চৈতন্য আবির্ভাবের পটভূমি’

রানা

চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের সমকালীন পৃথিবীর ধর্মজগতে নতুন জাগরণ দেখা দিয়েছিল। খ্রীস্টধর্মে তখন নানা কুসংস্কার অনুপ্রবেশ করেছিল; একজন ধর্মগুরু হিসেবে পোপের অখণ্ড

প্রতাপ তখন তাঁর স্বৈরতন্ত্রী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাচ্ছিল। তৎকালীন ধর্মজগতের সেই অন্যায়েব বিরুদ্ধে সুইডেনের ‘ডেসিডেরিয়াস ইরেসমাস’ (Desiderius Erasmus, 1466-1536)

লেখনী ধারণ করেছিলেন। তিনি একজন নিষ্ঠাবান ধর্ম সংস্কারক ছিলেন। যুগে যুগে ধর্মের মধ্যে অনেক কুসংস্কার, অনেক মিথ্যা আলৌকিকত্বের কথা অনুপ্রবেশ করে। সেই সব

ঐতিহ্যরূপী মিথ্যাকে দূর করবার জন্য তাঁর লেখনীতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা দিয়েছিল; তিনি বাইবেলের মূল বক্তব্যের দিকে সাধারণ মানুষকে তাঁদের দৃষ্টি ফেরাতে বলেছিলেন। ওই সময়ের

জার্মান ধর্ম সংস্কারক ‘লুথার’কে তিনি বিশেষভাবে সমর্থন করেছিলেন। অনেকেই মনে করেন যে, সেই সময়ে ইরেসমাস যে ডিমটি পেরেছিলেন, লুথার সেটাকে তা দিয়ে ফুটিয়েছিলেন;

অর্থাৎ, সংস্কারের ভাবনাটি ইরেসমাস প্রকাশ করেছিলেন, এবং লুথার তাঁর সেই ভাবনাকে রূপায়িত করেছিলেন।

ইরেসমাস ইংল্যাণ্ডে গিয়ে ‘টমাস মোর’ (Thomas More) এবং ‘কেলেট’ (Calet) এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। তাঁর লেখা ‘বোকামির প্রশংসা’ বইতে তিনি পুরোহিতদের অনাচার ও মানুষের

বোকামির পরিচয় দিয়েছিলেন। এর আগে তিনি নিজেই বহুদিন ধরে পুরোহিত ছিলেন বলেই ওই গ্রন্থ রচনা করা তাঁর পক্ষে সহজতর হয়েছিল। খ্রীস্টধর্মের গ্রন্থ ‘নিউ টেস্টামেন্টের’ একটি

সংস্করণ প্রকাশ করে তিনি বিশেষ খ্যাতিলাভ করলেও, বাইবেলের সমালোচনায় তিনিই পুরোধা ছিলেন। তিনি প্রচলিত ধর্মব্যবস্থাকে আক্রমণ করে ‘ম্যানুয়েল অফ দি ক্রিশ্চিয়ান

সোলজার’ নামের একটি গ্রন্থ, এবং সমকালীন পুরোহিত ও অন্যান্যদের মতামতকে তীব্র সমালোচনা করে তাঁর ধারাবাহিক গ্রন্থ ‘কোলোকুইয়া’ (Colloquia) রচনা করেছিলেন। কথিত আছে

যে, প্রতিবাদী ধর্মসংস্কারের (Protestant Reformation) জনক ‘মার্টিন লুথার’ (Martin Luther, 1483-1546) একদা বলেছিলেন, “এই আমার অভিমত, আর কিছুই আমি করতে পারি না,

ভগবান আমার সহায় হোন, আমেন।” সেটা ছিল ১৫২১ খ্রীস্টাব্দ, ওই সময়ে মহাপ্রভু নীলাচলে ছিলেন; অর্থাৎ, ওই সময়ে তিনি নতুন মানবধর্মের চিন্তায় মানুষকে জাগ্রত করবার কাজে

নিজের দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে জগন্নাথের সচল বিগ্রহ রূপে সকলকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন। রোমান ক্যাথলিক ধর্মের অনুশাসনে তখন জার্মানরা উত্যক্ত হয়েছিলেন, তাই শতকরা ৯০ জনেরও

বেশী সাধারণ মানুষ সংস্কারক পাদ্রী লুথারের অনুগামী হয়েছিলেন। সম্রাট তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন ও তাঁর গ্রন্থগুলিকে পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু জনসমর্থনের

চাপে তখন এর কোনটাই করা সম্ভব হয় নি। এই দেশের দুর্ভাগ্য যে, প্রচুর জনসমর্থন সত্ত্বেও তার চাপ প্রায় কোন বিষয়েই উপলব্ধি করা যায় না। লুথার এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ

করেছিলেন, এক সময়ে তাঁকে গান গেয়ে ভিক্ষা করতে হয়েছিলেন। শ্রমশীল পিতার প্রেরণায় এবং নিজের চেষ্টায় তিনি আগস্টেনিয়ান চার্চে ভর্তি হয়েছিলেন, এবং ধর্ম শিক্ষা করে

উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই কয়েক বৎসরের মধ্যেই তিনি রোমে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের কাজে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি পোপের বক্তব্যসমূহের

প্রকাশ্য বিরোধিতা আরম্ভ করলে দেশে ভয়ানক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ঠিক ওই একই সময়ে চৈতন্যদেবের চিন্তা এবং কার্যাবলীও এই দেশে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বলে

ইতিহাস থেকে দেখতে পাওয়া যায়। চার্চের বিধি-বিধানের এক খণ্ড পুস্তিকা পড়িয়ে ফেলে লুথার চার্চের বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। নিজের শেষ জীবন তিনি লিখে, প্রচার করে,

এবং প্রোটেস্টান্ট চার্চ প্রতিষ্ঠার কাজ করে অতিবাহিত করেছিলেন। তখন প্রোটেস্টান্টদের মধ্যেও নানা গোষ্ঠী তৈরী হয়েছিল। সব দেশেই নতুন পুরাতন সব ধর্মেই গোষ্ঠী আপনা

আপনি তৈরী হয়ে যায়। বৈষ্ণব ধর্মেও অনেকগুলি গোষ্ঠী আছে। মানুষের চিন্তা নব নব সৃষ্টি করে, তাই এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। সুইজারল্যান্ডে প্রোটেস্টান্টদের নেতৃত্ব

দিয়েছিলেন ‘উলরিস জিউইনগ্লি’ (Ulrich Zwingli, 1484-1531)। তিনি বিশেষ করে শহরের অনেক শিক্ষিত মানুষকে নিজের ধর্মের আওতায় নিয়ে এসেছিলেন। এরপরে ‘জন কেলভিন’ (John

Calvin, 1509-64) উলরিসের সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৫৩৬ খ্রীস্টাব্দে শ্রান্ত ক্লান্ত অবস্থায় কেলভিন জেনেভায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন। তাঁর আগমনবার্তা পেয়ে জেনেভাব

প্রোটেস্টান্ট চার্চের পুরোহিত তাঁকে জেনেভাতেই থেকে যেতে বলেছিলেন। সমস্ত সুইজারল্যাণ্ডকে তিনি প্রোটেস্টান্ট ধর্ম পরিচালিত রাষ্ট্রে পরিণত করতে অনুরোধ করেছিলেন। বেলভিন

ফরাসী দেশীয় পুরোহিত ছিলেন, কিন্তু রোমান ক্যাথলিক মতবাদের বিরোধিতা করবার জন্য তিনি সেখান থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। সুইজারল্যাণ্ড তখন একটি স্বাধীন রাজ্য,

এবং প্রোটেস্টান্ট ধর্ম মতাবলম্বী ছিল। ধর্মমতের বিরোধ পৃথিবীর সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়। এদেশেও মুসলমান সম্রাট-বাদশাহরা কিছু কম ধর্মমন্দির ভাঙ্গেন নি ও লুন্ঠন করেন

নি। সাধু-সন্তদের তখন শান্তিতে বাস করা সব সময়ে সম্ভব হয় নি। চৈতন্যদেবের সময়েও সেই মঠ-মন্দির ভাঙ্গার কাজ অব্যাহত ছিল। চৈতন্যদেবের ওপরে কি সেসবের কোন প্রভাবই

পড়ে নি? নিজের চিন্তার অনুসরণে সাইজারল্যান্ডকে প্রোটেস্টান্ট ধর্মের আওতায় সুন্দর রূপ দানের উদ্দেশ্যে কেলভিন সে দেশেই থেকে গিয়েছিলেন। জগন্নাথেদেবের প্রভাবে প্রভাবিত

বৈষ্ণবদের দেশে থাকবার পেছনে মহাপ্রভুর মধ্যেও কি সেই ধরনের কোন মনোভাব কাজ করেছিল? ১৫৩৬ খ্রীস্টাব্দে কেলভিনের লেখা অপূর্ব গ্রন্থ ‘দি ইনস্টিটিউটস অফ দি ক্রিশ্চিয়ান

রিলিজিয়ন’ প্রকাশিত হয়েছিল। কেলভিনের মতবাদ স্কটল্যান্ডে বিশেষ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ওই সময়ের জেনেভা কেলভিনের শহর বলে পরিচিত হয়েছিল, এবং ‘প্রোটেস্টান্টদের রোম’ বলে

সেটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।

ভারতের সন্ত ‘কবীর’ (আনুমানিক ১৪৪০-১৫১৮) কাশীতে জন্মেছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি বিধবার গর্ভজাত বলে পরিত্যক্ত হওয়ার পরে নিরু নামের এক মুসলমান জোলা তাঁকে পালন

করেছিলেন। শৈশব থেকেই তিনি সাধনা আরম্ভ করেছিলেন। তিনি মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক ‘রামানন্দের’ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। পরে তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি

 

137

 

লেখাপড়া না জানলেও একজন স্বভাব-কবি ছিলেন। সূফী, বৈদান্তিক প্রভৃতির সংস্পর্শে এসে তিনি তাঁর দার্শনিক ধ্যান-ধারণা গঠন করেছিলেন। তাঁর জ্ঞান, ভক্তি, নিষ্ঠা, সদাচার ও

রামনাম কীর্তনের কথা প্রচারিত হওয়ার পরে বহু হিন্দু ও মসলমান তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করেছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবতের কাল থেকেই ভারতে নামকীর্তনের প্রাধান্য দেখা দিয়েছিল। কবীর

হিন্দু ও মসলমান ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছিলেন; এবং, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক রীতি-নীতি ও সংস্কারের বিরোধিতা করায় তিনি উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মান্ধ

ব্যক্তিদের অপ্রীতিভাজন হয়ে উঠেছিলেন। কবীরের বাণী সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যেই বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয়েছিল। ‘পরমাত্মা এক’ এই সত্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের

মিলন সাধনই কবীরের লক্ষ্য ছিল। অদ্বৈতবাদ এবং ইসলামের একেশ্বরবাদের সক্ষম পার্থক্য বিচারের চেষ্টা না করে দু’য়ের মিশ্রণেই তিনি তাঁর ‘ভক্তিপণহ’ গড়ে তুলেছিলেন। রামরহিম,

আল্লা-হরিকে তিনি এক বলে প্রচার করেছিলেন। তিনি বৈষ্ণব রামানন্দ স্বামীর প্রধান দ্বাদশ শিষ্যের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাই বৈষ্ণবদের প্রতি তাঁর বিশেষ প্রীতি লক্ষ্য করা

গেলেও ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের দিক দিয়ে কবীরপন্থীরা কিন্তু কারও প্রভাবকে স্বীকার করেন না। সন্ন্যাসী কবীরপন্থীরা কবীরেরই ভজন করেন। সংগীতই তাঁদের উপাসনা। কবীরের

অনুসরণে উত্তর ভারতে সন্ত সাহিত্য গড়ে উঠেছিল। কবীরের কাল থেকে আরম্ভ করে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের ধর্মীয় ইতিহাসে এই ধারার প্রবাহকে লক্ষ্য করা যায়। সন্ত

কবিদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল যে, একদিকে তাঁরা যেমন ঈশ্বরের নাম ও গুরুর মহিমা কীর্তন করেন, অন্যদিকে তেমনি আবার জাত-পাতের ভেদ ভাবকে দূরে সরিয়ে রেখে মূর্তিপূজো,

অবতারবাদ ও কর্মকাণ্ডের বিরোধিতাও করেন। সতরাং, এই অঞ্চলে জাত-পাতের বিরোধিতার বিগ্রহ স্বরূপ মহাপ্রভুর উপস্থিতি বিশেষ কার্যকর হয়েছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

উত্তর ভারতে কবীর-নানক-বৈদাস, ধরমদাস, দাদু, মীরাবাঈ প্রভৃতি সন্তরা অনেকদিন ধরেই আলোর রোশনাই জ্বালিয়েছিলেন; তাঁদের কেউ কেউ মহাপ্রভুর পরবর্তী, আবার কেউ কেউ

সমকালীনও ছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের আকাশে তখন শুদু অস্ত্রের ঝংকার ছিল। তাই সেখানেই কি সর্বপ্রথম মহাপ্রভুর পদরেণু পড়বার প্রয়োজন ছিল না? ১৪৮৫ খ্রীস্টাব্দে ‘সপ্তম

হেনরী’ ইংল্যাণ্ডের সিংহাসনে বসেছিলেন। রানী ‘ক্যাথারিনের’ সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে পোপ ‘ক্লেমেন্ট’-এর সঙ্গে তাঁর বিরোধ বেঁধেছিল, এবং সেই সূত্রেই ধীরে ধীরে রোমের

চার্চের থেকে ইংলণ্ডের চার্চ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। উক্ত সপ্তম হেনরীর সিংহাসনে আরোহণের কাল থেকেই আধুনিক যুগ আরম্ভ হয়েছিল। ১৪৮৭ খ্রীস্টাব্দ থেকেই ইউরোপীয়রা

ভারতবর্ষের সঙ্গে জলপথে সরাসরি যোগ স্থাপনের চেষ্টা আরম্ভ করেছিলেন। অবশেষে ১৪৯৮ খ্রীস্টাব্দে পর্তুগীজ নাবিক ‘ভাস্কো দা গামা’ কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছেছিলেন। দক্ষিণ

ভারতে সেই পর্তুগীজদের বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। এই প্রসঙ্গে ‘শ্রীচৈতন্যদেব’ গ্রন্থে ‘শ্রীসুন্দরানন্দ বিদ্যাবিনোদ’ লিখেছিলেন, “১৫১৬ খ্রীস্টাব্দে পাশ্চাত্ত্য দেশে যখন Utopia

(No-Where) নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়া আদর্শ পার্থিব সমাজের কাল্পনিক চিত্র প্রচার করিতেছিল, সেই সময় ও তৎপূর্বেই শ্রীচৈতন্যদেব ঐকান্তিক পরমার্থের অনুগমনকারী

আদর্শ-সমাজের বাস্তব-চিত্র বঙ্গদেশে প্রচার করিয়াছিলেন।” (পঞ্চম সংস্করণ, পৃ- ৩৮) চৈতন্যদেব যখন নতুন সমাজ গঠনের কাজে এগিয়ে এসেছিলেন, তখনকার এবং এর

পূর্ববর্তীকালে বঙ্গদেশের সামাজিক, ধর্মনৈতিক, আর্থনীতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা কিরূপ ছিল, সেটা নিশ্চিতভাবে বুঝে নেওয়ার দরকার রয়েছে। চৈতন্যদেব ঠিক কিসের ভিত্তিতে

তাঁর চিন্তাকে সংহত করেছিলেন? পরিবেশই তো মানুষকে পথের সন্ধান দেয়, এবং অনেক সময়ে তাঁকে গড়েও তোলে। বিষ্ণু ভক্ত বর্মণ রাজারা বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন। অথচ রাঢ়-বঙ্গ গৌড়ে

তখন বৌদ্ধের সংখ্যা নেহাত কম কিছু ছিল না। সপ্তম শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম বঙ্গদেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর রামায়ণ-প্রণেতা রামানন্দ

নিজেকে বুদ্ধদেবের অবতার বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, ওই সময়ে দেশে বৌদ্ধের সংখ্যা অনেক না থাকলে তিনি সেই চেষ্টা আদৌ করতেন কি? ধর্মমঙ্গলে বৌদ্ধমতেরই প্রাধান্য

দেখতে পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরবর্তীকালে রচিত ধর্মমঙ্গলে অবশ্যই ব্রাহ্মণ্য প্রভাবই লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধদের সংখ্যা দেশে যখন এত অধিক তখন বৌদ্ধবিদ্বেষী

রাজারা প্রতিষ্ঠা পেতেই পারেন না। তাঁদের বৌদ্ধবিদ্বেষ এত অধিক পরিমাণে ছিল যে, বর্মণ রাজাদের অন্যতম মন্ত্রী ‘ভবদেব ভট্ট’ - ঋষি অগ্যস্ত যেমন সমুদ্র শোষণ করেছিলেন,

তেমনি বৌদ্ধদের শোষণ করবেন বলে গর্ব করতেন। ভবদেব ভট্টের ‘প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণে’ দেখা যায় যে, রজক কর্মকার নট কৈবর্ত ভিল চণ্ডাল কাপালিক তক্ষণ বর্ণকার শৌণ্ডিক

এবং পতিত ও নিষিদ্ধ বৃত্তিজীবী ব্রাহ্মণের ছোঁয়া বা রান্না যদি ব্রাহ্মণেরা খান তাহলে তাঁদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। শূদ্রের রান্না ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য গ্রহণ করলে তাঁকেও

প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। অথচ আশ্চর্যের কথা হল যে, শূদ্রের হাতের তৈল পক্ব বা দুগ্ধপক্ব খাদ্য গ্রহণ করা ব্রাহ্মণের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল না। সেজন্য অবশ্য তিনি সামান্য

অনুতাপের বিধি রেখেছিলেন। আরও আশ্চর্যের কথা হল যে, ওই সময়ে ব্রাহ্মণের পক্ষে নিম্নবর্ণের স্ত্রী গ্রহণে কোন বাধা ছিল না। অন্যদিকে পালরাজারা বৌদ্ধ হলেও তাঁরা ব্রাহ্মণ্য

সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। তাঁদের সময়ে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কৈবর্তরাও উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। পাল রাজাদের প্রেরণাতেই বঙ্গদেশে প্রথম সামাজিক সমন্বয়ের

চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই সময়ে যে সমন্বিত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, প্রকৃতপক্ষে সেটাকেই উত্তরকালের বাঙালীর সংস্কৃতি বলা যেতে পারে। এই সমন্বয়ের প্রচেষ্টাই বঙ্গের সাধারণ

বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সহজ সুন্দর বোঝাপড়া করতে পেরেছিলেন বলেই বোধ হয় সকলের সহযোগিতায় তাঁরা সুদীর্ঘ ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করতে পেরেছিলেন। এখানে এ

কথাটাও মনে রাখতে হবে যে, পাল রাজারা খাঁটি বাঙালী ছিলেন। এ দেশে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব অনেক পরে পড়েছিল; তার আগে থেকেই এখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয়ের

প্রচেষ্টা চলেছিল। পাল রাজাদের আমলের লিপিগুলোতে কৃষক-কর্ষকদের নাম, ডোমদের নামও পাওয়া গিয়েছে। জাতি বর্ণ প্রভৃতি নানা স্তরের ভেদ সৃষ্টি অনেক আগে থেকে আরম্ভ হলেও

সেন-বর্মণ রাজাদের আমল থেকেই সেই ভেদবিন্যাস দৃঢ় ও অনমনীয় হয়ে সমাজকে স্তরে-উপস্তরে বিভক্ত কবে ফেলেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তখনও দেশে এমন সব সাধকেরা ছিলেন যাঁরা

মানুষে-মানুষে ভেদকে স্বীকার করতেন না। জাতিভেদ বর্ণভেদের অপদেবতা তাঁদের উদার মনের পবিত্রতাকে কলুষিত করতে পারে নি। মানব মহিমাকে তাঁরা প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিলেন।

ভাগবতধর্মী এবং সহজয়ানী সাধকেরা সেই মহান আদর্শকে উচ্চে ধারণ করে রেখেছিলেন। সুতরাং একথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সেকালে সাধারণ মানুষের মন দোটানায় পড়েছিল - (১)

রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় জাতি-বর্ণে বিভক্ত সমাজকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলা, এবং (২) সাধকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মানুষে মানুষে মিলনের গ্রন্থি রচনা। সেন-বর্মণ আমলে ভেদবুদ্ধি

চরমে উঠেছিল। উক্ত দুই বংশই বঙ্গের বাইরে থেকে এসেছিলেন। ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের আওতায় বর্ধিত সেই দুই বংশই বৌদ্ধ পালরাজাদের মানবতার বিরোধিতা করেছিলেন। “সমাজে ওই

স্তরভেদ এবং স্তরে স্তরে আদান-প্রদানের বিচিত্র বিধি-নিষেধ নবগঠত বাঙলার সমাজ ও বাঙালী জাতিকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দিয়েছিল নিশ্চয়ই। … অব্রাহ্মণকে শিক্ষাদান এবং

অব্রাহ্মণের যাগযজ্ঞ পূজা অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল।” (বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়) আর্যেতর ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান এবং তন্ত্রের বিকৃতি তৎকালীন

বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মে, এবং স্বভাবতই তখনকার সমাজে প্রবিষ্ট হযে নানাপ্রকার ব্যভিচারে ব্যাধিগ্রস্ত করে তুলেছিল। তারই ফলে সমাজের সমস্ত স্তরে নানা ধরনের যৌনবিকৃতি

দেখা দিয়েছিল। একাদশ-দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে রামাবতী, বিজয়পুর, এবং নবদ্বীপে এর বিশেষ প্রাবল্য লক্ষ্য করা গিয়েছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর তাম্রশাসনগুলোতে নরনারীর প্রতি

আসক্তির জয়গীতিও ঘোষিত হয়েছিল। এক তাম্রশাসনে পাওয়া যায় যে, কলিঙ্গ রমণীদের প্রেমলাভ করেছিলেন বলে কবি লক্ষণ সেনের প্রসংশা করেছিলেন। ওই সময়ে রাজসভায় যে বিকার

দেখা দিয়েছিল, সেটা যখন সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন আরও বিকট হয়েছিল। “বৌদ্ধধর্মের অবনতির সময় এ দেশে স্বেচ্ছাচারিতা ও বাভিচার প্রভৃতি দ্বারা সমাজ একান্তরূপে

শিথিল ও উচ্ছঙ্খল হইয়া পড়িয়াছিল। বামচারী বৌদ্ধতান্ত্রিকগণ যে সমস্ত অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তাহা নীতি ও ধর্ম বিধ্বংসী। এই সময় ভৈরবীচক্র প্রভৃতি দ্বারা পুরুষও

নৈতিক আদর্শ হইতে একান্তরূপে স্খলিত হইয়াছিলেন। অপরপক্ষে তান্ত্রিকগণের খাদ্যাখাদ্যের কোন বিচার ছিল না। বঙ্গদেশের ঘরে ঘরে তান্ত্রিক দীক্ষা প্রচারিত হইয়া সমাজকে

বীভৎস করিয়া তুলিয়াছিল। হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানে সর্ব বিষয়ে এরূপ স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল। ব্যভিচারের সংশোধনার্থ যে সংস্কারকর্ম আরদ্ধ হইল তাহাতে

‘আচারই’ শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করিল।” (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, দীনেশচন্দ্র সেন) ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেছিলেন, “শ্রীধর দাসের ‘সদুক্তি কর্ণামৃত’ গ্রন্থে অবতার বিষয়ক শ্লোকাবলীর

মধ্যে দশাবতারের উল্লেখই প্রধান, এবং তাহার মধ্যে আবার কৃষ্ণাবতার সম্বন্ধেই ষাটটি শ্লোক। পরবর্তীকালে চৈতন্য ও চৈতন্যত্তর বাংলার বিষ্ণু-কৃষ্ণধর্মের যে রূপে আমরা

প্রত্যক্ষ করি তাহার আদি সংস্কৃতিপূত রূপ এই শ্লোকাবলীর মধ্যেই নিবন্ধ, এ সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কারণ নাই।” (বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়) সেই শ্লোকাবলী

