‘ঊনিশ শতকের বাংলায় নরবলি’

রানা

বিংশ শতাব্দীর জনৈক একজন ভারতীয় ঐতিহাসিক একদা বলেছিলেন যে, দৈবীশক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস যে অনেক সময়ে মানুষের চিত্তবৃত্তিকে নির্মল করবার পরিবর্তে তাঁর স্বাভাবিক

বিচারবুদ্ধি, এবং মানবিকতাবোধকে যে আচ্ছন্ন করে রাখে, সেটার সবচেয়ে জ্বলন্ত নিদর্শন হল ভারতীয়দের মত ধর্মপ্রাণ জাতির মধ্যে শত শত বছর ধরে সতীদাহ প্রথার মত

বিভীষিকাময় সংস্কারের অস্তিত্ব। তবে শুধু সতীদাহ কেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে প্রচলিত ভারতীয় হিন্দুসমাজের অনেক কুসংস্কারই, যেমন - গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, পুরীর

জগন্নাথের রথের তলায় আত্মবলিদান, কুষ্ঠরোগীকে জীবন্ত কবর দান, চড়ক পূজায় শরীরের নানা অংশ বাণবিদ্ধ করে অকালমৃত্যুকে বরণ, নর্মদার কাছে মহাদেও পর্বতের শিখর থেকে

লাফিয়ে পড়ে মৃত্যুকে আহ্বান, উড়িষ্যার খোন্দ জাতির মধ্যে শিশুকন্যা হত্যার প্রথা ইত্যাদি ইত্যাদি উপরোক্ত ঐতিহাসিক মতবাদের সত্যতাকেই প্রমাণ করে দেয়। এই প্রবন্ধে

ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে প্রচলিত সেই ধরণেরই একটি বীভৎস সামাজিক কুসংস্কারের পরিচয় তুলে ধরা হল, সেটি হচ্ছে শাস্ত্ৰীয় নরবলি। বহু প্রাচীন যুগ থেকেই ভারতীয় হিন্দুসমাজে

নরবলির উল্লেখ পাওয়া যায়। রামায়ণে শূদ্রকের ও মহীরাবণের উপাখ্যান, এবং মহাভারতে জরাসন্ধের কাহিনী প্রমাণ করে দেয় যে, মহাকাব্যর যুগেও ওই ধরণের ঘটনা ভারতের মত দেশে

সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল না। মনুসংহিতায় কলিযুগে ব্রাহ্মণদের জন্য গোহত্যা, অশ্বমেধ এবং নরবলিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই বিধিনিষেধ থেকে এটাই মনে হয় যে, মনুর

আগের যুগে অথবা মনুর যুগেও হিন্দুসমাজে নরবলি বেশী না হলেও কিছু কিছু অবশ্যই ঘটত। উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের নামের সঙ্গে জড়িত উপাখ্যান ‘বেতাল-পঞ্চবিংশতি’র সূচনাও

একটি কাপালিকের কাহিনীকে অবলম্বন করে হয়েছে বলেই দেখতে পাওয়া যায়। ভারতে হিন্দুরাজত্বের শেষভাগে, গুপ্তোত্তর যুগে, তন্ত্রধর্মের অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে

করে থাকেন, এবং বামাচারী তান্ত্রিক সাধকেরাই খুব সম্ভবতঃ নরবলিকে আবার শাস্ত্রীয় মহিমায় মণ্ডিত করেছিলেন বলে তাঁরা অভিমত প্রকাশ করেন। খ্রীষ্টীয় বারোশো বা তেরোশো

 

115

 

শতাব্দীতে রচিত ‘কালিকাপুরাণ’ গ্রন্থে নরবলি দানের শাস্ত্রীয় আচারগুলি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। উক্ত সময়ে পূর্বভারতের কামরূপ অঞ্চল এই ধরণের তান্ত্রিক সাধনার

একটি প্রধান কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল, এবং সমগ্র মধ্যযুগ ধরেই তন্ত্রধর্ম বাংলা, আসাম ও উড়িষ্যায় অপ্রতিহতভাবে নিজের রাজত্ব চালিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং, সেইসব তান্ত্রিক

কাপালিকদের সাধনার কল্যাণে ওই যুগে নরবলি ব্যাপারটাও যে খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, এখন সেকথা কল্পনা করে নিলে বোধকরি খুব একটা অন্যায় হবে না।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’, কাপালিকদের নরবলিদানের ঐতিহাসিক কাহিনীকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছে। কিন্তু বর্তমান সময় থেকে মাত্র

দেড়শো বছর আগেও বঙ্গদেশের নানা জায়গায়, এমন কি ভারতে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতার বুকের উপরেও যে মাঝে মাঝেই নরবলির ঘটনা ঘটত, সেকথা শুনলে

অনেকেই নিশ্চই এখন শিউরে উঠবেন। সত্যি ঘটনা অনেক সময়েই গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর হয় - এই কথাটা কিন্তু নিতান্তই কোন প্রবাদবাক্য নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর জনৈক একজন

ইংরেজ লেখকের রচনা থেকে জানা যায় যে, ১৮৪১ সালের ৮ই জানুয়ারি তারিখে পাঞ্জাব প্রদেশে একমাত্র পূর্ণিমা উৎসবেই নাকি ২৪০টি নরবলি হয়েছিল! কিন্তু সেই বিষয়ে সমসাময়িক

বঙ্গদেশের কৃতিত্ত্বও নিতান্ত কম কিছু ছিল না। পাদ্রী ‘ওয়ার্ড’ সাহেব তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘View of the History, Literature and Religion of the Hindus’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে

ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশের ঠিক কোন কোন জায়গায় নরবলি দেওয়া হত, সেটার একটি সুদীর্ঘ তালিকা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই তালিকে থেকে জানা যায় যে, ওই সময়ে বর্ধমানের কাছে

অবস্থিত ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা দেবীর মন্দিরে, মুর্শিদাবাদের করেছে কিরীটকণার কালী মন্দিরে, কাটোয়ার কাছে শ্রীরামপুরের তারামন্দিরে, গুপ্তিপাড়ারকাছে সুরা গ্রামের স্থানীয়

দেবীমন্দিরে, নদীয়ার কাছে ব্রাহ্মণীতলায় দুর্গামন্দিরে, এবং তমলুকে বর্গভীমার মন্দিরে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও মাঝে মধ্যেই নরবলি হত; এবং সেই সব নরবলির পিছনে

আদতে কে বা কারা থাকতেন, সেটা বহু অনুসন্ধান করেও কখনো জানা সম্ভব হয়নি। ওয়ার্ড লিখেছিলেন যে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমল পর্যন্ত নদীয়ায় বহু নরবলি হয়েছিল; এবং

তখন এই জনশ্রুতিও চালু ছিল যে, একবার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নাকি জনৈক ব্রহ্মচারীর (কাপালিকের?) পরামর্শে দু’-তিন বছরের মধ্যে প্রায় এক হাজার নরবলি দিয়েছিলেন! ‘রেভারেণ্ড

জেমস লঙ’ সাহেবও ১৮৪৬ সালে ‘Calcutta Review’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে, তৎকালীন বঙ্গদেশের বিভিন্ন জায়গায়, যথা - নদীয়া, শান্তিপুর, বিষ্ণুপুর, সুরা ইত্যাদি

জায়গায় নরবলির কথা উল্লেখ করেছিলেন। এইসব তথ্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই অনেকেরই একথা মনে হতে পারে যে, তখনকার খৃষ্টান পাদ্রীরা হিন্দুসমাজের দোষগুলির কথা স্বভাবতঃই

কিছু বাড়িয়ে বলেছিলেন। কিন্তু সমসাময়িক বাংলা সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবরণগুলি পড়লে তাঁদের সেই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হতে বাধ্য। এই প্রসঙ্গে ‘ব্রজেন্দ্রনাথ

বন্দ্যোপাধ্যায়’ সম্পাদিত ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ গ্রন্থটি থেকে উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি বিবরণ তুলে দিলেই যথেষ্ট হবে। ১৮২২ সালের ২২শে জুন তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’

পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, “শুনা গেল যে জিলা নদীয়ার অন্তঃপাতি চাঁদড়া জয়াকুঁড় নামে গ্রামের রূপরাম চক্রবর্তী আড়বান্দা নামে গ্রামে মাঘী পূর্ণিমাতে বলিদানরূপে খুন হইয়াছে। ইহা

প্রকাশ হওয়াতে ঐ গ্রামের গৌরকিশোর ভট্টাচার্যের প্রতি সন্দেহ হইয়া তাঁহাকে কএদ রাখিয়াছিল কিন্তু সপ্রমাণ না হওয়াতে সে মুক্ত হইয়াছে।” ১৮২৯ সালের ৪ঠা জুলাই তারিখের

‘বঙ্গদূত’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, “কিয়দিবস হুইল জেলা হুগলির অন্তর্বর্ত্তি কালীপুর গ্রামে এক সিদ্ধেশ্বরী আছেন তাঁহাকে পূজা করিয়া একদিবস পূজারিরা দ্বাররুদ্ধ করণাত্তর গমন

করিয়াছিল পরদিবস তথায় আসিয়া, ঐ পূজারিরা দেখিলেক যে কতকগুলিন ছাগ ও এক মহিষ ও এক নর ঐ সিদ্ধেশ্বরীর সম্মুখে ছেদিত হইয়া পড়িয়া আছে ইহাতে তাঁহারা অনুমান করিলেক যে

পূর্ব্ব রজনীতে কেহ পূজা দিয়া থাকিবেক, ইহাতে পূজারিরা নরবলি দেখিয়া রিপোর্ট করাতে তত্রস্থ রাজপুরুষ অস্ত্রশস্ত্রাদি সম্বলিত বহুলোক সমভিব্যাহারে তথায় আসিয়া অনেক সন্ধান

করিলেন কিন্তু তাহাতে কিছু অবধারিত হয় নাই আমরা অনুমান করি দস্যুদিগের কর্তৃক এরূপ কৰ্ম্ম হইয়া থাকিবেক।” ১৮৩৭ সালের ২১শে জানুয়ারি তারিখের ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায় এর

থেকেও রোমহর্ষক নরবলির সংবাদ পাওয়া যায়। “এক দিবস দেবীর (বর্দ্ধমানের নিকট রুক্মিণী দেবী) পূজক ব্রাহ্মণ যথানিয়মে প্রাতঃস্নানাদি সমাধাপূর্ব্বক মহামায়ার অর্চ্চনার্থে

মন্দিরের সন্নিকটে গমন করিয়া দেখিলেন যে খর্পরের স্থান রক্তে প্লাবিত চারিপার্শ্বে ধূপ ও ঘৃতের গন্ধে আমোদ করিয়াছে। ইহাতে পুরোহিত অত্যন্ত আশ্চৰ্য হইয়া কুঠুরির মধ্যে

প্রবেশ করতঃ আবার বিস্ময়াপন্ন হইলেন যেহেতু ঘরের চারিদিকে দেবীকে বেষ্টিত করিয়া রুধির জমাট হইয়াছে। সম্মুখে এক প্রকাণ্ড চিনির নৈবেদ্য এবং তদুপযুক্ত আর ২ সামগ্রী ও

একখানা চেলির শাটি তদুপরি এক স্বর্ণমুদ্রা দক্ষিণা এবং প্রায় ১০০০ রক্তজবা পুষ্প তন্মধ্যে নানাবিধ স্বর্ণালঙ্কার তাহাও প্রায় দুই সহস্র মুদ্রার অধিক হইবেক।” এরপরে পুরোহিত

ওই মন্দিরটি পরিস্কার করে নৈবেদ্য নিয়ে নিজের বাড়ীতে চলে গিয়েছিলেন। “পরন্তু তাহার দুই চারি দিন পরে উক্ত নদ (মন্দিরের নিকটস্থ পুষ্করিণী) হইতে এক মুণ্ডহীন শব ভাসিয়া

উঠিল, ইহাতে সুতরাং তত্রস্থ বিচক্ষণগণেরা বিলক্ষণরূপেই অনুমান করিলেন যে ঈশ্বরীর নিকট ঐ শব বলি হইয়াছিল কিন্তু পূজার বাহুল্য দেখিয়া সকলে কহিলেন কোন রাজা আপনার

সাধনার নিমিত্তই এ প্রকার ভয়ানক মহাকর্ম সমাধা করিয়াছেন।” ওই ভয়ানক ঘটনার পরে বর্ধমানের চারটি থানার দারোগা একত্রে এসে অনেক অনুসন্ধান করা সত্ত্বেও প্রকৃত

অপরাধীকে কোনদিনই ধরা সম্ভব হয়নি। এরপরে সেই ঘটনা নিয়ে মুর্শিদাবাদের কমিশনারের প্রতি তদন্তের আদেশ হওয়াতে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকাটি আশা প্রকাশ করে লিখেছিল, “এই

সন্ধানের ফল জানিবার নিমিত্ত আমরা অত্যন্ত আশাযুক্ত হইয়াছি যেহেতু সাধারণ লোকেরদের মধ্যে এমত জনরব উপস্থিত হইয়াছে যে তথাকার কোন প্রধান লোক এই নরবলিতে লিপ্ত

আছেন এবং আরো জানি এই রুক্মিণী দেবীর নিকট পূর্ব্বেও বিস্তর নরবলি হইয়াছে।” ১৮৩৭ সালের ২৩শে ডিসেম্বর তারিখে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা সেই বীভৎস ব্যাপারের উপরে

মন্তব্য করে লিখেছিল যে, ওই সময়ের সর্বসাধারণের মনে ধারণা হয়েছিল যে, সেই নরবলির কাজটি বর্ধমানের রাজার তরফ থেকেই করা হয়েছিল। উক্ত শতাব্দীতে বর্ধমানের রাজবংশের

সাথে যুক্ত কারো কঠিন অসুখ হলে রাজ্যে নরবলির আয়োজন হত বলে জনশ্রুতি ছিল। এখানে যে বলির ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, তার কিছুদিন আগে খুব সম্ভবতঃ বর্ধমানে যুবরাজের

বসন্ত রোগ হয়েছিল, আর হয়ত সেই কারণেই তখন নরবলির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তখন যাঁকে বলি দেওয়া হত, তাঁর নাকি তাতে সম্মতি থাকত, এবং তাঁকে তাঁর পিতার একমাত্র পুত্র হতে

হত। উপরোক্ত বলির কিছুদিন আগে থেকেই বর্ধমান রাজবাড়ীর এক বিধবা দাসীর পুত্রের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না (আর কোনদিন পাওয়াও যায়নি), হয়ত সেই হতভাগ্যকেই ওই

বলির জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজী সংবাদপত্রগুলিতেও মাঝে মাঝেই ওই ধরণের সংবাদ প্রকাশিত হত। ১৭৮৮ সালের ২৪শে এপ্রিল তারিখে ‘Calcutta Gazette’ পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে

কলকাতার চিৎপুরের চিত্রেশ্বরীর মন্দিরের একটি নরবলির সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে নরবলি দেওয়ার সময়ে দেবীর অঙ্গ বহুমূল্য বস্ত্র ও সোনারূপার গহনা দিয়ে সাজানো

হয়েছিল, এবং শাস্ত্রের আদেশমত একজন চণ্ডালকেই সেখানে বলি দেওয়া হয়েছিল। শাস্ত্রীয় নির্দেশমতই পূজার উপযোগী পাত্রাদিও ওই বলির স্থানে পাওয়া গিয়েছিল। এথেকে এটাই মনে

হয় যে, সেই বলির পিছনে তখনকার কোনো ধনী এবং শাস্ত্রজ্ঞ লোকের হাত ছিল। ওই বিষয়ে তৎকালীন কলকাতার ফৌজদার মন্দিরের পূজারী পুরোহিতকে গ্রেপ্তার করলেও শেষপর্যন্ত

কিন্তু আসল অপরাধীকে আর কোনদিনই ধরা যায়নি। চিৎপুরের চিত্রেশ্বরী ও সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দির প্রথম কবে স্থাপিত হয়েছিল, সেটা আজও সঠিকভাবে জানা যায় না। সর্বমঙ্গলা

দেবীর নাম বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গল’ (১৪৯৫/৯৬ খৃষ্টাব্দে রচিত) কাব্যেও পাওয়া যায়। তবে সতেরোশো’ শতাব্দীর সূচনাতেও বঙ্গদেশে যে ওই দুটি দেবীর মন্দিরে যথেষ্ট নরবলি হত, সে

বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৬৩৭ সালে চিত্রেশ্বরী দেবীর সেবায়েত মনোহর ঘোষের মৃত্যু হয়েছিল। সেই সময়ে ওই মন্দিরে এত পরিমাণে নরবলি হত যে, মনোহরের পুত্র ‘রামসন্তোষ ঘোষ’

রোজ সকালে মন্দিরে গিয়ে বহু নরমুণ্ড দেখতে পেতেন, এবং একটা সময়ে সেই ভীষণ ব্যাপার অসহ্য হওয়ার জন্যই নাকি তিনি চিৎপুর ছেড়ে বর্ধমানে চলে গিয়েছিলেন। তখন চিৎপুরের

চিত্রেশ্বরীর মন্দির ছাড়াও কলকাতার আরেকটি মন্দিরেও নরবলি হত, সেটি হচ্ছে কালীঘাটের কালী মন্দির। ওয়ার্ড এবং লঙ উভয়েই তাঁদের লেখায় কালীঘাটের নরবলির কথা উল্লেখ

করেছিলেন। ওয়ার্ড বলেছিলেন যে, ১৮০০ সালে দু’জন হিন্দু ওই কালীমন্দিরে দেবীর কাছে নিজেদের জিহ্বা বলি দিয়েছিলেন। ১৮২৭ সালের ২১শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’

পত্রিকাতেও জনৈক পশ্চিমদেশীয় ব্যক্তির কালী প্রতিমার চরণে জিহ্বাদানের সংবাদ পাওয়া যায়। কালীঘাটের নরবলি প্রসঙ্গে লঙ সাহেব ১৮৩২ সালে সেখানে সংঘটিত একটি বীভৎস

কাহিনীর উল্লেখ করেছিলেন। সেবারে কালীঘাটের জনৈক হিন্দু, সেখানকার একজন মুসলমান নাপিতকে মন্দিরে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁকে বলির ছাগলটি চেপে ধরতে বলেছিলেন। নাপিতটি সেকাজ

করবার পরে ওই হিন্দু ভদ্রলোকটি ছাগলের উপরে খাড়া না চালিয়ে সোজা নাপিতের উপরেই সেটা চালিয়ে দিয়েছিলেন। এর ফলে তৎক্ষণাৎ সেই নাপিতের মৃত্যু হয়েছিল, এবং কিছুদিন পরেই

সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে গিয়ে সদর নিজামত আদালত ওই হিন্দু ভদ্রলোকটিকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছিল। সাম্প্রতিক অতীতে ঐতিহাসিকেরা নয়াদিল্লীর ভারত সরকারের

মহাফেজখানায় সংরক্ষিত কালীঘাটের কালীমন্দিরে নরবলির বিষয়ে দুটি চিঠি পেয়েছিলেন। সেই চিঠিগুলির মধ্যে প্রথমটি ১৮৫৪ সালের ১৭ই জানুয়ারী তারিখে ২৪ পরগণা জেলার

ম্যাজিষ্ট্রেট ‘ন্যামুয়েস’ সাহেব পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ‘ডেম্পিয়ার’কে লিখেছিলেন, এবং দ্বিতীয় চিঠিটি ডেম্পিয়ার সাহেব ঐ মাসেরই ২১ তারিখে বাংলা সরকারের সেক্রেটারি ‘সিসিল

বিডন’কে লিখেছিলেন। প্রথম চিঠিতে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব লিখেছিলেন যে, ১৮৫৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, কৃষ্ণপক্ষ রাত্রি সাড়ে সাতটার সময়ে কালীঘাটের মন্দিরে একজন

হিন্দুস্থানী লোক আত্মবলিদান করেছিলেন। সেই সংবাদ পাওয়া মাত্র স্থানীয় থানার দারোগা ও পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও ডাক্তার

আসবার আগেই সেই হতভাগ্য মানুষটি প্রাণত্যাগ করেছিলেন। লোকটির আনুমানিক বয়স ছিল ৩৫ বছর। তিনি ঐ অঞ্চলের লোকেদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃতদেহটি

পাঁচদিন ধরে সংরক্ষণ করবার পরেও সনাক্ত করা যায় নি। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের ওই চিঠি থেকে একথাও জানা যায় যে, ১৮৩৬ সালে কালীঘাট মন্দিরে ওই ধরণের আত্মবলিদানের সংখ্যা

এত বেড়েছিল যে, শেষপর্যন্ত মন্দিরে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। বংশানুক্রমে কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েত হালদারদের সেই ব্যাপারে গোপন সহানুভূতি ছিল বলে পুলিশ সন্দেহ

করেছিল। কিন্তু মন্দিরে সান্ত্রী নিযুক্ত করবার পরেও সেই ব্যাপারের অবসান ঘটেনি। তারপরেও অন্ততঃ ছ’বার ছ’জন লোক মন্দিরে উপস্থিত প্রহরীদেরকে ফাঁকি দিয়ে সেখানে নিজেদের

জিহ্বাদান করেছিলেন। শেষে যখন দেখা গিয়েছিল যে, প্রহরী রেখেও ওই বিষয়ে কোনো সুবিধা হচ্ছে না, তখন ১৮৫০ সালের এপ্রিল মাসে কালীঘাট মন্দিরের সেই পাহারা বন্ধ করে দেওয়া

হয়েছিল। এরপরে ১৮৫৩ সালের একটি ঘটনায় ম্যাজিষ্ট্রেটের মনে রীতিমত বিভীষিকার সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, কালীঘাটের হালদারেরা সেই কুপ্রথা নিবারণের জন্য

কোনো চেষ্টা তো করেনই নি, এমন কি মন্দিরের পাহারায় নিযুক্ত চৌকীদারদেরও তাঁরা নিয়মিত বেতন দিতেন না; ফলে চৌকীদারেরা কালীঘাটে আগত তীর্থযাত্রীদের উপরে যথেচ্ছ

অত্যাচার করে যথাসম্ভব উপার্জন করতেন। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেণ্টকে সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে লিখেছিলেন যে,

হালদারদের বেতন দিয়ে মন্দিরে প্রহরী নিযুক্ত করতে বাধ্য করা হোক; এমনকি প্রয়োজন হলে আইনের সাহায্য নিয়েও যেন সেই কুপ্রথাকে দমন করা হয়। তবে কালীঘাটের হালদারেরা যে,

তখনকার ওই সব নৃশংস আত্মহত্যার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ছিলেন, তা নয়; কিন্তু তাঁরা খুব সম্ভবতঃ সেই সময়ের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করতে চাননি, কাজেই ওই কুপ্রথা

দমনের জন্য তখন তাঁরা কোনো বিশেষ চেষ্টাও করেন নি।

১৮৬৫-৬৬ সালেও যশোহর, হুগলী ও বীরভূম জেলায় ভূতপ্রেত, পূজা এবং ভাল শস্য লাভের জন্য মাঝে মাঝেই নরবলির কাহিনী শুনতে পাওয়া যেত। তখন ছোট ছোট ছেলেদের প্রায়শঃই ওই

সব জায়গায় বলি দেওয়া হত। অবশ সেই ধরণের বলি যে তখন খুব বেশী পরিমাণে ঘটত তা নয়। ‘হান্টার’ সাহেব তাঁর ‘Annals of Rural Bengal’ গ্রন্থটিতে ১৮৬৬ সালে যশোরের

লক্ষ্মীপাশা গ্রামে কালীমূর্তির সম্মুখে একটি মুসলমান বালকের বলির কথা লিখেছিলেন। ১৮৬৬ সালের ১৯শে মে তারিখের ‘Englishman’ কাগজে হুগলী জেলাতেও ওই ধরণের একটি

নরবলির কথা পাওয়া যায়। হান্টার বলেছিলেন যে, তিনি বীরভূমের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যেও শীঘ্র বৃষ্টিপাত কামনা করে তখন ওই ধরণের নরবলি দেওয়া হত বলে

শুনেছিলেন। ছোটনাগপুরের কমিশনার ‘ড্যান্টন’ সাহেব, ১৮৬৪ সালের ২০শে অক্টোবর তারিখে সরকারের কাছে জানিয়েছিলেন যে, ধলভূমের রাজার গৃহদেবী রঙ্কিণীর মন্দিরে মাঝে মাঝেই

নরবলি হয় বলে তিনি সন্দেহ করছেন, এবং সেই বলির জন্য কাছের গ্রাম থেকেই বালক সংগ্রহ করা হয়। এরপরে সেই বিষয়ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ধলভূমের রাজাকে গ্রেপ্তার করা

হলেও, আদালতে কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে তিনি মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন।

 

116

 

পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার প্রসারের ফলে বিংশ শতাব্দী থেকে ভারতে নরবলি প্রথা একরকম উঠে গিয়েছে বললেই চলে, কিন্তু এখনো আসাম, উড়িষ্যা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি,

এমনকি পশ্চিমবঙ্গের অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর অঞ্চল থেকেও মাঝে মাঝেই দু’-একটি বিচ্ছিন্ন নরবলির সংবাদ পাওয়া যায়। এমনকি ভারত স্বাধীন হওয়ার মাত্র আট বছরের মাথায়,

১৯৫৫ সালেও, উড়িষ্যার কালিয়াবোধার মঠে পুলিশের খানাতল্লাসীর ফলে অনেক গোপন কক্ষ ও নরবলির উপযোগী মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল। সাম্প্রতিক অতীতের ও

বর্তমানের সেই সব বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে দু’-একজন উন্মাদের কাজ মনে করে নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু জাতিগতভাবে ভারতীয়রা আজও যে নরবলিদানের অভ্যাস

সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেনি, সেটার প্রমাণ এখনও মাঝে মাঝেই সংবাদপত্রের পাতায় দেখতে পাওয়া যায়।

বৈদিক সাহিত্যে বামাচার’

রানা

‘ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস’ লিখেছিলেন, ‘‘… all understanding of primitive conditions remains impossible so long as we regard them through brothel spectacles.’’ (Friedrich

Engels; The Origin of the Family, Private Property and the State) অর্থাৎ, ‘‘গণিকালয়ের ঠুলি পরে আদিম অবস্থায় তাৎপর্য বোঝা অসম্ভব।’’ আধুনিক যুগের রুচিবোধের কাছে

‘বামাচার’ যে কী সাংঘাতিক ‘বিদ্বেষ-বিতৃষ্ণার’ উদ্রেক করে তার নিদর্শন হিসেবে ‘রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের’ একটি মন্তব্য উদ্বৃত করা যায়। ‘গুহ্যসমাজ’ বা ‘তথাগত গুহ্যক’ নামে

একটি ‘বৌদ্ধ বামাচারী পুঁথি’ সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, সেই পুঁথিতে এমন সব ‘মতবাদ’ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এমন সব ‘ক্রিয়াকর্মের নির্দেশ’ দেওয়া হয়েছে যে ‘মানুষের জঘন্যতম

প্রবৃত্তি’ও এর চেয়ে ‘ঘৃণিত ও ভয়াবহ’ কিছুই কল্পনা করতে পারে না এবং তার পাশে গত শতাব্দীর ‘বিলিতি বটতলা’ বা ‘হলিওয়েল স্ট্রিটের অশ্লীল সাহিত্য’ও একান্ত পবিত্র বলে মনে

