিজরিতে 'তাকিউদ্দিন আহমাদ ইবনে আব্দুল হালিম' তৎকালীন তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় হাররান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইবনে তাইমিয়া নামেই পরিচিত। হাররান শহরটি সেই সময় ছিলো হাম্বলি মাজহাব চর্চার প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলোর একটি। ইবনে তাইমিয়ার পিতা ছিলেন হাররানের বিখ্যাত ফকিহ। তিনি 'শায়খুল বালাদ' নামে পরিচিত ছিলেন। হাররানের জনগণ তাঁকে খতিব এবং ইসলামী জ্ঞান ও বিদ্যার শিক্ষক হিসেবেই জানতো। ইবনে তাইমিয়ার জীবনকাল ছিল ইসলামী ভূখণ্ডে মোঙ্গলদের পাশবিক হামলার সমকালীন। তিনি তাঁর যৌবনকাল কাটান দামেশকে। তাঁর পিতাসহ হাম্বলি মাজহাবের বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে তিনি ফিকাহ, হাদিস, উসূল, তাফসির, কালাম ইত্যাদি শেখেন। এক পর্যায়ে তিনি হাম্বলি মাজহাবে ইজতেহাদের পর্যায়ে পৌঁছেন এবং ফতোয়া দেওয়া ও শিক্ষকতা করার মতো যোগ্যতা অর্জন করেন। দামেশকে তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং কোরআনের তাফসির পড়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত হন। ইবনে তাইমিয়া অন্যান্য ধর্ম এবং মাজহাব নিয়েও পড়ালেখা করেন এবং এমন কিছু ফতোয়া দিতে থাকেন যেগুলোর সাথে আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবসহ শিয়া মাজহাবেরও কোনো মিল ছিলো না।
ইবনে তাইমিয়া মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত কিছু রীতিনীতিরও সমালোচনা করতে থাকেন এবং এমনকি কিছু কিছু সুন্নাতের অনুসরণকে শিরকের সাথে তুলনা করেন। এসব ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার কারণে এবং ব্যতিক্রমধর্মী ফতোয়া প্রদান করার কারণে ইবনে তাইমিয়ার জীবনে শুরু হয় ব্যাপক তোলপাড়। ইবনে তাইমিয়া নিজেকে 'সালাফি' বলে মনে করতেন। সালাফিরা মনে করতেন ইসলামের সকল আকিদা-বিশ্বাস সাহাবি এবং তাবেয়িনদের আমল অনুযায়ী বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। আর ইসলামী আকিদা কেবল কিতাব এবং সুন্নাত থেকেই গ্রহণ করতে হবে, আলেমদের উচিত হবে না কোরআনের বাইরের কোনো দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে কোনো কিছু আমল বা বাস্তবায়ন করা। সালাফিদের চিন্তায় বিবেক-বুদ্ধি বা যুক্তি তথা গবেষণার কোনো স্থান নেই, তাদের কাছে কেবল কোরআন-হাদিসের মূল টেক্সটই প্রমাণের জন্যে যথেষ্ট। তাদের যুক্তির বিরোধিতাকারীদের সাথে তারা কঠোর ব্যবহার করতো। ইবনে তাইমিয়া যখন তাঁর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাপ্রসূত বিভিন্ন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন, তখন তার ঐসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তিনি আল্লাহ স¤পর্কে বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহ সশরীরী একটি সত্ত্বা এবং তিনি আকাশসমূহের ঊর্ধ্বে থাকেন। তিনি মহানবী (সা.) এর রওজা শরিফ যিয়ারত করা কিংবা তাঁর স¤পর্কে কোনো স্মরণসভা বা কোনো অনুষ্ঠান করাকে হারাম এবং র্শেক বলে মনে করতেন। এছাড়া তিনি কোনো ওলি আওলিয়া কিংবা নেককার বান্দাদের শরণাপন্ন হওয়া অথবা তাদের সহায়তা প্রার্থনা করাকেও হারাম বলে মনে করতেন।
মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত বিখ্যাত ধ্যান-ধারণার সাথে ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য সাংঘর্ষিক হবার ফলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। যার পরিণতিতে ৭০৫ হিজরিতে সিরিয়ার আদালত তাঁর বিরুদ্ধে মিশরে নির্বাসনের রায় দেয়। হিজরি ৭০৭ সালে তিনি কারামুক্ত হন এবং তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গির অনকুলে পুনরায় লেখালেখি করতে থাকেন। ৭২১ হিজরিতে আবারো তাঁকে কারাগারে আটক করা হয় এবং ৭২৮ হিজরির জিলকাদ মাসে শেষ পর্যন্ত দামেশকের কেল্লা কারাগারে মারা যান।