লক্ষণসেনের সভায় রচিত এবং গীত হয়েছিল। ড. রায় এই সূত্রে আরও বলেছিলেন, “হরিভক্তি বা স্তূতি সমৃদ্ধ ‘সদুক্তি কর্ণামৃতে’ অনেকগগুলি শ্লোক আছে। কবি কুলশেখর রচিত একটি

শ্লোক এবং আরও দুই একটি শ্লোকে বিশুদ্ধ ভক্তিধর্ম ও হৃদয়াবেগের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাহাতে মনে হয় ইহাদের মধ্যে যেন চৈতন্যোত্তর কালের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তি ও হৃদয়াবেগ

প্রত্যক্ষ করিতেছি - ‘যানি ত্বচচবিতামৃতানি রশনা লেহ্যানি ধন্যাত্মনাং/ যে বা শৈশব চাপলব্যতিকরা রাধানুবন্ধোন্মুখাঃ/ যা বা ভাবিতবেণুগীত গতয়ো লীলামুখাম্ভোরুহে/ ধারা বাহিওয়া

বহন্ত হৃদয়ে তান্যেব তান্যেব মে।’ …” এই শ্লোক বুঝিয়ে দেয় যে, সমাজে অনাচার ব্যভিচার বর্ণভেদ এবং নানা প্রকার নিপীড়ন সত্ত্বেও চৈতন্যদেবের আগমনের পটভূমি প্রস্ত হচ্ছিল।

পরিবেশ না থাকলে অবতার বা মহামানবের অভ্যুদয় কখনোই সম্ভব হয় না। ১২০২ খ্রীস্টাব্দে মুসলমান সৈন্যরা নদীয়া এবং লক্ষণাবতী অধিকার ও লুন্ঠন করেছিলেন। বস্তুতপক্ষে

বখতিয়ার খিলজি স্বাধীন নবাব হয়ে উঠেছিলেন। তবে মুসলমান সৈন্যরা ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগের পূর্বে পূর্ব-বঙ্গ অধিকার করতে পারেন নি, ত্রয়োদশ শতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পরে

তাঁরা দক্ষিণ-বঙ্গ অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলায় মুসলমান রাজত্ব আরম্ভের সঙ্গে সঙ্গে দেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারও আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। রাজশক্তি বুঝতে পেরেছিল যে,

হিন্দু অধ্যূষিত দেশে তাঁদের টিকে থাকতে হলে নিজ ধর্ম-মতে বিশ্বাসী লোক বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। সূফী সাধকেরা সেই ব্যাপারে রাজশক্তির অনেক উপকার সাধন করেছিলেন। তাঁদের

ভক্তিবাদ সহজেই হিন্দুদের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। সূফীরা কোরান ও হাদীসের কিছু, বিধি ও নির্দেশকে জীবনে প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের কাছে প্রেমই ছিল প্রধান - “সূফী

সাধনায় প্রেমের গুরুত্ব অপরিসীম। স্রষ্টা আর সৃষ্টির মধ্যে মিলনের সেতুই হল প্রেম। সূফী সাধকদের কাছে প্রেমই ধর্ম। সূফী তত্ত্বের বক্তব্য অনুযায়ী আল্লাহ প্রেমময়। তিনি

সকলের একমাত্র প্রেমাস্পদ। আমরা সবাই তাঁর প্রেমিক। সূফী তত্ত্বে প্রেম ও দয়া (রহমত) মলতঃ একই অনভূতির দুটি আলাদা নাম। সূফীর জীবনে তাই আল্লাহর প্রেম ও দয়াই প্রধান

কাম্য। ... এই প্রেমের জন্য সূফীরা আত্মবিসর্জনে উন্মুখ।” (ভারতের সূফী, মোবারক করিম জওহর, ভূমিকা) ঐতিহাসিকদের মতে, বঙ্গদেশে বিষ্ণুর উপাসনা ষষ্ঠ, সপ্তম শতাব্দী থেকে

আরম্ভ হলেও ‘সদুক্তি কর্ণামৃতের’ আগে ভক্তি ও হৃদয়াবেগের বাংলার তেমনভাবে পরিচয় ছিল না। ‘সদুক্তি কর্ণামৃত’ রাজাদের সভায় গীত হত; তাতে ভক্তি ও হৃদয়াবেগের যে পরিচয়ই

থাকুক না কেন সেনবংশেব আচার-আচরণে সেটার কোন পরিচয়ই ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় নি। তাই সাধারণ মানুষ সেদিকে তেমনভাবে আকৃষ্টও হন নি। কিন্তু সূফীদের প্রেমভাব এবং

ইসলামের গণতন্ত্র সাধারণ মানষকে যথেষ্ট আকর্ষণ করেছিল। সূফী ‘শাহ জালাল’ তাঁর বহু গণমুগ্ধ ভক্তকে ইসলামে দীক্ষিত করেছিলেন' (ভারতের সূফী, মোবারক করিম জওহর, ভূমিকা,

পৃ- ৩) সেই বঙ্গদেশের স্বাধীন সুলতানের অনেকদিন ধরে রাজত্ব করবার পরে পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলমান রাজবংশের অভ্যন্তরীণ কলহের সুযোগ নিয়ে ‘রাজা গণেশ’ বঙ্গদেশ

অধিকার করে নিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে ‘ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার’ বলেছিলেন যে, বঙ্গদেশের (উত্তর-বঙ্গ ও গৌড়ের) মুসলমান সমাজে এর ফলে যথেষ্ট উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। তাঁদের

বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, বঙ্গদেশের তখতে কোন মুসলমান ছাড়া অন্য কেউ বসবার অধিকারী নন। ফলে গণেশকে অপসারিত করবার জন্য সেই সময়ের মুসলমান ধর্মনেতারা আন্দোলন

আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের তুলনায় গণেশকে বিশেষ শক্তিশালী দেখে তাঁরা বিদেশী নবাব ‘ইব্রাহিম খাঁ শর্কী’কে বঙ্গদেশ আক্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ইব্রাহিমের

সৈন্যদলকে গণেশ প্রতিরোধ করতে অসমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর পুত্র ‘যদু’ শত্রুপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। ইব্রাহিম তাঁকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে ১৪১৫-১৬ খ্রীস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে

বসিয়েছিলেন। তৎকালীন বাংলার হিন্দু ও বৌদ্ধরা তখন নানা কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ড. ‘দীনেশচন্দ্র সেন’ বলেছিলেন যে, ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে বাংলার বহু হিন্দু

ও বৌদ্ধ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালেও সেই ধর্মান্তর যে অব্যাহত ছিল সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তখন প্রধানতঃ তিনটি কারণে বঙ্গদেশের মানুষ

ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করে থাকেন - (১) সূফীদের প্রেম ভক্তি এবং ইসলামের গণতন্ত্র যা সে যুগের হিন্দু সমাজে দেখা যায় নি - সেটার আকর্ষণে; (২)

রাজশক্তির ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ফলে সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায়; এবং (৩) জবরদস্তির শিকার হয়ে। তখন অনেক সময়েই বলপূর্বক গোমাংস খাইয়ে দিয়ে, মুখে কুলকুলি করে জল দিয়ে

 

138

 

(যা পরবর্তী কালে কবিকঙ্কন মুকুন্দের লেখাতেও পাওয়া যায়) হিন্দুদের জাতিনাশ করা হয়েছিল। শোনা যায় যে, রাজা গণেশ সেই সময়ের অন্যান্য হিন্দু রাজাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা

করেও সফল হননি। গণেশের পুত্র যদু, ধর্মান্তরিত ‘জালালউদ্দীনের’ পরে বঙ্গদেশে ‘মহম্মদ শাহী বংশ’ রাজত্ব করেছিল, এবং হাবসী খোজারা সেই সময়ে বিরোধ-হত্যার রাজনীতি

চালানোর ফলে দেশে চরম অরাজকতা দেখা দিয়েছিল। এরপরে হাবসী খোজারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যথেচ্ছচার শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সুলতান ‘আলাউদীন হুসেন শাহ’ হাবসীদের

বঙ্গদেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ বিতাড়িত করেছিলেন। তিনি ১৪৯৯ থেকে ১৫১৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। অশান্ত বঙ্গদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে তিনি সক্ষম

হয়েছিলেন। হুসেন শাহ তাঁর রাজত্বকালে বাংলার আশেপাশের যেসব বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালিয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে উড়িষ্যা একটি। এই প্রসঙ্গে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছিলেন,

“Hussain Shah also carried on a protracted war against Orissa which began shortly after his accession and continued almost up to the end of his reign, at least up

to A. D. 1515. There is, however, no doubt that at one stage of the war Hussain Shah penetrated far into the interior of Orissa and destroyed the temple of Puri

and the images of deities of the famous place of Hindu pilgrimage. Prataparudra, the king of Orissa, is also credited with victories which enabled him to annex

territories of Bengal up to the Ganges. It seems to be certain that the king of Orissa besieged Mandaran (Hooghly District) but failed to capture it.” (History of

Mediaeval Bengal, P- 51) অর্থাৎ, হুসেন শাহ উড়িষ্যাও আক্রমণ করেন, এবং অনেকদূর পর্যন্ত প্রবেশ করে পুরীর মন্দির ও প্রসিদ্ধ হিন্দু তীর্থের বিগ্রহ ভগ্ন করেন। উড়িষ্যার

রাজা প্রতাপরুদ্রও বঙ্গদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হুগলী জেলার মান্দারণ দূর্গ অববোধ করেন। ওই সময়ে দুই দেশের যুদ্ধ অন্ততঃপক্ষে ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। তবে

রাজনীতি সচেতন হুসেন শাহ সেই সময়ে কোন কিছুকেই মাত্রাছাড়া হতে দেন নি। নিজের রাজ্যের অনেক হিন্দুকেই তিনি রাজকার্যের প্রধান প্রধান পদে বসিয়েছিলেন, এমনকি তাঁর

ব্যক্তিগত হিন্দু চিকিৎসকও ছিলেন। অনেকের মোতে তাঁর পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতাতেই তৎকালীন বাংলা সাহিত্য গৌরবদীপ্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এত গুণ থাকা সত্ত্বেও, বঙ্গদেশে তিনি

অনেক মসজিদ নির্মাণ করলেও নিজের হিন্দু প্রজাদের জন্য একটি মন্দিরও তৈরি করে দেন নি। এমনকি তিনি সেই ধরণের কোন কাজের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন বলেও ইতিহাসের কোথাও

কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। সমকালীন পর্তুগীজ পর্যটক ‘জুয়ার্ট বারবোজ’ বলেছিলেন যে, সেই সময়ের বঙ্গদেশে সুলতান এবং তাঁর পদস্থ কর্মচারীদের প্রীতি লাভের উদ্দেশ্যে

প্রতিদিন বহু সংখ্যক পৌত্তলিক হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন। এই তথ্য থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, তখনকার সাধারণ হিন্দুরা রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষ লাভ করতেন

না।

চৈতন্যদেবের আগমনের আগেই বঙ্গদেশে সহজিয়া ধ্যান ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। সে কালের বৈষ্ণবেরা এই ধ্যান-ধারণার বিরোধিতা করেও তাতে সাফল্য লাভ করতে পারেন নি।

অপর পক্ষে, পরবর্তীকালে বৈষ্ণবেরাই সহজিয়া ধ্যান-ধারণার দ্বারা অনেকটাই চালিত হয়েছিলেন। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতাব্দী থেকে “এক শ্রেণীর গান আমরা

রংপুর, কুচবিহার ও দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলে পাইতেছি তাহার নাম ‘কৃষ্ণ ধামালী’; ইহা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত, এক শ্রেণীর নাম ‘আসল’ ও অপর শ্রেণীর নাম ‘শুকুল’ (শুক্ল)।” (বঙ্গভাষা ও

সাহিত্য, অষ্টম সংস্করণ, পৃ- ১৩৪) তিনি আরো মনে করতেন যে, “শুক্লাধামালীকে সুন্দর করিয়া সাধু ভাষায় প্রবর্তিত করিয়া কবিত্ব মণ্ডিত করিয়া চণ্ডীদাস কৃষ্ণকীর্তন লিখিয়া

ছিলেন।” এবারে নীহাররঞ্জন রায়ের গ্রন্থ থেকে ওই সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থাটাও দেখে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, “প্রাচীন বাঙলার সমাজ যেমন বিভিন্ন বর্ণে

তেমনি বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণীতেও বিভক্ত ছিল। সামাজিক ধনের উৎপাদন ও বন্টনানুযায়ী সমাজে অর্থনৈতিক শ্রেণীর উদ্ভব ও স্তরভেদ দেখা যায়। যে সমাজে উৎপাদিত ধনের

উপর সকলের সমান অধিকার, ব্যক্তিগত ধনাধিকার যে সমাজে স্বীকৃত নয়, সেই সমাজে শ্রেণী-বিন্যাসের প্রশ্ন অবাস্তব। কিছু প্রাচীন বাঙলার সমাজে ব্যক্তিগত ধনাধিকার যেমন

আজিকার মতই স্বীকৃত হইত, তেমনি অস্বীকৃত হইত উৎপাদিত ধনের উপর সকলের সমান অধিকার। বস্তুতঃ বহু প্রাচীন কাল হইতেই ভারতবর্ষের অধ্যাত্ম চিন্তায় অন্নের উপর

সকলের সমানাধিকার অর্থাৎ সকলেরই খাইয়া বাঁচিবার অধিকার স্বীকৃত হইত (ভাগবত: ‘সর্বভূতে যথাযোগ্যভাবে অন্নাদির সম্যক বিভাগও ধর্ম’। এই ভাগবতেই অন্যত্র পাইতেছি,

‘ক্ষুধার ও প্রয়োজনের অনুরূপ অন্ন পাওয়া দেহী মাত্রেরই অধিকার; তাহার বেশী যে অধিকার করে সে দণ্ডার্হ’)। … “৮ম হইতে ১৩শ শতক পর্যন্ত বাঙালী সমাজ প্রধানতঃ এবং

প্রথমতঃ কৃষি নির্ভর। সামন্তপ্রথা প্রতিষ্ঠিত, ভূমিই সমাজের প্রধান সম্পদ। ইহার একপ্রান্তে জনপদজোড়া ভূমির অধিকার লইয়া দোর্দণ্ড প্রতাপে দণ্ডায়মান মুষ্টিমেয়

মহামাণ্ডলিক মহাসামন্তরা। অন্যদিকে লেশমাত্র ভূমিবিহীন অসংখ্য প্রকার দল; মধ্যস্থানে ভূমিস্বত্বাধিকারের নানা স্তর। এই বিচিত্র স্তরই প্রধানতঃ শ্রেণী নির্দেশের দ্যোতক। ...

বৌদ্ধ আমলে ডোম-ডোম্বী, শবর-শবরীরা স্বীকৃত ছিল। ব্রাহ্মণ্য সংস্কার বা সংস্কৃতিতে তাহা ছিল না, কাজেই সেন আমলে সমাজ-শ্রমিক শ্রেণীর এই অবজ্ঞা অস্বাভাবিক নয়।

(বাঙ্গালীর ইতিহাস, ১ম খণ্ড) কাজেই ওই সময়ের সমাজের এক বিরাট সংখ্যক মানুষের জীবনে দুঃখকষ্ট তাঁদের জীবন সাথী হয়ে পড়েছিল। তাঁদের জীবনে কোন আশা-আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ

হওয়ার সম্ভাবনা না থাকবার জন্য স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ভাগ্যনির্ভর হয়ে পড়েছিলেন। ভাগ্যনির্ভর মানুষের মধ্যে কখনোই আত্মবিশ্বাস জন্ম নিতে পারে না। তাই সেই আত্মবিশ্বাস

জাগিয়ে তোলবার প্রযোজন তখন একান্তরূপেই দেখা দিয়েছিল। সেই দরিদ্র নিম্নশ্রেণীর সমাজই তখন নবভাব প্রবর্তনের উপযুক্ত ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সেই আমলের

অধিকাংশ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতই যে কোন নতুন চিন্তা প্রবর্তনের বিরোধী ছিলেন। এই প্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন বলেছিলেন, “দ্বাদশ শতকের একেবারে শেষে পূর্বে ভারতে তুর্কী আক্রমণ শুরু

হয়। তাহার পর হইতে দেড়শত বৎসর ধরিয়া বাঙলাদেশে ধ্বংসের ও অরাজকতার তান্ডবলীলা চলে। দেশের ভিতরকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলো সর্বাগ্রে বিধ্বস্ত হইল।

বিদ্যাবুদ্ধিতে পারদর্শীরা নিহত হইলেন। তুর্কীদের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ বাঙ্গালা দেশে তখনো আর্য-অনার্যের স্তরভেদ ছিল - অখণ্ড বাঙ্গালী জাতি গঠিত হয় নাই। তুর্কী

আক্রমণের পরে আর্য-অনার্যের পূর্ণ মিলন ঘটিল, ভাবধর্মী এবং প্রাণধর্মী ধারার মিলন ঘটিল। তারই মূর্তিমান বিগ্রহ চৈতন্যদেব। ১৩৪৫-৪৬ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ ইলিয়াস শাহ

বাঙ্গলার স্বাধীন সুলতান হন - দেশে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে - জ্ঞানচর্চা সাহিত্যকর্ম আরম্ভ হয় : সর্বপ্রকার উন্নতির জন্য পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা

করিতেই হইল।” (বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস) ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেছিলেন, “নবদ্বীপে ন্যায়ের টোল তখন হিন্দুস্তানে অদ্বিতীয়; দর্শন, কাব্য, অলঙ্কার প্রভৃতি শাস্ত্রেরও সেই সময়

বিশেষরূপে চর্চা হইতেছিল। মঙ্গলচণ্ডী, বিষহরি ও ষষ্ঠীর পূজা, যোগীপাল ভোগীপাল মহীপালের গীত এবং পশু রক্ত ও মদ্যের দ্বারা আর্দ্র যজ্ঞস্থালী দেখিয়া কিছু কিছু লোক আক্ষেপ

করিতেন। হরিভক্তিহীন নবদ্বীপের অর্থ ও বিদ্যাসমৃদ্ধি তাঁহাদের নিকট সিন্দুরবিহীন রমণী ললাটের ন্যায় বৃথা মনে হইত। তাঁহারা পৃথিবীতে ভক্তির অভাব দেখিয়া অশ্রুপাত করিতেন। এই

ভক্তবৃন্দের মধ্যে অদ্বৈত আচার্য অগ্রগণ্য। … পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে নবদ্বীপ তিনটি শ্রেষ্ঠ পুরুষকে উপহার দিয়াছে - রঘুনাথ শিরোমণি, স্মার্ত রঘুনন্দন ও চৈতন্যদেব। প্রথম

দুইজন শাস্ত্রচর্চাকারীদের মধ্যে ‘রাজা’ উপাধি পাইবার যোগ্য। শেষোক্ত জনও অল্পবয়সে সর্বশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি শুষ্কপত্রের ন্যায় সেই শিক্ষা ভূতলে

নিক্ষেপ করিয়া সদ্য বিকাশত উৎকৃষ্ট মনুষ্যত্ব বা দেবত্ব দেখাইয়া ছিলেন। এই তৃতীয়জন মানবজাতির তপস্যার ফলস্বরূপ। (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, পৃ: ১৬৮-৬৯) তখন হরিভক্তি ছিল না,

বিশ্বাস ছিল। তাই বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবেরা বৈকুণ্ঠনাথের কাছে নিজেদের আকুল প্রার্থনা জানাচ্ছিলেন। ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’ - সেই বিশেষ সময় কি আসে নি?

পাষণ্ডরা ভক্তদের জীবন যে দুঃসহ করে তুললো! শ্রীবাসের গৃহে বৈকুণ্ঠ ঈশ্বরকে লক্ষ্য করে প্রতিদিন কীর্তনের উচ্চরোল উঠছিল, ‘এস, এস প্রাণবল্লভ - তোমার ভক্তদের রক্ষা

কর’। অদ্বৈত আচার্যের গৃহে তো শুধু প্রার্থনাই নয়, রীতিমত সিংহবীর্য হুংকার উঠছিল - ‘দরিদ্র নীচ মূর্খদের উদ্ধার করতে তোমাকে আসতেই হবে, চণ্ডালের কণ্ঠেও তোমার জয়ধ্বনি

উঠবে।’ দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় আচার্যের সেই সাধনা কিছুতেই ব্যর্থ হয়নি। ওই সময়ের নিপীড়িত দরিদ্র ভেদজর্জর মানুষের কণ্ঠেও গগনভেদী আর্তি শোনা যাচ্ছিল। নিজেদের আত্মবিশ্বাস

হারিয়ে তাঁরা ভাগ্য নির্ভর হয়ে পড়েছিলেন। বুদ্ধের শূন্যবাদ এবং শঙ্করের মায়াবাদ তাঁদের মনে তখন কোন কোন আশা, ভরসা জাগাতে পারছিল না। তাঁরা জীবিত কাউকে চেয়েছিলেন, যাঁকে

অবলম্বন করে তাঁরা নিজেদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন, তাঁদের মনে নিজেদের সন্তান-সন্ততির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা জেগে উঠবে। তখন বৈষ্ণব ভক্তরা ভাবছিলেন, অবতারের

আগমনের সময় হলেও তিনি বিলম্ব করছেন কেন? সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছিল, আমাদের এই দুর্দিনে আমাদের মনে বল-ভরসা জাগিয়ে তোলবার জন্য মহামানবের আসার সময় কি

এখনও হয় নি?

শুধু তৎকালীন বঙ্গদেশকে জানলে চৈতন্যদেবের জন্মের তাৎপর্য বুঝতে পারা গেলেও, তাঁর কর্মের তাৎপর্য বুঝতে গেলে ওই সময়ের, বিশেষ করে উড়িষ্যা এবং দক্ষিণ-ভারতের

সমকালীন অবস্থাকেও কিছুটা বুঝতে হবে। সেই সময়ে উড়িষ্যা যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিল - বঙ্গদেশের হুসেন শাহ এবং কর্ণাটের (বিজয়নগর) সম্রাট ‘কৃষ্ণদেব রায়া’ উড়িষ্যার তৎকালীন

সম্রাট ‘গজপতি প্রতাপরুদ্রের’ সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু ছিলেন। সম্ভবতঃ সেই যে শত্রুতা, সেটা উড়িষ্যার সোমবংশীয় শক্তিমান রাজা ‘দ্বিতীয় যযাতি’র সময় থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। তিনি

কর্ণাট, গুজরাট, কাঞ্চী, গৌড়, রাঢ় প্রভৃতি দেশের রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন ৷ কিন্তু তাঁর পুত্রের পরেই ওই বংশের পতন আরম্ভ হয়েছিল। এরপরের উড়িষ্যার শক্তিমান

সম্রাট ছিলেন গঙ্গাবংশীয় ‘অনন্ত বর্মণ চোল’ (চোড়) - ‘গঙ্গদেব’। তিনি গঙ্গা থেকে গোদাবরী পর্যন্ত নিজের রাজ্য বিস্তার করেছিলেন; প্রায় তিনশো বছর ধরে সেই বংশ উড়িষ্যায়

রাজত্ব করেছিল। ওই সময়ে উড়িষ্যা ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ হিন্দুরাষ্ট্র ছিল। সেই দেশের ওপরে চারদিক থেকে মুসলমান আক্রমণ ঘটেছিল। সেই সময়ে কঠোরতা এবং নিয়মনির্দিষ্টতার

জন্য শৈব ধর্ম যেমন সাধারণ মানুষকে আর সন্তুষ্ট করতে পারছিল না, তেমনি জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মকেও আর নতুন করে আহ্বান করা সম্ভব ছিল না। তখন ভারতবর্ষে রামানুজের প্রভাবে

বৈষ্ণবধর্ম বিস্তার লাভ করছিল। চোড়গঙ্গের রাজত্বকালে রামানুজ পুরীতে এসেছিলেন - “The Kalinga Emperor, during the closing years of a great career turned to religious

activities and vigorously championed the cause of Vaishnavism by taking up the construction of the temple of Jagannath ... The temple of Jagannath, as the

supreme abode of Vaishnavism, has invited millions of Hindus from all parts of India for all these centuries.” (Ancient and Mediaeval Empires and Kingdoms, Prof.

