যাঁরা নিয়মিত দিনের বেলা ২০–৩০ মিনিট ঘুমান
ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (ইউসিএল) এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা নিয়মিত দিনের বেলা ২০–৩০ মিনিট ঘুমান,বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্প সময়ের ঘুম মস্তিষ্ককে স্মৃতি সংরক্ষণ, টক্সিন দূর করা এবং নিউরনের স্বাভাবিক কার্যকারিতা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। এতে মনোযোগ, শেখার ক্ষমতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ে। মানসিক ক্লান্তি দূর করে মস্তিষ্ককে সতেজ রাখে এবং দিনভর কার্যক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন কয়টি ডিম খেতে পাবেন?
অক্সফোর্ড থেকে পুষ্টি নিয়ে পিএইচডি ও হার্ভার্ডে এমডি করা নিক নরউইটজ টানা ৩০ দিন ধরে প্রতিদিন ২৪টি করে মোট ৭২০টি ডিম খেয়ে দেখতে চেয়েছিলেন এতে তাঁর শরীরে বিশেষ করে কোলেস্টেরলের ওপর কী প্রভাব পড়ে।এই ব্যতিক্রমী খাদ্যাভ্যাসের পেছনে ছিল একটি বৈজ্ঞানিক যুক্তি। সাধারণভাবে আমরা জানি, ডিমে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি—এ কারণে বহুদিন ধরেই হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞরা ডিমকে 'খারাপ' খাবার হিসেবে দেখেছেন।কিন্তু পরীক্ষায় দেখা যায়, তাঁর এলডিএল কোলেস্টেরলের (যাকে সাধারণত 'খারাপ' কোলেস্টেরল বলা হয়) তা কমে যায় ১৮ শতাংশ পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা হলো আমাদের শরীরের লিভার নিজেই কোলেস্টেরল তৈরি করে থাকে এবং খাদ্য থেকে কোলেস্টেরল বেশি গ্রহণ করলে লিভারের উৎপাদন হ্রাস পায়। বিপরীতে, উচ্চ চিনি বা প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে তৈরি 'খারাপ' কোলেস্টেরলকণাগুলো হৃদ্রোগের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ।
জাপানে দম্পতিরা ঘুমান আলাদা বিছানায়, কারণ কি?
জাপানে ঘুমকে ‘পুনর্জীবনীশক্তির উৎস’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিরক্তিকর শব্দ, ঘুমানো অবস্থায় নাক ডাকা কিংবা নড়াচড়া সঙ্গীর ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। আলাদা বিছানায় ঘুমালে এসব সমস্যা থেকে অনেকখানি পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এতে ঘুম ভালো হয় এবং সম্পর্কও স্থিতিশীল থাকে।আলাদা শয়নবিন্যাস সম্পর্ককে দুর্বল করে না বরং ভালো ঘুম ও পারস্পরিক সম্মানের মাধ্যমে সম্পর্ককে শক্তিশালী করে। জাপানে দম্পতিরা আলাদা রুমে বা বিছানায় ঘুমান এটি তাঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, মানসম্মত বিশ্রাম এবং সম্পর্কের সুস্থতার বহিঃপ্রকাশ।
পশ্চিমা বিশ্বের স্মার্ট টয়লেট এখন আদিম পদ্ধতিতেই ফিরছে কেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, টয়লেট পেপারের তুলনায় পানি অনেক কোমল ও কার্যকর। সংবেদনশীল ত্বক বা জ্বালা-পোড়ার সমস্যায় ভোগা মানুষের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী। এই সামান্য পরিবর্তন প্রতিদিনের জীবনে এনে দিচ্ছে বাড়তি আরাম ও সুরক্ষা। একে প্রিমিটিভ বলে অবজ্ঞা করা হয়েছে। আর এখন সেই পথেই হাঁটছে অত্যাধুনিক স্মার্ট টয়লেট।
‘বেড রটিং’
ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় অলসভাবে পড়ে থাকা; সঙ্গে মুঠোফোন স্ক্রলিং, টিকটক দেখা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানোকে ‘বেড রটিং’ বলে। জেন–জিদের মতে, মানসিক ক্লান্তি থেকে মুক্তির সহজ উপায় হলো বিছানায় শুয়ে অলস সময় কাটানো। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অভ্যাস অতিরিক্ত হলে তা ঘুমের সমস্যা, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ও উদ্বেগ বা বিষণ্নতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। বর্তমানে টিকটকে এটা এতটাই ভাইরাল যে কেউ ইচ্ছানুযায়ী সারা দিন বিছানায় পড়ে থাকে ঘুমানো ছাড়া, খাওয়া, টিভি দেখা বা মুঠোফোনে স্ক্রলিং করে সময় কাটায়।মনোরোগবিশেষজ্ঞদের মতে, ক্লান্তি বা বার্নআউট কাটিয়ে উঠতে মাঝেমধে৵ এই ‘কর্মহীন’ দিন উপকারী হতে পারে।
তবে সতর্কতা জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত ‘বেড রটিং’ শারীরিক কার্যক্রম কমিয়ে দেয়, মাথাব্যথার কারণ হতে পারে এবং পেশিশক্তি ও মেটাবলিজমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ধরনের অভ্যাস অতিরিক্ত হলে তা ডিপ্রেশন, উদ্বেগ বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ঘরজামাই দত্তক নিচ্ছে জাপানের বিলিয়নিয়ার পরিবারগুলো
জাপানে প্রাপ্তবয়স্কদেরকে দত্তক নেওয়া একটি কমন ও বৈধ প্রথা। এটি মূলত পারিবারিক ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া এবং বংশগত ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্যই করা হয়। পাশ্চাত্যে যেখানে শিশু দত্তক গ্রহণ বেশি প্রচলিত, জাপানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদেরকেই দত্তক নেওয়া হয়।জাপান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই দত্তক গ্রহণে শীর্ষে, এবং এর ৯০ শতাংশর বেশি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। সাধারণত ২০-৩০ বছরের তরুণদেরকেই দত্তক নেওয়া হয়। এই মুকোয়োশি ট্র্যাডিশন অনুযায়ী, কন্যার শ্বশুরবাড়ির পদবি গ্রহণ করেন এবং ব্যবসা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। এদিকে কন্যাসন্তান বিয়ে হলে স্বামীর পদবী গ্রহণ করে। তাই জামাতাকে দত্তক নেওয়ার মাধ্যমে পরিবারের নাম প্রজন্ম ধরে টিকিয়ে রাখা হয়। দত্তক হওয়া ব্যক্তির বয়স অন্তত ১৫ বছর হতে হয়। বিদেশিদেরও জাপানে দত্তক নেওয়া হয়, তবে আদালতের অনুমোদন লাগে।
কফি
কফির যাত্রা শুরু হয়েছিল ইয়েমেনে। সুফি সাধকেরা রাত জেগে প্রার্থনার শক্তি পেতেন এই পানীয় থেকে। পরে সুলতান সুলেমান ইয়েমেন জয় করলে ১৫৩৮ সালে কফি চলে আসে অটোমান সাম্রাজ্যে। খুব বেশি দেরি হয়নি, পরের বছরই তা পৌঁছে যায় আজকের ইস্তাম্বুলে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে জন্ম নেয় প্রথম কাহভেহানে বা কফি হাউস। সেখান থেকে কফি ঢুকে পড়ে অটোমানদের জীবনযাত্রায়। অন্য কফির মতো এখানে শুধু গরম পানি দিয়ে ঝটপট বানানো হয় না। এই কফি তৈরি হয় ছোট ধাতব পাত্র জেজভেতে ধীরে ধীরে রান্না করে। অনেক সময় সেই জেজভে রাখা হয় গরম বালুর ওপর, যাতে আস্তে আস্তে ফুটে গাঢ় স্বাদ তৈরি হয়। ১৬৫২ সালে এক তুর্কি ব্যবসায়ীর সহায়তায় লন্ডনে খোলা হয় শহরের প্রথম কফি হাউস। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কফির সংস্কৃতি। ১৬৫২ সালে এক তুর্কি ব্যবসায়ীর সহায়তায় লন্ডনে খোলা হয় শহরের প্রথম কফি হাউস। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কফির সংস্কৃতি।
সুখী সমাজ
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ যতটা ভেবেছিল, বাস্তবে দুই গুণ বেশি অপরিচিত ব্যক্তিরা ফিরিয়ে দিয়েছে হারানো মানিব্যাগ। গবেষকেরা বলেন, ‘আপনি যদি মনে করেন, আপনার চারপাশের মানুষ সহানুভূতিশীল, আপনি তখনই সবচেয়ে সুখী।’ শক্তিশালী সামাজিক সহায়তার সংস্কৃতি সুখ শুধু সম্পদের ওপর নির্ভর করে না; বরং বিশ্বাস, সহমর্মিতা, মানসিক স্বাস্থ্য, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক, সামাজিক নিরাপত্তা ও খোলামেলা সংস্কৃতি—এই সবকিছুর সম্মিলনেই জন্ম নেয় একটি সুখী সমাজ।
দেশটির চতুর্থ রাজা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক ‘মোট জাতীয় সুখ’ ধারণা তৈরি করেছিলেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো—ভুটানে মানুষকে শুধু অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা নয়, এর চেয়ে তাদের মানসিক শান্তি, সমাজের সুস্থতা ও পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
কারাবন্দী নারীদের হাতে থাই ম্যাসাজ
থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলীয় শহর চিয়াং মাই ঘুরতে গেলে এমনই কিছু আপনাকে অবাক করবে। সেখানে কারাবন্দী নারীদের হাতে থাই ম্যাসাজ নেওয়া যায়!চিয়াং মাই শহরের পুরোনো এলাকার রাতভিথি রোডে রয়েছে চিয়াং মাই উইমেন্স কারেকশনাল সেন্টার। এটি মূলত নারীদের কারাগার। সেখানকার নারী বন্দীরা কোনো গুরুতর অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত নন। তাঁদের নিয়ে বিশেষভাবে চালু করা হয়েছে এই থাই ম্যাসাজ প্রোগ্রাম। ভ্রমণকারীরা চাইলে এখানে এসে ম্যাসাজ নিতে পারে।তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় পেশাদার থাই ম্যাসাজ থেরাপিস্ট হওয়ার জন্য। পুরো প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় কারাগারের নিয়ম মেনে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকে এই ম্যাসাজ সেন্টার।থাইল্যান্ডে একজন সার্টিফায়েড ম্যাসাজ থেরাপিস্ট হতে হলে প্রায় ৮০০ ঘণ্টার কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। এর মধ্যে থাকে দর্শন, অ্যানাটমি, শারীরবিদ্যা আর প্রায় ৩০০ ঘণ্টা হাতে-কলমে চর্চা। পুরো উদ্যোগটি নিয়ন্ত্রিত হয় থাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে।
থাইল্যান্ডে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক নারী বন্দী রয়েছেন। মুক্তির পর তাঁদের জন্য কাজ পাওয়াটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে অনেকে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এই বাস্তবতা বদলাতে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ডিগনিটি নেটওয়ার্ক। যেখানে নারী বন্দীরা চাকরি পান।
আমেরিকা ও ইউরোপের পর্যটকদের বকশিশ দেওয়ার অভ্যাস
সংখ্যাটি এভাবে বাড়তে থাকলে পুরো বছরে হবে ৪০ মিলিয়ন। পর্যটক বাড়ায় জাপানের নাগরিকদের কাছে কিছু বিষয় বিরক্তির কারণ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের পর্যটকদের বকশিশ দেওয়ার অভ্যাস, যা জাপানের নাগরিকেরা পছন্দ করেন না।
তাঁরা বকশিশ দেওয়ার যে অভ্যাসটি দেখান, তা মোটেও জাপানি সংস্কৃতিসম্মত নয়। প্রথমবার আসা অনেক পর্যটক জাপানের প্রথা ও রীতিনীতি নিয়ে দ্বিধায় থাকেন। জাপানের মানুষের বেশ কিছু বিশেষপ্রথমত, তাঁরা মনে করেন, ভালো পরিষেবা চাকরির অংশ। এর জন্য অতিরিক্ত অর্থ পাওয়ার দরকার নেই।’ বকশিশ দেওয়ার বিষয়টি সেই মানুষটিকে কিছুটা নিচু করে দেখাকে বোঝায়।জাপানে বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন, কারও দান বা দাতব্যের প্রয়োজন না হয়েই জীবনধারণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করা উচিত।
জাপানের ছাতা উৎসব
রোদ ঝলমলে দিনেও ছাতা নিয়ে হাঁটে জাপানের অনেক মানুষ। টোকিওর ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কিংবা কিয়োটোর প্রাচীন অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে এই দৃশ্য দেখা যাবে। বিদেশি হিসেবে আপনার চোখে বিষয়টি অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু জাপানের মানুষদের কাছে এটি যে শুধু রোদ বা বৃষ্টি থেকে বাঁচার কৌশল, তা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার একাগ্রতা।জাপানি ঐতিহ্যে ছাতাকে ধরা হয় ইওরিশিরো, মানে এমন এক বিশেষ বস্তু; যেখানে দেবতা বা আত্মা এসে অবস্থান করতে পারে। সহজভাবে বললে, ইওরিশিরো হলো আত্মা বা দেবতার জন্য একধরনের ‘অস্থায়ী আসন’। তাই প্রাচীনকাল থেকে ছাতা জাপানিদের কাছে আধ্যাত্মিকতার প্রতীক।কিয়োটোর ইয়াসুরাই মাতসুরি উৎসব: প্রতিবছর এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয় এই প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এখানে অংশগ্রহণকারীরা ফুলে সাজানো ছাতা হাতে অংশ নেন। বিশ্বাস করা হয়, এই বিশেষ ছাতাগুলো মানুষের শরীর থেকে রোগব্যাধি শোষণ করে নিয়ে যায়। এসব ছাতার নিচে দাঁড়ালে সুস্থতা ফিরে আসে।
ফুকুওকার হাকাতা দন্তাকু উৎসব: ৩ থেকে ৪ মে রং আর আনন্দের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে ফুকুওকা। এ সময় শহরের রাস্তায় নেমে আসে বিশাল আকারের বর্ণিল ছাতা কাসাবোকো। স্থানীয় লোকদের বিশ্বাস, এই ছাতার নিচ দিয়ে হাঁটতে পারলে সুস্বাস্থ্য ও সৌভাগ্য—দুটোই মেলে। তাই শোভাযাত্রার সময় ভিড় ঠেলে অনেকে চেষ্টা করে অন্তত একবার হলেও এর ছায়ায় দাঁড়াতে।
কোচি প্রিফেকচারের ওকিনোশিমা দ্বীপে ওবন উৎসব: প্রতিবছরের ১৩ থেকে ১৬ আগস্ট জাপানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠান এটি। এ সময় স্থানীয় লোকেরা সদ্য প্রয়াত মানুষের আত্মার স্মরণে রঙিন ও সজ্জিত ছাতার বড় বড় কাঠামো তৈরি করেন; বিশেষ করে, দুই বছর পরপর ১৬ আগস্ট রাতে এই ছাতার কাঠামোগুলো নিয়ে নৃত্যানুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠান আত্মাদের নিরাপদে আত্মিক জগতে ফিরে যাওয়ার প্রতীক। উৎসবটি একদিকে শোকের, অন্যদিকে পুনর্জন্ম ও শান্তির বার্তা দেয়।
শেফরা কেন এমন লম্বা টুপি পরেন?
