জাপানে, ২০২৪ সালে একাকী বসবাসকারী ৭৬,০০০-এরও বেশি মানুষকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।তাদের চার ভাগের তিন ভাগেরই বয়স ছিল ৬৫-এর বেশি। কাউকে কাউকে তখন আবিষ্কার করা হয় যখন তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাড়া দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদেরকে... যখন প্রতিবেশীরা মাছি দেখে। এটা আমাদের সকলের জন্য একটি সতর্কতা। এটাই হয় যখন নিঃসঙ্গতা স্বাভাবিক হয়ে যায়। যখন সমাজ এত দ্রুত চলে যে সে থামতে এবং যত্ন নিতে ভুলে যায়।
বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু
তিনি একজন বড় বিজ্ঞানী ছিলেন, কিন্তু তাকে নিয়ে গুজবের শেষ নাই।
১. গাছের যে প্রাণ আছে মানুষ বহু আগে থেকেই জানতো৷ গাছ বড় হয়, বাচ্চা দেয়, পানি খায়, এমনকি সালোকসংশ্লেষণ করে এসবও মানুষ জানতো - জগদীশের জন্মের বহু আগে থেকেই। লিনিয়াসের ক্লাসিফিকেশনেও জীব জগতেই গাছকে স্থান দেওয়া হয়।
২. জগদীশ দাবি করেন গাছের অনুভূতি আছে৷ এই ব্যাপারে তার গবেষণার ফলাফল খুবই কন্ট্রোভার্শাল, আর মেইনস্ট্রিম সায়েন্সের অংশ না। প্রাণ থাকতে হলে অনুভূতি থাকতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই - থাকলেও এই জিনিস প্রমাণের সরাসরি কোনো উপায় নাই৷
৩. মার্কোনি এসে জগদীশের আইডিয়া চুরি করেছে, আর তাতে রেডিও বের হয়ে গেছে - ব্যাপার মোটেও এতো সিম্পল এমন না। রেডিও আবিষ্কার ম্যাক্সওয়েল, ফ্যারাডে, হার্জ, টেসলা, বোস, মার্কোনি - বহু মানুষের অবদানের ফসল। জগদীশ বোস হার্জের উদ্ভাবনকে আরও উন্নত করেন, হাই ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও ওয়েভ পাঠানো আর ডিটেকশনের ব্যবস্থা করেন। বোসের উদ্ভাবন ব্যবহার করে মার্কোনি আরও উন্নত রেডিও সিস্টেম তৈরি করেন, কিন্তু বোসকে ক্রেডিট দেন নাই।
বিশ্ব সভ্যতায় বাঙালিদের অবদান খুব কম, এতো বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় প্রায় নগন্য। সে হিসেবে জগদীশের অবদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ - তবে অহেতুক গুজব ছড়িয়ে যা নয় তা না রটালেই ভালো।
আজ থেকে মাত্র ৭০ বছর আগে সিঙ্গাপুর ছিল মূলত একটি ছোট্ট জেলেপল্লি—ঘিঞ্জি ঘরবাড়ি, বেকারত্ব, অপরাধ ও দারিদ্র্যে ভরা একটি বন্দর-নগর। দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থাও ছিল প্রায় একই রকম। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ান যুদ্ধ শেষে দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশের চেয়েও কম। চীনের অবস্থাও খুব ভালো ছিল না। ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন গঠনের সময় দেশটি ছিল দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিধ্বস্ত।
অর্থাৎ উনিশ ও বিশ শতকের বেশিরভাগ সময় জুড়েই সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন তিনটি দেশই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অনুন্নত ও সমস্যাগ্রস্ত অঞ্চলের মধ্যে একটি। তাদের না ছিল তেল–গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ, না ছিল সামরিক শক্তি, না ছিল উন্নত শিল্প কারখানা। তবুও মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে এই তিনটি রাষ্ট্রই বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে নিজেদের জায়গা তৈরি করে ফেলেছে। সিঙ্গাপুর এখন বিশ্বের অন্যতম উচ্চ-আয়ের রাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া এখন বিশ্বের অন্যতম হাই-টেক রাষ্ট্র, আর চীন বৈশ্বিক সুপারপাওয়ার।
তাহলে কীভাবে সম্ভব হলো এত নাটকীয় পরিবর্তন?
উত্তরটি লুকিয়ে আছে তাদের নেতৃত্ব, নীতি, শিক্ষা, শিল্পায়ন ও রাষ্ট্রগঠনের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলে। এই দেশগুলোর নেতারা দেখিয়েছেন যে কীভাবে দুর্নীতিমুক্ত শাসন, সঠিক পরিকল্পনা, রাজনৈতিক ঐক্য, দ্রুত শিল্পায়ন, অবকাঠামো বিনিয়োগকে কাজে লাগিয়ে একটি দেশ বৈশ্বিক পরাশক্তিতে পরিণত হতে পারে।
ইরানের উচ্চভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে চেহরাবাদ লবণের খনি। এমন এক স্থান, যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ খনিজ উত্তোলন করেছে। ২০০৪ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে প্রত্নতত্ত্ববিদরা সেখানে খুঁজে পেলেন ‘সল্ট মেন’ নামে পরিচিত কিছু লবণ-মমি।
এরা ছিলেন শ্রমিক, যারা হঠাৎ খনিতে ধস নামার সময় খনির ভেতর চাপা পড়ে মারা যান। তাদের একজনের দেহের বয়স খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৫ সাল, অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন, স্বাভাবিকভাবে সংরক্ষিত মানবদেহগুলোর একটি।
লবণ তাদের দেহের ভেতরের সব আর্দ্রতা শুষে নিয়েছে, ব্যাকটেরিয়াকে বাঁচতে দেয়নি। ফলে দাড়ি–গোঁফসহ চুল অটুট আছে। মুখমণ্ডল যেন এখনো নিঃশ্বাস ফেলতে পারে! পেটের ভেতরের খাবারগুলোও রয়ে গেছে, যার বিশ্লেষণে জানা যায়, মৃত্যুর আগে তারা কী খেয়েছিলেন।
শুধু দেহ নয়, সঙ্গে পাওয়া গেছে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের বহু স্মৃতি: কাপড়ের খণ্ড, চামড়ার বুট, উলের প্যান্ট, লোহার ছুরি, এমনকি সূক্ষ্ম এক রুপার সূচও। যেন সময়ের পৃষ্ঠা উল্টে আমরা হঠাৎ দেখতে পাচ্ছি- বহু শতাব্দী আগে এক ইরানী শ্রমিক ঠিক কীভাবে বাঁচতেন, কী পরতেন, কী বহন করতেন!
আবিষ্কারগুলো দেখায়, চেহরাবাদে শুধু একবার নয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একাধিক ধস নামত। প্রতিটি ধসে কেউ না কেউ প্রাণ হারাত, আর লবণ তাদের দেহকে অমর করে রাখত।
আজ এসব লবণ-মমি ইরানের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। বিজ্ঞানীরা সেখান থেকে সংগ্রহ করছেন ডিএনএ, অধ্যয়ন করছেন প্রাচীন কাপড় বুননের কৌশল, খাদ্যাভ্যাস, আর সেই যুগের মানুষের জীবনধারা।
===
পরকিয়া নিউরোবায়োলজিক্যাল হত্যাকাণ্ড—আপনার ব্রেনের ‘safe zone’ ভেঙে ফেলা!
বিজ্ঞানী গটম্যান তার “দ্য সায়েন্স অব ট্রাস্ট” বইতে বলেছিলেন, যে সম্পর্কে পরকিয়া থাকে সেটি ম্যাথম্যাটিক্যালি অসম্ভব। আমরা যখন একটি সম্পর্কে জড়িত হই, তখন সেখানে একটি “Shared reality” তৈরি করি। আমরা একে অন্যের কাছে ট্র্যান্সপারেন্টলি তথ্য আদান-প্রদান করি। কিন্তু প্রতারণা এই শেয়ার্ড রিয়্যলিটি দুই ভাগে ভেঙে ফেলে- পাবলিক রিয়্যালিটি এবং সিক্রেট রিয়্যালিটি। মনে করুন, দুজন পাইলট ককপিটে বসে আছে। একজনের কাছে পুরো রাডার ডেটা, আবহাওয়ার রিপোর্ট, ফুয়েল লেভেল—সব সত্য তথ্য আছে। অন্যজনের কাছে আছে শুধু অর্ধেক তথ্য, কারণ প্রথম পাইলট গোপনে কিছু সতর্ক সংকেত লুকিয়ে যাচ্ছে। এখন দুইজন দুই রকম “রিয়্যালিটি ম্যাপ” দেখে প্লেন চালাচ্ছে—একজন ভাবছে আকাশ পরিষ্কার, অন্যজন জানে সামনে ঝড়। এই অসঙ্গতি যত বাড়ে, বিমান তত খারাপ সিদ্ধান্ত নেয়- শেষে সম্পর্কের মতো বিমানটিও অস্বাভাবিকভাবে ক্রাশ করে।
অনেকে মনে করেন, পরকিয়ার সম্পর্ক আকস্মিক হয়, আসলে পরকিয়ার সম্পর্ক আকস্মিক ঘটে না। গটম্যান তার ল্যাবে দীর্ঘ বিশ বছরের পরীক্ষামূলক প্রমাণ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, সঙ্গীর কাছ থেকে আসা হাজার হাজার মাইক্রো প্রতারণা একসাথে জমে এমন একটি কন্ডিশন তৈরি হয়, যখন রিলেশনশিপ সিস্টেম তার প্রেডিক্টিবিলিটি হারায়। পরকিয়ার পেছনে একটি শক্তিশালী কারণ অপমান ও হেয় করা, এটাকে বলে সম্পর্ক ভাঙার সালফিউরিক অ্যাসিড।
ছোট ছোট অপমান, উপেক্ষা ও অবহেলা দিনের পর দিন পুঞ্জিভূত হতে হতে এমন একটি সময় আসে যখন শেয়ার্ড রিয়্যালিটি ভেঙে যায়। পার্টনার যখন আপনাকে ছোট ছোট উপেক্ষা ও নীরবতার মাধ্যমে কষ্ট দেয়, আপনার মস্তিষ্কের অ্যামিগডেলা এটাকে মাইক্রোথ্রেট হিসেবে এনকোড করে। তখনই আসে সবচেয়ে ভয়ানক একটি খেলা। আপনার পার্টনার এ সময় বিকল্প একজন মানুষের সাথে কমিউনিকেশন করা শুরু করে, তাদের কাছ থেকে সামান্য পরিমাণ ভ্যালিডেশন পাওয়ার সাথে সাথে তাদের মাইক্রোস্ট্রেস রিলিফ হয় এবং ব্যাপকভাবে ডোপামিন বুস্ট করে। তাদের কাছে পাওয়া ডোপামিন, আপনার কাছ থেকে পাওয়া স্ট্রেস রিলিফ করে।
একজন পুরুষ যখন তার পার্টনারের পক্ষ থেকে বিকল্প কোনো পুরুষের সাথে যোগাযোগ করে, প্রাকৃতিকভাবে সে পুরুষটি তার উচ্চমাত্রিক প্রশংসা করে। আপনার কাছ থেকে সে পায় মাইক্রো থ্রেট আর বিকল্প পুরুষের কাছে পায় উচ্চমাত্রিক প্রশংসা। সে স্ট্রেস হর্মোন কর্টিসল থেকে মুক্তির জন্য বিকল্প পুরুষের সাথে নিয়মিত কথা বলা শুরু করে। আর এভাবেই প্রতারণার নিউরোলজিক্যাল বীজ বপন হয়। শেয়ার্ড রিয়্যালিটি ভেঙে গেলে দুজন দুটি আলাদা ইউনিভার্সে চলে যায়।
একজন ভাবে, আমরা ভালো আছি-শুধু একটু ডিস্টেন্সে আছি। অন্যজন ভাবে আমি একা একা ফাইট করছি, আমাকে কেউ বুঝতে পারে না। এভাবে তাদের ইউনিভার্স আলাদা হতে থাকে। তারা আর কিছুতেই একে অন্যের সাথে কানেক্ট হতে পারে না। মাইক্রো প্রতারণা থেকে আপনার সঙ্গী আপনার কাছ থেকে ডিসকানেক্ট হয়, ইমোশনাল ভ্যাকিউম তৈরি হয়, সে একটা সিক্রেট লাইফ তৈরি করে এবং আল্টিমেটলি সেটা পরকিয়ার সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়। আপনি আর এই সম্পর্ককে প্রেডিক্ট করতে পারেন না। কারণ অলরেডি সিস্টেম গাণিতিকভাবে অস্থিতিশীল। আর বিভিন্ন পুরুষ ও নারীর কাছ থেকে আসা র্যান্ডম ট্রিগার যেমন টেক্সট, অ্যাটেনশন ও ভ্যালিডেশন এই সম্পর্কের পতন ঘটনোর জন্য যথেষ্ট। আপনার পার্টনার স্ট্রেস হর্মোন থেকে রিলিফ চায় আর প্রতিযোগী পার্টনার চায় তার শরীর। কিন্তু সে একবারের জন্যেও কল্পনা করে না, যেই মাইক্রো থ্রেট আজ তাকে অন্য সম্পর্কের দিকে চালনা করছে, একই মাইক্রো থ্রেট তাকে আবারও অন্য একটি সম্পর্কের দিকে চালনা করবে।
একবার আপনার পার্টনার পরকিয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে আপনি তাকে কখনোই রিকভার করতে পারবেন না। এটা তার কোনো মুড বা ইগো নয়। এটা হলো তার একটি নিউরোবায়োলজিক্যাল রেজিস্ট্যান্স। আপনার সঙ্গী যদি আপনার দ্বারা প্রতারণার শিকার হয়, আপনি তাকে যতই সেফটি ও সিকিউরিটির নিশ্চয়তা দেন না কেন সে আর সেফ রিলেশনে ফিরে আসে না। তার ভ্যাগাস নার্ভ ও প্যারাসিম্পেথেটিক নার্ভাস সিস্টেম হাইপারঅ্যাকটিভ থাকে। তার ব্রেন কনস্ট্যান্ট ডেঞ্জার মোডে আটকে থাকে, তার হার্টরেট ১৬০ bpm পর্যন্ত লাফ দেয়। আপনি সম্পর্ক রিপেয়ার করতে চাইলেও তার ব্রেন আর রাজি হয় না। মস্তিষ্কের এমিগডেলা একবার আপনাকে “High Threat” হিসেবে গ্রহণ করে নিলে আর সহজে ছেড়ে দেয় না।
আপনি যদি তার সাথে সেফ মুডে কথা বলেন, তার ব্রেন এটাকে ক্রস চেক করে এভাবে: “This signal doesn’t match previous betrayal history.”। আপনি যখন তাকে বলবেন, চাইলেই তো সবকিছু ঠিক করে নেয়া যায়, সে আপনার কথা শুনবে না। কারণ আপনার কাছ থেকে মাইক্রোস্ট্রেস পেতে পেতে তার প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স দুর্বল হয়ে গেছে, সে এখন ডিসিশন নেয়ার ক্ষমতা রাখে না। আপনি তাকে যতই ফিরে আসতে বলেন, সে কিছুতেই আপনার কথা লজিক্যাল সেন্স তৈরি করতে পারবে না, আপনার বক্তব্য নিউরোলজিক্যালি হাস্যকর।
গটম্যান এটাকে বলেন সাইকোলজিক্যাল ফ্লাডিং। এই অবস্থায় রিপেয়ার পদক্ষেপ ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৯০% এর বেশি। ব্রেন যাকে একবার “unsafe” হিসেবে লেবেল করে, তাকে আবার “safe” করতে চাইলে শুধু ক্ষমা, কথা, ভালোবাসা—কিছুই যথেষ্ট নয়। এটা ইচ্ছাশক্তির খেলা নয়; এটা নার্ভাস সিস্টেমের স্বয়ংক্রিয় সার্ভাইভাল মেকানিজম। সে যদি আপনার কাছে ফিরে আসে, তবে ইমোশন দিয়ে নয়, তাকে নিউরোবায়োলজিক্যাল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে ফিরে আসতে হবে, ৯০% মানুষ এটা অর্জন করতে পারে না।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিজ্ঞানী গটম্যান পরকিয়াকে অনৈতিক আচরণ বলছেন না। এখানে কোনো ধর্ম, নীতিশাস্ত্র বা চরিত্রের বিচার নেই। তিনি বলেন পরকিয়া হলো “Personal emotional regulation problem”। একজন ব্যক্তি তার ট্রমা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে পরকিয়ার সম্পর্কে জড়ায়। কিন্তু আপনার পার্টনার যখন পরকিয়া করে আপনার কেমন লাগে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য কল্পনা করুন, রিলেশনশিপ হলো একটি ইকোসিস্টেম। একটি ইকোসিস্টেমে পানি, আলো, পুষ্টি—সবকিছু ভারসাম্য থাকলে গাছ বেঁচে থাকে, একইভাবে একটি সম্পর্ক টিকে থাকে দুজনের মনোযোগ, সহানুভূতি, অন্তরঙ্গতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংবেদনশীলতা ও বিশ্বাস থেকে। এগুলো একটি সম্পর্কের নিউট্রিয়েন্টস। পরকিয়া হলো এই ইকোসিস্টেম থেকে নিউট্রিয়েন্টস তুলে অন্য কোনো ইকোসিস্টেমে দেয়া। এটা চারিত্রিক সমস্যা নয়, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা। যখন আপনার প্রেমিকা আপনাকে অন্তরঙ্গতা না দিয়ে অন্য কাউকে অন্তরঙ্গতা দেয়, তখন সেটা আপনার মস্তিষ্কে সরাসরি নিউরোলজিক্যাল ক্ষত তৈরি করে। এটি আপনার সেফটি সিস্টেমে সরাসরি আঘাত করে। আর তখন আপনার মনে হতে থাকে __ আমি যথেষ্ট না।আমার জায়গা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমাকে ফেলে দেওয়া হলো। সে আমাকে আর নিরাপদ মনে করে না। আমি এখন একা। সে আপনার থেকে আদর, সহানুভূতি ও সেক্স কেড়ে নিয়ে অন্য কাউকে উপহার দিচ্ছে। আপনার মস্তিষ্ক এটাকে ডেপ্রিভেশন হিসেবে দেখে, তার অ্যাটাচমেন্ট প্যানিক তৈরি হয়, তার শরীর ফাইট অর ফ্লাইট এবং ফ্রিজ মোডে চলে যায়। পরকিয়ার আঘাত থেকে মানুষের মস্তিষ্কের স্মৃতির কর্টেক্স হিপোক্যাম্পাস ছোট হয়ে যায়।
ধরুন আপনার জীবনে একজনই আছে যার কাঁধে মাথা রেখে আপনি শান্ত হন। আপনার নার্ভাস সিস্টেম তাকে “safe person” হিসেবে রেজিস্টার করেছে। একদিন দেখলেন— সে তার কাঁধ অন্য কারো জন্য ব্যবহার করছে। এবং আপনাকে জানায়নি। এটা আপনার নৈতিক ক্ষোভ না—এটা আপনার সেফটি-সিস্টেমে আঘাত। আপনার ভেতরের ব্রেন শুধু বলে— “আমি এখন নিরাপদ নই।” যতক্ষণ পর্যন্ত এই ক্ষত শুকায় না, সম্পর্ক কাজ করে না, এটাকে বলে “Attachment wound”। পরকিয়া কোনো চারিত্রিক ত্রুটি নয়। এটি আমাদের নিরাপত্তাবোধ ভেঙে দেয়, এটি কোনো নৈতিক বিষয় নয়, স্নায়ুবিক আঘাত।
বহির্মুখী মানুষেরা অন্যের সঙ্গে মিশলে শক্তি পান। আর ইন্ট্রোভার্ট বা হোমবডিদের ক্ষেত্রে ঘটে উল্টোটা। বাইরের কোলাহল, ভিড় আর অনবরত কথা বলা তাঁদের ভালো লাগে না। তাঁদের চাঙা হওয়ার জন্য দরকার নিজস্ব একটা নিরাপদ জায়গা। নিজের ঘরের চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর কীই-বা হতে পারে? মনোবিজ্ঞানে একে বলা হয় ‘রেস্টোরেটিভ নিশ’, আক্ষরিক বাংলায় বললে ‘বলদায়ী স্থানবিশেষ’।আরেকটা ব্যাপার আছে। আমরা ফোমো বা ফিয়ার অব মিসিং আউটের কথা জানি। মানে কোনো কিছু মিস করার ভয় হলো ফোমো। কিন্তু জোমোর কথা জানেন? জোমো হলো জয় অব মিসিং আউট।
এটা হোমবডিদের এক সুপারপাওয়ার। তাঁরা জেনেশুনে বাইরের আড্ডা মিস করেন এবং তাতেই আনন্দ পান। তাঁরা অন্যের অনুমোদনের তোয়াক্কা করেন না। নিজের সঙ্গেই তাঁদের সেরা সময় কাটে।
দ্ধিমত্তার সঙ্গে সম্পর্ক
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস এবং সিঙ্গাপুর ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটির এক বিখ্যাত গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান, তাঁরা সাধারণত ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলেন।
তাঁদের সুখের জন্য খুব বেশি মানুষের দরকার হয় না। তাঁরা নিজেদের চিন্তা আর কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন। হতে পারে আপনার ঘরে থাকার স্বভাবটি আসলে আপনার উচ্চ বুদ্ধিমত্তারই লক্ষণ।মনোবিজ্ঞানীরা হোমবডিদের ব্যাপারে আগ্রহী কেন
এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, হোমবডিরা কি আসলেই সুখী? অবশ্যই! মনোবিজ্ঞানীরা এখন হোমবডিদের দিকে নতুন করে নজর দিচ্ছেন। তাঁরা দেখেছেন, যাঁরা নিজের ঘরে সময় কাটাতে পছন্দ করেন, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের বেশ কিছু ইতিবাচক দিক আছে।
এক. সৃজনশীলতা। একা থাকলে মস্তিষ্কের ডিফল্ট মোড চালু হয়। এতে তাঁরা নতুন নতুন আইডিয়া তৈরি করতে পারেন।
দুই. আত্মসচেতনতা। যাঁরা একা সময় কাটান, তাঁরা নিজেকে অন্যদের চেয়ে ভালো চেনেন।
তিন. গভীর সম্পর্ক। হোমবডিদের বন্ধুর সংখ্যা কম হতে পারে, কিন্তু যাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকে, তা হয় অত্যন্ত গভীর।
সুতরাং ঘরকুনো মানেই হতাশ ব্যক্তি নয়। এটাও একধরনের শক্তি। শুক্রবার পার্টিতে না গিয়ে ঘরে বসে পিৎজা খাওয়া বা বই পড়া কোনো অপরাধ নয়, বরং এটি আপনার মানসিক শান্তির জন্য নেওয়া একটি স্মার্ট সিদ্ধান্ত।
সমাজ যা-ই বলুক, নিজের ভালো লাগাটাকে গুরুত্ব দিন। কারণ, দিন শেষে আপনার ঘরই আপনার আসল দুর্গ! হ্যাপি স্টেইং হোম!