M. N. Das) কলিঙ্গ সম্রাট তাঁর গৌরবময় কর্মধারার শেষদিকে ধর্মে কর্মে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, এবং বৈষ্ণবধর্মকে জোরালো সমর্থন জানিয়ে জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণে হাত

দিয়েছিলেন। জগন্নাথদেব বৈষ্ণবদের পরম আশ্রয়স্থল, তাঁর মন্দির যুগ যুগ ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার হিন্দুকে আকর্ষণ করে আসছে। এরপরে সূর্য বংশীয় রাজারা

উড়িষ্যার সিংহাসনে বসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘কপিলেন্দ্রদেবের’ রাজত্বকাল আরম্ভ হয়েছিল ১৪৩৬ খ্রীস্টাব্দ থেকে। এর আগে থেকেই উড়িষ্যা চারিদিক থেকে শত্রু পরিবেষ্টিত

ছিল - তখন বঙ্গদেশের মুসলমান শাসক, বাহমনির মুসলমান সুলতান, এবং বিজয়নগরের হিন্দু রাজারাই উড়িষ্যার স্বাধীন সম্রাটদের প্রধান শত্রু ছিলেন। কপিলেন্দ্রদেব দুর্ধর্ষ

শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন, তাঁর হস্তীবাহিনীকে সকলেই ভয় করতেন। বিরাট হস্তীবাহিনীর অধিপতি ছিলেন বলে সেই রাজবংশের উপাধি হয়েছিল ‘গজপতি’। বাহমনির মুসলমান সৈন্যদের তিনি

বিধ্বস্ত করেছিলেন; এবং বাহমনি, বঙ্গ এবং বিজয়নগরের অনেক অঞ্চলও তিনি দখল করে নিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি কাঞ্চীও জয় করেছিলেন। বিভিন্ন অঞ্চল অধিকারের ব্যাপার নিয়ে

প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাঁর শত্রুতা চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী গজপতি রাজাদের মধ্যে আর কেউই কপিলের মত বীর্যশালী ছিলেন। প্রতাপরুদ্রের রাজত্বকালে কৃষ্ণদেব রায়া

বিজয়নগরের সিংহাসনে বসেছিলেন, এবং আলাউদ্দীন হুসেন শাহ বঙ্গদেশের সুলতান হয়েছিলেন। তাঁরা দু’জনেই অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন, পর্তুগীজদের কাছ থেকে বহু শত দ্রুতগামী অশ্ব

ক্রয় করে কৃষ্ণদেব রায় তাঁর সৈন্যবাহিনীতে নতুন শক্তি এবং গতি সঞ্চার করেছিলেন। এর ফলে প্রতাপরুদ্রের সামনে সমূহ বিপদ উপস্থিত হয়েছিল। কথিত আছে যে কপিলেন্দ্রদেবের ১৮

জন পুত্র ছিলেন। তাঁরা সকলেই উড়িষ্যার সিংহাসনের দাবীদার হলে ‘পুরুষোত্তম’ তাঁদের সকলকে বশীভূত করে, প্রত্যেককে উড়িষ্যার এক একটি অঞ্চলে স্বাধীন রাজত্ব স্থাপন করতে

দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান মনে করতেন যে, “If this account be correct, here was the beginning of the self-destructive

process of Orissa’s state power.” (Ancient and Mediaeval Empires and Kingdoms, Prof. M. N. Das) অর্থাৎ, একথা সত্যি হলে এটাই বলতে হবে যে, সেখান থেকেই উড়িষ্যার

রাষ্ট্রশক্তির ধ্বংসের শুরু হয়েছিল। পুরুষোত্তম নিজেও খুব সংস্কৃতি-সম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। পুরুষোত্তমেরই পুত্র ছিলেন প্রতাপরুদ্র। ১৪৯৭ খ্রীস্টাব্দে

 

139

 

তিনি উড়িষ্যার সিংহাসনে বসেছিলেন। ‘মাদলা পঞ্জী’তে পাওয়া যায় যে, গৌড়ের পাতশা (বাদশাহ) পুরীতে প্রবেশ করে জগন্নাথ মন্দিরের দেবমূর্তি ধ্বংস করেছিলেন। সেই সংবাদ পেয়ে

প্রতাপরুদ্র দ্রুত রাজধানীতে ফিরে এসেছিলেন (তিনি যখন দক্ষিণ ভারতে অভিযান করতে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সুযোগে গৌড়েশ্বর অরক্ষিত উড়িষ্যা আক্রমণ করে অনেকটা ভিতরে প্রবেশ

করতে পেরেছিলেন), এবং গঙ্গাতীর পর্যন্ত শত্রুর পশ্চাদ্ধাবন করেছিলেন। তখন পাতশা মান্দারণের দূর্গে আশ্রয় নেওয়ার পরে সেই দূর্গে অবরোধ করা হয়েছিল। “Govinda

Vidyadhara, an officer of the king now turned traitor. Pratap Rudra was compelled to make peace with the Patsa. He handed over the reins of Government to

Govinda Vidyadhara ... Govinda was the commandant of the fort of Cuttack He was the first of that group of traitors who were partly responsible for the fall of

Orissa.” (The Gajapati King of Orissa, Prof P. Mukherjee) অর্থাৎ, রাজার জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মচারী ‘গোবিন্দ বিদ্যাধর’ সেই সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করবার ফলে প্রতাপরুদ্র

বাদশাহের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁকে সেই অঞ্চলের শাসনভার গোবিন্দ বিদ্যাধরের হাতেই তুলে দিতে হয়েছিল। গোবিন্দ কটক দুর্গের অধ্যক্ষ ছিলেন।

পরবর্তীকালে উড়িষ্যার পতনের জন্য যে বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী আংশিকভাবে দায়ী ছিল, গোবিন্দ তাঁদের প্রধান ছিলেন। সম্ভবতঃ হুসেন শাহের অভিযানের কিছু আগেই চৈতন্যদেব পুরি হয়ে

দক্ষিণ ভারতের পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

আগেই বলা হয়েছে যে, অনন্তদেব চোড়গঙ্গের সময় থেকেই উড়িষ্যায় বৈষ্ণবধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল। জগন্নাথদেবের পূজায় অবশ্যই কিছটা বৌদ্ধ, শৈব এবং তান্ত্রিক রীতিপদ্ধতি

প্রবিষ্ট হয়েছিল। “Jagannath was conceived as Vasudeva, Siva and even as the Bhairava.” (History of Mediaeval Vaishnavism in Orissa, Prof. Pravat Mukherjee, P-

2) কপিলেন্দ্রর সময় থেকেই জগন্নাথদেব উড়িষ্যার রাষ্ট্রীয় দেবতা হয়ে উঠেছিলেন। জগন্নাথ মন্দিরে ‘গীতগোবিন্দ’ গীত হোক, সেটাও রাজার ইচ্ছা ছিল; সেখানে রাধাভাবের যে কথা

রয়েছে, তা চৈতন্যদেবের আগে বিশেষ জনপ্রিয় ছিল না। রাধার ধারণা এবং গোপীদের ধারণা প্রথমে উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতে প্রসার লাভ করেছিল। বৈষ্ণবরা রাধাকে গোপীদের মধ্যে

প্রধান বলে মনে করেন। উত্তর ভারত থেকেই সেই ভাব উড়িষ্যায় এসেছিল বলে গবেষকরা মনে করেন। সম্ভবতঃ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ‘তেলেঙ্গী নিম্বার্ক স্বামী’ বৃন্দাবনে বসবাস করতেন।

তাঁর শিক্ষাতেও রাধা-ধারণার বিশেষ প্রভাব ছিল। গীতগোবিন্দে সেই ধারণা আরও সম্পূর্ণতা লাভ করেছিল। রাধাভাবের জ্বলন্ত নিদর্শন শ্রীচৈতন্যদেব সম্ভবতঃ সেই কারণেই উড়িষ্যার

মানসিকতায় ওই ধরণের গভীর ছাপ ফেলতে পেরেছিলেন, এবং সহজেই সাধারণ্যে গৃহীত হয়ে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ-কীর্তনও তৎকালীন

উড়িষ্যায় পরিচিত ছিল। “Vaishnavism flourished in Orissa even before the advent of Chaitanya.five of the exponents of the pre-Chaitanya school of Vaishnavism in

Orissa lived during the reign of Prataprudia and were popularly known as the five Associates (Panchasakha). These scholarly and devout Vaishnavas Jagannath,

Balaram, Achyutananda, Ananta and Jasovanta regarded Chaitanya as embodiment of Jagannath and came under the spell of his influence. But they did not join

the Chaitanya sect commonly known as Gaudiya Vaishnava.” (The Gajapati King of Orissa, Prof Provat Mukherji, P- 2). অর্থাৎ, চৈতন্যের আগমনের পূর্বেই উড়িষ্যায়

বৈষ্ণবধর্ম বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। প্রতাপরুদ্রের রাজত্বকালে পাঁচজন বৈষ্ণবতত্ত্ব ব্যাখ্যাতা উড়িষ্যায় ছিলেন। তাঁরা ‘পঞ্চ সহযোগী’ বা ‘পঞ্চসখা’ বলে পরিচিত ছিলেন। সেই

পণ্ডিত বৈষ্ণব ভক্তরা হলেন জগন্নাথ, বলরাম, অচ্যুতানন্দ, অনন্ত এবং যশোবন্ত। তাঁরা চৈতন্যকে জগন্নাথের প্রতিমূর্তি বলে মনে করলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সঙ্গে কখনোই মিশে

যান নি। প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে যদ্ধরত কৃষ্ণদেব রায়াও বৈষ্ণব ছিলেন। উড়িষ্যার অধিকারভূক্ত উদয়গিরির দূর্ভেদ্য পার্বত্য দুর্গ জয় করে তিনি সেখান থেকে কৃষ্ণমূর্তি তুলে নিয়ে গিয়ে

বিজয়নগরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এবং বহু জমি দেবোত্তর সম্পত্তি করে দিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি কৃষ্ণের একটি বিরাট মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু দঃখের বিষয় হল যে, সেই দুই

বিশেষ প্রতাপশালী বৈষ্ণব সম্রাট পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করেই নিজেদের শক্তি ক্ষয় করে ফেলেছিলেন। অতীতের মুসলমান সুলতানেরা পরস্পরের সঙ্গে বিরোধিতা করলেও, প্রয়োজনের

সময়ে জোটবদ্ধও হতে পেরেছিলেন। যেমন, কৃষ্ণদেব রায়ার সঙ্গে যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে ‘আদিল শাহ’ পাঁচটি মুসলমান রাষ্ট্রকে একত্র করেছিলেন। দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ কালে চৈতন্যদেব

সেসব ব্যাপারের অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ করেছিলেন। হুসেন শাহের সঙ্গে প্রতাপরুদ্রের যুদ্ধের প্রস্তুতিকালেই চৈতন্যদেব বঙ্গদেশ থেকে উড়িষ্যায় গিয়েছিলেন। একজন সন্ন্যাসীর চোখে

দেখা অবস্থা কি তাঁর মনে কোন দাগ কাটে নি? ইউরোপে চৈতন্য-সমসাময়িক কালে যখন ধর্ম পুনরুদ্ধার এবং সংস্কার প্রচেষ্টা চলছিল, ঠিক একই সময়ে উত্তর ভারতে ও পাঞ্জাবে

ধরণের আন্দোলন চলছিল। বাংলার পাল রাজারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, মানুষে মানুষে সহযোগিতাই শক্তির উৎস; আর সেন-বর্মণরা দেখিয়েছিলেন যে, ভেদাভেদ সৃষ্টি

করে রাজশক্তিও বেশীদিন টিকতে পারে না। তারপরে দেখা গিয়েছিল যে, মুসলিম রাজশক্তি এবং ধর্মান্ধ মুসলমান ধর্মনেতারা হিন্দু মন্দির ভাঙলেও, এবং বহু ক্ষেত্রে জোর করে ইসলাম

ধর্ম গ্রহণ করলেও, সূফী সাধকেরা কিন্তু উদার মনে হিন্দু-মুসলমানকে ঐক্যের বন্ধনে আগ্রহভরে বেঁধেছিলেন। হিন্দু রাজারা তখন পরস্পরের মধ্যে লড়াই করে নিজেদের শক্তি ক্ষয়

করেছিলেন। এরই মধ্যে এসেছিল বৈষ্ণব ধর্ম, উড়িষ্যার এবং বিজয়নগরের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষ্ণব ধর্মের জয় জয়কার হয়েছিল, প্রেম ভক্তির প্রকাশ ঘটেছিল। এই পরিবেশেই

তো ‘অবতার’ বা মহামানবের জন্ম হয়। ধর্মের ওপর যে আঘাত আসছে সেটাকে রোধ করতে হবে এবং সেই সঙ্গে শুধু বঙ্গের নয়, সমস্ত ভারতের মানুষকে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ করতে

হবে। মানুষের মধ্যে ছোটো-বড় বলে কিছু নেই - সর্বত্র সমতা সৃষ্টি করা চাই। যুক্তিবাদীদের মতে পারিপার্শ্বিক অবস্থাই যুগস্রষ্টার জন্ম দেয়। দুষ্কৃতকারীদের অত্যাচার যত বৃদ্ধি

পায়, মানুষের পরিত্রাতা বা চিন্তাবিদ মহামানবের আবির্ভাব ততই ত্বরান্বিত হয়। ‘শ্রীমদ্ভাগবতে’ নারদ বলেছিলেন - “পাপে ভরা না হইলে বংশ কভু তার।/ ধ্বংস করিবারে পারে হেন সাধ্য

কার।” (পৃ- ৬৫৭) অত্যাচারের ফলে নিপীড়িত মানবাত্মাব ক্ষোভ তীব্র হয়, আর সেই ক্ষোভেরই সমন্বিত ফল হল, অত্যাচার দমন কল্পে বিরাট ব্যক্তিত্বের জন্ম। সেই বিরাট

ব্যক্তিত্বের আগমনের পূর্বে বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় নানা ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করে জমি প্রস্তুত করবার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন।

'শিবরাত্রি - লোকসংস্কৃতির এক জটিল সমন্বয়'

রানা

‘‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।

শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান।।’’

ভারতীয় ভাবনায় শিব দেবাদিদেব। ব্রহ্মা-বিষ্ণুর সঙ্গেই তাঁর নাম উচ্চারিত হয়। এক দিকে তিনি মহাপ্রলয়ের দেবতা, অপর দিকে তিনি কল্যাণসুন্দর। পণ্ডিতদের মতে শিব প্রাগার্য

সংস্কৃতির দেবতা। মহেঞ্জোদরোর একটি সিলে পশুপতির প্রতিকৃতি খোদিত দেখা যায়। আবার বৈদিক রুদ্র ছিলেন বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ঝড়ঝঞ্ঝার দেবতা। পরে শিবের সঙ্গে এই রুদ্র

সম্ভবতঃ মিলেমিশে যান। শিবপত্নী উমা-পার্বতী। যুগ যুগ ধরে ভারতীয় দাম্পত্যের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। (রানা চক্রবর্তী) গুপ্ত-পাল-সেন পর্বে উমা-মহেশ্বরের যুগ্মমূর্তি জনপ্রিয় ছিল।

বাংলার বিভিন্ন স্থানে এমন প্রস্তরমূর্তি অনেক পাওয়া গিয়েছে। বর্ধমান জেলার বিভিন্ন গ্রামে আজও হরগৌরীর প্রস্তরমূর্তি পূজিত হয়— যেমন কলিগ্রামে, মঙ্গলকোটের বনকাপাশি

কিংবা কাটোয়ার বিকিহাট গ্রামে। আজও কুমারী মেয়েরা মনের মতো বরের কামনায় শিবপূজা করেন। শিব-পার্বতীর বিয়ের মূর্তিকে বৈবাহিক/ পাণিগ্রহণ/ কল্যাণসুন্দর মূর্তি বলা হয়।

বিভিন্ন গুহাশিল্পে, মন্দিরগাত্রে কিংবা স্বতন্ত্র মূর্তিফলক হিসেবে এই মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।

শিবপুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতি পুরাণে, মহাকাব্যে, প্রাচীন সাহিত্যে শিবের গার্হস্থ্য জীবন বর্ণিত হয়েছে। শিবের গলায় মালা দিয়েছিলেন দক্ষকন্যা সতী। শিব-বিরোধী দক্ষ

এক বার শিবহীন যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সেখানে সতীর উপস্থিতিতে শিবের নিন্দা শুরু হল। সতী, পতির অপমানে যজ্ঞকুণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। শিব এসে দক্ষযজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে

সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নাচনে মেতে উঠলেন। সৃষ্টি বুঝি রসাতলে যায়। (রানা চক্রবর্তী) বিষ্ণু সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন বৃহত্তর ভারতবর্ষে। তার

পরে মহাদেব গভীর ধ্যানে ডুবে গেলেন। এ দিকে, সতী জন্ম নিলেন হিমালয়কন্যা উমা রূপে। স্বর্গরাজ্য তখন অসুর, দানবদের করতলে। তারকাসুরকে বধ করতে চাই শক্তিশালী দেবসেনাপতি।

ব্রহ্মা বললেন, যেমন করেই হোক উমার সঙ্গে মহেশ্বরের বিবাহ দিতে হবে। তবেই জন্ম হবে কার্তিকের। দেবতাদের প্রচেষ্টায় গৌরীর তপস্যায় মদন ভস্মের পরেই হরগৌরীর পরিণয়

সুসম্পন্ন হয়।

পুরাণ-লোকশ্রুতি অনুসারে শিব-গৌরীর বিয়ের স্থানটি উত্তরাখণ্ডে রুদ্রপ্রয়াগ জেলার ত্রিযুগীনারায়ণ গ্রামে। মন্দাকিনী ও শোনগঙ্গার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই পৌরাণিক জনপদটি

ছিল হিমালয় রাজার রাজধানী। এই বিবাহ দিয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। আর নারায়ণ গৌরীকে সমর্পণ করেন শিবের হাতে। চৈত্রে শিবগাজন উৎসব অনেকের মতে হর-কালীর বিয়ের অনুষ্ঠান।

যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি লিখেছিলেন, ‘‘শিবের গাজনের প্রকৃত ব্যাপার হর-কালীর বিবাহ। সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী। তাহাদের গর্জন হেতু গাজন শব্দ আসিয়াছে। ধর্মের গাজনে মুক্তির

সহিত ধর্মের বিবাহ হয়। দুই বিবাহ-ই প্রচ্ছন্ন।’’

তবে পৌরাণিক মতে, হরগৌরীর বিবাহ হয় শিবরাত্রির পুণ্যলগ্নে। অনেকেই বলেন, প্রতি কৃষ্ণপক্ষের চৌদ্দতম রাত্রিই শিবরাত্রি। কিন্তু ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চৌদ্দতম রাত্রি

হল মহাশিবরাত্রি। এটিকে বছরের সবচেয়ে অন্ধকার রাত বলে মনে করা হয়। এই রাতেই মহাদেব গৌরীর পাণিগ্রহণ করেন। এ দিন দেশের বহু শিবমন্দিরে হরগৌরীর বিবাহের অনুষ্ঠান হয়।

বর্ধমান জেলায় শিবরাত্রিতে হরগৌরীর বিবাহ উৎসব না হলেও মেলা বসে এবং বিশেষ পুজো ও অনুষ্ঠান হয়।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিই সেই সময়, যখন বসন্ত ইউরোপে পাড়ি দেয়, তুষারকে গিয়ে বলে, এখন তোমার বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে; আর তার পরেই ফের ভারতে ফিরে আসে সসম্মানে। (রানা

চক্রবর্তী) দু’টো উৎসবেরও মরশুম এটা, খ্রিস্টানদের ভ্যালেন্টাইন’স ডে আর হিন্দুদের শিবরাত্রি পালিত হয় এই সময়েই।

শিবরাত্রির দিনে হিন্দুরা মুখ্যতঃ শিবের বিয়ের উৎসব উদযাপন করে থাকেন, কেননা এ দিনেই শিব পার্বতীকে বিয়ে করেছিলেন বলে কথিত। খ্রিস্টান চার্চ কিন্তু মধ্য-ফেব্রুয়ারির

ভালবাসার উৎসবটিকে নিয়ে খানিক বিব্রত। প্রাচীন রোমানদের ‘লুপারকালিয়া’ নামের এই উৎসবকে বহু শতাব্দী ধরে গির্জাতন্ত্র দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। রোমানদের ওই উৎসবে

নারী-পুরুষের যৌন স্বাধীনতার উদযাপন হত। দুই লিঙ্গের মানুষের অবাধ মেলামেশা স্বাভাবিক ভাবেই চার্চের চোখে ছিল চরম অনৈতিক। ‘জুনো ফেব্রুয়াটা’, যে দেবীর উদ্দেশে এই ‘প্রেম-

জ্বর’ উৎসর্গীকৃত ছিল, চার্চ সেই দেবীকেও অস্বীকার ও বর্জন করে। অবশ্য পুরোপুরি পারেনি। বারবারা ওয়াকার লিখেছিলেন, ‘চার্চ সেই দেবীর পরিবর্তে নিয়ে এল এক শহিদ পুরুষের

মিথ, তিনিই সন্ত ভ্যালেন্টাইন।’ ভ্যালেন্টাইনের পরিচয় নিয়ে মতান্তর আছে। একটা মত বলে, তিনি ছিলেন এক পবিত্র, সুদর্শন রোমান যুবা, যিনি নিজের প্রিয়তমার জন্য প্রাণ

দিয়েছিলেন। একটা উৎসবের কেন্দ্রীয় চরিত্র কী ভাবে নারী থেকে পুরুষ হয়ে গেল, তা লক্ষ করার মতো বিষয়। সমস্ত ধর্মেরই একটা চড়া দাগের পুরুষতান্ত্রিক রং আছে। তারই প্রভাবে

নারী-পুরুষের মানুষী প্রেমের সম্পর্কটিকেও একটু বেশি শ্রদ্ধার, পুজো-পুজো রূপ দেওয়া হয়। (রানা চক্রবর্তী) এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ভুক্ত বৈষ্ণব ও

উত্তর ভারতের বহু কবির কথা, যাঁরা ঘোষণা করেছিলেন, রাধা-কৃষ্ণ আসলে বিবাহিত দম্পতি। পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল ধর্মবিশ্বাসগুলির কাছে ‘ভালবাসা’ ব্যাপারটা সব সময়েই সমস্যার,

বিশেষ করে যদি সেই ভালবাসা বৈধ বিবাহ, জাতি বা শ্রেণির বাইরে ঘটে যাওয়ার মতো স্পর্ধা দেখায়। দক্ষের যজ্ঞে শিব-পার্বতীর ট্রাজেডি কী করে ভুলি, ভালবেসে বিয়ে করার জন্য তাঁদের

কতটা মূল্য চোকাতে হয়েছিল! শিবরাত্রি পালনের প্রথাটি গত দু-তিন শতকে - ব্রিটিশদের হাতে মুসলমান শাসকের পরাজয়ের পরে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ার পর - সুদৃঢ়

হয়েছে। শিবরাত্রির দর্শনটি এমন: বিয়ে ব্যাপারটা এতই গুরুতর ও জটিল যে এটা বাবা-মায়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল, তাঁরা দেবদেবী, জাতপাত, কোষ্ঠী ইত্যাদি দেখেশুনে তাঁদের লক্ষ্মী

মেয়েদের জন্য (যাঁরা কিনা পুজো-উপোস ইত্যাদি করে) শিবের মতো বর খুঁজে আনবেন।

 

140

 

একই সঙ্গে দেখা যায় যে, ইতিহাস ও কিংবদন্তীর হাত ধরে সামাজিক, ভদ্রজনোচিত সম্মানের ধারণা কী ভাবে ভারতে ‘কাম’ ও ‘রতি’-র মতো বেয়াড়া চরিত্রকে এবং ইউরোপে ‘ইরোস’,

‘কিউপিড’, এমনকী ‘প্রায়াপুস’কেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কামদেব যেমন শুধু শিবের সঙ্গেই সম্পর্কিত নন, শিবপুরাণ মতে তাঁর যোগ আছে ব্রহ্মার সঙ্গেও, ব্রহ্মাই তাঁকে সৃষ্টি