হবে। ‘‘… theories are indulged in, and practices enjoined which are at once the most revolting and horrible that human depravity could think of, and compared to

which the words and specimens of Holiwell Street literature of the last century would appear absolutely pure.’’ (বৌদ্ধধর্ম, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা-

৮২) এই কথাগুলি নিশ্চয়ই মিথ্যে নয়। তবুও কিন্তু এ-জাতীয় মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হলে ‘প্রাচীন সাহিত্যের প্রকৃত তাৎপর্য’ উদ্ধার করা অসম্ভব। তার কারণ, যে-‘নীতিবোধ ও

রুচিবোধের মধ্যে’ এ-জাতীয় মন্তব্যের উৎস সেটা একান্তই আধুনিক কালের, ‘আধুনিক যুগের অবদান’। ‘প্রাচীনেরা’ ছিলেন ‘প্রাচীন’, তাই আমাদের ‘নীতিবোধ বা রুচিবোধের সঙ্গে’ তাঁদের

পরিচয় ছিল না। তাঁরা যে-সাহিত্য রচনা করে গিয়েছেন তা ‘তাঁদের রুচিবোধের অনুপাতেই’। তাই আমরা যদি ‘একালের নীতিবোধ’ নিয়ে তাঁদের সাহিত্যের দিকে চেয়ে দেখি এবং ‘বিদ্বেষ-

বিতৃষ্ণায়’ একেবারে বিরক্ত হয়ে উঠি তাহলে ‘তাঁদের কথার প্রকৃত তাৎপর্য’ কিছুতেই খুঁজে পাবো না। তাঁরা ঠিক কী ভেবে এ-জাতীয় কথাবার্তা লিখেছিলেন তা জানতে হবে, এবং সে-কথা

জানতে হলে অন্ততঃ সাময়িক ভাবে আমাদের ‘রুচিবোধ’কে মূলতবী রেখে ভেবে দেখতে হবে ‘তাঁদের উদ্দেশ্য’টা কী হওয়া সম্ভব। ‘বৈদিক সাহিত্যে বামাচারের নিদর্শন’ নিয়ে আলোচনা করবার

আগে এই কথাগুলি বিশেষ করে উল্লেখ্য; কেননা, ‘একালের ধ্যানধারণাগুলিকে’ সম্বল করে এগোলে ‘বৈদিক সাহিত্যে বামাচারের নিদর্শনগুলিকে’ ‘অত্যন্ত বীভৎস কামবিকার ও কুৎসিৎ

লাম্পট্যের নমুনা’ বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ ‘বৈদিক ঋষিদের’ কাছে কথাগুলি ছিল অত্যন্ত ‘গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্দেশ্যমূলক’। তাই ‘একালের লাম্পট্য-ব্যবহারের পটভূমিতে’ সেকালের

ঋষিদের এই সব কথাবার্তার ‘প্রকৃত তাৎপর্য’ অনুমান করা অসম্ভব।

‘বেদ-ব্রাহ্মণ-উপনিষদের তাৎপর্য’ খুঁজতে হলে ‘আজকালকার বটতলাসাহিত্য’ থেকে কোনোরকম ‘মূলসূত্র’ পাওয়া সম্ভব নয় - এক কথাটি স্পষ্টভাবে মনে রেখেই বৈদিক সাহিত্যে

‘বামাচার ও কামাচারের নিদর্শনগুলিকে’ বোঝবার চেষ্টা করা যাক। একটি নিদর্শন, ‘শুক্ল-যজুর্বেদ’-এর (‘বাজসনেয়ী সংহিতার’) ‘২৩।।২২ থেকে ২৩।।৩১’ সংখ্যক শ্লোক। এই ‘দশটি

বেদমন্ত্রের’ই ‘আক্ষরিক অনুবাদ’ দেবার দরকার নেই। শুধুমাত্র ‘দুটি মন্ত্রের তর্জমা’ উদ্বৃত করলেই চলবে, কেননা, ওই দুটির মধ্যেই ‘খুব প্রয়োজনীয় একটি ইঙ্গিত’ লুকিয়ে রয়েছে -

‘বাকি আটটি মন্ত্রে’ বারবার একঘেয়ে ভাবে, একই কথাবার্তা পাওয়া যায়। কিসের কথাবার্তা? ‘মৈথুনের’। কেবল এটা মনে রাখতে হবে, সেই ‘মৈথুন-দৃশ্যে’ ও ‘মৈথুন-সংলাপে’ যাঁরা

অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা কেউই ‘আজকালকার লম্পটদের মতো’ লোক ছিলেন না। তার বদলে ছিলেন ‘পাঁচজন যজ্ঞীয় ঋত্বিক’ - ‘অধ্বর্য্যু’, ‘ব্রহ্মা’, ‘উদ্গাতা’ ইত্যাদি। ‘২৩।।২২’ এবং

‘২৩।।২৩’ সংখ্যক শ্লোকে; ‘অধ্বর্য্যু’ ‘কুমারীকে অভিমেথন’ করছেন - এই দুটি মন্ত্রে ‘অধ্বয্যু ও কুমারীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ’ পাওয়া যায়। ‘২৩।।২৪’ এবং ‘২৩।।২৫’ সংখ্যক শ্লোকে,

‘ব্রহ্মা’ ‘মহিষীকে অভিমেথন’ করছেন - সেই মন্ত্র দুটিতে ‘ব্রহ্মা ও মহিষীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ’ লিপিবদ্ধ রয়েছে। এখানে আলোচনার জন্য ‘২৩।।২৬’ এবং ‘২৩।।২৭’ সংখ্যক শ্লোকই

সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হবে। তাই শুধু সেই ‘দুটি বেদমন্ত্র’ই উদ্বৃত করা হল।

‘‘উর্ধ্বামেনামুচ্ছ্রাপয় গিরৌ ভারং হরন্নিব।

অথাস্যৈ মধ্যমেধতাং শীতে বাতে পুনান্নিব।।’’

(শুক্ল-যজুর্বেদ, বাজসনেয়ী সংহিতা, ২৩।২৬।।)

অর্থাৎ, ‘‘এই স্ত্রীকে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরো। পর্বতে যেমন করিয়া তার উত্তোলন করে। অনন্তর ইহার মধ্যদেশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হউক। বায়ুকে শুদ্ধ করিতে করিতে …।’’

‘উবটভাষ্য’ - ‘‘উদ্গাতা বাবাতাম্‌ অভিমেথয়তি উর্ধ্বাম্‌ এনাম্‌ কম্‌ চিৎ পুরুষম্‌ আহ। উর্ধ্বাম্‌ এনাম্‌ বাবাতাম্‌ উচ্ছ্রিতাম্‌কুরু। কথম্‌ ইব। গিরৌ ভারম্‌ মধ্যে নিগৃহ্য হরেৎ এবম্‌

মধ্যে নিগৃহ্য উর্ধ্বাম্‌ উচ্ছ্রাপয়। অথ যথা ইতি এতস্য স্থানে। অথাচ উচ্ছ্রাপয় যথা অস্যা বাবাতায়া মধ্যম্‌ যোনিপ্রদেশঃ এধতাম্‌। ‘এধ্‌ বৃদ্ধৌ’ বৃদ্ধিম্‌ যায়াৎ অথ এনাম্‌ গৃহ্নীয়াঃ।

শীতে বাতে পুনন্‌ ইব। যথা কৃষীবলঃ ধান্যম্‌ বাতে শুদ্ধম্‌ কুর্বন্‌ গ্রহণমোক্ষৌ ঝটিতি করোতি।’’

অর্থাৎ, ‘‘উদ্গাতা বাবাতাকে অভিমেথন করিলেন। কোনো পুরুষকে বলিলেন, এই বাবাতাকে ঊর্ধ্বে তুলিয়া উষ্প্রিত করো। কেমন করিয়া? পর্বতে ভারবস্তুকে মধ্যস্থানে ধরিয়া যেমন ভাবে

উত্তোলন করা হয় তেমনি ইহাকে মধ্যে ধরিয়া উত্তোলন করো। যেমন কৃষক বায়ুতে ধান্য শুদ্ধ করিতে করিতে ঝটিতে গ্রহণ করে ও বপন করে …।’’

‘‘উর্ধ্বামেনমুচ্ছ্রয়োতাদিগিরৌ ভারং হরন্নিব।

অথাস্য মধ্যমেজতু শীতে বাতে পুনন্নিব।।’’

(শুক্ল-যজুর্বেদ, বাজসনেয়ী সংহিতা, ২৩.২৭।।)

অর্থাৎ, ‘‘ঊর্ধ্বে এই পুরুষকে তুলিয়া ধরো। যেমন করিয়া পর্বতে ভারবস্তুকে উত্তোলন করা হয়। অনন্তর ইহার মধ্যপ্রদেশ চলিতে থাকুক। শীতল বায়ুতে যব শস্য শুদ্ধ করিতে করিতে

…।’’

‘উবটভাষ্য’ - ‘‘বাবাতা প্রত্যাহ উদ্‌গাতারম্‌। ভবতঃ অপি এতৎ এবম্‌। উর্ধ্বম্‌ এনম্‌। উদ্‌গাতারম্‌ উচ্ছ্রয়তাম্‌ উচ্ছ্রাপয়। অত্র স্ত্রী পুরুষায়তে। গিরৌ ভাবম্‌ হরন্‌ ইব। অথ এবম্‌

ক্রিয়মাণস্য অস্য মধ্যম প্রজননম্‌ এজতু চলতু। অথ এনম্‌ নিগৃহীব শীতে বাতে পুনন্‌ ইব যবান্‌।’’

অর্থাৎ, ‘‘প্রত্যুত্তরে বাবাতা উদ্গাতাকে বলিল, তোমা কর্তৃকও এই রকমই করা হউক। এই পুরুষকে, অর্থাৎ উদ্গাতাকে, ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরো। এইখানে স্ত্রীলোক পুরুষের ন্যায় আচরণ

করিতেছে। পর্বতে যেমন করিয়া ভার তোলে। অনন্তর এইরূপ ক্রিয়মান ইহার মধ্যেপ্রদেশ চলিতে থাকুক, অর্থাৎ মৈথুন চলিতে থাকুক। অনন্তর ইহাকে চালিয়া ধরো। যেমন কৃষক শীতল

বায়ুতে যব শুদ্ধ করিতে করিতে ঝাটিতে গ্রহণ এবং বপন করে …।’’

উদ্ধৃত অংশের বিশেষ করে একটি বিষয়ের দিকে নজর রাখা দরকার, ‘মৈথুন-সংলাপের’ মধ্যে কী ভাবে ক্ষেত্রে ‘বীজ বপনের কথা’টা এলো! তাহলে ‘বামাচারের’ সঙ্গে ‘বার্ত্তা-বিদ্যার

সংযোগ’টা মনে হচ্ছে শুধুমাত্র ‘কাপালিক-লোকায়তিক সম্প্রদায়ের’ মধ্যেই নয়, খোদ ‘বৈদিক ঐতিহ্যের’ যেন একই ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে! এ-আলোচনায় পরে ফেরা যাবে। আপাততঃ,

বড় সমস্যাটাই দেখা যাক। সমস্যা হল, ‘যজুর্বেদে’ পরের পর দশ দশটি এই রকম মন্ত্র আছে, এবং আধুনিক কোনো পণ্ডিতই বলতে পারছেন না যে ‘উত্তরযুগের লম্পটেরা’ এগুলি রচনা করে

‘বেদের মধ্যে’ গুঁজে দিয়েছে। অর্থাৎ, রচনাটি খোদ ‘বৈদিক ঋষিদেরই’। অবশ্যই, পরের যুগের ‘বেদপন্থীরা’ এই মন্ত্রগুলি নিয়ে খুবই বিপদে পড়েছিলেন। তার কারণ, তাঁদের ‘উত্তরযুগের

রুচির’ সঙ্গে এগুলি কিছুতেই খাপ খায় না। তাই পরের যুগে এমনকি ‘বিধান’ দেওয়া হয়েছিল, এই বৈদিক মন্ত্রগুলি উচ্চারণ করবার জন্যই ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে হবে (Samhita: Original

Text With a Literal Prose English Translation, Manmatha Nath Dutt, page- 801)। ‘প্রায়শ্চিত্তবিধানের মূলে’ নিশ্চয়ই ‘পাপ-বোধ’। অথচ, পুরাকালের ‘বৈদিক ঋষিরা’ যদি সত্যিই

একে ‘পাপাচরণ’ মনে করতেন তাহলে নিশ্চয়ই তার জন্য পাঁচ-পাঁচজন ‘যজ্ঞীয় ঋত্বিক’কে নিয়োগ করতে চাইতেন না। তাই তাঁদের কাছে পুরো ব্যাপারটাই যে একটি ‘বৈদিক যজ্ঞ-বিশেষ’ ছিল

সে-বিষয়ে কোনো রকম সন্দেহের অবকাশ নেই। বস্তুতঃ, ‘বেদের ছাত্রমাত্রই’ জানেন এই মন্ত্রগুলির সঙ্গে ‘অশ্বমেধ যজ্ঞের’ কী রকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

কিন্তু ‘মৈথুনের’ সঙ্গে ‘বৈদিক যজ্ঞের’ সম্বন্ধ আবার কী? ঠিক কী সম্পর্ক এ-কথার জবাব এখুনি দেওয়া যাবে না। কেননা, ‘যজ্ঞ’ বলে ব্যাপারটির আসল তাৎপর্য নিয়েই প্রচুর

আলোচনার অবকাশ রয়েছে। আপাততঃ, শুধু এইটুকুই বলা যায় যে ‘যজ্ঞ’ মানে যাই হোক না কেন, অনেক জায়গায় দেখা যায় প্রাচীনেরা ‘মৈথুন’কেও সরাসরি ‘যজ্ঞের মতোই’ মনে করেছিলেন।

এ কথার প্রমাণ রয়েছে ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদে’ একেবারে শেষের দিকে -

‘‘স হ প্রজাপতিরীক্ষাংচক্রে হস্তাস্মৈ প্রতিষ্ঠাং কল্পযানীতি স স্ত্রিয়ং সসৃজে তাং সৃষ্ট্বাহধ উপাস্ত তস্মাৎ স্ত্রিয়মধ উপাসীত স এতং প্রাঞ্চং গ্রাবাণমাত্মন এব সমুদপারয়ত্তে

নৈনামভ্যসৃজৎ।। ৬।৪।২।।’’

অর্থাৎ, ‘‘প্রজাপতি মনে-মনে চিন্তা করলেন, ‘এসো আমি এর জন্যে একটি প্রতিষ্ঠা সৃষ্টি করি।’ তিনি স্ত্রী সৃষ্টি করলেন। তাঁকে সৃষ্টি করে তিনি তাঁর অধোদেশে মিলিত হলেন (উপাস্ত =

মিলিত হলেন। ‘মনিয়ার উইলিয়ম্‌স’-এর অভিধান দ্রষ্টব্য)। সেই কারণে স্ত্রীর অধোদেশে মিলিয়ে হওয়া উচিত (উপাসীত)। তিনি নিজের উর্ধ্বোত্থিত গ্রাবাণকে (আক্ষরিক অর্থে গ্রাবাণ

যদিও ‘সোমরস নিষ্কাশনের শিলাখণ্ড’, তবুও এখানে শব্দটি স্পষ্টই ‘শিশ্ন-ব্যঞ্জক’) প্রসারিত করে দিলেন। তার দ্বারা তিনি তাঁকে গর্ভবতী করলেন।। ৬।৪।২।।’’

‘‘তস্যা বেদিরুপস্থো লোমানি বর্হিশ্চর্মাধিষবণে সমিদ্ধো মধ্যতস্তৌ মুষ্কৌ স যাচান্‌ হ বৈ বাজপেয়েন যজমানস্য লোকো ভবতি তাবানস্য লোকো ভবতি য এবং

বিদ্বানধোপহাসংচরত্যাসাং স্ত্রীণাং সুকৃতং বৃঙক্তেহথ য ইদমবিদ্যানধোপহাসংচরত্যস্য স্ত্রিয়ঃ সুকৃতং বৃঞ্জতে।। ৬।৪।৩।।’’

অর্থাৎ, ‘‘তাঁর (অর্থাৎ স্ত্রীলোকটির) উপস্থ (নিম্নাঙ্গ) বেদি (যজ্ঞবেদী); তাঁর লোম (চুল) যজ্ঞতৃণ; তাঁর চর্ম অধিযবন (সোমরস নিষ্কাশনের যন্ত্র); তাঁর মুষ্কদ্বয় (the two labia

of the vulva - ‘রাধাকৃষ্ণণ ও হিউমের তর্জমা’ দ্রষ্টব্য) মধ্যস্থ অগ্নি। বাজপেয়-যজ্ঞকারীর কাছে জগৎ যতো বৃহৎ, এই (তত্ত্ব) জেনে যে মৈথুন করে তাঁর কাছেও জগৎ ততো বৃহৎ।

যে স্ত্রী দ্বারা নিজে শক্তিমান হয়। যে এ (তত্ত্ব) না জেনে মৈথুন করে স্ত্রী তাঁর সুকৃতকে …।। ৬।৪।৩।।’’

এরকম ‘প্রকট বামাচারী চিন্তা’ যদি ‘উপনিষদের’ মধ্যে মাত্র একবারই উঁকি দিতো তাহলে না হয় ‘আধুনিক পণ্ডিতদের পক্ষে’ একে দেখেও না দেখার ভাবটা অতখানি ‘দোষাবহ’ হত না।

কিন্তু উদ্বৃত অংশের মূল কথাটি শুধুমাত্র উদ্বৃত অংশটুকুর মধ্যেই আবদ্ধ নয়, অন্যত্রও তার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

‘ছান্দোগ্যের ঋষি’ বলছেন -

‘‘যোযা বাব গৌতমাগ্নিস্তস্যা উপস্থ এব সমিধ্‌ যদুপমন্ত্রয়তে স ধূমো যোনিরর্চির্ষদন্তঃ করোতি তেহঙ্গারা অভিনন্দা বিস্ফুলিঙ্গাঃ।। ৫।৮।১।।’’

 

117

 

অর্থাৎ, ‘‘হে গৌতম, স্ত্রীলোকই হলো যজ্ঞীয় অগ্নি। তাঁর উপস্থই হলো সমিধ। ওই আহ্বানই হলো ধূম। যোনিই হলো অগ্নিশিখা। প্রবেশ-ক্রিয়াই হলো অঙ্গার। রতিসম্ভোগই হলো

বিস্ফুলিঙ্গ।। ৫।৮।১।।’’

‘‘তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্নৌ দেবা রেতো জুহ্বতি তস্যা আহুতের্গর্ভঃ সম্ভবতি।। ৫।৮।২।।’’

অর্থাৎ, ‘‘এই অগ্নিতে দেবতারা রেতর আহুতি দেন। সেই আহুতি থেকেই গর্ভ সম্ভব হয়।। ৫।৮।২।।’’

আবার ‘বৃহদারণ্যকে’ও হুবহু এই কথাই দেখতে পাওয়া যায় -

‘‘যোযা বা অগ্নির্গৌতম তস্যা উপস্থ এব সমিল্লোমানি ধূমো যোনিরর্চির্ষদন্তঃ করোতি করোতি তেহঙ্গারা অভিনন্দা বিস্ফুলিঙ্গাস্তস্মিন্নেতস্মিন্নগৌ দেবা রেতো জুহ্বতি তস্যা

আহুত্যৈঃ পুরুষঃ সংভবতি …।। ৬।২।১৩।।’’

এর ‘তর্জমা’ আগের উদ্বৃতিটিরই অনুরূপ।

তাহলে, ‘উপনিষদের ঋষি’ ‘মৈথুন-ক্রিয়াকে’ খোলাখুলি ভাবেই ‘যজ্ঞ’ বলে উল্লেখ করছেন। কথায় কথায় ‘সোমযাগ’ থেকে ‘উপমা নেবার চেষ্টা’টাও লক্ষ্য করবার মতো। আমাদের আধুনিক

রুচিতে এ-সব কথাবার্তা যতোই ‘কদর্য’ লাগুক না কেন, ‘উপনিষদের ঋষিরা’ এই তত্ত্বটির প্রতিই যে কতখানি গুরুত্ব দিতে চাইতেন তার পরিচয় পাওয়া যায় নানান দিক থেকে।

‘বৃহদারণ্যকে’ উক্ত তত্ত্ব বলবার পরই ঋষি ‘তিনজন প্রাচীন জ্ঞানীর নজির’ দেখিয়েছেন - ‘বিদ্বান উদ্দালক আরুনি’, ‘বিদ্বান নাক মৌদ্গল্য’, ‘বিদ্বান কুমারহারিত’ - ‘তিনজন বিদ্বান’ই

নাকি এই তত্ত্ব জানতেন এবং সেই মর্মে ‘উপদেশ’ দিয়েছিলেন এবং এই প্রসঙ্গেই এগিয়ে ‘বৃহদারণ্যকের ঋষি’ বলেছিলেন -

‘‘… বদ্যুদক আত্মানং পশ্যেত্তদতিমন্ত্রয়েত ময়ি তেজ ইন্দ্রিয়ং যশো দ্রবিনং সুকৃতমিতি শ্রীর্হ বা এবাং স্ত্রীপাং যন্মলোদ্বাসাস্তস্মান্নলোদ্বাসসং

যশস্বিনীমভিক্রম্যোপমন্ত্রয়েত।। ৬।৪।৬।।’’

অর্থাৎ, ‘‘… কেউ যদি নিজেকে জলে দেখে তাহলে জপ করবে, ‘আমাতে তেজ, ইন্দ্রিয়সামর্থ্য, যশ, ধন, সুকৃত (আসুক)’। এই হলো স্ত্রীলোকের মধ্যে শ্রী, যখন সে মলোদ্বাসা হয় (মল +

উৎবাসাঃ, খুব সম্ভব, ঋতুর পর মলবস্ত্র ত্যাগ করবার উল্লেখ করা হচ্ছে)। অতএব মলোস্বাসা যশস্বিনী স্ত্রীলোকের নিকট গমন করে তাকে আহ্বান করবে।। ৬।৪।৬।।’’

‘‘সা চেদস্মৈ ন দন্তাৎ কামমেনামবক্রীণীয়াৎ সা চেদস্মৈ নৈব দস্যাৎ কামমেনাং যষ্ট্যা বা পাণিনা বোপহত্যাতিক্রামেদিন্দ্রিয়েণ তে যশসা যশ আদদ ইত্যযশা এব ভবতি।। ৬।৪।৭।।’’

অর্থাৎ, ‘‘সে (স্ত্রীলোকটি) যদি তাঁকে কাম দিতে রাজী না হয় তাহলে তাঁকে (স্ত্রীলোকটিকে) নিজ বসে আনয়ন করবে। সে (স্ত্রীলোকটি) যদি তাঁকে (পুরুষকে) কাম দিতে রাজী না হয় তাহলে

তাঁকে (স্ত্রীলোকটিকে) লাঠি দিয়ে বা হাত দিয়ে প্রহার করে অভিভূত করে বলবে, ‘আমার ইন্দ্রিয়শক্তি দ্বারা, আমার যশদ্বারা তোমার যশকে কেড়ে নিচ্ছি’। এই ভাবে সে (স্ত্রীলোকটি)

যশহীনা হয়।। ৬।৪।৭।।’’

বলাই বাহুল্য, আজকের দিনে ‘এই ধরনের উপদেশ’ দিতে গেলে আমরা ঋষির ‘গৌরব’ পাবার বদলে নিজেরাই ‘লাঠিপেটা বা কিলচড়’ খাবেন। কিন্তু ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদের লেখক’ মেয়েদের

‘লাঠি-পিটে করে’, ‘কিলচড় লাগিয়ে’ ‘কামভাব চরিতার্থ করিতে দিতে বাধ্য করবার উপদেশ’ দিয়েও মারধোর খেয়েছিলেন বলে কোথাও লেখা নেই। বরং তাঁর বইকে প্রাচীনেরা ‘জ্ঞানের আকর’

বলেই মনে করেছিলেন। আর, এই থেকে কি প্রমাণ হয় যে ‘মৈথুন ও কাম’ সম্বন্ধে ‘আমাদের আজকের দিনের যা-ধারণা’ তার সঙ্গে ‘সেকালের মানুষদের ধারণার’ একেবারে আকাশ-পাতাল

তফাত?