ইবনে তাইমিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর চিন্তাদর্শেরও প্রায় মৃত্যু ঘটে গিয়েছিলো। খুব কম লোকই তাঁর চিন্তাদর্শের অনুসারী ছিলো। কিন্তু‘ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নামে একজন আবির্ভূত হয়ে ইবনে তাইমিয়ার সেই ছাইয়ে ঢাকা আগুনকে আবার উন্মোচন করেন। তারই নাম অনুসারে সৃষ্টি হয় ওহাবী মতবাদ। এই আব্দুল ওহাব ছিলেন একজন ইসলামিক সালাফি পণ্ডিত। প্রাক্তন সৌদি বাদশাহ মুহাম্মদ বিন সৌদের সাথে তার চুক্তির ফলে বর্তমান সৌদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়ক হয়েছিলো। তার উত্তরসূরী আল আশ শাঈখ ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব রাষ্ট্রের ওলামাদেরকে পরিচালনা করেন।
যদিও ওহাবী মতবাদের উপর তাইমিয়ার প্রভাব রয়েছে, তথাপি অনেক জায়গায় আবার অমিলও আছে। যেমন, তাইমিয়া সুফিবাদকে স্বীকার করতেন, রসুলের জন্মদিন পালনের পক্ষপাতি ছিলেন কিন্তু ওহাবীরা এর বিপক্ষে। ওহাবী মতে, মানুষ ও অন্যান্য জীব যাদের আত্মা রযেছে, তাদের ফটো তোলা বা ছবি আঁকা নিষিদ্ধ। পয়গম্বর বা আওলিয়ার কাছে প্রর্থনা করা, মাজার জেয়ারত, তাবিজ-কবজ তারা অনুমোদন করে না। তাদের মত অনুসারে পীর পূজা/দরগা পূজা/ মাজার পূজা সবকিছুই ইসলামে হারাম! এমনকি ইসলামে নাত, গজল, কাওয়ালী গান শোনা/গান গাওয়া ঘোরতর নিষেধ! সালাফি মুসলমানদের মতে ইসলামের অন্যান্য সম্প্রদায় (যেমনÑ শিয়া, সুফী, আহমাদিয়া, বাহাই, কাদরী, বোরহানি) সবাই জাহান্নামী!
সালাফিরা সকল মাজার ধ্বংস করতে চান! কারণ, তা মুসলমানকে আল্লাহ এবং মানুষের মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির পূজায় লিপ্ত করছে/করেছে! ভারতের কাশ্মীরে এরকম অনেকগুলো দরগা ধ্বংস করেছিল সালাফি মুসলমানেরা!
০৭১ ▌ মোতাজিলা মতবাদ :
ইসলামে উগ্রপন্থার বিপরীতে আছে মুতাজিলা। এরা ইসলামি ধর্মতত্ত্বের একটি শাখা গোষ্টি। জীবন-যাপনের সবকিছু এরা যুক্তি আলোচনার উপর প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বসরা শহরে অষ্টম শতাব্দীতে মোতাজিলা মতবাদের সূচনা হয়। মুসলমানদের পাপ ও শাস্তি নিয়ে ইমাম হাসান আল বসরির সাথে তার ছাত্র ওয়াসিল ইবনে আতারের মতবিরোধ হয়। ওয়াসিল ও তার অনুসারীরা আল হাসানের শিক্ষায়তন পরিত্যাগ করে বলেই তাঁরা মোতাজিলি নামে অভিহিত হন। মোতাজিলি শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিত্যাগ করা। ৮ম থেকে ১০ শতাব্দীতে বসরা ও বাগদাদে মুতাজিলা মতবাদের প্রাধান্য ছিল। আব্বাসীয় যুগে এই মতবাদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।
মোতাজিলারা ছিলেন মূলত দার্শনিক। মুতাজিলারা বিখ্যাত আরব দার্শনিক বলে পরিচিত আল কিন্দির তথ্য ‘শূন্য থেকে সৃষ্টি’ তত্ত্বটি সত্য বলে বিশ্বাস করেন। আরবিতে গ্রিক দর্শন অনুবাদে আল কিন্দির বড় ভুমিকা ছিল। আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন মোতাজিলা মতবাদ গ্রহণ করেন। মোতাজিলাদের মতো খলিফাও বিশ্বাস করেন যে, কোরান শরীফ আসলে সৃষ্টি এবং এতে কিছু যুদ্ধের কাহিনী আছে মাত্র। এই বিশ্বাসে তিনি তার মতবাদকে সরকারী নীতি হিসাবে জনসাধারণকে গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। অনেকে এই মতবাদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। এর ফলে অসংখ্য মানুষ কারারুদ্ধ হন; শাস্তি ভোগ করেন। অনেকে প্রাণ হারান। এই ঘটনা মুসলিম ইনকুইজিশন মিনহা বলে পরিচিত। জনসাধারণের বিরোধিতার মুখে খলিফা আল মুতাওয়াকিলের রাজত্বকালে মিনহা বন্ধ করে দেয়া হয়।
মুতাজিলা দার্শনিকেরা প্রাচীন গ্রিক যুক্তিবাদী দর্শন, বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ধর্মবিশ্বাসকে কীভাবে যুক্তির সঙ্গে সমন্বিত করা যায়, এই চিরন্তন প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান ছিলো তাঁদের লক্ষ্য। কিন্তু‘ ইসলামের গোঁড়া সমর্থকদের তীব্র বিরোধিতার মুখে চিন্তার ক্ষেত্রে এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা সফল হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও এই ধারা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, উনিশ শতকের উদারনৈতিক পরিবেশে এই যুক্তিবাদী ধারাটি যেনো পরিপূর্ণতা লাভ করেছিলো। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন পাশ্চাত্য সভ্যতার উদার যুক্তিবাদী ধারার উন্মেষ ঘটেছিলো, সেই যুগে ১৭৮৫ সালে উত্তর ভারতের গোরাখপুর শহরে এক তাঁতি পরিবারে জন্ম হয় আবদুল রহীমের। তিনি লক্ষ্ণৌ ও দিল্লির প্রখ্যাত মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করে আরবি এবং ফারসি ভাষায় অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন। আবদুল রহীম ধর্মের গোঁড়ামি পরিহার করে একজন মুক্তমনা যুক্তিবাদী মানুষে পরিণত হন। ফলে মুতাজিলা দার্শনিকদের যুক্তিবাদী চিন্তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। ১৮১০ সাল নাগাদ আবদুল রহীম কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন এবং এখানে ১৮৫৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। কলকাতার মুক্ত পরিবেশে আবদুল রহীমকে কেন্দ্র করে এক বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুতাজিলার সমর্থক হিসেবে আমরা উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) ও বাংলার সৈয়দ আমির আলীকে (১৮৪৯-১৯২৮) দেখতে পাই। তাঁরা উভয়ই সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে এবং যুগের প্রয়োজনে ইসলামকে পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। আরেকজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন দেলওয়ার হোসেন আহমদ (১৮৪০-১৯১৫), তাঁর নিবাস ছিলো হুগলি জেলায়। তিনি ১৮৬১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। খুব সম্ভব তিনিই উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট। দেলওয়ার হোসেনের চিন্তাধারা ছিল তাঁর সমসাময়িক অন্য মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী। দেলওয়ার হোসেনই খুব সম্ভব আধুনিক যুগের প্রথম মুসলমান বুদ্ধিজীবী, যিনি বলিষ্ঠ ও পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে মুসলমানদের জাগতিক আইনকে ইসলামি ধর্মীয় বিধান থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করাই হলো মুসলমান সমাজের অগ্রগতির পূর্বশর্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরিবর্তনশীল সমাজের চাহিদা অপরিবর্তনশীল ধর্মীয় আইন বা বিধান দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আবুল হোসেন (১৮৯৬-১৯৩৮), কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭৬), মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) প্রমুখ কতিপয় বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবীর উদ্যোগে ঢাকা শহরে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তাঁদের মূলমন্ত্র ছিলো ‘বুদ্ধির মুক্তি’। বুদ্ধির ও যুক্তির আলোকে এবং সমকালীন যুগের প্রয়োজনের তাগিদে ইসলামের পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্ব্যাখ্যা করাই ছিলো এর প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু‘ তখনকার ঢাকার মুসলমান সমাজের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে এই আন্দোলন তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। তবে এর রেশ একেবারে মিলিয়ে যায়নি। পরবর্তীকালে বেশ কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী এটিকে লালন করেছেন এবং আমাদের সময়কালে বাঙালি মুসলিম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণে এঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
খলিফা আল মামুন-এ শাসনামলে মুতাজিলা মতবাদ চিন্তাশীল ও সংস্কৃতিমনা লোকদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়েছিল। অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তি ও বাস্তবতার ভিত্তিতে মানুষের ইচ্ছার পাশাপাশি মানুষের বুদ্ধির পক্ষেও প্রচার চালিয়েছিলেন মুতাজিলায়।
মতবাদটি ইউরোপের স্কলাশটিসিজিম দর্শনের সঙ্গে অনেকেই তুলনা করেছেন। রাজনৈতিকভাবে এই মতবাদের পতন হলেও মুসলমানদের ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনচর্চায় মুতাজিলাদের প্রভাব আজ পর্যন্ত মুছে যায়নি। ধর্মান্ধরা এই মতবাদকে ধর্মদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অনেক প্রসিদ্ধ ইসলামী চিন্তাবিদ বলেছেন, এই মতবাদে এমন কিছু নেই যে, মুতাজিলা মতবাদ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে যায়। মুতাজিলা মতবাদের পক্ষে স্যার সৈয়দ আমীর আলী তাঁর বিখ্যাত The Spirit of Islam গ্রন্থে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন।