করেছিলেন। ঋগ্বেদ, অথর্ববেদেও কামদেবের উল্লেখ আছে; বিষ্ণুপুরাণ মতে তিনি নারায়ণের অংশ, ভাগবতপুরাণ বলছে তিনি কৃষ্ণের এক রূপ। এ থেকে বোঝা যায়, তাঁর অস্তিত্ব ও

প্রতীকবাদকে হিন্দুধর্মের প্রামাণ্য মতবাদগুলিও অস্বীকার করতে পারেনি। (রানা চক্রবর্তী) যে পুরাণগুলির নাম বললাম, যদি তাদের রচনাকাল দেখি তা হলে দেখা যাবে সেগুলি রচিত

হয়েছে আড়াই হাজার বছর ধরে; খেয়াল করলে দেখব, কাম বা মদন নিয়ে চর্চা ভালই ছিল, ইন্দ্র বা বরুণের মতো তিনি হঠাৎ মানুষের পুজোর মঞ্চ থেকে বিদায় নেননি। আর কী আশ্চর্য,

সেই সুদর্শন রোমান যুবা যাঁকে খ্রিস্টানরা ‘ভ্যালেন্টাইন’-এর রূপ দিলেন, তাঁরই মতো, কামদেবকেও কল্পনা করা হয়েছে এক রূপবান পুরুষ হিসেবে। তাঁর গাত্রবর্ণ শ্যাম, হাতের ধনুটি তৈরি

ইক্ষুদণ্ড দিয়ে, তাতে মধুকরের আনাগোনা। তাঁর তূণীরে সুরভিত পঞ্চশর, অশোক-মল্লিকার মতো পাঁচ রকমের ফুল দিয়ে বানানো। কোকিল, গুঞ্জরিত অলি, মৃদুমন্দ মলয়পবনের মতো

বসন্ত-অনুষঙ্গ সঙ্গে নিয়ে তিনি আসেন। আরও অবাক করা ব্যাপার, হিন্দু ও গ্রিকো-রোমানের মতো বিস্তর দূরত্বের ব্যবধানে থাকা দুই সভ্যতায় ভালবাসার দেবতার প্রতীকটি একই -

তিরধনুক। গ্রিকরা প্রেমের দেবতার নাম দিয়েছিল ইরোস, রোমানরা - কিউপিড। বস্তুতঃ, প্রাচীন ইউরোপে কিউপিড আবির্ভূত হয়েছিলেন ডানাওয়ালা এক পুংদণ্ড রূপে, অনেক পরে রেনেসাঁর

সময়কার শিল্পভাবনা তাঁকে নতুন এক রূপ দান করে - এক শিশু দেবদূত, ছোট্ট, মিষ্টি তিরধনুক নিয়ে উড়ে উড়ে বেড়ায় সে। প্রেমের তির-বেঁধা হৃৎপিণ্ড এখন ভালবাসার বিশ্ববিদিত

অভিজ্ঞান, ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে এই প্রতীক আর ছবি-সম্বলিত কার্ড বিক্রি করে এক-একটি সংস্থা লক্ষ লক্ষ ডলার রোজগার করে। ভারতের কথায় ফিরে আসি, ইদানীং দেখতে পাচ্ছি

ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে জনবহুল স্থানগুলিতে নারী-পুরুষ যুগলের উপর নজরদারি চালাচ্ছে উগ্র মতাদর্শবাদীরা, যারা নিজেদের ধর্মের শেকড়ই জানে না। (রানা চক্রবর্তী) দিনটার নাম পালটে

‘কাম-রতি দিবস’ দিলে হয়তো এই দুর্বলমনা মানুষগুলো খানিকটা নরম হবে, কে বলতে পারে!

গবেষকদের ধারণা, বৈষ্ণবরা ভালবাসার নানান সংকটের দিক আত্মস্থ করেছিলেন রাধাকৃষ্ণ ও বসন্তের মাদকতাময় হোলি উৎসবের মধ্য দিয়ে, আবার তাঁদের প্রতিযোগী শৈবরা বাসনার

বিষয়টি সামলেছিলেন পৌরুষপূর্ণ দেবতা শিবের মধ্য দিয়ে - সেই শিব, যাঁর নিজেরও রসগল্পসম্ভার কম নয়। কিন্তু সমাজ তো শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ, এ সব ছাড়া চলতে পারে না। মনে করা হয়ে

থাকে, কামদেবকে শিবের শাস্তিদান আসলে অসংযতদের শিক্ষা দেওয়ারই নামান্তর। মৎস্যপুরাণে আছে ‘মদনভস্ম’ বা ‘কামদহন’-এর আখ্যান, যেখানে গভীর ধ্যানে মগ্ন শিবকে ছলাকলায়

প্রলুব্ধ করার অপরাধে শিব কামদেবকে ভস্মীভূত করেন। হিন্দুধর্ম প্রকৃতপক্ষে বহুবিধ বৈপরীত্যকে বাঁধবার এক প্রয়াস, আর এই আখ্যানও তার ব্যতিক্রম নয়, কারণ কামদেবের

ছলাকলা দিয়ে শিবকে ভোলানোর চেষ্টা নাকি আসলে পবিত্র এক কর্তব্য সাধন! অন্য সব দেবতা মিলে যুক্তি করেই তাঁকে শিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন, যাতে শিব-পার্বতীর মিলন সম্ভব হয়,

জন্ম নিতে পারে সুপারহিরো সুপুত্র কার্তিকেয়, এক ও একমাত্র যিনি বধ করতে পারেন ত্রিলোকত্রাস, অজেয় তারকাসুরকে। সুতরাং এক অর্থে কামদহন নয়, শিবরাত্রি নামের ধর্মীয়

উৎসব ও তার ব্রত-উপবাস-আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই কামনা-বাসনার বিষয়টিতে নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করা হল। আখ্যানটির পরের পর্বেও বৈপরীত্যের চমক। মদনদেব মৃত, তাঁর

স্ত্রী রতি হাহাকার করছেন। তার ফলে আর ফুল ফোটে না, পাখি ডাকে না। নতুন জীবন আসে না। সেই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে মদনের স্ত্রী রতির অনুরোধে শিব মদনকে

পুনরুজ্জীবিত করলেন, তবে কায়াহীন রূপে। (রানা চক্রবর্তী) তাই কামদেবের আর এক নাম অনঙ্গ বা অতনু। বিশ্বপ্রকৃতি জুড়ে প্রেমের বিচরণ, আবার মানবপ্রকৃতিও কামপ্রভাবে তাড়িত।

প্রসঙ্গত, শৈব ধর্ম যখন ভারতের বাইরে প্রচারিত হয়, কামদেব এবং অনেক চমকপ্রদ আখ্যান তার সঙ্গেই রফতানি হয়। জাভার হিন্দুরাও দ্বাদশ শতকে তাঁদের নিজস্ব ‘স্মরদহন’

কাব্যে মদনভস্ম ও তার পুনরুজ্জীবনের ঘটনা উদ্‌যাপন করেন। কাম ও তাঁর সঙ্গিনী রতিকে কাকাউইন কবিতায় ডাকা হয় কামজয় ও কামরতি নামে। পরবর্তী কালে ইন্দোনেশিয়ার

ওয়াইয়াং-আখ্যানের পুতুলনাচেও কাম আর রতির সগর্ব সদর্প উপস্থিতি।

প্রাচীন গ্রিসেও এক দেবতা শিবের মতোই পুজো পেতেন, শিবলিঙ্গের সমতুল্য প্রতীকে। তিনি ইরোস-এর ভাই, নাম প্রায়াপুস। মনে হয়, প্রায়াপুসের যাত্রা শুরু হয়েছিল এখনকার তুরস্ক

থেকে; রোমান সাম্রাজ্যে তাঁকে ‘বণিকদের দেবতা’ হিসেবেও পুজো করা হত। খ্রিস্টধর্ম সব পেগান দেবদেবীদের সরিয়ে দেওয়ার, বা সন্ত হিসেবে জবরদখল করে নেওয়ার পরেও গ্রামীণ

মানুষের মধ্যে এই দেবতাটির পুজোর চল থেকে গিয়েছিল। একই রকমের আরও লিঙ্গ-দেবতার উপস্থিতি পাই গ্রিসের ‘হারমিস’ ও রোমান ‘মিউটুনাস টিউটুনাস’ দেবতার মধ্যে। এঁদের কাজ

ছিল বিবাহ-অনুষ্ঠানে সন্তুষ্টিবিধান। তারও আগে, মিশরীয়রা পুজো করতেন ‘আইসিস’ ও ‘মিন’-এর, নরওয়ের মানুষের আরাধ্য ছিলেন দেবতা ‘ফ্রের’। বলকান দেশগুলিতে চালু ছিল ‘কুকেরি’-র

আরাধনা, জাপানেও আছে ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’-এর মন্দির ও প্রতীকোপাসনা। ওয়ালিস বাজ-এর লেখায় স্পষ্ট পাওয়া যায়, ইউরোপে ‘সপ্তদশ শতক অবধি বিশালাকায় পুং-প্রতীককে সন্ত

জ্ঞানে পুজো করা হত।’ তাঁর লেখায় সুদীর্ঘ এক তালিকাও মেলে। স্যর উইলিয়াম হ্যামিলটন আঠারোশো শতকে ‘কসমো’ নামের এক পুংপ্রতীকধর্মী সন্তের পূজনবিধির বর্ণনা দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বোমাবিধ্বস্ত ইংলিশ চার্চগুলি আবার গড়ে তোলা হচ্ছিল, তখন ‘রয়্যাল কমিশন অন হিস্টোরিক্যাল মনুমেন্টস’ মাটির নীচে বহু লিঙ্গমূর্তি খুঁজে পেয়েছিল।

তাই শিবরাত্রির দিনে বা শ্রাবণ মাস-ব্যাপী শিব-আরাধনার রকমসকম দেখে ভারতে-আসা ইউরোপীয়রা যে অভিঘাত ও বিস্ময়ে অভিভূত হতেন, তার খুব একটা কারণ আছে বলে মনে হয় না।

প্রাচীন এক সভ্যতার ধারক হিসেবে হিন্দুধর্ম মানুষের সমস্ত রকমের প্রয়োজনের প্রতি দুর্দান্ত সহনশীলতা দেখিয়েছে। এটাই দুঃখের যে আজ এই সহিষ্ণুতার গায়ে আঁচড় পড়ছে। প্রাচীন

ভারত জীবনের সর্বক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা দেখিয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) সেই সহিষ্ণুতা আজ কারও কারও পছন্দসই নয়, এটাই দুঃখের। প্রাচীন ভারত জীবনকে ছুপিয়ে নিয়েছিল উৎসবের

রঙে, পরিণত মানসিকতায় তার উদ্‌যাপন করেছিল খোলাখুলি, অলজ্জ ভাবে।

কোথাও পুণ্য সঞ্চয়ের অভিলাষ, কোথাও বা দীর্ঘলালিত মনোস্কামনা - এ সব নিয়েই আবালবৃদ্ধবনিতার ভক্তি আর বিশ্বাসে ফাগুনের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে পালিত হয় শিবরাত্রি।

দোল কিংবা দীপাবলির মতোই সমগ্র ভারতে এটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। শিবরাত্রির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা কাহিনি এবং কিংবদন্তি। উৎসবের আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা

রীতি রেওয়াজ। কোথাও শিব-পার্বতীর বিয়ে, কোথাও বা নানা উপচার-সহ রুদ্রাভিষেক। এ দিন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সারা দিনের উপবাসের শেষে শিবের পুজো করে থাকেন পুণ্য লাভের

আশায়। এমনটাই তো চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

এই শিবরাত্রি নিয়ে শোনা যায় এক প্রচলিত কাহিনী। কাশীতে এক ব্যাধ বাস করত। সারা দিন বনে শিকার করে সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরত। এমনই এক বনে গিয়ে সারাদিন অনাহারে ক্লান্ত সেই

ব্যাধ একটি গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছিল। যখন তার ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। ব্যাধ বুঝতে পারল সে দিন আর গভীর জঙ্গল অতিক্রম করে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। তাই ঠিক

করল একটি গাছের উপরে রাত কাটিয়ে পর দিন বাড়ি ফিরবে। কাছেই ছিল একটি প্রাচীন বেলগাছ। ব্যাধ তখন কাছেই একটি বেলগাছের ডালে শিকারগুলিকে বেঁধে রেখে নীচে একটি শক্ত ডালের

উপরে বসে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেই বেলগাছের কাছেই একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল। (রানা চক্রবর্তী) গাছের উপরে ব্যাধের নড়াচাড়ার ফলে একটি বেলপাতা সেই শিবলিঙ্গের

উপরে গিয়ে পড়ে। সে দিন ছিল শিবচতুর্দশী বা শিবরাত্রি। নিজের অজান্তেই উপবাসী থেকে বেলগাছের একটি পাতা শিবলিঙ্গের উপরে পড়ায় সেই ব্যাধের ব্রত পালন হয়ে গিয়েছিল। পর দিন

বাড়ি ফিরে, স্নান সেরে সে খেতে বসবে, এমন সময় তাঁর বাড়িতে অতিথি এসেছিল। ব্যাধ অতিথি সেবার রীতি মেনে খাওয়ানোরও ব্যবস্থা করল। ফলে নিজের অজান্তে সে ব্রতের সম্পূর্ণ ফল

লাভ করেছিল। বহু বছর পরে ব্যাধের মৃত্যুর সময় এক দিকে যমদূতেরা, অন্য দিকে শিব দূতেরা তাকে নিতে উপস্থিত হল। এই নিয়ে যুদ্ধও বেঁধে গেল। অবশেষে যখন যমদূতরা কৈলাসে শিবের

কাছে নালিশ করতে গিয়েছিল ঠিক তখনই শিবের প্রহরী নন্দী যমদূতদের বলেন, যেহেতু ব্যাধ শিবচতুর্দশীর ব্রত পালন করে পুণ্য অর্জন করেছে তাই তাকে যমদূতেরা নিয়ে যেতে পারেন না।

যমদূতরা, যমরাজের কাছে গিয়ে যখন এ কথা জানাল যমরাজ নাকি বলেছিলেন, এই ব্রত যে পালন করবে তার উপর যমের কোনও অধিকার থাকবে না। এই ব্রত মানুষকে সর্ব পাপ থেকে

উদ্ধার করে। সেই বিশ্বাস নিয়ে পুণ্যার্জনের আশায় নারী-পুরুষ যুগ যুগ ধরে এই ব্রতের পালন করে আসছে।

সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় সিন্ধু সভ্যতার যুগেও বিক্ষিপ্ত ভাবে লিঙ্গ রূপে শিব পূজিত হতেন। পরবর্তী কালে বৈদিক যুগে রুদ্রের সঙ্গে

তিনি মিলিত হলেন। তবে প্রাক আর্য যুগ থেকেই শিব ঊর্বরতা এবং প্রজননের দেবতা হিসেবে পূজিত হয়েছেন। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্যান্য নানা গুণ। শিবের মধ্যে বরাবরই দুটি

বৈপরীত্য বার বার ফুটে উঠেছে। এক দিকে তিনি শ্মশানবাসী। ভূত প্রেত তাঁর অনুচর এবং কাপালিক, অঘোড়িরা তাঁর উপাসক। অন্য দিকে সেই শিবই কৈলাসে পার্বতী এবং দুই পুত্র কার্তিক,

গণেশকে নিয়ে ঘোর সংসারী। এ ভাবেই ভোলা মহেশ্বর যেন একেবারে বাঙালির ঘরের লোক হয়ে গিয়েছেন। পরে সুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত যুগের শিল্পে ফুটে উঠেছে শিবের নানা রূপ। এমনকী, বাংলার

পাল আমলে যখন বৌদ্ধ ধর্মের এত রমরমা তার মধ্যেও শিবের অস্তিত্ব কিন্তু বিলুপ্ত হয়নি। (রানা চক্রবর্তী) আবার সেন যুগে যখন শৈব ও শাক্ত ধর্মের প্রাধান্য বাড়তে থাকে তখন

লিঙ্গ রূপ ছাড়াও কখনও নৃত্যরত শিব, উমা মহেশ্বর, কখনও বা অঘোড়শিব রূপে তিনি পুজিত হয়েছেন। তবে পরবর্তী সময়ে সুলতানি যুগের শেষে সমাজে বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্যের জন্য

মূর্তির চেয়ে লিঙ্গ রূপেই শিবপুজোর প্রাধান্য বাড়ে।

কাশীর বিশ্বনাথ, গুজরাতের সোমনাথ মন্দিরে কিংবা নেপালের পশুপতিনাথের মন্দিরে শিবরাত্রি উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমাগম হয়। এমনকী, পূজার্চনার ব্যতিক্রমী বিধি দেখা যায়।

যেমন ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরে পুজোর শেষে মন্দিরের মহাদীপ স্থাপন এক বিশেষ ঐতিহ্য। মন্দিরের গা বেয়ে এক ভক্ত যখন উঠে চূড়ায় এই মহাদীপ স্থাপন করেন তখন হাজার

হাজার মানুষ এই দৃশ্য দেখে পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য উপস্থিত থাকেন। তেমনই উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দিরে এক কালে নানা পবিত্র বস্তুসহ চিতাভষ্ম দিয়ে মহাদেবের ভষ্মাভিষেক করা

হত। (রানা চক্রবর্তী) এখন তার অন্য বিকল্প ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও হয় বিশেষ শৃঙ্গার। যা দর্শন করতে কয়েক লক্ষ মানুষের আগমন হয়।

অন্যান্য প্রদেশের মতো বাংলার শিবরাত্রির রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। মন্দিরে মন্দিরে চার প্রহরে বিশেষ পূজার্চনার পাশাপাশি কিছু কিছু জায়গায় বসে ঐতিহ্যবাহী মেলাও। যদিও মেলার

সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির, হুগলির তারকে‌শ্বর, চুঁচুড়ার ষাণ্ডেশ্বরতলা, নৈহাটির বুড়োশিবতলা, আতপুরের জোড়া শিবের মন্দির, হাটখোলার মহম্মদ

রমজান লেনে প্রাচীন শিবমন্দির, কালীঘাটের নকুলেশ্বরতলা, কিংবা খিদিরপুরের ভূকৈলাস রাজবাড়ির শিবমন্দিরেও সাড়ম্বরে শিবরাত্রি পালিত হয়। ১৭৮১ নাগাদ রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল

তাঁর প্রাসাদের সামনে শিবগঙ্গা নামে এক দিঘি খনন করান এবং তার উত্তর ও পূর্ব ভাগে দু’টি শিবমন্দির নির্মাণ করে সেখানে রক্তকমলেশ্বর ও কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা

করেন। (রানা চক্রবর্তী) পরে ১৭৮২-তে জয়নারায়ণ প্রাসাদের মধ্যেই পতিতপাবনীর (দুর্গা) মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে এক সময় এসেছিলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন। শোনা যায়,

তিনি এই অঞ্চলটির নামকরণ করেছিলেন ভূকৈলাস। শিবরাত্রিতে বিশেষ পুজো ছাড়াও মাঝরাতে ১০৮ ঘড়া জলে শিবের অভিষেক ও বিশেষ পুজো হয়। মেলা উপলক্ষে কয়েকটা দিন এখানে বহু

মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে।

বর্ধমান জেলায়, বিশেষ করে কাটোয়া মহকুমার অনেক প্রাচীন গ্রামে শিবরাত্রির মেলা বসে। যেমন মঙ্গলকোট থানার চৈতন্যপুর গ্রামে রয়েছে অনাদি শিবলিঙ্গ শৈলেশ্বর। কাটোয়ায়

সন্ন্যাস নিয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু দিব্যোন্মাদে তিন দিন রাঢ় ভ্রমণ করেছিলেন। ফিরে আসার সময়ে এই জনপদে তাঁর পূর্বেকার স্মৃতি ফিরে পান। এই সূত্রে স্থানটির নাম হয় চৈতন্যপুর।

এই গ্রাম থেকেই মিলেছে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের বিষ্ণুর ব্যতিক্রমী আভিচারিক মূর্তি, বর্তমানে সেটি ভারতীয় সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত। চৈতন্যপুরের শৈলেশ্বরের পুজোয় মেলা বসে।

গ্রাম-গ্রামান্তরের কুমারী মেয়েরা-সহ অনেকেই পুজো দিতে আসেন। (রানা চক্রবর্তী) কাটোয়ার ঘোষেশ্বরতলাতেও শিবরাত্রিতে অসংখ্য পুণ্যার্থী আসেন। পুইনি গীতগ্রাম সিঙ্গি প্রভৃতি

গ্রামে শিবরাত্রিতে জাঁকজমক-সহ পূজা হয়। কেতুগ্রামের বিল্বেশ্বরে বাবা বিল্বনাথকে কেন্দ্র করে শিবরাত্রিতে মেলা বসে। নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বসে লোকসংস্কৃতির

বর্ণময় আসর।

 

141

 

মঙ্গলকোটের শঙ্করপুর বাবলাডিহিতে শিবরাত্রিতে বিশেষ ভাবে পূজিত হন বাবা ন্যাংটেশ্বর। ইনি আদতে জৈন তীর্থঙ্কর শান্তিনাথ। এক সময় মঙ্গলকোট-সহ সমগ্র রাঢ় অঞ্চলে

জৈনধর্মের প্রাধান্য ছিল। মঙ্গলকোটের রাইতো দিঘি থেকে আবিষ্কৃত, বর্তমানে শঙ্করপুর বাবলাডিহিতে পূজিত শান্তিনাথের বিগ্রহটি কালো কষ্টিপাথরে খোদিত। উচ্চতায় চার ফুট।

চালিতে বিদ্যাধরের নীচে মূল মূর্তির পাশে আরও দু’জন তীর্থঙ্করের মূর্তি রয়েছে। (রানা চক্রবর্তী) পাদপীঠে সুসজ্জিত চামরধারীর পাশে আরও দু’টি তীর্থঙ্করের মূর্তি। মৃগ লাঞ্ছন

দেখে বোঝা যায় এটি শান্তিনাথের বিগ্রহ। আনুমানিক দশম শতকের এই বিরল মূর্তিটি পঞ্চতীর্থক জৈনমূর্তির দৃষ্টান্ত। এই মূর্তিটিই শিবের ধ্যানে পূজিত হয় ন্যাংটেশ্বর নামে।

বাৎসরিক উৎসব শিবরাত্রির সময়। মেলা বসে, নানা ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। ন্যাংটেশ্বরের মিলন মেলায় মেতে ওঠেন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এলাকার মানুষ।

গবেষণাপত্রের বাইরে আজ আর মেয়েলি ব্রত, ব্রতকথা এ সবের অস্তিত্ব আছে না কি? শিবরাত্রির উৎসব দেখলে অবশ্য এমন সন্দেহ মনে রাখার কোনও কারণ নেই। বাংলার গ্রামে-

শহরে ছড়ানো হাজার হাজার শিবমন্দির যেন ফাল্গুন মাসে জেগে ওঠে শিবরাত্রি উপলক্ষে। শহরের অলিতে গলিতে অজস্র শিবমন্দিরের অস্তিত্ব হঠাৎ টের পাওয়া যায় তারস্বরে বাজানো

চটুল গানের দৌলতে। হবে না-ই বা কেন, সব ব্রতের মধ্যে শিবরাত্রিকেই তো শ্রেষ্ঠ ব্রত বলে ধরা হয়। (রানা চক্রবর্তী) এই ব্রত পালন করলে নাকি নারীর সব কামনা পূর্ণ হয়ে যায় -

পতিকামনা, পুত্রকামনা, বৈধব্য খণ্ডন ও সাংসারিক মঙ্গল। মধ্যযুগের যে সমাজে এই ব্রতের প্রচলন হয়, সেখানে মেয়েদের - তা সে কুমারী সধবা বা বিধবা যাই হোক না কেন - পরিবারের

বাইরে অন্য কিছু চাইবার মতো কোনও ফাঁকই রাখা হয়নি। আজ পরদা সরেছে, কিন্তু সংস্কার কাটেনি, কিংবা সংস্কার - আরও অনেক সংস্কারের মতোই নিছক বাৎসরিক উৎসব হয়ে

উঠেছে।

ব্রতকথা অনুযায়ী, শিবরাত্রি ব্রতের ব্যাখ্যা করেন মহাদেব স্বয়ং। পার্বতী মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, প্রভু, এমন এক সহজ ব্রত বলে দিন, যা সকলেই পালন করে পাপমুক্ত হতে

পারে। মহাদেব বললেন, ‘ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে যে ভয়ানক অন্ধকার রাত্রি হয়, তা-ই শিবরাত্রি। শিবরাত্রিতে যে উপবাস করে, আমি তার উপর খুব সন্তুষ্ট হই। ...