রান্নার সময় যেন চুল বা ঘাম খাবারে না পড়ে, সে জন্য এই টুপি ব্যবহৃত হয়। তবে এখানেই শেষ নয়। টুপির উচ্চতা, ডিজাইন ও রং একজন শেফের অভিজ্ঞতা, দায়িত্ব ও অবস্থানও নির্দেশ করে। অনেক রেস্টুরেন্টে শুধু হেড শেফ ও স্যু শেফ উঁচু টুপি পরেন। রান্নাঘরে কে কতটা সিনিয়র, তা সহজে বুঝে নেওয়া যায় টুপির উচ্চতা দেখে।
খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে অ্যাসিরীয় রাজা আশুরবানিপাল তাঁর রান্নার লোকদের আলাদা টুপি পরতে বাধ্য করেছিলেন। কারণ ছিল, যেন পাচকদের সহজে চেনা যায় এবং কেউ রাজাকে বিষ খেয়ে পার পেয়ে যেতে না পারে। এমনকি ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি অষ্টম একবার খাবারে চুল পেয়ে শেফের শিরশ্ছেদ করেছিলেন। এরপর থেকে শেফরা টুপি পরা শুরু করেন আরও নিয়মতান্ত্রিকভাবে। আধুনিককালে উঁচু টুপির প্রচলন শুরু করেন ফ্রান্সের কিংবদন্তি শেফ মারি আন্তোয়ান ক্যারেম। তিনি রান্নাঘরকে সেনাবাহিনীর মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এর প্রতিফলন পড়ে ইউনিফর্মেও। সাদা রং পবিত্রতা আর পরিচ্ছন্নতার প্রতীক। টুপিতে সামান্য দাগও স্পষ্ট দেখা যায়, তাই শেফরা সব সময় সচেতন থাকেন পরিপাটি থাকার ব্যাপারে। তবে এখন অনেক কিচেনে কালো বা গাঢ় রঙের টুপিও দেখা যায়; বিশেষ করে খোলা রান্নাঘরে, যাতে দাগ সহজে লুকানো যায়।
বরাদ্দের ৬৭ শতাংশ চলে যায় শুধু দুইটা হাসপাতালে
৯২ শতাংশ মানুষ মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা নেয় না আমাদের টোটাল হেলথ বাজেটের দশমিক ৪৪ শতাংশ মেন্টাল হেলথের জন্য বরাদ্দ। এই বরাদ্দের আবার ৬৭ শতাংশ চলে যায় শুধু দুইটা হাসপাতালে। একটা পাবনা মেন্টাল হসপিটাল, আরেকটা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। বাকি ৩৩ ভাগ যাচ্ছে প্রাইমারি হেলথ কেয়ারে, ডিসট্রিক্ট হাসপাতালে, অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজে। আমাদের জেলা সদর হাসপাতালে কোন সাইকিয়াট্রিস্ট নাই। আমরা তথাকথিত শিক্ষিত হয়েও সচেতন না। দুনিয়া থেকে আমরা অনেক পেছনে পরে আছি।
খাবারে অতিরিক্ত লবণ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্করা প্রতিদিন গড়ে নয় গ্রাম লবণ গ্রহণ করছেন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত দৈনিক পাঁচ গ্রামের প্রায় দ্বিগুণ। এই প্রবণতা প্রতিবছর কেড়ে নিচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার জীবন।প্রক্রিয়াজাত খাবারকে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে নোনতা না লাগলেও এসব খাবারে লুকানো থাকে প্রচুর পরিমাণে লবণ, যা নীরবে হৃদরোগসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের মহামারি ডেকে আনছে।জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিবছর ১২ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব লবণ সচেতনতা সপ্তাহ’ পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য: ‘অতিরিক্ত লবণ বর্জন করি, সুস্থ জীবন গড়ি। ’
সিসা দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হলুদ
সিসা একটি বিষাক্ত ভারী ধাতু, যা নীরবে লাখ লাখ মানুষের, বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে চলেছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে সিসা দূষণে আক্রান্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে, যেখানে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু রক্তে উচ্চ মাত্রার সীসা নিয়ে জীবনধারণ করছে। সীসা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। এর ফলে বুদ্ধিমত্তা ও শেখার ক্ষমতা কমে যায়
আমরা নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে বাতাস নিই, যে খাবার খাই, দূষিত মাটি বা ধূলিকণা স্পর্শ করি এবং এমনকি গর্ভাবস্থায় মায়ের প্লাসেন্টা থেকেও সিসা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। গর্ভবতী নারীদের রক্তে সিসা দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হলুদ ।
সিসা দূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সিসা ও ব্যাটারি-সম্পর্কিত শিল্প-কারখানা, সিসাযুক্ত রঙ এবং প্রসাধনী ও রান্নার পাত্রের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সিসা-নির্ভর শিল্প স্থাপনা, যেমন সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি বানানো বা রিসাইক্লিং করার কারখানা বা স্থাপনা, অথবা যেসব কারখানা বা স্থাপনায় সিসা গলানো বা পোড়ানো হয়, এগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কারণ, এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরিয়ে নিলে বা দূষণ কমানোর ব্যবস্থা নিলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শিশুদের সিসা দূষণ থেকে বাঁচানো সম্ভব।
আপনি কি কোলবালিশ নিয়ে ঘুমান? আপনার জন্য ৪টি সুসংবাদ
যখন আপনি গভীর ঘুমে থাকেন, তখন শরীরের প্রতিটি কোষ নতুন শক্তি পায়।
ভালো ঘুম মানে-
* স্ট্রেস হরমোন (করটিসল) কমে যায়
* হৃৎস্পন্দন ও রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়
* ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়
* সকালে ঘুম ভাঙে সতেজ, হাসিখুশি মনে
ফলে, দীর্ঘ মেয়াদে সুস্থ শরীর, প্রশান্ত মন আর এটাই দীর্ঘ জীবনের গোপন রহস্য।
হাগিং পিলো বা কাডেল পিলো কী?
এটি এমন একধরনের বালিশ, যেটি ঘুমের সময় বুকের কাছে বা শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে রাখা হয়। বালিশটি দেয় এক ধরনের উষ্ণতা ও নিরাপত্তার অনুভূতি, যা শরীর ও মন - দুইকেই শান্ত করে।
একাকিত্ব বা উদ্বেগে ভোগা মানুষদের জন্য এটি সত্যিই আশ্চর্য কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমালে শরীরে ডোপামিন নামে এক প্রশান্তিদায়ক হরমোন নিঃসৃত হয়। যা আপনাকে দেয় মিষ্টি ঘুম আর হালকা সুখের অনুভূতি।
কেন ব্যবহার করবেন হাগিং পিলো?