সূত্র: মিডিয়াম, সাইকোলজি টুডে ও ব্রিটিশ জার্নাল অব সাইকোলজি
সিন্ধু সভ্যতা:
বড়ো পোস্ট হলে আমরা পড়তে চাই না। কিন্তু আমার এটা একটা পোস্ট নয় একটা বই মনে করে পড়তে পারেন
আমরা সেই মধ্যযুগীয় আরব যাযাবরদের ইতিহাস পড়ে মেধা নষ্ট করি। লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসায় লক্ষ লক্ষ শিক্ষক ছাত্ররা ভিন জাতের ভিনদেশি ইতিহাস নিয়ে অতিপ্রাকৃতিক চর্চা করেন। যা বাস্তব জীবনে কোনো কাজেই আসে না। কিন্তু আমাদের সভ্যতা আমাদের সংস্কৃতি আমাদের নাড়ীর শিকড় জানতে একটুও চেষ্টা করি না। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে কি পরানো উচিত আর কি পড়ানো উচিত না, সেটা বিবেচনা করতে আমি নিচের লেখাটি তৈরি করেছি, আমাদের সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে
সিন্ধু অববাহিকার সভ্যতা নিয়ে আলোচনা শুরু করলে আমাদের প্রথমেই একটি মৌলিক সত্য স্বীকার করতে হয়—সভ্যতার প্রাচীনত্বের বিচারে সিন্ধু সভ্যতা মেসোপটেমিয়া ও মিশর সভ্যতার তুলনায় কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং বহু দিক থেকে এটি সমসাময়িক কিংবা আরও প্রাচীন হওয়ার সম্ভাবনাও বহন করে। পার্থক্য একটাই—মেসোপটেমিয়া ও মিশরে আমরা লিখিত দলিল পাই, কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় যে চিত্রলিপি ও বর্ণমালার অস্তিত্ব ছিলো, তা আজও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এই অপঠিত চিত্রলিপিই সিন্ধু সভ্যতাকে একদিকে যেমন রহস্যময় করে তুলেছে, অন্যদিকে তেমনি গবেষণার ক্ষেত্রে এক বিশাল সম্ভাবনার দরজাও খুলে দিয়েছে। লিখিত ইতিহাস না থাকলেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমাদের জানিয়ে দেয়, এই সভ্যতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত ছিলো, এমনকি এমনও হতে পারে যে এর সূচনা মেসোপটেমিয়া ও মিশরের আগেই ঘটেছিলো।
এই গভীর শিকড়ের সন্ধান করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হয় পাথরের যুগের দীর্ঘ ইতিহাসে। মানবসভ্যতার প্রাথমিক বিকাশপর্বেই ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে যে, সাংস্কৃতিক উন্মেষ ঘটেছিলো, তা শুধু নগরসভ্যতার পূর্বশর্ত নয়, বরং মানব অভিযোজন ও প্রযুক্তিগত বিবর্তনের এক দীর্ঘ ধারাবাহিকতার ফলাফল। পৃথিবীর আদিতম কৃষির উদ্ভবক্ষেত্রগুলোর একটি হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এবং এখানেই মানুষের বহু প্রাগৈতিহাসিক পূর্বসূরীর বসবাসের চিহ্ন পায়োয়া যায়। বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত অঞ্চলে রামাপিথেকাস নামের মানবপূর্ব প্রাণীর উপস্থিতি আমাদের জানায়, এই ভূখণ্ড বহু লক্ষ বছর ধরেই মানব ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।
যদিও মানুষের প্রথম আবির্ভাব এই উপমহাদেশে হয়নি, তথাপি পুরাতন পাথরের যুগেই—অর্থাৎ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫ লক্ষ বছর থেকে ১ লক্ষ বছরের মধ্যে—এখানে মানুষের স্থায়ী বা যাযাবর ধরনের বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এই পুরাতন পাথরের যুগ, যাকে প্রত্নপ্রস্তর যুগও বলা হয়, মানব ইতিহাসের প্রথম পাথরের যোগ হিসেবে বিবেচিত। এই সময় মানুষের জীবন ছিলো শিকার ও খাদ্যসংগ্রহকেন্দ্রিক, এবং তাদের তৈরি অস্ত্র ছিলো বড়ো আকারের, অমুসৃন, কিন্তু কার্যকর। এই যুগের নিদর্শন হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে বহু জায়গায় পাথরের কুঠার, ছিদ্রকারী যন্ত্র ও ভারী অস্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মানব বুদ্ধির প্রাথমিক প্রয়োগকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
এই পুরাতন পাথরের যুগের মধ্যেই ভারতীয় উপমহাদেশে দুটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এর একটি ছিলো বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলের রাওয়ালপিণ্ডির নিকটবর্তী পটওয়ার মালভূমির সোয়ান উপত্যকা, যা সোয়ান সংস্কৃতি নামে পরিচিত। এই সংস্কৃতির সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছরের মধ্যে বিস্তৃত বলে গবেষকরা মনে করেন। এখানে পাওয়া গেছে বড়ো আকারের কুঠার, চপিং টুল এবং পাথর ছিদ্র করার যন্ত্র, যা শিকার ও কাঠ কাটার কাজে ব্যবহৃত হতো। এই সংস্কৃতির ভৌগোলিক সীমানা ছিলো উত্তরে পিরপাঞ্জাল পাহাড়, পশ্চিমে সিন্ধুনদ, পূর্বে ঝিলাম নদী এবং দক্ষিণে সল্ট রেঞ্জ, যা এর বিস্তৃত প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে।
অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে গড়ে ওঠে মাদ্রাজি সংস্কৃতি, যার নিদর্শন প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে। যদিও এই আবিষ্কা সময় আধুনিক, সংস্কৃতিটির সময়ও পুরাতন পাথরের যুগের মধ্যেই পড়ে। মাদ্রাজ অঞ্চলে পাওয়া অস্ত্রসমূহ সোয়ান সংস্কৃতির অস্ত্রের তুলনায় আকারে ছোট ও গঠনে ভিন্ন ছিলো, যা প্রমাণ করে যে ভৌগোলিক পরিবেশ, প্রাপ্ত পাথরের ধরন এবং জীবনযাপনের প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের প্রযুক্তি ভিন্ন পথে বিকশিত হয়েছিলো। এই দুটি সংস্কৃতি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সমান্তরালভাবে বিকশিত হলেও উভয় ক্ষেত্রেই শিকারীজীবী মানুষেরা জীবনধারণের জন্য অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিলো।
এই প্রথম পাথরের যুগের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পর মানব ইতিহাসে আসে দ্বিতীয় পাথরের যোগ, যাকে আমরা মধ্য পাথরের যুগ বা মেসোলিথিক যুগ বলি। এর সময় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ থেকে ৬,০০০ অব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই সময়েই মানুষ ধীরে ধীরে বড়ো ও ভারী অস্ত্রের বদলে ক্ষুদ্রাকৃতির, সূক্ষ্মভাবে ঘষা পাথরের অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে। পুরাতন পাথরের যুগের শেষভাগে নিগ্রো উৎসের জনগোষ্ঠী উপমহাদেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছিলো, আর মধ্য পাথরের যুগে এসে ককেশীয় জনগোষ্ঠী পশ্চিম ভারতে এবং মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী পূর্ব ভারতে বসতি স্থাপন করে। এই জনসংখ্যাগত পরিবর্তন প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির বিকাশেও প্রভাব ফেলেছিলো।
মধ্য পাথরের যুগের সবচেয়ে মূল্যবান নিদর্শন পাওয়া গেছে ভারতের গুজরাট অঞ্চল থেকে। এখানকার মানুষ জ্যামিতিক আকারের ক্ষুদ্র পাথরের টুকরোকে তীরের ফলা হিসেবে ব্যবহার করতো, যা শিকারের দক্ষতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। প্রথমদিকে তারা পশুশিকার ও মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল থাকলেও ধীরে ধীরে চাষাবাদের প্রাথমিক ধারণা রপ্ত করতে শুরু করে। এই যুগের শেষভাগে তারা হাত দিয়ে মাটির পাত্র তৈরি করতো এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কুমারের চাকের ব্যবহার শিখে নেয়, যা পরবর্তী নতুন পাথরের যুগের ভিত্তি তৈরি করে। তাদের বসতিস্থল থেকে গণ্ডার, শূকর, ষাঁড় ও হরিণের হাড়গোড় আবিষ্কৃত হয়েছে, যা খাদ্যাভ্যাস ও পরিবেশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়।
দক্ষিণ ভারতের তিনেভেল্লি, পশ্চিম ভারতের সিন্ধু অঞ্চল এবং পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভানপুরে মধ্য পাথরের যুগের বসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। যদিও উপমহাদেশের সর্বত্র এই যুগের বিকাশ সমান গতিতে হয়নি, তবুও সিন্ধু অঞ্চলের মানুষ তুলনামূলক দ্রুত কৃষির দিকে অগ্রসর হয়, যা ভবিষ্যতের নগরসভ্যতার বীজ পত্তন করে। এই ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই মানব ইতিহাসের তৃতীয় পাথরের যোগের দিকে যাত্রা শুরু হয়, যার ভিতর দিয়েই সিন্ধু অববাহিকায় নগর সভ্যতার সূচনা সম্ভব হয়ে ওঠে, এবং সেই দীর্ঘ সন্ধিক্ষণ থেকেই আমাদের আলোচনা পরবর্তী প্রবাহে প্রবেশ করতে শুরু করে, কারণ মধ্য পাথরের যুগের অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি ও জীবনদর্শনকে আত্মস্থ করেই মানুষ ধীরে ধীরে নতুন পাথরের যুগে পা রাখে, যা মানবসভ্যতার তৃতীয় পাথরের যোগ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং যার সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ থেকে ৩০০০ অব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত।
মধ্য পাথরের যুগের অর্জনসমূহের ধারাবাহিকতায় নতুন পাথরের যুগে মানুষ তার জীবনযাপনে এক মৌলিক পরিবর্তন আনে। এই যুগে পাথরের অস্ত্র শুধু ছোট ও ধারালোই হয়নি, বরং শান দেওয়া, পালিশ করা ও নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার কৌশল রপ্ত করা হয়। এর সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তনটি ঘটে খাদ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে—শিকার ও সংগ্রহের পাশাপাশি মানুষ পরিকল্পিতভাবে পশুপালন ও কৃষিকাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এই তৃতীয় পাথরের যোগই প্রকৃত অর্থে মানুষকে যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতির দিকে নিয়ে যায় এবং গ্রাম গঠনের ধারণাকে বাস্তব রূপ দেয়। কৃষি ও পশুপালনের সফলতা মানুষের হাতে অতিরিক্ত খাদ্য উদ্বৃত্ত এনে দেয়, যা ভবিষ্যতে নগরসভ্যতার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
সিন্ধু ও বেলুচিস্তান অঞ্চলে নতুন পাথরের যুগের সংস্কৃতি ছিলো তুলনামূলকভাবে উন্নত। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের প্রথম দিকে বর্তমান পাকিস্তানের কোয়েটা উপত্যকার কিলিগুল মুহম্মদ এলাকায় রোদে পোড়ানো ইটের ঘরবাড়ির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা স্থাপত্যচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নির্দেশ করে। একই সঙ্গে ছাগল ও ভেড়ার মতো পশুকে পোষ মানানো এবং গম-জাতীয় দানা শস্যের চাষের প্রমাণ মেলে, যা পরিকল্পিত খাদ্য উৎপাদনের সূচক। এখানকার মানুষরা সাধারণ পাথরের পাশাপাশি চকমকি পাথর, জ্যাসপার ও ক্যালসেডানি মণির ব্যবহার করতো, যা তাদের উপকরণ নির্বাচনের জ্ঞান ও নান্দনিক বোধের পরিচয় দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানেই মৃৎপাত্রের ব্যবহার বিস্তৃত হয় এবং ধাতুর প্রাথমিক প্রয়োগ শুরু হয়।
বেলুচিস্তানের রানা ঘুন্ডাই এলাকাতেও নতুন পাথরের যুগের সংস্কৃতির বিকাশ লক্ষ্য করা গেছে। এর পরবর্তী ধাপে আমরা তাম্রপ্রস্তর যুগের সূচনার স্পষ্ট প্রমাণ পাই ডাম্ব সাদাত অঞ্চলে, যেখানে তেজস্ক্রিয় কার্বন আইসোটোপ পদ্ধতির পরীক্ষায় খ্রিস্টপূর্ব ২৭ বা ২৬ শতকের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে। এখান থেকে পাওয়া তামার তৈরি সামগ্রী ও বার্ণিশ করা মৃৎপাত্র প্রমাণ করে যে মানুষ তখন ধাতু ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করছিলো এবং প্রযুক্তিগতভাবে এক নতুন স্তরে পৌঁছাচ্ছিলো।
দক্ষিণ ভারতে বেল্লারি জেলার সাঙ্গানাকাল্লু ও পিককলিহালে খ্রিস্টপূর্ব একুশ শতকের কাছাকাছি সময়ের নতুন পাথরের যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখানে পশুর খোঁয়াড়, কাঁচা ঘরবাড়ি এবং কৃষিকাজের সুস্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া যায়, যা গ্রামীণ অর্থনীতির শক্ত ভিত্তির ইঙ্গিত দেয়। একইভাবে কাশ্মীরের শ্রীনগরের নিকটবর্তী বুর্জাহোমে নতুন পাথরের যুগের মৃৎপাত্র, চুল্লি, হাড়ের তৈরি বর্শা ও সুঁই পাওয়া গেছে, যা এই অঞ্চলেও মানুষের জীবনযাপনের উন্নত পর্যায়কে তুলে ধরে।
পূর্ব ভারতের আসাম, বিহার ও উড়িষ্যায় নতুন পাথরের যুগের নিদর্শন পাওয়া গেলেও সিন্ধু উপত্যকার ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতা গড়ে ওঠার সময় পর্যন্ত উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের বহু এলাকা নুতন পাথরের কিংবা তাম্রপ্রস্তর যুগের সাংস্কৃতিক স্তরেই অবস্থান করেছিলো। অর্থাৎ সমগ্র উপমহাদেশে উন্নয়ন একই গতিতে ঘটেনি, তবে সিন্ধু অববাহিকা এই পরিবর্তনের অগ্রভাগে ছিলো। এই তৃতীয় পাথরের যোগের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই মানুষ ব্রোঞ্জের হাতিয়ার ব্যবহার শুরু করে, যা কৃষিকাজকে আরও উৎপাদনশীল করে তোলে এবং ধীরে ধীরে নগরকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থার জন্ম দেয়।
এই প্রেক্ষাপটেই সিন্ধু অববাহিকায় নগরসভ্যতার বিকাশ ঘটে, যার সময় নিয়ে মতভেদ থাকলেও পণ্ডিতদের মধ্যে একটি মৌলিক ঐকমত্য রয়েছে—এই সভ্যতা মেসোপটেমিয়া ও মিশরের সভ্যতার প্রায় সমসাময়িক। আইভার লিজনারের মতে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০০ অব্দে, স্যার জন মার্শালের মতে এর চরম উৎকর্ষ খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫০ থেকে ২৭৫০ অব্দের মধ্যে, আর মর্টিমার হুইলারের মতে এর সূচনা খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের দিকে। এই বিভিন্ন মতামত আসলে একটি বিষয়ই স্পষ্ট করে—সিন্ধু সভ্যতা হঠাৎ জন্ম নেয়নি, বরং তিনটি পাথরের যোগের দীর্ঘ ঐতিহাসিক অভিযাত্রার ফল হিসেবেই এই নগরসভ্যতার উত্থান ঘটে, এবং এখান থেকেই এর বিস্তৃতি ও বৈশিষ্ট্যের আলোচনা আরও গভীর দিকে প্রবেশ করতে থাকে এবং এখান থেকেই এর বিস্তৃতি ও বৈশিষ্ট্যের আলোচনা আরও গভীর দিকে প্রবেশ করতে থাকে, কারণ নগরসভ্যতা হিসেবে সিন্ধু অববাহিকার বিকাশ কেবল সময়ের প্রশ্ন নয়, বরং বিস্তৃত ভূগোল, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সামাজিক সংগঠনের সম্মিলিত ফলাফল।
সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি ছিলো অভাবনীয়ভাবে বিশাল। এই সভ্যতা কেবল সিন্ধু উপত্যকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো। পশ্চিমে ইরান সংলগ্ন বেলুচিস্তানের ঝোব নদী অঞ্চল থেকে শুরু করে পূর্বে সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী বিস্তৃত ভূমি এবং আরও পূর্বদিকে কাথিয়াওয়ার ও থর মরুভূমি পর্যন্ত এর সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার লাভ করে। তুলনামূলকভাবে বিচার করলে দেখা যায়, সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি ছিলো সুমেরীয় সভ্যতার চেয়ে প্রায় চারগুণ বড়, যা একে প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সভ্যতায় পরিণত করে।
১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করতেন যে এই সভ্যতার সীমানা ছিলো উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ, দক্ষিণে আরব সাগর, পশ্চিমে বেলুচিস্তানের পার্বত্য অঞ্চল এবং পূর্বে থর মরুভূমি ও কাথিয়াওয়ার। কিন্তু পরবর্তী খনন ও গবেষণায় স্পষ্ট হয় যে এর বিস্তার আরও ব্যাপক ছিলো। উত্তর প্রদেশ এবং আহমদাবাদ এলাকাতেও সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে যে এই সভ্যতা শুধু নদীকেন্দ্রিক নয়, বরং বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চলে অভিযোজিত হতে সক্ষম ছিলো। এই সব তথ্য মিলিয়ে দেখা যায় যে উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ, দক্ষিণে আরব সাগর, পশ্চিমে ইরান সীমান্তসংলগ্ন বেলুচিস্তান এবং পূর্বে উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল অঞ্চল ছিলো সিন্ধু সভ্যতার কার্যকর সীমানা।
এই বিস্তৃত ভূগোলের ভিতরেই আমরা সিন্ধু সভ্যতার একেবারে আদিপর্বের মানববসতির স্পষ্ট নিদর্শন পাই। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের মেহেরগড়ে খননের মাধ্যমে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৭০০০ অব্দের মানুষের ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়, যা সিন্ধু সভ্যতারও বহু আগেকার। এই মেহেরগড়ের মানুষরা গম ও যব চাষ করতো এবং স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজ গড়ে তুলেছিল। এখানে পাওয়া গেছে শিলনোড়া, মাটির তৈরি বাসন, বিভিন্ন মূর্তি, ঘর গরম করার চুল্লি, কঙ্কালের গায়ে লেগে থাকা গেরুয়া কাপড়ের টুকরো, কাস্তে, গোলাঘর, সিল, পাথরের গায়ে আঁকা স্বস্তিকা চিহ্ন এবং কার্পাস তুলোর নমুনা। এই সব নিদর্শন আমাদের দেখায় যে সিন্ধু সভ্যতার নগরজীবনের পেছনে কয়েক হাজার বছরের কৃষিভিত্তিক অভিজ্ঞতা কাজ করেছিলো।