তফাত যে হয়েছিল এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনো রকম অবকাশই নেই। কেননা, ‘মহাভারতের যুগে’ দেখা যায় এ-বিষয়ে ‘পুরোনো কালের ধ্যান-ধারণার’ সঙ্গে ‘নতুন কালের ধ্যানধারণাগুলো’ আর

মিল খাচ্ছে না। ‘মহাভারতের আদিপর্বের ১২২ নং অধ্যায়’ বলছে (মহাভারত, কালীপ্রসন্ন সিংহ, পৃষ্ঠা- ১০৯) -

‘‘পূর্বকালে উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন। তাঁহার পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদা তিনি পিতামাতার নিকট বসিয়া আছেন, এমন সময় এক ব্রাহ্মণ আসিয়া তাঁহার জননীর হস্ত

ধারণপূর্বক কহিলেন, আইস আমরা যাই! ঋষিপুত্র পিতার সমক্ষেই মাতাকে বলপূর্বক (‘বলাৎ ইব’) লইয়া যাইতে দেখিয়া সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইলেন। মহর্ষি উদ্দালক পুত্রকে তদবস্থ

দেখিয়া কহিলেন, বৎস ক্রোধ করিও না, ইহা নিত্যধর্ম। (এষঃ ধর্ম্মঃ সনাতনঃ ।।১।১২২।১৪।।)। গাভীগণের ন্যায় স্ত্রীগণ শত সহস্র পুরুষে আসক্ত হইলেও উহারা অধর্মলিপ্ত হয় না।

ঋষিপুত্র পিতার বাক্য শ্রবণ করিয়াও ক্ষান্ত হইলেন না, প্রত্যূত পূর্বাপেক্ষা ক্রুদ্ধ হইয়া মনুষ্যমধ্যে বলপূর্বক এই নিয়ম স্থাপন করিয়া দিলেন যে, অদ্যাবধি যে স্ত্রী পতিভিন্ন

পুরুষান্তর সংসর্গ করিবে এবং যে পুরুষ কৌমারব্রহ্মচারিনী বা পতিব্রতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য স্ত্রীতে আসক্ত হইবে, ইহাদের উভয়কেই ভ্রুণহত্যা সদৃশ ঘোরতর পাপপঙ্কে

লিপ্ত হইতে হইবে।’’ (কালিপ্রসন্ন সিংহের তর্জমা)

‘যৌনজীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা’ যে একটি বিশেষ যুগেই বদলেছে - আগে একরকম ছিল, পরে অন্যরকম হল - এ-কথার এর চেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ আর কী হবে? সেই যুগ বলতে ঠিক ‘কোন

যুগ’, কোন যুগ থেকে ‘কামজীবন সম্বন্ধে আধুনিক ধ্যানধারণার শুরু’, - এ-প্রশ্ন অবশ্যই স্বতন্ত্র।

এখানে প্রধান সমস্যা হল, ‘সেকালের ধারণা’টা ঠিক কী রকম? কোন রকম ধারণার বশবর্তী হলে পরে ‘বৈদিক ঋষিদের পক্ষে’ ‘কামজীবন’কে অতখানি ‘গুরুত্বপূর্ণ’, অতখানি

‘উদ্দেশ্যমূলক’, মনে করা সম্ভবপর? এ-প্রশ্নের পুরো জবাবটা অবশ্যই শুধুমাত্র ‘বৈদিক সাহিত্যের’ কাছ থেকে প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। অন্য কোন দিক থেকে জবাবটা পাবার

সম্ভাবনা সে-কথায় একটু পরে ফেরা যাবে। কিন্তু, যেটা খুবই ‘বিস্ময়ের কথা’, এ-বিষয়ে ‘বৈদিক সাহিত্য’ আমাদের সম্পূর্ণ নিরাশ করে না। ‘উপনিষদ’ এবং বিশেষ করে ‘ব্রাহ্মণ

গ্রন্থগুলি’র কাছ থেকেই প্রশ্নটার অন্ততঃ ‘আংশিক উত্তর’ পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়, ‘ছান্দোগ্য-উপনিষদের বামদেব্য ব্রতের কথা’। ‘বামদেব্য’ নামটার দিকে

নজর রাখাটা দরকার। ‘বৈদিক সাহিত্যে’ও ‘বামাচারের স্মারক’ রয়েছে তার একটি স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে ওই নামের মধ্যেই।

‘ছান্দোগ্য-উপনিষদে’ লেখা আছে -

‘‘উপমন্ত্রয়তে স হিংকারো জ্ঞপয়তে স প্রস্তাবঃ স্ত্রিয়া সহ শেতে স উদ্গীথঃ প্রতি স্ত্রীং সহ শেতে স প্রতিহারঃ কালং গচ্ছতি তন্নিধনং পারং গচ্ছতি তন্নিধনমেতদ্বামদেব্যং মিথুনে

প্রোতম্‌।। ২।১৩।১।।’’

অর্থাৎ, ‘‘আহ্বান করে, সেই হলো হিঙ্কার। প্রস্তাব করে, সেই হলো প্রস্তাব। স্ত্রী সঙ্গে সে শয়ন করে, সেই হল উদ্‌গীথ। স্ত্রীর অভিমুখ হয়ে শয়ন করে, সেই হল প্রতিহার। সময়

অতিবাহিত হয়, তাই নিধন। এই বামদেব্য নামক সাম মিথুনে প্রতিষ্ঠিত। ।।২।১৩।১।।’’

‘‘স য এবমেতদ্বামদেব্যং মিথুনে প্রোতং বেদ মিথুনীভবতি মিথুনান্মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বমায়ুরেতি জ্যোগ্‌ জীবতি মহান্‌ প্রজয়া পশুভির্ভবতি মহান্‌ কীর্ত্ত্যা ন কাঞ্চন পরিহরেৎ

তদ্‌ ব্রতম্‌।। ২।১৩।২।।’’

অর্থাৎ, ‘‘যে এইভাবে বামদেব্য সামকে মিথুনে প্রতিষ্ঠিত বলে যে জানে সে মিথুনে মিলিত হয়। (তাঁর) প্রত্যেক মিথুন থেকেই সন্তান উৎপন্ন হয়। সে পূর্ণজীবী হয়। সন্তান, পশু ও

কীর্তিতে মহান হয়। কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না - এই-ই ব্রত।। ২।১৩।২।।’’

“মিথুনাৎ মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বম্‌ আয়ুঃ এতি জ্যোক্‌ জীবতি মহান্‌ প্রজয়া পশুভির্ভবতি মহান্‌ কীর্ত্ত্যা” - এই হলো আসল কথা।

মিথুন থেকে কী কী পাওয়া যাবে তার ফর্দ নিম্নরূপ -

১) ‘সন্তান পাওয়া যাবে’।

২) ‘পূর্ণ জীবন পাওয়া যাবে’।

৩) ‘পশু পাওয়া যাবে’।

৪) ‘মহান্‌ কীর্তির নামডাক পাওয়া যাবে’।

এখানে বিশেষ করে যে-দিকে দৃষ্টি আকর্ষিত হয় তা হল, ‘উপনিষদের ঋষি’ ‘মৈথুন’কে শুধুমাত্র ‘সন্তান উৎপাদনেরই উপায়’ বলে মনে করছেন না, সেই সঙ্গেই ‘ধন উৎপাদনের উপায়’

বলেও বর্ণনা করছেন। ‘উপনিষদের যুগে’ও ‘অর্থনৈতিক পরিস্থিতি’টা অনেকখানিই ‘পশুপালনমূলক’ ছিল; তাই ‘ধনউৎপাদন’ বলতে প্রধানতই ‘পশুবৃদ্ধি’ বোঝানো হয়েছিল। আর এই ধারণার

দরুনই ‘মিথুন’কে এতোখানি জরুরী বলে মনে করা হয়েছিল যে ঋষি ‘মিথুনের বিভিন্ন স্তর’কে ‘হিঙ্কার’, ‘প্রস্তাব’, ‘উদ্‌গীথ’, ‘প্রতিহার’ প্রভৃতি ‘পঞ্চবিধ সামগানের সঙ্গে’ এক বলে বর্ণনা

করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘উপদেশ’ দেওয়া হয়েছিল, “ন কাঞ্চন (‘কাম্‌’ + ‘চন’ = ‘কোনো স্ত্রীলোককে’) পরিহরেৎ তদ্‌ ব্রতম” - ‘‘কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না, তাহা-ই ব্রত।’’

তাহলে প্রাচীনদের মনে ‘মিথুন’ সম্বন্ধে ধারণাটা ঠিক আমাদের মতো নয়। আমাদের ধারণায় ‘মিথুন’ থেকে কী পাওয়া যায়? ‘সন্তান’। ঋষিদের ধারণায় ‘মিথুন’ থেকে কী পাওয়া যায়? শুধু

‘সন্তান’ নয়, ‘ধনসম্পদ’ও। আমাদের ধারণায় ‘সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে ধনসম্পদ উৎপাদনের’ কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁদের ধারণায়, ‘ধনসম্পদ উৎপাদন ও সন্তান উৎপাদন’ - দু’য়ের

মধ্যে সম্পর্ক বড়ো গভীর।

এখন, আমাদের ধারণাটা ঠিক না তাঁদের ধারণাটা ঠিক, এ-নিয়ে তর্ক তোলবার দরকার নেই। অবশ্যই, এ-বিষয়ে আমাদের ধারণা তাঁদের চেয়ে অনেক স্পষ্ট, অনেক নির্ভুল। তার তুলনায়,

তাঁদের ধারণাটার প্রায় ‘পনেরো আনাই কল্পনা’। কিন্তু যেটা আসলে ঢের বড়ো কথা, তাঁদের যুগে তাঁদের মনে এই রকমের একটা ‘কল্পনা’ সত্যিই ছিল, ছিল ওই রকমের একটা ‘ভুল ধারণা’।

তাই তাঁদের লেখা পুঁথিপত্র আমরা যদি বুঝতে চাই তাহলে আমাদের ‘একালের ধ্যান-ধারণাগুলিকে’ তাঁদের লেখার উপর আরোপ করে বসলে প্রকাণ্ড ভুল হবে - ঠিক কী ভেবে তাঁরা কী

লিখেছিলেন সে-কথা আমরা বুঝতেই পারবো না। তবে তাঁদের মনে যে সত্যিই ওই রকমের একটা ধারণা ছিলো এই কথার প্রমাণ শুধুই ‘উপনিষদ’ নয়, ‘ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলি’ও। বরং

‘ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলি’তে এই কথা এতবার এবং এত স্পষ্টভাবে তাঁরা লিখে রেখেছেন যে সেদিকে চোখ না পড়াটাই বিস্ময়কর। স্থানসংকুলানের খাতিরে এখানে মাত্র একটি নমুনার উল্লেখ করা

যেতে পারে। এই দৃষ্টান্তটি ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণের প্রথম পঞ্চিকা প্রথম অধ্যায়’ থেকে ‘সংগৃহীত’, ‘তর্জমা’ শ্রদ্ধেয় ‘রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী’র (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, রামেন্দ্রসুন্দর

ত্রিবেদী, ৬-৭) -

‘‘যে যজমান আপনাকে অপ্রতিষ্ঠিত মনে করে সে ঘৃতপক্ক চরু নির্বাপন করিবে। (অপ্রতিষ্ঠিত অর্থ, পুত্রাদিরহিত ও গবাদিরহিত)।

হে বৎস, যে এইরূপ প্রতিষ্ঠারহিত সে ইহজগতে প্রতিষ্ঠিত (শ্লাঘ্য) হয় না। (ঘৃতচরুর দ্বারা সেই অপ্রতিষ্ঠার পরিহার হয়।)

তাহাতে (সেই ঘৃতপক্ক চরুতে) যে ঘৃত আছে তাহা স্ত্রীর পয়ঃ (শোনিতস্বরূপ) আর যে তণ্ডুল আছে তাহা পুরুষের (রেতঃ স্বরূপ); সেই ঘৃততণ্ডুল মিথুন সদৃশ; সেই জন্য এই মিথুনদ্বারাই

(ঘৃততণ্ডুলময় চরুপ্রদানদ্বারা) ইহাকে (যজমানকে) সন্ততিদ্বারা ও পশুদ্বারা বর্ধিত করা হয়। (সেই হেতু এই চরু) প্রতিষ্ঠারই হেতু।’’

 

118

 

এখানেও সেই একই ধারণা, ‘মিথুন’ থেকে শুধুই যে সন্তান পাওয়া যাবে তাই নয়, ‘ধনসম্পদ’ও পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, সে-যুগে ‘ধনসম্পদ’ বলতে প্রধানতঃ ‘পশু’ই ছিল। তাহলে সে-যুগের

যাঁরা ‘জ্ঞানী’ তাঁদের ধারণায় ‘ধনউৎপাদন’ আর ‘প্রজনন’ এমন কিছু আলাদা ব্যাপার ছিল না। ‘মিথুন’ থেকে শুধু ‘সন্তান পাবার আশা’ নয়, ‘পশুদ্বারা বর্ধিত হবার আশা’ও ছিল। আর এই

কথায় যদি বিশ্বাস অটুট হয় তাহলে তাঁরা স্বভাবতই ‘উপদেশ’ দিতেন - ‘‘ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্‌ ব্রতম্‌’’, অর্থাৎ ‘‘কোনো স্ত্রীলোককেই পরিত্যাগ করবে না - তাই-ই ব্রত’’।

আধুনিক কালের পণ্ডিতেরা ‘বেদ-উপনিষদে’ এ-ধরনের কথা লেখা আছে দেখে বিলক্ষণ ‘বিরক্তিবোধ’ করতে পারেন। তার কারণ, এ-ধরনের কথা বলবার পিছনে যেটা হল নিছক ‘আধুনিক

যুগের উদ্দেশ্য’ সেটাকেই তাঁরা একমাত্র উৎসাহ মনে করেন। আর যদি তাই হয় তাহলে ‘বেদ-উপনিষদের লেখকদের’ মধ্যে ‘অত্যন্ত স্থূল আর কদর্য মনোবৃত্তি’ কল্পনা না করে উপায়

থাকে না। কিন্তু তাই বা কী করে বলা যায়? হাজার হোক, তাঁরা ছিলেন ‘সত্যদ্রষ্টা ঋষি’! ক্রমে আধুনিক পণ্ডিতদের পক্ষে একমাত্র উপায় হল ঋষিদের এই জাতীয় কথাবার্তাগুলিকে চেপে

যাওয়া। তাই বলা যায়, ওই পদ্ধতিটাই ভুল। কেননা, ‘প্রাচীনেরা’ কী ভেবে কী লিখেছেন তা ঠিকমতো বুঝতে হলে সর্বপ্রথম মনে রাখা দরকার যে ‘প্রাচীনেরা’ ছিলেন ‘প্রাচীন’ - তাই ‘একালের

ধ্যানধারণাগুলি’ তাঁদের মধ্যে কল্পনা করাটাই ‘অসঙ্গত ও যুক্তিহীন’।

‘ঊনিশ শতকের নারীশিক্ষা আন্দোলন ও বাঙালী সমাজ’

রানা

ঊনিশ শতকের প্রথমদিকে বাঙালী হিন্দুসমাজে নারীদের অবস্থা সেই সময়ের অনেককেই ব্যথিত করে তুলেছিল। তখন নারীদের অবস্থার উন্নতি কিভাবে সম্ভব - এই প্রশ্নের উত্তর

খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছিল যে, পথ একটাই - আর সেটা হল শিক্ষা। তাই শিক্ষার দ্বারকে নারীদের সামনে খুলে দেওয়ার জন্য ওই সময়ের অনেকেই সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়

হল যে, উক্ত সময়ে হিন্দু সমাজের নারীদের জন্য শিক্ষালাভের পথ বন্ধ থাকলেও, প্রাচীন ভারতের নারীশিক্ষা নিয়ে ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। সুদূর অতীত থেকেই হিন্দুধর্ম ও

শাস্ত্রে নারীশিক্ষার প্রতি সমর্থনই জানানো হয়েছিল। এমনকি প্রাচীন ভারতেও বিদ্যাবতী মহিলার কোন অভাব ছিল না। অতীতে ‘রুক্মিণী’, ‘লীলাবতী’, ‘চিত্ররেখা’, ‘মৈত্রেয়ী’,

‘লক্ষ্মণসেনের স্ত্রী’ প্রমুখ নারীর বিদ্যার খ্যাতি বহুবিস্তৃত হয়েছিল। চৈতন্যযুগেও ‘জাহ্নবী দেবী’, ‘সীতা দেবী’, ‘সুভদ্রা দেবী’, ‘হেমলতা দেবী’র মতো সুশিক্ষিতা মহিলার কোন অভাব

বঙ্গদেশে ছিল না। এমনকি মধ্যযুগীয় বাংলাসাহিত্যেও ‘বিদ্যা’র মতো বিদূষীর নারীর সাক্ষাৎ একটু খোঁজ করলেই পাওয়া যায়। মধ্যযুগের বাংলার বৈষ্ণব পরিবারের অনেক নাম না জানা

নারীও বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থগুলির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ও ঊনিশ শতকের সুচনাতেও ‘আনন্দময়ী দেবী’, ‘গঙ্গামণি দেবী’, দুইজন ‘বিদ্যালঙ্কার’, ‘শ্যামমোহিনী দেবী’,

‘প্রবময়ী দেবী’ প্রভৃতির মত বিদ্বান মহিলারা বঙ্গদেশে বাস করতেন। মনে হতে পারে যে, উক্ত সময়ে তাঁরা ব্যতিক্রম মাত্র ছিলেন। কিন্তু তৎকালীন বাংলার অনেক জমিদার আর

অভিজাত পরিবারেও তখন নারীশিক্ষার রীতিমতো চল ছিল; যথা - বর্ধমান রাজপরিবার, কৃষ্ণনগর রাজপরিবার, শোভাবাজার রাজপরিবার ইত্যাদি, এমন দৃষ্টান্তের কোন অভাব ইতিহাসে

পাওয়া যায় না। শোভাবাজার রাজপরিবারের কর্তা নবকৃষ্ণের ছ’জন স্ত্রীই বাংলা লিখতে পড়তে পারতেন। (Memoirs of Maharaja Nubkissen Bahadur, 1901, N. N. Ghose, P- 203)

রাজা সুখময় রায়ের নাতনি আর শিবচন্দ্র রায়ের কন্যা ‘হরসুন্দরী’র বিদ্যার খ্যাতি বঙ্গদেশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। রামলোচন ঘোষ ও রাজা বৈদ্যনাথের স্ত্রী, আন্দুলের জগন্নাথ প্রসাদ বসু

মল্লিক, এবং ওই সময়েরকলকাতার বিখ্যাত ধনী আশুতোষ দেবের কন্যাও সেই যুগে বিদ্যার্জন করেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ইংরেজি জানা

অকালমৃতা জ্যেষ্ঠা কন্যা ‘সুরসুন্দরী দেবী’র হাতের লেখাই শুধু মুক্তোর মতই ছিল না, তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চমৎকার লিখতেও পারতেন। তখনকার ওই সব বড় ঘরের নারীদের কথা বাদ

দিলেও দেখতে পাওয়া যায় যে, ঊনিশ শতকের সূচনাতেও ভদ্র হিন্দু গৃহস্থ পরিবারের অনেক মেয়েরাই বাড়িতে একটু আধটু লেখাপড়ার চর্চা করতেন। তখন বিবাহের পরে চর্চার অভাবে

তাঁদের অনেকে লিখতে ভুলে গেলেও, নিজেদের অবসর সময় কাটানোর জন্য রামায়ণ, মহাভারত, অন্নদামঙ্গল, চণ্ডী ছাড়াও কৃষ্ণ, দুর্গা সম্বন্ধীয় বইয়ের পাতা ওলটাতেন। ‘প্যারীচাঁদ মিত্র’

তাঁর ‘আধ্যাত্মিকা’র ভূমিকায় জানিয়েছিলেন যে, তাঁর ঠাকুমা, মা ও খুড়িরাও বাংলা বই পড়তেন। (প্যারীচাঁদ রচনাবলী, ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, পৃ- ৪৯৯) ‘সংবাদ প্রভাকর’

ও ‘সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকার পরম ভক্ত ওই সবপাঠিকাদের দিবানিদ্রা তখন বটতলার বই না হলে ঠিক জমত না। (The Calcutta Review, Vol. 11, 1849, P- XXVIII) এমনকি তখন

দীর্ঘপথ চলবার ক্লান্তি দূর করবার জন্যও অনেকে বই পড়তেন। সেই ধরনের একটি চমকপ্রদ ঘটনার বিবরণ ১৮৪৯ সালের ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকা থেকে পাওয়া যায়। একদা একজন

যুবতী স্ত্রী, তাঁর মায়ের খুব অসুস্থতার খবর পেয়ে পাল্কি করে মাকে দেখতে যাওয়ার সময়ে, ছ’দিনের দীর্ঘ পথের ক্লান্তি দূর করবার জন্য ও সময় কাটানোর জন্য, পাল্কিতে নিজের

সঙ্গে বেশ কয়েকটি বইও নিয়ে নিয়েছিলেন। তবে সবকথা মাথায় রেখেও ইটা বলা যেতে পারে যে, ঊনিশ শতকের সূচনায় অধিকাংশ বাঙালী হিন্দু নারীই ঘরকন্নার কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকতেন;

পুঁথিগত শিক্ষালাভের জন্য সময়, সুযোগ ও প্রয়োজন - কোনোটাই তাঁদের বিশেষ ছিল না। একই সাথে একথাও মনে রাখতে হবে, ওই সময়ে, বিশেষ করে গ্রাম বাংলার জনসাধারণের এক বিরাট

অংশই নিরক্ষর ও শিক্ষার আলোকবঞ্চিত ছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) বাংলার অধিকাংশ পুরুষই যেখানে তখন অক্ষর জ্ঞানহীন ছিলেন, সেখানে গৃহলক্ষ্মী মেয়েদের শিক্ষার প্রশ্ন

কতখানি উঠতে পারত - সেই প্রশ্নও থেকে যায়। ওই সময়ের বাঙালী সমাজ সংস্কারকেরা নারীকল্যাণেই নিবেদিত-প্রাণ ছিলেন, বস্তুতঃ জনসাধারণের ব্যাপারে তাঁরা একটু কম বেশি

উদাসীনও ছিলেন। আর তাই জনশিক্ষা নয়, নারীশিক্ষা বিস্তারেই তখন তাঁরা উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।

ঘোর রক্ষণশীল, এবং নিজেদের চক্ষু-কর্ণ জোর করে ঢেকে রাখা হিন্দু সমাজপতির দল ঊনিশ শতকের সূচনাতেও লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা বিধবা অথবা অসতী হবেন, এই বিশ্বাস

তৎকালীন সমাজে চালু রাখতে কৃতসঙ্কল্প ছিলেন। বলা বাহুল্য যে, স্ত্রীশিক্ষার মতই তাঁরা শূদ্রদেরও শিক্ষালাভের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তখন তাঁদের প্রকোপের ফলে মেয়েদের

শিক্ষায় হিন্দুসমাজের কোন আগ্রহ ছিল না। তাছাড়া ওই সময়ে ‘গৌরীদান’কে অতি পুণ্যকর্ম বলে গণ্য করা হত, এর ফলে মাত্র দশ বছর বয়স না হতেই অধিকাংশ মেয়ে তখন মাথায় সিঁদুর

পরে শ্বশুরবাড়িতে ঘর করতে চলে যেতেন। কাজেই শিক্ষালাভের সময়ও তাঁদের ভাগ্যে জুটত না। (রানা চক্রবর্তী) একই সময়ে বাঙালীরা আবার নিজেদের স্বার্থেই নতুন অর্থকরী বিদ্যা

ইংরেজি শিখতে শুরু করেছিলেন। তখনকার দিনে অর্থকরী বিদ্যায় মেয়েদের তেমন কোন প্রয়োজন ছিল না। অন্ততঃ সেটাই ধরে নিয়ে, নিজেদের বাড়ির মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার

কথাও কোন পরিবারের কর্তারা ভাবেন নি। যদিও তাঁরা তখন মেয়েদের জন্য অন্তঃপুর শিক্ষার বিরোধী ছিলেন না। ‘রাধাকান্ত দেব’ তখন সেই দলের প্রতিনিধিস্থানীয় ছিলেন। রাধাকান্ত

দেব নিজে অত্যন্ত রক্ষণশীল হলেও, বঙ্গদেশে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের আদিপর্বে তাঁর অবদান কিন্তু অবিস্মরণীয়। ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’র অধীনস্থ

কতগুলি স্কুলে ছোট ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও শিক্ষা দেওয়া হত। স্কুল সোসাইটির পণ্ডিত ও শিক্ষকেরা রাধাকান্ত দেবের বাড়িতেই সেইসব মেয়েদের পরীক্ষা নিতেন। আর রাধাকান্ত

কিন্তু সেই বিষয়ে তাঁদের যথেষ্ট উৎসাহিত করতেন। ওই সময়ে শোভাবাজারের বাড়িতে স্কুল সোসাইটির ছাত্রদের যে বার্ষিক ও ত্রৈমাসিক পরীক্ষা হত, তাতে ‘ফিমেল জুবিনাইল

সোসাইটি’র পাঠশালার মেয়েরাও প্রথমে প্রথমে যোগদান করতেন। তবে ১৮২৪ থেকে তাঁর বাড়িতে হিন্দু মেয়েরা আর কোন পরীক্ষা দিতে যাননি। বঙ্গদেশে স্ত্রীশিক্ষার আদিপর্বে

রাধাকান্তের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে ১৮৩২ সালের ২৭শে জুন তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা লিখেছিল, “তিনি স্বদেশীয় বালিকারদের বিদ্যাধ্যয়নের বিষয়েও পোষকতাচরণ করিয়াছেন।

স্মরণ হয় যে ১৮২২ সালের আরম্ভকালে ত্রিশ জন বালিকার বিদ্যার পরীক্ষা লইতে তাঁহার বাটীতে দেখা গিয়াছে। কলিকাতার মধ্যে প্রথম যে হিন্দু কন্যারা বিদ্যাশিক্ষার্থ বিদ্যালয়ে

আনীতা হয় সে ঐ বালিকারা। এবং শ্রীমতী বিবি উইলসনের পাঠশালাতে যে অনেকবার বালিকাগণের পরীক্ষা হয় সে স্থানেও ঐ বাবুকে আমরা দেখিয়াছি বোধ হয় এবং তিনি বালিকারদের

যাহাতে বিদ্যাশিক্ষাতে উত্তেজনা হয় এমত অনেক প্রস্তাব্যোপদেশ তাহারদিগকে দিয়াছেন এবং বিদ্যালাভে কীদৃশ উপকার এমতও তাহারদিগকে অনেক উপদেশকতা করিতে তাঁহাকে দেখা

গিয়াছে।” (সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ- ৪২৬; Native Female Education, The Friends of India, July 1828, P- 228) পরবর্তীকালে

রাধাকান্ত প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে মেয়েদের পাঠানোকে সমর্থন না করলেও, নীতির দিক দিয়ে তিনি কিন্তু কখনও নারীশিক্ষার বিরোধিতা করেন নি। জাতির নৈতিক চরিত্র ও সামাজিক

সুখবৃদ্ধির জন্য স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তিনি ঊনিশ শতকের প্রথমদিকেই অনুভব করতে পেরেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) শুধু সেটাই নয়, ওই সময়ে স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে ‘প্রগতিশীল’

রামমোহন যেখানে স্রেফ দু’-চার কথা লিখেই নিজের কর্তব্য শেষ করেছিলেন (রামমোহন তাঁর ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদে’ স্ত্রীলোককে ‘বিদ্যাশিক্ষা জ্ঞানোপদেশ’ থেকে

বঞ্চিত করে রাখবার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন), ‘রক্ষণশীল’ রাধাকান্ত কিন্তু সেখানে সক্রিয়ভাবে আগ্রহ দেখাতেও কুণ্ঠিত হন নি। বেথুন সাহেব যথার্থ কারণেই আধুনিক যুগের

বাংলার ‘নারীশিক্ষার সমর্থক প্রথম হিন্দু’র গৌরব রাধাকান্ত দেবকেই দিয়েছিলেন।

উপরোক্ত দু’দল ছাড়াও ঊনিশ শতকে বাঙালীসমাজের আরও একদল মানুষ মেয়েদের সামনে শিক্ষার দ্বার খুলে দিতে চেয়েছিলেন। শিক্ষার জন্যই শিক্ষা - মতবাদে বিশ্বাসী ‘ইয়ংবেঙ্গল’রা

উক্ত শতাব্দীতে স্ত্রীশিক্ষার গোঁড়া সমর্থক ছিলেন। ১৮২৮ সালে প্রকাশিত ‘পার্থেনন’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়, ‘জ্ঞানান্বেষণ’ ও ‘এনকোয়েরার’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় তাঁরা স্ত্রীশিক্ষার

সমর্থনে নিজেদের কলম ধরেছিলেন। উক্ত সময়ে প্রতিষ্ঠিত ‘একাডেমিক এসোসিয়েশন’ ও ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’র অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল স্ত্রীশিক্ষা। প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর

‘বামাতোষিণী’র সপ্তম পরিচ্ছেদে ‘সাধারণ জ্ঞান উপাধিরা সভা’র যে কাল্পনিক বিবরণ দিয়েছিলেন, সেখানে স্ত্রীশিক্ষাও আলোচিত হয়েছিল। (প্যারীচাঁদ রচনাবলী, ডঃ অসিতকুমার

বন্দ্যোপাধ্যার সম্পাদিত, পৃ: ৫৭২-৭৪) ঈষৎ পরবর্তীকালে সে সম্পর্কে লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ, অথবা বিভিন্ন নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সক্রিয় উৎসাহও ওই সময়ের

নারীশিক্ষা সম্পর্কে তাঁদের খোলামেলা মনোভাবের পরিচয় দেয়। তখনকার অন্যতম ইয়ংবেঙ্গল ‘শিবচন্দ্র দেব’ তাঁর বালিকা স্ত্রীকে নিজের চেষ্টায় বাংলা লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছিলেন,

পরবর্তী সময়ে বেথুন স্কুল খোলা হলে সেখানে তিনি তাঁর মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্রও তাঁর বালিকা বধূকে বাংলা লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছিলেন। কলকাতায় বেথুন