উমাইয়া যুগে মুতাযিলা অনুসারীরা এতটাই অগ্রসর হয়েছিলেন যে, আল কোরআনকে গ্রিক দার্শনিক plato I aristotle-এর মতাদর্শের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। কিন্তু ঈমাম আল গাযযালি ছিলেন একজন সুফি শাস্ত্রজ্ঞ। তাঁর নেতৃত্বেই মুসলিম রক্ষণশীলতার পুনর্জাগরণ ঘটে। মুসলমানরা অলৌকিকভাবে প্রকাশিত বিষয়কে যুক্তির উপরে এবং নিয়তিবাদকে মুক্তচিন্তার উপরে স্থান দেয়। তারা গণিত শাস্ত্রকে ইসলামবিরোধী বলে চিহ্নিত করে, মুতাযিলা অনুসারীদের সঙ্গে আল-গাযযালির মূল দ্বন্দ্বের জায়গাটা ছিল, যা তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শরীয়তই ইসলামের মেরুদণ্ড, যার বিধান অলক্সঘনীয়। ফলে ইমাম আল-গাজ্জালীর প্রভাবে প্রতিক্রিয়াশীল প্রগতিবিমুখ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা আজ ঐতিহাসিকভাবেই সত্য।
অন্যদিকে আর এক সুফি সাধক জালাল উদ্দিন রুমি ছিলেন উদার পন্থী। তিনি ছিলেন ত্রয়োদশ শতকের একজন ফার্সি কবি, ধর্মতাত্ত্বিক এবং সুফি দর্শনের শিক্ষক। তাঁর পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদকে সমসাময়িক বিদ্বানরা ‘পণ্ডিতদের সুলতান’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। ফার্সি সাহিত্যের অন্য মরমী কবিদের মতো রুমিও তার রচনায় একত্ববাদ বা ‘তাওহীদ’বাদকে তুলে ধরেছেন। তার বিশ্বাস সংগীত ও কবিতার মধ্যেও স্রষ্টার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সম্ভব। বহু ভাষাতেই তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে। আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে জালাল উদ্দিন রুমির কবিতার বই ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপক সমাদৃত ও জনপ্রিয়, এমন কী তাঁর বই একাধিক বার বেস্ট সেইল তালিকাতেও রয়েছে ইউরোপে।
০৭২ ▌ শিয়া মতবাদ :
হযরত আলী(রা.)কে যাঁরা খিলাফত ও ইমামাত-এর একমাত্র যোগ্য উত্তরসূরি মনে করেন তারাই শিয়া। হযরত মুহাম্মদ(সা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসলামে সর্বপ্রথম কোন্দল শুরু হয়। হযরত আবু বকর(রা.)-এর নির্বাচনের সময় কিছু ব্যক্তি হযরত আলী(রা.)-কে সমর্থন করেন। কারণ তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর জামাতা এবং চাচাতো ভাই । ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক ইমাম হোসেনের নৃশংসভাবে মৃত্যু শিয়া আন্দোলনকে সুদূরপ্রসারী করে। এ সময় থেকেই শিয়া মতবাদের উদ্ভব হয়। উমাইয়া খিলাফতের আমলে (৬৬১-৭৫০ খ্রি.) শিয়া সম্প্রদায় কারবালার নৃশংসতার প্রতিবাদে আল-মুখতার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইরাক ও পারস্যে তাদের আধিপত্য দৃঢ় হয়। যাবের যুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ, সীমার প্রভৃতি ইমাম হোসেনের হত্যাকারীদের হত্যা করে প্রতিশোধ গ্রহণ করার শপথ নেয়। তখন পারস্য শিয়া মতাবলম্বীদের প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়। শিয়ারা হযরত আলী(রা.) এবং তাঁর বংশধরদের ইমাম হিসেবে সম্মান করে, মনে করে তারা নির্ভুল এবং ঐশ্বরিকভাবে মনোনীত।
শিয়াদের কিছু ধর্মবিশ্বাস
১. শিয়াদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, হযরত আলী (রা.)’র নবী হওয়ার কথা ছিল (শিয়াতেও মতভেদ আছে) কিন্তু জিব্রাঈল (আ:) রাসূল (সা.)’র কাছে চলে আসার কারণে রাসূল (সা.)ই নবী হয়েছেন।
২. শিয়ারা বিশ্বাস করেন, পবিত্র কুরআনের দুটি আয়াত বাদ দেয়া হয়েছে, কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, কুরআনের একটি সূরা বাদ দেয়া হয়েছে।
৩. চার মাজহাবের সকল ইমাম ও ৫০+ হাদীসের গ্রন্থের সকল ইমাম সবাইকেই পথভ্রষ্ট মনে করেন শিয়ারা।
৪. শিয়াদের নিজস্ব হাদিস গ্রন্থ রয়েছে, যার মধ্যে আলী (রা.)’র লেখা হিসাবে প্রচলিত নাহজুল বালাগা- যে গ্রন্থে সত্যি আলী (রা.)’র লেখা রয়েছে বলে মানেন।
৮. শিয়ারা সাময়িক বিবাহ তথা মু’তা বিবাহে বিশ্বাস রাখেন, যা অন্য ধারার মুসলিমরা রাখেন না। সাময়িক বিবাহ ইসলামে রদ হয়ে গেছে।
শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে মতভেদ থাকলেও অনেক মৌলিক বিষয়েই রয়েছে মতের মিল। যেমন, উভয় মাজহাবই এক আল্লাহ, অভিন্ন ধর্মগ্রন্থ তথা পবিত্র কুরআন এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে সর্বশেষ নবী হিসেবে মানেন। উভয় মাজহাবই পরকালের প্রতি তথা পুনরুত্থান ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ও নারীদের পর্দা করা ফরজ হওয়ার বিষয়সহ আরো অনেক বিষয়েই একমত।
০৭৩ ▌আহমদীয়া সম্প্রদায় :
মির্জা গোলাম আহমেদের নামানুসারেই আহমেদিয়া সম্প্রদায়। তিনি ভারতীয় পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান শহরে ১৮৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এই কাদিয়ান শহরের নামানুসারে সম্প্রদায়টির আরেক নাম কাদিয়ানি। পৃথিবীর ১১২টি দেশে কাদিয়ানিরা বাস করে। আহমেদিয়াদের মতে, রসুল(স:) বলেছিলেন যে, যখন মুসলমানদের ইমাম দূর্বল হয়ে আসবে, তখন ইসলামকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ ইমাম মেহেদি প্রেরণ করবেন। মাসলমানরা ইমাম মেহেদির জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আহমেদিয়রা মনে করেন যে, ইমাম মেহেদি আর্বিভুত হয়েছেন, যার নাম মির্জা গোলাম মোহাম্মদ। ইসলামে জিহাদকে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি মনে করতেন যে, বর্তমান যুগে মুসলমানরা যুদ্ধ করবে কলমের সাহায্যে, তরবারি নয়।
তাদের দাবি, ইসলামের আসল পথ থেকে বিচ্যুত মুসলমানদের সঠিক পথের সন্ধান দিতে প্রতিষ্ঠিত হয় আহ্মদিয়া আন্দোলনের। মির্যা গোলাম আহমেদের মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা মৌলানা নুরউদ্দিনকে তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচিত করেন। নুরউদ্দিনের মৃত্যুর পর ১৯১৪ সালে সম্প্রদায়টি ভাগ হয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুসারীরা কাদিয়ানে থেকে যায় এবং তারা গোলাম আহমদকে নবী বলে স্বীকার করে। অন্য শাখাটি গোলাম আহমদকে একজন সংস্কারক বলে স্বীকার করে এবং তারা ‘লাহোর আহ্মদিয়া’ মুসলিম সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করে।
আহমদিয়া মনে করে যে, ১৫০০ বছরের আগের তৈরি করা মুসলিম আইন যুগের কারণে সংস্কার কিংবা পরিবর্তন হওয়া উচিত। তাদের মতে, মির্যা গোলাম আহ্মেদ হচ্ছেন যিশুর পাশাপাশি মুহাম্মদ(সা.)-এর প্রদর্শিত পথে পাঠানো একজন নবী। তাদের মতে, নব্যুয়াতের সমাপ্তি মানে আর কোনো নতুন নবী আসতে পারবেন না তা নয়, নতুন নবী আসতে পারবেন তবে তা অবশ্যই হতে হবে মুহাম্মদ(সা.) যে পথ-প্রদর্শন করে গেছেন সেই পথে।
‘আহমদিয়া সমস্যা’ নামে মওলানা মওদুদী একটি বই লেখেন। পাকিস্তান সরকার বইটি নিষিদ্ধ করার আগেই ১৮ দিনে ৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবে মওদুদী আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে লাহোরে হামলা শুরু করলেন। এতে কয়েক হাজার আহমদিয়া হত্যার শিকার হয়। এর জন্য মওদুদীকে গ্রেফতার করে বিচার করা হলো এবং ফাঁসির আদেশ দেয়া হলো। পরে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপে তার ফাঁসি রদ করা হয়। উল্লেখ্য যে, নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানি পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোক।
ক্রুস বিদ্ধ যিশুখ্রিষ্টের মৃত্যু বিষয়ে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আহমদিয়ারা বলে যে, ঈসা (আ.) ক্রুসে বিদ্ধ হয়ে মারা যাননি, তিনি কেবল অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের মতে ক্রুস থেকে নামানোর পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীকালে ভারতে এসে ধর্ম প্রচার করেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগে ইসলাম খুব সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকবে এ সময় ইমাম মেহেদি এসে দজ্জালকে মেরে ইসলাম পুনর্জীবিত করবেন। কিন্তু আহমদিয়ারা বিশ্বাস করে যে, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানিই ইমাম মেহেদি।
০৭৪ ▌ইসমাইলিয়া সম্প্রদায় :
