সুনাগরিক সংঘ কি?
বাংলাদেশের প্রথম সমস্যা হচ্ছে - নৈতিকতার অভার এবং সুশিক্ষা আর অদক্ষতার সমস্যা। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের নৈতিকতা, বিনয়, রুচি, অভ্যাস, সামাজিক শিক্ষা, পরিবেশ সচেতনতা ইত্যাদি গুণের চরম অভাব তো আছেই; তার উপর তারা প্রশিক্ষণ নিতে চায় না; মনে করে এমনি এমনিতেই তার সবকিছু হয়ে যাবে। ফলে পেশাগত দক্ষতার অভাবে সে হা-হুকাস ও উদ্বিগ্নতার মধ্যে বিশৃঙ্খল জীবন যাপন করে। অর্থনৈতিক সমস্যায় তার জীবন সবসময় অস্থির ও ঝুঁকির মধ্যে থাকে এবং সে তার পরিবার, পরিবেশ এবং সমাজকেও ঝুঁকির মধ্যে রাখে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দরকার একটি সামাজিক পরিবর্তনের উদ্যোগ। যা সঠিকভাবে হতে পারে এক বা একাধীক সংগঠনের মাধ্যমে। ‘সুনাগরিক সংঘ’ হচ্ছে সেই আত্মউন্নয়নমূলক সংগঠন, যা বিশ্বমানের আদর্শিক, সুখী ও সমৃদ্ধশালী সুনাগরিক তৈরির লক্ষে কাজ করে।
সুনাগরিক সংঘের মূল উদ্দেশ্য কি?
মানুষের মধ্যে সভ্য আচার-আচরণ, বিজ্ঞানসম্মত জীবন-যাপন, রুচি, অভ্যাস, নৈতিকতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি মানবিক গুণাবলী চর্চার পাশাপাশি মেধা বিকাশ, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা ও স্কিল ডেভলপমেন্টের মাধ্যমে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও যোগ্য নের্তৃত্ব তৈরি করা। এই উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য সুনাগরিক সঙ্ঘ ২টি গ্রুপের সঙ্গে কাজ করে। একঃ শিক্ষার্থী (যারা স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে) দুইঃ যুব সমাজ (যারা ড্রপ আউট, বেকার, পেশাজীবী ও প্রবাসী)
সুনাগরিক সংঘ কিভাবে কাজ করে?
সুনাগরিক সংঘ অফলাইন এবং অনলাইন দুই মাধ্যমেই কাজ করে। অফলাইনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, অভিবাবক, ম্যানেজিং কমিটি বা স্থানীয় কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে "শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অন্যত্র" বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজ-এর আদব কায়দা , আচার- আচরণ,নৈতিকতা, রুচি ,অভ্যাস, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে" সুনাগরিক তৈরির লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এই কার্যাদি পরিচালনা করতে সুনাগরিক সংঘ ২ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে। ১) অনুদান ২) শিক্ষা সামগ্রী ও অন্যান্য বিক্রি। সুনানাগরিক সংঘের অনলাইন কার্যক্রম শীঘ্রই বড় পরিসরে চালু করা হবে।
সুনাগরিক সংঘ-এর অভিভাবক হিসাবে আপনি কিভাবে সম্পৃক্ত হবেন?
১৬৩১ সালে মমতাজ বেগমের স্মৃতিতে মোগল সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করেন। একই সময়ে, ১৬৩৬ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি। দুইটি স্থাপত্যই বিশ্ববিখ্যাত। তাজমহল বানাতে খরচ হয়েছে হাবার্ড-এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তাহলে প্রশ্ন জাগে: যারা তাজমহল বানাচ্ছিল, তারা কি হার্ভার্ড বানাতে পারতেন না? অথচ সেই যুগে বেশাইরভাগ মানুষ ছিল শিক্ষাহীন, চিকিৎসাহীন, দারিদ্র্যপীড়িত। হাবার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীকে বিজ্ঞানী , গবেষক, ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ারসহ লক্ষ লক্ষ সেরা পেশাজীবী দিয়েছে, অন্যদিকে তাজমহল দূর থেকে দেখা ছাড়া আর কিছুই দিতে পেরেছে কি?
শুধু তাজমহল নয়, ভারতবর্ষ জুড়ে আছে, অগণিত প্রাসাদ, উদ্যান,মন্দির, সমাধি আর সোনা-রুপা্, হিরা অলংকারের গল্প। এই সম্রাট, সুলতান আর ধনী জমিদাররা বাবু কালচার, হেরেম কালচার ছাড়া কিছুই দেয়নি দেশ ও জাতিকে। এখনো অন্যের জন্য বা সমাজের জন্য কিছু করার মানসিকতা আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি; সেটা রাষ্ট্রীয়ভাবে না, ব্যক্তিগত ভাবেও না। অথচ পশ্চিমে দৃশ্যটা একেবারে আলাদা। বিল গেটসসহ—বিশ্বের ধনীরা তাদের সম্পদ গরিব , অসহায় মানুষের উন্নয়নে বিলিয়ে দিতে পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন দাতব্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। আর আমরা ধনকুবের হলে—টাকা পাচার, গাড়ির বহর, দামী বাড়ী আর জীবনের শেষে মসজিদ, মন্দির গড়ি, সমাজসেবক তকমা্ পাওয়ার আশায়। তারপর মৃত্যুর পরেই শুরু হয় সম্পদের জন্য সন্তানদের মধ্যে মারামারি আর মামলা-মোকদ্দমা। এই গতানুগতিক ট্র্যাডিশন থেকে বেরিয়ে কিছু টাকা মানবতার কল্যাণে যারা ব্যয় করেন, তারা আমাদের সাথে শেয়ারিং করে স্বাধীনভাবে তা করতে পারেন।
সুনাগরিক সংঘের প্রধান নীতি কি?
সুনাগরিক সংঘের প্রধান নীতি হচ্ছে- আপনি মুষ্টিবদ্ধ হাত ততটুকু প্রসারিত করবেন, তা যেন অন্যের নাকে গিয়ে না লাগে অর্থাৎ আপনার প্রতিটি কথা, কাজ ও আচার-আচরণ যেন অন্য কাউকে আঘাত না করে, সেটা কঠোরভাবে চর্চা করা এবং আপনার চাহিদা বা প্রয়োজনের একটা সীমারেখা টেনে বিজ্ঞানসম্মত সভ্য জীবনধারা অনুসরণ করা। সর্বোপরি নতুন তথ্য ও জ্ঞান সংগ্রহ করে করে নিজেকে সমৃদ্ধ করা। সুনাগরিক সংঘের নৈতিক আদর্শ হচ্ছে-‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র’ অর্থাৎ ‘সবার কাছে সারা জীবনই আমি শিখব, সবার ভালোটা গ্রহণ কররো’। আর সুনাগরিক সংঘের ট্যাগ লাইন হচ্ছে -'সমৃদ্ধ হও আর আনন্দে বাচো'।
‘সুনাগরিক সংঘের লাইফস্ট্যাইল’ কিরকম?
আমরা মনে করি, যাপিত জীবনে সুখী হওয়া বা ভাল থাকার মূলমন্ত্রই হলো অঢেল সম্পত্তির অধিকারী হওয়া। সুতরাং বেশি আয় করতে আমরা সবাই খুব ব্যস্তময় জীবনযাপন করি এবং সার্বক্ষণিক চাপের মধ্যে থাকি। প্রতিনিয়ত এক কাজ থেকে অন্য কাজের মধ্যে ছুটে চলি, মনের মধ্যে অস্থিরতা, শূন্যতা, অসন্তুষ্টি নিয়ে। এই উন্মাদনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সুনাাগরিকরা এই’ লাইফস্ট্যাইল অনুসরণ করেন। এ লাইফস্ট্যাইলের মূল কথা হচ্ছে- আমার জীবন থেকে অতিরিক্ত চাহিদা কমিয়ে ফেলে, যেটা যেটা লাগবে ঠিক সেটা নিয়ে থাকা। জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে নিজের ভেতরে তৃপ্তি ও শান্তির সম্মিলন ঘটানো। প্রকৃতির অনুগামী হয়ে অল্পতে পরিপাটি জীবনযাপন করা। এক্সট্রা গেদারিং কমিয়ে এনে মনকে নির্দিষ্ট এক/দুইটি কাজে ফোকাস করা। নির্ধারিত ব্যাজেট-এর মধ্যে থেকে জীবনকে একদম প্যারামুক্ত, জঞ্জালমুক্ত রেখে ‘সময় এবং অর্থ’ বাঁচিয়ে ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন ও সমাজ জীবনে 'আনন্দে বাঁচো নীতি' অনুসরণ করে সুখ-শান্তিতে থাকার চেষ্টা এবং কিছু অর্থ ও সময়কে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য ব্যয় করা। এ ধরনের লাইফস্টাইলের অনুসরণকারীদের বলা হয় “সহজ মানুষ”। অর্থাৎ সুনাগরিকরা নিজেদেরকে ‘সহজ মানুষ’ হিসেবে পরিচয় দিবেন।
এক্সট্রা গেদারিং কমিয়ে নির্দিষ্ট কাজে ফোকাস করার একটা নিউরোলজিক্যাল ব্যাখ্যাও আছে। সেটা হচ্ছে: আমরা যদি অনেক বিষয় নিয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখি, তখন মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেয়া ও চিন্তা করার ক্ষমতা হ্রাস প্রাপ্ত হয় এবং অপ্রয়োজনীয় কাজে অধিক ফোকাস করার ফলে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে; ফলে সঠিক বিষয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হারায়। তাই সবকিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়টিতে ফোকাস করতে হবে।
‘সুনাগরিক সংঘ’ অনুসরণ করে উন্নত, সভ্য ও সুখী জীবন যাপনের বিজ্ঞানসম্মত লাইফস্ট্যাইল। পশ্চিমা বিশ্বের নতুন প্রজন্ম আজকাল ভোগবাদের স্থূল ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসেছে। বড় এপার্টমেন্ট বা দামি গাড়ি কিনে অযথা অর্থ লগ্নি করতে চাইছে না কেউ। একটা ছোট এপার্টমেন্টের প্লেসকে কিভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়; সে চেষ্টা করছে পশ্চিমা নতুন প্রজন্ম। গাড়ি না কিনে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা সাইকেলে যাতায়াতকেই যুক্তিসংগত মনে করছে তারা। যাদের কাজ অনলাইন নির্ভর; তারা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। আবার চাকরি থেকে অবসর নেয়া প্রজন্ম এখন গ্রামে বসবাসকেই বেছে নিচ্ছেন, শান্তিপূর্ণ ও পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনের জন্য। দামি গাড়ি আর বড় বাড়ির পেছনে অর্থ লগ্নি এবং সন্তানদের জন্য অর্থ সঞ্চয় করা, এসব ব্যাপারকেই জীবনের সাফল্য ও নিরাপত্তার সূচক বলে ধরে নেয়াকে নতুন প্রজন্ম ভুল চিন্তা বলেই চিহ্নিত করেছেন। তাদের ভাবনাটা এমন, অনাগত সন্তানকে ভালো শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের খানিকটা সুযোগ দিলেই যথেষ্ট; এরপর নিজের জীবন নিজেই গড়বে তারা।