এই ধারাবাহিকতায় রাজস্থানের কালিবাঙ্গানেও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ঘটে। এখানে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৫০০ অব্দের লাঙ্গলের দাগ ও তন্দুর নির্মাণের চুল্লি পাওয়া গেছে, যা পরিকল্পিত কৃষিকাজ ও খাদ্য প্রস্তুতির প্রমাণ বহন করে। এগুলো কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের চিহ্ন নয়, বরং সামাজিক সংগঠনেরও ইঙ্গিত দেয়, কারণ কৃষিকাজ মানেই জমির পরিকল্পনা, শ্রমবণ্টন ও উৎপাদন ব্যবস্থার সমন্বয়।
সিন্ধু সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থলগুলোর অধিকাংশই আজকের পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অবস্থিত হলেও ভারতে প্রায় ৭০০টি স্থানে এই সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০টি স্থানে নিয়মিত খননকাজ পরিচালিত হয়েছে। ভারতীয় ভূখণ্ডে এই সভ্যতার উত্তর প্রান্ত ছিলো জম্মু-কাশ্মীরের মান্ডা, দক্ষিণ প্রান্ত মহারাষ্ট্রের দাইমাবাদ, পূর্ব প্রান্ত উত্তর প্রদেশের আলমগীরপুর এবং পশ্চিম প্রান্ত গুজরাটের দেশলপুর ও ধোলাভিরা। আহমদাবাদের কোহাল, হরিয়ানার রূপার, উত্তর প্রদেশের হুলাস প্রভৃতি স্থানেও সিন্ধু সভ্যতার শক্তিশালী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যদিও এই সব এলাকা বিস্তৃত, তবুও পাকিস্তানের পাঞ্জাবের হরোপ্পা এবং সিন্ধু অঞ্চলের মোহেনজোদাড়োকেই প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এখানেই নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্যের সর্বোচ্চ উৎকর্ষ দেখা যায়।
এই কেন্দ্রগুলোতে পাওয়া প্রত্নসামগ্রী আমাদের জানায় যে সিন্ধু সভ্যতা ছিলো প্রযুক্তি ও নগর ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত উন্নত। এখানে তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা, রূপা, পোড়ামাটি, পাথর ও বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবহার ছিলো ব্যাপক। চিত্রলিপির প্রচলন ছিলো, যদিও তা আজও অপঠিত। প্রশস্ত রাজপথ, পরিকল্পিত আবাসগৃহ, গণস্নানাগার, শস্যগুদাম, সভাকক্ষ, শিক্ষায়তন, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং পাকা কুয়োর অস্তিত্ব এই সভ্যতার নাগরিক চরিত্রকে স্পষ্ট করে। মধ্য এশিয়া, ইরান এবং দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিলো নিয়মিত, যা একটি সুসংগঠিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচয় দেয়।
এই নগরসমূহে উন্নত সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিলো এবং পাথরের তৈরি বিশাল বাঁধের নিদর্শন পাওয়া গেছে। কোথাও ১৬ গজ চওড়া পাথরের বাঁধ, আবার কিছুটা উত্তরে ৩৪৮ গজ লম্বা ও ১২ ফুট চওড়া বাঁধ নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায়, যা জলব্যবস্থাপনায় তাদের দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে। এই সব আয়োজনের মধ্য দিয়ে সিন্ধু সভ্যতা শুধু একটি প্রাচীন নগরসভ্যতাই নয়, বরং মানব ইতিহাসে পরিকল্পিত জীবনব্যবস্থার এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, এবং এই বিস্তৃত কাঠামোর ভেতর দিয়েই আমরা ধীরে ধীরে এর পৃথক কেন্দ্র ও স্থানীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। কারণ সিন্ধু সভ্যতার প্রকৃত শক্তি লুকিয়ে আছে তার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা জনবসতির বৈচিত্র্য ও পারস্পরিক সংযোগে।
সিন্ধু সভ্যতার নগর ও জনবসতিগুলো শুধু আকারে বড়ো ছিলো না, বরং তাদের জীবনব্যবস্থা ছিলো সুসংগঠিত ও প্রযুক্তিনির্ভর। এখানে পায়োয়া প্রত্নসামগ্রী থেকে জানা যায় যে তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা, রূপা ও পোড়ামাটির দ্রব্যসামগ্রী নিয়মিত ব্যবহৃত হতো। বিশেষ করে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৭৫০ অব্দের মৃৎপাত্রের নমুনা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম নিদর্শনের মধ্যে পড়ে, যা শিল্পচর্চা ও দৈনন্দিন জীবনের উন্নত স্তর নির্দেশ করে। দুর্গপ্রাচীরে ঘেরা নগরসমূহে শস্যগুদাম, কবরস্থান ও সুপরিকল্পিত আবাসগৃহের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য সংরক্ষণের একটি সুদৃঢ় ব্যবস্থা ছিলো বলে ইঙ্গিত দেয়।
এই সভ্যতায় দু’চাকাওয়ালা গাড়ির প্রচলন ছিলো, যা যোগাযোগ ও বাণিজ্যকে দ্রুত ও কার্যকর করে তুলেছিলো। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বাণিজ্যের বিস্তার ঘটেছিলো, এবং এই বাণিজ্য শুধু পণ্য বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও ঘটেছিলো। সিলমোহর, ওজন ও মাপের একরূপতা এই বাণিজ্যিক ব্যবস্থার নিয়মানুবর্তিতার প্রমাণ দেয়। এই সব তথ্য একত্রে বিচার করলে বোঝা যায় যে সিন্ধু সভ্যতা ছিলো এক ধরনের প্রাথমিক বিশ্বায়নের অংশ, যেখানে দূরবর্তী অঞ্চলগুলো এক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কে যুক্ত ছিলো।
উত্তর বেলুচিস্তানের ঝোব নদীর উপত্যকায় খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দেরও আগেকার জনবসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখানে কুমোরের চাকে তৈরি মৃৎপাত্রের প্রচলন ছিলো এবং হরোপ্পা ও মোহেনজোদাড়োর সঙ্গে তাদের যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই অঞ্চলটি মূল নগরকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে আশেপাশের গ্রামীণ জনপদের এক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছিলো, যেখানে কৃষি, কারুশিল্প ও বাণিজ্য একে অপরের পরিপূরক ছিলো।
বেলুচিস্তানের বোলান পর্বতের নিকটবর্তী দক্ষিণ ও মধ্য বেলুচিস্তান অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৯০০ অব্দের উন্নত গ্রামগুলোর সন্ধান পাওয়া গেছে। এখান থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ২৫০০ অব্দের মধ্যকার ইট ও পাথরের তৈরি ইমারতের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। নান্দারায় বাড়ির দেয়ালে চুনকাম করা হতো এবং দুই সারি বাড়ির মাঝখানে ৬ থেকে ৮ ফুট চওড়া রাস্তা রাখা হতো, যা পরিকল্পিত গ্রাম বিন্যাসের পরিচয় দেয়। এখানে তামার ব্যবহার প্রচলিত ছিলো এবং মৃতদেহ কবর দেওয়ার প্রথা চালু ছিলো, যা সামাজিক ও ধর্মীয় ধারণার বিকাশের দিকেও ইঙ্গিত করে।
দক্ষিণ বেলুচিস্তানে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৪০০ অব্দের জনবসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই অঞ্চলে পাথর ও ইটের তৈরি ইমারতের দেয়ালে চুনকাম করা হতো এবং কোথাও কোথাও দোতলা বাড়ির অস্তিত্বও পাওয়া গেছে। মেঝেতে কাঠের পাটাতন ব্যবহারের প্রমাণ এই অঞ্চলের স্থাপত্য কৌশলের উৎকর্ষ নির্দেশ করে। এখান থেকে মাটির তৈরি খেলনা গাড়ি ও যাঁতো আবিষ্কৃত হয়েছে, যা একদিকে দৈনন্দিন জীবনের সরল আনন্দ, অন্যদিকে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রযুক্তিকে তুলে ধরে।
এই সব আঞ্চলিক কেন্দ্র ও জনবসতির ভেতর দিয়ে সিন্ধু সভ্যতা একটি সমন্বিত কাঠামো গড়ে তুলেছিলো, যেখানে নগর ও গ্রাম একে অপরের ওপর নির্ভরশীল ছিলো। কৃষিপণ্য গ্রাম থেকে নগরে আসতো, আবার নগর থেকে কারুশিল্প ও বাণিজ্যিক সামগ্রী গ্রামে ছড়িয়ে পড়তো। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়েই সিন্ধু সভ্যতা দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকতে সক্ষম হয়, এবং এই সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই আমরা তার বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের দিকগুলো আরও গভীরভাবে অনুধাবন করার দিকে এগিয়ে যাই, কারণ সিন্ধু সভ্যতা শুধু আঞ্চলিক উন্নয়নে সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং মধ্য এশিয়া ও পারস্য উপসাগরের সঙ্গে স্থায়ী বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলো।
ব্যবসা ও বাণিজ্য সিন্ধু সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৮০০ অব্দের দিকে এই এলাকার বণিকরা সুমেরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতো। শুধু পণ্যবিনিময় নয়, তথ্য, প্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলো। বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ব্যবহার হতো সিলমোহর ও ওজন-পম্প, যা একটি সুসংগঠিত অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিচায়ক। এই যোগাযোগ শুধুমাত্র পশ্চিম সীমান্তের সঙ্গে সীমিত ছিলো না, বরং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। ফলত সিন্ধু সভ্যতা আঞ্চলিক অর্থনীতি থেকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলোও বাণিজ্যিক কার্যকলাপে কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতো। হরোপ্পা ও মোহেনজোদাড়োর বিশাল শস্যগুদাম, বিশদ নগর পরিকল্পনা, সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নত কৌশল সবই বাণিজ্যিক উৎপাদন ও সংরক্ষণের সক্ষমতা নির্দেশ করে। নগরগুলোতে তৈরি পোড়ামাটি, মৃৎপাত্র, ধাতব সামগ্রী, কাঁচামাল ও কারুশিল্পের নিদর্শন স্থানীয় গ্রাম ও দূরবর্তী অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। ফলত নগর এবং গ্রাম পরস্পরের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিল এবং একে অপরকে পরিপূরক করতো।
সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যিক শক্তি আরেকটি ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়—দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আনা মূল্যবান পাথর ও ধাতব উপাদান। ক্যালসেডানি, জ্যাসপার, চকমকি পাথর এবং তামা, রূপা ও সোনার ব্যবহার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে স্পষ্ট। এই উপকরণগুলোকে শুধু দৈনন্দিন জীবনেই ব্যবহার করা হতো না, বরং বাণিজ্যিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদার চিহ্ন হিসেবেও বিবেচনা করা হতো। পণ্য ও উপকরণের এই বহুমাত্রিক ব্যবহার সিন্ধু সভ্যতার জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক চেতনার গভীরতা প্রকাশ করে।
সিন্ধু সভ্যতার স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনাও বাণিজ্যের সঙ্গে সমন্বিত। প্রতিটি শহরে পরিকল্পিত রাস্তা, পাকা ঘর, সভাকক্ষ, শস্যগুদাম এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করা হতো এবং বাণিজ্যিক কার্যকলাপ সুসংহত হতো। উদাহরণস্বরূপ, মোহেনজোদাড়োতে ১৬ গজ চওড়া পাথরের বাঁধ ও ৩৪৮ গজ দীর্ঘ ও ১২ ফুট চওড়া উত্তর বাঁধ নদীজল নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হতো, যা কৃষি ও খাদ্য সংরক্ষণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এই ধরনের প্রযুক্তিগত ও পরিকল্পিত উদ্যোগ ইঙ্গিত দেয় যে সিন্ধু সভ্যতার মানুষ শুধু কৃষক বা কারিগরই ছিলো না, বরং তারা বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক দক্ষতায়ও সমৃদ্ধ ছিলো।
শুধু নগর ও গ্রামীণ জনবসতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না এই বাণিজ্য। সিন্ধু সভ্যতার বণিকরা দূরবর্তী মেসোপটেমিয়া ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতো, যেখানে তারা বাণিজ্যের পাশাপাশি শিল্প ও প্রযুক্তি, নতুন ধারণা ও সাংস্কৃতিক উপাদানও গ্রহণ করতো। এই আন্তঃসংযোগই সিন্ধু সভ্যতাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যেকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন হিসেবে অবস্থান করায়।
এইভাবে সিন্ধু সভ্যতা শুধু কৃষি, স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনায় উন্নত ছিলো না, বরং এটি বাণিজ্যিকভাবে সুনির্দিষ্ট, আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে সুসংহত একটি প্রাচীন নগরসভ্যতা হিসেবে পরিচিত। এখানেই আমরা ধীরে ধীরে তার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিকে মনোযোগ দিতে পারি, কারণ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ছাড়া এই সভ্যতার পূর্ণাঙ্গ চিত্র উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, এবং ঠিক এখান থেকেই আমরা তার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিকে মনোযোগ দিতে পারি, যা সিন্ধু অববাহিকাকে মানব ইতিহাসে অনন্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সিন্ধু সভ্যতার নাগরিকরা শুধুমাত্র প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে দক্ষই ছিলেন না, তারা সামাজিক ও ধর্মীয় আয়োজনে ও সমন্বয়ে সমৃদ্ধ। নগরগুলোতে পাওয়া সভাকক্ষ, গণস্নানাগার এবং মন্দিরঘরজাতীয় স্থাপত্যের মাধ্যমে বোঝা যায় যে এখানে সামাজিক নিয়মাবলী এবং ধর্মীয় রীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ হত। মৃতদেহ দাফনের প্রথা, বিশেষভাবে ধাপে ধাপে পরিকল্পিত কবরস্থান এবং দোতলা বাড়ির গৃহস্থালীকরণ, সবই সমাজের সামাজিক স্তর ও নৈতিক কাঠামোর প্রতিফলন। এসব নিদর্শন শুধু দৈনন্দিন জীবনই নয়, বরং মানুষের মানসিক ও আধ্যাত্মিক চেতনারও প্রতিফলন।
চিত্রলিপির উপস্থিতি এই সভ্যতার আরেকটি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। যদিও আজও তা অপঠিত, তবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই লিপি থেকে প্রাথমিক প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক এবং সম্ভবত ধর্মীয় কার্যক্রমের ধারণা করতে পারেন। মুদ্রিত সিল, কারুকার্য এবং পাথরের উপর খোদাই করা নিদর্শন একদিকে মানুষের সৃজনশীলতা প্রমাণ করে, অন্যদিকে নগর পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচায়ক হিসেবে বিবেচিত। বিশেষভাবে হরোপ্পা ও মোহেনজোদাড়োর সিলমোহরগুলো বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক নিয়মনীতি চালু করার উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
সিন্ধু সভ্যতার স্থাপত্য কৌশলও চমৎকার। রোদে পোড়া ইট, কাঠ ও পাথরের সমন্বয়, ছাদবিন্যাস এবং রাস্তার পরিকল্পনা নগরবাসীর জীবনযাপনকে সহজ ও কার্যকর করে তুলতো। শস্যগুদাম, পানীয় জলের ব্যবস্থাপনা, সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা শুধু কৃষি ও জনজীবনের জন্যই নয়, বরং বাণিজ্যিক কার্যকলাপকে সমর্থন করার জন্যও কার্যকর ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মোহেনজোদাড়োর বিশাল পয়ঃনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক নগরবাসীর স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতো, যা একটি সুসংহত নাগরিক সমাজের পরিচায়ক।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর পাশাপাশি সিন্ধু সভ্যতা আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় ছিলো। পশ্চিমে মধ্য এশিয়া ও ইরান, পূর্বে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে নিয়মিত বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিনিময় ঘটতো। এই সংযোগ শুধু পণ্য ও ধাতব উপকরণ বিনিময় নয়, বরং সাংস্কৃতিক ধারণা ও কারুশিল্পের প্রসারও ঘটিয়েছিলো। ফলস্বরূপ, সিন্ধু সভ্যতা শুধু একটি স্থানিক নগরসভ্যতা নয়, বরং একটি বহুমাতৃক আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো।
সিন্ধু সভ্যতার এই বিস্তৃত সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক কাঠামো প্রমাণ করে যে এটি শুধু প্রাচীনতম নগরসভ্যতা নয়, বরং এক সুসংগঠিত, আত্মনিয়ন্ত্রিত এবং বহুমাত্রিক সভ্যতা, যা মানব ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। এই সভ্যতার সাফল্য আমাদের জানায় যে, হাজার হাজার বছর আগেই মানুষ কিভাবে পরিকল্পনা, বাণিজ্য, সামাজিক শৃঙ্খলা এবং শিল্পের মাধ্যমে উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলো।
পাথর নিদর্শন:
সোয়ান উপত্যকার পাথর কুঠার ও ছিদ্রকারী যন্ত্র – খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ১,৫০,০০০ – ৭০,০০০ অব্দ
গুজরাটের ক্ষুদ্রাকৃতির জ্যামিতিক পাথরের তীরের ফলা – খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০ – ৬,০০০ অব্দ
বেলুচিস্তানের ঝোব নদীর পাথর ও ইটের ইমারতের ধ্বংসাবশেষ – খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ
এই তিনটি পাথর নিদর্শন শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নয়, বরং সিন্ধু সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস ও তার প্রযুক্তিগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী।
Motaleb Dewan
ধূমপান
ধূমপান ছাড়তে না পারার প্রধান কারণ হলো নিকোটিন। এটি মস্তিষ্কে এমন প্রভাব ফেলে যে শরীর ধীরে ধীরে এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একবার দেহে প্রবেশ করলে নিকোটিন সহজে বের হয় না, ফলে হঠাৎ সিগারেট ছাড়লে শরীর ও মন দুটোই প্রতিক্রিয়া দেখায়।
‘ক্রেভিং’ কী?
