প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় সাহিত্যের একটি অন্যতম নিদর্শন হলো "বুক অব দ্যা ডেড"। এই বুক অব দ্যা ডেডই নাকি পারে মৃত্যুর পরে আত্মাকে মৃতের নগরীতে নিয়ে যেতে। মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো মানুষ মারা যাওয়ার পর মাটির নিচে শুরু হয় তার আরেকটি জীবন। সেই রাজ্যে ঢোকার পথে মৃতের প্রয়োজন হতো কিছু মন্ত্রের। আর সেই সব মন্ত্রই লিখে রাখা হতো পিরামিডের দেয়ালে কিংবা কফিনে। পরবর্তীতে লেট পিরিয়ড ইজিপ্টের সময়ে (৬৬৪-৩৩২ খ্রিস্টপূর্ব) এই মন্ত্রগুলো একত্র করে বই বানানো হয়। এই বইটিই পরবর্তীতে ইংরেজিতে অনুবাদ করে নাম দেওয়া হয় “বুক অব দ্যা ডেড”। তবে শুধু বইয়ের মন্ত্রগুলো জানা থাকলেই যে মৃতের নগরীতে যাওয়া সম্ভব তাও নয়। এর জন্যে আত্মাকে পাড়ি দিতে হয় ভীষণ দীর্ঘ এক পথ।
প্রাচীন মিশরীয়রা মৃতদেহকে কবর দিতো। ফারাও কিংবা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গদের মৃতদেহ যদিও মমি করা হতো। কিন্তু মামিফিকেশনের পর সেটা কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। সেই কবরের পাশে মন্ত্র পড়তো একজন পুরোহিত। এই মন্ত্রগুলোর একটির নাম হলো "ওপেনিং অব দ্যা মাউথ"। এই মন্ত্রবলে মৃতের শরীরে প্রাণ ফিরে আসে। তবে তখন আর সে মানুষ থাকেনা; নবজীবন পাওয়ার পর সে হয়ে যায় “আখ”। আখ হয়ে যাবার পর সে আর পৃথিবীতে বাস করতে পারবেনা, তার যেতে হবে মৃতের নগরীতে, যার অবস্থান মাটির নীচে।
প্রাচীন ইজিপশিয়ানরা বিশ্বাস করতো যে সূর্য পশ্চিমে অস্ত যাওয়ার পর মাটির নিচে যাত্রা করে। সূর্যদেবতা 'রা' অস্ত যাবার পর তাই মাটির নিচে আবার নৌকায় করে পশ্চিম থেকে পূর্বে যায়, যাতে পরের দিন ভোরে আবার আকাশে উঠতে পারে। তবে রা এর জন্যেও এই পথ বেশ ভয়ানক। প্রতি রাতেই রা এর নৌকায় আক্রমণ করে 'আপেপ' নামের এক বিশাল সাপ। আর প্রতি রাতেই রা তাকে হত্যা করে। যে রাতে আপেপ জিতে যাবে, তার পরের দিন সকালে আর সূর্য উঠবেনা। মৃত্যুর পরে আত্মাকেও তাই হাঁটতে হয় এই রা এর পথে।
আখরা মৃত্যু নগরীর খোঁজে মাটির নিচে চলতে থাকে। চলতে চলতে সে সবার প্রথমে পড়ে একটি গোলকধাঁধার সামনে। সেখানে আছে সাতটি দরজা আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এক পাহারাদার। সেখানে নির্দিষ্ট একটি মন্ত্র বলতে হবে আখকে। ঠিকঠাক মন্ত্র বললেই সেই দরজা খুলে দেবে পাহারাদার। কিন্তু এই মন্ত্র আখরা জানবে কীভাবে? এর জন্যেই দরকার হয় বুক অব দ্যা ডেড, যেটা প্যাপিরাসে লিখে মৃতদেহর সাথে দিয়ে দেওয়া হয়, অথবা মমির ব্যান্ডেজে কিংবা কফিনের দেয়ালে লিখে দেওয়া হয়।
বুক অফ ডেথ থেকে ঠিকঠাক মন্ত্র আওড়ে গোলকধাঁধা পার করলে এবার দরজার ওপাড়ে থাকবে “কোর্টস অব দ্যা ট্রুথস”। এখানে আখের সাথে দেখা হবে স্বয়ং মৃত্যুর দেবতা ওসাইরইসের সাথে। ওসাইরিস আর তার সাথে আরো ৪২ জন দেব-দেবী মিলে আত্মার বিচার করতে বসবে। এই বিচারে আখদের করতে হয় নেগেটিভ কনফেশন! মানে যে পাপগুলো জীবদ্দশায় করেনি সেগুলো বলতে হবে। মানুষ পৃথিবীতে আসলে কোনো না কোনো পাপ করবেই। তাই এই বিচারে ঠিক হবে সে কোন কোন পাপ করেনি। যদি ঠিকঠাক স্বীকার করতে পারে এরপরেই ওসাইরিস নেবে তার শেষ পরীক্ষা।
এবার মৃতের হৃদপিন্ডের ওজন করা হবে। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো যে হৃদপিন্ড একটা শরীরের সবচেয়ে পবিত্র অঙ্গ। তাই মমি বানানোর সময়ও শরীরের ভেতরের সব কিছু বের করে নিলেও হৃদপিন্ডকে যথাস্থানে রেখে দেওয়া হতো। এবার এখানে এগিয়ে আসবে আনুবিস, তিনি মামিফিকেশনের দেবতা। ওসাইরিসের পূর্বে আনুবিসকেই মৃত্যুর দেবতা বলে বিশ্বাস করতো মিশরীয়রা। আনুবিস এবার একটা দাঁড়িপাল্লা এনে একদিকে বসাবেন হৃদপিন্ডটাকে আর আরেকদিকে রাখবেন একটা অস্ট্রিচ পাখির পালক। এই পালকটি দেবী মাতের মুকুট থেকে নেওয়া। দেবী মাত হলেন সত্য ও ন্যায়ের দেবী। তিনি দাঁড়িপাল্লার পাশে দাঁড়িয়ে দেখবেন কোন দিকটা ভারী হলো। যদি হৃদপিন্ড পালকের থেকে হালকা হয় তবেই সেই আখ তার শেষ পরীক্ষায় পাশ করে গেলো। এবার সে নিশ্চিন্তে যেতে পারবে, মৃত্যুর পরের জগৎ 'দুয়াত'-এ।
তবে এ দুয়াত হলো চারিদিকে লোহার পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এক জায়গা। সেখানে আছে নদী, পাহাড় আর বার্লির ক্ষেত। দুয়াতে যাবার পর সেখানে মানুষ সুখেই থাকে। কিন্তু তার সাথে সেখানে তাকে কাজও করতে হয় ঈশ্বরের জন্য। তার সেখানে ক্ষেতে চাষ করতে হবে, নদী থেকে জল তুলতে হবে, গরু চড়াতে হবে। তবে এ সকল নিয়ম শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের জন্য প্রযোজ্য। ফারাওরা দুয়াতে গেলে তাদের সেখানে কাজ করতে হয়না। ফারাওদের সমাধিতেই তাদের কফিনের সাথে রাখা হতো মাটি ও কাঠ দিয়ে তৈরি পুতুল। মাটির নীচের জগতে এই পুতুলগুলোও বেঁচে ওঠে এবং সেখানে ফারাওয়ের কাজগুলো করে দেয়।
কিন্তু যদি মামিফিকেশনের সময় হৃদপিন্ডটি ভুলক্রমে উপড়ে ফেলা হয় তাহলে কী হবে? ঠিক এমন ভুলই হয়েছিলো দ্বিতীয় রামেসিসের মমি বানানোর সময়। তাই সেটা পরে আবার সোনার সুতো দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও একটা ভুল হয়ে যায়। দ্বিতীয় রামেসিসের মমিতে হৃদপিন্ডটি ছিলো বুকের ডানদিকে জোড়া লাগানো!
এবার আসি আনুবিসের পরীক্ষায় পাশ না করলে কী হবে সেই আলাপে। যদি হৃদপিন্ডের ওজন বেশি হয়ে যায় পালকটি থেকে?
যখন হৃদপিন্ডের পরিমাপ করা হয় তখন সেখানে আনুবিসের পিছনেই বসে থাকে একটা রাক্ষস যার নাম আমিত। আমিতের মুখ কুমিরের, শরীরটা সিংহের এবং পিছন্দের পা দুটো জলহস্তীর। হৃদপিন্ডের ওজন পালকের চেয়ে বেশি হলেই আমিত সেই হৃদপিন্ডটা সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে ফেলে। ফলে আত্মা আর এক পাও চলতে পারেনা। অনন্তকালের জন্য আটকা থাকে সেখানেই। তার আর মুক্তি নেই।
-উপমা অধিকারী।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী ।
নাম পরিচয়:-
বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক, আধ্যাত্মিক কবি মাওলানা রুমির নাম মুহাম্মদ, উপাধি জালালউদ্দিন। তার পিতার নামও মুহাম্মদ, উপাধি সুলতান বাহাউদ্দীন ওলাদ। পিতামহের নাম হোসাইন বলখী। হোসাইন বলখী উত্তর ইরানের বলখ নগরের অধিবাসী ছিলেন। রুমীর বংশগত সম্পর্ক নক্ষত্র সদৃশ বিখ্যাত এবং বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের সাথে সম্পর্কযুক্ত। রুমি পিতার পূর্ব পুরুষদের নবম ধাপে হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) সহিত মিলিত হন এবং মাতার দিকে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর সাথে মিলিত হন।
মাওলানা রুমীর পিতামহ হোসাইন ইবনে আহমেদ অতি উচ্চ পর্যায়ের সুফী এবং বুজুর্গ লোক ছিলেন। তৎকালীন সুলতান এবং বাদশাহগন তাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। খোরাসান হতে ইরাক পর্যন্ত এই সাম্রাজ্যের মহাপ্রতাপশালী বাদশাহ মুহাম্মদ শাহ খাওয়ারেযমী স্বীয় কন্যা মালাকায়ে জাহানকে তার সহিত বিবাহ দেন। মাওলানা রুমীর বুজুর্গ পিতা সুলতান বাহাউদ্দিন ওলাদও তৎকালের উচ্চশ্রেণীর ওলি, বিজ্ঞ আলেম, আধ্যাত্মিক সুফি এবং বিশিষ্টজন। মাওলানা রুমি হলেন বাদশাহ মুহাম্মদ শাহ খাওরেযমীর দৌহিত্র।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জন্ম এবং জন্মস্থান মাওলানা রুমী খোরাসানের অন্তর্গত বলখ শহরে ৬০৪ হিজরীর ৬ই ববিউল আউয়াল তারিখে জন্মগ্রহন করেন। তার পূর্বপুরুষদের বসবাস বলখেই ছিল। তার পিতা সুলতান বাহাউদ্দীন ওলাদ যৌবন বয়সেই খ্যাতনামা আলেম, পারদর্শী মুফতী ছিলেন। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তথা সর্ববিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। সমগ্র খোরাসানের জটিল ও কঠিন ফতওয়ার সমস্যাবলীর সমাধান তিনি করতেন। রুমির পিতার উপাধি ছিল সুলতানুল উলামা।
কোনো এক শুভ রাত্রিতে বলখ শহরের প্রায় তিনশত (৩০০) জন সুখ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞ আলেম ও মুফতীগণ একযোগে স্ব স্ব স্থানে অবস্থিত অবস্থায় স্বপ্নে দেখলেন দো-জাহানের সরদার রাসূলে মকবুল (স) একটি সবুজ বর্ণের তাবুর অভ্যন্তরে উপবিষ্ট আছেন। তাঁর পার্শ্বে সুলতান বাহাউদ্দীন ওলাদ উপবিষ্ট রয়েছেন। নবীজীর বিশেষ অনুকম্পা ও মেহেরবানীর স্নেহাশীষে ধন্য হয়েছেন। এমন কি, হুযুরের মোবারক মুখনিঃসৃত বানী ছিল – আমি বাহাউদ্দীনকে ‘সুলতানুল উলামা’ উপাধিতে ভূষিত করে দিলাম।
পরদিন সমস্ত আলেম, মুফতীগণ সুলতানুল উলামাকে এই শুভ স্বপ্ন ব্যক্ত করার জন্য এবং অভিনন্দন জানানোর জন্য তাঁর খেদমতে হাজির হলেন। তিনি বললেন, বেশ! আল্লাহর রাসূল (স) এর জবান মুবারকে শোনার পর তো আপনাদের বিশ্বাস হয়েছে যে, আমি ‘সুলতানুল উলামা’। সুলতানুল উলামা অর্থ আলেমকূলের সম্রাট। বাহাউদ্দীন ওলাদের এলমী মজলিসের নিয়ম-পদ্ধতি শাহী ধরনের ছিল। ভোর থেকে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত সাধারণ দারস, পাঠদান, এবং যোহরের পর বিশিষ্ট সহচরদের সমক্ষে এলম এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূক্ষতত্ত্ব ও গূঢ়রহস্য বর্ণনা করতেন।
তাঁর মুখমন্ডলে ভয় ও ভীতির চিহ্ন প্রকট থাকতো সর্বদা। মনে হতো যে, আখেরাতের ফেকেরে তিনি সর্বদা চিন্তান্বিত। **মাওলানা রুমির পিতার দেশত্যাগ সুলতানুল উলামা বাহাউদ্দিন ওলাদের নপ্রতিপত্তি দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকল, ওয়াজ-নছীহতের প্রতিক্রিয়া সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। মুরীদ ও ভক্তদের সংখ্যা অগনিত হারে বৃদ্ধি পেল। সুলতানুল উলামা বাহাউদ্দীন ওলাদ স্বীয় ওয়াজের মধ্যে ইউনানী বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদের নিন্দাবাদ করতেন, কিছু কিছু লোক আসমানী কিতাব উপেক্ষা করেন বৈজ্ঞানিকদের নিরর্থক উক্তিসমূহকে নিজেদের মত ও পথ হিসাবে গ্রহণ করে ছিলেন।
এই ধরনের লোক কিরূপে মুক্তি ও নাজাতের আশা করতে পারে? জনসমক্ষে এই নিন্দাবাদের কারণে বাহ্যিক এলমের পণ্ডিতদের অন্তরে আঘাত লেগেছিল। তারা সুলতানুল উলামার প্রতি বিরূপ ভাব পোষণ করতে লাগলেন। কিন্তু যেহেতু তৎকালীন বলখের বাদশাহ মোহাম্মদ খাওয়ারেযম শাহ ছিলেন সুলতানুল উলামা বাহাউদ্দীন ওলাদের আত্মীয় এ ভক্ত; সুতরাং রাজদরবারে সুলতানুল উলামার বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ করার সুযোগ তারা পেত না। একদিন বাদশা সুলতানুল উলামার সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে তাঁর খেদমতে হাজির হয়ে দেখলেন, বিরাট জনতার ভীড়।
বাহ্য এলেমের একজন দার্শনিক আলেম বাদশাহের মোসাহেব হিসাৰে সঙ্গে ছিলেন । বাদশাহ তাঁকে বললেন, জনতার এত বড় ভীড় আলেম, ফাযেল, আমীর সরদারের সমন্বয়ে বিরাট জনসমাবেশ! আলেম সাহেব সুযোগ বুঝে তীর ছুড়লেন। তিনি বললেনঃ জি হুযুর! এর কোন ব্যবস্থা না করলে অদূর ভবিষ্যতে রাজকীয় ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে। বাদশাহ খাওয়ারেযমের অন্তরে আলেম সাহেবের এই উক্তিটি রেখাপাত করল। বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, তাহা হলে কি করা উচিত?