নিজারী ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়, শিয়াদের মধ্য থেকে একটি দলছুট সম্প্রদায়। নিজারী শিয়াদের দাবি ও তালিকা মোতাবেক তাদের প্রথম ইমাম হলো আলী (রা.)। তাঁর পুত্র হুসাইন(রা.) দ্বিতীয় ইমাম, যথাক্রমে তাঁর পুত্র জয়নুল আবেদিন তৃতীয়, তাঁর পুত্র মোহাম্মদ আল বাকের চতুর্থ, তাঁর পুত্র ঈমাম জাফর সাদেক(রহ.) পঞ্চম। ঈমাম জাফর সাদেকের দুই সন্তান, যথাক্রমে মুসা কাজেম ও ইসমাইল।
এই ইসমাইল-এর ১৪তম অধঃস্থন পুরুষ নিজার এবং নিজারের ২৭তম অধঃস্থন পুরুষ প্রথম আগা খান। খলিফা আলী(রা.)-এর সূত্র ধরে তাদের হিসেবে বর্তমানের প্রিন্স করিম আগা খান ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের ৪৯তম ইমাম। এদের নিজস্ব কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই। তারা দাবি করে যে, কুরআন হলো তাদেরও ধর্ম গ্রন্থ। তারা আরও দাবি করে যে, কোরআন সর্বকালের সমাধান দিতে দুনিয়াতে আসেনি। ১৪০০ বছর আগে তদানীন্তন আরবের সমস্যার সমাধান দিয়েই কোরআনের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাদের ভাষায় সুন্নিরা কোরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ওহী আসার সিলসিলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে যে দাবি করা হয়, সেটিও আসলে ভুল ব্যাখ্যা! তাদের দৃষ্টিতে সঠিক হলো, কেয়ামত পর্যন্ত আসমানি ওহী আল্লাহর সুনির্দিষ্ট বান্দাদের উপর আসতে থাকবে। যেভাবে ইসমাইলিয়া ইমামদের উপর আসে। ফলে তারা কোরআনের কথা অস্বীকার করে না বরং সম্মান করে। তবে পবিত্র কোরআনে ১৪০০ বছর পূর্বের তদানীন্তন সময়ের কিছু কাহিনি ও কিছু নীতিকথা ছাড়া আর কিছু নেই বলে নিজ ধর্মের কাউকে পড়তে উৎসাহিত করা হয় না।
তাদের মতে এই ১৪০০ বছরে পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলিয়েছে, পবিত্র কোরআনে সে সবের কোনো আধুনিকতা নেই বলে, ধর্ম তো আর এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না! তাই ধর্ম-কর্মের গতি অব্যাহত রাখতে, ধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, আধুনিক প্রশ্নের ব্যাখ্যা ও দিক নির্দেশনা দেবেন ধর্মের ইমামগণ। রাসূলের(সা.) বংশধর হবার সুবাধে ইসমাইলিয়া ঈমামদের সব পাপ মার্জনীয়। তাঁদের পাপসমূহ লিপিবদ্ধ হয় না, তাঁরা চিরকাল নিষ্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক থাকবেন।
অধিকন্তু ইমামেরা জগতের সমস্ত পাপী ইসমাইলিয়া অনুসারীর পাপ ক্ষমা করতে পারেন। একজন ইমাম যে কাউকে নিষ্পাপ করতে পারেন। পাপীরা ইমাম আগা খানের নিকট এসে পাপের প্রায়চিত্তের জন্য ক্ষমা চাইলে, তিনি স্বীয় গুনে তা ক্ষমা করার অধিকার রাখেন। প্রিন্স করিম ইমাম আগা খান পাকিস্তান ভ্রমণে আসলে, শত শত যুবতী নারী শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসায় রাস্তার দুই পাশে শুয়ে, মাথার চুল বিছিয়ে রাস্তা বানিয়েছিলেন।
ইমাম প্রিন্স করিম আগা খান যুবতীদের বিছানো চুলের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে, তাদের উৎসর্গকে ধন্য করেন। ইসমাইলিয়ারা ইসলাম ধর্মের রীতি-নীতি অনুসারে নামাজ, রোজা, হজ্ব পালন করে না। বরং নামাজের স্থলে দৈনিক তিনবার কিছু দোয়া পড়ার নিয়ম শিক্ষা দিয়ে থাকে। তাদের বিশ্বাস, প্রিন্স করিম আগা খানের চেহারার দিকে নজর দিতে পারলেই, হজ্ব কর্ম সম্পাদন হয়ে যায়। প্রিন্স করিম ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে কখনও কখনও বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে থাকেন। তখন তিনি তাঁর অনুসারীদের দেখা দেওয়ার ব্যবস্থাটি করে থাকেন। এতে করে অনুসারীদের হজ্বের অনুষ্ঠানটি পালন করার সুযোগ ঘটে যায়।
বাংলাদেশে তিনি যতবার এসেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ততবার লাল গালিচা সম্বর্ধনা পেয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বর্তমান ঈমাম প্রিন্স করিম আগা খান বাল্যকালে কেনিয়া এবং বাকি জীবন ইউরোপে কাটানোর কারণে খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাব তাঁকে আচ্ছাদিত করেছিল। তিনি খ্রিস্ট ধর্মের বাইবেলের সু-সমাচার পদ্ধতির উপর আকৃষ্ট ছিলেন। ফলে তাদের ধর্ম বিশ্বাস মুসলমানদের মতো না হয়ে তা খ্রিস্ট ধর্মের কাছাকাছি হয়ে যায়।