ধূমপান ছাড়ার সময় সবচেয়ে বড় বাধা হলো ক্রেভিং—হঠাৎ করে সিগারেটের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সাধারণত ছাড়ার প্রথম ২–৩ দিনে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এই আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। তখন মানুষ অস্থির, বিরক্ত বা খিটখিটে হয়ে পড়তে পারে।
কী এই ৩-৩-৩-৩ নিয়ম?
ডা. নারায়ণের মতে, ধূমপান ছাড়ার প্রথম তিন সপ্তাহ সবচেয়ে কঠিন। এই সময় কিছু কৌশল মেনে চললে কাজ অনেক সহজ হয়—
হাতে কিছু রাখুন
চুইংগাম, লজেন্স বা চকোলেট রাখুন। এতে মুখ ও হাত ব্যস্ত থাকবে।
মনের জোর বাড়ান
নিজেকে বারবার বলুন—আপনি সিগারেট ছাড়তে পারবেন।
ক্রেভিং সামলান
ক্রেভিং সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট থাকে। তখন হাঁটাহাঁটি, গান শোনা বা অন্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
সাপোর্ট নিন
প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সময়ের সঙ্গে বাড়ে আত্মবিশ্বাস
ডা. নারায়ণ জানান,
প্রথম ৩ সপ্তাহ কষ্টকর,
৩ মাসে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়,
আর ৩ বছর ধূমপান না করলে বলা যায়, আপনি পুরোপুরি নেশামুক্ত।
সতর্কবার্তা
ধূমপান শুধু অভ্যাস নয়, এটি জীবনঘাতী। ভারতের ধূমপায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ওরাল ক্যান্সার ও ফুসফুসজনিত রোগ। তাই সময় থাকতে এই নেশা ছাড়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
চিকিৎসকের পরামর্শ
✔ ধূমপায়ী পরিবেশ এড়িয়ে চলুন
✔ হাতে বা মনে সবসময় ব্যস্ততা রাখুন
✔ ধাপে ধাপে আত্মবিশ্বাস তৈরি করুন
✔ প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা
উচ্চ বুদ্ধিমত্তার মানুষ
যে সব মানুষ উচ্চমাত্রিকভাবে বুদ্ধিমান তাদের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স হাইপারঅ্যাকটিভ। এরা যে কোনো বিষয়ে ওভার থিংকিং করে। প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স হলো আমাদের সিদ্ধান্তের কেন্দ্র। এই কর্টেক্স অতিরিক্ত ফায়ার হলে মানুষের ডিসিশন নেয়ার ক্ষমতা কমে যায়, রিস্ক নিতে ভয় পায় এবং সহজ জিনিস জটিল করে ফেলে।
উচ্চবুদ্ধির মানুষ যে কোনো টপিক নিয়ে বারবার চিন্তা করে। কিন্তু এত ডিপলি চিন্তা করা একটি ম্যালফাংশন। তারা দিবাস্বপ্ন, কল্পনা আর অতীতের স্মৃতি বারবার রিপিট করে। কোনো কারণে এরা ইমোশনালি শকড বা ট্রমার শিকার হলে, তাদের মস্তিষ্ক ডিফল্ট মুড নেটওয়ার্কে আটকে যায়। তারা একই স্মৃতি বারবার স্মরণ করে, একই ব্যথা রিহার্সাল করে, একই কল্পনা ও ভয় বারবার রিবিল্ড করে। অনেকে এটাকে গভীর চিন্তা মনে করলেও, এটা মূলত ইমোশনাল বাগ, এটা তাদের প্রসেসিং এরর। তাদের ভিজুয়ালাইজেশন ক্ষমতা এত শক্তিশালী যে তারা ছোট একটি সমস্যাকে টেনে লম্বা করে ফেলে।
তাদের মস্তিষ্ক সবসময় “হোয়াট ইফ” মুডে থাকে। তাদের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স ফিউচার সিমুলেশনে দক্ষ। তাই তারা একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার সিমুলেশন তৈরি করে, যেগুলোর ৯৫% বাস্তবে ঘটে না। তাদের আত্মসমালোচনার ক্ষমতা অনেক বেশি। আর এজন্য এসব মানুষ সবসময় অনুশোচনা, লজ্জা ও অনুতাপে ভোগে। তারা এতবেশি ওভারথিংকিং করে যে তাদের মস্তিষ্কে প্রচণ্ড শক্তি খরচ হয়, আর এতে করে তাদের মস্তিষ্কে ফিজিক্যালি ক্ষত তৈরি হয়, এরা তাদের নিজেদের তৈরি নিউরাল পেইন লুপে আটকে যায়।
উচ্চবুদ্ধির মস্তিষ্কের “Accept” করার ক্ষমতা কম। স্ম্যার্ট মানুষ এক সম্পর্ক থেকে বের হয়ে অন্য সম্পর্কে যেতে পারে না, নতুন রিওয়ার্ড সিস্টেম তৈরি করতে তাদের সময় লাগে। তারা সহজে “let go” করতে পারে না।
আইনস্টাইনের ভায়োলিনের গল্প !
আলবার্ট আইনস্টাইনকে আমরা চিনি আধুনিক দার্থবিজ্ঞানের জনক হিসেবে—আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, E = mc², মহাবিশ্বের সময়–স্থান ধারণা, সবই তাঁর অবদান। কিন্তু এই জিনিয়াস মানুষের জীবনের আরেকটি সুন্দর দিক ছিল, যা অনেকের অজানা। বিজ্ঞান নয়, সঙ্গীত—বিশেষ করে ভায়োলিন—ছিল তাঁর গভীর ভালোবাসা।
আইনস্টাইন ছোটবেলা থেকেই ভায়োলিন বাজাতে শিখেছিলেন এবং আজীবন এই অভ্যাস ধরে রেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সঙ্গীত মানুষের চিন্তাকে গভীর ও স্বাধীন করে তোলে। যখন কোনো জটিল বৈজ্ঞানিক সমস্যায় আটকে যেতেন, দিনের পর দিন হিসাব করেও যখন সমাধান মিলত না, তখন তিনি কাগজ-কলম সরিয়ে রেখে ভায়োলিন হাতে নিতেন। সুরের ওঠানামার মধ্যেই তাঁর মন শান্ত হতো, চিন্তাগুলো নতুনভাবে সাজাতে শুরু করত।
আইনস্টাইনের ঘনিষ্ঠরা বলেছেন, অনেক সময় তিনি গভীর রাতে হঠাৎ ভায়োলিন বাজাতে শুরু করতেন। বাখ বা মোজার্টের সুরে ডুবে থাকতে থাকতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলতেন—“পেয়ে গেছি!”—কারণ সঙ্গীতের মাঝেই নাকি কোনো নতুন ধারণার আভাস পেতেন তিনি। তাঁর মতে, বিজ্ঞান আর সঙ্গীত আলাদা কিছু নয়; দুটোই আসে একই সৃজনশীল উৎস থেকে।
আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, যদি তিনি বিজ্ঞানী না হতেন, তবে নিশ্চয়ই একজন সংগীতজ্ঞ হতেন। তাঁর জীবনে ভায়োলিন ছিল মানসিক আশ্রয়, চিন্তার সঙ্গী এবং সৃজনশীলতার চাবিকাঠি।
এই গল্প আমাদের শেখায়, সাফল্যের পথ একরৈখিক নয়। কখনো যুক্তি, কখনো কল্পনা, কখনো সুর—সব মিলিয়েই তৈরি হয় বড় আবিষ্কার। তাই নিজের ভালোবাসার জায়গাটাকে অবহেলা নয়, বরং শক্তিতে পরিণত করাই হলো আসল বুদ্ধিমত্তা।
আজ থেকে প্রায় ৩০০০ বছর আগের ঘটনা। অ্যাসিরিয়ার সম্রাট শালমানেসারের সেনাবাহিনী যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছে। ওই সময় দূরের দিগন্তে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়। ধুলো উড়তে উড়তে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে একটা বিশাল দল। কিন্তু দলটা কোনো যুদ্ধরথের নয়, এমনকি ঘোড়সওয়ারদেরও নয়। একটু কাছে আসার পর সবাই বুঝতে পারল, এটা মূলত একটা উটের দল। একটা, দুটো বা দশটা নয়—পুরো এক হাজার উটের বিশাল এক দল এগিয়ে আসছে এদিকে। প্রত্যেকটা উটের ওপর বসে আছে মরুর রোদে পুড়ে যাওয়া মানুষ। তাদের পরনের পোশাক ঢিলেঢালা, মুখে রহস্যময় নিশ্চিন্ততা।
এই উটের সেনাবাহিনীর নেতার নাম গিন্দিবু। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘আরব’ বলে ডাকা হয়েছিল এই ব্যক্তিকেই। আরবদের সেনাবাহিনী দেখে অ্যাসিরীয়রা বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। যুদ্ধের ময়দানে উট? এ আবার কেমন কথা! উট তখনো সামরিক বাহিনীর প্রচলিত কোনো বাহন নয়। উট মূলত মরুভূমিতে দীর্ঘ যাত্রার জন্য ব্যবহার করা হয়, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না। আসলে গিন্দিবুর সেনাবাহিনীর মানুষরা মরুর সন্তান। দিনের পর দিন জলহীন পথে পথচলা, তারা দেখে দিক চেনা, বাতাসের গন্ধ থেকে দূরের মরূদ্যান খুঁজে নেওয়া—এই সব দক্ষতা তাদের রক্তে মিশে ছিল।
আমরা যে যুদ্ধের কথা বলছি, এই যুদ্ধটা ইতিহাসে কারকারের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে গিন্দিবু তার এক হাজার উট নিয়ে লড়েছিলেন লেভান্ত ও ইসরায়েলের রাজাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। যুদ্ধের ফল নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো অ্যাসিরীয়দের সেই শিলালিপি—যেখানে প্রথমবার লেখা হলো, “গিন্দিবু আরবি—এক হাজার উটসহ।” আরবদের নিয়ে ইতিহাসে প্রথমবার এই একটি লাইনই লেখা হয়েছিল।
আরবরা কোনো সাম্রাজ্যের অধীন নয়, কোনো শহুরে মানুষ নয়। বরং আরবরা হলো মরুর স্বাধীন গোত্র। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই ইতিহাস প্রথম টের পায় যে, মরুর বুকেও এমন এক জনগোষ্ঠী আছে, যারা পরবর্তী হাজার বছরে ভাষা, বাণিজ্য, কবিতা, সামরিক কৌশল—সবকিছুতেই একদিন বিস্ময়কর প্রভাব ফেলবে। আরবদের ইতিহাস আসলেই কৌতূহল উদ্দীপক। আরবদের বিগত তিন হাজার বছরের সেই আশ্চর্য ইতিহাস বিস্তারিত লিখেছেন টিম ম্যাকিনটোশ-স্মিথ তাঁর Arabs: A 3,000-Year History of Peoples, Tribes and Empires বইতে।
এবার চলুন অটোমান সাম্রাজ্য থেকে ঘুরে আসা যাক—
মঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ সাইবেরিয়া আর কাজাখস্তানের সংযোগস্থলে রয়েছে বিশাল আলতাই পর্বতমালা অঞ্চল। এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বাস করত কয়েকটি সাহসী গোত্র। এই মানুষদের মধ্যে অনেকেই ছিল ঘোড়সওয়ার; বিশাল স্তেপের তৃণভূমিতে তারা যাযাবর জীবন কাটাত। কিন্তু তাদের ধনুক-বর্শার যুদ্ধকৌশল ছিল অসাধারণ। একটা পর্যায়ে এই গোত্রের মানুষরা পশ্চিমমুখী যাত্রা শুরু করে। প্রথমে তারা এসে পৌঁছায় মধ্য এশিয়ায়, তারপর কাস্পিয়ান অঞ্চল হয়ে প্রবেশ করে ইরানে।
আমরা যে মানুষগুলোর কথা বলছি তারা জাতিতে তুর্কি। একাদশ শতকে এসে এই তুর্কি গোত্রের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে। ইতিহাসে এই মানুষগুলোকে আমরা সেলজুক নামে চিনি। পরবর্তীতে এদের একটি দল ইরান থেকে ভূমধ্যসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করে। ১০৭১ সালে তারা মানজিকের্টের যুদ্ধে বাইজেন্টাইনদের পরাজিত করে আনাতোলিয়া অঞ্চল দখল করে। এরপর কয়েক শতকের ভেতর আনাতোলিয়া ধীরে ধীরে তুর্কি ভূমিতে পরিণত হয়। এই অভিবাসী তুর্কি গোত্রেরই একটি শাখা ছিল ওঘুজদের কাই গোত্র। আর এই গোত্রের বংশধর ওসমান গাজী পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা করেন অটোমান সাম্রাজ্য।
ভাবলে অবাক হতে হয় যে, আলতাই পর্বতমালা অঞ্চলের কয়েকটি ছোট গোত্র কীভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের মতো এত বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল! একসময় এশিয়া, ইউরোপ আর আফ্রিকা—এই তিন মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল তাদের সাম্রাজ্য। প্রায় ৬০০ বছর টিকে ছিল অটোমানরা। অটোমানদের সম্পর্কে না জানলে আসলে বিশ্ব-ইতিহাসের বিশাল একটা অংশই বাকি থেকে যায়। যেমন আশ্চর্য ছিল তাদের ক্ষমতা, তেমনি শক্তিশালী ছিল তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব। তুর্কি, আরবি, ফার্সি—এই তিনটি সংস্কৃতির মিশ্রণে তৈরি হয় অটোমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তাদের খাদ্য, পোশাক, কুঠার, সঙ্গীত, সাহিত্য—আজও ইউরোপের বালকান অঞ্চল থেকে আরব বিশ্ব পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে দেখা যায়। অটোমানদের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য A History of the Ottoman Empire বইটি একটি পরিপূর্ণ দলিল।
সবশেষে মধ্য এশিয়া—
মধ্য এশিয়া অঞ্চলটা বিস্তৃত আফগানিস্তান থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত; ছিল চীনের কিছু অঞ্চলও। ৮০০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে এখানে এক উন্নত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। তৎকালীন পণ্ডিতরা শিল্পকলা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ভূবিদ্যা, অর্থনীতি, রসায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে ছিলেন সর্বসেরা। এরাই তৈরি করেছিলেন মধ্যযুগের পর আধুনিক যুগের জ্ঞানের ভিত্তি। এরা সবাই যেহেতু আরবিতে লিখতেন, তাই আরব না হয়েও দুনিয়ার কাছে ‘আরব’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। "
দীর্ঘ সময় কোনো টক্সিক মানুষের সাথে থাকলে ক্ষতি শুধু সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ থাকে না ধীরে ধীরে তা আপনার মানসিক স্থিরতা, আর্থিক নিরাপত্তা ও আত্মসম্মান পর্যন্ত গ্রাস করে নেয়। অনেকেই বলেন,
“আঘাত করে জানি, তবু মায়ার টানে ছেড়ে যেতে পারি না।”
এই জায়গাটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
কারণ টক্সিক সম্পর্ক কেবল কষ্ট দেয় না এটা আপনার শরীরকেও অসুস্থ করে তোলে। দীর্ঘদিন এমন পরিবেশে থাকলে শরীরে স্ট্রেস হরমোন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা, চুল পড়া, ওজনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ও মানসিক অবসাদে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধরনের সম্পর্কে থাকার ফলে মানুষের ইমিউন সিস্টেম পর্যন্ত দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
সমস্যা হলো টক্সিক মানুষ সব সময় শুরুতে টক্সিক মনে হয় না।
যারা আপনাকে বারবার ছোট করে,
আপনার সাফল্যে অস্বস্তি বোধ করে,
নিজের ভুলের দায় আপনার ঘাড়ে চাপায়,
আর নিয়ন্ত্রণকে “ভালোবাসা” বলে চালিয়ে দেয়
তারাই ধীরে ধীরে আপনার ভেতরের শক্তিটা কেড়ে নেয়।
এরা আপনার কষ্টে অনুতপ্ত হয় না, বরং কোথাও কোথাও তৃপ্তি খুঁজে পায়। আপনি যাকে আপন ভাবছেন, সে আসলে আপনার নিরাপদ মানুষ নয়। এই সম্পর্কগুলো দেখতে নীরব কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ংকরভাবে ধ্বংসাত্মক।
দীর্ঘদিন টক্সিক আচরণ সহ্য করলে মস্তিষ্কের সেই অংশ দুর্বল হয়ে যায়, যেখান থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিই। তখন ভয় বাড়ে, আত্মবিশ্বাস কমে, আর ভুলকে ঠিক মনে হতে শুরু করে। এভাবেই মানুষ ধীরে ধীরে নিজের বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ করতে শেখে।
এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয় কারণ জড়িয়ে থাকে আবেগ, অপরাধবোধ, একা হয়ে যাওয়ার ভয়, পরিবার ও সমাজের চাপ। তাই অনেকেই কষ্টের মাঝেই থেকে যায়, শুধু মানিয়ে নেওয়ার নামে।
কিন্তু সত্যটা হলো
টক্সিক মানুষকে বদলানো আপনার দায়িত্ব না।
নিজেকে রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব।
নিজের ভালো থাকাকে গুরুত্ব দিতে শিখতে হবে। প্রয়োজনে দূরত্ব বাড়াতে হবে, আর দরকার হলে সম্পর্কের ইতি টানতে হবে। পজিটিভ ও নিরাপদ মানুষ আপনার মস্তিষ্কে এমন রাসায়নিক পরিবর্তন আনে, যা আপনাকে আবার আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। বিশ্বাসযোগ্য কাউকে বা পেশাদার কোন মেন্টর, কাউন্সিলর এর সাথে কথা বললে মানসিক চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে।
নিজের জীবনে শান্তি চাওয়াটা স্বার্থপরতা নয় এটা বাঁচার অধিকার।
আপনার অনুভূতি, আপনার মানসিক নিরাপত্তা কোনোটাই কারও হাতে জিম্মি থাকার কথা না।
মনে রাখবেন,
আপনার শান্তি আপনার অধিকার।
কাউকে সেই অধিকার কেড়ে নিতে দেবেন না।
এই ৭টি বাজে অভ্যাস আজই বাদ দিন।
সত্যি কথা বলতে কি, আমরা অনেকেই মনে করি সাকসেস বা Breakthrough হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো Breakthrough কোনো মিরাকল না, এটা একটা ট্রানজেকশন। আপনি আপনার বাজে অভ্যাসগুলো ত্যাগ করবেন, বিনিময়ে লাইফ আপনাকে নেক্সট লেভেলে নিয়ে যাবে।
এই ৭টি অভ্যাস যদি এখনই বাদ না দেন, বিশ্বাস করেন সামনের বছরটাও গত বছরের মতোই কাটবে।
০১ঃ Excitement দিয়ে শুরু করে মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া!