আলেম সাহেব পরামর্শ দিলেন যে, ধনভাণ্ডার এবং দূর্গসমূহের চাবিগুচ্ছ সুলতানুল উলামা সাহেবের নিকট পাঠিয়ে দিয়ে বলুন, লোকজনতো সকলেই আপনার, আমার কাছেতো শুধু চাবিগুলি; সুতরাং এগুলিও আপনিই নেন। প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ করা হল। সুলতানুল উলামা(র) এই পয়গাম শ্রবণ করে বিনীতভাবে বললেনঃ ইসলামের বাদশাহকে আমার সালাম জানিয়ে বলবেন, এই অস্থায়ী রাজত্বের ধনভাণ্ডার, লোক-লস্কর বাদশাহদের উপযোগী, আমরা ফকির-দরবেশ। এদের সাথে আমাদের কি সংস্রব? আমি অতি সন্তুষ্টচিত্তে দেশত্যাগ করছি। আগামী শুক্রবার ওয়ায করার পর দেশান্তরিত হব। বাদশাহ পরম সুখে ও সন্তুষ্ট চিত্তে এখানে সাঙ্গপাঙ্গ ও দোস্ত-আহবাবসহ পরমানন্দে রাজত্ব করুক। এই সংবাদ মত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল।
বলখ শহরে হুলস্থুল পড়ে গেল। এতে বাদশাহ অত্যন্ত শংকিত হয়ে পড়লেন। বাদশাহ সুলতানুল উলাম (র) সমীপে দূত প্রেরণ করলেন । রাত্রে বাদশাহ স্বয়ং তার খেদমতে হাজির হয়ে তাকে দেশান্তরের সংকল্প পরিত্যাগ করার জন্য সকাতরে নিবেদন করলেন; কিন্তু মাওলানা বাহাউদ্দিন ওলাদ(র) সংকল্পে দৃঢ়পদ রইলেন এবং বাদশাহর আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। অন্য উপায় না পেয়ে বাদশাহ করজোড় অনুরোধ করলেন, আমার প্রতি দয়াপরশ হয়ে অন্ততঃ এতটুকু করবেন যে, জনসাধারণের অগোচরে আপনি এ কাজ করবেন, অন্যথায় দেশে ভীষণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। মাওলানা বাহাউদ্দিন ওলাদ (র) এই প্রস্তাব মঞ্জুর করলেন।
মাওলানা শুক্রবার ওয়াজ করলেন, ওয়া্জের মধ্যে খাওয়ারেযম শাহের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করে গেলেন যে, আমার যাওয়ার পর মঙ্গোলিয়ার রাজা এই বলখ শহর ভস্মীভূত করার জন্য আসছে। ওয়াজের পর বিশিষ্ট মুরীদগণের মধ্য হতে ৩০০ (তিন শত) জন মুরীদকে সঙ্গে নিয়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লেন। সুলতানুল উলামার দেশত্যাগ করার কিয়ৎকাল পরে মঙ্গোলিয়ার অগণিত তাতারী সৈন্য বলখ। আক্রমণ করল । এই সংঘর্ষে বলখের দশ লক্ষ লোক প্রাণ হারাল। সমগ্র দেশ ছারখার হয়ে গেল। এদিকে মাওলানা হিজরতের পথে যেখানেই পৌছতেন, তথাকার আমীর-উমারা ও রঈস লোকগণ তাঁর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আগমন করতেন এবং অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করতেন।
এইরূপে ৬১০ হিজরী সনে তিনি নিশাপুরে উপনীত হলেন। **সুলতানুল উলামা (র)-এর নিশাপুর গমন নিশাপুরে হযরত খাজা ফরীদুদ্দীন আত্তার (র) সুলতানুল উলামার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তখন মাওলানা জালালউদ্দিন রূমীর বয়স ছিল মাত্র ছয় বৎসর। কিন্তু শৈশবেই তার ললাটে সৌভাগ্য ও বুযুর্গীর লক্ষণ প্রতিভাত হয়েছিল। খাজা ফরীদুদ্দীন আত্তার শেখ বাহারউদ্দীন ওলাদকে বললেন, এই সুযোগ্য রত্নটির প্রতি অবহেলা করবেন না। তিনি স্বরচিত কিতাব “গওহারনামা মাওলানা রূমীকে দান করে বললেনঃ অদূর ভবিষ্যতে এই কিশোর দগ্ধীভূত অন্তরবিশিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত করে দিবে। সুলতানুল উলামা মাওলানা বাহাউদ্দীন ওলাদের মুরীদগণের মধ্যে সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দীন তিরমিযী তত্ত্বজ্ঞানী এবং উচ্চ শ্রেণীর আলেম ছিলেন।
মাওলানা রূমীর পিতা তার শিক্ষা-দীক্ষা ও তরবিয়তের ভার উক্ত সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দীনের উপর অর্পণ করেছিলেন। মাওলানা অধিকাংশ বিষয়ের শিক্ষালাভ সাইয়্যেদ সাহেবের নিকট হতে করেছিলেন; আর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন স্বীয় বুযুর্গ পিতার নিকট হতে। **মক্কা মদীনায় সুলতানুল উলামা মাওলানা রূমীর পিতা সুলতানুল উলামা (র) নিশাপুর হতে বাগদাদে এসে পৌছলেন। কয়েক বছর তথায় অবস্থানের পর হেজায অভিমুখে রওয়ানা হন এবং মক্কা শরীফে উপস্থিত হয়ে হজ্জব্রত পালন করেন। অতঃপর মদীনা শরীফে গিয়ে রওযা পাক জিয়ারত করেন; তদন্তর সিরিয়া হয়ে যানজানে আসেন এবং যানজান হতে কয়েকটি শহর ভ্রমণপূর্বক অবশেষে মালাতিয়া উপস্থিত হন।
তথায় আকশহর অঞ্চলে তিনি চার বৎসর অবস্থান করেন এবং দ্বীন শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত থাকেন। অবশেষে কাউনিয়ার অন্তর্গত লারিন্দা এলাকায় গমন করেন। **বিবাহ বন্ধনে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির জীবনী এ বিবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হিজরী ৬২৩ সনে মাওলানা রুমী (র) সমরকন্দ নিবাসী মাওলানা মরফুদ্দিন সাহেবের কন্যা জাওহার খাতুনের সাথে শুভ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৯ বৎসর।
ঐ বৎসরই মাওলানা প্রথম সন্তান বাহাউদ্দীন সুলতান ওলাদ জন্মগ্রহণ করেন। এই বিবির গর্ভে মাওলানা রূমীর আরও দুইটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। মাওলানার তিন জন সন্তানের নামঃ • বাহাউদ্দীন মােহাম্মদ সুলতান ওলাদ • আলাউদ্দীন মোহাম্মদ • মুযাফফরুদ্দীন। মাওলানা রুমীর এই পত্নীর ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় বিবাহ কেরা খাতুন কাউনাবীর সাথে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিবির গর্ভে একমাত্র কন্যা মালাকা খাতুন জন্মগ্রহণ করেন। "
পেরিয়ার ই. ভি. রামাসামি
ছিলেন একজন ভারতীয় সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ এবং দ্রাবিড় আন্দোলনের জনক, যিনি থান্থাই পেরিয়ার নামেও পরিচিত; তিনি বর্ণবাদ, বর্ণ বৈষম্য, হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও ব্রাহ্মণ্যবাদের কঠোর সমালোচক ছিলেন এবং স্ব-সম্মান আন্দোলন ও দ্রাবিড় কাজগম প্রতিষ্ঠা করেন, যা দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
রামস্বামীর এইটি একটি বিখ্যাত উক্তি:
(ঈশ্বরের অস্তিত্ব কেবল টাকায়! যদি মন্দির, মসজিদ, গীর্জায় পয়সা দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ছয় মাসেই ঈশ্বর বিলুপ্ত হয়ে যাবে!) পেরিয়ার ই.ভি. রামস্বামীর একটি বিখ্যাত উক্তি, যা তাঁর নাস্তিকতা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক, এবং এটি সামাজিক মাধ্যমেও প্রায়শই উদ্ধৃত হয়.
উক্তিটির মর্মার্থ:
পেরিয়ার বোঝাতে চেয়েছেন যে ধর্ম ও ঈশ্বরের ধারণা টিকে থাকে মূলত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ও ভক্তদের অনুদানের ওপর ভিত্তি করে; যদি এই অর্থনৈতিক ভিত্তি সরিয়ে নেওয়া হয়, তবে ধর্ম ও ঈশ্বরের ধারণা দ্রুত বিলীন হয়ে যাবে.