এখন পশ্চিমারা সঞ্চিত অর্থ দিয়ে অসহায় মানুষের কল্যাণে যথাসাধ্য সাহায্য করে আর পৃথিবীর নানা জায়গায় ভ্রমণ করে। বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোতে বড় বাড়ি আর দামী গাড়ির গ্রাহক মূলত পৃথিবীর অনুন্নত এলাকা থেকে আসা অভিবাসীরা। তারা এখনো সেই অতীতের লাইফ-স্টাইল স¤পদ অর্জনের পিছেই দৌড়াচ্ছে। ‘অন্যকে ঠকিয়ে স¤পদ বাড়ানো এবং নিজের শুক্রকিটের জন্য সঞ্চয় করে মৌচাক তৈরি করা’ এর বাইরে কিছুই ভাবতে পারে না তারা। চিন্তাটা এমন, অর্জিত স¤পদ ভোগ করার জন্য তারা আবার করব থেকে উঠে আসবেন। আর স¤পদ যার জন্য রেখে যাবে, কষ্ট করে অর্জন না করলে সে কিন্তু মানুষ নয়, পশু হয়ে গড়ে উঠবে। কারণ সুসময় ও আরামদায়ক পরিবেশ (কম্পোট জোন) অলস ও দুর্বল মানুষের জন্ম দেয়, আর দুর্বল মানুষ দুঃসময় তৈরি করে। তাই উন্নত বিশ্বে ছেলেমেয়েরা সাবালক হলেই বাড়ির বাইরে গিয়ে পারটাইম জব করে নিজেদের থাকা-খাওয়া-চলার ব্যবস্থা করে। সেখানে সাবালক ছেলেমেয়ে স্বাবলম্বী না হলে সবাই তাকে করুণার চোখে দেখে; প্রতিবন্ধী ভেবে নেয়। কাজেই সহজ যুবকেরা অর্থ-বিত্ত, বংশ মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা পরিহার করে চোখের সামনে যা কিছু সেচ্ছাসেবা করার মত আছে, তা করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পার্টটাইম জব কিংবা অন্যান্য কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা চালাবেন।
আমাদের জীবন তো একটাই, এই এক জীবনে গৎবাধা ছাপোষা কলুর বলদ হয়ে কাটানোর কোনো মানে নাই। অড়েল টাকা পয়সা এবং স¤পত্তির মালিক হওয়াটা জীবনের সফলতা ও সার্থকতা নয়। দরকার হলো প্রতিটি মুহুর্তটিকে আনন্দের সাথে কাটানো, সকল প্যারামুক্ত হয়ে আত্মসন্তুষ্টি লাভ এবং নিজের ইচ্ছামতো চলা। এখানে একটা কথা জেনে রাখা দরকার, কোনো মানুষ জীবনের ২৪ ঘন্টা সুখে থাকতে পারে না। ১২ ঘন্টা দিন ১২ ঘন্টা রাত। অর্থাৎ সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতা, হতাশা, অপ্রাপ্তি, অসন্তুষ্টি এইসব জীবনেরই অংশ। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই ‘দিনের পর রাত’ আসবে, আর ‘রাত যত গভীর হবে, সকাল তত কাছাকাছি আসবে’। সুতরাং সফলতা-ব্যর্থতা ভালো-মন্দকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে প্রতিটি দিন এবং মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে 'আনন্দে বাঁচো' নীতি অনুসরণ করে সুনাগরিক সংঘ।
সুনাগরিক সংঘ কোন্ মডেল অনুসরণ করে?
সুনাগরিকরা তার দিনের ২৪ ঘন্টাকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেন। ৮ঘণ্টা নিজের কাজের জন্য, ৮ ঘন্টা তথ্য, জ্ঞান আর বিনোদনের জন্য এবং বাকি ৮ ঘন্টা বিশ্রামের জন্য। সুনাগরিকরা সারাক্ষণ মস্তিষ্ক বা দেহকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখবেন না, কিছুটা সময় একা থাকবেন এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করবেন। তেমনিভাবে নিজের আয়কেও তিন ভাগে ভাগ করবেন। প্রথম ভাগ রাখবেন নিজের জীবন-জীবিকা পরিচালনার জন্য। দ্বিতীয় ভাগ রাখবেন ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য, আর তৃতীয় ভাগটি রাখবেন অসহায় মানুষের পাশে থাকার জন্য। এই ভাগগুলি ছোট বড় বা সমান যে-কোনো রকম হতে পারে। ‘একজন 'সুনাগরিক' এই মডেল কতটুকু অনুসরণ করবেন কিংবা বাড়তি আরো কি কি যোগ করলে 'নিজে আরো বেশি সুখি ও সমৃদ্ধ' হবেন, সেটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার এবং সে সেটা করতে পারেন।
সুনাগরিক সংঘের -”আনন্দে বাচো” নীতি কিরকম?
বারো মাসে তের পার্বন। অর্থাৎ বারো মাসে যতটা সম্ভব উৎসব বাড়াতে হবে, উপলক্ষ তৈরি করতে হবে। পেঁচার মত মুখ করে বসে না থেকে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ফোক, লালন, জারি সারি গানের আসর থেকে শুরু করে বিদেশি ব্যান্ড-নাচ-গান-পানাহার-হৈ হুল্লোড়, পুঁথি পাঠ, কবিতা পাঠ, যাত্রাপালা, নববর্ষ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস, বন্ধু দিবস, বর্ষা বরণ, নবান্ন উৎসব, পৌষ মেলা, পহেলা ফালগুন, নৌকা বাইচ, বাউল উৎসব, পিঠা উৎসব, ঘুড়ি উৎসব, ভাই ফোঁটা, রাখি বন্ধন, ডিজে পার্টি, ব্রেন্ড পার্টি, ফ্যামিলি পার্টি, পিকনিক পার্টি, ক্লাব পার্টিসহ দেশি-বিদেশি শত শত আনন্দ উদযাপনের উপলক্ষ্য আছে, তা ঘরোয়াভাবে বা ছোট-বড় পরিসরে উদযাপন করতে হবে। সুনাগরিকতা চর্চার সূত্র একটাই, পৃথিবীর যা কিছু ভালো ও আনন্দময়, তা সবই আমার। নজরুল আমার, রবীন্দ্রনাথ আমার, লালনও আমার, জল আমার, পানিও আমার। বহুত্ববাদী সমাজের এই 'আনন্দে বাচো' নীতিতে চলতে গিয়ে 'অন্য কেউ যদি আপনার অপছন্দের কোনো বিষয়ে আয়োজন করে কিংবা আপনার কাজে বাধা দেয়, তা মেনে নিতে বা ম্যানেজ করতে নিতে হবে অর্থাৎ আপনার এবং অন্যের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি আয়োজন/কাজ করতে হবে। কারণ মানুষ মূলত স্বার্থের প্রাণি। টিকা দেখুন-
টিকাঃ রিচার্ড ডকিন্স তার "গড ডিল্যুশন" বইতে বলেছিলেন, মানুষের শরীরে থাকা ডিএনএ, পরিবার-সমাজ-দেশ অথবা বিদেশ চেনে না। মানুষের ডিএনএ তে আছে সেলফিশ কিছু জিন। একটি ভাইরাস যেমন জীবদেহ দখল করে তাকে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কাজ করে, মানুষের ডিএনএও তেমনি। এটি তার নিজের জিন সুরক্ষার স্বার্থে আমাদের দেহকে ব্যবহার করে। রেডব্যাক স্ত্রী মাকড়সা বা ম্যান্টিস নামে একটি পোকা আছে, যারা মিটিং-এর পর তার পুরুষটিকে খেয়ে ফেলে। এক ধরনের অক্টোপাস আছে; যারা নিজের ডিম ৬ মাস পর্যন্ত পাহারা দিতে গিয়ে অনাহারে মারা যায়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এইসব প্রাণি কেনো ঝুঁকি নেয়? কারণ তার কোনো স্বাধীন ইচ্ছা নেই, সে হলো তার শরীরের মধ্যে থাকা সেলফিশ জিনের একটি বাহক মাত্র। নিজেকে পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করার উদ্দেশ্যে সে চালিত। নোয়াহ হারারি বলেছেন, নর-নারীর প্রেম বা দেশপ্রেম একটি ফিকশন মাত্র। এর উদ্দেশ্য মায়া-মহব্বত বা দেশ নয়, নিজের পরবর্তী জেনারেশনকে রক্ষা করা। আমাদের দেহের মধ্যে এই সেলফিশ জিন আছে বলেই আমরা প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থের প্রশ্নে আপোষহীন। আপনি যদি আমার স্বার্থে আঘাত করেন, তবে আমি বিদ্রোহী হব। এটা আমার অস্তিত্বের লড়াই। এই কারণে আমরা একইসাথে দেশপ্রেমী এবং একইসাথে দেশদ্রোহী। আসলে আমরা সবাই সেলফিশ জিন চালিত এক একজন হিংস্র শিকারী। (শেষ)
সুনাগরিক সংঘ কোন্ ধর্ম প্রচার করে?
‘সুনাগরিক সংঘ’ কোনো ধর্মকে প্রমোট করে না। ‘সুনাগরিক সংঘ’ সকল ধর্মের ইতিবাচক ও উদারতার দিকগুলি মনে ধারণ করতে উৎসাহ প্রদান করে এবং ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও উগ্রপন্থা পরিহারের পরামর্শ দেয়। কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস-এর পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত তুলে ধরা বা যুক্তি-তর্ক করা কিংবা কোনো ধর্মীয় আচরণ পালন বা রারণ করতে অনুপ্রাণিত কিংবা বাধ্য করা ‘‘সুনাগরিক লাইফস্ট্যাইল’-এর পরিপন্থী। কে কোন্ পোশাক পড়বে, কি খাবে, কি বিশ্বাস করবে; এটা ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব ব্যাপার। সুনাগরিকদের কাছে মনুষ্যত্ব, মানবতা সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। সুনাগরিকরা সকল নারী-পুরুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী।
নারী ও পুরুষের সম্পর্কের বিষয়ে সুনাগরিক সংঘের নীতি কি?