শিবরাত্রিতে চার প্রহরে চারটি গঙ্গামাটির শিব গড়ে পূজা করবে। ... ওই দিন রাত্রি জাগবে ...’ পুজোর উপকরণ সরল, বেলপাতা আর গঙ্গাজলই যথেষ্ট। জটিল মন্ত্রতন্ত্র কিছু নেই,

দীর্ঘ প্রস্তুতিরও প্রয়োজন নেই। সাধে কি আর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রত, সহজে পাপমুক্তি আর সপরিবার মঙ্গলের ব্যবস্থা!

শুধু কি তাই? শিবরাত্রি মোটেই শুধু মেয়েদের পালনীয় ব্রত নয়। ছেলেরাও শিবরাত্রি করতে পারে। করেও। আসলে প্রথম শিবরাত্রি তো করেছিল এক জন পুরুষই! সে গল্পও শুনিয়েছেন শিব।

বারাণসীর এক ব্যাধ - ধর্মকর্মের বালাই নেই, পশুহত্যাই তাঁর জীবিকা। পাপের ভারা তাই কানায় কানায় পূর্ণ। সারা দিন শিকারের পর ক্লান্তিতে গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, সন্ধে হয়ে

যাওয়ায় বাড়ি যেতে পারবে না ভেবে সে গাছের ডালেই রাতটা কাটিয়ে দেয়। গাছটা ছিল বেলগাছ, আর তলায় ছিল একটা শিবলিঙ্গ। ব্যাধের গায়ে লেগে একটা বেলপাতা শিশিরের জলের সঙ্গে

মিশে শিবের মাথায় পড়ল। সেটা ছিল শিবরাত্রি, আর ব্যাধও ছিল উপবাসী। (রানা চক্রবর্তী) পরদিন বাড়ি ফিরে স্নান করে সে দেখে, এক অতিথি উপস্থিত। তাঁকে খাইয়ে তার পরেই ব্যাধ

নিজে খেয়েছিল। ফলে তার ব্রত পালন ঠিকমতই সম্পন্ন হল। ব্যাধ মারা যাওয়ার পর শিবদূত আর যমদূতদের মধ্যে মারামারি লেগে গেল তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শেষে শিবের দূতেরাই জয়ী

হল, আর যমরাজও স্বীকার করলেন, শিবচতুর্দশী করলে তার উপর আর যমের অধিকার থাকবে না। মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধারের এটাই একমাত্র উপায়, পার্বতীকে জানালেন শিব।

সত্যি, শিব তো আশুতোষ, খুব সহজেই তাঁর মন পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলায় তাঁর এত প্রভাব-প্রতিপত্তির উৎস কী? বাংলা এমনিতেই বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য পরিমণ্ডলের বাইরের দেশ ছিল।

পালযুগের বাংলায় বৌদ্ধদের রমরমা, এমনকী বৌদ্ধ তন্ত্রেরও পীঠস্থান এই পূর্ব ভারত। তবে এরই মধ্যে পাল আমলের শেষ দিক থেকে সেন আমল জুড়ে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের জন্য

রাজা এবং অভিজাতদের বিপুল পৃষ্ঠপোষণাও নজরে পড়ে। পরে সুলতানি শাসনের ধাক্কায় অনেক দিনের নিস্তব্ধতা। মধ্যযুগের শেষ পর্ব থেকে এক দিকে চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম,

অন্য দিকে আধা-ব্রাহ্মণ্য আধা-লৌকিক শৈবধর্ম যে ভাবে ব্যাপ্ত হয় বাংলা জুড়ে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায়, এ জমি ‘অন্য’ মতবাদের জন্য কতটা উর্বর ছিল! অন্য সব দেবদেবীকে এ

ব্যাপারে টেক্কা দিয়েছেন শিব। তিনি তো বৈদিক দেবতা নন, ঋগ্বেদে ‘রুদ্র’ ভয়ংকর দেবতা, কিন্তু শিবের কোনও উল্লেখ নেই, বরং সেখানে ‘লিঙ্গপূজক’ বিরোধী মনোভাবই নজরে পড়ে।

ক্রমে শ্মশানবাসী শিব হিন্দু ধর্মের তিন প্রধানের অন্যতম হয়ে উঠলেন। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের দেবতা বলে সাধারণ ভাবে চিহ্নিত করা হলেও, শিবভক্তরা

শিবকেই সব কিছুর স্রষ্টা ও সংহারকর্তা বলে মানেন। পৌরাণিক নানা কাহিনিতে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর থেকে শিবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা হয়েছে। (রানা চক্রবর্তী) সব থেকে পরিচিত বোধহয়

সেই স্তম্ভরূপী শিবের গল্প, যেখানে হংসের রূপ নিয়ে ব্রহ্মা স্তম্ভের শীর্ষ আর বরাহের রূপ নিয়ে বিষ্ণু তার তলদেশ নির্ণয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, ব্রহ্মা আবার মিথ্যে করে বলেন,

তিনি শীর্ষদেশ দেখতে পেয়েছেন, তাতে শিব অভিশাপ দেন - ভারতে আর ব্রহ্মার পূজা হবে না। শেষে ব্রহ্মা বিষ্ণু দুজনেই শিবকে স্রষ্টা হিসেবে মেনে নেন। শিবের লিঙ্গপূজা প্রচলনের গল্প

আছে ‘কূর্মপুরাণ’-এ। দেবদারু বনে তপস্যারত মুনিঋষিরা ছদ্মবেশী শিব আর বিষ্ণুকে চিনতে পারেননি, নানা ঘটনার পর প্রকৃত রূপ দেখে তাঁর বন্দনা করেন এবং লিঙ্গপূজা প্রচলিত হয়।

ব্রাহ্মণ্য পরিমণ্ডলে নিজের জায়গা করে নিতে ভূতপ্রেত নিয়ে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করতে হয়েছিল শিবকে, নাচতে হয়েছিল প্রলয়নাচন। কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও শিবের মধ্যে সেই দ্বৈত

সত্তাই থেকে গিয়েছে - এক দিকে তিনি শ্মশানের দেবতা, ভূতপ্রেত তাঁর অনুচর, কাপালিকরা তাঁর সাধক; অন্য দিকে তিনি কৈলাসে পার্বতী কার্তিক গণেশকে নিয়ে ঘোর সংসারী। আর এই

সংসারী, সহজে সন্তুষ্ট, আলাভোলা শিবকে কাছের করে নিতে মধ্যযুগের বাঙালির কোনও অসুবিধেই হয়নি।

শিবকে ঘরের লোকে পরিণত করার কালিক প্রয়োজন ছিল, জমিও তৈরি ছিল। শেষ দিকের পালরাজাদের লিপি থেকে বেশ কিছু শিবমন্দির তৈরির কথা জানা যায়। প্রাচীন পাশুপত সম্প্রদায়ের

শৈবদের জন্য রাজানুগ্রহের কথাও আছে সেখানে। সুন্দরবনে জটার দেউল, বর্ধমানের রাঢ়েশ্বর, বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর ষাঁড়েশ্বর শৈলেশ্বর-এর মতো আটশো-হাজার বছরের শিবমন্দির টিকে

আছে এখনও। (রানা চক্রবর্তী) পাল-সেন যুগের বাংলায় শিবের যে সব মূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে লিঙ্গমূর্তি বাদ দিলে শিব-পার্বতীর মূর্তি, বিশেষত উমা-মহেশ্বরের সংখ্যা

খুবই বেশি। অর্থাৎ বাঙালি মননে একক শিব নয়, হরগৌরীর কল্পনাই প্রাধান্য পেয়েছে। শিব ও শক্তির এই সব যুগ্মমূর্তির পিছনে সে কালের তন্ত্রচর্চার প্রভাব দেখেছেন কেউ কেউ।

সে যাই হোক, শিব ও পার্বতীর পারিবারিক রূপ যে ভাবে পরে বাঙালির সমাজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল, তার সূত্র কিছুটা হলেও যে এর মধ্যে থেকে গিয়েছে, সন্দেহ নেই।

তেরো শতক থেকে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেল। মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার পর প্রথম কয়েক শতক বিশাল মন্দির তৈরি দূরের কথা, বড় আকারের পাথরের মূর্তি তৈরির পৃষ্ঠপোষকও

রইল না। আক্রমণের ভয়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া হল দেবদেবীর মূর্তি, পুঁতে ফেলা হল মাটির নীচে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সমাজকে আবার ব্রাহ্মণ্য ভাবধারায় ফিরিয়ে আনার

চেষ্টা শুরু হল। দেখা গেল, দিনকাল বদলে গিয়েছে। যে বিষ্ণু বা সূর্যের মূর্তি এর আগে বাংলার সর্বত্র পাওয়া গিয়েছে, সেই দেবতাদের পূজা আর ফিরল না। (রানা চক্রবর্তী) মুঘল আমলে

এক দিকে চৈতন্যের বৈষ্ণবধর্ম যেমন বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের আনুকূল্য নিয়ে সবাইকে টানল, তেমনই শিবের মাহাত্ম্য সবার মন জয় করে নিল। বাংলার প্রতি গ্রামে গড়ে উঠল ছোটবড়

শিবমন্দির, পূজার চল হল লিঙ্গমূর্তিতে। দ্বাদশ শিব, ১০৮ শিবমন্দির তৈরি করে অভিজাতরাও পুণ্যের ভাগ নিতে এগিয়ে এলেন।

অন্দরমহলের দরজাও কি আর বন্ধ থাকে! ব্রতকথার মাধ্যমে শিব চলে এলেন ঘরের ভিতরে। কৃষিজীবী সমাজের প্রাত্যহিক যাপনেও মিশে গেল শিবের উৎসব - সারা বাংলা জুড়ে আজও

চৈত্র-বৈশাখে ‘গাজন’ হয়, যে নাম নাকি এসেছে শিববিবাহের এই লৌকিক উৎসবে সমবেত মানুষের গর্জন থেকে।

রাঢ়ের সব থেকে বড় লোক-উৎসব গাজন, উত্তরবঙ্গে আবার তারই নাম গম্ভীরা। গাজনের গানে লৌকিক শিবের কত না কীর্তিকলাপ - চাষবাস শুরুর গল্প বোধহয় সব থেকে আগ্রহ জাগায়।

‘শিবায়ন’ কাব্যেও আছে এমন গল্প। পার্বতীর পরামর্শে শিব চাষে মন দিলেন। জমি কই? ইন্দ্রের কাছে শিব জমি চাইলেন। ইন্দ্র আদিগন্ত পতিত জমি দিলেন চাষের জন্য। যম দিলেন তাঁর

মহিষ, শিবের ষাঁড় আর যমের মহিষ হাল চষবে। বিশ্বকর্মা চাষের যন্ত্রপাতি বানালেন, বীজ দিলেন কুবের। হাল চষার জন্য এলেন ভীম, দশমনি কাস্তে দিয়ে ফসলও কাটলেন। (রানা

চক্রবর্তী) ধান হল মাত্র দু’হাল। শিব বললেন, ধান পুড়িয়ে দাও। ভীম ধানে আগুন দিয়ে ফুঁ দিলেন - ধান পুড়তে লাগল, পুড়তেই লাগল। এ থেকেই তৈরি হল নানা রঙের ধান। এ গল্পের নানা

মাত্রা কল্পনা করা কঠিন নয়।

অর্থাৎ, শুধু শিবরাত্রিতে শিবের মাথায় জল ঢেলে ভাল বর চাওয়া নয়, শিবের মহিমা মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত অনেকটাই ব্যাপক। গবেষকদের মতে, বাংলায় এর উৎস আরও দূর অতীতে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রজত সান্যাল দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন চন্দ্রকেতুগড় তিলপি তমলুক তিলদা মঙ্গলকোট - বাংলার বিভিন্ন প্রাচীন প্রত্নস্থলে

পাওয়া লিঙ্গবেষ্টনকারী বিচিত্র নারীমূর্তির ভাস্কর্যের দিকে। তাঁর কথায়, এখনও এগুলির উপযুক্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি, কিন্তু শৈব কাল্ট-এর সঙ্গে এর যোগ অস্বীকার করার উপায়

নেই। আর তা হলে অবশ্যই এ বিষয়ে নতুন করে ভাববার অবকাশ রয়েছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য’

(দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)

রানা

প্রাক-পলাশী যুগের বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ওলন্দাজরা ইংরেজদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। উক্ত শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গদেশে ওলন্দাজ বাণিজ্যের পরিমাণ কিন্তু ইস্ট

ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য থেকে কিছু পরিমাণে বেশিই ছিল। ১৭৫৬-৫৭ সালে তাঁদের ইউরোপীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪২,১৯,৭৩৭ গিল্ডার্স। (চুঁচুড়ার ওলন্দাজ কোম্পানির ডিরেক্টর ‘এ

বিসডমের’ লেখা চিঠি, ফেব্রুয়ারী, ১৭৫৭ সাল; বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-৫৭, এস. সি. হিল, ১ম খণ্ড, পৃ- ২৯) সেই সময়ে বাংলার সমস্ত প্রধান প্রধান শিল্প ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলিতে তাঁদের কুঠি

ছিল। ১৭৩৯ সালে কাশিমবাজারে ওলন্দাজ কোম্পানি ১,৫৩,০০০ টাকা ব্যয়ে একটি বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করেছিল। ১৭৫৩ সাল থেকে তাঁরা ঢাকায় নিজেদের কুঠি স্থাপন করে আবার

সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছিলেন। (ঢাকাতে ওলন্দাজদের আগের কুঠি ১৬৯০ সালে পরিত্যক্ত হয়েছিল; দি ডাচ ইন বেঙ্গল এণ্ড বিহার: ১৭৪০-১৮২৫, কে. কে. দত্ত, পৃ: ১-১৯)

১৭৩৩ সালে ওলন্দাজ কোম্পানির শেয়ার মালিকেরা ২৫ শতাংশ হারে তাঁদের লভ্যাংশ পেয়েছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) প্রাক-পলাশী যুগে ওলন্দাজ কোম্পানির মোট এশীয় বাণিজ্যের ৩৩

শতাংশই বাংলার সঙ্গে হত। ওই সময়ের বঙ্গদেশে তাঁদের বাণিজ্যিক ধরনটাও অনেকটাই ইংরেজদের মতই ছিল। সেই সময়ে পরবর্তীকালের ইংরেজদের মতই ওলন্দাজরারাও মোঘল সম্রাট

‘বাহাদুর শাহ’ (১৭০৯), এবং ‘জাহান্দর শাহের’ (১৭১২) কাছ থেকে বাদশাহী সনদ আদায় করে ২.৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ভারতবর্ষে বাণিজ্য করতেন, তখন বাদশাহী সনদের বলে তাঁরা মাথা পিছু

কর (capita tax) থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। তবে ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তুলনায় ওলন্দাজ কোম্পানির কতগুলি অসুবিধাও ছিল। প্রথমতঃ, তাঁদের বাণিজ্যিক ও আর্থিক

সংগঠন তেমন ভাল ছিল না। ফলে মাঝে মাঝেই, বিশেষ করে উক্ত শতাব্দীর শেষের দিকে, তাঁদের বাণিজ্যিক পুঁজির অভাব দেখা দিয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ, ওলন্দাজ কোম্পানি ইন্দোনেশিয়া

(বাটাভিয়া), কোচিন, ত্রিবাঙ্কুর, মালাবার ও সিংহলে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করবার জন্য এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে তারা বঙ্গদেশের বাণিজ্য ও রাজনীতিকে তেমন প্রাধান্য দেয়নি।

তৃতীয়তঃ, বঙ্গদেশে তাঁদের কর্মচারীরা রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা বা কূটবুদ্ধির স্বাক্ষর রাখতে পারেন নি। (রানা চক্রবর্তী) অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার সবগুলি রাজনৈতিক সংকটেই তাঁরা

পরাজিত পক্ষে ছিলেন - সরফরাজ খাঁ, মারাঠা, দ্বিতীয় শাহ আলম ও মীরজাফর। উক্ত শতাব্দীতে ওলন্দাজ কোম্পানি ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মতই অগ্রিম ব্যবস্থার মাধ্যমে

বঙ্গদেশ থেকে রপ্তানিযোগ্য পণ্য কিনত। ইংরেজদের মতোই তাঁরাও তখন ইউরোপ থেকে সোনা ও রুপো আনতেন, এবং সেই সাথে এদেশে ব্যবসা করবার জন্য তাঁদের সঙ্গে পশমের কাপড়

থাকত। তবে ওলন্দাজদের ওই সময়ের বাংলা বাণিজ্যের প্রয়োজনীয় মূলধনের সমস্তটাই কিন্তু ইউরোপ থেকে আসত না। তখন ওলন্দাজ কোম্পানি জাপান থেকে তামা, মালয় দ্বীপপুঞ্জ

থেকে টিন ও দস্তা, এবং ওলন্দাজ অধিকারে থাকা পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে নানা রকমের মশলা - লঙ্কা, লবঙ্গ, জৈত্রি, জায়ফল প্রভৃতি বঙ্গদেশে নিয়ে আসত। সেগুলিকে বাংলায়

 

142

 

বিক্রি করে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের জন্য তাঁরা প্রয়োজনীয় পুঁজি সংগ্রহ করতেন। ওলন্দাজরা তখন বাংলার পণ্যসম্ভার ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ও ইউরোপীয়

বাজারগুলিতে যেতেন। (রানা চক্রবর্তী) সেই সময়ের রপ্তানি বাণিজ্যে ইংরেজদের সঙ্গে ওলন্দাজদের একটি প্রধান পার্থক্য ছিল যে, ওই সময়ে ইংরেজরা যখন বাংলা থেকে প্রধানতঃ

সুতীবস্ত্র, কাঁচা রেশম ও সোরা নিয়ে যেতেন, ওলন্দাজরা সেখানে প্রথমে সোরা ও আফিমকে প্রাধান্য দিতেন। তারপরে তাঁদের তালিকায় সুতীবস্ত্র, রেশমবস্ত্র ও কাঁচা রেশম প্রাধান্য

পেত। তখন নেপাল থেকে বিহারে আমদানি করা সোহাগা ও বাংলার মাখনও তাঁদের রপ্তানি পণ্য তালিকায় স্থান পেয়েছিল। পলাশী-উত্তর যুগে ওলন্দাজদের বাংলা বাণিজ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ

পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। প্রথমতঃ, ওই সময় থেকে তাঁদের বাণিজ্যিক পুঁজি সংগ্রহ করতে আর কোনো অসুবিধা হয়নি। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা বিপুল পরিমাণ টাকা

ওলন্দাজ কোম্পানির উপরে বিল অব একচেঞ্জের মাধ্যমে ইউরোপে পাঠাতেন। ফলে বঙ্গদেশে ব্যবসা করবার জন্য কোম্পানির হাতে যথেষ্ট পুঁজি মজুদ হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ, ওই সময়ে

তাঁদের দুটি প্রধান রপ্তানি পণ্য - আফিম ও সোরা ব্যবসায়ে ইংরেজ কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ওলন্দাজ কোম্পানির ব্যবসা ইংরেজদের উপরে

অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। সেই সময়ে লর্ড ক্লাইভ ওলন্দাজদের জন্য বিহারের ২৮,৫৭৯ মণ সোরা বরাদ্দ করেছিলেন; এবং উক্ত শতাব্দীর শেষের দিকে তাঁরা ইংরেজদের কাছ

থেকে ৫০০ বাক্স আফিম পেতেন। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ৬২ ও ৬৫) পলাশীর যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওলন্দাজ কোম্পানি

বাংলা থেকে বেশী করে সুতীবস্ত্র, রেশমবস্ত্র ও কাঁচা রেশম কিনতে শুরু করেছিল। তৃতীয়তঃ, পলাশী-উত্তর যুগে ওলন্দাজ কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির

কর্মচারীদের অত্যাচার ও বাধাদানের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ওলন্দাজদের তাঁতি, আফিমচাষী, গোমস্তা ও কর্মচারীরা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন;

তাঁরা মুঘল সম্রাটদের প্রদত্ত ফারমানের কোনো মূল্যই দিতেন না। (রানা চক্রবর্তী) সেই সময়ের ওলন্দাজ কোম্পানির ডিরেক্টর ‘এ. বিসডম’ ও ‘টিটসিং’-এর চিঠিতে এই প্রসঙ্গের

উল্লেখ পাওয়া যায়। (লেটার ফ্রম চিনসুরা, ৩০শে জুন, ১৭৬২ সাল; প্রসিডিংস, বোর্ড অব ট্রেড, ৫ই ডিসেম্বর, ১৭৮৭ সাল) ওই শতাব্দীর শেষের দিকে ওলন্দাজদের বাংলা বাণিজ্য মাঝে

মাঝেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ, সেই প্রসঙ্গে কোম্পানির বোর্ড অব ট্রেডের ১৭৮৭ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, “এ বছর মনে হচ্ছে ওলন্দাজদের কোনো বিনিয়োগ (বাণিজ্য) নেই।”

(প্রসিডিংস, বোর্ড অব ট্রেড, ২রা সেপ্টেম্বর, ১৭৮৮ সাল)

অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা বাণিজ্যে তৃতীয় প্রধান অংশীদার ছিলেন ফরাসিরা। ওই সময়ে চন্দননগরে তাঁদের প্রধান ঘাঁটি ছাড়াও কাশিমবাজার, পাটনা, ঢাকা ও বালেশ্বরে তাঁদের বাণিজ্য কুঠি

ছিল। ১৭২২ সালে মুঘল সম্রাট ‘মুহম্মদ শাহের’ বাদশাহী ফারমানের বলে ফরাসিদের প্রদেয় বাণিজ্য শুল্ক শতকরা ৩.৫ থেকে কমে ২.৫-এ গিয়ে পৌঁছেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসিদের

বাংলা বাণিজ্যকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে - (১) ১৭০০-১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ফরাসি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য; (২) সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের পরে (১৭৫৬-৬৩)

(সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে এবং আমেরিকার স্বাধীনতা সংক্রান্ত যুদ্ধে (১৭৭৮-৮৩) ইংরেজ ও ফরাসিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন) ফরাসি কোম্পানি ও স্বাধীন ফরাসি বণিকদের

বাণিজ্য (১৭৬৪-১৭৬৯), (৩) ১৭৬৯ সালে ফরাসি সম্রাট ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকারকে বাতিল করে দিলে ঐ বছর থেকে ১৭৭৮ সাল পর্যন্ত ফরাসি

স্বাধীন বণিকেরা বঙ্গদেশে ব্যক্তিগত ব্যবসা করেছিলেন, (৪) ১৭৮৩ সালে ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে প্যারিসের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পরে কালোনে (Calonne) ফরাসি ইস্ট

ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে আরেকটি নতুন ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠিত হয়েছিল। এরপরে ১৭৯০ সালে ফরাসি দেশের বিপ্লবী জাতীয় পরিষদ, প্রাচ্যের বাণিজ্যকে অবাধ ও উন্মুক্ত

বলে ঘোষণা করেছিলেন। উল্লেখিত প্রথম পর্যায়ের (১৭০০-১৭৫৭) প্রথম দিকে বঙ্গদেশে ফরাসি কোম্পানির বাণিজ্য খুবই সামান্য ছিল। (রানা চক্রবর্তী) অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার

দিকে ইংরেজ বণিক ‘হ্যামিলটন’ হুগলীতে এসেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন যে, চন্দননগরে ফরাসিদের একটি সুন্দর ছোট চার্চ রয়েছে, এবং বঙ্গদেশে তাঁদের প্রধান কাজ হল সেই চার্চে