উৎস:
এটি তাঁর বহু বক্তৃতার অংশ এবং তাঁর লেখা ও চিন্তাভাবনার মূল বিষয়বস্তু, যা ধর্মীয় কুসংস্কার ও শোষণকে চ্যালেঞ্জ করতো।
মূল পরিচিতি:
পুরো নাম: ইরোড ভেঙ্কটপ্পা রামাসামি।
জন্ম: ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৯, ইরোড, তামিলনাড়ু।
মৃত্যু: ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৩।
উপাধি: 'পেরিয়ার' (যার অর্থ 'বয়োজ্যেষ্ঠ' বা 'সম্মানি ব্যক্তি')।
জীবনী:
পেরিয়ার রামস্বামীর জন্ম তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত মাদ্রাজে ১৮৭৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। তারা ছিলেন এক ভাই ও দুই বোন। ছোটবেলায় স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তার শিক্ষাজীবন দীর্ঘ হয়নি। ১২ বছর বয়সে বিদ্যালয় ত্যাগ করে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন। তবে বাড়িতে অপ্রথাগত শিক্ষা ছেলেবেলা থেকে তার অন্তর্দৃষ্টি নির্মাণে সাহায্য করে। দ্রাবিড় জাতির মানুষ হিসেবে দক্ষিণ ভারতের তিনটি ভাষা কন্নড়, তেলুগু এবং তামিল ভাষা ভালোভাবে শিখেছিলেন।
১৯০৪ সালের একটি ঘটনা তার জীবনের মোড় পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এসময় তিনি কাশীতে তীর্থদর্শন করতে বিশ্বনাথ শিবমন্দিরে যান। এসময় ক্ষুধার্ত অবস্থায় মন্দিরের ভোজে অংশগ্রহণ করতে চাইলে ব্রাহ্মণ না হবার কারণে লাঞ্ছিত হন। পরিস্থিতির ফলে তাকে নিরুপায় হয়ে রাস্তার পরিত্যক্ত খাবার তুলে খেতে হয়। এ ঘটনার পর তিনি তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান সামাজিক লোকাচার ও জীর্ণ প্রথার অন্ধ অনুকরণ নিয়ে ভাবতে বাধ্য হন। তদুপরি জাতিভেদ ও ব্রাহ্মণ শূদ্রের অমানবিক ভেদাভেদ তার মনকে বিষিয়ে তোলে। এভাবেই তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
তার কর্মনিষ্ঠা ও জনকল্যাণমূলক কাজ তাকে ক্রমান্বয়ে জাতীয় রাজনীতির দিকে নিয়ে আসতে থাকে। ১৯১৯ সালে তিনি জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি সক্রিয়ভাবে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। খাদি কাপড়ের প্রচার, বিদেশী পণ্যের দোকানে পিকেটিং, অস্পৃশ্যতা দূর করা, রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানো এসব ছিলো তার লক্ষ্য। তবে ‘বৈকম সত্যাগ্রহ’ তার জীবনে সাড়া জাগানোর মতো অন্যতম একটি ঘটনা। বর্তমান কেরালা রাজ্যের বৈকম শিবমন্দির ছিল জাতিভেদ প্রথার জঘন্য এক দৃষ্টান্ত।
ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণ ছাড়া নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য মন্দিরে প্রবেশ তো দূরের কথা, মন্দিরের রাস্তা দিয়ে চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা ছিলো। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কিছু নেতা এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২৪ সালের ৩০ মার্চ এই আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের নেতাগণ নিম্নবর্ণের বহুসংখ্যক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরে প্রবেশের চেষ্টা করলে মন্দির কর্তৃপক্ষ বাধা দেয় এবং পুলিশ নেতাদের গ্রেফতার করে।
পেরিয়ার রামস্বামী আন্দোলনে সক্রিয় সমর্থন জানাতে তৎকালীন মাদ্রাজ থেকে বৈকম এলে ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর গ্রেফতার হন। এর ফলে দেশব্যাপী এ আন্দোলনে সমর্থন বাড়তে থাকে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী প্রথমে এ আন্দোলনে সমর্থন দিলেও পরে দ্বিমত পোষণ করেন। পেরিয়ার রামস্বামী বুঝতে পারলেন, রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কংগ্রেস কায়েমী স্বার্থের বাইরে আসতে পারবে না। ১৯২৫ সালে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন।
দক্ষিণ ভারতে ‘সাউথ ইন্ডিয়ান লিবারেশন ফেডারেশন’ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতিভেদ ও ব্রাহ্মণ আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছিলো। পেরিয়ার রামস্বামী এই দলে যোগ দেন এবং আন্দোলন বেগবান করতে সাহায্য করেন। হিন্দুদের আক্রমণ প্রতিহত করা, দ্রাবিড় পরিচয় সচেতনতা, জাতিভেদের অন্ধকার দূর করা, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য দূর করার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১৯৩৯ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পৃথিবীর অনেক দেশ পরিভ্রমণ করেন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে এসময় তার আস্থা গড়ে ওঠে।
১৯৩৭ সালে মাদ্রাজে কংগ্রেস নেতা চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী মুখ্যমন্ত্রী হলে হিন্দিকে প্রদেশের আবশ্যিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেন। পেরিয়ার রামস্বামী সহ জাস্টিস পার্টির আরো অনেক নেতা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। সরকার এ আন্দোলনের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। পেরিয়ায় তামিলনাড়ুতে হিন্দির প্রচলনকে সুদূর অতীতের আর্য আক্রমণের সাথে তুলনা করেন এবং ‘তামিলনাড়ু শুধু তামিলদের জন্য’ স্লোগান তোলেন। তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৪৪ সালে পেরিয়ার রামস্বামী জাস্টিস পার্টির প্রধান হিসেবে এই দলের নাম বদলে ‘দ্রাবিড়ার কাঝাগম’ বা ‘দ্রাবিড়িয়ান এসোসিয়েশন’ রাখেন। এই সংগঠনের কর্মক্ষেত্র শহর ও গ্রাম সবক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছিলো। এর অন্যতম প্রধান কাজ ছিলো দ্রাবিড় সংস্কৃতির প্রচার, হিন্দির আক্রমণ প্রতিরোধ, তামিল সংস্কৃতি ব্রাহ্মণদের প্রভাবমুক্ত করা, জাতিভেদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা ও দ্রাবিড়ভাষীদের মধ্যে সংহতি বৃদ্ধি করা। এর কাজের পরিধি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও উত্তর ভারতের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নে দলটি দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদল নমনীয় সদস্য পেরিয়ারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘দ্রাবিড়া মুন্নেত্রা কাঝাগম’ নামে পৃথক একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন।
পেরিয়ার রামস্বামী আজীবন একজন পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। বৈষম্যের বিরোধিতা করা, দমনমূলক সংস্কৃতির সমালোচনা করা এবং সাধারণ মানুষের অন্তর্দৃষ্টি উন্মীলনে তিনি তার রাজনৈতিক জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ ও সংস্কৃতি বিষয়ে অভিমত সবসময় বিতর্কের উর্ধ্বে থাকেনি।
১৯৫৬ সালে তামিলনাড়ুতে এক মিছিলে তিনি হিন্দু অবতার রামচন্দ্রের ছবিতে অগ্নিসংযোগের ঘোষণা দেন। তামিলনাড়ুর প্রাদেশিক সরকার এই মিছিলে নিষেধাজ্ঞা দিলেও তিনি অটল থাকেন। ফলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সনাতন ধর্মে ব্রাহ্মণের আধিপত্যকে তিনি আর্য বা ইন্দো-ইউরোপিয় আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন এবং দ্রাবিড় ও তামিল সংস্কৃতিকে এসব থেকে মুক্ত করাকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন।
তার বক্তব্য অনেক সময়ই বিচ্ছিন্নতাবাদী ও অন্ধ প্রাদেশিকতার দোষে আক্রান্ত বলে মনে করা হয়েছে। উপরন্তু উত্তর ভারতীয় ও দ্রাবিড় সংস্কৃতির পার্থক্য তিনি যত মোটা দাগে পার্থক্য করেছেন, এখনকার নৃবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদগণ এতটা মোটা দাগে তা করেন না। কিন্তু এসব বিষয় বাদ দিলে দ্রাবিড় জাতির আত্মসচেতনতা বৃদ্ধির রাজনীতিতে তার অবদান অনস্বীকার্য।
নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে পেরিয়ার রামস্বামী আজীবন সোচ্চার ছিলেন। বর্ণাশ্রম ও অন্যান্য সামাজিক অন্যায়ের ফলে নারীদের অবস্থা নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা তার হয়েছিলো। তার অভিমত ছিলো, যুগ যুগ ধরে ব্রাহ্মণ-আধিপত্যমূলক শাসনের ফলে অনাচার ও কুসংস্কার সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জালের মতো ছড়িয়ে গেছে। যার অন্যতম বিষফল ছিল ক্ষমতাবান পুরুষ কর্তৃক নারী শোষণ ও সমাজে সংস্কৃতিতে তার বৈধতা তৈরি হওয়া।
পেরিয়ার এসব অনাচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে গ্রামে গ্রামে গিয়েছেন, সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার আন্দোলন তামিল ও দ্রাবিড় সমাজে নারী জাগরণ ও ক্ষমতায়নে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলো। দলিত ও অস্পৃশ্যতাবিরোধী আন্দোলনেও তিনি অবদান রেখেছেন। দলিত আন্দোলনের নেতা ভীমরাও আম্বেদকর তার চিন্তার সমাদর করতেন। তিনি দলিতদের মানবেতর জীবনের জন্য হিন্দু সমাজের অনড় জাতিভেদকে দায়ী করেছেন এবং দলিত ও দ্রাবিড় জাতির আদি ইতিহাসের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে চেয়েছেন। যদিও তাঁর এই দৃষ্টিকোণ কিছুটা একদেশদর্শী ছিলো।
পেরিয়ার রামস্বামী দুই বিয়ে করেন। ১৯ বছর বয়সে তার পিতা তাকে বিয়ে দেন। তার স্ত্রী নাগাম্মাই স্বামীর চিন্তাধারাকে শ্রদ্ধা করতেন এবং রাজনীতিতে সহযাত্রী হতে চাইতেন। ১৯৩৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি মানিয়াম্মাইকে বিয়ে করেন। তিনিও তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিলেন, পেরিয়ারের মৃত্যুর পরও তার দলের সাংগঠনিক কাজে তিনি সময় ব্যয় করেছেন। পেরিয়ার রামস্বামী ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তামিলনাড়ুতে আজও তিনি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। তাকে আধুনিক তামিলনাড়ুর ‘জনক’ এর মর্যাদা দেওয়া হয়।
কর্মজীবন ও অবদান:
দ্রাবিড় আন্দোলন:
তিনি তামিল, তেলেগু ও অন্যান্য দ্রাবিড় ভাষাভাষীর মানুষের অধিকার ও স্বাতন্ত্র্যের জন্য দ্রাবিড় আন্দোলন শুরু করেন।
সামাজিক সংস্কার:
জাতিভেদ প্রথা, সামাজিক অসমতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেন।
ধর্মীয় অবস্থান:
তিনি হিন্দুধর্মের বর্ণভিত্তিক কাঠামো ও ব্রাহ্মণ্যবাদের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং নাস্তিকতা ও যুক্তিবাদে বিশ্বাস করতেন।
রাজনৈতিক জীবন:
তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিলেও পরে তা ত্যাগ করেন কারণ তিনি মনে করতেন কংগ্রেস অ-ব্রাহ্মণদের স্বার্থ রক্ষা করছে না।
সংগঠন:
তিনি 'স্ব-সম্মান আন্দোলন' (Self-Respect Movement) এবং 'দ্রাবিড় কাজগাম' (Dravidar Kazhagam) প্রতিষ্ঠা করেন।
গুরুত্ব:
পেরিয়ার দক্ষিণ ভারতের আধুনিক রাজনীতি ও সামাজিক চেতনার অন্যতম প্রধান স্থপতি হিসেবে বিবেচিত হন।
তাঁর দর্শন মানবিক সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তথ্য সংগ্রহ: মৃণাল নন্দী