ইমাম করিম আগা খানের বড় মেয়ে, ‘প্রিন্সেস জাহারা’ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষে বিয়ে করেন ব্রিটিশ মডেল ও ব্যবসায়ী মার্ক বয়ডেনকে। এরপর থেকে ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের মাঝে খ্রিস্টানদের অনুপ্রবেশের সুযোগ ঘটে যায়। এই ঘটনার পরে, ‘ইমামে জামান’ ধর্মীয় রীতিতে সংশোধনী আনেন। নতুন আইনে বলা হয়, প্রতিপত্তি লাভের আশায় ইসমাইলিয়া মুসলমান মেয়েরা যদি খ্রিস্টান ছেলেদের পছন্দ করে, তাহলে কন্যার বাবা-মা বিয়েতে বাদ সাধতে পারবে না। তাদেরকে তাদের মতো সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দিতে হবে।
মজার ব্যাপার হলো, আগা খান তরিকা বোর্ডের মাধ্যমে সুদকে হালাল ঘোষণা করেছেন। স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেবার ব্যবস্থা করেছেন। এই ব্যবস্থায় তারা পৃথিবীর দেশে দেশে বহুজাতিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। সহজে ঋণ দেবার কারণে দুনিয়াতে তাঁর সাফল্য ও সফলতা ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আগা খান এসব প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ লাভ থেকে চ্যারিটি, সমাজ উন্নয়ন, খেলাধুলা ও সহযোগিতার নামে সাহায্য দিয়ে থাকে। এতে করে ব্যক্তি প্রিন্স আগা খান একটি প্রবল, উদার ও বিশাল হিতাকাক্সক্ষী মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়। আগা খানের সংস্থা লাভের সঙ্গে আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিকে জড়িয়ে রাখে বলে এনজিওদের মতো মার খায় না। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামি ব্যাংকের নাম বলা যায়, যারা ব্যবসার সঙ্গে একটি আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিকে উজ্জ্ব¡ল করতে চায়, ফলে সেটা দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে। প্রতিজন নিজারী ইসমাইলিয়া শিয়া, প্রতি বছর তাদের ইমাম প্রিন্স করিম আগা খানকে তাদের ধর্মীয় ভাষায় দাসন্দ দিয়ে থাকেন। যার পরিমাণ পৃথিবীর সকল ইসমাইলীয়দের বাৎসরিক আয়ের ১২.৫%! ধারণা করা হয় এই ফান্ডেই প্রতি বছর হাজার মিলিয়ন ডলার জমা হয়।
প্রিন্স করিম আগা খানের হিসেবে পুরো দুনিয়াতে অনুসারীর সংখ্যা ছিল ৫০ লাখ। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে বহু দেশে বিভক্ত হয়ে যাবার ফলে, আগা খান তাজিকিস্তানে ঢুকে পড়েন এবং অকঋঊউ-এর মাধ্যমে ব্যাপক শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেন। দীর্ঘ বছর কমিউনিস্টের যাঁতাকলে পিষ্ট সেখানকার মুসলমানরা ইসলামের মূল ভিত্তি থেকে অনেক দূরে চলে যায়। এই সুযোগটি কাজে লাগায় আগা খানের অনুসারীরা। তারা মানুষদের ইহকালীন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীর সঙ্গে সঙ্গে পরকালীন মুক্তির জন্য ইসমাইলিয়া ধর্মকে উপস্থাপন করে।
দলে দলে মানুষ তাদের সঙ্গে ভিড়ে যায়! এই পদ্ধতিতে শুধুমাত্র তাজিকিস্তান থেকেই প্রায় ১ কোটি অনুসারীকে দলে ভিড়াতে সক্ষম হয়!
ব্যক্তি জীবনে প্রিন্স করিম আগা খান বর্তমান ইমাম আগা খানের ব্যক্তি জীবনের দুই একটি ঘটনা উল্লেখ না করলে নয়। আগা খান ইমামত পাবার দুই বছর পর তথা ১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ মডেল কন্যা সারাহকে বিয়ে করেন। সারাহর জন্য এটি ছিল দ্বিতীয় বিয়ে, তিনি মুসলমান হয়ে নাম রাখেন বেগম সালিমাহ আগা খান।
দীর্ঘ সংসার জীবনের এক পর্যায়ে সালিমাহ স্বামীর আচরণে সন্দেহ পোষণ করেন! স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন নারীর রাত কাটানোকে সহজে মেনে নিতে পারেননি। এই নিয়ে স্ত্রী সালিমাহ ১০ বছর পৃথক থেকেছেন। ১৯৯৫ সালে তিনি ২০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে তালাকপ্রাপ্ত হন। আগা খান ১৯৯৮ সালে গ্যাব্রিয়েল নামের ইউরোপিয়ান আরেক তরুণীকে বিয়ে করেন, যিনি মুসলমান হয়ে নাম রাখেন বেগম ইনারা আগা খান। তিনিও পূর্বের স্ত্রীর ন্যায় স্বামীর আচরণে খুশি ছিলেন না ফলে ২০১১ সালে ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে তালাকপ্রাপ্ত হন।
০৭৫ ▌ বাউল দর্শন :