স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ‘রামগোপাল ঘোষ’ ও ‘দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়’ বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই সময়ের অনেক ইংরেজিশিক্ষিত যুবকই তাঁদের স্ত্রীদের নিজের চেষ্টায়

ইংরেজি লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছিলেন। তখনকার ওই ধরণের একজন যুবক, তাঁর স্ত্রী ইংরেজি শিক্ষিত হওয়ার পরে, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপীয় সমাজে যাওয়ার ইচ্ছার কথা ১৮৩১ সালের

৯ই জুলাই তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় (৬৮৬ সংখ্যা, পৃ- ২২৭) একটি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। সেই কারণে, ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ অপর একটি পত্র প্রকাশ করে তাঁকে অশালীনভাবে

আক্রমণ করেছিল। উক্ত সময়ে হিন্দু কলেজের কোনো এক ছাত্র তাঁর স্ত্রীকে ‘৫নং পোয়েটিকাল রীডার’ পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন, এমনকি তিনি তাঁকে লিখতেও শিখিয়েছিলেন। কিন্তু

দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যে, নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবল উৎসাহী সেই তরুণটির অকালমৃত্যু তাঁর সেই বিষয়ক প্রচেষ্টাকে অকালেই স্তব্ধ করে দিয়েছিল। (The Calcutta Review, Vol. 11,

1849, P- XXIX) ওই ধরণের মানুষেরা ছাড়াও তখন খ্রীষ্টান মিশনারিরাও ছিলেন। তবে সেই সময়ের বাঙালী হিন্দু ঘরের মেয়েদের ধর্মান্তরিত করবার স্বার্থেই তাঁরা নারীশিক্ষাকে

বিস্তৃত করতে চেয়েছিলেন। ঊনিশ শতকের সূচনাতেই সেই বিষয়ে তাঁরা রীতিমতো সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) ‘মিঃ মে’ নামের একজন মিশনরি চুঁচুড়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয়

খুলে সেই বিষয়ে প্রথম পথ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু ১৮১৮ সালে অকাল মৃত্যুর ফলে তাঁর সেই বিষয়ক চেষ্টায় ছেদ পড়েছিল। অবশ্য ততদিনে বাংলার অন্যান্য মিশনরিরা সেই বিষয়ে তৎপর

হয়ে উঠেছিলেন। ১৮১৯ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতার কয়েকজন ব্যাপ্টিস্ট মিশনরি স্ত্রীশিক্ষার একটি কর্মসূচীকে রূপায়নের জন্য জনসাধারণের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন।

তাঁদের সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে কয়েকজন ইংরেজ মহিলা তখন সহৃদয়ভাবে এগিয়ে এসেছিলেন। ওই বছরই তাঁদের সাহায্যে ‘রেভারেণ্ড ডাব্লিউ. এইচ. পীয়ার্সের’ সভাপতিত্বে ‘ক্যালকাটা

ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ (পুরো নাম ছিল - The Female Juvenile Society for the Establishment and Support of Bengali Female Schools) স্থাপিত হয়েছিল। গৌরীবাড়িতে সেই

সোসাইটির প্রথম স্কুলটিতে প্রথম বছরের শেষে ছাত্রীসংখ্যা ছিল ৮ জন। সেখানে প্রথমে কোনো দেশীয় শিক্ষিকা না পাওয়া গেলেও, ১৮২০ সালে প্রথম একজন দেশীয় শিক্ষিকা যোগ

দিয়েছিলেন। এরপরে ধীরে ধীরে সেখানকার ছাত্রীসংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছিল। তখন নন্দনবাগানের জুভেনাইল স্কুল ছাড়া, কলকাতায় সেই সোসাইটির গৌরীবাড়ি, জানবাজার ও চিৎপুরের

 

119

 

স্কুল তিনটিতে যাঁরা নিয়মিতভাবে অর্থ সাহায্য করতেন, তাঁদের বাসস্থানের নামেই ওই স্কুল তিনটির নামকরণ, যথা - লিভারপুল স্কুল, সালেম স্কুল, ও বার্মিংহাম স্কুল - করা হয়েছিল।

১৮২৩ সালে সেই সোসাইটির পরিচালনাধীন স্কুলের সংখ্যা হয়েছিল ৮টি। ওই বছরেই ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ ‘বেঙ্গল খ্রীস্টান স্কুল সোসাইটি’র মহিলা বিভাগে পরিণত হয়েছিল।

১৮২৯ সালে সেই সোসাইটির স্কুলের সংখ্যা হয়েছিল ২০টি। এরপরে ১৮৩২ সাল থেকে - ‘ক্যালকাটা ব্যাপ্টিস্ট ফিমেল স্কুল সোসাইটি’ - এই নতুন নামে আগেকার সোসাইটি পরিচিত

হয়েছিল। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধের বঙ্গদেশে নারীশিক্ষাবিস্তারের ইতিহাসে ‘মিস মেরি আন কুক’ (১৮২৪ সাল থেকে ‘মিসেস উইলসন’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন) একটি স্মরণীয় নাম।

১৮২১ সালে কলকাতায় পদার্পন করে তিনি বাংলায় নারীশিক্ষাবিস্তারে স্কুল সোসাইটির সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু নারীশিক্ষার সমর্থক হয়েও স্কুল সোসাইটির তৎকালীন

দেশীয় সম্পাদক রাধাকান্ত দেব মিস কুকের শিক্ষা দেওয়ার নাম করে বাঙালী হিন্দু ঘরের মেয়েদের ধর্মচ্যূত করবার চেষ্টাকে কিছুতেই স্বাগত জানাতে পারেন নি। (রানা চক্রবর্তী) সেই

কারণে, ১৮২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর তারিখে তিনি স্কুল সোসাইটির ডাব্লিউ. এইচ. পিয়ার্সকে একটি চিঠিতে প্রকাশ্য মিশনরি স্কুলে মেয়েদের শিক্ষাদান বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে

লিখেছিলেন যে, সেটার পরিবর্তে “... they (the respectable Hindoos) may be all convinced of the utility of getting their female children taught at home in Bengali, by their

domestic school masters, as some families do, before such female children are married or arrived at the age of 9 or 10 years at (farthest). For these reasons, I am

humbly of opinion that we need not have a Meeting to discuss on the subject of the Education of Hindoo females by (Miss) Cooke, who may render her services, if

required, to the schools lately established by the Missionaries for the section of the poor (...) of native females.” (Report of the Calcutta School Society -

unpublished) উক্ত সময়ে স্কুল সোসাইটির সহায়তা লাভে ব্যর্থ হলেও মিস কুক কিন্তু ‘চার্চ মিশনরি সোসাইটি’র সাহায্যে সমগ্র কলকাতায় ৮টি ছোট ছোট বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে

সক্ষম হয়েছিলেন। সেই আটটি স্কুল ছিল - ঠনঠনিয়া স্কুল, মির্জাপুর স্কুল, প্রতিবেশী স্কুল, শোভাবাজার স্কুল, কৃষ্ণবাজার স্কুল, শ্যামবাজার স্কুল, মল্লিকবাজার স্কুল ও কুমারটুলি

স্কুল। তখন শোভাবাজার স্কুল ছাড়া বাকি ৭টি স্কুলের মোট ছাত্রীসংখ্যা ছিল ১৯৭ জন। (Hindoo Female Education, 1889, Priscilla Chapman, P: 79-80) ১৮২৩ সালে তাঁর

পরিচালনাধীন স্কুলের সংখ্যা ২২টিতে পৌঁছেছিল, এবং ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে ৪০০ জন হয়েছিল। সেই বিষয়ে তিনি লর্ড হেস্টিংসের স্ত্রীর কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সাহায্য লাভ করেছিলেন।

১৮২৪ সালে চার্চ মিশনরি সোসাইটি ‘লেডিস সোসাইটি’ (Ladies’ Society for Native Female Education in Calcutta and its vicinity) গঠন করে তাদের হাতে স্কুলগুলির পরিচালনার

ভার তুলে দিয়েছিলেন। লর্ড আমহার্স্টের স্ত্রী সেই সোসাইটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন। ‘ডেভিড হেয়ার’ও লেডিস সোসাইটিকে নিয়মিতভাবে চাঁদা দিয়ে নারীশিক্ষায় উৎসাহ

দিয়েছিলেন। ১৮২৪ সালে সেই সোসাইটির ২৮টি স্কুলে মোট ৪৮০ জন মেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ‘মিসেস উইলসনের’ ব্যবস্থাপনায় উক্ত সোসাইটির ৩০টি স্কুলের

ছাত্রীসংখ্যা বেড়ে প্রায় ৬০০ জনে পৌঁছে গিয়েছিল। ১৮২৫ সালের জুন মাসে লেডিস সোসাইটি সরকারের কাছে নিজস্ব গৃহনির্মাণের জন্য ১০,০০০ টাকা সাহায্য চাইলেও, গভর্নর

জেনারেলের আপত্তিতে তাঁদের সেই আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) তখন বাংলায় নারীশিক্ষা প্রসারের সাহায্যকল্পে ‘রাজা বৈদ্যনাথ’ নিজে থেকে এগিয়ে এসেছিলেন।

সেই উদ্দেশ্যে লেডিস সোসাইটিকে তিনি কুড়িহাজার টাকা দান করেছিলেন। ‘সমাচার দর্পণ’ ও ‘ইণ্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকা সেই কারণে তাঁকে উচ্ছ্বসিতভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিল। তাঁর সেই

টাকা হেদুয়ার পূর্বদিকে অবস্থিত ‘সেন্ট্রাল ফিমেল স্কুল’ প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করা হয়েছিল। ১৮২৬ সালের ১৮ই মে তারিখে লেডি আমহার্স্ট ওই স্কুলের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এরপরে ১৮২৮ সালের ১লা এপ্রিল তারিখ থেকে মিঃ ও মিসেস উইলসন ৮৫ জন বালিকাসহ সেই সেন্ট্রাল স্কুলের ভার গ্রহণ করেছিলেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলায় নারীশিক্ষা প্রচারের কাজে চার্চ মিশনরি সোসাইটি, লেডিস সোসাইটি, ও লণ্ডন মিশনরি সোসাইটি উঠে পড়ে লেগেছিল। কলকাতার

আশেপাশেও তখন নারীশিক্ষা আন্দোলনের সেই ঢেউ গিয়ে পৌঁছেছিল। ১৮২৩ সাল থেকেই ‘উইলিয়াম কেরী’, ‘ওয়ার্ড’ ও ‘মার্শম্যান’ বালিকা বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বাইবেল প্রচারের জন্য

শ্রীরামপুর ও তার কাছাকাছি অঞ্চলে বেশ সক্রিয় হয়েছিলেন বলে ইতিহাস থেকে দেখতে পাওয়া যায়। উক্ত সময়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ‘The Serampore Native Female Education

Society’ সেটারই ফল ছিল। অবশ্য যে কোনো কারণেই হোক না কেন, শ্রীরামপুর মিশনের সেই চেষ্টা কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। মেয়েদের জন্য ডে স্কুল, বোর্ডিং স্কুল ইত্যাদি স্থাপন

করে, তৎকালীন বাংলার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারগুলিতে গিয়ে শিক্ষা দিয়ে তাঁরা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে চেয়েছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টায় ১৮৫০

সালের শেষের দিকের বাংলায় মিশনরি পরিচালিত ২৬টি ডে স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা ৬৯০ জনে পৌঁছেছিল, ওই সময়ে তাঁদের ২৮টি বোর্ডিং স্কুলে ৮৩৬ জন ছাত্রী পড়তেন। (Dawn of

Renascent India, 2nd Edition, 1964, Dr. K. K. Datta, P- 96) কিন্তু বঙ্গদেশে মিশনরিদের নারীশিক্ষা বিস্তারের সেই কর্মপ্রচেষ্টা ঠিক কতটা সফল হয়েছিল - এই প্রশ্ন কিন্তু

থেকেই যায়। ইতিহাস থেকে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে এটা মনে রাখতে হবে যে, বঙ্গদেশে মিশনরিদের শিক্ষাবিস্তারের সেই চেষ্টা কিন্তু নিছকই উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল। বলা

বাহুল্য যে, ওই সময়ে শিক্ষার নাম করে তাঁরা খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে চেয়েছিলেন। হিন্দু ঘরের ৬/৭ বছর বয়সী মেয়েকেও ধর্মান্তরিত করতে তাঁদের স্বাভাবিকভাবেই কোনো দ্বিধা ছিল

না। তাঁদের তৈরী স্কুলগুলিতে ধর্মশিক্ষার ওপরেই সব গুরুত্ব আরোপিত হত। এমনকি গোঁড়া খ্রীষ্টান পাদ্রী ‘কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়’ও তাঁর লেখায় ওই সময়ের মিশনারিদের সেই কথার

উল্লেখ না করে পারেন নি - “... Now in the public schools … little has been done in education, though much attempted in the catechising way.” (A Prize Essay on

Native Female Education, 1841, Rev. K. M. Banerjea, P- 105) ওই সব স্কুলে বাইবেল অবশ্যপাঠ্য ছিল, আর সেই কারণে তখনকার জনসাধারণও ওই সব স্কুলকে খুব একটা

প্রসন্নচোখে দেখতেন না। মিশনারিদের ধর্মশিক্ষার সেই বাড়াবাড়ির জন্যই রাধাকান্ত দেব, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা বৈদ্যনাথ প্রভৃতি নারীশিক্ষার সমর্থকেরাও মিশনরি স্কুল

সম্পর্কে বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। তৎকালীন বাঙালীসমাজে মেয়েদের পর্দাপ্রথা তখনও বর্জিত না হওয়ার ফলে, হিন্দু ভদ্রঘরের মেয়েরাও প্রকাশ্যে ওই সব বিদ্যালয়ে পড়তে যেতেন না।

তাহলে ওই সব স্কুলে তখন কারা পড়তে যেতেন? তৎকালীন সমাজে যাঁরা দরিদ্র ও সর্বহারা ছিলেন, তখনকার বর্ণাশ্রমধর্মী সমাজ ব্যবস্থায় যাঁদের স্থান সবার নীচে ছিল, তাঁদের ঘরের

মেয়েরাই তখন ওই সব স্কুলে পড়তে যেতেন। অবশ্য তাঁরাও কতটা শিক্ষালাভের জন্য সেখানে যেতেন, আর কতটা অন্য প্রলোভনে যেতেন (কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘artificial

encouragements’), সেটা এখন বলা মুশকিল। এই প্রসঙ্গে ১৮৩৮ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি তারিখে চুঁচুড়ার জনৈক ব্রাহ্মণ ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার সম্পাদককে একটি চিঠিতে

লিখেছিলেন, “কয়েকজন হিতৈষি সাহেব লোক ও বিবি সাহেবরা স্ত্রীলোকেদের বিদ্যা শিক্ষার্থে পাঠশালা স্থাপনার্থ উদ্যোগী হইয়াছেন, কিন্তু দুই এক স্থানে অতি নীচ জাতীয় কয়েকজন

বালিকা বস্ত্র ও অন্যান্য পারিতোষিকের নিমিত্ত তাঁহারদের পাঠশালাতে গমন করেন কিন্তু অন্যান্য স্থানে তাঁহারদের ঐ উদ্যোগ বিফলই হইয়াছে।” (সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ২য়

খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ- ৯৯) তখনকার বৃহত্তর বাঙালীসমাজে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে কোনো ব্যাপক চেতনা জাগাতে মিশনরিরা ব্যর্থ হলেও, তাঁদের চেষ্টার কিছুটা

ঐতিহাসিক মূল্য অবশ্যই রয়েছে।

ইতিহাস বলে যে, ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলার বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন কারণে নারীশিক্ষার বিস্তার চেয়েছিলেন, ওই সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সভাসমিতিতে সেসব নিয়ে অনেক

আলোচনাও হয়েছিল; ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সভা’র সভ্যরাও তখন সেই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) অন্যদিকে একদল রক্ষণশীল মানুষও তখন নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে

রীতিমতো সক্রিয় ছিলেন। ওই রকম পরিবেশেই ১৮৪৮ সালের এপ্রিল মাসে বড়লাটের আইন পরিষদের সদস্য হিসাবে ‘ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন’ এদেশে পদার্পন করেছিলেন, এবং অল্প

কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজের কার্যকুশলতার জন্য শিক্ষা পরিষদের সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। বেথুন তাঁর প্রথম যৌবনে প্রিভি কাউন্সিলে সতী আপীলে সতীপক্ষীয়দের

সমর্থন জানানোর ত্রুটি সংশোধন করতেই যেন এদেশে এসে নারীকল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। প্রথমেই তিনি তখনকার হিন্দু ভদ্রঘরের মেয়েদের কাছে শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত

করে দিতে চেয়েছিলেন, আর সেটার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে তিনি কলকাতায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ‘রামগোপাল ঘোষের’ কাছে তিনি তাঁর মনের সেই

ইচ্ছা প্রথম প্রকাশ করেছিলেন। রামগোপাল তাঁকে শুধু মৌখিক উৎসাহ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হননি, নানাভাবে সাহায্য করতেও এগিয়ে এসেছিলেন। এমনকি বেথুনের স্কুলের জন্য প্রথম

ছাত্রী সংগ্রহের কাজটিও তিনি করেছিলেন। এরপরে রামগোপাল ঘোষের এক বন্ধু দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ও নিজে থেকে সেই কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। বেথুনের বালিকা বিদ্যালয়ের

জন্য দক্ষিণারঞ্জন বিনা ভাড়ায় তাঁর সুকিয়া স্ট্রীটের বৈঠকখানা বাড়িটি ছেড়ে দিয়েছিলেন, এবং দশ হাজার টাকা মূল্যের একখণ্ড জমিও দান করেছিলেন। বেথুনকে সাহায্য করবার জন্য

শুধু ইয়ংবেঙ্গলই নয়, ‘মদনমোহন তর্কালঙ্কারের’ মত ব্রাহ্মণপণ্ডিতও তখন এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি তাঁর দুই কন্যা - ‘ভুবনমালা’ ও ‘কুন্দমালা’কে বেথুনের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া

ছাড়াও, ওই স্কুলে বিনামূল্যে প্রাত্যহিক শিক্ষাদান ও স্ত্রীশিক্ষাপযোগী প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক রচনায় নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন; সেই সময়ে ‘সর্বশুভকরী’র পৃষ্ঠায় নারীশিক্ষার

সমর্থনে তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রথমে ঠিক হয়েছিল যে, ওই স্কুলে কেবলমাত্র সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদেরই ভর্তি করা হবে; শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা, অভিভাবকের

অনুমতি না নিয়ে কোনো মেয়েকে ইংরেজি শেখানো হবে না, পড়াশোনার সাথে ‘মিসেস রিওডেন্স’ মেয়েদের সেলাই ও হাতের কাজ শেখাবেন। (রানা চক্রবর্তী) আরো ঠিক হয়েছিল যে, বেথুনের

স্কুলের শিক্ষা হবে অবৈতনিক; সেখানে দূর থেকে যেসব মেয়েরা পড়তে আসবেন, তাঁদের যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা হবে, এবং সকাল ৯টায় সেই স্কুল বসবে। অনেক ভেবেচিন্তে

বেথুন তাঁর স্কুলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন রাজা কালীকৃষ্ণ, রাজা রাধাকান্ত, আশুতোষ দেব, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ রক্ষণশীল হিন্দু সমাজপতিদের যেমন কোন আমন্ত্রণ

জানান নি, তেমনি কোনো মিশনরিকেও তিনি সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আহ্বান করেন নি। এমকি নিজের স্কুলের জন্য প্রথমদিকে তিনি কোনো সরকারি সাহায্যের প্রার্থনাও করেন নি।

প্রাথমিক প্রস্তুতির পরে ১৮৪৯ সালের ৭মে তারিখে ২১ জন মেয়েকে নিয়ে ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুলের’ যাত্রারম্ভের সাথে সাথে বাংলায় প্রকৃত স্ত্রীশিক্ষার সূত্রপাত ঘটেছিল। সেই ২১

জনের মধ্যে গড়ে জনাদশেক মেয়ে প্রতিদিনই স্কুলে উপস্থিত থাকতেন। রামগোপাল ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বসু, নীলকমল ব্যানার্জি, গোবিন্দচন্দ্র গুপ্ত, দ্বারকানাথ গুপ্ত, দক্ষিণারঞ্জন

মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, হেমনাথ রায়, রসিকলাল সেন, মাধবচন্দ্র মল্লিক, হরিনারায়ণ দে, দেবনারায়ণ দে, হরমোহন চট্টোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, গৌরীশঙ্কর

ভট্টাচার্য ও হরকুমার বসু তাঁদের বাড়ির মেয়েদের সেই স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। (The Hindu Intelligencer, 21st May, 1849) বেথুনের উদ্যোগে ওই স্কুল স্থাপিত হওয়ার পরে তীব্র

সামাজিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। তখন যাঁরা কোন বালিকা বিদ্যালয়ে নিজেদের ঘরের মেয়েদের পাঠাতেন, তাঁদের সমাজে একরকম একঘরে করে রাখা হত। ওই সময়ে মেয়েদের নিয়ে

স্কুলের গাড়ি যখন রাজপথে বের হত, তখন সাধারণ মানুষ সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার সেই সব ছোট ছোট মেয়েদের উদ্দেশ্যে অভদ্র মন্তব্য ছুঁড়ে

দিতেও ইতঃস্ততঃ করতেন না। স্বাভাবিকভাবেই তখনকার অমন সামাজিক অবস্থায় বেথুনের স্কুল চালু হওয়ার পরে লোকেরা বলতে শুরু করেছিলেন, “এইবার কলির বাকি যা ছিল হইয়া গেল!

মেয়েগুলো কেতাব ধরলে আর কিছু বাকি থাকবে না।” ‘রামনারায়ণ’ রসিকতা করে কলকাতার রক্ষণশীল বাবুদের মজলিসে বসে বলতে শুরু করেছিলেন, “বাপরে বাপ মেয়েছেলেকে লেখাপড়া

শেখালে কি আর রক্ষা আছে? এক ‘আন’ শিখাইয়া রক্ষা নাই! চাল আন, ডাল আন, কাপড় আন করিয়া অস্থির করে, অন্য অক্ষরগুলো শেখালে কি আর রক্ষা আছে।” (রামতনু লাহিড়ী ও

তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, পৃ: ১৭২-৭৩) মদনমোহন তাঁর মেয়েদের ওই স্কুলে দেওয়ার জন্য, ও তিনি নিজে সেই বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার জন্য অন্য ব্রাহ্মণেরা তাঁর

উপরে ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) তখন কোথাও পণ্ডিতে-পণ্ডিতে দেখা হলেই কথা হত - “ওরে মদনা করলে কি? ওরে মদনা করলে কি?” (ইন্দ্র মিত্র লিখিত ‘করুণাসাগর

বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত, পৃ- ২০১) মদনমোহনকে সেই কারণে তখন ৮/৯ বছর ধরে সমাজচ্যুত হয়ে থাকতে, ও আজীবন সামাজিক উপদ্রব সহ্য করতে

হয়েছিল। (কবিবর মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচরিত ও তদগ্রন্থ সমালোচনা, কলকাতা, ১৯২৮ সংবৎ, পৃ- ২২) গোবিন্দচন্দ্র গুপ্ত তাঁর কন্যা ও ভগিনীকে ওই স্কুলে পাঠানোর ফলে

যাঁদের সঙ্গে মেয়ে দুটির বিবাহের সম্বন্ধ হয়েছিল, তাঁরা মেয়ে দু’টিকে বিবাহ করতে অসম্মত হয়েছিলেন। এসব থেকে বোঝা যায় যে, তখন সবদিক থেকেই বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের চলবার

 

120

 

পথ মোটেও মসৃণ হয়নি। ১৮৫০ সালের ২৯শে মার্চ তারিখে বেথুন গভর্নর জেনারেল ‘লর্ড ডালহৌসী’কে এক পত্রে নিজেই সেকথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, “Every Kind of annoyance

and persecution was set on foot to deter my friends from continuing to support the school and with such success that at one time the number of enrolled pupils

dwindled to 7, and on some occasion not more than 3/4 were present in the school. At this time the question was agitated whether or not I should offer stipends to

the girls who attended, as was done on the first establish- ment of some of the Govt. College and I was assured that if I would offer 5 or 6 rupees a month to each,

I might count on immediately recruiting the school to any extent that I might think desirable from Brahminical families of unquestioned caste and respectability.”