প্রাচীন ঐতিহাসিক যুগ থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ–সপ্তম শতক পর্যন্ত আজকের বাঙলাদেশ বহু স্বতন্ত্র জনপদে বিভক্ত ছিল—পুণ্ড্র, গৌড়, রাঢ়, সুহ্ম, সমতট, বঙ্গ, তাম্রলিপ্তি প্রভৃতি—যাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ছিল, তবে সময়ের প্রবাহে এই বিচ্ছিন্ন পরিচয়গুলো ধীরে ধীরে বৃহত্তর একক ধারণার মধ্যে মিলিত হতে থাকে; সপ্তম শতকের শুরুতে শশাঙ্ক গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করে প্রথমবারের মতো বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎকল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং যদিও ‘গৌড়’ নামটির ব্যবহার ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি থেকেই দেখা যায়, শশাঙ্কই একে ঐতিহাসিক মর্যাদা দেন; পরবর্তীকালে পাল ও সেন রাজারা নিজেদের ‘বঙ্গপতি’ বললেও ‘গৌড়েশ্বর’ উপাধিকেই অধিক সম্মানজনক মনে করতেন, ফলে রাঢ় ও পুণ্ড্রবরেন্দ্রীর মতো প্রাচীন জনপদগুলোর স্বতন্ত্র পরিচয় গৌড় নামের মধ্যেই বিলীন হতে থাকে, আর অষ্টম শতক থেকে পুণ্ড্র, গৌড় ও বঙ্গ—এই তিনটি নাম সমগ্র বাঙলাদেশের প্রতিশব্দে পরিণত হয়; যদিও পরবর্তীকালে গৌড় শব্দটি বাংলার একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এবং বাংলার বাইরে বাঙালিদের ‘গৌড়ীয়’ বলা হলেও শেষ পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলের পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ‘বঙ্গ’ নামটি, যা মুসলিম শাসনামলে বিস্তৃত হয়ে আকবরের আমলে সরকারিভাবে সুবাহ বাংলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ইংরেজ শাসনামলে ‘বাংলা’ নামটি চূড়ান্ত ও সর্বজনীন পরিচয়ে রূপ নেয়।
মধ্যযুগের সুলতানি আমলে বাংলার সাহিত্যচর্চা কেবল ইসলামি বিষয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না। মুসলিম শাসকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু ধর্ম, পুরাণ ও লোকবিশ্বাসভিত্তিক বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচিত ও অনূদিত হয়। এটি তৎকালীন বাংলায় ধর্মীয় সহাবস্থান ও সাংস্কৃতিক উদারতার একটি স্পষ্ট প্রমাণ। রাজদরবারের আশ্রয়ে বহু হিন্দু কবি ও পণ্ডিত তাঁদের সৃষ্টিকর্ম প্রকাশের সুযোগ পান।
রামায়ণ — অনুবাদক: কৃত্তিবাস ওঝা — পৃষ্ঠপোষক: জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহ
শ্রীকৃষ্ণবিজয় — অনুবাদক: মালাধর বসু — পৃষ্ঠপোষক: রুকনউদ্দিন বরবক শাহ
মনসাবিজয় — রচয়িতা: বিপ্রদাস পিপিলাই — পৃষ্ঠপোষক: আলাউদ্দিন হোসেন শাহ
মনসামঙ্গল — রচয়িতা: বিজয়গুপ্ত — পৃষ্ঠপোষক: আলাউদ্দিন হোসেন শাহ
শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল — রচয়িতা: যশোরাজ খান — পৃষ্ঠপোষক: আলাউদ্দিন হোসেন শাহ
মহাভারত — অনুবাদক: কবীন্দ্র পরমেশ্বর — পৃষ্ঠপোষক: নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহ
কীর্তিলতা সহ অন্যান্য গ্রন্থ — রচয়িতা/অনুবাদক: বিদ্যাপতি — পৃষ্ঠপোষক: নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহ
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যার কোনো স্থির ইতিহাস-চেতনা নেই। এক একটি সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের ছেলেমেরা নিজের দেশের এক নতুন ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হয়। এটি শুধু হাস্যকরই নয়, এভাবে নিজের দেশের ইতিহাস বিষয়ে অস্থিতিশীলতা এবং বিভ্রান্তি নিয়ে তরুণ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। সত্যি বলতে, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য একটা টাইম বোমা।
ডাচ লেখক ও গবেষক ভিলেম ভ্যান শেন্ডেল আরো বলেছেন,
ইতিহাস মানে তো শুধু পেছনের দিনগুলোর দিকে তাকানো নয়, ইতিহাস হতে পারে একটি সমাজের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সমস্যা সমাধানের পাথেয়। বাংলাদেশে তাই যথার্থ পেশাদার ইতিহাস-গবেষক প্রয়োজন এবং প্রয়োজন সেই গবেষকদের কথা শুনবার মতো শ্রোতা।
বাঙালি সম্পর্কে গোপন প্রতিবেদন
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বাংলার মানুষের চরিত্র এবং সমাজ সম্পর্কে প্রায় ২০০ বছর আগের গোপন প্রতিবেদনগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বাংলার মানুষের মধ্যে অনিয়ম, দুর্নীতি, মিথ্যা কথা, লোক ঠকানো, অবিশ্বাস এবং নৈতিক অবক্ষয়ের ব্যাপক চিত্র ফুটে উঠেছে। সেই সময়কার বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিচারকদের মতামত থেকে বোঝা যায়, বাংলার সমাজে সৎ ও সত্যবাদী মানুষের সংখ্যা কম, এবং সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় গভীর ছিল। বিশেষ করে, লোকসাধারণের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব এবং স্বার্থপরতা, ঘৃণা, বিবাদ, নিন্দাবাদ ও মামলাবাজি ছড়িয়ে পড়েছিল।।
ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল এবং রাজস্ব বিশেষজ্ঞ স্যার জন সোর 1784 সালে তার প্রতিবেদনে লিখেন বাঙালিরা ভীরু এবং দাসসুলভ তবে অধস্তনের প্রতি আবার ব্যাপক চোটপাট নেয়। ব্যক্তি হিসেবে মানসম্মানবোধ কম। জাতি হিসেবে এদের মধ্যে জনকল্যাণমূলক মনোভাব একেবারে নেই। যেখানে মিথ্যা কথা বললে কিছু সুবিধা হতে পারে সেখানে অনর্গল মিথ্যা বলতে এদের একটুও বাঁধে না। যেখানে শাস্তির ভয় নেই সেখানে মনিবের কথাও শুনতে গিরিমশি করে। তিনি আরো লেখেন বাঙালি মনে করে চালাকি এবং কূটকৌশলী জ্ঞানের পরিচয়ক লোক ঠকানো এবং ফাঁকি দেওয়াও গুণ। এর প্রায় এক দশক পর 1792 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান চার্লস গ্রান্ড তার 20 বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেন বাঙালিদের মধ্যে সততা সত্যবাদিতা এবং বিশ্বস্ততার বড়ই অভাব। স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিথ্যা বলা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার সাধারণ কাজেও । লোক ঠকানো , ফাঁকি দেওয়া , ধোঁকা দেওয়া , চুরি করা একটা সাধারণ ঘটনা। তিনি আরো লিখেছিলেন জীবনের সর্বক্ষেত্রেই চলে প্রবঞ্চনা প্রতারণা ফাঁকিবাজি; সেই সঙ্গে রয়েছে কাজে দীর্ঘশত্রতা ,জালিয়াতি, জুটচুরি চলে নির্দ্বিধায়। চার্লস গ্র্যান্ড আরো লিখেন , অন্যের ক্ষতি করার প্রবৃত্তি বাঙালি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । এমন পরিবার খুব কম আছে , যেখানে বিষয় সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ নেই । এরা অশ্রাব্য গালাগাল করে মনের ঝাল মেটায়। তার ভাষায়, আইন প্রয়োগ করেও বাঙালির চরিত্রগত অধঃপতন ও দুর্নীতি নির্মূল করা দূর হয় না। নীতিহীন স্বার্থপরতার এই সমাজে ছড়িয়ে আছে ঘৃণা বিবাদ নিন্দাবাদ মামলাবাজি। 200 বছরের বেশি সময় পরও এসব কথাকে অস্বীকার করা যাবে কি?
এর প্রায় 10 বছর পর 1801 সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসল বাংলার জেলা জজ এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে একটি প্রশ্নমালা বা কোশ্চেনার পাঠান। যার একটি অংশে প্রত্যেক জেলার অধিবাসীদের নৈতিক চরিত্র ও স্থানীয় অপরাধ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হয়। এ রিপোর্ট থেকে গোটা বাংলাদেশের মানুষদের সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ের সব বিচারকদের মতেও "বাঙালিরা কপট অকৃতজ্ঞ এবং মিথ্যাচারে নিমজ্জিত। সাধারণ মানুষ অসহায় ও নির্বিকার। সে সময় যশোরের বিচারক লিখেন- পুলিশ বাহিনী ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন। কর্মচারীদের সঙ্গে চোর ডাকাতদের যোগ সাজস রয়েছে; সাক্ষ্য দিলে জামেলা হওয়ার আশঙ্কা থাকায় লোকে সাক্ষ্য দিতে ভয় পায়। ঢাকার বিচারক জানান- শহরে তেমন মারাত্মক অপরাধ নেই, তবে যাদের টাকা-পয়সা খরচ করবার মত ক্ষমতা আছে; তারা সাধারণত ভোগবিলাসী, লম্পট। বাঘরগঞ্জ বা আজকের বরিশালের বিচারক লিখেন- এই জেলার অধিবাসীদের নৈতিক চরিত্র অতি জঘন্য। এমন কোন জোটচুরি নেই যা উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে দেখা যায় না। নিম্নশ্রেণীর মধ্যে আছে চুরি-ডাকাতি; শাস্তির ভয় এদেরকে সংযত করতে পারে। নীতি শিক্ষা বা আদর্শ এদের কখনোই সৎপথে চালিত করতে পারবে না। ত্রিপুরা বা আজকের কুমিল্লার বিচারকের মতামত- এখানকার অধিবাসীদের নৈতিক চরিত্র অতিশোচনীয়, এরা ইতর বিশেষ। রাজশাহীর বিচারকের মতে- যুবক থেকে বৃদ্ধ প্রায় সবার মধ্যেই চলচাতুরির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই দোষ সংশোধন করা কঠিন। জামালপুরের বিচারক বলেছিলেন, বাল্যকালে নীতি শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। ধৈর্যশক্তি বা সংযমের শিক্ষাও দেয়া হয় না, এটাই অপরাধ প্রবণতার কারণ। আরেক চিঠিতে তিনি লিখেন- নৈতিক কর্তব্য সম্পর্কে এদের কোন ধারণাই নেই। সাধারণ লোকেরা ছলচাতুরি করে চলে, এরা অলস ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ। নিঃশংস অথচ কাপুরুষ, উদ্ধত আবার হীনমন্য। রংপুরের বিচারক লিখেন- এখানকার লোকেরা বেশিরভাগে অত্যন্ত অলস, অজ্ঞ এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অনেক সময় প্রতিহিংসা পরায়ণ ,স্বার্থপর, মিথ্যাচারী ও নির্লজ্জ। জালিয়াতি ও ফাঁকিবাজিকে এরা খুব চালাক কাজ বলে মনে করে। এ কারণে পরিবারেও একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারে না।
আজও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, বিচারক, আইনজ্ঞ , চিকিৎসক , প্রকৌশলী, ডাক্তার, শিক্ষক বা ব্যবসায়ী সব জায়গায় একই চিত্র। যেন এক ধরনের সামঞ্জস্যহীন প্রতিযোগিতা চলছে- কে কাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে? নিয়ম কানুনের বালাই নেই? সে সময় সমাজ হিন্দু ও মুসলিম দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। কয়েকশো বছর শাসন করেছে মুসলিম শাসকরা। হিন্দুদের সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়- এরা ডাহা মিথ্যা বলতে পারে; চাকরের মত তোষামোদ করতে পারে। শিক্ষা কেবল তাদের নিজ ভাষা ও ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মুসলমানদের সম্পর্কে বলা হয়- তাদের শিক্ষা কিছুটা ছিল কিছু নীতিকথা শিখলেও সেগুলো মেনে চলে না। সাধারণ থেকে দেওয়ান পর্যন্ত সবার কাজ হলো কথা গোপন করা, অন্যকে ফাঁকি দেওয়া। ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সেই প্রতিবেদনগুলো তৈরি করা হয়েছিল প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থা পরিচালনার স্বার্থে। কর্মকর্তা কর্মচারীদের যাতে মানুষকে বুঝে শুনে কাজ করতে পারেন; বাঙালিকে অপমান করার উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। এসব প্রতিবেদন তাই তারাও প্রচারও করেনি।