আমরা বাঙালিরা হুজুগে মাতি খুব দ্রুত। জিম হোক বা নতুন স্কিল শেখা শুরু করি সেই লেভেলের এনার্জি নিয়ে, কিন্তু দুইদিন পরেই সব ফুস। মনে রাখবেন, মোমেন্টাম তখনি তৈরি হয় যখন আপনি কনসিস্টেন্সি ধরে রাখেন। ডিসিপ্লিন ছাড়া ইমোশন দিয়ে ক্যারিয়ার হয় না।
০২ঃ Learning এর বদলে শুধুই Entertainment খোঁজা!
আপনার ব্রেইন কি ক্লান্ত? না, আপনার ব্রেইন আসলে Overstimulated। সারাদিন রিলস আর শর্টস স্ক্রল করে করে ব্রেইনটাকে ফোকাসহীন বানিয়ে ফেলছেন। যে কন্টেন্ট আপনাকে ড্রেইন করে দেয়, তা থেকে গ্রোথ আসবে না। নয়েজ কমান, নলেজ বাড়ান।
০৩ঃ Motivation এর জন্য বসে থাকা!
আজকে মুড নাই, কালকে করব এই রোগ যার আছে, তার উন্নতি অসম্ভব। সফল মানুষরা কাজের জন্য রেডি ফিল করার অপেক্ষা করে না, তারা কাজ করতে করতেই রেডি হয়। মোটিভেশন হলো মেহমানের মতো, আসে আর যায়। কিন্তু ডিসিপ্লিন হলো বাড়িওয়ালার মতো, ওটা পার্মানেন্ট।
০৪ঃ ভুল মানুষের সাথে মেলামেশা!
আপনার বন্ধু যদি আপনাকে বড় স্বপ্ন দেখতে ভয় দেখায়, তবে সে বন্ধু না সে আপনার ক্যারিয়ারের জন্য বাধা। এমন এনভায়রনমেন্টে আপনি কখনোই গ্রো করবেন না যেটা আপনাকে ছোট হয়ে থাকতে বলে। Your circle should be your fertilizer, not poison.
০৫ঃ Emotional Spending
মন খারাপ তাই খেয়ে নিলাম, ভালো লাগলো তাই কিনে ফেললাম। এই ইমপালস বায়িং আর ছোট ছোট খরচগুলোই ফিউচার ওয়েলথ নষ্ট করে দেয়। সেলফ কন্ট্রোল না থাকলে ফিন্যান্সিয়াল ফ্রিডম আসবে না।
০৬ঃ Mentor ছাড়া এলোমেলো ইনফরমেশন নেওয়া!
ইউটিউবে সব আছে, কিন্তু কোনো স্ট্রাকচার নেই। আর এটাই কনফিউশনের মূল কারণ। আপনার শুধু ইনফরমেশন দরকার নেই, দরকার রাইট ডিরেকশন এবং রোডম্যাপ। একজন মেন্টর বা গাইডের অধীনে শেখাটা আপনাকে ১০ গুণ ফাস্ট আগাবে।
০৭ঃ নিজেকে আপডেট না করে ভাগ্যকে দোষ দেওয়া!
দেশের অবস্থা ভালো না, আমার কপাল খারাপ এই অজুহাতগুলো দিয়ে আপনি নিজের স্ট্রাগলকেই শুধু রিপিট করছেন। মনে রাখবেন, ২০২৬ সাল আপনার অজুহাত শুনবে না, শুধু আপনার গ্রোথ দেখবে।
সোজা কথা মাছ ধরা শিখবেন নাকি অন্যের দেওয়া মাছের আশায় বসে থাকবেন? স্কিল ডেভেলপমেন্ট হলো Poverty থেকে বের হওয়ার ফাস্টেস্ট উপায়।
Collected
কাঁচা রসুনের উপাদান শরীরের ভেতরে কীভাবে কাজ করে জানলে অবাক হবেন
অনেক মানুষই কাঁচা রসুনের গন্ধ বা ঝাঁঝের কারণে এটিকে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু ভয়টা এখানেই যে এই ঝাঁঝের পেছনেই লুকিয়ে আছে শক্তিশালী কিছু উপাদান। শরীর যখন নিয়মিত চাপ, সংক্রমণ বা দুর্বলতার মধ্যে থাকে তখন প্রাকৃতিক সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। ঠিক সেই জায়গাতেই কাঁচা রসুন নিয়ে গবেষকদের আগ্রহ বেড়েছে। কারণ এর প্রভাব চোখে না পড়লেও ভেতরে কাজ শুরু হয়।
চমক হলো কাঁচা রসুন কাটার বা চিবানোর সঙ্গে সঙ্গে allicin নামে একটি সক্রিয় যৌগ তৈরি হয়। গবেষণা বলছে এই allicin শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করতে ভূমিকা রাখে। এটি সরাসরি জীবাণু মারার চেয়ে শরীরকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে। তাই অনেকেই নিয়মিত কাঁচা রসুন খেলে সহজে অসুস্থ হন না।
গবেষণায় দেখা গেছে allicin রক্তনালীর ভেতরের প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। প্রদাহ কমলে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকে এবং হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ কম পড়ে। এজন্য কাঁচা রসুনকে হৃদযন্ত্রবান্ধব বলা হয়। তবে এটি কোনো ওষুধ নয়, বরং একটি পুষ্টিগত সহায়তা।
কাঁচা রসুন হজম ব্যবস্থায়ও আলাদা ভূমিকা রাখে। গবেষণা বলছে এটি হজম এনজাইমের কার্যকারিতা বাড়াতে পারে। ফলে খাবার সহজে ভাঙে এবং গ্যাস জমার প্রবণতা কমে। যাদের পেট ভার বা ঢেকুরের সমস্যা আছে তারা এজন্য কাঁচা রসুনে উপকার পান।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কাঁচা রসুনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রভাব। শরীরে যখন অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ে তখন কোষ দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষণা বলছে রসুনের উপাদান এই চাপ কমাতে সহায়তা করে। এতে কোষ দীর্ঘদিন কার্যক্ষম থাকে।
চমকপ্রদ বিষয় হলো কাঁচা রসুন রক্তে শর্করার ভারসাম্যেও পরোক্ষভাবে সাহায্য করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতাকে সাপোর্ট করে। তাই কিছু ডায়াবেটিক রোগী সীমিত পরিমাণে কাঁচা রসুন খেলে ভালো সাড়া পান। তবে এটি কখনোই চিকিৎসার বিকল্প নয়।
ভয় এখানেই যে অনেকেই কাঁচা রসুন অতিরিক্ত খাওয়া শুরু করেন। এতে মুখে জ্বালা, পেটে অস্বস্তি বা গ্যাস্ট্রিক বাড়তে পারে। যাদের আলসার বা সংবেদনশীল পাকস্থলী আছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা বেশি হয়। তাই কাঁচা রসুন সবার জন্য একভাবে উপযোগী নয়।
সমাধান হলো সঠিক পদ্ধতি ও পরিমাণ। গবেষণা বলছে অল্প পরিমাণ কাঁচা রসুন চূর্ণ করে কিছুক্ষণ রেখে খেলে allicin ভালোভাবে তৈরি হয়। খালি পেটে না খেয়ে খাবারের সঙ্গে বা পরে খেলে অনেকের জন্য আরামদায়ক হয়। নিয়মিত কিন্তু সীমিত ব্যবহারেই উপকার দেখা যায়।
যারা বারবার সংক্রমণ, হজমের সমস্যা বা সারাদিনের ক্লান্তিতে ভোগেন তারা কাঁচা রসুনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন অনুভব করতে পারেন। তবে যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ বা নিয়মিত ওষুধ চলে তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ রসুন কিছু ওষুধের সাথে প্রতিক্রিয়া করতে পারে।
অর্থাৎ কাঁচা রসুন কোনো অলৌকিক উপাদান নয়। কিন্তু গবেষণাভিত্তিকভাবে এর সক্রিয় উপাদান শরীরের প্রতিরোধ, হজম ও কোষের ভারসাম্যে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সঠিক প্রত্যাশা ও সচেতন ব্যবহারে কাঁচা রসুন দৈনন্দিন স্বাস্থ্যচর্চায় একটি কার্যকর সহায়ক হতে পারে।
১ প্লেট ভাত খাওয়ার পর শরীরে কি ঘটে?
এক প্লেট ভাত খাওয়ার পর শরীরে প্রথম যে পরিবর্তনটি হয় তা হলো শক্তির সরবরাহ শুরু হওয়া। ভাতে থাকা কার্বোহাইড্রেট হজম হয়ে গ্লুকোজে রূপ নেয়। এই গ্লুকোজই শরীরের প্রধান জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। তাই ভাত খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকেই শক্তি ও সতেজতা অনুভব করেন।
চমক হলো এই প্রক্রিয়াটি সবার শরীরে একরকম হয় না। গবেষণা বলছে কারও মেটাবলিজম দ্রুত, কারও ধীর। যার মেটাবলিজম ধীর, তার ক্ষেত্রে একই প্লেট ভাত রক্তে শর্করা তুলনামূলক দ্রুত বাড়াতে পারে। এখান থেকেই ভয় শুরু হয় ভাত নিয়ে।
ভাত খাওয়ার পর রক্তে শর্করা বাড়লে ইনসুলিন নিঃসরণ হয়। ইনসুলিনের কাজ হলো গ্লুকোজকে কোষের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া। এতে শরীর শক্তি ব্যবহার করতে পারে। যদি ইনসুলিন ভালোভাবে কাজ করে, তাহলে এই প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই সম্পন্ন হয়।
চমকপ্রদ বিষয় হলো এক প্লেট ভাত খাওয়ার পর মস্তিষ্কেও প্রভাব পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার পর সেরোটোনিন নিঃসরণ বাড়তে পারে। এর ফলে মন কিছুটা শান্ত লাগে। অনেকেই ভাত খাওয়ার পর স্বস্তি অনুভব করেন, এর পেছনে এই হরমোন কাজ করে।
তবে ভয় এখানেই যে ভাত খাওয়ার পর যদি শর্করা খুব দ্রুত বাড়ে, তাহলে কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দুর্বলতা বা ঘুম ভাব আসতে পারে। গবেষণা এটাকে blood sugar spike and dip বলে। এটা বেশি হয় যখন ভাতের সাথে ফাইবার বা প্রোটিন কম থাকে।
এক প্লেট ভাত পাকস্থলীতেও চাপ তৈরি করে। ভাত হজম করতে পাকস্থলী ও অন্ত্রকে কাজ করতে হয়। যদি পরিমাণ বেশি হয় বা খুব দ্রুত খাওয়া হয়, তাহলে পেট ভার লাগতে পারে। বদহজম বা গ্যাসের অনুভূতিও তখন দেখা যায়।
চমক হলো ভাত খাওয়ার পর শরীর কিছুটা তাপ উৎপাদন করে। হজম প্রক্রিয়ায় শক্তি লাগে। একে thermic effect of food বলা হয়। যদিও ভাতে এই প্রভাব খুব বেশি নয়, তবুও শরীর সক্রিয় থাকে।
ভাত খাওয়ার পর শরীর সিদ্ধান্ত নেয় গ্লুকোজ কীভাবে ব্যবহার হবে। যদি আপনি শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকেন, তাহলে এই গ্লুকোজ শক্তি হিসেবে খরচ হয়। যদি দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন, তাহলে অতিরিক্ত অংশ চর্বি হিসেবে জমার সম্ভাবনা বাড়ে।
এখানেই আসে খাওয়ার নিয়মের গুরুত্ব। গবেষণা বলছে এক প্লেট ভাত একা খাওয়ার চেয়ে ভাতের সাথে শাকসবজি ও প্রোটিন থাকলে রক্তে শর্করা ধীরে বাড়ে। এতে ইনসুলিনের ওপর চাপ কম পড়ে।
ভাতের ধরনও প্রভাব ফেলে। কম পালিশ চাল বা আতপ চাল হজম ধীরে করে। এতে পেট বেশি সময় ভরা থাকে। সাদা অতিরিক্ত পালিশ চাল তুলনামূলক দ্রুত শর্করা বাড়ায়।
ভাত খাওয়ার সময় যদি আপনি ধীরে খান, তাহলে মস্তিষ্ক পেট ভরার সংকেত ঠিকমতো পায়। গবেষণা বলছে এতে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে। দ্রুত খেলে এক প্লেট কখন দুই প্লেট হয়ে যায় তা বোঝাই যায় না।
ভাত খাওয়ার পর হালকা হাঁটা শরীরের জন্য উপকারী। এটি রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে খাবারের পর হাঁটা ডায়াবেটিস ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
তবে এটাও সত্য যে ভাত খাওয়ার পরই মেদ গলে যাবে এমন কিছু ঘটে না। ভাত কোনো ফ্যাট বার্নার নয়। আবার ভাত খেলেই শরীর থলথলে হয়ে যাবে এমনও নয়। সবকিছু নির্ভর করে দৈনিক মোট খাবার ও চলাফেরার ওপর।
যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ক্ষেত্রে এক প্লেট ভাতের প্রভাব আরও গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা বলছে পরিমাণ, সময় ও সাথে কী খাওয়া হচ্ছে এগুলো ঠিক থাকলে ভাত পুরোপুরি বাদ দেওয়ার দরকার হয় না।
রাতে এক প্লেট ভাত খাওয়ার পর শরীরে শক্তি খরচের সুযোগ কম থাকে। তাই রাতে ভাতের পরিমাণ কম রাখা অনেকের জন্য উপকারী। দিনে বা দুপুরে ভাত খেলে শরীর সেই শক্তি কাজে লাগাতে পারে।
সমাধান হলো ভাতকে শত্রু ভাবা নয়। বরং ভাতকে বুঝে খাওয়া। প্লেটের অর্ধেক শাকসবজি, এক অংশ ভাত আর এক অংশ প্রোটিন রাখলে শরীর ভারসাম্য পায়।
অর্থাৎ এক প্লেট ভাত খাওয়ার পর শরীরে শক্তি তৈরি হয়, হরমোনে পরিবর্তন আসে, হজম প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়। এই প্রক্রিয়া উপকারও করতে পারে, আবার ভুল নিয়মে ক্ষতির দিকেও যেতে পারে।
গবেষণাভিত্তিকভাবে বলা যায় সঠিক সময়, সঠিক পরিমাণ ও সঠিক উপায়ে ভাত খেলে শরীরের জন্য এটি সমস্যা নয়। সচেতনভাবে খাওয়াই এখানে সবচেয়ে বড় সমাধান।
দুধ চা কতটা নিরাপদ যারা রক্তস্বল্পতা ও অ্যাসিডিটিতে ভুগছেন
দুধ চা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের খুব পরিচিত একটি অভ্যাস। অনেকের সকাল শুরুই হয় দুধ চা দিয়ে, আবার কারও দিনে কয়েক কাপ না হলে স্বস্তি আসে না। কিন্তু যাদের রক্তস্বল্পতা বা অ্যাসিডিটির সমস্যা আছে, তাদের জন্য এই অভ্যাস কতটা নিরাপদ, সেটাই বড় প্রশ্ন। ভয়টা এখানেই যে নিয়মিত দুধ চা খাওয়া কিছু সমস্যাকে নীরবে বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই বিষয়টি বুঝে নেওয়া জরুরি।
চমক হলো চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে দুধ চা নিজে কোনো বিষ নয়, কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট অবস্থায় এটি সমস্যার কারণ হতে পারে। রক্তস্বল্পতার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো আয়রন শোষণ। গবেষণায় দেখা গেছে চায়ে থাকা ট্যানিন আয়রনের সাথে যুক্ত হয়ে শোষণ কমিয়ে দেয়। এর ফলে খাবার থেকে পাওয়া আয়রন শরীর ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দুধ। দুধে থাকা ক্যালসিয়ামও আয়রন শোষণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ দুধ ও চা একসাথে হলে আয়রনের ওপর দ্বিগুণ প্রভাব পড়ে। এজন্য রক্তস্বল্পতায় ভোগা মানুষদের ক্ষেত্রে নিয়মিত দুধ চা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
চমকপ্রদ বিষয় হলো অনেক মানুষ আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার পরই দুধ চা পান করেন। গবেষণা বলছে এতে ওষুধের কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে। তাই সময়ের ভুল সিদ্ধান্ত পুরো চিকিৎসাকে দুর্বল করে দিতে পারে।
এখন আসি অ্যাসিডিটির কথায়। চা পাকস্থলীতে অ্যাসিড নিঃসরণ বাড়াতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ আছে। খালি পেটে দুধ চা খেলে এই প্রভাব আরও বেশি হয়। ফলে বুক জ্বালা, টক ঢেঁকুর বা পেট ভার লাগার সমস্যা বাড়ে।
অনেকে ভাবেন দুধ থাকলে চা নরম হয়। কিন্তু গবেষণা বলছে দুধ পাকস্থলীতে হজমকে ধীর করে। এতে অ্যাসিডিটি কমার বদলে অনেক সময় ভারীভাব তৈরি হয়। বিশেষ করে যাদের গ্যাস্ট্রিক দীর্ঘদিনের সমস্যা, তাদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়।
ভয় এখানেই যে এই সমস্যাগুলো একদিনে বোঝা যায় না। ধীরে ধীরে ক্লান্তি বাড়ে, মাথা ঘোরে, বুক জ্বালা নিয়মিত হয়। তখন মানুষ বুঝতেই পারে না এর পেছনে দৈনন্দিন দুধ চা কাজ করছে।