প্রথমে বলে রাখি, সুনাগরিকরা কে কিরকম সম্পর্ককে সার্পোট কররে, এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। এর কোনো জবাবদিহিতা কারো কাছে বা সংঘের কাছে দিতে সে বাধ্য নন। তবে সুনাগরিক সংঘ মনে করে, নারী-পুরুষ এক জাতি হলেও নারী প্রজাতিগতভাবে আলাদা। পুরুষের কামনা-বাসনা হয় মূলত ‘টেস্টোস্টেরণ’ হরমোনের প্রভাবে। পুরুষের এই হরমোন তৈরির আলাদা একটি অঙ্গই আছে, যা হল অন্ডকোষ। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এমন কোনো অঙ্গ না থাকলেও নারীদের শরীরেও সামান্য পরিমাণ টেস্টোস্টেরন তৈরি হয়। নারীর কামনা-বাসনা আসে তাদের এড্রেনাল কর্টেক্স নিঃসৃত এন্ড্রোজেন হরমোনের কারণে। এজন্য নারীকে কামনা-বাসনার জন্য তাকে জাগাতে হয় বা জাগতে হয়, আর অন্যদিকে পুরুষ সদা জাগ্রত এবং আগ্রাসী। বলা যায় পুরুষ জলন্ত আগুন আর নারী ছাই চাপা আগুন। আরো সহজভাবে বলতে গেলে, পুরুষের অন্ডকোষে প্রতিদিন মিলিয়ন মিলিয়ন শুক্রাণুু তৈরি হয়। এই শুক্রাণুগুলো বের হওয়ার জন্য বা পৃথিবীতে জায়গা করে নেওয়ার জন্য পুরুষকে প্রচন্ড প্রেসার তৈরি করে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাধ্যমে। ফলে স্থান আর সুযোগ পেলে পুরুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধা যে কেউকে আক্রমণ করতে বা শিকার বানাতে পারে। তবে প্রত্যেক ব্যক্তির কামনা-বাসনা ব্যক্তিভেদে তারতম্য হয়। কামনা-বাসনা একটি জটিল বিষয়, যার মূলে শারীরিক-মানসিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অনেকগুলো ফ্যাক্টর একত্রে কাজ করে। ‘সুনাগরিকরা’ নারী-পুরুষ দুই জনের এই বিপরীতধর্মী চাওয়াকে সন্মান করে এবং সম্পর্কে অনিবার্য বিপর্যয় এড়াতে 'একে অপরের পরিপূরক' হয়ে পথ চলতে অনুপ্রাণিত করে।
গবেষকরা বলেছেন, প্রেমের স্থায়িত্ সীমিত। আজকে যাকে না পেলে বাঁচবো না বলে মনে হচ্ছে, ২/৩ বছর না ঘুরতেই মনে হতে পারে যে, তাকে না ছাড়লে বাঁচবো না। এর পেছনে আছে ডোপামাইন নামে এক নিউরো ট্রান্সমিটারের ভূমিকা। এই ডোপামাইন-এর প্রভাবে মনে সৃষ্টি হয় বাঁধভাঙা আনন্দ, অসাধারণ প্রাণশক্তি, গভীর মনোযোগ ও সীমাহীন অনুপ্রেরণা। কিন্তু এ তীব্র আবেগ খুব বেশি সময় ধরে থাকে না। সর্বউর্ধ্ব তিন বছরের পর থেকে শরীরের ডোপামাইন উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। ঘোলাটে হয়ে যায় আবেগের রঙিন চশমা। ফলে নতুনভাবে ডোপামাইন তৈরি করতে মানুষ আবার অন্য কাউকে খোঁজে, অন্য কারো প্রেমে পড়ে। এভাবেই চলতে থাকে প্রেমের সার্কেল।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৫ বছরের গবেষণার ফলাফল হলো, সুখ আপনি ক্যারিয়ার, সফলতা বা অর্থসম্পদের মধ্যে খুঁজে পাবেন না, বরং সুখে থাকার জন্য আমাদের দরকার হয় ‘সঠিক মানুষ’। আমাদের দরকার চারপাশে ‘সামাজিক সুস্থতা’ তৈরি করা। প্রিয়জনের সঙ্গে ঠুনকো ঝগড়া হলে যখন আপনি রাতে ঘুমাতে পারেন না, তখন বুঝবেন, সমস্যাটা আপনার ঘুমে নয়; সমস্যাটা আপনার সম্পর্কে। সুখ আভ্যন্তরীণ শান্তি অর্থাৎ ‘ডোপামিন হরমোনের’ উপর নির্ভরশীল। এই হরমোন ধরে রাখার উপায় হচ্ছে-‘পরিবর্তন’। অর্থাৎ নতুনভাবে কিছু করতে পারলে ডোপামিনের মাত্রা বাড়ে। কারণ মস্তিষ্ক নতুনত্ব পছন্দ করে। তাই সম্পূর্ণ নতুন কোনো দক্ষতা অর্জনের চেষ্টাও করুন। যা কিছু মস্তিষ্ককে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে, তাতেই তৈরি হবে টাটকা ডোপামিন। ভুল ও টক্সিক মানুষকে দূর করে সঠিক মানুষদের নিজের আশপাশে রাখা এবং সম্পর্ক মজবুত রাখার মাধ্যমে সামাজিকভাবে সুস্থ থাকার লাইফ স্ট্যাইল হচ্ছে চর্চা করে সুনাগরিকরা।
সম্মতি সাপেক্ষে যে-কোন সুস্থ সম্পর্কের পক্ষে ‘সুনাগরিক সংঘ’। এটি প্রতিটি মানুষের মনোদৈহিক এবং শারীরিক উৎকর্ষতা তৈরি করে। কিন্তু অসম্মতিতে স্বামী-স্ত্রীর দম্পত্যময় সম্পর্ককেও অনৈতিক এবং অপরাধ মনে করে ‘সুনাগরিক সংঘ’। ‘সুনাগরিকরা’ বিশ্বাস করেন যে, নারী-পুরুষের সকল সুখ-শান্তির পূর্ব শর্ত হচ্ছে তার স্বাধীনতা। সেটা যেমন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, তেমনি সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতা। সুতরাং নারীকে বা সন্তানকে কড়া অযৌক্তিক শাসন, মিথ্যা অপবাদ-সন্দেহ-অবিশ্বাসের শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার বিপরীতে তাকে উৎসাহ প্রদান করে তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে, তাকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে, সুন্দর পরিবার এবং আগামীর সমৃদ্ধ প্রজন্মের জন্য। স্বামী-স্ত্রী-সন্তান প্রত্যেকে যাতে আলাদা মানুষ হিসেবে পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যে সন্মানের সাথে সুখে বসবাস করতে পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরাধীনতা মানে কারাগার। আপনি স্বাধীনভাবে ঘরে শুয়ে-বসে যতদিন ইচ্ছা একাকী বসবাস করতে পারবেন, কোনো রকম সমস্যা হবে না, কিন্তু ঐ ঘরে যদি বাইরে থেকে কেউ তালা লাগিয়ে দেয়, তাহলে প্রতিটি মুহুর্ত মনে হবে অসহনীয় । তেমনিভাবে আপনার আপনজন বা অন্য কাউকে যখন আপনি নিয়ন্ত্রিত করেন, শর্ত আরোপ করেন বা আপনার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন, তখন সে পরাধীন হয়ে যায়। ফলে তার কর্মক্ষমতা, সৃজনশীলতা, আনন্দ, উৎসাহ, সৌন্দর্য সব হারিয়ে যায়। সর্বদা মনে রাখতে হবে, খোলা জায়গার বাতাশ মুক্ত-স্বাধীন বলেই নির্মল, কয়েকদিন ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখেন, বাজে গন্ধে বসতে পারবেন না। তেমনিভাবে নাদী বা সাগরের পানি চলমান বলেই পরিষ্কার, স্বচ্ছ। অন্যদিকে পুকুরের পানি আবদ্ধ বলেই দূষিত ও দুর্গন্ধময়।
শিশুসুরক্ষা ও লালন-পালনে ‘সুনাগরিক সংঘ’-এর নীতি কি?
কথায় আছে, সন্তানেরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় বাবা-মা এর কাছ থেকে। বাবা-মা যখন সন্তানের জন্য অতিরিক্ত ভালো চাইতে শুরু করেন, বিপত্তি ঘটে তখনই। একে ওভার প্যারেন্টিং বলে। আমরা নিজেদের জীবনের না পাওয়া বিষয়গুলো সন্তানের প্রাপ্তীর খাতায় যোগ করতে গিয়ে মনের অজান্তেই সন্তানের উপর কত ধরনের যে চাপ প্রয়োগ করি, তার ইয়ত্তা নেই। অনেকে অমুক-তমুকের সন্তানের সাফল্য দেখে বারবারই নিজের সন্তানকে হেয় করতে থাকেন। এ ধরনের তুলনা সন্তানের আত্মবিশ্বাসকে গুঁড়িয়ে দেয়, যার পরিণতি খুবই ভয়ংকর।
যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেটের স্কুলশিক্ষক ‘জেন এলিয়ট’ তার ছাত্র-ছাত্রীদের বর্ণবাদ, বৈষম্য, এই ব্যাপারগুলো বোঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তা কিছুতেই ফলপ্রসূ হচ্ছিলো না। শহরের শিক্ষার্থীরা মফস্বল শিক্ষার্থীদের এবং শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীরা কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের অবজ্ঞার চোখেই দেখে যাচ্ছিল। এলিয়ট তার শিক্ষার্থীদের উপর দুইমাসব্যাপী একটি এক্সপেরিমেন্ট চালালেন। প্রথমে তিনি তার ক্লাসের ২৬৮ছাত্র-ছাত্রীকে দুটি গ্রুপে ভাগ করলেন। প্রথম গ্রুপে রাখলেন যাদের চোখের রং নীল এবং দ্বিতীয় প্রুপে রাখলেন যাদের চোখের রং বাদামী।
তিনি প্রথম গ্রুপ অর্থাৎ যাদের চোখের রঙ নীল তাদেরকে বাদামী চোখের শিক্ষার্থীদের চেয়ে উঁচু মর্যাদার বলে ধরে নিলেন এবং বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যদের কোণঠাসা করার জন্য তিনি তাদের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি সবার সামনে বর্ণনা করতে লাগলেন।
এর ফলাফল হলো খুবই চমকপ্রদ। প্রথম গ্রুপের শিক্ষার্থীরা অর্থাৎ যারা নিজেদেরকে সুপিরিয়র ভাবছে, তাদের আচরণ খুব গ্রুপের পরিবর্তিত হতে লাগল। তারা ক্লাসে এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগী এবং ক্লাস টেস্টেও তারা দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যদের চেয়ে অনেক ভাল করলো। অন্যদিকে দ্বিতীয় গ্রুপের শিক্ষার্থীরা হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকলো এবং পিছিয়ে পড়তে লাগল।
পরের মাসে ‘এলিয়ট’ গ্রুপ ঠিক রেখে একই এক্সপেরিমেন্ট চালালেন। কিন্তু এবার যাদের চোখের রঙ বাদামী তাদেরকে নীল চোখের শিক্ষার্থীদের চেয়ে সুপিরিয়র হিসেবে ধরে নিয়ে অনুপ্রেরণা দিতে লাগলেন। তখন ফলাফলও উল্টে গেল। অর্থাৎ নীল চোখ যাদের তারা সবকিছুতে পিছিয়ে পড়তে লাগল।
এই এক্সপেরিমেন্টটির মাধ্যমে আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে, সমাজে যারা অবহেলিত তারা কেন পিছিয়ে পড়ে এবং নানা অপরাধের সাথে যুক্ত হয়। আর যারা সুপার পাওয়ার হয়, তারা কিসের জোরে দুনিয়াটা শাসন করে। পরিবারে বা সমাজে যদি কাউকে সমালোচনা বা অবহেলা কিংবা দমিয়ে রাখা হয়, তাহলে তার পক্ষে পাওয়ার হিসাবে গড়ে উঠা খুবই কঠিন, পক্ষান্তরে যদি কাউকে প্রশংসা ও উৎসাহিত করা হয়, তাহলে তাকে অনেকদূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই সম্ভাবনাময়, শুধু দরকার তার ভিতরের ঘুমন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। নিজের পরিবার, সন্তান বা কর্মচারী কিংবা অন্য কেউ থাকলে , সর্বদা তাদেরকে প্রশংসা ও উৎসাহের মধ্যে রাখুন, দেখবেন সে সত্যিই জ্বলে উঠবে এবং তার কারণে আপনি বেশি সুখী হবেন। আর সন্তানকে কড়া শাসনে রাখার ফল ভালো হওয়ার বদলে উল্টো বখাটে হয়ে যায়।
আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রাহ্মণ এবং শিখ বংশোদ্ভূত লোকেরাই সবক্ষেত্রে অন্যান্যদের কর্তাবাবু হবার কারণ আর্যদের জাতভেদ প্রথা। তারা পারিবারিকভাবে বংশ পরম্পরায় সন্তানদের বুঝিয়েছেন, তুমি উচু জাতের, তোমার জন্ম হয়েছে নেতা বা কর্তা হবার জন্য। ফলাফল সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক থেকে শুরু করে সব বড় পদে তারাই। এ্যাডওয়ার্ড সাইদ তার 'ওরিয়েন্টালিজম'-এ দেখিয়েছেন, পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী তৎপরতার পিছনে আছে এশিয়া-আফ্রিকাকে হেয় করার অপচেষ্টার সংস্কৃতি।
আধুনিক সমাজে নিউক্লিয়ার পরিবারে বেড়ে উঠছে সন্তানেরা। এতে সন্তানকে ঝুট-ঝামেলামুক্ত জীবন দিতে চান অনেক বাবা মা-ই। অতি আরাম-আহ্লাদ, ফুলের টোকাটি গায়ে না যেন লাগে সেভাবে সন্তানকে বড় করতে চান। কিন্তু বাইরের কঠিন পৃথিবীর সঙ্গে লড়াইটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত সন্তানকে একাই লড়তে হয়। তাই অল্পতে তুষ্ট থাকা, সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত থাকার চেষ্টা, নিজের শখগুলোর যতœ নেওয়া, মানুষের বিপদে এগিয়ে যাওয়া, অন্যের সংগে শেয়ারিং করে খাওয়ার শিক্ষা পরিবার থেকেই শুরু হওয়া প্রয়োজন। নয়তো দেখবেন সে আপনার শেষ জীবনে আপনাকেও ফেলে খাবে। কাজেই কেবল সস্তানের ভালো ছাত্র হওয়ার পেছনে না দৌড়িয়ে ভালো মানুষ হওয়ার চর্চা জারি রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের প্রথম বিদ্যালয় হচ্ছে পরিবার। পরিবারে আমরা যে আচরণ করব, আমাদের সন্তানরা সেটাই শিখবে। শিশুর প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে '‘সুনাগরিক সংঘ’-এর নির্দেশনা হল: যে-কোনো শিশু দেখলে তার সঙ্গে কৌশল বিনিময় করা; তাকে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করা। অন্যের নির্মম আচরণ ও মানবেতর জীবন থেকে শিশু সুরক্ষায় কাজ করা।
টিনেজ লাইফ নিয়ে ‘সুনাগরিক সংঘ’-এর মতামত কেমন?