আবার বিভিন্ন যুগে পর্যটক সমাজতাত্ত্বিক এবং রাজনীতিবিদরা নানাভাবে বাঙালির চরিত্র বর্ণনা করেছেন। এসব বিশ্লেষণে রয়েছে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, কেউ বলেছেন- বাঙালি ঝগড়াটে ও বিপ্লবী। কারো মতে বাঙালি কল্পনাবিলাসী, বাস্তব বিমুখ, অলস। কারো কারো ধারণা বাঙালি গুজবপ্রিয় ও আত্মকেন্দ্রিক। তবে একটা কথা সত্য-বাঙালির কোন নৈতিকতা নাই এবং বাঙালি কিছু না করেই সবকিছু অর্জন করতে চায় ফাঁকির মাধ্যমে।
বাঙালি একটি শংকর জাতি, এরা
‘জাতি ও সম্প্রদায়ের’ পার্থক্যও বোঝে না
---------------------------------------------
নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে বিশ্বের প্রধান চারটি নরগোষ্ঠী(নিগ্রীয়, মঙ্গোলীয় ককেশীয়, অস্ট্রেলিয়) প্রতিটির কোনো না কোনো শাখার আগমন ঘটেছিল
এ বাংলায়। ফলাফল বাঙালি একটি শংকর জাতি। যে কারণে এখানে চেহারার ভিন্নতা ভীষণ লক্ষনীয়। চীনা, জাপানি, কোরিয়ান এদের সবার চেহারার মধ্যে আপাত একটি মিল থাকে। ইংরেজদের দেখে চেনা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকদের চিহ্নিত করার উপায় নেই। বেঁটে-লম্বা-ফর্সা কালো, খাড়া- নাক-চ্যাপ্টা, নাক, প্লেইন চুল- কোঁকড়া চুল। চেহারার সাথে সাথে এদের রুচি, মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর ফারাক। এ কারণে বাঙালির মধ্যে জাতীয় ঐক্য নেই,জাতীয় চরিত্রই নেই। এ জাতির মধ্যে কোনো শৃঙ্খলাও নেই।
গোলাম মুরশিদ তাঁর হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি নামক গ্রন্থের লিখেছেন, অতীতে বাঙ্গালীরা ছিলেন বেশিরভাগই বৌদ্ধ, তারা দাক্ষিণাত্য থেকে আসা হিন্দু সেন রাজাদের অধীনে। এঁদের পরে আসেন মুসলমান শাসকরা। এই হিন্দু ও মুসলমান শাসকদের মন জুগিয়ে হাজার হাজার বাঙ্গালীকে কাজ করতে হয়েছে। ইংরেজ আমলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পর থেকে কিছু শিক্ষিত বাঙ্গালী একটি উদারনৈতিক সমাজ গড়তে চেষ্টা করলেও ইংরেজদের কাছে ‘সাহেব আমার বাপ মা’ বলে আনুগত্য প্রকাশ করতেন মাথা নিচু করে। বাঙালিদের এই প্রবণতা ব্রিটিশরা বিদায় হওয়ার পর দেখা যায়। ব্রিটিশদের বদলে পাকিস্তানিদের তোষামোদ করত। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই জাতির অনেকে ‘জাতি ও সম্প্রদায়ের’ পার্থক্যও বোঝে না। নিজেদের মুসলিম জাতি বলেও পরিচয় দেয় অনেকে। একজন বাঙালি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও সে জাতিতে বাঙালি, সম্প্রদায়গতভাবে মুসলিম। যেমন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে কেউ ইংরেজী জাতি (একজন) হতে পারে না।
বাঙ্গালি হিন্দু জাতীয়তাদের অন্যতম প্রবক্তা বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপধ্যায় তার স্বজাতি স¤পর্কে বলেছেন, “কোন কোন ঋষির মত এই যে, যেমন বিধাতা ত্রিলোকের সুন্দরীগণের সৌন্দর্য তিল তিল করে সংগ্রহ করিয়া তিলোত্তমার সৃজন করিয়াছিলেন; সেইরূপ পশুবৃত্তির তিল তিল করিয়া সংগ্রহপূর্বকেই অপূর্ব বাঙ্গালি চরিত্র সৃজন করিয়াছেন। শৃগাল হইতে শঠতা, কুক্কুর হইতে তোষামুদ ও বানর হইতে অনুকরণপটুতা এ জাতির।
ড. হুমায়ুন আজাদ বাঙ্গালি চরিত্র চিত্রায়ণ করতে গিয়ে লিখেছেন: “বাঙ্গালি পৃথিবীর সবচেয়ে অহমিকাপরায়ণ জাতিগুলোর একটি, বাস করে পৃথিবীর এককোণে; ছোটো, জুতোর গুহার মতো ভূভাগে;- খুবই দরিদ্র, এই বাঙ্গালি ভোগে অহমিকারোগে, নিজেকে বড়ো ভাবার ব্যাধিতে আক্রান্ত বাঙ্গালি। জাতি হিশেবে বাঙ্গালি বাচাল ও অপ্রয়োজনেও প্রচুর কথা বলে।
বাঙ্গালি চরিত্র বিশ্লেষণে একজন ভারতীয় কবি বলেছেন, “তুমি যদি কোনোকিছুকে লম্বা করতে চাও তাহলে বাঙ্গালির কথা শোনো।
রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘সপ্তকোটি সন্তানের হে বিমুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙ্গালী করে মানুষ করোনি।’ শিক্ষা-দীক্ষায়, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে লেখাপড়ায়, অর্থবিত্তে রবীন্দ্রনাথের আমলে চেয়ে এখনকার বাঙ্গালীরা অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের মন ও মননশীলতার কি কোন পরিবর্তন হয়েছে? বাঙ্গালী চরিত্র স¤পর্কে লর্ড মেকলে’ বলেছিলেন, ‘মহিষের যথা শৃঙ্গ, মৌমাছির যথা হুল, ব্যাঘ্রের যথা থাবা, বাঙ্গালী জাতির তদ্রুপ বড় বড় প্রতিজ্ঞা আর প্রতিশ্রুতি, অজুহাত, ছলচাতরি, মিথ্যা, জালিয়াতি এইগুলো হচ্ছে বাঙ্গালীর চিরন্তন অস্ত্র। আজ বাংলাদেশে যে চরিত্রগুলো দেখছি সেগুলো কি মেকলে’র দেখা চরিত্র থেকে ভিন্ন? পাঠকরাই বিবেচনা করুন। ।
খাবার সংরক্ষণে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল
আপনি কি খাবার সংরক্ষণের জন্য নিয়মিত অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ব্যবহার করেন? তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এই ফয়েল খাদ্যে বিষক্রিয়াসহ নানা সমস্যা ডেকে আনতে পারে। মনে রাখবেন, চকচকে মানেই স্বাস্থ্যকর নয়।
অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল কী
দোকানপাট থেকে শুরু করে ফুডকোর্ট—বিভিন্ন জায়গায় অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দেখা যায়। কিন্তু অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের মূল উপাদান হলো অ্যালুমিনিয়াম (৯৮.৫%)। সঙ্গে মেশানো থাকে লোহা ও সিলিকন।
এতে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত জন্মায়
অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল নিজে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে না। তবে ফয়েলগুলো দিয়ে যেভাবে খাবার ঢেকে রাখা হয়, তাতে ব্যাকটেরিয়া বাড়তে পারে।স্টাফ (লাল মাংস ও হাঁস-মুরগিতেও পাওয়া যায়) এবং ব্যাসিলাস সেরিয়াস (উচ্ছিষ্ট ভাত এবং অন্যান্য স্টার্চযুক্ত খাবারে থাকে) হলো দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যেসবের বৃদ্ধি এবং বংশবিস্তারের জন্য বাতাসের প্রয়োজন হয়। এই দুটি জীবাণুই উচ্চ তাপমাত্রায় খাবার আবার গরম করলেও মরে যায় না।
খোসাসহ আলু বেক করা যাবে না। কারণ, খোসায় ময়লা এবং ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধে। তবে রান্না করার সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে ফেললে খোসাসহ আলু নিরাপদ।
ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনাম নামক জীবাণুর দেহ থেকে যে বিষাক্ত পদার্থ নিঃসৃত হয়, তা আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বটুলিজম পুরোনো আলুতে বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফ্রিজে দীর্ঘদিন আলু রেখে দিলে তাতে বটুলিজম হওয়ার ঝুঁকি সদ্য রান্না করা আলুর চেয়ে বেশি। কারণ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ে।
খাদ্যে অ্যালুমিনিয়াম ঢুকে পড়তে পারে
অম্লজাতীয় খাবার, যেমন টমেটো সস অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলকে ক্ষয় করে। ফলে খাবারে অ্যালুমিনিয়াম ঢুকে পড়তে পারে। অ্যালুমিনিয়াম স্নায়ুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। খাদ্যের মাধ্যমে এই ধাতু মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রে জমে থাকতে পারে।গবেষণায় দেখা গেছে, আলঝেইমার্স ডিজিজে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে অ্যালুমিনিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলকে সরাসরি খাদ্যের সংস্পর্শে রাখা যাবে না। খাবার সংরক্ষণের জন্য কনটেইনার ব্যবহার করাই উত্তম।
কীভাবে খাবার সংরক্ষণ করা নিরাপদ
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) মতে, বায়ুরোধী পাত্র কিংবা সিল করা স্টোরেজ ব্যাগে খাবার সংরক্ষণ করা সবচেয়ে নিরাপদ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। কাঁচা সবজি, গোল আলু, মিষ্টি আলু, পেঁয়াজ, রসুন দিয়ে ঘরে তৈরি সস বা এ–জাতীয় খাবার বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করা যাবে না। অক্সিজেনের অভাবে ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনিয়াম দ্রুত জন্মে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সদ্য রান্না করা খাবার খাওয়ার আগে দুই ঘণ্টার বেশি ফ্রিজে রাখা উচিত নয়। ফ্রিজে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা বেঁচে যাওয়া খাবার তিন-চার দিনের মধ্যে খেয়ে ফেলতে হবে। ফ্রোজেন খাবার ছয় মাসের বেশি রেখে দেওয়া অনুচিত। সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট
কালো প্লাস্টিকের পাত্র কেন বেশি বিপজ্জনক
মার্কিন গবেষণা ও পরামর্শক সংস্থা ‘টক্সিক-ফ্রি ফিউচার’-এর এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। কালো প্লাস্টিকে একধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা আগুন ধরার ঝুঁকি কমানোর জন্য প্লাস্টিকে মেশানো হয়। কালো প্লাস্টিকে ডেকা-বিডিই, টিবিবিপিএ এবং আরডিপির মতো রাসায়নিক থাকে। এসব বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির জন্য অনুমোদিত। কিন্তু আমরা গবেষণায় দেখেছি, রিসাইকেল (পুনর্ব্যবহার) প্রক্রিয়ায় এসব প্লাস্টিক খেলনা, খাবার প্যাকেজিং ও রান্নার সরঞ্জামের মতো পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো এসব পণ্যে ছড়িয়ে পড়ছে, যা তৈরি করছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি।রাসায়নিকগুলো আমাদের শরীরে ও খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়ছে। স্বল্প মাত্রায়ও এসব রাসায়নিক শরীরের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। গবেষণায় উঠে এসেছে, এর ফলে ক্যানসার, হরমোনজনিত সমস্যা, স্নায়বিক ক্ষতি, প্রজনন ও বিকাশজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বেষকেরা কালো প্লাস্টিক ঘর থকে সরিয়ে ফেলতে বলছেন। তাঁরা এটির পুনর্ব্যবহারকেও নিরুৎসাহিত করছেন। এর পরিবর্তে স্টেইনলেস স্টিল বা কাঠের তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
অভিভাবকদের শিশুর খেলনার ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে। প্লাস্টিকের খেলনার পরিবর্তে অন্য কোনো উপাদানে তৈরি খেলনা খুঁজে নিতে বলেছেন গবেষকেরা।
কমোডের ঢাকনা তুলে রাখা উচিত নাকি নামিয়ে
অনেকেই মনে করেন, টয়লেট ফ্লাশ করার সময় কমোডের ঢাকনা নামিয়ে রাখলেই বুঝি স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি বজায় থাকে। বিজ্ঞান বলছে, আসল ব্যাপারটা বেশ জটিল। ‘আমেরিকান জার্নাল অব ইনফেকশন কন্ট্রোল’-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, টয়লেট ফ্লাশ করার আগে কমোডের ঢাকনা নামিয়ে রাখলেও বাথরুমের বিভিন্ন পৃষ্ঠে বায়ুবাহিত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার তেমন উল্লেখযোগ্য হারে কমে না। তাহলে উপায়?