* এটি শরীরের ভঙ্গি (posture) ভালো রাখে
* ঘাড় ও পিঠের ব্যথা কমায়
* শরীরের চাপের জায়গাগুলোতে ভারসাম্য আনে। ফলে রক্ত চলাচল ভালো হয়
* পাশ ফিরে ঘুমানো মানুষদের জন্য এটি একদম আদর্শ অনুষঙ্গ। হাত-পা অবশ হয়ে যায় না
* বুকে বালিশ রাখলে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকে এবং নাক ডাকার প্রবণতাও কমে
আর সবচেয়ে বড় সুবিধা? আপনি একা নন, সেই অনুভূতিটাই দেয় এই ছোট্ট বালিশটি।
বিশেষভাবে উপকারী গর্ভবতী নারীদের জন্য
গর্ভাবস্থায় বিশেষ ধরনের হাগিং পিলো ব্যবহার করলে পেট, কোমর ও পিঠে অতিরিক্ত সাপোর্ট পাওয়া যায়। ফলে ঘুম হয় আরামদায়ক, ব্যথা কমে, আর সকালে ক্লান্তি থাকে না।
বাজারে জনপ্রিয় কিছু হাগিং পিলো
স্নুগান পিলো:
অ্যান্টি-অ্যালার্জেন মাইক্রোফাইবার ভর্তি এই বালিশ ঘাড়ের সাপোর্টের জন্য দারুণ। উচ্চতা নিজে থেকে ঠিক করা যায়, তাই আরামও নিজের মতো করে পাওয়া যায়।
ক্লাউড পিলো:
নরম, তুলার মতো হালকা অনুভূতি। যারা নরম ফোলানো বালিশ পছন্দ করেন, তাদের জন্য একদম পারফেক্ট।
ক্লাউড পিলো:
শ্রেডেড মেমরি ফোম দিয়ে তৈরি এই বালিশ মাথা ও ঘাড়ের আকৃতি অনুযায়ী মানিয়ে নেয়, ফলে ঘুমের সময় শরীরের প্রাকৃতিক বাঁক ঠিক থাকে। যারা নানা ধরনের ব্যথায় আক্রান্ত তারা এই ধরনের বালিশ ব্যবহার করতে পারেন।
ঘুম শুধু শরীরের বিশ্রামের সময় নয়। এটি মন ও আত্মার রিসেট বোতাম। তাই ঘুমের অনুষঙ্গগুলোও বেশ জরুরি, যেমন হাগিং পিলো জড়িয়ে ঘুমানো, এনে দিতে পারে প্রশান্তি। তাই আজ থেকেই নিজের ঘুমকে দিন একটু ভালোবাসা। কারণ, আরামদায়ক ঘুম মানেই দীর্ঘ জীবনের শুরু।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
টুপিওয়ালা উঁচু মাথাটি যেন এক হারিয়ে যাওয়া পর্বতের স্মৃতি’ কবি আল মাহমুদের বিখ্যাত কবিতার লাইন। এই টুপিওয়ালা উঁচু মাথাটি আফ্রো-এশিয়ার নিপীড়িত মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মহান মানুষটি চিরতরে পরপারে পাড়ি জমান। বিংশ শতকে ব্রিটিশবিরোধী গণ-আন্দোলনের নায়ক, ১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির অন্যতম নেতা; ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা—সেই মানুষটি
সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, মওলানা ট্রেনে সফরসঙ্গীদের নিয়ে রওনা হন চট্টগ্রামের উদ্দেশে। তাঁর সঙ্গে একই কম্পার্টমেন্টে ছিলেন আবদুল হক, ডা. টি. আলী প্রমুখ। আখাউড়া জংশনে ট্রেন বদল করতে হবে। আখাউড়ার ন্যাপ নেতাকর্মীদের সংবাদ দেওয়া হয়েছিল, মওলানা সেখানে ট্রেন বদলাবেন। ওখানকার দুয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁর লাগেজ ঠিকমতো চট্টগ্রামের ট্রেনে তোলার। মওলানা স্টেশনে নেমে রেলওয়ের কর্মচারী ও জনতার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে দ্রুত গিয়ে চট্টগ্রামমুখী ট্রেনে ওঠেন। একজন দলীয় কর্মী একটি ছোট বালিশ নিয়ে তাঁর পিছে পিছে কম্পার্টমেন্টে ঢুকেন। এর মধ্যে আখাউড়ার যাদের ওপর মওলানার লাগেজ চট্টগ্রামের ট্রেনে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তারা হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ওই ট্রেনের কামরায় হুজুরের লাগেজ পাওয়া যাচ্ছে না। মওলানার এক সহচর বললেন, কিসের লাগেজ? ‘হুজুরের জিনিসপত্র। ব্যাগট্যাগ।’ সহচর বালিশটি দেখিয়ে বললেন, হুজুরের সঙ্গে তো শুধু এই বালিশ আর একটা গামছা। ওনার একটা লুঙ্গি আমার কাপড়ের ব্যাগটায় আছে। আর তো কোনো জিনিস নাই। এইগুলোই তো লাগেজ। কর্মীরা লজ্জিত ও বিস্মিত হয়ে দ্রুত ট্রেনের কামরা থেকে নেমে যান (মওলানার লাগেজ কোথায়, সৈয়দ আবুল মকসুদ)।
একবার মাদ্রাসা থেকে ডিগ্রি প্রাপ্ত একজন মওলানা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর, আপনিও মওলানা, আমরাও মওলানা; আমাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? তিনি মুহূর্তের মধ্যে বললেন, ‘তোমরা সেই মওলানা যারা দূরে শয়তান দেখলে ‘লা হাওলা ওলা’ পড়, আমরা সেই মওলানা যারা শয়তানকে আগে কাছে ডাকি তারপর শয়তানের ঘাড়ের ওপর সওয়ার হয়ে শয়তানকে দিয়ে আমাদের কাজ করায়ে নেই।’
আবদুল হামিদ খান যে গ্রামে বাস করতেন সে গ্রামের নাম ছিল ভাসানের চর। দশ সহস্রাধিক অধিবাসী সংবলিত এ গ্রামের সবাই ছিলেন মওলানার ভক্ত-মুরীদান। গ্রামবাসী দিন দিন মওলানা সাহেবের সুনাম, যশ ও ব্যাপক পরিচিতি লক্ষ করে গর্বিত হতে থাকে, কারণ মওলানা তাদের গ্রামের বাসিন্দা। এরপরে ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ি জেলার ভাসান চরে এক কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন গ্রামের সবাই মিলে মওলানাকে ধরে বসেন এই বলে যে, তার নামের সঙ্গে গ্রামের নামটি জুড়ে দিতে হবে। তখন থেকে তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয়ে যায় ‘ভাসানী’ (জানা অজানা মওলানা ভাসানী, আবদুল হাই শিকদার)।
রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি মাওপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর অনুসারীদের অনেকে এজন্য তাঁকে ‘লাল মওলানা’ নামে ডাকতেন। তিনি একদিকে কমিউনিস্টদের সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন; অন্যদিকে নিজের ঈমান-আকিদার সঙ্গে একতিলও আপস করেননি।
১৯৪৭ সালে মওলানা ভাসানী আসাম থেকে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার পর প্রথম সবচেয়ে বড় জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে। তৎকালীন সরকার সেই জনসভা পণ্ড করে দেওয়ার পদক্ষেপ নেয়। সরকারের পদক্ষেপের অংশ হিসেবে জনতার ভেতর থেকে একদল লোক হৈ চৈ শুরু করে। তখন সভাপতির আসন থেকে উঠে এসে মওলানা ভাসানী মাইকের সামনে দাঁড়ান। বলেন, ভাইয়ো, সরকার আমাদের সভা পণ্ড করতে চায়। এ অবস্থায় আমরা সভা করব না। আপনারা শান্ত হয়ে যার যার জায়গায় দাঁড়ান। আমরা আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানিয়ে মোনাজাতের মাধ্যমে সভা শেষ করব। এই কথা বলেই মওলানা ‘আল্লাহুম্মা আমিন’ বলে মোনাজাত শুরু করলেন। সভার সব শ্রোতাও হাত তুলে ‘আল্লাহুম্মা আমিন’ বলে দাঁড়িয়ে যায়। মোনাজাতকারীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ হিন্দু এবং কমিউনিস্ট ছিল। মওলানা আরবিতে দুয়েকটি মোনাজাতের দোয়া পাঠ করেই বলতে থাকেন: ‘হে দীন দুনিয়ার মালিক পরওয়ারদেগার, জালেমের অত্যাচার থেকে তুমি মজলুমকে রক্ষা করো।’ মোনাজাতে পরকালের কোনো কথা ছিল না। ছিল সরকারের অন্যায়-অবিচার ও জুলুমের কথা। তা থেকে মুক্তির জন্য জেহাদ ঘোষণার কথা। মাঝে মাঝেই শ্রোতা-মোনাজাতকারীরা ‘আল্লাহুম্মা আমিন’ বলতে থাকেন। কিন্তু মোনাজাত আর শেষ হয় না। মোনাজাতের মধ্যেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পটভূমি ও ইতিহাস বর্ণনা করা হয়। পাকিস্তানের দুই বছরের অন্যায়-অত্যাচারের বর্ণনা দেওয়া হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইসলামের শিক্ষা—তাও বলা হয়। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে মোনাজাত চলে। সমাবেশে তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতায় মওলানা যা বলতেন, মোনাজাতে সে কথাগুলোই বললেন। মোনাজাতে গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশের বিশেষ শাখার লোকেরা হাত তুলে অংশ নেওয়ায় সেদিন তারাও ভাসানীর ‘বক্তৃতা’র কোনো নোট নিতে পারেননি (ভাসানী কাহিনী: এক ঘণ্টার মোনাজাত, সৈয়দ আবুল মকসুদ)।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় এক জনসভায় খাজা নাজিমউদ্দিন মওলানা ভাসানীকে ‘ভারতের চর’ আখ্যায়িত করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে ঘোষণা দেন। খাজা নাজিমউদ্দিনের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ৪০ সদস্যবিশিষ্ট সেই কমিটির এক নম্বর সদস্য ছিলেন মওলানা ভাসানী। তিনি ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সফরে ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণ ও ছাত্রহত্যার খবর জেনেই ঢাকায় চলে আসেন এবং পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনের প্রধান সমর্থক সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ লিখেছে, ‘মেডিকেল কলেজের সম্মুখে লক্ষ লোকের একটি গায়েবি জানাজায় নেতৃত্ব দেন ভাসানী।’ এভাবেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন মওলানা।
তিনি ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ভাষার অধিকার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম? ব্রিটিশ গর্ভনেমেন্টের গোলামী করি নাই। ন্যায়সংগত অধিকারের জন্য চিরকাল লড়াই করেছি, আজও করব’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র: প্রথম খণ্ড)। পকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোন জননায়কের এটাই প্রথম চ্যালেঞ্জ। ১৯৫৭ সালের ‘কাগমারী সম্মেলন’-এ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বাধীনতা-স্বাধিকারের কথা বলেছিলেন। তখন তিনি পাকিস্তানের প্রতি বিদায়ী বচন ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেছিলেন। সুবিশাল জনসভায় বলেছিলেন, ‘যদি পূর্ব বাংলায় তোমরা তোমাদের শোষণ চালিয়ে যাও, যদি পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার স্বীকৃত না হয়—তাহলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, তোমরা আমাদের কাছ থেকে একটি কথাই শুনে রাখ, আসসালামু আলাইকুম, তুমি তোমার পথে যাও, আমরা আমাদের পথে যাবো’ (কিশোর মওলানা ভাসানী, আবদুল হাই শিকদার)। এ কারণে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, কাগমারী সম্মেলনে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বীজমন্ত্র নিহিত ছিল।