শিশু ১২ বছর বয়স পর্যন্ত পিতা-মাতা ও অভিভাবকের দায়িত্বে থাকবেন। কিশোর-কিশোরী ১৩ থেকে ১৯ বছর নিজ দায়িত্বে পরিচালিত হতে বাবা-মা সহযোগিতা করবেন। অন্যদের সাথে দায়িত্বশীল আচরণ থেকে কেনা-কাটা পর্যন্ত প্রায় সকল কিছু পরিচালনায় বাবা-মা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবেন। এই সময় সন্তানের সাথে বাবা মার বন্ধুত্ব থাকবে সবচেয়ে বেশি। সন্তানকে প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা দেবার পাশাপাশি নতুন নতুন ভাল বন্ধু নির্বাচন, সামাজিক ও স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক ক্লাব, সংঘ, এনজিও-তে অংশগ্রহন, বিনয়, ভাল আচরণ ও দায়িত্বশীলতা চর্চা করতে অনুপ্রেরণা ও পর্যবেক্ষণ করবেন বাবা-মা।
যুব সমাজ নিয়ে ‘সুনাগরিক সংঘ’-এর ভাবনা কি?
‘‘সুনাগরিক সংঘ’-এর লাইফস্টাইলে’ ১৯ বছর পার হলেই সন্তানকে আত্মনির্ভরশীল অর্থাৎ “নিজে ইনকাম করে পড়তে হবে, খেতে হবে” নীতি প্রয়োগের পরামর্শ দেয়া হয়। বাবা মায়ের অগাধ-সম্পত্তি আছে জানলে সন্তান কম্পোট জোন থেকে বের হবে না। তাকে জানাতে হবে, এই বয়সে পরিবারে বসবাস করতে হলে তাকে কোনো টিউশনি বা পার্ট টাইম জব করে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে থাকতে হবে। বাবা-মাকে ছা-পোষা বাঙালি না হয়ে সন্তানদেরকে বেশি বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে, যাতে তারা যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। তরুণ তরুণীরা উচ্চ শিক্ষা বা ক্যারিয়ার তৈরিতে পরিবারের প্রয়োজনীয় সহায়তা ও পরামর্শ দিতে পারেন কিন্তু আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজের জীবন পরিচালনা করার ক্ষেত্রে যে কোনো রকম আপোষ করার বিপক্ষে ‘সুনাগরিক সংঘ’ ।
যে ভাবেই হোক সন্তানকে কমফোর্ট জোন থেকে বের করতে হবে। একটি জাপানী প্রবাদ আছে- আপনি যদি আপনার আরামের অঞ্চল থেকে বেরিয়ে না যান, তবে আপনি সবসময় একই জায়গায় আটকে থাকবেন। এ নিয়ে আমেরিকায় একটি জনপ্রিয় গল্প আছে: একবার একটি এরোপ্লেন তার পাশে থাকা একটি রকেটকে জিজ্ঞাসা করল- রকেট ভাই, তুমি এত দ্রুত গতিতে কিভাবে উড়ে যাও বলতো? তখন রকেট উত্তর দেয় যে, আমার মত পাছায় আগুন ধরিয়ে দিলে তুমিও আমার মত দ্রুত যেতে পারবে। অর্থাৎ চাপে ও তাপে সবকিছুর অবস্থান পরিবর্তন হয়। লক্ষ কোটি বছরের চাপে ডায়মন্ড বা গোল্ড তৈরি হয়। জীবনে যে যত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে, সে তত সফল মানুষ। আর চ্যালেঞ্জ বাদ দিয়ে যে বা যারা কমফোর্ট জোনে পড়ে থাকে; তারা সব দিক থেকে ব্যর্থ মানুষ।
সাধারণত মানুষ আটে (৮) আটকায়। অর্থাৎ সে যা কিছু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-অফিস, বিয়ে সাদি সবকিছু ৮ কিলোমিটার জায়গার মধ্যেই করে। যারা এই ৮কে অতিক্রম করতে পারে, তারাই নেতা হন। আরাম অঞ্চল বা কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসা এমন একটি যাত্রা, যার জন্য সাহস, দৃঢ়তা এবং পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন জরুরি হয়ে পড়ে। এটা শুধু যুবক-যুবতীদের জন্য নয়, সব বয়সী নারী-পুরুষের জন্য প্রযোজ্য। দেখবেন, চাকরির প্রয়োজনে যারা এক স্থান থেকে অন্য স্থনে রদলি হন পরিবার নিয়ে, তাদের সন্তানরা সফলতা বেশি পায়। অর্থাৎ আটকাবেন না, পরিবর্তন করে চলতে হবে।
ক্যারিয়ার নিয়ে ‘সুনাগরিক সংঘ’ -এর মতামত কি?
‘সুনাগরিক সংঘ’ মনে করে, সুখ ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখা বড় ভুল। অসংখ্য মানুষ ভাবে "আমার এই ব্যাপারটা বা এই সমস্যাটা যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে"। কিন্তু এটা একটা ঘোর (ডিলুশন)। যখন "ওই একটা জিনিস" ঠিক হবে, তখন "আরো একটা জিনিস” আপনার জীবনে বাকি থেকে যাবে। জীবনে কখনো সবকিছু একসাথে আপনার কাছে ধরা দিবে না। এই মুহূর্তে আপনার যা আছে তা নিয়ে বর্তমানকে উপভোগ করতে হবে এবং একই সাথে ভবিষ্যতের জন্যে কাজ করে যেতে হবে। সাফল্য আসলে একটা ভ্রমণ, গন্তব্য নয়! কোনো বড় কিছুর জন্যে কাজ করলেও কাজটি শেষ হওয়া পর্যন্ত সুখী হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন না, কাজ করতে করতেই সুখী হওয়ার চেষ্টা করুন।
মনে রাখবেন, আরো বেশি টাকা কখনোই আপনার সব সমস্যার সমাধান করবে না। আপনার দামী বাড়ি বা ফ্ল্যাট এবং ঘরের দামী ফার্নিচার থাকার কারণে আপনি অযথাই অহংকার নামক রোগে ভোগবেন, এবং আপনি অন্য জায়গায় সহজে চলে যেতেও পারবেন না এবং এ রকম আরো দামী জিনিস পাওয়ার জন্যে আপনাকে সবসময় অনেক বেশি উপার্জন করা নিয়ে চিন্তা করতে হবে, নয়তো অনৈতিকতার আশ্রয় নিতে হবে। অথচ এইসব দামী সম্পদ আপনার জীবনকে সমৃদ্ধ করে না। যতো বেশি জিসিপত্র বেশি থাকবে, তত বেশি প্যারা তৈরি হবে, তত ভোগাবে।
মিডল এইজ ক্রাইসিস নিয়ে ‘সুনাগরিক সংঘ’-এর অভিমত কি?
বয়স যতই প্রৌঢ়ত্বের দিকে ঢলে, ততই শুরু হয় মানিয়ে নিতে না পারার কষ্ট, পিছিয়ে পড়ার ভয়। এই সময়ে শরীরে যৌন হরমোন কমতে থাকে, ফলে কেউ কথায় কথায় রেগে যান, কেউ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মনস্তত্ত্বের পরিভাষায় এইসব সমস্যাই হল মিডলাইফ ক্রাইসিস। সাধারণত ৪৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এ মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট ঘটতে পারে ।
মধ্যবয়সী এই জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে তিনটি কারণে। এক, তার স্বচ্ছলতার অভাব। মানে, প্রয়োজনের তূলনায় তার আয় বা সম্পদ কম থাকা। দ্বিতীয়ত, মনে হতাশা। জীবনে কী চেয়েছিলাম আর কী পেলাম, এই হিসেব মেলাতে মেলাতে হতাশা ঘিরে ধরে এবং তৃতীয়ত, নিত্যদিনের সাংসারিক ঝগড়া-ঝাটি কিংবা সন্দেহপ্রবণ অথবা অবিশ্বস্ত স্বামী বা স্ত্রী অথবা অবাধ্য অযোগ্য সন্তান ইত্যাদি। মানসিক একাকিত্ব কাটাতে কেউ একের পর এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, কেউ সাজগোজ, কেনাকাটা বা পার্টি করার পরিমাণ অত্যন্ত বাড়িয়ে দেন। ‘সুনাগরিক সংঘ’ এই ক্রাইসিসের সময় আপনাকে বন্ধু পরিবেষ্টিত থাকতে পরামর্শ দেয়।
সফল বার্ধক্য কিভাবে উপভোগ করে ‘সুনাগরিক সংঘ’?