ব্যবহারের পর টয়লেট ফ্লাশ করলেই ভেতরে পানির প্রচণ্ড চাপ ও ধাক্কা লাগে। সেই ধাক্কার কারণে নোংরা পানির ক্ষুদ্র কণা হাওয়ায় ভেসে যায়। বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়াকে বলেন ‘ফ্লাশিং প্লুম’।কমোডের ঢাকনা খোলা রেখে ফ্লাশ করলে এসব কণা টয়লেট থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত দূরে যেতে পারে। এসব অদৃশ্য কণা কিন্তু শুধু মেঝেতে গিয়েই পড়ে না, টয়লেটের সিংক, তাক, এমনকি টুথব্রাশের ওপরেও ছড়িয়ে পড়ে। এ জন্য অনেকেই ফ্লাশ করার আগে ঢাকনা নামিয়ে দেন। তাঁরা মনে করেন, ঢাকনাই সব জীবাণু আটকে দেবে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, ধারণাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ, ঢাকনা নামানো থাকলেও জীবাণুর খুব ছোট কণাগুলো ঢাকনার ফাঁকফোকর দিয়ে ঠিকই বেরিয়ে আসে।
তাই শুধু ঢাকনা নামিয়ে রেখে জীবাণুর বিস্তার পুরোপুরি রোধ করা বা বাথরুম পরিচ্ছন্ন রাখা যায় না। বিশেষ করে ছোট বাথরুমে, যেখানে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা কম। কেননা ফ্লাশ করার পর যখন জীবাণুগুলো বাতাসে ছড়ায়, তখন তা দ্রুত বাথরুম থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না।
স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কমোডের ঢাকনা নামিয়ে রাখলে দৃশ্যমান ছিটকে আসা পানির পরিমাণ ঠিকই কমে। কিন্তু এতে ক্ষুদ্র জীবাণুর কণার ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পারে না। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সুরক্ষার সামগ্রিক সুবিধার জন্য ঢাকনা নামিয়ে রাখাই উত্তম।
কমোডের ঢাকনা কি সব সময় নামিয়ে রাখা ভালো
জীবাণু মোকাবিলার এটি একমাত্র উপায় নয়। তারপরও কমোডের ঢাকনা সব সময় নামিয়ে রাখা ভালো। আরও যেসব কারণে ঢাকনা নামিয়ে রাখবেন—
ঢাকনা নামিয়ে রাখলে ফ্লাশ করার সময় বড় ফোঁটার পানি ছিটকে বাইরে আসে না।
ঢাকনা নামিয়ে রাখলে বাতাসে ভেসে জীবাণুর কণা থেকে টুথব্রাশ, রেজর বা তোয়ালের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসে পড়বে কম।
কমোডের ঢাকনা নামানো থাকলে বাথরুমের দুর্গন্ধ সহজে বাইরে আসে না। আর দেখতেও তুলনামূলক ভালো দেখায়।
অতিথি আপনার বাথরুম ব্যবহার করার সময় কমোডের ঢাকনা নামানো দেখলে পরিচ্ছন্নতা মেনে চলার একটা ইঙ্গিত পান। এতে তাঁরা স্বস্তি বোধ করেন এবং নিশ্চিত হন বাথরুমটি পরিচ্ছন্ন।
কমোডের ঢাকনা তুলে রাখলে কি অসুস্থ হতে পারেন
হ্যাঁ, কমোডের ঢাকনা তুলে রাখলে আপনি অবশ্যই অসুস্থ হতে পারেন। ফ্লাশ করার সময় জীবাণুর কণাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং টয়লেটের আশপাশের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের ওপর জমা হয়।যাঁদের পোষা প্রাণী আছে, তাঁদের জন্য ঝুঁকিটা বেশি। কারণ, পোষা প্রাণী বাথরুমে থাকা জীবাণুর সংস্পর্শে এসে আপনার কাছে এলে জীবাণু স্থানান্তরের মাধ্যমে আপনার পেটে সংক্রমণ, ত্বক বা চোখের অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
কমোডের ঢাকনা নামিয়ে রাখলেও জীবাণু রোধে করণীয়
টয়লেট সিট, ফ্লাশ বাটন, দরজার হাতল ও ট্যাপ—এসব স্পর্শকাতর স্থান নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন।
প্রতিবার টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়াই সংক্রমণ প্রতিরোধের সবচেয়ে শক্তিশালী উপায়।
বাথরুমে বাতাস চলাচলের ভালো ব্যবস্থা রাখুন, যাতে বায়ুবাহিত কণাগুলো দ্রুত বেরিয়ে যায়।
টুথব্রাশের মতো ব্যক্তিগত জিনিসপত্র টয়লেটের পাশে না রেখে বন্ধ ক্যাবিনেট বা কোনো ঢাকনাযুক্ত পাত্রে রাখতে পারেন।
পোষা প্রাণী যেন টয়লেটের পানি না খায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। কেননা এরা দূষিত পানি পান করে আপনার কাছে জীবাণু নিয়ে আসতে পারে।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট
কমোডের এই দুই ফ্লাশ বাটনের কাজ কী
একটি কমোডের ট্যাংকে ৬–৯ লিটার পানি থাকে। বড় বাটন প্রেস করলে একসঙ্গে পুরো ট্যাংক খালি হয়ে যায়। সাধারণত বর্জ্য পরিষ্কার করতে পুরো ট্যাংকের পানি প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে ছোট বাটনে খরচ হয় অর্ধেক ট্যাংক পানি। অর্থাৎ ৩–৪.৫ লিটার পানি। প্রসাবের পর তাই ছোট বাটনটি প্রেস করাই উত্তম। এভাবেই কমোডের ফ্লাশ বাটনের সঠিক ব্যবহার কমাতে পারে পানির অপচয়। ঠিকমতো ফ্লাশ ব্যবহার করে একটা বাসা থেকে বছরে প্রায় ২০ হাজার লিটার পানি সাশ্রয় করা সম্ভব।
কমোডে ডুয়েল বাটনের প্রচলন হয়েছিল জাপানে। ষাটের দশকে একই সঙ্গে ফ্লাশ ও হাত ধোয়ার কমোড উদ্ভাবন করে তারা। সেই কমোডে দুটি ফ্লাশের হাতলের পাশাপাশি ছিল একটি হ্যান্ডওয়াশ বেসিন। বেসিনের হাত ধোয়া ময়লা পানি পুনরায় ব্যবহার করা হতো ফ্লাশের কাজে। তবে সে ডিজাইন খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। পরবর্তী সময়ে, ১৯৭৬ সালে মার্কিন ডিজাইনার ভিক্টর পাপানেক কমোডে ডুয়েল ফ্লাশ বাটনের প্রস্তাব দেন। তাঁর ‘ডিজাইন ফর দ্য রিয়াল ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে দেখা মেলে এই ডিজাইনের। ১৯৮০ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হয় এর ব্যবহার। ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বে এটি জনপ্রিয়তা পায়।
লো কমোড কি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো
লো কমোড বা প্যানে যে ভঙ্গিতে বসা হয়, এই ভঙ্গির নাম স্কোয়াট। স্কোয়াট করা অবস্থায় মলত্যাগের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি সহজসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। ফলে মলত্যাগের জন্য অতিরিক্ত চাপ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। বিশেষত যাঁরা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন, তাঁদের জন্য লো কমোড বেশ স্বস্তিদায়ক। বারবার মলত্যাগের জন্য অতিরিক্ত চাপ দিতে হওয়ায় মলাশয়টি মলদ্বারের নিচে নেমে যায়। এত সব সমস্যা প্রতিরোধে লো কমোড বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। লো কমোডে আপনাকে কোনো সিটে বসতে হয় না। কাজেই এ ক্ষেত্রে এভাবে জীবাণু ছড়ানোর ঝুঁকি কম।
তবে, হাঁটুব্যথা বা কোমরব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে লো কমোডে বসা এবং সেখান থেকে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির পক্ষে তা ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে হাই কমোড ব্যবহৃত হলেও তাতেই স্কোয়াট ভঙ্গির সুবিধা পাওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ রকম ব্যবস্থার অনুষঙ্গ হলো ‘ফুটস্টুল’। অনেক সময় ‘স্কোয়াটি পটি’ নামেও পাওয়া যায় অনুষঙ্গটি। এই টুলে পা রেখে বসলে ভঙ্গিটি অনেকটা স্কোয়াটের মতোই হয়। তাই এ ক্ষেত্রেও মলত্যাগের প্রক্রিয়াটি সহজ হয়।
সূত্র: হেলথলাইন, ওয়েবএমডি
ব্ল্যাক ডেথ, ফিউডালিজম এবং জীবাণু
আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগের কথা। ১৩৪৭ সালের শরৎকাল। ওই সময় দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের সমাজ ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ, ইতালির ছোট ছোট গ্রামেও মানুষের অভাব নেই। চাষীরা ক্ষেতের দিকে যাচ্ছে, গির্জার ঘণ্টা বাজছে, আর ধনী জমিদারের উঠোনে প্রচুর মানুষ দিনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
অন্যদিকে, মধ্য এশিয়ার বিশাল স্তেপ তৃণভূমিতে সে বছর গাছপালা অস্বাভাবিকভাবে শুকিয়ে গেছে। হঠাৎ করেই যেন পরিবেশ বদলে যাচ্ছিল। ফলে খাদ্যের অভাবে স্তেপের মারমট নামের ইঁদুর জাতীয় প্রাণীগুলো মরিয়া হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে খাদ্য। এই প্রাণীগুলোর শরীরে লুকিয়ে থাকা উকুনেরাও তখন এক এক করে নামছে আর চলে যাচ্ছে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে। এইসব উকুনদের কিছু তখন আশ্রয় নিয়েছে স্তেপের ঘোড়সোয়ারদের ঘোড়ার লোমের ভেতর। ঠিক সেই সময় তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম সুপার-হাইওয়ে: মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সেই বিখ্যাত সিল্ক রোড। সেই রাস্তা ধরে কারাভান, উট, ঘোড়া, রেশম, শস্য, কামান এই সবকিছুই চলছে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে। আর তাদের পিঠে চলছে স্তেপের সেই উকুনগুলো।