১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে শুরু হওয়া গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে বন্দি অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গুলি করে হত্যা করা হলে পরদিন মওলানা ভাসানী পল্টনের বিশাল এক জনসভার ডাক দেন। তিনি সেখানে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, ‘দুমাসের মধ্যে ১১ দফা কায়েম ও রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া না হলে ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ মওলানার এই ভাষণের পর বিক্ষুব্ধ জনতার ঢল রাস্তায় নেমে আসে এবং স্বাধিকারের দাবিতে বিদ্রোহ রচিত হয়। এমন প্রেক্ষাপটে আইয়ুব সরকার সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে আঘাত হানে সবর্কালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। এই ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারায় লক্ষ লক্ষ মানুষ। অসুস্থ শরীর নিয়ে মওলানা ভাসানী প্রলয়বিধ্বস্ত উপকূল এলাকা পরিদর্শনে যান। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি দেখে খুব মর্মাহত হন। সৈয়দ আবুল মকসুদ তার মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গ্রন্থে লিখলেন, ‘২৩ নভেম্বর তড়িঘড়ি করে ভাসানী পল্টন ময়দানে এক জনসভা করেন। জাতির ইতিহাসে সেটি ছিল এক ঐতিহাসিক জনসভা। ক্ষয়ক্ষতি বর্ণনার পরে সকলকে বিস্মিত করে তিনি সেই সভায় স্লোগান দেন: ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কবি শামসুর রহমান এর পরেই লিখলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রথম কবিতা ‘হায়, আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী’। তাঁর সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ দেশে-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মওলানা ভাসানী সন্তোষে ছিলেন। ৩ এপ্রিল সন্তোষে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করে জ্বালিয়ে দিল মওলানার মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু। ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হলে মওলানা পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে সারা বিশ্বের কাছে আকুল আবেদন জানালেন প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য।৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে কমিউনিস্ট আদর্শের অনুসারীরা ভিন্নভাবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে পরিচালনা করার জন্য তাঁকে প্রধান করে ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ করলে ৯ সেপ্টেম্বর গঠিত মুজিবনগর সরকারের ছয় সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি ছিলেন তিনি।
ফারাক্কা লং মার্চ নিয়ে আহমদ ছফা লিখলেন, ‘মওলানা সাহেবকে ১৯৭৬ সালে যখন পিজি হাসপাতাল থেকে উঠিয়ে নেয়া হয় তখন তাঁর শরীরে ছিল আগুনের মতো জ্বর। তাঁকে যখন রাজশাহী পর্যন্ত নেয়া হলো। দেখা গেল তাঁর শারীরিক অবস্থার ভয়ংকর রকম অবনতি ঘটেছে। অনেকে মনে করলেন তাঁকে নিয়ে আর টানাহেঁচড়া করা ঠিক হবে না। সকলের মধ্যে একটা দোদুল্যমান মনোভাব দেখা দিল। তাঁর শরীরের এই অবস্থা, তার ওপর তুমুল বৃষ্টি। এই ধরনের আবহাওয়ায় মওলানাকে সীমানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই সকলে গড়িমসি করছিলেন। মওলানা সাহেবকে ব্যাপারটি জানানো হলে তিনি সেই প্রকাণ্ড হুঙ্কারটি ঝেড়ে দিলেন—‘কি মনে কর মিঞা, তোমাগো শরীরে মানুষের রক্ত নি আছে! চল, সামনে চল।’ অতএব আবার লং মার্চ শুরু হল। যেতে যেতে যখন সীমান্তের নিকটবর্তী কানসাট গ্রামটিতে মিছিল এসে থামল মওলানার অবস্থা তখন সঙ্গিন। ....এ রকম সংজ্ঞালুপ্ত অবস্থায় তিনি দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে কানসাটের জনসভাটিতে বজ্র কঠোর কণ্ঠে গুরুগম্ভীর ভাষায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী জীবনের শেষ বক্তৃতাটি কিভাবে তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, লং মার্চের অংশগ্রহণকারীরা এটাকে একটা আশ্চর্য ঘটনা বলে মনে করেন। মওলানা তাঁর বক্তৃতায় বললেন, ‘গঙ্গার পানি আমাদের ন্যায্য হিস্যা, এটা আমাদের প্রাকৃতিক অধিকার, এই অধিকার মানুষের একার নয়, পশু-পাখি, গাছপালা, কীটপতঙ্গ প্রাণবান সবকিছুর একান্ত জন্মগত অধিকার। যারা এই অধিকার হরণ করছে তারা প্রাণের বিরুদ্ধে জুলুম করছে। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে এই অঞ্চলে প্রাণের বিকাশ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে চাইছে। বাংলাদেশের প্রাণবান মানুষ এই জুলুম কিছুতেই মেনে নিতে পারে না এবং ভারত জুলুমবাজি করে শেষ পর্যন্ত কোনদিনই জয়যুক্ত হতে পারে না।’ আহমদ ছফা লিখলেন, ফারাক্কা লং মার্চ স্মৃতি উদযাপনের পোস্টারটিতে জীবনের অন্তিম ভাষণদানরত মওলানার ছবিটি দেখে কেন জানি আমার তাঁকে মনে হতে থাকল, ‘তিনি একজন জলদেবতা।
মওলানা ভাসানীর আজীবন সাথী একটি মাত্র স্যুটকেস। দৈর্ঘ্য ১৬ ইঞ্চি। সম্পদ বলতে তার মধ্যে থাকে একটি গামছা, একটি লুঙ্গি, একটি খদ্দরের পাঞ্জাবি, মাথার একটি টুপি, কিছুটা তামাক পাতা আর চুনের একটা ডিবা। এই নিয়েই তিনি গেছেন ইউরোপ সফরে। ইউরোপে ভাসানীর স্বল্প সময়ের যাত্রার ঘটনাবহুল দিনগুলো নিয়ে লেখা বই ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’। সারা বইজুড়ে পাকিস্তানের তৎকালীন সরকারের স্বরূপ জনগণের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। এই বইকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার দুবার নিষিদ্ধ করে। আইয়ুব খানের সময় ১৯৫৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের জন্য লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে জরিমানাসহ সাজা দেয়। ১৯৬৫ সালে আবার নিষিদ্ধ করা হয় এই বই।
স্বাধীনতাপূর্ব এবং স্বাধীন বাংলাদেশে এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রশ্নে সবচেয়ে সোচ্চার মানুষটি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।আজকের নতুন বাংলাদেশে ভীষণ প্রয়োজন আর একজন ভাসানী। যিনি দুর্দিনে, প্রতিবেশী শক্তির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকাণ্ড হুঙ্কার দিয়ে গর্জে উঠবেন—গড়ে তুলবেন নতুন বাংলাদেশ। যাঁর সাথে আপস’ বা ওই জাতীয় শব্দের সাথে কখনো দেখা হবে না।
সরকারি চাকরি
দেশে দুই ধরনের চাকরির সীমিত সুযোগ রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি। সরকারি চাকরির বাজার সীমিত থাকায় সবার ভাগ্যে সরকারি চাকরি জোটে না। বাধ্য হয়ে অনেকেই তখন বেসরকারি চাকরির দিকে ঝোঁকে। আবার অনেকেই চেষ্টা করে স্বকর্মে নিয়োজিত হতে।বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যারা সরকারি চাকরি পান তারা অনেক ভাগ্যবান। কারণ সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা অন্য চাকরির চেয়ে আলাদা। আবার চাকরির শেষে থাকে আজীবন পেনশন সুবিধা। কিন্তু যারা বেসরকারি চাকরি করেন তাদের অনেক ক্ষেত্রে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির থাকলেও সর্বক্ষেত্রে এ সুবিধাটা নেই। দীর্ঘদিনের দাবির মুখে সব পর্যায়ের মানুষের জন্য পেনশন সুবিধার কথা বলে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৮-৫০ বছর বয়সী যেকোনো বাংলাদেশী নাগরিকের জন্য স্বেচ্ছায় সর্বজনীন ব্যবস্থার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করে এ সুবিধা নিতে পারেন। পেনশন পেতে হলে একজন নাগরিককে কমপক্ষে ১০ বছরের জন্য নিজে টাকা জমা করে অবদান রাখতে হবে। এ সুবিধা পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক, অর্থাৎ নিজে যে পরিমাণ টাকা জমা করবেন তার লাভসহ আপনি পরবর্তী ১০ বছরের জন্য নির্দিষ্ট হারে পেনশন পেতে পারেন। ভবিষ্যতে এ পেনশন সবার জন্য বাধ্যতামূলক হবে। সরকার পরিচালিত জাতীয় পেনশন স্কিমে সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৮৭ জন রেজিস্ট্রি করেছেন এবং এতে সবচেয়ে বেশি রেজিস্ট্রেশন সমতায়—২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৪ জন। কারণ সমতায় সরকার টাকা দিচ্ছে। উল্লেখ্য সরকার প্রচলিত চার ধরনের পেনশন স্কিম চালু রয়েছে—প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা।সবার জন্য পেনশন সুবিধা চালুর একটা ভিত্তি হতে পারে—নিয়মিত করদাতাদের জন্য তাদের প্রদত্ত করের টাকায় পেনশন সুবিধা চালু করা। এটা করদাতাদের অধিকার। আমার করের টাকায় যাদের বেতন হয়, তারা আমার করের টাকাতেই পেনশন নেবেন। কিন্তু আমি করও দেব, নিজের পেনশনের জন্য টাকাও দেব, তা কী করে হয়?
গভর্নমেন্ট ফেইলিউর অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’। সেখানে লেখকরা দেখিয়েছেন, উন্নত বিশ্বে যেখানে কর থেকে সরকার মানুষকে পেনশন দেয় তারা বেশ সফল। যারা বেসরকারি চাকরি বা স্বকর্মে নিয়োজিত থাকেন তাদের জন্য কর্মজীবন শেষে সরকারি চাকরিজীবীদের মতো পেনশন সুবিধা থাকে না। তাদের জন্য সরকারের তরফ থেকে কর প্রদানের হার বা মোট কর প্রদানের হিসাবে অবসরকালীন সময়ে আজীবন পেনশন সুবিধা চালু করা হোক। বিভিন্ন উন্নত দেশে এ সুবিধা চালু রয়েছে। ফলে মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কর প্রদান করে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতির আওতায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৪ শতাংশ কর্মক্ষম লোক। গ্রাহকের কর ও ট্রাস্ট ফান্ডে জমা হওয়া অর্থ বিনিয়োগের মুনাফা থেকে এ পেনশন দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে বছরে চারবার ১ হাজার ৪১০ ডলার করে জমা অর্থাৎ ১০ বছরে ৫৬ হাজার ৬০০ ডলার জমা হলেই পেনশনের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করা যায়। একই পদ্ধতি অনুসরণ করে আমাদের দেশের করদাতাদের জন্য এই পেনশন ব্যবস্থা চালু করলে করের মাধ্যমে সরকারের আয় বৃদ্ধি পাবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। সামাজিক নিরাপত্তা ও কর প্রদানে উৎসাহিত করার জন্য নিয়মিত করদাতা এবং অন্যান্য বেসরকারি কর্মে নিয়োজিতদের জন্য পেনশন সুবিধা চালুর জোর দাবি জানাচ্ছি।
মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতেও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলার ভেলায় যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে। শহরের সঙ্গে সঙ্গে মফস্সলে ও গ্রামেও অভ্যুত্থানের পক্ষে জাগরণ দেখা গেছে। মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম বাঁচিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৫৪ বছরে একজন সরকারপ্রধানও কি গ্রামবাসীদের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন? চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের প্রধান কর্মসূচি ছিল ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ। ফ্যাসিবাদ হলো হিংসা-বিদ্বেষমূলক, বৈচিত্র্যময় স্ব–ব্যক্তিস্বাধীনতাবিরোধী অসহিষ্ণু ভাবনাকে বৈধতা দানকারী এমন চেতনা।
মুসোলিনি ও হিটলার মনে করতেন, নারীর কাজ গৃহে। বড়জোর চিকিৎসক ও শিক্ষকতার পেশায়।হিটলার মেয়েদের ঘরে ফেরাতে করলেন ‘বেকারত্ব প্রতিরোধ আইন’। যে মেয়েটি কাজ থেকে সরে এসে গৃহিণী হতে রাজি থাকতে, তাকে সুদহীন ঋণ দেওয়া হলো। প্রতিটি সন্তানের জন্য চার ভাগের এক ভাগ মকুব করা হলো। নারী-পুরুষের বিয়ের বয়স কমানো হলো। ইতালিতে মুসোলিনি চার্চের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ করলেন।
কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণ কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে আলাপ নেই, কৃষি সংস্কার কমিশন নেই। জেলা-উপজেলার সংস্কৃতিকর্মীদের মহড়ার ঘর নেই, উপস্থাপনের মঞ্চ নেই। শহরাঞ্চলে প্রতি ৫৫০ জনে একজন চিকিৎসক আর গ্রামাঞ্চলে প্রতি ৯ হাজার ৯০ জনে একজন ডাক্তার। এই চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে কথা কোথায়?
মাওলানা ভাসানী তাঁর ‘মাও সে-তুঙ এর দেশে’ বইতে লিখেছেন, ‘মাও সে-তুঙ–এর দেশে আমাকে সব থেকে মুগ্ধ করেছে কী—এ প্রশ্ন —হাসি। হ্যাঁ, হাসিই আমায় সব থেকে বেশি মুগ্ধ করেছে। চীনের মানুষ আজ হাসতে পারে।...আমরা কি হাসির উৎসের সন্ধান পাবো না?’ —একটা জাতি হাসবে কীভাবে? অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার জায়গাটা যখন নিশ্চিত হবে,
কোথায় যেন দেখেছি’ নামের একটি বাংলা চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। পরিচালক নিজামুল হক। সেই ছবিতে তাঁরই লেখা ও সুরারোপিত ‘রিকশাওয়ালা বলে কারে তুমি আজ ঘৃণা করো...’ গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়। এতটাই জনপ্রিয় যে এ গানের শিল্পী খন্দকার ফারুক আহমদকে পল্টনের এক জনসভায় সোনার মেডেল পরিয়ে দিয়েছিলেন জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।১৯৭০ সালে গাওয়া একটি গানের কথার বাস্তবতার সঙ্গে এতকাল পরও একজন রিকশাচালকের জীবনের বিশেষ পরিবর্তন না হলে উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধির মতো শব্দগুলো আর কোনো অর্থ বহন করে না।
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলে আবদ্ধ।’ ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ-জ্যাক রুশো তাঁর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বইটি এই উক্তি দিয়ে শুরু করেন। এখানে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সমাজ ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলার সঙ্গে মিলেমিশে টিকে থাকতে পারে। সিমোন দ্য বোভোয়ারের তাঁর সেকেন্ড সেক্স গ্রন্থে বলেন, ‘নারী জন্মগতভাবে হয় না, বরং সমাজ তাকে নারীতে পরিণত করে।’ এর মানে হলো—জৈবিক লিঙ্গ ও সামাজিক লিঙ্গ এক নয়। অর্থাৎ সমাজ জন্মের পর থেকেই নারীদের ওপর বিভিন্ন ভূমিকা, সীমাবদ্ধতা ও প্রত্যাশা আরোপ করে এবং তাদের একটি বিশেষ ‘নারীত্বের’ ছাঁচে গড়ে তোলে।স্বাধীন পুরুষ ‘নারীদের ওপর বিভিন্ন ভূমিকা, সীমাবদ্ধতা ও প্রত্যাশা আরোপ করেছে এবং তাদের একটি বিশেষ নারীত্বের ছাঁচে গড়ে তুলেছে।’ যখনই নারী সেই ছাঁচ ভাঙতে চেয়েছেন, তখনই পুরুষ তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।একবিংশ শতাব্দীতে এসেও পুরুষের কাছে, সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে নারীকে তাঁর স্বাধীনতার জন্য দেনদরবার করতে হয়। ‘আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও ইতিহাস দারুণ বৈচিত্র্যময় ও সংবেদনশীল। সেই বিশালতাকে উপেক্ষা করে আমরা গুটিকয় মানুষের সংকীর্ণ ব্যাখ্যাকে সর্বজনীন হতে দেব না। আমরা অধিকার ও ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে দেব না, যে ক্ষমতাকাঠামো এসব জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, আমরা সেই কাঠামোকে ভাঙব।’ ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নারীরা হাল ছাড়বেন না, মনোজাগতিক পরিবর্তনের সর্বাত্মক আন্দোলনের, বিপ্লবের। যে আন্দোলনে নারী, পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে শুধু নারীর জন্য নয়—সবার জন্য।
আর একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, পুরুষ নারীর প্রতিপক্ষ নয়। পুরুষের স্বার্থ ও নারীর স্বার্থ—একে অপরের পরিপূরক। পুরুষের নিজের স্বার্থেই নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে আমার দাঁড়ানো দরকার। একটি দেশের মোটামুটি ৫০ শতাংশই নারী থাকেন। ক্ষমতায়নের একটি প্রধান উপাদান হলো, লেবারফোর্স পার্টিসিপেশন তথা কর্মে নিযুক্তি। এই হার যত বেশি হবে, দেশের উৎপাদন তত বেশি হবে। নিজের পরিবারের স্ত্রী, কন্যা বা ভগ্নির কর্মে নিযুক্তি থেকে সরাসরি যে উপকার আসবে
‘আমাদের ডান পাশে ধস
আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ
আমাদের মাথায় বোমারু বিমান
পায়ে-পায়ে বাধা আর বাধা
আমাদের পথ নেই কোনো এগুবার
ইমানুয়েল কান্ট
ইমানুয়েল কান্ট হচ্ছেন এমন একজন দার্শনিক যার দর্শন ছাড়া দর্শনশাস্ত্র অপূর্ণ। কান্টের নৈতিকতা দর্শনে চিন্তা বা বুদ্ধি বিশাল ভূমিকায় থাকলেও তার দর্শনের মূলে রয়েছে ইচ্ছা ও ইচ্ছার ভালোত্ব, শুদ্ধ বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা ও ব্যবহারিক বুদ্ধির বৈধতা। বহু পন্ডিত মনে করেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের পরে পাশ্চাত্য দর্শনে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও মৌলিক দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। তিনি জার্মান আইডিয়ালিজমের প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তচিন্তার প্রবক্তা।
‘ক্রিটিক অব পিউর রিজন’ তাঁর লেখা মানব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দর্শন বিষয়ক বই। এই বইয়ে, তিনি প্রথাগত দর্শন এবং অধিবিদ্যার বাইরে গিয়ে অভিজ্ঞতার সাথে যুক্তির সমন্বয় করেছেন। তার দর্শনে প্রভাবিত হয়ে দর্শনশাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন হেগেল, ফিশটে, সুপেনহার এবং শেলিং এর মতো দার্শনিকগণ। তাঁর দর্শন পাঠ না করলে দর্শনচর্চা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ।
তিনি ছিলেন চিরকুমার। তাঁর জীবন ছিল কঠোর নিয়মে বন্দী। কখন ঘুম থেকে উঠবেন, চা পান করবেন, পড়াশুনা করবেন, খাবার খাবেন, কখন বিশ্রাম করবেন, সবই ছিল তাঁর কঠোর নিয়মে বাঁধা। তাঁর কাজের লোকটির নাম ছিল ল্যাম্বে। দিনরাত সারাক্ষণ ল্যাম্বে দার্শনিকের বাড়িতে থাকতেন। কান্টকে জ্ঞানচর্চার অবকাশ দিয়ে ঘরদোরের সব কাজ ল্যাম্বে করতেন। প্রায় চার দশক তিনি কান্টের বাড়িতে ছিলেন। তিনি ছিলেন দার্শনিকের অতি বিশ্বাসভাজন। কান্ট সারা দিনে পাঁচ-দশটি বাক্যের বেশি বলতেন না। অনেক সময় তিনি যখন লিখতেন তখন ল্যাম্বে চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কান্ট আপন মনে লেখালেখি করতেন। একদিন তিনি অনুভব করেন পেছনে দাঁড়িয়ে ল্যাম্বে কেমন অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পেছনে তাকিয়ে দেখেন ল্যাম্বের চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে।
কান্ট জিজ্ঞেস করেন, তুমি এখানে কাঁদছ? কান্টের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ল্যাম্বে বললেন, আমি আপনার লেখা পড়ে কাঁদছি। কান্ট অবাক হলেন। ল্যাম্বে বলেন, ঈশ্বর আছেন কি নেই, সে সম্পর্কে আপনি লিখছেন , আমি তা মানতে পারি না। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোনো কথা আমি সহ্য করতে পারব না।
মহাজ্ঞানী কান্ট ভেবে দেখলেন, ওর সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে ওর অনুভূতিরও মূল্য রয়েছে। থাকুক ল্যাম্বে ওর বিশ্বাস নিয়ে। দুই দিন পর এক সকালে কান্ট দেখেন ল্যাম্বে সুটকেস গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঈশ্বর সম্পর্কে বাইবেল পরিপন্থী লেখায় তাঁদের ৩০-৪০ বছরের সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে। বাক্স পেটরা নিয়ে ল্যাম্বে চিরদিনের জন্য কান্টের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
তখন কান্ট ইউরোপের দর্শনের ভুবনে সম্রাট। খ্রিষ্টান ধর্মযাজকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিক উইলিয়ামের কাছে নালিশ জানান।
সম্রাট ফ্রেডরিকের মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়ে কান্টকে এক কড়া চিঠি দেয়। তারা চিঠি দেয় এই মর্মে যে ধর্ম নিয়ে কোনো কথা বলা বা লেখালেখি চলবে না। তাঁর ওই রচনা একটি অফেন্স বা অপরাধ যা হাইয়েস্ট ডিসপ্লেজার বা সর্বোচ্চ অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। ঝামেলায় জড়িয়ে জ্ঞানচর্চায় ব্যাঘাত ঘটুক বা শেষ বয়সে গর্দানটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হোক, তা একেবারেই তাঁর কাম্য ছিল না। কান্ট সম্রাটের নির্দেশের লিখিত জবাবে জানান, আমি আপনার একজন অনুগত নাগরিক হিসেবে ভবিষ্যতে আমার কোনো বক্তৃতায় বা রচনায় ধর্মীয় বিষয়ে কোনো কথা বলব না। এরপর ১০ বছর বেঁচে ছিলেন, ধর্মের ধারেকাছেও যাননি কান্ট। তবে তিনি বলেছেন, তাকে যে নামেই ডাকা হোক, এই যে নক্ষত্রখচিত রাতের মহাকাশ, এর সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই রয়েছে মহারহস্য বা কোনো এক মহাশক্তি। তিনি আরও বলেছেন; "দুইটি জিনিস সবচেয়ে বিস্মিত করে আমাকে; উপরের তারকাময় আকাশ; এবং আমার নিজের মধ্যে নৈতিকতা।"
কান্টের আমলে আজকের মতো কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মহাসত্যগুলো অজানা ছিল। আজ শক্তির ও বস্তুর ধারণা আগের মতো নেই। এই মহাশক্তি যদি আমাদের প্রচলিত ঈশ্বর হয়, আমরা যদি সেই ঈশ্বরকে পেতে চাই, তা কি কোন সম্প্রদায়ে যুক্ত হয়ে নাকি মুক্ত হয়ে ? এই বিষয়টি নিয়ে কোন ধর্মীয় পন্ডিত স্পষ্ট করে কিছু বলে না। বলে না “ঈশ্বর” এবং প্রচলিত ধর্মগ্রন্থের ঈশ্বর এক কি না।
যদিও বিজ্ঞানের সঙ্গে কিন্তু কোন ঈশ্বর বা দেবতার কোন সংঘর্ষ নেই। আসলে বিজ্ঞানের দর্শনও তা দেখে না। ফরাসি মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং দার্শনিক জাঁক লাকাঁ মানব মনের গঠনের সঙ্গে ভাষার যে স্বরূপ দেখিয়েছে সেখানে এই উপকথার সঙ্গে মানুষের মনোজগতের গঠনের বিশেষ করে আনকনসাস মাইন্ড বা অচেতন-মনের সম্পর্ক দেখিয়েছে। বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে দেখলে তাই উপকথা বা পুরাণেও নতুন আবিস্কার আমরা দেখতে পাই। বিজ্ঞানের জগতের শিশুরাও কি নতুন উপকথা শিখছে না, পড়ছে না? বিজ্ঞান কি শুধুই ইন্দ্রিয় উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ খুঁজে বেড়ায়?
দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল তাঁর ‘প্রব্লেম অব ফিলোসফি’ গ্রন্থে বহু আগেই এই ইন্দ্রিয় উপাত্তের সঙ্গে অন্য কোন কিছুর অস্ত্বিত্বের সম্পর্ক নেই তা দেখিয়েছেন, এবং বাইবেলের ঈশ্বর কে মেনে না নিয়ে লিখেছেন “ হোয়াই আই আম নট এ খ্রিশ্চিয়ান’।" সেই অর্থে একজন মানুষ ধার্মিক না হয়েও স্পিরিচুয়াল হতে পারে। মহাশক্তির ব্যাখ্যা বিজ্ঞানভিত্তিক হলে সেখানে স্পিরিচুয়ালিটিও হবে বিজ্ঞানভিত্তিক।
মুতাজিলা মতবাদ