সফল বার্ধক্য মানে সুন্দর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা, ইতিবাচক মনোভাব থাকা, অর্থপূর্ণ কাজে জড়িত থাকা, চারদিকে সহায়ক সম্পর্ক থাকা ইত্যাদি। সফল বার্ধক্য কেবল দীর্ঘজীবন লাভ নয় বরং এ সময়ে উচ্চ মানস¤পন্ন জীবনযাপন ও সেই সঙ্গে জীবনে সন্তুষ্টি ও পরিপূর্ণতা খুঁজে পাওয়াকে বুঝায়। বয়স্করা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ, পরামর্শদানসহ অন্যন্য কার্যাবলির মাধ্যমে কমিউনিটিতে বড় অবদান রাখতে পারেন, যার মাধ্যমে সামাজিক সংযোগ শক্তিশালীকরণ এবং আন্তপ্রজন্মীয় বন্ধন তৈরির মাধ্যমে সফল বার্ধক্য অর্জন সম্ভব।
একটাই জীবন! এই জীবনের দৈর্ঘ কত, তা কেউ জানে না। অর্থাৎ একই সময় জন্ম নেয়া এই মানুষগুলোর একসাথে থাকার এই পরিসর খুবই ছোট। তারপরও ক্ষণিকের এই যাত্রায় নিজেদের মধ্যে এত হানাহানি, এত মারামারি, এত হিংসা, এত বিদ্বেষ, এত সংঘাত, এত বেঈমানী সত্ত্বেও সবকিছুকে ক্ষমা করে দিয়ে আন্তরিকতার সংগে সবাইকে নিয়ে বসবাস করতে হবে।
আপনি পৃথিবীতে যখন এসেছিলেন তখন এত দুর্বল ছিলেন যে, মায়ের সাহায্য ছাড়া নড়া-চড়া বা খাবারটুকুও মুখে নিতে পারতেন না। আপনি যখন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন, তখনও এরকম অত্যন্ত দুর্বল ও অসহায় থাকবেন। তার অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ মধ্য বয়সের পর থেকেই একাকিত্বের মাধ্যমে শুরু হবে এই বিরক্তিকর পথ চলা। বয়স যত বাড়বে, তত একা হতে থাকবেন আর সুত্র অনুযারী একা মানে বোকা।
‘সুনাগরিক সংঘ’-এর ৪টি মূলনীতি কি কি?
১। আত্মোন্নয়ন ও বিজ্ঞানসম্মত জীবন-যাপন: নিজের আচার-ব্যবহার থেকে শুরু করে খাবার-দাবার, এমনকি সম্পূর্ণ লাইফস্টাইল পরিবর্তনের জন্য 'সুনাগরিকরা সদা সর্বদা তৎপর থাকবেন।
২। মানবতা ও জীবনবাদিতা: কোনো মানুষ ব্যক্তিগতভাবে যে-কোন মতের বা পথের হতে পারে, কিন্তু ‘সুনাগরিক সংঘ’-এর সদস্যের কাছে ব্যক্তির মানবিকতাটাই মূখ্য। ‘সুনাগরিক সংঘ’-এর সদস্যরা এমন সকল কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন, যা কোন প্রাণী বা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায় এবং নিজের বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এক কথায় ধর্ম, বর্ণ, মত নির্বিশেষে সকল মানুষ তথা জীবের স্বার্থ বিবেচনা করে যে-কোনো পদক্ষেপ / সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন।
৩। অনগ্রসরদের জীবনমান উন্নয়ণে সহায়তা: নিজের অবসব সময়ের কিছু অংশ মানব কল্যাণে ব্যয় করা বাধ্যতামূলক ‘সুনাগরিক সংঘ’-এর সদস্যদের জন্য।‘সুনাগরিকরা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণে সময় বা অর্থ ব্যয় করবেন।
৪। জ্ঞান চর্চা: চর্চা না থাকলে জ্ঞান-প্রতিভায় মরিচা ধরে। আবার অনুমাননির্ভর জীবন-যাপন জীবনকে জটিল ও দূর্বিসহ করে তোলে। তাই জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে জ্ঞান চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। হাতে থাকা মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার করে, বই-পত্রিকা পড়ে, আলোচনা শুনে নিজে এগিয়ে থাকবেন এবং অন্যকে এগিয়ে রাখবেন। জ্ঞান চর্চার নীতি হিসেবে সর্বদা স্মরণে রাখবেন, বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র।
সুনাগরিকদের আচরণবিধি কি রকম?
মনে করুন একটি প্রতিষ্ঠানে দশজন মানুষ আছেন। এই দশজনের কেউ দারোয়ান আবার কেউ কর্মী বা কর্মকর্তা। সেখানে কেউ কাউকে স্যার বা ম্যম বলবেন না। সবাই সবাইকে নাম ধরে কিংবা ভাইজান/আপমনি বলে ডাকবেন। সার্টিফিকেট বা টাকার জোরে কেউ নেতা হবেন না, কাজে যোগ্যতার ভিত্তিতে পদ মর্যদা পাবেন। সবাই মিলে আনন্দ আর অসুবিধা ভাগাভাগি করে একটি কমিউনাল জীবন যাপন করবেন।
তারা হবেন স্ব-অধীনতার পাশাপাশি পরস্পরের অধীন। যেমন: আমাদের শরীরের দুই, হাত, দুই চোখ, দুই কান, দুই পা কিংবা দুই কিডনি যেমন পরস্পরের সাথে ব্যালেন্স করে চলে (কোনো কারণে একটি আক্রান্ত হলে অন্যটিতে প্রভাব পড়ে, ডায়বেটিস হলে, কিডনি, দন্ত, রক্তচাপ কিংবা হার্টের সমস্যা দেখা দেয়।) পরস্পরের উপর এই কানেক্টেবিটি ও নির্ভরতার মধ্য দিয়ে চলতে হবে। ‘সুনাগরিক সংঘ’-এ “আমি, আমার” ধারণা অর্থাৎ “আমিত্ব” ত্যাগ করতে বলা হয়। আমার স্বামী, আমার স্ত্রী এভাবে না বলে , বলতে হবে- আমি উমুকের সাথে আছি, উমুক আমার সাথে আছে। নিজেকে জাহির করার পরিবর্তে অন্যকে গুরুত্বপূর্ণ করানো ও দেখানোই হবে ‘সুনাগরিক সংঘ’-এ আদর্শ।
‘সুনাগরিক সংঘ’-এর অবশ্যই পালনীয় ৪টি আচরণবিধি:
‘সুনাগরিক সংঘ’-এ ৪টি F-কে প্রাধান্য দিয়ে চলতে হয়। ১। Find-খুঁজা, ২। Finance--অর্থ, ৩।Friends and Family-বন্ধু এবং পরিবার, ৪। Fitness-সুস্বাস্থ্য
১। Find-খুঁজা: কোনো ভাল বক্তব্য, লেখা, আলোচনা ইত্যাদি খঁজে খুঁজে বার বার আয়ত্ব করে শিখতে হবে। অর্থাৎ নিয়মিত প্রশিক্ষণের ইমপোর্ট নিতে হবে। আপনি সকল বিষয়ে জ্ঞান রাখবেন, তবে আপনার ভিতরের শক্তি এবং ক্রিয়েটিভিটির দিক থেকে যে-সব বিষয় নিয়ে গর্ববোধ করতে পারেন, সেগুলোর মধ্য থেকে যে-কোনো একটি বিষয়ে দক্ষ হবার জন্যে কিংবা দক্ষতা বাড়ানোর জন্যে নিয়মিত প্রচেষ্টা চালাবেন। পাশাপাশি আপনার মান উন্নয়নের জন্য ভ্রমণ করতে হবে। প্রথমে আপনার ওয়ার্ডে থাকা বিভিন্ন বন্ধু-বান্ধবের সাথে স¤পর্ক তৈরি করুন ‘গিভ এন্ড টেক’ নীতির ভিত্তিতে। এরপর আপনার পৗর এলাকা বা ইউনিয়নের সকল বন্ধুদের সাথে এভাবে কমিউনিকেশন করুন। তারপর থানা বা উপজেলার বিভিন্ন বন্ধুদের ¯পট ভ্রমণ করুন। অতঃপর ৬৪ জেলা তথা সারা দেশ ভ্রমণ করতে থাকুন ক্রমান্বয়ে। প্রতিটা স¤পর্কের মধ্যে ইমোশনাল কানেক্টিভিটি তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে। কোনো প্রোডাক্টে যেমন ভ্যালু এ্যাড না করে মূল্য বাড়ানো যায় না। তেমনি আপনার নিজের যোগ্যতায়ও ভ্যালু এ্যাড করতে প্রতিদিন কিছু না কিছু শিখুন, নতুন কাউকে কানেক্ট করুন এবং নতুন পবিবেশে ভ্রমন করুন।
২। Finance-অথকর্ড়ি: সর্বদা মনে রাখবেন, “বাঁচতে হলে বেচতে হবে এবং কেনাতে হলে চেনাতে হবে”। মুল প্রোডাক্ট আপনি নিজে। আপনাকে চেনাতে এবং বেচতে অন্যের কাছে তুলে ধরতে হবে। আপনার নিজের হাত ও মস্তিষ্ক দিয়ে অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতা করে আয় করার চেষ্টা করতে হবে। বলা হয়ে থাকে, টাকা থাকলে মিথ্যা কথাও বাণী, মূর্খ পাগলও মহাজ্ঞানী। টাকা দেখলে নাকি কাঠের পুতুলও হাঁ করে ফেলে। টাকা মানুষের শরীর ও মনকেও উজ্জীবিত করে। কাজেই টাকা আয়ের পথে লেগে থাকতে হবে। একবার না পারলে ভিন্ন উপায়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা যোগ করে অন্তত পাঁচবার চেষ্ঠা করতে হবে। আপনি যখন যেখানে আছেন, সেখানেই আপনার সেরাটা দিতে হবে। সবসময় আগ্রহ, মনযোগ এবং মেধা খাটিয়ে এটিটিউড রক্ষা করতে হবে।
পাশাপাশি আপনার ব্রেনকেও টার্গেট দিতে হবে। আপনি কি করতে চান বা কি হতে চান তা আত্মবিশ্বাসের সাথে মনে মনে এবং শব্দ করে বারবার নিজেকে শুনান। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনি সেই টার্গেটে থাকুন। দেখবেন আপনার লক্ষ্যের পথে নতুন নতুন আইডিয়া ও সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে আপনার ব্রেন। একটি পরিকল্পনার সিট তৈরি করুন, প্রথমে মনে মনে, তারপর লিখিত আকারে। এবার পরিকল্পনায় থাকা কাজগুলোকে টুকরো টুকরো করে ছোট আকারে ভাগ করে প্রতিদিন বা সপ্তাহব্যাপী সেগুলো শেষ করতে থাকুন।
৩। Friends and Family-বন্ধু এবং পরিবার: মনে রাখতে হবে- আয়-উন্নতি কিংবা সুখ-শান্তি সবকিছু টিকে থাকবে রিলেশনশিপের উপর। কথায় আছে আপনার যদি চারজন কোটিপতি বন্ধু থাকে, তাহলে পঞ্চম কোটিপতি ব্যক্তিটি আপনিই হবেন। কথাটা শেখ সাদী এভাবে বলেছেন- আপনি যদি কোনো কয়লা শ্রমিকের সাথে ধস্তাধস্তি করেন, তাহলে কয়লার গুড়ো আপনার গায়ে লাগবেই অর্থাৎ একটা বক যদি একটা কাকের সাথে বসবাস করে, তাহলে বকের গায়ের রং কাকের মত কালো না হলেও, তার ভিতরের জগতটা ঠিক কাকের মত কালো হয়ে যায়। আপনি কার ঘরে জন্ম নিয়েছেন সেটা বড় কথা নয়, মূল কথা হচ্ছে আপনি কাদের সাথে চলাফেরা করেন; তাদের সম্মিলিত জ্ঞানের শক্তিই হচ্ছে আপনি। কাজেই কে আপনার বন্ধু হবে, কে আপনার শুভাকাক্সক্ষী হবে এবং কারা আপনার উন্নতির সহায়ক হবে; তাদেরকে টার্গেট হিসেবে লিস্ট করুন এবং নিয়মিত ফলোআপ করুন। আপনার বিপক্ষে কেউ কোনো অভিযোগ করলে তার পক্ষে কথা বলুন, দেখবেন তার মানসিকতার ৬০% আপনার পক্ষে চলে আসছে। বাকিটা বিনয় ও আন্তরিকতার সঙ্গে ম্যানেজ করুন। কারণ দিনশেষে আপনাকে অর্গানাইজড হতে হবে। একা লড়াই করে আপনি অনেক কিছু অর্জন করতে পারবেন না।