ইউরোপের মানুষ তখনো এসবের কিছুই জানত না। ইউরোপের কিছু ব্যবসায়ী তখন শুধু জানত যে, ক্রিমিয়ার কফা বন্দর থেকে কয়েকটি জেনোইজ জাহাজ ভয়ে পালিয়ে আসছে ইতালির বন্দরগুলোতে। কফা তখন কৃষ্ণসাগরের তীরে জেনোইজদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য উপনিবেশ। কিন্তু ইউরোপীয় বনিকরা জানত না যে এই জাহাজগুলোর সাথে এমন একটি ভয়াবহ ব্যাকটেরিয়া এসে পৌছাচ্ছে ইতালির বন্দরে, যে ব্যাকটেরিয়া ইতিহাসের অন্যতম মহামারি শুরু করবে। ভয়াবহ এই ব্যাকটেরিয়ার নাম Yersinia pestis।
আসলে মঙ্গোল ও তাতারদের কাছ থেকে এই মহামারী ছড়িয়ে পড়লে জেনোইজ ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়ে জাহাজে চড়ে পালায়। প্রথমে তাদের কিছু জাহাজ দক্ষিণ ইতালির মেসিনা বন্দরে পৌঁছায়। পরবর্তীতে জীবাণু বহনকারী মানুষ, ইঁদুর ও পশমী পণ্যসহ অন্যান্য জাহাজ পৌঁছায় জেনোয়া, ভেনিস ইত্যাদি বন্দরে।
১৩৪৭ থেকে ১৩৫৩ সালের মধ্যে ইউরোপে এই মহামারি ছড়িয়ে পড়ে খুবই ভয়াবহ আকারে। ইতিহাসে এই মহামারি ব্ল্যাক ডেথ নামে পরিচিত। এই মহামারি শুধু ইউরোপ নয়, এটি মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মহামারি। এটি এতই ভয়াবহ ছিল যে, এই এক মহামারীতেই ইউরোপের জনসংখ্যা ৩০%–৫০% পর্যন্ত কমে যায়। আগে যেখানে ইউরোপের একটি গ্রামে ৩০০ জন মানুষ থাকত, প্লেগের পর সেখানে হয়তো বেঁচে ছিল মাত্র ১৫০ বা ১০০ জন। এমনকি কোনো কোনো অঞ্চলের পুরো গ্রামসহই উধাও হয়ে যায়।
এই প্লেগের কারনে ইউরোপের সমাজ আর অর্থনীতির কাঠামো বদলে যায় চিরস্থায়ীভাবে। প্লেগের আগে ইউরোপের কৃষি অর্থনীতি ছিল পুরোপুরি মানুষের উপর নির্ভরশীল। জমিদারদের হাতে ছিল জমি, আর কৃষকের হাতে ছিল শ্রম। ইউরোপের এই জমিদারি ব্যবস্থাকে বলা হতো ফিউডালিজম। কিন্তু এই মহামারির ফলে অসংখ্য শ্রমিক মারা গেল। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক মারা যাওয়ার ফলে জমিদারদের জমি চাষ করার জন্য কোনো মানুষই আর টিকে ছিল না। ফলে পরিত্যক্ত হয়ে পরে জমিদারদের হাজার হাজার একর জমি। খামার, মিল বা আঙুরক্ষেত—সব জায়গায় শ্রমিকের তীব্র অভাব। এই সময় এসে জমিদাররা বুঝতে পারে যে, মানুষ এখন দুর্লভ সম্পদ। যে শ্রমিকদের তারা আগে অবহেলা করত, তারাই এখন হয়ে উঠল সমাজের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। জমিদাদের পাশাপাশি বেঁচে থাকা কৃষকরাও অবশ্য সেটা বুঝতে পেরেছিল। আর এতে হঠাৎ করেই সাধারণ কৃষকের মজুরী বেড়ে গেল ভয়াবহভাবে। সবকিছু মিলিয়ে ইউরোপের কৃষি ব্যবস্থার কাঠামোটাই বদলে যায়।
জনসংখ্যা কমে যাওয়ার পর দুটি বিষয় ঘটে:
১। অপ্রয়োজনীয় জমি ফেলে দেওয়া হয়। বন, পর্বত, জলাভূমির প্রান্তে যেসব জমি খুব কষ্টে চাষ করা হতো, তা পরিত্যক্ত হয়। কারণ এগুলো চাষ করতে আগের মতো শ্রমিক পাওয়া সম্ভব ছিল না।
২। ভালো জমিতে উৎপাদন বাড়ানো হয়। যেসব জমি উর্বর ও সহজে চাষযোগ্য ছিল সেগুলোতে তখন আরও উন্নত কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করা হয়।
প্লেগের আগে ইউরোপের কৃষি প্রযুক্তি ছিল আসলে খুবই দুর্বল। শ্রম ছিল সস্তা, তাই যন্ত্রের দরকার হতো না। কিন্তু এই প্লেগ মহামারি কৃষকদের শ্রমকে মূল্যবান করে তোলে। ফলে ভারী লাঙ্গল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে সবাই। পাশাপাশি শুরু হয় তিন ফসলী পদ্ধতি। পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এই পদ্ধতির চাষাবাদ। ধীরে ধীরে ইউন্ডমিল আর ওয়াটারমিলে শুরু হয় ফসল ও খাবার প্রক্রিয়াজাত করা। এসব কারনে ঘোড়ার গুরুত্ব গরুর চেয়ে অনেক বেড়ে যায়।
যখন শ্রমের মূল্য বেড়ে যায়, তখন বাধ্য হয়েই মানুষকে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়। এই কৃষি প্রযুক্তিই পরবর্তী শতকে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে ইউরোপকে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
তবে প্রযুক্তির প্রয়োগ সত্ত্বেও ইউরোপের এই জমিদারি ব্যবস্থা বা ফিউডালিজম ভেঙে পড়ে। কারণ আগে যতটা সহজে যত বেশি কৃষি উৎপাদন সম্ভব ছিল, অনেক ধরনের প্রযুক্তি প্রয়োগ করেও সেই আগের মতো অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে ইউরোপের জমিদারদের সেই প্রতিপত্তি আর রইল না।
ফিউডাল ইউরোপে কৃষক ছিল প্রভুর জমিতে বাঁধা মানুষ। তারা চাইলেও কৃষিকাজ ছেড়ে চলে যেতে পারত না। কিন্তু শ্রমিকের ঘাটতির ফলে ইউরোপের সমাজ এমন একটা জায়গায় পৌছে গেল যে, কৃষকের সেই কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার ক্ষমতা তৈরি হলো। জমিদাররা অবশ্য বিভিন্ন আইনের তৈরি করে তাদের আটকে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা ছিল কঠোর। শ্রমিক ছাড়া জমিদারের ক্ষমতা বলতে গেলে শূন্য। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসসহ সব অঞ্চলেই দেখা গেল একই চিত্র। মনে হচ্ছিল যেন জমিদারদের চেয়ে কৃষকদেরই মূল্য বেশি।
শ্রমিকদের জোর করে কাজ করাতে ১৩৫১ সালে ইংল্যান্ডে ‘Statute of Labourers’ নামে একটি আইন পাস করা হয়। এই আইনে শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট একটা মজুরি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কৃষক আর শ্রমিকরা তা মানল না। নতুন এই ইউরোপে শ্রমই ছিল মূলত শক্তি, আর শক্তি কখনও আইনের ভয় মানে না।
ফলে ধীরে ধীরে শ্রমিকরা স্বাধীন হতে শুরু করে। তারা কোথায় কাজ করবে আর কত মজুরিতে কাজ করবে সেটা তারাই নির্ধারন করতে শুরু করে। প্লেগের আগে কৃষকরা ছিল পুরোপুরি পরাধীন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের একই জমিদারের অধীনে থাকতে হতো। এই ব্যবস্থাকে বলা হতো সার্ফডম। কিন্তু নতুন এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সার্ফডম অচল হয়ে পরে। এমনকি জমির মালিক হতে শুরু করে কৃষকেরাও। ইউরোপে জন্ম নেয় ভাড়াটে মজুরির অর্থনীতি।
কিন্তু একটা সমাজ তো শুধু কৃষক আর দিনমজুর দিয়েই চলে না। প্রয়োজন হয় কারিগর, কাঠমিস্ত্রি, ধাতুশিল্পী, বয়নশিল্পীসহ আরও অনেক রকম পেশার মানুষের। নতুন এই পরিস্থিতিতে সব পেশার মানুষের শ্রমের মূল্যই বেড়ে যায়। এর ফলে বহু কৃষক গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যেতে শুরু করে। এতে করে কারিগরি গিল্ডগুলি আরও অনেক নতুন শ্রমিক খুঁজে পায়। শুরু হয় নতুন নতুন অনেক ব্যবসা। জমিদারদের বদলে উত্থান ঘটে বণিক শ্রেণির। এই বণিক শ্রেণিটিই পরবর্তী সময়ে ইউরোপের ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, জাহাজ মালিক, বড় বড় উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছিল।
অর্থাৎ প্লেগ-পরবর্তী ইউরোপে শুধু কৃষকের শ্রমের দামই বাড়েনি, বরং ইউরোপের পুরো অর্থনীতির গতিপথই বদলে গেছে আমূল। কারণ শ্রমিকরা যখন বেশি টাকা আয় করতে শুরু করে তখন তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যায়। মানুষ যেমন অনেক জিনিস কিনতে শুরু করে, তেমনি বণিকেরাও খুঁজতে থাকে নতুন নতুন পণ্য। চাহিদা থাকলে নতুন নতুন পণ্য বাজারে পাওয়া যাবে এটাই স্বাভাবিক। মানুষের একটা চরিত্র হলো, তাদের চাহিদা অসীম। এর ফলে দূরবর্তী অঞ্চলে বাণিজ্য সম্প্রসারণ শুরু করে করে বনিকরা। দূরের অনেক অঞ্চলে এমনসব পণ্য পাওয়া যায় যেগুলো বাজারে তুললে বিক্রি করা কোনো সমস্যাই না। আর এমন সুযোগ ব্যবসায়ীরা হাতছাড়া করবে কেন?
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের এই প্রসারের ফলে তৈরি হয় নতুন নতুন শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্র। লেনদেন বাড়ায় প্রয়োজন হয় ব্যাংকের। ১৪ ও ১৫শ শতকে ইতালির ফ্লোরেন্স, ভেনিস, জেনোয়া শহর হয়ে উঠে ব্যাংকিংয়ের কেন্দ্র। হাউজ অব মেডিচি, পারুজ্জি, বার্দি এসব ব্যাংকই পরবর্তী শতকে ইউরোপের অর্থনৈতিক আধিপত্যের ভিত্তি তৈরি করেছিল। এভাবেই শুরু হয় ইউরোপের আধুনিক পুঁজিবাদি অর্থনীতি।
যারা ইতিহাসের গতিপথ বুঝতে চেষ্টা করেন তাদের অনেকের মনেই এখন প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এই একই প্লেগ তো চীন বা মধ্যপ্রাচ্যেও আঘাত করেছিল। কিন্তু তাহলে ওইসব অঞ্চলে কেন ইউরোপের মতো এমন পরিবর্তন হয়নি? শুধুমাত্র ইউরোপই কেন এই প্লেগের আঘাতে প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে গেল?
এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। পৃথিবীর অনেক বড় বড় বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ শত বছর ধরে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। লেখা হয়েছে শত শত বই। তাদের একটাই প্রশ্নঃ যে পরিবর্তন ইউরোপে হলো, সেটা কেন পৃথিবীর অন্য কোথাও হলো না?