আজকের ইসলাম ধর্ম বলতে আমরা যে সুস্পষ্ট সংজ্ঞাবন্ধ বিশ্বাস ও আচরণের ফিরিস্তি পাই, ইসলাম ধর্মে তা একদিনে গড়ে ওঠে নাই।
প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যুর পর চার খলিফা, মালিক, হনবল, হনীফা ও শাফীর মতবাদ নানা রকমের তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। সেই সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ও তাদের সমস্ত চিন্তাশক্তি এই তর্কযুদ্ধে নিয়োজিত ছিল।
কালামী সম্প্রদায় গ্রীকদর্শন দিয়ে কোরআনের বাক্য বিশ্লেষণ ও সমর্থনে নিযুক্ত হলেন। কদরী ও জবরীরা মানুষের স্বাধীনতা-পরাধীনতার কথা আলোচনা করলেন। কিরমিতরা একেশ্বরবাদকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে কাবার কালো পাথরে চুম্বন করা পৌত্তিলিকতা বলে প্রচার করলেন।
মুতাযিলারা ঈশ্বরের স্বরূপ, স্বর্গ-নরক ও কর্মফল নিয়ে তর্ক জুড়ে দিলেন। কারণ ও যুক্তি আলোচনার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হল মুতাজিলা। ৮ম থেকে ১০ শতাব্দীতে বসরা ও বাগদাদে এর প্রাধান্য বিস্তার পেল। আব্বাসীয় যুগে এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাল।
মুতাজিলা মতবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন খলিফা আল মামুন। মুতাজিলা মতবাদ চিন্তাশীল ও সংস্কৃতিমনা লোকদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়েছিল। অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তি ও বাস্তবতার ভিত্তিতে ‘মানুষের ইচ্ছা’র (Free Will) পাশাপাশি ‘মানুষের বুদ্ধি’র পক্ষেও প্রচার চালিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে ইবনে রুশদ এর নাম বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য।
ইবনে সিনা ৫ খণ্ডের চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর কানুন ফিততিব নামে বিশ্বকোষ রচনা করেন। এটি মুসলিম বিশ্বে এবং ইউরোপে ১৮ শতক পর্যন্ত প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে ব্যবহৃত হত।
আল-রাজি ছিলেন বিশ্বের প্রথম মহান চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের একজন। তাকে মনোবিজ্ঞান এবং সাইকোথেরাপির জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইউরোপ তখনও রেনেসাঁর ছোঁয়ায় সিক্ত হয়নি। এমনি সময়কালে একদিন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন কয়েকজন দার্শনিক। তারা "ইবনে রুশদ কর্তৃক ব্যাখায়িত এরিস্টটল" বিষয়ে নিজেদের পারঙ্গমতা দাবী করলেন। চমকে গেল পৃথিবী, পশ্চিমে এলো রেনেসাঁর ঝড়। নড়বড়ে হয়ে গেল চার্চের আসন, শুরু হল সেক্যুলার ইউরোপের যাত্রা।
মৌ পোকা যেমনি করে ফুল থেকে মধু আহরন করে, ঠিক তেমনি ইবনে রুশদের গ্রন্থ ভান্ডার থেকে পশ্চিম গ্রহন করতে শুরু করল এরিস্টটলীয় দর্শন।
ইবনে রুশদের মাধ্যমে ইউরোপ পায় সভ্যতার জনক এরিস্টটলের চিন্তাধারার উত্তরাধিকার। দ্রুত বিস্তৃত হতে শুরু করল এরিস্টটল এবং সাথে সাথে ইবনে রুশদের আইডিওলজি। শেষ মরণ চেষ্টায় চার্চ নিষিদ্ধ করতে চাইল রুশদের সমস্ত বই। ইউরোপিয়ান রেনেসাঁসে ইবনে রুশদের চিন্তার প্রভাব অপরিসীম।
"Ibn Rushd was a defender of Aristotelian philosophy against Ash'ari theologians led by Al-Ghazali and Ibn Rushd had a greater impact on Christian Europe: he has been described as the "founding father of secular thought in Western Europe।"
আজকের মুসলমানেরা ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, আল রাজী প্রমুখ পরোপকারী জ্ঞান সাধকদের নিয়ে গর্ব করে, ওদের নামে নানা চ্যারিটি তৈরী করে, হাসপাতাল বানায়; কিন্তু তৎকালীন রক্ষণশীল মুসলমানেরা ওই জ্ঞান সাধকদের কাফির, মুরদাত হিসেবে ঘোষণা দেয়। প্রাণের ভয়ে তাঁদের পালিয়ে বেড়াতে হয়।
ইসলামি ব্যাখ্যায় যুক্তিতর্ক (rationality) ও মানুষের বুদ্ধির (intellect/আকল) ব্যবহারকে যতোটা গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনটা আর কেউ দেয় নি।
মতবাদটি ইউরোপের স্কলাশটিসিজিম (Scholasticisim) দর্শনের সাথে অনেকেই তুলনা করেছেন। রাজনৈতিকভাবে এই মতবাদের পতন হলেও মুসলমানদের ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনচর্চায় মুতাজিলাদের প্রভাব আজ অবধি মুছে যায়নি।
ধর্মান্ধতা ও মূর্খতা এই মতবাদকে ধর্মদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বহু প্রসিদ্ধ ইসলামী চিন্তাবিদ বলেছেন এই মতবাদে এমন কিছু নেই যে তাদের মতবাদ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে যায়।
মুতাজিলা মতবাদের পক্ষে স্যার সৈয়েদ আমীর আলী তাঁর বিখ্যাত The Spirit of Islam গ্রন্থে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। এই বইতে মুতাজিলা মতবাদের পক্ষে বেশ দৃঢ়ভাবেই তিনি বলেছেন। সৈয়দ আমীর আলীর আরো একটি বই ' এ শর্ট হিষ্ট্রি অফ শ্যারাসিন ' এটি আরো বিষয় ভিত্তিক ও গঠন মুলক ইসলামের ইতিহাস সমসাময়িক আলোকপাত।
উমাইয়া যুগে মুতাজিলা অনুসারীরা এতটাই অগ্রসর হয়েছিলেন যে আল কোরআনকে গ্রীক দার্শনিক plato ও aristotle এর মতাদর্শের সাথে সমন্বয় সাধন করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন।
ঈমাম আল গাযযালি ছিলেন একজন ধর্মীয় শাস্ত্রজ্ঞ। তাঁর নেতৃত্বেই মুসলিম রক্ষণশীলতার পুনর্জাগরণ ঘটে। তিনি মুসলমানেরা অলৌকিকভাবে প্রকাশিত বিষয়কে যুক্তির উপরে এবং নিয়তিবাদকে মুক্তচিন্তার উপরে স্থান দেয়। গণিত শাস্ত্রকে ইসলামবিরোধী বলে চিহ্নিত করে, নিশ্চিত করে বিষয়টি মনে উন্মত্ততা জাগিয়ে বিশ্বাসকে দুর্বল করে দেয়।
মুতাজিলা অনুসারীদের সাথে আল গাযযালির মূল দ্বন্দ্বের জায়গাটা ছিল, যা তিনি বিশ্বাস করতেন যে শরীয়তই ইসলামের মেরুদণ্ড যার বিধান সার্বজনীন ও অলঙ্ঘনীয়।
ইমাম গাযযালি নিজেও গ্রীক দর্শন আয়ত্ত করে এর ভুল প্রমাণ চিহ্নিত করে ইসলামের দর্শন প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় রত ছিলেন।
তিনি ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে পার্থক্য দেখান এবং ধর্মকে দর্শনের উপর প্রাধান্য দেন।
আল-গাজ্জালীর প্রভাবে যে একটা প্রতিক্রিয়াশীল প্রগতি বিমুখ অবস্থার সৃষ্টি হয় তা আজ ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য।
অন্যদিকে ত্রয়োদশ শতকের আর এক সুফি সাধক জালালুদ্দিন রুমি ছিলেন উদার পন্থী একজন ফার্সি কবি, ধর্মতাত্ত্বিক এবং সুফি দর্শনের শিক্ষক। তাঁর লেখা মসনবী বা মসনবী-ই মা'নবী একটি বিখ্যাত ফার্সি সুফী কবিতা গ্রন্থ। সুফিবাদের উপর রচিত এটি সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রভাবশালী রচনার মধ্যে একটি। মসনবী ছয়টি কবিতার বইয়ের সংকলন। এই আধ্যাত্মিক ধাঁচের লেখনীটি কীভাবে ঈশ্বরের সাথে প্রেমের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় তার শিক্ষা দেয়। রুমি এতে কুরআন ও আধ্যাত্মিক জীবন সম্পর্কিত রুমির গভীর উপলব্ধির বর্ণনা করেছেন।
বহু ভাষাতেই জালালুদ্দিন রুমির সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে। আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে জালাল উদ্দিন রুমির কবিতার বই ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপক সমাদৃত ও জনপ্রিয়, এমন কী তাঁর কবিতার বই একাধিক বার বেস্ট সেলিং তালিকাতেও এসেছে।
মওলানা রুমির জন্মের ৮০০ বৎসর পুর্তি উপলক্ষে ২০০৭ সালকে ইউনেস্কো 'আন্তর্জাতিক রুমি বর্ষ' পালন করে। ফার্সি সাহিত্যের অন্য মরমী কবিদের মতো রুমিও তার রচনায় একত্ববাদ বা 'তাওহীদ'বাদকে তুলে ধরেছেন। রুমি তাঁর কবিতায় দেখিয়েছেন সংগীত এবং কবিতার মধ্যেও স্রষ্টার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সম্ভব।
ক্যানান'
ক্যানান' এর শাব্দিক অর্থ ‘নিম্নাঞ্চল। দেশটিকে জুডিয়াও বলা হতো। ক্যানানের আরেক প্রাচীন নাম ‘শ্যাম দেশ’। মিশরকে যেমন বলা হতো ‘হেম দেশ’।
মেসোপটেমিয়ার পশ্চিমপ্রান্তে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত প্রাচীন কালের ক্যানান ( Canaan) এবং পূর্বাঞ্চলীয় ভূমধ্যসাগর এলাকাকে লিভান্ত (LEVANT) বলা হতো। লিভান্ত বর্তমান মিশরের উত্তরাংশ থেকে বর্তমান তুরস্কের দক্ষিণাংশ পর্য়ন্ত বিস্তৃত। দেশের নাম ধরে ধরে বলতে গেলে দেশগুলো হলো বর্তমান ফিলিস্তিন, ইজরাইল, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, সাইপ্রাস, মিশরের উত্তরাংশ বা সিনাই উপত্যকা, তুরস্কের দক্ষিণাংশ বা আলেপ্পো প্রদেশ এবং ইরাকের দক্ষিণাং। এই দেশগুলোকে লিভ্যান্ট কান্ট্রি বলা হতো।
‘লিভান্ত'’ এর দক্ষিণাঞ্চলের নামই হলো ‘ ক্যানান’ — যা কিনা বর্তমান ফিলিস্তিন, ইজরাইল, জর্ডান, লেবাননের পূর্ব উপকূল এবং সিরিয়ার দক্ষিণাংশ অন্তর্ভূক্ত।
"প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ" এর সাথে ইতিহাসের প্রাচীন কাহিনীগুলো একসাথে করে স্পষ্টতই দেখতে পাওয়া যায়, ক্যানান ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীনতম বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। এ জনপদের অস্তিত্ত্ব যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৫ হাজার বছর আগেও খুঁজে পাওয়া যায় ।
ক্যানানে মানুষের বসবাসে কোনো সময়গত ছেদ সৃষ্টি হয়নি বা মানব বসতি স্থাপনে কোনো ধরণের ছেদ পড়েনি ।
আজ থেকে ৭ হাজার বছর আগে থেকে (খ্রীস্টপূর্ব ৫,০০০ ) লিভান্ত এ নতুন পাথরের যুগে পালেওলিথিক, নিওলিথিক আহামারিয়ান,, ক্যাবারিয়ান,ন্যাটুফিয়ান , হারিফিয়ান, গাস্সুলিয়ান সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল।
এই সময় মানুষরা শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। এবং ধারণা করা হয় এই সময় ধীরে ধীরে মাটিতে গাছ লাগিয়ে, চাষাবাদ শিখে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ হচ্ছিল। এই মানুষরা আফ্রিকা থেকে আগমনকারীদের বংশধর।
পরবর্তীতে লিভান্ত এ খ্রীস্টপূর্ব ৫,০০০ থেকে ১,০০০ খ্রীস্টাব্দে যখন ব্রোঞ্জ যুগ এর সূচনা হল তখন একাধিক গোত্রভিত্তিক নগরের উত্থান হতে শুরু করল। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধাপগুলো নব্য প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ ,ব্রোঞ্জ, লৌহ, বর্তমান যুগকে যেমন আণবিক যুগ বলে ধরা হয় ।
ধারণা করা হয় ক্যানান খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালের আগে থেকেই ছিল বিভিন্ন সেমেটিক , অসেমেটিক, তুরস্কের হিট্টাইট,সিরিয়ার মিটানি স্থায়ী, অস্থায়ী গোত্র জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল বা মিলনক্ষেত্র। মোয়াব, জেশুর,ফিলিস্তিয়া, এ্যাম্মোন, ত্যাজেকার উপকূলীয় এবং জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টি বা জনগোষ্ঠী। এরাই ছিল আজকের ইসরাইলীদের পূর্বপুরুষ। এরাই ছিল আজকের ফিলিস্তিনীদের/ প্যালেষ্টাইনীদের আদি পূর্বপুরুষ বা পূর্বজ ।