সমবেত হয়ে প্রার্থনা করা। ‘ডুপ্লে’ চন্দননগরে গভর্ণর হয়ে আসবার আগে (১৭৩১) বাংলা থেকে মাত্র ৬টি দেশী নৌকা ফরাসিদের বাণিজ্য পণ্য বহন করত, কিন্তু তখন মাঝে মাঝেই

তাদের কাজ থাকত না। ডুপ্লে গভর্ণর হয়ে আসবার পরেই বঙ্গদেশে ফরাসি বাণিজ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছিল। তাঁর সময়ে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০টি জাহাজ ফরাসি বাণিজ্যপণ্য বহন

করবার জন্য দরকার হত। সেযুগে চন্দননগরের ‘ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী’ ও হুগলীর আর্মেনীয় বণিক ‘খাজা ওয়াজেদের’ মাধ্যমে বঙ্গদেশে ফরাসিদের পণ্য বেচা কেনা চলত। ১৭৩৩ সালে

পাঁচটি জাহাজে করে ফরাসিদের রপ্তানি পণ্য ইউরোপে পাঠানো হয়েছিল। ডুপ্লে তাঁর সময়ের বঙ্গদেশের অভ্যন্তরের অনেকগুলি নতুন ফরাসি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে পণ্য কেনবার

ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৭৪১ সালে ডুপ্লে যখন ভারতে ফরাসি গভর্ণর জেনারেল হয়ে পন্ডিচেরীতে চলে গিয়েছিলেন, তখন বঙ্গদেশের ৭২টি জাহাজ ফরাসি বাণিজ্য পণ্য বহন করত। বাংলার

পণ্য তিনি সুরাট, জেদ্দা, মোখা, বসরা, পারস্য ও চীনদেশে পাঠিয়েছিলেন। এমন কি তিব্বতের সঙ্গেও তিনি বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। (ক্যালকাটা রিভিয়্যু, ১৮৬৬,

পৃ: ১৩২-৩৩) সেই সময়ে ইংরেজ ও ওলন্দাজদের মতই ফরাসিরাও বঙ্গদেশে আগাম ব্যবস্থার মাধ্যমে বাণিজ্যপণ্য কিনতেন। (রানা চক্রবর্তী) তখন অনেক সময়ে একই বণিক গোষ্ঠী

ইংরেজ ও ফরাসিদের পণ্য সরবরাহ করত। তৎকালীন বাংলার বণিক ও উৎপাদকেরা ফরাসিদের সঙ্গে বাণিজ্যে আগ্রহ দেখাতেন, কারণ তাঁরা তাঁদের বেশ লাভজনক শর্ত দিতেন। সেজন্য

ওই সময়ের বঙ্গদেশ থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে ফরাসিদের কোন অসুবিধা হত না। তখন ইংরেজ ও ওলন্দাজদের মতই ফরাসিরা এদেশে সোনা, রুপো, তামা, টিন, দস্তা, সীসা ও পশমের কাপড়

নিয়ে আসতেন, এবং বাংলা থেকে ইউরোপীয় বাজারের জন্য সুতীবস্ত্র, রেশম বস্ত্র, রেশম ও সোরা নিয়ে যেতেন। ওই সময়ে এশীয় দেশগুলির জন্য, পূর্বোক্ত পণ্যগুলো ছাড়াও ফরাসিরা

বাংলা থেকে চিনি, আফিম, লাক্ষা, চাল, কড়ি প্রভৃতি সংগ্রহ করতেন। (দি ফ্রেঞ্চ কোম্পানি এ্যান্ড দি মার্চেন্টস অব বেঙ্গল: ১৬৮০-১৭৩০, ইন্দ্রানী রায়, ইন্ডিয়ান ইকনমিক এণ্ড

সোস্যাল হিস্ট্রি রিভিয়্যু, ৮ম খণ্ড, পৃ: ৪১-৫৫) কিন্তু ডুপ্লের পরেই বঙ্গদেশের ফরাসি বাণিজ্যে আবার মন্দা দেখা দিয়েছিল। সেটির পিছনে দুটি প্রধান কারণ ছিল - (ক) তখন বাংলা

বাণিজ্যের জন্য ফরাসিদের কাছে যথেষ্ট মূলধন ছিল না; আর (খ) চন্দননগরে ডুপ্লের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বাণিজ্যিক কাজকর্মে অনুৎসাহ দেখা দিয়েছিল। ফলে ১৭৪১ সাল থেকে

১৭৫৩ সাল পর্যন্ত ফরাসিদের বাংলা বাণিজ্য অনেকটাই প্রাণহীন ও গতিহীন (stagnant) অবস্থায় ছিল। ১৭৫৩-৫৪ সাল থেকে বাংলায় ফরাসি বাণিজ্যের দ্রুত অধোগতি শুরু হয়েছিল।

চুঁচুড়ার ওলন্দাজ বণিকদের কাগজপত্রে সেই সময়কার ফরাসি বাণিজ্যের ক্রমাবনতি সম্পর্কে মন্তব্য পাওয়া যায়। ওই সময়ে ইউরোপে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ

শুরু হলে ১৭৫৭ সালের ২৩শে মার্চ তারিখে লর্ড ক্লাইভ চন্দননগর দখল করে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৭৬৪-৬৯) বঙ্গদেশে ফরাসি বাণিজ্য প্রকৃতপক্ষে ফরাসি বণিকদের

ব্যক্তিগত বাণিজ্য ছিল। সেই যুগের বঙ্গদেশে বাণিজ্য করবার জন্য ফরাসি বণিকদের বাণিজ্যিক মূলধন সংগ্রহে কোনো অসুবিধা হয়নি। (রানা চক্রবর্তী) উক্ত সময়ে ওলন্দাজদের মত

ফরাসিরাও ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইউরোপে ‘বিল অব এক্সচেঞ্জ’ দিতেন, ফলে তৎকালীন বঙ্গদেশে বাণিজ্য করবার মত যথেষ্ট মূলধন তাঁরা

সংগ্রহ করতে পারতেন। সেই যুগের ফরাসি বণিকেরা ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের জবরদস্তি ও জুলুম সত্ত্বেও বাংলার বিস্তৃত অঞ্চল থেকে - বাউলিয়া, রাধানগর, সোনামুখী, রংপুর,

মেদিনীপুর, কাশিমবাজার, পাট্টাহাট (ঢাকার কাছে), খিরপাই, হরিয়াল, শান্তিপুর, মালদা, পাটনা এবং ঢাকায় - বস্ত্র ও রেশম, রেশমী বস্ত্র, সোরা ও আফিম কিনতেন। তখন অনেক সময়েই

পণ্য কেনবার প্রশ্নে ইংরেজ কর্মচারীদের সঙ্গে ফরাসি বণিকদের বিরোধ দেখা দিত। ওই সময়ে ফরাসিরা বঙ্গদেশে ইংরেজদের আধিপত্যকে মেনে নিয়ে তাঁদেরই সহযোগিতায় বাংলায়

বাণিজ্য করেছিলেন। শেষ পর্যায়ে ১৭৮৩ সালে নতুন ফরাসি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি গঠিত হওয়ার পরে ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বাংলার অভ্যন্তরীণ বাজারে ফরাসি

প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনায় চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) সেই যুগে বাংলা ও বিহারের আফিম ও সোরার ব্যবসা ইংরেজদের কুক্ষিগত হলেও, ফরাসিরা বেশি দাম দিয়ে বাংলা

থেকে সুতীবস্ত্র ও রেশম কিনে নিতে পারেন ভেবে ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ভয়ও পেয়েছিল। যদিও শেষপর্যন্ত বাণিজ্য সহযোগিতার প্রশ্নেই তখন উক্ত দুই কোম্পানির মধ্যে দীর্ঘ

আলোচনার পরে ঠিক হয়েছিল যে, ফরাসি কোম্পানি বাংলা-বিহার থেকে বার্ষিক মোট ১৮,০০০ মণ সোরা ও দু’শো বাক্স আফিম পাবে; তবে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের ২

শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ৪২) নতুন ফরাসি কোম্পানি বঙ্গদেশে মূলধন হিসাবে সোনা-রুপো নিয়ে আসত। তাতে ইংরেজ

কোম্পানির কর্তৃপক্ষ খুশীই হয়েছিলেন, কারণ ওই সময়ে বঙ্গদেশে রূপোর ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। তবে শেষ পর্বেও ফরাসি কেম্পানির সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে বিরোধ

দেখা দিয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) তখনও ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় জোর করে ফরাসি কোম্পানির বাণিজ্য নষ্ট করবার চেষ্টা করেছিলেন। ওই সময়ে ঢাকা,

মালদা, খিরপাই, শান্তিপুর এবং পাটনাতে সুতীবস্ত্র, রেশম, আফিম ও সোরা কেনবার প্রশ্নে ফরাসি ও ইংরেজ বণিকদের মধ্যে তীব্র বিবাদ দেখা দিয়েছিল। সেই সময়ে ফরাসিদের পণ্য

কেনবার ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের রীতি অনুযায়ী বাংলার পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, এবং তার ফলে বণিকদের লাভের হার অনেকটাই কমে গিয়েছিল ও তাঁরা ফরাসিদের উপরে ক্ষুব্ধ

হয়েছিলেন। (প্রসিডিংস, বোর্ড অব ট্রেড, ১৯শে অক্টোবর, ১৭৮৭ সাল) অবশেষে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিপ্লবী ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের যুদ্ধ শুরু হলে বঙ্গদেশে ফরাসি

বাণিজ্য পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও সেই শেষ পর্বে ফরাসিরা বঙ্গদেশে সুনামের সঙ্গে বাণিজ্য করে প্রচুর রুপো এনেছিলেন, এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতামূলক

আবহাওয়া তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে তিনটি প্রধান কোম্পানি (ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি) ছাড়াও আরো তিনটি ইউরোপীয় কোম্পানি সেই সময়ের বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ করেছিল। তারা

ছিল - দিনেমার, বেলজিয়ামের ‘অস্টেণ্ড’, এবং জার্মানীর ‘রয়্যাল প্রাশিয়ান কোম্পানি’। উক্ত সময়ে দিনেমাররা চন্দননগরের কাছে গোঁদলপাড়ায় নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করে বঙ্গদেশে

ব্যবসা করতেন। (রানা চক্রবর্তী) বঙ্গদেশে ইংরেজদের মত বিনাশুল্কে বাণিজ্য করবার জন্য তাঁরাও মোঘল সম্রাটের ফারমান যোগাড় করবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। শেষে ১৭১৪

সালের ডিসেম্বর মাসে মুর্শিদকুলি সরকারের সঙ্গে দিনেমারদের মনোমালিন্য দেখা দিলে তাঁরা বঙ্গদেশের উপনিবেশ ত্যাগ করে তাঁদের দক্ষিণ ভারতের উপনিবেশ ট্রাঙ্কুভারে চলে

গিয়েছিলেন। ওই সময়ে নবাব সরকার ও দিনেমারদের মধ্যে মধ্যস্থতা করে ইংরেজরা দিনেমারদের বঙ্গদেশে রাখবার চেষ্টা করেও ফলপ্রসূ হতে পারেননি। সেই কারণেই, ১৭১৪ সাল থেকে

১৭৫৫ সাল পর্যন্ত বাংলা বাণিজ্যে দিনেমারদের অস্তিস্ত ইতিহাসে চোখে পড়ে না। (দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ্যান্ড দি ইকনমি অব বেঙ্গল: ১৭০৪-১৭৪০, এস. ভট্টাচার্য্য, পৃ- ৬৯)

এরপরে নবাব আলিবর্দির রাজত্বের শেষের দিকে (১৭৫৫) দিনেমাররা আবার বঙ্গদেশে ফিরে এসে হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে তাঁদের উপনিবেশ স্থাপন করে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেছিলেন।

উক্ত সময়ে দিনেমাররা ফরাসি ও ওলন্দাজদের মতই কক্সবন্দরে (হুগলী) ২.৫ শতাংশ হারে বাণিজ্য শুল্ক দিয়ে বঙ্গদেশে ব্যবসা করতেন। তবে এদেশের রাজশক্তি তখন তাঁদের পণ্যতরী

অনুসন্ধান করে দেখতে পারত না, বা তাঁদের কাছ থেকে পণ্যের কোন তালিকা দাবীও করতে পারত না। ১৭৮১ সালে ডেনমার্কের রাজা দিনেমার ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে ভেঙ্গে দিয়ে

ভারতের বাণিজ্য সবার জন্য অবাধ ও উন্মুক্ত বলে ঘোষণা করেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) উক্ত শতাব্দীর শেষ দিকে দিনেমার বণিকরা কোম্পানির জন্য নির্দিষ্ট ২.৫ শতাংশ হারে বাণিজ্য

শুল্ক দিয়ে বাংলায় বাণিজ্য করতেন। সেযুগে তাঁরা প্রধানতঃ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের পণ্য বহন করতেন। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল,

১ম খণ্ড, এন. কে. সিংহ, সংযোজন বি, পৃ- ২৪৮) সম্রাট ষষ্ঠ চার্লস অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যভুক্ত অস্ট্রিয় নেদারল্যাণ্ডস বা বেলজিয়ামের বণিকদের নিয়ে গঠিত অস্টেণ্ড কোম্পানিকে

১৭২৩ সালের আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বাংলার ইংরেজ ও ওলন্দাজ বণিকেরা প্রথম থেকেই তাঁদের সেই নতুন ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভাল চোখে দেখেন নি। সেই

কারণে, একটা সময়ে অস্ট্রিয়ার সম্রাটের কাছে তাঁরা ওই কোম্পানিটিকে বন্ধ করে দেওয়ার জন্যও আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজ ও ওলন্দাজদের সেই বাধাদান সত্ত্বেও ১৭২৬ সাল

থেকে ১৭৩৩ সালের মধ্যে ইংরেজ ‘আলেকজান্ডার হিউম’ ও ‘সোনামিলি’র (Schonornilli) অধীনস্থ অস্টেণ্ড কোম্পানি গঙ্গার পূর্বতীরে ব্যারাকপুরের কাছে বাঁকিবাজারে নিজেদের কুঠি

স্থাপন করে বঙ্গদেশে বাণিজ্য করেছিল। এছাড়া বহরমপুর ও ঢাকাতেও তাদের কুঠি ছিল, এবং তৎকালীন বাংলার - ইউরোপীয় ও অভ্যন্তরীণ - দু’ধরনের বাণিজ্যেই তারা অংশগ্রহণ

করেছিল। (দি ফ্যাক্টরি অব বাঙ্কি বাজার ইন বেঙ্গল, লুক রোয়েভা, বেঙ্গল পাস্ট এ্যান্ড প্রেজেন্ট,জানুয়ারি-জুন, ১৯৮০, পৃ- ৬০) সেই সময়ে এদেশের শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গেও তারা

 

143

 

যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) ১৭২৮ সালে অস্ট্রিয়ার সম্রাট সাত বছরের জন্য তাঁদের প্রাচ্য দেশের বাণিজ্য বন্ধ রাখতে রাজী হলেও অস্টেণ্ড কোম্পানির

বাংলা বাণিজ্য কিন্তু বন্ধ হয়নি। উক্ত সময়ে অস্টেণ্ড কোম্পানি বঙ্গদেশে বেশি দাম দিয়ে প্রচুর জিনিস কিনত, যথা - সুতীবস্ত্র, রেশম, রেশমী বস্ত্র, সোরা ইত্যাদি; আর ইউরোপ

থেকে আমদানি করা পণ্য বঙ্গদেশে সস্তায় বিক্রি করত। এর ফলে নিজেদের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনায় ইংরেজ ও ওলন্দাজরা একটা সময়ে বলপ্রয়োগ করে অস্টেণ্ড কোম্পানির

জাহাজ, স্লপ ইত্যাদি অধিকার করে লুঠ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথি থেকে জানতে পারা যায় যে, ১৭৩০ সালের জানুয়ারী মাসে অস্টেণ্ড কোম্পানির জাহাজ

‘সেইন্ট টেরেসা’কে তারা দখল করে নিয়েছিলেন। ১৭৩২ সালে নবাব সুজাউদ্দিন অস্টেণ্ড কোম্পানিকে বাংলা থেকে বিতাড়ন করবার কথা ঘোষণা করেছিলেন। (দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

এ্যান্ড দি ইকনমি অব বেঙ্গল: ১৭০৪-১৭৪০, এস. ভট্টাচার্য্য, পৃ- ৯২) কিন্তু ইংরেজ ও ওলন্দাজদের চরম শত্রুতা, বিরোধিতা ও সরকারি ঔদাসীন্যকে উপেক্ষা করেই অস্টেণ্ড

কোম্পানি ১৭৪৪ পর্যন্ত বঙ্গদেশে টিকে ছিল, অবশেষে ঐ বছরই সরকারি আদেশে তাদের বাংলা বাণিজ্যের উপরে যবনিকাপাত ঘটেছিল। (দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ্যান্ড দি ইকনমি অব

বেঙ্গল: ১৭০৪-১৭৪০, এস. ভট্টাচার্য্য, পৃ- ৬৫; দি ফ্যাক্টরি অব বাঙ্কি বাজার ইন বেঙ্গল, লুক রোয়েভা, বেঙ্গল পাস্ট এ্যান্ড প্রেজেন্ট,জানুয়ারি-জুন, ১৯৮০, পৃ- ৬২) নবাব

আলিবর্দির সময়ে প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক ‘রয়্যাল প্রাশিয়ান বেঙ্গল কোম্পানি’ গঠন করে প্রাচ্যদেশে ও বাংলায় বাণিজ্য করতে চেয়েছিলেন। আলিবর্দি ও ইংরাজদের মধ্যে

কেউই তখন বাংলা বাণিজ্যে জার্মান অনুপ্রবেশ পছন্দ করেননি। সেই যুগে জার্মানদের পক্ষে ইংরেজ বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে বঙ্গদেশে ব্যবসা চালানো কিছুতেই সম্ভব ছিল না; কারণ,

ওই সময়ে সমুদ্র থেকে গঙ্গার প্রবেশমুখের সবত্রই ইংরেজদের সতর্ক প্রহরা থাকত। সেই প্রহরা এড়িয়ে বঙ্গদেশের সমুদ্রবাণিজ্যে অংশ নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই

কিছুকাল কষ্টেসৃষ্টে বঙ্গদেশে বাণিজ্য চালানোর পরেই জার্মানদের সেই প্রচেষ্টা পরিত্যক্ত হয়েছিল। তাই ১৭৫৯ সালের পরে বঙ্গদেশে তাঁদের বাণিজ্যিক কাজকর্মের আর কোনো

উল্লেখ ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায় না। (প্রসিডিংস, ২১শে আগস্ট, ১৭৬০ সাল; সিলেকশনস ফ্রম দি আনপাবলিশড রেকর্ডস অব দ্য গভর্ণমেন্ট: ১৭৪৮-১৭৬৭, রেভারেণ্ড জেমস লঙ, পৃ-

৩৩২) উক্ত শতাব্দীর শেষ দুই দশকে বাংলার সঙ্গে আমেরিকা ও পর্তুগালের বাণিজ্য অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। ওই সময়ে ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকার মধ্যে সম্পাদিত ‘জয় চুক্তি’র (Joy

Treaty; ১৯শে নভেম্বর, ১৭৯৪ সাল) অসম্পূর্ণতা, অস্পষ্টতা ও ত্রুটির সুযোগ নিয়েই আমেরিকার বণিকেরা এদেশের আন্তঃপ্রাদেশিক, এশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু

করেছিলেন। তাঁরা হ্যামবুর্গ, ম্যানিলা, বাটাভিয়া ও দিনেমার উপনিবেশ শ্রীরামপুর ও ট্রাঙ্কুভারের সঙ্গে নিজেদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) ১৭৯৯ সালে

বাংলার সঙ্গে আমেরিকার মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩৭,৮৭,৯৩৭ সিক্কা টাকা। (ট্রেড এ্যান্ড ফিনান্স ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি: ১৭৯৩-১৮৩৩, অমলেশ ত্রিপাঠী, পৃ: ৪৪, ৬৩ ও

৬১) ওই শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে পর্তুগালের সঙ্গেও বাংলার বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। সেই প্রসঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ বছরে ‘লর্ড ওয়েলেসলি’ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া

কোম্পানির ডিরেক্টর সভার চেয়ারম্যানকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “এ বছর বাংলা থেকে পর্তুগালের রপ্তানি বাণিজ্য কোম্পানির বাণিজ্যের প্রায় সমান হবে।” (ট্রেড এ্যান্ড ফিনান্স

ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি: ১৭৯৩-১৮৩৩, অমলেশ ত্রিপাঠী, পৃ- ৬০; ওয়েলেসলি টু চেয়ারম্যান, ২৯শে নভেম্বর, ১৭৯৯ সাল) উক্ত শতাব্দীর শেষেরদিকে বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে

বিদেশী আধিপত্য (আমেরিকা, পর্তুগাল, ডেনমার্ক) কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে বেশ আতঙ্কিত করে তুলেছিল। তখন ওই বিদেশী আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে সেই বাণিজ্যকে পুনরায় হস্তগত

করবার জন্য কোম্পানি ও ইংরেজ বণিকেরা তাঁদের প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রেখে গিয়েছিলেন। ১৭৯৯-১৮০০ সালে বাংলার মোট বৈদেশিক রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২,৫৯,৬৮,০০০

সিক্কা টাকা। এর মধ্যে ইংরেজ কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় এক কোটি টাকা, অর্থাৎ, ওই সময়ের মোট রপ্তানি বাণিজ্যের ৬০ শতাংশেরও কম।

তুমি হিন্দু না মুসলিম?’