এই একই মহামারি চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকায় আঘাত করেছিল—এটা সত্যি। কিন্তু এইসব অঞ্চলের অর্থনীতিতে ইউরোপের মতো “শ্রমিক বিপ্লব” ঘটেনি। এর প্রধান কারণগুলো হলো: এশিয়ার কৃষি জমি ছিল অনেক বেশি উর্বর, অঞ্চলগুলোও ছিল জনবহুল। ফলে শ্রমিকের ঘাটতি ততটা তীব্র হয়নি। পাশাপাশি এইসব অঞ্চলের জমিদারিও ছিল ইউরোপের তুলনায় অনেক কম শক্তিশালী, তাই ভাঙার মতো কঠিন কাঠামোও ছিল না। আবার বণিক-শ্রেণির উত্থান এশিয়ায় রাজনৈতিকভাবেই সীমাবদ্ধ ছিল। এছাড়াও, মধ্যপ্রাচ্যে তৈমুর-লং এর ধ্বংসযজ্ঞ প্লেগ-পরবর্তী পুনর্গঠন বাধাগ্রস্ত করে। ফলে ইউরোপের বাইরে অনেক অঞ্চলের জনসংখ্যা হ্রাস পেলেও সামাজিক কাঠামো ভেঙে যায়নি।
এছাড়াও আরেকটি বিষয়ে ইউরোপ ছিল পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতা থেকে আলাদা। প্লেগ পরবর্তী ইউরোপে যে রেনেসাঁ থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলুশন হয়েছিল, সেটাও ইউরোপের বাইরে ঘটেনি।
ব্ল্যাক ডেথের ২০০–৩০০ বছরের মধ্যে ইউরোপে পরপর কয়েকটি ঘটনা ঘটতে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল এই রেনেসাঁ। রেনেসাঁ ছিল ক্লাসিক গ্রীক যুগের বিজ্ঞান ও মানবিক চেতনার নবজাগরণ। রেনেসাঁর ফলে ইউরোপে ব্যাপক বৈজ্ঞানিক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। নিউটনের মেকানিক্স ধীরে ধীরে ইউরোপে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলুসন ঘটায়।
এর পাশাপাশি ইউরোপীয়রা পৃথিবীর বিভিন্ন অজানা ভূখণ্ড আবিষ্কার করতে প্রচুর বিনিয়োগ করে। এই ভূগোল আবিষ্কার পরবর্তীতে তাদের উপনিবেশ বিস্তার করার সুযোগ করে দেয়। ইউরোপীয়রা তাদের উপনিবেশ থেকে প্রচুর সম্পদ লুট করে নিয়ে যায় ইউরোপে। এর জন্য অবশ্য তাদের বাণিজ্য ও জাহাজ প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে হয়েছিল।
তবে এখানে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউরোপের এই যে বিশাল পরিবর্তন, এই দীর্ঘ ধারা শুরু হয়েছিল সেই ১৩৪৭–এর শ্রম-সংকট থেকে। আর সেই মহামারি ঘটিত শ্রম সঙ্কট পরে ইউরোপকে নিয়ে যায় শিল্প বিপ্লব আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির দিকে। সেই থেকে ইউরোপীয় সভ্যতা এখনো পর্যন্ত সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।
এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে, অর্থনীতির কেন্দ্রে থাকে মানুষ। কিন্তু এতকিছুর মধ্যে একটা বিষয় চাপা পরে যায়। সেটা হলো, প্লেগ বা এই ধরনের মহামারীর মতো ঘটনা আমাদের সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে অদৃশ্যভাবে। প্লেগের পেছনে যে অতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া দায়ী, সেই ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের মতো অদৃশ্য জীবাণুরা যে আমাদের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়, সেটাও আমাদের সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই অদৃশ্য জীবাণুরা আমাদের ইতিহাসে কতটা তীব্র প্রভাব ফেলেছে।
তবে আপনি যদি ভেবে থাকেন যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই প্লেগের ঘটনাটাই জীবাণুদের একমাত্র উদাহরণ, তাহলে ভুল করবেন।
স্প্যানিশরা যখন প্রথমবারের মতো অ্যামেরিকায় পৌঁছায়, তখন তারা তাদের সঙ্গে নিয়ে যায় গুটি বসন্ত, হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ইউরোপীয় জীবাণু। ইউরোপীয় সমাজে এই রোগগুলো অনেক আগের থেকেই ছিল। মূলত পশুপালনের ফলে হাজার বছর ধরে এই জীবাণুগুলো ইউরোপ আর এশিয়ার মানুষদের শরীরে বাসা বেঁধেছিল। ফলে হাজার বছর ধরে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এইসব জীবাণুদের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। এই কারনে এইসব ভাইরাস আমাদের আক্রমণ করলেও আমাদের সমাজে এত ভয়ংকর মহামারি হয় না। কিন্তু অ্যামেরিকার সমাজে পশুপালনের চল ছিল না। ফলে স্থানীয় অ্যাজটেকদের কোনো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাই ছিল না এইসব ভাইরাসের বিরুদ্ধে। স্প্যানিশরা যখন অ্যামেরিকায় যায় তখন এই রোগগুলো দ্রুত মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ মারা যায় কয়েক মাসের মধ্যে।
প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও কৃষি—সব ক্ষেত্রেই অ্যাজটেকদের লোকসংখ্যা কমে গিয়ে ভেঙে পড়ে তাদের সমাজ ব্যবস্থা। ফলে অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে যায়। স্প্যানিশ কমান্ডার কোর্তেস এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সামান্য সৈন্যবাহিনী দিয়েও রাজধনী তেনোচ্তিত্লান দখল করতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ রোগই মূলত অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের মনোবল, শৃঙ্খলা ও শক্তি ভেঙে দেয়। ভাবলে সত্যি অবাক হতে হয় যে, এভাবে সামান্য এক গুটি বসন্তের ভাইরাস স্প্যানিশদের বিজয়কে নিশ্চিত করে দিয়েছিল।
মানব সভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এই অদৃশ্য রোগ-জীবাণুরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময় আমাদের সভ্যতার গতিপথ বদলে দিয়েছে। একবার নয়, বার বার।
-হিমাংশু কর
"নিজ চোখে আমি দেখেছি এক নেকড়ে একটি পিঁপড়েকে দোহন করছে, আর সেই অসম্ভব দোহন থেকে নিষ্কলুষ দুধ পান করে নির্বিকারভাবে চলে যাচ্ছে "।
সত্যিই কি নেকড়ে পিঁপড়েকে দোহন করতে পারে? পিঁপড়ের কি দুধ আছে?আর সেই দুধেই বা নেকড়ের ক্ষুধা মেটাতে সক্ষম কীভাবে?
এই প্রশ্নগুলো পাঠকের মনে উঁকি দেয় ঠিকই। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা। যেখানে শক্তি দুর্বলকে নিঃশেষে নিংড়ে নেয় । আর লুটতরাজ লুট করে বীরদর্পে চলে যায়।
এই বিস্ময়কর পঙ্ক্তির স্রষ্টা আরবি সাহিত্যের এক অদ্বিতীয় মহীরুহ কবি আল-মুতানাব্বি। ৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান ইরাকের কুফা নগরীতে জন্ম নেওয়া এই কবি ছিলেন শব্দচয়নে প্রখর, ছন্দে নিখুঁত এবং চিন্তায় দুর্দান্ত গভীর। তাঁর কবিতা ছিল সময়ের দর্পণ যেখানে সৌন্দর্যের পাশাপাশি সত্যের তীক্ষ্ণ প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে।
একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে কোনো কিছুর প্রকৃত কারণ জানা গেলে বিস্ময় দূর হয়ে যায়। তাই বিস্মিত হওয়ার আগে চলুন শুনি সেই সত্য ঘটনা যা এই অমর রূপকের জন্ম দিয়েছিল।
আল-মুতানাব্বি বলেন- একদিন আমি কুফার বাজারে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমার পাশেই এক দরিদ্র নারী মাছ বিক্রি করছে। এমন সময় সেখানে আবির্ভূত হয় এক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তার চলনে অহংকার, কণ্ঠে কর্তৃত্ব। মানুষ তাকে সমীহ করে পথ ছেড়ে দেয়, কেউ সালাম জানায়, কেউ চোখ নামিয়ে নেয়।
সে লোকটি মাছ বিক্রেতা মহিলাকে জিজ্ঞেস করে-এই বড় মাছটির দাম কত?
নারী শান্ত স্বরে বল- মাত্র পাঁচ দিরহাম।
লোকটি রুক্ষ হেসে বলে- না, এই মাছে কোনোভাবেই এক দিরহামের বেশি হতে পারে না।
কাঁপা কণ্ঠে নারী বলে- আমি একজন দরিদ্র জেলে। এই এক মাছের দামেই আমার সংসারের চাকা ঘোরে। দয়া করে আমাকে ঠকাবেন না।
কিন্তু শক্তির কাছে করুণা ছিল মূল্যহীন। লোকটি উদ্ধতভাবে এক দিরহাম ছুড়ে দিয়ে মাছটি হাতে নিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে চলে যায়।
নারীর চোখে অশ্রু নামে। সে পেছন থেকে ডাকে। বারবার মিনতি করে। কিন্তু ক্ষমতার নেশায় অন্ধ মানুষটি আর ফিরেও তাকায় না।
আল-মুতানাব্বি বলেন—আমি নিজেও তাকে ডাকলাম। তবু সে থামল না। সে ছিল কৃপণতা আর নীচতার আবরণে লুকিয়ে থাকা এক হিংস্র নেকড়ে। আর সেই নারী দারিদ্র্য আর অসহায়তার মাঝে আটকে পড়া এক ক্ষুদ্র পিঁপড়ে।
ঠিক তখনই আমার অজান্তেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো সেই অমর পঙ্ক্তি-
"নিজ চোখে আমি দেখেছি এক নেকড়ে একটি পিঁপড়েকে দোহন করছে,
আর সেই অসম্ভব দোহন থেকে নিষ্কলুষ দুধ পান করে নির্বিকারভাবে চলে যাচ্ছে "।
আজও আমাদের সমাজে এমন নেকড়ের অভাব নেই যারা শক্তির দম্ভে দুর্বল মানুষের শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নেয়। আর হাসতে হাসতে বিজয়ীর বেশে চলে যায়।
কবি আল মুতানাব্বির কবিতার আরেকটি বিখ্যাত লাইন- সিংহের দাঁত দেখা গেলে তাকে ভুলেও হাসি ভাবতে যেও না।
৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে আরবী সাহিত্যের এই দুর্দান্ত কবি নির্মম হত্যার শিকার হন। -আরিফ মাহামুদ
জাপানে 'ভাড়া করা সম্পর্ক'
জাপানের সমাজব্যবস্থায় মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং একাকীত্বের ক্রমবর্ধমান সমস্যার এক অদ্ভুত সমাধান হলো 'ভাড়া করা পরিবার' বা কৃত্রিম আত্মীয়তার প্রচলন। এখানে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এমন অভিনেতা পাওয়া যায়, যারা প্রয়োজনে জীবনসঙ্গী, সন্তান, বন্ধু কিংবা আত্মীয়ের ভূমিকা পালন করেন। মূলত সামাজিক চাপ, একাকীত্ব অথবা প্রিয়জনের অভাবজনিত শূন্যতা পূরণ করতেই মানুষ এই বিকল্প পথ বেছে নিচ্ছে।
এই ব্যবস্থার সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ হলো ইশিই ইউইচির জীবন। পেশাদার এই অভিনেতা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের ছদ্ম-স্বজন হিসেবে কাজ করেন। একবার এক মা তার নিখোঁজ স্বামীর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ইউইচিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। টানা আট বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি সেই মেয়ের বাবার অভিনয় করে গেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মেয়েটি বিন্দুমাত্র টের পায়নি যে তার প্রিয় বাবা আসলে একজন অভিনেতা।
জাপানে এই ধরনের কৃত্রিম সম্পর্কের জনপ্রিয়তা বাড়ার প্রধান কারণ হলো এটি মানুষকে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা ব্যক্তিগত সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। বিশেষ করে বিবাহবিচ্ছেদ, মৃত্যু কিংবা পারিবারিক কলহের ফলে তৈরি হওয়া শূন্যস্থান ঢাকতে এটি একটি সাময়িক ঢাল হিসেবে কাজ করে।
তবে এই ব্যবস্থার নৈতিকতা এবং দীর্ঘমেয়াদী মানসিক প্রভাব নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক রয়েছে। একটি শিশুর কাছে দীর্ঘ আট বছর সত্য গোপন রেখে একজন অভিনেতাকে বাবা হিসেবে উপস্থাপন করা বাস্তব সম্পর্ক এবং মিথ্যার সীমারেখাকে ঝাপসা করে দেয়। ইশিই ইউইচির মতো ব্যক্তিরা কেবল অভিনয়ই করেন না, বরং তারা মানুষের মানসিক হাহাকার এবং সামাজিক প্রত্যাশা মেটানোর দায়িত্ব নেন। এই পুরো বিষয়টি জাপানের আধুনিক সমাজের এক জটিল ও করুণ চিত্র ফুটিয়ে তোলে, যেখানে মানুষের আবেগ আর সম্পর্কও মাঝেমধ্যে পণ্য হয়ে ধরা দেয়।