বাউল গুরু ও তাদের অনুসারীদের নাম দেখে অনেকেই হয়তো মনে করেন তারা মুসলিম (বা হিন্দু)। আসলে কিন্তু তা নয়। বাউল দর্শন একটি আলাদা ধর্ম। ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধববিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন। হিন্দুতান্ত্রিক সাধনা, সুফী সাধনার বিকৃত রূপ ও বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধনার মিলন রূপ একটি নতুন সাধক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে, এরাই মূলত বাউল নামে পরিচিত। বাউল শব্দটি সংস্কৃত বাতুল শব্দ হতে জন্ম। আবেগে উন্মাদ, প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি ও লোকাচার পরিত্যাগী বন্ধনমুক্ত ধর্ম সাধকগণই বাউল নামে খ্যাত। বাউল দর্শনের মূল ভিত্তি হচ্ছে দেহতত্ত্ব। দেহকে বাউলগণ পরম সম্পদ বলে মনে করেন। তাদের সাধনার মূল হলো এই মানবদেহ। তাদের মতে মানবদেহের মধ্যেই আল্লাহ বা ভগবান বিরাজমান। মানবদেহকে আশ্রয় করে সাধন-ভজন করে মনের মানুষকে উপলব্ধি করাই তাদের আধ্যাত্মিক লক্ষ্য। বাউলরা মনে করেন বিশ্ব স্রষ্টা যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার সমস্তই এই মানব দেহে বিদ্যমান আছে। সুতরাং তাদের মতানুসারে ঈশ্বরকে খোঁজার জন্য দেহের বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কামাচার হলো বাউল সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় মিথুনাত্মক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত।
বাউলদের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে গৃহত্যাগী বাউল ও গৃহী বা সংসারী বাউল। যারা গুরুর নিকট ভেক খিলাফৎ-এর মাধ্যমে দীক্ষা গ্রহণ করে তাদের ত্যাগী বা ভেকধারী বাউল বলা হয়। এই শ্রেণির বাউলরা সংসার ও সমাজত্যাগী। ভিক্ষাই তাদের একমাত্র পেশা। তারা আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং সেখানে সাময়িকভাবে অবস্থান করে। পুরুষরা সাদা লুঙ্গি এবং সাদা আলখাল্লা এবং মহিলারা সাদা শাড়ি পরিধান করে। তাদের কাঁধে থাকে ভিক্ষার ঝুলি। তারা সন্তান ধারণ বা প্রতিপালন করতে পারে না। এ ধরনের জীবনকে বলা হয় ‘জ্যান্তে মরা’ বা জীবন্মৃত। মহিলাদেরকে বলা হয় সেবাদাসী। পুরুষ বাউল এক বা একাধিক সেবাদাসী রাখতে পারে। এই সেবাদাসীরা বাউলদের সাধনসঙ্গিনী। বর্তমানে সমগ্র দেশে ভেকধারী বাউলের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। গৃহী বা সংসারী বাউলরা স্ত্রী-পুত্র-পরিজনসহ লোকালয়ে একটি স্বতন্ত্র পাড়ায় বাস করে। সমাজের অন্যদের সঙ্গে তাদের ওঠা-বসা, বিবাহ ইত্যাদি নিষিদ্ধ।
ভেকধারী বাউলদের মতো তাদের কঠোর সাধনা করতে হয় না; ‘কলমা’ বা ‘বীজমন্ত্র’ পাঠ এবং নির্দিষ্ট কিছু সাধন-ভজন প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেই হয়। ভেকধারী বাউলরা গৃহী বাউলদের দীক্ষা দিয়ে থাকে। উভয়ের সম্পর্ক অনেকটা পীর-মুরিদের মতো। দীক্ষা নেওয়ার পর সন্তানধারণ নিষিদ্ধ, তবে গুরুর অনুমতিক্রমে কেউ কেউ সন্তান ধারণ করতে পারে। আখড়া বাউল-ফকিরদের সাময়িক আবাসস্থলের নাম আখড়া। এসব আখড়া পল্লিগ্রামের লোকালয় থেকে একটু দূরে অবস্থিত। সাধারণত সংসারত্যাগী এবং ভেকধারী বাউল-ফকিররাই এখানে অবস্থান করে। গুরুগৃহ এবং তার সমাধিকে কেন্দ্র করেও আখড়া গড়ে ওঠে। ত্যাগী বাউলদের সেবাদাসী ‘কণ্ঠিবদল’ করে একজনকে ছেড়ে অন্য জনের সঙ্গে চলে যেতে পারে। বর্তমানে গৃহী বাউলদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গুরুধারা বাউলদের ‘ঘর’ বা ‘গুরুধারা’ আছে। এক একজন প্রধান বাউলগুরুর নামানুসারে এই ‘ঘর’ নির্দিষ্ট হয়। যেমন লালন শাহী, পাঞ্জু শাহী, দেলবার শাহী, পাঁচু শাহী ইত্যাদি। বাউলদের একটি বিশেষ সম্প্রদায় হলো কর্তাভজা। এরা বৈষ্ণবপন্থী এবং ‘সতীমায়ের ঘর’ বলে পরিচিত। সতী মা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান গুরু। লালন ফকিরের আখড়া কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামে। আখড়ায় ভক্তরা জড় হয়ে গান গেয়ে ধর্মকর্ম পালন করে। ছেঁউড়িয়ায় প্রতি বছর দোল পূর্ণিমায় মার্চ-এপ্রিল মাসে তিনদিন ব্যাপী ‘মচ্ছব’ (মহোৎসব) ও ‘সাধুসেবা’ অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৭ অক্টোবর থেকে তিন দিন ধরে সাধুসেবা হয় ।