ক্যানানে বসবাসরত সকল সেমেটিক, অসেমেটিক, স্থায়ী, অস্থায়ী গোত্র/গোষ্ঠী বা লোক-সমষ্টিকে ডাকা হতো ক্যানানাইটস বা. ক্যানানের লোক। এই পর্যায়ে সকল ক্যানানাইটস ও গোত্রগুলো ছিল পৌত্তলিক—-প্রকৃতি ভীতি থেকে তারা সকলেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির পূজা করতো এবং বহু-দেবতাবাদী ও বহু-ঈশ্বরবাদী ছিল।
খ্রীস্টপূর্ব ২,৫০০ অব্দের দিকে জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টি ক্যানান এ প্রাধান্য বিস্তার শুরু করে।এই প্রাধান্য বিস্তার ও প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি ছিল এই অঞ্চলের অন্যান্য অধিবাসীদের সাথে বিশেষত: ফিলিস্তিয়াদের সংঘাতপূর্ণ। জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টির ধর্মবিশ্বাস-ভাষা-বেশভূষা-আচরণ ধীরে ধীরে ক্যানান এর অন্যান্য আদিবাসীদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। ইহুদীদের পূর্ব-পুরুষ হলো এই জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টি ও অন্যান্য ক্যানানাইটস গোত্র। ক্যানানাইটসদের ধর্মই হলো ইহুদী ধর্মের পূর্বরূপ। অর্থাৎ বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন আব্রাহামিক ধর্ম ক্যানানাইটসদের ধর্মের বিবর্তিত রূপ।
খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ সালে লিভান্ত পার্শ্ববর্তী মিশরীয় সভ্যতা ও বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়া কেন্দ্রিক ‘ হিট্টাইট সভ্যতার সংঘর্ষভূমিতে পরিণত হয়। তখন এই অঞ্চল মিশরীয়দের অধিকারে ছিল। এই সময়টাতে মিশরীয়রা ক্যানানাইটসদের দাস হিসেবে ব্যবহার করতো। মোজেসের কাহিনীর উৎপত্তিও এই সময়টাতে এবং ইহুদী ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিও এই সময়টিতে রচিত হয়।
খ্রীস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে
খ্রীস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে দিকে ক্যানান অঞ্চলের উপকূলীয় অংশে (বিশেষত: বর্তমান লেবানন, ইজরাইল-ফিলিস্তিনের উপকূল) ফিনিশীয়রা/ Phoenician প্রাধান্য বিস্তার করে। এই সময় জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টির উত্তর-পুরুষদের ইজরালাইট বলে সম্বোধন করা শুরু হয়।
ফিনিশীয়রা হলো ফিলিস্তিয়া গোত্র ও অন্যান্য সেমিটিক গোত্র বিশেষত: বর্তমান দক্ষিন আরব ও আরব-উপকূলের গোত্রগুলো এবং আশপাশের বিভিন্ন গোত্র ও সভ্যতার মানুষের মিশ্রণ। ১১৭৫ খ্রীস্টপূর্বাব্দে মিশরীয় শাসক তৃতীয় রামেসিসকে পরাজিত করে ফিনিশীয়রা তাদের পূর্বপুরুষ ফিলিস্তিয়াদের নামে একটি নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে; নগররাষ্ট্রের নাম ফিলিস্তিয়া। গ্রিকরা ফিনিশীয়দের ক্যানানাইটস বলতো। ফিনিশীয়রা দক্ষ নাবিক ছিল, এদের নিজেদের বর্ণমালা ছিল এবং সভ্যতার নানান দিকে এরা অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছিল। গ্রিকরা ফিনিশীয় বর্ণমালায় স্বরবর্র্র্র্ণ ( vowel) যোগ করে পূর্ণাঙ্গ বর্ণমালা সাজায় খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ সালের কাছাকাছি সময়ে। মিশরীয় সভ্যতা ও বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়া কেন্দ্রিক হিট্টাইট সভ্যতা তাদের প্রাচুর্য্য ও গুরুত্ব ফিনিশীয়দের কাছে হারায় এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ফিনিশীয়দের নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে।
ফিলিস্তিয়া গোত্রের সাথে ইজরালাইটদের পূর্বপুরুষ জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টির দ্বন্দ্বের কারণে খ্রীস্টপূর্ব ৫৫০ সালের কাছাকাছি পারসিয়ান ও গ্রীকদের কাছে ফিনিশীয়দের চুড়ান্ত পতন হয়।
ঐতিহাসিকভাবে ক্যানানাইটস গোত্রগুলোর ধর্মের উপাদান ভিত্তিক প্রচুর মিল থাকলেও, পরবর্তীতে ইজরালাইটদের ধর্ম ভিন্নরূপ লাভ করতে শুরু করে এবং ক্রমেই ইজরাইলাইটদের ধর্ম “ঈশ্বর ও ধর্মীয় রীতির” ক্ষেত্রে অন্য ক্যানানাইটসদের ধর্মের চেয়ে আলাদা হতে থাকে। প্যাগান ফিলিস্তিয়া ও অন্যান্য ক্যানানাইটস গোত্রগুলোর সাথে একেশ্বরবাদী ইজরালাইটদের ধর্মীয় বিরোধ সুস্পষ্ট হয়।
পরবর্তীতে, সভ্যতার দৌঁড়ে ইজরাইলাইটরা এগিয়ে যায় এবং এই অঞ্চলে তাদের ভাষা-ধর্ম-আচারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্যাগান ক্যানানাইটস ভাষা-ধর্ম-আচারও প্রচলিত ছিল। ততদিনে ইহুদী ধর্মের ভিত্তি রচিত হয়ে যায়; এবং এই অঞ্চলে দুটো ইজরালাইট রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়; খ্রীস্টপূর্ব ৯০০ সালে ইজরাইল-রাজ্য ও ৮০০ সালে জুদেয়া-রাজ্য।
খ্রীস্টপূর্ব ৭৪০ সালে অ্যাসিরীয়রা ইজরাইল রাজ্য-দখল করে। এই সময় প্রথম ইহুদীদের উচ্ছেদ হয়। অ্যাসিরীয়রা ৭৩২ খ্রীস্টপূর্বাব্দে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত ইহুদীদের তাদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করে এবং ইজরাইল রাজ্য ধ্বংস করে দেয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য অ্যাসিরীয়রা ইজরাইল-রাজ্যের শাসক ও তার গোত্র তথা ইহুদীদের শুধুমাত্র উচ্ছেদ করে, অন্যান্য ক্যানানাইটস গোত্রগুলো ছিল এই উচ্ছেদের আওতামুক্ত।
খ্রীস্টপূর্ব ৬২৭ সালে ব্যাবিলোনিয়ানরা অ্যাসিরীয়দের পরাজিত করে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ব্যাবিলোনিয়ানদের সাথে ইজিপ্টিয়ানদের রাজ্যবিস্তার নিয়ে বিরোধ ছিল। খ্রীস্টপূর্ব ৬০৯ থেকে ৬০৫ সাল পর্যন্ত ইজিপ্টিয়ানরা ব্যাবিলোনিয়ানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইহুদী রাজ্যগুলো অধিকার করে রাখে।
৬০৫ অব্দে ব্যাবিলোনিয়ানরা এই অঞ্চল পুর্নদখল করে। পরবর্তীতে ইজিপ্টিয়ান ও ব্যাবিলোনিয়ানদের মাঝে ব্যাপক যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ইজরালাইটদের (ইহুদীদের) বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাবিলোনিয়ানরা। ফলশ্রুতিতে, ৫৮৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলোনিয়ানরা জেরুজালেম ও সলোমনের মন্দির ধ্বংস করে দেয় ও পৃথিবীর ইতিহাসে “দ্বিতীয়বার” ইহুদীরা উচ্ছেদের সন্মুখীন হয়। ব্যাবিলোনীয়রা এবার শুধু ইজরালাইটদের (ইহুদীদের) নয়, পুরো দক্ষিণ লিভান্ত এর সবগুলো গোত্রকে হত্যা ও উচ্ছেদ করে।
খ্রীস্টপূর্ব ৫৪০ অব্দে পারশিয়ানরা ব্যাবিলোনিয়ানদের পরাজিত করে দক্ষিন-লিভান্ত ( ক্যানান) নিজেদের দখলভুক্ত করে।
এই সময় ইজরালাইট (ইহুদী) মন্দির পুর্ননির্মান হয় এবং ইহুদী ধর্ম ও ইজরাইলাইট পুনরুদ্ধার হয়। হিব্রু ভাষা ও ইজরালাইট ধর্ম যা বর্তমান ইহুদী ধর্মের পূর্বরূপ, পারশিয়ানদের শাসনামলে বিকশিত হয়।
৩৩০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে দক্ষিন লিভান্ত (ক্যানান) গ্রীকদের হস্তগত হয় এবং ১৪০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত গ্রীকরা এই অঞ্চল নিজেদের অধিকারে রাখে। এই সময় অঞ্চলটি গ্রীকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও আভ্যন্তরীনভাবে স্বাধীন ছিল।
১৬৭ খ্রীস্টপূর্বাব্দে গ্রীকরা ইজরালাইট ধর্মপালনে বাঁধা দেয়া শুরু করে। ফিনিশীয়দের সাথে গ্রীকদের অসংখ্য যুদ্ধ হয়ে, ফিনিশীয়ানদের পতনের মূলে গ্রীকরা অন্যতম প্রধান শক্তি ছিল।
১৪০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে জুদেয়ায় ইজরালাইটদের স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয়। এই রাজ্য শাসন করতো হ্যাসমোনিয়ান ডাইনেস্টি। এই রাজ্য ৬৩ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। এই সময়টিতেই ইজরালাইটরা রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি অগ্রসর হয়; দক্ষিন লিভান্তের (ক্যানান) অধিকাংশ অংশ ইজরালাইটদের রাজ্যভুক্ত হয়। এই সময়ে ইজরালাইটরা তাদের উন্নতি ও বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
ফিলিস্তিনিরা ইজরালাইটদের তাদের আদিনিবাস দক্ষিণ লিভান্ত থেকে বিতাড়িত করেনি। ইজরালাইটদের তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করেছে মূলত: রোমানরা। ফিলিস্তিনিরা বর্তমান ইজরাইল-ফিলিস্তিন ভূখন্ডের আদিবাসীদের বংশধর এবং ইজরালাইটরাও এই ভূখন্ডের আদিবাসীদের বংশধর।
সঙ্গত কারণেই কৌতুহল জাগতে পারে - ফিলিস্তিনিরা কারা, ওরা কিভাবে মুসলমান হলো ও তাদের ভাষা আরবী কেন?
ফিলিস্তিনিরা ঐতিহাসিক দক্ষিন লিভান্ত অঞ্চলের নানান সময়ে বসবাসকারী বিভিন্ন গোত্রের বংশধর। ফিলিস্তিনিরা ক্যানানাইটসদেরও বংশধর। ফিলিস্তিনিদের বর্তমানে ক্যানানাইট না ডেকে ফিলিস্তিনি ডাকা হয়, কারন, ১৩২ খ্রীস্টাব্দে এই অঞ্চলের শাসক রোমানরা এই অঞ্চলকে প্যালেস্টিনা এবং ইজরালাইট বাদে এর অন্যান্য অধিবাসীদের প্যালেস্টাইন বলে সম্বোধন করতো।
শাসকের ভাষা, ধর্ম ও সংষ্কৃতি প্রজারও ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়। এতে শাসকশ্রেণীর অংশ হওয়া যায়, নিরাপত্তার বিষয়টির সাথে সাথে ক্ষমতাও উপভোগ করা যায়।
৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্যালেস্টিনার ঠিক পাশেই আরব উপদ্বীপে হেজাজ অঞ্চলের মক্কা নগর রাষ্ট্রে ইসলাম নামে নতুন একটি সেমিটিক একেশ্বরবাদী ধর্মের আবির্ভাব হয়। উল্লেখ্য, আরবরাও একটি সেমিটিক জাতি। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা প্রার্থনার জন্য জেরুজালেমকে কিবলা হিসেবে ব্যবহার করত, পরে মক্কার কাবাকে কিবলা করা হয়।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দে চুক্তিভঙ্গ করায় আরব মুসলমানরা ইসরালাইট গোত্র বনু কুনাইকাকে উচ্ছেদ করে।
৬২৫ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের রাসূলকে হত্যা পরিকল্পনা করার অভিযোগ এনে আরব মুসলমানরা ইসরালাইট গোত্র বনু নাদিরকে উচ্ছেদ করে।
৬২৭ খ্রিস্টাব্দে চুক্তিভঙ্গ করার অভিযোগ এনে আরব মুসলমানরা মদিনার ইসরালাইট গোত্র বনু-কুরাইজার প্রায় এক হাজার পুরুষের শিরোচ্ছেদ এবং তাদের শিশু ও স্ত্রীদের দাস-দাসীতে পরিণত করে।
৬৩৪-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান আরবরা জেরুজালেম ও লিভান্ত জয় করে। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে আরব মুসলমানরা হেজাজ অঞ্চল (বর্তমান সৌদি আরব) থেকে খ্রিস্টান ও ইসরালাইটদের বসতি অন্যত্র সরিয়ে নেয়।
তখন জেরুজালেম খ্রিস্টানদের একটি পবিত্র শহর হিসেবে গণ্য হতো। আরবরা লিভান্ত জয়ের সময় খ্রিস্টান ও ইসরালাইটদের গণহত্যা বা উচ্ছেদের বিষয়ে কৌশলগত কারণে সংযত ছিল, লিভান্ত জয়ের সময় আরব মুসলমানরা লিভান্তের খ্রিস্টান ও ইসরালাইটদের গণহত্যা বা উচ্ছেদ করেনি কিন্তু জিজিয়া কর চালু করে।