রানা

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে নদীর তুলনা করেছিলেন। বাংলা সাহিত্য বারবারই নদীর মতোই নিজের বাঁক পরিবর্তন করেছে; বিষয়ে-বিন্যাসে নিরন্তর নিজের গতিপথ

বদলে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর বিভঙ্গে, কল্লোলে মহাকালের দিকে বয়ে গিয়েছে। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে যেমন সঠিক কারণেই ‘বঙ্কিমপর্ব’ বলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে

চিহ্নিত করা হয়, তেমনই বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশ, ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পরে তাঁরই প্রতিভার বর্ণচ্ছটায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। কিন্তু, ১৯৩০ সালের পর

থেকে সেই সময়ের বাংলার তরুণ লেখকগোষ্ঠীর নতুনতর জীবনবোধ, বিদ্রোহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার দুর্দম প্রাবল্যে রবীন্দ্র সাহিত্যের মায়াপাশ ছিন্ন হতে শুরু করেছিল। এর আগে

শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্য বাঙালিকে বাস্তবতার কঠোর ছবি দেখালেও, বিশ শতকের তিনের দশকের লেখকরা সেই সাহিত্যের মুখচ্ছবিটি, তাঁদের পূর্বসূরি রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র থেকে

একেবারে সরে এসে, সম্পূর্ণ নতুন করে এঁকেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) ওই সময়ের বাংলার সামাজিক ভাঙ্গন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের দ্বন্দ্বাদ্বন্দ্ব সেইসব নতুন প্রজন্মের

কথাসাহিত্যিকদের রচনাকে দুর্বিষহ, প্রবল ও পরুষ করে তুলেছিল; বলা বাহুল্য যে, ওই সময়ের কবিতাতেও সেটার ছোঁয়া লেগেছিল। তৎকালীন সময়ে ‘কল্লোল’ (১৯২৩), ‘কালিকলম’

(১৯২৩), ‘প্রগতি’ (১৯২৭) ইত্যাদি পত্রিকাগুলিকে নির্ভর করে বাংলা সাহিত্যের নতুন প্রজন্মের সেই লেখকেরা উঠে আসছিলেন, যাঁদের গায়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচ লেগেছিল।

ফলে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের ঔপনিষদিক ভাবধারার প্রতি আর আবিষ্ট থাকতে পারেননি। ওই সময়ের বিদেশি দর্শন, সমাজ-বাস্তবতা তাঁদের নতুনতর সৃষ্টিসুখের উল্লাসে প্রাণিত করেছিল।

সিগমুণ্ড ফ্রয়েড এবং কার্ল মার্কসের দর্শন তাঁদের যুগপৎ প্রণোদিত করছিল। ‘কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ’, ‘সুরেশচন্দ্র সমাজপতি’, ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায়’, ‘বিপিনচন্দ্ৰ পাল’ প্রমুখ

লেখকদের মত সেই কল্লোলীয় লেখকেরা রবীন্দ্রনাথকে কোনও বিরূপ চোখে দেখেননি। কল্লোল-এর সেই লেখকেরা রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেও তখন তাঁকে অতিক্রম করতে সচেষ্ট

হয়েছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) ঊনিশ শতকের শেষভাগে পুরাণচারী হিন্দুধর্মের মুখপত্র হিসাবে যোগেশচন্দ্র বসুর ‘বঙ্গবাসী’ (১৮৮১), কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের ‘হিতবাদী’ (১৮৯১),

এবং সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ‘সাহিত্য’ (১৮৯০) পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সব পত্রিকায় হিন্দুধর্মের নানা রক্ষণশীলতাকে আলোকিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে, ‘সঞ্জীবনী’

(১৮৮৩) পত্রিকা তখন হিন্দুধর্মের যাবতীয় সংস্কারকে আঘাতে জর্জরিত করা শুরু করেছিল। ১৮৯৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর পরে হিন্দুত্ববাদ বাংলা সাহিত্যের অবলম্বন হিসাবে

অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের অনুসারীরা স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের গুণগ্রাহী ছিলেন না। তাই তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেও বারবার তাঁদের

সৃষ্ট নিন্দার কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। এমনকী, পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত রবীন্দ্রসাহিত্যে অবাস্তবতার প্রাবল্য লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি

রবীন্দ্রসাহিত্যের পাশাপাশি একধরনের সাহিত্য-বাস্তবতা নির্মাণ করতে পারলেও, অন্যরা সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করেই রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য যে,

রবীন্দ্রসাহিত্যের সূক্ষ্ম বাস্তবতা অনুধাবন করবার বিন্দুমাত্র ক্ষমতাও তাঁদের মধ্যে ছিল না। রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রানুসরণকে শরৎচন্দ্র যেমন মেনে নেননি, তেমনই কাজী নজরুল

ইসলামও (১৮৯৮-১৯৭৬) কবিতার মতোই সেই সময়ের কথাসাহিত্যেও স্বাতন্ত্র্য্ দেখাতে পেরেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে, বাংলা কথাসাহিত্যের আলোচনার

ক্ষেত্রে আজও নজরুলের অবদান তেমনভাবে আলোচনা করা হয় না। কিন্তু বাস্তবে তিনিই বাংলা আধুনিক কথাসাহিত্যের মুসলমান-চরিত্র ও মুসলমান-সমাজের অন্যতম রূপকার ছিলেন।

তাঁর আগে ‘মির মোশারফ হোসেনের’ রচনায় (বিষাদসিন্ধু) বাংলার মুসলমান-জনজীবনের ছবি দেখতে পাওয়া গেলেও সেটা কিন্তু পুরাণাশ্রিত। সেদিক থেকে নজরুলই প্রথম সহজ-সাধারণ

মুসলমান-প্রেক্ষিত রচনা করে বাংলা কথাসাহিত্যকে একটি নতুন মাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক সাম্প্রদায়িক বাতাবরণে জন্ম নিলেও নজরুল ইসলামের জীবনযাপন ও রচনায় যে

অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়, সেটা খুবই দুর্লভ। (রানা চক্রবর্তী) ধর্মের সঙ্গে যুক্তির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি ধর্মকে সমন্বয়বাদী ও অসাম্প্রদায়িক করতে সচেষ্ট

হয়েছিলেন। অধ্যক্ষ ‘ইব্রাহিম খান’কে একদা একটি চিঠিতে নজরুল লিখেছিলেন, “হিন্দু-মুসলমানে পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিছু হবে না, এ আমিও মানি।

এবং আমিও জানি যে, একমাত্র সাহিত্যের ভিতর দিয়েই এ অশ্রদ্ধা দুর হতে পারে।” (নজরুল রচনা সম্ভার, আবদুল কাদির সংকলিত) নজরুল চিরকাল নিজের জীবনযাপনে সেই

অসম্প্রদায়িক পথই অনুসরণ করে গিয়েছিলেন। তিনি ব্রাহ্ম ঘরের ‘আশালতা সেনগুপ্ত’কে বিবাহ করলেও তাঁকে কখনো ধর্মান্তরিত করেননি। সেই আশালতা পরে ‘প্রমীলা নজরুল’ নামে

পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি নিজের পুত্রদের নাম রেখেছিলেন - ‘কৃষ্ণ মহম্মদ’, ‘অরিন্দম খালেদ’, ‘কাজী সব্যসাচী’ ও ‘কাজী অনিরুদ্ধ’। অবশ্য তিনি তাঁর সেই ‘হিন্দুয়ানি’র জন্য ওই সময়ের

গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী বা কট্টর মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে প্রবলভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন (এবং আজও হন)। সেই প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছিলেন, “আমায় মুসলমান সমাজ 'কাফের' খেতাবের

যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনোদিন অভিযোগ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। ... হিন্দুরা লেখক-অলেখক জনসাধারণ মিলে যে স্নেহ যে

নিবিড় প্রীতি ভালোবাসা দিয়ে আমায় এত বড় করে তুলেছেন, তাঁদের সে ঋণকে অস্বীকার যদি আজ করি তাহলে আমার শরীরে মানুষের রক্ত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। ... আজিকার

সাম্প্রদায়িক মাতলামির দিনে আমি যে মুসলমান এইটেই হয়ে পড়েছে অনেক হিন্দুর কাছে অপরাধ ... আমি যত বেশী অসাম্প্রদায়িক হই না কেন।” (নজরুল রচনা সম্ভার, আবদুল কাদির

সংকলিত) নজরুলের গান ও কবিতার মতো তাঁর কথাসাহিত্যেও সেই চেতনার প্রকাশ ঘটেছিল। (রানা চক্রবর্তী) তিনি মোট তিনটি উপন্যাস লিখেছিলেন - ‘বাঁধনহারা’ (১৯২৭), ‘মৃত্যুক্ষুধা’

(১৯৩০), এবং ‘কুহেলিকা’ (১৯৩১)। উক্ত তিনটি উপন্যাসেই তিনি তৎকালীন মুসলিম-জনজীবনকে আশ্রয় করেছিলেন। কিন্তু, সেখানেও তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও আধুনিকতা লক্ষ্য করা যায়।

সমকালীন মুসলমান সমাজের নানা অন্ধকারে তিনি যেমন আধুনিকতার আলো জ্বেলেছিলেন, বিভিন্ন দিকের সমালোচনা করেছিলেন, তেমনই নিজের লেখায় তিনি খ্রিস্টান বা হিন্দু-চরিত্রের

উদ্ভাবন করে জনজীবনকে পূর্ণতার মাত্রাও দিতে চেয়েছিলেন। ওই সময়ের মুসলমান সমাজের নানা অন্ধ সংস্কারকে নিজের উপন্যাসে তিনি যেমন সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন, তেমনই

হিন্দু বা খ্রিস্টান-চরিত্র ও সংস্কৃতিকে পাশাপাশি রেখে তিনি এটাও দেখাতে চেয়েছিলেন যে, জীবনের তুলনায় ধর্ম কখনও বড় হয়ে উঠতে পারে না। (রানা চক্রবর্তী) ‘বাঁধনহারা’ উপন্যাসে

তিনি যেমন ‘আয়েসা’ বা ‘রোকেয়া’র মতো মুসলমান-নারীর পাশে এক ব্রাহ্মণ-শিক্ষয়িত্রীর চরিত্র এঁকেছিলেন, তেমনই ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে তিনি ক্ষুধার জ্বালায় ধর্মান্তরিত রোমান-

ক্যাথলিক ‘মধু ঘরামি’ ও তাঁর কন্যা ‘কুর্শি’কে সমকালীন মুসলমান অন্ত্যজ সমাজের পটভূমিকায় স্থাপন করেছিলেন। নজরুল সৃষ্ট ‘প্যাঁকালে’ জাতিতে মুসলমান হয়েও নিজের মানবিক

সংস্কারের বশে ইসলামি বিধান অনুযায়ী ভ্রাতৃবধূকে বিবাহ করতে রাজি না হলেও, ধর্মান্তরিত কুর্ণির প্রেমে পড়ে তিনি যেমন ধর্মান্তরিত হতেও দ্বিধা করেন নি, তেমনি আবার কলমা

পড়ে মুসলমান হতেও তাঁর আটকায়নি। নজরুল তাঁর সৃষ্ট ওই সব অসহায় চরিত্রগুলির প্রতি যেমন স্বতই সহানুভূতিশীল ছিলেন, অন্যদিকে মৌলবী বা পাদ্রীদের - তাঁরা যেভাবে দরিদ্র,

সাধারণ মানুষের অসহায়তার সুযোগে ধর্মের ব্যবসা করেন - তাঁদের তিনি সমালোচনায় বিদ্ধ করতেও ছাড়েন নি; নজরুলের লেখনী-রোষ থেকে কেউই রেহাই পাননি। (রানা চক্রবর্তী) তাঁর

‘বাঁধনহারা’ উপন্যাসের নায়িকার নাম হল ‘সাহসিকা’। নজরুল তাঁর কণ্ঠে যেন নিজেই কথা বলেছিলেন। সাহসিকা তাঁর বান্ধবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “ধর্ম সম্পর্কে আমার আর একটু

বলবার আছে। আমি তো পূর্বেই বলেছি যে, সব ধর্মেরই ভিত্তি চিরন্তন সত্যের পর - যে সত্য সৃষ্টির আদিতে ছিল, এখনও রয়েছে এবং অনন্তেও থাকবে। এই সত্যটাকে যখন মানি, তখন

আমাকে যে ধর্মে ইচ্ছা ফেলতে পারিস। আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিস্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম। আমি তো কোনো ধর্মের বাইরের (সাময়িক সত্যরূপ) খোলসটা ধরে নেই।

গোঁড়া ধার্মিকদের ভুল তো ওইখানেই। ধর্মের আদতে সত্যটা না ধরে এঁরা ধরে আছেন যত সব নৈমিত্তিক বিধি-বিধান। এঁরা নিজের ধর্মের উপর এমনই অন্ধ অনুরক্ত যে, কেউ এতটুকু

নাড়াচাড়া করতে গেলেও ফোস করে ছোবল মারতে ছোটেন। কিন্তু এটুকু বোঝেন না তাঁরা যে তাঁদের ‘ইমান’ বা বিশ্বাস, তাঁদের ধর্ম কত ছোটো কত নীচ কত হীন যে, তা একটা সামান্য লোকের

এতটুকু আঁচড়ের ঘা সইতে পারে না। ধর্ম কি কাঁচের ঠুনকো গ্লাস যে, একটুতেই ভেঙে যাবে? ধর্ম যে ধর্মেরই মতন সহাশীল, কিন্তু এ সব বিড়াল-তপস্বীদের কাণ্ড দেখে তা কিছুতেই মনে

করতে পারিনে। ... এই সব কারণেই, ভাই, আমি এই রকম ভণ্ড আস্তিকদের চেয়ে নাস্তিকদের বেশি ভক্ত, বেশি পক্ষপাতী।” নজরুল তাঁর ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসটি রাজনীতিকে অবলম্বন করে

লিখেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) তৎকালীন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, ইংরেজদের সুচতুর রাজনীতি - তাঁর সেই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য। এই প্রসঙ্গে সাহিত্য-

 

144

 

আলোচক ‘লায়েক আলি খান’ লিখেছিলেন, “... ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রাজনীতি। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ইতিহাসে মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে চিন্তিত নজরুল

নিতান্ত সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে হিন্দু, মুসলমান ও ইংরেজদের রাজনৈতিক মনোভূমির পরিমাপ করেছেন। উপন্যাসের এটাই বাস্তব দিক। এবং বাংলা রাজনৈতিক উপন্যাসধারায় ‘কুহেলিকা’

উপন্যাসটি নতুন দিগন্ত নির্ণায়কও বটে।” কুহেলিকা উপন্যাসটিতে ওই সময়ের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে মুসলমান সমাজের যে দ্বিধাদীর্ণ মনোভাব দেখতে পাওয়া যায়, সেটা এক

ঐতিহাসিক সত্য। নজরুলের আগে বা পরে অন্য কোন লেখকই সমকালীন মুসলমান-সমাজকে ওরকম গভীরভাবে দেখতে পারেননি। তখন সামাজিকভাবে অগ্রগণ্য হিন্দুদের পাশে পশ্চাদবর্তী

মুসলমান-সম্প্রদায় অন্যান্য বিষয়ের মতো স্বাধীনতা-আন্দোলন নিয়েও হীনম্মন্যতায় ভুগছিল। (রানা চক্রবর্তী) সেই সময়ের হিন্দুরা যেমন তাঁদের মুসলমান প্রতিবেশীকে কখনও

সমকক্ষ করে তোলবার চেষ্টা করেন নি, উপরন্তু তাঁদের ঘৃণা করেছিলেন, তেমনই সমকালীন মুসলমানেরাও ধর্মীয় অন্ধকারে আচ্ছন্ন থেকে হিন্দুদের প্রতি ঈর্ষা ও বিভেদ অনুভব

করেছিলেন। আর, দুই সম্প্রদায়ের সেই টানাপোড়েনকেই সুচতুর ইংরেজ কাজে লাগিয়েছিল। তখনকার ভেদাভেদের, সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে তাঁরা স্বাধীনতা-আন্দোলনের কাঁটা হিসাবে

ব্যবহার করেছিল। নজরুল তাঁর ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে উক্ত বিষয়টিকে খুবই বিশ্লেষণী মনস্কতায় বর্ণনা করেছিলেন। নজরুল দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ওই সময়ের মুসলমানেরা এটাই মনে

করেছিলেন যে, দেশের স্বাধীনতার অর্থ হল হিন্দু শাসনের প্রতিষ্ঠা, তাতে আখেরে মুসলমানদের কোনও লাভ নেই। অন্য দিকে সেই সময়ের হিন্দু নেতৃত্বও মুসলমানদেরকে সঠিক

দেশপ্রেমিক বলে ভাবতে পারেন নি। নজরুল তাঁর উপন্যাসের হিন্দু-চরিত্র ‘প্রমত্ত’র মাধ্যমে ওই সব সমস্যাগুলিকে যেমন চিহ্নিত করেছিলেন, তেমনই সেগুলির সমাধানের পথও খুঁজেছিলেন।

‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের নায়ক ‘জাহাঙ্গির’কে তিনি এক অস্থির-মনস্ক মানুষ হিসাবেই এঁকেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) পুরানো কলকাতার এক বিখ্যাত বাইজি ‘ফিরদৌস বেগমের’ গর্ভে তাঁর

জন্ম হয়েছিল। সেই নারী জাহাঙ্গিরের পিতার বিবাহিতা-স্ত্রী ছিলেন না, রক্ষিতা ছিলেন। নিজের জন্মের সেই লাঞ্ছনা নিয়ে জাহাঙ্গির তাঁর মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য

স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিলেও, সেখানেও তিনি কখনও স্ফূর্ত হতে পারেন নি। হিন্দু-মুসলমানের অনৈক্য জাহাঙ্গিরকে কখনোই স্বাধীনতাব্রতে বিকশিত হতে দেয়নি। একজন

মুসলমানের দেশপ্রেম নিয়ে সতীর্থ হিন্দুদের মনে যেমন সংশয় জেগেছিল, অন্যদিকে তেমনি অন্তর্গত মানসিক বাধায় দেশকে ‘জননী’ বলে ভাববার মন্ত্রেও তিনি দীক্ষিত হতে পারেন নি।

প্রেমিকা ‘চম্পা’র সঙ্গে তাঁর মানসিক দ্বন্দ্ব ও রিরংসার নিয়ন্ত্রকও সেই অপার সামাজিক তথা ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতার বোধই ছিল। সেখানেই উদারমনস্ক প্রমত্ত জাহাঙ্গিরকে সান্ত্বনা

ও সান্নিধ্য দিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বিভেদকে মুছে দিয়ে তাঁকে মানসিক সুস্থতার দিকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) লক্ষ্য করা যায় যে, ওই উপন্যাসের মাধ্যমে

নজরুলই বাংলা সাহিত্যে প্রথম হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে যুগপৎ রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে দেখেছিলেন। কবিতা ও গানেও তাঁর সেই প্রণোদনা দেখতে পাওয়া যায়। দেশকে

মাতৃরূপে গ্রহণ করতে তাঁর কখনোই কোন দ্বিধা ছিল না। হিন্দু-মুসলমানের অনৈক্যই যে স্বাধীনতার পথে সর্বোত্তম বিঘ্ন, সেটা তিনি সম্যকভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন। আর সেই

কারণেই তিনি নিঃসংশয়ে লিখতে পেরেছিলেন, “হিন্দু না মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!” বলা বাহুল্য যে, এই সম্প্রীতিই বাংলা সাহিত্যের

শ্রেষ্ঠতম অভিজ্ঞান।

‘প্রাচীন বঙ্গের নারী’

রানা

‘বাৎস্যায়ন’ তাঁর ‘কামসূত্রে’ গৌড়ের নারীদের ‘মৃদুভাষিণী’, ‘অনুরাগবতী’, এবং ‘কোমলাঙ্গী’ বলে (‘‘মৃদুভাষিণ্যোহনুরাগবতো মুদ্বঙ্গ্যশ্চগৌড়াঃ’’) তৃতীয়-চতুর্থ শতকে যে উক্তি করে

গিয়েছিলেন, সেটাকে মোটামুটি সত্যি বললে ইতিহাসের অপলাপ করা হয় না। কিন্তু বাৎস্যায়নের উক্তির ভিতর প্রাচীন বাঙালী নারীর সমগ্র ছবিটা পাওয়া যায়না; ইতিহাসের মাধ্যমে সেই

চিত্র ফুটিয়ে তুলবার উপাদানও অত্যন্ত স্বল্প।

গোড়াতেই বলা চলে, বৃহত্তর হিন্দুসমাজের গভীরে, (শিক্ষিত নাগর-সমাজের কথা বলা হচ্ছে না) আজও যে সব ‘আদর্শ’, ‘আচার ও অনুষ্ঠান’ সক্রিয় প্রাচীন বাঙালী সমাজেও সেটাই ছিল; যে

সব ‘সামাজিক রীতি ও অনুষ্ঠান’ পল্লী ও নগরবাসী সাধারণ নারীরা দৈনন্দিন জীবনে আজও পালন করে থাকেন, যে সব সামাজিক ‘বাসনা ও আদর্শ’ পোষণ করেন, প্রাচীন বাঙালী নারীদের

মধ্যেও মোটামুটি সেটাই ছিল সক্রিয়। বাঙলার ‘লিপিমালা’ ও ‘সমসাময়িক সাহিত্য’ই তার প্রমাণ। রানা যে ‘অসবর্ণ বিবাহ’ আজও বৃহত্তর হিন্দুসমাজে প্রচলিত অথচ ‘সুআদৃত’

নয়, মাঝে মাঝে তেমন ঘটেও থাকে, এবং সমাজ ক্রমে সেই বিবাহ স্বীকার করেও নেয়, প্রাচীন বাঙলায়ও অবস্থাটা ঠিক সেটাই ছিল। দশম-একাদশ-দ্বাদশ শতকের বাঙালী রচিত

‘স্মৃতিশাস্ত্র’গুলিতে ‘অসবর্ণ বিবাহের’ কোনও ‘বিধান’ নেই, ‘সবর্ণে বিবাহ’ই ছিল সাধারণ নিয়ম, কিন্তু ‘অসবর্ণ বিবাহ’ যে প্রাচীন বাঙলায় একেবারে অপ্রচলিত ছিল না তার প্রমাণ

‘সমতট-রাজ লোকনাথের মাতামহ’ ‘পারশব কেশব’, কেশবের পিতা ছিলেন ‘ব্রাহ্মণ’ কিন্তু মাতা বোধহয় ছিলেন ‘শূদ্রকন্যা’; কেশবের ‘পারশব’ পরিচয়ের এটাই ‘মূল কারণ’ বলে ঐতিহাসিকরা

মনে করেন। কিন্তু তাতে কেশবকে সমাজে কিছু ‘হীনতা’ স্বীকার করতে হয়নি, তাঁর ‘কন্যা গোত্রদেবী’ বা ‘দৌহিত্র লোকনাথ’কেও নয়। কিন্তু কেবল সপ্তম শতকেই বোধ হয় নয়, পরেও এই

ধরনের ‘অসবর্ণ বিবাহ’ কিছু কিছু সংঘটিত হত; নাহলে পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় ‘সুলতান জলাল-উদ-দীন’ বা ‘যদু’র ‘সভাপণ্ডিত ও মন্ত্রী’, বাঙালী ‘বৃহস্পতি মিশ্র’, যে ‘স্মৃতিগ্রন্থ’ রচনা

করেছিলেন, তাতে ব্রাহ্মণের পক্ষে অন্য ‘নিম্নতর বর্ণ’ থেকে স্ত্রী গ্রহণে কোনো বাধা নেই, এ বিধান দেবার কোনো প্রয়োজন হত না।

বাঙলার ‘পাল ও সেন আমলের লিপি’গুলো পড়লে মনে হয় ‘লক্ষ্মীর মতো কল্যাণী’, ‘বসুধার মতো সৰ্বংসহা’, ‘স্বামীব্রতনিরতা নারীত্ব’ই ছিল প্রাচীন বাঙালী নারীর ‘চিত্তাদর্শ’;

‘বিশ্বস্তা’, ‘সহৃদয়া’, ‘বন্ধুসমা’ এবং ‘স্থৈৰ্য’, ‘শান্তি’ ও ‘আনন্দের উৎসস্বরূপ’ স্ত্রী হওয়াই ছিল তাঁদের ‘একান্ত কামনা’। ‘স্বামীর ইচ্ছাস্বরূপিনী’ হওয়াই ছিল ‘তাঁদের বাসনা’; এবং

শামুক যেমন মুক্তা প্রসব করে তেমনই মুক্তাস্বরূপ ‘বীর ও গুণী পুত্রের প্রসবিনী’ হওয়াই ছিল ‘সকল বাসনার চরম বাসনা’। বন্ধ্যা নারীর জীবন কেউই কামনা করতেন না। রানা

লিপির পর লিপিতে এই সব ‘কামনা’, ‘বাসনা’ ও ‘আদর্শ’ নানা প্রসঙ্গে বারবার ব্যক্ত হয়েছে। উচ্চকোটি শিক্ষিত সমাজে ‘মা’ ও ‘পত্নী’র ‘সন্মান ও মর্যাদা’ এই জন্যই বেশ ‘উচ্চ’ই ছিল,

সন্দেহ নেই। লিপিগুলিতে উভয়েরই সম্বন্ধে ও সসম্মান উল্লেখ সেটার সাক্ষ্য; কোনো কোনো রাজকার্যে ‘রাজ্ঞীর অনুমোদন গ্রহণ’ও সেটার অন্যতম সাক্ষ্য।

সমসাময়িক ‘নারীজীবনের আদর্শ ও কামনা’ লিপিমালায় আরও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ ও ‘পৌরাণিক বিচিত্র নারীচরিত্রের সঙ্গে’ সমসাময়িক নারীদের তুলনায়

এবং প্রাসঙ্গিক উল্লেখের ভিতর দিয়ে। ‘ধর্মপালের মাতা দদাদেবী’র তুলনা করা হয়েছে ‘চন্দ্রদেবতার পত্নী রোহিণী’, ‘অগ্নিপত্নী স্বাহা’, ‘শিবপত্নী সর্বাণী’, ‘কুবেরপত্নী ভদ্রা’,

‘ইন্দ্ৰপত্নী পেলোমী’ এবং ‘বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মী’র সঙ্গে। ‘শ্রীচন্দ্রের পত্নী শ্রীকাঞ্চনা’র তুলনা করা হয়েছে ‘শচী’, ‘গৌরী’ এবং ‘শ্রী’র সঙ্গে। ‘ধবলঘোষের পত্নী সদ্ভাব্য’ তুলিত হয়েছেন