(Selections from Educational Records, Part II, 1840-59, J. A. Bichey, 2nd Edition, 1965, P- 53) সঙ্গত কারণেই বেথুন ওভাবে তাঁর স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি করতে আগ্রহী

ছিলেন না। তাই সমস্ত রকমের প্রতিকূলতার মধ্যেও বেথুন তাঁর স্কুলটি চালিয়ে গিয়েছিলেন। স্কুলের মাসিক ব্যয় বাবদ ৮০০ টাকাই তিনি নিজের পকেট থেকেই দিতেন। প্রায় রোজই একবার

না একবার হলেও তিনি স্কুলে গিয়ে সেখানকার কাজকর্ম দেখতেন। স্কুলের ছোট ছোট মেয়েদের সব আবদার ও অত্যাচার তিনি হাসিমুখে সহ্য করে, কখনও তাঁদের খেলার ঘোড়া হতেন, তো

কখনও আবার তাঁদের নিজের কোলে পিঠে করতেন। ভুবনমালা আর কুন্দমালা - মদনমোহনের দুই কন্যাকে দু’কোলে নিয়ে তিনি প্রায়ই নিজের বাড়িতে যেতেন। (রানা চক্রবর্তী) বেথুনের

আগ্রহে ও উৎসাহে ওই ভাবেই আশা নিরাশার মধ্যে দিয়ে ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল তখন এগিয়ে গিয়েছিল। উক্ত সময়ে বাংলার নারীশিক্ষার একজন প্রধান প্রতিপক্ষের মৃত্যুর ফলে ওই

স্কুলে আবার প্রাণের স্পন্দন দেখা দিয়েছিল, এবং ছাত্রীসংখ্যা বেড়ে ৩১ জন হয়েছিল। কিন্তু বেথুন তখনও তাঁর স্কুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন। এরপরে একদিন বেথুনের

স্কুলের নিজস্ব ভবনের কাজ শুরু হয়েছিল। বালিকা বিদ্যালয়ের নিজস্ব গৃহের জন্য দক্ষিণারঞ্জন প্রদত্ত মির্জাপুরের জমির পাশাপাশি আরেক খণ্ড জমি বেথুন দশহাজার টাকায় কিনে

নিয়ে মেয়েদের যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করে, বাংলা সরকারের হেদুয়ার কাছের একখণ্ড জমির সঙ্গে সেই জমি বদল করে নিয়েছিলেন। মতিলাল শীল হেদুয়ার পশ্চিমদিকে তাঁর ইজারা

নেওয়া জমিটি বেথুনের বালিকা বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের জন্য নিজের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কয়েক মাস আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। (সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়, ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৮৫০

সাল) ১৮৫০ সালে স্কুলের নিজস্ব ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। যেদিন স্কুলের শিলান্যাস হয়েছিল, সেদিন রাত্রে দক্ষিণারঞ্জন ওই উপলক্ষে তাঁর বাড়িতে এক মহাভোজের

আয়োজন করেছিলেন। ১৮৫০ সালে বেথুন বিদ্যাসাগরকে স্কুলের সেক্রেটারি পদে নিয়োগ করেছিলেন। স্কুলবাড়ি তৈরীর খরচ ৪০,০০০ টাকার অধিকাংশও তিনিই দিয়েছিলেন। অবশেষে ১৮৫১

সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্কুলের নিজস্ব ভবনটি সম্পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু সেই বিষয়ে যাঁর আগ্রহ সবচেয়ে বেশি ছিল, বঙ্গদেশে নারীশিক্ষার ব্যাপারে অক্লান্তকর্মী সেই মানুষটিই তা দেখে

যেতে পারেন নি। কারণ এর আগেই, ১৮৫১ সালের ১২ই আগস্ট তারিখে বেথুনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই দুঃখের কথা স্মরণ করে বিদ্যাসাগর পরবর্তীকালে নিজের চোখের জল ফেলেছিলেন।

কিন্তু তখন নিজে বর্তমান না থাকলেও, বেথুন তাঁর উইলে কলকাতার ৩০,০০০ টাকার মতো সম্পত্তি স্কুলকে দান করে গিয়েছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) বঙ্গদেশে স্ত্রীশিক্ষার প্রকৃত

প্রবর্তক বেথুন, কোনো স্বার্থের জন্য নয়, খ্রীষ্টধর্ম প্রচার বা শোষণযন্ত্র অব্যাহত রাখার জন্যও নয়, শুধুমাত্র ভালোবাসার খাতিরেই নারীশিক্ষার কাজে নিজের সর্বস্ব পণ

করেছিলেন। সেকাজে তাঁর উচ্চপদ, মান-সম্ভ্রম তাঁকে যে সাহায্য করেছিল - সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই; কিন্তু সবমিলিয়ে এদেশে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারে হেয়ারের যে ভূমিকা,

নারীশিক্ষাবিস্তারে বেথুনের ভূমিকাও প্রায় অনুরূপ ৷ আর বুকভরা ভালোবাসা না থাকলে একজন খাঁটি সাহেব কখনোই এই দেশীয় মেয়েদের সম্পর্কে লিখতে পারতেন না, “The eagerness

of the children to learn, and their docility and quickness correspond fully with what we have seen of Bengali boys, and in the judgement of their intelligent teachers

far surpass what is found among European girls of the same age.” (Selections from Educational Records, Part II, 1840-59, J. A. Bichey, 2nd Edition, 1965, P- 59)

তবে বেথুনের মৃত্যুর পরেই ওই স্কুলের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলেও, লর্ড ডালহৌসী ও তাঁর স্ত্রী নারীশিক্ষা সম্পর্কে আগ্রহী হওয়ার জন্য স্কুলটি কোনোক্রমে টিকে গিয়েছিল।

ডালহৌসী প্রদত্ত অর্থসাহায্যই তখন স্কুলটিকে টিকিয়ে রেখেছিল বলা যেতে পারে। ইতিমধ্যে স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে সরকারি মনোভাবও ধীরে ধীরে অনুকূল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। যদিও

সেক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপ তখন ধীর, স্থির ও অতি সতর্ক ছিল। ১৮৫৪ সালে উডের শিক্ষা বিষয়ক ডেসপ্যাচে নারীশিক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়ে সেক্ষেত্রে সরকারি অর্থসাহায্য

করবার অনুকূলে মত প্রকাশ করা হয়েছিল। এরপরেই বঙ্গদেশে বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যাপারটা ধীরে ধীরে সহজ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। ১৮৫৬ সালের ৬ই মার্চ তারিখে ডালহৌসী ভারত

ত্যাগ করেছিলেন। তবে পূর্ব ব্যবস্থানুযায়ী তাঁর ভারতত্যাগের পরে সরকার বেথুন স্কুলের দায়িত্ব নেওয়ায় ওই স্কুলের অনিশ্চিত অবস্থার কিছুটা অবসান ঘটেছিল।

১৮৪৯ সালে বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বঙ্গদেশে নারীশিক্ষার যথার্থ সূত্রপাত ঘটেছিল। এই প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখ্য যে, এর আগে ১৮৪৭ সালে বারাসাতে ‘প্যারীচরণ সরকার’,

‘নবীনকৃষ্ণ মিত্র’ প্রমুখের উদ্যোগে গৃহস্থ হিন্দু পরিবারের মেয়েদের জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হলেও সেটা বৃহত্তর ক্ষেত্রে তখন কোনো ধরণের আলোড়ন সৃষ্টি করতে

পারেনি। যদিও অনেকের মতে বেথুন নাকি বারাসতের ওই স্কুলটি পরিদর্শন করতে গিয়েই তাঁর নিজের বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক প্রেরণা পেয়েছিলেন। (রানা চক্রবর্তী) বেথুন

স্কুলের দৃষ্টান্তে রাধাকান্ত দেব তাঁর শোভাবাজারের রাজবাড়িতে, এবং উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মিলে উত্তরপাড়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয়

স্থাপন করেছিলেন। এরপরে বাংলার অন্যত্রও, যথা - যশোহর, সুখসাগর, নিবাধুই ইত্যাদি জায়গায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর ঈষৎ পরবর্তীকালে পণ্ডিত বিদ্যাসাগর ছোট

লাট ‘হ্যালিডের’ শুধুমাত্র মুখের কথার ওপরে নির্ভর করে বর্ধমান, হুগলি, নদীয়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি জায়গায় প্রায় ৫০টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সেই ব্যাপারে

বিদ্যাসাগরের কাছে তখন কোনো সরকারি কাগজ কিংবা লিখিত আদেশ না থাকবার জন্য তৎকালীন শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর ‘ইয়ং’ সাহেব ওই সব বালিকা বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠা ও সেই

ব্যাপারে অর্থসাহায্যের বিরোধিতা করতে শুরু করেছিলেন। (বিদ্যাসাগর, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ- ১৭১) তাঁর সেই বিরোধিতার ফলে বিদ্যাসাগর আর্থিক দিক দিয়ে কিছুটা অস্বস্তিকর

অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। হ্যালিডে সেজন্য বিদ্যাসাগরকে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে বললেও বিদ্যাসাগর তাতে অস্বীকৃত হয়েছিলেন। এরপরে অনেক লেখালেখি করবার

পরে সরকার বিদ্যাসাগরকে ওই বিদ্যালয়গুলির আর্থিক দায়ভার থেকে মুক্তি দিলেও, সেগুলির জন্য কোন স্থায়ী সাহায্য করতে অস্বীকৃত হয়েছিল। (রানা চক্রবর্তী) সেই সময়ে একদিকে

বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে যখন দু’-একটি করে বালিকা বিদ্যালয় গড়ে উঠছিল, অন্যদিকে তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সভাসমিতিতে নারীশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়ে

গিয়েছিল। ১৮৫৫ সালের ২৫শে জুলাই তারিখে মানিকতলা স্ট্রীটে অনুষ্ঠিত তেমন একটি সভায় ‘হরচন্দ্র দত্ত’ জোরালো ভাষায় নারীশিক্ষাকে সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, “আমাদের

নিজেদের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এবং ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্য পালনের তাগিদে, এখনই স্ত্রীশিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।” ওই সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে তাঁর মুখ থেকে এটাও শোনা

গিয়েছিল, “The education of our females is a duty which we owe to ourselves, and more speedily it is fulfilled it is better.” (An Address on Native Female Education,

1856, Hurechunder Dutt, P-

এবারে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে নারীশিক্ষা নিয়ে হিন্দু বাঙালীসমাজে রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলেও, সব মিলিয়ে কি ফল পাওয়া

গিয়েছিল? উত্তরে এটাই বলা যেতে পারে যে, তখন অন্ততঃ একেবারে যুগান্তকারী কোন ফল পাওয়া যায়নি। সমস্ত ধরণের চেষ্টা করা সত্ত্বেও সেই সময়ের বাঙালীসমাজে নারীশিক্ষার

অনুকূল কোনো মনোভাব গড়ে ওঠে নি। আর সেই মনোভাব না গড়ে উঠবার পিছনে একাধিক কারণ ছিল। প্রথমতঃ, লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা বিধবা হবেন, বাঙালী সমাজমনের ওই সংস্কারকে

তখনও পর্যন্ত মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। ওই সময়ে বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েরা শিক্ষালাভের জন্য খুব একটা সময়ও পেতেন না। তাই ঊনিশ শতকের প্রথমদিকের ওই ধরণের সামাজিক

পরিবেশে, নারীশিক্ষা বিস্তারের কোন ধরণের চেষ্টাকে জনগণ প্রসন্নমনে নেন নি। (রানা চক্রবর্তী) অন্যদিকে বাঙালীসমাজে সেই সময়ে পর্দাপ্রথা, এবং অন্তঃপুরশুচিতা বজায় থাকবার

ফলে, পাশ্চাত্য দেশের মতো এদেশের মেয়েদের প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করাটাকে, সেই সময়ের নারীশিক্ষার সমর্থক অনেক ব্যক্তিও খোলা মনে মেনে নিতে পারেন নি; সেই কারণেই

রাধাকান্ত দেবের মত নারীশিক্ষার সমর্থক ব্যক্তিও তখন প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে মেয়েদের পড়াশোনাকে প্রীতির চোখে দেখেন নি। আগেই বলা হয়েছে যে, ১৮৪৯ সালে বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠার

মাধ্যমে বাংলায় প্রকৃত স্ত্রীশিক্ষার সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু বেথুনও তখনকার বাঙালী হিন্দুসমাজের শক্তির আসল উৎসকেন্দ্রটি ধরতে পারেন নি। তাই ওই সময়ের অন্য রক্ষণশীল

হিন্দু সমাজপতিদের শুধু নয়, তিনি রাধাকান্ত দেব, মতিলাল শীল প্রমুখ নারীশিক্ষার সমর্থককেও রক্ষণশীল বলে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। যেটা ওই সময়ের মর্যাদার প্রশ্নে একপক্ষে

তাঁদের অপমানই করা হয়েছিল। তাই তাঁরাও বেথুনের স্কুলের ব্যাপারে তাঁকে কোন সাহায্য না করে, উল্টে তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন। অথচ তৎকালীন বাঙালী হিন্দুসমাজে তাঁদের প্রভাব

তখন সাংঘাতিক ছিল। তাঁদের দ্বারস্থ না হয়ে বেথুন প্রধানতঃ ওই সময়ের বুদ্ধিজীবি বাঙালী তরুণদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁদের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ না

থাকলেও, ওই সময়ে যে ধরনের প্রভাব থাকলে কোনো সামাজিক পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল, সেই ধরনের কোন প্রভাব কিন্তু বাঙালী হিন্দুসমাজে তাঁদের ছিল না। ফলে বেথুনের

জীবিতাবস্থায় বাংলার নারীশিক্ষায় সেই প্রত্যাশিত সাফল্য আসেনি। কিন্তু একই সাথে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, ওই সময়ে নারীশিক্ষার প্রাথমিক ব্যর্থতাই কিন্তু শেষপর্যন্ত

চূড়ান্ত হয়ে ওঠে নি, বঙ্গদেশে নারীশিক্ষার পরবর্তী ইতিহাস অন্ততঃ সেই প্রমাণই দেয়।

‘চর্যাপদের যুগে বাংলার সামাজিক অবস্থা’

(প্রথম পর্ব)

রানা

এই কাহিনীর সূত্রপাত করা যেতে পারে একাদশ শতকের শুরু থেকে যখন পালবংশের প্রথম গৌরব-পর্বের শেষে মহীপাল (৯৮৮-১০৩৫) তাঁর হৃতগৌরব উদ্ধারে ব্যস্ত ছিলেন। সেই সময়ে

মহীপাল ‘গৌড়বঙ্গের’ রাজা হলেও, সেই গৌড় ও বঙ্গের সঠিক সীমা-নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভবই। ঐতিহাসিকদের মতে মোটামুটিভাবে সেই গৌড় তখন রাঢ় ও বরেন্দ্রের এক সমষ্টিগত

দেশ ছিল। ওই রাঢ় আবার অজয় নদ দিয়ে দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। তখন উত্তর রাঢ়কে বলা হত ‘ব্রহ্ম’, আর দক্ষিণ রাঢ়কে বলা হত ‘সুহ্ম’। সেই রাঢ় মোটামুটিভাবে আধুনিক বর্ধমান ও

প্রেসিডেন্সী বিভাগ নিয়ে গঠিত ছিল, হয়ত সেটার সঙ্গে তখন মানভূম ও হাজারীবাগের খানিকটাও যুক্ত ছিল। একই সময়ে বঙ্গের সীমা নির্ধারণ আরো কঠিন ব্যাপার। কারণ, ‘সমতট’ ও

‘হরিখেল’ তখন বঙ্গের ভিতরে ছিল নাকি বাইরে ছিল, সেটাও বলা সম্ভব নয়। ঐতিহাসিকদের মতে ওই হরিখেল সম্ভবতঃ অধুনা বাংলাদেশের আধুনিক বাখরগঞ্জ ও নোয়াখালির কিয়দংশ,

আর সমতট সম্ভবতঃ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক চব্বিশ পরগনা ও বাংলাদেশের কুমিল্লা নিয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু এ সবই প্রায় অনুমান, কিছুই সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তাই উক্ত

সময়ের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে আরো কিছু বলবার আগে, ওই সময়ের বৌদ্ধধর্মের হীনযান, মহাযান, বজ্রযান ও সহজযান সম্পর্কে একটা মোটামুটি একটা ধারণা করে নেওয়া উচিত

হবে। এখানে উদ্ধৃত বৌদ্ধধর্মের মতগুলির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব গৌতম বুদ্ধের দু’টি কথার তাৎপর্য নিয়ে; সেই কথা দু’টির একটি হল ‘নির্বাণ’, এবং অপরটি হল ‘করুণা’। এগুলোর কোনোটার

অর্থই বুদ্ধ নিজে স্পষ্ট করে বলে যাননি বা লিখে যাননি। অথচ নির্বাণই কিন্তু বৌদ্ধধর্মের শেষ কথা। হীনযান বৌদ্ধধর্মে জৈন মতের মতই ঈশ্বরের কোন স্থান নেই। হীনযানীরা

একমাত্র জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদে বিশ্বাস করেন। এই কর্মচক্রই জন্মজন্মান্তরে মানুষের মন, দেহ ও স্থান, অর্থাৎ জগতের ঠিক কোন স্তরে তাঁর জন্ম হবে সেটাকে নির্ধারিত

করে। ‘ত্রিশরণ’, অর্থাৎ - বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ - নিয়ে এই কর্মচক্রের অচ্ছেদ্য বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে তাঁরা মনে করেন। ত্রিশরণ নিলে নির্বাণ অর্থাৎ দুঃখ থেকে

আত্যন্তিক মুক্তিলাভ ঘটে। কৃচ্ছ সাধনযুক্ত এই পথ যেহেতু খুব কঠিন পথ, তাই এই পথের যাত্রীসংখ্যাও অত্যন্ত কম। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীর

সংখ্যা যেমন বেড়েছিল, তেমনি তাঁদের নৈতিক সমস্যাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। বুদ্ধের তিরোধানের পরে বৌদ্ধ বিহারগুলিতে বেশিদিন ধরে আগেকার শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি; এমনকি

 

121

 

নির্বাণের অর্থ নিয়েও তখন নানা তর্কবিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে, অর্থাৎ বুদ্ধের জন্মের প্রায় সাতশো বছর পরে ‘নাগার্জুন’ তাঁর মহাযান মতের বার্তা নিয়ে

এসেছিলেন। তিনি হীনযানের প্রচলিত মতকে নাকচ করে দিয়ে নির্বাণের যে অর্থ করেছিলেন, সেটা থেকে মনে হয় যে, নির্বাণলাভ করলে মানুষ শূন্যে পরিণত হয়; সে কোথাও আর যায় না,

তাঁর আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। হীনযানের ভাষ্য লেখা হয়েছিল পালিতে, আর মহাযানের ভাষ্য লেখা হয়েছিল সংস্কৃতে; ফলে ক্রমে মহাযানপন্থীরা দোলে বৃদ্ধি পেয়েছিলেন, ওই

সময়ের নানা ধর্মমতের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল, আর একই সাথে মহাযানে নানা মতের অনুপ্রবেশও ঘটেছিল। ক্ৰমে মহাযানীরা হীনযানে একক আত্মনির্বাণের চেষ্টাকে

আত্মপরায়ণতার নামান্তর বলেছিলেন, আর তাঁরা করুণার সঙ্গে যুক্ত করে সর্বপ্রাণীর মুক্তি বা নির্বাণের আদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন। এর ফলে বৌদ্ধধর্মের মূলগত আদর্শে চরম

প্রভেদ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাণরূপী সেই শূন্যবাদে তখনকার সাধারণ মানুষের মন তৃপ্ত না হওয়ার জন্য, ক্রমে সেটার সাথে বিজ্ঞানবাদ, অর্থাৎ, পরম জ্ঞানই নির্বাণের

পরিসমাপ্তি - যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সেটাও সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য না হওয়ার জন্য ক্রমে এর সাথে মহাসুখবাদ, অর্থাৎ, পরম সুখই নির্বাণের চরম অবস্থা - যুক্ত করা

হয়েছিল। এই ত্রয়ীর, অর্থাৎ, শূন্য, বিজ্ঞান ও মহাসুখবাদের সমন্বয়ে যে নির্বাণ গঠিত হয়েছিল, সেটাই ছিল বজ্রযানের মত। এরপরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ‘বৌদ্ধ-তান্ত্রিকতা’,

যেটার জন্ম হয়ত বুদ্ধের আমলেই হয়েছিল। ফলে, মহাসুখের অর্থ বদলে গিয়েছিল; বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীর কাছে সমাজবন্ধন শিথিল হওয়ার জন্য, মহাসুখের অর্থ স্থুল থেকে স্থুলতর

হয়ে শেষে নারী-সঙ্গমে গিয়ে সেটার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। অর্থাৎ নারী-সঙ্গমে যে সুখ সেটাই মহাসুখ। খুব সম্ভবতঃ ‘ছান্দোগ্য’ উপনিষদের (দ্বিতীয় অধ্যায়, ত্রয়োদশ খণ্ড, ১-২)

‘বামদেব্যা’ উপাসনা থেকে এর নজির খুঁজেও বের করা হয়েছিল। বামদেব্যা উপাসনা মন্ত্রের যে অংশটিকে মহাসুখবাদীরা লুফে নিয়েছিলেন, সেটা হল - “ন কাঞ্চন পরিহরেং; তদ্ ব্রতম্” -

অর্থাৎ, কোনো স্ত্রীকেই পরিহার করবে না - এই ব্ৰত। বাঙালী সিদ্ধাচার্য ‘লুইপাদ’ সেই মহাসুখবাদ প্রচার করেছিলেন; কাজেই, স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ যেটা করতে পারেননি, লুই সেটা করে

দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ওই সহজযানে, অর্থাৎ সহজ-সংঘের পালে ভর করে তাঁর ভবনদী-পারের নৌকা তরতর করে নির্বাণের পথে ছুটে গিয়েছিল; অর্থাৎ, বৌদ্ধধর্ম জাহান্নমে গিয়েছিল।

উক্ত লুইপাদকে কেন্দ্র করে একাদশ শতকের বাঙলায় যে সমাজ-জীবন গড়ে উঠেছিল, ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ তাঁর ‘বেণের মেয়ে’ উপন্যাসে সেটারই অপূর্ব চিত্র এঁকেছিলেন।

‘ধান ভানতে মহীপালের গীত’ গেয়ে সেকালের পল্লীবধূরা যে প্রশস্তি রচনা করেছিলেন, সেটা এখন বাংলার জাতীয় ইতিহাসের প্রবাদ হয়ে উঠেছে। ইতিহাসগতভাবে একথা সত্যি যে, পাল

রাজারা ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ মতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটা বাঙালী জাতীয়তা গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু তবুও বলতে হবে যে, সেই সহজসংঘকে সংযত না করে মহীপাল

বাঙালীর জাতীয় চরিত্রের নিরতিশয় অকল্যাণ সাধনই করেছিলেন। যদি পাশাপাশি ওই কালেরই চরিত্র ‘লাউসেনের’ কথা স্মরণ করা যায়, তাহলে এই কথাটা আরো স্পষ্ট হবে। পরবর্তী

যুগের নানা মঙ্গলকাব্যে তাঁর কাহিনী নানারূপে কীর্তিত হয়েছিল। অনেকেই তাঁকে সেই সময়ের বহুল প্রচলিত ব্যভিচারে লিপ্ত করতে চেষ্টা করলেও, তিনি নিজের দৃঢ়তায় অটল থেকে

বলেছিলেন -

“ধর্মের সেবক হৈয়্যা সুখ নাহি চাইবৈশ্যবাসের কুলে নাই আমিস্য ভোজন

ধর্ম বিনা অধর্ম করি না কখন।”

(ধর্মমঙ্গল, রূপরাম চক্রবর্তী)

একাদশ শতকে বাঙালী সমাজ শুধু কৃষিনির্ভরই ছিল না, বাণিজ্য-নির্ভরও ছিল। পালরাজাদের আমলে কর ব্যবস্থা অপরিমিত ছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন না। তখন চার রকমের কর

ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল - (১) ভাগ, অর্থাৎ ফসলের ষষ্ঠাংশ; (২) ভোগ, অর্থাৎ সাময়িক ফলসম্ভার; (৩) সাময়িক কর, জ্বালানী কাঠ ও ফুল; এবং (৪) আকস্মিক ও বাণিজ্য-ভিত্তিক

কর। ভাগের বদলে তখন হিরণ্য বা নগদ দেওয়াও প্রচলিত ছিল। একই সাথে অর্থদণ্ডের উল্লেখও পাওয়া যায়।

অষ্টম শতকে তাম্রলিপ্তি বন্দর লুপ্ত হওয়ার পরে, ক্রমে সেটার জায়গায় সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁ বাংলার বহির্বাণিজ্যের প্রধান বন্দর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। উক্ত সময়ে কৃষিতে

যে লাভ হত, বহির্বাণিজ্যে তার থেকে বহুগুণ বেশি লাভ হত। ওই সময়ে বৌদ্ধ বণিকেরা বা বেনেরাই সেই কাজে সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন। গুপ্তযুগে গৌড়ে অর্থাৎ পৌণ্ড্রবর্ধনে ও রাঢ়ে

ব্রাহ্মণের সংখ্যা কিছুটা হলেও বেড়েছিল; তখন তাঁরা শুধু অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন না, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন কৃষিকার্য করতেন, তেমনি কেউ কেউ রাজকার্যও

করতেন। অর্থের সামর্থ্যে বেনেরা তখন পরম শক্তিশালী ছিলেন; ওই সময়ে তাঁরা বাঙালী সমাজের প্রায় চূড়ামণি ছিলেন বললেও ভুল কিছু বলা হয় না। উক্ত সময়ের বৌদ্ধবিহারগুলি গৃহস্থ-

বৌদ্ধ ধরে ধরে ভিক্ষু-ভিক্ষুণী করে নেওয়ার চেষ্টায় সজাগ থাকত, কারণ বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ভিক্ষুণীরা তাঁদের নিজেদের সম্পত্তি নিয়ে বিহারে যোগ দিতে পারতেন; হিন্দু সন্ন্যাসীদের মত

বিত্ত-ঐশ্বর্য ছেড়ে দিয়ে তাঁদের সংসার ত্যাগ করতে হত না। বহির্বাণিজ্যের জন্য তখন নানা ধরণের সমুদ্রগামী নৌকা তৈরি হত, জাভার বরবুদুর মন্দিরের গাত্রকার্যে তার কিছু উদাহরণ

এখনও দেখতে পাওয়া যায়। সেই নৌকাগুলি সম্বন্ধে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন, “নৌকাগুলির আকার একরূপ নয়। কতকগুলি হালের দিকে খুব উঁচা, অপর দিকে তত উঁচা নয়। এগুলি প্রায়

গোল। ইহাদের খোল ফাদাল ও গভীর - অনেক মাল ধরে - প্রায় আগাগোড়া ছইয়ে ঢাকা। একখানি ছইয়ের নীচে অনেকগুলি কামরা। … আর এক সাঙ্ঘায় নৌকাগুলি লম্বা ছাঁদের। তাহাতেও ঐরূপ

ছই, ঐরূপ অনেকগুলি কামরা। প্রত্যেক নৌকার দুইধারে পিতলের দুইটা করিয়া বড় বড় চোখ। মাঝখানে বড় বড় বেণের নাম লিখা। এক এক নৌকায় ৩০/৪০ খানি করিয়া দাঁড়, প্রকাণ্ড মাস্তুল

ও অনেকগুলি করিয়া পাল।” বাঙলার সূত্রধররা বাঙলারই সেগুন, গাম্ভারী, তমাল, পিয়াল, কাঁঠাল, মনপবন প্রভৃতি কাঠ দিয়ে সেই নৌকাগুলি তৈরী করতেন। কারো কারো মতে মনপবন ওই

সময়ের এমন এক ধরণের কাঠ ছিল যা পরবর্তীকালে বিরল হতে হতে বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বাঙলায় তৈরী লোহার পেরেক দিয়েই তখন ঐসব নৌকার তক্তা জোড়া দেওয়া হত। গলুই

ও হাল পৃথক পৃথক ভাবে তৈরী করে পরে জুড়ে দেওয়া হত; সামনের গলুইটিকে সাধারণতঃ একটি প্রকাণ্ড ময়ূরের আকারে গড়া হত। নৌকাগুলোর নামও ছিল কাব্যঘেঁষা - ‘সাগরফেনা’,

‘হংসরব’, ‘রাজবল্লভ’ ইত্যাদি। একাদশ শতকে দক্ষিণাপথের চোল রাজ্যের রাজা ‘রাজেন্দ্র চোল’ বাঙলা আক্রমণ করেছিলেন। তখন তাঁরই নির্দেশে উৎকীর্ণ তিরুমলয় পাহাড়ের

শিলালিপিকে সত্যি বলে মেনে নিলে, বঙ্গের রাজা ‘গোপীচন্দ্ৰ’ বা ‘গোবিন্দচন্দ্র’কে একাদশ শতকের লোক বলে ধরা যেতে পারে, আর ‘ময়নামতীর গান’কেও মূলতঃ ওই শতকেরই কথা বলে

বলা চলে - যদিও সেটার মধ্যে কিছু কিছু প্রক্ষিপ্ত অংশ পরবর্তীকালে জুড়ে গিয়েছিল। ময়নামতির গান থেকে বোঝা যায় যে, ওই সময়ের বহির্বাণিজ্যের ফলে শুধু বাঙলার বণিকেরা নন,

সাধারণ মানুষও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়ে উঠেছিলেন।

“সেই জে রাজা রাইয়ত প্ৰজা দুস্কু নাহি পায়।

কারও মারুলি দিয়া কেহ নাহি যায়॥

কারও পুস্কনির জল কেহ না খায়।

আথাইলে ধনকড়ি পাথাইলে শুকায়॥

সোনার ভ্যাটা দিয়া রাইয়তের ছাওয়ালে খ্যালায়॥”

(মারুল = গ্রাম্যপথ, আল; ‘আথাইলে ধনকড়ি পাথাইলে শুকায়’ = অনায়াসলব্ধ অর্থ যেখানে সেখানে ফেলে রাখে।)