৪। Fitness-সুস্বাস্থ্য:
সুস্বাস্থ্য হচ্ছে একজন মানুষের শারীরিক, মানসিক, ও সামাজিকভাবে সুস্থ থাকা। স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় এমন সকল নেশা থেকে বিরত থাকবেন এবং পুষ্টিকর খাবার, সময়মত ঘুম ও নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস গড়তে তুলবেন। সূর্যের আলোতে ভিটামিন ডি আছে- যা আমাদের শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণ, শক্ত হাড় গঠন করে। ভিটামিন ডি-এর অভাবে অনেক রোগব্যাধি হতে পারে, হাড়ের ক্ষয় হয়। তাছাড়া আলো-বাতাসপূর্ণ জায়গা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে, আর শরীর চাঙ্গা করতেও সাহায্য করে।
সুনাগরিক সংঘের অবশ্য পালনীয় দশটি লাইফস্টাইল
‘সুনাগরিক সংঘ’-এর এই ১০টি লাইফস্ট্যাইল ছাড়াও আরো ৫০০ লাইফ স্ট্যাইল ওয়েবে ও পিডিএফ আকারে আছে। এই ৫০০ লাইফস্ট্যাইলের প্রতিটি আপনি ব্যক্তি জীবনে পালন করে চলতে পারেন, আবার এক বা একাধিক লাইফস্টাইল বাদ দিয়েও আপনার চিন্তাধারা অনুযায়ী চলতে পারেন। তবে নিচের ১০টি লাইফস্ট্যাইল অবশ্যই পালন করতে হবে।
প্রথম লাইফ স্ট্যাইল:
দারোয়ারন,কাজের বুয়া থেকে শুরু করে বস পর্যন্ত ছোট-বড় যে কারো সাথে প্রতিটি বিদায় যেন ‘গুডবাই’ হয়, সে দিকটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিদায় নেবার বা দেবার একটু আগে থেকেই 'বিদায় প্ল্যান' মনে মনে তৈরি করে নিতে হবে। কোনো কারণে বিদায়টা ‘ব্যাডবাই’ হলে তা নিয়ে অবসর সময়ে চিন্তা করতে হবে, কি করলে ‘গুডবাই’ করা যেত এবং সামনে কি কি সুযোগ আছে; সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।
মানুষের খারাপ আচরণের মূলে হচ্ছে উদ্বিগ্নতা। পরিবার বা কর্মক্ষেত্রে সমস্যা, স¤পর্কে অবনতি, অর্থনৈতিক সংকট, খারাপ স্বাস্থ্য-এসব বিভিন্ন কারণে অতিরিক্ত স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থেকেই উদ্বিগ্নতা তৈরি হচ্ছে। আশপাশের মানুষকে অনৈতিকভাবে বড়লোক হতে দেখেও তার ভিতর হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। নিজের অক্ষমতা বা সুযোগ না পাওয়া এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা তার ভিতর উদ্বিগ্নতা তৈরি করে। ফলে তার কথাবার্তা ও চলাফেরায় অস্থিরতা দেখা দেয়, মন মেজাজ খিটখিটে ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। এমতাবস্থায় তার বিদায়টা ‘গুডবাই না হয়ে ব্যাডবাই’-এ পরিণত হচ্ছে।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবন কখনো একই সরলরেখায় চলে না। কখনো এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যা আমাদের যাপিত জীবনকে বদলে দেয়। কিন্তু কোনো খারাপ ঘটনা থেকে অদূর ভবিষ্যতে ভালো কিছু বয়ে আসতেও পারে। তাই যে-কোনো বিষয়কে ইতিবাচকভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে এবং এর সুফল নিতে নতুন কিছু ভাবতে হবে। সব সময়ই আমাকে সেরা পজিশন ধরে রাখতেই হবে, এ মনোভাব বাদ দিতে হবে। নিজেকে নিয়ে হালকা মেজাজে থাকুন, চাপ নেবেন না। প্রিয় মানুষ-বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটান। মনের কথা বলে কিছুটা ভার লাঘব করেন এবং প্রচুর হাসুন। আমরা যে শুধু রোগব্যাধিতেই সংক্রমিত হই না, আনন্দেও সংক্রমিত হই। ভালো ব্যবহার ও সদয় আচরণের বিষয়টিও সেরকম। আপনার ভালো ব্যবহার ও হাসিখুশি জীবনধারা অন্যকেও প্রভাবিত করবে। খুব কঠোর কথা বলতে হলেও কারো উপর রাগ না ঝেড়ে, তেড়ে না উঠে, তার সঙ্গে এক কাপ চা খেতে খেতে বিষয়টি বুঝিয়ে বলা যায়। বরং এভাবে বললেই সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যে ধরনের সম্পর্কই হোক না কেন, ভালো ব্যবহার ও ইতিবাচক যোগাযোগ রক্ষা করার চর্চা করলে তাতে বোঝাপড়া ও সাফল্য আসে।
বাসের সিট ছেড়ে দেওয়া, লিফটের দরজা ধরে রাখা, মনযোগ সহকারে কারো মন খারাপের কথা শোনা, ইত্যাদি বিনয়ের চর্চায় কোনো সীমাবদ্ধতা রাখা যাবে না। যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজের ভ্যালু বাড়াতে হবে ভালো কিছু বলা বা করার মাধ্যমে।
দ্বিতীর্য় লাইফ স্ট্যাইল:
কোনো কিছু করার জন্য বা পাবার জন্য কিংবা লোভের বশে একেবারে অস্থির হয়ে তাড়াহুড়া করে কিছু করা যাবে না। কোনো কিছু করার আগে কিছুটা সময় নিয়ে দ্বিতীয়বার পুনরবিবেচনা করতে হবে। কাজটি করাতে গিয়ে বা করার পর সবচেয়ে খারাপ ফলগুলি কি কি হতে পারে, তা আগে থেকে কল্পনা করে নিয়ে সেই পরিস্থিতির জন্য নিজেকে তৈরি করে রাখতে হবে। আমাদের যখন কাজের চাপ থাকে, তখন আমরা তাড়াহুড়ো করে কাজটি দ্রুত শেষ করতে চাই। তখন পরিকল্পনা করে কাজটি করার চিন্তা মাথায় আসে না। কিন্তু “একটি ভাল পরিকল্পনা হল কাজের অর্ধেক”। জীবনের প্রতিটি ছোট-বড় কাজ পরিকল্পনা করে করা উচিত। কোনো কাজ করার আগে পরিকল্পনা করলে আমাদের মস্তিস্কের চর্চা হয় এবং ভাল ভাল আইডিয়া জেনারেট হয়।
মানুষ স্বভাবতই নতুন কোনো কিছুতে সহজে আকৃষ্ট হয়ে যায়। এই আগ্রহ থেকেই হঠাৎ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তবে তার সেই সিদ্ধান্ত বেশি সময় ধরে রাখতে পারে না। কতদিনে সাফল্য আসবে বা আদৌ আসবে কি-না এই সংশয় মনের মধ্যে থাকার কারণে অনেকে হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি যদি সঠিক পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন, তাহলে একদিন সফলতা আসবেই। তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, রড় কোনো সফলতা রাতারাতি হওয়ার বিষয় না। যেটা অকালে বাড়ে, সেটা সকালে মরে। তাই জলদি সফল হতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে কাজ করলে কাজ সাধারণত খারাপ হয়। এছাড়া যদি কেউ এতে সফলতা পেয়েও যায়, তাহলেও তা বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। এজন্য তাড়াহুড়ো না করে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে এবং বার বার পর্যালোচনা করে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
কোন্ কাজগুলো 'বেশি গুরুত্বপূর্ণ' এবং 'কতটা দ্রুত শেষ করতে হবে'- তার জন্য সময় নির্ধারণ করতে হবে। যাঁরা জীবনে ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁরা তিন কারণে ব্যর্থ হয়েছেন- ১. পরিকল্পনা করে কাজটিতে লেগে থাকার অভাবে, ২. অনুপ্রেরণা বা আত্মবিশ্বাসের অভাবে, ৩. নেটওয়ার্কিং বা মার্কেটিংয়ের অভাবে। তাই সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারলে আগ্রহ হারাবেন না। পরবর্তী কাজ থেকে সময় বাঁচিয়ে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করুন। একটি কাজ ব্যর্থ হলে পর পর অনেক কাজের উপর আপনার উৎসাহ ও একাগ্রতাকে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
পরিকল্পনা করা একটি অভ্যাস। যাঁরা কাজ শুরু করার আগে নিয়মিত পরিকল্পনা করতে অভ্যস্ত, তাঁরা দ্রুততর সময়ে পরিকল্পনা শেষ করতে পারে। একসময় দেখবেন, পরিকল্পনা করার জন্য সময় লাগছে না, পরিকল্পনা মাথায় তৈরি হয়েই আছে। কাজের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনাহূত শব্দ, আলাপী সহকর্মী, হুট করে আসা কোনো গভীর চিন্তা এড়িয়ে চলুন। কাজ করার সময় একটি বিশৃঙ্খলাহীন কাজের পরিবেশ তৈরি করুন। আবার বিরতি ছাড়া সবসময় কাজ করে গেলে কাজের উপর বিরক্তি এবং নিজের মধ্যে ক্লান্তি চলে আসে। তাই কিছুটা সময় বের করে এমন কিছু করুন, যা আপনাকে চাঙা করে তুলবে। যেমন- প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানো, মজা করে পছন্দের হালকা কিছু খাওয়া ইত্যাদি।