তবে চমক হলো দুধ চা পুরোপুরি বাদ দেওয়ার দরকার সবার নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, পরিমাণ ও সময় ঠিক থাকলে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। এটিই সবচেয়ে বাস্তব সমাধান।
এখন আসি খাওয়ার নিয়মে। রক্তস্বল্পতায় ভোগা মানুষদের উচিত খাবার বা আয়রনসমৃদ্ধ খাবারের অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা পরে দুধ চা খাওয়া। এতে আয়রন শোষণে বাধা কম পড়ে।
আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার আগে বা পরে দুধ চা এড়িয়ে চলা সবচেয়ে নিরাপদ। এই একটি অভ্যাস বদলালেই অনেক ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিন বাড়ার গতি ভালো হয়।
অ্যাসিডিটির ক্ষেত্রে খালি পেটে দুধ চা না খাওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম। নাশতার পরে বা দুপুরের দিকে খেলে পাকস্থলী তুলনামূলক নিরাপদ থাকে।
চায়ের রং হালকা রাখা খুব জরুরি। গাঢ় চায়ে ট্যানিন বেশি থাকে। হালকা দুধ চা অ্যাসিডিটি ও আয়রন উভয়ের জন্য তুলনামূলক কম ক্ষতিকর।
দিনে এক কাপের বেশি দুধ চা না খাওয়াই ভালো। গবেষণা বলছে অতিরিক্ত ক্যাফেইন অ্যাসিডিটি ও ঘুমের সমস্যা বাড়াতে পারে। ঘুম কম হলে রক্তস্বল্পতার উপসর্গ আরও তীব্র হয়।
যারা দুধ চা ছাড়তে পারছেন না তারা মাঝে মাঝে দুধ ছাড়া চা বা ভেষজ চা বেছে নিতে পারেন। এতে ট্যানিন ও ক্যালসিয়ামের প্রভাব একসাথে পড়ে না।
যাদের ল্যাকটোজ সহ্য হয় না তাদের ক্ষেত্রে দুধ চা অ্যাসিডিটি আরও বাড়াতে পারে। এই বিষয়টিও মাথায় রাখা জরুরি।
সমাধান হলো ভয় নয়, সচেতনতা। দুধ চা আপনার জন্য ক্ষতিকর হবে কি না, তা নির্ভর করে আপনার শারীরিক অবস্থা ও অভ্যাসের ওপর। এক নিয়ম সবার জন্য এক নয়।
রক্তস্বল্পতা ও অ্যাসিডিটি একসাথে থাকলে দুধ চা নিয়ে বাড়তি সতর্কতা দরকার। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ পথ।
অর্থাৎ দুধ চা পুরোপুরি নিষিদ্ধ নয়, আবার একেবারে নিরাপদও নয়। গবেষণাভিত্তিকভাবে বলা যায় সঠিক সময়, সঠিক পরিমাণ ও সঠিক নিয়ম মেনে খেলে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। নিজের শরীরের সংকেত বোঝাই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
১৯২৪ সালে ওসমানীয় খিলাফত বিলুপ্ত হওয়ার পর, মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বাধীন নতুন তুর্কি প্রজাতন্ত্র দ্রুত এমন কিছু আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেয়, যার মাধ্যমে তুরস্কে ওসমানীয় পরিবারের রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিক অস্তিত্বের অবসান ঘটে।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ওসমানীয় পরিবারের সদস্যদের তুর্কি নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়, তাদের সম্পত্তি ও অর্থ রাষ্ট্রীয়ভাবে জব্দ করা হয়, এবং তুরস্কের ভূখণ্ডে বসবাস নিষিদ্ধ করে নির্বাসনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এমনকি সিদ্ধান্তে এটাও অন্তর্ভুক্ত ছিল যে, ভবিষ্যতে পরিবারের কোনো সদস্যকে তুরস্কের মাটিতে দাফন করা যাবে না।
এই নির্বাসন আইন তৎকালীন তুরস্কের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ ধারার ভেতরে কারা এই আইনের আওতায় পড়বে, তা নিয়ে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়।
কিছু চরমপন্থী মহল দাবি তোলে, সিদ্ধান্তটি শুধু জীবিত সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে অতীতে মৃত ওসমানীয় সুলতানদের দেহাবশেষও তুরস্কের বাইরে সরিয়ে নেওয়া হোক!
শেষ খলিফা ২য় আবদুল মজিদ তখন দোলমাবাহচে প্রাসাদে অবস্থান করছিলেন। প্রচলিত বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি ‘মঁতেনের প্রবন্ধসমূহ’ পড়ছিলেন, ঠিক তখনই ইস্তাম্বুলের পুলিশপ্রধান আদনান বেগ সেখানে প্রবেশ করে তাঁকে জানান যে, ওসমানীয় পরিবারকে নির্বাসনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং পরদিন ভোরের মধ্যেই শহর ছাড়তে হবে।
খবরটি শোনার পর পরিবার ও প্রাসাদের কর্মচারীদের মধ্যে শোক ও কান্নার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ২য় আবদুল মজিদ তাঁর পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। তাদের পেছনে ছিল লাগেজ বোঝাই তিনটি গাড়ি। বহরটি বায়েজিদ মসজিদ ও গালাতা সেতু অতিক্রম করে দুপুর প্রায় এগারোটার দিকে চাতালজা রেলস্টেশনে পৌঁছায়।
বর্ণনাগুলোতে বলা হয়, দীর্ঘ যাত্রায় পরিবারের সদস্যরা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ক্ষমতা ও মর্যাদা হারানোর গভীর শোক।
রাতের মধ্যভাগে ‘ইস্ট এক্সপ্রেস’ ট্রেন এসে পৌঁছায়। নির্বাসনে পাঠানোর জন্য ট্রেনের দুটি বগি বিশেষভাবে ওসমানীয় পরিবারের জন্য বরাদ্দ করা হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় তাদের দীর্ঘ নির্বাসন যাত্রা।
রাষ্ট্রীয় জব্দের আওতায় আসে ওসমানীয় পরিবারের বিপুল সম্পদ। এর মধ্যে ছিল তোপকাপি প্রাসাদ, দোলমাবাহচে প্রাসাদ, ইয়িলদিজ প্রাসাদ এবং রাজকীয় গহনার সংগ্রহ। এই গহনাগুলোর মধ্যে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রুবি ও সবচেয়ে বড় পান্নার মতো দুর্লভ রত্নও ছিল।
ইস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনটি চাতালজা থেকে ফ্রান্সের নিস শহরের দিকে যাত্রা করে। সেখান থেকে ওসমানীয় পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। তাদের কেউ যান ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে। আবার কেউ আশ্রয় নেন সিরিয়া, মিসর ও লেবাননের মতো আরব দেশগুলোতে।
বিদেশে গিয়ে ওসমানীয় পরিবার চরম সংকটের মুখোমুখি হয়। তাদের কাছে ছিল না কোনো ব্যাংক হিসাব, পাসপোর্ট কিংবা কূটনৈতিক নথি। এই পরিস্থিতিতে অনেক সদস্য চরম দারিদ্র্যে জীবন কাটান। কেউ কেউ প্রতিবেশীদের সহায়তার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। আবার কেউ কেউ রাজকীয় জীবন থেকে হঠাৎ দারিদ্র্যের বাস্তবতায় মানিয়ে নিতে না পেরে মারাত্মক মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হন।
এভাবেই ওসমানীয় পরিবার ধীরে ধীরে তুরস্কের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সম্পূর্ণভাবে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
দীর্ঘ কয়েক দশক পর পরিবারের সদস্যদের তুরস্কে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৫২ সালে, নির্বাসনের প্রায় ৩০ বছর পর, নারী সদস্যদের দেশে ফেরার সুযোগ দেওয়া হয়। পুরুষ সদস্যদের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা ওঠে আরও দেরিতে, ১৯৭৪ সালে- প্রায় ৫০ বছর পর।
এই সিদ্ধান্তগুলোর মাধ্যমে রাজনৈতিক ও আইনি দিক থেকে ওসমানীয় খিলাফতের অধ্যায় চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক শতাব্দী ধরে চলা এক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে, এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ওসমানীয় পরিবারের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্থায়ীভাবে স্থান করে নেয়।
অনেকেই মনে করেন, পাকিস্তানের সাথে থাকলে হয়তো আমরা সামরিকভাবে আরও শক্তিশালী ও পারমাণবিক শক্তিধর হতাম। কিন্তু ইতিহাস ও সামরিক কৌশল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, স্বাধীনতা বরং বাংলাদেশকে সামরিকভাবে অস্তিত্বহীন হওয়া থেকে রক্ষা করেছে।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান ছিল আক্ষরিক অর্থেই অরক্ষিত। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এখানে মাত্র একটি ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন, নামমাত্র কিছু ট্যাংক এবং মাত্র ১২টি যুদ্ধবিমান ছিল। নৌ ও বিমানবাহিনীর সদরদপ্তরও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ভারত চাইলে তখন খুব সহজেই পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিতে পারত। পশ্চিম পাকিস্তানের অদ্ভুত সামরিক নীতি ছিল— "পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশ্চিমে নিহিত (The defense of East Pakistan lies in the West)।" অর্থাৎ, আমাদের নিরাপত্তা তারা ভারতের দয়ার ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। মূলত এই অরক্ষিত অবস্থার কারণেই ৬ দফায় আলাদা সামরিক কমান্ডের দাবি তোলা হয়।
জুনাগড় কিংবা ১৯৭১-এর লজিস্টিক ব্যর্থতাই প্রমাণ করে যে, হাজার মাইল দূর থেকে এ দেশ রক্ষা করা পাকিস্তানের পক্ষে অসম্ভব ছিল। গুজরাটের সাথে লাগোয়া এবং পাকিস্তানের খুব কাছে থাকা মুসলিম শাসিত রাজ্য ভারত জোর করে দখল করলেও পাকিস্তান তেমন কিছুই করতে পারে নি। বাংলাদেশ হবার পর আজ আমাদের ৯-১০ টি ডিভিশন, আধুনিক যুদ্ধবিমান ও ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী রয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী আরও উন্নতি করা প্রয়োজন এতে কোন সন্দেহ নেই। পাকিস্তানের সাথে থাকলে আমাদের অর্থ ও সম্পদ পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তায় ব্যয় হতো, আর আমরা সেই ১৯৬৫ সালের মতোই অরক্ষিত ও অবহেলিত থেকে যেতাম।
এই প্রসংগে বাংলাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদ এর "আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর" বইতে একটা ঘটনার উল্লেখ আছে। ১৯৫৫ র দিকে লেখকের সাথে আয়ুব খানের(আইয়ুব তখন সেনা প্রধান) দেখা হলে, লেখক আইয়ুব খানের কাছে জানতে চায় পুর্ব পাকিস্তানে এত কম সৈন্য মোতায়ন কেন? অর্ধেক পাকিস্তান হিসাবে এখানে অর্ধেক পাকিস্তানি সেনা থাকা উচিত। আইয়ুব তখন উত্তর দেয় সেনা অর্ধেক করে দুই অংশে রাখলে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা দুর্বল হতে যাবে। আর তোমাদের (পুর্ব পাকিস্তানের) এমন কিছুই নেই, যার জন্য তোমাদের কেউ আক্রমন করবে। লেখক তখন ভারতের উধাহরন বাদ দিয়ে বলে দক্ষিনের সমুদ্র দিয়ে বিদেশী কেউ যদি আক্রমন করে? এটা শুনে আইয়ুব বিরাট অট্টহাসি দিয়ে আবারও বলে "তোমাদের এমন কিছুই নেই যার জন্য তোমাদের কেউ আক্রমন করবে"
বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তকে কবর দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার -
আবুল আসাদ
(১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে বাংলাদেশে দুই ধরণের ন্যারেটিভ প্রচলিত আছে। আজ দুই ধরণের আলাপই পোস্ট করবো। এটা দ্বিতীয় ন্যারেটিভ।)
জাতির ইতিহাসে ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। অবশ্য ১৬ ডিসেম্বর ৭২-এর পর কয়েক বছর পর্যন্ত মওলানা ভাসানী ১৬ ডিসেম্বরকে কাল দিবস হিসেবে উদযাপন করেছেন। এটা ছিল তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। এর পক্ষে তার শক্তিশালী যুক্তিও ছিল। বলা হয়—যখন জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন; তখন (ভারতীয়) জেনারেল অরোরার সঙ্গে ছিলেন ১০০ জন ভারতীয় ব্যবসায়ীর একটি দল, ১৫০ জন সাংবাদিক এবং ২০০ জন আমলা (দি টেলিগ্রাফের রিপোর্ট, সাংবাদিক আকবর ইমাম, ১৬ ডিসেম্বর-১৯৯২)। মনে করা হয়—এসব ব্যবসায়ী ও আমলারা এসেছিলেন বাংলাদেশের ব্যবসা ও প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য। অর্থাৎ, এইদিন বাংলাদেশকে নতুন করে পরাধীন করার আয়োজন হয়েছিল। এছাড়া আরো অনেক যুক্তি মওলানা ভাসানীর ছিল।
যাক এসব কথা! ১৬ ডিসেম্বর ৭১-এ যাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ ছিল, সেই পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং আমাদের দেশ ও জনগণ মুক্ত হয়। ডিসেম্বর ৭১-এ আরেকটা বড় ঘটনা ঘটে, সেটা বুদ্ধিজীবী হত্যা। বিজয়ের আলোয় যখন দেশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, ঠিক সে সময় বাংলাদেশের কিছু খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, পেশাজীবী বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চোখ বন্ধ করে এর দায় চাপানো হয় রাজাকার, আলবদর এবং পাকিস্তান বাহিনীর ওপর। সে সময়ের জন্যে এটাই ছিল স্বাভাবিক। পরবর্তীকালেও এ নিয়ে ব্লেম-গেম চলেছে, কিন্তু কোনো তদন্ত, অনুসন্ধান হয়নি, সত্যও উদঘাটিত হতে পারেনি। দায় চাপানো, দায় এড়ানোর কাজ কিন্তু খুব জোরেশোরেই চলেছে-চলছে। সৈয়দ মবনু তার ‘লাহোর থেকে কান্দাহার’ বইতে আত্মসমর্পণকারী একজন পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে তার এক কথোপকথনের বিবরণ এভাবে লিখেছেন—
‘আপনারা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলেন কেন?’
রাও ফরমান আলী : ... ‘তখন ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে ঢাকাসহ গোটা পূর্ব পাকিস্তান ছিল। আমার প্রশ্ন হলো—তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করল কে? আমি মনে করি, এ জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তবে তা অবশ্যই ভারতকে।
‘আচ্ছা বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে রাজাকার বাহিনী কি জড়িত ছিল?’
‘আমি কী বলব। তবে আমার ধারণা ওরা জড়িত ছিল না। কারণ আমাদের আত্মসমর্পণের দুদিন আগেই ওরা পালাতে শুরু করে। রাজাকারদের অবস্থা (ছিল) না ঘরকা না ঘটকা। তাদের পক্ষে এত বড় কাজ করার সুযোগই ছিল না।’
‘তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন ভারত করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—তারা করবে কেন?’