প্রশ্ন জাগে যে, তখন দেশ থেকে কোন কোন বেসাত নিয়ে গিয়ে বণিকেরা সর্বসাধারণের এত সচ্ছলতার ব্যবস্থা করতেন? ইতিহাসের পাতা থেকে এর কোনো স্পষ্ট সাক্ষ্য পাওয়া না

গেলেও, ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, তখন বাংলার বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল কাপড় - মসলিন, বেনারসি, রেশম, তসর, গরদ, এণ্ডী, পাট, থলে ইত্যাদি; আর এর সঙ্গে হয়ত

ছিল গাঁজা, সিদ্ধি, কাঠের ও কাঁচের খেলনা। উল্লেখ্য যে, ওই সময়ে কোন বণিকের স্ত্রী যদি তাঁর বিদেশযাত্রার সময়ে অন্তঃসত্ত্বা থাকতেন, তাহলে তাঁকে ‘জয়পত্র’ দিয়ে যেতে হত যাতে

তাঁর স্ত্রীর কোন সামাজিক কোন দুর্নাম না ঘটে। বহির্বাণিজ্যে ওই জন্মবীজ-জাত দ্রাবিড়ী অনুপ্রেরণা ক্রমে বাঙালীর চরিত্রে ক্ষয় পেয়ে গিয়েছিল; আর সেটা নানা কারণে ঘটেছিল। হয়ত

পরবর্তী শতকে দৈবের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠবার ফলে বাঙালী তাঁর কর্মের মাহাত্ম্যকে ভুলে গিয়েছিল, হয়ত মনুর সমুদ্রযাত্রার নিষেধাজ্ঞা পরবর্তীকালে আরো প্রবলতর

হয়েছিল, হয়ত দেশে যথাযোগ্য বেসাত সংগ্ৰহ কষ্টসাধ্য হয়েছিল, হয়ত সমুদ্রপারের বাজারে নবাগত আরবীয় বণিকদের সঙ্গে পাল্লায় বাঙালী হেরে যেতে শুরু করেছিল। তবে যে কারণে, বা

যে সমষ্টিগত কারণেই হোক না কেন, ইতিহাস এটাই বলে যে, বাঙালীর বহির্বাণিজ্য ক্রমে ক্রমে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। উক্ত শতকেই বা হয়ত তারও কিছু আগেই যে সেই অবলুপ্তির সূচনা

ঘটেছিল, ‘দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার’ সংকলিত ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’র গল্পে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাতে ‘শঙ্খমালা’য় দেখা যায় যে, সওদাগরকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছিল, “যাগ কর

না, যজ্ঞ কর না, গাব দেও না, গব্য দেও না, জলের তলে চৌদ্দ ডিঙ্গা মধুকর সাপ, কুমীর হইয়া গেল।” গবেষকদের মতে দ্বাদশ শতকের আগেই বাংলাতে ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’ ও ‘ঠাকুরমার

ঝুলি’র গল্পগুলি রচিত হয়েছিল। তবে বিশ শতকের শুরুর আগে সেগুলি লিখিত ভাষার জালে ধরা পড়েনি। এর আগে সেগুলি শুধুমাত্র শ্রুতির স্রোতে ভেসে বেরিয়েছিল। বাঙালীর সেই অপূর্ব

জাতীয় রূপকথা ও গীতকথা কথ্যভাষায় শতকে শতকে পরিবর্তিত হয়ে বাঙালার শিশুদের মনের খোরাক জুগিয়েছে ও বয়স্কদের আনন্দ দান করেছে। বাঙলী জাতির সঙ্গে সঙ্গে শতকে শতকে

সেগুলি লোকের মুখে মুখে ভাষান্তরে পরিবর্তিত হয়েছে, পৌরাণিক ও বৌদ্ধজাতকের গল্পের মতই সেগুলি কোনো বিশিষ্ট ধর্মমতের দাবি বা সাক্ষ্য বহন করে আসে নি; সেগুলি

জাতিধর্মনির্বিশেষে সর্বজনীন, তাই হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান প্রভৃতি সর্ব-বাঙালীর কাছেই সেগুলি চির-সমাদৃত। কথায় ও কাহিনীতে সেগুলি জাতিহীন। রূপকথা ও গীতিকথার মধ্যে

মূল প্রভেদটি হল যে, প্রথমটিতে ছড়া থাকলেও গান থাকে না, অন্যদিকে গীতিকথার প্রাণশক্তিই হল গান। গীতিকথায় অতি প্রাকৃত ঘটনার সমাবেশ থাকলেও তাতে রূপকথার মত রাক্ষস-

খোক্কসের কথা বিরল। শতকে শতকে গল্পগুলির কথ্যভাষার রূপ পরিবর্তিত হয়েছে বলেই সেগুলি স্রোতোবহা নদীর মতই প্রাণবন্ত ও সাবলীল রয়েছে; নইলে, ‘চর্যাপদের’ মত সেগুলিও

অতীতের বাংলার ‘সান্ধ্য’ বা অস্পষ্ট ভাষারূপের সাক্ষ্য হয়েই পুঁথিগত হয়ে থেকে যেত। সেগুলির মধ্যে প্রাণ-প্রাচুর্যের একটু নমুনা উদ্ধৃত করা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না -

“ঢা ক্কড় ক্কড়, ঢা ক্কড় ক্কড়, ঢাকে বলে ভাই রে;

তবে গানা গাইতে পারি, আকাশ ছাউনি পাই রে।

তা ক্কুড় ক্কুড়, তা ক্কুড় যত ঢোলে কয়

ঢুলীর নাচনে ভাই সাতটা পুকুর হয়।

শানাই বাঁশরী সিঙ্গা ফেটে হল চীর

হারে, অষ্টরাজ্যের লোক হল রে বধীর!”

এই স্রোতোবহা নদীর স্রোতে দশম একাদশ শতকের বাঙলার সমাজ-কথাও কিছু কিছু ভেসে এসেছে। ভেসে এসেছে ওই সময়ের রাজকন্যাদের ‘এলোকেশ চুল’, ‘মেঘডম্বর শাড়ী’, ‘চন্দনরাঙা

চাদর’ ও ‘মালা-চন্দন’। তবে এ সবই তখনকার উচ্চ পর্যায়ের মানুষের বেশবাস ছিল। তখনো বিবাহের পরে বাংলার মেয়েরা সিঁদুর পড়তেন, ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা হত, শুভকার্যে শাঁখে

 

122

 

ফুঁ ও হুলুধ্বনি দেওয়া হত, বিবাহে বরণডালা সাজানো হত, ডালে চালে খিচুড়ি রান্না করা হত; তখন জাদুমন্ত্রে মানুষ ছাগল-ভেড়ায় পরিণত হয়ে যেতে পারে বলে বিশ্বাস করা হত, আর একই

সঙ্গে ঝাড়-ফুঁক, তুকতাকের ওপরে মানুষের চরম বিশ্বাস ছিল।

এবারে ‘ময়নামতির গান’ অনুসরণ করে একাদশ শতকের বাঙালীর সামাজিক রীতিনীতির চিত্তের সন্ধান করা যাক। তখন ব্রাহ্মণদের দরবারী বেশভূষা কি ছিল? ধুতি শালকিরাণি, চটক ও

মটক, কোমরবন্ধ, চল্লিশ পাগড়ি (চল্লিশ বার পাক দিয়ে যেটা তৈরী করা হত), এক হাতে অঙ্গদ, অপর হাতে বলয়, কণ্ঠে স্বর্ণ-মালা, গলায় জোড়া জোড়া পৈতা, কক্ষে একরাশি পুঁথি - ঠিক

যেন হিন্দুস্তানী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। আলবেরুনি তাঁর লেখায় একাদশ শতকের বাংলার পুরুষদের অলঙ্কার ও প্রসাধন-প্রীতি কথার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছেন। তিনি লিখেছিলেন যে,

তখন পুরুষেরাও স্ত্রীলোকের মত যেমন প্রসাধন-দ্রব্য ব্যবহার করতেন, তেমনি অলঙ্কারও পড়তেন; যথা - কানে মাকড়ি, হাতে বালা, হাতের আঙুলে আর পায়ের বুড়ো আঙুলে নানা ধরণের

আংটি। এর পাশেই ‘হীর নটি’র বেশভূষার বাহারের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সেটা এরকম - নাসের কাকই, বহুপ্রকারের খোঁপা (নিচু করে চুল বাঁধলে সেটাকে বলা হত ‘খোপ্যক’, আর উঁচু করে চুল

বাঁধলে সেটাকে বলা হত ‘ঘোড়াচূড়’ বা ঘোড়াচুলা), নিয়র-মেলানি শাটী (মসলিন), নাকের নত (নথ), হেট কানে (কানের লতিতে) পেন্দে ঢেরি, উপর কানে চাকি, শতেশ্বরি হার, পায়ে বাঁকামল,

সোনার কাচলি (কাঁচুলি), আর হরে পানের খিলি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ওই সময়ের নিয়র-মেলানি শাড়ি এত সূক্ষ্ম হত যে, রাতে সেটাকে দেখা যেত না; ফলে ওই শাড়ি পরে থাকলেও রাতে

নটিকে বিবসনা বলেই বোধ হত - “শাড়ি আর নটি গেইল মিলিয়া।” তখনকার ভদ্র বাঙালী পরিবারের মেয়েদের বেশবাশ ছিল - নিচের হাতে শাঁখা, উপরের হাতে ‘বাহ খড়’, গলায় সাতেসরী বা

দেবচ্ছন্দ হার, মাথায় হংসপদিকা, কানে সোনার তারঙ্গ বা কচি তালপাতার অবতংস তালীপত্র (কুণ্ডল হিসাবে), আর পরনে সূক্ষ্ম কার্পাসবস্ত্র, মলমল বা পাটের কাপড়; সেই

কাপড়গুলোর নামও ছিল বিচিত্র, যথা - ‘মেঘ-উদুম্বর’, ‘গঙ্গাসাগর’, ‘লক্ষ্মীবিলাস’, ‘দ্বারবাসিনী’, ‘সিলহটি’, ‘গাঙ্গেরী’ ইত্যাদি আরো কত নাম! এছাড়া ছিল পট্ট ও নেতবস্ত্র (সিল্ক)।

পাটের শাড়ির প্রচলন বাংলায় এখনো থাকলেও, ‘নেতের’ অধোগতি হতে হতে এখন সেটা ঘর পরিষ্কার করবার ‘ন্যাতা’য় পরিণত হয়েছে, যদিও উড়িষ্যায় সেটার গৌরব এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

উপরোক্ত সব কাপড়ই তখন বাংলাতেই তৈরী করা হত। ওই সময়ে বাংলার প্রতিটি ঘরেই ‘মলমলের’ সুতা কাটা হত। তখন বাঙলার তৈরী কাপড়ের কদর সারা উত্তর ভারত জুড়ে ছিল; আর

তাতে বাঙলার ঘরে ঘরে আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছিল। তখন শুধু বাংলায় নয়, ভারতবর্ষের সর্বত্রই সবাই পান চিবাতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাম্বুল দান ও গ্রহণ তখনকার ভারতীয় সভ্যতার

এক অঙ্গবিশেষ ছিল। কবে থেকে যে সেই রীতিটির সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা বলা যেমন দুষ্কর, তেমনি তাম্বুল-লতার উদ্ভবের কথাও ইতিহাসে অজ্ঞাত। অথচ, ভারতের ইতিহাসের সব শতকেই

কিন্তু তাম্বুলের প্রতিপত্তির কথা পাওয়া যায়। তখন ধনীদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের তাম্বুলবাহী সেবকও ঘুরে বেড়াতেন। ওই সময়ে আদর-আপ্যায়নে পানের স্থান সবার উপরে ছিল; পানের

জায়গায় ‘তামাক’ এসেছিল অনেক পরে - মাত্র ষোড়শ শতকে। তখন শুধু সধবারাই নন, বিধবারাও পান খেতেন। ‘ময়নামতীর গানের’ ময়না যে পান খেতেন, তাতে থাকত - লং (লবঙ্গ), জায়ফল,

এলাঞ্চি (এলাচ), দালচিনি (দারুচিনি), গুআমুরি, ধনিয়া, করপুর ও জৈষ্ঠমধু (যষ্টিমধু)। সেকালেও বিবাহের কথা পাকা হলে ‘দরগুআ’ করা হত; অর্থাৎ, তখনও শুভ সংবাদে ‘গুয়াপান’ বিলানো

হত। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে, সুপারি কথাটা কিন্তু কোনও আধুনিক শব্দ নয়; চতুর্দশ শতকের বাংলা সাহিত্যে ‘সিপরি’ নামে এর স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন সবাই ছবিও

আঁকতেন; হয়ত গুপ্তযুগে, অর্থাৎ, চতুর্থ, পঞ্চম শতকে চিত্রাঙ্কন-বিদ্যার ব্যাপক প্রসারের ফলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। ওই সময়ের গরীবেরাও নিজেদের ঘরের দেওয়ালে অন্ততঃ

দুটো ময়ূরের ছবি এঁকে রাখতেন। বেণেদের বাড়ীর দু’পাশে তখন দুটো টাকার থলি, তার সঙ্গে একপাশে একটা শাঁখ আর অন্যদিকে একটা পদ্ম আঁকা থাকত। ছবি আঁকার ব্যাপারটা তখন

গৃহসজ্জার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল। শুধু তাই নয়, তখন নারী হোন বা পুরুষ, তাঁরা সকলেই কিন্তু নাচতে জানতেন। তবে মেয়েরা যে তাতে বিশেষভাবে পারদর্শী ছিলেন, তাতে কোন

সন্দেহ নেই। ওই সময়ের নটীরা শুধু নন, নিতান্ত সাধারণ ভদ্র পরিবারের মেয়েরা, এমনকি রাজবাড়ির রাজবধূও নৃত্য পটিয়সী ছিলেন। ময়না নিজেই রাজবধূ ছিলেন - “ময়না গর খ্যামটা

আড়খ্যামটা নাচে হাততালি দিয়া”।

ইতিহাস বলে যে একাদশ শতকে পৌঁছেও বাঙালীর সমাজ কিন্তু তখনও দানা বাঁধতে পারেনি। সমাজের উচ্চপর্যায়ে তখন যেমন ‘গুভাজু’ বা সদ্ধর্মী বা বৌদ্ধ ও ‘দেবভাজু’ বা হিন্দুর মধ্যে

একটা লড়াই চলছিল, তেমনি সমাজের নিম্নপর্যায়ে তখন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বিপুলসংখ্যক বাঙালী - তাঁতি, ডোম, বাগদী, হাড়ী, শবর ইত্যাদি বাস করছিলেন। ওই সময়ে সমাজের

উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে নিম্নপর্যায়ের কোনো সম্পর্কই ছিল না, সমাজের নিম্নপর্যায়ের মানুষেরা তখন শহর ও গ্রামের বাইরে থাকতেন। তাঁরা তথাকথিত অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য ছিলেন।

আলবেরুনি তাঁর লেখাতে একাদশ শতকের বাংলার সমাজের সেই সামগ্রিক বিচ্ছন্নতার কথা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছিলেন। একাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতে এসে তিনি বহুদিন ধরে এখানে

বাস করেছিলেন। তৎকালীন বাংলার সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর লেখা থেকে যা জানা যায়, সেটার কিছুটা অংশ এরকম - “অন্ত্যজ গোষ্ঠীর এক-একটি জাতি এক-একরকমে সমাজসেবা

করে; সেবাই তাঁদের পেশা। তাঁদের বৃত্তি আট প্রকারের - রজক, চর্মকার, ঐন্দ্রজালিক, বেত ও বাঁশের তৈরী জিনিসের কারিগর, নৌ-চালক, মৎস্যজীবী, ব্যাধ অর্থাৎ মৃগয়াজীবী ও তাঁতী।

রজক, চর্মকার ও তাঁতীর সঙ্গে অন্য পাঁচটির কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক নেই; নিজ নিজ দলের মধ্যেই তাঁদের বিবাহাদি চলে। অন্য পাঁচটি দলের মধ্যে বিবাহাদি চলে। … হাড়ী, ডোম (ডোম্ব)

ও চণ্ডাল শ্রেণীর মানুষ কোনো বিশিষ্ট বৃত্তিভোগী বলে গণ্য হয় না; তাঁরা নানা ধরণের কাজকর্ম করে। যে যে বৃত্তি অবলম্বন করে সেই অনুসারেই তাঁদের শ্রেণীবিভাগ করা হয়। মোটের

উপরে তাঁদের সংকরশ্রেণী বলেই ধরা হয়; তাঁরা উচ্চশ্রেণীর বর্ণ-সংকর বিবাহজাত পুত্রকন্যারূপে অধঃপতিত। তাঁদের মধ্যে হাড়ীকে একটু উচ্চপর্যায়ে ধরা হয় - তাঁদের পরিচ্ছন্নতার

জন্য। ডোমের স্থান এরই পরে; তাঁরা বাঁশি বাজায় ও গান করে।” তবে ওই সময়ের ডোমেদের বা ডোম্বদের বৃত্তি সম্পর্কে আলবেরুনির মন্তব্য ইতিহাসগতভাবে প্রামাণিক নয়; কারণ

সমসাময়িক অন্য সব পুঁথিতেই সেই সময়ের ডোমদেরকে বাংলার দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার সেনা হিসাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। ওই সময়ের “ডোমকে নেই যমের ভয়”, “ডোমের পুত যমের দূত” -

বর্তমানে বাঙলার প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছ গিয়েছে, আর -

“আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে

ডাল, মৃগল ঘাঘর বাজে,

বাজতে বাজতে পড়ল সাড়া

সাড়া গেল বামনপাড়া।”

এই কিছুকাল আগেও বাঙলার শিশুদের ছড়ার বই আলো করে থাকত। ওই বাগদীরা পদাতিকও ছিলেন; তাঁরা ছিলেন দুর্ধর্ষ ও বিশালকায়, তাঁদের মাথায় ছিল বাবরিকাটা চুল, তাঁদের হাতে থাকত

একটা বড় বাঁশের লাঠি, যেটার নাম ছিল ‘রায় বাঁশ’। তাঁরাই হয়ত বাংলার ‘রায়বেঁশে নাচের’ আদি কর্তা।

তখনো বাঙালী সমাজে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হয়নি, সেটা আরো অনেক পরে হয়েছিল। তখনকার সমাজের একদিকে ছিলেন মুষ্টিমেয় মহাযানী বা শূন্যবাদী বৌদ্ধ সওদাগর ও

অভিজাত সম্প্রদায়রা, আর সমাজের অন্যদিকে তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতেন অল্পসংখ্যক হিন্দু ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতর জাতি, নানা বৃত্তিজীবী কিন্তু বিত্তশালী মানুষেরা। তাঁরা মূলতঃ

পৌরাণিক ধর্মী হলেও, বৈদিক ধর্মী ছিলেন না; হয়ত তাঁদের বেশিরভাগই তখন বিষ্ণু-উপাসক ছিলেন, কারণ পালযুগের সকল ক্ষেত্রেই পালরাজাদের মন্ত্রীরা বিষ্ণু-উপাসক ছিলেন বলে

ইতিহাস থেকে দেখা যায়। তাই বলে শাক্তরা যে তখন একেবারেই ছিলেন না, তা নয়। ‘শ্রীধর দাস’ সংকলিত ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থেই সেই প্রমাণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। উক্ত গ্রন্থটি

ত্রয়োদশ শতকের আগে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন কবির নির্বাচিত কবিতাংশের একটি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সংকলন। ঐতিহাসিকদের কাছে ওই গ্রন্থটি ভারতের সংস্কৃত সাহিত্যের

অন্যতম প্রাচীন সংকলনের মধ্যে একটি বলে গণ্য হয়। গ্রন্থটিতে ‘শতানন্দ’ নামক একজন কবির একটি কালীধ্যান রয়েছে। কালী মার্কণ্ডেয় পুরাণোক্ত চণ্ডিকারই রুদ্র রূপ। পুরাণের

মধ্যে ‘বায়ুপুরাণ’ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বলে ইতিহাসে গণ্য হয়; আর তারপরেই প্রাচীনত্বের দিক থেকে মার্কণ্ডেয় পুরাণের স্থান। মার্কণ্ডেয় পুরাণ রচনার কাল সঠিকভাবে বলা দুষ্কর,

তবে সেটি চতুর্থ শতক রচিত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা অনুমান করে থাকেন। কালী বাঙালীর প্রিয়তম দেবী। তবে যে রূপে তিনি এখন পূজিত হন, সেটা অবশ্য অনেক পরে এসেছে, এবং কেন

উক্ত দেবীটি বাঙালীর জীবন- সূত্রের সঙ্গে একান্তভাবে গ্রথিত হয়ে গিয়েছেন, সেটার মূলও অন্যত্র রয়েছে। কিন্তু এই প্রবন্ধটি সেকথা আলোচনার উপযুক্ত স্থান নয় বলে, এই

প্রসঙ্গটি আপাততঃ মুলতবি রাখা যেতে পারে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, শতানন্দ নবম শতকের প্রথমার্ধে পালরাজাদের রাজকবি ছিলেন। আর্যা ছন্দে লেখা তাঁর কালীবন্দনার

শ্লোকাংশটি নিম্নরূপ -

“জয়তি তব কূপিতেক্ষণমশ্বত্যা দশনপেষমসুরাস্থি।

কল্পশিখিস্ফুটদদ্রিক্কাণকরালঃ কউকার॥”

(ক্ষণ = রাত্রি; পেষ = পিষ্ট করা, চর্বিত করা; কল্প = মাদক দ্রব্য)

তখন ব্রাহ্মণদের মধ্যে যাঁরা পণ্ডিতশ্রেণীর ছিলেন, তাঁরা সবাই স্মার্ত ছিলেন; তাই শ্রুতি নিয়ে তাঁদের কারবার বেশি ছিল না। তাঁদের মতে বেণেরা যেহেতু শূদ্র ছিলেন, তাই গৃহ্যসূত্রোক্ত

সংস্কার হলেই তাঁরা চাতুর্বর্ণ্য সমাজে স্থান পেতে পারতেন। মজার ব্যাপার হল যে, ওই সময়ের বাংলার বৌদ্ধেরা যেমন বুদ্ধের মন্দিরে ধূপধুনা দিতেন, তেমনি আবার মনুসংহিতার

অনুশাসন মেনে চলতেন, এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে দশকর্মও করাতেন। তবে তখনকার সেই উচ্চতর সমাজের বাইরে বাঙালীর যে বৃহত্তম অংশটি ছিল, তাঁদের সঙ্গে উচ্চতর সমাজের

কারো কোন ধরণের যোগাযোগই ছিল না; না বৌদ্ধদের, আর না পৌরাণিক ধর্মীদের। বস্তুতঃ তাঁদের ধর্ম বিভিন্ন আর সমাজ মূলতঃ গোষ্ঠীসীমাবদ্ধ ছিল। ধর্মের দিক থেকে হয় তাঁরা

বৌদ্ধ সহজপন্থী, অর্থাৎ লুইসিদ্ধার চ্যালা ছিলেন, আর নয়ত নাথপন্থী ছিলেন; তখন সহজপন্থী ও নাথপন্থীদের মূলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ও সাধনপন্থায় বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। ওই

নাথপন্থীরা পূর্বভারতীয় তান্ত্রিক পর্যায়ের এক বৃহৎ শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত গোষ্ঠী ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে নবম বা দশম শতকে, সম্ভবতঃ চন্দ্রদ্বীপে, অর্থাৎ পূর্ববাঙলার

অধুনাতন বাখরগঞ্জ জেলায় সেই পন্থার জন্ম হয়েছিল। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ভেলকি বা নিম্নস্তরের যাদুবিদ্যায় অশেষ পারদর্শিতা অর্জনই তখন নাথপন্থীদের

পরম লক্ষ্য ছিল। তাঁদের মধ্যে যাঁরা তখন সেই লক্ষ্যে পৌঁছে যেতেন, তাঁদেরকেই ‘নাথ’ বলা হত। তাঁরা সবাই সমাজের নিম্নস্তরের লোক ছিলেন, তাই তাঁদের রচিত তান্ত্রিক গ্রন্থের

সংস্কৃত ভাষাও অশুদ্ধ ও দুর্বোধ্য। তবে আধুনিক সময়ের গবেষকদের মতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মন্তব্য হয়ত আংশিক সত্যি। ময়নামতির গানের ময়নামতী ‘গোরক্ষনাথের’ শিষ্যা ছিলেন,

‘হাঁড়িপা’ বা ‘হাঁড়িপাদ’ও তাই ছিলেন। গবেষকদের মতে হাঁড়িপা বাঙালী হলেও গোরক্ষনাথ হয়ত পাঞ্জাবী ছিলেন। প্রবাদ রয়েছে যে, গোরক্ষনাথই নাকি কালীঘাটের কালীকে প্রতিষ্ঠা

করেছিলেন। অবশ্য এই প্রবাদের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় না। ‘মৎস্যেন্দ্রনাথ’ উক্ত সময়ের নাথসিদ্ধদের অন্যতম শীর্ষমণি ছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রকৃত পরিচয় নিয়ে

পণ্ডিতদের মধ্যে বহু তর্কবিতর্ক রয়েছে। তবে যেটা নিয়ে কোন মতদ্বৈধ নেই, সেটা হল যে, মৎস্যেন্দ্ৰনাথই মহাযান বৌদ্ধপন্থার সঙ্গে নাথপন্থার মিলন ঘটিয়েছিলেন। তাই নাথপন্থা

বৌদ্ধমতেরই অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। অনেকের মতে সেই সময়ের নাথপন্থীদের ভেলকিবাজির মূলে হয়ত অথর্ববেদের মন্ত্রই ছিল, যা পরবর্তীকালে তান্ত্রিক সাধনায় পরিবর্তিত হয়ে

গিয়েছিল। অথর্ববেদ সংকলিত হয়েছিল ঋগ্বেদের পরে, কিন্তু তা বলে এটা মনে করবার কোন কারণ নেই যে, অথর্ববেদে গ্রথিত অনেকগুলি মন্ত্রই ঋগ্বেদ রচনার আগেই রচিত হয়নি।

কারণ, মানুষ সেই আদিম কাল থেকেই মরণাপন্ন রোগে, শত্রুদমনে, পুত্রলাভের আশায়, সর্পভয় দূর করতে, এবং অন্যান্য অনুরূপ কারণে মন্ত্র-তন্ত্র, তুকতাকের আশ্রয় গ্রহণ

করেছিল। অথর্ববেদের অনেকাংশই সেই ধরণের মন্ত্র-তন্ত্রে ভর্তি রয়েছে। অর্থবদেবের ভাষ্যকার ‘সায়ণ’ বলেছিলেন যে, অতীতের রাজাদের জন্য অথর্ববেদ অপরিহার্য ছিল; তখন

রাজপুরোহিতকেও অথর্ববেদের উপরে দখল রাখতে হত। সেই সময়ের সর্বসাধারণের কাছেও, বিশেষ করে গৃহস্থের কাছে, ওই সব মন্ত্র বা প্রক্রিয়ার মূল্য সমধিক ছিল, তাই সেগুলির

 

123

 

অনেকাংশ পরে গৃহ্যসূত্রেও স্থান পেয়েছিল। লক্ষ্যণীয় যে, মানুষের, বিশেষ করে হিন্দুদের মন থেকে এই সংস্কার কখনো যায় নি। তাই আজও সিংহভাগ হিন্দু তুকতাকে বিশ্বাস করে