মূল কথা হল: জীবনে তাড়াহুড়ো বা হুটহাট কোনো সিদ্ধান্ত নিলে পরবর্তীতে বিশাল সমস্যার সৃষ্টি হয়। বলা যায় পচা শামুকে পা কাটে। একটা ভাল সিদ্ধান্ত যেমন আপনার জীবনটাকে পাল্টে দিতে পারে, তেমনি আপনার জীবনকে অতিষ্ট করে দেবার জন্য একটা ছোট ভুল সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যত বেশি সম্ভব এই বিষয়ে অন্যের মতামত ও তথ্য জোগাড় করতে হবে। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে যতবেশি তথ্য থাকবে, আপনার মস্তিষ্ক তত সঠিকভাবে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। তবে সব সিদ্ধান্তের সুবিধা অসুবিধাগুলোকে পরিমাপ করে দেখতে হবে। একটা সিদ্ধান্ত দেরিতে নেয়ার ফলে আপনার যতটুকু ক্ষতি হবে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে যদি তাড়াহুড়ার মাঝে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেন। তাই সিদ্ধান্ত সেবার সময় মন শান্ত রাখা ও ধৈর্য্য ধরা বা একটু সময় নেয়া জরুরি।
তৃতীয় লাইফ স্ট্যাইল:
অন্যের সাথে সময় কাটানোর সময় যাতে দম বন্ধ করা পরিবেশ যেন তৈরি না হয়, সেদিকটা খেয়াল ও চেষ্টা রাখতে হবে। ছোট ছোট ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন করা, অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং অন্যের প্রশ্নের উত্তর দেবার পর থেমে না গিয়ে বাড়তি কিছু তথ্য দিয়ে কথার হাত-পা বের করে কথা বাড়াতে হবে, যাতে উৎসাহ নিয়ে আলাপ এগিয়ে নেয়া যায়। অন্য কেউ সামনে থাকা অবস্থায় মোবাইল বা অন্য কিছুতে মনঃসংযোগ করা যাবে না।
পরিবার থেকে বিশ্ব কথার মাধ্যমেই আপনাকে জয় করতে হবে, এমনকি কেবল কথার কারণে আপনি অনেক ক্ষেত্রে পেতে পারেন বাড়তি সুবিধাও। তাই সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলার চর্চা করুন। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নয়, দৃষ্টিভঙ্গীতে উদার হতে হবে। আমার কথাই শেষ কথা, আমার ভাবনাই সঠিক, এই রকম চিন্তাধারা থেকে থাকলে সেটা পাল্টান। দুনিয়ার সব বোঝা নিজের কাঁধে নেবেন তো জীবন বেশি ভারী হবেই! আমরা প্রায় সময় সামান্য সব বাজে ঘটনাও মনে চেপে রাখি। আমাদের সাথে একটু ভুল করা কিছু মানুষটাও হয়তো দিনের পর দিন ঘৃণার পাত্র হয়ে মনে থেকে যায়। তাকে ক্ষমা করে দিন। আপনার ঘৃণায় তার কিছুই হবে না কিন্তু আপনার মনের মধ্যে তার প্রতি যে বিষ জমে আছে, তা ভিতরে ভিতরে আপনাকে বিষাক্ত করে তুলবে।
চতুর্থ লাইফ স্ট্যাইল:
প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে 'গিভ এন্ড টেক' নীতি সর্বোত্তমভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বিনিময়ের দুইটি মাধ্যম-১. বিনয় এবং ২.টাকা। অর্থাৎ বিনয় হচ্ছে কিছু অর্জনের প্রথম মাধ্যম। মূল্য প্রদান ছাড়াই অনেক কিছুই অর্জন করা সম্ভব শুধু বিনয়ের মাধ্যমে। মুখে হাসি ভাব ফুটিয়ে তোলে ভদ্রতার সাথে প্রতিটি শব্দ-বাক্য খুব চিন্তা করে বলতে হবে। ভুল কিছু বললে বা করলে সঙ্গে সঙ্গে সরি বলে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা নেতিবাচক মন্তব্য করা যাবে না; কোনো হিংসা বিদ্বেষ মনে পুষে রাখা যাবে না, অন্যের সফল অসঙ্গতি অপরাধ ক্ষমা করে দিতে হবে। সর্বদা মনে রাখতে হবে, গলায় মালা পরতে হলে মাথা হালকা নিচু করতে হয়।
সারা দুনিয়া গিভ-এন্ড-টেক পলিসিতে চলে। কারো কাছে কিছু চাওয়ার আগে তাকে আগেই কিছু দিতে হবে। তখন দেখবেন আপনার চাওয়াটা খুব সহজেই পূরণ হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে দিবেন আপনার বিনয়, নম্রতা, শ্রদ্ধা। আমরা সবসময় জিততে চাই। নিজের বড়ত্ব জাহির করতে মরিয়া হয়ে উঠি। প্রমাণ করার চেষ্টা করি আমার অনেক ক্ষমতা। কথায় কথায় রিকশাওয়ালার কলার ধরি। হাতছাড়া করি না গরীব ও দূর্বলকে অপমান করার ন্যূনতম সুযোগও। এভাবে সর্বত্র খবরদারি ফলানোর চেষ্টা আমাদেরকে মানুষ তথা সমাজ বিচ্ছিন্ন করে তোলে। অন্যদিকে যারা ন¤্রভাবে সমাজে চলাফেরা করে, না চাইলেও লোকে তাদের সম্মান করে। বিনয়ী মানুষ কখনো ঘৃণামূলক কথা বা বক্তৃতা দেন না এবং বিদ্বেষ ছড়ান না। বিনয়ী মানুষ পরমতসহিষ্ণু হয়। বিনয় এমন এক পাওয়ার, যা জ্ঞানী মানুষের কাছে থাকলে সে মহাজ্ঞানী হয়ে ওঠে। আর সুন্দরীর মধ্যে থাকলে সে হয় বিশ্ব সুন্দরী।
পঞ্চর্ম লাইফ স্ট্যাইল:
যতোটুকু সম্ভব অন্যের সংগে শেয়ারিং করতে হবে। অন্য কেউ আপনার সাথে শেয়ার করার ফলে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আমিই অর্জন করেছি বলে এতে একমাত্র আমার অধিকার, এরকম সংকীর্ণমনা মানসিকতা পরিহার করে উদারতার চর্চা করতে হবে। প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ‘সহযোগিতা সবার সাথে, প্রতিযোগিতা নিজের সাথে।’-এই শ্লোগান সবসময় মনে ধরে রাখতে হবে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই যোগ্যতা যাচাই হয়। প্রতিযোগিতা না থাকলে সেইখানে যোগ্যতা অর্জনের প্রশ্ন থাকে না। তাই প্রতিযোগিতা সব ক্ষেত্রেই থাকবে। এটা যে কাউকে উন্নতি করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ আমরা প্রকৃতিগতভাবেই প্রতিযোগিতার অংশ। যে এই প্রতিযোগিতায় নামবে না, তাকে পিছিয়ে পড়তে হবেই। কারণ যোগ্যরাই কেবল টিকে থাকবে। কিন্তু অন্য কাউকে আঘাত করে, কারো সঙ্গে অন্যায় করে, বা জোর করে কোনো অর্জন ছিনিয়ে নিলে, সে হয় ছিনতাইকারী প্রতিযোগী নয়। এই অন্যায় আচরণ আমাদের নার্ভাস সিস্টেমকে দুর্বল করে এবং শরীর-মনকে করে তোলে অবসাদগ্রস্ত। কাজে মনোযোগ ও গতি কমে যায়। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি। বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়ে। কাজেই মনোভাবটা রাখতে হবে: আমি জিতব, কিন্তু আমার প্রতিদ্বন্দ্বী যেন না হারে। অর্থাৎ আমিও জিতব, সেও জিতবে। উইন উইন সিচুয়েশন।
প্রত্যেককে তার নিজস্ব ধারণা, তথ্য, মতামত ও বিশ্বাস কোনো বাধা ছাড়াই আপনার সঙ্গে শেয়ার করতে দেয়ার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে হবে। তবে নিজের সমস্যা কখনো অন্যের সাথে শেয়ার করবেন না। কিছু লোক থাকবে, যারা আপনার সমস্যার কথা শুনে বরং আরো খুশি হবে, আরো সুযোগ নিবে। আমাদেরকে সব সময় মনে রাখতে হবে, বন্ধু যে কোনো সময় শত্রুতে পরিণত হতে পারে, আবার শত্রু যে কোনো সময় বন্ধুতে পরিণত হতে পারে। তাই কোনো বিশেষ গোপনীয়তা শেয়ার করা বা কাউকে শত্রুজ্ঞানে এড়িয়ে চলা এগুলো পরিহার করতে হবে। আবার আপনার জোরালো মতামত প্রায় সময়ই অপ্রয়োজনীয় বিরোধের উৎস হতে পারে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে তর্ক, দ্বন্দ্ব, মারামারি বা সংঘাতে এড়িয়ে নিজের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস শুধু নিজের মধ্যেই রাখার চেষ্টা করতে হবে।
ষষ্ঠ লাইফ স্ট্যাইল:
পরিছন্নতা ও সুন্দর্য দিয়ে সবকিছু সুসজ্জিত করে রাখতে হবে। কোনো কিছু অযতেœ ফেলে রাখা যাবে না, নিজের অপছন্দের কিছু থেকে শুরু করে অতি তুচ্ছ গুরুত্বহীন জিনিসটিও পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে রাখতে হবে, নয়তো ছেড়ে দিতে হবে। আপনার কাছে যা বাতিলযোগ্য, তা অন্যের কাছে একান্ত সহায়ক শক্তি হতে পারে। তাই সঠিক যত্নের প্রয়োজনে তা অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে হবে অথবা নতুন আঙ্গিকে সারিয়ে নিতে হবে।
খুচরো আনন্দে বাঁচতে শিখুন। ছোট ছোট ঘটনায় খুশি খুঁজে নিন। সবসময় বিশাল প্রত্যাশার চাপে ‘হাতে থাকা আনন্দগুলোকে’ গলা টিপে মারবেন না। সুখ ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রাখা সবচেয়ে বড় ভুল। অসংখ্য মানুষ ভাবে "আমার এই ব্যাপারটা যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে"। এটা একটা ঘোর (ডিলুশন)। যখন "ওই একটা জিনিস" ঠিক হবে, তখন "আরো একটা জিনিস” আপনার জীবনে বাকি থেকে যাবে। জীবনে কখনো সবকিছু একসাথে আপনার কাছে ধরা দিবে না। এভাবে সুখী হওয়াও যায় না। এরচেয়ে এই মুহূর্তে আপনার যা আছে তা নিয়ে সুখী হোন, বর্তমানকে উপভোগ করুন এবং একই সাথে ভবিষ্যতের জন্যে কাজ করে যান। সুখ-আনন্দরা সামান্য জিনিষেই বাসা বাঁধে। প্রিয়জনের সাথে একান্তে কাটানো সময়, কাছের মানুষদের জন্য উপহার কেনা, কোনো অসহায় মানুষের একবেলার খাবারের দায়িত্ব নেয়া, দূরে কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে পড়া, অফিস-ফেরত টং দোকানের চা-আড্ডা, এসব হলো জীবনের আনন্দের উৎস। সুখে থাকার জন্য আমাদের দরকার অন্য মানুষ। আমাদের প্রিয়জন-বন্ধু মিলিয়ে চারপাশে সুন্দর একটা ‘সামাজিক সম্পর্কই পারে আপনাকে সুখী করে তুলতে। আমাদের সম্পর্কগুলোর যত্ন নেওয়ার কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। আমরা মনে করি, একবার সম্পর্ক হয়ে গেলেই তো শেষ। আলাদা কোনো মনোযোগ না দিলেও চলবে, কিন্তু এটা একেবারে ভুল।