‘হ্যাঁ, ভারত করতে পারে। আমাদের বা রাজাকারদের যে কারণে সন্দেহ করা হচ্ছে, একই কারণে ভারতও করতে পারে।’ (আবাবীল পাবলিকেশন্স, ২০০০, পৃষ্ঠা : ১৫৬-১৫৭)
আরেকটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৯৯২ ক ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। সাংবাদিক আকবর ইমাম স্বনামে অধুনালুপ্ত ‘দি টেলিগ্রাফ’ নামক ইংরেজি দৈনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বরাত দিয়ে লেখেন, ‘১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঐ শিক্ষক তাকে জানান যে, ভারতের ছত্রীসেনারা ৮ ডিসেম্বরের মধ্যেই ঢাকায় অবতরণ করে এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এই কথা জানতে পেরে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভারতীয়রা আত্মসমর্পণের মুহূর্তটি দুদিন পিছিয়ে ধার্য করে ১৬ ডিসেম্বর। এ সময়ের মধ্যে বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর তারা বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।’ (আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল, সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৫৭৫-৫৭৬, বুকস ফেয়ার, মে ২০০৪)
সরকার শাহাবুদ্দীন তার ‘আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল’ গ্রন্থে লেখেন, ‘একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের দিকে ঢাকা শহরে রাজাকার, আলবদরদের কোনো কার্যকারিতা ছিল না। সে সময় কারা হত্যা করেছিল নিজ নিজ গৃহে অবস্থানকারীদের—এ নিয়ে ৩৩ বছর ধরে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। নিহত বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের চাপে পরবর্তীকালে যে তদন্ত কমিশন (দেশি) গঠন করা হয়েছিল, এর রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। যখন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। অথচ রহস্যজনক কারণে এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে—রাজাকার-আলবদররা যদি সত্যি সত্যিই এর জন্য দায়ী হয়ে থাকে, তাহলে তখনই তাদের বিচার করে কঠোর শাস্তি দেওয়া হলো না কেন? যুদ্ধের পরপরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং শাস্তিই তো স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু কেন কোনো সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সব ব্যাপারকে রহস্যময় করে রাখা হলো?’ (ওই, পৃষ্ঠা : ৫৭১)
শুধু রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়া নয়, বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত সংগৃহীত দলিলপত্রও গুম করে ফেলা হয়। উল্লেখ্য, বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং তার কয়েক দিন পর শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের ছোট ভাই প্রতিভাবান, অনুসন্ধিৎসু ও সাহসী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানও গুম হন। বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো তারও গুম বা হত্যার কোনো তদন্ত হয়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যার দলিলপত্রের মতো জহির রায়হানের গুম হওয়া-সংক্রান্ত পুস্তকাদি এবং তার সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ ফুটেজ, রেকর্ড ও দলিলও গুম হয়ে যায়। এ সম্পর্কে শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার (জহির রায়হানের ভাবি) দৈনিক বাংলার বাণীতে ১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৯ (১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দ) তারিখে প্রকাশিত তার ‘কবিতা মিলনকে মিথ্যা সান্ত্বনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, ‘৩০ জানুয়ারি (১৯৭২) জহির রায়হান একটি ফোন পেয়ে মিরপুর ছুটে গিয়েছিলেন। এ কথা বহুবার লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে। কিন্তু বলা হয়নি সেলিমের (প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর স্টাফ অফিসার) কথা। সেদিন সেলিমও সে রকমেরই একটি ফোন পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীকে না বলেই জহির রায়হানের সঙ্গে মিরপুর ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর দুজনের ভাগ্যের একই নিষ্ঠুর পরিণতি। দুজনই নিখোঁজ। সেলিমের মা এ সংবাদ পেয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। সেলিম বঙ্গভবনের যে ঘরটিতে থাকতেন, ইত্যবসরে সে ঘর থেকে সব কাগজপত্র, কাপড়-চোপড় উধাও। শহীদ সেলিমের মা অনেক চেষ্টা করেও কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। রহস্য রহস্যই থেকে গেল। জহির রায়হানও নিখোঁজ হওয়ার পর বুদ্ধিজীবী হত্যার কোনো ধরনের কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাগজপত্রগুলো কোনো হদিসই পাওয়া গেল না। শহীদ সেলিমের মায়ের মতে, বঙ্গভবনের ওর ঘর থেকে যে প্রয়োজনীয় কাগজগুলো উধাও হয়েছিল, সেগুলো সম্ভবত তদন্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রই হবে। খোদ বঙ্গভবন থেকে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যাবে, তা ভাবতেও বিশ্বাস হয় না। শহীদ সেলিম বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন, এ কথা আমি আগে থেকে জানতাম না। আমি কেন আর কেউ জানে কি না, তাও জানি না। সেলিমের নিখোঁজ রহস্য যেমন গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত হয়নি, তেমনি জহির রায়হানের নিখোঁজ রহস্যও গুরুত্বের সঙ্গে উদঘাটিত করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। অথচ এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র।’ ...পান্না কায়সার আরো বলেছেন, ‘খোদ বঙ্গভবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উধাও হয়ে যাবে, সেটা ভাবনারও অতীত। স্বধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্টের ভবন থেকে কাগজপত্র উধাও করতে পারে কারা? রাজাকার বা পাকিস্তানপন্থিরা অবশ্যই নয়। এটা করা সম্ভব একমাত্র তাদের পক্ষে, যারা ক্ষমতার আশপাশে ছিলেন।’ কাগজপত্র, দলিলাদি উধাও করা এবং জহির রায়হান ও সেলিমকে গুম করার কাজে ক্ষমতার আশপাশের লোকরা জড়িত থাকতে পারেন, আবার ক্ষমতার মাথার ওপরের লোকরাও হতে পারেন। তারা শেখ মুজিব ও তার সরকারের চেয়েও শক্তিমান হতে পারেন। একটা ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্ধানে মিরপুর গিয়ে জহির রায়হানও গুম হয়ে গেলে তার বড় বোন নাফিসা কবির এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় হইচই শুরু করেন। তখন ক্ষমতাসীন শেখ মুজিব তাকে ডেকে বলেন, ‘জহিরের নিখোঁজ নিয়ে এ রকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে।’ (আজকের কাগজ, ৮ ডিসেম্বর, ১৯৯৩) এরপর নাফিসা কবির নীরব হয়ে যান। (‘রাহুর কবলে বাংলাদেশ’, সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ)
জহির রায়হানের বড় বোনকে শেখ মুজিবের এই শাসনের অর্থ হতে পারে—তিনি জানতেন কারা কিডন্যাপকারী, যাদের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অথবা হতে পারে তারা তার সরকারের চেয়েও শক্তিশালী কেউ। এই ‘কেউ’ যে ভারত হতে পারে, সেটাই তখনকার জন্য স্বাভাবিক। তবে অনেকেই মনে করেন, বুদ্ধিজীবী হত্যা, জহির রায়হানের নিখোঁজের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের যে উটপাখিতুল্য ভূমিকা, তাতে মনে হয়—বুদ্ধিজীবী হত্যা ও জহির রায়হানের নিখোঁজ বা হত্যার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো মহল জড়িত থাকতে পারে। এর পেছনে দুটি বড় কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রথমত, কলকাতার প্রবাসী আওয়ামী লীগার এবং আওয়ামী সরকার জহির রায়হানকে ভালো চোখে দেখত না। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে জহির রায়হান কলকাতায় গিয়ে খেয়ে-বসে আয়েশি জীবন কাটাননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের গ্রিন রুম হিস্ট্রি তৈরি করেছিলেন।’ কলকাতার বিলাসবহুল হোটেলে মেয়ে নিয়ে পড়ে থাকা শুধু নয়, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ, আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসহীন বাঙালিদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র, প্রভৃতির প্রামাণ্য দলিল জহির রায়হান সংগ্রহ করেন। ঢাকায় এসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রচুর প্রভাবশালী লোকের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জহির রায়হান ঘোষণা দেন—বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনে নীলনকশা তার কাছে আছে, যা প্রকাশ করলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই নেওয়া অনেক নেতার কুকীর্তি ফাঁসহয়ে পড়বে। ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এই প্রেস ক্লাবে ফিল্ম শো প্রমাণ করে দেবে কার কী চরিত্র ছিল।’ (‘ভাসানী, মুজিব, জিয়া’; জীবলু রহমান, পৃষ্ঠা : ২৬)
কিন্তু জহির রায়হানের জীবনে প্রেস ক্লাবে আসা আর হয়নি। ৩০ জানুয়ারি সকালে কায়েতটুলীর বাসায় জহির রায়হানের কাছে টেলিফোন আসে, শহীদুল্লাহ কায়সার মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে আছে। তিনি মিরপুরে ছুটে যান। সেই গেলেন আর ফিরে আসেননি।
দ্বিতীয়ত, ‘শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনির চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবেরসহ অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করলেও আওয়ামী লীগের অনুসারী ছিলেন না। এদের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিভূ, চূড়ান্ত বিচারে শ্রম-শোষক বা শ্রেণিশত্রু।... দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে। আওয়ামী লীগের মতো পেটুবুর্জোয়া সংগঠন দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম হবে না।
এখানেই ছিল আওয়ামী লীগারদের ভীতি।’ (‘ভাসানী, মুজিব, জিয়া’, জিবলু রহমান, পৃষ্ঠা : ৩১-৩২) এই ভীতির ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া গেছে মুক্তিযুদ্ধকালে বাম ও আওয়ামী বৈরিতা ও প্রাণঘাতী সংঘাতের মধ্যে। এ ছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কারো কারো সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর সুসম্পর্ক ইত্যাদি কারণেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে পড়েছিল। ঢাবি শিক্ষক অধ্যাপক মুনির চৌধুরী এবং ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা যায়।
পরলোকগত ‘ড. নীলিমা ইব্রাহিম এক নিবন্ধে বলেন, ৭১ সালের শেষদিকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে বলে গেল; যেন মুনির স্যারকে সতর্ক করে দেয়।’ এ থেকে নিশ্চিত বোঝা যায়, অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর ওপর মুক্তিযোদ্ধারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্তু পরে খবর যা রটল, তাতে দেশবাসী জানে অধ্যাপক মুনির চৌধুরী আলবদরদের হাতে নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি ১০ মে (২০০৩) দৈনিক অবজারভার-এর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর ভাই শামসের চৌধুরী ‘মাই ফ্রেন্ড ক্যাপ্টেন নাসের বারী’ নামে যে স্মৃতিকথামূলক নিবন্ধ লেখেন, তাতে সন্দেহ ঘনীভূত হতে পারে। ওই নিবন্ধের লেখক শমসের চৌধুরী বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন বাসের বারী চৌধুরীর পরিবারের কত ঘনিষ্ঠ ছিল। সেই ক্যাপ্টেন মুনীর চৌধুরীর বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন, ডাল-ভাত খেতেন, বাংলা শিখতেন, জয় বাংলা বলতেন।
এই সম্পর্ক ১৬ ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত ছিল। এ অবস্থায় অধ্যাপক মুনির চৌধুরীকে রাজাকার-আলবদর কীভাবে হত্যা করতে পারে বুঝে আসে না। ৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সামান্যতম পরিচয় (থাকা) ছিল আত্মরক্ষার নিশ্চিত ব্যবস্থা। পাকিস্তানি বাহিনীর পরিচিত কেউ অন্তত সেনাবাহিনীর হাতে মারা পড়ত না। বরং এসব লোক মুক্তিবাহিনীর সন্দিহান দৃষ্টিতে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে অনেকে অনেক সময়। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের কথা যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে অধ্যাপক মুনির চৌধুরী মুক্তিবাহিনীর কারো প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন।... (আরেকজন শহীদ বুদ্ধিজীবী) সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক। প্রথমদিকে আর্মিরা তার বাড়ি তছনছ করলেও পরে রাও ফরমান আলীর নির্দেশে সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রদত্ত তালিকা অনুযায়ী তার ক্ষতিপূরণ করা হয়। সেই তালিকায় নাকি লুণ্ঠিত মালামালের দশ গুণ দ্রব্যাদি দাবি করা হয়। সব তাকে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে তার এমন দোস্তি হলো যে, তাদের দৌলতে তিনি নাকি প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন।’ (আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল, সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা : ৫৬৮) অতএব, সেই পাকিস্তানিরা এবং রাজাকার-আলবদররা তার মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে পারে না।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী এবং পরিকল্পক কারা ছিল, ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ভারতের ‘দি নিউ এইজ’ পত্রিকায় বলা হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটির সভাপতি চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান আমাদের জানিয়েছেন, ‘আলবদরদের কার্যকলাপ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা একই সঙ্গে অপরাধীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বোঝার জন্য নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যখন নিহত বাবা ও ভাইয়ের দেহের অবশেষ ঢাকার বধ্যভূমিতে খুঁজে ফিরছিলেন, তখন আমাদের ধারণা ছিল যে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নিশ্চিত পরাজয় উপলব্ধি করে পশুরা ক্রোধান্ধ হয়ে কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করেছে। কিন্তু পরে বুঝেছি ঘটনা তা ছিল না।’ ঘটনা কী ছিল জহির রায়হানের নিখোঁজ বা হত্যার পর, তা আর জানা যায়নি। জানা যায়নি জহির রায়হানের কথিত হত্যাকারী রফিককে সপরিবারে আমেরিকায় কে পাঠিয়েছিল। আজকের কাগজের ৮ ডিসেম্বর ৯৩ সংখ্যায় ‘জহির রায়হানের হত্যাকারী রফিক এখন কোথায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে শহিদুল ইসলাম মিন্টু লেখেন, ‘জহির রায়হানের প্রথমা স্ত্রী সুমিতা দেবী বলেছেন, আমার বিশ্বাস জহির মিরপুরে মারা যায়নি। ঘাতকরা তাকে অন্য কোথাও হত্যা করেছে। সেদিন সকাল ৮টার দিকে জহিরের একটি ফোন আসে। ফোনটা ধরেছিল সুরাইয়া নিজে। রফিক নামে কেউ একজন টেলিফোন করেছিলেন। আমরা যে রফিককে চিনতাম, তিনি ইউসিস-এ চাকরি করতেন। কেন তড়িঘড়ি করে জহির রায়হানের কথিত হত্যাকারী এই রফিককে সপরিবারে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো।’ এই রফিক কে ছিলেন, কী তার রাজনৈতিক পরিচয় ছিল; এসব প্রশ্ন সবই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিকে একদিকে রাজাকার, আলবদরদের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় করা হয়েছে। অন্যদিকে তেমনি বুদ্ধিজীবী হত্যার নেপথ্য কারিগরদের আড়াল করার জন্য বুদ্ধিজীবী হত্যা-সংক্রান্ত সব বিষয়কে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হয়েছে। ড. নীলিমা ইব্রাহিমসহ কয়েকজন শেখ মুজিবরকে পীড়াপীড়ি করছিল বুদ্ধিজীবীদের জন্য আলাদা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য। বিরক্ত হয়ে শেখ সাহেব বললেন, ‘আপা এত বেশি মিনার বানালে এসবের ভেতরে গরু বেঁধে রাখবে।’ (বাংলাবাজার, উপ-সম্পাদকীয়, ১৬ মার্চ, ১৯৯৮)