থাকেন। বলা বাহুল্য যে, হিন্দুধর্মে যুগযুগ ধরে প্রচলিত শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি ওই সব তুকতাকেরই রকমফের মাত্র; সুদূর অতীতের তাবিজ, কবচ, ঝাড়ফুঁক, সাপের

মন্ত্র প্রভৃতিরই সমগোত্রীয়। এই কথাটা রূঢ় হলেও ঐতিহাসিক দিক থেকে সত্যি। কারো কারো মতে, বুদ্ধের জ্ঞাতসারেই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই তখন তন্ত্র-মন্ত্রের সাধনাও

করতেন। তাঁদের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার কথা ‘বিনয় পিটকের’ কোনো কোনো গল্পেও পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে বৌদ্ধসঙ্ঘেই তান্ত্রিক সাধনার সূচনা ঘটেছিল, এবং প্রথম

বৌদ্ধতন্ত্র লেখা হয়েছিল ‘গুহ্যসমাজে’ - যেটার জন্মকাল ছিল খৃষ্টীয় তৃতীয় বা চতুর্থ শতক। এটার দ্বিতীয় ধাপ দেখা দিয়েছিল ‘সংগীতি’র আকারে, সেটাও মহাযানপন্থার পরবর্তীকালে;

এবং উক্ত পন্থার সহজ ছিদ্রপথের মাধ্যমে সেসব জিনিস বৌদ্ধধর্মের মধ্যে অনুপ্রবেশও করেছিল। এরপরে জনসাধারণের পরম চিত্তগ্রাহী হয়ে এসেছিল হিন্দুদের পৌরাণিক পূজা। ফলে,

পৌরাণিক ধর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মহাযানকেও বিভিন্ন তান্ত্রিক দেবদেবীর সন্ধানে তৎপর হতে হয়েছিল। সেই ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার ফলে পৌরাণিক ধর্মেও একটা সময়ে

তান্ত্রিক সাধনা ঢুকে গিয়েছিল, যেটা অনেক ক্ষেত্রেই বৌদ্ধতান্ত্রিক সাধনার রূপান্তর মাত্র ছিল। তখন সমগ্র পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাঙলায় ও প্রাগজ্যোতিষপুরে, বৌদ্ধধর্মের

মহাযান পন্থা ও হিন্দুদের পৌরাণিক ধর্মের মধ্যে বিষম প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে কালক্রমে ওই উভয় ধর্মকেই অতিক্রম করে সর্বত্র তান্ত্রিকবাদই

প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তাই বাঙালীর পৌরাণিক ধর্মের মধ্যে বারো আনাই তান্ত্রিক খাদ মেশানো বলে গবেষকরা মনে করে থাকেন। এই তান্ত্রিকতার পটভূমিকাই বাঙালীর প্রকৃত পরিচয়

- এই কথা বিস্মৃত হলে বাঙালীর জাতীয়-মানস স্পষ্ট করে বোঝা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ‘ষোড়শমাতৃকা’ পূজা তান্ত্রিক অথচ, এই পূজাটি প্রথমে না করে বৈদিক

কর্ম - অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ প্রভৃতি করা বাঙালী সমাজে আজও বিধিবহির্ভূত। এরকম আরো দৃষ্টান্ত রয়েছে, কিন্তু সেসব নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে পাতার পর পাতা ভর্তি হবে

বলে, এখানে শুধু একটি মাত্র দৃষ্টান্তের কথাই উল্লেখ করা হল। আর যে প্রতিযোগিতার কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, একাদশ শতক পর্যন্ত বাঙলার সর্বত্রই সেটা প্রবল হয়ে

উঠেছিল। এবার আবার একাদশ শতকের বাঙলার সমাজ-কথায় ফিরে আসা যাক। উক্ত শতকে সহজপন্থার সিঁড়ি ধরে তৎকালীন বাঙালী সমাজে ব্যভিচারের স্রোত প্রধানতঃ নিম্নশ্রণীর

বাঙালীর সাজে, আর নাথপন্থার তুকতাক অগ্নি-পরীক্ষা, জলপরীক্ষা, সর্পপরীক্ষা, জলপড়া, চালপড়া, নলচালা, বাটিচালা প্রভৃতি রূপে এসেছিল। এর ফলেই উদ্ভব হয়েছিল ‘শার্কুন’

শাস্ত্রের; অর্থাৎ, সুলক্ষণ-দুর্লক্ষণ সংহিতার। ক্রমে বাঙালীর মনে সেটা নিজের স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছিল। উক্ত ‘শার্কুন-শাস্ত্র’ই বাঙালীর মনে হাঁচি-টিকটিকির এক অলঙ্ঘ্য

বাধার প্রাচীর গড়ে তুলেছিল। পরে অনেক ক্ষেত্রেই সেসব প্রায় প্রবাদ-বাক্যরূপে, যেমন ‘ডাকের বচনে’ প্রকাশ পেয়েছিল। এখানে প্রবাদের আগে ‘প্রায়’ বিশেষণটি এই কারণেই জুড়ে

দেওয়া হল যে, প্রবাদের প্রাণ শুধু শব্দের স্বল্পতা ও শব্দার্থের আধিক্য নয়, সেটার সঙ্গে সেটার উপযোগিতাও জুড়ে থাকে। এর উপযোগিতা হল যে, প্রবাদ-বাক্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে

জড়িত থাকে সেটির অভিপ্রায় ও সংকেত, যা প্রবাদটি শোনামাত্র মর্মের মধ্যে প্রবেশ করে যায়। ময়নামতীর গানেও ‘ডাকের বচনের’ হাঁচি-টিকটিকির কথা পাওয়া যায়।

“হাঁচি জিঠি যে জন বারে

বিঘ্নের সময় সে জন তরে।”

(জিঠি অর্থাৎ জ্যেষ্ঠী = টিকটিকি)

ডাক ও খনার বচনের উদ্ভব একাদশ শতকের পূর্বে হয়েছে বলে ধরা চলে। তবে দুটোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ডাকের বচনে সামাজিক বার্তা, মানুষের চরিত্র প্রভৃতির কথা পাওয়া যায়; আর

সেখানে খনার বচন মূলতঃ বাংলার চাষবাস, জলহাওয়া, শুভক্ষণ বা তিথি গণনা নিয়ে। বলা বাহুল্য যে, দুটিরই আদিম ভাষা লোকের মুখে মুখে ক্রমে ক্রমে বদলে গিয়েছে, আর ডালে ও চালে

মিশে খিচুড়ির সৃষ্টিও হয়েছে; তবে সেই খিচুড়িতাপে নয়, কালধর্মে তৈরী হয়েছে। ফলে অতীতে দু’য়ের মধ্যে কোনো ভাষাগত আদিম পার্থক্য ছিল কি না, সেটা এখন আর বোঝার কোন উপায়

নেই। তবে কৃষিভিত্তিক ও তুকতাক-ভক্ত অতীতের বাঙালী সমাজে যে দুটিরই বহুল প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। পরবর্তীকালে কৃষিকর্ম যতই অনাদর পেয়েছে খনার

বচনও তত ক্ষীণ হয়ে এসেছে, কিন্তু বাঙালীর তুকতাক ভক্তি ‘ডাক’কে এখনও পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে। এখনো বাঙালী সমাজের সিংহভাগ মানুষই জানেন -

“অজা জালি, পাকা মেষ, দই-এর আগা, ঘোলের শেষ,

শাকের ছা, মাছের মা, ডাক বলে, বেছে খা৷৷”

(অজা জালি = কচি পাঁঠা)

অথবা, চার্বাকপন্থীদের -

“দধি দুগ্ধ করিয়া ভোগ, ঔষধ দিয়া খণ্ডাব রোগ

বলে ডাক, এই সংসার, আপনে মইলে কিসের আর?”

খিচুড়ির নমুনা -

“ভরা হতে শূন্য ভাল, যদি ভরতে যায়

আগে হতে পিছে ভাল যদি ডাকে মায়।

মরা হতে তাজা ভাল যদি মরতেও যায়

বাঁয়ে হতে ডানে ভাল যদি ফিরে চায়।

বাঁধা হতে খোলা ভাল (যদি) মাথা তুলে চায়

হাসা হতে কাঁদা ভাল যদি কাঁদে বাঁয়।”

(ভরা = কলসী, মরা = মৃতদেহ, মরতে চায় = গঙ্গাযাত্রী, “বায়ে হতে ডানে ভাল যদি ফিরে চায়” = শেয়ালের কথা বলা হয়েছে, “বাঁধা হতে খোলা ভাল” = গরুর কথা বলা হয়েছে।)

এগুলি সবই যাত্রার সুলক্ষণ চিহ্ন নিয়ে বলা হয়েছে।

ওদিকে খনার বচনে -

“খাটে খাটায় লাভের গাঁতি, তার অর্ধেক মাথায় ছাতি

ঘরে বসে পুছে বাত, তার কপালে হাভাত।”

“যদি বর্ষে আগনে রাজা যায় মাগনে”

“যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজা পুণ্য দেশ”

(আগনে = অগ্রহায়ণে)

সময়ে সময়ে ডাক ও খনার বচনের মধ্যে নানা শতকের এত ধরণের খাদ মিশে গিয়েছে যে, সেটা থেকে একাদশ শতকের চিত্র বাছাই করা রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে মনে হয় যে, তখন

পিঁড়িতে বসে কলাপাতে ভাত খাওয়াই রীতি ছিল; আর সুলক্ষণা কন্যা দেখে তবেই বধূ বাছাই করা হত। কারণ, ‘পিঙ্গল আঁখি’, ‘ডাগর ওষ্ঠ’, ও ‘পেট পিঠ উচ্চ ললাট’-ওয়ালা মেয়েকে ঘরে

আনতে বারবার নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। উক্ত সময়ে বাংলার ফলের মধ্যে আখ, আম, কাঁঠাল, কলা, নারকেল, সুপারি এবং ধনে ও পান যে প্রধান ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

আলবেরুনি একাদশ শতকের ভারতবর্ষে হিন্দুদের যে ছ’টি উৎসব পালন করতে দেখেছিলেন, সেগুলোর একটা ফিরিস্তি তিনি তাঁর লেখায় দিয়ে গিয়েছেন। সেই উৎসবগুলির মধ্যে হয়ত দু’-

তিনটি ওই সময়ের বাঙলাতেও প্রচলিত ছিল; যেমন - চৈত্র পূর্ণিমাতে বসন্তোৎসব, কার্তিকে দীপাবলী, ফাল্গুনে দোল ও শিবরাত্রি। তবে তাঁর লেখায় গাজনের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায়

না, কিন্তু গাজন ওই সময়ে নিম্নপর্যায়ের বাঙালীর, বিশেষ করে লুইসিদ্ধার শিষ্যদের প্রধান উৎসব ছিল। তখন ব্রাহ্মণেরা অবশ্য গাজন দেখাও দোষের বলে মনে করতেন। ওই সময়ের

গাজনের মিছিলে অনেক কিছু থাকত - বাজনদার, দেবদেবীর সঙ, লাঠিয়াল বাগদী, ডোম ঘোড়সওয়ার, গাজনের মূল সন্ন্যাসী-গুরু আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ স্ত্রী ও পুরুষেরা। গাজনের মিছিলে

তখন গুরু ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গের দল খোল-করতাল সহযোগে নানা রাগ-রাগিণীতে কীৰ্তন গাইতেন। সেইসব রাগিণীর নাম ছিল - পটমঞ্জরী, গবড়া, গুঞ্জরী, শীবরী (শবরী), বাংগালা ইত্যাদি।

এথেকে বোঝা যায় যে, বাঙলার কীর্তন শ্রীচৈতেন্যর কালের দান নয়, বরং চৈতন্যের বহুযুগ আগে থেকেই বঙ্গদেশে কীর্তনের চল ছিল। ওই সময়ের বাঙলার নারীদের স্বাধীনতাও অবাধ

ছিল। ময়নার গানে পাওয়া যায় যে, ময়না “হাটে গ্যাছেন, বাজারে গ্যাছেন, কিনিয়া খাইছেন খই”। তখনকার পাঠশালে ছেলেমেয়েদের একসঙ্গেই পড়াশুনা করতে হত, ঠাকুরদা ও ঠাকুমার ঝুলির

গল্পগুলিতেও এর সাক্ষ্য পাওয়া যায়। পাঠশালে পড়ানো হত - সংস্কৃত, প্রাকৃত-বাঙলা, মাগধী, ও শৌরসেনী। তখন উচ্চবর্ণের পাঠশালায় যেমন ব্রাহ্মণ বা বৌদ্ধভিক্ষু গুরু হতেন, তেমনি

নিম্নবর্ণের ক্ষেত্রে ডোম গুরু হতেন। ওই সময়ে নিম্নপর্যায়ের ডোমেরা কিন্তু উচ্চপর্যায়ের ব্রাহ্মণদের তুল্য ছিলেন। ‘শূন্যপুরাণের’ রচয়িতা ও বঙ্গদেশে ধৰ্ম্মঠাকুরের প্রতিষ্ঠাতা

‘রামাই পণ্ডিত’ও জাতিতে ডোম ছিলেন; তিনি নিজেই নিজেকে ‘দ্বিজ রামাই’ বলেছিলেন। বস্তুতঃ কেউ কেউ বলেন যে, এখনও নাকি দক্ষিণ রাঢ়ে ডোম পণ্ডিতদের সন্ধান পাওয়া যায়;

শিক্ষকতাই তাঁদের প্রধান বৃত্তি। একাদশ শতকের বাঙলায় ‘পাকা’ তালপাতায় লেখালেখির কাজকর্ম চলত। তখন তালপাতাকে পাকানোর পদ্ধতিটি ছিল - প্রথমে মাজ-পাতা কেটে ছ’মাস ধরে

পুকুরে পুঁতে রাখতে হত, তারপরে সেই পাতাকে দুধে সেদ্ধ করা হত। এরপরে শাঁখ দিয়ে ডলে, কাঠি বাদ দিয়ে সেটাকে সমান করে কেটে নেওয়া হত। লেখার জন্য তখন কঞ্চির, বাখারির বা

লোহার কলমের ব্যবহার করা হত। লেখার কালির জন্য সাধারণতঃ ভুসাকালির চল ছিল, আর ব্লটিং বা চোষকের কাজটি মিহি বালি দিয়ে করা হত।

ঐতিহাসিকদের মতে অভিনন্দ লিখিত ‘রামচরিত’ পুরোবর্তী গ্রন্থ হলেও, ‘সন্ধ্যাকর নন্দী’ রচিত ‘রামচরিত’ সেটার থেকে অধিকতর মূল্যবান একটি ঐতিহাসিক রচনা। প্রথমটি রামায়ণকে

অনুসরণ করে অষ্টম শতকে লেখা হলেও, দ্বিতীয়টি কিন্তু একাদশ শতকের একটি উপাদেয় সংস্কৃত শ্লিষ্ট কাব্য। ‘শ্লিষ্ট’ শব্দের অর্থ হল - যেটার দু’রকম অর্থ করা যেতে পারে। রচনায়

সেই মুনশীয়ানা ছাড়াও ঐতিহাসিক ও সামাজিক দিক থেকেও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতের আরো অনেক মূল্য রয়েছে। তালপাতায় লেখা সেই পুঁথিটি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে সংগ্রহ

করেছিলেন। সমগ্র পুঁথিটি খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের বাঙলা অক্ষরে লিখিত। সন্ধ্যাকর নন্দী বাঙালী ছিলেন, বরেন্দ্রীর শ্রীপৌণ্ড্রবর্ধনপুরের সন্নিকটে কায়স্থকুলে তাঁর জন্ম

হয়েছিল, তিনি রাজা রামপালেরই প্রায় সমসাময়িক ছিলেন। সাম্প্রতিক অতীতে জাপানের ‘হরিউজি’ মন্দিরে অর্থাৎ বিহারে রক্ষিত কয়েকটি ধর্মশাস্ত্রের মধ্যেও ঐতিহাসিকেরা একাদশ

শতকের বাঙলা অক্ষরের নমুনা পেয়েছিলেন। সন্ধ্যাকরের কাব্যের প্রায় প্রতিটি শ্লোকই দ্ব্যর্থবাচক। রামচরিত বললে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের প্রথমেই রামায়ণের

রামচন্দ্রের কথা মনে পড়ে; সন্ধ্যাকরের কাব্যটি বস্তুতঃ প্রথম অর্থে তাই বটে। কিন্তু দ্বিতীয় অর্থে ওই কাব্যে তাঁর লেখা শ্লোকগুলি তৎকালীন গৌড়াধিপ রামপাল সম্পর্কেও

সমানভাবেই প্রযোজ্য; এমনি মুনশীয়ানা নিয়ে তিনি সমগ্র কাব্যটি লিখেছিলেন যে, সেটির কোথাও বিন্দুমাত্র কোন অসঙ্গতি পাওয়া যায় না। ইতিহাস বলে যে, রামপাল অস্তগামী পাল-

সূর্যের প্রায় শেষরশ্মি ছিলেন। কিন্তু অস্তগামী হলে কি হবে, সে রশ্মিটির তেজ কিন্তু প্রচণ্ডই ছিল। তাঁর অগ্রজ দ্বিতীয় মহীপালের কালে তাঁদেরই সামন্তরাজ ‘দিব্বোক’ বা ‘দিব্য’

বিদ্রোহী হয়ে গৌড়ের সিংহাসন দখল করে নিয়েছিলেন। এর বহু বছর পরে দিব্যের ভ্রাতুষ্পুত্র ‘ভীম’কে যুদ্ধে পরাজিত করে রামপাল পুনরায় গৌড় উদ্ধার করেছিলেন। সন্ধ্যাকরের লেখা

 

124

 

কাব্যটিতে সেই যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়, একই সাথে তাতে ওই সময়ের গৌড়ের সাধারণ চিত্রও ফুটে উঠেছে। দিব্য জাতে কৈবর্ত ছিলেন। তখন বাংলার কৈবর্তেরা দু’ভাগে বিভক্ত ছিলেন -

‘হালিক’ ও ‘জালিক’। হালিক বলতে সাধারণতঃ চাযজীবী, আর জালিক বলতে সাধারণতঃ মৎসজীবিকে বোঝানো হত। তবে তাঁদের কুলগত কর্ম নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা তর্কবিতর্ক

রয়েছে। ধর্মের দিক থেকে ওই সময়ে তাঁরা শৈব ছিলেন। দ্বাদশ শতকের পণ্ডিত ‘হলায়ুধ’ বলেছিলেন, “কৈবর্তো ধীবরো দাসো মৎস্যজীবী চ জালিকঃ”। কারো কারো মতে কৈবর্তেরা তখন

কর্ণধার, নৌচালক, ও নাবিক ছিলেন। অতীতে বালী, জাভা প্রভৃতি জায়গার ঔপনিবেশিক বাঙালীও ওই কৈবর্তজাতীয়, অর্থাৎ নৌচালক ও যুদ্ধব্যবসায়ী ছিলেন। এবারে প্রথমেই একাদশ

শতকের বাংলার যুদ্ধের কথা বলা যাক। তখন রাজারা চতুরঙ্গ সেনা, অর্থাৎ পদাতিক ধনুর্ধর, অশ্বারোহী, গজারোহী আর নৌবহর নিয়ে যুদ্ধ করতেন। তখনকার বাংলার যুদ্ধে অবশ্য

নৌবহরের তেমন কোন কাজ ছিল না। ওই সময়ে যুদ্ধের অস্ত্রের মধ্যে মূলতঃ অসি, কুন্ত অর্থাৎ বর্শা, শঙ্কু অর্থাৎ বড় ছুরি, তীরধনুক প্রভৃতি প্রধান ছিল। এমনকি পাথর ছুঁড়েও তখন

শত্রুদমন করা হত। মহিষ রণসম্ভার বহন করত। বলা বাহুল্য যে, নিম্নকোটির বাঙালীদের নিয়েই তখনকার সৈন্যদল গড়া হত; তাঁদের মধ্যে যুদ্ধে রত থাকবার সময়ে জাতি-বিভেদের কোন

প্রশ্ন উঠত না বলেই মনে হয়। পালরাজ্যের শাসনভার হাতে নেওয়ার পরে রামপাল ‘রামাবতী’তে তাঁর নতুন রাজধানীটি তৈরী করেছিলেন। সেই রামাবতী বর্তমান মালদহের কাছাকাছি কোথাও

ছিল বলে ঐতিহাসিকেরা অনুমান করে থাকেন। রামাবতী ছিল ‘দেবগণ’ ও ‘আঢ্যজনের’ পুরী - সবৈশ্বর্যজ্ঞাপক। সেখানকার প্রাসাদ কারুকার্যখচিত ইষ্টকালয় ছিল; বাংলার ইতিহাসে যেটার

অন্যকোন তুলনা পাওয়া যায় না। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ইষ্টক বা ইষ্টকা কিন্তু ওই সময়ের বহু আগে থেকেই ভারতবর্ষে দৃঢ় গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে নিজের স্থায়ী জায়গাটা কায়েম

করে বসেছিল। প্রখ্যাত নাটক ‘মৃচ্ছকটিক’-এও এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়; উক্ত নাটকটির রচনাকালকে কোনোক্রমেই ষষ্ঠ শতকের পরবর্তী বলে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে

তখনকার সেই ইঁটগুলো এখনকার ইঁটের তুলনায় অনেক ছোট ও সরু ছিল। রামপালের প্রাসাদটি হয়ত বরাহমিহির-বর্ণিত ‘বজ্রলেপ’ ও ইঁটের সংযোগে তৈরী করা হয়েছিল, তবে এখন অবশ্য

সেসবের কোন চিহ্নও নেই। তখন বঙ্গদেশে একমাত্র রাজমহল ছাড়া অন্য কোথাও পাথর পাওয়া যেত না; আর সেই পাথর সংগ্রহ করাও তখন দুঃসাধ্য ছিল। তাই ওই সময়ে পাথর দিয়ে

কোথাও মন্দির, বিহার বা প্রাসাদ তৈরী করা হয়নি। তাছাড়া বহু আগে থেকেই বাঙলায় পোড়ামাটির কাজের আদর ছিল। ওই সময়ের রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরেও ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি ছিল।

হীরক, বৈদুর্য, মুক্তা, মরকতমণি, পদ্মরাগমণি, নীলমণি খচিত আভরণেরই বা কত বাহার ছিল। এক্ষেত্রে কবির অতিশয়োক্তিকে বাদ দিলেও, সেই সময়ের রাজার সঙ্গে বিত্ত-ঐশ্বর্যের

যে একটা বিপুল সমাবেশ ছিল, তখনকার রাজ আভরণ ও রাজান্তঃপুরের ব্যাখ্যা থেকে সেটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায়। একাদশ শতকের উচ্চকোটি সমাজের মানুষের সঙ্গে ওই বিত্ত-

ঐশ্বর্যের একটা সামঞ্জস্য বর্তমান ছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়, বিশেষ করে তখনকার বেণেদের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে। ওই সময়ের ধবল প্রাসাদ-শ্রেণীর চূড়ায় কনক-কলস শোভা

পেত। সেকালেও অট্টালিকায় চুনের প্রলেপ লাগানো হত, আর সেই চুন নিঃসন্দেহে কলিচুন ছিল। তখন ‘শ্লক্ষ্ণ’ বস্ত্রেরও ছড়াছড়ি ছিল; ‘শ্লক্ষ’ বলতে শুধু মনোহর নয়, মোলায়েমও

বোঝায়। অবশ্য বঙ্গদেশই তখন ভারতবর্ষের প্রধান বস্ত্র-ভাণ্ডার ছিল। ওই সময়ে প্রসাধনের জন্য কস্তূরী, কালাগুরু (কৃষ্ণ অগুরু - কাষ্ঠ), চন্দন, কুঙ্কুম ও কর্পূর ব্যবহার করা হত।

এছাড়া নানা বাদ্যযন্ত্রও ছিল; সন্ধ্যাকর নন্দীর লেখায় তারও ফিরিস্তি পাওয়া যায়। গুপ্তযুগের সম্রাট ‘সমুদ্রগুপ্ত’ নিজেই একজন প্রসিদ্ধ বীণাবাদক ছিলেন; হয়ত তাঁরই আদর্শে

পালরাজারাও গীতবাদ্যে উৎসাহী হয়েছিলেন; আর পরবর্তী শতকে সেই ধারাটি আরো প্রশস্ততর হয়েছিল। তখনকার গৃহপালিত জীবের মধ্যে গরু ও মহিষই প্রধান ছিল। ওই সময়ে যুদ্ধের

জন্য সিন্ধুদেশ থেকে ঘোড়া সংগ্রহ করা হত, আর প্রাচীন বাঙলা তো বরাবরই হাতীর জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। নিজের রাজ্যে পানীয় জল ও জলসেচের জন্য রামপাল বড় বড় দীঘি খনন

করিয়েছিলেন; তিনি প্রজাদের করভারও লাঘব করেছিলেন। ফলে, ওই সময়ে একদিকে যেমন ফসল উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি চাষীদের স্বচ্ছলতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সন্ধ্যাকরের কাব্যটিতে ওই সময়ের একটি উপবনের চিত্রও পাওয়া যায়। সেখানে নানা ধরণের কন্দ (ফলাকার উদ্ভিদ মূল), লকুচ বা লকচ (মাদার ফল), শ্রীফল (বেল), লবনী (লতা), কন্দল

(কলাগাছ), প্রিয়ালা (আঙ্গুরের লতা), আমলকী, পুগ (গুবাক), অসন (পীতশাল - এই বৃক্ষটি সম্ভবতঃ এখন লুপ্ত হয়ে গিয়েছে), বৃহৎ মালতী, শ্রেষ্ঠ নাগকেশর, বকুল, অশোক, পারিজাত, ও

লবঙ্গলতার সমাবেশ ছিল। তৎকালীন বরেন্দ্রী যেহেতু সুজলা ছিল, সেহেতু শস্যশ্যামলা ছিল; সেখানকার মাঠে বহুবিধ ধান্য আর নারিকেলের বন দেখতে পাওয়া যেত। মহাযানপন্থী

পালরাজারা গোঁড়া বৌদ্ধ ছিলেন না। রামপাল তিন পংক্তি শিবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়া তাঁর রাজ্যে আরো অনেক মন্দির ছিল। সেই সব মন্দিরের দেবতাদের মধ্যে ছিলেন - ব্রহ্মা,

বিষ্ণু, মহেশ্বর, আদিত্য, স্কন্দ (কার্তিকেয়) ও বিনায়ক (গণেশ)। তবে অত সব ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে বসবাস করেও রামপালের সেসবের প্রতি কোন আসক্তি জন্মায়নি বলেই মনে

হয়; কারণ রামচরিতের কবি বলেছিলেন যে, নিজের শেষ বয়সে তিনি ছেলের হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে ‘মুগিরি’তে অর্থাৎ মুঙ্গেরে স্বেচ্ছায় গঙ্গাপ্রবেশ করে প্রাণত্যাগ করেছিলেন।

রামচরিতে সেকালের ওই ধরণের আত্মাবলুপ্তির কথা বহুল পরিমাণে পাওয়া যায়।

এবারে নেপালে ‘চর্যাপদ’ পুঁথির আবিষ্কর্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মত অনুসরণ করে কিছু কথা বলা যাক। চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়া মতের অতি পুরনো বাঙলা গান। হয়ত নানা কারণে তাতে

পশ্চিমা অপভ্রংশের অল্প কিছু রূপ অনুপ্রবেশ করেছিল, কিন্তু তার ফলে সেটির বাঙালীত্ত্ব কিন্তু কখনোই মুছে যায়নি। এখন প্রশ্ন হল যে, প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মধ্যে প্রভেদ কি?

সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপন্ন হলেই সেটাকে প্রাকৃত বলা হয়; সেই হিসাবে অশোকের শিলালিপিও প্রাকৃত, পালিও প্রাকৃত, আবার বাঙলাও প্রাকৃত। প্রাকৃত ব্যাকরণের সীমানা যে শব্দ

লঙ্ঘন করে সেটাকেই অপভ্রংশ বলা হয়। সহজিয়া ধর্মের সব পুঁথিই সান্ধ্যভাষায় লেখা হয়েছিল। এই সান্ধ্যভাষার অর্থ হল - আলো-আঁধারি ভাষা; অর্থাৎ, এই ভাষার কিছুটা স্পষ্ট, আর

কিছুটা অস্পষ্ট। চর্যাপদেরও তাই। লুইপাদ যে বাংলার সহজিয়া সিদ্ধাচার্যদের আদি-পুরুষ ছিলেন, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। লুইপাদ বাঙালী ছিলেন। তাঁর চ্যালাদের মধ্যে অনেকেই

সংকীর্তনের পদ আর দোঁহা লিখেছিলেন। ওই সময়ে বৌদ্ধ ও হিন্দু - দু’দল থেকেই কেউ কেউ নাথপন্থা গ্রহণ করেছিলেন। উক্ত শতাব্দীর নাথপন্থীদের দু’জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির মধ্যে

গোরক্ষনাথ যেখানে বৌদ্ধ ছিলেন, মৎস্যেন্দ্রনাথ সেখানে হিন্দু ছিলেন বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। সমসাময়িক নাথপন্থীরাও চর্যাপদের ধরণের বাঙলা ভাষাতেই অনেক পুঁথি

লিখেছিলেন। ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন যে, সেই দোহা থেকেই পরবর্তীকালে পয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল। একালে কীর্তনের পদকে পদ বলা হলেও, একাদশ শতকে সেটাকে চর্যাপদ বলা হত।

সহজ-মতের তিনটি পন্থা ছিল - অবধূতী, চণ্ডালী ও ডোম্বী বা বঙালী। অবধূতীরা দ্বৈতবাদী ছিলেন; চণ্ডালীরা দ্বৈতও ছিলেন না, আবার অদ্বৈতও ছিলেন না; আর ডোম্বী বা বঙালীরা

নিছকই অদ্বৈতবাদী ছিলেন। চর্যাপদের কথা বোঝার সুবিধা হবে বলেই এই প্রস্তাবনাটি এখানে উল্লেখ করা হল। চর্যাপদ সান্ধ্যভাষায় লেখা হয়েছিল, এখনও পর্যন্ত সেটির

সাতচল্লিশটি শ্লোক পাওয়া গিয়েছে। সেগুলিতে ওই সময়ের নিম্নকোটি বাঙালীর সিদ্ধাচার্যদের সাধনার কাহিনী যেমন লিপিবদ্ধ রয়েছে, তেমনি সেগুলির মাঝে মাঝে ওই সময়ের কিছু

সামাজিক কথাও উকিঝুঁকি দিয়েছে। একটি উদাহরণ তুলে ধরা যাক -

“উঁচা উঁচা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।

মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী৷৷

উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি।

নিত্য ঘরিণী নামে সহজ সুন্দারী॥

...

গুরুবাক পুঞ্চআ বিন্ধ ণিঅমন বাণে।

একে শর সন্ধানে বিন্ধহ বিন্ধহ পরমণি বাণে॥”

উক্ত পদ ক’টির আধুনিক বাঙলা রূপ হল - উঁচা পাহাড়ে বালিকা শবরী বাস করে। শবরীর পরনে ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালা। এখানে গুঞ্জার অর্থ হয় পুষ্পস্তবক, আর নয় তো তালবৃক্ষের

পাতা। শবরী শবরকে বলছে, তুমি আমাকে অবহেলা করে অন্য কারো কাছে যেয়ো না। আমি সহজ সুন্দরী - তোমার নিজ গৃহিণী, তোমারই গুহায় ঘুরি ফিরি। … গুরুবাক্যকে ধনু করে, নিজ মনকে

বাণ করে, এক শরসন্ধানে পরম নির্বাণকে বিদ্ধ কর - বিদ্ধ কর। এর মাঝে যে তত্ত্বকথা, অর্থাৎ রহস্যাবৃত সাধনার কথাও রয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তত্ত্বকথার অর্থ খোঁজা

এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়; এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হল, সামাজিক ইতিহাসের জন্য ওই সময়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কাহিনীকে খুঁজে বের করা।

তবুও উপরোক্ত অংশের শেষের দুটি পংক্তি সম্পর্কে কিছু বলবার প্রয়োজন রয়েছে। ওই পংক্তি দুটি যে উপনিষদের প্রতিধ্বনি তাতে সন্দেহ কোন নেই। উদাহরণ হিসেবে

‘মুণ্ডকোপনিষদের’ দ্বিতীয় মুণ্ডক থেকে একটি শ্লোক (৩৫/৩) উদ্ধৃত করা যেতে পারে -

“ধনুগৃহীত্বৌপনিষদং মহাস্ত্রং

শরঃ হ্যুপাসা-নিশিতং সংদধীত।

আযন্য তদ্ভাবগতেন চেতসা

লক্ষ্যং তদেবাক্ষরং সোম্য বিদ্ধি॥”

অর্থাৎ, হে প্রিয়দর্শন, উপনিষদবেদ্য মহাস্ত্র ধনু গ্রহণ করে তাতে উপাসনা দ্বারা শোধিত শর যোজনা কর। তারপর ব্রহ্মে তন্ময় হয়ে সে তন্ময় চিত্ত দিয়ে সে অক্ষর পুরুষকে বিদ্ধ

কর। এখানে এটুকু এই কারণেই বলা হল যে, উপনিষদে ‘গুরু’র কথার ছায়ামাত্র না থাকলেও, সহজিয়া দোহায় কিন্তু ‘গুরুবাক’ ছাড়া পরমনির্বাণ লাভ অসম্ভব। ওখান থেকেই পরবর্তীকালের

বাঙলার অন্ধ গুরুবাদের সূত্রপাত ঘটেছিল। চর্যাপদে সেই নিম্নকোটি বাঙালী সমাজের বৃত্তির কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে, যেটার সঙ্গে অলবেরূনির ঐতিহাসিক সাক্ষ্যও মিলে যায়। তখন

ডোমেরা তাঁত (তন্ত্রী) ও চাঙারি (চাঙেড়া) বা করগুহো (চুপড়ি) তৈরী করে বিক্রি করতেন; কেউ কেউ আবার মণ্ড (ভাতের মাড়) থেকে বারুণী (মদ) চোলাই করতেন। উক্ত সময়ে মদের সাথে

চাট হিসেবে নাপাকেলা বা কাঁচা কাঁকুড় ব্যবহার করা হত। ওদিকে “হাঁড়ীতে ভাত নাহি” অথচ “নিতি আবেগী”, অর্থাৎ নিত্যই তাঁর প্রয়োজন। তখনকার অত দারিদ্র্য সত্ত্বেও যে ‘আকাশ

ফুলিআ’ বা আকাশ-কুসুমের চাষ হত না, তা নয়; শবর- শবরীও প্রেমে মশগুল হতেন, কেউবা ‘নেউর’ বা নূপুর বেঁধে নাচও করতেন। তখন ‘কুঠার’ যেহেতু ছিল, সেহেতু কেউ কেউ নিশ্চই কাঠও

কাটতেন। কেউ কেউ আবার ‘সংক্রম’ অর্থাৎ সাঁকোও তৈরি করতেন। চর্যাপদে খালে, ণই (নদী) ও ণাব (নৌকা)-এর কথা যেমন বহুল পরিমাণে পাওয়া যায়; একই সঙ্গে কাচ্ছী (নৌকার

কাছি), খুন্টি (নোকা বাঁধিবার খুঁটা), গুণে (নৌকার গুণ), নৌবাহী (নেয়ে), পতবাল (হাল) বেরডুয়াল (বৈঠা), ও কবড়ী (কড়ি)-র কথাও পাওয়া যায়। ফলে যে চিত্রটি কল্পনায় জেগে ওঠে সেটা হল

- নদীতে খেয়া বেয়ে নেয়ে পারাপার করে; পারের কড়ি না পেলে যাত্রীর লাঞ্ছনা হয়; নেয়ে তাঁর তল্পিতল্পা পারের কড়ির জন্য তল্লাশ করেন, এমন কি ‘বাণ্ডকুরণ্ড’ও অর্থাৎ ‘বটুয়া’ ও

‘করঙ্ক’ও তল্লাশির তালিকা থেকে বাদ পড়ে না। ‘গঙ্গাসাঅরুর’ বা গঙ্গাসাগরের উল্লেখের ফলে মনে হয় যে, চর্যাপদের কোনো কোনো সিদ্ধাচার্য চন্দ্রদ্বীপের মানুষ ছিলেন। চর্যাপদে

ওই সময়ের পশুদের মধ্যে ‘গঅন্দা’ বা গজেন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়; তখন ‘গোহালী’ অর্থাৎ গোশালা যখন ছিল, তখন তাতে নিশ্চই গরুও ছিল; এছাড়া চর্যাপদে ‘তুরঙ্গ’ অর্থাৎ ঘোড়া,

‘মূষা’ বা মূষিক, ‘শিয়ালহ’ অর্থাৎ শিয়াল, ‘হরিআ’ বা হরিণের উল্লেখও পাওয়া যায়; এমনকি চর্যাপদে ‘বোড়ো’ বা বোড়া সাপেরও কোন অভাব নেই। আর এসবের সাথে সেখানে হরিণ-শিকারের

চিত্রও দেখতে পাওয়া যায়।

“বেরিল হাক পড়অ চৌদীস।

 

125

 

তুরঙ্গতে হরিণার খুর দীঘঅ॥”

অর্থাৎ, হরিণ ভয় পেয়ে ছুটছে; তার গতি এত দ্রুত যে তার ক্ষুরের চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তবে তখন ‘মৃগয়া’ শব্দের অর্থ হয়ত নিহত জীবের মাংস বিতরণ ছিল। চর্যাপদে

তৎকালীন বাংলার ফলের মধ্যে ‘কঙ্গুরি’ বা কাঁকুড়, ‘তেন্তলি’ বা তেঁতুল, ‘কলু’ বা কলা, ও ‘সিরফল’ বা বেলের উল্লেখ পাওয়া যায়। তখনকার ফসলের মধ্যে ভাতের মূল ছিল ধান; আর ‘তুসি’

অর্থাৎ তুষ যখন ছিল তখন নিশ্চই ধানভানাও চলত। ওই সময়ে তুলা আঁশ আঁশ করে ধোনাও হত; আর ‘তন্ত্রী’ যখন চলত, তাহলে নিশ্চই সুতাও কাটা হত। তখনও বিবাহের সময়ে বর

‘জউতুকে’ বা যৌতুক পেতেন; হয়ত ডোমও বিবাহ অনুষ্ঠানের বহ্মণ বা ব্রাহ্মণ হতে পারতেন; বিবাহের পরে ‘বহুড়ী’ বা বৌ ঘরে আসতেন। আর একই সাথে সেই সময়েও চোরের ভয় ছিল,

কারণ ঘুমন্ত বধূর কানের গয়নাও তখন চুরি হয়ে যেত।

“কানেট চোরে নিল আধারাতী॥

সসুরা নিদ্ গেল বহুড়ী জাগই।

কানেট চোরে নিল কা গই মাগই॥”

সাধারণ বঙ্গানুবাদ -

“কানের গহনা চোরে নিল আধা রাতে

শাশুড়ী ঘুমায় বউ জেগে আছে

কানের গহনা যে চোরে নিল কোথায় খোঁজা যায়৷৷”

ওই সময়ে খেলার মধ্যে হয়ত ‘নববল’ বা দাবাখেলা শ্রেষ্ঠ ছিল। সেকালেও ‘উপকারিক’ খেলোয়ারকে চাল বলে দিত। তখন ‘ইষ্টমালা’ বা জপমালাও ছিল। পরম জ্ঞানের সন্ধানে কেউ কেউ বা

লঙ্কায় যেতেন। তবে ‘সরহপাদ’ সবাইকে লঙ্কায় যেতে নিষেধ করে লিখেছিলেন - “নিঅহি বোহি মা জাহুরে লাঙ্ক”। চর্যাপদের অনেক পদই পরবর্তীকালে ক্রমে বাঙলা প্রবাদে পরিণত হয়ে

গিয়েছে। ‘ভুসুকু’র “আপনা মাংসে হরিণা বৈরী”, অর্থাৎ সুস্বাদু মাংসের জন্য হরিণ নিজেই নিজের শত্রু হয়েছে - এর প্রতিধ্বনি পরবর্তীকালের প্রবাদেও পাওয়া যায়। সরহপাদের “বর ঘুণ

গোহালী কি সো দুঠট বলঙ্গ”-র অধুনিক রূপটি হল - “দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল”। ঐ সিদ্ধাচার্যেরই “হাথেরে কাঙ্কাণ মা লোউ ছাপন” বর্তমানে “হাতের শাঁখা দর্পণে দেখা” হয়েছে।

আর ‘ঢেণ্টণপাদের’ “দুহিল দুধু কি বেন্টে সামাঅ” বর্তমানে হয়েছে - “দোয়া দুধ কি আর বাঁটে সেধোয়?”

এবারে একবার একাদশ শতকের বাঙালী সমাজের সামগ্রিক চিত্রটির সন্ধান করা যাক। বলাই বাহুল্য যে, বাঙালীর মধ্যে তখনও কোনো অখণ্ড সমাজসত্তা গড়ে উঠেনি। ওই সমাজের

একদিকে ছিলেন মুষ্টিমেয় উচ্চকোটি মানুষেরা, আর অন্যদিকে ছিলেন বিরাট ও নিঃস্বপ্ৰায় নিম্নকোটির জনতা; এর মধ্যে কোনো মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তর সংস্থা কিন্তু তখনও

পর্যন্ত ছিল না। উচ্চকোটির কাছে নিম্নকোটি ঘৃণ্য ও অবহেলিত ছিলেন। তখনকার ক্রমবর্ধমান তান্ত্রিকবাদে এর একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ওই সময়ে উচ্চকোটি মানুষেরা

উত্তরাপথের দিকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিপাত করে নিজেদেরকে আর্যসভ্যতার ধারক বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন, ওদিকে নিম্নকোটি মানুষেরা বাঙলার আদিম সভ্যতার বাহক হয়ে,

নিজেদেরই গড়া সমাজে উচ্চকোটি থেকে পরিপূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলেন। তখনকার ধর্মের একদিকে ছিলেন উচ্চকোটি শূন্যবাদী বৌদ্ধ ও পৌরাণিকধর্মী হিন্দু; আর অন্যদিকে ছিলেন

নিম্নকোটি বৌদ্ধ সহজযানপন্থী ও নাথপন্থী। সেই সময়ে শূন্যবাদী বা মহাযানপন্থী বৌদ্ধদের চারিত্রিক দৃঢ়তা ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছিল, বাঙলার বহির্বাণিজ্যে ভাটা আসবার ফলে দেশের

স্বচ্ছলতাও ক্ষীয়মাণ হচ্ছিল। একই সময়ে শূন্যবাদী বৌদ্ধদের দৃষ্টি সহজযানের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল বটে, কিন্তু সেই পথের পরিসমাপ্তি যে নোংরামিতে - সেটার দৃষ্টান্তও তাঁদের চোখ

এড়িয়ে যাচ্ছিল না। তখনকার উচ্চকোটিতে হিন্দু ও বৌদ্ধে মূলতঃ কোনো সামাজিক প্রভেদ ছিল না; তাঁদের উভয়েই মনুসংহিতার নির্দেশ মেনে চলতেন, আর শুধু গৃহ্যসূত্রোক্ত দশসংস্কার

হলেই বৌদ্ধরা হিন্দু হতে পারতেন। ফলে তৎকালীন বৌদ্ধ-সমাজের চূড়ামণি বেণেরা ক্রমশঃ সেদিকেই ঝুঁকে পড়ছিলেন। ওদিকে চাতুর্বর্ণ ধর্মের বাহক হিন্দুরা তখন নানা ধরণের

বৃত্তিভোগী ছিলেন। সেই সময়ের ব্রাহ্মণেরা স্মার্ত, এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিষ্ণুভক্ত ছিলেন; কিন্তু শ্রুতিতে, অর্থাৎ বেদ ও উপনিষদে তাঁদের দখল কম ছিল। একাদশ শতাব্দীতে

বৌদ্ধরা বাংলার রাজা হলেও, অন্য কোনো ধর্মের প্রতি তাঁদের কিন্তু কোন বিদ্বেষ ছিল না। বঙ্গদেশে তখন সামন্তরাজদের সংখ্যাও কিছু কম ছিল না; মূল রাজাকে তাঁদের কর দিতে

হলেও, সেই করভার কিন্তু খুব একটা বেশি ছিল না। যার ফলে দেশে তখন মোটামুটি শান্তিই বর্তমান ছিল। ওই সময়ের বাঙলার অন্তর্বাণিজ্যেও বিনিময় প্রথা চালু ছিল। তখন নগদ অর্থ

হিসাবে কড়ির প্রচলন বেশি হলেও, হয়ত কিছু স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার ব্যবহারও চালু ছিল, তবে সেটার কোন স্পষ্ট ঐতিহাসিক সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। তৎকালীন সময়ের চিকিৎসা

ব্যবস্থা সুশ্রুত-পন্থী হলেও, সর্বসমাজেই টোটকা, তুকতাক, ঝাড়ফুঁকই সাধারণ মানুষের অন্ততঃ প্রাথমিক সম্বল ছিল। মূলতঃ সেই কারণেই মানুষ তখন তান্ত্রিক পন্থার প্রতি বেশি

আকৃষ্ট হয়েছিল। চর্যাপদের যুগের বাংলার শিক্ষার বাহন ছিল প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষা, আর বাঙালীরপোশাক ছিল ধুতি ও শাড়ি। তবে বৌদ্ধরা তখন পাগড়ি পরতেন না, তাঁদের ছোঁয়াচে

একালে সর্বশ্রেণীর বাঙালী ক্রমশঃ পাগড়ি পরা ত্যাগ করে, মাথার বোঝা লাঘব করে, ওই সময়ে উত্তরাপথে প্রচলিত ‘নাঙ্গাশির’ হয়েছে। মৎস্য সম্পর্কে ওই সময়ের বৌদ্ধরা যে,

“অহিংসা পরমো ধর্মঃ” বলে মানতেন, এমনটা মনে করবার কোন কারণ নেই; তখনকার হিন্দুদের মধ্যে একমাত্র ব্রাহ্মণেরাই হয়ত খাওয়ার ক্ষেত্রে সামান্য কিছু বাছ-বিচার করতেন।

সহজযানের প্রবর্তক লুইপাদের মৎস্যপ্রীতি সর্বজনবিদিত; তিনি ‘মাছের আঁতড়ি’ (পাতরি?), ‘তেলের বড়া’, ছেঁচড়া ও চচ্চড়ি খেতে ভালবাসতেন। তখনকার প্রাসাদ, বিহার ও মন্দিরগুলি

ইষ্টকে তৈরী করা হত। একাদশ শতকের বাংলার শহরে ও বন্দরে ‘ইঁটকোঠা’, ‘মাটকোঠা’, বেত, বাঁশ, কাঠ ও শণের তৈরী বাড়ি দেখতে পাওয়া যেত। সেই ‘ইঁটকোঠা’ ও ‘মাটকোঠা’ বাড়িগুলির

প্রত্যেকটিতেই বাতায়ন আর রাস্তার দিকে একটা করে গোল বারান্দা থাকত। ওই সময়ের গ্রামে স্বাভাবিকভাবেই মাটকোঠা ও বেত-বাঁশ-শণের বাড়ি বেশি দেখতে পাওয়া যেত। উক্ত সময়ের

বহু আগেই লাঙ্গলের প্রচলন শুরু হয়ে গিয়েছিল, জোড়া বলদে মিলে সেই লাঙ্গল টানত। গবেষকদের মতে, লাঙ্গল শব্দটি মূলতঃ অস্ট্রিক ভাষার, অর্থাৎ আদি অস্ট্রেলিয়ার ভাষার, যেটা

ক্রমশঃ ধানচাষের প্রসারের ফলে সারা দূরপ্রাচ্যে ও ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর্যদের প্রথমে চাষবাস ছিল না; তাই সংস্কৃতে ওই ধরণের কোন শব্দের প্রয়োজনও তখন ঘটেনি।

পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে চাষবাস প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে লাঙ্গল শব্দটিও সংস্কৃতে গৃহীত হয়ে গিয়েছিল বলে অনেকেই বিশ্বাস করে থাকেন। তখনকার বাংলায় চাষের উপযোগী নানা

ধরণের যন্ত্রপাতি গ্রামে ও শহরে - উভয় জায়গাতেই তৈরী করা হত। বাঙালী তখন কলাপাতায় এবং মাটির ও কাঠের থালায় পিঁড়িতে বসে খাবার খেত। তবে সেই ব্যাপারে কলাপাতার ভূমিকা

তখন যে ব্যাপক ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বর্তমানেও খনার একটি বচনের আধুনিক রূপে সেটার রেশ পাওয়া যায় -

“এক হাত অন্তর দু’হাত খাই (খাদ, গর্ত)

কলা রুয়ো চাষা ভাই,

রুয়ো কলা না কেট পাত

তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।”

মূলতঃ এই প্রথাটিই এখনো বর্তমান রয়েছে, তবে ধাতুর তৈরী পাত্র ক্রমশঃ দ্বিতীয় দু’টির জায়গা নিয়েছে। তবে তখন অবশ্য রাজরাজড়া, বণিকশ্রেণী ও ধনীদের গৃহে, বিশেষ করে উৎসবে,

স্বর্ণ ও রৌপ্যের থালার ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তখনকার উৎসবে যে যে মাঙ্গলিক দ্রব্যাদির ব্যবহার করা হত, সেই প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন, “রাস্তার দু’ধারে বাঁশের

থাম। প্রত্যেক থামের গোড়ায় পূর্ণকলস, তাহার উপর আম্রশাখা, একটি টাটকা ডাব। কলসীতে সিন্দুর, চন্দন ও হলুদের দাগ। পূর্ণকলসের পিছনে একটি কলাগাছ।” একালেও বাঙালীর সেই

মাঙ্গলিক চিহ্নের কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি? অশন ও বসনেও বর্তমান বাঙালী সমাজে মূল পরিবর্তন কিন্তু বিশেষ কিছুই হয়নি; যেমনটা সেই একাদশ শতকে ছিল, বর্তমান শতকেও

প্রায় তেমনিই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখন থেকে এখনও পর্যন্ত যেটা সবচেয়ে অপরিবর্তিত রয়েছে, সেটা হল বাঙালী জাতির একটা অখণ্ড সমাজবোধের অভাব। সেই ফাঁক কিন্তু কোনোদিনই

ভরেনি, হয়ত কোনো শতকে একটু কমেছে মাত্র। এই অখণ্ড জাতীয়তাবোধের অভাবের ক্ষেত্রে বাঙালী অবশ্য সমগ্র ভারতবর্ষেরই অংশীদার, কিন্তু তাঁর এই সহজাত দৈন্যই তাঁকে আজও

চরম দুর্বল করে রেখেছে। ফলে ভারতের সমাজ-দেহের এই বিচ্ছিন্ন বৃহৎ অঙ্গটি তাই সর্ব শতকেই একটি নোঙর-ছেঁড়া নৌকার মত ঘাট খুঁজে মরেছে। সেকালে বাঙলা ও গুজরাটের

বহির্বাণিজ্যে সুনাম ছিল। সেজন্য ওই সময়ের বাঙালী বণিকেরা তাঁদের রপ্তানির মাল চারিদিক থেকে এনে কোন কোন জায়গায় গুদামজাত করতেন। সম্ভবতঃ সেটার জন্যই ওই সব জায়গায়

তখন ছোট ছোট শহরাঞ্চল গড়ে উঠেছিল; আর সেগুলিকে আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক শাসনকেন্দ্রে পরিণত করাও সুবিধাজনক হয়েছিল। সেই অঞ্চলগুলির চারদিকে বেষ্টনী তুলে সেগুলিকে

সুরক্ষিত করা হয়েছিল। তখনকার বাংলার বড় বড় গ্রামেও যে প্রধান বেষ্টনী থাকত, সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই; চর্যাপদেও সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ওই সময়ের

নিম্নকোটির বাঙালী সমাজের স্থান কখনো সেই বেষ্টনীর মধ্যে হয়েছিল কিনা - তাতে সন্দেহ রয়েছে। গুপ্তযুগ থেকেই বাঙলা তথা সৌরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সমগ্র উত্তরাখণ্ডে

‘গুপ্তাব্দের’ প্রচলন ঘটেছিল। গুপ্তাব্দ শুরু হয়েছিল ৩১৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, অর্থাৎ প্রথম চন্দ্রগুপ্তের আমলে। এরপরে ষষ্ঠ শতকের প্রায় প্রথম পাদ পর্যন্ত বাঙলায় গুপ্তাব্দ চালু

ছিল। তারপরে পালাব্দ শুরু হয়েছিল ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, কিন্তু একই সঙ্গে তখন হয়ত গুপ্তাব্দও কিছু চলত। নবম শতক থেকে সারা উত্তরাখণ্ডে বিক্রমাব্দের প্রচলন ঘটেছিল।

ঐতিহাসিকদের মতে বিক্রমাব্দের পিছনে কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, তাই সারা উত্তরাখণ্ডে সেটি চললেও বাঙলায় কিন্তু চলেনি। তখন ওই সব অব্দ সাধারণতঃ রাজকার্যে, আর

বিভিন্ন সামাজিক ব্যাপারে, দিনক্ষণ দেখতে এবং তিথি-বিচার করতে ব্যবহার করা হত। ক্রমে মানুষের জীবনে দৈবশক্তির তথা গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাববৃদ্ধির ফলে সেই বিচার সূক্ষ্ম

থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে উঠেছিল। বৌদ্ধযুগেও বঙ্গদেশে দিনক্ষণ দেখা চলত, ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’তে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সময়ে দিনক্ষণ দেখেই সওদাগরেরা বাণিজ্যে যাত্রা

করতেন। ‘মধুমালা’য় রানী ও রাজকন্যা “ক্ষণ-সময় দেখিয়া মদনকুমারকে সোনার ময়ূরে চড়াইয়া মধুমালার দেশে পাঠাইয়া দিলেন।” কিন্তু তখন সারা দেশ যে গণক-জ্যোতিষে ভর্তি ছিল না,

ডাকের বচনে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় -

“যে দেশে নাই গণক জ্যোতিষা

গোধূলি লগন, যাত্রা ঊষা।”

সেই কারণেই দ্বাদশ শতকে বাঙালীর তিথি-বিচার প্রবল হয়ে উঠেছিল।

(সমাপ্ত)