বেশি আয় কারও জীবনে অতিরিক্ত বেশি সুখ দিতে পারে না। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা একটু বেশি উপার্জন করেন তাদের মধ্যে অহংকার করার এবং স্বার্থপর হওয়ার মানসিকতা দেখা দেয়। অন্যদিকে যাদের আয় তুলনামুলকভাবে কম, তাদের মধ্যে সহমর্মী হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে, তাই সুখও বেশি।
সপ্তর্ম লাইফ স্ট্যাইল:
কায়িক পরিশ্রম বা হাটাকে আজীবন অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। হাঁটা পথের দূরত্বে কখনো যান ব্যবহার করবেন না, এমনকি গন্তব্যের একটু আগে যানবাহন থেকে নেমে হলেও হাঁটার সুযোগ তৈরি করে নিতে হবে। অন্তত রোজ আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা একা বা একত্রে হাঁটতে হবে। প্রোটিনযুক্ত অল্প খাবার দীর্ঘক্ষণ ধরে চিবিয়ে খেতে হবে। লবণ, চিনি, রুটি, ভাত, দুধ ইত্যাদি ‘হোয়াইট পয়জন’ বা সাদা বিষ যতটা সম্ভব কম খাবেন। একটি ছোট প্লেটে ভাতের চেয়ে সবজি বা তড়িতরকারি বেশি নিয়ে একটি ছোট চামচের মাধ্যমে খাবেন অতি ধীরে ধীরে কচ্ছপের গতিতে। হাত আর খাবারের দূরত্ব বজায় রাখবেন। মুখ বন্ধ করে খাবার ছিবাবেন, খাবারের সময় কারো সাথে সরাসরি বা মোবাইলে কথা বললে মুখের লালা তিন ফুট পর্যন্ত চারদিকে ছড়াতে থাকে, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এতে একজনের রোগ জীবাণু অন্যজনের পেটে যায়।
দিনের তিন বেলা খাবার কে ৬ থেকে ১০ ভাগে ভাগ করে খাবেন। খাবারে বেশিরভাগ থাকবে লাইভ ফুড, ডেড ফুড থাকবে কম। অর্থাৎ তাজা ফলমূল শাক সবজি মাছ তরি তরকারি বেশি খাবেন আর শুকনো খাবার কম খাবেন। খাবারের সময় বা খাবারের পর পর পানি বা ঔষধ খাবেন না, অন্তত খাবারের আধা ঘন্টা পরে খাবেন। ক্ষিধে না লাগলে কেউ জোর করে খাওয়ালেও খাবেন না, শরীরে খাবারের দরকার হলে ক্ষিদের মাধ্যমে শরীর সিগন্যাল দিবে তখন খাবেন, ঘুমের প্রয়োজন হলে শরীর সিগনাল দিবে তখন ঘুমাবেন, অসময়ে নয়। সব সময় বসে কাজ করবেন না, মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থেকেও কাজ করবেন। সন্ধ্যার পর ১৩ থেকে ১৮ ঘন্টা খাবার গ্রহণ বন্ধ রাখবেন। তখন আপনার দেহের কোষগুলো নিজেদের লাইসোজমে (ফ্রিজের মতো) জমা থাকা খাদ্যকে খাওয়া শুরু করবে! যদি উপস না করেন, তাহলে আমাদের ডিএনএ-তে থাকা ১৫টি জিন মিউটেশন হয়ে নানা ধরনের অসুখ তৈরি করবে, যাকে লাইফস্টাইল ডিজিস বলা হয়।
অষ্টম লাইফ স্ট্যাইল:
বন্ধুত্ব, দাম্পত্য বা ‘ইউনিলাভ’ সকল সম্র্ককেই মানবিক হিসেবে দেখতে হবে। অর্থাৎ কারো বেড রুমে উকি দেয়ার নিম্ন রুচি পরিহার করে চলতে হবে। বিয়ের এক থেকে তিন বছর পরে বিবাহিত জীবনে কামনা-বাসনার ভূমিকার পতন ঘটে! এক ঘরে দিনের পর দিন না থেকে বরং সম্ভব হলে আলাদা জীবন কাটালে দাম্পত্য জীবনে কামনা-বাসনার ভূমিকা বাড়ে। আপনি কারো সঙ্গে প্রেমে আছেন বলেই তার সমস্ত সময় শুধু আপনার জন্যই, এই ভাবনা একেবারেই ভুল। প্রেমের বাইরে আপনার যেমন একটা জগৎ আছে, তেমনি আপনার সঙ্গীরও আছে। তাই একে অপরকে স্পেস দিতে হবে নিজেদের জগতে সময় কাটানোর জন্য। সব সময় একে অপরের সঙ্গে আটকে থাকলে মধুরতার পরিবর্তে দম বন্ধ অবস্থা তৈরি হবে। সঙ্গীর সঙ্গে যতক্ষণই কাটাবেন, সে সময়টুকু কোয়ালিটিফুল করুন আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে।
আপনার সঙ্গীর অনুমতি না নিয়ে তার ব্যক্তিগত কোনো জিনিস ধরবেন না। প্রত্যেকেরই নিজস্ব জগৎ আছে এবং গোপনীয়তাও রয়েছে। সে নিজে থেকে না বললে তার ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে নাক গলাবেন না, এতে আপনার প্রতি তার সম্মান বাড়বে। তার অতিত বা প্রাক্তনকে নিয়েও কোনো প্রসঙ্গ তুলবেন না, এতে তার আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগবে, সে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। সুন্দর চেহারার পাশাপাশী সঙ্গী যদি বিশ্বাস্ত হয়, তাহলে অনেকটা সময় পর্যন্ত তার প্রতি আকর্ষণ থেকে যাবে। এর উপর সিঙ্গী যদি ব্যক্তিত্ববান ও যোগ্যতা সম্পন্ন হয়, তাহলে আকর্ষণের স্থায়ীত্ব অনেক বেশি হবে। কিন্তু সব আকর্ষণই এক সময় কমে যায় বা নিভে যায়। তবে, বন্ধুত্ব হোক বা দাম্পত্য কিংবা ওপেন রিলেশনশিপ, আপনার সঙ্গীর বা প্রিয় বন্ধুর উপস্থিতি মনের চাপ কমায়, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। তাই সঙ্গী বা বন্ধুকে সম্মান করতে শিখুন। এতে আপনার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা বাড়বে। কোনো সম্পর্ককে তখনই হেলদি রিলেশনশিপ বলা যায়, যখন এতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও সহানুভূতি থাকে।
নবম লাইফ স্ট্যাইল :
মুদ্রাদোষগুলি পরিহার করে শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। যেমন আপনি কারো কাছে এসেছেন বা কেউ আপনার কাছে এসেছে, আপনি তাকে বা সে আপনাকে নয়, গুরুত্ব দিচ্ছেন মোবাইলকে। এটা চরম অসভ্যতা। তেমনিভাবে পা ক্রস করে দাঁড়ানো, দুই হাত মুখের সামনে ধরা, সামনে ঝুঁকে হাঁটা, বাঁকা হাসি হাসা। টেবিলে হাত সামনে দিকে রাখা বা টেবিলে ঝুঁকে দাঁড়ানো, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো, কারো সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে কথা বলা। কারো অফিসে কারো বাড়িতে গিয়ে তার অনুমতি না নিয়ে ঘরের কোনো জিনিসে হাত দেয়া, কোনো কক্ষে প্রবেশের সময় সবাইকে হ্যালো না বলা। কেউ যদি আপনাকে খাওয়াতে নিয়ে যায় তবে বেশিদামি খাবার বেছে নেয়া। কোনো অফিসে গেলে শার্টের উপরের বোতাম খোলা রাখা বা শার্ট ইন করে না পরা। কেউ যদি তার মোবাইলে কোনো ছবি দেখতে দেয়, তাহলে অন্যছবি দেখা শুরু করা। কারো বাড়িতে গেলে খালি হাতে যাওয়া। পাবলিক টয়লেটে পাশের লোকটির সাথে কথা বলা। জনসম্মুখে দাঁত মাজা বা খোচানো, দাঁেত নখ কাটা, চুল আঁচড়ানো এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। খাবারের সময় এবং পান করার সময় যেন মুখ থেকে কোনো শব্দ বের না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারো সাথে কথা বলার সময় যদি কল ধরতে হয় বা করতে হয় তবে অনুমতি নিয়ে একটু দূরে গিয়ে কল করতে হবে। অপরিচিত কাউকে কল দিলে প্রথমে নিজের নাম বা পরিচয়টা বলতে হবে ইত্যাদি অসংখ্য বিষয় আছে (যা ৫০০ লাইফস্ট্যাইল বই ও নোটবুকে আছে) খুব কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
দশম লাইফ স্ট্যাইল :
কারো সুখে বা উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হবেন না। আপনার যা কিছু আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার দৃঢ় মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সম্পদ পুঞ্জিভূত করার দৌড়ে আপনি শামিল হবেন না, কারণ এই সম্পদ ভোগ করার জন্য পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আপনি আসার সুযোগ পাবেন না। পুঞ্জীভূত সম্পদ নয়, আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সময়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করে করে সার্থক জীবনের পথে এগোতে হবে। কে কি করে ফেলছে সে দিকে নজর না দিয়ে নিজের কাজের প্রতি সবসময় ফোকাস রাখতে হবে। জীবনে আশা, প্রত্যাশা, চাহিদার লিস্টটা সবসময় ছোট রাখবেন। মানসিকভাবে অশান্তিতে ভোগেন এমন টক্সিক মানুষ, নিউজ, সামাজিক সাইটগুলো এড়িয়ে চলবেন।
গরীব মানসিকতার কিছু বৈশিষ্ট্য হচ্ছে - চিৎকার-চেঁচামেচি,গলাবাজী, মুখে রাজা উজির মারা, কারো অগোচরে তার সমালোচনা করা, কাউকে দমিয়ে রাখা বা ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা, গোপনে অন্যের ক্ষতি করা, যেমন- আপনি যে-কোনো পাবলিক প্লেসে গেলে দেখবেন, সেখানে এটা ভাঙ্গা, উঠা ছিড়া বা কাটা, বাথরুম বা কোনো দেওয়ালে এটা ওটা লিখা-আঁকা ইত্যাদি।