‘ভবানী’, ‘সীতা’ এবং ‘বিষ্ণুজায়া পদ্মা’; এবং ‘বিজয়সেন মহিষী বিলাসদেবী’ ‘লক্ষ্মী’ এবং ‘গৌরী’র সঙ্গে। সমসাময়িক ‘কামরূপ শাসনাবলী’তেও এই ধরনের তুলনাগত উল্লেখ সুপ্রচুর।

প্রাচীন বঙ্গের সকল মায়ের ‘কামনা’ ছিল ‘শুভ্র নিষ্কলঙ্ক সুদর্শন সন্তানের জননী হওয়া’; ‘প্রসবাবস্থায় কামনানুরূপ সন্তান জন্মলাভ করে’, এই বিশ্বাসও জননীর মধ্যে সক্রিয় ছিল।

‘শ্রীচন্দ্রের রামপাল লিপি’তে ‘সুবর্ণচন্দ্রের নামকরণ’ সম্বন্ধে একটি সুন্দর ইঙ্গিত আছে। প্রসূতির স্বাভাবিক প্রবণতানুযায়ী সুবর্ণচন্দ্রের মায়ের ইচ্ছা হয়েছিল শুক্লপক্ষে নবেদিত

চন্দ্রের পূর্ণ ব্যাসরেখা দেখবার, তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হওয়ায় তিনি ‘সোনার মতো উজ্জ্বল’ অর্থাৎ ‘সুবর্ণময় একটি চন্দ্র’ (অর্থাৎ ‘সুবর্ণচন্দ্ররূপ পুত্র’) দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছিলেন।

বঙ্গদেশে সাধারণ লোকদের মধ্যে এ বিশ্বাস আজও সক্রিয় যে শুক্লপক্ষের গোড়ার দিকে নবোদিত চন্দ্রের পূর্ণ গোলকরেখা প্রত্যক্ষ করলে নাকি প্রসূতি চন্দ্রের মতো স্নিগ্ধ সুন্দর

সন্তান প্রসব করেন।

‘সংক্রান্তি ও একাদশী তিথি’তে এবং ‘সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণে তীর্থস্নান’, ‘উপবাস’ এবং ‘দানে’ অনেক নারীই অভ্যস্ত ছিলেন; ‘রাজাস্তঃপুরিকা’রাও ছিলেন। স্বামী ও স্ত্রী একই সঙ্গে

‘দান-ধ্যান’ করতেন, এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়; স্ত্রী ও মায়েরা একক অনেক মূর্তি ও মন্দির ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করছেন, ‘দান-ধ্যান’ করছেন এ রকম সাক্ষ্যও সুপ্রচুর। রামায়ণ-

মহাভারতের কথা প্রাচীন বাঙলায় সুপরিচিত ও সুপ্রচলিত ছিল, এমন কি নারীদের মধ্যেও। রানা ‘মদনপালের মহিষী চিত্রমতিকা দেবী’ ‘বেদব্যাস-প্রোক্ত মহাভারত’ আনুপূর্বিক

পাঠ ও ব্যাখ্যা করিয়ে শুনেছিলেন, এবং ‘নীতিপাঠক ব্রাহ্মণ’কে দক্ষিণস্বরূপ ‘মদনপাল’ কিছু ভূমিদানও করেছিলেন।

নারীরা বোধ হয় কখনও কখনও সম্পন্ন অভিজাত গৃহে ‘শিশুধাত্রীর কাজ’ও করতেন! ‘তৃতীয় গোপালদেব’ শৈশবে ধাত্রীর ক্রোড়ে শুয়ে খেলে মানুষ হয়েছিলেন, ‘মদনপালের মনহলি লিপি’তে এই

রকম একটু ইঙ্গিত আছে। ‘জীমূতবাহনের দায়ভাগ গ্রন্থের সাক্ষ্য’ প্রামাণিক হলে স্বীকার করতে হয়, নারীরা প্রয়োজন হলে ‘সূতা কেটে’, ‘তাঁত বুনে’ অথবা ‘অন্য কোনো শিল্পকর্ম করে’

স্বামীদের উপার্জনে সাহায্য করতেন, কখনো কখনো ‘অর্থলোভে’ প্ররোচিতা হয়ে স্ত্রীরা স্বামীদের শ্রমিকের কাজ করিতে পাঠাতেন। এ ব্যাপারে স্ত্রীরা নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে

‘উৎকোচ’ গ্রহণে দ্বিধাবোধ করতেন না!

‘একটি মাত্র স্ত্রী গ্রহণ’ই ছিল সমাজের ‘সাধারণ নিয়ম’; সাধারণ লোকেরা সেটাই করতেন। তবে, ‘রাজরাজড়া’, ‘সামন্ত-মহাসামন্তদের মধ্যে’, ‘অভিজাত সমাজে’, ‘সম্পন্ন ব্রাহ্মণদের

মধ্যে’ ‘বহুবিবাহ’ একেবারে অপ্রচলিত ছিল না, এবং ‘সপত্নী বিদ্বেষ’ও অজ্ঞাত ছিল না। ‘দেবপালের মুঙ্গের লিপি’তে, ‘মহীপালের বাণগড় লিপি’তে ‘সপত্নী বিদ্বেষের ইঙ্গিত’ আছে; আবার

কোনো কোনো লিপিতে স্বামী সমভাবে সকল স্ত্রীকেই ভালোবাসছেন, সে-ইঙ্গিতও আছে (‘ঘোষরাবা লিপি’)। প্রাচীন বাঙলার লিপিমালায় ‘বহুবিবাহের দৃষ্টান্ত’ সুপ্রচুর; তবে ‘একপত্নীত্মই

যে সুখী পরিবারের আদর্শ’ সেটা স্পষ্টই স্বীকৃত হয়েছে ‘তৃতীয় বিগ্রহপালের আমগাছি লিপি’তে।

প্রাচীন বাঙলায়ও ‘বৈধব্যজীবন’ নারীজীবনের ‘চরম অভিশাপ’ বলে বিবেচিত হত। প্রথমেই ঘুঁচে যেত সিঁথির সিঁদুর, এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সমস্ত প্রসাধন-অলংকার সমস্ত সুখসম্ভোগ খসে

পড়ত। সাধারণভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের অন্যত্র যেমন, প্রাচীন বাঙলায়ও কন্যা বা স্ত্রী হিসাবে ছাড়া নারীদের ধনসম্পত্তিতে ‘কোনো বিধি বিধানগত ব্যক্তিগত অধিকার’ বা ‘সামাজিক

অধিকার’ স্বীকৃত ছিল না। কিন্তু ‘স্মৃতিকার জীমূতবাহন’ বিধান দিয়েছিলেন, ‘স্বামীর অবর্তমানে অপুত্ৰক বিধবা স্ত্রী স্বামীর সমস্ত সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকারের দাবি করতে পারেন’।

এই প্রসঙ্গে ‘জীমূতবাহন’ অন্যান্য স্মৃতিকারদের ‘বিরুদ্ধ মতামত’ সব লিপিবদ্ধ করেছিলেন, এবং যাঁরা বিধান দিয়েছিলেন যে, ‘বিধবা স্ত্রী শুধু খোরাকপোশাকের দাবি ছাড়া আর কিছু করতে

পারেন না’, ‘কিংবা মৃত স্বামীর ভ্রাতা এবং নিকট আত্মীয়বর্গের দাবি বিধবা-স্ত্রী-র দাবি অপেক্ষা অধিকতর বিধিসঙ্গত’, তাঁদের বিধান সজোরে ‘খণ্ডন’ করতে চেষ্টা করেছিলেন। সঙ্গে

সঙ্গে তিনি অবশ্য একথা বলেছিলেন, ‘সম্পত্তি বিক্রয়, বন্ধক বা দানে বিধবার কোনো অধিকার নেই’, এবং তিনি যদি ‘যথার্থ বৈধব্য জীবন’ যাপন করেন তবেই স্বামীর সম্পত্তিতে তাঁর

অধিকার প্রতিষ্ঠিত থাকবে। রানা বিধবাকে মৃত্যু পর্যন্ত ‘স্বামীগৃহে’ স্বামীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বাস করতে হবে, ‘প্রসাধন-অলংকার-বিলাসবিহীন সংযত জীবন যাপন’

করতে হবে, এবং স্বামীর পরলোকগত আত্মার কল্যাণার্থে যে সব ক্রিয়াকর্মানুষ্ঠানের বিধান আছে সেগুলো পালন করতে হবে। স্বামীগৃহে যদি কোনো পুরুষ আত্মীয় না থাকেন তাহলে মৃত্যু

পর্যন্ত তাঁকে পিতৃগৃহে এসে বাস করতে হবে। ‘প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণ গ্রন্থ’ মতে বিধবাদের মাছ, মাংস প্রভৃতি যে কোনো রূপ উত্তেজক পদার্থভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল; ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণের

বিধান’ও সেটাই। বিবাহ প্রভৃতি অনুষ্ঠানে বিধবাদের উপস্থিতি ‘অমঙ্গলসূচক’ বলে তখনও পরিগণিত হত, এবং তাঁরা সাধারণতঃ উৎসব ও অন্যান্য মঙ্গলানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে

পরতেন না। ‘স্বামীর চিতায় সহমরণে’ যাবার জন্য তখনও ‘ব্রাহ্মণ্যসমাজ’ বিধবাদের ‘উৎসাহিত’ করতেন। ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ বলা হয়েছে -

 

145

 

‘‘যে স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যান তিনি স্বামীকে গুরু পাপ থেকে উদ্ধার করেন। নারীর পক্ষে এর চেয়ে সাহস ও বীরত্বের কাজ আর কিছু নেই; এই সহমরণের ফলেই স্ত্রী স্বর্গে গিয়ে

পূর্ণ এক মন্বন্তর স্বামীর সঙ্গে সহবাস করতে পারেন। স্বামীর মৃত্যুর বহু পরেও একান্ত স্বামীগতচিত্ত হয়ে স্বামীর কোনো প্রিয় বস্তুর সঙ্গে এক অগ্নিতে প্রবেশ করে যে বিধবা

আত্মাহুতি দিতে পারেন, তিনিও পূর্বোক্তফল প্রাপ্ত হন।’’

বৃহদ্ধর্মপুরাণের এই উক্তি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, সতীদাহ ও সহমরণপ্রথা প্রাচীন বাঙলায়, অন্ততঃ আদিপর্বের শেষ দিকে ‘অজ্ঞাত’ ছিল না।

নারীদের ‘যৌনশুচিতা’ ও ‘সতীত্বের আদর্শ’ স্মৃতিকারেরা যথেষ্ট জোরের সঙ্গেই প্রচার করেছিলেন, সেই বিষয়ে গবেষকদের সন্দেহ নেই; ‘সমাজের মোটামুটি আদর্শ’ও সেটাই ছিল, এ

বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ কম। তা সত্বেও স্বীকার করতেই হয়, ‘বিত্তবান নাগর-সমাজে’ সেটার ‘ব্যতিক্রম’ও কম ছিল না। আর, পল্লীসমাজের যে স্তরে ‘ব্রাহ্মণ্য আদর্শ’ পুরাপুরি

স্বীকৃত ছিল না, ‘আদিম কৌমগত সামাজিক আদর্শ’ ছিল বলবত্তর, সে স্তরে ‘যৌনজীবনের আদর্শ’ই ছিল অন্য মাপের, রীতিনীতিও ছিল অন্যতর। রানা ‘হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য

সমাজাদর্শ’ দিয়ে সেটার বিচার চলতে পারে না। ‘হাড়ি’, ‘ডোম’, ‘নিষাদ’, ‘শবর’, ‘পুলিন্দ’, ‘চণ্ডাল’, প্রভৃতিদের ‘বিবাহ ও যৌনজীবনের রীতিনীতি ও আদর্শ’ কী ছিল, সেটা জানতে হলে সেগুলো

বর্তমানের ‘সাঁওতাল’, ‘কোল’, ‘হো’, ‘মুণ্ডা’ প্রভৃতি জাতির ভিতরে খুঁজতে হবে। তবে ‘ব্রাহ্মণ্য আদর্শ’ দিয়ে শাসিত সমাজেও ‘অনিচ্ছায় বলপূর্বক ধর্ষিতা নারী’ তখনকার দিনেও সমাজে

‘পতিতা বা সমাজচ্যুতা’ বলে গণ্য হতেন না; ‘বিধিবদ্ধ প্রায়শ্চিত্ত’ অনুষ্ঠানেই তাঁর ‘শুদ্ধি’ হয়ে যেত, এ সাক্ষ্য পাওয়া যায় ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’। হিন্দুসমাজের নিম্নতম স্তরে ‘বিধবা-

বিবাহ’ও একেবারে অপ্রচলিত ছিল না বলেই ঐতিহাসিকরা মনে করেন।

নগর-সমাজের উচ্চকোটি স্তরের নারীরা লেখাপড়া শিখতেন বলেই মনে হয়; ‘পবনদূত কাব্যে’ নারীদের ‘প্রেমপত্র’ রচনার ইঙ্গিত আছে। ‘নানা কলাবিদ্যায় নিপুণতা’ও তাঁদের অর্জন করতে

হত, বিশেষভাবে ‘নৃত্যগীতে’। ‘নট গাঙ্গে’ বা ‘গাঙ্গোকের পুত্রবধূ বিদ্যুৎপ্রভা’ সম্বন্ধে ‘সেক শুভোদয়া’য় যে সুন্দর গল্পটি আছে সেটাই এর সাক্ষ্য দেয়। ‘কবি জয়দেব পত্নী পদ্মাবতী’ও

‘নৃত্যগীতে’ সুদক্ষা ছিলেন।

‘বাৎস্যায়নের সাক্ষ্যে’ মনে হয়, প্রাচীন বাঙলার ‘রাজান্তঃপুরের মেয়েরা’ স্বাধীনভাবে চলাফেরায় খুব একটা অভ্যস্ত ছিলেন না; পর্দার আড়াল থেকে তাঁরা অপরিচিত পুরুষদের সঙ্গে

কথাবার্তা বলতেন। ‘অন্তঃপুরে অবগুণ্ঠনময়ী’র জীবনই সমাজের উচ্চকোটি স্তরে সাধারণ নিয়ম ছিল বলে মনে করবার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। ‘লক্ষ্মণসেনের মাধ্যইনগর লিপি’তে

রাজান্তঃপুরের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। ‘কেশবসেনের ইদিলপুর লিপি’তে আছে, ‘বল্লাল সেন’ তাঁর বিজিত শত্রুর ‘রাজলক্ষ্মী’কে জয় করে এনেছিলেন ‘পান্ধীতে’ বহন করে। মনে হয়,

সম্ভ্রান্ত মহিলারা পথে ঘাটে যাতায়াতকালে পথযাত্রীদের দৃষ্টি থেকে নিজেদের আড়াল করেই চলতেন। ‘কেশবসেন’ সুপুরুষ ছিলেন; তাঁর ‘ইদিলপুর লিপি’তে দেখা যায়, তিনি যখন রাজপথে বের

হতেন, ‘পৌরসীমন্তিনীরা’ সৌধশিখরে উঠে তাঁর রূপ নিরীক্ষণ করতেন। কিন্তু, ‘পবনদূতে’ ‘বিজয়পুরের মহিলাদের যে বর্ণনা’ পাওয়া যায় তাতে মনে হয়, তাঁদের ‘অবগুণ্ঠনের বালাই’ খুব বেশি

ছিলনা। রানা সম্ভ্রান্ত স্তরে যেটাই হোক, সমাজের যে স্তরে নারীদের, হাঠে-মাঠে-ঘাটে খেটে জীবিকা নির্বাহ করতে হত, নানা কাজে কর্মে শারীরিক শ্রম করতে হত তাঁদের

মধ্যে অবগুণ্ঠিত জীবনযাপনের কোনও সুযোগই ছিলনা প্রয়োজনও ছিল না, সে আদর্শের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধাও ছিল না। মধ্যবিত্ত কুলমহিলারা ‘অবগুণ্ঠন’ দিতেন; বস্তুত, ‘অবগুণ্ঠন’ ছিল

‘তাঁদের কুলমর্যাদা জ্ঞাপনের অন্যতম অভিজ্ঞান’। এই মধ্যবিত্ত কুলমহিলাদের জীবনচর্যার একটি সুন্দরছবি রেখে গিয়েছেন ‘কবি লক্ষ্মীধর’ -

‘‘শিরোযদবগুষ্ঠিতং সহজরূঢ়লজ্জানতং

গতং চ পরিমন্থরং চরণকোটিলগ্নে দৃশৌ৷

বচঃ পরিমিতং চ ষন্মধুরমন্দমন্দাক্ষরং

নিজং তদিয়মঙ্গনা বদতি নুনমুচ্চৈঃ কুলম্‌।।’’

‘অবগুণ্ঠিত শির স্বতঃই লজ্জানত’, ‘গমন মন্থর’, ‘দৃষ্টি পায়ে নিবদ্ধ’, ‘বাক্য পরিমিত’ এবং ‘মৃদুমধুর’ - এই সব দ্বারা এই মহিলা যেন উচ্চস্বরে নিজের ‘কুলমর্যাদা’ প্রকাশ করছেন।

বাঙলার ‘কবি উমাপতিধর’ বাঙালী নারীর সুন্দর একটা প্রাকৃত অথচ অনন্যসাধারণ ছবি এঁকে রেখে গিয়েছেন, এবং ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থে সেটা উদ্ধৃত হয়েছে। রানা একবসনা

পল্লীবাসিনী বাঙালী নারী বনের মধ্যে ঢুকেছেন ফুল আহরণের জন্য; একটু উঁচুতে নাগালের বাইরে গাছের ডালে ফুল ফুটে আছে, পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়া দাঁড়িয়ে বাহু উপরের দিকে তুলে

সুন্দরী ফুল পাড়ছেন; নাভিন্ধদ বসনমুক্ত, একদিকের স্তন প্রকাশিত। সুন্দর অনবদ্য কাব্যময়তায় উমাপতিধর ছবি এঁকেছিলেন এভাবে -

‘‘দুরোদঞ্চিত বাহুমূলবিলসচ্চীন প্রকাশ স্তনা -

ভোগব্যয়ত মধ্যলম্বিবসনানির্মুক্ত নাভিহ্রদা।

আকৃষ্ট্রোজ্ঝিত-পুষ্প মঞ্জরিরজঃ পাতাবরুদ্ধেক্ষনা

চিন্বত্যাঃ কুসুমং ধিনোতি সুদৃশঃ পাদাগ্র-দুস্থা তনুঃ।।’’

পুরানো কলকাতার প্রথম মাদ্রাসা’

রানা

ইংরেজরা কলকাতা শহরের পত্তনের কিছুদিনের মধ্যেই একটু গুছিয়ে বসবার সঙ্গে সঙ্গে এদেশীয়দের ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য চেষ্টা করতে শুরু

করেছিলেন। তখন কোম্পানির অফিস কাছারি আর আদালতে কাজের জন্য ইংরেজি শিক্ষা জানাটা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। তাই কলকাতার এখানে সেখানে তখন স্কুল গড়ে উঠতে

শুরু করেছিল।

ওই সময়ে কলকাতায় হিন্দু, মুসলমান ও খৃষ্টান জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। ১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার কিছু শিক্ষিত মুসলমান ব্যক্তি তৎকালীন গভর্নর জেনারেল

লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা ‘মজিদউদ্দীন’ নামের একজন পণ্ডিতের সন্ধান পেয়েছেন। সেই পণ্ডিতকে নিয়ে কলকাতায় একটা মাদ্রাসা বা স্কুল

গড়ে তুলতে পারলে কলকাতার মুসলমান ছাত্রেরা আইন শিখে সরকারকে কাজে সাহায্য করতে পারবেন। হেস্টিংস তাঁদের সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে মজিদউদ্দীনকে মুসলমানদের স্কুল চালাবার

দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই স্কুল বা মাদ্রাসা চালাবার জন্যে হেস্টিংস তখন মাসে ৬২৫ টাকা করে খরচ দিতেন। এর কিছুদিন পরে হেস্টিংস মাদ্রাসার বাড়ি তৈরির জন্য ৫,৬৪১ টাকা দিয়ে

বৈঠকখানার কাছে পদ্মপুকুরে একটা জমি কিনেছিলেন। ওই ভাবে সাতমাস ধরে নিজের টাকায় মাদ্রাসা চালাবার পরে হেস্টিংস কোম্পানির বোর্ডের কাছে ব্রিটিশ সরকারকে সেই মাদ্রাসা

চালাবার দায় দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরপরে বিলেতে হেস্টিংসের সেই প্রস্তাব জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সরাসরি সরকারী খরচে সেই মাদ্রাসা চালাবার ব্যবস্থা

এরও বছর খানেক পরে পাকাপাকি হয়েছিল। কোম্পানির পুরানো নথি থেকে জানা যায় যে, হেস্টিংস একবছর ধরে সেই মাদ্রাসা চালাবার খরচ খরচা বাবদ ১৫,২৫১ টাকা আর পদ্মপুকুরের

জমির দাম বাবদ ৫,৬৪১ টাকা তাঁকে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য বোর্ডের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

পুরানো কলকাতায় আগে যেখানে সেই মাদ্রাসার বাড়িটা ছিল সেই জায়গাটা অস্বাস্থ্যকর তো ছিলই, সাথে সেখানকার পরিবেশও ছাত্রদের জন্য উপযুক্ত ছিল না। তাই তখনকার দিনের

কলকাতার মুসলমান প্রধান অঞ্চল ‘কলিঙ্গা’তে (পরবর্তী সময়ের ওয়েলেসলি স্কোয়ার) নতুন মাদ্রাসার বাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ১৮২৪ সালের ২৪শে জুলাই

তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় সেই মাদ্রাসা স্থাপন প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল, “সংপ্রতি শুনা গেল ১৫ জুলাই বৃহস্পতিবার শহর কলিকাতাতে এক মহম্মদী মদরসা অর্থাৎ পাঠশালার

মূল প্রস্তর সংস্থাপন হইয়াছে।” সেই মাদ্রাসাই বর্তমানে কলকাতার বুকে ‘আলিয়া মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়’ নাম নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 

১৯২২ সালের দিকে ৪৫৮ মিলিয়ন মানুষ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। পৃথিবীর ২৫% ভূমি, যেখানে ব্রিটিশ শাসন বিরাজমান ছিল, যখন আমেরিকা ১৭৮৩ সালে

ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা পায়, তখন তাদেরও মনে হয় যে পুরো আমেরিকার একটি নির্দিষ্ট পরিচয় হওয়া দরকার- যেটা আমেরিকার প্রত্যেকটি রাজ্যকে

একত্রিত করে রাখবে। এতটাই প্রাধান্য যে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অনেক রাজ্য অন্য ভাষায় শিক্ষাদানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে ১৯২৩ সালের দিকে

মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এই নিষেধাজ্ঞাকে অবৈধ ঘোষণা করে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, যেখানে মিত্র দেশ (ব্রিটেন, আমেরিকা এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন)

শত্রু দেশ (ইতালি, জার্মানি এবং জাপান)-এর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে।

 

146

 

স্বভাবতই যে দল বা জোট যুদ্ধে জয় লাভ করবে, সেই জোটের সংস্কৃতি এবং ভাষা অন্য দেশের থেকে বেশি প্রভাব বিস্তার করে বিশ্বে। তাই, যেহেতু ব্রিটেন এবং

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বযুদ্ধে জয় লাভ করেছে, তাই তাদের ভাষা (ইংরেজি) পুরো বিশ্বে বিস্তার লাভ করে। এছাড়াও, আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর

মহাশক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়াও একটি কারণ ইংরেজির পুরো বিশ্বজুড়ে বিস্তারের পেছনে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদের সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্রীয়

ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, ফলে ইংরেজি একটি ব্যবসায়িক ভাষায় রূপান্তরিত হয়। অনেকেরই ধারণা যে যদি যুদ্ধে হিটলার বাহিনী জয়

লাভ করত, তাহলে হয়তো ইংরেজির জায়গায় জার্মান ভাষা পুরো বিশ্বে বিস্তার লাভ করত।বর্তমান বিশ্বে পুরো ইন্টারনেটের ৫৮.৬% কন্টেন্ট ইংরেজি ভাষায়

তৈরি।