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শেখ সাহেবদের এমন এড়িয়ে চলার মানসিকতাই দেখা গেছে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকারে সর্বত্র। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা-বিষয়ের অনুসন্ধান কীভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা কবরস্থ হয়েছে, তার একটা উদাহরণ দিয়ে আমি আমার এই আলোচনা শেষ করছি : ‘জহির রায়হানের অন্তর্ধানের পর (বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তদন্ত) কমিটির অন্য সদস্যরা প্রাপ্ত সব তথ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। বঙ্গবন্ধু সব তথ্য এনএসআইয়ের তৎকালীন প্রধান নুরুল মোমেন খান মিহিরের কাছে দিতে বলেন। সে অনুযায়ী জমা দেওয়া হয়। এ সম্পর্কে ৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, ড. কামাল হোসেন সর্বশেষ সেগুনবাগিচায় একটি সরকারি অফিসে তিন ট্রাংকভর্তি সেসব দলিলপত্র দেখেছেন। কিন্তু এখন আর বুদ্ধিজীবী হত্যা অনুসন্ধানে দেশের প্রথম এবং শেষ তদন্ত কমিটির সেসব দলিলের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।’ (‘আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল’ দ্বিতীয় খণ্ড, সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা : ৫৭২-৫৭৫) (এ নিউজটি ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৫ তারিখে একটি আওয়ামী লীগ সমর্থক জাতীয় দৈনিকেও ছাপা হয়।)
কলমেঃ
আবুল আসাদ
লেখক, ঔপন্যাসিক, প্রবীণ সাংবাদিক ও সম্পাদক।
একজন মানুষ কাঁদছিলেন। তার নাম মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানতেন, যে স্বাধীনতার জন্য তিনি জীবন যৌবন সব উৎসর্গ করেছেন, সেই স্বাধীনতা আসছে এক গভীর ক্ষত নিয়ে— দেশভাগ। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষে যখন নীল হয়ে যাচ্ছে ভারত, তখন মৌলানা আজাদ ছিলেন সেই শেষ মানুষটি যিনি বুক চিতিয়ে বলেছিলেন— "ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হতে পারে না। হিন্দু আর মুসলিম এই ভারতের দুই চোখ।"
১৮৮৮ সালে মক্কায় জন্ম নেওয়া এক শিশু। যার ধমনীতে বইছিল আরব আর ভারতীয় রক্তের মিশ্রণ। বাবা ছিলেন বিখ্যাত সুফি পীর, মা আরবের সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে। ছোটবেলাতেই কোরআন, হাদিস, আরবি, ফারসি সব কণ্ঠস্থ। ১২ বছর বয়সে লাইব্রেরি চালাতেন, ১৬ বছর বয়সে পত্রিকা বের করতেন। কিন্তু এই তুখোড় মেধাবী ছেলেটি বেছে নিলেন কণ্টকাকীর্ণ পথ। ১৯০৮ সালে মিশর, তুরস্ক ঘুরে এসে তার রক্তে লাগল বিপ্লবের নেশা। তিনি বুঝলেন, ব্রিটিশদের তাড়াতে হলে হিন্দু-মুসলিমকে এক হতে হবে।
কলকাতায় ফিরে তিনি বের করলেন সাপ্তাহিক পত্রিকা 'আল-হিলাল'। তার কলম থেকে আগুনের মতো বের হতে লাগল ব্রিটিশ বিরোধী লেখা। ব্রিটিশ সরকার ভয় পেল। ১৯১৪ সালে বাজেয়াপ্ত হলো আল-হিলাল। কিন্তু আজাদ থামলেন না। বের করলেন 'আল-বালাগ'। ১৯১৬ সালে তাকে রাঁচির জেলে বন্দি করা হলো। চার বছর জেল খেটে যখন বেরোলেন, তখন তিনি আরও শক্তিশালী। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন এক অবিসংবাদিত নেতা।
১৯২৩ সাল। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি হলেন কংগ্রেসের সভাপতি। এত কম বয়সে এই পদ আর কেউ পাননি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এমন এক ভারতের, যেখানে রাম আর রহিম পাশাপাশি থাকবে। কিন্তু ১৯৪০-এর দশকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন পাকিস্তানের দাবিতে সোচ্চার হলেন, তখন আজাদ তার বিরুদ্ধে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। জিন্নাহ তাকে অপমান করতেন, বলতেন 'কংগ্রেসের শোপিস'। কিন্তু আজাদ তার বিশ্বাসে অটুট ছিলেন। ১৯৪০ সালে রামগড় কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি গর্জে উঠেছিলেন— "আমি গর্বিত আমি ভারতীয়। আমি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম যেমন ভারতের মাটিতে ১০০০ বছর ধরে আছে, তেমনি হিন্দুধর্ম হাজার হাজার বছর ধরে। আমরা একই নদীর দুই ধারা।"
১৯৪২ সাল। ভারত ছাড়ো আন্দোলন। আজাদ তখন কংগ্রেস সভাপতি। বোম্বাইয়ের গোওয়ালিয়া ট্যাঙ্কে তার জ্বালাময়ী ভাষণে কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ রাজ। ৯ আগস্ট ভোরে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। আহমেদনগর ফোর্টে বন্দি করা হলো নেহরু, প্যাটেলদের সাথে। চার বছর বাইরের জগতের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। জেলের ভেতরে বসেই তিনি লিখলেন তার বিখ্যাত বই 'গুবর-ই-খাতির' (Ghubar-e-Khatir)। চিঠির আকারে লেখা এই বইতে তিনি উজাড় করে দিলেন তার একাকীত্ব, তার দর্শন আর তার দেশপ্রেম।
১৯৪৬ সালে জেল থেকে বেরিয়ে দেখলেন দেশটা বদলে গেছে। জিন্নাহর ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-র ডাকে কলকাতায় দাঙ্গা। নোয়াখালি জ্বলছে। বিহারে রক্তগঙ্গা। আজাদ ছুটে গেলেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তার নিজের দল কংগ্রেসও তখন দেশভাগ মেনে নিচ্ছে। নেহরু, প্যাটেল— সবাই ক্লান্ত। তারা ভাবছেন দেশভাগই একমাত্র সমাধান। কিন্তু আজাদ শেষ পর্যন্ত গান্ধীজিকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, "দেশভাগ হলে দুই দেশেই সংখ্যালঘুরা বিপদে পড়বে। এটা সমস্যার সমাধান নয়, নতুন সমস্যার শুরু।" কিন্তু স্রোতের বিপরীতে তিনি একা। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন যখন দেশভাগের পরিকল্পনা গৃহীত হলো, আজাদ তখন মৌন। তার নীরবতাই ছিল তার প্রতিবাদ।
স্বাধীনতার পর তিনি হলেন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। তখন তার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ। এক অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতিকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। তিনি জানতেন, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি ছাড়া ভারত এগোতে পারবে না। তার হাত ধরেই তৈরি হলো আইআইটি খড়গপুর, ইউজিসি, সাহিত্য অ্যাকাডেমি, ললিত কলা অ্যাকাডেমি। তিনি বলতেন, "শিক্ষা হলো মানুষের জন্মগত অধিকার।" আজ আমরা যে আধুনিক ভারতের গর্ব করি, তার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়েছিল এই মানুষটির হাতেই।
১৯৫৮ সালে তিনি যখন মারা গেলেন, তখন তার ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল না, নিজের কোনো বাড়ি ছিল না। ছিল শুধু কিছু বই আর এক বুক ভালোবাসা এই দেশের জন্য। জওহরলাল নেহরু তাকে বলতেন 'মীর-ই-কারওয়ান' (কাফেলার নেতা)। গান্ধীজি তাকে তুলনা করতেন প্লেটো, অ্যারিস্টটলের সাথে।
আজ যখন আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দেখি, তখন মৌলানা আজাদের কথা খুব মনে পড়ে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, দেশপ্রেমের কোনো ধর্ম হয় না। মক্কায় জন্মেও তিনি ছিলেন ভারতের মাটির খাঁটি সন্তান। তার সমাধি দিল্লির জামা মসজিদের পাশে আজও নীরবে দাঁড়িয়ে আছে, যেন আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে— "দেশটা আমাদের সবার। এখানে বিভেদের কোনো জায়গা নেই।"
স্যালুট ভারতরত্ন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। আপনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, এক অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন হয়ে।
Source & Disclaimer:
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া (Maulana Azad), তার আত্মজীবনী 'India Wins Freedom', এবং ভারত সরকারের আর্কাইভাল রেকর্ডস।
পেজটি ভালো লাগলে লাইক ও ফলো করে আমাদের উৎসাহ জোগাবেন, আর বন্ধুদের মেনশন/শেয়ার করে অন্যদের দেখার সুযোগ করে দেবেন।
বিধিকরণ সতর্কতা:
©Bangla Tweet — সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত এই লেখার কোনো অংশ অনুমতি ছাড়া কপি বা পুনঃপ্রকাশ করা নিষিদ্ধ। ব্যবহার করতে চাইলে পেজের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে—অন্যথায় তা কপিরাইট লঙ্ঘন হিসেবে ধরা হবে।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের মহাকাব্য।
যেই বিজয় বদলে দিয়েছিল ইতিহাসের গতিপথ। অবিশ্বাস্য প্রতিভা, অপ্রতিরোধ্য সাহস, আর ১৭ বছর বয়সের এক ঐতিহাসিক যুদ্ধজয়ের এক মহানায়কের নাম মুহাম্মদ বিন কাসিম! ইসলামের ইতিহাসে এমন কিছু চরিত্র আছে, যাদের নাম উচ্চারিত হলেই রক্তে ঢেউ লাগে, শিরায় শিরায় জ্বলে ওঠে সাহসের আগুন। এমনই এক চরিত্র হলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম আস-সাকাফি। ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ৭ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে' ঠিক তখন প্রাচ্যের দ্বারপ্রান্তে জন্ম নেয় এক ঐতিহাসিক সংঘাত। এই যুদ্ধের নায়ক তখন কেবল মাত্র ১৭ বছরের এক তরুণ!
সাল ৭১১ খ্রিস্টাব্দ। উমাইয়া খিলাফতের প্রান্তসীমায় উত্তাল আরব সাগর। একটি ঘটনা আগুনের ফুল্কির মতো ছড়িয়ে পড়ল দামেস্কের রাজপ্রাসাদে। সিংহল থেকে ফেরত আসা মুসলিম নারী ও শিশুদের বহনকারী একটা জাহাজ দেবল বন্দরে লুণ্ঠিত হলো। সিন্ধুর রাজা দাহিরের নৌ-ডাকাতরা শুধু সম্পদ লুটেই ক্ষান্ত হয়নি, নারী-শিশুদের বন্দী করল রাজদরবারে। ততকালীন পৃথিবীর সুপার পাওয়ার এর সিংহাসনে বসা উমাইয়া সাম্রাজ্যে' আরবের গর্ব অপমানের রক্তে রঞ্জিত হলো।
এই অপমানের বার্তা যখন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, উমাইয়া খিলাফতের কঠোরতম ও দক্ষ গভর্নরের কাছে পৌঁছাল, তখন দামেস্কের বাতাসই যেন কাঁপতে শুরু করল। চোখে-মুখে আগুন, মুখে একটিই শব্দ: "প্রতিশোধ!"।
বিশ্বাসঘাতকতার রক্তে লেখা চ্যালেঞ্জ: রাজা দাহির পাঠালেন ঘোষণা- "লুণ্ঠিত মাল ফেরত দেওয়া হবে না। বন্দীরা মুক্তি পাবে না। সিন্ধু নদীর যত বালুকারাশি, ততটা লাশ দিয়েও সিন্ধু জয় করতে পারবে না তুমি, হে হাজ্জাজ!"
এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন হাজ্জাজ। কিন্তু তিনি সেনাপতি খুঁজছিলেন কোনো প্রবীণ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ যোদ্ধাকে নয়। তার চোখ ছিল দূর সৌদির তায়েফ-এর দিকে। সেখানে তারই প্রতিভাবান চাচাতো ভাই' মাত্র সতেরো বসন্ত দেখা এক যুবক মোহাম্মদ বিন কাসিম। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মনে মনে মুচকি হেসে ভেবেই নিলেন ওদের শিক্ষা দিতে আমার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ কোনো জেনারেল লাগবে না, আহামরি বড় কোনো বাহিনীও পাঠানোর দরকার নেই। ওদের জন্য আমার ছোট ভাই মুহাম্মদ বিন কাসিমই যথেষ্ট।
মাত্র ১৭ বছরের এক দানব যে শরীর ছিল লোহার ফ্রেম: মনে করুন' মরুভূমির উত্তপ্ত বালি, ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ, আর ঘামে ভেজা লোহিত সাগরের বাতাস। এই দুর্বিষহ পরিবেশেই গড়ে উঠেছিল মোহাম্মদ বিন কাসিমের অসামান্য শারীরিক গঠন।
পেশির বল: প্রতিদিনের তলোয়ার চালনার প্রশিক্ষণ, ঘোড়ায় দীর্ঘ অভিযান, আর ভারী বর্ম পড়ে কুচকাওয়াজ এই নিয়মিত অভ্যাসে তার বাহুগুলো ছিল কমপাউন্ড ঢালাই লোহার মতো শক্ত। ইতিহাসবিদদের বর্ণনা মতে, সে যুগের ভারী তলোয়ার যা সাধারণ সৈন্য দুই হাতে ধরতে কাঁপত, মোহাম্মদ বিন কাসিম তা এক হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সামরিক কৌশল চর্চা করতেন। সহনশীলতা: মরুভূমির জীবনই তাকে শিখিয়েছিল জলের মতো সংক্ষিপ্ত আর ইস্পাতের মতো অনমনীয় হতে। তিন দিনের রেশনের পানি দিয়ে পাঁচ দিনের পথ পাড়ি দেওয়া, ধূলিঝড়ের মধ্যেও দিক নির্দেশ ধরে রাখা এই ছিল তার নিত্যদিনের প্রস্তুতি।
যুদ্ধের কসরত: তার শরীর ছিল একটি জীবন্ত অস্ত্র। তলোয়ার, বর্শা, ধনুক প্রতিটি অস্ত্রেই তার দক্ষতা ছিল বিপজ্জনক পর্যায়ের। ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে ঘোড়া দৌড়ানোর অবস্থাতেই তীর নিক্ষেপ করা থেকে শুরু করে পদাতিক বাহিনীর সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সবকিছুতেই তার শারীরিক ফিটনেস ছিল অবিশ্বাস্য লেভেলের। তার শরীর ছিল যুদ্ধের জন্য যেন নির্মিত এক জীবন্ত দুর্গ।
যুদ্ধের জিনিয়াস হিসেবে তার কৃতিত্ব দেখুন:
1. মানসিক গণিতের জাদু: সিন্ধু অভিযানে তার প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল লজিস্টিকস। ৬,০০০ সৈন্য, তাদের অস্ত্র, রসদ, ঘোড়া, আর অবিশ্বাস্য দূরত্ব। তিনি নৌবহর গঠন করলেন, যা শুধু সৈন্য বহনই নয়, ভাসমান দুর্গ হিসেবে কাজ করবে। প্রতিদিনের রেশন, জল, অস্ত্রের মজুত প্রত্যেকটি গণনা ছিল মিলিমিটার পারফেক্ট।
2. সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার: দেবল দুর্গ আক্রমণের সময় তিনি মানসিক যুদ্ধের মাস্টারক্লাস দেখালেন। প্রচলিত যুদ্ধের পরিবর্তে তিনি শক্তিশালী মানজানিক (ক্যাটাপাল্ট) ব্যবহার করলেন, যা শুধু দেয়ালই ভাঙেনি, রক্ষীদের মনোবল ধ্বংস করেছিল। তিনি বুঝেছিলেন, ভয় হলো সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
3. অ্যাডাপ্টিবিলিটি: সিন্ধুর ভৌগোলিক চ্যালেঞ্জ নদী, জলাভূমি, দুর্গ সবকিছুর বিরুদ্ধে তার কৌশল ছিল ফ্লেক্সিবল। তিনি স্থানীয় গাইড নিয়োগ করলেন, শত্রুর দুর্বলতা বুঝে আক্রমণ করলেন। তার IQ ছিল রিয়েল-টাইম স্ট্র্যাটেজি তৈরির ক্ষেত্রে বিপজ্জনক মাত্রার কার্যকর।
মহাকাব্যের যুদ্ধ: রক্ত, আগুন ও বিজয়- দেবল বন্দর, ৭১২ খ্রিস্টাব্দ। মোহাম্মদ বিন কাসিমের নৌবহর দিগন্ত জুড়ে। প্রথম আঘাতটা মানসিক। তিনি উচ্চ সুরে আজান দিতে আদেশ দিলেন, যার প্রতিধ্বনি যেন সিন্ধুর বুকে ইসলামের আগমনের ঘোষণা দিল। মানজানিক দিয়ে তিনি যে শুধু দেয়াল ভাঙলেন তাই নয়, ভাঙলেন রাজা দাহিরের অহংকার। তারপর আসলো নেরুন, সিহওয়ান। প্রতিটি যুদ্ধে তার কৌশল ছিল ভিন্ন। কখনো দ্রুত আক্রমণ, কখনো দীর্ঘ অবরোধ, কখনো কূটনৈতিক আলোচনা। তিনি শত্রুকে কখনো এক ধরনের আক্রমণের অভ্যস্ত হতে দেননি।
চূড়ান্ত লড়াই- রাওয়ার যুদ্ধ। এখানে মুখোমুখি হয়েছিল দুই বাহিনী। প্রচণ্ড যুদ্ধে রাজা দাহির তার হাতির পিঠ থেকে যুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু মোহাম্মদ বিন কাসিমের কৌশলে সিন্ধু বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল। প্রচণ্ড সেই যুদ্ধে রাজা দাহির নিহত হলেন। সিন্ধুর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। বিজয়ের পর তিনি শুধু যোদ্ধাই নন, রাজনীতিবিদও হয়ে উঠলেন। তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, হিন্দু ও বৌদ্ধদের তাদের মন্দির ও উপাসনালয়ে নির্বিঘ্নে পূজা করতে দিলেন। ইসলামিক নিয়ম অনুযায়ীই তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়ে দিলেন।
তার মস্তিষ্ক ছিল একটি সুপরিকল্পিত যুদ্ধের সিন্ধু, যেখানে প্রতিটি চিন্তা ছিল একটি সৈন্য, এবং প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল একটি বিজয়। এটি ছিল তার স্ট্র্যাটেজিক জিনিয়াস-এর সর্বোচ্চ প্রকাশ।
একটা বার চিন্তা করুন বিষয়টা? একজন প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ রাজা' তার অহংকারের শেষ পরিণাম হিসেবে মাত্র ১৭ বছরের একটা বালক দ্বারা আল্লাহ তাকে ধ্বংস করালেন।
যে বিজয় রচনা করেছিল নতুন ইতিহাস: সতেরো বছর বয়সে। এই বয়সে সাধারণ কোনো তরুণ হয়তো জীবন আর ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ওই বয়সে মোহাম্মদ বিন কাসিম ইতিহাসের গতিপথই বদলে দিলেন। তিনি প্রমাণ করলেন, বয়স একটা সংখ্যা মাত্র, সক্ষমতাই তার আসল প্রমাণ।
তার এই বিজয় ছিল:
➤ সামরিক কৌশলের এক মাস্টারপিস
➤ প্রশাসনিক বিচক্ষণতার উদাহরণ
➤ সাংস্কৃতিক সংহতির সূচনা
তার পেশির শক্তি তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু তার মেধার শক্তি তাকে ইতিহাসের পাতায় অমর করেছে। তিনি ছিলেন দুই হাতে তলোয়ার, আর মাথায় সমগ্র সিন্ধু নদের কৌশল নিয়ে জন্মানো এক মহানায়ক। সেই অগ্নিশিখা আজও জ্বলে, ইতিহাসের পাতায়, প্রতিটি সাহসিকতার গল্পে, যার নাম মোহাম্মদ বিন কাসিম সতেরোর বসন্তের সেই অপরাজেয় মহাকাব্য।
সিন্ধুর মাটিতে ইতিহাস আজো ফিসফিস করে কয়,
এখানে এসেছিল এমন এক যুবক, যে ভয়কে করেছিল জয়, অসম্ভবকে করেছিল সম্ভব। তলোয়ারে ছিল সংযম, রক্তে ছিল না হিংসা, বীরত্ব মানে দয়া' এই শিক্ষা দিল কাসিমের দিশা। ঘোড়ার ক্ষুরে ধুলো উড়ে, আকাশ হয় বজ্রধ্বনি, আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে ভাঙ্গে অন্যায়ের বর্মখানি। রক্ত নয়' ন্যায়ের পথে খুলে দিল মুক্ত দ্বার, বিজয়ের মানে শাসন নয়, ইনসাফেরই অহংকার। না ছিল রাজ্যলোভের নেশা, না ছিল স্বর্ণের ঘোর, ছিল শুধু তাওহীদের ডাক, মজলুমের অধিকারের ভোর। তরুণ বুকে ইস্পাত মন, কপালে সিজদার ছাপ, এক হাতে কুরআন, এক হাতে ন্যায় এই তার আসল মাপ।
সাগর কাঁপে, নদী কাঁপে, কাঁপে রাজপ্রাসাদ, নারী-পুরুষ শিশুর মুখে মুক্তির আশ্বাস, নবযুগের সূর্যোদয় সিন্ধুভূমে আজ, ইতিহাসের পাতায় অমর তার অভিযান। কিশোর বয়সে কাঁধে তলোয়ার, চোখে আলোর প্রদীপ, মুহাম্মদ বিন কাসিম নাম তার ইতিহাসে অমর ছাপ। সিন্ধুর বুকে বজ্র নেমে কাঁপল রাজা দাহির, ইমানের শক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিল, কে সত্যিকারের মহাবীর।
নোটস: এটা কোনো জাতিগত বিদ্বেষের উদ্দেশ্য লেখা হয়নি। তবে আর্টিকেলটা লেখা হয়েছে বাস্তব ইতিহাসের সত্য ঘটনা অবলম্বনে আর ইতিহাসের পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ-এর ব্যাখ্যার উপর ভিত্তিতে।