এদিকে ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে রোমানদের দ্বারা উচ্ছেদের পর ইসরালাইটদের অধিকাংশই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে অধিকাংশ ইসরালাইট ইউরোপে আশ্রয় নেয়। ইউরোপিয়ানরা ৩৮০ খ্রিস্টাব্দের পর শাসকের ধর্ম হিসেবে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করা শুরু করে। খ্রিস্টান ধর্ম অনুসারে, ইসরালাইটরা যিশুকে ত্রুশবিদ্ধ করেছে। ফলে খ্রিস্টানরা ইসরালাইটদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করত। এর প্রভাব আমরা দেখতে পাই, ইউরোপে ইউরোপিয়ান খ্রিস্টানদের দ্বারা ইসরালাইটদের হত্যা ও উচ্ছেদের অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে।
৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আরব-মুসলমানরা লিভান্ত জয় করার পর, লিভান্তের প্যাগানরা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলের প্যাগানদের মতো ধর্মান্তরিত হয় এবং দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে আরবীর প্রচলন হয়।
ক্যানানাইটস গোত্রগুলোর মাঝে ইজরালাইটদের রোমানরা উচ্ছেদ করেছিল বলে, ওরা নানান জায়গায় মাইগ্রেট করে কিন্তু বর্তমান ইজরায়েল-ফিলিস্তিন ভূখন্ড এদের পূর্বপুরুষের মাতৃভূমি। বর্তমানে ফিলিস্তিনি যাদেরকে বলা হয়, এরাও ক্যানানাইটস গোত্রসমূহ, আরব সহ অন্যান্য সেমিটিক গোত্র ও এই অঞ্চলে বসতিস্থাপনকারীদের বংশধর। এরা প্রাচীনকাল থেকে হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে; বর্তমান ইজরায়েল-ফিলিস্তিন ভূখন্ডটি ফিলিস্তিনিদের হাজার হাজার বছরের বসতভূমি ও মাতৃভূমি।
"'The Imp and the Crust'
রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক লিও তলস্তয় ১৯০২ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার-এর জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং তাঁর পুরস্কার না পাওয়ার ঘটনাটি নোবেল পুরস্কার বিতর্কের একটি অন্যতম বিষয় আজও হয়ে আছে।
তলস্তয়কে নিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন, ‘তলস্তোয় নিজেই একটি পৃথিবী’। দস্তয়ভস্কি মনে করতেন, “জীবিত সকল সাহিত্যিকদের মধ্যে তলস্তয় সর্বশ্রেষ্ঠ”। আন্তন চেখভ বলেছেন, “কত প্রতিভাবান একজন শিল্পী এবং মনস্তাত্বিক!!” তাঁর সমগ্র লেখা দিয়ে মানুষের মধ্যে জীবনবোধ, মনুষ্যত্ববোধ, নীতিবোধ জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন তলস্তয়।
তলস্তয়য়ের "'The Imp and the Crust' গল্পটি আমার প্রিয় গল্পগুলির অন্যতম। চমৎকার এই গল্পটির সারকথা লেখার তাগিদ অনুভব করছি আজ।
এক গরিব চাষী ভোরবেলা লাঙল নিয়ে মাঠে এসেছে জমি চাষ করতে। খাবারের জন্য সঙ্গে আছে এক টুকরো রুটি। সে তার গায়ের জামা খুলে তা দিয়ে রুটিখানা পেঁচিয়ে রেখে দিল এক ঝোপের আড়ালে।
দুপুর অবধি লাঙল টেনে ঘোড়াটা ক্লান্ত হয়ে উঠল, চাষীরও বেশ খিদে পেল। তখন চাষী খাবার খাবে বলে ঝোপের কাছে এল। কিন্তু জামাটা খুলেই সে অবাক! দেখে রুটির টুকরোটি সেখানে নেই। সে জামা তুলে ঝাড়ল, আশেপাশে অনেক খুঁজল কিন্তু রুটিখানা সত্যিই নেই। চাষী খুব অবাক হল। সে মনে মনে ভাবল, তাজ্জব ব্যাপার কাউকে কোথাও দেখতে পেলাম না অথচ রুটিটা নেই! নিশ্চয়ই কেউ চুপিচুপি এসে রুটি নিয়ে পালিয়েছে।
আসলে এক শয়তান তখন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। চাষী যখন কাজে ব্যস্ত ছিল তখন সে রুটি সরিয়েছে। রুটি হারিয়ে চাষী কীভাবে গালাগালি করে তাই সে শুনবে। শুনে আমোদ পাবে।
রুটির টুকরো হারিয়ে চাষীর মনে দুঃখ হলেও সে মনে মনে বলল; আমি তো খিদেয় মরে যাব না। নিশ্চয়ই কোনো ক্ষুধার্ত লোক ওটা নিয়েছে।
লোকটি কুয়োর কাছে গেল। সেখান থেকে পেট পুরে জল পান করল। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আবার লাঙল জুড়ে জমি চাষ করতে লাগল।
এদিকে শয়তান ভেবেছিল, রুটির টুকরোটি না-পেয়ে চাষী ভয়ানক রেগে যাবে। রেগে গিয়ে গালাগালি শুরু করবে। কিন্তু চাষীকে তেমন কিছু করতে না দেখে খুব হতাশ হল। শয়তান অবশেষে তাদের সরদারের কাছে গিয়ে সব খুলে বলল।
শয়তান সরদার তার কথা শুনে ভয়ানক চোটে গেল, সবাই যদি এমন ভালোমানুষ হয়ে ওঠে তাহলে শয়তানদের ঠাই হবে কোথায় ? তিনি আদেশ দিলেন শিগগির আবার ফিরে যাও। গিয়ে ঠিকমতো কাজ করে এসো। যদি তিন বছর সময়ের মধ্যে সে ওই চাষীকে বিপথে না-আনতে পারে তবে তাকে আর দলে রাখা হবে না বলে হুঁশিয়ার করে দিল।
সরদারের কথায় শয়তান ভয় পেয়ে গেল। সময় নষ্ট না করে সে আবার পৃথিবীতে নেমে এল। এসে ভাবতে লাগল, কী উপায় সে করবে। কী করে লোকটাকে দিয়ে খারাপ কাজ করাবে। ভাবতে ভাবতে একটা মতলব শয়তানের মাথায় এল। চমৎকার মতলব!
সে এক মজুর সেজে সেই গরিব চাষীর বাড়িতে কাজ করতে গেল। চাষী তার কথায় মুগ্ধ হল। প্রথম বছরে সে চাষীকে পরামর্শ দিল শুধু নিচু জমিতে ফসল বুনতে। চাষী তার কথা শুনে নিচু জমিতে ফসল বুনল। সে বছর বৃষ্টি খুব কম হল। খড়ায় জ্বলেপুড়ে সব ফসল নষ্ট হয়ে গেল। এদিকে সেই গরিব চাষীর দ্বিগুণ ফসল ফলল। ফলে সারাবছর খেয়েও তার অনেক শস্য বেঁচে গেল। বাড়তি শস্য বিক্রি করে সে অনেক টাকা পেল।
শয়তান পরের বছর অপেক্ষাকৃত উঁচুভূমিতে ফসল ফলাতে চাষীকে পরামর্শ দিল। চাষীও সেবার তাই করল। সেবার গ্রীষ্মের সময় বৃষ্টি হল খুব বেশি। সবার ক্ষেতের ফসল অতিবৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেল। আর চাষী উঁচুজমির ফসল আগের বছরের চেয়েও ভালো হল। এবার খেয়ে বেঁচে গেল আরও বেশি ফসল। শয়তান তখন চাষীকে এক নতুন পথ বাতলে দিল। শস্য থেকে কী করে মদ তৈরি করতে হয় তাই চাষীকে শিখিয়ে দিল।
চাষীর তখন মহানন্দ। মদ তৈরি করে সে নিজেও পান করল, বন্ধুদেরও ডেকে পান করাতে লাগল।
শয়তান তখন মনের আনন্দে তার সরদারকে গিয়ে বলল, এতদিনে আমার মনের বাসনা পূরণ করে এসেছি।
সরদার শুনে বলল, দাঁড়াও, একবার আমার নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখে আসতে দাও।
এই বলে সরদার নেমে এল চাষীর বাড়ি। এসে দেখল, চাষী তার সব ধনী–বন্ধুদের দাওয়াত করে এনেছে। বাড়িতে এনে মদ পান করতে দিয়েছে। চাষীর বউ মেহমানদের মদ পরিবেশন করছে। মদের পাত্র নিয়ে একটি টেবিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ধাক্কা লেগে তার খানিকটা মেঝেয় পড়ে গেল। তাই দেখে চাষী রেগে বলল, ও কী করেছ, যতসব বে-আক্কেলে মেয়েমানুষ।
শয়তান তখন সরদারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, এবার দেখ, এ লোকই একদিন একমাত্র সম্বল তার রুটির টুকরোটি হারিয়ে একটুও অস্থির হয়নি। কিন্তু আজ ?
এমন সময় চাষীর বাড়িতে এসে ঢুকল সে-গাঁয়েরই এক গরিব লোক। তাকে দাওয়াত করা হয় নি। মাঠে কাজ করে লোকটা বাড়ি ফিরছিল। ঘরে ঢুকেই সবাইকে অভিবাদন করে সে একপাশে বসে মদ খাওয়া দেখতে লাগল। সারাদিন কাজ করে লোকটা খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তৃষ্ণাও পেয়েছে বেশ। সে ভাবছিল, এ-সময় একফোটা মদ পেলে বেশ হত। চেয়ে চেয়ে দেখে তৃষ্ণাটা তার বেড়েই চলেছে। কিন্তু চাষী তার দিকে একফোটা মদও দিতে রাজি নয়। সে বরং বলে উঠল, যাকে-তাকে মদ বিলানো তার কাজ নয়।
চাষীর মুখে একথা শুনে শয়তানের সরদার খুব খুশি। কিন্তু শয়তান নিজে খুশি হয়েছে আরও বেশি। তাই হাসতে হাসতে সে সরদারকে বলল, চুপ করো একটু, আরও মজা দেখতে পাবে এক্ষুনি।
মেহমানরা সবাই মদ খেয়েছে। বাড়িঅলা চাষীও খেয়েছে মনের সুখে। ভদকা খেয়ে যত রাজ্যের সত্যিমিথ্যে আবোলতাবোল গল্প শুরু করেছে সবাই মিলে।
শয়তানের সরদার সব শুনছে আর মনে মনে শয়তানের বুদ্ধির প্রশংসা করছে। শয়তান বলল, আরেকটু থামো। দেখে নাও এরপর কী মজা শুরু হয়। আরেক গ্লাস করে সবাইকে খেতে দাও। তখন দেখবে মজা। এখন ওরা শিয়ালের মতো লেজ নাড়ছে আর একে অপরকে খুশি করতে চাইছে। এরপর দেখবে, এরাই হয়েছে সব এক একটা ভয়ানক নেকড়ে বাঘ!
আরও এক গ্লাস করে সবাই যখন খেল তখন তাদের মুখে তুবড়ি ছুটছে। গল্প-গুজবের পরিবর্তে এবার আরম্ভ হয়েছে চিৎকার। রাগের মাথায় একজন আরেকজনকে যা-খুশি বলছে। একটু পরেই শুরু হল হাতাহাতি আর মারামারি। একজনের নাকের উপর আরেক জনের ঘুষি। চাষীও এসে যোগ দিল মেহমানদের সঙ্গে। সে মারও খেল আচ্ছারকম।
শয়তানের সরদার অতি-আনন্দে তামাশা দেখতে লাগল। আর মনে মনে বলে উঠল, চমৎকার তো!
কিন্তু তখনও শয়তান বলছে, আরেকটু সবুর করো। আরেক গ্লাস পেটে পড়তে দাও, তারপর দেখবে মজা। এখন ওরা লড়াই করছে নেকড়ের মতো। এরপর করবে শূকরের মতো।
তৃতীয় গ্লাস খেয়ে সত্যিই লোকগুলো জানোয়ারের মতো ব্যবহার করতে লাগল। অদ্ভুত ধরনের চিৎকার শুরু করল তারা। অকারণে শুধুই চিৎকার করছে, কেউ কারোর কথায় কান দিচ্ছে না।
এরকমভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়ে তারা বাড়ি ফিরতে লাগল। কেউ একাই টলতে টলতে হেলেদুলে চলতে লাগল, অনেকে দুজন বা তিনজনের দল বেঁধে বাড়িওলা চাষী দরজা অবধি এসেছিল তাদের বিদায় দিতে। সেখানে সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কাদায়। মাথা থেকে পা অবধি সারা গা তার লেপটে গেল কাদার ভেতর। মুখ গুঁজে পড়ে সে ঠিক শূকরের মতো ঘোঁত ঘোত করত লাগল।
তাই দেখে শয়তানের সরদার আরও খুশি। সে শয়তানকে বলল, ভারি মজার জিনিস তৈরি করেছ তুমি। রুটির ব্যাপারে যে ভুলটুকু করেছিলে, মদ তৈরি করে সে-ভুল শুধরে গেল তোমার। কিন্তু এখন বলো তো, কী করে এই আজব জিনিসটা তুমি তৈরি করেছ? প্রথমে বুঝি দিয়েছ শিয়ালের রক্ত, তাই শিয়ালের মতো করছিল লোকগুলো। তারপর বুঝি দিয়েছ নেকড়ের খানিকটা রক্ত, তাতেই নেকড়ের স্বভাব পেয়েছিল ওরা। আর সবশেষে দিয়েছ শূকরের রক্ত, তাই ঘোঁত ঘোঁত করছিল ওরা ঠিক শূকরের মতোই।
শয়তান মাথা নেড়ে বলল, না, সেসব কিছুই না। প্রথমে আমি শুধু বুঝতে পেরেছিলাম, চাষী তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফসল পেয়েছে। জানোয়ারের রক্ত মানুষের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। যতক্ষণ অবধি সে শুধু প্রয়োজনীয় ফসল পেয়েছে ততক্ষণ সেই জানোয়ারের স্বভাব চাপা পড়েছিল। সে সময় চাষী তার শেষ সম্বল একটুকরো রুটি হারিয়েও কোনও অনাসৃষ্টি কাণ্ড বাধায়নি। কিন্তু যখন থেকে তার ফসল খেয়েদেয়ে বাড়তি হতে লাগল তখনই সেই বাড়তি ফসল দিয়ে সে আমোদ করার উপায় খুঁজল। আমি তখনই তাকে সেই আমাদের পথ দেখিয়ে দিলাম, মদ পানের আনন্দ। তারপর যখন থেকে সে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ দান এই ফসলকে মদে পরিণত করে তাই পান করতে লাগল তখন থেকেই তার ভেতরকার শিয়াল, নেকড়ে ও শূকর মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।